(টপিক#১০৫১/মুনাফিক কি? বই নং ৩৩:-) [‘তােমাদের জন্যে আল্লাহর রাসূলের মধ্যে উত্তম আদর্শ রয়েছে।’] www.motaher21.net সুরা:-(৩৩) আহযাব পারা:- ২১ আয়াত:-২১-৩১

أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#১০৫১/মুনাফিক কি? বই নং ৩৩:-)
[‘তােমাদের জন্যে আল্লাহর রাসূলের মধ্যে উত্তম আদর্শ রয়েছে।’]
www.motaher21.net
সুরা:-(৩৩) আহযাব
পারা:- ২১
আয়াত:-২১-৩১
لَقَدۡ کَانَ لَکُمۡ فِیۡ رَسُوۡلِ اللّٰہِ اُسۡوَۃٌ حَسَنَۃٌ لِّمَنۡ کَانَ یَرۡجُوا اللّٰہَ وَ الۡیَوۡمَ الۡاٰخِرَ وَ ذَکَرَ اللّٰہَ کَثِیۡرًا ﴿ؕ۲۱﴾
অবশ্যই তোমাদের জন্য রয়েছে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)‌ মধ্যে উত্তম আর্দশ , তার জন্য যে আসা রাখে আল্লাহ্ ও শেষ দিনের এবং আল্লাহ্‌কে বেশী স্মরণ করা।
৩৩:২২
وَ لَمَّا رَاَ الۡمُؤۡمِنُوۡنَ الۡاَحۡزَابَ ۙ قَالُوۡا ہٰذَا مَا وَعَدَنَا اللّٰہُ وَ رَسُوۡلُہٗ وَ صَدَقَ اللّٰہُ وَ رَسُوۡلُہٗ ۫ وَ مَا زَادَہُمۡ اِلَّاۤ اِیۡمَانًا وَّ تَسۡلِیۡمًا ﴿ؕ۲۲﴾
মুমিনগণ যখন সম্মিলিত বাহিনীকে দেখল, তারা বলে উঠল, ’এটা তো তাই, আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল যার প্রতিশ্রুতি আমাদেরকে দিয়েছিলেন এবং আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল সত্যই বলেছেন। ‘ আর এতে তাদের ঈমান ও আনুগত্যই বৃদ্ধি পেল।
৩৩:২৩
مِنَ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ رِجَالٌ صَدَقُوۡا مَا عَاہَدُوا اللّٰہَ عَلَیۡہِ ۚ فَمِنۡہُمۡ مَّنۡ قَضٰی نَحۡبَہٗ وَ مِنۡہُمۡ مَّنۡ یَّنۡتَظِرُ ۫ۖ وَ مَا بَدَّلُوۡا تَبۡدِیۡلًا ﴿ۙ۲۳﴾
ঈমানদারদের মধ্যে এমন লোক আছে যারা আল্লাহর সাথে কৃত অঙ্গীকার পূর্ণ করে দেখালো। তাদের কেউ নিজের নজরানা পূর্ণ করেছে এবং কেউ সময় আসার প্রতীক্ষায় আছে। তারা তাদের নীতি পরিবর্তন করেনি।
৩৩:২৪
لِّیَجۡزِیَ اللّٰہُ الصّٰدِقِیۡنَ بِصِدۡقِہِمۡ وَ یُعَذِّبَ الۡمُنٰفِقِیۡنَ اِنۡ شَآءَ اَوۡ یَتُوۡبَ عَلَیۡہِمۡ ؕ اِنَّ اللّٰہَ کَانَ غَفُوۡرًا رَّحِیۡمًا ﴿ۚ۲۴﴾
যাতে আল্লাহ্ পুরস্কৃত করেন সত্যবাদীদেরকে তাদের সত্যবাদীতার জন্য এবং শাস্তি দেন মুনাফিকদেরকে যদি তিনি চান অথবা তাদের ক্ষমা করেন। নিশ্চয় আল্লাহ্ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।
৩৩:২৫
وَ رَدَّ اللّٰہُ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا بِغَیۡظِہِمۡ لَمۡ یَنَالُوۡا خَیۡرًا ؕ وَ کَفَی اللّٰہُ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ الۡقِتَالَ ؕ وَ کَانَ اللّٰہُ قَوِیًّا عَزِیۡزًا ﴿ۚ۲۵﴾
আল্লাহ্ কাফিরদেরকে ত্রুদ্ধাবস্থায় ফিরিয়ে দিলেন, তারা কোন কল্যাণ লাভ করেনি। আর যুদ্ধে মুমিনদের জন্য আল্লাহ্ই যথেষ্ট ; এবং আল্লাহ্ সর্বশক্তিমান, প্রবল পরাক্রমশালী।
৩৩:২৬
وَ اَنۡزَلَ الَّذِیۡنَ ظَاہَرُوۡہُمۡ مِّنۡ اَہۡلِ الۡکِتٰبِ مِنۡ صَیَاصِیۡہِمۡ وَ قَذَفَ فِیۡ قُلُوۡبِہِمُ الرُّعۡبَ فَرِیۡقًا تَقۡتُلُوۡنَ وَ تَاۡسِرُوۡنَ فَرِیۡقًا ﴿ۚ۲۶﴾
কিতাবীদের মধ্যে যারা তাদেরকে সাহায্য করেছিল, তাদেরকে তিনি তাদের দূর্গ হতে অবতরণ করালেন এবং তাদের অন্তরে ভীতি সঞ্চার করলেন ; তোমরা তাদের কিছু সংখ্যককে হত্যা করছ এবং কিছু সংখ্যককে করছ বন্দী ।
৩৩:২৭
وَ اَوۡرَثَکُمۡ اَرۡضَہُمۡ وَ دِیَارَہُمۡ وَ اَمۡوَالَہُمۡ وَ اَرۡضًا لَّمۡ تَطَـُٔوۡہَا ؕ وَ کَانَ اللّٰہُ عَلٰی کُلِّ شَیۡءٍ قَدِیۡرًا ﴿٪۲۷﴾
তিনি তোমাদেরকে তাদের জায়গা-জমি, ঘর-বাড়ি ও ধন-সম্পদের ওয়ারিস করে দিয়েছেন এবং এমন এলাকা তোমাদের দিয়েছেন যাকে তোমরা কখনো পদানত করোনি। আল্লাহ‌ সর্বময় ক্ষমতা সম্পন্ন।
৩৩:২৮
یٰۤاَیُّہَا النَّبِیُّ قُلۡ لِّاَزۡوَاجِکَ اِنۡ کُنۡـتُنَّ تُرِدۡنَ الۡحَیٰوۃَ الدُّنۡیَا وَ زِیۡنَتَہَا فَتَعَالَیۡنَ اُمَتِّعۡکُنَّ وَ اُسَرِّحۡکُنَّ سَرَاحًا جَمِیۡلًا ﴿۲۸﴾
হে নবী! তোমার স্ত্রীদেরকে বলো, যদি তোমরা দুনিয়া এবং তার ভূষণ চাও, তাহলে এসো আমি তোমাদের কিছু দিয়ে ভালোভাবে বিদায় করে দিই।
৩৩:২৯
وَ اِنۡ کُنۡـتُنَّ تُرِدۡنَ اللّٰہَ وَ رَسُوۡلَہٗ وَ الدَّارَ الۡاٰخِرَۃَ فَاِنَّ اللّٰہَ اَعَدَّ لِلۡمُحۡسِنٰتِ مِنۡکُنَّ اَجۡرًا عَظِیۡمًا ﴿۲۹﴾
পক্ষান্তরে তোমরা আল্লাহ, তাঁর রসূল এবং পরকাল কামনা করলে, তোমাদের মধ্যে যারা সৎকর্মশীলা আল্লাহ তাদের জন্য মহা প্রতিদান প্রস্তুত রেখেছেন।’
৩৩:৩০
یٰنِسَآءَ النَّبِیِّ مَنۡ یَّاۡتِ مِنۡکُنَّ بِفَاحِشَۃٍ مُّبَیِّنَۃٍ یُّضٰعَفۡ لَہَا الۡعَذَابُ ضِعۡفَیۡنِ ؕ وَ کَانَ ذٰلِکَ عَلَی اللّٰہِ یَسِیۡرًا ﴿۳۰﴾
হে নবী-পত্নীগণ! তোমাদের মধ্যে কেউ কোন প্রকাশ্য অশ্লীল কাজ করলে তাকে দ্বিগুণ শাস্তি দেওয়া হবে। আর আল্লাহর জন্য তা সহজ।
৩৩:৩১
وَ مَنۡ یَّقۡنُتۡ مِنۡکُنَّ لِلّٰہِ وَ رَسُوۡلِہٖ وَ تَعۡمَلۡ صَالِحًا نُّؤۡتِہَاۤ اَجۡرَہَا مَرَّتَیۡنِ ۙ وَ اَعۡتَدۡنَا لَہَا رِزۡقًا کَرِیۡمًا ﴿۳۱﴾
তোমাদের মধ্যে যে কেউ আল্লাহ এবং তাঁর রসূলের প্রতি অনুগতা হবে ও সৎকাজ করবে, তাকে আমি দ্বিগুণ পুরস্কার দান করব। আর তার জন্য আমি সম্মানজনক জীবিকা প্রস্তুত রেখেছি।

ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-

*আদর্শ মানুষ হযরত মুহাম্মদ(স.) : ওপরে যে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আলােচিত হয়েছে, ওটা ছিলাে মােনাফেক তথা কপট ও ডন্ড মুসমানদের মানসিক ব্যাধিগ্রস্ত তথা বিপথগামী মুসলমানদের এবং মুসলিম সমাজে নানারকমের কুৎসা রটনা, অপপ্রচার ও গুজব ছড়ানাের অপকর্মে নিয়ােজিত বর্ণচোরা গৃহশত্রুদের। এটা ছিলাে তাদের চরিত্রের কুৎসিত দিক। তবে বিপদ-মুসিবত ও দুর্যোগ দুর্বিপাক মুসলমানদের সবাইকে পুরােপুরি বিকৃত ও বিপথগামী করতে পারেনি। সেই ঘুটঘুটে অন্ধকারের ভেতরেও একশ্রেণীর আলােকোজ্জ্বল, অটল ও দৃঢ় প্রত্যয়ী, আল্লাহর ওপর আস্থাশীল, তার ফয়সালায় তুষ্ট এবং তার সাহায্য লাভে আশাবাদী এক শ্রেণীর মুসলমানও ছিলাে। সমস্ত ভয় ভীতি, ও বিপদ-মুসিবতকে উপেক্ষা করে তারা নিজেদের নৈতিক মান টিকিয়ে রেখেছিলাে। এই দীপ্তিমান শ্রেণীটার বিবরণ স্বয়ং রসূল(স.)-এর বর্ণনা দিয়েই শুরু হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তােমাদের জন্যে আল্লাহর রসূলের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ’ যারা আল্লাহ তায়ালা ও আখেরাতে বিশ্বাসী এবং আল্লাহ তায়ালাকে বেশী করে স্মরণ করে তাদের জন্য (আয়াত ২১) সেই বিপজ্জনক ও শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতেও রাসুল(স.) মুসলমানদের জন্যে শান্তি ও নিরাপত্তার গ্যারান্টিযুক্ত আশ্রয়স্থল ছিলেন এবং তাদের আশা ভরসা ও পরিতুষ্টির উৎস ছিলেন। এই ভয়ংকর ঘটনায় অর্থাৎ খন্দক যুদ্ধে রসূল(স.) যে নীতি অনুসরণ করেন, তাতে বিভিন্ন আন্দোলন ও সংগঠনের নেতাদের জন্যে বহু শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে। যারা আল্লাহ তায়ালা ও আখেরাতে বিশ্বাসী, যাদের মন পবিত্র ও নিখুঁত আদর্শ কামনা করে এবং আল্লাহ তায়ালাকে স্মরণ রাখে, ভুলে যায় না, তাদের জন্যে রাসূলের জীবনে উত্তম আদর্শ রয়েছে। রসূল(স.)-এর জীবনে যে উত্তম ও চমৎকার অনুকরণীয় আদর্শ রয়েছে, তার বিস্তারিত বিবরণ দেয়া তাে সম্ভব নয়, তবে উদাহরণস্বরূপ তার কিছু নমুনা তুলে ধরছি, রসূল(স.) খন্দক ৰা পরিখা খননের কাজে মুসলমানদের সাথে সর্বতােভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিনি স্বহস্তে কোদাল দিয়ে মাটি কাটা, ঝুড়িতে করে মাটি অন্যত্র নিয়ে যাওয়া, সাধারণ মুসলমানদের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে কাজের ফাঁকে ফাঁকে উদ্দীপনাময় ধ্বনি বা শ্লোগান দেয়াসহ সব কাজে অংশ নেন। মুসলমানরা প্রচলিত ঘটনাবলীর শিক্ষা সম্বলিত সহজ-সরল কিছু গানও সমবেত গাচ্ছিলাে। এই মুসলমানদের মধ্যে জুয়াইল নামে এক ব্যক্তি ছিলাে রসূল(স.) তার নামটা অপছন্দ করলেন এবং তার নাম রাখলেন আমর। তৎক্ষনাৎ পরিখা খননের কাজে নিয়ােজিত লােকেরা সমবেত স্বরে গেয়ে উঠলাে, নাম ছিলাে তার জুয়াইল রাসূল রাখলেন আমর দুস্থ মানুষটির দিন হয়ে গেলাে উজ্জ্বল দিন। আর তাদের সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে রসূল(স.) গাইলেন। আমরা ডেবে দেখতে পারি, কেমন পরিবেশে মুসলমানরা কাজ করছিলাে। রাসূল(স.) তাদের মধ্যেই ছিলেন, কখনাে কোদাল দিয়ে মাটি কাটছিলেন, কখনাে ঝুড়িতে বয়ে মাটি সরাচ্ছিলেন, আর তাদের সাথে সমবেত কণ্ঠে উদ্দীপনামূলক গানও গাইছিলেন। ভেবে দেখা উচিত, এই পরিবেশ তাদের অন্তরাত্মায় কোন শক্তি সঞ্চারিত করছিলাে, তাদের সত্ত্বার অভ্যন্তরে বীরত্ব, সাহস, প্রত্যয়, আত্মসম্মানবােধ ও সর্বাবস্থায় সন্তুষ্ট থাকার মনােভাব কোন উৎস থেকে এনে দিচ্ছে। যায়েদ বিন ছাবিত মাটি সরানাের কাজে নিয়ােজিত ছিলেন। রাসূল(স.) তার প্রশংসা করে বললেন, বালকটা চমৎকার! ক্লান্তি ও অবসাদে এক সময় সে পরিখার ভেতরে ঘুমিয়ে পড়লাে। তখন প্রচন্ড শীত। আম্মারা ইবনে হাযম যায়েদের অস্ত্রটা নিয়ে গেলেন। যায়দ তা টের পেলাে না। পরে সে জেগে উঠে অন্ত্র না পেয়ে অস্থির হয়ে পড়লাে। রসূল(স.) তাকে বললেন, “ওহে ঘুমের বাবা, তুমি এমন ঘুমই পেড়েছে যে, তােমার অস্ত্র হারিয়ে গেছে। তারপর পুনরায় বললেন, এই বালকের অস্ত্রের সন্ধান কারাে জানা আছে নাকি? আম্মারা বললেন, ইয়া রসুলাল্লাহ, ওর অস্ত্র আমার কাছে আছে। তিনি বললেন, তাহলে ওটা ওকে ফিরিয়ে দাও। সেই সাথে বললেন, খেলাচ্ছলেও কখনাে কোনাে মুসলমানকে আতংকিত করা উচিত নয় এবং তার কোনাে জিনিস নেয়া উচিত নয়।’ এটা এমন একটা ঘটনা, যা মুসলিম বাহিনীর প্রত্যেক ছােট ও বড়াে সদস্যের চোখ ও মনের সচেতনতা ফুটিয়ে তােলে। সেই সাথে ‘হে ঘুমের বাবা, এমন ঘুম ঘুমিয়েছে যে, তোমার অন্তর উধাও হয়ে গেছ…’ এ উক্তির সন্ধান পাই সেই কঠিনতম পরিস্থিতিতেও মুসলমানরা পরিখাগুলোর ভেতরে তাদের নবীর নেতৃত্বে কেমন মিষ্ট ও মমতা বিজড়িত পরিবেশ সৃষ্টি করে রেখেছিলাে। তাছাড়া কোদাল দিয়ে মাটি কাটার সময় রাসূল(স.)-এর অন্তরাত্মা ইসলাম ও মুসলমানদের চূড়ান্ত বিজয় স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করছিলাে এবং সে কথা তিনি মুসলমানদেরকে জানিয়ে তাদের ভেতরে দৃঢ় আস্থা ও প্রত্যয় গড়ে তুলছিলেন। ইবনে ইসহাক বর্ণনা করেন, সালমান ফারসী বলেছেন যে, আমি খন্দকের এক কিনারে কোদাল চালালাম। কিন্তু একটা পাথর আমার কাছে অত্যন্ত শক্ত মনে হলো। রসূল(স.) তখন আমার কাছেই ছিলেন। আমাকে যখন মাটিতে আঘাত করতে দেখলেন এবং জায়গাটা আমার কাছে শক্ত লাগছে বলে অনুভব করলেন, তখন তিনি পরিখার ভেতরে নামলেন এবং আমার কাছ থেকে কোদালটা নিলেন। তারপর এমন জোরে কোদাল মারলেন যে, বিদ্যুৎ চমকে উঠলাে। তারপর পুনরায় কোদাল মারলেন। এবারও আগুন জ্বলে উঠলাে। তৃতীয়বারও কোদাল মারলেন এবং আগুন জ্বললাে। আমি বললাম, ইয়া রসূলাল্লাহ, আমার মা বাবা আপনার প্রতি উৎসর্গিত হােক! এটা কী দেখলাম? আপনি কোদাল দিয়ে আঘাত করা মাত্র আগুন জ্বললাে কেনাে? তিনি বললেন, হে সালমান, তুমি কি এটা দেখেছাে? আমি বললাম, জী হা। তিনি বললেন, প্রথম আগুন জ্বালার অর্থ হলাে, আল্লাহ তায়ালা আমাকে ইয়ামানের বিজয় দেবেন। দ্বিতীয়টার অর্থ হলাে, আল্লাহ তায়ালা আমাকে সিরিয়া ও পাশ্চাত্যের বিজয় দেবেন। আর তৃতীয়টার তাৎপর্য এই যে, আল্লাহ তায়ালা আমাকে প্রাচ্যের বিজয় দান করবেন। মিকরীযী রচিত ইমতাউল আসমা গ্রন্থে বলা হয়েছে যে, এ ঘটনায় হযরত সালমান ফারসী উপস্থিত ছিলেন বটে তবে ঘটনাটা রসূল(স.) এর সাথে নয়, বরং হযরত ওমরের সাথে ঘটেছিলাে। আমাদের ভাবা দরকার যে, যে সময়ে মদীনার সমগ্র মুসলিম রাষ্ট্রের অস্তিত্ব চরম সংকট ও হুমকির সম্মুখীন, তখন এ কথাটা তাদের অন্তরে কিভাবে রেখাপাত না করে থাকতে পারে, ওদিকে হানাদার বাহিনীর খবরাখবর নিয়ে হযরত হােযায়ফা যখন ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে ফিরে এলেন, তখনকার দৃশ্যটাও লক্ষ্য করার মতাে। তখন স্বীয় স্ত্রীর একখানা কম্বল গায়ে দিয়ে নামায আদায়রত থেকেও রাসূল(স.) হুযায়ফা প্রতি নিস্পৃহ থাকতে পারলেন না, বরং নামাযের ভেতরেই তিনি হােযায়ফাকে পায়ের কাছে বসালেন এবং তার গায়ের ওপর নিজের কম্বলের একাংশ দিয়ে ঢেকে দিলেন। তারপর নামায শেষে হােযায়ফা(রা.) রসূল(স.)-কে সেই সুসংবাদটা দিলেন, যা তিনি আগেভাগেই জেনে নিয়েছিলেন। হােযায়ফাকে কেবল হানাদার বাহিনীর পরিস্থিতির পর্যবেক্ষণের জন্যেই পাঠিয়েছিলেন। এই ভয়ংকর পরিস্থিতিতে রসূল(স.) এর সাহসিকতা, ধৈর্য, ও বিশ্বাস কেমন ছিলাে, সেটা সমগ্র ঘটনার মধ্যে প্রতিফলিত। সেগুলাে নতুন করে উল্লেখ করার কোনাে প্রয়ােজন নেই । ওগুলাে সকলেরই জানা আছে। আল্লাহ তায়ালা যথার্থই বলেছেন, ‘তােমাদের জন্যে আল্লাহর রাসূলের মধ্যে উত্তম আদর্শ রয়েছে।’

*মানবীয় দোষ গুণ সহ একজন মুমিনের পরিচয় : এরপর আসছে অটুট ঈমান ও দৃঢ় প্রত্যয়ের দৃশ্য তথা ঈমানী জ্যোতিতে জ্যোতির্ময় মুসলমানরা সেই ভয়াবহ সংকট কিভাবে মােকাবেলা করলেন তার দৃশ্য। যে সংকট মােমেনদের হৃদয়কে কাপিয়ে দিয়েছিলো, সেই সংকটকে তারা শুধু ধৈর্যের সাথে মােকাবেলাই করেননি, বরং তা থেকে দৃঢ় প্রত্যয়, আস্থা ও পরিতৃপ্তিও অর্জন করেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর যখন মুসলমানরা হানাদার বাহিনীগুলােকে দেখলাে, তখন বললাে, আল্লাহ তায়ালা ও তার রসুল আমাদের সাথে যে ওয়াদা করেছেন, এটা তাে তারই বাস্তব রূপ। আল্লাহ তায়ালা ও তার রসূল সত্য কথাই বলেছেন। বস্তুত এ ঘটনা তাদের ঈমান ও আত্মসমর্পণকে আরাে বাড়িয়ে দিয়েছে।’ বস্তুত খন্দকের যুদ্ধে মুসলমানরা যে ভীতি, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও ত্রাসের কবলে পড়েছিলাে, তা এতাে কঠিন, মারাত্মক ও ভয়াবহ ছিলাে যে, তা তাদেরকে কাঁপিয়ে দিয়েছিলাে। আল্লাহ তায়ালা নিজেই বলেছেন, ‘সেখানে ঈমানদারদেরকে পরীক্ষা করা হয়েছিলাে এবং প্রবলভাবে কাঁপিয়ে দেয়া হয়েছিলাে। তারা তো মানুষই ছিলেন। আর মানুষের শক্তি সীমাবদ্ধ। আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে মানবীয় শক্তির অতিরিক্ত কোনাে দায়িত্ব অর্পণ করেন না। আল্লাহ তায়ালা সর্বশেষে সাহায্য করবেনই এই বিশ্বাস থাকা সত্তেও এবং রসূল(স.)-এর ইয়ামান, সিরিয়া, পাশ্চাত্য ও প্রাচ্য বিজয়ের সুসংবাদ পাওয়া সত্তেও উপস্থিত ভয়াবহ বিপদ তাদেরকে দিশাহারা, অস্থির ও উদ্বিগ্ন করে তুলছিলাে। এই পরিস্থিতি সম্পর্কে সবচেয়ে নিখুঁত বর্ণনা আমরা হযরত হােযায়ফা থেকে পাই। রসূল(স.) তার সাহাবীদের অবস্থা তখন অনুভব করছিলেন এবং ভেতর থেকেই তাদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছিলেন। তাই বললেন, এমন কে আছে যে, কাফেরদের অবস্থার খোঁজ খবর নিয়ে ফিরে আসতে পারবে? অর্থাৎ রসূল(স.) বিশেষ গুরুত্ব সহকারে শর্ত আরােপ করছিলেন যে, যে ব্যক্তি যাবে, তাকে অবশ্যই ফিরে আসতে হবে, তারপর বললেন, এই ব্যক্তি যাতে বেহেশতে আমার সাথী হয়, সে জন্যে আমি আল্লাহর কাছে আবেদন জানাবাে। ফিরে আসার এই শর্ত এবং বেহেশতে রাসূল(স.)-এর সাথী হবার এই দোয়া সত্তেও কোন সাহাবী তার আহ্বানে সাড়া দিলেন না। কেবল নাম ধরে হােযায়ফা(রা.)-কে ডাকার পরই তিনি যেতে উদ্বুদ্ধ হলেন। তিনি বলেন, তিনি যখন আমাকে ডাকলেন, তখন আমার উঠে দাঁড়ানাে ছাড়া উপায়ন্তর ছিলাে না। সর্বোচ্চ পর্যায়ের আতংকের শিকার হওয়া ছাড়া এমন ব্যাপার যে ঘটতেই পারে না, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু এই ভীতিজনিত কাঁপুনি, চোখ উল্টে যাওয়া ও স্বাস বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম সত্তেও আল্লাহর সাথে তাদের সম্পর্ক ছিন্ন হয়নি এবং আল্লাহর চিরাচরিত রীতিনীতি সম্পর্কে তাদের উপলব্ধি ভ্ৰষ্ট হয়নি। তাদের এ বিশ্বাস অটুট ছিলাে যে, আল্লাহর পরীক্ষার স্তর যখন সফলতার সাথে উতরে যাওয়া যাবে, তখন তার সুফল তথা বিজয় অবশ্যই আসবে। এ জন্যে মুসলমানরা তাদের এই প্রাণান্তকর কষ্টের পর আল্লাহর সাহায্যের প্রতীক্ষায় ছিলেন এবং বিজয় নিশ্চিত বুঝতে পেরেছিলেন। কেননা তারা ইতিপূর্বে সূরা বাকারার এই আয়াতের বক্তব্যকে বাস্তবায়িত করেছিলেন, ‘তোমরা কি ভেবেছ, বেহেশতে চলে যাবে, অথচ এখনাে তােমাদের ওপর তােমাদের পূর্ববর্তীদের ন্যায় বিপদ মুসিবত আসেনি।’ তাদের ওপর এতাে বিপদ-মুসিবত ও দুঃখ-কষ্ট এসেছে যে, তারা কেঁপে উঠেছে। এমনকি রসূল ও তার সাথীরা বলে উঠেছে, ‘আল্লাহর সাহায্য কখন আসবে? জেনে রেখাে, আল্লাহর সাহায্য আসন্ন।’ যেহেতু তারাও কেঁপে উঠেছে। তাই আল্লাহর সাহায্য তাদের কাছেও আসন্ন । এ জন্যেই তারা শত্ৰুদেরকে দেখে বলেছে যে, এটা তাে আল্লাহ তায়ালা ও তার রসূল আমাদের সাথে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তারই বাস্তব রূপ । আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রসূল সত্য কথাই বলেছেন। এটা তাদের ঈমান ও আত্মসমর্পণকে কেবল বাড়িয়েই দিয়েছে। যেহেতু তারা মানুষ ছিলেন, তাই মানবীয় আবেগ অনুভূতি ও দুর্বলতার উর্ধ তারা ছিলেন এবং সেটা তাদের কাছে আশাও করা হয়নি। মানুষ তার স্বভাব ও বৈশিষ্ট্যের উর্ধ্বে উঠবে, বা সেই বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলবে, তা কখনাে সম্ভব নয়। আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে মানুষ বানিয়ে সৃষ্টি করেছেন, যাতে তারা মানুষই থাকে, ফেরেশতা, শয়তান, জীব জানােয়ার, গাছ পাথর ইত্যাদিতে পরিণত না হয়। মানুষ হিসেবে তারা ভীতিজনক পরিস্থিতিতে ভীত সন্ত্রস্ত হতেন, বিপদে-আপদে বিব্রত হতেন এবং ক্ষমতা বহির্ভূত সংকটে পড়ে ভয়ে কাঁপতেন। কিন্তু এসব সত্তেও তারা আল্লাহর সাথে সেই অটুট বন্ধনে আবদ্ধ থাকতেন, যা তাদেরকে আল্লাহর সাথে সংযুক্ত রাখতাে, তাদেরকে পতন থেকে রক্ষা করতাে, তাদের মধ্যে নতুন আশার সঞ্চার করতো এবং কখনাে হতাশায় ভেংগে পড়তে দিত না। এভাবে তারা মানবেতিহাসে এমন বিরল জাতের মানুষে পরিণত হয়েছিলেন, যা ছিলাে অতুলনীয় ও নজিরবিহীন। এ জিনিসটা আমাদের বুঝতে হবে এ জন্য যে, আমরা মানবেতিহাসের এই নযিরবিহীন ও শ্রেষ্ঠমানের মানুষগুলােকে যেন চিনতে ও বুঝতে পারি। আমাদেরকে বুঝতে হবে যে, তারা মানুষ ছাড়া আর কিছু ছিলেন না এবং মানবীয় স্বভাব প্রকৃতি তথা জন্মগত দোষণের উর্ধেও ছিলেন না। তাদের শ্রেষ্ঠত্বের কারণ এই যে, তারা মানুষ হয়েও মানুষের পক্ষে যে সর্বোচ্চ স্তরে উন্নীত হওয়া সম্ভব, সেই সর্বোচ্চস্তরে উন্নীত হয়েছিলেন। মানবীয় দোষগুণের অধিকারী হয়েও তারা । আল্লাহর সাথে সম্পর্ক বজায় রাখার মাধ্যমেই সেই সর্বোচ্চ স্তরে উন্নীত হয়েছিলেন। আমরা যখন দেখি যে, আমাদের চরিত্রে কোনাে দুর্বলতা ও দোষ ঢুকে গেছে কিংবা যখন দেখি যে, আমরা কোনাে পার্থিব ভয়ভীতি দ্বারা আক্রান্ত হয়েছি, তখন আমাদের নিজেদের সম্পর্কে হতাশ হয়ে যাওয়া উচিত নয় এবং এমন ভাবা উচিত নয় যে, আমরা ধ্বংস হয়ে গিয়েছি। কিংবা সমস্ত মহৎ কাজের যােগ্যতা আমরা হারিয়ে ফেলেছি। তবে আমাদের জন্মগত স্বভাব এবং আমাদের চেয়ে উৎকৃষ্টতর মানুষদের ভেতরেও ছিলাে বিধায়, ওগুলাে ভালাে ও মহৎ-এরূপ মনে করা অন্যায়। মহান আল্লাহর সাথে আমাদের সম্পর্ক রক্ষা করতে হবে এবং সেই সম্পর্কের সাথে সামঞ্জস্যশীল গুণবৈশিষ্ট গড়ে তুলতে হবে যাতে আমরা দুর্বলতা ও কাপুরুষতা থেকে রক্ষা পাই। আত্মবিশ্বাস এবং বিবেকের তুষ্টি ও তৃপ্তি পুনর্বহাল করা আমাদের কর্তব্য। যতাে আতংকজনক দুর্যোগই আসুক, বিশ্বাস রাখতে হবে যে, ওটা আমাদের বিজয়ের সুসংবাদ মাত্র। আর এই বিশ্বাসের ভিত্তিতে ধৈর্য, স্থিরতা, সাহসিকতা ও মনােবল গড়ে তুলতে হবে, দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ ও খুঁত খুঁতে মানসিকতা ঝেড়ে ফেলতে হবে এবং দ্বিধাহীন ও নির্ভীকচিত্তে পথ চলা অব্যাহত রাখতে হবে। এই ভারসাম্যপূর্ণ গুণাবলী ও মানসিকতা থেকেই সৃষ্টি হয়েছিলাে ইসলামের প্রথম যুগের সেই শ্রেষ্ঠ মানবগােষ্ঠী- যাদের অতীতের উজ্জ্বল ভূমিকা, আল্লাহর কঠিন অগ্নি পরীক্ষায় উত্তরণ, সর্বাত্মক জেহাদ এবং আল্লাহর সাথে করা অংগীকার রক্ষায় আপােষহীন ভূমিকার কথা কোরআনে উল্লেখ করা হয়েছে। এই ভূমিকা পালন করতে করতে কেউবা আল্লাহর দরবারে পৌছে গেছে, কেউবা পৌছার প্রতীক্ষায় রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘ঈমানদারদের মধ্যে কিছু ব্যক্তি এমন রয়েছে, যারা আল্লাহর সাথে করা অংগীকার পূরণ করেছে। তাদের মধ্যে কেউবা শহীদ হয়েছে, কেউবা শহীদ হবার অপেক্ষায় রয়েছে'(আয়াত ২৩) এর ঠিক বিপরীত হলাে তারা, যারা ইতিপূর্বে আল্লাহর সাথে অংগীকার করেছে যে, কখনাে কাপুরুষের মতাে জেহাদ থেকে পালাবে না, কিন্তু সেই অংগীকার রক্ষা না করে তারা তারা পালিয়েছে। ইমাম আহমাদ(র) হযরত ছাবেতের একটা বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন। এই বর্ণনায় হযরত ছাবেত বলেন, আমার চাচা আনাছ ইবনুন নাযার(রা.) রাসূল(স.)-এর সাথে বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি। এটা সহ্য করা তার পক্ষে কঠিন হয়ে পড়লাে। তিনি বললেন, রসূল(স.)-এর অংশ নেয়া প্রথম যুদ্ধটায় আমি অনুপস্থিত থেকে গেলাম। পরবর্তীতে আল্লাহ তায়ালা যদি আর কোনাে যুদ্ধ আমার জীবদ্দশায় সংঘটিত করেন, তাহলে আমি কী করবাে, সেটা আল্লাহ তায়ালা দেখতেই পাবেন। (অর্থাৎ পরিপূর্ণভাবে অংশ নেবাে) ছাবেত বলেন, তিনি এ ছাড়া অন্য কিছু (নির্দিষ্টভাবে) বলতে সাহস করেননি। পরে তিনি রাসূল(স.)-এর সাথে ওহুদ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করলেন। যুদ্ধ চলাকালে তিনি সাদ ইবনে মােয়ায(রা.)-কে দেখে আনাস(রা.) বললেন, ‘ওহে আমরের বাবা, কোথায় যাচ্ছ? আমি কিন্তু ওহুদের অপর পাশ থেকে বেহেশতের সুঘ্রাণ পাচ্ছি।’ এই বলেই লড়াই করতে করতে শহীদ হয়ে গেলেন। তার দেহে ৮০ টারও বেশী তরবারী, বর্শা ও তীরের আঘাত ছিলাে। হযরত আনাসের বােন অর্থাৎ আমরের ফুফু রুহিয়ী বিনতে নাযার বলেছেন, ‘আমি আমার ভাইকে শুধু তার আংগুল দেখে চিনেছি।’ হযরত ছাবেত বলেন, এই ঘটনা উপলক্ষেই উক্ত ২৩ নং আয়াত নাযিল হয়। অনেকে মনে করতেন যে, এ আয়াত রসূল(স.) এবং তার সাহাবীদের সম্পর্কে নাযিল হয়েছে।(হাদীসটা মুসলিম, তিরমিযী এবং নাসায়ীও বর্ণনা করেছেন) এই উজ্জ্বল বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন মােমেনদের সম্পর্কে এখানে উল্লেখ করার উদ্দেশ্য হলাে, মােনাফেকী, ভন্ডামী, দুর্বল ঈমান ও অংগীকার ভংগ করার মােকাবেলায় এগুলো বিপরীত ঈমানের পূর্ণাংগ চিত্র তুলে ধরা যাতে কোরআনের শিক্ষা ও ময়দানী শিক্ষার মাধ্যমে মুসলমানদের প্রশিক্ষণের কাজটা সমাধা করা যায়। পরবর্তী আয়াতে এসব পরীক্ষার নিগূঢ় উদ্দেশ্য এবং অংগীকার পালন করা ও ভংগ করার পুরস্কার ও শাস্তি কী তা বর্ণনা করা আর এসব কিছুর বেলায় আল্লাহর ইচ্ছার ওপর সবকিছুকে সােপর্দ করার কথা বলে মন্তব্য করা হয়েছে। (আয়াত ২৪) সব ঘটনার মাঝখানেই এ ধরনের মন্তব্য করা হয়ে থাকে, যাতে ব্যাপারটাকে আল্লাহর ইচ্ছার কাছে ন্যস্ত করা যায় এবং ঘটনাবলীতে আল্লাহর মহৎ উদ্দেশ্য বর্ণনা করা যায়। কেননা কোনাে ঘটনাই নিরর্থক নয় বা কাকতালীয় নয়। যা কিছুই ঘটে, আল্লাহর সুচিন্তিত পরিকল্পনা ও মহৎ উদ্দেশ্য অনুসারেই ঘটে। তিনি যে ঘটনাকে যে খাতে প্রবাহিত করতে চান, তা সেই খাতেই প্রবাহিত হয়। এবং তাতেই আল্লাহর দয়া ও ক্ষমা লাভ করা যায় । তার দয়া ও ক্ষমাই সবচেয়ে বড় ও সবচেয়ে নিকটবর্তী। ‘আল্লাহ তায়ালা ক্ষমাশীল ও দয়াশীল।’
*মদীনায় ইহুদীদের ষড়যন্ত্র ও তাদের পতন : অতপর এই বিরাট ও ভয়াবহ ঘটনার বিবরণের সমাপ্তি টানা হচ্ছে এর সেই শেষ ফল বর্ণনার মাধ্যমে, যা মহান প্রতিপালক সম্পর্কে মােমেনদের সুধারণার সত্যতা প্রতিপন্ন করে, মুনাফিক ও গুজব রটনাকারীদের বিপথগামিতা ও তাদের ধ্যান-ধারণার ভ্রান্তি তুলে ধরে এবং ঈমানী মূল্যবােধগুলােকে প্রতিষ্ঠিত করে, আর আল্লাহ কাফেরদেরকে ফের পাঠালেন এমনভাবে যে, তারা কোনই সুফল অর্জন করতে পারেনি'(আয়াত-২৫) যুদ্ধ শুরু হয়েছে, অগ্রসর হয়েছে এবং শেষ হয়েছে। এই সবকটা পর্যায়েই তার নিয়ন্ত্রণ আল্লাহর হাতে থেকেছে। তিনি যেভাবে চেয়েছেন, তাকে চালিয়েছেন। কোরআন নিজস্ব ভাষায় ও বর্ণনাভংগীতে এ বিষয়টা ব্যক্ত করেছে এবং যুদ্ধের প্রতিটা ঘটনা ও ফলাফলকে সরাসরি আল্লাহর অবদান বলে ঘােষণা করেছে, যাতে এই সত্য প্রমাণিত হয়, হৃদয়ে বদ্ধমূল হয় এবং বিশুদ্ধ ইসলামী ধ্যান ধারণা স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। খন্দক যুদ্ধের ফলে শুধু কোরায়শ ও বনু গাতফানের মােশরেকরাই বিপর্যয়ের কবলে পড়েনি, বরং মােশরেকদের মিত্র ইহুদী গােত্র বনু কোরায়যাও ঘােরতর বিপর্যয়ের শিকার হয়। ২৬ ও ২৭ নং আয়াতে এই বিপর্যয়ের বিবরণ দেয়া হয়েছে। এই কাহিনী বর্ণনার জন্যে মুসলানদের সাথে ইহুদীদের সম্পর্কের ইতিবৃত্ত তুলে ধরা প্রয়ােজন। মদীনায় ইসলাম ও মুসলমানদের আগমনের পর ইহুদীরা মুসলমানদের সাথে অল্প কিছুদিন ছাড়া শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করেনি। অথচ রসূল(স.) মদীনায় আসার অব্যবহিত পরই তাদের সাথে একটা শান্তি চুক্তি সম্পাদন করেন। সেই চুক্তি অনুসারে উভয় পক্ষের পরস্পরকে সাহায্য করা ও আক্রান্ত হলে রক্ষা করার দায়িত্ব অর্পিত হয়। তাদের ওপর এই শর্তও আরােপ করা হয় যে, কখনাে এই চুক্তি লংঘন করা যাবে না, কারাে ওপর বাড়াবাড়ি করা যাবে না, গােয়েন্দাগিরি করা চলবে না, শত্রুকে সাহায্য করা চলবে না এবং কাউকে কোনােরকমের কষ্ট দেয়া চলবে না। কিন্তু ইহুদীরা শীঘ্রই বুঝতে পারলাে যে, প্রথম আসমানী কিতাবধারী হিসেবে তারা মদীনায় এতােকাল যে ঐতিহ্যগত মর্যাদা ভােগ করে এসেছে, তা ইসলামের কারণে হুমকির সম্মুখীন। অনুরূপভাবে রাসূল(স.)-এর নেতৃত্বে নতুন সামাজিক অবকাঠামো পুর্নগঠনের যে কাজ করা হয়, তাতেও তাদের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়ে। কেননা ইতিপূর্বে তারা মদীনায় নিজেদের আধিপত্য ও প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে আওস ও খাযরাজ গােত্রদ্বয়ের বিরােধকে কাজে লাগাতাে। কিন্তু ইসলাম এসে রাসূল(স.)-এর নেতৃত্বে আওস ও খাযরাজ গোত্রদ্বয়কে ঐক্যবদ্ধ করে ফেললাে। ফলে দুই গোত্রের বিরোধের সুযােগে তাদের ঘােলা পানিতে মাছ শিকারের অবকাশ আর রইল না। সব শেষে মদীনার ইহুদীদের ওপর যে ঘটনা মড়ার ওপর খাড়ার ঘা হয়ে নেমে এসে তাদের মেরুদন্ড ভেংগে দিলাে। তা ছিলাে তাদের সবচেয়ে বড় পন্ডিত ও আলেম আবদুল্লাহ ইবনে সালামের ইসলাম গ্রহণ। এই ইহুদী আলেম যখন সর্বান্তকরণে উপলব্ধি করলেন যে, ইসলামই একমাত্র সত্য সঠিক ধর্ম, তখন তিনি শুধু নিজেই ইসলাম গ্রহণ করলেন না, বরং তার পরিবার-পরিজনকেও ইসলাম গ্রহণের আদেশ দিলেন এবং তারা ইসলাম গ্রহণ করলাে। কিন্তু তিনি আগে ভাগে ইসলামের ঘােষণা দিলে ইহুদীরা তার সম্পর্কে নানারকমের মনগড়া অভিযােগ তুলবে, এই আশংকায় ঘােষণা দিলেন না। বরং রাসূল(স.)-কে অনুরােধ করলেন, তার ইসলাম গ্রহণের কথা জানানাের আগে তিনি যেনাে তাদের কাছে জিজ্ঞেস করেন আব্দুল্লাহ ইবনে সালাম কেমন লােক। রসূল(স.) তাই করলেন। ইহুদীরা জবাব দিলো যে, তিনি তাে আমাদের নেতার ছেলে নেতা, আমাদের বড় আলেম ও পন্ডিত । তখন আব্দুল্লাহ ইবনে সালাম তাদের সামনে বেরিয়ে এলেন এবং তাদেরকে অনুরােধ করলেন তার মতাে ইসলাম গ্রহণ করতে। আর যায় কোথায়! তারা তার সাথে ঝগড়া শুরু করে দিলাে, তাকে নানারকমের অশালীন ও অশ্রাব্য কটুবাক্য শােনাতে লাগলাে। তারা ইহুদী গােত্রগুলােকে তার উপদেশ গ্রহণ করা থেকে সাবধান করে দিলাে। তথাপি ইহুদীরা বুঝতে পারলাে যে, তাদের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক অস্তিত্ব এবার যথার্থই বিপন্ন। তাই তারা রসূল(স.)-এর বিরুদ্ধে মারাত্মক চক্রান্ত শুরু করে দিলাে। এই দিন থেকেই শুরু হয়েছে ইহুদীদের সাথে ইসলামের প্রাণান্তকর লড়াই এবং সে লড়াই আজো আব্যাহত রয়েছে। প্রথমে শুরু হলাে আজকালকার ভাষায় যাকে বলা হয় স্নায়ুযুদ্ধ বা ঠান্ডা লড়াই । রসূল(স.) ও ইসলামের বিরুদ্ধে শুরু হলাে ঘােরতর অপপ্রচার। এই যুদ্ধে ইহুদীরা তাদের অতীতের সুপরিচিত যাবতীয় অপকৌশলগুলাে প্রয়ােগ করেছে। উদাহরণ স্বরূপ তারা মােহাম্মদ(স.)-এর নবুওয়ত সম্পর্কে সন্দেহ ও ইসলামী মতাদর্শের সত্যতা সম্পর্কে সংশয় প্রকাশ করতে লাগলাে। কখনাে আবার মুসলমানদের বিভিন্ন গােষ্ঠীর মধ্যে ভুল বুঝাবুঝি ও বিভেদ সৃষ্টির কৌশল অবলম্বন করতে লাগলাে । কখনাে আওস ও খাযরাজের মাঝে এবং কখন আনসার ও মােহাজেরদের মাঝে বিভেদ সৃষ্টির অপচেষ্টা চালালাে। কখনাে মুসলমানদের ভেতরকার গােপন তথ্য জানার জন্যে গোয়েন্দাগিরির কৌশল অবলম্বন করে তাদের শত্রু মােশরেকদের সাহায্য করতে লাগলাে। কখনাে মুসলিম নামধারী মােনাফেকদেরকে বিশ্বস্ত বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করে তাদের মাধ্যমে মুসলমানদের সমাজে বিভেদ সৃষ্টি করতে লাগলাে। সবার শেষে তারা তাদের সমস্ত মুখােশ খুলে ফেলে নগ্নভাবে মুসলমানদের বিরুদ্ধে তাদের শত্রুদেরকে সংঘবদ্ধ করতে লাগলাে, যেমনটি করেছে খন্দক যুদ্ধে। প্রধান ইহুদী গােত্রগুলাে ছিলাে বনু কাইনুকা, বনু নযীর ও বনু কোরায়যা। রসূল(স.) ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে তাদের প্রত্যেকেরই স্বতন্ত্র আক্রোশ ছিলাে। এদের মধ্যে বনু কাইনুকাই ছিলাে সবচেয়ে শৌর্য বীর্য ধারী ইহুদী গোত্র। বদর যুদ্ধে মুসলমানদের বিজয় লাভের কারণে তারা তাদের প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়ে। তাদের ও রসূল(স.)-এর মাঝে যে চুক্তি ছিলাে, সেটা তারা লংঘন করতে লাগলাে। পাছে তিনি ও তার দল এতাে শক্তিশালী হয়ে যায় যে, পরে আর তাদেরকে প্রতিরােধ করা যাবে না-এই আশংকায় তারা তখন থেকেই তাদের শক্তি খর্ব করার চেষ্টা করতে লাগলাে। কেননা কোরায়েশদের সাথে প্রথম সংঘর্ষেই তাদের বিজয় লাভ করায় এই ধারণাই বদ্ধমূল হতে শুরু করেছিলো যে, ভবিষ্যতে হয়তাে মুসলমানদের পথ আর আগলে রাখা যাবে না। সীরাতে ইবনে হিশামে বলা হয়েছে, রসূল(স.) বনু কাইনুকার বাজারে এক জনসভায় তাদেরকে সমবেত করে বললেন, ‘হে ইহুদী সম্প্রদায়, কোরায়শদের ওপর যে ধরনের বিপর্যয় নেমে এসেছে, তেমন কিছু সংঘটিত হবার আগে তােমরা আল্লাহর ব্যাপারে সাবধান হও এবং ইসলাম গ্রহণ করাে। তােমরা তাে জেনেছােই যে, আমি নবী হিসেবে প্রেরিত হয়েছি। তােমাদের কিতাবেও এটা রয়েছে এবং আল্লাহ তায়ালা এ ব্যাপারে তােমাদেরকে আদেশও দিয়েছেন। তারা বললাে, ওহে মােহাম্মদ। তুমি কি আমাদেরকে তােমার গােত্র কোরায়শ ভেবেছে? যুদ্ধবিদ্যা সম্পর্কে পারদর্শী নয় এমন একটা গােত্রের ওপর জয়ী হয়ে তুমি অহংকারী হয়ে যেও না। আল্লাহর কসম, আমরা যদি তােমার সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হই, তাহলে তুমি জানতে পারবে আমরা মানুষ বটে। সীরাতে ইবনে হিশামে আরাে বলা হয়েছে, জনৈকা মুসলিম মহিলা দুধ নিয়ে বনু কাইনুকার বাজারে বিক্রি করতে এসে জনৈক স্বর্ণকারের দোকানের পাশে বসলাে। ইহুদী যুবকরা তার মুখ খােলার জন্যে নানাভাবে চেষ্টা করতে লাগলাে, কিন্তু সে রাযী হলাে না। তখন স্বর্ণকার চুপিসারে গিয়ে মহিলার কাপড়ের এক প্রান্ত তার পিঠের সাথে বেঁধে রেখে দিলাে। ফলে মহিলা যখন উঠে দাঁড়ালাে, তখন তার লজ্জাস্থান বেরিয়ে পড়লাে। তা দেখে সবাই হেসে উঠলাে। মহিলা চিৎকার করে উঠলাে। তার চিৎকার শুনে জনৈক মুসলমান স্বর্ণকারের ওপর ঝাপিয়ে পড়ে তাকে হত্যা করলাে। স্বর্ণকার ছিলাে ইহুদী। তৎক্ষণাত ইহুদীরা মুসলমান হামলাকারীকে হত্যা করলাে। এবার তার আত্মীয় স্বজন মুসলমানদেরকে সমবেত করলাে। আর সংগে সংগে বনু কাইনুকার সাথে মুসলমানদের যুদ্ধ বেধে গেলাে। এরপর রসূল(স.) বনু কাইনুকা গােত্রকে অবরােধ করলেন। তারা তার ফায়সালার সামনে নতি স্বীকার করলাে। আল্লাহ তায়ালা বনু কাইনুকাকে শাস্তি দেয়ার জন্যে যখন পরিবেশ রসূল(স.)-এর অনুকূল করে দিলেন, তখন মােনাফেকদের নেতা আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সুলুল বললাে, ওরা আমার মুক্ত গােলাম । ওদের প্রতি অনুগ্রহ করুন। ওরা খাযরাজ গােত্রের মিত্র ছিলাে। রসূল(স.) একটু থামলেন। সে আবারও বললাে ইয়া রসুলাল্লাহ, আমার মিত্রদের প্রতি অনুগহ করুন। রসূল(স.) তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই রসূল(স.) এর বর্মের ভেতরে হাত ঢুকিয়ে দিলাে। রসূল(স.) তাকে বললেন, আমাকে ছাড়াে। এই সময় রসূল(স.) এতাে রেগে গিয়ে ছিলেন যে, তার চেহারায় রাগের ছাপ দেখা গিয়েছিলাে। তিনি আবারাে বললেন, তুমি এ কী করছাে! আমাকে ছেড়ে দাও। সে বললাে, ‘না, আল্লাহর কসম, আমি আপনাকে ততােক্ষণ ছাড়বাে না, যতক্ষণ না আমার মিত্রদের প্রতি অনুগ্রহ না করেন । ওরা চারশ সাধারণ পােশাকধারী এবং তিনশ বর্মধারী। ওরা আমাকে সারা দুনিয়ার মানুষ থেকে রক্ষা করেছে। ওদেরকে আপনি এক সকালেই খতম করে দেবেন। আল্লাহর কসম, আমি বিপদের আশংকা করছি। রসূল(স.) বললেন, ঠিক আছে। ওদের ব্যাপারে অনুরােধ রাখলাম। আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই নিজ গােত্রে মান্যগণ্য ব্যক্তি ছিলাে । তাই বনু কাইনুকার ব্যাপারে তার সুপারিশ রসূল(স.) এই শর্তে গ্রহণ করলেন যে, ওদেরকে মদীনা থেকে তাড়িয়ে দেয়া হবে এবং তারা অস্ত্র ছাড়া তাদের অন্যসব অস্থাবর সম্পত্তি নিয়ে যেতে পারবে। এভাবে মদীনা একটা শক্তিশালী ইহুদী গোত্রের হাত থেকে মুক্ত হলাে। এরপর বনু নযীরের প্রসংগ। ওহুদ যুদ্ধের পর রসূল(স.) পূর্বে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী দুটো দিয়াত (রক্তপণ) পরিশােধ করার ব্যাপারে তাদের সহযােগিতা চাইতে এই গােত্রটার কাছে গিয়েছিলেন। তিনি গেলে বনু নযীর গােত্রের লােকেরা বললাে, ঠিক আছে, আমরা আপনাকে সাহায্য করবে। কিন্তু আড়ালে গিয়ে তারা পরস্পরকে বললাে, এই ব্যক্তিকে তােমরা এমন অবস্থায় আর কখনো পাবে না। এই সময় রাসূল(স.) তাদের বাড়ীর একটা প্রাচীরের পাশে বসেছিলেন। ওরা বললাে, তােমরা একজন এই বাড়ীর ছাদের ওপর গিয়ে বড় একটা পাথর ওর ওপর ফেলে দাও এবং ওর হাত থেকে আমাদেরকে মুক্ত করাে। এরপর তারা এই জঘন্য চক্রান্ত বাস্তবায়নের চেষ্টা শুরু করলাে। আল্লাহ তায়ালা রসূল(স.)-কে ওহীর মাধ্যমে পুরাে ষড়যন্ত্রের কথা জানিয়ে দিলেন। তিনি তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়ালেন এবং মদীনায় ফিরে গেলেন। তিনি মুসলমানদেরকে বনু নযীরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্যে প্রস্তুত হতে নির্দেশ দিলেন। বনু নযীরের লােকেরা দুর্গের ভেতরে আশ্রয় নিল। মােনাফেক নেতা আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই তাদের কাছে বার্তা পাঠালাে যে, তোমরা পালিও না, নিজ নিজ স্থানে আত্মরক্ষার জন্যে প্রস্তুত হয়ে থাকে। আমরা তােমাদেরকে আত্মসমর্পণ করতে দেবাে না। তােমাদের ওপর যুদ্ধ চাপানাে হলে তােমাদের সাথে যুদ্ধ করবে এবং তােমাদেরকে বহিষ্কার করা হলে আমরাও তােমাদের সাথে বেরিয়ে যাব। কিন্তু মােনাফেকরা তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি। আল্লাহ তায়ালা বনু নযীরের লােকদের মনে ভয় সৃষ্টি করে দেন, ফলে তারা বিনা যুদ্ধেই আত্মসমর্পণ করে। তারা রসূল(স.)- এর কাছে আবেদন জানায় যে, তিনি যেন তাদেরকে হত্যা না করেন, বরং তাদের প্রত্যেককে অস্ত্র বাদে যা কিছু অস্থাবর সম্পত্তি একটা উটের পিঠে নিয়ে যাওয়া সম্ভব তা নিয়ে যেতে দেন। রসূল(স.) অনুমতি দিলেন। বনু নযীরের লােকেরা মদীনা থেকে বেরিয়ে গেলাে। কেউ গেলাে খয়বর, কেউ গেলা সিরিয়ায়। যারা খয়বরে গিয়েছিলাে, তাদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হলাে সালাম ইবনে আবিল হাকীম, কেনান ইবনে আর রবী ইবনে আবিল হাকীক ও হুয়াই ইবনে আখতারী। এরা কোরায়শ ও গাতফানের মােশরেকদেরকে মদীনায় জড়াে করে আহজাব যুদ্ধ সংগঠিত করতে উল্লেখযােগ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। এবার বনু কোরায়যা অভিযানের বিষয়ে আসা যাক। আহযাব যুদ্ধের প্রসংগে ইতিপূর্বে বলা হয়েছে যে, তারা মােশরেকদের মিত্র হয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে আগ্রাসন চালিয়েছিলাে। এ ব্যাপারে হয়াই বিন আখতারের নেতৃত্বে বনু নযীরের নেতারা তাদেরকে উস্কে দিয়েছিলাে। এ পরিস্থিতিতে রসূল(স.) -এর কাছে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি বনু কোরায়যাকর্তৃক ভংগ করাটা মুসলমানদের জন্যে মদীনার বাইরে থেকে আরবের সকল গোত্রের হামলা পরিচালনার চেয়েও ভয়ংকর বিপজ্জনক ব্যাপার ছিলাে। বনু কোরায়যার এই প্রতিশ্রুতি ভংগ মুসলমানদের জন্যে যে ভীতি ও আতংকের কারণ হয়েছিলাে, সেটা কতাে মারাত্মক ছিলাে, তা বুঝবার জন্যে নিম্নের বর্ণনাটা যথেষ্ট। রাসূল(সা.) যখন বনু কুরায়যার প্রতিশ্রুতি ভংগের খবর শুনলেন, তখন তিনি আওস নেতা হযরত সাদ ইবনে মােয়াযকে এবং খাযরাজ নেতা সাদ ইবনে ওবাদকে আব্দুল্লাহ ইবনে রওয়াহা ও খাওয়াত ইবনে যায়েরকে পাঠালেন। তাদেরকে তিনি বললেন, তােমরা যাও, ওদের সম্পর্কে যা শুনেছি, তা সত্য কি না আমাদেরকে জানাও। যদি সত্য হয়, তাহলে একটা সংকেত দিয়ে আমাকে জানিও এবং সাধারণ জনগণের কাছে প্রকাশ করাে না। আর যদি তারা প্রতিশ্রুতি পালন করে, তাহলে সেটা জনগণের কাছে, প্রকাশ করে দিও। তারা বেরিয়ে গেলেন এবং বনু কোরায়যার কাছে পৌছলেন। তারা দেখলেন, তাদের সম্পর্কে তারা যেসব জঘন্য খবরাদি শুনেছিলেন, তার সবই সত্য। তাদেরকে যখন রসূল(স.) সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলাে, তখন তারা বললাে, রসূলুল্লাহ আবার কে? আমাদের ও মােহাম্মদের মধ্যে কোনাে চুক্তি বা অংগীকার নেই। অতপর সেই প্রতিনিধি দল রসূল(স.)-এর কাছে ফিরে এলাে এবং ইশারা-ইংগিতে সবকিছু তাকে জানালাে। রসূল(স.) তৎক্ষণাত বললেন, আল্লাহু আকবার, হে মুসলমানরা, সুসংবাদ নাও! (দুঃসংবাদটা যাতে মুসলমানদের বিচলিত করতে না পারে)। ইবনে ইসহাক বলেন, এই পর্যায়েই সংকট চরম আকার ধারণ করলাে । আতংক তীব্রতর হলাে এবং শত্রুরা মুসলমানদের ওপর ও নিচ থেকে আসতে লাগলাে। মুসলমানরা হরেক রকমের ধারণা করতে লাগলাে এবং কিছু মুনাফিক মােনাফেকীর বিস্তার ঘটাতে লাগলাে। আযহাব যুদ্ধের সময় এভাবেই উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছিলাে। অবশেষে যখন আল্লাহ তায়ালা তাঁর নবীকে সাহায্য করলেন, তার শত্রুদেরকে ব্যর্থ মনােরথ করে ফিরিয়ে দিলেন এবং তাঁর ঈমানদার বান্দাদের পক্ষে যুদ্ধ করার জন্যে নিজেই যথেষ্ট হয়ে গেলেন, তখন রসূল(স.) বিজয়ীর বেশে মদীনায় ফিরে গেলেন, মােজাহেদরা অস্ত্র রেখে দিলেন এবং রসূল(স.) যুদ্ধে বিগ্রহের অবসাদ ঝেড়ে ফেলে উম্মুল মােমেনীন হযরত উম্মে সালমার গৃহে গােসল করতে লাগলেন। এ সময়ে তার সামনে হযরত জিবরীল হাযির হলেন। জিবরীল বললেন, ‘ইয়ারসূলাল্লাহ, আপনি কি অন্ত্র রেখে দিয়েছেন? রাসূল(স.) বললেন, হ্যা। জিবরাঈল বললেন, কিন্তু ফেরেশতারা এখনও অস্ত্র রাখেনি। আল্লাহ তায়ালা আপনাকে বনু কোরায়যা অভিযানে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।’ বনু কোরায়যার আবাসস্থল মদীনা থেকে কয়েক মাইল দূরে অবস্থিত ছিলাে। সেখানে যােহরের নামাযের পর যাওয়ার আদেশ দেয়া হয়েছিলাে। রসূল(স.) বললেন, ‘তােমাদের কেউ যেন বনু কোরায়যার মহল্লায় না গিয়ে আসরের নামায না পড়ে। লােকেরা রওনা হয়ে গেলাে। পথিমধ্যে নামাযের সময় হয়ে গেলাে। কেউ কেউ পথিমধ্যেই নামায আদায় করলেন। তারা বললাে যে, রসূল(স.) বনু কোরায়যায় পৌছেই যে আসরের নামায পড়তে বলেছেন, তার উদ্দেশ্য ছিলাে তাড়াতাড়ি সেখানে পৌছা। অনােরা বললাে, আমরা বনু কোরায়যা না গিয়ে নামায পড়বাে না। রাসূল(স.) এই দুই দলের কাউকেই তিরস্কার করেননি। তাদের পেছনে পেছনে রাসূল(স.) গেলেন। ইবনে উম্মে মাকতুমকে (যার উপলক্ষে ‘আবাছা ওয়া তাওয়াল্লা’ সূরাটা নাযিল হয়েছিলাে) মদীনার তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত করে গেলেন। আর হযরত আলীকে করলেন সেনাপতি। অতপর যথাস্থানে গিয়ে বনু কোরায়যাকে ২৫ দিন অবরুদ্ধ করে রাখলেন। অবশেষে অবরােধ দীর্ঘায়িত হয়ে যাওয়ায় তারা আওস নেতা সাদ ইবনে মুয়াযের মধ্যস্থতায় নিচে নেমে এলাে। কেননা তারা জাহেলী যুগে পরস্পরের মিত্র ছিলাে। তারা মনে করেছিলাে যে, আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সালুল যেমন বনু কোরায়যার প্রতি সহানুভূতি দেখিয়ে রসূল(স.)-এর কাছ থেকে তাদের প্রতি ক্ষমা আদায় করেছিলাে, সাদ ইবনে মােয়াযও তেমনি করবেন। কিন্তু তারা জানতাে না যে, খন্দকের অবরোধকালে সাদের বাহুতে একটা বর্শা এসে বিদ্ধ হওয়ায় এমন একটা প্রধান রগে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছিলাে, যা কাটা গেলে রক্তপাত বন্ধ হয় না। রসূল(স.) তাকে তপ্ত লোহার সেঁকা দিয়ে চিকিৎসা করলেন এবং তাকে মসজিদে নববীর একটা কক্ষে রাখলেন যাতে কাছ থেকে তার সেবা সুশ্রুষা করা যায়। এই সময় সা’দ দোয়া করলেন, হে আল্লাহ তায়ালা তুমি যদি কুরাইশদের সাথে আমাদের যুদ্ধের কিছু বাকী রেখে থাকো, তবে তার জন্যে আমাদেরকে বাঁচিয়ে রাখে। আর যদি তাদের ও আমাদের মধ্যে যুদ্ধ বিরতি ঘটিয়ে থাকো, তবে যুদ্ধকে পুনরুজ্জীবিত করাে। আর বনু কোরায়যার ব্যাপারে আমার চোখ না জুড়িয়ে আমাকে মৃত্যু দিও না। (অর্থাৎ বনু কোরায়যার সমুচিত শাস্তি দেখে চোখ না জুড়ানাে পর্যন্ত) আল্লাহতায়ালা হযরত সাদের দোয়া কবুল করলেন এবং বনু কোরায়যার ভাগ্য এমনভাবে নির্ধারণ করলেন যে, তারা স্বেচ্ছায় সা’দের সালিশী কামনা করে তারই ফায়সালা অনুসারে দুর্গ থেকে নেমে এলো। এরপর রসূল(স.) সাদকে মদীনা থেকে ডেকে আনলেন, যাতে বনু কোরায়যা সম্পর্কে তার সিদ্ধান্ত ঘােষণা করেন। একটা গাধার পিঠে চড়ে যখন সাদ এলেন, তখন আওসের লােকেরা তাকে অনুরােধ করলাে যে, ‘হে সাদ! বনু কোরায়যা আপনার মিত্র। তাদের প্রতি অনুকম্পা প্রদর্শন করুন।’ এই অনুরােধ করার পর তারা সাদকে তাদের প্রতি দয়ায় বিগলিত করার জন্যে নানাভাবে চেষ্টা চালালাে। কিন্তু সা’দ তাদের কথার কোনাে জবাব না দিয়ে নীরবতা অবলম্বন করলেন। কিন্তু তারা যখন অতিরিক্ত অনুনয় বিনয় করতে লাগলাে, তখন তিনি বললেন, সাদের কাছে সেই সময়টা উপস্থিত হয়েছে, যখন সে আল্লাহর হুকুম পালনে কারাে তিরস্কারের পরােয়া করবে না। তখন আওসের লােকেরা বুঝে ফেললাে যে, সা’দ বনু কোরায়কে রক্ষা করবেন না। তিনি যখন রসূল(স.)-এর তাঁবুর কাছে গেলেন, তখন রসূল(স.) বললেন, তােমরা তােমাদের নেতার সম্মানে উঠে দাঁড়াও। মুসলমানরা উঠে দাঁড়িয়ে তাকে সম্মান প্রদর্শন করলাে ও তাবুতে নিয়ে তাকে সাদরে থাকতে দিলাে। তার জন্যে এতাে অভ্যর্থনার আয়ােজন করার উদ্দেশ্য ছিলাে এই যে, তার কর্তৃত্বাধীন এলাকায় তিনি যেন পর্যাপ্ত সম্মান ও আনুগত্য লাভ করেন এবং বনু কোরায়যা সম্পর্কে তাঁর রায় সহজেই কার্যকরী হয়। তিনি যখন বসলেন, তখন রসূল(স.) তাকে বললেন, এরা (বনু কোরায়যা) তােমাকে বিচারক মেনে নীচে এসেছে। এখন তাদের ব্যাপারে তুমি যেমন ইচ্ছা রায় দাও।’ হযরত সা’দ জিজ্ঞেস করলেন, আমার রায় কি তাদের ওপর কার্যকর হবে? রসূল(স.) বললেন, হ্যা, তিনি বললেন, আর এখানে (তাবুর যে পাশে রসূল(স.) ছিলেন, সেই দিকে ইংগিতপূর্বক। এ সময় পরম সম্মান ও ভক্তির সাথে তিনি রসূল(স.)-এর দিক থেকে মুখ সরিয়ে নিচ্ছিলেন) যারা আছে, তাদের ওপরও? রসূল(স.) বললেন, হা। হযরত সা’দ(রা.) বললেন, তাহলে আমি ফায়সালা ঘােষণা করছি যে, বনু কোরায়যার মধ্যে যুদ্ধ করার যােগ্য যতাে পুরুষ রয়েছে তাদের সকলকে হত্যা করা হােক, তাদের সকল সন্তান সন্তুতিকে বন্দী এবং সমুদয় ধন সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হােক!’ রসূল(স.) তাকে বললেন, ‘আল্লাহ তায়ালা সাত আকাশের ওপর থেকে যে ফায়সালা করেছেন, তুমি সেই অনুসারেই ফায়সালা করেছো।’ এরপর রসূল(স.) লম্বা লম্বা কয়েকটা পরিখা খনন করার নির্দেশ দিলেন। পরিখা খনন করা হলে তাদের সকলকে পিঠমােড়া দিয়ে বেঁধে আনা হলাে এবং সকলকে হত্যা করা হলাে। এভাবে যাদেরকে হত্যা করা হলাে তাদের সংখ্যা ছিলাে সাতশ থেকে আটশর মধ্যে। সকল অপ্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ ও সকল মহিলাকে বন্দী করা হলাে এবং সমুদয় সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হলাে। নিহতদের মধ্যে বনু নযীরের গােত্রপতি হুযাই বিন আখতারও ছিলাে। সে প্রতিশ্রুতি মােতাবেক তাদের সাথে দুর্গে অবস্থান করছিলো। সেই দিন থেকে মদীনায় ইহুদী শক্তির পতন ঘটে ও মােনাফেকদের আন্দোলন দুর্বল হয়। মােনাফেক মাথা নত করে এবং ইতিপূর্বে তারা যেসব বাড়াবাড়ি করছিলাে, তা খর্ব হয়। এর ফল দাঁড়ায় যে, এরপর আর মােশরেকরা মুসলমানদের ওপর আগ্রাসন চালানাের স্পর্ধা দেখায়নি; বরং এর পর মুসলমানরাই তাদের ওপর আক্রমণ চালাতে লাগলাে এবং সেই ধারাবাহিকতায় মক্কা ও তায়েফ বিজিত হয়। বলা যেতে পারে যে, ইহুদী মুনাফিক মােশরেক-এই ত্রিশক্তির তৎপরতার মধ্যে একটা অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক ছিলাে। মদীনা থেকে ইহুদীদের উচ্ছেদ এই সম্পর্ক ছিন্ন করে। এই উচ্ছেদের পূর্বে ও পরে ইসলামী রাষ্ট্রের গঠন ও স্থিতিশীলতায় সুস্পষ্ট পার্থক্য পরিদৃষ্ট হয়। ইহুদী শক্তির মূলােৎপাটনের এই ঘটনাই অভিব্যক্ত হয়েছে ২৬ ও ২৭ নং আয়াতে। ছায়াছী অর্থ দুর্গ। আর ‘যে ভূমি তােমরা এখনও পা দিয়েও মাড়াওনি’ এর অর্থ বনু কোরায়যার মহল্লার বাইরে তাদের যেসব জায়গা-জমি ছিলাে এবং যা অন্যান্য সম্পত্তির ন্যায় মুসলমানদের দখলে এসেছিলাে, অথবা বিনা যুদ্ধে বনু কোরায়যা কর্তৃক সমর্পিত ভূমি। পা দিয়ে মাড়ানাে দ্বারা যুদ্ধ বুঝানাে হয়েছে। কেননা যুদ্ধের সময় ভূমি পদদলিত হয়ে থাকে। ‘আর আল্লাহ সর্ব বিষয়ে শক্তিমান।’ এ হচ্ছে বাস্তবসম্মত পর্যালােচনা। এই পর্যালােচনার মধ্য দিয়ে সবকিছুকে আল্লাহর কর্তৃত্বে ন্যস্ত করার ঘােষণা দেয়া হয়। ইতিপূর্বে সমগ্র যুদ্ধকে এমনভাবে তুলে ধরা হয়েছে যে, তার যাবতীয় বিষয় পুরােপুরিভাবে আল্লাহর নিয়ন্ত্রণাধীন । তার সমস্ত তৎপরতাকে সরাসরি আল্লাহর তৎপরতা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এভাবে আল্লাহ তায়ালা বাস্তব ঘটনাবলী এবং ঘটনার পরে নাযিল হওয়া কোরআন দ্বারা মুসলমানদের মনে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ও তাঁর সর্বময় কর্তৃত্বের ধারণা বদ্ধমূল করতে চান এবং এর ওপরই ইসলামী চিন্তার ভিত্তি স্থাপন করেন। এভাবে সেই বিরাট ও গুরুতর ঘটনার পর্যালােচনা ও বিবরণ শেষ হচ্ছে। যে নীতিমালা, মূল্যবােধ, শিক্ষা ও মূলনীতি মুসলমানদের মনে বদ্ধমূল করা ও তাদের বাস্তব জীবনে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কোরআন এসেছে, এই পর্যালােচনায় সে সবই অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এভাবে যুদ্ধ-বিগ্রহসহ যাবতীয় ঘটনাবলী প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পরিণত হয় এবং কোরআন জীবন, জীবনের ঘটনাবলী, তার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য এবং তার চিন্তাধারার দিক দর্শনে পরিণত হয়। এভাবেই দুঃখ-কষ্টে পরিপূর্ণ পরীক্ষামূলক ঘটনাসমূহ দ্বারা ও কোরআন দ্বারা মূল্যবােধ ও মূলনীতির স্থায়িত্ব ও স্থীতি এবং হৃদয়ের প্রশান্তি অর্জিত হয়ে থাকে।
‘হে ঈমানদাররা… বিরাট পুরস্কার।’ অবশ্যই নবী(স.) তার নিজের জন্যে ও তাঁর পরিবারের জন্যে একেবারেই সাধারণ মানুষের উপযােগী জীবিকা নির্বাহের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন, এটা শুধু মজবুরীর কারণেই ছিলাে না, বরং জনসাধারণের সুখ দুঃখের সাথে তিনি নিজেকে ও নিজ পরিবারকে একাকার করে দিয়েছিলেন বলেই তিনি এই নীতি গ্রহণ করেছিলেন। মক্কা বিজয় না হওয়া পর্যন্ত তিনি এইভাবে জীবনযাপন করতে থাকেন। অতপর মক্কা বিজয়ের পর প্রচুর পরিমাণে যুদ্ধ লব্ধ সম্পদ আসতে থাকে এবং সাধারণভাবে মুসলমানদের জীবনে সচ্ছলতা ফিরে আসে, সে সময় জনগণের জীবনে প্রাচুর্য আসে এর পূর্বে কখনও এমন হয়েছে যে এক মাসের মধ্যেও তার ঘরে আগুন জ্বলেনি, যদিও বিভিন্ন দিক থেকে দান উপঢৌকন বা যথেষ্ট পরিমাণে হাদিয়া আসতে থাকে। প্রিয় নবী (স.) এ সময়েও এই কৃচ্ছ সাধনা করেছেন যে, তিনি পার্থিব জীবন ও দুনিয়ার জীবনের সুখ শান্তির তুলনায় আখেরাতের জীবনকে অগ্রাধিকার দিতেন। আখেরাতের জীবনের উদ্দেশ্যে তিনি হাতে পাওয়া সুখের জীবনকে পায়ে ঠেলে দূরে সরিয়ে দিয়েছেন। অবশ্য বিশ্বাসগতভাবে বা শরীয়তের নির্দেশ পালন করার উদ্দেশ্যেই যে রসূল(স.) এভাবে আত্মপীড়ন ও পরিবারকে নিয়ন্ত্রণ করছিলেন তা নয়। পবিত্র খাদ্য খাবার বর্জন করতে শরীয়ত বলেনি বা এটা ঈমানের কোনাে অংগও নয়, আর বিনা কষ্টে যখন প্রাচুর্য আসছিলাে তখন যে তিনি গ্রহণ করেননি তাও নয়; তবে এটাও সত্য যে বিলাসিতার জীবনযাপন করা তাঁর জীবনধারা ছিলাে না, তিনি বিলাসী হয়ে যাননি এবং বিলাসিতায় মেতেও থাকেননি আর তাঁর উম্মত বিলাসিতা বর্জিত জীবনযাপন করুক এবং দুনিয়ার ভালাে ভালাে বন্ধু গ্রহণ করা থেকে নিজেদেরকে বঞ্চিত রাখুক তিনি তাও চাননি। তিনি নিজে যে ত্যাগী জীবনযাপন করেছেন এটাকে তার উম্মতের জন্যে তিনি চাপিয়েও দেননি, তবে কোনাে ব্যক্তি তাঁর অনুসরণে দুনিয়ার ভােগ-বিলাসকে বর্জন করতে চাইলে তাকে তিনি মানাও করেননি। আল্লাহ রব্বুল আলামীন ভালাে ভালাে খাদ্য-খাবার ও সৌন্দর্যের যেসব বস্তুসম্ভার সৃষ্টি করেছেন তার থেকে ভােগ ব্যবহারকে তিনি নিরুৎসাহিত করেননি, কারণ এটা হচ্ছে মানুষের মনের স্বাভাবিক চাহিদা।  *উম্মুল মােমেনীনদের আখরাতমুখী জীবন ধারা : নবী(স.)-এর স্ত্রীরা তাে সাধারণ মানুষই ছিলেন। এ জন্যে তাদের মধ্যে মানুষ হিসাবে মানবীয় চাহিদা থাকা একটি স্বাভাবিক ব্যাপার। নবীর স্ত্রী হওয়ার মর্যাদা লাভ করা সত্তেও মানবীয় এসব চাহিদা একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। নবুওতের ঝর্ণাধারা থেকে তারা সিঞ্চিত হয়েছেন সত্য, কিন্তু তাই বলে তাদের প্রকৃতিগত চাহিদাগুলাে একেবারে খতম হয়ে যায়নি, স্বভাবগত এসব চাহিদা তাঁদের মধ্যে অবশ্যই জাগরুক ছিলাে। এ কারণে যখন আল্লাহ রব্বুল আলামীন তাঁর রসূল(স.) ও মােমেনদেরকে প্রশস্ততা ও সচ্ছলতা দান করলেন তখন নবী(স.)-এর স্ত্রীরা খরচ-পত্র দেয়ার ব্যাপারে তার কাছে দরবার করা শুরু করলেন; কিন্তু নবী(স.) তাদের এই দাবী-দাওয়াকে হৃষ্টচিত্তে গ্রহণ করতে পারেননি, বরং হতাশা ও অসন্তোষ নিয়ে তাদের এসব দাবী দাওয়াতে সাড়া দিলেন। কারণ আল্লাহর নবী(স.) অত্যন্ত সহজ সরল জীবন যাপন করতে অভ্যস্ত ছিলেন এবং আল্লাহ তায়ালা যখন যে হালে তাকে রেখেছেন সেই অবস্থাতেই তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন এ জন্যে তার স্ত্রীরা সম্মিলিতভাবে যখন বিভিন্ন দাবী পেশ করলেন তখন জীবনটা তার কাছে বড়ই কঠিন মনে হবে। যদিও হালাল-হারাম প্রশ্নে তেমন কোনাে সংকট ছিলাে না-হালাল-হারাম এর ব্যাপারটা তাদের সবার কাছে স্পষ্ট ছিলাে। তারা কোনাে হারাম জিনিসের জন্যে দাবী করছিলেন তা নয়, তারা অন্যান্য দুনিয়াবাসীদের মতাে একটু ভালো-খাওয়া, ভালো পরা ও অন্যান্যদের মতাে একটু সচ্ছল জীবন যাপন করার প্রয়ােজনে যা দরকার তাই-ই দাবী করছিলেন মাত্র- যা দাবী করায় প্রকৃতপক্ষে কোনাে দোষ ছিলাে না। স্ত্রীদের নানাপ্রকার দাবী দাওয়া শুনে নবী(স.) বড়ই হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। তিনি তাঁর সাহাবাদেরকে এ ব্যাপারে কিছুই অবহিত করেননি অথচ এ বিষয়টি ছাড়া অন্য সকল বিষয়ে তাদের অবহিত করতেন। এ বিষয়টি তাদেরকে না জানানােটা তাঁর নিজের কাছেই খুব কঠিন লাগছিলাে। সাহাবারা রসূলুল্লাহ(স)-এর মনােবেদনার কথা বুঝার জন্যে এসেছেন। কিন্তু তাদেরকে রসূলুল্লাহ সাক্ষাতের অনুমতি দেননি। ইমাম আহমদ জাবের(রা.)-র বরাত দিয়ে রেওয়ায়াত করছেন, তিনি বলেন, একদিন আবু বকর(রা.) রসূলুল্লাহ(স.)-এর সাক্ষাতের অনুমতি চাইলেন, অন্যান্য আরও অনেকে দরজায় (সাক্ষাতপ্রার্থী হয়ে) বসেছিলেন। রসূলুল্লাহ(স.) সামনে বসেছিলেন, কিন্তু তাঁকে সাক্ষাতের অনুমতি দিলেন না, এরপর ওমর(রা.) এসে সাক্ষাতের অনুমতি চাইলে তাকেও রসূলুল্লাহ(স.) অনুমতি দিলেন না। এর কিছুক্ষণ পর রসূলুল্লাহ(স.) দুজনকে এক সাথে আসার অনুমতি দিলেন। তারা দুজনে প্রবেশ করে দেখেন রসূলুল্লাহ চুপ করে বসে আছেন এবং তাঁর স্ত্রীরা তাকে ঘিরে বসে রয়েছেন। ওমর(রা.) বলছেন, আমি চিন্তা করলাম এমন কিছু আমি বলবাে, যেন রসূলুল্লাহ একটু হাসতে বাধ্য হন। তাই ওমর(রা.) বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ যায়েদের কন্যা (ওমরের স্ত্রী) যদি এর আগে আমার কাছে এটা ওটা দাবি করার সাহস দেখাতাে তাহলে অবশ্য অবশ্যই তার গর্দান মেরে দিতাম।(এ কথা বুঝা যায় যে আরবে এমন কোনাে শাসন ব্যবস্থা ছিলাে না যার কারণে কেন্দ্রীয়ভাবে কোনাে আইন কানুন চালু করা যেতাে। কেউ এভাবে কাউকে হত্যা করলে ধরপাকড়ের কেউ ছিলো না, বিশেষ করে নারীদের ব্যাপারে, শুধু ভিন্ন গোত্রের হলে তারা হয় অনুরূপ হত্যার দাবী করতাে, অথবা রক্তের মূল্য নিয়ে থেমে যেত) এ কথায় রসূলুল্লাহ (স.) এতাে জোরে হেসে উঠলেন যে তার আক্কেল দাত পর্যন্ত আমাদের নযরে ভেসে উঠলো। তিনি বললেন, এরা আমাকে ঘিরে ধরে নানাপ্রকার সামগ্রীর দাবী তুলেছে। তখন আবু বকর উঠে আয়শাকে মারতে উদ্যত হলেন, ওমর(রা.)ও অনুরূপভাবে তার মেয়ে হাফসাকে মারার জন্যে এগিয়ে গেলেন। এই কথা বলতে বলতে তারা উভয়ে নিজ নিজ কন্যার দিকে এগিয়ে গেলেন, নবী(স.)-এর কাছে এমন কিছু তােমরা দাবী করছে যা তাঁর কাছে নেই। কিন্তু রসূলুল্লাহ(স.) তাদেরকে থামালেন, তখন তার স্ত্রীরা বললেন, আল্লাহর কসম আমরা প্রতিজ্ঞা করছি, এরপর থেকে আমরা রসূলুল্লাহ(স)-এর কাছে এমন কিছু চাইবাে না যা তাঁর কাছে নেই। রসূলুল্লাহ(স.) বলেন, এরপরই মহান আল্লাহ তায়ালা আয়াত নাযিল করলেন, যাতে নবী(স.)-এর স্ত্রীদের এই এখতিয়ার দেয়া হলাে যে তারা ইচ্ছা করলে কৃচ্ছতা সাধনের জীবন নিয়ে রসূলুল্লাহ(স.)-এর সাথে থাকতে পারেন অথবা ভালােভাবে মান-ইযযতের সাথে বিদায় নিয়ে যেতে পারেন। তখন রসূলুল্লাহ পয়লা আয়শা(রা.)-কে বললেন, ‘তােমাকে আমি একটি বিষয় সম্পর্কে জানাচ্ছি, তােমার আব্বা আম্মাকে জিজ্ঞাসা না করে মতামত না জানা পর্যন্ত সে বিষয়ে তাড়াহুড়াে করে হঠাৎ করে কোনাে সিদ্ধান্ত নিয়াে না।’ আয়শা(রা.) বললেন, সে বিষয়টি কি? রেওয়ায়াতকারী জাবের(রা.) বলেন, এরপর রসূলুল্লাহ(স.) ওপরে বর্ণিত আয়াতটি ‘ইয়া আইয়ুহান্নাবিয়্যু কুল লি-আযওয়াজিকা’-শেষ পর্যন্ত তেলাওয়াত করলেন। শােনার পর আয়িশা(রা.) বললেন, আব্বা-আম্মাকে জিজ্ঞাসা করার এ কথা কি আপনার নিজের, না এটা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের নির্দেশ? আর আমি আপনাকে একটি অনুরােধ করছি, যে এখতিয়ার আমাকে দিলে এ বিষয়ে আপনাকে আমি যা বলবাে, তা দয়া করে আপনার অন্য স্ত্রীদেরকে বলবেন না । অতপর রসূলুল্লাহ(স.) বললেন, অবশ্যই আল্লাহ তায়ালা আমাকে একজন কঠোর মেজাজের মানুষ বানিয়ে পাঠাননি, বরং তিনি আমাকে একজন সহৃদয়বান শিক্ষক বানিয়েছেন। যে এখতিয়ার তাদেরকে আমি দিয়েছি, সে বিষয়ে ওদের যে কেউ আমাকে যা কিছু জিজ্ঞাসা করেছে আমি তার জবাব দিয়েছি ।(ইমাম মুসলিম যাকারিয়া ইবনে ইসহাক-এর বরাত দিয়ে হাদীসটি তার কিতাব মুসলিম শরীফে এনেছেন) আর আবু সালমা ইবনে আব্দুর রহমান-এর বরাত দিয়ে বােখারী শরীফে যে, রেওয়ায়েতটি পাওয়া যায় তাতে দেখা যায়, রসূলুল্লাহ(স.)-এর স্ত্রী আয়েশা(রা.) তাকে জানিয়েছেন যে, যখন স্ত্রীদেরকে এখতিয়ার দেয়ার কথা বলে আয়াত নাযিল হলাে তখন তিনি প্রথমেই আমাকে এখতিয়ার দিলেন, বললেন, আমি তােমাকে একটি কথা জানাচ্ছি, তুমি ব্যস্ত হয়াে না, বরং তােমার আব্বা আম্মাকে জিজ্ঞাসা করে আমাকে জানাবে। অথচ তিনি তাে জানতেনই যে আমার আব্বা-আম্মা কিছুতেই বিচ্ছেদ ঘটানাের পক্ষে মত দেবেন না। তিনি বলছেন, এরপর রসূলুল্লাহ(স.) নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘হে নবী, বলাে তােমার স্ত্রীদেরকে… দুটি আয়াতের শেষ পর্যন্ত পড়ে শােনালেন।’ আমি তখন তাকে বললাম, কোনাে জিনিস সম্পর্কে তাদের মতামত জানার জন্যে আপনি আমাকে বলছেন?’ আমি তাে আল্লাহ ও তাঁর রসূলকে এবং আখেরাতের বাসস্থানকেই চাই।’ জীবনের জন্য ইসলামী মতাদর্শের মৌলিক মূল্যবােধকে শাণিত করে তুলে ধরার জন্যেই কুরআনুল করীমের অবতারণা। আর এই মূল্যবােধকে নবী(স.)-এর বাড়ীতেই জীবন্ত ছবির মতাে তুলে ধরা হয়েছে, সুস্পষ্টভাবে জীবনের সকল দিক ও বিভাগকে ফুটিয়ে তােলা হয়েছে। এই মােবারক ঘর, গােটা মুসলিম বিশ্বের জন্যে এবং ইসলামের অগ্রগতির পথে চিরদিন এক উজ্জ্বল আলােক স্তম্ভ হিসাবে কাজ করতে থাকবে এবং সেদিন খুব দূরে নয় যখন সমুন্নত আদর্শের অবদান অবশেষে সারা পৃথিবী ও তার অধিকারীদের দ্বারা গৃহীত হবে। মানবমন্ডলীকে সঠিক পথ প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে এবং এ পথের যৌক্তিকতা সমুজ্জ্বল করে তােলার জন্যে অত্যন্ত জোরদার দুটি নমুনা পেশ করা হয়েছে। একটি একান্তভাবে দুনিয়ার জীবন ও তার সৌন্দর্যকে উপভােগ করার জন্যে অনিয়ন্ত্রিত ও লাগাম ছাড়া এক জীবন, যার মধ্যে অদৃশ্য বিশ্বাসের প্রশ্ন নেই এবং অন্যটি হচ্ছে আল্লাহ-রসূল ও আখেরাতের ওপর অবিচল বিশ্বাসের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা চিরন্তন জীবন। অন্য কথায় বলা যায়, একটি হচ্ছে নিছক দুনিয়াকেন্দ্রিক জীবন এবং অন্যটি আল্লাহ তায়ালা রসূল ও আখেরাতমুখী জীবন। এমতাবস্থায় একথা ভালাে করে বুঝে নিতে হবে যে, জীবন ও জগৎ সম্পর্কে একই অন্তরে দুটি চিন্তাধারা (সমানভাবে স্থান পেতে পারে না, যেমন করে পারে না এক পেটের মধ্যে দুটি হৃদপিন্ড বিরাজ করতে। নবী(স.)-এর স্ত্রীদের অবস্থা ছিলাে যে, তারা দ্বার্থহীন কণ্ঠে বলে দিয়েছিলেন, আল্লাহর কসম, আজকের এই বৈঠকের পরে আমরা রসূলুল্লাহ(স.)-এর কাছে এমন কিছু চাইবে না যা তার কাছে নেই। এ জন্যে তাদের আসল অবস্থাটি জানিয়ে আল কোরআন নাযিল হলাে। বলা হলাে, রসূলুল্লাহ(স.)-এর কাছে সুখ-সম্পদের দ্রব্যাদি আছে বা না আছে সেটা আসল প্রশ্ন নয় আসল প্রশ্ন হচ্ছে, আল্লাহ, রসূল ও আখেরাতকে পূর্ণাংগভাবে গ্রহণ করা, অথবা দুনিয়ার সুখ সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে দুনিয়ার জীবনকে আকণ্ঠ ভােগ করার দিকে ঝুঁকে পড়া এবং দুনিয়ার সম্পদ ও বিলাস দ্রব্যাদি লাভ করার জন্যে মেতে ওঠা, আখেরাতের চিরন্তন জীবনকে বিশ্বাস করে তার জন্যে লালায়িত হওয়া, তাতে সুখ সম্পদের সকল উপকরণ ঘরে থাকুক বা ঘরে কোনাে আসবাবপত্র না থাকুক তাতে কিছু যায় আসে না। আল্লাহর পক্ষ থেকে এই অকাট্য জ্ঞাতব্য বিষয়টি এসে যাওয়ার পর নবী(স.)-এর স্ত্রীরা খােলা মনে এবং একবাক্যে আল্লাহ তায়ালা, রসূল ও আখেরাতের যিন্দেগীকেই গ্রহণ করে নিলেন। প্রকৃতপক্ষে তারা প্রাণ প্রিয়নবী(স.)-এর পরিবার ভুক্ত ছিলেন, তাঁর সান্নিধ্য লাভে যে জীবন, তা ছিলাে পরম পরিতৃপ্ত জীবন, যে জীবনের কোনাে তুলনা হতে পারে না। রসূলুল্লাহ(স.)-এর গৃহ তাে সারা বিশ্বের মধ্যে সর্বাধিক মর্যাদাপূর্ণ গৃহ। কোনাে কোনাে বর্ণনায় জানা যায়, যে তার নেককার স্ত্রীদের এই খােলা মনে আল্লাহ, রসূল ও আখেরাতের যিন্দেগী গ্রহণ করার ঘোষণা নবী(স.)-কে বড়ােই মুগ্ধ করে ফেললাে। সে সময়ে পেয়ারা নবী(স.)-এর মানসিক অবস্থা আঁচ করার জন্যে আমাদের কিছুক্ষণের জন্যে একটু গভীরভাবে চিন্তা করতে হবে এবং সে অবস্থা ও পরিবেশ মনের আঁখরে একবার টেনে আনতে হবে, আহ! কী মনােরম সে দৃশ্য, কতাে মধুময় নবী(স.)-এর সেই মােহব্বত পরশ। আশে-পাশে জীবনকে আকন্ঠ ভােগ করার সকল বস্তু ও দৃশ্য মওজুদ, কিন্তু আল্লাহ পাকের তরফ থেকে তাদেরকে যে কোনাে জীবন গ্রহণ করার এখতিয়ার দেয়ার পর শান্ত মনে তারা সব কিছু ছেড়ে একমাত্র আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রসূলকে বড়াে করে দেখা ও আখেরাতের জন্যে সকল ভােগ-বিলাস ত্যাগ করতে প্রস্তুত হয়ে যাওয়া- এটা কোনাে সাধারণ ব্যাপার ছিলো না। এটা একমাত্র তাদের পক্ষে সম্ভব ছিলাে যাদের অন্তরে ঈমানের আলােতে ঝলমল করছিলাে এবং যারা দুনিয়ার ওপর আখেরাতকে অগ্রাধিকার দিতে পেরেছিলেন।  *তারা ছিলেন সত্যিকার আদর্শ নারী : প্রকৃতপক্ষে, সে ঘটনাটি তাদের চিন্তাধারার মূল্যমানকে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছে এবং দুনিয়া ও আখেরাতের অনুভূতির মধ্যে তুলনা করে সাফল্যের সঠিক পথকে চূড়ান্তভাবে চিহ্নিত করে দিয়েছে। এ ঘটনাটি মুসলমানদেরকে একথা জানিয়ে দিচ্ছে যে, দুনিয়ার নগদ পাওনা ও আখেরাতের বাকি পাওনার মধ্যে কোনটা বেশী লাভজনক এবং কোনটা অধিক স্থায়ী। দুনিয়ামুখিতা ও আখেরাতমুখিতার মধ্যে পার্থক্য কি তা বলে দিচ্ছে এবং ঐকান্তিক নিষ্ঠার সাথে একান্তভাবে অন্তরের মধ্যে মােমেনদের দিলে আল্লাহর সাথে ও শান্তভাবে অন্তরের মধ্যে মােমেনদের দিলে আল্লাহর মােহব্বত কতাে গভীরভাবে বিরাজ করছে তার প্রমাণ পেশ করছে, তাদের জানিয়ে দিচ্ছে যে, এমন মােহব্বত একমাত্র আল্লাহ সােবহানাহু ওয়া তায়ালার জন্যেই সম্ভব, অন্য কারও জন্যে নয়, আল্লাহর প্রতি এই মােহব্বতই ঈমানের মাধুর্যকে দুনিয়াবাসীর সামনে সমুজ্জ্বল করে তুলেছে এবং আখেরাতের যথার্থতাকে প্রমাণ করেছে। এ ঘটনাটি কয়েকটি দিক দিয়ে রসূলুল্লাহ(স.)-এর জীবনের মাহাত্মকে ছবির মতাে ফুটিয়ে তুলেছে, ফুটিয়ে তুলেছে তাদের জীবনকে যারা তাঁর সাথে ঈমানের নিশানবরদার হিসাবে কাজ করেছেন এবং তাঁর সান্নিধ্যে থেকে ইসলামের পতাকাকে সমুন্নত করেছেন। এ ঘটনার মধ্যে | সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি এবং সব থেকে সুন্দর যে জিনিসটি মনকে প্রবলভাবে দোলা দেয়, তা হচ্ছে প্রিয় নবী(স.)-এর সংগী সেসব মানুষের যিন্দেগী তাে দুনিয়ার অন্যান্য মানুষের মতােই মানবীয় জীবন ছিলাে। স্বভাবতই মানবীয় জীবনের সকল চাহিদা ও বৈশিষ্টও তাদের মধ্যে বর্তমান ছিলাে, তারা জৈবিক চাহিদা ও মানবীয় দুর্বলতা থেকে মুক্ত ছিলেন না। চেতনা, অনুভূতি ও ঝোক প্রবণতার দিক দিয়েও তারা অন্যান্য মানুষের উর্ধের কোনাে জীব ছিলেন না। এতদসত্তেও কিসের টানে, কিসের আকর্ষণে এবং কিসের মােহব্বতে তাঁরা এসব কিছুকে নিয়ন্ত্রিত করতে সমর্থ হয়েছিলেন? সকল প্রকার মানবীয় ক্রটি-বিচ্যুতি-ভুল-ভ্রান্তি, প্রবণতা আবেগ-উচ্ছাস ও দুর্বলতা সবই তাঁদের মধ্যে থাকা সত্তেও তারা তাদের মানবতাবােধকে সমুন্নত করতে পেরেছিলেন যে, সােনার কাঠির ছোঁয়াতে সেই খাঁটি সোনা-না- সেই পরশ পাথরই তো ছিলেন নবী মােহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ(স.)। তাহলে কি তারা শয়তানের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে চলে গিয়েছিলেন, তারা মানবীয় চেতনা ও অনুভূতিনিচয় থেকে উর্ধে উঠে গিয়েছিলেন? মানবীয় দুর্বলতাগুলাে কি তাদের মধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিলাে? না, সকল ভুল-ত্রুটি ও দুর্বলতা সবই তাদের মধ্যে বর্তমান ছিলাে; কিন্তু আল্লাহর প্রতি গভীর বিশ্বাস, আখেরাতের প্রতি অবিচল আস্থা এবং নবী মােহাম্মদ(স.)-এর মহান পরশ মাটির এ কায়াগুলােকে সকল সুষমায় ভরে দিয়েছিলাে পাপ-পংকিলতায় ভরা এ পৃথিবীর সকল আবর্জনার মধ্যে থেকেও আল্লাহভীতির মহিমায় তারা মহিমান্বিত হয়েছিলেন। বিশ্বনবী(স.)-এর মধুর সাহচর্য তাদেরকে সম্ভাব্য সকল দিক থেকে পূর্ণতা দান করেছিলাে। আমরা নবী করীম(স.) ও তার সাহাবাদের সম্পর্কে যখন কল্পনা করি তখন বেশীরভাগ লােকই তাদের সম্পর্কে অনুমান করতে গিয়ে এক অবাস্তব চিন্তা করে বসি বা অপূর্ণাংগ এক ধারণার মধ্যে পড়ে যাই-আমরা মনে করে বসি যে, তারা মানবীয় ক্রুটি-বিচ্যুতিসমূহ থেকে একেবারেই পবিত্র হয়ে গিয়েছিলেন, তাদের চিন্তা-চেতনাও মানবীয় সম্পর্কের সাধারণ নিয়ম থেকে তারা অনেক ঊর্ধ্বে উঠে গিয়েছিলাে, আর এসব কথা মনে করেই আমরা তাদেরকে সকল দুর্বলতা থেকে মুক্ত মনে করতে চাই, আর সকল ত্রুটি ও দুর্বলতার ঊর্ধ্বে মনে করতে গিয়ে আমরা দারুণ ভুল করে বসি। আমাদের অধিকাংশের এই ত্রুটির কারণে অবাস্তব ও কল্পনা-কুসুম অনেক কিছু আমরা আশা করি। কোনাে কোনাে মানুষকে আমরা এতাে রহস্যপূর্ণ গুণের অধিকারী মনে করি যে তাদের মানব প্রকৃতির আসল দুর্বলতাকে আর বুঝতে পারি না। এর ফলে আমাদের এবং তাদের মধ্যে মানবীয় সম্বন্ধ কেটে যায়। তাদের সম্পর্কে ধারণা-কল্পনা এতােদূর বৃদ্ধি পায় যে তাদেরকে আর মর্তের মানুষ মনে করা যায় না। বরং তাদেরকে মনে করতে শুরু করি, তারা অতিমানব ও মানুষের ধরা-ছোঁয়ার বাইরের এক কাল্পনিক জীব। আমাদের মতাে মানুষ ছাড়া অন্য আর সৃষ্টি অনেকটা ফেরেশতাদের সম্পর্কে আমাদের কল্পনার মতাে। তখন হয় তাদেরকে মনে করা হতে থাকে ফেরেশতা বা তাদের মতােই অন্য কোনাে সৃষ্টি, যাদের সাথে কোনাে অবস্থাতেই মানুষের কোনাে সম্পর্ক বা সম্বন্ধ স্থাপিত হতে পারে না। আর তাদের সম্পর্কে মনের মধ্যে এই ধরনের কাল্পনিক চিন্তা আনার পর তারা মূলত আমাদের জীবন সীমানা থেকে অনেক অনেক দূরে সরে চলে যায়। তখন তাদের সম্পর্কে এমন হতাশা জন্মে যায়, যা আর কখনও দূর হতে চায় না এবং তাদের থেকে আমাদের জীবনের জন্যে কোনাে প্রভাব গ্রহণ করাও আর সম্ভব হয় না। বরং তাদের থেকে প্রভাব গ্রহণ করা বা তাদের অনুকরণ অনুসরণ মানুষের জন্যে ক্ষতিকর বলে মনে হতে থাকে। এইভাবে তাদের থেকে আমাদের জীবনের জন্যে কোনাে আদর্শ খুঁজে পাওয়ার পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। যেহেতু আমাদের চিন্তা-চেতনায় তারা ভিন্ন এক সৃষ্টি বলে প্রতীতি জন্মে যায়, ফলে তাদেরকে বড়াে করতে গিয়ে তারা আমাদের মধ্য থেকে হারিয়ে যায়। আসলে সত্যিকারে সম্পর্ক তাে তাদের সাথেই গড়ে উঠতে পারে যাদের সাথে প্রকৃতিগত মিল থাকে, মিল থাকে তাদের সাথে চিন্তা-চেতনায়, সম্পর্ক-সম্বন্ধে, কাজে-কর্মে, চেষ্টা-সাধনায় এবং বাস্তব জীবনের প্রতিটি ব্যাপারে। যখন তাদের উন্নতি এসব সীমানা পার হয়ে যায় তখন তারা আর ইহজগতের মানুষ থাকে না, এ জন্যে তারা আর অনুসরণযােগ্যও থাকতে পারেন না। মহা বিজ্ঞানময় আল্লাহ রব্বুল আলামীন এসব যুক্তি বিবেচনায় মানুষের শিক্ষক হিসাবে মানুষকেই বাছাই করেছেন এবং তার বার্তা মানুষের কাছে পৌছে দেয়ার জন্যে মানুষকেই তিনি নিয়ােগ দিয়েছেন, তিনি মানুষ ছাড়া ফেরেশতা বা অন্য কোনাে সৃষ্টিকে এ দায়িত্ব দেননি। যাতে তাদের মধ্যে আসল সম্পর্কের চেতনা বহাল থাকে এবং সে চেতনার কারণে তারা পরস্পরের কাছে যেতে পারে এবং প্রয়ােজনীয় প্রভাব গ্রহণ করে জীবনকে সমৃদ্ধ করার সুযােগ পায়। যেন তারা অনুভব করে, যাদের অনুকরণ করার চিন্তা আসছে তারাও তাে মানুষ, তারা যদি এমন ভালাে হতে পারে তাহলে আমরা কেন হতে পারবাে না। তখন মানবিক কারণে তাদের সাথে অতি স্বাভাবিকভাবে সম্পর্ক-সম্বন্ধ ও আন্তরিক মােহব্বত-এ মােহব্বত গড়ে উঠতে পারে মানুষে মানুষে স্বাভবিক সম্পর্কের কারণে ছােট মানুষের জন্যে বড়াে মানুষের অনুকরণ করার তখন আকাংখা পয়দা হয়। ওপরে বর্ণিত ‘এখতিয়ারদানের’ ঘটনায় আমরা দেখতে পাচ্ছি প্রকৃতিগত কারণেই ধন-সম্পদ ও আসবাব পত্রের জন্যে নবী(স.)-এর সহধর্মিনীদের মধ্যে এক বাসনা, আবার সাথে সাথে আমরা এটাও দেখতে পাচ্ছি নবী(স.) ও তার ঘরের বাসিন্দাদের মধ্যে ত্যাগ-তিতিক্ষা ও উন্নত মননশীলতার এক অত্যুজ্জ্বল নমুনা। দেখা যাচ্ছে, তারা যখন আসবাবপত্র ও সুখ সম্পদের দ্রব্যাদির জন্যে নবী(স.)-এর কাছে দরবার করছেন তখন নবী(স.) ঠিকই কষ্ট পাচ্ছেন। কিন্তু আবু বকর(রা.) ও ওমর(রা.) যখন তাদেরকে প্রহার করতে উদ্যত হচ্ছেন তখন এই কষ্টদায়ক ব্যবহার, প্রাণপ্রিয় নবী(স.) আর সহ্য করতে পারছেন না, তাই তিনি কিছুতেই সে বিষয়ে অনুমতি দিতে পারছেন না। এতে বুঝা যাচ্ছে আয়শা(রা.) ও হাফসা(রা.) সহ তাঁর স্ত্রীদের জন্যে তার মােহব্বত ছিলাে কতাে গভীর। তাদের ব্যবহারে তিনি নিজে কষ্ট পেলেও তার দ্বারা কেউ কষ্ট পাক এটা ছিলাে তার সহ্যের বাইরে। নবী(স.)-এর মধ্যে এ বিবেচনা কাজ করছিলাে যে ভালাে খাওয়া পরা ও বিলাস দ্রব্যের জন্যে চাহিদা-এটা অবশ্যই মানব প্রকৃতির দাবী, এ চাহিদাকে পরিমার্জিত করা যেতে পারে, কিন্তু এ চাহিদাকে দমিয়ে দেয়া যায় না। এ আকাংখাকে একেবারে নিভিয়েও দেয়া তাে যায় না। মানব জাতির সাধারণ এ প্রবণতার কারণেই রসূল পত্নীদের এসব দাবী-দাওয়া অযৌক্তিক বা অগ্রাহ্য করার মতো ছিলে না। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নবী(স.)-এর সাথী হওয়ার যে সম্মান তাদের দিয়েছিলেন তারই দাবী হিসাবে চেয়েছিলেন তারা সাধারণ মহিলাদের মধ্যে বাস করা সত্তেও এক অসাধারণ ভূমিকা গ্রহণ করে পৃথিবীর সকল মানুষের জন্যে এক আদর্শ স্থাপন করুক- আল্লাহ তায়ালা এটা কেন তাদের কাছে চাইবেন না; তারা যে মােমেনকূলের মা! তাই, দুনিয়ার জীবনের স্বাদ-আহলাদ ও আখেরাতের জীবনকে সামনে রেখে আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে যে কোনাে বিষয় পছন্দ করার এখতিয়ার দিলেন, যেন তারা স্বেচ্ছাপ্রণােদিত হয়ে আল্লাহর রসূলের মােহব্বতে আখেরাতের যিন্দেগীকে গ্রহণ করার মাধ্যমে তাদের ঈমানের জ্বলন্ত প্রমাণ পেশ করতে পারে এবং দুনিয়াবাসীদের সামনে ভােগী ও ত্যাগী জীবনের মধ্যে পার্থক্য করে দেখাতে পারে। এখতিয়ার দেয়ার আর একটি উদ্দেশ্য বুঝা যায়, স্বেচ্ছায় যেন ত্যাগ স্বীকার করার নিদর্শন হাযির করে- অসন্তোষের সাথে নয়, কারাে দ্বারা প্রভাবিত হয়েও নয়, অথবা বাইরের কোনাে চাপে পড়েও নয়! তাদের এ মহান ভূমিকায় প্রাণপ্রিয় স্বামী ও নবীকুল শিরোমণি বড়ােই চমকৃত হলেন, খুশীতে ভরে গেলাে তার অন্তর, তার হৃদয়ের মধ্যে স্ত্রীদের মর্যাদা ও মােহ্বত আরও সমুন্নত হলাে। আহ! একবার ভেবে দেখুন, স্বামীভক্ত স্ত্রী হওয়ার সুযােগের সাথে সাথে তারা সারওয়ারে দো-আলমের নয়নমণিতে পরিণত হলেন! এ সৌভাগ্য কি সব পাওয়া থেকে বড়াে পাওয়া নয়, নয় কি এটা ইহ-পরকালের পরম ও চরম মর্যাদা। বিশ্ববাসী নারীকূলের জন্যে কি এ ঘটনা এ শিক্ষা বহন করেনি যে, ভালাে কিছু পেতে হলে অবশ্যই কিছু ত্যাগ স্বীকার করতে হয় এবং এ যামানার পরে সকল মাতৃকুল কি এ শিক্ষা লাভ করেনি যে তারা তাদের স্বভাবজাত চাহিদা-নিচয়কে দমন করার মাধ্যমে স্বামীর সন্তোষের সাথে সাথে বেহেশতের সুসংবাদ ও নিশ্চয়তা লাভ করতে পারে? কোরআনের আয়াতে আমরা এখানে যে ছবিটি দেখতে পাচ্ছি, তাতে আমরা যেন দেখছি যে প্রবাহমান প্রেম-সূধার নহরের সামনে আমরা সবাই দাঁড়িয়ে আছি। প্রেমের প্রতীক মহান নবী(স.)-কে যেন সহাস্যবদনে আমাদের সামনে উপবিষ্ট দেখতে পাচ্ছি। তিনি আয়শাকে ভালবাসেন, এটা সবার কাছেই সুস্পষ্ট, স্বভাবতই তিনি চাইছেন তার মর্যাদা আরও বাড়ুক এবং নবী(স.)-এর আদর্শ এবং উপযুক্ত স্ত্রী হওয়ার মর্যাদায় তিনি ভূষিত হন; আল্লাহ রব্বুল আলামীনও চাইছেন তার জন্যে আয়শাকে আদর্শ বানাতে চাইছেন নবীর পরিবারের জন্যে এই মহিয়ষী মহিলা এক আদর্শ নমুনা স্থাপন করুন, এই জন্যে এখতিয়ার দেয়ার কাজটি তার থেকেই শুরু করা হয়েছে। তার মর্যাদা-বৃদ্ধি এবং আল্লাহ-মুখী হওয়ার প্রচেষ্টায় যেন তিনি তার বাপ-মার সাথে পরামর্শ না করে জলদি কোনাে সিদ্ধান্ত না দিয়ে বসেন। অথচ মজার ব্যাপার হচ্ছে, আল্লাহ রববুল আলামীন তা ভালাে করেই জানতেন আয়শার বাপ-মা তাকে বিচ্ছেদ ঘটানাের পরামর্শ দেবেন না, যেমন আয়শা(রা.)-এর প্রথম কথাতেই জানা গেছে। যেহেতু নবী(স.)-এর হৃদয়ে তার জন্যে কতাে মধুর অনুরাগ ছিলাে, একথা আল্লাহ তায়ালা ছাড়া তার থেকে বেশী কে আর জানতাে! তাই তিনি একথা বুঝে তার মতামত প্রকাশ করতে ভুল করেননি। তিনি হৃষ্ট-চিত্তে যে কথাটি বলে উঠলেন তা তার গভীর হৃদয়ানুভূতির সুবাস ছড়িয়ে এমনই এক মধুর কথােপকথােনকালে বেরিয়ে এলাে। মানুষ নবী‌(স.)-এর হৃদয় থেকে তাঁর কনিষ্ঠতম স্ত্রীর জন্যে প্রাণঢালা মােহব্বত ঝরেছিলাে। এখানে একটা প্রশ্ন জাগতে পারে, রসূলুল্লাহ (স)-এর হৃদয়াবেগ এক স্ত্রীর জন্যে উদ্বেলিত হলে অন্য স্ত্রীরা কি কষ্ট পাননি? এর জবাব হচ্ছে, সবাই জানেন যে একমাত্র তিনিই ছিলেন কুমারী বাকি সবই ইতিপূর্বে কিছু না কিছু স্বামী সােহাগ পেয়েছেন, একমাত্র আয়শা(রা.)-ই তা পাননি, এ জন্যে তার পাওনা অগ্রগণ্য। সবাই ছিলেন বয়স্কা এবং দু’একজন বাদে সবাই ছিলেন সন্তানের মা, আয়শা(রা.) ছিলেন নিঃসন্তান এবং নয় বছরের ছােট মানুষটি তিপ্পান্ন বছর বয়সের একজন মানুষকে, আল্লাহর নবী হওয়ার কারণেই সানন্দে বরণ করে নিচ্ছেন। এ জন্যে একটু বেশী আদর সােহাগ পাওয়া তার ন্যায্য হক ছিল, তাছাড়া ত্যাগ-কুরবানী ও মানবীয় সকল বৈশিষ্ট বিবেচনায় খাদীজা(রা.) বাদে তিনি বাকি সবার মধ্যে ছিলেন অনন্য, যার কারণে রসূলুল্লাহ(স.)-এর মনটা মানবীয় প্রকৃতির স্বাভাবিক দাবীতেই তার দিকে একটু বেশী ঝুঁকে ছিলাে-এ বিষয়ে আল্লাহ তায়ালা মানুষকে দায়ী করেননি, যেহেতু এটা মানুষের আয়ত্বের বাইরে। তবে, বস্তুগত সকল ব্যাপারে ইনসাফ করার হুকুম রয়েছে এবং এ বিষয়ে রসূলুল্লাহ(স) ইনসাফ করে দেখিয়েছেন। এ জন্যে রসূলুল্লাহ(স.) যে উন্নতর জ্ঞান-বুদ্ধি ও চেতনা নিয়ে দুনিয়ার স্বাদ আহলাদ ও বিলাস ব্যসনকে গৌণ করে দেখেছেন, সেই বুঝটা আয়শা(রা.)-এর মধ্যে বেশী পয়দা হােক এবং ইতিপূর্বেকার সর্বাধিক ত্যাগ-তিতীক্ষার সাথে আরও ত্যাগ যুক্ত হয়ে তাঁর মর্যাদা আরও বৃদ্ধি পাক এটাই ছিলাে কাম্য। নবী(স.)-এর ত্যাগী জীবনের সাথে শরীক হয়ে তিনিও নবী(স.)-এর ঘরনী হিসাবে ত্যাগের পরাকাষ্ঠা দেখাতে পারেন এবং পরবর্তী মােমেন নারীকুলের জন্যে আদর্শ স্থাপন করতে পারেন, তার রবও তার জন্যে এটাই চেয়েছেন। আয়শা(রা.)-এর আত্মপ্রকাশ এইভাবেই ঘটেছে। মানুষ হিসাবে, নারী জীবনের সব থেকে বড় পাওনা স্বামীর প্রাণঢালা ভালবাসা- সকল কিছুর বিনিময়ে তিনি তা অত্যন্ত দ্রুত ও তাৎক্ষণিক ইতিবাচক সিদ্ধান্তদানের মাধ্যমে অর্জন করতে সক্ষম হচ্ছেন। তার প্রখর বুদ্ধিমত্তা তাকে জানাচ্ছে স্বামী কী চান, স্বামীর প্রশ্ন সর্বাগ্রে তার প্রতি নিক্ষিপ্ত হওয়ার আনন্দে আপ্লুত হয়ে তিনি কাংখিত জবাবদানে সাফল্য মন্ডিত হচ্ছেন। তিনি পরম পুলকিত, প্রিয়তম স্বামী, প্রাণপ্রিয় আল্লাহর রসূল(স.)-এর মনােযােগ লাভে, তার মােহব্বত হাসিল করায় এবং পিতামাতার সাথে পরামর্শ করার প্রতি অমনােযােগিতা দেখিয়ে কথা বলা দ্বারা নবী (স.)-এর মনােযােগ আকর্ষণে তিনি আসলেই সফল হচ্ছেন। তারপর আমরা আবারও আঁচ করতে পারছি তার নারীসুলভ চিন্তা-চেতনা ও উপলব্ধিকে, যেহেতু তিনি রসূলুল্লাহ(স.)-এর কাছে আবেদন পেশ করছেন যেন তিনি তাঁর অন্য স্ত্রীদেরকে এ কথা না জানান যে এখতিয়ার দেয়ার পর তিনি নবী (স.)-কেই সব কিছুর বিনিময়ে গ্রহণ করেছেন। অবশ্য এ এখতিয়ার অন্যদেরকেও পরবর্তীতে দেয়া হয়েছে এবং তারাও নবী(স.)-কেই গ্রহণ করেছেন, কিন্তু আয়শা(রা.) প্রথমে জিজ্ঞাসিত হওয়ায় নবী(স.)-এর মনােযােগ লাভে অগ্রাধিকার পেয়েছেন এবং বুঝছেন তার স্থান রসূলুল্লাহ(স.)-এর হৃদয়ের কতো কাছে। এ পর্যায়ে এসে আমরা নবুওতের মর্যাদাও অবলােকন করতে পারছি, দেখছি কেমন করে মােহাম্মদ(স.) আল্লাহর রসূলের ভূমিকা পালন করছেন, তিনি বলছেন, ‘আল্লাহ তায়ালা আমাকে কঠোর হৃদয় বানাননি, বরং তিনি আমাকে সহৃদয়বান শিক্ষক বানিয়েছেন। আমি যা এখতিয়ার ওদের সবাইকে দেয়ার মনস্থ করেছি সে বিষয়ে আমি অবশ্যই ওদের সবাইকে জানাবাে; সুতরাং এ বিষয়ে তুমি আমাকে তাদের কার সাথে কী ব্যবহার করবাে বা কাকে কী বলবাে না বলবাে সে বিষয়ে কিছু বলাে না। এ কথাগুলােতে দেখা যাচ্ছে, নবী(স.) তাদের সবার জন্যে যে বিষয়টিকে কল্যাণকর বলে বুঝেছেন তা কারও কাছে গােপন করা পছন্দ করেননি এবং তাদেরকে কোনাে বড়াে পরীক্ষার মধ্যেও ফেলেননি; বরং সহজ অবস্থা যে চায় তার জন্যে তিনি সহজ অবস্থাকে অবারিত করে দিয়েছেন, যাতে করে সহজ অবস্থা গ্রহণ করে সে উপকৃত হতে পারে এবং পৃথিবীর সাধারণ আকর্ষণীয় দ্রব্য থেকে মনকে মুক্ত করে নিয়ে চিরস্থায়ী যিন্দেগীর সাফল্যের দিকে এগিয়ে যেতে পারে। মানুষের মধ্যে আল্লাহ প্রদত্ত এসব বৈশিষ্ট্য আমাদের বড়ো প্রয়ােজন। গােটা জীবন এবং তার নানামুখী দাবী দাওয়াসমূহ আমাদের সামনে রয়েছে এগুলােকে আমরা উপেক্ষা করতে পারি না বা এসব বিষয়কে অন্তর থেকে একেবারে মুছে ফেলতে পারি না; এগুলােকে আমরা অবহেলা করতে পারি না অথবা কোনাে অবস্থাতেই এগুলো অবমূল্যায়ন করতেও পারি না। এ জন্যে এ সব বিষয়কে আল্লাহর রসূল(স.) সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করেছেন এবং আমাদের ও রসূলুল্লাহ(স.)-এর মধ্যে প্রকৃত যে সম্পর্ক গড়ে ওঠা দরকার তা স্থির করে দিয়েছেন। এসব বিষয়ে তার মর্যাদা ও সাহাবায়ে কেরামের মর্যাদা কি হওয়া দরকার তা সঠিকভাবে নির্ধারণ করে দিয়েছেন, যা আজও আমাদের মধ্যে জীবন্ত রয়েছে। এর মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক সম্বন্ধের বিষয়টিও রয়েছে, মােহাব্বতের আদান-প্রদান, যা কঠোর বাস্তবতার মধ্যে বড়ো প্রয়ােজন তাও রয়েছে। বাস্তব জীবনের কঠিন সন্ধিক্ষণে উপনীত হয়ে মানুষ যখন হতাশ হয়ে পড়ে তখন প্রেম-প্রীতির সুশীতল স্পর্শ তার হৃদয়ে জাগিয়ে তােলে আশার স্নিগ্ধ আলাে আর ঠিক তখনই সে সঠিক পথে চলার দিশা পেয়ে সংকটমুক্ত বােধ করে।

*নবীপত্নীদের বৈশিষ্ট্য ও তাদের মর্যাদা : কিছুক্ষণের জন্যে মূল আলােচ্য বিষয় থেকে একটু দূরে সরে গেলেও আসুন আমরা কোরআনুল করীমের মূল আয়াতের দিকে আবার ফিরে যাই, সেখানে দুনিয়া ও আখেরাতের জীবনের সঠিক অবস্থা আমরা দেখতে পাবাে এবং আমাদের করণীয় কাজগুলাে কিভাবে নিরূপণ করে দেয়া হয়েছে তাও বলা হয়েছে। সকল বিষয় সম্পর্কে আল্লাহর আয়াতসমূহের স্বর্ণালী শিক্ষা জানানাে হয়েছে,। এরশাদ হচ্ছে, ‘কারাে বুকে আল্লাহ তায়ালা দু দুটি হৃদয় বানাননি।’ অর্থাৎ নবী(স.) এর বাস্তব জীবনে ও তার পরিবারের মধ্যে যে ব্যবহারের দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হয়েছে তাইই ভবিষ্যতের মানুষের জন্যে অনুকরণীয়। এই বিবৃতির পরে আমরা দেখতে পাচ্ছি, নবী(স.)-এর স্ত্রীদের জন্যে আল্লাহ রব্বুল আলামীন-এর কাছে যে প্রভুত পুরস্কার রক্ষিত রয়েছে তার বিশদ বর্ণনা। এ বর্ণনায় একদিকে যেমন তাদের বৈশিষ্ট্যের কথা এসেছে, তেমনি এসেছে তাদের মহান দায়িত্বের কথাও। তাঁদের ব্যক্তিগত উঁচুমানের কারণে রসূলুল্লাহ(স.)-এর কাছে তাদের যথাযথ মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এরশাদ হচ্ছে, ‘হে নবী পত্নীরা, তোমাদের মধ্যে যদি কেউ খােলাখুলি কোনাে অশ্লীল কাজ করে, তাহলে তার জন্যে দ্বিগুণ শাস্তির ব্যবস্থা… তার কাজের পুরস্কার দান করবাে, আমি (পরকালের জীবনে সত্যিই) তার জন্যে সম্মানজনক রিযিক প্রস্তুত করে রেখেছি'(আয়াত ৩০-৩১) ওপরের আয়াত দু’টিতে বলা হচ্ছে যে, নবী(স.)-এর স্ত্রী হওয়ার কারণে যেমন সকল মােমেন স্ত্রীলােকদের মধ্যে তাদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তেমনি তাদের দায়িত্বও অনুরূপভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। তারা মােমেনদের মা হওয়ার মর্যাদায় অভিষিক্ত। মােমেনদের মা ও নবী(স.)-এর স্ত্রী-এই দুটি মর্যাদা একত্রিত হয়ে তাদের ঘাড়ে কঠিন দায়িত্বের বােঝা এসে গেছে এবং এ দায়িত্ববােধ তাদেরকে হেফাযত করছে লজ্জাজনক সকল আচার আচরণের-আক্রমণ থেকে । এমতাবস্থায় তাদের মধ্যে কেউ যদি কোনাে অন্যায় কাজ বা আচরণ করে বসে তাহলে তাকে অন্য যে কোনাে ব্যক্তির তুলনায় দ্বিগুণ শাস্তি পেতে হবে। এটা এই জন্যে যে তাদেরকে যে উঁচু মর্যাদা দান করা হয়েছে তার অমর্যাদা করার কারণেই এ কঠিন সাজা। আল্লাহ তায়ালা জানাচ্ছেন, ‘এটা আল্লাহর জন্যে বড়ােই সহজ।’ অর্থাৎ তাদের এ কথা ভালােভাবে হৃদয়ংগম করা দরকার যে মহা সম্মানিত রসূল(স.)-এর জীবন সাথী হওয়ার কারণেই যে কোনাে ব্যক্তি মানবীয় এ সব দুর্বলতা থেকে দূরে থাকতে পারবে এই গ্যারান্টি তাদের কখনও দেয়া হয়নি, এ মর্যাদার কারণে অন্যায় কাজ করা তাদের কাছে কঠিনও করে দেয়া হয়নি, যেমন সাধারণভাবে মানুষ মনে করে, তবে মর্যাদা নামক প্রাপ্ত হওয়ার নেয়ামতকে যে কদর করবে তাকে তার পুরস্কার দো-জাহানের সবখানেই দেয়া হবে, কিন্তু এ নেয়ামতের অমর্যাদা করলে শান্তি হবে দ্বিগুণ। এরশাদ হচ্ছে, ‘আর তােমাদের মধ্যে যে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের কাছে অনুগত থাকবে এবং ভালাে কাজ করবে’ ‘কুনুত’ শব্দটি বলতে বুঝায় আনুগত্য ও বিনয় নম্রতা; এবং এই গুণ দুটির বহিপ্রকাশ ঘটে সকল প্রকার ভালাে কাজের মাধ্যমে।… এসব নেক আমলের দ্বারা যদি কেউ আনুগত্য প্রকাশ করে তাহলে তার জন্যে আল্লাহর ওয়াদা হচ্ছে, আমি তাকে দ্বিগুণ পুরস্কার দান করবেন। একইভাবে তাদের অন্যায় কাজের সাজাও হবে দ্বিগুণ। এরপর আল্লাহ রব্বুল আলামীন তাদের নিশ্চয়তা দিচ্ছেন। ‘আমি তাদের জন্যে সম্মানজনক রিযিক ঠিক করে রেখেছি।’ এ রিযিকে অবশ্যই মজুদ রয়েছে এবং দ্বিগুণ পুরস্কারদানের ওয়াদার সাথে অতিরিক্ত সম্মানজনক রিযিক- দুনিয়াতেই নগদ পাওনা হিসাবে দান করার নিশ্চয়তা তাদেরকে দেয়া হয়েছে। এটা মানুষের জন্যে আল্লাহর বিশেষ মেহেরবানী এবং সকল বান্দার জন্যে বিরাট এক ইহসান। এরপর মােমেনদের মা-দের কাছে, তাদের বৈশিষ্ট্য ও বিশেষ মর্যাদার কথা সম্পষ্ট করে তােলা হচ্ছে। তাদেরকে জানানাে হচ্ছে যে, এসব নেয়ামত একমাত্র তাদেরকেই খাস করে দেয়া হচ্ছে যা অন্য কোনাে মহিলাদেরকে দেয়া হবে না। তারা মানুষের সাথে কিভাবে ব্যবহার করবেন সে বিষয়ে তাদের কর্তব্যও স্থির করে দেয়া হচ্ছে, স্থির করে দেয়া হচ্ছে তাদের জন্যে আল্লাহর হুকুম পালন করার পদ্ধতিসমূহ এবং ঘরে তারা কি কি কর্তব্য পালন করবেন তাও তাদেরকে সুনির্দিষ্টভাবে জানিয়ে দেয়া হচ্ছে। আলােচ্য ঘটনার আলােকে নবী(স.)-এর এই সম্মানিত ঘরের উপযােগী করে তাদেরকে যে বিশেষ ট্রেনিং দেয়া হচ্ছে সে কথাটিকেও স্পষ্ট করে বলে দেয়া হচ্ছে। এইভাবে আল্লাহ তায়ালা চেয়েছেন বিশ্বনবী(স.)-এর এই মহান ঘরকে সকল আবিলতা থেকে হেফাযত করতে, মুক্ত করতে সকল প্রকার কলুষতা থেকে। এই উদ্দেশ্যে আল্লাহ তায়ালা এই পবিত্র ঘর সম্পর্কে তাঁর অবতীর্ণ আয়াতগুলাে তাদের স্মরণ করাচ্ছেন, স্মরণ করাচ্ছেন এই ঘরে সদা সর্বদা যে জ্ঞান ও বুদ্ধির গবেষণা হচ্ছে সে সম্পর্কে, যাতে করে এ বাড়ী সকল গুণ ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে পৃথিবীর সকল নারীকূলের জন্যে আদর্শ হতে পারে এবং সবকিছুর ব্যাপারেই এ মর্যাদাপূর্ণ অনন্য ও একক দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে।

Leave a Reply