(টপিক#১০৪৩) [আল্লাহ রব্বুল আলামীন-এর কিছু গুণাবলীর বর্ণনা:-] www.motaher21.net সূরা:- ৩২:আস-সাজদাহ পারা:২১ ৪- ১১ নং আয়াত:-

أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#১০৪৩)
[আল্লাহ রব্বুল আলামীন-এর কিছু গুণাবলীর বর্ণনা:-]
www.motaher21.net
সূরা:- ৩২:আস-সাজদাহ
পারা:২১
৪- ১১ নং আয়াত:-
৩২:৪
اَللّٰہُ الَّذِیۡ خَلَقَ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضَ وَ مَا بَیۡنَہُمَا فِیۡ سِتَّۃِ اَیَّامٍ ثُمَّ اسۡتَوٰی عَلَی الۡعَرۡشِ ؕ مَا لَکُمۡ مِّنۡ دُوۡنِہٖ مِنۡ وَّلِیٍّ وَّ لَا شَفِیۡعٍ ؕ اَفَلَا تَتَذَکَّرُوۡنَ ﴿۴﴾
আল্লাহ; যিনি আকাশমন্ডলী, পৃথিবী এবং ওদের অন্তর্বর্তী সমস্ত কিছু ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তিনি আরশে সমাসীন হন। তাঁর বিরুদ্ধে তোমাদের কোন অভিভাবক অথবা সুপারিশকারী নেই; তবুও কি তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে না?
৩২:৫
یُدَبِّرُ الۡاَمۡرَ مِنَ السَّمَآءِ اِلَی الۡاَرۡضِ ثُمَّ یَعۡرُجُ اِلَیۡہِ فِیۡ یَوۡمٍ کَانَ مِقۡدَارُہٗۤ اَلۡفَ سَنَۃٍ مِّمَّا تَعُدُّوۡنَ ﴿۵﴾
তিনি আকাশ হতে পৃথিবী পর্যন্ত সকল বিষয় পরিচালনা করেন, অতঃপর সমস্ত কিছুই তাঁর দিকে ঊর্ধ্বগামী হয় এমন এক দিনে — যা তোমাদের গণনায় হাজার বছরের সমান।
৩২:৬
ذٰلِکَ عٰلِمُ الۡغَیۡبِ وَ الشَّہَادَۃِ الۡعَزِیۡزُ الرَّحِیۡمُ ۙ﴿۶﴾
তিনিই প্রত্যেকটি অদৃশ্য ও দৃশ্যমানকে জানেন, মহাপরাক্রমশালী ও করুণাময় তিনি।
৩২:৭
الَّذِیۡۤ اَحۡسَنَ کُلَّ شَیۡءٍ خَلَقَہٗ وَ بَدَاَ خَلۡقَ الۡاِنۡسَانِ مِنۡ طِیۡنٍ ۚ﴿۷﴾
যে জিনিসই তিনি সৃষ্টি করেছেন উত্তম রূপে সৃষ্টি করেছেন। তিনি মানুষ সৃষ্টির সূচনা করেছেন কাদামাটি থেকে,
৩২:৮
ثُمَّ جَعَلَ نَسۡلَہٗ مِنۡ سُلٰلَۃٍ مِّنۡ مَّآءٍ مَّہِیۡنٍ ۚ﴿۸﴾
তারপর তিনি তার বংশ উৎপন্ন করেন তুচ্ছ তরল পদার্থের নির্যাস থেকে।
৩২:৯
ثُمَّ سَوّٰىہُ وَ نَفَخَ فِیۡہِ مِنۡ رُّوۡحِہٖ وَ جَعَلَ لَکُمُ السَّمۡعَ وَ الۡاَبۡصَارَ وَ الۡاَفۡـِٕدَۃَ ؕ قَلِیۡلًا مَّا تَشۡکُرُوۡنَ ﴿۹﴾
পরে তিনি ওকে সুঠাম করেছেন এবং তাঁর নিকট হতে ওতে জীবন সঞ্চার করেছেন এবং তোমাদেরকে দিয়েছেন চোখ, কান ও অন্তর। তোমরা অতি সামান্যই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।
৩২:১০
وَ قَالُوۡۤا ءَ اِذَا ضَلَلۡنَا فِی الۡاَرۡضِ ءَ اِنَّا لَفِیۡ خَلۡقٍ جَدِیۡدٍ ۬ؕ بَلۡ ہُمۡ بِلِقَآیِٔ رَبِّہِمۡ کٰفِرُوۡنَ ﴿۱۰﴾
আর তারা বলে, ‘আমরা মাটিতে হারিয়ে গেলেও কি আমরা হবো নূতন সৃষ্টি?’ বরং তারা তাদের রবের সাক্ষাতের সাথে কুফরিকারী।
৩২:১১
قُلۡ یَتَوَفّٰىکُمۡ مَّلَکُ الۡمَوۡتِ الَّذِیۡ وُکِّلَ بِکُمۡ ثُمَّ اِلٰی رَبِّکُمۡ تُرۡجَعُوۡنَ ﴿٪۱۱﴾
বলুন, ‘তোমাদের জন্য নিযুক্ত মৃত্যুর ফেরেশতা তোমাদের প্রাণ হরণ করবে । তারপর তোমাদের রবের কাছেই তোমাদেরকে ফিরিয়ে নেয়া হবে।’

ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-

এই পর্যায়ে এসে আল্লাহ রব্বুল আলামীন-এর গুণাবলীর বর্ণনা প্রদান শুরু হচ্ছে, যেন সেসব গুণাবলীর কথা শুনে তারা পাক-পরওয়ারদেগার মহান আল্লাহ তায়ালার সার্বভৌম ক্ষমতার কথা সম্যকভাবে উপলব্ধি করতে পারে এবং পার্থক্য করতে পারে সেই মহান সত্ত্বার মধ্যে যার মাঝে ‘আল্লাহ’ শব্দটির গুণাবলী রয়েছে এবং তাদের মধ্যে যাদের মাঝে সে শব্দটির কোনাে গুণই বর্তমান নেই এবং তারা কাউকে কোনভাবে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন-এর সমকক্ষ মনে করে না, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন-এর মর্যাদার স্তরেও কাউকে তােলে না। তাই এরশাদ হচ্ছে, ‘তিনিই হচ্ছেন সেই আল্লাহ তায়ালা যিনি আসমান যমীন সৃষ্টি করেছেন…(আয়াত ৪-৯) হাঁ, (যাঁর কথা ওপরের আয়াতগুলােতে বলা হয়েছে) তিনিই আল্লাহ এবং পৃথিবীতে চতুর্দিকে আমরা যা কিছু দেখতে পাচ্ছি তা সবই আল্লাহ তায়ালার সার্বভৌমত্বের অনুপম নিদর্শন এবং তার অস্তিত্বের প্রমাণ বহন করে চলেছে। সৃষ্টিজগতের পাতায় পাতায় বিরাজমান এসব নিদর্শন আমাদের চোখের সামনে সদা সর্বদা ভাসছে এবং আরও কিছু বিষয় আছে যা আমরা চোখেও দেখি না; যেহেতু আমাদের সীমাবদ্ধ দৃষ্টিতে সব কিছু দেখা সম্ভব নয়, কিন্তু হৃদয়ের গভীরে সে সব বিষয়ের অস্তিত্ব আমরা অনুভব করি। আমরা জানি না কিভাবে প্রথম মানুষটির সৃষ্টি হয়েছিল, একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই তার সুস্পষ্ট কিতাবের মাধ্যমে সেসব বিষয় সম্পর্কে আমাদেরকে জানিয়েছেন। এরশাদ হচ্ছে, ‘আল্লাহ তায়ালাই সেই মহান সত্ত্বা, যিনি আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী এবং এ দুয়ের মধ্যবর্তী যা কিছু আছে সব কিছুকেই সৃষ্টি করেছেন। আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী এবং এ দুয়ের মাঝে বিদ্যমান এ বিশাল সৃষ্টি জগত সবই মহান আল্লাহ রব্বুল আলামীন-এর ইচ্ছাতে বাস্তবে এসেছে। এগুলাে সম্পর্কে আমরা অতি সামান্যই জানি, বেশীরভাগ কথাই আমরা জানি না। কতাে আর আমরা গুণতে পারি আল্লাহ পাকের এ সব নিদর্শন, যা মহাবিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছে, সত্যিই আমরা গভীরভাবে যখন এসব কিছুর দিকে দৃষ্টিপাত করি তখন আমাদের বুদ্ধি খেই হারিয়ে ফেলে, চিন্তা শক্তি জবাব দিয়ে দেয় এবং এসব সৃষ্টি নৈপুণ্য দেখে হয়রান পেরেশান হয়ে আমাদের দৃষ্টি ফিরে আসে, এসব কিছুর মধ্যে বিরাজমান ভারসাম্য এবং অকল্পনীয় শংখলা অবলােকনে চমৎকৃত হয়ে যেতে হয়, হ্যা, চিন্তাশীল যে কোন ব্যক্তিই দেখতে পায় যে সামগ্রিকভাবে সকল সৃষ্টির চমৎকারিত্বের মধ্যে, সব কিছুর সম্মিলিত সৌন্দর্যের মধ্যে এবং দৃশ্য-অদৃশ্য সব কিছুর মধ্যে বিরাজমান অভংগুর নিয়ম-শৃংখলার মধ্যে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন হাযির রয়েছেন। আল্লাহ রব্বুল আলামীন-এর সৌন্দর্যের এই পূর্ণাঙ্গতা কোন চর্ম চোখ দেখতে পায় না, কেউ তাকে তার চিন্তা ও অনুভূতির গন্ডীর মধ্যে আনতে পারে না, হৃদয় দিয়েও তার চিত্র আঁকা যায় না, যেহেতু অসীমকে সসীমে ধরা সম্ভব নয়, আর যতাে দীর্ঘকাল ধরেই তার অস্তিত্ব সম্পর্কে চিন্তা করা হােক না কেন কোনাে চিন্তাবিদ তার সম্পর্কে চিন্তা করে শেষ করতে পারে না এবং তার জন্য মােহাব্বত ও আকর্ষণ অনুভব করে অথবা তার কথা বারবার আলােচনা করে এবং জ্ঞান গবেষণা করেও তার সম্পর্কে সঠিক কোন উপলব্ধি কেউ পেতে পারে না। এ জন্যই তাকে জানতে হলে তার বৈচিত্রময় সৃষ্টির দিকে তাকাতে হবে; মানুষ, পশু পাখী কীটপতংগ, রং-বেরং-এর বৃক্ষ-লতা, ফল ও ফুলে ভরা এ বিশ্বময় বাগিচার দিকে আর তখনই বুঝা যাবে এ সব কিছু হচ্ছে এক রব্বুল আলামীন-এরই অস্তিত্বের নমুনা। দেখা যাবে যে, সব কিছুই একমাত্র একটি শক্তি-থেকে উৎসারিত হয়েছে এবং সব কিছুরই উৎসই সেই একই শক্তি-মূলের দিকে নিবদ্ধ- সব কিছু একই ইচ্ছা-কর্তৃক পরিচালিত হচ্ছে এ সবই একই বিধি-বিধান ও নিয়ম কানুন মেনে চলছে।   *বিশ্বজগতের সর্বত্র আল্লাহর সৃষ্টি ও সৌন্দর্য বিরাজমান : আল্লাহ কে?… তিনি সেই মহান সত্ত্বা যিনি সৃষ্টি করেছেন আকাশ মন্ডলী ও পৃথিবীকে, আর এ দুয়ের মাঝে যা কিছু আছে সে সবও তাঁরই সৃষ্টি, তিনিই সত্য ও চিরস্থায়ী, তিনি সকল কমতি থেকে পবিত্র তিনি সকল গুণের আধার।’ ‘তিনি আকাশ মন্ডলী ও পৃথিবী এবং এ দুয়ের মাঝে অবস্থিত সকল বস্তুকে ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন।’ এই ছয় দিন বলতে আমাদের গণনার ছয় দিন নয়। পৃথিবীতে আমাদের সময় পরিমাপ করার জন্য সূর্যের আনাগােনার ওপর ভিত্তি করে এই দিন গণনার রীতি চালু করা হয়েছে, আবর্তিত হয় রাত ও দিন এই ছােট্ট পৃথিবীর বুকে; কিন্তু এই পৃথিবীটাও একদিন ভেংগে চুরমার হয়ে যাবে এবং ধূলায় পরিণত হয়ে উড়তে থাকবে বিশাল বিশ্বের বুকে; আর সময়ের পরিমাপ করার এই যে ধারা এটা পৃথিবী ও চাঁদ সূর্য ইত্যাদি সৃষ্টি হওয়ার পর থেকেই তাে শুরু হয়েছে। সময় পরিমাপ করার এই মাপকাঠি দ্বারা, ছােট্ট এই পৃথিবীর বুকে বাস করাকালীন সময়ে আমরা উপকৃত হই। আল কোরআনে বর্ণিত এই ছয়দিনের প্রকৃত তাৎপর্য কি তা একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই জানেন। এর অর্থকে সীমাবদ্ধ করে দেয়া এবং এর পরিমাণ ঠিক করে দেয়ার কোনাে সাধ্য আমাদের নেই। এগুলাে হচ্ছে আল্লাহ তায়ালার বানানাে দিনগুলাের মধ্যে কয়েকটি দিন, যার সম্পর্কে তিনি বলছেন, ‘আর তােমার রব-এর কাছে যে সব দিন রয়েছে তার প্রত্যেকটি তােমাদের গণনার দিনের এক হাজার বছরের সমান।’ আল কোরআনে উল্লেখিত ছয়টি দিন হচ্ছে সেই সব দিন, যে অনুসারে আকাশমন্ডলী, পৃথিবী এবং এ দু’য়ের মধ্যবর্তী সব কিছু চলছে এবং এই ভাবেই এসব কিছু একদিন সব শেষ হয়ে যাবে। অথবা সে দিনগুলাে দ্বারা সৃষ্টির ছয়টি পর্যায়কে এবং ছয়টি গঠন প্রক্রিয়াকে বুঝানাে হয়েছে; অথবা বুঝানাে হয়েছে ছয়টি যামানাকে যার একটি এবং অন্যটির মাঝে ব্যবধান যে কতাে আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কেউ জানে না, তবে সন্দেহ নেই যে সে সময়কালটা দুনিয়ায় বসবাসকারী ধ্বংসশীল মানুষের গােনা সময়কাল থেকে ভিন্ন। সুতরাং এ কথাটাকে আমাদের আল্লাহ তায়ালার নিকট রক্ষিত অন্যান্য অদৃশ্য বিষয়ের মতােই বুঝতে হবে। অবশ্য উপরােক্ত কথা দ্বারা এ উদ্দেশ্যটি পূরণ করতে চাওয়া হয়েছে যে, মানুষ চূড়ান্তভাবে এ কথাটা মেনে নিক যে দুনিয়া জাহানে যা কিছু ঘটছে তা সবই আল্লাহ তায়ালার হেকমত ও জ্ঞান অনুযায়ী ঘটছে। আরও জানানাে হচ্ছে যে, এ মহাসৃষ্টির বুকে বিভিন্ন পর্যায়ে, বিভিন্ন সময়ে এবং বিভিন্ন অবস্থায় তিনি সৃষ্টি করেছেন, সব কিছুর মধ্যে তিনি অনবদ্য এক সৌন্দর্য দান করেছেন এবং সব কিছুর প্রতিই তার এহসান সুস্পষ্টভাবে বিরাজ করছে। এরপর তিনি সমাসীন হয়েছেন তার ক্ষমতায়। ‘আরশের ওপর অধিষ্ঠিত হয়েছেন’ কথাটা দ্বারা বুঝানাে হয়েছে যে গােটা সৃষ্টির বুকে সর্বত্র তিনি তার ক্ষমতাকে বিরাজমান করেছেন। আরশ বলতে সত্যিকারে কী বুঝায় তা খুব নিশ্চিতভাবে আমরা বলতে পারি না এবং এ শব্দটিকে ঠিক কোন বস্তুর ওপর প্রয়ােগ করা হবে তাও আমরা বলতে পারবাে না। এরপর ইসতাওয়া-শব্দটিও অনুরূপ একটি জটিল শব্দ। সুতরাং এটাই বুঝতে হবে যে শব্দ দুটি ইংগীতে আল্লাহ তায়ালার ক্ষমতার কথাকেই বুঝিয়েছে। এরপর ব্যবহৃত হয়েছে, ‘সুম্মা’ -এর দ্বারা কোন নির্দিষ্ট সময় পার হওয়ার পর কিছু বুঝানাে হয়েছে বলে আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারবাে না, কারণ আল্লাহ সােবহানাহর জন্য সময়ের পরিবর্তন কোনাে ব্যাপারই নয়, তিনি সদা-সর্বদা বর্তমান অথবা যখন খেয়াল করা হয় তখনই তার অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়, আসলে আমরা সীমিত জ্ঞান বুদ্ধির ও সীমিত বয়সের মানুষ। আমাদেরকে বুঝানাের জন্যই এই পর্যায়ক্রমিক চিন্তার কথা বলা হয়। অতপর বুঝতে হবে যে, ক্ষমতাধর হওয়ার অবস্থা, সৃষ্টি ক্রিয়ার ওপর তার এই গুণ কতাে বেশী প্রভাবশালী! এইভাবেই আমাদেরকে আল্লাহ তায়ালার ক্ষমতার কথা বুঝানাের চেষ্টা করা হয়ে থাকে। আল্লাহ রব্বুল আলামীন-এর শ্রেষ্ঠত্ব ঘােষণার মাধ্যমে মানুষের অন্তরে যে সত্যটি অনুভূত হয় তা হচ্ছে, ‘তােমাদের জন্য তিনি ছাড়া কোনাে অভিভাবক, বন্ধু এবং শাফায়াতকারী নেই।’ এ শাফায়াতকারী কোথায় হবে এবং কে হবে? তিনি পবিত্র, তিনিই তার সিংহাসনে এবং আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সর্বত্র তার ক্ষমতায় চিরদিন সমাসীন আছেন এবং সাবভীম ক্ষমতার মালিক একমাত্র তিনিই । তিনিই আকাশ মন্ডলী, পৃথিবী এবং এ দু’য়ের মধ্যবর্তী স্থানে যা কিছু আছে, সে সব কিছুর সৃষ্টিকর্তা! সুতরাং তিনি ছাড়া আর কে কোথায় বন্ধু বা অভিভাবক আছে? তার রাজ্যের বাইরে কোথাও কেউ শাফায়াতকারী আছে কি? তাই জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে, ‘(এসব অবস্থা সামনে রেখে) তােমরা কি শিক্ষা গ্রহণ করবে না?’ এই চরম ও পরম সত্যটিই অন্তরের মধ্যে আল্লাহ তায়ালাকে স্বীকার করার কথা মনে করিয়ে দেয়, একমাত্র তার দিকেই মনকে ঝুঁকিয়ে তােলে, অন্য কারও প্রতি নয়। আল্লাহ রব্বুল আলামীনই সকল কিছুর সৃষ্টিকর্তা, সর্বোচ্চ ক্ষমতার মালিক হওয়ার সাথে সাথে তিনি সবার জীবনের সার্বিক পরিচালক এবং সবার ভাগ্য নির্ধারণকারীও বটে! দুনিয়া ও আখেরাতে কার কি কি হবে সব কিছুই তিনি পূর্বে নির্ধারণ করে রেখেছেন, যার মধ্যে কেউ কোনাে পরিবর্তন আনার ক্ষমতা রাখে না। সুতরাং এটা ভালাে করেই বুঝতে হবে, আল্লাহ তায়ালার এই বিশাল সাম্রাজ্যের কোনাে বিষয়কে তার নিয়মের বাইরে অন্য কেউ যদি পরিচালনা করতে চায়, আসমান যমীন এবং এ দুয়ের মধ্যবর্তী কোনাে জিনিসকে যদি কেউ স্বাধীনভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে চায় কিংবা তাকে ব্যবহার করতে চায়, সে খবর সর্ব শক্তিমান মালিকের কাছে অবশ্যই পৌছে যাবে এবং কেয়ামতের সেই দিনে তার পরিণতি অবশ্যই তাকে ভােগ করতে হবে। এই কথাটিই নীচের আয়াতে বলা হয়েছে, ‘আসমান থেকে যমীন পর্যন্ত সব কিছুকে তিনিই পরিচালনা করেন, তারপর এখানকার সবার সব কর্মকান্ড তার কাছেই উঠে যায় এমন একটি দিনে যার সময়কাল তােমাদের গণনা মতে হাজার বছরের সমান।’ এ কথা দ্বারা আল্লাহ তায়ালা বুঝাতে চাইছেন যে তার ব্যবস্থাপনা সর্বত্র এমনভাবে পরিব্যাপ্ত হয়ে রয়েছে, যা একটু খেয়াল করলেই নযরে পড়ে; আকাশ থেকে পৃথিবী পর্যন্ত তাঁর কুদরতী হাত সক্রিয় রয়েছে যেন মানুষ তার অনুভূতি ও চিন্তা শক্তি দ্বারা তা হৃদয়ংগম করে এবং আবেগাপ্লুত মনে তার সামনে অবনত হয়; প্রকৃত অর্থে, আল্লাহ রব্বুল আলামীনের ক্ষমতার ক্ষেত্র শুধু আসমান থেকে যমীন পর্যন্তই সীমাবদ্ধ নয়, বরং আরও বহু প্রশস্ত পরিমন্ডল নিয়ে ছড়িয়ে রয়েছে, যার কল্পনা করাও মানব শক্তির বাইরে। আজ জ্যোতির্বিদরা ধ্যান ধারণা ও বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারকে এক চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌছানাে সত্তেও উর্ধাকাশের কোনাে এক সীমা পর্যন্ত গিয়ে তারা দিশাহারা হয়ে যাচ্ছে । তাদের বুদ্ধি খেই হারিয়ে ফেলছে এবং নিজেদের অজান্তেই বলে উঠছে, না মানুষ নিজেদের বুদ্ধি ও গবেষণা বলে সৃষ্টি রহস্যের সব কিছু বুঝতে সক্ষম নয়। তারপর আসবে এমন একদিন, যখন বিশ্বময় ছড়িয়ে থাকা রাব্বুল আলামীন-এর সাজানাে গােছানাে এই বাগান এবং ব্যবস্থাপনা সবকিছুই লন্ডভন্ড হয়ে যাবে, সকল কার্যকারণ ও তার প্রতিক্রিয়া প্রাপ্তির প্রচলিত এসব নিয়ম পদ্ধতি শেষ হয়ে যাবে এবং সকল কিছুই শেষ পরিণতির দিকে এগিয়ে যাবে, সব কিছুকেই আল্লাহ রব্বুল আলামীন-এর কাছে তুলে নেয়া হবে, সেই দিনে যা পূর্ব থেকেই নির্ধারিত হয়ে আছে, যাতে করে সেখানে সকলের কাজ কথা ও ব্যবহার পেশ হতে পারে, সকল বিষয় ও প্রাণীকে (হিসাবযােগ্য-মানুষ জ্বিন জাতিকে) হাযির করা যেতে পারে এমন এক দীর্ঘ দিনে যার সময়কাল তােমাদের হিসাবের হাজার বছর। এ কঠিন দিনের হিসাব থেকে কোনাে কথা, কাজ বা ব্যবহার কিছুই বাদ পড়বে না, কোনাে কিছুই অপ্রয়ােজনীয় বােধ হবে না। সেদিন কোনাে সৃষ্টিই অপ্রয়ােজনীয় বলে মনে হবে না । আজ যা কিছু আমাদের দৃষ্টি সমক্ষে বিরাজ করছে, সকল কাজ, প্রচেষ্টা, ব্যবস্থাপনা, নিয়মকানুন, সব কিছুই একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য এবং সব কিছুই মহান আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছাতেই সম্পাদিত হচ্ছে এবং অবশেষে সব কিছুই গুটিয়ে তার কাছেই ফিরে যাবে, সব কিছুকে তার ইচ্ছা ও তার হুকুমে যখন তিনি চাইবেন তখন তুলে নেয়া হবে। ‘তিনিই সেই গায়ব ও হাযির জানেন, তিনি মহাশক্তিমান মেহেরবান।’ অর্থাৎ, তিনিই সেই পাক পরওয়ারদেগার যিনি আকাশ মন্ডলী ও পৃথিবীকে সৃষ্টি করেছেন। নিজ ক্ষমতায়, তিনিই এককভাবে চির প্রতিষ্ঠিত রয়েছেন, হ্যা, পুরােপুরি এককভাবেই আসমান থেকে যমীন পর্যন্ত সকল কিছুকে তিনি পরিচালনা করছেন। তিনিই উপস্থিত অনুপস্থিত, সব কিছুর জাননেওয়ালা। যা সামনে আছে এবং যা রয়েছে দৃষ্টির অন্তরালে- সবই তার সামনে সদা সর্বদা হাযির, তার অজানা কোনাে কিছুই নেই এবং তার অজান্তে কোনাে কিছুই সংঘটিত হয় না, তিনিই সৃষ্টিকর্তা, তিনিই সর্বময় কর্তৃত্বের মালিক, তিনিই সব কিছুর পরিচালক। ‘আর তিনিই সর্বশক্তিমান মেহেরবান’ অর্থাৎ, এতােই শক্তি-ক্ষমতার মালিক তিনি, যিনি যা চান তা-ই করতে সক্ষম, সাথে সাথে তার ইচ্ছায় এবং গােটা সৃষ্টি জগতের সব কিছুকে পরিচালনায় তিনি দয়াবান, তাঁর দয়া সব কিছুর ওপর পরিদৃশ্যমান। তার যে পরিচয়টি এখানে বিশেষভাবে ব্যক্ত হয়েছে তা হচ্ছে, ‘যা কিছু তিনি সৃষ্টি করেছেন, তা বড় সুন্দর করেই সৃষ্টি করেছেন।’ সােবহানাল্লাহ! তিনি সেই মহাসত্য যাকে গােটা বিশ্ব প্রকৃতি প্রতি নিয়ত দেখছে, দেখছে প্রতিটি দিল এ মহাশক্তিকে সকল বস্তুর চেহারা ছবির মধ্যে। এসব কিছুর মাঝে তিনি এমনভাবে ফুটে রয়েছেন যা একটু খেয়াল করে তাকালেই দেখা যায়, তাদের কার্যকলাপের মধ্য দিয়ে দেখা যায়, তাদের পৃথক পৃথক স্বভাব প্রকৃতির মধ্য দিয়ে দেখা যায় আবার তাদের মধ্যে কিছু কিছু ক্ষেত্রে যে ভারসাম্যপূর্ণ মিল রয়েছে। তার মধ্য দিয়েও তা দেখা যায়, দেখা যায় তাদের আকৃতি-প্রকৃতি, তাদের বিভিন্ন অবস্থা, তাদের যােগ্যতা এবং তাদের প্রতিটি নড়াচড়ার মধ্য দিয়েও। আরও দেখা যায় সব কিছুর মধ্যে যে মন মাতানাে সৌন্দর্য বিকশিত হয়ে রয়েছে তার মধ্যে এবং সবার মধ্যে এহসান করার যে একটি বিশেষ দিক রয়েছে তার মাধ্যমেও তা দেখা যায়। হৃদয়ের চোখ দিয়ে সৃষ্টিকূলের এই বিশেষ গুণের দিকে একবার তাকিয়ে দেখুন, আপনি দেখতে পাবেন হিংস্র থেকে হিংস্র প্রাণীর মধ্যেও কোনো না কোনােভাবে কারও প্রতি এহসান করার, যে কোনােভাবে কারও উপকার করার এক সুপ্ত বাসনা প্রচ্ছন্ন রয়েছে, মাঝে মাঝে তার বহিপ্রকাশ যখন ঘটে তখন আমরা এই সেরা সৃষ্টি হওয়ার দাবীদারেরাও বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাই। কখনও দেখা যায়, পড়ে থাকা মানব শিশুকে হিংস্র মানব খেকো বাঘ দুধ খাওয়ায়। কখনও দেখা যায় কোন কুকুর অসহায় মা হারা বিড়াল বাচ্চাকে নিয়মিত ও নির্দিষ্ট সময়ে এসে দুধ খাইয়ে যায়। এই ভাবে নিকট ও দূরের বহু ঘটনাবলী এই এহসানের স্বাক্ষর বহন করে। হে আমার আল্লাহ, তুমি মহান, মহা পবিত্র তােমার শান। সব কিছুর মধ্যে তােমার এই শিল্পশৈলী অহরহ বিরাজমান। তােমার মহা স্নেহময় হাতের মধুর পরশ প্রসারিত হয়ে রয়েছে সৃষ্টির সকল কিছুর মধ্যে, সব কিছুতেই ভাস্বর হয়ে রয়েছে তােমার মহামূল্যবান এহসান! কতা দয়াময় তুমি, কিভাবে বুঝবে তােমায় এ ভােগবাদী মানব সন্তান! একটু খেয়াল করলেই কি বুঝা যায় না? সব কিছুর মধ্যেই বিস্ময়করভাবে পূর্ণতা বিরাজমান! হাঁ, হাঁ, এ সব কিছুই তাে আমরা নিতে পারেনি কোনাে দিন, কেউ এর মধ্যে কোনােদিনই কমতি আনতে পারেনি। কোনাে কিছুকে এক নির্দিষ্ট সীমার ওপর ইচ্ছামত বাড়াতেও পারেনি। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যেখানে যা দিয়েছেন তার থেকে, আকৃতি প্রকৃতি, সৌন্দর্য-শিল্পনৈপুণ্য অথবা আয় রােজগারের যােগ্যতা-কোনটাকেই মাত্রাতিরিক্ত বাড়ানাে বা মাত্রা থেকে কমানাে, এর কোনােটাই কারও পক্ষে সম্ভব নয়। সব কিছুই রয়েছে পূর্ব নির্ধারিত। আল্লাহ সােবহানাহ তায়ালা তার সৌন্দর্যের মাপকাঠি দ্বারা সব কিছুকে যে অবস্থা দিয়েছেন তার মধ্যে কোনাে কিছুকে বাড়িয়ে দেয়া বা কোন কিছুকে কমিয়ে দেয়া কোনটাই কারও দ্বারা সম্ভব নয়। তিনি যার জন্য যে মেয়াদ দিয়েছেন সে মেয়াদ ফুরানাের পূর্বে অথবা পরে তার কোন ক্ষয় বা লয় নেই। তার নির্দিষ্ট সীমানা পার হতেও কেউ পারবে না বা মাত্রার নীচেও থাকতে পারে না। যমীনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিন্দু থেকে আকাশের সর্বোচ্চ স্তরে অবস্থিত সর্বাপেক্ষা বড় নক্ষত্র বরং একটি সাধারণ কোষ বা মৌচাক থেকে নিয়ে সব থেকে কঠিন বিষয় বা বস্তু পর্যন্ত সব কিছুর মধ্যে আল্লাহ রব্বুল আলামীনের এহসান ও কল্যাণকামিতার বােধ তিনি দিয়ে দিয়েছেন। এই ভাবে সকল কাজ, ব্যবহার গতিবিধি, ঘটনাবলী সব কিছুর মধ্যেই তিনি পরিপূর্ণ সৌন্দর্য দিয়েছেন, এ সব কিছুই আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টি হওয়ারই বৈশিষ্ট। সব কিছুকে আল্লাহ রব্বুল আলামীন এক নির্দিষ্ট সময়ের জন্যই পয়দা করেছেন। সে সময় পর্যন্ত টিকিয়ে রাখার জন্য সব কিছুকে অতি সূক্ষ্ম এক ব্যবস্থা দিয়েছেন, যার অধীনে তারা পরিণতির দিকে এগিয়ে চলেছে। তাদের এই চলতে থাকা চিরদিন আল্লাহ পাকের তদ্বীরের অধীনে সম্পন্ন হতে থাকবে। প্রত্যেকটি জিনিস ও প্রত্যেকটি সৃষ্টিকে, বিশ্বজগতের মধ্যে সব কিছুর সাথে তাল রেখে এক বিশেষ ভূমিকা পালন করার জন্য পয়দা করা হয়েছে। এই ভূমিকা পালন করার জন্য সবার সাথে সহযােগিতার যে ব্যবস্থা রাখা হয়েছে তা এততাই সূক্ষ্ম যে, তা বুঝতে হলে চোখ খুলে তাকাতে হবে এবং আল কোরআনের নির্দেশনাকে সামনে রেখে গবেষণা চালাতে হবে, তবেই দেখা যাবে গােটা বিশ্বের সবকিছুর মধ্যে এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক বিরাজ করছে এবং কোন কিছুর প্রাপ্তি, অন্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে নেয়া সম্ভব নয় । দেখুন অনেকগুলাে পায়ের ওপর সন্তরণরত গুটি পােকার দিকে, কেমন করে সে এক একবিন্দু লালা মুখে নিয়ে ঘুরে ঘুরে কী চমৎকার মসৃণ ও নরম সূতা তৈরী করে, যার থেকে অতি সুন্দর মনােরম বস্ত্র তৈরী হয় যা সৌন্দর্যের বস্তু হিসাবে ব্যবহৃত হওয়ার সাথে সাথে যুদ্ধের সময় বর্ম হিসাবেও পরিধান করা হয়। অতি মসৃণ হওয়ার কারণে তার ওপর তরবারির আঘাত কার্যকর হয় না। তারপর পর্যায়ক্রমে তাকান বিচিত্র বৈশিষ্ট সম্বলিত পানিতে সন্তরণরত রকম-বেরকমের মাছের দিকে তাকান উর্ধাকাশে উড্ডীয়মান পক্ষীকুলের দিকে তাকান বুকে হাঁটা কীট পতংগের দিকে তাকান জীব-জানােয়ারের দিকে এবং পরিশেষে তাকান এই মানুষের দিকে। এর সাথে আরও তাকিয়ে দেখুন মহাকাশের বুকে সন্তরণত গ্রহ-নক্ষত্র ও উপগ্রহসমূহের দিকে, সে ধ্রুব তারাটির দিকে, যাকে স্থির বলে মনে হয়, আবার নযর মেলে চেয়ে দেখুন, সামগ্রিকভাবে এই মহাবিশ্বের দিকে, দেখতে পাবেন, অবিরামভাবে এক নির্দিষ্ট গতিতে সব কিছুর সাথে তাল রেখে এবং নিজ নিজ কক্ষপথে আবহমানকাল ধরে প্রতিটি জিনিস কি সুন্দরভাবে কাজ করে যাচ্ছে। প্রতিটি জিনিস, হ্যা প্রতিটি জিনিসই পুরােপুরি শৃংখলার সাথে নিজ নিজ কাজ করে চলেছে। দৃষ্টি প্রসারিত করে যে দিকেই তাকানাে হােক না কেন, দেখা যাবে আল্লাহ তায়ালার এ মহা কারখানার সর্বত্র এক প্রকার নিয়ম শৃংখলা বিরাজমান। বড়ই চমৎকার এ শৃংখলা- এ সব কিছুর মধ্য থেকে ঝিলিক দিয়ে উঠছে আল্লাহ রব্বুল আলামীন-এর এহসান ও এক অনুপম পরিপূর্ণতা।  *ডারউইনের বিবর্তনবাদ বনাম কোরআনের সৃষ্টিতত্ত্ব : এই নিখিল জাহানের সর্বত্র যে অনুপম সৌন্দর্য ছড়িয়ে রয়েছে তা হৃদয়াবেগ প্রচন্ড দোলা লাগে, তখন বিশ্ব রাজ্যের প্রতিটি অংশ ও প্রত্যেক ব্যক্তির মধ্যে এ সৌন্দর্য সে দেখে, আরও দেখে যে এসব কিছুর প্রত্যেকটিই সদা-সর্বদা অপরের জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করে চলেছে। এ সময় আল্লাহর সৃষ্টির যে দিকেই সে তাকাক না কেন এবং যে দিকেই তার হৃদয়-মন ঝুঁকে পড়ুক না কেন, আর সব কিছু নিয়ে যতাে চিন্তাই সে করুক না কেন, সকল দিকেই সে শুধু সুন্দরেরই মেলা দেখতে পায়, তখন সে অন্তর প্রাণ দিয়ে দেখতে পায় যে, মহাকুশলী আল্লাহ তায়ালাই সব কিছুর মধ্যে মুঠি মুঠি সৌন্দর্য ছড়িয়ে রেখেছেন, রেখেছেন পারস্পরিক অবর্ণনীয় এক সম্পর্ক, এক অভিনব ভারসাম্য ও পরিপূর্ণতা, সকল দিক থেকে আল্লাহ তায়ালার রহমত সুমিষ্ট ফলমূল আকারে প্রতিনিয়ত বর্ষিত হয়, যা মানুষের অন্তরকে আনন্দে ভরে দেয়। সে এবং তার মন আল্লাহ রব্বুল আলামীন-এর এই পরিপূর্ণ সুন্দর সাজানাে বাগানে ভ্রমণ করে ধন্য হয়। পৃথিবী নামক এই গ্রহের ওপর চলাফেরার সময় যা কিছু মানুষ দেখে, শােনে এবং অনুভব করে, সব কিছুর মধ্য দিয়ে সে আল্লাহ তায়ালার মেহেরবাণীরই ঝলক দেখতে পায়। এসব কিছু এ বিশ্বের বাইরে বর্তমান রহস্যরাজির সাথে এই ক্ষণস্থায়ী বিশ্বের নিবিড় সম্পর্কের কথা ঘােষণা করে এবং অস্থায়ী এ বিশ্বের সৌন্দর্যকে সর্বশক্তিমান আল্লাহ তায়ালার স্থায়ী সৌন্দর্যের সাথে সম্পৃক্ত করে দেয়। কিন্তু বড়ই আফসােস, এই পৃথিবীতে সুস্থ সবল শরীরে যতদিন মানুষ বেঁচে থাকে ততদিন আল্লাহ তায়ালার এসব নেয়ামত সে অনুভব করে না। একমাত্র তখনই বুঝতে পারে যখন সে গাফলতির ঘুম থেকে হঠাৎ করে জেগে ওঠে, তখন পৃথিবীর সাথে তার সম্পর্কে ভাটা পড়তে থাকে, যখন তার চতুর্দিকে নানা অকল্পনীয় ঘটনা সংঘটিত হতে দেখে এবং যখন সে এসব কিছু নিজে থেকে বুঝতে চায়; যখন তার সামনে আল্লাহ তায়ালার আলােকবর্তিকাসমূহ জ্বলজ্বল করে জ্বলে ওঠে, যখন সে আল্লাহ রব্বুল আলামীনের দেয়া আলােতে সব কিছুর মধ্যে স্বয়ং মহান আল্লাহ পাকের অস্তিত্বের নিদর্শনকেই দেখতে পায়, সেই মুহূর্তেই সে তাকে দেখে যখন তাকে বাহ্যিক চোখ ও হৃদয়ের চোখ দ্বারা দেখতে পাওয়া যায় না, তখনই সে মহান সৃষ্টিকর্তাকে এবং তার মহা আশ্চর্যজনক সৃষ্টিকে দেখতে পায় তখনই তার হৃদয়ের দ্বার খুলে যায় এবং সে সময় যা কিছু সে দেখে তার মধ্যে তার সকল সৌন্দর্যের মধ্যে তার চেতনার মধ্যে আল্লাহ তায়ালাকেই খুজে পায়, এসব কিছুর অন্তরালে লুকিয়ে থাকা আল্লাহ তায়ালার মর্যাদা ও ক্ষমতাকে সে গভীরভাবে অনুভব করে। তবে প্রসংগত এ কথা উল্লেখ করা দরকার যে, ডারউইনের ক্রমবিবর্তন সংক্রান্ত মতবাদ সম্পূর্ণরূপে ভ্রান্ত। এই মতবাদে ডারউইন বলেছেন যে, একই জীবকোষ থেকে বিভিন্ন প্রাণীর জন্ম গ্রহণের মধ্য দিয়ে ক্রমান্বয়ে মানুষের উদ্ভব ঘটে এবং বহুসংখ্যক জন্ম ও ক্রমবিকাশের ধারাবাহিক স্তর অতিক্রম করার পরও মানুষের মূল রূপটা উৎকৃষ্টতর বানরের ওপরে ও মানুষের নীচে থাকে। এই মতবাদের এই অংশটা সম্পূর্ণ ভুল। কেননা প্রজাতিক উত্তরণের উপাদানগুলাে এক জাতের প্রাণীর ভিন্ন আর এক জাতের প্রাণীতে রূপান্তর অসম্ভব করে তােলে। অথচ এ সত্যটা ডারউইনের জানা ছিলাে না। প্রত্যেক জাতের প্রাণীর জীবকোষে প্রজাতিক রূপান্তরের বা উত্তরণের যেসব উপাদান সুপ্ত থাকে, তা সেই প্রজাতির বৈশিষ্টগুলােকে সংরক্ষণ করে, যে প্রজাতিতে সে জন্ম গ্রহণ করেছে, সেই প্রজাতির আওতাভুক্ত থাকতে তাকে বাধ্য করে এবং সেই প্রজাতি থেকে বের হতে ওসৌ তাকে নতুন কোন প্রজাতিতে রূপান্তরিত হতে দেয় না। তাই বিড়াল বিড়াল হয়েই জন্মেছে এবং আজীবন সে বিড়ালই থাকবে। কুকুরও তদ্রুপ। ষাড়, ঘােড়া বানর ও মানুষের অবস্থাও তথৈবচ। প্রজাতিক রূপান্তরের মতবাদের আলােকে বড়জোর এতটুকু হতে পারে যে, একই প্রজাতির আওতার ভেতরে থেকেই কিছুটা বৈচিত্রপূর্ণ রূপান্তর ঘটতে পারে। সেটা কোনমতেই ভিন্ন প্রজাতিতে রূপান্তরিত হওয়া নয়। এ আলােচনা থেকে বুঝা গেলাে যে, ডারউইনের বিবর্তনবাদের প্রধান অংশটা ভ্রান্ত ও বাতিল। অথচ একশ্রেণীর প্রতারিত মানুষ বিজ্ঞানের নামে এটাকে অভ্রান্ত এবং কোনােকালেও এটাকে খন্ডন করা যাবে না বলে মনে করে। (‘আল ইলমু ইয়াদউ ইলাল ঈমান’ বিজ্ঞান ইসলাম গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করে নামক গ্রন্থ পৃঃ ৫০ ও ১৯শ পারা দ্রষ্টব্য) এবার যিলালীল কোরআনের মূল আলােচনায় ফিরে আসি। [চার্লস ভারউইন বিজ্ঞানের নামে যে গাজাখুরি মতবাদটি চালু করেছেন তার বিরুদ্ধে জীব বিজ্ঞানীরা এতাে বেশী যুক্তি প্রমাণ খাড়া করেছেন যে, আজ ডারউইনের এই বানরতন্ত্র তার স্মৃতি বিজড়িত বাসভবন ইংল্যান্ডের কেন্টেও মনে হয় নিরাপদ নয়। আমি নিশ্চিত যে, ডারউইন বেঁচে থাকলে নিজের উদ্ভাবিত তন্ত্রে এই অসংখ্য স-বিরােধীতা দেখে নিজেই আ’তকে উঠতেন এবং নিজে বানর সিম্পাঞ্জীর উত্তরাধীকার না হয়ে একজন মানুষের সন্তান হিসেবে বেঁচে থাকাকেই তিনি বেশী পছন্দ করতেন।-সম্পাদক] ‘অতপর তার বংশধর সৃষ্টি করেছেন তুচ্ছ পানির নির্যাস থেকে।'(আয়াত ৮) অর্থাৎ বীর্যের পানি থেকে, যা মানুষের ভ্রুণ উৎপাদনের প্রথম স্তর। বীর্য থেকে জমাট রক্ত, তা থেকে গােশতের টুকরাে, তা থেকে হাড়গােড় এবং অবশেষে পূর্ণাংগ মানব সন্তান। এতােসব রূপান্তর ঘটে এই নির্যাসের ভেতরেই, যার উদ্ভব ঘটে নগণ্য পানি থেকে। নগণ্য পানির সেই বিলীন হয়ে যাওয়া বিন্দুটা পর্যায়ক্রমিক বিবর্তনের যে ধারাবাহিকতার সিড়ি বেয়ে এগিয়ে চলে, তার দিকে দৃষ্টি দিলে এটা একটা বিস্ময়কর সফর বলে প্রতীয়মান হয়। বীর্য বিন্দুটা এই সফর শেষ করেই পরিণত হয় নযীরবিহীন সৃষ্টি মানুষে। এ সফরে প্রথম পর্যায় ও শেষ পর্যায়ের মাঝে দীর্ঘ পথ তাকে পাড়ি দিতে হয়। এই দীর্ঘ সফরের চিত্র কোরআনের পরবর্তী একটা আয়াতেই ফুটে উঠেছে, ‘অতপর তাকে তিনি সুঠাম রূপ দান করলেন, তাতে নিজের পক্ষ থেকে রূহ ফুঁকে দিলেন, আর তােমাদেরকে দান করলেন কান, চোখ ও অন্তকরণ'(আয়াত-৯) সােৰহানাল্লাহ! কী বিশ্বয়কর সফর। কতাে দীর্ঘ পথ! কী চমকপ্রদ অলৌকিক ঘটনা যা দেখেও লােকেরা উদাসীন থাকে। এই অলৌকিক ঘটনা সংঘটনের পেছনে যদি মহান আল্লাহর হাত সক্রিয় না থাকতাে, তাহলে অমন নগণ্য এক ফোঁটা পানি কি করে মানুষের রূপ ধারণ করতে পারতাে? তিনিই তাে সেই ক্ষুদ্র ও দুর্বল বিন্দুটাকে তার সরল ও নগণ্য আকৃতি থেকে মানুষের ন্যায় জটিল, বহুমুখী ও বিস্ময়কর সৃষ্টিতে রূপান্তরিত হওয়ার পথে চালিত করেন। একটা মাত্র জীবকোষে এতাে বিভিন্নতা, এত বহুমুখিতা, বিভিন্ন স্বভাব ও বিভিন্ন কাজের ক্ষমতা সম্পন্ন এতাে রকমারী কোষপুঞ্জ-যার প্রত্যেকটা কোষপুঞ্জ একটা বিশেষ কাজ সম্পাদনকারী বিশেষ অংগ গড়ে তােলার দায়িত্ব সম্পন্ন এবং বিশেষ ধরনের নির্দিষ্টসংখ্যক জীবকোষ দ্বারা নির্মিত এই অংগ বিশেষ বিশেষ গুণাবলী ও ভূমিকার অধিকারী। বিভিন্ন অংশে বিভক্ত এবং যেগুলাে একই অংগের অভ্যন্তরে অধিকতর বৈশিষ্টমন্ডিত বহুসংখ্যক কোষ সমন্বয়ে গঠিত, এতসব বিভিন্নতা, বহুমুখিতা ও বৈচিত্র-সেই প্রথম কোষটি একাকী কিভাবে ধারণ করলাে? সেই একটিমাত্র কোষ থেকে উদ্ভূত বিশেষ ধরনের কোষগুলােতে পরবর্তীকালে যে সমস্ত বৈশিষ্ট প্রকাশ পায়, তা আগে কোথায় ছিলাে? যাবতীয় মানবীয় ভ্রুণের মধ্য থেকে বিশেষ বিশেষ মানবীয় ভ্রুণের বৈশিষ্টগুলাে কোথায় লুকিয়ে ছিল? আর এই ভ্রুণে পরবর্তীকালে যেসব বিশেষ ধরনের যােগ্যতা, প্রতিভা নির্দিষ্ট ভূমিকা ও বৈশিষ্টসমূহ পরিলক্ষিত হয় তাই বা কোথায় লুকিয়ে ছিলাে? আর এই বিস্ময়কর অলৌকিক ঘটনা বাস্তবে সংঘটিত ও বারবার সংঘটিত না হলে কেই বা কল্পনা করতে পারতাে যে, এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে? আসলে এর পেছনে রয়েছে স্বয়ং আল্লাহ তায়ালার সুনিপুণ হাত। তিনিই মানুষকে এভাবে সুগঠিত করেছেন। তিনি এই প্রাণীর দেহে নিজের পক্ষ থেকে যে রূহ বা আত্মা ফুঁকে দিয়েছেন, সেটাই এর মূল রহস্য। এই যে বিস্ময়কর ঘটনা প্রতিমুহূর্তে বারবার ঘটে চলেছে অথচ লােকেরা তার দিকে ভ্রুক্ষেপ করছে না, এর একমাত্র সম্ভাব্য ব্যাখ্যা এটাই। তাছাড়া মহান আল্লাহর রূহ ফুঁকে দেয়ার কারণেই মানুষ চোখ কান ও বিবেক বুদ্ধিসম্পন্ন এমন এক প্রাণীতে রূপান্তরিত হয়, যা তাকে অন্য সকল প্রাণী থেকে বিশিষ্ট করে তােলে। আল্লাহ তায়ালা বলছেন, ‘আর তিনি তােমাদের জন্য কান, চোখ হৃদয় সৃষ্টি করেছেন।’ বস্তুত এই ব্যাখ্যা ছাড়া অন্য কোনাে ব্যাখ্যা দিয়ে এই বিস্ময়কর ঘটনার রহস্য উদ্ধার করা সম্ভব নয়। আল্লাহ তায়ালার অনুগ্রহের এই সর্বাত্মক সয়লাব সত্তেও মানুষ খুব কমই শােকর আদায় করে থাকে। তুচ্ছ পানি থেকে এমন মর্যাদাবান মানুষ সৃষ্টি করেছেন, একটা অতি ক্ষুদ্র ও দুর্বল কোষের ভেতরে বিকাশ ও বৃদ্ধির উন্নয়ন ও উৎকর্ষের এবং প্রাচুর্য ও বিশিষ্টতার এতাে বিপুল শক্তি ও সম্ভাবনার ভান্ডার পুঞ্জীভূত করে রেখেছেন এবং তার ভেতরে সেই সব উচ্চাংগের গুণ বৈশিষ্ট, যােগ্যতা-প্রতিভা ও কর্মক্ষমতা সমবেত করে রেখেছেন-যা মানুষকে সৃষ্টির সেরা জীবে পরিণত করেছে। অথচ এসবের জন্য মানুষকে খুব কমই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে দেখা যায়। এ জন্যই আয়াতের শেষভাগে বলা হয়েছে, ‘তােমরা খুব কমই শােকর করে থাকো।’ পৃথিবীতে মানুষের এই প্রথম বিশ্বয়কর ও অলৌকিক জন্ম যদিও প্রতিনিয়তই ও সবার জ্ঞাতসারেই ঘটে চলেছে, তথাপি মােশরেকরা পরকালের পুনর্জন্মে সংশয় প্রকাশ করে ও আপত্তি তােলে। তাদের এই সংশয় ও আপত্তি বিশন্ময়কর বৈকি? আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তারা বলে, আমরা যখন পৃথিবীর মাটিতে হারিয়ে যাবো, তখন আবার কি আমাদেরকে নতুন করে সৃষ্টি করা হবে? আসলে তারা তাদের প্রতিপালকের সাথে সাক্ষাতের কথা অবিশ্বাস করে।’ অর্থাৎ তাদের মরে যাওয়া, দাফন হয়ে যাওয়া তাদের দেহ পচে গলে মাটিতে বিলীন হয়ে যাওয়া এবং মাটির কণাগুলাের সাথে মিশে উধাও হয়ে যাওয়ার পরও যে আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে নতুন করে সৃষ্টি করতে পারেন-এটা তাদের কাছে অসম্ভব মনে হয়। অথচ প্রথমবার যে পৃথিবীতে তাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছিলাে, সেই সৃষ্টির তুলনায় আখেরাতের এই দ্বিতীয়বার সৃষ্টিতে অবাক হবার মতাে কী আছে? আল্লাহ তায়ালা তাে তাদেরকে এই পৃথিবীর মাটি থেকেই সৃষ্টি করেছেন, যার সম্পর্কে তারা বলে থাকে যে, ওর ভেতরে তাদের দেহ পচে গলে মিশে যাবে ও বিলীন হয়ে যাবে। দ্বিতীয়বারের সৃষ্টি তাে প্রথমবারের সৃষ্টির মতােই বরং তার চেয়েও সহজ। এতে অবাক হবার মত কিছু নেই, নতুনত্ব কিছু নেই। আসলে তারা তাদের প্রতিপালকের সাথে সাক্ষাতের বিষয়টাই অবিশ্বাস করে।’ এ জন্যই তারা এসব কথাবার্তা বলে থাকে। আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের বিষয়টা অবিশ্বাস করার কারণেই তাদের এমন একটা স্পষ্ট ব্যাপারে সন্দেহ জন্মে গেছে, যা একবার ঘটে গেছে এবং তার কাছাকাছি জিনিস প্রতি মুহুর্তেই ঘটে চলেছে। এ কারণেই পরবর্তী আয়াতে তাদের মৃত্যু ও মৃত্যুর পরে পুনর্জন্মের কথা উল্লেখ করে তাদের আপত্তির নিষ্পত্তি করা হচ্ছে। তাদের প্রথম জন্মের ভেতর দিয়ে এর যে জ্যান্ত ও অকাট্য প্রমাণ পাওয়া গেছে, তাকেই যথেষ্ট মনে করা হয়েছে এবং আর কোনাে কিছু বাড়িয়ে বলার দরকার মনে করা হয়নি। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘বলাে, সেই মৃত্যুর ফেরেশতাই তােমাদের মৃত্যু ঘটাবে, যাকে তােমাদের দায়িত্বে নিযুক্ত করা হয়েছে। তারপর তােমরা আবারাে তােমাদের প্রতিপালকের কাছে ফিরে যাবে।’ এভাবে একটা সুনিশ্চিত খবরের আকারে কথাটা বলা হয়েছে। এখন প্রশ্ন এই যে, মৃত্যুর ফেরেশতা কে এবং কিভাবে তিনি মৃত্যু ঘটান? এটা আল্লাহ তায়ালার অদৃশ্য ও গুপ্ত বিষয়গুলাের অন্তর্ভুক্ত, যার সংবাদ আমরা কোরআনের এই নিশ্চিত ও অকাট্য সূত্র থেকে পাই। এই একমাত্র সূত্র থেকে আমরা যে তথ্য পাই, তার সাথে আর কোন তথ্য সংযােজন করার অধিকার আমাদের নেই।

তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
# এবার মুশরিকদের দ্বিতীয় আপত্তির জবাব দেয়া হচ্ছে। নবী (সা.) এর তাওহীদের দাওয়াতের ব্যাপারে তারা এ আপত্তিটি করতো। নবী (সা.) তাদের দেবতা ও মনীষীদের উপাস্য হওয়ার কথা অস্বীকার করেন এবং জোরেশোরে এ দাওয়াত দেন যে, এক আল্লাহ‌ ছাড়া আর কোন মাবুদ, কর্ম সম্পাদনকারী, প্রয়োজন পূরণকারী, প্রার্থনা শ্রবণকারী, দুর্দশা নিরসনকারী ও স্বাধীন ক্ষমতা সম্পন্ন শাসক নেই, এ ব্যাপারে তারা কঠোর আপত্তি জানাতো।
# পৃথিবী ও আকাশের স্রষ্টাইতো আসল খোদা। তোমাদের চিন্তা-ভাবনা কতই উদ্ভট, বিশ্ব-জাহানের এ বিশাল সাম্রাজ্যে তোমরা তাকে বাদ দিয়ে অন্যদেরকে কর্ম-সম্পাদনকারী মনে করে বসেছো। এ সমগ্র বিশ্ব-জাহান এবং এর মধ্যে যা কিছু আছে মহান আল্লাহই এসবের স্রষ্টা। তার সত্তা ছাড়া বাকি এখানে যা কিছু আছে সবই সৃষ্টি। মহান আল্লাহ‌ এ দুনিয়া সৃষ্টি করার পর কোথাও গিয়ে ঘুমিয়েও পড়েননি। বরং তিনিই নিজের এ রাজ্যের সিংহাসনে আসীন এবং শাসনকর্তা হয়েছেন। অথচ তোমাদের বুদ্ধি এতই ভ্রষ্ট হয়ে গেছে যে, তোমরা সৃষ্টিকুলের মধ্য থেকে কয়েকটি সত্তাকে নিজেদের ভাগ্যের মালিক গণ্য করে বসেছো। যদি আল্লাহ‌ তোমাদের সাহায্য করতে না পারেন তাহলে তাদের মধ্যে থেকে কার তোমাদের সাহায্য করার ক্ষমতা আছে? যদি আল্লাহ‌ তোমাদেরকে পাকড়াও করেন, তাহলে তাদের মধ্য থেকে কে তোমাদেরকে তার হাত থেকে ছাড়িয়ে নেবার শক্তি রাখে? যদি আল্লাহ‌ সুপারিশ না শোনেন, তাহলে তাদের মধ্য থেকে কে তার কাছ থেকে এ সুপারিশ গ্রহণ করিয়ে নেবার ক্ষমতা রাখে?
# তোমাদের কাছে যেটা এক হাজার বছরের ইতিহাস আল্লাহর কাছে যেন সেটা মাত্র একদিনের কাজ। আল্লাহর ইচ্ছা পূরণকারীদের হাতে আজ এর পরিকল্পনা পেশ করা হয় এবং কালই তারা এ বিবরণ তার কাছে পেশ করে যাতে তাদেরকে আবার পরদিনের (অর্থাৎ তোমাদের হিসেবে এক হাজার বছর) কাজ দেয়া হয় এ প্রসঙ্গটি কুরআনের আরো দু’জায়গায় এসেছে। সেগুলোও সামনে রাখলে এর অর্থ ভালোভাবে অনুধাবন করা যেতে পারে। আরবের কাফেররা বলতোঃ মুহাম্মাদ ﷺ নবুয়তের দাবী নিয়ে সামনে এসেছেন আজ কয়েক বছর হয়ে গেল। তিনি বারবার আমাদের বলছেন, যদি আমার এ দাওয়াত তোমরা গ্রহণ না করো এবং আমাকে প্রত্যাখ্যান করো তাহলে তোমাদের ওপর আল্লাহর আযাব নেমে আসবে। কয়েক বছর থেকে তিনি নিজের এ দাবীর পুনরাবৃত্তি করে চলছেন কিন্তু আজও আযাব আসেনি। অথচ আমরা একবার নয় হাজার বার তাকে পরিষ্কারভাবে প্রত্যাখ্যান করেছি। তার এ হুমকি যদি যথার্থই হতো তাহলে এতদিন কবে না জানি আমাদের ওপর আযাব এসে যেতো। এর জবাবে আল্লাহ‌ সূরা হাজ্জে বলেন-

وَيَسْتَعْجِلُونَكَ بِالْعَذَابِ وَلَنْ يُخْلِفَ اللَّهُ وَعْدَهُ وَإِنَّ يَوْمًا عِنْدَ رَبِّكَ كَأَلْفِ سَنَةٍ مِمَّا تَعُدُّونَ

“এরা শীঘ্রই আযাব চাচ্ছে। আল্লাহ‌ কখনো ওয়াদার বরখেলাফ করবেন না। কিন্তু তোমার রবের কাছে একদিন তোমাদের গণনায় এক হাজার বছরের সমান হয়ে থাকে।” ( ৪৭ আয়াত )

অন্য এক জায়গায় একথার জবাব এভাবে দেয়া হয়েছেঃ

سَأَلَ سَائِلٌ بِعَذَابٍ وَاقِعٍ – لِلْكَافِرِينَ لَيْسَ لَهُ دَافِعٌ – مِنَ اللَّهِ ذِي الْمَعَارِجِ – تَعْرُجُ الْمَلَائِكَةُ وَالرُّوحُ إِلَيْهِ فِي يَوْمٍ كَانَ مِقْدَارُهُ خَمْسِينَ أَلْفَ سَنَةٍ – فَاصْبِرْ صَبْرًا جَمِيلًا – إِنَّهُمْ يَرَوْنَهُ بَعِيدًا – وَنَرَاهُ قَرِيبًا

“প্রশ্নকারী প্রশ্ন করছে সেই আযাব সম্পর্কে, যা কাফেরদের ওপর আপতিত হবে, যার প্রতিরোধকারী কেউ নেই, সেই আল্লাহর পক্ষ থেকে যিনি সমুচ্চ স্তরসম্পন্ন (অর্থাৎ পর্যায়ক্রমে কাজ করেন)। ফেরেশতা ও রূহ তার দিকে উঠতে থাকে এমন একদিনে যার পরিমাণ পঞ্চাশ হাজার বছর। কাজেই হে নবী! সুন্দর সবর অবলম্বন করুন। এরা তাকে দূরবর্তী মনে করে এবং আমি তাকে দেখছি নিকটে। ( আল মা’আরিজ ১-৭ আয়াত )

এসব উক্তি থেকে যে কথা বুঝানো হয়েছে তা হচ্ছে এই যে, মানুষের ইতিহাসে আল্লাহর ফায়সালা দুনিয়ার সময় ও পঞ্জিকা অনুসারে হয় না কোন জাতিকে যদি বলা হয়, অমুক নীতি অবলম্বন করলে তোমাদের এ ধরনের পরিণামের সম্মুখীন হতে হবে, তাহলে যে জাতি একথার এ অর্থ গ্রহণ করবে যে, আজই সে নীতি অবলম্ব করলে কালই তার অশুভ পরিণাম সামনে এসে যাবে, সে হবে বড়ই নির্বোধ। পরিণামফল প্রকাশের জন্য দিন, মাস, বছর এমনকি শত শত বছর ও কোন বড় মেয়াদ নয়।
# অন্য যেই হোক না কেন তার কাছে একটি জিনিস প্রকাশিত থাকলে অন্য অসংখ্য জিনিস রয়েছে অপ্রকাশিত। ফেরেশতা, জিন, নবী, ওলী, অথবা আল্লাহর নির্বাচিত পছন্দনীয় বান্দাগণ যেই হোন না কেন তাদের মধ্যে এমন একজনও নেই যিনি সবকিছু জানেন। একমাত্র আল্লাহ‌ এ গুণের অধিকারী, তার কাছে সবকিছুই দিনের আলোকের মতই উজ্জ্বল। যা কিছু হয়ে গেছে, যা কিছু বর্তমান, যা কিছু হবে সবই তার কাছে সমান আলোকোজ্জ্বল।
# প্রত্যেকটি জিনিসের ওপর প্রাধান্যের অধিকারী। বিশ্ব-জাহানে এমন কোন শক্তি নেই যা তার ইচ্ছার পথে প্রতিরোধ সৃষ্টি করতে এবং তার আদেশ বাস্তবায়নে বাধা দিতে পারে। প্রত্যেকটি জিনিস তার অধীন এবং তার মোকাবেলা ক্ষমতা কারো নেই।
# এ প্রাধান্য, পরাক্রম ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি সত্ত্বেও তিনি জালেম নন। বরং নিজের সৃষ্টির প্রতি দয়ার্দ্র ও করুণাময়।
# এ মহাবিশ্বে তিনি অসংখ্যও অগণিত জিনিস সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু এর মধ্যে কোনো একটি জিনিসও অসুন্দর, সৌষ্ঠবহীন ও বেখাপ্পা নয়। প্রত্যেকটি জিনিসের নিজস্ব একটি আলাদা সৌন্দর্য আছে। প্রত্যেকটি জিনিস তার নিজের জায়গায় সুসামঞ্জস্য ও উপযোগী। যে কাজের জন্য যে জিনিসই তিনি তৈরি করেছেন সবচেয়ে উপযোগী আকৃতিতে সর্বাধিক কার্যকর গুণাবলী সহকারে তৈরি করেছেন। দেখার জন্য চোখ ও শোনার জন্য কানের যে আকৃতি তিনি দিয়েছেন এর চেয়ে ভালো ও উপযোগী কোন আকৃতির কল্পনাও এ জন্য করা যেতে পারে না। হাওয়া ও পানি যেসব উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছে তাদের জন্য হাওয়া ঠিক তেমনি যেমন হওয়া উচিত এবং পানি ঠিক তেমনি গুণাবলী সম্পন্ন যেমন তার হওয়া উচিত। আল্লাহ‌ তৈরি করা কোন জিনিসের নকশার মধ্যে কোন রকমের খুঁত বা ত্রুটি চিহ্নিত করা সম্ভবই নয় এবং তার মধ্যে কোনো প্রকার সংস্কার সাধনের প্রস্তাব দেয়াও অসম্ভব।
# প্রথমে তিনি নিজের প্রত্যক্ষ সৃষ্টিকর্মের (direct creation) মাধ্যমে মানুষ সৃষ্টি করেন এবং তারপর সেই মানুষের মধ্যেই বংশ বিস্তারের এমন শক্তি সৃষ্টি করে দেন যার ফলে তার শুক্র থেকে তারই মতো মানুষের জন্ম হতে থাকে। এক্ষেত্রে ভূমির সারবস্তু একত্র করে একটি সৃষ্টি-নির্দেশের মাধ্যমে তার মধ্যে এমন জীবন, চেতনা ও বৃদ্ধিবৃত্তি সৃষ্টি করে দেন যার সাহায্যে মানুষের মতো একটি আশ্চর্য সৃষ্টি অস্তিত্ব লাভ করে, এটি ছিল একটি কর্মকুশলতা। আবার দ্বিতীয় কর্মকুশলতা হচ্ছে, আগামীতে আরো মানুষ তৈরি করার জন্য এমন একটি অদ্ভূত যন্ত্র মানুষের নিজের কাঠামোতেই রেখে দেন যার গঠন প্রকৃতি ও কার্যধারা দেখে মানবীয় বিবেক-বুদ্ধি বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে যায়। কুরআন মজীদের যেসব আয়াত থেকে প্রথম মানুষের প্রত্যক্ষ সৃষ্টির কথা সুস্পষ্ট হয় এটি তার অন্যতম। ডারউইনের যুগ থেকে বিজ্ঞানীগণ এ চিন্তাধারার ব্যাপারে নাসিকা কুঞ্চন করে আসছেন এবং একটি অবৈজ্ঞানিক মতবাদ গণ্য করে অত্যন্ত তাচ্ছিল্যভরে একে প্রায় ঠেলে ফেলে দিয়ে থাকেন। কিন্তু মানুষের ও জীবের সমস্ত প্রজাতির না হোক অন্ততপক্ষে সর্বপ্রথম জীবন কোষের সরাসরি সৃষ্টি থেকে তো তারা নিজেদের চিন্তাকে কোনক্রমেই মুক্ত করতে পারবেন না। এ সৃষ্টিকে মেনে না নেয়া হলে এ ধরনের একদম বাজে কথা মেনে নিতে হবে যে, জীবনের সূচনা হয় নিছক একটি দুর্ঘটনাক্রমে। অথচ শুধুমাত্র এক কোষসম্পন্ন (cell) জীবের মধ্যে জীবনের সবচেয়ে সহজ অবস্থাও এতটা জটিল ও সূক্ষ্ম বৈজ্ঞানিক কারুকাজে পরিপূর্ণ, যাকে একটি দুর্ঘটনার ফল গণ্য করা একেবারেই অযৌক্তিক। এটা ক্রমবিবর্তন মতবাদের প্রবক্তারা সৃষ্টি মতবাদকে যতটা অবৈজ্ঞানিক গণ্য করেন তার চেয়ে লাখো গুণ বেশি অবৈজ্ঞানিক। আর মানুষ যদি একবার একথা মেনে নেয় যে, জীবনের প্রথম কোষটি সরাসরি সৃষ্টির মাধ্যমে অস্তিত্বলাভ করেছিল, তাহলে এরপর আর একথা মেনে নিতে দোষ কি যে, জীবের প্রত্যেক প্রজাতির প্রথমজন স্রষ্টার সৃষ্টিকর্মের মাধ্যমে অস্তিত্বলাভ করে এবং তারপর তার বংশধারা প্রজনন প্রক্রিয়ার(procreation) বিভিন্ন ধারার মাধ্যমে চলে আসছে। একথা মেনে নেবার ফলে এমন অনেক জটিল সমস্যার সমাধান হয়ে যায় ডারউইনবাদের পতাকাবাহীদের সকল বৈজ্ঞানিক কাব্য চর্চা সত্ত্বেও তাদের ক্রমবিবর্তন মতবাদে যেগুলোর কোন সমাধান হয়নি। (আরো বেশি ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, সূরা আল ইমরান, ৩৫ ; আন নিসা, ১ ; আল আন’আম ৬৩ ; আল আ’রাফ ১০ ও ১৪৫ ; আল হিজর, ১৭ ; আল হাজ্জ, ৫ ; এবং আল মু’মিনুন, ১২ – ১৩ টীকা। )
# একটি সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অস্তিত্ব থেকে বাড়িয়ে তাকে পূর্ণ মানবিক আকৃতিতে পৌঁছান এবং সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও পঞ্চন্দ্রিয় সহকারে তাকে পুরোপুরি শারীরিক আকৃতি দান করেন।
# রূহ বলতে নিছক যে জীবন প্রবাহের বদৌলতে একটি জীবের দেহ যন্ত্র সচল ও সক্রিয় হয় তাকে বুঝানো হয়নি। বরং এমন বিশেষ সার সত্তা ও সার উপাদান বুঝানো হয়েছে যা চিন্তা, চেতনা, বুদ্ধি, বিবেক, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও স্বাধীন ক্ষমতার অধিকারী হয় এবং যার বদৌলতে মানুষ পৃথিবীর অন্য সমস্ত সৃষ্টি থেকে পৃথক একটি ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন, অহংবোধের অধিকারী এবং প্রতিনিধিত্ব ক্ষমতা সম্পন্ন সত্তার পরিণত হয়। এ রূহ কে মহান আল্লাহ‌ নিজের রূহ এ অর্থে বলেছেন যে, তা তারই মালিকানাধীন এবং তার পবিত্র সত্তার সাথে তাকে সম্পর্কিত করণ ঠিক তেমনি ধরনের যেমন একটি জিনিস তার মালিকের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে তার জিনিস হিসেবে আখ্যায়িত হয়। অথবা এর অর্থ হচ্ছে, মানুষের মধ্যে জ্ঞান, চিন্তা চেতনা, ইচ্ছা, সংকল্প, সিদ্ধান্ত ইখতিয়ার এবং এ ধরনের আরো যেসব গুণাবলীর উদ্ভব হয়েছে এসবই মহান আল্লাহর গুণাবলীর প্রতিচ্ছায়া। বস্তুর কোন যৌগিক উপাদান এদের উৎস নয় বরং এদের উৎস হচ্ছে আল্লাহর সত্তা। আল্লাহর তত্ত্বজ্ঞান থেকে সে জ্ঞান লাভ করেছে। আল্লাহর প্রজ্ঞা থেকে সে লাভ করেছে জ্ঞানবত্তা ও বিচক্ষণতা। আল্লাহর ক্ষমতা থেকে সে লাভ করেছে স্বাধীন ক্ষমতা। এসব গুণাবলী মানুষের মধ্যে কোন অজ্ঞান, নির্বোধ ও অক্ষম উৎস থেকে আসেনি। (আরো বেশি ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, সূরা আল হিজর, ১৭ ও ১৯ টীকা। )
# এটি একটি সূক্ষ্ম বর্ণনাভঙ্গি। রূহ সঞ্চার করার আগে মানুষের সমস্ত আলোচনা প্রথম পুরুষের করা হয়ঃ “তাকে সৃষ্টি করেছেন”, “তার বংশ উৎপাদন করেছেন”, “তাকে সর্বাঙ্গ সুন্দর করেছেন”, “তার মধ্যে প্রাণ সঞ্চার করেছেন” এর কারণ হচ্ছে তখন পর্যন্ত সে সম্বোধন লাভের যোগ্যতা অর্জন করেনি। তারপর প্রাণ সঞ্চার করার পর এখন তাকে বলা হচ্ছে, “তোমাকে কান দিয়েছেন”, “চোখ দিয়েছেন”, “হৃদয় দিয়েছেন” কারণ প্রাণের অধিকারী হয়ে যাবার পরই সে এখন এমন যোগ্যতা অর্জন করেছে যার ফলে তাকে সম্বোধন করা যেতে পারে। কান ও চোখ অর্থ হচ্ছে এমন সব যার সাহায্যে মানুষ জ্ঞান আহরণ করে। যদিও জ্ঞান আহরণের মাধ্যমের মধ্যে জিহ্বা, নাসিকা ও ত্বকও অন্তর্ভুক্ত তবুও যেহেতু শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তি অন্যান্য ইন্দ্রিয়গুলোর তুলনায় অনেক বেশি বড় ও বেশি গুরুত্বপূর্ণ তাই কুরআন বিভিন্ন স্থানে এ দু’টিকেই আল্লাহর উল্লেখযোগ্য দান আকারে পেশ করছে। এরপর “হৃদয়” মানে হচ্ছে এমন একটি “মন” (min) যা ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে সংগৃহীত ও তথ্যাদি বিন্যস্ত করে তা থেকে ফলাফল বের করে আনে এবং কর্মের বিভিন্ন সম্ভাব্য পথগুলোর মধ্য থেকে কোন একটি পথ নির্বাচন করে এবং সে পথে চলার সিদ্ধান্ত নেয়।
# এ মহান মর্যাদাসম্পন্ন মানবিক রূহ এত উন্নত পর্যায়ের গুণাবলী সহকারে তোমাকে তো এ জন্য দেয়া হয়নি যে, তুমি দুনিয়ায় পশুদের মতো অবস্থান করবে এবং পশুরা নিজেদের জীবনের যে চিত্র তৈরি করতে পারে তুমি তোমার জীবনের জন্য তেমনি ধরনের একটি চিত্র তৈরি করে নেবে। এ চোখ দু’টি তোমাকে দেয়া হয়েছিল অন্তরদৃষ্টি দিয়ে দেখার জন্য, অন্ধ হয়ে থাকার জন্য দেয়া হয়নি। এ কান দু’টি তোমাকে দেয়া হয়েছিল পূর্ণ মনোযোগ সহকারে শোনার জন্য, বধির হয়ে বসে থাকার জন্য নয়। এ জন্য দেয়া হয়নি যে, তোমার সমস্ত যোগ্যতা কেবলমাত্র নিজের পাশবিক প্রবৃত্তি লালনের উপকরণ সংগ্রহে ব্যয় করবে এবং এর চাইতে যদি কিছুটা ওপরে ওঠো তাহলে নিজের স্রষ্টার বিরূদ্ধে বিদ্রোহের দর্শন ও কর্মসূচি তৈরি করতে লেগে যাবে। আল্লাহর কাছ থেকে এ মহামূল্যবান নিয়ামত লাভ করার পর যখন তুমি নাস্তিক্যবাদ বা শিরকের পথ অবলম্বন করো, যখন তুমি নিজেই খোদা বা অন্য খোদাদের বান্দা হয়ে বসো, যখন তুমি প্রবৃত্তির দাস হয়ে দেহ ও কামনার ভোগ-লালসায় ডুবে থাকো তখন যেন নিজের খোদাকে একথা বলো যে, আমি এসব নিয়ামতের যোগ্য ছিলাম না, আমাকে মানুষ সৃষ্টি না করে একটি বানর, নেকড়ে, কুমীর বা কাক হিসেবে সৃষ্টি করা উচিত ছিল।
# রিসালাত ও তাওহীদ সম্পর্কে কাফেরদের আপত্তির জবাব দেবার পর এবার ইসলামের তৃতীয় মৌলিক আকীদা অর্থাৎ আখেরাত সম্পর্কে তাদের আপত্তি উল্লেখ করে তার জবাব দেয়া হচ্ছে। আয়াতে وَقَالُوا শব্দের প্রথমে যে “ওয়াও” হরফটি বসানো হয়েছে সেটি আসলে পূর্ববর্তী বিষয়বস্তুর সাথে এ প্যারাগ্রাফটির সম্পর্ক জুড়ে দিয়েছে। অর্থাৎ শব্দ বিন্যাস যেন এভাবে করা হয়েছেঃ “তারা বলে মুহাম্মাদ আল্লাহর রসূল নয়”, “তারা বলে আল্লাহ‌ একক উপাস্য নয়” এবং “তারা বলে আমরা মারা যাবার পর আবার আমাদের উত্থান হবে না।”
# ওপরের বাক্য এবং এ বাক্যের মধ্যে পুরোপুরি একটি কাহিনী অব্যক্ত রয়ে গেছে। শ্রোতার চিন্তার ওপর এটা ছেড়ে দেয়া হয়েছে। প্রথম বাক্যে কাফেরদের যে আপত্তির কথা বলা হয়েছে তা এতই বাজে ও উদ্ভট যে, তার প্রতিবাদ করার প্রয়োজন অনুভব করা হয়নি। শুধুমাত্র তার উল্লেখ করাই তার উদ্ভট হওয়ার বিষয়টি প্রকাশ করার জন্য যথেষ্ট মনে করা হয়েছে। কারণ তাদের আপত্তি যে দু’টি অংশ নিয়ে সে দু’টিই আদতে অযৌক্তিক। তাদের একথা বলা, “আমরা মাটিতে মিশে যাবো” এর কি অর্থ হতে পারে? “আমরা” যে জিনিসটির নাম সেটি আবার কবে মাটিতে মিশে যায়? মাটিতে তো কেবল সেই দেহ মিশে যায় যার ভেতর থেকে “আমরা” বের হয়ে গেছে। দেহের নাম “আমরা” নয়। জীবন্ত অবস্থায় যখন সেই দেহের অংশগুলো কেটে ফেলা হয় তখন অঙ্গের পর অঙ্গ কেটে ফেলা হয় কিন্তু “আমরা” পুরোপুরি নিজের জায়গায় থেকে যায়। তার কোন একটি অংশও কর্তিত কোন অঙ্গের সাথে চলে যায় না। আর যখন “আমরা” দেহ থেকে বের হয়ে যায় তখন সম্পূর্ণ দেহটি বর্তমান থাকলেও তার ওপর এই “আমরা” এর কোন সামান্যতম অংশও প্রযোজ্য হয় না। তাইতো একজন প্রাণ উৎসর্গকারী প্রেমিক নিজের প্রেমাস্পদের মৃতদেহটি নিয়ে কবরস্থ করে। কারণ প্রেমাস্পদ সে দেহ থেকে বের হয়ে গেছে। এখন আর সে প্রেমাস্পদ নয়। বরং যে দেহের মধ্যে এক সময় প্রেমাস্পদ থাকতো সেই শূন্য দেহ পিঞ্জরটিকে সে দাফন করে। কাজেই আপত্তি উত্থাপনকারীদের আপত্তির প্রথম কথাই ভিত্তিহীন। এখন থাকে এর দ্বিতীয় অংশ। অর্থাৎ “আমাদের কি আবার নতুন করেসৃষ্টি করা হবে? ” এ ধরনের অস্বীকার ও বিস্ময়সূচক প্রশ্ন আদতে সৃষ্টিই হতো না যদি আপত্তিকারীরা কথা বলার আগে এই “আমরা” এবং এ প্রশ্নের উদ্ভব ঘটার তাৎপর্য নিয়ে একটু খানি চিন্তা-ভাবনা করতো। এই “আমরা” এর বর্তমান জন্মের উৎস এ ছাড়া আর কি যে, কোথাও থেকে কয়লা, কোথাও থেকে লোহা, কোথাও থেকে চুন এবং এ ধরনের অন্যান্য উপকরণ একত্র হয়ে গেছে আর এপর তাদের মৃত্তিকায় দেহ পিঞ্জরে এ “আমরা” বিরাজিত হয়েছে। তারপর তাদের মৃত্যুর পর কি ঘটে? তাদের মৃত্তিকার দেহপিঞ্জর থেকে যখন “আমরা” বের হয়ে যায় তখন তাদের আবাস নির্মাণ করার জন্য মাটির বিভিন্ন অংশ থেকে তাদের শরীরের যেসব অংশ সংগ্রহ করা হয়েছিল তা সবই সেই মাটিতে ফিরে যায়। প্রশ্ন হচ্ছে, প্রথমে যে এই “আমরা” কে এ আবাস তৈরি করে দিয়েছিলেন, তিনি কি পুনর্বার সেই একই উপকরণের সাহায্যে সেই একই আবাস তৈরি করে নতুন করে তাদেরকে তার মধ্যে রাখতে পারেন না? এ জিনিস যখন প্রথম সম্ভব ছিল এবং ঘটনার রূপ পরিগ্রহ করার পথে বাধা কোথায়? সামান্য বুদ্ধি ব্যবহার করলে মানুষ নিজেই এগুলো বুঝতে পারে। কিন্তু এ ব্যাপারে সে নিজের বুদ্ধি প্রয়োগ করে না কেন? কি কারণে সে জেনে বুঝে মৃত্যু পরের জীবন ও পরকাল সম্পর্কে এ ধরনের অযথা আপত্তি তুলছেন? মাঝখানের সমস্ত আলোচনা বাদ দিয়ে মহান আল্লাহ‌ দ্বিতীয় বাক্যে এ প্রশ্নেরই জবাব দিচ্ছেন এভাবেঃ “আসলে এরা এদের রবের সাথে সাক্ষাতকার অস্বীকার করে।” অর্থাৎ আসল কথা এ নয় যে, পুনর্বার সৃষ্টি কোন অভিন্ন ও অসম্ভব কথা, ফলে একথা তারা বুঝতে পারছে না। বরং তাদের একথা বুঝার পথে যে জিনিসটি বাধা দিচ্ছে তা হচ্ছে তাদের এ ইচ্ছা যে, তারা পৃথিবীতে স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াবে, ইচ্ছা মতো পাপকাজ করবে এবং তারপর কোনো প্রকার দণ্ড লাভ না করেই (set-free) এখান থেকে বের হয়ে যাবে, তারপর তাদেরকে কোন জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে না এবং নিজেদের কৃতকর্মের জন্য কোন জবাবদিহি তাদের করতে হবে না।
# তোমাদের সেই “আমরা” মাটিতে মিশে একাকার হয়ে যাবে না বরং তার কর্মসময় শেষ হতেই আল্লাহর মউতের ফেরেশতা আসবে এবং তাকে দেহ থেকে বের করে পুরোপুরি নিজের কবজায় নিয়ে নেবে। তাকে সম্পূর্ণত এবং একেবারে অবিকৃত ও অটুট অবস্থায় তত্ত্বাবধানে (custody) নিয়ে নেয়া হবে এবং তার রবের সামনে পেশ করা হবে। এ সংক্ষিপ্ত আয়াতে অনেকগুলো সত্যের ওপর আলোকপাত করা হয়েছে। এগুলোকে হালকা দৃষ্টিতে দেখে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া ঠিক নয়।

একঃ এখানে দ্ব্যর্থহীনভাবে বলে দেয়া হয়েছে যে, মৃত্যু এমনভাবে আসে না যেমন নাকি একটি ঘড়ি চলতে চলতে হঠাৎ দম শেষ হয়ে যাবা কারণে বন্ধ হয়ে যায়। বরং এ কাজের জন্য আসলে আল্লাহ‌ একজন বিশিষ্ট ফেরেশতা নিযুক্ত করে রেখেছেন। তিনি এসে যথারীতি রূহকে ঠিক তেমনিভাবে গ্রহণ করেন যেমন একজন সরকারী আমীন (official Receiver) কোন জিনিস নিজের কবজায় নিয়ে নেয়। কুরআনের অন্যান্য স্থানে এর আরো যে বিস্তারিত বিবরণ দেয়া হয়েছে তা থেকে জানা যায়, মৃত্যু বিভাগীয় এ অফিসারের অধীনে পুরোপুরি একটি আমলা বাহিনী রয়েছে। তারা মৃত্যু দান করা, রূহকে দেহ থেকে বের করে আনা এবং তাকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেবার বহুতর দায়িত্ব পালন করেন। তাছাড়া এ আমলারা অপরাধী রূহ ও সৎ মু’মিন রূহদের সাথে ভিন্ন ভিন্ন ব্যবহার করেন। (এসব বিষয়ে বিস্তারিত জানার জন্য সূরা নিসা, ৯৭ ; আন’আম, ৯৩ ; আন নাহল, ২৮ ; এবং ওয়াকি’আহ ৮৩ ও ৯৪ আয়াত দেখুন।)

দুইঃ এ থেকে একথাও জানা যায় যে, মৃত্যুর ফলে মানুষের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে যায় না। বরং তার রূহ দেহ থেকে বের হয়ে সঞ্জীবিত থাকে। কুরআনের “মৃত্যুর ফেরেশতা তোমাদেরকে পুরোপুরি তার কবজায নিয়ে নেবে” শব্দগুলো এ সত্যটির প্রকাশ করে। কারণ কোন বিলুপ্ত জিনিসকে কবজায় নেয়া বা নিয়ন্ত্রণাধীন করা হয় না। কবজায় বা অধিকারে নিয়ে নেবার অর্থই হচ্ছে অধিকৃত জিনিস অধিকারকারীর কাছে রয়েছে।

তিনঃ এ থেকেও জানা যায় যে, মৃত্যুকালে যে জিনিসটি অধিকারে নিয়ে নেয়া হয় তা মানুষের জৈবিক জীবন (Biological life) নয় বরং তার সেই অহম (Ego) যাকে “আমরা” “তুমি”“তোমরা” শব্দাবলীর সাহায্যে চিত্রিত করা হয়। এ অহম দুনিয়ার কাজ করে যে ধরনের ব্যক্তিত্বের অধিকারী হয় তার সবটুকুই পুরোপুরি (Intact) বের করে নেয়া হয়। এমনভাবে বের করে নেয়া হয় যার ফলে তার গুণাবলীতে কোনো প্রকার কমবেশি দেখা দেয় না। মৃত্যুর পরে এ জিনিসই তার রবের কাছে ফিরিয়ে দেয়া হয়। একেই পরকালে নবজন্ম ও নতুন দেহ দান করা হবে। এরই বিরূদ্ধে ‘মোকদ্দমা’ চালানো হবে। এর কাছ থেকেই হিসেব নেয়া হবে এবং একেই পুরস্কার ও শাস্তি দেয়া হবে।

তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
৪-৬ নং আয়াতের তাফসীর:

আল্লাহ তা‘আলা প্রথমে খবর দিচ্ছেন যে, তিনি আকাশমণ্ডলী ও জমিন এবং এতদুভয়ের মধ্যে যা কিছু আছে তা ছয়দিনে সৃষ্টি করেছেন। এ সম্পর্কে সূরা আ‘রাফের ৫৪, ইউনুসের ৩ ও হুদের ৭ নং আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে।

এরপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন: আকাশমণ্ডলী, জমিন ও সকল কিছু সৃষ্টি করার পর তিনি আরশে সমুন্নত হয়েছেন। এ সম্পর্কে সূরা আ‘রাফের ৫৪ নং আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে।

সুতরাং আল্লাহ তা‘আলাই যেহেতু আকাশমণ্ডলী, পৃথিবী ও এতদুভয়ের মধ্যে যা কিছু আছে সকল কিছুর স্রষ্টা তাই কিয়ামত দিবসে তিনি ব্যতীত আর কোনই মালিক থাকবে না এবং কোন সুপারিশকারীও থাকবে না। সেদিন সকল ক্ষমতা থাকবে তাঁরই হাতে, কোন মানুষের কোন ক্ষমতা থাকবে না। তিনি তাঁর ইচ্ছামত ন্যায়সঙ্গতভাবে বিচারকার্য সম্পাদন করবেন।

অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন যে, আকাশমণ্ডলী ও জমিনে যা কিছু রয়েছে সকল কিছু একমাত্র তিনিই পরিচালনা করেন। সকল কিছুর নির্দেশ প্রদান করেন একমাত্র তিনিই। আল্লাহ তা‘আলার বাণী:

(اَللّٰهُ الَّذِيْ خَلَقَ سَبْعَ سَمٰوٰتٍ وَّمِنَ الْأَرْضِ مِثْلَهُنَّ ط يَتَنَزَّلُ الْأَمْرُ بَيْنَهُنَّ لِتَعْلَمُوْآ أَنَّ اللّٰهَ عَلٰي كُلِّ شَيْءٍ قَدِيْرٌ لا وَّأَنَّ اللّٰهَ قَدْ أَحَاطَ بِكُلِّ شَيْءٍ عِلْمًا)‏

“আল্লাহই সৃষ্টি করেছেন সপ্ত আকাশ এবং এর অনুরূপ পৃথিবী, ওগুলোর মধ্যে নেমে আসে তাঁর নির্দেশ; যাতে তোমরা জানতে পার যে, নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান এবং জ্ঞানে আল্লাহ সবকিছুই পরিবেষ্টন করে রেখেছেন।” (সূরা তালাক ৬৫:১২)

আর এ সকল জিনিস একদিন মহান আল্লাহ তা‘আলার দিকে উঠিয়ে নেয়া হবে, সেই একদিনের পরিমাণ দুনিয়ার দিনের পঞ্চাশ হাজার বছরের সমপরিমাণ। অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(تَعْرُجُ الْمَلٰ۬ئِكَةُ وَالرُّوْحُ إِلَيْهِ فِيْ يَوْمٍ كَانَ مِقْدَارُه۫ خَمْسِيْنَ أَلْفَ سَنَةٍ)‏

“ফেরেশতা এবং রূহ (জিবরাঈল–) তাঁর দিকে ঊর্ধ্বগামী হবে এমন এক দিনে যার পরিমাণ পঞ্চাশ হাজার বছরের সমান।” (সূরা মা‘আরিজ ৭০:৪)

অত্র সূরায় বলা হল আমাদের গণনামতে এক হাজার বছরের সমান, আর সূরা মাআরিজে বলা হয়েছে পঞ্চাশ হাজার বছরের সমান, উভয়ের সমাধান হলন সেদিনটি অত্যন্ত ভয়ংকর হবে বিধায় মানুষের কাছে অতিশয় দীর্ঘ বলে মনে হবে। এরূপ দীর্ঘানুভূতি নিজ নিজ ঈমান ও আমলানুপাতে হবে। যারা বড় অপরাধী তাদের নিকট অতিদীর্ঘ এবং যারা কম অপরাধী তাদের কাছে কম দীর্ঘ বলে মনে হবে। এমনকি কারো কাছে এক হাজার বছর মনে হবে, আর কারো কাছে পঞ্চাশ হাজার বছর মনে হবে।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:

১. সকল কিছুর স্রষ্টা একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা এবং তিনিই এগুলোর পরিচালক।
২. আল্লাহ তা‘আলা সকল কিছুকে সৃষ্টি করেছেন ছয়দিনে মানুষকে কর্মে ধীরস্থিরতা শিক্ষা দেয়ার জন্য।
৩. পরকালে আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত আর কোন মালিক থাকবে না, আর কোন সাহায্যকারীও থাকবে না।
৪. আখিরাতের একদিন সমান দুনিয়ার পঞ্চাশ হাজার বছর।
৫. আল্লাহ তা‘আলা আরশের ওপর সমুন্নত আছেন যেমনভাবে তাঁর জন্য উপযুক্ত। তিনি পৃথিবীর সর্বত্র বিরাজমান নন।
৬. আল্লাহ তা‘আলা দৃশ্য-অদৃশ্য সকল কিছু সম্পর্কে অবগত আছেন।
৭-৯ নং আয়াতের তাফসীর:

এ আয়াতগুলোতে আল্লাহ তা‘আলার মানব সৃষ্টির নৈপুণ্যতা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন: তিনি সবকিছুই সৃষ্টি করেছেন। সবই তিনি এমন সুন্দরভাবে ও উত্তম পদ্ধতিতে সৃষ্টি করেছেন যা কল্পনাতীত। প্রত্যেক বস্তুর সৃষ্টিই কত উত্তম, কত দৃঢ় ও কত মজবুত! আকাশ-পাতাল সৃষ্টির সাথে মানব সৃষ্টির ওপর চিন্তা-ভাবনা করলে বিস্মিত হতে হয়। তিনি মাটি হতে মানব সৃষ্টির সূচনা করেছেন। এর দ্বারা মূলত আদম (عليه السلام)-কে উদ্দেশ্য করা হয়েছে যার থেকে মানব সৃষ্টির সূচনা হয়েছে। অতঃপর তিনি তার (আদমের) বংশ বিস্তার করেন তুচ্ছ তরল পদার্থের নির্যাস হতে। এর দ্বারা সমগ্র মানব জাতিকে বুঝানো হয়েছে। যে নির্যাস পুরুষের পিঠ ও নারীর বক্ষস্থল হতে নির্গত হয়ে থাকে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(يَّخْرُجُ مِنْۭ بَيْنِ الصُّلْبِ وَالتَّرَا۬ئِبِ)

“যা বের হয় পিঠ ও বুকের হাড়ের মধ্য হতে।” (সূরা তারিক ৮৬:৭)

পরে তিনি তা সংগঠিত করেছেন মায়ের পেটে নির্দিষ্ট কয়েক দিনের জন্য, তারপর তাতে তাঁর রূহ ফুঁকে দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(فَإِذَا سَوَّيْتُه۫ وَنَفَخْتُ فِيْهِ مِنْ رُّوْحِيْ فَقَعُوْا لَه۫ سٰجِدِيْنَ)‏

‘যখন আমি তাকে পূর্ণ মাত্রায় বানিয়ে দিব এবং তাতে আমার পক্ষ হতে রূহ সঞ্চার করব তখন তোমরা তার প্রতি সিজ্দাবনত হও’, (সূরা হিজর ১৫:২৯)

এরপর তিনি মানুষকে চক্ষু, কর্ণ ও অন্তর দান করেছেন তথাপি তারা মহান রবের শুকরিয়া আদায় করে না।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:

১. মানব সৃষ্টির সূচনা করা হয়েছে মাটি থেকে।
২. আদম, হাওয়া ও ঈসা (আলাইহিমুস সালাম)-এর পরবর্তী সকল মানুষকে বীর্য হতে সৃষ্টি করা হয়েছে।
১০-১১ নং আয়াতের তাফসীর:

যখন এক বস্তুর ওপর অন্য বস্তু প্রভাবশালী হয় এবং পূর্বের সমস্ত চিহ্নকে মিটিয়ে দেয়, তখন তাকে ضلالة বলা হয়। এখানে

ضللنا في الأرض

এর অর্থ হবে মাটিতে মিশে আমাদের দেহ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেও কি আমাদের পুনরুত্থান করা হবে? অর্থাৎ কাফির-মুশরিকরা এটা বিশ্বাস করত না যে, মৃত্যুর পর তাদেরকে পুনরায় জীবিত করা হবে, এটা সম্ভব হতে পারে না। তাই তারা এরূপ প্রশ্ন করত। তারা বলত:

(وَلَئِنْ قُلْتَ إِنَّكُمْ مَّبْعُوْثُوْنَ مِنْۭ بَعْدِ الْمَوْتِ لَيَقُوْلَنَّ الَّذِيْنَ كَفَرُوْآ إِنْ هٰذَآ إِلَّا سِحْرٌ مُّبِيْنٌ)‏

“তুমি যদি বল:‎ ‘মৃত্যুর পর তোমরা অবশ্যই উত্থিত হবে’, কাফিররা নিশ্চয়ই বলবে, ‘এটা তো সুস্পষ্ট জাদু।’ (সূরা হূদ ১১:৭) মূলত তারা পুনরুত্থানকে অসম্ভব মনে করে অস্বীকার করত।

এরপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন: তোমাদের জন্য নিযুক্ত ফেরেশতা তোমাদের প্রাণ হরণ করবে। অর্থাৎ যখন নির্ধারিত সময় উপস্থিত হবে তখন “মালাকূল মাউত ও তার সাথে অন্যান্য ফেরেশতারা প্রাণ হরণ করে নিবে। সেই সুনির্দিষ্ট সময় থেকে ক্ষণকালের জন্যও অবকাশ দেয়া হবে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(وَلَنْ يُّؤَخِّرَ اللّٰهُ نَفْسًا إِذَا جَا۬ءَ أَجَلُهَا ط وَاللّٰهُ خَبِيْرٌۭبِمَا تَعْمَلُوْنَ)

“নির্ধারিত কাল যখন উপস্থিত হবে, তখন আল্লাহ কাউকেও অবকাশ দেবেন না। তোমরা যা কর আল্লাহ সে সম্বন্ধে সবিশেষ অবহিত।” (সূরা মুনাফিক ৬৩:১১)

প্রকৃতপক্ষে মৃত্যুর মালিক একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা “মালাকুল মাউত” ফেরেশতাকে তিনি এ কাজে নিযুক্ত রেখেছেন আর অন্যান্য যারা আছে তারা হল মালাকুল মাউতের সাহায্যকারী। আল্লাহ তা‘আলার অনুমতি ব্যতীত মৃত্যুদান করার ক্ষমতা কারো নেই। আল্লাহ তা‘আলার বাণী:

(وَمَا كَانَ لِنَفْسٍ أَنْ تَمُوْتَ إِلَّا بِإِذْنِ اللّٰهِ كِتٰبًا مُّؤَجَّلًا)

“আর আল্লাহর আদেশ ব্যতীত ধার্যকৃত লিপিবদ্ধ নির্দিষ্ট সময়ে কেউই মৃত্যু বরণ করে না।” (সূরা আলি ইমরান ৩:১৪৫) যেহেতু মালাকুল মাউত মানুষের আত্মা কবয করার দায়িত্বে নিযুক্ত তাই তার দিকে সম্পৃক্ত করে বলা হয়েছে, মালাকুল মাউত তোমাদের মৃত্যু দেয়।

মালাকুল মাউত সম্পর্কে প্রখ্যাত মুফাসসির মুজাহিদ বলেন: মালাকুল মাউতের সামনে গোটা বিশ্ব কোন ব্যক্তির সামনে রক্ষিত বিভিন্ন খাবার সামগ্রীপূর্ণ একটি থালার মত, তিনি যা ইচ্ছা থালা থেকে তুলে নেন। মালাকুল মাউত মানুষের মত অন্যান্য জীবজন্তুর প্রাণ কবয করেন কিনা তা নিয়ে একাধিক মত পাওয়া যায়। ইমাম মালেক (رحمه الله) বলেন: তিনি অন্যান্য কীট-পতঙ্গেরও প্রাণ কবয করে থাকে। কিন্তু কতিপয় বর্ণনা দ্বারা জানা যায়নফেরেশতাগণের দ্বারা আত্মার বিয়োগ ঘটানো কেবল মানুষের জন্য নির্দিষ্ট তাদের মর্যাদার দিকে লক্ষ্য রেখে। অন্যান্য জীব-জন্তু আল্লাহ তা‘আলার অনুমতিতে মারা যায়। (কুরতুবীর বরাত দিয়ে ইবনু আতিয়্যাত বর্ণনা করেছেন)

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:

১. মানুষকে মৃত্যুর পর আল্লাহ তা‘আলার নিকটেই ফিরে যেতে হবে।
২. আল্লাহ তা‘আলার অনুমতি ছাড়া কেউ মৃত্যু দান করতে পারে না। তবে মালাকূল মাউত ফেরেশতাকে শুধু একাজে নিযুক্ত করে রাখা হয়েছে।
৩. মানুষকে মৃত্যুর পর হিসাব-নিকাশের জন্য পুনরায় জীবিত করা হবে।

তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
৪-৬ নং আয়াতের তাফসীর

আল্লাহ তা’আলা খবর দিচ্ছেন যে, তিনিই সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা। তিনি ছয় দিনে যমীন, আসমান ও এতোদুভয়ের মধ্যে যা কিছু আছে তা সৃষ্টি করে। আরশের উপর সমাসীন হন। এর তাফসীর ইতিপূর্বে গত হয়েছে। মালিক ও সৃষ্টিকর্তা তিনিই। প্রত্যেক জিনিসের পূর্ণতা প্রাপ্তি তাঁরই হাতে। সবকিছুর তদবীর ও তদারক তিনিই করে থাকেন। সবকিছুরই উপর আধিপত্য তাঁরই। তিনি ছাড়া সৃষ্টজীবের কোন বন্ধু ও অভিভাবক নেই। তাঁর অনুমতি ছাড়া কারো কোন সুপারিশ চলবে না।

মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ হে জনমণ্ডলী! আল্লাহকে ছেড়ে তোমরা যাদের উপাসনা করছে এবং যাদের উপর নির্ভরশীল হচ্ছ, তোমরা কি বুঝতে পার না যে, এতো বড় শক্তিশালী সত্তা কি করে তাঁর একজন শরীক গ্রহণ করতে পারেন? তিনি তাঁর সমকক্ষতা, পরামর্শদাতা ও শরীক হতে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র ও মুক্ত। তিনি ছাড়া কোন উপাস্য নেই, পালনকর্তাও নেই।

হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁর হাতটি ধারণ করে বলেনঃ “আল্লাহ তাআলা যমীন, আসমান এবং এ দুয়ের মধ্যস্থিত সবকিছু সৃষ্টি করার পর সপ্তম দিবসে আরশের উপর অধিষ্ঠিত হন। তিনি মাটিকে শনিবার, পাহাড়কে ররিবার, গাছ-পালাকে সোমবারে, মন্দ জিনিসকে মঙ্গলবার, জ্যোতিকে বুধবার, জীবজন্তুকে বৃহস্পতিবার এবং হযরত আদম (আঃ)-কে শুক্রবার আসরের পরে দিবসের শেষভাগে সৃষ্টি করেন। তাঁকে তিনি সারা দুনিয়ার মাটি দ্বারা সৃষ্টি করেন। এতে লাল, কালো, সাদা, ভাল-মন্দ ইত্যাদি সব রকমের মাটি ছিল। এ কারণেই আদম সন্তান ভাল ও মন্দ হয়ে থাকে।” (এ হাদীসটি ইমাম নাসাঈ (রঃ) বর্ণনা করেছেন। ইমাম বুখারী (রঃ) এটাকে মুআল্লাল বলে উল্লেখ করেছেন। এসব ব্যাপারে আল্লাহই সবচেয়ে ভাল জানেন)

আল্লাহ তা’আলার আদেশ সপ্তম আকাশ হতে অবতীর্ণ হয় এবং সাত তবক যমীনের নীচে পর্যন্ত চলে যায়। যেমন অন্য আয়াতে উল্লিখিত হয়েছেঃ (আরবি)

অর্থাৎ “আল্লাহ তিনিই যিনি সাতটি আকাশ সৃষ্টি করেছেন এবং অনুরূপ সংখ্যক যমীন। তার হুকুম এগুলোর মাঝে অবতীর্ণ হয়।” (৬৫:১২) আল্লাহ তা’আলা তাদের আমল নিজ কাচারীর দিকে উঠিয়ে নেন যা দুনিয়ার আকাশের উপরে রয়েছে। যমীন হতে প্রথম আসমান পাঁচশ’ বছরের পথের ব্যবধানে রয়েছে। ঐ পরিমাণই ওর ঘনত্ব। এতো দূরের ব্যবধান সত্ত্বেও ফেরেশতারা চোখের পলকে নীচে আসেন ও উপরে যান। এজন্যেই বলা হয়েছেঃ তোমাদের হিসেবে সহস্র বছরের সমান। এতদসত্ত্বেও আল্লাহ প্রতিদিন আমলগুলো অবগত হয়ে থাকেন। ছোট ও বড় সব আমল তার কাছে আনীত হয়। তিনি সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান। তিনি সবকিছু নিজের অধীনস্থ করে রেখেছেন। সমস্ত বান্দার গ্রীবা তার সামনে ঝুঁকে থাকে। তিনি মুমিন বান্দাদের উপর বড়ই স্নেহশীল। তাদের উপর তিনি করুণা বর্ষণ করে থাকেন। তিনিই দৃশ্য ও অদৃশ্যের জ্ঞাতা। তিনি পরাক্রমশালী ও পরম দয়ালু।
৭-৯ নং আয়াতের তাফসীর

আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ তিনি (আল্লাহ) সব কিছুই সৃষ্টি করেছেন। সবই তিনি এমন সুন্দরভাবে ও উত্তম পদ্ধতিতে সৃষ্টি করেছেন যা ধারণা করা যায় না। প্রত্যেক বস্তুর সৃষ্টিই কত উত্তম, কত দৃঢ় ও কত মযবুত! আকাশ-পাতাল সৃষ্টির সাথে সাথে মানব-সৃষ্টির উপর চিন্তা-ভাবনা করলে বিস্মিত হতে হয়। তিনি কর্ম হতে মানব সৃষ্টির সূচনা করেছেন। অতঃপর তিনি তার বংশ উৎপন্ন করেন তুচ্ছ তরল পদার্থের নির্যাস হতে যা পুরুষের পিঠ ও স্ত্রীর বক্ষস্থল হতে বের হয়ে থাকে। ‘

পরে তিনি তাকে করেছেন সুঠাম এবং তাতে রূহ ফুকে দিয়েছেন নিজের নিকট হতে। মানুষকে তিনি চক্ষু, কর্ণ ও অন্তঃকরণ দান করেছেন। কিন্তু বড়ই পরিতাপের বিষয় যে, এর পরও মানুষ খুব কমই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে থাকে। তাদের পরিণতি অতি উত্তম ও আনন্দদায়ক যারা আল্লাহ-প্রদত্ত শক্তিসমূহকে তাঁর আদেশ অনুযায়ী তাঁর পথে ব্যবহার করে থাকে। মহান তাঁর শান ও মর্যাদাপূর্ণ তার নাম।
১০-১১ নং আয়াতের তাফসীর

কাফিরদের আকীদা বা বিশ্বাস সম্পর্কে ব্যাখ্যা দেয়া হচ্ছে। মৃত্যুর পর পুনর্জীবনে তারা বিশ্বাসী নয়। ওটা তারা অসম্ভব বলে মনে করে। তারা বলে থাকেঃ যখন আমরা মরে সড়ে পচে যাবো এবং আমাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ছিন্ন ভিন্ন হয়ে মাটির সাথে মিশে যাবে, তারপর আবার কি আমাদেরকে নতুনভাবে সৃষ্টি করা হবে? দুঃখের কথা এই যে, আল্লাহকে তারা নিজেদের সাথে তুলনা করে থাকে। তারা তাদের সীমাবদ্ধ শক্তিকে আল্লাহর অসীম শক্তির সাথে তুলনা করে। তারা জানে ও স্বীকার করে যে, আল্লাহ তা’আলা তাদেরকে প্রথমে সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু বড়ই আশ্চর্যজনক কথা এই যে, দ্বিতীয়বার সৃষ্টি করারও শক্তি যে তার আছে এটা তারা স্বীকার করে না। অথচ তারা তো তাঁরই শক্তিতে চালিত হচ্ছে। তার তো শুধু হুকুম মাত্র। যখনই তিনি কোন কিছুকে বলেনঃ হও, আর তেমনি তা হয়ে যায়। এ জন্যেই আল্লাহ তাআলা বলেন যে, তারা তাদের প্রতিপালকের সাক্ষাৎকার অস্বীকার করে।

এরপর মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ তোমাদের জন্যে নিযুক্ত ফেরেশতা তোমাদের প্রাণ হরণ করবে। এর দ্বারা বুঝা যাচ্ছে যে, মালাকুল মাউত’ একজন ফেরেশতার উপাধী। হযরত বারা (রাঃ)-এর ঐ হাদীসটি যার বর্ণনা সূরায়ে ইবরাহীমে গত হয়েছে, ওর দ্বারাও প্রথম কথাটি এটাই বোধগম্য হয়ে থাকে। আর কোন কোন আসারে তার নাম আযরাঈলও (আঃ) রয়েছে এবং এটাই প্রসিদ্ধও বটে। হ্যাঁ, তবে তাঁর সঙ্গী-সাথী ও তার সাথে কাজকারী আরো ফেরেশতা রয়েছেন, যারা দেহ হতে রূহ বের করে থাকেন এবং হুলকুম পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়ার পর মালাকুল মাউত ওটা নিয়ে নেন। তাদের জন্যে দুনিয়াকে। ছোট করে দেয়া হয়। যেমন আমাদের সামনে খাবারের খাঞ্চা থাকে। মন চায় যে, সেটা এমন স্থানে রাখা হালে যাতে সেটা থেকে খাবার উঠিয়ে নেয়ার সুবিধা হয়। ফেরেশতাদের কাছে দুনিয়াও ঠিক তদ্রুপ।

এই বিষয়ের উপর একটি মুরসাল হাদীসও রয়েছে। আর ওটা হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর উক্তিও বটে।

জাফর ইবনে মুহাম্মাদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি তাঁর পিতাকে বলতে শুনেছেনঃ একজন আনসারীর শিয়রে মালাকুল মাউতকে দেখে রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাকে বলেনঃ “হে মালাকুল মাউত! আমার সাহাবীর রূহ সহজভাবে কব করুন।” মালাকুল মাউত উত্তরে বললেনঃ “হে আল্লাহর নবী (সঃ)! আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন ও চিত্তকে আনন্দিত রাখুন। কেননা, আমি প্রত্যেক মুমিনের ব্যাপারে কোমলতা অবলম্বন করে থাকি। শুনুন, হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আল্লাহর শপথ! সারা দুনিয়ার প্রত্যেক কাঁচাপাকা ঘরে, স্থলে হালে বা জলে হালে, প্রত্যেক দিন আমি পাঁচবার চক্কর লাগিয়ে থাকি। তাদের ছোট ও বড় নিজেদেরকে যতটা চিনে তার চেয়ে বেশী আমি তাদেরকে চিনি। হে মুহাম্মাদ (সঃ)! আল্লাহর শপথ! আল্লাহর আদেশ না হওয়া পর্যন্ত আমি একটি মশারও জান কবয করতে পারি না।” (এ হাদীসটি ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

হযরত জাফর (রঃ) বর্ণনা করেছেন যে, মালাকুল মাউতের দিনের মধ্যে পাঁচবার একটি মানুষের খোঁজ-খবর নেয়ার অর্থ হচ্ছে পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের সময় তাকে দেখে নেয়া। যদি সে নামাযের হিফাযতকারী হয় তবে ফেরেশতা তার নিকটে অবস্থান করেন এবং শয়তান তার থেকে দূরে থাকে। শেষ সময়ে ফেরেশতা তাকে “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’-এর তালকীন দিয়ে থাকেন।

মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, মালাকুল মাউত প্রত্যেকদিন প্রতিটি বাড়ীতে দু’বার করে এসে থাকেন। কা’ব আহবার (রঃ) তো এর সাথে সাথে একথাও বলেন যে, মালাকুল মাউত দরজার উপর অবস্থান করেন এবং সারা দিনের মধ্যে সাতবার দৃষ্টিপাত করেন যে, ঐ বাড়ীর লোকদের মধ্যে কারো জান কবয করার নির্দেশ হয়েছে কি-না।

মহান আল্লাহ বলেনঃ অবশেষে তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের নিকট প্রত্যানীত হবে। কবর থেকে বের হয়ে হাশরের মাঠে আল্লাহর সামনে তোমাদেরকে হাযির হতে হবে এবং সেখানে তোমরা তোমাদের কৃতকর্মের ফল ভোগ করবে।

أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(Book#1043)
[Some attributes of Allah:-]
www.motaher21.net
Sura:32:As-Sajda
Para:21
Ayat: – 4-11
32:4

اَللّٰہُ الَّذِیۡ خَلَقَ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضَ وَ مَا بَیۡنَہُمَا فِیۡ سِتَّۃِ اَیَّامٍ ثُمَّ اسۡتَوٰی عَلَی الۡعَرۡشِ ؕ مَا لَکُمۡ مِّنۡ دُوۡنِہٖ مِنۡ وَّلِیٍّ وَّ لَا شَفِیۡعٍ ؕ اَفَلَا تَتَذَکَّرُوۡنَ ﴿۴﴾

It is Allah who created the heavens and the earth and whatever is between them in six days; then He established Himself above the Throne. You have not besides Him any protector or any intercessor; so will you not be reminded?

 

Allah is the Creator and Controller of the Universe

Allah says;

اللَّهُ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالاَْرْضَ وَمَا بَيْنَهُمَا فِي سِتَّةِ أَيَّامٍ ثُمَّ اسْتَوَى عَلَى الْعَرْشِ

Allah it is He Who has created the heavens and the earth, and all that is between them in six Days. Then He Istawa over the Throne.

Allah tells us that He is the Creator of all things. He created the heavens and earth and all that is between them in six days, then He rose over the Throne — we have already discussed this matter elsewhere.

مَا لَكُم مِّن دُونِهِ مِن وَلِيٍّ وَلَاا شَفِيعٍ

You have none, besides Him, as a protector or an intercessor,

means, only He is the Sovereign Who is in control of all affairs, the Creator of all things, the Controller of all things, the One Who is able to do all things. There is no Creator besides Him, no intercessor except the one to whom He gives permission.

أَفَلَ تَتَذَكَّرُونَ

Will you not then remember! —

this is addressed to those who worship others apart from Him and put their trust in others besides Him — exalted and sanctified and glorified be He above having any equal, partner, supporter, rival or peer, there is no God or Lord except Him

32:5

یُدَبِّرُ الۡاَمۡرَ مِنَ السَّمَآءِ اِلَی الۡاَرۡضِ ثُمَّ یَعۡرُجُ اِلَیۡہِ فِیۡ یَوۡمٍ کَانَ مِقۡدَارُہٗۤ اَلۡفَ سَنَۃٍ مِّمَّا تَعُدُّوۡنَ ﴿۵﴾

He arranges [each] matter from the heaven to the earth; then it will ascend to Him in a Day, the extent of which is a thousand years of those which you count.

 

يُدَبِّرُ الاَْمْرَ مِنَ السَّمَاء إِلَى الاَْرْضِ ثُمَّ يَعْرُجُ إِلَيْهِ

He directs the command from the heavens to the earth; then it will go up to Him,)

means, His command comes down from above the heavens to the furthest boundary of the seventh earth.

This is like the Ayah,

اللَّهُ الَّذِى خَلَقَ سَبْعَ سَمَـوَتٍ وَمِنَ الاٌّرْضِ مِثْلَهُنَّ يَتَنَزَّلُ الاٌّمْرُ بَيْنَهُنَّ

It is Allah Who has created seven heavens and of the earth the like thereof. The command descends between them,(65:12)

Deeds are raised up to the place of recording above the lowest heaven. The distance between heaven and earth is the distance of five hundred years traveling, and the thickness of the heaven is the distance of five hundred years.

Mujahid, Qatadah and Ad-Dahhak said,

“The distance covered by the angel when he descends or ascends is the distance of five hundred years, but he covers it in the blink of an eye.”

Allah says:

فِي يَوْمٍ كَانَ مِقْدَارُهُ أَلْفَ سَنَةٍ مِّمَّا تَعُدُّونَ

32:6

ذٰلِکَ عٰلِمُ الۡغَیۡبِ وَ الشَّہَادَۃِ الۡعَزِیۡزُ الرَّحِیۡمُ ۙ﴿۶﴾

That is the Knower of the unseen and the witnessed, the Exalted in Might, the Merciful,

 

ذَلِكَ عَالِمُ الْغَيْبِ وَالشَّهَادَةِ

in one Day, the measurement of which is a thousand years of your reckoning. That is He, the All-Knower of the unseen and the seen,

meaning, He is controlling all these affairs. He sees all that His servants do, and all their deeds, major and minor, significant and insignificant, ascend to Him. He is the Almighty Who has subjugated all things to His control, and to Whom everybody submits, and He is Most Merciful to His believing servants. He is Almighty in His mercy and Most Merciful in His might. This is perfection:might combined with mercy and mercy combined with might, for He is Merciful without any hint of weakness.

الْعَزِيزُ الرَّحِيمُ

the All-Mighty, the Most Merciful

32:7

الَّذِیۡۤ اَحۡسَنَ کُلَّ شَیۡءٍ خَلَقَہٗ وَ بَدَاَ خَلۡقَ الۡاِنۡسَانِ مِنۡ طِیۡنٍ ۚ﴿۷﴾

Who perfected everything which He created and began the creation of man from clay.

 

The Creation of Man in Stages

Allah tells us that He has created everything well and formed everything in a goodly fashion.

Malik said, narrating from Zayd bin Aslam:

الَّذِي أَحْسَنَ كُلَّ شَيْءٍ خَلَقَهُ

Who made everything He has created good,

means, “He created everything well and in a goodly fashion.”

When Allah mentions the creation of the heavens and the earth, He follows that by mentioning the creation of man.

Allah says:

وَبَدَأَ خَلْقَ الاِْنسَانِ مِن طِينٍ

and He began the creation of man from clay.

meaning, He created the father of mankind, Adam, from clay.

ثُمَّ جَعَلَ نَسْلَهُ مِن سُلَلَةٍ مِّن مَّاء مَّهِينٍ
32:8

ثُمَّ جَعَلَ نَسۡلَہٗ مِنۡ سُلٰلَۃٍ مِّنۡ مَّآءٍ مَّہِیۡنٍ ۚ﴿۸﴾

Then He made his posterity out of the extract of a liquid disdained.

 

Then He made his offspring from semen of despised water.

means, they reproduce in this fashion, from a Nutfah which comes from the loins of men and from between the ribs of women

32:9

ثُمَّ سَوّٰىہُ وَ نَفَخَ فِیۡہِ مِنۡ رُّوۡحِہٖ وَ جَعَلَ لَکُمُ السَّمۡعَ وَ الۡاَبۡصَارَ وَ الۡاَفۡـِٕدَۃَ ؕ قَلِیۡلًا مَّا تَشۡکُرُوۡنَ ﴿۹﴾

Then He proportioned him and breathed into him from His [created] soul and made for you hearing and vision and hearts; little are you grateful.

 

ثُمَّ سَوَّاهُ

Then He fashioned him in due proportion,

means, when He created Adam from clay, He created him and gave him shape and made him upright.

وَنَفَخَ فِيهِ مِن رُّوحِهِ وَجَعَلَ لَكُمُ السَّمْعَ وَالاَْبْصَارَ وَالاَْفْيِدَةَ

and breathed into him the soul; and He gave you hearing, sight and the sense of deduction.

means, reason.

قَلِيلً مَّا تَشْكُرُونَ

Little is the thanks you give!

means, for these strengths with which Allah has provided you; the one who is truly blessed is the one who uses them to worship and obey his Lord, may He be exalted and glorified

32:10

وَ قَالُوۡۤا ءَ اِذَا ضَلَلۡنَا فِی الۡاَرۡضِ ءَ اِنَّا لَفِیۡ خَلۡقٍ جَدِیۡدٍ ۬ؕ بَلۡ ہُمۡ بِلِقَآیِٔ رَبِّہِمۡ کٰفِرُوۡنَ ﴿۱۰﴾

And they say, “When we are lost within the earth, will we indeed be [recreated] in a new creation?” Rather, they are, in [the matter of] the meeting with their Lord, disbelievers.

 

Refutation of Those Who think the Resurrection is unlikely to happen

Allah tells;

وَقَالُوا

And they say:

Allah tells us how the idolators thought it unlikely that the resurrection would ever come to pass, and how they said:

أَيِذَا ضَلَلْنَا فِي الاَْرْضِ

When we are lost in the earth,

meaning, `when our bodies have been scattered and have disintegrated and dispersed in the earth,’

أَيِنَّا لَفِي خَلْقٍ جَدِيدٍ

shall we indeed be created anew,

means, `after that, will we come back again’

They thought it unlikely that this would happen, and in terms of their own feeble abilities it is indeed unlikely, but this is not the case with regard to the power of the One Who created them from nothing, Who when He wills a thing merely says to it, “Be!” and it is.

Allah says:

بَلْ هُم بِلِقَاء رَبِّهِمْ كَافِرُونَ

Nay, but they deny the meeting with their Lord!)

Then Allah says

32:11

قُلۡ یَتَوَفّٰىکُمۡ مَّلَکُ الۡمَوۡتِ الَّذِیۡ وُکِّلَ بِکُمۡ ثُمَّ اِلٰی رَبِّکُمۡ تُرۡجَعُوۡنَ ﴿٪۱۱﴾

Say, “The angel of death will take you who has been entrusted with you. Then to your Lord you will be returned.”

 

قُلْ يَتَوَفَّاكُم مَّلَكُ الْمَوْتِ الَّذِي وُكِّلَ بِكُمْ

Say:”The angel of death, who is set over you, will take your souls…”

The apparent meaning of this Ayah is that the angel of death is a specific personality among the angels, as is also apparent from the Hadith of Al-Bara’ which we quoted in (our Tafsir of) Surah Ibrahim.

In some reports he (the angel of death) is called `Izra’il, which is well known. This is the view of Qatadah and others.

The angel of death has helpers. It was reported in the Hadith that his helpers draw out the soul from the rest of the body until it reaches the throat, then the angel of death takes it.

Mujahid said,

“The earth is brought together for him and it is like a platter from which he takes whenever he wants.”

ثُمَّ إِلَى رَبِّكُمْ تُرْجَعُونَ

Then you shall be brought to your Lord.

means, on the Day when you are resurrected and brought forth from your graves to receive your reward or punishment

For getting Quran app: play.google.com/store/apps/details?id=com.ihadis.quran

Leave a Reply