أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#১০৫৩/মুনাফিক কি? বই নং ৩৪:-)
[*দত্তক প্রথার মূল উৎপাটন :-]
www.motaher21.net
সূরা:- ৩৩:আহযাব
পারা:২২
৩৫- ৩৮ নং আয়াত:-
৩৩: ৩৫
اِنَّ الۡمُسۡلِمِیۡنَ وَ الۡمُسۡلِمٰتِ وَ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ وَ الۡمُؤۡمِنٰتِ وَ الۡقٰنِتِیۡنَ وَ الۡقٰنِتٰتِ وَ الصّٰدِقِیۡنَ وَ الصّٰدِقٰتِ وَ الصّٰبِرِیۡنَ وَ الصّٰبِرٰتِ وَ الۡخٰشِعِیۡنَ وَ الۡخٰشِعٰتِ وَ الۡمُتَصَدِّقِیۡنَ وَ الۡمُتَصَدِّقٰتِ وَ الصَّآئِمِیۡنَ وَ الصّٰٓئِمٰتِ وَ الۡحٰفِظِیۡنَ فُرُوۡجَہُمۡ وَ الۡحٰفِظٰتِ وَ الذّٰکِرِیۡنَ اللّٰہَ کَثِیۡرًا وَّ الذّٰکِرٰتِ ۙ اَعَدَّ اللّٰہُ لَہُمۡ مَّغۡفِرَۃً وَّ اَجۡرًا عَظِیۡمًا ﴿۳۵﴾
নিশ্চয় মুসলিম পুরুষ ও মুসলিম নারী, মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারী, অনুগত পুরুষ ও অনুগত নারী, সত্যবাদী পুরুষ ও সত্যবাদী নারী, ধৈর্যশীল পুরুষ ও ধৈর্যশীল নারী, বিনীত পুরুষ ও বিনীত নারী, দানশীল পুরুষ ও দানশীল নারী, সওম পালনকারী পুরুষ ও সওম পালনকারী নারী, যৌনাঙ্গ হিফাজতকারী পুরুষ ও যৌনাঙ্গ হিফাজতকারী নারী, আল্লাহ্কে অধিক স্মরণকারী পুরুষ ও আল্লাহ্কে অধিক স্মরণকারী নারী —— তাদের জন্য আল্লাহ্ রেখেছেন ক্ষমা ও মহাপ্রতিদান।
৩৩:৩৬
وَ مَا کَانَ لِمُؤۡمِنٍ وَّ لَا مُؤۡمِنَۃٍ اِذَا قَضَی اللّٰہُ وَ رَسُوۡلُہٗۤ اَمۡرًا اَنۡ یَّکُوۡنَ لَہُمُ الۡخِیَرَۃُ مِنۡ اَمۡرِہِمۡ ؕ وَ مَنۡ یَّعۡصِ اللّٰہَ وَ رَسُوۡلَہٗ فَقَدۡ ضَلَّ ضَلٰلًا مُّبِیۡنًا ﴿ؕ۳۶﴾
যখন আল্লাহ ও তাঁর রসূল কোন বিষয়ের ফায়সালা দিয়ে দেন তখন কোন মু’মিন পুরুষ ও মু’মিন নারীর সেই ব্যাপারে নিজে ফায়সালা করার কোন অধিকার নেই। আর যে কেউ আল্লাহ ও তাঁর রসূলের নাফরমানী করে সে সুস্পষ্ট গোমরাহীতে লিপ্ত হয়।
৩৩:৩৭
وَ اِذۡ تَقُوۡلُ لِلَّذِیۡۤ اَنۡعَمَ اللّٰہُ عَلَیۡہِ وَ اَنۡعَمۡتَ عَلَیۡہِ اَمۡسِکۡ عَلَیۡکَ زَوۡجَکَ وَ اتَّقِ اللّٰہَ وَ تُخۡفِیۡ فِیۡ نَفۡسِکَ مَا اللّٰہُ مُبۡدِیۡہِ وَ تَخۡشَی النَّاسَ ۚ وَ اللّٰہُ اَحَقُّ اَنۡ تَخۡشٰہُ ؕ فَلَمَّا قَضٰی زَیۡدٌ مِّنۡہَا وَطَرًا زَوَّجۡنٰکَہَا لِکَیۡ لَا یَکُوۡنَ عَلَی الۡمُؤۡمِنِیۡنَ حَرَجٌ فِیۡۤ اَزۡوَاجِ اَدۡعِیَآئِہِمۡ اِذَا قَضَوۡا مِنۡہُنَّ وَطَرًا ؕ وَ کَانَ اَمۡرُ اللّٰہِ مَفۡعُوۡلًا ﴿۳۷﴾
স্মরণ কর, আল্লাহ যাকে অনুগ্রহ করেছেন এবং তুমিও যার প্রতি অনুগ্রহ করেছ, তুমি তাকে বলেছিলে, ‘তুমি তোমার স্ত্রীকে ত্যাগ করো না এবং আল্লাহকে ভয় কর।’ আর তুমি তোমার অন্তরে যা গোপন করছিলে আল্লাহ তা প্রকাশ করে দিচ্ছেন; তুমি লোককে ভয় করছিলে, অথচ আল্লাহকেই ভয় করা তোমার পক্ষে অধিকতর সঙ্গত। অতঃপর যায়েদ যখন তার (স্ত্রী যয়নাবের) সাথে বিবাহ-সম্পর্ক ছিন্ন করল, তখন আমি তোমার সাথে তার বিবাহ দিলাম; যাতে বিশ্বাসীদের পোষ্যপুত্রগণ নিজ স্ত্রীদের সাথে বিবাহসূত্র ছিন্ন করলে সে সব রমণীকে বিবাহ করায় তাদের কোন বিঘ্ন না থাকে। আর আল্লাহর আদেশ কার্যকর হয়েই থাকে।
৩৩:৩৮
مَا کَانَ عَلَی النَّبِیِّ مِنۡ حَرَجٍ فِیۡمَا فَرَضَ اللّٰہُ لَہٗ ؕ سُنَّۃَ اللّٰہِ فِی الَّذِیۡنَ خَلَوۡا مِنۡ قَبۡلُ ؕ وَ کَانَ اَمۡرُ اللّٰہِ قَدَرًا مَّقۡدُوۡرَۨا ﴿۫ۙ۳۸﴾
নবীর জন্য সেটা কোন সমস্যা নেই যা আল্লাহ্ বিধিসম্মত করেছেন তার জন্য। আগে যারা চলে গেছে তাদের ক্ষেত্রেও এটাই ছিল আল্লাহ্র বিধান । আর আল্লাহ্র ফয়াসালা সুনির্ধারিত, অবশ্যম্ভাবী।
ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
*ঈমানদারদের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য : ইসলামী জামায়াতকে পবিত্র বানানাের ক্ষেত্রে এবং ইসলাম যে মূল্যবোধ নিয়ে এসেছে তার ভিত্তিতে জীবন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করার জন্যে পুরুষ ও নারীর ভূমিকা আসলেই সমান সমান। এ বিশ্বের যা কিছু সৌন্দর্য্য ও যা কিছু সমারােহ তা তাদের উভয়ের পারস্পরিক সহযােগিতার মাধ্যমেই এসেছে… এ জন্যে সেইসব মূল্যবােধকে আমি একটু বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করতে চাই। ‘অবশ্যই মুসলমান পুরুষ ও নারী, মােমেন পুরুষ ও নারী,… তাদের (সবার) জন্যে আল্লাহ তায়ালা ক্ষমা ও মহা পুরস্কার নির্ধারণ করে রেখেছেন।'(আয়াত ৩৪) অর্থাৎ এই বহুসংখ্যক মূল্যবান গুণ একটি মাত্র আয়াতের মধ্যে একত্রিত করা হয়েছে যাতে করে এগুলাের ভিত্তিতে মুসলিম জাতিসত্ত্বার বিশাল প্রাসাদটি গড়ে ওঠে, আর সে গুণগুলাে হচ্ছে ইসলাম, ঈমান, আনুগত্য, সত্যবাদিতা, সবর, বিনয় নম্রতা, দানশীলতা, রােযা, চরিত্রের হেফাযত এবং আল্লাহর বেশী বেশী স্মরণ। এসব গুনের প্রত্যেকটিই আত্মসমর্পণকারী মুসলিম জাতিসত্ত্বার বিশাল প্রাসাদের এক একটি মূল্যবান ইট। এবারে আসুন, আমরা আরও নির্দিষ্ট করে এই সব গুণের বৈশিষ্ট্যগুলাে বুঝার চেষ্টা করি। ইসলাম অর্থাৎ আত্মসমর্পণ ও বিশ্বাস, এ দুটি কথার মধ্যে এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক বিদ্যমান রয়েছে, অথবা অন্যভাবে বলা যায়, একটি অপরটির সম্পূরক। আত্মসমর্পণ তাে মানুষ তখনই করতে পারে যখন তার অন্তরে গভীর ও অবিচল বিশ্বাস পয়দা হয়, বরং বলা যায়, বিশ্বাসের অমােঘ দাবীই হচ্ছে আত্মসমর্পণ, আর সঠিক বিশ্বাসই মানুষের মধ্যে আত্মসমর্পণের প্রেরণা যােগায়। ইসলাম (আত্মসমর্পণ) ও ঈমান (বিশ্বাস)-এর ফলশ্রুতিতে আনুগত্য, (কুনূত) সৃষ্টি হয়, অন্তরের অভ্যন্তরে সন্তুষ্টচিত্তে গঠিত এক তাগিদের কারণে, কোনাে বাইরের চাপে আনুগত্যের এ মূল্যবান গুণটি পয়দা হওয়া সম্ভব নয়। সত্যবাদিতা (সিদকুন) এ মূল্যবান গুণটি একমাত্র মুসলিম জামায়াতের মধ্যেই সুনির্দিষ্টভাবে এবং অপরিবর্তিত অবস্থায় বর্তমান থাকতে পারে, (অন্যদের মধ্যে এ গুণটির উপস্থিতি নেহাতই আপেক্ষিক)। অর্থাৎ যতােদিন অন্য কোনাে জাতি তাদের স্বার্থ ও সুনামের জন্যে এ গুণটির প্রয়ােজনবোধ করবে ততােদিন তারা এ শুণটির অধিকারী থাকবে, যখন তারা অনুভব করবে যে, এ গুণটি ছাড়াই তাদের স্বার্থ বা সুনাম অর্জিত হচ্ছে, তখন তারা এ গুণটি ধরে রাখার আর কোনাে পরওয়াই করবে না। এ জন্যেই আল্লাহ রব্বুল আলামীন জানাচ্ছেন, ‘মনগড়া মিথ্যা কথা তারাই তৈরী করে বলে- যারা আল্লাহ তায়ালার আয়াতগুলােকে বিশ্বাস করে না।’ অতএব, সত্য কথা দ্বারা মিথ্যাবাদীরা ইসলামী জামায়াতের সারি থেকে বহিষ্কৃত হতে বাধ্য, বাধ্য সেই জাতির দল থেকে বাদ পড়তে- যারা পৃথিবীর বুকে সত্য ও ন্যায়পরায়ণতা-সততা ও সত্যবাদিতাকে প্রতিষ্ঠিত করেছে, সত্যকে তারা হৃদয়-মন দিয়ে গ্রহণ করেছে এবং এ মহান গুণটি প্রতিষ্ঠার জন্যে তারা প্রাণপণ সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছে। আর সবর; হচ্ছে এমন একটা গুণ, যার অভাবে কোনাে মুসলমান তার আকীদাকে ধরে রাখতে পারে না এবং তার দাবীও পূরণ করতে পারে না। অর্থাৎ বিশ্বাস অনুযায়ী কাজ করা তখনই সম্ভব হয় যখন মানুষের মধ্যে সবর-এর গুণটি থাকে। যখন মন কোনাে বিপদ আপদ ও কারও বিরােধিতায় অস্থির হয় না, বরং সর্বাবস্থায় অবিচল থাকে, তখনই সে নিজের আকীদার ভিত্তিতে দৃঢ়তার সাথে কাজ করতে পারে। সবর-এর গুণ দ্বারা ঝোঁক প্রবণতা, সত্যবিমুখতা এবং নানা মানসিক পরিবর্তন থেকে মানুষ বাঁচতে পারে, যে কোনাে পরীক্ষায় ও ফিতনা-ফাসাদের মধ্যে উত্তীর্ণ হতে পারে, সুখে ও দুঃখে মযবুত হয়ে থাকতে পারে। এই গুণটি ছাড়া সত্য-সঠিক পথে অবিচলভাবে টিকে থাকা সম্ভব নয়। এরপর আসছে বিনয়াবনত থাকার গুণটি। এ গুণটি হচ্ছে অন্তর ও অংগ প্রত্যংগের বৈশিষ্ট্য। এই গুণটির কারণেই অন্তরের মধ্যে আল্লাহর মেহেরবাণী ও তার মর্যাদার প্রভাব পড়ে এবং তাঁর সম্পর্কে এক লজ্জানুভূতি ও ভীতি পয়দা হয়। এরপর সদকা করার বিষয়টিও আলােচ্য। এ গুণটি দ্বারা অন্তরের সংকট ও সংকীর্ণতা নিয়ন্ত্রিত হয়, মানুষের প্রতি দয়া প্রদর্শনের চেতনা জাগ্রত হয়, দলীয় জীবনে পারস্পরিক সহযোগিতার মনােভাব সৃষ্টি হয়, বান্দার হক আদায়ের জন্যে হৃদয়ের মধ্যে প্রেরণা জাগে এবং উপকারীর উপকার স্বীকার করে তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের মনােভাব পয়দা হয়। তারপর রােযা রাখার তাৎপর্যটি কতাে মধুর- তাও লক্ষণীয়। বৈধ ভােগ্যবস্তু পরিত্যাগ ও নিয়ন্ত্রিত করার এবাদাতটি একটি কষ্টের কাজ হলেও এই কষ্ট বরদাশত করাকে একটি বিশেষ গুণ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে, কারণ এর মাধ্যমে মানুষের মধ্যে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার উদ্দেশ্যে আত্মনিয়ন্ত্রণের শক্তি পয়দা হয় এবং জীবনে সবদিকে তার শৃংখলা ফিরে আসে। এ মহান শুণটির প্রধানতম তাৎপর্য হচ্ছে, মানুষের দেহের চাহিদার ওপর মনের চাহিদার নিয়ন্ত্রণ লাভ, জীবনের প্রধান প্রধান চাহিদাকে নিজের আয়ত্তে আনার শক্তি অর্জন, ইচ্ছা শক্তিকে বিজয়ী ও প্রতিষ্ঠিত করা এবং মানবতাকে পাশববৃত্তির ওপর বিজয়ী করা। এবারে লজ্জাস্থানগুলােকে হেফাযত করার প্রশ্নটি। এটি হচ্ছে এমন এক বিষয়ের প্রশ্ন, যার সাথে জীবনের পবিত্রতা পরিচ্ছন্নতা, শালীনতা ও মানব সমাজের সর্বত্র পারস্পরিক সুষ্ঠ সম্পর্ক জড়িত। আসলে এ বিষয়ের ওপর ইসলাম যে নিয়ম শৃংখলা শিখিয়েছে তার মাধ্যমে পশু জীবনের হিংস্রতা ও বর্বরতা ত্যাগ করে অন্তরের গভীরে মানবতা, নম্রতা, দরদ-সহানুভূতি ও শালীনতা সৃষ্টি হয়। এ বিষয়ে যে সতর্কতার মানসিকতা গড়ে ওঠে, তা আল্লাহ তায়ালার প্রতি ভয় ও তার তরফ থেকে সাহায্যপ্রাপ্তি ছাড়া অন্য কোনােভাবে সৃষ্টি হতে পারে না। এ সতর্কতা পারস্পরিক সম্পর্ককে নিরাপদ, শৃংখলাপূর্ণ ও সংহত করে। এর ফলে মানুষ সেই মহান লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যেতে পারে, যা নারী-পুরুষের মিলনের কারণে রক্ত-মাংসের ন্যায্য দাবী পূরণ করে। আলােচ্য আয়াত মানুষের এ দাবীকে দমন করে না, বরং একে তা নিয়ন্ত্রিত করে, একে আল্লাহর বিধানের অনুগামী বানায় এবং পৃথিবীকে আরও সুন্দর করে গড়ে তােলার ও জীবনকে সমৃদ্ধ করার দিকে মানুষকে এগিয়ে দেয়। পরিশেষে জানানাে হয়েছে বেশী বেশী আল্লাহ তায়ালাকে স্মরণ করার বিষয়টি। এর মাধ্যমে তারা নিজেদের মধ্যে মধুর সম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের স্মরণ এমন একটি গুণ যা সকল মানুষের মধ্যেই সঠিক সম্পর্ক গড়ে তােলার জন্যে সাহায্য করে। সাথে সাথে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসকে তা দৃঢ় বানায় এবং প্রতি মুহূর্তে অন্তরের মধ্যে আল্লাহর চেতনাকে এমনভাবে জিইয়ে রাখে যার কারণে সকল অবস্থা ও সকল পরিবেশে মানুষে মানুষে একটা অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এর ফলে তারা এমন এক মজবুত রশি ধরতে পারে, যা কখনও ছিড়ে না। আল্লাহ পাকের স্মরণের মাধ্যমে মানুষের অন্তরের বন্ধ দুয়ার খুলে যায়, সংকীর্ণতা, হীন ও হিংস্র মনােভাব দূরীভূত হয় এবং খােলা মনে ও হাসিখুশি সথে তারা পরস্পর মেলামেশা করতে পারে, এমন এক অবস্থায় তাদের মধ্যে সত্যের এমন এক মহান আলাে ছড়িয়ে পড়ে যা তাদের গােটা সত্ত্বাকে আলােকিত করে এবং তাদের মধ্যে ভালবাসা ও শান্তিপূর্ণ এক জীবন স্পন্দন এনে দেয়। যাদের জীবন আল্লাহ রব্বুল আলামীন-এর স্মরণে অতিবাহিত হয় তাদের মধ্যে এই গুণাবলীর সমাবেশ ঘটে। এ বিষয়টি তাদের মধ্যে সেই বলিষ্ঠ গুণাবলী গড়ে তুলতে সক্ষম হয়, যা তাদেরকে অন্য যে কোনাে মানুষের জন্যে অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় বানিয়ে দেয়। এরশাদ হচ্ছে, ‘তিনি তাদের জন্যে ক্ষমা ও মহা প্রতিদান প্রস্তুত করে রেখেছেন।’ এইভাবে সূরাটির প্রথম অধ্যায়ে আলােচ্য আয়াতগুলাে নবী(স.)-এর স্ত্রীদের বৈশিষ্ট্যসমূহ বর্ণনা করার পর এবার সাধারণ মুসলমান পুরুষ ও নারীর মধ্যে বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব গড়ে তােলার জন্যেও ভূমিকা গ্রহণ করেছে। এসব আয়াতে নারীদেরকে স্মরণ করানাে হয়েছে যে, তাদের মর্যাদা বৃদ্ধির ব্যাপারে পুরুষের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করতে হয় এবং ইসলামের নির্দেশগুলাে পালন করার মাধ্যমে নারীদেরকে পুরুষদের সাথে সমভাবে সমাজে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে যেতে হবে। আল্লাহর সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধির ব্যাপারে পুরুষ ও নারী সমান অধিকার ও সুযােগ রয়েছে। চিন্তা ও আনুষ্ঠানিক এবাদতের নিরীখে যদি চিন্তা করা হয় তাহলেও দেখা যাবে, সর্বক্ষেত্রেই নারী পুরুষের পাশে সমান মর্যাদা ও কৃতিত্বের অধিকারী হয়ে দাঁড়াতে সক্ষম। তারা উভয়েই পবিত্রতা অর্জন করার মাধ্যমে, আনুষ্ঠানিক এবাদত বন্দেগী ও জীবনের সকল কাজে আল্লাহর আনুগত্য দ্বারা একইভাবে তাঁর প্রিয়পাত্র হতে পারে।
#ইসলামী চিন্তাধারার ভিত্তিতে মুসলমানদের গড়ে তােলার জন্যে বর্তমান আলােচনাটি একটি নতুন অধ্যায় পেশ করেছে। বিশেষ করে মুখে বলা সম্পর্ক বা ধর্ম-আত্মীয়তার যে প্রচলন সে সমাজে বিদ্যমান ছিলাে (এবং এখনও আছে,) যার কারণে ধর্মপুত্রকে আপন পুত্রের সমকক্ষ মনে করা হতাে এবং আপন পুত্রবধূকে বিয়ে করার মতােই সে বিয়েকে সমাজে আপত্তিকর মনে করা হতাে- সে প্রচলনকে ভুল প্রমাণ করার উদ্দেশ্যে সুরাটির শুরুতেই এ আলােচনা এসেছে। এ উদ্দেশ্যে আল্লাহ তায়ালা যায়েদের সাথে যায়নাবের বিয়ে, পরবর্তীতে তালাক, তালাকের গ্লানি দূর করার জন্যে রসূলুল্লাহ(স.)-এর সাথে তার বিয়ের ব্যবস্থা করে এ ধরনের সম্পর্ক যে সত্যিকারে রক্তের সম্পর্ক হয়ে যায় না- একথাটাই প্রমাণ করেছেন। এতে দীর্ঘদিন ধরে যে কৃত্রিম পদ্ধতি আরব সমাজে প্রচলিত ছিলো তা যে শুধু নিষিদ্ধ ঘােষণা করায় বা অন্য কারও মাধ্যমে এ পদ্ধতি উৎখাত করা সম্ভব ছিলাে না, অন্য কোনােভাবে মানুষ এটা মেনেও নিতে পারতাে না। এই জন্যে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নিজ নবীর মাধ্যমে এই ভুলের অপনােদন করতে চেয়েছিলেন। রসূলুল্লাহর প্রতি মুসলমানদের অবিচল বিশ্বাস, শ্রদ্ধাবােধ ও তার চরিত্রবলের প্রতি সবার সুগভীর আস্থা এবং তার আজীবন সত্যবাদিতার এক নযিরবিহীন ইতিহাস, সবকিছু মিলে তার এ কাজ আপামর জনসাধারণের কাছে গ্রহণযােগ্য হবে বলে আল্লাহ তায়ালা জানতেন। এ জন্যে মহান রাব্বুল আলামীন তার দ্বারাই এ পরিবর্তনটি সাধন করলেন। ফলে পরবর্তীতে এ ধরনের বিয়ে শাদীকে আর কোনাে মুসলমানই আপত্তিকর মনে করেনি। কিন্তু এখনও যে সকল এলাকায় মোশরেকদের রসম রেওয়াজের প্রাধান্য চালু রয়েছে, সেসব এলাকায় এ কাজকে মানুষ যথেষ্ট ঘৃণার চোখে দেখে। ইসলাম মানুষকে প্রকৃতিসংগত ব্যবস্থা দিয়েছে। ইসলাম রক্তের সম্পর্কে যাদের সাথে বিয়ে শাদী হারাম বলে ঘােষণা করেছে তারা হচ্ছেন এমন সব ব্যক্তি, যাদের সাথে প্রকৃতিগতভাবে মানুষ সে ধরনের আকর্ষণ অনুভব করে না। কিন্তু এর বাইরে কৃত্রিমভাবে কোনাে হারামের বলয় সৃষ্টি করা হলে সে বলয়ের মর্যাদা রক্ষা করতে গিয়ে (প্রকৃতি বিরুদ্ধ হওয়ার কারণে) অনেক সময়েই সেখানে নিয়ন্ত্রণ রাখা সম্ভব হয় না, যার ফলে দুনিয়ায় বিভিন্ন সময়ে বহু অঘটন ঘটেছে, আল্লাহর ইচ্ছায় রসূলুল্লাহ(স.)-এর এ কাজকে মুসলমান সমাজ, যারা প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রসূলের আনুগত্য করে, সবই সন্তুষ্টচিত্তে ও নির্দ্বিধায় গ্রহণ করেছিলাে। *আল্লাহর ও রসুলের সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে কারােই মত খাটানাে যায় না : এখানে কোরআনের আয়াতে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘােষণা দেয়া হয়েছে যে আল্লাহ তায়ালা ও তার রসূলই হচ্ছেন সকল ফায়সালা দেয়ার মালিক। আর আল্লাহ ও তাঁর রসূল যখন কোনাে বিষয়ে ফায়সালা দিয়ে দেন তখন সে বিষয়ে মতামত প্রকাশ করার কোনাে অধিকার কোনাে মােমেন পুরুষ বা কোনাে স্ত্রীলােকের নেই। এ কথাটা এ জন্যেই উচ্চারিত হয়েছিলাে যে, আলােচ্য ফায়সালাটি দান করা হয়েছিলাে আরবদের অন্ধ অনুকরণের বিরুদ্ধে, যা পালন করা তাদের কাছে বড়ােই কঠিন লাগছিলাে। যখন আল্লাহ তায়ালা ও তার রসূল কোনাে বিষয়ে কোনাে ফায়সালা দান করেন, সেই বিষয়ে এখতিয়ার খাটানাের কোনাে অধিকার কোনাে মােমেন পুরুষ বা স্ত্রীলােকের নেই। ‘আর যে ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রসূলের আনুগত্য করাকে অস্বীকার করবে, অবশ্যই সে সুস্পষ্ট ভুলপথে ধাবিত হবে।’ বর্ণিত আছে যে, যায়নাব বিনতে জাহশ(রা.) সম্পর্কেই ওপরের আয়াতটি তখন নাযিল হয়েছিলাে । জাহেলী জমানা থেকে চলে আসা মুসলমানদের মধ্যে বংশ গরিমার বদ্ধমূল ভুল ধারণা নবী(স.) ভেংগে দিতে চেয়েছিলেন ইসলাম ঘােষণা দিলাে যে, তাকওয়া (আল্লাহভীতি) ছাড়া একের ওপর অন্যের কোনাে শ্রেষ্ঠত্ব নেই। স্বাধীনতাপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা [এখানে উপরােক্ত শ্রেণী ছাড়া অন্যদের বিরুদ্ধে কথা বলা হয়েছে। আসলে পুরাকালে অনেক সময়ে দেখা যেতে এক কাবিলা আর এক কাবিলা মুক্তিপ্রাপ্ত দাসদের মুক্তি, রক্তপণ ও কোনাে কিছু বিনিময় দান করার ব্যাপারে সাহায্য করতাে। এ সাহায্য করার অর্থ দাসত্ব মুক্তি ছাড়া আরও অন্য কিছু ছিলাে, যার দ্বারা তাদের মধ্যে আত্মীয়তার বন্ধন স্থাপিত হয়] হচ্ছে তারা, যারা বন্দীদশা বা দাসত্ব থেকে মুক্তি পেয়েছে এরা সমাজে মনিবদের শ্রেণী থেকে কম সম্মানিত ব্যক্তি বলে বিবেচিত হতাে। এমনই এক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিলাে রসূলুল্লাহ(স.) এর সাথে যায়েদ ইবনে হারেসার। তিনি ছিলেন রসূলুল্লাহ(স.)-এর মুক্তিপ্রাপ্ত এক দাস। তাকে রসূলুল্লাহ(স.) আপন পালক ছেলে বানিয়ে নিয়েছিলেন। অতপর যে কোনাে একজন স্বাধীন মানুষের পূর্ণ ও সমমর্যাদা দানের উদ্দেশ্যে রসূলুল্লাহ(স.) তার নিকটাত্মীয় বনু হাশেম গােত্রের যায়নাব বিনতে জাহশ-এর সাথে তার বিয়ে দেন, যাতে করে শ্রেণীগত ভেদাভেদ চিরদিনের জন্যে ও পরিপূর্ণভাবে দূরীভূত হয় এবং এ জন্যে তাঁর পরিবারের মধ্য থেকেই তিনি এ পার্থক্য দূর করার উদ্যোগ শুরু করেন। আসলে সে সময়ে শ্রেণীবৈষম্যের শিকড় সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রােথিত ছিলাে, যা নবী(স.)-এর বাস্তব পদক্ষেপ ছাড়া দূর হওয়া সম্ভব ছিলাে না। এই ঘটনার ফলে গােটা মুসলিম জামায়াত এ নতুন আদর্শ গ্রহণ করে এবং সমগ্র মানব মন্ডলী পুরাতন সম্পর্ককে অসার মনে করতে থাকে। ইবনে কাসীর তাঁর রচিত তাফসীরে বর্ণনা করেন, আওফী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস(রা.) থেকে বর্ণনা করেছেন, এই আয়াতটি নাযিল হওয়ার শানে নুযুল সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি জানান যে, রসূলাল্লাহ(স.) তাঁর খাদেম যায়েদ ইবনে হারেসার বিয়ে পড়ানাের জন্যে রওয়ানা হলেন। যেতে যেতে চিন্তা করলেন, বনু আসাদ গােত্রের জাহশ এর কন্যা যায়নাবের সাথে একটু কথা বলা যাক। তিনি তার কাছে গেলেন এবং তার সামনে যায়েদ(রা.) সাথে তার বিয়ের কথা বললেন। যায়নাব বললেন, না, আমি তাকে বিয়ে করতে রাজী নই।’ তখন রসূলুল্লাহ(স.) তাকে একটু হুকুমের সুরে বললেন, অবশ্যই তাকে তুমি বিয়ে করবে। যায়নাব বললেন, ‘ইয়া রসূলুল্লাহ, আমার ব্যাপারে আপনি কি এই নির্দেশ দিচ্ছেন?’ তাঁরা দুজন যখন কথাবার্তা বলছিলেন সে সময়ে এই আয়াতটি রসূলুল্লাহ(স.)-এর ওপর নাযিল হল, ‘যখন আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রসূল কোনাে বিষয়ে কোনাে ফায়সালা দান করেন তখন সেই ব্যাপারে মুমিন কোনাে পুরুষ বা স্ত্রীলােকের এখতিয়ার খাটানাের কোনাে অধিকার থাকে না।’ এ আয়াতটি শােনার সাথে সাথে যায়নাব(রা.) বললেন, আমি কি এই বিয়ের ব্যাপারে আমার সম্মতির কথা জানাবাে?’ রসূলুল্লাহ(স.) বললেন, হ্যা। যায়নাব বললেন, ইয়া রসূলাল্লাহ, আমি আল্লাহ ও তাঁর রসূলের নাফরমানী করবাে না। এ প্রস্তাব আমি কবুল করলাম।’ হযরত ইবনে আব্বাস(রা.) থেকে আর একটি রেওয়ায়াত পাওয়া যায়, তিনি বলেছেন, রসূলুল্লাহ(স.) যায়েদ ইবনে হারেসার সাথে যায়নাবের বিয়ের প্রস্তাব দিলেন, কিন্তু যায়নাব তার প্রতি অবজ্ঞার ভাব দেখালেন ও বললেন, আত্মর্যাদার দিক দিয়ে আমি ওর থেকে উত্তম। অবশ্য এটা সত্য কথা যে, যায়নাব আসলেই ছিলেন উত্তম, তিনি কারাে সাথে তেমন মেলামেশা করতেন না, বরং একাকী থাকতেই ভালােবাসতেন। তখন আল্লাহ তায়ালা এই আয়াতটি নাযিল করলেন। এমনি করে মােজাহেদ, কাতাদা ও মােকাতেল ইবনে হায়যান বলেন, যখন রসূলুল্লাহ(স.) তাঁর মুক্ত ক্রীতদাস যায়েদ ইবনে হারেসার সাথে তার বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তখন এ আয়াতটি যায়নাব বিনতে জাহশ সম্পর্কে নাযিল হয়েছিলাে। তিনি রাজি হননি, কিন্তু পরে রাজি হয়েছিলেন। ইবনে কাসীর আর একটি রেওয়ায়াতে এইভাবে বর্ণনা করেছেন, আব্দুর রহমান ইবনে যায়েদ ইবনে আসলাম বলেন, এ আয়াতটি উম্মে কুলসুম বিনতে ওকবা ইবনে আবী মুঈত(রা.) সম্পর্কে নাযিল হয়েছে। তিনি মহিলাদের মধ্যে প্রথম হিজরত করেন। অর্থাৎ হােদায়বিয়ার সন্ধির পর তিনি রসূলুল্লাহ(স.)-এর হাতে কোনাে মােহরের দাবী ছাড়াই নিজেকে সােপর্দ করেন। রসূলুল্লাহ(স.) বলেন, আমি কবুল করলাম। এরপর যায়নাব-এর সাথে রসূলুল্লাহ (স.) যায়েদ ইবনে হারেসার বিয়ে দেন। এতে তিনি ও তার ভাই অসন্তুষ্ট হলেন ও বললেন, ‘আমরা তাে চেয়েছিলােম, রসূলুল্লাহ(স.) নিজেই বিয়ে করবেন; কিন্তু তিনি তাঁর একজন দাসের সাথে বিয়ের ব্যবস্থা করে দিলেন।’ রেওয়ায়াতে কারী আব্দুর রহমান বলেন, এই ঘটনার পরই আয়াতটি নাযিল হয়েছে। এই বর্ণনাকারী আরও বলেন, এর থেকে আরও ব্যাপক অর্থের আয়াত নাযিল হলাে, ‘নবী মােমেনদের কাছে তাদের নিজেদের জীবন থেকেও বেশী প্রিয়।’ তিনি বলেন, প্রথম আয়াতটি নাযিল হয়েছিলাে খাস যায়নাব-এর সম্পর্কে এবং শেষের আয়াতটি নাযিল হয়েছে সকল মুসলমানদের জন্যে। তৃতীয় আর একটি রেওয়াতে ইমাম আহমাদ বলেন, ‘আমাদেরকে আব্দুর রাযযাক একটি হাদীস শুনিয়েছেন, তিনি হযরত আনাস(রা.) থেকে বর্ণনা করেছেন, তাতে বলা হয়েছে, নবী(স.) যায়েদের সাথে জুলাইবীব নামক আনসারের একটি মেয়েকে বিয়ে দেয়ার জন্যে তার বাপের কাছে প্রস্তাব পাঠালেন। সে ব্যক্তি বলল, আমি তার মায়ের সাথে পরামর্শ না করে বলতে পারছি না। নবী(স.) বললেন, আচ্ছা, ঠিক আছে, শুনে দেখাে।’ তারপর লােকটি তার বিবির কাছে গিয়ে কথাটি বললাে। শুনেই সেই মহিলাটি বলে উঠলো, না না এ হতে পারে না। এ দাসটির সাথে বিয়ে দেয়ার জন্যে রসূলুল্লাহ(স.) জুলাইবীব ছাড়া আর কোনাে মেয়ে পেলেন না। আমরা অমুক অমুক-এর কাছ থেকে আসা মূল্যবান প্রস্তাবও প্রত্যাখ্যান করেছি। এ সময়ে জুলাইবীব নামের সে মেয়েটি আড়াল থেকে এ সব কথাবার্তা শুনছিলাে। সে লােকটি (মেয়েটির বাপ) যখন রসূলুল্লাহ(স.)-কে এই না সূচক খবরটি পৌছানাের জন্যে রওয়ানা হলাে, অমনি মেয়েটি এগিয়ে এসে বলল, ‘আপনারা কি রসূলুল্লাহ(স.)-এর নির্দেশকে প্রত্যাখ্যান করতে চান? তিনি যদি আপনাদের জন্যে তাকে (যায়েদকে) এ প্রস্তাবে রাযি করিয়েছেন বলে আপনারা জেনে থাকেন তাহলে (বিনা দ্বিধায়) তার সাথে আমার এ বিয়ে পড়িয়ে দিন।’ বর্ণনাকারী আনাস(রা.) বলেন, তাকে যেন তার পিতামাতা থেকে অনেক বেশী বুদ্ধি-বিবেচনার অধিকারী বলে মনে হলাে। এ কথা শুনে তার বাপ-মা বলে উঠলেন, ‘সত্যই বলেছাে তুমি’, তারপর তার মাতাপিতা রসূলুল্লাহ(স.)-এর কাছে গিয়ে বললেন, আপনি এ বিষয়ে সন্তুষ্ট থাকলে আমরাও সন্তুষ্ট আছি। রসূলুল্লাহ(স.)-এর মতের শুরুত্ব একটি মুসলিম মেয়ের অন্তরে কতাে অধিক; তা লক্ষণীয় যখন আল্লাহর রসূল কথা বলেছেন, তখন আর নিজের কোনাে মত নেই, থাকতে পারে না। এই কথাটিই আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘আল্লাহ ও রসূলের পক্ষ থেকে কোনাে ফায়সালা এসে যাওয়ার পর সেই বিষয়ে পুনরায় চিন্তা ভাবনা করার কোনাে এখতিয়ার কোনাে মুসলিম পুরুষ বা স্ত্রীলােকের থাকতে পারে না।’ এর নামই হচ্ছে আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রসূলের কাছে আত্মসমর্পণ। এসময় রসূলুল্লাহ(স.) বললেন, হ্যা আমি তার জন্যে এ বিয়েকে মনযুর করেছি। বর্ণনাকারী বলেন, এরপর রসূলুল্লাহ(স.) সে মেয়েটিকে বিয়ে দিয়ে দিলেন। এক সময়ে মদীনায় প্রচন্ড ভয় ভীতিকর অবস্থা সৃষ্টি হলাে। তখন জুলাইবীব উটে চড়ে স্বামীর সন্ধানে রওয়ানা হয়ে অকুস্থলে পৌছুলেন এবং দেখলেন স্বামী (যায়েদ) শহীদ হয়েছেন। দেখলেন তার (নিহত স্বামীর) চতুর্দিকে মােশরেকদের বেশ কিছু মৃতদেহ পড়ে রয়েছে, যাদেরকে তিনি হত্যা করেছেন। আনাস(রা.) বলেন, আমি তাকে (মেয়েটিকে) দেখেছি, তিনি মদীনায় সব থেকে বেশী দানশীলা ছিলেন। (এটা যায়নাবের সাথে যায়েদের বিয়ে ভেংগে যাবার পরের কথা) এখানে তৃতীয় রেওয়াতেটিকেও আমরা উপেক্ষা করতে পারি না, সেই রেওয়ায়েতে আমরা দেখতে পাচ্ছি, জুলাইবীবের ঘটনাটিও এই প্রসংগে বর্ণিত সেই প্রথার সাথে সামঞ্জস্যশীল নয়। এই প্রথাকে রহিত করাই ছিলাে ইসলামের লক্ষ্য। রসূলুল্লাহ(স.) তার ব্যক্তিগত জীবনের কাজ এবং রেসালাতের যিন্দেগীতে তার প্রবর্তিত নিয়মের মাধ্যমেই তাকে রহিত করতে চেয়েছিলেন। ইসলামী দেশ ও পরিবেশে রসূলুল্লাহ(স.) যে নতুনত্ব আনতে চেয়েছিলেন এ প্রথার পরিবর্তন ছিলাে তারই অংশ। ইসলামী সমাজব্যবস্থা কায়েমের মাধ্যমে রসূলুল্লাহ(স.) যে স্থাধীন ও পরিচ্ছন্ন সমাজ গঠন করতে চেয়েছিলেন তার জন্যে এ কৃত্রিম, প্রকৃতি বিরুদ্ধ ও অবাস্তব রীতির উৎখাত সাধন প্রয়ােজন ছিলাে। ইসলাম চায় সেই প্রাণবন্তু সমাজ কায়েম করতে,যা মানুষের স্বভাবসংগত মনে করে গ্রহণ করে। *সাহাবারা যেভাবে নিজেদের সমর্পণ করেছিলেন : আয়াতটি বিশেষ একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে নাযিল হলেও এর হুকুম কিন্তু সর্বসাধারণ মুসলমানদের জন্যে সমভাবে প্রযােজ্য। আল কোরআনের আয়াতের মাধ্যমে প্রথা রহিত করা সত্তেও মুখে বলা সম্পর্ক, ধর্ম ছেলে মেয়ে বা পালক সন্তানের প্রথা পরবর্তি সকল সমাজে কিছু না কিছু রয়েই গেছে। পালক ছেলের তালাকপ্রাপ্তা বিবিকে বিয়ে করা হালাল হওয়ার হুকুম হওয়া নাযিল হওয়া এবং রসূলুল্লাহ(স.) নিজে যায়েদ নামের পালক ছেলের তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রী যায়নাবকে বিয়ে করে নযির স্থাপন করা সত্তেও এ প্রথা সমাজ থেকে একেবারে দূরীভূত হয়ে যায়নি। অবশ্য এটা ঠিক যে, রসূলুল্লাহ(স.)-এর যায়নাব কে বিয়ে করার এ ঘটনাটি চিরদিনই মুসলিম সমাজকে প্রভাবিত করেছে। পালক ছেলে ও ছেলে বউ মনে করে মুসলমানরা পূর্বের মতাে বেপরওয়াভাবে তাদের সাথে মেলামেশা করা থেকে বিরত থেকেছে। এরপর থেকে মুসলিম সমাজের সবাই একথা বুঝতে সক্ষম হয়েছে যে, রসূলুল্লাহ(স.)-এর জন্যেই এ ঘটনাটি খাস ছিলাে না, বরং ইসলামী সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তির জন্যেই সাধারণভাবে এ ঘটনাটি একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসাবে গৃহীত হয়েছে। তারা একথাও বুঝেছে যে, রসূলুল্লাহ-এর জীবনে এ ঘটনাটি ঘটিয়ে আল্লাহ তায়ালা চেয়েছেন মুসলমান জনসাধারণ এ ঘটনা থেকে শিক্ষা নিক। যেমন বলা হয়েছে, ‘অবশ্যই তােমাদের জন্যে রসূলুল্লাহ(স.)-এর জীবনের মধ্যে এক উৎকৃষ্ট আদর্শ রয়েছে।'(আয়াত-২১) আলােচ্য আয়াতের শানে নুযুল বর্ণনা করার উদ্দেশ্যে হােক অথবা যায়নাবকে রসূলুল্লাহ(স.) বিয়ে করার কারণেই হােক, মুসলমানদের সমাজ থেকে এ প্রথাকে তুলে দেয়াই ছিলাে এ আয়াতটির মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। একারণেই পরবর্তীকালে এ আয়াতের প্রভাবে সাধারণ মুসলমানরা সঠিক শিক্ষাই গ্রহণ করতে পেরেছে এবং এই কৃত্রিম প্রথাকে আর কোনােদিন তারা চালু হতে দেয়নি, যদিও প্রথম প্রথম রসূলুল্লাহ(স.)-এর জীবদ্দশায় এ প্রথা রহিত করা নিয়ে বেশ কিছু চেঁচামেচি হয়েছে এবং ইসলামের দুশমনরা রসূলুল্লাহ(স.)-কে নানা কথা বলে দোষারােপ করতেও কুণ্ঠিত হয়নি এবং আজও তারা একইভাবে দোষারােপ করে চলেছে। শুধু তাই নয়, আজও মুসলমানদের দুশমনরা এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ইসলামের বিরুদ্ধে নানা ধরনের কথা বলার অপপ্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। ইসলামী জীবন ব্যবস্থা কায়েমের লক্ষ্যে যেসব দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে সেগুলাের মধ্যে আলােচ্য ঘটনাটি চিরদিনের জন্যে নীতি নৈতিকতার ক্ষেত্রে সকল শ্রেণীর মানুষের জন্যে এক অত্যুজ্জ্বল নযির হয়ে রয়েছে। প্রথম যুগের মুসলমানরা এ বিষয়টিকে তাদের আকীদা বিশ্বাসের এক অপরিহার্য অংগ হিসাবে গ্রহণ করেছে, এ ঘটনার অবতারণায় তাদের মন নিশ্চিন্ত হয়ে গেছে। সঠিক পদক্ষেপ নেয়ার জন্যে তারা এ আয়াতটিকে যথেষ্ট বলে মেনে নিয়েছে… এ ঘটনা তাদেরকে সুনির্দিষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে যে, আসলে তাদের জীবনধারা নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে তাদের নিজেদের কোনাে হাত নেই এবং কোনাে বিষয়েই তারা নিজেরা কোনাে ফায়সালা করতে পারে না। তারা ও তাদের অধীনস্থ যারা আছে তাদের সবার মালিক হচ্ছেন আল্লাহ তায়ালা। তিনিই তাদেরকে যেভাবে ইচ্ছা সেইভাবে পরিচালনা করেন এবং তাদের জন্যে তিনি তাই পছন্দ করেন যা তিনি চান। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সৃষ্টি জগতকে যে নিয়মে সৃষ্টি করেছেন তারা সবাই তারই অধীনে পরিচালিত হতে বাধ্য। তারা তাে সৃষ্টি মাত্র এবং একমাত্র তিনিই এ সকল সৃষ্টির স্রষ্টা, তিনিই সবার পরিচালক। অন্যান্য সবাইকে যে প্রক্রিয়ায় তিনি সঞ্চালন করেন ওদেরকেও সেই একই নিয়মে সঞ্চালন করেন। এ বিশাল সৃষ্টিজগতের দৃশ্যপটে তাদের ভূমিকাকে তিনিই নির্ধারণ করে দিয়েছেন। এই মহাবিশ্বের বুকে তাদের কি দায়িত্ব পালন করা প্রয়ােজন, তা তিনিই স্থির করে দিয়েছেন। সৃষ্টির-বুকে তাদের কি ভূমিকা রাখতে হবে, মানুষ নিজেরা তা স্থির করে নিতে পারে না, কারণ, তারা এ বিশাল জগতকে দেখেও না জানেও না। এ জন্যে কোথায় এবং কোন প্রয়ােজনে তাদের কি ভূমিকা রাখতে হবে তা বুঝা তাদের পক্ষে সম্ভবও নয়। এটাও সত্য কথা, তাদের পছন্দমতাে কোনাে কাজ করা বা তাদের জন্যে কল্যাণকর কোনাে পথ বের করে নেয়ার এখতিয়ার বা ক্ষমতা তাদের নেই। সৃষ্টিকর্তা তাদেরকে যে উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছেন, তিনিই তা জানেন এবং সেই কাজের জন্যে তিনিই তাদেরকে পরিচালনা করেন। এ বিশ্বে তাদের নিজেদেরকে নিজেদের নায়ক বানিয়ে দেয়া হয়নি, এ জন্যে তারা নিজেরা যা পছন্দ করে তা তাদের সৃষ্টির উদ্দেশ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে এবং কোনাে কিছুকেই তাদের ইচ্ছামতাে কোনাে বিশেষ পরিণতিতে পৌছে দেয়ার ক্ষমতা তাদেরকে দেয়া হয়নি। এইভাবে তাদের জীবনকে তারা আল্লাহর ইচ্ছার কাছে সমর্পণ করেছে, সমর্পণ করেছে তাদের জীবনের সমস্ত বিষয়কে। একবার আত্মসমর্পণ করার পর তারা আর কখনও আল্লাহর নাফরমানী করেনি এবং নিজেদের ইচ্ছামতাে চলার চিন্তা করেনি। তারা তাদের সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত সকল নিয়মের সাথে নিজেদেরকে খাপ খাইয়ে নিয়েছে এবং এইভাবে দুনিয়ার বুকে তারা নিজেদের সঠিক ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হয়েছে। তারা তাদের জীবনের আকাশেও সুনির্দিষ্ট পথ ধরে চলেছে- যেমন করে, গ্রহ নক্ষত্র তাদের নিজ নিজ কক্ষ পথে চলে। তাদের এ সব পথ থেকে দূরে সরে যাওয়ার কোনাে ক্ষমতাই নেই, নেই তাদের চলার দ্রুত বা মন্থর করার কোনাে এখতিয়ার, তারা সদা সর্বদা সৃষ্টিকর্তার হকুমে অন্যান্য সৃষ্টির সাথে তাল মিলিয়ে চলে। মুসলমানরা যখন আল্লাহর বিধানকে পুরাপুরি মেনে নেয় এবং কোনাে ব্যাপারেই নিজেদের ইচ্ছা খাটায় না তখন তারা এভাবেই আল্লাহর সন্তুষ্টির সাথে নিজেদেরকে একাত্ব করে ফেলে। অন্তরের গভীরে, চিন্তা-চেতনায়, অনুভূতিতে ও সকল কাজে কর্মে আল্লাহ তায়ালার মর্জির কাছে তারা আত্মসমর্পণ করে। এভাবেই তারা জেনে বুঝে সজ্ঞানে সচেতনভাবে আল্লাহ তায়ালা নির্ধারিত পরিণতির দিকে এগিয়ে যায়। তারা পরিপূর্ণ আস্থা ও নিশ্চিন্ততা সহকারে আনন্দ ও তৃপ্তির সাথে আল্লাহর বিধানের কাছে মাথা নত করে পরম শান্তির অধিকারী হয়। অতপর দেখা গেছে, তারা ধীরে ধীরে এমনভাবে নিজেদেরকে আল্লাহর অনুগত বানিয়ে নিয়েছে যে, তাঁর পথে টিকে থাকতে গিয়ে এবং তার হুকুম পালন করতে গিয়ে যখন কোনাে বিপদ মুসিবত এসেছে তখন তারা নিশ্চিন্ত মনে ও পরম দৃঢ়তা সহকারে সে পথে টিকে থেকেছে। কোনাে প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও তারা নতি স্বীকার করেনি, তারা সকল বাধা-বিঘ্ন, দুঃখ-বেদনা ও সকল প্রকার বিপদ-আপদের ঝড় তুফানকে জয় করেছে। তারা জেনে বুঝে ও সম্পূর্ণ সচেতনভাবে আল্লাহর নির্ধারিত সকল পরিণতিকে মেনে নিয়েছে। তাদের হৃদয়ের গভীরে ও অনুভূতির সকল পর্যায়ে এবং বিবেকের মধ্যে তারা সজ্ঞানে আল্লাহ তায়ালার দেয়া সিদ্ধান্তকে সঠিক বলে গ্রহণ করে নিয়েছেন এবং কোনাে বিপদ আপদ বা দুর্ঘটনায় তারা মােটেই বিচলিত বােধ করেনি, অস্থিরও হয়ে যায়নি অথবা কোনাে আকস্মিক বিপদকে অনির্বচনীয় বা কোনাে বিচ্ছন্ন ঘটনাও মনে করেননি। এই কারণে তারা নিজেদের অবস্থান থেকে কখনাে বিচ্যুত হননি। এ দুনিয়ায় তাদের সঠিক ভূমিকা রাখার প্রশ্নে তারা ব্যস্ত হয়ে পড়েননি বরং তারা নিজেদের মালিকের ইচ্ছার কাছেই তার ইচ্ছা ও ফায়সালাকে পূরণ করার জন্যে বদ্ধপরিকর থেকেছেন। এইভাবে নিজেদেরকে আল্লাহর কাছে সােপর্দ করার পর আর কখনও তারা সে অবস্থান থেকে ফিরে আসেননি। অথচ প্রকৃতিগতভাবে তাদেরও তাে কিছু স্বাধীন ইচ্ছা ছিলাে, কিন্তু সে ইচ্ছা পূরণ করার জন্যে তারা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন-এর ফায়সালা বাস্তবায়নে কখনও বিলম্বিত করেননি, যদিও তাদের সেই ইচ্ছা তাদের দাবী পূরণ ও নিজেদের জীবনকে নিশ্চিন্ত ও নির্লিপ্ত করার লক্ষ্যে পরিচালিত হতে চাইতাে। সর্বান্তঃকরণে তারা আল্লাহ জাল্লা শানুহুর কাছে এবং তার মেহেরবানীপূর্ণ ফায়সালা বা তকদীরের কাছে নিজেদেরকে সােপর্দ করে তারই পথে চলাকে নিজেদের জন্যে বাধ্যতামূলক করে নিয়েছিলেন, যেখানে তাদের থেমে যাওয়াকে আল্লাহ তায়ালা পছন্দ করেছেন, সেখানেই তারা থেমে গিয়েছেন, যেখানে তাদের চলাকে মহান রাব্বুল আলামীন পছন্দ করেছেন, তারা নির্দ্বিধায় ও পরম খুশী মনে সেই দিকেই চলেছেন। তারা কোনাে ব্যস্ততা না দেখিয়ে ও মনকে কোনােভাবে সংকীর্ণ না করে তাদের জীবন-যৌবন, ধন সম্পদ ও তাদের সকল স্বাধীন ইচ্ছা ও রুচিকে আল্লাহর রোমন্দি হাসিল করার উদ্দেশ্যে ব্যয় করেছেন। এ ব্যাপারে তারা কারাে ওপর এহসান প্রদর্শন করেননি বা কোনাে অহংকারও দেখাননি। মেহেরবান মালিকের কাজে নিজেদেরকে নিয়ােজিত করে ঠকেছেন মনে করে কখনও আক্ষেপ করেননি বা কোনাে দিন আফসােসও করেননি। সদা-সর্বদা তারা দৃঢ় বিশ্বাস রেখেছেন যে তারা তাই করছেন যা আল্লাহ রব্বুল আলামীন তাদের ভাগ্যে পূর্ব থেকেই লিখে রেখে দিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা যা চান তাকে তাে হতেই হবে। কারণ প্রত্যেকটি কাজ তার নির্দিষ্ট সময়ের বহু পূর্ব থেকেই সম্পর্কিত হয়ে রয়েছে, অর্থাৎ কখন কোথায় কি কি কাজ হবে তা অনেক আগেই আল্লাহর ইচ্ছাতে নির্ধারিত হয়ে রয়েছে, নির্ধারিত হয়ে রয়েছে কোনাে নিয়মে কোনাে কাজ চলবে-তাও। এইটিই হচ্ছে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ, অর্থাৎ তারা মেনে নিয়েছে যে তাদের পা কোন দিকে ফেলতে হবে তা তাে আল্লাহরই হাতে, তিনিই তাদের গতিবিধির পরিচালক, যে হাত তাদেরকে পরিচালনা করছে সেই হাতের কাছে নিজেদেরকে সােপর্দ করে তারা পরম পরিতৃপ্ত। এই তৃপ্তির পেছনে তাদের সঠিক বুঝশক্তি নিরাপত্তাবােধ, গভীর আস্থা ও পরিপূর্ণ বিশ্বাস রয়েছে। এই জন্যেই তারা সুপ্রশস্ত মন নিয়ে, সহজে ও গভীর আবেগ ভরে সেই পথে চলতে পেরেছেন। তারা এসব আনুগত্যসহ যথাসাধ্য আল্লাহর হুকুম পালন করে চলেছেন। যে সব বিষয় সম্পদের ওপর তাদের কর্তৃত্ব রয়েছে সেগুলাে থেকে তারা যথাসম্ভব খরচ করেন, কখনও অপচয় করেন না বা লাগাতে তারা তাদের প্রচেষ্টাকে কাজে লাগাতে ব্যর্থও হন না। এ ব্যাপারে কোনাে মাধ্যমকে কাজে লাগাতে দ্বিধা বােধ করেন না। এরপর এটা আশা করা যায় না যে, তাদের সাধ্যের বাইরে তাদেরকে কোনাে কষ্ট দেয়া হবে, আশা করা যায় যে, তাদের মানবতা ও তার বৈশিষ্ট্যসমূহ থেকে কখনও তাদের বিচ্যুত করা হবে না। তাদের দুর্বলতা ও শক্তি কোনােটা থেকেও তারা মুক্ত হবেন না। তাদের চেতনা ও শক্তি সামর্থ্যের যে কমতি তাদের মধ্যে রয়েছে সে বিষয়ে তাদেরকে ডেকে এমন কিছু জিজ্ঞাসাবাদও করা হবে না, যা তারা করতে পারেননি। সেসব বিষয়ে তাদের আবার দুনিয়ার বুকে প্রশংসা করা হােক-এটাও তারা চান না এবং তারা এমন কথা বলেন না- যা তারা করেন না। এইভাবে তাদের জন্যে আল্লাহ তায়ালা যে তকদীর নির্ধারণ করে রেখেছেন এবং তাদের শক্তিসামর্থ অনুযায়ী প্রচেষ্টা তারা অব্যাহত রাখেন। প্রথম যুগের ইসলামী জামায়াতের মুসলমানদের মধ্যে অত্যন্ত সুসামঞ্জস্যভাবে এই গুণাবলীর সমাহার ঘটেছিলাে, যার কারণে তারা এই আকীদা বিশ্বাসের পাহাড়সম বিরাট আমানতের বােঝা বহন করতে সক্ষম হয়েছেন। প্রথম যুগে আল্লাহর সেসব নেক বান্দাদের কৃতিত্ব সমূহ এমনভাবে সমসাময়িক লােকদের হৃদয়ের মধ্যে রেখাপাত করেছিলাে যে, তার ফলে তারা এ মহান গুণে গুণান্বিত একটি জামায়াত গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং পৃথিবীর সামনে তা ছিলাে একটি অলৌকিক দৃষ্টান্ত। এ জীবনাদর্শ বিশ্বব্যাপী এক সামাজিক বিপ্লব সংঘটিত করেছিলাে, মানুষকে এমন আচরণ শিখিয়েছিলাে যা সহজে মুছে ফেলার মতাে নয়। এটা ছিলাে সাহাবায়ে কেরামের সংগ্রাম ও ত্যাগের ফল, কিন্তু মানুষ তার মাধুর্য স্বল্পকালের জন্যেই ভােগ করতে পেরেছে। এরপর মানুষের অন্তরের মধ্যে পরিবর্তন এসেছে, অন্যদের সংস্পর্শে এসে তাদের আচার ব্যবহার অনেকাংশে বিগড়ে গেছে। তারা পূর্বের মতাে তাদের একতা, সততা, সত্যবাদিতা, সত্যনিষ্ঠা ও আল্লাহর কাছে পূর্ণ আত্মসমর্পণের গুণাবলী ধরে রাখতে পারেনি। আরব জাহেলিয়াতের মধ্য থেকে, রসূলুল্লাহ(স.)-এর সাহচর্যের কারণে এককালে যে মুসলিম জনগােষ্ঠীর মধ্যে চারিত্রিক মহাবিপ্লব এসেছিলো, তা আর এই মানুষরা দেখাতে পারেনি। প্রকৃতপক্ষে তা আগে সম্ভব হয়েছিলাে আল্লাহরই সরাসরি ইচ্ছা ও মদদের ফলেই। ভবিষ্যতে সে গুণাবলী আবার যদি কোথাও পূর্ণতা লাভ করে, তা করবে সেই মহান সত্তার সরাসরি ইচ্ছায়, যিনি পৃথিবী ও আকাশমন্ডলীকে সৃষ্টি করেছেন, তিনিই তাদের পদক্ষেপ ও বিশ্বভূবনে তাদের প্রকৃত ভূমিকা রাখতে সাহায্য করবেন। আল কোরআনের বহু আয়াত এই সত্যের দিকে ইংগিত করেছে, যেখানে আল্লাহ তাবারক ওয়া তায়ালা বলছেন, ‘তুমি যাকে চাইবে তাকে তুমি হেদায়াত করতে পারবে না, বরং আল্লাহ তায়ালা যাকে চাইবেন তাকে তিনি হেদায়াত করবেন… অথবা বলছেন, ‘ওদের হেদায়াতের দায়িত্ব তােমাকে দেয়া হয়নি, বরং আল্লাহ তায়ালা যাকে ইচ্ছা তাকে হেদায়াত করবেন। অথবা বলছেন, ‘আল্লাহর হেদায়াতই হচ্ছে আসল হেদায়াত। মহাসত্যের সন্ধান এবং হেদায়াতের ব্যাপক অর্থ বলতে গেলে ওপরের এই কথাটিই এখানে প্রযােজ্য। এই বিশাল সৃষ্টির বুকে মানুষকে পথ দেখানাের ক্ষমতা আর কারও নেই, থাকতে পারে না। কেউ জানে না, কোন পথে পা বাড়ালে তার সার্বিক সাফল্য আসবে। এক মহান সত্ত্বা রয়েছেন, অবশ্যই তিনি সর্বজ্ঞ ও সর্বশক্তিমান। আল্লাহর কাছে নিজেকে সােপর্দ করে তাই তার কাছেই হেদায়াত চাইতে হবে। যতােদিন সৃষ্টিজগত টিকে আছে ততােদিন এই প্রক্রিয়াতেই মানুষ সাফল্য লাভ করার আশা করতে পারবে। মহান আল্লাহ থেকে বেপরোয়া হয়ে মানুষ যখন নিজেদের কল্যাণের পথ নিজেরাই রচনা করে নিতে চেয়েছে, তখনই তারা পদে পদে ঠোকর খেয়েছে এবং কল্যাণের পরিবর্তে তাদের জীবনে সবদিক থেকে অশান্তি ও সর্বনাশা পরিণতি নেমে এসেছে। কোনাে ব্যক্তির চূড়ান্ত প্রচেষ্টায়ই পরিপূর্ণ সাফল্যের মনযিলে উপনীত হতে পারে না, যতােক্ষণ না তার অন্তর আল্লাহর হেদায়াতের ওপর দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত না হয়। ব্যক্তির সকল তৎপরতা তখনই সঠিকভাবে দৃঢ়তা লাভ করতে পারে, মানব প্রকৃতি তখনই প্রকৃত স্বস্তি লাভ করতে পারে, যখন সে এ বিশ্ব প্রকৃতির সকল ক্ষেত্রে আল্লাহর নির্ধারিত তকদির ও তার মর্জির ওপর সন্তুষ্টি প্রকাশ করে, আল্লাহর ইচ্ছাশক্তির কাছে নিজেকে সমর্পণ করে। কোরআনে হাকীমের এ সুস্পষ্ট বর্ণনা লক্ষণীয়, ‘কোনাে মােমেন পুরুষ ও মােমেন নারীর আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রসূলের কোনাে নির্দেশ প্রদানের পর তা অমান্য করার কোনাে এখতিয়ার নেই, যে ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রসূলের নাফরমানী করে সে প্রকাশ্য গােমরাহীতে লিপ্ত হয়।'(আয়াত ৩৬) অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রাসূলের অবাধ্য ও নাফরমান সত্যপথ ও হেদায়াত থেকে অনেক দূর-দূরান্তে অবস্থান করে। আল্লাহ তায়ালা ও রসূলের নির্দেশ যে কোনাে ব্যাপারেই হােক কেনাে? (এমনকি তা যদি যয়নব এর সাথে রাসূলের বিয়ের নির্দেশের ব্যাপারও হয় তবুও) তা অমান্য করা যাবে না। তাই উল্লেখিত আয়াত নাযিলের পর যয়নব এবং তার ভাই রসূলের পালক পুত্র যায়েদের তালাকের পর রাসূলের সাথে বিয়ের সম্মত হননি। এ ঘটনা প্রসংগেই উল্লেখিত আয়াত অবতীর্ণ হয়। এ আয়াত দ্বারা ইসলামের এ চিরন্তন মূলনীতি স্ব- প্রমাণিত হয় যে, জীবনের কোনাে ক্ষেত্রেই আল্লাহ তায়ালা ও তার রসূল প্রদত্ত নির্দেশকে অমান্য করা যায় না। ইসলামী জীবন পদ্ধতির এ হচ্ছে চিরন্তন শাশ্বত বিধান। এ প্রসংগে যায়দ ইবনে হারেসের স্ত্রী যয়নব বিনতে জাহশের কথা উল্লেখিত হয়েছে। বিভিন্ন হাদীসে তার উল্লেখ রয়েছে। আয়াত নাযিল হওয়ার পর যয়নব ও তার ভাই তাদের আপত্তিকে পরিহার করে এ বিয়েতে স্বতস্ফূর্তভাবে সম্মতি প্রদান করেন। এসব ঘটনা, এর বিস্তারিত বিবরণ ও ব্যাখ্যা পূর্বেই আলােচিত হয়েছে।
*দত্তক প্রথার মূল উৎপাটন : ‘যে ব্যক্তির প্রতি আল্লাহ তায়ালা অনুগ্রহ করেছেন, আর তুমিও যার ওপর অনুকম্পা প্রদান করেছাে… আর আল্লাহ তায়ালা সব ব্যাপারেই সম্যকভাবে জ্ঞাত।'(আয়াত ৩৭) পূর্ববর্তী সূরায় পােষ্যপুত্রকে স্বীয় পুত্ররূপে সম্বােধন করা ও তাকে নিজ বংশের সাথে সম্পৃক্ত করার প্রচলিত সামাজিক পদ্ধতিকে সুস্পষ্ট আয়াত দ্বারা বিলুপ্ত ঘােষণা করা হয়েছে। তাদের বংশধারা ও পরিচিতি এখন থেকে তাদের প্রকৃত জন্মদাতা পিতার সাথেই সম্পৃক্ত করার নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। তাদের পারিবারিক সম্পর্কে প্রকৃতিগত মূল সূত্রের সাথে নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। কোরআনে হাকীমে এরশাদ হচ্ছে, ‘তােমরা স্বতঃপ্রণােদিতভাবে যা করো তাতে আল্লাহ তায়ালা ক্ষমাশীল ও মেহেরবান।’ তদানীন্তন আরবদের জীবনে পােষ্যপুত্র প্রথা ঐতিহ্যগতভাবেই সমাজের একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিলাে। এ ছিলাে আবহমান কাল থেকে এক স্বীকৃত ও প্রতিষ্ঠিত প্রথা। সমাজে ঐতিহাগতভাবে প্রচলিত এ পদ্ধতিকে বিলুপ্ত করা কোনাে সহজ কথা ছিলাে না। এ প্রথাকে রাতারাতি পরিবর্তন সাধন করাও সহজ ছিলাে না। কেননা এ প্রথা সমাজে গভীরভাবে শিকড় গেড়ে বসেছিলাে। এ পুরাতন প্রথা সমাজের জন্যে অবশ্যই ক্ষতিকর ছিলাে। এ প্রাচীন ও ব্যাপক প্রচলিত প্রথার মােকাবেলা করা ও এটিকে অস্বীকার করা মূলত খুবই কঠিন ব্যাপার ছিলো। কারণ সমাজের বিপুলসংখ্যক লােকের কাছে এটিই ছিলাে গ্রহণযােগ্য একটি সাধারণ ঘটনা। এর আগেই বলা হয়েছে যে, আল্লাহর রসূল নিজেই যায়েদ ইবনে হারেসাকে বিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। তিনি তাকে পােষ্যপুত্র হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন। তাকে যায়েদ ইবনে মােহাম্মদ নামেই ডাকা হতাে। এ পরিচয়েই সমাজে তার পরিচিতি হয়ে গিয়েছিলাে। একারণেই রসূলুল্লাহ(স.) স্ব-গােত্রীয় ফুফাতাে বোন যয়নব বিনতে জাহশকে যায়েদের সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন। এ বিয়ে ছিলাে আরবদের বংশ অহংকার, গােত্রীয় ভেদাভেদ ও বিদ্বেষকে দূরীভূত করার এক বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। যায়দ ক্রীতদাস হওয়ার কারণে এ অসম গােত্রীয় দাম্পত্য বন্ধন ছিলাে আরবদের মাঝে আল কোরআনের সাম্যের ঘোষণাকে বাস্তবায়িত করার পথে এক বৈপ্লবিক পদক্ষেপ। ‘নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে তারাই সর্বাধিক সম্মানিত যারা তাকওয়ার গুণে ভূষিত।’ এ দাম্পত্য বন্ধনের মাধ্যমে ইসলামের সাম্য ব্যবস্থা ও গােত্রীয় ভেদাভেদ বিলুপ্ত করার বাস্তব ও বৈপ্লবিক নীতির বাস্তবায়ন সম্ভবপর হয়েছিল। যায়েদের স্ত্রী জয়নবের যায়েদের দাম্পত্য বন্ধন থেকে মুক্ত করে আল্লাহরই নির্দেশে স্বয়ং নবী করীম(স.) কর্তৃক বিয়ে করার মাধ্যমে ভ্রান্ত প্রথা ও কুসংস্কার থেকে সমাজকে চিরতরে মুক্ত করা সম্ভব হয়েছে। আবহমান কাল থেকে সমাজে প্রচলিত এই প্রথাটির বিলুপ্তির ব্যাপারটি ছিলাে সত্যিই এক বিস্ময়কর ও বৈপ্লবিক পদক্ষেপ। আল্লাহ সােবহানাহু ওয়া তায়ালা বিশেষ ওহীর মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ(স.)-কে যায়েদ ইবন হারেসা কর্তৃক জয়নাবকে তালাক প্রদান, যায়েদের সাথে যয়নাবের অশান্তিপূর্ণ দাম্পত্য জীবন, যয়নাবের সাথে যায়েদের দাম্পত্য বন্ধন অটুট রাখার ব্যাপারে অক্ষমতার ব্যাপার গুলো আগে ভাগেই জানিয়ে দিয়েছেন। এমনকি যায়েদের তালাক প্রদানের পর শরীয়াতের নিয়ম অনুযায়ী আল্লাহর রসূল কর্তৃক যয়নাবের বিয়ে সম্পাদনের ব্যাপার এবং সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে এ বৈপ্লবিক পদক্ষেপের কল্যাণকারিতা ও কৌশলগত দিক সম্পর্কেও আল্লাহ তায়ালা তাকে ওহী মারফত অবগত করিয়েছেন। যায়েদ ও যয়নাবের অস্থিতিশীল দাম্পত্য সম্পর্ক আর বেশীদিন যে অব্যাহত থাকার নয়- এ পরিস্থিতি তিনি ওহীর মাধ্যমেই অবগত হয়েছিলেন। যায়েদ ইবনে হারেসা(রা.) যয়নাব সাথে তার দাম্পত্য সম্পর্কের তিক্ততা, অস্বস্তিপূর্ণ দাম্পত্য জীবন ও তাদের দাম্পত্য বন্ধন অটুট রাখার ব্যাপারে বারবার নিজের অক্ষমতার অভিযােগ রাসূলুল্লাহ(স.)-এর কাছে এসে উত্থাপন করেন। আল্লাহর রাসূল(স) নির্ভীক চিত্তে তার সাথীর দৃষ্টিভংগীর মােকাবেলা করার দৃঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। কিন্তু মনে মনে আল্লাহর ওহীর এ নির্দেশকে কার্যকর করার ক্ষেত্রে সমাজের আবহমানকালের এ প্রথার বিলুপ্তি এবং সমাজের অন্ধ কুসংস্কার বর্জনের ক্ষেত্রে সাধারণ লােকদের মনােভাব ও দৃষ্টিভংগী স্বাভাবিকভাবেই তাকে চিন্তান্বিত করে তুলেছিলাে। তাই যায়েদের উত্থাপিত অভিযােগের ব্যাপারে তিনি যায়েদকে সান্ত্বনা ও উপদেশ প্রদান করেন। আল্লাহ তায়ালা যায়েদের প্রতি ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ, রসূলের নৈকট্য লাভ, তার প্রতি রাসূল(স.) -এর অগাধ স্নেহ মমতা ও মােহব্বতের কথা তাকে মনে করিয়ে দেন, তার প্রতি সমধিক ভালােবাসা সর্বোপরি তাকে ক্রীতদাসত্বের শৃংখলমুক্ত করে স্বাধীন মানুষ এবং তাকে নবী পরিবারের সদস্যরূপে গ্রহণের মর্যাদা প্রদানের অনুগ্রহের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রাসুল তাকে বললেন, তুমি তােমার দাম্পত্য বন্ধনকে অটুট রাখাে, আর আল্লাহ তায়ালাকে ভয় করাে।’ এখানে আল্লাহ তায়ালা রসূল(স.)-কে সামাজিক কুসংস্কারের বন্ধন থেকে বেরিয়ে আসার ক্ষেত্রে তার অন্তরের ইতস্ততভাবের প্রতি ইংগিত প্রদান করেছেন, তুমি মনের এমন কোনাে বিষয় কে গোপন করে রেখেছিলে, যা আল্লাহ তায়ালা প্রকাশ করে দেবেন। তুমি লােকনিন্দার ভয় করেছিলে, অথচ আল্লাহ তায়ালাকেই অধিকতর ভয় করা দরকার। আয়াতে এ বিষয়টি পরিষ্কারভাবে উল্লেখিত হয়েছে যে, লােক নিন্দার আশংকায় পরবর্তী পর্যায়ে ওহীর নির্দেশক্রমে যায়েদ কর্তৃক যয়নাবকে তালাক প্রদানের পর আল্লাহর রসূল তাকে বিয়ে করবেন, এ ব্যাপারটি গােপন রেখে আল্লাহর রাসূল যায়েদকে যয়নাবের সাথে দাম্পত্য বন্ধন অটুট রাখার পরামর্শ প্রদান করেছিলেন। অথচ তার এটা জানা ছিলাে যে, আল্লাহ তায়ালা তা প্রকাশ করে দেবেন। যদিও প্রকাশ্য নির্দেশ ছিলাে না, তবুও আল্লাহ তায়ালা ইলহামের মাধ্যমে যায়েদের তালাক প্রদান, অতপর যয়নাবের সাথে রসুলের বিয়ের নির্দেশ যে আল্লাহর রসূল কর্তৃক কার্যকর করা হবে- তাও জানিয়ে দিয়েছিলেন। অদূর ভবিষ্যতে এ সবই পর্যায়ক্রমে অনুষ্ঠিত হবে, কোনাে তাড়াহড়া ছাড়া তা ধীরে সুস্থেই কার্যকর হবে, এ সবই রসূলের জানা ছিলাে। সমাজের এ চিরাচরিত পন্থার অবসান ঘটিয়ে এ বিয়ের পর যে হৈ, চৈ ও লােক নিন্দার যে আশংকা রসূল করেছেন, তা সবই ছিলাে ঠিক। আল্লাহ তায়ালা যখন ঘটনা পরম্পরার রসূলকে যয়নাবের সাথে দাম্পত্য বন্ধন সৃষ্টির নির্দেশ প্রদান করলেন, তখন যায়েদের তালাক প্রদানের পরই চূড়ান্ত পর্যায়ে আল্লাহর রসূল যয়নাবকে বিয়ে করলেন। এ ব্যাপারে আল্লাহর রসূল ও যয়নাব কেউ কোনাে ইতস্ততায় নিমজ্জিত হননি। তারা এমন দুশ্চিন্তায়ও পতিত হননি যে, সমাজের আবহমানকাল থেকে প্রচলিত এ কুসংস্কারকে বর্জনের পর পরিস্থিতি কী হবে? কারণ সমাজের বদ্ধমূল ধারণা ছিলো যে, যয়নাব হচ্ছে মােহাম্মদ(স.)-এর পােষ্যপুত্র যায়েদের স্ত্রী, তাই তার জন্যে পুত্রবধূকে বিয়ে করা কোনোমতেই হালাল নয়। এমনিভাবে এ ঘটনার মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা পােষ্যপুত্র গ্রহণের ও কথিত পালক পুত্রের বধূকে তালাক প্রদানের পর বিয়ে করার বৈধতা প্রসংগে আয়াত নাযিল করলেন। নতুন আয়াত দ্বারা আল্লাহ তায়ালা পােষ্যপুত্র গ্রহণের এ পন্থাকে চিরতরে রহিত করে দিলেন। এ ঘটনা নবী করীম(স.)-এর বিয়ে নীতির ক্ষেত্রে এক নতুন অধ্যায়ের সংযােজন ঘটিয়েছে, আর এ পদ্ধতি গ্রহণ করার ফলে সমাজে আকস্মিকভাবে এক প্রলয়ংকরী ঝড়ের সৃষ্টি হলাে। কানাঘুষা এবং অপবাদের তুফান প্রবাহিত হতে লাগলাে। এ ঘটনা সমাজের প্রচলিত ঐতিহ্যের মূলে কুঠারাঘাত করলো। এতে সমাজের সকল কুসংস্কারের মূলােচ্ছেদ করা হলাে। এমনি ধরনের একটি কু-প্রথার মূলােৎপাটন করার কারণে ইসলামবিরােধী শক্তিরা ব্যংগ বিদ্রুপ তিরঙ্কার, অপবাদ ও মনগড়া কিসসা কাহিনী করতে শুরু করলাে। আল্লাহ সােবহানাহু ওয়া তায়ালা এমন পরিস্থিতিতে সকল অপবাদ ঘুচিয়ে সকল কুসংস্কারের মূলােচ্ছেদ করে আয়াতে চুড়ান্ত সিদ্ধান্তকারী এই নির্দেশ প্রদান করলেন, অতপর যায়েদ যখন যয়নবের সাথে বিবাহ বন্ধন ছিন্ন করলাে। তখন আমিই তােমার সাথে তাকে বিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা সম্পন্ন করলাম। যাতে করে মােমেনের পােষ্যপুত্ররা তাদের স্ত্রীদের সাথে দাম্পত্য বন্ধন ছিন্ন করলে, তাদেরকে বিয়ে করার ব্যাপারে আর কোনাে অসুবিধা বা প্রতিবন্ধকতা না থাকে। রসূল কর্তৃক আল্লাহ তায়ালা এ সিদ্ধান্ত কার্যকর করা ছিলাে মূলত কুফরী সমাজের কুপ্রথা অপনােদনকল্পে বড়াে ধরনের একটি আঘাত। এ আঘাত তিনি যখন হেনেছিলেন, তখন সমস্ত জনগােষ্ঠী প্রচন্ড বিক্ষোভে ফেটে পড়লাে। সকল শ্রেণীর মানুষের দৃষ্টি এর প্রতি নিবদ্ধ হলাে। সকল শক্তি দিয়ে এর প্রতি ঘৃণা ও বিরােধিতা শুরু করলাে । গােটা সমাজে প্রচন্ড কম্পন সৃষ্টি হলাে। তাদের মনগড়া মাবুদ ও বাপ দাদাদের প্রচলিত কুপ্রথার সাথে এর ভীষণ দ্বন্দ্বের সূচনা ঘটলাে। কিন্তু তা তাওহীদি আকীদার সাথে দ্বন্দ্ব ও সংঘাত সৃষ্টির পরিবর্তে তার প্রতি দৃঢ়তার প্রমাণই উত্থাপিত করলাে। আয়াতের শেষাংশে বলা হলাে, মূলত আল্লাহর নির্দেশনাই কার্যকর হয়ে থাকে। অর্থাৎ আল্লাহর নির্দেশকে পরিত্যাগ করা, তাঁর নির্দেশকে অমান্য করা, তার নির্দেশ থেকে পলায়ন করা কিংবা তার বিরােধিতার কোনাে পথই অবশিষ্ট থাকে না। চূড়ান্ত পর্যায়ে আল্লাহর নির্দেশই কার্যকর হয়ে থাকে। তার নির্দেশকে অমান্য করার কোনাে পথই আর উন্মুক্ত থাকে না। বস্তুত যয়নাব(রা.) তালাকের ইদ্দত শেষ হবার পরেই তার সাথে রসূলের বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছিলাে। যায়নাব(রা.)-এর পূর্ব স্বামী যায়েদ(রা.)-কে তার কাছে সৃষ্টির সেরা ব্যক্তিত্ব, রাসূল(স.)-এর বিয়ের পয়গাম নিয়ে প্রেরণ করা হয়েছিলাে। বিষয়টি হাদীসে এভাবে উল্লেখ রয়েছে, হযরত আনাস(রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, যয়নাব(রা.)-এর বিবাহ বিচ্ছেদের পর যখন তিনি ইদ্দত পূর্ণ করলেন, তখন মহানবী(স.) যায়েদ ইবন হারেসা(রা.)-কে সম্বােধন করে বললেন, ‘তুমি যাও এবং যয়নাবের কাছে আমার পয়গামের কথা উল্লেখ করাে । হযরত যায়েদ(রা.) যখন যয়নাবের কাছে গেলেন, তখন তার মুখমন্ডল ওড়না দ্বারা আবৃত ছিলাে। হযরত যায়েদ(রা.) বলেন, তার সাথে আমার সাক্ষাতের পর আমি হতচকিত হয়ে গেলাম, আমার অন্তরে এক অকল্পনীয় ভীতির সৃষ্টি হলাে। আমি যেন তার প্রতি তাকাবার শক্তিই হারিয়ে ফেললাম। রসূলের পয়গামের কথা উচ্চারণ করতে গিয়ে আমার বাকশক্তি যেন রুদ্ধ হয়ে আসছিলাে। যয়নাব আমার দিকে পিঠ ফিরে দাঁড়ালাে, আমিও তাকে পশ্চাতে রেখে দাঁড়িয়ে বললাম, হে যয়নাব! আমি তােমাকে একটি শুভ সংবাদ দিচ্ছি; আমাকে আল্লাহর রসূল বিয়ের পয়গামসহ তােমার কাছে প্রেরণ করেছেন। এ কথা শুনে যয়নাব বললেন, আমি এ ব্যাপারে কোনাে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারছি না, যতােক্ষণ পর্যন্ত না আল্লাহ তায়ালা এ বিষয়ে আমাকে কোনাে নির্দেশ প্রদান না করেন। এ বলে তিনি মসজিদে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। ঠিক এই মুহূর্তেই আল্লাহ তায়ালা এই নির্দেশনামূলক আয়াত নাযিল করলেন। পরক্ষণেই রাসূলুল্লাহ(স.) তার কাছে গমন করলেন। (এবং তাকে আল্লাহর আয়াত শুনালেন) মুসনাদে আহমদ(র.) মুসলিম ও নাসায়ী হাদীসটি সোলায়মান ইবনে মুগীরার সনদে সংকলিত করেছেন। ইমাম বােখারী(র.) হযরত আনাস বিন মালেক(রা.)-এর সনদে একটি হাদীস সংকলন করেছেন যে, হযরত আনাস(রা.) বলেন, যয়নাব বিনতে জাহশ(রা.) রসূলের জীবন সংগীনীর মর্যাদাপ্রাপ্তির পর অন্যসব উম্মুল মােমেনীনের সাথে গর্ব প্রকাশ করে বলতেন, তােমাদেরকে তােমাদের অভিভাবকরা ও তােমাদের পরিবারের লােকেরা রসূলের কাছে বিয়ে দিয়েছে, আর আমাকে বিয়ে দিয়েছেন সপ্তাকাশের উর্ধে অবস্থানকারী স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা। তারপরও ঘটনাটি এমনি এমনি শেষ হয়ে যায়নি। চিরাচরিত প্রথা ও অতীত ঐতিহ্য বিরােধী এ ঘটনা সমগ্র সমাজে আলােড়ন সৃষ্টি করলাে। মােনাফেক ও মােশরেকদের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে মুসলিম নামধারী কতিপয় ব্যক্তিও এ প্রচারণায় শরীক হলাে যে, ‘মুহাম্মদ(স.) তার পুত্রবধূকে বিয়ে করেছে।’ এমনিভাবে এ সমস্যা যখন জটিল আকার ধারণ করলাে, আর আবহমানকালের ঐতিহ্যের বিপরীত এ পদ্ধতিকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করা হলাে; তখন কোরআনুল করীম এ যথার্থ গুরুত্ব আরোপ করে এর মৌলিক ও ঐতিহাসিক ধারায় সকল অপপ্রচার ও অপবাদকে অপসারিত করার যুক্তিসংগত প্রমাণ উত্থাপন করে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘােষণা করলা, ‘নবী(স.)-এর জন্যে আল্লাহ তায়ালা যা ফরয করে দিয়েছেন, তা কার্যকর করার মধ্যে কোনাে ক্ষতি (প্রতিবন্ধকতা) নেই।’ অর্থাৎ আয়াতে অত্যন্ত সুস্পষ্ট এ ঘোষণা দেয়া হলাে যে, যয়নাবকে স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করার ব্যাপারটি আল্লাহ তায়ালা স্বয়ং নিজেই তাঁর ওপর ফরষ করে দিয়েছেন। আসলে আরব সমাজে পােষ্যপুত্রের স্ত্রীকে বিয়ে না করার এ ভ্রান্ত প্রথা বাতিল করার জন্যেই আল্লাহ তায়ালা নবীর ওপর এ বিধান ফরয করেছেন। তাই আল্লাহর এ নির্দেশকে বাস্তবায়ন করার মধ্যে কোনাে প্রকার ক্ষতি নিহিত নেই এবং আল্লাহর নির্ধারিত বিধান কার্যকর করা তার জন্যে কোনাে দোষণীয়ও নয় । পূর্ববর্তী নবী ও রসূলদের যুগেও এ ধরনের ঘটনা অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং সর্বত্রই আল্লাহর নির্ধারিত বিধান কার্যকর হয়েছে। মোহাম্মদ(স.) নিজেও নবী ও রসূলদের সে ধারাকে অব্যাহত রেখেছেন। এ ক্ষেত্রে তিনি কোনাে অভিনব পন্থা অবলম্বন করেননি। তিনি যে পূর্ববর্তী নবী ও রসূলদেরই পদ্ধতিই অনুসরণ করেছেন, তার প্রমাণ উপস্থাপন করে আল কোরআনে বলা হয়েছে, মােহাম্মদ(স.)-এর আগে যে সকল নবী ও রসূল চলে গেছে, তাদের যুগেও আল্লাহর বিধান অনুরূপই ছিলে। বস্তুত এ ব্যাপারটিও আল্লাহর চিরন্তন অপরিবর্তনীয় নীতির ভিত্তিতেই অনুষ্ঠিত হয়েছে, যা প্রত্যেক বিষয়ের অন্তর্নিহিত গভীর উপলব্ধি ও তাৎপর্যের সাথেই সম্পৃক্ত ও সমন্বিত। এটি ঘুণেধরা সমাজ জীবনে আবর্তিত ভিত্তিহীন ধ্যান-ধারণা, অন্ধ আবেগ ও অভিশপ্ত কুসংস্কারের ওপর ভিত্তি করে গৃহীত হয়নি। সকল ব্যাপারই আল্লাহর ইলম ও পরিকল্পনার মধ্যে পূর্ব নির্ধারিত ছিলাে। এ স্থায়ী সত্যের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করেই কোরআনে হাকীমে এরশাদ হচ্ছে, ‘প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর নির্দেশই নির্ধারিত ও অবধারিত।’ আল্লাহ প্রদত্ত নির্দেশই তাে কার্যকর হবে। আল্লাহর নির্দেশের সামনে কোনাে কিছুই বাধার প্রাচীর হয়ে দাঁড়াতে ও টিকে থাকতে পারে না। কেননা তা পূর্ব নির্ধারিত, দার্শনিক ও কৌশলগত দিক থেকেও একান্ত তাৎপর্যবহ। আল্লাহর কাংখিত ও পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনায়ও তা পূর্ব অনুমােদিত ব্যাপার। সে অসীম জ্ঞানময় একমাত্র মহান সত্ত্বাই এর প্রয়ােজনীয়তা, এর মূল্যমান নির্ধারণ করেন। এর যুগ ও কাল সম্পর্কে সম্যকভাবে তিনিই ওয়াকেফহাল। অবশ্যই আল্লাহতায়ালা তাঁর রসূলের প্রতি সমাজের প্রচলিত ভ্রান্ত পদ্ধতিকে বাতিল করা এবং তার সকল নিদর্শনকে কার্যকরভাবে বিলুপ্ত করার হুকুম দিয়ে থাকেন এবং আল্লাহ সােবহানাহু ওয়া তায়ালাই পূর্ববর্তী নবী ও রসূলদের অনুসৃত নীতির উদাহরণ ও দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করে তাঁর নির্দেশের বাস্তবতা, অপরিহার্যতা যৌক্তিকতা ও কল্যাণকামিতাকে স্বপ্ৰমাণিত করেন। কারও পক্ষেই আল্লাহর এসব নির্দেশকে কার্যকর করা থেকে বিরত থাকার কোনাে অবকাশ থাকে না।
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
# পিছনের প্যারাগ্রাফের পরপরই এ বিষয়বস্তু উপস্থাপন করে এই মর্মে একটি সূক্ষ্ম ইঙ্গিত করা হয়েছে যে ওপরে রসূলের ﷺ পবিত্র স্ত্রীগণকে যে নির্দেশ দেয়া হয়েছে তা কেবলমাত্র তাঁদের জন্যই নির্দিষ্ট নয় বরং মুসলিম সমাজের সামগ্রিক সংশোধন কাজ সাধারণভাবে এসব নির্দেশ অনুযায়ীই করতে হবে।
# যারা নিজেদের জন্য ইসলামকে জীবন বিধান হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছে এবং এখন জীবন যাপনের ক্ষেত্রে এ বিধানের অনুসারী হবার ব্যাপারে স্থির সিদ্ধান্ত করে নিয়েছে। অন্য কথায়, যাদের মধ্যে ইসলাম প্রদত্ত চিন্তাপদ্ধতি ও জীবনধারার বিরুদ্ধে কোন রকমের বিরোধিতা ও প্রতিবন্ধকতার লেশমাত্র নেই। বরং তারা তার পরিপূর্ণ আনুগত্য ও অনুসরণের পথ অবলম্বন করেছে।
# যাদের এ আনুগত্য নিছক বাহ্যিক নয়, গত্যন্তর নেই, মন চায় না তবুও করছি, এমন নয়। বরং মন থেকেই তারা ইসলামের নেতৃত্বকে সত্য বলে মেনে নিয়েছে। চিন্তা ও কর্মের যে পথ কুরআন ও মুহাম্মাদ ﷺ দেখিয়েছেন সেটিই সোজা ও সঠিক পথ এবং তারই অনুসরণের মধ্যে আমাদের সাফল্য নিহিত, এটিই তাদের ঈমান। যে জিনিসকে আল্লাহ ও তাঁর রসূল ভুল বলে দিয়েছেন তাদের নিজেদের মতেও সেটি নিশ্চিতই ভুল। আর তাকে আল্লাহ ও তাঁর রসূল ﷺ সত্য বলে বলে দিয়েছেন তাদের নিজেদের মন-মস্তিষ্কও তাকেই সত্য বলে নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করে। তাদের চিন্তা ও মানসিক অবস্থা এমন নয়। কুরআন ও সুন্নাত থেকে যে হুকুম প্রমাণিত হয় তাকে তারা অসঙ্গত মনে করতে পারে এবং এ চিন্তার বেড়াজালে এমনভাবে আটকে যেতে পারে যে, কোন প্রকারে তাকে পরিবর্তিত করে নিজেদের মন মাফিক করে নেবে অথবা দুনিয়ার প্রচলিত পদ্ধতি অনুসারে তাকে ঢালাইও করে নেবে আবার এ অভিযোগও নিজেদের মাথায় নেবে না যে, আমরা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের হুকুম কাটছাঁট করে নিয়েছি। হাদীসে নবী ﷺ ঈমানের সঠিক অবস্থা এভাবে বর্ণনা করেছেনঃ
ذَاقَ طَعْمَ الإِيمَانِ مَنْ رَضِىَ بِاللَّهِ رَبًّا وَبِالإِسْلاَمِ دِينًا وَبِمُحَمَّدٍ رَسُولاً
“ঈমানের স্বাদ আস্বাদন করেছে সেই ব্যক্তি যে আল্লাহকে তার রব, ইসলামকে তার দ্বীন এবং মুহাম্মাদকে তার রসূল বলে মেনে নিতে রাজি হয়ে গেছে।” (মুসলিম)
অন্য একটি হাদীসে তিনি এর ব্যাখ্যা এভাবে করেছেনঃ
لاَ يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى يَكُونَ هَوَاهُ تَبَعًا جِئْتَ بِهِ
“তোমাদের কোন ব্যক্তি মু’মিন হয় না যতক্ষণ না তার প্রবৃত্তি আমি যা এনেছি তার অনুগত হয়ে যায়।”(শারহুস সুন্নাহ)
# তারা নিছক মেনে নিয়ে বসে থাকার লোক নয়। বরং কার্যত আনুগত্যকারী। তাদের অবস্থা এমন নয় যে, আল্লাহ ও তাঁর রসূল যে কাজের হুকুম দিয়েছেন তাকে সত্য বলে মেনে নেবে, ঠিকই কিন্তু কার্যত তার বিরুদ্ধাচরণ করবে এবং আল্লাহ ও তাঁর রসূল যেসব কাজ করতে নিষেধ করেছেন নিজেরা আন্তরিকভাবে সেগুলোকে খারাপ মনে করবে কিন্তু নিজেদের বাস্তব জীবনে সেগুলোই করে যেতে থাকবে।
# নিজেদের কথায় যেমন সত্য তেমনি ব্যবহারিক কার্যকলাপেও সত্য। মিথ্যা, প্রতারণা, অসৎ উদ্দেশ্য, ঠগবৃত্তি ও ছলনা তাদের জীবনে পাওয়া যায় না। তাদের বিবেক যা সত্য বলে জানে মুখে তারা তাই উচ্চারণ করে। তাদের মতে যে কাজ ঈমানদারীর সাথে সত্য ও সততা অনুযায়ী হয় সে কাজই তারা করে। যার সাথেই তারা কোন কাজ করে বিশ্বস্ততা ও ঈমানদারীর সাথে করে।
# আল্লাহ ও তাঁর রসূলের নির্দেশিত সোজা সত্য পথে চলার এবং আল্লাহর দ্বীনকে প্রতিষ্ঠত করার পথে যে বাঁধাই আসে, যে বিপদই দেখা দেয়, যে কষ্টই সহ্য করতে হয় এবং যে সমস্ত ক্ষতির মুখোমুখি হতে হয়, দৃঢ়ভাবে তারা তার মোকাবিলা করে। কোন প্রকার ভীতি, লোক ও প্রবৃত্তির কামনার কোন দাবী তাদেরকে সোজা পথ থেকে হটিয়ে দিতে সক্ষম হয় না।
# তারা দম্ভ, অহংকার ও আত্মম্ভরীতামুক্ত। তারা এ সত্যের পূর্ণ সচেতন অনুভূতি রাখে যে, তারা বান্দা এবং বন্দেগীর বাইরে তাদের কোন মর্যাদা নেই। তাই তাদের দেহ ও অন্তরাত্মা উভয়ই আল্লাহর সামনে নত থাকে। আল্লাহ ভীতি তাদের ওপর প্রাধান্য বিস্তার করে থাকে। আত্ম অহমিকায় মত্ত আল্লাহভীতি শূন্য লোকদের থেকে যে ধরনের মনোভাব প্রকাশিত হয় এমন কোন মনোভাব কখনো তাদের থেকে প্রকাশিত হয় না। আয়াতের বিন্যাসের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে জানা যায়, এখানে এ সাধারণ আল্লাহভীতি মূলক মনোভাবের সাথে বিশেষ ভাবে “খুশু” বা বিনত হওয়া শব্দ ব্যবহার করায় এর অর্থ হয় নামায। কারণ এরপরই সাদকাহ ও রোযার কথা বলা হয়েছে।
# এর অর্থ কেবল ফরয যাকাত আদায় করাই নয় বরং সাধারণ দান-খয়রাতও এর অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ তারা আল্লাহর পথে উন্মুক্ত হৃদয়ে নিজেদের অর্থ ব্যয় করে। আল্লাহর বান্দাদের সাহায্য করার ব্যাপারে নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী প্রচেষ্টা চালাতে তারা কসুর করে না। কোন এতিম, রুগ্ন, বিপদাপন্ন, দুর্বল, অক্ষম, গরীব ও অভাবী ব্যক্তি তাদের লোকালয়ে তাদের সাহায্য থেকে বঞ্চিত থাকে না। আর আল্লাহর দ্বীনকে সুউচ্চ আসনে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য প্রয়োজন হলে তার জন্য অর্থ-সম্পদ ব্যয় করতে তারা কখনো কার্পণ্য করে না।
# ফরয ও নফল উভয় ধরনের রোযা এর অন্তর্ভুক্ত হবে।
# এর দু’টি অর্থ হয়। একটি হচ্ছে, তারা যিনা থেকে দূরে থাকে এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে, তারা উলংগতাকে এড়িয়ে চলে। এই সাথে এটাও বুঝে নিতে হবে যে, কেবলমাত্র মানুষের পোশাক না পরে উলংগ হয়ে থাকাকে উলংগতা বলে না বরং এমন ধরনের পোশাক পরাও উলংগতার অন্তর্ভুক্ত, যা এতটা সূক্ষ্ম হয় যে, তার মধ্য দিয়ে শরীর দেখা যায় অথবা এমন চোস্ত ও আঁটসাঁট হয় যার ফলে তার সাহায্যে দৈহিক কাঠামো ও দেহের উঁচু-নীচু অংগ সবই সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে।
# আল্লাহকে বেশী বেশী স্মরণ করার অর্থ হচ্ছে, জীবনের সকল কাজেকর্মে সমস্ত ব্যাপারেই সবসময় যেন মানুষের মুখে আল্লাহর নাম এসে যায়। মানুষের মনে আল্লাহর চিন্তা পুরোপুরি ও সর্বব্যাপী আসন গেঁড়ে না বসা পর্যন্ত এ ধরনের অবস্থা তার মধ্যে সৃষ্টি হয় না। মানুষের চেতনার জগত অতিক্রম করে যখন অচেতন মনের গভীরদেশেও এ চিন্তা বিস্তৃত হয়ে যায় তখনই তার অবস্থা এমন হয় যে, সে কোন কথা বললে বা কোন কাজ করলে তার মধ্যে আল্লাহর নাম অবশ্যই এসে যাবে। আহার করলে “বিসমিল্লাহ” বলে শুরু করবে। আহার শেষ করবে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলে। আল্লাহকে স্মরণ করে ঘুমাবে এবং ঘুম ভাঙবে আল্লাহর নাম নিতে নিতে। কথাবার্তায় তার মুখে বারবার বিসমিল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, ইনশাআল্লাহ, মাশাআল্লাহ এবং এ ধরনের অন্য শব্দ ও বাক্য বারবার উচ্চারিত হতে থাকবে। প্রত্যেক ব্যাপারে বারবার সে আল্লাহর সাহায্য চাইবে। প্রত্যেকটি নিয়ামত লাভ করার পর আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে। প্রত্যেকটি বিপদ আসার পর তাঁর রহমতের প্রত্যাশী হবে। প্রত্যেক সংকটে তাঁর দিকে মুখ ফিরাবে। কোন খারাপ কাজের সুযোগ এলে তাঁকে ভয় করবে। কোন ভুল বা অপরাধ করলে তাঁর কাছে মাফ চাইবে। প্রত্যেকটি প্রয়োজন ও অভাবের মুহূর্তে তাঁর কাছে প্রার্থনা করবে। মোটকথা উঠতে বসতে এবং দুনিয়ার সমস্ত কাজকর্মে আল্লাহর স্মরণ হয়ে থাকবে তার কণ্ঠলগ্ন। এ জিনিসটি আসলে ইসলামী জীবনের প্রাণ। অন্য যে কোন ইবাদাতের জন্য কোন না কোন সময় নির্ধাতির থাকে এবং তখনই তা পালন করা হয়ে থাকে এবং তা পালন করার পর মানুষ তা থেকে আলাদা হয়ে যায়। কিন্তু এ ইবাদাতটি সর্বক্ষণ জারী থাকে এবং এটিই আল্লাহ ও তাঁর বন্দেগীর সাথে মানুষের জীবনের স্থায়ী সম্পর্ক জুড়ে রাখে। মানুষের মন কেবলমাত্র এসব বিশেষ কাজের সময়েই নয় বরং সর্বক্ষণ আল্লাহর প্রতি আকৃষ্ট এবং তার কণ্ঠ সর্বক্ষণ তাঁর স্মরণে সিক্ত থাকলেই এরই মাধ্যমেই ইবাদাত ও অন্যান্য দ্বীনী কাজে প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয়। মানুষের মধ্যে যদি এ অবস্থার সৃষ্টি হয়, তাহলে তার জীবনে ইবাদাতও দ্বীনী কাজ ঠিক তেমনিভাবে বুদ্ধি ও বিকাশ লাভ করে যেমন একটি চারাগাছকে তার প্রকৃতির অনুকূল আবহাওয়ায় রোপণ করা হলে তা বেড়ে উঠে। পক্ষান্তরে যে জীবন আল্লাহর এ সার্বক্ষণিক স্মরণ শূন্য থাকে সেখানে নিছক বিশেষ সময়ে অথবা বিশেষ সুযোগে অনুষ্ঠিত ইবাদাত ও দ্বীনী কাজের দৃষ্টান্ত এমন একটি চারাগাছের মতো যাকে তার প্রকৃতির প্রতিকূল আবহাওয়ায় রোপণ করা হয় এবং নিছক বাগানের মালির বিশেষ তত্ত্বাবধানের কারণে বেঁচে থাকে। একথাটিই নবী ﷺ একটি হাদীসে এভাবে বর্ণনা করেছেনঃ
عَنْ مُعَاذبن انس الجهنى عَنْ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم أَنَّ رَجُلاً سَأَلَهُ اىُّ الْمجاهدِين أَعْظَمُ أَجْراً يَا رسول الله؟ قَالَ أَكْثَرُهُمْ لِلَّهِ تَعَالَى ذِكْراً- قَالَ َأَىُّ الصَّائِمِينَ اكثر أَجْراً؟ قَالَ أَكْثَرُهُمْ لِلَّهِ عز وجل ذِكْراً – ثُمَّ ذَكَرَ الصَّلاَةَ وَالزَّكَاةَ وَالْحَجَّ وَالصَّدَقَةَ كُلُّ ذَلِكَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم أَكْثَرُهُمْ لِلَّهِ ذِكْراً-
“মু’আয ইবনে আনাস জুহানী বর্ণনা করেন, এক ব্যক্তি রসূলুল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করেন, হে আল্লাহর রসূল! জিহাদকারীদের মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রতিদান লাভ করবে কে? জবাব দিলেন, যে তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী আল্লাহকে স্মরণ করবে। তিনি নিবেদন করেন, রোযা পালনকারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী প্রতিদান পাবে কে? জবাব দিলেন, যে তাদের মধ্যে আল্লাহকে সবচেয়ে বেশী স্মরণ করবে। আবার তিনি একই ভাবে নামায, যাকাত, হ্জ্জ ও সাদকা আদায়কারীদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন। জবাবে নবী করীম ﷺ বলেন, “যে আল্লাহকে সবচেয়ে বেশী স্মরণ করে।” (মুসনাদে আহমাদ)
# আল্লাহর দরবারে কোন্ গুণাবলীকে আসল মূল্য ও মর্যাদা দেয়া হয় এ আয়াতে তা বলে দেয়া হয়েছে। এগুলো ইসলামের মৌলিক মূল্যবোধ। একটি বাক্যে এগুলোকে একত্র সংযোজিত করে দেয়া হয়েছে। এ মূল্যবোধগুলোর প্রেক্ষিতে পুরুষ ও নারীর মধ্যে কোন ফারাক নেই। কাজের ভিত্তিতে নিঃসন্দেহে উভয় দলের কর্মক্ষেত্র আলাদা। পুরুষদের জীবনের কিছু বিভাগে কাজ করতে হয়। নারীদের কাজ করতে হয় ভিন্ন কিছু বিভাগে। কিন্তু এ গুণাবলী যদি উভয়ের মধ্যে সমান থাকে তাহলে আল্লাহর কাছে উভয়ের মর্যাদা সমান এবং উভয়ের প্রতিদানও সমান হবে। একজন রান্নঘর ও গৃহস্থালী সামলালো এবং অন্যজন খেলাফতের মসনদে বসে শরীয়তের বিধান জারী করলো আবার একজন গৃহে সন্তান লালন-পালন করলো এবং অন্যজন যুদ্ধের ময়দানে গিয়ে আল্লাহ ও তাঁর দ্বীনের জন্য প্রাণ উৎসর্গ করলে–এ জন্যে উভয়ের মর্যাদা ও প্রতিদানে কোন পার্থক্য দেখা দেবে না।
# হযরত যয়নবের (রা.) সাথে নবী ﷺ এর বিবাহ প্রসঙ্গে যে আয়াত নাযিল হয়েছিল এখান থেকেই তা শুরু হচ্ছে।
# ইবনে আব্বাস (রা.), মুজাহিদ, কাতাদাহ, ইকরামাহ ও মুকাতিল ইবনে হাইয়ান বলেন, এ আয়াত তখন নাযিল হয়েছিল যখন নবী ﷺ হযরত যায়েদের (রা.) জন্য হযরত যয়নবের (রা.) সাথে বিয়ের পয়গাম দিয়েছিলেন এবং হযরত যয়নব ও তাঁর আত্মীয়রা তা নামঞ্জুর করেছিলেন। ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেছেন, নবী ﷺ যখন এ পয়গাম দেন তখন হযরত যয়নব (রা.) বলেনঃ انا خير منه نسبا
“আমি তার চেয়ে উচ্চ বংশীয়া” ইবনে সাদ বর্ণনা করেছেন, তিনি জবাবে একথাও বলেছিলেনঃ لارضاه لنفسى وانا ايم قريش
“আমি অভিজাত কুরাইশ পরিবারের মেয়ে, তাই আমি তাকে নিজের জন্য পছন্দ করি না।” তাঁর ভাই আবদুল্লাহ ইবনে জাহশও (রা.) এ ধরনের অসম্মতি প্রকাশ করেছিলেন। এর কারণ ছিল এই যে, হযরত যায়েদ নবী ﷺ এর আযাদ করা গোলাম ছিলেন এবং হযরত যয়নব ছিলেন তাঁর ফুফু (উমাইমাহ বিনতে আবদুল মুত্তালিব)-এর কন্যা। এত উঁচু ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে, তাও আবার যা তা পরিবার নয়, নবীর নিজের ফুফাত বোন এবং তার বিয়ের পয়গাম তিনি দিচ্ছিলেন নিজের আযাদ করা গোলামের সাথে একথা তাদের কাছে অত্যন্ত খারাপ লাগছিল। এজন্য এ আয়াত নাযিল হয়। এ আয়াত শুনতেই হযরত যয়নব ও তাঁর পরিবারের সবাই নির্দ্বিধায় আনুগত্যের শির নত করেন। এরপর নবী ﷺ তাদের বিয়ে পড়ান। তিনি নিজে হযরত যায়েদের (রা.) পক্ষ থেকে ১০ দ্বীনার ও ৬০ দিরহাম মোহরানা আদায় করেন, কনের কাপড় চোপড় দেন এবং কিছু খাবার দাবারের জিনিসপত্র পাঠান।
এ আয়াত যদিও একটি বিশেষ সময়ে নাযিল হয় কিন্তু এর মধ্যে যে হুকুম বর্ণনা করা হয় তা ইসলামী আইনের একটি বড় মূলনীতি এবং সমগ্র ইসলামী জীবন ব্যবস্থার ওপর এটি প্রযুক্ত হয়। এর দৃষ্টিতে যে বিষয়ে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের পক্ষ থেকে কোন হুকুম প্রমাণিত হয় সে বিষয়ে কোন মুসলিম ব্যক্তি, জাতি, প্রতিষ্ঠান, আদালত, পার্লামেন্ট বা রাষ্ট্রের নিজের মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা ব্যবহার করার কোন অধিকার নেই। মুসলমান হবার অর্থই হচ্ছে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের সামনে নিজের স্বাধীন ইখতিয়ার বিসর্জন দেয়া। কোন ব্যক্তি বা জাতি মুসলমানও হবে আবার নিজের জন্য এ ইখতিয়ারটিও সংরক্ষিত রাখবে। এ দু’টি বিষয় পরস্পর বিরোধী-এ দু’টি কাজ এক সাথে হতে পারে না। কোন বুদ্ধিমান ব্যক্তি এ দু’টি দৃষ্টিভংগীকে একত্র করার ধারণা করতে পারে না। যে ব্যক্তি মুসলমান হিসেবে বেঁচে থাকতে চায় তাকে অবশ্যই আল্লাহ ও তাঁর রসূলের সামনে আনুগত্যের শির নত করতে হবে। আর যে মুসলমান নয়। যদি সে না মানে তাহলে নিজেকে মুসলমান বলে যত জোরে গলা ফটিয়ে চিৎকার করুক না কেন আল্লাহ ও বান্দা উভয়ের দৃষ্টিতে সে মুনাফিকই গণ্য হবে।
# এখান থেকে ৪৮ আয়াত পর্যন্তকার বিষয়বস্তু এমন সময় নাযিল হয় যখন নবী ﷺ হযরত যয়নবকে (রা.) বিয়ে করে ফেলেছিলেন এবং একে ভিত্তি করে মুনাফিক, ইহুদী ও মুশরিকরা রসূলের বিরুদ্ধে তুমূল অপপ্রচার শুরু করে দিয়েছিল। এ আয়াতগুলো অধ্যয়ন করার সময় একটি কথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে। যে শত্রুরা নবী (সঃ) বিরুদ্ধে ইচ্ছা করেই দুর্নাম রটাবার এবং নিজেদের অন্তর্জ্বালা মিটাবার জন্য মিথ্যা, অপবাদ, গালমন্দ ও নিন্দাবাদের অভিযান চালাচ্ছিল তাদেরকে বুঝাবার উদ্দেশ্যে এগুলো বলা হয়নি। বরং এর আসল উদ্দেশ্য ছিল তাদের এ অভিযানের প্রভাব থেকে মুসলমানদেরকে রক্ষ করা এবং ছাড়ানো সন্দেহ-সংশয় থেকে তাদেরকে সংরক্ষিত রাখা। একথা স্পষ্ট, আল্লাহর কালাম অস্বীকারকারীদেরকে নিশ্চিন্ত করতে পারতো না। এ কালাম যদি কাউকে নিশ্চিন্ত করতে পারতো, তাহলে তারা হচ্ছে এমন সব লোক যারা একে আল্লাহর কালাম বলে জানতো এবং সে হিসেবে একে মেনে চলতো। শত্রুদের এসব আপত্তি কোনভাবে তাদের মনেও সন্দেহ-সংশয় এবং তাদের মস্তিষ্কেও জটিলতা ও সংকট সৃষ্টিতে সক্ষম না হয়ে পড়ে, সম্ভাব্য সকল সন্দেহ নিরসন করেছেন অন্যদিকে মুসলমানদেরকেও এবং স্বয়ং নবীকেও ﷺ এ ধরনের অবস্থায় তাদের ভূমিকা কি হওয়া উচিত তা জানিয়ে দিয়েছেন।
# এখানে যায়েদের (রা.) কথা বলা হয়েছে। সামনের দিকে কথাটি সুস্পষ্ট করে প্রকাশ করা হয়েছে। তাঁর প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ কি ছিল এবং নবী ﷺ এর অনুগ্রহ কি ছিল? এ বিষয়টি অনুধাবন করার জন্য এখানে সংক্ষেপে তাঁর কাহিনীটি বর্ণনা করে দেয়া জরুরী মনে করছি। তিনি ছিলেন আসলে কালব গোত্রের হারেসা ইবনে শারাহীল নামক এক ব্যক্তির পুত্র। তাঁর মাতা সু’দা বিনতে সা’লাব ছিলেন তাঈ গোত্রের বনী মা’ন শাখার মেয়ে। তাঁর বয়স যখন আট বছর তখন তাঁর মা তাঁকে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে যান। সেখানে নবী কাইন ইবনে জাসরের লোকেরা তাদের লোকালয় আক্রমণ করে এবং লুটপাট করে যেসব লোককে নিজেদের সাথে পাকড়াও করে নিয়ে যায় তাদের মধ্যে হযরত যায়েদও ছিলেন। তারা তায়েফের নিকটবর্তী উকাযের মেলায় নিয়ে গিয়ে তাঁকে বিক্রি করে দেয়। হযরত খাদীজার (রা.) ভাতিজা হাকিম ইবনে হিযাম তাঁকে কিনে নিয়ে যান। তিনি তাঁকে মক্কায় নিয়ে এসে নিজের ফুফুর খেদমতে উপঢৌকন হিসেবে পেশ করেন। নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে হযরত খাদীজার (রা.) যখন বিয়ে হয় তখন নবী করীম ﷺ তাঁর কাছে যায়েদকে দেখেন এবং তাঁর চালচলন ও আদব কায়দা তাঁর এত বেশী পছন্দ হয়ে যায় যে, তিনি হযরত খাদীজার (রা.) কাছ থেকে তাঁকে চেয়ে নেন। এভাবে এই সৌভাগ্যবান ছেলেটি সৃষ্টির সেরা এমন এক ব্যক্তিত্বের সংস্পর্শে এসে যান যাঁকে কয়েক বছর পরেই মহান আল্লাহ নবীর মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করতে যাচ্ছিলেন। তখন হযরত যায়েদের (রা.) বয়স ছিল ১৫ বছর। কিছুকাল পরে তাঁর বাপ চাচা জানতে পারেন তাদের ছেলে মক্কায় আছে। তারা তাঁর খোঁজ করতে করতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে পৌঁছে যার। তারা বলেন, আপনি মুক্তিপণ হিসেবে যা নিতে চান বলুন আমরা তা আপনাকে দিতে প্রস্তুত আছি, আপনি আমাদের সন্তান আমাদের হাতে ফিরিয়ে দিন। নবী করীম ﷺ বলেন, আমি ছেলেকে ডেকে আনছি এবং তাঁর ইচ্ছার ওপর ছেড়ে দিচ্ছি, সে চাইলে আপনাদের সাথে চলে যেতে পারে এবং চাইলে আমার কাছে থাকতে পারে। যদি সে আপনাদের সাথে চলে যেতে চায় তাহলে আমি এর বিনিময়ে মুক্তি পণ হিসেবে কোন অর্থ নেবো না এবং তাঁকে এমনিই ছেড়ে দেবো। আর যদি সে আমার কাছে থাকতে চায় তাহলে আমি এমন লোক নই যে, কেউ আমার কাছে থাকতে চাইলে আমি তাকে খামখা তাড়িয়ে দেবো। জবাবে তারা বলেন, আপনি যে কথা বলেছেন তাতো ইনসাফেরও অতিরিক্ত। আপনি ছেলেকে ডেকে জিজ্ঞেস করে নিন। নবী করীম ﷺ যায়েদকে ডেকে আনেন এবং তাঁকে বলেন, এই দু’জন ভদ্রলোককে চেনো? যায়েদ জবাব দেন, জি হ্যাঁ, ইনি আমার পিতা এবং ইনি আমার চাচা। তিনি বলেন, আচ্ছা, তুমি এদেরকেও জানো এবং আমাকেও জানো। এখন তোমার পূর্ণ স্বাধীনতা আছে, তুমি চাইলে এদের সাথে চলে যেতে পারো এবং চাইলে আমার সাথে থেকে যাও। তিনি জবাব দেন, আমি আপনাকে ছেড়ে কারো কাছে যেতে চাই না। তার বাপ ও চাচা বলেন, যায়েদ, তুমি কি স্বাধীনতার ওপর দাসত্বকে প্রাধান্য দিচ্ছো এবং নিজের মা-বাপ ও পরিবার পরিজনকে ছেড়ে অন্যদের কাছে থাকতে চাও? তিনি জবাব দেন, আমি এ ব্যক্তির যে গুণাবলী দেখেছি তার অভিজ্ঞতা লাভ করার পর এখন আর দুনিয়ার কাউকেও তাঁর ওপর প্রাধান্য দিতে পারি না। যায়েদের এ জবাব শুনে তার বাপ ও চাচা সন্তুষ্ট চিত্তে তাঁকে রেখে যেতে রাজি হয়ে যান। নবী ﷺ তখনই যায়েদকে আযাদ করে দেন এবং হারাম শরীফে গিয়ে কুরাইশদের সাধারণ সমাবেশে ঘোষণা করেন, আপনারা সবাই সাক্ষী থাকেন আজ থেকে যায়েদ আমার ছেলে, সে আমার উত্তরাধিকারী হবে এবং আমি তাঁর উত্তরাধিকারী হবো। এ কারণে লোকেরা তাঁকে যায়েদ ইবণে মুহাম্মাদ বলতে থাকে। এসব নবুওয়াতের পূর্বের ঘটনা। তারপর যখন নবী (সা.) আল্লাহর পক্ষ থেকে নবুওয়াতের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হন তখন চারজন এমন ছিলেন যারা এক মুহূর্তের জন্যও কোন প্রকার সন্দেহ ছাড়াই তাঁর মুখে নবুওয়াতের দাবী শুনতেই তাকে নবী বলে মেনে নেন। তাদের একজন হযরত খাদীজা (রা.), দ্বিতীয়জন হযরত যায়েদ (রা.), তৃতীয় জন হযরত আলী (রা.) এবং চতুর্থজন হযরত আবু বকর (রা.)। এ সময় হযরত যায়েদের (রা.) বয়স ছিল ৩০ বছর এবং নবী করীমের ﷺ সাথে তাঁর ১৫ বছর অতিবাহিত হয়ে গিয়েছিল। হিজরাতের পরে ৪ হিজরীতে নবী (সা.) নিজের ফুফাত বোনের সাথে তাঁর বিয়ে দিয়ে দেন। নিজের পক্ষ থেকে তার মোহরানা আদায় করেন এবং ঘর-সংসার গুছিয়ে নেবার জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রও দেন।
এ অবস্থার প্রতিই মহান আল্লাহ তাঁর “যার প্রতি আল্লাহ ও তুমি অনুগ্রহ করেছিল” বাক্যাংশের মধ্যে ইশারা করেছেন।
# এটা সে সময়ের কথা যখন হযরত যায়েদ (রা.) ও হযরত যয়নবের (রা.) সম্পর্ক তিক্ততার চরম পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল এবং তিনি বারবার অভিযোগ করার পর শেষ পর্যন্ত নবী (সা.) এর কাছে নিবেদন করেন, আমি তাকে তালাক দিতে চাই। হযরত যয়নব (রা.) যদিও আল্লাহ ও তাঁর রসূলের হুকুম মেনে নিয়ে তাঁকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে যান কিন্তু নিজের মন থেকে এ অনুভূতিটি তিনি কখনো মুছে ফেলতে পারেননি যে, যায়েদ একজন মুক্তিপ্রাপ্ত দাস, তাদের নিজোদের পরিবারের অনুগ্রহে লালিত এবং তিনি নিজে আরবের সবচেয়ে সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে হওয়া সত্ত্বেও এ ধরনের একজন নিম্নমানের লোকের সাথে তার বিয়ে দেয়া হয়েছে। এ অনুভূতির কারণে দাম্পত্য জীবনে তিনি কখনো হযরত যায়েদকে নিজের সমকক্ষ ভাবেননি। এ কারণে উভয়ের মধ্যে তিক্ততা বেড়ে যেতে থাকে। এক বছরের কিছু বেশী দিন অতিবাহিত হতে না হতেই অবস্থা তালাক দেয়া পর্যন্ত পৌঁছে যায়।
# কেউ কেউ এ বাক্যটির উল্টা অর্থ গ্রহণ করেছেন এভাবে, নবী ﷺ নিজেই হযরত যয়নবকে (রা.) বিয়ে করতে ইচ্ছুক ছিলেন এবং তাঁর মন চচ্ছিল হযরত যায়েদ তাকে তালাক দিয়ে দিক। কিন্তু যখন যায়েদ (রা.) এসে বললেন, আমি স্ত্রীকে তালাক দিতে চাই তখন তিনি নাউযুবিল্লাহ আসল কথা মনের মধ্যে চেপে রেখে কেবলমাত্র মুখেই তাঁকে নিষেধ করলেন। একথায় আল্লাহ বলছেন, “তুমি মনের মধ্যে যে কথা লুকিয়ে রাখছিলে আল্লাহ তা প্রকাশ করতে চাচ্ছিলেন।” অথচ আসল ব্যাপারটা এর সম্পূর্ণ উল্টো। যদি এ সূরার ১, ২, ৩ ও ৭ আয়াতের সাথে এ বাক্যটি মিলিয়ে পড়া হয়, তাহলে পরিষ্কার অনুভূত হবে যে, হযরত যায়েদ ও তাঁর স্ত্রীর মধ্যে যে সময় তিক্ততা বেড়ে যাচ্ছিল সে সময়ই আল্লাহ নবী ﷺ কে এ মর্মে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে, যায়েদ যখন তাঁর স্ত্রীকে তালাক দিয়ে দেবে তখন তোমাকে তার তালাক প্রাপ্ত স্ত্রীকে বিয়ে করতে হবে। কিন্তু যেহেতু আরবের সে সমাজে পালকপুত্রের তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীকে বিয়ে করার অর্থ কি তা নবী ﷺ জানতেন এবং তাও এমন এক অবস্থায় যখন মুষ্টিমেয় কিছু সংখ্যক মুসলমান ছাড়া বাকি সমগ্র আরব দেশ তাঁর বিরুদ্ধে ধনুকভাঙাপণ করে বসেছিল-এ অবস্থায় তিনি এ কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হতে ইতস্তত করছিলেন। এ কারণে হযরত যায়েদ (রা.) যখন স্ত্রীকে তালাক দেবার সংকল্প প্রকাশ করেন তখন নবী করীম ﷺ তাঁকে বলেন আল্লাহকে ভয় করো এবং নিজের স্ত্রীকে তালাক দিয়ো না। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল, যায়েদ যদি তালাক না দেন, তাহলে তিনি এ বিপদের মুখোমুখী হওয়া থেকে বেঁচে যাবেন। নয়তো যায়েদ তালাক দিলেই তাঁকে হুকুম পালন করতে হবে এবং তারপর তাঁর বিরুদ্ধে খিস্তি-খেউড় ও অপপ্রচারের ভয়াবহ তুফান সৃষ্টি করা হবে। কিন্তু মহান আল্লাহ তাঁর নবীকে উচ্চ মনোবল, দৃঢ় সংকল্প ও আল্লাহর ফায়সালায় রাজি থাকার যে উচ্চ মর্যাদার আসনে দেখতে চাচ্ছিলেন সে দৃষ্টিতে নবী করীমের ﷺ ইচ্ছা করে যায়েদকে তালাক থেকে বিরত রাখা নিম্নমানের কাজ বিবেচিত হয়। তিনি আসলে ভাবছিলেন যে, এর ফলে তিনি এমন কাজ করা থেকে বেঁচে যাবেন যাতে তাঁর দুর্নামের আশঙ্কা ছিল। অথচ আল্লাহ একটি বড় উদ্দেশ্য সাধনের জন্য তাঁকে দিয়ে সে কাজটি করাতে চাচ্ছিলেন। “তুমি লোকভয় করছ অথচ আল্লাহকে ভয় করাই অধিকতর সঙ্গত”-এ কথাগুলো পরিষ্কারভাবে এ বিষয়বস্তুর দিকে ইঙ্গিত করছে।
# যায়েদ (রা.) যখন নিজের স্ত্রীকে তালাক দিয়ে দিলেন এবং তাঁর ইদ্দত পুরা হয়ে গেলো। “প্রয়োজন পূর্ণ করলো” শব্দ গুলো স্বতঃস্ফূর্তভাবে একথাই প্রকাশ করে যে, তাঁর কাছে যায়েদের আর কোন প্রয়োজন থাকলো না। কেবলমাত্র তালাক দিলেই এ অবস্থাটির সৃষ্টি হয় না। কারণ স্বামীর আর কোন আকর্ষণ থেকে গেলে ইদ্দতের মাঝখানে তাকে ফিরিয়ে নিতে পারে। আর তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীর গর্ভবতী হওয়া বা না হওয়ার কথা জানতে পারার মধ্যেও স্বামীর প্রয়োজন থেকে যায়। তাই যখন ইদ্দত খতম হয়ে যায় একমাত্র তখনই তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীর মধ্যে স্বামীর প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়।
# নবী ﷺ নিজেই নিজের ইচ্ছায় এ বিয়ে করেননি বরং আল্লাহর হুকুমের ভিত্তিতে করেন, এ ব্যাপারে এ শব্দগুলো একবারেই সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন।
# এ শব্দগুলো একথা পরিষ্কারভাবে বর্ণনা করে যে, আল্লাহ এ কাজ নবী ﷺ এর মাধ্যমে এমন একটি প্রয়োজন ও উদ্দেশ্য সম্পাদনের জন্য করিয়েছিলেন যা এ পদ্ধতিতে ছাড়া অন্য কোনভাবে সম্পাদিত হতে পারতো না। আরবে পালক পুত্রদের সম্পর্কিত আত্মীয়তার ব্যাপারে যে সমস্ত ভ্রান্ত রসম-রেওয়াজের প্রচলন হয়ে গিয়েছিল আল্লাহর রসূল নিজে অগ্রসর হয়ে না ভাঙলে সেগুলো ভেঙে ফেলার ও উচ্ছেদ করার আর কোন পথ ছিল না। কাজেই আল্লাহ নিছক নবীর গৃহে আর একজন স্ত্রী বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যে নয় বরং একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য পূর্ণ করার জন্য এ বিয়ে করিয়েছিলেন।
# থেকে একথা পরিষ্কারভবে প্রকাশিত হয় যে, অন্য মুসলমানদের জন্য তো এ ধরনের বিয়ে নিছক মুবাহ তথা অনুমোদিত কাজ কিন্তু নবীর ﷺ জন্য এটি ছিল একটি ফরয এবং এ ফরয আল্লাহ তাঁর প্রতি আরোপ করেছিলেন।
# নবীদের জন্য চিরকাল এ বিধান নির্ধারিত রয়েছে যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে যে হুকুমই আসে তা কার্যকর করা তাঁদের জন্য স্থিরীকৃত কর্তব্য। এ কর্তব্য পালনে বিরত থাকার কোন অবকাশ তাঁদের জন্য নেই। যখন আল্লাহ নিজের নবীর ওপর কোন কাজ ফরয করে দেন তখন সারা দুনিয়া তাঁর বিরোধিতায় উঠে পড়ে লাগলেও তাঁকে সে কাজ করতেই হয়।