(বই#১০৩৯)   [ সুরা:- আস-সাজদাহ সংক্ষিপ্ত আলােচনা ।] www.motaher21.net সূরা:- ৩২:আস-সাজদাহ পারা:২১ ১-৩ নং আয়াত:-

أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#১০৩৯)
[ সুরা:- আস-সাজদাহ সংক্ষিপ্ত আলােচনা ।]
www.motaher21.net
সূরা:- ৩২:আস-সাজদাহ
পারা:২১
১-৩ নং আয়াত:-
৩২:১
الٓـمّٓ ۚ﴿۱﴾
আলিফ-লাম-মীম,
৩২:২
تَنۡزِیۡلُ الۡکِتٰبِ لَا رَیۡبَ فِیۡہِ مِنۡ رَّبِّ الۡعٰلَمِیۡنَ ؕ﴿۲﴾
এ কিতাবটি রব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে অবতীর্ণ, এতে কোন সন্দেহ নেই।
৩২:৩
اَمۡ یَقُوۡلُوۡنَ افۡتَرٰىہُ ۚ بَلۡ ہُوَ الۡحَقُّ مِنۡ رَّبِّکَ لِتُنۡذِرَ قَوۡمًا مَّاۤ اَتٰہُمۡ مِّنۡ نَّذِیۡرٍ مِّنۡ قَبۡلِکَ لَعَلَّہُمۡ یَہۡتَدُوۡنَ ﴿۳﴾
এরা কি বলে, এ ব্যক্তি নিজেই এটি তৈরি করে নিয়েছেন? না, বরং এটি সত্য তোমার রবের পক্ষ থেকে, যাতে তুমি সতর্ক করতে পারো এমন একটি জাতিকে যাদের কাছে তোমার পূর্বে কোন সতর্ককারী আসে নি, হয়তো তারা সৎপথে চলবে।

তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
(৩২-সাজদাহ) : নামকরণ:
১৫ আয়াতের সাজদাহর যে বিষয়বস্তু এসেছে তাকেই এ সূরার শিরোনাম হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে।
(৩২-সাজদাহ) : নাযিল হওয়ার সময়-কাল :

বর্ণনাভঙ্গি থেকে বুঝা যায়, এর নাযিল হবার সময়টা হচ্ছে মক্কার মধ্যযুগ এবং তারও একেবারে শুরুর দিকে। কারণ পরবর্তী যুগে নাযিলকৃত সূরাগুলোর পশ্চাতভূমিতে যেমন জুলুম- নিপীড়নের প্রচণ্ডতা দেখা যায় এ সূরাটির পটভূমিতে সে ধরনের প্রচণ্ডতা অনুপস্থিত।
(৩২-সাজদাহ) : বিষয়বস্তু:

সূরার বিষয়বস্তু হচ্ছে, তাওহীদ, রিসালাত ও আখেরাত সম্পর্কে লোকদের সন্দেহ দূর করা এবং এ তিনটি সত্যের প্রতি ঈমান আনার জন্য তাদেরকে আহ্বান জানানো। মক্কার কাফেরদের মধ্যে নবী (সা.) সম্পর্কে আলোচনা চলছিল যে, এ ব্যক্তি অদ্ভূত সব কথা বানিয়ে বানিয়ে শুনাচ্ছে। কখনো মরার পরের খবরও দেয় এবং বলে মরে পঁচে মাটিতে মিশে যাবার পর তোমাদের আবার উঠানো হবে। সবার হিসেব-নিকেশ হবে এবং দোজখ হবে ও বেহেশত হবে। কখনো বলে, এসব দেব-দেবী, ঠাকুর-টাকুর এসব কিছুই নয়। একমাত্র এক ও একক আল্লাহই উপাস্য। কখনো বলে, আমি আল্লাহর রাসূল। আকাশ থেকে আমার কাছে অহী আসে। যে বাণী আমি তোমাদের শুনাচ্ছি এসব আমার বাণী নয় বরং আল্লাহর বাণী। এ ব্যক্তি আমাদের এ অদ্ভূত কাহিনী শুনাচ্ছে। এসব কথার জবাব দেয়াই হচ্ছে এ সূরার মূল আলোচ্য বিষয়।

। এর জবাবে কাফেরদেরকে বলা হয়েছে, নি:সন্দেহে এগুলো আল্লাহর কালাম ও বাণী। নবুয়তের কল্যাণ বঞ্চিত গাফলতির নিদ্রায় বিভোর একটি জাতিকে জাগিয়ে দেবার জন্য এ কালাম নাযিল করা হয়েছে। আল্লাহর পক্ষ থেকে এর অবতীর্ণ হবার বিষয়টি যখনি সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন তখন তোমরা একে মিথ্যা বলতে পারো কেমন করে ?

। তারপর তাদেরকে বলা হয়েছে, এ কুরআন তোমাদের সামনে যেসব সত্য পেশ করে, বুদ্ধি-বিবেক ব্যবহার করে নিজেরাই চিন্তা করে বলো এর মধ্যে কোনটা তোমাদের মতে অদ্ভূত। আকাশ ও পৃথিবীর ব্যবস্থাপনা দেখো, নিজেদের জন্ম ও গঠনাকৃতি সম্পর্কে চিন্তা করো- এসব কিছু কি এ কুরআনে এ নবীর মাধ্যমে তোমাদের যেসব শিক্ষা দেয়া হচ্ছে তার সত্যতার প্রমাণ নয়? বিশ্ব- জাহানের এ ব্যবস্থা তাওহীদের সত্যতা প্রমাণ করে, না শির্কের? এ সমগ্র দেখে এবং তোমাদের নিজেদের জন্মের ব্যাপারটি দৃষ্টি সমক্ষে রেখে তোমাদের বুদ্ধি- বিবেক কি একথাই বলে যে, যিনি বর্তমানে তোমাদের সৃষ্টি করেছেন তিনি পুনর্বার তোমাদের সৃষ্টি করতে পারবেন না?

। এরপর পরলোকের একটা চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। ঈমানের পুরস্কার ও কুফরের পরিণাম বর্ণনা করে লোকদের কে অশুভ পরিণামের মুখোমুখি হবার আগে ত্যাগ ও কুরআনের শিক্ষা গ্রহণ করার জন্য উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করা হয়েছে। তাদেরকে নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে যে, এভাবে নিজেদের পরিণাম শুভ ও সুন্দর হবে।

। তারপর তাদেরকে বলা হয়েছে, আল্লাহ মানুষের ভুলের দরুন তাকে আকস্মিকভাবে চূড়ান্ত ও শেষ শাস্তি দেবার জন্য পাকড়াও করেন না, এটা তার মহা অনুগ্রহ। বরং এর পূর্বে তাকে ছোটখাটো কষ্ট, বিপদ-আপদ ও ক্ষতির সম্মুখীন করেন। তাকে হালকা হালকা ও কম কষ্টকর আঘাত করতে থাকেন। এভাবে তাকে সতর্ক করতে থাকেন, যাতে তার চোখ খুলে যায়। মানুষ যদি এসব প্রাথমিক আঘাতে সতর্ক হয়ে যায় তাহলে তা হবে তার নিজের জন্য ভালো।

। এরপর বলেন, আল্লাহর পক্ষ থেকে এক ব্যক্তির কাছে কিতাব এসেছে, দুনিয়ায় এটা কোন প্রথম ও নতুন ঘটনা নয়। এর আগে মূসার (আ) এর কাছেও তো কিতাব এসেছিল। একথা তোমরা সবাই জানো। এটা এমন কী কথা যে, তা শুনেই তোমরা এভাবে কানখাড়া করছো! বিশ্বাস করো এ কিতাব আল্লাহরই পক্ষ থেকে এসেছে এবং মূসার (আ) এর যুগে যা হয়েছিল এখন আবার সেসব কিছুই হবে, একথা নিশ্চিত জেনো। আল্লাহর এ কিতাব কে যারা মেনে নেবে এখন নেতৃত্ব তারাই লাভ করবে। একে যারা প্রত্যাখ্যান করবে তাদের জন্য নিশ্চিত ব্যর্থতা ছাড়া আর কিছুই নেই।

। তারপর মক্কার কাফেরদেরকে বলা হয়েছে, নিজেদের বাণিজ্যিক সফরকালে তোমরা অতীতের যেসব জাতির ধ্বংস প্রাপ্ত জনপদ অতিক্রম করে থাকো তাদের পরিণাম দেখো। নিজেদের জন্য তোমরা কি এ পরিণাম পছন্দ করো? বাহিরের অবস্থা দেখে প্রতারিত হয়ো না। আজ তোমরা দেখছো মুহাম্মদ (সা.) এর কথা কতিপয় ছেলে- ছোকরা, গোলাম ও গরীব মানুষ ছাড়া আর কেউ শুনছে না এবং চারদিক তার বিরূদ্ধে কেবল বিদ্রুপ, তিরস্কার ও নিন্দাবাদ ধ্বনিত হচ্ছে। এ থেকে তোমরা ধারণা করে নিয়েছো, এ বক্তব্য-বিষয় টেকসই হবে না, কিছু দিন চলবে তারপর খতম হয়ে যাবে। কিন্তু এটা কেবল তোমাদের দৃষ্টিভ্রম। তোমরা দিনরাত দেখছো আজ একটি জমি নিষ্ফল পড়ে আছে, সেখানে পানি ও লতাপাতার চিহ্নমাত্র নেই। জমিটি দেখে কেউ কল্পনা করতে পারে না যে, এর গর্ভে সবুজ শ্যামলিমার বিশাল ভাণ্ডার লুকিয়ে আছে। হঠাৎ পরদিন বৃষ্টিপাত হতেই ঐ মরা মাটির বুকে দেখা দেয় অভাবিত পূর্বে জীবন প্রবাহ এবং সর্বত্র সবুজের বিচিত্র সমারোহ।

। উপসংহারে নবী (সা.) কে সম্বোধন করে বলা হয়েছে, এরা তোমার কথা শুনে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করছে এবং জিজ্ঞেস করছে, জনাব! আপনার সেই চূড়ান্ত বিজয় কবে অর্জিত হবে ? তার সন-তারিখটা একটু বলেন না। ওদেরকে বলো, যখন আমাদের ও তোমাদের ফায়সালার সময় আসবে তখন তা মেনে নেয়ায় তোমাদের কোন উপকার হবে না। মানতে হয় এখন মানো। আর যদি শেষ ফায়সালার অপেক্ষা করতে চাও তাহলে বসে বসে তা করতে থাকো।
# কুরআন মজীদের অনেকগুলো সূরা এ ধরনের কোন না কোন পরিচিতিমূলক বক্তব্য দিয়ে শুরু হয়েছে। এ বাণী কোথায় থেকে আসছে সূরার শুরুতেই তা জানিয়ে দেয়াই হয় এর উদ্দেশ্য। রেডিও ঘোষক প্রোগ্রাম শুরু করার সূচনাতেই যেমন ঘোষণা করে দেন, আমি অমুক স্টেশন থেকে বলছি, এটা বাহ্যত তেমনি ধরনের একটা ভূমিকাসূচক বক্তব্য। কিন্তু রেডিওর এমনি ধরনের একটা মামুলি ঘোষণার বিপরীতে কুরআন মজীদের কোন সূরার সূচনা যখন এ ধরনের একটা অসাধারণ ঘোষণার মাধ্যমে শুরু হয়, যাতে বলা হয়, এ বাণী আসছে বিশ্ব-জাহানের শাসনকর্তার পক্ষ থেকে তখন এটা শুধমাত্র বাণীর উৎস বর্ণনা করাই হয় না বরং এই সঙ্গে এর মধ্যে শামিল হয়ে যায় একটা বিরাট বড় দাবী, একটা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ এবং একটা কঠোর ভীতি প্রদর্শনও। কারণ কথা শুরু করেই সে ঝট করে এত বড় একটা খবর দিয়ে দিচ্ছে যে, এটা মানুষের সামনে এ দাবী স্বীকার করা না করার কোন প্রশ্ন উত্থাপন করে। স্বীকার করলে চিরকালের জন্য তার সামনে আনুগত্যের শির নত করে দিতে হবে, তারপর তার মোকাবিলায় মানুষের আর কোন স্বাধীনতা থাকতে পারে না। আর স্বীকার না করলে নিশ্চিতভাবেই তাকে একটা ভয়াবহ আশঙ্কার মুখোমুখি হতে হবে। অর্থাৎ যদি সত্যিই এটা বিশ্ব-জাহানের প্রভুর বাণী হয়ে থাকে তাহলে একে প্রত্যাখ্যান করার ফল স্বরূপ তাকে চিরন্তন দুভার্গ্যের শিকার হতে হবে। এ জন্য এ ভূমিকাসূচক বাক্যটির শুধুমাত্র নিজের এই প্রকৃতিগত অসাধারণত্বেরই কারণে মানুষকে কান লাগিয়ে চূড়ান্ত মনোনিবেশ সহকারে এ বাণী শোনার এবং একে আল্লাহর বাণী হিসেবে স্বীকার করার বা না করার ফয়সালা করতে বাধ্য করে।

এ কিতাব রব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে নাযিল করা হয়েছে, শুধুমাত্র এতটুকু কথা বলেই এখানে শেষ করা হয়নি। বরং এর পরেও পূর্ণ জোরেশোরে বলা হয়েছেلَا رَيْبَ فِيهِ অর্থাৎ এটা আল্লাহর কিতাব এবং আল্লাহর কাছ থেকে এর অবতীর্ণ হবার ব্যাপারে আদৌ কোন সন্দেহের অবকাশই নেই। এ তাগিদসূচক বাক্যাংশ টিকে যদি কুরআন নাযিলের ঘটনামূলক পটভূমি এবং খোদ কুরআনের নিজের পূর্বাপর বক্তব্যের আলোকে দেখা হয় তাহলে পরিষ্কার অনুভব করা যাবে যে, তার মধ্যে দাবীর সাথে যুক্তি-প্রমাণও নিহিত রয়েছে এবং এ যুক্তি-প্রমাণ মক্কা মু’আযযামার যেসব অধিবাসীর সামনে এ দাবী পেশ করা হচ্ছিল তাদের কাছে গোপন ছিল না। এ কিতাব উপস্থাপনকারীর সমগ্র জীবন তাদের সামনে ছিল। কিতাব উপস্থাপন করার আগেরও এবং পরেরও। তারা জানতো, যিনি এ দাবী সহকারে এ কিতাব পেশ করছেন তিনি আমাদের জাতির সবচেয়ে সত্যবাদী, দায়িত্বশীল ও সৎ চরিত্রের অধিকারী ব্যক্তি। তারা এও জানতো যে, নবুওয়াত দাবী করার একদিন আগে পর্যন্তও কেউ তার মুখ থেকে কখনো সেসব কথা শোনেননি যেগুলো নবুওয়াত দাবী করার পরপরই তিনি সহসাই বলতে শুরু করে দিয়েছিলেন। তারা এ কিতাবের ভাষা ও বর্ণনাভঙ্গি এবং মুহাম্মাদ ﷺ এর ভাষা ও বর্ণনাভঙ্গির মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য দেখতে পেতো। তারা পরিষ্কারভাবে একথাও জানতো যে, একই ব্যক্তি কখনো এত বেশি সুস্পষ্ট পার্থক্য সহকারে দু’টি ভিন্ন স্টাইলের অধিকারী হতে পারে না। তারা এ কিতাবের একান্ত অসাধারণ সাহিত্য অলংকারও দেখছিল এবং আরবী ভাষাভাষি হিসেবে তারা নিজেরাই জানতো যে, তাদের সকল কবি ও সাহিত্যিক এর নজির পেশ করতে অক্ষম হয়েছে। তাদের জাতির কবি, গণক ও বাগ্নীদের বাণী এবং এ বাণীর মধ্যে কত বড় ফারাক রয়েছে এবং এ বাণীর মধ্যে যে পবিত্র-পরিচ্ছন্ন বিষয়বস্তু বর্ণিত হয়েছে কত উন্নতমানের তাও তাদের অজানা ছিল না। তারা এ কিতাব ও এর উপস্থাপকের দাওয়াতের মধ্যে কোথাও দূরবর্তী এমন কোন স্বার্থপরতার সামান্যতম চিহ্নও দেখতে পেতো না যা থেকে কোন মিথ্যা দাবীদারের কথা ও কাজ কখনো মুক্ত হতে পারে না। নবুওয়াতের দাবী করে মুহাম্মাদ ﷺ নিজের, নিজের পরিবার অথবা নিজের গোত্র ও জাতির জন্য কি অর্জন করতে চাচ্ছিলেন এবং এ কাজের মধ্যে তার নিজের কোন স্বার্থটি নিহিত রয়েছে তা তারা অণুবীক্ষণ যন্ত্র লাগিয়েও চিহ্নিত করতে পারতো না। তারপর এ দাওয়াতের দিকে তার জাতির কেমন ধরনের লোকেরা আকৃষ্ট হয়ে চলছে এবং তার সাথে সম্পৃক্ততাদের জীবনে কতবড় বিপ্লব সাধিত হচ্ছে তাও তারা দেখছিল। এ সমস্ত বিষয় মিলে মিশে দাবীর স্বপক্ষে যুক্তি হিসেবে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। তাই এ পটভূমিতে একথা বলা একদম যথেষ্ট ছিল যে, এ কিতাবের রব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে নাযিলকৃত হওয়াটা সকল প্রকার সন্দেহ-সংশয়ের উর্ধ্বে। এর পাশে আরো কোন যুক্তি বসিয়ে যুক্তির বহর বৃদ্ধি করার কোন প্রয়োজন ছিল না।
# ওপরের ভূমিকামূলক বাক্যের পর মুহাম্মাদ ﷺ এর রিসালাত সম্পর্কে মক্কার মুশরিকরা যে প্রথম আপত্তিটি করতো সেটির পর্যালোচনা করা হচ্ছে।
# এটি নিছক প্রশ্ন ও জিজ্ঞাসা নয়। বরং এখানে মহাবিস্ময় প্রকাশের ভঙ্গি অবলম্বন করা হয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে, যে সমস্ত বিষয়ের কারণে এ কিতাবের আল্লাহর কাছ থেকে অবতীর্ণ হওয়ার ব্যাপারটি যাবতীয় সন্দেহ-সংশয়মুক্ত হয় সেসব সত্ত্বেও কি এরা প্রকাশ্যে এমন হঠকারিতার কথা বলে যাচ্ছে যে, মুহাম্মাদ ﷺ নিজেই এটি রচনা করে মিথ্যামিথ্যি একে আল্লাহ‌ রব্বুল আলামীনের রচনা বলে চালিয়ে দিয়েছেন? এমন একটি বাজে ও ভিত্তিহীন দোষারোপ করতে তারা একটুও লজ্জিত হচ্ছে না? যারা মুহাম্মাদ ﷺ এবং তার কথা ও কাজ সম্পর্কে জানে আর এ কিতাবটিও অনুধাবন করে তারা এ বাজে ও ভিত্তিহীন দোষারোপের কথা শুনে কি অভিমত পোষণ করবে সে সম্পর্কে কোন অনুভূতি কি তাদের নেই?
# যেভাবে প্রথম আয়াতেلَا رَيْبَ فِيهِ বলা যথেষ্ট মনে করা হয়েছিল এবং কুরআনুল কারীমের আল্লাহর কালাম হবার স্বপক্ষে এর চেয়ে বড় কোন যুক্তি পেশ করার প্রয়োজন মনে করা হয়নি। অনুরূপভাবে মক্কার কাফেরদের মিথ্যা অপবাদের জবাবে কেবলমাত্র এতটুকু বলাই যথেষ্ট মনে করা হচ্ছে যে, “এটি সত্য তোমার রবের পক্ষ থেকে।” ওপরে এক নম্বর টীকায় আমরা যে কারণ বর্ণনা করেছি এর কারণও তাই। কে, কোন্ ধরনের পরিবেশে, কিতাবে এ কিতাব পেশ করছিলেন সেসব বিষয় শ্রোতাদের সামনে ছিল এবং এ কিতাবও তার নিজস্ব ভাষাশৈলী, সাহিত্য সম্পদ ও বিষয়বস্তু সহকারে সবার সামনে ছিল। এই সঙ্গে এর প্রভাব ও ফলাফলও মক্কার সমকালীন সমাজে সবাই স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করছিল। এ অবস্থায় এ কিতাবের রব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে আগত সত্য হওয়াটা এমন সুস্পষ্ট বাস্তব ঘটনা ছিল যাকে শুধুমাত্র চূড়ান্তভাবে বর্ণনা করে দেয়াই কাফেরদের দোষারোপ খণ্ডনের জন্য যথেষ্ট ছিল। এ জন্য কোন যুক্তি প্রদান করার প্রচেষ্টা চালানো প্রতিপাদ্য বিষয়কে মজবুত করার পরিবর্তে তাকে আরো দুর্বল করে দেবার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ব্যাপারটি ঠিক যেমন নাকি দিনের বেলা সূর্য কিরণ দিতে থাকে এবং কোন বেহায়া বেলাজ ব্যক্তি নির্দ্ধিধায় বলে দেয় এখন তো অন্ধকার রাত। এর জবাবে কেবলমাত্র এতটুকু বলাই যথেষ্ট হয় যে, তুমি একে রাত বলছো? এখন তো সামনে রয়েছে আলো ঝলমল দিন। এরপর দিনের উপস্থিতির স্বপক্ষে যদি যুক্তি প্রমাণ পেশ করা হয়, তাহলে এর ফলে নিজের জবাবের শক্তিবৃদ্ধি করা হবে না বরং তার শক্তি কিছুটা কমই করে দেয়া হবে।
# যেমন এর সত্য হওয়া ও আল্লাহর পক্ষ থেকে হওয়াটা নিশ্চিত ও সন্দেহাতীত বিষয় ঠিক তেমনি এর পেছনে সদুদ্দেশ্য থাকা এবং তোমাদের জন্য এর আল্লাহর রহমত হওয়াটাও সুস্পষ্ট। তোমরা নিজেরাই জানো শত শত বছর থেকে তোমাদের মধ্যে কোন নবী আসেননি। তোমরা নিজেরাই জানো তোমাদের সমগ্র জাতিটাই মূর্খতা, অজ্ঞতা, নৈতিক অধঃপতন ও মারাত্মক ধরনের পশ্চাদপদতায় ভুগছে। এ মূর্খতার মধ্যে যদি তোমাদেরকে জাগ্রত করার ও সঠিক পথ দেখাবার জন্য তোমাদের মধ্যে একজন নবী পাঠানো হয়ে থাকে, তাহলে এতে তোমরা অবাক হচ্ছো কেন? এটা তো একটি মস্ত বড় প্রয়োজন এবং তোমাদের কল্যাণার্থে আল্লাহ‌ এ প্রয়োজন পূর্ণ করে দিয়েছেন।

উল্লেখ্য, আরবে সত্য দ্বীনের আলো সর্বপ্রথম পৌঁছেছিল হযরত হূদ ও হযরত সালেহ আলাইহিস সালামের মাধ্যমে। এটা ছিল প্রাগৈতিহাসিক যুগের ঘটনা। তারপর আসেন হযরত ইবরাহীম ও হযরত ইসমাঈল (আ)। নবী (সা.) এর যুগের আড়াই হাজার বছর আগে অতিক্রান্ত হয়েছিল তাদের যুগ। এরপর নবী (সা.) এর পূর্বে আরবের যমীনে যে সর্বশেষ নবী পাঠানো হয় তিনি ছিলেন হযরত শো’আইব (আ)। তার আগমনের পরও প্রায় দু’হাজার বছর অতিক্রান্ত হয়েছিল। এ সময়টা এত দীর্ঘ ছিল যে, এ প্রেক্ষিতে এ জাতির মধ্যে কোন সতর্ককারী আসেনি একথা বলা একেবারেই যথার্থ ছিল। এ উক্তির অর্থ এ নয় যে, এ জাতি একজন সতর্ককারীর প্রত্যাশী ছিল।

এখানে আর একটা প্রশ্ন সামনে এসে যায়। সেটাও পরিষ্কার করে দেয়া দরকার। এ আয়াতটি পড়তে গিয়ে মানুষের মনে সংশয় জাগে, নবী (সা.) এর পূর্বে শত শত বছর পর্যন্ত আরবে যখন কোন নবী আসেননি তখন সে জাহেলী যুগে যেসব লোক অতিক্রান্ত হয়ে গেছে তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে কিসের ভিত্তিতে? সৎ পথ কোনটা এবং অসৎ পথ তথা পথভ্রষ্টতা কোনটা তা কি তারা জানতো? তারপর যদি তারা পথভ্রষ্ট হয়ে থাকে তাহলে তাদের এ পথভ্রষ্টতার জন্য তাদেরকে দায়ী করা যেতে পারে কেমন করে? এর জবাব হচ্ছে, সেকালের লোকদের দ্বীনের বিস্তারিত জ্ঞান না থাকলেও আসল দ্বীন যে তাওহীদ তথা আল্লাহর একত্ববাদ এবং নবীগণ কখনো মূর্তিপূজা শিখান নি, একথা সেকালেও লোকদের অজানা ছিল না। আরবের লোকেরা তাদের দেশে আবির্ভূত নবীদের যেসব বাণী ও ঐত্যিহের অধিকারী হয়েছিল তার মধ্যেও এ সত্য সংরক্ষিত ছিল। নিকটতম দেশগুলোয় আগত নবীগণ যথা হযরত মূসা, হযরত দাউদ, হযরত সুলাইমান ও হযরত ঈসা (আ) এর শিক্ষার মাধ্যমেও তারা এ সত্যের সন্ধান পেয়েছিল। আরবী প্রবাদসমূহের মাধ্যমে একথা ব্যাপকভাবে প্রচারিত ও সর্বজন পরিচিত ছিল যে, প্রাচীনযুগে আরববাসীদের আসল ধর্ম ছিল ইবরাহীমের ধর্ম এবং মূর্তিপূজার ব্যাপক প্রচলন সত্ত্বেও আরবের বিভিন্ন অংশে স্থানে স্থানে এমন সব লোক ছিল যারা শিরক অস্বীকার করতো, তাওহীদের ঘোষণা দিতো এবং মূর্তির বেদীমূলে বলিদান করার প্রকাশ্যে নিন্দা করতো। নবী (সা.) এর আমলের একেবারেই কাছাকাছি সময়ে কুসসা ইবনে সায়েদাতিল ইয়াদী, উমাইয়াহ ইবনে আবিস সালত, সুওয়াইদ ইবনে আমরিল মুসতালেকী ওকী ইবনে সালামাহ ইবনে যুহাইরিল ইয়াদী, আমর ইবনে জুনদুবিল জুহানী, আবু কায়েস সারমাহ ইবনে আবী আনাস, যায়েদ ইবনে শিহাবিত তামিমী, আলমুতালামমিস ইবনে উমাইয়াহ আলকিনানী, যুহাইর ইবনে আবী সুলমা, খালেদ ইবনে সিনান ইবনে গাইসিল আবসী, আবদুল্লাহ আলকুদ্বাঈ এবং এ ধরনের আরো বহু লোকের অবস্থা আমরা ইতিহাস থেকে জানতে পারি। ইতিহাসে এদেরকে ‘হুনাফা’ তথা সঠিক সত্যপন্থী নামে স্মরণ করা হয়। এরা সবাই প্রকাশ্যে তাওহীদকে আসল দ্বীন বলে ঘোষণা করতেন এবং মুশরিকদের ধর্মের সাথে নিজেদের সম্পর্কহীনতার কথা পরিষ্কারভাবে প্রকাশ করতেন। একথা সুস্পষ্ট, পূর্ববর্তী নবীগণের যেসব শিক্ষা সমাজে তখনো প্রচলিত ছিল তার প্রভাব থেকেই তাদের মনে এ চিন্তার জন্ম হয়েছিল। তাছাড়া ইয়ামনে খৃষ্টীয় চতুর্থ-পঞ্চম শতকের প্রাচীন ধ্বংসাবশেষের যে শিলালিপির আধুনিক প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার মাধ্যমে আবিষ্কৃত হয়েছে তা থেকে জানা যায়, সেকালে সেখানে একটি তাওহীদী ধর্মের অস্তিত্ব ছিল। তার অনুসারীদের আকাশ ও পৃথিবীর করুণাময় রবকেই একক ইলাহ ও উপাস্যে স্বীকার করতো। ৩৭৮ খৃষ্টাব্দের একটি শিলালিপি পাওয়া গেছে একটি প্রাচীন উপাসনালয়ের ধ্বংসাবশেষে থেকে। তাতে লিখিত আছে, এ উপাসনালয়টি “যু-সামাওয়া”র“ইলাহ” অর্থাৎ আকাশের ইলাহি অথবা আকাশের রবের ইবাদাত করার জন্য নির্মাণ করা হয়েছে। ৪৬৫ খৃষ্টাব্দের একটি শিলালিপিতে লিখিত হয়েছেঃ

بنصر وردا الهن بعل سمين وارضين (بنصرو تعون الاله رب السماء ولارض)

এ কথাগুলো সুস্পষ্টভাবে তাওহীদ বিশ্বাসের কথা ব্যক্ত করছে। একটি কবরগাত্রে সে যুগের আর একটি শিলালিপি পাওয়া গেছে। তাতে লেখা আছেঃ بخيل رحمنن (يعنى استعين بحول الرحمن)

অনুরূপভাবে দক্ষিণ আরবে ফোরাত নদী ও কিন্নাসিরীনের মাঝখানে যাবাদ নামক স্থানে ৫১২ খৃষ্টাব্দের একটি শিলালিপি পাওয়া গেছে। তাতে লেখা আছেঃ

بسم الا له , لاعز الا له , لاشكر الا له

এ সমস্ত কথাই প্রকাশ করছে যে, নবী (সা.) এর নবুয়ত লাভের পূর্বে পূর্ববর্তী নবীগণের শিক্ষার প্রভাব আরব ভূখণ্ড থেকে একেবারে নির্মূল হয়ে যায়নি। কমপক্ষে “তোমাদের আল্লাহ‌ এক ও একক” এ কথাটুকু স্মরণ করিয়ে দেবার মতো বহু উপায় ও উপকরণ বিদ্যমান ছিল। (আরো বেশি ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, সূরা আল ফুরকান, ৮৪ টীকা।)

ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-

সংক্ষিপ্ত আলােচনা : মানব প্রকৃতির মধ্যে যে সঠিক আকীদা ঘুমিয়ে রয়েছে তাকে জাগিয়ে তােলার জন্য আল কোরআনের মধ্যে ইতিপূর্বে মর্মস্পর্শী আহ্বানের যে সব আদর্শ নমুনা পেশ করা হয়েছে আলােচ্য সূরার মধ্যে সেই রকমেরই আর একটি নমুনা পেশ করা হলাে, যা হৃদয়ের মধ্যে পুরােপুরিই গেঁথে যায়; আর তা হচ্ছে, একমাত্র একক ও নিরংকুশ সর্বশক্তিমান আল্লাহ তায়ালার কথা, যিনি মানবজাতিসহ গােটা বিশ্বের সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা, তার সামনে আনুগত্যের মাথা ঝুকিয়ে দেয়া। একথা মেনে নেয়া যে তিনিই আকাশমন্ডলী, পৃথিবী এবং এ দু’য়ের মাঝে যা কিছু আছে সব কিছুর পরিচালক এবং এ কথার সাক্ষ্য দেয়া যে মােহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ(স.)-এর রেসালাত অবশ্যই সত্য; আর এ কথাও মেনে নেয়া যে মানবমন্ডলীকে আল্লাহ তায়ালার দিকে এগিয়ে নেয়ার জন্য তাকে পথ প্রদর্শক হিসাবে পাঠানাে হয়েছে। এটা বিশ্বাস করা যে পুনরুত্থান দিবস আছে, একদিন কেয়ামত অবশ্যই সংঘটিত হবে, হিসাব-নিকাশ হবে এবং যার যা পাওনা তা পুরােপুরিই তাকে বুঝিয়ে দেয়া হবে। আলােচ্য সূরার মধ্যে এসব আকীদা-বিশ্বাস সম্পর্কেই আলােচনা করা হয়েছে, আর মক্কায় অবতীর্ণ সকল সূরাতেই বিশেষভাবে অদৃশ্য এসব আকীদা গ্রহণ করার ওপর জোর দেয়া হয়েছে। মূল কথাটির প্রতি সকল মানব-হৃদয়কে আকৃষ্ট করা হয়েছে তা হচ্ছে সবাইকে এ কথা জানিয়ে দেয়া যে, এ কথাগুলাে সেই মহান সত্তার কাছ থেকে নাযিল হয়েছে যিনি সর্বজ্ঞ এবং সব কিছুই যার জ্ঞান ভান্ডারের মধ্যে রয়েছে। সারাবিশ্বের সকল মানুষের অন্তরের মধ্যে যে চিন্তাস্রোত নিরন্তর প্রবাহিত হয়ে চলেছে, সে সবের বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ যাবতীয় অবস্থার খবর একমাত্র তিনিই রাখেন। তিনিই জানেন সে চিন্তাধারার বাঁকে বাঁকে কতাে জটিলতা রয়েছে এবং সেসব চিন্তা স্রোত জীবনের গিরি সংকট ও নানাবিধ বন্ধুর পথ অতিক্রম করার সময় কতাে প্রকার বাধা-বিঘ্নের সম্মুখীন হয়, তিনিই জানেন সে সব চিন্তাধারার প্রকৃতি কি এবং সে চিন্তাস্রোত কোন উৎসমূল থেকে উৎসারিত হয়; তিনিই জানেন কোন বলিষ্ঠ যুক্তি এসব বিক্ষিপ্ত চিন্তাকে প্রভাবিত করে ও এককেন্দ্রিক করে এবং অনুকূল ও প্রতিকূল সকল পরিস্থিতির মধ্যে কোন মহামূল্যবান কথা এসব চিন্তাবিদদের হৃদয়ে সাড়া জাগায়। সূরা আস সাজদা আকীদার বিষয়গুলােকে এমন কিছু নতুন এবং অভিনব পদ্ধতিতে পেশ করেছে যে এর পূর্বে অবতীর্ণ সূরা লোকমান পেশ করেনি। এ বিষয়ক কথাগুলােকে প্রথম দিককার আয়াতগুলাের মধ্যে উপস্থাপন করা হয়েছে, পরে এসব কথাকে ধীরে ধীরে এবং অত্যন্ত প্রভাবপূর্ণ ভাষা ও পদ্ধতিতে মানব হৃদয়ের সামনে তুলে ধরা হয়েছে। যেন অমিয় এ সুধা গাফলতির ঘুমে নিদ্রিত কলবগুলােকে জাগিয়ে তােলে, সত্যের প্রদীপ্ত প্রভায় আত্মাগুলোকে আলােকিত করে, সংসার জীবনের ঘূর্ণাবর্তে পতিত পেরেশান এবং নগদ প্রাপ্তিতে মুগ্ধ হৃদয়গুলােকে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে চিন্তা করতে বাধ্য করে। ভবিষ্যতকে সামনে রেখে নিজেদের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করতে বলে, যেমন করে পূর্বে অবতীর্ণ অন্যান্য বহু সূরার মধ্যে সৃষ্টি বৈচিত্রের এসব বিষয়ের ওপর বহু যুক্তি ও প্রমাণ পেশ করা হয়েছে। মানব সৃষ্টির সূচনা ও পদ্ধতিসমূহ সম্পর্কে আলােচনা করা হয়েছে আলােচনা এসেছে আখেরাতের সেই দৃশ্যাবলী সম্পর্কে, যার মধ্যে জীবন ও জীবনের স্পন্দন থাকবে, আলােচনা করা হয়েছে অতীতের সেই স্বার্থ সন্ধানী ক্ষমতাধর ও বলদর্পীদের করুণ পরিণতি সম্পর্কে, যার বিবরণে যে কোনাে শ্রোতার মনে দাগ কেটে যায় এবং তাকে নিজ অন্তিম অবস্থা সম্পর্কে চিন্তা করতে বাধ্য করে। ওপরে বর্ণিত সূরাটির ভূমিকার সাথে সাথে আরও যে বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে তা হচ্ছে, সূরাটি পাঠকালে অন্তরের মধ্যে প্রচন্ড এক ভীতির সঞ্চার হয় এবং নিজের অজান্তেই আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দরবারে মাথা নুয়ে পড়ে, সকল অহংকার ও আত্মম্ভরিতা দুর হয়ে যায় । অপর দিকে সত্যকে অস্বীকারকারী অন্তর, ওপরের বর্ণনার সংস্পর্শে এসে আরও বিদ্বেষী, আরও কঠিন এবং আরও জিদ্দী হয়ে যায়; এই জন্য এ উভয় শ্রেণীর ব্যক্তিদের পরিণতি সম্পর্কে এমনভাবে জানানাে হয়েছে যেন ভাল ও মন্দ সকল ব্যক্তির শেষ পরিণতির ছবিগুলাে তাদের চোখের সামনে ভাসতে থাকে এবং আল কোরআনের প্রত্যেক পাঠকই যেন এসব দৃশ্য দেখতে থাকে। আলােচ্য সূরার মধ্যে পেশ করা প্রত্যেকটি বর্ণনা ও দৃশ্যই এমন কিছু বিষয়ের দিকে মানব হৃদয়কে আকৃষ্ট করে যা তন্দ্রাচ্ছন্ন মানুষকে চাংগা করতে থাকে এবং নিদ্রায় ঢলে পড়া মানুষকে প্রচন্ডভাবে নাড়া দিয়ে জাগিয়ে তােলে ও চিন্তা-ভাবনা করতে তাদের উদ্বুদ্ধ করে। কেয়ামতের তয়াবহ বর্ণনা কখনও মনের মধ্যে প্রচন্ড ভয় জাগায়, আবার কখনও আশার সঞ্চার করে, কখনও সতর্ক ও সাবধান হওয়ার জন্য প্রেরণা যােগায়, কখনও লোভ জাগায়, আবার কখনও তৃপ্তি ও অল্পে তুষ্টি আনে। অবশেষে এসব মানসিক অবস্থা সেসব যুক্তি প্রমাণ গ্রহণের দিকে আহ্বান জানায় এবং তখন যে কোনাে মানুষ নিজের জন্য একটি পদ্ধতি বেছে নেয় এবং জেনে বুঝে সঠিক ও সমুজ্জ্বল পদ্ধতি অনুসরণ করে তার শুভফলের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। আলােচনা প্রসংগে দেখা যাচ্ছে যে, গােটা সুরাটিকে চার বা পাঁচটি অধ্যায়ে ভাগ করা হয়েছে, যার প্রত্যেকটি পাশাপাশি অবস্থিত এবং একটি শিকলের মাধ্যমে তা পরস্পরের সাথে জড়িত। সুরাটি শুরু হচ্ছে বিচ্ছিন্ন কয়েকটি অক্ষর; আলিফ লাম ও মীম দিয়ে। এর দ্বারা আল কোরআন জানাতে চায় যে এই অক্ষরগুলাের শ্রেণী থেকেই আল কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে এবং এগুলাে দ্বারা আল্লাহর নিকট থেকে আল কোরআনের অবতরণ ও ওহী স্বরূপ আসা সম্পর্কে সকল সন্দেহের অপনােদন হয়েছে। আল্লাহ তায়ালার প্রেরিত সবই রাসূলের শিক্ষা এবং তাঁর রব-এর পক্ষ থেকে আগত বাণী সবই এক, যেন এর দ্বারাও রসূল তাঁর জাতিকে সতর্ক করতে পারেন এরশাদ হচ্ছে, যেন তারা হেদায়াত পায় আর এইটিই হচ্ছে আকীদার বিষয়গুলাের মধ্যে প্রথম বিষয়, অর্থাৎ ওহীর আগমন এবং বিশ্ব জাহানের প্রতিপালক আল্লাহ রব্বুল আলামীন সম্পর্কে মানুষকে জানানাের জন্য রসূলুল্লাহ(স.)-এর বার্তাবাহক হওয়ার সত্যতা। এরপর পেশ করা হচ্ছে সারা জাহানের মালিক, সকল ক্ষমতার অধিকারী এবং জীবন-মৃত্যুর একমাত্র ফায়সালা দাতা আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে এবং অস্তিত্বের বুকে তার শক্তি ক্ষমতা ও যাবতীয় গুণাবলী ছড়িয়ে থাকার বিষয়, যা আকাশমন্ডলী, পৃথিবী এবং এ দু’য়ের মাঝে যা কিছু বর্তমান রয়েছে সে সবকে বাস্তবে অস্তিত্ব দান করার মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। সৃষ্টির বুকে বিদ্যমান এ সব কিছুকে রক্ষণাবেক্ষণের মধ্য দিয়ে এবং আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর মধ্যস্থিত বিষয়াদিকে নিয়ন্ত্রিত করার মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালার শক্তির বহিপ্রকাশ ঘটেছে। পরিশেষে এগুলাে সব কিছু যে তার কাছে ফিরে যাবে ও অবশেষে তার কাছেই সবাইকে চলে যেতে হবে, আলােচ্য সূরাতে এ কথাগুলােকে হৃদয়ংগম করানাের চেষ্টা করা হয়েছে। এরপর আরও বেশী দৃষ্টি আকর্ষণী যে বিষয়টি পেশ করা হয়েছে তা হচ্ছে মানব সৃষ্টির সূচনা ও দুনিয়ার বুকে তার বিস্তার দান এক বিশেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে চলছে এবং তাকে কান, চোখ ও বুঝ শক্তি দেয়া হয়েছে যেন সেগুলাের দিকে তাদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। আর এসব সত্ত্বেও মানুষ খুব কমই আল্লাহ তায়ালার শােকরগােযারি করে। এবারে এখানে দ্বিতীয় বিষয়টিকে পেশ করা হচ্ছে; আর তা হচ্ছে জীবন মৃত্যুর মালিক ও সকল ক্ষমতার অধিকারী আল্লাহ তায়ালার সার্বভৌমত্ব এবং তাঁর গুণবৈশিষ্ট সম্পর্কে জানানাের কাজ। এই উলুহিয়্যাৎ’ শব্দটির মধ্যে যে গুণগুলাে লুকিয়ে রয়েছে তা হচ্ছে; সৃজনী ক্ষমতা, পরিকল্পনা ও পরিচালনার ক্ষমতা, এহসান করার ক্ষমতা, পুরস্কার দানের ক্ষমতা, সকল জ্ঞানের অধিকারী হওয়ার গুণ, দয়ামায়া মমতা ইত্যাদি আর এসব বিষয়ই ইতিপূর্বে আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টি ও পালন সম্পর্কিত আলােচনার প্রসংগে বর্ণিত হয়েছে। এরপর আসছে পুনরুত্থানের বিষয়টি; অর্থাৎ এ পার্থিব জীবন শেষে অবশ্যই মৃত্যু আসবে, তারপর এক নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত মৃত অবস্থায় মাটির সাথে মিশে থাকার পর আল্লাহ তায়ালার হুকুমে সবাইকে আবার যিন্দা হয়ে উঠতে হবে। এই বিষয়টির ওপরই সাধারণ মানুষের মনের মধ্যে সন্দেহ জাগে যে, পচে গলে মাটির সাথে মিশে একাকার হয়ে যাওয়ার পর আবার শরীরের অণু-পরমাণুগুলাে কিভাবে একত্রিত হবে? আবার যিন্দা হওয়া, এটা এক অসম্ভব ব্যাপার ছাড়া আর কি? এ জন্য তাদের কথা উদ্ধৃতি দিতে গিয়ে আল কোরআন বলছে, ‘ওরা বলল, আমরা এ ধরার বুকে হারিয়ে যাওয়ার পর আবার কি নতুন এক সৃষ্টিতে পরিণত হবাে?’ এখানে তাদের সন্দেহ সূচক অত্যন্ত দৃঢ়তা ও নিশ্চয়তাপূর্ণ কথা দিয়ে এ কথার জবাব দেয়া হয়েছে। এবার আসছে তৃতীয় বিষয়টি। আর তা হচ্ছে কবর থেকে উঠে এসে আল্লাহর নিকট ফিরে যাওয়া আর এখানে এসে দেখা যায়, কেয়ামতের দশ্যসমূহের মধ্য থেকে একটি দৃশ্যকে পেশ করা হচ্ছে। এরশাদ হচ্ছে, ‘স্মরণ করে দেখাে সেই সময়ের কথা যখন অপরাধীরা তাদের রব এর কাছে মাথা ঝুঁকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে এ সময়ে তারা আখেরাত সম্পর্কে তাদের নিশ্চিত বিশ্বাসের কথা ঘােষণা করতে থাকবে এবং বলবে যে, তাদের নিকট সত্যের যে দাওয়াত পৌছানাে হয়েছিলাে তা অবশ্যই সত্য, তখন তারা এমন এমন আরও কিছু কথা বলতে থাকবে, যদি তারা দুনিয়ার জীবনে সে সব কথা বলতাে তাহলে তাদের জন্য অবশ্যই জান্নাতের সকল দরজা খুলে দেয়া হতাে। কিন্তু এমন সময় তারা এ কথাগুলাে বলবে যখন এগুলাে তাদের কোনােই ফায়দা হবে না। তখন হয়ত তারা সে ভয়ানক দৃশ্য বাস্তবে দেখার পরেই এসব কথা বলবে। যেহেতু তখন এ দৃশ্যই তাদেরকে অলসতার নিদ্রা থেকে জাগিয়ে তুলবে। কিন্তু হায়! সংশােধনের সকল সময় ফুরিয়ে যাওয়ার পরই তাদের চেতনার উদয় হবে আর তাদের ওপর সে কঠিন অবস্থা ও শাস্তি নেমে আসার পরই এই নিস্ফল কথাগুলাে তারা বলতে থাকবে। বলবে সেই মুহূর্তে যে মুহর্তের খবর নবীর মাধ্যমে তাদেরকে পূর্বাহ্নে দেয়া হয়েছিল, কিন্তু তখন তারা নবীকে মিথ্যাবাদী বানিয়েছে এবং চরম হঠকারিতার সাথে তাঁর আনীত সত্যকে অস্বীকার করেছে। এ প্রসংগে অনাগত সে কঠিন ও দুঃখ ভরা দিনের পূর্বাভাস দানের পাশাপাশি পৃথিবীর বুকে থাকাকালীন মােমেনদের জীবন কেমন ছিল তারও একটি উজ্জ্বল ছবি তুলে ধরা হচ্ছে, এরশাদ হচ্ছে, ‘প্রকৃতপক্ষে তারাই আমার আয়াতগুলােকে বিশ্বাস করে… আমি তাদেরকে দিয়েছি তার থেকে তারা খরচ করে।’ এ হচ্ছে এক প্রাণ উদ্দীপক অবস্থার ছবি যা তাদের অন্তরের মধ্যে বিরাজমান মহত্বের সাক্ষ্য বহন করে। আল্লাহ রব্বুল আলামীন এসব পবিত্র দিল, আল্লাহভীরু ও আখেরাতে বিশ্বাসী ব্যক্তিদের জন্য সে রােজ হাশরের কঠিন দিনে কি কি বরাদ্দ করার ব্যবস্থা করে রেখেছেন সেই কথাটাকেই এখানে চমৎকারভাবে পেশ করছেন। পেশ করছেন তাদের কথা যারা শেষ রাতের অতি গভীর ও আরামের ঘুম ত্যাগ করে শুধুমাত্র আল্লাহ তায়ালারই মােহাব্বতে শয্যা ত্যাগ করে এবং তাকে ডাকতে থাকে ভয় ও বুকভরা আশা-আকাংখা নিয়ে। অতএব, সেসব নেক বান্দার জন্য কেয়ামতের সেই ভয়ানক দিনে যে আনন্দঘন ও সুখময় পরিবেশ সৃষ্টি করে দেয়া হবে, তা হবে আজকের এই ক্ষণস্থায়ী মানবমন্ডলীর ধারণা-কল্পনা থেকে বহু বহু উর্ধের বন্তু। এ অবস্থাটি জানাতে গিয়ে অত্যন্ত বলিষ্ঠভাবে জানানাে হচ্ছে, না, না কেউ জানে না, কোন ব্যক্তি উপলব্ধি করতে পারে না, তাদের চোখ জুড়ানাের মত কতাে অসংখ্য মর্যাদার জিনিস সেখানে তাদের জন্য সংগ্রহ করে রাখা হয়েছে। এসবই হবে তাদের অতীতের নেক কাজগুলাের প্রতিদান। এরপর খুব দ্রুতগতিতে আর একটি দৃশ্য সামনে আসছে যার মধ্যে পর্যায়ক্রমে মােমনদের জন্য আমােদ প্রমােদে ভরা জান্নাত এবং মুনাফিকদের জন্য আগুনে ভরা দোযখের কথা তুলে ধরা হচ্ছে। এক্ষেত্রে অপরাধী চক্রের জন্য আর একটি প্রচন্ড ধমকি প্রদান করা হয়েছে, যাতে বলা হয়েছে যে, তারা সে বেদনাদায়ক পরিণামের সম্মুখীন হওয়ার আগেই তাদেরকে পৃথিবীর বুকে অবশ্যই কিছু না কিছু শাস্তির মধ্যে ফেলা হবে। এরপর মূসা(আ.)-এর দিকে কথার মােড় ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে, জানানাে হচ্ছে যে মােহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ(স.) ও মূসা(আ.)-এর মাধ্যমে মানব মন্ডলীর মুক্তির জন্য সময়ান্তরে একই পয়গাম এসেছে। আলােচনা এসেছে মূসা(আ.)-এর কওমের ব্যাপারে, তাদের যথাযথ মূল্যায়ন ও প্রচুর প্রশংসা করতে গিয়ে বলা হয়েছে যে, তারা অবশ্যই সঠিক পথে ছিলাে এবং আল্লাহর বাণী নিয়ে তারা বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়েছিলাে। এ কাজ করতে গিয়ে তারা খুবই দৃঢ়তা ও অবিচলতা দেখিয়েছিলাে, যার পুরস্কার স্বরূপ আল্লাহ রব্বুল আলামীন তাদের সারা বিশ্বের নেতা বানিয়ে দিয়েছিলেন। মূসা(আ.) ও তার কওমের এ বিবরণ পেশ করতে গিয়ে মােমেনদেরকে ইংগীতে জানিয়ে দেয়া হচ্ছে যে, সত্যের শত্রুদের ষড়ন্ত্র ও মােহাম্মাদ(স.)-কে ও তার আনীত দাওয়াতকে প্রতিহত করার হীন উদ্দেশ্যে তারা খােদ নবী(স.)-কে যেভাবে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করার চেষ্টা করছে, সেই কঠিন পরিস্থিতির মােকাবেলায় মােমেনদেরকে পাহাড়ের মতাে দৃঢ়তা অবলম্বন করতে হবে, সকল অবস্থায় তাদেরকে অনেক বেশি সবর করতে হবে, চূড়ান্ত ধৈর্য অবলম্বন করতে হবে এবং বিরামহীনভাবে দিকে দিকে আল্লাহ তায়ালার দ্বীনের দাওয়াত ছড়িয়ে দিতে হবে। এখানে এই সাথে আর যে কাজটি করার জন্য ইংগীত করা হয়েছে, তা হচ্ছে; সারা জাহানের ইসলাম-দুশমনরা সত্যের বাতিকে নিভিয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যে জেনে বুঝে ইসলামের সাথে দুশমনি করছে এবং সকল যামানাতেই, নিছক ব্যক্তি, গােষ্ঠী বা কোনাে শ্রেণীর সাথে ইসলামী জীবন ব্যবস্থা কায়েমের আন্দোলনকে নস্যাৎ করার হীন চক্রান্তে তারা মেতে রয়েছে; অথচ এহেন সংগীন অবস্থায় তথাকথিত মুসলমানরা তাদের বাড়ীতে গাফেল হয়ে বসে থাকতে চায়, ইসলামী দাওয়াতকে অপরের নিকট পৌছে দেয়ার কোনাে দায়িত্বই তারা অনুভব করে না। চিন্তা করে না যে আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে জীব-জানোয়ারের মতাে শুধু খাওয়া পরা ও ফুর্তি করার জন্যই পয়দা করেননি, বরং তাদেরকে দায়িত্ব দিয়েছেন তার প্রতিনিধি হিসাবে কাজ করার। এরপরও তাদের নিশিদিনের ব্যস্ততা চলছে শুধুমাত্র ক্ষণস্থায়ী এ জীবনকে কেন্দ্র করেই। এ জন্যে তাদেরকে একবার পৃথিবীর যে কোনাে এক ভূমির দিকে গভীরভাবে তাকিয়ে দেখতে আহ্বান জানানাে হচ্ছে ও বলা হচ্ছে, ‘তাকিয়ে দেখাে হে মানব জাতি, গভীরভাবে চিন্তা করে দেখাে। কে এ মৃত যমীনকে (একবার মুর্দা বানিয়ে দেয়ার পর) পুনরায় যিন্দা করলাে, কে এখানে প্রতিনিয়ত তােমাদের জন্য তােমাদের জীবনকে সমৃদ্ধ ও উন্নত করে চলেছে এবং কে একে ক্রমান্বয়ে সমৃদ্ধ ও সম্প্রসারিত করে যাচ্ছে! এইভাবে প্রাকৃতিক বিভিন্ন দৃশ্য ও অতীতের পাপিষ্ঠ জাতির ধ্বংসের দৃশ্যাবলী দেখে আশা করা যায়, মানুষ বুঝবে এবং ধ্বংসপ্রাপ্ত দৃশ্য ও জীবন্ত দৃশ্যের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করতে সক্ষম হবে। অতপর সূরাটি ওদের একটি কথার উদ্ধৃতি পেশ করার সাথে সমাপ্ত হচ্ছে, ‘কখন আসবে এ বিজয়?’ অর্থাৎ, ওরা সেই বিজয় দিবস সম্পর্কে সন্ধিগ্ধ মন নিয়ে এ প্রশ্ন করে যে দিনে তাদের প্রতি শাস্তির ধমকিকে কার্যকর করা হবে এবং মােমেনরা বিজয় লাভে ধন্য হবে! ওদের এসব সন্দেহের জবাবে এবং তাদেরকে ভীতি প্রদর্শন করার সাথে বলা হচ্ছে যে, অবশ্যই মােমেনদের সফলতা এবং সত্যবিরােধীদের ওপর তাদের বিজয় আসবেই। রসূলুল্লাহ(স.)-কে সম্বােধন করে বলা হচ্ছে, তিনি যেন ওদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন এবং তাদেরকে ছেড়ে দেন তাদের চূড়ান্ত পরিণতির দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য। এবার আমরা সূরাটির ওপর একটু বিস্তারিত আলােচনা পেশ করছি।
‘আলিফ-লাম-মীম’, ‘আল কিতাব’ অবতীর্ণ হচ্ছে আল্লাহ রব্বুল আলামীন-এর পক্ষ থেকে এর মধ্যে কোনাে সন্দেহ নেই… যাতে করে তারা হেদায়াতের দিকে এগিয়ে যায়।’ উচ্চারিত হলাে তিনটি অক্ষর, আলিফ-লাম-মীম এ হরফগুলাে আরবের যে সব লােককে সম্বােধন করে উচ্চারণ করা হয়েছিলাে তারা বুঝেছিলাে এগুলাের গূঢ় মর্ম কি। তারা একথাও জানতাে যে এমন কথা তারা নিজেরা তৈরী করতে পারে না, তারা এটাও বুঝতাে যে তাদের তৈরী করা কথা এবং এসব কথার মধ্যে কতাে বিরাট পার্থক্য রয়েছে। যারা ভাষা সম্পর্কে কিছু না কিছু চেতনা রাখে এবং ভাষার মধ্যে কতাে নিগূঢ় অর্থ ও চিন্তাধারা লুকিয়ে থাকতে পারে সে বিষয়ে যাদের সামান্যতম জ্ঞান আছে তারাই বুঝে এ ভাষা মানুষের ভাষা থেকে কতাে স্বতন্ত্র। তারা দেখতে পায় আল কোরআনের প্রতিটি আয়াতের মধ্যে এক অকল্পনীয় শক্তি এবং এমন কিছু গােপন ক্ষমতা রয়েছে, যা অন্তরকে বশীভূত করে ফেলে এবং যে কোন পাঠকের অনুভূতির ওপর গভীরভাবে রেখাপাত করে, যা দুনিয়ার অন্য কোনাে ভাষার মধ্যে থাকা সম্ভব নয়। আরববাসীরা অবশ্যই আল কোরআনের এ শক্তিকে অনুভব করেছিল এবং তারা অবাক বিস্ময়ে এ পাক কালামের সামনে ধীরে ধীরে হলেও মাথা নত করতে শুরু করেছিলাে, যেহেতু তারা এ মহা গ্রন্থের বাণীর সমকক্ষ কোনাে বাণী আর কখনও শােনেনি বা এমন অমিয় বচনের সন্ধানও কখনও পায়নি, তাই যখন এ পাক কালামের সুর লহরী তাদের কর্ণ কুহরে প্রবেশ করতে থাকে তখন তারা গভীর আবেগ ভরে দুলতে থাকতাে, আর ভাবতে হয় এমন অমিয় বচন তারা আর কখনও শােনেনি, এমন অভিজ্ঞতা তাে তাদের জীবনে আর কখনও হয়নি। হায় কী মধু মেশানাে রয়েছে এর সুর লহরীতে! মানুষের কথা ও আল্লাহর কথার মধ্যে পার্থক্য ঠিক সেই রকম যেমন পার্থক্য আল্লাহতায়ালার কাজ এবং মানুষের কাজে। আল্লাহ রব্বুল আলামীনের কীর্তিসমূহ সকল মানুষের সামনে সুস্পষ্টভাবে বিরাজ করছে, যার সমকক্ষ নিপুণ কীর্তি কোনােদিন কোন মানুষ স্থাপন করতে পারেনি, না পেরেছে তুচ্ছ থেকে তুচ্ছ কোনাে জিনিসের মধ্যে সামান্যতম কোনাে পরিবর্তন আনতে! গভীরভাবে লক্ষণীয় যে, একটি গােলাপ ফুলের পাপড়ির মধ্যে যে বিভিন্ন রং এর সমাহার রয়েছে তা কি সকল যামানার শিল্পীদের জন্য এক অত্যাশ্চর্য শিল্পকার্য হিসাবে বিবেচিত। এমনিভাবে আল্লাহ রব্বুল আলামীন এর কীর্তিসমূহকে আল কোরআনের মধ্যে এমনভাবে বর্ণনা করা হয়েছে, যা কোনাে মানুষের পক্ষে বর্ণনা করা সম্ভব নয়।  *আল কোরআনের কিছু চিরন্তন আবেদন : ‘আলিফ-লাম-মীম’ রব্বুল আলামীন-এর পক্ষ থেকে প্রেরিত হয়েছে এই আল-কিতাব। এটিই একমাত্র সত্য ও নির্ভুল কিতাব। এর মধ্যে সন্দেহের কোনাে অবকাশ নেই। এইটিই সেই চুড়ান্তভাবে সুরক্ষিত কিতাব। আল্লাহ তায়ালার কথা ও কাজের মধ্যে সুস্পষ্টভাবে যে সামঞ্জস্য বিরাজ করছে সেই বিষয়টিকে চূড়ান্ত সত্যরূপে তুলে ধরার জন্যই এইভাবে ‘না সূচক’ বাক্য ব্যবহার দ্বারা এ কিতাবের সত্যতা ঘােষণা করা হয়েছে; অর্থাৎ বলিষ্ঠভাবে আহ্বান জানানাে হচ্ছে যেন মানুষ আল্লাহ তায়ালার চিরন্তন ও অমােঘ এ সত্য কিতাবটিকে বুঝার জন্যে সন্দেহমুক্ত মন নিয়ে অধ্যয়ন করে এবং বাস্তবতার নিরীখে সৃষ্টি রহস্যগুলাে বুঝার চেষ্টা করে। এ জন্য সাংকেতিক কয়েকটি অক্ষরের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা এমন কিছু রহস্যের দিকে ইংগীত করেছেন, যে বিষয়ে বিতর্ক তােলার ক্ষমতা কোনাে বান্দার থাকতে পারে না। সাংকেতিক এ অক্ষরগুলাে দ্বারা এ কথাই বলতে চাওয়া হয়েছে যে, উল্লেখিত এ অক্ষরগুলাের অনুরূপ অক্ষরসমূহের মাধ্যমে আল কোরআন রচিত হয়েছে এবং সেই কথাগুলােকে এমন এক বাচনভংগীতে ব্যক্ত করা হয়েছে, যার অনুপম চমৎকারিত্ব অন্তরকে বিমুগ্ধ করে, যার প্রতিটি কথা ভারসাম্যপূর্ণ এবং এতাে পরিমাপ মতাে এর প্রত্যেকটি ব্যবহৃত হয়েছে যার বিকল্প অন্য কোনাে পদ্ধতি কেউ চিন্তাও করতে পারে না। এ পাক কালামের প্রতিটি আয়াত ও প্রত্যেকটি সূরার মধ্যে এমন কিছু বিস্ময়কর উপাদান রয়েছে যা অন্তরকে কাপিয়ে তােলে এবং এ কালামের মধ্যে এমন গােপন শক্তি লুকিয়ে রয়েছে যা যে কোন হৃদয়ানুভূতিকে প্রচন্ডভাবে আন্দোলিত করে। যতোবারই মানুষ আল কুরআন খুলে অধ্যয়ন শুরু করে ততােবারই সে তার গােটা অস্তিত্বের মধ্যে এক অভাবনীয় পরিবর্তন অনুভব করে। অধ্যয়নকালে তার গােটা সত্ত্বা পরম পুলক অনুভব করে, তার ধমনীতে এক অভিনব সুর বাজতে থাকে, সে আত্মহারা হয়ে ছত্রের পরে ছাত্র পড়তে থাকে আর তার হৃদয়তন্ত্রীতে পাক পরওয়ারদেগারের মধুর বাণী ঝংকৃত হতে থাকে, আর এ বাণী ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হতে থাকে এক মুখ থেকে অন্য মুখে। অতএব বলুন, এ অপ্রতিরোধ্য আবেগ উচ্ছাস কে থামাতে পারে। তাই তাে অবাক বিস্ময়ে আমরা দেখতে পাই, আল কোরআন যেথায় পঠিত হয় শত্ৰু-মিত্র সবার মধ্যে এ মহান কালাম যেন এক যাদুর পরশ বুলিয়ে দেয়। বিরােধিতায় যারা সংকল্পবদ্ধ, এ কালামের আহ্বান যারা স্তব্ধ করে দিতে চায়, তাদের অজান্তেই কখন যে তারা এ মহাবাণীর প্রচারকে পরিণত হয়ে যায় তা তারা নিজেরাই টের পায় না। মহাবিশ্বের সর্বত্র অগণিত অবহেলিত মানুষের মর্মপীড়া দূর করার আহ্বান নিয়ে যে মহান কালাম এসেছিলাে, শিক্ষা সংস্কৃতির সম্প্রসারণের সাথে সাথে তা দিগ্বিজয়ী অশ্বের মতাে ছুটে চলেছে দেশ থেকে দেশ দেশান্তরে, যার গতিরােধ করতে গিয়ে সত্য বিরােধী সম্মিলিত শক্তিবর্গ পাগলপ্রায় হয়ে তাদের ব্যর্থ প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। তাহলে কি এটা এক অন্ধ আবেগ? না, এ হচ্ছে যুক্তির শক্তি, চিরন্তন সত্যের শক্তি, এ হচ্ছে আল কিতাবের মহাশক্তি, যে শক্তির সামনে পৃথিবীর সকল শক্তি মাথা নত করতে বাধ্য; বরং আরও খেয়াল করার বিষয় এ পাক কালামের অনির্বাচনীয় অভিব্যক্তির মধ্যে প্রচ্ছন্ন রয়েছে এমন কিছু শক্তি যার সামনে পৃথিবীর সমুদয় শক্তির সম্মিলিত অগ্রযাত্রা থমকে দাড়াতে বাধ্য। এ কিতাবের ধারক ও বাহকদের সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে এ মহাগ্রন্থের অধ্যয়ন, প্রচার ও প্রসারে এগিয়ে যাওয়া এবং এর আরকান ও আহকামকে দুনিয়ার বুকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সকল ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা চালানাে সব চেয়ে বড় প্রয়ােজন। কিন্তু এটা মনে করা ঠিক হবে না যে, আল কোরআন শুধুমাত্র একটি ভয়ের জিনিস এবং এক অবােধ্য হৃদয়াবেগ আনয়নকারী গ্রন্থ মাত্র; বরং মানব প্রকৃতির নিকট যখন আল কোরআন সরাসরি দাওয়াত পেশ করে তখন কোনাে হৃদয় মন বলে ওঠে যে, এ মধুর আবেদন কখনও বৃথা যেতে পারে না! এ মহান কিতাবের উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হবেই, যতােই অন্তর দিয়ে যাচাই বাছাই করা হােক না কেন, যতই যুক্তি বুদ্ধি দিয়ে চিন্তা করা হােক না কেন, মানুষের মন-মগজে জ্ঞান-গরিমার ভান্ডার যতাে প্রশস্তই হােক না কেন, আল কোরআনের মধ্যে বর্ণিত জ্ঞান-বিজ্ঞান সম্পর্কিত সকল কথা অনুধাবন করতে কেউই কোনােদিন সক্ষম হবে না এবং যতােই সময় পার হতে থাকবে ততােই মানব সভ্যতার জন্য প্রয়ােজনীয় উপায়-উপাদানের সম্ভার আরও বেশী মানুষের গােচরীভূত হতে থাকবে, অবশ্য এর জন্য শর্ত হচ্ছে আল কোরআনের ওপর অবিচল আস্থা থাকতে হবে এবং কোনাে অবস্থাতেই মানুষের স্বাধীন খেয়াল খুশী ও ইচ্ছাকে এর ওপর প্রাধান্য দেয়া যাবে না। এ কথা মনে রাখতে হবে যে, আলকোরান কোনাে মানুষের তৈরী নয়, এ পাক কালাম সেই কিতাব, যা আরশে মুয়াল্লায় অবিকল এই ভাবে এবং এই ভাষাতেই লিপিবদ্ধ রয়েছে যেভাবে মােহাম্মদ(স.)-এর নিকট নাযিল হয়েছে। ইতিপূর্বে যত কিতাব নাযিল হয়েছে সে সবই এ ‘আল কিতাবের মধ্যে থেকে গৃহীত হুকুম আহকাম সম্বলিত অন্যান্য ভাষায় ব্যক্ত কিতাব। কিন্তু সপ্ত আকাশের ওপর লিপিবদ্ধ রব্বুল আলামীন-এর নিকট থেকে আসা ‘আল কিতাব’ অবিকল সে ভাব ও ভাষা সহ একমাত্র মুহাম্মদ(স.)-এর নিকটই নাযিল হয়েছে, এতপর এর মধ্যে কোন সন্দেহ নেই। তাই এরশাদ হচ্ছে, ‘ওরা কি বলছে, সে এ কিতাবকে বানিয়ে নিয়েছে নাকি?’ ওরা নিজেরা যেমন কলুষিত চরিত্রের মানুষ এবং যেভাবে নিজেরা নােংরা চিন্তা ও ধারণা পােষণ করে, সেই ভাবেই আল কোরআনের বাহক মােহাম্মদ(স.) সম্পর্কে মন্তব্য করে; তাই এ প্রসংগে ওদের সম্পর্কে ঘৃণার সাথেই উচ্চারিত হয়েছে, ‘ওরা কি বলছে, সে নিজে তৈরী করে- এ কথা বলছে।’ আসলে কোনােভাবেই মােহাম্মদ(স.) সম্পর্কে এভাবে কথা বলা ওদের শােভা পায় না, যেহেতু তাদের সামনে দীর্ঘ জীবনের ইতিহাস বর্তমান রয়েছে। তাঁর জীবনের দীর্ঘ একটি বয়স তাদের মধ্যেই কেটেছে। কোনাে লেখাপড়া শেখার সুযােগ তাঁর হয়নি এবং কারও কাছে গিয়ে শেখার মতাে অবসরও তার ছিল না, এসব কারণগুলাে সামনে রাখলে কোনাে সন্দেহ থাকার। সুযােগ থাকে না যে, এটা আল্লাহ তায়ালারই কালাম । তাই এরশাদ হচ্ছে, ‘বরং এটাই সেই মহাসত্য যা তােমার রব-এর পক্ষ থেকে এসেছে।’ একমাত্র সত্য যা চিরন্তন সত্য আল্লাহ পাকের নিকট থেকে নাযিল হয়েছে এবং যা মানুষের প্রকৃতি সংগত এবং যা বিশ্ব প্রকৃতির সাথেও পুরােপুরিভাবে সামঞ্জস্যশীল। এ হচ্ছে সেই মহাসত্য যা চিরদিন প্রকৃতির বুকে বিরাজ করছে, যার বহিপ্রকাশ সবখানে ও সবার নযরে প্রতিভাত। এ সত্য ব্যাপারটি সৃষ্টির সব কিছুর মধ্যে পরিপূর্ণ নিয়ম-শৃংখলার সাথে চিরদিন চলে এসেছে এবং চিরদিন থাকবে। প্রকৃতির বুকে বিরাজমান এ সত্যের বহিপ্রকাশের কোন কিছুর মধ্যে পারস্পরিক কোন দ্বন্দ্ব নেই। এ মহা সত্য আল কিতাব। এই সত্য কিতাবই গােটা সৃষ্টির বুকে বিরাজমান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন-এর বিশাল সাম্রাজ্যের প্রতিনিধিত্বকারী কিতাব। সর্বত্র বিরাজমান চরম ও পরম সত্যের প্রতিচ্ছবি এ কিতাব। আল কিতাবের চৌহদ্দীতে তা শব্দ ও ভাষা আকারে বিস্তৃত হয়েছে। এ হচ্ছে সেই মহাসত্য কিতাব, যা মহান আল্লাহ তায়ালা চূড়ান্ত কিতাব হিসাবে এবং শেষবারের মতাে করে পাঠিয়েছেন এবং এই কিতাবের মাধ্যমেই তিনি সেই সব মানুষকে সংঘবদ্ধ মানব গােষ্ঠীতে পরিণত করবেন যারা তার সন্তুষ্টি পেতে চায়, যারা চায় এ কিতাব থেকে তাদের জীবনের সমস্যাসমূহের সমাধান পেতে, যারা এ পাক কালামের মধ্যে বর্ণিত সকল আইন কানুনকে বাস্তবায়িত করার জন্য বদ্ধপরিকর, যারা তাদের ও অপর মানবগােষ্ঠীর মধ্যে বিরাজমান সংকটসমূহকে এই কিতাবের মাধ্যমেই নিরসন করতে চায় এবং চায় এ কিতাবের মাধ্যমেই শান্তিপূর্ণভাবে তাদের পারস্পরিক সাহায্য সহযােগিতা বাড়াতে ও নিজেদের মধ্যে সমঝোতা এবং মেলামেশার ক্ষেত্র প্রসারিত করতে। প্রকৃতপক্ষে এই কিতাবের মাধ্যমেই পূর্ণ সততা ও সত্যবাদিতা নিয়ে মহাবিশ্বের এ রাজ্যে তারা নিজেদের জন্য এবং অপরের জন্য শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবে। এ মহাসত্য কিতাবের বিধানকে যখন বাস্তব জীবনে চালু করা হবে একমাত্র তখনই এর প্রতিটি কথার যথার্থতা মানুষ বুঝতে সক্ষম হবে এবং অন্তর-প্রাণ দিয়ে এবং পরিপূর্ণ মােহাব্বতের সাথে তারা এ কিতাবকে গ্রহণ করতে পারবে। তখন তারা দেখতে পাবে এর প্রতিটি কথাকে বাস্তবায়িত করা কতাে সহজ ও কতাে সুন্দর। তখন এ কালামের কোনাে কথাকেই গ্রহণ করা কারও জন্য কোনাে কষ্টকর বলে মনে হবে না; কারণ তখন তারা এর মধ্যে বর্ণিত প্রত্যেকটি কথাকে দেখতে পাবে চিরসত্য, চির বাস্তব এবং চিরসুন্দর। এ পাক কিতাব এমন সত্য বহন করে এনেছে যা সকল বিচ্ছিন্ন জনগােষ্ঠীকে একত্রিত করে, তাদের মধ্যে বৈষম্য বা মতভেদ দূর করে দেয়, তাদের হৃদয়গুলােকে ভালােবাসার বন্ধনে আবদ্ধ করে এবং যারা এর সংস্পর্শে আসে তাদেরকে এর বিধানসমূহকে পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়িত করতে উদ্বুদ্ধ করে। পৃথিবীর কোনাে দেশে যখনই এর বিধানগুলােকে বাস্তবায়িত করা হয়েছে তখনই দেখা গেছে এর শক্তি কতাে মযবুত, কতাে অমােঘ এবং কতাে অপ্রতিরােধ্য, তখনই মানুষ দেখতে পেয়েছে মানব জীবনের সমস্যাসমূহের সমাধান দানে এ কিতাব কতো বেশী কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম। যে কোনাে এলাকায় আল কোরআনের বিধানকে পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়িত করা হয়েছে সেখানকার ঝগড়া-বিবাদ এবং সকল সমস্যাকে শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান করা সম্ভব হয়েছে; সমাধান দিয়েছে এ মহান কিতাব সকল প্রকার দুর্বলতা, বিপদ-আপদ এবং সে সব বিশৃংখলার যা মানুষের মন মস্তিষ্ককে সাধারণভাবে বিপর্যস্ত করে। এ কিতাব এমনসব সত্য বহন করে এনেছে যা দুনিয়া ও আখেরাতে কারও ওপর যুলুম করে না, কোন মানুষের মানসিক বা দৈহিক শক্তি ক্ষমতার ওপর অযৌক্তিক কোনাে চাপ প্রয়ােগ করে না, চিন্তাধারার স্বাধীনতা বিনষ্ট করে না, অথবা দুনিয়ায় স্বাধীনভাবে তার কার্যকলাপ ও চলাফেরার ওপরও এমন কোনাে বাধা সৃষ্টি করে না যার কারণে তার অস্তিত্ব বিলুপ্তির আশংকা দেখা দিতে পারে অথবা তার উন্নতি বিঘ্নিত হতে পারে। এটা সত্য কথা, যতােদিন আল কোরআনে উপস্থাপিত মহাশক্তির সাথে মানুষ ঐক্যমত পােষণ করতে থাকবে এবং এ পবিত্র কিতাবের নির্দেশমতাে জীবনের সকল বিষয়াদিকে পরিচালনা করতে থাকবে ততদিন তাদের ওপর সকল দিক থেকে শান্তি ও সমৃদ্ধির বারিধারা বর্ষিত হতে থাকবে। এর কারণ জানাতে গিয়ে আল্লাহ পাক বলছেন, ‘বরং এটাই হচ্ছে সেই একমাত্র সত্য, যা তােমার রব-এর পক্ষ থেকে এসেছে’ অর্থাৎ, আল্লাহ তায়ালা নিজেই জানাচ্ছেন; অবশ্যই এ কিতাব এটা তােমার নিজের পক্ষ থেকে আনা হয়নি, এ কিতাব এসেছে তােমার রব-এর পক্ষ থেকে, যিনি বিশ্বজগতের প্রতিপালক, যেমন পূর্ববর্তী আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। পূর্ববর্তী কথার প্রতি শ্রদ্ধা দেখাতে গিয়েই এখানে পেছনের কথাটির পুনরাবৃত্তি করা হলাে; এ শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা হয়েছে রসূলুল্লাহ(স.)-এর প্রতি, সেই রসূলের প্রতি যাকে ওরা দোষারােপ করছিল যে, তিনি নিজেই এ কিতাব রচনা করেছেন এবং তারা এ তােহমতও তাকে দিচ্ছিল যে তিনি রব্বুল আলামীনের সাথে নিকটাত্মীয়তার সম্পর্কের দাবীদার। এ জন্য অত্যন্ত জোরালাে ভাষায় তোহমতের জবাব দেয়া হয়েছে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন-এর সাথে তার সঠিক ও সম্মানজনক সম্পর্কের কথা জানানাে হয়েছে এবং তাকে আল্লাহ তায়ালার কথা মানুষের কাছে পৌছে দেয়ার দায়িত্ব দান করা হয়েছে এবং তাকে দ্বীন ইসলাম দুনিয়ার মানুষের মধ্যে প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করার আমানত দিয়ে পাঠানাে হয়েছে ওপরের আয়াতাংশে সেই কথাটাকেই সুস্পষ্টভাবে ঘােষণা দেয়া হয়েছে। বলা হচ্ছে, ‘যেন তুমি ভীতি প্রদর্শন কর এমন এক জাতিকে যাদের কাছে তােমার নিকট অতীতে কোনাে সতর্ককারী আসেনি, (আশা করা যায় এর ফলে) তারা সঠিক পথ গ্রহণ করবে।’ যে আরববাসীদের নিকট মােহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম প্রেরিত হয়েছিলেন তাদের নিকট ইতিপূর্বে আর কোন রাসূল প্রেরিত হননি, এমন ইতিহাস পাওয়া যায় না যে, প্রথম আরববাসীদের দাদা ইসমাঈল(আ.) ও মােহাম্মদ(স.)-এর মধ্যবর্তী সময়ের মধ্যে আর কোনাে রসূল এসেছেন। তাই, আল্লাহ রব্বুল আলামীন তাদেরকে সতর্ক করার জন্য এই সত্য সঠিক আল কিতাব পাঠালেন, যার মধ্যে এমন সত্য নিহিত রয়েছে যা, মানব-প্রকৃতি ও তাদের অন্তরকে আকর্ষণ করে। এই হচ্ছে সেই জাতি যাদের নিকট আল্লাহ তায়ালা এই আল কিতাব প্রেরণ করেছেন যাতে করে তার রসূল এই কিতাবের সাহায্যে তাদেরকে সতর্ক করেন। ওরা আল্লাহ তায়ালার সাথে অনেক অংশীদার খাড়া করে নিয়েছিলাে।

তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-

নামকরণ:

এ সূরা সাজদাহ নামে নামকরণের অন্যতম একটি দিক হল সূরার ১৫ নং আয়াতে মু’মিনদের একটি অন্যতম গুণ বর্ণনা করা হয়েছে, তা হল তাদের সামনে যখন আল্লাহ তা‘আলার নিদর্শনাবলী স্মরণ করিয়ে দেয়া হয় তখন তারা সিজদায় লুটিয়ে পড়ে। মূলত উক্ত আয়াতটি করলে বা শুনলে তেলাওয়াত সিজদার বিধান রয়েছে।

ফযীলত:

আবূ হুরাইরাহ (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জুমু‘আর দিন ফজরের সালাতে আলিফ-লাম-মীম তানযীল, আস-সাজদাহ এবং হাল আতা আলাল ইনসান পাঠ করতেন। অর্থাৎ সূরা সাজদাহ এবং দাহর পাঠ করতেন। (সহীহ বুখারী হা: ৮৯৭, সহীহ মুসলিম হা: ৮৮০)

অন্য এক বর্ণনাতে আছে, জাবের হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সূরা সাজদাহ এবং সূরা মুলক পাঠ না করে রাতে ঘুমাতেন না। (তিরমিযী হা: ২৮১২, মিশকাত হা: ২১৫৫, সহীহ)

১-৩ নং আয়াতের তাফসীর:

الٓمّ (আলিফ-লাম-মীম) এ জাতীয় “হুরূফুল মুক্বাত্বআত” বা বিচ্ছিন্ন অক্ষর সম্পর্কে সূরা বাকারার শুরুতে আলোচনা করা হয়েছে। এর উদ্দেশ্য একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাই ভাল জানেন।

কাফির-মুশরিকরা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে এবং তাঁর প্রতি অবতারিত কিতাব কুরআনকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করত, সে কথার জবাব দিয়ে আল্লাহ তা‘আলা বলছেন: এ কুরআন মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রচনা করেনি বরং এটি বিশ্বজগতের প্রতিপালক মহান আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকেই অবতারিত কিতাব, এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(تَبٰرَكَ الَّذِيْ نَزَّلَ الْفُرْقَانَ عَلٰي عَبْدِه۪ لِيَكُوْنَ لِلْعٰلَمِيْنَ نَذِيْرَا)

“কত বরকতময় তিনি যিনি তাঁর বান্দার প্রতি ফুরকান অবতীর্ণ করেছেন যাতে সে বিশ্বজগতের জন্য সতর্ককারী হতে পারে!” (সূরা ফুরকান ২৫:১) আর এ কুরআন নাযিল করার কারণ হল যে, যাতে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এমন এক সম্প্রদায়কে সতর্ক করতে পারেন যাদের নিকট ইতোপূর্বে কোন নাবী-রাসূল আগমন করেনি। যাতে তারা সত্যের অনুসরণ করে পরিত্রাণ লাভ করতে পারে। কেননা আল্লাহ তা‘আলা কোন জাতির কাছে রাসূল প্রেরণ না করা পর্যন্ত সে জাতিকে তাদের অবাধ্যতার কারণে শাস্তি দেন না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(وَمَا كُنَّا مُعَذِّبِيْنَ حَتّٰي نَبْعَثَ رَسُوْلًا)

“আমি রাসূল না পাঠান পর্যন্ত‎ কাউকেও শাস্তি‎ দেই না।” (সূরা ইসরা ১৭:১৫)

সুতরাং কুরআন কারো তৈরি করা কিতাব নয়, বরং তা সারা বিশ্বের মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে নাযিলকৃত একটি আসমানী কিতাব। এটি নাযিল করা হয়েছে মানুষকে পথভ্রষ্ট হওয়া থেকে হিদায়াতের পথে বের করে আনার জন্য।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:

১. কুরআন আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে অবতীর্ণ কিতাব, এতে কোন প্রকার সন্দেহ নেই। আর এটা রচনা করা কোন মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়।
২. কুরআন নাযিল করার উদ্দেশ্য হল মানুষকে সতর্ক করে ভ্রান্ত পথ থেকে সঠিক পথে নিয়ে আসা।

তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-

হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) জুমআর দিন ফজরের নামাযে ‘আলিফ-লাম-মীম-তানযীল আস্-সাজদাহ’ এবং ‘হাল আতা আলাল ইনসানে’ পাঠ করতেন। (এ হাদীসটি ইমাম বুখারী (রঃ) কিতাবুল জুমআ’র মধ্যে বর্ণনা করেছেন)

হযরত জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী (সঃ) আলিফ-লামমীম-তানযীল আস্-সাজদাহ’ এবং তাবারাকাল্লাযী বিইয়াদিহিল মুক’ এ দু’টি সূরা (রাত্রে) তিলাওয়াত না করে ঘুমাতেন না। (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

১-৩ নং আয়াতের তাফসীর

সূরাসমূহের শুরুতে যে হুরূফে মুকাত্তাআ’ত রয়েছে ওগুলোর পূর্ণ আলোচনা আমরা সূরায়ে বাকারার তাফসীরের শুরুতে করে এসেছি। সুতরাং এখানে পুনরাবৃত্তির কোন প্রয়োজন নেই। এটা নিঃসন্দেহে সত্য যে, এই কিতাব আল -কুরআন আল্লাহ রাব্বল আলামীনের নিকট হতে অবতীর্ণ হয়েছে। মুশরিকদের এ কথা সম্পূর্ণরূপে মিথ্যা যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) এটা স্বয়ং রচনা করেছেন। না, না, এটা তো চরম সত্য কথা যে, এ কিতাব স্বয়ং আল্লাহ তা’আলার পক্ষ হতে অবতীর্ণ করা হয়েছে। এটা এজন্যেই অবতীর্ণ করা হয়েছে যেন রাসূলুল্লাহ (সঃ) এমন কওমকে ভয় প্রদর্শন করেন যাদের কাছে তার পূর্বে কোন নবী আগমন করেননি। যাতে তারা সত্যের অনুসরণ করে পরিত্রাণ লাভ করতে পারে।

أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(Book#1039)
[Sura:32:As-Sajda brief discussion]
www.motaher21.net
Sura:32:As-Sajda
Para:21
Ayat: – 1-3
32:1

الٓـمّٓ ۚ﴿۱﴾

Alif, Lam, Meem.

 

The Qur’an is the Book of Allah in which there is no Doubt

Allah says;

الم

Alif Lam Mim.

We discussed the individual letters at the beginning of Surah Al-Baqarah, and there is no need to repeat it here

32:2

تَنۡزِیۡلُ الۡکِتٰبِ لَا رَیۡبَ فِیۡہِ مِنۡ رَّبِّ الۡعٰلَمِیۡنَ ؕ﴿۲﴾

[This is] the revelation of the Book about which there is no doubt from the Lord of the worlds.

 

تَنزِيلُ الْكِتَابِ لَا رَيْبَ فِيهِ

The revelation of the Book in which there is no doubt,

means, there is no doubt whatsoever that it has been revealed.

مِن رَّبِّ الْعَالَمِينَ

from the Lord of all that exists.

Then Allah tells us about the idolators

32:3

اَمۡ یَقُوۡلُوۡنَ افۡتَرٰىہُ ۚ بَلۡ ہُوَ الۡحَقُّ مِنۡ رَّبِّکَ لِتُنۡذِرَ قَوۡمًا مَّاۤ اَتٰہُمۡ مِّنۡ نَّذِیۡرٍ مِّنۡ قَبۡلِکَ لَعَلَّہُمۡ یَہۡتَدُوۡنَ ﴿۳﴾

Or do they say, “He invented it”? Rather, it is the truth from your Lord, [O Muhammad], that you may warn a people to whom no warner has come before you [so] perhaps they will be guided.

 

أَمْ يَقُولُونَ افْتَرَاهُ

Or say they:”He has fabricated it”:

they say, he has fabricated it, i.e., he has made it up by himself.

بَلْ هُوَ الْحَقُّ مِن رَّبِّكَ لِتُنذِرَ قَوْمًا مَّا أَتَاهُم مِّن نَّذِيرٍ مِّن قَبْلِكَ لَعَلَّهُمْ يَهْتَدُونَ

Nay, it is the truth from your Lord, so that you may warn a people to whom no warner has come before you, in order that they may be guided.

means, in order that they may follow the truth

For getting Quran app: play.google.com/store/apps/details?id=com.ihadis.quran

Leave a Reply