(টপিক#১০৬৪) [* ‌ পার্থিব জীবন যেন তোমাদের প্রতারিত না করে : -] www.motaher21.net সূরা:- ৩৫:ফা-ত্বির পারা:২২ ০১-৯ নং আয়াত:-

أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#১০৬৪)
[* ‌ পার্থিব জীবন যেন তোমাদের প্রতারিত না করে : -]
www.motaher21.net
সূরা:- ৩৫:ফা-ত্বির
পারা:২২
০১-৯ নং আয়াত:-
ফা-ত্বির:- ৩৫:০১
اَلۡحَمۡدُ لِلّٰہِ فَاطِرِ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ جَاعِلِ الۡمَلٰٓئِکَۃِ رُسُلًا اُولِیۡۤ اَجۡنِحَۃٍ مَّثۡنٰی وَ ثُلٰثَ وَ رُبٰعَ ؕ یَزِیۡدُ فِی الۡخَلۡقِ مَا یَشَآءُ ؕ اِنَّ اللّٰہَ عَلٰی کُلِّ شَیۡءٍ قَدِیۡرٌ ﴿۱﴾

সমস্ত প্রশংসা আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা আল্লাহরই — যিনি ফিরিশতাদেরকে বাণীবাহক (দূত) করেন;‌যারা দুই-দুই, তিন-তিন অথবা চার-চার ডানাবিশিষ্ট। তিনি তাঁর সৃষ্টিতে যা ইচ্ছা বৃদ্ধি করে থাকেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান।
ফা-ত্বির:- ৩৫:০২
مَا یَفۡتَحِ اللّٰہُ لِلنَّاسِ مِنۡ رَّحۡمَۃٍ فَلَا مُمۡسِکَ لَہَا ۚ وَ مَا یُمۡسِکۡ ۙ فَلَا مُرۡسِلَ لَہٗ مِنۡۢ بَعۡدِہٖ ؕ وَ ہُوَ الۡعَزِیۡزُ الۡحَکِیۡمُ ﴿۲﴾
আল্লাহ যে রহমতের দরজা মানুষের জন্য খুলে দেন তা রুদ্ধ করার কেউ নেই এবং যা তিনি রুদ্ধ করে দেন তা আল্লাহর পরে আর কেউ খোলার নেই। তিনি পরাক্রমশালী ও জ্ঞানী।
ফা-ত্বির:- ৩৫:০৩
یٰۤاَیُّہَا النَّاسُ اذۡکُرُوۡا نِعۡمَتَ اللّٰہِ عَلَیۡکُمۡ ؕ ہَلۡ مِنۡ خَالِقٍ غَیۡرُ اللّٰہِ یَرۡزُقُکُمۡ مِّنَ السَّمَآءِ وَ الۡاَرۡضِ ؕ لَاۤ اِلٰہَ اِلَّا ہُوَ ۫ۖ فَاَنّٰی تُؤۡفَکُوۡنَ ﴿۳﴾
হে মানুষ! তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ কর। আল্লাহ ব্যতীত কি কোন স্রষ্টা আছে যে তোমাদেরকে আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী হতে রুযী দান করে? তিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। সুতরাং কিরূপে তোমরা সত্যবিমুখ হচ্ছ?
ফা-ত্বির:- ৩৫:০৪
وَ اِنۡ یُّکَذِّبُوۡکَ فَقَدۡ کُذِّبَتۡ رُسُلٌ مِّنۡ قَبۡلِکَ ؕ وَ اِلَی اللّٰہِ تُرۡجَعُ الۡاُمُوۡرُ ﴿۴﴾
এরা যদি তোমাকে মিথ্যাবাদী বলে, তবে তোমার পূর্ববর্তী রসূলগণকেও তো মিথ্যাবাদী বলা হয়েছিল। আর আল্লাহর দিকেই সকল বিষয় প্রত্যাবর্তিত হয়ে থাকে।
ফা-ত্বির:- ৩৫:০৫
یٰۤاَیُّہَا النَّاسُ اِنَّ وَعۡدَ اللّٰہِ حَقٌّ فَلَا تَغُرَّنَّکُمُ الۡحَیٰوۃُ الدُّنۡیَا ٝ وَ لَا یَغُرَّنَّکُمۡ بِاللّٰہِ الۡغَرُوۡرُ ﴿۵﴾
হে মানুষ! নিশ্চয় আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সত্য; সুতরাং পার্থিব জীবন যেন কিছুতেই তোমাদেরকে প্রতারিত না করে এবং কোন প্রবঞ্চক যেন কিছুতেই আল্লাহ সস্পর্কে তোমাদেরকে প্রবঞ্চিত না করে।
ফা-ত্বির:- ৩৫:০৬
اِنَّ الشَّیۡطٰنَ لَکُمۡ عَدُوٌّ فَاتَّخِذُوۡہُ عَدُوًّا ؕ اِنَّمَا یَدۡعُوۡا حِزۡبَہٗ لِیَکُوۡنُوۡا مِنۡ اَصۡحٰبِ السَّعِیۡرِ ؕ﴿۶﴾
শয়তান তোমাদের শত্রু; সুতরাং তাকে শত্রু হিসাবেই গ্রহণ কর। সে তো তার দলবলকে এ জন্য আহবান করে যে, ওরা যেন জাহান্নামী হয়।
ফা-ত্বির:- ৩৫:০৭
اَلَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا لَہُمۡ عَذَابٌ شَدِیۡدٌ ۬ؕ وَ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ لَہُمۡ مَّغۡفِرَۃٌ وَّ اَجۡرٌ کَبِیۡرٌ ﴿٪۷﴾
যারা কুফরী করে তাদের জন্য আছে কঠিন শাস্তি। আর যারা ঈমান আনে ও সৎকাজ করে তাদের জন্য আছে ক্ষমা ও মহাপুরস্কার।
ফা-ত্বির:- ৩৫:০৮
اَفَمَنۡ زُیِّنَ لَہٗ سُوۡٓءُ عَمَلِہٖ فَرَاٰہُ حَسَنًا ؕ فَاِنَّ اللّٰہَ یُضِلُّ مَنۡ یَّشَآءُ وَ یَہۡدِیۡ مَنۡ یَّشَآءُ ۫ۖ فَلَا تَذۡہَبۡ نَفۡسُکَ عَلَیۡہِمۡ حَسَرٰتٍ ؕ اِنَّ اللّٰہَ عَلِیۡمٌۢ بِمَا یَصۡنَعُوۡنَ ﴿۸﴾
কাউকে যদি তার মন্দকাজ শোভন করে দেখানো হয় ফলে সে এটাকে উত্তম মনে করে, (সে ব্যক্তি কি তার সমান যে সৎকাজ করে?) তবে আল্লাহ্ যাকে ইচ্ছে বিভ্রান্ত করেন এবং যাকে ইচ্ছে হিদায়াত করেন। অতএব তাদের জন্য আক্ষেপ করে আপনার প্রাণ যেন ধ্বংস না হয়। তারা যা করে নিশ্চয় আল্লাহ্ সে সম্পর্কে সম্যক পরিজ্ঞাত।
ফা-ত্বির:- ৩৫:০৯
وَ اللّٰہُ الَّذِیۡۤ اَرۡسَلَ الرِّیٰحَ فَتُثِیۡرُ سَحَابًا فَسُقۡنٰہُ اِلٰی بَلَدٍ مَّیِّتٍ فَاَحۡیَیۡنَا بِہِ الۡاَرۡضَ بَعۡدَ مَوۡتِہَا ؕ کَذٰلِکَ النُّشُوۡرُ ﴿۹﴾
আল্লাহই বায়ু প্রেরণ করে তার দ্বারা মেঘমালা সঞ্চালিত করেন। অতঃপর তিনি তা নির্জীব ভূখন্ডের দিকে পরিচালিত করেন, অতঃপর তিনি তা দিয়ে পৃথিবীকে ওর মৃত্যুর পর সঞ্জীবিত করেন। পুনরুত্থান এরূপেই হবে।

ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-

সংক্ষিপ্ত আলােচনা : এই মক্কী সূরাটির ভাষায় ও বিষয়বস্তুতে যে বিশেষ ধরনের বিন্যাস রয়েছে, তার সাথে সূরা ‘রাদ’-এর বিন্যাসের নিকটতম সাদৃশ্য বিদ্যমান রয়েছে। সূরাটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মানুষের মনকে প্রভাবিত করে, ঝাঁকি দেয় এবং উদাসীনতা ও শৈথিল্য থেকে তাকে জাগিয়ে তােলে, যাতে সে সৃষ্টি জগতের বিশালতা ও চমৎকারিত্ব নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে পারে, সমগ্র প্রকৃতিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মহান আল্লাহর নিদর্শনাবলী নিয়ে ভাবতে পারে, তার নেয়ামতসমূহ স্মরণ রাখে, তার দয়া ও করুণাকে অন্তর দিয়ে অনুভব করে, অতীতের কাফেরদের ইহকালীন ধ্বংস ও বিপর্যয় এবং পরকালীন শােচনীয় পরিণতিকে উপলব্ধি করে, মহান আল্লাহর অতুলনীয় বিষ্ময়কর সৃষ্টিগুলাে, সৃষ্টি জগত, মানব জীবন, ইতিহাসের ঘটনাবলী ও মানবাত্মার গভীরতম প্রকোষ্ঠে মহান আল্লাহর সৃজনী হাতের নিদর্শনাবলী লক্ষ্য করার সময় তার সামনে বিনয়াবনত হয় এবং এই অতুলনীয় বিস্ময়কর সৃষ্টিগুলাে ও তার এসব নিদর্শনের মধ্য দিয়ে সে সৃষ্টিজগতে কার্যকর প্রাকৃতিক নিয়মাবলী, রসূল ও কিতাবের মাধ্যমে প্রেরিত সত্য বিধান এবং সর্বশক্তিমান আল্লাহর সুদক্ষ সুনিপুণ সৃজনী হাতের অখণ্ড একত্ব দেখে তা অনুভব করতে পারে। আর এই সব কিছুই যেন এমন সামঞ্জস্যপূর্ণ উপায় সম্পন্ন হয়, যাতে কোনাে অনুভূতিশীল হৃদয়ই সত্যের উপলব্ধি থেকে বঞ্চিত না হয়। সূরাটা এমন অখণ্ড ও ঘনিষ্ঠ, পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত একক যে, একে আলাদা আলাদা অধ্যায়ে বিভক্ত করা কঠিন। কেননা পুরাে সূরাটা জুড়ে একই বিষয় আলােচিত, মানব হৃদয়ের ওপর একই ঐকতান ঝংকৃত এবং প্রকৃতি, মানবাত্মা, জীবন, ইতিহাস ও পরকালের উৎস থেকে উদ্ভূত এই সত্য এর সর্বত্র উচ্চারিত, তাই এ সূরা মানব হৃদয়কে সর্বদিক থেকে ঈমান, প্রত্যয় ও বিনয়ের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। এ সূরার আয়াতগুলাের একটা উল্লেখযােগ্য বৈশিষ্ট্য এই যে, এগুলাে একমাত্র মহান স্রষ্টা আল্লাহ এই সকল তৎপরতার শক্তির উৎস নির্ধারণ করে, তার হাতকেই সকল তৎপরতার মূল শক্তিদাতা ও প্রেরণা হিসাবে চিহ্নিত করে এবং ঘােষণা করে যে, সব কিছুর সুতাে তার হাতেই নিবদ্ধ, তিনিই এই সুতাে ছাড়েন বা টানেন, ঢিল দেন বা সংকুচিত করেন। কেউ এ ক্ষেত্রে তাকে বাধা দিতে পারে না, তার সাথে শরীক হতে পারে না বা তার প্রতিদ্বন্ধী হতে পারে না। সূরার শুরু থেকেই এই বৈশিষ্ট্যটা আমরা সুস্পষ্টভাবে দেখতে পাই এবং শেষ পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে। আমরা দেখতে পাই, এক মহাশক্তিধর ও মহাপরাক্রমশালী শক্তি এই মহাবিশ্বকে নিজের ইচ্ছা অনুসারে সৃষ্টি করে, ‘আল্লাহর জন্যে সকল প্রশংসা, যিনি আকাশ ও পৃথিবীর স্রষ্টা'(আয়াত-১) স্ৰষ্টা হওয়ার সুবাদে সৃষ্টির ওপর তার এই জোরদার নিয়ন্ত্রণ আবার তাঁর দয়ালু হওয়ার কারণে শিথিলও হয়। তখন আল্লাহর দয়া করুণা মুষলধারে বর্ষিত হয়। পুনরায় সেই করুণার ধারাও নিয়ন্ত্রিত এবং বন্ধ হয়। এর কোনােটাতেই কেউ তার অংশীদার হয় না এবং এখানে কারাে কিছু করণীয়ও থাকে না। ‘আল্লাহ মানুষের জন্যে যে করুণাধারা উন্মুক্ত করেন, তা কেউ বন্ধ করতে পারে না, আর যা তিনি বন্ধ করেন তা কেউ পুনরায় চালু করতেও পারে না'(আয়াত-২) হেদায়াত ও গােমরাহী আল্লাহর এই করুণাধারা উন্মুক্ত করা অথবা বন্ধ করার ফল। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আল্লাহ যাকে ইচ্ছা করেন বিপথগামী করেন, যাকে ইচ্ছা করেন হেদায়াত করেন।… আল্লাহ তায়ালা যাকে চান শিখান। যারা কবরে আছে, তাদের তুমি শােনাতে পারবে না। তুমি তো সতর্ককারী মাত্র।’ মহান আল্লাহর এই হাতই পার্থিব জীবন সৃষ্টি করে এবং পরকালে মৃতদেহকে পুনরুজ্জীবিত করে। ‘আল্লাহ তায়ালাই সেই মহান সত্ত্বা, যিনি বাতাস প্রেরণ করেন, অতপর মেঘমালা চালু করেন….'(আয়াত-৯) এরপর ১০ নং আয়াতে বলা হয়েছে যে, সব সম্মান মর্যাদা কেবলমাত্র আল্লাহর প্রাপ্য এবং এর একমাত্র উৎসও তিনি। ‘যে ব্যক্তি সম্মান চায় তার জানা উচিত যে, সকল সম্মান একমাত্র আল্লাহর।’ ১১ নং আয়াতের বক্তব্য এই যে, বিশ্বজগতের যাবতীয় সৃষ্টির নির্মাণ, বংশ বৃদ্ধি ও আয়ুস্কাল নির্ধারণ সব কিছুরই সুতাে আল্লাহর হাতে রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, আল্লাহ তায়ালা তােমাদের সৃষ্টি করেছেন মাটি থেকে… ১৩ নং আয়াতে বলা হয়েছে যে, মহান আল্লাহর হাতেই রয়েছে আকাশ ও পৃথিবীর চাবিকাঠি এবং গ্রহ নক্ষত্রের গতিবিধি আর আল্লাহর হাতই যে তার সুনির্দিষ্ট পন্থায় সমগ্র সৃষ্টি জগতে সক্রিয় রয়েছে এবং জড় পদার্থ, উদ্ভিদ, মানুষ ও জীবজন্তুকে বিভিন্ন রঙে রঞ্জিত করে, সে কথা বলা হয়েছে ২৭ ও ২৮ নং আয়াতে। আর এই হাতই মানব জাতির বংশ বিস্তার ঘটায় এবং এক প্রজন্মকে আর এক প্রজন্মের উত্তরাধিকারী বানায়, এ কথা রয়েছে ৩২ ও ৩৯ নং আয়াতে। এই হাতই আকাশ ও পৃথিবীকে ধ্বংসের কবল থেকে রক্ষা করে, ৪১ নং আয়াতে এ কথাই ঘােষণা করা হয়েছে। ৪৪ নং আয়াতে বলা হয়েছে যে, তার এই হাতই সব কিছুকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছে এবং আকাশ ও পৃথিবীর কেউ তার এ কাজে বাধা দিতে পারে না। মহান আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে সূরার কয়েকটা বক্তব্য লক্ষণীয়; ‘তিনি সর্ববিষয়ে ক্ষমতাবান’ ‘তিনি পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়’, ‘সব জিনিসই আল্লাহর কাছে ফিরে যাবে’ ‘তিনি তােমাদের কার্যকলাপ সম্পর্কে অবহিত’, ‘রাজত্ব কেবল তারই’, ‘আল্লাহর কাছেই সকলের প্রত্যাবর্তন’, ‘তিনি প্রতাপশালী ও ক্ষমাশীল, তিনি ক্ষমাশীল ও গুণগ্রাহী’, ‘তিনি তাঁর বান্দাদের অবস্থা পর্যবেক্ষণকারী, সর্বোত্তম’, তিনি আকাশ ও পৃথিবীর সকল অদৃশ্য বিষয় জানেন’, ‘তিনি অন্তর্যামী ‘তিনি ধৈর্যশীল ও ক্ষমাশীল’, ‘তিনি মহাজ্ঞানী ও সর্বশক্তিমান এবং তাঁর বান্দাদের তত্ত্বাবধায়ক।’ এসব বক্তব্য এবং এই সব আয়াত নিয়েই সূরাটা গঠিত, আর এগুলাে দ্বারাই বুঝা যায় সূরার বৈশিষ্ট্য কি এবং মনের ওপর তা সাধারণভাবে কি প্রভাব বিস্তার করে। সূরার এই সব বৈশিষ্ট্যের প্রতি লক্ষ্য রেখেই আমি একে ভালােভাবে বিশ্লেষণ ও হৃদয়ংগম করার সুবিধার্থে ছয়টা অংশে ভাগ করেছি। তবে প্রত্যেকটা অংশের বক্তব্য এতাে সাদৃশ্যপূর্ণ যে, পুরাে সূরাটা আসলে একটা অধ্যায় বলেই প্রতীয়মান হয়।
* ‘সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্যে যিনি আকাশ ও পৃথিবীর স্রষ্টা'(আয়াত-১) সূরাটার শুরুতেই আল্লাহর প্রশংসা করা হয়েছে। তাই বলা যায়, এ সূরার মূল লক্ষ্যই আল্লাহর দিকে মনকে নিবিষ্ট করা। তার নেয়ামতগুলাে দর্শনের জন্যে মনকে জাগিয়ে তােলা, তার দয়া ও অনুগ্রহ অন্বেষণ করা, তার সৃষ্টি জগতে তার অতুলনীয় শিল্প নৈপুণ্যর নিদর্শন দেখা, সমগ্র চেতনা ও অনুভূতিকে এসব নিদর্শন দিয়ে পরিপূর্ণ করা এবং প্রশংসা, গুণকীর্তন ও ক্ষমা প্রার্থনা করা।  *প্রাকৃতিক নিয়মে পৃথিবীর পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ : সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর। এই কথাটা বলার সাথে সাথেই সৃজন সম্বলিত তাঁর গুণবাচক নামটির উল্লেখ করা হয়েছে। যিনি আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা। অর্থাৎ তিনি এই বিশাল সৃষ্টি জগতের নির্মাতা, যার একাংশ আমাদের ওপরে ও একাংশ নীচে দেখতে পাই। এর সবচেয়ে ক্ষুদ্র অংশ এবং আমাদের নিকটতম অংশ হলাে আমাদের এই পৃথিবী। এর সম্পর্কে আমরা খুবই কম জানি। এই সমগ্র সৃষ্টি জগত শাসিত হচ্ছে একই প্রাকৃতিক নিয়মে এবং পরিপূর্ণ সমন্বয় সহকারে পরিচালিত হচ্ছে এর রক্ষণাবেক্ষণ । অথচ এ সৃষ্টি জগতের একাংশ থেকে আরেক অংশের দূরত্ব এতাে বেশী যে, প্রাণান্তকর চেষ্টা সাধনা ছাড়া তা নির্ণয় করা আমাদের মানবীয় চিন্তাশক্তির পক্ষে সম্ভব নয়। এই সৃষ্টি জগতের এতাে বিশালতা, এক একটা জগতের সাথে অপর জগতের এতাে ব্যবধান এবং একটা কক্ষপথ থেকে অপর কক্ষপথের এতাে দূরত্ব সত্ত্বেও এগুলাের পারস্পরিক আনুপাতিক তারতম্য এতাে সুক্ষ্ম যে, এর একটা ক্ষুদ্রতম অনুপাতেও যদি ব্যত্যয় ঘটে, তবে গােটা সৃষ্টিজগত বিধ্বস্ত ও ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হয়ে লুটিয়ে পড়বে। পবিত্র কোরআনে আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্ট সংক্রান্ত এ ধরনের অসংখ্য উক্তি আমরা পড়ে থাকি, কিন্তু তার সুগভীর মর্ম উদ্ধারের জন্য চিন্তা ভাবনা করি না। একই ধরনের সরলতা ও নির্বুদ্ধিতা নিয়ে আমরা আকাশ এবং পৃথিবীর বহু দৃশ্য দেখেও না দেখার ভান করে তা নিয়ে দীর্ঘস্থায়ী চিন্তাগবেষণা ছাড়াই এগিয়ে যাই। কেননা আমাদের অনুভূতিশক্তি স্থবির ও ভোঁতা হয়ে গেছে। তাই সেসব প্রাকৃতিক দৃশ্য আমাদের চেতনায় কোনাে জাগরণ সৃষ্টি করে না। অথচ আল্লাহকে সর্বদা স্মরণকারী হৃদয়ে তা তীব্র আলােড়ন ও জাগরণ সৃষ্টি করতে বাধ্য। কেননা সেই হৃদয়গুলাে মহান আল্লাহর সুনিপুণ নির্মাণকারী হাতের স্বাক্ষর প্রত্যেক সৃষ্টিতে দেখতে পায়। কারণ এই বিস্ময়কর সৃষ্টিগুলাে প্রথম বার দেখার সময় যে বিষয়, কৌতূহল ও আতংক অনুভূত হতাে, দীর্ঘকাল দেখতে দেখতে অভ্যস্ততা ও সখ্যতার সৃষ্টি হওয়ায় আমাদের সেই আতংক ও বিস্ময়ের ঘাের কেটে গেছে। যাদের মন আল্লাহর সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ, তারা কখনাে এ সব সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বৈজ্ঞানিক তথ্য জানার প্রয়ােজন বােধ করে না যে, আকাশের কোথায় কোথায় কোন কোন গ্রহ নক্ষত্র অবস্থান করে, সেগুলাে আয়তনে পরস্পরের তুলনায় কত বড় বা ছােট, সেগুলাের চারপাশে বিরাজিত মহাশূন্যের আপেক্ষিক আয়তন কেমন, সেসব গ্রহ নক্ষত্র মহাশূন্যের কোন কোন কক্ষপথে প্রদক্ষিণ করে, আয়তনে, অবস্থানে ও গতিবিধিতে সেগুলাের কোনটা কোনটার চেয়ে অগ্রগামী বা পশ্চাদপদ ইত্যাদি। এই বিস্ময়কর ও চমৎকার সৃষ্টিজগত সম্পর্কে কৌতূহল ও বিস্ময় জন্মানাের জন্যে তাদের এ সব তথ্য জানার কোনােই প্রয়ােজন হয় না। প্রকৃতির এ সব দৃশ্য অবলােকন করাই তাদের জন্যে যথেষ্ট। অন্ধকারাচ্ছন্ন রাতে আকাশ জুড়ে ছড়িয়ে থাকা নক্ষত্রমালা, জ্যোৎস্না রাতের আলাের বন্যা, মুক্তি ও স্বাধীনতার বার্তা বহনকারী ঊষাকালের আবির্ভাব এবং বিদায় ও সমাপ্তির ঘন্টা বাজানাে অন্ধকার বয়ে আনা সূর্যাস্তের দৃশ্যই তাদের জন্যে যথেষ্ট প্রমাণিত হয়। এমন কি শুধুমাত্র অফুরন্ত বিষয়ের ভাণ্ডার এই পৃথিবী ও তার অভিভূতকারী দৃশ্যাবলীই তাদের জন্যে যথেষ্ট হয়ে থাকে, যা একজন পর্যটক সারা জীবনেও দেখে শেষ করতে পারে না। আরাে নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে বলা যায়, তার জন্যে একটা মাত্র ফুল দেখাই যথেষ্ট, যার পাপড়িগুলো বিচিত্র বর্ণের সমাহার, তার মনোমুগ্ধকর শােভা ও সুসমন্বিত বিন্যাস নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করে কোনাে কূল কিনারা করা যায় না। এইসব সৃষ্টিজগত নিয়ে চিন্তা গবেষণা করার উৎসাহ যুগিয়েই কোরআন এগুলাের বিবরণ দিয়েছে। ছােট বড় এ সব সৃষ্টির যে কোনাে একটা নিয়ে গবেষণা করাই তার স্রষ্টার মহত্ত উপলব্ধি করার জন্যে এবং তাঁর গুণকীর্তন ও প্রশংসায় পঞ্চমুখ হওয়ার জন্যে যথেষ্ট। সূরার প্রথম আয়াত থেকেই এ বিষয়টা স্পষ্ট হয়ে গেছে- ‘আকাশ ও পৃথিবীর স্রষ্টা আল্লাহর জন্য সকল প্রশংসা।’  *ফেরেশতাদের গঠন প্রকৃতি ও দায়িত্ব : এ সূরার আলােচনায় রসূল, ওহী এবং আল্লাহর নাযিল করা নির্ভুল জীবন বিধান সবই অন্তর্ভুক্ত। ফেরেশতারা পৃথিবীতে আল্লাহর মনােনীত নবীদের কাছে ওহী নাযিল করার জন্যে দূত হিসাবে নিয়ােজিত। এই ওহী নাযিল করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও মর্যাদাপূর্ণ কাজ। এ জন্যেই তিনি আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টির উল্লেখ করার পর পরই ফেরেশতাদের দূত হিসাবে প্রেরণের উল্লেখ করেছেন। তারা হচ্ছেন আকাশ ও পৃথিবীর মাঝে সংযােগ রক্ষাকারী। তারা আকাশ ও পৃথিবীর স্রষ্টা এবং তার নবী ও রসূলদের মাঝে সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে সংযােগ রক্ষা করেন। পবিত্র কোরআনে এই প্রথম আমরা এমন একটা বক্তব্যের সন্ধান পেলাম, যাতে ফেরেশতাদের আকৃতি সম্পর্কে কিছু বিবরণ রয়েছে। ইতিপূর্বে তাদের প্রকৃতি ও দায়িত্ব সম্পর্কে অনেক কথা বলা হয়েছে। যেমন, ‘তারা আল্লাহর এবাদাতে কখনাে দম্ভ দেখায় না ও ক্লান্ত হয় না, দিনরাত তাসবীহ পাঠ করেও তারা থামে না।'(আম্বিয়া ১৯,২০) ‘যারা তােমার প্রতিপালকের কাছে থাকে, তারা কখনাে তার এবাদাত করতে দম্ভ দেখায় না, তার তাসবীহ পাঠ করে ও তার জন্যে সিজদা করে।'(আল আরাফ ২০৬) কিন্তু এখানে আমরা ফেরেশতাদের দেহাকৃতি সংক্রান্ত বক্তব্য পাচ্ছি যে, তারা দুটো, তিনটে ও চারটে করে ডানার অধিকারী। তবে এই বিবরণ দ্বারা তাদের আকৃতি সম্পর্কে ধারণা করা যায় না। কেননা আমরা জানি না আসলে তারা কেমন এবং তাদের এ সব ডানাই বা কেমন। কেবল এই বিবরণ পেয়ে নীরবতা অবলম্বন করা ছাড়া আমাদের আর কোনাে করণীয় নেই। আমরা তাদের আকৃতি সম্পর্কে কোনো সুনির্দিষ্ট ধারণা করতে পারি না। কেননা আমরা যে ধারণাই করবো সেটাই ভুল হতে পারে। তাদের আকৃতি ও চেহারা সম্পর্কে কোনাে সুনিশ্চিত বিবরণ কোনাে নির্ভরযােগ্য সূত্রের মাধ্যমে পাওয়া যায় না। কোরআনে কেবল এই স্থানে এতােটুকু এসেছে, আর সূরা তাহরীমের ৬ নং আয়াতে আছে, ‘তার (দোযখের) ওপর বিশাল বিশাল ও ভয়ংকর ভয়ংকর ফেরেশতারা রয়েছে, তারা আল্লাহর হকুম মেনে চলে।’ দুটো হাদীসে যে বিবরণ পাওয়া যায়, তাতেও কোনাে সুনির্দিষ্ট চেহারা ও আকৃতি বুঝা যায় না। যেমন রসূল(স.) জিবরাঈলকে তার আসল আকৃতিতে দু’বার দেখেছেন’ এবং ‘জিবরীলের ছয়শ ডানা রয়েছে।’ সুতরাং বিষয়টা অনির্দিষ্ট ও অজ্ঞাত। এ সব অদৃশ্য ব্যাপারে প্রকৃত তথ্য শুধু আল্লাহ তায়ালাই জানেন। দুটি, তিনটি ও চারটি করে ডানা থাকার উল্লেখ প্রসংগে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ তায়ালা তার সৃষ্টিকে যতাে চান বাড়ান। এ থেকে বুঝা যায়, আল্লাহর ইচ্ছার কোনাে বাধা বন্ধন নেই এবং তার সৃষ্টি কোনাে আকৃতিতে সীমাবদ্ধ থাকে না। মানুষ পাখীর দুটো ডানার কথা জানে। আর আমাদের দেখা ও জানা সৃষ্টিজগতে আরাে বহু অগণিত আকৃতির সৃষ্টি রয়েছে, আর আমাদের না জানা যে কত বেশী সৃষ্টি রয়েছে, তার তাে কোনাে সংখ্যাই আমাদের জানা নেই। আল্লাহ তায়ালা সর্বশক্তিমান। এ মন্তব্যটা পূর্ববর্তী যে কোনাে মন্তব্যের চেয়ে ব্যাপকতর; সুতরাং এর অর্থ দাঁড়ায়, আল্লাহর সৃষ্টি, নির্মাণ, পরিবর্তন ও পুনঃনির্মাণের ডিজাইন বা নকশার কোনাে সীমা পরিসীমা নেই।

*মানুষের প্রতি আল্লাহর রহমত বর্ষণ : ‘আল্লাহ মানুষের জন্যে যে অনুগ্রহ অবমুক্ত করেন, তা কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারে না'(আয়াত ২) প্রথম আয়াতের শেষে আল্লাহর যে সীমাহীন শক্তির উল্লেখ করা হয়েছে, দ্বিতীয় আয়াতে তারই একটা দৃশ্য তুলে ধরা হয়েছে। মানুষের মনে যখন এই দৃশ্যটা বদ্ধমূল হয় তখন তার পার্থিব জীবনে, তার চিন্তা চেতনায়, আবেগ অনুভূতিতে, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যে এবং মূল্যবােধ ও মানদন্ডে সর্বাত্মক পরিবর্তন সাধিত হয়। এ দৃশ্য আকাশ ও পৃথিবীর অন্য সকল শক্তি থেকে তার সম্পর্ক ছিন্ন করে এবং একমাত্র আল্লাহর শক্তির সাথে তার সম্পর্কে জুড়ে দেয়। আকাশ ও পৃথিবীর অন্য সকলের দয়া থেকে তাকে নিরাশ করে এবং একমাত্র আল্লাহর দয়া ও করুণার প্রতি তাকে আশান্বিত করে। আকাশ ও পৃথিবীর অন্য সকল দরজা তার সামনে বন্ধ এবং শুধু আল্লাহর দরজাকেই উন্মুক্ত করে। তার সামনে আকাশ ও পৃথিবীর সকল পথ রুদ্ধ করে এবং শুধু আল্লাহর পথকেই খুলে দেয়। আল্লাহর দয়া অনুগ্রহের প্রকাশ ও অভিব্যক্তি যে কত উপায়ে কত জিনিসের মাধ্যমে ঘটে, কে তার ইয়ত্তা রাখে? এমনকি, মানুষের নিজ সত্তার অভ্যন্তরে যে আল্লাহ তায়ালা কত অনুগ্রহ, কত নেয়ামত, কত সম্মান ও মর্যাদা দান করেছেন এবং কত জিনিসকে যে তার অনুগত করেছেন, তার সীমা সংখ্যা তার অজ্ঞাত। আল্লাহ তায়ালা যা যা দিয়েছেন, তার মাধ্যমে যেমন আল্লাহর অনুগ্রহ প্রকাশ পায়, তেমনি যা যা তিনি দেয়া থেকে বিরত থেকেছেন তাতেও তার অনুগ্রহ প্রকাশ পায়। আল্লাহ তায়ালা তার দয়া ও অনুগ্রহ যার জন্যে উন্মুক্ত করেছেন, সে প্রতিটা জিনিসে, প্রতিটা অবস্থায় ও প্রতিটা জায়গায়ই তা পায়। নিজের সত্ত্বায়, নিজের চিন্তা চেতনায় এবং আশপাশের পরিবেশেও তা দেখতে পায়। আর যেসব জিনিস না পাওয়াকে মানুষ বঞ্চনা মনে করে, সেসব জিনিস না পাওয়া এবং মহান আল্লাহ কর্তৃক সেসব জিনিস আটকে রাখাতেও আল্লাহর দয়া অনুগ্রহ নিহিত থাকে তা সে যে স্থানে ও যে পরিস্থিতিতেই হােক না কেন, আর যেসব জিনিস পাওয়াকে মানুষ প্রাপ্তি ও সন্তুষ্টির লক্ষণ মনে করে, সেসব জিনিস পাওয়াতেও আল্লাহর সন্তুষ্টি ও দয়া নিহিত থাকে। আল্লাহ তায়ালা যে কোনাে নেয়ামত থেকে যদি তার রহমত ওঠিয়ে নেন, তবে সেই নেয়ামতও দুঃখের কারণ হয়ে দাড়ায়। আর বাহ্যত যা দুঃখ কষ্টের কারণ মনে হয়, তাতে যদি আল্লাহ তায়ালা তার রহমত দান করেন, তবে তা নেয়ামতে পরিণত হয়। আল্লাহর রহমত যুক্ত হলে মানুষ কাটার ওপরও ঘুমাতে পারে এবং তা বিছানায় রূপান্তরিত হতে পারে, আর আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হলে মখমলের বিছানা তার জন্যে কন্টকময় হতে পারে। আল্লাহর রহমত দ্বারা একান্ত কঠিন ও জটিলতম সমস্যার সহজ সমাধান করা সম্ভব হয়, আর একটা অতি সহজ কাজও আল্লাহর রহমতের অভাবে জটিলতম সমস্যায় রূপান্তরিত হয়। বিপজ্জনক, সংকটপূর্ণ অভিযানও আল্লাহর রহমতে অনায়াসে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধা হয়ে যায়। আর আল্লাহর রহমতের অভাবে একটা সাধারণ বিষয় ও ধ্বংসযজ্ঞ পরিণত হয়। যেখানে আল্লাহর রহমত থাকে সেখানে কোনাে সংকীর্ণতা থাকে না। সংকীর্ণতা শুধু সেখানেই, যেখানে আল্লাহর রহমত নেই। যার ওপর আল্লাহর অনুগ্রহ আছে সে কারাগারের অন্ধ কুঠুরিতে, নির্যাতন কক্ষে কিংবা বধ্যভূমিতে থাকলেও তার কোনাে ক্ষতি হয় না। আর যার ওপর আল্লাহর রহমত নেই, সে যদি বিপুল ধনৈশ্বর্যের মধ্যেও লালিত পালিত হয় তবু তার দুঃখ কষ্টের সীমা থাকে না। মােটকথা, আল্লাহর রহমত থাকলে মানুষের ভেতর থেকেই সুখ ও সৌভাগ্যের উৎস এবং শান্তি ও সন্তোষের ঝর্ণা ফুটে ওঠে। আর আল্লাহর রহমত না থাকলে হৃদয়ের অভ্যন্তর থেকেই দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ উৎকণ্ঠা, ক্লান্তি, অবসাদ ও দুঃখ শােকের অসংখ্য জ্বালামুখ বেরিয়ে আসে। একমাত্র এই রহমতের দরজাটাই যদি খোলা থাকে, আর বাদ বাকী সমস্ত দরজা, জানালা ও পথ যদি রুদ্ধ হয়ে যায়, তাহলে আমাদের কোনাে সমস্যা নেই। কেননা যা কিছু প্রশস্ততা, সমৃদ্ধি, সচ্ছলতা ও সাবলীলতা- সবই আল্লাহর রহমতের মাঝে নিহিত। আর এই দরজাটাই যদি বন্ধ থাকে তবে আর সব কিছুর দরজা খােলা থাকলেও আমাদের কোনাে লাভ নেই। কেননা এ দরজা বন্ধ হওয়ার অর্থই হলাে সংকীর্ণতা, অভাব, বিপদ, দারিদ্র্য ও কষ্ট। আল্লাহর করুণার ধারা যদি প্রবহমান থাকে, তবে জীবিকা সংকীর্ণ হয় হােক, বসবাসের জায়গা সংকীর্ণ হয় হােক, জীবন দুর্বিষহ হয় হোক, শােয়ার বিছানা কন্টকাকীর্ণ হয় হােক, আমাদের তা নিয়ে কোনাে ভাবনার দরকার নেই। কেননা আল্লাহর করুণার ধারাতেই নিহিত রয়েছে সমস্ত সুখ, শান্তি, সৌভাগ্য, সমৃদ্ধি ও নিরাপত্তা, আর এই করুণার ধারা বন্ধ হয়ে গেলে জীবিকার প্রাচুর্য যতােই থাক, দ্রব্য সামগ্রীর যতােই আধিক্য হােক- তাতে কোনাে লাভ নেই। প্রাচুর্যের ভেতরেই দুঃখ, দুর্ভাগ্য ও অভাব অনটন ভােগ করতে হবে। ধন সম্পদ, সন্তান সন্ততি, স্বাস্থ্য, শক্তি, সম্মান, সাম্রাজ্য- সবই উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, দুঃখ ও দুর্বিপাকের উৎস হয়ে দাড়ায়, যদি তা থেকে আল্লাহর রহমত দূর হয়ে যায়। পক্ষান্তরে আল্লাহ তায়ালা যখন রহমতের দুয়ার খুলে দেন, তখন তা শান্তি, তৃপ্তি, সৌভাগ্য ও সমৃদ্ধিতে পরিপূর্ণ হয়ে যায়। আল্লাহ তায়ালা যখন তার রহমত সহকারে জীবিকার প্রাচুর্য দেন, তখন তা পবিত্র সম্পদ ও প্রকৃত সুখের উৎস হয়। তা দুনিয়ায়ও তৃপ্তির উপায় আর আখেরাতেও পাথেয় হয়ে যায়। মহান আল্লাহ যেই তার রহমত বর্ষণ বন্ধ করে দেন, অমনি তা হয়ে যায় ভীতি ও উদ্বেগের কারণ, ঈর্ষা বিদ্বেষ ও প্রতিহিংসার উস্কানি। জীবিকার প্রাচুর্যের সাথে সাথে যদি কৃপণতা বা কোনাে রােগ ব্যাধির প্রাদুর্ভাব ঘটে, তা হলে সম্পদ থাকলেও তা থেকে বঞ্চিতই থেকে যেতে হয়, ভােগ করা আর কপালে জোটে না। আবার সম্পদের প্রাচুর্যের পাশাপাশি যদি দাস্তিকতা বা অহংকার থাকে, তবে সেই সম্পদ কখনাে কখনাে ধ্বংসও হয়ে যেতে পারে। আল্লাহ তায়ালা যদি সন্তান সন্তুতি দেন এবং সেই সাথে তাঁর রহমতও দেন, তাহলে সেই সন্তান সন্তুতি জীবনের অলংকার, সুখ শান্তির উৎস এবং পরকালের সওয়াবও বহুগুণ বৃদ্ধির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কেননা সন্তান হয় তার সেই উত্তরাধিকারী, যে সব সময় আল্লাহকে স্মরণ করে, আর আল্লাহ তায়ালা যদি রহমতের ধারা শুদ্ধ করে দেন, তাহলে হয়তাে দেখা যাবে, সন্তানই মহাবিপদ মসিবতের কারণ হয়ে দাড়িয়েছে, হয়ে দাড়িয়েছে দিনের ক্লান্তি ও অবসাদের কারণ আর হারাম করে দিয়েছে রাতের ঘুম। আল্লাহ তায়ালা যদি ভালাে স্বাস্থ্য ও শক্তি দেন, আর সেই সাথে নিজের রহমতও দেন, তবে তা হবে এক পবিত্র নেয়ামত, হবে পবিত্র জীবনের সূচক এবং যথার্থ আরামদায়ক জীবনের শুভ সূচনা, আর যদি রহমত না দেন, তাহলে এই স্বাস্থ্য ও শক্তি উল্টো মুসিবতে পরিণত হয়ে যায় । আল্লাহ তায়ালা রহমত শূন্য সুস্বাস্থ্য একজন স্বাস্থ্যবান শক্তিমান মানুষের ওপর বােঝাস্বরূপ চাপিয়ে দেন। ফলে সে স্বাস্থ্য ও শক্তি এমন কাজে খরচ করে, যা শরীর ও আত্মা উডয়কেই ধ্বংস করে দেয় এবং আখেরাতের জন্যে ভয়াবহ পরিণতি অনিবার্য করে তােলে। আল্লাহ তায়ালা যদি পদমর্যাদা ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সাথে সাথে তার রহমতও দেন, তাহলে তা সংস্কার সংশােধনের হাতিয়ার, সুখ শান্তি ও নিরাপত্তার উৎস এবং সৎকর্ম ও কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের পুঁজি গড়ে তােলার উপায় হয়ে দাড়ায়। পক্ষান্তরে আল্লাহর রহমত যদি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সাথে যুক্ত হয়, তাহলে তা হয় পতন-ভীতি, প্রতিহিংসা, ঈর্ষা ও স্থীতিহীনতার আশংকায় ভারাক্রান্ত। ফলে পদ ও ক্ষমতার মালিক তা দুনিয়ায়ও যেমন আরামের সাথে ভােগ করতে পারে না, তা দ্বারা আখেরাতেও তেমনি দোযখ ছাড়া আর কিছুই সে অর্জন করতে সমর্থ হয় না। প্রচুর জ্ঞান, দীর্ঘ আয়ুষ্কাল, উত্তম পদমর্যাদা ইত্যাদির সাথে আল্লাহর রহমত যুক্ত হলে তার ফলাফল এক রকম এবং যুক্ত না হলে অন্য রকম হয়ে থাকে। সামান্য জ্ঞানকেই আল্লাহ তায়ালা ফলপ্রসূ ও উপকারী বানাতে পারেন। ক্ষুদ্র আয়ুদস্কালকে আল্লাহ তায়ালা কল্যাণময় করে দিতে পারেন। সুখ ও সমৃদ্ধির ভাণ্ডার গড়ে দিতে পারেন সামান্য সম্পদ থেকে। ব্যক্তির মতাে সমাজ ও জাতির ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে । উল্লেখিত উদাহরণগুলাের ভিত্তিতে অন্যগুলােও অনুমান করে নেয়া যায়। আপনি যদি আল্লাহর রহমত অনুভব করতে পারেন, তাহলে সেটাও আল্লাহর রহমতের আওতাভুক্ত। আল্লাহর রহমত আপনাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে, কিন্তু আপনি যে তা অনুভব করতে পারেন, সেটাও আল্লাহর রহমত । আপনার আল্লাহর রহমত লাভের আশা, চেষ্টা সাধনা, তার প্রতি আপনার আস্থা এবং সর্বক্ষেত্রে তার প্রত্যাশাও আল্লাহর রহমতের অন্তর্ভুক্ত, আর রহমত সম্পর্কে সংশয়, হতাশা কিংবা রহমত থেকে বঞ্চিত হওয়াই আসল আযাব। আল্লাহ তায়ালা কোনাে মােমেনকে কখনাে এ আযাব দেন না। আল্লাহ তায়ালা সূরা ইউসুফে বলেন, ‘আল্লাহর রহমত থেকে কেবল কাফেররাই হতাশ হয়।’ যে ব্যক্তি আল্লাহর রহমত কামনা করে ও তার যােগ্যতা লাভ করে, সে কোনাে অবস্থাতেই তা থেকে বঞ্চিত হয় না। হযরত ইবরাহীম আগুনের ভেতরে বসেও আল্লাহর রহমত পেয়েছেন। হযরত ইউসুফ কুয়ার মধ্যে এবং কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়েও তা পেয়েছেন। হযরত ইউনুস মাছের পেটে বসেও পেয়েছেন। হযরত মূসা(আ.) অসহায় অরক্ষিত অবস্থায় যখন সাগরে ভাসমান, ফেরাউন যখন তার শত্রু, তাকে খুঁজছে ও তার অপেক্ষায় ও পেতে আছে আর সেই অবস্থায় তিনি যখন তারই প্রাসাদে বাস করছেন, তখন তিনি সে রহমত লাভ করেছেন। আসহাবুল কাহফ’ যখন পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নিয়েছিলেন এবং দেশবাসী তাদেরকে বাড়ীঘরে খুঁজে পাচ্ছিলাে না, তখন তারা আল্লাহর রহমতের আশ্রয়েই ছিলেন। তারা পরস্পরকে বলছিলেন, ‘তােমরা গুহায় আশ্রয় নাও, তােমাদের প্রতিপালক তােমাদের ওপর রহমত বিস্তার করবেন।’ রাসূল(সা.) ও তাঁর সফরসংগী হযরত আবু বকর যখন গুহায় আশ্রয় নিয়েছিলেন এবং লােকেরা তাদেরকে পদচিহ্ন ধরে খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন, তখন তারা আল্লাহর রহমতের নিরাপদ আশ্রয় পেয়েছিলেন। অন্য সব কিছু থেকে হতাশ হয়ে যারা কেবল আল্লাহর রহমতের কোলে আশ্রয় নিয়েছে, তারাও তা পেয়েছে। যারা অন্যান্য শক্তির দয়া ও করুণার পরিবর্তে শুধু আল্লাহর করুনা চেয়েছে, তার দরজায় ধর্ণা দিয়েছে, তারা তা পেয়েছে। আল্লাহ যখন তার করুণার দুয়ার উন্মুক্ত করেন, তখন কেউ তা বন্ধ করতে পারে না এবং তিনি যখন বন্ধ করেন তখন কেউ তা খুলতে পারে না। সুতরাং আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কাউকে ভয় করা ও আর কারাে কাছে কিছু আশা করার কোনাে অর্থ নেই। কোনাে জিনিসের সাথেও ভয় বা আশার সম্পর্ক থাকতে পারে না। কোনাে শক্তি বা উপকরণের সাথেও নয়। শুধু আল্লাহর ইচ্ছায় সাথে এর সম্পর্ক এবং তার ইচ্ছার ওপরই সব কিছু নির্ভরশীল। ভয় ও আশার ব্যাপারটা প্রত্যক্ষভাবে আল্লাহর সাথে যুক্ত। “তিনিই প্রতাপশালী ও বিজ্ঞানময়। অর্থাৎ নিজের রহমত কোথায় বর্ষণ করবেন ও কোথায় করবেন না, সেটা তিনি নিজেই স্থির করেন এবং তার জন্যে কারাে কাছে তিনি জবাবদিহি করেন না, আর রহমত বিতরণ ও বন্ধ করেন এক সূক্ষ্ম কল্যাণকর উদ্দেশ্যে। ‘আল্লাহ মানব জাতির জন্যে যে রহমত উন্মুক্ত করেন তা কেউ বন্ধ করতে পারে না।’ সুতরাং মানুষের একমাত্র করণীয় হলাে কোনাে মাধ্যম ছাড়াই সরাসরি আল্লাহর কাছ থেকে তার রহমত চাওয়া। মহান আল্লাহর প্রতি গভীর মনােনিবেশ, আনুগত্য, আশা ভরসা, আস্থা ও আত্মসমর্পণের মাধ্যমে নিজেকে রহমতের যােগ্য বানাতে হবে। আর যে রহমত তিনি বন্ধ করেন তা কেউ উন্মুক্ত করতে পারে না।’ সুতরাং তার কোনাে সৃষ্টির কাছে কিছুই আশা করা উচিত নয়। কাউকে ভয় করাও উচিত নয়। কেননা আল্লাহ তায়ালা যা বন্ধ করেন তা কেউ খুলতে পারবে না। ভেবে দেখার বিষয় যে, এ আয়াত মানুষের মনমগযে কত প্রশান্তি, কত স্থিরতা এবং চিন্তা অনুভূতি, মূল্যবোেধ ও ধ্যান ধারণায় কত স্বচ্ছতা এনে দেয়। এই একটা মাত্র আয়াত গােটা মানব জীবনের একটা নতুন ছবি ও নতুন নকশা এঁকে দেয়। তার চেতনায় পার্থিব জীবনের জন্যে একটা স্বতন্ত্র ও চিরস্থায়ী মূল্যবােধ ও মানদণ্ড প্রতিষ্ঠিত করে দেয়। সেই মানদণ্ড পৃথিবীর আর কোনাে প্রভাবে প্রভাবিত হয় না, তার উৎস মানুষ হােক, কোনাে ঘটনা হােক বা কোনাে বস্তু হােক। এই একটা মাত্র নকশা যদি মানুষের হৃদয়ে বদ্ধমূল হয়, তাহলে তা পেরেকের মতাে সেখানে দৃঢ়ভাবে বসে যাবে। হাজারাে ঘটনা, হাজারাে বস্তু, হাজারাে ব্যক্তি, হাজারাে শক্তি, হাজারাে মূল্যবোধ এবং হাজারাে চিন্তাধারাও তাকে আর নড়বড়ে করতে পারবে না। সমগ্র জ্বিন এবং মানুষ জাতিও যদি চেষ্টা করে তবু পারবে না। কেননা আল্লাহ তায়ালা স্বয়ং যখন তার রহমতের দরজা বন্ধ করেন, তখন তারা তা খুলতে পারে না এবং তিনি যখন তা খােলেন, তখন তারা তা বন্ধ করতে পারে না। এই আয়াতের মতােই এবং নকশার মতােই কোরআন ইসলামের প্রথম যুগের সেই বিস্ময়কর মানবগােষ্ঠীটাকে গড়ে তুলেছিলাে। সে মানবগােষ্ঠীটাকে আল্লাহর চোখের সামনেই তৈরী করা হয়েছিলাে, যাতে তারা মহান আল্লাহর ক্ষমতা প্রয়ােগের একটা হাতিয়ারে পরিণত হয়, আল্লাহর ইচ্ছা অনুযায়ী পৃথিবীতে বিশেষ আকীদা ও আদর্শ, চিন্তাধারা, মূল্যবােধ, মানদন্ড, সমাজব্যবস্থা ও রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তােলে। পৃথিবীতে আল্লাহর মনােনীত সেই বাস্তব সমাজ ব্যবস্থার নমুনা প্রতিষ্ঠিত করে, যা আজকাল আমাদের কাছে স্বপ্ন ও প্রাচীন যুগের রূপকথা বলে মনে হয়। সেই মানব গােষ্ঠীটা ছিলাে আল্লাহর পরিকল্পনা বাস্তবায়নকারী শক্তি। আল্লাহ তায়ালা যা পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত করতে চান তা প্রতিষ্ঠা করে এবং যা উৎখাত করতে চান তা উৎখাত করে। কেননা তারা শুধু কোরআনের শব্দ ও তার চমকপ্রদ অর্থের অনুকরণ করতাে না, বরং সেই সাথে কোরআনের আয়াতগুলাে কি সত্য তুলে ধরতাে তার অনুকরণ এবং বাস্তবায়ন করতে। সেই কোরআন আজও মানুষের হাতে রয়েছে। তার সেই আয়াতগুলাে দিয়ে সে আজও এমন সব ব্যক্তি ও দল তৈরী করতে সক্ষম, যারা আল্লাহর মনােনীত ব্যবস্থা পৃথিবীতে বাস্তবায়িত করতে ও অমনােনীত ব্যবস্থা উৎখাত করতে পারে। তবে সেটা সে তখনই পারে, যখন এই নকশাগুলাে তাদের মনে বদ্ধমূল হবে। এগুলাে তারা গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করবে, তদনুসারে নিজেদের জীবন গড়ে তুলবে এবং এ নকশাকে এমন বাস্তব মনে করবে যেন হাত দিয়ে ধরা ও চোখ দিয়ে দেখা যায়। এই আয়াত থেকে আমি আল্লাহর এমন একটা বিশেষ রহমতের সন্ধান পেয়েছি, যার জন্যে আমি আল্লাহর প্রশংসা ও কতৃজ্ঞতা জানাই। এ আয়াত আমি এমন এক সময়ে অধ্যায়ন করি যখন আমি নিদারুণ দুঃখ কষ্টে কালাতিপাত করছি। এ আয়াত যখন পড়ি, তখন আমার প্রাণ ওষ্ঠাগতপ্রায়, আমার হৃদয় মুহ্যমান এবং আমি শােচনীয় দুর্দশার শিকার। ঠিক এহেন মুহূর্তেই এ আয়াত আমার সামনে আসে। আল্লাহ তায়ালা এর তাৎপর্য উপলব্ধি করা আমার জন্যে সহজ করে দিয়েছেন। এর তাৎপর্য তিনি আমার অন্তরে এমনভাবে ঢুকিয়ে দিলেন, যেন আমি আমার সমগ্র সত্তায় একটা পানীয় ছড়িয়ে পড়ার রেশ অনুভব করছি। আমার মনে হচ্ছে যেন আয়াতের শুধু মর্মার্থই উপলব্ধি করছি না; বরং একটা সত্যের স্বাদ উপভােগ করছি। স্বয়ং এ সত্যটাই ছিলাে একটা রহমত। এ রহমত আমার কাছে আয়াতের তাৎপর্য সম্বলিত একটা বাস্তব ব্যাখ্যা তুলে ধরেছে। এ আয়াত আমি আগেও বহুবার পড়েছি। বহুবার অতিক্রম করেছি এ আয়াতকে, কিন্তু মনে হয় এইমাত্রই তার প্রকৃত তাৎপর্য উপলব্ধি করতে পারলাম। এখনই এ আয়াত বুঝি তার প্রকৃত মর্ম আমার কাছে উন্মােচিত করলাে। আমাকে বললো, এই নাও, সানন্দে গ্রহণ করাে আল্লাহর উন্মােচিত রহমতের একটা নমুনা। দেখাে, রহমত কেমন হয়।’ এরপর যদিও আমার চারপাশের কোনাে জিনিস বদলে যায়নি। কিন্তু আমার অনুভূতিতে সব কিছু বদলে গেছে। বিশ্বজগতের অসংখ্য সত্যের মধ্য থেকে একটা মহাসত্য হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করতে পারাটাও একটা বিরাট নেয়ামত। সেই রকম একটা মহাসত্য এই আয়াতেও রয়েছে। এ নেয়ামত মানুষ উপভোগ ও অনুভব করতে পারে, কিন্তু তার ছবি আঁকা ও অন্যদের কাছে তার লিখিত বিবরণ দেয়া খুব কমই সম্ভব হয়ে থাকে। আমি এ মহাসত্য চিনেছি, উপভােগ করেছি ও আস্বাদন করেছি আমার জীবনের সবচেয়ে কঠিন, কষ্টকর ও নীরস মুহূর্তে। এর ফলে আমি এই কষ্টকর মুহূর্তের আনন্দ, প্রফুল্লতা এবং সকল কষ্ট ও বন্ধন থেকে আরামদায়ক মুক্তি লাভ করেছি। অথচ আমি একই স্থানে রয়েছি। মহান আল্লাহ তার যে কোনাে একটা আয়াতে তার রহমতের ফল্গুধারা উন্মােচিত করতে পারেন, খুলে দিতে পারেন তার করুণার দুয়ার। কোরআনের এক একটা আয়াত এভাবে আলাের ভান্ডার খুলে দিতে পারে, করুণার ঝর্ণা বইয়ে দিতে পারে। সন্তোষ, আস্থা, তৃপ্তি ও শান্তির পথ সুগম করে দিতে পারে চোখের পলকে। ‘হে মহান আল্লাহ, তােমার জন্যে সকল প্রশংসা। কোরআনকে মােমেনদের জন্যে হেদায়াত ও রহমত হিসাবে প্রেরণকারী হে মহান আল্লাহ, তুমি আমাদের ওপর দয়া করাে। [ এই তাফসীরের লেখক শহীদ সাইয়েদ কুতুব(র.) এ সময় তার জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময় অতিবাহিত করছিলেন। এ সময়টাতেই কারাগারে তার ওপর অমানুষিক অত্যাচার চালানাে হয়। ইখওয়ানুল মুসলিমুনের জন্মান্ধ বর্ষীয়ান আলেম শেখ আব্দুল হামিদ কেশক-এর বর্ণনামতে এ সময়ে কারাগারে মুসলমান নামের কলংক জামাল নাসেরের ভাড়াটে সিক্রেট সার্ভিসের লােকেরা তার ওপর শিকারী কুকুর লেলিয়ে দিয়েছিলাে। যালেমরা ভেবেছিলাে, সকালে উঠে তারা দেখবে সাইয়েদের দেহ শিকারী কুকুর ক্ষত-বিক্ষত করে দিয়েছে, কিন্তু ভোরের আলােতে তারা দেখলো, সাইয়েদ কুতুব নামায পড়ছেন এবং শিকারী কুকুরটি তাকে অন্য সব মানুষরূপী কুকুরগুলাের অত্যাচার থেকে পাহারা দিচ্ছে। তাঁর জীবনের এই কঠিন সময়ের সামান্য কিছু অনুভূতি এ কথাগুলােতে স্থান পেয়েছে-সম্পাদক ]

# এই বিশেষ আলােকময় মুহূর্তটার বিবরণ দেয়ার পর আবার ফিরে যাচ্ছি সূরার মূল বক্তব্যে। তৃতীয় আয়াতেও দেখতে পাচ্ছি প্রথম ও দ্বিতীয় আয়াতের বক্তব্যের প্রতি সমর্থন ও সত্যায়ন করা হয়েছে। মানুষকে দেয়া আল্লাহর নেয়ামতের কথা স্মরণ করানাে হচ্ছে। স্মরণ করানাে হচ্ছে, যিনি একমাত্র স্রষ্টা, একমাত্র রিযিকদাতা ও একমাত্র মাবুদ সেই আল্লাহর নেয়ামতের কথা। এই অকাট্য, সুস্পষ্ট সত্য থেকে মানুষ কিভাবে বিপথগামী হয়, সে ব্যাপারে বিস্ময় প্রকাশ করা হচ্ছে হে মানব জাতি, তােমাদের ওপর বর্ষিত আল্লাহর নেয়ামত স্মরণ করাে। আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কোনাে স্রষ্টা এমন আছে কি, যিনি আকাশ ও পৃথিবী থেকে তােমাদের জীবিকা দিয়ে থাকেন। মানুষকে আল্লাহ তায়ালা যে নেয়ামত দেন, তার কেবল উল্লেখ ও স্মরণই যথেষ্ট। আসলে তা সুস্পষ্ট। সবাই তা দেখতে পায়, অনুভব করে ও স্পর্শ করে। অথচ তা ভুলে যায়। তাই তার উল্লেখ করে স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়। মানুষের চারপাশে আকাশ ও পৃথিবী তাকে নিরন্তর নেয়ামতে ভাসিয়ে দিচ্ছে। প্রতি মুহূর্তে ও প্রতি পদক্ষেপে তাকে এনে দিচ্ছে রকমারি জীবিকা, রকমারি সুখ ও কল্যাণের উপকরণ, মহান স্ৰষ্টা আকাশ ও পৃথিবী থেকে উৎপন্ন করছেন এ সব নেয়ামত তাঁর সৃষ্টির জন্যে। আল্লাহ ছাড়া আর কোনাে স্রষ্টা কি কোথাও আছে যে, এতাে সব নেয়ামত দিতে পারে? এমন দাবী করার কোনাে অধিকার তাদের নেই। জঘন্যতম শিরক ও গােমাহীতে লিপ্ত হয়েও তারা এ ধরনের দাবী করে না। আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কোনাে স্রষ্টা ও জীবিকাদাতা যখন নেই, তখন তাদের আল্লাহকে স্মরণ ও আল্লাহর শােকর না করার কী কারণ ও কী যুক্তি থাকতে পারে? একমাত্র আল্লাহর প্রশংসা এবং এক মনে এক ধ্যানে কেবল তাঁরই আনুগত্য না করার কী কারণ থাকতে পারে আল্লাহ ছাড়া যখন আর কোনাে মাবুদ নেই’ তখন এই সন্দেহাতীত সত্যে ঈমান না আনার কী কারণ থাকতে পারে? তারা কোথায় ফিরে যাচ্ছে। অর্থাৎ তাদের সামনে প্রকাশ্যে জীবিকা আসছে, এই অনস্বীকার্য সত্য যে কেউ উপেক্ষা করতে পারে, এটা বিস্ময়কর ব্যাপার। এমন প্রকাশ্য সত্য অস্বীকার করতে না পেরেও আল্লাহর প্রশংসা ও শােকর না করে মানুষ কিভাবে পারে এটা সত্যই আশ্চর্যজনক। সূরার এই তিনটি তীব্র কষাঘাতপূর্ণ বাণীই এর প্রথম অংশ। এর প্রত্যেকটা বাণীতেই এমন দৃশ্য রয়েছে, যা মানুষের মন মগযে বদ্ধমূল হলে তাকে নতুন সৃষ্টিতে রূপান্তরিত করতে পারে। । সঠিকভাবে এ আয়াত তিনটি পরস্পরের পরিপূরক ও সমন্বয়কারী।
# সূরার প্রথমাংশে যে তীব্র প্রভাবশালী তিনটি বাণী ও যে কটা প্রধান সত্য উচ্চারিত হয়েছে, তাহলাে মহান স্রষ্টার একত্ব, তার একক ও অতুলনীয় বৈশিষ্ট্য হিসেবে রহমত ও করুণার বর্ণনা এবং একমাত্র জীবিকাদাতা হিসাবে তাঁর উল্লেখ। দ্বিতীয় অংশটাতে প্রথমে রসূলের প্রতি কাফেরদের মিথ্যারােপ ও প্রত্যাখ্যানের কারণে তাকে সান্তনা ও প্রবােধ দেয়া হয়েছে। বিষয়টাকে সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর দিকে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে। দ্বিতীয় পর্যায়ে সমগ্র মানব জাতিকে সম্বােধন করে বলা হয়েছে যে, আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সত্য ও অকাট্য। অতপর তাদের শয়তান সম্পর্কে সাবধান করা হয়েছে যেন সে তাদের উল্লেখিত মহাসত্যগুলাে সম্পর্কে ধোকা দিতে না পারে এবং তাদের জাহান্নামে ঠেলে দিতে না পারে। সে হচ্ছে মানুষের আসল শত্রু। তারপর জানিয়ে দেয়া হয়েছে মােমেনদের কর্মফল কেমন হবে, আর চিরশত্র শয়তানের ধোকায় যারা বিভ্রান্ত হয়েছে তাদের পরিণতিই বা কেমন হবে। সবার শেষে পুনরায় রসূল(স.)-কে বলা হয়েছে যে, তিনি যেন কাফেরদের ব্যাপারে আক্ষেপ না করেন। কেননা হেদায়াত ও গোমরাহী আল্লাহর হাতে। মানুষ কী কাজ করে তা তিনি জানেন। সত্যগুলাে সুস্পষ্ট ও অকাট্য। এগুলােকে তারা যদি মিথ্যা সাব্যস্ত করে তবে তাতে তােমার কোনাে ক্ষতি নেই এবং কোনাে দায় দায়িত্ব নেই। কেননা তুমি নতুন কোনাে রসূল নও। তােমার পূর্বেও বহু রসূলকে প্রত্যাখ্যান ও মিথুক সাব্যস্ত করা হয়েছে।’ সমগ্র ব্যাপার হচ্ছে আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রচার ও কাফেরদের পক্ষ থেকে প্রত্যাখ্যান এবং এর কার্যকারণ ও উপকরণ। এর ফলাফল আল্লাহর হাতে, তিনি যেভাবে চান এর নিষ্পত্তি করবেন।

*পার্থিব জীবন যেন মােমেনদের প্রতারিত না করে : মানব জাতিকে উদ্দেশ্য করে আল্লাহ বলছেন, হে মানব জাতি! আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সত্য। কাজেই দুনিয়ার জীবন যেন তােমাদের প্রতারণা করে।’ (আয়াত ৫-৬) আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সত্য। অর্থাৎ কেয়ামত ও আখেরাতের কর্মফলের প্রতিশ্রুতি সত্য অকাট্য। কেয়ামতের হিসাব নিকাশ ও কর্মফল অবধারিত, সন্দেহাতীত। ওটা সত্য এবং সত্য কার্যকরি না হয়ে ছাড়ে না। সত্য কখনাে বৃথা যায় না, বাতিল হয় না, তামাদি হয় না। তবে পার্থিব জীবন সেই সত্য ভুলিয়ে দেয় ও ধোকায় ফেলে দেয়। অতএব পার্থিব জীবন যেন তােমাদের ধোকায় না ফেলে। শয়তানও ধোকা দেয় ও ভুলিয়ে দেয়। কাজেই তাকে ধোঁকা দেয়ার সুযােগ দিয়াে না ধোঁকাবাজ শয়তান যেন তােমাদের ধোকা না দেয়। শয়তান তােমাদের বিরুদ্ধে তার শত্রুতার কথা প্রকাশ্যেই ঘােষণা করেছে এবং বার বার করেছে। কাজেই তাকে শত্ৰু হিসাবে গ্রহণ করাে। অর্থাৎ তার কাছে দুর্বল হয়াে না। তার দিকে ঝুঁকে পড়ে না। তাকে হিতাকাংখী মনে করাে না। তার পদাংক অনুসরণ করাে না। কোনাে ব্যক্তি জেনে শুনে তার শত্রুর পদাংক অনুসরণ করে না কেননা সে কখনাে কল্যাণ ও মুক্তির দিকে ডাকে না। ‘সে তাে তার দলকে জাহান্নামের অধিবাসী হবার আহ্বান জানায়।’ কাজেই এমন কোনাে বুদ্ধিমান থাকতে পারে কি, যে জাহান্নামের অধিবাসী হবার আহ্বানকারীর কথায় কর্ণপাত করতে পারে? এ হচ্ছে বিবেককে সচকিত ও সচেতন করার একটা প্রয়াস। কেননা মানুষ যদি শয়তান ও তার মধ্যকার চিরস্থায়ী যুদ্ধের কথা স্মরণ রাখে, তাহলে সে সর্বশক্তি দিয়ে, সমস্ত চেতনা ও বুদ্ধি দিয়ে আত্মরক্ষায় সচেষ্ট হবেই, শয়তানের ধোকা প্রতিহত করবেই। শয়তানকে তার ধারে কাছে ঘেঁষতে দেবে না এবং আল্লাহর মানদন্ডে রেখে চিরশত্রু শয়তানের প্রতিটা গােপন চক্রান্ত বুঝবার চেষ্টা করবে। কোরআন মানুষের বিবেকে এই সচেতনতা জাগিয়ে তুলতে চায়। শয়তানের বিভ্রান্তিকর প্ররোচনা প্রতিরােধ করার প্রেরণা ও ক্ষমতা সৃষ্টি করতে চায়। তার শক্রর প্রত্যেকটা প্রকাশ্য ও গােপন প্ররােচনা থেকে তাকে সতর্ক করে। তাকে সকল অকল্যাণ ও অপকর্মের পথ থেকে দূরে থাকবার জন্যে উদ্দীপিত করে। তার সকল গােপন ও প্রকাশ্য ইংগিত সংকেত থেকে হুশিয়ার করে। তাকে বুঝিয়ে দেয় যে, শয়তানের সাথে তার যুদ্ধ দুনিয়ার জীবনে কোনােদিন থামবে না। তাই এ যুদ্ধের জন্যে সার্বক্ষণিক প্রস্তুতি রাখতে হবে।

পরবর্তী আয়াতে এই সতর্কতা, প্রস্তুতি, প্রতিরােধ চেতনাকে দৃঢ় ও সতেজ করার জন্যে শয়তানের আহ্বানে সাড়াদানকারী কাফেরদের ভয়াবহ পরিণাম ও তাকে প্রত্যাখ্যানকারী মােমেনদের শুভ পরিণামও জানিয়ে দেয়া হয়েছে। ‘যারা কুফরী করেছে তাদের জন্যে রয়েছে কঠিন আযাব, আর যারা ঈমান এনেছে ও সৎকাজ করেছে তাদের জন্যে ক্ষমা ও বিরাট প্রতিদান।'(আয়াত ৭) এ আলােচনার পরেই গোমরাহীর প্রকৃতি চিত্রায়িত হয়েছে। এতে দেখানাে হয়েছে শয়তান কিভাবে কাজ করে, কিভাবে সে সকল অপকর্মের পথ খুলে দেয়, কিভাবে সে গোমরাহীর সেই পথ উন্মুক্ত করে দেয়, যে পথে কেউ অনেক দূরে চলে গেলে ফিরে আসতে পারে না। ‘যাকে মন্দ কাজ শোভনীয় করে দেখানাে হয়, ফলে সে তাকে উত্তম মনে করে…’ অর্থাৎ সকল অপকর্মের চাবিকাঠি ও উৎস এটাই যে, শয়তান মানুষের সামনে তার মন্দ কাজগুলােকে সুন্দর শােভনীয় করে দেখায়, ফলে সে সেগুলােকে ভালাে কাজই মনে করতে থাকে। মানুষ শয়তানের এই ধােকায় পড়ে নিজেকে ও নিজের সব কাজকে পছন্দ করতে থাকে। নিজের কাজে কোনাে ভুলক্রটি বা খুঁত আছে কিনা, তা খোজ করার প্রয়ােজন বােধ করে না। কেননা সে নিজের সম্পর্কে বিশ্বাস করে যে, সে ভুল করে না। সে নিশ্চিত থাকে যে, সে সব সময় সঠিক কাজ করে। তার সব কাজে সে আত্মতৃপ্তি বােধ করে। নিজের ব্যাপারে সে ঘােরতর ভ্রান্তিতে লিপ্ত। আত্মসমালােচনার প্রয়ােজনের কথা তার কল্পনায়ও আসে না। কোনাে ব্যাপারে নিজের কাজের হিসাব নেয়ার দরকার আছে কি না তা সে ভাবেই না। স্বভাবতই সে অন্যকেও নিজের কাজ বা মতামতের সমালােচনা করতে দেয় না। কেননা নিজের চোখে সে ভুলক্রটির উর্ধ্বে। তার অনুভূতি সব সময় নিজের সম্পর্কে ভালাে ও তৃপ্তিকর। কাজেই সমালােচনার কোনাে অবকাশ নেই। তার কোনাে খুঁত ও অসম্পূর্ণতা নেই। এটাই মানুষের ওপর শয়তানের পক্ষ থেকে আমদানি করা সবচেয়ে বড় মুসিবত। এই পথ ধরে সে মানুষকে প্রথমে বিভ্রান্তির দিকে এবং পরে ধ্বংসের দিকে টেনে নিয়ে যায়। আল্লাহ তায়ালা যার কপালে হেদায়াত ও ভালাই রাখেন, তার অন্তরে তীব্র অনুভূতি, সতর্কতা, আত্মসমালােচনা ও আত্মজিজ্ঞাসার মনােভাব সৃষ্টি করে দেন। ফলে আল্লাহ তায়ালা কখন তার কোনাে অঘটন ঘটান, সে সেই চিন্তায় অস্থির থাকে, এক মুহূর্তের জন্যেও নিশ্চিন্ত থাকে না যে, আল্লাহ তায়ালা তাকে কোনাে বিপাকে ফেলবেন না, তার মনে কোনাে বক্রতা বা পরিবর্তন আসবে না, তার কোনাে ভুল বা পদ্স্খলন হতে পারে না, তার কোন খুঁত বা অক্ষমতা দেখা দিতে পারে না। সে অনবরতই নিজের কাজের সমালােচনা করে। শয়তান থেকে সব সময় সতর্ক থাকে। সব সময় আল্লাহর সাহায্য কামনা করতে থাকে। হেদায়াত ও গােমরাহীর মধ্যে এবং ধ্বংস ও কল্যাণের মধ্যে এটাই সীমানা চিহ্ন। এটা একটা সূক্ষ্ম ও সুগভীর মনস্তাত্ত্বিক সত্য, যাকে কোরআন মাত্র কয়েকটা শব্দে সুন্দরভাবে তুলে ধরেছে। যে ব্যক্তির মন্দ কাজকে সুশােভিত করে দেয়া হয়েছে, ফলে সে মন্দ কাজকে ভালাে কাজ হিসাবে দেখে। বস্তুত এ হচ্ছে বিপথগামী, ধ্বংসােন্মুখ ও অশুভ পরিণতির দিকে ধাবমান মানুষের নমুনা। এ সব কিছুর চাবিকাঠি হলাে এই সুশােভিতকরণ। এটাই হলাে ধোকা ও প্রতারণা। এটাই হলাে সেই পর্দা, যা চোখ ও হৃদয় অন্ধ করে দেয়। ফলে মানুষ পথের বিপদ দেখতে পায় না। সে সৎকাজও করে না। কেননা সে মনে করে, সে যা কিছু করছে তার সবই সৎকাজ, যদিও তা আসলে খারাপ কাজ, সে নিজের কোনাে ভুল সংশােধন করে না। কেননা সে আত্মবিশ্বাসী যে, তার কোনাে ভুল হয় না। সে কোনাে অন্যায় পরিত্যাগ করে না। কেননা সে নিশ্চিত, সে কোনাে অন্যায় করে না। তার অন্যায় অপকর্মের কোনাে শেষ সীমা থাকে না। কেননা সে মনে করে, প্রতি পদক্ষেপেই সে ভালাে কাজ করে যাচ্ছে। তাই এটাই সকল অন্যায় ও অপকর্মের উৎস। এটাই চুড়ান্ত গােমরাহীর চাবিকাঠি। আয়াতে প্রশ্নটার কোনাে জবাব দেয়া হয়নি। ‘যে ব্যক্তির মন্দ কাজকে সুশােভিত করা হয়েছে, ফলে সে মন্দকেই ভালাে দেখতে পায়, সে কি?’ এর জবাব দেয়া হয়নি, যাতে এর সাথে সব জবাবই খাটে। যেমন বলা যেতে পারে, এ ধরনের লােকের সংশােধনের কি আশা করা যায়। এ ধরনের লোক কি সেই ব্যক্তির মতাে হতে পারে যে আত্মসমালােচনা করে ও আল্লাহকে ভয় করে? সে কি খােদাভীরু বিনয়ী লােকদের সমান হতে পারে? অনুরূপ আরাে অনেক জবাব হতে পারে। কোরআনে এই স্টাইলের প্রশ্ন প্রচুর রয়েছে। আয়াতের পরবর্তী অংশে এই সব জবাবেরই একটা দেয়া হয়েছে পরােক্ষভাবে। ‘আসলে আল্লাহ তায়ালা যাকে চান বিপথগামী করেন ও যাকে চান সুপথগামী করেন। তােমার মন যেন তাদের সম্বন্ধে আক্ষেপ না করে।’ যেন বলা হচ্ছে, এ ধরনের লােকের জন্যে আল্লাহ তায়ালা গােমরাহী ও বিপথগামিতাই বরাদ্দ করে রেখেছেন। শয়তান তার অপকর্মকে ভালাে কাজ বানিয়ে দেখানাের কারণে এবং তাকে এরূপ গােমরাহীর পথে ঠেলে দেয়ার কারণেই সে এর যােগ্য হয়েছে। কোনাে পথভ্রষ্ট ব্যক্তি এরপর আর সুপথে ফিরে আসতে পারে না। বস্তুত আল্লাহ যাকে চান বিপথগামী করেন এবং যাকে চান হেদায়াত দান করেন। অর্থাৎ গােমরাহীর প্রকৃতিই এ রকম যে, তাকে এদিকে চালিত করে, আর সুপথগামিতারও প্রকৃতিই এ রকম যে, তাকে সুপথে চালিত করে। অসৎ কাজকে ভালাে কাজ হিসাবে দেখাই গােমরাহীর প্রকৃতি। আর ভালাে মন্দ প্রত্যেক কাজের আত্মসমালােচনা, আত্মজিজ্ঞাসা, সতর্কতা, সচেতনতা ও আল্লাহ ভীতি হলাে হেদায়াতের প্রকৃতি। এটাই হলাে হেদায়াত ও গােমরাহীর শেষ সীমারেখা। আর যেহেতু এটাই চিরাচরিত রীতি- ‘তাই তােমার মন যেন তাদের ওপর আক্ষেপ না করে।’ বস্তুত হেদায়াত ও গোমরাহী এই নীতিটা কোনাে মানুষের হাতে নয়, এমনকি রসূল(স.)-এর হাতেও নয়। এটা স্বয়ং আল্লাহর হাতে থাকে। মানুষের অন্তর আল্লাহর দুই আংগুলের মাঝে থাকে। তাই তিনি তার অন্তরকে যেমন খুশী ঘুরান ও বদলান। এই সত্যটা ব্যক্ত করে আল্লাহ তায়ালা তাঁর রসূলকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন যাতে তার উদার, দয়ালু ও মমতাময় হৃদয় তার জাতির গােমরাহী ও গােমরাহীর ফলে তাদের শােচনীয় পরিণাম দেখে অস্থির ও বিচলিত না হয়। যাতে তার মানে তাদের হেদায়াত লাভ করা ও তার দেয়া সত্যের দাওয়াত মেনে নেয়ার আশা যেন তিনি ছেড়ে দেন। বস্তুত এই আশা মানুষের জন্যে স্বাভাবিক। আল্লাহ তায়ালা তাঁর রসূলের অনুভূতির এই তীব্রতাকে কোমল ভাষায় প্রশমিত করছেন এবং বুঝাচ্ছেন যে, এটা তােমার হাতের ব্যাপার নয়; বরং এটা আমার হাতের ব্যাপার। সকল যুগের ইসলাম প্রচারকরাই পরম নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা সহকারে দাওয়াত দেয়ার পর এই একই পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে থাকেন। কেননা এই দ্বীনের মূল্য, সৌন্দর্য ও কল্যাণময়তা তারা সঠিকভাবে হৃদয়ংগম করে থাকেন। অথচ চোখের সামনে তারা দেখতে পান, মানুষ এ দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করছে। এর সৌন্দর্য ও সুফল বুঝতে পারছে না এবং এর সত্যতা ও সর্বাংগীণ কল্যাণ উপভােগ করতে পারছে না। আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক প্রবােধ দেয়া এই বিষয়টা উপলব্ধি করেই প্রচারকদের প্রচার কাজ করা উচিত এবং সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়েও কে তা গ্রহণ করলা বা প্রত্যাখ্যান করলাে তার পরোয়া না করা ও আক্ষেপ না করা উচিত। আল্লাহ তায়ালা তাদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অবহিত। বস্তু তাদের কার্যকলাপের সত্যিকার পরিচয় জেনেই তিনি তাদের মধ্যে কাউকে হেদায়াত ও কাউকে গোমরাহী বরাদ্দ করেন। হেদায়াত ও গােমরাহী দেখা দেয়ার আগেও তিনি জানেন পরেও তিনি জানেন, কারা কারা হেদায়াত লাভ করবে এবং কারা লাভ করবে না। তিনি তার আদি জ্ঞানের ভিত্তিতে এই বরাদ্দ করে থাকেন। তবে হেদায়াত বা গােমরাহী বাস্তবে সংঘটিত হওয়ার পরেই তাদের কর্মফল দান করেন। এই পর্যায়ে এসে সূরার দ্বিতীয় অংশটা শেষ হচ্ছে। এটা প্রথম অংশের সাথেই যুক্ত এবং পরের অংশের সাথেও এর সমন্বয় রয়েছে।

 

এই তৃতীয় অংশটায় কোরআন ঈমানের প্রাকৃতিক প্রমাণগুলো উপস্থাপন করেছে। মনের চোখে ও চামড়ার চোখে প্রকৃতির যে দৃশ্যাবলী দেখা যায় তা থেকেই এই অকাট্য প্রমাণগুলাে পেশ করেছে। ইতিপূর্বে হেদায়াত ও গোমরাহী, কাফেরদের পক্ষ থেকে রাসূলের প্রতি উপেক্ষাজনিত বিষণ্নতা দূর করার জন্যে আল্লাহর প্রবােধ ও সান্তনা এবং প্রত্যাখ্যানের ব্যাপারটা তাদের কার্যকলাপ সম্পর্কে অবগত মহান আল্লাহর হাতে সমর্পণের কথা বলার অব্যবহিত পরই সূরার এ অংশটা আসছে। অতএব যার ইচ্ছা হয় ঈমান আনুক। প্রকৃতির জগতে ঈমানের এ সব প্রমাণ সুস্পষ্টভাবেই বিরাজ করছে। আর যার ইচ্ছা হয় গােমরাহ হয়ে যাক। তবে সে গােমরাহ হলেও যুক্তি প্রমাণ পাওয়ার পরই গােমরাহ হবে। কেননা প্রমাণগুলাে তাকে চারদিক থেকে বেষ্টন করে রেখেছে।  *প্রকৃতিতে ছড়িয়ে থাকা ঈমানের প্রমাণসমূহ : এ আয়াতগুলােতে নির্জলা নিলা মাটির উর্বর ও শস্য শ্যামল ইওয়ার দৃশ্য রয়েছে। এ দৃশ্যে মানুষের ইহকালীন জীবনের অবসানের পর ‘পুনরুজ্জীবন ও পরকালের জীবনের প্রমাণ রয়েছে। মানুষের মাটি থেকে জন্মলাভ ও তারপর এমন উন্নত মানের সৃষ্টিতে রূপান্তরের প্রমাণ রয়েছে। তার সৃষ্টির জীবনের প্রত্যেকটা স্তর এক সুস্পষ্ট গ্রন্থে লিপিবদ্ধ পরিকল্পনা অনুসারে চলে। দুটো-সমুদ্রের দু’রকম-বৈশিষ্ট্যমন্ডিত ইওয়ায়ও প্রমাণ রয়েছে মহান স্রষ্টার অসীম ক্ষমতার উভয় সমুদ্রে মানব জাতিকে আল্লাহর দেয়া এতাে বিপুল নেয়ামত সামগ্রী রয়েছে, যার জন্যে তাদের আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়া এবং আল্লাহকে চেনা উচিত। রাত ও দিন যেভাবে একটার পর আর একটা আসে এবং ছোট বড় হয়, সে দৃশ্যেও মহান প্রষ্টার অস্তিত্ব এবং একত্বের প্রমাণ রয়েছে। তিনি যে চমৎকার পরিষল্পক ও ব্যবস্থাপক, এতে তার প্রমাণ রয়েছে। অনুরূপভাবে সূর্য ও চন্দ্রের দৃশ্য প্রমাণ রয়েছে। সূর্য চন্দ্র উভয়ই মহাবিশ্বের এই নিখুঁত বিস্ময়কর ব্যবস্থার অধীন ও অনুগত। বিশালায়তন ও সুপ্রশস্ত এই প্রাকৃতিক জগতে বিরাজমান এ জিনিসগুলোর সবই অকাট্য প্রমাণ। মহান আল্লাহ এ সবের সৃষ্টিকর্তা ও মালিক। কাফের মােশরেকরা আল্লাহ তায়ালা ছাড়া অন্যান্য যে সব জিনিসের বা প্রাণীর উপাসনা করে সেসব তাে খেজুরের আঁটির বাকলেরও মালিক নয় । ‘তারা কারাে প্রার্থনা শোনে না, সাড়াও দেয় না। উপরন্তু কেয়ামতের দিন তাদের বিপথগামী। উপাসকদের সকল উপাসনা বন্দনা অস্বীকার করবে। সুতরাং সত্য অস্বীকার করার পর গোমরাহী ছাড়া আর কিছুই থাকে না।’ আর তিনিই সেই আল্লাহ, যিনি বার্তা প্রেরণ করেন, সেই বাতাস মেঘকে পরিচালিত করে। অতপর আমি সেই মেঘকে একটা মৃত শহরের দিকে পাঠাই (আয়াত ৯) কোরআনে ঈমানের প্রাকৃতিক প্রমাণাদি উপস্থাপনার ক্ষেত্রে এ দৃশ্যটা বার বার দেখানাে হয় এদৃশ্যে রয়েছে বাতাস কর্তৃক সমুদ্র থেকে মেঘমালার সৃষ্টি। বাতাস দু’রকমের, গরম ও ঠাণ্ডা। গরম বাতাস সমুদ্রের পানি থেকে বাশ উৎপন্ন করে আর ঠান্ডা বাতাস এই বাম্পকে ঘনীভূত করে মেঘ বানায়। এরপর আল্লাহ তায়ালা বাতাসের প্রবহমান স্রোত দারা এই মেঘমালাকে মহাশূন্যের বিভিন্ন স্তষে পাঠান। মেঘমালা কখনাে ডানে কখনাে বামে চলতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত আল্লাহ ‘যেখানে পাঠাতে মনস্থ করেন সেখানে গিয়ে উপনীত হয়। সাধারণত এমন কোনাে অঞ্চলে উপনীত হয়, যেখানে অনাবৃষ্টি ও খরার দরুন অজন্মা দেখা দিয়েছে। মহান আল্লাহর পরিকল্পনা অনুসারে সেই অঞ্চলে এই মেঘ ধারা বৃষ্টি দিয়ে নবজীবনের সমারােহ ঘটানাে হয়। পানিই হলাে পৃথিবীতে সব জিনিসের জন্মের উৎস। অতপর সেই মেঘ দিয়ে আমি মৃত মাটিকে পুনরুজ্জীবিত করি এভাবে এই অলৌকিক কাণ্ড ঘটে যায়। এ অলৌকিক কাণ্ড প্রতি মুহর্তেই ঘটে চলেছে ‘অথচ এই বিস্ময়কর প্রক্রিয়া মানুষ সচেতন নয়। প্রতি মুহূর্তে অলৌকিক কান্ড ঘটা সত্তেও মানুষ আখেরাতের পুনরুজ্জীবনকে অসম্ভব মনে করে। অথচ পৃথিবীতে তাদের চোখের সামনেই এই পুনরুজ্জীবন প্রক্রিয়া চলে। ‘ঐ ভাবেই পুনরুজ্জীবন সম্পন্ন হয়।’ অর্থাৎ অতি সহজে, অনায়াসে এবং কোনাে বিতর্ক ও জটিলতা ছাড়াই এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। কোরআনে ঈমানের প্রাকৃতিক প্রমাণ উপস্থাপনের জন্যে এই দৃশ্য বার বার দেখানাের কারণ এই যে, এটা অত্যন্ত বাস্তব ও ইন্দ্রিয়ানুভূত প্রমাণ এবং এটা অস্বীকার করার কোনােই অবকাশ নেই। তাছাড়া এ দৃশ্যটা নিয়ে মানুষ যখন সচেতনভাবে চিন্তা ভাবনা করে, তখন তা হৃদয়কে প্রবলভাবে নাড়া দেয়, আলােড়িত করে। এটা মানুষের অনুভূতিকে স্পর্শ করে ও এ নিয়ে চিন্তা ভাবনা করলে সে এ থেকে গভীর শিক্ষা লাভ করে। এটা চমৎকার, মনােমুগ্ধকর ও আলােড়ন সৃষ্টিকারী একটা প্রাকৃতিক দৃশ্য। বিশেষত মরু অঞ্চলে, যাকে আজ নির্জলা নিস্ফলা দেখা গেলেও কালই হয়তাে দেখা যাবে পানির প্রভাবে সুজলা সুফলা হয়ে গেছে। কোরআন মানুষের চেনা জানা পরিবেশ থেকেই শিক্ষামূলক দৃশ্য গ্রহণ করে, যা সে প্রতিনিয়ত দেখে, কিন্তু দেখে উদাসীনভাবে। চর্মচক্ষু ও অন্তর্চক্ষু দিয়ে এগুলাে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে তা মানুষকে বিস্মিত ও আলােড়িত না করে পারে না।

Leave a Reply