(বই#১০৩৭)   [   *হযরত লােকমানের উপদেশনামা :-] www.motaher21.net সূরা:- ৩১:লুকমান পারা:২১ ১০-১৯ নং আয়াত:-

أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#১০৩৭)
[   *হযরত লােকমানের উপদেশনামা :-]
www.motaher21.net
সূরা:- ৩১:লুকমান
পারা:২১
১০-১৯ নং আয়াত:-
৩১: ১০
خَلَقَ السَّمٰوٰتِ بِغَیۡرِ عَمَدٍ تَرَوۡنَہَا وَ اَلۡقٰی فِی الۡاَرۡضِ رَوَاسِیَ اَنۡ تَمِیۡدَ بِکُمۡ وَ بَثَّ فِیۡہَا مِنۡ کُلِّ دَآبَّۃٍ ؕ وَ اَنۡزَلۡنَا مِنَ السَّمَآءِ مَآءً فَاَنۡۢبَتۡنَا فِیۡہَا مِنۡ کُلِّ زَوۡجٍ کَرِیۡمٍ ﴿۱۰﴾
তিনি আসমানসমূহ নির্মাণ করেছেন খুঁটি ছাড়া—তোমরা এটা দেখতে পাচ্ছ; তিনিই যমীনে স্থাপন করেছেন সুদৃঢ় পর্বতমালা যাতে এটা তোমাদেরকে নিয়ে ঢলে না পড়ে এবং এতে ছড়িয়ে দিয়েছেন সব ধরনের জীব-জন্তু। আর আমরা আকাশ হতে বারি বর্ষণ করি তারপর এতে উদ্গত করি সব ধরণের কল্যাণকর উদ্ভিদ।
৩১:১১
ہٰذَا خَلۡقُ اللّٰہِ فَاَرُوۡنِیۡ مَاذَا خَلَقَ الَّذِیۡنَ مِنۡ دُوۡنِہٖ ؕ بَلِ الظّٰلِمُوۡنَ فِیۡ ضَلٰلٍ مُّبِیۡنٍ ﴿٪۱۱﴾
এ আল্লাহর সৃষ্টি! তিনি ব্যতীত অন্যেরা কি সৃষ্টি করেছে আমাকে দেখাও তো।বরং সীমালংঘনকারীরা স্পষ্ট বিভ্রান্তিতে রয়েছে।
৩১:১২
وَ لَقَدۡ اٰتَیۡنَا لُقۡمٰنَ الۡحِکۡمَۃَ اَنِ اشۡکُرۡ لِلّٰہِ ؕ وَ مَنۡ یَّشۡکُرۡ فَاِنَّمَا یَشۡکُرُ لِنَفۡسِہٖ ۚ وَ مَنۡ کَفَرَ فَاِنَّ اللّٰہَ غَنِیٌّ حَمِیۡدٌ ﴿۱۲﴾
আমি লুকমানকে দান করেছিলাম সূক্ষ্মজ্ঞান। যাতে সে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ হয়।যে ব্যক্তি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে তার কৃতজ্ঞতা হবে তার নিজেরই জন্য লাভজনক। আর যে ব্যক্তি কুফরী করবে, সে ক্ষেত্রে প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ‌ অমুখাপেক্ষী এবং নিজে নিজেই প্রশংসিত।
৩১:১৩
وَ اِذۡ قَالَ لُقۡمٰنُ لِابۡنِہٖ وَ ہُوَ یَعِظُہٗ یٰبُنَیَّ لَا تُشۡرِکۡ بِاللّٰہِ ؕؔ اِنَّ الشِّرۡکَ لَظُلۡمٌ عَظِیۡمٌ ﴿۱۳﴾
স্মরণ করো যখন লুকমান নিজের ছেলেকে উপদেশ দিচ্ছিল, সে বললো, “হে পুত্র! আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করো না। যথার্থই শিরক অনেক বড় জুলুম।
৩১:১৪
وَ وَصَّیۡنَا الۡاِنۡسَانَ بِوَالِدَیۡہِ ۚ حَمَلَتۡہُ اُمُّہٗ وَہۡنًا عَلٰی وَہۡنٍ وَّ فِصٰلُہٗ فِیۡ عَامَیۡنِ اَنِ اشۡکُرۡ لِیۡ وَ لِوَالِدَیۡکَ ؕ اِلَیَّ الۡمَصِیۡرُ ﴿۱۴﴾
আমি তো মানুষকে তার পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণের নির্দেশ দিয়েছি। জননী কষ্টের পর কষ্ট বরণ করে সন্তানকে গর্ভে ধারণ করে এবং তার স্তন্যপান ছাড়াতে দু বছর অতিবাহিত হয়। সুতরাং তুমি আমার প্রতি ও তোমার পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। আমারই নিকট (সকলের) প্রত্যাবর্তন।
৩১:১৫
وَ اِنۡ جَاہَدٰکَ عَلٰۤی اَنۡ تُشۡرِکَ بِیۡ مَا لَیۡسَ لَکَ بِہٖ عِلۡمٌ ۙ فَلَا تُطِعۡہُمَا وَ صَاحِبۡہُمَا فِی الدُّنۡیَا مَعۡرُوۡفًا ۫ وَّ اتَّبِعۡ سَبِیۡلَ مَنۡ اَنَابَ اِلَیَّ ۚ ثُمَّ اِلَیَّ مَرۡجِعُکُمۡ فَاُنَبِّئُکُمۡ بِمَا کُنۡتُمۡ تَعۡمَلُوۡنَ ﴿۱۵﴾
কিন্তু যদি তারা তোমার প্রতি আমার সাথে এমন কাউকে শরীক করার জন্য চাপ দেয় যাকে তুমি জানো না, তাহলে তুমি তাদের কথা কখনোই মেনে নিয়ো না। দুনিয়ায় তাদের সাথে সদাচার করতে থাকো কিন্তু মেনে চলো সে ব্যক্তির পথ যে আমার দিকে ফিরে এসেছে। তারপর তোমাদের সবাইকে ফিরে আসতে হবে আমারই দিকে। সে সময় তোমরা কেমন কাজ করছিলে তা আমি তোমাদের জানিয়ে দেবো।
৩১:১৬
یٰبُنَیَّ اِنَّہَاۤ اِنۡ تَکُ مِثۡقَالَ حَبَّۃٍ مِّنۡ خَرۡدَلٍ فَتَکُنۡ فِیۡ صَخۡرَۃٍ اَوۡ فِی السَّمٰوٰتِ اَوۡ فِی الۡاَرۡضِ یَاۡتِ بِہَا اللّٰہُ ؕ اِنَّ اللّٰہَ لَطِیۡفٌ خَبِیۡرٌ ﴿۱۶﴾
“হে পুত্র! কোন জিনিস যদি সরিষার দানা পরিমাণও হয় এবং তা লুকিয়ে থাকে পাথরের মধ্যে, আকাশে বা পৃথিবীতে কোথাও, তাহলে আল্লাহ‌ তা বের করে নিয়ে আসবেন। তিনি সূক্ষ্মদর্শী এবং সবকিছু জানেন।
৩১:১৭
یٰبُنَیَّ اَقِمِ الصَّلٰوۃَ وَ اۡمُرۡ بِالۡمَعۡرُوۡفِ وَ انۡہَ عَنِ الۡمُنۡکَرِ وَ اصۡبِرۡ عَلٰی مَاۤ اَصَابَکَ ؕ اِنَّ ذٰلِکَ مِنۡ عَزۡمِ الۡاُمُوۡرِ ﴿ۚ۱۷﴾
হে পুত্র! নামায কায়েম করো, সৎকাজের হুকুম দাও, খারাপ কাজে নিষেধ করো এবং যা কিছু বিপদই আসুক সেজন্য সবর করো। একথাগুলোর জন্য বড়ই তাকিদ করা হয়েছে।
৩১:১৮
وَ لَا تُصَعِّرۡ خَدَّکَ لِلنَّاسِ وَ لَا تَمۡشِ فِی الۡاَرۡضِ مَرَحًا ؕ اِنَّ اللّٰہَ لَا یُحِبُّ کُلَّ مُخۡتَالٍ فَخُوۡرٍ ﴿ۚ۱۸﴾
‘আর তুমি মানুষের প্রতি অবজ্ঞাভরে তোমার গাল বাঁকা কর না এবং যমীনে উদ্ধতভাবে বিচরণ কর না ; নিশ্চয় আল্লাহ্ কোন উদ্ধত, অহংকারীকে পছন্দ করেন না।
৩১:১৯
وَ اقۡصِدۡ فِیۡ مَشۡیِکَ وَ اغۡضُضۡ مِنۡ صَوۡتِکَ ؕ اِنَّ اَنۡکَرَ الۡاَصۡوَاتِ لَصَوۡتُ الۡحَمِیۡرِ ﴿٪۱۹﴾
নিজের চলনে ভারসাম্য আনো‌ এবং নিজের আওয়াজ নীচু করো। সব আওয়াজের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ হচ্ছে গাধার আওয়াজ।

তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
১০-১১ নং আয়াতের তাফসীর:

প্রথমত মহান আল্লাহ তা‘আলা তাঁর কুদরতের বর্ণনা দিয়ে বলেন: তিনি আকাশমণ্ডলী নির্মাণ করেছেন খুঁটি ছাড়া যা তোমরা স্বচক্ষে দেখতে পারছ। এ সম্পর্কে সূরা রাদের ২ নং আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে।

এরপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন: তিনি পৃথিবীতে স্থাপন করেছেন পবর্তমালা যাতে সৃষ্টিজীবকে নিয়ে ঢলে না পড়ে। এ সম্পর্কেও সূরা নাহলের ১৫ নং আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে।

অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন: তিনিই পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিয়েছেন সর্বপ্রকার জীবজন্তু। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(وَمِنْ اٰيٰتِه۪ خَلْقُ السَّمٰوٰتِ وَالْأَرْضِ وَمَا بَثَّ فِيْهِمَا مِنْ دَا۬بَّةٍ ط وَهُوَ عَلٰي جَمْعِهِمْ إِذَا يَشَا۬ءُ قَدِيْرٌ)

“তাঁর মহা নিদর্শনের অন্তর্ভুক্ত হল আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং এতদুভয়ের মধ্যে তিনি যেসব জীবজন্তু ছড়িয়ে দিয়েছেন সেগুলো; তিনি যখন ইচ্ছা তখনই তাদেরকে সমবেত করতে সক্ষম।” (সূরা শূরা ৪২:৯২) এবং একমাত্র তিনিই আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করেন এবং সেই বৃষ্টির পানি দ্বারা জমিন হতে সর্বপ্রকার কল্যাণকর উদ্ভিদ উৎপন্ন করেন। যেমনটি আলোচনা করা হয়েছে সূরা নাহলের ১০ ও ১১ নং আয়াতে।

এ পৃথিবীতে মানুষ, জীন, গরু-ছাগল, উট, গাছ-পালাসহ যত প্রকার সৃষ্টি রয়েছে সবকিছুই একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা সৃষ্টি করেছেন, অন্য কেউ নয়। এ সম্পর্কে সূরা বাকারার ১৬৪ নং আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে।

এসব সৃষ্টি ও নেয়ামত দেয়ার পর আল্লাহ তা‘আলা মুশরিকদের লক্ষ্য করে বলেছেন: এ সব আমি সৃষ্টি করেছি, তোমাদের অংশীরা কিছু সৃষ্টি করে থাকলে তা দেখাও?

মূলত তারা কিছুই সৃষ্টি করেনি, কারণ তারা সে ক্ষমতা রাখে না। আল্লাহ তা‘আলার বাণী:

(وَاتَّخَذُوْا مِنْ دُوْنِه۪ٓ اٰلِهَةً لَّا يَخْلُقُوْنَ شَيْئًا وَّهُمْ يُخْلَقُوْنَ وَلَا يَمْلِكُوْنَ لِأَنْفُسِهِمْ ضَرًّا وَّلَا نَفْعًا وَّلَا يَمْلِكُوْنَ مَوْتًا وَّلَا حَيٰوةً وَّلَا نُشُوْرًا‏)‏

“আর তারা তাঁর পরিবর্তে মা‘বূদরূপে গ্রহণ করেছে অন্যদেরকে, যারা কিছুই সৃষ্টি করে না, বরং তারা নিজেরাই সৃষ্ট এবং তারা নিজেদের অপকার অথবা উপকার করার ক্ষমতা রাখে না এবং মৃত্যু, জীবন ও পুরুত্থানের ওপরও কোন ক্ষমতা রাখে না।” (সূরা ফুরকান ২৫:৩)

সুতরাং যারা আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্যের ইবাদত করে তারা কোন ক্ষমতাই রাখে না। তাহলে তারা কিভাবে ইবাদত পেতে পারে? তাই আল্লাহ তা‘আলাকে বাদ দিয়ে অন্যের ইবাদত করা নিতান্তই স্পষ্ট বিভ্রান্তি। অতএব সর্বপ্রকার শিরক থেকে বিরত থাকা একান্ত জরুরী।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:

১. সকল কিছুর ওপর ক্ষমতাবান একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা, অন্য কেউ নয়।
২. আল্লাহ তা‘আলার সাথে কাউকে শরীক করা যাবে না।
৩. পর্বতমালা না থাকলে পৃথিবী নড়াচড়া করত, ফলে তখন তাতে বসবাস করা সম্ভব হত না।
৪. সৃষ্টিকর্তা একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাই, তাই সকল ইবাদত পাওয়ার হকদার তিনিই।
১২ নং আয়াতের তাফসীর:

এ আয়াতে লুকমান (عليه السلام) সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা তাকে হিকমাত বা প্রজ্ঞা দান করেছিলেন। বিশিষ্ট তাবেয়ী কাতাদাহ (رحمه الله) বলেন: লুকমান (عليه السلام)-কে প্রদত্ত হিকমত ছিল দীনের সঠিক বুঝ। তিনি নাবী ছিলেন না এবং তাঁর কাছে ওয়াহী করা হয়নি। ইবনু কাসীর (رحمه الله) বলেন: তাঁর হিকমতটা ছিল জ্ঞান, সঠিক বুঝ ও স্বপ্নের তাবীর। (ইবনু কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর)

একদা তাকে কেউ জিজ্ঞেস করল, আপনি এ জ্ঞান-বুদ্ধি কিভাবে অর্জন করলেন? তিনি উত্তরে বলেলেন: সদ্ব্যবহার করে, আমানত রক্ষা করে, বাজে কথা থেকে দূরে থেকে এবং নীরবতা অবলম্বন করে। তাঁর প্রজ্ঞা ও হিকমতপূর্ণ একটি ঘটনা সম্পর্কে এরকমও প্রসিদ্ধ আছে যে, তিনি একজন দাস ছিলেন। একদা তাঁকে তাঁর মালিক বললেন: ছাগল জবেহ করে তার মধ্য হতে সর্বোৎকৃষ্ট দুই টুকরো গোশ্ত কেটে নিয়ে এস। সুতরাং তিনি জিভ ও হৃৎপিন্ড নিয়ে আসলেন। অন্য একদিন তাঁর মালিক তাঁকে ছাগল জবেহ করে তার মধ্য হতে সবচেয়ে নিকৃষ্ট দু টুকরো গোশ্ত নিয়ে আসার আদেশ করলে তিনি পুনরায় জিভ ও হৃদপিন্ড নিয়ে আসলেন। এর কারণ জিজ্ঞেস করা হলে তিনি উত্তরে বললেন: জিভ ও হৃদপিন্ড যদি ঠিক থাকে তাহলে তা সর্বোৎকৃষ্ট জীব। আর যদি তা নষ্ট হয়ে যায় তাহলে তার চেয়ে নিকৃষ্ট জীব আর কিছু হতে পারে না। (ইবনু কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর)

আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে যেহেতু হিকমত দান করেছেন সেজন্য তিনি আল্লাহ তা‘আলার শুকরিয়া আদায় করেন। কেননা যারা শুকরিয়া আদায় করে তারা মূলত তা নিজেদের কল্যাণের জন্যই করে। আর যদি কেউ অকৃতজ্ঞ হয় তাহলে অকৃতজ্ঞতার পরিণাম নিজের ওপরেই বর্তাবে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(مَنْ كَفَرَ فَعَلَيْهِ كُفْرُه۫ ج وَمَنْ عَمِلَ صَالِحًا فَلِأَنْفُسِهِمْ يَمْهَدُوْنَ)

“যে ব্যক্তি কুফরী করে, তারই ওপর পড়বে তার কুফরীর ফল। আর যে ব্যক্তি নেক কাজ করে, তারা নিজেদেরই জন্য সুখের ঠিকানা করে নিচ্ছে।” (সূরা রূম ৩০:৪৪)

সুতরাং মানুষ যে কাজই করুক না কেন তার ভাল মন্দ ফলাফল নিজের ওপরই বর্তাবে। এতে আল্লাহ তা‘আলার কোন লাভ বা ক্ষতি হবে না। কেননা আল্লাহ মানুষের মুখাপেক্ষী নন। আর এটাও বুঝা যাচ্ছে আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে যে নেয়ামত দান করেছেন তার জন্য শুকরিয়া আদায় করা উচিত। লুকমান (عليه السلام) সম্পর্কে সালাফগণ দুটি মত প্রকাশ করেছেন, কেউ বলেছেন তিনি নাবী ছিলেন, আবার কেউ বলেছেন; তিনি শুধুমাত্র সৎ ব্যক্তি ছিলেন। অধিকাংশরাই দ্বিতীয় মত পোষণ করেছেন।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:

১. লুকমান হাকীম ছিলেন একজন সৎ ব্যক্তি, তিনি নাবী ছিলেন না।
২. মানুষের কৃতকর্মের ফল তার নিজের ওপরই বর্তাবে। কেউ ভাল কাজ করলে তা তার আবার কেউ খারাপ কাজ করলে তাও তারই।
৩. আল্লাহ তা‘আলা বান্দার সকল জিনিস থেকে অমুখাপেক্ষী।
৪. যারা আল্লাহ তা‘আলার কৃতজ্ঞ হয়, আল্লাহ তা‘আলা তাদের মর্যাদা অনেক বৃদ্ধি করে দেন।
১৩-১৯ নং আয়াতের তাফসীর:

এখানে আল্লাহ তা‘আলা লুকমান হাকীমের দৃষ্টান্ত বর্ণনা করে একজন আদর্শ পিতার সন্তানের প্রতি কী করণীয় সে সম্পর্কে আলোচনা তুলে ধরেছেন। লুকমান (عليه السلام) তাঁর পুত্রকে যে নসীহত করেছিলেন ও উপদেশ দিয়েছিলেন সে সকল উপদেশ যদি প্রতিটি পিতা তার সন্তানকে প্রদান করেন তাহলে প্রত্যেক পরিবার, সমাজ ও দেশ আদর্শ পরিবার, সমাজ ও দেশে পরিণত হবে। লুকমান হাকীম তাঁর পুত্রকে যে নসীহত ও উপদেশ দিয়েছিলেন সেগুলো হলন

প্রথম উপদেশ:

তিনি তাঁর ছেলেকে সর্বপ্রথম আল্লাহ তা‘আলার হক সম্পর্কে সচেতন করে বললেন: একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করবে, কখনো আল্লাহ তা‘আলার সাথে শির্ক করবে না। কেননা শির্ক একটি বড় ধরনের জুলুম। হাদীসে এসেছে, ইবনু মাসউদ (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: যখন

(الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا وَلَمْ يَلْبِسُوْآ إِيمَانَهُمْ بِظُلْمٍ)

-এ আয়াতটি নাযিল হয় তখন সাহাবীদের নিকট বিষয়টি খুবই কঠিন মনে হল। তারা বলল: আমাদের মধ্যে এমন কে আছে যে, তার ঈমানকে জুলুমের সাথে সংমিশ্রণ করেনি? তখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, বিষয়টি এরূপ নয়। তোমরা লুকমান (عليه السلام)-এর কথা শুননি? সে তার সন্তানকে বলেছিলন

(إِنَّ الشِّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِيْمٌ)

-নিশ্চয়ই শির্ক মহা জুলুম।।

অপর এক হাদীসে রয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: সবচেয়ে বড় গুনাহ হল তিনটি, তার মধ্যে প্রথম হলো আল্লাহ তা‘আলার সাথে শরীক করা। (সহীহ বুখারী হা: ৬৮৭০-৭১)

দ্বিতীয় উপদেশ:

আল্লাহ তা‘আলার হকের পর বান্দার মাঝে যারা বেশি হকদার তাদের হক সম্পর্কে সচেতন করছেন। তারা হলেন পিতা-মাতা। তিনি তাঁর ছেলেকে পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করার জন্য নসীহত করলেন। কেননা আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে তার পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করার জন্য জোরালো আদেশ করেছেন। এমনকি কুরআনে প্রত্যেক জায়গায় আল্লাহ তা‘আলার অধিকারের পর পিতা-মাতার অধিকারের কথা বলেছেন। আল্লাহ তা‘আলার বাণী:

(وَقَضٰي رَبُّكَ أَلَّا تَعْبُدُوْآ إِلَّآ إِيَّاهُ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا ط إِمَّا يَبْلُغَنَّ عِنْدَكَ الْكِبَرَ أَحَدُهُمَآ أَوْ كِلَاهُمَا فَلَا تَقُلْ لَّهُمَآ أُفٍّ وَّلَا تَنْهَرْهُمَا وَقُلْ لَّهُمَا قَوْلًا كَرِيْمًا)

“তোমার প্রতিপালক আদেশ দিয়েছেন তিনি ব্যতীত অন্য কারও ‘ইবাদত কর না ও পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার কর। তাদের একজন অথবা উভয়ে যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয় তবে তাদেরকে ‘উফ্’ বল না এবং তাদেরকে ধমক দিও না; তাদের সাথে সম্মানসূচক কথা বল।” (সূরা বানী ইসরাঈল ১৭:২৩)

এখানে পিতা-মাতার প্রতি কর্তব্য পালন এবং তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকারের নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। এর হিকমত ও অন্তর্নিহিত রহস্য বর্ণনা করা হয়েছে যে, তার মা ধরাধামে তার আবির্ভাব ও অস্তিত্ব বজায় রাখার ক্ষেত্রে অসাধারণ ত্যাগ স্বীকার ও অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট বরদাশত করেছেন। নয় মাস গর্ভ ধারণ, প্রসব বেদনা, লালন-পালন, দুধ পান ইত্যাদি ক্ষেত্রে মাকে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে।

তবে পিতা-মাতা যদি এমন কোন বিষয়ের নির্দেশ দেয় যা বাস্তবায়ন করলে আল্লাহ তা‘আলার সাথে শরীক করা হয় সেক্ষেত্রে তাদের কথা মানা যাবে না। তবে তাদের সাথে সদ্ব্যবহার করতে হবে। এমনকি তাদের জন্য মহান আল্লাহ তা‘আলার দরবারে দু‘আ করতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(وَقُلْ رَّبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِيْ صَغِيْرًا)

“এবং বল:‎ ‘হে আমার প্রতিপালক! তাদের প্রতি দয়া কর‎ যেভাবে শৈশবে তারা আমাকে প্রতিপালন করেছিলেন।’’ (সূরা বানী ইসরাঈল ১৭:২৩-২৪)

তৃতীয় উপদেশ:

তৃতীয় উপদেশ দানের ক্ষেত্রে আল্লাহ তা‘আলার সূক্ষ্মদর্শীতার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বললেন: হে বৎস! তুমি যে আমলই করা না কেন যদি তা সরিষার দানা পরিমাণও হয় আর তা যদি শিলাগর্ভে বা আকাশে কিংবা মৃত্তিকার নীচে থেকে থাকে তাহলেও তা হাযির করে তোমাকে তার প্রতিদান দেবেন। এর দ্বারা তিনি ছেলেকে সতর্ক করছেন যাতে কখনো আল্লাহ তা‘আলার অবাধ্য ও পাপ কাজে লিপ্ত না হয়। আল্লাহ তা‘আলা কারো প্রতি কোন জুলুম করবেন না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(وَنَضَعُ الْمَوَازِيْنَ الْقِسْطَ لِيَوْمِ الْقِيٰمَةِ فَلَا تُظْلَمُ نَفْسٌ شَيْئًا ط وَإِنْ كَانَ مِثْقَالَ حَبَّةٍ مِّنْ خَرْدَلٍ أَتَيْنَا بِهَا ط وَكَفٰي بِنَا حٰسِبِيْنَ)‏

“এবং কিয়ামত দিবসে আমি স্থাপন করব ন্যায়বিচারের মানদণ্ড। সুতরাং কারো প্রতি কোন অবিচার করা হবে না এবং কর্ম যদি সরিষার দানা পরিমাণ ওজনেরও হয় তবুও সেটা আমি উপস্থিত করব; হিসেব গ্রহণকারীরূপে আমিই যথেষ্ট।” (সূরা আম্বিয়াহ ২১:৪৭)

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:

(فَمَنْ يَّعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ خَيْرًا يَّرَه۫ – وَمَنْ يَّعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ شَرًّا يَّرَه۫)

“অতঃপর কেউ অণু পরিমাণ সৎকর্ম করলে তা দেখতে পাবে, এবং কেউ অণু পরিমাণ অসৎকর্ম করলে তাও দেখতে পাবে।” (সূরা যিলযালা ৯৯:৭-৮)

সুতরাং মানুষ গোপনে বা প্রকাশ্যে যত ভাল আর খারাপ কাজ করুক না কেন আল্লাহ তা‘আলা তা কিয়ামতের দিন অবশ্যই উপস্থিত করবেন।

কেউ কেউ বলেন: صَخْرَةٌ হল যা সাত জমিনের নীচে থাকে। তবে এগুলোর ব্যাপরে সঠিক কথা আল্লাহ তা‘আলাই ভাল জানেন।

চতুর্থ উপদেশ:

চতুর্থ উপদেশ হল কর্ম পরিশুদ্ধতা সম্পর্কে। মানুষ যত আমল করে তার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হল সালাত। তাই তিনি তাঁর ছেলেকে বললেন, তুমি সালাত কায়েম কর। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:

مُرُوا أَوْلَادَكُمْ بِالصَّلَاةِ وَهُمْ أَبْنَاءُ سَبْعِ سِنِينَ، وَاضْرِبُوهُمْ عَلَيْهَا، وَهُمْ أَبْنَاءُ عَشْرٍ وَفَرِّقُوا بَيْنَهُمْ فِي الْمَضَاجِعِ

সাত বছর বয়সে উপনীত হলে তোমাদের সন্তানদেরকে সালাতের নির্দেশ দাও, আদায় না করা অবস্থায় দশ বছর বয়সে পৌঁছলে প্রহার কর এবং বিছানা আলাদা করে দাও। (আবূ দাঊদা হা: ৪৯৫, সহীহ)

পঞ্চম উপদেশ:

পঞ্চম উপদেশ হল চরিত্র সংশোধন। ইসলাম একটি সমষ্টিগত ধর্ম, ব্যক্তির সাথে সমষ্টির সংশোধন ও জীবনব্যবস্থার প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ অংগ। এজন্য সালাতের ন্যায় অবশ্য পালনীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল সৎ কাজের আদেশ করা ও অসৎ কাজ থেকে বাধা দেয়া। সে জন্য লুকমান (عليه السلام) বললেন: হে বৎস! তুমি সৎ কাজের আদেশ করবে এবং অসৎ কাজ থেকে মানুষকে বিরত থাকতে বলবে।

ষষ্ঠ উপদেশ:

ষষ্ঠ উপদেশ হল, যখন তুমি মানুষকে সৎ কাজের আদেশ দিবে এবং অসৎ কাজে বাধা দিবে তখন মানুষের পক্ষ হতে অনেক কষ্ট, বিপদ তোমাকে আঘাত করবে। আর তখন তোমার কাজ হল তুমি বিচলিত না হয়ে ধৈর্যধারণ করবে। কেননা এটা দৃঢ় সঙ্কল্পের একটি কাজ।

সপ্তম উপদেশ:

তুমি অহঙ্কারের বশবর্তী হয়ে মানুষকে অবজ্ঞা কর না। এবং উদ্ধতভাবে জমিনে বিচরণ কর না। কেননা আল্লাহ তা‘আলা উদ্ধত, অহঙ্কারীকে ভালবাসেন না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(وَلَا تَمْشِ فِي الْأَرْضِ مَرَحًا ج إِنَّكَ لَنْ تَخْرِقَ الْأَرْضَ وَلَنْ تَبْلُغَ الْجِبَالَ طُوْلًا)

“ভূপৃষ্ঠে দম্ভভরে বিচরণ কর না; তুমি তো কখনই পদভরে ভূপৃষ্ঠ বিদীর্ণ করতে পারবে না এবং উচ্চতায় তুমি কখনই পর্বত সমান হতে পারবে না।” (সূরা বানী ইসরাঈল ১৭:৩৭)

হারিস বিন ওয়াহাব খুযা’য়ী (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: আমি কি তোমাদেরকে জান্নাতবাসীদের পরিচয় বলে দিব না? তারা কোমল স্বভাবের লোক, মানুষের কাছেও কোমল বলে পরিগণিত। যদি তারা কোন বিষয়ে আল্লাহ তা‘আলার নামে শপথ করে আল্লাহ তা‘আলা তা অবশ্যই পূর্ণ করেন। আর আমি কি তোমাদেরকে জাহান্নামবাসীদের পরিচয় বলে দিব না? তারা কঠোর স্বভাবের লোক, দাম্ভিক ও অহংকারী। অপর সনদে আনাস বিন মালেক (رضي الله عنه) বলেন: মদীনাবাসীদের ক্রীতদাসীদের মধ্যে একজন ক্রীতদাসী ছিল। সে তার প্রয়োজনে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর হাত ধরে যেখানে চাইতো নিয়ে যেত। (অর্থাৎ তার উদ্দিষ্টস্থলে হাত ধরে নিয়ে যেত। আর নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-ও তার সাথে সাথে চলে যেতেন এবং তার প্রয়োজনীয় কাজ করে দিতেন। এমনই কোমল স্বভাবের ছিলেন তারা। অথচ তিনি তখনও রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন।) (সহীহ বুখারী হা: ৬০৭০, সহীহ মুসলিম হা: ২৮৫৩)

অষ্টম উপদেশ:

তুমি সংগতভাবে জমিনে তোমার পা ফেলবে। খুব ধীরে ধীরেও নয় আবার দম্ভভরেও নয়। বরং মধ্যম পন্থায় চলবে। কেননা আল্লাহ তা‘আলার বান্দারা জমিনে নম্রভাবে চলাফেরা করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(وَعِبَادُ الرَّحْمٰنِ الَّذِيْنَ يَمْشُوْنَ عَلَي الْأَرْضِ هَوْنًا وَّإِذَا خَاطَبَهُمُ الْجٰهِلُوْنَ قَالُوْا سَلَامًا)‏

‘রাহমান’-এর বান্দা তারাই, যারা পৃথিবীতে নম্রভাবে চলাফেরা করে এবং তাদেরকে যখন অজ্ঞ ব্যক্তিরা সম্বোধন করে তখন তারা বলে, ‘সালাম’। (সূরা ফুরকান ২৫:৬৩)

নবম উপদেশ:

তুমি কথা বলার সময় নীচু স্বরে কথা বলবে। কেননা সবচেয়ে নিকৃষ্ট স্বর হচ্ছে গাধার স্বর। তাই তুমি গাধার মত উচ্চ স্বরে কথা বল না। বরং তোমরা কথায় নম্রতা বজায় রাখবে। হাদীসে এসেছে, আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: যখন তোমরা মোরগের ডাক শুনবে তখন আল্লাহ তা‘আলার অনুগ্রহ কামনা কর। আর যখন গাধার ডাক শুনবে তখন আল্লাহ তা‘আলার কাছে শয়তান থেকে আশ্রয় প্রার্থনা কর। (সহীহ বুখারী হা: ৩৩০৩, সহীহ মুসলিম হা: ৮২)

সুতরাং প্রত্যেক পিতা-মাতার উচিত তার সন্তানকে এ সকল উপদেশ প্রদান করা। ফলে সন্তান আদর্শবান হবে এবং পিতা-মাতার বৃদ্ধ অবস্থায় সেবাযত্ন করবে।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:

১. পিতা-মাতার উচিত তাদের সন্তানদেরকে লুকমান (عليه السلام)-এর মত উপদেশ প্রদান করা।
২. আল্লাহ তা‘আলার সাথে কাউকে শরীক করা যাবে না। কেননা শির্ক হল সবচেয়ে বড় গুনাহ।
৩. আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করার পাশাপাশি পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করতে হবে।
৪. কিয়ামতের মাঠে মানুষের সমস্ত আমল উপস্থিত করা হবে এবং সেই অনুপাতে তাকে প্রতিদান দেয়া হবে। কারো প্রতি কোন প্রকার জুলুম করা হবে না।
৫. প্রতিটি পিতা-মাতা সন্তানকে সালাত কায়েম করার, সৎ কাজের আদেশ করার, অসৎ কাজে বাধা এবং বিপদে ধৈর্য ধারণ করার উপদেশ দিবে।
৬. অহংকার পতনের মূল, তাই কোন প্রকার অহঙ্কার করা যাবে না।
৭. আল্লাহ তা‘আলার সৃষ্টিকে অবজ্ঞা করা যাবে না।
৮. সংযতভাবে চলা ফেরা করতে হবে।
৯. উচ্চকণ্ঠে নয় বরং নম্রভাবে কথা বলতে হবে।

ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-

*সৃষ্টিজগতের পাতায় পাতায় আল্লাহর নিদর্শন : এ বিশ্বজগতের পরিচালনা ব্যবস্থা এত সুষ্ঠু সুশৃংখল ও ভারসাম্যপূর্ণ যে, তা সকলের মনমগযকে স্তম্ভিত করে দেয়। প্রতিটি সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের সামনে তা এতাে স্পষ্ট ও স্বচ্ছ যে, কেউ তা উপেক্ষা করতে পারে না এর মহান স্রষ্টার একত্ব কেউ অস্বীকার করতে পারে না এবং তার সাথে যারা অন্য কাউকে শরীক করে তাদেরকে সুস্পষ্ট ও অকাট্য সত্যের প্রতি অত্যাচারকারী ও বিপথগামী বলে আখ্যায়িত না করে পারে না।(আয়াত ১০-১১) এখানে যে আকাশের কথা বলা হয়েছে, তার সম্পর্কে জটিল বৈজ্ঞানিক আলােচনায় না গিয়েও নিছক বাহ্যিক অর্থের আলােকেই বলা যায় যে, এই সুপ্রশস্ত আকাশ মানুষের দৃষ্টি ও অনুভূতিকে আকৃষ্ট ও প্রভাবিত করে। যে মহাশূন্যের প্রকৃত রহস্য ও চতুঃসীমা আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কেউ জানে না, সেই মহাশূন্যে প্রদক্ষিণরত ও পরিভ্রমণরত গ্রহ নক্ষত্র, ছায়াপথ ও নিহারীকাগুলােকেই আকাশ মনে করা হােক অথবা খালি চোখে দৃশ্যমান আমাদের মাথার ওপরের এই আকাশকেই আকাশ বলা হােক- এর কোলে বহু অতিকায় সৃষ্টি কোন স্তম্ভ বা খুঁটি ছাড়াই ঝুলন্ত রয়েছে। মানুষ তার দৃষ্টিসীমার ভেতরে এ সব সৃষ্টির কোনাে কোনােটা দিনে বা রাতে দেখতে পায়। এসব সৃষ্টির বিশালত্বের প্রকৃত পরিমাণ উপলব্ধি না করলেও খালি চোখে এগুলাের আপাত দৃশ্যমান কুলকিনারাহীন বিশালত্ব দেখে যে কোন মানুষের স্নায়ুতন্ত্রী শিহরিত হয় ও মাথা ঘুরে যায়। কী বিস্ময়কর শৃংখলা সমন্বয় এই সৃষ্টিগুলােকে অটুট বন্ধনে আবদ্ধ রাখে এবং কী অতুলনীয় সৌন্দর্য দ্বারা এগুলাে দৃষ্টিকে বিমােহিত, মনকে চিন্তা গবেষণায় অনুপ্রাণিত ও স্নায়ুকে আচ্ছন্ন করে রাখে, তা অভাবনীয় । এমতাবস্থায় মানুষ যদি জানতে পারে যে, মহাশূন্যে সন্তরণরত এসব সৃষ্টির প্রত্যেকটার আয়তন পৃথিবীর আয়তনের চেয়ে বহুগুণ বড় এবং পৃথিবী সেগুলাের চেয়ে লক্ষ লক্ষ গুণ ছােট, তাহলে তার মনােভাব কী হতে পারে, ভেবে দেখার মতাে। মহাশূন্যের এই দুর্জেয় রহস্য সম্পর্কে অতি সংক্ষেপে ‘তিনি আকাশকে এমন কোন স্তম্ভ ছাড়াই সৃষ্টি করেছেন, যা তােমরা দেখতে পাও’ এই কথাটা বলার পর আয়াতের পরবর্তী অংশে ক্ষুদ্র পৃথিবীর দিকে মানুষের মনােযােগ আকর্ষণ করা হয়েছে। পৃথিবীটা এতই ক্ষুদ্র যে, বিশালায়তন মহাবিশ্বের সামনে তা একটা বিন্দুর সমান। অথচ মানুষ এই পৃথিবীটাকেও এত প্রশস্ত দেখতে পায় যে, কোন ব্যক্তি তার সমগ্র জীবন পৃথিবী পরিভ্রমণে কাটিয়ে দিলেও সে এর শেষ প্রান্তে পৌছতে সক্ষম হবে না। আয়াতে এই পৃথিবীর দিকে মানুষের মনােযােগ আকর্ষণ করা হচ্ছ যাতে সে এদিকে সচেতন দৃষ্টি দেয় এবং যাতে এই পৃথিবীর বিস্ময়কর দৃশ্যগুলাের ওপর বারবার দৃষ্টি দেয়ার একঘেয়েমি দূর হয়, আর পৃথিবীতে তিনি বহু নােঙ্গর ফেলেছেন, যাতে তা তােমাদেরকে নিয়ে ঢলে না পড়ে। নােংগর দ্বারা পাহাড় পর্বতকে বুঝানাে হয়েছে। ভূ-তত্ত্ববিদরা বলেছেন যে, ভূ-পৃষ্ঠের কিছু উচু নীচু জায়গা থাকে, যা ভূ-গর্ভের প্রচন্ড ঠান্ডা থেকে জন্মে। ঠান্ডার জন্য ভূ-গর্ভে গ্যাস জমাট বাঁধে ও তার আকৃতি সংকুচিত হয়ে যায়। ফলে ভূ-পৃষ্ঠের আকৃতি আঁকাবাকা ও উঁচু নীচু হয়ে যায়। এ কারণে কোথাও উঁচু পাহাড় পর্বত আবার কোথাও নিম্ন জলাভূমির সৃষ্টি হয় এবং সেটা ঠান্ডার দরুন গ্যাসের আকৃতির আভ্যন্তরীণ ওঠানামার তারতম্য অনুসারেই হয়। ভূ-তত্ত্ববিদদের এ মতবাদ ভুল হােক বা শুদ্ধ হােক। আল্লাহ তায়ালার কিতাব দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়ে দিচ্ছে যে, এসব পাহাড় পর্বত পৃথিবীর ভারসাম্য রক্ষা করে। এগুলাে থাকার কারণে পৃথিবী কোনাে দিকে হেলে পড়ে না, দোদুল্যমান হয় না? বা নড়বড়ে হয় না। ভূ-তত্ত্ববিদদের মতবাদ সঠিকও হতে পারে। আভ্যন্তরীণ গ্যাসের ওঠানামা ও ভূ-পৃষ্ঠের এখানে সেখানে চুপসে যাওয়ার সময় হয়তাে পাহাড় পর্বত তার ভারসাম্য রক্ষা করে। পাহাড় পর্বতের উচ্চতা ভূ-পৃষ্ঠের কোথাও কোথাও ধ্বসে যাওয়া বা দেবে যাওয়ার পরিপূরক হয়ে থাকতে পারে। যা হােক, আল্লাহ তায়ালার কথা সর্বাবস্থায় সবার ওপরে থাকবেই। কেননা’তিনি সবচেয়ে সত্যবাদী। ‘এবং তিনি এই পৃথিবীতে সব ধরনের প্রাণী ছড়িয়ে দিয়েছেন।’ এটা পৃথিবীর অন্যতম বিস্ময়। পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্ব এমন এক রহস্য। যার কোনাে ব্যাখ্যা দিতে পারে-এমন দাবী আজ পর্যন্ত কেউ করেনি। প্রাণের প্রাথমিক ও আদি রূপ-যা একটা ক্ষুদ্র, মামুলী ধরনের কোষের ভেতরে অবস্থান করে, সেটাই এক মহা রহস্য। উপরন্তু সেই প্রাণ যদি বিভিন্ন রূপ ধারণ করে ও বিভিন্ন দেহের সাথে মিলিত হয়ে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে এবং এত ব্যাপক বিন্তৃতি লাভ করে, যার কোন সীমা-সরহদ মানুষের জানা থাকে না। তাহলে সেই রহস্য কতাে বড় হয়ে দাঁড়ায় ভেবে দেখার মতাে। তথাপি মানুষ এসব বিস্ময় ও রহস্য দেখেও না দেখার ভান করে। এমনভাবে এর পাশ দিয়ে চলে যায়, যেন একটা নগন্য জিনিসই দেখেছে এবং তা নিয়ে ভাবনা চিন্তার কিছু নেই। পক্ষান্তরে তারা মানুষের তৈরী একটা অতি সাধারণ যন্ত্রপাতির ওপরই হুমড়ি খেয়ে পড়ে এবং তা দেখে তাদের সংজ্ঞা লােপ পাওয়ার উপক্রম হয়। অথচ একটা জীবন্ত প্রাণী কোষ এবং তার বিস্ময়কর ও সুসংবন্ধ তৎপরতা মানুষের তৈরী যে কোন যন্ত্রের তুলনায় অত্যন্ত ক্ষুদ্র, এবং তার নির্মাণ শৈলী মানুষের জ্ঞানের সীমারেখারই বাইরে। জটিল প্রাণীগুলাের কথা এবং মানুষের কথা না হয় বাদই থাকুক- যাদের দেহে শত শত বিস্ময়কর রাসায়নিক কারখানা, বন্টন ও সংরক্ষণের জন্য শত শত রক্ষণাগার। তথ্য প্রেরণ ও গ্রহণের জন্য শত শত বেতার কেন্দ্র এবং শত শত এমন ধরনের জটিল কর্মকান্ড রয়েছে, যার রহস্য একমাত্র মহাজ্ঞানী ও মহাকুশলী আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানে না। ‘আমি আসমান থেকে পানি বর্ষণ করেছি। সুন্দর জিনিসপত্র উৎপাদন করিয়েছি'(আয়াত ১০) এখানে আল্লাহ তায়ালার অসীম কুদরত মেঘমালা থেকে বৃষ্টিধারা বর্ষণের বর্ণনা দেয়া হয়েছে, আসমান থেকে পানি বর্ষণ প্রকৃতি জগতে আল্লাহ তায়ালার বিস্ময়কর কুদরত ও অসীম ক্ষমতারই এক নিদর্শন। বারিধারার এ প্রবাহ বে-খবর লােকদের শিক্ষার জন্য এক অনুপম দৃষ্টান্ত। আসমান থেকে বর্ষিত এ বৃষ্টির পানির প্রবাহ বৃক্ষরাজীকে সজীব করে তােলে। নদ নদী ও সমুদ্রকে কানায় কানায় ভরে তােলে, আর ঝর্ণাধারাকে করে তােলে প্রবাহমান। আসমান থেকে বৃষ্টিধারা বর্ষণের মাধ্যমে আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যে মহান আল্লাহ তায়ালার ক্ষমতার এক অতীব সুক্ষ সম্পৃক্ততার প্রক্রিয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়, অথচ আসমান ও যমীনের মধ্যে এর নিয়মাবলীর মধ্যে অনেক দূরত্ব ও ব্যবধান বিদ্যমান, আর তার প্রকৃতি ও কৌশলগত দিকের মধ্যেও রয়েছে সুস্পষ্ট পার্থক্য। বর্ষণের পর সে পানির সাহায্যে যমীনের বুক চিরে চারাগাছ উদগমের মধ্যেও আল্লাহ তায়ালার অভিনব কৌশলের প্রমাণ নিহিত রয়েছে। এ এমন এক বিস্ময়কর প্রক্রিয়া, যার অব্যাহত ধারা অনন্তকাল পর্যন্ত আর সমাপ্ত হয় না। সে চারাগাছের উদ্ভাবন, তার পরিবর্ধন, তার সজীবতা, তার বৈচিত্রময় আকৃতি, পৃথক পৃথক বৈশিষ্টমন্ডিত ডালপালার দিকে তাকিয়ে দেখুন, তাদের বংশধারা বিস্তারের অভিনব পদ্ধতি, প্রথম উদগমের পর কচি চারাগাছ আকৃতি থেকে বিশাল বৃক্ষে পরিণত হওয়া এ বৃক্ষরাজীর নানাবিধ রূপ ও আকৃতি ধারণ বিচিত্র স্বাদের বর্ণের ও আকৃতির ফলফুল, পুষ্টি ও হৃদয়ের শক্তিবর্ধক রােগ প্রতিষেধক মূল্যবান ফল ফলাদির প্রতিও লক্ষ্য করুন, এ সব কিছু কি আল্লাহ তায়ালার অসীম কুদরতের গভীর উপলব্ধি ও চেতনাকে বিকশিত করে আল্লাহর প্রতি দৃঢ় প্রত্যয়কে উন্মুক্ত ও প্রশস্ত করে দেয় না? মূলত এসব কিছুই হচ্ছে আল্লাহর অস্তিত্বের প্রতি, তার সীমাহীন কুদরতের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন ও বিশ্বাসবাদী জীবন চেতনার উৎস। এখানে আল কোরআন তার এ সুস্পষ্ট ভাষ্য দ্বারা এ মহাসত্যকে স্বতসিদ্ধভাবে প্রমাণ করে যে, আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক উৎপাদিত এ গাছগুলােকেও তিনি যুগলভাবে সৃষ্টি করেন। যেমন, আয়াতে বলা হয়েছে, ‘কল্যাণকরভাবে তিনি সব কিছুই যুগল সৃষ্টি করেছেন।’ এসব কিছুকে তিনি সন্দেহাতীতভাবে এমন প্রক্রিয়ায় নির্দেশনা প্রদান করেছেন, তারা যুগলভাবে উদগম হওয়ার পর অত্যন্ত অন্তরংগ পরিবেশে কাছাকাছি থেকে যুগলভাবেই বেড়ে ওঠে। প্রতিটি উদগত কচি চারাগাছই পৃথক পৃথক স্বাতন্ত্র ও বৈশিষ্ট সংরক্ষণ করে নর ও মাদা হিসাবে বর্ধিত হতে থাকে। কখনও এক বৃন্তে বা একই ডালে, নর-নারী একত্রে তাদের শিশু থেকে কৈশোর, কৈশোর থেকে যৌবনে, যৌবন থেকে পূর্ণতা ও বার্ধক্য উপনীত হয়। আবার কখনও একই কলি ও বৃন্তে একই ডাল ও শাখায় অথবা পৃথক পৃথক বৃত্তে, ডালে ও আলাদা আলাদা বৃক্ষ রূপে পরিবর্ধিত হতে থাকে। এমনভাবে যুগল উদ্ভিদ ও বৃক্ষরাজী তাদের কর্ম তৎপরতাকে অব্যাহত রাখে, ফলফুল ফসল প্রদান করে। পূর্ণতার স্তরে উপনীত হয়ে মানব সমাজের ও প্রাণীকূলের অনুরূপ তাদের প্রাকৃতিক জীবন ধারা অতিবাহিত করে। এখানে ‘বাজ’ শব্দটিকে ‘কারীম’ শব্দ-এর বিশেষণে ভূষিত করা হয়েছে। এর তাৎপর্য হচ্ছে এই যে, যুগল সৃষ্টি এক মহান উদ্দেশ্যে আল্লাহ তায়ালা বিশেষ মেহেরবাণীতে সৃষ্টি করেছেন। এর মাধ্যমে এক বিশেষ প্রক্রিয়ায় আল্লাহ তায়ালার আশ্রয়ে মানব বংশের সৃষ্টি বর্ধিত হচ্ছে এবং এর সাথে প্রতিটি নব নব সৃষ্টি সংযােজিত হচ্ছে। আল্লাহ তায়ালা প্রচ্ছন্নভাবে মানবকূলের দৃষ্টির সামনে এ প্রশ্ন উত্থাপন করছেন, এ যে সম্প্রসারিত সৃষ্টিকূল যে বৃক্ষ ও তৃণলতার প্রতিটি প্রভাবে নব নব সংস্করণ বৃদ্ধি ও সম্প্রসারণ হচ্ছে এ সব কি একমাত্র আমারই সৃষ্টি নয়? মানব সমাজকে চ্যালেঞ্জ ও হুমকির ভাষায় এ প্রশ্ন উত্থাপন করা হচ্ছে, বলাে আমার সৃষ্টির বাইরে যাদেরকে তােমরা আমার সাথে শরীক বানাচ্ছে আমার অংশীদারিত্বে যাদের জড়িত করছো তাদের সৃষ্ট বস্তু প্রাণীকুল কোথায় বলা হয়েছে, ‘আমাকে দেখিয়ে দাও, আমি আল্লাহ ছাড়া অপর যে সকল শক্তির সৃষ্টির ক্ষমতা রয়েছে বলে তােমরা মনে করো তাদের সৃষ্টি কোথায়?'(আয়াত ১১) অতঃপর এ চ্যালেঞ্জের পর সমকালীন লেখকদের অবস্থা সম্পর্কে আল্লাহ সােবহানাহু তায়ালা চূড়ান্ত রায় প্রদান করে বলেছেন, ‘এসবই তাে আল্লাহর সৃষ্টি, অতপর আমাকে দেখাও আল্লাহ ব্যতীত যাদেরকে স্রষ্টা মনে কর তাদের সৃষ্টি কোথায়? আসলেই এ সকল যালেমরা প্রকাশ্য বিভ্রান্তিতে ও গামরাহীতে লিপ্ত রয়েছে।’ এখানে বিভ্রান্তি ও জুলুম বলতে আল্লাহর সাথে শিরকের জুলুম-এর বিভ্রান্তিকে বুঝানাে হয়েছে। আর যুলুম হচ্ছে আল্লাহর সাথে শিরকে লিপ্ত হওয়ার অনধিকার চর্চা। আল্লাহর সাথে শিরক করার চেয়ে বড় যুলুম আর কী হতে পারে। প্রকৃতির বুকে আল্লাহর অনন্ত সৃষ্টিকূলই তাে আল্লাহ তায়ালার তাওহীদ তথা একক একচ্ছত্র ক্ষমতার সুস্পষ্ট ও জ্বলন্ত প্রমাণ। এ সকল শক্তিশালী সুস্পষ্ট প্রমাণ উত্থাপনের মাধ্যমে এ সূরার হৃদয়গ্রাহী প্রাণস্পর্শী প্রভাব সৃষ্টিকারী প্রথম স্তরের উজ্জ্বল দৃষ্টান্তগুলাে সমাপ্ত করা হয়েছে।
#   *হযরত লােকমানের উপদেশনামা : অতপর দ্বিতীয় স্তরের প্রমাণ ও তার প্রভাবকে উত্থাপন করে নতুন পদ্ধতিতে নতুন ঘটনাসমূহ ও তাৎপর্যের আলােকে বর্ণনা পেশ করা হয়েছে। এক আল্লাহর শােকর আদায়ের ক্ষেত্রে সৃষ্ট রােগের প্রতিষেধক, শিরক থেকে পবিত্র হওয়ার পন্থা এবং ঘটনার পশ্চাতে অপর একটি প্ৰসংগ উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘আমি লােকমানকে হিকমত (প্রজ্ঞা) দান করেছি যেন সে, আল্লাহ তায়ালার শােকর আদায় করে।…তিনি পরম প্রশংসিত।'(আয়াত ১২) এ পর্যায়ে আল্লাহ সােবহানাহু তায়ালা হযরত লােকমানের প্রসিদ্ধ ঘটনাকে কোরআনুল কারীমে তাওহীদের জ্বলন্ত প্রমাণ হিসাবে তার নিজের ভাষা দিয়েই প্রমাণ করার জন্য বাছাই করে নিয়েছেন। এ ছাড়া আরও বিভিন্ন প্রসংগও হযরত লােকমানের ঘটনায় তিনি উপস্থাপন করেছেন। হযরত লােকমান সম্পর্কে কারাে কারাে অভিমত হচ্ছে, তিনি নবীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। অনেকেরই মত হচ্ছে তিনি আল্লাহ তায়ালার একজন নেক বান্দা, জ্ঞানী পন্ডিত ও বুযুর্গদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তিনি নবী ছিলেন না। অধিকাংশের নিকট দ্বিতীয় অভিমত গ্রহণযােগ্য। কেউ কেউ বলেছেন, তিনি শাসক ও বিচারক ছিলেন। বলা হয়ে থাকে যে, তিনি বনী ইসরাঈল সম্প্রদায়ের বিচারক মন্ডলীর একজন বড়াে বিচারক ছিলেন। আবার কেউ কেউ তাকে ইরিত্রিয়ার কাফ্রী ক্রীতদাস বলে উল্লেখ করেছেন। এ পর্যায়ে আমরা অত্যন্ত সতর্কতার সাথে আল কোরআনের ভাষ্যের ওপর যথার্থ গুরুত্ব আরােপ করে এ মতকেই প্রাধান্য দিতে পারি যে, কোরআনে হাকীমে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় আল্লাহ জাল্লা-শানুহু উল্লেখ করেছেন যে, আমি লােকমানকে এমন প্রজ্ঞা দান করেছি যে প্রজ্ঞা তাকে আল্লাহর শােকর আদায়ের জন্য উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত করে। ‘আমি অবশ্যই লােকমানকে আল্লাহর শোকর আদায়ের জন্য হেকমত (প্রজ্ঞা) দান করেছি।'(আয়াত ১২) এ হচ্ছে এমন এক শিক্ষা ও ব্যাখ্যা যাতে কোরআনে হাকীমে ইংগিত করা হয়েছে যে, লােকমান-এর পান্ডিত্য ও গভীর জ্ঞান তাকে আল্লাহ তায়ালার শােকর আদায়ের বৈশিষ্টমন্ডিত করেছে। মানুষের মধ্যে যারা প্রকৃত জ্ঞান ও পান্ডিত্যের অধিকারী প্রজ্ঞাবান, তারাও এ প্রসিদ্ধ জ্ঞানী ব্যক্তির অনুসরণ করে আল্লাহ সােবহানাহু তায়ালার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে। পান্ডিত্যের প্রমাণ নাস্তিকতা নয়; পান্ডিত্যের ও প্রজ্ঞার নিদর্শন ও প্রমাণ হচ্ছে, আল্লাহ তায়ালার অস্তিত্বের প্রতি স্বীকৃতি ও আস্থাবান হওয়া এবং আল্লাহর শােকর আদায় করা। আল্লাহ তায়ালা উল্লেখিত আয়াতে প্রজ্ঞাবান গভীর পান্ডিত্যের অধিকারী লােকমানের এ ঘটনাকে পরবর্তী মানব গােষ্ঠীর মধ্যে যারা প্রকৃত জ্ঞানী- তারা অবশ্যই আল্লাহর শােকর আদায় করার শিক্ষা গ্রহণ করবে, এ জন্যই তিনি এ ঘটনাকে বাছাই করেছেন। আয়াতের শেষ অংশটুকু দ্বারা মহান রাব্বুল আলামীন অপর একটি শিক্ষা ও তাৎপর্যকে মানুষের সামনে তুলে ধরেছেন। বলা হয়েছে মানুষ কতক রাশি রাশি শােকর ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ দ্বারা মহান আল্লাহ তায়ালার কোনাে ফায়দা নেই। বরং এ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ও শােকরিয়া আদায়ের মধ্যে আদায়কারীরই উপকার নিহিত রয়েছে। মানুষ তার শোকরিয়া আদায় করুক এ জন্য আল্লাহ তায়ালা লালায়িত ও মুখাপেক্ষী নন। বান্দার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ দ্বারা বান্দাই লাভবান ও উপকৃত হয়। আল্লাহ তায়ালার কৃতজ্ঞতা ও প্রশংসা প্রকাশের দ্বারা বান্দার নিজেই উপকার সাধিত হয়। আল্লাহ তায়ালা বে-নিয়ায় ও অভাবমুক্ত। আল্লাহ তায়ালা ও তার সত্ত্বা এমনিই প্রশংসিত। সৃষ্টিলােকের কেউ তার হামদ ও শােকর আদায় না করলেও তিনি প্রশংসিত। তাই কোরআনে হাকীমে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ‘যে শােকর করে সে তা নিজের জন্যই করে, আর যে কুফরীতে লিপ্ত হয়েছে (তার জেনে রাখা উচিৎ যে) আল্লাহ তায়ালা অভাবমুক্ত ও প্রশংসিত।'(আয়াত ১২) এ ঘােষণা থেকে স্বতসিদ্ধভাবে প্রমাণিত হয় যে, যারা তাদের প্রজ্ঞা ও পান্ডিত্যের দ্বারা আল্লাহর অস্তিত্বের স্বীকৃতি ও তার কৃতজ্ঞতা ও প্রশংসার মহামূল্যবান সম্পদকে অস্বীকার করে তাদের চেয়ে আহমক আর কেউ হতে পারে না। অতপর পরবর্তী আয়াতসমূহে এ বিশ্বনন্দিত প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি লোকমান কর্তৃক সমকালীন | তরুণ সমাজকে লক্ষ্য করে উপদেশ প্রদান তথা ওসীয়তের ভাষায় বলা হচ্ছে, ‘যখন লোকমান তার সন্তানদেরকে (সমকালীন যুব সমাজকে সমবেত করে) বললেন, হে আমার সন্তান! আল্লাহর সাথে শিরকে লিপ্ত হয়াে না। নিশ্চয়ই শিরক হচ্ছে জঘন্যতম যুলুম। (আয়াত ১৩) এ ছিল সমাজের শীর্ষস্থানীয় এক জ্ঞানী পিতা কর্তৃক তার সন্তানদের (তথা সমকালীন যুব সমাজের প্রতি) প্রতি গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ বাণী । তিনি উপদেশ স্থলে তাদের প্রতি এ নসীহত প্রদান করেছেন। পিতা আসলে কখনও সন্তানের কল্যাণ ব্যতীত আর কিছুই কামনা করেন না। পিতা কখনও সন্তানকে নসীহত করা ছাড়া থাকতে পারে না। তাই প্রসিদ্ধ জ্ঞানী লােকমান সন্তানদেরকে শিরক থেকে বিরত থাকার নির্দেশ প্রদান করেছেন, আর এ বিরত থাকার কারণ উল্লেখ করে বলেছেন, শিরক হচ্ছে সবচেয়ে বড় ধরনের যুলুম। এর প্রতি অধিকতর গুরুত্ব প্রদান করে তিনি দু-দু’বার জোর দিয়ে বাক্যটি বলেছেন। প্রথম হচ্ছে ইন্না শব্দটি সুনিশ্চিত অর্থে প্রয়ােগ করা হয়েছে। আবার যুলুম শব্দের পূর্বে লাম শব্দটি অবশ্য অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যার অর্থ দাঁড়ায় ‘সুনিশ্চিতভাবে অবশ্যই শিরক হচ্ছে সবচেয়ে মারাত্মক অপরাধ।’ আয়াতটি তৎকালীন আরব সমাজের শিরক তথা এ জঘন্য অপরাধে লিপ্ত থাকার প্রতি ইংগিত করা হয়েছে। মােহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম ও তার সম্প্রদায়ের মধ্যে সংঘাত ও দ্বন্দের মূল বিষয়টিই ছিলাে তারা তাওহীদকে বর্জন করে এ জঘন্য পাপাচার তথা শিরকে লিপ্ত ছিলাে। অথচ কোরায়শসহ তৎকালীন আরব সম্প্রদায় রাসূলের বিরুদ্ধে এ অপবাদ ও অভিযােগ উত্থাপন করেছিলাে যে, তাদের শিরকমুক্ত খালেস তাওহীদের দাওয়াতের তিনি তাদের কর্তৃত্ব, প্রাধান্য ও শ্রেষ্ঠত্ব হতে অপসারিত করে নিজ কর্তৃত্ব প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা ও রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করতে চান। শিরক বর্জন করে রাসূল কর্তৃক উত্থাপিত তাওহীদের দাওয়াত কে গ্রহণ করলে তাদের কর্তৃত্ব, শ্রেষ্ঠত্ব, প্রাধান্য ও কায়েমী স্বার্থ ধূলিসাৎ হয়ে যাবে এ আশংকা তারা করছিলাে। তাই রাসূলের বিরুদ্ধে শিরক বর্জনের দাওয়াতের আড়ালে ক্ষমতা দখলের প্রয়াসের অভিযােগ তারা উত্থাপন করেছিলাে। এখানে স্বাভাবিকভাবে এ প্রশ্ন উত্থাপিত হয় যে, এ আয়াতের বক্তব্য অনুযায়ী সমকালীন যুব সমাজের কাছ থেকে ক্ষমতা দখল ও নিজ প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার অভিপ্রায় কি লােকমানের মনেও বিদ্যমান ছিলাে? সমাজে প্রভাব, প্রাধান্য ও কর্তৃত্ব তাতে তার প্রতিষ্ঠিত ছিলই। অথচ হযরত লোকমান তার সন্তানদেরকে উপদেশ প্রদানের মধ্যে কোন স্বার্থপর মানসিকতাই বিদ্যমান ছিলাে না। পিতা কর্তৃক সন্তানদের উপদেশ বাণীর মধ্যে কোনাে প্রকার স্বার্থপরতার সাথে দূরতম সম্পর্কও কল্পনা করা যায় না। বরং আয়াত থেকে এ মহাসত্য উদ্ভাসিত হচ্ছে যে, এ চিরন্তন কালজয়ী নীতিই আবহমানকাল থেকে চলে আসছে যে, সৃষ্টিকূলের মধ্যে যাদের আল্লাহ তায়ালা প্রকৃত হিকমত ও প্রজ্ঞার অধিকারী করেন তারা নিস্বার্থভাবে স্বীয় সন্তানদের কল্যাণ কামনাই করে থাকেন। তাদের উপদেশ ও নসীহতের আড়ালে মানব সমাজের কোনাে ক্ষতির চিন্তা লুকায়িত থাকে না। কোনাে খারাপ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার লক্ষ্যে তারা কাউকে নসীহত করেন না। এ মনস্তাত্তিক যুক্তিটিও আলােচ্য আয়াতে বিদ্যমান রয়েছে।
# মাতা পিতার সাথে সদ্ব্যবহারের নির্দেশ : প্রকৃতপক্ষে সন্তানের প্রতি মাতা-পিতার উপদেশমালার মধ্যে কোন প্রকার স্বার্থপরতা ও উদ্দেশ্য প্রণােদিত নয় বরং তার আড়ালে এক অবর্ণনীয় অকল্পনীয় আপাত্য স্নেহ-মমতা ও সন্তানের কল্যাণ কামনার মধুর সম্পর্কই লুকায়িত থাকে। আর এ সম্পর্ক হচ্ছে সন্তানের প্রতি পিতৃযস্নেহের এক জীবন্ত রূপ। তাই আল্লাহ তায়ালা বলছেন, ‘আমি মানবকূলের প্রতি তাদের পিতামাতার সৌজন্যমূলক আচরণের নির্দেশ প্রদান করেছি… আর আমি তােমাদের সকল কর্মতৎপরতা সম্পর্কে অবগত করাবাে'(আয়াত ১৪)। আল্লাহ তায়ালা সন্তানদেরকে মাতা পিতার প্রতি সৌজন্যমূলক আচরণ ও সদ্ব্যবহার সম্পর্কে গুরুত্ব সহকারে উপদেশ প্রদান করেছেন। বিশেষ করে মায়ের প্রতি সন্তানের খেদমতের ব্যাপারে অধিকতর গুরুত্বসহ উপদেশ দেয়া হয়েছে অথচ সন্তানের তার পিতার প্রতি কর্তব্য সম্পর্কে তেমন কিছু এখানে উল্লেখ করেননি। কেননা সন্তানের গর্ভ ধারণ, প্রসবকালীন ও শিশুর দুগ্ধপান করানাে ও লালন পালনের ক্ষেত্রে পিতার চেয়ে মা-ই বেশী কষ্ট ও যাতনা ভােগ করেন। বিশেষ করে উল্লেখিত বিশেষ অবস্থায় সন্তানের রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষেত্রে ও গর্ভে সন্তান ধারণের ক্ষেত্রে মা-ই অবর্ণনীয় দুঃখ কষ্ট সহ্য করেন। আল্লাহ তায়ালা প্রকৃতিগতভাবেই পিতার চেয়ে মায়ের প্রতি এ সুনির্দিষ্ট সময়ে সন্তান লালন-পালনের অধিকতর দায়িত্ব অর্পণ করেছেন। তাই প্রকৃতিগতভাবেই ভাবী বংশধরের লালন পালন ও তাদের সুন্দর জীবন গঠনের দায়িত্ব জীবনের প্রথম স্তরে মায়ের ওপরই অর্পিত হয়েছে। আল্লাহ সােবহানাহু তায়ালা মাতাপিতার হৃদয়ে সন্তানের প্রতি মায়া মমতার এক অনুপম চেতনা সৃষ্টি করে রেখেছেন। মা-বাপ তাদের সন্তানের জন্য তাদের দেহের প্রতিটি রক্তকণা, অংগ-প্রত্যংগ, জীবন ও অর্থ সম্পদ আল্লাহ প্রদত্ত এ মমতা ও স্নেহের কারণেই অকাতরে বিলিয়ে দিতে পারেন। সন্তানের প্রতি এসব ত্যাগের মধ্যে তাদের অন্তরে কোন মানসিক উদ্বিগ্নতা-দুশ্চিন্তা আফসােস থাকে না। বরং মাতা-পিতা প্রফুল্ল হৃদয়ে হাসি খুশী ও পরম আনন্দের সাথে সন্তানের জন্য সকল কিছু পরিত্যাগ করেন। নিজে কষ্টে ও দারিদ্র্যের মধ্যে জীবন যাপন করেও সন্তানকে তা বুঝতে দেন না। অনেক কষ্ট সহ্য করেও সন্তানের সকল দাবী, আবদার ও প্রয়ােজন পূরণ করেন। তাই মাতা-পিতার প্রতি এ ব্যাপারে উপদেশ প্রদানের প্রয়ােজনীয়তাকে এতাে গুরুত্বপূর্ণ করে দেখানাে হয়েছে। মা-বাপ যেন প্রকৃতিগতভাবেই এ বােঝা বহনের দায়িত্ব নিয়ে পৃথিবীতে আগমন করেছেন। স্বেচ্ছায় সানন্দে এ দায়িত্ব স্বীয় কাঁধে তারা তুলে নিয়েছেন। তাই প্রকৃতিগতভাবে সন্তানের প্রতি পিতামাতার সাথে আচরণের ক্ষেত্রে উপদেশসমূহের প্রয়ােজনীয়তা ও গুরুত্ব রয়েছে। সন্তানদের জন্যই উপদেশের প্রয়ােজন। মাতা-পিতাই ভাবী বংশধরদের চিন্তা, গবেষণা, পরিকল্পনা শ্রম সাধনা দুঃখ যাতনায় স্বেচ্ছা প্রণােদিত হয়ে সকল কিছু অকাতরে বিলিয়ে দেন। সন্তানের জীবন গঠনের পথে এমন কিছু নেই, যা তারা অকাতরে বিলিয়ে দিতে কার্পণ্য করেন। প্রিয় সন্তানের জীবনকে সুখী ও আনন্দময় করে তােলার জন্য ভাবী বংশধরদের ভবিষ্যৎ গড়ে তােলার জন্য তারা তাদের হৃদয় নিংড়ানাে সকল স্নেহমমতা উজাড় করে দেন। জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সময়, রক্ত ঝরা শ্রম দেহের শােনিত ধারাকে ঘামরূপে প্রবাহিত করে সন্তান লালন পালন ও শিক্ষিত করে তােলেন। মাতা পিতার বিরামহীন প্রানান্তকর শ্রমের পর ও এ নযীরবিহীন ত্যাগ ও কোরবানীর পর যখন তারা বার্ধক্যে উপনীত হন যখন তাদের অস্থি গ্রন্থী দুর্বল হয়ে তাদের কর্মশক্তি স্থবির হয়ে পড়ে তখন সন্তান জীবিত থাকলে মাতাপিতা তাদের ত্যাগ কোরবানীর বিনিময়ে সন্তানের কাছ থেকে সে দয়া অনুগ্রহ ফিরে পাওয়ার ন্যায্য অধিকার রাখেন। সন্তানের কাছ থেকে সদ্ব্যবহার ও সৌজন্যমূলক আচরণ প্রাপ্তি মাতা-পিতার প্রকৃতিগত পাওনা। এ পর্যায়ে আয়াতে উপদেশের মাধ্যমে মা-বাপের এ প্রকৃতগত পাওনা সন্তানের তরফ থেকে বিনিময় প্রাপ্তির হিসেবেও দেখানাে হয়েছে, ‘তার মা তাকে যাতনার পর যাতনা সহ্য করে গর্ভ ধারণ করেছে। অতপর মাতৃগর্ভ থেকে প্রসবের পর তার মধ্যে মায়ের দুধপান হতে বিচ্ছিন্ন হওয়ার মেয়াদ দু বছর।'(আয়াত ১৪) আয়াতে মায়ের এ মহান ত্যাগ ও কষ্টকে অত্যন্ত প্রাণস্পর্শী ভাষায় চিহ্নিত করা হয়েছে। মা-ই প্রকৃতপক্ষে গর্ভধারণ, প্রসবকালীন ও দুগ্ধ পানকালীন সময়ে শিশুর প্রতি বেশীরভাগ দায়িত্ব পালন করেন বরং বলা যেতে পারে, সম্পূর্ণ কষ্টকর দায়িত্ব স্বভাবিকভাবে মায়ের ওপরই ন্যস্ত থাকে। এ অসহনীয় বােঝা মা-ই বহন করে। মা-ই সন্তানের প্রতি অধিকতর মমতা, গভীর ও মধুময় আপাত্য স্নেহ উজাড় করে ঢেলে দেয়। তাই মার প্রতি সন্তানের খেদমতের ব্যাপারে আল কোরআন ও সুন্নাহ অধিকতর গুরুত্ব আরােপ করেছে। প্রশাসনিক ও আনুগত্যের ক্ষেত্রে পিতার প্রতি অবশ্য অধিকতর গুরুত্ব প্রদান করেছে। মায়ের হক আদায় ও খেদমতের গুরুত্ব সম্পর্কে আবু বকর বাযযার তার মাসনাদে বাযযার এ একটি হাদীস নিম্নোক্ত সনদে সংকলিত করেছেন, “আবু বকর বায়যার বুরাইদ থেকে, বুরাইদ তার পিতা থেকে রেওয়ায়েত করেছেন, এক ব্যক্তি কাবাঘরের তাওয়াফ করার সময়ে তার বৃদ্ধা মাতাকে কাঁধে বহন করে তাওয়াফ করছিলাে। এ অবস্থা দেখে নবী কারীম(স.) তাকে প্রশ্ন করলেন, তুমি কি তােমার মায়ের হক আদায় করতে পেরেছো? যে ব্যক্তি বললাে, ইয়া রাসূলাল্লাহ। আমি সে হক বিন্দুমাত্রও আদায় করতে পারিনি। এমনকি মায়ের যাতনাজড়িত একটি শ্বাসগ্রহণের ‘হক’ও আদায় করতে পারিনি। মা গর্ভধারণকালীন অথবা প্রসবকালীন সময়ে কষ্টের কারণে একটি শ্বাস প্রশ্বাস নিক্ষেপ ও গ্রহণ যে কষ্ট করেছেন সে পরিমাণ হকটুকুও আমি আদায় করতে পারিনি। (মােসনাদে রাযযার) তাই আয়াতে বলা হয়েছে, ‘মা তাকে যন্ত্রণার পর যন্ত্রণা সহ্য করে গর্ভ ধারণ করেছে।’ কোরআনে কারীমে উল্লেখিত আয়াতের প্রেক্ষিতে সন্তানের প্রতি সর্বপ্রথম করুণাময় আল্লাহ তায়ালার শ্রেষ্ঠতম অবদানের কৃতজ্ঞতা প্রকাশের সাথে মাতা-পিতার প্রতি কৃতজ্ঞতার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। এ দ্বারা ইসলামের মহান নীতিমালার দুটো ফরয আদায়ের দায়িত্ব সন্তানের প্রতি অর্পিত হয়েছে। প্রথম হচ্ছে আল্লাহর শােকর আদায়, অতপর মাতাপিতার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ। আল্লাহ তায়ালা বলছেন, ‘সর্ব প্রথম আমার অতপর তােমার মাতাপিতার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করাে।'(আয়াত ১৪) এতদসংগে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিকের সংযােজনকেও সম্পৃক্ত করা হয়েছে। আর তা হচ্ছে, ‘অতপর আমার কাছেই তােমাদের প্রত্যাবর্তনস্থল'(আয়াত ১৪)
#   *আল্লাহর হুকুমের বিরুদ্ধে কারােই আনুগত্য নেই : বস্তুত মাতা-পিতার সাথে সন্তানের সম্পর্ক সকল অবস্থায়ই স্নেহ মমতা ও শ্রদ্ধার সম্পর্ক। আর প্রকৃত পক্ষে শর্তহীন আনুগত্য আকীদার দিক থেকে আল্লাহ তায়ালা ও তদীয় রাসূলের সাথে সম্পৃক্ত। স্তর বিন্যাসের দিক থেকে আল্লাহ তায়ালার আনুগত্যের গুরুত্বই সকলের আগে। আল্লাহর আনুগত্যের বিপরীত হলে মাতা-পিতার প্রতি আনুগত্য এক্ষেত্রে লুপ্ত হয়ে যায়। অবশ্য মাতা-পিতার প্রতি দায়িত্ব ও শ্রদ্ধার সম্পর্ক সকল অবস্থায়ই বিদ্যমান থাকবে। তবে আল্লাহর আনুগত্যের বিপরীত হলে মাতা-পিতার আনুগত্যের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাবে। কোরআনে হাকীমে এরশাদ হচ্ছে, ‘মাতা-পিতা যদি তােমাকে আমার সাথে শিরকে লিপ্ত হওয়ার ক্ষেত্রে, যে ব্যাপারে সঠিকভাবে তুমি কোন কিছুই অবগত নও, প্রাণান্তকরভাবে প্রচেষ্টা চালায় তবে এক্ষেত্রে তাদের আনুগত্য করাে না।'(আয়াত ১৫) এ আয়াত দ্বারা পরিস্কারভাবে আল্লাহর আনুগত্যের খেলাফ হলে মাতা-পিতার আনুগত্যের ফরজ বিলুপ্ত ঘােষিত হয়। সব কিছুর উর্ধে শিরক বর্জিত তাওহীদের আকীদার প্রাধান্যই সর্বাধিক গুরুত্ব সহকারে প্রতিষ্ঠিত হয়। সন্তান প্রতিপালনের ক্ষেত্রে মাতা-পিতার স্নেহ মমতা, তাদের অবদান, তাদের শ্রম সাধনা কিছুতেই আল্লাহ তায়ালার উলুহিয়াতের চেয়ে বেশী প্রাধান্য পেতে পারে না। আল্লাহ তায়ালার তাওহীদের আকীদা সম্পর্কে অজ্ঞতাপ্রসূত কোন কারণে মাতা-পিতার স্নেহ মমতা ও অনুগ্রহের কারণে আল্লাহর সাথে শিরকে কখনাে লিপ্ত হওয়া যাবে না। আল্লাহ তায়ালার সার্বভৌমত্বের বিপরীত সকল কর্তৃত্বকেই বর্জন করতে হবে। এ আয়াতে আল্লাহ তায়ালার আনুগত্যের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বী ও বিপরীত সকল আনুগত্য বর্জন ও বিলুপ্তির নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তায়ালার আনুগত্যের অধিকারই সর্বপ্রথম ও সর্বাধিক প্রাধান্য পাবে। আয়াতের নির্দেশনার এ ব্যাপারটি গভীরভাবে প্রণিধানযােগ্য যে, আকীদার ক্ষেত্রে আল্লাহর আনুগত্যের সাথে সাংঘর্ষিক হওয়ার কারণে মাতা-পিতার আনুগত্য বর্জনের নির্দেশ সত্বেও ব্যবহারিক জীবনে তাদের প্রতি শ্রদ্ধা পােষণ, মার্জিত আচরণ ও সদ্ব্যবহার ও তাদের সামাজিক সম্পর্ক সংরক্ষণের ব্যাপারে তাদের অধিকার আদায়ের ফরয যথাযথ অব্যাহত থাকবে। আয়াতে বলা হয়েছে, (শিরকে লিপ্ত হওয়ার ক্ষেত্রে তাদের আনুগত্য বর্জনের নির্দেশনা সত্ত্বেও) ‘তােমরা পৃথিবীতে সামাজিক জীবন যাপনের সময় তাদের সাথে সহ অবস্থান ও সৌজন্যমূলক উত্তম আচরণের ভিত্তিতে বসবাস করবে।’ সামাজিক সহ অবস্থানের ভিত্তিতে জীবন যাপনের উত্তম আচরণভিত্তিক জীবন পরিচালনার গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। মার্জিত আচরণ মূলত শিরক বর্জিত তাওহীদভিত্তিক বিশ্বাস ও প্রত্যয়ের ক্ষেত্রে কোন ক্রিয়াশীল প্রভাব সৃষ্টি করে না। আয়াতের পরবর্তী অংশে তাই বলা হয়েছে, ‘আর তাদের পথ অনুসরণ করাে, যারা আমার অভিমুখে ধাবিত হয়।'(আয়াত ১৫) অর্থাৎ মােমেনদের পথে, যারা আমার প্রদর্শিত পথের অনুগামী, যাদের জীবনের চেতনা, প্রেরণা, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের উৎস আমি, যারা আমার সন্তুষ্টির লক্ষ্যেই আমার প্রতি ধাবিত হয় তাদের কথাই তােমরা মেনে চলে। ‘তোমাদের প্রত্যাবর্তনের স্থল আমার নিকট'(আয়াত ১৫) অর্থাৎ দুনিয়ার জীবনে স্বল্পকালীন অবস্থানের পর তােমরা অনন্ত জীবনে আমার নিকটেই ফিরে আসবে। ‘অতপর তােমরা দুনিয়ার স্বল্প পরিসর জীবনে যা কিছুই করেছো তার সকল কিছুই অনন্ত আখেরাতে আমি তােমাদেরকে অবগত করবাে।’ অর্থাৎ তােমাদের ভালােমন্দ সকল ক্রিয়াকান্ড তােমাদের কৃতজ্ঞতা ও অবাধ্যতার সকল পরিণাম ও পরিণতি শান্তি ও পুরস্কার, তাওহীদ ও শিরকের সকল আকীদা-আমল তথা সকল ব্যাপারে আমি তোমাদেরকে সম্যকভাবে অবগত করবেন। হাদীসে বর্ণিত আছে, সূরা লােকমানের এই আয়াত ও একই ধরনের সূরা আনকাবুত ও সূরা আহকাফের আয়াতসমুহের শানে নযুল হচ্ছে, হযরত সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস ও তার মা সম্পর্কিত ঘটনা, তিনি ঈমান গ্রহণের পর তার মা ঈমান বর্জন করার দাবীতে অনশন ব্রত পালন শুরু করে এবং বলে যে, তুমি পিতামাতার ধর্মে ফিরে না আসলে আমি অনাহারে মরে যাবাে। তার। মৃত্যুবরণের হুমকি প্রদানের পর এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। অপর রেওয়ায়েতে রয়েছে যে, এই আয়াত সা’দ ইবনে মালেক(রা.)-এর ঘটনা সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছে। তাবরানীর বর্ণনায় সা’দ ইবনে মালেক(রা.)-এর ঘটনার উল্লেখ রয়েছে। মুসলিম শরীফে হযরত সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস-এর ঘটনার কথা উল্লেখ রয়েছে। সনদ ও বর্ণনার দিক থেকে হযরত সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস(রা.) ও তার মা সম্পর্কিত ঘটনার প্রেক্ষিতে এ আয়াত নাযিল হয়েছে বলে মনে হয়। এটিই বেশী প্রামাণ্য ও গ্রহণযােগ্য। (এ সম্পর্কে আমি সূরায়ে আনকাবুত তাফসীরে আলােচনা করেছি) আলােচ্য আয়াতে আল্লাহর আনুগত্যের গুরুত্বকে প্রথমে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। আল্লাহর সাথে সম্পর্ক সুদৃঢ়করণ, আল্লাহর সাথে সুদৃঢ় বন্ধন, আল্লাহর হকের প্রতিরক্ষাকে প্রথম ফরয হিসাবে নির্ধারণ করা হয়েছে। কোরআনুল কারীমে পুন পুন আল্লাহর আনুগত্যের গুরুত্বের প্রতি তাকিদ করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালার সার্বভৌমত্ব, তাওহীদ কে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। আল্লাহর আনুগত্যের এর মূলনীতিকে সর্বাধিক ও সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। সন্দেহাতীতভাবে কোরআনে হাকীমের বিভিন্ন সূরায় এ চিরন্তন শাশ্বত মূলনীতির চেতনা বিশ্বাস, প্রত্যয় ও অনুভূতিকে উপস্থাপিত করা হয়েছে।
#   *জীবনের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কর্মেরও হিসাব দিতে হবে : আলোচ্য আয়াতে হযরত লােকমানের ওসীয়াতের মধ্যবর্তী স্তরে আল্লাহ সুবহানা তায়ালা তাওহীদ, শিরক ও আনুগত্য সম্পর্কিত শাশ্বত মূলনীতি উপস্থাপনের পর পরবর্তী আয়াতসমূহে পুনরায় হযরত লােকমানের ওসীয়াতের ধারাবাহিক বর্ণনা শুরু করেছেন। উপদেশমূলক ওসীয়াতের আয়াতে মানব জীবনের বিভিন্ন বিষয়ের বিবরণ, আখেরাতের ইনসাফপূর্ণ বিচার, জীবনের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কর্মের হিসাব, মানুষের এ জীবনে মৃত্তিকার তলদেশে, সমুদ্রে, মহাশূন্যে সর্বত্রকৃত কর্মকান্ডের সূক্ষ্মতিসূক্ষ্ম হিসাব ইত্যাদি অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী প্রাণস্পর্শী শব্দ দ্বারা অলংকৃত করা হয়েছে। অনুপম এই রচনাশৈলী মানব হৃদয় ও অনুভূতিতে বিস্ময়কর আলােড়ন সৃষ্টিকারী ভাব ও শব্দ সম্ভারে সজ্জিত করে পরিবেশন করেছে। জীবন্ত ও প্রাণবন্ত চেতনা সৃষ্টিকারী, আল্লাহ সােবাহানাহু তায়ালার জটিল ও সুক্ষ সংরক্ষণ পদ্ধতিকেও সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে। এ ওসিয়াতটি শুধু সাদামাটা এক উপদেশ আকারেই উপস্থাপিত হয়নি; বরং তাকে এক অসাধারণ ভাব গডীর সুকুমার ভাষাশৈলী, পান্ডিত্যপূর্ণ বক্তব্য অনুভূতিসহ পেশ করা হয়েছে। অনন্ত জগতে আল্লাহ তায়ালার ন্যায় ও ইনসাফভিত্তিক সুক্ষ বিচারের ও তার দৃশ্য জগতের জ্ঞানের বিবরণও তাতে সন্নিবেশিত রয়েছে। এরশাদ হচ্ছে, ‘হে আমার বৎস। কোন বস্তু যদি তা সরিষার বীজ কম হয় অতপর তা যদি প্রস্তর খন্ডের ভেতরেও থাকে…'(আয়াত ১৬) আয়াতে শুধু আল্লাহ তায়ালার সকল ব্যাপারে অবগতির জ্ঞান সম্পর্কেই উল্লেখিত হয়নি, বরং আল্লাহ তায়ালার জ্ঞানের গভীরতা, অসীমতা ও সুক্ষাতিসুক্ষভাবে সকল ব্যাপারে অবগতির ও গােপন রহস্য সম্পর্কে তার সম্যক জ্ঞানের বিষয়ও এতে শামিল রয়েছে। এতদসংগে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার অনন্ত কুদরত, বিচার দিবসে সুক্ষাতিসুক্ষ, অণু পরমাণু, সরিষা বীজ পরিমাণ কোন কিছুর ক্ষেত্রেও ন্যায় দন্ডের তাৎপর্য ও বিশ্লেষণের দৃশ্য এতে সন্নিবেশিত রয়েছে। এ হচ্ছে অলৌকিক গ্রন্থ আল কোরআনে কোনাে বিষয়কে অনুপম বর্ণনাভংগী ও রচনাশৈলীতে উপস্থাপনের এক নিজস্ব প্রক্রিয়া পদ্ধতি। এ অপরূপ সৌন্দর্যময় রচনা ও উপস্থাপন পদ্ধতি প্রকৃত পক্ষে আল কোরআনের একক বৈশিষ্ট।(তরীকাতুল কোরআন পরিচ্ছদে আতাছওয়রীরুল ফান্নী ফিল কোরআন অধ্যায় দ্রষ্টব্য) ‘সরিষার বীজ বা দানা পরিমাণ।’ অংশদ্বাৱা এমন এক ক্ষুদ্র বস্তু বুঝানাে হয়েছে, যার তেমন কোন ওযন, মূল্য বা গুরুত্ব নেই; অথচ তাও সেখানে উপস্থিত করা হবে। তা যদি প্রস্তরখন্ডের অভ্যন্তরেও থাকে। অর্থাৎ বাহ্য দৃষ্টিতে যা পরিদৃষ্ট হয় না, যা প্রকাশ্যে দৃশ্যমান নয়, যাকে খুঁজে পাওয়া যায় না, যা ধরা ছােয়ার বাইরে, অথচ সে কর্মটুকুরও হিসাব গ্রহণ করা হবে, এমন ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ব্যাপারেও আল্লাহর আদালতে মানুষদের জবাবদিহি করতে হবে। ‘অথবা থাকে যদি আসমানের কোথাও’ অর্থাৎ আকাশপুঞ্জে, দূরদূরান্তে মহাশূন্যে যার অবস্থান। যে জগতে বিশাল গ্রহ, উপগ্রহ, নক্ষত্ররাজী নিজ নিজ কক্ষপথে আবর্তিত হচ্ছে। এমন জগতের একটি পরমাণু ও বিন্দু পরিমাণ একটি অবহেলিত ছােট্ট অপরাধও গুরুত্ব সহকারে মহান আদালতে সেদিন বিচারের জন্য উপস্থিত করা হবে। ‘কিংবা থাকে যদি যমীনের কোথাও খুবই সামান্য যা ধূলিকণা বা পাথর কুচির সাথে মিশ্রিত বা আচ্ছাদিত হয়ে আছে, যা প্রকাশ্যে দৃষ্টিগোচর হয় না তাও সেখানে উপস্থিত করা হবে। তাকেও আল্লাহ তায়ালা এনে হাযির করবেন এমন ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণা পরিমাণ বিষয়ের জ্ঞানও আল্লাহর এলেমের বাইরে থাকবে না। তা বাদ পড়বে না। তাও আল্লাহ তায়ালার অসীম জ্ঞান ও অনন্ত কুদরাতের আয়াত্তাধীন থাকবে। এ ছােট্ট বাক্যটির অন্তরালে আল্লাহ সােবহানাহু তায়ালার ক্ষুদ্র সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ব্যাপারে অবগতির দিককে তুলে ধরা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা যে সব কিছুই উপস্থিত করবেন তার ঘােষণাও রয়েছে। মহাশূন্যে, প্রস্তর খন্ডের অভ্যন্তরে, যমীনের বালুকারাজি পাথর কুচির সংমিশ্রণে যেখানে বিন্দু পরিমাণ কোন তৎপরতা ও ক্রিয়াকান্ড বিদ্যমান রয়েছে, তার সকল কিছুকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে ন্যায়দন্ড ও বিচারমঞ্চে সেদিন উপস্থিত করা হবে। কোন সুক্ষাতিসুক্ষ ব্যাপারও সুক্ষদর্শী, শক্তিমান সত্ত্বা আল্লাহর জ্ঞান ও অবগতির বাইরে থাকবে না, আল্লাহ তায়ালার জ্ঞানের পরিধি, অনন্ত অসীম। অদৃশ্য জগতের কণা পরিমাণ বস্তুও তার জ্ঞান ও অবগতির বাইরে নয়। তিনি সকল কিছুকেই স্ব-স্ব অবস্থান থেকে বিচার দিবসে সংশ্লিষ্ট জায়গায় এনে হাযির করবেন। আল কোরআনের এই বর্ণনা ভংগীও এ উপস্থাপনা মানবচিত্তে আল্লাহর কাছে জবাবদিহিতার প্রত্যয় ও ভীতি সৃষ্টি করে। মানুষের মনে আল্লাহর কাছে প্রত্যাবর্তন, আল্লাহর কাছে রুজু হওয়া, আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য লাভের অনুপ্রেরণা মানব হৃদয় উদ্বেলিত ও অনুপ্রাণিত করে। সে সুক্ষাতিসূক্ষ দ্রষ্টা গােপন রাজ্যের সব কিছু সম্পর্কেই অবগত রয়েছেন তাঁর কাছে কোন কিছুই গায়ব নয়, অনুপস্থিত নয়, অদৃশ্যমান নয়; বরং সব কিছুই তার কাছে দৃশ্যমান ও গােচরীভূত। আল কোরআন অভিনব বিস্ময়কর পদ্ধতিতে এ মহাসত্যকে মানব হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছে, এ সত্যকে স্বীকৃতি প্রদান করে তাকে সুদৃঢ় বিশ্বাস ও প্রত্যয় রূপে গ্রহণের শিক্ষাও আলােচ্য এই আয়াতে আমাদের দেয়া হয়েছে।

তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
# ওপরের প্রস্তাবনা ও প্রারম্ভিক বাক্যগুলোর পর এখন আসল বক্তব্য অর্থাৎ শিরক খণ্ডন করে তাওহীদের দাওয়াত দেবার জন্য বক্তব্য পেশ করা হচ্ছে।
# মূল শব্দ হচ্ছে, بِغَيْرِ عَمَدٍ تَرَوْنَهَا এর দু’টি মানে হতে পারে। একটি হচ্ছে, “তোমরা নিজেরাই দেখছো, স্তম্ভ ছাড়াই তা প্রতিষ্ঠিত রয়েছে।” দ্বিতীয় অর্থ হতে পারে “এমন সব স্তম্ভের ওপর সেগুলো প্রতিষ্ঠিত যা চোখে দেখা যায় না” ইবনে আব্বাস (রা.) ও মুজাহিদ এর দ্বিতীয় অর্থটি গ্রহণ করেছেন। আবার মুফাসসিরগণের অন্য একটি দল এর প্রথম অর্থটি নেন। বর্তমান যুগের পদার্থ বিদ্যার দৃষ্টিতে যদি এর অর্থ বর্ণনা করা হয় তাহলে বলা যেতে পারে, সমগ্র আকাশ জগতে ও সীমা-সংখ্যাহীন বিশাল গ্রহ-নক্ষত্রপুঞ্জকে যার যার গতিপথে অদৃশ্য স্তম্ভের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। কোন তারের সাহায্যে তাদের পরস্পরকে সংযুক্ত করে রাখা হয়নি। কোন পেরেকের সাহায্যে তাদের একটির অন্যটির ওপর উল্টে পড়ে যাওয়াকে ঠেকিয়ে রাখা হয়নি। একমাত্র মাধ্যাকর্ষণ শক্তিই এ ব্যবস্থাকে সচল রেখেছে। আমাদের আজকের জ্ঞানের ভিত্তিতে এটিই আমাদের ব্যাখ্যা। হতে পারে আগামীকাল আমাদের জ্ঞান আরো কিছু বেড়ে যেতে পারে। তখন এর আরো কোন বেশি মানানসই ব্যাখ্যা করা যেতে পারে।
# যেসব সত্ত্বাকে তোমরা নিজেদের উপাস্য করে নিয়েছো, যাদেরকে তোমরা নিজেদের ভাগ্যবিধাতা করে নিয়েছো এবং যাদের বন্দেগী ও পূজা করার জন্য তোমরা এত হন্যে হয়ে লেগেছো।
# যখন এরা এ বিশ্ব-জাহানে আল্লাহ‌ ছাড়া আর কারো কোন সৃষ্টি চিহ্নিত করতে পারেনি এবং একথা সুস্পষ্ট যে, তারা তা করতে পারে না তখন তাদের যারা স্রষ্টা নয় এমন সত্ত্বাকে আল্লাহর একচ্ছত্র ও সার্বভৌম কর্তৃত্বে শরীক করা, তাদের সামনে আনুগত্যের শির নত করা এবং তাদের কাছে প্রার্থনা করা ও অভাব মোচন করার জন্য আবেদন জানানোকে সুস্পষ্ট নির্বুদ্ধিতা ছাড়া আর কী বলা যেতে পারে। যতক্ষণকোন ব্যক্তি একেবারেই উন্মাদ হয়ে না যায় ততক্ষণ সে এত বড় নির্বুদ্ধিতা করতে পারে না যে, সে কারো সামনে নিজেই নিজের উপাস্যদেরকে সৃষ্টিকর্মে অক্ষম বলে এবং একমাত্র আল্লাহকে স্রষ্টা বলে স্বীকার করে নেবার পরও তাদেরকে উপাস্য বলে মেনে নেবার জন্য জিদ ধরবে। যার ঘটে একটুখানিও বুদ্ধি আছে সে কখনো চিন্তা করবে না, কোন জিনিস সৃষ্টি করার ক্ষমতাই যার নেই এবং পৃথিবী ও আকাশের কোন জিনিসের সৃষ্টিতে যার নামমাত্র অংশও নেই সে কেন আমাদের উপাস্য হবে? কেন আমরা তার সামনে সিজদাবনত হবো? অথবা তার পদচুম্বন করবো এবং তার আস্তানায় গিয়ে ষষ্ঠাংগ প্রণিপাত করবো? আমাদের ফরিয়াদ শোনার এবং আমাদের অভাব পূরণ করার কী ক্ষমতা তার আছে? তর্কের খাতিরে মেনে নিলাম, সে আমাদের প্রার্থনা শুনছে কিন্তু তার জবাবে সে নিজে কি পদক্ষেপ নিতে পারে, যখন তার নিজের কিছু করার ক্ষমতা নেই? যে কিছু করতে পারে সে-ই তো কিছু ভেঙ্গে যাওয়া জিনিস গড়তে পারে কিন্তু যার আদতে করারই কোন ক্ষমতা নেই সে আবার কেমন করে ভেঙ্গে যাওয়া জিনিস গড়তে পারবে।
# একটি শক্তিশালী বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তির মাধ্যমে শিরকের অসারতা প্রমাণ করার পর এখন আরবের লোকদেরকে একথা জানানো হচ্ছে যে, এ যুক্তিসঙ্গত কথা প্রথমবার তোমাদের সামনে তোলা হচ্ছে না বরং পূর্বেও বুদ্ধিমান ও জ্ঞানীরা একথাই বলে এসেছেন এবং তোমাদের নিজেদের বিখ্যাত জ্ঞানী লুকমান আজ থেকে বহুকাল আগে একথাই বলে গেছেন। তাই শিরক যদি কোন অযৌক্তিক বিশ্বাস হয়ে থাকে তাহলে ইতিপূর্বে কেউ একথা বলেনি কেন, মুহাম্মাদ ﷺ এর দাওয়াতের জবাবে তোমরা একথা বলতে পারো না।

একজন বুদ্ধিমান ও জ্ঞানী হিসেবে আরবে লুকমান বহুল পরিচিত ব্যক্তিত্ব। জাহিলী যুগের কবিরা যেমন ইমরাউল কায়েস, লবীদ, আ’শা, তারাফাহ প্রমুখ তাদের কবিতায় তার কথা বলা হয়েছে। আরবের কোন কোন লেখাপড়া জানা লোকের কাছে “সহীফা লুকমান” নামে তার জ্ঞানগর্ভ উক্তির একটি সংকলন পাওয়া যেতো। হাদীসে উদ্ধৃত হয়েছে, হিজরাতের তিন বছর পূর্বে মদীনার সর্বপ্রথম যে ব্যক্তি নবী (সা.) এর দাওয়াতের প্রভাবিত হন তিনি ছিলেন সুওয়াইদ ইবনে সামেত। তিনি হজ্ব সম্পাদন করার জন্য মক্কায় যান। সেখানে নবী করীম ﷺ নিজের নিয়ম মতো বিভিন্ন এলাকা থেকে আগত হাজীদের আবাসস্থলে গিয়ে ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যেককে ইসলামের দাওয়াত দিতে থাকেন। এ প্রসঙ্গে সুওয়াইদ যখন নবী (সা.) এর বক্তৃতা শুনেন, তাকে বলেন, আপনি যে ধরনের কথা বলেছেন তেমনি ধরনের একটি জিনিস আমার কাছেও আছে। তিনি জিজ্ঞেস করেন, সেটা কি? জবাব দেন সেটা লুকমানের পুস্তিকা। তারপর নবী করীমের ﷺ অনুরোধে তিনি তার কিছু অংশ পাঠ করে তাকে শুনান। তিনি বলেন, এটা বড়ই চমৎকার কথা। তবে আমার কাছে এর চেয়েও বেশি চমৎকার কথা আছে। এরপর কুরআন শুনান। কুরআন শুনে সুওয়াইদ অবশ্যই স্বীকার করেন, নিঃসন্দেহে এটা লুকমানের পুস্তিকার চেয়ে ভালো। ( সীরাতে ইবনে হিশাম , ২ খণ্ড, ৬৭-৬৯ পৃ; উসুদুল গাবাহ, ২ খণ্ড, ৩৭৮ পৃষ্ঠা) ঐতিহাসিকগণ বলেন, এই সুওয়াইদ ইবনে সামেত তার যোগ্যতা, বীরত্ব, সাহিত্য ও কাব্য মনীষা এবং বংশ মর্যাদার কারণে মদীনায় “কামেল” নামে পরিচিত ছিলেন। কিন্তু নবী (সা.) এর সাথে সাক্ষাতের পর যখন তিনি মদীনায় ফিরে যান তার কিছুদিন পর বুয়াসের যুদ্ধ শুরু হয়ে যায় এবং তাতে তিনি মারা যান। তার গোত্রের লোকদের সাধারণভাবে এ ধারণা ছিল যে, নবী (সা.) এর সাক্ষাতের পর তিনি মুসলমান হয়ে যান।

ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে লুকমানের ব্যক্তিত্বের ব্যাপারে ব্যাপক মতবিরোধ দেখা যায়। জাহেলিয়াতের অন্ধকার যুগে কোন লিখিত ইতিহাসের অস্তিত্ব ছিল না। শত শত বছর থেকে মুখে মুখে শ্রুত যেসব তথ্য স্মৃতির ভাণ্ডারে লোককাহিনী-গল্প-গাঁথার আকারে সংগৃহীত হয়ে আসছিল সেগুলোর ওপর ছিল এর ভিত্তি। এসব বর্ণনার প্রেক্ষিতে কেউ কেউ হযরত লুকমানকে আদ জাতির অন্তর্ভুক্ত ইয়ামনের বাদশাহ মনে করতো। মাওলানা সাইয়েদ সুলাইমান নদবী এসব বর্ণনার ওপর নির্ভর করে তার “আরদুল কুরআন” গ্রন্থে এ মত প্রকাশ করেছেন যে, আদ জাতির ওপর আল্লাহর আযাব নাযিল হবার পর হযরত হূদের (আ) সাথে তাদের যে ঈমানদার অংশটি বেঁচে গিয়েছিল লুকমান ছিলেন তাদেরই বংশোদ্ভূত। ইয়ামনে এ জাতির যে শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তিনি ছিলেন তার অন্যতম শাসক ও বাদশাহ। কিন্তু কতিপয় প্রবীণ সাহাবী ও তাবেঈদের মাধ্যমে প্রাপ্ত অন্য বর্ণনাগুলো এর সম্পূর্ণ বিপরীত। ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, লুকমান ছিলেন একজন হাবশী গোলাম। হযরত আবু হুরাইরা (রা.), মুজাহিদ, ইকরিমাহও খালেদুর রাব’ঈও একথাই বলেন। হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ আনসারী (রা.) বলেন, তিনি ছিলেন নূবার অধিবাসী। সাঈদ ইবনে মুসাইয়েবের উক্তি হচ্ছে, তিনি মিসরের কালো লোকদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। এ তিনটি বক্তব্য প্রায় কাছাকাছি অবস্থান করছে। কারণ আরবের লোকেরা কালো বর্ণের মানুষদেরকে সেকালে প্রায়ই হাবশী বলতো। আর নূবা হচ্ছে মিসরের দক্ষিণে এবং সুদানের উত্তরে অবস্থিত একটি এলাকা। তাই তিনটি উক্তিতে একই ব্যক্তিকে নূবী, মিসরীয় ও হাবশী বলা কেবলমাত্র শাব্দিক বিরোধ ছাড়া আর কিছুই নয়। অর্থের দিক দিয়ে এখানে কোন বিরোধ নেই। তারপর রওদাতুল আনাফে সুহাইলির ও মরূজুয যাহাবে মাস’উদীর বর্ণনা থেকে এ সূদানী গোলামের কথা আরবে কেমন করে ছড়িয়ে পড়লো এ প্রশ্নের ওপরও আলোকপাত হয়। এ উভয় বর্ণনায় বলা হয়েছে, এ ব্যক্তি আসলে ছিলেন নূবী। কিন্তু তিনি বাসিন্দা ছিলেন মাদযান ও আইল (বর্তমান আকাবাহ) এলাকার। এ কারণে তার ভাষা ছিল আরবী এবং তার জ্ঞানের কথা আরবে ছড়িয়ে পড়ে। তা ছাড়া সুহাইলী আরো বিস্তারিত ভাবে বলেছেন যে, লুকমান হাকীম ও লুকমান ইবনে আদ দু’জন আলাদা ব্যক্তি। তাদেরকে এক ব্যক্তি মনে করা ঠিক নয়। (রওদুল আনাফ, ১ম খণ্ড, ২৬৬ পৃষ্ঠা এবং মাসউদী, ১ম খণ্ড, ৫৭ পৃষ্ঠা।) এখানে একথাটিও সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করে দেয়া প্রয়োজন যে, প্রাচ্যবিদ ডিরেনবুর্গ ( derenbourg) প্যারিস লাইব্রেরীর যে আরবী পাণ্ডুলিপিটি “লুকমান হাকীমের গাঁথা” ( Fables de Loqman Le Sage ) নামে প্রকাশ করেছেন সেটি আসলে বানোয়াট। “লুকমানের সহীফা”র সাথে তার দূরতম কোন সম্পর্কও নেই। ত্রয়োদশ ঈসায়ী শতকে এ গাঁথাগুলো কেউ সংকলন করেছিলেন। তার আরবী সংস্করণ বড়ই ত্রুটিপূর্ণ। সেগুলো পড়লে পরিষ্কার অনুভব করা যাবে যে, আসলে অন্য কোন ভাষা থেকে অনুবাদ করে গ্রন্থকার নিজের পক্ষ থেকে সেগুলোর সম্পর্ক লুকমান হাকীমের সাথে জুড়ে দিয়েছেন। প্রাচ্যবিদরা এ ধরনের জাল ও বানোয়াট জিনিসগুলো বের করে যে উদ্দেশ্যে সামনে আনেন তা এছাড়া আর কিছুই নয় যে, কুরআন বর্ণিত কাহিনীগুলোকে যে কোনভাবেই অনৈতিহাসিক কাহিনী প্রমাণ করে অনির্ভরযোগ্য গণ্য করা। যে ব্যক্তিই ইনসাইক্লোপিডিয়া অব ইসলামে “লুকমান” শিরোনামে ( B.Heller ) হেলারের নিবন্ধটি (পৃষ্ঠা: 811-813) পড়বেন তার কাছেই তাদের মনোভাব অস্পষ্ট থাকবে না।
# আল্লাহ‌ প্রদত্ত এ জ্ঞান ও অন্তরদৃষ্টির প্রাথমিক চাহিদা এই ছিল যে, মানুষ তার রবের মোকাবিলায় কৃতজ্ঞও অনুগৃহিত হবার নীতি অবলম্বন করবে, অনুগ্রহ অস্বীকার করার ও বিশ্বাসঘাতকতার নীতি অবলম্বন করবে না। আর তার কৃতজ্ঞতা নিছকে মৌখিক হিসেব-নিকেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না বরং
# যে ব্যক্তি কুফরী করে তার কুফরী তার নিজের জন্য ক্ষতিকর। এতে আল্লাহর কোন ক্ষতি হয় না। তিনি অমুখাপেক্ষী। কারো কৃতজ্ঞতার মুখাপেক্ষী নন। কারো কৃতজ্ঞতা তার সার্বভৌম কর্তৃত্বে কোন বৃদ্ধি ঘটায় না। বান্দার যাবতীয় নিয়ামত যে একমাত্র তাঁরই দান কারো অকৃতজ্ঞতা ও কুফরী এ জাজ্জ্বল্যমান সত্যে কোন পরিবর্তন ঘটাতে পারে না। কেউ তার প্রশংসা করুক বা নাই করুক তিনি আপনা আপনিই প্রশংসিত। বিশ্ব-জাহানের প্রতিটি অণু-কণিকা তার পূর্ণতা ও সৌন্দর্য এবং তার স্রষ্টা ও অন্নদাতা হবার সাক্ষ্য দিচ্ছে এবং প্রত্যেকটি সৃষ্ট বস্তু নিজের সমগ্র সত্তা দিয়ে তার প্রশংসা গেয়ে চলছে।
# লুকমানের পাণ্ডিত্যপূর্ণ উপদেশমালা থেকে এ বিশেষ উপদেশ বাণীটিকে এখানে উদ্ধৃত করা হয়েছে দু’টি বিশেষ সম্পর্কের ভিত্তিতে। এক, তিনি নিজ পুত্রকে এ উপদেশটি দেন। আর একথা সুস্পষ্ট, মানুষ যদি দুনিয়ায় সবচেয়ে বেশি কারো ব্যাপারে আন্তরিক হতে পারে তাহলে সে হচ্ছে তার নিজের সন্তান। এক ব্যক্তি অন্যকে ধোঁকা দিতে পারে, তার সাথে মুনাফিকী আচরণ করতে পারে কিন্তু সবচেয়ে নিকৃষ্ট প্রকৃতির লোকটিও নিজ পুত্রকে এ নসীহত করা অকাট্যভাবে প্রমাণ করে যে, তার মতে শিরক যথার্থই একটি নিকৃষ্ট কাজ এবং এ জন্যই তিনি সর্বপ্রথম নিজের প্রাণাধিক পুত্র কে এ গোমরাহীটি থেকে দূরে থাকার উপদেশ দেন। দুই, মক্কার কাফেরদের অনেক পিতা-মাতা সে সময় নিজের সন্তানদেরকে শিরকী ধর্মের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকার এবং মুহাম্মাদ ﷺ এর তাওহীদের দাওয়াত থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবার জন্য বাধ্য করছিল। সামনের দিকের একথা বর্ণনা করা হয়েছে। তাই সেই অজ্ঞদেরকে শুনানো হচ্ছে, তোমাদের দেশেরই বহুল পরিচিতি জ্ঞানী পণ্ডিত তো তার নিজের পুত্রের মঙ্গল করার দায়িত্বটা তাকে শিরক থেকে দূরে থাকার নসিহত করার মাধ্যমেই পালন করেন। এখন তোমরা যে তোমাদের সন্তানদেরকে শিরক করতে বাধ্য করছো, এটা কি তাদের প্রতি শুভেচ্ছা না তাদের অমঙ্গল কামনা?
# জুলুমের প্রকৃত অর্থ হচ্ছে, কারো অধিকার হরণ করা এবং ইনসাফ বিরোধী কাজ করা। শিরক এ জন্য বৃহত্তর জুলুম যে, মানুষ এমন সব সত্তাকে তার নিজের স্রষ্টা, রিযিকদাতা ও নিয়ামতদানকারী হিসেবে বরণ করে নেয়, তার সৃষ্টিতে যাদের কোন অংশ নেই তাকে রিযিক দান করার ক্ষেত্রে যাদের কোন দখল নেই এবং মানুষ এ দুনিয়ায় যেসব নিয়ামত লাভে ধন্য হচ্ছে সেগুলো প্রদান করার ব্যাপারে যাদের কোন ভূমিকাই নেই। এটা এত অন্যায়, যার চেয়ে বড় কোন অন্যায়ের কথা চিন্তাই করা যায় না। তারপর মানুষ একমাত্র তার স্রষ্টারই বন্দেগী ও পূজা-অর্জনা করে তার অধিকার হরণ করে। তারপর স্রষ্টা ছাড়া অন্য সত্তার বন্দেগী ও পূজা করতে গিয়ে মানুষ যে কাজই করে তাতে সে নিজের দেহ ও মন থেকে শুরু করে পৃথিবী ও আকাশের বহু জিনিস ব্যবহার করে। অথচ এ সমস্ত জিনিস এক লা-শরীক আল্লাহই সৃষ্টি করেছেন এবং এর মধ্যে কোন জিনিসকে আল্লাহ‌ ছাড়া অন্য কারো বন্দেগীতে ব্যবহার করার অধিকার তার নেই। তারপর মানুষ নিজেকে লাঞ্ছনা ও দুর্ভোগের মধ্যে ঠেলে দেবে না, তার নিজের ওপর এ অধিকার রয়েছে। কিন্তু সে স্রষ্টাকে বাদ দিয়ে সৃষ্টির বন্দেগী করে নিজেকে লাঞ্ছিত ও অপমানিতও করে এবং এই সঙ্গে শাস্তির যোগ্যও বানায়। এভাবে একজন মুশরিকের সমগ্র জীবন একটি সর্বমুখী ও সার্বক্ষণিক জুলুমে পরিণত হয়। তার কোন একটি মুহূর্তও জুলুমমুক্ত নয়।
# এখান থেকে প্যারার শেষ পর্যন্ত অর্থাৎ ১৪ ও ১৫ আয়াত দু’টি প্রসঙ্গক্রমে বলা হয়েছে। আল্লাহ‌ নিজের পক্ষ থেকে লুকমানের উক্তির অতিরিক্ত ব্যাখ্যা হিসেবে একথা বলেছেন।
# এ শব্দগুলো থেকে ইমাম শাফে’ঈ (র), ইমাম আহমাদ (র), ইমাম আবু ইউসুফ (র) ও ইমাম মুহাম্মাদ (র) এ অর্থ গ্রহণ করেছেন যে, শিশুর দুধ পান করার মেয়াদ ২ বছরে পূর্ণ হয়ে যায়। এ মেয়াদকালে কোন শিশু যদি কোন স্ত্রীলোকের দুধপান করে তাহলে দুধ পান করার “হুরমাত” (অর্থাৎ দুধপান করার কারণে স্ত্রীলোকটি তার মায়ের মর্যাদায় উন্নীত হয়ে যাওয়া এবং তার জন্য তার সাথে বিবাহ হারাম হয়ে যাওয়া) প্রমাণিত হয়ে যাবে। অন্যথায় পরবর্তীকালে কোনো প্রকার দুধ পান করার ফলে কোন “হুরমাত” প্রতিষ্ঠিত হবে না। এ উক্তির স্বপক্ষে ইমাম মালেকেরও একটি বর্ণনা রয়েছে। কিন্তু ইমাম আবু হানীফা (র) অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করার উদ্দেশ্যে এ মেয়াদকে বাড়িয়ে আড়াই বছর করার অভিমত ব্যক্ত করেন। এই সঙ্গে ইমাম সাহেব একথাও বলেন, যদি দু’বছর বা এর চেয়ে কম সময়ে শিশুর দুধ ছাড়িয়ে দেয়া হয় এবং খাদ্যের ব্যাপারে শিশু কেবল দুধের ওপর নির্ভরশীল না থাকে, তাহলে এরপর কোন স্ত্রীলোকের দুধ পান করার ফলে কোন দুধপান জনিত হুরমাত প্রমাণিত হবে না। তবে যদি শিশুর আসল খাদ্য দুধই হয়ে থাকে তাহলে অন্যান্য খাদ্য কম বেশি কিছু খেয়ে নিলেও এ সময়ের মধ্যে দুধ পানের কারণে হুরমাত প্রমাণিত হয়ে যাবে। কারণ শিশুকে অপরিহার্যভাবে দু’বছরেই দুধপান করাতে হবে, আয়াতের উদ্দেশ্য এটা নয়। সূরা বাকারায় বলা হয়েছে,

وَالْوَالِدَاتُ يُرْضِعْنَ أَوْلَادَهُنَّ حَوْلَيْنِ كَامِلَيْنِ لِمَنْ أَرَادَ أَنْ يُتِمَّ الرَّضَاعَةَ

“মায়েরা শিশুদেরকে পুরো দু’বছর দুধ পান করাবে, তার জন্য যে দুধপান করার মেয়াদ পূর্ণ করতে চায়।” ( ২৩৩ আয়াত )

ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন এবং উলামায়ে কেরাম এ ব্যাপারে তার সাথে একমত হয়েছেন যে, গর্ভধারণের সর্বনিম্ন মেয়াদ ছ’মাস। কারণ কুরআনের অন্য এক জায়গায় বলা হয়েছে, وَحَمْلُهُ وَفِصَالُهُ ثَلَاثُونَ شَهْرًا

“তার পেটের মধ্যে অবস্থান করা ও দুধ ছেড়ে দেয়ার কাজ হয় ৩০ মাসে। ( আল আহকাফ আয়াত ১৫ )

এটি একটি সূক্ষ্ম আইনগত বিধান এবং এর ফলে বৈধ ও অবৈধ গর্ভের অনেক বিতর্কের অবসান ঘটে।
# তোমার জানা মতে যে আমার সাথে শরীক নয়।
# সন্তান ও পিতা-মাতা সবাইকে।
# লুকমানের অন্যান্য উপদেশমালার উল্লেখ এখানে একথা বলার জন্য করা হচ্ছে যে, আকীদা-বিশ্বাসের মতো নৈতিকতার যে শিক্ষা নবী (সা.) পেশ করেছেন তাও আরবে নতুন ও অজানা কথা নয়।
# আল্লাহর জ্ঞান ও তার পাকড়াও এর বাইরে কেউ যেতে পারে না। পাথরের মধ্যে ছোট্ট একটি কণা দৃষ্টির অগোচরে থাকতে পারে কিন্তু তার কাছে তা সুস্পষ্ট। আকাশ মণ্ডলে একটি ক্ষুদ্রতম কণিকা তোমার থেকে বহু দূরবর্তী হতে পারে কিন্তু তা আল্লাহর বহু নিকটতর। ভূমির বহু নিম্ন স্তরে পতিত কোন জিনিস তোমার কাছে গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত। কিন্তু তার কাছে তা রয়েছে উজ্জ্বল আলোর মধ্যে। কাজেই তুমি কোথাও কোন অবস্থায়ও এমন কোন সৎ বা অসৎ কাজ করতে পারো না যা আল্লাহর অগোচরে থেকে যায়। তিনি কেবল তা জানেন তাই নয় বরং যখন হিসেব-নিকেশের সময় আসবে তখন তিনি তোমাদের প্রত্যেকটি কাজের ও নড়াচড়ার রেকর্ড সামনে নিয়ে আসবেন।
# এর মধ্যে এদিকে একটি সূক্ষ্ম ইঙ্গিত রয়েছে যে, সৎকাজের হুকুম দেয়া এবং অসৎকাজে নিষেধ করার দায়িত্ব যে ব্যক্তিই পালন করবে তাকে অনিবার্যভাবে বিপদ আপদের মুখোমুখি হতে হবে। এ ধরনের লোকের পেছনে দুনিয়া কোমর বেঁধে লেগে যাবে এবং সব ধরনের কষ্টের সম্মুখীন তাকে হতেই হবে।
# এর দ্বিতীয় অর্থ হতে পারে, এটি বড়ই হিম্মতের কাজ। মানবতার সংশোধন এবং তার সংকট উত্তরণে সাহায্য করার কাজ কম হিম্মতের অধিকারী লোকদের পক্ষে সম্ভব নয়। এসব কাজ করার জন্য শক্ত বুকের পাটা দরকার।
# মূল শব্দগুলো হচ্ছে, لَا تُصَعِّرْ خَدَّكَ لِلنَّاسِ “সা’আর” বলা হয় আরবী ভাষায় একটি রোগকে। এ রোগটি হয় উটের ঘাড়ে। এ রোগের কারণে উট তার ঘাড় সবসময় একদিকে ফিরিয়ে রাখে। এ থেকেই فلان صعرخده “অমুক ব্যক্তি উটের মতো তার মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।” অর্থাৎ অহংকারপূর্ণ ব্যবহার করলো এবং মুখ ফিরিয়ে কথা বললো। এ ব্যাপারেই তাগলাব গোত্রের কবি আমর ইবনে হাই বলেনঃ وكنا اذا الجبار صعر خده اقمنا له من ميله فتقوما- “আমরা এমন ছিলাম কোন দাম্ভিক স্বৈরাচারী আমাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে কথা বললো তখন আমরা তার বক্রতার এমন দফারফা করলাম যে একেবারে সোজা হয়ে গেলো।”
# মূল শব্দগুলো হচ্ছে مُخْتَالٍ ও فَخُورٍ “মুখতাল” মানে হচ্ছে, এমন ব্যক্তি যে নিজেই নিজেকে কোন বড় কিছু মনে করে। আর ফাখূর তাকে বলে, যে নিজের বড়াই করে অন্যের কাছে। মানুষের চালচলনে অহংকার, দম্ভ ও ঔদ্ধত্যের প্রকাশ তখনই অনিবার্য হয়ে উঠে, যখন তার মাথায় নিজের শ্রেষ্ঠত্বের বিশ্বাস ঢুকে যায় এবং সে অন্যদেরকে নিজের বড়াই ও শ্রেষ্ঠত্ব অনুভব করাতে চায়।
# কোন কোন মুফাসসির এর এই অর্থ গ্রহণ করেছেন যে, “দ্রুতও চলো না এবং ধীরেও চলো না বরং মাঝারি চলো।” কিন্তু পরবর্তী আলোচনা থেকে পরিষ্কার জানা যায়, এখানে ধীরে বা দ্রুত চলা আলোচ্য বিষয় নয়। ধীরে বা দ্রুত চলার মধ্যে কোন নৈতিক গুণ বা দোষ নেই এবং এ জন্য কোন নিয়মও বেঁধে দেয়া যায় না। কাউকে দ্রুত কোনো কাজ করতে হলে সে দ্রুত ও জোরে চলবে না কেন। আর যদি নিছক বেড়াবার জন্য চলতে থাকে তাহলে এক্ষেত্রে ধীরে চলায় ক্ষতি কি? মাঝারি চালে চলার যদি কোন মানদণ্ড থেকেই থাকে, তাহলে প্রত্যেক অবস্থায় প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য তাকে একটি সাধারণ নিয়মে পরিণত করা যায় কেমন করে? আসলে এখানে উদ্দেশ্য হচ্ছে, প্রবৃত্তির এমন অবস্থার সংশোধন যার প্রভাবে চলার মধ্যে দম্ভ অথবা দীনতার প্রকাশ ঘটে। বড়াই করার অহমিকা যদি ভেতরে থেকে যায় তাহলে অনিবার্যভাবে তা একটি বিশেষ ধরনের চাল-চলনের মাধ্যমে বের হয়ে আসে। এ অবস্থা দেখে লোকটি যে কেবল অহংকারে মত্ত হয়েছে, একথাই জানা যায় না, বরং তার চাল-চলনের রং ঢং তার অহংকারের স্বরূপটিও তুলে ধরে। ধন-দৌলত, ক্ষমতা-কর্তৃত্ব, সৌন্দর্য, জ্ঞান, শক্তি এবং এ ধরনের অন্যান্য যতো জিনিসই মানুষের মধ্যে অহংকার সৃষ্টি করে তার প্রত্যেকটির দম্ভ তার চাল-চলনে একটি বিশেষ ভঙ্গি ফুটিয়ে তোলে। পক্ষান্তরে চাল-চলনে দীনতার প্রকাশ ও কোন না কোন দূষণীয় মানসিক অবস্থার প্রভাবজাত হয়ে থাকে। কখনো মানুষের মনের সুপ্ত অহংকার একটি লোক দেখানো বিনয় এবং কৃত্রিম দরবেশী ও আল্লাহ‌ প্রেমিকের রূপ লাভ করে এবং এ জিনিসটি তার চাল-চলনে সুস্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। আবার কখনো মানুষ যথার্থই দুনিয়া ও তার অবস্থার মোকাবিলায় পরাজিত হয় এবং নিজের চোখে নিজেই হেয় হয়ে দুর্বল চালে চলতে থাকে। লুকমানের উপদেশের উদ্দেশ্য হচ্ছে, নিজের মনের এসব অবস্থার পরিবর্তন করো এবং একজন সোজা-সরল-যুক্তিসঙ্গত ভদ্রলোকের মতো চলো, যেখানে নেই কোন অহংকার ও দম্ভ এবং কোন দুর্বলতা, লোক দেখানো বিনয় ও ত্যাগ।

এ ব্যাপারে সাহাবায়ে কেরামের রুচি যে পর্যায়ের গড়ে উঠেছিল তা এ ঘটনাটি থেকেই অনুমান করা যেতে পারে। হযরত উমর (রা.) একবার এক ব্যক্তিকে মাথা হেঁট করে চলতে দেখলেন। তিনি তাকে ডেকে বললেন, “মাথা উঁচু করে চলো। ইসলাম রোগী নয়।” আর একজনকে তিনি দেখলেন যে কুঁকড়ে চলছে। তিনি বললেন, “ওহে জালেম! আমাদের দ্বীনকে মেরে ফেলছো কেন? এ দু’টি ঘটনা থেকে জানা যায়, হযরত উমরের কাছে দ্বীনদারীর অর্থ মোটেই এটা ছিল না যে, পথ চলার সময় রোগীর মতো আচরণ করবে এবং অযথা নিজেকে দীনহীন করে মানুষের সামনে পেশ করবে। কোন মুসলমানকে এভাবে চলতে দেখে তার ভয় হতো, এভাবে চললে অন্যদের সামনে ইসলামের ভুল প্রতিনিধিত্ব করা হবে এবং মুসলমানদের মধ্যেই নিস্তেজ ভাব সৃষ্টি হয়ে যাবে। এমনি ঘটনা হযরত আয়েশার (রা.) ব্যাপারে একবার ঘটে। তিনি দেখলেন একজন লোক কুঁকড়ে মুকড়ে রোগীর মতো চলছে। জিজ্ঞেস করলেন, কি হয়েছে? বলা হলো, ইনি একজন ক্বারী (অর্থাৎ কুরআন অধ্যয়ন ও অধ্যাপনা করেন এবং শিক্ষাদান ও ইবাদাত করার মধ্যে মশগুল থাকেন) এ কথা শুনে হযরত আয়েশা (রা.) বললেন, “উমর ছিলেন ক্বারীদের নেতা। কিন্তু তার অবস্থা ছিল, পথে চলার সময় জোরে জোরে হাঁটতেন। যখন কথা বলতেন, জোরে জোরে বলতেন। যখন মারধর করতেন খুব জোরেশোরে মারধর করতেন।” (আরো বেশি ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, বনী ইসরাঈল ৪৩ টীকা এবং আল ফুরকান ৭৯ টীকা ।)
# এর মানে এ নয় যে, মানুষ সবসময় আস্তে নীচু স্বরে কথা বলবে এবং কখনো জোরে কথা বলবে না। বরং গাধার আওয়াজের সাথে তুলনা করে কোন্ ধরনের ভাব-ভঙ্গিমা ও কোন্ ধরনের আওয়াজে কথা বলা থেকে বিরত থাকতে হবে তা পরিষ্কার করে বলে দেয়া হয়েছে। ভঙ্গী ও আওয়াজের এক ধরনের নিম্নগামিতা ও উচ্চগামিতা এবং কঠোরতা ও কোমলতা হয়ে থাকে স্বাভাবিক ও প্রকৃত প্রয়োজনের খাতিরে। যেমন কাছের বা কম সংখ্যক লোকের সাথে কথা বললে আস্তে ও নীচু স্বরে বলবেন। দূরের অথবা অনেক লোকের সাথে কথা বলতে হলে অবশ্যই জোরে বলতে হবে। উচ্চারণভঙ্গীর ফারাকের ব্যাপারটাও এমনি স্থান-কালের সাথে জড়িত। প্রশংসা বাক্যের উচ্চারণভঙ্গী নিন্দা বাক্যের উচ্চারণভঙ্গী থেকে এবং সন্তোষ প্রকাশের কথার ঢং এবং অসন্তোষ প্রকাশের কথার ঢং বিভিন্ন হওয়াই উচিত। এ ব্যাপারটা কোন অবস্থায়ই আপত্তিকর নয়। হযরত লুকমানের নসীহতের অর্থ এ নয় যে, এ পার্থক্যটা উঠিয়ে দিয়ে মানুষ সবসময় একই ধরনের নীচু স্বরে ও কোমল ভঙ্গীমায় কথা বলবে। আসলে আপত্তিকর বিষয়টি হচ্ছে অহংকার প্রকাশ, ভীতি প্রদর্শন এবং অন্যকে অপমানিত ও সন্ত্রস্ত করার জন্য গলা ফাটিয়ে গাধার মতো বিকট স্বরে কথা বলা।

Leave a Reply