أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#১০৬৩)
[এবং কাফেররা বলে -২/ কাফেরদের বক্তব্য ও তাদের গোঁড়ামি:-}
www.motaher21.net
সূরা:- ৩৪:সাবা
পারা:২২
২২-৫৪ নং আয়াত:-
সাবা:-৩৪:২২
قُلِ ادۡعُوا الَّذِیۡنَ زَعَمۡتُمۡ مِّنۡ دُوۡنِ اللّٰہِ ۚ لَا یَمۡلِکُوۡنَ مِثۡقَالَ ذَرَّۃٍ فِی السَّمٰوٰتِ وَ لَا فِی الۡاَرۡضِ وَ مَا لَہُمۡ فِیۡہِمَا مِنۡ شِرۡکٍ وَّ مَا لَہٗ مِنۡہُمۡ مِّنۡ ظَہِیۡرٍ ﴿۲۲﴾
বলুন, ‘তোমরা আল্লাহ্ ছাড়া যাদেরকে ইলাহ্ মনে করতে তাদেরকে ডাক। তারা আসমানসমূহে অণু পরিমাণ কিছুরও মালিক নয়, যমীনেও নয়। আর এ দু’টিতে তাদের কোন অংশও নেই এবং তাদের মধ্য থেকে কেউ তাঁর সহায়কও নয় ।
সাবা:-৩৪:২৩
وَ لَا تَنۡفَعُ الشَّفَاعَۃُ عِنۡدَہٗۤ اِلَّا لِمَنۡ اَذِنَ لَہٗ ؕ حَتّٰۤی اِذَا فُزِّعَ عَنۡ قُلُوۡبِہِمۡ قَالُوۡا مَاذَا ۙ قَالَ رَبُّکُمۡ ؕ قَالُوا الۡحَقَّ ۚ وَ ہُوَ الۡعَلِیُّ الۡکَبِیۡرُ ﴿۲۳﴾
আর আল্লাহ যাকে অনুমতি দেবেন, সে ছাড়া তাঁর কাছে কারো সুপারিশ ফলপ্রসূ হবে না। অবশেষে যখন তাদের অন্তর থেকে ভয় বিদূরিত হয়, তখন তারা পরস্পরের মধ্যে জিজ্ঞাসাবাদ করে, ‘তোমাদের রব কী বললেন?’ তার উত্তরে তারা বলে, যা সত্য তিনি তা-ই বলেছেন ‘ আর তিনি সমুচ্চ, মহান।
সাবা:-৩৪:২৪
قُلۡ مَنۡ یَّرۡزُقُکُمۡ مِّنَ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ ؕ قُلِ اللّٰہُ ۙ وَ اِنَّاۤ اَوۡ اِیَّاکُمۡ لَعَلٰی ہُدًی اَوۡ فِیۡ ضَلٰلٍ مُّبِیۡنٍ ﴿۲۴﴾
বলুন, ‘আসমানসমূহ ও যমীন থেকে কে তোমাদেরকে রিযিক প্ৰদান করেন? বলুন, ‘আল্লাহ। আর নিশ্চয় আমরা অথবা তোমরা সৎপথে স্থিত অথবা স্পষ্ট বিভ্ৰান্তিতে পতিত ।
সাবা:-৩৪:২৫
قُلۡ لَّا تُسۡـَٔلُوۡنَ عَمَّاۤ اَجۡرَمۡنَا وَ لَا نُسۡـَٔلُ عَمَّا تَعۡمَلُوۡنَ ﴿۲۵﴾
বলুন, ‘আমাদের অপরাধের জন্য তোমাদেরকে জবাবদিহি করতে হবে না এবং তোমরা যা কর সে সম্পর্কে আমাদেরকেও জবাবদিহি করতে হবে না।’
সাবা:-৩৪:২৬
قُلۡ یَجۡمَعُ بَیۡنَنَا رَبُّنَا ثُمَّ یَفۡتَحُ بَیۡنَنَا بِالۡحَقِّ ؕ وَ ہُوَ الۡفَتَّاحُ الۡعَلِیۡمُ ﴿۲۶﴾
বলুন, ‘আমাদের রব আমাদের সকলকে একত্র করবেন, তারপর তিনি আমাদের মধ্যে সঠিকভাবে ফায়সালা করে দেবেন। আর তিনিই শ্রেষ্ঠ ফয়সালাকারী, সর্বজ্ঞ।’
সাবা:-৩৪:২৭
قُلۡ اَرُوۡنِیَ الَّذِیۡنَ اَلۡحَقۡتُمۡ بِہٖ شُرَکَآءَ کَلَّا ؕ بَلۡ ہُوَ اللّٰہُ الۡعَزِیۡزُ الۡحَکِیۡمُ ﴿۲۷﴾
বলুন, ‘তোমরা আমাকে তাদের দেখাও, যাদেরকে তোমরা শরীকরূপে তাঁর সাথে জুড়ে দিয়েছ। না, কখনো না, বরং তিনিই আল্লাহ্ পরাক্রমশালী, হিকমতওয়ালা।’
সাবা:-৩৪:২৮
وَ مَاۤ اَرۡسَلۡنٰکَ اِلَّا کَآفَّۃً لِّلنَّاسِ بَشِیۡرًا وَّ نَذِیۡرًا وَّ لٰکِنَّ اَکۡثَرَ النَّاسِ لَا یَعۡلَمُوۡنَ ﴿۲۸﴾
আর আমরা তো আপনাকে সমগ্ৰ মানুষের জন্যই সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে প্রেরণ করেছি ; কিন্তু অধিকাংশ মানুষ জানে না।
সাবা:-৩৪:২৯
وَ یَقُوۡلُوۡنَ مَتٰی ہٰذَا الۡوَعۡدُ اِنۡ کُنۡتُمۡ صٰدِقِیۡنَ ﴿۲۹﴾
আর তারা বলে, ‘তোমরা যদি সত্যবাদী হও তবে বল, এ প্রতিশ্রুতি কখন বাস্তবায়িত হবে?’
সাবা:- ৩৪:৩০
قُلۡ لَّکُمۡ مِّیۡعَادُ یَوۡمٍ لَّا تَسۡتَاۡخِرُوۡنَ عَنۡہُ سَاعَۃً وَّ لَا تَسۡتَقۡدِمُوۡنَ ﴿٪۳۰﴾
বলুন, ‘তোমাদের জন্য আছে এক নির্ধারিত দিনের প্রতিশ্রুতি, তা থেকে তোমরা মুহুর্তকালও বিলম্ব করতে পারবে না, আর ত্বরান্বিতও করতে পারবে না’
সাবা:- ৩৪:৩১
وَ قَالَ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا لَنۡ نُّؤۡمِنَ بِہٰذَا الۡقُرۡاٰنِ وَ لَا بِالَّذِیۡ بَیۡنَ یَدَیۡہِ ؕ وَ لَوۡ تَرٰۤی اِذِ الظّٰلِمُوۡنَ مَوۡقُوۡفُوۡنَ عِنۡدَ رَبِّہِمۡ ۚۖ یَرۡجِعُ بَعۡضُہُمۡ اِلٰی بَعۡضِۣ الۡقَوۡلَ ۚ یَقُوۡلُ الَّذِیۡنَ اسۡتُضۡعِفُوۡا لِلَّذِیۡنَ اسۡتَکۡبَرُوۡا لَوۡ لَاۤ اَنۡتُمۡ لَکُنَّا مُؤۡمِنِیۡنَ ﴿۳۱﴾
এ কাফেররা বলে, “আমার কখখনো এ কুরআন মানবো না এবং এর পূর্বে আগত কোন কিতাবকেও স্বীকার করবো না।” হায়! যদি তোমরা দেখো এদের তখনকার অবস্থা যখন এ জালেমরা নিজেদের রবের সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে। সে সময় এরা একে অন্যকে দোষারোপ করবে। যাদেরকে দুনিয়ায় দাবিয়ে রাখা হয়েছিল তারা ক্ষমতাগর্বীদেরকে বলবে, “যদি তোমরা না থাকতে তাহলে আমরা মু’মিন হতাম।”
সাবা:- ৩৪:৩২
قَالَ الَّذِیۡنَ اسۡتَکۡبَرُوۡا لِلَّذِیۡنَ اسۡتُضۡعِفُوۡۤا اَنَحۡنُ صَدَدۡنٰکُمۡ عَنِ الۡہُدٰی بَعۡدَ اِذۡ جَآءَکُمۡ بَلۡ کُنۡتُمۡ مُّجۡرِمِیۡنَ ﴿۳۲﴾
যারা অহংকারী ছিল তারা, যাদেরকে দুর্বল করে রাখা হয়েছিল তাদেরকে বলবে, ‘তোমাদের কাছে সৎপথের দিশা আসার পর আমরা কি তোমাদেরকে তা থেকে নিবৃত্ত করেছিলাম? বরং তোমরাই ছিলে অপরাধী।’
সাবা:- ৩৪:৩৩
وَ قَالَ الَّذِیۡنَ اسۡتُضۡعِفُوۡا لِلَّذِیۡنَ اسۡتَکۡبَرُوۡا بَلۡ مَکۡرُ الَّیۡلِ وَ النَّہَارِ اِذۡ تَاۡمُرُوۡنَنَاۤ اَنۡ نَّکۡفُرَ بِاللّٰہِ وَ نَجۡعَلَ لَہٗۤ اَنۡدَادًا ؕ وَ اَسَرُّوا النَّدَامَۃَ لَمَّا رَاَوُا الۡعَذَابَ ؕ وَ جَعَلۡنَا الۡاَغۡلٰلَ فِیۡۤ اَعۡنَاقِ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا ؕ ہَلۡ یُجۡزَوۡنَ اِلَّا مَا کَانُوۡا یَعۡمَلُوۡنَ ﴿۳۳﴾
সেই দমিত লোকেরা ক্ষমতাগর্বীদেরকে বলবে, “না, বরং দিবারাত্রের চক্রান্ত ছিল যখন তোমরা আমাদের বলতে আমরা যেন আল্লাহ কুফরী করি এবং অন্যদেরকে তাঁর সমকক্ষ উপস্থাপন করি।”শেষ পর্যন্ত যখন তারা আযাব দেখবে তখন মনে মনে পস্তাতে থাকবে এবং আমি এ অস্বীকারকারীদের গলায় বেড়ী পরিয়ে দেবো। লোকেরা যেমন কাজ করেছিল তেমনি প্রতিদান পাবে, এছাড়া আর কোন প্রতিদান কি তাদেরকে দেয়া যেতে পারে?
সাবা:- ৩৪:৩৪
وَ مَاۤ اَرۡسَلۡنَا فِیۡ قَرۡیَۃٍ مِّنۡ نَّذِیۡرٍ اِلَّا قَالَ مُتۡرَفُوۡہَاۤ ۙ اِنَّا بِمَاۤ اُرۡسِلۡتُمۡ بِہٖ کٰفِرُوۡنَ ﴿۳۴﴾
কখনো এমনটি ঘটেনি যে, আমি কোন জনপদে কোন সতর্ককারী পাঠিয়েছি এবং সেই জনপদের সমৃদ্ধিশালী লোকেরা একথা বলেনি যে, তোমরা যে বক্তব্য নিয়ে এসেছ আমরা তা মানি না।
সাবা:- ৩৪:৩৫
وَ قَالُوۡا نَحۡنُ اَکۡثَرُ اَمۡوَالًا وَّ اَوۡلَادًا ۙ وَّ مَا نَحۡنُ بِمُعَذَّبِیۡنَ ﴿۳۵﴾
ওরা আরও বলত, ‘আমাদের ধন-জন সবার চেয়ে বেশী; সুতরাং আমাদেরকে কিছুতেই শাস্তি দেওয়া হবে না।’
সাবা:- ৩৪:৩৬
قُلۡ اِنَّ رَبِّیۡ یَبۡسُطُ الرِّزۡقَ لِمَنۡ یَّشَآءُ وَ یَقۡدِرُ وَ لٰکِنَّ اَکۡثَرَ النَّاسِ لَا یَعۡلَمُوۡنَ ﴿٪۳۶﴾
বলুন, ‘আমার রব যার প্রতি ইচ্ছে তার রিযিক বাড়িয়ে দেন অথবা সীমিত করেন; কিন্তু অধিকাংশ লোকই এটা জানে না।’
সাবা:- ৩৪:৩৭
وَ مَاۤ اَمۡوَالُکُمۡ وَ لَاۤ اَوۡلَادُکُمۡ بِالَّتِیۡ تُقَرِّبُکُمۡ عِنۡدَنَا زُلۡفٰۤی اِلَّا مَنۡ اٰمَنَ وَ عَمِلَ صَالِحًا ۫ فَاُولٰٓئِکَ لَہُمۡ جَزَآءُ الضِّعۡفِ بِمَا عَمِلُوۡا وَ ہُمۡ فِی الۡغُرُفٰتِ اٰمِنُوۡنَ ﴿۳۷﴾
তোমাদের এই ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি এমন নয় যা তোমাদেরকে আমার নিকটবর্তী করে; হ্যাঁ, তবে যারা ঈমান আনে ও সৎকাজ করে। এরাই এমন লোক যাদের জন্য রয়েছে তাদের কর্মের দ্বিগুণ প্রতিদান এবং তারা সুউচ্চ ইমারতসমূহে নিশ্চিন্তে-নিরাপদে থাকবে।
সাবা:- ৩৪:৩৮
وَ الَّذِیۡنَ یَسۡعَوۡنَ فِیۡۤ اٰیٰتِنَا مُعٰجِزِیۡنَ اُولٰٓئِکَ فِی الۡعَذَابِ مُحۡضَرُوۡنَ ﴿۳۸﴾
যারা আমার আয়াতকে ব্যর্থ করার জন্য প্রচেষ্টা চালায় তারা শাস্তি ভোগ করবে।
সাবা:- ৩৪:৩৯
قُلۡ اِنَّ رَبِّیۡ یَبۡسُطُ الرِّزۡقَ لِمَنۡ یَّشَآءُ مِنۡ عِبَادِہٖ وَ یَقۡدِرُ لَہٗ ؕ وَ مَاۤ اَنۡفَقۡتُمۡ مِّنۡ شَیۡءٍ فَہُوَ یُخۡلِفُہٗ ۚ وَ ہُوَ خَیۡرُ الرّٰزِقِیۡنَ ﴿۳۹﴾
বলুন, ‘নিশ্চয় আমার রব তো তার বান্দাদের মধ্যে যার প্রতি ইচ্ছে রিযিক বাড়িয়ে দেন এবং তার জন্য সীমিত করেন। আর তোমরা যা কিছু ব্যয় করবে, তিনি তার বিনিময় দেবেন এবং তিনিই শ্রেষ্ঠ রিযিকদাতা।’
সাবা:- ৩৪:৪০
وَ یَوۡمَ یَحۡشُرُہُمۡ جَمِیۡعًا ثُمَّ یَقُوۡلُ لِلۡمَلٰٓئِکَۃِ اَہٰۤؤُلَآءِ اِیَّاکُمۡ کَانُوۡا یَعۡبُدُوۡنَ ﴿۴۰﴾
যেদিন তিনি এদের সকলকে একত্রিত করবেন এবং ফিরিশতাদেরকে জিজ্ঞাসা করবেন, ‘এরা কি তোমাদেরই পূজা করত?’
সাবা:- ৩৪:৪১
قَالُوۡا سُبۡحٰنَکَ اَنۡتَ وَلِیُّنَا مِنۡ دُوۡنِہِمۡ ۚ بَلۡ کَانُوۡا یَعۡبُدُوۡنَ الۡجِنَّ ۚ اَکۡثَرُہُمۡ بِہِمۡ مُّؤۡمِنُوۡنَ ﴿۴۱﴾
ফেরেশ্তারা বলবে, ‘আপনি পবিত্র, মহান! আপনিই আমাদের অভিভাবক, তারা নয়; বরং তারা তো ইবাদাত করত জিনদের। তাদের অধিকাংশই জিনদের প্রতি ঈমান রাখত।
সাবা:- ৩৪:৪২
فَالۡیَوۡمَ لَا یَمۡلِکُ بَعۡضُکُمۡ لِبَعۡضٍ نَّفۡعًا وَّ لَا ضَرًّا ؕ وَ نَقُوۡلُ لِلَّذِیۡنَ ظَلَمُوۡا ذُوۡقُوۡا عَذَابَ النَّارِ الَّتِیۡ کُنۡتُمۡ بِہَا تُکَذِّبُوۡنَ ﴿۴۲﴾
‘ফলে আজ তোমাদের একে অন্যের উপকার বা অপকার করার মালিক হবে না।’ আর যারা যুলুম করেছিল আমরা তাদেরকে বলব, তোমরা ‘যে আগুনের শাস্তিতে মিথ্যারোপ করেছিলে তা আস্বাদন কর।’
সাবা:- ৩৪:৪৩
وَ اِذَا تُتۡلٰی عَلَیۡہِمۡ اٰیٰتُنَا بَیِّنٰتٍ قَالُوۡا مَا ہٰذَاۤ اِلَّا رَجُلٌ یُّرِیۡدُ اَنۡ یَّصُدَّکُمۡ عَمَّا کَانَ یَعۡبُدُ اٰبَآؤُکُمۡ ۚ وَ قَالُوۡا مَا ہٰذَاۤ اِلَّاۤ اِفۡکٌ مُّفۡتَرًی ؕ وَ قَالَ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا لِلۡحَقِّ لَمَّا جَآءَہُمۡ ۙ اِنۡ ہٰذَاۤ اِلَّا سِحۡرٌ مُّبِیۡنٌ ﴿۴۳﴾
এদেরকে যখন আমার সুস্পষ্ট আয়াত শুনানো হয় তখন এরা বলে, “এ ব্যক্তি তো চায় তোমাদের বাপ-দাদারা যেসব উপাস্যের পূজা করে এসেছে তাদের থেকে তোমাদেরকে দূরে সরিয়ে দিতে।” আর বলে, “এ (কুরআন) নিছক একটি মনগড়া মিথ্যা ছাড়া আর কিছুই নয়।” এ কাফেরদের সামনে যখনই সত্য এসেছে তখনই এরা বলে দিয়েছে “এ তো সুস্পষ্ট যাদু।”
সাবা:- ৩৪:৪৪
وَ مَاۤ اٰتَیۡنٰہُمۡ مِّنۡ کُتُبٍ یَّدۡرُسُوۡنَہَا وَ مَاۤ اَرۡسَلۡنَاۤ اِلَیۡہِمۡ قَبۡلَکَ مِنۡ نَّذِیۡرٍ ﴿ؕ۴۴﴾
অথচ না আমি এদেরকে পূর্বে কোন কিতাব দিয়েছিলাম, যা এরা পড়তো, আর না তোমার পূর্বে এদের কাছে কোন সতর্ককারী পাঠিয়ে ছিলাম।
সাবা:- ৩৪:৪৫
وَ کَذَّبَ الَّذِیۡنَ مِنۡ قَبۡلِہِمۡ ۙ وَ مَا بَلَغُوۡا مِعۡشَارَ مَاۤ اٰتَیۡنٰہُمۡ فَکَذَّبُوۡا رُسُلِیۡ ۟ فَکَیۡفَ کَانَ نَکِیۡرِ ﴿٪۴۵﴾
এদের পূর্বে অতিক্রান্ত লোকেরা মিথ্যা আরোপ করেছিল। যা কিছু আমি তাদেরকে দিয়েছিলাম তার এক-দশমাংশেও এরা পৌঁছুতে পারেনি। কিন্তু যখন তারা আমার রসূলের প্রতি মিথ্যা আরোপ করলো তখন দেখে নাও আমার শাস্তি ছিল কেমন কঠোর।
সাবা:- ৩৪:৪৬
قُلۡ اِنَّمَاۤ اَعِظُکُمۡ بِوَاحِدَۃٍ ۚ اَنۡ تَقُوۡمُوۡا لِلّٰہِ مَثۡنٰی وَ فُرَادٰی ثُمَّ تَتَفَکَّرُوۡا ۟ مَا بِصَاحِبِکُمۡ مِّنۡ جِنَّۃٍ ؕ اِنۡ ہُوَ اِلَّا نَذِیۡرٌ لَّکُمۡ بَیۡنَ یَدَیۡ عَذَابٍ شَدِیۡدٍ ﴿۴۶﴾
বলুন, ‘আমি তোমাদেরকে কেবল একটি বিষয়ে উপদেশ দিচ্ছিঃ তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে দু-দুজন অথবা এক-একজন করে দাঁড়াও, তারপর তোমরা চিন্তা করে দেখ—তোমাদের সাথীর মধ্যে কোন উন্মাদনা নেই। তিনি তো আসন্ন কঠিন শাস্তি সম্পর্কে তোমাদের জন্য একজন সতর্ককারী মাত্ৰ ।’
সাবা:- ৩৪:৪৭
قُلۡ مَا سَاَلۡتُکُمۡ مِّنۡ اَجۡرٍ فَہُوَ لَکُمۡ ؕ اِنۡ اَجۡرِیَ اِلَّا عَلَی اللّٰہِ ۚ وَ ہُوَ عَلٰی کُلِّ شَیۡءٍ شَہِیۡدٌ ﴿۴۷﴾
বল, ‘আমি তোমাদের নিকট যে পারিশ্রমিক চেয়েছি তা তোমাদের জন্যই; আমার পারিশ্রমিক আছে আল্লাহর নিকট এবং তিনি সর্ববিষয়ে সাক্ষী।’
সাবা:- ৩৪:৪৮
قُلۡ اِنَّ رَبِّیۡ یَقۡذِفُ بِالۡحَقِّ ۚ عَلَّامُ الۡغُیُوۡبِ ﴿۴۸﴾
বল, ‘আমার প্রতিপালক সত্য অবতারণ করেন;তিনি অদৃশ্যের পরিজ্ঞাতা।’
সাবা:- ৩৪:৪৯
قُلۡ جَآءَ الۡحَقُّ وَ مَا یُبۡدِئُ الۡبَاطِلُ وَ مَا یُعِیۡدُ ﴿۴۹﴾
বলো, “সত্য এসে গেছে এবং এখন মিথ্যা যত চেষ্টাই করুক তাতে কিছু হতে পারে না।”
সাবা:- ৩৪:৫০
قُلۡ اِنۡ ضَلَلۡتُ فَاِنَّمَاۤ اَضِلُّ عَلٰی نَفۡسِیۡ ۚ وَ اِنِ اہۡتَدَیۡتُ فَبِمَا یُوۡحِیۡۤ اِلَیَّ رَبِّیۡ ؕ اِنَّہٗ سَمِیۡعٌ قَرِیۡبٌ ﴿۵۰﴾
বলুন, ‘আমি বিভ্রান্ত হলে বিভ্রান্তির পরিণাম আমারই, পরিণাম আমারই, আর যদি আমি সৎপথে থাকি তবে তা এ জন্যে যে, আমার রব আমার প্রতি ওহী পাঠান। নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা, অতি নিকটবর্তী।’
সাবা:- ৩৪:৫১
وَ لَوۡ تَرٰۤی اِذۡ فَزِعُوۡا فَلَا فَوۡتَ وَ اُخِذُوۡا مِنۡ مَّکَانٍ قَرِیۡبٍ ﴿ۙ۵۱﴾
আহা, যদি তুমি দেখতে তাদেরকে সেসময় যখন তারা ভীত-সন্ত্রস্ত্র হয়ে ঘুরে বেড়াবে এবং কোথাও নিরাপদে বের হয়ে যেতে পারবে না বরং নিকট থেকেই পাকড়াও হয়ে যাবে।
সাবা:- ৩৪:৫২
وَّ قَالُوۡۤا اٰمَنَّا بِہٖ ۚ وَ اَنّٰی لَہُمُ التَّنَاوُشُ مِنۡ مَّکَانٍۭ بَعِیۡدٍ ﴿ۚۖ۵۲﴾
সেসময় তারা বলবে, আমরা তার প্রতি ঈমান আনলাম, অথচ দূরে চলে যাওয়া জিনিস নাগালের মধ্যে আসতে পারে কেমন করে?
সাবা:- ৩৪:৫৩
وَّ قَدۡ کَفَرُوۡا بِہٖ مِنۡ قَبۡلُ ۚ وَ یَقۡذِفُوۡنَ بِالۡغَیۡبِ مِنۡ مَّکَانٍۭ بَعِیۡدٍ ﴿۵۳﴾
ওরা তো পূর্বে তা প্রত্যাখ্যান করেছিল; ওরা (সত্য হতে) দূরে থেকে অদেখা বিষয়ে মন্তব্য করত।
সাবা:- ৩৪:৫৪
وَ حِیۡلَ بَیۡنَہُمۡ وَ بَیۡنَ مَا یَشۡتَہُوۡنَ کَمَا فُعِلَ بِاَشۡیَاعِہِمۡ مِّنۡ قَبۡلُ ؕ اِنَّہُمۡ کَانُوۡا فِیۡ شَکٍّ مُّرِیۡبٍ ﴿٪۵۴﴾
এদের এবং এদের কামনার মধ্যে অন্তরাল সৃষ্টি করা হয়েছে,যেমন করা হয়েছিল এদের পূর্ববর্তীদের ক্ষেত্রে। ওরা ছিল বিভ্রান্তিকর সন্দেহে সন্দিহান।
ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
#’বল, তাদের পক্ষে সন্ভব নয়। কারণ তারা নভােমন্ডল ও ভূ-মন্ডলের অণু পরিমাণ কোন কিছুরও মালিক নয় সব কিছুর প্রকৃত মালিক ও নিয়ন্ত্রক হচ্ছেন স্বয়ং আল্লাহ পাক তিনি ব্যতীত আর কারও কোনাে ক্ষমতা নেই। বিশেষ কল্পিত দেব-দেবীদের তাে কোনাে কিছুই করার নেই। এই বিশাল জগতের পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের পেছনে এদের কি আদৌ কোনাে কর্তৃত্ব আছে? নিখিল বিশ্বের কোন কিছুরই একক মালিকানা এদের নেই। এমনকি যৌথ বা শরীকানা ভিত্তিতেও নেই । সে কথাই এখানে বলা হয়েছে, ‘এতে তাদের কোনাে অংশ নেই নয়, আল্লাহ পাক এদের কারও সাহায্য সহযােগিতাও নেন না। তাই বলা হয়েছে, ‘এবং তাদের কেউ আল্লাহর সহায়কও নয়।’ পরবর্তী আয়াতে আর এক ধরনের কল্পিত শরীকদের প্রতি ইংগিত করা হয়েছে, এরা হচ্ছে ফেরেশতা। এদেরকে তৎকালীন আরব মােশরেকরা আল্লাহর কন্যা বলে বিশ্বাস করতাে এবং মনে করতাে যে, এরা তাদের জন্য আল্লাহর নিকট সুপারিশ করবে। খুব সম্ভবত এদের সম্পর্কেই তারা বলতাে, ‘আমরা কেবল আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্যই এদের উপাসনা করি…’ কিন্তু আল্লাহ পাক অত্যন্ত সুস্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিচ্ছেন, যার জন্য অনুমতি দেয়া হয়, ‘তার জন্যে ব্যতীত আল্লাহর কাছে কারও সুপারিশ ফলপ্রসূ হবে না…'(আয়াত ২৩) সুপারিশ বা শাফায়াত এর গোটা ব্যাপারটাই নির্ভর করছে আল্লাহর অনুমতির ওপর। আল্লাহ পাক কখনই তাঁর প্রতি অবিশ্বাসী কোনাে বান্দার জন্য সুপারিশের অনুমতি কাউকে দেবেন না। কাজেই যারা কাফের ও মােশরেক, তাদের জন্য সুপারিশ জানানাের অনুমতি ফেরেশতাদেরকেও দেবেন না এবং প্রথম থেকেই যারা সুপারিশের অনুমতিপ্রাপ্ত বলে গণ্য তাদেরকেও দেবেন না। সুপারিশ জানানাের প্রয়ােজন যে মুহূর্তে দেখা দেবে, সেই ভয়াবহ ও মহা আতংকে মুহূর্তটির প্রতি ইংগিত করে বলা হয়েছে, ‘যখন তাদের মন থেকে ভয়-ভীতি দূর হয়ে যাবে তখন তারা পরস্পরে বলবে'(আয়াত ২৩) এই মুহূর্তটি সত্যিই একটি কঠিন দিনের মুহূর্ত। যেদিন মানুষ দাঁড়িয়ে থাকবে এবং অপেক্ষা করতে থাকবে যে, কেউ আল্লাহর দরবারে তাদের জন্য একটু সুপারিশ করে কিনা। এই অপেক্ষা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকবে। চোহারা মলিন হয়ে আসবে। কণ্ঠস্বর ক্ষীণ হয়ে আসবে। মহান আল্লাহর দরবার হতে সুপারিশের অনুমতি ঘােষণার অপেক্ষায় তাদের মন ভীত হয়ে উঠবে। মহান আল্লাহর গুরু-গম্ভীর ঘোষণা যখন ধ্বনিত হবে তখন সবার মনে ভয়ের উদ্রেক হবে এবং কিছুক্ষণের জন্য তারা খেই হারিয়ে ফেলবে। এরপর যখন তাদের মনের ভয়-ভীতি কেটে যাবে তখন তারা পরস্পরকে জিজ্ঞেস করবে, ‘তােমাদের প্রভু কি বললেন?’ উত্তরে বলবে, ‘তিনি সত্য বলেছেন’ এই উত্তরটি সম্ভবত আল্লাহর খুব নিকটের ফেরেশতারা দেবেন। অত্যন্ত অর্থপূর্ণ উত্তর, ‘তিনি সত্য বলেছেন’ তিনি তাে সত্যই বলবেন, কারণ, তিনিই তাে পরম সত্য। তিনি সর্ব মহান। এই হচ্ছে সেই ভয়াবহ মুহূর্তের চিত্র এবং আল্লাহর অতি নিকটের ফেরেশতাদের অবস্থা ও তাদের সংক্ষিপ্ত উত্তর। এই ধরনের ভয়াবহ মুহূর্তে কেউ কি কোনাে কাফের মােশরেকের জন্য সুপারিশ করার ধৃষ্টতা দেখাতে পারবে? পরবর্তী আয়াতে স্থান পেয়েছে মানুষের জীবিকার বিষয়টি। এই জীবিকা মানুষ ভােগ করছে, অথচ এর উৎস সম্পর্কে তারা উদাসীন। এই জীবিকার ব্যবস্থা যে মহান সত্ত্বার পক্ষ থেকে করা হচ্ছে তিনি হচ্ছেন একক ও অভিন্ন সত্ত্বা। তিনি সব কিছুর স্রষ্টা ও রিযিকদাতা। তিনি দানও করতে পারেন এবং ছিনিয়েও নিতে পারেন। তার একক ক্ষমতায় কোনাে অংশীদার নেই। বলা হয়েছে, ‘বলাে নভােমন্ড্রল ও ভ-মন্ডল থেকে কে তােমাদেরকে রিযিক দান করে?'(আয়ত ২৪) ‘বলাে, নভােমন্ডল ও ভূ-মন্ডল থেকে কে তোমাদেরকে রিযিক দান করে?…'(আয়াত ২৪) বলা বাহুল্য, রিযিকের বিষয়টি মানুষের জীবনের একটা বাস্তব ও চাক্ষুষ বিষয়। আকাশ থেকে বৃষ্টি, তাপ, আলাে ও জ্যোতির আকারে মানুষ যা কিছু পাচ্ছে ও প্রত্যক্ষ করছে, তা এক প্রকারের রিযিক। এর বাইরেও অসংখ্য রিযিক মানুষের জন্য আল্লাহ পাক মহাশূন্যে পুঞ্জিভূত করে রেখেছেন যা ধীরে ধীরে প্রকাশ পাচ্ছে। পৃথিবীর বুকেও আল্লাহ পাক মানুষের জন্য অগণিত নেয়ামত ও রিযিক রেখেছেন। বৃক্ষ-তরুলতা, জীবজন্তু, নদ-নদী, খনিজ সম্পদ এবং আরও অজানা ও অগণিত-সম্পদ পৃথিবীর বুকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে যা ধীরে ধীরে আবিষ্কৃত হচ্ছে। ‘বলাে, আল্লাহ’ এটাই যথার্থ উত্তর। কারণ, এর বাইরে আর কোনাে উত্তর ওদের কাছে নেই। তাছাড়া এ ব্যাপারে ওদের সন্দেহেরও কোনো অবকাশ নেই। রসূলুল্লাহ(স.)-কে উদ্দেশ্য করে বলা হচ্ছে, ‘কাফের মােশরেকদের জানিয়ে দাও যে, আল্লাহই হচ্ছেন রিযিকদাতা।’ এরপর যার যার পথে সেই সেই চলবে। তবে সবশেষে চূড়ান্ত বিচার আল্লাহর হাতেই থাকবে। কেউ হয়তাে ভুল পথে চলবে, আবার কেউ হয়তাে সঠিক পথে চলবে। সবাই একই পথের পথিক হবে-এমনটি হয় না। তাই বলা হয়েছে, ‘আমরা অথবা তােমরা সৎ পথে অথবা স্পষ্ট বিভ্রান্তিতে আছি ও আছ?’ আলোচ্য আয়াতে বিরুদ্ধবাদীদের সাথে কিভাবে তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত হতে হবে এবং এর ভাষা ও ভংগী কেমন হওয়া উচিত, সে সম্পর্কে শিক্ষা দেয়া হয়েছে। এখানে স্বয়ং রসূলুল্লাহ(স.) কে মােশরেকদের সাথে কথা বলার নিয়ম শিক্ষা দিয়ে বলা হয়েছে, ‘বলাে, আমাদের যে কোনাে এক পক্ষ হয় সঠিক পথে আছে, অথবা ভ্রান্ত পথে আছে।’ কে সঠিক, আর কে ভ্রান্ত-এই বিষয়টি নির্দিষ্টভাবে বলার আর প্রয়ােজন হচ্ছে না; বরং তা না বলাই উচিত। এর ফলে বিবেকবান ব্যক্তিমাত্রই চিন্তা-ভাবনার সুযােগ পাবে। অহংকার ও আত্মগরিমা না থাকলে মানুষ নিজেই অবস্থা উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে। বস্তুত আল্লাহ পাক মানুষের হেদায়াত চান, তার মঙ্গল চান। তার অপমান ও লাঞ্চনা কামনা করেন না। যারা অহংকারী, যারা আত্মম্ভরী, যারা ক্ষমতার দাপটে অন্ধ, যারা হার মানতে রাজি নয়-তাদের সাথে কোরআন নির্দেশিত এই পন্থায়ই তর্ক-বিতর্ক করা উচিত। এর ফলে তারা সত্যকে উপলব্ধি করতে পারবে। সত্যকে মেনে নিতে প্রস্তুত হবে। এটাই হচ্ছে যথার্থ পদ্ধতি। দাওয়াত ও তাবলীগের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের জন্য এই পদ্ধতিই উত্তম।
#’বলো, আমাদের অপরাধের জন্য তােমরা জিজ্ঞাসিত হবে না এবং তােমরা যা কিছু কর, সে সম্পর্কে আমরা জিজ্ঞাসিত হবাে না'(আয়াত ২৫) এই আয়াতের বক্তব্য দ্বারা খুব সম্ভবত, রসূলুল্লাহ(স.) ও সাহাবায়ে কেরামদের সম্পর্কে মোশরেকদের মিথ্যা অপবাদের উত্তর দেয়া হয়েছে। মােশরেকরা রসূলুল্লাহ(স) ও তাঁর সাহাবায়ে কেরামকে ভ্রান্তবাদী ও ধর্মত্যাগী বলে অপবাদ দিতাে। আসলে বাতিলপন্থীরা এভাবেই লজ্জা-শরমের মাথা খেয়ে যুগে যুগে হকপন্থীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ রটিয়ে আসছে, তাদেরকে দোষারােপ করে আসছে। তাই রসূলকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে, ‘বল, আমাদের অপরাধের জন্যে তােমরা জিজ্ঞাসিত হবে না…’ অর্থাৎ প্রত্যেকেই নিজ নিজ কর্মের ফল ভােগ করবে। কাজেই প্রত্যেকেই নিজের ব্যাপারে চিন্তা করা উচিত এবং তলিয়ে দেখা উচিৎ যে, সে মঙ্গলের পথে ধাবিত হচ্ছে না অমঙ্গলের পথে? এই হৃদয়গ্ৰাহী বর্ণনাভংগী মানুষের মনকে নাড়া দেয়, তার মাঝে চিন্তা ভাবনার উদ্রেক ঘটায়। এর ফলে সে সত্যকে উপলব্ধি করতে পারে এবং স্বতস্ফূর্তভাবে তা গ্রহণ করতে সম্মত হয়। পরবর্তী আয়াতে বলা হয়েছে, ‘বল আমাদের পালনকর্তা আমাদেরকে সমবেত করবেন…'(আয়াত ২৬) প্রথম পর্যায়ে আল্লাহ পাক হকপন্থী ও বাতিল পন্থীদেরকে একত্রিত করবেন যেন, হক ও বাতিল মুখোমুখি হতে পারে। এর ফলে হকপন্থীরা তাদের সত্য আদর্শের প্রতি অবিচল থাকতে পারবে। তবে প্রথম দিকে হক ও বাতিলের মাঝে সংমিশ্রণ ঘটবে। ফলে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হবে। হক ও বাতিলের পার্থক্য নির্ণয় করা কঠিন হয়ে পড়বে। সংশয়-সন্দেহ জন্ম নেবে। এমনকি হকের ওপর বাতিলের প্রাধান্য লক্ষ্য করা যাবে। কিন্তু তা হবে ক্ষণিকের জন্য। এরপর উভয় শ্রেণীর মধ্যকার ব্যবধান আল্লাহ পাক সুস্পষ্টরূপে নির্ণয় করে দেবেন। উভয়ের ব্যাপারে তার চুড়ান্ত ফয়সালা ঘােষণা করে দেবেন। তার ফয়সালা হবে বস্তুনিষ্ঠ ও সত্যনির্ভর। কারণ তিনি হক ও বাতিলের পার্থক্য জেনেই সে ব্যাপারে তার চূড়ান্ত রায় ঘােষণা করবেন। তিনি ফয়সালাকারী, সর্বজ্ঞ। সে কারণেই আল্লাহ তায়ালা ফয়সালা ও সিদ্ধান্তের প্রতি আস্থা রাখা যায় তিনি কেবল বিচারকই নন, বরং তিনি মীমাংসা কারী এবং সত্য মিথ্যার পার্থক্য নির্ণয়কারীও। তিনি ক্ষণিকের জন্যই বিভ্রান্তিকে প্রশ্রয় দেন না এবং হক ও বাতিলের মধ্যকার সংমিশ্রণকে মেনে নেন না। এর ফলে সত্যের ধারকরা নিজ সাধনা বলে, নিজ দাওয়াতী কর্মকান্ডের মাধ্যমে এবং নিজ অভিজ্ঞতার বলে সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করার সুযােগ পাবে। এর বাইরে তাে আল্লাহ পাকের চূড়ান্ত শক্তি আছেই। তিনি অবশ্যই সত্য ও মিথ্যা এবং হক ও বাতিলের পার্থক্য সুস্পষ্টরূপে নির্ণয় করে থাকেন। হক ও বাতিলের মাঝে চূড়ান্ত ফয়সালা কখন হওয়া উচিত, এ ব্যাপারে একমাত্র আল্লাহ পাকই ভালাে জানেন। এর সময়সীমা নির্ধারণ করার শক্তি কারও নেই। কারণ হক ও বাতিলকে একত্রিত করেন আল্লাহ পাক নিজেই। এবং এর মীমাংসাও করেন তিনি নিজেই। পরের আয়াতে পুনরায় কল্পিত শরীকদের প্রসংগের অবতারণা করে অত্যন্ত জোরালাে ভাষায় ও চ্যালেঞ্জের সুরে বলা হয়েছে, ‘বল, তােমরা যাদেরকে আল্লাহর সাথে অংশীদার রূপে সংযুক্ত করেছে, তাদেরকে এনে আমাকে দেখাও…'(আয়াত ২৭) প্রশ্নের মাঝে নিন্দা ও তাচ্ছিল্যের সুর ধ্বনিত হয়েছে। অর্থাৎ ওরা কারা? ওদের মূল্য কি? ওদের গুনাগুণ কি? ওদের মান-মর্যাদা কি? কিসের ভিত্তিতে ওদেরকে তােমরা আল্লাহর শরীক মনে করছাে? এই তাচ্ছিল্য ও অবজ্ঞাপূর্ণ প্রশ্ন রেখে অত্যন্ত কঠোর ভাষায় ও ধমকের সুরে বলা হয়েছে, ‘প্রয়ােজন নেই বরং তিনিই আল্লাহ, পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময়’ কাজেই এই গুণের অধিকারীও কেউ হতে পারবে না এবং তাঁর শরীকও কেউ হতে পারবে না।
# ‘আমি তােমাকে সমগ্র মানব জাতির জন্যে সু সংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে পাঠিয়েছি। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা জানে না…'(আয়াত ২৮-৪২) এই পর্বে আল্লাহর রসূলের অস্বীকারকারী ভােগবাদী ও ধনবাদী সম্প্রদায়ের বিষয়ে আলােচনা করা হয়েছে। ভােগ-বিলাস, পার্থিব ধন-সম্পদ ও সন্তান সন্তুতির অধিকারী হয়ে এ সকল লােকেরা মনে করে যে, তারাই আল্লাহর প্রিয় পাত্র। এরা আরও মনে করে, তাদের ধন-দৌলত ও সন্তান সন্তুতি তাদেরকে সব ধরনের আযাব থেকে রক্ষা করবে। কিন্তু, পরকালে তাদের প্রকৃত অবস্থা কী দাঁড়াবে তা দৃশ্যমান করে তাদের সামনে তুলে ধরা হয়েছে যেন তারা সঠিক চিত্রটি অনুধাবন করতে পারে। এখানে তাদেরকে আরও জানিয়ে দেয়া হচ্ছে যে, পরকালে তাদের কেউ উপকার করতে পারবে না, কোন সাহায্য করতে পারবে না। এমনকি যে সব জ্বীন বা ফেরেশতাদের উপাসনা তারা করে থাকে, তারাও কোনাে কাজে আসবে না। এই বক্তব্যের ফাঁকেই আল্লাহ পাক জানিয়ে দিচ্ছেন, সত্যিকার মূল্যবােধ ও আদর্শ কোনটি যা পরকালীন মাপকাঠিতে উতরে যাবে এবং কৃত্রিম ও বানােয়াট মূল্যবােধ কোনটি যা নিয়ে ওরা পার্থিব জীবনে গর্ব করে থাকে। সাথে সাথে আল্লাহ পাক এও জানিয়ে দিচ্ছেন যে, দারিদ্র্য ও স্বচ্ছলতা হচ্ছে এমন একটি বিষয় যা সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল। দারিদ্র কখনও আল্লাহর সন্তুষ্টি অথবা অসন্তুষ্টির মাপকাঠি হতে পারে না। তদ্রুপ এর দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য প্রাপ্তিও প্রমাণ করা যায় না এবং আল্লাহর রহমত হতে বঞ্চিত হওয়াও প্রমাণ করা যায় না। মােটকথা, দারিদ্র্য ও স্বচ্ছলতা হচ্ছে আল্লাহর পক্ষ থেকে এক ধরনের পরীক্ষান্বরূপ। *নবীর দায়িত্ব ও সীমাবদ্ধতা : ‘আমি তােমাকে সমগ্র মানব জাতির জন্যে সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী রূপে পাঠিয়েছি…'(আয়াত ২৮-৩০) পূর্ববর্তী আয়াতে হকপন্থী ও বাতিলপন্থীদের ব্যক্তিগত করণীয় বিষয়াদি নিয়ে আলােচনা করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে যে, উভয় শ্রেণীর লােকেরা নিজ নিজ আদর্শের প্রতি মানুষকে আহ্বান করা ছাড়া তাদের আর কিছুই করার নেই। কারণ চূড়ান্ত ফলাফল আল্লাহর হাতেই ন্যস্ত। আলােচ্য আয়াতে রসূলুল্লাহ(স.)-এর নবুওতি দায়-দায়িত্বের বর্ণনার সাথে সাথে সেই দায়িত্ব সম্পর্কে মানুষের অজ্ঞতা বিষয়েও আলােচনা করা হয়েছে। আয়াতে বলা হয়েছে যে, অজ্ঞতা ও অপরিণামদর্শিতার বশবর্তী হয়ে মানুষ অনেক সময় আল্লাহ নির্ধারিত পুরস্কার অথবা শাস্তি দ্রুত কামনা করে থাকে। অথবা এ সব ব্যাপারে সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে। তিনি এ সবের জন্য যে সময়সীমা নির্ধারণ করে রেখেছেন, তার কখনও ব্যতিক্রম ঘটবে না। নবুওতের দায়িত্ব প্রসংগ বলতে গিয়ে আলোচ্য আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তােমাকে সকল মানব জাতির জন্যে সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে পাঠিয়েছি…’ অর্থাৎ সুসংবাদ দান করা ও সতর্ক করা হচ্ছে একজন নবীর অন্যতম মূল দায়িত্ব। তবে এই সুসংবাদ ও সতর্কবাণীর বাস্তবায়ন নবীর দায়িত্ব নয়। বরং এ দায়িত্ব হচ্ছে স্বয়ং আল্লাহর কিন্তু অনেক মানুষই তা জানে না। তারা বলে থাকে, ‘তােমরা যদি সত্যবাদী হও, তবে বলাে, এ ওয়াদা কখন বাস্তবায়িত হবে?’ এ সব প্রশ্ন দ্বারা বুঝা যায় যে, প্রশ্নকারীরা একজন নবীর মূল দায়িত্ব সম্পর্কে অজ্ঞ। এমনকি নবুওত ও রেসালতের সীমারেখা সম্পর্কেও এরা অজ্ঞ। এই অজ্ঞতা তাওহীদের আকীদার পরিপন্থী। তাই তাওহীদের বিশ্বাস কুসংস্কার মুক্ত রাখার জন্য পবিত্র কোরআন ঘোষণা দিয়ে জানিয়ে দিচ্ছে যে, মোহাম্মদ(স.) হচ্ছেন একজন রসূল, তাকে নির্ধারিত কিছু দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করা হয়েছে। এই দায়িত্বের বাইরে তার করার মতাে কিছুই নেই। চূড়ান্ত ফয়সালার মালিক তিনি নন; বরং আল্লাহই হচ্ছেন এর মালিক। তিনিই রসূলকে মানুষের হেদায়াতের দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছেন। তার দায়িত্ব ও কর্তব্যের সীমারেখাও তিনি নির্ধারণ করে দিয়েছেন। কোনাে আসমানী ওয়াদা বা শাস্তির বাস্তবায়নের দায়িত্ব নবীর হাতে ন্যস্ত নয়। এমনকি এসব বিষয়ের সঠিক জ্ঞানও তার নেই। কারণ এসব বিষয় হচ্ছে নিতান্তই আল্লাহর জানার বিষয়। তিনিই এসব বিষয়ের সঠিক জ্ঞান রাখেন এবং এসব বিষয়ের বাস্তবায়নও তার হাতেই ন্যস্ত। কাজেই রসূলকে যে বিষয়ের জ্ঞান ও দায়িত্ব দেয়া হয়নি, সে বিষয়ে তাকে কোন প্রশ্ন করাই সমীচীন নয়। এর পরও যদি কেউ প্রশ্ন করে তাহলে তার উত্তর এ ভাবে দেয়ার জন্য নবীকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, ‘বল, তোমাদের জন্যে একটি দিনের ওয়াদা রয়েছে যাকে তােমরা এক মুহূর্তও বিলম্বিত করতে পারবে না এবং ত্বরান্বিতও করতে পারবে না।'(আয়াত ৩০) অর্থাৎ আল্লাহ পাক যে সব বিষয়ের জন্যে চূড়ান্ত সময়সীমা নির্ধারণ করে রেখেছেন তা সেই নির্ধারিত সময়েই ঘটবে। এর ব্যতিক্রম হবে না। ব্যক্তি বিশেষের ইচ্ছায় তা পূর্বেও ঘটবে না এবং পরেও ঘটবে না। এখানে খাম খেয়ালীর কোনাে অবকাশ নেই এবং চমক দেখানােরও কোনাে সুযােগ নেই। যা কিছু ঘটছে বা ঘটবে তা সম্পূর্ণরূপে নির্দিষ্ট নিয়মের মধ্যেই ঘটছে বা ঘটবে। প্রতিটি ঘটনা বা বিষয় পরস্পর সম্পৃক্ত। আল্লাহ পাকের কুদরতী নিয়ম-নীতিই সকল ঘটনাবলী ও তার স্থান কাল নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। এ সব বিষয় মানুষের জ্ঞানের আওতাধীন নয়। তবে আল্লাহ পাক তার কোনাে বিশেষ বান্দাকে এ ব্যাপারে কিছু জানালে জানাতেও পারেন। এই সত্যটুকু যারা অনুধাবন করতে পারে না, তারাই আসমানী ওয়াদা বা শাস্তির ব্যাপারে তাড়াহুড়াে করে, এর দ্রুত বাস্তবায়ন দাবী করে। এরা অজ্ঞ বলেই এমনটি করে থাকে।
*পথভ্রষ্ট জনগণ ও নেতাদের ঝগড়া : ‘কাফেররা বলে, আমরা কখনও এ কোরআনে বিশ্বাস করবো না এবং এর পূর্ববর্তী কিতাবেও নয়…'(আয়াত ৩১) কাফেরদের এই বক্তব্য তাদের গোঁড়ামি ও গােমিয়ার্তুমিরই সাক্ষ্য বহন করে। এরা সত্যের ধারই ধারে না। হেদায়াত এদের কাম্য নয়। এরা কোরআনকেও বিশ্বাস করে না এবং পূর্ববর্তী অন্য কোনাে আসমানী কিতাবও মানে না। অর্থাৎ কোনাে আসমানী কিতাবের প্রতি বিশ্বাস করার জন্য এরা কখনই প্রস্তুত নয়। বর্তমানেও নয় এবং ভবিষ্যতেও নয়। এরা কুফরী মতবাদের ওপরই অটল ও অবিচল থাকতে চায়। তাই ইচ্ছা করেই তারা সত্যের প্রতি, সত্যের দলীল প্রমাণের প্রতি দৃষ্টিপাত করবে না বলে স্থির করে রেখেছে। তাদের এই কার্যকলাপ ইচ্ছাকৃত অপরাধেরই শামিল। তাই পরকালে এই অপরাধের শাস্তি কিরূপ হতে পারে তার একটা চিত্র নিচের আয়াতে তুলে ধরা হয়েছে, ‘তুমি যদি পাপিষ্ঠদেরকে দেখতে যখন তাদেরকে তাদের পালনকর্তার সামনে দাঁড় করানাে হবে, তখন তারা পরস্পর কথা কাটাকাটি করবে…'(আয়াত ৩১-৩৩) পৃথিবীর বুকে দম্ভ ভরে তারা বলতে পারে, আমরা কখনও এই কোরআনের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবাে না কিন্তু পরকালে এ কথা বলা তাদের পক্ষে মােটেও সম্ভবপর হবে না। কারণ তখন তাদেরকে আসামীর মতাে মহান আল্লাহর দরবারে এনে হাযির করা হবে। নিজেদের কৃতকর্মের জন্য তাদেরকে অপেক্ষায় ভীত সন্ত্রস্ত থাকতে হবে। তখন তাদের করার কিছুই থাকবে না। সেই মুহূর্তে তারা পরস্পরকে দোষারােপ করতে থাকবে, গালমন্দ করতে থাকবে এবং কথা কাটাকাটি করতে থাকবে। তাদের বক্তব্য হবে এরূপ, যাদেরকে দুর্বল মনে করা হতাে, তারা অহংকারীদেরকে বলবে, তােমরা না থাকলে আমরা অবশ্যই মােমেন হতাম। অর্থাৎ পরকালের এই দুর্গতি ও লজ্জাজনক পরিণতির জন্য তারা তখন প্রভাবশালী লােকদেরকে দায়ী করবে। পরকালে দুর্বল লােকেরা প্রভাবশালী লোকদের এভাবে প্রকাশ্যে দোষারােপ করতে পারবে। অথচ দুনিয়ার জীবনে এমনটি করা তাদের পক্ষে কখনও সম্ভবপর নয়। কারণ জাগতিক জীবনে এদের অবস্থান হয় দুর্বল, হীন ও আপােষকামী। এদের ব্যক্তিস্বাধীনতা বলতে কিছু থাকে না, আত্মমর্যাদা বলতে কিছু থাকে না এবং থাকে না সচেতনতা বলতে কোনাে কিছু। এরা সম্পূর্ণরূপে পরাধীন। কিন্তু পরকালে যখন কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হবে এবং নিজেদের মনগড়া আদর্শের ধস নামবে তখন তারা নির্ভয়ে ও নির্বিঘ্নে বলে উঠবে, ‘তােমরা না থাকলে আমরা অবশ্যই মােমেন হতাম। দুর্বল লােকদের এসব কথায় বড় লােকেরা খুবই ব্রিতকর অবস্থায় পড়ে যাবে। কারণ তারা আজ একই পরিস্থিতির শিকার। এর ওপর দুর্বল লােকেরা তাদের দোষারােপ করছে। নিজেদের দুর্গতির জন্য তাদেরকে দায়ী করছে। কাজেই এখন আর চুপ থাকা যায় না। কঠিন ভাষায় এর একটা উত্তর দিতেই হয়। তাই তারা দুর্বলদেরকে উদ্দেশ্য করে বলছে অহংকারীরা দুর্বলকে বলবে, ‘তােমাদের কাছে হেদায়াত আসার পর আমরা কি তােমাদেরকে বাধা দিয়েছিলাম’ বরং তােমরাই তো ছিলে অপরাধী'(আয়াত ৩২) উত্তরে তারা বলতে চায় যে, এই পরিস্থিতির জন্য তারা আদৌ দায়ী নয়। তারা কাউকে হেদায়াত গ্রহণে বাধা দেয়নি। অথচ দুনিয়ার বুকে এই বড় লােকেরাই দুর্বলদেরকে দমিয়ে রাখতাে। তাদেরকে মূল্যহীন মনে করতাে। তাদের মতামতের কোনােই তােয়াক্কা করতাে না। এদের অস্তিত্বকেই স্বীকার করতাে না। এদের কোনাে কথাই তারা মানতাে না এমন কি শুনতেও চাইত না। কিন্তু আজকের এই ভয়াবহ কঠিন শাস্তির মুখােমুখি দাঁড়িয়ে সেই বড় লােকেরাই দুর্বল লােকদের কথার প্রতিবাদ জানিয়ে প্রশ্ন রাখছে, ‘তােমাদের কাছে হেদায়াত আসার পর আমরা তােমাদেরকে বাধা দিয়েছিলাম নাকি?’ বরং তােমরা ছিলে অপরাধী'(আয়াত ৩২) এই অপরাধীরা যখন দুনিয়াতে ছিলাে তখনও তারা বিবেকের দংশন জ্বালায় অস্থির থেকেছে এবং মনের দিক দিয়ে এত দুর্বল থেকেছে যে, মাথা উচু করে কখনাে কথা বলতে পারেনি, কথা বলতে গেলে তাদের ঠোট কেঁপে উঠেছে, কিন্তু আখেরাতে আজ তাদের সকল মিথ্যা মর্যাদা শেষ হয়ে যাবে। অলীক মর্যাদা ও সম্মানবােধ নিয়ে দুনিয়াতে বন্ধ চোখে যে দিবা স্বপ্ন তারা দেখেছে সেখানে তাদের সে মিথ্যার পর্দা সরে যাবে এবং তাদের সকল গােপন আচরণ তাদের আমলনামার আকারে সামনে এসে যাবে। সেদিন যারা দুর্বল ছিলাে, নানা চাপে পড়ে দুনিয়াতে যারা কথা বলতে পারেনি, তারা সােচ্চার হয়ে উঠবে। তারা সেদিন আর চুপ থাকবে না এবং পৃথিবীর মতাে অবনত মাথায়ও থাকবে না; বরং পৃথিবীর সেসব অহংকারী ও দাপট প্রদর্শনকারী যালেমদের মুখােমুখি দাঁড়িয়ে তাদের সকল ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে দেবে, ছাফ ছাফ তাদের মুখের ওপর তাদের সত্য বিরােধিতার কথা তাদের হঠকারিতা ও সত্যকে গােপন করার কথা ঘােষণা করতে থাকবে, শক্তি-ক্ষমতা ব্যবহার করে অন্যায় কাজে মানুষকে উস্কানি দেয়ার কথা জানাতে থাকবে অন্যায় কাজের দিকে মানুষকে এগিয়ে দেয়ার জন্য এবং মানুষকে পথভ্রষ্ট করার জন্য তারা তাদের সকল ক্ষমতা যেভাবে ব্যবহার করেছে সেসব কথা সেদিন সবই প্রকাশ করে দেয়া হবে। তাই এরশাদ হচ্ছে, ‘আল্লাহ তায়ালার ক্ষমতায় আরও কেউ অংশীদার আছে বলে মেনে নেই।'(আয়াত ৩৩) হাশরের সেই ভয়ানক দিনে তারা দেখবে দুনিয়ার বুকে অমুক তমুক যারা ক্ষমতার দাপট এবং যারা কেয়ামতের আযাব থেকে বাঁচিয়ে নেবে বলে গলাবাজি করতাে, তাদের কোনােই ক্ষমতা নেই, তারা কোনাে বলদর্পী ও আত্মম্ভরী ব্যক্তিকে বাঁচাতে পারবে না, না পারবে কোনাে দুর্বল ও অসহায় ব্যক্তিকে উদ্ধার করতে। প্রত্যেককেই তার নিজের ভুল-ভ্রান্তি ও ইচ্ছাকৃত অপরাধের জন্য দায়ী হতে হবে। যারা নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রদর্শন করেছে তাদের ঘাড়ে তাদের গোনাহের বােঝা থাকবে- আরও থাকবে অন্য সেসব লােকদের বােঝা, যাদেরকে তারা পথভ্রষ্ট করেছিলাে এবং ধোকা দিয়ে সঠিক পথ থেকে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। দুর্বলতায় যারা ঘেরাও হয়েছিলাে তাদেরকেও কিছু বােঝা বইতে হবে। তাদেরকে জিজ্ঞাসা করা হবে, কেন তারা এ বিদ্রোহী ও নাফরমান লােকদের তাবেদারী করেছিলাে? শুধু এতটুকু অজুহাতে তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হবে না যে, তারা দুর্বল ছিলাে এবং নানা প্রকার অসুবিধার কারণে তারা ওদের কথা মানতে বাধ্য হয়েছিলাে। আল্লাহ রব্বুল আলামীন তাদেরকে বুঝ শক্তি তাে দিয়েছিলেন, যার দ্বারা তারা ভাল মন্দ পার্থক্য করতে পারতাে এবং তাদেরকে তিনি আযাদীও দিয়েছিলেন, যার কারণে তারা তাদের আনুগত্যেও বাধ্য ছিল না। সামান্য কিছু বৈষয়িক অসুবিধা হবে, এ জন্য তাদের বােধশক্তিকে তারা খর্ব করে দিয়েছিলাে এবং তাদের স্বাধীনতাকে তারা বিক্রি করে দিয়েছিল। তাদের ওপর গিয়ে স্বেচ্ছায় নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলাে বা নিজের ইচ্ছাতেই তাদের প্রিয়পাত্র হওয়ার জন্য তাদের লেজুড়বৃত্তি করতে রাযি হয়ে গিয়েছিল। আল্লাহ তায়ালার আযাবের ভয় যদি তাদের অন্তরে থাকতাে, তাহলে নিশ্চয়ই তারা এ বিদ্রোহীদের অন্ধ আনুগত্য করত না। অতএব সবাই আজ শাস্তির হকদার হয়ে যাবে। তাদেরকে দুঃখ ও গ্লানি স্পর্শ করবে এবং তারা দেখতে পাবে তাদের জন্য আজ শাস্তির ব্যবস্থা উপস্থিত রয়েছে। এরশাদ হচ্ছে, ‘যখন তারা আযাবকে দেখবে তখন তারা লজ্জাকে গােপন করে রাখতে চাইবে’ এ হবে এমন এক দুঃখজনক অবস্থা, যা তারা প্রকাশ করতে পারবে না, বুকের মধ্যে তাদের কথা আটকে যাবে, মুখে কথা উচ্চারণ করতে গিয়ে জিহ্বা আড়ষ্ঠ হয়ে যাবে এবং ঠোট নড়তে চাইবে না। তারপর তাদেরকে অপমানজনক এক কঠিন আযাব স্পর্শ করবে। এরশাদ হচ্ছে, ‘আমি কাফেরদের গলায় শিকল পরিয়ে দেবো’ এরপর প্রসংগ এগিয়ে চলেছে তাদের কথার দিকে যাদেরকে গলায় শিকল পরিহিত অবস্থায় |টেনে হিচড়ে নিয়ে যাওয়া হবে। তাদেরকে অবহেলা ভরে সেইভাবে সম্বোধন করা হবে যেমন কোন পরিদর্শক কাউকে সম্বােধন করে। বলা হবে, ‘তাদেরকে সেই কাজের প্রতিদান কি দেয়া হবে না, যা তারা করেছে’। তারপর যালেমদের মধ্য থেকে যারা অহংকারী এবং দুর্বল ছিলাে তাদের থেকে পর্দা সরিয়ে নেয়া হবে, কারণ তারা উভয়েই ছিলাে যালেম। তাদের একদল লােক যুলুম করেছে, তারা অন্য মানুষকে অন্যায় করার জন্য মজবুর করেছে, তারা নিজেরা অহংকার ও বিদ্রোহ করেছে এবং মানুষকে পথভ্রষ্ট করেছে। আর একদল যুলুম করেছে, তারা অন্যায়কারীদের কাছে নতি স্বীকার করে নিজেদের আত্মসম্মানবােধকে ক্ষুন্ন করেছে, সত্যিকার অর্থে তারা তাদের মানবতাবােধকে অপমান করেছে, মানবতার আযাদীকে তারা পর্যদুস্তু করেছে, বিদ্রোহী ও নাফরমানদের কাছে নতি স্বীকার ও আত্মসমর্পণের মাধ্যমে তারা নিজেদের সম্মান করেছে, এ জন্য উভয়পক্ষই আজ সমানভাবে শাস্তির মধ্যে থাকবে। তাদের সেই পরিমাণ শাস্তিই দেয়া হবে যে পরিমাণ অন্যায় তারা করেছে।
*প্রাচুর্য ও দৈন্য আল্লাহর সন্তুষ্টি অসন্তুষ্টির মাপকাঠী নয় : আবারও এ দৃশ্য থেকে পর্দা সরিয়ে নেয়া হবে। এবারে যালেমরা তাদের নিজেদেরকে জীবন্ত দৃশ্যের মধ্যে দেখতে পাবে। এ পরিস্থিতি দেখে তাদের চোখ উল্টে যাবে, সেখানে তারা তাদের নিজেদের দেখবে। সেখানে তারা অন্যদেরকে এমনভাবে দেখতে থাকবে যেন, তারা নিজেদেরকেই দেখছে। এখানে কুরাইশদের সচ্ছল ব্যক্তিরা তাদের পূর্ববর্তীদের মতােই কথা বলেছে। আর এভাবেই প্রত্যেক যামানার বিত্তশালী লােকেরা তাদের কাছে আগত রাসূলের সাথে কথা বলেছে। এরশাদ হচ্ছে, ‘আমি যখনই কোনাে এলাকায় কোনাে সাবধানকারী কোনাে রসূল পাঠিয়েছি সেগুলােকে আমরা মানি না'(আয়াত ৩৪) এ কাহিনীর পুনরাবৃত্তি পৃথিবীতে বারবারই হয়েছে এবং যুগ যুগান্তর ধরে এই ধরনের ব্যবহার আল্লাহ তায়ালার পথে আহ্বানকারীদেরকে বারবারই সইতে হয়েছে। এ সব ঘটনাকে সামনে রাখলে সহজে যে জিনিসটি বুঝা যায় তা হচ্ছে, মানুষ যখন সচ্ছল হয়, যখন কোনাে ব্যাপারে তার কোন অভাববােধ থাকে না তখন তাদের হৃদয় মন শক্ত হয়ে যায়, তাদের স্বাভাবিক বুদ্ধি-বিবেক লােপ পেয়ে যায়। তারা যেন আর ভাল-মন্দের বিচার করতে পারে না, উপস্থিত অবস্থার বাইরে তাদের দৃষ্টি আর প্রসারিত হয় না; তাদের স্বাভাবিক প্রকৃতিতে যেসব বিষয় অনুভূত হওয়া উচিত ছিলাে তা যেন আর স্ভব হয় না, অনুভূতি শক্তি জমাট বেঁধে যায়, যার কারণে সত্য-সঠিক পথের প্রমাণ তারা দেখেও আর দেখতে পারে না, তাদের চোখের ওপর পর্দা পড়ে যায়, আর এই কারণেই তারা হেদায়াতের নিদর্শনগুলােকে অবজ্ঞাভরে প্রত্যাখ্যান করে এবং অন্যায় ও মিথ্যার ওপর জমে থাকে, এর ফলে হেদায়াতের আলাে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হয়। একবার সে সম্পদশালী ও অভাবমুক্ত ব্যক্তিদের দিকে তাকিয়ে দেখুন, কেমন করে জীবনের মিথ্যা মূল্যবােধ তাদের ধোকার মধ্যে ফেলে রেখেছে, নশ্বর পৃথিবীর এসব ক্ষণস্থায়ী সহায় সম্পদ কেমন করে তাদের গাফলতির নিদ্রায় বেহুশ করে রেখেছে, শক্তি ও সম্পদের নেশায় তারা বুঁদ হয়ে রয়েছে, দুঃখ-যাতনা অভাব অভিযােগ না থাকায় এবং অঢেল সম্পদের প্রাচুর্য থাকায় তাদের মধ্যে বদ্ধমূল ধারণা সৃষ্টি হয়ে রয়েছে যে, এসব রাশি রাশি অর্থের বিনিময়ে তারা আল্লাহ তায়ালার আযাব থেকে রেহাই পেয়ে যাবে, তারা আরাে ধারণা করে যে, আল্লাহর প্রিয় না হলে কি এমনি এমনি তারা এতাে সচ্ছল হতে পেরেছে। অথবা তারা এ ধারণা করে যে, তারা যাবতীয় হিসাব নিকাশের উর্ধে। এরশাদ হচ্ছে, ‘আর ওরা বলে, সম্পদ ও সন্তানাদিতে আমরাই বেশী, কাজেই আমাদেরকে কোন আযাব দেয়া হবে না।’ মর্যাদা পাওয়ার সঠিক মানদন্ড কি আল কোরআন তাদের তা সুস্পষ্ট বক্তব্যে জানিয়ে দিচ্ছে এবং এ বিষয়ে একটা নীতিমালা নির্ধারণ করে দিয়েছে। তাদেরকে জানিয়ে দিয়েছে যে, রিযিকের প্রশস্ততা এবং তার সীমিতকরণ, এসব কারও এখতিয়ারাধীন নয় এবং কোনাে গােষ্ঠী বা জনপদকে এগুলাের ইজারাদারী দেয়া হয়নি যে, তারাই স্থায়ীভাবে এগুলাের মালিক হবে। সহায়-সম্পদ কমবেশী হওয়ার ওপরই আল্লাহর রেযামন্দি ও শান্তি দান নির্ভর করে না, এগুলাের আধিক্যের কারণে আযাব আসা বন্ধ হবে বা এগুলাের অভাবে আযাবে নিক্ষিপ্ত হবে, তাও নয়। হিসাব-নিকাশ বা কাকে কী প্রতিদান দেয়া হবে, এ বিষয়টির সাথে কার কতােটা ধন-সম্পদ আছে- তার কোনাে সম্পর্ক নেই, নেই এগুলাের সাথে আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি বা গযবের কোনাে সম্পর্ক। এ বিষয়ে আল্লাহতায়ালার বিধানে অন্য আইন রয়েছে; এরশাদ হচ্ছে, ‘বল, নিশ্চয়ই আমার রব যার জন্য ইচ্ছা তার জন্য রিযিক সম্প্রসারিত করেন এবং যার জন্য ইচ্ছা তার জন্য সংকুচিত করেন; কিন্তু অধিকাংশ মানুষ জানে না।'(আয়াত ৩৬) সচ্ছলতা ও অভাব, ধন সম্পদ ও সহায়-সম্পত্তি এবং সুখ-সৌন্দর্যের অধিকারী হওয়া বা এসব থেকে বঞ্চিত হওয়া এসব কিসের ভিত্তিতে হয় বা এসবের জন্য কি কি যােগ্যতা বা অযােগ্যতা প্রয়ােজন? অনেকের কাছেই এটা একটা জটিল প্রশ্ন। অনেক সময়ই দেখা যায়, অন্যায়কারী ও মিথ্যার ধান্ধা যারা করে তাদের জন্য দুনিয়া তার ভান্ডারের দ্বার অবারিত করে দিয়েছে। তারাই এগুলাের মালিক হয়ে গেছে যারা ফেতনা ফাসাদ এবং অশান্তিতে মানুষের জীবনকে ভরে দিচ্ছে এবং ভাল লােক ও আল্লাহর নেক বান্দাদের জীবনকে সমস্যা ও অভাব অভিযােগে দুর্বিষহ করে তুলছে এবং ফলে অনেকের ধারণা হয় যে আল্লাহ তায়ালার এ ভান্ডার থেকে তা তারাই বেশী বেশী পায়, যাদের মান মর্যাদা আল্লাহ তায়ালার কাছে বেশী এবং এই কারণে সে সম্পদশালী ব্যক্তিরাও এ কথা বলার সুযােগ পায় যে, তারাই আল্লাহ তায়ালার প্রিয়পাত্র। আবার অনেক মানুষ সত্য-ন্যায় ও সংশােধিত জীবন যাপনের মূল্য সম্পর্কেও সন্দেহ করে যে, এ সবের আসলেই তেমন মূল্য নেই; বরং খাও, পান কর ও ফুর্তি করাে এতে যে যেভাবে সুযােগ করে নিতে পারে নিক, এসব বিষয়ে ধরপাকড় করারও কেউ নেই। সত্যপন্থী হতে হলে চতুর্দিক থেকে বাধা আর বাধা, তার থেকে আর দশ জনের মতাে যখন যেমন তখন তেমন করলেই জীবনটা সহজ হয়ে যায়। এই পর্যায়ে এসে আল কোরআন চূড়ান্তভাবে দুনিয়ার সুখ আহলাদের আকর্ষণ ও সেই মূল্যবােধের মধ্যে পার্থক্য দেখিয়েছে, যা আল্লাহ তায়ালা নিজে চান। তারপর আল্লাহ তায়ালা স্থির করে দিচ্ছেন যে, তিনি যার জন্য ইচ্ছা তার জন্য রিযিকের ভান্ডার প্রশস্ত করেন, আবার যার জন্য ইচ্ছা সংকুচিত কৱেন । আর এই বিষয়টিই এখানে শুধু তার সন্তুষ্টির সাথে জড়িত। তার ক্রোধের বিষয়টি সম্পূর্ণ পৃথক একটি ব্যাপার, এ দুয়ের মধ্যে কোনাে সম্পর্ক নেই। রিযিকে দেয়ার ব্যাপারটা সম্পূর্ণ আলাদা। যার ওপর তিনি ক্রুদ্ধ তাকেও তিনি রিযিক দেন, তাকেও দেন যার ওপর তিনি সন্তুষ্ট। সংকীর্ণ যখন করেন তখন উভয়ের জন্যই সংকীর্ণ করেন। এখানে নেক ও বদের মধ্যে তিনি কোনাে পার্থক্য করেন না। তিনি কি জন্য কি করেন এবং কোন উদ্দেশ্যে তিনি কি করেন তা শুধু তিনিই জানেন। কারণ ও উদ্দেশ্য সকল সময়ে এক হয় না। অন্যায়কারীদের তিনি খাদ্য খাবার দিয়ে বাঁচিয়ে রাখেন, যেন ধীরে ধীরে তাদের পাপের ভান্ড পুরে যায়, অহংকারের পেয়ালা ভরে যায়, ফেতনা ফাসাদ ছড়ানাের ব্যাপারে তারা যেন চূড়ান্ত অবস্থায় পৌছে যায় এবং তাদের গুণাহ খাতা ও অপরাধ অসংখ্য গুণ বৃদ্ধি পায়। তারপর তাদের তিনি, তার জ্ঞান ও পূর্ব নির্ধারিত ফায়সালা অনুযায়ী দুনিয়া অথবা আখেরাতে পাকড়াও করেন এই ভাবে ওঁৎ পেতে থেকে তাদের অপরাধের খতিয়ান বের করা হয়। আবার কখনও তাদের প্রতি রুজি রােজগারের উপায়-উপাদান নিষিদ্ধ করা হয়, ফলে তাদের অন্যায় কাজ ও আচরণ আরও বাড়তে থাকে, তাদের গুনাহ বৃদ্ধি পেতে থাকে, তাদের অস্থিরতা সংকট বিপদ-আপদ বাড়ে এবং তারা আল্লাহ তায়ালার রহমত থেকে নিরাশ হয়ে যায়। এইভাবে তাদের থেকে তার মেহেরবানীর দৃষ্টি তুলে নিয়ে তিনি তাদেরকে বহুগুণে অন্যায় ও অপকর্ম এবং তিনি চূড়ান্তভাবে তাদেরকে বিপথগামী হওয়ার সুযােগ করে দেন। একইভাবে আল্লাহ রব্বুল আলামীন নেক পথের পথিকদের তার ভান্ডার থেকে তাদের প্রয়ােজনীয় দ্রব্য সামগ্রী দান করেন, যেন তারা ভাল কাজগুলাে স্থায়ীভাবে করে যেতে পারে, কারণ এসব সুযােগের অভাবে সেসব ভাল কাজ করা সম্ভব নয়। তাদের মন ও চেষ্টা আছে, প্রয়ােজন শুধু সুযােগ করে দেয়ার, তাই পরম দয়াময় তাদের এসব সুযােগ থেকে বঞ্চিত রাখেন না। তারা যেন তাদের অন্তর, জিহ্বা ও কাজ দ্বারা আল্লাহ পাকের নেয়ামতের শােরগােযারি করতে পারে, সকল দিক থেকে তাদের এসব অনুকূল অবস্থা সরবরাহ করেন, যেন তারা পরম পরিতৃপ্তির সাথে ভাল কাজ করতে পারে এবং এ সবের বিনিময়ে তারা তাদের পরওয়ারদেগারের কাছ থেকে অফুরন্ত পুরস্কার পাবেন, অভাবের মধ্যে ভাল কাজের প্রতি তাদের আকর্ষণের কথা আল্লাহ তায়ালা জানেন। তাদের সংশােধিত জীবন যাপনের সংকল্পের কথাও তিনি জানেন; এরপর, উদারচেতা এবং নেক দিল বান্দাদের থেকে তিনি বঞ্চনার অনুভূতি দূর করে, আল্লাহর মােহব্বতপূর্ণ অবদানের প্রাচূর্য্যে তাদের হৃদয় পরিপূর্ণ করে দেন এবং রহমানুর রহীম আল্লাহর ওপর তাদের অনাবিল আস্থা সঞ্চার করে দেন। করুণাময় আল্লাহ পাকের নেক নযর ও অযাচিত বরাদ্দ দানে তাদের হৃদয়মন পরম পরিতৃপ্তিতে ভরে থাকে এবং এক ও অদ্বিতীয় পাক পরওয়ারদেগারের সন্তুষ্টিতে তারা ধন্য হয়ে যায়, কেননা, তিনিই চিরস্থায়ী সকল কল্যাণের আধার। সেসব লােক নেক বান্দাদেরও তিনি তার কল্যাণ ও সন্তোষের ভান্ডার থেকে বহু গুণ বাড়িয়ে দিয়ে থাকেন, যার কোন সীমা সংখ্যা নেই। আল্লাহ তায়ালার হেকমতের দরুণ রিযিক বন্টন করা, প্রশস্ত করা আবার কখনও সেগুলােকে সংকুচিত করার কারণসমূহ যাইই হােক না কেন, সেটা একটা বিচ্ছিন্ন প্রশ্ন এবং আল্লাহ তায়ালা যখন যা দিতে চাইবেন তাই দেবেন। কার প্রতি কোন কারণে তিনি সন্তুষ্ট হবেন, তা একমাত্র তিনিই জানেন, এ বিষয়টি আমরা আমাদের বুদ্ধি দ্বারা মাপতে পারব না। তবে যে তার সন্তুষ্টিপ্রাপ্তির আশায় তার বান্দাদের কল্যাণে আত্মনিবেদন করবে, তার প্রতি তার নেক নজর পড়ার আশা করা যায়। কিন্তু তাই বলে কোনাে মানুষ নিজে নিজে এই সব নেক কাজ সামনে নিয়ে দাবী করতে পারে না যে, সে আল্লাহ তায়ালার নেক নযর পাবেই। ধন-দৌলত, খাদ্য খাবার, সন্তানাদি সব তার মেহেরবানীর দান, এসব কারও অর্জিত প্রতিদান নয় যে, কেউ দাবী করে বলতে পারবে। আমি এই এই ভাল কাজ করে এসব নেয়ামত অর্জন করেছি। আগে পরে যা কিছু প্রাপ্তি ঘটেছে। সবই আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে এবং তারই মেহেরবানীতে এসেছে এবং অবশেষে তার কাছেই সব ফিরে যাবে। তবে সাময়িকভাবে তাদেরকে কিছু দেয়া হয়েছে, যেন তারা এগুলাে থেকে খরচ করতে পারে, সেখানেও কাউকে দেয়া হয়েছে বেশী এবং কাউকে দেয়া হয়েছে কম। যাকে আল্লাহ পাক ধন সম্পদ ও সন্তানাদি দিয়েছেন, তারা যদি এসব নেয়ামতের সঠিক ব্যবহার করে, তাহলে আল্লাহ রব্বুল আলামীন তাদেরকে এ সব নেক কাজের বিনিময়ে সর্বোত্তম প্রতিদান দেবেন, কিন্তু, আমাদেরকে আল্লাহ তায়ালার সাথে নিকটবর্তী করে দেয়ার ব্যাপারে ধন-সম্পদ এবং সন্তানাদির কোন ক্ষমতা নেই, বরং সম্পদ ও সন্তানাদির সাথে যে ব্যবহার করা হবে, সেই ব্যবহারের ওপরই তার প্রতিদানকে কম বা বেশী করা হবে। এরশাদ হচ্ছে, ‘আর তােমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তানাদি তােমাদেরকে আমার নিকটস্থ করতে পারবে না।'(আয়াত ৩৮) রিযিকের প্রশস্ততা ও সংকুচিত হওয়ার মূলনীতি সম্পূর্ণ ভিন্ন ভিন্ন জিনিস। এর দ্বারা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ভিন্ন হেকমত প্রদর্শন করতে চান। এ সম্পদ থেকে যা কিছু আল্লাহর পথে খরচ করা হবে তা পূজি আকারে জমা হতে থাকবে, যা পরকালীন জীবনের দুঃসময়ে তাদের ফায়দা দেবে। এ কথা এ জন্য জানিয়ে দেয়া হচ্ছে, যাতে করে অন্তরের মধ্যে এ সত্যটি সুস্পষ্টভাবে জাগরুক থাকে এবং মানুষকে আল্লাহ তায়ালার পথে ব্যয় করতে উৎসাহ যােগাতে পারে। এরশাদ হচ্ছে, ‘হে নবী তুমি বলো আমার মালিক… সর্বোত্তম রিযিকদাতা'(আয়াত ৩৯)কেয়ামতের বিশাল জনতার দৃশ্যের ছবি পেশ করে আপাতত এই পরিক্রমাটি সমাপ্ত করা হচ্ছে। সেখানে তিনি তাদেরকে সেই ফেরেশতাকুলের সাথে মুখােমুখি করাবেন আল্লাহ সােবহানাহু ওয়া তায়ালাকে বাদ দিয়ে যাদের ওরা পূজা করতাে এবং তাদের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করতাে। তারপর তাদের সেই আগুনের আযাব স্পর্শ করবে যার জন্য তারা বড়ই তাড়াহুড়াে করতাে এবং বলতাে, কখন আসবে সেই প্রতিশ্রুত দিন? সূরাটির প্রথম অধ্যায়ে এই বর্ণনা পেশ করা হয়েছে। এরশাদ হচ্ছে, ‘আজ তােমাদের একে অন্যের… মজা ভোগ করার'(আয়াত ৪২) আল্লাহ তায়ালাকে বাদ দিয়ে এই ফেরেশতাকুলের পূজা করতাে, অথবা মনে করতাে যে, ফেরেশতারা তাদের জন্য কেয়ামতের দিন সুপারিশ করবে। কাজেই কেয়ামতের সেই দিনে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাদের সাথে ওদের মােকাবেলা করাবেন, আর তখন তারা সবাই আল্লাহ। তায়ালার তসবীহ (পবিত্রতা বর্ণনা) করতে থাকবে, যাতে করে ওদের আশা ভুল বলে প্রমাণিত হয় এবং তারা বুঝতে পারে যে, আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছা ছাড়া ফেরেশতাদের কারও কোনাে উপকার করার কোনাে ক্ষমতা নেই। কে তাদের পূজা করত না করতাে- সে বিষয় তারা কিছুই জানে না। এইভাবে তাদের পূজা-অর্চনা সবই তখন অলীক ও ভুল বলে প্রমাণিত হবে। এ ধরনের সকল কাজই অসার ও ভিত্তিহীন হবে যে, তারা শুধু শয়তানের পায়রুবীই করতে থেকেছে। কখনও শয়তানের আনুগত্য ও তার প্রভাবে প্রভাবিত আবার কখনও বা আল্লাহ তায়ালাকে বাদ দিয়ে তার ক্ষমতায় অন্যদের শরীক জেনে তাদের পূজা পার্বন করার মাধ্যমে তা প্রমাণিত হয়ে। এটা তাে সত্য কথা, যখন তারা ফেরেশতাদেরকে পূজা করতাে, প্রকারান্তরে সে পূজা তারা করত শয়তানের! তৎকালীন আরবে জ্বিনদের এবাদত করা সম্পর্কে লােকেরা জানতাে, এ জন্য তাদের মধ্যে একদল লােক জ্বিনদেরও পূজা করত এবং তাদের কাছে সাহায্য চাইত। এরশাদ হচ্ছে, ‘বরং ওরা (যারা) জ্বিনদের পূজা করত তাদের অধিকাংশই তাদেরকে শক্তি, ক্ষমতার মালিক বলেও বিশ্বাস করত।’ এই পর্যায়ে এসে এই সূরার মধ্যে সােলায়মান(আ.) এর ঘটনাটা উল্লেখিত হয়েছে। যেখানে দেখা যায়, জ্বিনদের সাথে কাজ কারবার করার বেশ কিছু দৃষ্টান্ত রয়েছে এবং এখানে আল-কোরআনের মধ্যে অতীতের বিভিন্ন কাহিনী বর্ণনার এক বিশেষ পদ্ধতি অবলম্বিত হয়েছে। এ দৃশ্যের মধ্যে দেখা যাচ্ছে কাহিনী ও গুণ বর্ণনার ধারা পরিবর্তন করে সম্বােধন ও মুখখামুখি কথা বলার পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়েছে এবং অন্যায়ের জন্য তাদের দোষারােপ করা হয়েছে। এরশাদ হচ্ছে, ‘আজকের দিনে তােমাদের কেউ কারও কোনাে উপকার করতে পারবে না এবং পারবে না কেউ কারাে কোন ক্ষতি করতে।’ অর্থাৎ ফেরেশতারা মানুষের ওপর কোন কর্তৃত্ব খাটানাের মালিক নয়, এই কাফেররাও কেউ কারও ওপর কর্তৃত্বশীল নয়। যে আগুন বা দোযখের কথা যালেমরা প্রত্যাখ্যান করে বলত, তােমরা যদি সত্যবাদীই হয়ে থাক তাহলে বল না কখন আসবে সেই ওয়াদা করা দোযখ। হা, অবশ্যই ওরা সে দোযখের বাস্তব দৃশ্য দেখতে থাকবে এবং এর মধ্যে কোনই সন্দেহ নেই। এরশাদ হচ্ছে, ‘যালেমদের বলবাে, তােমরা দোযখের আযাবের স্বাদ গ্রহণ করাে, যাকে তােমরা অস্বীকার করতে।’ এইভাবে এই সফর শেষ হচ্ছে। অন্যান্য আরও বিষয়ের মত পুনরুত্থান দিবস, হিসাব ও প্রতিদান দেয়া সম্পর্কিত আলােচনা নিয়েই তা কেন্দ্রীভূত হয়ে রয়েছে।
# সংক্ষিপ্ত আলোচনা(৪৩-৫৩) : এখান থেকে শুরু হচ্ছে সূরাটির শেষ অধ্যায়ের তাফসীর। এখানে বিস্তারিত আলােচনা করা হয়েছে মােশরেকদের সম্পর্কে আলােচনা করা হয়েছে নবী(স.)-এর সাথে তাদের কথােপকথােন ও সেই মহান কিতাব আল কোরআন সম্পর্কে এবং নাফরমানী করার কারণে তাদের মত অতীতে অন্যান্য জাতির যে পরিণতি হয়েছিলাে সে সব ঘটনাবলীর আলােকে তাদের উপদেশ দান সম্পর্কে। এ অধ্যায়ে আরও দেখানাে হয়েছে, সে সব সত্য-বিমুখ লােকের পরিণতি, যারা সরাসরি সত্যের বিরােধিতা না করলেও সত্যকে গ্রহণ করা থেকে পিছিয়ে থাকার কারণে দুনিয়াতেই তাদের নানা আযাব ঘিরে ফেলেছে। অথচ অতীতের সেই সব জাতি এদের থেকে আরও বেশী শক্তিশালী আরও জ্ঞানী এবং আরও ধনী ছিল। এরপর এসেছে আরও বেশ কিছু দুর্ঘটনা, যেন তা উপযুপরি আসা কতিপয় ধ্বংসযজ্ঞ। অতীতের নাফরমান জাতিসমূহের বিপর্যয়ের ইতিহাস তুলে ধরে তাদের আহ্বান জানানাে হচ্ছে, তারা যেন সব দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে সর্বান্তকরণে আল্লাহ তায়ালার পথে এগিয়ে আসে এবং বাতিল ব্যবস্থার সেই সকল বাধা-বিঘ্ন ও প্রভাব থেকে মনকে মুক্ত করে নেয়, যা হেদায়াত থেকে তাদের বিরত রাখে, বিরত রাখে তাদের সঠিক চিন্তা করতে। আলােচ্য অধ্যায়টি যে বর্ণনা আমাদের কাছে পেশ করেছে, তা হচ্ছে, মানুষকে কেয়ামতের বাস্তবতা সম্পর্কে চিন্তা করতে আহ্বান জানানো। আল্লাহর রসূল(স.) যে মহান দাওয়াত নিয়ে এসেছিলেন তার মধ্যে দুটি কথাই ছিলাে প্রধান। এক. সারাবিশ্বের মালিক আল্লাহ তায়ালা, সুতরাং তার ভুবনে এবং তার রাজ্যে তারই আইন-কানুন চালু করার মাধ্যমে তাঁর প্রভুত্বকে প্রতিষ্ঠিত করা। দুই. এ কথা বুঝা যে, দুনিয়ার এ জীবনটা চিরস্থায়ী নয়, ক্ষণস্থায়ী এ জীবন শেষে চিরস্থায়ী জীবন আসবে, সেই জীবনে শান্তি পাওয়ার জন্যই এ জীবনে শৃংখলামতে চলতে হবে। ত্যাগ-তিতিক্ষা বরদাশত করা এবং সকল ব্যাপারেই জীবন-মৃত্যুর মালিক আল্লাহ পাকের হুকুম মতাে জীবন যাপন করার মধ্যেই ইহ-পরকালের সমূহ কল্যাণ ও শান্তি রয়েছে। এর বাইরে যে কাজ ও যে আচরণ তাতে সামগ্রিকভাবে মানুষের কোনাে কল্যাণই আসবে না। সুতরাং, তার দাওয়াতের মধ্যে যারা সন্দেহ আরােপ করবে অথবা সে দাওয়াত বাধাগ্রস্ত করবে তাদের পরিণতি বা তাদের শাস্তি হবে। ভয়ানক। তারপর রাসূলুল্লাহ(স.)-এর প্রতি পর্যায়ক্রমে অন্যান্য নির্দেশ আসছে। ‘বলা হচ্ছে, বল, বল, বল’ যাকে আল্লাহ রব্বুল আলামীন তার প্রতিনিধি বানিয়ে সারা বিশ্বকে পরিচালনার দায়িত্ব দিচ্ছেন, তিনি বারবার এই নির্দেশ পেয়ে প্রচন্ডভাবে কেঁপে উঠছেন, তার অন্তর এসব কঠিন দায়িত্বের সকল বােঝা জীবনের সকল শক্তি ও চেতনা দিয়েও যেন বহন করতে পারছেন না। এ অধ্যায়টি এখানে শেষ হচ্ছে। কেয়ামতের দৃশ্যাবলীর মধ্য থেকে একটি কঠিন দৃশ্যের উল্লেখ করা হয়েছে, তা যেন অন্যান্য ঘটনার সাথে সংযুক্ত রয়েছে। *তাফসীর : ৪৩ ও ৪৪ নং আয়াতের ব্যাখ্যা ৪৪ নং আয়াতে পড়ুন।
# *সত্যের দাওয়াতের বিরুদ্ধে পাপীদের অপপ্রচার : ‘আর যখন তাদের সামনে আমার সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী তেলাওয়াত করে শােনানাে হয়, তখন ওরা বলে ওঠে…’ (আয়াত ৪৩-৪৫) যখন রাসূল(স.) আল কুরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে তাদের কাছে সত্যকে সুস্পষ্টভাবে পেশ করেন, তখন তারা তার সাথে অতীতের সন্দেহপূর্ণ নিয়ম-কানুনের সাথে তুলনা করে দেখার সুযােগ পাচ্ছে। এই তুলনামূলক পর্যালােচনার মাধ্যমে তাদের সামনে ইসলামের যুক্তি ও সৌন্দর্য এবং বাস্তব জীবনে তার কার্যকারিতার কথা প্রমাণিত হয়ে যাচ্ছে। তারা এই যুক্তিহীন, অস্পষ্ট ও অন্ধ অনুকরণের অসারতাও দেখতে পাচ্ছে, যা কোনাে মযবৃত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়, যার পেছনে কোনাে শক্তিশালী যুক্তিও নেই। এমতাবস্থায় যখন কোরআনের আয়াত তাদের সম্বোধন করছিলাে তখন তারা এক অশনি সংকেত অনুভব করছিলাে, বুঝছিলাে আকীদা-বিশ্বাসের ব্যাপারে তাদের গােজামিলের দিন বােধ হয় শেষ হয়ে আসছে, সম্ভবত এবারে তাদের অন্ধ আনুগত্য এবং অযৌক্তিকভাবে দাসত্ব করার যামানার সমাপ্তি ঘটবে, যা তারা নিছক তাদের বাপ-দাদার অনুকরণের মাধ্যমে করে আসছিল। তবুও তারা শেষ রক্ষার নিমিত্তে বলে উঠলাে, ‘এ ব্যক্তি তাে একজন মানুষ ছাড়া আর কিছু নয়, তােমাদের বাপ-দাদারা যে ধর্মের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল- এ লােক তাে দেখছি সেই সব ব্যবস্থার বিরােধিতা করতে চায়।’ কিন্তু সে তাে একা একজন ব্যক্তি, কি সে করতে পারে! এক জন মাত্র ব্যক্তি বাপ-দাদার ধর্মের বিরােধিতা করতে গিয়ে নিশ্চয়ই কারও মন পরিবর্তন করতে পারবে না, পিতৃ-ধর্মকে বদনাম করতে পারবে না বা মানুষের মন-মগজের সকল খেয়াল পরিবর্তন করে তার অনুগত বানিয়ে নিতে পারবে না। এরই কারণে তারা প্রথম আনুগত্যকে দ্বিতীয় আনুগত্যের আহ্বানের ওপর অন্ধভাবে প্রাধান্য দিলাে, যদিও তারা বুঝছিলাে যে, তাদের কাছে পৌছে যাওয়া এক আমানতের তারা খেয়ানত করছে। তারা এই নতুন ও চিত্তাকর্ষক দাওয়াতকে এই বলে প্রত্যাখ্যান করতে লাগলাে যে আল্লাহর কাছ থেকে সে লাকটি এটা একটা ফালতু কথা নিয়ে এসেছে। ওদের কথাটি উদ্ধৃত করা হচ্ছে, ‘ওরা বললাে, এটা তো নিছক মনগড়া একটা কথা মাত্র।’ ওপরের এ বাক্যটির মধ্যে ব্যবহৃত ইফকুন শব্দটির অর্থ হচ্ছে মিথ্যা ও মনগড়া কথা। কিন্তু কথাটাকে সাধারণভাবে উচ্চারণ না করে জোর দিয়ে বলার জন্য তারা বলত, এটা মিথ্যা মনগড়া কথা ছাড়া আর কিছু নয়।’ এই দৃঢ় প্রত্যয় যুক্ত কথা দ্বারা মানুষের মনকে সত্যের প্রতি সন্দিগ্ধ করে তুলতে চাইতাে এবং চাইতাে যেন লােকেরা নবাগত এই সত্যের মূল্যকে তুচ্ছ জ্ঞান করে, একইভাবে তারা এ মূল্যবান সত্যের উৎস, অর্থাৎ বিশ্বজাহানের সৃষ্টিকর্তা, মালিক ও প্রভু সম্পর্কে মানুষকে সন্দিহান করে তুলতে চাইতাে। তারপর তারা আল কোরআন সম্পর্কেও অলীক ও কাল্পনিক প্রচারনা করতে দ্বিধাবােধ করতাে না। এরশাদ হচ্ছে, আর কাফেররা, সত্য সমাগত হওয়ার পর বলে উঠলাে, ‘এটা নিছক এক যাদু ছাড়া আর কিছু নয়। আসলে লােকদের মন নড়বড়ে করে দেয়ার জন্যই এ ধরনের বাচনভংগী ব্যবহার করা হয়। তাই তারা শুধু মনগড়া কথা বলেই ক্ষান্ত হয়নি, বরং হৃদয়ানুভূতির মধ্যে এক তীব্র বিষক্রিয়া সৃষ্টি করার জন্য আল্লাহ পাকের মর্মস্পর্শী আয়াতগুলােকে যাদু বলে আখ্যায়িত করল, বলল, ‘এতাে সুস্পষ্ট এক যাদু ছাড়া আর কিছুই নয়।’ এই ভাবে মহাগ্রন্থ আল-কোরআনের প্রতি তাদের তীব্র আক্রমণ মিথ্যা দোষারােপের এক বিরাট অভিযান চললাে, মিথ্যা এই জন্য যে, যা তারা মুখ দিয়ে বলতে শুরু করলাে তার প্রতি তাদের হৃদয়াভ্যন্তরে বিশ্বাসের লেশমাত্র ছিল না তারপরও তাদের এ অভিযান সহজে থামেনি, যুক্তির ধােপে একটি যদি না টেকে এবং মানুষ যদি একটি দ্বারা বিভ্রান্ত না হয় তাহলে তারা আর একটি পন্থা উদ্ভাবন করে, এইভাবে তারা বিভিন্ন আয়াতকে চিহ্নিত করে সেগুলােকে নানাপ্রকার আখ্যা দিতে লাগলাে, যেন মানুষের হৃদয় দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে যায় এবং সে আয়াতগুলাের প্রতি তারা আকৃষ্ট না হয়ে পড়ে। অথচ তারা যখন স্ববিরােধী এইসব অভিযান চালাচ্ছিল তখন তাদের কথা বা মতের সপক্ষে তারা কোন যুক্তি-প্রমাণ পেশ করতে পারছিল না (এ জন্যে যত জোরেশােরে তারা এ সব মিথ্যা অভিযান চালানাের চেষ্টা করছিলাে, সেভাবে তারা পারছিলাে না। কেননা, অন্তরে তাদের কোনাে শক্তি ছিল না। জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করার জন্য এবং মানুষকে পথভ্রষ্ট করার উদ্দেশ্যে তারা মিথ্যার ওপর মিথ্যার জাল বুনে চলছিল। এখন দেখতে হবে, কারা ছিলাে এসব জ্ঞানপাপী, যারা জেনে-বুঝে সত্য বিরােধী অভিযানে আদা পানি খেয়ে লেগেছিলাে এবং এখানে তাদের উদ্দেশ্যই বা কী ছিলাে। একটু খেয়াল করলেই বুঝা যায় যে, এরা ছিল সমাজের সুবিধাভােগী বিত্তবান ও ক্ষমতাভোগী লােক, যারা মিথ্যার বেসাতি করে মানুষকে বিভ্রান্ত করে নিজেদের প্রাধান্য কায়েম রাখার জন্য নিশিদিন মিথ্যা রচনা করতাে। তারা ভালাে করেই জানতাে, আল-আমীন মােহাম্মদ(স.) প্রৌঢ়ত্বের বয়স পর্যন্ত যার দিকে আংগুল তুলে কথা বলার সাহস কেউ করত না, আপামর জনসাধারণের হৃদয়ে যার আসন ছিলাে সুপ্রতিষ্ঠিত, তাকে সহজে বদনাম করা যাবে না, তার থেকে মানুষকে খুব বেশীদিন ফিরিয়ে রাখাও যে সম্ভব হবে না- তাও তারা বুঝতাে, তবুও তারা ভাবতাে দেখা যাক, মিথ্যার ওপর মিথ্যা ছড়িয়ে কতদিন পারা যায়। আল কোরআন যে সর্বশক্তিমান আল্লাহ তায়ালারই কালাম, এ কথা কি তারা বুঝতাে না? অবশ্যই বুঝতাে। এ কালামের আহ্বানকে ঠেকিয়ে রাখা মানুষের পক্ষে অসাধ্য, অসাধ্য কোনাে কুট তার্কিকের পক্ষে এ পাক কালামের মধুর বচন থেকে মানুষদের দূরে সরিয়ে রাখা। তবু দেখা যাক যতদিন পারা যায়। ফী যিলালিল কোরআন এ ইতিমধ্যে মুহাম্মদ(স.)-এর সম্পর্কে কাফের মােশরেকদের কিছু সংখ্যক নেতার কথা বিভিন্ন জায়গায় বর্ণনা করা হয়েছে। এই তেজোদীপ্ত ভাষণের কথা এই মহাগ্রন্থের বিভিন্ন স্থানে বর্ণিত হয়েছে। এগুলাের সংস্পর্শে এসে তারা বিমােহিত হয়ে যেত এবং তাদের অন্তর প্রাণ বশীভূত হয়ে যেতাে। তারপর তা এই অলৌকিক আকর্ষণ থেকে জনগণকে ঠেকানাের অসদুদ্দেশ্যে এবং তার আহ্বানকে প্রতিহত করার জন্য সজ্ঞানে ও সম্পূর্ণ সচেতনভাবেই তার বিরােধিতা করে আসছিলাে। (যেমন ওলীদ ইবনে মুগিরা, আবু সুফিয়ান ইবনে হারব এবং আখনাস ইবনে শুরায়েক-এর হাদীস থেকে জানা যায়) আল কোরআন তাদের খোলস উন্মোচন করে দিয়ে বলছে, কোরায়শী লোকজন ছিলাে সাধারণভাবে নিরক্ষর। আগে তাদের কখনও কিতাব দেয়া হয়নি, অর্থাৎ মক্কায় অবস্থিত কোরায়শ জনপদের নিকট কোনােকালেই কোনাে নবীর আগমন হয়নি এবং ঐশী গ্রন্থ নাযিল হয়নি যার শিক্ষার আলােকে আসমানী কিতাবসমূহকে কিংবা এর ওহী তারা যাচাই করতে পারতাে এবং এর দ্বারা পরখ করে এই কিতাব সম্পর্কে তারা মন্তব্য করতে পারতাে যে, আজকে নাযিল হওয়া এ কেতাব আসমানী কেতাব বা ওহী নয় এবং আল্লাহর কাছ থেকেও আসেনি। ইতিপূর্বে তাদের কাছে কোন রাসূল আসেননি এ সম্পর্কে কোন জ্ঞানও নেই। এরশাদ হচ্ছে, ‘আমি তাদের কোনাে কিতাব দেইনি, যা তারা পড়তে পারতাে এবং তােমার পূর্বে তাদের কাছে কোন সতর্ককারীও পাঠাইনি।’
*মানবজাতির জন্যে কোরআনের উপদেশ : যখন পূর্ববর্তী লােকদের সত্য বিরােধী সগ্রামের কথা তারা শােনে, তখন তাদের অন্তর এসব কথা অনুভব করে, অথচ তাদের পূর্বের লােকদের যে ধন-দৌলত, শক্তি এবং নির্মাণ ক্ষমতা দেয়া হয়েছিলাে তার দশ ভাগের এক ভাগও তাদের দেয়া হয়নি। এরপর যখন তারা রসূলদের প্রত্যাখ্যান করেছে তখন তাদের কঠিন শাস্তি এসে পাকড়াও করেছে। ভয়ংকর ঝড় তুফান অথবা ভীষণ ও দুরারােগ্য ব্যধির রূপ নিয়ে তাদের ওপর শাস্তি নেমে এসেছে। এরশাদ হচ্ছে , ‘ওদের আগে লােকেরাও রসূলদের প্রত্যাখ্যান করেছে… কেমন (কঠিন) হয়েছিলাে তাদের পরিণতি?’ অবশ্যই তাদের পরিণতি হয়েছিল অত্যন্ত ধ্বংসকর। কোরায়শরা আরব উপদ্বীপে অবস্থিত তাদের অনেকের ধ্বংসাবশেষেরই খবর রাখতাে, সুতরাং স্মারক হিসাবে এগুলােই তাদের জন্য ছিল যথেষ্ট। ‘অতপর খেয়াল করে দেখাে, কি ভয়ংকর হয়েছিল সে শাস্তি?’ এ একটা জীবন্ত প্রশ্ন। যা শ্রোতাদের হৃদয়কে গভীরভাবে আকর্ষণ করে, যেহেতু তারা জানে যে, সে শাস্তি কেমন হতে পারে! এখানে আল্লাহ তায়ালা মানুষদের সত্য সম্পর্কে আলােচনার খাঁটি পদ্ধতি জেনে নেয়ার জন্য আহবান জানাচ্ছেন, আহ্বান জানাচ্ছেন সত্য ও বাস্তবতা থেকে মনগড়া কথা কাকে বলে তাকে আলাদা করে বুঝার জন্য, এ ব্যাপারে কোনােপ্রকার মিথ্যার আশ্রয় না নিয়ে বা কারও অধিকারে হস্তক্ষেপ না করেই যেন এ চেষ্টা করা হয় তাই বলা হয়েছে।
# এরশাদ হচ্ছে, ‘বলাে, অবশ্য অবশ্যই আমি তােমাদের একটি বিষয়ে উপদেশ দিচ্ছি… সে তাে কঠিন আযাবের সামনে তােমাদের জন্য একজন সতর্ককারী মাত্র।'(আয়াত ৪৬) এ দাওয়াত হচ্ছে আল্লাহ তায়ালার দরবারে দাঁড়ানাের দাওয়াত। অর্থাৎ কুপ্রবৃত্তি ও সর্ব প্রকার পার্থিব চিন্তা থেকে নিজেকে মুক্ত করে একান্তভাবে আল্লাহ তায়ালার স্মরণে সুখ নিদ্রা পরিত্যাগ করার জন্য ও তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে তওবা করার আহব্বান। দুনিয়ার কোনাে স্বার্থ পাওয়ার অজুহাতে কোনাে অন্যায়ের সাথে আপোষ না করার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হওয়ার আহ্বান, বাজে সংস্রব থেকে দূরে থাকার আহ্বান, বাজে শােরগােল ও গান-বাজনা পরিহার করার আহ্বান। সর্বোপরি যাবতীয় প্ররােচনামূলক কাজ ও ব্যবহার যা মনকে সত্য থেকে দূরে সরিয়ে দিতে চায় তার থেকে দূরে থাকার আহ্বানও এর মধ্যে শামিল রয়েছে, কেননা এইসব জিনিসই মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়, প্রচলিত নিয়ম কানুন এবং জনশ্রুতিও মানুষকে অনেক ভ্রান্তির দিকে ধাবিত করে। ওপরের আয়াতে আল্লাহ তায়ালা দিগন্তে বিস্তৃত এই বাস্তবতার সাথে সামঞ্জস্য রেখে কাজ করে জীবনকে পরিচালনা করার আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু তাই বলে মানুষের মনগড়া ফায়সালা গ্রহণ করা নয়, বা লাগামছাড়া উপস্থিত আনন্দের জোয়ারে গা-ভাসিয়ে দেয়া নয় এবং মানুষের মনগড়া বিস্তৃত ব্যাখ্যার জালে নিজেকে আবদ্ধ করাও নয়। কেননা এসব কিছু মানুষের অন্তর ও বুদ্ধি সত্যকে গ্রহণ করতে ও সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে বাধা প্রদান করে। আলােচ্য আয়াতটি মানুষের প্রকৃতির মধ্যে অবস্থিত আবিলতাহীন সুস্থ বিবেক বুদ্ধির দিকে আহ্বান জানায়, সর্বদা মানুষকে সঠিক পথ দেখায় এবং লােভ লালসা চরিতার্থ করার জন্য মানুষের মজ্জাগত প্রবণতা নিয়ন্ত্রিত করে। ন্যায়-অন্যায়ের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয়ে শক্তি যােগায় এবং সেইসব প্রবণতা থামিয়ে দেয় যা সত্যকে ঢেকে দিয়ে মন্দের দিকে মানুষকে ধাবিত করে, সেইসব আপত্তিকর দৃশ্য থেকে তাদের বাঁচায়। আলােচ্য আয়াতটি সত্য সম্পর্কে এমনই এক বিস্ময়কর পথ প্রদর্শন করছে, যা জীবনের সকল ব্যাপারেই প্রযোজ্য। এটা এমনই এক প্রশস্ত পথ, যা মানুষের তৈরী জাহেলী যামানার অবশিষ্ট সকল প্রভাবকে প্রতিহত করে এবং মােমেনদের হৃদয়কে আল্লাহ তায়ালার হুকুম পালন করা ও তাকে ভয় করে চলার জন্য সদা-সর্বদা জাগ্রত করে রাখে। এ আয়াতে যে বিপ্লবী আকীদার প্রতি ইংগীত করা হয়েছে সে আকীদা একটিই… এই আকীদা যদি ঠিক হয়ে যায় তাহলে জীবনের চলার পথ সময়ই স্থির হয়ে যায় এবং সাফল্যে পৌছে দেয়ার জন্য তা মযবুতভাবে দাঁড়িয়ে যায়। আর সে উপায় হচ্ছে মনে-মগযের দিক থেকে আল্লাহমুখী হয়ে যাওয়া অর্থাৎ যা কিছু করবে একমাত্র আল্লাহ তায়ালার জন্য করবে, অন্য কোন উদ্দেশ্যে নয়। মন ভুলানাে অন্যান্য খেলাধূলা বা আমোদ-প্রমােদের কাজে সময় ব্যয় নয়, পার্থিব কোন সুযােগ-সুবিধার খাতিরেও নয়, বা এমন কোনাে বিনোদনের জন্যও নয়, যা মন মগযকে পুরােপুরিভাবে মজিয়ে ফেলে এবং আল্লাহ তায়ালার স্মরণ ও তার বিধান থেকে বেপরোয়া হয়ে এমন কোনাে বিষয়ে নিজেকে নিয়ােজিত করা সেখানে ন্যায়-অন্যায়ের অনুভূতি পর্যন্ত বিলুপ্ত হয়ে যায়। তাই এরশাদ হচ্ছে, ‘যেনাে তােমরা আল্লাহর জন্য দুজন দুজন করে এবং একাকী অবস্থায় দাঁড়াতে পারাে।’ দু’জন দু’জন করে বলতে বুঝানো হয়েছে, একজন অপর জনের কাজ পরখ করতে পারে, সহযােগিতা করতে পারে এবং কোনােপ্রকার প্রভাবিত না হয়ে সম্পূর্ণ যুক্তি বুদ্ধি সহকারে যা কিছু সঠিক তা সমর্থন করতে পারে। এ ব্যাপারে কোনােপ্রকার অস্বাভাবিক বা অযৌক্তিক আচরণ হয়ে গেলে তা খেয়াল করে একজনের ভুল অপর জন যেন শুধরে দেয়, যা কিছু যুক্তিপূর্ণ তা বলতে যেন কোনাে দ্বিধা না করে। আবার যখন একাকী কারও সামনাসামনি আল্লাহর কোনাে হুকুম পালন করবে তখন তার কাজের যথার্থতা ও যুক্তিসংগতা অপরকে প্রভাবিত করবে এবং এইভাবে সে আল্লাহর হক আদায় করবে।[আমাদের মনে রাখতে হবে, আলােচ্য সূরাটি মক্কী যিন্দেগীর প্রথম দিকে অবতীর্ণ, যখন ব্যক্তিগত আকীদা, কাজ ও সবর যেমন প্রয়োজন ছিলাে, তেমনি আলােচা আয়াতে পারত পক্ষে অন্তত দুজনকে একত্রিত হয়ে কাজ করার জন্যে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে দুজন এমন লােক পরস্পর সহযােগীতা করতে পারলে অনেক জটিলতাই সহজ হয়ে যায়- একথাও এখানে ইংগীতে বুঝা যাচ্ছে।-সম্পাদক] *নবী মুহাম্মদ(স.)-এর উদাহরণ : ‘তারপর চিন্তা-ভাবনা করতে থাকো, (জেনে রেখাে) তােমাদের সংগীকে কোনাে পাগলামী পেয়ে বসেনি।’ তােমরা তাে তাকে এতােকাল ধরে দেখছ তােমরা অবশ্যই তাকে যুক্তি বুদ্ধি নিয়ে চলাফেরা করতে দেখেছে, বরাবর তােমরা তাকে একজন ব্যক্তিত্বশীল, আত্মমর্যাদাবােধ সম্পন্ন এবং একজন গাম্ভীর্যপূর্ণ ব্যক্তি হিসাবে পেয়েছাে। তােমরা তাকে কখনও খারাপ ধারণার বশবর্তী হয়ে অথবা এখনও তােমরা দেখছো যে কথা সে বলছে তা কতাে মযবুত এবং কতাে স্পষ্ট ও শক্তিশালী। এরশাদ হচ্ছে, ‘সে তো এক কঠিন আযাব আসার পূর্বে তােমাদের জন্য একজন সুস্পষ্ট সতর্ককারী ব্যক্তি হিসাবে আগমন করেছে।’ এ আয়াতাংশে এক আসন্ন আযাবের ধারণা দেয়া হচ্ছে যে, সেই কঠিন আযাব আসার আগেই একজন সতর্ককারী সে আযাব সম্পর্কে সতর্ক করছে, যাতে করে সেই ব্যক্তি সে আযাব থেকে বাঁচতে পারে যে তার কথা খেয়াল করে শুনবে এবং সতর্ক হবে। এ আয়াতে যা বলা হয়েছে তার উদাহরণ এই, যেন আগুন সম্পর্কে সাবধান করতে গিয়ে একজন সতর্ককারী চীৎকার করে জানাচ্ছে, হুঁশিয়ার করে দিচ্ছে, এ ভয়ংকর আগুন থেকে যে না পালাবে তাকে সহসা সে আগুন এসে গ্রাস করে ফেলবে। এ বিবরণ যেন ছবির মত আগুনের দৃশ্যকে তার সামনে তুলে ধরছে, যার কারণে এ অবস্থা যে আসবেই সে বিষয়ে আর কোন সন্দেহই থাকছে না এবং মনের ভেতরে সে দৃশ্যের ছবি ভেসে উঠাতে মুহুর্মুহু তার হৃদয় প্রকম্পিত হচ্ছে। ইমাম আহমাদ বলেন, আবদুল্লাহ ইবনে বারীরের পিতা বলেন, রাসূলুল্লাহ(স.) একদিন আমাদের কাছে এলেন অতপর তিনি তিনবার ডাক দিয়ে বললেন, হে জনগণ, তােমরা কি আমার এবং তােমাদের উদাহরণ জানাে? সবাই বললেন, আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রাসূল ভালাে জানেন। তখন রাসূলুল্লাহ(স.) বললেন, শােনাে, আমার ও তােমাদের উদাহরণ হচ্ছে সে জাতির মতাে, যারা এক দুশমন দলের আগমনের ভয় করছে, অতপর তারা এক ব্যক্তিকে খোঁজ নেয়ার জন্য সেখানে পাঠালাে, তারপর লােকটা সে শত্রুদেরকে দেখলাে এবং ফিরে এসে তাদের সতর্ক হতে বললাে। তাদের কাছে আসার পূর্ব পর্যন্ত প্রতিমুহূর্তে তার ভয় হচ্ছিলাে যে জনগণের কাছে খবরটা পৌছানাের পূর্বেই হয়তাে দুশমন তাদেরকে আক্রমণ করে বসবে! তখন ভীত সন্ত্রস্ত অবস্থায় তার কাপড় চোপড় নিয়ে সে পড়ে গেলাে এবং চীৎকার করে বলতে লাগলাে, ‘হে জনগণ, তোমরা এসে গেছো, হে জনগণ, তােমরা এসে গেছো, হে জনগণ, তােমরা এসে গেছো।’ এই বর্ণনা ধারায় আর একটি রেওয়ায়েত এসেছে। বর্ণনাকারী বলছেন, রাসূলুল্লাহ(স.) বলেছেন, ‘আমি ও কেয়ামত এক সাথে প্রেরিত হয়েছি, হতে পারে আমার মৃত্যুর পূর্বেই কেয়ামত সংঘটিত হয়ে যাবে।’ এই ভাবে প্রথম হাদীসটিতে যে ঘটনার উল্লেখ হয়েছে তা দ্বিতীয় ঘটনা থেকে মনের ওপর বেশী দাগ কাটে এবং তাকে বেশী জীবন্ত বলে মনে হয়। দ্বিতীয় হাদীসটিও মনের ওপর প্রভাব বিস্তার করে।
# এরশাদ হচ্ছে, ‘বলাে, আমি তাে তােমাদের কাছে কোনাে প্রতিদান চাই না, সে প্রতিদান তাে তােমাদের জন্যই রয়েছে (যদি তােমরা আমার ডাকে সাড়া দাও)। আমার প্রতিদান আল্লাহর কাছেই রয়েছে, তিনি সব কিছু দেখেন।’ প্রথমবারে আল্লাহ রব্বুল আলামীন তাদের এমনভাবে চিন্তা করার আহ্বান জানিয়েছেন যেন সে চিন্তা তাদের সঠিক পথ দেখাতে পারে এবং আযাব থেকে বাঁচাতে পারে, সে আহবানে বলা হয়েছে, তােমাদের নেতার মধ্যে কোনাে পাগলামী নেই, তার মধ্যে নেই কোনাে মস্তিষ্ক বিকৃতি এইভাবে এই আয়াতটিতে আল্লাহ রব্বুল আলামীন তাদেরকে আবারাে চিন্তা করার আহ্বান জানাচ্ছেন এবং তাদেরকে সেই বিষয়ে আত্মজিজ্ঞাসা করতে বলছেন, যে বিষয়ের কারণে তাদের ওপর এক কঠিন আযাব আসা আসন্ন হয়ে গেছে এবং যে বিষয়ে তাদেরকে আগে থেকেই সতর্ক করা হচ্ছে। এইভাবে তাদেরকে কেন চিন্তা-ভাবনা করতে বলা হচ্ছে। এতে তাদের কী ফায়দা হবে? এর উদ্দেশ্যই বা কি? এই সতর্কীকরণের ফলে তাদের মধ্যে কী পরিবর্তন আসবে? স্বাভাবিকভাবেই এসব প্রশ্ন আসে আল্লাহ রব্বুল আলামীন এমনভাবে তাদের জিজ্ঞাসা করছেন, যেন তাদের যুক্তি বুদ্ধিতে বা বিবেকে সাড়া জাগে, তাদের চেতনাবােধ জেগে ওঠে এবং আযাবের এই প্রাণবন্ত বর্ণনা তাদের এ সত্য গ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ করে। এরশাদ হচ্ছে, ‘বলাে আমি তােমাদের কাছে কোন প্রতিদান চাই না, আমি চাই এ প্রতিদান তােমাদের জন্য থাকুক।’ অর্থাৎ তােমরা সেই প্রতিদান গ্রহণ করাে যা আমি তােমাদের থেকে চেয়েছি। এ এমন এক বাচনভংগী, যার মধ্যে এক গভীর কটাক্ষ রয়েছে, রয়েছে পথনির্দেশ রয়েছে সতর্কবাণী। এরশাদ হচ্ছে, ‘আমার প্রতিদান তো আল্লাহ তায়ালার কাছে।’ অর্থাৎ যিনি আমাকে এ কাজের দায়িত্ব দিয়েছেন তিনিই আমাকে প্রতিদান দেবেন আর সেই পুরস্কার পাওয়ার জন্যই আমি চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। ‘আল্লাহ তায়ালার কাছে যা আছে তা পাওয়ার জন্য যে ব্যক্তি চেষ্টা চালিয়ে যাবে তার কাছে দুনিয়ার ভােগবিলাস বড়ই তুচ্ছ এবং বড়ই ক্ষণস্থায়ী’ অর্থাৎ এত সামান্য যার সম্পর্কে কোন চিন্তাই করা যায় না।
# আল্লাহ তায়ালা সত্যের আঘাতে মিথ্যাকে ধ্বংস করেন : ‘সবকিছু সম্পর্কেই তিনি অবগত।’ তিনি জানেন ও দেখেন, তার কাছে কোনাে কিছুই গােপন নেই, আর তিনি আমার সকল ব্যাপারেই প্রত্যক্ষদর্শী। তিনি দেখছেন, আমি যা কিছু করছি এবং যা কিছু করার নিয়ত করছি। যা কিছু আমি বলছি তাও তিনি শুনছেন। আর এ ছাড়া তৃতীয় যে বিষয়টি তার পদক্ষেপকে দুর্বল করে দেয় তা হচ্ছে ‘বল, আমার রব সত্য দ্বারা অসত্যকে উৎখাত করেন, তিনি গায়বের সবকিছু জানেন।’ এই হচ্ছে সেই মহাশক্তি, যা আমি তােমাদের কাছে নিয়ে এসেছি। এটাই প্রকৃত সত্য, এটা সকল শক্তি থেকে মযবুত সত্য, যার দ্বারা আল্লাহ তায়ালা সকল অসত্য ও অসুন্দরকে উৎখাত করেন। কে আছে এমন যে এ সত্যের শক্তি প্রয়ােগ ক্ষমতাকে রােধ করতে পারে? এই যে বর্ণনাভংগী, এ যেন এক জীবন্ত ও চলমান দেহের বাস্তব ছবি। আর সত্য? সে যেন প্রচন্ড এক ক্ষেপণাস্ত্র, যা ভেংগে চুরমার করে দেয়। তা অসত্যের সকল শক্তিকে ভেদ করে চলে যায়, শত্রুর সকল ব্যুহ ভেদ করে দূরন্ত বেগে এগিয়ে যায় এবং ধীরে ধীরে তার অমােঘ বিধানসমূহকে প্রবর্তন করতে থাকে যা পথের সকল বাধা অতিক্রম করার পর নিজ শক্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়, আল্লাহ তায়ালা প্রদত্ত এ শক্তির সামনে কেউ দাঁড়াতে পারে না। মহাজ্ঞানী আল্লাহ তায়ালা নিজেই তাঁর অসীম জ্ঞানের শক্তি দ্বারা সত্য বিরােধী সকল তৎপরতার মােকাবেলা করেন, কে কোন উদ্দেশ্যে কী করছে সবই তাে তার জানা রয়েছে এবং তার কাছে কারও কোন কিছু গােপন নেই। যে সত্য সকল যুক্তিবাদীর সব রকমের চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে ফেলে দেয়, তার সামনে কেউ কোনাে কিছু নিয়ে দাঁড়াতে পারে না, পারে না কেউ তার কাজকে থামিয়ে দিতে বা বাধাগ্রস্ত করতে! সকল পথই তার সামনে সদা-সর্বদা উন্মুক্ত রয়েছে এবং কোন পথই তার থেকে গােপন বা রহস্যাবৃত নয়। এবার আল্লাহ রব্বুল আলামীন সে হঠকারী যালেমদের জন্য নির্ধারিত চতুর্থ শাস্তির কথা জানাচ্ছেন, কত কঠিন হবে সে শাস্তি এবং কত দ্রুতগতিতে সেই ভয়ংকর শাস্তি তাদেরকে ঘেরাও করে ফেলেবে তাও জানাচ্ছেন। এরশাদ হচ্ছে, ‘বলাে, সত্য সমাগত হয়েছে এবং বাতিল শক্তি না কিছু সৃষ্টি করতে পারে, আর না পারে কাউকে পুনরায় জীবন দান করতে।’ অর্থাৎ, সত্য আল্লাহ তায়ালার দেয়া বহু উপায়ের মধ্যে একটি উপায়ে আমাদের কাছে এসেছে, যা সবার সামনে হাযির রয়েছে, সে সত্য রাসূলুল্লাহ(স.)-এর প্রতি এক মহামূল্য বার্তা (রেসালাত) আকারে এসেছে। এ রেসালত মানুষের কাছে এক অভিনব পদ্ধতির মধ্য দিয়ে এসেছে। এ রিসালাত অজ্ঞানতার অন্ধকারে আচ্ছন্ন জনতার কাছে পৌছানাের এক বিস্ময়কর পথ রয়েছে। বলা হচ্ছে, বল, সত্য এসে গেছে, এ ঘােষণা দিয়ে দাও এবং সত্যের অভূতপূর্ব এ অবস্থাকে প্রতিষ্ঠিত করে, এ খবরকে ছড়িয়ে দাও। হ্যা অবশ্যই সত্য এসে গেছে, সত্য তার পূর্ণ শক্তি নিয়ে এসেছে, বড়ত্ব ও বিজয়ী ক্ষমতা নিয়েই তা এসে গেছে। বাতিল শক্তি কোনাে কিছু সৃষ্টি করতে পারে না এবং মৃত্যু বা ধ্বংস এসে যাওয়ার পর সে জীবনকে কোনভাবেই আর সে ফিরিয়ে দিতে পারে কিনা তা অবশ্যই ভেবে দেখার বিষয়। এটা সবার কাছে প্রমাণিত হয়ে রয়েছে যে, সবাইকে একদিন এ জীবন ছেড়ে চলে যেতে হবে এবং অবশেষে সব কিছুরই শেষ বা ধ্বংস অনিবার্য। এ হচ্ছে প্রচন্ডভাবে কাঁপিয়ে তােলার মতাে এক ভীষণ শাস্তি, যার ওপর এ শাস্তি নেমে আসে সেইই বুঝতে পারে যে, এ চূড়ান্ত শাস্তি নেমে আসার পর এর থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার আর কোন উপায় থাকবে না। এ শাস্তির ভয়ংকর ধ্বনি যার কর্ণকুহরে প্রবেশ করে সেই এর ভয়াবহতা অনুধাবন করতে পারে এবং সেইই বুঝতে পারে যে, শাস্তির এ চূড়ান্ত ফায়সালা এসে যাওয়ার পর এর থেকে বাঁচার আর কোনাে উপায় থাকবে না। এ শাস্তির ধ্বনি যার কাছে পৌছে সেইই বুঝে যে, শান্তির এ ফায়সালাই চূড়ান্ত, আর এ শাস্তির বিনিময়ে অন্য কিছু গ্রহণ করার সাধ্য কারাে নেই। এই কারণেই আল-কোরআন এসে মানুষের মাঝে সত্য জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করল এবং এ ব্যবস্থার প্রয়ােজন ও যৌক্তিকতা সুস্পষ্ট করে তাদের জানিয়ে দিল। এর মােকাবেলায় যখনই কোনাে বাতিল শক্তি আক্রমণাত্মক তৎপরতা চালাতে শুরু করল, তখন তারা প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে চূড়ান্ত ও অপ্রতিরােধ্য হাতে উপর্যুপরি পরাজয়ের পর পরাজয়ের গ্লানি ভােগ করতে থাকল। হা, কখনও কখনও দু একটি ঘটনা যদি এমন ঘটে থাকে যে, বস্তুগত প্রস্তুতির অভাবে বা বিরূপ পরিবেশের কারণে বাতিল শক্তি কিছু সুবিধাজনক অবস্থায় পৌছুতে সক্ষম হয়েছে, কিন্তু তার অর্থ কখনও এটা নয় যে, তারা সত্যের ওপর বিজয়ী হয়েছে, বরং বলা যায়, সত্যের কিছু ধারক ও বাহকদের ওপর শত্রুরা সাময়িকভাবে কিছু বিজয় অর্জন করেছে। এটা কিছু সংখ্যক লােকের পরাজয়- সত্য ও আদর্শের পরাজয় এটা মােটেই নয়, নয় এটা কোনাে চূড়ান্ত উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের পরাজয়। এটা নিছক সাময়িক দুর্ঘটনা, এর পরবর্তীতে সত্য আবার গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। কারণ সত্য তাে চির সুন্দর এবং যারা সত্যের উপাসক, যারা সত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিবেদিত, তাদের জন্য আল্লাহ তায়ালার এ সত্য জীবন ব্যবস্থা একমাত্র শুভ্র সমুজ্জল ও সুস্পষ্ট সাফল্যের পথই হাযির করে। সত্য বিরােধীদের জন্য শেষ শাস্তির কথা এভাবে বলা হয়েছে, ‘বল, যদি আমি পথভ্রষ্ট হয়ে গিয়ে থাকি, তাহলে… নিশ্চয়ই তিনি সব কিছু শুনেন, তিনি নিকটবর্তী।’ আমি বিপথগামী হয়ে গেলে তাতে তােমাদের কি? তােমাদের তাে এতে কোনাে দায়িত্ব বা ক্ষতি নেই। আর যদি আমি হেদায়াতের পথ অনুসরণকারী হয়ে থাকি, তাহলে অবশ্যই মানতে হবে যে আল্লাহ তায়ালাই ওহী দ্বারা আমাকে সঠিক পথ দেখিয়েছেন। তার হুকুম ছাড়া আমার নিজের ওপর আমার নিজের কোনােই কর্তৃত্ব নেই। তার মেহেরবানীর ছায়াতলে আমি একজন অসহায় গােলাম মাত্র। এরশাদ হচ্ছে, ‘অবশ্যই তিনি অতি নিকট থেকে শুনেন।’ এইভাবেই তৎকালীন মুসলমানরা আল্লাহ তায়ালাকে বড়ই কাছে অনুভব করতেন। এইভাবে তারা তার গুণাবলী তাদের অন্তরের মধ্যে অনুভব করতেন। তার গুণাবলীর সজীবতা তাদের বাস্তব জীবনে দেখতে পেতেন। তারা অনুভব করতেন যে, আল্লাহ তায়ালা অবশ্যই তাদের কথা শুনেন এবং তিনি তাদের অতি নিকটে রয়েছেন। তাদের সকল কাজের সাথে তার সম্পৃক্ততা সেটা অবশ্যই তার সরাসরি মেহেরবাণী। তাদের অভিযােগ তাদের ফরিয়াদ কোন মধ্যস্থতা ছাড়াই তাঁর দরবারে পৌছায়। তিনি তাদের ভুলে যান না, অবহেলা করেন না এবং অন্য কারও হাতে ছেড়েও দেন না। আর এইভাবে তারা তাদের রব-এর সাথে মােহব্বতের বাঁধনে আবদ্ধ হয়ে রয়েছে, রয়েছে তাঁরই হেফাযতে ও সরাসরি তারই তদারকীতে, রয়েছে তাঁর মেহেরবাণীর ছায়াতলে ও তাঁর নিজস্ব পরিচালনায়। তারা আল্লাহ তায়ালার এসব মেহেরবানী তাদের বাস্তব জীবনে হামেশা অনুভব করে, তারা যেন মেহেরবান আল্লাহর সুবিস্তীর্ণ অস্তিত্বকে বাস্তবে দেখতে পায়। এই দেখা শুধু দেখার অর্থে দেখা নয়, নয় শুধু চিন্তার ক্ষেত্রে হৃদয়ের চোখ দিয়ে দেখা, ‘নিশ্চয়ই তিনি শুনেন (সকল কিছু) নিকটেই অবস্থিত।’