أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#১০৭৮/ এবং কাফেররা বলে -৩)
[*তাওহীদ তত্ত্বের সাথে কৌশলে শিরকের সংমিশ্রণ :-]
www.motaher21.net
সূরা:- ৩৮:সােয়াদ
পারা:২৩
১-১১ নং আয়াত:-
সূরা:- ৩৮:সােয়াদ-১
صٓ وَ الۡقُرۡاٰنِ ذِی الذِّکۡرِ ؕ﴿۱﴾
সােয়াদ, উপদেশে পরিপূর্ণ কোরআনের শপথ।’
সূরা:- ৩৮:সােয়াদ-২
بَلِ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا فِیۡ عِزَّۃٍ وَّ شِقَاقٍ ﴿۲﴾
বরং কাফিররা ঔদ্ধত্য ও বিরোধিতায় নিপতিত আছে।
সূরা:- ৩৮:সােয়াদ-৩
کَمۡ اَہۡلَکۡنَا مِنۡ قَبۡلِہِمۡ مِّنۡ قَرۡنٍ فَنَادَوۡا وَّ لَاتَ حِیۡنَ مَنَاصٍ ﴿۳﴾
এদের পূর্বে আমি এমনি আরো কত জাতিকে ধ্বংস করেছি (এবং যখন তাদের সর্বনাশ এসে গেছে) তারা চিৎকার করে উঠেছে, কিন্তু সেটি রক্ষা পাওয়ার সময় নয়।
সূরা:- ৩৮:সােয়াদ-৪
وَ عَجِبُوۡۤا اَنۡ جَآءَہُمۡ مُّنۡذِرٌ مِّنۡہُمۡ ۫ وَ قَالَ الۡکٰفِرُوۡنَ ہٰذَا سٰحِرٌ کَذَّابٌ ۖ﴿ۚ۴﴾
এরা একথা শুনে বড়ই অবাক হয়েছে যে, এদের নিজেদের মধ্য থেকেই একজন ভীতি প্রদর্শনকারী এসে গেছে। অস্বীকারকারীরা বলতে থাকে, “এ হচ্ছে যাদুকর, বড়ই মিথ্যুক,”
সূরা:- ৩৮:সােয়াদ-৫
اَجَعَلَ الۡاٰلِہَۃَ اِلٰـہًا وَّاحِدًا ۚۖ اِنَّ ہٰذَا لَشَیۡءٌ عُجَابٌ ﴿۵﴾
সকল খোদার বদলে সে কি মাত্র একজনকেই খোদা বানিয়ে নিয়েছে? এতো বড় বিস্ময়কর কথা!”
সূরা:- ৩৮:সােয়াদ-৬
وَ انۡطَلَقَ الۡمَلَاُ مِنۡہُمۡ اَنِ امۡشُوۡا وَ اصۡبِرُوۡا عَلٰۤی اٰلِہَتِکُمۡ ۚۖ اِنَّ ہٰذَا لَشَیۡءٌ یُّرَادُ ۖ﴿ۚ۶﴾
ওদের প্রধানেরা এ বলে সরে পড়ল, ‘তোমরা চল এবং তোমাদের দেবতাগুলির পূজায় তোমরা অবিচলিত থাক। নিশ্চয়ই এটি কোন উদ্দেশ্যমূলক।
সূরা:- ৩৮:সােয়াদ-৭
مَا سَمِعۡنَا بِہٰذَا فِی الۡمِلَّۃِ الۡاٰخِرَۃِ ۚۖ اِنۡ ہٰذَاۤ اِلَّا اخۡتِلَاقٌ ۖ﴿ۚ۷﴾
নিকট অতীতের মিল্লাতগুলোর মধ্য থেকে কারো কাছ থেকে তো আমরা একথা শুনিনি। এটি একটি মনগড়া কথা ছাড়া আর কিছুই নয়।
সূরা:- ৩৮:সােয়াদ-৮
ءَ اُنۡزِلَ عَلَیۡہِ الذِّکۡرُ مِنۡۢ بَیۡنِنَا ؕ بَلۡ ہُمۡ فِیۡ شَکٍّ مِّنۡ ذِکۡرِیۡ ۚ بَلۡ لَّمَّا یَذُوۡقُوۡا عَذَابِ ؕ﴿۸﴾
আমরা এত লোক থাকতে কি তারই ওপর কুরআন অবতীর্ণ করা হল?’ ওরা তো প্রকৃতপক্ষে আমার কুরআনে সন্দিহান, ওরা এখনও আমার শাস্তি আস্বাদন করেনি।
সূরা:- ৩৮:সােয়াদ-৯
اَمۡ عِنۡدَہُمۡ خَزَآئِنُ رَحۡمَۃِ رَبِّکَ الۡعَزِیۡزِ الۡوَہَّابِ ۚ﴿۹﴾
তোমার মহান দাতা ও পরাক্রমশালী পরওয়ারদিগারের রহমতের ভাণ্ডার কি এদের আয়ত্বাধীনে আছে?
সূরা:- ৩৮:সােয়াদ-১০
اَمۡ لَہُمۡ مُّلۡکُ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ وَ مَا بَیۡنَہُمَا ۟ فَلۡیَرۡتَقُوۡا فِی الۡاَسۡبَابِ ﴿۱۰﴾
নাকি তাদের কর্তৃত্ব আছে আসমানসমূহ ও যমীন এবং এ দু’য়ের অন্তর্বতী সমস্ত কিছুর উপর? থাকলে, তারা কোন উপায় অবলম্বন করে আরোহণ করুক !
সূরা:- ৩৮:সােয়াদ-১১
جُنۡدٌ مَّا ہُنَالِکَ مَہۡزُوۡمٌ مِّنَ الۡاَحۡزَابِ ﴿۱۱﴾
বহুদলের মধ্য থেকে এতো ছোট্ট একটি দল, এখানেই এটি পরাজিত হবে।
ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
সংক্ষিপ্ত আলােচনা : এই সূরাটা মক্কী। মক্কী সূরাগুলােতে সাধারণত যেসব বিষয় আলােচিত হয়ে থাকে, এ সূরায়ও প্রধানত সেগুলােই আলােচিত হয়েছে। যেমন, তাওহীদ, মােহাম্মদ(স.)-এর কাছে প্রেরিত ওহী এবং আখেরাতের হিসাব নিকাশ। এই তিনটি বিষয় সূরার প্রথম অধ্যায়ে আলােচনা করা হয়েছে। এই বক্তব্যের ওপরে যে ১৬টা আয়াত উদ্ধৃত হয়েছে, এগুলাে নিয়েই সূরার প্রথম অধ্যায়। মক্কার নেতৃস্থানীয় মােশরেকদের যখন রাসূল(স.) আল্লাহর একত্ববাদের দাওয়াত দিতেন, তার কাছে ওহী নাযিল হয় বলে তাদেরকে জানাতেন এবং তাঁকে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে রসূলরূপে মনােনীত করার কথা অবহিত করতেন, তখন তারা যে বিস্ময় প্রকাশ করতাে, সেটাই এ আয়াতগুলাের মূল আলােচ্য বিষয়। বলা হয়েছে, ‘তারা এতে অবাক হয়ে গেছে যে, তাদের কাছে তাদেরই মধ্য থেকে একজন সতর্ককারী এসেছে। আর কাফেররা বলেছে যে, এ ব্যক্তি তাে মিথ্যাবাদী যাদুকর। সে কি এতােগুলাে মাবুদকে এক মাবুদ বানিয়ে দিলাে? এতাে একটা চরম বিস্ময়কর ব্যাপার।'(আয়াত ৪-৮) অনুরূপভাবে তারা এ দাওয়াত অস্বীকার করলে তাদের শাস্তি দেয়া হবে বলে যে হুমকি দেয়া হয়েছে, সেই হুমকির প্রতি বিদ্রুপ করা হয়েছে। যেমন : (আয়াত-১৬) বলা হয়েছে, ‘তারা বললাে! হে আমাদের প্রতিপালক, আমাদের প্রাপ্য অংক হিসাবের দিনের আগেই দিয়ে দাও।’ আল্লাহ তায়ালা তার ওহী নাযিল করার জন্যে তাদের ভেতর থেকেই একজনকে বিশেষত আবদুল্লাহর ছেলে মুহাম্মদ(স.)-কে মনােনীত করতে পারেন এটা তাদের কাছে কল্পনাতীত ব্যাপার ছিলাে। কেননা ইতিপূর্বে তিনি সমাজের কোনাে পর্যায়ে কোনাে নেতৃত্ব দেননি। এ জন্যে সূরার শুরুতে তাদের এই বিষয় প্রকাশের ওপর এবং তাদের ‘আমাদের সবার মধ্য থেকে শুধু ওর ওপরই স্মরণিকা নাযিল হলাে নাকি?’ এই উক্তির ওপর মন্তব্য প্রসংগে আল্লাহ তায়ালা পাল্টা প্রশ্ন রেখেছেন; ‘তােমার পরম দাতা, মহাপরাক্রমশালী প্রভুর সমস্ত রহমতের ভান্ডার কি ওদের কাছে। অথবা আকাশ, পৃথিবীর মধ্যবর্তী সমস্ত কিছুর রাজত্ব কি ওদের? তা যদি হয়ে থাকে, তাহলে ওরা রশি ঝুলিয়ে আকাশে ওঠে যাক।’ অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা নিজের দয়াবশত যখন তার কোন মনােনীত ব্যক্তিকে কিছু দিতে চান তখন তা থেকে কেউ তাকে বিরত রাখতে পারে না। আকাশ পৃথিবীর রাজত্বে ও সার্বভৌম ক্ষমতায় কোনাে মানুষেরই কোনাে হাত নেই। তিনি তার অনুগ্রহ ও জীবিকার যতােটুকু যাকে দিতে চান দেন, তাঁর বান্দাদের মধ্য থেকে যাকে তার অনুগ্রহ লাভের যােগ্য মনে করেন তাকে মনােনীত করেন এবং বিনা হিসাবে, বিনা বাধায় ও বিনা শর্তে তাকে রকমারি অনুগ্রহ বিতরণ করেন। এই প্রসংগে হযরত দাউদ ও সােলায়মানের কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে কি বিপুল অনুগ্রহে ধন্য করেছেন, নবুওত ও রাজত্ব দান করেছেন, পাহাড় ও পাখিদের তার হুকুমের অনুগত করে দিয়েছেন, জ্বিন ও বাতাসকে তার তাবেদার বানিয়েছেন, এ ছাড়া রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা, দ্রব্যসামগ্রী ও পৃথিবীর অগাধ ধন সম্পদ তাে ছিলােই। এসব সত্তেও তারা উভয়ে নিছক মানুষ। মানুষ হিসাবে তার স্বভাবসুলভ দুর্বলতা ও ক্ষমতার সীমাবদ্ধতার উর্ধে নন। কেবল আল্লাহর মেহেরবানী ও পৃষ্ঠপােষকতা তাদের দুর্বলতা অক্ষমতা দূর করে দেয়, তাদের তওবা ও আনুগত্য গ্রহণ করে এবং তাদের আল্লাহর পথে বহাল রাখে। এই কাহিনী দুটোর সাথে সাথে রসূল(স.)-কে কাফেরদের পক্ষ থেকে আগত অত্যাচার ও নিপীড়নে ধৈর্য ধারণের শিক্ষা দেয়া হয়েছে। উপদেশ দেয়া হয়েছে আল্লাহর অনুগ্রহ ও সাহায্য কামনা করে। হযরত দাউদ ও সােলায়মানের কাহিনীতে এই শিক্ষাটা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘ওরা যা কিছু বলে তাতে ধৈর্য ধারণ করাে এবং আমার বান্দা শক্তিশালী দাউদকে স্মরণ করো। সে খুবই অনুগত।’ অনুরূপভাবে হযরত আইয়ুবের কাহিনীতেও আল্লাহর নিষ্ঠাবান বান্দাদের কিভাবে কঠিন বিপদ ও রােগব্যাধি দিয়ে পরীক্ষা করেন তার দৃষ্টান্ত দেয়া হয়েছে। হযরত আইয়ুবের ধৈর্য অতি উচ্চাংগের ধৈর্যের নমুনা। এ কাহিনীতে দেখানাে হয়েছে, ধৈর্যের ফলে হযরত আইয়ুব শেষ পর্যন্ত বিপদ থেকে উদ্ধার পান, আল্লাহর রহমত লাভ করেন এবং আল্লাহ তায়ালা স্বীয় স্নেহময় হাতের পরশ দিয়ে তাকে রােগমুক্ত করেন। এ কাহিনী বর্ণনা করার মধ্য দিয়ে রসূল(স.) ও মােমেনদের ওপর মক্কায় অবস্থানকালে আপতিত নির্যাতনের ব্যাপারে সান্তনা দেয়া হয়। এতে বলা হয় যে, ‘এই পরীক্ষার পেছনে আল্লাহর অফুরন্ত রহমত রয়েছে এবং আল্লাহর ভান্ডার থেকে সেই রহমত যখন তিনি ইচ্ছা করেন বিপুল পরিমাণে বিতরণ করেন।’ ভূমিকার পরে এই কাহিনীগুলাে সূরার অধিকাংশ স্থান জুড়ে বিরাজ করছে। সূরার দ্বিতীয় অধ্যায় এগুলােরই সমষ্টি। অনুরূপভাবে সূরাটায় কাফেরদের পক্ষ থেকে আল্লাহর আযাব তাড়াতাড়ি নাযিল করার আবদারের জবাব দেয়া হয়েছে। তারা বলতাে, ‘হে আমাদের প্রতিপালক, আমাদের আযাবের প্রাপ্য অংশ বিচারের দিনের আগেই দিয়ে দাও।’ এর জবাবে কাহিনীগুলাের পর কেয়ামতের দৃশ্য উপস্থাপন করা হয়েছে। এই দৃশ্যে আল্লাহভীরু সৎলােকদের জন্যে যে নেয়ামত সঞ্চিত এবং কাফেরদের জন্যে যে জাহান্নাম প্রস্তুত রয়েছে তার ছবি তুলে ধরা হয়েছে। এই দুই দলের আখেরাতের অবস্থানে কত পার্থক্য, তাও এখানে স্পষ্ট করে দেয়া হয়েছে। দুনিয়াতে যারা ক্ষমতাশালী ও অহংকারী ছিলাে, আখেরাতে তারা নিজেদের পরিণামও দেখবে, আর সেসব দরিদ্র ও দুর্বল লােকদের দেখবে, যাদের সাথে তারা দুনিয়ায় ঠাট্টা বিদ্রুপ ও উপহাস করতাে। তারা কোনাে মান্যগণ্য প্রভাবশালী লােক না হয়েও আল্লাহর কৃপা করুণা লাভ করতে পারবে, এটা ছিল তাদের কল্পনারও অতীত। সেখানে মুস্তাকী পরহেযগারদের জন্যে থাকবে পরম শাস্তিময় নিবাস ! (আয়াত ৫০-৫২) আর আল্লাহদ্রোহীদের জন্যে থাকবে জঘন্যতম আশ্রয়স্থল। (আয়াত ৫৫-৫৭) তারা জাহান্নামে পরস্পরকে অভিসম্পাত দেবে, ঝগড়াঝাটিতে লিপ্ত থাকবে এবং মুমিনদের সাথে কিভাবে ঠাট্টা বিদ্রুপ করতাে তা স্মরণ করবে। ‘তারা বলবে ব্যাপার কি, যে লােকগুলােকে আমরা দুষ্কতকারী বলে গণ্য করতাম, এখানে তাদের দেখি না কেন?'(আয়াত ৬২-৬৪) বস্তুত তাদেরকে তারা জাহান্নামে কোথাও খুঁজে পাবে না। তখন তারা জানতে পারবে যে, তারা জান্নাতে অবস্থান করছে। এভাবেই তাদের তাড়াতাড়ি আযাব নাযিল করার আবদারের জবাব দেয়া হয়েছে। আখেরাতের এ দৃশ্যটা নিয়ে সূরার তৃতীয় অধ্যায় গঠিত হয়েছে। এরপর চতুর্থ অধ্যায়ের শুরুতেই বলা হয়েছে যে, রসূল(স.)-এর ওপর ওহী নাযিল হওয়ার বিষয়টা কাফেররা অস্বীকার করতো। এ অধ্যায়ে তার জবাব দিতে গিয়ে হযরত আদম(আ.)-এর ঘটনাকে প্রমাণ হিসাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। যে উর্ধ্বজগতে ঘটনাটা ঘটেছিলাে, সেখানে তাে রসূল(স.) উপস্থিত ছিলেন না। স্বয়ং আদম(আ.) ব্যতীত আর কোনাে মানুষই তা দেখেনি এবং সেখানে উপস্থিত থাকেনি। তাহলে মুহাম্মদ(স.) সে ঘটনা কিভাবে জানলেন? একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই ওহীর মাধ্যমে এটা জানিয়েছেন। এই কাহিনীর মাধ্যমে এ কথাও স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, ইবলীস হযরত আদমকে দেয়া অগ্রাধিকার মেনে নেয়নি বলেই মহান আল্লাহর দরবার থেকে বিতাড়িত ও অভিশপ্ত হয়েছে। মক্কার কোরায়শরাও ঠিক তেমনি ভাবে তাদের আর সবাইকে বাদ দিয়ে মােহাম্মদ(স.)-কে ওহী নাযিলের জন্যে মনােনীত করায় তার ওপর ক্ষিপ্ত হয়েছে। তাদের এ ভূমিকা ও আচরণ অভিশপ্ত বিতাড়িত ইবলীসের ভূমিকা এবং আচরণের সাথে সুম্পষ্ট সাদৃশ্য রাখে। এই চতুর্থ ও সর্বশেষ অধ্যায়ের মধ্য দিয়েই সূরাটা শেষ হয়েছে। এর শেষ বক্তব্যে রসূল(স.)-কে শিখিয়ে দেয়া হয়েছে, তিনি যেন তাদের জানিয়ে দেন যে, তিনি যে দাওয়াত দেন তাতে তার ব্যক্তিগত কোনাে স্বার্থ নেই, এ জন্যে তিনি পারিশ্রমিক চান না এবং এ দাওয়াত কতাে গুরুত্বপূর্ণ তা তারা অচিরেই জানতে পারবে। (আয়াত ৮৬-৮৮) সূরার আলােচ্য বিষয়গুলাে এই চারটি অধ্যায়ে এভাবে আলােচিত হয়েছে। এর ভেতর দিয়ে এক পর্যায়ে পূর্ববর্তী জাতিগুলাের মধ্যে যারা রাসূলের দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করে এবং রসূল ও মােমেনদের ওপর নিজেদের বড়াই জাহির করে শেষ পর্যন্ত আল্লাহর আযাবে অপমানিত, লাঞ্ছিত, পরাভূত ও বিধ্বস্ত হয়েছে, তাদের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে। (আয়াত ১১-১৪) আল্লাহর রাসূলের দাওয়াত প্রত্যাখ্যানকারীদের পরাজয় ও ধ্বংসের বিবরণ সম্বলিত মানবেতিহাসের এই মর্মান্তিক ও দৃষ্টান্তমূলক অধ্যায়ের মানুষের চিত্তপটে আরো একবার তুলে ধরা হয়েছে। তারপর আল্লাহ তার প্রিয় ও মনােনীত বান্দাদের কিভাবে সম্মানিত, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত এবং সাহায্য ও করুণায় ভূষিত করেছেন তার বিবরণ দিয়েছেন হযরত দাউদ, সোলায়মান ও আইয়ুব(আ.)-এর কাহিনীতে। উক্ত উভয় প্রকারের পরিণতি এই ইহকালীন জগতেই ঘটেছে। এরপর মানুষকে দেখানাে হয়েছে কেয়ামতের দৃশ্য, কেয়ামত পরবর্তী বেহেশতের নেয়ামত, সম্পদ, সন্তোষ এবং ভালাে ও মন্দ কর্মফল। আখেরাতের অবিনশ্বর জগতের উক্ত কর্মফল হলাে তা থেকে ভিন্ন ধরনের। সর্বশেষ অধ্যায়টাতে মানব জাতির প্রথম প্রজন্মের কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে। মানব জাতি তার প্রথম শক্রর পক্ষ থেকে ঈর্যা ও পরশ্রীকাতরতার অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে এ কাহিনীতে। এই শত্রু চিরদিন তাকে পরিকল্পিত ও ইচ্ছাকৃতভাবে বিপথগামী করে থাকে, অথচ মানুষ সব কিছু জেনেও তার সম্পর্কে উদাসীন থাকে। কিসসা কাহিনীর এক পর্যায়ে আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টির মূলে নিহিত এক মহাসত্যের প্রতি মানব জাতির মনােযােগ আকর্ষণ করা হয়েছে। এই মহাসত্যটাই নবী রসূল প্রেরণের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা মানুষের অন্তরে এক মহাসত্য বদ্ধমূল করতে চান। সে সত্যটা এই যে, আমি আকাশ ও পৃথিবী নির্থক সৃষ্টি করিনি। এ ধরনের মনােযােগ আকর্ষণী বক্তব্যের বহু দৃষ্টান্ত কোরআনে রয়েছে। কোরআনের মক্কায় নাযিল হওয়া অংশে বর্ণিত মৌলিক আকীদাগত বিষয়ের মধ্যে এটা একটা বহুল আলোচিত বিষয়। এবার আসুন আমরা বিস্তারিত তাফসীরে মনােনিবেশ করি।
‘সােয়াদ, উপদেশে পরিপূর্ণ কোরআনের শপথ।'(আয়াত ১-৩) মহান আল্লাহ এখানে এই সােয়াদ অক্ষর এবং উপদেশে পরিপূর্ণ কোরআন উভয়েরই কসম খেয়েছেন। এ অক্ষরটা আল্লাহর সৃষ্টি। তিনি এটাকে মানুষের কণ্ঠ থেকে উচ্চারিত একটা ধ্বনি হিসাবে যেমন সৃষ্টি করেছেন, তেমনি আরবী বর্ণমালার একটা বর্ণ হিসাবেও সৃষ্টি করেছেন, যা দিয়ে কোরআন রচিত হয়েছে। এ বর্ণমালা মানুষের ক্ষমতার আওতাধীন। অথচ কোরআন মানুষের ক্ষমতার আওতা বহির্ভূত। কেননা কোরআন আল্লাহর রচিত। কোরআন মানুষের ক্ষমতার উর্ধ্বে এমন এক নিপুণ শিল্প, যার সমকক্ষ কোনাে কিছু তৈরী করা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়, তা সে কোরআনেই হােক বা কোরআনের বাইরেই হোক। আর এই সােয়াদ ধ্বনিটা কণ্ঠনালী থেকে উচ্চারিত হওয়া স্বয়ং কণ্ঠনালী ও উক্ত ধ্বনির স্রষ্টা মহান আল্লাহর অসীম ক্ষমতা এবং কুদরতের বলেই সম্ভব হচ্ছে। মানুষ এ ধরনের কণ্ঠনালী সৃষ্টি করতে সক্ষম নয়, যার ভেতর দিয়ে এই ধ্বনিগুলো বের হয়। দেহ ও মনের সমন্বয়ে মানুষের যে সত্ত্বা গঠিত, তা তার সবচেয়ে কাছের থাকা জিনিস। এই সত্তার ভেতরে যেসব খুঁটিনাটি জিনিস রয়েছে, তা নিয়ে চিন্তা গবেষণা করলে সে দেখতে পাবে যে, তার প্রত্যেকটা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জিনিসেও বহু অলৌকিক উপাদান রয়েছে। এগুলাে যদি মানুষ বুঝতাে, তাহলে আল্লাহর মনােনীত একজন মানুষের কাছে তাঁর কাছ থেকে ওহী আসাতে সে এতােটা হতবুদ্ধি হয়ে যেতনা। প্রত্যেকটা মানুষের দেহে ও মনে এতাে সব অসংখ্য অলৌকিক বৈশিষ্ট্য নিহিত থাকা যতখানি বিস্ময়ােদ্দীপক, ওহীর আগমন তার চেয়ে বেশী বিস্ময়ােদ্দীপক নয়। আল্লাহ তায়ালা সূরার প্রথম আয়াতে বলেন, সােয়াদ, এবং উপদেশপূর্ণ কোরআনের কসম!
*কোরআন যুগপৎ উপদেশ ও আইন গ্রন্থ : এ কথা সত্য যে, কোরআনে শুধু উপদেশই থাকে না, থাকে অন্যান্য জিনিসও, যেমন আইন ও বিধান, কিসসা কাহিনী, আর সুসভ্য জীবন যাপনের উপকরণ ও পদ্ধতি সমূহ। তবে আল্লাহর স্মরণ এবং আল্লাহর দিকে মনােনিবেশটাই সর্বাগ্রে আবশ্যক এবং এগুলােই সর্বপ্রথম। এগুলােই কোরআনের প্রথম ও প্রধান বক্তব্য। সত্য বলতে কি, আইন বিধান এবং কিসসা কাহিনীও আসলে এই উপদেশমালারই অংশ। কেননা এগুলোর প্রত্যেকটাই আল্লাহর কথা মনে করিয়ে দেয় এবং আল্লাহর দিকে মন ঝুঁকিয়ে দেয়। ‘যিয্ যিকর’ শব্দটার অর্থ যেমন উপদেশপূর্ণ হতে পারে, তেমনি এর অর্থ আলােচনায় পরিপূর্ণ অথবা ‘প্রখ্যাত’ হতে পারে। বস্তুত এটাই কোরআনের আসল গুণ বৈশিষ্ট্য, ‘বরং কাফেররা অহংকার ও বিরােধিতায় লিপ্ত।’ বক্তব্যের ভেতরে এই আকস্মিক মােড় পরিবর্তন দৃষ্টি আকর্ষণ করে। মনে হয় যেন এখানে প্রথম আলােচ্য বিষয়টায় ছেদ পড়েছে। অর্থাৎ সােয়াদ ও কোরআনের নামে শপথ করেই ক্ষান্ত হচ্ছে। অথচ শপথের বিষয়টা শেষ হলাে না বলে মনে হচ্ছে। কেননা কেবল শপথের উল্লেখ করা হয়েছে, শপথ করে যে কথাটা বলা হবে তা এখনাে বলা হয়নি। এর অব্যবহিত পরেই মােশরেকদের এবং তাদের অহংকার ও বিরােধিতার বিষয়টি এসে গেছে, কিন্তু প্রথম আলোচিত বিষয়ে এই ছেদ পড়াটা আসলে বাহ্যিক। এ দ্বারা পরবর্তী বক্তব্যের গুরুত্ব বাড়ানােই উদ্দশ্য। সােয়াদ ও উপদেশপূর্ণ কোরআনের কসম খাওয়া থেকেই বুঝা যায়, পরবর্তীতে যা বলা হচ্ছে তা এতােই গুরুত্বপূর্ণ যে, সে ব্যাপারে আল্লাহর কসম খাওয়াও বেমানান নয় । এরপর মোশরেকদের অহংকার ও কোরআনের বিরােধিতার উল্লেখ করা হয়েছে। বস্তুত ‘বরং’ কথাটার আগে এবং পরে যা বলা হয়েছে, দুটোই আসলে একই বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত। বাচনভংগিতে এই মােড় পরিবর্তনটা অত্যন্ত তীব্রভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করে দেখিয়ে দিল যে, মহান আল্লাহ তায়ালা এই কোরআনকে যে গুরুত্ব ও মর্যাদা দেন, আর কুরআন থেকে মােশরেকদের অহংকারভরে মুখ ফেরানাে ও তার বিরােধিতাকে যে গুরুত্ব দেন, এই উভয় গুরুত্বের পার্থক্য কতখানি। মােশরেকদের অহংকার এবং বিরােধিতাও একটা গুরুতর ব্যাপার বই কি! এরপর এই অহংকার ও বিরােধিতা সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে আল্লাহ তায়ালা তাদেরই মতাে অহংকারী, বিরােধিতাকারী ও প্রত্যাখ্যানকারী অতীতের মােশরেকদের ধ্বংসের কাহিনী তুলে ধরেছেন। তাদের ধ্বংসের করুণ দৃশ্য তুলে ধরে দেখানাে হয়েছে যে, আযাব এসে যাওয়ার পর তারা অনেক আর্তনাদ করেছে। অহংকার ও বিরােধিতা পরিত্যাগ করে নতি স্বীকার করেছে, কাকুতি মিনতি করে অনুগ্রহ ভিক্ষা করেছে, কিন্তু তাতে কোনােই কাজ হয়নি। কারণ এ সবের জন্যে যে নির্দিষ্ট সময় ছিলাে তা এতােক্ষণে পার হয়ে গেছে। ‘আমি তাদের আগের কত জাতিকে ধ্বংস করেছি। তখন তারা আর্তনাদ করেছে, কিন্তু তাদের নিষ্কৃতি পাওয়ার সুযোগ ছিলাে না।'(আয়াত ৩) হয়তাে বা মক্কার এই মােশরেকরাও তাদের বর্তমান আয়ুষ্কাল ফুরিয়ে যাওয়ার পর অহংকার ও বিরােধিতা থেকে ফিরে আসবে। সেসব অতীত জাতিগুলাের মতােই আর্তনাদ করবে, করুণা ভিক্ষা করবে, কিন্তু একইভাবে তা বৃথা যাবে। অথচ এখনও তাদের হাতে অবকাশ রয়েছে। নিষ্কৃতির সকল সযােগ ফুরিয়ে যাওয়ার আগে এবং আর্তনাদ ও কাকুতি মিনতির আগে এখনাে সময় রয়েছে। এরপর আর কোনাে সাহায্য ও মুক্তির সুযােগ থাকবে না।
*আল্লাহর রসূলকে জাদুকর আখ্যা দেয়ার ঘটনা : মােশরেকদের অহংকার ও বিরােধিতার বিস্তারিত বিবরণ দেয়ার আগে অতীতের করুণ ইতিহাসের এক ঝলক দেখিয়ে তাদের বিবেককে কষাঘাত করা হচ্ছে। এরপর তাদের অহংকার ও বিরােধিতার বিবরণ দেয়া হচ্ছে, তাদের মধ্য থেকেই একজন সতর্ককারী তাদের কাছে আসায় তারা বিস্মিত হয়েছে এবং কাফেররা বলেছে, এতে একজন মিথ্যাবাদী যাদুকর।(আয়াত ৪-৮) যে কথার মধ্য দিয়ে তাদের অহংকার ফুটে ওঠেছে তা হলো, ‘আমাদের মধ্য থেকে কেবল তার ওপরই উপদেশ নাযিল হয়ে গেলাে?’ আর যে কথার মধ্য দিয়ে বিরােধিতা ফুটে ওঠেছে তা হলাে, সমস্ত দেব-দেবীকে সে মাত্র একজন দেবতায় পরিণত করে ফেললো?’ ‘আমরা সর্বশেষ ধর্মে এমন কথা শুনিনি… এতাে মিথ্যাবাদী যাদুকর।’ সবই বানােয়াট কথা, আল্লাহর রসূল মানুষের মধ্য থেকে হওয়ায় বিস্ময়বােধ করাটা অনেক পুরনাে ব্যাপার। বহুবার এর পুনরাবৃত্তি হয়েছে। সকল জাতিই এ কথা বলতাে এবং এই কারণ দেখিয়ে নিজেদের ঈমান আনার অক্ষমতা প্রকাশ করতো আদিকাল থেকেই। এতদসত্তেও আবহমানকাল ধরে মানুষই নবী রসূল হয়ে এসেছে, আর এতদসত্তেও মানুষ বার বার এই আপত্তিই তুলতে থেকেছে। ‘তারা অবাক হয়ে গেছে এজন্যে যে, তাদের মধ্য থেকেই একজন সতর্ককারী তাদের কাছে এসেছে।’ অথচ যুক্তি ও বুদ্ধির বিচারে সবচেয়ে সংগত ব্যাপার এটাই যে, মানুষের মধ্য থেকেই সতর্ককারী আসা উচিত। মানুষই বুঝতে পারে মানুষ কিভাবে চিন্তা করে, কী তার অনুভূতি, তার অন্তরে কি চিন্তাভাবনার উদয় হয়। তাদের দেহমনে কি টানাপড়েন চলে, তারা কি কি ক্ষতি ও কষ্ট ভােগ করে। কিসের কিসের দিকে ঝোঁক আকর্ষণ বােধ করে, কি কি চেষ্টা সাধনা তারা করতে সক্ষম কিংবা অক্ষম, কি কি বাধা বিপত্তির সম্মুখীন হয় তারা এবং কি কি উপকরণ তাদের ওপর ইতিবাচক বা নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে। যে মানুষ অন্য মানুষের সাথেই বসবাস করে, তার জীবন সেই মানুষদের জন্যে অনুকরণীয় হতে পারে। কেননা তারা মনে করে যে, সে তাদেরই একজন। সে যা করতে পারে তা আমরা কেন করতে পারবাে না? সে তাে আমাদেরই মতাে, সে যে মতবাদ নিজে পালন করছে এবং অন্যদের তার দিকে দাওয়াত দিচ্ছে, তা সব মানুষেরই পালনযােগ্য। কেননা একজন মানুষ তাদের সামনেই তা পালন করছে। সে মানুষটা তাদেরই বংশধর। তাদের ভাষাতেই সে কথা বলে এবং তাদের ভাষা, আদত অভ্যাস, রীতিপ্রথা এবং জীবনের খুঁটিনাটি সব তথ্যই তার জানা। এ জন্যে তার সাথে তাদের কি খুব বেশী প্রভেদ নেই। জাতীয়তার দিক দিয়েও নয়, ভাষার দিক দিয়েও নয় এবং জীবনের স্বভাব প্রকৃতির দিক দিয়েও নয়। কিন্তু যে জিনিসটা হওয়া সবচেয়ে বেশী দরকারী ও সবচেয়ে বেশী সংগত, সেই জিনিসটা নিয়েই কাফেররা চিরকাল বিস্ময় প্রকাশ করেছে, অসন্তোষ প্রকাশ করেছে এবং তাকে মিথ্যা সাব্যস্ত করেছে। কেননা মানুষের মধ্য থেকে রসূল নিযুক্ত হওয়ার যৌক্তিকতা তারা বুঝতাে না। রেসালাতকে আল্লাহর দিকে বাস্তব পথ প্রদর্শনের উপায় হিসাবে না দেখে তারা একটা কাল্পনিক, রহস্যময়, অস্পষ্ট ও দুর্বোধ্য জিনিস হিসাবে বিবেচনা করতাে। রেসালাতকে তারা এমন একটা উড়ন্ত ও বায়বীয় জিনিস মনে করতাে, যা হাত দিয়ে স্পর্শ করা যায় না, আলােতে দেখা যায় না, সুস্পষ্টভাবে চেনা এবং বুঝাও যায় না, পার্থিব জীবনে যার অস্তিত্ব নেই। তারা একে একটা রূপকথার কল্পকাহিনী হিসাবেই বিবেচনা করতাে, যা তাদের পৌত্তলিক আকীদা বিশ্বাস থেকে জন্ম নেয়া কল্পকাহিনীর মতাে। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা রেসালাতের বিশেষত সর্বশেষ রসূলের রিসালাত মানব জাতির জন্যে বাস্তব, স্বাভাবিক, পূত পবিত্র, পরিচ্ছন্ন ও উচ্চমানের জীবন পথ হিসেবে মনোনীত করলেন। তিনি এটাকে একটা বস্তুনিষ্ঠ ব্যবস্থা হিসাবে উপস্থাপন করেন। কাল্পনিক, অস্পষ্ট স্বপ্নিল ও রহস্যময় কোনাে ব্যবস্থা হিসাবে নয়। এমন কোনাে ব্যবস্থা হিসাবে নয় যাকে বাস্তব রূপ দান করা কঠিন এবং যা কল্পনার কুয়াশায় হারিয়ে যায়। কাফেররা বললাে, এতাে মিথ্যাবাদী এক জাদুকর। তাদের একথা বলার কারণ এই যে, আল্লাহ তায়ালা তাদের মধ্যকার একজন মানুষের কাছে ওহী পাঠাতে পারেন তা তাদের কল্পনা বহির্ভূত। তাছাড়া জনগণকে মােহাম্মদ(স.)-এর প্রতি বীতশ্রদ্ধ করে তােলা এবং তাঁর সুপরিচিত সত্যবাদিতা সম্পর্কে জনমনে সংশয় সৃষ্টি করাই এই বক্তব্যের উদ্দেশ্য। পক্ষান্তরে যে সত্য সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত তা হলাে, কোরায়শ নেতা মােহাম্মদ(স.)-কে সঠিকভাবেই চিনতাে এবং মুখে তাকে মিথ্যাবাদী এবং যাদুকর বললেও আদতে এ কথায় তারা এক মুহূর্তের জন্যেও বিশ্বাস করতাে না। তাদের এ উক্তি ছিলাে নিছক জনগণকে বিভ্রান্ত করা ও ধোঁকা দেয়ার অস্ত্র বিশেষ। এই ধোকাবাজিতে সেই নেতারা ছিলাে খুবই দক্ষ। তাদের এই অপপ্রচারের উদ্দেশ্য ছিলাে কেবল মােহাম্মদ(স.)-এর দেয়া সত্যের দাওয়াতের কবল থেকে নিজেদের কায়েমী স্বার্থকে রক্ষা করা। কেননা তারা জানতাে যে, এই দাওয়াত বাস্তবে প্রতিষ্ঠিত হলে তাদের বাতিল সমাজ ব্যবস্থা ও মূল্যবােধ আদৌ টিকবে না। মুহাম্মদ(সা.) ও তার আনীত সত্য দ্বীনের দাওয়াতের বিরুদ্ধে কিভাবে অপপ্রচার চালালে কোরায়শ নেতারা নিজেদের এবং মক্কার জনগণের মনে তাদের ভক্তি শ্রদ্ধা ও ভাবমূর্তি রক্ষা করতে পারবে, আর হজ্জের মৌসুমে মক্কায় আগত প্রতিনিধি দলগুলােকে মুহাম্মদ(সা.) ও তার প্রচারিত নতুন ধর্ম থেকে ফিরিয়ে রাখতে পারবে, সে সম্পর্কে তারা এক পর্যায়ে একটা ঐকমত্যে পৌঁছেছিলাে। সেই ঘটনাটা ইতিপূর্বেও আমি উল্লেখ করেছি। এখানে তার পুনরাবৃত্তি করা জরুরী মনে হচ্ছে। ইবনে ইসহাকের বর্ণনা অনুসারে ঘটনাটা নিম্নরূপ- প্রবীণ কোরায়শ নেতা ওলীদ ইবনে মুগীরার কাছে একদিন কোরায়শ বংশের কিছু লােক জমায়েত হলো। হজ্জের মৌসুম সমাগত প্রায়। ওলীদ তাদের সম্বোধন করে বললেন, ‘হে কোরায়শ জনতা, শােন, হজ্জের মৌসুম ঘনিয়ে এসেছে এ সময় আরবের বিভিন্ন এলাকা থেকে দলে দলে তীর্থযাত্রীরা আসবে। তােমাদের এই সাথী অর্থাৎ মােহাম্মদ(স.) সম্পর্কে তারা ইতিমধ্যে নিশ্চয়ই কিছু না কিছু শুনেছে। এখন তােমরা তার সম্পর্কে কোনাে একটা বক্তব্যে একমত হও। হরেক জনে হরেক রকম বক্তব্য দিয়াে না এবং একজন আরেক জনের বিপরীত কথা বলাে না। উপস্থিত জনতা বললাে, তাহলে এ ব্যাপারে কি বলতে হবে তা আপনিই বলে দিন, আপনিই একটা মত ঠিক করে দিন। আমরা সেই মতই প্রচার করবাে। ওলীদ বললাে; বরং তােমরা বলাে। আমি শুনি। জনতার একাংশ বললাে, আমরা ওকে জ্যোতিষী বলবাে। ওলীদ বললাে, না, আল্লাহর কসম, সে জ্যোতিষী নয়। আমরা বহু জ্যোতিষী দেখেছি, কিন্তু জ্যোতিষীরা যে রকম রহস্যময়, ধাঁধালাে ও ছন্দ-পয়ারযুক্ত কথা বলে, মুহাম্মদ(স.) সে রকম বলে না। লোকেরা বললাে, ঠিক আছে, আমরা ওকে পাগল বলবাে, ওলীদ বললাে, না, না, সে তাে পাগল নয়। পাগলামি আমরা দেখেছি এবং চিনিও। পাগল যে রকম আবােল তাবােল বলে, কথা বলতে বলতে শ্বাসরুদ্ধ ও জিহবা আড়ষ্ট হয়ে আসে এবং কু-প্ররােচণা দেয়ার ভংগিতে কথা বলে, সেসব লক্ষণ ওর ভেতরে নেই। জনতা বললাে, তাহলে কবি বললে কেমন হয়? ওলীদ বললাে, না, ও তাে কবি নয়। আমরা সব রকমের কবিতা চিনি। যুদ্ধের কবিতা চিনি, নিন্দাসূচক কবিতা চিনি, প্রশংসার কবিতা চিনি, ছােট কবিতা চিনি, বড় কবিতা চিনি, কিন্তু কোন মাপকাঠিতেই মােহাম্মদ(স.)-এর কথাবার্তা কবিতার আওতায় পড়ে না। জনতা বললাে, তাহলে যাদুকর বলি? ওলীদ বললাে না, ওতাে যাদুকরও নয়। আমরা বহু যাদুকর এবং তাদের যাদু দেখেছি, কিন্তু তাদের ফুক দেয়া ও গেরাে দেয়ার লক্ষণটা ওর ভেতরে নেই। তারা বললাে, তাহলে এখন আপনিই বলে দিন আমরা কি বলবাে । ওলীদ বললাে, আসলে ওর কথাবার্তা এতাে মিষ্টি, এতাে ব্যাপক অর্থবােধক ও তাৎপর্যপূর্ণ যে, তার সম্পর্কে তােমাদের এসব বক্তব্যের কোনােটাই ধােপে টিকবে না। সই মিথ্যা বলে গণ্য হবে। তার সম্পর্কে তােমাদের একথাই অধিকতর গ্রহণযােগ্য হবে যে, সে একজন যাদুকর। সে এমন কথা নিয়ে এসেছে, যা ছেলে ও বাবার মধ্যে, ভাই ও ভাইয়ের মধ্যে, স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে এবং ব্যক্তি ও তার গােত্রের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে দেয়। কাজেই একে যাদু বলাই সমীচীন।’ লােকেরা এই বক্তব্য নিয়েই সর্বত্র ছড়িয়ে পড়লাে এবং ছােট ছােট দলে বিভক্ত হয়ে লােকজনের চলাচলের পথের পাশে বসে পড়লো। হজ্জের মৌসুমে লােকজন আসতে আরম্ভ করলে তারা যাকেই আসতে দেখলাে, তাকেই মােহাম্মদ(স.) সম্পর্কে সাবধান করতে লাগলাে এবং তার দাওয়াত সম্পর্কে হুঁশিয়ার করতে লাগলাে। কোরায়শ নেতাদের মােহাম্মদ(স.)-কে মিথ্যাবাদী যাদুকর বলার এই ছিলাে পটভূমি। প্রকৃতপক্ষে তারা নিজেরাও জানতাে যে, তাদের এ কথা নির্জলা মিথ্যা। তারা ভালো করেই জানতাে, রাসূল(স.) মিথ্যাবাদী নন, যাদুকরও নন।
*তাওহীদ তত্ত্বের সাথে কৌশলে শিরকের সংমিশ্রণ : তারা রাসূল(স.) কর্তৃক তাদের এক আল্লাহর এবাদাতের আহ্বান জানানােতেও অবাক হতো। অথচ এটাই ছিলাে সবচেয়ে সত্য কথা এবং সবচেয়ে শ্রবণযােগ্য বক্তব্য। আল্লাহ তায়ালা তাদের এ সংক্রান্ত কথা উদ্ধৃত করেছেন। (আয়াত ৫-৮) সে কি বহু উপাস্যের পরিবর্তে মাত্র একজন উপাস্য স্থির করে নিলাে? এতাে একটা নিদারুণ বিস্ময়ের ব্যাপার তাদের কয়েকজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি এই বলে চলে যায় যে, তােমরা যা করছে, তা করে যেতে থাকে এবং তােমাদের উপাস্যদের ব্যাপারে দুঢ় থাকো। নিশ্চয় এ বক্তব্য কোনাে উদ্দেশ্যপ্রণােদিত। ‘আমরা সর্বশেষ আগত ধর্মে এ কথা শুনিনি। এটা নিশ্চয়ই মনগড়া ব্যাপার।’ কোরআনের বর্ণনা থেকে তাদের বিশ্বের চরমতম মাত্রার ছবি ফুটে ওঠছে। অথচ এটা আসলে একটা স্বাভাবিক ও সহজ বাস্তবতা। সে কি বহু উপাস্যের পরিবর্তে মাত্র একজন উপাস্য স্থির করে দিয়েছে? ভাবখানা এই যে, এটা যেন অকল্পনীয় ব্যাপার! ‘এটা তাে একটা নিদারুণ বিস্ময়ের ব্যাপার। এখানে ‘উজাব’ শব্দটার ব্যবহার বিস্ময়ের আতিশয্য ও চরম মাত্রা বুঝাচ্ছে। অনুরূপভাবে জনগণের মন থেকে এই দাওয়াতের প্রভাব মুছে ফেলার জন্যে তারা কিরূপ পন্থা অবলম্বন করেছে, তা চিত্রিত করা হয়েছে পরবর্তী আয়াতে। তাদের পুরুষানুক্রমিক আকীদা বিশ্বাস আঁকড়ে ধরে রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং এরূপ ধারণা দেয়া হয়েছে যে, রসূল(স.) যে দাওয়াত দিচ্ছেন তা বাহ্যত যেরূপ দেখা যায়, আসলে তা নয়। আসলে এই দাওয়াতের পেছনে এমন কোনাে গােপন উদ্দেশ্য নিহিত রয়েছে, যা একমাত্র তাদের মতাে প্রবীণ নেতারাই বুঝতে পারে। ‘তাদের কতিপয় নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি এই বলে চলে যায় যে…’ অর্থাৎ কিনা, ওটা কোনাে ধর্মও নয়, কোনো আকীদা-বিশ্বাসও নয়, বরঞ্চ এই দাওয়াতের পেছনে অন্য কোনাে উদ্দেশ্য নিহিত রয়েছে, যার প্রকৃত তত্ত্ব সাধারণ জনগণ বুঝতে পারে না। এ সম্পর্কে বুঝা ও সিদ্ধান্ত নেয়ার ভার সেই নেতাদের হাতেই অর্পণ করা উচিত যারা খুব সূক্ষ্মজ্ঞানী ও গুপ্ত তত্ত্ব বিশারদ। তারপর জনগণের নিজ নিজ কাজে যথারীতি নিয়ােজিত থাকা উচিত। নিজেদের এ নিয়ে মাথা ঘামানাে উচিত নয়। নেতারাই এর প্রতিরােধের জন্যে যথেষ্ট। তারাই জনগণের স্বার্থ, আকীদা বিশ্বাস ও দেবদেবীর রক্ষণাবেক্ষণে দিবারাত্র নিয়ােজিত। জনগণের এ ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাকা উচিত। একনায়ক শাসকরা চিরদিনই এরূপ করতে অভ্যস্ত। তারা জনগণকে তাদের স্বার্থ নিয়ে ভাবতে দেয় না। প্রকৃত সত্য কি তা নিয়ে মাথা ঘামাতে দেয় না। তাদের প্রকৃত হুমকি কোন দিক থেকে আসতে পারে তা তাদের চিন্তা করতে দেয় না। কেননা নিজেদের বিষয় নিয়ে জনগণ যদি নিজেরাই চিন্তা ভাবনা করে, তাহলে সেটা একনায়কদের জন্যে বিপজ্জনক হতে পারে। তারা যে বাতিলের মধ্যে, অন্যায় অসত্যের মধ্যে নিমজ্জিত আছে, সেটা তারা বুঝে ফেলতে পারে। অথচ জনগণকে ভুল ভ্রান্তির মধ্যে ডুবিয়ে রেখেই তারা আয়েশী ও স্বেচ্ছাচারী জীবন যাপন করতে পারে। তারা সজাগ সচেতন হলে তা পারে না। তারপর তারা অন্য যে কৌশলটা অবলম্বন করে জনগণকে ধোকা দেয়, তাহলে তাদের আকীদা বিশ্বাসের প্রায় কাছাকাছি আহলে কিতাবের আকীদা বিশ্বাসের বরাত দেয়া। অথচ ইতিমধ্যেই ওগুলােতে নানা কথার অনুপ্রবেশ ঘটেছে এবং ওগুলােকে প্রকৃত তাওহীদ থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে ও বিকৃত করেছে। ‘তারা বলে, সর্বশেষ ধর্মে আমরা এমন কথা শুনিনি। এটা নিশ্চয়ই মনগড়া।’ এ সময় খৃষ্টধর্মে ত্রিত্ববাদ ও ইহুদী ধর্মে ওযায়র তত্ত্বের মিশ্রণ ঘটেছে। এই ভেজাল মিশ্রিত খৃষ্টধর্ম ও ইহুদী ধর্মের দিকে ইংগিত করেই কোরায়শ নেতারা বলতাে, ‘সর্বশেষ ধর্মে আমরা এমন কথা শুনিনি।’ অর্থাৎ এমন এক আল্লাহর এবাদাতের কথা শুনিনি যা মােহাম্মদ(স.) নিয়ে এসেছে। সুতরাং মুহাম্মদ(সা.) যা বলে, ওটাই মনগড়া! এ কথা সুবিদিত যে, তাওহীদ বিশ্বাসকে নির্ভেজাল করা ও তার সাথে মিশ্রিত নানা রকমের মনগড়া ধ্যান ধারণা, রূপকথা ও উপকথা থেকে তাকে মুক্ত করার প্রতি ইসলাম প্রবল আগ্রহ পােষণ করে। ইসলামের পূর্বে যেসব ধর্ম এসেছিলাে, তাতে প্রথমে নির্ভেজাল তাওহীদই ছিলাে। পরবর্তীকালে তাতে এসব মানব রচিত ধ্যান ধারণার মিশ্রণ ঘটে। ইসলামের এই আগ্রহের কারণ এই যে, তাওহীদই হচ্ছে সেই আদি ও আসল মহাসত্য, যার ওপর গােটা সৃষ্টিজগতের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত। গােটা সৃষ্টিজগত দার্থহীনভাবে ও অকাট্যভাবে এই মহাসত্যের পক্ষে সাক্ষ্য দিচ্ছে। তা ছাড়া এই তাওহীদই হচ্ছে সেই স্তম্ভ, যার ওপর মানব জীবন প্রতিষ্ঠিত না হলে তা তার মূল ও শাখা-প্রশাখা সমেত অশুদ্ধ, বিকৃত ও পথভ্রষ্ট হয়ে যেতে পারে। বহু উপাস্যের পরিবর্তে একমাত্র উপাস্যের ঘােষণায় কোরায়শ যেমন হতভম্ব হয়ে যায় এবং এর প্রতিরােধে রুখে দাঁড়ায়, তেমনি কোরায়শের আগেও বহু জাতি এ ঘােষণা ও এ আকীদার বিরুদ্ধে প্রতিরােধ গড়ে তােলে। অপরদিকে প্রত্যেক রাসূল(স.) এ আকীদা প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে ছিলেন বদ্ধপরিকর। তাদের রেসালাতের ভিত্তিই ছিলাে এর ওপর প্রতিষ্ঠিত। যুগ যুগ কাল ধরে রসূলরা এ আকীদা মানব জাতির মন-মগযে বদ্ধমূল করার জন্যে সর্বাত্মক চেষ্টা চালান। এই ইতিহাস পর্যালােচনা করতে গেলে একটু বিস্তারিতভাবে এই তত্ত্বটার মূল্যায়ন ও ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করা সমীচীন হবে বলে মনে হয়। আমি বলেছি যে, তাওহীদ তথা একেশ্বরবাদ বা একক উপাস্য তত্ত্ব হচ্ছে সেই আদি ও আসল মহাসত্য, যার ওপর এই গােটা সৃষ্টিজগত দাড়িয়ে আছে ও টিকে আছে। আমি একথাও বলেছি যে, এই সৃষ্টিজগতের যেখানে যা কিছু আছে সবই এই মহাসত্যের পক্ষে সাক্ষ্য দিচ্ছে। সংগতভাবেই প্রশ্ন জাগে যে, এই সত্যের পক্ষে সৃষ্টিজগত কিভাবে সাক্ষ্য দিচ্ছে? এর জবাবে বলছি, দৃশ্যমান এই মহাবিশ্বকে পরিচালনাকারী ও নিয়ন্ত্রণকারী প্রাকৃতিক নিয়মগুলাে যে একই প্রকৃতির, একই ধরনের এবং একই উৎস থেকে উদ্ভূত তা একেবারেই স্পষ্ট ও স্বচ্ছ। আর প্রাকৃতিক নিয়মের এই প্রকৃতিগত ও গুণগত ঐক্য অকাট্যভাবেই প্রমাণ করে যে, যে ইচ্ছা ও সিদ্ধান্ত এই প্রাকৃতিক নিয়মগুলাে তৈরী করেছে, সেই ইচ্ছা ও সিদ্ধান্তও অবশ্যই এক ও অভিন্ন হওয়া অপরিহার্য। বিশ্বজগতের যেদিকেই তাকাই, এই সত্যটাই আমাদের সামনে প্রতিভাত হয়ে ওঠে যে, প্রাকৃতিক নিয়ম গুলো সবই গুণগত, প্রকৃতিগত, চরিত্রগত ও জাতগতভাবে এক ও অভিন্ন। এই ঐক্য থেকে পরিস্ফুট হয় যে, এগুলোর পেছনে বিরাজমান ইচ্ছা এবং সিদ্ধান্তও এক ও অভিন্ন। মহাবিশ্বের যেখানে যা কিছু আছে, তার প্রত্যেকটা জিনিসই নিরন্তর চলমান, নিয়মানুগ ও সুশৃংখলভাবে গতিশীল ও আবর্তনশীল। সৃষ্টিজগতের প্রাণী কিংবা অপ্রাণী প্রত্যেক বস্তুর প্রথম একক হচ্ছে অতি ক্ষুদ্র অণু। এই অণু সদা চলমান ও গতিশীল। কেননা এই অণু সেসব ইলেকট্রন দ্বারা গঠিত, যা বহু সংখ্যক প্রোটন দ্বারা গঠিত পরমাণুর চারপাশে আবর্তনশীল। ঠিক যেমন সৌরজগতে সূর্যের চারপাশে গ্রহগুলোর ঘূর্ণায়মান এবং অগণিত সৌরজগতের সমষ্টি, ছায়াপথ যেমন নিজের চারপাশে কক্ষপথ প্রদক্ষিণ করে থাকে, আর গ্রহগুলাের ভেতরে, সূর্যের ভেতরে এবং ছায়াপথের ভেতরে যে আবর্তন প্রক্রিয়া চলে, তার সবটার একই গতিপথ পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে, যা ঘড়ির গতিপথের ঠিক বিপরীত! আর যে সমস্ত উপাদান দিয়ে পৃথিবী ও অন্যান্য চলমান গ্রহগুলাে গঠিত, সেগুলাে সব একই উপাদান। নক্ষত্রগুলাের উপাদান ও তদ্রপ। আর উপাদানগুলাে সব অণু দ্বারা গঠিত, আর অণুগুলাে ইলেকট্রোন, প্রােটোন ও নিউট্রন দিয়ে গঠিত, সব কিছুই এই তিনটে মৌলিক জিনিস দিয়ে তৈরী। আবার বস্তু যেমন তিনটি মৌলিক উপাদানের সমষ্টি, তেমনি বিজ্ঞানীরা শক্তিগুলাের মূল নির্ধারণ করেছেন একটামাত্র, আলাে ও তাপ, আর পৃথিবীতে যতাে রশ্মি আছে, সবই একটা মাত্র শক্তির বিভিন্ন রূপ, সেই শক্তিটা হলাে ইলেক্ট্রো ম্যাগনেটিক শক্তি, এসব শক্তিই চলাচল করে একই গতিতে, এদের গতিতে যেটুকু পার্থক্য তা শুধু তরংগের পার্থক্য। বস্তুর উপাদান তিনটি আর শক্তির উপাদান হচ্ছে ভিন্ন ভিন্ন শক্তিসম্পন্ন তরংগ। আইনষ্টাইন তার আপেক্ষিকতা তত্ত্বে বস্তু ও শক্তির সমীকরণ করেছেন। তিনি বলেছেন, বস্তু ও শক্তি সমান। বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা থেকে তার দাবীর সত্যতা প্রমাণিত হয়, সর্বশেষ পরীক্ষা তার দাবীকে এতাে উচ্চকণ্ঠে সত্যায়ন করে যে, সারা দুনিয়াই তা যেন শুনতে পায়। তা হলাে, আয়ােডিন বােমায় অণুর চুর্ণ বিচূর্ণ হওয়া তত্ত্ব। সুতরাং এদিক থেকে বস্তু ও শক্তি সমমানের জিনিস। এই হলাে বিশ্বজগতের সৃষ্টির একত্ব, যেমনটি মানুষ সর্বশেষ পরীক্ষা-নিরীক্ষা থেকে জেনেছে। ‘নিরবিচ্ছিন্ন গতি তত্ত্বে যেমন আমি বলেছি, প্রাকৃতিক জগতে যে ঐক্য রয়েছে, তা চোখ মেলে তাকালেই দেখা যায়। বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না। তারপর প্রাকৃতিক জগতে সুসমন্বিত সুশৃংখল গতিবিধিও বিদ্যমান। বিশ্বজগতের কোনাে জিনিসই এই গতিবিধির আওতা বহির্ভূত নয়। কোনাে জিনিসই এখানে বিশৃংখল নয়। সমুদয় সৃষ্টিতে এই গতি এমন ভারসাম্যপূর্ণ যে, এর একটা অপরটাকে অচল বা নিষ্ক্রিয় করে দেয় না, সংঘাত-সংঘর্ষও বাধায় না। এই সংঘাত সংঘর্ষহীন সুচারু ও সশৃংখল গতির সর্বোত্তম দৃষ্টান্ত হলাে সৌরজগত, যেখানে গ্রহ-নক্ষত্র ও বড় বড় ছায়াপথ মহাশূন্যে চলাচল করছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, সকলেই আকাশে সাঁতার কাটছে। এসব গ্রহ-নক্ষত্র সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, যে সত্ত্বা তাদের এই মহাশূন্যে পরিচালিত করছে এবং তাদের গতি, দূরত্ব ও অবস্থান সুশৃংখল রাখছে, সে সত্ত্বা এক একাধিক নয়। সে সত্ত্বা তাদের স্বভাব প্রকৃতি ও গতিবিধি জানে এবং এই বিস্ময়কর মহাবিশ্বের পরিকল্পনা করার সময় সব কিছুর পরিমাণ নির্ধারণ করে দিয়েছে। বিশ্বজগতের প্রতিটি বস্তু ও এর সার্বিক ব্যবস্থাপনা যে ঐক্য এবং একত্বের সাক্ষ্য দেয়, সে সম্পর্কে আপাতত এই সংক্ষিপ্ত বিবরণটুকু উপস্থাপন করেই ক্ষান্ত থাকছি। বস্তুত একত্ব বা তাওহীদ এমন এক বাস্তব সত্য, যা মেনে না নিলে মানব জাতির জীবন সুস্থ ও সঠিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। চারপাশের প্রাকৃতিক জগত সম্পর্কে, প্রাকৃতিক জগতে নিজেদের অবস্থান সম্পর্কে এবং জগতের প্রতিটা বস্তু ও প্রাণী সম্পর্কে মানুষের সঠিক ধারণা লাভ করতে হলে এই তাওহীদ তত্ত্ব সম্পর্কে তার সুস্পষ্ট ধারণা লাভ করা অত্যন্ত জরুরী। আর এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে সঠিক ধারণা লাভ এবং তার সাথে যথােচিত সম্পর্ক বজায় রাখা আর তিনি ছাড়া আর যতাে প্রাণী বা বস্তু এ বিশ্ব চরাচরে রয়েছে, তাদের সাথেও যথােচিত সম্পর্ক বজায় রাখার জন্যে এই তত্ত্ব সম্পর্কে সঠিক ধারণা লাভ করা অপরিহার্য। আর মানুষের চিন্তা-চেতনা ও আবেগ-অনুভূতিকে জীবনের যাবতীয় বিষয়ের সাথে সঠিকভাবে খাপ খাইয়ে নেয়ার জন্যে এ সব কিছুই অত্যন্ত জরুরী। যে ব্যক্তি এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে এবং এই একত্বের মর্ম অনুধাবন করে, সে এই ঈমান ও অনুধাবনের ভিত্তিতেই তার প্রতিপালকের সাথে তার সম্পর্ক সংগতিশীল ও সুসমন্বিত করে। আর আল্লাহ তায়ালা ছাড়া অন্য সব কিছু ও অন্য সকলের সাথে তার সম্পর্ক যেমন হওয়া উচিত ঠিক তেমনি পর্যায়েই রাখে। তার শক্তি ও আবেগ অনুভূতি নানারকমের স্বভাব| প্রকৃতির অধিকারী বিভিন্ন উপাস্যের মধ্যে কিংবা তার ওপর আধিপত্যশীল বিভিন্ন সৃষ্টির মধ্যে বিভক্ত হয়ে যায় না। যে ব্যক্তি বিশ্বাস করে যে, এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহ তায়ালাই এই ঐক্যবদ্ধ সৃষ্টিজগতের উৎস, সে গােটা সৃষ্টিজগত ও তার মধ্যকার যাবতীয় বস্তু এবং প্রাণীর সাথে পরিচিতি, সহযােগিতা, সখ্যতা ও প্রীতির ভিত্তিতে আচরণ করে। সে জীবনকে এমন একটা স্বাদ ও আকৃতি দান করে, যা এই ঐক্যে বিশ্বাস করে না এমন ব্যক্তির পক্ষে দান করা সম্ভব নয়। এমনকি সে নিজের ও নিজের আশপাশের অন্যান্য বস্তু এবং প্রাণীর মাঝে এই প্রীতি, সখ্য ও সহযােগিতা অনুভবও করে না। আর যে ব্যক্তি বিশ্বাস করে যে, প্রকৃতির জগতে কার্যকর আল্লাহর প্রাকৃতিক বিধান সর্বত্র একই ধরনের, সে আল্লাহর আইন ও বিধানকে এমনভাবে গ্রহণ করে, যে আইন বিধান দিয়ে মানব জীবন নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয় এবং যে প্রাকৃতিক বিধান দ্বারা গােটা বিশ্ব পরিচালিত হয়, উভয়ের মধ্যে পূর্ণ সময় প্রতিষ্ঠিত হয়। সে মানব রচিত আইনের ওপর আল্লাহর আইনকে অগ্রাধিকার দেয়। কেননা আল্লাহর আইনই মানুষের আচরণ ও সমগ্র সৃষ্টির গতিবিধির সমন্বয় সাধন করতে সক্ষম। মােটকথা, তাওহীদ তত্ত্ব বুঝা মানব জাতির বিবেকের সুস্থতা, বিশুদ্ধতা ও চারপাশের সৃষ্টিজগতের সাথে তার সম্পর্ক বহাল রাখার জন্যে, তার তৎপরতাকে গােটা সৃষ্টিজগতের সাথে সমন্বিত করার জন্যে অপরিহার্য। তার ও তার স্রষ্টার মধ্যকার সম্পর্ক, তার ও তার চারপাশের সৃষ্টির সম্পর্ক, তার ও তার চারপাশের যাবতীয় বস্তু ও প্রাণীর সাথে সম্পর্কের সঠিক ধরন নির্ণয়ের জন্যে অপরিহার্য। আর এই সম্পর্ক থেকে জীবনের বিভিন্ন দিক ও বিভাগে যে সার্বিক, নৈতিক, সামাজিক ও মানবিক রীতিনীতির উৎপত্তি ঘটে, তার রক্ষণাবেক্ষণের জন্যেও তাওহীদ তত্ত্ব বুঝা অপরিহার্য। এ কারণেই ইসলাম তাওহীদী আকীদা বিশ্বাসকে স্বচ্ছ স্পষ্টভাবে তুলে ধরা ও প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে এতাে উদগ্রীব। প্রত্যেক রাসূলের আগমনেই এই চেষ্টার পুনরাবৃত্তি হয়েছে। রসূলরা তাওহীদের কালেমার ওপর অত্যধিক গুরুত্ব দিয়েছেন এবং এ ব্যাপারে কোনাে উদাসীনতা ও নমনীয়তা দেখাননি।
*অহংকারই আল্লাহর একাত্মবাদ অস্বীকারের কারণ : পবিত্র কোরআনে এই উদগ্রীবতা মক্কী সূরাগুলােতে বিশেষভাবে বার বার তাওহীদ তত্ত্বের সোচ্চার প্রকাশের মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হয়েছে। মাদানী সূরা গুলােতেও আলােচ্য বিষয়ের প্রাসংগিকতা অনুপাতে তাওহীদের আলােচনা দেখা যায়। আর এ কারণেই মক্কার মােশরেকরা রসূল(স.)-এর এই বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দিতে দেখে বিস্ময় প্রকাশ করতাে। সেই সাথে জনগণকেও তাওহীদের প্রচার থেকে যে কোনাে উপায়ে দূরে সরিয়ে রাখতে চেষ্টা করতো। এরপর তারা মুহাম্মদ(স.)-এর রাসূল হিসাবে নির্বাচিত হওয়াতেও বিস্ময় প্রকাশ করতাে। তারা বলতাে ‘আমাদের এতাে লােকের মধ্য থেকে কেবল তার ওপরই আল্লাহর ওহী নাযিল হলাে?’ এটা নতুন কোনাে ব্যাপার ছিলাে না। তারা জানতাে যে, আবহমানকাল ধরে এ রকমই হয়ে এসেছে। এটা ছিলাে শুধু ঈর্ষাপ্রসূত ব্যাপার। ঈর্ষা থেকেই শত্রুতা ও অহংকারের জন্ম হয়ে থাকে। ইবনে ইসহাক বলেন, একদিন রাতে আবু সুফিয়ান, আবু জাহল ও আখনাস বিন শােরায়ক রসূল(স.)-এর কোরআন পড়া শুনতে বেরিয়ে পড়লাে। তিনি তখন নিজ বাড়ীতে নামাযে কোরআন পড়ছিলেন। তারা তিন জনে তিনটে আলাদা আলাদা জায়গায় বসে পড়লাে। এদের একজন আরেকজনের কথা জানতাে না কে কোথায় বসেছে। শুনতে শুনতে তারা সারা রাত কাটিয়ে দিলাে। অবশেষে যখন ভাের হলাে, সবাই যার যার পথে প্রস্থান করলাে। পথে গিয়ে তারা একত্রিত হল। তারা পরস্পরকে তিরস্কার করলাে এবং একজন আর একজনকে বললাে, খবরদার, এখানে আর এসাে না। নচেত বেকুব লােকদের কেউ দেখতে পেলে তােমাদের সম্পর্কে কোনাে খারাপ ধারণা পােষণ করতে পারে। সবাই চলে গেলাে। পরের দিন আবার তারা ফিরে এলাে সেই একই জায়গায়। আবারাে তারা সারা রাত জেগে কোরআন শুনলো। অতপর পুনরায় পথে একত্রিত হলাে। এবার তারা আগের দিনের মতাে পরস্পরকে সতর্ক করলাে এবং স্থান ত্যাগ করলো। তৃতীয় দিনও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলাে। ফেরার পথে তারা বললাে, এখানে আমরা আর ফিরে আসবাে না এই মর্মে অংগীকার না করে এখান থেকে নড়বাে না। অতপর তারা অংগীকার করে স্ব স্ব বাড়ী অভিমুখে ফিরে গেলাে। সকালে আখনাস ইবনে শােরায়ক নিজের লাঠি নিয়ে আবু সুফিয়ানের বাড়ীতে গেলাে। সে আবু সুফিয়ানকে বললাে, আঙ্ছা, বলতাে দেখি, মােহাম্মদের কাছে যা শুনলে, সে সম্পর্কে তোমার অভিমত কী? আবু সুফিয়ান বললাে, আমি যা যা শুনলাম, তার কতক জিনিস আমি জানি এবং তার অর্থ বুঝি। আবার কতক জিনিস আমি জানি না এবং তার অর্থ বুঝি না। আখনাস বললাে, আমার অবস্থাও তদ্রুপ। অতপর আখনাস আবু জাহলের বাড়ীতে গিয়ে তার সাথে দেখা করলাে। সে বললাে, ওহে আবুল হাকাম, তুমি মােহাম্মদ(স.)-এর কাছ থেকে যা শুনলে, সে সম্পর্কে তােমার অভিমত কি? আবু জাহল বললাে, কী আর শুনেছি। আমরা এবং বনু আবদ মানাফ আভিজাত্য নিয়ে ঝগড়া করতাম। তারা লােকজনকে খাওয়াতাে, আমরাও খাওয়াতাম। তারা অনেক আর্তের দায়িত্ব বহন করতাে, আমরাও করতাম। তারা দান করতাে, আমরাও করতাম। শেষ পর্যন্ত যখন ভারবাহী পশুর ব্যাপারেও আমরা সমান সমান হয়ে দুই প্রতিযােগিতার ঘােড়ার মতাে হয়ে গেলাম, তখন তারা বললাে, আমাদের ভেতরে একজন নবী আছে, যার কাছে আকাশ থেকে ওহী আসে। এ ব্যাপারে আমরা তাদের সমকক্ষ কোনােকালেও হতে পারবাে না। তাই আল্লাহর কসম, আমরা তার ওপর কখনাে ঈমান আনবাে না এবং কখনাে তার দাবী মানবে না। এরপর আখনাস তার কাছ থেকে বিদায় নিলাে। সুতরাং আমরা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, এর পেছনে রয়েছে হিংসুটে স্বভাব! এটাই আবু জাহলকে সত্যের স্বীকৃতি দেয়া থেকে বিরত রাখছে। অথচ এই সত্য তার ওপর তিন দিনব্যাপী প্রাধান্য বিস্তার করে রেখেছিলাে। তাদের হিংসার কারণ ছিলাে এই যে, মােহাম্মদ(স.) এমন এক সাফল্য অর্জন করে ফেলেছেন, যা কেউ চেয়েও পায় না। যারা বলতাে, ‘আমাদের এতাে লােকের মধ্য থেকে কেবল তার ওপরই ওহী নাযিল হলাে নাকি?’ তাদের কথার মূল রহস্য এটাই। এসব লােকই বলতাে, এই কোরআন দুই শহরের কোন গণ্যমান্য লােকের ওপর অবতীর্ণ হলাে না কেন? দুই শহর দ্বারা তারা মক্কা ও তায়েফকে বুঝাতাে। কেননা এই দুই শহরেই মােশরেকদের বড় বড় নেতা, সরদার ও শাসক থাকতাে। এসব নেতা যখন শুনেছে যে, নতুন একজন নবীর আগমনের সময় ঘনিয়ে এসেছে, তখন তারা ধর্মের পথ ধরে নেতৃত্ব লাভের অভিলাষ পােষণ করতে আরম্ভ করেছিলাে। শেষ পর্যন্ত যখন আল্লাহ তায়ালা মােহাম্মদ(স.)-কে নবী হিসেবে নিয়ােগ করলেন, তার প্রতি নিজের করুণা ও অনুগ্রহের ভান্ডার খুলে দিলেন এবং পৃথিবীতে এই মর্যাদালাভে একমাত্র তিনিই যােগ্য বলে প্রমাণিত হলেন, তখন একাধারে হিংসা ও আভিজাত্যবােধের অনুভূতি তাদের বেসামাল করে তুললাে। তাদের উপরােক্ত প্রশ্নের এমন জবাব দেয়া হচ্ছে, যার ভেতরে হুমকি, হুঁশিয়ারী ও বিদ্রুপ প্রচ্ছন্ন রয়েছে, ‘আসলে তারা আমার ওহীর ব্যাপারেই সংশয়ে রয়েছে, তারা এখনাে আমার শাস্তির স্বাদ ভােগ করেনি।’ তারা প্রশ্ন তুলেছে যে, আমাদের সবার ভেতর থেকে একমাত্র তার ওপরই ওহী নাযিল হলাে নাকি? অথচ স্বয়ং ওহী সম্পর্কেই তাদের সন্দেহ রয়েছে। যে ওহী নিয়ে তাদের মনে এখনাে বিশ্বাস জন্মেনি যে, তা আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে কিনা, যে ওহীর প্রকৃতি নিয়ে এখনাে তাদের ঝগড়া থামেনি এবং যে ওহী তাদের চেনাজানা মানবীয় কথাবার্তা থেকে অনেক উর্ধ্বে, তা নিয়ে তাদের এ প্রশ্ন তােলা একেবারেই বেমানান। এরপর ওহী সম্পর্কে তাদের কথাবার্তা ও সন্দেহ সংশয় সম্পর্কে কথা বন্ধ করে আযাবের হুমকি দেয়া হয়েছে, ‘আসলে এখনাে তারা আমার আযাবের স্বাদ পায়নি।’ অর্থাৎ তারা এখনাে আমার আযাব থেকে নিরাপদে আছে বলেই এসব কথা বলার সাহস পাচ্ছে এবং ধৃষ্টতা দেখাচ্ছে। যখন আযাবের মজা টের পাবে তখন আর এসব কথা বলবে না। কেননা তখন তারা বুঝবে আসল ঘটনা কি।
# এরপর তাদের মধ্য থেকে আর সবাইকে বাদ দিয়ে কেবল মােহাম্মদ(স.)-কে নবী নিযুক্ত করার ব্যাপারে তাদের বিস্ময় ও আপত্তি খন্ডন করার জন্যে তাদের কাছে পাল্টা প্রশ্ন করা হয়েছে যে, কাকে তা দেয়া হবে আর কাকে দেয়া হবে না, তা নিয়ে মতামত দেয়ার তারা কে? এ ব্যাপারে এমন কি অধিকার তাদের রয়েছে। তাদের কাছে কি তােমার পরম দাতা ও মহাপরাক্রমশালী প্রভুর অনুগ্রহের ভান্ডার রয়েছে? এখানে মহান আল্লাহর সাথে তাদের বে-আদবীর নিন্দা করা হয়েছে। যে বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা বান্দার পক্ষে একেবারেই অশোভন, তাতে হস্তক্ষেপ করার কঠোর সমালোচনা করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা যাকে যা খুশী দেবেন অথবা দেবেন না, সেটা একান্তভাবে তার নিজস্ব বিবেচনার ওপর নির্ভরশীল। তিনি সর্বময় ক্ষমতার মালিক ও পরাক্রমশালী। তার ইচ্ছায় বাধা দেয়ার ক্ষমতা কারাে নেই। তিনি এমন দাতা ও দয়ালু যে, তাঁর বদান্যতার কোন শেষ নেই। অথচ তারা আল্লাহর মােহাম্মদ(স.)-কে নবী হিসেবে মনােনীত করা নিয়ে আপত্তি তুলছে। কোন অধিকারে ও কোন মর্যাদার বলে তারা আল্লাহর দান বিতরণ করার ক্ষমতা পেয়েছে। অথচ তারা তাে আল্লাহর ভান্ডারের মালিক নয়! আয়াতে বলা হয়েছে, ‘নাকি নভােমন্ডল, ভূমন্ডল ও এতদুভয়ের মধ্যবর্তী সবকিছুর ওপর তাদের সাম্রাজ্য রয়েছে?'(আয়াত ১০) অবশ্য সে জাতীয় দাবী করার মতাে সাহস কারও নেই। যিনি আসমান ও যমীনের স্রষ্টা, যিনি উভয়ের মধ্যকার সকল কিছুর স্রষ্টা। কেবল তিনিই দান করেন, তিনিই বারণ করেন এবং যাকে চান তাকে নবুওতের জন্যে পছন্দ করেন, নির্বাচিত করেন, আসমান ও যমীন বা এর মধ্যকার কোনাে কিছুর ওপর যাদের কর্তৃত্ব নেই, ক্ষমতা নেই, তারা কি করে এবং কোন সাহসে সেই একচ্ছত্র ক্ষমতা ও কতৃত্বের অধিকারী মহান সত্ত্বার পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে যায়। এই প্রশ্নের পর ওদের মুখ বন্ধ করে দেয়ার জন্যে চ্যালেঞ্জের সুরে বলা হচ্ছে, ‘থাকলে রশি ঝুলিয়ে তাদের আকাশে আরােহণ করা উচিত।’ যাতে করে সেখান থেকে আসমান ও যমীনের দেখা শুনা করা তাদের জন্যে সম্ভব হয়, আল্লাহর ভান্ডারগুলাের নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয় এবং সেখান থেকে যাকে ইচ্ছা দান করা বা না করা সম্ভব হয় । যারা সর্বময় কর্তৃত্ব ও ক্ষমতার অধিকারী মহান আল্লাহর স্বাধীন ইচ্ছা এবং পছন্দের ব্যাপারে আপত্তি করার সাহস দেখায় তাদের পারলে তেমনটিই করা উচিত। এই চ্যালেঞ্জ রাখার পর ওদের প্রকৃত অবস্থার প্রতি ইংগিত করে বলা হচ্ছে, ‘এক্ষেত্রে বহু বাহিনীর মধ্যে ওদেরও এক বাহিনী আছে, যা পরাজিত হবে।’
(আয়াত ১১) অর্থাৎ ওদের অস্তিত্ব একটা পরাজিত বাহিনীর চেয়ে বেশী কিছু নয়, যারা সুদূর কোনাে প্রান্তে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। এই বিশাল সাম্রাজ্যের পরিচালনা বা এসকল ভান্ডার নিয়ন্ত্রণের ধারে কাছেও ওরা নেই। আল্লাহর সাম্রাজ্যে কি ঘটছে সে ব্যাপারে ওদের কোনােই দখল নেই, আল্লাহর ইচ্ছা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার ক্ষমতাও ওদের নেই এবং নেই আল্লাহর পছন্দের ব্যাপারে কোনাে আপত্তি করার শক্তি। তাই ওদের আখ্যায়িত করা হয়েছে অজ্ঞাত, অখ্যাত এক পরাজিত বাহিনী হিসেবে, যার অস্তিত্বের সাথেই লেগে আছে পরাজয়ের গ্লানি। সে অস্তিত্বও আবার এককভাবে নয়; বরং একাধিক ও বহুমূখী অস্তিত্বের মাঝে একটি অস্তিত্ব মাত্র। কোরআনের ভাষায় আল্লাহ ও রসূলের শত্রুদের যে অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে, তার চেয়ে ভালাে অবস্থায় ওরা কোনাে দিনই ছিলাে না। কোরআনের ভাষায় ওরা দুর্বল, অক্ষম এবং বিশ্বের পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ থেকে বহু যােজন দূরে ওরা যতােই ক্ষমতার বাহাদুরী করুক, যতই দাপট প্রদর্শন করুক এবং পৃথিবীর বুকে কিছু দিনের জন্যে যতই স্বৈর শাসন কায়েম করে রাখুক, তারপরও ওরা দূর্বল অক্ষম।
তাফসিরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
(৩৮-সোয়াদ) : নামকরণ:
সূরা শুরুর হরফ ‘সা-দ’ কে এর নাম হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে।
(৩৮-সোয়াদ) : নাযিল হওয়ার সময়-কাল : যেমন সামনের দিকে বলা হবে, কোন কোন হাদীস অনুযায়ী দেখা যায়, এ সূরাটি এমন এক সময় নাযিল হয়েছিল যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কা মুআযযমায় প্রকাশ্যে দাওয়াত দেয়া শুরু করেছিলেন এবং এ কারণে কুরাইশ সরদারদের মধ্যে হৈ চৈ শুরু হয়ে গিয়েছিল। এ হিসেবে প্রায় নবুওয়াতের চতুর্থ বছরটি এর নাযিল হবার সময় হিসেবে গণ্য হয়। অন্যান্য হাদীসে একে হযরত উমরের (রা.) ঈমান আনার পরের ঘটনা হিসেবে বর্ণনা করা হয়। আর হযরত উমর হাবশায় হিজরাত অনুষ্ঠিত হবার পর ঈমান আনেন একথা সবার জানা। আর এক ধরনের হাদীস থেকে জানা যায়, আবু তালেবের শেষ রোগগ্রস্ততার সময় যে ঘটনা ঘটে তারই ভিত্তিতে এ সূরা নাযিল হয়। একে যদি সঠিক বলে মেনে হয়, তাহলে এর নাযিলের সময় হিসেবে ধরতে হয় নবুওয়াতের দশম বা দ্বাদশ বছরকে।
(৩৮-সোয়াদ) : ঐতিহাসিক পটভূমি :
ইমাম আহমাদ, নাসাঈ, তিরমিযী, ইবনে জারীর, ইবনে আবী শাইবাহ, ইবনে আবী হাতেম ও মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক প্রমুখ মুহাদ্দিসগণ যেসব হাদীস উদ্ধৃত করেছেন সেগুলোর সংক্ষিপ্তসার হচ্ছে: যখন আবু তালেব রোগাক্রান্ত হলেন এবং কুরাইশ সরদাররা অনুভব করলো, এবার তাঁর শেষ সময় এসে গেছে, তখন তারা নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করলো, বৃদ্ধের কাছে গিয়ে তাঁর সাথে কথা বলা উচিত। তিনি আমাদের ও তাঁর ভাতিজার ঝগড়া মিটিয়ে দিয়ে গেলে ভালো। নয়তো এমনও হতে পারে, তাঁর ইন্তিকাল হয়ে যাবে এবং আমরা তাঁর পরে মুহাম্মাদের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে কোন কঠোর ব্যবহার করবো আর আরবের লোকেরা এ বলে আমাদের খোঁটা দেবে যে, যতদিন বৃদ্ধ লোকটি জীবিত ছিলেন ততদিন এরা তাঁর মর্যাদা রক্ষা করে চলেছে, এখন তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর ভাতিজার গায়ে হাত দিয়েছে। একথায় সবাই একমত হয়। ফলে প্রায় ২৫ জন কুরাইশ সরদার আবু তালেবের কাছে হাজির হয়। এদের অন্যতম ছিল আবু জেহেল, আবু সুফিয়ান, উমাইয়াহ ইবনে খালফ, আস ইবনে ওয়ায়েল, আসওয়াদ ইবনুল মুত্তালিব, উকাবাহ ইবনে আবী মু’আইত, উতবাহ ও শাইবাহ। তারা যথারীতি প্রথমে আবু তালেবের কাছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিরুদ্ধে নিজেদের অভিযোগ পেশ করে তারপর বলে, আমরা আপনার কাছে একটি ইনসাফপূর্ণ আপোষের কথা পেশ করতে এসেছি। আপনার ভাতিজা আমাদেরকে আমাদের ধর্মের ওপর ছেড়ে দিক আমরাও তাকে তার ধর্মের ছেড়ে দিচ্ছি। সে যে মাবুদের ইবাদাত করতে চায় করুক, তার বিরুদ্ধে আমাদের কোন আপত্তি নেই। কিন্ত সে আমাদের মাবুদদের নিন্দা করবে না এবং আমরা যাতে আমাদের মাবুদদেরকে ত্যাগ করি সে প্রচেষ্টা চালাবে না। এ শর্তের ভিত্তিতে আপনি তার সাথে আমাদের সন্ধি করিয়ে দিন। আবু তালেব নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ডাকলেন। তাঁকে বললেন, ভাতিজা! এই যে তোমার সম্প্রদায়ের লোকেরা আমার কাছে এসেছে। তাদের আকাংখা, তুমি একটি ইনসাফপূর্ণ আপোষের ভিত্তিতে তাদের সাথে একমত হয়ে যাবে। এভাবে তোমার সাথে তাদের বিবাদ খতম হয়ে যাবে। তারপর কুরাইশ সরদাররা তাঁকে যে কথাগুলো বলেছিল সেগুলো তিনি তাঁকে শুনিয়ে দিলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জবাবে বললেন: “চাচাজান! আমি তো তাদের সামনে এমন একটি কালেমা পেশ করছি তাকে যদি তারা মেনে নেয় তাহলে সমগ্র আরব জাতি তাদের হুকুমের অনুগত হয়ে যাবে এবং অনারবরা তাদেরকে কর দিতে থাকবে।” ১ একথা শুনে প্রথমে তো তারা হতভম্ব হয়ে গেল।
। ১. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ উক্তিটি বিভিন্ন বর্ণনাকারী বিভিন্নভাবে বর্ণনা করেছেন। একটি হাদীসে বলা হয়েছে তিনি বলেছেন:
। أُرِيدُهُمْ عَلَى كَلِمَةٍ وَاحِدَةٍ يقولونها تَدِينُ لَهُمْ بِهَا الْعَرَبُ وَتُؤَدِّى إِلَيْهِمْ بِهَا الْعَجَمُ الْجِزْيَةَ
। (অর্থাৎ আমি তাদের সামনে এমন একটি কালেমা পেশ করছি তা পাঠ করলে তারা সমগ্র আরব জয় করে ফেলবে এবং অনারবরা তাদেরকে জিযিয়া দেবে।) অন্য একটি হাদীসের শব্দাবলী হচ্ছে:
। ادعوهم الى ان يتكلموا بكلمة تدين لهم بها العرب ويملكون بها ارفجم كلمة واحدة تعطونيها تملكون بها العرب وتدين لكم بها العجم
। (অর্থাৎ আমি তাদেরকে এমন একটি কালেমা পড়ার ডাক দিচ্ছি যা পাঠ করলে তারা সমগ্র আরব জয় করবে এবং অনারবরা তাদের শাসনাধীন হবে।) অন্য একটি বর্ণনায় বলা হয়েছে, তিনি আবু তালেবের পরিবর্তে কুরাইশ সরদারদেরকে সম্বোধন করে বলেন: ارأيتم ان اعطيتكم كلمة تكلمتم بها ملكتم بها العرب ودانت لكم بها العجمঅন্য একটি হাদীসের শব্দাবলী হচ্ছে:আরবী—————————————————————————–বর্ণনাগুলোর এ শাব্দিক পার্থক্য সত্ত্বেও বক্তব্য সবগুলোর একই। অর্থাৎ নবী করীম (সা.) তাদেরকে বলেন, যদি আমি এমন একটি কালেমা তোমাদের সামনে পেশ করি যা গ্রহণ করে তোমরা আরব ও আজমের মালিক হয়ে যাবে তাহলে বলো, এটি বেশী ভালো, না তোমরা ইনসাফের নামে যে কথাটি আমার সামনে পেশ করছো সেটি বেশী ভালো ? তোমরা এ কালেমাটি মেনে নেবে অথবা যে অবস্থার মধ্যে তোমরা এখন পড়ে রয়েছো তার মধ্যেই তোমাদের পড়ে থাকতে দেবো এবং নিজের জায়গায় বসে আমি নিজের আল্লাহর ইবাদাত করতে থাকবো— কোনটির মধ্যে তোমাদের কল্যাণ রয়েছে ?
। তারা বুঝতে পারছিল না এমন লাভজনক কথার প্রতিবাদ করবে কি বলে। কাজেই নিজেদের বক্তব্য কিছুটা গুছিয়ে নিয়ে তারা বলতে শুরু করলো, তুমি একটি কালেমা বলছো কেন আমরা তো এমন দশটি কালেমা বলতে রাজি কিন্তু সেই কালেমাটি কি তাতো একবার বলো। তিনি বললেন: লা- ইলা- হা ইল্লাল্লাহু। একথা শুনেই তারা সবাই একসাথে উঠে দাঁড়ালো এবং সে কথাগুলো বলতে বলতে চলে গেলো যা আল্লাহ এ সূরার শুরুতে উদ্ধৃত করেছেন।
। ওপরে যেভাবে উল্লিখিত হয়েছে ইবনে সা’দ তাবকাতে ঠিক তেমনিভাবেই সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করেছেন। কিন্তু তাঁর বর্ণনা অনুযায়ী এটা আবু তালেবের মৃত্যুকালীন রোগগ্রস্ততার সময়কার ঘটনা নয় বরং এটা এমন এক সময়ের ঘটনা যখন নবী করীম (সা.) তাঁর সাধারণ দাওয়াতের কাজ শুরু করেছিলেন এবং মক্কায় অনবরত খবর ছড়িয়ে পড়ছিল যে, আজ অমুক ব্যক্তি মুসলমান হয়ে গেছে এবং কাল অমুক ব্যক্তি। সে সময় কুরাইশ সরদাররা একের পর এক কয়েকটি প্রতিনিধি দল নিয়ে আবু তালেবের কাছে পৌঁছেছিল। তারা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ প্রচার কাজ থেকে বিরত রাখতে চাচ্ছিল। এ প্রতিনিধি দলগুলোরই একটির সাথে উল্লিখিত আলাপ আলোচনা হয়।
। যামাখশারী, রাযী, নিশাপুরী ও অন্যান্য কতিপয় মুফাসসির বলেন, এ প্রতিনিধি দল আবু তালেবের কাছে গিয়েছিল এমন এক সময় যখন হযরত উমরের (রা.) ঈমান আনার ফলে কুরাইশ সরদাররা হকচকিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু হাদীসের কোন কিতাবে এর সমর্থন পাওয়া যায়নি এবং মুফাসসিরগণও তাঁদের উৎসসমূহের বরাত দেননি। তবুও যদি এটা সঠিক হয়ে থাকে তাহলে একথা বোধগম্য। কারণ কাফের কুরাইশরা প্রথমেই এ দৃশ্য দেখে ভীত হয়ে পড়েছিল যে, ইসলামের দাওয়াত নিয়ে তাদের মধ্য থেকে এমন এক ব্যক্তি উঠেছেন যিনি নিজের পারিবারিক আভিজাত্য, নিষ্কলংক চরিত্র, বুদ্ধিমত্তা, প্রজ্ঞা ও বিচার-বিবেচনার দিক দিয়ে সমস্ত জাতির মধ্যে অদ্বিতীয়। তারপর আবু বকরের মতো লোক তাঁর ডানহাত, যাকে মক্কা ও তার আশপাশের এলাকার প্রত্যেকটি শিশুও একজন অত্যন্ত ভদ্র, বিবেচক, সত্যবাদী ও পবিত্র-পরিচ্ছন্ন মানুষ হিসেবে জানে। এখন যখন তারা দেখলো, উমর ইবনে খাত্তাবের মতো অসম সাহসী ও দৃঢ় সংকল্প ব্যক্তিও এ দু’জনের সাথে মিলিত হয়েছেন তখন নিশ্চিতভাবেই তারা অনুভব করে থাকবে যে, বিপদ সহ্যের সীমা অতিক্রম করে যাচ্ছে।
(৩৮-সোয়াদ) : বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্য :
ওপরে যে মজলিসের উল্লেখ করা হয়েছে তার ওপর মন্তব্য দিয়েই সূরার সূচনা করা হয়েছে। কাফের ও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মধ্যকার আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে আল্লাহ বলেছেন, তাদের অস্বীকারের আসল কারণ ইসলামী দাওয়াতের কোন ত্রুটি নয় বরং এর আসল কারণ হচ্ছে, তাদের আত্মম্ভরিতা, হিংসা ও একগুঁয়েমীর ওপর অবিচল থাকা। নিজেদের জ্ঞাতি-বেরাদরির এক ব্যক্তিকে আল্লাহর নবী বলে মেনে নিয়ে তাঁর আনুগত্য করতে তারা প্রস্তুত নয়। তাদের পূর্বপুরুষদেরকে তারা যেমন জাহেলী ধ্যান-ধারণায় বিশ্বাসী পেয়েছে ঠিক তেমনি ধারণা-কল্পনার ওপর তারা নিজেরাও অবিচল থাকতে চায় আর যখন এ জাহেলিয়াতের আবরণ ছিন্ন করে এক ব্যক্তি তাদের সামনে আসল সত্য উপস্থাপন করেন তখন তারা উৎকর্ণ হয় এবং তাঁর কথাকে অদ্ভূত, অভিনব ও অসম্ভব গণ্য করে। তাদের মতে, তাওহীদ ও আখেরাতের ধারণা কেবল যে, অগ্রহণযোগ্য তাই নয় বরং এটা এমন একটা ধারণা যা নিয়ে কেবল ঠাট্টা তামাশাই করা যেতে পারে।
। এরপর আল্লাহ সূরার শুরুর দিকে এবং শেষ বাক্যগুলোতেও কাফেরদেরকে সুস্পষ্টভাবে সতর্ক করে দিয়েছেন যে, আজ তোমরা যে ব্যক্তিকে বিদ্রূপ করছো এবং যার নেতৃত্ব গ্রহণ করতে জোরালো অস্বীকৃতি জানাচ্ছো, খুব শিগগির সে-ই বিজয়ী হবে এবং সে সময়ও দূরে নয় যখন যে মক্কা শহরে তোমরা তাঁকে অপদস্থ ও লাঞ্ছিত করার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাচ্ছো, এ শহরেই তোমরা তাঁর সামনে অবনত মস্তক হবে।
। এরপর একের পর এক ৯ জন পয়গম্বরের কথা বলা হয়েছে। এঁদের মধ্যে হযরত দাউদ (আ) ও হযরত সুলাইমানের (আ) কাহিনী বেশী বিস্তারিত। এর মাধ্যমে মহান আল্লাহ শ্রোতাদেরকে একথা হৃদয়ংগম করিয়েছেন যে, ইনসাফের আইন পুরোপুরি ব্যক্তি নিরপেক্ষ। মানুষের সঠিক মনোভাব ও কর্মনীতিই তার কাছে গ্রহণীয়। অন্যায় কথা, যে-ই বলুক না কেন, তিনি তাকে পাকড়াও করেন। ভুলের ওপর যারা অবিচল থাকার চেষ্টা করে না বরং জানার সাথে সাথেই তাওবা করে এবং দুনিয়ায় আখেরাতের জবাবদিহির কথা মনে রেখে জীবন যাপন করে তারাই তাঁর কাছে পছন্দনীয়।
। এরপর অনুগত ও বিদ্রোহী বান্দারা আখেরাতের জীবনে যে পরিণামের সম্মুখীন হবে তার চিত্র অংকন করা হয়েছে এবং এ প্রসংগে কাফেরদেরকে বিশেষ করে দু’টি কথা বলা হয়েছে। এক, আজ যেসব সরদার ও ধর্মীয় নেতাদের পেছনে মূর্খ লোকেরা অন্ধের মতো ভ্রষ্টতার দিকে ছুটে চলছে আগামীতে তারাই জাহান্নামে পৌঁছে যাবে তাদের অনুসারীদের আগে এবং তারা উভয়দল পরস্পরকে দোষারোপ করতে থাকবে। দুই, আজ যেসব মু’মিনকে এরা লাঞ্ছিত ও ঘৃণিত মনে করছে আগামীতে এরা অবাক চোখে তাকিয়ে দেখবে জাহান্নামে কোথাও তাদের নাম নিশানাও নেই এবং এরা নিজেরাই তার আযাবে পাকড়াও হয়েছে।
। সবশেষে আদম (আ) ও ইবলিসের কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে এবং এর উদ্দেশ্য হচ্ছে কাফের কুরাইশদেরকে একথা বলা যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে নত হবার পথে যে অহংকার তোমাদের বাঁধা দিচ্ছে সে একই অহংকার আদমের সামনে নত হতে ইবলিসকে বাঁধা দিয়েছিল। আল্লাহ আদমকে যে মর্যাদা দিয়েছিলেন ইবলিস তাতে ঈর্ষান্বিত হয়েছিল এবং আল্লাহর হুকুমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে লানতের ভাগী হয়েছিল। অনুরূপভাবে আল্লাহ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে যে মর্যাদা দিয়েছেন তাতে তোমাদের হিংসা হচ্ছে এবং আল্লাহ যাঁকে রসূল নিযুক্ত করেছেন তাঁর আনুগত্য করতে প্রস্তুত হচ্ছো না। তাই ইবলিসের যে পরিণতি হবে সে একই পরিণতি হবে তোমাদেরও।
# সমস্ত “মুকাত্তা’আত” হরফের মতো ‘সা-দ’ —এর অর্থ চিহ্নিত করা যদিও কঠিন তবুও ইবনে আব্বাস (রা.) ও যাহহাকের এ উক্তিও কিছুটা মনে দাগ কাটে যে, এর অর্থ হচ্ছে, صادق فى قوله অথবা صدق محمد অর্থাৎ “মুহাম্মাদ ﷺ সত্যবাদী। তিনি যা বলছেন সবই সত্য।”
# মূল শব্দ হচ্ছে ذِي الذِّكْرِ এর দু’টি অর্থ হতে পারে। এক, ذى شرف অর্থাৎ জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও মহাপাণ্ডিত্যপূর্ণ। দুই, ذى التذكير অর্থাৎ উপদেশ পরিপূর্ণ। অর্থাৎ ভুলে যাওয়া শিক্ষা আবার স্মরণ করিয়ে দেয় এবং গাফলতি থেকে সজাগ করে দেয়।
# যদি ইবনে আব্বাস ও দ্বাহ্হাক বর্ণিত সা-দ-এর ব্যাখ্যা গ্রহণ করা হয়, তাহলে এ বাক্যের অর্থ হবে, “জ্ঞানপূর্ণ বা উপদেশমালায় পরিপূর্ণ কুরআনের কসম, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সত্য কথা উপস্থাপন করছেন। কিন্তু যারা অস্বীকার করার ওপর অবিচল রয়েছে তারা আসলে জিদ ও অহংকারে লিপ্ত হয়েছে।” আর যদি সা-দকে এমন সব হরফে মুকাত্তা’আতের অন্তর্ভুক্ত করা হয় যাদের অর্থ নির্ধারণ করা যেতে পারে না তাহলে এখানে বলতে হবে কসমের জবাব উহ্য রয়েছে যা “বরং” তার পরবর্তী বাক্যাংশ নিজেই একথা প্রকাশ করছে। অর্থাৎ এ অবস্থায় সম্পূর্ণ বাক্যটি এভাবে হবে, “এ অস্বীকারকারীদের অস্বীকার করার কারণ এ নয় যে, তাদের সামনে যে দ্বীন পেশ করা হচ্ছে তার মধ্যে কোন ত্রুটি আছে অথবা মুহাম্মাদ ﷺ তাদের সামনে সত্য প্রকাশে কোন ত্রুটি করেছেন, বরং এর কারণ হচ্ছে কেবলমাত্র তাদের মিথ্যা অহংকার, তাদের জাহেলী আত্মম্ভরিতা এবং তাদের হঠকারিতা, আর উপদেশে পরিপূর্ণ এ কুরআন এ ব্যাপারে সাক্ষী, যা দেখে প্রত্যেক নিরপেক্ষ ব্যক্তি স্বীকার করবে যে, এর মধ্যে উপদেশ দেবার দায়িত্ব পুরোপুরি পালন করা হয়েছে।”
# এরা এমনই নির্বোধ যে, যখন এদের নিজেদেরই জাতি, সম্প্রদায় ও গোত্র থেকে একজন জানা-শোনা ভালো লোককে এদেরকে সতর্ক করার জন্য নিযুক্ত করা হয় তখন এ ব্যাপারটি এদের কাছে অদ্ভূত মনে হয়েছে। অথচ মানুষকে সতর্ক করার জন্য যদি আকাশ থেকে কোন ভিন্ন ধরনের প্রাণী পাঠিয়ে দেয়া হতো অথবা তাদের মাঝখানে হঠাৎ যদি বাহির থেকে কোন একজন অপরিচিত ব্যক্তি এসে দাঁড়াতো এবং নিজের নবুওয়াতি চালিয়ে যেতো, তাহলে সেটাই তো অদ্ভূত মনে হবার কথা। সে অবস্থায় তারা নিসন্দেহে বলতে পারতো, আমাদের সাথে অদ্ভূদ আচরণ করা হয়েছে। যে মানুষই নয়, সে আমাদের অবস্থা, আবেগ-অনুভূতি ও প্রয়োজনের কথা জানবে কেমন করে? কাজেই যে আমাদের পথের দিশা কেমন করে দেবে? অথবা যে অপরিচিত ব্যক্তি হঠাৎ আমাদের মধ্যে এসে গেছে আমরা কেমন করে তার সত্যতা ও ন্যায়পরায়ণতা যাচাই করবো এবং কেমন করে জানাবো সে নির্ভরযোগ্য কিনা? তার চরিত্র ও কার্যকলাপই বা আমরা দেখলাম কোথায়? কাজেই তাকে নির্ভরযোগ্য বা অনির্ভরযোগ্য মনে করার ফায়সালা করবো কেমন করে?
# নবী করীমের ﷺ জন্য যাদুকর শব্দটি তারা যে অর্থে ব্যবহার করতো তা হচ্ছে এই যে, তিনি মানুষের এমন কিছু যাদু করতেন যার ফলে তারা পাগলের মতো তাঁর পেছনে লেগে থাকতো। কোন সম্পর্কচ্ছেদ করার বা কোন প্রকার ক্ষতির মুখোমুখি হবার কোন পরোয়াই তারা করতো না। পিতা পুত্রকে এবং পুত্র পিতাকে ত্যাগ করতো। স্ত্রী স্বামীকে ত্যাগ করতো এবং স্বামী স্ত্রী থেকে আলাদা হয়ে যেতো। হিজরাত করার প্রয়োজন দেখা দিলে একেবারে সবকিছু সম্পর্ক ত্যাগ করে স্বদেশভূমি থেকে বের হয়ে পড়তো। কারবার শিকেয় উঠুক এবং সমস্ত জ্ঞাতি-ভাইরা বয়কট করুক—কোনদিকেই দৃকপাত করতো না। কঠিন থেকে কঠিনতর শারীরিক কষ্টও বরদাশত করে নিতো কিন্তু ঐ ব্যক্তির পেছনে চলা থেকে বিরত হতো না। (আরো বেশী ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, সূরা আল আম্বিয়া ৫ টীকা)
# যে সরদাররা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথা শুনে আবু তালেবের মজলিস থেকে উঠে গিয়েছিল তাদের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে।
# নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একথা যে, কালেমা লা-ইলা-হা ইল্লাল্লাহু কে মেনে নাও, তাহলে সমস্ত আরব ও আজম তোমাদের হুকুমের তাবেদার হয়ে যাবে।
# তাদের বক্তব্য ছিল, এটা একটা মতলবী কথা বলে মনে হচ্ছে। অর্থাৎ এ উদ্দেশ্যে দাওয়াত দেয়া হচ্ছে যে, আমরা মুহাম্মাদের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হুকুমের তাবেদারী করবো এবং তিনি আমাদের মাথার উপর নিজে ছড়ি ঘোরাবেন।
# নিকট অতীতে আমাদের নিজেদের মুরব্বি ও মনীষীরাও অতিক্রান্ত হয়েছেন। ইহুদী ও খৃস্টানরাও আমাদের দেশে এবং পাশপাশের দেশে রয়েছে এবং অগ্নি উপাসকরা তো ইরান-ইরাক ও সমগ্র পূর্ব আরব ভরে আছে। তাদের কেউও আমাদের একথা বলেনি যে, মানুষ একমাত্র আল্লাহ রাব্বুল আলামীনকে মেনে নেবে এবং আর কাউকেও মানবে না। একজন এবং মাত্র একক খোদাকে কেউ যথেষ্ট মনে করতে পারে না। আল্লাহর প্রিয় পাত্রদেরকে তো সবাই মেনে চলছে। তাদের আস্তানায় গিয়ে মাথা ঠেকাচ্ছে। নজরানা ও সিন্নি দিচ্ছে। প্রার্থনা করছে। কোথাও থেকে সন্তান পাওয়া যায়। কোথাও রিযিক পাওয়া যায়। কোন আস্তানায় গিয়ে যা চাইবে তাই পাবে। দুনিয়ার বিরাট অংশ তাদের ক্ষমতা মেনে নিয়েছে। তাদের দরবারসমূহ থেকে প্রার্থীদের প্রার্থনা পূর্ণ ও সংকট নিরসন কিভাবে হয়ে থাকে, তাদের অনুগ্রহ লাভকারীরা তা জানিয়ে দিচ্ছে। এখন এ ব্যক্তির কাছ থেকে আমরা এমন অভিনব কথা শুনছি যা ইতিপূর্বে কোথাও শুনিনি। এ ব্যক্তি বলছে, এদের কারো প্রভুত্বে কোন অংশ নেই এবং সমস্ত প্রভুত্ব একমাত্র এবং একচ্ছত্রভাবে আল্লাহরই জন্য নির্ধারিত।
# অন্যকথায় বলা যায়, আল্লাহ বলেন, যে মুহাম্মাদ! (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এরা মূলত তোমাকে অস্বীকার করছে না বরং অস্বীকার করছে আমাকে, তারাতো পূর্বেও তোমার সত্যবাদীতায় সন্দেহ করেনি। আজ তারা যে এ সন্দেহ করছে এটা আসলে যিকরের কারণে। তাদেরকে উপদেশ দেবার দায়িত্ব যখন আমি তোমার ওপর সোপর্দ করেছি তখন তারা এমন ব্যক্তির সত্যবাদিতায় সন্দেহ করতে শুরু করেছে যার সত্যবাদিতার তারা ইতিপূর্বে কসম খেতো। একই বিষয়বস্তু সূরা আল আন’আমের ৩৩ আয়াতেও ইতিপূর্বে আলোচিত হয়েছে। (দেখুন তাফহীমুল কুরআন আল আন ’আম ২১ টীকা।)
# “এটি হচ্ছে আমাদের মধ্যে কি মাত্র এ এক ব্যক্তিই থেকে গিয়েছিল যার কাছে আল্লাহর যিকর নাযিল করা হয়েছে।” কাফেরদেরকে এ উক্তির জবাব। এর জবাবে আল্লাহ বলছেনঃ আমি কাকে নবী করবো এবং কাকে করবো না এর ফায়সালা করার দায়িত্ব আমার নিজের। এরা কবে থেকে এ ফায়সালা করার ইখতিয়ার লাভ করলো? যদি এরা এর ইখতিয়ার লাভ করতে চায়, তাহলে বিশ্ব-জাহানের শাসন কর্তৃত্বের আসন লাভ করার জন্য এরা আরশের ওপর পৌঁছে যাবার চেষ্টা করুক। এর ফলে এরা যাকে নিজেদের অনুগ্রহের হকদার মনে করবে তার ওপর অহী নাযিল করবে এবং যাকে আমি হকদার মনে করি তার ওপর অহী নাযিল করবে না। এ বিষয়বস্তু কুরআন মজীদের বিভিন্ন স্থানে আলোচিত হয়েছে। কারণ কুরাইশ বংশীয় কাফেররা বারবার বলছিল, মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কেমন করে নবী হয়ে গেলেন? আল্লাহ কি এ কাজের জন্য কুরাইশদের বড় বড় সরদারদের মধ্য থেকে কাউকে পেলেন না? (দেখুন বনী ইসরাঈল ১০০ আয়াত এবং আয যুখরুফ ৩১-৩২ আয়াত)
# এখানে বলতে মক্কা মু’আযযমাকে বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ যেখানে এরা এসব কথা রচনা করছে সেখানেই একদিন এরা পরাজিত হবে। আর এখানেই একদিন এমন সময় আসবে যখন এরা নতমুখে এমন এক ব্যক্তির সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে যাকে আজ এরা তুচ্ছ মনে করে নবী বলে মেনে নিতে অস্বীকার করছে।
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
নামকরণ :
প্রত্যেকটি সূরার নামকরণের পেছনে একটি কারণ থাকে। যে নামে নামকরণ করা হয় হয়তো সে সম্পর্কে উক্ত সূরাতে আলোচনা করা হয়েছে নতুবা ঐ শব্দটি ঐ সূরাতে ব্যবহার হয়েছে। এ সূরার শুরুতেই সোয়াদ শব্দটি ব্যবহার হয়েছে। ফলে একে সোয়াদ নামে নামকরণ করা হয়েছে।
অত্র সূরায় পূর্ববর্তী কয়েকটি অবাধ্য জাতির ধ্বংসের বিবরণ, সকল বাতিল মা‘বূদ বর্জন করত এক আল্লাহর ইবাদত করাটা কাফিরদের কাছে আর্শ্চযের মনে হওয়া, পূর্বের নাবীদের মত নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে ধৈর্য ধারণ করার নির্দেশ, দাঊদ (আঃ) ও তাঁর সাথে সংশ্লিষ্ট একটি বিচারের ঘটনা, সুলাইমান (আঃ) ও তাঁর পরীক্ষার কথা, আইয়ুব (আঃ), ইবরাহীম, ইসহাক, ইয়া‘কূব, ইয়াসা‘ ও যুলকিফালসহ অনেক নাবীর বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। সূরার শেষে মানব জাতির পিতা আদম (আঃ)-কে সকল ফেরেশতা দ্বারা সিজদা করার নির্দেশ ও ইবলিসের অমান্য করা প্রসঙ্গ আলোচনা করা হয়েছে।
১-৩ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
صٓ (সোয়াদ)- এ জাতীয় “হুরূফুল মুক্বাত্বআত” বা বিচ্ছিন্ন অক্ষর সম্পর্কে পূর্বে সূরা বাকারার শুরুতে আলোচনা করা হয়েছে। এগুলোর আসল উদ্দেশ্য একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাই ভাল জানেন।
আল্লাহ তা‘আলা এখানে কুরআনের শপথ করে বলছেন : কুরআন উপদেশে পরিপূর্ণ। এতে তোমাদের জন্য সর্বপ্রকার নসীহত ও এমন কথা আলোচনা করা হয়েছে যার দ্বারা তোমাদের ইহকাল ও পরকাল উভয়ই শুধরে যাবে।
আবার কেউ ذي الذكر-এর অর্থ বলেছেন : কুরআন মর্যাদা ও মাহাত্ম্যের অধিকারী। ইমাম ইবনু কাসীর বলেন, দু’টি অর্থই ঠিক। কারণ কুরআন মর্যাদারও অধিকারী এবং মু’মিন ও মুত্তাক্বীদের জন্য উপদেশ ও শিক্ষণীয় গ্রন্থও বটে। আল্লাহর বাণী :
(لَقَدْ أَنْزَلْنَآ إِلَيْكُمْ كِتٰبًا فِيْهِ ذِكْرُكُمْ ط أَفَلَا تَعْقِلُوْنَ)
“আমি তোমাদের প্রতি অবতীর্ণ করেছি কিতাব যাতে আছে তোমাদের জন্য উপদেশ, তবুও কি তোমরা বুঝবে না?” (সূরা ‘আম্বিয়া ২১ : ১০)
আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা যে শপথ করেছেন তার উত্তর হলো যে, মক্কার কাফিররা বলে যে, মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জাদুকর, কবি, পাগল এবং মিথ্যুক, তা সঠিক নয়। বরং তিনি আল্লাহ তা‘আলার সত্য রাসূল; তাঁর ওপর এ মর্যাদাপূর্ণ কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে।
(فِيْ عِزَّةٍ وَّشِقَاقٍ)
‘অহঙ্কার ও বিরোধিতায় লিপ্ত’ অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা কুরআনকে উপদেশপূর্ণ করার পরেও কাফিররা তা হতে উপদেশ গ্রহণ করতে অহঙ্কার করছে ও ঈমান আনা হতে বিমুখ রয়েছে এবং সত্যকে বাতিল করার জন্য বিবাদে নিমজ্জিত।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(وَإِذَا قِيْلَ لَهَااِتَّقِ اللّٰهَ أَخَذَتْهُ الْعِزَّةُ بِالْإِثْمِ فَحَسْبُهُ جَهَنَّمُ ط وَلَبِئْسَ الْمِهَادُ)
“আর যখন তাকে বলা হয়, তুমি আল্লাহকে ভয় কর, তখন তার সম্মানের গরীমা তাকে অনাচারে লিপ্ত করে। অতএব জাহান্নামই তার জন্য যথেষ্ট, আর তা কতইনা নিকৃষ্ট বাসস্থান!” (সূরা বাকারাহ ২ : ২০৬)
(كَمْ أَهْلَكْنَا مِنْ قَبْلِهِمْ) ‘তাদের পূর্বে আমি বহু সম্প্রদায়কে ধ্বংস করেছি; অর্থাৎ পূর্ববর্তী জাতির মধ্যে যারা আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছিল তাদেরকে তিনি ধবংস করেছিলেন। তারা যখন আযাব প্রত্যক্ষ করেছিল তখন আল্লাহ তা‘আলার কাছে সাহায্য কামনা করেছিল, কিন্তু তাদের এ কামনা কোন উপকারে আসেনি। অতএব যে-কেউ তাদের মত আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলের সাথে এরূপ আচরণ করে তাহলে তারাও শাস্তির সম্মুখিন হবে।
لات শব্দটি মূলত لا, এখানে ت অক্ষরটি অতিরিক্ত যুক্ত হয়েছে। যেমন ثم-তে ثمت এবং رب-তে ربت বলা হয়ে থাকে। এগুলোতেও ت অক্ষরটি অতিরিক্ত।
مناص-এর অর্থ হলো, পলায়ন করা, পিছু হটা ইত্যাদি। সুতরাং পূর্ববর্তী জাতিদের ইতিহাস অধ্যয়ন করত আমাদের সতর্ক হওয়া উচিত যে, আমরা আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূলের নাফরমান হব না বরং একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করব এবং রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর রেখে যাওয়া পন্থার অবলম্বন করব।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. কুরআন একটি উপদেশ বাণী।
২. অহঙ্কার করা, কুরআন সুন্নাহর বিরোধিতা করা কাফির-মুশরিকদের কাজ।
৩. দুনিয়ার কোন শক্তিশালীর শক্তি আল্লাহ তা‘আলার শাস্তির বিপরীতে কোন কাজে আসবে না।
৪-১১ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
শানে নুযূল :
ইবনু ‘আব্বাস বলেন : আবূ ত্বালিব যখন অসুস্থ হয়ে পড়লেন তখন তার নিকট আবূ জাহল-সহ কুরাইশদের একটি দল হাজির হল। তারা তাকে বলল : আপনার ভ্রাতুষ্পুত্র আমাদের মা‘বূদদেরকে গালি দেয়/অবজ্ঞা করে, সে অমুক অমুক কাজ করছে ও বলছে। আপনি তাঁকে ডেকে পাঠান এবং বলে দিন- সে যেন এরূপ না করে। তখন তিনি তাঁকে খবর দেন অতঃপর নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘরে প্রবেশ করলেন। আবূ ত্বালিব ও ঐ বাহিনীর মাঝখানে একজন লোক বসার জায়গা ছিল। আবূ জাহল আশঙ্কা করল যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঐ জায়গায় আবূ ত্বালিব-এর পাশে যদি বসেন তাহলে তাঁর সাহচর্যের কারণে আবূ ত্বালিব-এর হৃদয় ইসলামের দিকে ঝুঁকে যাবে। তাই সে লাফ দিয়ে উঠে ঐ খালি জায়গায় বসে পড়ল। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর চাচার কাছে বসার কোন জায়গা না পেয়ে দরজার একপাশে বসলেন। আবূ ত্বালিব তাঁকে বললেন : হে আমার ভ্রাতুষ্পুত্র! তোমার গোত্রের লোকেরা তোমার বিরুদ্ধে নালিশ করছে যে, তুমি নাকি তাদের দেবতাদের ব্যাপারে কটুক্তি করছ এবং এরূপ এরূপ কথা বলছ? তারা তোমার বিরুদ্ধে আরো অনেক অভিযোগ নিয়ে এসেছে। এর উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন : হে আমার চাচা! আমি তো তাদের কাছ থেকে শুধু একটি কালিমার স্বীকৃতি চাচ্ছি, যদি তারা তা করে তাহলে সমগ্র আরব জাতি তাদেরকে অনুসরণ করবে এবং অনারবরা তাদেরকে জিযিয়া প্রদান করবে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কী বলতে চাচ্ছেন তা তারা চিন্তিত মনে বুঝতে চেষ্টা করল এবং শেষে বলল : একটি মাত্র কালিমা! তোমার পিতার শপথ, একটি নয়, বরং আমরা দশটি কালিমা হলেও বলতে রাজী আছি। বলো, কী সে কালিমা? আবূ ত্বালিবও বললেন : হে আমার ভ্রাতুষ্পুত্র! সে কালিমাটি কী? রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন : তা হলো
لَا إِلٰهَ اِلَّا اللّٰهُ
“আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত সত্যিকার কোন মা‘বূদ নেই” এ কথা শোনার সাথে সাথে তারা সবাই রাগে-ক্রোধে দাঁড়িয়ে গেল এবং তাদের পরিধেয় বস্ত্র মাটিতে হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে এই বলে চলে গেল :
(أَجَعَلَ الْاٰلِهَةَ إلٰهًا وَّاحِدًا إِنَّ هٰذَا لَشَيْءٌ عُجَابٌ)
তখন ঐ আয়াতটিসহ
(بَلْ لَمَّا يَذُوقُوا عَذَابِ)
পর্যন্ত অবতীর্ণ হয়। (মুসনাদে আহমাদ : – ১/৩৬২, তিরমিযী হা. ৩২৩২, ইমাম তিরমিযী হাসান বলেছেন, আলবানী সনদ দুর্বল বলেছেন)
তারা আরো আশ্চর্যান্বিত হয়েছিল এই ভেবে যে, একজন সাধারণ লোককে আল্লাহ তা‘আলা নাবী করে পাঠিয়েছেন তার সাথে সাথে সে আবার এতগুলো মা‘বূদকে এক মা‘বূদে পরিণত করেছে! এরূপ কথা আমরা ইতোপূর্বে কোন ধর্মে শুনতে পাইনি। নিঃসন্দেহে এটি একটি উদ্দেশ্য মূলক কথা যার দ্বারা সে আমাদেরকে আমাদের উপাস্য থেকে দূরে সরিয়ে তাঁর অনুসারী বানাতে এবং নিজের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব বাস্তবায়ন করতে চায়। এমনকি তারা এ টালবাহানাও দেখাল যে, আল্লাহ তা‘আলা যদি নাবী পাঠাতেন তাহলে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর চেয়ে আরো বড় বড় নেতৃবর্গ রয়েছে তাদের একজনকে নাবী হিসেবে প্রেরণ করতেন। এরূপ সাধারণ মানুষের নবুওয়াত মানতে পারব না। যেমন তারা বলত,
(وَقَالُوْا لَوْلَا نُزِّلَ هٰذَا الْقُرْاٰنُ عَلٰي رَجُلٍ مِّنَ الْقَرْيَتَيْنِ عَظِيْمٍ)
“এবং তারা বলে : এই কুরআন কেন অবতীর্ণ করা হল না দুই জনপদের কোন প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তির ওপর?” (সূরা যুখরুফ ৪৩ : ৩১)
অবশেষে তাদের এ সকল মিথ্যা টালবাহানা তাদেরকে ঈমান আনা থেকে বিরত রাখল ও তারা শিরকের ওপর দৃঢ়তার সাথে স্থির রইল এবং সাধারণ লোকদেরকে দেব-দেবীর পূজা করার নির্দেশ প্রদান করল।
এরপর আল্লাহ তা‘আলা এ সকল কাফিরদেরকে লক্ষ করে বলেন : তাদের নিকট কি আল্লাহ তা‘আলার রহমতের ধন-ভাণ্ডার রয়েছে, অথবা আকাশসমূহ ও জমিনের কর্তৃক্ত রয়েছে? মূলত এগুলোর কর্তৃত্ব একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার, তাই তিনি তাঁর ইচ্ছা মতো যাকে খুশি নবুওয়াত দান করতে পারেন। এগুলোর ওপর যদি মানুষের কর্তৃত্ব থাকত তাহলে তারা কাউকে কোন কিছুই দিত না বরং উপেক্ষা করে চলত। আল্লাহ তা‘আলার বাণী :
(قُلْ لَّوْ أَنْتُمْ تَمْلِكُوْنَ خَزَا۬ئِنَ رَحْمَةِ رَبِّيْٓ إِذًا لَّأَمْسَكْتُمْ خَشْيَةَ الْإِنْفَاقِ ط وَكَانَ الْإِنْسَانُ قَتُوْرًا)
“বল : ‘যদি তোমরা আমার প্রতিপালকের দয়ার ভাণ্ডারের অধিকারী হতে, তবুও ‘ব্যয় হয়ে যাবে’ এ আশঙ্কায় তোমরা তা ধরে রাখতে; মানুষ তো অতিশয় কৃপণ।’ (সূরা বানী ইসরাঈল ১৭ : ১০০)
অতএব সকল নেয়ামত, রহমত ও ক্ষমতার মালিক একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা, তিনি যাকে ইচ্ছা তাঁর অনুগ্রহ দান করে থাকেন। তাই একজন অসহায় দরিদ্র ব্যক্তি যদি দীনের সঠিক জ্ঞান রাখে তাহলে তার সত্যের দাওয়াত বর্জন করার কোন সুযোগ নেই।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কোন জাদুকর, কবি ছিলেন না এবং মিথ্যাবাদীও নন বরং তিনি ছিলেন সত্যসহ প্রেরিত একজন নাবী ও রাসূল।
২. দীনের কাজ করতে গিয়ে যদি কোন দুঃখ-কষ্ট আসে তাহলে বিচলিত না হয়ে বরং ধৈর্য ধারণ করতে হবে।
৩. আকাশসমূহ ও জমিনের যাবতীয় রাজত্ব আল্লাহ তা‘আলার। তাঁর বিরুদ্ধে কোন বাহিনীই জয়ী হতে পারবে না।
৪. আল্লাহ তা‘আলাই হচ্ছেন একমাত্র মা‘বূদ। তিনি ব্যতীত আর সত্য কোন মা‘বূদ নেই।