(টপিক#১০৮৪) [*বলে দাও আমার জন্যে আল্লাহই যথেষ্ট:-] www.motaher21.net সূরা:- ৩৯:আয-যুমার পারা:২৪ ৩৬-৫২ নং আয়াত:-

أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#১০৮৪)
[*বলে দাও আমার জন্যে আল্লাহই যথেষ্ট:-]
www.motaher21.net
সূরা:- ৩৯:আয-যুমার
পারা:২৪
৩৬-৫২ নং আয়াত:-
সূরা:- ৩৯:আয-যুমার-৩৬
اَلَیۡسَ اللّٰہُ بِکَافٍ عَبۡدَہٗ ؕ وَ یُخَوِّفُوۡنَکَ بِالَّذِیۡنَ مِنۡ دُوۡنِہٖ ؕ وَ مَنۡ یُّضۡلِلِ اللّٰہُ فَمَا لَہٗ مِنۡ ہَادٍ ﴿ۚ۳۶﴾
আল্লাহ কি তার বান্দার জন্য যথেষ্ট নন? অথচ তারা আপনাকে আল্লাহর পরিবর্তে অন্যের ভয় দেখায় । আর আল্লাহ্ যাকে পথভ্রষ্ট করেন তার জন্য কোন হেদায়াতকারী নেই।
সূরা:- ৩৯:আয-যুমার-৩৭
وَ مَنۡ یَّہۡدِ اللّٰہُ فَمَا لَہٗ مِنۡ مُّضِلٍّ ؕ اَلَیۡسَ اللّٰہُ بِعَزِیۡزٍ ذِی انۡتِقَامٍ ﴿۳۷﴾
যাকে আল্লাহ পথনির্দেশ করেন, তাকে কেউ পথভ্রষ্ট করতে পারে না, আল্লাহ কি পরাক্রমশালী, প্রতিশোধগ্রহণকারী নন?
সূরা:- ৩৯:আয-যুমার-৩৮
وَ لَئِنۡ سَاَلۡتَہُمۡ مَّنۡ خَلَقَ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضَ لَیَقُوۡلُنَّ اللّٰہُ ؕ قُلۡ اَفَرَءَیۡتُمۡ مَّا تَدۡعُوۡنَ مِنۡ دُوۡنِ اللّٰہِ اِنۡ اَرَادَنِیَ اللّٰہُ بِضُرٍّ ہَلۡ ہُنَّ کٰشِفٰتُ ضُرِّہٖۤ اَوۡ اَرَادَنِیۡ بِرَحۡمَۃٍ ہَلۡ ہُنَّ مُمۡسِکٰتُ رَحۡمَتِہٖ ؕ قُلۡ حَسۡبِیَ اللّٰہُ ؕ عَلَیۡہِ یَتَوَکَّلُ الۡمُتَوَکِّلُوۡنَ ﴿۳۸﴾
তোমরা যদি এদের জিজ্ঞেস করো যমীন ও আসমান কে সৃষ্টি করেছে? তাহলে এরা নিজেরাই বলবে, আল্লাহ। এদের বলে দাও, বাস্তব ও সত্য যখন এই তখন আল্লাহ‌ যদি আমার ক্ষতি করতে চান তাহলে আল্লাহকে বাদ দিয়ে যেসব দেবীদের তোমরা পূজা করো তারা কি তাঁর ক্ষতির হাত থেকে আমাকে রক্ষা করতে পারবে? কিংবা আল্লাহ‌ যদি আমাকে রহমত দান করতে চান তাহলে এরা কি তাঁর রহমত ঠেকিয়ে রাখতে পারবে? তাদের বলে দাও, আমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। ভরসাকারীরা তাঁরই ওপর ভরসা করে।
সূরা:- ৩৯:আয-যুমার-৩৯
قُلۡ یٰقَوۡمِ اعۡمَلُوۡا عَلٰی مَکَانَتِکُمۡ اِنِّیۡ عَامِلٌ ۚ فَسَوۡفَ تَعۡلَمُوۡنَ ﴿ۙ۳۹﴾
তাদেরকে পরিষ্কার করে বলে দাও, হে আমার জাতির লোকেরা! তোমরা তোমাদের কাজ করতে থাকো। আমি আমার কাজ করে যাবো। অচিরেই তোমরা জানতে পারবে,
সূরা:- ৩৯:আয-যুমার-৪০
مَنۡ یَّاۡتِیۡہِ عَذَابٌ یُّخۡزِیۡہِ وَ یَحِلُّ عَلَیۡہِ عَذَابٌ مُّقِیۡمٌ ﴿۴۰﴾
কার ওপর লাঞ্ছনাকর আযাব আসে এবং কে চিরস্থায়ী আযাবে নিক্ষিপ্ত হয়।
সূরা:- ৩৯:আয-যুমার-৪১
اِنَّاۤ اَنۡزَلۡنَا عَلَیۡکَ الۡکِتٰبَ لِلنَّاسِ بِالۡحَقِّ ۚ فَمَنِ اہۡتَدٰی فَلِنَفۡسِہٖ ۚ وَ مَنۡ ضَلَّ فَاِنَّمَا یَضِلُّ عَلَیۡہَا ۚ وَ مَاۤ اَنۡتَ عَلَیۡہِمۡ بِوَکِیۡلٍ ﴿٪۴۱﴾
আমি সব মানুষের জন্য এ সত্য (বিধান সহ) কিতাব নাযিল করেছি। সুতরাং যে সোজা পথ অনুসরণ করবে সে নিজের জন্যই করবে। আর যে পথভ্রষ্ট হবে তার পথভ্রষ্টতার প্রতিফলও তাকেই ভোগ করতে হবে। তার জন্য তুমি দায়ী হবে না।
সূরা:- ৩৯:আয-যুমার-৪২
اَللّٰہُ یَتَوَفَّی الۡاَنۡفُسَ حِیۡنَ مَوۡتِہَا وَ الَّتِیۡ لَمۡ تَمُتۡ فِیۡ مَنَامِہَا ۚ فَیُمۡسِکُ الَّتِیۡ قَضٰی عَلَیۡہَا الۡمَوۡتَ وَ یُرۡسِلُ الۡاُخۡرٰۤی اِلٰۤی اَجَلٍ مُّسَمًّی ؕ اِنَّ فِیۡ ذٰلِکَ لَاٰیٰتٍ لِّقَوۡمٍ یَّتَفَکَّرُوۡنَ ﴿۴۲﴾
মৃত্যুর সময় আল্লাহ প্রাণ হরণ করেন এবং যারা জীবিত তাদেরও চেতনা হরণ করেন ওরা যখন নিদ্রিত থাকে। অতঃপর যার জন্য মৃত্যু অবধারিত করেছেন, তিনি তার প্রাণ রেখে দেন এবং অপরকে এক নির্দিষ্ট সময়ের জন্য চেতনা ফিরিয়ে দেন। এতে অবশ্যই চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য নিদর্শন রয়েছে।
সূরা:- ৩৯:আয-যুমার-৪৩
اَمِ اتَّخَذُوۡا مِنۡ دُوۡنِ اللّٰہِ شُفَعَآءَ ؕ قُلۡ اَوَ لَوۡ کَانُوۡا لَا یَمۡلِکُوۡنَ شَیۡئًا وَّ لَا یَعۡقِلُوۡنَ ﴿۴۳﴾
এসব লোক কি আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্যদেরকে সুপারিশকারী বানিয়ে রেখেছে? তাদেরকে বলো, তাদের ক্ষমতা ও ইখতিয়ারে যদি কিছু না থাকে এবং তারা কিছু না বুঝে এমতাবস্থায়ও কি সুপারিশ করবে?
সূরা:- ৩৯:আয-যুমার-৪৪
قُلۡ لِّلّٰہِ الشَّفَاعَۃُ جَمِیۡعًا ؕ لَہٗ مُلۡکُ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ ؕ ثُمَّ اِلَیۡہِ تُرۡجَعُوۡنَ ﴿۴۴﴾
বল, ‘সকল সুপারিশ আল্লাহরই এখতিয়ারে, আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সার্বভৌমত্ব আল্লাহরই, অতঃপর তাঁরই নিকট তোমরা প্রত্যানীত হবে।’
সূরা:- ৩৯:আয-যুমার-৪৫
وَ اِذَا ذُکِرَ اللّٰہُ وَحۡدَہُ اشۡمَاَزَّتۡ قُلُوۡبُ الَّذِیۡنَ لَا یُؤۡمِنُوۡنَ بِالۡاٰخِرَۃِ ۚ وَ اِذَا ذُکِرَ الَّذِیۡنَ مِنۡ دُوۡنِہٖۤ اِذَا ہُمۡ یَسۡتَبۡشِرُوۡنَ ﴿۴۵﴾
যখন শুধু এক আল্লাহর কথা বলা হয় তখন যারা আখিরাতে বিশ্বাস করে না, তাদের অন্তর বিতৃষ্ণায় সংকুচিত হয়। আর আল্লাহর পরিবর্তে অন্য মাবুদগুলোর উল্লেখ করা হলে তখনই তারা আনন্দে উল্লসিত হয়।
সূরা:- ৩৯:আয-যুমার-৪৬
قُلِ اللّٰہُمَّ فَاطِرَ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ عٰلِمَ الۡغَیۡبِ وَ الشَّہَادَۃِ اَنۡتَ تَحۡکُمُ بَیۡنَ عِبَادِکَ فِیۡ مَا کَانُوۡا فِیۡہِ یَخۡتَلِفُوۡنَ ﴿۴۶﴾
বলো, হে আল্লাহ, আসমান ও যমীনের সৃষ্টিকর্তা, দৃশ্য ও অদৃশ্য সম্পর্কে জ্ঞানের অধিকারী, তোমার বান্দারা যেসব বিষয়ে মতানৈক্য পোষণ করে আসছে তুমিই সে বিষয়ে ফায়সালা করবে।
সূরা:- ৩৯:আয-যুমার-৪৭
وَ لَوۡ اَنَّ لِلَّذِیۡنَ ظَلَمُوۡا مَا فِی الۡاَرۡضِ جَمِیۡعًا وَّ مِثۡلَہٗ مَعَہٗ لَافۡتَدَوۡا بِہٖ مِنۡ سُوۡٓءِ الۡعَذَابِ یَوۡمَ الۡقِیٰمَۃِ ؕ وَ بَدَا لَہُمۡ مِّنَ اللّٰہِ مَا لَمۡ یَکُوۡنُوۡا یَحۡتَسِبُوۡنَ ﴿۴۷﴾
এসব জালেমদের কাছে যদি পৃথিবীর সমস্ত সম্পদরাজি এবং তাছাড়া আরো অতটা সম্পদও থাকে তাহলে কিয়ামতের ভীষণ আযাব থেকে বাঁচার জন্য তারা মুক্তিপণ হিসেবে সমস্ত সম্পদ দিয়ে দিতে প্রস্তুত হয়ে যাবে। সেখানে আল্লাহর পক্ষ থেকে এমন কিছু তাদের সামনে আসবে যা তারা কোন দিন অনুমানও করেনি।
সূরা:- ৩৯:আয-যুমার-৪৮
وَ بَدَا لَہُمۡ سَیِّاٰتُ مَا کَسَبُوۡا وَ حَاقَ بِہِمۡ مَّا کَانُوۡا بِہٖ یَسۡتَہۡزِءُوۡنَ ﴿۴۸﴾
সেখানে তাদের সামনে নিজেদের কৃতকর্মের সমস্ত মন্দ ফলাফল প্রকাশ হয়ে পড়বে। আর যে জিনিস সম্পর্কে তারা ঠাট্টা-বিদ্রূপ করতো তা-ই তাদের ওপর চেপে বসবে।
সূরা:- ৩৯:আয-যুমার-৪৯
فَاِذَا مَسَّ الۡاِنۡسَانَ ضُرٌّ دَعَانَا ۫ ثُمَّ اِذَا خَوَّلۡنٰہُ نِعۡمَۃً مِّنَّا ۙ قَالَ اِنَّمَاۤ اُوۡتِیۡتُہٗ عَلٰی عِلۡمٍ ؕ بَلۡ ہِیَ فِتۡنَۃٌ وَّ لٰکِنَّ اَکۡثَرَہُمۡ لَا یَعۡلَمُوۡنَ ﴿۴۹﴾
যখন কোন বিপদ-আপদ মানুষকে স্পর্শ করে, তখন সে আমাদেরকে ডাকে; তারপর যখন তাকে আমরা আমাদের কোন নিয়ামতের অধিকারী করি তখন সে বলে, ‘আমাকে এটা দেয়া হয়েছে কেবল আমার জ্ঞানের কারণে।’ বরং এটা এক পরীক্ষা, কিন্তু তাদের বেশীর ভাগই তা জানে না।
সূরা:- ৩৯:আয-যুমার-৫০
قَدۡ قَالَہَا الَّذِیۡنَ مِنۡ قَبۡلِہِمۡ فَمَاۤ اَغۡنٰی عَنۡہُمۡ مَّا کَانُوۡا یَکۡسِبُوۡنَ ﴿۵۰﴾
তাদের পূর্ববর্তী লোকেরাও একথাই বলেছিলো। কিন্তু তারা নিজেদের কর্ম দ্বারা যা অর্জন করেছিল তা তাদের কোন কাজে আসেনি। অতঃপর নিজেদের উপার্জনের মন্দ ফলাফল তারা ভোগ করেছে।
সূরা:- ৩৯:আয-যুমার-৫১
فَاَصَابَہُمۡ سَیِّاٰتُ مَا کَسَبُوۡا ؕ وَ الَّذِیۡنَ ظَلَمُوۡا مِنۡ ہٰۤؤُلَآءِ سَیُصِیۡبُہُمۡ سَیِّاٰتُ مَا کَسَبُوۡا ۙ وَ مَا ہُمۡ بِمُعۡجِزِیۡنَ ﴿۵۱﴾
এদের মধ্যেও যারা জালেম তারা অচিরেই তাদের উপার্জনের মন্দ ফলাফল ভোগ করবে। এরা আমাকে অক্ষম করে দিতে পারবে না।
সূরা:- ৩৯:আয-যুমার-৫২
اَوَ لَمۡ یَعۡلَمُوۡۤا اَنَّ اللّٰہَ یَبۡسُطُ الرِّزۡقَ لِمَنۡ یَّشَآءُ وَ یَقۡدِرُ ؕ اِنَّ فِیۡ ذٰلِکَ لَاٰیٰتٍ لِّقَوۡمٍ یُّؤۡمِنُوۡنَ ﴿٪۵۲﴾
তারা কি জানে না, আল্লাহ যার জন্য ইচ্ছে রিযিক প্রশস্ত করেন, আর সীমিত করেন? নিশ্চয় এতে নিদর্শনাবলী রয়েছে এমন সম্প্রদায়ের জন্য, যারা ঈমান আনে।

ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-

‘আল্লাহ কি তার বান্দার পক্ষে যথেষ্ট নন?…’(আয়াত ৩৬-৫২) আলােচ্য সূরার এই বিরাট পর্বটিতে তাওহীদের বিভিন্ন দিক নিয়ে বিচিত্র বর্ণনাভংগিতে আলােচনা করা হয়েছে। প্রথমেই বিশ্বাসী মনের স্বরূপ বর্ণনা করা হয়েছে। পৃথিবীর নানা শক্তির প্রতি এই বিশ্বাসী মনের আচরণ কি তা বর্ণনা করা হয়েছে। এই পর্যায়ে বলা হয়েছে, বিশ্বাসী মন। কেবল এক মহাশক্তির ওপরই ভরসা করে, অন্য কোনাে দুর্বল শক্তি বা কাল্পনিক শক্তির ওপর নয়। যারা এসব কাল্পনিক শক্তির পূজারী তাদের বিষয়টি পরকালের জন্যে ছেড়ে দিয়ে নিজের আদর্শের ওপর দৃঢ় ও অবিচল থাকে। এরপর বর্ণনা করা হয়েছে, রসূলুল্লাহ(স.)-এর মূল দায়িত্বের কথা। সেই পর্যায়ে বলা হয়েছে যে, মানুষের হেদায়াত বা গােমরাহীর ব্যাপারে তার কোনাে হাত নেই; বরং মানুষের সর্বময় বিষয়ের মালিক হচ্ছেন একমাত্র আল্লাহ। সর্বাবস্থায় তিনিই তাদের নিয়ন্ত্রণ করেন, শাসন করেন। তিনি ব্যতীত বান্দার জন্যে সুপারিশ গ্রহণকারী আর অন্য কেউ নেই। কারণ, যাবতীয় সুপারিশের মালিক একমাত্র তিনিই। তার হাতেই আসমান ও যমীনের মালিকানা। তিনিই হচ্ছেন চূড়ান্ত কর্তৃপক্ষ এবং সর্বশেষ আশ্রয়স্থল। এরপর মােশরেকদের ব্যাপারে আলােচনা করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে যে, তাওহীদের বাণী কানে আসলেই তাদের মন সংকুচিত হয়ে পড়ে। আর শিরকের কথা শুনলে তাদের মন প্রফুল্ল হয়ে ওঠে। তাই রসূলকে এদের বিচারের ভার আল্লাহর হাতে ছেড়ে দিয়ে তাওহীদের বাণী প্রচার করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পরকালে মােশরেকদের অবস্থা কি হবে সে ব্যাপারেও আলােচনা করা হয়েছে। এ পর্যায়ে বলা হয়েছে, জাহান্নামের কঠিন শাস্তি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে তারা গােটা পৃথিবী বা তার চেয়েও বড় কিছু মুক্তিপণ হিসেবে দিতে ইচ্ছা প্রকাশ করবে। এরপর বলা হয়েছে যে, মােশরেকরা কেবল বিপদে পড়লেই এককভাবে আল্লাহকে ডাকে। আর যখন সুখ স্বাচ্ছন্দ্যে থাকে, আরাম আয়েশে থাকে তখন বড় বড় দাবী করতে থাকে। যেমন এদের কেউ কেউ বলে, এগুলাে আমার নিজস্ব জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তার ফলস্বরূপ। এসব কথাবার্তা ইতিপূর্বে যারা বলেছিলাে তাদের আল্লাহ তায়ালা যেভাবে পাকড়াও করেছেন ঠিক একইভাবে এদেরও পাকড়াও করতে পারবেন। এটা তার জন্য মােটেও কোনাে কঠিন ব্যাপার নয়। তাছাড়া জীবিকার প্রাচুর্য ও স্বল্পতা আল্লাহর নির্ধারিত বিধানের অধীন। এই বিধান তারই ইচ্ছায় চলে, তারই জ্ঞান ও প্রজ্ঞা অনুযায়ী চলে। সচ্ছলতা ও অসচ্ছলতার মালিক একমাত্র তিনিই। তাই বলা হয়েছে, “নিশ্চয় এতে বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে।'(আয়াত ৫২) আল্লাহ কি তাঁর বান্দার পক্ষে যথেষ্ট নন?’ (আয়াত ৩৬-৪০) এই চারটি আয়াতে সঠিক ঈমানের ভাষাকে বর্ণনা দেয়া হয়েছে। এই ভাষা সহজ ও শক্তিশালী, এই ভাষা সুস্পষ্ট ও গভীর। এই সঠিক ঈমান রসূলুল্লাহ(স.) নিজ অন্তরে যেভাবে পোষণ করতেন ঠিক সেভাবেই পােষণ করতে হবে তার রেসালাতে বিশ্বাসী প্রত্যক মােমেনকে এবং প্রত্যেক প্রচারককে। কারণ এই রেসালাতই হচ্ছে তার একমাত্র জীবন বিধান। এটাই তার জন্যে যথেষ্ট। অন্য কোনাে আদর্শ বা বিধানের তার আদৌ কোনাে প্রয়ােজন নেই। কারণ জীবনে চলার পথে এই বিধানই হচ্ছে তার পথপ্রদর্শক।  *রসূল (স.)-কে দেব দেবীর অভিশাপের ভয় প্রদর্শন : আলােচ্য আয়াতগুলাের শানে নুযুল সম্পর্কে বলা হয়েছে, কোরায়শ বংশের মােশরেকরা রসূলুল্লাহ(স.)-কে তাদের দেব-দেবীর অভিশাপের ভয় দেখাতাে। তারা বলতো, তিনি যদি এদের ব্যাপারে কথা বলা বন্ধ না করেন তাহলে অচিরেই বিপদের সম্মুখীন হবেন। কিন্তু আয়াতের বক্তব্য এর তুলনায় আরও ব্যাপক ও অর্থপূর্ণ। এখানে সত্যের প্রচারক ও গােটা পৃথিবীর বিরুদ্ধবাদী শক্তির মধ্যকার চিরন্তন লড়াই দ্বন্দ্বের ব্যাপার তুলে ধরা হয়েছে। সাথে সাথে এসব শক্তির প্রকৃত রূপ প্রকাশ করার পর মােমেনদের মনে কি ধরনের আত্মবিশ্বাস, দৃঢ় প্রত্যয় ও প্রশান্তির সৃষ্টি হয় সে.চিত্রও তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ তায়ালাই কি তাঁর বান্দার পক্ষে যথেষ্ট নন? নিশ্চয়ই। তাহলে ভয়ের কি আছে? আল্লাহ তায়ালা তাে তার সাথেই রয়েছেন। যদি বান্দা সত্যিকার অর্থে আল্লাহর আনুগত্য ও দাসত্ব করে তাহলে তিনিই যে তার হেফাযতের জন্যে যথেষ্ট, এ বিষয়ে সন্দেহের কি আছে। কারণ তিনিই তাে মহাশক্তিধর, পরম ক্ষমতার অধিকারী এবং সকল বান্দার ওপর তাঁরই কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত। এরপর বলা হয়েছে, ‘অথচ তারা তােমাকে আল্লাহর পরিবর্তে অন্যান্য উপাস্যদের ভয় দেখায়…… কিন্তু তিনি এদের কেন ভয় করবেন? স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা যাকে পাহারা দিয়ে রাখছেন, নিরাপত্তা দিয়ে রাখছেন তাকে ভয় দেখানাের মতাে শক্তি কি কোনাে দেব-দেবীর আছে?’ এই গােটা পৃথিবীর বুকে যারা বিচরণ করছে তারা কি আল্লাহর তুলনায় নিতান্তই নগণ্য নয়? এটা একটা সহজ ও সুস্পষ্ট বিষয়। এটা প্রমাণ করার জন্যে যুক্তি তর্কের প্রয়ােজন নেই এবং মাথা ঘামানোর কোনো প্রয়ােজন নেই। সােজা কথা, একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই হচ্ছেন পরম শক্তিশালী। তাঁর সমকক্ষ আর কেউ নেই। এই সত্যটি যখন কেউ মনে প্রাণে বিশ্বাস করবে তখন কোনাে সন্দেহ থাকবে না, কোনাে সংশয় থাকবে না। মনে রাখতে হবে যে, আল্লাহর ইচ্ছাই বাস্তবায়িত হয়, তার ইচ্ছাই জয়ী হয়। তিনিই বান্দার ফয়সালা করেন। তাঁর এই ফয়সালা বান্দার দেহ-মন এবং চিন্তা চেতনার প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিফলিত হয়। তাই বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ তায়ালা যাকে গোমরাহ করেন তার কোনাে পথপ্রদর্শক নেই, আর আল্লাহ তায়ালা যাকে পথ প্রদর্শন করেন তাকে পথভ্রষ্টকারী কেউ নেই।'(আয়াত ৩৬-৩৭) কারণ তিনিই জানেন, কে হেদায়াতের উপযুক্ত, ফলে তাকে হেদায়াত দান করেন। তেমনি তিনিই জানেন কারা গােমরাহীর পাত্র, ফলে তিনি তাদের গােমরাহ করেন। তার এই ফয়সালা পাল্টানাের ক্ষমতা কারাে নেই। কারণ আল্লাহ তায়ালা কি পরাক্রমশালী, প্রতিশােধ গ্রহণকারী নন? হাঁ, নিশ্চয়ই তিনি পরাক্রমশালী এবং প্রতিশােধ প্রহণকারী। যার যা প্রাপ্য তিনি তাকে তা দান করেন। যারা প্রতিশােধের উপযুক্ত তাদের কাছ থেকে তিনি প্রতিশােধ নিয়ে থাকেন। কাজেই যারা সত্যিকার অর্থে আল্লাহর বান্দা তাদের ভয়ের কি আছে? কারণ আল্লাহ তায়ালাই তাে তাদের রক্ষক এবং তিনিই তাে তাদের জন্যে যথেষ্ট। আল্লাহর সত্যিকার পরিচয় যে মােশরেকরাও স্বীকার করে সেটা তাদের বক্তব্য থেকেই প্রমাণ করার জন্যে বলা হয়েছে, ‘যদি তুমি তাদের জিজ্ঞেস করো, আসমান ও যমীন কে সৃষ্টি করেছেন? তারা অবশ্যই বলবে, আল্লাহ…'(আয়াত ৩৮) আসমান যমীনের স্রষ্টা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে মােশরেকরা স্বীকার করতাে যে, আল্লাহ তায়ালাই হচ্ছেন এর স্রষ্টা। তাদের স্বভাব, ধর্ম ও বিবেক বুদ্ধি এ স্বীকারােক্তি করতে তাদের বাধ্য করতাে। শুধু তারাই নয়; বরং যে কোনাে বিবেকবান বুদ্ধিমান ব্যক্তিই এই স্বাভাবিক সত্যটি স্বীকার না করে পারবে না। যদি আল্লাহ তায়ালাই এই আসমান ও যমীনের স্রষ্টা হয়ে থাকেন, তাহলে তিনি যদি তার কোনাে বান্দার ক্ষতি সাধন করতে চান অথবা কোনাে উপকার করতে চান, তাহলে অন্য কোনাে শক্তি কি আছে এতে বাধা দিতে পারে? এর সাফ সাফ উত্তর হচ্ছে, না, যদি তাই হয়, তাহলে সত্যের ধারক বাহকদের ভয় কিসের? আল্লাহ তায়ালা ছাড়া তাদের ভয়ের আর কে আছে? আল্লাহ ছাড়া তাদের আশার স্থল কে আছে? কারণ, তিনি ব্যতীত লাভ-লােকসান ও মঙ্গল-অমঙ্গলের মালিক অন্য কেউ তাে নেই। তাহলে চিন্তার কি আছে? ভয়ের কি আছে? আদর্শ থেকে বিচ্যুত করার কে আছে? এই সত্যটি যখন মােমেন বান্দার হৃদয়ে গেঁথে যাবে তখন তার সব কিছুই ঠিক হয়ে যাবে। তখন সে আল্লাহকে ছাড়া আর কাউকে ভয় করবে না, আল্লাহ তায়ালা ছাড়া অন্য কারাে কাছে আশা করবে না; বরং একমাত্র তাঁকেই পরম মনে করবে এবং তার ওপরই ভরসা করবে। তাই বলা হয়েছে, ‘বলাে, আমার পক্ষে আল্লাহ তায়ালাই যথেষ্ট, নির্ভরকারীরা তারই ওপর নির্ভর। করে।’ এই ঘােষণার পর মনে আসবে শান্তি, আস্থা ও দৃঢ় প্রত্যয়। নির্ভয় শান্তি, নিরুদ্বেগ আস্থা এবং অবিচল প্রত্যয়- এই প্রত্যয় নিয়েই সে তার চলার পথে ধাবিত হতে পারবে। বলা হয়েছে, ‘বলাে, হে আমার জাতি! তােমরা তােমাদের জায়গায় কাজ করাে, আমিও কাজ করছি…’(আয়াত ৩৯-৪০) অর্থাৎ তােমরা তােমাদের মত ও পথ অনুসারে কাজ করাে, আর আমি আমার মত ও পথ অনুসারে কাজ করবাে, এই পথ হতে আমি বিচ্যুত হবে না, কাউকে ভয় করবাে না এবং কোনাে উৎকষ্ঠায়ও ভুগবে না। অচিরেই তােমরা জানতে পারবে, পৃথিবীর বুকে কাদের ওপর অপমানজনক শাস্তি নেমে আসছে এবং পরকালে কারা জাহান্নামের আগুনে বসবাস করবে। স্বাভাবিক বিবেক বুদ্ধিই সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ তায়ালাই হচ্ছেন আসমান যমীনের স্রষ্টা, আসমান ও যমীনে তিনিই কতৃত্বশীল। যে বাণীর প্রচার নবী রসূলরা করেছেন এবং উম্মতের অন্যান্য লােকজন করছেন সেই বাণীর উৎস তিনি নিজেই। তাহলে আসমান ও যমীনে এমন কেউ আছে কি যে, আল্লাহর সেসব বান্দার উপকার করার কোনাে শক্তি রাখে অথবা তাদের কোনাে ক্ষতি দূর করতে পারে। অথবা তাদের কোনাে মঙ্গল কাজে বাধা দিতে পারে? যদি এমন কেউ না থেকে থাকে, তাহলে গায়রুল্লাহর কাছে আশা করারই বা কি আছে? সাবধান! বিষয় সুস্পষ্ট হয়ে গেছে, পথও নির্ধারিত হয়ে গেছে। এখন আর তর্ক-বিতর্কের কোনাে সুযােগ নেই, কোনাে অবকাশ নেই। এই হচ্ছে আল্লাহর নবী রসূলরা ও তাদের বিরুদ্ধবাদী সকল শক্তির প্রকৃত অবস্থা।
# এখন তাদের দায়িত্ব কি হবে এবং অবিশ্বাসীদের ব্যাপারে তাদের নীতি কি হবে সে সম্পর্কে কেতাব নাযিল করেছি মানুষের কল্যাণের জন্য…(আয়াত ৪১-৪৪) আলােচ্য আয়াতে সত্য ধর্ম সম্পর্কে বলা হয়েছে। কারণ এ ধর্ম প্রকৃতিগত দিক থেকে সত্য, আদর্শগত দিক থেকে সত্য এবং বিধানগত দিক থেকে সত্য। এ হচ্ছে সেই সত্য যার ওপর নির্ভর করছে আসমান ও যমীন। এ হচ্ছে সেই সত্য যা মানুষের হেদায়াতের জন্যে অবতীর্ণ করা হয়েছে, এর বিধান অনুযায়ী জীবন যাপন করার জন্যে অবতীর্ণ করা হয়েছে এবং এর ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকার জন্যে অবতীর্ণ করা হয়েছে। আর এই সত্যের প্রচারক হচ্ছেন স্বয়ং রসূলুল্লাহ(স.)। এখন যার ইচ্ছা হেদায়াত গ্রহণ করুক, যার ইচ্ছা বিপথে পরিচালিত হােক, যার ইচ্ছা জান্নাত বেছে নিক আর যার ইচ্ছা জাহান্নাম বেছে নিক। এ ব্যাপারে রসূলের করার কিছু নেই এবং কোনাে দায়-দায়িত্বও নেই। তাই বলা হচ্ছে, ‘অতঃপর যে সৎপথে আসে সে নিজের কল্যাণের জন্যেই আসে, আর যে পথভ্রষ্ট হয় সে নিজের অনিষ্টের জন্যেই পথভ্রষ্ট হয়, তুমি তাদের জন্য দায়ী নও।'(আয়াত ৪১) তাদের দায় দায়িত্ব আল্লাহর হাতেই ন্যস্ত। জাগ্রত অবস্থায় হােক অথবা নিদ্রা অবস্থায়, সর্ব অবস্থায়ই তারা আল্লাহর কতৃত্বাধীন। তিনি যেভাবে চান সেভাবেই তাদের পরিচালিত করেন। বলা হচ্ছে, ‘আল্লাহ তায়ালা মানুষের প্রাণ হরণ করেন তার মৃত্যুর সময়…'(আয়াত ৪২) অর্থাৎ মানুষের জীবনের জন্যে নির্ধারিত আয়ু মৃত্যুর মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা নিঃশেষ করেন। এ ছাড়া ঘুমের মাধ্যমেও জীবনের এক ধরনের মৃত্যু ঘটে, যদিও এটাকে প্রকৃত মৃত্যু বলা যায় না। তবে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ঘুমন্ত ব্যক্তিকে মৃতই বলা যায়, কিন্তু যদি ঘুমন্ত অবস্থায়ই মৃত্যু তার ভাগ্যে থেকে থাকে, তাহলে সে আর ঘুম থেকে জাগ্রত হবে না। আর যার মৃত্যুর সময় এখনও হয়নি সে পুনরায় জীবন ফিরে পায় এবং জেগে ওঠে, এরপর নির্ধারিত আয়ু পূর্ণ করে। মােটকথা, জাগ্রত ও নিদ্রা দু অবস্থায়ই মানুষের জীবন আল্লাহর হাতের মুঠোয় থাকে। তাই বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয় এতে চিন্তাশীল লােকদের জন্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে।’ আর সেভাবেই মানুষের জীবন সব সময়ই আল্লাহর মুঠোর মধ্যে থাকে। কাজেই মানুষের অভিভাবক স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা, রাসুল নন। তারা যদি হেদায়াত লাভ করে তাহলে সেটার শুভফল তারা নিজেরাই ভােগ করবে। আর যদি বিপথগামী হয় তাহলে এর অশুভ পরিণতিও তারা নিজেরাই ভােগ করবে। অর্থাৎ তাদের জবাবদিহি করতে হবে। তাদের ছেড়ে দেয়া হবে না। যদি তাই হয় তাহলে কেন তারা মুক্তি ও কল্যাণের পথ অনুসরণ করে না? পরের আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তারা কি আল্লাহ তায়ালা ব্যতীত সুপারিশকারী গ্রহণ করেছে’(আয়াত ৪৩) এই প্রশ্ন তাচ্ছিল্য ও বিদ্রপপূর্ণ একটি প্রশ্ন। যারা ফেরেশতাদের মূর্তি বানিয়ে পূজা করে এবং মনে করে এরা আল্লাহর নৈকট্যলাভে তাদের সাহায্য করবে, এই প্রশ্ন তাদের লক্ষ্য করেই করা হয়েছে। কারণ, সুপারিশের অধিকার আল্লাহ তায়ালা ব্যতীত আর কারাে নেই। তিনি যাকে অনুমতি দেবেন এবং যার জন্যে অনুমতি দেবেন কেবল সে-ই সুপারিশ করতে পারবে ও সুপারিশের যােগ্য বলে গণ্য হবে, কিন্তু যারা আল্লাহ ব্যতীত অন্যান্য দেব দেবীর উপাসনা করে তারা কি কখনও এই সুপারিশের জন্যে যােগ্য বলে বিবেচিত হতে পারে? আর যেহেতু আসমান যমীনের মালিকানা ও কর্তৃত্ব তারই হাতে ন্যস্ত। তাই তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে, তার নির্দেশের বিরুদ্ধে কোনাে কিছুই হবার নয়। তাছাড়া মৃত্যুর পর সবাইকে একমাত্র তারই কাছে ফিরে যেতে হবে। তাই তার দরবার থেকে পলায়ন করার শক্তিও কারাে নেই।
# আল্লাহর একচ্ছত্র মালিকানা ও কর্তৃত্বের বর্ণনার পর এখানে মােশরেকদের মানসিক অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে বলা হয়েছে, যখন খাটিভাবে আল্লাহর নাম উচ্চারণ করা হয়, তখন যারা পরকালে বিশ্বাস করে না, তাদের অন্তর সংকুচিত হয়ে যায়…।(আয়াত ৪৫) আলােচ্য আয়াতে রসূলুল্লাহ(স.)-এর যুগে মােশরেকদের মানসিক অবস্থা কি ছিলাে তার প্রতি ইংগিত করা হয়েছে। এখানে বলা হয়েছে যে, মােশরেকদের সামনে যখন তাদের দেব-দেবীর নাম উচ্চারণ করা হতাে তখন তাদের চেহারায় আনন্দের হাসি ফুটে ওঠতাে। যখন তাওহীদের কথা বা লা-শরীক আল্লাহর কথা উচ্চারণ করা হতাে, তখন তাদের চেহারা মলিন হয়ে যেতাে, মনটা ছােট হয়ে যেতাে। আলােচ্য আয়াতটিতে কেবল মক্কার মােশরেকদের মানসিক অবস্থাই চিত্রায়িত হয়নি; বরং বিভিন্ন যুগের ও বিভিন্ন পরিবেশের আল্লাহদ্রোহী লােকদের মানসিক অবস্থাও চিত্রায়িত হয়েছে। কারণ আমরা এমন অনেক লােকের সাক্ষাত পাই যাদের সামনে এক আল্লাহর কথা, শরীয়তভিত্তিক আইনের কথা এবং ইসলামী আদর্শের কথা বলা মাত্রই তাদের মুখ কালো হয়ে যায়, মেজাজ খারাপ হয়ে যায়, কিন্তু এদের সামনেই যখন জাগতিক আইনের কথা বলা হয়, জাগতিক নিয়ম-নীতির কথা বলা হয় এবং জাগতিক বিধি বিধানের কথা বলা হয়, তখন তারা হেসে ওঠে, নেচে ওঠে, অন্তর খুলে কথা বলা এবং অত্যন্ত উদার মন নিয়ে তর্ক করতে এগিয়ে আসে। ঠিক এই শ্রেণীর লোকদের কথাই যেন আলােচ্য আয়াতে বলা হয়েছে। এদের অস্তিত্ব সর্বযুগে এবং সর্বস্থানেই পাওয়া যাবে। এরা বিকৃত স্বভাবের মানুষ, এরা নষ্ট প্রকৃতির মানুষ, এরা ভ্রষ্ট ও বিভ্রান্তকারী । যে কোনাে যুগের হােক, যে কোনাে পরিবেশের হােক, যে কোনাে দেশের হােক এবং যে কোনাে জাতির হােক, এদের স্বভাব ও প্রকৃতি এমনটিই হয়ে থাকে । এই বিকৃতি নষ্টামি এবং ভ্রষ্টতার জবাবে আল্লাহ তায়ালা তার প্রিয় রসূলকে যা বলার উপদেশ দিচ্ছেন তা হলাে, ‘বলাে, হে আল্লাহ! আসমান ও যমীনের স্রষ্টা, দৃশ্য ও অদৃশ্যের জ্ঞানী, আপনিই আপনার বান্দাদের ফয়সালা করবেন যে বিষয়ে তারা মতবিরােধ করে।’(আয়াত ৪৬)। এই দোয়া ও আরজি কেবল এমন হৃদয় থেকেই উচ্চারিত হতে পারে যা আল্লাহ তায়ালা ব্যতীত অন্য কাউকে আসমান ও যমীনের স্রষ্টা বলে বিশ্বাস করে না। আর সে কারণেই একমাত্র সেই মহান স্রষ্টার দরবারেই নিজের আকুতি মিনতি জানাচ্ছে। আর সে কারণেই মহান স্রষ্টার উপযুক্ত গুণাবলীর উল্লেখ করছে, তাকে মহাবিশ্বের স্রষ্টা বলে আখ্যায়িত করছে, দৃশ্য অদৃশ্য জগতের দ্রষ্টা বলে আখ্যায়িত করছে এবং তাকে শেষ বিচারের মালিক বলে আখ্যায়িত করছে। মৃত্যুর পর শেষ বিচারের দিন মহান আল্লাহর ফয়সালার মুখােমুখি হয়ে মােশরেক ও আল্লাহদ্রোহী লােকেরা কি রূপ আতংকিত ও ভীত সন্ত্রস্ত হবে সে সম্পর্কে পরবর্তী আয়াতে এভাবে বলা হয়েছে, ‘যদি গােনাহগারদের কাছে পৃথিবীর সব কিছু থাকে এবং তার সাথে সমপরিমাণ আরও থাকে।’(আয়াত ৪৭) মহা আতংকের একটা চিত্র এখানে ভাষার মাধ্যমে ফুটিয়ে তােলা হয়েছে। এই আতঙ্কের ফলে শিরকের অপরাধে অপরাধী ব্যক্তিরা তাদের যাবতীয় ধন দৌলত এমনকি গােটা পৃথিবীটাও কঠিন শাস্তি থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে মুক্তিপণস্বরূপ দিতে প্রস্তুত হয়ে যাবে। অথচ এই ধন দৌলত ও পৃথিবীর কারণেই তারা ইসলামের আহ্বানে সাড়া দেয়নি। আতঙ্কের আর একটি ভয়াল চিত্র ভাষার আবরণে এভাবে তুলে ধরা হয়েছে, ‘অথচ তারা দেখতে পাবে, আল্লাহর পক্ষ থেকে এমন শাস্তি যা তারা কল্পনাও করতাে না’ আল্লাহ তায়ালা ওদের জন্যে কি শাস্তি নির্ধারণ করে রেখেছেন তা সুস্পষ্টভাবে বলা হয়নি। এর দ্বারা আরও আতংকের সৃষ্টি করা হয়েছে। অর্থাৎ এমন শাস্তিই আল্লাহ তায়ালা তাদের জন্যে নির্ধারণ করে রেখেছেন যা তারা কখনও চিন্তা করতে পারে না, ভাবতেও পারে না। ‘সেদিন তাদের দুষ্কর্মের শাস্তি শুরু হয়ে যাবে এবং যেসব (আযাবের) বিষয়ে তারা দুনিয়ার জীবনে ঠাট্টা মস্কারি করতাে তা তাদের চারদিক থেকে ঘিরে ফেলবে’( আয়াত ৪৮) অর্থাৎ এইভাবে নিকৃষ্ট পরিণতির বহিপ্রকাশ স্বরূপ তাদের শাস্তি আরও বেড়ে যাবে। তখন পার্থিব জীবনে যা কিছু তারা করেছে তা তাদের সামনে প্রকাশিত হয়ে যাবে। পৃথিবীতে তাদের সতর্ক করা ও ভীতি প্রদর্শন করাতে তারা অনবরত ঠাট্টা বিদ্রুপ করেছে। তাই সেই কঠিন দিনে তার শাস্তি তাদের ঘেরাও করে ফেলবে। সেদিন সেই ভয়ানক যন্ত্রণাদায়ক আযাবের মধ্যে তাদের গ্রেফতার হয়ে যাওয়ার পর সেখান থেকে বের হওয়ার আর কোনাে উপায়ই থাকবে না।
*মানবীয় চরিত্রের দু’টো বিপরীতমূখী দিক : আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের শক্তি ক্ষমতায় তারা অনেককে অংশীদার বানাতাে, তার কথা স্মরণ করার কথা বললে বিরক্তির ভাব প্রকাশ করতাে এবং তাদের দেবদেবীদের প্রশংসা করলে তারা খুশি হতাে। এ সবের পরিণতিতে যখন তাদের শেষ বিচার দিনে হাযির করা হবে তখন তাদের যে কঠিন দুর্গতি হবে, সে অবস্থার ছবি তুলে ধরার পর জানানাে হচ্ছে যে, সেদিন তাদের অদ্ভুত এক অবস্থা হবে, কারণ তারা আল্লাহর একত্বকে অবিশ্বাস করতাে, তিনিই যে সকল শক্তি-ক্ষমতার একমাত্র মালিক একথা তারা মানতে চাইতো না; কিন্তু তাদের যখন বিপদ আপদে পেয়ে বসতাে তখন একমাত্র তার কাছে ছাড়া আর কারাে কাছে ধর্না দিতাে না, তার কাছেই কাতর হয়ে প্রার্থনা করতে ও সর্বান্তকরণে তার দিকে রুজু হয়ে যেতাে। আবার যখন পরম করুণাময় আল্লাহ তায়ালা তাদের দয়া করতেন আর তারা বিপদ মসিবত থেকে রেহাই পেতাে, তখন পুনরায় তারা অহংকারী ও বেপরওয়া হয়ে যেতাে। এরশাদ হচ্ছে, ‘মানুষের অবস্থা তাে হচ্ছে এই যে, যখনই তার ওপর কোনাে দুঃখ-বিপদ নেমে আসে তখন কায়মনােবাক্যে সে আমাকে ডাকতে থাকে, আবার যখনই আমার পক্ষ থেকে তাকে নেয়ামত দান করি তখন সে বলতে শুরু করে, আমার নিজের জ্ঞান বুদ্ধির কারণেই এগুলাে আমাকে দেয়া হয়েছে। ‘অবশ্যই এটা এক পরীক্ষা, কিন্তু ওদের অধিকাংশ ব্যক্তিই জানে না।’ এ আয়াতটি মানুষকে বার বার উদাহরণ দিয়ে তাদের ভ্রান্তি বুঝিয়ে দিচ্ছে, আর সত্যি বলতে কি, মানুষ যদি এ আয়াতটি বার বার পড়তে থাকে এবং এর তাৎপর্যের দিকে খেয়াল করে, তাহলে আয়াতটি তাদের মনের মধ্যে অবশ্যই দাগ কাটবে এবং তাদের সত্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। তারা এক আল্লাহর দিকে ফিরে আসবে এবং তার দিকে পৌছানাের সঠিক পথ তারা জানতে পারবে। সুখে বা দুঃখে কোনাে অবস্থাতেই তারা আর গােমরাহ হবে না। দুনিয়ার জীবনে বিপদ আপদ তাে আসবেই। আল্লাহ তায়ালা নিজেই ঘােষণা দিয়েছেন, ‘অবশ্যই আমি তােমাদের পরীক্ষা করবাে, কিছু ভয় ভীতি, ক্ষুধা, আর্থিক সংকট জান মালের ক্ষয় ক্ষতি দিয়ে।’ রহমানুর রহীমের পক্ষ থেকে দেয়া এ সব বিপদ আপদ, এগুলাের সবটাই প্রকারান্তরে তার রহমত; বিপদ আপদ, দুঃখ-সংকট, জ্বালা যন্ত্রণা- এগুলাে মানুষের প্রকৃতির মধ্যে অবস্থিত কু-কাজের চিন্তা মন্দপ্রবণতা ও পুঞ্জীভূত অসৎ তৎপরতার ইচ্ছা দূরে সরিয়ে দেয়, যা পরিশেষে তাদের জীবনকে অশান্তির দিকে এগিয়ে দেয়। সত্য দর্শন থেকে তাদের দৃষ্টি আচ্ছন্ন করে রাখতে চায়, এ সব বাহ্যিক বাধা বিঘ্নের অন্তরালে নিহিত সত্যের সুষমাকে বুঝতে দিতে চায় এবং কঠিন শিলাভ্যন্তরে প্রবাহমান সুমধুর সুপেয় পানীয় মাধুরীকে জানতে দিতে চায় না, তাই সূক্ষ্ম দৃষ্টির অধিকারী আল্লাহর প্রিয় বান্দা সেসব কঠিন বিপদের মধ্যে আল্লাহকে পেতে চায়। এ দুঃখ বেদনার মধ্যেই তাকে চেনা যাবে এবং তখনই সর্বাত্মকভাবে তার দিকে রুজু করা সহজ হবে, আর তখনই ধীরে ধীরে বিপদ আপদের ঘনঘটা কেটে গিয়ে তিমিরের বুক চিরে সাফল্যের আলােকোজ্জ্বল শুভ্র-সুন্দর মুখচ্ছবি বেরিয়ে আসবে, কিন্তু শয়তানের ফেরে পড়ে অনেক সময়ে মানুষের এ সব চিন্তা-চেতনা বিলুপ্ত হয়ে দুঃখের কষাঘাতে অস্থির হয়ে যায়, দিগন্ত রব্বুল আলামীনের বিস্তৃত করুণারাশি ভুলে যায়, কু-প্রবৃত্তির তাড়নে তার ব্যস্ত বাগীশ মন রহমানুর রহীমের কৃপা-ঝরা কথা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। চরম অকৃতজ্ঞতাভরে আল্লাহর যাবতীয় নেয়ামত, অজস্র সুখ-সম্পদ ও সকল প্রকার মেহেরবানী বিস্মৃত হয়ে বলে ওঠে, আরে, আমাকে তাে এসব আমার জ্ঞান-গরিমার কারণেই দেয়া হয়েছে। অতীতের কুখ্যাত ধনকুবের কারুন তাে এইভাবেই কথা বলেছিলাে, এইভাবেই দুনিয়ার বহু জ্ঞানগর্বী তাদের উদ্ভাবনী শক্তির ভূয়সী প্রশংসায় নিজের সীমাবদ্ধতার কথা ভুলে যায় এবং প্রাপ্ত ধন দৌলত, মান সম্ভ্রম ও প্রভাব ভুলে যায়, এসব নেয়ামতের উৎস কোথায়, কে দিলাে এ নেয়ামত তাকে কে দিলাে এসব এলেম ও কুদরত জ্ঞান-গরিমা-শক্তি-সাহস ও যােগ্যতা, কোত্থেকে এলাে এসব উপায় উপাদান, তা ভুলে যায়। ভুলে যায় কে সংগ্রহ করে দিয়েছে তাকে দুনিয়ায় সুখ-সম্ভোগের নানাবিধ উপকরণ। তাকে স্মরণ করাতে গিয়ে বলা হচ্ছে, এসব প্রভূত নেয়ামত অবশ্যই তার জন্যে এক পরীক্ষা, কিন্তু অধিকাংশ মানুষই জানে না। এ সব সুখ-সম্ভোগের উপকরণাদির প্রাচুর্য সম্পদশালী লোকদের দুই কারণে দেয়া হয়। এক. আন্তরিকতাপূর্ণ পরিশ্রমের বিনিময় হিসেবে। দুই. সকল সম্পদের মালিক আল্লাহ তায়ালা তাদের পাওনা থেকেও বেশী দিয়ে দেখতে চান তারা কমপ্রাপ্তদের প্রতি তাদের কর্তব্য পালন করে কিনা এবং তাদের অধীনস্থদের প্রতি তারা মানবতাসুলভ ব্যবহার করে কিনা, না নিজেদেরই সম্পদের নিরংকুশ মালিক মনে করে যেভাবে খুশী সে সম্পদ ব্যবহার করে। এইভাবে আল্লাহ তায়ালা দেখতে চান, তারা নেয়ামতের শােরগােযারী করে, না মূল মালিকের দেয়া সম্পদের ওপর খােদকারী করে। এই খােদকারী করা বা নিজেদেরই আসল মালিক মনে করাই হচ্ছে নেয়ামত অস্বীকার করা, অর্থাৎ সকল নেয়ামতের মূল মালিক আল্লাহ তায়ালা এ কথার প্রতি অস্বীকারকারী হয়ে আল্লাহর প্রতি অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। এভাবে সম্পদ ব্যবহারের সঠিক বা বেঠিক পন্থা অনুসরণ করার কারণে আল্লাহ রব্বুল ইযযত কারাে ওপর খুশী হন এবং কারাে কাছ থেকে সম্পদ ছিনিয়ে নেন। এর ফলে কেউ আল্লাহর করুণায় হেদায়াতপ্রাপ্ত হয় আর কেউ হয় বিপথগামী, ভুল পথের পথিক। মহাগ্রন্থ আল কোরআন, এ কিতাবের মালিকের পক্ষ থেকে তাঁর বান্দাদের জন্যে এক বিরাট রহমত, যা তাদের সামনে তার কৃপা করুণার সুপ্রশস্ত দরজা অবারিত করে দেয় এবং তাদের সম্পদ ও সচ্ছলতায় ভরে দেয়। যুক্তিপূর্ণ এ মহাগ্রন্থকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন না করার কারণে কাল কেয়ামতের দিনে কাফেরদের কঠিন পরিণতি ভােগ করতে হবে- এ কথা স্বতসিদ্ধ বিধায় আজকে তাদেরকে তাদের কর্তব্য স্মরণ করিয়ে দেয়া হচ্ছে। কেয়ামতের দিন ওর পেশ করার মতাে তাদের কাছে আর কোনাে ওজুহাত বা কোনাে যুক্তিই থাকবে না। তাদের পূর্বে যারা সত্যকে পর্যুদস্ত করার জন্যে নানা প্রকার অন্যায় পদক্ষেপ নিয়েছিলাে, তাদের দৃষ্টান্ত তাদের সামনে পেশ করা হয়েছে। তাদের অপপ্রয়াসের একটি নযির হচ্ছে, ‘তাদের মধ্যে কেউ কেউ বলতাে- আমার জ্ঞান-গরিমার কারণেই আমাকে এটা দেয়া হয়েছে।’ ওদের আগেকার লােকেরাও এভাবে কথা বলেছে, কিন্তু তারা যাই করুক না কেন তাদের তৎপরতা দ্বারা তারা কোনাে ফায়দাই পায়নি। যেসব অন্যায় কাজ তারা করেছে অবশ্যই তার শাস্তি তাদের ভােগ করতে হয়েছে, আর যারা ওদের মধ্য থেকে যুলম করেছে তাদেরও শীঘ্রই তার সাজা পেতে হবে। কিছুতেই তারা সে আযাব প্রতিহত করতে পারবে না। এখানে তাদের যে ভুল কথাটি উদ্ধৃত করা হলাে- এ ধরনের কথা একইভাবে তাদের পূর্বেকার লােকেরাও বলতাে। তারাও তাদের মতােই শান্তি পেয়েছে এবং তাদের জ্ঞান-গরিমা, ধন সম্পদ বা তাদের শক্তি কোনােটাই তাদের কোনাে কাজে লাগেনি। অতএব এখন যারা অনুরূপ হঠকারিতার মধ্যে লিপ্ত হবে তাদেরও নিসন্দেহে একই প্রকার সাজা পেতে হবে। এটাই হচ্ছে আল্লাহ রব্বুল আলামীনের নিয়ম, যার কোনাে পরিবর্তন কোনােদিন হবে না। তারা তাকে সাজা দেয়ার ব্যাপারে অক্ষম করতে পারবে না। আল্লাহকে তার এসব দুর্বল ও তুচ্ছ সৃষ্টি কোনাে ব্যাপারেই অক্ষম করতে পারে না। আল্লাহর ইচ্ছানুযায়ী তারাই শুধু চলতে পারে যাদের তিনি তার কৃপাধন্য করেছেন, অনুগ্রহ করেছেন, তার অফুরন্ত ভান্ডারে রক্ষিত নেয়ামতের মধ্য থেকে যাদের তিনি প্রচুর পরিমাণে দান করার সিদ্ধান্ত পূর্বাহ্নেই গ্রহণ করেছেন, তারাই তার সেসব নেয়ামত লাভ করতে পারে। তিনি যাকে পর্যাপ্ত পরিমাণে চান দিয়ে দেন, যার জন্যে সংকীর্ণ করতে চান তাকে তা কমিয়ে দেন- এটা তারই ইচ্ছা। এভাবে তিনি তাঁর বান্দাকে পরীক্ষা করেন এবং যেমন খুশী তিনি তাঁর ইচ্ছা বাইয়াত করেন। এরশাদ হচ্ছে, ‘ওরা কি জানে না যে, আল্লাহ তায়ালা যার জন্যে ইচ্ছা তার জন্যে তার ভান্ডারকে খুলে দেন এবং যার জন্যে খুশী তার ভান্ডারের দরজা বন্ধ করে দেন। অবশ্যই এর মধ্যে ঈমানদার কওমের জন্যে বহু নিদর্শন রয়েছে।’ এ জন্যে তারা যেন আল্লাহর এসব নিদর্শনকে কুফরী ও গােমরাহীর কারণ হিসাবে গ্রহণ না করে; বরং সেগুলাে তাকে হেদায়াত ও ঈমানের উদ্দেশ্যেই এসেছে।

তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
৩৬-৪০ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

(أَلَيْسَ اللّٰهُ بِكَافٍ عَبْدَه)

‘আল্লাহ কি তাঁর বান্দার জন্য যথেষ্ট নন?’ অর্থাৎ উক্ত عَبْدَه বান্দা বলতে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বুঝানো হয়েছে। কারো কারো নিকট সাধারণভাবে এতে সমস্ত নাবী ও প্রত্যেক মু’মিন শামিল। মূর্তি ও প্রতিমা বর্জন করার কারণে মক্কার মুশরিকরা নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে ভয় দেখালো যে, আমাদের মা‘বূদ তোমার ক্ষতি করবে। কিন্তু স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলা নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাহায্যকারী ও মা‘বূদ, তিনিই সকল অকল্যাণ থেকে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে রক্ষা করবেন, তারা কিছুই করতে পারবে না। নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পক্ষ হতে তাদের মোকাবেলায় তিনিই (আল্লাহ তা‘আলাই) যথেষ্ট। মূলত নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) গায়রুল্লাহর কোন ভয় করতেন না বিশেষ করে তাদের মূর্তিকে ভয় করতেন না। যেমন ইবরাহীম (আঃ)-কে ভয় দেখানো হলে তিনি বললেন :

(وَكَيْفَ أَخَافُ مَآ أَشْرَكْتُمْ وَلَا تَخَافُوْنَ أَنَّكُمْ أَشْرَكْتُمْ بِاللّٰهِ مَا لَمْ يُنَزِّلْ بِه۪ عَلَيْكُمْ سُلْطٰنًا ط فَأَيُّ الْفَرِيْقَيْنِ أَحَقُّ بِالْأَمْنِ ج إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُوْنَ)‏

‘তোমরা যাকে আল্লাহর সাথে শরীক কর আমি তাকে কিভাবে ভয় করব? অথচ তোমরা আল্লাহর সাথে শরীক করতে ভয় কর না, যে বিষয়ে তিনি তোমাদেরকে কোন সনদ দেননি। সুতরাং যদি তোমরা জান তবে বল : ‎ দু দলের মধ্যে কোন্ দল নিরাপত্তা লাভের বেশি হকদার।’ (সূরা আন‘আম ৬ : ৮১)

অতঃপর মক্কার মুশরিকরা আল্লাহ তা‘আলার তাওহীদে রুবুবিয়্যাহ তথা সৃষ্টিকর্তা, রিযিকদাতা, হায়াত-মউতের মালিক, আসমান-জমিনসহ যাবতীয় কিছুর মালিক যে একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা ইত্যাদি স্বীকার করত-সে কথা ব্যক্ত করা হচ্ছে। কিন্তু যখন কোন কিছু চাইতো তখন তারা মূর্তি ও বিভিন্ন দেব-দেবীর কাছে চাইতো। যার কারণে তারা মুশরিকই থেকে গেল, তাওহীদে রুবুবিয়্যাহ স্বীকার করাতে কোন উপকার হয়নি। ফলে তারা ঈমানদার হতে পারেনি, তাই তারা জাহান্নামী। আমাদের দেশেও একশ্রেণির নামধারী মুসলিম আছে যারা স্বীকার করে- আল্লাহ তা‘আলা সবকিছুর মালিক যেমন মক্কার মুশরিকরা স্বীকার করতো, কিন্তু যখন সন্তানের প্রয়োজন হয় কিম্বা কোন বিপদে পড়ে বা কোন মানত করে তখন তারা মাযার, পীর-ফকীর ও দরবেশের কাছে দৌড়ায়। এদের মাঝে আর তৎকালীন মক্কার মুশরিকদের মাঝে কোন পার্থক্য নেই। এ সম্পর্কে সূরা লুকমানের ২৫ নম্বর আয়াতসহ অন্যান্য স্থানেও আলোচনা করা হয়েছে।

সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা আছেন, তিনি সব কিছুর সৃষ্টিকর্তা তথা কেবল তাওহীদে রুবুবিয়্যাহর ওপর বিশ্বাস করলেই ঈমানদার হওয়া যাবেনা যতক্ষণ না সকল প্রকার ইবাদত একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার জন্য সম্পাদন করবে।

(أَفَرَأَيْتُمْ مَّا تَدْعُوْنَ مِنْ دُوْنِ اللّٰهِ)

অর্থাৎ তোমরা আল্লাহ তা‘আলাকে সৃষ্টিকর্তা ও সকল কিছুর মালিক বলে বিশ্বাস করছ কিন্তু তাঁকে বাদ দিয়ে মূর্তি ও প্রতিমার কাছে ভাল চাওয়া ও মন্দ প্রতিহত করার জন্য প্রার্থনা করছ কেন? তোমরা কি চিন্তা করে দেখেছ, আল্লাহ তা‘আলা যদি আমার বা অন্য কারো অনিষ্ট করতে চান তাহলে তা কি কেউ প্রতিহত করতে পারবে, অথবা যদি কারো কল্যাণ চান তাহলে কি তাতে কেউ বাধা দিতে পারবে? না, কেউ পারবেনা। এসব মূর্তি, প্রতিমা ও কবরে শায়িত ব্যক্তি মানুষের ভাল মন্দের কোন ক্ষমতা রাখেনা। সুতরাং আল্লাহ তা‘আলাকে সৃষ্টিকর্তা স্বীকার করার সাথে সাথে তাঁর ইবাদত করতে হবে, সকল আরাধনা তাঁর কাছেই করতে হবে।

এরপরেও তোমরা না মানলে তোমরা তোমাদের আমল করতে থাক, আমি আমার আমল করতে থাকি, তবে অচিরেই জানতে পারবে কে সঠিক পথের অনুসারী?

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. মু’মিন ব্যক্তির জন্য সর্বক্ষেত্রে আল্লাহ তা‘আলাই যথেষ্ট।
২. আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত হিদায়াত দান করার মালিক কেউ নয়।
৩. আল্লাহ তা‘আলার রুবুবিয়্যাহকে স্বীকার করলেই মু’মিন হওয়া যাবে না, যদি সকল প্রকার ইবাদত একামাত্র আল্লাহ তা‘আলার জন্য না করা হয়।
৪. সর্বাবস্থায় আল্লাহ তা‘আলার ওপর ভরসা করতে হবে।
৪১-৪২ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

(إِنَّآ أَنْزَلْنَا عَلَيْكَ الْكِتٰبَ لِلنَّاسِ… الخ)

মক্কাবাসীর কুফরীর ওপর অটল থাকা নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর জন্য ছিল বড়ই কষ্টকর। তাই এ আয়াতে তাঁকে সান্ত্বনা দেয়া হয়েছে যে, তোমার দায়িত্ব কেবলমাত্র এ কিতাবের কথা তাদের কাছে পৌঁছে দেয়া, যা আমি তোমার ওপর নাযিল করেছি। তাদেরকে হিদায়াত দেয়া তোমার দায়িত্ব নয়। যদি তারা হিদায়াতের পথ অবলম্ব করে নেয়, তবে তাতে তাদেরই কল্যাণ। আর যদি তা অবলম্বন না করে তবে তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

وَكِيْل অর্থ- দায়িত্বপ্রাপ্ত। অর্থাৎ তাদের হিদায়াতের দায়িত্ব তোমার ওপর নয়।

পরবর্তী আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর এমন এক পরিপূর্ণ ক্ষমতার এবং বিস্ময়কর কর্মের কথা উল্লেখ করেছেন, যা মানুষ প্রতিদিন প্রত্যক্ষ করে। আর তা হল, যখন সে ঘুমিয়ে যায়, তখন তার আত্মা আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশে দেহ থেকে যেন বেরিয়েই যায়। কেননা, তখন তার অনুভূতি ও বোধশক্তি বিলুপ্ত হয়ে যায়। আর যখন সে জেগে ওঠে, তখন আত্মাকে তার মধ্যে পুনরায় প্রেরণ করা হয়। ফলে তার অনুভূতি পূর্বের ন্যায় ফিরে আসে। অবশ্য যার জীবনের মেয়াদ পূর্ণ হয়ে যায়, তার আত্মা আর ফিরে আসে না এবং সে উক্ত ঘুমের মাঝেই মৃত্যুবরণ করে। এজন্য ঘুমকে মৃত্যুর ভাই বলা হয়। তাই আমরা ঘুমানোর সময় দু‘আয় বলে থাকি :

اللّٰهُمَّ بِاسْمِكَ أَمُوتُ وَأَحْيَا

হে আল্লাহ তোমার নামে মৃত্যু বরণ করি, তোমার নামেই জীবিত হই। আবার ঘুম থেকে জেগে ওঠার পর দু‘আতে বলে থাকি :

الحَمْدُ لِلّٰهِ الَّذِيْ أَحْيَانَا بَعْدَ مَا أَمَاتَنَا وَإِلَيْهِ النُّشُورُ

প্রশংসা আল্লাহর যিনি আমাদের মৃত্যুর পর জীবিত করেছেন এবং তাঁর কাছেই আমাদের পুনরুত্থান। (সহীহ বুখারী হা. ৬৩১৪)

এটাকেই মুফাসসীরগণ ওয়াফাতে কুবরা বা বড় মৃত্যু এবং ওফাতে সুগরা বা ছোট মৃত্যু বলে আখ্যায়িত করেছেন। এ বড় মৃত্যু ও ছোট মৃত্যু সম্পর্কে সূরা আন‘আমের ৬০-৬১ নম্বর আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে কারো ব্যাপারে তত্ত্বাবধায়ক করে পাঠানো হয়নি। বরং তাঁর দায়িত্ব শুধু পৌঁছে দেয়া।
২. মৃত্যুর মালিক একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা, অন্য কেউ নয়।
৩. ঘুমানোর আগে ও ঘুম থেকে জাগার পর কোন্ দু‘আ পড়তে হবে তা অবগত হলাম।
৪৩-৪৫ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

প্রথম আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা মুশরিকদেরকে ভর্ৎসনা করে বলছেন : তারা কি আল্লাহ ছাড়া অপরকে শাফায়াতকারী গ্রহণ করেছে? সকল প্রকার শাফায়াত শুধুমাত্র আল্লাহ তা‘আলার ক্ষমতায়। অর্থাৎ কিয়ামতের মাঠে আল্লাহ তা‘আলা যাকে অনুমতি দেবেন তিনিই কেবল শাফায়াত করতে পারবেন, অন্য কেউ নয়, সে যত বড় ওলী-আওলীয়াই হোক না কেন সেখানে কোন কথা বলতে পারবে না। তারা আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্য যাদেরকে শাফায়াতকারী হিসেবে আহ্বান করছে তারা কোন ক্ষমতা রাখেনা। এ সম্পর্কে সূরা বাকারার ২৫৫ নম্বর আয়াতে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

অতঃপর আল্লাহ বলেন : এ সকল কাফির-মুশরিকদের অবস্থা হল এমন, যখন তাদের সামনে এক আল্লাহর ইবাদত ও সকল মা‘বূদ বর্জন করার কথা বলা হয় তখন তারা কুফরী ও অহঙ্কার করে তীব্র ঘৃণা করে। অর্থাৎ মুশরিকদেরকে যখন বলা হয়, উপাস্য কেবল একজনই তখন তাদের মন তা মেনে নেয়ার জন্য প্রস্তুত হয় না। তবে হ্যাঁ, যখন বলা হয় যে, অমুক অমুকরাও উপাস্য অথবা তারাও তো আল্লাহ তা‘আলারই ওলীই বটে, তাদেরও কিছু এখতিয়ার আছে, তারাও বিপদাপদ দূর করা এবং প্রয়োজনাদি পূরণ করার সামর্থ্য রাখে, তখন মুশরিকরা বড়ই আনন্দিত হয়। পথভ্রষ্ট লোকদের এ অবস্থা আজও বিদ্যমান। যখন তাদেরকে বলা হয় কেবল বল, ‘ইয়া আল্লাহ মদদ’ কারণ তিনি ছাড়া তো কেউ সাহায্য করার ক্ষমতা রাখে না, তখন তারা চরম অসন্তুষ্ট হয়। এ বাক্য তাদের কাছে বড়ই অপছন্দনীয়। কিন্তু যদি বলা হয়, ‘ইয়া আলী মদদ’ অথবা ইয়া রাসূলুল্লাহ মদদ’ অনুরূপভাবে অন্যান্য মৃতদের কাছেও সাহায্য চাওয়া হয় যেমন যদি বলা হয়, ‘হে পীর আবদুল কাদের! আল্লাহ তা‘আলার ওয়াস্তে কিছু দিন!’ তবে তাদের অন্তর আনন্দে নেচে ওঠে। বস্তুত এদের চিন্তা-চেতনা ওদের মতই। উল্লেখ্য যে, আল্লাহ ছাড়া অন্যের কাছে সাহায্য কামনা করা ও অন্যের ইবাদতে খুশী হওয়া শির্ক।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. আল্লাহ তা‘আলার অনুমতি ছাড়া কেউ আল্লাহ তা‘আলার সম্মুখে শাফায়াত করতে পারবে না।
২. কাফিরদেরকে এক আল্লাহ তা‘আলার কথা বলা হলে তাদের মন তা মানে না, বরং অহঙ্কারী হয়ে যায়।
৪৬-৪৮ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

আল্লাহ তা‘আলা আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা, অদৃশ্য ও প্রকাশ্যের পরিজ্ঞাতা। তাঁর নিকট কিভাবে প্রার্থনা করতে হবে তিনি তাঁর রাসূলের মাধ্যমে এ আয়াতে সে পদ্ধতি শিখিয়ে দিয়েছেন। আয়িশাহ (রাঃ)-কে জিজ্ঞাসা করা হল, রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রাতের সালাত কিসের মাধ্যমে শুরু করতেন? তিনি বললেন :

>اَللّٰهُمَّ رَبَّ جَبْرَائِيلَ وَمِيكَائِيلَ وَإِسْرَافِيلَ فَاطِرَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ عَالِمَ الْغَيْبِ وَالشَّهَادَةِ أنت تَحْكُمُ بين عِبَادِكَ فِيمَا كَانُوا فيه يَخْتَلِفُونَ اهْدِنِي لِمَا اخْتُلِفَ فيه من الْحَقِّ بِإِذْنِكَ إِنَّكَ تَهْدِي من تَشَاءُ إلي صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ

হে আল্লাহ তা‘আলা! হে জিররাঈল, মীকাঈল ও ইসরাফীলের প্রভু! হে আকাশসমূহ ও পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা! হে দৃশ্য ও অদৃশ্যের পরিজ্ঞাতা! তুমি তোমার বান্দাদের মাঝে মীমাংসা কর যে-বিষয়ে ওরা মতভেদ করে। যে বিষয়ে মতভেদ করা হয়েছে সে বিষয়ে তুমি আমাকে তোমার অনুগ্রহে সত্য পথ দেখাও। নিশ্চয়ই তুমি যাকে ইচ্ছা পথ দেখাও। (সহীহ মুসলিম হা. ৭৭০)

সবচেয়ে বড় মতবিরোধ হল তাওহীদপন্থীরা বলে- আমরা যে সত্যের ওপর আছি এটাই ঠিক, আমরাই পরকালে সফলকাম হবো। আর মুশরিক ও আল্লাহ ব্যতীত যারা অন্যদের মা‘বূদ হিসেবে ইবাদত করে তারা বলে- আমরাই সত্যের ওপর আছি, আমরাই সফলকাম। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(اِنَّ الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا وَالَّذِیْنَ ھَادُوْا وَالصَّابِئِیْنَ وَالنَّصٰرٰی وَالْمَجُوْسَ وَالَّذِیْنَ اَشْرَکُوْٓاﺣ اِنَّ اللہَ یَفْصِلُ بَیْنَھُمْ یَوْمَ الْقِیٰمَةِﺚ اِنَّ اللہَ عَلٰی کُلِّ شَیْءٍ شَھِیْدٌ‏)‏

“যারা ঈমান এনেছে এবং যারা ইয়াহূদী হয়েছে, যারা সাবিয়ী, খ্রিস্টান ও অগ্নিপূজক এবং যারা মুশরিক হয়েছে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাদের মধ্যে ফায়সালা করে দেবেন। আল্লাহ সমস্ত‎ কিছুর সম্যক প্রত্যক্ষকারী।” (সূরা হাজ্জ ২২ : ১৭) তাদের এ ফায়সালা করা হবে তাদের বিবাদের পর, আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(هٰذٰنِ خَصْمٰنِ اخْتَصَمُوْا فِيْ رَبِّهِمْ ز فَالَّذِيْنَ كَفَرُوْا قُطِّعَتْ لَهُمْ ثِيَابٌ مِّنْ نَّارٍ ط يُصَبُّ مِنْ فَوْقِ رُؤُوْسِهِمُ الْحَمِيْمُ) ‏

“এরা দু’টি বিবদমান পক্ষ, তারা তাদের প্রতিপালক সম্বন্ধে বিতর্ক করে; যারা কুফরী করে তাদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে আগুনের পোশাক, তাদের মাথার ওপর ঢেলে দেয়া হবে ফুটন্ত‎ পানি।” (সূরা হাজ্জ ২২ : ১৯)

অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা বলছেন, কিয়ামত দিবসে কোন মুক্তিপণ গ্রহণ করা হবে না। কাফিররা যখন কিয়ামতের দিনে শাস্তি প্রত্যক্ষ করবে তখন তারা এ শাস্তি থেকে বাঁচার জন্য পৃথিবীর সমস্ত কিছু ও তার সমপরিমাণ আরো কিছু দিয়ে হলেও চেষ্টা করবে বাঁচার জন্য, কিন্তু তাদের থেকে কিছুই গ্রহণ করা হবে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(وَاتَّقُوْا يَوْمًا لَّا تَجْزِيْ نَفْسٌ عَنْ نَّفْسٍ شَيْئًا وَّلَا يُقْبَلُ مِنْهَا شَفَاعَةٌ وَّلَا يُؤْخَذُ مِنْهَا عَدْلٌ وَّلَا هُمْ يُنْصَرُوْنَ)

“আর তোমরা সেদিনকে ভয় কর যেদিন কোন ব্যক্তি অন্য কোন ব্যক্তি হতে কিছুমাত্র উপকৃত হবে না এবং কোন ব্যক্তি হতে কোন সুপারিশ গৃহীত হবে না, কোন ব্যক্তি হতে কোন বিনিময়ও গ্রহণ করা হবে না এবং তারা সাহায্যপ্রাপ্তও হবে না।” (সূরা বাকারাহ ২ : ৪৮)

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন :

(إِنَّ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا وَمَاتُوْا وَهُمْ كُفَّارٌ فَلَنْ يُّقْبَلَ مِنْ أَحَدِهِمْ مِّلءُ الْأَرْضِ ذَهَبًا وَّلَوِ افْتَدٰي بِه۪ ط أُولٰ۬ئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ أَلِيْمٌ لا وَّمَا لَهُمْ مِّنْ نّٰصِرِيْنَ)‏

“নিশ্চয়ই যারা কুফরী করেছে এবং কাফির অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছে তাদের কাছ থেকে পৃথিবী ভরা স্বর্ণও বিনিময়স্বরূপ প্রদান করতে চাইলে তা কখনো গ্রহণ করা হবে না। তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি এবং তাদের কোন সাহায্যকারীও থাকবেনা।” (সূরা আলি ইমরান ৩ : ৯১)

অর্থাৎ আযাবের কঠিনতা, ভয়াবহতা এবং তা এত প্রকারের হবে যা কোনদিন তাদের ধারণা ও কল্পনাতেও আসেনি। চতুর্দিক থেকে শাস্তি তাদেরকে বেষ্টন করে নেবে।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. দু‘আ করার পদ্ধতি জানলাম।
২. কিয়ামতের মাঠে কোন বিনিময় গ্রহণ করা হবে না।
৩. আল্লাহ মানুষের মধ্যে কিয়ামতের মাঠে তাদের মতানৈক্যপূর্ণ বিষয়ে মীমাংসা করে দেবেন।
৪৯-৫২ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

আলোচ্য আয়াতগুলোতে আল্লাহ তা‘আলা মানুষের একটি মন্দ অভ্যাসের বিবৃতি দিয়েছেন। তা হল- যখন তারা বিপদে পড়ে যেমন অসুস্থতা, অনাবৃষ্টি, প্লাবন, ঘুর্ণিঝড়, সমুদ্রে নিমজ্জিত হওয়ার উপক্রম হওয়া ইত্যাদি তখন একাগ্রচিত্তে কেবল আল্লাহ তা‘আলার কাছে প্রার্থনা করে। তারপর যখনই বিপদ থেকে মুক্ত হয় তখনই তারা আল্লাহ তা‘আলার সাথে কুফরী করে বসে। বলে যে, ডাক্তার খুব পারদর্শী, যথাসময়ে না আসলে হয়তো মরেই যেতাম, নাবিক খুব বিচক্ষণ অন্যথায় জাহাজ ডুবেই যেত, আমি একজন বিজ্ঞ পাইলট তাই একসিডেন্ট থেকে বেঁেচ গেছি ইত্যাদি কথা বলে থাকে। কিন্তু একটু পূর্বে আল্লাহ তা‘আলাকে একাগ্রচিত্তে আহ্বান করেছিল, তারা সে-কথা ভুলেই গেছে, এখন নিজের জ্ঞান-গরীমার বড়ত্ব প্রকাশ করছে। সমুদ্রে ভ্রমণকালে মানুষের অবস্থা বর্ণনায় আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(وَّجَا۬ءَھُمُ الْمَوْجُ مِنْ کُلِّ مَکَانٍ وَّظَنُّوْٓا اَنَّھُمْ اُحِیْطَ بِھِمْﺫ دَعَوُا اللہَ مُخْلِصِیْنَ لَھُ الدِّیْنَﹰ لَئِنْ اَنْجَیْتَنَا مِنْ ھٰذِھ۪ لَنَکُوْنَنَّ مِنَ الشّٰکِرِیْنَ)

এমতাবস্থায় নৌকাগুলোর ওপর এক প্রচণ্ড বাতাস এসে পড়ে এবং সর্বদিক হতে তরঙ্গাহত হয় এবং তারা তা দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে পড়েছে মনে করে, তখন তারা আনুগত্যে বিশুদ্ধচিত্ত হয়ে আল্লাহকে ডেকে বলে : ‘তুমি আমাদেরকে এ হতে পরিত্রাণ দিলে আমরা অবশ্যই কৃতজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত হব।’ (সূরা ইউনুস ১০ : ২২) এটা ছিল মক্কার তৎকালীন মুশরিকদের অবস্থা। কিন্তু আমাদের দেশের এক শ্রেণির মুসলিম রয়েছে যারা মক্কার মুশরিকদের থেকেও নিকৃষ্ট। তারা বিপদে পড়লে আল্লাহ তা‘আলাকে ডাকত, আর এরা বিপদে পড়লে খাযা বাবা, মাযার ও পীরের কাছে দৌড়ায়। তৎকালীন মক্কার মুশরিকরদের চেয়ে এ সকল মুসলিমদের ধর্মীয় অবস্থা কত জঘন্য। এ সম্পর্কে সূরা ইউনূসের ২২ নম্বর আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে।

(قَدْ قَالَهَا الَّذِيْنَ مِنْ قَبْلِهِمْ)

‘তাদের পূর্ববর্তীরাও এটাই বলত’ অর্থাৎ মক্কার মুশরিকদের সম্বোধন করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, তোমাদের পূর্বে যারা ছিল তারাও এরূপ কথা যেমন “ আমার জ্ঞানের কারণেই এরূপ পেয়েছি” বলত।

অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন, রিযিক বৃদ্ধি করা বা হ্রাস করা আল্লাহ তা‘আলার দায়িত্বে। তিনি যাকে ইচ্ছা বৃদ্ধি করে দেন আবার যাকে ইচ্ছা হ্রাস করে দেন। এটা ছিল মূলত মক্কার কাফিরদের জন্য হুশিয়ারী আর হলও তা-ই। এরাও বিগত জাতির মত অনাবৃষ্টি, হত্যা এবং বন্দিদশা ইত্যাদির শিকার হয়। আর এটা ছিল তাদের অবাধ্যতার ফল। সুতরাং এখনো যদি কেউ আল্লাহ তা‘আলার অবাধ্য হয় তবে তাদের অবস্থাও এর চেয়ে ভাল হবে বলে আশা করা যায় না।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. সর্বাবস্থায় আল্লাহ তা‘আলাকে ডাকতে হবে। কখনো ডাকব আবার কখনো কুফরী করব, এমন করা যাবে না। তাহলে শাস্তি পেতে হবে।
২. দুনিয়াতে যারা মন্দ আমল করবে তাদের ফলাফল পরকালে মন্দই হবে।
৩. রিযিকের মালিক একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা, অন্য কেউ নয়।

তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
# মক্কার কাফেররা নবীকে ﷺ বলতো, তুমি আমাদের উপাস্যদের সাথে বেআদবী করে থাকো এবং তাদের বিরুদ্ধে কথা বলে থাকো। তারা কত বড় সম্মানিত সত্তা তা তুমি জানো না। যে-ই তাদের অবমাননা ও অপমান করেছে সে-ই ধ্বংস হয়েছে। তুমি যদি তোমার কথাবার্তা থেকে বিরত না হও তাহলে এরা তোমাকে ধ্বংস করে ছাড়বে।
# এটাও তাদের হিদায়াত থেকে বঞ্চিত হওয়ার ফলশ্রুতি। কারণ এসব উপাস্যদের শক্তি ও মর্যাদার প্রতি এসব নির্বোধদের ভাল খেয়াল আছে। কিন্তু এ খেয়াল তাদের কখনো আসে না যে, আল্লাহ‌ এক মহা পরাক্রমশালী সত্তা, শিরক করে এরা তাঁর যে অপমান ও অবমাননা করছে সে জন্যও শাস্তি হতে পারে।
# ইবনে আবী হাতেম ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে হাদীস উদ্ধৃত করেছেন যে, নবী ﷺ বলেছেনঃ من احب ان يكون اقون الناس فليتو كل على الله , ومن احب ان يكون اغنى الناس فليكن بما فى يد الله عز وجل او ثق منه بما فى يديه , ومن احب ان يكون اكرم الناس فليتق الله عز وجل – “যে ব্যক্তি সব মানুষের চেয়ে অধিক শক্তিশালী হতে চায় সে যেন আল্লাহর ওপর ‘তাওয়াক্কুল’ করে, যে ব্যক্তি সবার চেয়ে অধিক ধনবান হতে চায় সে যেন তার নিজের কাছে যা আছে তার চেয়ে আল্লাহর কাছে যা আছে তার ওপর বেশী আস্থা ও নির্ভরতা রাখে, আর যে ব্যক্তি সবার চেয়ে বেশী মর্যাদার অধিকারী হতে চায় সে যেন মহান আল্লাহকে ভয় করে।”
# আমাকে পরাভূত করার জন্য তোমরা যা কিছু করছো এবং যা কিছু করতে সক্ষম তা করে যাও, এ ব্যাপারে কোন কসুর করো না।
# তাদের সঠিক পথে নিয়ে আসা তোমার দায়িত্ব নয়। তোমার কাজ শুধু এই যে, তাদের সামনে সত্য পথটি পেশ করো। এরপর যদি তারা পথভ্রষ্ট থেকে যায় তাতে তোমার কোন দায়িত্ব নেই।
# ঘুমন্ত অবস্থায় রূহ কবজ করার অর্থ অনুভূতি ও বোধ, উপলব্ধি ও অনুধাবন এবং ক্ষমতা ও ইচ্ছা নিষ্ক্রিয় করে দেয়া। এটা এমন এক অবস্থা যে, “ঘুমন্ত মানুষ ও মৃত মানুষ সমান” এ প্রবাদ বাক্যটি এক্ষেত্রে হুবহু খাটে।
# একথা দ্বারা আল্লাহ‌ তা’আলা প্রত্যেক মানুষকে এ অনুভূতি দিতে চাচ্ছেন যে, জীবন ও মৃত্যু কিভাবে তাঁর অসীম ক্ষমতার করায়ত্ব। রাতে ঘুমালে সকালে অবশ্যই জীবিত উঠবে এবং নিশ্চয়তা কোন মানুষের জন্যই নেই। কেউ-ই জানে না এক মুহূর্তের মধ্যে তার ওপর কি বিপদ আসতে পারে। আবার পরবর্তী মুহূর্তটি তার জন্য জীবনের মুহূর্ত না মৃত্যুর মুহূর্ত তাও কেউ জানে না। শয়নে, জাগরনে, ঘরে অবস্থানের সময় কিংবা কোথাও চলাফেরা করার সময় মানব দেহের আভ্যন্তরীণ কোন ত্রুটি অথবা বাইরের অজানা কোন বিপদ অকস্মাত এমন মোড় নিতে পারে যা তার মৃত্যু ঘটাতে পারে। যে মানুষ আল্লাহর হাতে এতটা অসহায় সে যদি সেই আল্লাহ‌ সম্পর্কে এতটা অমনোযোগী ও বিদ্রোহী হয় তাহলে সে কত অজ্ঞ।
# এসব লোক নিজের পক্ষ থেকেই ধরে নিয়েছে যে, কিছু সত্তা এমন আছে যারা আল্লাহর দরবারে অত্যন্ত ক্ষমতাধর। তাদের সুপারিশ কখনো বিফলে যায় না। অথচ তারা যে সুপারিশকারী এ ব্যাপারে না আছে কোন প্রমাণ, না আল্লাহ‌ তা’আলা কখনো বলেছেন যে, আমার দরবারে তাদের এ ধরনের মর্যাদা রয়েছে, না ঐ সব সত্তা ও ব্যক্তিবর্গ দাবী করেছেন যে আমরা নিজেদের ক্ষমতায় তোমাদের সকল প্রয়োজন পূরণ করে দেবো। তাদের আরো নির্বুদ্ধিতা এই যে, তারা প্রকৃত মালিককে বাদ দিয়ে সব অনুমানকৃত সুপারিশকারীদেরই সবকিছু মেনে নিয়েছে এবং এদের সকল সবিনয় প্রার্থনা ও আকুতি তাদের জন্যই নিবেদিত।
# সুপারিশ গ্রহণ করানোর ক্ষমতা তো দূরের কথা নিজে নিজেই আল্লাহর দরবারে সুপারিশকারী হিসেবে যাবে সে শক্তিও কারো নেই। যাকে ইচ্ছা সুপারিশের অনুমতি দেয়া ও যাকে ইচ্ছা না দেয়া এবং যার জন্য ইচ্ছা সুপারিশ করতে দেয়া আর যার জন্য ইচ্ছা করতে না দেয়া সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর ইখাতিয়ারে। (শাফা’আত সম্পর্কে ইসলামী আকীদা ও শিরকমূলক আকীদার পার্থক্য বুঝার জন্য নিম্নোদ্বৃত স্থানসমূহে দেখুন। তাফহীমুল কুরআন, আল বাকারাহ, টীকা ২৮১ ; আল আন’আম, টীকা ৩৩ ; ইউনুস টীকা ৫ ও ২৪ ; হূদ, টীকা ৮৪ ও ১০৬ ; আর রা’দ, টীকা ১৯ ; আন নাহল, টীকা ৬৪ , ৬৫ , ৭৯ ; ত্বা-হা, টীকা ৮৫ ও ৮৬ ; আল আম্বিয়া, টীকা ২৭ ; আল হাজ্জ, টীকা ১২৫ , আস সাবা, টীকা ৪০ )
# গোটা পৃথিবীর মুশরেকী রুচি ও ধ্যান-ধারণার অধিকারী প্রায় সব মানুষের মধ্যেই এটি বিদ্যমান। এমনকি মুসলমানদের মধ্যেও যে দুর্ভাগাদের এ রোগ পেয়ে বসেছে তারাও এ দোষ থেকে মুক্ত নয়। মুখে বলে আমরা আল্লাহকে মানি। কিন্তু অবস্থা এই যে, শুধু আল্লাহর কথা বলুন, দেখবেন তাদের চেহারা বিকৃত হতে শুরু হয়েছে। এরা বলে বসবে, এ ব্যক্তি নিশ্চয়ই বুযুর্গ ও আওলিয়াদের মানে না। সেজন্য শুধু আল্লাহর কথাই আওড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু যদি আল্লাহ‌ ছাড়া অন্যদের কথাও বলা হয় তাহলে আনন্দে ও প্রফুল্লতায় তাদের চেহারা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। প্রকৃতপক্ষে তাদের আগ্রহ ও ভালবাসা কার প্রতি তা এ কর্মপন্থার মাধ্যমেই পরিষ্কার প্রকাশ পায়। আল্লামা আলুসী তাফসীরে রূহুল মা’আনীতে এ আয়াতের ব্যাখ্যায় তাঁর নিজের একটি অভিজ্ঞতার বিষয় বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেনঃ একদিন আমি দেখলাম, কোন বিপদে পড়ে এক ব্যক্তি সাহায্যের জন্য এক মৃত বুযুর্গকে ডাকছে। আমি বললাম হে আল্লাহর বান্দা, আল্লাহকে ডাকো। আল্লাহ‌ বলেছেনঃ

وَإِذَا سَأَلَكَ عِبَادِي عَنِّي فَإِنِّي قَرِيبٌ أُجِيبُ دَعْوَةَ الدَّاعِ إِذَا دَعَانِ

—-আমার একথা শুনে সে ভীষণ চটে গেল। পরে লোকজন আমাকে বলেছে, সে বলছিলোঃ এ ব্যক্তি আওলিয়াদের মানে না। তাছাড়া কিছু সংখ্যক লোক তাকে একথাও বলতে শুনেছে যে, অলীরা আল্লাহর চাইতে দ্রুত শুনে থাকেন।
# যার আল্লাহর নাম অপছন্দনীয় এবং একমাত্র আল্লাহর নামে যার চেহারা বিকৃত হতে শুরু করে।
# এ আয়তাংশটির দু’টি অর্থ হতে পারে। একটি অর্থ হচ্ছে, আমি যে, এ নিয়ামতের উপযুক্ত তা আল্লাহ‌ জানেন। তাই তিনি আমাকে এসব দিয়েছেন। আমি যদি তার কাছে একজন দুষ্ট ভ্রষ্ট আকীদা এবং দুষ্কর্মশীল মানুষ হতাম তাহলে আমাকে তিনি এসব নিয়ামত কেন দিতেন? এর আরেকটি অর্থ এও হতে পারে যে, এসব তো আমি আমার যোগ্যতার ভিত্তিতে লাভ করেছি।
# কেউ যদি নিয়ামত লাভ করতে থাকে তখন মানুষ তার মূর্খতা ও অজ্ঞতার কারণে মনে করে, সে অনিবার্যরূপে তার যোগ্যতার ভিত্তিতেই তা লাভ করছে আর তা লাভ করাটা আল্লাহর দরবারে তার প্রিয়পাত্র হওয়ার লক্ষণ বা প্রমাণ। অথচ এখানে যাকেই যা কিছু দেয়া হচ্ছে আল্লাহর পক্ষ থেকে পরীক্ষা হিসেবেই দেয়া হচ্ছে। এটা পরীক্ষার উপকরণ, যোগ্যতার পুরস্কার নয়। অন্যথায় কি কারণে বহু যোগ্য লোক দুর্দশাগ্রস্ত এবং বহু অযোগ্য লোক নিয়ামতের প্রাচুর্যে ডুবে আছে? অনুরূপভাবে এসব পার্থিব নিয়ামত আল্লাহর দরবারে প্রিয়পাত্র হওয়ারও লক্ষণ নয়। যেকোন ব্যক্তি দেখবেন, পৃথিবীতে বহু সৎকর্মশীল ব্যক্তি বিপদাপদে ডুবে আছে, অথচ তাদের সৎকর্মশীল হওয়া অস্বীকার করা যায় না। আবার বহু দুশ্চরিত্র লোক আরাম-আয়েশে জীবন কাটাচ্ছে যাদের কুৎসিত আচরণ ও তৎপরতা সম্পর্কে সবাই অবহিত। এখন কোন জ্ঞানবান ব্যক্তি কি একজনের বিপদাপদ এবং আরেকজনের আরাম-আয়েশকে একথার প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করতে পারে যে, আল্লাহ‌ সৎকর্মশীল মানুষদের পছন্দ করেন না, দুশ্চরিত্র ও দুষ্কর্মশীল মানুষদের পছন্দ করেন?
# যখন দুর্ভাগ্যের দিন আসলো তখন তাদের যোগ্যতার দাবী কোন কাজে লাগলো না। তাছাড়া একথাও পরিষ্কার হয়ে গেল যে, তারা আল্লাহর প্রিয় বান্দা ছিলো না। একথা স্পষ্ট যে তাদের এসব উপার্জন যদি যোগ্যতা ও প্রিয়পাত্র হওয়ার কারণে হতো তাহলে দুর্দিন কি করে আসলো?
# রিযিকের স্বল্পতা ও প্রাচুর্য আল্লাহর আরেকটি বিধানের ওপর নির্ভরশীল। সেই বিধানের উদ্দেশ্যও সম্পূর্ণ ভিন্ন। রিযিকের বণ্টন ব্যক্তির যোগ্যতা কিংবা তার প্রিয়পাত্র বা বিরাগভাজন হওয়ার ওপর আদৌ নির্ভর করে না। (এ বিষয়টি বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, আত-তাওবা, টীকা ৫৪ , ৭৫ , ৮৯ ; ইউনুস, টীকা ২৩ ; হূদ, টীকা ৩ ও ৩৩ ; আর রা’দ, টীকা ৪২ ; আল কাহাফ, টীকা ৩৭ ; মারয়াম, টীকা ৪৫ ; ত্বা-হা, টীকা ১১৩ ও ১১৪ ; আল আম্বিয়া, টীকা ৯৯ ; আল মু’মিনূন, ভূমিকা এবং টীকা ১ , ৪৯ ও ৫০ ; আশ শু’য়ারা, টীকা ৮১ ও ৮৪ ; আল কাসাস, টীকা ৯৭ , ৯৮ ও ১০১ ; সাবা টীকা ৫৪ থেকে ৬০ )।

Leave a Reply