(টপিক#১০৬১) [*কৃতজ্ঞতা ও অকৃতজ্ঞতার কিছু দৃশ্য, সাবা জাতির ইতিহাস :-] www.motaher21.net সূরা:- ৩৪:সাবা পারা:২২ ১০-২১ নং আয়াত:- তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-

أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#১০৬১)
[*কৃতজ্ঞতা ও অকৃতজ্ঞতার কিছু দৃশ্য, সাবা জাতির ইতিহাস :-]
www.motaher21.net
সূরা:- ৩৪:সাবা
পারা:২২
১০-২১ নং আয়াত:-
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
# মহান আল্লাহ‌ হযরত দাউদ আলাইহিস সালামের প্রতি যে অসংখ্য অনুগ্রহ বর্ষণ করেছিলেন সেদিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। তিনি ছিলেন বাইতুল লাহমের ইয়াহুদা গোত্রের একজন সাধারণ যুবক। ফিলিস্তিনীদের বিরুদ্ধে একটি যুদ্ধের জালুতের মতো এক বিশাল দেহী ভয়ংকর শত্রুকে হত্যা করে তিনি রাতারাতি বনী ইসরাঈলের নয়নমণিতে পরিণত হন। এ ঘটনা থেকেই তাঁর উত্থান শুরু হয়। এমনকি তালুতের ইন্তিকালের পরে প্রথমে তাঁকে ‘হাবরূনে’ (বর্তমান আল খালীল) ইয়াহুদিয়ার শাসনকর্তা করা হয়। এর কয়েক বছর পর সকল বনী ইসরাঈল গোত্র সর্বসম্মতভাবে তাঁকে নিজেদের বাদশাহ নির্বাচিত করে এবং তিনি জেরুসালেম জয় করে ইসরাঈলী রাজ্যের রাজধানীতে পরিণত করেন। তাঁরই নেতৃত্বে ইতিহাসে প্রথমবার এমন একটি আল্লাহর অনুগত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয় যার সীমানা আকাবা উপসাগর থেকে ফোরাত নদীর পশ্চিম উপকূল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এসব অনুগ্রহের সাথে সাথে আল্লাহ‌ তাঁকে আরো দান করেন জ্ঞান, প্রজ্ঞা, বুদ্ধিমত্তা, ইনসাফ, ন্যায়নিষ্ঠা, আল্লাহভীতি, আল্লাহর বন্দেগীও তাঁর প্রতি আনুগত্যশীলতা। (বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন আল বাকারাহ, ২৭৩ টীকা এবং বনী ইসরাঈল, ৭ টীকা )।
# এর আগে এ বিষয়টি সূরা আম্বিয়ার ৭৯ আয়াতে উল্লেখিত হয়েছে। সেখানে আমি এর ব্যাখ্যা করেছি। (দেখুন তাফহীমুল কুরআন, আল আম্বিয়া, ৭১ টীকা)
# কোন কোন প্রাচীন তাফসীরকার এর এ অর্থ গ্রহণ করেছেন যে, ভূগর্ভ থেকে হযরত সুলাইমানের জন্য একটি প্রস্রবণ প্রবাহিত হয়েছিল। তাতে পানির পরিবর্তে গলিত তামা প্রবাহিত হতো। কিন্তু আয়াতের অন্য ব্যাখ্যা এও হতে পারে যে, হযরত সুলাইমান আলাইহিস সালামের আমলে তামা গলাবার এবং তার সাহায্যে বিভিন্ন প্রকার জিনিস তৈরি করার কাজ এত ব্যাপক আকারে চলতো যেন মনে হতো সেখানে তামার প্রস্রবণ প্রবাহিত রয়েছে। (বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, আল আম্বিয়া ৭৪ – – ৭৫ টীকা))
# যেসব জিনকে হযরত সুলাইমানের অধীন করে দেয়া হয়েছিল তারা গ্রামীণ ও পাহাড় পর্বতে বসবাসকারী মানবগোষ্ঠী ছিল, না সত্যিকার জিন ছিল, যারা সারা দুনিয়ার মানুষের কাছে একটি অদৃশ্য সৃষ্টি হিসেবে পরিচিত —সে ব্যাপারে সূরা আম্বিয়া ও সূরা নামলের ব্যাখ্যায় আমি বিস্তারিত আলোচনা করেছি। দেখুন তাফহীমুল কুরআন, আল আম্বিয়া, ৭৫ এবং আন নামল ২৩ , ৪৫ ও ৫২ টীকা )
# মূলে تَمَاثِيلَ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে এটি تمثال শব্দের বহু বচন। আল্লাহর সৃষ্ট জিনিসের মতো করে তৈরি করা প্রত্যেকটি জিনিসকে আরবীতে বলে। এসব জিনিস মানুষ, পশু, গাছ, ফুল, নদী বা অন্য যে কোন নিষ্প্রাণ জিনিসও হতে পারে।

التمثال اسم للشئ المصنون مشبها بخلق من خلق الله (لسان العرب)

“এমন প্রত্যেকটি কৃত্রিম জিনিসকে তিমসাল বলা হয় যা আল্লাহর তৈরি করা জিনিসের মতো করে তৈরি করা হয়েছে।”

التمثال كل ماصور على صورة غيره من حيوان وغير حيوان-

“এমন প্রত্যেকটি ছবিকে তিমসাল বলা হয়, যা অন্য কোন জিনিসের আকৃতি অনুযায়ী তৈরি করা হয়েছে, তা সপ্রাণ ও নিষ্প্রাণ যাই হোক না কেন।” (তাফসীরে কাশশাফ)

এ কারণে কুরআন মজিদের এ বর্ণনা থেকে হযরত সুলাইমান আলাইহিস সালামের জন্য যে ছবি তৈরি করা হতো তা মানুষের ও প্রাণীর ছবি অথবা তাদের ভাস্কর মূর্তি হওয়াটা আপরিহার্য ছিল না। হতে পারে হযরত সুলাইমান (আ) নিজের ইমারতগুলো যেসব ফুল, পাতা, প্রাকৃতিক দৃশ্য ও কারুকাজে শোভিত করেছিলেন সেগুলোকেই তামাসীল বলা হয়েছে।

হযরত সুলাইমান (আ) ফেরেশতা ও নবীদের ছবি অংকন করিয়েছিলেন, কোন কোন মুফাসসিরের এ ধরনের বক্তব্যই বিভ্রান্তির উদগাতা। বনী ইসরাঈলের পৌরাণিক বর্ণনাবলী থেকে তাঁরা একথা সংগ্রহ করেন এবং তারপর এর ব্যাখ্যা এভাবে করেন যে, পূর্ববর্তী শরীয়াতগুলোতে এ ধরনের ছবি আঁকা নিষিদ্ধ ছিল না। কিন্তু কোন প্রকার অনুসন্ধান না করে এ বর্ণনাগুলো উদ্ধৃত করার সময় এ মনীষীবৃন্দ একথা চিন্তা করেননি যে, হযরত সুলাইমান আলাইহিস সালাম যে মূসার শরীয়াতের অনুসারী ছিলেন সেখানেও শরীয়াতে মুহাম্মাদীর ﷺ মতো মানুষের ও প্রাণীর ছবি ও মূর্তি নির্মাণ একই পর্যায়ে হারাম ছিল। আর তারা একথাও ভুলে যান যে, বনী ইসরাঈলের একটি দলের তাঁর সাথে শত্রুতা ছিল এবং এরই বশবর্তী হয়ে তারা শিরক, মূর্তি পূজা ও ব্যভিচারের নিকৃষ্টতম অপবাদ তাঁর প্রতি আরোপ করে। তাই তাদের বর্ণনার ওপর নির্ভর করে এ মহিমান্বিত পয়গম্বর সম্পর্কে এমন কোন কথা কোন ক্রমেই মেনে নেয়া উচিত নয় যা আল্লাহ‌ প্রেরিত কোন শরীয়াতের বিরুদ্ধে চলে যায়। একথা সবাই জানেন, হযরত মূসা আলাইহিমুস সালামের পরে হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম পর্যন্ত ইসরাঈলে যত নবীই এসেছেন তাঁরা সবাই ছিলেন তাওরাতের অনুসারী। তাঁদের একজনও এমন কোন শরীয়াত আনেননি যা তাওরাতের আইন রদ করে দেয়। এখন তাওরাতের প্রতি দৃষ্টি দিলে দেখা যাবে সেখানে মানুষ ও পশুর ছবি ও মূর্তি নির্মাণকে বারবার একেবারেই হারাম বলে ঘোষণা করা হচ্ছেঃ

“তুমি আপনার নিমিত্তে খোদিত প্রতিমা নির্মাণ করিও না; উপরিস্থ স্বর্গে, নীচস্থ পৃথিবীতে ও পৃথিবীর নীচস্থ জলমধ্যে যাহা যাহা আছে, তাহাদের কোন মূর্তি নির্মাণ করিও না।” ‍‌(যাত্রা পুস্তক ২০: ৪)

“তোমরা আপনাদের জন্য অবস্তু প্রতিমা নির্মাণ করিও না, না ক্ষোদিত প্রতিমা কিংবা স্তম্ভ স্থাপন করিও না, ও তাহার কাছে প্রণিপাত করিবার নিমিত্তে তোমাদের দেশে কোন ক্ষোদিত প্রস্তর রাখিও না।” (লেবীয় পুস্তক ২৬: ১)

“পাছে তোমরা ভ্রষ্ট হইয়া আপনাদের জন্য কোন আকারের মূর্তিতে ক্ষোদিত প্রতিমা নির্মাণ কর, পাছে পুরুষের বা স্ত্রীর প্রতিকৃতি, পৃথিবীস্থ কোন পশুর প্রতিকৃতি, আকাশে উড্ডীয়মান কোন পক্ষীর প্রতিকৃতি, ভূচর কোন সরীসৃপের প্রতিকৃতি, অথবা ভূমির নীচস্থ জলচর কোন জন্তুর প্রতিকৃতি নির্মাণ কর।” (দ্বিতীয় বিবরণ ৪: ১৬-১৮)

“যে ব্যক্তি কোন ক্ষোদিত কিংবা ছাদে ঢালা প্রতিমা, সদাপ্রভুর ঘৃণিত বস্তু, শিল্পকরের হস্তনির্মিত বস্তু নির্মাণ করিয়া গোপনে স্থাপন করে, সে শাপগ্রস্ত।” (দ্বিতীয় বিবরণ ২৭: ১৫)

এ পরিষ্কার ও সুস্পষ্ট বিধানের পর কেমন করে একথা মেনে নেয়া যেতে পারে যে, হযরত সুলাইমান (আ) জিনদের সাহায্যে নবী ও ফেরেশতাদের ছবি বা তাদের প্রতিমা তৈরি করার কাজ করে থাকবেন। আর যেসব ইহুদী হযরত সুলাইমানের বিরুদ্ধে অপবাদ দিতো যে, তিনি নিজের মুশরিকা স্ত্রীদের প্রেমে বিভোর হয়ে মূর্তি পূজা করতে শুরু করেছিলেন, তাদের বর্ণনার ওপর নির্ভর করে একথা কেমন করে মেনে নেয়া যায়। (দেখুন বাইবেলের রাজাবলী-১, ১১অধ্যায়)

( উপরোক্ত অধ্যায় গুলি বাইবেল থেকে দেখুন।)

তবুও মুফাসসিরগণ বনী ইসরাঈলের এ বর্ণনা উদ্ধৃত করার সাথে সাথে একথাও সুস্পষ্ট করে দিয়েছিলেন যে, মুহাম্মাদের ﷺ শরীয়াতে এটি হারাম। তাই এখন হযরত সুলাইমানের (আ) অনুসরণ করে ছবি ও ভাস্কর মূর্তি নির্মাণ করা কারো জন্য বৈধ নয়। কিন্তু বর্তমান যুগের কিছু লোক পাশ্চাত্যবাসীদের অনুকরণে চিত্রাংকন ও মূর্তি নির্মাণকে হালাল করতে চান। তাঁরা কুরআন মজীদের এ আয়াতকে নিজেদের জন্য প্রমাণ হিসেবে গণ্য করছেন। তারা বলেন, একজন নবী যখন এ কাজ করেছেন এবং আল্লাহ‌ নিজেই যখন তাঁর কিতাবে একথা আলোচনা করেছেন এবং এর ওপর তাঁর কোন প্রকার অপছন্দনীয়তার কথা প্রকাশ করেননি তখন অবশ্যই তা হালাল হওয়া উচিত।

পাশ্চাত্য সভ্যতার এসব অন্ধ অনুসারীর এ যুক্তি দু’টি কারণে ভুল। প্রথমত কুরআনে এই যে, “তামাসীল” শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে এ থেকে সুস্পষ্টভাবে মানুষ ও পশুর ছবির অর্থ প্রকাশ হয় না। বরং এ থেকে নিষ্প্রাণ জিনিসের ছবিও বুঝা যায়। তাই নিছক এ শব্দটির ওপর ভিত্তি করে কুরআনের দৃষ্টিতে মানুষের ও পশুর ছবি হালাল এ বিধান দেয়া যেতে পারে না। দ্বিতীয়ত বিপুল সংখ্যক শক্তিশালী সনদযুক্ত মুতাওয়াতির হাদীস থেকে একথা প্রমাণিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রাণী জাতীয় যে কোন জিনিসের ছবি নির্মাণ ও সংরক্ষণকে অকাট্যভাবে ও চূড়ান্তভাবে হারাম ঘোষণা করেছেন। এ প্রসঙ্গে নবী করীম ﷺ থেকে যেসব উক্তি প্রমাণিত হয়েছে এবং সাহাবীগণ থেকে যেসব বাণী ও কর্ম উদ্ধৃত হয়েছে সেগুলো আমি এখানে উল্লেখ করছিঃ

(1) عَنْ عَائِشَةَ ام المؤمنين أَنَّ أُمَّ حَبِيبَةَ وَأُمَّ سَلَمَةَ ذَكَرَتَا كَنِيسَةً رَأَيْنَهَا بِالْحَبَشَةِ فِيهَا تَصَاوِيرُ ، فَذَكَرَتَا لِلنَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ إِنَّ أُولَئِكَ إِذَا كَانَ فِيهِمُ الرَّجُلُ الصَّالِحُ فَمَاتَ بَنَوْا عَلَى قَبْرِهِ مَسْجِدًا ، وَصَوَّرُوا فِيهِ تِلْكَ الصُّوَرَ ، فَأُولَئِكَ شِرَارُ الْخَلْقِ عِنْدَ اللَّهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ (بخارى , كتاب الصلوة – مسلم , كتاب المساجد , نسائى , كتاب المساجد) “উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত। হযরত উম্মে হাবীবা (রা.) ও হযরত উম্মে সালামাহ (রা.) আবিসিনিয়ায় একটি গীর্জা দেখেছিলেন, তাতে ছবি ছিল। তাঁরা নবী করীম ﷺ কে একথা বলেন। নবী (সা.) বলেন তাদের অবস্থা এমন ছিল যে, যখন তাদের মধ্যে কোন সৎলোকের জন্ম হতো, তার মৃত্যুর পর তার কবরের ওপর তারা একটি উপাসনালয় তৈরি করতো এবং তার মধ্যে এ ছবিগুলো তৈরি করতো। কিয়ামতের দিন তারা আল্লাহর কাছে নিকৃষ্টতম সৃষ্টি হিসেবে গণ্য হবে।”

(2) عن ابى حجيفة ان رسول الله صلى الله عليه وسلم لَعَنَ الْمُصَوِّرَ– “আবু হুজাইফা বলেন, রসূলুল্লাহ ﷺ চিত্রকর্মের প্রতি লানত বর্ষণ করেছেন। (বুখারীঃ ব্যবসা-বাণিজ্য অধ্যায়, তালাক অধ্যায়, পোশাক অধ্যায়)

(3) عن أَبى زُرْعَةَ قَالَ دَخَلْتُ مَعَ أَبِى هُرَيْرَةَ دَارًا بِالْمَدِينَةِ فَرَأَى أَعْلاَهَا مُصَوِّرًا يُصَوِّرُ ، قَالَ سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ وَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنْ ذَهَبَ يَخْلُقُ كَخَلْقِى ، فَلْيَخْلُقُوا حَبَّةً ، وَلْيَخْلُقُوا ذَرَّةً- “আবু যুর’আহ বলেন, একবার আমি হযরত আবু হুরাইরার (রা.) সাথে মদীনার একটি গৃহে প্রবেশ করলাম। দেখলাম, গৃহের ওপর দিকে একজন চিত্রকর চিত্র নির্মাণ করছে। এ দৃশ্য দেখে হযরত আবু হুরাইরাহ (রা.) বললেন, আমি রসূলুল্লাহ ﷺ কে বলতে শুনেছি যে, মহান আল্লাহ‌ বলেন, তার চেয়ে বড় জালেম আর কে হবে যে আমার সৃষ্টির অনুরূপ সৃষ্টি করার চেষ্টা করে! তারা একটি শস্যদানা অথবা একটি পিঁপড়ে বানিয়ে দেখাক তো।” (বুখারী-পোশাক অধ্যায়, মুসনাদে আহমাদ ও মুসলিমের বর্ণনায় পরিষ্কার হয়েছে, এটি ছিল মাওয়ানের গৃহ)

(4) عَنْ أَبِى مُحَمَّدٍ الْهُذَلِىِّ عَنْ عَلِىٍّ قَالَ كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فِى جَنَازَةٍ فَقَالَ أَيُّكُمْ يَنْطَلِقُ إِلَى الْمَدِينَةِ فَلاَ يَدَعُ بِهَا وَثَناً إِلاَّ كَسَرَهُ وَلاَ قَبْراً إِلاَّ سَوَّاهُ وَلاَ صُورَةً إِلاَّ لَطَّخَهَا فَقَالَ رَجُلٌ أَنَا يَا رَسُولَ اللَّهِ فَانْطَلَقَ فَهَابَ أَهْلَ الْمَدِينَةِ فَرَجَعَ فَقَالَ عَلِىٌّ أَنَا أَنْطَلِقُ يَا رَسُولَ اللَّهِ. قَالَ فَانْطَلِقْ فَانْطَلَقَ ثُمَّ رَجَعَ فَقَالَ يَا رَسُولَ اللَّهِ لَمْ أَدَعْ بِهَا وَثَناً إِلاَّ كَسَرْتُهُ وَلاَ قَبْراً إِلاَّ سَوَّيْتُهُ وَلاَ صُورَةً إِلاَّ لَطَّخْتُهُا ثُمَّ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم مَنْ عَادَ لِصَنْعَةِ شَىْءٍ مِنْ هَذَا فَقَدْ كَفَرَ بِمَا أُنْزِلَ عَلَى مُحَمَّدٍ- আবু মুহাম্মাদ হাযালী হযরত আলী (রা.) থেকে বর্ণনা করেছেন, রসূলুল্লাহ ﷺ একটি জানাযায় শরীক হয়েছিলেন। তিনি বলেন, তোমাদের মধ্যে কে আছে যে মদীনায় গিয়ে সকল মূর্তি ভেঙ্গে ফেলবে। সকল কবর ভূমির সমান করে দেবে এবং সকল ছবি নিশ্চিহ্ন করে দেবে? এক ব্যক্তি বললো, আমি এজন্য প্রস্তুত। কাজেই সে গেলো কিন্তু মদীনাবাসীদের ভয়ে এ কাজ না করেই ফিরে এলো। তখন হযরত আলী (রা.) নিবেদন করলেন, হে আল্লাহর রসূল! আমি যাই? নবী করীম ﷺ বললেন, ঠিক আছে তুমি যাও। হযরত আলী (রা.) গেলেন এবং ফিরে এসে বললেন, আমি কোন মূর্তি না ভেঙ্গে কোন কবর ভূমির সমান না করে এবং কোন ছবি নিশ্চিহ্ন না করে ছাড়িনি। একথায় নবী করীম ﷺ বললেন, এখন যদি কোন ব্যক্তি এ জাতীয় কোন জিনিস তৈরি করে তাহলে সে মুহাম্মাদের ﷺ ওপর যে শিক্ষা অবতীর্ণ হয়েছে তার সাথে কুফরী করলো। (মুসনাদে আহমাদ, মুসলিম-জানাযাহ অধ্যায় এবং নাসাঈ, জানাযাহ অধ্যায়েও এ বিষয়বস্তু সম্বলিত একটি হাদীস উদ্ধৃত হয়েছে)।

(5) عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم………………… ومَنْ صَوَّرَ صُورَةً عَذَّبَ وكلف ان ينفخ فيها وَلَيْسَ بِنَافِخٍ “ইবনে আব্বাস (রা.) নবী ﷺ থেকে বর্ণনা করেছেন,—-আর যে ব্যাক্তি ছবি অংকন করলো তাকে শাস্তি দেয়া হবে এবং তাকে বাধ্য করা হবে তার মধ্যে প্রাণ সঞ্চার করার জন্য। কিন্তু সে প্রাণ সঞ্চার করতে পারবে না। (বুখারী, তাফসীর অধ্যায় ; তিরমিযী, পোশাক অধ্যায় ; নাসাঈ সৌন্দর্য অধ্যায় এবং মুসনাদে আহমাদ)

(6) عن سَعِيدُ بْنُ أَبِى الْحَسَنِ قَالَ كُنْتُ عِنْدَ ابْنِ عَبَّاسٍ رضى الله عنهما اذ اتاه رَجُلٌ فَقَالَ يَا ابا عَبَّاسٍ إِنِّى انسان إِنَّمَا مَعِيشَتِى مِنْ صَنْعَةِ يَدِى وَإِنِّى أَصْنَعُ هَذِهِ التَّصَاوِيرَ- فقَالَ ابن عباس لاَ أُحَدِّثُكَ إِلاَّ مَا سَمِعْتُ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ سَمِعْتُهُ يَقُولُ مَنْ صَوَّرَ صُورَةً فَإِنَّ اللَّهَ مُعَذِّبُهُ حَتَّى يَنْفُخَ فِيهَا الرُّوحَ وَلَيْسَ بِنَافِخٍ فِيهَا أَبَداً فَرَبَا الرَّجُلُ رَبْوَةً شَدِيدَةً وَاصْفَرَّ وَجْهُهُ – فَقَالَ وَيْحَكَ إِنْ أَبَيْتَ إِلاَّ أَنْ تَصْنَعَ فَعَلَيْكَ بِهَذَا الشَّجَرِ وَكُلِّ شَىْءٍ لَيْسَ فِيهِ رُوحٌ “সাঈদ ইবনে আবুল হাসান বলেন, আমি ইবনে আব্বাসের (রা.) কাছে বসে ছিলাম। এমন সময় এক ব্যাক্তি এলো এবং সে বললো, হে আবু আব্বাস! আমি এমন এক ব্যক্তি যে নিজের হাতে রোজগার করে এবং এ ছবি তৈরি করেই আমি রোজগার করি। ইবনে আব্বাস জবাব দিলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে যা বলতে শুনেছি তোমাকেও তাই বলবো। আমি নবী করীম ﷺ থেকে একথা শুনেছি যে, যে ব্যক্তি ছবি তৈরি করবে আল্লাহ‌ তাকে শাস্তি দেবেন এবং যতক্ষন সে তার মধ্যে প্রাণ সঞ্চার না করবে ততক্ষন তাকে রেহাই দেবেন না। আর সে কখনো তার মধ্যে প্রাণ সঞ্চার করতে পারবে না। একথা শুনে সে ব্যক্তি বড়ই উত্তেজিত হয়ে উঠলো এবং তার চেহারা হলুদ হয়ে গেলো। এ অবস্থা দেখে ইবনে আব্বাস (রা.) বললেন, হে আল্লাহর বান্দা! যদি তোমার ছবি আঁকতেই হয়, তাহলে এই গাছের ছবি আঁকো অথবা এমন কোন জিনিসের ছবি আঁকো যার মধ্যে প্রাণ নেই।” (বুখারী ব্যবসায় অধ্যায় ; মুসলিম, পোশাক অধ্যায় ; নাসাঈ, সৌন্দর্য অধ্যায় এবং মুসনাদে আহমাদ)

(7) عن عَبْدَ اللَّهِ بْنَ مَسْعُودٍ قَالَ سَمِعْتُ النبى صلى الله عليه وسلم يقول إِنَّ أَشَدَّ النَّاسِ عَذَاباً عند الله يَوْمَ الْقِيَامَةِ الْمُصَوِّرُونَ “আবুদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, নবী (সা.) বলেছেন, কিয়ামতের দিন আল্লাহর কাছ চিত্রকরেরা সবচেয়ে কঠিন শাস্তি পাবে।” (বুখারী, পোশাক অধ্যায়; মুসলিম, পোশাক অধ্যায়; নাসাঈ, সৌন্দর্য অধ্যায় এবং মুসনাদে আহমাদ)

(8) عَنْ عَبْدَ اللَّهِ بْنَ عُمَرَ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ إِنَّ الَّذِينَ يَصْنَعُونَ هَذِهِ الصُّوَرَ يُعَذَّبُونَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ يُقَالُ لَهُمْ أَحْيُوا مَا خَلَقْتُمْ- আবুদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত রসুলুল্লাহ ﷺ বলেন, “যারা এ ছবি আঁকে তাদেরকে কিয়ামতের দিন শাস্তি দেয়া হবে। তাদেরকে বলা হবে, যা কিছু তোমরা তৈরি করেছো তাকে জীবিত করো।” (বুখারী পোশাক অধ্যায়, মুসলিম পোশাক অধ্যায়, নাসাঈ, সৌন্দর্য অধ্যায় মুসনাদে আহমাদ)

(9)عَنْ عَائِشَةَ رضى الله عنها أَنَّهَا اشْتَرَتْ نُمْرُقَةً فِيهَا تَصَاوِيرُ فَقَامَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم بِالْبَابِ فَلَمْ يَدْخُلْ فَقُلْتُ أَتُوبُ إِلَى اللَّهِ مِمَّا أَذْنَبْتُ قَالَ مَا هَذِهِ النُّمْرُقَةُ قُلْتُ لِتَجْلِسَ عَلَيْهَا وَتَوَسَّدَهَا قَالَ إِنَّ أَصْحَابَ هَذِهِ الصُّوَرِ يُعَذَّبُونَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ يُقَالُ لَهُمْ أَحْيُوا مَا خَلَقْتُمْ وَإِنَّ الْمَلاَئِكَةَ لاَ تَدْخُلُ بَيْتًا فِيهِ الصُّورَةُ- হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি একটি বালিশ কেনেন। তার গায়ে ছবি আঁকা ছিল। তারপর নবী (সা.) এলেন। তিনি দরজায়ই দাঁড়িয়ে রইলেন। ভিতরে প্রবেশ করলেন না। আমি বললাম, আমি এমন প্রত্যেকটি গোনাহ থেকে তাওবা করছি যা আমি করেছি। নবী করীম ﷺ বললেন, এ বালিশটি কেন? বললাম, আপনি এখানে আসবেন এবং এর গায়ে হেলান দেবেন এজন্য এটা এখানে রাখা হয়েছে। বললেন, এই ছবি অংকনকারীদেরকে কিয়ামতের দিন শাস্তি দেয়া হবে। তাদেরকে বলা হবে, যা কিছু তোমরা তৈরি করেছো তাকে জীবিত করো। আর ফেরেশতারা (রহমতের ফেরশতারা) এমন কোন গৃহে প্রবেশ করে না যেখানে ছবি থাকে।” (বুখারী, পোশাক অধ্যায়; মুসলিম, পোশাক অধ্যায়; নাসাঈ, সৌন্দর্য অধ্যায়; ইবনে মাজাহ, ব্যবসায় অধ্যায়, মুআত্তা, অনুমতি চাওয়া অধ্যায়)

(10) عَنْ عَائِشَةَ قَالَتْ دَخَلَ عَلَىَّ رسول الله صلى الله عليه وسلم وانا متستره بقِرَامٌ فِيهِ صُوَرٌ فَتَلَوَّنَ وَجْهُهُ ، ثُمَّ تَنَاوَلَ السِّتْرَ فَهَتَكَهُ ثم قال ان مِنْ أَشَدِّ النَّاسِ عَذَابًا يَوْمَ الْقِيَامَةِ الَّذِينَ يشتهون بخلق الله- “হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, একবার রসূলুল্লাহ ﷺ আমার কাছে এলেন। তখন আমি একটি পর্দা টাঙিয়ে রেখেছিলাম। তার গায়ে ছবি আঁকা ছিল। তার চেহারার রং বদলে গেলো। তারপর তিনি পর্দাটা নিয়ে ছিড়ে ফেললেন এবং বললেন, কিয়ামতের দিন যাদেরকে কঠিনতম শাস্তি হবে তাদের মধ্যে আল্লাহর সৃষ্টির অনুরূপ সৃষ্টি করার চেষ্টা যারা করে তারাও রয়েছে।” (বুখারী, পোশাক অধ্যায়, মুসলিম পোশাক অধ্যায়, নাসাঈ, সৌন্দর্য অধ্যায়)

(11) عَنْ عَائِشَةَ قَالَتْ قَدِمَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم مِنْ سَفَرٍ وَقَدْ سَتَّرْتُ عَلَى بَابِى دُرْنُوكًا فِيهِ الْخَيْلُ ذَوَاتُ الأَجْنِحَةِ فَأَمَرَنِى فَنَزَعْتُهُ- “হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, একবার রসূলুল্লাহ ﷺ সফর থেকে ফিরে এলেন। তখন আমি আমার দরজায় একটি পর্দা টাঙিয়ে রেখেছিলাম। তার গায়ে পক্ষ বিশিষ্ট ঘোড়ার ছবি আঁকা ছিল। নবী করীম ﷺ হুকুম দিলেন, এটি নামিয়ে ফেলো। আমি তা নামিয়ে ফেললাম।” (মুসলিম পোশাক অধ্যায় এবং নাসাঈ, সৌন্দর্য অধ্যায়)

(12) عَنْ جَابِرٍ قَالَ نَهَى رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم عَنِ الصُّورَةِ فِى الْبَيْتِ وَنَهَى أَنْ يُصْنَعَ ذَلِكَ- “জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) বলেন, রসূলুল্লাহ ﷺ ঘরের মধ্যে ছবি রাখতে মানা করেছেন এবং ছবি আঁকতেও নিষেধ করেছেন।” (তিরযিমী, পোশাক অধ্যায়)

(13) عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ عَنْ أَبِى طَلْحَةَ عَنِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ لاَ تَدْخُلُ الْمَلاَئِكَةُ بَيْتًا فِيهِ كَلْبٌ وَلاَ صُورَةٌ- “ইবনে আব্বাস (রা.) আবু তালহা আনসারী (রা.) থেকে বর্ণনা করেন, নবী করীম ﷺ বলেছেন, ফেরেশতারা (অর্থাৎ রহমতের ফেরেশতারা) এমন কোন গৃহে প্রবেশ করে না যেখানে কুকুর পালিত থাকে এবং এমন কোন গৃহেও প্রবেশ করে না যেখানে ছবি থাকে।” (বুখারী, পোশাক অধ্যায়)

(14) عن عبد الله بن عمر قَالَ وَعَدَ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم جِبْرِيلُ فَرَاثَ عَلَيْهِ حَتَّى اشْتَدَّ عَلَى النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم فَخَرَجَ النَّبِىُّ – صلى الله عليه وسلم فَلَقِيَهُ فَشَكَا إِلَيْهِ مَا وَجَدَ فَقَالَ لَهُ إِنَّا لاَ نَدْخُلُ بَيْتًا فِيهِ صُورَةٌ وَلاَ كَلْبٌ- “আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) বলেন, একবার জিব্রীল নবী (সা.) এর কাছে আসার ওয়াদা করেন কিন্তু অনেক দেরী হয়ে যায় এবং তিনি আসেন না। নবী করীম ﷺ এতে পেরেশান হন। তিনি ঘর থেকে বের হয়ে পড়েন এবং তাঁকে পেয়ে যান। তিনি তাঁর কাছে অভিযোগ করেন। তাতে তিনি বলেন, আমরা এমন কোন গৃহে প্রবেশ করি না যেখানে কুকুর বা ছবি থাকে।” (বুখারী, পোশাক অধ্যায়, এ বিষয়বস্তু সম্বলিত বহু হাদীস বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসাঈ, ইবনে মাজা, ইমাম মালেক ও ইমাম মুহাম্মাদ বিভিন্ন সাহাবী থেকে উদ্ধৃত করেছেন)

এসব হাদীসের মোকাবিলায় আরো কিছু হাদীস এমন পেশ করা হয় যেগুলোতে ছবির ব্যাপারে ছাড় পাওয়া যায়। যেমন আবু তালহা আনসারীর এ হাদীসঃ যে কাপড়ে ছবি উৎকীর্ণ থাকে তা দিয়ে পর্দা তৈরি করে টানিয়ে দেবার অনুমতি আছে। বুখারী, পোশাক অধ্যায়) হযরত আয়েশার (রা.) এ বর্ণনাঃ ছবিযুক্ত কাপড় ছিড়ে যখন তিনি তা দিয়ে তোষক বা গদি বানিয়ে নেন তখন নবী করীম ﷺ তা বিছাতে নিষেধ করেননি। (মুসলিম) সালেম ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে উমরের (রা.) এ হাদীসঃ প্রকাশ্য স্থানে যে ছবি টাংগিয়ে দেয়া হয়েছে তা নিষিদ্ধ, ছবি সম্বলিত যে কাপড় বিছানায় বিছিয়ে দেয়া হয়েছে তা নিষিদ্ধ নয়। (মুসনাদে আহমাদ) কিন্তু এর মধ্য থেকে কোন একটি হাদীসও ওপরে উদ্ধৃত হাদীসগুলো খণ্ডন করে না। ছবি অঙ্কন করার বৈধতা এর মধ্য থেকে কোন একটি হাদীস থেকেও পাওয়া যায় না। এ হাদিসগুলোতে যদি কোন কাপড়ের গায়ে ছবি অংকিত থাকে এবং তা কিনে নেয়া হয়ে গিয়ে থাকে তাহলে তা কিভাবে ব্যবহার করতে হবে কেবলমাত্র সে কথাই আলোচিত হয়েছে। এ বিষয়ে আবু তালহা আনসারীর বর্ণিত হাদীসটি কোনক্রমেই গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ এটি এমন বহু সহীহ হাদীসের পরিপন্থী যেগুলোতে নবী (সা.) ছবি সম্বলিত কাপড় টানিয়ে দিতে কেবল নিষেধই করেননি বরং তা ছিঁড়ে ফেলেছেন। তাছাড়া তিরমিযী ও মুআত্তায় হযরত আবু তালহার নিজের যে কার্যক্রম উদ্ধৃত হয়েছে তা হচ্ছে এই যে, তিনি ছবি সম্বলিত পর্দা ঝুলানো তো দূরের কথা এমন বিছানা বিছাতেও অপছন্দ করতেন যাতে ছবি আঁকা থাকতো। আর হযরত আয়েশা ও সালেম ইবনে আবদুল্লাহর রেওয়ায়াত সম্পর্কে বলা যায়, তা থেকে কেবলমাত্র এতটুকু বৈধতাই প্রকাশ পায় যে, ছবি যদি মর্যাদাপূর্ণ স্থানে না থাকে বরং হীনভাবে বিছনায় রাখা থাকে এবং তাকে পদদলিত করা হয়, তাহলে তা সহনীয়। যে সভ্যতা ও সংস্কৃতি চিত্রাংকন ও মূর্তি নির্মাণ শিল্পকে মানব সভ্যতার সবচেয়ে গৌরবোজ্জাল কৃতিত্ব গণ্য করে এবং তা মুসলমানদের মধ্যে প্রচলিত করতে চায় সার্বিকভাবে তার বৈধতা এ হাদীসগুলো থেকে কেমন করে প্রমাণ করা যেতে পারে?

ছবির ব্যাপারে নবী (সা.) চূড়ান্তভাবে উম্মাতের জন্য যে বিধান রেখে গেছেন তার সন্ধান বর্ষীয়ান ও শ্রেষ্ঠ সাহাবীগণের অনুসৃত কর্মনীতি থেকেই পাওয়া যায়। ইসলামে এটি একটি স্বীকৃত মূলনীতি যে, সমস্ত পর্যায়ক্রমিক বিধান ও প্রাথমিক উদারনীতির পর সর্বশেষে নবী করীম ﷺ যে বিধান নির্ধারণ করেন সেটাই নির্ভরযোগ্য ইসলামী বিধান। নবী করীমের ﷺ পর শ্রেষ্ঠ ও বর্ষীয়ান সাহাবীগণ কর্তৃক কোন পদ্ধতিকে কার্যকর করা একথাই প্রমাণ পেশ করে যে, নবী করীম ﷺ উম্মাতের ঐ পদ্ধতির ওপরই রেখে গিয়েছিলেন। এবার দেখুন ছবির ব্যাপারে এই পবিত্র দলটির আচরণ কিরূপ ছিলঃ قَالَ عُمَرُ رضى الله عنه إِنَّا لاَ نَدْخُلُ كَنَائِسَكُمْ مِنْ أَجْلِ التَّمَاثِيلِ الَّتِى فِيهَا الصُّوَرَ-(بخارى , كتاب الصلوة) “হযরত উমর (রা.) খৃস্টানদের বলেন, আমরা তোমাদের গীর্জায় প্রবেশ করবো না, কারণ তার মধ্যে ছবি রয়েছে।” (বুখারী, সালাত অধ্যায়) كان ابن عباس يصلى فى بيعة الابيعة فيها تماثيل- “ইবনে আব্বাস (রা.) গীর্জায় নামায পড়ে নিতেন কিন্তু এমন কোন গীর্জায় পড়তেন না যার মধ্যে ছবি থাকতো।” (বুখারী, সালাত অধ্যায়) عَنْ أَبِى الْهَيَّاجِ الأَسَدِىِّ قَالَ لِى عَلِىُّ أَلاَّ أَبْعَثُكَ عَلَى مَا بَعَثَنِى عَلَيْهِ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم أَنْ لاَ تَدَعَ تِمْثَالاً إِلاَّ طَمَسْتَهُ وَلاَ قَبْرًا مُشْرِفًا إِلاَّ سَوَّيْتَهُ ولاصورة الاطمستها- “আবুল হাইয়াজ আসাদী বলেন, হযরত আলী (রা.) আমাকে বলেছেন, রসূলুল্লাহ ﷺ আমাকে যে অভিযানে পাঠিয়েছিলেন আমি কি তোমাকে সেখানে পাঠাবো না? আর তা হচ্ছে এই যে, তুমি মূর্তি না ভেঙ্গে ছাড়বে না, কোন উঁচু কবর মাটির সমান না করে ছেড়ে দেবে না এবং কোন ছবি নিশ্চিহ্ন না করে ছাড়বে না।” (মুসলিম জানাযাহ অধ্যায় এবং নাসাঈ জানাযাহ অধ্যায়) عَنْ حَنَشٍ الْكِنَانِىِّ عَنْ عَلِىٍّ أَنَّهُ بَعَثَ عَامِلَ شُرْطَتِهِ فَقَالَ لَهُ أَتَدْرِى عَلَى مَا أَبْعَثُكَ ؟ عَلَى مَا بَعَثَنِى عَلَيْهِ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم أَنْ أَنْحَتَ كُلَّ صُورَةً وَأَنْ أُسَوِّىَ كُلَّ قَبْرٍ- “হানশুল কিনানী বলেন, হযরত আলী (রা.) তাঁর পুলিশ বিভাগের কোতায়ালকে বলেন, তুমি জানো আমি তোমাকে কোন অভিযানে পাঠাচ্ছি? এমন অভিযানে যাতে রসূলুল্লাহ ﷺ আমাকে পাঠিয়েছিলেন। তা হচ্ছে এই যে, প্রত্যেকটি ছবি নিশ্চিহ্ন করে দাও এবং প্রত্যেকটি কবরকে জমির সাথে মিশিয়ে দাও।” (মুসনাদে আহমাদ)

এই প্রমাণিত ইসলামী বিধানকে ইসলামী ফকীহগণ মেনে নিয়েছেন এবং তাঁরা একে ইসলামী আইনের একটি ধারা গণ্য করেছেন। কাজেই আল্লামা বদরুদ্দীন “আইনী তাওযীহ” এর বরাত দিয়ে লিখছেনঃ

“আমাদের সহযোগীগণ (অর্থাৎ হানাফী ফকীহগণ) এবং অন্যান্য ফকীহগণ বলেন, কোন জীবের ছবি আঁকা কেবল হারামই নয় বরং মারাত্মক পর্যায়ের হারাম এবং কবীরাহ গোনাহের অন্তর্ভুক্ত। অংকনকারী হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য অথবা অন্য কোন উদ্দেশ্যে তা তৈরি করলেও সর্বাবস্থায় তা হারাম। কারণ এতে আল্লাহর সৃষ্টিকর্মের সাথে সাদৃশ্য রয়েছে। অনুরূপভাবে ছবি কাপড়ে, বিছানায়, দীনারে বা দিরহামে অথবা পয়সায় কিংবা কোন পাত্রে বা দেয়ালে যেখানেই অংকন করা হোক না কেন তা হারাম। তবে জীব ছাড়া অন্য কোন জিনিস যেমন গাছ পালা ইত্যাদির ছবি অংকন করা হারাম নয়। এ সমস্ত ব্যাপারে ছবির ছায়াধারী হবার বা না হবার মধ্যে কোন ফারাক নেই। এ অভিমতই প্রকাশ করেছেন ইমাম মালেক (রা.), ইমাম সুফিয়ান সওরী (রা.) ইমাম আবু হানীফা (রা.) এবং অন্যান্য উলামা। কাযী ঈয়ায বলেন, মেয়েদের খেলনা পুতুল এর আওতা বহির্ভূত। কিন্তু ইমাম মালেক (রা.) এগুলো কেনাও অপছন্দ করতেন।” (উমদাতুল কারী ২২ খণ্ড, ৭০ পৃষ্ঠা, এ অভিমতকেই ইমাম নববী মুসলিমের ব্যাখ্যায় আরো বেশী বিস্তারিত আকারে উদ্ধৃত করেছেন। দেখুন শারহে নববী, মিসরে মুদ্রিত, ১৪ খন্ড, ৮১-৮২ পৃষ্ঠা)

এতো গেলো ছবি আঁকা সম্পর্কিত বিধান। এখন থাকে অন্যের আঁকা ছবি ব্যবহার করার বিষয়। এ ব্যাপারে আল্লামা ইবনে হাজার অবকালানী মুসলিম ফকীহগণের অভিমত এভাবে ব্যক্ত করেছেনঃ

“মালেকী ফকীহ ইবনে আরাবী বলেন, যে ছবির ছায়া তার হারাম হওয়ার ব্যাপারে তো ‘ইজমা’ অনুষ্ঠিত হয়েছে–চাই তা অসম্মানজনকভাবে রাখা হোক বা না হোক। একমাত্র মেয়েদের খেলার পুতুল এ ইজমার বাইরে থাকে।—ইবনে আরাবী একথাও বলেন, যে ছবির ছায়া হয় না তা যদি তার নিজের অবস্থায় অপরিবর্তিত থাকে (অর্থাৎ আয়নার প্রতিচ্ছায়ার মতো না হয় বরং ছাপানো ছবির মতো স্থায়ী ও অনড় হয়) তাহলে তাও হারাম –তাকে হীনতার সাথে রাখা হোক বা না হোক। তবে হ্যাঁ, যদি তার মাথা কেটে দেয়া হয় অথবা তার অংশগুলো আলাদা করে দেয়া হয়, তাহলে তার ব্যবহার বৈধ।—-ইমামুল হারামাইন একটি অভিমত উদ্ধৃত করেছেন। সেটি হচ্ছে এই যে, পর্দা বা বালিশের ওপর যদি কোন ছবি আঁকা থাকে, তাহলে তা ব্যবহারের অনুমতি আছে কিন্তু দেয়াল বা ছাদের গায়ে লাগানো ছবি অবৈধ। কারণ এ অবস্থায় ছবি মর্যাদা লাভ করে। পক্ষান্তরে পর্দা ও বালিশে ছবি অসম্মানজনক অবস্থায় থাকবে।—-ইবনে আবী শাইবা ইকরামা (রা.) থেকে উদ্ধৃত করেছেন, তাবে’ঈদের যুগের আলেমগণ এ অভিমত পোষণ করতেন যে, বিছানায় ও বালিশে ছবি, থাকলে তা তার জন্য লাঞ্ছনাকর হয়। তাছাড়া তাদের এ চিন্তাও ছিল যে, উচু জায়গায় যে ছবিই লাগানো হয় হারাম এবং পদতলে যাকে পিষ্ট করা হয় তা জায়েয। এ অভিমত ইবনে সীরীন, সালেম ইবনে আবদুল্লাহ, ইকরামা ইবনে খালেদ এবং সাঈদ ইবনে জুবাইর থেকেও উদ্ধৃত হয়েছে। (ফাতহুল বারী, ১০ খণ্ড, ৩০০ পৃষ্ঠা)

এ বিস্তারিত আলোচনা থেকে একথা ভালোভাবেই পরিষ্কার হয়ে যায় যে, ইসলামে ছবি হারাম হওয়ার ব্যাপারটি কোন মতদ্বৈততামূলক বা সন্দেহযুক্ত বিষয় নয়। বরং নবীর (সা.) সুস্পষ্ট উক্তি, সাহাবায়ে কেরামের কর্মধারা এবং মুসলিম ফকীহগণের সর্বসম্মত ফতোয়ার ভিত্তিতে এটি একটি স্বীকৃত আইন। বিদেশী ও বিজাতীয় সভ্যতা-সংস্কৃতি প্রভাবিত কিছু লোকের চুলচেরা অপব্যাখ্যা তাতে কোন পরিবর্তন ঘটাতে পারে না।

এ প্রসঙ্গে আরো কয়েকটি কথাও অনুবাধন করতে হবে। এর ফলে আর কোন প্রকার বিভ্রান্তির অবকাশ থাকবে না।

কেউ কেউ ফটো ও হাতে আঁকা ছবি মধ্যে পার্থক্য করার চেষ্টা করেন। অথচ শরীয়াত ছবিকেই হারাম করেছে, ছবির কোন বিশেষ পদ্ধতিকে হারাম করেনি। ফটো ও হাতে আঁকা ছবির মধ্যে ছবি হবার দিক দিয়ে কোন পার্থক্য নেই। তাদের মধ্যে যা কিছু পার্থক্য তা কেবলমাত্র ছবি নির্মাণ পদ্ধতির দিক দিয়েই আছে এবং এদিক দিয়ে শরীয়াত স্বীয় বিধানের মধ্যে কোন পার্থক্য করেনি।

কেউ কেউ যুক্তি দিয়ে থাকেন, ইসলামে ছবি হারাম করা হয়েছিল শুধুমাত্র শিরক ও মূর্তি পূজা রোধ করার জন্য। আর এখন তার কোন ভয় নেই। কাজেই এখন এ নির্দেশ কার্যকর না থাকা উচিত। কিন্তু এ যুক্তি সঠিক নয়। প্রথমত হাদীসে কোথাও একথা বলা হয়নি যে, কেবলমাত্র শিরক মূর্তিপূজার বিপদ থেকে রক্ষা করার জন্য ছবিকে হারাম করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত এ দাবীও একেবারেই ভিত্তিহীন যে, বর্তমানে দুনিয়ায় শিরক ও মূর্তিপূজার অবসান ঘটেছে। আজ এই উপমহাদেশেই কোটি কোটি মুশরিক ও মূর্তিপূজারী রয়ে গেছে। দুনিয়ার বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্নভাবে শিরক হচ্ছে। খৃস্টানদের মতো কিতাবধারীগণও আজ হযরত ঈসা (আ), হযরত মারয়াম (আ) ও তাদের বহু মনীষীর মূর্তি ও ছবির পূজা করছে। এমনকি মুসলমানদের একটি বড় অংশ ও সৃষ্টিপূজার বিপদ থেকে রেহাই পেতে পারেনি।

কেউ কেউ বলেন, কেবলমাত্র মুশরিকী ধরনের ছবিগুলোই নিষিদ্ধ হওয়া উচিত। অর্থাৎ এমনসব ব্যক্তির ছবি ও মূর্তি যাদেরকে উপাস্য বানিয়ে নেয়া হয়েছে। বাদবাকি অন্যান্য ছবি ও মূর্তি হারাম হবার কোন কারণ নেই। কিন্তু এ ধরনের কথা যারা বলেন তারা আসলে শরীয়াত প্রণেতার উক্তি ও বিধান থেকে আইন আহরণ করার পরিবর্তে নিজেরাই নিজেদের শরীয়াত প্রণেতা হয়ে বসেছেন। তারা জানেন না, ছবি কেবলমাত্র শিরক ও মূর্তিপূজার কারণ হয় না বরং দুনিয়ায় আরো অনেক ফিতনারও কারণ হয়েছে এবং হয়ে চলছে। যেসব বড় বড় উপকরণের মাধ্যমে রাজা বাদশাহ, স্বৈরাচারী ও রাজনৈতিক নেতাদের শ্রেষ্টত্বের প্রভাব সাধারণ মানুষের মগজে বসিয়ে দেবার চেষ্টা করা হয়েছে ছবি তার অন্যতম। দুনিয়ায় অশ্লীলতা ও যৌনতার বিস্তারের জন্যেও ছবিকে ব্যাপক হারে ব্যবহার করা হয়েছে এবং আজকের যুগে এ ফিতনাটি অন্য যে কোন সময়ের তুলনায় অনেক বেশী অগ্রসরমান। বিভিন্ন জাতির মধ্যে ঘৃণা ও শত্রুতার বীজ বপন, বিপর্যয় ও দাঙ্গা-হাঙ্গামা সৃষ্টি এবং সাধারণ মানুষকে নানাভাবে বিভ্রান্ত করার জন্য ছবিকে ব্যাপক হারে ব্যবহার করা হয় এবং আজকের যুগে এর প্রচলন হয়েছে সবচেয়ে বেশী। তাই শরীয়াত প্রণেতা কেবলমাত্র মূর্তিপূজা প্রতিরোধের জন্য ছবি হারাম হবার হুকুম দিয়েছেন, একথা মনে করা আসলেই ভুল। শরীয়াত প্রণেতা শর্তহীনভাবে জীবের ছবি আঁকা নিষিদ্ধ করেছেন। আমরা নিজেরা যদি শরীয়াত প্রণেতা নই বরং শরীয়াত প্রণেতার অনুসারী হয়ে থাকি, তাহলে আমাদের শর্তহীনভাবে এ কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে। আমরা নিজেদের পক্ষ থেকে হুকুমের কোন কার্যকারণ বের করে সে দৃষ্টিতে ছবি হারাম এবং কিছু ছবি হালাল গণ্য করতে থাকবো, এটা আমাদের জন্য কোনক্রমেই বৈধ নয়।

কিছু লোক আপাত দৃষ্টিতে একেবারেই ‘অক্ষতিকর ধরনের কতিপয় ছবির দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, এগুলোতে ক্ষতি কি? এগুলোতে শিরক, অশ্লীলতা বিপর্যয় সৃষ্টি, রাজনৈতিক প্রচারণা এবং এমনি ধরনের অন্যান্য ক্ষতিকর বিষয় থেকে পুরোপুরি মুক্ত। এক্ষেত্রে এগুলোর নিষিদ্ধ হবার কারণ কি হতে পারে? এ ব্যাপারে লোকেরা আবার সেই একই ভুল করে অর্থাৎ প্রথমে হুকুমের কার্যকারণ নিজেরা বের করে এবং তারপর প্রশ্ন করতে থাকে, যখন অমুক জিনিসের মধ্যে এ কার্যকারণ পাওয়া যাচ্ছে না তখন তা নাজায়েয হবে কেন? এছাড়াও তারা ইসলামী শরীয়াতের এ নিয়মটিও বোঝে না যে, শরীয়াতে হালাল ও হারামের মধ্যে এমন কোন অস্পষ্ট সীমারেখা কায়েম করে না যা থেকে মানুষ এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে না যে সে বৈধতার সীমার মধ্যে কতদূরে অবস্থান করছে এবং কোথায় এ সীমা অতিক্রম করে গেছে। বরং শরীয়াত এমন পার্থক্য রেখা টেনে দেয় যাকে প্রত্যেক ব্যক্তি উন্মুক্ত দিবালোকের মতো প্রত্যক্ষ করতে পারে। জীবের ছবি হারাম এবং অজীবের ছবি হালাল–ছবির ব্যাপারে এ পার্থক্য রেখা পুরোপুরি সুস্পষ্ট। এ পার্থক্য রেখার মধ্যে কোন প্রকার সংশয়ের অবকাশ নেই। যে ব্যক্তি শরীয়াতের বিধান মেনে চলতে চায় তার জন্য কোন্ জিনিসটি হারাম এবং কোন্ জিনিসটি হালাল তা সে পরিষ্কারভাবে জানতে পারে। কিন্তু জীবের ছবির মধ্যে যদি কোনটিকে জায়েয ও কোনটিকে নাজায়েয গণ্য করা হয় তাহলে উভয় ধরনের ছবির বৃহত্তর তালিকা দিয়ে দেবার পরও বৈধতা ও অবৈধতার সীমারেখা কোনদিনও সুস্পষ্ট হতে পারে না এবং অসংখ্য ছবি এমন থেকে যাবে যেগুলোকে বৈধতার সীমারেখার মধ্যে না বাইরে মনে করা হবে সে ব্যাপারে সন্দেহ থেকে যাবে। এ ব্যাপারটি ঠিক তেমনি যেমন মদের ব্যাপারে ইসলামের হুকুম হচ্ছে এ থেকে একেবারেই দূরে অবস্থান করতে হবে। এটি এ ব্যাপারে একটি সীমারেখা নির্ধারণ করে দেয়। কিন্তু যদি বলা হয়, এর এমন একটি পরিমাণ ব্যবহার করা থেকে দূরে থাকা উচিত যার ফলে নেশার সৃষ্টি হয়, তাহলে হালাল ও হারামের মধ্যে কোন জায়গায়ও পার্থক্য রেখা প্রতিষ্ঠিত করা যেতে পারবে না এবং কি পরিমাণ মদ পান করা যাবে এবং কোথায় গিয়ে থেমে যেতে হবে, এ ফায়সালা কোন ব্যক্তিই করতে পারবে না। (আরো বেশী বিস্তারিত আলোচনার জন্য দেখুন, রাসায়েল ও মাসায়েল , ১ খণ্ড, ১৫২-১৫৫ পৃষ্ঠা)
# এ থেকে জানা যায়, হযরত সুলাইমান (আ) এর রাজগৃহে বিরাট আকারে মেহমানদের আপ্যায়ন করা হতো। বড় বড় হাওযের সমান গামলা তৈরি করা হয়েছিল। তার মধ্যে লোকদের জন্য খাবার উঠিয়ে রাখা হতো। বৃহদাকার ডেগ বানিয়ে রাখা হয়েছিল। তার মধ্যে এক সঙ্গে হাজার হাজার মানুষের খাদ্য পাকানো হতো।
# কৃতজ্ঞ বান্দাদের মতো কাজ করো। যে ব্যক্তি মুখেই কেবল অনুগ্রহকারীর অনুগ্রহ স্বীকার করে কিন্তু তার অনুগ্রহকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ব্যবহার করে, তার নিছক মৌখিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ অর্থহীন। আসল কৃতজ্ঞ বান্দা হচ্ছে এমন এক ব্যক্তি যে তার মুখেও অনুগ্রহের স্বীকৃত দেয় এবং এ সঙ্গে অনুগ্রহকারীর অনুগ্রহকে তার ইচ্ছা মতো কাজেও ব্যবহার করে।
# মূল শব্দ হচ্ছে, تبينت الجن –এ ব্যাক্যাংশের একটি অনুবাদ আমি ওপরে করেছি। এর আরেকটি অনুবাদ এও হতে পারেঃ জিনদের অবস্থা পরিষ্কার হয়ে গেলো অথবা উন্মুক্ত হয়ে গেলো। প্রথম অবস্থায় এর অর্থ হবে, খোদ জিনেরাই জানতে পারবে যে, অদৃশ্য বিষয় জানার ব্যাপারে তাদের ধারণা ভুল। দ্বিতীয় অবস্থায় এর অর্থ হবে, সাধারণ মানুষেরা যারা জিনদেরকে অদৃশ্যজ্ঞানী মনে করতো তাদের কাছে একথা পরিষ্কার হয়ে গেল যে, জিনেরা কোন অদৃশ্য বিষয়ের জ্ঞান রাখে না।
# বর্তমান যুগের কোন কোন মুফাসসির এর ব্যাখ্যা এভাবে করেছেনঃ হযরত সুলাইমানের (আ) ছেলে রাহুব্’আম যেহেতু ছিলেন অযোগ্য, বিলাশী ও তোষামোদকারী মোসাহেব পরিবৃত, তাই নিজের মহিমান্বিত পিতার ইন্তেকালের পর তার ওপর যে মহান দায়িত্ব এসে পড়েছিল তা পালন করতে তিনি সক্ষম হননি। তার ক্ষমতা গ্রহণের কিছুদিন পরেই রাষ্ট্রব্যবস্থা পতনমুখী হয় এবং আশপাশের সীমান্ত এলাকার যেসব উপজাতিকে (অর্থাৎ জিন) হযরত সুলাইমান (আ) তাঁর প্রবল পরাক্রমের মাধ্যমে নিজের দাসে পরিণত করে রেখেছিলেন তারা সবাই নিয়ন্ত্রণমুক্ত হয়ে যায়। কিন্তু এ ব্যাখ্যা কোনক্রমেই কুরআনের শব্দাবলীর সাথে সামঞ্জস্যশীল নয়। কুরআনের শব্দাবলী আমাদের সামনে যে নকশা পেশ করছে তা হচ্ছে এই যে, হযরত সুলাইমান এমন সময় মৃত্যবরণ করেন যখন তিনি একটি লাঠিতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে বা বসে ছিলেন। এ লাঠির কারণে তাঁর নিষ্প্রাণ দেহ স্বস্থানে প্রতিষ্ঠিত ছিল এবং তিনি জীবিত আছেন মনে করেই জিনেরা তাঁর কাজ করে চলছিল। শেষে যখন লাঠিতে ঘূন ধরে গেল এবং তা ভেতর থেকে অন্তসারশূন্য হয়ে গেল তখন তাঁর মরদেহ মাটিতে গড়িয়ে পড়লো এবং জিনেরা জানতে পারলো তিনি মারা গেছেন। এই পরিষ্কার ও দ্ব্যর্থহীন ঘটনা বর্ণনার গায়ে এ ধরনের অর্থের প্রলেপ লাগাবার কি যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকতে পারে যে, ঘূন অর্থ হচ্ছে হযরত সুলাইমানের ছেলের অযোগ্যতা, লাঠি অর্থ হচ্ছে তাঁর কর্তৃত্ব ক্ষমতা এবং তাঁর মৃতদেহ পড়ে যাবার মানে হচ্ছে তাঁর রাজ্য টুকরো হয়ে যাওয়া? এ বিষয়টি বর্ণনা করাই যদি আল্লাহর উদ্দেশ্য হতো তাহলে কি এজন্য সাবলীল আরবী ভাষায় শব্দের আকাল হয়ে গিয়েছিল? এভাবে হেরফের করে তা বর্ণনা করার কি কোন প্রয়োজন ছিল? এ ধরনের হেঁয়ালি ও ধাঁধার ভাষা কুরআনের কোথায় ব্যবহার হয়েছে? আর এ বাণী প্রথমে সে যুগের সাধারণ আরবদের সামনে যখন নাযিল হয় তখন তারা কিভাবে এ ধাঁধার মর্মোদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছিলেন?

তারপর এ ব্যাখ্যার সবচেয়ে বেশী অদ্ভুত বিষয়টি হচ্ছে এই যে, এখানে জিন বলতে বুঝানো হয়েছে সীমান্ত উপজাতিগুলোকে, যাদেরকে হযরত সুলাইমান নিজের সেবাকর্মে নিযুক্ত করে রেখেছিলন। প্রশ্ন হচ্ছে, এ উপজাতিগুলোর মধ্যে কে অদৃশ্যজ্ঞানের দাবীদার ছিল এবং মুশরিকরা কাকে অদৃশ্য জ্ঞানী মনে করতো? আয়াতের শেষের শব্দগুলো একটু মনোযোগ সহকারে পড়লে যে কোন ব্যক্তি নিজেই দেখতে পারে, জিন বলতে এখানে অবশ্যই এমন কোন দল বুঝানো হয়েছে যারা নিজেরাই অদৃশ্যজ্ঞানের দাবীদার ছিল অথবা লোকেরা তাদেরকে অদৃশ্যজ্ঞানী মনের করতো এবং তাদের অদৃশ্য বিষয়ক অজ্ঞতার রহস্য এ ঘটনাটিই উদঘাটন করে দিয়েছে যে, তারা হযরত সুলাইমানকে জীবিত মনে করেই তাঁর খেদমতে নিযুক্ত থাকে অথচ তাঁর ইন্তেকাল হয়ে গিয়েছিল। কুরআনের এই সুস্পষ্ট বর্ণনা দেবার পর জিন বলতে সীমান্ত উপজাতিদেরকে বুঝানো হয়েছে এই মতটি পুনরবিবেচনা করা একজন ঈমানদার ব্যক্তির জন্য যথেষ্ট ছিল। কিন্তু বস্তুবাদী দুনিয়ার সামনে জিন নামের একটি অদৃশ্য সৃষ্টির অস্তিত্ব মেনে নিতে যারা লজ্জা অনুভব করছিলেন তারা এ কুরআনের এ সুস্পষ্ট বর্ণনার পর নিজেদের জটিল মনগড়া ব্যাখ্যার ওপরই জোর দিতে থাকেন। কুরআনের বিভিন্ন স্থানে আল্লাহ‌ বলেছেন, আরবের মুশকিরা জিনদেরকে আল্লাহর সাথে শরীক করতো, তাদেরকে আল্লাহর সন্তান মনে করতো এবং তাদের কাছে আশ্রয় চাইতঃ

وَجَعَلُوا لِلَّهِ شُرَكَاءَ الْجِنَّ وَخَلَقَهُمْ

“আর তারা জিনদেরকে আল্লাহর সাথে শরীক করে নিয়েছে অথচ তিনি তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন।” (আল আন’আম, ১০০)

وَجَعَلُوا بَيْنَهُ وَبَيْنَ الْجِنَّةِ نَسَبًا “আর তারা আল্লাহ‌ ও জিনদের মধ্যে বংশগত সম্পর্ক কল্পনা করে নিয়েছে।”

(আস সাফফত, ১৫৮) وَأَنَّهُ كَانَ رِجَالٌ مِنَ الْإِنْسِ يَعُوذُونَ بِرِجَالٍ مِنَ الْجِنِّ

“আর ব্যাপার হচ্ছে, মানবজাতির মধ্য থেকে কিছু লোক জিনদের মধ্য থেকে কিছু লোকের কাছে আশ্রয় চাইতো।” (আল জিন, ৬)

তাদের এসব বিশ্বাসের মধ্যে একটি বিশ্বাস এও ছিল যে, তারা জিনদেরকে অদৃশ্য বিষয়ের জ্ঞান সম্পন্ন মনে করতো এবং অদৃশ্য বিষয় জানার জন্য জিনদের শরণাপন্ন হতো। এ বিশ্বাসটির অসারতা প্রমাণ করার জন্য আল্লাহ‌ এখানে এ ঘটনাটি শুনাচ্ছেন এবং এর উদ্দেশ্য হচ্ছে আরবের কাফেরদের মধ্যে এ অনুভূতি সৃষ্টি করা যে, তোমরা অনর্থক জাহেলিয়াতের মিথ্যা বিশ্বাসের ওপর জোর দিয়ে চলছো অথচ তোমাদের এ বিশ্বাসগুলো একেবারেই ভিত্তিহীন। (আরো বিস্তারিত ব্যাখ্যার জন্য সামনের দিকে ৬৩ টীকা দেখুন)
# এ বর্ণনার ধারাবাহিকতা বুঝতে হলে প্রথম রুকু’র বিষয়বস্তু সামনে রাখতে হবে। সেখানে বলা হয়েছেঃ আরবের কাফেররা আখেরাতের আগমনকে বুদ্ধি ও যুক্তি বিরোধী মনে করতো এবং যে রসূল এ আকীদা পেশ করতেন তাঁর ব্যাপারে প্রকাশ্যে বলতো যে এ ধরনের অদ্ভূত কথা যে ব্যক্তি বলে সে পাগল হতে পারে অথবা জেনে বুঝে মিথ্যাচারে লিপ্ত হয়েছে। এর জবাবে আল্লাহ‌ প্রথমে কয়েকটি বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তি পেশ করেন। ৭ , ৮ ও ১২ টীকায় আমি এগুলো পরিষ্কারভাবে তুলে ধরেছি। এরপর দ্বিতীয় রুকু’তে হযরত দাউদ ও হযরত সুলাইমানের এবং তারপর সাবার কাহিনীকে একটি ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। ধরাপৃষ্ঠে মানবজাতির নিজের জীবন বৃত্তান্তই কর্মফল বিধানের সাক্ষ্য দিয়ে যাচ্ছে–একথাটি অনুধাবন করানোই ছিল এর উদ্দেশ্য। নিজের ইতিহাস মনোযোগ সহকারে পর্যালোচনা করলে মানুষ নিজেই একথা জানতে পারে যে, এ দুনিয়া এমন কোন নৈরাজ্যময় জগত নয় যার সমগ্র কারখানাটি নিজের ইচ্ছামতো খামখেয়লীভাবে চলে। বরং এমন এক আল্লাহ‌ এখানে শাসন কর্তৃত্ব পরিচালনা করছেন যিনি সবকিছু শুনেন এবং দেখেন। তিনি কৃতজ্ঞতার পথ অবলম্বনকারীদের সাথে এক ধরনের ব্যবহার করেন এবং অকৃতজ্ঞ ও নিয়ামত অস্বীকারকারীদের সাথে সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যবহার করেন। যে আল্লাহ‌র রাষ্ট্র ব্যবস্থা এ ধরনের নিয়মের অধীন। তাঁর রাজ্যে পুণ্য ও পাপের পরিণাম কখনো এক হতে পারে না। যদি কেউ শিক্ষা নিতে চায় তাহলে এ ইতিহাস থেকেই এ শিক্ষা নিতে পারে। তাঁর ইনসাফ ও ন্যায় নীতির অনিবার্য দাবী হচ্ছে এই যে, এমন একটি সময় আসতেই হবে যখন সৎকাজের পূর্ণ প্রতিদান এবং অসৎকাজের পুরোপুরি বদলা দেয়া হবে।
# এ বিষয়ের নিদর্শন যে, যা কিছু তারা লাভ করেছে তা কারো দান, তাদের নিজেদের উদ্ভাবন নয়। আর এ বিষয়েরও নিদর্শন যে, তাদের বন্দেগী ও ইবাদাত এবং কৃতজ্ঞতা ও প্রশংসার অধিকারী হচ্ছেন এমন এক আল্লাহ‌ যিনি তাদেরকে নিয়ামত দান করেছেন। ঐ নিয়ামত দানের ব্যাপারে যাদের কোন অংশ নেই তারা ইবাদাত ও কৃতজ্ঞতা লাভের অধিকারী নয়। আবার এ বিষয়েরও নিদর্শন যে, তাদের সম্পদ অবিনশ্বর নয় বরং এভাবে তা এসেছে ঠিক তেমনিভাবে চলে যেতেও পারে।
# এর অর্থ এ নয় যে, সাবা দেশে মাত্র দু’টিই বাগান ছিল। বরং এর অর্থ হচ্ছে, সমগ্র সাবা রাজ্য শ্যামল সবুজ ক্ষেত ও বনানীতে পরিপূর্ণ ছিল। তার যে কোন জাগয়ায় দাঁড়ালে দেখা যেতো ডাইনেও বাগান এবং বাঁয়েও বাগান।
# বন্দেগী ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার পরিবর্তে তারা নাফরমানি ও নিমকহারামির পথ অবলম্বন করে।
# মূলে বলা হয়েছে ‍سَيْلَ الْعَرِمِ দক্ষিণ আরবের ভাষায় ‘আরিম’ শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে ‘আরিমন’ (عرمن) থেকে। এর অর্থ হচ্ছে “বাঁধ।” ইয়ামনের প্রাচীন ধ্বংসাবশেষের মধ্যে সম্প্রতি যেসব প্রাচীন শিলালিপির সন্ধান পাওয়া গেছে সেগুলোতে এ শব্দটি এ অর্থে ব্যাপক হারে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন ৫৪২ বা ৫৪৩ খৃস্টাব্দের একটি শিলালিপি সম্পর্কে বলা যায়। ইয়ামনের হাবশী গভর্ণর আবরাহা “সাদ্দি মারিব” এর সংস্কার কাজ শেষ করার পর এটি স্থাপন করেন। এতে তিনি বারবার এ শব্দটি বাঁধ অর্থে ব্যবহার করেন। কাজেই “সাইলুল আরিম” মানে হচ্ছে বাঁধ ভেঙ্গে যে বন্যা আসে।
# “সাইলুল আরিম” আসার ফলে সাবা এলাকা ধ্বংস হয়ে যায়। সাবার অধিবাসীরা পাহাড়ের মধ্যে বাঁধ বেঁধে যেসব খাল ও পানি প্রবাহের সৃষ্টি করেছিল তা সব নষ্ট হয়ে যায় এবং পানি সেচের সমগ্র ব্যবস্থা বিধ্বস্ত হয়। এরপর যে এলাকা এক সময় জান্নাতসদৃশ ছিল তা আগাছা ও জংগলে পরিপূর্ণ হয়ে যায় এবং সেখানে নিছক বন্য কুল ছাড়া আর আহারযোগ্য কিছু থাকেনি।
# “সমৃদ্ধ জনপদ” বলতে সিরিয়া ও ফিলিস্তীন বুঝানো হয়েছে। কুরআন মজীদে সাধারণভাবে এ গুনবাচক শব্দ দিয়ে এর উল্লেখ করা হয়েছে। (দৃষ্টান্ত স্বরূপ দেখুন আল আ’রাফ ১৩৭ আয়াত ; বনী ইসরাঈল ১ আয়াত এবং আল আম্বিয়া ৭১ ও ৮১ আয়াত ) “দৃশ্যমান জনপদ” হচ্ছে এমন সব জনবসতি যেগুলো সাধারণ রাজপথের পাশে অবস্থিত। কোন এক কোণায় আড়ালে অবস্থিত নয়। আবার এর এ অর্থও হতে পারে যে, এ জনবসতিগুলো বেশী দূরে দূরে অবস্থিত ছিল না বরং লাগোয়া ছিল। একটি জনপদের চিহ্ন শেষ হবার পর দ্বিতীয় জনপদ হয়ে যেতো।

একটি আন্দাজ অনুযায়ী ভ্রমনের দূরত্ব নির্ধারণ করার মানে হচ্ছে, ইয়ামন থেকে সিরিয়া পর্যন্ত পুরা সফর অবিচ্ছিন্ন জনবসতিপূর্ণ এলাকার মধ্য দিয়ে পরিচালিত হতো, এর এক মঞ্জিল থেকে আর এক মঞ্জিলের দূরত্ব নির্ধারিত ও জানা ছিল। জনবসতিপূর্ণ এলাকা সফর ও অনাবাদ মরু এলাকা সফরের মধ্যে এ পার্থক্য থাকে। মরুভুমির মধ্যে মুসাফির যতক্ষণ চায় চলে এবং যতক্ষণ চলে কোথাও এক জায়গায় ডেরা বাঁধে। পক্ষান্তরে জনবসতিপূর্ণ এলাকায় পথের এক জনপদ থেকে আর এক জনপদ পর্যন্ত এলাকার মধ্যকার দূরত্ব নির্ধারিত ও জানা থাকে। পথিক পথে কোন্ কোন্ জায়গায় থামবে, দুপুরে কোথায় বিশ্রাম নেবে এবং কোথায় রাত কাটাবে এর পূর্ণ কর্মসূচী পূর্বাহ্ণেই তৈরি করে নিতে পারে।
# তারা যে মুখে এ দোয়া উচ্চারণ করেছিল, এমনটি অপরিহার্য নয়। আসলে যে ব্যক্তিই আল্লাহ‌ প্রদত্ত নিয়ামতের প্রতি অকৃতজ্ঞ হয় সে যেন তার অবস্থা ও কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে একথা বলে, হে আল্লাহ!‌ আমি এ নিয়ামতগুলোর যোগ্য নই। অনুরূপভাবে যে জাতি আল্লাহর অনুগ্রহ থেকে অযথা সুবিধা লাভ করে সে যেন নিজের রবের কাছে দোয়া করে, হে আমাদের বর! এ অনুগ্রহগুলো আমাদের থেকে ছিনিয়ে নাও, কারণ আমরা এর যোগ্য নই।

এছাড়াও رَبَّنَا بَاعِدْ بَيْنَ أَسْفَارِنَا (হে আল্লাহ! আমাদের সফর দীর্ঘায়িত করে দাও) —এ শব্দগুলো থেকে কিছুটা একথাও প্রতীয়মান হয় যে, সম্ভবত সাবা জাতির চোখে তাদের বিপুল জনসংখ্যা বিরক্তিকর মনে হয়েছিল এবং অন্যান্য জাতির মতো তারাও নিজেদের বর্ধিত জনসংখ্যাকে সংকট মনে করে জন্ম নিয়্ন্ত্রণের চেষ্টা চালিয়েছিল।
# সাবা জাতি এমনভাবে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় যে তাদের বিক্ষিপ্ততা ও বিশৃঙ্খলা প্রবাদে পরিণত হয়। আজও যদি আরববাসী কোন জাতির মধ্যকার বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্যের কথা আলোচনা করে তাহলে বলেتفرقوا ايدى سبا “তারা তো এমন নৈরাজ্যের শিকার হয়েছে যেমন সাবা জাতি নৈরাজ্যের শিকার হয়েছিল।” আল্লাহর পক্ষ থেকে যখন অনুগ্রহের অবসান ও অবক্ষয়ের যুগ শুরু হয় তখন সাবার বিভিন্ন গোত্র নিজেদের স্বদেশ ত্যাগ করে আববের বিভিন্ন এলাকায় চলে যায়। গাসসানীরা জর্দ্দান ও সিরিয়ার দিকে চলে যায়। আওস ও খাযরাজ গোত্র ইয়াসরিবে বসতি স্থাপন করে। খুযা’আহ গোত্র জেদ্দার নিকটবর্তী তিহামা এলাকায় আবাস গড়ে তোলে। আযদ গোত্র ওমানে গিয়ে ঠাঁই নেয়। লাখম, জযাম এবং কিন্দাও বেরিয়ে পড়তে বাধ্য হয়। এমনকি শেষ পর্যন্ত সাবা নামে কোন জাতিই আর দুনিয়ার বুকে বেঁচে থাকেনি। কেবলমাত্র গল্প কাহিনীতেই তার আলোচনা থেকে গেছে।
# এ প্রেক্ষাপটে সবরকারী ও কৃতজ্ঞ বলতে এমন ব্যক্তি বা দল বুঝায় যারা আল্লাহর পক্ষ থেকে নিয়ামত লাভ করে অহংকারে মেতে ওঠে না, সমৃদ্ধিশালী হয়ে আত্মম্ভরী হয় না এবং যে আল্লাহ‌ এসব কিছু দান করেছেন তাকে ভুলে যায় না। এ ধরনের লোকেরা যারা উন্নতি ও অগ্রগতির সুযোগ পেয়ে নাফরমানির পথ অবলম্বলন করে এবং অশুভ পরিণামের সম্মুখীন হয় তাদের অবস্থা থেকে অনেক কিছু শিক্ষা নিতে পারে।
# ইতিহাস থেকে জানা যায়, প্রাচীনকাল থেকে সাবা জাতির মধ্যে এমন একটি দল ছিল যারা অন্য উপাস্যদেরকে মেনে চলার পরিবর্তে এক আল্লাহকে মেনে চলতো। বর্তমান যুগের প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার মাধ্যমে ইয়ামনের প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ থেকে যেসব শিলালিপি উদ্ধার করা হয় তার মধ্য থেকে কোন কোনটি এই স্বল্প সংখ্যক দলের অস্তিত্ব চিহ্নিত করে। খৃঃ পূঃ ৬৫০ অব্দের কাছাকাছি সময়ের কোন কোন শিলালিপি একথা বলে যে, সাবা রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে এমন কিছু ইবাদাত গৃহ স্থাপিত ছিল যেগুলো আসমানি বা আসমান ওয়ালার (অর্থাৎ আসমানের রব) ইবাদাতের জন্য নির্দিষ্ট ছিল। কোন কোন স্থানে এ উপাস্যের নাম ملكن ذوسموى (আকাশসমুহের মালিক বাদশাহ) লেখা হয়েছে। এ দলের লোকেরা এক নাগাড়ে শত শত বছর ইয়ামনে বাস করে থাকে। কাজেই ৩৭৮ খৃস্টাব্দে একটি শিলালিপিতে اله ذوسموى (আকাশসমূহের ইলাহ) নামে একটি ইবাদাত গৃহ নির্মাণের উল্লেখ দেখা যায়। তারপর ৪৬৫ খৃস্টাব্দের একটি শিলালিপিতে এ শব্দগুলো পাওয়া যায়ঃ بنصر وردا الهن بعل سمعين وارضين (অর্থাৎ এমন খোদার মদদ ও সাহায্য সহকারে যিনি আকাশ সমূহ ও পৃথিবীর মালিক) একই সময়ের ৪৫৮ খৃস্টাব্দের আর একটি শিলালিপিতে এই খোদার জন্য “রহমান” শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। মুল শব্দ হচ্ছে بردا رحمنن (অর্থাৎ রহমানের সাহায্যে)।
# এ ক্ষমতা ইবলিসের ছিল না যে তারা আল্লাহর হুকুম মেনে চলতে চাচ্ছিল কিন্তু ইবলিস জোর করে তাদেরকে নাফরমানির পথে টেনে নিয়ে গেছে। আল্লাহ‌ তাকে যে শক্তি দিয়েছিলের তা কেবল এতটুকুই ছিল যে, সে তাদেরকে বিভ্রান্ত করতে এবং যারা তার পিছনে চলতে চায় তাদেরকে নিজের অনুসারী করতে পারে। যারা পরকাল মানে এবং যারা পরকালের আগমনের ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করে তাদের মধ্যকার পার্থক্য সুস্পষ্ট করার জন্য ইবলিসকে এ বিপথগামী করার সুযোগ দেয়া হয়েছে।

অন্য কথায় আল্লাহর এ বাণী এ সত্যটির সুস্পষ্ট করে তুলে ধরে যে, আখেরাত বিশ্বাস ছাড়া অন্য কোন জিনিসই এমন নেই যা এ দুনিয়ায় মানুষকে সঠিক পথে প্রতিষ্ঠিত রাখার গ্যারান্টি দিতে পারে। যদি কোন ব্যক্তি একথা না মানে যে, মৃত্যুর পর তাকে আবার জীবিত হতে হবে এবং আল্লাহর সামনে নিজের কাজের জন্য জবাবদিহি করতে হবে। তাহলে সে অবশ্যই পথ ভ্রষ্ট ও কুপথগামী হবে। কারণ যে দায়িত্বানুভূতি মানুষকে সঠিক পথে প্রতিষ্ঠিত রাখে তা তার মধ্যে আদৌ সৃষ্টিই হতে পারবে না। তাই শয়তান মানুষকে আখেরাত থেকে গাফিল করে দেয়। এটিই তার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার এবং এর সাহায্যেই সে মানুষকে নিজের ফাঁদে আটকে ফেলে। যে ব্যক্তি তার এ প্রতারণা জাল ছিন্ন করে বের হয়ে আসে সে কখনো নিজের আসল চিরন্তন জীবনের স্বার্থকে দুনিয়ার এ সাময়িক জীবনের স্বার্থে কুরবানী করে দিতে রাজি হবে না। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি শয়তানের প্রতারণায় বিভ্রান্ত হয়ে আখেরাতকে অস্বীকার করে বসে অথবা কমপক্ষে সে ব্যাপারে সন্দিহান হয়ে পড়ে সে কখনো এ দুনিয়ায় যে নগদ লাভ পেয়ে যাচ্ছে তা থেকে কেবলমাত্র এজন্য হাত সংকুচিত করে নিতে রাজি হবে না যে এর ফলে পরবর্তী জীবনে ক্ষতি হবার আশঙ্কা আছে। দুনিয়ায় যে ব্যক্তিই কখনো পথভ্রষ্ঠ হয়েছে তার পথভ্রষ্ঠতা এ আখেরাত অস্বীকার বা এ ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করার কারণেই সংঘটিত হয়েছে এবং যে-ই সঠিক পথ অবলম্বন করেছে তার সঠিক কর্মের ভিত্তি আখেরাতের প্রতি ঈমানের ওপরই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
# কুরআন মজীদে সাবা জাতির ইতিহাসের প্রতি যে ইঙ্গিত করা হয়েছে তা অনুধাবন করতে হলে এ জাতি সম্পর্কে ইতিহাসের অন্যান্য মাধ্যম থেকে যেসব তথ্য সংগৃহীত হয়েছে সেগুলোও সামনে থাকা প্রয়োজন।

ইতিহাসের দৃষ্টিতে সাবা দক্ষিণ আরবের একটি বৃহৎ জাতির নাম। কতগুলো বড় বড় গোত্র সমন্বয়ে এ জাতিটি গড়ে উঠেছিল। ইমাম আহমাদ ইবনে জারীর, ইবনে আবী হাতেম, ইবনে আবদুল বার ও তিরমিযী রসূলুল্লাহ ﷺ থেকে নিম্নোক্ত বর্ণনাটি উদ্ধৃত করেছেন। সাবা ছিল আরবের এক ব্যক্তির নাম। আরবে তার বংশ থেকে নিম্নোক্ত গোত্রগুলোর উদ্ভব হয়ঃ কিন্দাহ, হিময়ার, আযদ, আশ’আরীন, মাযহিজ, আনমার (এর দু’টি শাখাঃ খাস’আম ও বাজীলাহ) আমেলাহ, জুযান, লাখম ও গাসসান। অতি প্রাচীনকাল থেকে আরবে এ জাতির খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। খৃস্টপূর্ব ২৫০০ অব্দে উর –এর শিলালিপিতে সাবোম নামের মধ্য দিয়ে এর উল্লেখ পাওয়া যায়। এরপর ব্যাবিলন ও আসিরিয়ার শিলালিপিতে এবং অনুরূপভাবে বাইবেলেও ব্যাপকহারে এর উল্লেখ দেখা যায়। (দৃষ্টান্ত স্বরূপ দেখুন যাবুর ৭২: ১৫, যিরমিয় ৬: ২০, যিহিস্কেল ২৭: ২২ ও ৩৮: ১৩ এবং ইয়োব ৬: ১৯ ) গ্রীক ও রোমীয় ঐতিহাসিকবৃন্দ এবং ভূগোলবিদগণ থিয়োফ্রষ্টিসের (খৃঃ পূঃ ২৮৮) সময় থেকে খৃস্ট পরবর্তী কয়েক শো বছর পর্যন্ত অবিচ্ছিন্নভাবে এর আলোচনা করে এসেছেন। এ জাতির আবাসভূমি ছিল আরবের দক্ষিণ পশ্চিম কোণে বর্তমানে ইয়ামন নামে পরিচিত এলাকাটি। এর উত্থানকাল শুরু হয় খৃষ্টপূর্ব এগারো শত বছর থেকে। হযরত দাউদ ও হযরত সুলাইমান (আ) এর যুগে একটি ধনাঢ্য ও সম্পদশালী জাতি হিসেবে সারা দুনিয়ায় এর নাম ছড়িয়ে পড়ে। শুরুতে এটি ছিল একটি সূর্যোপাসক জাতি। তারপর এর রাণী যখন হযরত সুলাইমানের (৯৬৫-৯২৬ খৃঃ পূঃ) হাতে ঈমান আনেন তখন জাতির বেশীর ভাগ লোক মুসলমান হয়ে যায়। কিন্তু পরে না জানি কোন্ সময় থেকে আবার তাদের মধ্যে শিরক ও মূর্তিপূজা প্রবল হয় এবং তারা আলমাকা (চন্দ্র দেবতা), ‘আশতার (শুক্র) যাতে হামীম ও যাতে বা’দা (সূর্যদেবী), হোবস হারমতন বা হারীমত এবং এ ধরনের আরো বহু দেব-দেবীর পূজা করতে শুরু করে। আলমাকা ছিল এ জাতির সবচেয়ে বড় দেবতা। তাদের বাদশাহ নিজেকে এ দেবতার প্রতিনিধি হিসেবে আনুগত্য লাভের যোগ্য মনে করতো। ইয়ামনে এমন অসংখ্য শিলালিপি পাওয়া গেছে যা থেকে জানা যায়, সমগ্র দেশ উল্লেখিত দেবতাবৃন্দ বিশেষ করে আলমাকার মন্দিরে পরিপূর্ণ ছিল এবং প্রত্যেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনায় তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হতো। প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ অনুসন্ধান করতে গিয়ে ইয়ামন থেকে প্রায় ৩ হাজার শিলালিপি উদ্ধার করা হয়েছে। এগুলো সাবা জাতির ইতিহাসের ওপর আলোকপাত করে। এই সঙ্গে আরবীয় ঐতিহ্য ও প্রবাদ এবং গ্রীক ও রোমীয় ইতিহাস থেকে সংগৃহীত তথ্যাবলী একত্র করলে এ জাতির একটি বিস্তারিত ইতিহাস লেখা যেতে পারে। এসব তথ্যাবলীর দৃষ্টিতে তার ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ যুগগুলো নিন্মভাবে বিবৃত করা যেতে পারেঃ

একঃ খৃস্টপূর্ব ৬৫০ অব্দের পূর্ববর্তী যুগ। এ সময় সাবার রাজার উপাধি ছিল “মুকাররিবে সাবা” (مكرب سبا) । সম্ভবত এখানে مكرب শব্দটি مقرب এর সমার্থক ছিল। এভাবে এর অর্থ দাঁড়ায়ঃ এ বাদশাহ মানুষ ও খোদাদের মধ্যে নিজেকে সংযোগ মাধ্যম হিসেবে গণ্য করতেন। অথবা অন্যকথায় বলা যায়, তিনি ছিলেন পুরহিত বাদশাহ (Priest Kings) এ সময় তাঁর রাজধানী ছিল সারওয়াহ নগরীতে। মারিবের পশ্চিম দিকে একদিনের দূরত্বে অবস্থিত খারীবাহ নামক স্থানে আজো এর ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়। এ আমলে মারিবের বিখ্যাত বাঁধের ভিত্তি স্থাপন করা হয়েছিল এবং এরপর বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বাদশাহ এর সীমানা আরো সম্প্রসারিত করেন।

দুইঃ খৃস্টপূর্ব ৬৫০ অব্দ থেকে খৃস্টপূর্ব ১১৫ অব্দ পর্যন্ত সময়। এ সময় সাবার বাদশাহরা মুকাররিব উপাধি ত্যাগ করে মালিক (বাদশাহ) উপাধি গ্রহণ করেন। এর অর্থ হয়, রাজ্য পরিচালনায় ধর্মীয় ভাবধারার পরিবর্তে রাজনীতি ও সেকুলারিজমের রং প্রাধান্য লাভ করেছে। এ আমলে সাবার বাদশাহগণ সারওয়াহ ত্যাগ করে মারিবকে তাদের রাজধানী নগরীতে পরিণত করেন এবং এর অসাধারণ উন্নতি সাধন করেন। এ নগরটি সাগর থেকে ৩৯০০ ফুট উঁচুতে সানয়া থেকে ৬০ মাইল পূর্ব দিকে অবস্থিত ছিল। আজ পর্যন্ত এর প্রাচীন ধ্বংসাবশেষগুলো সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, এক সময় এটি ছিল দুনিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ সুসভ্য জাতির কেন্দ্রভূমি।

তিনঃ ১১৫ খৃস্টপূর্বাব্দে থেকে ৩০০ খৃস্টাব্দ পর্যন্ত সময়। এ সময় সাবার রাষ্ট্র ব্যবস্থায় হিময়ার গোত্র প্রাধান্য লাভ করে। এটি ছিল সাবা জাতিরই অন্তর্ভুক্ত একটি উপজাতি। অন্যান্য উপজাতিদের থেকে এদের লোকসংখ্যা ছিল অনেক বেশী। এ আমলে মারিবকে জনশুন্য করে যাইদানে রাজধানী প্রতিষ্ঠিত করা হয়। এ শহরটি ছিল হিময়ার গোত্রের কেন্দ্র। পরবর্তীকালে এ শহরটি যাফার নামে আখ্যায়িত হয়। বর্তমানে ইয়েরেম শহরের কাছে একটি গোলাকার পর্বতের ওপর এর ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায় এবং এরই কাছাকাছি এলাকায় হিময়ার নামে একটি ক্ষুদ্রাকার উপজাতির বসতি রয়েছে। একে দেখে কোন ব্যক্তি ধারণাই করতে পারবে না যে, এটি এমন একটি জাতির স্মৃতিচিহ্ন একদিন যার ডংকা নিনাদ সমগ্র বিশ্বে গুঞ্জরিত হতো। এ সময়ই রাজ্যের একটি অংশ হিসেবে ইয়ামনত ও ইয়ামনিয়াত শব্দটির ব্যবহার শুরু হয় এবং ধীর ধীরে এটি আরবের দক্ষিণ পূর্ব কোণে অবস্থিত আসীর থেকে আদন (এডেন) এবং বাবুল মানদাব থেকে হাদরামাউত পর্যন্ত সমগ্র এলাকার নামে পরিণত হয়। এ সময়ই সাবা জাতির পতন শুরু হয়।

চারঃ ৩০০ খৃস্টাব্দের পর থেকে ইসলামের প্রারন্তকাল পর্যন্ত সময়। এটি ছিল সাবা জাতির ধ্বংসের সময়। এ সময় তাদের মধ্যে অনবরত গৃহযুদ্ধ চলতে থাকে। বাইরের জাতিসমুহের অনুপ্রবেশ ঘটতে থাকে। ব্যবসা-বানিজ্য ধ্বংস হয়ে যায়। কৃষি ব্যবস্থা বরবাদ হয়ে যায়। শেষে জাতীয় স্বাধীনতারও বিলোপ ঘটে। প্রথমে যাইদানী, হিময়ারী ও হামদানীদের পারস্পরিক বিরোধ ও সংঘাতের সুযোগ গ্রহণ করে ৩৪০ থেকে ৩৭৮ খৃস্টাব্দ পর্যন্ত ইয়ামনে হাবশীদের রাজত্ব চলে। তারপর স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার হয় ঠিকই কিন্তু মারিবের বিখ্যাত বাঁধে ফাটল দেখা দিতে থাকে। এমনকি শেষ পর্যন্ত ৪৫০ বা ৪৫১ খৃস্টাব্দে বাঁধ ভেঙ্গে পড়ে এবং এর ফলে যে মহাপ্লাবন হয় তার উল্লেখ কুরআন মাজীদের ওপরের আয়াতে করা হয়েছে। যদিও এরপর থেকে আবরাহার সময় পর্যন্ত অনবরত বাঁধের মেরামত কাজ চলতে থাকে তবুও যে জনবসিত একবার স্থানচ্যুত হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছিল তা পুনরায় আর একত্র হতে পারেনি এবং পানি সেচ ও কৃষির যে ব্যবস্থা একবার বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছিল তার আর পুনর্গঠন সম্ভবপর হয়নি। ৫২৩ খৃস্টাব্দে ইয়ামনের ইহুদী বাদশাহ যু-নওয়াস নাজরানের খৃস্টানদের ওপর যে জুলুম-নিপীড়ন চালায় কুরআন মজীদে আসহাবুল উত্থদুদ নামে তার উল্লেখ করা হয়েছে। এর ফলে হাবশার (আবিসিনিয়া এবং বর্তমানে ইথিওপিয়া) খৃস্টান শাসক ইয়ামনের ওপর প্রতিশোধমূলক আক্রমণ চালান। তিনি সমগ্র দেশ জয় করে নেন। এরপর ইয়ামনের হাবশী গভর্ণর আবরাহা কা’বা শরীফের কেন্দ্রীয় গুরুত্ব খতম করার এবং আরবের সমগ্র পশ্চিম এলাকাকে রোমান-হাবশী প্রভাবাধীনে আনার জন্য ৫৭০ বা ৫৭১ খৃস্টাব্দে নবী (সা.) এর জন্মের মাত্র কিছুদিন পূর্বে মক্কা মুআযযমা আক্রমণ করে। এ অভিযানে তার সমগ্র সেনাদল যে ধ্বংসের সম্মুখীন হয় কুরআন মজীদে আসহাবুল ফীল শিরোনামে তা উল্লেখিত হয়েছে। সবশেষে ৫৭৫ খৃস্টাব্দে ইরানীরা ইয়ামন দখল করে ৬২৮ খৃস্টাব্দে ইরানী গভর্ণর বাযান –এর ইসলাম গ্রহণের পর এ দখল দারিত্বের অবসান ঘটে।

সাবা জাতির উত্থান মূলত দুইটি ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। এক, কৃষি এবং দুই, ব্যবসায়। কৃষিকে তারা পানি সেচের একটি সর্বোত্তম ব্যবস্থার মাধ্যমে উন্নত করে। প্রাচীন যুগে ব্যবিলন ছাড়া আর কোথাও এর সমপর্যায়ের পানি সেচ ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। সে দেশটি প্রাকৃতিক নদী সম্পদে সমৃদ্ধ ছিল না। বর্ষা কালে পাহাড় থেকে পানির ঝরণা প্রবাহিত হতো। সারা দেশে এ ঝরণাগুলোতে বিভিন্ন স্থানে বাঁধ বেঁধে তারা কৃত্রিম হ্রদ তৈরি করতো। তারপর এ হ্রদগুলো থেকে খাল কেটে সারা দেশে এমনভাবে পানি সেচের ব্যবস্থা গড়ে তুলে ছিল যাকে কুরআন মজীদের বর্ণনা মতে, যেদিকে তাকাও সেদিকেই কেবল বাগ-বগিচা ও সবুজ-শ্যামল গাছ-গাছালি দেখা যেত। এ সেচ ব্যবস্থার মাধ্যমে সবচেয়ে বড় জলধারাটি মারিব নগরীর নিকটবর্তী বালক পাহাড়ের মধ্যস্থলের উপত্যকায় বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে গড়ে তোলা হয়েছিল। কিন্তু আল্লাহর অনুগ্রহ দৃষ্টি যখন তাদের ওপর থেকে সরে গেলো তখন পঞ্চম শতকের মাঝামাঝি সময়ে এ বিশাল বাঁধটি ভেঙে গেলো। এ সময় এ থেকে যে বন্যা সৃষ্টি হলো তা পথের বাঁধগুলো একের পর এক ভাঙতে ভাঙতে এগিয়ে চললো, এমনকি শেষ পর্যন্ত দেশের সমগ্র পানি সেচ ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে গেলো এবং এরপর আর কোন ভাবেই এ ব্যবস্থা পুনর্বহাল করা গেলো না।

ব্যবসায়ের জন্য এ জাতিকে আল্লাহ‌ সর্বোত্তম ভৌগলিক স্থান দান করেছিলেন। তারা এর পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করে। এক হাজার বছরের বেশী সময় পর্যন্ত এ জাতিটিই পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে ব্যবসায়ের সংযোগ মাধ্যমের স্থান দখল করে থাকে। একদিকে তাদের বন্দরে চীনের রেশম, ইন্দোনেশিয়া ও মালাবারের গরম মশলা, হিন্দুস্থানের কাপড় ও তলোয়ার, পূর্ব আফ্রিকার যংগী দাস, বানর, উটপাখির পালক ও হাতির দাঁত পৌঁছে যেতো এবং অন্যদিকে তারা এ জিনিসগুলোকে মিসর ও সিরিয়ার বাজারে পৌঁছিয়ে দিতো। সেখান থেকে সেগুলো গ্রীস ও রোমে চলে যেতো। এছাড়াও তাদের নিজেদের এলাকায়ও উৎপন্ন হতো লোবান, চন্দন কাঠ, আম্বর, মিশক, মুর, কারফা, কাসবুখ, যারীরাহ, সালীখাহ ও অন্যান্য সুগন্ধি দ্রব্যাদি বিপুল পরিমাণে। মিসর, সিরিয়া, গ্রীস ও রোমের লোকেরা এগুলো লুফে নিতো।

দুটি বড় বড় পথে এ বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য চলতো। একটি ছিল সমুদ্রপথ এবং অন্যটি স্থলপথ। হাজার বছর পর্যন্ত সমুদ্রপথে ব্যবসায় ছিল সাবায়ীদের একচেটিয়া দখলে। কারণ লোহিত সাগরের মৌসুমী বায়ু প্রবাহ, ভূগর্ভস্থ পাহাড় ও নোঙ্গর করার স্থানগুলোর গোপন তথ্য একমাত্র তারাই জানতো। অন্য কোন জাতির এ ভয়াল সাগরে জাহাজ চালাবার সাহসই ছিল না। এ সামূদ্রিক পথে তারা জর্দান ও মিসরের বন্দরসমুহে নিজেদের পণ্যদ্রব্য পৌঁছেয়ে দিতো। অন্যদিকে স্থলপথ আদন (এডেন) ও হাদরামাউত থেকে মারিবে গিয়ে মিশতো এবং তারপর আবার সেখান থেকে একটি রাজপথ মক্কা, জেদ্দা, ইয়াসরিব, আলউলা, তাবুক ও আইলা হয়ে পেট্টা পর্যন্ত পৌঁছে যেতো। এরপর একটি পথ মিসরের দিকে এবং অন্য পথটি সিরিয়ার দিকে যেতো। যেমন কুরআনে বলা হয়েছে, এ স্থলপথে ইয়ামন থেকে সিরিয়া সীমান্ত পর্যন্ত অবিচ্ছিন্নভাবে সাবায়ীদের উপনিবেশ প্রতিষ্ঠিত ছিল এবং তাদের বাণিজ্য কাফেলা দিনরাত এ পথে যাওয়া আসা করতো। এ উপনিবেশগুলোর মধ্যে অনেকগুলোর ধ্বংসাবশেষ এ এলাকায় আজও রয়ে গেছে এবং সেখানে সাবায়ী ও হিময়ারী ভাষায় লিখিত শিলালিপি পাওয়া যাচ্ছে।

খৃস্টীয় প্রথম শতকের কাছাকাছি সময়ে এ ব্যবসায়ে অধোগতি শুরু হয়। মধ্যপ্রাচ্যে গ্রীক ও তারপর রোমানদের শক্তিশালী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবার পর তারা এ মর্মে শোরগোল শুরু করে দেয় যে, আরব ব্যবসায়ীরা নিজেদের ইজারাদারীর কারণে প্রাচ্যের ব্যবসায় পণ্যের ইচ্ছামতো মূল্য আদায় করে নিয়ে যাচ্ছে, এ ময়দানে অগ্রবর্তী হয়ে এ বাণিজ্য আমাদের নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে হবে। এ উদ্দেশ্যে সর্ব প্রথম মিসরের গ্রীক বংশোদ্ভূত শাসক দ্বিতীয় বাতলিমূস (২৮৫-২৪৬ খৃঃ পূঃ) সেই প্রাচীন খালটি পুনরায় খুলে দেন, যা সতের শো বছর আগে ফেরাউন সিসুস্ত্রীস নীলনদকে লোহিত সাগরের সাথে সংযুক্ত করার জন্য এ খালটি খনন করেছিলেন। এ খালের মাধ্যমে মিসরের নৌবহর প্রথমবার লোহিত সাগরে প্রবেশ করে কিন্তু সাবায়ীদের মোকাবিলায় এ প্রচেষ্টা বেশী কার্যকর প্রমাণিত হতে পারেনি। তারপর রোমানরা যখন মিসর দখল করে তখন তারা লোহিত সাগরে অধিকতর শক্তিশালী বাণিজ্য বহর নিয়ে আসে এবং তার পশ্চাৎভাগে একটি নৌবাহিনীও জুড়ে দেয়। এ শক্তির মোকাবিলা করার ক্ষমতা সাবায়ীদের ছিল না। রোমানরা বিভিন্ন বন্দরে নিজেদের ব্যবসায়িক উপনিবেশ গড়ে তোলে সেখানে জাহাজের প্রয়োজন পূর্ণ করার ব্যবস্থা করে। যেখানে সম্ভব হয় সেখানে নিজেদের সামরিক বাহিনীও রেখে দেয়। শেষ পর্যন্ত এমন এক সময় আসে যখন এডেনের ওপর রোমানদের সামরিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এ সুযোগে রোমান ও হাবশী শাসকরা সাবায়ীদের মোকাবিলায় সম্মিলিতভাবে চক্রান্ত করে। এর ফলে শেষ পর্যন্ত এ জাতির স্বাধীনতা সূর্যও অস্তমিত হয়।

নৌবাণিজ্য বেদখল হয়ে যাবার পর সাবায়ীদের হাতে থেকে যায় শুধুমাত্র স্থলপথের বাণিজ্য। কিন্তু নানাবিধ কারণে ধীরে ধীরে তারও কোমর ভেঙ্গে যায়। প্রথমে নাবতীরা পেট্টা থেকে নিয়ে আল’উলা পর্যন্ত হিজায ও জর্দানের উচ্চ ভূমির সমস্ত উপনিবেশ থেকে সাবায়ীদেরকে বের করে দেয়। তারপর ১০৬ খৃস্টাব্দে রোমানরা নাবতী রাজত্বের অবসান ঘটিয়ে হিজাযের সীমান্ত পর্যন্ত সিরিয়া ও জর্দানের সমস্ত এলাকা নিজেদের শক্ত হাতের মুঠোয় নিয়ে নেয়। এরপর হাবশা ও রোম সাবায়ীদের পারস্পরিক সংঘাতকে কাজে লাগিয়ে তাদের ব্যবসাকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেবার জন্য সম্মিলিতভাবে প্রচেষ্টা চালাতে থাকে। এ কারণে হাবশীরা বারবার ইয়ামনের ব্যাপারে নাক গলাতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত সারা দেশ অধিকার করে নেয়।

এভাবে আল্লাহর ক্রোধ এ জাতিকে উন্নতির শিখর থেকে টেনে নামিয়ে এমন এক গর্তের মধ্যে নিক্ষেপ করে যেখান থেকে কোন অভিশপ্ত জাতি আর কোনদিন বের হয়ে আসতে পারেনি। এক সময় ছিল যখন তার সম্পদশালিতার কথা শুনে গ্রীক ও রোমানরা ভীষণভাবে প্রলুদ্ধ হত। অষ্ট্রাবু লিখছেনঃ তারা সোনা ও রূপার পাত্র ব্যবহার করত। তাদের গৃহের ছাদ, দেয়াল ও দরজায়ও হাতির দাঁত, সোনা, রূপা ও হীরা জহরতের কারূকাজে পরিপূর্ণ থাকতো। প্লিনি লিখেছেনঃ রোম ও পারস্যের সম্পদ তাদের দিকে প্রবাহিত হয়ে চলেছে। তারা তৎকালীন দুনিয়ার সবচেয়ে ধনাঢ্য ও সম্পদশালী জাতি। তাদের সবুজ-শ্যামল দেশ বাগ-বাগিচা, ক্ষেত-খামার ও গবাদি পশুতে পরিপূর্ণ। আর্টি মেড্রোস বলেনঃ তারা বিলাসীতার স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়েছে। জ্বালানী কাঠের পরিবর্তে তারা দারুচিনি, চন্দন ও অন্যান্য সুগন্ধি কাঁঠ ইন্ধন হিসেবে ব্যবহার করে। অনুরূপভাবে অন্যান্য গ্রীক ঐতিহাসিকগণ বর্ণনা করেন, তাদের এলাকার সমুদ্রোপকূল অতিক্রমকারী বিদেশী জাহাজগুলোতেও খোশবুর ছোঁয়াচ পৌঁছে যেতো। তারাই ইতিহাসে প্রথমবার সান’আর উচ্চ পার্বত্য স্থানসমূহে আকাশ ছোঁয়া (Skyscraper) ইমারত নির্মাণ করে। গুমদান প্রাসাদ নামে এগুলো দীর্ঘকাল ধরে প্রসিদ্ধ থাকে। আরব ঐতিহাসিকদের বর্ণনা অনুযায়ী এগুলো ছিল ২০ তলা বিশিষ্ট ইমারত এবং প্রত্যেকটি তলার উচ্চতা ছিল ৩৬ ফুট। আল্লাহর অনুগ্রহ যতদিন তাদের সহযোগী ছিল ততদিন এসব কিছু ছিল। শেষে যখন তারা চরমভাবে অনুগ্রহ অস্বীকার করার এবং নিয়ামতের প্রতি অকৃতজ্ঞ হবার পর্যায়ে পৌঁছে গেল তখন মহান সর্বশক্তিমান রবের অনুগ্রহ দৃষ্টি তাদের ওপর থেকে চিরকালের জন্য সরে যায় এবং তাদের নাম নিশানা পর্যন্তও মুছে যায়।

Leave a Reply