أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#১০৮৫)
[*আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না:-]
www.motaher21.net
সূরা:- ৩৯:আয-যুমার
পারা:২৪
৫৩- ৭৫ নং আয়াত:-
সূরা:- ৩৯:আয-যুমার-৫৩
قُلۡ یٰعِبَادِیَ الَّذِیۡنَ اَسۡرَفُوۡا عَلٰۤی اَنۡفُسِہِمۡ لَا تَقۡنَطُوۡا مِنۡ رَّحۡمَۃِ اللّٰہِ ؕ اِنَّ اللّٰہَ یَغۡفِرُ الذُّنُوۡبَ جَمِیۡعًا ؕ اِنَّہٗ ہُوَ الۡغَفُوۡرُ الرَّحِیۡمُ ﴿۵۳﴾
বলে দাও, হে আমার বান্দারা যারা নিজের আত্মার ওপর জুলুম করেছো আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চিতভাবেই আল্লাহ সমস্ত গোনাহ মাফ করে দেন। তিনি ক্ষমাশীল ও দয়ালু।
সূরা:- ৩৯:আয-যুমার-৫৪
وَ اَنِیۡبُوۡۤا اِلٰی رَبِّکُمۡ وَ اَسۡلِمُوۡا لَہٗ مِنۡ قَبۡلِ اَنۡ یَّاۡتِیَکُمُ الۡعَذَابُ ثُمَّ لَا تُنۡصَرُوۡنَ ﴿۵۴﴾
তোমাদের নিকট শাস্তি আসার পূর্বে তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের অভিমুখী হও এবং তাঁর নিকট আত্মসমর্পণ কর; শাস্তি এসে পড়লে তোমাদেরকে সাহায্য করা হবে না।
সূরা:- ৩৯:আয-যুমার-৫৫
وَ اتَّبِعُوۡۤا اَحۡسَنَ مَاۤ اُنۡزِلَ اِلَیۡکُمۡ مِّنۡ رَّبِّکُمۡ مِّنۡ قَبۡلِ اَنۡ یَّاۡتِیَکُمُ الۡعَذَابُ بَغۡتَۃً وَّ اَنۡتُمۡ لَا تَشۡعُرُوۡنَ ﴿ۙ۵۵﴾
তোমাদের অজ্ঞাতসারে তোমাদের ওপর অতর্কিতে শাস্তি আসার পূর্বে তোমাদের প্রতি তোমাদের প্রতিপালকের তরফ থেকে যে সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ অবতীর্ণ করা হয়েছে, তার অনুসরণ কর।
সূরা:- ৩৯:আয-যুমার-৫৬
اَنۡ تَقُوۡلَ نَفۡسٌ یّٰحَسۡرَتٰی عَلٰی مَا فَرَّطۡتُّ فِیۡ جَنۡۢبِ اللّٰہِ وَ اِنۡ کُنۡتُ لَمِنَ السّٰخِرِیۡنَ ﴿ۙ۵۶﴾
যাতে কাউকেও বলতে না হয়, ‘হায়! আল্লাহর প্রতি আমার কর্তব্যে আমি তো শৈথিল্য করেছি। আর অবশ্যই আমি ঠাট্টা-বিদ্রূপকারীদের একজন ছিলাম।’
সূরা:- ৩৯:আয-যুমার-৫৭
اَوۡ تَقُوۡلَ لَوۡ اَنَّ اللّٰہَ ہَدٰىنِیۡ لَکُنۡتُ مِنَ الۡمُتَّقِیۡنَ ﴿ۙ۵۷﴾
অথবা বলবেঃ “কতই না ভাল হতো যদি আল্লাহ আমাকে হিদায়াত দান করতেন। তাহলে আমিও মুত্তাকীদের অন্তর্ভুক্ত থাকতাম।”
সূরা:- ৩৯:আয-যুমার-৫৮
اَوۡ تَقُوۡلَ حِیۡنَ تَرَی الۡعَذَابَ لَوۡ اَنَّ لِیۡ کَرَّۃً فَاَکُوۡنَ مِنَ الۡمُحۡسِنِیۡنَ ﴿۵۸﴾
কিংবা আযাব দেখতে পেয়ে বলবেঃ “কতই না ভাল হতো যদি আরো একবার সুযোগ পেতাম তাহলে নেক আমলকারীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যেতাম।”
সূরা:- ৩৯:আয-যুমার-৫৯
بَلٰی قَدۡ جَآءَتۡکَ اٰیٰتِیۡ فَکَذَّبۡتَ بِہَا وَ اسۡتَکۡبَرۡتَ وَ کُنۡتَ مِنَ الۡکٰفِرِیۡنَ ﴿۵۹﴾
হ্যাঁ, অবশ্যই আমার নিদর্শন তোমার কাছে এসেছিল, কিন্তু তুমি এগুলোতে মিথ্যারোপ করেছিলে এবং অহংকার করেছিলে; আর তুমি ছিলে কাফিরদের অন্তর্ভুক্ত।
সূরা:- ৩৯:আয-যুমার-৬০
وَ یَوۡمَ الۡقِیٰمَۃِ تَرَی الَّذِیۡنَ کَذَبُوۡا عَلَی اللّٰہِ وُجُوۡہُہُمۡ مُّسۡوَدَّۃٌ ؕ اَلَیۡسَ فِیۡ جَہَنَّمَ مَثۡوًی لِّلۡمُتَکَبِّرِیۡنَ ﴿۶۰﴾
যারা আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করে, আপনি কিয়ামতের দিন তাদের চেহারাসমূহ কালো দেখবেন। অহংকারীদের আবাসস্থল কি জাহান্নাম নয়?
সূরা:- ৩৯:আয-যুমার-৬১
وَ یُنَجِّی اللّٰہُ الَّذِیۡنَ اتَّقَوۡا بِمَفَازَتِہِمۡ ۫ لَا یَمَسُّہُمُ السُّوۡٓءُ وَ لَا ہُمۡ یَحۡزَنُوۡنَ ﴿۶۱﴾
অন্যদিকে যেসব লোক এখানে তাকওয়া অবলম্বন করেছে, তাদেরকে আল্লাহ তাদের সাফল্যের পন্থা অবলম্বনের জন্যই নাজাত দেবেন। কোন অকল্যাণ তাদেরকে স্পর্শ করবে না এবং তারা দুঃখ ভারাক্রান্তও হবে না।
সূরা:- ৩৯:আয-যুমার-৬২
اَللّٰہُ خَالِقُ کُلِّ شَیۡءٍ ۫ وَّ ہُوَ عَلٰی کُلِّ شَیۡءٍ وَّکِیۡلٌ ﴿۶۲﴾
আল্লাহ সব কিছুর স্রষ্টা এবং তিনি সমস্ত কিছুর তত্ত্বাবধায়ক।
সূরা:- ৩৯:আয-যুমার-৬৩
لَہٗ مَقَالِیۡدُ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ ؕ وَ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا بِاٰیٰتِ اللّٰہِ اُولٰٓئِکَ ہُمُ الۡخٰسِرُوۡنَ ﴿٪۶۳﴾
যমীন ও আসমানের ভাণ্ডারের চাবিসমূহ তাঁরই কাছে। যারা আল্লাহর আয়াতসমূহের সাথে কুফরী করে তারাই ক্ষতির সম্মুখীন হবে।
সূরা:- ৩৯:আয-যুমার-৬৪
قُلۡ اَفَغَیۡرَ اللّٰہِ تَاۡمُرُوۡٓنِّیۡۤ اَعۡبُدُ اَیُّہَا الۡجٰہِلُوۡنَ ﴿۶۴﴾
বলুন, ‘হে অজ্ঞরা! তোমরা কি আমাকে আল্লাহ ছাড়া অন্যের ইবাদাত করতে নির্দেশ দিচ্ছ?’
সূরা:- ৩৯:আয-যুমার-৬৫
وَ لَقَدۡ اُوۡحِیَ اِلَیۡکَ وَ اِلَی الَّذِیۡنَ مِنۡ قَبۡلِکَ ۚ لَئِنۡ اَشۡرَکۡتَ لَیَحۡبَطَنَّ عَمَلُکَ وَ لَتَکُوۡنَنَّ مِنَ الۡخٰسِرِیۡنَ ﴿۶۵﴾
আপনার প্রতি ও আপনার পুর্ববর্তীদের প্রতি অবশ্যই ওহী করা হয়েছে যে, ‘যদি আপনি শির্ক করেন তবে আপনার সমস্ত আমল তো নিষ্ফল হবে এবং অবশ্যই আপনি হবেন ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত।
সূরা:- ৩৯:আয-যুমার-৬৬
بَلِ اللّٰہَ فَاعۡبُدۡ وَ کُنۡ مِّنَ الشّٰکِرِیۡنَ ﴿۶۶﴾
তুমি শুধু আল্লাহরই বন্দেগী করো এবং তাঁর কৃতজ্ঞ বান্দা হয়ে যাও।
সূরা:- ৩৯:আয-যুমার-৬৭
وَ مَا قَدَرُوا اللّٰہَ حَقَّ قَدۡرِہٖ ٭ۖ وَ الۡاَرۡضُ جَمِیۡعًا قَبۡضَتُہٗ یَوۡمَ الۡقِیٰمَۃِ وَ السَّمٰوٰتُ مَطۡوِیّٰتٌۢ بِیَمِیۡنِہٖ ؕ سُبۡحٰنَہٗ وَ تَعٰلٰی عَمَّا یُشۡرِکُوۡنَ ﴿۶۷﴾
ওরা আল্লাহর যথোচিত কদর করেনি। কিয়ামতের দিন সমস্ত পৃথিবী তাঁর হাতের মুঠোয় থাকবে এবং আকাশমন্ডলী থাকবে তাঁর ডান হাতে গুটানো। পবিত্র ও মহান তিনি, ওরা যাকে অংশী করে, তিনি তার ঊর্ধ্বে।
সূরা:- ৩৯:আয-যুমার-৬৮
وَ نُفِخَ فِی الصُّوۡرِ فَصَعِقَ مَنۡ فِی السَّمٰوٰتِ وَ مَنۡ فِی الۡاَرۡضِ اِلَّا مَنۡ شَآءَ اللّٰہُ ؕ ثُمَّ نُفِخَ فِیۡہِ اُخۡرٰی فَاِذَا ہُمۡ قِیَامٌ یَّنۡظُرُوۡنَ ﴿۶۸﴾
সেদিন শিংগায় ফুৎকার দেয়া হবে। আর তৎক্ষণাত আসমান ও যমীনে যারা আছে তারা সব মরে পড়ে যাবে। তবে আল্লাহ যাদের জীবিত রাখতে চান তারা ছাড়া। অতঃপর আরেকবার শিংগায় ফুৎকার দেয়া হবে তখন হঠাৎ সবাই জীবিত হয়ে দেখতে থাকবে।
সূরা:- ৩৯:আয-যুমার-৬৯
وَ اَشۡرَقَتِ الۡاَرۡضُ بِنُوۡرِ رَبِّہَا وَ وُضِعَ الۡکِتٰبُ وَ جِایۡٓءَ بِالنَّبِیّٖنَ وَ الشُّہَدَآءِ وَ قُضِیَ بَیۡنَہُمۡ بِالۡحَقِّ وَ ہُمۡ لَا یُظۡلَمُوۡنَ ﴿۶۹﴾
বিশ্ব-প্রতিপালকের জ্যোতিতে উদ্ভাসিত হবে বিশ্ব, আমলনামা উপস্থিত করা হবে এবং নবীগণ ও সাক্ষীদেরকে আনয়ন করা হবে এবং সকলের মধ্যে ন্যায় বিচার করা হবে ও তাদের প্রতি অবিচার করা হবে না।
সূরা:- ৩৯:আয-যুমার-৭০
وَ وُفِّیَتۡ کُلُّ نَفۡسٍ مَّا عَمِلَتۡ وَ ہُوَ اَعۡلَمُ بِمَا یَفۡعَلُوۡنَ ﴿٪۷۰﴾
প্রত্যেককে তার আমলের পূর্ণ প্রতিফল দেয়া হবে এবং তারা যা করে সে সম্পর্কে আল্লাহ্ সর্বাধিক অবগত।
সূরা:- ৩৯:আয-যুমার-৭১
وَ سِیۡقَ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡۤا اِلٰی جَہَنَّمَ زُمَرًا ؕ حَتّٰۤی اِذَا جَآءُوۡہَا فُتِحَتۡ اَبۡوَابُہَا وَ قَالَ لَہُمۡ خَزَنَتُہَاۤ اَلَمۡ یَاۡتِکُمۡ رُسُلٌ مِّنۡکُمۡ یَتۡلُوۡنَ عَلَیۡکُمۡ اٰیٰتِ رَبِّکُمۡ وَ یُنۡذِرُوۡنَکُمۡ لِقَآءَ یَوۡمِکُمۡ ہٰذَا ؕ قَالُوۡا بَلٰی وَ لٰکِنۡ حَقَّتۡ کَلِمَۃُ الۡعَذَابِ عَلَی الۡکٰفِرِیۡنَ ﴿۷۱﴾
যারা কুফরী করেছিলো সেসব লোককে দলে দলে জাহান্নাম অভিমুখে হাঁকিয়ে নেয়া হবে। তারা যখন সেখানে পৌঁছবে তখন দোজখের দরজাসমূহ খোলা হবে এবং তার ব্যবস্থাপক তাদেরকে বলবেঃ তোমাদের কাছে কি তোমাদের নিজেদের মধ্য থেকে রসূলগণ আসেননি যারা তোমাদেরকে তোমাদের রবের আয়াতসমূহ শুনিয়েছেন এবং এ বিষয়ে সাবধান করে দিয়েছেন যে, একদিন তোমাদেরকে এ দিনটির সম্মুখীন হতে হবে? তারা বলবেঃ “হ্যাঁ, এসেছিলো। কিন্তু আযাবের সিদ্ধান্ত কাফেরদের জন্য অবধারিত হয়ে গিয়েছে।”
সূরা:- ৩৯:আয-যুমার-৭২
قِیۡلَ ادۡخُلُوۡۤا اَبۡوَابَ جَہَنَّمَ خٰلِدِیۡنَ فِیۡہَا ۚ فَبِئۡسَ مَثۡوَی الۡمُتَکَبِّرِیۡنَ ﴿۷۲﴾
বলা হবে, জাহান্নামের দরজার মধ্যে প্রবেশ করো, তোমাদেরকে চিরকাল এখানেই থাকবে হবে। অহংকারীদের জন্য এটা অত্যন্ত জঘন্য ঠিকানা।
সূরা:- ৩৯:আয-যুমার-৭৩
وَ سِیۡقَ الَّذِیۡنَ اتَّقَوۡا رَبَّہُمۡ اِلَی الۡجَنَّۃِ زُمَرًا ؕ حَتّٰۤی اِذَا جَآءُوۡہَا وَ فُتِحَتۡ اَبۡوَابُہَا وَ قَالَ لَہُمۡ خَزَنَتُہَا سَلٰمٌ عَلَیۡکُمۡ طِبۡتُمۡ فَادۡخُلُوۡہَا خٰلِدِیۡنَ ﴿۷۳﴾
যারা তাদের রবের তাকওয়া অবলম্বন করেছে তাদেরকে দলে দলে জান্নাতের দিকে নিয়ে যাওয়া হবে। অবশেষে যখন তারা জান্নাতের কাছে আসবে এবং এর দরজাসমূহ খুলে দেয়া হবে এবং জান্নাতের রক্ষীরা তাদেরকে বলবে, ‘তোমাদের প্রতি সালাম’, তোমরা ভাল ছিলে সুতরাং জান্নাতে প্রবেশ কর স্থায়ীভাবে অবস্থিতির জন্য। ‘
সূরা:- ৩৯:আয-যুমার-৭৪
وَ قَالُوا الۡحَمۡدُ لِلّٰہِ الَّذِیۡ صَدَقَنَا وَعۡدَہٗ وَ اَوۡرَثَنَا الۡاَرۡضَ نَتَبَوَّاُ مِنَ الۡجَنَّۃِ حَیۡثُ نَشَآءُ ۚ فَنِعۡمَ اَجۡرُ الۡعٰمِلِیۡنَ ﴿۷۴﴾
তারা বলবে, ‘সকল প্ৰশংসা আল্লাহর, যিনি আমাদের প্রতি তাঁর প্রতিশ্রুতি সত্য করেছেন এবং আমাদেরকে অধিকারী করেছেন এ যমীনের; আমরা জান্নাতে যেখানে ইচ্ছে বসবাসের জায়গা করে নেব।’ অতএব নেক আমলকারীদের পুরস্কার কত উত্তম!
সূরা:- ৩৯:আয-যুমার-৭৫
وَ تَرَی الۡمَلٰٓئِکَۃَ حَآفِّیۡنَ مِنۡ حَوۡلِ الۡعَرۡشِ یُسَبِّحُوۡنَ بِحَمۡدِ رَبِّہِمۡ ۚ وَ قُضِیَ بَیۡنَہُمۡ بِالۡحَقِّ وَ قِیۡلَ الۡحَمۡدُ لِلّٰہِ رَبِّ الۡعٰلَمِیۡنَ ﴿٪۷۵﴾
তুমি ফিরিশতাদেরকে দেখতে পাবে যে, ওরা আরশের চারিপাশ ঘিরে ওদের প্রতিপালকের সপ্রশংস পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করছে। ন্যায়ের সঙ্গে সকলের বিচার করা হবে; আর বলা হবে, ‘সমস্ত প্রশংসা বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহর প্রাপ্য।’
ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
‘বলাে, আমার সেসব বান্দা, যারা নিজেদের ওপর যুলুম করেছ, তােমরা আমার রহমত থেকে নিরাশ হয়াে না। নিশ্চয়ই তিনি সকল গুনাহ মাফ করে দেবেন, তিনি ক্ষমাশীল দয়াময়। এই হচ্ছে আল্লাহর সেই প্রশস্ত রহমত যা সকল গুনাহ ঢেকে দেয় (প্রকাশ থাকে যে, গুনাহ তাই যা আল্লাহর অধিকারের সাথে জড়িত। বান্দার অধিকার এর বাইরে এবং তা বান্দা মাফ না করলে মাফ হয় না, আর এই জন্যেই রসূলুল্লাহ(স.) বলেছেন, ঋণ ছাড়া শহীদের সকল গুনাহ মাফ হয়ে যায়। পরম করুণাময় আল্লাহ তায়ালা তার অবাধ্য বান্দাকে কাছে টানার জন্যে তার ক্ষমা করার সীমাহীন ক্ষমতার কথা জানিয়ে দিয়েছেন। তিনি এতাে দয়াময় যে, বান্দা যতাে বড় নাফরমানীই করুক না কেন, তার ক্ষমার দরজা কখনও তার জন্যে বন্ধ হবে না, তবে শর্ত হচ্ছে মৃত্যুর পূর্বে তাকে অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা চাইতে হবে এবং যেহেতু তিনি সুবিচারক, এ জন্যে অন্য কারাে অধিকার নষ্ট করলে সে অধিকার আদায় করার দায়িত্বও তাঁর। তাঁর নাফরমানীর সীমা অতিক্রমকারীদের যারা ভুল পথে চলতে চলতে এত দূরে চলে গেছে, যেখান থেকে ফেরার কল্পনাও করা যায় না- সেসব হতাশাগ্রস্ত মানুষের প্রতি উদাত্ত আহ্বান, ফিরে এসাে, ফিরে এসাে হে আমার ভ্রান্ত বান্দারা, যতাে বড় গুনাহই তােমরা করো না কেন। আমার ক্ষমার কোনাে সীমা নেই, শেষ নেই। এ ক্ষমা তার জন্যেই যে আনুগত্য প্রকাশ করে নিজের দাসত্বের প্রমাণ দেবে, অবশ্যই আল্লাহ তায়ালা তার বান্দার জন্যে বিশেষভাবে দয়াবান। তিনি তাদের দুর্বলতা ও অক্ষমতা জানেন এবং তিনি আরও জানেন যে, বান্দার প্রকৃতির মধ্যে ও বাইরে কোন কোন জিনিস তাকে অবাধ্য বানানোর জন্যে সদা ক্রিয়াশীল রয়েছে। তিনি আরও জানেন, মরদূদ শয়তান জীবনের বন্ধুর পথের বাঁকে বাঁকে ওৎ পেতে থেকে তাকে ভুল পথে চালিত করছে। তিনি জানেন, কেমন করে তাকে ধােকার মধ্যে ফেলার জন্যে শয়তান সকল প্রকার দুরভিসন্ধি এঁটে বসে আছে এবং কেমন করে আল্লাহর পথ থেকে তাকে সরিয়ে নেয়ার জন্যে তার বিরুদ্ধে তার অশ্বারােহী বাহিনী ও পদাতিক বাহিনীকে পরিচালিত করছে। এটাও তিনি ভালাে করে জানেন, তার ঘৃণ্য চক্রান্তজাল প্রসারিত করার ব্যাপারে সে কত পারদর্শী। তিনি আরও জানেন, মানবরূপী এ তুচ্ছ সৃষ্টির কাজের উপাদানসমূহ অতি দুর্বল। সে বড়ই অভাবগ্রস্ত, তার হাত থেকে সেই উপাদানসমূহ যখন দ্রুত গতিতে সরে যায় তখন সে নেহায়াত অসহায় হয়ে পড়ে। তার প্রকৃতির মধ্যে এমন কোন কোন প্রবণতা এবং কোন কোন জিনিসের চাহিদা রয়েছে যা তিনি ছাড়া আর কেউ জানে। তার প্রকৃতির মধ্যে ভারসাম্যপূর্ণ আচরণ থেকে দূরে সরে যাওয়ার সম্ভাবনা যে রয়েছে তা তিনি জানেন। কেমনভাবে সে কখনও এদিকে কখনও ওদিকে চালিত হয় এবং এর ফলে সে কত সহজে অপরাধজনক কাজ ও কু-প্রবৃত্তির শিকার হয়ে যায়, জীবনের সব ব্যাপারে নিজেকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রেখে ভারসাম্য রক্ষা করে চলার ব্যাপারে কত বেশী দুর্বল আল্লাহ তায়ালা তাও আল্লাহ সােবহানাহু তায়ালা মানব সৃষ্টির রহস্য সম্পর্কে সম্যক অবগত, এ জন্যেই মহা দয়াময় আল্লাহ তায়ালা তার সাহায্যের জন্যে তার করুণার হাত সদা-সর্বদা প্রসারিত করে রেখেছেন এবং প্রসারিত করে রেখেছেন তার রহমতের হাত, এ জন্যে তিনি ততক্ষণ বান্দার অপরাধের কারণে তাকে সংগে সংগে পাকড়াও করেন না। তার সংশােধনের জন্যে সুযােগ দেন, আত্মােপলব্ধি করে শােধরানাের জন্যে তাকে প্রচুর উপায় উপাদান ও সময় দিতে থাকেন। এরপরও যখন সে অপরাধে লিপ্ত হয়ে যায়, সীমা ছাড়া গুনাহ করে ফেলে, তারপর সে বুঝতে পারে, সে অন্যায় কাজ করতে করতে সঠিক পথ থেকে এতাে দূরে চলে গেছে যে, এ সময় তার দোয়া কবুল হবে বলে সে আর মনে করে না, বা সে মনে করে যে তাকে আর সঠিক পথে কেউ এগিয়ে নেবে না, এমনই এক কঠিন হতাশার মুহূর্তে সে শুনতে পায় আল্লাহ রব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে ঘােষিত উদাত্ত আহ্বান বলে দাও (হে রসূল), সেসব সীমা অতিক্রমকারী ব্যক্তিদের, তােমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়াে না, নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা সকল গুনাহ মাফ করে দেবেন, ‘নিশ্চয়ই তিনি মাফ করনেওয়ালা, মেহেরবান।’ মানুষ অন্যায় করে, সীমা অতিক্রম করে অপরাধের জালে আবদ্ধ হয়ে যায় এবং এ সব অপরাধের শাস্তি থেকে দূরে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে, ফলে তার এবং তার মালিকের মধ্যে এক বিরাট দূরত্ব সৃষ্টি হয়ে যায়। এ জন্যে তার প্রতি তার মালিকের দয়া মায়া মমতা কমে যেতে শুরু করে, ক্রমান্বয়ে সে রব্বুল আলামীনের বহমতের ছায়া থেকে আরও দূরে সরে যেতে থাকে। সে অবস্থাতে কোন্ জিনিস তার এবং তার এ হতাশাব্যঞ্জক অবস্থার মধ্যে এবং মালিক ও বান্দার মধ্যে বিরাজমান দূরত্বের অবসান ঘটাতে পারে? সে উপায়টিই হচ্ছে তাওবা। একমাত্র তাওবা বা অপরাধ স্বীকার করে অনুতপ্ত হওয়া ও সকল প্রকার অন্যায় কাজ থেকে প্রত্যাবর্তন করাই এই দূরত্ব কমানাের একমাত্র উপায়। অন্যায় থেকে প্রত্যাবর্তনকারীদের জন্যে ক্ষমাপ্রাপ্তির দরজা সদা সর্বদাই অবারিত রয়েছে এবং তাওবাকারীর আবেদন ফিরিয়ে দেয়ার মতাে কোনাে দারােয়ান সেখানে নেই। প্রয়ােজন নেই সে দরজা দিয়ে প্রবেশ করার জন্যে কোনাে অনুমতির। এরশাদ হচ্ছে, ‘আর ফিরে এসাে… এবং তােমাদের অজান্তেই হঠাৎ করে আযাব এসে যাবে’(আয়াত ৫৪-৫৫) *এবাদাতের সঠিক তাৎপর্য : অন্যায় কাজ করার পর আল্লাহর দিকে রুজু করা, তার কাছে আত্মসমর্পণ করা, আনুগত্যভরা মন নিয়ে আল্লাহর নির্দেশ পালন করা এবং তার দিকে প্রত্যাবর্তন করা, এগুলােই হচ্ছে আসল এবাদাত। কোনাে প্রকার ধর্মীয় অনুষ্ঠান বা আনুষ্ঠানিক কোনাে বিশেষ কাজ বা প্রথা, কোনাে মাধ্যম বা মধ্যস্থতা আল্লাহর প্রিয় হওয়ার জন্যে আসল জিনিস নয়। অর্থাৎ যাই-ই করা হােক না কেন, যদি আনুগত্যভরা মন নিয়ে মালিকের দিকে এগিয়ে যাওয়ার মনােভাব না থাকে বা অন্যায় করার পর অনুতাপ না হয়, তাহলে শুধু বিভিন্ন প্রকার অনুষ্ঠান দ্বারা তার সন্তুষ্টি পাওয়া সম্ভব নয়। যদি আনুগত্যবােধক কার্যাবলী না থাকে তাহলে কারাে কোনাে সুপারিশ বা মধ্যস্থতা দ্বারাও নাজাত পাওয়া সম্ভব হবে না, আর প্রকৃতপক্ষে যে নিজে তাওবা না করবে তার জন্যে কেউই সুপারিশ করতে পারবে না। মনিব ও তার গােলামের মাঝে সম্পর্ক সরাসরি, কারাে মাধ্যমে নয়, স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যেও সেই সম্পর্ক কারাে মাধ্যমে নয়। অতএব সৃষ্টিকর্তার দরবার থেকে পলায়নপর ব্যক্তি যদি ফিরে আসতে চায়, সে অবস্থায় তাকে কারাে মাধ্যমে আসা লাগে না বা সেখানে কারাে সুপারিশেরও দরকার করে না। ভুল পথ পরিহার করে যে সঠিক পথে ফিরে আসতে চায় তাকে বলা হচ্ছে, সে যেন নির্ধিধায় নিরুদ্বিগ্ন চিত্তে ফিরে আসে। এমনই অনুতাপ-দগ্ধ হৃদয়ের জন্যে মহাদয়াময় আল্লাহর তাওবার দরজা চির উন্মুক্ত। নাফরমানী করে কেউ যদি দোষ স্বীকার করে মহান রাব্বুল ইযযতের কাছে আত্মসমর্পণ করে, সে যেন নিশংক চিত্তে, নির্ভয়ে পরম করুণাময় পরওয়ারদেগারের কাছে নিজেকে সমর্পণ করে দেয়। তার জন্যে রয়েছে তাওবার দরজার ওপারে রহমানুর রহীমের মেহেরবানী ঘেরা সুসজ্জিত জান্নাত, যার স্নিগ্ধ কোমল স্পর্শ ধীরে ধীরে তার মর্মজ্বালা নির্বাপিত করে তাকে মাবুদের প্রিয়পাত্রে পরিণত করবে- এই হচ্ছে তওবার মাহাত্ম্য। তাওবা করার পর বান্দার মাবুদের কাছে পৌঁছে যাওয়ার পথে কোনাে বাধা নেই, নেই কোনাে প্রতিবন্ধকতা এবং নেই তাকে ঠেকানাের মতাে কেউ! অতএব পরম করুণাময় আল্লাহর তরফ থেকে তার পথভ্রষ্ট বান্দার প্রতি জানানাে হচ্ছে উদাত্ত আহবান। ফিরে এসাে, ফিরে এসাে, হে আমার পথহারা দিশাহারা বান্দারা, সময় থাকতেই তােমরা ফিরে এসাে, সময় শেষ হওয়ার পূর্বেই তােমরা অসীম করুণার মালিকের দরবারে ধর্না দাও, ফিরে এসাে কঠিন আযাব নেমে আসার আগেই। কেননা একবার সে আযাব এসে গেলে কিছুতেই আর তোমাদের সাহায্য করা হবে না। এরপর কোনাে সাহায্যকারী থাকবে না। অতএব ফিরে এসাে সময় শেষ হয়ে যাওয়ার পূর্বেই, কারণ সময় বড়ই বিপদসংকুল, বড়ই বিশ্বাসঘাতক, সময় কোনাে নিরাপত্তার ওয়াদা দেয় না। কাজেই সময়ান্তে এটা করব ওটা করবাে, সময় পার হওয়ার সাথে সাথে পাপের চিহ্ন ধীরে ধীরে জ্ঞান হয়ে যাবে, সময়ই সর্বশ্রেষ্ঠ নিরাময় প্রদানকারী- এ সব দার্শনিক চিন্তা সবই ভুল প্রমাণিত হবে, বরং ‘সময়ের এক ফোড় অসময়ের দশ ফোড়’ থেকে উত্তম- এই বুঝ নিয়ে কাজ করাে। কখন যে সময় শেষ হয়ে যাবে এবং কখন যে তাওবার দরজা বন্ধ হয়ে যাবে তা কেউই বলতে পারে না। রাত দিনের যে কোনাে মুহূর্তে চূড়ান্ত ফয়সালা এসে যেতে পারে এবং তাওবার দরজা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যেতে পারে, একথা মনে রেখে সময় থাকতেই নিজেকে শুধরে নাও এবং আল্লাহর কাছ থেকে তাঁর রহমতের বারিধারা গ্রহণ করে নিয়ে ধন্য হও। এসাে, এসাে হে ভ্রান্ত মানব, ‘অতি সুন্দর যে হেদায়াত নাযিল হয়েছে তােমাদের রব আল্লাহর কাছ থেকে তার অনুসরণ করে। আর সে হেদায়াতই তাে হচ্ছে আল কোরআন, যা তােমাদের সামনেই রয়েছে। সে হেদায়াতের পথ গ্রহণ করাে হঠাৎ করে আযাব এসে যাওয়ার পূর্বেই, যখন তােমরা বুঝতেও পারবে না।’ এসাে, পথহারা আমার সৃষ্টির সেরা হে মানুষ, সুযােগ ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই ভুল পথ থেকে ফিরে এসাে। আল্লাহর অধিকার ধ্বংস করার দুঃসাহসে লিপ্ত হয়াে না। আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের ওয়াদার সাথে বিদ্রুপ করাে না। এরশাদ হচ্ছে, ‘কেউ যেন বলতে না পারে, আল্লাহ সম্পর্কে যে আমি বাড়াবাড়ি করেছি তার জন্যে আফসােস। ‘আর অবশ্যই আমি ঠাট্টা মঙ্কারি করনেওয়ালা লােকদের দলভুক্ত ছিলাম।’ অর্থাৎ, এমন কথা কেউ বলতে না পারে, আল্লাহ তায়ালা আমার ভাগ্যে পথভ্রষ্ট হয়ে যাওয়ার কথাই লিখে দিয়েছিলেন। তিনি যদি আমার হেদায়াত যদি লিখে দিতেন তাহলে আজকে আমি গােমরাহ হতাম না এবং তাকওয়া পরহেযগারী অবলম্বন করে চলতে পারতাম। তাই কালামে পাকে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ তায়ালা যদি আমাকে হেদায়াত করতেন তাহলে আমি মােত্তাকীদের মধ্যে গণ্য হয়ে যেতাম।’ এ হবে শুধু এক সাস্তনা, এর ভিত্তি কিছুই থাকবে না। এটা শুধু এক সুন্দর ধারণা হয়েই রয়ে যাবে, বাস্তবে এর থেকে কোনাে ফায়দাই পাওয়া যাবে না। হেদায়াতের উপায় পদ্ধতি আজ সব সময় উপস্থিত আছে এবং তওবার দরজা আজও উন্মুক্ত রয়েছে। আর কেউ এমন কথাও যেন সেদিন বলতে না পারে, যদি আমি কোনাে সুযােগ পেতাম তাহলে অবশ্যই ভাল লােকদের মধ্যে গণ্য হয়ে যেতাম। এটা হবে নিছক একটা আকাংখা বা আক্ষেপ, কিন্তু সেদিন এরও বাস্তব কিছু থাকবে না। কারণ এ জীবন শেষ হয়ে যাওয়ার পর পুনরায় আর যে এ জীবনে ফিরে আসা সম্ভব নয়। তােমাদের এটা জানা দরকার যে, তােমাদের এ জাগতিক জীবনই আসল কাজের জায়গা। এখানেই ভালাে বা মন্দ যে কোনাে কাজ করার সুযােগ রয়েছে, এ জীবন শেষ হয়ে গেলে আর এখানে ফিরে আসা সম্ভব নয়। শীঘ্রই ধমকের সাথে এবং অপমানিত করতে গিয়ে সেদিন তােমাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। এরশাদ হচ্ছে, ‘অবশ্যই তােমাদের কাছে আমার আয়াতসমূহ এসেছে, কিন্তু নবীকে মিথ্যা বলে সেসব আয়াত তােমরা প্রত্যাখ্যান করেছে এবং এর ফলশ্রুতিতে তােমরা কাফের হয়ে গেছো।’
# আলােচনার ধারা এগিয়ে চলেছে, আয়াতগুলাে অন্তরের গভীরে এবং চেতনাশীল লােকদের হৃদয়তন্ত্রীতে ধীরে ধীরে আখেরাত সম্পর্কে সাড়া জাগাতে শুরু করেছে…। এরপর আসছে পাশাপাশি আযাবে নিপতিত অপরাধী মানুষের এবং মােত্তাকী-পরহেযগার লােকদের পুরস্কৃত হওয়ার দৃশ্য। এরশাদ হচ্ছে, ‘আর যারা আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে মিথ্যা কথা বলেছে, দেখবে কেয়ামতের দিন তাদের মুখ কালাে হয়ে গেছে। …….. আর তারা দুঃখিত হবে না’(আয়াত ৬০-৬১) এটাই হচ্ছে শেষ প্রত্যাবর্তনস্থল। এখানে অপমানের গ্লানিতে, জাহান্নামের আগুনের তাপে তাদের গােটা অস্তিত্ব ঝলসে যেতে থাকবে, এরাই ছিলাে পৃথিবীতে অহংকারীদের দল এদের আল্লাহর দিকে ডাকা হয়েছে, নানা প্রকার অপরাধজনক কাজ করতে থাকাবস্থায় তাদের সংশােধনের জন্যে বার বার আহ্বান জানানাে সত্ত্বেও তারা আহ্বানকারীদের ডাকে কোনাে সাড়া দেয়নি, যার কারণে সে কঠিন দিনে তাদের হীন অবস্থায় সেখানে নেয়া হবে এবং তাদের মুখমন্ডল কলুষ কালিমায় ছেয়ে থাকবে। তাদের পাশেই থাকবে আর একদল লােক, যারা সে কঠিন অবস্থা থেকে মুক্ত থাকবে এবং কোনাে দুঃখ বেদনায় তারা জর্জরিত থাকবে না, এরা হবে সব আল্লাহভীরু মানুষ, তারা আখেরাতের ভয় অন্তরে নিয়েই দুনিয়ায় জীবন যাপন করেছে এবং সদা সর্বদা তারা আল্লাহর রহমতের প্রত্যাশী থেকেছে। এ দলের লােকেরাই আজ নাজাত লাভ করবে, সাফল্য পাবে। ফলে তাদের কোনাে দুঃখ কষ্ট এবং কোনাে শাস্তি স্পর্শ করবে না । এ পবিত্র গ্রন্থ নাযিল হওয়ার পর মানুষের কর্তব্য হচ্ছে আল্লাহর দূতের আহ্বান সাড়া দেয়া, যিনি আল্লাহর রহমতের দিকেই আহ্বান জানাচ্ছেন, যিনি ডাকছেন সেই নির্মল ছায়াদার বাগিচার দিকে, যার দরজা প্রকৃত নেককার ব্যক্তিদের জন্যে চির উন্মুক্ত। আর যার খুশী সে অন্যায় অপকর্মে মজে থাকুক, অবশেষে তার মন্দ পরিণাম ভােগ করার জন্যে প্রস্তুত হয়ে যাক, এটা এমনভাবে এসে যাবে যে তারা বুঝতেই পারবে না। এরশাদ হচ্ছে, ‘আল্লাহ তায়ালাই সব কিছুর সৃষ্টিকর্তা… সকল কৃতিত্ব ও প্রশংসা আল্লাহর জন্যে যিনি সারা জগতের মালিক।’
# ওপরে বর্ণিত আয়াতগুলাে হচ্ছে সূরাটির শেষ অংশ, যা তওহীদের তাৎপর্য পেশ করছে। এর মধ্যে বলা হয়েছে সৃষ্টিকর্তা এক আল্লাহ তায়ালাই, তিনিই সকল কিছু সৃষ্টি করেছেন। তিনি সব কিছুর একচ্ছত্র মালিক। অতপর আল্লাহর নবীর প্রতি মােশরেকদের দাবী কি ছিলাে তাও এ আয়াতে পেশ করা হয়েছে। আল্লাহর এবাদাতের পরিবর্তে তাদের কল্পিত মাবুদদের তার সাথে শরীক করার জন্যে তারা নবী(স.)-এর প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে। এই হচ্ছে তাদের আজব আহ্বান। অথচ এটা স্পষ্টভাবে সবাই বুঝছে যে, আল্লাহ তায়ালাই সকল কিছুর সৃষ্টিকর্তা এবং আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সব কিছুর ওপর একমাত্র তারই কর্তৃত্ব চলছে। এমতাবস্থায় তার সাথে অন্য কাউকে কিভাবে নিরংকুশ আনুগত্য দেয়া যায়? এটাও সবাই খেয়াল করলে বুঝতে পারে যে, একমাত্র তাঁরই হাতে রয়েছে আসমান যমীনের চাবিকাঠি। ওদের অদ্ভূত এসব আচরণের প্রেক্ষাপটে এরশাদ হচ্ছে, ‘ওরা আল্লাহর মর্যাদা সঠিকভাবে বুঝেনি বিধায় তাকে সেইভাবে মর্যাদাও দেয়নি। তিনিই একমাত্র মাবুদ, অর্থাৎ সর্বব্যাপী তার ক্ষমতা বিরাজমান বিধায় নিঃশর্ত ও নিরবঙ্ছিন্ন আনুগত্য বলে তিনি চালু করার ক্ষমতাও পুরােপুরি রাখেন। ‘আর কেয়ামতের দিন গােটা পৃথিবী তার মুঠোর মধ্যে থাকবে এবং আকাশ গুটানাে অবস্থায় তার ডান হাতে বিরাজ করবে…’ অর্থাৎ কেয়ামতের দিন যে মহাসত্য সংঘটিত হবে তারই অবিকল একটি চিত্র এখানে পেশ করা হয়েছে। পরিশেষে আর একটি ছবি এখানে তুলে ধরা হচ্ছে। ফেরেশতারা সারিবদ্ধভাবে আরশের চতুর্দিকে দাঁড়িয়ে তাদের রবের কৃতিত্ব বর্ণনার সাথে সাথে তার প্রশংসাগীতি গাইতে থাকবে এবং সকল সৃষ্টিই তার প্রশংসায় মুখর হয়ে থাকবে। আর বিশ্ব জগতের প্রতিপালকেরই সকল কৃতিত্ব ও প্রশংসা উচ্চারিত হতে থাকবে। তাওহীদের বর্ণনায় এভাবেই চূড়ান্ত কথা বলা হয়েছে। এরশাদ হচ্ছে, ‘আল্লাহ তায়ালা সকল কিছুর সৃষ্টিকর্তা… ওরাই, হাঁ, অবশ্যই ওরা ক্ষতিগ্রস্ত।’ *সৃষ্টিকুলের সব কিছু আল্লাহর অস্তিত্বের স্বীকৃতি দিচ্ছে : বিশ্ব জগতের যেখানে যা আছে, সজীব-নির্জীব সবকিছুই নানাভাবে নিশিদিন এ সত্য কথাটিই বলে চলেছে; সুতরাং, ‘কোনাে কিছু কেউ সৃষ্টি করেছে বলে কেউই কখনও দাবী করে না, বা কারাে দাবী করার ক্ষমতাও নেই। কোথাও কোনাে বুদ্ধিমান ব্যক্তি এমন নেই যে একথা মনে করতে পারে যে, সবাই নিজ ইচ্ছায় এবং নিজের বুদ্ধিতে কথা বলছে বা শব্দ করছে। তার কাজের মধ্যে কোনােটাই এমন নেই যা পরিত্যাজ্য হতে পারে, কারাে কাছে নিরুত্সাহব্যঞ্জক হতে পারে অথবা ছােট থেকে বড়র দিকে আপনা থেকে হয়ে গেছে মনে হতে পারে। তিনি সব কিছুর ব্যাপারেই দায়িত্ব গ্রহণকারী।’ অর্থাৎ আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সার্বিক পরিচালনা তিনিই আঞ্জাম দেন। তিনি যেভাবে ইচ্ছা সেভাবেই সব কিছু পরিচালনা করেন। তার দেয়া নিয়ম-শৃংখলার অধীনে সারা বিশ্বের সব কিছুই চলছে এবং তাঁর স্থিরীকৃত সিদ্ধান্তমতে সব কিছু সমাপ্ত হচ্ছে। কোথাও এমন কেউ নেই যে, তার সিদ্ধান্তের ওপর হস্তক্ষেপ করতে পারে বা তার সিদ্ধান্তের ওপর তর্ক-বিতর্ক বা দরকষাকষি করতে পারে। তার সকল কাজই মানুষের উপকারের জন্যে, অর্থাৎ যে প্রকৃতিতে তিনি বিশ্বজগতকে সৃষ্টি করেছেন, তার সাথে পূর্ণ সামঞ্জস্য রেখেই তিনি মানুষের জীবন বিধান দিয়েছেন। সুতরাং তার বিধান মানব প্রকৃতি বিরােধী কিছুতেই নয়। তার সকল সিদ্ধান্ত বাস্তব অবস্থার সাথে পূর্ণ সামঞ্জস্যশীল, মােটেই সাংঘর্ষিক নয়। তার যাবতীয় আইন কানুন মানুষের যুক্তি বুদ্ধিসংগত ও বিবেকের কাছে তা সমাদৃত। এরশাদ হচ্ছে, ‘আমার আয়াতগুলাের সাথে যারা কুফরী করেছে তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’ অর্থাৎ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তখন যখন তারা তাদের সেই চেতনা হারিয়ে ফেলেছে, যা সঠিক পথে সব কিছুর সাথে সামঞ্জস্য রেখে চলে। পরে যখন আল্লাহর হুকুমকে বাদ দিয়ে স্বাধীনভাবে চলার চেষ্টা করেছে তখন তারা ঈমানের মজা, ঈমানী যিন্দেগীর আরাম এবং তৃপ্তি হারিয়ে ফেলেছে। প্রকৃতপক্ষে এই স্বেচ্ছাচারিতার দরুন দুনিয়ার শাস্তি থেকেও তারা বঞ্চিত হয়েছে, তারা ঈমানের সৌন্দর্য হারিয়েছে। আখেরাতের জীবনে তারা এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে ওরাই হচ্ছে সেসব ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি যাদের ব্যাপারে আল খাসেরুন বা ‘ক্ষতিগ্ৰস্ত’ শব্দটি পুরােপুরিই খাপ খায়। আকাশে বাতাসে অন্তরীক্ষে সর্বত্র যে সত্য নিয়ত কথা বলে চলেছে এবং যার অস্তিত্বের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে সৃষ্টির প্রতি পত্রপল্লব ও সকল বস্তুনিচয়, তার সম্পর্কেই তাে রসূলুল্লাহ(স.) খবর দিচ্ছেন, কিন্তু বড়ই আশ্চর্যের বিষয়, সেই জাজ্জল্যমান সত্যকেই কাফের মােশরেকরা স্বীকার করতে রাযি নয়। তারই সাথে তারা অন্য আরও অনেককেই শরীক বানাচ্ছে এবং তার ক্ষমতায় আরও কেউ ভাগ বসানাের মতাে আছে বলে মনে করছে। শুধু তাই নয়, নিজেদের গােমরাহীর সাথে তারা চাইছে যে, স্বয়ং আল্লাহর রসূলও তাদের কাজে শরীক হয়ে যাক, এটা তাে বাজারে অনেকটা দর কষাকষি করে জিনিসপত্র কেনাকাটার মতাে। এর জওয়াবে বলতে বলা হচ্ছে, ‘হে জাহেলরা, আল্লাহ ছাড়া অন্য কারাে নিশর্ত ও নিরংকুশ আনুগত্য আমি করি- তােমরা কি এইটাই চাও?’ ওপরের আয়াতটিতে যে কথা বলা হয়েছে তার দ্বারা সে ব্যক্তির প্রতি ঘৃণা প্রদর্শন করা হয়েছে যে চরম বেওকুফের মতাে এমন বস্তুর সামনে মাথানত করতে বলে, যার নড়াচড়ার পর্যন্ত ক্ষমতা নেই এবং তারা সাহায্য চাইতে বলে তার কাছে, যার নিজেকে পর্যন্ত সাহায্য করার কোনাে শক্তি নেই। অর্থাৎ ওরা নিজেরা যেমন চরম নির্বুদ্ধিতা করছে, তেমনি ওরা চাইছে নবী মােহাম্মদ(স.)ও ওদের সাথে যােগ দিয়ে একই নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিক। এরপর তাদের শিরক থেকে বিরত থাকার জন্যে বলা হচ্ছে। শিরকের ক্ষতি থেকে বাঁচার জন্যে সতর্ক করা হচ্ছে। এ জন্যে সর্বপ্রথম নবী রসূলদের থেকে শুরু করে সর্বসাধারণ মানুষকে এই বদভ্যাস ত্যাগ করতে বলা হয়েছে। তারা তাে সেসব ব্যক্তি যাদের প্রতি রয়েছে আল্লাহর রহমত ও শাস্তি। তাদের মধ্যে কোনােদিন শিরেকের কোনাে আঁচড় পর্যন্ত লাগা সম্ভব নয়, কিন্তু এখানে তাদের লক্ষ্য করে যে হুঁশিয়ারি বাণী উচ্চারিত হয়েছে তা মূলত তাদের ভ্রান্ত জাতির জন্যে, যাতে করে তারা আল্লাহ সােবহানাহু ওয়া তায়ালার পরিপূর্ণ আনুগত্যের দিকে ফিরে আসে এবং মানুষকে সকল দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে একমাত্র তার সৃষ্টিকর্তার দিকে রুজু করতে শেখায়, শেখায় সেই পথে চলতে যে পথে নবী রসূলরা চলেছেন। এরশাদ হচ্ছে, ‘অবশ্যই ওহী পাঠানাে হয়েছে তােমার কাছে এবং তােমার পূর্ববর্তীদের কাছে।’ বলা হয়েছে, ‘যদি তুমি শিরক করাে তাহলে তােমার সকল নেক কাজ ধ্বংস হয়ে যাবে এবং তুমি ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে গণ্য হবে।’ শিরক থেকে সতর্ক থাকার নির্দেশের সাথে তাওহিদী বিশ্বাস গ্রহণ করার জন্যেও হুকুম দেয়া হচ্ছে। অর্থাৎ এবাদাত একমাত্র আল্লাহর করতে হবে, তাঁরই শোকরগুজারী করতে হবে, যেহেতু তিনি হেদায়াত করেছেন, নিশ্চিত বিশ্বাসের নেয়ামত দিয়েছেন এবং তাঁর বান্দাদের তার সর্বপ্রকার ঘিরে রেখেছে, যার সীমা সংখ্যা পরিমাপ করতে তারা অক্ষম বরং তার নেয়ামত সাগরে তারা ডুবে রয়েছে। এরশাদ হচ্ছে, বরং আল্লাহর এবাদাত করাে এবং শোকরগোজার বান্দাদের গণ্য হয়ে যাও।’ এরশাদ হচ্ছে, ‘আসলে ওরা আল্লাহকে যথাযথভাবে মর্যাদা দেয়নি। হাঁ, সত্যিই তারা আল্লাহকে সঠিকভাবে মর্যাদা দেয়নি। কারণ ওরা তার কোনাে কোনাে সৃষ্টিকে তাঁরই সমকক্ষ বানিয়েছে, এ জন্যে যে এবাদাত তারা করে তা সঠিক হয় না। ওরা তাঁর একত্ব ও বড়ত্ব অনুভব করতে পারে না, না তার মান সম্মান ও শক্তি অনুভব করে। এরপর আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তার বড়ত্ব ও শক্তির কিছু নিদর্শন ছবির মতাে তাদের সামনে তুলে ধরেছেন, তাঁর প্রেরিত আল কোরআনের মধ্যে বর্ণিত তার নিজস্ব এক পদ্ধতির মাধ্যমেই। তা মানুষের জন্যে সার্বিক সত্য তুলে ধরেছে। এইভাবে তাদের সীমাবদ্ধ অনুভূতি দিয়ে তাঁর সম্পর্কে কিছু কল্পনা করা যায়। যেমন, এরশাদ হয়েছে, ‘গােটা পৃথিবীটাই কেয়ামতের দিন তার হাতের মুঠোর মধ্যে থাকবে এবং তার ডান হাতে থাকবে আকাশমন্ডলী গুটানাে অবস্থায়। পবিত্র তিনি, আর তার সাথে যাদের ওরা শরীক করছে তাদের থেকে তিনি অতি মহান।’ কোরআন এবং হাদীসে এসব ছবি ও দৃশ্যাবলী বার বার বর্ণনা করা হয়েছে যে, এসব কিছু মানুষকে সে সকল বিষয় সম্পর্কে একটা মােটামুটি ধারণা দেয়, যা বুঝবার ক্ষমতা মানুষের আদৌ নেই। আসলে সেটা তাদের এর কিছু কিছু ব্যাখ্যা বুঝানাের একটা ক্ষুদ্র প্রয়াসমাত্র এবং এসবের দ্বারা সঠিক কোনাে বুঝ কখনাে সাধিত হয় না; বরং একটা কল্পনামাত্র তাতে করা যায়। যেসব রহস্য কোনাে আকৃতির মধ্যে আনা সম্ভব নয়, সেগুলােকে এমন কিছু চিত্রের মাধ্যমে বুঝানাের চেষ্টা করা হয়েছে যা মানুষ বুঝতে পারে। এ জন্যেই ওপরে বর্ণিত এই ছবির উল্লেখ বিশেষ কোনাে আকৃতির মধ্যে সীমাবদ্ধ করে দেয়া হচ্ছে না বা কোনাে সীমার মধ্যে আবদ্ধ করে দেয়া হচ্ছে না।
*কেয়ামতের একটি ভয়াবহ দৃশ্য : তারপর কেয়ামতের দৃশ্যাবলীর মধ্য থেকে একটি দৃশ্য এখানে তুলে ধরা হচ্ছে। এটা শুরু হচ্ছে শিংগার প্রথম কুঁক থেকে। জাহান্নামবাসীদের জাহান্নামের দিকে টেনে নিয়ে যাওয়া এবং জান্নাতবাসীদের জান্নাতে প্রবেশ করানাের সাথে এ বর্ণনা শেষ হচ্ছে। এ বিষয়ে পরিষ্কার করে জানানাে হচ্ছে যে, এ সব কাজ একমাত্র আল্লাহর ইচ্ছা এখতিয়ারে সম্পাদিত হবে। এ জন্যেই গােটা সৃষ্টি জগতের মধ্যে যা কিছু আছে সব কিছুর মনােযোগ তাঁর দিকেই ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে, যেন তারা সবাই বিভিন্ন কায়দায় তার প্রশংসা করে এবং তার পবিত্রতা ঘােষণা করে। এ হবে এক ভয়ানক দৃশ্য, কুলকিনারাহীন এক মহা জনসমুদ্র, যার শুরুতে সব কিছুকে গতিমান দেখা যাবে এবং শেষে নেমে আসবে কঠিন নিস্তব্ধতা। অর্থাৎ সকল কলরােল ধীরে ধীরে কমে আসতে আসতে নিচুপ হয়ে যাবে, সর্বশক্তিমান আল্লাহর সামনে নীরব-নিথর হয়ে যাবে সকল কাতর ধ্বনি, সুবিশাল সে প্রান্তরের সকল কলরব থেমে গিয়ে নেমে আসবে এক কঠিন নীরবতা, এমন ভয়ংকর স্তব্ধতা বিরাজ করতে থাকবে যা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। এটাই হবে শিংগায় প্রথম ফুকের সাথে কেয়ামতের প্রথম অবস্থা। এর ফলে পৃথিবীর ওপর অবস্থিত সকল জীবিত প্রাণী মুখ থুবড়ে পড়ে গিয়ে মৃত্যুবরণ করবে। অনুরূপভাবে আকাশমন্ডলীর যেখানে যা কিছু জীবিত আছে তাও সব খতম হয়ে যাবে। অবশ্য তাদের মধ্যে আল্লাহ তায়ালা কাউকে যিন্দা রাখতে চাইলে সে হবে স্বতন্ত্র কথা। আমরা জানি না সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর কতােদিন এই নীরবতা থাকবে। অবশেষে আবার আসবে এক সময় যখন দ্বিতীয় বারের শিংগায় ফুঁক দেয়া হবে। এরপর তৃতীয় কোনাে শিংগানির কথা আর বলা হয়নি যে, সবাইকে হাশরের মাঠে একত্রিত করার জন্যে আবার কখন ফুঁক দেয়া হবে। এ সময় হাশরের ময়দানে অসংখ্য মানুষের এত ঠাসাঠাসি অবস্থাতেও কোনাে শব্দ থাকবে না। কী জানি কেন? সম্ভবত অবস্থার ভয়াবহতায় নির্বাক, নীরব-নিথর হয়ে যাবে সবাই, কোনাে শোরগােল থাকবে না। এই অবস্থায় জনতার ভিড় নীরবে-নিঃশব্দে এগুতে থাকবে। এরশাদ হচ্ছে, ‘সমগ্র যমীন আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জতের আলােতে ঝলমল করতে থাকবে।’ এ হবে সেই উন্মুক্ত ময়দানের যমীন, যেখানে সমগ্র মানব সন্তানদের বিশ্ব জমায়েত অনুষ্ঠিত হবে এবং তাদের রবের নূরের (মিষ্টি মধুর সুরভিত ও স্নিগ্ধ আলাের) জ্যোতিতে সকল দিক উদ্ভাসিত হবে। এ বিশাল প্রান্তরে তাদের রবের নূর ছাড়া আর কোনাে আলােই খাকবে না। তাদের সামনে আমলনামা এগিয়ে দেয়া হবে, যার মধ্যে বান্দাদের যাবতীয় কার্যাবলী সংরক্ষিত থাকবে। এই সময়ে এগিয়ে নিয়ে আসা হবে নবী ও সাক্ষীদের যেন তারা তাদের জানা সত্য সঠিক কথাটি বলে দেন এবং সে মহান সত্তার পরিচালনায় সে দিনের অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জনগণকে আল্লাহর দিকে এগিয়ে দেন এবং তাদের যুক্তি প্রমাণ দ্বারা সে সমাবেশে বাজে তর্ক করার প্রবণতা থামিয়ে দেন। এরশাদ হচ্ছে, ‘চূড়ান্তভাবে আল্লাহ তায়ালা এদের ফয়সালা করে দিয়েছেন, অতপর তাদের প্রতি কোনাে যুলুম করা হবে না এবং প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার কাজের প্রতিদান দেয়া হবে আর তিনি ভালাে করেই জানেন যা তারা পার্থিব জীবনে করেছে।’ অতএব তারা কি বলৰে বা কোন যুক্তি পেশ করবে তা শােনার আর কোনাে প্রয়ােজন থাকবে না, না সেদিন কারাে কণ্ঠস্বর বেশী উঁচু হতে পারবে। এভাবেই হিসাব নিকাশ ও সওয়াল জওয়াব সব কিছু গুটিয়ে নেয়া হবে, যার বিবরণ অত্যন্ত ভীতিজনক। এরশাদ হচ্ছে, ‘এমন কি যখন সেখানে তারা পৌছে যাবে তখন সেই জাহান্নামের দরজা খুলে দেয়া হবে।’ তখন সেই জাহান্নামের প্রহরীরা তাদের সে স্থানের উপযুক্ত অধিবাসী জেনে এবং সেখানে পৌছানাের কারণ অবগত হয়ে তাদের অভ্যর্থনা জানাবে। ‘তারা তাদের বলবে, তােমাদের কাছে কি তােমাদের মধ্য থেকে রাসূল এসে তােমাদেরকে তােমাদের রব সম্পর্কে কোনাে কিছু পড়ে শোনাননি এবং আজকের এই দিনের সাথে সাক্ষাত হবে বলে কি তােমাদের সতর্ক করেননি। তারা বলবে অবশ্যই তারা বলেছেন, কিন্তু কাফেরদের জন্যে আযাবের ওয়াদা বাস্তবায়িত হওয়াটাই স্থির হয়ে গেছে।’ এ জায়গা হবে বিনয় নম্রতা প্রদর্শনের এবং নিজেকে সােপর্দ করার জন্যে নির্দিষ্ট ঝগড়া-ফাসাদ বা তর্ক-বিতর্ক করার কোনাে সুযােগ এখানে থাকবে না। তারা সবাই অপরাধ স্বীকার করে আত্মসমর্পণকারী হবে। বলা হবে, জাহান্নামের দরজাগুলো দিয়ে সেখানে চিরদিন থাকার জন্যে প্রবেশ কর, অতপর নিকৃষ্ট হবে অহংকারকারীদের সেই বাসস্থান।’ হাঁ, এরাই হবে জাহান্নামের যাত্রী, অহংকারী মানুষদের এটাই হবে শেষ ঠিকানা। জান্নাতের যাত্রীদের অবস্থা কেমন এবং মােত্তাকীদের ঠিকানা কোথায় হবে? সে মর্মে এরশাদ হচ্ছে, ‘যারা আল্লাহ তায়ালাকে ভয় করে চলেছে তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে দলে দলে জান্নাতের দিকে… (বলা হবে,) যাও চিরদিনের জন্যে ওখানে দাখিল হয়ে’(আয়াত ৭৩-৭৪) এ হবে বড় চমৎকার এক অভ্যর্থনা, তাদের কাছে ভালাে লাগে এমন সব সুমধুর ভাষায় তাদের অভিবাদন করা হবে। এ সব অভিবাদন অভ্যর্থনার কারণ জানাতে গিয়ে বলা হবে, তােমরা (জীবনে) ভালাে থেকেছে, অর্থাৎ জীবনকে কলুষমুক্ত রেখেছাে, তােমরা পাক পবিত্র থেকেছে এবং এখানে পবিত্র অবস্থায়ই এসেছো। সুতরাং এখানে ভালাে ও পাকসাফ জিনিস ছাড়া ততামাদের জন্যে আর কিছুই থাকবে না এবং এখানে পবিত্র মানুষ ছাড়া আর কেউ প্রবেশও করবে না। এটাই হবে নেয়ামতভরা চিরন্তন যিন্দেগী। এখানে জান্নাতবাসীদের কণ্ঠস্বর গুঞ্জরিত হতে থাকবে। আল্লাহ রব্বুল ইযযতের পবিত্রতা ও প্রশংসাগীতি উচ্চারণের সাথে সাথে তারা বলতে থাকবে ‘আলহামদু লিল্লাহ, সকল প্রশংসা আল্লাহর যিনি তার ওয়াদা সত্যে পরিণত করেছেন এবং আমাদের এই যমীনের উত্তরাধিকারী বানিয়েছেন। আহ্, আজ আমরা জান্নাতের এ সুষমাময় পরিবেশের যেখানে খুশী সেখানে বাস করবাে।’ হাঁ, এটাই সেই যমীন যা ওদের জন্যে হবে উপযােগী বাসস্থান, এ বাসস্থানের যেখানে তাদের মন চাইবে তারা অবস্থান করবে- ঘুরে বেড়াবে, যা কিছু তারা পেতে চাইবে সবই সেখানে পাবে। সুতরাং সকর্মশীল লােকদের জন্যে এই হবে চমৎকার প্রতিদান। তারপর সেই কঠিন দৃশ্যের বর্ণনা সমাপ্ত হচ্ছে যা মানুষের অন্তরকে ভয় ভীতিতে সন্ত্রস্ত করে দেয়, আল্লাহর সুমহান মর্যাদার অনুভূতিতে পরিবেশকে তার গাম্ভীর্যপূর্ণ পরশে ভরে দেয়, যা মনকে উদাস করে ফেলে। এভাবে তাওহীদের বর্ণনায় পরিপূর্ণ এ মর্মস্পর্শী সূরার যথােপযুক্ত ইতি টানা হয়েছে। এই দিনে গােটা সৃষ্টিজগত তার রবের প্রশংসাগীতিতে মুখর হয়ে ওঠবে, সবাই তাকে কেন্দ্র করে তার জয়গান গাইতে থাকবে, বিনয়াবনত ও নিবেদিত হয়ে ওঠবে সবার প্রাণ। প্রাণহীন বস্তু ও সকল প্রাণী আত্মনিবেদন করতে গিয়ে আল্লাহর কৃতিত্বের কথাই বার বার উচ্চারণ করতে থাকবে। ‘তােমরা সে সময়ে ফেরেশতাদের সারিবদ্ধভাবে দন্ডায়মান দেখবে, আল্লাহর আরশের চতুর্দিকে তারা তাদের মালিকের মাহাত্ম্য বর্ণনার সাথে সাথে তার সকল দুর্বলতা থেকে মুক্ত হওয়ার কথা ঘােষণা করতে থাকবে, আর সঠিকভাবে তাদের মধ্যে সেদিন সকল বিষয়ের ফয়সালা করে দেয়া হবে। সর্বদিকে একই ধ্বনি ওঠবে- ‘আলহামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামীন।’