أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#১০৫২)
[পরপুরুষের সাথে কোমল কণ্ঠে কথা বলো না:-]
www.motaher21.net
সূরা:- ৩৩:আহযাব
পারা:২২
৩২-৩৪ নং আয়াত:-
৩৩: ৩২
یٰنِسَآءَ النَّبِیِّ لَسۡتُنَّ کَاَحَدٍ مِّنَ النِّسَآءِ اِنِ اتَّقَیۡتُنَّ فَلَا تَخۡضَعۡنَ بِالۡقَوۡلِ فَیَطۡمَعَ الَّذِیۡ فِیۡ قَلۡبِہٖ مَرَضٌ وَّ قُلۡنَ قَوۡلًا مَّعۡرُوۡفًا ﴿ۚ۳۲﴾
হে নবী -পত্নিগণ! তোমরা অন্য নারীদের মত নও; যদি তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর সুতরাং পর-পুরুষের সাথে কমল কন্ঠে এমন ভাবে কথা বলো না, কারণ এতে যার অন্তরে ব্যাধি আছে, সে প্রলুব্ধ হয় এবং তোমরা ন্যায়সংগত কথা বলবে।
৩৩:৩৩
وَ قَرۡنَ فِیۡ بُیُوۡتِکُنَّ وَ لَا تَبَرَّجۡنَ تَبَرُّجَ الۡجَاہِلِیَّۃِ الۡاُوۡلٰی وَ اَقِمۡنَ الصَّلٰوۃَ وَ اٰتِیۡنَ الزَّکٰوۃَ وَ اَطِعۡنَ اللّٰہَ وَ رَسُوۡلَہٗ ؕ اِنَّمَا یُرِیۡدُ اللّٰہُ لِیُذۡہِبَ عَنۡکُمُ الرِّجۡسَ اَہۡلَ الۡبَیۡتِ وَ یُطَہِّرَکُمۡ تَطۡہِیۡرًا ﴿ۚ۳۳﴾
তোমরা নিজ ঘরে অবস্থান করবে এবং প্রাচীন জাহেলী যুগের প্রদর্শনীর মত নিজেদেরকে প্রদর্শন করে বেড়াবে না। আর তোমরা সালাত কায়েম কর, যাকাত প্রদান কর এবং আল্লাহ্ তাঁর রাসূলের অনুগত থাক হে নবী -পরিবার ! আল্লাহ্ তো শুধু চান তোমাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদেরকে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করতে।
৩৩:৩৪
وَ اذۡکُرۡنَ مَا یُتۡلٰی فِیۡ بُیُوۡتِکُنَّ مِنۡ اٰیٰتِ اللّٰہِ وَ الۡحِکۡمَۃِ ؕ اِنَّ اللّٰہَ کَانَ لَطِیۡفًا خَبِیۡرًا ﴿٪۳۴﴾
আল্লাহর আয়াত ও জ্ঞানের যেসব কথা তোমাদের গৃহে শুনানো হয়। তা মনে রেখো। অবশ্যই আল্লাহ সূক্ষ্মদর্শী ও সর্ব অবহিত।
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
# এখান থেকে শেষ প্যারা পর্যন্ত আয়াতগুলোর মাধ্যমে ইসলামে পরদা সংক্রান্ত বিধানের সূচনা করা হয়েছে। এ আয়াতগুলোতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্ত্রীদেরকে সম্বোধন করা হয়েছে। কিন্তু এখানে উদ্দেশ্য হচ্ছে সমস্ত মুসলিম পরিবারে এ সংশোধনীগুলো প্রবর্তন করা। নবীর পবিত্র স্ত্রীগণকে সম্বোধন করার একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে এই যে, যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের গৃহ থেকে এ পবিত্র জীবন ধারার সূচনা হবে তখন অন্যান্য সকল মুসলিম গৃহের মহিলারা আপনা আপনিই এর অনুসরণ করতে থাকবে। কারণ এ গৃহটিই তাদের জন্য আদর্শ ছিল। এ আয়াতগুলোতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্ত্রীদেরকে সম্বোধন করা হয়েছে কেবলমাত্র এরই ভিত্তিতে কেউ কেউ দাবী করে বসেছেন যে, এ বিধানগুলো কেবলমাত্র তাঁদের সাথেই সংশ্লিষ্ট। কিন্তু সামনের দিকে এ আয়াতগুলোতে যা কিছু বলা হয়েছে তা পাঠ করে দেখুন। এর মধ্যে কোন্ টি এমন যা শুধুমাত্র নবীর ﷺ পবিত্র স্ত্রীদের সাথে সংশ্লিষ্ট এবং বাকি মুসলমান নারীদের জন্য কাংখিত নয়? কেবলমাত্র নবীর স্ত্রীগণই আবর্জনামুক্ত নিষ্কলুষ জীবন যাপন করবেন, তাঁরাই আল্লাহ ও রসূলের আনুগত্য করবেন, নামায তাঁরাই পড়বেন এবং যাকাত তাঁরাই দেবেন, আল্লাহর উদ্দেশ্য কি এটাই হতে পারতো? যদি এ উদ্দেশ্য হওয়া সম্ভব না হতো, তাহলে গৃহকোণে নিশ্চিন্তে বসে থাকা, জাহেলী সাজসজ্জা থেকে দূরে থাকা এবং ভিন্ন পুরুষদের সাথে মৃদুস্বরে কথা বলার হুকুম একমাত্র তাদের সাথে সংশ্লিষ্ট এবং অন্যান্য সমস্ত মুসলিম নারীরা তা থেকে আলাদা হতে পারে কেমন করে? একই কথার ধারাবাহিকতায় বিধৃত সামগ্রিক বিধানের মধ্য থেকে কিছু বিধিকে বিশেষ শ্রেণীর মানুষের জন্য নির্দিষ্ট ও কিছু বিধিকে সর্বসাধারণের পালনীয় গণ্য করার পেছনে কোন ন্যায়সঙ্গত যুক্তি আছে কি? আর “তোমরা সাধারণ নারীদের মতো নও” এ বাক্যটি থেকেও এ অর্থ বুঝায় না যে, সাধারণ নারীদের সাজসজ্জা করে বাইরে বের হওয়া এবং ভিন্ন পুরুষদের সাথে খুব ঢলাঢলি করে কথাবার্তা বলা উচিত। বরং এ কথাটা কিছুটা এমনি ধরনের যেমন এক ভদ্রলোক নিজের সন্তানদেরকে বলে, “তোমরা বাজারের ছেলেমেয়েদের মত নও। তোমাদের গালাগালি না করা উচিত।” এ থেকে কোন বুদ্ধিমান ব্যক্তি ও বক্তা এ উদ্দেশ্য আবিষ্কার করবে না যে, সে কেবলমাত্র নিজের ছেলেমেয়েদের জন্য গালি দেয়াকে খারাপ মনে করে, অন্য ছেলেমেয়েদের মধ্যে এ দোষ থাকলে তাতে তার কোন আপত্তি নেই।
# প্রয়োজন হলে কোন পুরুষের সাথে কথা বলতে বাধা নেই কিন্তু এ সময় নারীর কথা বলার ভংগী ও ধরন এমন হতে হবে যাতে আলাপকারী পুরুষের মনে কখনো এ ধরনের কোন চিন্তার উদয় না হয় যে, এ নারীটির ব্যাপারে অন্য কিছু আশা করা যেতে পারে। তার বলার ভংগীতে কোন নমনীয়তা থাকবে না। তার কথায় কোন মনমাতানো ভাব থাকবে না। সে সজ্ঞানে তার স্বরে মাধুর্য সৃষ্টি করবে না, যা শ্রবণকারী পুরুষের আবেগকে উদ্বেলিত করে তাকে সামনে পা বাড়াবার প্ররোচনা দেবে ও সাহস যোগাবে। এ ধরনের কথাবার্তা সম্পর্কে আল্লাহ পরিষ্কার বলেন, এমন কোন নারীর পক্ষে এটা শোভনীয় নয়, যার মনে আল্লাহ ভীতি ও অসৎকাজ থেকে দূরে থাকার প্রবণতা রয়েছে। অন্যকথায় বলা যায়, এটা দুশ্চরিত্রা ও বেহায়া নারীদের কথা বলার ধরন, মু’মিন ও মুত্তাকী নারীদের নয়। এই সাথে সূরা নূরের নিম্নোক্ত আয়াতটিও সামনে রাখা দরকার وَلَا يَضْرِبْنَ بِأَرْجُلِهِنَّ لِيُعْلَمَ مَا يُخْفِينَ مِنْ زِينَتِهِنَّ (আর তারা যেন যমীনের ওপর এমনভাবে পদাঘাত করে না চলে যার ফলে যে সৌন্দর্য তারা লুকিয়ে রেখেছে তা লোকদের গোচরীভূত হয়।) এ থেকে মনে হয় বিশ্ব-জাহানের রবের পরিষ্কার উদ্দেশ্য হচ্ছে এই যে, নারীরা যেন অযথা নিজেদের স্বর ও অলংকারের ধ্বনি অন্য পুরুষদেরকে না শোনায় এবং যদি প্রয়োজনে অপরিচিতদের সাথে কথা বলতে হয়, তাহলে পূর্ণ সতর্কতা সহকারে বলতে হবে। এজন্য নারীদের আযান দেয়া নিষেধ। তাছাড়া জামায়াতের নামাযে যদি কোন নারী হাজির থাকে এবং ইমাম কোন ভুল করেন তাহলে পুরুষের মতো তার সুবহানাল্লাহ বলার অনুমতি নেই, তার কেবলমাত্র হাতের ওপর হাত মেরে আওয়াজ সৃষ্টি করতে হবে যাতে ইমাম সতর্ক হয়ে যান।
এখন চিন্তার বিষয় হচ্ছে যে, দ্বীন নারীকে ভিন্ পুরুষের সাথে কোমল স্বরে কথা বলার অনুমতি দেয় না এবং পুরুষদের সাথে অপ্রয়োজনে কথা বলতেও তাদেরকে নিষেধ করে, সে কি কখনো নারীর মঞ্চে এসে নাচগান করা, বাজনা বাজানো ও রঙ্গরস করা পছন্দ করতে পারে? সে কি রেডিও-টেলিভিশনে নারীদের প্রেমের গান গেয়ে এবং সুমিষ্ট স্বরে অশ্লিল রচনা শুনিয়ে লোকদের আবেগকে উত্তেজিত করার অনুমতি দিতে পারে? নারীরা নাটকে কখনো কারো স্ত্রীর এবং কখনো কারো প্রেমিকার অভিনয় করবে, এটাকে কি সে বৈধ করতে পারে? অথবা তাদেরকে বিমানবালা (Air-hostess) করা হবে এবং বিশষভাবে যাত্রীদের মন ভোলাবার প্রশিক্ষণ দেয়া হবে, কিংবা ক্লাবে, সামাজিক উৎসবে ও নারী-পুরুষের মিশ্র অনুষ্ঠানে তারা চমকপ্রদ সাজ-সজ্জা করে আসবে এবং পুরুষদের সাথে অবাধে মিলেমিশে কথাবার্তা ও ঠাট্টা-তামাসা করবে, এসবকে কি সে বৈধ বলবে? এ সংস্কৃতি উদ্ভাবন করা হয়েছে কোন্ কুরআন থেকে? আল্লাহর নাযিল করা কুরআন তো সবার সামনে আছে। সেখানে কোথাও যদি এ সংস্কৃতির অবকাশ দেখা যায় তাহলে সেখানটা চিহ্নিত করা হোক।
# মূলে বলা হয়েছে قَرْنَ কোন কোন অভিধানবিদ একে قرار শব্দ থেকে গৃহীত বলে মত প্রকাশ করেন আবার কেউ কেউ বলেন وقار থেকে গৃহীত। যদি এটি قرار থেকে উদ্ভূত হয়, তাহলে এর অর্থ হবে “স্থিতিবান হও” “টিকে থাকো।” আর যদি وقار থেকে উদ্ভূত হয়, তাহলে অর্থ হবে “শান্তিতে থাকো।”, “নিশ্চিন্তে ও স্থির হয়ে বসে উভয় অবস্থায় আয়াতের অর্থ দাঁড়ায়, নারীর আসল কর্মক্ষেত্র হচ্ছে তার গৃহ। এ বৃত্তের মধ্যে অবস্থান করে তাকে নিশ্চিন্তে নিজের দায়িত্ব সম্পাদন করে যেতে হবে। কেবলমাত্র প্রয়োজনের ক্ষেত্রে সে গৃহের বাইরে বের হতে পারে। আয়াতের শব্দাবলী থেকেও এ অর্থ প্রকাশ হচ্ছে এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীস একে আরো বেশী সুস্পষ্ট করে দেয়। হাফেয আবু বকর বায্যার হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণনা করেছেনঃ নারীরা নবী করীমের ﷺ কাছে নিবেদন করলো যে, পুরুষরা তো সকল শ্রেষ্ঠ মর্যাদা লুটে নিয়ে গেলো। তারা জিহাদ করে এবং আল্লাহর পথে বড় বড় কাজ করে। মুজাহিদদের সমান প্রতিদান পাবার জন্য আমরা কি কাজ করবো? জবাবে বললেনঃ
مَنْ قَعَدَةْ مِنْكُنَّ فِى بَيْتِهَا فَاِنَّهَا تَدْرِكَ عَمَلَ الْمُجَاهِدِيْن-
“তোমাদের মধ্য থেকে যে গৃহমধ্যে বসে যাবে সে মুজাহিদদের মর্যাদা লাভ করবে।” অর্থাৎ মুজাহিদ তো তখনই স্থিরচিত্তে আল্লাহ পথে লড়াই করতে পারবে যখন নিজের ঘরের দিক থেকে সে পূর্ণ নিশ্চিন্ত থাকতে পারবে, তার স্ত্রী তার গৃহস্থালী ও সন্তানদেরকে আগলে রাখবে এবং তার অবর্তমানে তার স্ত্রী কোন অঘটন ঘটাবে না, এ ব্যাপারে সে পুরোপুরি আশঙ্কামুক্ত থাকবে। যে স্ত্রী তার স্বামীকে এ নিশ্চিন্ততা দান করবে সে ঘরে বসেও তার জিহাদে পুরোপুরি অংশীদার হবে। অন্য একটি হাদীস বায্যার ও তিরমিযী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে উদ্ধৃত করেছেন। তাতে তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ উক্তি বর্ণনা করেছেনঃ
ان الْمَرْأَةُ عَوْرَةٌ فَإِذَا خَرَجَتِ اسْتَشْرَفَهَا الشَّيْطَانُ وَاَقْرَبَ مَا تَكُوْنُ بِرَوْحَةٍ رَبِّهَا وَهِى فِى قَعْرِ بَيْتِهَا-
“নারী পর্দাবৃত থাকার জিনিস। যখন সে বের হয় শয়তান তার প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখে এবং তখনই সে আল্লাহর রহমতের নিকটতর হয় যখন সে নিজের গৃহে অবস্থান করে।” (আরো বেশী ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফসীর সূরা নূর ৪৯ টীকা)
কুরআন মজীদের এ পরিষ্কার ও সুস্পষ্ট হুকুমের উপস্থিতিতে মুসলমান নারীদের জন্য অবকাশ কোথায় কাউন্সিল ও পার্লামেন্টে সদস্য হবার, ঘরের বাইরে সামাজিক কাজকর্মে দৌঁড়াদৌঁড়ি করার, সরকারী অফিসে পুরুষদের সাথে কাজ করা, কলেজে ছেলেদের সাথে শিক্ষালাভ করার, পুরুষদের হাসপাতলে নার্সিংয়ের দায়িত্ব সম্পাদন করার, বিমানে ও রেলগাড়িতে যাত্রীদের সেবা করার দায়িত্বে নিয়োজিত হবার এবং শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ লাভের জন্য তাদেরকে আমেরিকায় ও ইংল্যাণ্ড পাঠাবার? নারীদের ঘরের বাইরে গিয়ে কাজ করার বৈধতার সপক্ষে সবচেয়ে যে যুক্তি পেশ করা হয় সেটি হচ্ছে এই যে, হযরত আয়েশা (রা.) উষ্ট্র যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু এ যুক্তি যারা পেশ করেন তারা সম্ভবত এ ব্যাপারে স্বয়ং হযরত আয়েশার কি চিন্তা ছিল তা জানেন না। আবদুল্লাহ ইবনে আহমাদ ইবনে হাম্বল যাওয়ায়েদুয যাহদ এবং ইবনুল মুনযির, ইবনে আবী শাইবাহ ও ইবনে সা’দ তাঁদের কিতাবে মাসরূক থেকে হাদীস উদ্ধৃত করেছেন। তাতে বলা হয়েছে, হযরত আয়েশা (রা.) যখন কুরআন তেলাওয়াত করতে করতে এ আয়াতে পৌঁছতেন (وَقَرْنَ فِي بُيُوتِكُنَّ) তখন স্বতঃস্ফূর্তভাবে কেঁদে ফেলতেন, এমনকি তাঁর উড়না ভিজে যেতো। করণ এ প্রসঙ্গে উষ্ট্র যুদ্ধে গিয়ে তিনি যে ভুল করেছিলেন সে কথা তাঁর মনে পড়ে যেতো।
# এ আয়াতে দু’টি গুরুত্বপূর্ণ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। আয়াতের অর্থ অনুধাবন করার জন্য এ দু’টি বুঝে নেয়া জরুরী। এর একটি হচ্ছে “তাবাররুজ” এবং দ্বিতীয়টি “জাহেলিয়াত।” আরবী ভাষায় ‘তাবাররুজ” মানে হচ্ছে উন্মুক্ত হওয়া, প্রকাশ হওয়া এবং সুস্পষ্ট হয়ে সামনে এসে যাওয়া। দূর থেকে দেখা যায় এমন প্রত্যেক উঁচু ভবনকে আরবরা “বুরুজ” বলে থাকে। দুর্গ বা প্রাসাদের বাইরের অংশের উচ্চ কক্ষকে এ জন্যই বুরুজ বলা হয়ে থাকে। পালতোলা নৌকার পাল দূর থেকে দেখা যায় বলে তাকে “বারজা” বলা হয়, নারীর জন্য তাবাররুজ শব্দ ব্যবহার করা হলে তার তিনটি অর্থ হবে। এক, সে তার চেহারা ও দেহের সৌন্দর্য লোকদের দেখায়। দুই, সে তার পোশাক ও অলংকারের বহর লোকদের সামনে উন্মুক্ত করে। তিন, সে তার চাল-চলন ও চমক-ঠমকের মাধ্যমে নিজেকে অন্যদের সামনে তুলে ধরে। অভিধান ও তাফসীর বিশারদগণ এ শব্দটির এ ব্যাখ্যাই করেছেন। মুজাহিদ, কাতাদাহ ও ইবনে আবি নুজাইহ বলেন, التبرج المشى بتبخر وتكسر وتغنج- “তাবাররুজের অর্থ হচ্ছে, গর্ব ও মনোরম অংগভংগী সহকারে হেলেদুলে ও সাড়ম্বরে চলা।” মুকাতিল বলেন, ابداء قلائدها وقرطها وعنقها “নিজের হার, ঘাড় ও গলা সুস্পষ্ট করা।” আল মুবাররাদের উক্তি হচ্ছেঃ ان تبدى من مناسنها مايجب عليها ستره “নারীর এমন গুণাবলী প্রকাশ করা যেগুলো তার গোপন রাখা উচিত।” আবু উবাইদাহর ব্যাখ্যা হচ্ছেঃ ان تخرج من محاسنها ماتستدهى به شهوة الرجال “নারীর শরীর ও পোশাকের সৌন্দর্য এমনভাবে উন্মুক্ত করা যার ফলে পুরুষেরা তার প্রতি আকৃষ্ট হয়।” জাহেলিয়াত শব্দটি কুরআন মজিদের এ জায়গা ছাড়াও আরো তিন জায়গায় ব্যবহার করা হয়েছে।
এক, আলে ইমরানের ১৫৪ আয়াত । সেখানে আল্লাহর পথে যুদ্ধ করার ক্ষেত্রে যারা গা বাঁচিয়ে চলে তাদের সম্পর্কে বলা হয়েছে, তারা “আল্লাহ সম্পর্কে সত্যের বিরুদ্ধে জাহেলিয়াতের মতো ধারণা পোষণ করে।”
দুই, সূরা মা-য়েদাহর ৫০ আয়াতে । সেখানে আল্লাহর আইনের পরিবর্তে অন্য কারোর আইন অনুযায়ী ফায়সালাকারীদের সম্পর্কে বলা হয়েছে, “তারা কি জাহেলিয়াতের ফায়সালা চায়? ”
তিন, সূরা ফাতহের ২৬ আয়াতে সেখানে মক্কার কাফেররা নিছক বিদ্বেষ বশত মুসলমানদের উমরাহ করতে দেয়নি বলে তাদের এ কাজকেও “জাহেলী স্বার্থান্ধতা ও জিদ” বলা হয়েছে।
হাদীসে বলা হয়েছে, একবার হযরত আবু দারদা করো সাথে ঝগড়ায় লিপ্ত হয়ে তার মাকে গালি দেন। রসূলুল্লাহ ﷺ তা শুনে বলেন, “তোমার মধ্যে এখনো জাহেলিয়াত রয়ে গেছে।” অন্য একটি হাদীসে রসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, “তিনটি কাজ জাহেলিয়াতের অন্তর্ভুক্ত। অন্যের বংশের খোটা দেয়া, নক্ষত্রের আবর্তন থেকে ভাগ্য নির্ণয় করা এবং মৃতদের জন্য সুর করে কান্নাকাটি করা।” শব্দটির এ সমস্ত প্রয়োগ থেকে একথা সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, জাহেলিয়াত বলতে ইসলামী পরিভাষায় এমন প্রত্যেকটি কার্যধারা বুঝায় যা ইসলামী কৃষ্টি ও সংস্কৃতি, ইসলামী শিষ্টাচার ও নৈতিকতা এবং ইসলামী মানসিকতার বিরোধী। আর প্রথম যুগের জাহেলিয়াত বলতে এমন অসৎকর্ম বুঝায় যার মধ্যে প্রাগৈসলামিক আরবরা এবং দুনিয়ার অন্যান্য সমস্ত লোকেরা লিপ্ত ছিল।
এ ব্যাখ্যা থেকে একথা সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, আল্লাহ নারীদেরকে যে কার্যধারা থেকে বিরত রাখতে চান তা হচ্ছে, তাদের নিজেদের সৌন্দর্যের প্রদর্শনী করে গৃহ থেকে বের হওয়া। তিনি তাদের আদেশ দেন, নিজেদের গৃহে অবস্থান করো। কারণ, তোমাদের আসল কাজ রয়েছে গৃহে, বাইরে নয়। কিন্তু যদি বাইরে বের হবার প্রয়োজন হয়, তাহলে এমনভাবে বের হয়ো না যেমন জাহেলী যুগে নারীরা বের হতো। প্রসাধন ও সাজ-সজ্জা করে, সুশোভন অলংকার ও আঁটসাঁট বা হালকা মিহিন পোষাকে সজ্জিত হয়ে চেহারা ও দেহের সৌন্দর্যকে উন্মুক্ত করে এবং গর্ব ও আড়ম্বরের সাথে চলা কোন মুসলিম সমাজের নারীদের কাজ নয়। এগুলো জাহেলিয়াতের রীতিনীতি। ইসলামে এসব চলতে পারে না। এখন প্রত্যেক ব্যক্তি নিজেই দেখতে পারেন আমাদের দেশে যে সংস্কৃতির প্রচলন করা হচ্ছে তা কুরআনের দৃষ্টিতে ইসলামের সংস্কৃতি না জাহেলিয়াতের সংস্কৃতি? তবে হ্যাঁ, আমদের কর্মকর্তাদের কাছে যদি অন্য কোন কুরআন এসে গিয়ে থাকে, যা থেকে ইসলামের এ নতুন তত্ত্ব ও ধ্যান-ধারণা বের করে তারা মুসলমানদের মধ্যে ছড়াচ্ছেন, তাহলে অবশ্য ভিন্ন কথা।
# যে প্রেক্ষাপটে এ আয়াত নাযিল হয়েছে তা থেকে সুস্পষ্টভাবে জনা যায় যে, এখানে আহলে বায়েত বা নবী পরিবার বলতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্ত্রীদেরকে বুঝানো হয়েছে। কারণ সম্বোধনের সূচনা করা হয়েছে “হে নবীর স্ত্রীগণ!” বলে এবং সামনের ও পিছনের পুরো ভাষণ তাদেরকে সম্বোধন করেই ব্যক্ত হয়েছে। এছাড়াও যে অর্থে আমরা “পরিবারবর্গ” শব্দটি বলি এ অর্থে একজন লোকের স্ত্রী ও সন্তানরা সবাই এর অন্তর্ভুক্ত হয় ঠিক সেই একই অর্থে আরবী ভাষায় “আহলুল বায়েত” শব্দটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। স্ত্রীকে বাদ দিয়ে “পরিবারবর্গ” শব্দটি কেউ ব্যবহার করে না। খোদ কুরআন মজীদেও এ জায়গা ছাড়াও আরো দু’জায়গায় এ শব্দটি এসেছে এবং সে দু’জায়গায়ও তার অর্থের মধ্যে স্ত্রী অন্তর্ভুক্তই শুধু নয়, অগ্রবর্তীও রয়েছে। সূরা হূদে যখন ফেরেশতারা হযরত ইবরাহীমকে (আ) পুত্র সন্তান লাভের সুসংবাদ দেন তখন তাঁর স্ত্রী তা শুনে বিস্ময় প্রকাশ করেন এই বলে যে, এ বুড়ো বয়সে আমাদের আবার ছেলে হবে কেমন করে! একথায় ফেরেশতারা বলেনঃ
أَتَعْجَبِينَ مِنْ أَمْرِ اللَّهِ رَحْمَتُ اللَّهِ وَبَرَكَاتُهُ عَلَيْكُمْ أَهْلَ الْبَيْتِ
“তোমরা কি আল্লাহর কাজে অবাক হচ্ছো? হে এ পরিবারের লোকেরা! তোমাদের প্রতি তো আল্লাহর রহমত ও তাঁর বরকত রয়েছে।”
সূরা কাসাসে যখন হযরত মূসা (আ) একটি দুগ্ধপোষ্য শিশু হিসেবে ফেরাউনের গৃহে পৌঁছে যান এবং ফেরাউনের স্ত্রী এমন কোন ধাত্রীর সন্ধান করতে থাকেন যার দুধ এ শিশু পান করবে তখন হযরত মূসার বোন গিয়ে বলেনঃ
هَلْ أَدُلُّكُمْ عَلَى أَهْلِ بَيْتٍ يَكْفُلُونَهُ لَكُم
“আমি কি তোমাদের এমন পরিবারের খবর দেবো যারা তোমাদের জন্য এ শিশুর লালন-পালনের দায়িত্ব নেবেন?” কাজেই ভাষার প্রচলিত কথ্যরীতি, কুরআনের বর্ণনাভংগী এবং খোদ এ আয়াতটির পূর্বাপর আলোচ্য বিষয় সবকিছুই চূড়ান্তভাবে প্রমাণ করে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আহলি বায়েতের মধ্যে তাঁর পবিত্র স্ত্রীগণও আছেন এবং তাঁর সন্তানরাও আছেন। বরং বেশী নির্ভুল কথা হচ্ছে এই যে, আয়াতে মূলত সম্বোধন করা হয়েছে তাঁর স্ত্রীগণকেই এবং সন্তানরা এর অন্তর্ভুক্ত গণ্য হয়েছেন শব্দের অর্থের প্রেক্ষিতে। এ কারণে ইবনে আব্বাস (রা.), উরওয়া ইবনে যুবাইর (রা.) এবং ইকরামাহ বলেন, এ আয়াতে আহলে বায়েত বলতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্ত্রীদেরকেই বুঝানো হয়েছে।
কিন্তু কেউ যদি বলেন, ‘আহলুল বায়েত” শব্দ শুধুমাত্র স্ত্রীদের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে, অন্য কেউ এর মধ্যে প্রবেশ করতে পারে না, তাহলে একথাও ভুল হবে। “পরিবারবর্গ” শব্দের মধ্যে মানুষের সকল সন্তান-সন্ততি কেবল শামিল হয় তাই নয় বরং নবী ﷺ নিজে সুস্পষ্টভাবে তাদের শামিল হবার কথা বলেছেন। ইবনে আবি হাতেম বর্ণনা করেছেন, হযরত আয়েশাকে (রা.) একবার হযরত আলী (রা.) সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়। জবাবে তিনি বলেনঃ
تَسْأَلُنِىْ عَنْ رَجُلٍ كَانَ مِنْ اَحَبَّ النَّاسِ اِلَى رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَكَانَتْ تَحْتَهُ ابْنَتَهُ وَاَحَبُّ النَّاسِ اِلَيْهِ-
“তুমি আমাকে এমন ব্যক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছো যিনি ছিলেন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রিয়তম লোকদের অন্তর্ভুক্ত এবং যার স্ত্রী ছিলেন রসূলের এমন মেয়ে যাকে তিনি মানুষদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী ভালোবাসতেন।” তারপর হযরত আয়েশা (রা.) এ ঘটনা শুনানঃ নবী করীম ﷺ হযরত আলী ও ফাতেমা এবং হাসান ও হোসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুমকে ডাকলেন এবং তাঁদের উপর একটা কাপড় ছড়িয়ে দিলেন এবং দোয়া করলেনঃ
اللَّهُمَّ هَؤُلاَءِ أَهْلُ بَيْتِى فَأَذْهِبْ عَنْهُمُ الرِّجْسَ وَطَهِّرْهُمْ تَطْهِيرًا
“হে আল্লাহ এরা আমার আহলে বায়েত (পরিবারবর্গ), এদের থেকে নাপাকি দূর করে দাও এবং এদেরকে পাক-পবিত্র করে দাও।”
হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, আমি নিবেদন করলাম, আমিও তো আপনার আহলে বায়েতের অন্তর্ভুক্ত (অর্থাৎ আমাকেও এ কাপড়ের নীচে নিয়ে আমার জন্যও দোয়া করুন) নবী করীম ﷺ বলেন, “তুমি আলাদা থাকো, তুমি তো অন্তর্ভুক্ত আছোই।” প্রায় একই ধরনের বক্তব্য সম্বলিত বহু সংখ্যক হাদীস মুসলিম, তিরমিযী, আহমাদ, ইবনে জারীর, হাকেম, বায়হাকি প্রমুখ মুহাদ্দিসগণ আবু সাঈদ খুদরী (রা.), হযরত আয়েশা (রা.), হযরত আনাস (রা.), হযরত উম্মে সালামাহ (রা.), হযরত ওয়াসিলাহ ইবন আসকা’ এবং অন্যান্য কতিপয় সাহাবা থেকে বর্ণনা করেছেন। সেগুলো থেকে জানা যায়, নবী ﷺ হযরত আলী (রা.), ফাতেমা (রা.) এবং তাদের দু’টি সন্তানকে নিজের আহলে বায়েত গণ্য করেন। কাজেই যাঁরা তাঁদেরকে আহলে বায়েতের বাইরে মনে করেন তাদের চিন্তা ভুল।
অনুরূপভাবে যার উপরোক্ত হাদীসগুলোর ভিত্তিতে রসূলের পবিত্র স্ত্রীগণকে আহলে বায়েতের বাইরে গণ্য করেন তাদের মতও সঠিক নয়। প্রথমত যে বিষয়টি সরাসরি কুরআন থেকে প্রমাণিত, তাকে কোন হাদীসের ভিত্তিতে প্রত্যাখ্যান করা যেতে পারে না। দ্বিতীয়ত সংশ্লিষ্ট হাদীসগুলোর অর্থও তা নয় যা সেগুলো থেকে গ্রহণ করা হচ্ছে। এগুলোর কোন কোনটিতে এই যে কথা এসেছে যে, হযরত আয়েশা (রা.) ও হযরত উম্মে সালামাকে (রা.) নবী ﷺ সেই চাদরের নীচে নেননি যার মধ্যে হযরত আলী, ফতেমা, হাসান ও হোসাইনকে নিয়েছিলেন, এর অর্থ এ নয় যে, তিনি তাঁদেরকে নিজের “পরিবারের” বাইরে গণ্য করেছিলেন। বরং এর অর্থ হচ্ছে, স্ত্রীগণ তো পরিবারের অন্তর্গত ছিলেনই। কারণ কুরআন তাঁদেরকেই সম্বোধন করেছিল। কিন্তু নবী করীমের ﷺআশঙ্কা হলো, এ চারজন সম্পর্কে কুরআনের বাহ্যিক অর্থের দিক দিয়ে কারো যেন ভুল ধারণা না হয়ে যায় যে, তাঁরা আহলে বায়েতের বাইরে আছেন, তাই তিনি পবিত্র স্ত্রীগণের পক্ষে নয়, তাঁদের পক্ষে ব্যাপারটি সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ করার প্রয়োজন অনুভব করেন।
একটি দল এ আয়াতের ব্যাখ্যায় শুধুমাত্র এতটুকু বাড়াবাড়ি করেই ক্ষান্ত থাকেননি যে, পবিত্র স্ত্রীগণকে আহলে বায়েত থেকে বের করে দিয়ে কেবলমাত্র হযরত আলী (রা.), ফাতেমা (রা.) ও তাঁদের দু’টি সন্তানকে এর মধ্যে শামিল করেছেন বরং এর ওপর এভাবে আরো বাড়াবাড়ি করেছেন যে, “আল্লাহ তো চান তোমাদের থেকে ময়লা দূর করে তোমাদের কে পুরোপুরি পবিত্র করে দিতে” কুরআনের এ শব্দগুলো থেকে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, হযরত আলী, ফাতেমা এবং তাঁদের সন্তান-সন্ততি আম্বিয়া আলাইহিমুস সালামগণের মতোই মাসূম তথা গোনাহমুক্ত নিষ্পাপ। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, “ময়লা” অর্থ ভ্রান্তি ও গোনাহ এবং আল্লাহর উক্তি অনুযায়ী আহলে বায়েতকে এগুলো থেকে মুক্ত করে দেয়া হয়েছে। অথচ আয়াতে একথা বলা হয়নি যে, তোমাদের থেকে ময়লা দূর করে দেয়া হয়েছে এবং তোমাদেরকে পাক-পবিত্র করা হয়েছে। বরং বলা হয়েছে, আল্লাহ তোমাদের থেকে ময়লা দূর করতে এবং তোমাদের পুরোপুরি পাক পবিত্র করতে চান। পূর্বাপর আলোচনাও এখানে আহলে বায়েতের মর্যাদা বর্ণনা করাই উদ্দেশ্য একথা বলে না। বরং এখানে তো আহলে বায়েতকে এ মর্মে নসিহত করা হয়েছে, তোমরা অমুক কাজ করো এবং অমুক কাজ করো না কারণ আল্লাহ তোমাদের পাক পবিত্র করতে চান। অন্য কথায় এর অর্থ হচ্ছে, তোমরা অমুক নীতি অবলম্বন করলে পবিত্রতার নিয়ামতে সমৃদ্ধ হবে অন্যথায় তা লাভ করতে পারবে না। তবুও যদি يُرِيدُ اللَّهُ لِيُذْهِبَ عَنْكُمُ الرِّجْسَ ……………….. وَيُطَهِّرَكُمْ تَطْهِيرًا এর অর্থ এ নেয়া হয় যে, আল্লাহ তাঁদেরকে নিষ্পাপ করে দিয়েছেন, তাহলে অযু, গোসল ও তায়াম্মুমকারী প্রত্যেক মুসলমানকে নিষ্পাপ বলে মেনে না নেয়ার কোন কারণ নেই। কারণ তাদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেছেনঃ
وَلَكِنْ يُرِيدُ لِيُطَهِّرَكُمْ وَلِيُتِمَّ نِعْمَتَهُ عَلَيْكُمْ
“কিন্তু আল্লাহ চান তোমাদেরকে পাক-পবিত্র করে দিতে এবং তাঁর নিয়ামত তোমাদের উপর পূর্ণ করে দিতে।” (আল মা-য়েদাহ, ৬)
# মূলে وَاذْكُرْنَ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এর দু’টি অর্থঃ “মনে রেখো” এবং বর্ণনা করো। প্রথম অর্থের দৃষ্টিতে এর তাৎপর্য এই দাঁড়ায়ঃ হে নবীর স্ত্রীগণ! তোমরা কখনো ভুলে যেয়ো না যে, যেখান থেকে সারা দুনিয়াকে আল্লাহর আয়াত, জ্ঞান ও প্রজ্ঞার শিক্ষা দেয়া হয় সেটিই তোমাদের আসল গৃহ। তাই তোমাদের দায়িত্ব বড়ই কঠিন। লোকেরা এ গৃহে জাহিলিয়াতের আদর্শ দেখতে থাকে, এমন যেন না হয়। দ্বিতীয় অর্থটির দৃষ্টিতে এর তাৎপর্য হয়ঃ হে নবীর স্ত্রীগণ! তোমরা যা কিছু শোনো এবং দেখো তা লোকদের সামনে বর্ণনা করতে থাকো। কারণ রসূলের সাথে সার্বক্ষণিক অবস্থানের কারণে এমন অনেক বিধান তোমাদের গোচরীভূত হবে যা তোমাদের ছাড়া অন্য কোন মাধ্যমে লোকদের জানা সম্ভব হবে না।
এ আয়াতে দু’টি জিনিসের কথা বলা হয়েছে। এক, আল্লাহর আয়াত, দুই, হিকমাত বা জ্ঞান ও প্রজ্ঞা। আল্লাহর আয়াত অর্থ হচ্ছে, আল্লাহর কিতাবের আয়াত। কিন্তু হিকমাত শব্দটি অত্যন্ত ব্যাপক অর্থবোধক। সকল প্রকার জ্ঞানের কথা এর অন্তর্ভুক্ত, যেগুলো নবী ﷺ লোকদেরকে শেখাতেন। আল্লাহর কিতাবের শিক্ষার ওপরও এ শব্দটি প্রযোজ্য হতে পারে। কিন্তু কেবলমাত্র তার মধ্যেই একে সীমিত করে দেবার সপক্ষে কোন প্রমাণ নেই। কুরআনের আয়াত শুনানো ছাড়াও নবী ﷺ নিজের পবিত্র জীবন ও নৈতিক চরিত্র এবং নিজের কথার মাধ্যমে যে হিকমাতের শিক্ষা দিতেন তাও অপরিহার্যভাবে এর অন্তর্ভুক্ত। কেউ কেউ কেবলমাত্র এরই ভিত্তিতে যে আয়াতে مَا يُتْلَى (যা তেলাওয়াত করা হয়) শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, এ দাবী করেন যে আল্লাহর আয়াত ও হিকমাত মানে হচ্ছে কেবলমাত্র কুরআন। কারণ “তেলাওয়াত” শব্দটি একমাত্র কুরআন তেলাওয়াতের সাথেই সংশ্লিষ্ট। কিন্তু এ যুক্তি একবারেই ভ্রান্ত। তেলওয়াত শব্দটি পারিভাষিকভাবে একমাত্র কুরআন বা আল্লাহর কিতাব তেলাওয়াতের সাথে সংশ্লিষ্ট করে দেয়া পরবর্তীকালের লোকদের কাজ। কুরআনে এ শব্দটিকে পারিভাষিক অর্থে ব্যবহার করা হয়নি। সূরা বাকারার ১০২ আয়াতে এ শব্দটিকেই যাদুমন্ত্রের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। শয়তানরা হযরত সুলাইমানের নামের সাথে জড়িত করে এ মন্ত্রগুলো লোকদেরকে তেলাওয়াত করে শুনাতোঃ
وَاتَّبَعُوا مَا تَتْلُو الشَّيَاطِينُ عَلَى مُلْكِ سُلَيْمَانَ
“তারা অনুসরণ করে এমন এক জিনিসের যা তেলাওয়াত করতো অর্থাৎ যা শুনাতো শয়তানরা সুলাইমানের বাদশাহীর সাথে জড়িত করে”–থেকে স্পষ্টত প্রমাণিত হয়, কুরআন এ শব্দটিকে এর শাব্দিক অর্থে ব্যবহার করে। আল্লাহর কিতাবের আয়াত শুনাবার জন্য পারিভাষিকভাবে এক নির্দিষ্ট করে না।
# আল্লাহ সূক্ষ্মদর্শী অর্থাৎ গোপনে এবং অতিসঙ্গোপনে রাখা কথাও তিনি জানতে পারেন। কোন জিনিসই তাঁর কাছ থেকে লুকিয়ে রাখা যেতে পারে না।
ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
*পারিবারিক শান্তির রক্ষাকবচ : এরশাদ হচ্ছে, ‘নবী পত্নীরা, তােমরা অন্য নারীদের মত (সাধারণ কোনাে নারী) নও, যদি তােমরা (সত্যিই) আল্লাহ তায়ালাকে ভয় করাে, তাহলে (বাইরের পুরুষদের সাথে) কথা বলার সময় কোমলতা অবলম্বন করাে না… করা হয় তা স্মরণ রেখাে, নিসন্দহে আল্লাহ তায়ালা সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম (বিষয় সম্পর্কে জানেন এবং তিনি (সবার অবস্থা সম্পর্কেই) সমাক অবগত।'(আয়াত ৩২-৩৪) যখন ইসলামের আগমন ঘটলাে তখন এই মহান আদর্শের সামনে উপস্থিত আরব সমাজ তৎকালীন অন্যান্য অনারব সমাজের মতাে একই প্রকার কুসংস্কার ও ভ্রান্তির বেড়াজালে আবদ্ধ ছিলাে। নারীদেরকে ভােগের সামগ্রী মনে করা হতাে, তাদেরকে মাত্র কামনা বাসনা মেটানাের বস্তু মনে করা হতাে। আর এই কারণে তাদেরকে মানবতার দৃষ্টিকোণ থেকে সঠিক মর্যাদা না দিয়ে হীন দৃষ্টিতে দেখা হতাে। এইভাবে সমাজের সর্বত্র যৌন উচ্ছৃংখলতা বিরাজিত ছিলাে এবং পারিবারিক বন্ধন ছিলাে অত্যন্ত শিথিল। এই বর্ণনাও ইতিপূর্বে আলােচ্য সূরার মধ্যে এসে গেছে। একথা সেকথা যাই বলা হােক না কেনাে যৌন বিষয়ের প্রতি হীন নযর থাকার কারণে এবং সুরুচি বিনষ্ট হওয়ার ফলে তৎকালীন মানুষের এই অধপতন এসেছিলাে, উক্ত উৎসব স্থলে উৎকট শারীরিক সৌন্দর্য ও যৌন উদ্দীপক দৈহিক প্রদর্শনী করা হতাে। এর ফলে পরিচ্ছন্ন আবেগ-উচ্ছাস ও প্রেম প্রীতি এবং সৎপথ চলার উদ্দীপনা প্রায় বিলীন হয়ে গিয়েছিলাে। শুধু নারীর দৈহিক সৌন্দর্য চর্চা রয়ে গিয়েছিলাে, যা তৎকালীন বিভিন্ন আরবী কাব্যের মাধ্যমে ফুটে উঠেছে। তাদের মধ্যে পুরােপুরিভাবে পাশববৃত্তি বিরাজ করতাে, পশুদের মতােই তাদের লজ্জা শরম বলতে কিছু ছিলাে না এবং মানুষ ও পশুর মধ্যে মানবতারূপ পার্থক্যটা তারা প্রায় ভুলেই দিয়েছিলাে। তারপর যখন ইসলামের আবির্ভাব হলাে, তখন নারী সমাজের মর্যাদা বৃদ্ধির প্রতি মনােযােগ দেয়া হলাে এবং নারী পুরুষের সম্পর্কের ক্ষেত্রে মানবতার দিকটিকে বিশেষভাবে তুলে ধরা হলাে। ইসলাম এ শিক্ষা দিলাে যে, নারী পুরুষের সম্পর্ক শুধু দৈহিক ও যৌন তৃপ্তির বিষয়ই নয়, নয় এটা শুধু রক্ত মাংসের ক্ষুধা মেটানাের ব্যাপার! এটা হচ্ছে একজন ব্যক্তি থেকে উদ্গত দুই মানব সৃষ্টির মিলন। মােহব্বত ও পারস্পরিক দয়া সহানুভূতির সম্পর্ক এবং উভয়ের এ মিলনের মাধ্যমে শান্তি ও আনন্দ আসে; মানবজাতির মধ্যে মিল-মেহব্বত পয়দা করার লক্ষ্যেই আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, পৃথিবীকে গড়ে তুলতে তাদের পয়দা করেছেন এবং এর মধ্যেই তিনি তাদের খলীফা বানিয়েছেন। এইভাবে আল্লাহ তায়ালা পরিবারের মধ্যে বন্ধন কায়েমের মাধ্যমে এ বিশ্বকে আবাদ করেছেন, পারিবারিক জীবন থেকে গড়ে ওঠা এক নিয়মকানুন বানিয়ে দিয়েছেন। এরই ভিত্তিতে মযবুত সামাজিক বন্ধন কায়েম হয়। এই পরিবারকে এমন এক সূতিকাগার বানানাে হয়েছে যার মধ্যে ভবিষ্যতের বংশধর ও ক্রমবদ্ধিষ্ণু জাতি লালিত হয়। এই পরিবার ও পারিবারিক জীবনকে সুন্দর ও সুরুচিপূর্ণ বানানাের জন্যে একে বিভিন্নভাবে হেফাযতের ব্যবস্থা করা হয়েছে, আর মানুষের ধারণা কল্পনা এবং ব্যক্তিগত লাগামদ্বারা ও মুক্ত চিন্তা থেকে পরিবারের সদস্যদেরকে পবিত্র রাখার জন্যে সর্ব প্রযত্নে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, আসলে ইসলামী শরীয়তের যতগুলাে বিধান রয়েছে সেগুলাের মধ্যে একটি বড়ো অংশ দখল করে আছে পরিবারকে কেন্দ্র করে এবং আমরা দেখছি, আল কোরআনের আয়াতসমূহ থেকেই সে সব বিধান আসছে, এসব বিধানের পাশাপাশি মুসলিম সমাজে প্রচলিত বাস্তব অনুশীলন থেকেই এসবের সার্বক্ষণিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায়, যা পারিবারিক জীবন সম্পর্কিত সেইসব মৌলিক নিয়ম কানুনকে শক্তিশালী করে, এগুলাের ভিত্তিতেই মূলত গড়ে ওঠে এক সুন্দর সমাজ। ইসলাম এমন এক সমাজ গড়তে চায় যা আত্মা ও মনের দিক থেকে হয় পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন, যা নারী ও পুরুষের সম্পর্ককে মধুর ও পবিত্র বানায়, তাকে সকল কলুষতা ও চারিত্রিক খারাবী থেকে, এমনকি এসব নিয়ম-কানুন মানুষকে দৈহিক সম্পর্ক স্থাপনের ব্যাপারেও নিয়ন্ত্রণ করে এবং সর্বত্র এর যথাযথ নিরাপত্তা দেয়। আলােচ্য এ সূরাটিতে এই সামাজিক সংগঠন সম্পর্কে যে আইন কানুন বর্ণনা করা হয়েছে তা ইসলামের পূর্ণাঙ্গ বিধানের বিরাট একটি অংশ দখল করে আছে এবং আল কোরআনের এই আয়াতগুলাের মধ্যে দেখা যাচ্ছে, রসূলুল্লাহ(স.) তাঁর স্ত্রীদেরকে সম্বােধন করে যে কথাগুলাে বলছেন তা আমাদেরকে দিক-নির্দেশনা দেয়ার ব্যাপারে চিরদিনের জন্যে আমাদের সামনে এক মাইলফলক হয়ে রয়েছে, গােটা মানবমন্ডলীর জন্যে তা এক উজ্জ্বল দিক-নির্দেশক হয়ে রয়েছে। এ ঘটনা তাদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনায় এবং আল্লাহর সাথে তাঁদের সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রেও দেখা যায় এক বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছে। এমন এক শিক্ষা এখানে আছে যার সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলছেন, “অবশ্যই আল্লাহ তায়ালা চান তােমাদের থেকে কলুষতা দূর করে দিতে, যেহেতু তােমরা রসূলুল্লাহ(স.)-এর আহলে বায়ত। ‘তিনি তােমাদেরকে পুরােপুরিভাবে পবিত্র করতে চান।’ আমাদের এখানে লক্ষ্য করতে হবে, কলুষতাকে দূর করার উপায়সমূহ কি কি? এবং কি কি উপায়ে মানুষকে পবিত্র করা যায় যা খােদ আল্লাহ সােবহানাহু তায়ালা বলছেন এবং সেগুলােকে বাস্তবে কাজে লাগিয়ে তিনি মানুষকে পবিত্র করছেন। ওরা তাে আহলে বায়ত এবং নবী(স.)-এর স্ত্রী, তারা পৃথিবীর জানা সকল নারীদের মধ্যে সর্বাধিক পবিত্র। রসূলুল্লাহ(স.)-এর মর্যাদাপূর্ণ ঘরের হেফাযত থাকা সত্তেও মােমেনদের মা-দেরকে যেসব উপায়-উপাদান দ্বারা নিরাপত্তা দেয়া হয়েছে অন্যান্যদের জন্যে এর থেকে আরও অনেক বেশী নিরাপত্তা বেষ্টনী প্রয়ােজন এবং অন্যান্যদেরকে আরও বেশী হেফাযতে রাখা দরকার। নবী(স.)-এর স্ত্রীদেরকে যে উঁচু মর্যাদা আল্লাহ রব্বল আলামীন-এর পক্ষ থেকে দেয়া হয়েছিলাে আলােচ্য অধ্যায়ে সে বিষয়ে তাদের চৈতন্য উদয়ের প্রক্রিয়া শুরু করা হচ্ছে। সে বিষয়ে আল্লাহ তায়ালা বলছেন, ‘অবশ্যই আল্লাহ তায়ালা চাইছেন তােমাদের মধ্য থেকে অপবিত্রতা দূর করতে, (কারণ তােমরা যে) আহলে বাইত (প্রিয় রাসূলের ঘরের লােক)। ‘আরও চাইছেন তােমাদেরকে পুরােপুরিভাবে পবিত্র করতে।’ আল্লাহ রব্বুল আলামীন কর্তৃক প্রদত্ত মর্যাদা, শ্রেষ্ঠত্ব ও সকল প্রকার গুণ দ্বারা ভূষিত করার কারণে রাসূল(স.)-এর স্ত্রীরা সারা জগতের সকল রমণীকৃলের মধ্যে শ্রেষ্ঠ মর্যাদার অধিকারিণী ছিলেন-এ জন্যে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনও চান তারা এ অনন্য মর্যাদার কদর করবেন এবং এ মহা সম্মানের হক আদায় করবেন। তাই এরশাদ হচ্ছে, ‘হে নবীর স্ত্রীরা, তােমরা যদি তাকওয়া এখতিয়ার করে থাকো, তাহলে জেনে রাখাে, তােমরা অন্য স্ত্রীলােকদের মতাে নও।’ অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালাকে ভয় করে চলার জীবন যদি তােমরা গ্রহণ করে থাকো তাহলে তােমাদের জানা দরকার যে, কোনাে দিক দিয়েই তােমাদের অবস্থা দুনিয়ার অন্য কোনাে মহিলার মতাে নয়….. এমন এক অবস্থানে তােমরা উপবিষ্ট রয়েছো, যেখানে তােমাদের মর্যাদার অন্য কেউ অংশীদার হতে পারে না। কিন্তু এ মর্যাদা একমাত্র তাকওয়া পরহেযগারী দ্বারাই অর্জন করা সম্ভব। তাহলে বুঝা যাচ্ছে, শুধু নবীর স্ত্রী হওয়ার কারণেই এ মর্যাদা নয়, বরং এ মর্যাদা লাভ তখনই সম্ভব যখন তােমাদের মধ্যে তাকওয়ার গুণাবলী বিশেষভাবে বর্তমান থাকবে, আর নবীর স্ত্রী হওয়ার সুবাদেই তােমাদের মধ্যে এ সব গুণাবলী চূড়ান্তরূপ নিতে পেরেছে। এই অকাট্য ও চূড়ান্ত সত্যের ওপরেই দ্বীন ইসলামের মযবুত দ্বীন এর ভিত্তি গড়ে উঠেছে। রসূলুল্লাহ(স.)ও এ কথাটিকে সুনির্দিষ্টভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তিনি তাঁর স্ত্রীদেরকে চূড়ান্তভাবে এ কথা জানিয়ে দিয়েছেন যে তার সাথে সম্পর্কের কারণেই যে আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে বিশেষ মর্যাদা দান করেছেন এ ধোকার মধ্যে যেন তারা না থাকে, তার স্ত্রী বলে যে কারও জন্যে তিনি আল্লাহর কাছ থেকে বিশেষ মর্যাদা আদায় করে আনতে পারতেন তাও নয়। এজন্যে তার পরিবারকে ডাক দিয়ে তিনি বলছেন, হে ফাতেমা বিনতে মােহাম্মদ, তুমি নিজেকে আগুন থেকে বাঁচাও। হে সাফিয়্যা বিনতে আব্দুল মােত্তালেব, হে আব্দুল মােত্তালেবের বংশধর আল্লাহর আযাব থেকে তােমাদেরকে বাঁচানোর আমার কোনাে ক্ষমতা নেই। তােমরা আমার সম্পদ থেকে যা খুশী চেয়ে নাও।'(মুসলিম শরীফের মধ্যে হাদীসটি আনা হয়েছে) অপর আর একটি রেওয়ায়েতে বলা হয়েছে, ‘হে কোরায়শ জাতি, তােমরা নিজেদেরকে আগুন থেকে বাঁচাও, হে কাবের গােষ্ঠী, তােমরা নিজেদেরকে আগুন থেকে বাঁচাও, হে হাশেমের গােত্র, তােমরা নিজেদেরকে দোযখের আগুন থেকে বাচাও। হে আবদুল মোতালেবের বংশধরেরা, তােমরা নিজেদেরকে আগুন থেকে বাঁচাও। শােনাে আমি আল্লাহর কসম খেয়ে বলছি, আল্লাহর থেকে তােমাদেরকে বাঁচানাের আমার কেন নেই। তবে তােমাদের হক রয়েছে আমার দরদ সহানুভূতি লাভ করার, এ জন্যে অবশ্যই আমি সে দয়া মমতার আর্দ্রতা দ্বারা সে আগুন নেভাবো।'(মুসলিম ও তিরমিীতে বর্ণিত) *নারীদের রূপ ও সুরের পসরা যখন ধ্বংস আনে : যে জিনিসটি দ্বারা তারা আগুন থেকে বাঁচার আশা করবে তা হচ্ছে তাকওয়া। সেই তাকওয়ার গুণটি দ্বারা তারা যে উঁচু মর্যাদার অধিকারী হবে, সে বিষয়টি বর্ণনা করার পর আসছে সেই সব উপায়ের বর্ণনা যেগুলাে দ্বারা আল্লাহ সােবহানাহু তায়ালা আহলে বায়তের লােকদের দোষ-ক্রটি দূরীভূত করে তাদেরকে পুরােপুরিভাবে পবিত্র বানাতে চান। তাই এরশাদ হচ্ছে, ‘সুতরাং তােমাদের কথাকে মােলায়েম (ও শ্রুতিমধুর) বানিয়াে না, কারণ তাতে যার অন্তরের মধ্যে ব্যাধি রয়েছে, সে লােভাতুর হয়ে উঠবে।’ ওপরের আয়াতটি দ্বারা আল্লাহ রব্বুল আলামীন (বিশেষভাবে) নবী(স.)-এর স্ত্রীদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন তারা যেন, অজানা লােকদের সাথে এমন মােলায়েম ও মিষ্টি আওয়াযে কথা না বলে, কারণ তাতে (নারী কণ্ঠের এই মধুর আওয়াজ) মানুষের যৌন আবেগকে উস্কিয়ে দেয়, তাদের প্রকৃতিগত মােহকে নাড়িয়ে তােলে এবং যাদের অন্তরের মধ্যে (ভাবের আবেগ-দ্বারা অস্থির হয়ে যাওয়ার) ব্যাধি আছে তাদের মধ্যে কামনা বাসনার সৃষ্টি হবে এবং তাদের যৌন আবেগকে উদ্দীপিত করে তুলবে। ফলে, হিতাহিত জ্ঞান বিবর্জিত হয়ে তারা কোনাে অন্যায় পদক্ষেপ নিয়ে বসতে পারে। অবশ্যই এটা এক কঠিন সত্য যে, চিরদিন অসুস্থ অন্তর মানুষকে প্রবাহিত করে এবং অদম্য লালসা সৃষ্টি করে। সকল পরিবেশ পরিস্থিতি এ ধরনের শয়তানী ওয়াসওয়াসা সকল মানুষের পেছনে লেগে থাকে এবং এ দিকে তাদেরকে প্ররােচিত করে, এমনকি মহানবীর স্ত্রী মােমেনদের মায়েরাও তাদের কুদৃষ্টি থেকে বাঁচতে পারে না। এ জন্যে, মৌলিক যেসব উপায়-উপকরণ মানুষকে প্ররােচিত ও প্রলুব্ধ করে সে সব উপাদানের প্রবেশ পথগুলাে বন্ধ না করা পর্যন্ত কলুষ কালিমা ও নানা প্রকার কদর্যতা থেকে মানুষ বাঁচতে পারে না। আমরা আজ যে সমাজে বাস করছি তার অবস্থা একবার চিন্তা করে দেখা দরকার। আমাদের এ যুগে আল্লাহ তায়ালার ভয়-ভীতির অভাবে এবং মানুষের জীবন দুনিয়াকেন্দ্রিক হয়ে যাওয়ার কারণে এ মনােরােগ মানুষকে অধঃপতনের অতল তলে ডুবিয়ে দেয়ার অবস্থায় পৌছে গেছে। চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে ফিৎনা-ফাসাদের সয়লাব, মানুষ ইন্দ্রিয় প্রভৃতির দাস হয়ে গেছে এবং লােভ-লালসা মানুষকে পশুর অধম বানিয়ে ফেলেছে, সব কিছুর মধ্যে যৌন আবেগকে হাওয়া দেয়া হচ্ছে এবং নারী-পুরুষের সহজাত বৃত্তি পারস্পরিক আকর্ষণকে নানাভাবে উস্কিয়ে তােলা হচ্ছে। তাদের উত্তপ্ত যৌন অনুভূতিকে জাগিয়ে তােলার ব্যবস্থা হচ্ছে, এমন পরিবেশ পরিস্থিতির মধ্যে আমরা যারা আল্লাহ তায়ালাকে ভয় করে চলতে চাই, তাকে মানতে চাই এবং তার হুকুম মতাে জীবন যাপন করতে চাই, তারা এই চরম বিশৃংখল সমাজে কিভাবে নিজেদের স্বাতন্ত্র বজায় রাখবাে, কিভাবে এই পরিবেশে চলাফেরা করব? যেখানে কণ্ঠস্বর উচ্চমার্গে তােলার জন্যে নারী পুরুষ নির্বিশেষে কণ্ঠশিল্পের প্রতিযোগিতা নামে নারীরা তাদের সুরেলা কণ্ঠের মনমাতানো তালে সকল শ্রেণীর পুরুষকে প্রলুব্ধ করতে বদ্ধপরিকর, উন্মত্ত-যৌবনা নারীরা তাদের সকল অংগ প্রত্যংগকে সৌন্দর্যের পসরা সাজিয়ে বেগানা পুরুষের সামনে এগিয়ে দিচ্ছে, প্রতিপক্ষকে আকৃষ্ট করার জন্যে যে প্রকার যৌন সুড়সুড়ি থাকতে পারে সবকিছুকে ব্যবহার করা হচ্ছে এবং কী-প্রবৃত্তিকে ভীষণভাবে জাগিয়ে তােলার জন্যে সর্বপ্রকার প্রচেষ্টা চলছে, তাদের উচ্চমার্গের যৌনাবেগপূর্ণ সংগীত লহরী পুরুষের হৃদয় তরংগে উপর্যুপরি আঘাত হেনে চলেছে- সে অবস্থায় তাদের কাছে আমরা কি পবিত্রতা আশা করতে পারি? কি করে এই কলুষিত অবস্থায় পবিত্র পরিবেশ বজায় রাখা সম্ভব। যেখানে ললনারা তাদের শারীরিক সৌন্দর্যকে সর্ব সমক্ষে বিকশিত করে হেলে দুলে চলেছে, আর কোমল কণ্ঠে প্রলুব্ধ করছে পুরুষদেরকে। সেখানে সেই সব অন্যায়-অপকর্ম ও দু্চরিত্রতা রােধ করা কিভাবে সম্ভব, মহান আল্লাহ রব্বুল আলামীন এরই মূলােৎপাটন করতে চেয়েছেন, যাতে তার অনুগত বান্দারা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে মধুর ও পবিত্র পরিবেশ গড়ে তুলতে পারে। এই জন্যে আল্লাহ তায়ালা নারীকুল শিরােমনি ও মােমেনদের মায়েদেরকে মডেল হিসাবে তাদের জীবন, চাল চলন, বেশ ভূষা ও আচার আচরণকে সকল মানুষের অনুসরণযােগ্য করে তুলে ধরার জন্যে নির্দেশ দিচ্ছেন, তােমরা এমন কথা বলাে, যা বােধগম্য হয় (এবং যে অপরের জন্যে কল্যাণবাহী হয়) এবং কল্যাণকর হয়। এক্ষেত্রে প্রণিধানযােগ্য, মােমেনদের মায়েদেরকে নরম মােলায়েম ও আকর্ষণীয় কণ্ঠে কথা বলতে মানা করা হচ্ছে এবং তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হচ্ছে এমন ভাষা ও এমন আওয়াযে কথা বলতে যা তাদের সবার জন্যে উপকারী হয়, তা যেন ভাল কথা হয়, মন্দ কথা না হয়। অবশ্য এখানে আয়াতের যে উদ্দেশ্য বুঝা যায় তা হচ্ছে, নারীদেরকে আল্লাহ তায়ালা যে কণ্ঠস্বর দিয়েছেন তা স্বাভাবিকভাবে পুরুষদের জন্যে প্রিয় ও আকর্ষণীয়। এরপর তারা আওয়াযকে মােলায়েম বানিয়ে তাদের কণ্ঠস্বরকে আরও সুমধুর, আরও আকর্ষণীয় বানাতে পারে এবং ইচ্ছা করলে সে এই মাধুর্যকে ঠেকাতেও পারে। এ জন্যে তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হচ্ছে, তারা যেন দৃঢ়তাপূর্ণ আওয়াযে কথা বলে এবং বেগানা পুরুষের সাথে জরুরী কথা ছাড়া অপ্রয়ােজনীয় কথা বলা থেকে পরহেয করে, যেন তাদের গলার সুর বা কোনাে ভাব-ভংগী, ঠাট্টা-মস্কারি, অপ্রয়ােজনীয় গল্প-গুজব, রশিকতা বা আনন্দ-কৌতুকপূর্ণ কথা বলাবলি না করা হয়, যা শন্ত্র ও অথবা দেৱীতে হলেও মনের মধ্যে দূরাকাংখার জন্য দিতে পারে।
*নারীদের ঘরে থাকার নির্দেশ ও তার কারণ : আল্লাহ সােবহানাহু ওয়া তায়ালা একমাত্র সৃষ্টিকর্তা, তিনিই তার সৃষ্টির সকল অবস্থা সম্পর্কে সম্যক অবগত। তিনিই সঠিকভাবে তাদের প্রকৃতি সম্পর্কে জানেন, জানেন তাদের অবস্থান। সম্পর্কে। তিনিই মােমেনদের পাক পবিত্র মায়েদের সম্পর্কেই এ কথাগুলাে বলেছেন, যাতে করে তাদের যামানার লােকদেরকে সম্বােধন করার সময়ে তারা এসব নিয়ম-কানুন মেনে চলে। অথচ পৃথিবীর সকল যামানার মধ্যে সে যামানা ছিলাে সব থেকে ভালাে এ কথা সবাই জানেন ও বুঝতে পারেন, তা সত্তেও যদি এ সময়ে এতাে সাবধানতা অবলম্বন করা লেগে থাকে, তাহলে এখন কতটুকু সাবধান হওয়া দরকার তা সহজেই অনুমেয়। এরশাদ হচ্ছে, ‘তোমরা তােমাদের ঘরে অবস্থান গ্রহণ করো।’ এ আয়াতাংশের মধ্যে ‘বিকরুন’ শব্দটি রয়েছে-এর অর্থ হচ্ছে যা ভারী হয়ে থাকে, স্থির হয়ে থাকে। কিন্তু এর দ্বারা অবশ্যই একথা বুঝায় না ঘরে আবদ্ধ হয়ে থাকতে হবে এবং কোনাে সময়েই নড়াচড়া করা যাবে না বা বাড়ীর বাইরে আসা যাবে না। আসলে এ কথা দ্বারা যে সুক্ষ্ম ইংগিত পাওয়া যায় তা হচ্ছে, তাদেরকে আল্লাহ তায়ালা গুরুত্ব সহকারে জানাচ্ছেন যে, তাদের জীবনের সুখ শান্তির জন্যে ঘরকেই মূল স্থান বলে জানতে হবে, এটাই তাদের অবস্থানক্ষেত্র আর এর বাইরে যাওয়াটা একটা ব্যতিক্রম মাত্র, অর্থাৎ বাইরে তাদের বেড়ানােটা স্বাভাবিক নিয়মের ব্যতিক্রম। জরুরী কোনো প্রয়ােজনেই তারা বাইরে যাবে। সেখানে তারা প্রয়ােজনের চেয়ে বেশীক্ষণ থাকবে না এবং সেখানে থাকার ব্যাপারে নিজের তরফ থেকে কোনাে আকর্ষণ বােধ করবে না এবং বাইরে থাকতে নিশ্চিন্ততাও বােধ করবে না। বাইরে যাওয়াটা শুধুমাত্র বিশেষ প্রয়ােজন মেটানাের জন্যে । যা সারা হলেই তারা তাদের মূল স্থান (ঘরে) ফিরে আসবে যতােক্ষণ তাদের বিশেষ সেই প্রয়োজন না মেটে, যার জন্যে তাদের উপস্থিতি একান্ত দরকার, ততােক্ষণই তারা শুধু বাইরে থাকবে। আর ঘরই হচ্ছে মেয়েদের আসল পরিবেষ্টনী, যেখানে তার প্রাণ শান্তি পেতে পারে এবং সেই প্রধান দায়িত্ব পালন করতে পারে যার জন্যে আল্লাহ তায়ালা তাকে পয়দা করেছেন। এই পরিবেষ্টনীর বাইরে তার মন অন্য কোনাে কোথাও যেন কারণে যেতে না চায়, সে যেন ঘর-বিমুখ এবং বাইরের কলুষ কালিমায় বিজড়িত না হয়, আর যে বিশেষ দায়িত্ব পালন করার জন্যে আল্লাহ তায়ালা তাকে পয়দা করেছেন তার বাইরে অন্য কোনাে কঠিন পরিশ্রমের কাজে তারা নিজেদেরকে যেন নিয়োজিত না করে। যেহেতু ইসলাম তাদেরকে ঘরমুখী থাকতে বলেছে এবং তাদেরই পরিচর্যায় বাচ্চা-কাচ্চাদের লালন পালনের ব্যবস্থা করেছে, এ জন্যে ইসলাম ভরণপােষণের দায়িত্ব পুরুষদের দিয়েছে, বরং আয় রােযগার করে পরিবারের ভরণ পোষণ করা পুরুষদের জন্যে বাধ্যতামূলক করেছে। যাতে করে মায়েদের লালন-পালনের দায়িত্ব পালনের সাথে সাথে আয়-রােযগারের জন্যে কষ্ট করতে না হয়, কষ্টের সময়ে তারা যেন সাহায্য পায়, মন-দিল যেন তাদের সুস্থির থাকে এবং কচি কচি বাচ্চাদের লালন-পালনের ব্যাপারে তারা যেন নিরুদ্বিগ্ন থাকতে পারে, ঘরের যাবতীয় ব্যবস্থাপনা সুশৃংখল থাকতে পারে, ঘরের মধ্যে এক শান্তির সুবাস ও হাসিখুশীর পরিবেশ বিরাজ করতে পারে। অপর দিকে যে মাকে আয় রােযগারের জন্যে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়, নানা প্রকার কঠিন কাজ করতে হয়, সে কঠিন কাজ করতে করতে তার কোমলতা হারিয়ে ফেলে, কমনীয়তা, মেজাজের ভারসাম্য, যে মা নানা প্রকার দায়িত্বপালনের নিগড়ে পিষ্ট হয়, যাকে শারীরিক শক্তি প্রয়োগে নানাবিধ জটিল কাজে আবদ্ধ করে রাখা হয় তার পক্ষে ঘরের পরিবেশকে মনােরম, সুবাসিত ও হাস্য-মুখর রাখা সম্ভব হয় না, সম্ভব হয় না তার পক্ষে বাচ্চার হক আদায় করা এবং নিপুণভাবে বাচ্চা-কাচ্চা মানুষ করার দায়িত্ব পালন করা। কর্মক্ষেত্র অফিস আদালত কল-কারখানা যেটাই হােক না কেনাে, সাধারণত তার পরিবেশ হােটেল-রেস্তোরা (পানশালা) থেকে উন্নত নয়। বাড়ীতে যে শান্তি ও পবিত্রতা সহযােগিতার পরিবেশ থাকে সেসব স্থানে তা না থাকতেও পারে । এটা সত্য কথা ঘরের শান্তি-সম্প্রীতি মেয়েরাই গড়ে তােলে এবং স্ত্রীর হাস্য মুখরিত চেহারাই ঘরের বাতাসে সুরভি ছড়ায় আর স্নেহ ও মায়া মমতার পরশ বুলিয়ে দেয়। ঘরের কেন্দ্রীয় ব্যক্তি হচ্ছে স্নেহময়ী মা। করুণাময়ী মা তার সকল শ্রম ও শক্তি ঘরের অংগনকে সুন্দর ও সুষমাময় করার জন্যে বিলিয়ে দেয়, তার আত্মার সকল আবেগ ঢেলে দিয়ে বাড়ীর গােটা পরিমন্ডলকে সাজাতে থাকে আর ততােক্ষণ পর্যন্ত এ জিনিস পূর্ণাংগ হয় না যতােক্ষণ তার সযত্ন সকল সাধনা সফল ও হয় না। অপর দিকে এসব দায়িত্বানুভূতি-বিবর্জিত নারী যখন বাইরের জীবনকে প্রাধান্য দেয় তখন তার কাছে ঘরের বাইরের প্রয়ােজনগুলাে বড়ােই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এভাবে, এসব গুরুত্ব এড়ানাের ক্ষমতা থাকা সত্তেও যখন মানুষ বাইরের কাজকে প্রাধান্য দিতে থাকে, তখনই এর প্রতিক্রিয়া স্বরূপ নেমে আসে অবশ্যম্ভাবী এক অকল্যাণের অভিশাপ ও দুঃখ-বেদনা, যা তার আত্মা ও বিবেক বুদ্ধিকে ঘেরাও করে ফেলে। তাই তাে আমরা আধুনিক সমাজের দিকে তাকিয়ে দেখতে পাচ্ছি, গােটা পারিবারিক জীবন বিগড়ে যাচ্ছে, ঘরে ঘরে অশান্তি অধঃপতন ও সব দিক থেকে অকল্যাণ ও ভ্রান্তি নেমে আসছে।(এই উদ্ধৃতিটি গৃহীত হয়েছে, আস্ সালামুল আলামীয়া ওয়াল ইসলাম গ্রন্থের ‘সালামুল বায়েত’ অধ্যায় থেকে পৃঃ ৫৪-৫৫) মহিলারা যখন বিনা কাজে ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসে, তখন তার এই বেরােনাে- হয় নারী পুরুষের অবাধ মেলামেশার প্রয়ােজনে হবে, না হয় গান-বাজনা ও নৃত্য-কলা শিল্পকে সমৃদ্ধ করার উদগ্র লালসার জন্যে হবে, যা তাদেরকে বিভিন্ন আসরে ও বিভিন্ন সামাজিক মেলামেশায় ঠেলে দেয়। [আল্লাহ তায়ালার এ স্বভাবসিদ্ধ নিয়ম ভংগ করে যে সত্যতা-সংস্কৃতি বাজারী পণ্যের মতাে নারীদের পাইকারী হারে ঘরের বের করেছে, তাদের সমাজের ভয়াল চিত্রের দিকে তাকিয়ে দেখুন, গত বছরের গােড়ার দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্টের যেসব মহিলার অফিস-আদালত ও কল-কারখানায় পুরুষের সাথে কাজ করছেন-তাদের ওপর একটি সমীক্ষা চালিয়ে দেখতে পেয়েছেন যে, শতকরা ৬৯ জন কর্মজীবি মহিলাই কর্ম জীবনের কোনাে না কোনাে পর্যায়ে যৌন হয়রানীর সম্মুখীন হয়েছেন। ‘দি হিডেন লাইফ অব একসিকিউটিভ ওয়েমেন’ নামক গ্রন্থটিতে এ পর্যায়ে এমন সব তথ্য পরিবেশিত হয়েছে যা পড়লে রীতিমতাে আঁতকে উঠতে হয়। তাদের সমাজ ব্যবস্থায় যে ধ্বস নেমেছে তা রুখতে হলে মানুষদের আবার আল্লাহ তায়ালার নিয়মের দিকেই ফিরে যেতে হবে। এছাড়া কোনাে বিকল্প নেই। এই স্বল্প পরিসরে বিষয়টির বিশাল তথা ভান্ডার পেশ করা আমার পক্ষে অসম্ভব, তাফসীর ফি যিলালিল কোরআন-এর পাঠক পাঠিকাদের বিষয়টি সম্পর্কে আরাে বৃহত্তর অঙ্গনে পড়া-শুনা ও চিন্তা ভাবনা করার আবেদন জানাই।-সম্পাদক] এইটিই হচ্ছে সেই অধপতন ও ধ্বংস যার পংকিলতায় পড়ে মানুষ জীব,জানােয়ার ও হিংস্র পশুর বিচরণ ক্ষেত্রে পৌছে যায়। রসূলুল্লাহ(স.)-এর জামানায় নামাযের জন্যে মহিলারা ঘর থেকে বের হতেন এবং এটা শরীয়তে নিষিদ্ধ নয়। কিন্তু সে তাে ছিলাে এমন এক যামানা যখন সাধারণভাবে মানুষ ছিলাে সৎ, সকলের অন্তরে আল্লাহর ভয় ছিলাে এবং সে অবস্থাতেও মহিলারা নিজেদেরকে এমনভাবে আবৃত করে বের হতাে যে তাদেরকে কেউ চিনতে পারতাে না। তাদের শরীরের যৌন অনুভূতি উদ্রেককারী অংগগুলাে বাইরেও প্রকাশ পেতাে না, এতদসত্তেও রসূল(স.)-এর ইন্তেকালের পর হযরত আয়েশা(রা.) ঘরের বাইরে যাওয়াটা পছন্দ করেননি। বােখারী ও মুসলিম শরীফের মধ্যে হযরত আয়শা(রা.)-এর আর একটি হাদীস পাওয়া যায়, তাতে তিনি বলেছেন, মােমেন মহিলারা ফজরের নামাযে রসূলুল্লাহ(স.)-এর জামায়াতে শরীক হতেন। তারপর যখন তারা চাদরে আবৃত্ত অবস্থায় ফিরে আসতেন তখন অন্ধকারের কারণে তাদেরকে চেনা যেত না। এই হাদীস দুটির আর একটি বর্ণনায় হযরত আয়শা(রা.) থেকে জানা যায়, তিনি বলেছেন, ‘যদি রসূলুল্লাহ(স.) জানতে পারতেন (বাইরে বেরুলে) মেয়েদের কি কি অবস্থার সম্মুখীন হতে হয়, তাহলে তিনি তাদের মসজিদে যাওয়া থেকে মানা করে দিতেন, যেমন বনী ইসরাঈল জাতির মহিলাদেরকে মানা করা হয়েছিলাে। *বাইরে বেরুনাের সময় সাজগােজ না করার নির্দেশ : এখন বুঝা দরকার, হযরত আয়শা(রা.)-এর যামানায় মহিলাদের কি কি অসুবিধা হয়েছিলাে? আর কি কি বিপদের আশংকা তিনি করেছিলেন, যার কারণে তিনি মনে করেছিলেন যে, রসূলুল্লাহ(স.) সেগুলাে জানলে অবশ্যই তাদের মসজিদে নামায পড়তে যাওয়াকে নিষিদ্ধ ঘােষণা করতেন। আমাদের ভেবে দেখা দরকার, আজকের পরিবেশ পরিস্থিতির আলোকে সে অসুবিধাটা কি হতে পারে। আমরা একটু আন্দাজই করে দেখতে পারি। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এরশাদ করেছেন, ‘(হে মহিলারা) প্রথম জাহেলী যুগের মতাে তােমরা সেজেগুজে বেরিয়াে না।’ এ আয়াতাংশে বুঝা যাচ্ছে, বাড়ীতে অবস্থান গ্রহণ করার হুকুম হওয়ার পরও যদি কোনাে বিশেষ প্রয়ােজনে বাড়ীর বাইরে যাওয়া জরুরী হয়ে পড়ে, তাহলে যাওয়া যাবে, কিন্তু সে যাওয়াটা সেজেগুজে অপরের মনােরঞ্জন করার জন্যে হবে না। আসলে জাহেলী যুগের মেয়ের বাইরে যাওয়ার সময়ে সাধারণভাবে সেজে গুজেই বের হতাে। কিন্তু আদিম জাহেলী যুগে মহিলারা সাধারণভাবে অথবা সেজেগুজে যেভাবেই বের হােক না কেনাে, এই নব্য যুগের সাথে তার তুলনা করলে কেউই স্বীকার করবেন যে, অতীতের সকল যামানাকেই আধুনিক জাহেলিয়াত সবদিক দিয়েই হার মানিয়েছে। মােজাহেদ বলেন, জাহেলী যামানায় পুরুষের মাঝে মহিলাদের অবাধ চলাফেরা ছিলাে এটাকেই তাবাররুজ বলা হয়েছে। কাতাদা বলেন, ‘ওদের হাঁটার একটা বিশেষ ধরণ ছিলাে। শরীর হেলে দুলে লাস্যময়ী ভংগীতে হাটতো এবং এতে তাদের প্রতি পুরুষরা প্রলুন্ধ হতাে। এই ধরনের চলনকে আল্লাহ তায়ালা নিষিদ্ধ ঘােষণা করেছেন। মােকাতেল ইবনে হাব্বান বলেন, ‘তাবাররুজ’ বলতে বুঝায় যে, স্ত্রীলােকরা মাথার ওপর ওড়না পরতাে ঠিকই, কিন্তু মাথায় ওড়না পেঁচিয়ে বাঁধতাে না, বরং ওড়না এমনভাবে কাঁধের ওপর দিয়ে ঝুলিয়ে দিতো যে তাদের কানের অলংকার, গলা এবং ঘাড় দেখা যেতাে, এইটিই ছিলাে তাদের সাজগােজ। ইবনে কাসীর তার তাফসীরে বলেন, সে সময়কার মহিলাদের মধ্যে কেউ কেউ পুরুষদের মধ্যে এমনভাবে চলাফেরা করতে যে তাদের বক্ষ স্ফীতাবস্থায় রাখতে এবং তার ওপর কোনাে আবরণী বা ওড়না থাকতাে না, কখনও কখনও তাদের ঘাড়, কানের অলংকার ও গলার হার প্রদর্শন করতাে (এবং এইভাবেই তারা পুরুষদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতাে) এ জন্যে আল্লাহ রব্বুল আলামীন মােমেন মেয়েদেরকে সেসব অংগ প্রত্যংগকে ঢাকার নির্দেশ দিয়েছেন এবং তাদের এসব জায়গাগুলোকে পুরুষদের দৃষ্টি থেকে আড়াল করে রাখতে বলেছেন। জাহেলী যুগে এসবই ছিলাে সাজগােজের বিভিন্ন অবস্থা, যা মহান আল্লাহ তায়ালা কোরআনে করীমের মধ্যে মানা করেছেন, যাতে করে এসব আচরণের কুফল থেকে ইসলামী সমাজ বাঁচতে পারে এবং ফিতনা-ফাসাদ, সমাজ বিধ্বংসী আচার আচরণ, কার্যকলাপ ও বিপথগামী হওয়া থেকে মানুষ দূরে থাকতে পারে। তাদের আদব শৃংখলা ও পারস্পরিক সম্পর্ককে উন্নত করতে পারে এবং তাদের উঁচু মানের রুচিবােধ ও চারিত্রিক সৌন্দর্যের পরিচয় দিতে পারে। আমরা এখানে বলতে চাই যে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন-এর রুচি তাই, যা মানুষের জন্যে উপকারী এবং সবদিক দিয়ে কল্যাণকর। কিন্তু মানুষ তাে বেশী দূরের জিনিস দেখতে বা বুঝতে পারে না, এ জন্যে তার কাছে উপস্থিত ও নগদ আনন্দদায়ক যা, তাই ভালাে লাগে, ভালাে লাগে তার কাছে তাৎক্ষণিকভাবে যৌন উন্মাদনা সৃষ্টিকারী আচার আচরণ। এ কারণেই উত্তেজনা সৃষ্টিকারী উন্মুক্ত অংগসমূহ তারা প্রদর্শনী করতে চায়, যাতে মানুষ মােহাবিষ্ট হয়। অবশ্য এটা ঠিক যে, আত্মার উৎকর্ষ সাধনকল্পে ইসলামী ব্যবস্থার মাধ্যমে যে সৌন্দর্যের বিকাশ ঘটাতে চাওয়া হয়েছে, মুসলমানদের মধ্যে যে সুকুমারবৃত্তির চর্চা করা হয়েছে, মানবতার পূর্ণ বিকাশ ঘটানাের যে পাক-পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা পয়দা করা হয়েছে এবং যেভাবে চেতনাকে সুন্দর করে তােলা হয়েছে, তার থেকেও সে কদর্য যৌনানুভূতির উস্কানি ছিলাে বেশী আকর্ষণীয়। তবে, মানবতার পূর্ণ বিকাশ-সাধনে নিয়ােজিত ব্যবস্থা মানব কল্যাণকল্পে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করার ব্যাপারে স্থায়ী মানদন্ড দিতে কখনও ভুল করে না। নারীদের সৌন্দর্য চর্চা ও তার বিকাশ সাধনকে ইসলাম মােটেই নিরুৎসাহিত করে না, বরং সে তার সঠিক মূল্যায়ন করে। তার সার্বিক ও স্থায়ী মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে এক মহান প্রােগ্রাম পেশ করে। কিন্তু আফসােস, দুর্গন্ধময় ও জাহেলী কর্দমাক্ততা যাদের মনমগজকে আচ্ছন্ন করে রেখে দিয়েছে তাদের নযরে ইসলামী ব্যবস্থার এ সৌন্দর্য সহজে রেখাপাত করে না। কারণ, তারা তাদের বাহ্যিক চোখ দিয়ে শুধু বিবস্ত্র মাংসপিন্ডের সৌন্দর্য দেখে এবং এর বাহ্যিক আবেদনটাই তারা বেশী শুনতে পায় । মহাগ্রন্থ আল কোরআনের এ অবিস্মরণীয় আয়াত জাহেলী বা আদিম মূর্খ যামানার কদর্য ও ঘৃণিত রীতিনীতির দিকে ইশারা করতে গিয়ে বলছে যে, বাইরে বের হওয়ার সময় সাজগােজ করার এ অভ্যাসটি জাহেলিয়াতের পরিত্যক্ত সম্পত্তি। এটা অনুসরণে আধুনিক জাহেলিয়াত পুরাতন জাহেলিয়াতের ওপর আরও এক কদম এগিয়ে গেছে এবং তার যাবতীয় চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-ধারণা ও অনুভূতি সব প্রাচীন জাহেলিয়াত থেকেই গৃহীত। এটাও সত্য কথা যে, জাহেলিয়াত-মূর্খতা বা অজ্ঞতা কোনাে এক যামানার বৈশিষ্ট্য নয় যে, এটা নির্দিষ্ট একটি যামানায় বা কোনাে এক নির্দিষ্ট দেশে বা নির্দিষ্ট সময়ে থাকবে। আসলে এটা একটা নির্দিষ্ট সামাজিক অবস্থা, এর পেছনে জীবনের এক নির্দিষ্ট চিন্তা-ভাবনা সক্রিয় রয়েছে। হতে পারে এ অবস্থা আবারও আসবে, এ চিন্তা আবারও পুনরুজ্জীবিত হবে। পূর্বের জাহেলিয়াত তখন নব্য জাহেলিয়াতের জন্যে দিশারী হিসাবে কাজ করবে, তা যখন এবং যেখানেই হােক না কেন। এ কারণেই আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, মানুষ এখন এক অন্ধ জাহেলিয়াতের দিকে এগিয়ে চলেছে, যা ভালাে মন্দ কিছুই দেখতে পায় না, যা স্রোতের গতিতে গা ভাসিয়ে দিয়ে স্থূল অনুভূতি নিয়ে এগিয়ে চলেছে, যার চিন্তাধারার মধ্যে পাশববৃত্তিই অধিক ক্রিয়াশীল। এটি মানব জাতিকে মানবতাবােধ থেকে সরিয়ে নিয়ে হীনতার অতল গহ্বরে নিক্ষেপ করার জন্যে বদ্ধপরিকর। আমরা আরও দেখতে পাচ্ছি, এহেন মানবনির্মিত সভ্যতায় না আছে কোনাে পবিত্রতা, না আছে কোনাে স্বচ্ছতা না আছে এমন কোনাে বরকত যা জীবনকে টিকিয়ে রাখার জন্যে প্রয়ােজনীয় দিকনির্দেশনা দিতে পারে। এ আধুনিক ব্যবস্থা অপবিত্রতা ও কদর্যতা থেকে পবিত্রতার দিকে এগিয়ে নেয়ার মতাে কোনাে উপায় উপাদান সরবরাহ করার কোনাে গ্যারান্টি দিতে পারেনি, পারেনি আদিম জাহেলিয়াতের ক্ষতিকারক দিক থেকে মানুষকে নাজাত দেয়ার কোনাে কর্মসূচী পেশ করতে। আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জতের প্রেরিত ইসলামী জীবন ব্যবস্থাই অতীতের মূর্খতা ও যুক্তিহীন অবস্থার ক্ষতি থেকে মানুষকে সত্যিকার কল্যাণের দিকে ও মানবতার বিকাশ সাধনের দিকে ডাকে। মানুষে মানুষে শান্তি ও সম্প্রীতি স্থাপনে এবং সকল দিক দিয়ে মানবতার সমৃদ্ধি ও উৎকর্ষ সাধনে সর্বপ্রথম এ জীবন ব্যবস্থাই এগিয়ে এসেছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ঘরের মানুষরাই এ কাজে প্রথম সাড়া দিয়েছেন, তারা এ ব্যবস্থাকে পবিত্র পরিচ্ছন্ন মন নিয়ে এবং সুস্পষ্ট বুঝ নিয়ে গ্রহণ করেছেন। কোরআনুল করীম সব উপায় ও পদ্ধতির দিকে নবী(স.)-এর স্ত্রীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তাদের অন্তরগুলােকে আল্লাহ রব্বুল আলামীন-এর সাথে সম্পর্কিত করে দিচ্ছে, তাদের অন্তরগুলােকে মহা আলােকময় আকাশের দিকে তুলে উর্ধগামী দিচ্ছে, যেখানে শুধু আল্লাহ জাল্লা শানুহুর নূরই বিচ্ছুরিত হয়, আল্লাহর মেহেরবানীতে ধীরে ধীরে তাদের অন্তর নশ্বর পৃথিবীর সাময়িক চাকচিক্যকে পরিহার করে শুভ্র সমুজ্জ্বল মহাকাশ পানে এগিয়ে যেতে পারে, আর সেই পদ্ধতিগুলাে হচ্ছে নিম্নরূপ, ‘তােমরা নামায কায়েম করাে, যাকাত আদায় করো এবং আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রসূলের আনুগত্য করো।’ সামাজিক জীবনের মধ্যে বাস করার সময় যেসব বাস্তব ব্যবহার ও কার্যকলাপের সম্মুখীন হতে হয়, সেসব থেকে জীবনকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে কিছু অনুষ্ঠান পালন করার নাম এবাদাত নয়; বরং গােটা জীবনে আল্লাহ পাকের সকল হুকুম পালন করার মাধ্যমে তাঁর পূর্ণাংগ আনুগত্য করাই হচ্ছে এবাদাত। এ জন্যে এই বিশেষ আনুষ্ঠানিক কাজগুলাে অবশ্য সহায়ক ভূমিকা পালন করে এবং এগুলাে সেই আনুগত্য পূর্ণ জীবন যাপনের পথের পাথেয় হয়। সুতরাং, আনুগত্য প্রকাশক সে অনুষ্ঠানসমূহ আল্লাহর সাথে মানুষের সম্পর্ক স্থাপনে সহায়তা করে এবং তা এ পথের উপাদান হিসাবে কাজ করে, আর আল্লাহ তায়ালার সাথে সম্পর্ক যতাে গভীর হবে ততােই মােমেনের অন্তর পবিত্র হবে ও নানাবিধ কলুষ-কালিমা থেকে তা মুক্ত হবে। আল্লাহ তায়ালার সাথে সম্পর্কের কারণেই মানুষের নযরে মানুষ সম্মানিত বলে বিবেচিত হয়, সমাজের নেতৃত্ব ও আশেপাশের পরিবেশ ও পরিস্থিতি তার নিয়ন্ত্রণে এসে যায় এবং তখন সে ভালােভাবে বুঝতে পারে যে, তার এসব সাফল্যের পেছনে এই জিনিসটিই সবথেকে বেশী সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। এ সময়ে সে নিজেই বুঝতে পারে যে, সে হচ্ছে মানুষের মধ্যে বেশী হেদায়াতপ্রাপ্ত এবং অধিক সম্মানিত, সমাজ ও আশে পাশের পরিবেশের মধ্যে মানুষের কাছে সেই বেশী মর্যাদাবান। সে আরও বুঝতে পারে যে, সে হেদায়াতের যে নূর দেখতে পাচ্ছে, তার দ্বারা অপরকে অধিক যােগ্যতার সাথে পরিচালনা করা যায়। কেননা, মানবনির্মিত জাহেলী ব্যবস্থা। আল্লাহর ব্যবস্থার বিরােধী হওয়ার কারণে তা জীবনকে চরম অধপতনের দিকে নিয়ে যায়। ইসলাম এমন একটি একক ও তুলনাহীন জীবন ব্যবস্থা, যার মধ্যে যুক্তি বুদ্ধি ও মানুষের বিবেককে জাগিয়ে তােলার মতাে কর্মসূচী, নিয়ম শৃংখলা, চরিত্র, জীবনের জন্য প্রয়ােজনীয় বিধানাবলী ও সঠিক আদব কায়দা মজুদ রয়েছে। অবশ্য এসব কিছু পরিচালিত হয় তার অন্তরের গভীরে অবস্থিত দৃঢ় বিশ্বাসের ভিত্তিতে। এই আকীদার ভিত্তিতে সঠিক কাজ করার জন্যে প্রয়ােজন এক বিশেষ আকাংখা। হ্যা, এই সামগ্রিক ও সর্বব্যাপী জীবন ব্যবস্থা কায়েম হওয়ার ওপরই বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠা নির্ভর করে, যার অভাবে গােটা বিশ্ব অশান্তির অংগারে পরিণত হচ্ছে। এ জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু হয়েছে নামায কায়েম, যাকাত আদায় এবং জীবনের সকল ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রসূলের আনুগত্যের মাধ্যমে। *আহলে বাইতের অনুকরণীয় আদর্শ : আল্লাহ তায়ালা তার বান্দা ও খলীফা হিসাবে যে মানুষকে পয়দা করলেন, তার প্রতি এসব নির্দেশ দান করে তাকে চিন্তা-চেতনা, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও ব্যবহারের মাধ্যমে সর্বাধিক যােগ্য ও আদর্শ হিসাবে দুনিয়ার সামনে দাঁড় করাতে চাইলেন এবং মহান রাব্বুল আলামীন রসূলুল্লাহ(স.)-এর ঘর ও তার অধিবাসীদেরকে সেখানে পেশ করলেন আদর্শের প্রতীক হিসেবে। এরা নামায-রােযা ও আল্লাহর যাবতীয় হুকুম পালন করার ব্যাপারে অগ্রণী ছিলেন। এই আহলে বাইত বা রসূলুল্লাহ(স)-এর পবিত্র গৃহবাসীরা ছিলেন পুরােপুরিই আল্লাহমুখী। আল্লাহমুখী হওয়ার জন্যে যেমন সদা-সর্বদা আল্লাহ তায়ালার যাবতীয় হুকুম পালন করার জন্যে উন্মুখ হয়ে থাকা প্রয়ােজন, তেমনি আনুগত্য প্রকাশক কিছু প্রতীকী কাজ নিয়মিতভাবে পালন করাও প্রয়ােজন। সেই প্রতীকী কাজ (যা সকল মুসলমানের জন্যে সমভাবে প্রযােজ্য, তা) হচ্ছে নামায, রোযা এবং এ দুটি এবাদতের সাথে অন্যান্য যে কোনাে হুকুম সামনে আসবে, তা মানার জন্যে সর্বান্তঃকরণে প্রস্তুত থাকা, এ সকল ফরমাবরদারীর বিবেচনাতেই ‘আহলে বায়ত’ ছিলেন সারা দুনিয়ার সামনে মডেল বা আদর্শ। এই পরিবারটিকে মডেল বানানাের পেছনে আল্লাহ তায়ালার জ্ঞান, ইচ্ছা ও লক্ষ্যই প্রধানত সক্রিয় ছিল। তাই এরশাদ হচ্ছে, ‘অবশ্যই আল্লাহ তায়ালা আহলে বায়তদের থেকে সকল প্রকার কলুষ কালিমা দূর করতে চান এবং তাদেরকে সকল দিক থেকে পবিত্র বানাতে চান।’ এ আয়াতটির ব্যাখ্যা করতে গেলে অনেকগুলাে মূল্যবান তথ্য পাওয়া যায়; এবং সেগুলাের প্রত্যেকটিই আকর্ষণীয় এক স্নেহ মায়ামমতায় ভরা। আয়াতটির মধ্যে ‘আহলুল বায়ত’ (গৃহবাসী) শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এর মধ্যে কোন ঘর তা বলা হয়নি। কিন্তু আল বায়ত শব্দের মধ্যে ‘আল’ নির্দিষ্টসূচক অব্যয় রয়েছে, যেমন, আশ-শামসু, আল কামারু ও আল কাবা, অর্থাৎ এ শব্দগুলাে দ্বারা যে সব জিনিসকে বুঝায় সেগুলোর প্রত্যেকটি নিজ নিজ স্থানে একক বােধক, এগুলাের কোনাে দ্বিতীয় নেই। এগুলাের জন্যে ইংরেজীতে যেমন ‘দি’ ব্যবহার করা হয়েছে, আরবীতে তেমনি এর সম অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে ‘আল’। সুতরাং বুঝা যাচ্ছে, আল বায়ত হচ্ছে সেই একক ও অদ্বিতীয় ঘর বা বাড়ী যার সমকক্ষ দুনিয়াতে আর কোনাে ঘর নেই। বায়ত+আল্লাহ= ‘বায়তুল্লাহ’ এবং বায়ত+আল+হারাম= ‘বাইতুল হারাম’ বলে যেমন আল্লাহর মর্যাদাবান ঘর বলে অভিহিত করা হয়েছে, তেমনি আহল+আল+বায়ত=আহলুল বায়ত বলে একমাত্র নবী(স.)-এর ঘরকে সারা পৃথিবীর বুকে মর্যাদাবান বলে ঘােষণা দেয়া হয়েছে এবং এই মর্যাদাকে অক্ষুণ্ন রাখতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নিজেই মােমেনদের জানাচ্ছেন, ‘অবশ্য তিনি তােমাদের থেকে সকল কলুষ কালিমাকে দূর করে দিতে চান, হে আহলে বায়ত (বিশেষ ঘরের বাসিন্দারা) এবং তােমাদেরকে সর্বোতভাবে পবিত্র করতে চান তিনি)।’ এখানে বিশেষভাবে বলা হয়েছে যে, তাদের প্রতি আল্লাহ রব্বুল আলামীন-এর স্নেহের কথা এবং এই স্নেহের কারণ বর্ণনা করে বলা হচ্ছে, আল্লাহ সােবহানাহু ওয়া তায়ালা তাদের মর্যাদা বাড়াতে চান এবং তিনি আহলে বায়তের মধ্যে তাদের মর্যাদা সম্পর্কে তাদের মধ্যে সচেতনতা আনতে চান, তিনি তাদেরকে পবিত্র বানাতে চান এবং তাদের মধ্য থেকে সকল কলুষ কালিমাকে দূর করতে চান। হ্যা, তাদেরকে পরিচালনার জন্যে এটা আল্লাহর সরাসরি মর্যাদাপূর্ণ হস্তক্ষেপ। যখন আমরা চিন্তা করি- এ কোন মহান সত্ত্বা, যিনি এ পবিত্র বাণী উচ্চারণ করছেন, তখন দেখতে পাই, এ বাণী উচ্চারণকারী হচ্ছেন সেই মহামহিম সম্রাট, যিনি গােটা বিশ্বের প্রতিপালক, যিনি তার সৃষ্টিকে লক্ষ্য করে বলেছেন, ‘হয়ে যাও, ব্যস- তা অমনি হয়ে যায়।’ মহা-সম্মানিত ও মহা মর্যাদাবান আল্লাহ, তিনিই সবার খবরদারী করেন, হেফাযত করেন, তিনি মহা শক্তিমান, যিনি শক্তি বলে সবাইকে নিয়ন্ত্রণ করেন… তার এ শব্দগুলাে সামনে রেখে যখন আমরা চিন্তা-ভাবনা করি, তখন তার কথার অর্থসমূহ একে একে আমাদের বােধগম্য হতে থাকে; হৃদয়ের অভ্যন্তরে পরম মর্যাদাপূর্ণ আল্লাহর পবিত্র অস্তিত্বের কথা শ্রদ্ধাসহকারে অনুভূত হতে থাকে। মহান পরওয়ারদেগার এ কথাগুলাে সেই পবিত্র কিতাবের মধ্যে উল্লেখ করছেন, যার তেলাওয়াত মহাকাশের সর্বোচ্চ মনযিলে এবং দুনিয়াতে সদা-সর্বদা নিশিদিন পঠিত হচ্ছে, পঠিত হচ্ছে পৃথিবীর কোণায় কোণায় প্রতি মুহূর্তে। এ পাক কালামের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কোটি কোটি মানুষ আল্লাহ তায়ালার আনুগত্য প্রকাশ করে চলেছে। এ পাক কালামের আলােচ্য আয়াতগুলােই ঘােষণা দিচ্ছে যে, এই আকর্ষণীয় বাক্যসমূহ আল বায়ত’-এর মধ্য থেকে সকল আবিচলতাকে দুরীভূত করতে চায় এবং এ ঘরকে সকল পাক-পংকিলতা থেকে পবিত্র করার উদ্দেশ্যেই এগুলাে অবতীর্ণ হয়েছে। এখানে তাত্বহীর শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, যার অর্থ হচ্ছে পবিত্রকরণ। আর (আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক) অপবিত্রতা বা কলুষতা দূরীভূত করণ দ্বারা সেই সব উপায় অবলম্বন করা সম্ভব হয় যেগুলাের ফলে মানুষ নিজেদেরকে নিষ্কলুষ বানানাের এরাদা করতে পারে, অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা নিজেই যখন কাউকে পবিত্র করতে চান, তখন সে লক্ষ্য অর্জনের জন্যে যে সব উপায় ও পদ্ধতি অবলম্বন করা প্রয়ােজন, আল্লাহ তায়ালা সেগুলাে তার জন্যে সহজ করে দেন। এর ফলে তারা তাদের কর্মজীবনে সে সব উপায় ও পদ্ধতিকে বাস্তবায়িত করে। এটাই হচ্ছে আল্লাহর ইচ্ছা… অন্তরের মধ্যে চেতনা ও তাকওয়া সৃষ্টি করা। যার প্রতিফলন ঘটবে ব্যবহার ও কাজের মধ্যে। এভাবেই পরিপূর্ণ ইসলামী জীবন ব্যবস্থা কায়েম হবে এবং জীবনের সর্বক্ষেত্রে এর উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অর্জিত হবে। নবী(স.)-এর স্ত্রীদেরকে যেভাবে আল্লাহ তায়ালা গড়তে চেয়েছিলেন তার বিবরণ শেষ হচ্ছে, রসূলুল্লাহ(স)-এর স্ত্রী হওয়ার কারণে তাঁদের মর্যাদার বিবরণও এখানে শেষ হচ্ছে, সমাপ্ত হচ্ছে তাঁদের প্রতি মহান আল্লাহর মেহেরবানীর বিবরণ । তারপর মহান রাব্বুল আলামীন তাদের ঘরগুলােকে কোরআন ও জ্ঞান বিজ্ঞানের কথা নাযিল হওয়ার উপযুক্ত স্থানে পরিণত করলেন, এ ঘরগুলােকে আল্লাহ, হেদায়াত ও ঈমানের উৎস বানালেন।
# এরশাদ হচ্ছে, ‘স্মরণ করাে। (হে নবীর স্ত্রীরা) আল্লাহর সেই সব আয়াত এবং জ্ঞানগর্ভ কথাগুলােকে- যা তােমাদের ঘরসমূহে পঠিত হয়ে থাকে, নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়সমূহ সম্পর্কে সম্যক অবগত।’ অর্থাৎ, এই মহাগ্রন্থ আল কোরআন মহা সৌভাগ্যের প্রতীক, উপদেশ দেয়ার জন্যে এ পাক পবিত্র কালামই যথেষ্ট। এটা এজন্যে যেন মানুষ তার মহান মর্যাদা বুঝতে পারে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কীর্তিসমূহ অনুভব করে এবং আল্লাহর ভান্ডারে রক্ষিত চির নেয়ামতসমূহের প্রাচুর্য হৃদয়ংগম করতে পারে, যার সমকক্ষ অন্য কোনাে নেয়ামত হতে পারে না। আরেকটি মূল্যবান উপদেশের কথা এখানে আসছে, যা নবী(স.)-এর স্ত্রীদেরকে সম্বাধন করে দেয়া হয়েছিলাে, আর তা হচ্ছে, তারা যেন ক্ষণস্থায়ী এ দুনিয়ার সাময়িক সুখ-সৌন্দর্য্য ও সাজ-সজ্জার সাথে আল্লাহ তায়ালা, তাঁর রসুল এর সন্তুষ্টি এবং আখেরাতের স্থায়ী যিন্দেগীর তুলনা করে দেখে এবং বুঝতে চেষ্টা করে যে, কোনটা বেশী গ্রহণযােগ্য। এতে করে তারা বুঝতে পারবে যে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাদেরকে সারা দুনিয়ার নারীকূলের মধ্যে যে মর্যাদা দান করেছেন তা কতাে বড়াে নেয়ামত এবং দুনিয়ার যিন্দেগীর সুখ-সম্পদ সে মহা নেয়ামতের তুলনায় কতাে তুচ্ছ-কতাে সামান্য।
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
৩২-৩৪ নং আয়াতের তাফসীর:
পূর্ববর্তী আয়াতসমূহে পুণ্যবতী স্ত্রীগণকে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সমীপে এমনসব দাবী পেশ করতে বারণ করা হয়েছে তাঁর পক্ষে যা পূরণ করা কঠিন বা যা তাঁর মহান মর্যাদার পক্ষে অশোভনীয়। যখন তারা তা মেনে নিয়েছেন তখন সাধারণ নারীদের তুলনায় তাদের মর্যাদা বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে এবং তাদের এক আমলকে দুয়ের সমতুল্য করে দেয়া হয়েছে। পরবর্তী পর্যায়ে তাদের কর্মের পরিশুদ্ধি এবং রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সান্নিধ্য ও দাম্পত্য সম্পর্কের যোগ্য করে গড়ে তোলার জন্য কয়েকটি উপদেশ বাণী দিয়েছেন। এসব উপদেশ শুধু তাদের সাথে সীমাবদ্ধ নয় বরং সকল মু’মিন নারীদের জন্যই প্রযোজ্য। এখানে তাদেরকে বিশেষভাবে সম্বোধন করা হয়েছে তাদেরকে বিশেষ গুরুত্বারোপের জন্য।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(يٰنِسَا۬ءَ النَّبِيِّ لَسْتُنَّ كَأَحَدٍ مِّنَ النِّسَا۬ءِ)
‘হে নাবীর স্ত্রীগণ! তোমরা কোন সাধারণ স্ত্রীলোকের মত নও’ অর্থাৎ মর্যাদা ও সম্মানে অন্যান্য সাধারণ মু’মিন নারীদের মত নও, বরং তাদের অনেক ঊবের্ধ। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:
وَإِنَّ فَضْلَ عَائِشَةَ عَلَي النِّسَاءِ كَفَضْلِ الثَّرِيدِ عَلَي سَائِرِ الطَّعَامِ
সকল নারীদের ওপর আয়িশাহ (رضي الله عنها) তেমন শ্রেষ্ঠ সারীদ (গোশত ও রুটি দিয়ে তৈরি করা খাবার) যেমন অন্যান্য খাবারের ওপর শ্রেষ্ঠ। (সহীহ মুসলিম হা: ২৪৩০) তবে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর স্ত্রীগণের মত আরো অনেক স্ত্রী শ্রেষ্ঠ রয়েছেন। যেমন তিনি বলেন: অনেক পুরুষ পরিপূর্ণতার শিখরে পৌঁছেছে কিন্তু নারীদের মধ্যে কেবল মারইয়াম বিনতে ইমরান (ঈসা (عليه السلام)-এর মা) ও ফির‘আউনের স্ত্রী পরিপূর্ণতা লাভ করেছে। (সহীহ বুখারী হা: ৩৪১১)
এখন আল্লাহ তা‘আলা নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর স্ত্রীসহ সকল মু’মিন নারীদেরকে কয়েকটি অবশ্য পালনীয় নির্দেশ প্রদান করছেন:
(১) আল্লাহ তা‘আলা বলছেন: (فَلَا تَخْضَعْنَ بِالْقَوْلِ) ‘কোমল কন্ঠে কথা বল না’
অর্থাৎ নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর স্ত্রীদেরকে সম্বোধন করে সকল মু’মিন নারীদেরকে বলছেন; যদি পর্দার অন্তরাল থেকে পর পুরুষের সাথে কথা বলার প্রয়োজন দেখা দেয় তাহলে কোমল কন্ঠে কথা বলবে না, যদি বল তাহলে যাদের অন্তরে কৃপ্রবৃত্তির ব্যাধি রয়েছে তারা আসক্ত হয়ে যাবে। বরং ন্যায়সঙ্গতভাবে বলবে। মোট কথা নারীদের সম্মান রক্ষা ও পর পুরুষের কুপ্রবৃত্তি থেকে নিরাপদ রাখার জন্য এ ব্যবস্থা।
(২) আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَقَرْنَ فِيْ بُيُوْتِكُنَّ)
‘আর তোমরা নিজেদের ঘরে অবস্থান কর’
অর্থাৎ প্রাক-ইসলামী যুগে মহিলারা যেমন দেহ সৌষ্ঠব ও সৌন্দর্য প্রদর্শন করে ঘোরাফেরা করত তোমরা তাদের মত কর না। বরং তোমরা তোমাদের বাড়িতে অবস্থান কর। এ আয়াতে পর্দা সম্পর্কিত দুটি বিষয় জানা যায়ন প্রথমত: আল্লাহ তা‘আলার নিকট নারীদের বাড়িতে থাকাই কাম্য। গৃহকর্ম সম্পন্ন করার উদ্দেশ্যেই তাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে, তাই এ কাজেই তারা আত্মনিয়োগ করবে। কারণ ইসলাম নারীদেরকে উপার্জনের নির্দেশ দেয়নি, যতদিন পিতার বাড়িতে থাকবে ততদিন পিতা দায়িত্ব বহণ করবে, আর যখন স্বামীর বাড়িতে চলে যাবে তখন স্বামী ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নিবে। সুতরাং মহিলাদের বাইরে যাওয়ার কোন প্রয়োজন নেই।
দ্বিতীয়ত: যদি একান্ত প্রয়োজন দেখা দেয় তাহলে বাইরে যেতে পারবে তবে জাহিলী যুগের নারীদের মত সৌন্দর্য প্রদর্শন করে নয় বরং আপদমস্তক ঢেকে মাথার ওপর থেকে চাদর দ্বারা আবৃত করে নিবে। এ সম্পর্কে অত্র সূরার ৫৯ নং আয়াতে আলোচনা করা হবে। ইনশাআল্লাহ।
ইবনু মাসউদ (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত, নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: নিশ্চয়ই মহিলারা হল পর্দায় থাকার বস্তু। যখন সে বাড়ি থেকে (বেপর্দায়) বের হয় তখন শয়তান তাদের প্রতি ওঁৎ পেতে থাকে। তারা আল্লাহ তা‘আলার খুব বেশি নিকটবর্তী হয় তখন যখন নিজেদের বাড়িতে অবস্থান করে। (তিরমিযী হা: ১১৭৩, ইবনু খুযায়মা হা: ১৬৮৫, সহীহ)
তাই মহিলাদের বিশেষ প্রয়োজন ব্যতীত নিজের বাড়ি থেকে বের না হওয়াটাই উত্তম। এমনকি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাদের সালাত আদায় করার ব্যাপারে বলেনন নারীর অন্দর মহলের সালাত তার বাড়ির সালাত অপেক্ষা উত্তম এবং বাড়ির সালাত আঙ্গিনার সালাত হতে উত্তম। (আবূ দাঊদ হা: ৫৭০, ইবনু খুযায়মাহ হা: ১৬৯০, সহীহ)
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: যে মহিলা আঁতর ব্যবহার করে কোন জাতির পাশ দিয়ে অতিক্রম করে যাতে তারা সুঘ্রাণ পায় তাহলে সে মহিলা ব্যভিচারিণী। (নাসায়ী হা: ৫১২৬, হাসান)
সুতরাং নারীদের সম্ভ্রম, সম্মান রক্ষা করার জন্য ও ইভটিজিং এর হাত থেকে বাঁচার জন্য সারা পৃথিবীব্যাপীও যদি নারী দিবস, নারী মুক্তি আন্দোলন ও মিটিং-মিছিল করা হয় তাতে নারীদের সম্মান রক্ষা করা সম্ভব হবে না যদি আল্লাহ তা‘আলার এ বিধানের কাছে আত্মসমর্পণ না করে। তাই প্রতিটি নারী বিশেষ করে মুসলিম নারীর উচিত বাড়ির বাইরে বের হলে পর্দার সাথে বের হওয়া। এতে নিজের সম্মান রক্ষা পাবে ও পরিবেশ স্থিতিশীল থাকবে।
আয়িশাহ (رضي الله عنها)-এর উষ্ট্রের যুদ্ধে ভূমিকা সম্পর্কে রাফিযীদের অসার ও অযৌক্তিক মন্তব্য:
উপরোক্ত আলোচনা থেকে এ কথা প্রতিয়মান হয় যে, কুরআনের ভাষ্য ও রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর আমল ও সাহাবীদের ইজমা দ্বারা প্রমাণিত যে, প্রয়োজনীয় স্থানসমূহ আয়াতের আওতা বহির্ভূত। হাজ্জ ও ওমরা প্রভৃতি ধর্মীয় প্রয়োজনে মহিলারা বাড়ির বাইরে যেতে পারবে। যেমন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ইনতেকালের পর আয়িশাহ ও সাফিয়্যাহসহ অনেকে হাজ্জ সফরে গিয়েছেন। কিন্তু উষ্ট্রের যুদ্ধে আয়িশাহ (رضي الله عنها)-এর অংশ গ্রহণকে কেন্দ্র করে রাফিযীরা তাঁর ব্যাপারে অশালীন ও অসার কথা রটনা করেছে। মূলত তারা এসব করেছে তাঁর প্রতি হিংসা বিদ্বেষবশত। তিনি সে সব থেকে পবিত্র ও অনেক ঊর্ধ্বে। আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে এসব অপবাদের জন্য ধ্বংস করুক।
(৩-৫) আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে নির্দেশ প্রদান করছেন যে, তারা যেন সালাত কায়েম করে, যাকাত আদায় করে এবং আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর আনুগত্য করে। কেননা এর দ্বারা তাদের থেকে অপবিত্রতা দূর হয়ে যাবে এবং তারা পূতপবিত্র থাকতে পারবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(مَا يُرِيْدُ اللّٰهُ لِيَجْعَلَ عَلَيْكُمْ مِّنْ حَرَجٍ وَّلٰكِنْ يُّرِيْدُ لِيُطَهِّرَكُمْ)
“আল্লাহ তোমাদেরকে কষ্ট দিতে চান না; বরং তিনি তোমাদেরকে পবিত্র করতে চান” (সূরা মায়িদাহ ৫:৬)
(إِنَّمَا يُرِيْدُ اللّٰهُ لِيُذْهِبَ عَنْكُمُ الرِّجْسَ أَهْلَ الْبَيْتِ)
‘হে নাবীর পরিবার! আল্লাহ তোমাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করতে চান’ এ আয়াতে আহলে বাইতকে পাপের পংকিলতা ও কলুষতা থেকে মুক্ত ঘোষণা দেয়া হয়েছে।
رِجْسَ শব্দটি আরবি ভাষায় বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়। কখনো প্রতিমা ও মূর্তি অর্থে, কখনা নিছক পাপ অর্থে, কখনো আযাব অর্থে আবার কখনো কলূষতা ও অপবিত্রতা অর্থে ব্যবহৃত হয়। এ আয়াতে সে অর্থেই ব্যবহার করা হয়েছে। (বাহরুল মুহীত)
আহলে বাইত দ্বারা উদ্দেশ্য: উপরোক্ত আয়াতগুলোতে নাবী-স্ত্রীগণকে সম্বোধন করা হয়েছিল বলে স্ত্রীবাচক ক্রিয়া ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু এখানে পুণ্যবতী স্ত্রীগণের সাথে সাথে তাঁদের সন্তান-সন্ততি এবং পিতা-মাতাও আহলে বাইতের অন্তর্ভুক্ত। সে জন্যই পুংলিঙ্গ পদ ব্যবহার করা হয়েছে।
কোন কোন মুফাসসিরদের মতে আহলে বাইত দ্বারা কেবল রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর স্ত্রীদেরকেই বুঝানো হয়েছে। ইবনু আব্বাস, সাঈদ বিন যুবাইর, ইকরিমা ও মুকাতির (رضي الله عنهم) এ মত পোষণ করেছেন। কিন্তু হাদীসের বিভিন্ন বর্ণনায় যেগুলো ইবনু কাসীর স্বীয় তাফসীরে উল্লেখ করেছেন তা একথার সাক্ষ্য বহন করে যে, ফাতিমা, হাসান ও হুসাইন আহলে বাইতের অন্তর্ভুক্ত। যেমন মুসলিমের বর্ণনা, আয়িশাহ (رضي الله عنها) বলেন: একদা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বাড়ি থেকে বাইরে যাচ্ছিলেন। এমন সময় তাঁর গায়ে একটি কালো রুমী চাদর জড়ানো ছিলেন। তখন সেখানে হাসান, হুসাইন, ফাতিমা ও আলী (رضي الله عنهم) সবাই একের পর এক আসলেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাদের সবাইকে চাদরের ভিতরে প্রবেশ করিয়ে নিয়ে এ আয়াত তেলাওয়াত করলেন। (সহীহ মুসলিম হা: ২৪২৪)
উম্মু সালামাহ (رضي الله عنها) বলেন: এ আয়াতটি আমাদের বাড়ির ব্যাপারে নাযিল হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আলী, ফাতিমা, হাসান ও হুসাইন (رضي الله عنهم)-কে ডাকলেন, তারপর তার জামার নিচে প্রবেশ করিয়ে নিলেন এবং বললেন: এরা আমার আহলে বাইত। তারপর আয়াত তেলাওয়াত করলেন এবং বললেন: হে আল্লাহ তা‘আলা! তাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করুন ও পূর্ণরূপে পবিত্র করুন। উম্মু সালামাহ (رضي الله عنها) বললেন: আমিও তাদের সাথে হে আল্লাহ তা‘আলার রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন: তুমি আমার সাথে থাক, তুমি কল্যাণের ওপর রয়েছো। (তিরমিযী হা: ৩২০৫, সহীহ)
সুতরাং আহলে বাইত বলতে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সেই পরিবার-পরিজন উদ্দেশ্য যাদের ওপর সাদকাহ হারাম। এরা হলেনন আলী, জাফর, আব্বাস (رضي الله عنه)-এর পরিবার ও সন্তান-সন্ততি এবং বনু হারেস বিন আবদুল মুত্তালিব এবং নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সকল পবিত্রা স্ত্রীগণ ও কন্যাগণ।
ইবনু কাসীর (رحمه الله) এ সম্পর্কে আরো বর্ণনা এনে বলেন: কুরআন মাজীদ নিয়ে যে ব্যক্তি চিন্তা-গবেষণা করে সে কখনো এ ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করে না যে, নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর স্ত্রীগণও উপরোক্ত আয়াতে শামিল। কেননা বাক্যের পূর্বাপর ধারা নাবীর স্ত্রীদের সাথে সম্পৃক্ত। এজন্য উপরোক্ত আয়াতের পর পরই আল্লাহ তা‘আলা বলেন: ‘আর তোমাদের বাড়িতে আল্লাহর যে আয়াতসমূহ ও জ্ঞানের কথা যা পাঠ করা হয় তা তোমরা স্মরণ কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ খুব সূক্ষ্মদর্শী, সর্বজ্ঞ।’
কাতাদাহ ও আরো অনেকে বলেন: আয়াতের অর্থ হলন তোমরা সে নেয়ামতের কথা স্মরণ কর যা সকল মানুষের মধ্য থেকে শুধু তোমাদের জন্যই নির্ধারণ করা হয়েছে। তা হলন তোমাদের ঘরেই ওয়াহী নাযিল করা হয়। আয়িশাহ তাদের মধ্যে প্রথম যিনি এ নেয়ামত লাভ করেছেন এবং এ ব্যাপক রহমত লাভে তিনি তাদের মধ্যে এক বিশেষ মর্যদার অধিকারিণী ছিলেন। কেননা তিনি ব্যতীত রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর আর কোন স্ত্রীর বিছানায় ওয়াহী নাযিল হয়নি, যেমন স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন। এ জন্য আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআত আহলে বাইতকে ভালবাসে ও মহব্বত করে থাকে। আর তাদের ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর অসিয়তকে স্মরণ রাখে যা তিনি ‘গাদীরে খাম’ নামক স্থানে ব্যক্ত করেছেন।
أذكركم الله في أهل بيتي
আমি তোমাদেরকে আমার আহলে বাইতের ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলার কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি। (সহীহ মুসলিম হা: ২৪০৮)
কিন্তু আহলে বাইতকে ভালবাসা ও মহব্বত করা হবে শর্তসাপেক্ষে। তারা সুন্নাতের অনুসারী হলে এবং মিল্লাতের আদর্শের ওপর স্থিতিশীল থাকলে, যেমনিভাবে তাদের পূর্ববর্তী সালফে সালেহীন আব্বাস (رضي الله عنه) ও তাঁর সন্তানরা, আলী (رضي الله عنه) ও তাঁর সন্তানরা প্রমুখ আদর্শের ওপর ছিলেন। পক্ষান্তরে যারা সুন্নাতের বিরোধিতা করবে এবং দীনের ওপর স্থিতিশীল থাকবে না, তারা আহলে বাইতের অন্তর্ভুক্ত হলেও তাদের সাথে বন্ধুত্ব রাখা জায়েয হবে না।
অতএব আহলে বাইত সম্পর্কে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের ভূমিকা ন্যায়পরায়ণ ও ইনসাফের ওপর প্রতিষ্ঠিত। তারা দীনদার ও সঠিক পথের ওপর অবিচল থাকলে তাদেরকে ভালবাসতে হবে, আর দীন থেকে সরে গেলে ও সুন্নাতের বিরোধিতা করলে আহলে বাইতের অর্ন্তভুক্ত হওয়া, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে আত্মীয় সম্পর্ক থাকা কোন কাজে আসবে না।
হাদীসে এসেছে:
وَمَنْ بَطَّأَ بِهِ عَمَلُهُ، لَمْ يُسْرِعْ بِهِ نَسَبُهُ
আমল যাকে পেছনে ফেলে দেয় বংশ তাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে না। আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআত সে সব রাফেজী-শিয়াদের পথ ও মত থেকে পূত-পবিত্র যারা কোন কোন আহলে বাইতের ব্যাপারে খুবই বাড়াবাড়ি করে থাকে এবং তাদেরকে মা‘সূম বলে দাবী করে থাকে। (সহীহ মুসলিম হা: ২৬৯৯)
অনুরূপ আহলুস সুন্নাহ সে সব নাসেবী লোকদের ভ্রান্ত পথ থেকে মুক্ত যারা দীনের প্রকৃত অনুসারী আহলে বাইতের প্রতি শত্র“তা পোষণ করে থাকে এবং তাদের প্রতি কটুক্তি আরোপ করে থাকে। এ সম্পর্কে সূরা শুরা ২৩ নং আয়াতে আলোচনা করা হবে। ইনশাআল্লাহ।
(اٰيٰتِ اللّٰهِ) অর্থ কুরআন আর الْحِكْمَةِ অর্থ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সুন্নাত। অধিকাংশ মুফাসসির এর তাফসীর সুন্নাত দিয়ে বর্ণনা করেছেন। তবে শব্দের অর্থ দুটি হতে পারেন –
১. এসব বিষয় স্মরণ রাখা, যার ফলশ্র“তিতে এগুলোর ওপর আমল হবে।
২. কুরআনের যা কিছু তাদের গৃহে নাযিল হয়েছে বা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন, উম্মাতের অন্যান্য লোকদের কাছে তা পৌঁছে দেয়া।
ইবনুল আরাবী আহকামুল কুরআনে বলেন: এ আয়াত প্রমাণ করেন যদি কোন ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছ থেকে কোন আয়াত বা হাদীস শুনে তাহলে তা অন্যের নিকট পৌঁছে দেয়া আবশ্যক এমনকি নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর স্ত্রীগণও পৌঁছে দিতে বাধ্য। সুতরাং এ আয়াতে যেরূপভাবে কুরআনের প্রচার-প্রসার ও শিক্ষা প্রদান করা উম্মাতের ওপর আবশ্যক করা হয়েছে তেমনি হেকমত শব্দের মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর হাদীসসমূহের প্রচার এবং শিক্ষা দান করাও আবশ্যক।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. নিজের স্বামী ব্যতীত অন্য কোন পরপুরুষের সঙ্গে মিষ্টি ভাষায় কোমল কণ্ঠে কথা বলা যাবে না।
২. মহিলারা সদা-সর্বদা ঘরের মধ্যে অর্থাৎ নিজ বাড়িতে অবস্থান করবে, বাইরে বের হলে পর্দার সাথে বের হবে ।
৩. পর্দা মহিলাদের সম্মান বৃদ্ধি করে, পর্দা নারীদের উন্নতির অন্তরায় নয় ।
৪. শীয়া ও তাদের চরমপন্থী দল রাফিযীদের ভ্রান্ত আকীদাহ ও অপপ্রচার থেকে সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে।
৫. কুরআনের প্রচার ও শিক্ষার পাশাপাশি হাদীস চর্চা ও শিক্ষা আবশ্যক, কারণ উভয়টি ইসলামী শরীয়তের উৎস।
৬. আহলে বাইতের প্রতি ভালবাসা ও মহব্বত থাকবে ন্যায়পরায়ণতা ও ইনফাসের ভিত্তিতে।