أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#১০৭৫)
[* আনুগত্য, কোরবানি , আত্মসমর্পণের ও হিকমত এর দৃষ্টান্ত :-]
www.motaher21.net
সূরা:- ৩৭:সাফফাত
পারা:২৩
৭৫-১১৩ নং আয়াত:-
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-৭৫
وَ لَقَدۡ نَادٰىنَا نُوۡحٌ فَلَنِعۡمَ الۡمُجِیۡبُوۡنَ ﴿۫ۖ۷۵﴾
নূহ আমাকে ডেকেছিল,৪০ তাহলে দেখো, আমি ছিলাম কত ভালো জওয়াবদাতা।
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-৭৬
وَ نَجَّیۡنٰہُ وَ اَہۡلَہٗ مِنَ الۡکَرۡبِ الۡعَظِیۡمِ ﴿۫ۖ۷۶﴾
আমি তাঁকে ও তাঁর পরিবারবর্গকে উদ্ধার করি ভয়াবহ যন্ত্রণা থেকে,
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-৭৭
وَ جَعَلۡنَا ذُرِّیَّتَہٗ ہُمُ الۡبٰقِیۡنَ ﴿۫ۖ۷۷﴾
শুধু তাঁর বংশধরদেরকেই টিকিয়ে রাখি।
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-৭৮
وَ تَرَکۡنَا عَلَیۡہِ فِی الۡاٰخِرِیۡنَ ﴿۫ۖ۷۸﴾
আমি তা পরবর্তীদের স্মরণে রেখেছি,
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-৭৯
سَلٰمٌ عَلٰی نُوۡحٍ فِی الۡعٰلَمِیۡنَ ﴿۷۹﴾
সমগ্র সৃষ্টির মধ্যে নূহের প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক।
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-৮০
اِنَّا کَذٰلِکَ نَجۡزِی الۡمُحۡسِنِیۡنَ ﴿۸۰﴾
এভাবেই আমি সৎকর্মপরায়ণদেরকে পুরস্কৃত করে থাকি;
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-৮১
اِنَّہٗ مِنۡ عِبَادِنَا الۡمُؤۡمِنِیۡنَ ﴿۸۱﴾
নিশ্চয় তিনি ছিলেন আমাদের মুমিন বান্দাদের অন্যতম।
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-৮২
ثُمَّ اَغۡرَقۡنَا الۡاٰخَرِیۡنَ ﴿۸۲﴾
অবশিষ্ট সকলকে আমি নিমজ্জিত করেছিলাম;
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-৮৩
وَ اِنَّ مِنۡ شِیۡعَتِہٖ لَاِبۡرٰہِیۡمَ ﴿ۘ۸۳﴾
নিশ্চয় ইব্রাহীম তার অনুসারীদের একজন।
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-৮৪
اِذۡ جَآءَ رَبَّہٗ بِقَلۡبٍ سَلِیۡمٍ ﴿۸۴﴾
স্মরণ করুন, যখন তিনি তার রবের কাছে উপস্থিত হয়েছিলেন বিশুদ্ধচিত্তে ;
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-৮৫
اِذۡ قَالَ لِاَبِیۡہِ وَ قَوۡمِہٖ مَاذَا تَعۡبُدُوۡنَ ﴿ۚ۸۵﴾
যখন তিনি তার পিতা ও তার সম্পপ্রদায়কে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘তোমরা কিসের ইবাদাত করছ?
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-৮৬
اَئِفۡکًا اٰلِہَۃً دُوۡنَ اللّٰہِ تُرِیۡدُوۡنَ ﴿ؕ۸۶﴾
আল্লাহকে বাদ দিয়ে কি তোমরা মিথ্যা বানোয়াট মাবুদ চাও?
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-৮৭
فَمَا ظَنُّکُمۡ بِرَبِّ الۡعٰلَمِیۡنَ ﴿۸۷﴾
সমস্ত বিশ্ব-জগতের রব আল্লাহ সম্পর্কে তোমাদের ধারণা কি?”
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-৮৮
فَنَظَرَ نَظۡرَۃً فِی النُّجُوۡمِ ﴿ۙ۸۸﴾
অতঃপর তিনি তারকারাজির দিকে একবার তাকালেন,
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-৮৯
فَقَالَ اِنِّیۡ سَقِیۡمٌ ﴿۸۹﴾
এবং বলল, ‘আমি অসুস্থ।’
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-৯০
فَتَوَلَّوۡا عَنۡہُ مُدۡبِرِیۡنَ ﴿۹۰﴾
কাজেই তারা তাঁকে ত্যাগ করে চলে গেলো।
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-৯১
فَرَاغَ اِلٰۤی اٰلِہَتِہِمۡ فَقَالَ اَلَا تَاۡکُلُوۡنَ ﴿ۚ۹۱﴾
পরে তিনি চুপিচুপি তাদের দেবতাগুলোর কাছে গেলেন এবং বললেন, ‘তোমরা খাদ্য গ্রহণ করছ না কেন?’
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-৯২
مَا لَکُمۡ لَا تَنۡطِقُوۡنَ ﴿۹۲﴾
‘তোমাদের কী হয়েছে যে তোমরা কথা বল না?’
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-৯৩
فَرَاغَ عَلَیۡہِمۡ ضَرۡبًۢا بِالۡیَمِیۡنِ ﴿۹۳﴾
অতঃপর তিনি তাদের উপর সবলে আঘাত হানলেন।
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-৯৪
فَاَقۡبَلُوۡۤا اِلَیۡہِ یَزِفُّوۡنَ ﴿۹۴﴾
(ফিরে এসে) তারা দৌঁড়ে তাঁর কাছে এলো।
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-৯৫
قَالَ اَتَعۡبُدُوۡنَ مَا تَنۡحِتُوۡنَ ﴿ۙ۹۵﴾
তিনি বললেন, ‘তোমরা নিজেরা যাদেরকে খোদাই করে নির্মাণ কর তোমরা কি তাদেরই ইবাদাত কর?
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-৯৬
وَ اللّٰہُ خَلَقَکُمۡ وَ مَا تَعۡمَلُوۡنَ ﴿۹۶﴾
অথচ আল্লাহই তোমাদেরকেও সৃষ্টি করেছেন এবং তোমরা যে জিনিসগুলো তৈরি করো তাদেরকেও।”
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-৯৭
قَالُوا ابۡنُوۡا لَہٗ بُنۡیَانًا فَاَلۡقُوۡہُ فِی الۡجَحِیۡمِ ﴿۹۷﴾
তারা বলল, ‘এর জন্য এক অগ্নিকুন্ড তৈরী কর, অতঃপর একে জ্বলন্ত অগ্নিতে নিক্ষেপ কর।’
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-৯৮
فَاَرَادُوۡا بِہٖ کَیۡدًا فَجَعَلۡنٰہُمُ الۡاَسۡفَلِیۡنَ ﴿۹۸﴾
তারা তাঁর বিরুদ্ধে একটি পদক্ষেপ নিতে চেয়েছিল কিন্তু আমি তাদেরকে হেয়প্রতিপন্ন করেছি।
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-৯৯
وَ قَالَ اِنِّیۡ ذَاہِبٌ اِلٰی رَبِّیۡ سَیَہۡدِیۡنِ ﴿۹۹﴾
তিনি বললেন, ‘আমি আমার রবের দিকে চললাম , তিনি আমাকে অবশ্যই হেদায়াত করবেন,
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-১০০
رَبِّ ہَبۡ لِیۡ مِنَ الصّٰلِحِیۡنَ ﴿۱۰۰﴾
‘হে আমার রব! আমাকে এক সৎকর্মপরায়ণ সন্তান দান করুন।’
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-১০১
فَبَشَّرۡنٰہُ بِغُلٰمٍ حَلِیۡمٍ ﴿۱۰۱﴾
সুতরাং আমি তাকে এক ধৈর্যশীল পুত্রের সুসংবাদ দিলাম।
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-১০২
فَلَمَّا بَلَغَ مَعَہُ السَّعۡیَ قَالَ یٰبُنَیَّ اِنِّیۡۤ اَرٰی فِی الۡمَنَامِ اَنِّیۡۤ اَذۡبَحُکَ فَانۡظُرۡ مَاذَا تَرٰی ؕ قَالَ یٰۤاَبَتِ افۡعَلۡ مَا تُؤۡمَرُ ۫ سَتَجِدُنِیۡۤ اِنۡ شَآءَ اللّٰہُ مِنَ الصّٰبِرِیۡنَ ﴿۱۰۲﴾
অতঃপর তিনি যখন তার পিতার সাথে কাজ করার মত বয়সে উপনীত হলেন, তখন ইবরাহীম বললেন, ‘হে প্রিয় বৎস! আমি স্বপ্নে দেখি যে, তোমাকে আমি যবেহ করছি, এখন তোমার অভিমত কি বল?’ তিনি বললেন, ‘হে আমার পিতা! আপনি যা আদেশপ্ৰাপ্ত হয়েছেন তা-ই করুন। আল্লাহর ইচ্ছায় আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন।’
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-১০৩
فَلَمَّاۤ اَسۡلَمَا وَ تَلَّہٗ لِلۡجَبِیۡنِ ﴿۱۰۳﴾ۚ
অতঃপর যখন তারা উভয়ে আনুগত্য প্রকাশ করলেন এবং ইবরাহীম তার পুত্রকে উপুড় করে শায়িত করলেন,
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-১০৪
وَ نَادَیۡنٰہُ اَنۡ یّٰۤاِبۡرٰہِیۡمُ ﴿۱۰۴﴾ۙ
এবং আমি আওয়াজ দিলাম,“হে ইবরাহীম!
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-১০৫
قَدۡ صَدَّقۡتَ الرُّءۡیَا ۚ اِنَّا کَذٰلِکَ نَجۡزِی الۡمُحۡسِنِیۡنَ ﴿۱۰۵﴾
আপনি তো স্বপ্নের আদেশ সত্যই পালন করলেন!’—এভাবেই আমরা মুহসিনদেরকে পুরস্কৃত করে থাকি।
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-১০৬
اِنَّ ہٰذَا لَہُوَ الۡبَلٰٓـؤُا الۡمُبِیۡنُ ﴿۱۰۶﴾
নিশ্চয় এটা এক সুস্পষ্ট পরীক্ষা।’
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-১০৭
وَ فَدَیۡنٰہُ بِذِبۡحٍ عَظِیۡمٍ ﴿۱۰۷﴾
একটি বড় কুরবানীর বিনিময়ে আমি তাকে ছাড়িয়ে নিলাম ।
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-১০৮
وَ تَرَکۡنَا عَلَیۡہِ فِی الۡاٰخِرِیۡنَ ﴿۱۰۸﴾ۖ
আর এ বিষয়টি পরবর্তীদের জন্য স্মরণীয় করে রাখলাম।
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-১০৯
سَلٰمٌ عَلٰۤی اِبۡرٰہِیۡمَ ﴿۱۰۹﴾
ইবরাহীমের উপর শান্তি বৰ্ষিত হোক।
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-১১০
کَذٰلِکَ نَجۡزِی الۡمُحۡسِنِیۡنَ ﴿۱۱۰﴾
নিশ্চয় আমি এইভাবে সৎকর্মপরায়ণদেরকে প্রতিদান দিয়ে থাকি।
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-১১১
اِنَّہٗ مِنۡ عِبَادِنَا الۡمُؤۡمِنِیۡنَ ﴿۱۱۱﴾
নিশ্চয় তিনি ছিলেন আমাদের মুমিন বান্দাদের অন্যতম;
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-১১২
وَ بَشَّرۡنٰہُ بِاِسۡحٰقَ نَبِیًّا مِّنَ الصّٰلِحِیۡنَ ﴿۱۱۲﴾
আর আমরা তাকে সুসংবাদ দিয়েছিলাম ইসহাকের, তিনি ছিলেন এক নবী, সৎকর্মপরায়ণদের অন্যতম।
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-১১৩
وَ بٰرَکۡنَا عَلَیۡہِ وَ عَلٰۤی اِسۡحٰقَ ؕ وَ مِنۡ ذُرِّیَّتِہِمَا مُحۡسِنٌ وَّ ظَالِمٌ لِّنَفۡسِہٖ مُبِیۡنٌ ﴿۱۱۳﴾٪
বরকত দিলাম তাঁকে ও ইসহাককে, এখন এ দু’জনের বংশধরদের মধ্য থেকে কতক সৎকর্মকারী আবার কতক নিজেদের প্রতি সুস্পষ্ট জুলুমকারী।
ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
আলােচ্য সূরার পূর্বের প্রসংগ ছিলাে পরকালীন জীবন এবং জান্নাত ও জাহান্নামের আলােচনা। এখন আলােচনা করা হচ্ছে কালের গহ্বরে হারিয়ে যাওয়া পূর্ববর্তী বিভিন্ন জাতি ও সম্প্রদায়ের বিষয়টি। এই আলােচনায় স্থান পাচ্ছে মানবতার উষালগ্ন হতে চলে আসা হেদায়াত ও গােমরাহীর দীর্ঘ কাহিনী । যুগে যুগে ও দেশে দেশে যে কাহিনীর পুনরাবৃত্তি ঘটে চলেছে। এর প্রমাণ পাই আমরা মক্কার কাফের মােশরেক সম্প্রদায়ের মাঝে। এরা আল্লাহর রসূলকে অস্বীকার করে এবং তার দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করে সেই ভ্রষ্ট ও আল্লাহদ্রোহী লোকদের কাতারেই শামিল হয়েছে। কাজেই এদের পরিণতিও তাই হবে যা তাদের পূর্বসূরীদের হয়েছে। এই পরিণতির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যেই অতীতের সেই ভুলে যাওয়া ঘটনাগুলাের উল্লেখ করা হয়েছে। এর মাধ্যমে মােমেনদেরও সান্তনা দেয়া হচ্ছে এবং তাদের জানিয়ে দেয়া হচ্ছে আল্লাহর মদদ ও সাহায্য তাদের সাথে রয়েছে। কারণ তিনি অতীতে কখনও মােমেনদের অসহায় অবস্থায় ছেড়ে যাননি। অতীতের এসব ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে আংশিকভাবে নূহ, ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক মুসা, হারুন, ইলিয়াস, লুত এবং ইউনুস প্রমুখ নবী-রসূলদের ঘটনাও বর্ণনা করা হয়েছে। বিশেষ করে এবং দীর্ঘ আকারে ইবরাহীম(আ.) ও ইসমাঈল(আ.)-এর ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। এই ঘটনার ভেতর দিয়ে বিশ্বাস, ত্যাগ ও আনুগত্যের মহিমা ফুটে উঠেছে, ফুটে উঠেছে ইসলামের সত্যিকার রূপ ও পরিচয়। যার ধারক ও বাহক ছিলেন ইবরাহীম(আ.) ও ইসমাঈল(আ.)। তাই এই সূরার প্রতিপাদ্য বিষয়ই হচ্ছে এসব ঘটনা। বলা হয়েছে, তারা তাদের পূর্বপুরুষদের পেয়েছিলাে বিপথগামী অর্থাৎ ওদের গােমরাহী ও ভ্রষ্টতার শিকড় গভীরে প্রােথিত। একই সাথে ওরা হচ্ছে অন্ধ অনুসারী, ওরা চিন্তা-ভাবনা করে না, বিচার-বিবেচনা করে না; বরং না দেখে এবং না বুঝেই। পূর্বপুরুষদের ভুল পথে ধাবিত হয়। ফলে পূর্বপরুষদের ন্যায় এরাও বিপথগামী। সাবধান সতর্ক করার পরও তারা সেই ভুল পথেরই অনুসরণ করে চলেছে। তাই এদের পরিণতি কি হবে এবং আল্লাহর খাঁটি বান্দাদের কি পরিণতি হবে সে সম্পর্কে ইংগিতময় ভাষা ব্যবহার করে বলা হচ্ছে, নূহ(আ.)-এর ঘটনার মাধ্যমে কাফেরদের পরিণতি এবং নেক বান্দাদের প্রতি আল্লাহর বিশেষ দয়া ও রহমতের বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘আর নূহ আমাকে ডেকেছিলাে, তখন আমি কি চমৎকারতাবে তার ডাকে সাড়া দিয়েছিলাম…'(আয়াত ৭৫-৮২) আলােচ্য আয়াতে বলা হয়েছে যে, নূহ(আ.) নিজ মালিক ও প্রভুকে ডাকছেন আর প্রভু তার ডাকে সাড়া দিচ্ছেন। শুধু সাড়াই দিচ্ছেন না; বরং উত্তমভাবে ও পরিপূর্ণরূপে সাড়া দিচ্ছেন। তাকে এবং তার পরিবার পরিজনকে মহা প্রলয়ের কবল থেকে রক্ষা করেছেন। মহা প্লাবনের কঠিন আঘাত থেকে রক্ষা করেছেন। এই সেই মহাপ্লাবন। যার করালগ্রাস থেকে কেবল তারাই রক্ষা পেয়েছে যাদের প্রতি আল্লাহর দয়া ছিলো, করুণা ছিলাে। আয়াতে আরও বলা হয়েছে যে, আল্লাহ তায়ালা নুহ(আ.)-এর বংশধরদের মাধ্যমে এই পৃথিবীকে আবাদ করবেন এবং তার স্মৃতিকে যুগ যুগ ধরে পরবর্তী বংশধরদের জন্যে টিকিয়ে রাখবেন। তার প্রতি আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষভাবে শান্তি বর্ষিত হবে। বলা হচ্ছে, ‘বিশ্ববাসীর মধ্যে নূহের প্রতি শান্তি বর্ষিত হােক। যেখানে স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা কারও প্রতি শান্তি বর্ষণ করেন তার আর কি চাওয়ার আছে। কারণ, এর চেয়ে বড় প্রতিদান আর কিছুই হতে পারে না। এরপর রয়েছে অমর স্মৃতির নিশ্চয়তা। এই প্রতিদান আর এই কৃপা হচ্ছে আল্লাহর প্রতি দৃঢ় ঈমানের বিনিময়। বলা হয়েছে, ‘সে ছিলাে আমার ঈমানদার বান্দাদের অন্যতম।'(আয়াত ৮১) এটাই হচ্ছে মােমেন সম্প্রদায়ের শেষ পরিণতি। অপরদিকে নূহ(আ.)-এর জাতির মধ্যে যারা কাফের ছিলাে অবিশ্বাসী ছিলো, তাদের পরিণতি হচ্ছে ধ্বংস ও বিনাশ। তাই বলা হয়েছে, ‘অতপর আমি অপরাপর সবাইকে নিমজ্জিত করেছিলাম।'(আয়াত ৮২) মানব জাতির উষালগ্ন থেকেই আল্লাহর এই শাশ্বত ও চিরন্তন নিয়ম চলে আসছে। অর্থাৎ অবিশ্বাসী সম্প্রদায়ের পরিণতি ধ্বংস, আর বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের মুক্তি ও কল্যাণ। এরপর আসছে ইবরাহীম(আ.)-এর ঘটনা। এই ঘটনা দুটো মূল পর্বে বর্ণিত হচ্ছে। প্রথম পর্বে এসেছে তার দাওয়াত ও তাবলীগের বর্ণনা, প্রতিমা ভাংগার বর্ণনা, তাকে হত্যা করার বর্ণনা এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে তাকে রক্ষা ও তার শত্রুদের লাঞ্ছিত অপমানিত করার বর্ণনা। এই বর্ণনা ইতিপূর্বে অন্যান্য সূরাতেও এসেছে, কিন্তু এই ঘটনার দ্বিতীয় পর্বটি বর্ণনা সম্পূর্ণ নতুন। এই বর্ণনা ইতিপূর্বে অন্য কোনাে সূরায় আসেনি। পর্বটি হচ্ছে তার স্বপ্ন, সন্তান যবাই করা এবং পরিশেষে আল্লাহর পক্ষ থেকে বিকল্প কোরবানী সংক্রান্ত। এই পর্বটি বিশদভাবে, অত্যন্ত আবেগময় ভাষা ও মনকে নাড়া দেয়ার মতাে বর্ণনা ভংগির মাধ্যমে আলােচিত হয়েছে। আনুগত্য, উৎসর্গ, কোরবানী এবং আত্মসমর্পণের এমন দৃষ্টান্ত ও রূপ গােটা মানব ইতিহাসে বিরল।
* পৌত্তলিকদের সাথে হযরত ইবরাহীমের সংঘাত : ঘটনার প্রথম পর্বের বর্ণনা দিতে গিয়ে আয়াতে বলা হয়েছে, আর নূহ(আ.)-এর সম্প্রদায়েরই একজন ছিলাে ইবরাহীম(আ.)…'(আয়াত ৮৩-৮৭) নূহ(আ.)-এর ঘটনার সূত্র ধরেই ইবরাহীম(আ.)-এর ঘটনার অবতারণা করা হয়েছে। কারণ উভয়েরই আদর্শ অভিন্ন, মিশন অভিন্ন এবং পথও অভিন্ন। উভয়ের যুগের মাঝে বিরাট ব্যবধান থাকা সত্তেও ইবরাহীম(আ.)-কে নুহ(আ.)-এর সম্প্রদায়েরই একজন রূপে গণ্য করা হয়েছে। কারণ, দুজনের দুটো পথ একই কেন্দ্র থেকে বের হয়েছে, একই কেন্দ্রে গিয়ে মিলিত হয়েছে এবং একই লক্ষ্যপানে প্রসারিত হয়েছে। ইবরাহীম(আ.)-এর হৃদয়ের পরিচ্ছন্নতা, আকীদা বিশ্বাসের বিশুদ্ধতা এবং বিবেকের অকৃত্রিমতার প্রতি ইংগিত করে বলা হয়েছে, ‘যখন সে তার পালনকর্তার কাছে সন্তুষ্ট চিত্তে উপস্থিত হয়েছিলাে।'(আয়াত ৮৪) আলোচ্য আয়াতের ভাব ও ভাষায় যে বিষয়টি ফুটে উঠেছে তা হলাে, আল্লাহর প্রতি ইবরাহীম(আ.)-এর অগাধ বিশ্বাস এবং পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ। তার হৃদয় ছিলাে সুস্থ, পবিত্র, আবিলতামুক্ত, পঙ্কিলতামুক্ত এবং সুস্থ। সুস্থতা এমন একটি শব্দ যার আওতায় একাধিক গুণবৈশিষ্ট্য আসতে পারে। এই শব্দ দ্বারা পবিত্রতা, স্বচ্ছতা, অকপটতা এবং চারিত্রিক নির্মলতা বুঝায়। তা সত্তেও শব্দটি শুনতে সহজ সরল মনে হয় এবং এর দ্বারা যে অর্থ প্রকাশ পায়, তা এই সবগুলাে বিশেষণ একত্র করেও প্রকাশ পাবে না। এটা হচ্ছে পবিত্র কোরআনের অপূর্ব বর্ণনাভংগির একটা নযির। ইবরাহীম(আ.) যেহেতু সুস্থ ও পবিত্র মন-মানসিকতার অধিকারী ছিলেন, তাই তিনি স্বজাতির ভ্রষ্টতা ও গােমরাহীকে মেনে নিতে পারেন নি। তিনি তা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছেন, নিন্দা করেছেন। যারা সুস্থ বিবেক ও মন-মানসিকতার অধিকারী, যারা সৎ স্বভাবের অধিকারী এবং সৎচিন্তা ও আচরণের অধিকারী, তারা সেই জাতীয় ভ্রষ্টতার নিন্দা না জানিয়ে পারে না। আর সেই কারণেই ইবরাহীম(আ.) স্বজাতিকে লক্ষ্য করে বলেন, ‘যখন সে তার পিতা ও সম্প্রদায়কে বলেছিলাে, তােমরা কিসের উপাসনা করছাে?'(আয়াত ৮৫-৮৭) ইবরাহীম(আ.) স্বচক্ষেই দেখেছেন, তার সম্প্রদায়ের লােকেরা নিজ হাতে গড়া মূর্তি ও প্রতিমার পূজা করছে। তারপরও তিনি নিন্দার সুরে ও উচ্চকণ্ঠে তাদের জিজ্ঞেস করছেন, ‘তােমরা কিসের উপাসনা করছো’?’ এই প্রশ্ন তিনি করেছেন তাঁর পাপ পংকিলতামুক্ত সুস্থ বিবেকের তাড়নায়ই। কারণ তারা যেসব জড় পদার্থের উপাসনা করছে তা আদৌ উপাসনার পাত্র নয় এবং তাদেরও উচিত নয় এ সবের উপাসনা করা। মানুষ যখন সত্যের ব্যাপারে সন্দেহের বশবর্তী হয়ে গায়রুল্লাহর উপাসনা করে, তখন সেটা নিছক অপবাদ ও নিরেট মিথ্যায়ই পর্যবসিত হয়। তাই ইবরাহীম(আ.) তার সম্প্রদায়ের লােকদের জিজ্ঞেস করছেন, ‘তােমরা কি স্বেচ্ছায় সজ্ঞানে এই মিথ্যা অপবাদের দিকে পা বাড়াচ্ছাে? আলােচ্য আয়াতে তার বক্তব্য এভাবে তুলে ধরা হয়েছে, ‘তোমরা কি আল্লাহ ব্যতীত মিথ্যা উপাস্য কামনা করছো? বিশ্বজগতের পালনকর্তা সম্পর্কে তােমাদের ধারণা কি?'(আয়াত ৮৬-৮৭) অর্থাৎ বিশ্বজগতের যিনি স্রষ্টা এবং প্রতিপালক, তার সম্পর্কে তােমাদের ধারণা কি এতােই নিচু? নিজ হাতে গড়া মূর্তির মাঝে তার অস্তিত্ব খুঁজছো? এই প্রশ্নের মাঝে এক ধরনের নিন্দা ও ভৎর্সনা রয়েছে, যা কেবল পংকিলতামুক্ত ও সুস্থ বিবেকের কারণেই প্রকাশ পেয়ে থাকে। আর সেই জাতীয় প্রশ্ন তখনই দেখা দেয় যখন এমন কিছুর প্রকাশ ঘটে যা অনুভূতি এবং বিবেক বুদ্ধিকে আঘাত করে। প্রশ্নের উত্তরে ইবরাহীম(আ.)-এর সম্প্রদায়ের লােকেরা কি বলেছিলাে সে কথা এখানে উল্লেখ করা হয়নি; বরং এই প্রকাশ্য গােমরাহী ও ভ্রষ্টতার বিরুদ্ধে ইবরাহীম(আ.) মনের মাঝে কি দৃঢ় সংকল্প পােষণ করছিলেন সে প্রসংগ পরবর্তী আয়াতে এসেছে।
# ‘অতপর সে একবার তারকাদের প্রতি লক্ষ্য করলাে এবং বললাে, আমি পীড়িত…'(আয়াত ৮৮-৯৩) বর্ণিত আছে, সেদিন ছিলাে তাদের উৎসবের দিন। খুব সম্ভবত নওরােজ বা নববর্ষের দিন হবে। এই দিন তারা মূর্তির সামনে ফলের নৈবেদ্য পেশ করে আনন্দ ফুর্তি করার জন্য উদ্যানে যেতাে, নির্জন স্থানে যেতাে। আনন্দ ফুর্তি শেষে তারা ফিরে আসতাে এবং মূর্তির সামনে রাখা নৈবেদ্য গ্রহণ করতাে। ইবরাহীম(আ.) যখন তার সম্প্রদায়ের লােকদের কাছ থেকে কোনাে সদুত্তর না পেয়ে নিরাশ হয়ে পড়লেন, তাদের আদর্শিক ও নৈতিক পতন এবং পদস্খলনের ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে গেলেন তখন তিনি মনে মনে একটা সংকল্প নিলেন এবং এই উৎসবের দিনটির জন্যে অপেক্ষা করতে থাকলেন। তিনি জাতির বিপথগামিতা ও চূড়ান্ত পর্যায়ের ভ্রষ্টতার কারণে মানসিকভাবে ভেংগে পড়েছিলেন, দৈহিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। এই জন্যে যখন তাকে উপাসনালয় ত্যাগ করার কথা বলা হলো, তখন আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমি অসুস্থ’, বাইরে গিয়ে ঘােরাফেরা ও আনন্দ ফুর্তি করার মতাে শারীরিক অবস্থা আমার নেই। কারণ বাগানে ও উদ্যানে তাে কেবল তারাই যায়, যাদের মনে আনন্দ থাকে, ফুর্তি থাকে; যাদের মন চিন্তামুক্ত এবং ভাবনামুক্ত থাকে, কিন্তু ইবরাহীম(আ.)-এর মনে শান্তি ছিলাে না, আনন্দ ছিলাে না। তাই তিনি যা বলেছেন তা নিজের মানসিক অশান্তি ও দৈহিক ক্লান্তি প্রকাশ করার জন্যেই বলেছেন যেন সম্প্রদায়ের লােকেরা তাকে বিরক্ত করতে না পারে। এটা তার পক্ষ থেকে কোনো মিথ্যা বক্তব্য ছিলাে না; বরং সেই উৎসবের দিনে তার প্রকৃত অবস্থা যা ছিলাে তাই তিনি অকপটে জানিয়ে দিয়েছেন। বিরক্তি বিড়ম্বনাও যে কখনও কখনও অসুস্থতা এবং পীড়ার কারণ হয়ে দাড়ায় এটা একটা বাস্তব সত্য, যা অস্বীকার করার উপায় নেই। উৎসবের অনুষ্ঠানাদিতে যােগ দেয়ার জন্যে সম্প্রদায়ের লােকেরা যেহেতু ব্যতিব্যস্ত ছিলো, তাই ইবরাহীম(আ.)-এর অবস্থা তলিয়ে দেখার মতাে সময় তাদের ছিলাে না। ফলে তাঁকে ওখানেই ফেলে রেখে তারা চলে যায় এবং নিজেদের আনন্দ উৎসবে মেতে ওঠে, আর এভাবেই তিনি সেই মােক্ষম সুযােগটি পেয়ে যান যার অপেক্ষায় প্রহর গুণছিলেন। তিনি দ্রুত ওদের দেব-দেবীর কাছে চলে যান। সেখানে মজার মজার খাবার আর তরতাজা ফল রাখা ছিলাে। তিনি রাগের স্বরে বললেন, কি ব্যাপার, তােমরা খাচ্ছ না কেন?’ স্বভাবতই তিনি সেই মূর্তিগুলাের কাছ থেকে এর কোনাে উত্তর পেলেন না। ফলে তিনি আরও রেগে যান এবং তাচ্ছিল্যভরে পুনরায় প্রশ্ন করেন, কি হয়েছে তােমাদের? তােমরা কথা বলছো না কেন?’ এসব প্রশ্নের মধ্য দিয়ে একটা চিরাচরিত মানসিক অবস্থারই প্রতিফলন ঘটেছে। এই অবস্থার বশবর্তী হয়ে মানুষ এমন সব বস্তুকেও সম্বােধন করে কথা বলে, যেগুলাের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে তার জানা থাকে এবং সে ভাল করেই জানে, এসব বস্তুর মাঝে শ্রবণেরও শক্তি নেই এবং বলারও শক্তি নেই। ঠিক এই পর্যায়ের মানসিক অবস্থারই শিকার হয়েছিলেন ইবরাহীম(আ.) যখন তিনি স্বজাতির ভ্রষ্টতার নমুনা স্বচক্ষে দেখতে পান এবং তাদের মনগড়া উপাসের মুখােমুখি হন। যা হােক, এবারও তিনি কোনাে উত্তর পেলেন না। ফলে তার মনের ভেতর জমে ওঠা ক্রোধ এবার কথায় নয়; বরং কাজে প্রকাশ পেয়ে যায়। অর্থাৎ তিনি ‘প্রবল আঘাতে তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন।’ আর এর মাধ্যমেই তিনি মানসিক অসুস্থতা, বিষন্নতা ও চাপ থেকে নিষ্কৃতি পান। ঘটনার সমাপ্তি এভাবেই ঘটে। এরপর আসছে নতুন ঘটনা।
# সম্প্রদায়ের লােকেরা ফিরে এসে তাদের দেব-দেবীর করুণ অবস্থা দেখে শিউরে ওঠে। এরপর তারা কি কি করেছিলাে তার বিস্তারিত বিবরণ এখানে নেই, অন্য সূরায় আছে। সেখানে বলা হয়েছে, তারা অপরাধীকে চিহ্নিত করার জন্যে জিজ্ঞেসাবাদ করে, তদন্ত চালায়। অবশেষে তারা এই ধৃষ্টতাপূর্ণ কাজের নায়ককে ধরতে সক্ষম হয়। এখানে কেবল ইবরাহীম(আ.)-এর মুখোমুখি হয়ে তারা কি করলাে সে কথায়ই বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘তখন লােকজন তার দিকে ছুটে এলাে ভীতসন্ত্রস্ত পদে।'(আয়াত ৯৪) অর্থাৎ লােকজনের মাঝে খবরটি জানাজানি হযে যায় এবং তারা বুঝতে পারে, কাজটি কে করেছে। ফলে তারা দ্রুত তার কাছে ছুটে আসে। বিক্ষুব্ধ ও ক্রুদ্ধ জনতা তার চার পাশে ভিড় জমাতে থাকে এবং উচ্চ স্বরে কথা বলতে থাকে। তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ একা; কিন্তু ঈমানের বলে ছিলেন বলীয়ান। সঠিক পথটি তার জানা ছিলাে। নিজের উপাস্যের ব্যাপারে তার সুস্পষ্ট ধারণা ছিলাে। নিজের আকীদা বিশ্বাস ও আদর্শের রূপরেখা এবং চৌহদ্দি তার জানা ছিলাে। এই আকীদা বিশ্বাস তিনি নিজের মাঝে অনুভব করেন, নিজের আশপাশের জগতে এর দৃষ্টান্ত দেখতে পান। তাই তিনি একা হলেও এই উদভ্রান্ত ও উত্তেজিত বিশাল জনগােষ্ঠীর তুলনায় ছিলেন অধিক শক্তিশালী। কারণ আকীদা বিশ্বাসে ছিলাে ওরা ভংগুর, চিন্তা-চেতনায় ছিলাে বিশৃংখল। তাই তিনি ওদের আদৌ কোনাে পরােয়া করেননি, ওদের সংখাধিক্য, ওদের আস্ফালন এবং উচ্চ কণ্ঠকে আদৌ আমলে আনেননি; বরং অত্যন্ত শান্ত ও সহজ কণ্ঠে ওদেরকে প্রশ্ন করেন ‘তোমরা স্বহস্তে নির্মিত পাথরের পূজা করাে কেন? অথচ আল্লাহ তােমাদের এবং তােমরা যা নির্মাণ করেছ সবাইকে সৃষ্টি করেছেন।'(আয়াত ৯৫-৯৬) অর্থাৎ প্রকৃত উপাস্যের গুণ হচ্ছে এই যে, তিনি সৃষ্টি করেন, কারও দ্বারা সৃষ্ট নন, আর যেহেতু আল্লাহ তায়ালাই হচ্ছেন একমাত্র স্রষ্টা, কাজেই কেবল তিনিই হতে পারেন উপাস্য বা মাবুদ। এই স্পষ্ট ও যুক্তিসংগত বিষয়টি জানার পরও ইবরাহীম(আ.)-এর সম্প্রদায়ের লােকেরা নিছক অজ্ঞতা ও জিদের বশবর্তী হয়ে তার বক্তব্যের প্রতি কর্ণপাত করলাে না। বাতিলপন্থীরা কি আদৌ কোনদিন সত্যের সহজ সরল আহ্বানে সাড়া দিয়েছে? না, কখনও দেয়নি, আর সে কারণেই ইবরাহীম(আ.)-এর সম্প্রদায়ের প্রভাবশালী লােকেরা তাঁর বিরুদ্ধে জঘন্যতম অত্যাচারে মেতে ওঠে। ‘তারা নির্দেশ দিলাে, এর জন্যে একটি ভিত নির্মাণ করাে অতপর তাকে আগুনের স্তুপে নিক্ষেপ করাে।'(আয়াত ৯৭) এটা হচ্ছে লাঠি ও অস্ত্রের ভাষা। এই ভাষায়ই যুগে যুগে অত্যাচারী ও জুলুমবাজরা কথা বলে থাকে। বিশেষ করে যখন তারা যুক্তি তর্কে হেরে যায় এবং সত্যের কঠিন বাক্য যখন তাদের চরম বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দেয়। তাদের এই বক্তব্যের পরে আর কি কি ঘটেছিলাে সে প্রসংগ এখানে বাদ দিয়ে পরবর্তী প্রসংগ উল্লেখ করে বলা হয়েছে, ‘তারপর তারা তার বিরুদ্ধে মহাষড়যন্ত্র আঁটতে চাইলাে, কিন্তু আমি তাদেরকেই পরাভূত করে দিলাম।’ (আয়াত ৯৮) স্বয়ং আল্লাহ তায়ালাই যদি ষড়যন্ত্র নস্যাত করতে চান, তাহলে বান্দার ষড়যন্ত্রে কি কাজ হবে? স্বয়ং মহান আল্লাহ তায়ালাই যদি তার নেক বান্দাদের রক্ষা করতে চান তাহলে সেসব দূর্বল ও নগণ্য অত্যাচারী, অহংকারী, ক্ষমতাধর ব্যক্তি ও তাদের ঊর্ধ্বতন সাংগ-পাংগরা কি করতে পারে?
* ইবরাহীম(আ.)-এর পুত্র সন্তান লাভ ও পিতা পুত্রের পরীক্ষা : এর পরবর্তী আয়াতগুলােতে ইবরাহীম(আ.)-এর ঘটনার দ্বিতীয় পর্বটি আসছে। পিতার সাথে এবং সম্প্রদায়ের লােকদের সাথে তার যে ঘটনা ঘটেছিলাে সে বর্ণনা আপাতত শেষ। তারা তাকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করতে চেয়েছিলাে, কিন্তু পরিণামে তাদেরকেই আল্লাহ তায়ালা ধ্বংস করে দিয়েছেন এবং তাকে ওদের ষড়যন্ত্রের কবল থেকে রক্ষা করেছেন। এখন ইবরাহীম(আ.)-এর জীবনের আর একটা ঘটনার সূত্রপাত হচ্ছে। সে দিকেই ইংগিত করে আয়াতে বলা হয়েছে, ‘সে বললাে, আমি আমার পালনকর্তার দিকে চললাম, তিনি আমাকে পথ প্রদর্শন করবেন।'(আয়াত-৯৯) তিনি ত্যাগ করে চলে যাচ্ছেন। এই ত্যাগ স্থানের চেয়ে অধিক মানসিকতার ত্যাগ। তিনি নিজ অতীত জীবনের সকল ধ্যান-ধারণা ও চিন্তা চেতনা ত্যাগ করছেন। নিজের পিতা, সম্প্রদায় পরিবার পরিজন, ঘর-বাড়ি, নিজের জন্মভূমি এবং জন্মভূমির সাথে যা কিছু জড়িত সব কিছুই তিনি ত্যাগ করছেন। লােকজনকে ত্যাগ করছেন এবং নিজের চলার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে এমন সব কিছুই ত্যাগ করছেন। সব কিছু ছেড়ে ছুড়ে এবং সম্পূর্ণরূপে দায়মুক্ত হয়ে তিনি ছুটে চলেছেন নিজ প্রভুর পালনকর্তার পানে। নিজের গােটা অস্তিত্ব তার কাছে সােপর্দ করছেন এবং মনে-প্রাণে বিশ্বাস করছেন যে, প্রভু তাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবেন, চলার পথে সহায় হবেন এবং সরল সত্য পথে পরিচালিত করবেন। এটা হচ্ছে এক অবস্থা হতে সম্পূর্ণ ভিন্ন আর এক অবস্থায় উত্তরণ, এক পরিস্থিতি থেকে অন্য পরিস্থিতিতে উত্তরণ এবং একাধিক বন্ধন ছিন্ন করে একক বন্ধনে নিজেকে আবদ্ধকরণ, যেখানে থাকবে না অন্য কারও সম্পর্ক। এটা হচ্ছে চরম নিরপেক্ষতা, একনিষ্ঠতা, আত্মসমর্পণ, প্রশান্তি ও বিশ্বাসের বহিপ্রকাশ। যে মুহূর্তে তিনি পরিবার পরিজন ও আত্মীয়স্বজনদের বন্ধন ছিন্ন করে চলে যাচ্ছেন, সে মুহূর্তে তিনি অতীত জীবনের সকল স্মৃতি এবং জন্মভূমির সকল আকর্ষণ ও মায়া ত্যাগ করে চলে যাচ্ছেন, যে মুহুর্তে তিনি নিজ সম্প্রদায়ের লােকদের সাথে সম্পর্ক চুকিয়ে চলে যাচ্ছেন যারা তাকে আগুনে পুড়িয়ে মারতে উদ্যত হয়েছিলাে, সেই মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ একাকী ও নিসংগ। ফলে যে প্রভুর পানে তিনি যাচ্ছেন বলে ঘােষণা দিয়েছিলেন, সেই প্রভুর দরবারেই দু’হাত তুলে কাতরস্বরে বলছেন, ‘হে আমার পালনকর্তা! আমাকে এক সং পুত্র দান করাে'(আয়াত ১০০) মহান করুণাময় আল্লাহ তাঁর এই ত্যাগী ও সৎ বান্দার ফরিয়াদে সাড়া দেন। কারণ সে তার জন্যেই সর্বস্ব ত্যাগ করেছে এবং তার পানেই ছুটে এসেছে সুস্থ অন্তকরণ নিয়ে। তাই তার ফরিয়াদে সাড়া দিয়ে বলা হয়, ‘সুতরাং আমি তাকে এক সহনশীল পুত্রের সুসংবাদ দান করলাম।'(আয়াত ১০১) এই সহনশীল পুত্র আর কেউ নন, তিনি হচ্ছেন হযরত ইসমাঈল(আ.)। কারণ পরবর্তীতে তার মাঝেই আমরা এই সহনশীলতা গুণের পরিচয় পাব। এই সুসংবাদ পেয়ে ইবরাহীম(আ.)-এর মতাে একজন নিসংগ নিসন্তান, পরবাসী এবং আত্মীয়স্বজন হতে বিচ্ছিন্ন একজন মানুষ কতটুকু আনন্দিত হতে পারে তা আমরা অনুমান করতে পারি। আমরা আরও অনুমান করতে পারি, তিনি এই শিশুকে পেয়ে কতটুকু আনন্দিত হতে পেরেছিলেন যাকে স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা সহনশীল বলে আখ্যায়িত করছেন। এখন আমরা দেখবাে, এই অভূতপূর্ব ঘটনার কি প্রভাব পড়েছিলাে খােদ ইবরাহীম(আ.)-এর এবং গােটা মানব জাতির জীবনে। এই ঘটনার বিবরণ আমরা স্বয়ং আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিল করা ওহীর ভাষায় জানতে পারি। বলা হয়েছে, ‘অতপর যখন সে তার সাথে চলাফেরা করার বয়সে উপনীত হলাে, তখন সে (ইবরাহীম) বললাে, বৎস! আমি স্বপ্নে দেখি যে, তােমাকে যবাই করছি…'(আয়াত-১০২) কি অপূর্ব বিশ্বাস! কি অপূর্ব আনুগত্য! কি অপূর্ব আত্মসমর্পণ! এই বয়ােবৃদ্ধ ইবরাহীম, যিনি পরিবার পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন, যিনি নিজ মাতৃভূমি ত্যাগ করে চলে এসেছেন, তাকেই এই বৃদ্ধ বয়সে, এই অক্ষমতার মূহূর্তে একটি সন্তান দান করা হলাে, কারণ তিনি তা কামনা করেছিলেন। তাকে সন্তান দান করা হলাে এবং উত্তম এক সন্তান, যার সম্পর্কে স্বয়ং তার প্রভু সাক্ষ্য দিলেন যে, সে সহনশীল হবে, ধৈর্যশীল হবে। এই পরম কামনার সন্তানটির মাধ্যমে সবেমাত্র তিনি নিজের নিসংগতা দূর করতে পেরেছিলেন এবং তাকে নিয়ে এদিক সেদিক যাওয়া আসা করা আরম্ভ করেছিলেন, আর তখনই তিনি স্বপ্নে দেখেন যে, তাকে নিজ হাতে যবাই করছেন। এটা যে তার প্রভুর পক্ষ থেকে কোরবানীর জন্যে একটা ইংগিত ছিলাে, সেটা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, কিন্তু তাতে কি। তিনি সেই ইংগিত পেয়েই কোনাে বিলম্ব করেননি, দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভােগেননি; বরং তার মাঝে আনুগত্যের অনুভূতিই জাগ্রত হয়েছে। আত্মসমর্পণের মনােভাবই তার মাঝে জন্ম নিয়েছে। হাঁ, সেটা ইংগিতই ছিলো, নিছক একটা ইংগিত। সেটা কোনাে সুস্পষ্ট প্রত্যাদেশ ছিলাে না, ছিলাে না কোনাে প্রত্যক্ষ নির্দেশ। কিন্তু ইংগিতটা তাে ছিলাে তার প্রভুর পক্ষ থেকেই। এটাই তাে যথেষ্ট। তাই সেই ইংগিতেই তিনি সাড়া দিলেন। কোনাে অভিযােগ করলেন না, কোনাে প্রশ্নও করলেন না যে, কেন একমাত্র পুত্রকে নিজ হাতে যবাই করবেন? তিনি বিরক্ত হয়ে সেই ইংগিতে সাড়া দিচ্ছেন না, ভয়ে কাতর হয়ে আত্মসমর্পণ করছেন না, অস্থিরতার বশবর্তী হয়ে আনুগত্য প্রকাশ করছেন না। নিশ্চয়ই তেমন কিছুই নয়; বরং যা করছেন তা স্বেচ্ছায় করছেন, সজ্ঞানে করছেন, সন্তুষ্ট চিত্তে করছেন এবং অত্যন্ত শান্তশিষ্টভাবে করছেন। এটা তার বক্তব্যেই প্রকাশ পাচ্ছে। কারণ তিনি একটা গুরুতর বিষয় অত্যন্ত সুস্থিরভাবে এবং এক অদ্ভুত শান্ত মনে নিজের সন্তানের সামনে উপস্থাপন করে বলছেন, ‘হে বৎস। আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, তােমাকে যবাই করছি, এখন তােমার অভিমত কি বলো’ এ ধরনের কথা কেবল তারাই বলতে পারে, যারা নিজেদের স্নায়ুর ওপর যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণ রাখে, যারা গুরুতর পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েও শান্ত থাকে এবং যারা নিজ দায়িত্বের ওপর অটল, অনড় থাকে। এ ধরনের বক্তব্য কেবল একজন মােমেনেরই হতে পারে। কারণ প্রকৃত মােমেন কখনও গুরুতর কোনাে কাজের সম্মুখীন হলে বিচলিত হয় না, অস্থির হয়ে পড়ে না এবং তা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে ব্যাকুল হয়ে পড়ে না। সন্দেহ নেই যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে সেই নির্দেশটি ছিলাে বড়ই কঠিন। কারণ তিনি ইবরাহীম(আ.)-এর একমাত্র পুত্রটিকে কোনাে যুদ্ধের ময়দানে পাঠাবার নির্দেশ দিচ্ছেন না এবং তাকে এমন কোন কাজেও নিযুক্ত করার নির্দেশ দিচ্ছেন না যার কারণে তার জীবন চলে যাবে; বরং কাজটি স্বয়ং তাকেই করতে বলছেন। কি সেই কাজ। নিজ হাতে পুত্রকে যবাই করার কাজ। তা সত্তেও তিনি এই নির্দেশ মেনে নিয়ে নিজের পুত্রের সামনে এভাবেই তুলে ধরছেন এবং তাকে চিন্তা-ভাবনা করে মতামত জানাতে বলছেন। তিনি অতর্কিতভাবে ছেলেকে ধরে নিয়ে গিয়ে তাকে হত্যা করে আপন প্রভুর নির্দেশের বাস্তবায়ন করেই কাজ শেষ করে দিচ্ছেন না; বরং তিনি বিষয়টি তার সামনে এমনভাবে উপস্থাপন করছেন যেন একটা সাধারণ ও জানা-পরিচিত বিষয়। কারণ বিষয়টি তার কাছে সে রকমই মনে হচ্ছিলাে। প্রভু নির্দেশ করছেন, কাজেই তার নির্দেশ শিরােধার্য। তবে বিষয়টি ছেলেকে জানিয়ে নিলে ভালাে হয়, যাতে কাজটা স্বেচ্ছায় সমাধা হয়, জোর জবরদস্তি করে না হয়। এর ফলে সেও আনুগত্যের প্রতিদান পাবে, আত্মসমর্পণের স্বাদ গ্রহণ করতে পারবে। তিনি চাচ্ছেন, তাঁর সন্তানও মনে প্রাণে আল্লাহর আনুগত্যের স্বাদ গ্রহণ করুক, যেমনটি তিনি স্বয়ং গ্রহণ করতে পেরেছেন এবং সাথে সাথে সেই মংগল ও কামিয়াবী লাভে সক্ষম হােক যেটাকে তিনি জীবনের চেয়েও অধিক স্থায়ী ও মূল্যবান মনে করেন। ছেলের অবস্থা কি দাঁড়ালাে? পিতার স্বপ্নকে বাস্তব রূপ দান করার জন্যে তার সামনে যখন যবাই করার প্রস্তাব রাখা হলাে, তখন তার প্রতিক্রিয়া কি ছিলাে? সে তখন উর্ধ্বজগতে বিচরণ করছিলাে। যেমনটি বিচরণ করছিলাে তার পিতা। তাই তার উত্তর ছিলো এ রূপ, ‘পিতা! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে তাই করুন। আল্লাহ চাহে তাে আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন।'(আয়াত ১০২) সে এই ঐশী নির্দেশটি গ্রহণ করতে গিয়ে কেবল আনুগত্য ও আত্মসমর্পণই প্রদর্শন করছে; বরং সাথে সাথে স্বতস্ফূর্ততা এবং আত্মবিশ্বাসও প্রদর্শন করছে। সে পিতাকে অত্যন্ত আদর ও মহব্বতের সুরে সম্বােধন করছে। তার কষ্ঠে কোনাে জড়তা নেই, তার মাঝে যবাই হয়ে যাওয়ার কোনাে ভয়-ভীতি নেই, কোনাে অস্থিরতা নেই, অসতর্কতা নেই; বরং সেই মুহূর্তে শিষ্টাচার সৌজন্যবােধও সে হারিয়ে ফেলেনি। সে পিতাকে সম্বােধন করে বলছে, আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে তা করে ফেলুন। এই কথা বলার সময় তার অনুভূতিও তাই ছিলাে যা তার পিতার ছিলাে। সে বুঝতে পেরেছিলাে, স্বপ্নও হচ্ছে এক প্রকার ঐশী ইংগিত, আর এই ঐশী ইংগিত নির্দেশেরই নামান্তর। কাজেই নির্দ্বিধায়, নিসংকোচে ও নিসন্দেহে এই নির্দেশ পালন করতে হবে। এর পরের আয়াতে আল্লাহর প্রতি ইসমাঈল(আ.)-এর বিনয়, আদব ও শিষ্টাচার প্রকাশ পাচ্ছে, নিজের শক্তি সামর্থ্য ও ধারণ ক্ষমতার সীমারেখার ব্যাপারে তার জ্ঞান প্রকাশ পাচ্ছে এবং দুর্বল মুহূর্তে সাহায্য কামনা, কোরবানীর জন্যে শক্তি কামনা এবং আনুগত্যের জন্যে সহায়তা কামনার মনােভাব প্রকাশ পাচ্ছে। বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ চাহেন তাে আমাকে আপনি ধৈর্যশীল পাবেন।’ আল্লাহর নামে কোরবান হয়ে যাওয়ার বিষয়টিকে ইসমাঈল(আ.) বীরত্ব প্রকাশ বা বাহাদুরী প্রকাশের কোন উপায় হিসেবে নেননি। এমন কি কোনাে আগপাছ না ভেবে নিজেকে নিশ্চিত বিপদের মুখে ঠেলে দেয়ার জন্যেও বিষয়টি গ্রহণ করেননি তিনি; বরং বিষয়টি গ্রহণ করার সময় নিজের ব্যক্তিত্বকে কোনাে আমলেই আনেননি, নিজেকে মােটেও বড় করে দেখেননি। এসব কিছুকে তিনি আল্লাহর রহমত ও করুণা হিসেবেই দেখেছেন এবং এর জন্যে তারই সাহায্য কামনা করেছেন, ধৈর্য ধারণের তাওফীক কামনা করেছেন। এটাই হচ্ছে আল্লাহর প্রতি পরম শ্রদ্ধা, বিশ্বাস, আনুগত্য ও আত্মসমর্পণের উৎকৃষ্ট নমুনা। পিতা-পুত্রের মধ্যকার আলাপ ও সংলাপের পর এখন আসছে মূল কাজ বাস্তবায়নের পালা। বলা হচ্ছে, ‘যখন পিতা পুত্র উভয়েই আনুগত্য প্রকাশ করলো এবং ইবরাহীম তাকে যবাই করার জন্যে শুইয়ে দিলাে।'(আয়াত ১০৩) পিতা পুত্রের এই কর্মকান্ডের মাধ্যমে আর একবার সত্যিকার আনুগত্য, ঈমানের মাহাত্ম্য ও পরম সন্তুষ্টি স্বাভাবিক মানবীয় প্রবৃত্তির উর্ধ্বে স্থান পেলাে। নিজের পুত্রকে যবাই করার জন্যে পিতা তাকে উপুড় করে শােয়াচ্ছেন। ছেলেও নিজেকে পিতার হাতে সঁপে দিচ্ছে। কোনাে বাধা নেই, কোনাে নড়াচড়া নেই। একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে গােটা দৃশ্যটা চোখের সামনে ভেসে ওঠবে। পিতা পুত্র উভয়ই আল্লাহর নির্দেশের সামনে নিজেদের সঁপে দিলেন। এটাই হচ্ছে ইসলাম। এই পরম আত্মসমর্পণের নামই হচ্ছে প্রকৃত ইসলাম। এতে থাকবে পরম আস্থা, বিশ্বাস, আনুগত্য, সন্তুষ্টি, আত্মসমর্পণ ও নিশর্ত বাস্তবায়ন। পিতা পুত্রের মাঝে এই অনুভূতি কাজ করছিলো। কারণ তারা উভয়েই ছিলেন দুর্জয় ঈমানী বলে বলীয়ান। এটা শৌর্য বীর্যের বিষয় নয় এবং উৎসাহ উদ্দীপনার বিষয়ও নয়। কোনাে যােদ্ধা উদ্দীপ্ত হয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে লড়াই করে কখনও হত্যাও করতে পারে এবং কখনও নিজেও নিহত হতে পারে। কেউ কেউ আবার কমান্ডো আক্রমণে অংশ গ্রহণ করে থাকে এবং ভালােভাবেই জানে যে, সে ওখান থেকে জীবিত ফিরে নাও আসতে পারে, কিন্তু ইবরাহীম ও ইসমাঈল(আ.) যা করেছেন তা এসব থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখানে রক্তের উন্মত্ততা নেই, উল্লাসের উদ্দামতা নেই এবং ভয় ও আশংকা মিশ্রিত ব্যাকুলতা নেই। এখানে রয়েছে সুচিন্তিত, স্বতস্ফূর্ত ও সজ্ঞাত আত্মসমর্পণ। এখানে যা কিছু করা হচ্ছে তা জেনে শুনেই করা হচ্ছে, সন্তুষ্ট মনেই করা হচ্ছে, পরিণামের ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েই করা হচ্ছে। এখানে যা কিছু করা হচ্ছে তার পেছনে রয়েছে আনুগত্যের সুমধুর স্বাদ গ্রহণের বাসনা। ইবরাহীম ও ইসমাঈল(আ.)-এর পক্ষে যা করার তা তারা করে ফেলেছেন, ঐশী নির্দেশের বাস্তবায়ন তারা ঘটিয়েছেন। এখন কেবল ইসমাঈলকে যবাই করা বাকী আছে, এটা আল্লাহর কাছে আদৌ কোনাে ধর্তব্যের বিষয় নয়। কারণ তারা উভয়েই নিজেকে আল্লাহর সামনে সঁপে দিয়েছেন, আল্লাহর নির্দেশ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে দৃঢ় সংকল্প নিয়ে সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করে ফেলেছেন। পরীক্ষার পালা শেষ হয়েছে, ফলাফল সামনে এসেছে, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য বাস্তবায়িত হয়েছে। এখন কেবল দৈহিক কষ্টই বাকী আছে, রক্তপাত বাকী আছে, নিথর দেহই বাকী আছে, কিন্তু আল্লাহর তাে এসবের প্রয়ােজন নেই। তিনি বান্দাদের বিপদে ফেলে কষ্ট দিতে রাযি নন। তিনি তাদের রক্তও চান না এবং তাদের দেহও চান না। তিনি কেবল দেখতে চান, বান্দা তার নির্দেশ পালনের ক্ষেত্রে কতটুকু আন্তরিক। যখন বান্দা এই আন্তরিকতা প্রদর্শন করবে, নির্দেশ পালনে স্বতস্ফুর্তভাবে এগিয়ে আসবে, তখনই ধরে নেয়া হবে সে নির্দেশ পালন করে নিয়েছে এবং পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হয়েছে।