أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#১০৮৭)
[*আল্লাহ চোখের চুরি ও মনের গোপন কথা পর্যন্ত জানেন:-]
www.motaher21.net
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন
পারা:২৪
১৮-২৭ নং আয়াত:-
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:১৮
وَ اَنۡذِرۡہُمۡ یَوۡمَ الۡاٰزِفَۃِ اِذِ الۡقُلُوۡبُ لَدَی الۡحَنَاجِرِ کٰظِمِیۡنَ ۬ؕ مَا لِلظّٰلِمِیۡنَ مِنۡ حَمِیۡمٍ وَّ لَا شَفِیۡعٍ یُّطَاعُ ﴿ؕ۱۸﴾
ওদেরকে আসন্ন দিন সম্পর্কে সতর্ক করে দাও, যখন দুঃখে-কষ্টে ওদের হৃদয় কণ্ঠাগত হবে। সীমালংঘনকারীদের জন্য অন্তরঙ্গ কোন বন্ধু নেই এবং এমন কোন সুপারিশকারীও নেই যার সুপারিশ গ্রাহ্য করা হবে।
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:১৯
یَعۡلَمُ خَآئِنَۃَ الۡاَعۡیُنِ وَ مَا تُخۡفِی الصُّدُوۡرُ ﴿۱۹﴾
*আল্লাহ চোখের চুরি ও মনের গোপন কথা পর্যন্ত জানেন।
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:২০
وَ اللّٰہُ یَقۡضِیۡ بِالۡحَقِّ ؕ وَ الَّذِیۡنَ یَدۡعُوۡنَ مِنۡ دُوۡنِہٖ لَا یَقۡضُوۡنَ بِشَیۡءٍ ؕ اِنَّ اللّٰہَ ہُوَ السَّمِیۡعُ الۡبَصِیۡرُ ﴿٪۲۰﴾
আল্লাহ সঠিকভাবে ফায়সালা করেন, আল্লাহর পরিবর্তে ওরা যাদেরকে আহবান করে, তারা কিছুরই ফায়সালা করে না। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:২১
اَوَ لَمۡ یَسِیۡرُوۡا فِی الۡاَرۡضِ فَیَنۡظُرُوۡا کَیۡفَ کَانَ عَاقِبَۃُ الَّذِیۡنَ کَانُوۡا مِنۡ قَبۡلِہِمۡ ؕ کَانُوۡا ہُمۡ اَشَدَّ مِنۡہُمۡ قُوَّۃً وَّ اٰثَارًا فِی الۡاَرۡضِ فَاَخَذَہُمُ اللّٰہُ بِذُنُوۡبِہِمۡ ؕ وَ مَا کَانَ لَہُمۡ مِّنَ اللّٰہِ مِنۡ وَّاقٍ ﴿۲۱﴾
এরা কি পৃথিবীতে ভ্রমণ করে না? করলে দেখত এদের পূর্ববর্তীদের পরিণাম কি হয়েছিল। পৃথিবীতে ওরা ছিল এদের অপেক্ষা শক্তিতে এবং কীর্তিতে অধিকতর প্রবল। অতঃপর আল্লাহ ওদের অপরাধের জন্য ওদেরকে শাস্তি দিয়েছিলেন এবং আল্লাহর শাস্তি হতে ওদেরকে রক্ষাকারী কেউ ছিল না।
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:২২
ذٰلِکَ بِاَنَّہُمۡ کَانَتۡ تَّاۡتِیۡہِمۡ رُسُلُہُمۡ بِالۡبَیِّنٰتِ فَکَفَرُوۡا فَاَخَذَہُمُ اللّٰہُ ؕ اِنَّہٗ قَوِیٌّ شَدِیۡدُ الۡعِقَابِ ﴿۲۲﴾
তাদের এহেন পরিণতির কারণ হলো তাদের কাছে তাদের রসূল স্পষ্ট নিদর্শনসমূহ নিয়ে এসেছিলো আর তারা তা মানতে অস্বীকার করেছিলো। অবশেষে আল্লাহ তাদের পাকড়াও করলেন। নিঃসন্দেহে তিনি অত্যন্ত শক্তিশালী এবং কঠোর শাস্তিদাতা।
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:২৩
وَ لَقَدۡ اَرۡسَلۡنَا مُوۡسٰی بِاٰیٰتِنَا وَ سُلۡطٰنٍ مُّبِیۡنٍ ﴿ۙ۲۳﴾
আমি আমার নিদর্শনাবলী ও স্পষ্ট প্রমাণ সহ মূসাকে প্রেরণ করেছিলাম,
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:২৪
اِلٰی فِرۡعَوۡنَ وَ ہَامٰنَ وَ قَارُوۡنَ فَقَالُوۡا سٰحِرٌ کَذَّابٌ ﴿۲۴﴾
ফেরাউন ও হামান এবং কারূণের কাছে। কিন্তু তারা বললো : জাদুকর, মিথ্যাবাদী
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:২৫
فَلَمَّا جَآءَہُمۡ بِالۡحَقِّ مِنۡ عِنۡدِنَا قَالُوا اقۡتُلُوۡۤا اَبۡنَآءَ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا مَعَہٗ وَ اسۡتَحۡیُوۡا نِسَآءَہُمۡ ؕ وَ مَا کَیۡدُ الۡکٰفِرِیۡنَ اِلَّا فِیۡ ضَلٰلٍ ﴿۲۵﴾
অতঃপর মূসা আমাদের নিকট থেকে সত্য নিয়ে তাদের কাছে উপস্থিত হলে তারা বলল, ‘মূসার সাথে যারা ঈমান এনেছে, তাদের পুত্ৰ সন্তানদেরকে হত্যা কর এবং তাদের নারীদেরকে জীবিত রাখ।’ আর কাফিরদের ষড়যন্ত্র কেবল ব্যর্থই হবে।
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:২৬
وَ قَالَ فِرۡعَوۡنُ ذَرُوۡنِیۡۤ اَقۡتُلۡ مُوۡسٰی وَ لۡیَدۡعُ رَبَّہٗ ۚ اِنِّیۡۤ اَخَافُ اَنۡ یُّبَدِّلَ دِیۡنَکُمۡ اَوۡ اَنۡ یُّظۡہِرَ فِی الۡاَرۡضِ الۡفَسَادَ ﴿۲۶﴾
একদিন ফেরাউন তার সভাসদদের বললোঃ আমাকে ছাড়ো, আমি এ মূসাকে হত্যা করবো। সে তার রবকে ডকে দেখুক। আমার আশঙ্কা হয়, সে তোমাদের দ্বীনকে পাল্টে দেবে কিংবা দেশে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে।”
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:২৭
وَ قَالَ مُوۡسٰۤی اِنِّیۡ عُذۡتُ بِرَبِّیۡ وَ رَبِّکُمۡ مِّنۡ کُلِّ مُتَکَبِّرٍ لَّا یُؤۡمِنُ بِیَوۡمِ الۡحِسَابِ ﴿٪۲۷﴾
মূসা বললেন, ‘আমি আমার রব ও তোমাদের রবের নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি এমন প্ৰত্যেক অহংকারী হতে যে বিচার দিনের উপর ঈমান রাখে না।’
তাফসীরে ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
*রসূলদের দায়িত্ব ও কর্তব্য : এরপর বলা হচ্ছে যে, ওহী নাযিল করার জন্যে যে বান্দাদেরকে মনােনীত করা হয়, তাদের। প্রধান দায়িত্ব ও কর্তব্য হলাে সতর্ক করা। যেন সে মহামিলনের দিন সম্পর্কে সতর্ক করে। এই দিন সমগ্র মানবজাতি একত্রিত হবে। পৃথিবীতে তারা যা কিছু করেছে, তাও প্রকাশিত হবে, মানুষ, জ্বিন, ফেরেশতা ও সমস্ত সৃষ্টি সেদিন একত্রিত হবে এবং মহান, আল্লাহর সামনে হিসাব দিতে জমায়েত হবে। বস্তুত তালাক শব্দের সব অর্থের আলােকেই এটা সম্মেলন ও সাক্ষাতের দিন। তাছাড়া এটা আত্মপ্রকাশেরও দিন। কোনাে পর্দা, ঢাকনা, বা গােপনীয়তা ছাড়াই এদিন সবাই আত্মপ্রকাশ করবে। ‘সেদিন তারা সবাই আত্মপ্রকাশ করবে। আল্লাহর কাছে কোনাে কিছুই গােপন থাকবে না।’ বস্তুত কোনাে সময়ে এবং কোনাে অবস্থাতেই কোনাে কিছু আল্লাহর চোখের আড়াল হয় না। এ দিন ছাড়া অন্যান্য দিন কেউ ভাবতে পারে যে, তাকে ও তার কাজ কর্মকে কউ দেখতে পায় না। কিন্তু কেয়ামতের দিন কেউ এ রকম ভাববে না। সবাই ভাববে যে, আজ আর কোনাে কিছু লুকানাের উপায় নেই। সবকিছুই প্রকাশিত। এমনকি চিন্তা ও কল্পনার পর্দাও সরে যাবে। সেদিন বড় বড় অহংকারীরাও নিজের ক্ষুদ্রত্ব উপলদ্ধি করবে এবং সবাই বিনয়ী বান্দা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করবে। সেদিন আল্লাহ তায়ালাই হবেন একমাত্র সর্বময় শাসক ও দন্ডমুন্ডের মালিক। তিনি সব সময়ই একক সর্বময় কর্তা। তবে কেয়ামতের দিন তার এই কর্তৃত্ব সবার চোখের সামনে স্বচ্ছ স্পষ্ট হয়ে ধরা দেবে। সকল নাস্তিক ও সকল বলদর্পী এটা বুঝবে। সবাই নীরব ও নিস্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে থাকবে। একটা গুরুগম্ভীর আওয়ায ধ্বনিত হবে যে, আজ রাজত্ব কার? একমাত্র পরাক্রমশালী এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহর। নিজেই প্রশ্ন করবেন আর নিজেই উত্তর দেবেন। কেননা সেদিন তিনি ছাড়া আর কোথাও কোনাে প্রশ্নকারী ও উত্তর দাতা থাকবে না। ‘আজ প্রত্যেক প্রাণীকে তার কৃতকর্মের ফল দেয়া হবে। আজ কোনাে অবিচার হবে না। নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা দ্রুত হিসাব গ্রহণকারী।’ অর্থাৎ আজ ন্যায্য কর্মফলের দিন। আজ সুবিচারের দিন। আজ চূড়ান্ত নিষ্পত্তির দিন। কাউকে কোনাে সময়ও দেয়া হবে না, কারাে বিচার বিলম্বিত করা হবে না। এক ভয়াল গুরুগম্ভীর পরিবেশ বিরাজ করবে। সকল সৃষ্টি বিনয়াবনত হয়ে শুনবে। এর ভেতর দিয়েই বিচারের কাজ সমাধা হয়ে যাবে এবং হিসাব নিকাশের দফতর বন্ধ করা হবে। ‘কেয়ামতের মাঠের এ পরিবেশটা সূরার শুরুতে আল্লাহর ওহী নিয়ে বিতর্ককারীদের সম্পর্কে উচ্চারিত, ‘সুতরাং দেশে তাদের বিচরণ যেন তােমাকে বিভ্রান্তিতে ফেলে না দেয়,’ এই উক্তিটার সাথে সংগতিপূর্ণ, কেননা কেয়ামতের ময়দানের এ পরিবেশ সমস্ত দর্পিত বিচরণ, দাম্ভিকতা, অহংকার ও ভােগবিলাসের সাধ মিটিয়ে দেবে। পরবর্তী আয়াতগুলােতেও রসূল(স.)-কে উক্ত কেয়ামতের দিন সম্পর্কে জনগণকে হুঁশিয়ার করে দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ দিনের একটা দৃশ্যে আল্লাহ তায়ালা নিজের নিরংকুশ প্রভুত্ব ও সর্বময় কর্তৃত্বের ঘােষণা দেয়া হয়েছে। অথচ ইতিপূর্বে কোনাে সম্বােধন না করেই নিছক বর্ণনার আকারে তা তুলে ধরা হয়েছে। (আয়াত ১৮-২০) ‘তুমি তাদেরকে কেয়ামত সম্পর্কে সাবধান করা…’ ‘আযিফা’ শব্দের অর্থ হচ্ছে আসন্ন ও নিকটবর্তী। এ দ্বারা কেয়মতের দিনকে বুঝানাে হয়েছে । আয়াতে যে শব্দ প্রয়ােগ করা হয়েছে, তাতে এমন একটা ছবি আঁকা হয়েছে, যার আগমন আসন্ন এবং যার আগমনের আতংকে সবার হৃৎপিন্ড কণ্ঠনালীতে উপনীত হবে। আতংকে সবার শ্বাস প্রশ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসবে। এই শ্বাস রুদ্ধকর অবস্থা তাদেরকে উৎকন্ঠিত করবে। তাদের বুককে ভারী করে তুলবে। এ অবস্থায় তাদের প্রতি স্নেহ ও সমবেদনা প্রকাশ করে এবং সুপারিশ করে এমন কোনাে লােক থাকবে না। অথচ সেদিন তারা সবাই হাযির হবে। আল্লাহর কাছে তাদের কিছুই গুপ্ত আকবে না। এমনকি বিশ্বাসঘাতকতাকারী চোখের চোরা চাহনি এবং মনের একান্ত গােপন কথাও আল্লাহর অজানা থাকে না। ‘তিনি চোখের চোরাচাহনি ও বুকের একান্ত গুপ্ত কথাও জানেন। বিশ্বাসঘাতক চোখ তার বিশ্বাসঘাতকতাকে লুকিয়ে রাখার জন্যে সর্বাত্মক চেষ্টা চালায়। তবে তা আল্লাহর দৃষ্টির আড়াল করতে পারে না। মানুষ তার অন্তরে অনেক কথা লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু আল্লাহর কাছে সবকিছুই উন্মুক্ত। একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই কেয়ামতের দিন সঠিক বিচার করবেন। মােশরেকদের কল্পিত উপাস্যদের তখন কিছুই করার ক্ষমতা থাকবে না, কোনাে শাসন ক্ষমতা ও বিচার ক্ষমতা থাকবে না। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালা ন্যায়বিচার করেন। আর যাদেরকে তারা আল্লাহর শরীক মনে করে ডাকে, তারা কোনাে ধরনের বিচারই করতে পারে না।’ আল্লাহ যে ন্যায়বিচার করেন, তা করেন নিজের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার কারণে এবং সূক্ষ্ম দৃষ্টি ও শ্রবণের ভিত্তিতে, তাই তিনি কারাে ওপর যুলুম করেন না এবং কোনাে কিছুই ভুলে যান না। ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা সর্বশ্রোতা ও সর্বস্রষ্টা।’
ইতিপূর্বে আমি সূরার এ অংশটার সংক্ষিপ্তসার দিয়েছি। এ অংশের বিস্তারিত তাফসীর আলােচনা করার আগে যে কথা বলা দরকার তা হলাে, এ অংশটা সূরার সার্বিক আলােচ্য বিষয়ের সাথে একান্ত সংগতিপূর্ণ। এমনকি এ অংশের ভাষা ও বাচনভংগীর সাথেও অনেকাংশে সূরার সার্বিক ভাষা ও বাচনভংগীর সাথে মিল রয়েছে। ফেরাউনের অনুসারীদের মধ্য থেকে যে ব্যক্তি নিজের ঈমান গােপন করে রেখেছিলাে, তার মুখ দিয়ে এমনসব বক্তব্য উচ্চারণ করানাে হয়েছে যা সূরার পূর্ববর্তী অংশেও ছিলাে। সে ফেরাউন ও তার অনুসারীদেরকে পূর্ববর্তী সম্প্রদায়সমূহের ওপর আগত দিনের ন্যায় বিপজ্জনক দিন আগমন সম্পর্কে সতর্ক করে। অনুরূপভাবে তাদেরকে কেয়ামত সম্পর্কেও সাবধান করে, যার কিছু কিছু দৃশ্য সূরার শুরুতে তুলে ধরা হয়েছে। যারা আল্লাহর আয়াতগুলাে নিয়ে তর্ক করে, তাদের সম্পর্কে এবং তাদের প্রতি আল্লাহর ও মােমেনদের ক্ষোভ ও অসন্তোষের বিষয় নিয়ে সে আলােচনা করে, যা সূরার প্রথম অংশে আলােচিত হয়েছে। এরপর তুলে ধরা হয়েছে দোযখে তাদের শােচনীয় অবমাননাকর আযাবের দৃশ্য। তখন তারা দোয়া করবে, অথচ সে দোয়া কবুল হবে না। সূরার পূর্ববর্তী অংশেও এ ধরনের দৃশ্য তুলে ধরা হয়েছে। এ ধরনের আরাে অনেক বক্তব্য এসেছে সূরার এ অংশে, যা দ্বারা বুঝা যায় যে, ঈমানভিত্তিক যুক্তি ও মােমেনদের যুক্তি এক ও অভিন্ন। কেননা একই সত্য উৎস থেকে তা উৎসারিত। এ বৈশিষ্ট্যটাই সমগ্র সূরাকে সমন্বিত করেছে এবং তাকে একটা একীভূত রূপ দান করেছে। কোরআনের সব কটা সূরাতেই এ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। *মূসা ও ফেরাউনের সংঘাত : ‘তারা কি পৃথিবীতে ভ্রমণ করে না…’(আয়াত ২১-২২) হযরত মূসার(আ.) কাহিনী ও তার আগে আলােচিত সূরার অংশটা আরবের মােশরেকদের মধ্যে যারা আল্লাহর ওহী নিয়ে তর্ক করতাে, তাদেরকে তাদের পূর্ববর্তীকালের ইতিহাস ও তা থেকে কী শিক্ষা পাওয়া যায় তা স্মরণ করে দিচ্ছে এবং তাদেরকে দেশ-বিদেশ সফর করে অতীত জাতিগুলাের ধ্বংসস্তুপ দেখে আসতে বলছে। কেননা আজ যারা ইসলামের দাওয়াত অস্বীকার করছে, তারা তাদেরই উত্তরসূরী। পূর্ববর্তীঁরা এই উত্তরসূরীদের চেয়েও অধিক শক্তিশালী ও প্রতাপশালী ছিলাে। তথাপি তারা আল্লাহর আযাবের সামনে ছিলাে দুর্বল ও অসহায়। তাদের পাপাচার তাদেরকে আসল শক্তির উৎস থেকে হটিয়ে দিয়েছিলাে তাদের ওপর ঈমানী শক্তিগুলাে মহান আল্লাহর প্রদত্ত ক্ষমতাবলে বিজয়ী হয়েছিলাে। আল্লাহ তায়ালা তাদের পাপাচারের দায়ে তাদেরকে পাকড়াও করেছিলেন। সুতরাং তিনি ছাড়া তাদেরকে রক্ষা করার সাধ্য কারাে ছিলাে । বস্তুত নিজের ঈমানদার ও সৎকর্মশীল হওয়া এবং ঈমানদার, সৎকর্মশীল ও সত্যনিষ্ঠদের দলভুক্ত হওয়া ছাড়া আর কোনাে কিছুই আল্লাহর আযাব থেকে রক্ষা করতে পারে না। পক্ষান্তরে রসূলদেরকে ও তাদের আনীত অকাট্য প্রমাণাদীকে প্রত্যাখ্যান করার পরিণতি ধ্বংস ছাড়া আর কিছুই নয়। এর কারণ এই যে, ‘তাদের রসূলরা যখনই অকাট্য প্রমাণাদি নিয়ে তাদের কাছে আসতাে, অমনি তারা তাদেরকে অস্বীকার করতাে। ফলে আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে পাকড়াও করলেন। নিশ্চয় তিনি কঠিন শাস্তিদাতা ও শক্তিশালী।’(আয়াত ২২) এই সার্বিক ও সংক্ষিপ্ত বিবরণের পর পূর্ববর্তীদের কিছু নমুনা তুলে ধরা হচ্ছে। তারা ছিলাে অধিকতর শক্তিশালী, প্রভাবশালী। তাই আল্লাহ তায়ালা তাদের পাপের দায়ে তাদেরকে পাকড়াও করলেন। এরা হচ্ছে ফেরাউন, কারূণ, হামান ও তাদের সহযােগী অন্যান্য স্বৈরাচারী ও একনায়ক। মূসা(আ.)-এর কাহিনীর এ অংশটা একাধিক পর্বে বিভক্ত। প্রথম পর্বটায় রয়েছে ফেরাউন ও তার দলবলের কাছে তার রেসালাত উপস্থাপন। এর শেষ পর্বটা হলাে আখেরাতের জাহান্নামে ফেরাউন ও তার অনুসারীদের ঝগড়া-বিবাদের দৃশ্য সম্বলিত। এটা এক দীর্ঘ সফর। তবে আয়াতগুলােতে এই দীর্ঘ সফরের কিছু কিছু বাছাই করা অংশ তুলে ধরা হয়েছে। আর এগুলাে দ্বারাই সূরার এ অংশটার উদ্দেশ্য স্পষ্ট হয়ে যায়। ‘আমি মূসাকে আমার নিদর্শনাবলী ও সুস্পষ্ট প্রমাণ সহকারে ফেরাউন হামান ও কারূণের কাছে পাঠিয়েছিলাম। তারা বলেছিলাে, মূসা একজন মিথুক যাদুকর।’ এ হচ্ছে প্রথম সাক্ষাতের পটভূমি। মূসা(আ.) ও তার সাথে আল্লাহর নিদর্শনাবলী, তার সাথে বিদ্যমান সত্যের প্রভাবে সৃষ্ট গাম্ভীর্যপূর্ণ ব্যক্তিত্ব আর ফেরাউন, কারুন, হামান এবং তাদের সাথে তাদের যা বাতিল শক্তি, তাদের দৃশ্যমান ক্ষমতা ও প্রতাপ, তাদের সেই ক্ষমতার কেন্দ্র, যা নিয়ে তারা শক্তিশালী সত্যের মােকাবেলা করতে ভয় পায়। একারণেই তারা সত্যকে পরাভূত করার জন্যে ভুয়া যুক্তির ভিত্তিতে তর্কে লিপ্ত হয়। তাই তারা বলে, মূসা মিথ্যুক যাদুকর। এই বিতর্কের পর কী ঘটেছিলাে, আয়াতে তার বিশদ বিবরণ দেয়া হয়নি। যাদুকরদের সাথে সংঘটিত প্রতিযােগিতা যাদুকরদের ঈমান আনয়ন এবং তাদের যাদুর পরাজয়ের কাহিনী এখানে উহ্য রাখা হয়েছে। আর এসব ঘটনার পরবর্তী ভূমিকাটা তুলে ধরা হয়েছে।(আয়াত ২৫) অতপর যখন মূসা আমার কাছ থেকে অকাট্য সত্য নিয়ে তাদের কাছে এলাে, তখন ফেরাউন ও তার সহযােগীরা আদেশ জারী করলাে যে, যারা মূসার ওপর ঈমান এনেছে, তাদের ছেলেদের হত্যা করো এবং তাদের মেয়েদেরকে বাঁচিয়ে রাখো। আগে এ বিষয়ে মন্তব্য করা হয়েছে, ‘কাফেরদের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হতে বাধ্য।’ অতপর আয়াত শেষ করার বস্তুত এ হচ্ছে চরম গােয়ার্তুমি বক্তব্য। যখনই বাতিল শক্তি অকাট্য যুক্তি প্রমাণের সামনে অসহায় হয়ে যায় ও হেরে যায় তখন এ ধরনের বক্তব্যের আশ্রয় নেয়। কেননা সত্য সুস্পষ্ট, স্বচ্ছ, নির্ভেজাল ও জোরালাে হওয়ার কারণে তা বিজয়ী হয়ে যাবে বলে তারা আশংকা করে। তারা ভয় পায় যে, মানুষের অকৃত্রিম স্বভাব প্রকৃতিকে আহ্বান জানানাের কারণে মানুষ এ আহবান গ্রহণ করতে পারে। যেমন যাদুকররা গ্রহণ করেছে। অথচ ফেরাউন তাদেরকে মূসার ওপর বিজয়ী হবার উদ্দেশ্যেই এনেছিলাে। কিন্তু ফেরাউনকে হতবাক করে দিয়ে যাদুকররা প্রথম ঈমান আনয়ন করলাে, ওদিকে ফেরাউন, কারুন হামান বলল, মূসার ওপর যারা ঈমান এনেছে, তাদের পুরুষদের হত্যা করাে আর মহিলাদের বাঁচিয়ে রাখাে। হযরত মূসার জন্মের প্রাক্কালে ফেরাউন এ ধরনের আদেশ জারী করেছিলাে। এই আদেশ জারী করার পর যা ঘটেছে, সে সম্পর্কে দু’রকমের সম্ভাবনা থাকতে পারে। প্রথমত, যে ফেরাউন। এ আদেশ জারী করেছিলাে, সে হয়তাে মারা গিয়েছিলাে এবং তার ছেলে তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলাে। কিন্তু নতুন শাসকের আমলে আদেশটা কার্যকরী হয়নি। এই অবস্থার ভেতরেই হযরত মূসা এসে নতুন ফেরাউনের সম্মুখীন হয়েছেন। এ ফেরাউন যুবরাজ থাকা অবস্থায়ই হযরত মূসাকে চিনতাে। তাকে যে রাজ প্রাসাদেই লালন-পালন করা হতাে, তাও যুবরাজ জানতাে। সে বনী ইসরাঈলের পুরুষ সন্তানদেরকে হত্যা করা ও মেয়ে সন্তাদেরকে সংরক্ষণ করার প্রথম আদেশের কথাও জানতাে। তাই তার সভাসদরা তাকে এই আদেশটার দিকেই ইংগিত করছিলাে এবং মূসার ওপর যারা ঈমান এনেছে, কেবল তাদের সন্তানদের মধ্যেই আদেশটাকে সীমাবদ্ধ রাখতে পরামর্শ দিলাে চাই তারা যাদুকর হােক, অথবা বনী ইসরাঈল হােক। যারা সংখ্যালঘু হয়েও ফেরাউন ও তার দলবলের ভয়ে চুপিসারে তার প্রতি ঈমান এনেছিলাে। আর দ্বিতীয় সম্ভাবনা এই যে, সে ছিলাে প্রথম ফেরাউন, যে মূসাকে নিজের পালিত পুত্র হিসাবে গ্রহণ করেছিলাে এবং সে এই সময়েও সিংহাসনে বহাল রয়েছে। হয়তাে তার এ আদেশটা কিছুদিন পর আর কার্যকর থাকেনি, অথবা তার তেজ কমে যাওয়ার পর তার বাস্তবায়ন বন্ধ হয়ে গিয়েছিলাে। সভাসদরা হয়তাে ওটাকে পুনরায় বলবত করার পরামর্শ দিচ্ছিলাে এবং শুধু মূসার ওপর ঈমান আনয়নকারীদেরকে এর আওতাধীন করেছিলাে, যাতে তারা ভয় পায়। ‘ওদিকে ফেরাউন ভিন্নমত পোষণ করছিলো বলে মনে হয়। আবার এও হতে পারে যে, সলাপরামর্শের সময় সে একটা অতিরিক্ত প্রস্তাব আকারে এটা পেশ করেছিলাে। সেটা ছিল, স্বয়ং মূসাকেই হত্যা করে পথের কাটা দূর করা। ‘আর ফেরাউন বললাে, তােমরা আমাকে ছেড়ে দাও, মূসাকে হত্যা করে ফেলি। সে তার প্রভুকে ডাকুক। আমার আশঙ্কা, সে তােমাদের গােটা বিধানকেই পরিবর্তন করে ফেলতে পারে, কিংবা দেশময় অরাজকতা ছড়িয়ে দিতে পারে।’ ফেরাউনের আমাকে ছেড়ে দাও, ‘আমি মূসাকে হত্যা করে ফেলি’ এই কথা থেকে বুঝা যায় যে, তার এই অভিমত কিছুটা বিরােধিতা ও বাধার সম্মুখীন হচ্ছিলাে অন্যান্য পরামর্শদাতার পক্ষ থেকে। উদাহরণস্বরূপ, মনে করা যেতে পারে যে, কেউ হয়তাে বলে থাকবে, মূসাকে হত্যা করলে সমস্যার সমাধান হবে না। এতে বরঞ্চ জনসাধারণের কাছে তার মর্যাদা বেড়ে যেতে পারে এবং তাকে শহীদ রূপে বিবেচনা করা হতে পারে। আর তার প্রতি ও তার আনীত ধর্মের প্রতি জনগণের আবেগ উদ্দীপনাও বেড়ে যেতে পারে। বিশেষত একটা প্রকাশ্য জনসমাবেশের ভেতরে যাদুকরদের ইসলাম গ্রহণ এবং ইসলাম গ্রহণের কারণ প্রকাশ করার পর পরিবেশটা খুবই স্পর্শকাতর হয়ে গেছে। অথচ এই যাদুকরদের আনাই হয়েছিলাে মূসা(আ.)-এর দাওয়াত ও আন্দোলন বাতিল সাব্যস্ত করার উদ্দেশ্যে। এমনও হতে পারে যে, ফেরাউনের কোনাে কোনাে উপদেষ্টা এই ভেবে শংকা বােধ করছিলাে যে, মূসাকে হত্যা করা হলে মূসার খােদা তার প্রতিশােধ নেবে এবং তাদের পাকড়াও করবে। এটাও অসম্ভব নয়। কারণ পৌত্তলিকেরা বহু উপাস্যে বিশ্বাস করতাে, তাদের পক্ষে এরূপ ধারণা করা খুবই সহজ যে, মূসার ওপর কেউ অত্যাচার করলে মূসার এমন কোনাে দেবতা বা খােদা থাকতে পারে যে তার প্রতিশােধ নেবে। হয়তাে এ ধরনের আশংকা কেউ ব্যক্ত করেছিলাে এবং তার জবাবেই ফেরাউন বলেছিলাে, ‘সে । তার প্রভুকে ডাকুক।’ এটাও অসম্ভব নয় যে, ফেরাউনের এই ঔদ্ধত্যপূর্ণ কথাটা নিছক ধৃষ্টতা ও স্পর্ধার প্রতীক। আর এর প্রতিফল সে শেষ মুহর্তে পেয়েছিলাে। কিছু পরেই এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যাবে। হযরত মূসাকে হত্যা করার সপক্ষে ফেরাউন যে যুক্তি দিয়েছিলাে, তা নিয়ে একটু ভেবে দেখা হয়তাে কৌতূহলােদ্দীপক হবে। সে বলেছিল, ‘আমি আশংকা করছি, সে তােমাদের গােটা জীবন ব্যবস্থাই পাল্টে ফেলবে, অথবা পৃথিবীতে নৈরাজ্য ছড়াবে।’ ‘বিপথগামী ও পৌত্তলিক ফেরাউন আল্লাহর রসূল হযরত মূসা সম্পর্কে দেশবাসীর ধর্ম জীবন ব্যবস্থা পাল্টে দেয়া ও দেশময় নৈরাজ্য ছড়ানাের অভিযােগ তুলবে, এর চেয়ে মজার ব্যাপার আর কী হতে পারে? পৃথিবীর প্রত্যেক ফ্যাসিবাদী ও অরাজকতা সৃষ্টিকারী একনায়ক এবং মানবরচিত জীবন ব্যবস্থার ধারক বাহকরা চিরকাল সত্যের আহ্বায়ক ও সংস্কারক সম্পর্কে ঠিক এ ধরনের কথাই বলে থাকে। নির্মল ও নিখুত সত্যের সামনে কুৎসিত ও কদাকার বাতিল ঠিক এ রকম কথাই বলে থাকে। নােংরা ধাপ্পাবাজ শক্তি প্রশান্ত ঈমানের সামনে অবিকল এ ধরনের কথাই বলার ধৃষ্ঠতা দেখিয়ে থাকে। হক ও বাতিলের মাঝে, ঈমান ও কুফরির মাঝে এবং সততা ও অসততার মাঝে যখনই সংঘাত বাধে, তখনই এই যুক্তির পুনরাবৃত্তি ঘটে থাকে, তা স্থান ও কালের যতাে ব্যবধানই থাকনা কেন। এ ব্যাপারটা আবহমানকাল থেকেই চলে আসছে এবং বারবার এর পুনরাবৃত্তি ঘটছে। ওদিকে মূসা(আ.) সবচেয়ে শক্তিশালী ও দুর্ভেদ্য দুর্গে আশ্রয় নিয়েছেন, যেখানে আশ্রয় গ্রহণকারীরা চিরদিনই নিরাপদ আশ্রয় লাভ করে থাকে। মুসা বলল, আমি আমার প্রভু ও তােমাদের প্রভুর কাছে এমন প্রত্যেক অহংকারীর কবল থেকে আশ্রয় চাই, যে হিসাবের দিনে বিশ্বাস করে না।’ হযরত মূসা এ কথাটা বলেই নিশ্চিন্ত হয়ে গেলেন, আর নিজের যাবতীয় বিষয় সেই আল্লাহর হাতে সােপর্দ করলেন। যিনি সকল অহংকারীর ওপর প্রতাপশালী যিনি সকল স্বৈরাচারকে দমন করেন এবং যিনি তার কাছে আশ্রয় প্রার্থনাকারীদেরকে রক্ষা করতে সক্ষম। এখানে হযরত মূসা আল্লাহকে তার ও তাদের প্রভু আখ্যায়িত করে সুকৌশলে আল্লাহর একত্বের ইংগিত দিলেন। হুমকি ও শাসানির এই ভয়াল পরিবেশেও সেটা ভােলেননি এবং ত্যাগ করেননি। অনুরূপভাবে তিনি অহংকারীর কেয়ামতে অবিশ্বাসের কথাও উল্লেখ করেছেন। কেননা কোনাে মানুষ যতক্ষণ কেয়ামতের দিনে বিশ্বাস করে, ততােক্ষণ সে অহংকারী হতে পারে না। কেননা সেদিন তার সম্ভাব্য বিপদ ও লাঞ্ছনার কথা এবং শক্তিহীনতা, ও বন্ধুহীনতার কথা ভেবে সে বিনয়ী না হয়ে পারে না।
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
১৮-২০ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নাবীকে আহবান করে বলেন, তুমি জনবসতিকে আসন্ন কিয়ামতের দিন সম্পর্কে সতর্ক করে দাও। সেদিন অবস্থা এমন হবে যে, দুঃখ-কষ্টে তাদের প্রাণ কণ্ঠাগত হয়ে পড়বে। সেদিন জালিমদের জন্য কোন অন্তরঙ্গ বন্ধু থাকবে না এবং থাকবে না কোন সাহায্যকারী ও সুপারিশকারী। সেদিনের অবস্থা হবে খুবই ভয়াবহ। সেদিন কেউ বিন্দু পরিমাণ অপরাধ করলেও তা থেকে সে রেহাই পাবে না।
الْاٰزِفَةِ শব্দের অর্থ অতি নিকটে, অতি সত্বর আগমনকারী। এটি কিয়ামতের একটি নাম। কেননা কিয়ামত অতি নিকটবর্তী। আল্লাহ তা‘আলার বাণী :
(أَزِفَتِ الْاٰزِفَةُ ج – لَيْسَ لَهَا مِنْ دُوْنِ اللّٰهِ كَاشِفَةٌ)
“কিয়ামত আসন্ন, আল্লাহ ছাড়া কেউই এটা ব্যক্ত করতে সক্ষম নয়।” (সূরা আন্ নাজ্ম ৫৩ : ৫৭-৫৮)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন :
(اِقْتَرَبَتِ السَّاعَةُ وَانْشَقَّ الْقَمَرُ)
“কিয়ামত নিকটবর্তী হয়েছে, চন্দ্র ফেটে গেছে।” (সূরা আল ক্বামার ৫৪ : ১)
(يَعْلَمُ خَا۬ئِنَةَ الْأَعْيُنِ)
‘চক্ষুর অপব্যবহার ও অন্তরে যা গোপন আছে সে সম্বন্ধে তিনি অবহিত।’ এখানে মহান আল্লাহর জ্ঞানের পরিপূর্ণতা বর্ণনা করা হচ্ছে। তিনি সকল বস্তুরই জ্ঞান রাখেন, তা ছোট হোক বা বড় হোক, সূক্ষ্ম হোক বা স্থূল, উচ্চমানের হোক কিংবা তুচ্ছ। যেহেতু আল্লাহ তা‘আলা জ্ঞানের দ্বারা সবকিছুকে পরিবেষ্টন করে আছেন, তখন মানুষের উচিত তাঁর অবাধ্যতা থেকে বিরত থাকা এবং নিজেদের অন্তরে প্রকৃতার্থে তাঁর ভয় সৃষ্টি করা। চোখের খিয়ানত না করা, আর চোখের খিয়ানত হলো আড়চোখে দেখা, কোন মন্দ জিনিস দেখা ও তা নিয়ে মনে কল্পনা করা।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. আল্লাহ তা‘আলার সকল বিষয়ের ওপর জ্ঞান রয়েছে এ সম্পর্কে জানতে পারলাম।
২. কিয়ামতের মাঠে কাফিরদের অবস্থা কেমন হবে তা জানতে পারলাম।
২১-২২ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
পূর্বোক্ত আয়াতসমূহে আখিরাতের অবস্থা বর্ণনা করার পর, এ আয়াতসমূহে দুনিয়াতে কাফিরদের যে মর্মান্তিক অবস্থা হয়েছিল তা বর্ণনা করে জনসাধারণকে সতর্ক করে দেয়া হচ্ছে যে, এরা একটু জমিনে ঘুরে-ফিরে সে জাতিসমূহের পরিণাম দেখুক, পূর্বে আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূলদের সাথে বেঈমানী করার ফলাফল কী হয়েছিল। এরাও সে পাপেই জড়িত। অথচ পূর্বের জাতিরা শক্তি ও সামর্থ্যে এদের থেকেও বেশি শক্তিশালী ছিল। যখন তারা তাদের শক্তি-সামর্থ্যরে বলে সত্যকে প্রত্যাখ্যান করল তখনই তাদের ওপর আল্লাহ তা‘আলার আযাব এসেছিল, আর তখন তাদেরকে আর কেউ রক্ষা করতে পারেনি। সুতরাং তোমরা যদি সতর্ক না হও তাহলে তোমাদের অবস্থাও এরূপই হবে।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. কুরআনে পূর্ববর্তী জাতিসমূহের ইতিহাস বর্ণনা করা হয়েছে তা থেকে আমাদের শিক্ষা গ্রহণ করার জন্য।
২. আল্লাহ তা‘আলার শাস্তির মোকাবেলা করার কেউ নেই ।
তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
১৮-২০ নং আয়াতের তাফসীর:
(আরবী) কিয়ামতের একটি নাম। কেননা, কিয়ামত খুবই নিকটবর্তী। যেমন মহান আল্লাহ বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “কিয়ামত আসন্ন। আল্লাহ ছাড়া কেউই এটা ব্যক্ত করতে সক্ষম নয়।”(৫৩:৫৭-৫৮) মহামহিমান্বিত আল্লাহ আর এক জায়গায় বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “কিয়ামত আসন্ন, চন্দ্র বিদীর্ণ হয়েছে।” (৫৪:১) মহান আল্লাহ আরো বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ মানুষের হিসাব নিকাশের সময় আসন্ন।”(২১:১) আর এক জায়গায় বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “আল্লাহর আদেশ আসবেই; সুতরাং এটা ত্বরান্বিত করতে চেয়ো না।” (১৬:১) অন্য এক জায়গায় বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “যখন তারা ওটাকে নিকটবর্তী দেখবে তখন কাফিরদের চেহারা কালো হয়ে যাবে।” (৬৭:২৭) মোটকথা, নিকটবর্তী হওয়ার কারণে কিয়ামতের নাম (আরবী) হয়েছে।
প্রবল প্রতাপান্বিত আল্লাহ বলেনঃ যখন দুঃখ-কষ্টে তাদের প্রাণ কণ্ঠাগত হবে। কাতাদা (রঃ) বলেন যে, ভয় ও সন্ত্রাসের কারণে তাদের কণ্ঠাগত প্রাণ হবে। সুতরাং তা বেরও হবে না এবং স্বস্থানে ফিরে যেতেও পারবে না। ইকরামা (রঃ) এবং সুদ্দীও (রঃ) একথাই বলেছেন। কারো মুখ দিয়ে কোন কথা সরবে না। সবাই থাকবে নীরব-নিস্তব্ধ। কার ক্ষমতা যে, মুখ খুলে! সবাই কাদতে থাকবে এবং হতবুদ্ধি অবস্থায় অবস্থান করবে। যারা আল্লাহর সঙ্গে শরীক স্থাপন করে নিজেদের উপর যুলুম করেছে তাদের সেই দিন কোন বন্ধু থাকবে না এবং তাদের দুঃখে কেউ সমবেদনা জানাবে না। তাদের জন্যে এমন কেউ সুপারিশকারী হবে না যার সুপারিশ কবূল করা হবে। সেই দিন মঙ্গল ও কল্যাণের উপায় উপকরণ সবই ছিন্ন হয়ে যাবে।
মহান আল্লাহর জ্ঞান সব কিছুকেই পরিবেষ্টন করে রয়েছে। ছোট-বড়, প্রকাশ্য-গোপনীয় এবং মোটা ও পাতলা সবই তার কাছে সমানভাবে প্রকাশমান। এমন ব্যাপক জ্ঞানের অধিকারী তিনি যে, তাঁর কাছে কোন কিছুই গোপন নেই। তাকে প্রত্যেকেরই ভয় করা উচিত এবং কারো এ ধারণা করা উচিত নয় যে, কোন এক সময় সে তার থেকে গোপন রয়েছে এবং তার অবস্থা সম্পর্কে তিনি অবহিত নন। বরং সদা-সর্বদা তার এ বিশ্বাস রাখা উচিত যে, তিনি তাকে দেখছেন। তাঁর জ্ঞান তাকে ঘিরে রয়েছে। সুতরাং সব সময় তাঁকে স্মরণ রাখা। উচিত এবং তার নিষিদ্ধ কাজ হতে বিরত থাকা একান্ত কর্তব্য।
মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ চক্ষুর অপব্যবহার এবং অন্তরে যা গোপন আছে সে সম্বন্ধে আল্লাহ অবহিত।
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, এই আয়াতে ঐ ব্যক্তি উদ্দেশ্য যে হয়তো কোন বাড়ীতে গেল যেখানে কোন সুন্দরী মহিলা রয়েছে, কিংবা সে হয়তো যাতায়াত করে থাকে। তখন ঐ লোকটি কোন আড়াল হতে ঐ মহিলাটির দিকে তাকায় যেখানে তাকে কেউ দেখতে পায় না। তার দিকে যখনই কারো দৃষ্টি পড়ে তখনই সে মহিলাটির দিক হতে চক্ষু ফিরিয়ে নেয়। আবার যখন সুযোগ পায় তখন পুনরায় তার দিকে তাকায়। তাই মহান আল্লাহ বলেন যে, বিশ্বাসঘাতক চক্ষুর বিশ্বাসঘাতকতা এবং অন্তরে যা গোপন আছে সে সম্বন্ধে তিনি অবহিত। অর্থাৎ তার অন্তরে হয়তো এটা রয়েছে যে, সম্ভব হলে সে মহিলাটির গুপ্তাঙ্গও দেখে নিবে। তার এই গোপন ইচ্ছাও আল্লাহ তাআলার অজানা নয়।
যহহাক (রঃ) বলেন যে, (আরবী)-এর অর্থ হলো চোখমারা, ইশারা করা এবং মানুষের বলাঃ “আমি দেখেছি।” অথচ সে দেখেনি এবং তার বলাঃ “আমি দেখিনি।” অথচ সে দেখেছে।
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, দৃষ্টি যে নিয়তে নিক্ষেপ করা হয় তা আল্লাহ তাআলার কাছে উজ্জ্বল ও প্রকাশমান। আর অন্তরের মধ্যে এই লুক্কায়িত খেয়াল যে, যদি সুযোগ পায় এবং ক্ষমতা থাকে তবে নির্লজ্জতাপূর্ণ কাজ হতে সে বিরত থাকবে কি থাকবে না এটাও তিনি জানেন। সুদ্দী (রঃ) বলেন যে, অন্তরের কুমন্ত্রণা সম্পর্কেও আল্লাহ পূর্ণ ওয়াকিফহাল।
আল্লাহ তা’আলা সঠিকভাবে ও ন্যায়ের সাথে বিচার করে থাকেন। পুণ্যের বিনিময়ে পুরস্কার এবং পাপের বিনিময়ে শাস্তি দানে তিনি সক্ষম। তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা। যেমন আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “যেন তিনি মন্দ লোকদেরকে তাদের কৃতকর্মের শাস্তি প্রদান করেন এবং সৎকর্মশীলদেরকে তাদের ভাল কাজের পুরস্কার প্রদান করেন।”(৫৩:৩১)
আল্লাহ তাআলা বলেনঃ আল্লাহর পরিবর্তে তারা যাদেরকে ডাকে, অর্থাৎ মূর্তি, প্রতিমা ইত্যাদি, তারা বিচার করতে অক্ষম। অর্থাৎ তারা কোন কিছুরই মালিক নয় এবং তাদের হুকুমত নেই, সুতরাং তারা বিচার ফায়সালা করবেই বা কি? আল্লাহ তাআলাই তাঁর সৃষ্টজীবের কথা শুনেন এবং তাদের অবস্থা দেখেন। যাকে ইচ্ছা তিনি পথ প্রদর্শন করেন এবং যাকে ইচ্ছা পথভ্রষ্ট করেন। এর মধ্যেও তার পুরোপুরি ন্যায় ও ইনসাফ বিদ্যমান রয়েছে।
২১-২২ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ হে নবী (সঃ)! তোমার রিসালাতকে অবিশ্বাসকারীরা কি এদিক ওদিক ভ্রমণ করে তাদের পূর্ববর্তী রাসূলদেরকে অবিশ্বাসকারী কাফিরদের অবস্থা অবলোকন করেনি? তারা তো এদের চেয়ে বেশী শক্তিশালী ছিল এবং কীর্তিতেও ছিল তারা এদের চেয়ে উন্নততর। তাদের ঘরবাড়ী এবং আকাশচুম্বী অট্টালিকার ভগ্নাবশেষ এখনো বিদ্যমান রয়েছে। এদের চেয়ে তারা বয়সও বেশী পেয়েছিল। যখন তাদের কুফরী ও পাপের কারণে তাদের উপর আল্লাহর আযাব আপতিত হলো তখন না কেউ তাদের হতে আযাব সরাতে পারলো, না কারো মধ্যে ঐ শাস্তির মুকাবিলা করার শক্তি পাওয়া গেল, না তাদের বাঁচবার কোন উপায় বের হলো। তাদের উপর আল্লাহর গযব অবতীর্ণ হওয়ার বড় কারণ এই ছিল যে, তাদের কাছেও তাদের রাসূলগণ স্পষ্ট দলীল ও উজ্জ্বল প্রমাণাদি নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু এতদসত্ত্বেও তারা তাদেরকে প্রত্যাখ্যান করে। ফলে, আল্লাহ তা’আলা তাদেরকে ধ্বংস করে দেন। অন্যান্য কাফিরদের জন্যে এটাকে শিক্ষা ও উপদেশ গ্রহণের উপকরণ বানিয়ে দেন। আল্লাহ তা’আলা পূর্ণ ক্ষমতাবান এবং শাস্তিদানে তিনি অত্যন্ত কঠোর। আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা আমাদেরকে এসব আযাব হতে পরিত্রাণ দান করুন!
২৩-২৭ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তাআলা হযরত মুহাম্মাদ (সঃ)-কে সান্ত্বনা দেয়ার জন্যে তাঁর পূর্ববর্তী রাসূলদের (আঃ) বর্ণনা দিচ্ছেন যে, পরিণামে যেমন তারাই জয়যুক্ত ও সফলকাম হয়েছিলেন, অনুরূপভাবে তিনিও তার সময়ের কাফিরদের উপর বিজয়ী হবেন। সুতরাং তাঁর চিন্তিত ও ভীত হওয়ার কোনই কারণ নেই। যেমন হযরত মূসা ইবনে ইমরান (আঃ)-এর ঘটনা তার সামনে রয়েছে। আল্লাহ তা’আলা তাঁকে দলীল প্রমাণাদিসহ কিবতীদের বাদশাহ ফিরাউনের নিকট, যে ছিল মিসরের সম্রাট, তার প্রধানমন্ত্রী হামানের নিকট এবং সেই যুগের সবচেয়ে ধনী এবং বণিকদের বাদশাহ নামে খ্যাত কারূনের নিকট প্রেরণ করেন। এই হতভাগারা এই মহান রাসূল (সঃ)-কে অবিশ্বাস করে এবং তাকে ঘৃণার, চোখে দেখে। তারা পরিষ্কারভাবে বলেঃ “এ ব্যক্তি যাদুকর এবং চরম মিথ্যাবাদী।” এই উত্তরই তাঁর পূর্ববর্তী নবীগণও পেয়েছিলেন। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “এরূপই তাদের পূর্ববর্তী লোকদের নিকট কোন রাসূল (আঃ) আসলেই তারা বলতোঃ এ ব্যক্তি যাদুকর অথবা পাগল। তারা কি তার সম্পর্কে পরস্পরে এটাই স্থির করে নিয়েছে? না, বরং তারা হলো উদ্ধত সম্প্রদায়।”(৫১:৫২-৫৩)
মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ আমার রাসূল মূসা (আঃ) যখন আমার নিকট হতে সত্য নিয়ে তাদের নিকট হাযির হলো তখন তারা তাকে দুঃখ-কষ্ট দিতে শুরু করলো। ফিরাউন হুকুম জারী করলোঃ “এই রাসূল (আঃ)-এর উপর যারা ঈমান এনেছে তাদের পুত্র সন্তানদেরকে হত্যা করে ফেলো এবং কন্যা সন্তানদেরকে জীবিত রাখো।” এর পূর্বেও সে এই নির্দেশ জারী করে রেখেছিল। কেননা, তার আশংকা ছিল যে, না জানি হয়তো হযরত মূসা (আঃ)-এর জন্ম হবে, অথবা হয়তো এ জন্যে যে, যেন বানী ইসরাঈলের সংখ্যা কমে যায়। ফলে যেন তারা দুর্বল ও শক্তিহীন হয়ে পড়ে। অথবা সম্ভবতঃ এ দু’টি যুক্তিই তার সামনে ছিল। এখন দ্বিতীয়বার সে এই হুকুম জারী করে। এর কারণও ছিল এটাই যে, যেন বানী ইসরাঈল দলটি বিজিত থাকে এবং তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি না পায়। আর তারা যেন লাঞ্ছিত অবস্থায় কালাতিপাত করে। আর বানী ইসরাঈলের মনে যেন এ ধারণা বদ্ধমূল হয় যে, তাদের এ বিপদের কারণ হলো হযরত মূসা (আঃ)। যেহেতু তারা হযরত মূসা (আঃ)-কে বলেও ছিলঃ “আপনি আসার পূর্বেও আমাদেরকে কষ্ট দেয়া হয়েছিল এবং আপনার আগমনের পরেও আমাদেরকে কষ্ট দেয়া হচ্ছে।” তিনি উত্তরে বলেছিলেনঃ “তাড়াতাড়ি করো না, খুব সম্ভব আল্লাহ তাআলা তোমাদের শত্রুদেরকে ধ্বংস করে দিবেন এবং তোমাদেরকে যমীনের প্রতিনিধি বানিয়ে দিবেন, অতঃপর তোমরা কেমন আমল কর তা তিনি দেখবেন।” কাতাদা (রঃ) বলেন যে, এটা ছিল ফিরাউনের দ্বিতীয়বারের হুকুম।
মহান আল্লাহ বলেনঃ ‘কাফিরদের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হবেই।’ অর্থাৎ ফিরাউন যে চক্রান্ত করেছিল যে, বানী ইসরাঈল ধ্বংস হয়ে যাবে তা সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছিল।
অতঃপর ফিরাউনের ঘৃণ্য ইচ্ছার বর্ণনা দেয়া হচ্ছে যে, সে হযরত মূসা (আঃ)-কে হত্যা করার ইচ্ছা করে এবং স্বীয় কওমকে বলেঃ “তোমরা আমাকে ছেড়ে দাও, আমি মূসা (আঃ)-কে হত্যা করে ফেলবো। সে তার প্রতিপালকের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করুক, আমি এর কোন পরোয়া করি না। আমি আশংকা করছি যে, যদি তাকে জীবিত ছেড়ে দেয়া হয় তবে সে তোমাদের দ্বীনের পরিবর্তন ঘটাবে অথবা সে পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে ।” এ জন্যেই আরবে নিম্নের প্রবাদ প্রসিদ্ধ হয়ে রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “ফিরাউনও উপদেশদাতা হয়ে গেল।” অনেকেই (আরবী)-এরূপ পড়েছেন। অন্যেরা (আরবী)-এরূপ পাঠ করেছেন। আর কেউ কেউ (আরবী) পড়েছেন।
হযরত মূসা (আঃ) যখন ফিরাউনের ঘৃণ্য উদ্দেশ্যের বিষয় জানতে পারলেন তখন তিনি বললেনঃ “যারা বিচার দিবসে বিশ্বাস করে না, ঐ সব উদ্ধত ও হঠকারী ব্যক্তি হতে আমি আমার ও (হে সম্বোধনকৃত ব্যক্তিরা) তোমাদের প্রতিপালকের শরণাপন্ন হয়েছি।”
এ জন্যেই হাদীসে এসেছেঃ হযরত আবু মূসা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) যখন কোন কওম হতে ভীত হতেন তখন বলতেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “হে আল্লাহ! আমরা তাদের (শত্রুদের) অনিষ্ট হতে আপনার নিকট আশ্রয় চাচ্ছি এবং আপনাকে তাদের মুকাবিলায় (দাঁড়) করছি।”
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
# কুরআন মজীদে মানুষকে বার বার এ উপলব্ধি দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে যে, কিয়ামত তাদের থেকে বেশী দূরে নয়, বরং তা অতি সন্নিকটবর্তী হয়ে পড়েছে এবং যে কোন মুহূর্তে সংঘটিত হতে পারে। কোথাও বলা হয়েছেঃ أَتَى أَمْرُ اللَّهِ فَلَا تَسْتَعْجِلُوهُ (আল নাহল ১) কোথাও বলা হয়েছে اقْتَرَبَ لِلنَّاسِ حِسَابُهُمْ وَهُمْ فِي غَفْلَةٍ مُعْرِضُونَ (আল আম্বিয়া ১) কোথাও সতর্ক করে দিয়ে বলা হয়েছে اقْتَرَبَتِ السَّاعَةُ وَانْشَقَّ الْقَمَرُ আল ক্বামার ১)। কোথাও বলা হয়েছেঃ أَزِفَتِ الْآزِفَةُ – لَيْسَ لَهَا مِنْ دُونِ اللَّهِ كَاشِفَةٌ (আন নাজম ৫৭)। এসব কথার উদ্দেশ্য মানুষকে এ মর্মে সাবধান করে দেয়া যে, তারা যেন কিয়ামতকে দূরের কোন জিনিস মনে করে শঙ্কাহীন না থাকে। সতর্ক ও সামলিয়ে চলার প্রয়োজন মনে করলে এক মুহূর্তও নষ্ট না করে যেন নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে।
# মূল আয়াতে حَمِيمٍ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এর অর্থ এমন বন্ধু যাকে প্রহৃত হতে দেখে নিজেও উত্তেজিত হয়ে উঠে এবং তাঁকে রক্ষার জন্য দ্রুত অগ্রসর হয়।
# কাফেরদের শাফায়াত সম্পর্কিত আকীদা-বিশ্বাসের প্রতিবাদ করে অবরোহমূলক ভাবে একথাটি বলা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে জালেমদের জন্য সেখানে আদৌ কোন শাফায়াতকারী থাকবে না। কারণ, শাফায়াতে অনুমতি লাভ করলে কেবল আল্লাহর নেক বান্দারাই করবে। আর আল্লাহর নেক বান্দারা কখনো কাফের, মুশরিক এবং ফাসেক ও পাপাচারীদের বন্ধু হতে পারে না যে, তারা তাদের বাঁচানোর জন্য শাফায়াত করে চিন্তা করবে। তবে যেহেতু কাফের, মুশরিক ও পথভ্রষ্ট লোকদের সাধারণ আকীদা-বিশ্বাস অতীতেও এই ছিল এবং বর্তমানেও আছে যে, আমরা যে বুযর্গদের অনুসরণ করে চলেছি তারা কখনো আমাদেরকে দোযখে যেতে দেবেন না। তারা বরং বাঁধা হয়ে সামনে দাঁড়াবেন এবং ক্ষমা করিয়েই ছাড়বেন। তাই বলা হয়েছে সেখানে এ রকম শাফায়াতকারী কেউ থাকবে না, যার কথা মেনে নেয়া হবে এবং আল্লাহকে যার সুপারিশ অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে।
# তিনি তোমাদের উপাস্যদের মত কোন অন্ধ ও বধির আল্লাহ নন যে, যে ব্যক্তির ব্যাপারে তিনি সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন তার কৃতকর্ম সম্পর্কে কিছু জানেন না।
# স্পষ্ট নিদর্শন বলতে তিনটি জিনিস বুঝানো হয়েছে। এক, এমন সুস্পষ্ট চিহ্ন ও নিদর্শন যা তাঁদের আল্লাহ তা’আলা কর্তৃক আদিষ্ট হওয়ার প্রমাণ। দুই, এমন সব উজ্জল প্রমাণ যা তাঁদের আনীত শিক্ষার সত্যতা প্রমাণ করছিলো। তিন, জীবনের বিভিন্ন বিষয় ও সমস্যা সম্পর্কে এমন সব সুস্পষ্ট দিক-নির্দেশনা যা দেখে যে কোন যুক্তিবাদী মানুষ বুঝতে পারতো যে, কোন স্বার্থপর মানুষ এরূপ পবিত্র শিক্ষা দিতে পারে না।
# এমন স্পষ্ট নিদর্শনসহ যা দেখে এ বিষয়ে আর কোন সন্দেহ থাকতো না যে, তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত আর তাঁর পক্ষে আছে বিশ্ব-জাহানের পালনকর্তা মহান আল্লাহর শক্তি। যে নিদর্শনগুলোকে এখানে আল্লাহর পক্ষ থেকে হযরত মূসার (আ) আদিষ্ট হওয়ার সুস্পষ্ট প্রমাণ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে সেগুলো কি কুরআন মজীদে হযরত মূসার (আ) কাহিনীর যে বিস্তারিত বিবরণ দেয়া হয়েছে সে দিকে গভীরভাবে লক্ষ্য করলে তা বুঝা যায়। প্রথমত, এটা একটা বিস্ময়কর ব্যাপার যে কয়েক বছর আগে যে ব্যক্তি ফেরাউনের কওমের এক ব্যক্তিকে হত্যা করে দেশ থেকে পালিয়ে গিয়েছিলো এবং যার বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা ছিল, সে একখানা লাঠি হাতে হঠাৎ সোজা ফেরাউনের ভরা দরবারে নির্ভীক ও নিশষ্কচিত্তে হাজির হচ্ছে এবং সাহসিকতার সাথে বাদশাহ ও তার সভাসদদের সম্বোধন করে আহবান জানাচ্ছেন যে, তারা যেন তাঁকে আল্লাহ রব্বুল আলামীনের প্রতিনিধি হিসেবে মেনে নেয় এবং তাঁর নির্দেশনা অনুসারে কাজ করে। কিন্তু তার গায়ে হাত তোলার সাহস কারো হচ্ছে না। অথচ মূসা (আ) যে কওমের লোক তার এমন নিদারুনভাবে গোলামীর যাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছিলো যে, হত্যার অভিযোগে যদি তৎক্ষণাৎ তাকে গ্রেফতার করা হতো তাহলে তার কওমের বিদ্রোহ করা তো দূরের কথা প্রতিবাদের জন্য মূখ খোলারও কোন আশংখা ছিল না। এ থেকে স্পষ্ট বুঝা যায়, লাঠি ও “ইয়াদে বায়দা”র (শ্বেত-শুভ্র হাত) মু’জিযা দেখারও পূর্বে ফেরাউন এবং তার সভাসদরা হযরত মূসার (আ) আগমনেই ভীত হয়ে পড়েছিলো। প্রথম দর্শনেই তারা উপলব্ধি করতে পেরেছিলো যে, এ ব্যক্তি অন্য কোন শক্তির ভরসায় এখানে এসেছে। অতঃপর তার হাতে একের পর এক বিস্ময়কর যেসব মু’জিযা সংঘটিত হলো তার প্রত্যেকটি এ বিশ্বাস দৃঢ়মূল করার জন্য যথেষ্ট ছিল যে, এটা জাদুশক্তি নয়, বরং খোদায়ী শক্তির বিস্ময়কর প্রকাশ। এমন কোন জাদু আছে যার জোরে লাঠি সত্যিকার আজদাহায় রূপান্তরিত হতে পারে? কিংবা গোটা একটা দেশে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি হতে পারে? কিংবা একটি নোটিশ দেয়ার সাথে সাথে লক্ষ লক্ষ বর্গ মাইল বিস্তৃত একটি এলাকায় নানা ধরনের ঝড় তুফান আসতে পারে এবং আরেকটি নোটিশে তা বন্ধ হয়ে যেতে পারে? কুরআন মজীদের বর্ণনা অনুসারে এ কারণে ফেরাউন ও তার দায়িত্বশীল লোকজন মুখে যত অস্বীকার করুক না কেন, মন তাদের পুরোপুরি উপলব্ধি করতে পেরেছিলো যে, হযরত মূসা (আ) সত্যিই আল্লাহর পক্ষ থেকে আদিষ্ট। (বিস্তারিত ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, আল আ’রাফ, টীকা ৮৬ থেকে ৮৯ ; ত্বা-হা, টীকা ২৯ থেকে ৫৩ ; আশ শু’আরা, টীকা ২২ থেকে ৪১ ; আন নামল, টীকা ১৬ )
# যখন হযরত মূসা (আ) একের পর এক মু’জিযা ও নিদর্শনসমূহ দেখিয়ে পুরোপুরি প্রমাণ করলেন যে, তিনি আল্লাহর প্রেরিত রসূল এবং মজবুত প্রমাণাদি দ্বারা তাঁর সত্য হওয়া সুস্পষ্ট করে দিলেন।
# পূর্বেই সূরা আ’রাফের ১২৭ আয়াতে একথা উল্লেখিত হয়েছে যে, ফেরাউনের দরবারের লোকজন তাকে বলেছিলো, মূসাকে এভাবে অবাধে তৎপরতা চালানোর অধিকার আর কতদিন দেয়া যাবে এবং তার জবাবে ফেরাউন বলেছিলো অচিরেই আমি বনী ইসরাঈলদের পুত্র সন্তানদের হত্যা করার এবং কন্যা সন্তানদের জীবিত রাখার নির্দেশ দিতে যাচ্ছি। (তাফহীমুল কুরআন, আল আ’রাফ, টীকা ৯৩)। এ আয়াতটি থেকে জানা যাচ্ছে যে, ফেরাউনের পক্ষ থেকে শেষ পর্যন্ত যে নির্দেশ জারী করা হয়েছে তার উদ্দেশ্য ছিল হযরত মূসা (আ) এবং তাঁর সহযোগী ও অনুসারীদের এতটা ভীত সন্ত্রস্ত করে দেয়া যে, তারা যেন ভয়ের চোটে তার পক্ষ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়।
# মূল আয়াতাংশ হচ্ছে وَمَا كَيْدُ الْكَافِرِينَ إِلَّا فِي ضَلَالٍ । এ আয়তাংশের আরেকটি অর্থ হতে পারে এই যে, ঐ কাফেরদের চক্রান্ত ছিল গোমরাহী, জুলুম-নির্যাতন এবং ন্যায় ও সত্যের বিরোধিতার খাতিরে। অর্থাৎ ন্যায় ও সত্য স্পষ্ট হয়ে যাওয়া এবং মনে মনে তার সমর্থক হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও নিজেদের জিদ ও হঠকারিতা বৃদ্ধিই পেয়েছে এবং সত্যকে হেয়প্রতিপন্ন করার জন্য তারা জঘন্য থেকে জঘন্যতম পন্থা অবলম্বন করতেও দ্বিধান্বিত হয়নি।
# এখান থেকে যে ঘটনার বর্ণনা শুরু হচ্ছে তা বনী ইসরাঈল জাতির ইতিহাসের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। অথচ বনী ইসরাঈল নিজেরাই তা বিস্মৃত হয়ে বসেছে। বাইবেল এবং তালমুদে এর কোন উল্লেখ নেই এবং অন্যান্য ইসরাঈলী বর্ণনায়ও তার কোন নাম গন্ধ পর্যন্ত দেখা যায় না। ফেরাউন এবং হযরত মূসার (আ) মধ্যকার সংঘাতের যুগে এক সময় এ ঘটনাটিও যে সংঘটিত হয়েছিলো বিশ্ববাসী কেবল কুরআন মজীদের মাধ্যমেই তা জানতে পেরেছে। ইসলাম ও কুরআরে বিরুদ্ধে শত্রুতায় অন্ধ হয়ে না থাকলে যে ব্যক্তিই এ কাহিনী পাঠ করবে সে একথা উপলব্ধি না করে পারবে না যে, ন্যায় ও সত্যের দিকে আহবানের দৃষ্টিকোণ থেকে এ কাহিনী অত্যন্ত মূল্যবান ও বিশেষ মর্যাদার দাবীদার। তাছাড়া হযরত মূসার (আ) ব্যক্তিত্ব, তাঁর তাবলীগ ও প্রচার এবং তাঁর মাধ্যমে প্রকাশ পাওয়া বিস্ময়কর মু’জিযাসমূহ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ফেরাউনের নিজের সভাসদদের মধ্য থেকে কারো সঙ্গোপনে ঈমান গ্রহণ করা এবং মূসাকে (আ) হত্যার ব্যাপারে ফেরাউনকে উদ্যোগী হতে দেখে আত্মসংবরণ করতে না পারা বুদ্ধি-বিবেক ও যুক্তি বিরোধীও নয়। কিন্তু পাশ্চাত্যের প্রাচ্যবিদরা জ্ঞান চর্চা ও গবেষণার লম্বা চওড়া দাবী সত্ত্বেও গোঁড়ামি ও সংকীর্ণতায় অন্ধ হয়ে কুরআনের সুস্পষ্ট সত্যসমূহের ধামাচাপা দেয়ার প্রচেষ্টা চালায়। ইনসাইক্লোপেডিয়া অব ইসলামের “মূসা” নামক প্রবন্ধের লেখক এ শিরোনামের প্রবন্ধে যা লিখেছেন তা থেকেই একথা বুঝা যায়। তিনি লিখছেনঃ “ফেরাউনের দরবারে একজন বিশ্বাসী মূসাকে রক্ষা করার চেষ্টা করছেন, কুরআনের বর্ণিত এ কাহিনী সুস্পষ্ট নয় ( সূরা ৪০, আয়াত ২৮ )। আমরা কি তাহলে হাগগাদায় বর্ণিত কাহিনীর বিষয়বস্তুর সাথে এ কাহিনীর তুলনা করবো যাতে ক্ষমা সুলভ দৃষ্টিতে কাজ করার জন্য ইয়েথরো ফেরাউনের দরবারে পরামর্শ দিয়েছিলো? ” জ্ঞান গবেষণার এসব দাবিদারদের কাছে এটা যেন স্বতঃসিদ্ধ যে, কুরআনের প্রতিটি বিষয়ে অবশ্যই খুঁত বের করতে হবে। কুরআনের কোন বক্তব্যের মধ্যে যদি কোন খুঁত বের করার সুযোগ না-ই পাওয়া যায় তাহলেও অন্তত এতটুকু যেন বলা যায় যে, এ কাহিনী পুরোপুরি স্পষ্ট নয়। এভাবে ধীরে ধীরে পাঠকদের মনে এ সন্দেহও সৃষ্টি করে দেয়ার চেষ্টা করা যে, ইয়েথরো কর্তৃক মূসার (আ) জন্ম পূর্ব যে কাহিনী হাগগাদায় বর্ণিত হয়েছে মুহাম্মাদ ﷺ হয়তো কোথাও থেকে তা শুনে থাকবেন এবং সেটাই এখানে এভাবে বর্ণনা করে থাকবেন। এটা হচ্ছে জ্ঞানচর্চা ও গবেষণার একটা বিশেষ ষ্টাইল যা এসব লোকেরা ইসলাম, কুরআন এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ব্যাপারে অবলম্বন করে চলেছে।
# একথার দ্বারা ফেরাউন এ ধারণা দেয়ার চেষ্টা করছে যেন কিছু লোক তাকে বিরত রেখেছে আর সেই কারণে সে মূসাকে (আ) হত্যা করছে না। তারা যদি বাঁধা না দিতো তাহলে বহু পূর্বেই সে তাঁকে হত্যা করে ফেলতো। অথচ প্রকৃতপক্ষে বাইরের কোন শক্তিই তাকে বাঁধা দিচ্ছিলো না। তার মনের ভীতিই তাকে আল্লাহর রসূলের গায়ে হাত তোলা থেকে বিরত রেখেছিলো।
# আমি তার পক্ষ থেকে বিপ্লবের আশঙ্কা করছি। আর সে যদি বিপ্লব করতে নাও পারে তাহলে এতটুকু বিপদাশঙ্কা অন্তত অবশ্যই আছে যে, তার কর্ম-তৎপরতার ফলে দেশে অবশ্যই বিপর্যয় দেখা দেবে। তাই সে মৃত্যুদণ্ড লাভের মত কোন অপরাধ না করলেও শুধু দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার (Maintenance of public order) খাতিরে তাকে হত্যা করা প্রয়োজন। সে ব্যক্তির ব্যক্তি সত্তা আইন শৃঙ্খলার জন্য সত্যিই বিপজ্জনক কিনা তা দেখার দরকার নেই। সেজন্য শুধু “হিজ ম্যাজেষ্টি”র সন্তুষ্টিই যথেষ্ট। মহামান্য সরকার যদি এ ব্যাপারে নিশ্চিত হন যে, এ লোকটি বিপজ্জনক তাহলে মেনে নিতে হবে, সে সত্যিই বিপজ্জনক এবং সেজন্য শিরোচ্ছেদের উপযুক্ত। এ স্থানে “দ্বীন পাল্টে দেয়া”র অর্থও ভালভাবে বুঝে নিন, যার আশঙ্কায় ফেরাউন হযরত মূসাকে (আ) হত্যা করতে চাচ্ছিলো। এখানে দ্বীন অর্থ শাসন ব্যবস্থা। তাই ফেরাউনের কথার অর্থ হলো انى اخاف ان يغير سلطانكم (روح المعانى ج 24 ص 56) । অন্য কথায়, ফেরাউন ও তার খান্দানের চূড়ান্ত ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের ভিত্তিতে ধর্ম, রাজনীতি, সভ্যতা ও অর্থনীতির যে ব্যবস্থা মিসরে চলছিলো তা ছিল তৎকালে ঐ দেশের ‘দ্বীন’। ফেরাউন হযরত মূসার আন্দোলনের কারণে এ দ্বীন পাল্টে যাওয়ার আশঙ্কা করছিলো। কিন্তু প্রত্যেক যুগের কুচক্রী ও ধূরন্ধর শাসকদের মত সেও একথা বলছে না যে, আমার হাত থেকে ক্ষমতা চলে যাওয়ার আশঙ্কা করছি। তাই আমি মূসাকে হত্যা করতে চাই। বরং পরিস্থিতিকে সে এভাবে পেশ করছে যে, হে জনগণ, বিপদ আমার নয়, তোমাদের। কারণ মূসার আন্দোলন যদি সফল হয়, তাহলে তোমাদের দ্বীন বদলে যাবে। নিজের জন্য আমার চিন্তা নেই। আমি তোমাদের চিন্তায় নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছি এই ভেবে যে, আমার ক্ষমতার ছত্রছায়া থেকে বঞ্চিত হলে তোমাদের কি হবে। তাই যে জালেমের দ্বারা তোমাদের ওপর থেকে এ ছত্রছায়া উঠে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে তাকে হত্যা করা প্রয়োজন। কারণ সে দেশ ও জাতি উভয়ের শত্রু।
# এখানে দু’টি সমান সম্ভাবনা বিদ্যমান। এ দু’টি সম্ভাবনার কোনটিকেই অগ্রাধিকার দেয়ার কোন ইঙ্গিত এখানে নেই। একটি সম্ভাবনা হচ্ছে, হযরত মূসা নিজেই সে সময় দরবারে উপস্থিত ছিলেন। তাঁর উপস্থিতিতেই ফেরাউন তাঁকে হত্যা করার ইচ্ছা প্রকাশ করে এবং হযরত মূসা (আ) তাকে ও তার সভাসদদের উদ্দেশ্য করে তখনই সবার সামনে প্রকাশ্যে এ জবাব দেন। অপর সম্ভাবনাটি হচ্ছে, ফেরাউন হযরত মূসার (আ) অনুপস্থিতিতে তার সরকারের দায়িত্বশীল লোকদের কোন মজলিসে একথা প্রকাশ করে এবং হযরত মূসাকে (আ) তার এ আলোচনার খবর কিছু সংখ্যক ঈমানদার লোক পৌঁছিয়ে দেয়, আর তা শুনে তিনি তাঁর অনুসারীদের একথা বলেন। এ দু’টি অবস্থার যেটিই বাস্তবে ঘটে থাকুক না কেন হযরত মূসার (আ) কথায় স্পষ্টত প্রকাশ পাচ্ছে যে, ফেরাউনের হুমকি তাঁর মনে সামান্যতম ভীতিভাবও সৃষ্টি করতে পারেনি। তিনি আল্লাহর ওপর নির্ভর করে তার হুমকির জবাব তার মুখের ওপরেই দিয়ে দিয়েছেন। যে পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে কুরআন মজীদে এ ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে তা থেকে আপনা আপনি একথা প্রকাশ পায় যে, “হিসেবের দিন” সম্পর্কে বেপরোয়া হয়ে যেসব জালেমরা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করছিলো তাদের জন্যও সে একই জবাব।