أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#১০৬১)
[*কৃতজ্ঞতা ও অকৃতজ্ঞতার কিছু দৃশ্য, সাবা জাতির ইতিহাস :-]
www.motaher21.net
সূরা:- ৩৪:সাবা
পারা:২২
১০-২১ নং আয়াত:-
৩৪:১০
وَ لَقَدۡ اٰتَیۡنَا دَاوٗدَ مِنَّا فَضۡلًا ؕ یٰجِبَالُ اَوِّبِیۡ مَعَہٗ وَ الطَّیۡرَ ۚ وَ اَلَنَّا لَہُ الۡحَدِیۡدَ ﴿ۙ۱۰﴾
নিশ্চয় আমি দাঊদকে আমার তরফ থেকে অনুগ্রহ প্রদান করেছিলাম। হে পর্বতমালা! তোমরা দাঊদের সঙ্গে আমার পবিত্রতা ঘোষণা কর এবং হে পক্ষীকুল তোমরাও। আর লৌহকে তার জন্য নম্র করেছিলাম।
৩৪:১১
اَنِ اعۡمَلۡ سٰبِغٰتٍ وَّ قَدِّرۡ فِی السَّرۡدِ وَ اعۡمَلُوۡا صَالِحًا ؕ اِنِّیۡ بِمَا تَعۡمَلُوۡنَ بَصِیۡرٌ ﴿۱۱﴾
আপনি পূর্ণ মাপের বর্ম তৈরী করুন এবং বুননে পরিমাণ রক্ষা করুন’। আর তোমরা সৎকাজ কর, নিশ্চয় তোমরা যা কিছু কর আমি তার সম্যক দ্রষ্টা।
৩৪:১২
وَ لِسُلَیۡمٰنَ الرِّیۡحَ غُدُوُّہَا شَہۡرٌ وَّ رَوَاحُہَا شَہۡرٌ ۚ وَ اَسَلۡنَا لَہٗ عَیۡنَ الۡقِطۡرِ ؕ وَ مِنَ الۡجِنِّ مَنۡ یَّعۡمَلُ بَیۡنَ یَدَیۡہِ بِاِذۡنِ رَبِّہٖ ؕ وَ مَنۡ یَّزِغۡ مِنۡہُمۡ عَنۡ اَمۡرِنَا نُذِقۡہُ مِنۡ عَذَابِ السَّعِیۡرِ ﴿۱۲﴾
সুলাইমানের অধীন করেছিলাম বায়ুকে যা ভোরে একমাসের পথ অতিক্রম করত ও সন্ধ্যায় একমাসের পথ অতিক্রম করত । আমরা তার জন্য গলিত তামার এক প্রস্রবণ প্রবাহিত করেছিলাম এবং তার রবের অনুমতিক্রমে জিনদের কিছু সংখ্যক তার সামনে কাজ করত। আর তাদের মধ্যে যে আমাদের নির্দেশ অমান্য করে, তাকে আমরা জ্বলন্ত আগুনের শাস্তি আস্বাদন করাব।
৩৪:১৩
یَعۡمَلُوۡنَ لَہٗ مَا یَشَآءُ مِنۡ مَّحَارِیۡبَ وَ تَمَاثِیۡلَ وَ جِفَانٍ کَالۡجَوَابِ وَ قُدُوۡرٍ رّٰسِیٰتٍ ؕ اِعۡمَلُوۡۤا اٰلَ دَاوٗدَ شُکۡرًا ؕ وَ قَلِیۡلٌ مِّنۡ عِبَادِیَ الشَّکُوۡرُ ﴿۱۳﴾
তারা সুলাইমানের ইচ্ছানুযায়ী তার জন্য প্রাসাদ , ভাস্কৰ্য, হাউজসদৃশ বৃহদাকার পাত্ৰ এবং সুদৃঢ়ভাবে স্থাপিত ডেগ নির্মাণ করত। ‘হে দাউদ পরিবার! কৃতজ্ঞতার সাথে তোমরা কাজ করতে থাক। আর আমার বান্দাদের মধ্যে অল্পই কৃতজ্ঞ!’
৩৪:১৪
فَلَمَّا قَضَیۡنَا عَلَیۡہِ الۡمَوۡتَ مَا دَلَّہُمۡ عَلٰی مَوۡتِہٖۤ اِلَّا دَآبَّۃُ الۡاَرۡضِ تَاۡکُلُ مِنۡسَاَتَہٗ ۚ فَلَمَّا خَرَّ تَبَیَّنَتِ الۡجِنُّ اَنۡ لَّوۡ کَانُوۡا یَعۡلَمُوۡنَ الۡغَیۡبَ مَا لَبِثُوۡا فِی الۡعَذَابِ الۡمُہِیۡنِ ﴿ؕ۱۴﴾
যখন আমি সুলাইমানের মৃত্যু ঘটালাম, তখন উই পোকাই জ্বিনদেরকে তার মৃত্যু বিষয় জানাল; যা সুলাইমানের লাঠি খাচ্ছিল। যখন সুলাইমান মাটিতে পড়ে গেল, তখন জ্বিনেরা বুঝতে পারল যে, ওরা যদি অদৃশ্য বিষয় অবগত থাকত, তাহলে ওরা এতকাল লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তিতে আবদ্ধ থাকত না।
৩৪:১৫
لَقَدۡ کَانَ لِسَبَاٍ فِیۡ مَسۡکَنِہِمۡ اٰیَۃٌ ۚ جَنَّتٰنِ عَنۡ یَّمِیۡنٍ وَّ شِمَالٍ ۬ؕ کُلُوۡا مِنۡ رِّزۡقِ رَبِّکُمۡ وَ اشۡکُرُوۡا لَہٗ ؕ بَلۡدَۃٌ طَیِّبَۃٌ وَّ رَبٌّ غَفُوۡرٌ ﴿۱۵﴾
অবশ্যই সাবাবাসীদের জন্য তাদের বাসভূমিতে ছিল এক নিদর্শনঃ দুটি উদ্যান, একটি ডান দিকে, অন্যটি বাম দিকে। বলা হয়েছিল, ‘তোমরা তোমাদের রবের দেয়া রিযিক ভোগ কর এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর । উত্তম নগরী এবং ক্ষমাশীল রব।’
৩৪:১৬
فَاَعۡرَضُوۡا فَاَرۡسَلۡنَا عَلَیۡہِمۡ سَیۡلَ الۡعَرِمِ وَ بَدَّلۡنٰہُمۡ بِجَنَّتَیۡہِمۡ جَنَّتَیۡنِ ذَوَاتَیۡ اُکُلٍ خَمۡطٍ وَّ اَثۡلٍ وَّ شَیۡءٍ مِّنۡ سِدۡرٍ قَلِیۡلٍ ﴿۱۶﴾
পরে ওরা আদেশ অমান্য করল। ফলে আমি ওদের ওপর বাঁধ-ভাঙ্গা বন্যা প্রবাহিত করলাম এবং ওদের বাগান দু’টিকে পরিবর্তন করে দিলাম এমন দু’টি বাগানে, যাতে উৎপন্ন হয় বিস্বাদ ফলমূল, ঝাউগাছ এবং কিছু কুলগাছ।
৩৪:১৭
ذٰلِکَ جَزَیۡنٰہُمۡ بِمَا کَفَرُوۡا ؕ وَ ہَلۡ نُجٰزِیۡۤ اِلَّا الۡکَفُوۡرَ ﴿۱۷﴾
ঐ শাস্তি আমরা তাদেরকে দিয়েছিলাম তাদের কুফরির কারণে। আর অকৃতজ্ঞ ছাড়া আমরা আর কাউকেও এমন শাস্তি দেই না।
৩৪:১৮
وَ جَعَلۡنَا بَیۡنَہُمۡ وَ بَیۡنَ الۡقُرَی الَّتِیۡ بٰرَکۡنَا فِیۡہَا قُرًی ظَاہِرَۃً وَّ قَدَّرۡنَا فِیۡہَا السَّیۡرَ ؕ سِیۡرُوۡا فِیۡہَا لَیَالِیَ وَ اَیَّامًا اٰمِنِیۡنَ ﴿۱۸﴾
ওদের এবং যে সব জনপদে আমি প্রাচুর্য দান করেছিলাম সেগুলির অন্তর্বর্তী স্থানে দৃশ্যমান বহু জনপদ স্থাপন করেছিলাম এবং ঐ সকল জনপদে ভ্রমণকালে বিশ্রামের জন্য নির্দিষ্ট ব্যবধানে বিশ্রামস্থান নির্ধারিত করেছিলাম এবং ওদেরকে বলেছিলাম, ‘তোমরা এ সব জনপদে রাত-দিন নিরাপদে ভ্রমণ কর।’
৩৪:১৯
فَقَالُوۡا رَبَّنَا بٰعِدۡ بَیۡنَ اَسۡفَارِنَا وَ ظَلَمُوۡۤا اَنۡفُسَہُمۡ فَجَعَلۡنٰہُمۡ اَحَادِیۡثَ وَ مَزَّقۡنٰہُمۡ کُلَّ مُمَزَّقٍ ؕ اِنَّ فِیۡ ذٰلِکَ لَاٰیٰتٍ لِّکُلِّ صَبَّارٍ شَکُوۡرٍ ﴿۱۹﴾
কিন্তু তারা বলল, “হে আমাদের রব! আমাদের ভ্রমণের দূরত্ব দীর্ঘায়িত করো।” তারা নিজেরাই নিজেদের ওপর জুলুম করেছে। শেষ পর্যন্ত আমি তাদেরকে কাহিনী বানিয়ে রেখে দিয়েছি এবং তাদেরকে একদম ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছি। নিশ্চিতভাবেই এর মধ্যে নিদর্শন রয়েছে বেশী বেশী সবরকারী ও বেশী বেশী কৃতজ্ঞ প্রতিটি ব্যক্তির জন্য।
৩৪:২০
وَ لَقَدۡ صَدَّقَ عَلَیۡہِمۡ اِبۡلِیۡسُ ظَنَّہٗ فَاتَّبَعُوۡہُ اِلَّا فَرِیۡقًا مِّنَ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ ﴿۲۰﴾
তাদের ব্যাপারে ইবলিস তার ধারণা সঠিক পেয়েছে এবং একটি ক্ষুদ্র মু’মিন দল ছাড়া বাকি সবাই তারই অনুসরণ করছে।
৩৪:২১
وَ مَا کَانَ لَہٗ عَلَیۡہِمۡ مِّنۡ سُلۡطٰنٍ اِلَّا لِنَعۡلَمَ مَنۡ یُّؤۡمِنُ بِالۡاٰخِرَۃِ مِمَّنۡ ہُوَ مِنۡہَا فِیۡ شَکٍّ ؕ وَ رَبُّکَ عَلٰی کُلِّ شَیۡءٍ حَفِیۡظٌ ﴿٪۲۱﴾
তাদের উপর শয়তানের কোন আধিপত্য ছিল না। তবে কে আখিরাতের প্রতি ঈমান রাখে এবং কে তাতে সন্দিহান, তা প্রকাশ করে দেয়াই ছিল আমাদের উদ্দেশ্য। আর আপনার রব সবকিছুর সম্যক হিফাযতকারী।
ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
এ অধ্যায়টাতে কৃতজ্ঞতা ও অকৃতজ্ঞতার কিছু দৃশ্য রয়েছে। অনুরূপভাবে, এতে আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক তাঁর ইচ্ছাক্রমে তার কোনাে কোনাে বান্দার জন্য কিছু কিছু প্রাকৃতিক শক্তিকে অনুগত ও বশীভূত করার দৃশ্যও রয়েছে যা সাধারণত কোনাে মানুষের অনুগত হয় না। কিন্তু আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছা ও ক্ষমতা মানব সমাজে প্রচলিত রীতিপ্রথা ও আদত অভ্যাসের অধীন নয়। এই সব দৃশ্যের মধ্য দিয়ে সেই সব জ্বিন ও শয়তান সম্পর্কে কিছু তথ্য জানা যায়, যাদেরকে কিছু কিছু পৌত্তলিক পূজা করে অথবা তাদের কাছ থেকে অদৃশ্য তথ্য জানতে চায়। অথচ তারা অদৃশ্য সম্পর্কে অজ্ঞ। এ সব দৃশ্য থেকে আরাে জানা যায়, কি কি উপায়ে শয়তান মানুষের ওপর জেঁকে বসে ও তার ওপর আধিপত্য বিস্তার করে অথচ মানুষ স্বেচ্ছায় তাকে সুযােগ না দিলে সে আধিপত্য বিস্তার করতে পারে না। এ থেকে আরো জানা যায় যে, মানুষের কিছু কিছু গােপনীয় কাজকে বাস্তব ঘটনার আকারে প্রকাশ করার জন্য আল্লাহ তায়ালা কখনাে কখনাে ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকেন, যাতে তারা সে জন্য আখেরাতে ফল পায়। এ অধ্যায়টা প্রথম অধ্যায়ের মতই আখেরাতের বর্ণনার মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে। *হযরত দাউদ ও সােলায়মান(আ.)-এর মোজিজা : ‘আমি নিজের পক্ষ থেকে দাউদকে অনুগ্রহ করেছিলাম…'(আয়াত ১০) ‘হে পর্বতমালা তােমরা দাউদের সাথে বারবার আমার মহিমা ঘােষণা করাে। আর পক্ষীকূলকেও আমি এরূপ নির্দেশ দিয়েছিলাম।’ বর্ণিত আছে যে, হযরত দাউদ(আ.)-কে অলৌকিক ধরনের সুললিত কণ্ঠস্বর দেয়া হয়েছিল। এই কণ্ঠস্বর দিয়ে তিনি ধর্মীয় তাসবীহ পাঠ করতেন। বাইবেলের ‘প্রাচীন পুস্তক’ বা ওল্ড টেস্টামেন্টে-এর কিছু তাসবীহ উদ্ধৃত হয়েছে, যার শুদ্ধাশুদ্ধ আল্লাহ তায়ালাই ভালাে জানেন। সহীহ বােখারীতে আছে যে, রসূল(স.) হযরত আবু মূসা আশয়ারীর কণ্ঠস্বর শুনে বলেছিলেন, এই ব্যক্তি হযরত দাউদের বংশধরের কণ্ঠস্বরের কিছুটা পেয়েছে। আলােচ্য আয়াতে আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক হযরত দাউদকে প্রদত্ত অনুগ্রহের একটা চিত্র এমন দেখানাে হয়েছে, যা থেকে মনে হয়েছে, তাঁর তাসবীহ পাঠে এমন একাগ্রতা ও স্বচ্ছতা ছিলাে যে, তার ও প্রাকৃতিক জগতের মধ্যে আর কোনাে আড়াল থাকতাে না। আল্লাহ তায়ালার তাসবীহ পাঠের সময় তার সাথে পাহাড় পর্বত ও পক্ষীকূল এমনভাবে কণ্ঠ মেলাতাে যে, সকলে একাকার হয়ে এই তাসবীহর সাথে মিলিত হতাে। আল্লাহ তায়ালার বিশেষ অনুগ্রহ ছাড়া এমন অলৌকিক একাত্মতা ও স্বচ্ছতা কেউ অর্জন করতে পারে না। হযরত দাউদ(আ.)-এর কণ্ঠ থেকে যখনই আল্লাহ তায়ালার মহিমা কীর্তনকারী শব্দ উচ্চারিত হতাে, অমনি পাহাড় পর্বত ও পক্ষীকূল সেই সাথে আওয়াজ তুলতাে এবং সমগ্র প্রাকৃতিক জগত থেকে একই সূর প্রতিধ্বনিত হতাে। এ সময় প্রতিটা সৃষ্টি আপন স্রষ্টার দিকে নিবিষ্ট হতাে। এই মুহূর্তগুলাে এমন উপভােগ্য ও মনােমুগ্ধকর যে, জীবনের কোনাে এক মুহূর্তেও যে ব্যক্তি এর অভিজ্ঞতা অর্জন করেনি, সে এর স্বাদ বুঝবে না।। আমি তার জন্য লােহা গলিয়ে দিয়েছিলাম।’ এটা হযরত দাউদের প্রতি বর্ষিত আরেকটা অনুগ্রহ। আয়াতের ভাষা থেকে স্পষ্টতই মনে হয় যে, এটা একটা অলৌকিক ও অস্বাভাবিক ঘটনা ছিলাে। ব্যাপারটা এমন ছিলাে না যে, লােহাকে উত্তপ্ত করে নরম বানিয়ে হাতুড়ি পিটিয়ে বিভিন্ন আকৃতি দেয়া হয়েছিলাে। বরং এটা ছিল একটা অলৌকিক ব্যাপার এবং লােহাকে নরম করার প্রচলিত সকল উপকরণ ছাড়াই নরম করা হয়েছিলাে। প্রকৃত সত্য আল্লাহ তায়ালাই জানেন। এ কথা যদিও সত্য যে, আগুনে উত্তপ্ত করে লােহা গরম করার পন্থা জানিয়ে দেয়াও আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে একটা উল্লেখযােগ্য অনুগ্রহ গণ্য হতাে। কিন্তু আয়াতের পূর্বাপর বর্ণনাভংগী থেকে মনে হয়, এটা একটা অলৌকিক ঘটনা ছাড়া আর কিছু নয়। কেননা এখানে যে দৃশ্যগুলাে দেখানাে হয়েছে সবই অলৌকিক ও অপ্রচলিত ঘটনাবলীর দৃশ্য। আমি বলেছিলাম, ‘পূর্ণ মাপের বর্ম নির্মাণ করাে এবং সংযােজনকালে পরিমাপ ঠিক রেখ।’ বর্ণিত আছে যে, হযরত দাউদ(আ.)-এর আগে এই সব বর্ম আন্ত আস্ত লৌহ শীটের আকারে তৈরী করা হতাে। এই সব শীট শরীরকে নিরাপদ করতাে বটে। তবে সেই সাথে খুব ভারিও করে তুলতাে। তাই আল্লাহ তায়ালা হযরত দাউদকে নির্দেশ দিলেন যে, একটার মধ্যে আরেকটা পাতলা, ঢেউ তােলা ও নরম শীটে ঢুকিয়ে হাল্কা বর্ম বানাও, যাতে শরীর চালনার সাথে সাথে ওগুলােকে চালনা করা সহজ হয়। আর এই পাতলা শীটগুলােকে ঘন ঘন বুনে দিতে আদেশ দিলেন, যাতে এগুলাে এতটা মযবুত হয় যে, বর্শা বা তীর এগুলােকে ভেদ করতে না পারে । সংযােজনকালে পরিমাপ ঠিক রাখার অর্থ এটাই। এই পুরাে ব্যাপারটাই আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে প্রশিক্ষণ ও ইলহাম তথা জ্ঞান সঞ্চালনের মাধ্যমে শেখানাে হয়েছিলাে। অতপর হযরত দাউদ(আ.) ও তার বংশধরকে বলা হয়, ‘আর তােমরা সৎ কাজ কর।’ তাদের সকল কাজের ক্ষেত্রে সততার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা সব কাজ দেখছেন এবং সব কাজের প্রতিফল দেবেন, কোন কাজই তার প্রতিফলের বাইরে থাকবে না-এ কথা মনে রাখতে হবে। এ ছিলাে হযরত দাউদ(আ.)-কে প্রদত্ত অনুগ্রহ। পক্ষান্তরে তিনি হযরত সােলায়মান(আ.)-কেও আরাে কিছু অনুগ্রহ প্রদান করেন। ‘আর সুলায়মানের জন্য অনুগত করেছিলাম বাতাসকে…'(আয়াত ১২-১৩) হযরত সােলায়মানের জন্য বাতাসকে অনুগত করা সম্পর্কে বহু বর্ণনা আছে। সে সব বর্ণনায় ইসরাঈলী প্রভাব সুস্পষ্ট অবশ্য ইহুদীদের মূল পুস্তকাদিতে এ সম্পর্কে তেমন কিছুই লেখা নেই। এ সব বর্ণনা থেকে আমাদের বিরত থাকাই ভালাে। কোরআনে যতটুকু আছে, ততটুকুকে যথেষ্ট মনে করাই নিরাপদ। আয়াত থেকে জানা যায় যে, আল্লাহ তায়ালা বাতাসকে হযরত সােলায়মানের অনুগত করে দিয়েছিলেন। এই টুকু শাব্দিক তথ্যের বাইরে আমাদের যাওয়া অনুচিত। এই বাতাস সকালবেলা একটা নির্দিষ্ট স্থানের উদ্দেশ্যে (সূরা আম্বিয়ায় বলা হয়েছে যে, ওটা পবিত্র ভূমি) হযরত সোলায়মান নিয়ে যাত্রা করতাে এবং তা একমাস স্থায়ী হতাে। আবার বিকালবেলা প্রত্যাবর্তন করতাে এবং তার এক মাস স্থায়ী হতাে। তার সকাল ও সন্ধ্যার এই ভ্রমণে হযরত সােলায়মান একটা সুবিধা লাভ করতেন এবং আল্লাহ তায়ালার নির্দেশক্রমে তা বাস্তবায়িত করতেন। এর ওপর আমি আর কোনাে ব্যাখ্যা সংযােজন করতে পারবাে না। কেননা তা করতে গেলেই ভিত্তিহীন ও প্রমাণহীন গল্পে জড়িয়ে পড়তে হবে। ‘আমি তার জন্য প্রবাহিত করেছিলাম এক তরল তামার ঝর্ণা।’ আল ফিতর শব্দের অর্থ তামা। আয়াত থেকে বুঝা যায় যে, হযরত দাউদের জন্য লােহা গলিয়ে দেয়ার মতাে এটা হযরত সুলায়মানের মোজিজা। এটা দুটো উপায়ে হতে পারে। প্রথম, আল্লাহ তায়ালা তার জন্য ভূগর্ভের গলিত তামার কোনাে ঝর্ণা আগ্নেয়গিরির মাধ্যমে বের করে দিয়ে থাকতে পারেন। দ্বিতীয়ত, আল্লাহ তায়ালা তাকে ইলহাম তথা গােপন ওহীর মাধ্যমে তামা গলানাের প্রযুক্তি শিখিয়ে দিয়ে থাকতে পারেন, যাতে তা তরল হয়ে যায় এবং তা দিয়ে ঢালাই ও নির্মাণের কাজ করা যায়। যেভাবেই হােক, এটা ছিলাে আল্লাহ তায়ালার এক বিরাট অনুগ্রহ। ‘তার প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে তার সামনে কিছু জ্বিন কাজ করতাে।’ অর্থাৎ বাতাসের মতাে একদল জ্বিনকেও আল্লাহ তায়ালা তার অনুগত করে দিয়েছিলেন। তারা আল্লাহ তায়ালার অনুমতিক্রমে তার অধীনে ও আদেশে কাজ করতাে। শান্দিক অর্থে মানুষ দেখতে পায় না এমন প্রত্যেক গােপন বস্তুকে জ্বিন বলা হয়। তবে আল্লাহ তায়ালার এক ধরনের সৃষ্ট জীবও আছে, যাকে তিনি জ্বিন নামে আখ্যায়িত করেছেন। তাদের সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা যতটুকু উল্লেখ করেছেন, তার চেয়ে বেশী কিছু আমরা জানি না। তিনি এখানে জানাচ্ছেন যে, তাদের একটা দলকে আল্লাহ তায়ালা হযরত সুলায়মানের অনুগত করেছিলেন। তাদের কেউ হযরত সুলায়মানের আদেশ বা নিষেধ লংঘন করলে আল্লাহ তায়ালার আযাবে পতিত হবে। তাদের মধ্য থেকে কেউ আমার আদেশ অমান্য করলে আমি তাকে জাহান্নামের আযাব ভােগ করাবাে। অনুগত করার কাহিনী শেষ করার আগে এই মন্তব্যটা এভাবে উল্লেখ করার উদ্দেশ্য সম্ভবত জিনেরা আল্লাহর অনুগত সৃষ্টি-এটা প্রমাণ করা। কেননা মােশরেকদের কানাে কোনাে গােষ্ঠী আল্লাহ তায়ালার পাশাপাশি জ্বীনদের উপাসনা করে। অথচ সেই মােশরেকদের মতােই জ্বিনরাও আল্লাহ তায়ালার অবাধ্য হলে শাস্তি পাবে। হযরত সােলায়মানের অনুগত হিসেবে তারা এসব কাজ করতাে, তার জন্য তার ইচ্ছামতাে বড় বড় উপাসনালয়, মূর্তি, চৌবাচ্চার মতাে বড় বড় পাত্র ও বড় বড় ডেগসমূহ নির্মাণ করতাে। ‘মাহারীব” অর্থ এবাদাতের স্থান। আর ‘তামাছীল’ দ্বারা বুঝানাে হয়েছে তামা কিংবা কাঠের তৈরী মূর্তি বা ভাস্কর্য। ‘জাওয়াব’ ‘জাবিয়ার’ বহুবচন। এর অর্থ পানি সংরক্ষণের চৌবাচ্চা। জিনেরা হযরত সুলায়মানের জন্য চৌবাচ্চা সদৃশ বড় বড় খাবারের পাত্র বানাতাে। তারা রান্না করার জন্য যে সব ডেগ বানাতাে তাতে বড় বড় ছিল যে, সেগুলাের একাংশ পুতে রাখা হতাে । এ সব হচ্ছে আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক অনুগত বানানাে জ্বিনেরা হযরত সােলায়মানের জন্য যে সব কাজ করতাে তার কিছু নমুনা। এ গুলোর সবই মােজেযা ও অলৌকিক ঘটনা এবং আল্লাহ তায়ালারই করা। এর একমাত্র ব্যাখ্যা সম্ভবত এটাই। অন্য কোন ব্যাখ্যা দেয়ার কোনই উপায় নেই। এ বর্ণনার শেষ ভাগে হযরত দাউদের বংশধরকে সম্বােধন করে বলা হয়েছে, হে দাউদের বংশধর, ‘তােমরা শােকরের কাজ কর।’ অর্থাৎ আমি দাউদ ও সােলায়মানের মাধ্যমে এত কিছুকে তােমাদের আয়ত্তাধীন করে দিলাম। কাজেই হে দাউদের বংশধর। তােমরা অহংকার ও দাম্ভিকতা দেখানাের জন্য নয়-বরং আল্লাহ তায়ালার কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য কাজ করাে। বস্তুত সৎ কাজ হচ্ছে আল্লাহর বিরাট কৃতজ্ঞতা। ‘আমার বান্দাদের মধ্যে কৃতজ্ঞ খুবই কম।’ কোরআনে কিসসা কাহিনীর ওপর অনেক মন্তব্য রয়েছে। সেগুলাের মধ্যে এ মন্তব্যটা অনন্য বৈশিষ্টের অধিকারী। এটা একাধারে বর্ণনামূলকও এবং নির্দেশনামূলকও। একদিকে এটা আল্লাহ তায়ালার অনুগ্রহ ও নেয়ামতকে এতো বড় করে দেখিয়েছে যে, খুব কম লােকই এর শোকর আদায় করতে সক্ষম। অপরদিকে এতে আল্লাহ তায়ালার নেয়ামতের পরিপূর্ণ শােকর আদায়ে মানুষের অক্ষমতাকে ফুটিয়ে তােলা হয়েছে। তারা যত বেশী শোকর আদায় করুক, এর দাবী পূরণ করতে পারবে না। আর যদি শােকর আদায়ে গাফেলতি করে ও শৈথিল্য দেখায়, তাহলে তাে কথাই নেই। সীমাবদ্ধ ক্ষমতা সম্পন্ন মানুষ আল্লাহ তায়ালার সীমাহীন নেয়ামত ও অনুগ্রহের শােকর আদায় করবেই বা কিভাবে? আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, তােমরা যদি আল্লাহর নেয়ামত গণনা করাে, তবে গণনা করে শেষ করতে পারবে না। এ সব নেয়ামত তাকে চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছে এবং তার আপদমস্তক নেয়ামতে ডুবে আছে। তার সত্ত্বার ভেতরেও অগণিত নিয়ম বিরাজ করছে। এমনকি সে নিজেই একটা মন্তবড় নেয়ামত। ধরা যাক, আমরা কিছু লােক একত্রে বসে আছি, কথাবার্তা বলছি, মতামত বিনিময় করছি, পরস্পরকে আকর্ষণ করছি এবং আমাদের মনে যা কিছু আসছে, তা মুখ দিয়ে প্রকাশ করছি। ইতিমধ্যে আমাদের বিড়াল মিনি এসে আমাদের চারপাশে ঘুর ঘুর করতে লাগলো। মনে হলাে, সে কিছু খুঁজছে। হয়তাে বা আমাদের কাছ থেকে কিছু চাইতে তার ইচ্ছা করছে। কিন্তু সে কথা বলতে পারছে না। আমরাও বুঝতে পারছি না। এক সময় আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে বুঝিয়ে দিলেন যে, সে পানি চাইছে। সে আসলে তাই চাইছিলাে। সে তীব্র পিপাসায় কাতর ছিলাে। অথচ সে বলা তাে দূরের কথা, ইশারাও করতে অক্ষম। এই সময়ে আমরা আল্লাহ তায়ালার দেয়া এক দুর্লভ নেয়ামত বাক শক্তির অধিকারী হয়েছি। সেই সাথে বােধশক্তির এবং সিদ্ধান্ত নেয়ার শক্তিরও। তৎক্ষণাত আমাদের মন কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠলাে, কিন্তু এত বড় নেয়ামতের এতােটুকু শােকর কি যথেষ্ট? আমরা দীর্ঘদিন সুর্যের দর্শন থেকে বঞ্চিত ছিলাম। সূর্যের যেটুকু আলাে আমাদের কাছে কখনাে কখনাে আসতাে, তা অতি সামান্য। আমাদের এক একজন তার সামনে গিয়ে নিজের মুখ, হাত, বুক, পিঠ, পেট ও পায়ে যতটুকু পারে, ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ততটুকু সূর্যরশ্মী লাগাতাে। তারপর অন্য ভাইয়ের জন্য জায়গা খালি করে চলে যেত। সেও যতােটুকু পারতাে, এই নেয়ামতকে উপভােগ করতাে। এরপর যেদিন সর্ব প্রথম সূর্যের আলাে পেলাম, সেদিনের কথা আমি ভুলতে পারি না। আমরা প্রত্যেকে কতাে খুশী হয়েছিলাম তা ভাষায় ব্যক্ত করতে পারবাে না। এরপর প্রতিদিন সূর্য ওঠে। আমরা আল্লাহর শােকর করি। এখন এই সূর্যরশ্মী আমরা প্রতিদিন কতাে ভােগ করছি? কতাে সূর্য স্নান করে চলেছি। আল্লাহর এ নেয়ামতে কিভাবে ডুবে আছি? বিনাচেষ্টায়, বিনাকষ্টে, বিনামূল্যে প্রাপ্ত এই রাশিরাশি নেয়ামতের কতটুকু শােকর আদায় করছি? এভাবে যদি আল্লাহ তায়ালার প্রতিটি নেয়ামত পর্যবেক্ষণ করি, তবে সারাটা জীবন কাটিয়ে দিয়ে এবং সর্ব প্রকারের চেষ্টা সাধনা করেও এ কাজ শেষ করতে পারবাে না। এ হচ্ছে আল্লাহ তায়ালার একটা নেয়ামত মাত্র। যে যতােটুকু পারে, একনিষ্ঠভাবে এর শােকর আদায় করতে পারে। এবার এই কাহিনীর শেষ দৃশ্যে উপনীত হতে চাই। এটা হচ্ছে হযরত সােলায়মানের ইন্তেকালের দৃশ্য। তিনি ইন্তেকাল করলেন। অথচ জিনরা তখনও তার অর্পিত দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। তারা টেরও পেল না যে, তিনি মারা গেছেন। অবশেষে তিনি যে লাঠির ওপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন, সেটা যেদিন পােকায় খেয়ে দিলাে এবং তিনি পড়ে গেলেন, কেবল তখনই তারা টের পেলাে।(আয়াত ১৪) বর্ণিত আছে যে, তিনি যখন মারা যান, তখন তিনি তার লাঠির ওপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। তার অনুগত জ্বিনেরা আসা যাওয়া করছিল এবং কঠিন পরিশ্রমের কাজ করছিলাে। তারা বুঝতেও পারেনি যে, তিনি মারা গেছেন। অবশেষে এক ধরনের কীট এলাে কারাে কারাে মতে, এটা ছিল ঘুন পােকা। যা কাঠ খেয়ে জীবন ধারণ করে। এই কীট বাড়ীঘরের ছাদ, দরজা, খুঁটি সবই খেয়ে নষ্ট করে এবং ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটায়। মিশরের কোনাে কোনাে গ্রামে এই কীটের ভয়ে একেবারেই কাঠ ব্যবহার না করে বাড়ীঘর বানানাে হয়। হযরত সােলায়মানের ঘুনে খাওয়া লাঠি যখন ভেতর থেকে জীর্ণ হয়ে পড়লাে, তখন তা আর তার ভার বহন করতে পারলাে না। ফলে হযরত সােলায়মান মাটিতে পড়ে গেলেন। জ্বিনেরা কেবল তখনই তার মৃত্যুর কথা জানলো। আর তখনই জিনেরা বুঝতে পারলাে যে, তারা যদি অদৃশ্য জানতাে, তাহলে এমন লাঞ্চনাকর শান্তিতে এত দীর্ঘক্ষণ ভুগতাে না। এই হলাে সেই সব জ্বিনের অবস্থা, যাকে কোনাে কোনাে মানুষ পূজা পর্যন্ত করে। সত্যিকার অর্থে তারা আল্লাহর এক বান্দার অনুগত ছিলাে এবং নিজেদের অতি নিকটে ঘটে যাওয়া অদৃশ্য ঘটনাটা জানতে পারেনি। অথচ কিছু মুর্থ লােক তাদের কাছ থেকে অদৃশ্য তথ্য জানতে চেষ্টা করে।
*সাবা জাতির ইতিহাস : হযরত দাউদের বংশধরদের কাহিনীর মধ্য দিয়ে আল্লাহ তায়ালার প্রতি ঈমান ও তাঁর নেয়ামতের শােকরের নমুনা দেখানাে হয়েছে, আর ঠিক এর বিপরীত অকৃতজ্ঞতার নমুনা দেখানাে হয়েছে পরবর্তীতে সাবার কাহিনীতে। সূরা নামলে হযরত সােলায়মান ও সাবার রাণীর ঘটনা উপস্থাপন করা হয়েছে। আর এখানে হযরত সােলায়মানের কাহিনীর পর সাবার কাহিনী আসছে। এ থেকে বুঝা যায় যে, এখানে সাবার যে কাহিনী তুলে ধরা হয়েছে, তা হযরত সােলায়মান ও সাবার রাণীর ঘটনার পরে ঘটেছে। আমার এ ধারণার কারণ, এখানে যে কাহিনী বর্ণিত হয়েছে, তাতে আল্লাহ তায়ালার নেয়ামতের প্রাচুর্যে সাবার দ্ম্ভ ও অহংকার, তাদের পতন ও ছিন্নভিন্ন হয়ে চতুর্দিকে ছাড়িয়ে পড়ার উল্লেখ রয়েছে। অথচ সূরা নামলে যে রাণীর কাহিনী বর্ণিত হয়েছে তার আমলে তারা বিশাল সাম্রাজ্য ও বিপুল সুখ ঐশ্বর্যের অধিকারী ছিলাে। কেননা হুদহুদ পাখী হযরত সােলায়মানের কাছে সাবার রাজ্যের বিপুল ধন ঐশ্বর্যের খবর দিয়েছিলাে। এরপর জানানাে হয়েছে যে, সেই রাণী হযরত সােলায়মানের নিকট ইসলাম গ্রহণ করেছিল। সুতরাং এখানে তাদের পতনের যে কাহিনী, তা রাণীর ইসলাম গ্রহণের পরে তাদের পরবর্তী প্রজন্মের অকৃতজ্ঞতা ও অহংকারের পরিণামে ঘটেছে। এই কাহিনীর শুরুই হয়েছে সাবার প্রাচুর্যের ও তাদেরকে শােকরের আদেশ দানের বিবরণের মধ্য দিয়ে। ‘সাবার অধিবাসীদের জন্য তাদের আবাসভূমিতে একটা নিদর্শন ছিল…'(আয়াত ১৫) সাবা একটি জাতির নাম। তারা দক্ষিণ ইয়ামানে বসবাস করতাে। তারা এমন উর্বর ভূমিতে বাস করতাে, যার কিছুই অবশিষ্ট নেই। তারা সভ্যতার এত উচ্চস্তরে উন্নীত হতে পেরেছিল যে, দক্ষিণ ও পূর্ব দিকের সাগর থেকে আগত মৌসুমী বৃষ্টির পানির ওপর তারা পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছিলাে। তারা এমন একটা প্রাকৃতিক জলভান্ডার গড়ে তুলেছিল, যার দু’প্রান্তে ছিল দুটো পাহাড়। তারা আল্লাহর শোকর গুজারী ত্যাগ করলো, সৎকাজ ত্যাগ করলাে, আল্লাহ প্রদত্ত সদাচরণ ত্যাগ করলাে। ফলে আল্লাহ তায়ালা পাকও তাদের জীবনের সুখ সাচ্ছন্দ ও আরাম-আয়েশ কেড়ে নিলেন। তাদের ওপর প্রবল বন্যা চাপিয়ে দিলেন। যে বন্যা তাদের বাধ ভেংগে ফেলে প্রচন্ড গতিতে বন্যার পানি জনপদে ঢুকে পড়ে এবং তা গােটা এলাকাকে প্লাবিত করে ফেলে। বন্যার পানি শুকিয়ে গেলে গােটা এলাকা পানিশূন্য হয়ে পড়ে এবং খরায় আক্রান্ত হয়। এর ফলে তদের বাগানগুলো এবং খামারগুলাে মরুভূমিতে পরিণত হয়ে যায়, যেখানে সুস্বাদু ও মিষ্টি ফলমূলের পরিবর্তে জন্ম নেয় কাটাযুক্ত ও বিস্বাদ ফলযুক্ত কিছু বন্য গাছপালা। সে কথাই নিচের আয়াতে বলা হয়েছে, ‘আর তাদের উদ্যানদ্বয়কে পরিবর্তন করে দিলাম এমন দুটো উদ্যানে, যাতে উদগত হয় বিস্বাদ ফলমূল…'(আয়াত ১৬) আলােচ্য আয়াতে বলা হয়েছে যে, কুফরীর শাস্তিস্বরূপ তাদেরকে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে। এখানে কুফুরী বলতে খুব সম্ভব অকৃতজ্ঞতাকেই বুঝানাে হয়েছে। কারণ কুফর শব্দের একটি অর্থ অকৃতজ্ঞতাও। সাবাবাসী তখনও তাদের নিজ নিজ এলাকা ও ঘর বাড়ীতে বহাল তবিয়তেই ছিলাে। তবে আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে অভাব-অনটন ও দুঃখ-দুর্দশার মাঝে ফেলে রেখেছিলেন। তাদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও আরাম-আয়েশ ছিনিয়ে নিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি তাদেরকে বিচ্ছিন্ন করে রাখেননি। কারণ তখনও মক্কা ও বায়তুল মাকদাস এর সাথে তাদের যােগাযোগ অবিচ্ছিন্ন ছিলোে। ইয়েমেনের উত্তর প্রান্তের সাবা নগরী পরিপূর্ণ আবাদ ছিল এবং পবিত্র নগরীগুলাের সাথে সংযুক্ত ছিল। যোগাযোগ ব্যবস্থা সুষ্ঠু ও নিরাপদ ছিলাে। লােক চলাচলও ছিলাে ভালাে। নিচের আয়াতে সেদিকে ইংগিত করেই বলা হয়েছে, ‘তাদের এবং যে সব জনপদের লোকদের প্রতি আমি অনুগ্রহ করেছিলাম সেগুলাের মধ্যবর্তী স্থানে অনেক দৃশ্যমান জনপদ স্থাপন করেছিলাম…'(আয়াত ১৮) ওপরের আয়াতের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে যে, পথিকরা তাদের নিজ নিজ জনপদ থেকে বের হতাে এবং রাতের অন্ধকার নেমে আসার আগেই অন্য জনপদে প্রবেশ করতে পারত। কারণ তখন পথের দূরত্ব ছিলাে সীমিত এবং নিরাপদ। গন্তব্যস্থলগুলাে ছিল পরস্পর নিকটবর্তী। কাজেই চলার পথে যাত্রীদের তেমন কোনাে অসুবিধাই হতাে না। বরং ভ্রমণ তখন আরামদায়কই ছিলাে। এই সাবাবাসীদের দুর্ভাগ্যই বলতে হবে যে, তারা প্রথম আসমানী গযব থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেনি। আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি করেনি। আগের ছিনিয়ে নেয়া সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ফিরে পাওয়ার জন্য আল্লাহর নিকট ফরিয়াদ করেনি। বরং নির্বোধ ও মূর্খদের মতাে আল্লাহর নিকট দাবী জানিয়ে বলে উঠলাে, ‘হে প্রভু! আমাদের ভ্রমণের পরিসর বাড়িয়ে দাও! কি অদ্ভূত এদের দাবী। ভ্রমণের দূরত্ব কমানাের পরিবর্তে আরও বাড়িয়ে দিতে বলছে। অথচ এর ফলে তারা বছরে এক -দু’বারের বেশী ভ্রমণ করতে পারবে না। কাছাকাছি দূরত্বের ভ্রমণ তাদের ভালাে লাগলাে না। তাই ভ্রমণ তৃপ্তি মিটানাের জন্য তারা পথের দূরত্ব বাড়িয়ে দিতে বলছে। এটাকে এক ধরনের বাড়াবাড়ি এবং অত্যাচারই বলা চলে। আর এই বাড়াবাড়ি ও অত্যাচার তারা নিজের সাথেই করছে। তাই বলা হয়েছে, ‘তারা নিজেদের প্রতি অত্যাচার করেছিলাে। তাদের দাবী পূরণ করা হয়েছে সত্য। তবে অর্বাচীন ও দাম্ভিক জাতিদের বেলায় যা ঘটে থাকে, তাদের বেলায়ও তাই ঘটেছে।’ এ প্রসংগে বলা হয়েছে, ‘ফলে আমি তাদেরকে উপাখ্যানে পরিণত করলাম এবং সম্পূর্ণরূপে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে দিলাম…'(আয়াত ১৯) অর্থাৎ বাস্তুভিটা এবং বন্ধনহারা হয়ে তারা উদ্বাস্তুদের মত গােটা আরব দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়লাে। স্বতন্ত্র জাতি হিসাবে তাদের আর কোন অস্তিত্বই বাকী থাকলাে না। তারা রূপকথার বিষয়বস্তুতে পরিণত হলাে। মানুষ এসব কাহিনী বলে বেড়াতে থাকে। তাদের এই ঘটনা থেকে উপদেশ গ্রহণ করার মতাে অনেক কিছুই রয়েছে। তাই বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয় এতে প্রত্যেক ধৈর্যশীল কৃতজ্ঞের জন্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে।’ আলােচ্য আয়াতে শােরগােযারীর পাশাপাশি ধৈর্যের কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ বিপদাপদে ধৈর্য ধারণ করতে হবে এবং সুখ-স্বাচ্ছন্দের মুহূর্তে আল্লাহর শােকর আদায় করতে হবে। মােটকথা সাবাবাসীদের ঘটনা থেকে উভয় শ্রেণীর লোকের জন্য উপদেশ গ্রহণ করার সুযােগ রয়েছে। আলােচ্য আয়াতের এই ব্যাখ্যার পাশাপাশি আরও একটা ব্যাখ্যা দেয়া যায়, আর তা হচ্ছে, প্রকাশ্য জনপদ বলতে ক্ষমতাধর ও কর্তৃত্বের অধিকারী জনপদ বুঝায়। অর্থাৎ যখন সাবাবাসীরা একটা দরিদ্র জাতিতে পরিণত হয়ে পড়লাে, মরুভূমিতে বসবাস করতে করতে তাদের জীবন নিতান্ত নিরানন্দ ও শুষ্ক হয়ে পড়েছিল। এক জায়গায় স্থির হয়ে বসবাস করা তাদের পক্ষে সম্ভব ছিলাে না, পানির জন্য এবং চারণভূমির জন্য তাদেরকে এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় ছুটাছুটি করতে হতাে, তখন তারা অস্থির হয়ে পড়েছিলাে, অধৈর্য হয়ে পড়েছিলো। তাই আল্লাহর নিকট ফরিয়াদ জানিয়ে বলে, ‘হে আমাদের প্রতিপালক, আমাদের ভ্রমণের পরিসর বাড়িয়ে দাও…’ অর্থাৎ আমাদের ভ্রমণের সংখ্যা কমিয়ে দাও। কারণ আমরা অধিক ভ্রমণের ফলে ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে পড়েছি। কিন্তু তাদের এই দোয়া কবুল হওয়ার মতাে কোনাে আমল বা আচরণ তাদের দ্বারা প্রকাশ পায়নি; বরং তারা সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের সময় দাম্ভিক ও বেপরোয়া হয়ে উঠতাে। আর বিপদাপদের মুহূর্তে হয়ে উঠতাে অধৈর্য। এ কারণে আল্লাহ পাক তাদের এই অপকর্মের শাস্তিস্বরূপ তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছেন। তাদেরকে ধ্বংস করে দিয়েছেন। পরবর্তিতে তারা কিসসা কাহিনীর বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়ে পড়ে। তাই এই ঘটনা থেকে শিক্ষা গ্রহণের জন্য উপসংহারে বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয় এতে প্রত্যেক ধৈর্যশীল কৃতজ্ঞের জন্য নিদর্শনাবলী রয়েছে…’ এই উপসংহার পূর্ববর্তী ঘটনার সাথে সংগতিপূর্ণ। অর্থাৎ অধৈর্য ও অকৃতজ্ঞতার কারণে সাবাবাসীদেকে যে পরিণতির সম্মুখীন হতে হয়েছে তা ধৈর্যশীল ও কৃতজ্ঞ ব্যক্তিদের জন্য নিদর্শন ও উপদেশ স্বরূপ। যা হােক, এটা আমার নিজস্ব ব্যাখ্যা। প্রকৃত ব্যাখ্যা আল্লাহ তায়ালাই ভালাে জানেন। ঘটনায় শেষ দিকে এসে এখন বক্তব্য তার সীমিত গন্ডি থেকে বের হয়ে এসে চলে যাচ্ছে আল্লাহর ব্যবস্থাপনা, মযবুত নিয়ন্ত্রণ এবং সাধারণ নিয়ম-নীতির বিশাল এক গন্ডির দিকে। এখানে এসে গােটা ঘটনার অন্তরালে নিহিত ও লুকায়িত মূল তাৎপর্য ও রহস্যের দিকে ইংগিত করে বলা হচ্ছে, ‘আর তাদের ওপর ইবলীস তার অনুমান সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করলাে। ফলে তাদের মধ্যে মােমেনদের একটি দল ব্যতীত সকলেই তার পথ অনুসরণ করলাে…'(আয়াত ২০ ও ২১) তারা এই ভ্রান্ত পথ অনুসরণ করার ফলেই এই পরিণতির সম্মুখীন হয়েছে। তাদের ক্ষেত্রে শয়তানের ধারণাই সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। কারণ, শয়তান তাদেরকে বিভ্রান্ত করতে চেয়েছিলাে, তাদেরকে পথভ্রষ্ট করতে চেয়েছিলাে। শেষ পর্যন্ত অল্প সংখ্যক খাটি মােমেন ব্যতীত সবাই শয়তানের প্ররােচনার শিকার হয়েছে। এটাই নিয়ম। প্রত্যেক দলেই কিছু সংখ্যক লােক এমন থাকে যারা মযবুত ঈমানের অধিকারী হয় এবং তারা শয়তানের প্ররােচনা ও ধোঁকাবাজির উর্ধে থাকতে পারে। এর দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, সত্যের অস্তিত্ব চিরকালই থাকবে। এই সত্যকে চিনে ও জেনে গ্রহণ করতে হবে। প্রতিকূল পরিবেশেও এই সত্যের ওপর টিকে থাকতে হবে। যারা এটা করতে সক্ষম হয় তাদের ওপর শয়তানের কোন কর্তত্বই চলে না। তারা সর্বদা শয়তানের নিয়ন্ত্রণের উর্ধে থাকতে পারে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, আল্লাহ তায়ালা মানুষের ওপর শয়তানকে চাপিয়ে দিয়ে সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য চিহ্নিত করতে চান। তাই যারা সত্যের ধারক বাহক তারা কখনও শয়তানের কূটচালের শিকার হয় না বরং যাদের কাছে সত্য কাম্য নয় এবং যারা সত্যের সন্ধানও করে না কেবল তারাই শয়তানের চক্রান্তের শিকার হয়ে পথভ্রষ্ট হয়ে পড়ে। মানুষের মনে পরকালের বিশ্বাস বদ্ধমূল থাকলে বিভ্রান্তির জালে সে কখনও আটকা পড়বে না। শয়তানের ধোকাবাজি থেকে সে মুক্তি পাবেই। কিন্তু যারা পরকালের ব্যাপারে সংশয় সন্দেহের শিকার তারা অবশ্যই বিভ্রান্তিতে ভুগবে, শয়তানের চক্রান্তে জড়িয়ে পড়বে। তাদের ভাগ্যে আল্লাহর সাহায্যও নেই এবং পরকালের মুক্তিও নেই। মানুষের জীবনে কি ঘটবে, তা ঘটার পূর্বেই আল্লাহ তায়ালা জানেন। তবে বাস্তব জগতে তা ঘটার পরই সে সংক্রান্ত কর্মফল নির্ধারণ করেন। সব কিছুর নিয়ামক ও নিয়ন্ত্রক আল্লাহ পাক। অপরদিকে আল্লাহ পাক অদৃশ্য জগত ও অনাগত-ভবিষ্যত জীবনের পরিণতি ও ফলাফলের বহিঃপ্রকাশ ঘটানাের জন্য কোনরূপ অবাধ ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব প্রদান না করেই মানুষ জাতিকে বিভ্রান্ত করার একটা সুযােগ শয়তানকে দিয়ে রেখেছেন। এ দুটো বিষয়ই হচ্ছে স্থান-কাল-পাত্র নিরপেক্ষ একটা চাক্ষুষ সত্য। এই সত্য কেবল সাবা জাতির ঘটনাবহুল ইতিহাসের বেলায়ই প্রযােজ্য নয়, বরং স্থান-কাল-পাত্র নির্বিশেষে প্রতিটি জাতির বেলায়ই তা প্রযােজ্য। কাজেই সাবা জাতির ঘটনা বর্ণনার পর যে উপসংহার টানা হয়েছে তা গােটা মানব জাতির জন্য প্রযােজ্য। কারণ আলােচ্য ঘটনার প্রতিপাদ্য বিষয় ছিলাে হেদায়াত ও গােমরাহীর কারণ, এর শেষ পরিণতি ও ফলাফল। তাই বলা হয়েছে, ‘তােমার প্রভু সব কিছুর রক্ষক’ অর্থাৎ কোন কিছুই তাঁর দৃষ্টির আড়ালে নেই। সব কিছুই তার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। কাজেই কোন কিছুর বিচ্যুতির সুযােগ নেই এবং হারিয়ে যাওয়ারও ভয় নেই। আলােচ্য সূরার প্রথম পর্বে পরকালীন জীবনের বিষয়াদি স্থান পেয়েছে। দ্বিতীয় পর্বেও সেই একই বিষয় পুনরায় অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে আলােচিত হয়েছে।