أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#১০৭১)
[*তাদের হাত, পা, কর্ণ তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিবে।:-]
www.motaher21.net
সূরা:- ৩৬:ইয়া-সীন
পারা:২৩
৫১-৬৭ নং আয়াত:-
ইয়া-সীন:৫১
وَ نُفِخَ فِی الصُّوۡرِ فَاِذَا ہُمۡ مِّنَ الۡاَجۡدَاثِ اِلٰی رَبِّہِمۡ یَنۡسِلُوۡنَ ﴿۵۱﴾
যখন শিঙ্গায় ফুৎকার দেওয়া হবে তখন মানুষ কবর থেকে তাদের প্রতিপালকের দিকে ছুটে আসবে।
ইয়া-সীন:৫২
قَالُوۡا یٰوَیۡلَنَا مَنۡۢ بَعَثَنَا مِنۡ مَّرۡقَدِنَا ٜۘؐ ہٰذَا مَا وَعَدَ الرَّحۡمٰنُ وَ صَدَقَ الۡمُرۡسَلُوۡنَ ﴿۵۲﴾
ভীত হয়ে বলবে, “আরে কে আমাদেরকে আমাদের নিঁদমহল থেকে উঠিয়ে দাঁড় করালো?”—-“এটা সে জিনিস যার প্রতিশ্রুতি দয়াময় আল্লাহ দিয়েছিলেন এবং রসূলদের কথা সত্য ছিল।”
ইয়া-সীন:৫৩
اِنۡ کَانَتۡ اِلَّا صَیۡحَۃً وَّاحِدَۃً فَاِذَا ہُمۡ جَمِیۡعٌ لَّدَیۡنَا مُحۡضَرُوۡنَ ﴿۵۳﴾
এ হবে এক মহাগর্জন; তখনই ওদের সকলকে আমার সম্মুখে উপস্থিত করা হবে।
ইয়া-সীন:৫৪
فَالۡیَوۡمَ لَا تُظۡلَمُ نَفۡسٌ شَیۡئًا وَّ لَا تُجۡزَوۡنَ اِلَّا مَا کُنۡتُمۡ تَعۡمَلُوۡنَ ﴿۵۴﴾
আজ কারো প্রতি তিলমাত্র জুলুম করা হবে না এবং যেমন কাজ তোমরা করে এসেছ ঠিক তারই প্রতিদান তোমাদের দেয়া হবে
ইয়া-সীন:৫৫
اِنَّ اَصۡحٰبَ الۡجَنَّۃِ الۡیَوۡمَ فِیۡ شُغُلٍ فٰکِہُوۡنَ ﴿ۚ۵۵﴾
এ দিন জান্নাতবাসীগণ আনন্দে মগ্ন থাকবে,
ইয়া-সীন:৫৬
ہُمۡ وَ اَزۡوَاجُہُمۡ فِیۡ ظِلٰلٍ عَلَی الۡاَرَآئِکِ مُتَّکِـُٔوۡنَ ﴿۵۶﴾
তারা ও তাদের স্ত্রীরা ঘন ছায়ায় রাজকীয় আসনে হেলান দিয়ে বসে আছে।
ইয়া-সীন:৫৭
لَہُمۡ فِیۡہَا فَاکِہَۃٌ وَّ لَہُمۡ مَّا یَدَّعُوۡنَ ﴿ۚۖ۵۷﴾
সব রকমের সুস্বাদু পানাহারের জিনিস তাদের জন্য সেখানে রয়েছে, যা কিছু তারা চাইবে তা তাদের জন্য হাজির রয়েছে।
ইয়া-সীন:৫৮
سَلٰمٌ ۟ قَوۡلًا مِّنۡ رَّبٍّ رَّحِیۡمٍ ﴿۵۸﴾
দয়াময় রবের পক্ষ থেকে তাদেরকে “সালাম” বলা হয়েছে।
ইয়া-সীন:৫৯
وَ امۡتَازُوا الۡیَوۡمَ اَیُّہَا الۡمُجۡرِمُوۡنَ ﴿۵۹﴾
এবং হে অপরাধীরা! আজ তোমরা ছাঁটাই হয়ে আলাদা হয়ে যাও।
ইয়া-সীন:৬০
اَلَمۡ اَعۡہَدۡ اِلَیۡکُمۡ یٰبَنِیۡۤ اٰدَمَ اَنۡ لَّا تَعۡبُدُوا الشَّیۡطٰنَ ۚ اِنَّہٗ لَکُمۡ عَدُوٌّ مُّبِیۡنٌ ﴿ۙ۶۰﴾
হে আদম সন্তানেরা! আমি কি তোমাদের এ মর্মে হিদায়াত করিনি যে, শয়তানের বন্দেগী করো না, সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।
ইয়া-সীন:৬১
وَّ اَنِ اعۡبُدُوۡنِیۡ ؕؔ ہٰذَا صِرَاطٌ مُّسۡتَقِیۡمٌ ﴿۶۱﴾
এবং আমারই বন্দেগী করো, এটিই সরল-সঠিক পথ?
ইয়া-সীন:৬২
وَ لَقَدۡ اَضَلَّ مِنۡکُمۡ جِبِلًّا کَثِیۡرًا ؕ اَفَلَمۡ تَکُوۡنُوۡا تَعۡقِلُوۡنَ ﴿۶۲﴾
কিন্তু এ সত্ত্বেও সে তোমাদের মধ্য থেকে বিপুল সংখ্যককে গোমরাহ করে দিয়েছে, তোমাদের কি বুদ্ধি-জ্ঞান নেই?
ইয়া-সীন:৬৩
ہٰذِہٖ جَہَنَّمُ الَّتِیۡ کُنۡتُمۡ تُوۡعَدُوۡنَ ﴿۶۳﴾
এটা সে জাহান্নাম, যার ভয় তোমাদের দেখানো হতো।
ইয়া-সীন:৬৪
اِصۡلَوۡہَا الۡیَوۡمَ بِمَا کُنۡتُمۡ تَکۡفُرُوۡنَ ﴿۶۴﴾
তোমরা যে কুফরী করতে সে কারণে আজ তোমরা এতে দগ্ধ হও।
ইয়া-সীন:৬৫
اَلۡیَوۡمَ نَخۡتِمُ عَلٰۤی اَفۡوَاہِہِمۡ وَ تُکَلِّمُنَاۤ اَیۡدِیۡہِمۡ وَ تَشۡہَدُ اَرۡجُلُہُمۡ بِمَا کَانُوۡا یَکۡسِبُوۡنَ ﴿۶۵﴾
আমি আজ এদের মুখে মোহর মেরে দেব, এদের হাত আমার সঙ্গে কথা বলবে এবং এদের পা এদের কৃতকর্মের সাক্ষী দেবে।
ইয়া-সীন:৬৬
وَ لَوۡ نَشَآءُ لَطَمَسۡنَا عَلٰۤی اَعۡیُنِہِمۡ فَاسۡتَبَقُوا الصِّرَاطَ فَاَنّٰی یُبۡصِرُوۡنَ ﴿۶۶﴾
আমি চাইলে এদের চোখ বন্ধ করে দিতাম, তখন এরা পথের দিকে চেয়ে দেখতো, কোথা থেকে এরা পথের দেখা পাবে?
ইয়া-সীন:৬৭
وَ لَوۡ نَشَآءُ لَمَسَخۡنٰہُمۡ عَلٰی مَکَانَتِہِمۡ فَمَا اسۡتَطَاعُوۡا مُضِیًّا وَّ لَا یَرۡجِعُوۡنَ ﴿٪۶۷﴾
আমি চাইলে এদের নিজেদের জায়গায়ই এদেরকে এমনভাবে বিকৃত করে রেখে দিতাম যার ফলে এরা না সামনে এগিয়ে যেতে পারতো, না পেছনে ফিরে আসতে পারতো।
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
# (مَتٰي هٰذَا الْوَعْدُ)
‘এ প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন কখন হবে?’ অর্থাৎ কাফির-মুশরিকরা কিয়ামত সংঘঠিত হওয়াকে অসম্ভব মনে করে জিজ্ঞাসা করে কিয়ামত কখন হবে? আল্লাহ তা‘আলা বলছেন, মূলত তারা একটি মহা গর্জনের অপেক্ষা করছে।
অর্থাৎ মানুষ বাজারে কেনা-বেচা এবং স্বাভাবিক অভ্যাস অনুযায়ী কথাবার্তা ও বাক-বিতণ্ডায় লিপ্ত থাকবে, এমন সময় হঠাৎ শিঙ্গায় ফুঁৎকার দেয়া হবে এবং কিয়ামত সংঘঠিত হয়ে যাবে। এটা হবে প্রথম ফুঁৎকার, যাকে نفخة الفزع বলা হয়। বলা হয়েছে যে, এর পরে দ্বিতীয় ফুঁৎকার হবে, যাকে نفخة الصعق বলা হয়। যাতে আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া সমস্ত জীব মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে।
وَنُفِخَ فِي الصُّوْر
অর্থাৎ প্রথম মত অনুযায়ী এটা দ্বিতীয় ফুঁৎকার এবং দ্বিতীয় মত অনুযায়ী এটা তৃতীয় ফুৎকার হবে, যাকে
نفخة البعث و النشور
বলা হয়। এতে মানুষকে কবর থেকে জীবিত করা হবে। (ইবনু কাসীর)
الْأَجْدَاثِ শব্দটি جدث এর বহুবচন, অর্থ কবর। يَنْسِلُوْنَ শব্দটি نسلان থেকে উদ্ভূত। অর্থ দ্রুত চলা। অর্থাৎ তারা দ্রুত কবর থেকে বের হবে। অন্য আয়াতে রয়েছে : হাশরের সময় মানুষ কবর থেকে উঠে দেখতে থাকবে। এ বক্তব্য পূর্ববর্তী বক্তব্যের পরিপন্থী নয়, কারণ প্রথমাবস্থায় বিস্মিত হয়ে দন্ডায়মান অবস্থায় দেখতে থাকবে এবং পরে দ্রুতগতিতে হাশরের দিকে দৌড়াতে থাকবে।
(مَنْۭ بَعَثَنَا مِنْ مَّرْقَدِنَا)
‘কে আমাদেরকে আমাদের কবর থেকে উঠাল?’ অর্থাৎ মু’মিনরা কবরে যে আরাম-আয়েশে ছিল কিয়ামত সংঘটিত হলে তা বর্জন করে উঠতে হবে আর কাফিররা কবরের আযাবের চেয়ে আরো কঠিন আযাবের সম্মুখিন হবে তাই তারা সবাই এ কথা বলবে। ফেরেশতারা তাদের কথার জবাবে বলবে :
(هٰذَا مَا وَعَدَ الرَّحْمٰنُ وَصَدَقَ الْمُرْسَلُوْنَ)
‘দয়াময় আল্লাহ তো এরই ওয়াদা দিয়েছিলেন এবং রাসূলগণ সত্যই বলেছিলেন।’
অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন, কিয়ামতের দিবসে কারো প্রতি কোন প্রকার জুলুম করা হবে না। প্রত্যেকে যা আমল করবে তাকে তারই প্রতিদান দেয়া হবে। সুতরাং যে যা আমল করবে কিয়ামতের দিন সে তা-ই পাবে।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. আল্লাহ তা‘আলার বিধানের প্রতি ঠাট্টা-বিদ্রূপ করা যাবে না।
২. কিয়ামত মানুষের নিকট হঠাৎ চলে আসবে। তারা বুঝতেও পারবে না। সুতরাং সর্বদা ভাল কাজ করতে হবে মন্দ কাজ করা যাবে না।
৩. বিচারের মাঠে কারো প্রতি কোন জুলুম করা হবে না, প্রত্যেকে আপন-আপন কর্মের ফল পাবে।
৫৫-৫৮ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
এখানে আল্লাহ তা‘আলা ঐ বর্ণনা দিচ্ছেন যে, কিয়ামতের মাঠে বিচার কার্য সম্পন্ন করার পর জান্নাতীরা জান্নাতে চলে যাবে এবং তারা সেখানে অতি আনন্দে বসবাস করবে। তারা এবং তাদের স্ত্রীগণ সুশীতল ছায়ায় সুসজ্জিত আসনে হেলান দিয়ে বসবে। তথায় তাদের কোন দুঃখ থাকবে না। সেথায় থাকবে তাদের জন্য ফলমূল যে ফলমূলের কথা সূরা আল ওয়াক্বিয়াতে আলোচনা করা হবে ইনশাআল্লাহ। আর সেথায় থাকবে তারা যা কিছু চাইবে তার সবই। কোন কিছুর ঘাটতি তথায় থাকবে না এবং জান্নাতীদের জন্য সবচেয়ে বড় পাওয়া হবে মহান আল্লাহ তা‘আলার দিদার ও তাঁর পক্ষ থেকে তাদের প্রতি সালাম। আল্লাহ তা‘আলার বাণী,
(تَحِيَّتُهُمْ يَوْمَ يَلْقَوْنَه۫ سَلَامٌ ﺊ وَّأَعَدَّ لَهُمْ أَجْرًا كَرِيْمًا)
“যেদিন তারা আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করবে, সেদিন তাদের অভিবাদন হবে ‘সালাম’। আর তিনি তাদের জন্য প্রস্তুত করে রেখেছেন সম্মানজনক প্রতিদান।” (সূরা আহযাব ৩৩ : ৪৪)
সুতরাং জান্নাতীরা জান্নাতে পরম আরাম-আয়েশে বসবাস করবে। তারা সেখানে কোন কিছুর অভাব অনুভব করবে না। তাদের প্রয়োজন মতো সেখানে সবকিছু থাকবে।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. ঈমান ও সদামলের প্রতিদান চিরস্থায়ী জান্নাত।
২. জান্নাতীদের বড় পাওয়া হবে আল্লাহ তা‘আলার সাক্ষাত।
৩. জান্নাতীদের প্রতি আল্লাহ তা‘আলার অভিভাদন হবে সালাম।
৫৯-৬৭ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
পূর্বের আয়াতগুলোতে জান্নাতীদের আরাম-আয়েশের বর্ণনা দেয়ার পর এ আয়াতগুলোতে কিয়ামতের মাঠে জাহান্নামীদের কিরূপ অবস্থা হবে তা বর্ণনা করেছেন। কিয়ামতের মাঠে জাহান্নামীদেরকে বলা হবে- হে আদম সন্তান! আমি কি তোমাদের সতর্ক করিনি যে, তোমরা শয়তানের ইবাদত করবে না, সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্র“, তোমরা একমাত্র আমার ইবাদত করবে? কিন্তু তোমরা তা মাননি, নিষেধ করার পরও তোমরা আমার সাথে শয়তানের ইবাদত করেছ। সুতরাং আজ তোমরা সৎ লোকদের থেকে পৃথক হয়ে যাও। আল্লাহ তা‘আলার বাণী :
(وَيَوْمَ تَقُوْمُ السَّاعَةُ يَوْمَئِذٍ يَّتَفَرَّقُوْنَ)
“আর যেদিন কিয়ামত অনুষ্ঠিত হবে, সেদিন মানুষ আলাদা আলাদা হয়ে যাবে।” (সূরা রূম ৩০ : ১৪)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন :
(وَيَوْمَ نَحْشُرُهُمْ جَمِيْعًا ثُمَّ نَقُوْلُ لِلَّذِيْنَ أَشْرَكُوْا مَكَانَكُمْ أَنْتُمْ وَشُرَكَآؤُكُمْ ج فَزَيَّلْنَا بَيْنَهُمْ وَقَالَ شُرَكَآؤُهُمْ مَّا كُنْتُمْ إِيَّانَا تَعْبُدُوْنَ)
“এবং সেদিন আমি তাদের সকলকে একত্র করে যারা মুশরিক তাদেরকে বলব, ‘তোমরা এবং তোমরা যাদেরকে শরীক করেছিলে তারা স্ব স্ব স্থানে অবস্থান কর’; আমি তাদেরকে পরস্পর হতে পৃথক করে দিব এবং তারা যাদেরকে শরীক করেছিল তারা বলবে, ‘তোমরা তো আমাদের ‘ইবাদত করতে না।” (সূরা ইউনুস ১০ : ২৮)
আর তাদেরকে বলা হবে, তোমরা জাহান্নামে প্রবেশ করো যার ওয়াদা তোমাদেরকে দেয়া হয়েছিল এবং তোমরা যার প্রতি মিথ্যা আরোপ করেছিলে। ফেরেশতাদেরকে বলা হবে, তাদেরকে জাহান্নামের দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আল্লাহ তা‘আলার বাণী :
(اُحْشُرُوا الَّذِيْنَ ظَلَمُوْا وَأَزْوَاجَهُمْ وَمَا كَانُوْا يَعْبُدُوْنَ لا – مِنْ دُوْنِ اللّٰهِ فَاهْدُوْهُمْ إِلٰي صِرَاطِ الْجَحِيْمِ )
“(ফেরেশতাদেরকে বলা হবে : ) একত্র কর যালিমদেরকে এবং তাদের সাথীদেরকে আর তাদেরকে যাদের তারা ‘ইবাদত করত আল্লাহ ব্যতীত। অতএব তাদেরকে হাঁকিয়ে নিয়ে যাও জাহান্নামের পথে।” (সূরা সফফাত ৩৭ : ২২-২৩)
এ অঙ্গীকার হলো সে অঙ্গীকার যা আদম (আঃ)-এর পিঠ থেকে সন্তানদেরকে বের করার পর নেওয়া হয়েছিল। অথবা ঐ অসিয়ত যা নাবীদের মুখে মানুষকে করা হয়েছে।
এরপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন : হাশরের হিসাব-নিকাশের জন্য উপস্থিতির সময় প্রথমে প্রত্যেকে ওযর পেশ করতে থাকবে। মুশরিকরা কসম করে বলবে, আমরা শির্ক করিনি। আল্লাহ তা‘আলা মুশরিকদের সম্পর্কে বলেন :
(وَاللّٰهِ رَبِّنَا مَا كُنَّا مُشْرِكِينَ)
“আল্লাহর শপথ! হে আমাদের রব, আমরা মুশরিক ছিলাম না।” কেউ বলবে, আমাদের আমলনামায় ফেরেশতারা যা কিছু লিখেছে তা থেকে আমরা মুক্ত। তখন আল্লাহ তা‘আলা তাদের মুখে মোহর মেরে দেবেন। তাদের হাত, পা তাদের কৃতকর্মের সাক্ষ্য দিবে। এ সম্পর্কে সূরা নূর-এর ২৪ নম্বর আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে।
অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন : আমি যদি ইচ্ছা করতাম তাহলে তাদের চক্ষুগুলোকে নষ্ট করে দিতে পারতাম। তখন তারা সৎ পথে চলতে চাইলে কি করে দেখতে পেত? আর যদি ইচ্ছা করতাম তাহলে তাদেরকে তাদের নিজেদের স্থানে বিকৃত করে দিতে পারতাম। তাদের চেহারা পরিবর্তন করে দিয়ে তাদেরকে ধ্বংস করে দিতাম। ফলে তারা চলতে পারত না। অর্থাৎ তারা সামনেও যেতে পারত না এবং পেছনেও ফিরে আসতে পারত না। বরং মূর্তির মতো একই জায়গায় বসে থাকত।
অতত্রব সকল প্রকার শয়তানী কর্মকান্ড ছেড়ে দিয়ে একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করে আখেরাতের সফলতা অর্জনের চেষ্টা করা উচিত।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. শয়তানের অনুসরণ করা যাবে না, কারণ সে ভ্রান্ত পথের নির্দেশ দেয়।
২. কিয়ামতের মাঠে অপরাধীদের মুখে মোহর মেরে দেয়া হবে এবং তাদের হাত, পা, কর্ণ তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিবে।
তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
৫১-৫৪ নং আয়াতের তাফসীর:
এই আয়াতগুলোতে দ্বিতীয় ফুৎকারের বর্ণনা দেয়া হচ্ছে যার দ্বারা মৃতরা জীবিত হয়ে যাবে। (আরবী) ক্রিয়া পদটির (আরবী) হলো (আরবী) এবং এর অর্থ হচ্ছে দ্রুত গতিতে চলা। যেমন আল্লাহ্ তা’আলা অন্য আয়াতে বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “সেদিন তারা কবর হতে বের হবে দ্রুত বেগে, মনে হবে তারা কোন একটি লক্ষ্যস্থলের দিকে ধাবিত হচ্ছে।” (৭০:৪৩) যেহেতু দুনিয়ায় তারা কবর হতে জীবিতাবস্থায় উত্থিত হওয়াকে অবিশ্বাস করতো, সেই হেত সেদিন তারা বলবেঃ ‘হায়! দুর্ভোগ আমাদের! কে আমাদেরকে আমাদের নিদ্ৰাস্থল হতে উঠালো।’ এর দ্বারা কবরে আযাব না হওয়া প্রমাণিত হয় না। কেননা, ঐ সময় তারা যে ভীষণ কষ্ট ও বিপদের সম্মুখীন হবে তার তুলনায় কবরের শাস্তি তাদের কাছে খুবই হালকা অনুভূত হবে। তারা যেন কবরে আরামেই ছিল।
কোন কোন গুরুজন একথাও বলেছেন যে, কবর হতে উত্থিত হওয়ার কিছু পূর্বে সত্যি সত্যিই তাদের ঘুম এসে যাবে। হযরত কাতাদা (রঃ) বলেন যে, প্রথম ফুৎকার ও দ্বিতীয় ফুৎকারের মধ্যবর্তী সময়ে তারা ঘুমিয়ে পড়বে। তাই কবর হতে উঠার সময় তারা এ কথা বলবে। ঈমানদার লোকেরা এর জবাবে বলবেঃ দয়াময় আল্লাহ্ তো এরই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এবং তাঁর রাসূলগণ সত্যি কথাই বলতেন। একথাও বলা হয়েছে যে, ফেরেশতারা এই জবাব দিবেন। এ দু’টি উক্তির মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের উপায় এই যে, হয়তো এ জবাব মুমিনরাও দিবে এবং ফেরেশতারাও দিবেন। এসব ব্যাপারে সঠিক জ্ঞানের অধিকারী একমাত্র আল্লাহ্।
আব্দুর রহমান ইবনে যায়েদ (রঃ) বলেন যে, এগুলো সবই কাফিরদের উক্তি। কিন্তু সঠিক কথা ওটাই যা আমরা বর্ণনা করলাম। যেমন সূরায়ে সাফাতে আল্লাহ তা’আলা বলেছেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “এবং তারা বলবেঃ হায়! দুর্ভোগ আমাদের! এটাই তো কর্মফল দিবস। এটাই ফায়সালার দিন যা তোমরা অস্বীকার করতে।”(৩৭:২০-২১) অন্য জায়গায় আল্লাহ পাক বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “যেই দিন কিয়ামত সংঘটিত হবে সেই দিন পাপীরা কসম করে বলবে যে, তারা (দুনিয়ায় এক ঘন্টার বেশী অবস্থান করেনি। এভাবে তারা সদা সত্য হতে ফিরে থাকতো। ঐ সময় জ্ঞানীরা ও মুমিনরা বলবেঃ তোমরা আল্লাহর লিখন অনুযায়ী পুনরুত্থানের দিন পর্যন্ত অবস্থান করেছে, আর পুনরুত্থানের দিন এটাই, কিন্তু তোমরা জানতে না।”(৩০:৫৫-৫৬)
মহামহিমান্বিত আল্লাহ্ বলেনঃ ‘এটা হবে শুধুমাত্র এক মহানাদ, তখনই তাদের সকলকে হাযির করা হবে আমার সামনে।’ যেমন তিনি বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “এটা তো শুধু এক বিকট আওয়ায়, তখনই ময়দানে তাদের আবির্ভাব হবে।”(৭৯:১৩-১৪) মহান আল্লাহ্ আরো বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “কিয়ামতের ব্যাপারটি তো শুধু চোখের পলক ফেলার মত, বরং তার চেয়েও নিকটতর।”(১৬:৭৭) মহিমান্বিত আল্লাহ আর এক জায়গায় বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “যেই দিন তিনি তোমাদেরকে আহ্বান করবেন তখন তোমরা তাঁর প্রশংসা করতে করতে তাঁর আহ্বানে সাড়া দিবে এবং তোমরা ধারণা করবে যে, তোমরা অল্পদিনই (দুনিয়ায়) অবস্থান করেছো।”(১৭:৫২) মোটকথা, হুকুমের সাথে সাথেই সবাই একত্রিত হয়ে যাবে।
মহান আল্লাহ বলবেনঃ ‘আজ কারো প্রতি যুলুম করা হবে না, বরং তোমরা যা করতে শুধু তারই প্রতিফল দেয়া হবে।’
৫৫-৫৮ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা’আলা খবর দিচ্ছেন যে, জান্নাতীরা কিয়ামতের ময়দান হতে মুক্ত হয়ে সসম্মানে জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং তথাকার বিবিধ নিয়ামত ও শান্তির মধ্যে এমনভাবে মগ্ন থাকবে যে, অন্য কোন দিকে না তারা ক্ৰক্ষেপ করবে, না তাদের অন্য কিছুর প্রতি খেয়াল থাকবে। তারা জাহান্নাম হতে ও জাহান্নামবাসীদের হতে সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিন্ত থাকবে। তারা নিজেদের ভোগ্য জিনিসের মধ্যে এমনভাবে মগ্ন থাকবে যে, অন্য কোন জিনিসের খবর তারা রাখবে না। তারা অত্যন্ত আনন্দ মুখর থাকবে। কুমারী হুর তারা লাভ করবে। তাদের সাথে তারা আমোদ-আহলাদে লিপ্ত থাকবে। মনোমুগ্ধকর সঙ্গীতের সুর দ্বারা তাদেরকে প্রলুব্ধ ও বিমোহিত করা হবে। এই আমোদ-আহলাদ ও আনন্দের মধ্যে তাদের স্ত্রীরা ও হূরেরাও শামিল থাকবে। জান্নাতী ফলমূল বিশিষ্ট বৃক্ষাদির সুশীতল ছায়ায় তারা আরামে সুসজ্জিদ আসনে হেলান দিয়ে বসবে এবং পরম দয়ালু আল্লাহর পক্ষ হতে তারা আপ্যায়িত হবে। প্রত্যেক প্রকারের ফলমূল তাদের কাছে প্রচুর পরিমাণে বিদ্যমান থাকবে। তাদের মন যে জিনিস চাইবে তাই তারা পাবে।
সুনানে ইবনে মাজাহ ও মুসনাদে ইবনে আবি হাতিমে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “তোমাদের মধ্যে কেউ কি ঐ জান্নাতে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা কর এবং প্রস্তুতি গ্রহণ করতে ইচ্ছুক যাতে কোন ভয় ও বিপদ নেই? কা’বার প্রতিপালকের শপথ! ওটা সরাসরি জ্যোতি আর জ্যোতি। ওর সজীবতা ‘ সীমাহীন। ওর সবুজ-শ্যামলতা ফুটে পড়ছে। ওর প্রাসাদগুলো মযবূত, সুউচ্চ ও পাকা। ওর প্রস্রবণগুলো পরিপূর্ণ ও প্রবাহিত। ওর ফলগুলো সুস্বাদু ও পাকা। ফলগুলো প্রচুর পরিমাণে রয়েছে। তথায় সুন্দরী ও যুবতী হুর রয়েছে। তাদের পোশাকগুলো রেশমী ও মূল্যবান। ওর নিয়ামতরাশি চিরস্থায়ী ও অবিনশ্বর। ওটা শান্তির ঘর। ওটা সবুজ ও সজীব ফুলের বাগান। ওর নিয়ামতগুলো প্রচুর ও চমৎকার। ওর প্রাসাদগুলো সুউচ্চ ও সৌন্দর্যমণ্ডিত।” তাঁর একথা শুনে যতজন সাহাবী (রাঃ) সেখানে উপস্থিত ছিলেন সবাই সমস্বরে বলে উঠলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমরা এর জন্যে প্রস্তুতি গ্রহণ করবো এবং এটা লাভ করার জন্যে চেষ্টা করবো।” তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “ইনশাআল্লাহ। বলো।” সাহাবীগণ তখন ইনশাআল্লাহ বললেন।
মহান আল্লাহ বলেনঃ পরম দয়ালু প্রতিপালকের পক্ষ হতে তাদেরকে বলা হবে ‘সালাম’। স্বয়ং আল্লাহ জান্নাতবাসীদের জন্যে সালাম। যেমন আল্লাহ তা’আলার উক্তিঃ (আরবী) অর্থাৎ “যেদিন তারা তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করবে, তাদের তুহফা হবে সালাম।”(৩৩:৪৪)
হযরত জাবির ইবনে আবদিল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “জান্নাতীরা তাদের নিয়ামতরাশির মধ্যে মগ্ন থাকবে এমন সময় উপরের দিক হতে আলো চমকাবে। তারা তাদের মস্তক উত্তোলন করবে এবং মহামহিমান্বিত আল্লাহকে দর্শন করার সৌভাগ্য লাভ করবে। আল্লাহ তাআলা বলবেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “হে জান্নাত বাসীরা! তোমাদের উপর শান্তি বর্ষিত হোক।”
(আরবী)-এ আয়াতের ভাবার্থ এটাই। আল্লাহ তা’আলা তাদের দিকে তাকাবেন এবং তারাও তার দিকে তাকিয়ে থাকবে। তারা যতক্ষণ আল্লাহ তা’আলার দিকে তাকিয়ে থাকবে ততক্ষণ অন্য কোন নিয়ামতের প্রতি তারা ভ্রুক্ষেপ করবে না। অবশেষে আল্লাহ তাআলা তার ও তাদের মাঝে পর্দা ফেলে। দিবেন এবং নূর (জ্যোতি) ও বরকত তাদের উপর থেকে যাবে।” ( এ হাদীসটি ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন। কিন্তু এর সদন দুর্বল। ইমাম ইবনে মাজাহ (রঃ) স্বীয় ‘কিতাবুস সুন্নাহ’ নামক গ্রন্থে এটা বর্ণনা করেছেন)
হযরত উমার ইবনে আবদিল আযীয (রঃ) বলেন যে, আল্লাহ তাআলা যখন জাহান্নামী ও জান্নাতীদের হতে ফারেগ হবেন তখন তিনি মেঘের ছায়ার দিকে মনোনিবেশ করবেন। ফেরেশতারা আশে পাশে থাকবেন এবং আল্লাহ জান্নাতীদেরকে সালাম করবেন ও জান্নাতীরা জবাব দিবে। হযরত কারাযী (রঃ) বলেন যে, এটা আল্লাহ তা’আলারঃ (আরবী)-এই উক্তির মধ্যে বিদ্যমান রয়েছে। ঐ সময় আল্লাহ তাআলা বলবেনঃ “তোমরা আমার কাছে যা চাইবে চাও।” তারা উত্তরে বলবেনঃ “হে আমাদের প্রতিপালক! কি চাইবো, সবই তো বিদ্যমান রয়েছে?” আল্লাহ তা’আলা বলবেনঃ “হ্যা, ঠিক আছে, তবুও যা মনে চায় তাই চাও।” তখন তারা জবাব দিবেঃ “আমরা আপনার সন্তুষ্টি চাই।” মহান আল্লাহ বলবেনঃ “ওটা তো আমি তোমাদেরকে দিয়েছিই। আর এরই ভিত্তিতে তোমরা আমার মেহমানখানায় এসেছে এবং আমি তোমাদেরকে এর মালিক বানিয়ে দিয়েছি।” জান্নাতীরা বলবেঃ “হে আল্লাহ! এখন তাহলে আমরা আপনার কাছে আর কি চাইবো? আপনি তো আমাদেরকে এতো বেশী দিয়ে রেখেছেন যে, যদি আপনি হুকুম করেন তবে আমাদের মধ্যে একজন লোক সমস্ত মানব ও দানবকে নিমন্ত্রণ করতে পারে এবং তাদেরকে পেটপুরে পানাহার করাতে পারে ও পোশাক পরাতে পারে, এমনকি তাদের সমস্ত প্রয়োজন পুরো করতে সক্ষম হবে। এর পরেও তার অধিকারভুক্ত জিনিস একটুও হ্রাস পাবে না। আল্লাহ তাআলা বলবেনঃ “আমার কাছে অতিরিক্ত আরো রয়েছে।” অতঃপর ফেরেশতারা তাদের কাছে আল্লাহ তা’আলার নিকট হতে নতুন নতুন উপঢৌকন নিয়ে আসবেন। (ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) এ রিওয়াইয়াতটি বহু সনদে এনেছেন। কিন্তু এটা গারীব বা দুর্বল রিওয়াইয়াত। এসব ব্যাপারে আল্লাহই সবচেয়ে ভাল জানেন)।
৫৯-৬২ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা’আলা খবর দিচ্ছেন যে, সৎ লোকদেরকে অসৎ লোকদের থেকে পৃথক করে দেয়া হবে। কাফিরদেরকে বলা হবেঃ তোমরা মুমিনদের থেকে দূর হয়ে যাও। মহান আল্লাহ বলেনঃ অতঃপর আমি কাফিরদেরকে মুমিনদের হতে পৃথক করে দিবো। আল্লাহ তা’আলা অন্য জায়গায় বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “যেই দিন কিয়ামত সংঘটিত হবে সেই দিন তারা পৃথক পৃথক হয়ে যাবে।”(৩০:১৪) আর এক জায়গায় বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “(ফেরেশতাদেরকে বলা হবে) একত্রিত কর যালিম ও তাদের সহচরদেরকে এবং তাদেরকে যাদের ইবাদত করতো তারা আল্লাহর পরিবর্তে এবং তাদেরকে পরিচালিত কর জাহান্নামের পথে।”(৩৭:২২-২৩)
জান্নাতীদের উপর যেমনভাবে নানা প্রকারের দয়া-দাক্ষিণ্য করা হবে তেমনই কাফিরদের উপর নানা প্রকারের কঠোরতা করা হবে। ধমক ও শাসন গর্জনের সুরে তাদেরকে বলা হবেঃ আমি কি তোমাদেরকে নির্দেশ দিইনি যে, তোমরা শয়তানের দাসত্ব করো না, কারণ সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু? কিন্তু এতদসত্ত্বেও তোমরা পরম দয়ালু আল্লাহর অবাধ্যাচরণ করেছে এবং শয়তানের আনুগত্য করেছে। সৃষ্টিকর্তা, অধিকর্তা এবং আহার্যদাতা হলাম আমি, আর আনুগত্য করা হবে আমার দরবার হতে বিতাড়িত শয়তানের? আমি তো বলে দিয়েছিলাম যে, তোমরা শুধু আমাকেই মানবে এবং শুধুমাত্র আমারই ইবাদত করবে। আমার কাছে পৌঁছবার সঠিক, সরল ও সোজা পথ এটাই। কিন্তু তোমরা চলেছে উল্টো পথে। সুতরাং এখানেও উল্টোভাবেই থাকো। সৎ লোকদের ও তোমাদের পথ পৃথক হয়ে গেল। তারা জান্নাতী এবং তোমরা জাহান্নামী।
(আরবী) দ্বারা বহু সৃষ্টিকে বুঝানো হয়েছে। অভিধানে (আরবী) এবং (আরবী)-এই। উভয়রূপেই বলা হয়ে থাকে।
অর্থাৎ শয়তান তোমাদের বহু লোককে বিভ্রান্ত করেছে ও সঠিক পথ হতে সরিয়ে দিয়েছে। তোমাদের কি এটুকু জ্ঞান ছিল না যে, তোমরা এর ফায়সালা করতে পারতে যে, পরম দয়ালু আল্লাহকে মানবে, না শয়তানকে মানবে? সৃষ্টিকর্তার ইবাদত করবে, না সৃষ্টের উপাসনা করবে?
হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা’আলার নির্দেশক্রমে জাহান্নাম তার ঘাড় বের করবে, যা হবে অন্ধকারময়ও প্রকাশমান। সে বলবেঃ “হে আদম সন্তান! আল্লাহ তা’আলা কি তোমাদেরকে নির্দেশ দেননি যে, তোমরা শয়তানের দাসত্ব করবে না, কারণ সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু? আর শুধু তাঁরই ইবাদত করবে, এটাই সরল পথ? শয়তান তো তোমাদের বহু দলকে বিভ্রান্ত করেছিল, তবুও কি তোমরা বুঝনি? হে পাপী ও অপরাধীরা! আজ তোমরা পৃথক হয়ে যাও।” প্রত্যেকেই তখন হাঁটুর ভরে পড়ে যাবে। প্রত্যেককেই তার আমলনামার দিকে ডাকা হবে। মহান আল্লাহ বলবেনঃ “আজ তোমাদেরকে তারই প্রতিফল দেয়া হবে যা তোমরা করতে। (এটা ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বর্ণনা করেছেন)।
৬৩-৬৭ নং আয়াতের তাফসীর:
জাহান্নাম জ্বলন্ত, শিখাযুক্ত ও বিকট চীৎকার করা অবস্থায় সামনে আসবে এবং কাফিরদেরকে বলা হবেঃ “এটা ঐ জাহান্নাম আল্লাহর রাসূলগণ যার বর্ণনা দিতেন। যার থেকে তারা ভয় দেখাতেন এবং তোমরা তাদেরকে অবিশ্বাস করতে ও মিথ্যাবাদী বলতে। সুতরাং এখন তোমরা তোমাদের কুফরীর স্বাদ গ্রহণ কর। ওঠো, এর মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়।” যেমন মহিমান্বিত আল্লাহ অন্য জায়গায় বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “যেই দিন তাদেরকে জাহান্নামের আগুনের দিকে ধাক্কা দিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে এবং বলা হবেঃ এটা ঐ জাহান্নাম যাকে তোমরা অবিশ্বাস করতে। বল তো, এটা কি যাদু, না তোমরা কিছুই দেখতে পাও না?”(৫২:১৩-১৫)
কিয়ামতের দিন যখন কাফির ও মুনাফিকরা নিজেদের পাপ অস্বীকার করবে এবং ওর উপর শপথ করবে তখন আল্লাহ তা’আলা তাদের মুখ বন্ধ করে দিবেন এবং তাদের দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো সত্য সাক্ষ্য দিতে শুরু করবে।
হযরত আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ একদা আমরা নবী (সঃ)-এর নিকট ছিলাম, হঠাৎ তিনি হেসে উঠলেন, এমন কি তাঁর দাঁতের মাড়ি পর্যন্ত দেখা গেল। অতঃপর তিনি বললেনঃ “আমি কেন হাসলাম তা তোমরা জান কি?” উত্তরে আমরা বললামঃ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই (সঃ) খুব ভাল জানেন। তিনি তখন বললেনঃ কিয়ামতের দিন বান্দার তার প্রতিপালকের সাথে বিতর্কে লিপ্ত হওয়ার ব্যাপারটাই আমাকে হাসিয়েছে। সে বলবেঃ “হে আমার প্রতিপালক! আপনি কি আমাকে যুলুম হতে রক্ষা করেননি?” আল্লাহ তা’আলা উত্তর দিবেনঃ “হ্যা, অবশ্যই। বান্দা তখন বলবেঃ “তাহলে আমার বিপক্ষে কোন সাক্ষ্যদানকারীর সাক্ষ্য আমি স্বীকার করবো না। আমার দেহ শুধু আমার নিজের। বাকী সবাই আমার শত্রু।” তখন আল্লাহ তা’আলা বলবেনঃ “আচ্ছা, ঠিক আছে, তাই হবে। তুমি নিজেই তোমার সাক্ষী হবে এবং আমার সম্মানিত লিপিকর ফেরেশতারা সাক্ষী হবে।” লাগিয়ে দেয়া হবে এবং তার দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোকে বলা হবেঃ তোমরা নিজেরাই সাক্ষ্য দাও যা সে করেছে। তারা তখন স্পষ্টভাবে খুলে খুলে সত্য সত্যভাবে প্রত্যেক কাজের কথা বলে দিবে। তারপর তার মুখ খুলে দেয়া হবে। সে তখন নিজের দেহের জোড় এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোকে বলবেঃ তোমাদের জন্যে অভিশাপ! তোমরাই আমার শত্রু হয়ে গেলে? তোমাদেরকে বাঁচাবার জন্যেই তো আমি চেষ্টা করেছিলাম এবং তোমাদেরই উপকারার্থে তর্ক-বিতর্ক করছিলাম।” (এ হাদীসটি ইবনে আবি হাতিম (রঃ), ইমাম মুসলিম (রঃ) এবং ইমাম নাসাঈ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত বাহ ইবনে হাকীম (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি তাঁর পিতা হতে এবং তিনি তাঁর দাদা হতে বর্ণনা করেছেন যে, নবী (সঃ) বলেছেনঃ “নিশ্চয়ই তোমাদেরকে তোমাদের প্রতিপালকের সামনে আহ্বান করা হবে যখন তোমাদের মুখ বন্ধ থাকবে। সর্বপ্রথম উরু ও স্কন্ধকে প্রশ্ন করা হবে।” (এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন ইমাম নাসাঈ (রঃ))
কিয়ামতের একটি দীর্ঘ হাদীসে আছে যে, ততীয়বারে তাকে বলা হবেঃ “তুমি কি?” সে জবাবে বলবেঃ “আমি আপনার বান্দা। আমি আপনার উপর আপনার নবী (সঃ)-এর উপর এবং আপনার কিতাবের উপর ঈমান এনেছিলাম। রোযা, নামায, যাকাত ইত্যাদির আমি পাবন্দ ছিলাম।” আরো বহু পুণ্যের কাজের কথা সে বলতে থাকবে। ঐ সময় তাকে বলা হবেঃ “আচ্ছা, থামো। আমি সাক্ষী হাযির করছি।” সে চিন্তা করবে যে, কাকেই বা সাক্ষীরূপে পেশ করা হবে। হঠাৎ তার মুখ বন্ধ করে দেয়া হবে। অতঃপর তার উরুকে বলা হবেঃ “তুমি সাক্ষ্য দাও।” তখন উরু, অস্থি এবং গোশত কথা বলে উঠবে এবং ঐ মুনাফিকের সমস্ত কপটতা ও গোপন কথা প্রকাশ করে দিবে। এসব এজন্যেই হবে যাতে তার কোন যুক্তি পেশ করার সুযোগ না থাকে এবং শাস্তি হতে সে রক্ষা না পায়। আল্লাহ তা’আলা তার প্রতি অসন্তুষ্ট ছিলেন বলেই পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে তার হিসাব নেয়া হবে। (এ হাদীসটি ইমাম আবু দাউদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
অন্য একটি হাদীসে আছে যে, মুখের উপর মোহর লেগে যাওয়ার পর সর্বপ্রথম মানুষের বাম উরু কথা বলবে।
হযরত আবু মূসা আশআরী (রাঃ) বলেন যে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা মুমিনকে ডেকে তার সামনে তার পাপ পেশ করে বলবেনঃ “এটা কি ঠিক?” সে উত্তরে বলবেঃ “হে আমার প্রতিপালক! হ্যাঁ, অবশ্যই আমি এ কাজ করেছি।” তিনি বলেন যে, আল্লাহ তাআলা তার পাপরাশি মার্জনা করে দিবেন এবং তিনি এগুলো গোপন করে রাখবেন। তার একটি পাপও সৃষ্টজীবের কারো কাছে প্রকাশিত হবে না। অতঃপর তার পুণ্যগুলো আনয়ন করা হবে এবং সমস্ত মাখলুকের সামনে ওগুলো খোলাখুলিভাবে প্রকাশ করে দেয়া হবে। তারপর কাফির ও মুনাফিককে আহ্বান করা হবে। অতঃপর তাকে বলা হবে:“তুমি এসব কাজ করেছিলে কি?” তখন সে অস্বীকার করে বলবেঃ “হে আমার প্রতিপালক! আপনার মর্যাদার শপথ! আপনার এই ফেরেশতা এমন কিছু লিখেছেন যা আমি করিনি।” তখন ফেরেশতা বলবেনঃ “তুমি কি এটা অমুক দিন অমুক জায়গায় করনি?” সে জবাব দিবেঃ ‘না। হে আমার প্রতিপালক! আপনার ইযযতের কসম! আমি এটা করিনি।” যখন সে এ কথা বলবে তখন আল্লাহ তার মুখ বন্ধ করে দিবেন। হযরত আবু মূসা (রাঃ)-এর ধারণায়। সর্বপ্রথম তার ডান উরু তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিবে। অতঃপর তিনি … (আরবী)-এই আয়াতটি পাঠ করেন। (ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) এটা বর্ণনা করেছেন)
এরপর মহান আল্লাহ বলেনঃ আমি ইচ্ছা করলে তাদের চক্ষুগুলোকে লোপ করে দিতে পারতাম, তখন তারা পথ চলতে চাইলে কি করে দেখতে পেতো? আর যদি আমি ইচ্ছা করতাম তবে তাদেরকে তাদের নিজেদের স্থানে বিকৃত করে দিতে পারতাম। তাদের চেহারা পরিবর্তন করে দিয়ে তাদেরকে ধ্বংস করে দিতাম, তাদেরকে পাথর বানিয়ে দিতাম এবং তাদের পা ভেঙ্গে দিতাম। ফলে তখন তারা চলতে পারতো না। অর্থাৎ তারা সামনেও যেতে পারতো না এবং পিছনেও ফিরে আসতে পারতো না। বরং মূর্তির মত একই জায়গায় বসে থাকতো।
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
# শিঙ্গা সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, সূরা ত্বা-হা, ৭৮ টীকা। শিঙ্গার প্রথম ফুঁৎকার ও দ্বিতীয় ফূঁৎকারের মধ্যে কত সময়ের ব্যবধান হবে, এ ব্যাপারে আমাদের কাছে কোন তথ্য নেই। এ সময়টা শত শত ও হাজার হাজার বছর দীর্ঘ হতে পারে। হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) বর্ণিত একটি হাদীসে নবী ﷺ বলেনঃ ঈসরাফীল (আঃ) শিঙ্গায় মুখ লাগিয়ে আরশের দিকে তাকিয়ে আছেন এবং কখন ফূঁৎকার দেবার হুকুম হয় তার অপেক্ষা করছেন। শিঙ্গায় তিনবার ফুঁক দেয়া হবে। প্রথমটি হবেنفخة الفزع এটি পৃথিবী ও আকাশের সমস্ত সৃষ্টিকে হতবিহ্বল করে দেবে। দ্বিতীয়টি হবে نفخة الصعق এটি শোনার সাথে সাথেই সবাই মরে পড়ে যাবে। তারপর যখন একমাত্র ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী আল্লাহ ছাড়া আর কেউ থাকবে না তখন পৃথিবীকে সম্পূর্ণ পরিবর্তিত করে দেয়া হবে। উক্কাযের বাজারের সমতল ভূমির মতো তাকে এমনভাবে সমতল করা হবে যে, তার মধ্যে সামান্য একটু ভাঁজও কোথাও পড়ে থাকবে না। তারপর আল্লাহ তাঁর সৃষ্টিকে একটি বিকট ধমক দেবেন আর তা শুনতেই প্রত্যেক ব্যক্তিই যেখানে সে মরে পড়ে গিয়েছিল সেখানকার পরিবর্তিত জমি থেকেই উঠে দাঁড়াবে। এটিই শেষ ফুঁক বলে পরিচিত। এর নাম হবে نفخة القيام لرب العالمين কুরআন মজীদের বিভিন্ন ইশারা-ইঙ্গিত থেকে এ বিষয়বস্তুটিরই প্রতি সমর্থন পাওয়া গেছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ দেখুন তাফহীমুল কুরআন, সূরা ইবরাহীম, ৫৬ — ৫৭ ও সূরা ত্বা-হা ৮২ — ৮৩ টীকা।
# তখন তাদের এ অনুভূতিই থাকবে না যে, তারা মরে গিয়েছিল এবং দীর্ঘকাল পরে এখন আবার তাদেরকে জীবিত করে উঠানো হয়েছে। বরং তারা এ চিন্তায় মগ্ন থাকবে যে, তারা ঘুমিয়েছিল, এখন হঠাৎ কোন ভয়াবহ দুর্ঘটনার কারণে জেগে উঠেছে এবং ছুটে চলছে। (আরো বেশী ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, সূরা ত্বা-হা ৭৮ এবং ইবরাহীম, ১৮ টীকা।
# কে এ জবাব দেবে, তা এখানে স্পষ্ট করে বলা হয়নি। হতে পারে কিছুক্ষণ পরে তারা নিজেরাই বিষয়টির প্রকৃত স্বরূপ উপলব্ধি করতে পারবে এবং মনে মনে বলবে, হায়! আমাদের দুর্ভাগ্য, এ তো সে জিনিসই যার খবর আল্লাহর রসূল আমাদের দিতেন এবং আমরা তাঁকে মিথ্যুক বলতাম। আবার এও হতে পারে, মু’মিনরা তাদের বিভ্রান্তি দূর করে দেবে এবং তাদেরকে জানাবে, এটা ঘুম থেকে জেগে ওঠা নয় বরং মৃত্যুর পর দ্বিতীয় জীবন। তাছাড়া এও হতে পারে যে, কিয়ামতের সমগ্র পরিবেশ তাদেরকে এ জবাব দেবে অথবা ফেরেশতারা তাদেরকে প্রকৃত অবস্থা জানাবে।
# কাফের, মুশরিক, ফাসেক ও অপরাধীদেরকে যখন আল্লাহর সামনে হাজির করা হবে তখন আল্লাহ তাদের উদ্দেশ্যে এ ভাষণ দেবেন।
# এ বক্তব্য অনুধাবন করার জন্য প্রথমে মনে রাখতে হবে যে, সৎকর্মশীল মু’মিনদেরকে হাশরের ময়দানে আটকে রাখা হবে না বরং শুরুতেই তাদেরকে কোন প্রকার হিসেব-নিকেশ ছাড়াই অথবা সামান্য হালকা হিসেব গ্রহণ করার পর জান্নাতে পাঠিয়ে দেয়া হবে। কারণ তাদের রেকর্ড হবে পরিষ্কার। আদালত চলাকালীন সময় তাদের অপেক্ষা করার কষ্ট বরদাশত করার কোন প্রয়োজন হবে না। তাই মহান আল্লাহ হাশরের ময়দানে জবাবদিহিকারী অপরাধীদেরকে বলবেন, দেখো, যেসব সৎলোককে তোমরা দুনিয়ায় বোকা মনে করে বিদ্রূপ করতে তারা নিজেদের বুদ্ধিমত্তার কারণে আজ জান্নাতে বসে আরাম করছে এবং তোমরা যারা নিজেদেরকে অতি বুদ্ধিমান ও চালাক-চতুর মনে করতে তারা আজ দেখো কেমন এখন দাঁড়িয়ে নিজেদের অপরাধের জন্য জবাবদিহি করছো।
# দু’টি অর্থ হতে পারে। একটি হচ্ছে, সৎকর্মশীল মু’মিনদের থেকে ছাঁটাই হয়ে আলাদা হয়ে যাও। কারণ দুনিয়ায় তোমরা তাদের সম্প্রদায়, পরিবার ও গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত থাকলে থাকতে পারো, কিন্তু এখানে এখন তোমাদের সাথে তাদের কোন সম্পর্ক নেই। দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে, তোমরা নিজেদের মধ্যে আলাদা হয়ে যাও। এখন তোমাদের কোন দল ও জোট থাকতে পারে না। তোমাদের সমস্ত দল ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে। তোমাদের সকল প্রকার সম্পর্ক ও আত্মীয়তা খতম করে দেয়া হয়েছে। তোমাদের প্রত্যেক ব্যক্তিকে এখন একাকী ব্যক্তিগতভাবে নিজের কৃতকর্মের জন্য জবাবদিহি করতে হবে।
# এখানে আবার আল্লাহ “ইবাদাত”কে আনুগত্য অর্থে ব্যবহার করেছেন। ইতিপূর্বে তাফহীমুল কুরআনে আমি বিভিন্ন স্থানে এ বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছি। (দেখুন আল বাকারাহ, ১৭০ ; আন নিসা, ১৪৫ ; আল আনআম, ৮৭ ও ১০৭ ; আত তাওবা, ৩১ ; ইবরাহীম ৩২ ; আল কাহফ, ৫০ ; মারয়াম, ২৭ ; আল কাসাস, ৮৬ এবং সাবা, ৬৩ টীকা) এ প্রসঙ্গে এ আয়াতটি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ইমাম রাযী তাঁর তাফসীরে কবীরে যে চমৎকার আলোচনা করেছেন তাও প্রণিধানযোগ্য। তিনি লিখেছেন,لَا تَعْبُدُوا الشَّيْطَانَ মানে হচ্ছে لاتطيعوه (তার আনুগত্য করো না)। এর সপক্ষে যুক্তি হচ্ছে, তাকে নিছক সিজদা করাই নিষিদ্ধ নয় বরং তার আনুগত্য করা এবং তার হুকুম মেনে চলাও নিষিদ্ধ। কাজেই আনুগত্য হচ্ছে ইবাদত। এরপর ইমাম সাহেব এ প্রশ্ন করেছেন যদি ইবাদতের অর্থ হয় আনুগত্য তাহলে, أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ আয়াতে আমাদের কি রসূল ও কর্তৃত্বশীলদের ইবাদাত করার হুকুম দেয়া হয়েছে? তারপর এ প্রশ্নের জবাব তিনি এভাবে দিয়েছেনঃ “তাঁদের আনুগত্য যখন আল্লাহর হুকুমে করা হয় তখন তা আল্লাহরই ইবাদাত এবং তাঁরই আনুগত্য হবে। দেখছেন না, ফেরেশতারা আল্লাহর হুকুমে আদমকে সিজদা করলো এবং এটি আল্লাহর ছাড়া আর কারো ইবাদাত ছিল না। কর্তৃত্বশীলদের আনুগত্য একমাত্র তখনই তাদের ইবাদাত হতে পারে যখন এমন ব্যাপারে তাদের আনুগত্য করা হবে যে ব্যাপারে তাদের আনুগত্য করার হুকুম আল্লাহ দেননি।” তারপর বলেন, “তোমার সামনে যদি কোন লোক আসে এবং তোমাকে কোন জিনিসের হুকুম দেয় তাহলে দেখো তার এ হুকুম আল্লাহর হুকুমের অনুসারী কিনা। অনুসারী না হলে শয়তান সে লোকদের সহযোগী হয়েছে। যদি এ অবস্থায় তুমি তার আনুগত্য করো তাহলে তুমি তার ও তার শয়তানের ইবাদাত করলে। অনুরূপভাবে তোমার নিজের প্রবৃত্তি যদি তোমাকে কোন কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করে তাহলে এক্ষেত্রে শরীয়াতের দৃষ্টিতে সে কাজটি করার অনুমতি আছে কিনা দেখো। অনুমতি না থাকলে তোমার প্রবৃত্তি নিজেই শয়তান হয়ে গেছে অথবা শয়তান তার সহযোগী হয়েছে এ অবস্থায় যদি তুমি তার আনুগত্য করো তাহলে তুমি তার ইবাদাত করলে।” সামনের দিকে অগ্রসর হয়ে তিনি আবার বলছেন, “কিন্তু শয়তানের ইবাদাত করার বিভিন্ন পর্যায় রয়েছে। কখনো এমন হয়, মানুষ একটি কাজ করে এবং তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সাথে সাথে তার কণ্ঠও তার সহযোগী হয় এবং মনও তার সাথে অংশ গ্রহণ করে। আবার কখনো এমনও হয়, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সাহায্যে মানুষ একটি কাজ করে কিন্তু অন্তর ও কণ্ঠ সে কাজে তার সহযোগী হয় না। কেউ কেউ এমন অবস্থায় একটি গোনাহ করে, যখন তার অন্তর তাতে সায় দেয় না এবং তার কণ্ঠ সেজন্য আল্লাহর জন্য ক্ষমাপ্রার্থী হয়, এ অবস্থায় সে স্বীকার করে আমি এ খারাপ কাজ করেছি। এ হচ্ছে নিছক বাইরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সাহায্যে শয়তানের ইবাদাত। আবার এমন কিছু লোকও আছে যারা ঠাণ্ডা মাথায় অপরাধ করে এবং মুখেও নিজেদের এ কাজে আনন্দ ও সন্তোষ প্রকাশ করে। …এরা ভিতরে বাইরে উভয় পর্যায়ে শয়তানের ইবাদাতকারী।” (তাফসীরে কবীর, ৭ খণ্ড, ১০৩-১০৪ পৃষ্ঠা)
# যদি তোমরা বুদ্ধি-জ্ঞান বঞ্চিত হতে এবং তারপর নিজেদের রবকে ত্যাগ করে তোমাদের শত্রুদের ইবাদাত করতে তাহলে তোমাদের জন্য কোন ওজরের অবকাশ ছিল না। কিন্তু তোমাদের কাছে তো আল্লাহ প্রদত্ত বুদ্ধি-জ্ঞান ছিল। তার মাধ্যমে তোমরা দুনিয়ার সমস্ত কাজ-কারবার করে চলছিলে এবং আল্লাহ তোমাদের পয়গম্বরদের মাধ্যমে সতর্কও করে দিয়েছিলেন। এরপরও যখন তোমরা তোমাদের শত্রুদের প্রতারণা জালে আবদ্ধ হয়েছো এবং তারা তোমাদেরকে পথভ্রষ্ট করতে সক্ষম হয়েছে তখন নিজেদের বোকামির দায়-দায়িত্ব থেকে তোমরা কোনক্রমেই মুক্ত হতে পারো না।
# যে উদ্ধত অপরাধীরা তাদের অপরাধ মেনে নিতে অস্বীকার করবে, সাক্ষীদেরকে মিথ্যা বলবে এবং আমলনামার নির্ভুলতাও মেনে নেবে না, তাদের ব্যাপারে এ ফায়সালা দেয়া হবে। তখন আল্লাহ হুকুম দেবেন, ঠিক আছে তোমাদের বাজে কথা বন্ধ করো এবং এখন দেখো তোমাদের নিজেদের শরীরের অংগ-প্রত্যংগ তোমাদের কৃতকর্মের কি বর্ণনা দেয়। এ প্রসঙ্গে এখানে কেবলমাত্র হাত ও পায়ের সাক্ষ্যদানের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু অন্যান্য স্থানে বলা হয়েছে তাদের চোখ, কান, জিহ্বা এবং শরীরের চর্মও তাদেরকে দিয়ে যেসব কাজ করানো হয়েছে সেগুলোর পূর্ণ বিবরণ শুনিয়ে দেবেঃ
يَوْمَ تَشْهَدُ عَلَيْهِمْ أَلْسِنَتُهُمْ وَأَيْدِيهِمْ وَأَرْجُلُهُمْ بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ (النور-24) حَتَّى إِذَا مَا جَاءُوهَا شَهِدَ عَلَيْهِمْ سَمْعُهُمْ وَأَبْصَارُهُمْ وَجُلُودُهُمْ بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ (حم السجده – 20)
এখানে এ প্রশ্ন দেখা দেয় যে, একদিকে আল্লাহ বলেন, আমি এদের কণ্ঠ রুদ্ধ করে দেবো এবং অন্যদিকে সূরা নূরের আয়াতে বলেন, এদের কণ্ঠ সাক্ষ্য দেবে– এ দু’টি বক্তব্যের মধ্যে কিভাবে সামঞ্জস্য বিধান করা যাবে? এর জবাব হচ্ছে, কণ্ঠ রুদ্ধ করার অর্থ হলো, তাদের কথা বলার ক্ষমতা কেড়ে নেয়া। অর্থাৎ এরপর তারা স্বেচ্ছায়, নিজেদের মর্জি মাফিক কথা বলতে পারবে না। আর কণ্ঠের সাক্ষ্যদানের অর্থ হচ্ছে, পাপিষ্ঠ লোকেরা তাদেরকে কোন্ কোন্ কাজে লাগিয়েছিল, তাদের মাধ্যমে কেমন সব কুফরী কথা বলেছিল, কোন্ ধরনের মিথ্যা উচ্চারণ করেছিল, কত প্রকার ফিতনা সৃষ্টি করেছিল এবং কোন্ কোন্ সময় তাদের মাধ্যমে কোন্ কোন্ কথা বলেছিল সেসব বিবরণ তাদের কণ্ঠ স্বতঃস্ফূর্তভাবে দিয়ে যেতে থাকবে।
# কিয়ামতের চিত্র অঙ্কন করার পর এখন এদেরকে জানানো হচ্ছে, এ কিয়ামত তো তোমাদের কাছে দূরের জিনিস বলে মনে হচ্ছে কিন্তু একটু গভীরভাবে চিন্তা করে দেখো, এ দুনিয়ায় যে জীবনের জন্য তোমরা অহংকারে স্ফীত হচ্ছো, তোমরা কিভাবে আল্লাহর বিপুল শক্তির হাতে অসহায় হয়ে আছো! যে চোখের দৃষ্টিশক্তির কারণে তোমরা দুনিয়ার সমস্ত কাজ করে যাচ্ছো আল্লাহর একটিমাত্র ইশারায় তা অন্ধ হয়ে যেতে পারে। যে পায়ের ওপর ভর করে তোমরা এসব দৌড়াদৌড়ি ও চেষ্ঠা-তদবীর চালাচ্ছো, আল্লাহর একটিমাত্র হুকুমে অকস্মাৎ তা অবশ হয়ে যেতে পারে। আল্লাহর দেয়া এ শক্তিগুলো যতক্ষণ কাজ করতে থাকে ততক্ষণ তোমরা আত্মশক্তির বিভ্রমে মশগুল হয়ে থাকো। কিন্তু যখন এদের মধ্য থেকে কোন একটি শক্তিও বিকল হয়ে পড়ে, তখন তোমাদের শক্তির বহর বুঝতে আর তোমাদের মোটেই বেগ পেতে হয় না।
ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
*কেয়ামত দিবসের বিভীষিকাময় দৃশ্য : এখন তাদের এ অপ্রিয় প্রশ্নের জওয়াবে শুধু কেয়ামতের কিছু ভয়াবহ দৃশ্যের বর্ণনা তুলে ধরা হচ্ছে যেন তারা বুঝতে পারে সেখানে কি কঠিন অবস্থা হবে, কিন্তু ঠিক কখন আসবে সেই কঠিন মুহূর্ত তা বলা হচ্ছে না। (কারণ তাদের অন্তর প্রাণ জানে মোহাম্মদ অবশ্যই নবী এবং তার মুখনিসৃত বাণী অবশ্যই সত্য)! এ জন্যে কেয়ামতের কঠিন অবস্থাসমূহের মধ্য থেকে যেটুকু তাদের সামনে পেশ করা হচ্ছে তাতেই তাদের হৃদকম্প শুরু হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু হায়, দুনিয়ার নানাপ্রকার স্বার্থ; কখনও অর্থের স্বার্থ, কখনও নেতৃত্বের স্বার্থ, আবার কখনও বা ইন্দ্রিয় উচ্ছলতার স্বার্থ, এগুলাে এমনই বালাই যা মানুষকে বুঝেও বুঝতে দেয় না। এইভাবেই জেনে বুঝে যারা পার্থিব লাভ ও লােভকে গুরুত্ব দেয় এবং ‘নগদ যা পাও হাত পেতে নাও, বাকির খাতায় শূন্য দাও’-এর তালীম গ্রহণ করে, সাময়িক ও স্থায়ী জীবনের পার্থক্য নির্ণয় করে না, তাদের জন্যে অবশ্যই রয়েছে সে কঠোর সাজা। সে ভয়াবহ দিনের প্রতি বিশ্বাস তাদের অভ্যন্তরে রয়েছে বলেই তাদের সামনে এ ভয়াবহ অবস্থার বর্ণনা পেশ করা হচ্ছে। ‘দেখো তারা শুধুমাত্র একটি চিৎকার ধ্বনি তাদেরকে পেয়ে বসছে… আর তৎক্ষণাৎ তারা সবাই হাযির হয়ে যাবে। (মূলত এসব প্রশ্নের মাধ্যমে) এরা যে বিষয়টির জন্যে অপেক্ষা….সবাইকে (হাশরের ময়দানে) আমার সামনে এনে হাযির করা হবে।'(আয়াত ৪৯-৫৩) ‘(আজ) সত্য প্রত্যাখ্যানকারীরা জিজ্ঞেস করছে, বলাে কখন আসবে সেই ওয়াদাকৃত দিবসগুলাে যদি তােমরা সত্যবাদী হয়ে থাকো? এর জওয়াবে অত্যন্ত দ্রুততার সাথে বলা হচ্ছে, সেদিন এমন এক বিকট শব্দ উত্থিত হবে যার কারণে সকল প্রাণী বেহুশ হয়ে পড়ে যাবে এবং এ শব্দের তােড়ে সকল জীবন ও জীবন্ত প্রাণের অবসান ঘটবে। এরশাদ হচ্ছে, ‘তারা দেখতে পাবে এমন একটি প্রচন্ড শব্দ উত্থিত হচ্ছে, যা তাদের সবাইকে গ্রাস করে ফেলবে। এমন সময়ে তাদের প্রচন্ড শব্দ পাকড়াও করে বসবে যখন তারা নানা প্রকার তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত থাকবে। সুতরাং সে অবস্থায় তারা কাউকে উপদেশ দান করা বা নিজেদের পরিবারের কাছে ফিরে যাওয়ার কোনাে সুযােগ পাবে না।’ এ অবস্থা, হঠাৎ করেই তাদের পেয়ে বসবে যখন তারা জীবনের বিবিধ সমস্যা নিয়ে নানা প্রকার ঝগড়া বিবাদে লিপ্ত থাকবে। এই অবস্থায় কিছুতেই তাদের ধারণায় আসবে না যে, এমন একটা কঠিন অবস্থা তাদের ওপর আসতে পারে। এরকম কঠিন অবস্থা পূর্বাহ্নে আঁচ করতে পারলে হয়তাে তার ঝগড়া বিবাদ থেকে বিরত হতে পারতাে। ওরা সবাই যে যে অবস্থায় থাকবে সে অবস্থায়ই বেহুশ হয়ে পড়ে যাবে। সমসাময়িক কাউকে বা পরবর্তী কারও জন্যে কোনাে উপদেশ দেয়ার মতাে কোনাে ক্ষমতা বা সুযােগ কারও থাকবে না, আর নিজ নিজ পরিবারের কাছে ফিরে গিয়ে কোনাে একটি কথাও তারা বলতে পারবে না। ওরা সবাই নিজ নিজ স্থানেই শেষ হয়ে যাবে। তারপর আসবে সেই মহাভয়ংকর দিন, যেদিন পুনরায় শিংগায় ফুঁক দেয়া হবে, আর অমনি কবরের মধ্য থেকে মাটি ঝেড়ে মুছে ফেলে কবরস্থ ব্যক্তিরা বেরিয়ে আসবে এবং দ্রুতগতিতে চলতে থাকবে। ভয় ও জ্ঞানহারা অবস্থায় তারা একে অপরকে জিজ্ঞাসা করতে থাকবে। বলবে ‘কে তুললাে আমাদেরকে আমাদের কবর থেকে?” তারপর বেহুশ অবস্থা একটু কমে আসলে তারা প্রকৃত অবস্থাটা বুঝতে পারবে এবং জানতে পারবে তাদের প্রকৃত অবস্থা। তখন তারা বলে উঠবে। হাঁ, হাঁ এই অবস্থা আসবে বলেই তাে মহা দয়াময় আল্লাহ তায়ালা আমাদের সাথে ওয়াদা করেছিলেন এবং অবশ্যই রসূলরা সত্য কথা বলেছিলেন।’ এরপর আবারও একবার এক ভীষণ শব্দ উত্থিত হবে, গর্জে উঠবে একটিমাত্র প্রচণ্ড শব্দ আর অমনি হয়রানি পেরেশান হয়ে দ্রুতগতিতে সবাই দৌড়াতে থাকবে, কিন্তু সম্বিহারা ও দিশাহারা এসব অসংখ্য মানুষ বুঝতে পারবে না কোথায় যাবে, কি করবে। এর অব্যবহিত পরে তাদেরও জ্ঞান ফিরে আসবে। ‘অতপর তারা সবাই আমার (আমি সর্বশক্তিমান আল্লাহর) কাছে এসে হাযির হয়ে যাবে…’ তখন তারা সুশৃংখলার সাথে কাতারে কাতারে দাঁড়িয়ে যাবে এবং সবাই মুহূর্তকালের মধ্যে বিচারার্থে হাযির হয়ে যাবে আল্লাহ রব্বুল আলামীনের আদালতে, আর তখন মহান রব্বুল আলামীনের পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তাদের প্রত্যেক দলের দাড়ানাের জন্যে নির্দিষ্ট জায়গা নির্ধারিত হয়ে যাবে এবং তাদের সবার জন্যে ঘােষণা আসবে, ‘আজকের দিনে কারাে প্রতি কোন জুলুম করা হবে না, আর তােমরা যা কিছু করতে থেকে তারই প্রতিদান ছাড়া অন্য কিছু তােমাদের দেয়া হবে না।’ আর এই দ্রুত ফয়সালা দানের সাথে সাথে এই তৃতীয় অধ্যায়টি শেষ হয়ে যাবে এবং সেসব সন্দেহবাদী ও দ্বিধাগ্রস্ত লােকদের সেই ওয়াদা করা দিনে তাদের ন্যায্য পাওনা বুঝিয়ে দেয়া হবে।
# এরপর অন্যদিকে এগিয়ে আনা হবে মােমেনদের, তাদের হিসাব নেয়া হবে এবং অত্যন্ত দ্রুততার সাথে তাদের হিসাব নেয়ার কাজ শেষ করা হবে। ন্যায্য পাওনা হিসাবে তাদের জান্নাত দেয়া হবে। এরশাদ হচ্ছে, ‘অবশ্যই জান্নাতবাসীরা আজকের এই দিনে আনন্দের মাঝে উল্লসিত হয়ে থাকবে, তারা ও তাদের সংগী সংগিনীরা ছায়াঘেরা মহাসম্মানজনক আসনে সমাসীন থাকবে এবং আরাম কেদারায় ঠেস দিয়ে আরামে বসে থাকবে। (সেদিন) অবশ্যই জান্নাতের অধিবাসীরা মহা আনন্দে… পক্ষ থেকে তােমাদের ওপর) সালাম (বর্ষিত হােক)।'(আয়াত ৫৫-৫৮) অর্থাৎ, ওরা ব্যস্ত থাকবে নেয়ামতভরা জান্নাতের মধ্যে, আল্লাহর মহাদান ও পুরস্কার পেয়ে তারা পরম পুলকিত থাকবে। স্নিগ্ধ ছায়াঘেরা পরিবেশে উপবিষ্ট থেকে তারা মৃদুমন্দ গতিতে প্রবাহমান মধুর বাতাসের স্বাদ গ্রহণ করতে থাকবে। আর তারা ও তাদের সংগীর মহা আরামের সাথে হেলান দেয়া অবস্থায় উপবিষ্ট থাকবে সেই মহাসম্মানজনক আসনে। সেখানে তাদের জন্যে উপাদেয় ফলমূল থাকবে, সেখানে তাদের জন্যে আরও থাকবে সেসব ভােগ্য সামগ্রী যা তারা চাইতে থাকবে আর তাদের সেসব জিনিসও দেয়া হবে পাওনা হিসাবে যেসব জিনিসের জন্যে তারা দাবী জানাতে থাকবে। আর সকল কিছু স্বাদযুক্ত জিনিসের সাথে তাদের মধ্যে থাকবে জান্নাতের মালিকানা লাভের মহাসম্মান। অতপর তাদের রবের পক্ষ থেকে উচ্চারিত হতে থাকবে ‘শান্তি শাস্তি।’ ‘এইভাবে তাদের জন্যে বিশেষভাবে বর্ষণ করা হবে শান্তিবাণী’ অর্থাৎ তাদের প্রদত্ত অভ্যর্থনা জানানাের ভাষা হিসাবে ব্যবহার করা হবে ‘শান্তি শান্তি’। মহাদয়াময় আল্লাহর পক্ষ থেকে দেয়া হবে তাদের এই মধুময় অমীয় বাণী।
# অপরদিকে অন্যদের অবস্থা হবে এই যে, তাদের হিসাব নিকাশের অবস্থানটি সহজে শেষ হয়ে যাবে না; বরং তাদের প্রতি ভৎর্সনা তিরস্কার অবিরতভাবে চলতেই থাকবে। বলা হবে, ‘হে অপরাধীরা, আজ তােমরা পৃথক হয়ে যাও…'(আয়াত ৫৯-৬৪) এখানে অপরাধীদের লাঞ্চিত অপমানিত করা হয়েছে। মােমেনদের দল থেকে তাদের পৃথক হয়ে যাওয়ার জন্যে বলা হয়েছে। এই অপরাধীদের পরের আয়াতে ‘আদমের সন্তান’ বলে সম্বোধন করা হয়েছে। এটা করা হয়েছে তাদের তিরস্কার ও ভ্ৎর্সনা করার উদ্দেশে, অর্থাৎ তােমরা আদমের সন্তান হয়ে সেই শয়তানেরই আনুগত্য করছাে যে তােমাদের পিতা আদমকে চক্রান্ত করে বের করে এনেছিলাে। সে তাে তােমাদের প্রকাশ্য শত্রু। তার আনুগত্য অনুসরণ না করার জন্যে আমি তােমাদের কাছ থেকে অংগীকার নিয়েছিলাম। তারপরও তােমরা সেই অভিশপ্ত শয়তানের কথাই মেনে চলছে। আমি তােমাদের একমাত্র আমার ইবাদত বন্দেগী করতে এবং আমার নির্দেশিত সত্য পথে চলতে বলেছিলাম। কিন্তু তােমরা তা করনি এবং তােমাদের প্রধান শত্রুর ব্যাপারেও তােমরা সতর্ক হওনি। তাহলে তােমরা কি নির্বোধ। যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে তােমাদের শাস্তির বিষয়টিও জেনে নাও। তােমাদের শাস্তি হবে জাহান্নামের আগুন। ‘এই সে জাহান্নাম, যার ওয়াদা তােমাদের দেয়া হয়েছে। তােমাদের কুফরীর কারণে আজ এতে প্রবেশ করাে।'(আয়াত ৬৩-৬৪) ওদের মর্মান্তিক শাস্তির দৃশ্যের এখানেই শেষ নয়। সামনে আরও ভয়ঙ্কর ও বিস্ময়কর দৃশ্য আসছে। বলা হচ্ছে, ‘আজ আমি তাদের মুখে মােহর এঁটে দেবাে, তাদের হাত আমার সাথে কথা বলবে এবং তাদের পা তাদের কৃতকর্মের সাক্ষ্য দেবে।'(আয়াত ৬৫) সেভাবেই তাদেরকে অপদস্থ করা হবে। তাদের প্রতিটি অংগ তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে। তাদের গােটা অস্তিত্ব এক এক করে একটা থেকে আরেকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে এবং পরস্পরকে দোষারােপ করবে, অস্বীকার করবে। প্রতিটি অংগ পৃথক পৃথকভাবে নিজ প্রভুর সামনে আত্মসমর্পণ করবে এবং নিজেদের অপরাধ স্বীকার করবে। কি অদ্ভুত, কি ভয়াবহ এই দৃশ্য। এর কল্পনা করতে গিয়েই মানুষের মন আতংকিত হয়ে পড়ে। এই অভাবনীয় ও অপ্রত্যাশিত দৃশ্যের বর্ণনা উপরের আয়াতে এভাবেই শেষ হয়েছে। দৃশ্যটিতে আমরা দেখতে পাচ্ছি, অপরাধীদের মুখ বন্ধ করে রাখা হয়েছে, তাদের হাত কথা বলছে এবং তাদের পা সাক্ষ্য দিচ্ছে। অবশ্য আল্লাহ ইচ্ছা করলে তাদের সাথে অন্য ব্যবহারও করতে পারতেন, তাদের ওপর ভিন্ন ধরনের শাস্তিও প্রয়োগ করতে পারতেন। নিচের আয়াতে সে জাতীয় দুটো শাস্তির কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে, ‘আমি ইচ্ছা করলে তাদের দৃষ্টিশক্তি বিলুপ্ত করে দিতে পারতাম।'(আয়াত ৬৬-৬৭) ওপরের আয়াতে যে শাস্তির কথা বলা হয়েছে তা কেবল শান্তিই নয়; বরং তা এক ধরনের বিদ্রুপ এবং উপহাসও। সত্যকে যারা অস্বীকার করেছিলাে তাদের বিদ্রুপ করা হচ্ছে এবং যারা উপহাস করে বলতাে, ‘তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাকলে বলাে, সেই ওয়াদা করা আযাব কখন আসবে তাদের এখন উপহাস করা হচ্ছে। প্রথম দৃশ্যে আমরা অপরাধীদের দৃষ্টিশক্তি রহিত অবস্থায় দেখতে পাই। এই অবস্থায়ও তারা জান্নাতের পথ পাড়ি দেয়ার জন্যে ভিড় জমাবে, হুড়ােহুড়ি করবে, কিন্তু বার বার হোঁচট খেয়ে পড়ে যাবে, অন্ধের ন্যায় হাতড়াতে থাকবে। কারণ, তারা তাে কিছুই দেখতে পারবে না। তাদের দৃষ্টিশক্তি তাে ছিনিয়ে নেয়া হবে। দ্বিতীয় দৃশ্যে আমরা এসব অপরাধীদের নিজ নিজ জায়গায় পাথরের মূর্তির ন্যায় অনড় ও স্থবির দেখতে পাই। নড়াচড়া করার মতাে শক্তি তাদের নেই। অথচ এই কিছুক্ষণ আগেও তারা দৌড়াদৌড়ি করেছে, হুড়ােহুড়ি করেছে। দুটো দৃশ্যেই এদের খেলনা বা পুতুলের মতাে মনে হবে, তাদের এ জাতীয় অবস্থা হাসি তামাশার সৃষ্টি করবে। অথচ এরাই এককালে আল্লাহর ওয়াদা করা আযাবের বিষয় নিয়ে ঠাট্টা-মস্করায় মেতে ওঠতাে। ওপরে যে অবস্থার কথা বর্ণনা করা হয়েছে তা ঘটবে সেই চরম মুহূর্তাটিতে, যার আগমনের জন্যে ওরা অস্থির হয়ে অপেক্ষা করছিলাে, কিন্তু ওদের যদি পৃথিবীর বুকেই দীর্ঘ আয়ু দিয়ে টিকিয়ে রাখা হতাে এবং নির্ধারিত চরম মুহূর্তটি কিছু কালের জন্যে স্থগিত রাখা হতাে, তাহলে ওরা আর এক আপদের সম্মুখীন হতাে যে আপদের চেয়ে তাদের মৃত্যুই ভালাে। কারণ, এই দীর্ঘ আয়ুর কারণে ওদের চরম বার্ধক্যের বােঝা বয়ে বেড়াতে হবে এবং দৈহিক শক্তি ও বােধশক্তি হারিয়ে বসতে হবে। সে প্রসংগে বলা হচ্ছে, ‘আমি যাকে দীর্ঘ জীবন দান করি, তাকে সৃষ্টিগত পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নেই। তবুও কি তারা বুঝে না?'(আয়াত ৬৮) শৈশবের অবস্থায় ফিরিয়ে যাওয়ার নামই হচ্ছে বার্ধক্য। যদিও বৃদ্ধদের মাঝে শিশুদের সেই লাবণ্য, কোমলতা ও নিস্পাপ আচরণ থাকে না। তবুও তাদের অনেক আচরণই শিশুসুলভ হয়ে থাকে। বয়সের ভারে তাদের স্মৃতিশক্তি লােপ পায়। ফলে অনেক জানা কথাই স্মৃতি থেকে হারিয়ে যায়। দৈহিক শক্তি লােপ পেয়ে যায়। চিন্তা করার শক্তিও হারিয়ে ফেলে। ধারণ ক্ষমতাও স্তিমিত হয়ে আসে। শিশুদের যে অবস্থা হয় সেই অবস্থাই তাদেরও পেয়ে বসে। তবে পার্থক্য শুধু এতোটুকু যে, শিশুদের আধো আধো বোলও ভালো লাগে, ওদের বোকামিও মানুষের মনে আনন্দ দেয়, কিন্তু বৃদ্ধ লােকদের ছেলেমি কেউ ভালাে চোখে দেখে না, তাদের বােকামিও কেউ সহজে মেনে নিতে চায় না। হয়তো অনেকে করুণাবশত তাদের এসব আচরণ মেনে নেয়, কিন্তু অন্যরা এগুলাে নিয়ে রীতিমত হাসি ঠাট্টায় মেতে ওঠে। মৃত্যুর পরবর্তী জীবনের কঠিন শাস্তি এবং বার্ধক্যজনিত শাস্তি এই দুই ধরনের শাস্তিই কাফের মােশরেকদের জন্যে অপেক্ষা করছে, যাদের ভাগ্যে ঈমান জুটেনি, যাদের আল্লাহ তায়ালা হেদায়াতের গৌরবে ভূষিত করেননি।