أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#১০৩৬)
[ *কোরআনের দৃষ্টিতে সৎ ও অসৎ লোক :-]
www.motaher21.net
সূরা:- ৩১:লুকমান
পারা:২১
১- ৯ নং আয়াত:-
৩১:১
الٓـمّٓ ۚ﴿۱﴾
আলিফ-লাম-মীম;
৩১:২
تِلۡکَ اٰیٰتُ الۡکِتٰبِ الۡحَکِیۡمِ ۙ﴿۲﴾
এগুলো হিকমতপূর্ণ কিতাবের আয়াত,
৩১:৩
ہُدًی وَّ رَحۡمَۃً لِّلۡمُحۡسِنِیۡنَ ۙ﴿۳﴾
পথনির্দেশনা ও অনুগ্রহ সৎকর্মশীলদের জন্য।
৩১:৪
الَّذِیۡنَ یُقِیۡمُوۡنَ الصَّلٰوۃَ وَ یُؤۡتُوۡنَ الزَّکٰوۃَ وَ ہُمۡ بِالۡاٰخِرَۃِ ہُمۡ یُوۡقِنُوۡنَ ؕ﴿۴﴾
যারা সালাত কায়েম করে এবং যাকাত দেয়, আর তারাই আখিরাতে নিশ্চিত বিশ্বাসী;
৩১:৫
اُولٰٓئِکَ عَلٰی ہُدًی مِّنۡ رَّبِّہِمۡ وَ اُولٰٓئِکَ ہُمُ الۡمُفۡلِحُوۡنَ ﴿۵﴾
এরাই তাদের রবের পক্ষ থেকে সঠিক পথে রয়েছে এবং এরাই সাফল্য লাভ করবে।
৩১:৬
وَ مِنَ النَّاسِ مَنۡ یَّشۡتَرِیۡ لَہۡوَ الۡحَدِیۡثِ لِیُضِلَّ عَنۡ سَبِیۡلِ اللّٰہِ بِغَیۡرِ عِلۡمٍ ٭ۖ وَّ یَتَّخِذَہَا ہُزُوًا ؕ اُولٰٓئِکَ لَہُمۡ عَذَابٌ مُّہِیۡنٌ ﴿۶﴾
আর মানুষদেরই মধ্যে এমনও কেউ আছে, যে মনোমুগ্ধকর কথা কিনে আনে লোকদেরকে জ্ঞান ছাড়াই আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করার জন্য এবং এ পথের আহ্বানকে হাসি-ঠাট্টা করে উড়িয়ে দেয়। এ ধরনের লোকদের জন্য রয়েছে লাঞ্ছনাকর আযাব।
৩১:৭
وَ اِذَا تُتۡلٰی عَلَیۡہِ اٰیٰتُنَا وَلّٰی مُسۡتَکۡبِرًا کَاَنۡ لَّمۡ یَسۡمَعۡہَا کَاَنَّ فِیۡۤ اُذُنَیۡہِ وَقۡرًا ۚ فَبَشِّرۡہُ بِعَذَابٍ اَلِیۡمٍ ﴿۷﴾
তাকে যখন আমার আয়াত শুনানো হয় তখন সে বড়ই দর্পভরে এমনভাবে মুখ ফিরিয়ে নেয় যেন সে তা শুনেইনি, যেন তার কান কালা। বেশ, সুখবর শুনিয়ে দাও তাকে একটি যন্ত্রণাদায়ক আযাবের।
৩১:৮
اِنَّ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ لَہُمۡ جَنّٰتُ النَّعِیۡمِ ۙ﴿۸﴾
নিশ্চয় যারা ঈমান আনে ও সৎকাজ করে তাদের জন্য রয়েছে নেয়ামতপূর্ণ জান্নাত;
৩১:৯
خٰلِدِیۡنَ فِیۡہَا ؕ وَعۡدَ اللّٰہِ حَقًّا ؕ وَ ہُوَ الۡعَزِیۡزُ الۡحَکِیۡمُ ﴿۹﴾
সেখানে তারা চিরকাল থাকবে। আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সত্য। আর তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।
ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
সংক্ষিপ্ত আলােচনা : পবিত্র কোরআন মানুষের সাথে তার বােধগম্য ভাষায় কথা বলার জন্য নাযিল হয়েছে। কেননা এই কোরআনকে তিনিই নাযিল করেছেন, যিনি মানুষের স্বভাব প্রকৃতিকে সৃষ্টি করেছেন, যিনি জানেন তার স্বভাব-প্রকৃতির জন্য কোন কোন জিনিস উপযুক্ত এবং কোন কোন জিনিস তার স্বভাব প্রকৃতিকে বিশুদ্ধ রাখবে ও বিশুদ্ধ করবে, যিনি জানেন কিভাবে তার সাথে কথা বলা দরকার এবং কোন কোন উপায়ে তার অন্তরে কথা প্রবেশ করানাে যাবে। মানুষের জন্মগত স্বভাব প্রকৃতিতে ও সত্ত্বায় যে সত্য আগে থেকেই সুপ্ত ছিল এবং যে সত্যকে তার জন্মগত সত্ত্বা কোরআনের বক্তব্য শােনার আগে থেকেই জানে, সেই সত্যকেই তার সামনে তুলে ধরার জন্য কোরআন নাযিল হয়েছে। কেননা মানব সত্ত্বা ও মানব প্রকৃতি তার প্রথম সৃষ্টিকালে মূলত এই সত্যের ওপরই প্রতিষ্ঠিত ছিলাে। সেই সত্যটা হলাে আল্লাহ তায়ালার অস্তিত্ব ও একত্বের স্বীকৃতি প্রদান এবং আল্লাহ তায়ালার প্রশংসা ও গুণগানে মুখর সমুদয় সৃষ্টিজগতের সাথে একাত্ম হয়ে আল্লাহ তায়ালার আনুগত্য ও এবাদত করা। কিন্তু পরবর্তীকালে উল্লেখিত সত্যের ওপর তার স্বভাব প্রকৃতির প্রতিষ্ঠিত থাকা নানা কারণে কষ্টকর ও অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। যে পৃথিবীর মাটিতে সে বাস করে। সেই মাটি থেকে উঠে আসা বাষ্প তার স্বভাব প্রকৃতিকে আচ্ছন্ন ও নিস্ক্রিয় করে দেয়। তার রক্ত ও মাংস থেকে সৃষ্ট উত্তেজনা এবং তার প্রবৃত্তিজাত আবেগ উচ্ছাস ও কামনা-বাসনা তাকে বিপথগামী করে দেয়। এই আচ্ছন্নতা ও নিষ্ক্রিয়তা ও বিপথগামিতা থেকে তাকে রক্ষা করার জন্য আবির্ভূত হয় কোরআন। সে তার বােধগম্য ভাষা ও যুক্তি প্রয়ােগ করে তার সাথে কথা বলে। যে সত্যকে সে ভুলে গেছে, সেই সত্যকে তার সামনে তারই পরিচিত পদ্ধতিতে তুলে ধরে এবং সেই সত্যের ভিত্তিতে তার গােটা জীবন ব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠিত করে। আর ইসলামী আকীদা ও আদর্শের প্রতি তার আনুগত্যকে, জন্মগত স্বভাব প্রকৃতির সাথে তার একাত্মতা ও সংহতিকে এবং মহান স্রষ্টা আল্লাহর পথে তার যাত্রাকে মযবুত, অবিচল ও অভ্রান্ত করে। কোরআন মানুষের সাথে হৃদয়গ্রাহী ভাষায় ও মনমগজ দখলকারী ভংগিতে কথা বলার যে চমকপ্রদ পদ্ধতি প্রবর্তন করেছে, আলােচ্য সূরাটা তার একটা নমুনা। উপরােক্ত সত্য থেকে ভ্রষ্ট মােশরেক জনগােষ্ঠীর মনমগজে আকীদা-বিশ্বাসের যে ভ্রান্তি ছিল, এ সূরা সে ভ্রান্তি দূর করে। সকল মক্কী সূরাই এই ভ্রান্তি দূর করতে নানাভাবে চেষ্টা চালায় এবং মানুষের সুপ্ত স্বভাব প্রকৃতিকে সম্বােধন করে ও জাগ্রত করে। মানুষের মন-মগজকে পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন করার জন্য এ সূরা সর্বদিক থেকে অভিযান চালায়। এই আকীদাগত বিভ্রান্তি দূর করে মহান সৃষ্টিকর্তার একত্ব, একক এবাদাত ও আনুগত্য, তাঁর নেয়ামতসমূহের জন্য কৃতজ্ঞতা, আখেরাতে বিশ্বাস এবং আখেরাতের হিসাব নিকাশ ও ন্যায় বিচার আল্লাহ তায়ালার নাযিল করা বিধানের অনুসরণ এবং তা ছাড়া অন্য সমস্ত আকীদা বিশ্বাস ও আচার-অনুষ্ঠান বর্জনের শিক্ষা দেয়া হয়। সূরাটা এই শিক্ষাগুলাে এমন ভংগিতে তুলে ধরে যে, তা উপলব্ধি করার জন্য যথেষ্ট চিন্তা-গবেষণা করার প্রয়ােজন। চিন্তা-গবেষণার প্রয়ােজন মানবীয় মন-মগযকে উদ্বুদ্ধ করার কোরআনী ভংগি আয়ত্ত করার জন্য । আল্লাহ তায়ালার এবাদাত ও আনুগত্যের পথে মানুষকে আহ্বান করে-এমন প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য এই ভংগি আয়ত্ত করা অত্যন্ত জরুরী। সুরা লােকমানে আকীদা বিশ্বাস সংক্রান্ত এই শিক্ষাকে উপস্থাপন করা হয় কোরআনের চির পরিচিতি প্রেক্ষাপটে অর্থাৎ এই বিশাল বিশ্ব জগতের প্রেক্ষাপটে- যার ভেতরে রয়েছে আকাশ পৃথিবী, চন্দ্র সূর্য, নক্ষত্র, রাত, দিন, সাগর মহাসাগর, মহাশূন্য, তরংগমালা, বৃষ্টি, গাছপালা ও তরুলতা ইত্যাদি। এই সৃষ্টিগুলাে কোরআনে বারবার আলােচিত হয়ে থাকে। কেননা গােটা সৃষ্টিজগত এর মাধ্যমেই সরব ও সােচ্চার হয়ে ওঠে। এর ডানে বামে সর্বত্র ছড়িয়ে থাকে তাওহীদ, রেসালাত ও আখেরাতের সত্যতা প্রমাণকারী নিদর্শনাবলী । এসব নিদর্শন মানুষের অন্তরের অন্তস্থলে পৌছে দেয় তাওহীদের মর্মবাণী। তার অন্তর্জগতকে প্রভাবিত করে, আলােড়িত ও উজ্জীবিত করে এবং তার সামনে তার চলার পথ তুলে ধরে। যদিও মূল শিক্ষা একই এবং উপস্থাপনের প্রেক্ষাপটও অভিন্ন, তথাপি এটা এ সূরায় চারবার চার পর্বে আলােচিত হয়েছে। প্রতিবারই তা সেই সুপ্রশস্ত অংগনে মানব হৃদয়কে আলােড়িত করে, প্রতিবারই তার সাথে থাকে মন-মগযকে প্রভাবিত করার নতুন উপাদান এবং প্রতিবারই তা নতুন নতুন প্রকাশভংগীতে উপস্থাপিত হয়। এই চারটা পর্ব বিশেষ যত্ন সহকারে অধ্যয়ন করা উচিত। কেননা প্রত্যেকটা পর্বের সূচনা ও সমাপ্তি ঘটেছে এমন আশ্চর্যজনক পন্থায় যে, তাতে বিবেক ও মনের জন্য পর্যাপ্ত খােরাক রয়েছে। রয়েছে হৃদয়ের কাছে গ্রহণযােগ্য হবার মতা প্রচুর দরকারী উপাদান। আরবী বর্ণমালার কয়েকটা অক্ষর দিয়ে সূরাটার উদ্বোধন হবার পর শুরু হয়েছে এর প্রথম পর্ব বা অধ্যায়। বর্ণমালার এ অক্ষরগুলাের তাৎপর্য হলাে, এ ধরনের বর্ণমালা দিয়েই এই সূরাটা এবং এই বিজ্ঞানময় গ্রন্থের আয়াতসমূহ রচিত হয়েছে। এই আয়াতগুলাে হচ্ছে হেদায়াতের উৎস এবং সৎকর্মশীলদের জন্য আল্লাহর রহমত লাভের পথনির্দেশক। আর এই সৎকর্মশীল তারাই, যারা নামায প্রতিষ্ঠা করে, যাকাত দেয় এবং আখেরাতে বিশ্বাস করে। এভাবে আখেরাতে বিশ্বাস ও আল্লাহর এবাদতের বিষয়ে বিতর্কের অবসান ঘটানাে হয়েছে। এই সাথে একটা প্রেরণাদায়ক বক্তব্য দেয়া হয়েছে। সেটা হলাে, ওরাই তাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে সঠিক পথনির্দেশনার ওপর আছে এবং ওরাই সফলকাম। সফলকাম হতে চায় না এমন কে আছে। অপরদিকে আর একটা মানবগােষ্ঠী রয়েছে, যারা নানা রকমের মনভোলানাে কথাবার্তা কিনে আনে, যাতে মানুষকে অজ্ঞতার সুযােগ নিয়ে বিপথগামী করতে পারে এবং আল্লাহর আয়াতগুলােকে উপহাসের সামগ্রী হিসাবে গ্রহণ করে। আর এই মানবগােষ্ঠীর জন্যও উচ্চারিত হয়েছে আল্লাহর আয়াতগুলাের সাথে তাদের উপহাসের সাথে সংগতিশীল এক ভয়ংকর আতংকজনক হুমকি। ‘সেটা হলো, তাদের জন্য রয়েছে অপমানজনক শাস্তি।’ অতপর এই গােষ্ঠীর অপতৎপরতার বিবরণ দেয়া হয়েছে এভাবে, যখন আমার আয়াতগুলাে তার সামনে পড়া হয়, তখন সে অহংকারের সাথে পেছন ফিরে চলে যায় এবং এমন ভাব প্রকাশ করে যেন সে তা শুনতেই পায়নি। এই বিবরণের সাথেও রয়েছে এমন একটা মনােজ্ঞ মন্তব্য, যা এই গােষ্ঠীটার প্রতি তাচ্ছিল্য প্রকাশ করে। সেই মন্তব্যটা হচ্ছে, যেন তার দু’কানের মধ্যে বধিরতা রয়েছে। এরপর আরাে একটা হুমকি, ‘তাকে যন্ত্রণাদায়ক আযাবের সুসংবাদ জানাও’ এখানে ‘সুসংবাদ’ কথাটার মধ্যে কী সাংঘাতিক কটাক্ষ রয়েছে লক্ষ্য করুন। অতপর পুনরায় মােমেনদের প্রসংগ তুলে তাদের সেই সফলতা ব্যাখ্যা করা হচ্ছে, যার উল্লেখ সূরার শুরুতে সংক্ষিপ্তভাবে করা হয়েছে। আর আখেরাতে তারা কী প্রতিফল পাবে সেটাও এই সাথেই জানিয়ে দেয়া হয়েছে, যেমন জানিয়ে দেয়া হয়েছে অহংকারী ও উপহাসকারীদের শাস্তির কথা। ‘নিশ্চয় যারা ঈমান এনেছে ও সৎকাজ করেছে তাদের জন্য রয়েছে নেয়ামতে ভরপুর জান্নাত।'(আয়াত-৮ ও ৯) অতপর এখানে মহাবিশ্বকে উপস্থাপন করা হয়েছে প্রমাণ হিসাবে। এই প্রমাণ মানুষের স্বভাবগত সত্ত্বা এবং তার জন্মগত বিবেক বুদ্ধি ও মন মগজে সর্বদিক থেকে ঘিরে ধরে। তাকে জোরদার ভাষায় সম্বােধন করে এবং যে সত্যকে জনগণ দেখেও অবহেলা করে সেই সত্যকে তার সামনে তুলে ধরে। যেমন- ‘তিনি আকাশকে সৃষ্টি করেছেন স্তম্ভ ছাড়া…'(আয়াত ১০) আর এই প্রাকৃতিক প্রমাণগুলাে উপস্থাপন করে চেতনাকে জাগ্রত করা ও অনুভূতিকে শাণিত করার পর আল্লাহ তায়ালার অনবদ্য সৃষ্টিকে দেখেও যারা শিরকে লিপ্ত রয়েছে তাদের বিবেকে কষাঘাত করা হচ্ছে, ‘এই হচ্ছে আল্লাহর সৃষ্টি। এখন আমাকে দেখাওতাে দেখি, অন্যেরা কী কী সৃষ্টি করেছে।'(আয়াত-১১) এই সুগভীর, শাণিত ও অকাট্য প্রাকৃতিক যুক্তিটা পেশ করার মধ্য দিয়েই শেষ হচ্ছে সূরা লোকমানের প্রথম অধ্যায়। দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু হচ্ছে কতিপয় ব্যক্তির উক্তির মাধ্যমে। তবে আলােচ্য বিষয় ও আলােচনার প্রেক্ষাপট এখানে অভিন্নই থাকছে। কেবল বর্ণনাভংগি ও উদ্বুদ্ধকরণ বক্তব্যের নতুনত্বই। এখানে লক্ষণীয়। আল্লাহ তায়ালা বলছেন, আমি ‘লােকমানকে জ্ঞান দান করেছিলাম।’ এখন প্রশ্ন এই যে, এই জ্ঞান কি ধরনের এবং তার বিশেষত্ব কি? এই জ্ঞানের সারকথা হলাে, ‘আল্লাহ তায়ালার শােকর আদায় করাে।’ এটাও জ্ঞান এবং এটাই বিজ্ঞজনােচিত পথ। পরবর্তী পদক্ষেপ হচ্ছে লােকমান কর্তৃক তার ছেলেকে উপদেশ দান। এ হচ্ছে একজন জ্ঞানী লােক কর্তৃক নিজের ছেলেকে প্রদত্ত উপদেশ। এ উপদেশ দোষমুক্ত। উপদেশদাতাকে জ্ঞান দান করা হয়েছে। এ উপদেশের বিরুদ্ধে অভিযােগ তােলার অবকাশ নেই। কেননা কোনাে পিতা তার সন্তানকে যে উপদেশ দেয়, তার বিরুদ্ধে কোন অভিযােগ আরােপ করা যায় না। প্রথম পর্বে যেমন তাওহীদ ও আখেরাতের বিষয়ে বক্তব্য রাখা হয়েছে, এ উপদেশেও তেমনি। সেই সাথে রয়েছে অন্তরে উদ্দীপনা সৃষ্টিকারী নতুন নতুন বক্তব্য। লোকমান যখন তার ছেলেকে উপদেশ ছলে বললাে, ‘হে বৎস, আল্লাহর সাথে শরীক করাে না। নিশ্চয় শিরক একটা বড়ো মাপের যুলুম।’ এরপর এই উপদেশকে জোরদার করা হচ্ছে আরাে একটা উদ্দীপনাময় বক্তব্য দিয়ে যার মধ্যে দিয়ে পিতৃত্ব ও মাতৃত্বের সম্পর্ককে এমনভাবে তুলে ধরা হচ্ছে যে, স্নেহ ও মমতাকে প্রবলভাবে জাগিয়ে তােলা হয়েছে। ‘আমি মানুষকে তার পিতামাতা সম্পর্কে উপদেশ দিয়েছি'(আয়াত-১৪)। এখানে লক্ষণীয় যে, আল্লাহ তায়ালার শােকরকে পিতামাতার শােকরের পাশাপাশি উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহর শােকরকে পিতা মাতার শােকরের আগে উল্লেখ করা হয়েছে। ‘আমার ও তােমার পিতামাতার শােকর করাে।’ অতপর আকীদা ও আদর্শের ক্ষেত্রে যে সর্বোচ্চ মূলনীতি উল্লেখ করা হয়েছে তা হলাে, আদর্শিক সম্পর্ক বংশীয় ও রক্তের সম্পর্কের চেয়ে অগ্রগণ্য। বংশীয় ও রক্তের সম্পর্কে যতােই দৃঢ়তা ও স্নেহমমতা থাকুক না কেন, আকীদার সম্পর্কের পরেই তার স্থান। আয়াতের শেষাংশে বলা হয়েছে, ‘আর যদি তারা উভয়ে তােমাকে আমার সাথে কাউকে শরীক করতে চাপ দেয়। তা হলে তাদের আনুগত্য করাে না।’ এর পরবর্তী আয়াতেই আল্লাহ তায়ালার জ্ঞানের মহত্ব, সুক্ষ্মতা ও ব্যাপকতার এমন বর্ণনা দেয়া হয়েছে যে, তা মানবীয় আবেগ-অনুভূতিতে শিহরণ জাগায়। ব্যাপকতর প্রাকৃতিক অংগনে লােকমান এ দৃশ্যটা তুলে ধরেছেন।(আয়াত-১৬) এরপর লােকমান তার ছেলেকে আরাে উপদেশ দেন ইসলামী আদর্শের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে, সৎ কাজের আদেশ দেয়া ও অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করা সম্পর্কে এবং এই সমস্ত কাজ করতে গিয়ে ইসলামের অনুসারীকে যেসব দুঃখকষ্ট ও বিপদ-মুসিবতের সম্মুখীন হতে হয় তার ওপর ধৈর্য ধারণ করা সম্পর্কে। এমনকি ইসলামের অনুসারী যদি স্বাভাবিকভাবে নিজের আকীদা-বিশ্বাস অনুসারে চলে এবং এতে তার দ্বারা অন্যরা প্রভাবিত হয়, তাহলেও তার ওপর নানারকম বাধা-বিপত্তি ও বিপদ মুসিবত আসতে পারে।(আয়াত ১৭) এরপর ১৮ নং আয়াতে বলা হয়েছে যে, সৎ কাজের আদেশ দান, অসৎ কাজের প্রতিরােধ এবং বিপদ মুসিবতে ধৈর্য ধারণের পাশাপাশি ইসলামের দাওয়াতদাতার আরাে একটা জরুরী কর্তব্য হলাে, মানুষের সাথে দুর্ব্যবহার না করা। কেননা দুর্ব্যবহারের অর্থ দাঁড়াবে, নিছক মুখের কথা দ্বারা সমাজে যেটুকু সংস্কারের কাজ করার সুযােগ ছিলাে তা নিজের আচরণ দ্বারা নষ্ট করলো। ১৯ ও ২০ নং আয়াতে সে কথাই বলা হয়েছে। এখানে বিশেষভাবে মুখমন্ডলকে বিকৃত করা, ভেংচি দেয়া, কুটি করা ইত্যাদির কঠোর নিন্দা ও সমালােচনা করা হয়েছে। এর মধ্য দিয়েই দ্বিতীয় পর্ব সমাপ্ত হয়েছে। এ অধ্যায়ে আকীদার বিষয়টা সংশ্লিষ্ট প্রেক্ষাপটে সম্পূর্ণ নতুন ভংগিতে ও নতুন আবেশে তুলে ধরা হয়েছে। এরপর শুরু হয়েছে তৃতীয় অধ্যায়। তাওহীদ ও আখেরাতের আকীদাটাকে আকাশ ও পৃথিবীর প্রেক্ষাপটে ব্যাখ্যা করা হয়েছে এ অধ্যায়ে। সেই সাথে আকাশ ও পৃথিবীর সাথে এবং এ দুটোতে বিদ্যমান নেয়ামতগুলাের সাথে মানুষের সম্পর্ক অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী ও মর্মস্পর্শী ভাষায় আলােচিত হয়েছে। বলা হয়েছে যে, মহান আল্লাহ এই সব নেয়ামতকে মানুষের আয়ত্তাধীন করেছেন, অথচ তারা এর শােকর আদায় করে না।(আয়াত-২০) এরই প্রেক্ষাপটে আয়াতের শেষভাগে আল্লাহ তায়ালাকে নিয়ে যে কোনরকম বিতর্কে লিপ্ত হওয়াকে প্রকৃতি বিরােধী ও ঘৃণ্য ব্যাপার বলে নিন্দা করা হয়েছে। বিকারমুক্ত ও কলুষমুক্ত বিবেক এ ধরনের আচরণকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে। অতপর এ কুফরির আচরণের প্রতি ঘৃণা ও ক্ষোভ প্রকাশ অব্যাহত রাখা হয়েছে পরবর্তী আয়াতে।(আয়াত ২১) এটাকে বিকারগ্রস্ত ও নির্বোধসুলভ আচরণ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে এবং এর পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ বলে হুশিয়ারী জ্ঞাপন করা হয়েছে। আর এ কারণেই ২২ ও ২৩ নং আয়াতে আখেরাতের কর্মফল ও সেই কর্মফলের সাথে ঈমান ও কুফরের সম্পৃক্ততা দেখানাে হয়েছে। এরপর ২৪ নং আয়াতে ভয়ংকর আযাবের হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করা হয়েছে। অতপর অধ্যায়টা শেষ করার আগে মােশরেকদেরকে সৃষ্টি জগতের মুখােমুখি দাঁড় করিয়ে এর স্রষ্টা কে জিজ্ঞেস করা হয়েছে, যার জবাবে মহান আল্লাহকে স্রষ্টা হিসাবে স্বীকার না করে তাদের উপায়ন্তর থাকে না। অবশেষে অধ্যায়ের শেষ আয়াত দুটোতে ২৬ ও ২৭ নং আয়াতে এমন একটা প্রাকৃতিক দৃশ্য তুলে ধরা হয়েছে, যাতে আল্লাহ তায়ালার সীমাহীন জ্ঞান, সৃষ্টির ক্ষেত্রে তাঁর বাধা-বন্ধনহীন ইচ্ছা এবং এর মাধ্যমে সমগ্র সৃষ্টি জগতকে ধ্বংস করে তা পুনরায় সৃষ্টি করতঃ আখেরাত প্রতিষ্ঠার প্রমাণ পেশ করা হয়েছে। চতুর্থ অধ্যায়টা শুরু হয়েছে একটা বিশেষ প্রাকৃতিক দৃশ্যের বর্ণনার মাধ্যমে। এ দৃশ্য মানুষের মনের ওপর একটা বিশেষ ধরনের প্রভাব বিস্তার করে। এ দৃশ্য রয়েছে রাত, যা দীর্ঘস্থায়ী হয়ে দিনের দেহের ভেতরে প্রবেশ করে ও বিলীন হয়ে যায়। আর রয়েছে দিন যা একইভাবে দীর্ঘস্থায়ী হয়ে রাতের দেহের ভেতরে ঢুকে যায় ও বিলীন হয়ে যায়। এ দৃশ্যে আরো রয়েছে চাঁদ ও সূর্য, যারা মহাশূন্যে নিজ নিজ কক্ষপথে নিতান্ত অনুগত হয়ে নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে প্রদক্ষিণ করে। সেই সময়সীমা কী, তা একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই জানেন, যিনি সূর্য চন্দ্র, আকাশ পৃথিবী, মানুষ ও মানুষের যাবতীয় কাজ-সম্বন্ধে সম্যক অবগত।(আয়াত-২৮-২৯ ) এরপর মানুষকে দেয়া আল্লাহ তায়ালার অন্য একটা নেয়ামতের কথাও স্মরণ করানাে হয়েছে। এ নেয়ামত বা সাগরে চলাচলকারী নৌকা বা জাহাজ।(আয়াত-৩০) অতপর ৩১ নং আয়াতে মানুষকে পুনরায় প্রাকৃতিক যুক্তি প্রদর্শন করা হয়েছে। বিশেষত যে সময়ে তারা সাগরের ভয়াবহ তরংগমালার সম্মুখীন হয়, ক্ষমতার দর্প চূর্ণ হয় এবং বিদ্যা বুদ্ধি ও জ্ঞান বিজ্ঞান তাদেরকে আল্লাহদ্রোহী বানিয়েছে, সেই বিদ্যা বুদ্ধি নিয়ে তাদের আর কোনাে অহংকার থাকে না, সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে এ যুক্তি খুবই ধারালাে ও যুৎসই। এ যুক্তি দ্বারা তাওহীদের সত্যতা প্রমাণ করা হয়েছে। (আয়াত নং ৩২ দেখুন) সমুদ্রের ভয়ংকর তরংগমালার সাথে সামঞ্জস্য থাকার সুবাদে ৩৩ নং আয়াতে তাদের কেয়ামত ও আখেরাতের অধিকতর ভয়াল অবস্থা স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে। এভাবে এ আয়াত আখেরাতের সত্যতা প্রমাণ করে। বস্তুত আখেরাত এমন আতংকজনক জায়গা, যা রক্ত সম্পর্কীয় বন্ধনগুলােকে পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে, অথচ দুনিয়ার জীবনে এমন কোন বিপদ নেই যা এই বন্ধনগুলােকে বিচ্ছিন্ন করে। অতপর যে আয়াত দ্বারা সূরার সমাপ্তি টানা হয়েছে, তাতে কেয়ামতের সময়, বৃষ্টি বর্ষণ, মাতৃগর্ভের ক্ষণ, মানুষের আগামী দিনের উপার্জন এবং তার মৃত্যুর স্থান-এই কটা বিষয় সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত দেয়া হয়েছে। এই চারটে অধ্যায় এগুলাের নিজস্ব বর্ণনাভংগি, উদ্দীপক বক্তব্যসমূহ, যুক্তিপ্রমাণ ও নিদর্শনাবলীসহ, মানব হৃদয়কে উদ্বুদ্ধকরণে কোরআনের গৃহীত কৌশলের প্রকৃষ্ট নমুনা। যিনি হৃদয়গুলাের স্রষ্টা, যিনি হৃদয়গুলাের উপযুক্ত কৌশল ও ভাষা সম্পর্কে অবগত, তিনিই এই কৌশল নির্ধারণ করেছেন। এবার আমরা এই চারটি অধ্যায়কে দুটো অধ্যায়ে ভাগ করে এর আয়াতগুলাের তাফসীরে মনােনিবেশ করব। কেননা এর প্রত্যেক দুটো অধ্যায়ের মধ্যে গভীর সমন্বয় ও সামঞ্জস্য বিদ্যমান।
# আফিল-লাম-মীম… এ ধরনের বিচ্ছিন্ন আরবী অক্ষরসমূহ দিয়ে যে সব সূরা শুরু হয়, সে সব সূরার তাফসীরে ইতিপূর্বে আমি বলেছি যে, এ সব অক্ষর দিয়ে শুরু করা এবং এগুলােকে বিজ্ঞানময় গ্রন্থের আয়াতসমূহ’ বলে আখ্যায়িত করার তাৎপর্য শুধু এই যে, এই মহাগ্রন্থের আয়াতগুলাে এ ধরনের আরবী বর্ণমালা দিয়েই রচিত ও লিখিত হয়েছে। আর এই কিতাবকে এখানে ‘হাকীম’ বা বিজ্ঞানময় বিশেষণে বিশেষিত করার কারণ এই যে, এই সূরায় একাধিকবার ‘হিকমত’ বা বিজ্ঞান শব্দের উল্লেখ করা হয়েছে। তাই এই গ্রন্থর অন্যান্য বিশেষণের মধ্য থেকে এই বিশেষণটা ব্যবহার করাই পরিবেশ ও পরিস্থিতির অধিকতর উপযােগী বিবেচিত হয়েছে। বস্তুত এটাই কোরআনের স্থায়ী রীতি। কোরআন শরীফকে বিজ্ঞানময় বা হাকীম বিশেষণে বিশেষিত করা দ্বারা তার সম্পর্কে এরূপ ধারণা জন্মে যেন কোরআন এমন এক জীবন্ত ব্যক্তিত্ব, যার কথায় নির্দেশনাবলীতে যথেষ্ট বিজ্ঞতার ছাপ রয়েছে, সে যা বলে, তা যেন সে সূদুরপ্রসারী পরিকল্পনা করেই বলে এবং তার যা লক্ষ্য, সেটাই যেন সে বাস্তবায়িত করতে চায়। কোরআন কিন্তু আসলেই তদ্রুপ। তার ভেতরে আত্মা রয়েছে, জীবন রয়েছে, গতি রয়েছে, স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব রয়েছে, চিত্তাকর্ষণের ক্ষমতা রয়েছে যারা কোরআনের নির্দেশনা মােতাবেক জীবন যাপনের মাধ্যমে তার সাহচর্য, ঘনিষ্ঠতা ও সান্নিধ্য লাভ করে, তারা তার সান্নিধ্য অনুভব করে এবং তার প্রতি একই ধরনের আকর্ষণ ও মমত্ববােধ করে- ঠিক যেমনটি দুটো প্রাণী এবং দুই বন্ধু একে অপরের আকর্ষণ ও মমতুবােধে সাড়া দেয়।
*কোরআনের দৃষ্টিতে সৎ ও অসৎ লোক : ৩ নং আয়াতের মর্ম এই যে, এই বিজ্ঞানময় গ্রন্থ বা এর আয়াতগুলাে ‘সৎ লােকদের জন্য পথনির্দেশিকা ও করুণা।’ এটাই কোরআনের আসল ও চিরন্তন রূপ । সৎ লােকদেরকে তা এমন পথের সন্ধান দেয়, যে পথের যাত্রীরা কখনাে পথভ্রষ্ট হয় না, আর এমন করুণা ও অনুগ্রহ দান করে, যা হেদায়াত তথা সৎপথ প্রাপ্তির কারণে তাদের অন্তরকে অনাবিল শান্তি ও পরিতৃপ্তিতে ভরে দেয়। অন্তরকে শান্তি ও পরিতৃপ্তিতে ভরে দেয় দুনিয়া ও আখেরাতে সার্বিক কল্যাণ ও সাফল্য লাভের কারণে। তার কারণে সুপথপ্রাপ্তদের মাঝেও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ও অন্তরংগতা বিরাজ করে। তাদের ও প্রাকৃতিক নিয়মের মধ্যে পরিপূর্ণ সমন্বয় ও সামঞ্জস্য বিরাজ করার কারণে এবং পরিস্থিতি পরিবেশ ও সুপথপ্রাপ্তদের কাছে সুপরিচিত ও সমাদৃত। নৈতিক মূল্যবােধের মাঝে যে একাত্মতা ও সমন্বয় বিরাজ করে তার কারণেও সর্বোপরি স্বভাব প্রকৃতির সাথে মূল্যবােধগুলাের সমন্বয় ও সাজুয্যের কারণেও তাদের অন্তর পরিতৃপ্ত থাকে। এই স্বভাব প্রকৃতি সাধারণত অবিকৃতই থাকে। সৎলােক হচ্ছে তারা, যারা নামায কায়েম করে, যাকাত দেয় এবং আখেরাতে বিশ্বাস রাখে। নামায যথা নিয়মে ও যথাসময়ে পূর্ণাংগভাবে আদায় করা ও প্রতিষ্ঠা করা হলে তার মধ্য দিয়ে নামাযের বিজ্ঞানসম্মত মহৎ উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য বাস্তবায়িত হয়। চিন্তায় ও আচরণে তার সুফল প্রতিষ্ঠিত হয়। বান্দার অন্তর ও মহান প্রভুর মাঝে মযবুত সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। এর মাধ্যমে মহান আল্লাহর সাথে সখ্যতা গড়ে ওঠে এবং এই সখ্যের এমন অপূর্ব স্বাদ উপভােগ করা যায়, যা নামাযের প্রতি মনকে আকৃষ্ট করে রাখে। আর যাকাত দান করলে মানুষ তার স্বভাবগত কার্পণ্য থেকে মুক্তি পায় এবং সমাজ জীবনে পারস্পরিক সহযােগিতা ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তাভিত্তিক সামষ্টিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়। এ সমাজে ধনী ও দরিদ্র উভয় শ্রেণী পরম শান্তি ও পরিতৃপ্তি, এবং পারস্পরিক আস্থা ও আন্তরিক সম্প্রীতির পরিবেশে বাস করে। ধনীদের বিলাসিতা ও দরিদ্রদের বঞ্চনা, যা সামাজিক শান্তি, পারস্পরিক আস্থা ও সম্প্রীতিকে নষ্ট করে দেয়- যাকাত প্রচলিত থাকায় এ সমাজে স্থান পায় না। আর আখেরাতে বিশ্বাস মানুষের মনের সার্বক্ষণিক সতর্কতা ও সচেতনতা, আল্লাহ তায়ালার কাছে তার জন্য যা কিছু প্রাপ্য রয়েছে তার আকাংখায় উজ্জীবিত থাকা, পার্থিব জীবনের সকল মােহ ও প্রলােভনের উর্ধে ওঠা, ক্ষুদ্র বা বড় এবং গােপন বা প্রকাশ্য সর্বাবস্থায় আল্লাহ তায়ালাকে স্মরণ রাখা এবং এহসানের পর্যায়ে উপনীত হওয়ার নিশ্চয়তা দান করে। এহসান কী-এই প্রশ্নের জবাবে রসূল(স.) বলেছেন, ‘তুমি এমনভাবে আল্লাহ তায়ালার ইবাদত করবে যেন তাকে দেখতে পাচ্ছ। আর যদি তাকে দেখতে না পাও, তবে অন্তত এতােটুকু জেনে রেখাে, তিনি তােমাকে দেখছেন। (বােখারী ও মুসলিম) এরই নাম এহসান। এই এহসান নামক গুণটি যাদের মধ্যে আছে, তারাই মুহসিন বা সংলােক। এই সৎলােকদের জন্যই কোরআন হেদায়াত ও রহমতে পরিণত হয়। কেননা তাদের অন্তর উদার। নমনীয় ও স্বচ্ছ হওয়ার কারণে আল্লাহ তায়ালার এই কিতাবের সাহচর্যে তারা পরম শান্তি ও পরিতৃপ্তি লাভ করে, কোরআনে যে হেদায়াত ও আলাে রয়েছে তা অর্জন করে। তার মহৎ উদ্দেশ্যসমূহ হৃদয়ঙ্গম করে। কোরআনের সাথে তাদের গভীর পরিচিতি, ঘনিষ্ঠতা ও সমন্বয় গড়ে ওঠে এবং তারা অনুভব করে উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের ঐক্য এবং পথের স্বচ্ছতা। প্রত্যেক মানুষের অন্তরে যে পরিমাণ সংবেদনশীলতা উদারতা ও মহানুভবতা রয়েছে এবং যে পরিমাণ উচ্চাভিলাষ, মর্যাদা ও ভালােবাসা অর্জন করতে চায়, এই কোরআন ঠিক সেই পরিমাণেই তাকে হেদায়াত দান করে। তাই বলা যায় যে, কোরআন এমন একটা প্রাণবন্ত সত্ত্বা যা বন্ধু-প্রতিম হৃদয়গুলাের প্রতি সহানুভূতিশীল এবং যারা তার দিকে এগিয়ে আসে, তাদের দিকে সেও ভাবাবেগ সহকারে এগিয়ে যায়। যারা নামায কায়েম করে, যাকাত দেয় ও আখেরাতে বিশ্বাস করে। তাদের সম্পর্কেই ৫ম আয়াতে বলা হয়েছে যে, ‘তারা তাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে সুপথপ্রাপ্ত এবং তারাই সফলকাম।’ এ কথা স্বতঃসিদ্ধ যে, যে সুপথ প্রাপ্ত হয়, সে-ই সফলকাম হয়। কেননা সে আলাের পথের যাত্রী, সে গন্তব্যে পৌছে গেছে, দুনিয়ার জীবনে সে গােমরাহী থেকে মুক্ত এবং আখেরাতেও গোমরাহীর কুফল থেকে মুক্ত। এই পৃথিবীতে জীবন যাপনকালে সে নিশ্চিন্ত যে, সমগ্র প্রকৃতি ও সৃষ্টিজগতের সাথে সে পুরােপুরি একাত্ম । তাই সে সৃষ্টিজগতের প্রতিটি সৃষ্টির প্রতি সখ্য অনুভব করে। আল্লাহ তায়ালার কিতাব দ্বারা হেদায়াত তথা সুপথপ্রাপ্ত সেসব সৎলােক যারা নামায কায়েম করে, যাকাত দেয়। আখেরাতে বিশ্বাস করে এবং দুনিয়া ও আখেরাতে সফলকাম- এরা একটা গােষ্ঠী। আর এদের বিপরীতে রয়েছে আরা একটা গােষ্ঠী। এই গােষ্ঠীটা সম্পর্কে ৬ ও ৭ নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘এমন কিছু লােক রয়েছে, যারা মন ভােলানাে কথা কিনে আনে…’ ‘লাহুয়াল হাদীস’ শব্দটা দ্বারা এমন কথা বুঝানাে হয়েছে যা মনকে উদাসীন করে দেয়, সময়ের অপচয় ঘটায়, কোন সুফল বয়ে আনে না এবং তা দ্বারা এমন কোন জিনিস অর্জিত হয় না, যা এই পৃথিবীতে কল্যাণ, ন্যায় বিচার ও সার্বিক সংস্কারের কাজ করার জন্য খেলাফতের দায়িত্বে নিয়ােজিত মানুষের মৌলিক দায়িত্ব পালনে কোন সাহায্য করে। খেলাফতের এই দায়িত্বের প্রকৃতি, চৌহদ্দী, তা পালনের উপায়-উপকরণ ও পথ-পন্থা ইসলামই নির্ধারণ করে দিয়েছে। আয়াতে এমন কিছু লােক রয়েছে বলে যে শ্রেণীর মানুষের কথা বলা হয়েছে, তা সকল যুগে সকল স্থানে পাওয়া যায়। কিছু কিছু বর্ণনায় জানা যায় যে, এ দ্বারা রসূল(সঃ)-এর যুগের একটা বিশেষ ঘটনার দিকে ইংগীত দেয়া হয়েছে। নযর ইবনুল হারিস পারস্যের কীংবদন্তী, তাদের জাতীয় বীর ও যুদ্ধ বিগ্রহের কাহিনী সম্বলিত পুস্তকাদি কিনতাে, তারপর যে পথ দিয়ে মুসলমানরা রসূল(স.)-এর কাছে কোরআন শুনতে যেতাে, সেই পথের পাশে বসে পড়তাে। সেখানে বসে তাদেরকে সেই সব কিংবদন্তী ও কিসসা কাহিনীর দিকে আকৃষ্ট ও কোরআনের কিসসা কাহিনীর প্রতি বীতশ্রদ্ধ করার চেষ্টা করতাে । আয়াতটা এই বিশেষ ঘটনার ব্যাপারে নাযিল হয়েছে-এ কথা সত্য হলেও এর ভাষা এ ঘটনার চেয়েও ব্যাপকতর ক্ষেত্রে প্রযােজ্য। এতে স্পষ্টতই বিশেষ ধরনের গুণবৈশিষ্ট সম্বলিত এমন এক শ্রেণীর মানুষের ছবি এঁকে দেয়া হয়েছে, যা সর্বকালেই পাওয়া যায়। মক্কী যুগের মাঝামাঝি সময়ে, যখন এ আয়াতগুলাে নাযিল হয়েছিল, তখনই এ শ্রেণীর কিছু লােক মক্কায় বিদ্যমান ছিল। ‘কিছুলােক মন ভােলানাে কথা খরিদ করে।’ অর্থাৎ নিজের অর্থ সম্পদ, সময় ও আয়ুষ্কালের ন্যায় বহু মূল্যবান জিনিসের বিনিময়ে এই সস্তা জিনিস খরিদ করে। তাদের সীমাবদ্ধ জীবন এতে ব্যয়িত হয় অথচ তা আর কখনাে ফিরে আসবে না এবং ফিরিয়ে আনাও যাবে না। এই সব দামী দামী সম্পদ দিয়ে তারা এই মনভােলানাে কিসসা কাহিনী খরিদ করে শুধু এই উদ্দেশ্যে যেন, ‘তারা আল্লাহ তায়ালার পথ থেকে মানুষকে বিপথগামী করতে পারে…’ বস্তুত এ ধরনের লােকেরা হয়ে থাকে সম্পূর্ণ অজ্ঞ ও মূর্খ। কোন জ্ঞানের ভিত্তিতে তারা কোনাে কাজ করে না এবং সুবিবেচনার আলােকে তারা কোন লক্ষ্য স্থির করে না। তারা যা-ই করে খারাপ উদ্দেশ্যে করে। আল্লাহর পথ থেকে নিজেকেও বিচ্যুত করতে চায়, অন্যকেও বিচ্যুত করতে চায়। আর এই কদর্য উদ্দেশ্যে তারা নিজেদের মূল্যবান আয়ুষ্কালকে এই নিকৃষ্ট ধরনের মন ভােলানাে কাজে ব্যয় করে। তারা বেয়াদব ও উচ্ছৃংখল। তাই আল্লাহ তায়ালার পথ তাদের কাছে উপহাসের ব্যাপার। তিনি মানুষের জন্য যে জীবন বিধান রচনা করে দিয়েছেন, তা তাদের ব্যংগ-বিদ্রুপের বিষয়। এ জন্য এই শ্রেণীর পূর্ণাংগ পরিচয় দেয়ার আগেই তাদেরকে অপমানজনক শাস্তির দুঃসংবাদ দিয়েছে, তাদের জন্য রয়েছে অপমানজনক শাস্তি। এখানে শাস্তিকে ‘অপমানজনক’ বিশেষণে বিশেষিত করা হয়েছে এই উদ্দেশ্যেই যে, তারা মহান আল্লাহর মহিমান্বিত দ্বীনকে ঠাট্টা-বিদ্রুপের মাধ্যমে যেভাবে অবমাননার শিকার করতাে, ঠিক সেইভাবে আল্লাহ তায়ালাও তাদের জন্য অবমাননাকর শাস্তি নির্ধারণ করে রেখেছেন। এরপর এই শ্রেণীর বাদ বাকী পরিচয় দেয়া হচ্ছে ৭ নং আয়াতে, আর যখন তাকে আমার আয়াতগুলাে পড়ে শােনানাে হয় তখন এমন দম্ভের সাথে তা প্রত্যাখ্যান করে যেন তা সে শোনেনি। এখানে এমন একটা সচল দৃশ্য তুলে ধরা হয়েছে, যা তাচ্ছিল্যের সাথে ও অবমাননাকর পন্থায় সদয়ে প্রত্যাখ্যানকারীর আচরণকে চিত্রিত করে। তাই এমন একটা অপমানজনক ভাষায় তার বর্ণনা দেয়া হয়েছে, যা তার এই আচরণকে আরাে হীন ও তুচ্ছ আকারে তুলে ধরে। বলা হয়েছে, ‘যেন তার উভয় কানে কোন ভারী জিনিস রয়েছে।’ আর তার কানের এই ভারী জিনিস যেন তাকে আল্লাহ তায়ালার আয়াত শুনতে বাধা দেয়। নচেত যার কান আছে, সে এগুলাে শুনে এমন জঘন্যভাবে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে না। অতপর এই তাচ্ছিল্যজনক বর্ণনাকে পূর্ণতা দেয়া হয়েছে বিদ্রুপাত্মক হুমকির মধ্য দিয়ে, অতএব তাকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সুসংবাদ দিয়ে দাও।’ এই বিষয়ে সুসংবাদ দান এক ধরনের অপমানজনক হুমকি ছাড়া কিছু নয়। এ ধরনের হুমকি একমাত্র দাম্ভিক বিদ্রুপকারীদেরই উপযুক্ত। প্রত্যাখ্যানকারী দাম্ভিক কাফেরদের আলােচনা প্রসংগে এবার সৎকৰ্মশীল মােমেনদের বিষয় আলােচিত হচ্ছে, যাদের সম্পর্কে সূরার শুরুতেই বক্তব্য এসেছে। তবে সেখানে তাদের পুরস্কার সংক্ষেপে এবং এখানে কিঞ্চিৎ বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। ‘নিশ্চয় যারা ঈমান এনেছে ও সৎকাজ করেছে, তাদের জন্য রয়েছে নেয়ামতে পরিপূর্ণ বাগিচাসমূহ…’ পবিত্র কোরআনের যেখানেই ভালাে প্রতিদানের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, সেখানে তার পূর্বে ঈমানের সাথে সৎকাজ করার উল্লেখ রয়েছে। বস্তুত ইসলামী আকীদা বিশ্বাসের প্রকৃতিই এমন। যে, তার প্রতি ঈমান বা বিশ্বাস নিছক সুপ্ত, নিষ্ক্রিয় ও নিশ্চল বিশ্বাস হিসাবেই থেকে যেতে প্রস্তুত হয় না বরং তা একটা জীবন্ত সক্রিয় ও সচল বিশ্বাসে পরিণত হতে চায় এবং নিজেকে কাজে, কর্মে ও আচরণে প্রকাশ না করে অন্তরে নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকতে রাযী হয় না। বিবেক ও মনমগযের জগতে তা যে রূপ ও প্রকৃতি নিয়ে বিরাজমান, বাস্তব জগতে লক্ষণীয় আলামতের মাধ্যমে নিজের সেই রূপ ও প্রকৃতিকে প্রকাশ না করে সে ক্ষান্ত হয় না। ‘যারা ঈমান এনেছে ও ঈমানকে সৎ কাজের মধ্য দিয়ে বাস্তবায়িত করেছে, তাদের জন্য নেয়ামতে পরিপূর্ণ জান্নাত রয়েছে, যার মধ্যে তারা চিরদিন বসবাস করবে আল্লাহ তায়ালার সত্য ওয়াদা হিসাবে।’ অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালার অভ্রান্ত ও অলংঘনীয় ওয়াদা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যেই এই জান্নাত ও জান্নাতে চিরস্থায়ী বসবাস তাদের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে। বস্তুত এটা আল্লাহ তায়ালার অতি বড় করুণা যে, তিনি তাঁর বান্দাহদের সাথে ওয়াদা করে তাদের প্রতি অনুগ্রহ করাকে বাধ্যতামূলক ও অপরিহার্য করে নিয়েছেন। অথচ এ কাজটা করেছেন তাদের সেই সৎকর্মের প্রতিদান হিসাবে, যা তারা আল্লাহ তায়ালার কোনাে উপকারের জন্য নয় বরং নিজেদের উপকারের জন্যই করে থাকে। কেননা তিনি কারাে কাছ থেকেই কোন উপকার বা অনুগ্রহের মুখাপেক্ষী নন। ‘আর তিনি মহাপরাক্রমশালী মহাকুশলী।’ অর্থাৎ নিজের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের ক্ষমতা তার রয়েছে এবং সৃষ্টি করা, ওয়াদা করা ও ওয়াদা বাস্তবায়নের কলাকৌশল তার জানা আছে। প্রশ্ন উঠতে পারে যে, মহান আল্লাহ যে এতাে ক্ষমতার অধিকারী এবং এত বিজ্ঞ কুশলী তার লক্ষণাদি ও নিদর্শনাবলী কোথায় আর এ সূরায় তাওহীদ, আখিরাত, রিসালাত ও অন্য যেসব বিষয় আলােচিত হয়েছে তার প্রমাণই বা কী? এর জবাবে পরবর্তী আয়াতে বলা হয়েছে যে, এ সবের নিদর্শনাবলী ও সাক্ষাৎ প্রমাণ হলাে এই বিশাল ও প্রকান্ড মহাবিশ্ব, যার সম্পর্কে কোনাে মানুষ দাবী করতে পারে না যে, এটাকে সে অথবা আল্লাহ তায়ালা ছাড়া অন্য কেউ সৃষ্টি করেছে।
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
(৩১-লুকমান) : নামকরণ:
এ সূরার দ্বিতীয় রুকুতে লুকমান হাকীমের উপদেশাবলী উদ্ধৃত করা হয়েছে। তিনি নিজের পুত্রকে এ উপদেশ দিয়েছিলেন। এই সুবাদে এ সূরার লুকমান নামকরণ করা হয়েছে।
(৩১-লুকমান) : নাযিল হওয়ার সময়-কাল :
এ সূরার বিষয়বস্তু সম্পর্কে চিন্তা করলে পরিষ্কার বুঝা যায়, এটি এমন সময় নাযিল হয় যখন ইসলামের দাওয়াতের কণ্ঠরোধ এবং তার অগ্রগতির পথরোধ করার জন্য জুলুম-নিপীড়নের সূচনা হয়ে গিয়েছিল এবং এ জন্য বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করা হচ্ছিল। কিন্তু তখনও বিরোধিতা তোড়জোড় ষোলকলায় পূর্ণ হয়নি। ১৪ ও ১৫ আয়াত থেকে এর আভাস পাওয়া যায়। সেখানে নতুন ইসলাম গ্রহণকারী যুবকদের বলা হয়েছে, পিতা-মাতার অধিকার যথার্থই আল্লাহর পরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু তারা যদি তোমাদের ইসলাম গ্রহণ করার পথে বাধা দেয় এবং শির্কের দিকে ফিরে যেতে বাধ্য করে তাহলে তাদের কথা কখনোই মেনে নেবে না। একথাটাই সূরা আনকাবুতেও বলা হয়েছে। এ থেকে জানা যায় যে, দুটি সূরাই একই সময় নাযিল হয়। কিন্তু উভয় সূরার বর্ণনা রীতি ও বিষয়বস্তুর কথা চিন্তা করলে অনুমান করা যায় সূরা লোকমান প্রথমে নাযিল হয়। কারণ এর পশ্চাতভূমে কোন তীব্র আকারের বিরোধিতার চিহ্ন পাওয়া যায় না। বিপরীত পক্ষে সূরা আনকাবুত পড়লে মনে হবে তার নাযিলের সময় মুসলমানদের ওপর কঠোর জুলুম নিপীড়ন চলছিল।
(৩১-লুকমান) : বিষয়বস্তু :
এ সূরায় লোকদের বুঝানো হয়েছে, শির্কের অসারতা ও অযৌক্তিকতা এবং তাওহীদের সত্যতা ও যৌক্তিকতা। এই সঙ্গে আহ্বান জানানো হয়েছে এই বলে যে, বাপ-দাদার অন্ধ-অনুসরণ ত্যাগ করো, মুহাম্মদ (সা.) সম্পর্কে উন্মুক্ত হৃদয়ে চিন্তা-ভাবনা করো এবং উন্মুক্ত দৃষ্টিতে দেখো, বিশ্ব- জগতের চারদিকে এবং নিজের মানবিক সত্তার মধ্যেই কেমন সব সুস্পষ্ট নিদর্শন এর সত্যতার সাক্ষ্য দিয়ে চলছে।
। এ প্রসঙ্গে একথাও বলা হয়েছে, দুনিয়ায় বা আরবদেশে এই প্রথমবার মানুষের কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত একটি আওয়াজ উঠানো হয়নি। আগেও লোকেরা বুদ্ধি-জ্ঞানের অধিকারী ছিল এবং তারা একথাই বলতো যা আজ মুহাম্মদ (সা.) বলছেন। তোমাদের নিজেদের দেশেই ছিলেন মহাজ্ঞানী লুকমান। তার জ্ঞানগরিমার কাহিনী তোমাদের এলাকায় বহুল প্রচলিত। তোমরা নিজেদের কথাবার্তায় তার প্রবাদ বাক্য ও জ্ঞানগর্ভ কথা উদ্ধৃত করে থাকো। তোমাদের কবি ও বাগ্মীগণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তার কথা বলেন। এখন তোমরা নিজেরাই দেখো তিনি কোন্ ধরনের আকীদা- বিশ্বাস ও কোন্ ধরনের নীতি-নৈতিকতার শিক্ষা দিতেন।
# এমন কিতাবের আয়াত যা জ্ঞানে পরিপূর্ণ, যার প্রত্যেকটি কথা জ্ঞানগর্ভ।
# এ আয়াতগুলো সঠিক পথনির্দেশক এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে অনুগ্রহের রূপলাভ করে এসেছে। কিন্তু এ পথনির্দেশনা ও অনুগ্রহ থেকে লাভবান হয় একমাত্র তারাই যারা সৎকাজ করার পথ অবলম্বন করে, সৎ হতে চায়, কল্যাণ ও ন্যায়ের সন্ধান করে এবং অসৎকাজ সম্পর্কে যখনই সতর্ক করে দেয়া হয় তখনই তা পরিহার করে এবং কল্যাণ ও ন্যায়ের পথ যখনই সামনে খুলে রেখে দেয়া হয় তখনই সে পথে চলতে শুরু। আর যারা অসৎকাজ করে ও অসৎ মনোবৃত্তির অধিকারী তারা এ পথনির্দেশনা কে লাভবান হবে না এবং এ অনুগ্রহেরও কোনো অংশ পাবে না।
# যাদেরকে সৎকর্মশীল বলা হয়েছে তারা কেবলমাত্র এ তিনটি গুণাবলীর অধিকারী, একথা বলা হয়নি। আসলে প্রথমে ‘সৎকর্মশীল’ শব্দটি ব্যাপক অর্থে বর্ণনা করে এদিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, এ কিতাব যেসব অপকর্মে বাধা দেয় এ সৎকর্মশীলরা সেসবগুলোই করে। তারপর এ “সৎকর্মশীলদের” তিনটি গুরুত্বপূর্ণ গুণাবলী বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এর মাধ্যমে একথা প্রকাশ করাই উদ্দেশ্য যে, বাদবাকি সমস্ত সৎকাজ কিন্তু এ তিনটি সদগুণের ওপরই নির্ভর করবে। তারা নামায কায়েম করে। এর ফলে আল্লাহর হুকুম মেনে চলা ও আল্লাহর ভয়ে ভীত হওয়া তাদের স্থায়ী অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়। তারা যাকাত দেয়। এর ফলে আত্মত্যাগের প্রবণতা তাদের মধ্যে সুদৃঢ় ও শক্তিশালী হয়, পার্থিব সম্পদের প্রতি মোহ প্রদমিত হয় এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের আকাঙ্ক্ষা জেগে ওঠে। তারা আখেরাতে বিশ্বাস করে। এর ফলে তাদের মধ্যে দায়িত্ববোধ ও জবাবদিহি করার অনুভূতি জাগে। এর বদৌলতে তারা এমন জন্তু-জানোয়ারের মতো হয় না যারা চারণক্ষেত্রে বাঁধনহারা হৃদয়ে এদিক ওদিক চরে বেড়ায়। বরং তারা এমন মানুষদের মতো হয়ে যায় যারা নিজেদেরকে স্বেচ্ছাচারী মনে করে না। মনে করে, তারা কোন প্রভুর গোলাম এবং নিজেদের সমস্ত কাজের জন্য প্রভুর সামনে জবাবদিহি করতে বাধ্য। এ তিনটি বিশেষত্বের কারণে এ ‘সৎকর্মশীলরা’ ঠিক তেমনি ধরনের সৎকর্মশীল থাকে না যারা ঘটনাক্রমে কোন সৎকাজ করে বসে এবং তাদের অসৎকাজও তেমনি সৎকাজের মতো একই ধারায় অনুষ্ঠিত হতে পারে। পক্ষান্তরে এ বিশেষত্বগুলো তাদের মধ্যে একটি চিন্তা ও নৈতিক ব্যবস্থার জন্ম দেয় যার ফলে তাদের সৎকাজগুলো একটি ধরা বাঁধা নিয়মানুসারে অনুষ্ঠিত হতে থাকে এবং অসৎকাজ যদি কখনো হয়ে যায়ই তাহলে তা হয় ঘটনাক্রমে। তাদের কোন গভীর চিন্তা ও নৈতিক উদ্যোগ তাদেরকে নিজেদের প্রাকৃতিক চাহিদা অনুসারে অসৎপথে নিয়ে যায় না।
# যে সময় এ আয়াত নাযিল হয় তখন মক্কার কাফেররা মনে করতো এবং প্রকাশ্যে বলতো যে, মুহাম্মাদ ﷺ এবং তাঁর এ দাওয়াত গ্রহণকারী লোকেরা নিজেদের জীবন ধ্বংস করে চলছে। তাই একেবারে নির্দিষ্ট করে এবং পুরোপুরি জোর দিয়ে বলা হয়েছে, “এরাই সফলকাম হবে॥” অর্থাৎ এরা ধ্বংস হবে না, যেমন বাজেও উদ্ভট চিন্তার মাধ্যমে তোমরা মনে করে বসেছো। বরং এরাই আসলে সফলকাম হবে এবং যারা এপথ অবলম্বন করতে অস্বীকার করেছে তারাই হবে অকৃতকার্য।
এখানে যে ব্যক্তি সাফল্যকে শুধুমাত্র এ দুনিয়ার চৌহদ্দির মধ্যেই সীমাবদ্ধ এবং তাও আবার বৈষয়িক প্রাচুর্য ও সমৃদ্ধি অর্থে গ্রহণ করবে, কুরআনের প্রকৃত অর্থ অনুধাবন করার ব্যাপারে সেও মারাত্মক ভুল করবে। সাফল্যের কুরআনী ধারণা জানার জন্য নিম্নলিখিত আয়াতগুলো তাফহীমুল কুরআনের ব্যাখ্যা সহকারে গভীরভাবে অধ্যয়ন করা উচিত। আল বাকারা ২-৫ ; আল ইমরান ১০৩ , ১৩০ ও ২০০ ; আল মায়েদাহ ৩৫ ও ৯০ ; আল আন’আম ২১ ; আল আরাফ ৭-৮ ও ১৫৭ ; আত তাওবাহ ৮৮ ; ইউনুস ১৭ ; আন নাহল ১১৬ ; আল হাজ্জ ৭৭ ; আল মু’মিনুন ১ ও ১১৭ ; আন নূর ৫১ ; এবং আর রূম ৪৮ আয়াত।
# একদিকে তো আল্লাহর পক্ষ থেকে এ পথনির্দেশনা ও অনুগ্রহ এসেছে, যা থেকে কিছু লোক লাভবান হচ্ছে। অন্যদিকে ঐ সমস্ত সৌভাগ্যবান লোকদের পাশাপাশি এমন দুর্ভাগ্যবান লোকেরাও রয়ে গেছে যারা আল্লাহর আয়াতের মোকাবিলায় এ কর্মপদ্ধতি অবলম্বন করেছে।
# আসল শব্দ হচ্ছে “লাহওয়াল হাদীস” অর্থাৎ এমন কথা যা মানুষকে আত্ম-সমাহিত করে অন্য প্রত্যেকটি জিনিস থেকে গাফিল করে দেয়। শাব্দিক অর্থের দিক দিয়ে এ শব্দগুলোর মধ্যে নিন্দার কোন বিষয় নেই। কিন্তু খারাপ, বাজে ও অর্থহীন কথা অর্থে শব্দটির ব্যবহার হয়। যেমন গালগল্প, পুরাকাহিনী, হাসি-ঠাট্টা, কথা-কাহিনী, গল্প, উপন্যাস, গান বাজনা এবং এ জাতীয় আরো অন্যান্য জিনিস।
‘লাহওয়াল হাদীস’ কিনে নেয়ার এ অর্থও হতে পারে যে, ঐ ব্যক্তি সত্য কথা বাদ দিয়ে মিথ্যা কথা গ্রহণ করে এবং সঠিক পথনির্দেশনা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে এমন কথার প্রতি আগ্রহান্বিত হয় যার মাধ্যমে তার জন্য দুনিয়াতেও কোন মঙ্গল নেই এবং আখেরাতেও নেই। কিন্তু এটি এই বাক্যাংশটির রূপক অর্থ। এর প্রকৃত অর্থ এই যে, মানুষ তার নিজের পকেটের পয়সা খরচ করে কোন বাজে জিনিস কিনে। এ ব্যাখ্যার সমর্থনে বহু হাদীসও রয়েছে। ইবনে হিশাম মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাকের হাদীস উদ্ধৃত করেছেন। তাতে তিনি বলেছেন, মক্কার কাফেরদের সমস্ত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও যখন এ দাওয়াত সম্প্রসারিত হয়েই চলছিল তখন নদ্বর ইবনে হারেস কুরাইশ নেতাদেরকে বললো, তোমরা যেভাবে এ ব্যক্তির মোকাবিলা করছো, তাতে কোনো কাজ হবে না। এ ব্যক্তি তোমাদের মধ্যেই জীবন যাপন করে শৈশব থেকে প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছেছে। আজ পর্যন্ত নৈতিক চরিত্রের দিকে দিয়ে সে ছিল তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো, সবচেয়ে সত্যবাদী ও সবচেয়ে বিশ্বস্ত লোক। এখন তোমরা বলছো, সে গণক, যাদুকর, কবি, পাগল। একথা কে বিশ্বাস করবে? যাদুকর কোন্ ধরনের তুকতাক কারবার চালায় তা কি লোকেরা জানে না? গণকরা কি সব কথাবার্তা বলে তা কি লোকদের জানতে বাকি আছে? লোকেরা কি কবি ও কবিতা চর্চার ব্যাপারে অনভিজ্ঞ। পাগলরা কেমন কেমন করে তা কি লোকেরা জানে না? এ দোষগুলো মধ্য থেকে কোন্টি মুহাম্মাদ ﷺ এর ওপর প্রযোজ্য হয় যে, সেটি বিশ্বাস করার জন্য তোমরা লোকদেরকে আহ্বান জানাতে পারবে? থামো, এ রোগের চিকিৎসা আমিই করবো। এরপর সে মক্কা থেকে ইরাক চলে গেলো। সেখান থেকে অনারব বাদশাহদের কিস্সা কাহিনী এবং রুস্তম ও ইসফিন্দিয়ারের গল্পকথা সংগ্রহ করে এনে গল্প বলার আসর জমিয়ে তুলতে লাগলো। তার উদ্দেশ্য ছিল, এভাবে লোকেরা কুরআনের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে এবং এসব গল্প-কাহিনীর মধ্যে ডুবে যাবে। ( সীরাতে ইবনে হিশাম, ১ম খণ্ড, ৩২০-৩২১পৃঃ ) আসবাবুন নযুলের মধ্যে এ বর্ণনাটি ওয়াহেদী কালবী ও মুকাতিল থেকে উদ্ধৃত করেছেন। ইবনে আব্বাস (রা.) এর ওপর আরো এতটুকু বৃদ্ধি করেছেন যে, নদ্বর এ উদ্দেশ্যে গায়িকা বাঁদীদেরকেও কিনে এনেছিল।কোন ব্যক্তি সম্পর্কে নবী (সা.) এর কথায় প্রভাবিত হতে চলেছে বলে তার কাছে খবর এলেই সে তার জন্য নিজের একজন বাঁদী নিযুক্ত করতো এবং তাকে বলে দিতো ওকে খুব ভালো করে পানাহার করাও ও গান শুনাও এবং সবসময় তোমার সাথে জড়িয়ে রেখে ওদিক থেকে ওর মন ফিরিয়ে আনো। বিভিন্ন জাতির বড় বড় অপরাধীরা প্রত্যেক যুগে যেসব ধুর্তামী ও চালবাজীর আশ্রয় নিয়ে এসেছে এ প্রায় সে একই ধরনের চালবাজি ছিল। তারা জনগণকে খেল-তামাশা ও নাচগানে (কালচার) মশগুল করতে থাকে। এভাবে তাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার প্রতি নজর দেবার চেতনাই থাকে না এবং এ অস্তিত্ব জগতের মধ্যে তারা একথা অনুভবই করতে পারে না যে, তাদেরকে এক ভয়াবহ ধ্বংসের দিকে ঠেলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
লাহওয়াল হাদীসের এ ব্যাখ্যাই বিপুল সংখ্যক সাহাবী ও তাবেঈ থেকে উদ্ধৃত হয়েছে। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদকে (রা.) জিজ্ঞেস করা হয়, এ আয়াতে যে লাহওয়াল হাদীস শব্দ এসেছে এর তাৎপর্য কি? তিনি তিনবার জোর দিয়ে বলেন,هو والله الغناء “আল্লাহর কসম এর অর্থ হচ্ছে গান।” (ইবনে জারীর, ইবনে আবি শাইবাহ, হাকেম, বায়হাকী) প্রায় এ একই ধরনের উক্তি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.), জাবের ইবনে আবদুল্লাহ, মুজাহিদ, ইকরামাহ, সাঈদ ইবনে জুবাইর, হাসান বাসরী ও মাকহূল থেকে উদ্ধৃত হয়েছে। ইবনে জারীর, ইবনে আবি হাতেম ও তিরমিযী হযরত আবু উমামাহ বাহেলীর (রা.) হাদীস উদ্ধৃত করেছেন। তাতে নবী (সা.) বলেছেনঃ
لايحِلُّ بَيْعُ المُغَنِّيَاتِ، وَلا شِرَاؤُهُنَّ، وَلا التِّجارَةُ فِيهِنَّ، وَلا أثمَانُهُنَّ
“গায়িকা মেয়েদের কেনাবেচা ও তাদের ব্যবসায় করা হালাল নয় এবং তাদের দান নেয়াও হালাল নয়।”
অন্য একটি হাদীসে শেষ বাক্যটির শব্দাবলী হচ্ছেঃ
أكْلُ ثَمَنِهِنَّ حَرَامٌ
“তাদের মূল্য খাওয়া হারাম।”
অন্য একটি হাদীসে একই আবু উমামাহ থেকে নিম্নোক্ত শব্দাবলী উদ্ধৃত হয়েছেঃ
لا يحلّ تَعْلِيمُ المُغَنِّياتِ، وَلا بَيْعُهُنَّ وَلا شِرَاؤُهُنَّ، وَثمَنُهُنَّ حَرامٌ
‘বাঁদীদেরকে গান-বাজনা করার শিক্ষা দেয়া এবং তাদের বেচা-কেনা করা হালাল নয় এবং তাদের দাম হারাম।”
এ তিনটি হাদীসে একথা সুস্পষ্ট করে বলে দেয়া হয়েছে যে, مَنْ يَشْتَرِى لَهْوَ الْحَدِيثِ
আয়াতটি এ ব্যাপারেই নাযিল হয়। কাজী আবু বকর ইবনুল আরাবী ‘আহকামুল কুরআনে’ হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক ও ইমাম মালেকের বরাত দিয়ে হযরত আনাস (রা.) একটি রেওয়ায়াত উদ্ধৃত করেছেন। তাতে বলা হয়েছে, নবী সাল্লাহু আলাইহি সাল্লাম বলেছেনঃ
من جلس الى قينة يسمع منها صب فى اذنيه الانك يوم القيمة-
“যে ব্যক্তি গায়িকা বাঁদীর মাহফিলে বসে তার গানশুনবে, কিয়ামতের দিন তার কানে গরম শীসা ঢেলে দেয়া হবে।”
(এ প্রসঙ্গে একথা জেনে নেয়া উচিত যে, সে যুগে গান-বাজনার “সংস্কৃতি” বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বরং পুরোপুরি বাঁদীদের বদৌলতেই জীবিত ছিল। স্বাধীন ও সম্ভ্রান্ত মেয়েরা সেকালে “আর্টিষ্ট” হননি। তাই নবী (সা.) গায়িকাদের কেনা-বেচার কথা বলেছেন, দাম শব্দের সাহায্যে তাদের “ফী” র ধারণা দিয়েছেন এবং গায়িকা মেয়েদের জন্য “কাইনা” শব্দ ব্যবহার করেছেন। আরবী ভাষায় বাঁদীদের জন্য এ শব্দটি বলা হয়।)
# “জ্ঞান ছাড়াই” শব্দের সম্পর্কে “কিনে আনে” এর সাথেও হতে পারে আবার “বিচ্যুত করে” এর সাথেও হতে পারে। যদি প্রথম বাক্যাংশের সাথে এর সম্পর্ক মেনে নেয়া হয়, তাহলে এর অর্থ হবে, সেই মূর্খ অজ্ঞ লোক এই মনোমুগ্ধকর জিনিসটি কিনে নেয় এবং সে জানে না কেমন মূল্যবান জিনিস বাদ দিয়ে সে কেমন ধ্বংসকর জিনিস কিনে নিচ্ছে। একদিকে আছে জ্ঞান ও সঠিক পথনির্দেশনা সমৃদ্ধ আল্লাহর আয়াত। বিনামূল্যে সে তা লাভ করছে কিন্তু তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। অন্যদিকে রয়েছে সব অর্থহীন ও বাজে জিনিস। সেগুলো চিন্তা ও চরিত্রশক্তি ধ্বংস করে দেয়। নিজের টাকা পয়সা খরচ করে সে সেগুলো লাভ করছে। আর যদি একে দ্বিতীয় বাক্যাংশের সাথে সম্পর্কযুক্ত মনে করা হয়, তাহলে এর অর্থ হবে যে, সে জ্ঞান ছাড়াই লোকদের পথ দেখাচ্ছে এবং আল্লাহর সৃষ্টিকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করার চেষ্টা করে সে যে নিজের ঘাড়ে কত বড় জুলুমের দায়ভাগ চালিয়ে নিচ্ছে, তা সে জানে না।
# এ ব্যক্তি লোকদেরকে কিস্সা-কাহিনী গান-বাজনায় মুশগুল করে আল্লাহর আয়াতের প্রতি বিদ্রূপ করতে চায়। সে কুরআনের এ দাওয়াতকে ঠাট্টা-তামাশার মধ্যে উড়িয়ে দিতে চায় আল্লাহর দ্বীনের সাথে লড়াই করার জন্য সে যুদ্ধের এমনসব নকশা তৈরি করতে চায় যেখানে একদিকে মুহাম্মাদ ﷺ আল্লাহর আয়াত শোনাতে বের হবেন, অন্যদিকে কোন সুশ্রী ও সুকণ্ঠী গায়িকার মাহফিল গুলজার হতে থাকবে, আবার কোথাও কোন বাচাল কথক ইরান-তুরানের কাহিনী শুনাতে থাকবে এবং লোকেরা এসব সাংস্কৃতিক তৎপরতায় আকণ্ঠ ডুবে গিয়ে আল্লাহ, আখেরাত ও নৈতিক চরিত্রনীতির কথা শোনার মুডই হারিয়ে ফেলবে।
# এ শাস্তি তাদের অপরাধের সাথে সামঞ্জস্য রেখেই নির্ধারিত। তারা আল্লাহর দ্বীন, তার আয়াত ও তার রসূলকে লাঞ্ছিত করতে চায়। এর বদলায় আল্লাহ তাকে কঠিন লাঞ্ছনাকর আযাব দেবেন।
# তাদের জন্য জান্নাতের নিয়ামতসমূহ রয়েছে, একথা বলেননি। বরং বলেছেন, তাদের জন্য রয়েছে নিয়ামতে পরিপূর্ণ জান্নাত। যদি প্রথম কথাটি বলা হতো, তাহলে এর অর্থ হতো, তারা এ নিয়ামতসমূহ উপভোগ করবে ঠিকই কিন্তু এ জান্নাতগুলো তাদের নিজেদের হবে না। এর পরিবর্তে “তাদের জন্য রয়েছে নিয়ামতে পরিপূর্ণ জান্নাতসমূহ” একথা বলায় আপনা-আপনি একথা প্রকাশ হয়ে গেছে যে, জান্নাত পুরোটাই তাদের হাওয়ালা করে দেয়া হবে এবং তারা তার নিয়ামতসমুহ এমনভাবে ভোগ করতে থাকবে যেমন একজন মালিক তার মালিকানাধীন জিনিস ভোগ করে থাকে। মালিকানা অধিকার ছাড়াই কাউকে কোন জিনিস থেকে নিছক লাভবান হবার সুযোগ দিলে যেভাবে তা ভোগ করা হয় সেভাবে নয়।
# নিজের প্রতিশ্রুতি পালন থেকে কোন জিনিসই তাকে ঠেকিয়ে রাখতে পারে না এবং তিনি যা কিছু করেন ঠিকমতো জ্ঞান ও ন্যায়পরায়ণতার দাবী অনুযায়ীই করেন। “এটা আল্লাহর অকাট্য প্রতিশ্রুতি”-একথা বলার পর আল্লাহর উপরি উক্ত দু’টি বিশেষ গুণের কথা বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে, একথা বলা যে, মহান আল্লাহ ইচ্ছাকৃতভাবে নিজের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন না এবং এ বিশ্ব-জাহানে এমন কোন শক্তিই নেই যে তার প্রতিশ্রুতি পালনের ব্যাপারে তার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাই ঈমান ও সৎকাজের বিনিময়ে আল্লাহ যা কিছু দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তা কারো না পাওয়ারআশঙ্কা নেই। তা তা ছাড়া আল্লাহর পক্ষ থেকে এ পুরস্কারের ঘোষণা পুরোপুরি তার জ্ঞান ও ন্যায়পরায়ণাতার ওপর নির্ভরশীল। সেখানে হকদারকে বঞ্চিত করে না হকদারকে দান করার কোন কারবার নেই। প্রকৃতপক্ষে ঈমানদার ও সৎকর্মশীল লোকেরাই এ পুরস্কারের হকদার এবং আল্লাহ এ পুরস্কার তাদেরকেই দেবেন।
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
নামকরণ:
এ সূরাতে লুকমান (عليه السلام) সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিবৃত হয়েছে বিধায় এ নামে সূরার নামকরণ করা হয়েছে। তাছাড়া লুকমান (لقمان) শব্দটি এ সূরায় উল্লেখ রয়েছে। লুকমান (عليه السلام) নাবী ছিলেন, না সৎ বান্দা ছিলেনন সে সম্পর্কে সামনে আলোচনা আসছে।
সূরার শুরুতে উল্লেখ করা হয়েছে মহা গ্রন্থ আল কুরআন তাদের জন্য হিদায়াত যারা মুহসিন, অতঃপর মুহসিনের পরিচয়, যারা অসার কথা ও গান-বাজনা ইত্যাদি নিয়ে মগ্ন থাকে তাদের অবস্থা এবং আল্লাহ তা‘আলার রুবুবিয়্যাহ সম্পর্কে, তারপর আল্লাহ তা‘আলার নেক বান্দা লুকমান (عليه السلام) তাঁর ছেলেকে উপদেশ প্রদান করেছেন তা নিয়ে এসেছেন, একশ্রেণির মানুষ রয়েছে যারা ওয়াহীর অনুসরণ বাদ দিয়ে বাপ-দাদার ভ্রান্ত তরীকা অনুসরণ করে তাদের কথা, বান্দার প্রতি আল্লাহ তা‘আলার কয়েকটি নেয়ামতের কথা এবং সবশেষে আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করার নির্দেশ দিয়ে গায়েবের চাবিকাঠি যে একমাত্র তাঁর কাছে সে সম্পর্কে জানিয়ে দিয়েছেন।
১-৫ নং আয়াতের তাফসীর:
الم (আলিফ-লাম-মীম) এ জাতীয় “হুরূফুল মুক্বাত্বআত” বা বিচ্ছিন্ন অক্ষর সম্পর্কে সূরা বাকারার শুরুতে আলোচনা করা হয়েছে। এর উদ্দেশ্য একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাই ভাল জানেন।
এরপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন, যারা সৎ আমল করে তথা সালাত কায়েম করে, যাকাত আদায় করে এবং পরকালের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস রাখে এ সকল লোকদের জন্য কুরআন হল হিদায়াত ও রহমতস্বরূপ। আর তারাই হল মুহসিন বা সৎ কর্মপরায়ণ।
محسن- এর কয়েকটি অর্থ হতে পারে। প্রথম অর্থ হল, পিতা-মাতা, আত্মীয়, হকদার ও অভাবীদের সাথে সদ্ব্যবহারকারী। দ্বিতীয় অর্থ হলন সৎ কর্মপরায়ণ, অর্থাৎ অসৎ কর্ম থেকে দূরে থেকে সৎ কর্ম সম্পাদনকারী। তৃতীয় অর্থ হল, আল্লাহ তা‘আলার ভয়ে ভীত হয়ে ইখলাস ও একাগ্রতার সাথে আল্লাহ তা‘আলার ইবাদতকারী। যেমন হাদীসে জিবরীলে বলা হয়েছে, “ইহসান” হলন তুমি এমনভাবে আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত কর, যাতে মনে হয় যেন তুমি আল্লাহ তা‘আলাকে দেখতে পাচ্ছ, আর যদি তুমি তাঁকে না দেখতে পাও তাহলে জেনে রেখ, তিনি তোমাকে দেখছেন। (সহীহ বুখারী হা: ৫০, সহীহ মুসলিম হা: ৮)
আর এখানে কুরআনকে সৎ কর্ম পরায়ণদের জন্য হিদায়াত ও রহমত বলা হয়েছে, অথচ কুরআন সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য হিদায়াত ও রহমতস্বরূপ। এভাবে বলার কারণ হল যেহেতেু সৎ কর্ম পরায়ণগণই কুরআন দ্বারা উপকৃত হয়ে থাকে তাই তাদের কথা বলা হয়েছে। এ সকল সৎ কর্মশীলরাই তাদের রবের পক্ষ থেকে সঠিক পথের ওপর প্রতিষ্ঠিত, এরাই সফলকাম। এরাই জান্নাতে প্রবেশ করবে।
এখানে সালাত ও যাকাতের সাথে বিশেষভাবে পরকালের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাসের কথা উল্লেখ করার অন্যতম কারণ হল পরকালের প্রতি ঈমান না থাকলে কোন প্রকার সৎ আমল কবূল করা হবে না এবং তা ঈমানের অন্যতম একটি রুকন যা ছাড়া ঈমান সঠিক হবে না।
সুতরাং সফলতা অর্জনের প্রধান উপায় হল সঠিক ঈমান ও সৎআমল। ঈমান ও আমল ছাড়া কারো মাধমে পরকালে সফল হওয়া যাবে না। তাই আমাদেরকে সৎ আমলের প্রতি সচেষ্ট হওয়া উচিত, বিশেষ করে সালাত, সিয়াম, যাকাত ইত্যাদি।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. যারা সৎ কর্মপরায়ণ তারা কুরআন থেকে উপকৃত হয়।
২. মু’মিনদের বৈশিষ্ট্য হলো তারা সালাত আদায় করে, যাকাত প্রদান করে এবং পরকালের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে।
৩. পরকালের প্রতি ঈমান না থাকলে কোন প্রকার আমল কবূল করা হবে না।
৬-৭ নং আয়াতের তাফসীর:
প্রথমে আল্লাহ তা‘আলা সৎ লোদেকর বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করার পর এ আয়াতগুলোতে অসৎ লোকদের অসৎ কার্যকলাপের বিবরণ তুলে ধরেছেন। সৎ লোকেরা কুরআন দ্বারা উপকৃত হয় কিন্তু এ সকল অসৎ লোকেরা যারা আল্লাহ তা‘আলার কুরআন শ্রবণ করা থেকে দূরে থাকে বরং অনর্থক কথাবার্তা ইত্যাদি খুব একাগ্রতার সাথে শোনে এবং তাতে বড় আগ্রহী হয় তারা কুরআন থেকে উপকৃত হতে পারে না।
(لَهْوَ الْحَدِيْثِ)
বলতে গান-বাজনা ও এ জাতীয় সামগ্রী যা মানুষকে আল্লাহ তা‘আলার স্মরণ থেকে উদাস করে রাখে তা বুঝানো হয়েছে।
আলোচ্য আয়াতটি একটি বিশেষ ঘটনার প্রেক্ষাপটে নাযিল হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। মক্কার মুশরিক ব্যবসায়ী নযর বিন হারেস ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন দেশে সফর করত। সে একবার পারস্য থেকে কেসরা প্রমুখ আজমী সম্রাটগণের ঐতিহাসিক কাহিনীর বই ক্রয় করে আনল এব্ং মক্কার মুশরিকদেরকে বলল, মুহাম্মাদ তোমাদেরকে আ‘দ, সামূদ প্রভৃতি সম্প্রদায়ের কিসসা কাহিনী শোনায়। আমি তোমাদেরকে রুস্তম, ইসফেন্দিয়ার প্রমুখ পারস্য সম্রাটগণের সেরা কাহিনী শুনাই। মক্কার মুশরিকরা অত্যন্ত আগ্রহের সাথে আনীত কাহিনী শুনতে থাকে। কারণ এগুলোতে শিক্ষা বলতে কিছু ছিল না বরং এগুলো ছিল চটকদার গল্পগুচ্ছ। এর ফলে অনেক মুশরিক, যারা এর আগে ক্রুআনের অলৌকিকতা ও অদ্বিতীয়তার কারণে একে শোনার আগ্রহ পোষণ করত এবং গোপনে গোপনে শুনতো ও তারা কুরআন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ার ছুতো পেয়ে গেল। (রুহুল মা‘আনী)
নাযিলের প্রেক্ষাপট যাই হোক, এর দ্বারা উদ্দেশ্য হল প্রত্যেক সেসব কথা যা হারাম, অনর্থক ও বাতিল যা মানুষকে কুফরী, পাপ কাজ ও আল্লাহ তা‘আলার অবাধ্যতার দিকে নিয়ে যায়। সুতরাং গীবত, পরনিন্দা, মিথ্যা কথা, গালি-গালাজ করা, গান-বাজনা ও তৎসদৃশ সকল কথা ও কাজ শামিল। কেননা গান-বাজনার মাঝে কোন প্রকার উপকার-ই নেই, বরং তা মানুষকে পাপ কাজে উৎসাহিত করে এবং আল্লাহ তা‘আলার অবাধ্য ও শরীয়ত গর্হিত কাজে ধাবিত করে।
এখানে ক্রয় করার অর্থ হচ্ছে, গান-বাজনা শোনার উদ্দেশ্যে সে সব সামগ্রী যেমন রেডিও, টিভি, সিডি, ডিভিডি ইত্যাদি ক্রয় করে নিয়ে আসা এবং তৃপ্তি সহকারে তার সুর ও ঝঙ্কার উপভোগ করা। তবে এসব দ্বারা ভাল কোন কিছু শুনে উপকৃত হওয়ার জন্য ক্রয় করলে অপরাধ হবে না ।
অধিকাংশ সাহাবী, তাবেয়ী ও মুফাসসিরগণের মতে গান, বাদ্যযন্ত্র ও অনর্থক কিসসা কাহিনীর যেসব বস্তু মানুষকে আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত থেকে গাফেল রাখে সেগুলো সবই
(لَهْوَ الْحَدِيْثِ)
ইবনু আব্বাস, ইবনু মাসঊদ (رضي الله عنه)-সহ প্রমুখ সাহাবীগণ বলেছেন: এ আয়াতটি গান বাজনার ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়েছে। (ইবনু কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর) সহীহ বুখারী ও ইমাম বায়হাকী স্ব-স্ব গ্রন্থে এর এ তাফসীরই উল্লেখ করেছেন।
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর যুগে অনেকে এ উদ্দেশ্যে গায়িকা ক্রয় করত যে, যাতে সে গান শুনিয়ে লোকদের মন জয় করতে এবং কুরআন ও ইসলাম থেকে দূরে রাখতে পারে। এ অর্থে গায়ক-গায়িকা, নায়ক-নায়িকাও এসে যায়। বর্তমানে যারা শিল্পী, ফিল্মী তারকা বা সংস্কৃতির শিল্পী তারাও ঐ
(لَهْوَ الْحَدِيْثِ)
বা অসার জিনিসেরই অন্তর্ভুক্ত। এর দ্বারা তারা কুরআনুল কারীমের সাথে ঠাট্টা-বিদ্রƒপ করে থাকে। সুতরাং যারাই এ সকল কাজে লিপ্ত হবে তাদের জন্যই থাকবে লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি।
ক্রীড়া-কৌতুক ও গান-বাজনা এবং এ সবের সরঞ্জামাদি সম্পর্কে শরীয়তের বিধান: গান-বাজনা করা ও গান-বাজনা শোনা যেমন হারাম তেমনি তার সরঞ্জামাদি ক্রয়-বিক্রয় করাও হারাম। তবে যেসব কথা ও সংগীত উপকারী, দীনের দিকে আহ্বান, শত্র“দের বিরুদ্ধে মুসলিমদেরকে অনুপ্রাণিত করে ও পরকালমুখী করে তা বৈধ। যেমন হাসসান বিন সাবেত শত্র“দের বিরুদ্ধে কবিতা বলে মুসলিমদেরকে উৎসাহিত করতেন। (সহীহ বুখারী হা: ৪১২৩, ৩২১২, সহীহ মুসলিম হা: ২৪৮৫)
আর তিন প্রকার খেলা শরীয়তে বৈধ
১. তীর নিক্ষেপ তথা ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ প্রশিক্ষণ নেয়া,
২. কুস্তী খেলা এবং
৩. দৌড় প্রতিযোগিতা। (সহীহ মুসলিম ও আবূ দাঊদ )
এ ছাড়া সকল প্রকার খেল-তামাশা যাতে ধর্মীয় ও পার্থিব উপকারিতা নেই তা ইসলামে অনুমতি নেই। এসবই অসার ও অনর্থক। আর অনর্থক কাজ থেকে একজন মু’মিন সর্বদা দূরে থাকবে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَالَّذِيْنَ هُمْ عَنِ اللَّغْوِ مُعْرِضُوْنَ)
“যারা অসার ক্রিয়াকলাপ হতে বিরত থাকে” (সূরা মু’মিনূন ২৩:৩)
এরপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন: এ সকল লোকদের সম্মুখে যখনই কুরআন ও আল্লাহ তা‘আলার নিদর্শনাবলীর আলোচনা করা হয় তখনই তারা দম্ভভরে মুখ ফিরিয়ে নেয়। যেন তারা কিছুই শুনতে পায়নি। তাদের কর্ণ যেন বধির, সুতরাং তাদের জন্যই থাকবে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَيْلٌ لِّكُلِّ أَفَّاكٍ أَثِيْمٍ يَّسْمَعُ اٰيٰتِ اللّٰهِ تُتْلٰي عَلَيْهِ ثُمَّ يُصِرُّ مُسْتَكْبِرًا كَأَنْ لَّمْ يَسْمَعْهَا ج فَبَشِّرْهُ بِعَذَابٍ أَلِيْمٍ وَإِذَا عَلِمَ مِنْ اٰيَاتِنَا شَيْئَا نِاتَّخَذَهَا هُزُوًا ط أُولٰ۬ئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ مُّهِيْنٌ ط مِنْ وَّرَا۬ئِهِمْ جَهَنَّمُ ج وَلَا يُغْنِيْ عَنْهُمْ مَّا كَسَبُوْا شَيْئًا وَّلَا مَا اتَّخَذُوْا مِنْ دُوْنِ اللّٰهِ أَوْلِيا۬ءَ ج وَلَهُمْ عَذَابٌ عَظِيْمٌ)
“দুর্ভোগ প্রত্যেক ঘোর মিথ্যাবাদী পাপীর, যে আল্লাহর আয়াতের তেলাওয়াত শোনে অথচ অহংকারের সাথে অটল থাকে যেন তা সে শোনেনি। তাকে সুসংবাদ দাও যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির। যখন আমার কোন আয়াত সে অবগত হয় তখন সে তা ঠাট্টা-বিদ্রƒপচ্ছলে গ্রহণ করে। তাদের জন্য রয়েছে লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি। তাদের পশ্চাতে রয়েছে জাহান্নাম; তাদের কৃতকর্ম তাদের কোন কাজে আসবে না, তারা আল্লাহর পরিবর্তে যাদেরকে অভিভাবক স্থির করেছে তারাও নয়। তাদের জন্য রয়েছে মহাশাস্তি।” (সূরা জাসিয়াহ ৪৫:৭-১০)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(وَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنْ ذُكِّرَ بِاٰيٰتِ رَبِّه۪ فَأَعْرَضَ عَنْهَا وَنَسِيَ مَا قَدَّمَتْ يَدَاهُ ط إِنَّا جَعَلْنَا عَلٰي قُلُوْبِهِمْ أَكِنَّةً أَنْ يَّفْقَهُوْهُ وَفِيْٓ اٰذَانِهِمْ وَقْرًا ط وَإِنْ تَدْعُهُمْ إِلَي الْهُدٰي فَلَنْ يَّهْتَدُوْآ إِذًا أَبَدًا)
“কোন ব্যক্তিকে তার প্রতিপালকের নিদর্শনাবলী স্মরণ করিয়ে দেয়ার পর সে যদি তা হতে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং তার কৃতকর্মসমূহ ভুলে যায় তবে তার অপেক্ষা অধিক জালিম আর কে? আমি তাদের অন্তরের ওপর আবরণ দিয়েছি যেন তারা কুরআন বুঝতে না পারে এবং তাদের কানে বধিরতা বদ্ধমূল করে দিয়েছি। তুমি তাদেরকে সৎ পথে আহ্বান করলেও তারা কখনও সৎ পথে আসবে না।” (সূরা কাহফ ১৮:৫৭)
অতএব সকল প্রকার গান-বাজনা ও অসার কথাবার্তা থেকে দূরে থাকবে হবে। মু’মিন কখনো অসার কার্যকলাপ ও কথা-বার্তায় জড়িত হতে পারে না।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. মাল্টিমিডিয়াসংশ্লিষ্ট কিছু অসৎ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করার জন্য ক্রয় করা হারাম। তবে শর্তসাপেক্ষে ভাল কাজে ব্যবহার ও ক্রয়-বিক্রয় বৈধ রয়েছে।
২. মানুষকে আল্লাহ তা‘আলার পথ থেকে বাধা দেয় এমন সব কার্যকলাপ হারাম।
৩. গর্ব-অহঙ্কার করা কবীরা গুনাহ।
৪. গান-বাজনা শোনা ও শোনানো এবং তার দ্বারা অর্জিত সমস্ত সম্পদ হারাম। তবে যে সব কথা ও কবিতা উপকারী, কোন প্রকার শির্ক ও অনর্থক কথা নেই তা বলা বৈধ।
৮-৯ নং আয়াতের তাফসীর:
মন্দ লোকদের পরিণতির কথা বর্ণনা করার পর আল্লাহ তা‘আলা আবার সৎ লোকেদের কথা নিয়ে এসেছেন। যারা সৎ আমল করবে ও ঈমান আনবে তারা চিরস্থায়ীভাবে জান্নাতে বসবাস করবে। এ সম্পর্কে সূরা কাহফের ১০৭ ও ১০৮ নং আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. ঈমান আনার সাথে সাথে সৎ কাজ করতে হবে।
২. আল্লাহ তা‘আলা যা ওয়াদা করেন তা সত্য, তিনি কখানো ওয়াদা ভঙ্গ করেন না।
তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
১-৫ নং আয়াতের তাফসীর
সূরায়ে বাকারার তাফসীরের প্রারম্ভেই হুরূফে মুকাত্তাআ’তের অর্থ ও মতলব বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।
যারা শরীয়তের পূর্ণ অনুসারী তাদের জন্যে এই কুরআন হিদায়াত, শিক্ষা ও রহমত স্বরূপ। যারা নামায কায়েম করার সময় নামাযের রু, সময় ইত্যাদির পূর্ণ হিফাযতের সাথে সাথে নফল, সুন্নাত ইত্যাদিও পূর্ণভাবে আদায় করে। যারা ফরয যাকাত আদায় করে, আত্মীয়দের প্রতি দয়া দাক্ষিণ্য করে ও তাদের সাথে উত্তম ব্যবহার করে, দানশীলতার কাজ নিষ্ঠার সাথে চালিয়ে যায় এবং আখিরাতের পুরস্কার ও শাস্তির প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস রাখে বলে আল্লাহর দিকে পরিপূর্ণভাবে আকৃষ্ট হয়ে থাকে। যারা পুণ্যের কাজ করে যায় এবং মহান প্রতিপালকের পুরস্কারের প্রতি দৃষ্টি রাখে। যারা রিয়াকারী বা লোক দেখানো কাজ করে না এবং লোকদের প্রশংসাও চায় না। এ ধরনের গুণবিশিষ্ট লোকেরাই সঠিক পথ প্রাপ্ত এবং এরাই তারা যারা দ্বীন ও দুনিয়ায় হবে সফলকাম ও কৃতকার্য।
৬-৭ নং আয়াতের তাফসীর
উপরে বর্ণিত সত্বৰ্মশীল লোকেরা আল্লাহর কিতাব হতে হিদায়াত গ্রহণ করতঃ কিতাব শুনে লাভবান হতো। এখানে বর্ণিত হচ্ছে যে, পাপী ও দুষ্ট লোকেরা আল্লাহর কিতাব শুনে কোন উপকার লাভ করতো না, বরং এর পরিবর্তে গান-বাজনা, ঢোল-করতাল নিয়ে মত্ত থাকতো।
(আরবি) এ আয়াত সম্পর্কে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেনঃ “আল্লাহর কসম! এর দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে গান-বাজনা ও রাগ-রাগিণী নিয়ে সর্বক্ষণ লিপ্ত থাকা।” তাকে এ আয়াতের ভাবার্থ জিজ্ঞেস করা হলে তিনি তিনবার কসম করে বলেনঃ “এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো গান-বাজনা ও রাগ-রাগিণী।” হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ), হযরত জাবির (রাঃ), হযরত ইকরামা (রঃ), হযরত সাঈদ ইবনে জুবাইর (রঃ), হযরত মুজাহিদ (রঃ), হযরত মাকহুল (রঃ), হযরত আমর ইবনে আয়েব (রঃ) প্রমুখ। গুরুজনেরও এটাই উক্তি। হযরত হাসান বসরী (রঃ) বলেছেন যে, গান-বাজনা, রঙ-তামাশা ইত্যাদির ব্যাপারে এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয়েছে। হযরত কাতাদা (রঃ) বলেছেন যে, এর উদ্দেশ্য শুধুমাত্র এটাই নয়, বরং এ কাজের পিছনে টাকা। পয়সা খরচ করা, একে আন্তরিকভাবে পছন্দ করা ও ভালবাসাও এর অন্তর্ভুক্ত।
তাদের পথভ্রষ্টতার জন্যে এটাই যথেষ্ট যে, বাতিলকে তারা সত্যের উপর প্রাধান্য দেয় এবং ক্ষতিকর বিষয়কে লাভজনক বিষয়ের উপর স্থান দিয়ে থাকে।
একটি উক্তি এও আছে যে, অসার বাক্য ক্রয় করা দ্বারা গায়িকা বা ছুক্রী ক্রয় করাকে বুঝানো হয়েছে। হযরত আবু উমামা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী (সঃ) বলেছেনঃ “গান-বাজনা কারিণী ও গায়িকা মেয়ে বেচাকেনা করা হারাম। বেচে তার মূল্য ভক্ষণ করাও অবৈধ। এ ব্যাপারেই মহামহিমান্বিত আল্লাহ্ (আরবি)-এ আয়াতটি অবতীর্ণ করেছেন।” (এ হাদীসটি ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন। ইমাম তিরিমিযী (রঃ) ও ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) উবাইদুল্লাহ ইবনে যাহর (রাঃ) হতে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন এবং ইমাম তিরমিযী (রঃ) হাদীসটিকে দুর্বল বলেছেন। এসব ব্যাপারে আল্লাহই সবচেয়ে ভাল জানেন)
যহ্হাক (রঃ) বলেন যে, এর দ্বারা শিরকে বুঝানো হয়েছে। ইমাম ইবনে জারীর (রঃ)-এর মত এই যে, প্রত্যেক কথা, যা কালামুল্লাহ ও শরীয়তের অনুসরণে বাধা সৃষ্টি করে তার সবগুলোই এ আয়াতের অন্তর্ভুক্ত। এর দ্বারা তার উদ্দেশ্য হয় ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধাচরণ করা। একটি কিরআত বা পঠনে (আরবি) রয়েছে। তখন (আরবি) টি (আরবি) হবে অথবা (আরবি) হবে।
মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ তারা আল্লাহর প্রদর্শিত পথ নিয়ে ঠাট্টা-পি করে। তাদেরই জন্যে রয়েছে অবমাননাকর শাস্তি। যেমন তারা আল্লাহর পথ ও তাঁর কিতাবকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করেছে, তেমনই কিয়ামতের দিন তাদেরকেও ঠাট্টা-বিদ্রুপ করা হবে। তাদেরকে অপমানজনক শাস্তি প্রদান করা হবে।
এরপর মহা প্রতাপান্বিত আল্লাহ বলেনঃ যখন তার নিকট আমার আয়াত আবৃত্তি করা হয় তখন সে দম্ভভরে মুখ ফিরিয়ে নেয়। অর্থাৎ এই হতভাগারা, যারা খেল-তামাশায়, গান-বাজনায় ও রাগ-রাগিণীতে মত্ত ছিল তারা কুরআন থেকে দূরে সরে গিয়েছিল, তা শোনা হতে তারা নিজেদের কানকে বধির করে ফেলেছিল, এগুলো তাদের ভাল লাগতো না, শুনলেও তারা তা শোনার মত শুনতো না, বরং তা শোনা তাদের কাছে অপছন্দনীয় ছিল। এটাকে তারা বাজে কাজ মনে করতো। এ কারণে এর মান-সম্মান তাদের কাছে ছিল না। এ জন্যে এ থেকে তারা কিছুই লাভবানও হয়নি। এ থেকে তার প বেপরোয়া হয়ে গিয়েছিল। এখানে আল্লাহর বিধি-বিধান দেখে তারা যেমন বিরক্ত হচ্ছে, কিয়ামতের দিন তারা আল্লাহর আযাব দেখেও বিরক্ত হবে। এখানে আল্লাহর আয়াত শুনে তারা বিরক্তি বোধ করছে বটে, কিন্তু কিয়ামতের দিন তাদের জন্যে রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।
৮-৯ নং আয়াতের তাফসীর
এখানে ভাল লোকদের শেষ পরিণতির কথা বর্ণনা করা হচ্ছে যে, যারা আল্লাহর উপর ঈমান এনেছে ও রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে মেনে নিয়েছে, শরীয়ত মুতাবেক কাজ করেছে তাদের জন্যে জান্নাত নির্ধারিত আছে, যার মধ্যে নানা প্রকারের নিয়ামত থাকবে। বিভিন্ন প্রকারের সুস্বাদু খাদ্য, সুন্দর ঝকঝকে তকতকে পোশাক, সুন্দর সুন্দর গাড়ী-ঘোড়া, পবিত্র ডাগর চোখা পরমা সুন্দরী হরীরা বিদ্যমান থাকবে। সেখানে এসব নিয়ামত কখনো নিঃশেষ হবে না। না এগুলো নষ্ট হবে, না ধ্বংস হবে, না কমে যাবে। এসব নিয়ামত অবশ্যই দেয়া হবে। কেননা, এটা আল্লাহর ওয়াদা এবং তিনি তাঁর ওয়াদা কখনো ভঙ্গ করেন না। তিনি দয়ালু, অনুগ্রহশীল ও পরম করুণাময়। তিনি যা ইচ্ছা তাই করে থাকেন। তিনি অসীম ক্ষমতার অধিকারী। সার্বভৌম ক্ষমতা তারই। সবকিছুই তাঁর অয়িত্তের মধ্যে রয়েছে। তিনি প্রজ্ঞাময়। তাঁর কোন কথা, কোন কাজ জ্ঞান-বিবেক বহির্ভূত নয়। তিনি কুরআন কারীমকে মুমিনদের জন্যে পথপ্রদর্শক। ও শিক্ষাদানকারী করেছেন। আর বেঈমানদের জন্যে এটা বোঝা স্বরূপ ও চোখের কাঁটার ন্যায়। মহান আল্লাহ অন্য আয়াতে বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “আমি অবতীর্ণ করি কুরআন যা মুমিনদের জন্যে আরোগ্য ও রহমত। আর এটা যালিমদের ক্ষতিই বৃদ্ধি করে।” (১৭:৮২)
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(Book#1036)
[According to the Qury The Honest and Dishonest:-]
www.motaher21.net
Sura:31:Luqman
Para:21
Ayat: – 1-9
31:1
الٓـمّٓ ۚ﴿۱﴾
Alif, Lam, Meem.
Allah says:
الم
Alif Lam Mim.
At the beginning of Surah Al-Baqarah we discussed the letters such as those that appear at the beginning of this Surah.
تِلْكَ ايَاتُ الْكِتَابِ الْحَكِيمِ
31:2
تِلۡکَ اٰیٰتُ الۡکِتٰبِ الۡحَکِیۡمِ ۙ﴿۲﴾
These are verses of the wise Book,
These are Ayat of the Wise Book.
هُدًى وَرَحْمَةً لِّلْمُحْسِنِينَ
31:3
ہُدًی وَّ رَحۡمَۃً لِّلۡمُحۡسِنِیۡنَ ۙ﴿۳﴾
As guidance and mercy for the doers of good
الَّذِينَ يُقِيمُونَ الصَّلَةَ وَيُوْتُونَ الزَّكَاةَ وَهُم بِالاْخِرَةِ هُمْ يُوقِنُونَ
31:4
الَّذِیۡنَ یُقِیۡمُوۡنَ الصَّلٰوۃَ وَ یُؤۡتُوۡنَ الزَّکٰوۃَ وَ ہُمۡ بِالۡاٰخِرَۃِ ہُمۡ یُوۡقِنُوۡنَ ؕ﴿۴﴾
Who establish prayer and give zakah, and they, of the Hereafter, are certain [in faith].
A guide and a mercy for the Muhsinin. Those who perform the Salah and give Zakah and they have faith in the Hereafter with certainty.
Allah has made the Qur’an a guidance and healing and a mercy for the Muhsinin, who are those who do good deeds in accordance with the Shariah. They establish the obligatory prayers in the proper manner and at the correct times, and follow that with regular, optional and supererogatory prayers; they pay the Zakah to those who deserve it; they uphold the ties of kinship with their relatives; they have certain faith that there will be rewards and punishments in the Hereafter, and they seek the reward with Allah; they do not show off or seek a reward or thanks from other people. Whoever does this is one of those of whom Allah says
31:5
اُولٰٓئِکَ عَلٰی ہُدًی مِّنۡ رَّبِّہِمۡ وَ اُولٰٓئِکَ ہُمُ الۡمُفۡلِحُوۡنَ ﴿۵﴾
Those are on [right] guidance from their Lord, and it is those who are the successful.
أُوْلَيِكَ عَلَى هُدًى مِّن رَّبِّهِمْ
Such are on guidance from their Lord,
meaning, they follow His guidance with clear understanding.
وَأُوْلَيِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ
and such are the successful.
in this world and in the Hereafter
31:6
وَ مِنَ النَّاسِ مَنۡ یَّشۡتَرِیۡ لَہۡوَ الۡحَدِیۡثِ لِیُضِلَّ عَنۡ سَبِیۡلِ اللّٰہِ بِغَیۡرِ عِلۡمٍ ٭ۖ وَّ یَتَّخِذَہَا ہُزُوًا ؕ اُولٰٓئِکَ لَہُمۡ عَذَابٌ مُّہِیۡنٌ ﴿۶﴾
And of the people is he who buys the amusement of speech to mislead [others] from the way of Allah without knowledge and who takes it in ridicule. Those will have a humiliating punishment.
The Doomed are preoccupied with Idle Talk and They turn away from the Ayat of Allah
Allah says:
وَمِنَ النَّاسِ مَن يَشْتَرِي لَهْوَ الْحَدِيثِ لِيُضِلَّ عَن سَبِيلِ اللَّهِ بِغَيْرِ عِلْمٍ
And of mankind is he who purchases idle talk (Lahw Al-Hadith) to mislead from the path of Allah without knowledge,
When Allah mentions the blessed — who are those who are guided by the Book of Allah and benefit from hearing it, as He says:
اللَّهُ نَزَّلَ أَحْسَنَ الْحَدِيثِ كِتَـباً مُّتَشَـبِهاً مَّثَانِيَ تَقْشَعِرُّ مِنْهُ جُلُودُ الَّذِينَ يَخْشَوْنَ رَبَّهُمْ ثُمَّ تَلِينُ جُلُودُهُمْ وَقُلُوبُهُمْ إِلَى ذِكْرِ اللَّهِ
Allah has sent down the Best Statement, a Book, its parts resembling each other (and) oft-repeated. The skins of those who fear their Lord shiver from it. Then their skin and their heart soften to the remembrance of Allah. (39:23)
He connect that with mention of the doomed, those who turn away from the Qur’an and do not benefit from hearing the Words of Allah. Instead, they turn to listening to flutes and singing accompanied by musical instruments. As Ibn Mas`ud commented about the Ayah:
وَمِنَ النَّاسِ مَن يَشْتَرِي لَهْوَ الْحَدِيثِ لِيُضِلَّ عَن سَبِيلِ اللَّهِ
And of mankind is he who purchases Lahu Al-Hadith to mislead (men) from the path of Allah,
he said, “This — by Allah — refers to singing.”
وَمِنَ النَّاسِ مَن يَشْتَرِي لَهْوَ الْحَدِيثِ لِيُضِلَّ عَن سَبِيلِ اللَّهِ بِغَيْرِ عِلْمٍ
And of mankind is he who purchases Lahw Al-Hadith to mislead (men) from the path of Allah without knowledge,
Qatadah said:
“By Allah, he may not spend money on it, but his purchasing it means he likes it, and the more misguided he is, the more he likes it and the more he prefers falsehood to the truth and harmful things over beneficial things.”
It was said that what is meant by the words
يَشْتَرِي لَهْوَ الْحَدِيث
(purchases idle talks) is buying singing servant girls.
Ibn Jarir said that it means all speech that hinders people from seeing the signs of Allah and following His path.
His saying:
لِيُضِلَّ عَن سَبِيلِ اللَّه
(to mislead (men) from the path of Allah) means,
he does this to oppose Islam and its followers.
وَيَتَّخِذَهَا هُزُوًا
and takes it by way of mockery.
Mujahid said,
“This means mocking the path of Allah and making fun of it.”
أُولَيِكَ لَهُمْ عَذَابٌ مُّهِينٌ
For such there will be a humiliating torment.
Just as they showed no respect to the signs and path of Allah, so they will be shown no respect on the Day of Resurrection, and they will be subjected to a painful, ongoing torment.
Then Allah says
31:7
وَ اِذَا تُتۡلٰی عَلَیۡہِ اٰیٰتُنَا وَلّٰی مُسۡتَکۡبِرًا کَاَنۡ لَّمۡ یَسۡمَعۡہَا کَاَنَّ فِیۡۤ اُذُنَیۡہِ وَقۡرًا ۚ فَبَشِّرۡہُ بِعَذَابٍ اَلِیۡمٍ ﴿۷﴾
And when our verses are recited to him, he turns away arrogantly as if he had not heard them, as if there was in his ears deafness. So give him tidings of a painful punishment.
وَإِذَا تُتْلَى عَلَيْهِ ايَاتُنَا وَلَّى مُسْتَكْبِرًا كَأَن لَّمْ يَسْمَعْهَا كَأَنَّ فِي أُذُنَيْهِ وَقْرًا
And when Our Ayat are recited to such a one, he turns away in pride, as if he heard them not — as if there were deafness in his ear.
means, when these Qur’anic verses are recited to one who is fond of idleness and play, he turns away from them and does not want to hear them. He turns a deaf ear to them as if he can hear nothing, because it annoys him to hear them since he gains no benefit from them and has no interest in them.
فَبَشِّرْهُ بِعَذَابٍ أَلِيمٍ
So announce to him a painful torment.
i.e., on the Day of Resurrection, which will hurt him just as much as listening to the Book of Allah and its verses hurt him
31:8
اِنَّ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ لَہُمۡ جَنّٰتُ النَّعِیۡمِ ۙ﴿۸﴾
Indeed, those who believe and do righteous deeds – for them are the Gardens of Pleasure.
The Good Destiny of the Believers
Allah says:
إِنَّ الَّذِينَ امَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ
.
Verily, those who believe and do righteous good deeds, for them are Gardens of Delight.
Here Allah mentions the destiny of the righteous in the Hereafter, those who believe in Allah and His Messenger and do righteous deeds in accordance with the Laws of Allah.
..
لَهُمْ جَنَّاتُ النَّعِيم
31:9
خٰلِدِیۡنَ فِیۡہَا ؕ وَعۡدَ اللّٰہِ حَقًّا ؕ وَ ہُوَ الۡعَزِیۡزُ الۡحَکِیۡمُ ﴿۹﴾
Wherein they abide eternally; [it is] the promise of Allah [which is] truth. And He is the Exalted in Might, the Wise.
خَالِدِينَ فِيهَا
for them are Gardens of Delight. To abide therein.
means, there they will enjoy all kinds of delights and pleasures, food, drink, clothing, dwelling-places, means of transportation, women, a light of beauty and delightful sounds, which have never crossed the mind of any human being. They will stay there forever, never leaving and never desiring change.
وَعْدَ اللَّهِ حَقًّا
It is a promise of Allah in truth.
meaning, this will undoubtedly come to pass, for it is a promise from Allah, and Allah never breaks His promise, because He is the Most Generous Bestower Who does what He wills and is able to do all things.
وَهُوَ الْعَزِيزُ
And He is the All-Mighty,
Who has subjugated all things and to Whom all things submit,
الْحَكِيمُ
the All-Wise.
in what He says and what He does, Who has made this Qur’an a guidance to the believers.
قُلْ هُوَ لِلَّذِينَ ءَامَنُواْ هُدًى وَشِفَأءٌ وَالَّذِينَ لَا يُوْمِنُونَ فِى ءَاذَانِهِمْ وَقْرٌ وَهُوَ عَلَيْهِمْ عَمًى
Say:”It is for those who believe, a guide and a healing. And as for those who disbelieve, there is heaviness (deafness) in their ears, and it is blindness for them. (41:44)
وَنُنَزِّلُ مِنَ الْقُرْءَانِ مَا هُوَ شِفَأءٌ وَرَحْمَةٌ لِّلْمُوْمِنِينَ وَلَا يَزِيدُ الظَّـلِمِينَ إَلاَّ خَسَارًا
And We send down of the Qur’an that which is a healing and a mercy to those who believe, and it increases the wrongdoers nothing but loss. (17:82
For getting Quran app: play.google.com/store/apps/details?id=com.ihadis.quran