(বই#১০৭৩) [*শৃঙ্খলা ও নিয়ন্ত্রণ, যেমন কাজ তেমন ফল : -] www.motaher21.net সূরা:- ৩৭:সাফফাত পারা:২৩ ১-৩৯ নং আয়াত:-

أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#১০৭৩)
[*শৃঙ্খলা ও নিয়ন্ত্রণ, যেমন কাজ তেমন ফল : -]
www.motaher21.net
সূরা:- ৩৭:সাফফাত
পারা:২৩
১-৩৯ নং আয়াত:-
সূরা:- ৩৭:১
وَ الصّٰٓفّٰتِ صَفًّا ۙ﴿۱﴾
শপথ তাদের যারা সারিবদ্ধভাবে দণ্ডায়মান ।
সূরা:- ৩৭:২
فَالزّٰجِرٰتِ زَجۡرًا ۙ﴿۲﴾
ও যারা সজোরে ধমক দিয়ে থাকে,
সূরা:- ৩৭:৩
فَالتّٰلِیٰتِ ذِکۡرًا ۙ﴿۳﴾
এবং যারা কুরআন আবৃত্তিতে রত–
সূরা:- ৩৭:৪
اِنَّ اِلٰـہَکُمۡ لَوَاحِدٌ ﴿ؕ۴﴾
তোমাদের প্রকৃত মাবুদ মাত্র একজনই ।
সূরা:- ৩৭:৫
رَبُّ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ وَ مَا بَیۡنَہُمَا وَ رَبُّ الۡمَشَارِقِ ؕ﴿۵﴾
যিনি পৃথিবী ও আকাশমণ্ডলীর এবং পৃথিবী ও আকাশের মধ্যে যা কিছু আছে তাদের সবার মালিক এবং সমস্ত উদয়স্থলের মালিক।
সূরা:- ৩৭:৬
اِنَّا زَیَّنَّا السَّمَآءَ الدُّنۡیَا بِزِیۡنَۃِۣ الۡکَوَاکِبِ ۙ﴿۶﴾
আমি তোমাদের নিকটবর্তী আকাশকে নক্ষত্ররাজি দ্বারা সুশোভিত করেছি,
সূরা:- ৩৭:৭
وَ حِفۡظًا مِّنۡ کُلِّ شَیۡطٰنٍ مَّارِدٍ ۚ﴿۷﴾
এবং প্রত্যেক বিদ্রোহী শয়তান থেকে তাকে সুরক্ষিত রেখেছি।
সূরা:- ৩৭:৮
لَا یَسَّمَّعُوۡنَ اِلَی الۡمَلَاِ الۡاَعۡلٰی وَ یُقۡذَفُوۡنَ مِنۡ کُلِّ جَانِبٍ ٭ۖ﴿۸﴾
ফলে, শয়তানরা ঊর্ধ্ব জগতের কিছু শ্রবণ করতে পারে না। ওদের ওপর সকল দিক হতে (উল্কা) নিক্ষিপ্ত হয়;
সূরা:- ৩৭:৯
دُحُوۡرًا وَّ لَہُمۡ عَذَابٌ وَّاصِبٌ ۙ﴿۹﴾
ওদেরকে বিতাড়নের জন্য। আর ওদের জন্য আছে অবিরাম শাস্তি।
সূরা:- ৩৭:১০
اِلَّا مَنۡ خَطِفَ الۡخَطۡفَۃَ فَاَتۡبَعَہٗ شِہَابٌ ثَاقِبٌ ﴿۱۰﴾
তবুও যদি তাদের কেউ তার মধ্য থেকে কিছু হাতিয়ে নিতে সক্ষম হয় তাহলে একটি জ্বলন্ত অগ্নিশিখা তার পেছনে ধাওয়া করে।
সূরা:- ৩৭:১১
فَاسۡتَفۡتِہِمۡ اَہُمۡ اَشَدُّ خَلۡقًا اَمۡ مَّنۡ خَلَقۡنَا ؕ اِنَّا خَلَقۡنٰہُمۡ مِّنۡ طِیۡنٍ لَّازِبٍ ﴿۱۱﴾
এখন এদেরকে জিজ্ঞেস করো, এদের সৃষ্টি বেশী কঠিন, না আমি যে জিনিসগুলো সৃষ্টি করে রেখেছি সেগুলোর? এদেরকে তো আমি সৃষ্টি করেছি আঠাল কাদামাটি দিয়ে।
সূরা:- ৩৭:১২
بَلۡ عَجِبۡتَ وَ یَسۡخَرُوۡنَ ﴿۪۱۲﴾
তুমি তো (আল্লাহর কুদরাতের মহিমা দেখে) অবাক হচ্ছো এবং এরা তার প্রতি করছে বিদ্রূপ।
সূরা:- ৩৭:১৩
وَ اِذَا ذُکِّرُوۡا لَا یَذۡکُرُوۡنَ ﴿۪۱۳﴾
এবং যখন তাদেরকে উপদেশ দেয়া হয়, তখন তারা তা গ্রহণ করে না।
সূরা:- ৩৭:১৪
وَ اِذَا رَاَوۡا اٰیَۃً یَّسۡتَسۡخِرُوۡنَ ﴿۪۱۴﴾
কোন নিদর্শন দেখলে উপহাস করে উড়িয়ে দেয়
সূরা:- ৩৭:১৫
وَ قَالُوۡۤا اِنۡ ہٰذَاۤ اِلَّا سِحۡرٌ مُّبِیۡنٌ ﴿ۚۖ۱۵﴾
এবং বলে, ‘এতো এক স্পষ্ট যাদু ছাড়া কিছু নয়।
সূরা:- ৩৭:১৬
ءَ اِذَا مِتۡنَا وَ کُنَّا تُرَابًا وَّ عِظَامًا ءَاِنَّا لَمَبۡعُوۡثُوۡنَ ﴿ۙ۱۶﴾
আমরা মরে গিয়ে মাটি ও হাড়ে পরিণত হলেও কি আমাদেরকে পুনরুত্থিত করা হবে?
সূরা:- ৩৭:১৭
اَوَ اٰبَآؤُنَا الۡاَوَّلُوۡنَ ﴿ؕ۱۷﴾
এবং আমাদের পিতৃপুরুষদেরকেও কি?’
সূরা:- ৩৭:১৮
قُلۡ نَعَمۡ وَ اَنۡتُمۡ دَاخِرُوۡنَ ﴿ۚ۱۸﴾
এদেরকে বলো, হ্যাঁ এবং তোমরা (আল্লাহর মোকাবিলায়) অসহায়।
সূরা:- ৩৭:১৯
فَاِنَّمَا ہِیَ زَجۡرَۃٌ وَّاحِدَۃٌ فَاِذَا ہُمۡ یَنۡظُرُوۡنَ ﴿۱۹﴾
ব্যস, একটিমাত্র বিকট ধমক হবে এবং সহসাই এরা স্বচক্ষে (সেই সবকিছু যার খবর দেয়া হচ্ছে) দেখতে থাকবে।
সূরা:- ৩৭:২০
وَ قَالُوۡا یٰوَیۡلَنَا ہٰذَا یَوۡمُ الدِّیۡنِ ﴿۲۰﴾
এবং ওরা বলবে, ‘হায় দুর্ভোগ আমাদের! এটিই তো কর্মফল দিবস।’
সূরা:- ৩৭:২১
ہٰذَا یَوۡمُ الۡفَصۡلِ الَّذِیۡ کُنۡتُمۡ بِہٖ تُکَذِّبُوۡنَ ﴿٪۲۱﴾
এটাই ফয়সালার দিন, যার প্রতি তোমরা মিথ্যা আরোপ করতে।
সূরা:- ৩৭:২২
اُحۡشُرُوا الَّذِیۡنَ ظَلَمُوۡا وَ اَزۡوَاجَہُمۡ وَ مَا کَانُوۡا یَعۡبُدُوۡنَ ﴿ۙ۲۲﴾
(হুকুম দেয়া হবে) ঘেরাও করে নিয়ে এসো সেই সব জালেমদেরকে, তাদের সাথীদেরকে এবং যাদের ইবাদত তারা করতো তাদেরকে।
সূরা:- ৩৭:২৩
مِنۡ دُوۡنِ اللّٰہِ فَاہۡدُوۡہُمۡ اِلٰی صِرَاطِ الۡجَحِیۡمِ ﴿ٙ۲۳﴾
( সব জালেমকে, তাদের সাথীদেরকে এবং) আল্লাহকে বাদ দিয়ে যেসব মাবুদদের তারা বন্দেগী করতো তাদেরকে ( সবাইকে ঘেরাও করে নিয়ে আসো ), তারপর তাদের সবাইকে জাহান্নামের পথ দেখিয়ে দাও।
সূরা:- ৩৭:২৪
وَ قِفُوۡہُمۡ اِنَّہُمۡ مَّسۡئُوۡلُوۡنَ ﴿ۙ۲۴﴾
আর এদেরকে একটু থামাও, এদেরকে কিছু জিজ্ঞেস করতে হবে।
সূরা:- ৩৭:২৫
مَا لَکُمۡ لَا تَنَاصَرُوۡنَ ﴿۲۵﴾
“তোমাদের কি হয়েছে, এখন কেন পরস্পরকে সাহায্য করো না?
সূরা:- ৩৭:২৬
بَلۡ ہُمُ الۡیَوۡمَ مُسۡتَسۡلِمُوۡنَ ﴿۲۶﴾
বস্তুতঃ সেদিন ওরা আত্মসমর্পণ করবে,
সূরা:- ৩৭:২৭
وَ اَقۡبَلَ بَعۡضُہُمۡ عَلٰی بَعۡضٍ یَّتَسَآءَلُوۡنَ ﴿۲۷﴾
এবং ওরা একে অপরের মুখোমুখি হয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করবে–
সূরা:- ৩৭:২৮
قَالُوۡۤا اِنَّکُمۡ کُنۡتُمۡ تَاۡتُوۡنَنَا عَنِ الۡیَمِیۡنِ ﴿۲۸﴾
ওরা বলবে, ‘তোমরা তো ডান দিক হতে আমাদের নিকট আসতে।’
সূরা:- ৩৭:২৯
قَالُوۡا بَلۡ لَّمۡ تَکُوۡنُوۡا مُؤۡمِنِیۡنَ ﴿ۚ۲۹﴾
তারা জবাব দেবে, “না, তোমরা নিজেরাই মু’মিন ছিলে না।
সূরা:- ৩৭:৩০
وَ مَا کَانَ لَنَا عَلَیۡکُمۡ مِّنۡ سُلۡطٰنٍ ۚ بَلۡ کُنۡتُمۡ قَوۡمًا طٰغِیۡنَ ﴿۳۰﴾
তোমাদের ওপর আমাদের কোন জোর ছিল না। বরং তোমরা নিজেরাই ছিলে বিদ্রোহী।
সূরা:- ৩৭:৩১
فَحَقَّ عَلَیۡنَا قَوۡلُ رَبِّنَاۤ ٭ۖ اِنَّا لَذَآئِقُوۡنَ ﴿۳۱﴾
শেষ পর্যন্ত আমরা আমাদের রবের এ ফরমানের হকদার হয়ে গেছি যে, আমরা আযাবের স্বাদ গ্রহণ করবো।
সূরা:- ৩৭:৩২
فَاَغۡوَیۡنٰکُمۡ اِنَّا کُنَّا غٰوِیۡنَ ﴿۳۲﴾
আমরা তোমাদেরকে বিভ্রান্ত করেছিলাম; কারণ আমরা নিজেরাই ছিলাম বিভ্রান্ত।’
সূরা:- ৩৭:৩৩
فَاِنَّہُمۡ یَوۡمَئِذٍ فِی الۡعَذَابِ مُشۡتَرِکُوۡنَ ﴿۳۳﴾
সুতরাং নিশ্চয় ওরা সকলেই সেদিন শাস্তির শরীক হবে।
সূরা:- ৩৭:৩৪
اِنَّا کَذٰلِکَ نَفۡعَلُ بِالۡمُجۡرِمِیۡنَ ﴿۳۴﴾
আমি অপরাধীদের সাথে এমনটিই করে থাকি।
সূরা:- ৩৭:৩৫
اِنَّہُمۡ کَانُوۡۤا اِذَا قِیۡلَ لَہُمۡ لَاۤ اِلٰہَ اِلَّا اللّٰہُ ۙ یَسۡتَکۡبِرُوۡنَ ﴿ۙ۳۵﴾
ওদের নিকট ‘আল্লাহ ব্যতীত কোন সত্য উপাস্য নেই’ বলা হলে ওরা অহংকারে অগ্রাহ্য করত।
সূরা:- ৩৭:৩৬
وَ یَقُوۡلُوۡنَ اَئِنَّا لَتَارِکُوۡۤا اٰلِہَتِنَا لِشَاعِرٍ مَّجۡنُوۡنٍ ﴿ؕ۳۶﴾
এবং বলত, আমরা কি এক পাগল কবির কথায় আমাদের উপাস্যদেরকে বর্জন করব?
সূরা:- ৩৭:৩৭
بَلۡ جَآءَ بِالۡحَقِّ وَ صَدَّقَ الۡمُرۡسَلِیۡنَ ﴿۳۷﴾
অথচ সে সত্য নিয়ে এসেছিল এবং রসূলদেরকে সত্য বলে মেনে নিয়েছিল।
সূরা:- ৩৭:৩৮
اِنَّکُمۡ لَذَآئِقُوا الۡعَذَابِ الۡاَلِیۡمِ ﴿ۚ۳۸﴾
তোমরা অবশ্যই মর্মন্তুদ শাস্তি আস্বাদন করবে,
সূরা:- ৩৭:৩৯
وَ مَا تُجۡزَوۡنَ اِلَّا مَا کُنۡتُمۡ تَعۡمَلُوۡنَ ﴿ۙ۳۹﴾
এবং পৃথিবীতে তোমরা যে সমস্ত কাজ করতে তারই প্রতিদান তোমাদের দেয়া হচ্ছে।

তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
নামকরণ :

الصّٰفّٰتِ শব্দটি বহুবচন, এর একবচন হল صافة অর্থ সারিবদ্ধ হয়ে থাকা। সূরায় সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে থাকা বলতে ফেরেশতাদেরকে বুঝানো হয়েছে। অত্র সূরার প্রথম আয়াত ও ১৬৫ নম্বর আয়াতে এ শব্দটি উল্লেখ রয়েছে, সেখান থেকেই উক্ত নামে সূরার নামকরণ করা হয়েছে।

এটি একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ সূরা। সূরার শুরুতে আনুগত্যশীল কয়েক শ্রেণির ফেরেশতার শপথ করে আল্লাহ তা‘আলার একত্বের কথা বলা হয়েছে, কাফির-মুশরিকরা পুনরুত্থানকে অসম্ভব মনে করে অথচ তা সত্য-সে কথা তুলে ধরা হয়েছে। জালিমদেরকে দলবদ্ধভাবে হাশর করা হবে, ভ্রান্ত পথের অনুসৃতরা অনুসারীদেরকে দোষারোপ করবে, কিন্তু তাতে কোন উপকার হবে না, বরং সবাই জাহান্নামে যাবে, জান্নাতীদের আরাম-আয়েশের কথা এবং জাহান্নাম ও তার অধিবাসীদের অবস্থা বর্ণিত হয়েছে। পৃথিবীর প্রথম রাসূল নূহ (আঃ)-এর মধ্য হতে জাতির যারা মহা প্লাবন থেকে বেঁেচ গিয়েছিল এবং যারা নিমজ্জিত হয়েছিল তাদের কথা, ইবরাহীম (আঃ)-এর মূর্তি ভাঙার ঐতিহাসিক ঘটনা এবং পুত্র ইসমাঈলকে কুরবানীর ঘটনা, মূসা (আঃ) ও ফির‘আউনের ঘটনা, ইউনুস (আঃ)-এর ঘটনাও তুলে ধরা হয়েছে। সূরার শেষের দিকে মুশরিকদের কর্তৃক ফেরেশতাদেরকে আল্লাহ তা‘আলার কন্যা বলে সাব্যস্ত করা থেকে আল্লাহ তা‘আলার পবিত্রতা ঘোষণা করা, নাবী-রাসূল ও যারা দীনের অনুসারী তাদেরকে আল্লাহ তা‘আলার সহযোগিতার আশ্বাস এবং সর্বশেষ যাদের আঙ্গিনায় আযাব চলে আসে তাদের সকাল যে খুবই ভয়াবহ হয় তা আলোচনা করা হয়েছে।

১-৫ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

ইবনু আব্বাস, ইবনু মাসউদ (রাঃ)-সহ অধিকাংশ মুফাসসিরের মতে

الصفات , الزجرات , التاليات

শব্দগুলো দ্বারা ফেরেশতাদের বুঝানো হয়েছে এবং তাদেরই তিনটি বিশেষণ উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রথম বিশেষণ হচ্ছে : (وَالصّٰـٓفّٰتِ صَفًّا) ‘শপথ! তাদের যারা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে।’ الصّٰـٓفّٰتِ শব্দটি صف থেকে উদ্ভূত। এর অর্থ কোন জনসমষ্টিকে এক সরল রেখায় সন্নিবেশিত করা (কুরতুবী)। তাই আয়াতের অর্থ হল সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়ানো ফেরেশতাগণ।

অন্যত্র আল্লাহ ফেরেশতাদের সম্পর্কে বলেন :

(وَّإِنَّا لَنَحْنُ الصَّآفُّوْنَ – وَإِنَّا لَنَحْنُ الْمُسَبِّحُوْنَ)‏

“আর আমরা তো সারিবদ্ধভাবে দন্ডায়মান। এবং আমরা তাসবীহ পাঠে নিয়োজিত আছি।” (সূরা সফফাত ৩৭ : ১৬৫-১৬৬)

ফেরেশতারা আল্লাহ তা‘আলার আনুগত্যপূর্ণ কাজে প্রাচীরের ন্যায় সারিবদ্ধ। ইবনু আব্বাস (রাঃ), হাসান বাসরী (রহঃ) প্রমুখ বলেন : ফেরেশতারা সদাসর্বদা শূন্যপথে সারিবদ্ধ হয়ে আল্লাহ তা‘আলার আদেশের অপেক্ষায় থাকে। যখনই কোন আদেশ করা হয় তখনই তা কার্যে পরিণত করে।

শৃঙ্খলা ও নিয়ন্ত্রণ :

আলোচ্য আয়াত থেকে জানা গেল যে, দীনের প্রত্যেক কাজে নিয়ম ও শৃঙ্খলা ও উত্তম রীতি-নীতির প্রতি লক্ষ্য রাখা উচিত এবং এটা আল্লাহর কাছে পছন্দনীয়। বলাবাহুল্য, আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত হোক আর তাঁর অন্য যে-কোন আদেশ পালন হোক, সারিবদ্ধ হওয়ার পরিবর্তে এলোমেলোভাবে একত্রিত হয়েও ফেরেশতারা করতে পারত। কিন্তু এহেন বিশৃঙ্খলার পরিবর্তে তাদেরকে সারিবদ্ধ হওয়ার কথা বলে উক্ত গুণটিকে উত্তম এবং প্রশংসনীয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

সালাতে সারিবদ্ধ বা কাতারবদ্ধ হওয়ার গুরুত্ব : বস্তুত অত্র আয়াতে মানবজাতিকেও ইবাদতের সময় সারিবদ্ধ হওয়ার প্রতি উৎসাহ দেয়া হয়েছে এবং জোর তাকিদ দেওয়া হয়েছে।

সাহাবী হুযাইফাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : তিনটি বিষয়ে আমাদেরকে সকল মানুষের ওপর প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। আমাদের কাতারগুলোকে করা হয়েছে ফেরেশতাদের কাতারের মতো। সমস্ত জমিনকে আমাদের জন্য মাসজিদ (সিজদা দেয়ার উপযুক্ত) করে দেয়া হয়েছে এবং এর মাটিকে আমাদের জন্য পবিত্র করে দেয়া হয়েছে যখন পানি না পাওয়া যাবে। (সহীহ মুসলিম হা. ৫২২)

জাবির ইবনু সামুরাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : “ফেরেশতারা তাদের প্রতিপালকের সামনে যেভাবে দণ্ডায়মান হয় তোমরা সালাতে সেভাবে দণ্ডায়মান হও না কেন? সাহাবীগণ বলেন : আমরা বললাম, ফেরেশতারা কিভাবে দণ্ডায়মান হয়? তিনি বললেন : তাঁরা প্রথম কাতার পরিপূর্ণ করে নেয় এবং কাতারগুলোকে মিলিয়ে নেয়।” (সহীহ মুসলিম হা. ৪৩০)

ইবনু মাসউদ (রাঃ) বলেন : রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সালাতে আমাদের কাঁধের ওপর হাত রেখে বলতেন সোজা হও, আগ পিছ থেকো না। অন্যথায় তোমাদের অন্তরে অনৈক্য সৃষ্টি হবে। (সহীহ মুসলিম হা. ৪৩২) সুতরাং সালাতে কাতার পূর্ণ করা এবং সোজা করার গুরুত্ব অপরিসীম। এটা ঐক্যের প্রতীক, ভেদাভেদ দূরীকরণের মাধ্যম এবং ভ্রাতৃত্ব সৃষ্টির উপায়।

দ্বিতীয় বিশেষণ হচ্ছে : الزّٰجِرٰتِ এটা زجر থেকে উৎপন্ন। অর্থ হাঁকিয়ে নিয়ে যাওয়া, ধমক দেয়া। এ বলে এখানে সে সকল ফেরেশতাদের বিশেষণ বর্ণনা করা হয়েছে যারা মেঘমালা হাঁকিয়ে নিয়ে যায়। অথবা যে সকল ফেরেশতারা বিভিন্ন ওয়াজ নসিহত এবং নাবীদের কাছে যে ওয়াহী করা হয় তার মাধ্যমে মাখলুককে আল্লাহ তা‘আলার অবাধ্য কাজ হতে বাধা দেয়।

তৃতীয় বিশেষণ হচ্ছে : التَّالِيَاتِ দ্বারা আল্লাহ তা‘আলার যিক্র আদায়কারী ও কালাম তেলাওয়াতকারী ফেরেশতাদেরকে বুঝানো হয়েছে। যারা সকাল সন্ধ্যায় উক্ত কাজে নিয়োজিত।

আল্লাহ তা‘আলা এ সকল আনুগত্যশীল ফেরেশতাদের শপথ করে বলছেন, তোমাদের প্রতিপালক একক, তাঁর কোন শরীক নেই। এভাবে শপথ করে আল্লাহ তা‘আলার এককত্ব বা তাওহীদের বাণী উল্লেখ করার কারণ হল মক্কার মুশরিকরা বহু মা‘বূদে বিশ্বাসী এবং একজন মা‘বূদ হওয়া অস্বীকার করত ও এতে আশ্চর্যবোধ করত।

যেমন আল্লাহ বলেন :

(أَجَعَلَ الْاٰلِهَةَ إلٰهًا وَّاحِدًا ﺊ إِنَّ هٰذَا لَشَيْءٌ عُجَابٌ)‏

“সে কি বহু উপাস্যের স্থানে একজন মাত্র উপাস্য সাব্যস্ত করে দিয়েছে? বস্তুত এটা এক আশ্চর্য ব্যাপার।” (সূরা সোয়াদ ৩৮ : ৫)

আল্লাহর এককত্বের প্রমাণস্বরূপ পরের আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন : “তিনি আসমান ও জমিন এবং উভয়ের মাঝে অবস্থিত সব কিছুর প্রতিপালক এবং তিনি সকল উদয় স্থলের প্রতিপালক।” সুতরাং মা‘বূদ একজন, আর তিনি হলেন আল্লাহ।

অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(وَإِلٰهُكُمْ إِلٰهٌ وَّاحِدٌ ج لَآ إِلٰهَ إِلَّا هُوَ الرَّحْمٰنُ الرَّحِيْمُ)‏

“আর তোমাদের মা‘বূদ একমাত্র আল্লাহ। তিনি ব্যতীত অন্য কোন সত্য মা‘বূদ নেই। তিনি করুণাময়, অতি দয়ালু।” (সূরা বাকারাহ ২ : ১৬৩)

অতএব যারা আল্লাহ তা‘আলার সাথে অন্যান্য দেব-দেবীর পূজা করে সেসব দেব-দেবী প্রকৃত মা‘বূদ নয়, তারা ইবাদত পাওয়ার হকদার নয়। ইবাদত পাওয়ার প্রকৃত হকদার হলেন তিনি যিনি আকাশ ও জমিনসহ সব কিছু সৃষ্টি করেছেন, তিনিই হচ্ছেন আল্লাহ তা‘আলা। তাই আমরা তাঁর ইবাদত করব, অন্য কারো নয়।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. ফেরেশতারা যেভাবে কাতারবদ্ধ হয়ে মিলিয়ে দাঁড়ায় অনুরূপ মানুষেরও উচিত সালাতে একজন অপরজনের সাথে মিলে দাঁড়ানো, মাঝখানে কোন ফাঁকা না রাখা।
২. সকল কিছুর প্রতিপালক একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা, তিনি একক, তাঁর কোন শরীক নেই।
৩. ফেরেশতারা যেভাবে সুন্দর করে দায়িত্ব পালন করে মানুষেরও উচিত অনুরূপ সুন্দরভাবে আল্লাহ তা‘আলার দেয়া দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করা।
৪. সকল ইবাদতের হকদার একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা, যেহেতু তিনিই সকল কিছুর স্রষ্টা।
৬-১০ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

উক্ত আয়াতে তারকা সৃষ্টির লক্ষ্য-উদ্দেশ্য এবং শয়তান ঊর্ধ্বাকাশে কোন কথা শ্রবণ করতে গেলে যে পরিস্থিতির মুখোমুখি হয় সে সম্পর্কে বলা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা তারকার সৌন্দর্য দ্বারা দুনিয়ার আকাশকে সুশোভিত করেছেন। আল্লাহ তা‘আলার বাণী :

(وَلَقَدْ زَيَّنَّا السَّمَا۬ءَ الدُّنْيَا بِمَصَابِيْحَ وَجَعَلْنٰهَا رُجُوْمًا لِّلشَّيٰطِيْنِ وَأَعْتَدْنَا لَهُمْ عَذَابَ السَّعِيْرِ)

“আমি নিকটবর্তী আকাশকে সুশোভিত করেছি প্রদীপমালা (তারকারাজী) দ্বারা আর ওগুলো শয়তানদেরকে প্রহার করার উপকরণ করেছি এবং তাদের জন্য প্রস্তুত রেখেছি জাহান্নামের আযাব।” (সূরা মুল্ক ৬৭ : ৫)

এখানে কেবল এতটুকুই বলা উদ্দেশ্য নয় যে, এই তারকাশোভিত আকাশ দেখতে সুন্দর লাগবে এবং দৃষ্টিনন্দন পরিবেশ সৃষ্টি হবে ইত্যাদি। বরং উদ্দেশ্য হল- তারকাশোভিত আকাশ সাক্ষ্য দেয় যে, এগুলো আপনা-আপনি অস্তিত্ব লাভ করেনি। এগুলো একজন স্রষ্টা সৃষ্টি করেছেন। যে সত্তা এসব বস্তুকে অস্তিত্ব দান করেছেন তাঁর কোন শরীক বা অংশীদারের প্রয়োজন নেই। এ ছাড়া মুশরিকদের কাছেও এ কথা স্বীকৃত যে, সমগ্র সৌরজগতের স্রষ্টাই আল্লাহ তা‘আলা। অতএব আল্লাহ তা‘আলাকে স্রষ্টা ও মালিক জেনেও অন্যের ইবাদত করা সত্যি সত্যি মহা অবিচার ও জুলুম।

(وَحِفْظًا مِّنْ كُلِّ شَيْطَانٍ مَّارِدٍ)

অর্থাৎ আকাশে কোন কথা বা ফায়সালা হলে শয়তান যেন তা শুনে নিতে না পারে সে জন্য এ তারকাগুলোকে বিতাড়িত শয়তানের জন্য ক্ষেপণাস্ত্রস্বরূপ বানিয়ে আকাশকে সংরক্ষণ করা হয়েছে। ফলে শয়তানরা ঊর্ধ্ব জগতের কোন কথাই চুরি করে শুনতে পারে না।

যখন তারা সেখানে কান পেতে শুনতে যায় তখনই তাদেরকে আগুনের উল্কাপিণ্ড নিক্ষেপ করে আঘাত করা হয়। যেমন সূরা জিনের শানে নুযূলে বলা হবে- ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন : রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একদল সাহাবীকে নিয়ে উকায বাজারের দিকে রওনা হলেন। এ সময়ই জিনদের আসমানী খবরাদি শোনার ব্যাপারে বাধা দেয়া হয়েছে এবং ছুঁড়ে মারা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে লেলিহান অগ্নিশিখা। ফলে জিন শয়তানরা ফিরে আসলে অন্য জিনরা তাদেরকে বলল : তোমাদের কী হয়েছে? তারা বলল : আসমানী খবরাদি সংগ্রহ করার ক্ষেত্রে আমাদের ওপর বাধা দেওয়া হয়েছে এবং আমাদের প্রতি লেলিহান অগ্নিশিখা ছুঁড়ে মারা হয়েছে। তখন শয়তান বলল : আসমানী খবরাদি সংগ্রহের ব্যাপারে তোমাদের প্রতি যে বাধা সৃষ্টি হয়েছে তা অবশ্যই নতুন কোন ঘটনা ঘটার কারণে হয়েছে। উল্কাপিন্ড বা অগ্নিশিখা সম্পর্কে প্রাচীন গ্রীক দার্শনিকদের মত হল- তা ভূ-ভাগে উৎপন্ন এক প্রকার উপাদান, যা বাষ্পের সাথে ওপরে উত্থিত হয় এবং অগ্নিমণ্ডলের নিকটে পৌঁছে বিস্ফোরিত হয়। কিন্তু কুরআনের বাহ্যিক ভাষা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, উল্কাপিণ্ড ভূ-ভাগে উৎপন্ন কোন উপাদান নয়, বরং তা ঊর্ধ্বজগতেই উৎপন্ন হয়। উল্কাপিন্ড সম্পর্কে প্রাচীন গ্রীকদের ধারণা নিছক অনুমান ও আন্দাজের ওপর নির্ভরশীল। আধুনিক বিজ্ঞান বলে : উল্কাপিণ্ড অসংখ্য তারকারাজিরই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশ যা সাধারণতঃ বড় আকারের হয়ে থাকে। এগুলো মহাশূন্যে অবস্থান করে এবং ৩৩ বছরে একবার সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে। এগুলোর সমষ্টিকেই উল্কা (ংযড়ড়ঃরহম ংঃধৎ) বলা হয়। পৃথিবীর নিকটবর্তী হলে এরা পৃথিবীর মধ্যাকর্ষণ দ্বারাও আকৃষ্ট হয়। তখন প্রচণ্ড বেগে এ উল্কা ভূ-পৃষ্ঠের দিকে ছুটে আসে। বায়ূমন্ডলের নিম্নস্তরে ৬০ মাইল দূরত্বে পৌঁছলে তা বাতাসের ঘর্ষণে প্রজ্জ্বলিত ও ভষ্মীভূত হয়। ঊর্ধ্বাকাশে পরিলক্ষিত অধিকাংশ উল্কাই বায়ুমণ্ডলে জ্বলে নিঃশেষ হয়ে যায়। ইংরেজিতে এগুলোকে (গবঃবড়ৎড়ফ) বলা হয়।

আগস্টের ১০ তারিখ এবং নভেম্বরের ২৭ তারিখে এগুলো অধিক পরিলক্ষিত হয় এবং ২০ শে এপ্রিল, ২৮ শে নভেম্বর, ১৮ ই অক্টোবর ও ৬, ৯, ও ১৩ ই ডিসেম্বর রাতে হ্রাস পায়। (আল জাওয়াজাহির)

সুতরাং বুঝা গেল, উল্কাপিন্ড ভূ-ভাগে সৃষ্ট নয়, বরং ঊর্ধ্বাকাশেই উৎপন্ন হয়। এসব উল্কাপিন্ড সৃষ্টির অনেক রহস্য রয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হল দুনিয়ার আকাশকে সুশোভিত করা, আল্লাহ তা‘আলার এককত্বের প্রমাণ বহন ও শয়তানের বিরুদ্ধে ক্ষেপণাস্ত্রস্বরূপ।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. পৃথিবীর আকাশকে তারকা দ্বারা সুশোভিত করা হয়েছে।
২. তারকারাজি সৃষ্টির উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবগত হলাম।
৩. কোন শয়তান আসমানী খবর চুরি করে আনতে সক্ষম হয় না, কখনো একটি চুরি করতে পারলে তার সাথে শতটা মিথ্যা সংমিশ্রণ করে।
৪. উল্কাপিন্ড সম্পর্কে কুরআনের তথ্য অবগত হলাম।
১১-২৬ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

এখানে আল্লাহ তা‘আলা ঐ সকল কাফির-মুশরিকদের কথা বর্ণনা করছেন যারা কিয়ামত ও পুনরুত্থান দিবসকে বিশ্বাস করে না, আল্লাহ তা‘আলার কোন নিদর্শন দেখলে হাসি-তামাশা ছলে বর্জন করে এবং সাথে সাথে মানুষের সৃষ্টিতত্ত্ব সম্পর্কেও। আল্লাহ তা‘আলা এখানে পুনরুত্থানের দুটি দলীল পেশ করেছেন।

(১) (فَاسْتَفْتِهِمْ أَهُمْ أَشَدُّ خَلْقًا أَمْ مَّنْ خَلَقْنَا)

অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা মানুষ ব্যতীত অন্যান্য যে-সকল মাখলুকাত সৃষ্টি করেছেন যেমন আকাশ, জমিন, পাহাড়, সমুদ্র, চন্দ্র-সূর্য ও ফেরেশতা ইত্যাদি। এসব বিশাল বিশাল সৃষ্টি পুনরায় সৃষ্টি করা কঠিন, নাকি মানুষকে সৃষ্টি করা কঠিন? প্রশ্নের কোন উত্তর নেই, কেবল একটি কথা ছাড়া যে, আল্লাহ তা‘আলা বিশাল বিশাল মাখলুক সৃষ্টিতে সক্ষম হলে তিনি মানুষকেও সৃষ্টি করতে সক্ষম, তাতে কোন সন্দেহ নেই। অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(أَوَلَمْ يَرَوْا أَنَّ اللّٰهَ الَّذِيْ خَلَقَ السَّمٰوٰتِ وَالْأَرْضَ وَلَمْ يَعْيَ بِخَلْقِهِنَّ بِقَادِرٍ عَلٰٓي أَنْ يُّحْيِيَ الْمَوْتٰي ط بَلٰٓي إِنَّه۫ عَلٰي كُلِّ شَيْءٍ قَدِيْرٌ)‏

“তারা কি এটুকুও বোঝে না, যে আল্লাহ জমিন ও আসমান সৃষ্টি করলেন এবং এগুলো সৃষ্টি করতে তিনি ক্লান্ত হননি, সেই আল্লাহ মৃতকে অবশ্যই জীবিত করার ক্ষমতা রাখেন। কেন নয়? নিশ্চয়ই তিনি সব কিছুর ওপর শক্তিশালী।” (সূরা আহকাফ ৪৬ : ৩৩)

(২) (إِنَّا خَلَقْنٰهُمْ مِّنْ طِيْنٍ لَّازِبٍ)

এ কথার এক অর্থ এই যে, তাদের আদি পিতা আদম (আঃ)-কে মাটি দ্বারা সৃষ্টি করা হয়েছিল। দ্বিতীয় অর্থ প্রত্যেক মানুষই মাটি দ্বারা সৃষ্টি। কারণ, প্রত্যেকের সৃষ্টির মূল উপাদান হল মাটি। যে আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে মাটি থেকে সৃষ্টি করতে পারলেন তিনি পুনরায় তাদের সৃষ্টি করতে সক্ষম। কারণ অন্যান্য বস্তু অপেক্ষা মানুষের সৃষ্টি অধিকতর সহজ। তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে আঠাল মৃত্তিকা হতে। এ সৃষ্টি সম্পর্কে পূর্বে সূরা হাজ্জ-এর ৫ নম্বর আয়াতসহ একাধিক স্থানে আলোচনা করা হয়েছে।

এরপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন, যারা উপদেশ গ্রহণ করে না, যারা আল্লাহ তা‘আলার বিধানের সাথে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে এবং পুনরুত্থান দিবসকে অস্বীকার করে তাদেরকে কিয়ামতের মাঠে লাঞ্চিত অবস্থায় পুনরুত্থিত করা হবে। আল্লাহ তা‘আলার বাণী :

(وَأَلْقَوْا إِلَي اللّٰهِ يَوْمَئِذِ نِالسَّلَمَ وَضَلَّ عَنْهُمْ مَّا كَانُوْا يَفْتَرُوْنَ)‏

“সেদিন তারা আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণ করবে এবং তারা যে মিথ্যা উদ্ভাবন করত তা তাদের থেকে উধাও হয়ে যাবে।” (সূরা নাহ্ল ১৬ : ৮৭)

زَجْرَةٌ অর্থ ধমক দেয়া, এখানে ফুঁৎকার বা বিকট আওয়াজকে বুঝানো হয়েছে। কারণ এর উদ্দেশ্য হল কাফিরদের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করা এবং তাদেরকে ধমক দেয়া। অর্থাৎ পুনরুত্থানকে অস্বীকারকারী কাফির-মুশরিকরা যখন কিয়ামতের ভয়াবহ অবস্থা দেখবে এবং কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখী হবে তখন তারা আফসোস করে বলবে : এটাই হচ্ছে কর্মফল দিবস। তাদের আফসোস বৃদ্ধি ও তিরস্কার করে বলা হবে : ‘এটাই সেই ফায়সালার দিন, যাকে তোমরা অস্বীকার করতে।’

কিয়ামতের দিন ফেরেশতাদেরকে নির্দেশ দেয়া হবে- যারা জালিম তথা কাফির তাদেরকে এবং তাদের সাথী ও তারা আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত যাদের ইবাদত করত তাদের সবাইকে জাহান্নামের পথে পরিচালিত কর। وَأَزْوَاجَهُمْ বা তাদের সাথী বলতে : অধিকাংশ বিদ্বানদের মতে- তাদের মত ও তাদের সদৃশ।

সুতরাং যারা মূর্তিপূজা করে অনুরূপ মূর্তিপূজকদেরকে একত্রে জাহান্নামে নিয়ে যাওয়া হবে, চোর চোরের সাথে জাহান্নামে যাবে, ব্যভিচার ব্যভিচারীর সাথে জাহান্নামে যাবে, এভাবে একই ধরণের অপরাধীরা সহচর হয়ে জাহান্নামে যাবে।

(وَمَا كَانُوْا يَعْبُدُوْنَ)

(যাদের) শব্দটি ব্যাপকার্থে ব্যবহার করে সকল উপাস্যকে বুঝানো হয়েছে। সে উপাস্য মূর্তি হোক বা নিজের ইবাদতের দিকে আহ্বানকারী আল্লাহ তা‘আলার কোন নেক বান্দা, সকলকে লজ্জিত করার জন্য একত্রিত করা হবে। নেক বান্দাদের তো আল্লাহ তা‘আলা জাহান্নাম থেকে দূরে রাখবেন, তবে অন্য উপাস্যগুলোকে তাদের সাথেই জাহান্নামে নিয়ে যাওয়া হবে। পথিমধ্যে ফেরেশতাদেরকে বলা হবে তাদেরকে থামাও! তাদেরকে জিজ্ঞাসা করি। আল্লাহ তা‘আলা জিজ্ঞাসা করে বলবেন : তোমাদের কী হল যে, পরস্পর সাহায্য করছ না? তাদের কোন জবাব থাকবে না, বরং সবাই আত্মসমর্পণ করবে।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. মানুষকে আঁঠাল মাঠি থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে।
২. কিয়ামতের মাঠে কেউ কাউকে কোন প্রকার সাহায্য করতে পারবে না।
৩. যারা এক আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া অন্যদের ইবাদত করে তাদের সকলকে একত্রে জাহান্নামে দেয়া হবে যাতে তারা এ কথা জেনে নিতে পারে যে, আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া অন্যান্য উপাস্যরা কোন উপকার করতে পারে না।

২৭-৩৯ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

যারা দুনিয়াতে আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্যকে অনুসরণ করত এবং যাদেরকে অনুসরণ করত তারা পরস্পর তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত হবে এবং একে অপরকে দোষারোপ করবে- সে সম্পর্কে এখানে আলোচনা করা হয়েছে।

(قَالُوْآ إِنَّكُمْ كُنْتُمْ تَأْتُوْنَنَا عَنِ الْيَمِيْنِ)

এ বাক্যে الْيَمِيْنِ শব্দের একাধিক অর্থ হতে পারে। এক অর্থ শক্তি ও বল। অর্থাৎ তোমরা বেশ প্রবলভাবে আমাদের নিকট আসতে এবং বল প্রয়োগের মাধ্যমে আমাদেরকে পথভ্রষ্ট করতে। দ্বিতীয় অর্থ হল- শপথ। তাই কেউ কেউ বলেছেন- তোমরা আমাদের নিকট শপথ করে বলতে, আমাদের ধর্মই সঠিক। অন্য আরো একটি অর্থ হল ডান, এখানে বাম দিকের কথাটিও উহ্য রয়েছে। অর্থাৎ তোমরা আমাদেরকে পথভ্রষ্ট করার জন্য ডান-বাম চতুর্দিক থেকে আসতে। যেমন শয়তান বলেছিল-

(ثُمَّ لَاٰتِيَنَّهُمْ مِّنْۭ بَيْنِ أَيْدِيْهِمْ وَمِنْ خَلْفِهِمْ وَعَنْ أَيْمَانِهِمْ وَعَنْ شَمَآئِلِهِمْ ط وَلَا تَجِدُ أَكْثَرَهُمْ شٰكِرِيْنَ)‏

‘‘অতঃপর আমি তাদের নিকট আসবই তাদের সম্মুখ, পশ্চাৎ , ডান ও বাম দিক হতে এবং তুমি তাদের অধিকাংশকে কৃতজ্ঞ পাবে না।’’ (সূরা আ‘রাফ ৭ : ১৭)

এভাবে দুর্বল লোকেরা নিজেদের ওজর আপত্তি পেশ করলে সবল লোকেরা বলবে- আরে! আমাদের দোষ দিচ্ছো কেন? তোমাদের ওপর আমাদের তো কোন ক্ষমতাই ছিল না, তোমরাই সীমালংঘন করেছিলে, তোমরা ঈমান আননি, আর এখন আমাদের দোষ দিচ্ছো? তারা হাশরের ময়দানে এবং জাহান্নামে যাওয়ার পরে এরূপ কথা কাটাকাটি করবে।

অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(وَإِذْ يَتَحَا۬جُّوْنَ فِي النَّارِ فَيَقُوْلُ الضُّعَفٰ۬ؤُا لِلَّذِيْنَ اسْتَكْبَرُوْآ إِنَّا كُنَّا لَكُمْ تَبَعًا فَهَلْ أَنْتُمْ مُّغْنُوْنَ عَنَّا نَصِيْبًا مِّنَ النَّارِ -‏ قَالَ الَّذِيْنَ اسْتَكْبَرُوْا إِنَّا كُلٌّ فِيْهَآ إِنَّ اللّٰهَ قَدْ حَكَمَ بَيْنَ الْعِبَادِ)

“যখন তারা জাহান্নামে পরস্পর ঝগড়ায় লিপ্ত হবে তখন দুর্বলেরা অহংকারীদেরকে বলবে : আমরা তো তোমাদেরই অনুসারী ছিলাম, এখন কি তোমরা আমাদের হতে জাহান্নামের আগুনের কোন অংশ নিবারণ করতে পারবে? দাম্ভিকেরা বলবে : আমরা সবাই তো জাহান্নামে আছি; নিশ্চয়ই আল্লাহ বান্দাদের ফায়সালা করে ফেলেছেন।” (সূরা মু’মিন ৪০ : ৪৭-৪৮)

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন :

(قَالَ الَّذِيْنَ حَقَّ عَلَيْهِمُ الْقَوْلُ رَبَّنَا هٰ۬ؤُلَا۬ءِ الَّذِيْنَ أَغْوَيْنَا ج أَغْوَيْنٰهُمْ كَمَا غَوَيْنَا ج تَبَرَّأْنَآ إِلَيْكَ ز مَا كَانُوْآ إِيَّانَا يَعْبُدُوْنَ)

“যাদের জন্য শাস্তি অবধারিত হয়েছে তারা বলবে : হে আমাদের প্রতিপালক এদেরকেই আমরা বিভ্রান্ত করেছিলাম; এদেরকে বিভ্রান্ত করেছিলাম যেমন আমরাও বিভ্রান্ত হয়েছিলাম; আপনার সমীপে আমরা দায়িত্ব হতে সম্পর্কহীনতা ঘোষণা করছি। এরা আমাদের ‘ইবাদত করত না।’’ (সূরা ক্বাসাস ২৮ : ৬৩) এ ছাড়াও সূরা সাবার ৩১-৩২, সূরা আহযাবের ৬৭-৬৮ নম্বর আয়াতে এ সম্পর্কে আলোচনা রয়েছে।

(فَأَغْوَيْنٰكُمْ إِنَّا كُنَّا غَاوِيْنَ)

অর্থাৎ তারা পূর্বে যে কথা অস্বীকার করে বলেছিল, তোমাদের ওপর আমাদের এমন কী জোর ছিল যে, তোমাদেরকে পথভ্রষ্ট করেছিলাম। পরবর্তীতে তা-ই স্বীকার করবে এই বলে যে- হ্যাঁ, সত্যই আমরা তোমাদেরকে পথভ্রষ্ট করেছিলাম। কিন্তু এ স্বীকারোক্তি এ সতর্কবাণীর সাথে হবে যে, এর জন্য আমাদেরকে দায়ী বা দোষী করবে না। কারণ আমরা নিজেরাই পথভ্রষ্ট ছিলাম, আমরা এর জন্য তোমাদেরকেও আমাদের মতই বানাতে চেয়েছিলাম এবং তোমরা সহজেই আমাদের পথ অবলম্বন করেছিলে। যেমন শয়তানও সেদিন বলবে : “যখন বিচার কার্য সম্পন্ন হবে তখন শয়তান বলবে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সত্য প্রতিশ্রুতি, আমিও তোমাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, কিন্তু আমি তোমাদেরকে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছি। তোমাদের ওপর আমার তো কোন আধিপত্য ছিল না, আমি কেবল তোমাদেরকে আহ্বান করেছিলাম এবং তোমরা আমার আহ্বানে সাড়া দিয়েছিলে। সুতরাং তোমরা আমার প্রতি দোষারোপ কর না, তোমরা নিজেদেরই প্রতি দোষারোপ কর‎। আমি তোমাদের উদ্ধারে সাহায্য করতে সক্ষম নই এবং তোমরাও আমাকে উদ্ধারে সাহায্য করতে সক্ষম নও। তোমরা যে পূর্বে আমাকে আল্লাহর শরীক করেছিলে আমি তা অস্বীকার করছি, নিশ্চয়ই‎ জালিমদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি‎।” (সূরা ইবরাহীম ১৪ : ২২) কিন্তু সেখানে তাদের এসকল ওযর-আপত্তি কোনই কাজে আসবে না। তাদের সকলকেই জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।

আল্লাহ তা‘আলার বাণী :

(وَلَنْ يَّنْفَعَكُمُ الْيَوْمَ إِذْ ظَّلَمْتُمْ أَنَّكُمْ فِي الْعَذَابِ مُشْتَرِكُوْنَ)

“আর আজ তোমাদের (এ অনুুতাপ) অবশ্যই কোন উপকারে আসবে না, যেহেতু তোমরা জুলুম করেছিলে। নিশ্চয়ই তোমরা তো সবাই শাস্তিতে শরীক।” (সূরা যুখরুফ ৪৩ : ৩৯)

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন : “আল্লাহ বলবেন, ‘তোমাদের পূর্বে যে জিন ও মানবদল গত হয়েছে তাদের সাথে তোমরা জাহান্নামে প্রবেশ কর’। যখনই কোন দল তাতে প্রবেশ করবে তখনই অপর দলকে তারা অভিসম্পাত করবে, এমনকি যখন সকলে তাতে একত্রিত হবে তখন তাদের পরবর্তীগণ পূর্ববর্তীদের সম্পর্কে বলবে, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! এরাই আমাদেরকে পথভ্রষ্ট করেছিল; সুতরাং এদেরকে দ্বিগুণ আগুনের শাস্তি দাও। ‘আল্লাহ বলবেন, ‘প্রত্যেকের জন্যই দ্বিগুণ রয়েছে, কিন্তু তোমরা জান না।’’ (সূরা আ‘রাফ ৭ : ৩৮)

এ সম্পর্কে সূরা আহ্যাবের ৬৭-৬৮ নম্বর, সূরা সাবা-’র ৩১-৩৩ নম্বর আয়াতে আরো আলোচনা গত হয়েছে।

এরপর আল্লাহ তা‘আলা তাদের এ সকল শাস্তির আরো কারণ বর্ণনা করে বলেন, তারা যে শুধু র্শিক করত তা নয় বরং তারা আল্লাহ তা‘আলার বিধানের ব্যাপারে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করত, অহংকার করত এবং এ কথাও বলত যে, আমরা কি একজন কবির কথায় আমাদের মা‘বূদদেরকে পরিত্যাগ করব? সুতরাং তা কখনো হতে পারে না। যার ফলে তাদের ওপর আল্লাহ তা‘আলার উক্ত শাস্তি বাস্তবায়িত হয়েছে।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. কিয়ামতের মাঠে অপরাধীরা একে অন্যকে দোষারোপ করবে কিন্তু তাতে কোনই ফায়দা হবে না।
২. রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কবি ছিলেন না, বরং তিনি ছিলেন সত্যসহ প্রেরিত আল্লাহ তা‘আলার রাসূল।
৩. গর্ব-অহংকার পরিত্যাগ করতে হবে, কেননা গর্ব-অহংকার মানুষকে সত্য হতে বিমুখ করে।

তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ “রাসূলুল্লাহ (সঃ) আমাদেরকে হালকাভাবে নামায পড়ার নির্দেশ দিতেন এবং তিনি সূরায়ে সাফফাত পড়ে আমাদের ইমামতি করতেন।” (এ হাদীসটি ইমাম নাসাঈ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

১-৫ নং আয়াতের তাফসীর:

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেন যে, এই তিন শপথের দ্বারা ফেরেশতাদেরকে বুঝানো হয়েছে। অন্যান্য গুরুজনদেরও এটাই উক্তি। হযরত কাতাদা (রঃ) বলেন যে, ফেরেশতাদের সারি আকাশের উপরে রয়েছে।

হযরত হুযাইফা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “সমস্ত মানুষের উপর তিনটি বিষয়ে আমাদেরকে মর্যাদা দান করা হয়েছে। আমাদের সারিকে ফেরেশতাদের সারির মত করা হয়েছে, সমগ্র যমীনকে আমাদের জন্যে মসজিদ বানানো হয়েছে এবং পানি না পাওয়া অবস্থায় মাটিকে আমাদের জন্যে অযুর স্থলাভিষিক্ত করা হয়েছে।” (এ হাদীসটি ইমাম মুসলিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

হযরত জাবির ইবনে সামুরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “ফেরেশতারা তাঁদের প্রতিপালকের সামনে যেভাবে সারিবদ্ধ হয়ে দণ্ডায়মান হন সেই ভাবে তোমরা সারিবদ্ধ হওনা কেন?” সাহাবীগণ (রাঃ) আর করলেনঃ “ফেরেশতারা কিভাবে তাদের প্রতিপালকের সামনে কাতারবন্দী হন?” রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) উত্তরে বলেনঃ “তারা প্রথম সারিকে পূরণ করে নেন এবং অন্যান্য সারিগুলোকেও সম্পূর্ণভাবে মিলিয়ে নেন। (ইমাম মুসলিম (রঃ), ইমাম আবু দাঊদ (রঃ), ইমাম নাসাঈ (রঃ) এবং ইমাম ইবনে মাজাহ (রঃ) এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন)

(আরবী) (যারা কঠোর পরিচালক) এ আয়াতের তাফসীরে সুদ্দী (রঃ) প্রমুখ গুরুজন মেঘ-বৃষ্টিকে একদিক থেকে অন্যদিকে ধমক দিয়ে পরিচালনকারী ফেরেশতার দল অর্থে এটা ব্যবহৃত হয়েছে বলে মত প্রকাশ করেছেন। রাবী ইবনে আনাস (রঃ) প্রমুখ গুরুজন বলেন যে, উক্ত আয়াতের ভাবার্থ হচ্ছেঃ কুরআন কারীম যে জিনিস হতে বাধা প্রদান করেছে তা থেকে তারা এক পদও অগ্রসর হন না।

(আরবী) (যারা যিকর আবৃত্তিতে রত), সুদ্দী (রঃ)-এর মতে এঁরা হলেন ঐ ফেরেশতা যারা আল্লাহ্ পয়গাম বান্দাদের নিকট আনয়ন করে থাকেন। যেমন মহান আল্লাহ্ বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “এবং (শপথ তাদের) যারা মানুষের হৃদয়ে পৌছিয়ে দেয় উপদেশঅনুশোচনা স্বরূপ বা সতর্কতা স্বরূপ।”

এই শপথসমূহের পর এখন যে বিষয়ের উপর শপথ করা হয়েছে তার বর্ণনা দেয়া হচ্ছে ও তোমাদের সবারই সত্য ও সঠিক মা’বুদ একমাত্র আল্লাহ। যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী এবং এতোদুভয়ের অন্তর্বর্তী সব কিছুর প্রতিপালক, এবং প্রতিপালক সকল উদয়স্থলের। তিনিই আকাশের উপর তারকারাজি, চন্দ্র এবং সূর্যকে কাজে নিয়োজিত রেখেছেন, যেগুলো পূর্ব দিকে উদিত হয় ও পশ্চিম দিকে অস্ত যায়। মাশরিকের উল্লেখ করে মাগরিবের ইঙ্গিত থাকার কারণে ওর উল্লেখ করা হয়নি। অন্য আয়াতে উল্লেখ করাও হয়েছে। যেমন ঘোষিত হয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “তিনিই দুই উদয়াচল ও দুই অস্তাচলের নিয়ন্তা।”(৫৫:১৭) অর্থাৎ শীতকালের ও গ্রীষ্মকালের উদয় ও অস্তের স্থানের প্রতিপালক তিনিই।
৬-১০ নং আয়াতের তাফসীর:

আল্লাহ্ তা’আলা খবর দিচ্ছেন যে, দুনিয়ার আকাশকে তারকামণ্ডলী দ্বারা তিনি সুশোভিত করেছেন। (আরবী) ও (আরবী) উভয়ভাবেই পড়া হয়েছে। উভয় অবস্থাতেই একই অর্থ হবে। আকাশের নক্ষত্ররাজি এবং ওর সূর্যের কিরণ যমীনকে আলোকোজ্জ্বল করে তুলে। যেমন অন্য আয়াতে রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “আমি নিকটবর্তী আকাশকে সুশোভিত করেছি প্রদীপমালা দ্বারা এবং ওগুলোকে করেছি শয়তানের প্রতি নিক্ষেপের উপকরণ এবং তাদের জন্যে প্রস্তুত রেখেছি জ্বলন্ত অগ্নির শাস্তি।” (৬৭:৫) আর এক জায়গায় বলেছেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “আমি আকাশে রাশিচক্র বানিয়েছি এবং ওকে দর্শকদের চোখে সৌন্দর্যময় জিনিস করেছি। প্রত্যেক বিতাড়িত শয়তান হতে ওকে রক্ষিত রেখেছি। যে কেউ কোন কথা চুরি করে শুনবার চেষ্টা করে তার পশ্চাদ্ধাবন করে এক তীক্ষ্ণ অগ্নিশিখা।” (১৫:১৬-১৮) মহান আল্লাহ বলেনঃ আমি আসমানকে হিফাযত করেছি প্রত্যেক দুষ্ট ও উদ্ধত শয়তান হতে। ফলে তারা উধ্বজগতের কিছু শ্রবণ করতে পারে না। চুরি করে শুনবার চেষ্টা করলে এবং হঠাৎ কিছু শুনে ফেললে তাদেরকে তাড়ানোর জন্যে জ্বলন্ত উল্কাপিণ্ড তাদের পশ্চাদ্ধাবন করে। তারা আকাশ পর্যন্ত পৌঁছতেই পারে না। আল্লাহ্ শরীয়ত ও তকদীর বিষয়ের কোন আলাপ-আলোচনা তারা শুনতেই পারে না। এ ব্যাপারে বর্ণিত হাদীসগুলো আমরা … (আরবী) (৩৪:২৩) এই আয়াতের তাফসীরে বর্ণনা করে দিয়েছি।

মহামহিমান্বিত আল্লাহ্ বলেনঃ যেই দিক থেকে তারা আকাশে উঠতে চায় সেই দিক থেকেই তাদের উপর অগ্নি নিক্ষেপ করা হয়। তাদেরকে বিতাড়িত ও লজ্জিত করার উদ্দেশ্যে বাধা দেয়া ও আসতে না দেয়ার জন্যে এই শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে। আর তাদের জন্যে পরকালের স্থায়ী শাস্তি তো বাকী রয়েছেই যা হবে খুবই যন্ত্রণাদায়ক। যেমন মহামহিমান্বিত আল্লাহ্ বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “আমি তাদের জন্যে প্রস্তুত রেখেছি জ্বলন্ত অগ্নির শাস্তি।”(৬৭:৫)

প্রবল প্রতাপান্বিত আল্লাহ বলেনঃ হ্যা, তবে যদি কোন জ্বিন ফেরেশতাদের কোন কথা শুনে তার নীচের কাউকেও বলে দেয় তবে দ্বিতীয়জন তার নীচের অপরজনকে তা বলার পূর্বেই জ্বলন্ত অগ্নি তার পিছনে ধাবিত হয়। আর কখনো কখনো তারা সে কথা অপরের কানে পৌছিয়ে দিতে সক্ষম হয় এবং এ কথাই যাদুকররা বর্ণনা করে থাকে।

(আরবী) শব্দের অর্থ অত্যন্ত তে এবং অত্যধিক উজ্জ্বল ও জ্যোতির্ময়। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, পূর্বে শয়তানরা আকাশে গিয়ে বসতো এবং অহী শুনতো। ঐ সময় তাদের উপর তারকা নিক্ষিপ্ত হতো না। সেখানকার কথা নিয়ে তারা একের জায়গায় দশটি কথা বেশী করে বানিয়ে নিয়ে যাদুকরদেরকে বলে দিতো। অতঃপর যখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) নবুওয়াত লাভ করলেন তখন তাদের আকাশে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। তখন থেকে তারা সেখানে গিয়ে কান পাতলে তাদের উপর অগ্নিশিখা নিক্ষিপ্ত হতো। যখন তারা এই নতুন ঘটনা অভিশপ্ত ইবলীসকে জানালো তখন সে বললোঃ “নতুন বিশেষ কোন জরুরী ব্যাপারে এরূপ সতর্কতা অবলম্বন করা হয়েছে। সুতরাং সংবাদ জানার জন্যে সে তার দলবলকে পৃথিবীতে পাঠিয়ে দিলো। ঐ দলটি হিজাযের দিকে গেল। তারা দেখলো যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) নাখলার দু’টি পাহাড়ের মাঝে নামাযে রত আছেন। তারা এ খবর ইবলীস শয়তানকে জানালে সে বললোঃ “এই কারণেই তোমাদের আসমানে যাতায়াত বন্ধ হয়ে গেছে।” এর পূর্ণ বিবরণ ইনশাআল্লাহ্ নিম্নের আয়াতগুলোর তাফসীরে আসবে যেগুলোতে জ্বিনদের উক্তি উদ্ধৃত হয়েছ। আয়াতগুলো হলোঃ (আরবী) অর্থাৎ “এবং আমরা চেয়েছিলাম আকাশের তথ্য সংগ্রহ করতে; কিন্তু আমরা দেখতে পেলাম কঠোর প্রহরী ও উল্কাপিণ্ড দ্বারা আকাশ পরিপূর্ণ। আর পূর্বে আমরা আকাশের বিভিন্ন ঘাঁটিতে সংবাদ শুনার জন্যে বসতাম, কিন্তু এখন কেউ সংবাদ শুনতে চাইলে সে তার উপর নিক্ষেপের জন্য প্রস্তুত জ্বলন্ত উল্কাপিণ্ডের সম্মুখীন হয়। আমরা জানি না যে, জগতবাসীর অমঙ্গলই অভিপ্রেত, না তাদের প্রতিপালক তাদের মঙ্গল চান।”(৭২:৮-১০)
১১-১৯ নং আয়াতের তাফসীর:

আলাহ তা’আলা স্বীয় নবী (সঃ)-কে নির্দেশ দিচ্ছেনঃ তুমি কিয়ামত অস্বীকার কারীদেরকে প্রশ্ন করঃ আল্লাহ্ তা’আলার কাছে তোমাদেরকে সৃষ্টি করা কঠিন, না আসমান, যমীন, ফেরেশতা, জ্বিন ইত্যাদি সৃষ্টি করা কঠিন? হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ)-এর কিরআতে (আরবী) রয়েছে। ভাবার্থ এই যে, তারা তো এসবের সত্যতা স্বীকার করে, তবে মৃত্যুর পর পুনর্জীবনকে তারা কেন অস্বীকার করে? অন্য আয়াতে রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “অবশ্যই আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করা মানব সৃষ্টি করা অপেক্ষা কঠিনতর, কিন্তু অধিকাংশ মানুষই জানে না।”(৪০:৫৭)।

অতঃপর মহান আল্লাহ্ বলেনঃ আমি তাদেরকে আঠাল মাটি হতে সৃষ্টি করেছি। মুজাহিদ (রঃ), সাঈদ ইবনে জুবাইর (রঃ) এবং যহ্হাক (রঃ) বলেন। যে, মানুষকে এমন মাটি দ্বারা সৃষ্টি করা হয়েছে যা হাতের মাঝে আঠালভাবে লেগে যায়।

আল্লাহ পাকের উক্তিঃ হে নবী (সঃ)! তুমি তো বিস্ময়বোধ করছে আর তারা বিদ্রুপ করছে। কারণ তারা কিয়ামতকে অস্বীকার করে, আর তুমি তাতে দৃঢ় বিশ্বাসী। আল্লাহ্ তা’আলা খবর দিচ্ছেন যে, মানুষের মৃত্যুর পর তাদের গলিত দেহ পুনর্গঠন করা হবে, এ শুনে তারা তামাশা করছে। আর যখন কোন প্রকাশ্য প্রমাণ তাদের সামনে পেশ করা হয় তখন তারা বিদ্রুপ করে বলে যে, এটা তো নিচক যাদুর খেলা। তারা বলেঃ মৃত্যুর পর আমরা মাটিতে মিশে যাবো এবং এরপর পুনরুজ্জীবিত হবো, এমন কি আমাদের পূর্বপুরুষদেরও পুনরায় জীবিত করা হবে, এ কথা তো আমরা কখনো মানতে পারি না।

তাদের এ কথার জবাবে আল্লাহ তা’আলা স্বীয় নবী (সঃ)-কে বলেনঃ হে নবী (সঃ)! তুমি তাদেরকে বলে দাওঃ তোমরা যে অবস্থাতেই থাকো না কেন তোমাদেরকে অবশ্যই পুনর্জীবিত করা হবে। কারণ তোমরা সবাই আল্লাহর ক্ষমতাধীন। তাঁর সামনে কারো কোন অস্তিত্ব নেই। যেমন আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “প্রত্যেকেই তাঁর কাছে লাঞ্ছিত অবস্থায় আসবে।”(২৭:৮৭) আরো বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “নিশ্চয়ই যারা আমার ইবাদতের ব্যাপারে অহংকার করবে, সত্বরই তারা লাঞ্ছিত অবস্থায় জাহান্নামে প্রবেশ করবে।”(৪০:৬০)

এরপর মহামহিমান্বিত আল্লাহ্ বলেনঃ এটা তো একটিমাত্র প্রচণ্ড শব্দ, আর তখনই তারা প্রত্যক্ষ করবে। অর্থাৎ যেটাকে তোমরা খুবই কঠিন মনে করছো তা আল্লাহর কাছে মোটেই কঠিন নয়, বরং খুবই সহজ। একটিমাত্র প্রচণ্ড শব্দ হবে, আর তখনই সবাই কবর হতে বের হয়ে কিয়ামতের ভয়াবহ অবস্থা প্রত্যক্ষ করবে। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।
২০-২৬ নং আয়াতের তাফসীর:

কিয়ামত অস্বীকারকারীরা বলবেঃ হায়, দুর্ভোগ আমাদের! এটাই তো প্রতিফল দিবস! মুমিন ও ফেরেশতারা তাদের লজ্জা আরো বাড়ানোর জন্যে বলবেনঃ হ্যা, এটাই ফায়সালার দিন যা তোমরা অবিশ্বাস করতে।

অতঃপর ফেরেশতাদেরকে আল্লাহ্ তা’আলা নির্দেশ দিবেনঃ তোমরা তাদের সহচরদেরকে, তাদের ভাই বন্ধুদেরকে এবং তাদের অনুরূপ ব্যক্তিবর্গকে এক জায়গায় একত্রিত কর। যেমন ব্যভিচারীকে ব্যভিচারীর সাথে, সুদখোরকে সুদখোরের সাথে, মদ্যপায়ীকে মদ্যপায়ীর সাথে ইত্যাদি। একটি উক্তি এও আছে যে, এর ভাবার্থ হচ্ছেঃ যালিমদেরকে ও তাদের স্ত্রীদেরকে একত্রিত কর। কিন্তু এটা খুবই দুর্বল উক্তি। সঠিক ভাবার্থ এটাই তাদের অনুরূপ লোকদেরকে এবং তাদের সাথে তাদের উপাস্যদেরকে একত্রিত কর যাদেরকে আল্লাহর শরীক হিসেবে গ্রহণ করেছিল। অতঃপর তাদেরকে জাহান্নামের পথে পরিচালিত কর। যেমন আল্লাহ তা’আলা অন্য জায়গায় বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “আমি তাদেরকে কিয়ামতের দিন মুখের ভরে অন্ধ, মূক ও বধির করে একত্রিত করবো। তাদের আশ্রয়স্থল হবে জাহান্নাম, যার আগুন যখনই কিছুটা হালকা হবে তখনই আমি ঐ আগুনকে আরো বেশী প্রজ্বলিত করে দিবো।”(১৭:৯৭) আল্লাহ তা’আলা ফেরেশতাদেরকে আরো বলবেনঃ তাদেরকে জাহান্নামের নিকট কিছু সময়ের জন্যে দণ্ডায়মান রাখো। কেননা, আমি তাদেরকে কিছু প্রশ্ন করবো এবং তাদের হিসাব নিবো।

হযরত আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি কোন ব্যক্তিকে কোন জিনিসের দিকে ডাকবে, কিয়ামতের দিন তাকে তারই সাথে খাড়া করা হবে, বিশ্বাসঘাতকতাও হবে না এবং বিচ্ছিন্নতাও হবে না, যদিও একজন লোক একজন লোককেও ডেকে থাকে।” অতঃপর তিনি (আরবী)-এ আয়াতটি পাঠ করেন। (এ হাদীসটি ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

হযরত উসমান ইবনে যায়েদাহ (রাঃ) বলেন যে, মানুষকে সর্বপ্রথম তার সঙ্গীদের সম্বন্ধে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। তারপর তাকে প্রশ্ন করা হবেঃ আজ কেন একে অপরকে সাহায্য করছো না? অথচ তোমরা দুনিয়ায় বলে বেড়াতে আমরা সবাই একত্রে রয়েছি এবং আমরা পরস্পরকে সাহায্য করবো? কিন্তু আজ তো তারা অস্ত্র-শস্ত্র ফেলে দিয়ে আল্লাহ্ তা’আলার নিকট আত্মসমর্পণ করেছে। না আজ তারা তার কোন বিরুদ্ধাচরণ করবে, না তারা তাঁর আযাব থেকে বাঁচতে পারবে, না পালাতে পারবে। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সর্বাধিক সঠিক জ্ঞানের অধিকারী।
২৭-৩৭ নং আয়াতের তাফসীর:

আল্লাহ তা’আলা বর্ণনা করছেন যে, কাফিররা জাহান্নামের মধ্যে যেভাবে জ্বলতে থাকবে ও পরস্পর দ্বন্দ্বে ও তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত হবে ঠিক তেমনিভাবে তারা কিয়ামতের মাঠে একে অপরকে দোষারোপ করতে থাকবে। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “দুর্বলরা ক্ষমতাদর্পীদেরকে বলবেঃ আমরা তোমাদের অনুসারী ছিলাম, সুতরাং আজ কি তোমরা আমাদেরকে শাস্তির কিছু অংশ থেকে রক্ষা করবে না? ক্ষমতাদপীরা উত্তরে বলবেঃ আমরা নিজেরাও তো তোমাদের সাথে জাহান্নামে রয়েছি, নিশ্চয়ই আল্লাহ্ বান্দাদের মধ্যে প্রকৃত ফায়সালা করেছেন।”(৪০:৪৭-৪৮) আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “হায়! যদি তুমি দেখতে যালিমদেরকে, যখন তাদেরকে তাদের প্রতিপালকের সামনে দণ্ডায়মান করা হবে তখন তারা পরস্পর বাদ-প্রতিবাদ লুতে থাকবে, যাদেরকে দুর্বল মনে করা হতো তারা ক্ষমতাদর্পীদেরকে বলবেঃ তোমরা না থাকলে আমরা অবশ্যই মুমিন হতাম। যারা ক্ষমতাদর্পী ছিল তারা যাদেরকে দুর্বল মনে করা হতো তাদেরকে বলবেঃ তোমাদের নিকট সৎ পথের দিশা আসার পর আমরা কি তোমাদেরকে ওটা হতে নিবৃত্ত করেছিলাম? বস্তুতঃ তোমরাই তো ছিলে অপরাধী। যাদেরকে দুর্বল মনে করা হতো তারা ক্ষমতাদর্পীদেরকে বলবেঃ প্রকৃতপক্ষে তোমরাই তো দিবারাত্র চক্রান্তে লিপ্ত ছিলে, আমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছিলে যে, যেন আমরা আল্লাহকে অমান্য করি এবং তার শরীক স্থাপন করি। যখন তারা শাস্তি প্রত্যক্ষ করবে তখন অনুতাপ গোপন রাখবে এবং আমি কাফিরদের গলদেশে শৃংখল পরাবো। তাদেরকে তারা যা করতো তারই প্রতিফল দেয়া হবে।”(৩৪:৩১-৩৩) অনুরূপ বর্ণনা এখানেও রয়েছে যে, তারা তাদের নেতৃবর্গকে বলবেঃ তোমরা আমাদের ডান দিকে ছিলে। অর্থাৎ যেহেতু আমরা তোমাদের চেয়ে কম শক্তি সম্পন্ন ছিলাম এবং তোমরা আমাদের উপর আধিপত্য বিস্তার করেছিলে সেই হেতু তোমরা আমাদেরকে জোরপূর্বক ন্যায় হতে অন্যায়ের দিকে ফিরিয়ে দিতে। মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, কাফিররা এ কথা শয়তানদেরকে বলবে।

কাতাদা (রঃ) বলেন যে, একথা মানুষ জ্বিনদেরকে বলবে। মানুষ তাদেরকে বলবেঃ তোমরা আমাদেরকে ভাল কাজ হতে ফিরিয়ে মন্দ কাজ করতে উত্তেজিত করতে, পাপের কাজকে আমাদের চোখে সুন্দর করে দেখাতে এবং ভাল ও পুণ্যের কাজকে কঠিন ও মরূপে প্রদর্শন করতে। হক হতে ফিরিয়ে দিতে এবং বাতিলের প্রতি আমাদেরকে প্রভাবিত করতে। কোন কোন সময় যখন আমাদের মনে পুণ্য কাজের প্রতি খেয়াল জাগতো তখন তোমরা প্রতারণা করে আমাদেরকে তা হতে সরিয়ে দিতে। ইসলাম, ঈমান এবং পুণ্য লাভ হতে তোমরা আমাদেরকে বঞ্চিত করেছে, তাওহীদ হতে আমাদেরকে বহু দূরে তোমরা নিক্ষেপ করেছো। তোমাদেরকে আমাদের মঙ্গলকামী ও শুভাকাঙ্ক্ষী মনে করে আমরা তোমাদেরকে আমাদের সব গোপন কথা বলেছিলাম ও তোমাদেরকে বিশ্বস্ত ভেবেছিলাম। তোমাদের কথা আমরা মেনে চলতাম এবং তোমাদেরকে ভাল মানুষ মনে করতাম।

মহান আল্লাহ শক্তিশালী নেতৃবৃন্দের উক্তি উদ্ধৃত করেনঃ বরং তোমরা তো বিশ্বাসীই ছিলে না। অর্থাৎ দুর্বলদের অভিযোগ শুনে জ্বিন ও মানুষের মধ্যে যারা নেতৃস্থানীয় ও সম্মানিত ব্যক্তি ছিল তারা ঐ দুর্বলদেরকে উত্তরে বলবেঃ আমাদের কোন দোষ নেই। তোমরা নিজেরাই তো অন্যায়কারী ছিলে। তোমাদের অন্তর ঈমান হতে দূরে ছিল। কুফরী ও পাপের কাজে তোমরা সদা লিপ্ত থাকতে।

তোমাদের উপর আমাদের কোন কর্তৃত্ব ছিল না। বস্তুতঃ তোমরাই ছিলে সীমালংঘনকারী সম্প্রদায়। তোমাদের মনের মধ্যে অবাধ্যতা ও দুষ্টামি ছিল। তাই তোমরা আমাদের কথা মান্য করেছিলে এবং নবীদের আনয়নকৃত সত্যকে পরিত্যাগ করেছিলে। তারা যা নিয়ে এসেছিলেন তার স্বপক্ষে তারা প্রমাণও পেশ করেছিলেন। এতদসত্ত্বেও তোমরা তাদের বিরোধিতা করেছিলে। তাই আমাদের সবারই উপর আল্লাহর আযাবের বাণী সত্যভাবে স্থির হয়েছে। আমাদেরকে অবশ্যই শাস্তির স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। আমরা তোমাদেরকে ধোঁকায় ফেলেছিলাম ও বিভ্রান্ত করেছিলাম, কারণ আমরা নিজেরাও ছিলাম বিভ্রান্ত।

মহামহিমান্বিত আল্লাহ্ বলেনঃ তারা সবাই সেই দিন শাস্তিতে শরীক হবে। অর্থাৎ নিজ নিজ কাজ অনুযায়ী সবাই জাহান্নামী। আর অপরাধীদের প্রতি আমি এরূপই করে থাকি। যখন তাদেরকে বলা হতো যে, আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নেই তখন তারা গর্বভরে বলতোঃ আমরা কি এক পাগল কবির কথায় আমাদের মা’বৃদদেরকে বর্জন করবো? অর্থাৎ তারা অহংকার ভরে তাওহীদের বাণী উচ্চারণ করতো না, যে বাণী মুমিনরা উচ্চারণ করতো।

হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আমি মানব জাতির সাথে যুদ্ধ করতে আদিষ্ট হয়েছি যে পর্যন্ত না তারা বলে যে, আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নেই। সুতরাং যে ব্যক্তি বলবে যে, আল্লাহ ছাড়া কোন মা’বুদ নেই সে ইসলামের হক ছাড়া তার মাল ও জান আমা হতে বাঁচিয়ে নিবে এবং তার হিসাব মহামহিমান্বিত আল্লাহর নিকট রয়েছে।” (এ হাদীসটি ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

এ বিষয়টিই আল্লাহর কিতাবেও রয়েছে এবং এক অহংকারী সম্প্রদায়ের ঘটনা বর্ণিত হয়েছে যে, তারা এ কালেমা উচ্চারণ করতে গর্বভরে অস্বীকার করছিল।

আবুল আ’লা (রাঃ) বলেন যে, কিয়ামতের দিন ইয়াহূদীদেরকে আনয়ন করা হবে, অতঃপর তাদেরকে বলা হবেঃ “তোমরা দুনিয়াতে কার ইবাদত করতে?” উত্তরে তারা বলবেঃ “আমরা আল্লাহর এবং উযায়ের (আঃ)-এর ইবাদত কাম।” তখন তাদেরকে বাম পাশে রাখার নির্দেশ দেয়া হবে। তারপর খৃষ্টানদেরকে এনে জিজ্ঞেস করা হবেঃ “তোমরা কার ইবাদত করতে?” তারা উত্তর দিবেঃ “আমরা আল্লাহর ও ঈসা (আঃ)-এর ইবাদত করতাম।” এদেরকেও বাম পাশে রাখার হুকুম করা হবে। এরপর মুশরিকদেরকে আনয়ন করে বলা হবেঃ “আল্লাহ ছাড়া কোন মা’বুদ নেই।” তখন তারা অহংকার করবে। তিনবার তাদেরকে এ কথা বলা হবে এবং তিনবারই তারা অহংকার প্রকাশ করবে। তাদেরকেও বাম দিকে রাখার নির্দেশ দেয়া হবে। আবু নাযা (রাঃ) বলেন যে, তাদেরকে পাখীর চেয়েও বেশী দ্রুতগতিতে নিয়ে যাওয়া হবে। আবুল আ’লা (রাঃ) বলেন যে, এরপর মুসলিমদের আনয়ন করা হবে এবং তাদেরকে প্রশ্ন করা হবেঃ “তোমরা কার ইবাদত করতে?” তারা জবাবে বলবেঃ “আমরা আল্লাহ তাআলার ইবাদত করতাম। তখন তাদেরকে জিজ্ঞেস করা হবেঃ “তোমরা তাঁকে দেখলে চিনতে পারবে কি?” তারা উত্তর দিবেঃ “হ্যা পারবো।” আবার তাদেরকে প্রশ্ন করা হবেঃ “তোমরা তো তাঁকে দেখোনি, সুতরাং কি করে তাঁকে চিনতে পারবে?” তারা উত্তর দিবেঃ “আমরা জানি যে, কেউই তার সমকক্ষ নয়।” তখন আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা তাদেরকে স্বীয় পরিচয় প্রদান করবেন এবং তাদেরকে মুক্তি দিবেন।

কাফির ও মুশরিকরা কালেমায়ে তাওহীদ শুনে উত্তর দিতোঃ “আমরা কি একজন কবি ও পাগলের কথায় আমাদের উপাস্যদেরকে পরিত্যাগ করবো?” অর্থাৎ তারা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে কবি ও পাগল বলে আখ্যায়িত করতো। আল্লাহ তা’আলা তাদেরকে মিথ্যাবাদী প্রমাণিত করতঃ তাদের মত খণ্ডন করে বলেনঃ “বরং এই নবী (সঃ) সত্য নিয়ে এসেছে এবং সমস্ত রাসূলকে সে সত্য বলে স্বীকার করেছে। অন্যান্য নবীরা (আঃ) ইতিপূর্বে এই নবী (সঃ) সম্বন্ধে যে গুণাবলী ও পবিত্রতার বর্ণনা দিয়েছিলেন যেসবের সঠিক প্রমাণ তিনি নিজেই। পূর্ববর্তী নবীগণ (আঃ) যেসব হুকুম বর্ণনা করেছেন, তিনিও সেসবেরই বর্ণনা দিয়ে থাকেন। যেমন অন্য আয়াতে রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “(হে নবী সঃ)! তোমাকে ঐ কথাই বলা হচ্ছে যা তোমার পূর্ববর্তী রাসূলদেরকে (আঃ) বলা হয়েছিল।”(৪১:৪৩)

৩৮-৩৯ নং আয়াতের তাফসীর:

আল্লাহ তাআলা লোকদেরকে সম্বোধন করে বলছেনঃ তোমরা অবশ্যই বেদনাদায়ক শাস্তির স্বাদ গ্রহণ করবে এবং তোমরা যা করতে তারই প্রতিফল পাবে। এরপর মহান আল্লাহ স্বীয় মনোনীত বান্দাদের এর থেকে পৃথক করে নিচ্ছেন যে, তারা নয় যারা আল্লাহর একনিষ্ঠ বান্দা। যেমন তিনি বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “মহাকাশের শপথ! মানুষ অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত, কিন্তু তারা নয় যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে।”(১০৫: ১-৩) মহামহিমান্বিত আল্লাহ আরো বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “আমি তো মানুষকে সৃষ্টি করেছি সুন্দরতম গঠনে। অতঃপর আমি তাকে হীনতাগ্রস্তদের হীনতমে পরিণত করি, কিন্তু তাদেরকে নয় যারা মুমিন ও সৎকর্মপরায়ণ।”(৯৬:৪-৬) আর এক জায়গায় বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “তোমাদের প্রত্যেকেই ওটা (জাহান্নাম) অতিক্রম করবে, এটা তোমার প্রতিপালকের অনিবার্য সিদ্ধান্ত। পরে আমি মুত্তাকীদেরকে উদ্ধার করবো এবং যালিমদেরকে সেখানে নতজানু অবস্থায় রেখে দিবো।”(১৯:৭১-৭২) অন্য এক জায়গায় প্রবল পরাক্রান্ত আল্লাহ বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “প্রত্যেক ব্যক্তি নিজ কৃতকর্মের দায়ে আবদ্ধ, তবে দক্ষিণ পার্শ্বস্থ ব্যক্তিরা নয়।”(৭৪:৩৮-৩৯)

এজন্যেই মহামহিমান্বিত আল্লাহ এখানে বলেনঃ “তারা নয় যারা আল্লাহর একনিষ্ঠ বান্দা।” বেদনাদায়ক শাস্তিতে পতিত ব্যক্তিদের হতে আল্লাহ তা’আলা স্বীয় একনিষ্ঠ বান্দাদেরকে পৃথক করে নিয়েছেন যাতে তারা কঠিন শা হিসাব-নিকাশের ভীষণ বিপদ থেকে মুক্ত থাকতে পারে। তাদেরকে যাবতীয় বিপদাপদ থেকে দূরে রাখা হবে। আর ঐ সব বান্দার নেক আমলগুলোকে একটির বদলে দশগুণ তা হতে সাতশগুণ এমনকি আল্লাহ তা’আলার ইচ্ছানুযায়ী আরো বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়া হবে ।

ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-

সংক্ষিপ্ত আলােচনা : পূর্ববর্তী সূরার মতােই এই মক্কী সূরার ছােট ছােট আয়াত সম্বলিত, অত্যন্ত দ্রুত প্রভাব বিস্তারকারী, বিচিত্র দৃশ্য চিত্রণকারী, প্রচন্ডভাবে আঘাতকারী ও তীব্র আবেগ সৃষ্টিকারী বর্ণনার সমষ্টি। অন্য সমস্ত মক্কী সূরার মতাে এটাও অন্তরে ঈমানের আবেগ উদ্দীপনা সৃষ্টি করতে চায়, সব ধরনের শিরকের কলুষতা থেকে অন্তরাত্মাকে মুক্ত ও পবিত্র করতে চায়। তবে আরবে প্রাচীনকাল থেকে বিরাজমান এক বিশেষ ধরনের শিরকের মূলােৎপাটন-এর বিশেষ লক্ষ্য। এই বিশেষ ধরনের শিরক নিয়ে দীর্ঘ আলােচনা করে তার উচ্ছেদ সাধনে নানাভাবে চেষ্টা চালানাে হয়েছে। শিরকের এই বিশেষ ধরনটা আরবের জাহেলী যুগে খুবই সমাদৃত হতাে। ধারণাটা ছিলাে এ রকম যে, মহান আল্লাহ ও জ্বিনদের মধ্যে একটা আত্মীয়তার সম্পর্ক রয়েছে। তিনি জিনদের মেয়ে বিয়ে করেছিলেন এবং সেই স্ত্রীর পেটে ফেরেশতারা আল্লাহর সন্তান হিসেবে জন্ম নিয়েছিলাে, আর এই ফেরেশতারা সবাই নাকি মেয়ে সন্তান এবং তারা সবাই আল্লাহর মেয়ে। (নাউযু বিল্লাহ!) এই ভিত্তিহীন কল্পকাহিনীর ওপর এই সূরায় প্রচন্ড আক্রমণ চালানাে হয়েছে। এতে এই ধারণার প্রতি প্রচন্ড ধিক্কার দেয়া হয়েছে এবং একে অত্যন্ত জঘন্য ও একেবারেই ভুয়া অভিমত বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আর যেহেতু এ সূরার এটা একটা প্রধান আলােচ্য বিষয়, তাই ফেরেশতাদের বিভিন্ন দলের উল্লেখ করেই সূরার সূচনা করা হয়েছে। ‘শপথ তাদের, যারা সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, অতপর যারা ধমক দিয়ে ভীতি প্রদর্শন করে, অতপর যারা মুখস্থ আবৃত্তি করে…’ এর অল্প পরেই রয়েছে বিদ্রোহী শয়তানদের প্রসংগ, যাদের উর্ধ্বজগতের কাছে যাওয়া থেকে বিরত রাখার জন্যে উল্কা নিক্ষেপ করে বিতাড়িত করা হয়। উল্কা নিক্ষপের ফলে তারা উর্ধ্বজগতে যা কিছু আলােচিত হয় শুনতে পায় না। জাহেলী সমাজে ভূত-প্রেত শয়তানের যেটা শক্তিশালী ও মর্যাদাশালী মনে করা হতাে, তা যদি সত্য হতো, তাহলে এভাবে উল্কার ধাওয়া খেয়ে তাদের পালাতে হতাে না। অনুরূপভাবে জাহান্নামে যাক্কুম গাছের ফল দিয়ে অত্যাচারীদের শাস্তি দেয়া হবে, তার আকৃতি শয়তানের মাথার মতাে বলে শয়তানকে ধিকৃত ও নিন্দিত করা হয়েছে। সূরার শেষভাগে আবার সেই কল্পিত তত্ত্বের ওপর প্রত্যক্ষ আক্রমণ চালানাে হয়েছে এভাবে, ‘অতএব তাদের জিজ্ঞেস করাে, তােমার প্রতিপালকেরই কি সমস্ত কন্যা সন্তান, আর ওদের সমস্ত পুত্র সন্তান? আমি কি তাদের চোখের সামনেই ফেরেশতাদের কন্যা হিসেবে সৃষ্টি করেছি। (আয়াত ১৪৯-১৫৮) জাহেলী যুগের বিভিন্ন রকমের শিরকের মধ্য থেকে এই বিশেষ ধরনের শিরকটার সমালােচনা ছাড়া এ সূরায় সাধারণ মক্কী সূরাগুলাের ন্যায় অন্যান্য আকীদার বিষয়ও আলােচিত হয়েছে। যেমন প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী দ্বারা তাওহিদী মতাদর্শের যথার্থতা প্রমাণ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘তােমাদের মাবুদ একজন। তিনি আকাশ পৃথিবী, উভয়ের মধ্যবর্তী যা কিছু আছে তার এবং পূর্ব দিকের প্রতিপালক।'(আয়াত ৪-৫) দ্ব্যর্থহীন ভাষায় এখানে বলা হয়েছে যে, ‘কেয়ামতের দিন এই শিরকই হবে আযাব ভােগ করার কারণ। তারা সেদিন একই সাথে আযাব ভােগ করবে। আমি অপরাধীদের সাথে এ রকমই আচরণ করে থাকি।’ অনুরূপভাবে এ সূরায় পুনরুত্থান ও কেয়ামতের হিসাব নিকাশের বিষয় আলােচিত হয়েছে। যেমন ‘তারা বলে, এতাে সুস্পষ্ট যাদু। আমরা মরে মাটি হয়ে যাওয়ার পর আবার পুনরুজ্জীবিত হবাে নাকি?…’ এরপর এ প্রসংগে কেয়ামতের এক সুদীর্ঘ বিবরণ দেয়া হয়েছে। ওহী ও রেসালাতের বিষয়ে তাদের উক্তি উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, ‘আমরা একজন পাগল কবির জন্যে আমাদের মাবুদদের পরিত্যাগ করবে নাকি?’ অতপর এর জবাবে বলা হয়েছে, ‘বরং সে সত্য নিয়ে এসেছে এবং রসূলদের সত্য প্রতিপন্ন করেছে।’ তাদের বিপথগামিতা ও প্রত্যাখ্যান প্রসংগে বেশ কয়েকজন নবীর কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে। হযরত নূহ, হযরত ইবরাহীম, তার পুত্র, মূসা, হারুন, ইলিয়াস, লূত ও ইউনুসের কাহিনী উপস্থাপন করা হয়েছে। এ সব কাহিনীতে দেখানাে হয়েছে কিভাবে আল্লাহ তায়ালা প্রত্যাখ্যানকারীদের আযাব দিয়ে পাকড়াও করে থাকেন। যেমন, ‘তাদের পূর্বে পূর্ববর্তীদের অধিকাংশই বিপথগামী হয়েছে। আমি তাদের কাছে সতর্ককারীদের পাঠিয়েছি। দেখাে, যাদেরকে সতর্ক করা হয়েছে তাদের কেমন পরিণতি হয়েছিলো। তবে আমার একনিষ্ঠ বান্দাদের কথা স্বতন্ত্র।’ এ সব কাহিনীর মধ্যে বিশিষ্টতার দাবী রাখে পুত্র ইসমাইল এর সাথে হযরত ইবরাহীমের কাহিনী। এ কাহিনীতে আছে হযরত ইসমাইল যবাই করার চেষ্টা ও তার পবিবর্তে দুম্বা কোরবানী হওয়ার কথা। এতে আল্লাহর আনুগত্য ও তার কাছে আত্মসর্পণের সবচেয়ে বিস্ময়কর সবচেয়ে মহৎ দৃশ্য দেখানাে হয়েছে। এ আনুগত্য এতাে উঁচুস্তরে পৌছেছে, যে একনিষ্ঠ ঈমান ছাড়া আর কোনােভাবে সেখানে পৌছা সম্ভব নয়। সূরার আলােচিত বিষয়গুলাে উপস্থাপনের সাথে সাথে যে শিক্ষণীয় বিষয়গুলাে তুলে ধরা হয়েছে তা নিম্নের আয়াতগুলােতে সুস্পষ্টভাবে বিদ্যমান। প্রথমত. আকাশ, গ্রহ নক্ষত্র, উল্কা ও উল্কা দিয়ে বিতাড়নের দৃশ্যে। যেমন, ‘নিশ্চয় আমি সর্বনিম্ন আকাশকে সৌন্দর্যমন্ডিত করেছি গ্রহ নক্ষত্র দিয়ে। প্রত্যেক বিদ্রোহী শয়তান থেকে সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে…?’ দ্বিতীয়ত. কেয়ামতের দৃশ্যাবলীতে, কেয়ামতের লােমহর্ষক ঘটনাবলীতে, তার নযিরবিহীন আকস্মিকতা এবং তার তীব্র প্রভাবের বর্ণনায় এ সূরায় যে দৃশ্যাবলী উপস্থাপন করা হয়েছে, তা যথার্থই নযিরবিহীন এবং যথাস্থানে এ বিষয়ে আলােচনা করবাে ইনশাআল্লাহ। তৃতীয়ত বিভিন্ন কাহিনী ও তার শিক্ষা সংক্রান্ত মন্তব্যে, বিশেষত হযরত ইবরাহীম ও তার পুত্র হযরত ইসমাঈলকে যবাই করার চেষ্টার ঘটনা হৃদয়ের মর্মমূলে প্রচন্ডভাবে ধাক্কা দেয়। এ ছাড়া ছন্দোবদ্ধ সূরের মূর্ছনা এ সূরার অন্যতম বৈশিষ্ট্য, যা সূরায় বর্ণিত ঘটনাবলী, দৃশ্যাবলী, শিক্ষা ও নীতিমালার সাথে পুরােপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ। সূরাটি তার আলােচ্য বিষয়গুলো মােটামুটি তিনটি প্রধান ভাগে বিভক্ত করে পেশ করেছে। প্রথম অংশটায় রয়েছে শপথের মাধ্যমে সূরার সূচনা। এই শপথ করা হয়েছে ইতিপূর্বে বর্ণিত কয়েক শ্রেণীর ফেরেশতার নামে। এই শ্রেণীগুলাে হচ্ছে কাতারবন্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা, ধমক দিয়ে ভীতি সঞ্চারকারী ও আবৃত্তিকারী ফেরেশতারা। শপথ করা হয়েছে এই মর্মে যে, উদয়াচলসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয়। তিনি আকাশকে নক্ষত্রমন্ডলী দ্বারা সুসজ্জিত করেছেন। এরপর রয়েছে শয়তানের প্রসংগ, উর্ধজগতের ফয়সালাগুলাে তাদের আড়ি পেতে শােনার চেষ্টা এবং তাদের উজ্জ্বল উল্কা দিয়ে বিতাড়িত করার বিবরণ। তারপর মানব জাতির কাছে প্রশ্ন করা হয়েছে, ‘সৃষ্টির দিক দিয়ে তাদের সৃষ্টিই কি জটিলতর, না আমার অন্যান্য সৃষ্টি।’ অর্থাৎ ফেরেশতা, আকাশ, গ্রহ নক্ষত্র, শয়তান ও উল্কা। এ প্রশ্ন দ্বারা আখেরাত সম্পর্কে তাদের কথাবার্তা নির্বুদ্ধিতাপূর্ণ এবং তারা যা সংঘটিত হওয়া অসম্ভব মনে করে ও যা নিয়ে বিদ্রুপ করে তার বাস্তবতা ও অকাট্যতা প্রমাণ করা হয়েছে। এ জন্যে আখেরাতে পুনরুথান, হিসাব, বেহেশতের নেয়ামত ও দোযখের শাস্তির দীর্ঘ বিবরণ দেয়া হয়েছে। এ বিবরণ যথার্থই নযিরবিহীন। দ্বিতীয় অংশের শুরু হয়েছে যে বক্তব্যের মাধ্যমে তা হলাে, এসব বিপথগামী লােকের (মক্কার মােশরেকদের) সাদৃশ্য অতীতের কিছু লােকের মধ্যে পাওয়া যায়। তাদের কাছেও নবী ও রসূলরা সতর্কবাণী নিয়ে আসতেন। তথাপি তাদের অধিকাংশই বিপথগামী থেকে যায়। এ ধরনের লােকদের মধ্যে রয়েছে হযরত নূহ, ইবরাহীম, মূসা, হারুন, ইলিয়াস, লূত ও ইউনুস(আ.)-এর জাতিসমূহ। তাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে তাদের পরিণাম কেমন ছিলাে এবং যারা ঈমান আনেনি তাদের পরিণাম বা কেমন হয়েছে, তা স্মরণ করতে ও চিন্তা করতে বলা হয়েছে। তৃতীয় অংশে রয়েছে সেই ভিত্তিহীন কল্পকাহিনীর বিবরণ, অর্থাৎ জ্বিন ও ফেরেশতাদের সাথে আল্লাহর আত্মীয়তার কাহিনী । এতে আল্লাহর এই প্রতিশ্রুতিরও উল্লেখ রয়েছে যে, তিনি তার রসূলদের বিজয়ী করেছেন। যেমন তিনি বলেছেন, আমার প্রেরিত বান্দাদের জন্যে ইতিপূর্বে আমার প্রতিশ্রুতি ছিলাে যে, ‘তাদের অবশ্যই সাহায্য করা হবে এবং আমার বাহিনীগুলাে অবশ্যই বিজয়ী হবে।’ এ অংশটা সূরার সমাপ্তি পর্যন্ত চলেছে, যেখানে আল্লাহর পবিত্রতা ঘােষণা করে, তাঁর রসূলদের ওপর সালাম প্রেরণ করে মহান আল্লাহর সারা বিশ্বজগতের প্রভুত্বের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে, এই হচ্ছে সূরার মূল আলােচ্য বিষয়। এবার বিস্তারিত তাফসীর আলােচনা করবাে।‌
# ‘শপথ তাদের যারা সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, যারা ধমক দিয়ে ভীতি সঞ্চার করে…'(আয়াত ১-৫) সারিবদ্ধভাবে দন্ডায়মান, ধমকদানকারী ও আবৃত্তিকারী- এরা হচ্ছে কয়েক শ্রেণীর ফেরেশতা, যাদের তাদের ওপর অর্পিত কাজগুলাের মাধ্যমে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর অর্থ এও হতে পারে যে, যারা নিজেদের পা বা ডানাগুলাে নামাযের মধ্যে সারিবদ্ধভাবে বিছিয়ে রেখে আল্লাহর আদেশের জন্য প্রতীক্ষারত থাকে। আর ধমক দানকারী বলতে বুঝানাে হয়েছে, আল্লাহর অবাধ্য বান্দাদের প্রাণ সংহার করার সময়, কেয়ামতের মাঠে সমবেত করার সময়, জাহান্নামের দিকে হাকিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় অথবা অন্য কোন অবস্থায় ও সময়ে ধমকদানকারী ফেরেশতাদের। আর আবৃত্তিকারী অর্থ কোরআন বা আল্লাহর অন্য কোনাে কিতাব আবৃত্তিকারী বা আল্লাহর স্মরণকারী। মহান আল্লাহ এই কয় শ্রেণীর ফেরেশতার নামে শপথ করে নিজের একত্বের কথা ঘােষণা করছেন, ‘তােমাদের মাবুদ এক ও অদ্বিতীয়। আগেই বলেছি, এই শপথের কারণ হলাে জাহেলী যুগের এই অলীক ধারণা যে, ফেরেশতারা আল্লাহর মেয়ে বিধায় তাদেরও উপাসনা করা উচিত। এর পরবর্তী আয়াতে আল্লাহ তায়ালা নিজের এমন একটি গুণের বর্ণনা দিচ্ছেন যা তাঁর একত্বের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। সে গুণটা হলাে, ‘আকাশ পৃথিবী ও তার মধ্যবর্তী সমস্ত সৃষ্টির প্রতিপালক এবং সকল উদয়াচলের প্রতিপালক।’ আকাশ ও পৃথিবী বান্দাদের সামনেই দাঁড়িয়ে থেকে সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, এই বিশাল বিশ্ব জগতের একজন স্রষ্টা, পরিকল্পক ও শাসক রয়েছেন। এ বিশাল বিশ্বজগতের সৃষ্টি ও পরিচালনার ক্ষমতার দাবী তিনি ছাড়া আর কেউ করে না। আর এর স্রষ্টার সীমাহীন ক্ষমতা এবং তার সর্বময় কর্তৃত্ব ও প্রভুত্বের কথা কেউ অস্বীকারও করতে পারে না। উভয়ের মাঝখানে যা কিছু আছে, অর্থাৎ বাতাস, মেঘ, আলাে, কিরণ, তাপ এবং অন্যান্য সূক্ষ্মতর সৃষ্টি, যার সম্পর্কে মানুষ মাঝে মাঝে কিছু কিছু তথ্য জানতে পারে, তবে অধিকাংশ তথ্যই তাদের অজানা। আকাশ, পৃথিবী ও তার মাঝখানে যা কিছু আছে, এগুলাের কোনােটা বিশাল আকৃতির, কোনােটা ক্ষুদ্রকায়, কোনােটা অতি সূক্ষ্ম, কোনােটা সুন্দর ও চমকপ্রদ, আর সবই বিচিত্র রকমের। ফলে এগুলাের সামনে দাঁড়িয়ে একজন সচেতন মানুষ এ দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে, বিস্ময়ে হতবাক হয়ে ও দীর্ঘস্থায়ী চিন্তায় নিমগ্ন না হয়ে পারে না। কেবলমাত্র যার হৃদয় নির্জীব হয়ে গেছে, সেই এগুলাের দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে এবং চিন্তাভাবনা না করে থাকতে পারে। এ ধরনের চেতনাহীন মানুষ বিস্ময়কর এই মহাবিশ্বের কোনাে দৃশ্য দ্বারাই প্রভাবিত হয় না।  *উদয়াচল ও অস্তাচলে আল্লাহ তায়ালার সার্বভৌমত্ব : ‘উদয়াচলসমূহের প্রতিপালক।’ প্রত্যেক নক্ষত্রের একটা উদয়াচল রয়ছে। প্রত্যেক গ্রহের একটা উদয়াচল রয়েছে। এভাবে বিশাল আকাশের বিভিন্ন দিকে বহু উদয়াচল রয়েছে। এ কথাটার আরাে একটা অর্থ হতে পারে, যা আমাদের এই পৃথিবীর বাস্তব অবস্থানের সাথে সংগতিশীল। পৃথিবী যখন সূর্যের সামনে প্রদক্ষিণ করে, তখন তার বিভিন্ন অঞ্চলের ওপর উদয়াচল ও অস্তাচল ঘুরতে থাকে। পৃথিবীর কোনাে অংশ যখন সূর্যের সামনে আসে, তখন সে অংশের ওপর সূর্য উদিত হয়। তাই ওটা একটা উদয়াচল হয় সে অংশের জন্য। এর ঠিক বিপরীত দিকে পৃথিবীর অস্তাচল থাকে। ফলে পৃথিবী যখন চলতে থাকে তখন সেখানে পরবর্তী অংশের জন্যে আর একটা উদয়াচল হয় এবং তার বিপরীত অংশের জন্যে হয় আর একটা অন্তাচল। এ সত্যটা কোরআন নাযিল হবার সময়কার মানুষের জানা ছিলাে না। অথচ এই একটা কথা দ্বারা আল্লাহ তায়ালা সেই প্রাচীন যুগেই মানুষকে এ সত্যটা জানিয়ে দিলেন। পৃথিবীর সামনে এভাবে পর্যায়ক্রমে অনেকগুলাে উদয়াচল আসতে থাকার এই সূক্ষ্ম তত্ত্বটা এবং উদয়াচলসমূহে প্রকৃতিকে উদ্ভাসনকারী এই মনােমুগ্ধকর ও চমকপ্রদ দৃশ্য মানুষের মনে এই উপলব্ধি জাগরূক করতে সক্ষম যে, এ বিচিত্র সৃষ্টির যিনি স্রষ্টা তিনি নিসন্দেহে এক ও একক এবং অতুলনীয় ক্ষমতার অধিকারী। কেননা এ সব বৈচিত্র্যময় সৃষ্টির স্বভাব প্রকৃতিতে মৌলিক কোনাে পার্থক্য নেই এবং এ সবের সৃষ্টির লক্ষণসমূহ এক ও অভিন্ন। মহান আল্লাহর গুণাবলীর মধ্য থেকে এখানে এই একটা গুণের উল্লেখের এটাই কারণ। পরবর্তীতে নক্ষত্র, উল্কা, শয়তান ও তার বিতাড়নের উল্লেখ প্রসংগে আমরা দেখবাে যে, আকাশ ও উদয়াচলের উল্লেখের আরো কিছু কারণ রয়েছে। ‘আমি সর্বনিম্ন আকাশকে নক্ষত্রমন্ডলী দ্বারা সজ্জিত করেছি।'(৬-১০ নং আয়াত) সূরার শুরুতে ফেরেশতাদের সাথে সংশ্লিষ্ট কল্পকাহিনীর উল্লেখের পর এখানে শয়তানের সাথে সম্পৃক্ত কল্পকাহিনীর দিকে ইংগিত করা হয়েছে। তারা মনে করতাে যে, আল্লাহ তায়ালা ও জ্বিনদের মাঝে আত্মীয়তার সম্পর্ক রয়েছে। এ কারণে জাহেলী যুগের কেউ কেউ শয়তানের পূজাও করতাে। এর আরাে কারণ ছিলাে এই যে, তারা মনে করতাে, উর্ধ্বজগতের সাথে শয়তানের যােগাযােগ আছে এবং এই যােগাযােগের কল্যাণে শয়তান অনেক অদৃশ্য তথ্য জানে। আকাশ, পৃথিবী, উভয়ের মাঝখানের যাবতীয় জিনিস এবং উদয়াচল সমূহের উল্লেখের পর নক্ষত্রমন্ডলীর উল্লেখ করা হয়েছে। আমি সর্বনিম্ন আকাশকে নক্ষত্র মন্ডলী দ্বারা সুশােভিত করেছি।’ আকাশের দিকে একটা নযর বুলানােই এই অপরূপ শােভা ও সৌন্দর্য দেখার জন্যে যথেষ্ট। বিশ্বজগতের সৃষ্টির ক্ষেত্রে সৌন্দর্য যে একটা ঈপ্সিত জিনিস, মহাবিশ্বের দিকে চোখ মেলে তাকালেই তা বুঝা যায়। মহাবিশ্বের প্রতিটা সৃষ্টি নযিরবিহীন এবং এগুলাের পারস্পরিক সমন্বয় এক অপরূপ শােভা ও সৌন্দর্যের সৃষ্টি করেছে। সৌন্দর্যই এর স্বাভাবিক ও স্থায়ী বৈশিষ্ট্য, ক্ষণস্থায়ী বা অস্থায়ী নয়। সৃষ্টির সৌন্দর্য এবং কাজের পূর্ণতা এই দুটোই এখানে সমভাবে পরিকল্পনার ভিত্তি হিসাবে বিদ্যমান। সব কিছুই এখানে পরিমিত এবং এর প্রত্যেকটা জিনিস নিজের করণীয় কাজ নিখুঁতভাবে সম্পন্ন করে থাকে। সামগ্রিকভাবে গােটা সৃষ্টিজগতই তাই অপরূপ সুন্দর। আর আকাশ ও আকাশের সর্বত্র বিস্তৃত নক্ষত্রমন্ডল প্রকৃতির সবচেয়ে সুন্দর ও চমকপ্রদ দৃশ্য। যে দীর্ঘ সময় এর দিকে তাকানো হােক ক্লান্তি বােধ হয় না। প্রতিটা গ্রহ তার প্রতিফলিত আলাে এবং প্রতিটা নক্ষত্র তার মিটিমিটি জ্যোতি এমনভাবে বিকিরণ করে যে, মনে হয় ওটা তােমার দিকে ভালোবাসার দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। তুমি যেই তার দিকে স্থিরভাবে তাকাও, অমনি সে চোখ বন্ধ করে ও নিজেকে লুকায়। আর যেই তুমি তার দিক থেকে চোখ সরাও, অমনি সে জ্বল জ্বল করে জ্বলতে থাকে। আর এক রাতের পর আর এক রাতে ক্রমান্তয়ে তার কক্ষপথ পরিবর্তন করতে থাকায় এমন এক উপভােগ্য মনােরম দৃশ্যের সৃষ্টি হয় যে, তা দেখে কারাে মনে ক্লান্তি ও একঘেয়েমি বােধ হয় না।
# আবার পরবর্তী আয়াতে বলা হচ্ছে যে, ‘এই সব গ্রহ-নক্ষত্র অন্যান্য কাজও করে থাকে। যেমন কতক নক্ষত্র শয়তানকে বিতাড়িত করার কাজে ব্যবহৃত হয়, যাতে শয়তান উর্ধ্বজগতের কাছে না যেতে পারে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, প্রত্যেক বিদ্রোহী শয়তানের কবল থেকে রক্ষা করার লক্ষ্যে। যাতে তারা উর্ধ্বজগতে কান পাততে না পারে এবং সকল দিক থেকে তাদের ওপর নিক্ষেপ করা হয়'(আয়াত ৭-১০) বস্তুত কিছু নক্ষত্র এমনও রয়েছে, যা আল্লাহদ্রোহী শয়তানদের কবল থেকে আকাশকে রক্ষা করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। উর্ধ্বজগতে যা কিছু হয়, তা যাতে তারা শুনতে না পায় সে জন্যে তাদের প্রতি উল্কা ছুঁড়ে মারা হয়। যখনই কোনাে শয়তান আড়ি পেতে কিছু শুনতে চেষ্টা করে, অমনি চারদিক থেকে উল্কা মেরে তাকে তাড়িয়ে দেয়া হয়। উপরন্তু আখেরাতে তার জন্যে আযাব নির্ধারিত রয়েছে। কখনাে কখনাে শয়তান অনেকের জন্যে কান পেতে উর্ধ্ব জগতের কিছু তথ্য সংগ্রহ করে, কিন্তু তৎক্ষণাত সমস্ত উল্কা এসে তাকে আঘাত করে জ্বালিয়ে ভস্মীডূত করে দেয়। শয়তান কিভাবে আড়ি পেতে শোনে, কিভাবে তথ্য সগ্রহ করে এবং কিভাবে জুলন্ত উল্ডার আঘাতে বিতাড়িত হয়, তা আমরা জানি না। কেননা এ সবই অদৃশ্য তত্ত্ব। আমাদের মানবীয় বিবেক বুদ্ধি এগুলাে কল্পনা করতে পারে না। এক্ষেত্রে আমাদের একমাত্র করণীয় হলাে যা কিছু আল্লাহ তায়ালা জানিয়েছেন তা বিশ্বাস করা। আমাদের চোখের সামনে যে প্রাকৃতিক জগত রয়েছে, তার সম্পর্কেও তাে আমরা ছিটেফোটা তথ্য ছাড়া কিছুই জানি না। সুতরাং যে জগত সম্পূর্ণ অদৃশ্য, তার সম্পর্কে আল্লাহর জানানাে তথ্যের বাইরে কিছু জানার তাে প্রশ্নই ওঠে না। এখানে প্রতিপাদ্য বিষয় এই যে, যে জাতি সম্পর্কে জাহেলী যুগের লােকদের ধারণা হচ্ছে, তারা আল্লাহর আত্মীয় তথা শালা-সম্বন্ধী ও স্বশুর ইত্যাদি, সেই জ্বিন বংশােদ্ভুত শয়তানদের উর্ধ্ব জগতের কাছেও ঘেঁষতে দেয়া হয় না এবং সেখানকার কিছুই শুনতে দেয়া হয় না। তাদের এই দাবী যদি সত্য হতাে, তাহলে ব্যাপারটা সম্পূর্ণ অন্য রকম হতাে। আল্লাহর তথাকথিত শালা-সম্বন্ধী ও শ্বশুরদের এমন শােচনীয় পরিণতি হতাে না এবং এভাবে তাদের তাড়ানো ও জ্বালানাে হতাে না। ফেরেশতা, আকাশ, পৃথিবী, আকাশ ও পৃথিবীর মাঝখানে বিরাজমান যাবতীয় সৃষ্টি, নিম্নতম আকাশকে সৌন্দর্যমন্ডিত করা এই নক্ষত্রমন্ডলী এবং বিদ্রোহী শয়তানদের দল ও তাদের বিতাড়নের বিষয় উল্লেখ করার পর আল্লাহ তায়ালা রসূল(স.)-কে নির্দেশ দিচ্ছেন যেন মােশরেকদের কাছে জিজ্ঞেস করেন, তাদের সৃষ্টি করা বেশী কঠিন, না এ সব সৃষ্টিকে সৃষ্টি করা। এসব সৃষ্টি যখন অধিকতর শক্তিশালী ও কঠিন, তখন তারা আখেরাতের জীবন নিয়ে বিস্মিত হচ্ছে কেন এবং ব্যংগ বিদ্রুপই বা করছে কেন? কেনই বা পরকালকে তারা অসম্ভব মনে করছে। কেননা দুনিয়ার সৃষ্টিজগতের সাথে আখেরাতের সৃষ্টির কোনাে তুলনাই চলে না।
# ‘অতপর তাদেরকে তুমি জিজ্ঞেস করাে, তাদের সৃষ্টি করা বেশী কঠিন, না আমি অন্য যাদের সৃষ্টি করেছি তাদের সৃষ্টি করা বেশী কঠিন?… ‘(আয়াত ১১-১৭) আল্লাহ তায়ালা বলছেন, ওদের জিজ্ঞেস করে, ফেরেশতা, আকাশ, পৃথিবী, আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যবর্তী সব কিছু, শয়তানরা, গ্রহ-নক্ষত্র, ও উল্কাগুলাে সবই যখন আল্লাহর সৃষ্টি, তখন এগুলাে সৃষ্টি করার চেয়ে কি তাদের সৃষ্টি করা বেশী কঠিন? এরপর আল্লাহ তায়ালা তাদের জবাবের অপেক্ষা করছেন না। কেননা ব্যাপারটা সুস্পষ্ট ও সুবিদিত। এ প্রশ্নের মাধ্যমে আসলে তাদের বিস্ময়কর অবস্থান সম্পর্কে বিস্ময় ও অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়েছে। চারপাশের সৃষ্টিজগতের প্রতি তাদের উদাসীনতায় ক্ষোভ এবং মােশরেকদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন জিনিসের মূল্যায়নে বিদ্রুপ করা হয়েছে। এ জন্যে তাদের প্রথম সৃষ্টির উপাদানটা কি তা তাদের জানানাে হচ্ছে। সে উপাদানটা হলাে নরম চটচটে মাটি, যা এই পৃথিবী থেকেই নেয়া হয়েছে। আর পৃথিবীটা হলাে আল্লাহর সেই শক্তিশালী সৃষ্টিগুলাের অন্যতম। আমি তাদের সৃষ্টি করেছি কাদামাটি থেকে।’ অতএব তাদের সৃষ্টি করা কিছুতেই সেসব সৃষ্টির চেয়ে কঠিন নয়। আর তা যখন নয়, তখন তাদের অবস্থা তাে বিস্ময়কর। অথচ তারা আল্লাহর নিদর্শনাবলী দেখে এবং ইহকাল ও পরকালের ব্যাপারে আল্লাহর প্রতিশ্রুতি দেখে ব্যংগ বিদ্রুপ করে। তাদের এই ব্যংগ বিদ্রুপ দেখে রসূল(স.)-এর মনে বিস্ময় জাগে। অথচ তারা তাদের বর্তমান ভূমিকা অব্যাহত রেখে চলেছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘বরং তুমি অবাক হচ্ছো আর তারা ঠাট্টা করছো।’ (আয়াত ১২-১৪) আর তাদের অবস্থা দেখে রসূল(স.)-এর অবাক হওয়া সম্পূর্ণ ন্যায়সংগত। কেননা মােহাম্মদ(স.) যেভাবে আল্লাহকে দেখেন, সেখানে যে মােমেন আল্লাহকে হৃদয়ের চোখ দিয়ে দেখে এবং আল্লাহর নিদর্শনাবলী এতাে সুস্পষ্টভাবে দেখতে পায়, সে মােমেন নিশ্চয়ই অবাক হবে যে, মানুষ কিভাবে এ সব নিদর্শন না দেখে পারে এবং কিভাবে সে এমন বিস্ময়কর অবস্থান গ্রহণ করে। রসূল(স.) যখন তাদের ব্যাপারে এতােই বিস্মিত, তখন তারা তাদের কাছে রসূল(স.) কর্তৃক উপস্থাপিত তাওহীদ ও আখেরাতের বিষয় নিয়ে ঠাট্টা বিদ্রুপ করে। এ সময় তাদের মন বিকৃত ও অচল হয়ে যায়, ফলে তা আর কোনাে উপদেশ গ্রহণ করে না। এ সময় তারা আল্লাহর নিদর্শনাবলীর প্রতি প্রচন্ড উপহাস বিদ্রুপ করে, বিস্ময় প্রকাশ করে। ‘ইয়াসতাসখিরূনা’ শব্দ দ্বারা উপহাসের প্রচন্ডতা প্রকাশ করা হয়েছে। এ জন্যেই কোরআন বলেছে, তারা বলেছে, এতাে প্রকাশ্য যাদু ছাড়া কিছু নয়। আমরা যখন মরে যাবাে এবং মাটি হয়ে যাবো, তখন কি আমরা পুনরুজ্জীবিত হবাে? আর আমাদের পূর্বপুরুষরা বস্তুত আল্লাহর অসীম কুদরতের যে নিদর্শনাবলী তাদের চারপাশে ও তাদের নিজ সত্ত্বার মধ্যে রয়েছে, সে সম্পর্কে তারা উদাসীন ছিলো। আকাশ, পৃথিবী ও উভয়ের মধ্যবর্তী সকল জিনিসের সৃষ্টিতে, গ্রহ নক্ষত্র ও উল্কাগুলাের সৃষ্টিতে, ফেরেশতা ও শয়তানদের সৃষ্টিতে এবং নরম কাদামাটি থেকে তাদের সৃষ্টিতে যে অসীম ক্ষমতার নিদর্শন রয়েছে, সে সম্পর্কে তারা সচেতন ছিলাে না। তারা ও তাদের পিতৃপুরুষদের মরে মাটি হয়ে যাওয়ার পর পুনরায় জীবিত হওয়া তারা অসম্ভব মনে করতাে। অথচ আল্লাহর অসীম ক্ষমতার পক্ষে এটা কিছুমাত্র অসম্ভব নয়। যদি তারা তাদের সত্ত্বায় ও চারপাশে বিরাজমান নিদর্শনাবলীর আলােকে চিন্তা ভাবনা করে। এ সব নিদর্শনাবলী নিয়ে তারা যখন ঠান্ডা মাথায় চিন্তা ভাবনা করে না, তখন আল্লাহ তায়ালা তাদের তীব্র শ্লেষাত্মক কথাবার্তা এবং আখেরাতের কষ্টকর দৃশ্যাবলী স্মরণ করিয়ে দেয়ার মাধ্যমে তাদের সচেতন করে দিচ্ছেন। ‘বলাে, হাঁ, আর তােমরা অপমানিত হবে।’ অর্থাৎ হাঁ, তােমরা ও তােমাদের পূর্বপুরুষেরা মরে মাটিতে মিশে যাওয়া সত্তেও পুনরুজ্জীবিত হবে, লাঞ্ছিত ও আত্মসমর্পিত হয়ে সমবেত হবে। কিভাবে হবে তাও জানিয়ে দেয়া হচ্ছে, ‘তারা এক বিরাট দৃশ্যের সামনে সমবেত হবে। সেখানে থাকবে যতােসব জীবন্ত দৃশ্যাবলী ও ধারাবাহিক কর্মকান্ড। এতে আলাপ আলােচনার মাধ্যমে পরিস্থিতির বিবরণ দেয়া হয়েছে, আবার বর্ণনার মাধ্যমেও এ সব বিবরণের মাঝে মাঝে বিভিন্ন মন্তব্য করা হয়েছে। এভাবে জীবনের সকল বৈশিষ্ট্য এতে ফুটে ওঠেছে। সেটা হবে শুধু একটা ধমক। এতে তারা তাকিয়ে থাকবে।’ এখানে ধমক বা ঝাজরা শব্দটার ভেতরে এক ধরনের কঠোরতা ও কষ্টের অনুভূতি বিদ্যমান। ‘তারা বলবে, হায় দুর্ভাগ্য আমাদের, এটা তাে বিচারের দিন।’ এভাবে তারা যখন বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে যাবে, তখন অপ্রত্যাশিতভাবে তাদের সামনে ঘােষণা করা হবে, ‘এ হচ্ছে সেই মীমাংসার দিন, যাকে তোমরা অবিশ্বাস করতে।’
*শেষ বিচার দিনের আলোচনা : এভাবে খবর থেকে সম্বোধনের দিকে চলে যাওয়া হয়েছে এবং যারা বিচারের দিনকে অবিশ্বাস করতাে, তাদের সম্বােধন করা হয়েছে। এটা একটা কঠোর ও চূড়ান্ত ঘােষণা। এরপর ফেরেশতাদের নির্দেশ দেয়া হচ্ছে ‘যারা যুলুম করেছে তাদের ও তাদের সহগামীদের সমবেত করাে।'(আয়াত ২২ -২৩)। অর্থাৎ যারা যুলুম ও অন্যায় করেছে তাদের ও তাদের মতাে পাপাচারীদের একত্রিত করাে। এখানে আদেশটিতে এক ধরনের বিদ্রুপ সুস্পষ্ট। বলা হয়েছে, তাদের জাহান্নামের পথে পরিচালিত করে। এখানে ‘হেদায়াত’ শব্দটা এমন স্থানে প্রয়ােগ করা হয়েছে, যেখানে হেদায়াতের চেয়ে বিপথগামিতাই ভালাে। যারা পৃথিবীতে সঠিক পথে পরিচালিত হয়নি, তাদের জন্যে এটা সঠিক জবাব। পৃথিবীতে তারা যখন সরল সঠিক পথ সিরাতুল মুসতাকীমে চালিত হয়নি, তখন আজ তাদের জাহান্নামের পথের দিকে চালিত হওয়াই ভালাে। পরবর্তী আয়াতে বলা হচ্ছে যে, তাদের জাহান্নামের পথে চালিত করা হবে, তখন তাদের জিজ্ঞেস করা হবে, ‘কি হলাে তােমাদের, তােমরা পরস্পরকে এখন সাহায্য করাে না কেন?’ অর্থাৎ তােমরা আজ এখানে সবাই সমবেত। তােমাদের প্রত্যেকের একজন সাহায্যকারী প্রয়ােজন। আজ তাে তােমাদের সাথে তােমাদের সেসব দেব দেবী রয়েছে, যাদের তােমরা পূজা করতে। স্বভাবতই এ প্রশ্নের জবাব থাকবে না তাদের কাছে। থাকবে না তাদের মুখে কোনাে কথা। তাই মহান আল্লাহ নিজেই মন্তব্য করছেন। ‘বরঞ্চ তারা আজ আত্মসমর্পিত।’ এরপর পুনরায় বিবরণ দেয়া হচ্ছে তাদের পরস্পরের বিতর্ক ও ঝগড়ার। তারা পরস্পর পরস্পরের দিকে এগিয়ে আসবে। বলবে, ‘তােমরা তাে ডান দিক থেকে আমাদের কাছে আসতে।’ অর্থাৎ তামরা আমাদের ডান দিক থেকে কুপ্ররােচণা দিয়ে যেতে। গােপন শলাপরামর্শের বেলায় সাধারণত এ রকমই হয়ে থাকে। বলা হচ্ছে, তােমরা যেহেতু আমাদের কুপ্ররােচণা দিতে। কাজেই আমাদের আজকের সমস্ত দুর্দশার জন্যে তােমরাই দায়ী। অভিযুক্তরা তৎক্ষণাত নিজেদের দোষ প্রক্ষালন করার জন্যে পাল্টা দোষারােপ করবে। তারা বলবে, ‘বরং তােমরাই ঈমান আননি।’ অর্থাৎ তােমরা ঈমান আনার পর আমাদের কুপ্ররােচণা তােমাদের বিপথগামী করতে পারে। ‘তােমাদের ওপর আমাদের কোনাে আধিপত্য ছিলাে না।’ অর্থাৎ তােমাদের অনিচ্ছা সত্তেও বল প্রয়ােগে আমাদের পছন্দনীয় বিষয় মেনে নিতে আমরা তোমাদের বাধ্য করেনি। ‘বরং তােমরাই বিপথগামী জাতি ছিলে।’ অর্থাৎ তােমরাই সীমা অতিক্রমকারী ছিলে। আমাদের ওপর আমাদের প্রভুর কথা খেটে গেছে। আমরা স্বাদ গ্রহণ করবাে। অর্থাৎ আমরা ও তােমরা আযাবের যােগ্য হয়ে গেছি। তাই আমাদের আযাবের স্বাদ গ্রহণ অনিবার্য। তােমরা আমাদের সাথে সাথে পদস্খলিত হয়েছে, এটাই তােমাদের বিপথগামী হবার কারণ। আমরা তােমাদের আমাদের অনুসারী হবার জন্যে কিছুই করছি না; বরং তােমরাই আমাদের কুপথের অনুসারী হয়েছো। তাই আমরা তােমাদের বিপথগামী করেছি। কেননা আমরা নিজেরাও ছিলাম বিপথগামী। এখানে আরাে একটা মন্তব্য করা হয়েছে, যেন জনসমক্ষে একটা ফয়সালা ঘােষণা করা হয়েছে। এতে এ ফয়সালার কারণও বলা হয়েছে। দুনিয়াতে তারা যা যা করেছে তাও প্রকাশ করা হয়েছে। এর কারণেই শাস্তি অবধারিত হয়েছে।
# তারা সেদিন আযাবে শরীক থাকবে।'(আয়াত ৩৩-৩৬) এরপর এই মন্তব্যকে পূর্ণতা দেয়া হয়েছে এই ধিকৃত কথার বক্তাদের নিন্দা ও সমালােচনার মাধ্যমে। বরঞ্চ তিনি সত্য নিয়ে এসেছেন এবং রসূলদের সমর্থন করেছেন…'(আয়াত৩৭-৩৯) যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি লাভ করবে।

Leave a Reply