أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#১০৭০)
[*কোন নিদর্শন ওদের নিকট আসে, তখনই ওরা তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।:-]
www.motaher21.net
সূরা:- ৩৬:ইয়া-সীন
পারা:২৩
৩৩-৫০নং আয়াত:-
ইয়া-সীন:৩৩
وَ اٰیَۃٌ لَّہُمُ الۡاَرۡضُ الۡمَیۡتَۃُ ۚۖ اَحۡیَیۡنٰہَا وَ اَخۡرَجۡنَا مِنۡہَا حَبًّا فَمِنۡہُ یَاۡکُلُوۡنَ ﴿۳۳﴾
এদের জন্য নিষ্প্রাণ ভূমি একটি নিদর্শন। আমি তাকে জীবন দান করেছি এবং তা থেকে শস্য উৎপন্ন করেছি, যা এরা খায়।
ইয়া-সীন:৩৪
وَ جَعَلۡنَا فِیۡہَا جَنّٰتٍ مِّنۡ نَّخِیۡلٍ وَّ اَعۡنَابٍ وَّ فَجَّرۡنَا فِیۡہَا مِنَ الۡعُیُوۡنِ ﴿ۙ۳۴﴾
আমি তার মধ্যে খেজুর ও আংগুরের বাগান সৃষ্টি করেছি এবং তার মধ্যে থেকে ঝরণাধারা উৎসারিত করেছি
ইয়া-সীন:৩৫
لِیَاۡکُلُوۡا مِنۡ ثَمَرِہٖ ۙ وَ مَا عَمِلَتۡہُ اَیۡدِیۡہِمۡ ؕ اَفَلَا یَشۡکُرُوۡنَ ﴿۳۵﴾
যাতে এরা তার ফল ভক্ষণ করে। এসব কিছু এদের নিজেদের হাতের সৃষ্ট নয়। তারপরও কি এরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না?
ইয়া-সীন:৩৬
سُبۡحٰنَ الَّذِیۡ خَلَقَ الۡاَزۡوَاجَ کُلَّہَا مِمَّا تُنۡۢبِتُ الۡاَرۡضُ وَ مِنۡ اَنۡفُسِہِمۡ وَ مِمَّا لَا یَعۡلَمُوۡنَ ﴿۳۶﴾
পাক-পবিত্র সে সত্ত্বা যিনি সব রকমের জোড়া সৃষ্টি করেছেন, তা ভূমিজাত উদ্ভিদের মধ্য থেকে হোক অথবা স্বয়ং এদের নিজেদের প্রজাতির (অর্থাৎ মানব জাতি) মধ্য থেকে হোক কিংবা এমন জিনিসের মধ্য থেকে হোক যাদেরকে এরা জানেও না।
ইয়া-সীন:৩৭
وَ اٰیَۃٌ لَّہُمُ الَّیۡلُ ۚۖ نَسۡلَخُ مِنۡہُ النَّہَارَ فَاِذَا ہُمۡ مُّظۡلِمُوۡنَ ﴿ۙ۳۷﴾
এদের জন্য রাত হচ্ছে আর একটি নিদর্শন। আমি তার উপর থেকে দিনকে সরিয়ে দেই তখন এদের ওপর অন্ধকার ছেয়ে যায়।
ইয়া-সীন:৩৮
وَ الشَّمۡسُ تَجۡرِیۡ لِمُسۡتَقَرٍّ لَّہَا ؕ ذٰلِکَ تَقۡدِیۡرُ الۡعَزِیۡزِ الۡعَلِیۡمِ ﴿ؕ۳۸﴾
আর সূর্য, সে তার নির্ধারিত গন্তব্যের দিকে ধেয়ে চলছে।এটি প্রবল পরাক্রমশালী জ্ঞানী সত্তার নিয়ন্ত্রিত হিসেব।
ইয়া-সীন:৩৯
وَ الۡقَمَرَ قَدَّرۡنٰہُ مَنَازِلَ حَتّٰی عَادَ کَالۡعُرۡجُوۡنِ الۡقَدِیۡمِ ﴿۳۹﴾
আর চাঁদ, তার জন্য আমি মঞ্জিল নির্দিষ্ট করে দিয়েছি, সেগুলো অতিক্রম করে সে শেষ পর্যন্ত আবার খেজুরের শুকনো ডালের মতো হয়ে যায়।
ইয়া-সীন:৪০
لَا الشَّمۡسُ یَنۡۢبَغِیۡ لَہَاۤ اَنۡ تُدۡرِکَ الۡقَمَرَ وَ لَا الَّیۡلُ سَابِقُ النَّہَارِ ؕ وَ کُلٌّ فِیۡ فَلَکٍ یَّسۡبَحُوۡنَ ﴿۴۰﴾
না সূর্যের ক্ষমতা আছে চাঁদকে ধরে ফেলে এবং না রাত দিনের ওপর অগ্রবর্তী হতে পারে, সবাই এক একটি কক্ষপথে সন্তরণ করছে।
ইয়া-সীন:৪১
وَ اٰیَۃٌ لَّہُمۡ اَنَّا حَمَلۡنَا ذُرِّیَّتَہُمۡ فِی الۡفُلۡکِ الۡمَشۡحُوۡنِ ﴿ۙ۴۱﴾
এদের জন্য এটিও একটি নিদর্শন যে, আমি এদের বংশধরদেরকে ভরা নৌকায় চড়িয়ে দিয়েছি।
ইয়া-সীন:৪২
وَ خَلَقۡنَا لَہُمۡ مِّنۡ مِّثۡلِہٖ مَا یَرۡکَبُوۡنَ ﴿۴۲﴾
এবং ওদের জন্য অনুরূপ যানবাহন সৃষ্টি করেছি, যাতে ওরা আরোহণ করে।
ইয়া-সীন:৪৩
وَ اِنۡ نَّشَاۡ نُغۡرِقۡہُمۡ فَلَا صَرِیۡخَ لَہُمۡ وَ لَا ہُمۡ یُنۡقَذُوۡنَ ﴿ۙ۴۳﴾
আমি চাইলে এদেরকে ডুবিয়ে দেই, এদের কোন ফরিয়াদ শ্রবণকারী থাকবে না এবং কোনভাবেই এদেরকে বাঁচানো যেতে পারে না।
ইয়া-সীন:৪৪
اِلَّا رَحۡمَۃً مِّنَّا وَ مَتَاعًا اِلٰی حِیۡنٍ ﴿۴۴﴾
ওদের প্রতি আমার করুণা না হলে এবং ওদেরকে কিছুকালের জন্য জীবনোপভোগ করতে না দিলে।
ইয়া-সীন:৪৫
وَ اِذَا قِیۡلَ لَہُمُ اتَّقُوۡا مَا بَیۡنَ اَیۡدِیۡکُمۡ وَ مَا خَلۡفَکُمۡ لَعَلَّکُمۡ تُرۡحَمُوۡنَ ﴿۴۵﴾
এদেরকে যখন বলা হয়, তোমাদের সামনে যে পরিণাম আসছে এবং যা তোমাদের পেছনে অতিক্রান্ত হয়েছে তার হাত থেকে বাঁচো, ৪১ হয়তো তোমাদের প্রতি অনুগ্রহ করা হবে (তখন এরা এক কান দিয়ে শুনে অন্য কান দিয়ে বের করে দেয়) ।
ইয়া-সীন:৪৬
وَ مَا تَاۡتِیۡہِمۡ مِّنۡ اٰیَۃٍ مِّنۡ اٰیٰتِ رَبِّہِمۡ اِلَّا کَانُوۡا عَنۡہَا مُعۡرِضِیۡنَ ﴿۴۶﴾
আর যখনই তাদের রবের আয়াতসমূহের কোন আয়াত তাদের কাছে আসে, তখনই তারা তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।
ইয়া-সীন:৪৭
وَ اِذَا قِیۡلَ لَہُمۡ اَنۡفِقُوۡا مِمَّا رَزَقَکُمُ اللّٰہُ ۙ قَالَ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا لِلَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اَنُطۡعِمُ مَنۡ لَّوۡ یَشَآءُ اللّٰہُ اَطۡعَمَہٗۤ ٭ۖ اِنۡ اَنۡتُمۡ اِلَّا فِیۡ ضَلٰلٍ مُّبِیۡنٍ ﴿۴۷﴾
এবং যখন এদেরকে বলা হয়, আল্লাহ তোমাদের যে রিযিক দান করেছেন তার মধ্য থেকে কিছু আল্লাহর পথে খরচ করো তখন এসব কুফরীতে লিপ্ত লোক মু’মিনদেরকে জবাব দেয় “আমরা কি তাদেরকে খাওয়াবো, যাদেরকে আল্লাহ চাইলে নিজেই খাওয়াতেন? তোমরা তো পরিষ্কার বিভ্রান্তির শিকার হয়েছো।”
ইয়া-সীন:৪৮
وَ یَقُوۡلُوۡنَ مَتٰی ہٰذَا الۡوَعۡدُ اِنۡ کُنۡتُمۡ صٰدِقِیۡنَ ﴿۴۸﴾
ওরা বলে, ‘তোমরা যদি সত্যবাদী হও, তাহলে বল, এ প্রতিজ্ঞা কখন পূর্ণ হবে?’
ইয়া-সীন:৪৯
مَا یَنۡظُرُوۡنَ اِلَّا صَیۡحَۃً وَّاحِدَۃً تَاۡخُذُہُمۡ وَ ہُمۡ یَخِصِّمُوۡنَ ﴿۴۹﴾
তারা তো অপেক্ষায় আছে এক বিকট শব্দের, যা তাদেরকে আঘাত করবে তাদের বাক-বিতণ্ডাকালে।
ইয়া-সীন:৫০
فَلَا یَسۡتَطِیۡعُوۡنَ تَوۡصِیَۃً وَّ لَاۤ اِلٰۤی اَہۡلِہِمۡ یَرۡجِعُوۡنَ ﴿٪۵۰﴾
তখন তারা ওসিয়াত করতে সমর্থ হবে না এবং নিজেদের পরিবার-পরিজনদের কাছে ফিরেও আসতে পারবে না।
ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
*আল্লাহ তায়ালা কখনাে মানুষের দুর্গতি দেখতে চান না : পরম করুণাময় আল্লাহর কাছে মানুষের দুর্গতি বড়ই কঠিন, এ জন্যে তিনি উদ্বেগ উৎকণ্ঠার সাথে তাদের জন্যে আফসােস করছেন। কেননা সেই ভয়ানক দিনে তারা আযাব থেকে বের হওয়ার জন্যে যে আহাজারি করতে থাকবে, কিন্তু তাতে কোনাে ফায়দা হবে না। সেদিন কিন্তু মহাবিচারক আল্লাহ তায়ালা তাদের জন্যে আর এতােটুকু আফসােস করবেন না। তাই আজকেই তিনি জানাচ্ছেন, সেদিনকার ঘটনার বৃশ্চিকতা যারা অনুভব করবে তারা অবশ্যই আফসােস করবে! সেদিনকার অবস্থা তাে এতােই কঠিন ও দুঃখজনক হবে যে, তার থেকে রেহাই পাওয়ার কোনাে উপায় থাকবে না এবং পাপাচারী মানুষেরা ধ্বংসের অতলতলে নিমজ্জিত হবে। এ অবস্থা হবে মানুষের জন্যে মহাবিপজ্জনক। হায় আফসােস, মানুষের জন্যে, আজকে তাদের সে ভয়ানক দিনের আযাব থেকে আত্মরক্ষার ব্যবস্থা করে নেয়ার জন্যে যথেষ্ট সময় দেয়া হয়েছে। কিন্তু এ সুযোেগ তারা গ্রহণ করছে না, বরং তারা এ সকল সুযােগ জেনে বুঝে হেলায় হারাচ্ছে। শুধু তাই নয়, তারা আল্লাহর পরম বিশ্বস্ত মহান রসূলের দেয়া এ সম্পর্কিত খবর নিষ্ঠুরভাবে প্রত্যাখ্যান করছে, উল্টা তাকেই মিথ্যাবাদী ঠাওরাচ্ছে। অথচ তাদের সামনে অতীতের ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতিসমূহের ইতিহাস রয়েছে, সেসব ইতিহাস তারা দেখছে, পড়ছে, জানছে, তা সত্তেও তা থেকে তারা কোনাে শিক্ষা নিচ্ছে না। অপরদিকে মহা দয়াময় পাক পরওয়ারদেগার তাদের সামনে তার রহমতের দরজা তার বাছাইকৃত বান্দা ও রসূলদের মাধ্যমে খুলে দিয়েছেন, যারা কিছু দিন পর পরই আগমন করেছেন এবং ভ্রান্ত মানবকে পথ দেখানাের জন্যে সর্বতােভাবে চেষ্টা করেছেন; কিন্তু তারা আল্লাহর রহমতের দরজাগুলাে নিজেদের আচরণ দ্বারা বন্ধ করে দিচ্ছে এবং আল্লাহর সাথেও বেয়াদবী করতে কসুর করছে না। তাই এরশাদ হচ্ছে, যে কোনাে রসূলই তাদের কাছে এসেছে, তার সাথে তারা ঠাট্টা মঙ্কারি করেছে উপহাস বিদ্রুপ করে তাকে প্রত্যাখ্যান করেছে।’ ওরা কি দেখেনি, আমি (সর্বশক্তিমান আল্লাহ) তাদের পূর্বে কত শত শত জাতিকে এমনভাবে ধ্বংস করে দিয়েছি যে, তারা আর কখনােই ফিরে আসবে না। অবশই অতীতের ধ্বংসপ্রাপ্ত সেসব জাতি আর কোনােদিন ফিরে আসবে না তারা বহু বছর ও বহু যুগ ধরে পৃথিবীতে প্রাধান্য বিস্তার করেছিলাে। যারা চিন্তা করে তাদের জন্যে এ কথার মধ্যে অবশ্যই শিক্ষা রয়েছে; কিন্তু বলদর্পী মানুষেরা- যারা আজকে শক্তিমদমত্ত হয়ে সঠিকভাবে চিন্তা করতে পারে না যে, তাদের থেকে আরও বহু বহুগুণে শক্তিশালী বহু জাতি দুনিয়ায় বার বার এসেছে এবং এক নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত নিজেদের ভূমিকা পালন করে অবশেষে অসহায় অবস্থায় দুনিয়া থেকে এমনভাবে বিদায় নিয়েছে যে, আজ তাদের কোনাে নাম-নিশানা আর বাকি নেই, কিন্তু হলে কি হবে। অবশ্যই সেদিনটি আসবে যেদিন সবাইকে একই প্রত্যাবর্তনস্থলে জড়াে হতে হবে! সুতরাং অতীতের জাতিসমূহের অবস্থার মতাে আজকের এই দুঃখজনক অবস্থা লক্ষ্য করুন, এর থেকে অধিক আর কোনাে দুঃখজনক অবস্থা কি তারা দেখতে চায়? আজকের অনেক জীবজন্তু মানুষের ব্যর্থ প্রচেষ্টাসমূহ প্রত্যক্ষ করছে এবং সাধ্যমতাে তাদের অস্তিত্বের সত্যতা দ্বারা তাদের আশু ও অবশ্যম্ভাবী ধ্বংস থেকে রক্ষা করার জন্যে চেষ্টা করে যাচ্ছে, কিন্তু কি হলাে এই হতভাগা মানুষের! তারা দেখছে তাদেরই সামনে নেমে আসা কত মানুষের জীবনে বিপর্যয়ের ওপর বিপর্যয়। এরপরও কি তারা মনে করছে যে, তাদের পথের সকল কাটা তারা দূরীভূত করতে সক্ষম হবে? হা, অহংকারই তাদের সঠিক কথাটি বুঝতে দিচ্ছে না এবং মানতে দিচ্ছে না সেই সঠিক কথাটি, যা মানুষের প্রত্যাবর্তনস্থল সম্পর্কে সকল যামানায়ই বলে আসা হয়েছে। আর এ হচ্ছে যুগ যুগ ধরে আলােচিত মানুষের দ্বন্দ্ব-সংগ্রামের সেই সুস্পষ্ট কথা, যার সত্যতা মানুষের চোখের সামনে ভাসছে; কিন্তু আত্মকেন্দ্রিক ও স্বার্থপর মানুষরা এগুলাে দেখেও দেখতে চায় না, এমন অন্ধ হয়ে থাকার ভান করে যেন সত্যিই তারা দেখে না! আর ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে ধরাপৃষ্ঠ থেকে বিলীন হয়ে গেছে যেসব জাতি, যারা আর কখনও তাদের উত্তরসূরীদের কাছে ফিরে আসবে না, তারা কিছুতেই আল্লাহর নযর থেকে বাদ পড়বে না, এমন হবে না যে তারা সীমাহীন সৃষ্টির বুকে হারিয়ে যাবে এবং সময়ান্তরে বিশ্ব জগতের মালিক আল্লাহর হিসাব থেকে বাদ পড়ে যাবে। তাই এরশাদ হচ্ছে, ‘তাদের সবাইকেই আমার কাছে একত্রিত করা হবে (সর্বশক্তিমান আল্লাহ আমি, আমিই তাদের আজ একথা সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিচ্ছি)। আমার শক্তি ক্ষমতা বুঝার জন্যে তাদের সামনে যে জাজ্বল্যমান নিদর্শনসমূহ রয়েছে সেগুলাের মধ্যে বিশেষভাবে যা উল্লেখযােগ্য তা হচ্ছে, মৃত পৃথিবীকে পুনরায় জীবিত করার দৃষ্টান্ত। যেমন এরশাদ হচ্ছে, ‘তাদের (শিক্ষা) জন্যে আমার (কুদরতের) একটি নিদর্শন হচ্ছে (এই) মৃত যমীন, যাকে মানুষ (এ পর্যন্ত) আদৌ (কিছু) জানেই না’ (আয়াত ৩৩-৩৬) ও রসূলদের অস্বীকার করছে, তাদের মিথ্যাবাদী বানানাের চেষ্টা করছে এবং তাদের আনীত সংবাদগুলাে প্রত্যাখ্যান করছে। অথচ এ যালেমদের পরিণতি অতীতে কি হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও কি হতে পারে, সে বিষয়ে একবারও তারা ভেবে দেখছে না। তাদের সামনেই তাে রয়েছে সৃষ্টির বুকে কত দৃষ্টান্ত, কত সাক্ষ্য-প্রমাণ। সেগুলাে তারা দেখছে, তাদের মনের মুকুরে ভেসে রয়েছে যালেমদের শাস্তির দৃশ্যাবলী, তবুও তারা হঠকারিতা থেকে বিরত হচ্ছে না। তারা একটুও চিন্তা করছে না রসূলদের ভূমিকা কি! কেন তারা মরণপণ করে সত্য প্রচারে আত্মনিবেদিত। তারা তাে ওদের আল্লাহর দিকেই আহ্বান জানাচ্ছেন। একটু খেয়াল করলে অবশ্যই তারা একথা বুঝতে পারবে যে, তাদের চতুষ্পর্শে ছড়িয়ে থাকা বিশ্ব প্রকৃতির সব কিছু প্রতিনিয়ত তাদের মহান আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে অবহিত করছে, তার উপস্থিতির কথা জানাচ্ছে এবং তার অস্তিত্বের বিষয়ে সাক্ষ্য দিচ্ছে। আর তাদের অতি কাছের যে জিনিসটি তারা সবসময় দেখছে, তারই উদাহরণ দিয়ে তাদের আল্লাহ তাবারকা ওয়া তায়ালা তার ক্ষমতা সম্পর্কে জানাচ্ছেন। দেখুন এই পৃথিবী ও তার মাটি, যা কঠিন রৌদ্রের তাপে ঠন ঠন করতে তাকে এবং এ মাটি আপাতদৃষ্টিতে সম্পূর্ণ নির্জীব বলে মনে হয়, সেই মাটিতে আল্লাহর মেহেরবানীতে যখন বৃষ্টিধারা নেমে আসে তখন সেই মরে যাওয়া মাটি আবার যিন্দা হয়ে আসে এবং তার থেকে আবার সুন্দর শ্যামল শস্য ও চোখ জুড়ানাে ফলে ফুলে সুশােভিত গাছ-গাছালি বেরিয়ে আসে, মানুষের প্রয়ােজন মেটানাের মতাে নানা প্রকার দ্রব্য সামগ্রী বেরিয়ে আসে, উৎপন্ন হয় খেজুর ও আংগুরের বাগিচা, প্রবাহিত হতে শুরু করে ঝর্ণাধারা, যা জীবনের গতিতে শক্তি জোগায়। আর জীবনই বা কি? এটা কি এক অলৌকিক ব্যাপার নয়? একটু খেয়াল করলে মানুষ বুঝতে পারবে, মানুষের জীবনটাই এক মােজেযা, কেননা এ জীবনটাকে সজীব সচল রাখার ব্যাপারে মানুষের কোনাে হাত নেই। অবশ্যই এই অত্যাশ্চর্য জীবনকে একমাত্র আল্লাহর হাতই জারি রেখেছে, আর মৃতদের মধ্যে জীবনের প্রবাহ ঘটানাে তারই মহান হাতের কারিশমা। আর দেখুন সে ক্ৰমবর্ষিষ্ণু শ্যামল ফসলের দিকে, বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে রয়েছে সবুজের বাগ-বাগিচার সমারােহ। গাছে গাছে পরিপক ফলমূলের দিকে যদি একটু গভীর দৃষ্টিতে তাকান তাহলে আপনার চোখ ও অন্তর খুলে যাবে এবং আপনার মন ডাক ছেড়ে বলে ওঠবে, এ সবই সকল কিছুর সৃষ্টিকারী আল্লাহর কুদরতেই অস্তিত্বে এসেছে। সেই মহান হাত মাটি ফাটিয়ে তার থেকে বের করছেন ফুলে ফলে ও পত্রপল্লবে ভরা অগণিত এ সব গাছপালা। তিনি ব্যবস্থা করছেন উক্ত আকাশে প্রবাহমান এই আলাে বাতাস, সূর্য ও তাপে বর্ধিত হচ্ছে গাছের কান্ড, ডালপালা ও পত্রপুষ্পে সুশােভিত হচ্ছে গােটা পরিবেশ; ফুল ফুটছে, ফল পাকছে, তারপর ফসল কাটা ও ফল পাড়ার সময় আসছে… যাতে করে ওরা খেতে পারে এর ফল এবং গ্রহণ করতে পারে তাদের হাতের উপার্জন থেকে। চিন্তা করে দেখুন, আল্লাহর কুদরতি হাত তাদের কাজ করার যােগ্যতা দান করছে, যেমন করে সে হাতই ফসল উৎপন্ন করার শক্তি যােগাচ্ছে, যােগাচ্ছে তাদের বাঁচিয়ে রাখার ও বেড়ে ওঠার ক্ষমতা। ‘তারা কি (এর জন্য) শােকরগােযারীর করবে না?’ এসব গভীর আবেগপূর্ণ আলোচনার পরও যারা উদাসীনতা দেখাচ্ছে তাদের থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়া হচ্ছে এবং পাশাপাশি সুযােগ করে দেয়া হচ্ছে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ বান্দাদের যেন তারা তাদের রবের প্রশংসা-গীতি গাইতে পারে, জপতে পারে তার নাম, যিনি তাদের জন্যে পয়দা করেছেন গাছপালা ও ফলমূল এবং উৎপন্ন করেছেন নানা প্রকার ফসল। যার মধ্যে মানুষের মতাে এবং জানা অজানা অন্যান্য প্রাণী ও প্রাণহীন পদার্থের মত নারী ও পুরুষ বীজ বর্তমান রয়েছে। এসব প্রাণী বা বস্তু সম্পর্কে একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই জানেন। এরশাদ হচ্ছে, ‘মহা পবিত্র সেই সত্ত্বা যিনি পৃথিবীর পেট থেকে উৎপন্ন দ্রব্যাদি সৃষ্টি করেছেন এবং মানুষের নিজেদের মধ্য থেকেই সবাইকে জোড়া জোড়া বানিয়েছেন, আরও তিনি সৃষ্টি করেছেন এমন কিছুকে যা তারা জানে না। আর এই সকল তাসবীহ বা প্রশংসাগীতি (আনুগত্যের মাধ্যমে আল্লাহর প্রশংসা) সকল সময় এবং সকল স্থানেই চলছে, আর এই প্রশংসাসূচক আনুগত্যের মাধ্যমে এই সৃষ্টির রহস্যরাজির মধ্যে অবস্থিত সব থেকে বড় যে সত্যটি প্রকাশ পাচ্ছে, তা হচ্ছে সৃষ্টিকর্তা মাত্র একজনই। তিনিই আল্লাহ তায়ালা যিনি ছাড়া আর সৃষ্টিকর্তা নেই। অতএব গােটা বিশ্বলােকে আইনও চলবে তার। এই সৃষ্টি কাজের রহস্য ও প্রধান বৈচিত্র্য হচ্ছে, এই যে জানদার ও বেজান যা কিছু রয়েছে তিনিই সৃষ্টি করেছেন সেসব, এই বিশ্বজাহানে সবাইকেই তিনিই জোড়া জোড়া বানিয়েছেন। মানুষ, জীবজন্তু ও জড় পদার্থ ‘এসবের মধ্যে রয়েছে, তােমরা জান না এমন কিছু।’ অন্যান্য জানা ও অজানা সব কিছুকে জোড়া জোড়া পয়দা করার মাধ্যমে সম্ভবত তিনি দুটি বিষয়ের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছেন; এক. তিনি ছাড়া একক আর কেউ নেই। দুই. সৃষ্টি কাজ দুনিয়ায় যা কিছু চলছে চলবে, সবাই ও সবকিছু সম্ভব হবে দুইয়ের পারস্পরিক সহযােগিতায়। এককভাবে কোন কিছুই বিশ্ব জাহানে চলে না, চলবে না। এই সেই একক শক্তি যিনি সকল শক্তি ক্ষমতার অধিকারী, যিনি সব কিছুর সূচনা করেছেন। এ কথা দ্বারা সৃষ্টি প্রক্রিয়ার নিয়ম বুঝা যাচ্ছে যে, চেহারা-ছবি ও আকৃতি-প্রকৃতি যার যাই-ই হােক না কেন সবার মালিক ও সৃষ্টিকর্তা একজনই। যতাে শ্রেণীর বস্তু এবং আকৃতি ও প্রকৃতির দিক দিয়ে যতাে প্রকার বৈশিষ্ট্যমন্ডিত জীবজন্তু ও পদার্থ সকল দিকে ছড়িয়ে রয়েছে, সেসবের পুরাে খবর তিনি ছাড়া আর কেউ রাখে না। আর কেই বা জানে কোথায় কি আছে। জীবজন্তু ও জড় পদার্থ এবং এ সব কিছুর মধ্যে বিরাজমান প্রতিটি বস্তু কিভাবে ব্যবহার করা হবে এসব খবর একমাত্র আল্লাহ আলেমুল গায়বই রাখেন। সারা বিশ্বের মধ্যে সরিষা পরিমাণ একটি বীজও যদি কোথাও লুকিয়ে থাকে বা তার থেকে আরও সুক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম কোনাে বীজ যদি কোথাও থেকে থাকে, তবে তা সবই আল্লাহর জানা রয়েছে এবং সবাই পয়দা হয়েছে জোড়া জোড়া বস্তুকণার মাধ্যমে। এই বস্তুর শেষ পর্যায় হচ্ছে ইলেকট্রন এবং এর মধ্যেও রয়েছে ধনাত্মক ও ঋণাত্মক রশ্মি। এই দুইয়ের সম্মিলনে যে কোনাে বস্তু অস্তিত্ব লাভ করছে! এইভাবে তারকারাজির মধ্যেও রয়েছে এই দ্বিত্ব। দুটি দুটি তারা একত্রে মিলিত হয় ও পরস্পর আবদ্ধ হয়ে থাকে, তারা উভয়ে একই কক্ষপথে চলে যেন দুই জনে একযােগে গান গেয়ে চলেছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে এই যে, এই মৃত পৃথিবীর মধ্য থেকেই তাে বেরিয়ে আসছে জীবন ও জীবন্ত প্রাণী… এগুলাে থেকে নিয়ে আকাশের মধ্যে অবস্থিত রয়েছে যাবতীয় নিদর্শনসমূহ এবং তাদের সাথে সম্পর্কিত হয়ে চলছে সব কিছু, যা মানুষ তাদের বাহ্যিক চোখ দিয়ে দেখতে পাচ্ছে। এ সব কিছু আল্লাহ রব্বুল আলামীনের অদৃশ্য হাত অলৌকিকভাবে প্রতিনিয়ত পরিচালনা করছে।
*বিশ্বপ্রকৃতির সর্বত্রই আল্লাহর শক্তি ক্ষমতা বিরাজমান : ‘তাদের (জ্ঞান চক্ষু খুলে দেয়ার) জন্যে (আমার আরেকটি) নিদর্শন হচ্ছে (এই) রাত, আমি… এরা প্রত্যেকেই (বিশাল) শূন্যলােকে সাতার কেটে চলেছে।'(আয়াত ৪০-৪৪) অহরহ আমরা দেখতে পাচ্ছি সেই ঘার কাল রাত্রি যা দিনের আলােকে আড়াল করে দিচ্ছে এবং অন্ধকার নেমে আসছে… এ এমন দৃশ্য যা পৃথিবীর সকল অঞ্চলে চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে বার বার মানুষ প্রত্যক্ষ করছে (অবশ্য এই নিয়ম থেকে সে দুটি মেরু অঞ্চল ব্যতিক্রম যেখানে সপ্তাহের পর সপ্তাহ এবং মাসের পর মাস ধরে কখনও রাত থাকে আর কখনও থাকে দিন)। এগুলাে ব্যতীত পৃথিবীর (দৈনিক এই) আহ্নিক গতি আমাদের অবাক বিস্ময়ে হতবাক করে দেয় এবং বিদগ্ধ মানুষের মনে গভীর চিন্তার উদ্রেক করে আরও গভীরভাবে সৃষ্টি রহস্যের দিকে তাকাতে উদ্বুদ্ধ করে। এসব বিষয়ে আল কোরআনে যে ব্যাখ্যা দান করা হয়েছে তা তাে অত্যন্ত সুস্পষ্ট এবং এখানে যে কথাটি উল্লেখিত হয়েছে তা এক বিরল দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছে। এখানে দিনের ছবিটি এমনভাবে আঁকা হয়েছে যেন তাকে রাত্রির পােশাক পরানাে হয়েছে। আর যখন আল্লাহ তায়ালা দিনকে রাত্র থেকে সরিয়ে নেন তখন তারা গভীর অন্ধকারের মধ্যে পড়ে যায়। আর প্রকৃত সত্য বিষয়ের তাৎপর্য বুঝার জন্যে যদি সঠিকভাবে আমরা চিন্তা করি তাহলে এই বিরল রহস্যের কথা আমরা হয়তাে কিছুটা বুঝতে পারবাে। অতপর খেয়াল করুন, বলের মতাে গােলাকার পৃথিবী নামক এই গ্রহটি যখন নিজ মেরু রেখার ওপর আহ্নিক গতিতে ঘুরতে ঘুরতে সূর্যের চতুর্দিকে প্রদক্ষিণ করতে থাকে, তখন এর প্রতিটি বিন্দু সূর্যের সামনে দিয়ে অতিক্রম করে। তারপর যখন এই বিন্দুটিতে দিন হয় এবং সূর্যের সামনে দিয়ে অতিক্রম করতে করতে এই বিন্দুটি সূর্য থেকে আড়াল হয়ে যায়, তখন দিন শেষ হয়ে যায় এবং পৃথিবীর অংশটিতে অন্ধকার ছেয়ে যায়। এভাবে ভূপৃষ্ঠার প্রতিটি বিন্দুতে পর্যায়ক্রমে এবং এক বিশেষ নিয়মে দিনের আগমন ঘটে এবং এক নির্দিষ্ট সময় পার হওয়ার পর দিনের আলাে নিভে যায় ও রাত্রি আসে। এটিই হচ্ছে প্রাকৃতিক অবস্থার সেই আসল চিত্র যা প্রতিনিয়ত পরিদৃশ্যমান হচ্ছে। এরশাদ হচ্ছে, ‘আর সূর্য তার নির্দিষ্ট কক্ষপথে সদাসর্বদা পরিভ্রমণ করে চলেছে।’ অর্থাৎ সূর্যও তার নির্দিষ্ট কক্ষপথে সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকে সদাসর্বদা আবর্তিত হচ্ছে। সাধারণভাবে মনে করা হয় সূর্য নিজের সেই স্থানে স্থির হয়ে রয়েছে যা আভ্যন্তরীণভাবে আবর্তিত হচ্ছে। অর্থাৎ আল কোরআন চৌদ্দশত বছর পূর্বে জানিয়ে দিয়েছে যে, চাঁদ সূর্য গ্রহ-নক্ষত্র যেথায় যা কিছু আছে সবই এবং সবাই তাদের নিজেদের নির্দিষ্ট স্থানে থেকে আবহমান কাল ধরে অবিরামভাবে আবর্তিত হয়ে চলেছে, যা অতি সাম্প্রতিককালের জ্যোতির্বিদদের জ্ঞান-গবেষণায় ধরা পড়েছে। তারা আজকে বুঝতে পেরেছে যে, একই গতিতে এবং একই লক্ষ্যে আবর্তনরত এসব গােলক অত্যাশ্চর্য এক গতিতে চলছে, যার আনুমানিক দ্রুততা হচ্ছে সেকেন্ডে বারাে মাইল। আল্লাহ সােবহানাহু ওয়া তায়ালা এ সবের মালিক, তিনি এদের সম্পর্কে, এদের গতি সম্পর্কে এবং এদের সবার গন্তব্যস্থল বা পরিণতি সম্পর্কে সম্যক অবগত; তাই তাে তিনি বলছেন, ‘এরা চলছে। এদের নির্দিষ্ট গতি পথে। এই গতি পথের অবস্থান কোথায় কিভাবে রয়েছে এবং কবে কিভাবে এই আবর্তনের অবসান ঘটবে তা আল্লাহ সােবহানাহু ওয়া তায়ালা ছাড়া আর কেউ জানে না, তিনি ছাড়া আর কেউ জানে না কার শেষ পরিণতি কি হবে।’ আর আমরা যখন পৃথিবী থেকে তেরাে লক্ষ গুণ বড় এই সূর্যের আয়তনের কথা চিন্তা করি এবং আরও যখন চিন্তা করি এ বিশাল জগতের মহাশূন্যতায় কোনাে কিছুর সাহায্য ছাড়া আবর্তনরত কোটি কোটি গ্রহ নক্ষত্রের কথা, তখন মহান আল্লাহ রব্বুল আলামীনের কুদরতের কথা কিছুটা হলেও আঁচ করতে পারি। বুঝতে পারি, সৃষ্টিজগত পরিচালনায় মহান আল্লাহর হাত ও তার জ্ঞান কতটা সক্রিয় ভূমিকা পালন করে চলেছে। এরশাদ হচ্ছে, ‘এটিই হচ্ছে মহাশক্তিমান মহাজ্ঞানী আল্লাহর ফয়সালা, ‘আর চাঁদের জন্যে সিদ্ধান্ত দিয়েছি পর্যায়ক্রমে কয়েকটি অবস্থা ধারণ করার, যা অবশেষে খেজুরের একটি শুকনা শাখার আকারে পৌছে যায়।’ অর্থাৎ চাঁদকে মানুষ সেসব কয়েকটি স্তর বা পর্যায়ে দেখতে থাকে। প্রথমে তাে এর জন্ম হয় কাস্তের অগ্রভাগের ন্যায়, তারপর প্রতি রাতে বাড়তে বাড়তে অবশেষে ষােলকলায় পূর্ণ হয় এবং নতুন এ চাঁদটি চৌদ্দ তারিখে পূর্ণিমার চাঁদ আকারে আত্মপ্রকাশ করে। এরপর থেকেই আবার এ পূর্ণ চাঁদটি কমতে শুরু করে এবং কমতে কমতে অবশেষে বাকা ধনুকের রূপ ধারণ করে; বরং তা পুনরায় খেজুরের শুকনা ডালের আকারে ফিরে আসে। উরজুন বলতে খেজুরের সেই কান্দি বুঝায় যাতে থরে থরে খেজুরের গাঁথুনি সজ্জিত থাকে। কোনাে ব্যক্তি উপর্যুপরি কয়েক রাত ধরে চাঁদকে খেয়াল করে দেখতে থাকলে আল কোরআনের এই চমৎকার বর্ণনার মজা টের পাবে। তাই এরশাদ হচ্ছে, অবশেষে সে ফিরে যায় তার পূর্বাবস্থায়, যেন তা খেজুরের একটি শুকনা পুরাতন ডাল। বিশেষভাবে লক্ষ্যযােগ্য হচ্ছে ‘কাদীম’ শব্দটি। কারণ চাঁদ প্রথম দিকে একটি বাকা ধনুকের মতাে দৃশ্যপট ভেসে ওঠে সুদূর ওই নীল আকাশের ভালে, অতপর পূর্ণিমার পূর্ণ চাঁদ পর্যন্ত বৃদ্ধি পাওয়ার পর পুনরায় কমতে কমতে চাঁদটি আর বাকা কাস্তের মতাে পূর্বাবস্থায় ফিরে আসে। এ জন্যে শুরুতে যেমন এর নাম হেলাল (কাস্তের মতাে বাঁকা ক্ষীণ চাঁদ), তেমনি এর শেষ স্তরে এসেও এটা পূর্বের মতাে সেই একই নাম ধারণ করে; তবে যখন চাঁদ উদিত হয় তখন অত্যন্ত ক্ষীণ হলেও তার মধ্যে কিছু উজ্জ্বলতা থাকে, কিন্তু কৃষ্ণপক্ষে কমতে কমতে চাঁদ যখন শেষ অবস্থায় পৌছে যায় এবং বিলীন হওয়ার পূর্বে যখন কাস্তের বক্র অগ্রভাগের মতাে পরিদৃষ্ট হয়, তখন খেয়াল করলে বুঝা যায় যে, শুক্লপক্ষের প্রথম দিনের চাঁদের তুলনায় তা অত্যন্ত স্নান থাকে, উজ্জ্বলতাবিহীন ও শুধু সাদা রেখা আকারে থেকে অবশেষে নিভে যায়। আল কোরআনে চৌদ্দশত বছর পূর্বে এই বিশেষ তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে, যা আজ পর্যন্ত কোনাে বৈজ্ঞানিক গবেষণায় অপ্রমাণিত করা সম্ভব হয়নি! একটু সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখুন এই আকাশপানে, কেমন করে সুন্দর সুকোমল চাঁদটি মুঠো মুঠো স্নিগ্ধ আলাে ছড়িয়ে দিয়ে আমাদের জীবনকে মধুময় করে তুলছে। শুক্লপক্ষে একের পর এক রাত্রি অতিক্রান্ত হওয়ার সাথে সাথে চাঁদের আলাে তার সকল মাধুরী নিয়ে স্নিগ্ধ ও মায়া মমতার পরশ বুলিয়ে আমাদের হৃদয় মনকে পরম পুলকে ভরে দিতে থাকে। কোথাও এমন কেউ নেই যার হৃদয়ের তারে চাঁদের এই মধুর রাগিনী ঝংকার না তােলে, নেই এমন কোনাে বেরসিক যার হৃদয় রাজ্য চাঁদের মধুর রসে সিঞ্চিত না হয়, এর সুমহান সৌন্দর্য প্রেমিকের কোমল হৃদয়ে গভীরভাবে রেখাপাত না করে, বিদগ্ধ জনতাকে আকাশমন্ডলী বিস্ময়কর বস্তুসমূহ সম্পর্কে চিন্তা না জাগায়; তারা সীমাহীন এ মহাকাশের মধ্যে অবস্থিত নক্ষত্রপুঞ্জের রহস্যরাজি বুঝতে পারুক আর নাই পারুক, চাঁদের মাধুরীতে তারা মুগ্ধ হতে বাধ্য এবং কিছু না কিছু চিন্তা তাদের মধ্যে জাগবেই জাগবে। সবশেষে বিশাল এই সৃষ্টিজগতের সেই সূক্ষ্ম নিয়ম শৃংখলার দিকে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হচ্ছে, যার অধীনে চলছে গােটা সৌরজগত এবং উর্ধ্বলােকে নভােমন্ডলে যে কাজ চলছে সেই সর্বজনবিদিত বাহ্যিক রহস্যরাজি সম্পর্কে জানানাে হচ্ছে, এই একক ও সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম রশিতে বাধা এক অপরিবর্তনীয় নিয়ম শৃংখলার দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হচ্ছে। আল কোরআন জানাচ্ছে, আল্লাহ রব্বুল আলামীনের অমােঘ বিধান অনুযায়ী যখন প্রত্যেকে এবং প্রতিটি জিনিস নিজ নিজ কাজ করে চলেছে, তখন কেউ কারও কাছে হস্তক্ষেপ করতে বা বাধা সৃষ্টি করতে পারে । তাই এরশাদ হচ্ছে, সূর্যের পক্ষে চাঁদকে ধরে ফেলা (তার চলার পথে এসে তার পরিক্রমাকে বাধাগ্রস্ত করা) কখনও সম্ভব নয়, আর (নির্দিষ্ট সময় ছাড়া) রাতও দিনের আগে যেতে পারে না এবং প্রত্যেকেই তার নিজ নিজ কক্ষপথে পরিভ্রমণ করছে।’ প্রত্যেকটি তারা এবং প্রতিটি গ্রহের জন্যে রয়েছে (তার নিজস্ব) কক্ষপথ অথবা পরিভ্রমণের রাস্তা, চলবার সময় কেউ সে পথ বাদ দিয়ে অন্য পথে চলতে পারে না; আর তারকারাজি ও গ্রহগুলাের চলার পথসমূহের মধ্যে বিরাট পার্থক্য রয়েছে, রয়েছে অকল্পনীয় দূরত্বের ব্যবধান। বৈজ্ঞানিক ও জ্যোতির্বিদদের জ্ঞান গবেষণায় ধরা পড়েছে যে, পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব হচ্ছে নয় কোটি ত্রিশ লক্ষ মাইল এবং পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব হচ্ছে দুই লক্ষ চল্লিশ হাজার মাইল, আর এই দূরত্ব কোনাে দূরত্ব বলেই মনে হয় না যখন সৌরজগৎ ও অপর আকাশে অবস্থিত সব থেকে নিকটবর্তী তারকার মধ্যে দূরত্বের কথা আমাদের চিন্তায় আসে। এই দূরত্বের পরিমাপ অনুমান করতে গিয়ে একটা হিসাব এইভাবে বের করা হয়েছে যে, সৌরজগৎ থেকে নিকটবর্তী তারার দূরত্ব অতিক্রম করতে চারটি আলােক বছরের সময় লাগে (অর্থাৎ, সেকেন্ডে আলাের গতি এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল হলে এক বছরে আলো যে মাইল চলে, তার চার গুণ বেশী হবে সৌরজগৎ থেকে নিকটবর্তী তারকাটির দূরত্ব। আর একভাবে হিসাব কষা যায়। ১০১৬ দশকে যদি পর্যায়ক্রমে যােল বার গুণ করা হয় তাহলে যে সংখ্যা দাঁড়াবে ততাে মাইল দূর হচ্ছে সৌরলােক থেকে নিকটতম তারকার দূরত্ব। আল্লাহ রাব্বুল আলামীনই এই মহা সৃষ্টিজগতের সৃষ্টিকর্তা। তিনি সৌরলােককে সুদূর আকাশে অবস্থিত তারকারাজির সাথে (এতাে বিশাল দূরত্বের ব্যবধান সত্তেও) এমন এক রশি দিয়ে বেঁধে রেখেছেন, যা কখনও ছিড়বার নয় এবং গােটা সৃষ্টিজগতকে তাদের সবার পারস্পরিক সহযােগিতায় টিকিয়ে রেখেছেন। তাদের পারস্পরিক সহযােগিতার এই পরিমন্ডলকে তিনিই অটুট রেখেছেন, যেন গ্রহ-উপগ্রহ ও তারকাগুলাে নিজ নিজ কক্ষপথে চলতে চলতে কাছাকাছি হয়ে না যায় এবং কোনাে সংঘর্ষে লিপ্ত না হয়ে পড়ে। আর এভাবেই সুপরিজ্ঞাত পরিসমাপ্তির দিন না আসা পর্যন্ত এইভাবেই তারা চলতে থাকবে। সুতরাং সূর্যের পক্ষে কোনােভাবেই চাঁদকে ধরে ফেলা সম্ভব নয়, আর রাত্রিও (তার জন্যে নির্ধারিত নিয়মকে ফাকি দিয়ে) দিবাভাগের সামনে কখনও এগিয়ে আসবে না, অথবা তার চলার পথে কোনাে পরিবর্তন আসবে না। কারণ রাত ও দিনের জন্যে পূর্ব থেকে স্থিরীকৃত নিয়মের মধ্যে কোনাে দিন কোনাে পরিবর্তন আসবে না, যার যা নিয়ম সে নিয়মেই তারা প্রত্যেকে চলবে। এ নিয়ম ভেংগে কেউ কারাে আগে বা পরে আসবে, এমনটি কখনও হবে না। আবার চলার পথে কেউ কারও জন্যে কোনাে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারবে না। তাই এরশাদ হচ্ছে, ‘আর প্রত্যেকেই নিজ নিজ কক্ষপথে পরিভ্রমণরত রয়েছে।’ মহাশূন্যলােকে নভােমন্ডলের এই মহাবিস্ময়কর পরিক্রমাকে তুলনা করা যেতে পারে মহাসাগরের বুকে ভাসমান জাহাজগুলোর সাথে। এসব জাহাজ যতাে বড়ই হােক না কেন, সেই মহা বারিধির বুকে সন্তরণরত অবস্থায় এগুলােকে মনে হয় কিছু বিন্দুর সমাহার মাত্র। এই বিশ্ব চরাচরে মানুষের অবস্থান অতি ক্ষুদ্র, এতদসত্তেও সে কোটি কোটি নক্ষত্রের দিকে তাকায়, তাকায় সেই সীমা-সংখ্যাহীন সদা সচল তারকারাজির দিকে তাকায় মহাশূন্যলােকে সদা-সর্বদা সন্তরণৱত গ্রহ-উপগ্রহগুলাের দিকে, আর দেখে কোটি কোটি এ সব তারকার অবস্থানের বাইরে বহু প্রশস্ত শূন্যতা বিরাজমান। তখন তাদের বুদ্ধি, তাদের চিন্তা-শক্তি সবই খেই হারিয়ে ফেলে; হয়রান পেরেশান হয়ে বিস্ফারিত নেত্রে তারা উর্ধ্বলােকে অবস্থিত গ্রহ-উপগ্রহ ও ছায়ালােকে পরিভ্রমণরত সকল সৃষ্টির দিকে শুধু তাকিয়ে থেকে যায়।(আয়াত ৪১-৪৪) এ প্রসংগে এটা উল্লেখযােগ্য যে, এ বিশাল জগতের সীমাহীন মহাশূন্য তায় পরিভ্রমণরত তারকারাজি ও গ্রহ উপগ্রহাদির সাথে অকূল সাগরের বুকে ভাসমান আদম সন্তানদের বহনকারী জাহাজসমূহের মধ্যে বেশ চমৎকার সাদৃশ্য রয়েছে। বহু দিক দিয়ে এ সাদৃশ্য বুঝা যায়; যেমন আকৃতি-প্রকৃতি, গতিবিধি ও উভয় বক্তুনিচয় একইভাবে আল্লাহর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে থাকার দিক দিয়ে সাদৃশ্যপূর্ণ। একদিকে যেমন দেখা যায় নভোমন্ডলে অবস্থিত সকল কিছুকে আল্লাহ তায়ালা পরস্পর সংঘর্ষ লেগে যাওয়া থেকে হেফাযত করছেন, অপরদিকে একইভাবে বিশ পঁচিশ হাজার ফুট গভীর ও হাজার হাজার মাইলব্যাপী ছড়িয়ে থাকা মহাবারিধির বুকে ভাসমান (মহাসাগরের তুলনায়) তুচ্ছাতিতুচ্ছ জাহাজগুলােকেও সর্বশক্তিমান রবুল আলামীনই ঝড় তুফান ও নানা প্রকার প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা করছেন। আল্লাহ রব্বুল আলামীনের শক্তি ক্ষমতার এসব অসংখ্য নিদর্শন মানুষ প্রতিনিয়ত অবলােকন করছে। কিন্তু হায়, অকৃতজ্ঞ অর্বাচীন এ সব নরপশু একটুও চিন্তা করার প্রয়ােজন বােধ করছে না। যদি তারা আল্লাহ সােবহানাহু ওয়া তায়ালার এ সব নিদর্শন বুঝবার জন্যে তাদের হৃদয়-দুয়ারকে অবারিত করতাে, তাহলে এগুলাে থেকে শিক্ষা নেয়া তাদের জন্যে খুব সহজ হয়ে যেতাে। এখানে উল্লেখিত ‘আল ফুলকিল মাশহুন’ (মানুষ ও জীবজন্তুতে ভর্তি জাহাজ) দ্বারা সম্ভবত মানবকুলের দ্বিতীয় পিতা হযরত নূহ(আ.)-এর নির্মিত জাহাজটি বুঝানাে হয়েছে, যিনি সে জাহাজে করে আদম(আ.)-এর (মােমেন) বংশধরকে বহন করেছিলেন। তারপর সে জাহাজের মতােই মানুষ তৈরী করেছে অসংখ্য জাহাজ, যা মহাসাগরের বুকে উত্থিত উথাল তরংগমালার মধ্যে নীল বারিধির বুক চিরে চিরে মানুষ ও মালামাল বহন করে দেশ থেকে দেশান্তরে পৌছে দিচ্ছে। আকাশের মহাশূন্যতায় পরিভ্রমণরত সকল নক্ষত্রমালাও মহাসাগরের বুকে ভ্রমণরত জাহাজসমূহের মধ্যে একইভাবে আল্লাহর শক্তি ক্ষমতা সক্রিয় রয়েছে বলে বুঝা যায়। এ দুটি বিস্ময়কর দৃশ্যের দিকে চিন্তাপূর্ণ দৃষ্টি দিয়ে তাকালে মানুষ সহজেই বুঝতে পারে যে, সৃষ্টির বুকে অন্যত্র যেখানে যা কিছু আছে সবই আল্লাহর অদৃশ্য পরিচালনায় নিশিদিন কাজ করে চলেছে। দেখুন না, অকূল সমুদ্রের বুকে কেমন করে, কোন বিশেষ নিয়মে এতাে বিপুল পরিমাণ লোহালক্কড় সম্বলিত জাহাজগুলাে কেমন অবলীলাক্রমে মাসের পর মাস ধরে ভ্রমণ করে হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিচ্ছে। এই পাড়ি জমাননার মধ্যে বিচিত্র যেসব বৈশিষ্ট্য পরিস্ফুট হয়ে ওঠে, সেগুলাের দিকে তাকালে একবার জাহাজের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বিস্ময় জাগে, বিস্ময় জাগে পানির ধারণ ক্ষমতার দিকে যখন তাকানাে হয়, তেমনি অবাক বিস্ময়ে বিদগ্ধ মানুষ হতবাক হয়ে যায় বায়ু ও বায়বীয় বাষ্পের ধারণ ক্ষমতায়, অথবা হতবাক হয়ে যায় তখন যখন অণু ও আণবিক শক্তির অকল্পনীয় ক্ষমতা সে অনুভব করে। এভাবে চিন্তাশীল মানুষ আল্লাহ রব্বুল আলামীনের আরও কত যে শক্তি-ক্ষমতা পর্যবেক্ষণ করতে থাকে আর তখন সে অকুতােভয়ে দ্বিধাহীন চিত্তে স্বীকার করে যে, বিশ্বের সকল কিছু চলছে একমাত্র আল্লাহর হুকুমে এবং তারই ফয়সালা অনুসারে। তাই পাক পরওয়ারদেগারের ঘােষণায় জানা যাচ্ছে, ‘আর যদি আমি চাইতাম, তাহলে তাদের সে কূল কিনারাহীন সমুদ্র বক্ষে ডুবিয়ে দিতে পারতাম, আর তখন কেউ তাদের বাঁচাতে পারত না। কিছুতেই তাদের সে মহাবিপদ থেকে রক্ষা করতে পারতাে না; কিন্তু আমার রহমত ও সুনির্দিষ্ট এক সময় পর্যন্ত তাদের বাঁচিয়ে রাখার সিদ্ধান্তের কারণেই তারা অকূল পাথারে পাড়ি জমায় এবং সকল বিপদ আপদের মধ্যে দিয়েও পুনরায় নিরাপদে ঘরে ফিরে আসে।’ মহাসাগরের বুকে প্রচন্ড বাতাসের তাড়নে যখন জাহাজগুলাে পাখির পাখনার মতাে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত অবস্থায় ভেসে বেড়াতে থাকে এবং এ জাহাজগুলাে যতাে ভারীই হােক না কেন বা এদের নির্মাণ কৌশল যতাে নিপুণই হােক না কেন, ভীষণ ঝড়ের ঝাপটায় জাহাজগুলাে মুহুর্মুহু আছড়ে পড়তে থাকে, যাত্রীরা হাহাকার করতে থাকে এবং প্রতি মুহূর্তে তারা প্রমাদ গুনতে থাকে যে, আজ বুঝি আর রক্ষা নেই, কোনাে উপায় নেই এ কঠিন বিপদ থেকে বাচার, আর বাস্তব সত্য হচ্ছে এই যে, শক্তিমান আল্লাহর রহমত না থাকলে রাত দিনের মধ্যে যে কোনাে সময়ে এসব জাহাজ ধ্বংস হয়ে যেতাে। ট্রলার, ছােট ছােট নৌকা বা সমুদ্রগামী বড় বড় জাহাজে যারা সমুদ্র ভ্রমণ করেছে, তারা দেখেছে সমুদ্রবক্ষের ভয়াবহতা। তারা দেখেছে এ ভ্রমণকালে মানুষের অনুসৃত সতর্কতামূলক। ব্যবস্থা কত তুচ্ছ, কত অকিঞ্চিৎকর, তারা দেখেছে ঝড়াে হাওয়ার ঝাপটায় সমুদ্র কেমন রুদ্র রূপ ধারণ করে। এ কঠিন অবস্থার মধ্যে আল্লাহর মেহেরবানীতে যারা বেঁচে যায় এবং স্থলভাগে প্রত্যাবর্তন করে, তারা সঠিকভাবে রব্বুল আলামীনের মেহেরবানী বুঝতে পারে এবং হৃদয় দিয়ে তার ক্ষমতা অনুভব করতে পারে। তীব্র বাতাসের তােড়ে অথবা ঘূর্ণিঝড়ের দাপটে সমুদ্রের বুকে যে অবস্থার সৃষ্টি হয়, উত্তাল তরংগাভিঘাতে যখন পাহাড়সম উচ্চতা ও তৎপরবর্তীকালে যখন পাতালসম নীচুতা পয়দা হয়, তখন বৃহৎ থেকে বৃহৎ জাহাজ গুলো শােলার মতাে উৎক্ষিপ্ত হতে থাকে, সে কঠিন অবস্থা থেকে রক্ষা পাওয়া এবং যাত্রীদের নিজ নিজ বাড়ীতে ফিরে আসা সম্ভব হয় একমাত্র আল্লাহর রহমতে, তারই অপার করুণায় মানুষ আবার জীবনের স্বাদ ফিরে পায়। প্রকৃতপক্ষে ভুক্তভােগী ছাড়া সে অবস্থাটা সঠিকভাবে আঁচ করা, সাধারণভাবে অন্য কারাে পক্ষে সম্ভব নয়। আকাশে-বাতাসে-অন্তরীক্ষে সর্বত্র আল্লাহর রহমত বিরাজ করছে। তিনি অবশ্যই এক নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তার রহমত বর্ষণ করতে থাকবেন, তারপর তারই কুদরতে এসে যাবে সেই শেষ দিনটি, যেদিন সবই নিশেষে ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে। তাই এরশাদ হচ্ছে, জীবনসামগ্রী ভােগ করার জন্যে রয়েছে একটি নির্দিষ্ট সময়। আল্লাহ রব্বুল আলামীনের শক্তি ক্ষমতার এসব সুস্পষ্ট নিদর্শন সারা বিশ্বের বুকে ছড়িয়ে থাকা সত্তেও অপরিণামদর্শী বান্দারা গাফলতির ঘুমে মগ্ন রয়েছে। তাদের নযর পড়ে না এই নিদর্শনসমূহের দিকে এবং তাদের অন্তরও জাগ্রত হয় না। যার কারণে তারা নবী(স.)-কে উপহাস বিদ্রুপ করা থেকে বিরত হয় না, তাকে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করা থেকে তারা থেমে যায় না; বরং তারা আযাব জলদি নাযিল করার জন্যে দাবী জানাচ্ছে এবং সদাসর্বদা ব্যস্ততা দেখিয়েই চলেছে, যার ব্যাপারে রসূলরা তাদের সতর্ক করছেন।
# এরশাদ হচ্ছে, আর যখন তাদের বলা হয়… যদি তােমরা সত্যবাদী হও।'(আয়াত ৪৫-৪৮) হায়, আল্লাহ রব্বুল আলামীনের তরফ থেকে আসা এসব নিদর্শন তাদের অন্তরে কোনাে দাগ কাটে না, কোনাে চিন্তা অনুভূতিও জাগায় না বা কোনাে ভয়ভীতিও তাদের মধ্যে সৃষ্ট হয় না। অথচ যে কোনাে জাগ্রত হৃদয়ের মধ্যে চেতনা সৃষ্টি করার জন্যে, কম্পন আনয়নের জন্যে বা তাদের অন্তরকে বিপ্লবী বানানাের জন্যে আল্লাহ রব্বুল আলামীনের কুদরত বর্ণনাকারী ওপরে বর্ণিত আয়াত গুলো যথেষ্ট ছিলাে, যথেষ্ট ছিলাে সৃষ্টির সব কিছুর সাথে সামঞ্জস্য রেখে চলা। উন্মুক্ত এ বিশ্ব প্রকৃতি আমাদের সামনে যেন একখানি সুবিশাল গ্রন্থ, যা আমাদের চোখে আংগুল দিয়ে আল্লাহর মহিমা দেখিয়ে দিচ্ছে, তাঁর মহত্ত্বের কথা জানাচ্ছে, আমাদের তার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ব্যবস্থাপনা ও তার অমােঘ সিদ্ধান্ত সম্পর্কে অবহিত করছে, কিন্তু মৃত হৃদয়ের কাফেরদের নযরে এ সবের কোনাে কিছুই ধরা পড়ে না, আর কখনও এসবের দিকে যদি চোখ মেলে তারা চায়ও, এ সবের ওপর কোনাে চিন্তা তারা করে না এবং এসব থেকে কোনাে শিক্ষাও তারা গ্রহণ করে না। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এতােই মেহেরবান এবং আদিগন্ত বিস্তৃত তার রহমত এতাে প্রশস্ত যে, তিনি তাদের ওপর ক্রুদ্ধ হয়ে তাদের নােংগরবিহীন জাহাজের মতাে অকূল সাগরে দিশেহারা হয়ে যাওয়ার জন্যে ছেড়ে দেন না, তাদের তার প্রেরিত রসূলের পরিচালনামুক্ত হয়ে জীবনের প্রতি পদে পদে হোঁচট খাওয়ার জন্যে ছেড়ে দেন না, তিনি তাদের সেসব নির্বাচিত ও পরীক্ষিত পরিচালকদের পরিচালনা থেকে বঞ্চিত করেন না যারা জীবনের বাঁকে বাঁকে তাদের সতর্ক করার জন্যে সর্বদা নিয়ােজিত থেকেছে এবং গোটা সৃষ্টিরাজ্যের প্রতিপালকের দিকে সদা-সর্বদা আহ্বান জানানাের জন্যে নিবেদিতপ্রাণ। যারা এসব ব্যাধিগ্রস্ত লােকদের মনের ওপর প্রভাব ছড়ানাের জন্যে, তাদের মনে আল্লাহ রব্বুল আলামীনের ভয়ভীতি ও সতর্ক হয়ে চলার অনুভূতি জাগানাের জন্যে এবং তাঁর গযব ও আযাব থেকে বাঁচানাের জন্যে তীব্র মর্মবেদনা নিয়ে সংকল্পবদ্ধ। এসব নবী রসূলদের জানানাে হয়েছে যে, মানুষের সামনে ও পেছন থেকে অসংখ্য লােভনীয় বস্তু এবং বিষয় এসে তাদের অন্যায়ের দিকে প্ররােচিত করার জন্যে সদা সর্বদা হাতছানি দিয়ে চলেছে, যার জন্যে তাদের প্রতি পদে পদে হুঁশিয়ার করার প্রয়ােজন রয়েছে, প্রয়ােজন রয়েছে তাদের দৃষ্টিকে আল্লাহর যমীনে সেসব নিদর্শনের দিকে আকৃষ্ট করার, যা তার প্রেরিত বাণীর সাথে পরিপূর্ণভাবে সামঞ্জস্যশীল। কিন্তু হায়, এসব সত্তেও তারা অন্ধত্বের আঁধারে হাবুডুবু খেয়ে মরছে। এরশাদ হচ্ছে, ‘যখন তাদের বলা হয় যে, তােমরা তােমাদের সামনে… আসেনি যা থেকে তার মুখ ফিরিয়ে নেয়নি!’ (আয়াত ৪৫-৪৬)
# *জীবন পরিচালনায় আল্লাহকে না জানা কুফরীরই নামান্তর : আর যখন অভাবগ্রস্তদের খাওয়ানাের জন্যে তাদের সম্পদ থেকে খরচ করার জন্যে আহ্বান জানানাে হয়, তখন তারা বিদ্রুপাত্মক ভংগিতে এবং দোষারােপের ভাষায় উক্তি করতে থাকে- ‘আমরা কি খাওয়াবাে তাদের যাদের চাইলে আল্লাহ তায়ালাই নিজেই তাে খাওয়াতে পারেন?’ যারা তাদের নেকী অর্জনের জন্যে এবং আল্লাহর ওয়াস্তে খরচ করার জন্যে আহ্বান জানায়, তাদের বরাবর এইভাবে সেই হতভাগারা বিদ্রুপ করতে থাকে এবং বলে, ‘অবশ্যই তােমরা সুস্পষ্ট গােমরাহীর মধ্যে রয়েছ।’ বান্দাদের জীবনে আল্লাহ রব্বুল আলামীন যে বিধান বা নিয়ম কানুন দিয়ে রেখেছেন তা সঠিকভাবে না জানার কারণে তারা জীবন সম্পর্কে যেসব ধারণা পােষণ করে, তাতে প্রকৃতপক্ষে তাঁর নিয়মকেই অস্বীকার করা হয়, কিন্তু এটা স্পষ্টভাবে জানা দরকার যে, সবার রুজির মালিক একমাত্র আল্লাহ রবুল আলামীন, তিনিই সবাইকে খেতে পরতে দেন, তিনি মানুষের জীবনের জন্য প্রয়ােজনীয় সব কিছু যেমন সরবরাহ করার ব্যবস্থা করেন, তেমনি জীবজন্তু, কীট পতংগ এবং পৃথিবীর বুকে আমাদের জানা অজানা সবার ও সব কিছুর জন্যে যাবতীয় প্রয়ােজনীয় দ্রব্যাদির ব্যবস্থা একমাত্র তিনিই করে থাকেন। তারা নিজেরা কেউ তাদের কোনাে প্রয়ােজনীয় জিনিস তৈরী করেনি, তৈরী করতে পারে না, মূলত, কারও পক্ষেই কোনাে কিছু সৃষ্টি করা সম্ভব নয়, কিন্তু পৃথিবী সৃষ্টির প্রাক্কালে আল্লাহ তায়ালা নিয়ম করে দিয়েছেন যে, মানুষকে তার প্রয়ােজনীয় দ্রব্যসামগ্রী লাভ করার জন্যে চেষ্টা ও কষ্ট করতে হবে। যমীনে চাষবাস করা, খনিজ দ্রব্যাদি আহরণ করা, অঞ্চল থেকে অঞ্চলে মালামাল বহন করা এবং বিভিন্ন কালের দাবী পূরণ করতে গিয়ে মালের পরিবর্তে মালের লেনদেন করা ও মুদ্রার বিনিময়ে বেচাকেনা, এ সবই হয়েছে। বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন সরকারের চাহিদা ও নীতি নির্ধারণের কারণে। বিভিন্ন যামানায় বিভিন্ন শাসক বা খলীফারা (গণপ্রতিনিধিত্বকারী সরকার) তাদের যােগ্যতা অনুসারে জনগণের প্রয়ােজন পূরণ করার চেষ্টা করেছে, এবং এভাবে বিভিন্ন কালে বিভিন্ন দেশে পূর্ণ প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার (খেলাফত প্রতিষ্ঠা) করার চেষ্টা হয়েছে। এ সব সরকার শুধুমাত্র মানুষের প্রয়ােজন মেটানাের কাজে নিয়ােজিত থাকেনি; বরং এরা মানুষের অধিকার আদায় করার দায়িত্ব পালন করার সাথে সাথে পৃথিবীতে প্রকৃতপক্ষে খেলাফত কায়েম করার চেষ্টা করে গেছে। এ দায়িত্বের মধ্যে মানুষের খাদ্য খাবার ও অন্যান্য সরঞ্জাম সরবরাহ করা অন্যতম। বিশাল এ পৃথিবীতে খেলাফত বা রাষ্ট্রের অজস্র প্রয়ােজন ও দাবী দাওয়া মানুষের প্রতিভা এবং তার জীবনকে সচল, সুন্দর ও সমৃদ্ধ করার জন্যে জরুরী যােগ্যতা, উপকারী দ্রব্যাদি ও পর্যায়ক্রমে আবশ্যকীয় জিনিসপত্রের পর্যাপ্ত সরবরাহ ও অভাব অনটন মানুষের জীবনের নিত্যদিনের এক জীবন্ত ইতিহাস। এ সমস্যা কোনাে একটি দেশ বা বিশেষ কোনাে এক যুগের বা শতাব্দীর ব্যাপারেই যে সত্য তা নয়; বরং সারা পৃথিবীর সব দেশের, সর্বযুগের ও সর্বকালের এ এক অবিসংবাদিত সত্য তথ্য। মহাকালের জানা অজানা ইতিহাসের মধ্যে মানব জাতির সংকট ও সচ্ছলতা, শান্তি সমৃদ্ধি ও ধ্বংসলীলার অসংখ্য ইতিবৃত্তে, যা নিহিত রয়েছে এসব কিছু নিয়েই ইসলামের পদযাত্রা। মানব জীবনের সকল সমস্যা অপনােদন করে তাদের ইহকাল ও পরকালের অবিমিশ্র সুখ শান্তির সন্ধানদান ইসলামের মূল লক্ষ্য। ব্যক্তি, পরিবার সমাজ ও বৃহত্তর মানবতার কল্যাণ বিধান করার জন্যেই যুগে যুগে ও দেশে দেশে আল্লাহর বাছাইকৃত প্রতিনিধিবৃন্দের আগমন ঘটেছে। মানুষের মধ্যে মজ্জাগতভাবে বর্তমান রয়েছে লােভ লালসা ও তারতম্য করার প্রবণতা, যা তাদের অসম প্রতিযােগিতায় নামায়, তাদের মধ্যে বর্ণবৈষম্য আনে। স্বার্থের এই হানাহানি তাদের পরস্পরের বিরুদ্ধে মারমুখী করে তােলে। মানুষের হাতে মানুষের জন্যে নেমে আসে লাঞ্ছনা বঞ্চনা, কলহ বিবাদ, সংঘাত, সংকট সমস্যা এবং সর্বোপরি শৃংখলাহীনতার ফলশ্রুতিতে নিরাপত্তাহীনতার সয়লাব জনজীবনের সর্বত্র বয়ে যায়। যুগের পর যুগ ও শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে জমে থাকা এ সব গ্লানি দূরীভূত করে মানুষে মানুষে দরদ-সহানুভূতি, মায়া মমতা, সহযােগিতা সহমর্মিতার ফল্গু ধারা প্রবাহিত করার উদ্দেশ্যে যুগে যুগে ও দেশে দেশে আগমন ঘটেছে ইসলামের নিশানবর্দারদের, যার চূড়ান্ত রূপ, পরিপূর্ণ ছবি শেষ নবী ও রসূল মােহাম্মদ(স.)-এর জীবনী ও শিক্ষাতে এবং তার কর্মধারার বাস্তবায়নে ফুটে ওঠেছে। তাই ইসলামের এ শিক্ষায় দেখা যায়, অর্থনৈতিক দিক দিয়ে যে বড় হয়েছে সে আরও বড় হতে থাকবে আর যে একবার অভাব অভিযােগের শিকার হয়েছে, সে ধীরে ধীরে নেমেই যেতে থাকবে, জীবনের হৃত আশা ভরসা আর কোনােদিন পার পাবে না এমনটি হবার নয়; ইসলামী ব্যবস্থার বাস্তবায়নে এ নযির স্থাপিত হয়েছে যে, সমাজের বিত্তবানদের সম্পদের একটি অংশ এমনভাবে বেরিয়ে আসবে যা দ্বারা দরিদ্র জনগণের নিরাপত্তা ও জীবনের স্থিতিশীলতা গড়ে তােলা হবে ইসলামী সরকারের দায়িত্ব। ইসলামী সরকার নিজ দায়িত্বে বিত্তবানদের সম্পদের হিসাব নিকাশ করে, তাদের মৌলিক প্রয়ােজন মেটানাের পর অবশিষ্ট বা অতিরিক্ত সম্পদ থেকে শতকরা দুই দশমিক পাঁচ (২.৫) ভাগ যাকাত স্বরূপ নিয়ে নেবে এবং সকল বিত্তশালী সম্প্রদায়ের নিকট থেকে সংগৃহীত এসব সম্পদ দ্বারা ইসলামী সরকারই দরিদ্র জনগোষ্ঠীর খাদ্য খাবার থেকে নিয়ে অন্যান্য যাবতীয় প্রয়ােজন মেটানাের ব্যবস্থার নিশ্চয়তা দেবে। এর ফলে অভাবী লােকদের চিরদিন একইভাবে অভাবের অভিশাপ বহন করতে হবে না; উপরন্তু যাকাত হিসেবে আদায় করা এ দান একটি ফরয এবাদাত হওয়ার কারণে কারও মনে অহংকার বা এহসান প্রদর্শন করার প্রবণতা আসার কোনাে সুযােগ নেই, নেই যাকাত গ্রহীতার মনে হীনমন্যতার ব্যাধি পয়দা হওয়ার কোনাে আশংকা, আর এর ফলে ধনী গরীব সবাইকে সমান সমান মৌলিক প্রয়ােজন মেটানােরও কাছাকাছি আসার সুযােগ দান করা যাবে। ইসলাম ধনী-গরীবের মধ্যে বিরাজমান বৈষম্য দূরীকরণার্থে যাকাত দান করার ব্যবস্থা চালু করেছে এবং এই যাকাতের মধ্যে তাহারাত বা পবিত্রকরণের ব্যবস্থা নিহিত রয়েছে। আল্লাহর হুকুমে যাকাত আদায় করা বাধ্যতামূলক হওয়ায় এ ব্যবস্থা অবশ্যই অন্যতম প্রধান প্রতীকী ইবাদত। শুধু অন্যতম প্রতীকী ইবাদত নয়, এ এবাদাতের সাথে বান্দার হক জড়িত থাকায় ইসলাম এর গুরুত্ব এতাে বেশী দিয়েছে যে, কোনাে ব্যক্তি বা কোনাে জনপদ যাকাত দিতে অস্বীকার করলে তার বা তাদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘােষণা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে (যেমন হযরত আবু বকর রাদিআল্লাহু আনহুর আমলে এ ধরনের লােকদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘােষণা করা হয়েছিলাে)। এই যাকাত ব্যবস্থার মাধ্যমেই ধনী-গরীবের মধ্যে বিরাজমান বৈষম্য দূর হয়ে এমন এক বন্ধন সৃষ্টি হয়েছে, যা তাদের বিশ্ব মানব সভায় এক অত্যুজ্জ্বল আসন করে দিয়েছে। ইসলাম মানব জাতির ইতিহাসে যে স্বর্ণ-যুগের সৃচনা করেছে এবং মানব সমস্যা সমাধানে ইসলামী ব্যবস্থা যে অবদান রেখেছে, তা একমাত্র হঠকারী ও অন্ধজন ছাড়া যে কোনাে বিদগ্ধ ও জ্ঞানপিপাসু জনগােষ্ঠীকে চমৎকৃত করেছে। ইসলাম এই যাকাত ব্যবস্থার মাধ্যমে অর্থনৈতিক সমস্যার এমন এক সমাধান দিয়েছে, সারা পৃথিবীর ইতিহাসে যার কোনাে তুলনা নেই। দেখুন, যাকাত ব্যবস্থা সম্পর্কে আত্মকেন্দ্রিক, সংকীর্ণমনা ও চোখে পর্দা-পড়া সে হতভাগা ব্যক্তিদের উক্তি, যারা আল্লাহ প্রদত্ত জীবন বিধানের মর্ম বুঝতে পারেনি, ‘আমরা কি খাওয়াব তাদের যাদের চাইলে আল্লাহ নিজেই খাওয়াতে পারেন?’ এতােটুকু বলেই তারা থেমে যায়নি; বরং যারা আল্লাহর বিধান চালু করার আহ্বান জানাচ্ছেন তাদেরকেই তারা বিপথগামী বলতে দ্বিধাবােধ করেনি। তারা বলেছে, ‘তােমরা সুস্পষ্ট গােমরাহীর মধ্যে পতিত জনতা ছাড়া আর কিছুই নও।’ আল্লাহর বিধানের প্রকৃতি ও তাৎপর্য বুঝতে অক্ষম হওয়ার কারণে তারাই যে প্রকৃতপক্ষে ভুল পথে রয়েছে তা তারা বুঝতে পারছে না, তারা জানতে পারছে না জীবন স্পন্দনের তাৎপর্য কি, তারা উপলব্ধি করতে পারছে না এই স্পন্দনের গুরুত্ব কি, তারা খেয়াল করছে না তাদের জীবনের লক্ষ্য কত মহান, অথচ সেই লক্ষ্যে পৌছুনাের জন্যে তাদের কতাে প্রতিভা ও কতাে যােগ্যতা দেয়া হয়েছে, আর এ সব যােগ্যতা ও প্রতিভা বিকাশের জন্যে তাদের অর্থ সম্পদ ও খাদ্য খাবারের কত বিপুল পরিমাণ সংগ্রহ দেয়া হয়েছে। ইসলাম এমনই এক ব্যবস্থা দিয়েছে যার মধ্যে সুসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে প্রত্যেক ব্যক্তির জন্যে তার মধ্যে নিহিত প্রতিভা বিকাশের সুযােগ দেয়া হয়েছে। মানুষ সাধারণভাবে জানে না তার মধ্যে কত অফুরন্ত সম্ভাবনার বীজ লুকিয়ে রয়েছে, জানে না বিধায় আল্লাহর রাজ্যে খেলাফতের দায়িত্ব পালনের জন্যে ইসলাম তাকে যথাযথভাবে জানানাের ব্যবস্থা করেছে এবং তাদের এই গুরুদায়িত্ব পালনে সাহায্য করেছে। তারপর তার মধ্যে সকল প্রকার মন্দ প্রভাবের অনিষ্ট রােধ করার জন্যে প্রতিরােধমূলক বিভিন্ন ব্যবস্থা দেয়া হয়েছে। পরিশেষে আসছে শেষ বিচারের দিন সম্পর্কিত আল্লাহর ওয়াদার বিষয়ে তাদের সন্দেহ সংশয়ের ওপর আলােচনা, আরও আলােচনা এসেছে আল্লাহ প্রদত্ত শাস্তির ধমক সম্পর্কে তাদের ঠাট্টা-বিদ্রুপ ও কটাক্ষপাত সম্পর্কিত কথা। দেখুন আল্লাহর এরশাদে কি বলা হচ্ছে, ‘আর ওরা বলে, কখন আসবে সেই ওয়াদা করা কেয়ামতের দিন? (বলাে না জলদি) যদি তােমরা সত্যবাদী হয়ে থাকো। কিন্তু মানুষ ব্যস্ত হচ্ছে বলে ওয়াদা করা সেই ভয়ংকর দিনটি নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বেই এসে যাবে, এমনটি কখনও হবে না। ‘আর যদি তারা আযাব বিলম্বিত হােক বলে কামনা করে তাতেও তা বিলম্বিত হবে না।’ অর্থাৎ যা কিছু হবে সবই পূর্বনির্ধারিত পরিকল্পনামাফিক হবে। কোনাে অবস্থাতেই নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বে বা পরে ওয়াদা করা সে কঠিন পরিণতি আসবে না। প্রত্যেকটি জিনিসের জন্যেই আল্লাহ রব্বুল আলামীনের কাছে এক সুনির্দিষ্ট পরিমাপ রয়েছে এবং প্রত্যেক বিষয়ই তার জন্যে নির্দিষ্ট সময়ে সংঘটিত হবে। অবশ্যই আল্লাহর চিরন্তন ও অমােঘ নিয়ম অনুযায়ী সবকিছু সংঘটিত হবে, এটাই আল্লাহর হেকমাতের দাবী, এটাই আল্লাহ রব্বুল আলামীনের বিশাল রাজ্যের মধ্যে অবস্থিত শৃংখলার প্রধান বৈশিষ্ট্য যা সবার সামনে পরিস্ফুট হয়ে রয়েছে।
*কেয়ামত দিবসের বিভীষিকাময় দৃশ্য : এখন তাদের এ অপ্রিয় প্রশ্নের জওয়াবে শুধু কেয়ামতের কিছু ভয়াবহ দৃশ্যের বর্ণনা তুলে ধরা হচ্ছে যেন তারা বুঝতে পারে সেখানে কি কঠিন অবস্থা হবে, কিন্তু ঠিক কখন আসবে সেই কঠিন মুহূর্ত তা বলা হচ্ছে না। (কারণ তাদের অন্তর প্রাণ জানে মোহাম্মদ অবশ্যই নবী এবং তার মুখনিসৃত বাণী অবশ্যই সত্য)! এ জন্যে কেয়ামতের কঠিন অবস্থাসমূহের মধ্য থেকে যেটুকু তাদের সামনে পেশ করা হচ্ছে তাতেই তাদের হৃদকম্প শুরু হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু হায়, দুনিয়ার নানাপ্রকার স্বার্থ; কখনও অর্থের স্বার্থ, কখনও নেতৃত্বের স্বার্থ, আবার কখনও বা ইন্দ্রিয় উচ্ছলতার স্বার্থ, এগুলাে এমনই বালাই যা মানুষকে বুঝেও বুঝতে দেয় না। এইভাবেই জেনে বুঝে যারা পার্থিব লাভ ও লােভকে গুরুত্ব দেয় এবং ‘নগদ যা পাও হাত পেতে নাও, বাকির খাতায় শূন্য দাও’-এর তালীম গ্রহণ করে, সাময়িক ও স্থায়ী জীবনের পার্থক্য নির্ণয় করে না, তাদের জন্যে অবশ্যই রয়েছে সে কঠোর সাজা। সে ভয়াবহ দিনের প্রতি বিশ্বাস তাদের অভ্যন্তরে রয়েছে বলেই তাদের সামনে এ ভয়াবহ অবস্থার বর্ণনা পেশ করা হচ্ছে। ‘দেখো তারা শুধুমাত্র একটি চিৎকার ধ্বনি তাদেরকে পেয়ে বসছে… আর তৎক্ষণাৎ তারা সবাই হাযির হয়ে যাবে। (মূলত এসব প্রশ্নের মাধ্যমে) এরা যে বিষয়টির জন্যে অপেক্ষা….সবাইকে (হাশরের ময়দানে) আমার সামনে এনে হাযির করা হবে।'(আয়াত ৪৯-৫৩) ‘(আজ) সত্য প্রত্যাখ্যানকারীরা জিজ্ঞেস করছে, বলাে কখন আসবে সেই ওয়াদাকৃত দিবসগুলাে যদি তােমরা সত্যবাদী হয়ে থাকো? এর জওয়াবে অত্যন্ত দ্রুততার সাথে বলা হচ্ছে, সেদিন এমন এক বিকট শব্দ উত্থিত হবে যার কারণে সকল প্রাণী বেহুশ হয়ে পড়ে যাবে এবং এ শব্দের তােড়ে সকল জীবন ও জীবন্ত প্রাণের অবসান ঘটবে। এরশাদ হচ্ছে, ‘তারা দেখতে পাবে এমন একটি প্রচন্ড শব্দ উত্থিত হচ্ছে, যা তাদের সবাইকে গ্রাস করে ফেলবে। এমন সময়ে তাদের প্রচন্ড শব্দ পাকড়াও করে বসবে যখন তারা নানা প্রকার তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত থাকবে। সুতরাং সে অবস্থায় তারা কাউকে উপদেশ দান করা বা নিজেদের পরিবারের কাছে ফিরে যাওয়ার কোনাে সুযােগ পাবে না।’ এ অবস্থা, হঠাৎ করেই তাদের পেয়ে বসবে যখন তারা জীবনের বিবিধ সমস্যা নিয়ে নানা প্রকার ঝগড়া বিবাদে লিপ্ত থাকবে। এই অবস্থায় কিছুতেই তাদের ধারণায় আসবে না যে, এমন একটা কঠিন অবস্থা তাদের ওপর আসতে পারে। এরকম কঠিন অবস্থা পূর্বাহ্নে আঁচ করতে পারলে হয়তাে তার ঝগড়া বিবাদ থেকে বিরত হতে পারতাে। ওরা সবাই যে যে অবস্থায় থাকবে সে অবস্থায়ই বেহুশ হয়ে পড়ে যাবে। সমসাময়িক কাউকে বা পরবর্তী কারও জন্যে কোনাে উপদেশ দেয়ার মতাে কোনাে ক্ষমতা বা সুযােগ কারও থাকবে না, আর নিজ নিজ পরিবারের কাছে ফিরে গিয়ে কোনাে একটি কথাও তারা বলতে পারবে না। ওরা সবাই নিজ নিজ স্থানেই শেষ হয়ে যাবে।