তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
২২-২৩ নং আয়াতের তাফসীর:
(قُلِ ادْعُوا الَّذِيْنَ زَعَمْتُمْ…..)
আল্লাহ তা‘আলা নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে দুনিয়ার মুশরিকদের মাঝে ঘোষণা দেয়ার নির্দেশ দিয়ে বলেন: সে সকল মুশরিকদেরকে বলে দাওন যারা আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত তৈরি করা অন্যান্য মা‘বূদদেরকে কল্যাণ নিয়ে আসার জন্য ও অকল্যাণ দূরভিত করার জন্য আহ্বান করতো তাদেরকে উপস্থিত কর? তারা সেদিন হারিয়ে যাবে। কারণ তারা আকাশ-জমিনের কোন কিছুর মালিক নয়। আল্লাহ তা‘আলার বাণী,
(وَالَّذِيْنَ تَدْعُوْنَ مِنْ دُوْنِه۪ مَا يَمْلِكُوْنَ مِنْ قِطْمِيْرٍ)
“তোমরা তাকে ব্যতীত যাকে ডাক তারা খেজুরের আঁটি সংলগ্ন আবরণের মালিকও নয়।” (সূরা ফাতির ৩৫:১৩)
সুতরাং যারা কোন কিছুর মালিক নয় তাদেরকে কেন বিপদাপদে আহ্বান করব, যিনি বিপদাপদ দিয়েছেন তিনিই তো তা থেকে মুক্ত করতে পারেন। তাই তাঁকেই আহ্বান করা আবশ্যক। এ সম্পর্কে পূর্বে সূরা বানী ইসরা‘ঈলের ৫৬ নং আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে।
(وَلَا تَنْفَعُ الشَّفَاعَةُ عِنْدَه)
‘আল্লাহর কাছে কারও সুপারিশ উপকারে আসবে না’ এ শাফা‘আত বা সুপারিশ সূরা বাকারার আয়াতুল কুরসীসহ একাধিক স্থানে আলোচনা করা হয়েছে। কিয়ামতের দিন কোন ব্যক্তিই কোন প্রকার সুপারিশ করতে পারবে না তবে আল্লাহ তা‘আলা যাকে অনুমতি দেবেন সে ব্যতীত। আল্লাহ তা‘আলার বাণী,
(وَكَمْ مِّنْ مَّلَكٍ فِي السَّمٰوٰتِ لَا تُغْنِيْ شَفَاعَتُهُمْ شَيْئًا إِلَّا مِنْمبَعْدِ أَنْ يَّأْذَنَ اللّٰهُ لِمَنْ يَّشَا۬ءُ وَيَرْضٰي)
“আকাশসমূহে কত ফেরেশতা রয়েছে! তাদের কোন সুপারিশ কাজে আসবে না যতক্ষণ আল্লাহ যাকে ইচ্ছা এবং যার প্রতি সন্তুষ্ট তাকে অনুমতি না দেন।” (সূরা নাজম ৫৩:২৬)
সুতরাং কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা‘আলার সামনে কথা বলার কেউ সাহস পাবে না।
(قَالُوْا مَاذَا لا قَالَ رَبُّكُمْ)
এখানে দু’টি অর্থের সম্ভাবনা রয়েছে: ১. কিয়ামতের দিন যখন মুশরিকদের অন্তর থেকে ভয় দূর হয়ে যাবে এবং তাদের জ্ঞান ও সস্তি ফিরে আসবে দুনিয়াতে তারা যে সত্যকে অস্বীকার ও মিথ্যা প্রতিপন্ন করত সে সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে তখন তারা তা স্বীকার করবে যে, আমরা তা অস্বীকার করতাম এবং আমরা শিরক ও বাতিলের ওপর ছিলাম। আল্লাহ তা‘আলা যা বলেছেন ও রাসূলগণ যা সংবাদ দিয়েছেন তা-ই সত্য। পূর্বাপর আয়াতের সাথে এ অর্থই বেশি সামঞ্জস্য। ২. ফেরেশতারা তথায় ভয়ে ভীত হয়ে পড়বে এবং কোন কথাই বলবে না। অবশেষে যখন ভয় চলে যাবে তখন পরস্পর বলবে যে, তোমাদের প্রভু কী বলেছেন? উত্তরে তারা বলবে যে, তিনি যথার্থই বলেছেন।
যেমন হাদীসে উক্ত আয়াতের তাফসীরে বলা হয়েছে যে, আবূ হুরাইরাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: যখন আল্লাহ তা‘আলা আকাশে কোন কাজের সিদ্ধান্ত করেন তখন ফেরেশ্তারা ভয়ে তাদের ডানা নাড়াতে থাকে। যেন এটি পাথরের ওপর শিকলের মসৃণ শব্দ। যখন তাদের অন্তর থেকে ভয় চলে যায় তখন তারা পরস্পর বলাবলি করতে থাকে যে, তোমাদের প্রতিপালক তিনি কী বলেছেন? তারা বলে যে, তিনি যথার্থই বলেছেন। তিনি সুউচ্চ ও বড়। (সহীহ বুখারী হা: ৪৮০০)
সুতরাং কেউ আল্লাহ তা‘আলার অনুমতি ব্যতীত তার সম্মুখে কথা বলার সাহস পাবে না।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. আল্লাহ তা‘আলা এক ও অদ্বিতীয়, তিনি ব্যতীত আর কোন মা‘বূদ নেই এবং কোন মালিকও নেই।
২. আল্লাহ তা‘আলার অনুমতি ব্যতীত তার সম্মুখে কেউ কোন কথা বলতে পারবে না।
৪. কিয়ামতের মাঠে কারো জন্য কেউ কোন লোক সুপারিশ করতে পারবে না, কেবল তারাই পারবে যাদেরকে আল্লাহ তা‘আলা অনুমতি দিব।
২৪-২৭ নং আয়াতের তাফসীর:
এখানে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রুবুবিয়ার প্রমাণ বহন করে এমন কিছু সৃষ্টির বর্ণনা উল্লেখ করছেন। পৃথিবীর সকল যুগের নাস্তিকদেরকে বলে দেয়ার জন্য রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ তা‘আলা বলেন: বলে দাওন আকাশ ও জমিন থেকে তোমাদেরকে কে রিযিক দেন? অর্থাৎ আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করেন ফলে জমি উর্বর হয় আর ফসল ফলে, তা কে করেন? উত্তর হল: আল্লাহ তা‘আলা। এ কথা মক্কার মুশরিকরাও স্বীকার করত। আল্লাহ তা‘আলার বাণী,
(قُلْ مَنْ يَّرْزُقُكُمْ مِّنَ السَّمَا۬ءِ وَالْأَرْضِ أَمَّنْ يَّمْلِكُ السَّمْعَ وَالْأَبْصَارَ وَمَنْ يُّخْرِجُ الْحَيَّ مِنَ الْمَيِّتِ وَيُخْرِجُ الْمَيِّتَ مِنَ الْحَيِّ وَمَنْ يُّدَبِّرُ الْأَمْرَ ط فَسَيَقُوْلُوْنَ اللّٰهُ ج فَقُلْ أَفَلَا تَتَّقُوْنَ)
“বল: ‘কে তোমাদেরকে আকাশ ও পৃথিবী হতে জীবনোপকরণ সরবরাহ করে অথবা শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তি কার কর্তৃত্বাধীন, জীবিতকে মৃত হতে কে বের করেন এবং মৃতকে জীবিত হতে কে বের করেন এবং সকল বিষয় কে নিয়ন্ত্রণ করেন?’ তখন তারা অবশ্যই বলবে, ‘আল্লাহ।’ বল: ‘তবুও কি তোমরা সাবধান হবে না?’’ (সূরা ইউনুস ১০:৩১)
সুতরাং যে এ বিশ্বাসের ওপর আছে সে কি সঠিক পথে আছে, না-কি যে তা বিশ্বাস করে না সে সঠিক পথে? কখনো নয়, বরং যে তা বিশ্বাস করে সেই সঠিক পথের অনুসারী।
এরপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন, হে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! তুমি এ কাফির-মুশরিকদেরকে বলে দাও, যখন তোমাদের মধ্যে ও আমাদের মধ্যে এত মতানৈক্য ও মতভেদ রয়েছে তবে এতে কোন সন্দেহ নেই যে, একদল হিদায়াতের ওপর এবং অন্যদল বিভ্রান্তির ওপর। কেননা বিপরীত মুখী বা বিবাদমান দু’টি দল কখনো সঠিক পথ প্রাপ্ত হতে পারে না। সুতরাং একদল হিদায়াত প্রাপ্ত আর অন্য দল পথভ্রষ্ট। আমরা হলাম আল্লাহর একত্বে আর স্পষ্ট দলিল-প্রমাণের ওপর সু-প্রতিষ্ঠিত। আর তোমরা হলে মুশরিক। তোমরা এমন কিছুর উপাসনা করো যার কোন দলিল-প্রমাণ তোমাদের নিকট নেই। সুতরাং তোমরা যদি আল্লাহর একত্বে বিশ্বাসী হও তাহলে তোমরা আমাদের অন্তর্ভুক্ত আর যদি একত্বে বিশ্বাসী না হও তাহলে তোমরা আমাদের থেকে মুক্ত। আল্লাহ তা‘আলার বাণী,
(وَإِنْ كَذَّبُوْكَ فَقُلْ لِّيْ عَمَلِيْ وَلَكُمْ عَمَلُكُمْ ج أَنْتُمْ بَرِيْـٓئُوْنَ مِمَّآ أَعْمَلُ وَأَنَا بَرِيْ۬ءٌ مِّمَّا تَعْمَلُوْنَ)
“এবং তারা যদি তোমার প্রতি মিথ্যা আরোপ করে তবে তুমি বল: ‘আমার কর্ম আমার এবং তোমাদের কর্ম তোমাদের জন্য। আমি যা করি সে বিষয়ে তোমরা দায়মুক্ত এবং তোমরা যা কর সে বিষয়ে আমিও দায়মুক্ত।’’ (সূরা ইউনূস:১০:৪১)
তোমাদের কাজের জন্য তোমরা দায়ী আর আমাদের কাজের জন্য আমরা দায়ী। কেউ কারো কাজের জন্য দায়ী হবে না। যার যার ‘আমাল তার তার জন্য।
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
(تِلْكَ أُمَّةٌ قَدْ خَلَتْ ج لَهَا مَا كَسَبَتْ وَلَكُمْ مَّا كَسَبْتُمْ ج وَلَا تُسْأَلُوْنَ عَمَّا كَانُوْا يَعْمَلُوْنَ)
“ওরা একটা দল ছিল যা অতীত হয়ে গেছে; তারা যা অর্জন করেছিল তা তাদের জন্য এবং তোমরা যা অর্জন করেছ তা তোমাদের জন্য এবং তারা যা করে গেছে তার জন্য তোমরা জিজ্ঞাসিত হবে না।” (সূরা বাকারাহ ২:১৩৪)
তারপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন: হে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! তুমি কাফির-মুশরিকদেরকে বলে দাও যে, কিয়ামত দিবসে আল্লাহ তা‘আলা সকলকে একত্রিত করবেন এবং তাদের মধ্যে সঠিকভাবে ফয়সালা করে দেবেন এবং যারা সঠিক পথপ্রাপ্ত তাদেরকে পুরস্কৃত করবেন আর যারা পথভ্রষ্ট তারা শাস্তি প্রাপ্ত হবে। আল্লাহ তা‘আলার বাণী,
(وَیَوْمَ تَقُوْمُ السَّاعَةُ یَوْمَئِذٍ یَّتَفَرَّقُوْنَﭝ فَاَمَّا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا وَعَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ فَھُمْ فِیْ رَوْضَةٍ یُّحْبَرُوْنَﭞ وَاَمَّا الَّذِیْنَ کَفَرُوْا وَکَذَّبُوْا بِاٰیٰتِنَا وَلِقَا۬یِٔ الْاٰخِرَةِ فَاُولٰ۬ئِکَ فِی الْعَذَابِ مُحْضَرُوْنَ)
“আর যেদিন কিয়ামত অনুষ্ঠিত হবে, সেদিন মানুষ ভিন্ন ভিন্ন হয়ে যাবে। সুতরাং যারা ঈমান আনে এবং ভাল কাজ করে, তারা তো জান্নাতে আনন্দে থাকবে। আর যারা কুফরী করে এবং অবিশ্বাস করে আমার আয়াতসমূহকে ও আখিরাতের সাক্ষাতকে, তাদেরকেই ‘আযাবের মধ্যে উপস্থিত করা হবে।” (সূরা রূম ৩০:১৪-১৬) অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা বলেনন হে নাবী! তাদেরকে বলে দাও, তারা যেন দেখিয়ে দেয়ন ঐ সকল লোকদেরকে যাদেরকে আল্লাহ তা‘আলার সাথে শরীক করে, মূলত তারা এটা কখনো করতে সক্ষম হবে না।
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَجَعَلُوْا لِلّٰهِ شُرَكَا۬ءَ ط قُلْ سَمُّوْهُمْ ط أَمْ تُنَبِّئُوْنَه۫ بِمَا لَا يَعْلَمُ فِي الْأَرْضِ أَمْ بِظَاهِرٍ مِّنَ الْقَوْلِ ط بَلْ زُيِّنَ لِلَّذِيْنَ كَفَرُوْا مَكْرُهُمْ وَصُدُّوْا عَنِ السَّبِيْلِ ط وَمَنْ يُّضْلِلِ اللّٰهُ فَمَا لَه۫ مِنْ هَادٍ)
“তারা আল্লাহর সাথে বহু শরীক সাব্যস্ত করেছে। বল: ‘তাদের পরিচয় দাও।’ তোমরা কি পৃথিবীর মধ্যে এমন কিছুর সংবাদ দিতে চাও যা তিনি জানেন না? অথবা এটা ব্যাহ্যিক কথা মাত্র? না, কাফিরদের নিকট তাদের চক্রান্ত শোভন করে দেয়া হয়েছে এবং তাদেরকে সৎ পথ হতে নিবৃত্ত করা হয়েছে, আর আল্লাহ যাকে বিভ্রান্ত করেন তার কোন পথ প্রদর্শক নেই।” (সূরা রাদ ১৩:৩৩)
সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত ইবাদাতের যোগ্য দ্বিতীয় আর কেউ নেই। তিনিই একমাত্র ইবাদাতের যোগ্য।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. সকল কিছুর মালিক একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা, অন্য কেউ নয়।
২. যার যার কর্মের জন্য সে নিজে শাস্তি প্রাপ্ত হবে।
৩. যারা আল্লাহ তা‘আলার সাথে শরীক করে তারা কখনো হকের ওপর থাকতে পারে না।
৪. বিতর্কে প্রতিপক্ষের মানসিকতার প্রতি লক্ষ্য রাখা এবং উত্তেজিত না হওয়া।
২৮-৩০ নং আয়াতের তাফসীর:
পূর্বের আয়াতসমূহে তাওহীদ এবং আল্লাহ তা‘আলার মহত্ত্ব ও বড়ত্ব সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। অত্র আল্লাহ তা‘আলা মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে সর্বজনীন করে সারা পৃথিবীবাসীর রাসূল হিসেবে প্রেরণ করেছেন সে কথাই ব্যক্ত করা হচ্ছে। তিনি সমস্ত মানব ও দানব জাতির জন্য প্রেরিত হয়েছেন। পূর্বে পৃথিবীতে যত নাবী-রাসূল প্রেরণ করা হয়েছে সকলকে নির্দিষ্ট একটি সময় ও নির্দিষ্ট একটি গোত্রের নিকট প্রেরণ করা হয়েছিল। কিন্তু মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে সমগ্র মানব জাতির জন্য প্রেরণ করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
(تَبٰرَكَ الَّذِيْ نَزَّلَ الْفُرْقَانَ عَلٰي عَبْدِه۪ لِيَكُوْنَ لِلْعٰلَمِيْنَ نَذِيْرَا)
“কত মহান তিনি যিনি তাঁর বান্দার প্রতি ফুরকান অবতীর্ণ করেছেন যাতে সে বিশ্বজগতের জন্য সতর্ককারী হতে পারে!” (সূরা ফুরকান ২৫:১)
জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: আমাকে পাঁচটি জিনিস দেয়া হয়েছে যা অন্য কোন নাবীকে দেয়া হয়নি। তন্মধ্যে একটি হলো, প্রত্যেক নাবীকে শুধু তার কওমের নিকট পাঠানো হয়েছিল, আর আমাকে সমস্ত মানুষের নিকট নাবী করে পাঠানো হয়েছে। (সহীহ বুখারী হা: ৩৩৫, ৪৩৮, সহীহ মুসলি হা: ৫২১) এ সম্পর্কে সূরা আল আ‘রাফ-এর ১৫৮ নং আয়াতে পূর্বে আলোচনা করা হয়েছে।
এরপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন, এ বিষয়ের সঠিক জ্ঞান অধিকাংশ মানুষই রাখে না।
আল্লাহ তা‘আলার বাণী,
(وَمَآ أَكْثَرُ النَّاسِ وَلَوْ حَرَصْتَ بِمُؤْمِنِيْنَ)
“তুমি যতই আকাক্সক্ষা কর না কেন, অধিকাংশ লোকই বিশ্বাসী নয়।” (সূরা ইউসুফ ১২:১০৩) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
(وَإِنْ تُطِعْ أَكْثَرَ مَنْ فِي الْأَرْضِ يُضِلُّوْكَ عَنْ سَبِيْلِ اللّٰهِ ط إِنْ يَّتَّبِعُوْنَ إِلَّا الظَّنَّ وَإِنْ هُمْ إِلَّا يَخْرُصُوْنَ)
“যদি তুমি দুনিয়ার অধিকাংশ লোকের কথামত চল তবে তারা তোমাকে আল্লাহর পথ হতে বিচ্যুত করবে। তারা তো শুধু অনুমানের অনুসরণ করে; আর তারা শুধু অনুমানভিত্তিক কথা বলে।” (সূরা আন‘আম ৬:১১৬)
কাফির-মুশরিকরা কিয়ামত সংঘঠিত হওয়াকে অসম্ভব মনে করত নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে তা সংঘটিত হওয়ার সময়কাল সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। আল্লাহ তা‘আলা নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে সে প্রশ্নের জবাব শিখিয়ে দিয়ে বলছেন: বলে দাও; কিয়ামতের জন্য নির্ধারিত সময় রয়েছে, যা এ নির্ধারিত সময়ের আগেও হবে না এবং পরেও হবে না। আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
(إِنَّ أَجَلَ اللّٰهِ إِذَا جَا۬ءَ لَا يُؤَخَّرُ م لَوْ كُنْتُمْ تَعْلَمُوْنَ)
“নিশ্চয়ই আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত সময় উপস্থিত হলে তা বিলম্বিত হয় না, যদি তোমরা এটা জানতে!” (সূরা নূহ ৭১:৪)
সুতরাং নির্ধারিত সময় ব্যতীত কিয়ামত সংঘটিত হবে না। আর এ নির্ধারিত সময় সম্পর্কে একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাই ভাল জানেন, অন্য কেউ নয়। এ সম্পর্কে সূরা আল আন‘আম-এর ৫৯ নং আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে। আরো আলোচনা সূরা লুক্বমান-এ করা হয়েছে।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর মর্যাদা সম্পর্কে জানা গেল যে, তিনি সারা বিশ্বের জন্য রহমাতস্বরূপ প্রেরিত রাসূল।
২. সত্য ও সঠিকতার ওপর একজন লোক প্রতিষ্ঠিত থাকলে তিনিও অনুসরণীয় ব্যক্তি যদিও অধিকাংশ লোক তার বিপক্ষে অবস্থান করে।
৩. প্রত্যেক জিনিসের মতো কিয়ামতের একটি নির্ধারিত সময় রয়েছে। ঐ সময় ব্যতীত তা সংঘটিত হবে না।
৩১-৩৩ নং আয়াতের তাফসীর:
পূর্বের আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছেন যারা কিয়ামত সংঘটিত হওয়াকে অস্বীকার করে তারা চায় তা দ্রুত সংঘটিত হোক, যাতে তারা তা প্রত্যক্ষ করতে পারে। অত্র আয়াতে কাফিরদের ঔদ্ধত্যপনা ও হকের প্রতি জিদের বর্ণনা দিতে গিয়ে আল্লাহ তা‘আলা বলেন: এসব কাফিররা বলে যে, আমরা এ কুরআনের প্রতি কক্ষনো বিশ্বাস স্থাপন করব না এবং এর পূর্ববর্তী কিতাবসমূহের প্রতিও না। যদিও তারা এ ব্যাপারে বহু দলীল প্রমাণ প্রত্যক্ষ করে, তাও মেনে নিবে না। কিয়ামত অস্বীকার ও উদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের কারণে কিয়ামতের মাঠে তাদের কিরূপ অবস্থা হবে তার বর্ণনা দিয়ে আল্লাহ তা‘আলা নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে সম্বোধন করে বলেন: এসব কিয়ামত অস্বীকারকারী যালেমরা কিয়ামতের মাঠে আল্লাহ তা‘আলার সামনে যখন দণ্ডায়মান হবে তখন তারা পরস্পর কথা কাটাকাটি করবে। সমাজে সাধারণত দু’ শ্রেণীর মানুষ থাকে, শাসক ও ক্ষমতাবান এবং শোষিত ও দুর্বল। দুর্বলরা সর্বদা নির্যাতিত হয়ে থাকে। কিয়ামতের দিন দুর্বলরা দোষারোপ করে সবলদেরকে বলবে, যদি আপনারা আমাদেরকে পথভ্রষ্ট না করতেন তাহলে আমরা মু’মিন হতাম। আপনারা আমাদেরকে ঈমান আনতে বাধা দিয়েছেন, ঈমান আনলে নির্যাতন করেছেন। ফলে আমরা ঈমান আনতে পারিনি। তাদের এ কথার জবাবে শাসক ও সবল ব্যক্তিরা বলবে: তোমাদের নিকট সৎ পথের নির্দেশ আসার পর আমরা কি তোমাদেরকে শক্তি ও ভয় দেখিয়ে ওটা হতে নিবৃত্ত করেছিলাম? মূলত তোমরা নিজেরাই পথভ্রষ্ট হয়েছ। তখন দুর্বলরা বলবে: প্রকৃতপক্ষে তোমরাই দিবা-রাত্রি চক্রান্তে লিপ্ত ছিলে। তোমরা আমাদেরকে নির্দেশ দিতে যেন আল্লাহ তা‘আলার সাথে কুফরী করি, তাঁর সাথে শিরক করি। এ দিকেই আমাদেরকে আহ্বান করতে। এটাই ছিল আমাদের ঈমান থেকে বিরত থাকার কারণ। এভাবে একদল অপরদলকে দোষারোপ করবে।
আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
(إِذْ تَبَرَّأَ الَّذِيْنَ اتُّبِعُوْا مِنَ الَّذِيْنَ اتَّبَعُوْا وَرَأَوُا الْعَذَابَ وَتَقَطَّعَتْ بِهِمُ الْأَسْبَابُ -وَقَالَ الَّذِيْنَ اتَّبَعُوْا لَوْ أَنَّ لَنَا كَرَّةً فَنَتَبَرَّأَ مِنْهُمْ كَمَا تَبَرَّأُوْا مِنَّا ط كَذٰلِكَ يُرِيْهِمُ اللّٰهُ أَعْمَالَهُمْ حَسَرٰتٍ عَلَيْهِمْ ط وَمَا هُمْ بِخٰرِجِيْنَ مِنَ النَّارِ )
“(কি করুণ অবস্থা হবে তখন) যখন অনুসরণীয় নেতারা অনুসারীদেরকে প্রত্যাখ্যান করবে তখন তারা শাস্তি প্রত্যক্ষ করবে ও তাদের সকল সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। আর অনুসরণকারীরা বলবে, যদি আমাদের জন্য (দুনিয়াতে) ফিরে যাওয়ার সুযোগ থাকত তাহলে তারা যেভাবে আমাদেরকে প্রত্যাখ্যান করেছে আমরাও সেভাবে তাদেরকে প্রত্যাখ্যান করতাম। এভাবে আল্লাহ তাদের কার্যকলাপ তাদের সামনে দুঃখজনকভাবে প্রদর্শন করবেন এবং তারা জাহান্নাম হতে বের হতে পারবে না।” (সূরা বাকারাহ ২:১৬৬-১৬৭)
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَيَوْمَ يَعَضُّ الظَّالِمُ عَلٰي يَدَيْهِ يَقُوْلُ يٰلَيْتَنِي اتَّخَذْتُ مَعَ الرَّسُوْلِ سَبِيْلًا -يٰوَيْلَتٰي لَيْتَنِيْ لَمْ أَتَّخِذْ فُلَانًا خَلِيْلًا لَقَدْ أَضَلَّنِيْ عَنِ الذِّكْرِ بَعْدَ إِذْ جَا۬ءَنِيْ ط وَكَانَ الشَّيْطَانُ لِلْإِنْسَانِ خَذُوْلًا)
“যালিম ব্যক্তি সেদিন নিজ দু’হাত দংশন করতে করতে বলবে, ‘হায়! আমি যদি রাসূলের সাথে সৎ পথ অবলম্বন করতাম! ‘হায়, দুর্ভোগ আমার! আমি যদি অমুককে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করতাম! ‘আমাকে তো সে বিভ্রান্ত করেছিল কুরআন থেকে আমার নিকট তা পৌঁছার পর।’ শয়তান তো মানুষের জন্য মহাপ্রতারক।” (সূরা ফুরকান ২৫:২৭)
অবশেষে তাদেরকে গলদেশে শৃঙ্খল পরিয়ে তারা যা করত তারই প্রতিফল দেয়া হবে। যারা পথভ্রষ্ট করেছিল এবং যারা হয়েছিল উভয়দলই শাস্তিপ্রাপ্ত হবে।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. কোন কিছুর দলীল-প্রমাণ ছাড়া অন্ধ অনুসরণ করা যাবে না।
২. কেউ কারো পাপের জন্য শাস্তিপ্রাপ্ত হবে না। প্রত্যেকে নিজ নিজ পাপের শাস্তি প্রাপ্ত হবে।
৩. কাউকে দোষারোপ করে শাস্তি থেকে নাযাত পাওয়া যাবে না।
৩৪-৩৯ নং আয়াতের তাফসীর:
যুগে যুগে প্রত্যেক জনপদবাসীর বিত্তবান ও ক্ষমতাসীন ব্যক্তিরাই রাসূলদের দাওয়াত বর্জন করতঃ তাদের সাথে কুফরী করেছে। মক্কার মুশরিকরাও এর ব্যতিক্রম ছিল না। তাই পূর্ববর্তী সেসব কাফিরদের ইতিহাস উল্লেখ করে আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে সান্ত্বনা প্রদান করছেন। কিয়ামত পর্যন্তও এ শ্রেণির লোকেই ইসলাম ও মুসলিমদের সাথে এমন আচরণ করবে। সুতরাং হে রাসূল! তোমাকেও অস্বীকার করাটাই স্বাভাবিক। এতে তুমি মনক্ষুণœ হয়ো না। তাদের কথা তুলে ধরে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(قَالَ الْمَلَأُ الَّذِيْنَ اسْتَكْبَرُوْا مِنْ قَوْمِه۪ لِلَّذِيْنَ اسْتُضْعِفُوْا لِمَنْ اٰمَنَ مِنْهُمْ أَتَعْلَمُوْنَ أَنَّ صَالِحًا قَالَ الَّذِيْنَ اسْتَكْبَرُوْآ إِنَّا بِالَّذِيْٓ اٰمَنْتُمْ بِه۪ كٰفِرُوْنَ)
“তার সম্প্রদায়ের দাম্ভিক প্রধানেরা সে সম্প্রদায়ের ঈমানদার যাদেরকে দুর্বল মনে করা হত তাদেরকে বলল: ‘তোমরা কি জান যে, সালেহ ‘আল্লাহ কর্তৃক প্রেরিত?’ তারা বলল: ‘তার প্রতি যে বাণী প্রেরিত হয়েছে আমরা তাতে বিশ্বাসী।’ তখন অহংকারীরা বললো, তোমরা যা বিশ্বাস কর আমরা তা অবিশ্বাস করি।” (সূরা আ‘রাফ ৭:৭৫-৭৬)
আর গরীব লোকেরাই নবী-রাসূলদের বেশি অনুসরণ করত। আল্লাহ তা‘আলার বাণী,
(قَالُوْآ أَنُؤْمِنُ لَكَ وَاتَّبَعَكَ الْأَرْذَلُوْنَ)
“তারা বলল: ‘আমরা কি তোমার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করব অথচ নিচু শ্রেণির লোকেরা তোমার অনুসরণ করছে?’’ (সূরা শুআরা:২৬:১১১)
হিরাকল আবূ সুফিয়ানকে জিজ্ঞেস করল: সমাজের বিত্তশালী ও উচুঁ বংশের লোকজন তাঁর (মুহাম্মাদের) অনুসরণ করে, না দুর্বলরা? তিনি বললেন: দুর্বলরা। হিরাকল বলল: দুর্বলরাই রাসূলদের অনুসারী হয়। (সহীহ বুখারী হা: ৭)
এরপর আল্লাহ বলেন: তারা বলত, আমরা ধনে-জনে সমৃদ্ধশালী, সুতরাং আমরা শাস্তি প্রাপ্ত হব না। আমরা আল্লাহ তা‘আলার শাস্তিযোগ্য হলে আমাদরেকে এ বিপুল ধনৈশ্বর্য কেন দিলেন? নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহ তা‘আলার প্রিয়পাত্র, তিনি আমাদেরকে আযাব দেবেন না। আল্লাহ নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলছেন বলে দাও; এ ধারণা সঠিক নয়। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা অপরিমেয় ধন-সম্পদ, সন্তান-সন্তুতি দিতে থাকেন। পার্থিব ধন-সম্পদ ও সম্মানকে আল্লাহ তা‘আলার প্রিয়পাত্র হওয়ার কারণ মনে করো না। বরং এসব সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি যা তোমাদেরকে আল্লাহ তা‘আলার নিকটে পৌঁছে দিবে বলে বিশ্বাস কর তারা তা করতে পারবে না। আল্লাহর বাণী,
(أَيَحْسَبُوْنَ أَنَّمَا نُمِدُّهُمْ بِه۪ مِنْ مَّالٍ وَّبَنِيْنَ لا نُسَارِعُ لَهُمْ فِي الْخَيْرَاتِ ط بَلْ لَّا يَشْعُرُوْنَ)
“তারা কি মনে করে যে, আমি তাদেরকে ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি দ্বারা সাহায্য করি। তাদের জন্য সকল প্রকার মঙ্গল ত্বরান্বিত করছি? না, তারা বুঝে না।” (সূরা মু’মিনূন ২৩:৫৫-৫৬)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
(فَلَا تُعْجِبْكَ أَمْوَالُهُمْ وَلَآ أَوْلَادُهُمْ ط إِنَّمَا يُرِيْدُ اللّٰهُ لِيُعَذِّبَهُمْ بِهَا فِي الْحَيٰوةِ الدُّنْيَا وَتَزْهَقَ أَنْفُسُهُمْ وَهُمْ كٰفِرُوْنَ)
“সুতরাং তাদের সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি তোমাকে যেন আশ্চর্য না করে, আল্লাহ তার দ্বারাই তাদেরকে পার্থিব জীবনে শাস্তি দিতে চান। তারা কাফির থাকা অবস্থায় তাদের আত্মা দেহত্যাগ করবে।” (সূরা তাওবাহ ৯:৫৫) তবে যদি ঈমান আনয়ন করে ও সৎ আমল করে এবং এসব সম্পদ সৎ পথে উপার্জন ও ব্যয় করতে পারে তাহলে উপকারে আসবে।
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: মৃত ব্যক্তির সাথে তিনটি জিনিস যায়, দুটি জিনিস ফিরে আসে, একটি জিনিস সাথে থাকে। তার পরিবার, সম্পদ ও আমল সাথে যায়, এর মধ্যে পরিবার ও সম্পদ ফিরে আসে, আর আমল তার সাথে থেকে যায়। (তিরমিযী হা: ২৩৭৯, সহীহ)
হাদীসে এসেছে, আবূ হুরাইরাহ্ (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: “নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের চেহারা ও তোমাদের সম্পদের দিকে দেখবেন না। বরং তোমাদের অন্তর ও ‘আমালের দিকে দেখবেন। (সহীহ মুসলিম হা: ৩৪)
তাই ধন-সম্পদ, সন্তান-সন্ততি কোন কিছুই বিন্দু পরিমাণ উপকার করার ক্ষমতা রাখে না। যারা সৎ কর্ম করবে তারা ভাল প্রতিদান পাবে আর যারা অসৎ কর্ম করবে তারা মন্দ প্রতিদান পাবে।
রিযিকের মালিক আল্লাহ তা‘আলা, তিনি যাকে খুশি রিযিক বর্ধিত করে দেন। আবার যার জন্য ইচ্ছা সীমিত করে দেন। কেউ চাইলেই সে তার রিযক বর্ধিত করতে পারে না।
তারপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন যে, তোমরা যা কিছুই আল্লাহ তা‘আলার রাস্তায় ব্যয় করো না কেন তার প্রতিদান তোমরা পাবে। দানের ফযীলত ও দানকারীর মর্যাদা সম্পর্কে হাদীসে বলা হয়েছে।
আবূ হুরাইরাহ্ (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত, নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: “প্রত্যহ সকালে দু’জন ফেরেশ্তা অবতরণ করে। একজন দু‘আ করে হে আল্লাহ তা‘আলা! খরচকারীকে উত্তম প্রতিদান দাও। অন্যজন দু‘আ করে হে আল্লাহ তা‘আলা! কৃপণের মালকে ধ্বংস করে দাও।” (সহীহ বুখারী, হা: ১৪৪২, সহীহ মুসলিম হা: ১০১০)
অন্য এক হাদীসে বলা হয়েছে যে, আবূ হুরাইরাহ্ (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন: “তুমি খরচ করো, তোমার প্রতি খরচ করা হবে। তিনি আরো বলেন: আল্লাহ তা‘আলার হাত পরিপূর্ণ। দিবা-রাত্রির খরচ তাতে কোন কিছুই কমায় না।” (সহীহ বুখারী হা: ৪৬৮৪, সহীহ মুসলিম হা: ৯৯৩)
সুতরাং আল্লাহ তা‘আলার রাস্তায় ব্যয় করলে কোন কিছু কমে না বরং তা বৃদ্ধি পায় এবং আখিরাতে তা আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে দান করবেন।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. গরীব লোকদের মর্যাদা সম্পর্কে জানা গেল যে, তারাই মূলত নাবী-রাসূলদের বেশি অনুসরণ করে, আর ধনীরা বিরোধিতাই বেশি করে।
২. ধন-সম্পদ, সন্তান-সন্ততি শাস্তি থেকে বাঁচাতে পারে না, যদি সঠিক ঈমান ও সৎ আমল না থাকে।
৩. রিযক বাড়ানো বা কমানো আল্লাহ তা‘আলার হাতে, কোন মানুষের হাতে নয়।
৪. খরচ করলে ধন-সম্পদ কমে না বরং তা আল্লাহ তা‘আলার নিকট জমা থাকে ও আখিরাতে তার বিনিময়ে জান্নাত লাভ করা যায়।
৪০-৪২ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা‘আলা কিয়ামতের মাঠে সকলকে একত্রিত করার পর কাফির-মুশরিকদেরকে লজ্জিত ও অপমানিত করার উদ্দেশ্যে ফেরেশ্তাদেরকে লক্ষ্য করে বলবেন যে, এরাই কি তোমাদের ইবাদত করত? অর্থাৎ তোমরা কি তাদেরকে বলেছিলে তোমাদের ইবাদত করার জন্য? না কি তারাই পথভ্রষ্ট ছিল? যেমন আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন:
(وَيَوْمَ يَحْشُرُهُمْ وَمَا يَعْبُدُوْنَ مِنْ دُوْنِ اللّٰهِ فَيَقُوْلُ أَأَنْتُمْ أَضْلَلْتُمْ عِبَادِيْ هٰٓؤُلَا۬ءِ أَمْ هُمْ ضَلُّوا السَّبِيْلَ)
“এবং যেদিন তিনি একত্র করবেন তাদেরকে এবং তারা আল্লাহর পরিবর্তে যাদের ‘ইবাদত করত তাদেরকে, সেদিন তিনি জিজ্ঞেস করবেন, ‘তোমরাই কি আমার এ বান্দাদেরকে বিভ্রান্ত করেছিলে, না তারা নিজেরাই পথভ্রষ্ট হয়েছিল?’’ (সূরা ফুরকান ২৫:১৭)
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
(وَإِذْ قَالَ اللّٰهُ يَا عِيْسَي ابْنَ مَرْيَمَ أَأَنْتَ قُلْتَ لِلنَّاسِ اتَّخِذُوْنِيْ وَأُمِّيَ إِلٰهَيْنِ مِنْ دُوْنِ اللّٰهِ ط قَالَ سُبْحٰنَكَ مَا يَكُوْنُ لِيْٓ أَنْ أَقُوْلَ مَا لَيْسَ لِيْ بِحَقٍّ ط إِنْ كُنْتُ قُلْتُه۫ فَقَدْ عَلِمْتَه۫ ط تَعْلَمُ مَا فِيْ نَفْسِيْ وَلَآ أَعْلَمُ مَا فِيْ نَفْسِكَ ط إِنَّكَ أَنْتَ عَلَّامُ الْغُيُوْبِ)
“আর (স্মরণ কর) আল্লাহ যখন বললেন: ‘হে মারিয়ামের ছেলে ঈসা! তুমি কি লোকদেরকে বলেছিলে যে, তোমরা আল্লাহ ছাড়া আমাকে ও আমার জননীকে দুই ইলাহরূপে গ্রহণ কর?’ সে বলবে, ‘তোমার প্রবিত্রতা বর্ণনা করছি! যা বলার অধিকার আমার নেই তা বলা আমার পক্ষে শোভনীয় নয়। যদি আমি তা বলতাম তবে তুমি তো তা জানতে। আমার অন্তরের কথা তো তুমি অবগত আছ, কিন্তু তোমার অন্তরের কথা আমি অবগত নই; তুমি তো অদৃশ্য সম্বন্ধে সম্যক পরিজ্ঞাত।’’ (সূরা মায়িদাহ ৫:১১৬)
উত্তরে ফেরেশতারা বলবে যে, হে আমাদের রব! আপনি পবিত্র, মহান; আপনার কোন শরীক নেই। আপনি আমাদের রব, আমরা আপনাকেই অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করেছি, আপনার আগনুত্য ও ইবাদত করি। অন্য কারো সাথে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই। মূলত তারা জিন, শাইত্বানের পূজা করত। আর তারা তাদেরই প্রতি বিশ্বাসী ছিল। আল্লাহ তা‘আলার বাণী,
(إِنْ يَّدْعُوْنَ مِنْ دُوْنِه۪ٓ إِلَّآ إِنٰثًا ج وَإِنْ يَّدْعُوْنَ إِلَّا شَيْطٰنًا مَّرِيْدًا – لَّعَنَهُ اللّٰهُ م وَقَالَ لَأَتَّخِذَنَّ مِنْ عِبَادِكَ نَصِيْبًا مَّفْرُوْضًا)
“তাঁর (আল্লাহ) পরিবর্তে তারা দেবীরই পূজা করে এবং বিদ্রোহী শয়তানেরই পূজা করেন আল্লাহ তাকে লা‘নাত করেন এবং সে বলে, ‘আমি অবশ্যই তোমার বান্দাদের এক নির্দিষ্ট অংশকে আমার অনুসারী করে নেব।” (সূরা নিসা ৪:১১৭-১১৮)
কাফির-মুশরিকরা আল্লাহ তা‘আলাকে বাদ দিয়ে অন্যদের যাদের ইবাদত করত, তারা কিয়ামতের দিন কোন উপকার ও ক্ষতি কিছুই করতে পারবে না। আল্লাহ তা‘আলা এসব মুশরিকদেরকে বলবেন: তোমরা যে শাস্তির কথা অস্বীকার করতে তা আস্বাদন করো।
সুতরাং প্রত্যেককে সতর্ক হওয়া উচিত, আমরা কেন আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া অন্যের কাছে চাইতে যাব, কেন অন্যের ইবাদত করব? তারা তো কিয়ামতের দিন কোন উপকার তো দূরের কথা ক্ষতিও করতে পারবে না। বরং আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্য যাদের ইবাদত করা হয়ন তারা সেদিন অস্বীকার করে বলবেন আমরা তাদেরকে আমাদের ইবাদত করতে বলিনি, বরং তারা শয়তান ও জিনদের ইবাদত করেছে।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. কিয়ামতের মাঠে সকলকে একত্রিত করা হবে।
২. কাউকে রব হিসেবে যদি পূজা করা হয়ে থাকে, তাহলে তাকেও জিজ্ঞেস করা হবে যদিও সে ফেরেশ্তা কিংবা নাবী-রাসূল যে কেউ হোক না কেন।
৩. আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া অন্য যাদের ইবাদত করা হয় তারা কিয়ামতের দিন তা অস্বীকার করবে।
৪৩-৪৫ নং আয়াতের তাফসীর:
পূর্ব যুগের কাফির-মুশরিকরদের মত মক্কার কাফিররাও নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে আল্লাহ তা‘আলা প্রেরিত রাসূল হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকার করে। যখন তিনি তাদের কাছে আল্লাহ তা‘আলার আয়াত তথা কুরআন তেলাওয়াত করেন তখন তারা বলে: মুহাম্মাদ তো একজন মানুষ, সে আমাদের বাপ-দাদার মা‘বূদদের ইবাদত করা থেকে বিরত রাখতে চায়। পূর্ব যুগের কাফির-মুশরিকরাও এরূপ কথা বলতো, যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَمَا مَنَعَ النَّاسَ أَنْ يُّؤْمِنُوْآ إِذْ جَا۬ءَهُمُ الْهُدٰٓي إِلَّآ أَنْ قَالُوْآ أَبَعَثَ اللّٰهُ بَشَرًا رَّسُوْلًا)
“যখন তাদের নিকট আসে পথনির্দেশ তখন লোকদেরকে ঈমান আনা হতে বিরত রাখে তাদের এ উক্তি, ‘আল্লাহ কি মানুষকে রাসূল করে পাঠিয়েছেন?’’ (সূরা ইসরা ১৭:৯৪)
তারা কুরআনের ব্যাপারে আরো বলতন এ কুরআন মিথ্যা ও মুহাম্মাদ তা তৈরি করেছে।
(وَمَآ اٰتَيْنٰهُمْ مِّنْ كُتُبٍ يَّدْرُسُوْنَهَا)
‘আর আমি এদেরকে আগে কখনও কোন গ্রন্থ দেইনি যা তারা পাঠ করত’ অর্থাৎ তারা যে কুরআনকে মিথ্যা ও মুহাম্মাদ তা তৈরি করেছে বলে দাবী করে তার প্রমাণ কোথায়? ইতোপূর্বে তো এমন কোন কিতাব দেইনি যা অধ্যয়ন করে তারা জেনেছে যে, কুরআন মিথ্যা ও বানোয়াট। আর এমন কোন রাসূলও প্রেরণ করিনি যে, তিনি বলেছেন কুরআন মিথ্যা ও বানোয়াট। সুতরাং তারা কিসের ভিত্তিতে এসব কথা বলছে। তাদের কথার কোন প্রমাণ নেই।
(وَمَا بَلَغُوْا مِعْشَارَ مَآ اٰتَيْنٰهُمْ)
‘তাদেরকে আমি যা দিয়েছিলাম এরা তার দশ ভাগের এক ভাগও পায়নি’ কারো মতে مِعْشَارَ শব্দের অর্থ عشر অর্থাৎ দশ ভাগের একভাগ। কারো মতে عشر العشر অর্থাৎ একশ ভাগের এক ভাগ। কারো মতে عشر العشير অর্থাৎ এক হাজার ভাগের একভাগ। সুতরাং আয়াতের অর্থ হবেন পূর্ববর্তী উম্মতের পার্থিব ধনৈশ্বর্য, শাসনক্ষমতা, সুদীর্ঘ বয়স, স্বাস্থ্য ও শক্তি-সামর্থ্য ইত্যাদি যে পরিমাণ দান করা হয়েছিল, মক্কাবাসীরা তার দশ ভাগের এক বরং একহাজার ভাগের এক ভাগও পায়নি। তাই পূর্ববর্তীদের অবস্থা ও অশুভ পরিণাম থেকে তাদের শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত। তারা নাবীদেরকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে আযাবে পতিত হয়েছিল এবং সে আযাব যখন এসে যায়, তখন তাদের শক্তি-সামর্থ্য, বীরত্ব, ধনৈশ্বর্য ও সুরক্ষিত দূর্গ কোনই কাজে আসেনি। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَلَقَدْ مَكَّنّٰهُمْ فِيْمَآ إِنْ مَّكَّنّٰكُمْ فِيْهِ وَجَعَلْنَا لَهُمْ سَمْعًا وَّأَبْصَارًا وَّأَفْئِدَةً ﺘ فَمَآ أَغْنٰي عَنْهُمْ سَمْعُهُمْ وَلَآ أَبْصَارُهُمْ وَلَآ أَفْئِدَتُهُمْ مِّنْ شَيْءٍ إِذْ كَانُوْا يَجْحَدُوْنَ بِاٰيٰتِ اللّٰهِ وَحَاقَ بِهِمْ مَّا كَانُوْا بِه۪ يَسْتَهْزِئُوْنَ)
“আমি তাদেরকে এমন সব কিছু দিয়েছিলাম, যা তোমাদেরকে দিইনি। আমি তাদেরকে কান, চোখ ও হৃদয় দিয়েছিলাম; কিন্তু তাদের কান, চোখ ও হৃদয় তাদের কোনো কাজে আসল না। কারণ, তারা আল্লাহর আয়াতগুলোকে অস্বীকার করেছিল। যা নিয়ে তারা ঠাট্টা-বিদ্রƒপ করত তা-ই তাদেরকে ঘিরে ফেলল।” (সূরা আহকাফ ৪৬:২৬)
এখানে পূর্ববর্তী লোকদের কথা উল্লেখ করে বুঝাতে চেয়েছেন যে, পূর্ববর্তী লোকদেরকে নাবীদের অস্বীকার করার কারণে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছিল। সুতরাং এদের চিন্তা করে তোমরা শিক্ষা গ্রহণ কর। তারা ছিল সর্বদিক দিয়ে শক্তিশালী, তারপরেও তারা ধ্বংস হয়ে গেছে। সুতরাং তোমাদেরকে ধ্বংস করাটা কোন ব্যাপারই নয়।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. কাউকে সৎ পথের অনুসরণ করা থেকে বাধা প্রদান করা যাবে না।
২. নাবী রাসূলগণকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করা যাবে না।
৩. নাবী-রাসূলগণ যে সকল মু‘জিযা দেখিয়েছেন এগুলো সত্য, এগুলো কোন জাদুবিদ্যা নয়। কারণ জাদুবিদ্যা হারাম। আর নাবী-রাসূলগণ কখনো হারাম কাজ করতে পারেন না।
৪৬ নং আয়াতের তাফসীর:
নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পক্ষ থেকে এটা হল মক্কার কাফির-মুশরিকদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত প্রমাণ ও দাওয়াত যে, আমি তোমাদেরকে একটি বিষয়ের উপদেশ দিচ্ছি, তোমরা একনিষ্ঠতার সাথে সত্যানুসন্ধানের জন্য উঠে পড়, তা সমষ্টিগত হোক আর একাকী হোক, তারপর চিন্তা করে দেখ তোমাদের সাথী মুহাম্মাদ কি পাগল? তাঁর মাঝে কি পাগলের কোন গুণাগুণ আছে? তাঁর চলা-ফেরায়, কথা বার্তায়, লেবাস-পোষাকে? না কি তিনি একজন নাবী, যিনি তোমাদের সম্মুখে আগত কঠিন শাস্তি থেকে ভীতি প্রদর্শন করছেন? তোমরা যদি এসব চিন্তা করে দেখ তাহলে অবশ্যই জানতে পারবে যে, তিনি কোন পাগল নন, তিনি একজন রাসূল যিনি আগত কঠিন শাস্তি সম্পর্কে ভয় দেখাচ্ছেন।
তাছাড়া তোমরা কিভাবে পাগল বল? তিনি তোমাদের সাথে বড় হয়েছেন, তোমাদের এলাকার সন্তান, বহিরাগত কোন এলাকা থেকে আসেননি? সুতরাং তাঁকে পাগল বলা তোমাদের সমীচীন নয়। হাদীসে বলা হয়েছে।
ইবনু ‘আব্বাস (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন: একদা নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাফা পাহাড়ের ওপর আরোহণ করে বললেন: “ইয়া স্ববা-হা-হু” (আরবরা যখন দুঃখজনক কোন বিষয়ে ঘোষণা দিতেন তখন এ শব্দটি বা এ জাতীয় শব্দ ব্যবহার করতেন) তখন কুরাইশরা তাঁর নিকট একত্রিত হলো। অতঃপর তারা বলল: তোমার কী হয়েছে? তখন তিনি বললেন: যদি আমি বলি যে, শত্র“ সৈন্য তোমাদের ওপর হামলা করতে আসছে এবং এতে বিস্ময়ের কিছুই নেই যে, তারা সকালে বা সন্ধ্যায় তোমাদেরকে আক্রমণ করে বসবে, তাহলে কি তোমরা আমার কথাকে সত্য বলে মেনে নিবে? তারা বলল: হ্যাঁ। তিনি বললেন: আমি তোমাদেরকে ঐ শাস্তি থেকে ভয় দেখাচ্ছি যা তোমাদের সামনে রয়েছে। (সহীহ বুখারী হা: ৪৮০১)
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মূলত একজন সতর্ককারী ও সুসংবাদদাতা। তিনি কোন পাগল নন।
৪৭-৫০ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা‘আলা প্রথমত বর্ণনা করেছেন যে, দীন প্রচারে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিজের কোনই স্বার্থ নেই এবং তাঁর পার্থিব ধন-সম্পদের প্রতি কোন লোভ নেই। সে কথা মহান আল্লাহ তা‘আলা এ আয়াতে সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ করে দিয়েছেন। তাদের মনে যাতে করে এ সন্দেহের সৃষ্টি হয়ে তারা দূরে সরে না যায় যে, উক্ত দা‘ওয়াতের পিছনে তাঁর পার্থিব কোন পদ, মর্যাদা, ক্ষমতা বা ধন-সম্পদ উপার্জনের উদ্দেশ্য আছে। যদি তা উপার্জন করা উদ্দেশ্য থাকত তাহলে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মক্কার কুরাইশদেরকে এ কথা বলতেন না যখন তারা মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে আরবের রাজত্ব দিতে চেয়েছিলন যদি তোমরা আমার এক হাতে চাঁদ এবং সূর্য এনে দাও তবুও আমি আল্লাহ তা‘আলার দীন থেকে একটুও পিছপা হব না। মূলত তাঁর উদ্দেশ্য ছিল সঠিক ধর্ম প্রচার করা এবং মানুষকে জাহান্নাম থেকে রক্ষা করে জান্নাতের পথ দেখানো। এরপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন যে, তিনি সত্যই অবতীর্ণ করেন। অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা হক্ব কথা বলেন, নিজ রাসূলগণের প্রতি ওয়াহী অবতীর্ণ করেন এবং তাদের মাধ্যমে মানুষের জন্য হক্ব কথা ও বিষয় স্পষ্ট করে থাকেন এবং হক্ব দ্বারা মিথ্যা ও বাতিলকে বিদূরিত করেন। মিথ্যা কখনো সত্যের ওপর বিজয়ী হতে পারে না।
আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
(يُلْقِي الرُّوْحَ مِنْ أَمْرِه۪ عَلٰي مَنْ يَّشَا۬ءُ مِنْ عِبَادِه۪ لِيُنْذِرَ يَوْمَ التَّلَاقِ)
“তিনি তাঁর বান্দাদের মধ্যে যার প্রতি ইচ্ছা রূহ (ওয়াহী) প্রেরণ করেন স্বীয় আদেশ সহ, যাতে সে সতর্ক করতে পারে সাক্ষাত (কিয়ামত) দিবস সম্পর্কে।” (সূরা মু’মিন ৪০:১৫)
হাদীসে বলা হয়েছে, ইবনু মাস‘ঊদ (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মক্কায় প্রবেশ করলেন তখন বায়তুল্লাহর চারদিকে ৩৬০টি মূর্তি ছিল। তিনি তাঁর হাতের লাঠি দ্বারা সেগুলোকে খোঁচা মারছিলেন আর নিম্ন আয়াত পড়ছিলেন।
(وَقُلْ جَا۬ءَ الْحَقُّ وَزَهَقَ الْبَاطِلُ ط إِنَّ الْبَاطِلَ كَانَ زَهُوْقًا)
“এবং বল: ‘সত্য এসেছে এবং মিথ্যা বিলুপ্ত হয়েছে’; নিশ্চয়ই মিথ্যা তো বিলুপ্ত হবারই।” (সূরা বানী ইসরাঈল ১৭:৮১)
সুতরাং সত্য যেখানে সমাগত মিথ্যা সেখানে বিতাড়িত হবেই। মিথ্যা কখনো বিজয়ী হতে পারে না।
এরপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন: হে রাসূল! তুমি বলো: যদি আমি পথভ্রষ্ট হই তাহলে তার পরিণাম আমাকেই ভোগ করতে হবে। আর যদি হিদায়াত প্রাপ্ত হই তাহলে আমার প্রতিপালক আমার প্রতি সত্যসহ ওয়াহী করেছেন। অর্থাৎ সর্বপ্রকার কল্যাণ আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে। আল্লাহ তা‘আলা যে ওয়াহী ও স্পষ্ট সত্য অবতীর্ণ করেছেনন তাতে সঠিক পথ ও হিদায়াত নিহিত আছে। মানুষ তাতেই সঠিক পথের দিশা পায়। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি পথভ্রষ্ট হয়, তাতে মানুষের নিজের ত্র“টি এবং প্রবৃত্তির খেয়াল-খুশি থাকে। এ জন্য তার কুফলও তাকেই ভোগ করতে হবে।
তারপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন, তিনি হচ্ছেন সর্বশ্রোতা ও সন্নিকটবর্তী। হাদীসে বলা হয়েছে, আবূ মূসা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: তোমরা এমন কাউকে আহ্বান করছো না যিনি বধির ও অনুপস্থিত। বরং তোমরা আহ্বান করছ এমন সত্তাকে যিনি সর্বশ্রোতা, সন্নিকটবর্তী ও তোমাদের আহ্বানে সাড়া দানকারী। (সহীহ বুখারী হা: ২৯৯২, সহীহ মুসলিম হা: ২৭০৪)
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. আল্লাহ তা‘আলা সদা-সর্বদা সত্য জিনিসই অবতীর্ণ করেন।
২. সত্যের মোকাবেলায় মিথ্যা সর্বদা পরাভূত হয়। মিথ্যা কখনো বিজয়ী হতে পারে না।
৩. সর্ব প্রকার কল্যাণ আল্লাহ তা‘আলার হাতে। তিনি কখনো কারো অকল্যাণ করেন না।
৫১-৫৪ নং আয়াতের তাফসীর:
যারা আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূলকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে এবং আল্লাহ তা‘আলাদ্রোহী ও শির্কী কর্মে লিপ্ত কিয়ামতের মাঠে তাদের ভয়াবহ পরিণতির বর্ণনা অত্র আয়াতসমূহে ফুটে উঠেছে।
ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন: কাফির-মুশরিকদের এ ভীত-বিহবল অবস্থা তখন হবে যখন কবরে কঠিন শাস্তির আওয়াজ শুনতে পাবে। অধিকাংশ বিদ্বানদের মতেন এ ভীত-বিহ্বল অবস্থা হাশর দিবসে হবে। তখন কাফির-মুশরিকরা ভীত-বিহবল হয়ে পালাতে চাইবে কিন্তু পালাতে পারবে না। তাদেরকে (مَّكَانٍ قَرِيْبٍ) তথা স্বস্থান থেকে গ্রেফতার করা হবে। তখন তারা ঈমান আনবে কিন্তু সে ঈমান কোন কাজে আসবে না। তাদের উক্তি:
(وَلَوْ تَرٰٓي إِذِ الْمُجْرِمُوْنَ نٰكِسُوْا رُؤُوْسِهِمْ عِنْدَ رَبِّهِمْ ط رَبَّنَآ أَبْصَرْنَا وَسَمِعْنَا فَارْجِعْنَا نَعْمَلْ صَالِحًا إِنَّا مُوْقِنُوْنَ )
“আর যদি তুমি দেখতে, যখন পাপীরা তাদের প্রতিপালকের সামনে স্বীয় মাথা নীচু করে বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা দেখলাম ও শ্রবণ করলাম, (এখন) তুমি আমাদেরকে পুনরায় (পৃথিবীতে) প্রেরণ কর; আমরা নেক কাজ করব। আমরা তো দৃঢ় বিশ্বাসী হয়েছি।” (সূরা সাজদাহ ৩২:১২)
التَّنَاوُشُ -অর্থ হাত বাড়িয়ে কোন কিছু তুলে আনা। আয়াতের উদ্দেশ্য হল কাফির-মুশরিকরা কিয়ামতের দিন সত্য-সত্যই সামনে এসে যাওয়ার পর বলবেন আমরা ঈমান আনলাম। যেহেতু তারা দুনিয়ার জীবনে ঈমান আনয়ন করেনি বরং তারা অদৃশ্য বিষয়ে দূরবর্তী স্থান হতে বাক্য ছুঁড়ে মারত সে জন্য তা গ্রহণযোগ্য হবে না।
কিয়ামত দিবসে তাদের ও তাদের কামনা-বাসনার মধ্যে অন্তরাল সৃষ্টি করে দেয়া হবে যেমন দেয়া হয়েছিল পূর্ববর্তী লোকদের ক্ষেত্রে। কারণ তারাও শাস্তি অবলোকন করার পর ঈমান এনেছিল কিন্তু তা কোনই উপকারে আসেনি। اشياع শব্দটি شيعة শব্দের বহুবচন। একবচন হল অর্থ হল দল, গোষ্ঠী। যেহেতু কাফিররা একই দলভুক্ত তাই এভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. কিয়ামতের মাঠে অপরাধীরা ভীত-বিহ্বল হয়ে পড়বে।
২. আখিরাতে নাজাত পাওয়ার জন্য দুনিয়াতেই প্রস্তুতি নিতে হবে।
৩. শাস্তি অবলোকন করার পর ঈমান আনয়ন কোন ফায়দা দিবে না।