أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#১০৪৭/ মুনাফেকি কী, কেন ও কীভাবে? :- নং ৩০ )
[কাফের ও মােনাফেকদের আনুগত্য করাে না’]
www.motaher21.net
সূরা:- ৩৩:আহযাব
পারা:২১
১- ৩ নং আয়াত:-
৩৩:১
یٰۤاَیُّہَا النَّبِیُّ اتَّقِ اللّٰہَ وَ لَا تُطِعِ الۡکٰفِرِیۡنَ وَ الۡمُنٰفِقِیۡنَ ؕ اِنَّ اللّٰہَ کَانَ عَلِیۡمًا حَکِیۡمًا ۙ﴿۱﴾
হে নবী! আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন করুন এবং কাফিরদের ও মুনাফিকদের আনুগত্য করবেন না। আল্লাহ্ তো সর্বজ্ঞ হিকমতওয়ালা
৩৩:২
وَّ اتَّبِعۡ مَا یُوۡحٰۤی اِلَیۡکَ مِنۡ رَّبِّکَ ؕ اِنَّ اللّٰہَ کَانَ بِمَا تَعۡمَلُوۡنَ خَبِیۡرًا ۙ﴿۲﴾
তোমার প্রতিপালকের নিকট থেকে তোমার প্রতি যা অহী (প্রত্যাদেশ) করা হচ্ছে তার অনুসরণ কর; নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমরা যা কর, সে বিষয়ে সম্যক অবহিত।
৩৩:৩
وَّ تَوَکَّلۡ عَلَی اللّٰہِ ؕ وَ کَفٰی بِاللّٰہِ وَکِیۡلًا ﴿۳﴾
এবং আপনি নির্ভর করুন আল্লাহ্র উপর। আর কর্ম বিধায়ক হিসেবে যথেষ্ট।
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
(৩৩-আহযাব) : নামকরণ:
এ সূরাটির নাম ২০ আয়াতের يَحْسَبُونَ الْأَحْزَابَ لَمْ يَذْهَبُوا বাক্যটি থেকে গৃহীত হয়েছে।
(৩৩-আহযাব) : নাযিল হওয়ার সময়-কাল :
এ সূরাটিতে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের আলোচনা করা হয়েছে। এক, আহযাব যুদ্ধ। এটি ৫ হিজরীর শাওয়াল মাসে সংঘটিত হয়। দুই, বনী কুরাইযার যুদ্ধ। ৫ হিজরীর যিল্কাদ মাসে এটি সংঘটিত হয়। তিন, হযরত যয়নবের (রা.) সাথে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিয়ে। এটি অনুষ্ঠিত হয় একই বছরের যিল্কাদ মাসে। এ ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর মাধ্যমে সূরার নাযিল হওয়ার সময়-কাল যথাযথ ভাবে নির্ধারিত হয়ে যায়।
(৩৩-আহযাব) : ঐতিহাসিক পটভূমি :
তৃতীয় হিজরীর শাওয়াল মাসে অনুষ্ঠিত ওহোদ যুদ্ধে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিয়োজিত তীরন্দাজদের ভুলে মুসলিম সেনাবাহিনী পরাজয়ের সম্মুখীন হয়েছিলো। এ কারণে আরবের মুশরিক সম্প্রদায়, ইহুদি ও মুনাফিকদের স্পর্ধা ও দু:সাহস বেড়ে গিয়েছিল। তাদের মনে আসা জেগেছিল, তারা ইসলাম ও মুসলমানদেরকে নির্মূল করতে সক্ষম হবে। ওহোদের পরে প্রথম বছরে যেসব ঘটনা ঘটে তা থেকেই তাদের এ ক্রমবর্ধমান স্পর্ধা ও ঔদ্ধত্য আন্দাজ করা যেতে পারে। ওহোদ যুদ্ধের পরে দু’মাসও অতিক্রান্ত হয়নি এমন সময় দেখা গেলো যে, নজদের বনী আসাদ গোত্র মদীনা তাইয়েবার ওপর আক্রমণ করার প্রস্তুতি চালাচ্ছে। তাদের আক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আবু সালামার সারীয়া * বাহিনী পাঠাতে হলো। তারপর ৪ হিজরীর সফর মাসে আদাল ও কারাহ গোত্রদ্বয় তাদের এলাকায় গিয়ে লোকদেরকে দ্বীন ইসলামের শিক্ষা দেবার জন্য নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে কয়েকজন লোক চায়। নবী (সা.) ছ’জন সাহাবীকে তাদের সংগে পাঠিয়ে দেন। কিন্তু রাজী’ (জেদ্দা ও রাবেগের মাঝখানে) নামক স্থানে পৌঁছে তারা হুযাইল গোত্রের কাফেরদেরকে এ নিরস্ত্র ইসলাম প্রচারকদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়। তাঁদের মধ্য থেকে চারজনকে তারা হত্যা করে এবং দু’জনকে (হজরত খুবাইব ইবনে আদী ও হযরত যায়েদ ইবনে দাসিন্নাহ) নিয়ে মক্কায় শত্রুদের হাতে বিক্রি করে দেয়। তারপর সেই সফর মাসেই আমের গোত্রের এক সরদারের আবেদনক্রমে রাসূলুল্লাহ (সা.) আরো একটি প্রচারক দল পাঠান। এ দলে ছিলেন চল্লিশ জন (অথবা অন্য উক্তি মতে ৭০ জন) আনসারি যুবক। তাঁরা নজদের দিকে রওনা হন। কিন্তু তাদের সাথেও বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়। বনী সুলাইমের ‘উসাইয়া, বি’ল ও যাক্ওয়ান গোত্রত্রয় বি’রে মা’ঊনাহ নামক স্থানে অকস্মাত তাঁদেরকে ঘেরাও করে সবাইকে হত্যা করে ফেলে। এ সময় মদীনার বনী নাযীর ইহুদি গোত্রটি সাহসী হয়ে ওঠে এবং একের পর এক প্রতিশ্রুতি ভংগ করতে থাকে। এমনকি চার হিজরীর রবিউল আউয়াল মাসে তারা স্বয়ং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে শহীদ করে দেবার ষড়যন্ত্র করে। তারপর ৪ হিজরীর জমাদিউল আউয়াল মাসে বনী গাত্ফানের দু’টি গোত্র বনু সা’লাবাহ ও বনু মাহারিব মদীনা আক্রমণের প্রস্তুতি চালায়। তাদের গতিরোধ করার জন্য স্বয়ং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকেই তাদের বিরুদ্ধে এগিয়ে যেতে হয়। এভাবে ওহোদ যুদ্ধে পরাজয়ের ফলে মুসলমানদের ভাবমূর্তি ও প্রতাপে যে ধস নামে, ক্রমাগত সাত আট মাস ধরে তার আত্মপ্রকাশ হতে থাকে।
।*সীরাতের পরিভাষায় “সারীয়া” বলা হয় এমন সামরিক অভিযানকে যাতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শরীক ছিলেন না। আর “গাযওয়া” বলা হয় এমন যুদ্ধ বা সমর অভিযানকে যাতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে সশরীরে অংশ গ্রহণ করেছিলেন।
। কিন্তু শুধুমাত্র মুহম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিচক্ষণতা এবং সাহাবায়ে কেরামের জীবন উৎসর্গের প্রেরণাই মাত্র কিছু দিনের মধ্যেই অবস্থার গতি পাল্টে দেয়। আরবদের অর্থনৈতিক বয়কট মদীনাবাসীদের জন্য জীবন ধারণ কঠিন করে দিয়েছিল। আশেপাশের সকল মুশরিক গোত্র হিংস্র ও আক্রমণাত্মক হয়ে উঠছিল। মদীনার মধ্যেই ইহুদী ও মুশরিকরা ঘরের শত্রু বিভীষণ হয়ে উঠছিল। কিন্তু এ মুষ্টিমেয় সাচ্চা মু’মিন গোষ্ঠী আল্লাহর রসূলের নেতৃত্বে একের পর এক এমন সব পদক্ষেপ নেয় যার ফলে ইসলামের প্রভাব প্রতিপত্তি কেবল বহাল হয়ে যায়নি বরং আগের চেয়ে অনেক বেড়ে যায়।
আহ্যাব যুদ্ধের পূর্বের যুদ্ধসমূহ:
এর মধ্যে ওহোদ যুদ্ধের পরপরই যে পদক্ষেপগুলো নেয়া হয় সেগুলোই ছিল প্রাথমিক পদক্ষেপ। যুদ্ধের পরে ঠিক দ্বিতীয় দিনেই যখন বিপুল সংখ্যক মুসলমান ছিল আহত, বহু গৃহে নিকটতম আত্মীয়দের শাহাদাত বরণে হাহাকার চলছিল এবং স্বয়ং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও আহত ছিলেন এবং তাঁর চাচা হাম্যার (রা.) শাহাদাত বরণে ছিলেন শোক সন্তপ্ত, তখন তিনি ইসলামের উৎসর্গীত প্রাণ সেনানীদের ডেকে বলেন, আমাদের কাফেরদের পশ্চাদ্ধাবন করা উচিত। কারণ মাঝ পথ থেকে ফিরে এসে তারা আমাদের ওপর আক্রমণ চালাতে পারে। নবী করীমের (সা.) এ অনুমান একদম সঠিক ছিল। কাফের কুরাইশরা তাদের হাতের মুঠোয় এসে যাওয়া বিজয় থেকে লাভবান না হয়ে খালি হাতে চলে গেছে ঠিকই কিন্তু পথের মধ্যে কোথাও যখন তারা থেমে যাবে তখন নিজেদের নির্বুদ্ধিতার জন্য লজ্জা অনুভব করবে এবং পুনর্বার মদীনা আক্রমণের জন্য দৌঁড়ে আসবে। এজন্য তিনি তাদের পশ্চাদ্ধাবনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এবং সংগে সংগেই ৬৩০ জন উৎসর্গীত প্রাণ সাথী তাঁর সংগে যেতে প্রস্তুত হয়ে যান। মক্কার পথে হাম্রাউল আসাদ নামক স্থানে পৌঁছে তিনি তিন দিন অবস্থান করেন। সেখানে একজন অমুসলিম শুভানুধ্যায়ীর কাছ থেকে জানতে পারেন আবু সুফিয়ান তার ২৯৭৮ জন সহযোগীকে নিয়ে মদীনা থেকে ৩৬ মাইল দূরে দওরুর রওহা নামক স্থানে অবস্থান করছিল। তারা যথার্থই নিজেদের ভুল উপলব্ধি করে আবার ফিরে আসতে চাচ্ছিল। কিন্তু রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম (স) একটি সেনাদল নিয়ে তাদের পেছনে ধাওয়া করে আসছেন একথা শুনে তাদের সব সাহস উবে যায়। এ কার্যক্রমের ফলে কুরাইশরা আগে বেড়ে যে হিম্মত দেখাতে চাচ্ছিল তা ভেঙে পড়ে, এর ফায়দা স্রেফ এতটুকুই হয়নি বরং আশপাশের দুশমনরাও জানতে পারে যে, মুসলমানদের নেতৃত্ব দান করছেন এক সুদৃঢ় সংকল্পের অধিকারী অত্যন্ত সজাগ ও তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি এবং তাঁর ইঙ্গিতে মুসলমানরা মৃত্যুবরণ করতে প্রস্তুত। (আরো বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন তাহফীমুল কুরআন, সূরা আলে ইমরানের ভূমিকা এবং ১২২ টীকা) ।
তারপর যখনই বণী আসাদ মদীনার ওপর নৈশ আক্রমণ করার প্রস্তুতি চালাতে থাকে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর গোয়েন্দারা যথাসময়ে তাদের সংকল্পের খবর তাঁর কানে পৌঁছিয়ে দেয়। তাদের আক্রমণ করার আগেই তিনি হযরত আবু সালামার (উম্মুল মু’মিনীন হযরত উম্মে সালামার প্রথম স্বামী) নেতৃত্বে দেড়শো লোকের একটি বাহিনী তাদের মোকাবিলা করার জন্য পাঠান। এ সেনাদল হঠাৎ তাদের ওপর আক্রমণ চালায়। অসচেতন অবস্থায় তারা নিজেদের সবকিছু ফেলে রেখে পালিয়ে যায়। ফলে তাদের সমস্ত সহায়-সম্পদ মুসলমানদের হস্তগত হয়।
এরপর আসে বনী নাযীরের পালা। যেদিন তারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে শহীদ করার ষড়যন্ত্র করে এবং সে গোপন কথা প্রকাশ হয়ে যায় সেদিনই তিনি তাদেরকে নোটিশ দিয়ে দেন, দশ দিনের মধ্যে মদীনা ত্যাগ করো এবং এরপর তোমাদের যাকেই এখানে দেখা যাবে তাকেই হত্যা করা হবে। আবদুল্লাহ ইবনে উবাই তাদেরকে অভয় দিয়ে বলে যে, অবিচল থাকো এবং মদীনা ত্যাগ করতে অস্বীকার করো, আমি দু’হাজার লোক নিয়ে তোমাদের সাহায্য করবো। বনী কুরাইযা তোমাদের সাহায্য করবে। নজ্দ থেকে বনী গাত্ফানও তোমাদের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসবে। এসব কথায় সাহস পেয়ে তারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলে পাঠায়, আমরা নিজেদের এলাকা ত্যাগ করবো না, আপনার যা করার করেন। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নোটিশের মেয়াদ শেষ হবার সাথে সাথেই তাদেরকে ঘেরাও করে ফেলেন, তাদের সহযোগীদের একজনেরও সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসার সাহস হয়নি। শেষ পর্যন্ত তারা এ শর্তে অস্ত্র সম্বরণ করে যে, তাদের প্রত্যেক তিন ব্যক্তি একটি উটের পিঠে যে পরিমাণ সম্ভব সহায়-সম্পদ বহন করে নিয়ে চলে যাবে এবং বাদবাকি সবকিছু মদীনায় রেখে যাবে। এভাবে মদীনার শহরতলীর সমস্ত মহল্লা যেখানে বনী নযীর থাকতো, তাদের সমস্ত বাগান, দুর্গ, পরিখা, সাজ-সরঞ্জাম সবকিছু মুসলমানদের হাতে চলে আসে। অন্যদিকে এ প্রতিশ্রুতি ভংগকারী গোত্রের লোকেরা খায়বার, আল কুরা উপত্যকা ও সিরিয়ায় বিক্ষিপ্তভাবে বসতি স্থাপন করে।
তারপর তিনি বনী গাত্ফানের দিকে নজর দেন। তারা আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুত নিচ্ছিল। তিনি চরশো সেনার একটি বাহিনী নিয়ে বের হয়ে পড়েন এবং যাতুর রিকা’ নামক স্থানে গিয়ে তাদেরকে ধরে ফেলেন। এ অতর্কিত হামলায় তারা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে এবং কোন যুদ্ধ ছাড়াই নিজেদের বাড়িঘর মাল-সামান সবকিছু ফেলে রেখে পাহাড়ে গিয়ে আশ্রয় নেয়।
এরপর ৪ হিজরীর শাবান মাসে তিনি আবু সুফিয়ানের চ্যালেঞ্জের জবাব দেবার জন্য বের হয়ে পড়েন। ওহোদ থেকে ফেরার সময় আবু সুফিয়ান এ চ্যালেঞ্জ দেয়। যুদ্ধ শেষে সে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও মুসলমানদের দিকে ফিরে ঘোষণা দিয়েছিল: ان موعدكم بدر للعام المقبل (আগামী বছর বদরের ময়দানে আবার আমাদের ও তোমাদের মোকাবিলা হবে।) নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জবাবে একজন সাহাবীর মাধ্যমে ঘোষণা করে দেন: نعم , هى بيننا وبينك موعد (ঠিক আছে, আমাদের ও তোমাদের মধ্যে একথা স্থিরীকৃত হলো)। এ সিদ্ধান্ত আনুসারে নির্দিষ্ট দিনে তিনি দেড় হাজার সাহাবীদের নিয়ে বদরে উপস্থিত হন। ওদিকে আবু সুফিয়ান দু’হাজার সৈন্য নিয়ে রওয়ানা হয়। কিন্তু মার্রায্ মাহ্রান (বর্তমান ফাতিমা উপত্যকা) থেকে সামনে অগ্রসর হবার হিম্মত হয়নি। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আট দিন পর্যন্ত বদরে অপেক্ষা করেন। এ অন্তবর্তীকালে ব্যবসা করে মুসলমানরা বেশ দু’পয়সা কামাতে থাকে। এ ঘটনার ফলে ওহোদে মুসলমানদের যে প্রভাবহানি ঘটে তা আগের চাইতেও আরো কয়েক গুণ বেড়ে যায়। এর ফলে সারা আরবদেশে একথা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, কুরাইশ গোত্র একা আর মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মোকাবিলা করার ক্ষমতা রাখে না। (এ সম্পর্কিত আরো বিস্তারিত জানতে হলে পড়ুন তাহফীমুল কুরআন, সূরা আলে ইমরান, ১২৪ টীকা)।
আর একটি ঘটনা এ প্রভাব আরো বাড়িয়ে দেয়। আরব ও সিরিয়া সীমান্তে দূমাতুল জান্দাল (বর্তমান আল জওফ) ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। সেখান থেকে ইরাক এবং মিসর ও সিরিয়ার মধ্যে আরবের বাণিজ্যিক কাফেলা যাওয়া আসা করতো। এ জায়গার লোকেরা কাফেলাগুলোকে বিপদগ্রস্ত এবং অধিকাংশ সময় লুন্ঠন করতো। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ৫ হিজরীর রবিউল আউয়াল মাসে এক হাজার সৈন্য নিয়ে তাদেরকে শায়েস্তা করার জন্য নিজেই সেখানে যান। তারা তাঁর মোকাবিলা করার সাহস করেনি। লোকালয় ছেড়ে তারা পালিয়ে যায়। এর ফলে দক্ষিণ আরবের সমস্ত এলাকায় ইসলামের প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় এবং বিভিন্ন গোত্র ও উপজাতি মনে করতে থাকে মদীনায় যে প্রবল পরাক্রান্ত শক্তির উন্মেষ ঘটেছে তার মোকাবিলা করা এখন আর একটি দু’টি গোত্রের পক্ষে সম্ভবপর নয়।
আহ্যাবের যুদ্ধ :
এ অবস্থায় আহ্যাব যুদ্ধ সংঘঠিত হয়। এটি ছিল আসলে মদীনার এ শক্তিটিকে গুঁড়িয়ে দেবার জন্য আরবের বহুসংখ্যক গোত্রের একটি সম্মিলিত হামলা। এর উদ্যোগ গ্রহণ করে বনী নযীরের মদীনা থেকে বিতাড়িত হয়ে খয়বরে বসতি স্থাপনকারী নেতারা। তারা বিভিন্ন এলাকা সফর করে কুরাইশ, গাতফান, হুযাইল ও অন্যান্য বহু গোত্রকে একত্র হয়ে সম্মিলিতভাবে বিরাট বাহিনী নিয়ে মদীনার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করে। এভাবে তাদের প্রচেষ্টায় ৫ হিজরীর শাওয়াল মাসে আরবের বিভিন্ন গোত্রের এক বিরাট বিশাল সম্মিলিত বাহিনী এ ক্ষুদ্র জনপদ আক্রমণ করে। এতবড় বাহিনী আরবে ইতিপূর্বে আর কখনো একত্র হয়নি। এতে যোগ দেয় উত্তর থেকে বনী নযীর ও বনী কাইনুকার ইহুদিরা। এরা মদীনা থেকে বিতাড়িত হয়ে খয়বর ও ওয়াদিউল কুরায় বসতি স্থাপন করেছিল। পূর্ব থেকে যোগ দেয় গাত্ফানের গোত্রগুলো (বনু সালীম, ফাযারাহ, মুর্রাহা, আশজা’, সা’আদ ও আসাদ ইত্যাদি)। দক্ষিণ থেকে এগিয়ে আসে কুরাইশ তাদের বন্ধু গোত্রগুলোর সমন্বয়ে গঠিত বিশাল বাহিনী সহকারে। এদের সবার সম্মিলিত সংখ্যা দশ বারো হাজারের কম হবে না।
এটা যদি অতর্কিত আক্রমণ হতো তাহলে তা হতো ভয়াবহ ধ্বংসকর। কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদীনা তাইয়েবায় নির্লিপ্ত ও নিষ্ক্রিয় বসে ছিলেন না। বরং সংবাদদাতারা এবং সমস্ত গোত্রের মধ্যে ছড়িয়ে থাকা ইসলামী আন্দোলনের সহযোগী ও প্রভাবিত লোকেরা তাঁকে দুশমনদের চলাফেরা ও প্রত্যেকটি গতিবিধি সম্পর্কে সর্বক্ষণ খবরাখবর সরবরাহ করে আসছিলেন।* এ বিশাল বাহিনী তাঁর শহরে পৌঁছবার আগেই ছ’দিনের মধ্যেই তিনি মদীনার উত্তর পশ্চিম দিকে পরিখা খনন করে ফেলেন এবং সাল্’আ পর্বতকে পেছনে রেখে তিন হাজার সৈন্য নিয়ে পরিখার আশ্রয়ে প্রতিরক্ষা যুদ্ধ পরিচালনা করতে প্রস্তুত হন। মদীনার দক্ষিণে বাগান ও গাছপালার পরিমাণ ছিল এত বেশী (এবং এখনো আছে) যে, সেদিক থেকে কোন আক্রমণ চলানো সম্ভব ছিল না। পূর্বদিকে ছিল লাভার পর্বতমালা। তার উপর সম্মিলিত সৈন্য পরিচালনা করা কোন সহজ কাজ ছিল না। পশ্চিম-দক্ষিণ কোণের অবস্থাও এ একই ধরনের ছিল। তাই আক্রমণ হতে পারতো একমাত্র ওহোদের পূর্ব ও পশ্চিম কোণগুলো থেকে। নবী করীম (সা.) এদিকেই পরিখা খনন করে নগরীকে সংরক্ষিত করে নেন। আসলে মদীনার বাইরে পরিখার মুখোমুখি হতে হবে, এটা কাফেররা ভাবতেই পারেনি। তাদের যুদ্ধের নীল নক্শায় আদতে এ জিনিসটি ছিলই না। কারণ আরববাসীরা এ ধরনের প্রতিরক্ষার সাথে পরিচিত ছিল না। ফলে বাধ্য হয়েই সেই শীতকালে তাদেরকে একটি দীর্ঘ স্থায়ী অবরোধের জন্য তৈরি হতে হয়। অথচ এজন্য তারা গৃহ ত্যাগ করার সময় প্রস্তুতি নিয়ে আসেনি।
এরপর কাফেরদের জন্য শুধুমাত্র একটা পথই খোলা ছিল। তারা ইহুদি গোত্র বনী কুরাইযাকে বিশ্বাসঘাতকতায় উদ্বুদ্ধ করতে পারতো। এ গোত্রটির বসতি ছিল মদীনার দক্ষিণ পূর্ব কোণে। যেহেতু এ গোত্রটির সাথে মুসলমানদের যথারীতি মৈত্রী চুক্তি ছিল এবং এ চুক্তি অনুযায়ী মদীনা আক্রান্ত হলে তারা মুসলমানদের সাথে মিলে প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত হতে বাধ্য, তাই মুসলমানরা এদিক থেকে নিশ্চিত হয়ে নিজেদের পরিবার ছেলে মেয়েদেরকে বনী কুরাইযার সন্নিহিত এলাকায় পাঠিয়ে দেয় এবং সেদিকে প্রতিরক্ষার কোন ব্যবস্থা করেনি। কাফেররা মুসলমানদের প্রতিরক্ষার এ দুর্বল দিকটি আঁচ করতে পারে। তাদের পক্ষ থেকে বনী নযীরের ইহুদি সরদার হুয়াই ইবনে আখ্তাব বনী কুরাইযার কাছে পাঠানো হয়। বনী কুরাইযাকে চুক্তি ভংগ করে দ্রুত যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ করানোই ছিল তার কাজ। প্রথমদিকে তারা অস্বীকার করে এবং তাদেরকে পরিষ্কার বলে দেয়, মুহাম্মাদের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে আমরা চুক্তিবদ্ধ এবং আজ পর্যন্ত তিনি আমাদের সাথে এমন কোন ব্যবহার করেননি যার ফলে আমরা তাঁর বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ আনতে পারি। কিন্তু যখন ইবনে আখ্তাব তাদেরকে বললো, “দেখো, আমি এখন সারা আরবের সম্মিলিত শক্তিকে এ ব্যক্তির বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়েছি। একে খতম করে দেবার এটি একটি অপূর্ব সুযোগ। এ সুযোগ হাতছাড়া করলে এরপর আর কোন সুযোগ পাবে না” তখন ইহুদি জাতির চিরাচরিত ইসলাম বৈরী মানসিকতা নৈতিকতার মর্যাদা রক্ষার ওপর প্রাধান্য লাভ করে এবং বনী কুরাইযা চুক্তি ভংগ করতে প্রস্তুত হয়ে যায়।
* জীতীয়তাবাদী গোষ্ঠীর মোকাবিলায় একটি আদর্শবাদী আন্দোলনের প্রাধান্যের এটি হয় একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। জাতীয়তাবাদীরা শুধুমাত্র নিজেদের জাতির সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সমর্থন ও সহযোগিতার ওপর নির্ভরশীল হয়। কিন্তু একটি আদর্শবাদী ও নীতিবাদী আন্দোলন নিজের দাওয়াতের মাধ্যমে সবদিকে এগিয়ে চলে এবং স্বয়ং ঐ জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীগুলোর মধ্য থেকেও তার সমর্থক বের করে আনে।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ ব্যাপারেও বেখবর ছিলেন না। তিনি যথা সময়ে এ খবর পেয়ে যান। সংগে সংগেই তিনি আনসার সরদারদেরকে (সা’দ ইবনে উবাদাহ, সা’দ ইবনে মু’আয, আবদুল্লাহ ইবনে রওয়াহ ও খাওয়াত ইবনে জুবাইর) ঘটনা তদন্ত করার এবং এ সংগে তাদের বুঝাবার জন্য পাঠান। যাবার সময় তিনি তাদেরকে নির্দেশ দেন, যদি বনী কুরাইযা চুক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত থাকে তাহলে ফিরে এসে সমগ্র সেনাদলকে সুস্পষ্ট ভাষায় এ খবর জানিয়ে দেবে। কিন্তু যদি তারা চুক্তি ভংগ করতে বদ্ধপরিকর হয় তাহলে শুধুমাত্র আমাকে ইঙ্গিতে এ খবরটি দেবে যাতে এ খবর শুনে সাধারণ মুসলমানরা হিম্মতহারা হয়ে না পড়ে। এ সরদারগণ সেখানে পৌঁছে দেখেন বনি কুরাইযা তাদের নোংরা চক্রান্ত বাস্তবায়নে পুরোপুরি প্রস্তুত। তারা প্রকাশ্যে তাঁদেরকে জানিয়ে দেয় لاعقد بيننا وبين محمد ولا عهد “আমাদের ও মুহাম্মাদের মধ্যে কোন অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতি নেই।” এ জবাব শুনে তারা মুসলিম সেনাদলের মধ্যে ফিরে আসেন এবং ইঙ্গিতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জানান عضل وقاره অর্থাৎ ‘আদল ও কারাহ ইসলাম প্রচারক দলের সাথে রাজী’ নামক স্থানে যে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল বনী কুরাইযা এখন তাই করছে। এ খবরটি অতি দ্রুত মদীনার মুসলমানদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। তাদের মধ্যে ব্যাপক অস্থিরতা দেখা দেয়। কারণ এখন তারা দু’দিক থেকেই ঘেরাও হয়ে গিয়েছিল এবং তাদের শহরের যে অংশে তারা কোন প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা নেয়নি সে অংশটি বিপদের সম্মুখীন হয়ে গিয়েছিল। তাদের সন্তান ও পরিবারের লোকেরা সে অংশেই ছিল। এর ফলে মুনাফিকদের তৎপরতা অনেক বেশী বেড়ে যায়। মু’মিনদের উৎসাহ-উদ্যম নিস্তেজ করে দেবার জন্য তাদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের মনস্তাত্বিক হামলা শুরু করে দেয়। কেউ বলে, “আমাদের সাথে অঙ্গীকার করা হয়েছিল পারস্য ও রোমান সাম্রাজ্য জয় করা হবে কিন্তু এখন অবস্থা এমন যে আমরা পেসাব পায়খানা করার জন্যও বের হতে পারছি না।” কেউ একথা বলে খন্দক যুদ্ধের ময়দান থেকে ছুটি চাইতে থাকে যে, এখন তো আমাদের গৃহও বিপদাপন্ন, সেখানে গিয়ে সেগুলো রক্ষা করতে হবে। কেউ এমন ধরনের গোপন প্রচারণাও শুরু করে দেয় যে, আক্রমণকারীদের সাথে আপোষ রফা করে নাও এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তাদের হাতে তুলে দাও। এটা এমন একটা কঠিন পরীক্ষার সময় ছিল যার মধ্যে পড়ে এমন প্রত্যেক ব্যক্তির মুখোস উন্মোচিত হয়ে গেছে যার অন্তরে সামান্য পরিমাণও মুনাফিকি ছিল। একমাত্র সাচ্চা ও আন্তরিকতা সম্পন্ন ঈমানদাররাই এ কঠিন সময়েও আত্মোৎসর্গের সংকল্পের ওপর অটল থাকে।
এহেন নাজুক সময়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম গাত্ফানদের সাথে সন্ধির কথাবার্তা চালাতে থাকেন এবং তাদেরকে মদীনায় উৎপাদিত ফলের এক তৃতীয়াংশ নিয়ে ফিরে যেতে উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন। কিন্তু যখন আনসার সরদার বৃন্দের (সা’দ ইবনে উবাদাহ ও সা’দ ইবনে মু’আয) সাথে তিনি চুক্তির এ শর্তাবলী নিয়ে আলোচনা করেন তখন তাঁরা বলেন, “হে আল্লাহর রসূল! আমরা এমনটি করবো এটা কি আপনার ইচ্ছা? অথবা এটা আল্লাহর হুকুম, যার ফলে আমাদের এটা করা ছাড়া আর কোন পথ নেই? না কি নিছক আমাদেরকে বাঁচাবার একটি ব্যবস্থা হিসেবে আপনি এ প্রস্তাব দিচ্ছেন?” জবাবে তিনি বলেন, “আমি কেবল তোমাদের বাঁচাবার জন্য এ ব্যবস্থা অবলম্বন করছি। কারণ আমি দেখছি সমগ্র আরব একজোট হয়ে তোমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। আমি তাদের এক দলকে অন্য দলের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত করে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে চাই।” একথায় উভয় সরদার এক কন্ঠে বলেন, “যদি আপনি আমাদের জন্য এ চুক্তি করতে এগিয়ে গিয়ে থাকেন তাহলে তা খতম করে দিন। যখন আমরা মুশরিক ছিলাম তখনও এ গোত্রগুলো আমাদের কাছ থেকে একটি শস্যদানাও কর হিসেবে আদায় করতে পারেনি, আর আজ তো আমরা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের প্রতি ঈমান আনার গৌরবের অধিকারী। এ অবস্থায় তারা কি এখন আমাদের থেকে কর উসূল করবে? আমাদের ও তাদের মাঝখানে এখন আছে শুধুমাত্র তলোয়ার যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ আমাদের ও তাদের মধ্যে ফায়সালা না করে দেন।” একথা বলে তাঁরা চুক্তিপত্রের খসড়াটি ছিঁড়ে ফেলে দেন, যার ওপর তখনো স্বাক্ষর করা হয়নি।
এ সময় গাত্ফান গোত্রের আশ্জা’ শাখার না’ঈম ইবনে মাস’উদ নামক এক ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে আসেন। তিনি বলেন, এখনো কেউ আমার ইসলাম গ্রহনের খবর জানে না। আপনি আমাকে দিয়ে যে কোন কাজ করাতে চান আমি তা করতে প্রস্তুত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তুমি গিয়ে শত্রুদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করার চেষ্টা করো।* একথায় তিনি প্রথমে যান বনী কুরাইযার কাছে। তাদের সাথে তাঁর মেলামেশা ছিল খুব বেশী। তাদেরকে গিয়ে বলেন, কুরাইশ ও গাতফান তো অবরোধে বিরক্ত হয়ে এক সময় ফিরে যেতেও পারে। এতে তাদের কোন ক্ষতি হবে না। কিন্তু তোমাদের তো মুসলমানদের সাথে এখানে বসবাস করতে হবে। তারা চলে গেলে তখন তোমাদের কি অবস্থা হবে? আমার মতে তোমরা ততক্ষণ যুদ্ধে অংশ নিয়ো না যতক্ষণ বাইর থেকে আগত গোত্রগুলোর মধ্য থেকে কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ লোককে তোমাদের কাছে যিম্মী হিসেবে না রাখে। একথা বনী কুরাইযার মনে ধরলো। তারা গোত্রসমূহের সংযুক্ত ফ্রন্টের কাছে যিম্মী চাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। এরপর তিনি কুরাইশ ও গাতফানের সরদারদের কাছে যান। তাদেরকে বলেন, বনী কুরাইযা কিছুটা শিথিল হয়ে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। তারা তোমাদের কাছে যদি যিম্মী হিসেবে কিছু লোক চায় তাহলে আশ্চর্য হবার কিছু নেই এবং তাদেরকে মুহাম্মাদের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হাতে সোপর্দ করে আপোষ রফা করে নিতে পারে। কাজেই তাদের সাথে সতকর্তার সাথে কাজ করা উচিত। এর ফলে সম্মিলিত জোটের লোকেরা বনী কুরাইযার ব্যাপারে সন্দিহান হয়ে পড়ে। তারা কুরাইযার নেতৃবৃন্দের কাছে বার্তা পাঠায় যে, দীর্ঘ অবরোধে আমাদের জন্য বিরক্তিকর হয়ে উঠেছে। এখন আমরা চাই একটি চূড়ান্ত যুদ্ধ। আগামীকাল তোমরা ওদিক থেকে আক্রমণ করো, আমরা একই সংগে এদিক থেকে মুসলমানদের ওপর আক্রমণ চালাবো। বনী কোরাইযা জবাবে বলে পাঠায়, আপনারা যতক্ষণ যিম্মী স্বরূপ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে আমাদের হাওয়ালা করে না দেন ততক্ষণ আমরা যুদ্ধের বিপদের সম্মুখীন হতে পারি না। এ জবাব শুনে সম্মিলিত জোটের নেতারা না’ঈমের কথা সঠিক ছিল বলে বিশ্বাস করে। তারা যিম্মী দিতে অস্বীকার করে। ফলে বনী কুরাইযা বিশ্বাস করে না’ঈম আমাদের সঠিক পরামর্শ দিয়েছিল। এভাবে এ যুদ্ধ কৌশল বড়ই সফল প্রমাণিত হয়। এর ফলে শত্রু শিবিরে ফাটল সৃষ্টি হয়।
*এ সময় রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছিলেনالحرب خدعة অর্থাৎ যুদ্ধে প্রতারণা করা বৈধ।
।এখন অবরোধ কাল ২৫ দিন থেকেও দীর্ঘ হতে চলছিল। শীতের মওসুম চলছিল। এত বড় সেনাদলের জন্য পানি, আহার্যদ্রব্য ও পশুখাদ্য সংগ্রহ করা কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে চলছিল, অন্যদিকে বিভেদ সৃষ্টি হওয়ার কারণে অবরোধকারীদের উৎসাহেও ভাটা পড়েছিল। এ অবস্থায় এক রাতে হঠাৎ ভয়াবহ ধূলিঝড় শুরু হয়। এ ঝড়ের মধ্যে ছিল শৈত, বজ্রপাত ও বিজলী চমক এবং অন্ধকার ছিল এত গভীর যে নিজের হাত পর্যন্ত দেখা যাচ্ছিল না। প্রবল ঝড়ে শত্রুদের তাঁবুগুলো তছনছ হয়ে যায়। তাদের মধ্যে ভীষণ হৈ-হাংগামা সৃষ্টি হয়। আল্লাহর কুদরাতের এ জবরদস্ত আঘাত তারা সহ্য করতে পারেনি। রাতের অন্ধকারেই প্রত্যেকে নিজ নিজ গৃহের পথ ধরে। সকালে মুসলমানরা জেগে ওঠে ময়দানে একজন শত্রুকেও দেখতে পায়নি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ময়দান শত্রুশূন্য দেখে সংগে সংগেই বলেন:
। لن تغزوكم قريش بعد عامكم هذا ولكنكم تغزونهم
। “এরপর কুরাইশরা আর কখনো তোমাদের ওপর আক্রমণ চালাবে না, এখন তোমরা তাদের ওপর আক্রমণ চালাবে।” এটি ছিল অবস্থার একেবারে সঠিক বিশ্লেষণ। কেবল কুরাইশ নয়, সমস্ত শত্রু গোত্রগুলো একত্র হয়ে সম্মিলিতভাবে ইসলামের বিরুদ্ধে নিজেদের শেষ অস্ত্র হেনেছিল। এতে হেরে যাওয়ার পরে এখন আর তাদের মদীনার ওপর আক্রমণ করার সাধ্য ছিল না। এখন আক্রমণাত্মক শক্তি (Offensive) শত্রুদের হাত থেকে মুসলমানদের হাতে স্থানান্তরিত হয়ে গিয়েছিল।
বনী কুরাইযার যুদ্ধ : খন্দক থেকে গৃহে ফিরে আসার পর যোহরের সময় জিব্রীল (আ) এসে হুকুম শুনালেন, এখনই অস্ত্র নামিয়ে ফেলবেন না। বনী কুরাইযার ব্যাপারটি এখনো নিষ্পত্তি হয়নি। এ মুহূর্তেই তাদেরকে সমুচিত শিক্ষা দেয়া দরকার। এ হুকুম পাওয়ার সাথে সাথেই তিনি ঘোষণা করে দিলেন, “যে ব্যক্তিই শ্রবণ ও অানুগত্যের ওপর অবিচল আছো সে আসরের নামায ততক্ষন পর্যন্ত পড়ো না যতক্ষণ না বনী কুরাইযার আবাসস্থলে পৌঁছে যাও।” এ ঘোষণার সাথে সাথেই তিনি হযরত আলীকে (রা.) একটি ক্ষুদ্র সেনাদলসহ অগ্রবর্তী সেনাদল হিসেবে বনী কুরাইযার দিকে পাঠিয়ে দিলেন। তাঁরা যখন সেখানে পৌঁছলেন তখন ইহুদিরা নিজেদের গৃহের ছাদে উঠে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড গালি বর্ষণ করলো। কিন্তু একেবারে ঠিক যুদ্ধের সময়েই তারা চুক্তি ভংগ করে এবং আক্রমণকারীদের সাথে মিলে মদীনার সমগ্র জনবসতিকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়ে যে মহাঅপরাধ করেছিল তার দণ্ড থেকে এ গালাগালি তাদেরকে কেমন করে বাঁচাতে পারতো? হযরত আলীর ক্ষুদ্র সেনাদল দেখে তারা মনে করেছিল এরা এসেছে নিছক ভয় দেখানোর জন্য। কিন্তু যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নেতৃত্বে পুরা মুসলিম সেনাদল সেখানে পৌঁছে গেল এবং তাদের জনবসতি ঘেরাও করে নেয়া হল তখন তাদের হুশ হলো। দু’তিন সপ্তাহের বেশী তারা অবরোধের কঠোরতা বরদাশ্ত করতে পারলো না। অবশেষে তারা এ শর্তে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে আত্মসমর্পণ করলো যে, আওস গোত্রের সরদার হযরত সা’দ ইবনে মু’আয (রা.) তাদের জন্য যা ফায়সালা করবেন উভয় পক্ষ তাই মেনে নেবে। তারা এ আশায় হযরত সা’দকে শালিস মেনেছিল যে, জাহেলিয়াতের যুগ থেকে আওস ও বনী কুরাইযার মধ্যে দীর্ঘকাল থেকে যে মিত্রতার সম্পর্ক চলে আসছিল তিনি সেদিকে নজর রাখবেন এবং তাদেরকে ঠিক তেমনিভাবে মদীনা থেকে বের হয়ে যাবার সুযোগ দেবেন যেমন ইতিপূর্বে বনী কাইনুকা’ ও বনী নযিরকে দেয়া হয়েছিল। আওস গোত্রের লোকেরাও হযরত সা’দের কাছে নিজেদের মিত্রদের সাথে সদয় আচরণ করার দাবি করছিল। কিন্তু হযরত সা’দ মাত্র এই কিছুদিন আগেই দেখেছিলেন, দু’টি ইহুদি গোত্রকে মদীনা থেকে বের হয়ে যাবার সুযোগ দেয়া হয়েছিল এবং তারা কিভাবে আশপাশের সমস্ত গোত্রকে উত্তেজিত করে দশ বারো হাজার সৈন্য নিয়ে মদীনা আক্রমণ করতে এসেছিল। তারপর এ সর্বশেষ ইহুদি গোত্রটি একেবারে ঠিক বহিরাগত আক্রমণের সময়ই চুক্তিভংগ করে মদীনাবাসীদেরকে ধ্বংস ও বরবাদ করে দেবার কি ষড়যন্ত্রটাই না করেছিল সে ঘটনা এখনো তার সামনে তরতাজা ছিল। তাই তিনি ফায়সালা দিলেন: বনী কুরাইযার সমস্ত পুরুষদেরকে হত্যা করা হোক, নারী ও শিশুদেরকে গোলামে পরিণত করা হোক এবং তাদের সমুদয় ধন-সম্পত্তি মুসলমানদের মধ্যে বন্টন করে দেয়া হোক। এ ফায়সালাটি বাস্তবায়িত করা হলো। এরপর মুসলমানরা প্রবেশ করলো বনী কুরাইযার পল্লীতে। সেখানে তারা দেখলো, আহযাব যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করার জন্য এ বিশ্বাসঘাতক গোষ্ঠীটি ১৫ শত তলোয়ার, ৩ শত বর্ম, ২ হাজার বর্শা এবং ১৫ শত ঢাল গুদামজাত করে রেখেছে। মুসলমানরা যদি আল্লাহর সাহায্য লাভ না করতো তাহলে এ সমস্ত যুদ্ধাস্ত্র ঠিক এমন এক সময় পেছন থেকে মুসলমানদের ওপর হামলা করার জন্য ব্যবহার করা হতো যখন সামনে থেকে মুশরিকরা একজোটে খন্দক পার হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার উদ্যোগ নিতো। এ বিষয়টি প্রকাশ হয়ে যাবার পর এখন আর এ বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করার কোন অবকাশই থাকেনি যে, হযরত সা’দ ইহুদিদের ব্যাপারে যে ফায়সালা করেছিলেন তা সঠিক ছিল।
সামাজিক সংস্কার ওহোদ যুদ্ধ ও আহযাব যুদ্ধের মাঝখানের এ দু’টি বছর যদিও এমন সংকট এবং গোলযোগে পরিপূর্ণ ছিল যার ফলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর সহাবীগণ এক দিনের জন্যও নিরাপত্তা ও নিশ্চয়তা লাভ করতে পারেননি, তারপরও এ সমগ্র সময়-কালে নতুন মুসলিম সমাজ গঠন এবং জীবনের প্রতিটি বিভাগে সংস্কার ও সংশোধনের কাজ অব্যাহতভাবে চলছিল। এ সময়েই মুসলমানদের বিয়ে ও তালাকের আইন প্রায় পূর্ণতা লাভ করেছিল। উত্তরাধিকার আইন তৈরি হয়ে গিয়েছিল। মদ ও জুয়াকে হারাম করা হয়েছিল। অর্থ ও সমাজ ব্যবস্থার অন্যান্য বহু দিকে নতুন বিধি প্রয়োগ করা হয়েছিল।
। এ প্রসংগে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনযোগ্য ছিল দত্তক গ্রহন। আরবের লোকেরা যে শিশুকে দত্তক বা পালিত পুত্র বা কন্যা হিসেবে গ্রহণ করতো তাকে একেবারে তাদের নিজেদের গর্ভজাত সন্তানের মতো মনে করতো। সে উত্তরাধিকার লাভ করতো। তার সাথে দত্তক মাতা ও বোনেরা ঠিক তেমনি খোলামেলা থাকতো যেমন আপন পুত্র ও ভাইয়ের সাথে থাকা হয়। তার সাথে দত্তক পিতার কন্যার এবং এ পিতার মৃত্যুর পর তার বিধিবা স্ত্রীর বিবাহ ঠিক তেমনি অবৈধ মনে করা হতো যেমন সহোদর বোন ও গর্ভধারিনী মায়ের সাথে কারো বিয়ে হারাম হয়ে থাকে। পালক পুত্র মরে যাবার বা নিজের স্ত্রীকে তালাক দেবার পরও এ একই পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়। দত্তক পিতার জন্য সেই স্ত্রীলোককে তার আপন ঔরসজাত সন্তানের স্ত্রীর মতো মনে করা হতো। এ রীতিটি বিয়ে, তালাক ও উত্তরাধিকারের যেসব আইন সূরা বাকারাহ ও সূরা নিসায় আল্লাহ বর্ণনা করেছেন তার সাথে পদে পদে সংঘর্ষশীল ছিল। আল্লাহর আইনের দৃষ্টিতে যারা উত্তরাধিকারের প্রকৃত হকদার ছিল এ রীতি তাদের অধিকার গ্রাস করে এমন এক ব্যক্তিকে দিতো যার আদতে কোন অধিকারই ছিল না। এ আইনের দৃষ্টিতে যে সমস্ত পুরুষ ও নারীর মধ্যে বিয়ে হালাল ছিল এ রীতি তা হারাম করে দিতো। আর সবচেয়ে মারাত্মক ব্যাপার হচ্ছে, ইসলামী আইন যেসব নৈতিকতা বিরোধী কার্যকলাপের পথরোধ করতে চায় এ রীতি সেগুলোর বিস্তারের পথ প্রশস্ত করতে সাহয্য করছিল। কারণ প্রচলিত রীতি অনুযায়ী দত্তক ভিত্তিক (মুখে ডাকা) আত্মীয়তার মধ্যে যতই পবিত্রতার ভাব সৃষ্টি করা হোক না কেন দত্তক মা, দত্তক বোন ও দত্তক কন্যা আসল মা, বোন ও কন্যার মতো হতে পারে না। এসব কৃত্তিম আত্মীয়তার লোকাচার ভিত্তিক পবিত্রতার ওপর নির্ভর করে পুরুষ ও নারীর মধ্যে যখন প্রকৃত আত্মীয়দের মতো অবাধ মেলামেশা চলে তখন তা অনিষ্টকর ফলাফল সৃষ্টি না করে থাকতে পারে না। এসব কারণে ইসলামের বিবাহ, তালাক ও উত্তরাধিকার আইন এবং যিনা হারাম হবার আইনের দাবি হচ্ছে এই যে, দত্তককে প্রকৃত সন্তানের মতো মনে করার ধারণাকে পুরোপুরি উচ্ছেদ করতে হবে।
। কিন্তু এ ধারণাটি এমন পর্যায়ের নয় যে, শুধুমাত্র একটি আইনগত হুকুম হিসেবে এতটুকু কথা বলে দেয়া হলো যে, “দত্তক ভিত্তিক আত্মীয়তা প্রকৃত আত্মীয়তা নয়” এবং তারপর তা খতম হয়ে যাবে। শত শত বছরের অন্ধ কুসংস্কার নিছক মুখের কথায় বদলে যাবে না। আইনগতভাবে যদি লোকেরা একথা মেনেও নিতো যে, এ আত্মীয়তা প্রকৃত আত্মীয়তা নয়, তবুও পালক মা ও পালক পুত্রের মধ্যে, পালক ভাই ও পালক বোনের মধ্যে, পালক বাপ ও পালক মেয়ের মধ্যে এবং পালক শ্বশুর ও পালক পুত্রবধুর মধ্যে বিয়েকে লোকেরা মাকরূই মনে করতো থাকতো। তাছাড়া তাদের মধ্যে অবাধ মেলামেশাও কিছু না কিছু থেকে যেতো। তাই কার্যত এ রেওয়াজটি ভেঙে ফেলাই অপরিহার্য ছিল। আর এ ভেঙে ফেলার এ কাজটি স্বয়ং রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাতেই সম্পন্ন হওয়ার প্রয়োজন ছিল। কারণ যে কাজটি রসূল নিজে করেছেন এবং আল্লাহর হুকুমে করেছেন তার ব্যাপারে কোন মুসলমানের মনে কোন প্রকার অপছন্দনীয় হবার ধারনা থাকতে পারতো না। তাই আহযাব যুদ্ধের কিছু পূর্বে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আল্লাহর পক্ষ থেকে ইশারা করা হয় যে, তুমি নিজের পালক পুত্র যায়েদ ইবনে হারেসার তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীকে নিজেই বিয়ে করে নাও। বনী কুরাইযাকে অবরোধ করার সময় তিনি এ হুকুমটি তামিল করেন। (সম্ভবত ইদ্দত খতম হওয়ার জন্য অপেক্ষা করাই ছিল বিলম্বের কারণ। আবার এ সময় যুদ্ধ সংক্রান্ত কাজের চাপ বেড়ে গিয়েছিল।)
যয়নবকে বিয়ে করার ফলে তুমুল অপপ্রচার :
এ বিয়ে হওয়ার সাথে সাথেই নবী করীমের (সা) বিরুদ্ধে অকস্মাৎ ব্যাপক অপপ্রচার শুরু হয়ে যায়। মুশরিক, মুনাফিক ও ইহুদি সবাই তাঁর ক্রমাগত বিজয়ে জ্বলে পুড়ে মরছিল। ওহোদের পরে আহযাব ও বনী কুরাইযার যুদ্ধ পর্যন্ত দুটি বছর ধরে যেভাবে তারা একের পর এক মার খেতে থেকেছে তার ফলে তাদের মনে আগুন জ্বলছিল দাউদাউ করে। এখন প্রকাশ্য ময়দানে যুদ্ধ করে আর কোন দিন তাঁকে হারাতে পারবে, ব্যাপারেও তারা নিরাশ হয়ে গিয়েছিল। তাই তারা এ বিয়ের ব্যাপারটিকে নিজেদের জন্য আল্লাহ প্রদত্ত একটি সুযোগ মনে করে এবং ধারনা করে যে, এবার আমরা মুহাম্মাদের (সা) শক্তি ও তাঁর সাফল্যের মূলে রয়েছে যে চারিত্রিক শ্রেষ্ঠত্ব তাকে খতম করে দিতে পারবো। কাজেই গল্প ফাঁদা হয়, (নাউযুবিল্লাহ) মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর পুত্রবধুকে দেখে তার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েন। পুত্র এ প্রেমের কথা জানতে পেরে নিজের স্ত্রীকে তালাক দিয়ে দেন। আর এরপর তিনি পুত্রবধুকে বিয়ে করে ফেলেন। অথচ এটা ছিল একদম বাজে কথা। কারণ হযরত যয়নব (রা) ছিলেন নবী করীমের (সা) ফুফাত বোন। শৈশব থেকে যৌবন পর্যন্ত তাঁর সমস্ত সময়টা অতিবাহিত হয় নবী করীমের (সা) সামনে। কোন এক সময় তাঁকে দেখে আসক্ত হবার প্রশ্ন কোথা থেকে আসে? তারপর রসূল (সা) নিজেই বিশেষ উদ্যোগী হয়ে হযরত যায়েদের (রা) সাথে তাঁর বিবাহ দেন। কুরাইশ বংশের মতো সম্ভ্রান্ত গোত্রের একটি মেয়েকে একজন আযাদকৃত গোলামের সাথে বিয়ে দেবার ব্যাপারে কেউই রাজী ছিল না। হযরত যয়নব (রা) নিজেও এ বিয়েতে অখুশী ছিলেন। কিন্তু নবী করীমের (সা) হুকুমের সামনে সবাই হযরত যায়েদের (রা) সাথে তাঁকে বিয়ে দিতে বাধ্য হন। এভাবে তাঁরা সমগ্র আরবে এ মর্মে প্রথম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন যে, ইসলাম একজন আযাদকৃত গোলামকে, অভিজাত বংশীয় কুরাশীদের সমপর্যায়ে নিয়ে এসেছে। সত্যিই যদি হযরত যয়নবের (রা) প্রতি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কোন আকর্ষণ থাকতো, তাহলে যায়েদ ইবনে হারেসার (রা) সাথে তাঁকে বিয়ে দেবার কি প্রয়োজন ছিল? তিনি নিজেই তাঁকে বিয়ে করতে পারতেন। কিন্তু নির্লজ্জ বিরোধীরা এসব নিরেট সত্যের উপস্থিতিতেও এ প্রেমের গল্প ফেঁদে বসে। খুব রঙ চড়িয়ে এগুলো ছড়াতে থাকে। অপপ্রচারের অভিযান ক্রমে এত প্রবল হয় যে, তার ফলে মুসলমানদের মধ্যেও তাদের তৈরি করা গল্প ছড়িয়ে পড়ে।
পর্দার প্রাথমিক বিধান : শত্রুদের এ মনগড়া কাহিনী যে মুসলমানদের মুখ দিয়েও রটিত হতে বাধেনি, এ দ্বারা স্পষ্টতই বুঝা যায় যে, সমাজে যৌনতার উপাদান সীমাতিরিক্ত বেড়ে গিয়েছিল। সমাজ জীবনে এ নোংরামিটা যদি না থাকতো তাহলে এ ধরনের পাক-পবিত্র ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে এমন ভিত্তিহীন, অশালীন ও কুরুচিপূর্ণ মনগড়া কাহিনী মুখে উচ্চারিত হওয়া তো দূরের কোথা সেদিকে কারো বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ করাও সম্ভবপর হতো না। যে সংস্কারমূলক বিধানটিকে “হিজাব” (পর্দা) নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে এটি ছিল ইসলামী সমাজে তার প্রবর্তন করার সথিক সময়। এ সূরা থেকেই এ সংস্কার কাজের সূচনা করা হয় এবং এক বছর পরে যখন হযরত আয়েশাড় (রা) বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন অপবাদের কদর্য অভিযানটি চালানো হয় তখনই সূরা নূর নাযিল করে এ বিধানকে সম্পূর্ণ ও সমাপ্ত করা হয়। ( আরও বেশী জানার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, সূরা নূরের ভূমিকা।)
রসূলের পারিবারিক জীবনের বিষয়াবলী এ সময়ে আরও দুটি বিষয় ছিল দৃষ্টি আকর্ষণ করার মত। যদিও আপাতদৃষ্টিতে এর সম্পর্ক ছিল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পারিবারিক জীবনের সাথে কিন্তু যে সত্তা আল্লাহর দ্বীনকে সম্প্রসারিত ও বিকশিত করার জন্য প্রাণান্ত স্নজ্ঞ্রাম-সাধনা করে চলছিলেন এবং নিজের সমস্ত দেহ-মন-প্রাণ এ মহৎ কাজে নিয়োজিত করে রেখেছিলেন তাঁর জন্য পারিবারিক জীবনে শান্তি লাভ, তাকে মানসিক অস্থিরতামুক্ত রাখা এবং মানুষের স্নদেহ-সংশয় থেকে রক্ষা করা ও স্বয়ং দ্বীন তথা ইসলামী জীবন ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্যও জরুরী ছিল। তাই আল্লাহ নিজেই সারাসরি এ দুটি বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেন।
প্রথম বিষয়টি ছিল, নবী (সা) চরম আর্থিক সঙ্কটে ভুগছিলেন। প্রথম চার বছর তো তাঁর অর্থোপার্জনের কোন উপায়-উপকরণ ছিল না। চতুর্থ হিজরীতে বনী নযিরকে দেশান্তর করার পর তাদের পরিত্যক্ত ভূমির একটি অংশকে আল্লাহর হুকুমের মাধ্যমে তাঁর প্রয়োজন পূর্ণ করার জন্য নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়। কিন্তু তাঁর পরিবারের জন্য তা যথেষ্ট ছিল না। এদিকে রিসালাতের দায়িত্ব ছিল এত বিরাট যে, তাঁর দেহ, মন ও মস্তিস্কের সমস্ত শক্তি এবং সময়ের প্রতিটি মুহূর্ত এ কাজে ব্যয়িত হবার দাবী জানাচ্ছিল। ফলে নিজের অর্থোপার্জনের জন্য সামান্যতম চিন্তা ও প্রচেষ্টা তিনি চালাতে পারতেন না। এ অবস্থায় তাঁর পবিত্র স্ত্রীগণ আর্থিক অনটনের কারণে যখন তাঁর মানসিক শান্তিতে ব্যাঘাত ঘটাতেন তখন তাঁর মনের ওপর দ্বিগুণ বোঝা চেপে বসতো।
দ্বিতীয় সমস্যাটি ছিল, হযরত যয়নবকে (রা) বিয়ে করার আগে তাঁর চারজন স্ত্রী ছিল। তাঁরা ছিলেন: হযরত সওদা (রা), হযরত আয়েশা (রা), হযরত হাফসা (রা) ও হযরত উম্মে সালামা (রা)। উম্মুল মুমিনীন হযরত যয়নব (রা) ছীলেণ তাঁর পঞ্চম স্ত্রী। এর ফলে বিরোধীরা এ আপত্তি উঠালো এবং মুসলমানদের মনেও এ সন্দেহ দানা বাঁধতে লাগলো যে, তাদের জন্য তো এক সঙ্গে চারজনের বেশী স্ত্রী রাখা অবৈধ গণ্য করা হয়েছে কিন্তু নবী (সা) নিজে এ পঞ্চম স্ত্রী রাখলেন কেমন করে।
(৩৩-আহযাব) : বিষয়বস্তু ও মুল বক্তব্য:
সূরা আহযাব নাযিল হবার সময় এ সমস্যাগুলোর উদ্ভব ঘটে এবং এখানে এগুলোই আলচিত হয়েছে।
। এর বিষয়বস্তু সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করলে এবং এর পটভূমি সামনে রাখলে পরিষ্কার জানা যায়, এ সমগ্র সূরাটি একটি ভাষণ নয়। একই সময় একই সঙ্গে এটি নাযিল হয়নি। বরং এটি বিভিন্ন বিধান এবং ফরমান সম্বলিত। এগুলো সে সময়ের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলী প্রসঙ্গে একের পর এক নাযিল হয় তারপর সবগুলোকে একত্র করে একটি সূরার আকারে বিন্যাস্ত করা হয়। এর নিম্নলিখিত অংশগুলোর মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য দেখা যায়।
। এক: প্রথম রুকু। আহযাব যুদ্ধের কিছু আগে নাযিল হয়েছে বলে মনে হয়। ঐতিহাসিক পটভূমি সামনে রেখে এ রুকুটি পড়লে পরিষ্কার অনুভূত হবে, এ অংশটি নাযিল হবার আগেই হযরত যায়েদ (রা) হযরত যয়নবকে (রা) তালাক দিয়ে ফেলেছিলেন। নবী (সা) দত্তক সম্পর্কিত জাহেলী যুগের ধারণা, কুসংস্কার ও রসম-রেওয়াজ খতম করে দেবার প্রয়োজন অনুভব করছিলেন। তিনি এও অনুভব করছিলেন যে, লোকেরা “পালক” সম্পর্কে স্রেফ আবেগের ভিত্তিতে যে ধরনের স্পর্শকাতর ও কঠোর চিন্তাধারা পোষণ করে তা কোনক্রমেই খতম হয়ে যাবে না যতক্ষণ না তিনি নিজে (অর্থাৎ নবী) অগ্রবর্তী হয়ে এ রেওয়াজটি খতম করে দেন। কিন্তু এ সত্ত্বেও তিনি এ ব্যাপারেই বড় সন্দিহান ছিলেন এবং সামনে অগ্রসর হতেও ইতস্তত করছিলেন। কারণ যদি তিনি এ সময় যায়েদের তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীকে বিয়ে করেন তাহলে ইসলামের বিরুদ্ধে হাঙ্গামা সৃষ্টি করার জন্য পূর্বে যেসব মুনাফিক, ইহুদি ও মুশরিকরা তৈরি হয়ে বসেছিল তারা এবার একটা বিরাট সুযোগ পেয়ে যাবে। এ সময় প্রথম রুকূর আয়াতগুলো নাযিল হয়।
। দুই: দ্বিতীয় ও তৃতীয় রুকূতে আহযাব ও বনী কুরাইযার যুদ্ধ সম্পর্কে মন্তব্য করা হয়েছে। এ দুটি রুকূ যে সংশ্লিষ্ট যুদ্ধ দুটি হয়ে যাবার পর নাযিল হয়েছে এটি তার সুস্পষ্ট প্রমাণ।
। তিন: চতুর্থ রুকূ থেকে শুরু করে ৩৫ আয়াত পর্যন্ত যে ভাষণ দেয়া হয়েছে তা দুটি বিষয়বস্তু সম্বলিত। প্রথম অংশে আল্লাহ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্ত্রীগণকে নোটিশ দিয়েছেন। এ অভাব অনটনের যুগে তাঁরা বেসবর হয়ে পড়ছিলেন। তাঁদেরকে বলা হয়েছে, তোমরা একদিকে দুনিয়া ও দুনিয়ার শোভা সৌন্দর্য এবং অন্যদিকে আল্লাহ, তাঁর রসূল ও আখেরাত এ দুটির মধ্য থেকে যে কোন একটিকে বেছে নাও। যদি প্রথমটি তোমাদের কাঙ্খিত হয় তাহলে পরিষ্কার বলে দাও। তোমাদেরকে একদিনের জন্যও এ অনটনের মধ্যে রাখা হবে না বরং সানন্দে বিদায় দেয়া হবে। আর যদি দ্বিতীয়টি তোমাদের পছন্দ হয়, তাহলে সবর সহকারে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের সাথে সহযোগিতা করো। পরবর্তী অংশগুলোতে এমন সামাজিক সংস্কারের দিকে অগ্রণী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে যার প্রয়োজনীয়তা ইসলামী ছাঁচে ঢালাই করা মন-মগজের অধিকারী ব্যক্তিগণ স্বত:স্ফূর্তভাবেই অনুভব করতে শুরু করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের গৃহ থেকে সংস্কারের সূচনা করতে গিয়ে নবির পবিত্র স্ত্রীগণকে হুকুম দেয়া হয়েছে, তোমরা জাহেলী যুগের সাজসজ্জা পরিহার করো। আত্মমর্যাদা নিয়ে গৃহে বসে থাকো। বেগানা পুরুষদের সাথে কথা বলার ব্যাপারে কঠোর সতর্কতা অবলম্বন করো। এ ছিল পর্দার বিধানের সূচনা।
। চার: ৪৬ থেকে ৪৮ পর্যন্ত আয়াতের বিষয়বস্তু হচ্ছে হযরত যয়নবের সাথে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিয়ে সম্পর্কিত। বিরোধীদের পক্ষ থেকে এ বিয়ের ব্যাপারে যেসব আপত্তি উঠানো হচ্ছিল এখানে সেসবের জবাব দেয়া হয়েছে। মুসলমানদের মনে যেসব সন্দেহ সৃষ্টি করার চেষ্টা করা হচ্ছিল সেগুলো সবই দূর করে দেয়া হয়েছে। মুসলমানদেরকে নবীর (সা) মর্যাদা কি তা জানানো হয়েছে এবং খোদ নবীকে (সা) কাফের ও মুনাফিকদের মিথ্যা প্রচারণার মুখে ধৈর্য ধারণ করার উপদেশ দেয়া হয়েছে।
। পাচ: ৪৯ আয়াতে তালাকের আইনের একটি ধারা বর্ণনা করা হয়েছে। এটি একটি একক আয়াত। সম্ভবত এসব ঘটনাবলী প্রসঙ্গে কোন সময় এটি নাযিল হয়ে থাকবে।
। ছয়: ৫০ থেকে ৫২ আয়াতে নবীর (সা) জন্য বিয়ের বিশেষ বিধান বর্ণনা করা হয়েছে। সেখানে একথা সুস্পষ্ট করে দেয়া হয়েছে যে, দাম্পত্য জীবনের ক্ষেত্রে সাধারণ মুসলমানদের ওপর যেসব বিধি-নিষেধ আরোপিত হয়েছে নবীর (সা) ব্যাপারে তা প্রযোজ্য হবে না।
। সাত: ৫৩–৫৫ আয়াতে সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় পদক্ষেপ উঠানো হয়েছে। এগুলো নিম্নলিখিত বিধান স্মবলিত:
। নবীর (সা) গৃহাভ্যন্তরে বেগানা পুরুষদের যাওয়া আসার ওপর বিধি-নিষেধ, সাক্ষাত করা ও দাওয়াত দেবার নিয়ম-কানুন, নবীর পবিত্র স্ত্রীগণ সম্পর্কিত এ আইন যে, গৃহাভ্যন্তরে কেবলমাত্র তাঁদের নিকটতম আত্মীয়রাই আসতে পারেন, বেগানা পুরুষদের যদি কিছু বলতে হয় বা কোন জিনিস চাইতে হয় তাহলে পর্দার আড়াল থেকে বলতে ও চাইতে হবে, নবীর (সা) পবিত্র স্ত্রিদের ব্যাপারে এ হুকুম যে, তাঁরা মুসলমানদের জন্য নিজেদের মায়ের মতো হারাম এবং নবীর (সা) পরও তাঁদের কারো সাথে কোন মুসলমানদের বিয়ে হতে পারে না।
। আট: ৫৬ থেকে ৫৭ আয়াতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিয়ে ও তাঁর পারিবারিক জীবনের বিরুদ্ধে যেসব কথাবার্তা বলা হচ্ছিল সেগুলো সম্পর্কে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। এই সঙ্গে মুমিনদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, তারা যেন শত্রুদের পরনিন্দা ও অন্যের ছিদ্রান্বেষণ থেকে নিজেদের দূরে রাখে এবং নিজেদের নবীর উপর দরূদ পাঠ করে। এছাড়া এ উপদেশও দেয়া হয় যে, নবী তো অনেক কথা, ঈমানদারদের তো সাধারণ মুসলমানদের বিরুদ্ধেও অপবাদ দেয়া ও দোষারোপ করা থেকে দূরে থাকা উচিত।
। নয়: ৫৯ আয়াতে সামাজিক সংস্কারের ক্ষেত্রে তৃতীয় পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এতে সমগ্র মুসলিম নারী সমাজের যখনই বাইরে বের হবার প্রয়োজন হবে চাদর দিয়ে নিজেদেরকে ঢেকে এবং ঘোমটা টেনে বের হবার হুকুম দেয়া হয়েছে।
। এরপর থেকে নিয়ে সূরার শেষ পর্যন্ত গুজব ছড়ানোর অভিযানের (Whispering campaign) বিরুদ্ধে কঠোর নিন্দাবাদ ও ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে। মুনাফিক, অকাটমূর্খ ও নিকৃষ্ট লোকেরা এ অভিযান চালাচ্ছিল।
# ওপরে ভূমিকায় বর্ণনা করে এসেছি, এ আয়াত এমন এক সময় নাযিল হয় যখন হযরত যায়েদ (রা.) হযরত যয়নবকে (রা.) তালাক দিয়েছিলেন। তখন নবী ﷺ নিজেও অনুভব করেছিলেন এবং আল্লাহর ইশারাও এটিই ছিল যে, দত্তক সম্পর্কের ব্যাপারে জাহেলীয়াতের রসম-রেওয়াজ ও কুসংস্কারের ওপর আঘাত হানার এটিই মোক্ষম সময়। নবীর ﷺ নিজেকে অগ্রসর হয়ে তাঁর দত্তক পুত্রের (যায়েদ) তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীকে বিয়ে করা উচিত। এভাবে এ রেওয়াজটি চূড়ান্তভাবে খতম হয়ে যাবে। কিন্তু যে কারণে নবী করীম ﷺ এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে ইতস্তত করেছিলেন তা ছিল এ আশঙ্কা যে, এর ফলে তাঁর একের পর এক সাফল্যের কারণে যে কাফের ও মুশরিকরা পূর্বেই ক্ষিপ্ত হয়েই ছিল এখন তাঁর বিরুদ্ধে প্রোপাগাণ্ডা করার জন্য তাঁরা একটি শক্তিশালী অস্ত্র পেয়ে যাবে। এটা তাঁর নিজের দুর্নামের আশঙ্কা জনিত ভয় ছিল না। বরং এ কারণে ছিল যে, এর ফলে ইসলামের উপর আঘাত আসবে, শত্রুদের অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হয়ে ইসলামের প্রতি ঝুঁকে পড়া বহু লোকের মনে ইসলাম সম্পর্কে খারাপ ধারণা জন্মাবে, বহু নিরপেক্ষ লোক শত্রুপক্ষে যোগ দেবে এবং স্বয়ং মুসলমানদের মধ্যে যারা দুর্বল বুদ্ধি ও মননের অধিকারী তারা সন্দেহ-সংশয়ের শিকার হবে। তাই নবী ﷺ মনে করতেন, জহেলীয়াতের একটি রেওয়াজ পরিবর্তন করার জন্য এমন পদক্ষেপ উঠানো কল্যাণকর নয় যার ফলে ইসলামের বৃহত্তর উদ্দেশ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
# ভাষণ শুরু করে প্রথম বাক্যেই নবী করীমের ﷺ এ আশঙ্কার অবসান ঘটিয়েছেন। বক্তব্যের নিগূঢ় অর্থ হচ্ছে দ্বীনের কল্যাণ কিসে এবং কিসে নয় এ বিষয়টি আমিই ভালো জানি। কোন্ সময় কোন্ কাজটি করতে হবে এবং কোন্ কাজটি অকল্যাণকর তা আমি জানি। কাজেই তুমি এমন কর্মনীতি অবলম্বন করো না যা কাফের ও মুনাফিকদের ইচ্ছার অনুসারী হয় বরং এমন কাজ করো যা হয় আমার ইচ্ছার অনুসারী। কাফের ও মুনাফিকদেরকে নয় বরং অামাকেই ভয় করা উচিত।
# এ বাক্যে সম্বোধন করা হয়েছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে, মুসলমানদেরকেও ইসলাম বিরোধীদেরকেও। এর অর্থ হচ্ছে নবী যদি আল্লাহর হুকুম পালন করে দুর্নামের ঝুঁকি মাথা পেতে নেন এবং নিজের ইজ্জত আবরুর ওপর শত্রুর আক্রমণ ধৈর্য সহকারে বরদাশ্ত করেন তাহলে তাঁর বিশ্বস্তামূলক কর্মকাণ্ড আল্লাহর দৃষ্টির আড়ালে থাকবে না। মুসলমানদের মধ্য থেকে যেসব লোক নবীর প্রতি বিশ্বাসের ক্ষেত্রে অবিচল থাকবে এবং যারা সন্দেহ-সংশয়ে ভুগবে তাদের উভয়ের অবস্থাই অগোচরে থাকবে না। কাফের ও মুনাফিকরা তাঁর দুর্নাম করার জন্য যে প্রচেষ্টা চালাবে সে সম্পর্কেও আল্লাহ বেখবর থাকবেন না। কাজেই ভয়ের কোন কারণ নেই। প্রত্যেকে যার যার কার্য অনুযায়ী যে পুরস্কার বা শাস্তি লাভের যোগ্য হবে তা সে অবশ্যই পাবে।
# এ বাক্যে আবার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সম্বোধন করা হয়েছে। তাঁকে এই মর্মে নির্দেশ দেয়া হচ্ছে যে, তোমার ওপর যে দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে আল্লাহর প্রতি নির্ভর করে তা সম্পন্ন করো এবং সারা দুনিয়ার মানুষ যদি বিরোধিতায় এগিয়ে আসে তাহলেও তার পরোয়া করো না। মানুষ যখন নিশ্চিত ভাবে জানবে উমুক হুকুমটি আল্লাহ দিয়েছেন তখন সেটি পালন করার মধ্যেই সমস্ত কল্যাণ নিহিত রয়েছে বলে তার পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হয়ে যাওয়া উচিত। এরপর তার মধ্যে কল্যাণ, সুবিধা ও প্রজ্ঞা খুঁজে বেড়ানো সেই ব্যক্তির নিজের কাজ নয় বরং কাজ হওয়া উচিত শুধুমাত্র আল্লাহর প্রতি নির্ভর করে তাঁর হুকুম পালন করা। বান্দা তার যাবতীয় বিষয় আল্লাহর হাতে সোপর্দ করে দেবে, তার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। তিনি পথ দেখাবার জন্যও যথেষ্ট এবং সাহায্য করার জন্যও। আর তিনিই এ বিষয়ের নিশ্চয়তাও দেন যে, তাঁর পথনির্দেশের আলোকে কার্য সম্পাদনকারী ব্যক্তি কখনো অশুভ ফলাফলের সম্মুখীন হবে না।
ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
সংক্ষিপ্ত আলোচনা : এই সূরাটা বদর যুদ্ধের পর থেকে হুদায়বিয়ার সন্ধির পূর্ব পর্যন্ত সময়কার মদীনার মুসলমানদের অবস্থা বর্ণনা করে এবং তাদের জীবনধারার একটা বাস্তব চিত্র তুলে ধরে। এ সময়ে তারা যেসব ঘটনা-দুর্ঘটনার সম্মুখীন হন এবং এই নবীন ইসলামী রাষ্ট্র যে সামাজিক আচরণ বিধি গড়ে তােলে, সূরায় তার উল্লেখ রয়েছে। অবশ্য এইসব ঘটনা ও আচরণ বিধি সংক্রান্ত আলােচনা ও পর্যালােচনা অন্যান্য বিষয়ের তুলনায় ক্ষুদ্র কলেবরের এবং সূরার একটা সীমিত অংশ জুড়ে এর অবস্থান। এতে ঘটনাবলী ও আচরণ বিধিগুলােকে ইসলামের প্রধান মূলনীতির সাথে যুক্ত করা হয়েছে। সেই প্রধান মূলনীতি হলাে, আল্লাহর প্রতি ঈমান আনা ও তার নির্ধারিত ভাগ্য অম্লান বদনে মেনে নেয়া। সূরার প্রথম চার আয়াতে এ মূলনীতি দুটো প্রতিফলিত হয়েছে। অনুরূপভাবে সূরার প্রথমভাগে সামাজিক আচরণ বিধি সংক্রান্ত মন্তব্যেও তা প্রতিফলিত হয়েছে। এ মন্তব্য রয়েছে ৬, ৭ ও ৮ নং আয়াতে। আহযাব তথা খন্দক যুদ্ধের দিন যেসব মুসলমান পালিয়ে গিয়েছিলাে তাদের আচরণ সংক্রান্ত মন্তব্যেও তার প্রতিফলন ঘটেছে। এখান থেকেই সূরার নামকরণ হয়েছে ‘আহযাব’। এ মন্তব্য রয়েছে ১৬ ও ১৭ নং আয়াতে। অনুরূপভাবে জাহেলী যুগের প্রচলিত রীতিপ্রথা ও ধ্যান-ধারণার পরিপন্থী নতুন সামাজিক আচরণ বিধি সম্পর্কে এ মন্তব্যটাতেও মূলনীতিদ্বয়েরই অভিব্যক্তি ঘটেছে, ‘কোনাে ঈমানদার নারী ও পুরুষের এ অধিকার নেই যে, আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রসূল কোনাে বিষয়ে ফায়সালা করার পর সেই ব্যাপারে সে নিজের খেয়াল খুশী মতাে কাজ করবে।’ সর্বশেষে এর প্রতিফলন ঘটেছে সূরার শেষভাগের ৭২ নং আয়াতের গুরুগম্ভীর ঘােষণায়। মদিনার মুসলমানদের জীবনের এই অংশটার একটা উল্লেখযােগ্য বৈশিষ্ট্য রয়েছে মুসলমানদের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক জীবনে ইসলামী স্বাতন্ত্রের লক্ষণগুলাে এই সময়েই ফুটে উঠেছিলাে। তবে সেটা একদিকে যেমন স্থীতিশীল হয়নি, তেমনি তা সর্বময় কর্তৃত্ব ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় সফল হয়নি, যেমনটি হয়েছিলাে মক্কা বিজয়ের পর এবং দলে দলে ইসলাম গ্রহণ ও ইসলামী সরকারের হাতে প্রশাসন ক্ষমতা হস্তান্তরিত হওয়ার পর। সূরাটিতে মুসলিম সমাজের পুনর্গঠন, ইসলামী চারিত্রিক বৈশিষ্টগুলােকে পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে স্থীতিশীল ও প্রসারিত করা এবং ইসলামের মৌলিক আকীদা বিশ্বাস ও আইন কানুন যেমন বর্ণনা করা হয়েছে, তেমনি প্রচলিত সামাজিক রীতিনীতি, ঐতিহ্য ও আচার অনুষ্ঠানের সংস্কার, সংশােধন, উচ্ছেদ সাধন ও সঠিক পরিবেশ নতুন ইসলামী বিধিব্যবস্থার আওতাধীন করার কথাও ঘােষিত হয়েছে। এইসব বিষয় আলােচনার প্রেক্ষাপটে আহযাব যুদ্ধ, বনু কোরায়যার যুদ্ধ এবং এই উভয় যুদ্ধে কাফের, মােনাফেক ও ইহুদী গােষ্ঠীগুলাের ভূমিকাও আলােচিত হয়েছে। দেখানাে হয়েছে, কিভাবে তারা মুসলমানদের ভেতরে থেকে ষড়ন্ত্র করে এবং এই ষড়যন্ত্রের ফলে মুসলমানদের কতাে ক্ষতি হয়- এরপর আলােচিত হয়েছে মুসলমানদের ঈমান, চরিত্র, আদব আখলাক, পরিবার ও নারী সমাজের বিরুদ্ধে তাদের চক্রান্ত। সূরায় এইসব সামাজিক বিধিব্যবস্থা, এই দুই যুদ্ধ এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য ঘটনার মধ্যকার যােগসূত্র হলাে কাফের মুনাফিক ও ইহুদিদের নীতির সাথে এগুলাের সংশ্লিষ্টতা এবং মুসলমানদের মধ্যে অনৈক্য ও ভেদাভেদ ও বিশৃংখলা সৃষ্টির জন্যে কাফের, মােনাফেক ও ইহুদীদের অপচেষ্টা, চাই সে অপচেষ্টা সামরিক আক্রমণ চালানাে, অনৈক্য ও বিশৃংখলা সৃষ্টি এবং পরাজয় মেনে নেয়ার কু-মন্ত্রণা দেয়ার মাধ্যমে হােক অথবা সামাজিক ও নৈতিক অধপতন ঘটানাের মাধ্যমে হােক। এ ছাড়া মুসলমানদের জীবনে যুদ্ধ ও যুদ্ধলব্ধ সম্পদের যে প্রভাব পড়ে, তার কারণে কিছু কিছু সামাজিক বিধিব্যস্থায় ও ধ্যান ধারণায় পরিবর্তন ও সংস্কার সাধন অপরিহার্য হয়ে পড়ে এবং সেগুলােকে যুদ্ধ ও যুদ্ধলব্ধ গনিমতের প্রভাবে মুসলিম সমাজে সৃষ্ট নতুন পরিস্থিতির আলােকে পুনর্বিন্যস্ত করার প্রয়ােজন দেখা দেয়। এই পটভূমিতেও সূরায় নতুন বিধিব্যবস্থার সংযােজন ঘটেছে। এসব দিক দিয়ে বিবেচনা করলে দেখা যাবে সূরার আলোচিত বিষয় গুলোতে বিভিন্নতা ও বৈচিত্র্য থাকলেও ঐক্য, সংহতি ও সমন্বয় বহাল রয়েছে। সূরায় বর্ণিত ঘটনাবলী ও বিধিব্যবস্থার কালগত ঐক্য এগুলােকেই সুসমন্বিত করে। সূরাটা শুরু হয়েছে আল্লাহর প্রতি রসুল(স.)-এর ভয় সৃষ্টি, কাফের ও মােনাফেকদের অনুসরণ না করা, একমাত্র ওহীর মাধ্যমে আল্লাহর পাঠানাে নির্দেশাবলীর অনুসরণ করা এবং শুধু তার ওপর তাওয়াক্কুল বা নির্ভর করার আদেশদানের মাধ্যমে। এভাবে শুরু হওয়ার কারণে সূরায় আলােচিত সমুদয় ঘটনাবলী ও বিধি ব্যবস্থার সংযােগ সেই প্রধান মূলনীতির সাথে প্রতিষ্ঠিত হলাে, যার ওপর ইসলামের যাবতীয় আইন কানুন, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা এবং নৈতিক বিধানের ভিত্তি দাঁড়িয়ে আছে। সেই প্রধান মূলনীতিটা হলাে আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্বের আন্তরিক উপলব্ধি, তার ইচ্ছা ও সিদ্ধান্তের কাছে শর্তহীন আত্মসমর্পণ, তার মনােনীত বিধানের অনুসরণ, একমাত্র তার ওপর নির্ভর করা এবং তাঁর রক্ষণাবেক্ষণ ও সাহায্যকে যথেষ্ট মনে করা ও নিশ্চিন্ত হওয়া। শুরুর কিছু পরই সমাজে প্রচলিত কিছু রীতি ও প্রথা সম্পর্কে সঠিক ও চূড়ান্ত ফায়সালা ঘোষিত হয়। এ পর্যায়ে সর্ব প্রথম তথ্য সম্বলিত একটা বাস্তব উক্তি উচ্চারিত হয়, ‘আল্লাহ তায়ালা কোনাে মানুষের জন্যে দুটো হৃদয় তৈরী করেননি।’ এ দ্বারা এই মর্মে ইংগিত দেয়া হচ্ছে যে, মানুষ একই সময়ে একাধিক বিষয়ে মনােযােগ দিতে, কিংবা একাধিক বিধান অনুসরণ করতে পারে না। তা করতে গেলে তাকে মুনাফিকী করতে হবে এবং তাকে বিপথগামী হবার ঝুঁকি নিতে হবে। তার যখন একটার বেশী হৃদয় নেই, তখন তাকে অবশ্যই একমাত্র মা’বুদ আল্লাহর অনুগত হতে হবে, একমাত্র বিধান ইসলামের অনুসারী হতে হবে এবং এ ছাড়া আর যতাে পথ, পন্থা, নিয়ম, বিধি, রীতি, নীতি, প্রথা ও পদ্ধতি আছে, তা যতােই প্রিয় হােক বর্জন করতে হবে। এ কারণেই যেহারের প্রথাটা বিলােপের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। যেহার হলাে জাহেলী যুগের একটা ন্যক্কারজনক প্রথা। স্বামী রেগে গেলে স্ত্রীকে বলতাে, ‘তুই আমার মায়ের মতাে যাতে সে মায়ের মতােই তার জন্যে নিষিদ্ধ হয়ে যায়।’ আল্লাহ তায়ালা বলেন, যে সমস্ত স্ত্রীর সাথে তােমরা যেহার করাে, তাদেরকে আল্লাহ তায়ালা তােমাদের মা বানাননি। অর্থাৎ এ কথাটা নিছক মুখ দিয়েই বলা হয়, আসলে এর পেছনে কোনাে সত্য নেই। স্ত্রী স্ত্রীই থেকে যায়। শুধু এই কথাটার কারণেই সে মা হয়ে যায় না। (এ ধরনের পরিস্থিতিতে কী করতে হবে, সেটা পরবর্তীতে এই আয়াতের বিস্তারিত ব্যাখ্যা প্রসংগে বর্ণনা করবাে) এরপর এই বলে পালক পুত্র গ্রহণের প্রথা ও সেই প্রথা থেকে উদ্ভূত অন্যান্য সামাজিক, রীতি-নীতি উচ্ছেদ করা হয়ছে, ‘তোমাদের পালক পুত্রদেরকে আল্লাহ তায়ালা তােমাদের পুত্র বানাননি।’ সুতরাং এখন থেকে তারা আর উত্তরাধিকারী হবে না এবং এই পালকপুত্র গ্রহণের অন্যান্য ফলাফলও কার্যকর হবে না। (এ সম্পর্কে বিশদ আলােচনা পরে আসছে) এরপর সকল মুসলমানদের জন্যে রসূল(স.)-এর সার্বিক অভিভাবকত্ব বহাল থেকে যাবে বা বহাল করা হবে। আর এই অভিভাকত্ব তাদের নিজেদের অভিভাবকত্বের ওপর অগ্রগণ্য হবে। রসূল(স.)-এর এই অভিভাবকত্ব সর্বসাধারণ মুসলমানদের সাথে রাসূল সহধর্মিনীদের আদর্শগত মাতৃত্বের সম্পর্কের মতােই। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘মুসলমানদের জন্যে রসূল(স.) তাদের নিজেদের চেয়ে উত্তম অভিভাবক, আর তার স্ত্রীরা তাদের মাতা।’ অতপর হিজরতের প্রথম দিকে আনসার ও মােহাজেরদের মধ্যে যে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক গঠন করা হয়েছিলাে সেই ভ্রাতৃত্বের ফলাফলও বাতিল করা হয়েছে এবং উত্তরাধিকার ইত্যাদি বিষয়কে স্বাভাবিক আত্মীয়তার সাথেই সংশ্লষ্ট করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আল্লাহর কিতাবে মুসলমান ও মােহাজেরদের চেয়ে রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়রাই পরস্পরের অভিভাকত্বের ক্ষেত্রে অগ্রগণ্য।’ এর মধ্য দিয়েই কোরআন স্বাভাবিক আত্মীয়তার ভিত্তির ওপর মুসলমানদের সমাজব্যবস্থা পুনর্গঠিত এবং অন্যসব সাময়িক বিধি ব্যবস্থা কে বাতিল করেছে। ইসলামের বিধান ও আল্লাহর ফায়সালা থেকে উৎসারিত এই পুনর্গঠন প্রক্রিয়া সম্পর্ক এই বলে মন্তব্য করা হয়েছে যে, এটাই আল্লাহর প্রাচীন কিতাবে লেখা রয়েছে এবং নবীদের কাছ থেকে বিশেষত তাদের মধ্য থেকে অধিকতর মর্যাদাবান নবীদের কাছ থেকে এটাই বাস্তবায়িত করার অংগীকার নেয়া হয়েছে। মূলত আইন কানুন ও নীতি নির্দেশনাবলীর ক্ষেত্রে এরূপ মন্তব্য করা কোরআনের স্থায়ী রীতি। এ রীতির উদ্দেশ্য হলাে, এসব আইন কানুন ও নীতিমালাকে মানুষের মনমগজে বদ্ধমূল করা। এই হচ্ছে প্রথম অধ্যায়ের সংক্ষিপ্ত সার। দ্বিতীয় অধ্যায়ে আল্লাহ তায়ালা মােমেনদের ওপর ইসলামের শত্রুদের সর্বাত্মক ও ঐক্যবদ্ধ আক্রমণজনিত খন্দক যুদ্ধকে নস্যাত করে দিয়ে যে অনুগ্রহ করেন, তা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। এরপর খন্দক যুদ্ধের দুটো ঘটনা ও বনু কোরায়যার ঘটনার প্রাণবন্ত দৃশ্য তুলে ধরা হয়েছে। এগুলাে উপস্থাপন করা হয়েছে পর্যায়ক্রমিকভাবে এবং এমনভাবে যে, অন্তরের সুপ্ত অনুভূতি, প্রকাশ্য তৎপরতা এবং দল ও ব্যক্তির মধ্যকার সংলাপ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। যুদ্ধ ও তার সাথে সংশ্লিষ্ট ঘটনাগুলাের দৃশ্য অংকনের সময় বিভিন্ন নির্দেশাবলীকে যথাস্থানে উল্লেখ করা হয়েছে। আর বিভিন্ন ঘটনাবলীর ওপর যে মন্তব্যগুলাে করা হয়েছে, সেগুলাে করা হয়েছে কোরআনের স্থায়ী নিয়ম অনুসারে। বাস্তবে যা ঘটেছে এবং মনমগজকে যা প্রচন্ডভাবে আলােড়িত করেছে, তার মধ্য দিয়ে জীবনের জন্যে স্থায়ী মূল্যবােধ নির্ধারণে কোরআনের এই স্থায়ী নিয়ম অনুসৃত হয়েছে। পবিত্র কোরআন চরিত্র গঠন, মূল্যবােধ ও মানদন্ড নিরুপণ এবং যে চিন্তাধারাকে সে সমাজে বিজয়ী ও আধিপত্যশীল দেখতে চায়, সেই চিন্তাধারার বিস্তার ও প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে যে সমস্ত ঘটনাকে উপকরণ হিসেবে গ্রহণ করে, সেইসব ঘটনা বর্ণনার ক্ষেত্রে কোরআনের একটা স্বতন্ত্র পদ্ধতি রয়েছে। কোরআনের এই পদ্ধতিটা হলাে, সে সংঘটিত ঘটনাটাকে হুবহু বর্ণনা করবে, সেই সাথে প্রকাশ্য ও সুপ্ত অনুভূতি তুলে ধরবে, অতপর তার তথ্যাবলী এমনভাবে উদঘাটন করবে যে তার যাবতীয় গুপ্ত দিক প্রকাশিত হবে। তারপর মুসলমানদেরকে যা ঘটেছে সে সম্পর্কে নিজের সিদ্ধান্ত জানাবে। তাতে যদি কিছু ভ্রান্তি ও ভ্রষ্টতা থেকে থাকে, তবে তার সমালােচনা করবে। আর সুষ্ঠু ও নির্ভুল কিছু থাকলে তার প্রশংসা করবে, ভুল ভ্রান্তি থাকলে তার সংশােধনের জন্যে এবং সুষ্ঠু ও উত্তম কিছু থাকলে তার বিকাশ বৃদ্ধির জন্যে জোর নির্দেশ দেয়া হবে। আর এই সবকিছুকে আল্লাহ তায়ালা তার নির্ধারিত ভাগ্যলিপি, তার ইচ্ছা, কাজ, নির্ভুল বিধান, স্বভাব প্রকৃতি এবং প্রাকৃতিক নিয়মাবলী ও শক্তিগুলাের সাথে যুক্ত ও সমন্বিত করেছেন। এভাবে আমরা দেখতে পাই, খন্দকের যুদ্ধের বিবরণ শুরু হয়েছে, ‘হে ঈমানদাররা, তােমাদের ওপর আল্লাহর অনুগ্রহকে স্মরণ কর, যখন তােমাদের কাছে শক্র সেনারা এলাে। আমি তখনই তাদের কাছে বাতাস ও তােমরা কখনাে দেখোনি এমন বাহিনী পাঠালাম…'(আয়াত ৯) এর মাঝখানে রয়েছে, বলো, তােমাদের পালানােতে কোনাে লাভ হবে না…'(আয়াত ১৬-১৭) ‘তােমাদের জন্যে আল্লাহর রসূলের মধ্যে সর্বোত্তম আদর্শ রয়েছে…'(আয়াত ২১) এবং সবার শেষে ‘সত্যনিষ্ঠদেরকে যেনাে আল্লাহ তাদের সত্যনিষ্ঠার জন্যে পুরস্কার দিতে পারেন…'(আয়াত ২৪) এরই পাশাপাশি যুদ্ধে যােগদান সম্পর্কে সত্যনিষ্ঠ মােমেনদের মনােভাব এবং মনোব্যাধি আক্রান্ত মােনাফেকদের মনােভাব এমনভাবে তুলে ধরা হয়েছে যে, সেই মনােভাবের মধ্য দিয়ে বিশুদ্ধ ও অশুদ্ধ মূল্যবােধগুলাে আলাদা আলাদা হয়ে বাছাই হয়ে যায়। যেমন ‘মােনাফেক ও মনােব্যাধিতে আক্রান্তরা বলে যে, আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রাসূল আমাদের কাছে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তা ধোকা ছাড়া কিছু নয়।’ মােমেনরা যখন আক্রমণকারী সেনাদলগুলােকে দেখলাে, তখন বললাে, আমাদের সাথে আল্লাহ ও তাঁর রসূল যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তাতো এটাই। এতে তাদের প্রত্যয় ও আত্মসমর্পণ কেবল বেড়েই যায়। অতপর অকাট্য ফায়সালা ও দৃঢ় বিশ্বাস সহকারে ঘােষণা করা হয়েছে। ‘আর আল্লাহ তায়ালা কাফেরদেরকে তাদের আক্রোশ সহকারেই ফেরত পাঠালেন। তারা এক বিন্দুও লাভবান হতে পারলাে না। মােমেনদের যুদ্ধের জন্যে আল্লাহ তায়ালাই যথেষ্ট। তিনি মহাশক্তিধর ও মহাপ্রতাপশালী।’ এরপর রাসূল(স.)-এর কতিপয় স্ত্রীর প্রসংগ আলােচিত হয়েছে। বিতাড়িত ইহুদী গােষ্ঠী বনু কোরায়যার পরিত্যক্ত সম্পদ ও ইতিপূর্বেকার যুদ্ধলব্ধ সম্পদের সুবাদে রাসূল(স.) ও মুসলমানদেরকে আল্লাহ তায়ালা যখন বিপুল সম্পদের অধিকারী করলেন, তখন রসূল(স.)-এর এই ক’জন স্ত্রী তাদের খােরপােষের পরিমাণ আরাে বাড়িয়ে দেয়ার দাবী জানালেন। এই দাবীর জবাবে তাদেরকে দুনিয়ার সহায় সম্পদ, আরাম আয়েশ ও বিলাস ব্যসন অথবা আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রসূলের সন্তুষ্টি ও আখেরাতের সুখ শান্তি-এই দুটোর যে কোনাে একটা বেছে নেয়ার আহ্বান জানানাে হলাে। তারা আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রাসূলের সন্তুষ্টি এবং আখেরাতের সুখ শন্তিকেই বেছে নিলেন। আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রসূলের চোখে সম্মানজনক এই স্থানকে পার্থিব সহায় সম্পদের ওপরে অগ্রাধিকার দিলেন। এ জন্যেই তাদেরকে জানানাে হলাে যে, তাদের পরহেযগারী ও তাকওয়ার জন্যে যেমন তারা দ্বিগুণ পুরস্কার পাবে, তেমনি কোনাে খারাপ কাজ করলেও প্রমাণ সাপেক্ষে দ্বিগুণ শাস্তি ভােগ করবে। এই দ্বিগুণ শাস্তি ও দ্বিগুণ পুরষ্কারের কারণ দেখানাে হলো এই যে, তারা অত্যন্ত মহীয়সী ও শ্রদ্ধাভাজন, রসূল(স.)-এর সাথে তাদের রয়েছে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, তাদের ঘরে প্রতিনিয়ত কোরআন নাযিল ও পঠিত হয় এবং রসূল(স.)-এর কাছ থেকে তারা হরহামেশা জ্ঞানের কথা শােনার সৌভাগ্য লাভ করে থাকেন। এরপর সকল মুসলিম নারী ও পুরুষের উত্তম প্রতিদানের আরাে বর্ণনা দিয়ে তৃতীয় অধ্যায় শেষ হয়। চতুর্থ অধ্যায়ে সংযােজিত হয়েছে রসূল (স.)-এর মুক্ত গােলাম যায়েদ বিন হারেসার সাথে রসূল(স.)-এর ফুফাতাে বােন যয়নব বিনতে জাহাশের বিয়ে সম্পর্কে অস্পষ্ট আভাস। এ অধ্যায়ে এ বিষয়টাও স্পষ্ট করে দেয়া হয়েছে যে, মুসলিম নারী ও পুরুষদের যাবতীয় বিষয়ের ফায়সালার ক্ষমতা ও অধিকার একমাত্র আল্লাহর হাতে নিবদ্ধ। মুসলিম নারী পুরুষদের হাতে কোনাে ক্ষমতা নেই এবং কোনাে অধিকার নেই। একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই নিজের স্বাধীন ইচ্ছা ও পরিকল্পনা অনুযায়ী সবকিছু পরিচালনা করেন এবং মােমেন মাত্রেরই তার কাছে দ্ব্যর্থহীন ও পূর্ণাংগভাবে আত্মসমর্পণ করা কর্তব্য। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রাসূল যখন কোন ব্যাপারে ফায়সালা করে দেন, তখন কোনাে মুসলিম নারী ও পুরুষের নিজেদের ব্যাপারে কোনাে নিজস্ব সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার থাকে না। এরপর বিয়ের ঘটনা, তালাকের ঘটনা ও পালকপুত্র গ্রহণের ফলাফল বাতিল করা নিয়ে আলােচনা করা হয়। শেষােক্ত বিষয়টা নিয়ে সূরার শুরুতেই আলােচনা করা হয়েছে। পালকপুত্র গ্রহণের ফলাফল বাতিল করার জন্যে স্বয়ং রসূল(স.) কে দিয়েই এমন একটা কাজ করানাে হয়, যা সেই পরিবেশে অন্য কারাে দ্বারা সম্ভব হতো না। কেননা সেকালের আরবীয় সমাজে এই প্রথাটা ছিলাে খুবই গভীর এবং এর বিরােধিতা করা খুবই দুরূহ ছিলাে। তাই পরীক্ষাটা এসে পড়লাে রসূল(স.) -এর ওপরেই, যাতে তিনি দাওয়াতী কাজ পরিচালনা ও তার মূলনীতিগুলাে মন মগজে বদ্ধমূল করার পর সমাজ জীবনে প্রতিষ্ঠিত করার পাশাপাশি এ দায়িত্বটাও যেন পালন করেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘অতঃপর যায়েদ যখন তাকে (যয়নব) পরিত্যাগ করলাে, তখন আমি তাকে তােমার সাথে বিয়ে দিলাম…'(আয়াত ৩৭) এ প্রসংগে রাসুল(স.)-এর সাথে সকল মুসলমানের সম্পর্ক কী ধরনের তা স্পষ্ট করে দেয়া হয়েছে এই বলে যে, ‘মােহাম্মদ (স.) তােমাদের কারাে পিতা নয়, তিনি কেবল আল্লাহর রসূল ও শেষ নবী…'(আয়াত ৪০) সবার শেষে রসূল(স.) ও তাঁর সাথী মুসলমানদেরকে কিছু নির্দেশ দেয়ার মধ্য দিয়ে এ অধ্যায় শেষ করা হয়েছে, ‘কাফের ও মােনাফেকদের অনুসরণ করাে না…'(আয়াত ৪৮) পঞ্চম অধ্যায় শুরু হয়েছে যেসব স্ত্রীকে সহবাসের পূর্বে তালাক দেয়া হয় তাদের ব্যাপারে শরীয়তের বিধান বর্ণনার মধ্য দিয়ে। তারপর রসূল(স.)-এর দাম্পত্য জীবনকে সুশৃংখল করা হয়েছে। মুসলিম নারীদের মধ্যে কাকে কাকে তার বিয়ে করা বৈধ এবং কাকে কাকে বিয়ে করা অবৈধ, তাও বর্ণনা করা হয়েছে। অতপর রসূল(স.) ও তার স্ত্রীদের বাড়ীর সাথে মুসলমানরা রসূল(স.)-এর জীবদ্দশায় ও ইন্তেকালের পরে কিভাবে সম্পর্ক রাখবে। পিতা, পুত্র, ভাই, ভাতিজা, দাসদের ছাড়া আর সবার সাথে পর্দা করা এবং রসূল(স.)-কে যারা নানাভাবে কষ্ট দেয় তাদের শান্তি ও দুনিয়া আখেরাতে অভিশাপ লাভের বিষয়ও আলােচিত হয়েছে। এসব থেকে বুঝা যায় যে, মুনাফিকরা এ জাতীয় অনেক অপকর্মই করে। এ প্রসংগে উপসংহারে রসূল(স.)-এর স্ত্রীরা, কন্যা ও দাসীদেরকে সারা দেহ চাদর দিয়ে ঢেকে রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এতে তাদেরকে চেনা যাবে এবং উত্ত্যক্ত করা হবে না। উপসংহারে আরাে হুমকি দেয়া হয়েছে যে, মােনাফেক, মনােব্যাধিগ্রস্ত ও গুজব রটনাকারীদের ওপর রসূল(স.)-কে ক্ষমতাশালী করা হবে এবং বনু কাইনুকা ও বনু নযীরের মতাে তাদেরকেও মদিনা থেকে বিতাড়িত করা হবে অথবা বনু কোরায়যার মতাে খতম করে দেয়া হবে। এসব কথা থেকে বুঝা যায় যে, এই গােষ্ঠীগুলাে মদিনার মুসলমানদেরকে নানা ন্যক্কারজনক পন্থায় কষ্ট দিতাে। ৬ষ্ঠ ও সর্বশেষ অধ্যায়ে বলা হয়েছে যে, লােকেরা কেয়ামত কবে হবে-এই মর্মে প্রশ্ন করে। তার জবাবে বলা হয়েছে যে, কেয়ামতের ব্যাপারে সমস্ত জ্ঞান একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই রাখেন। আভাস দেয়া হয়েছে যে, কেয়ামত ঘনিয়েও এসে থাকতে পারে। এরপর কেয়ামতের একটা ভয়াবহ দৃশ্য দেখানাে হয়েছে ৬৬ নং আয়াতে এবং ৬৭ ও ৬৮ নং আয়াতে তাদের নেতাদের বিরুদ্ধে তাদের কঠোর প্রতিশােধ স্পৃহা ব্যক্ত করা হয়েছে। কেননা তারাই তাদেরকে আনুগত্যের সুযােগ নিয়ে তাদেরকে বিপথগামী করেছে। অতপর সূরার সমাপ্তি টানা হয়েছে এমন একটা বক্তব্য দেয়ার মাধ্যমে যা গভীর তাৎপর্যবহ। ‘আমি এই আমানতকে আকাশ ও পৃথিবীর সামনে রেখেছিলােম কিন্তু তারা এটা বহন করতে অস্বীকার করলাে…'(আয়াত ৭২-৭৩) এ থেকে জানা যায় যে, মানব জাতির ঘাড়ে যে দায়িত্বের বােঝা চাপানাে হয়েছে বিশেষত মুসলমানদের ঘাড়ে তা কতাে বড়ো মুসলিম উম্মাহ একাই এই গুরুদায়িত্ব বহন করছে। এ দায়িত্ব হচ্ছে ইসলামী আকীদা ও আদর্শ এবং তার ওপর টিকে থাকার দায়িত্ব। এই দায়িত্ব উপলব্ধি করার দাওয়াত দিতে হবে এবং এর ওপর ধৈর্য ধারণ করতে হবে। নিজেদের ওপর ও সারা পৃথিবীতে এ আদর্শকে বাস্তবায়িত করতে হবে। এ আহ্বান সমগ্র সূরার বিষয়বস্তুর সাথে তার পটভূমির সাথে ও আল্লাহর বিধানের মেযাজের সাথে সংগতিপূর্ণ। এ বিধান সমগ্র মুসলিম জাতিকে তার মূল আদর্শের ওপর পুনপ্রতিষ্ঠিত করতে চায়। এই সংক্ষিপ্ত পরিচিতির পর এবার সূরার বিশদ ব্যাখ্যায় মনােনিবেশ করতে চাই।
# ‘হে নবী, আল্লাহকে ভয় করাে এবং কাফের ও মােনাফেকদের আনুগত্য করাে না'(আয়াত ১-৩) এ হচ্ছে সূরার সূচনা। সদ্য প্রসূত ইসলামী সমাজের অনেকগুলাে নৈতিক ও সামাজিক দিক এ সূরায় আলােচিত হয়েছে। সূরার সূচনা দেখেই ইসলামী বিধানের স্বরূপ ও প্রকৃতি এবং তার বাস্তব ও মনস্তাত্ত্বিক ভিত্তি কি, তা অবগত হওয়া যায়। বস্তুত ইসলাম কতকগুলাে উপদেশ ও ওয়ায নসিহতের সমষ্টি মাত্র নয়, নিছক কতকগুলাে নৈতিক ও সামাজিক আচরণের দিকনির্দেশক নীতিবাক্যের সমষ্টিও নয়। কতকগুলাে প্রচলিত রীতি প্রথা ও ঐতিহ্যের সমষ্টিও নয়, কিংবা কতকগুলাে দেওয়ানী, ফৌজদারী, সাংবিধানিক ও অন্যান্য ধরনের আইন কানুনও নয়। যদিও এগুলাে সবই ইসলামের আওতাভুক্ত কিন্তু এগুলাের মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ নয়। ইসলাম অর্থ পূর্ণাংগ আত্মসমর্পণ। আল্লাহর ইচ্ছা ও পরিকল্পনার কাছে আত্মসমর্পণ, তাঁর আদেশ ও নিষেধের আনুগত্যের সার্বিক প্রস্তুতি ও সম্মতি, তাঁর রচিত বিধান ও নীতিমালার অনুসরণের সর্বাত্মক অংগীকার ও প্রতিজ্ঞা। অন্যসব রকমের নীতি, নির্দেশ, বিধান ও দৃষ্টিভংগীকে সর্বতােভাবে প্রত্যাখ্যান এবং আল্লাহ তায়ালা ছাড়া অন্য সবার ওপর অনাস্থা ও অনির্ভরতা। ইসলাম হচ্ছে প্রাথমিকভাবে এই অনুভূতি ও উপলব্ধির নাম যে, একক ও অদ্বিতীয় মহান আল্লাহর যে বিধান মানবজাতিকে ও গোটা বিশ্বজগতকে নিরংকুশভাবে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করছে, স্বয়ং মানুষও এই পৃথিবীতে সেই আল্লাহর বিধানই মেনে চলতে বাধ্য। তিনি একাধারে সমগ্র পৃথিবীকে, সমুদয় গ্রহ-নক্ষত্রকে ও সমগ্র নভােমন্ডলকে পরিচালনা ও শাসন করছেন। সমগ্র বিশ্ব জগতের যেখানে যা কিছু গােপন বা প্রকাশ্যে বিরাজ করছে। যা কিছু দৃশ্যমান বা অদৃশ্য, যা কিছু মানুষের বিবেক বুদ্ধির নাগালের মধ্যে রয়েছে এবং যা কিছু বিবেক বুদ্ধির নাগালের বাইরে-সব কিছুরই তিনি পরিকল্পনা ও পরিচালনা করেন । ইসলাম হচ্ছে এই প্রত্যয় ও বিশ্বাসের নাম যে, আল্লাহ তায়ালা যা আদেশ করেন, তা মেনে চলা এবং যা নিষেধ করেন তা থেকে বিরত থাকা, যে উপায় উপকরণ তিনি মানুষের করায়ত্ত করেছেন, তা ধারণ ও প্রয়ােগ করা এবং তার যে ফলাফল আল্লাহ তায়ালা নির্ধারণ ও বিধিবদ্ধ করেছেন সেই ফলাফলই প্রত্যাশা করা । এ হচ্ছে ইসলামের ভিত্তিমূল। এই ভিত্তিমূলের ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে আইন কানুন ও সংবিধান সামাজিক রীতি প্রথা ও ঐতিহ্য এবং নৈতিক ও চারিত্রিক বিধি বিধান। এইসব আইন, রীতিপ্রথা ও নৈতিকতা সবই হতে হবে মনমগজে ধারণ করা আকীদা বিশ্বাসের দাবীর বাস্তব রূপ এবং মহান আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ ও তার জীবন বিধানের আনুগত্যের বাস্তব প্রতিকৃতি। অন্যকথায়, ইসলাম হচ্ছে একটা সুনির্দিষ্ট আকীদা বিশ্বাস। সেই আকীদা বিশ্বাস থেকে উৎসারিত আইন ও বিধান। সেই আইন ও বিধান অনুসারে গঠিত সামগ্রিক রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক বিধিব্যবস্থা এবং এই তিনটির সম্মিলিত ও সমন্বিত রূপ। এ কারণে যদিও মুসলমানদের সামষ্টিক জীবনকে বিভিন্ন আইন কানুন ও নৈতিক বিধি বিধানের ভিত্তিতে সংগঠিত করা ও শৃংখলাবদ্ধ করাই বর্তমান সূরার আলােচ্য বিষয়, তথাপি সূরাটার প্রথম নির্দেশ হিসেবে স্থান পেয়েছে তাকওয়া তথা আল্লাহভীতিমূলক আত্মসংযমের নির্দেশ। আর এ নির্দেশও দেয়া হয়েছে প্রাথমিকভাবে রসূল(স.)-কে, যিনি এইসব আইন কানুন ও বিধি বিধানের পূর্ণ অনুগত ও বাস্তবায়নকারী । বলা হয়েছে, ‘হে নবী আল্লাহ তায়ালাকে ভয় সহকারে আত্মসংযম করুন…’ বস্তুত আল্লাহর ভয় সহকারে আত্মসংযম, আল্লাহর সার্বক্ষণিক প্রহরা ও তত্ত্বাবধানের অনুভূতি এবং তার প্রতাপ ও পরাক্রমের উপলব্ধিই হচ্ছে ইসলামের ভিত্তিমূল ও প্রথম স্তম্ভ। আল্লাহর আইন ও বিধানের বাস্তবায়নের ব্যাপারে এই আল্লাহভীতিই বিবেকের ওপর সার্বক্ষণিক প্রহরীরূপে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ইসলামের প্রতিটি দায়িত্ব ও প্রতিটি নির্দেশ বাস্তবায়নের প্রেরণা এই আল্লাহ ভীতি থেকেই আসে। *আদর্শের প্রশ্নে ইসলামের আপােষহীন ভূমিকা : এরপর দেয়া হয়েছে কাফের ও মােনাফেকদের আনুগত্য থেকে বিরত থাকার নির্দেশ এবং তাদের আদেশ, নিষেধ, উপদেশ, মতামত ও প্ররােচনা শ্রবণ ও বাস্তবায়নে কড়া নিষেধাজ্ঞা এবং কাফের ও মােনাফেকদের আনুগত্য করোনা। এই নিষেধাজ্ঞাটাকে আগে ও আল্লাহর পাঠানাে ওহীর বিধান অনুসরণের আদেশটাকে পরে উল্লেখ করা থেকে বুঝা যায় যে, সেই সময় মদীনায় ও তার আশেপাশে কাফের ও মােনাফেকদের চাপ খুবই জোরদার ও তীব্র ছিলাে। এ জন্যে তাদের মতামত ও প্ররােচণা অনুসরণে এবং তাদের চাপের কাছে নতি স্বীকারে এই নিষেধাজ্ঞা অপরিহার্য হয়ে উঠেছিলাে। পরে এই নিষেধাজ্ঞা সকল পরিবেশে ও সকল যুগে বহাল থেকেছে। মােমেনদেরকে কাফের ও মােনাফেকদের মতামত অনুসরণ করতে সর্বতােভাবে নিষেধ করা হয়েছে, বিশেষত আকীদা বিশ্বাসে। আইন প্রণয়নে, সামাজিক ও সামষ্টিক ব্যবস্থাপনার এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠায় এটা আরাে কড়াকড়িভাবে নিষিদ্ধ। কেননা আল্লাহ তায়ালা চান মুসলমানদের জীবন যাপন পদ্ধতি সম্পূর্ণ নির্ভেজাল ও একনিষ্ঠভাবে আল্লাহমুখী থাকুক এবং আল্লাহ তায়ালা ছাড়া অন্য কারাে নির্দেশের সাথে কোনােভাবেই তার মিশ্রণ না ঘটুক। তিনি চান, কাফের ও মােনাফেকদের হাতে বস্তুবাদী জ্ঞানবিজ্ঞান, পরীক্ষা নিরীক্ষা, অভিজ্ঞতা, গবেষণালব্ধ জ্ঞান ও আবিষ্কার উদ্ভাবনের যে ভান্ডার সঞ্চিত রয়েছে, তা দ্বারা কোনাে মুসলমান যেন প্রতারিত না হয়-যেমনটি দুর্বলতা ও বিকৃতির মুহূর্তগুলােতে কিছু সংখ্যক মুসলমান প্রতারিত হয়ে থাকে। তাদের মনে রাখা উচিত যে আল্লাহ তায়ালাই সবচেয়ে বড়াে বিজ্ঞানী এবং সবচেয়ে বড়াে তথ্যাভিজ্ঞ। তিনি নিজের জ্ঞান ও প্রজ্ঞার আলােকে তাদের জন্যে জীবন যাপন পদ্ধতি রচনা করে দিয়েছেন। ‘নিশ্চয় মহান আল্লাহ মহাবিজ্ঞানী ও মহাপ্রজ্ঞাময়।’ তাই তাঁর রচিত জীবনবিধানও সর্বাধিক যৌক্তিক ও বিজ্ঞানসম্মত। মানুষের রচিত সবকিছুই অযৌক্তিক ও বিজ্ঞান বিরােধী। কারণ তাদের কাছে জ্ঞান বিজ্ঞানের খােলস ছাড়া কিছু নেই এবং যেটুকু আছে তা নিতান্তই সামান্য ও পর্যাপ্ত। তৃতীয় প্রত্যক্ষ নির্দেশ হলাে, তুমি তােমার কাছে ওহীযােগে যা কিছু আসে, তার অনুসরণ করো। কেননা এই উৎস থেকেই নির্দেশসমূহ এসে থাকে এবং একমাত্র এই উৎসই অনুসরণের যােগ্য। ‘তুমি তােমার কাছে ওহীযােগে পাঠানাে বিধানের অনুসরণ করাে’ এ উক্তির বর্ণনাভংগীর আলােকে এতে বহু সংখ্যক তাৎপর্যবহ ইংগিত রয়েছে। যেমন ‘তােমার কাছে’ এবং ‘তােমার প্রভুর কাছ থেকে’ এই কথা দুটো প্রণিধানযােগ্য। এইসব তাৎপর্যবহ ও স্পর্শকাতর ইংগিতের আলােকেই অনুসরণের দায়িত্বটা নির্দিষ্ট হয়ে আছে। উপরন্তু আদেশদাতার পক্ষ থেকে জারিকৃত আদেশ বলেও এ কাজ দায়িত্বের আওতাভুক্ত। আর আল্লাহ তায়ালা তােমাদের কার্যকলাপ সম্পর্কে অবহিত । এই মন্তব্যও বিশেষভাবে দায়িত্ব সচেতনতা জাগিয়ে তােলে। কেননা এ থেকে জানা যায় যে, আল্লাহ তায়ালা মানুষ ও তার কাজ, কাজের প্রকৃত পরিচয় এবং কাজের প্রেরণার উৎস বা বিবেকের তাড়না-সবই জানেন। সর্বশেষ নির্দেশ হলাে, ‘আর তুমি আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করাে, আল্লাহ তায়ালা কর্মব্যবস্থাপক হিসাবে যথেষ্ট।’ সুতরাং জনগণ তােমার পক্ষে থাকলাে, না বিপক্ষে চলে গেলাে, তা নিয়ে মাথা ঘামিও না । তাদের ষড়যন্ত্র ও প্রতারণায় বিব্রত হয়াে না। তােমার সমস্ত কাজের ভার আল্লাহর ওপর ন্যস্ত করাে। তিনি নিজের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও কুশলতা দ্বারা সব ব্যবস্থা সম্পন্ন করবেন। চুড়ান্তভাবে সবকিছু আল্লাহর ওপর সােপর্দ করা ও একমাত্র তার ওপর নির্ভর করাটাই হলাে মােমেনের জন্যে একমাত্র আশ্বস্তকারী চিরন্তন মূলনীতি। এই মূলনীতি অনুসারে মােমেন বান্দা তার সীমাবদ্ধতা বুঝতে ও ক্ষমতার প্রান্তসীমা জানতে পারে। সেই সীমার বাইরের সবকিছুই নিশ্চিন্ত মনে আদেশদাতা মহান আল্লাহর জন্যে রেখে দেয়। কাফের ও মােনাফেকদের মতামত ও প্ররােচণার চাপের কাছে নতি স্বীকার না করা ও তার বিরুদ্ধে চলতে থাকার পাশাপাশি আল্লাহর ভয়, তার ওহীর অনুসরণ এবং তার ওপর ভরসা ও নির্ভরশীলতা এই তিনটি বৈশিষ্ট্য ইসলামের দাওয়াত ও আন্দোলনের পতাকাবাহীকে পর্যাপ্ত শক্তি, সাহস ও হিকমতের রসদ যােগায় এবং আন্দোলনকে তার স্বচ্ছ ও নির্ভেজাল আদর্শের ওপর প্রতিষ্ঠিত রাখে। আল্লাহর কাছ থেকে আগত এ আদর্শ তাকে আল্লাহর দিকেই নিয়ে যায় এবং আল্লাহর ওপরই নির্ভরশীল রাখে।
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
নামকরণ:
খন্দক যুদ্ধের অপর নাম “غزوة الأحزاب” আহযাবের যুদ্ধ। এ সূরায় আহযাবের যুদ্ধ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে বিধায় উক্ত নামে সূরার নামকরণ করা হয়েছে। সূরাটি মদীনায় অবতীর্ণ, তাই তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও বিধি-বিধান সম্বলিত। মুনাফিকরা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে যে কষ্ট দিত, পালক পুত্রের স্ত্রী বিবাহ করেছেন সে জন্য অপবাদ দিত ইত্যাদি বিষয় নিয়ে সূরাটি অবতীর্ণ হয়। এ সূরাতেই সে আয়াত রয়েছে যার বিধান বলবত রয়েছে কিন্তু তেলাওয়াত রহিত হয়ে গেছে। তাহল
(الشيخ والشيخة إذا زنيا فاجلدوهما البتة نكالا من الله والله عزيز حكيم)
-বৃদ্ধ ও বৃদ্ধা ব্যভিচার করলে তাদেরকে অবশ্যই পাথর মেরে হত্যা করবে, এটা আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে শাস্তি। আল্লাহ তা‘আলা পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়। সূরায় মূল যে কয়টি বিষয় আলোচনায় প্রাধান্য পেয়েছে:-
(১) যিহারের পরিচয় ও বিধান,
(২) পালক পুত্র ও তাদের স্ত্রীদের বিধান,
(৩) মু’মিনদের প্রতি নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর অধিকার,
(৪) আহযাবের যুদ্ধের ঘটনা,
(৫) নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর জীবন ও রীতি-নীতি মু’মিনের জন্য উত্তম আদর্শ,
(৬) নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর স্ত্রীদের বিধান ও মু’মিনদের সাথে সম্পর্ক,
(৭) নারীদের পর্দার বিধান,
(৮) নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর যে কোন ফয়াসালার ক্ষেত্রে মু’মিনদের অবস্থান,
(৯) নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সর্বশেষ নাবী ও রাসূল,
(১০) নিজ ও অন্যের বাড়িতে প্রবেশের আদব কায়দা, বিশেষ করে তিন সময়,
(১১) যারা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে গালি গালাজ করে কষ্ট দিত তাদের বিধান ইত্যাদি।
১-৩ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা‘আলা সূরাটি শুরু করলেন নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে সম্বোধন করার মাধ্যমে যে, হে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তুমি আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় কর। তুমি আল্লাহ তা‘আলার দীনের ওপর প্রতিষ্ঠিত আছো ও তাঁর বিধান মেনে চলছো বিধায় কে কী বলবে সে ভয় করো না। যে আল্লাহ তা‘আলা তোমাকে রিসালাত দিয়েছেন ও তোমার প্রতি ওয়াহী করে ধন্য করেছেন সে আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় কর। আর কাফির ও মুনাফিকদের অনুসরণ করো না বরং তোমার প্রতি যা ওয়াহী করা হয়েছে তার অনুসরণ কর। কারণ তারা আল্লাহ তা‘আলার বিধানের ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়। তুমি আল্লাহ তা‘আলার দীনের ওপর প্রতিষ্ঠিত আছ এবং তাঁর বিধান মেনে চলছো বলে তারা কত ঠাট্টা-বিদ্রƒপ করবে, কত রসিকতা করবে। তাই বলে আল্লাহ তা‘আলার বিধান থেকে সরে যাওয়া যাবে না, কারণ তারা চায় তুমিও তাদের মত পথভ্রষ্ট হয়ে যাও।
মূলত আয়াতগুলোতে আল্লাহ তা‘আলা সতর্ক করার একটি সুন্দর পদ্ধতি বর্ণনা করছেন। তা হল তিনি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে সতর্ক করার দ্বারা তাঁর সকল উম্মতকে সতর্ক করেছেন। অর্থাৎ বড়দের মাধ্যমে ছোটদেরকে সতর্ক করা। যদিও এখানে রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে সম্বোধন করে বলা হয়েছে কিন্তু এর দ্বারা সকল মু’মিন ব্যক্তি উদ্দেশ্য। এসব নিদের্শ দেয়ার পর আল্লাহ তা‘আলা বলছেন, সকল কাজে একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার ওপর ভরসা করো। কেননা আল্লাহ তা‘আলার ওপর ভরসা করলে কোন নিন্দুকের নিন্দা ও তিরস্কারকারীর তিরস্কার দীন থেকে সরাতে পারবে না। তিনিই তার জন্য যথেষ্ট, সে অন্য কারো সাহায্য-সহযোগীতার মুখাপেক্ষী হবে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَمَنْ يَّتَوَكَّلْ عَلَي اللّٰهِ فَهُوَ حَسْبُه)
“যে ব্যক্তি আল্লাহর ওপর নির্ভর করে তার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট” (সূরা তালাক ৬৫:৩)
সুতরাং আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করে তাঁর দীনের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকলে কোন নিন্দুকের নিন্দা ও তিরস্কারকারীর তিরস্কার দীন থেকে সরাতে পারবে না।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. কাফির ও মুনাফিকদের অনুসরণ করা যাবে না, বরং অনুসরণ করতে হবে আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূলের।
২. সদা-সর্বদা ওয়াহীর নির্দেশ মেনে চলতে হবে তাহলে দীনের সঠিক পথে প্রতিষ্ঠিত থাকা যাবে।
৩. সর্বাবস্থায় একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় ও তাঁর ওপর ভরসা করতে হবে।
৪. ভদ্রতা, শিষ্টাচার শিক্ষা দেয়া বা সতর্ক করার একটি সুন্দর দিক হলো, বড়দেরকে বলে ছোটদেরকে শিক্ষা দেয়া, যাতে ছোটরা শিক্ষার ব্যপারে লজ্জাবোধ না করে।
(Book#1047/Munafiqn What, Why and How? Book No:- 30)
[Don’t obey Kafir & Munafiqn]
www.motaher21.net
Sura:33:Al-Ahzaab
Para:21
Ayat: – 1-3
33:1
یٰۤاَیُّہَا النَّبِیُّ اتَّقِ اللّٰہَ وَ لَا تُطِعِ الۡکٰفِرِیۡنَ وَ الۡمُنٰفِقِیۡنَ ؕ اِنَّ اللّٰہَ کَانَ عَلِیۡمًا حَکِیۡمًا ۙ﴿۱﴾
O Prophet, fear Allah and do not obey the disbelievers and the hypocrites. Indeed, Allah is ever Knowing and Wise.
The Command to defy the Disbelievers and Hypocrites by following the Revelation of Allah and putting One’s Trust in Him
Allah says,
يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ اتَّقِ اللَّهَ
O Prophet! Have Taqwa of Allah,
Here Allah points out something lower by referring to something higher. When He commands His servant and Messenger to do this, He is also commanding those who are lower than him, and the command is addressed to them more so.
Talq bin Habib said:
“Taqwa means obeying Allah in the light of the guidance of Allah and in hope of earning the reward of Allah, and refraining from disobeying Allah in the light of the guidance of Allah and fearing the punishment of Allah.”
وَلَا تُطِعِ الْكَافِرِينَ وَالْمُنَافِقِينَ
and obey not the disbelievers and the hypocrites.
means, do not listen to what they say and do not consult them.
إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلِيمًا حَكِيمًا
Verily, Allah is Ever All-Knower, All-Wise.
means, He is more deserving of your following His commandments and obeying Him, for He knows the consequences of all things and is Wise in all that He says and does.
Allah says
33:2
وَّ اتَّبِعۡ مَا یُوۡحٰۤی اِلَیۡکَ مِنۡ رَّبِّکَ ؕ اِنَّ اللّٰہَ کَانَ بِمَا تَعۡمَلُوۡنَ خَبِیۡرًا ۙ﴿۲﴾
And follow that which is revealed to you from your Lord. Indeed Allah is ever, with what you do, Acquainted.
وَاتَّبِعْ مَا يُوحَى إِلَيْكَ مِن رَّبِّكَ
And follow that which is revealed to you from your Lord.
meaning, of the Qur’an and Sunnah.
إِنَّ اللَّهَ كَانَ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرًا
33:3
وَّ تَوَکَّلۡ عَلَی اللّٰہِ ؕ وَ کَفٰی بِاللّٰہِ وَکِیۡلًا ﴿۳﴾
And rely upon Allah ; and sufficient is Allah as Disposer of affairs.
وَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ
Verily, Allah is Well-Acquainted with what you do. And put your trust in Allah,
means, nothing at all is hidden from Him, and put your trust in Allah, i.e., in all your affairs and situations.
وَكَفَى بِاللَّهِ وَكِيلً
and sufficient is Allah as a Wakil.
means, sufficient is He as a Trustee for the one who puts his trust in Him and turns to Him
For getting Quran app: play.google.com/store/apps/details?id=com.ihadis.quran
তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
মুসনাদে আহমাদে বর্ণিত আছে যে, হযরত উবাই ইবনে কা’ব (রাঃ) হযরত যির (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করেনঃ “সূরায়ে আহযাবের কতটি আয়াত গণনা করা হয়?” উত্তরে তিনি বলেনঃ “ তেহাত্তরটি।” তখন হযরত উবাই ইবনে কা’ব (রাঃ) বলেনঃ “না, না। আমি তো দেখেছি যে, এ সূরাটি প্রায় সূরায়ে বাকারার সমান ছিল। এই সূরার মধ্যেই নিম্নের আয়াতটিও আমরা পাঠ করতামঃ (আরবি)
অর্থাৎ “বুড়ো ও বুড়ী যদি ব্যভিচারে লিপ্ত হয়ে পড়ে তবে তোমরা তাদেরকে অবশ্যই প্রস্তরাঘাতে হত্যা করে ফেললো, এটা হলো আল্লাহর পক্ষ হতে শাস্তি এবং আল্লাহ মহাপরাক্রমশালী, বিজ্ঞানময়।” এর দ্বারা জানা যায় যে, এই সূরার। কতকগুলো আয়াত আল্লাহর নির্দেশক্রমে রহিত হয়ে গেছে। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলাই সর্বাধিক সঠিক জ্ঞানের অধিকারী।
১-৩ নং আয়াতের তাফসীর
সতর্ক করার সুন্দর পন্থা এই যে, বড়দেরকে বলতে হবে যাতে ছোটরা তা শুনে সাবধান হয়ে যায়। আল্লাহ তা’আলা স্বীয় নবী (সঃ)-কে যখন কোন কথা গুরুত্বের সাথে বলেন তখন বুঝে নিতে হবে যে, অন্যের জন্যে এর গুরুত্ব আরো বেশী। আল্লাহর হিদায়াত অনুযায়ী পুণ্য লাভ করার নিয়তে তাঁর ফরমানের আনুগত্য করা এবং তাঁর ফরমান অনুযায়ী তার শাস্তি থেকে বাচার উদ্দেশ্যে তাঁর নাফরমানী পরিত্যাগ করার নাম হলো তাকওয়া। আর কাফির ও মুনাফিকদের কথা না মানা, তাদের পরামর্শ অনুযায়ী কাজ না করা এবং স্বীকার করে নেয়ার নিয়তে তাদের কথা না শোনার নামও তাকওয়া। জ্ঞান ও প্রজ্ঞার অধিকারী তো। একমাত্র আল্লাহ। তিনি তাঁর প্রশস্ত ও ব্যাপক জ্ঞানের মাধ্যমে প্রত্যেক কাজের ফুল বা পরিণাম সম্যক অবগত। তার সীমাহীন হিকমতের কারণে তার কোন কাজ, কোন কথা বিবেচনা ও নীতি বহিভূর্ত হয় না। তাই তিনি স্বীয় নবী (সঃ)-কে বলেনঃ অতএব তোমার প্রতিপালকের নিকট হতে তোমার প্রতি যা অহী করা হয় তুমি তারই অনুসরণ কর, যাতে তুমি খারাপ পরিণতি ও বিভ্রান্তি হতে বাঁচতে পার। আল্লাহ তা’আলার কাছে কারো ক্রিয়াকলাপ গোপন নেই। নিজের সমস্ত কাজকর্মে শুধু আল্লাহর উপরই ভরসা কর। তার উপর যে ভরসা করে তার জন্যে তিনিই যথেষ্ট হন। কারণ তিনি সমস্ত কাজের উপর পূর্ণ শক্তিশালী। তাঁর প্রতি যে আকৃষ্ট হয় বা তাঁর দিকে যে ঝুঁকে পড়ে সে সফলকামই হয়ে থাকে।