أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#১০৮৮)
[ *স্বৈরাচারী শাষকের সামনে মোমেনের বলিষ্ঠ ভাষণ :-]
www.motaher21.net
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন
পারা:২৪
২৮-৪৪ নং আয়াত:-
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:২৮
وَ قَالَ رَجُلٌ مُّؤۡمِنٌ ٭ۖ مِّنۡ اٰلِ فِرۡعَوۡنَ یَکۡتُمُ اِیۡمَانَہٗۤ اَتَقۡتُلُوۡنَ رَجُلًا اَنۡ یَّقُوۡلَ رَبِّیَ اللّٰہُ وَ قَدۡ جَآءَکُمۡ بِالۡبَیِّنٰتِ مِنۡ رَّبِّکُمۡ ؕ وَ اِنۡ یَّکُ کَاذِبًا فَعَلَیۡہِ کَذِبُہٗ ۚ وَ اِنۡ یَّکُ صَادِقًا یُّصِبۡکُمۡ بَعۡضُ الَّذِیۡ یَعِدُکُمۡ ؕ اِنَّ اللّٰہَ لَا یَہۡدِیۡ مَنۡ ہُوَ مُسۡرِفٌ کَذَّابٌ ﴿۲۸﴾
ফেরাউনের দরবারের এক ব্যক্তি যে তার ঈমান গোপন রেখেছিলো- বললোঃ তোমরা কি এক ব্যক্তিকে শুধু এ কারণে হত্যা করবে যে, সে বলে, আল্লাহ আমার রব? অথচ সে তোমাদের রবের পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে সুস্পষ্ট নিদর্শনসমূহ নিয়ে এসেছে। সে মিথাবাদী হয়ে থাকলে তার মিথ্যার দায়-দায়িত্ব তারই। কিন্তু সে যদি সত্যবাদী হয়ে থাকে তাহলে যেসব ভয়ানক পরিণামের কথা সে বলছে তার কিছুটা তো অবশ্যই তোমাদের ওপর আসবে। আল্লাহ কোন সীমালংঘনকারী মিথ্যাবাদী লোককে হিদায়াত দান করেন না।
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:২৯
یٰقَوۡمِ لَکُمُ الۡمُلۡکُ الۡیَوۡمَ ظٰہِرِیۡنَ فِی الۡاَرۡضِ ۫ فَمَنۡ یَّنۡصُرُنَا مِنۡۢ بَاۡسِ اللّٰہِ اِنۡ جَآءَنَا ؕ قَالَ فِرۡعَوۡنُ مَاۤ اُرِیۡکُمۡ اِلَّا مَاۤ اَرٰی وَ مَاۤ اَہۡدِیۡکُمۡ اِلَّا سَبِیۡلَ الرَّشَادِ ﴿۲۹﴾
‘হে আমার সম্প্রদায়! আজ তোমাদেরই রাজত্ব, যমীনে তোমরাই প্রভাবশালী; কিন্তু আমাদের উপর আল্লাহর শাস্তি এসে পড়লে কে আমাদেরকে সাহায্য করবে?’ ফিরআউন বলল, ‘আমি যা সঠিক মনে করি, তা তোমাদেরকে দেখাই। আর আমি তোমাদেরকে শুধু সঠিক পথই দেখিয়ে থাকি।’
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:৩০
وَ قَالَ الَّذِیۡۤ اٰمَنَ یٰقَوۡمِ اِنِّیۡۤ اَخَافُ عَلَیۡکُمۡ مِّثۡلَ یَوۡمِ الۡاَحۡزَابِ ﴿ۙ۳۰﴾
যে ঈমান এনেছিল সে আরও বলল, ‘হে আমার সম্প্রদায়! নিশ্চয় আমি তোমাদের জন্য পূর্ববর্তী দলসমূহের দিনের অনুরূপ আশংকা করি—
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:৩১
مِثۡلَ دَاۡبِ قَوۡمِ نُوۡحٍ وَّ عَادٍ وَّ ثَمُوۡدَ وَ الَّذِیۡنَ مِنۡۢ بَعۡدِہِمۡ ؕ وَ مَا اللّٰہُ یُرِیۡدُ ظُلۡمًا لِّلۡعِبَادِ ﴿۳۱﴾
‘যেমন ঘটেছিল নূহ, ‘আদ, সামূদ এবং তাদের পরবর্তীদের ব্যাপারে। আর আল্লাহ্ বান্দাদের প্রতি কোন যুলুম করতে চান না।
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:৩২
وَ یٰقَوۡمِ اِنِّیۡۤ اَخَافُ عَلَیۡکُمۡ یَوۡمَ التَّنَادِ ﴿ۙ۳۲﴾
হে কওম, আমার ভয় হয়, তোমাদের ওপর ফরিয়াদ ও অনুশোচনা করার দিন না এসে পড়ে,
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:৩৩
یَوۡمَ تُوَلُّوۡنَ مُدۡبِرِیۡنَ ۚ مَا لَکُمۡ مِّنَ اللّٰہِ مِنۡ عَاصِمٍ ۚ وَ مَنۡ یُّضۡلِلِ اللّٰہُ فَمَا لَہٗ مِنۡ ہَادٍ ﴿۳۳﴾
‘যেদিন তোমরা পিছনে ফিরে পালাতে চাইবে, আল্লাহর শাস্তি হতে রক্ষা করার কেউ থাকবে না। আর আল্লাহ্ যাকে বিভ্রান্ত করেন, তার জন্য কোন হেদায়াতকারী নেই।’
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:৩৪
وَ لَقَدۡ جَآءَکُمۡ یُوۡسُفُ مِنۡ قَبۡلُ بِالۡبَیِّنٰتِ فَمَا زِلۡتُمۡ فِیۡ شَکٍّ مِّمَّا جَآءَکُمۡ بِہٖ ؕ حَتّٰۤی اِذَا ہَلَکَ قُلۡتُمۡ لَنۡ یَّبۡعَثَ اللّٰہُ مِنۡۢ بَعۡدِہٖ رَسُوۡلًا ؕ کَذٰلِکَ یُضِلُّ اللّٰہُ مَنۡ ہُوَ مُسۡرِفٌ مُّرۡتَابُۨ ﴿ۚۖ۳۴﴾
আর অবশ্যই পূর্বে তোমাদের কাছে ইউসুফ এসেছিলেন স্পষ্ট প্রমাণাদিসহ; অতঃপর তিনি তোমাদের কাছে যা নিয়ে এসেছিলেন তোমরা তাতে সর্বদা সন্দেহ করেছিলে। পরিশেষে যখন তার মৃত্যু হল তখন তোমরা বলেছিলে, ‘তার পরে আল্লাহ্ আর কোন রাসূল প্রেরণ করবেন না।’ এভাবেই আল্লাহ্ যে সীমালংঘনকারী, সংশয়বাদী তাকে বিভ্ৰান্ত করেন —
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:৩৫
الَّذِیۡنَ یُجَادِلُوۡنَ فِیۡۤ اٰیٰتِ اللّٰہِ بِغَیۡرِ سُلۡطٰنٍ اَتٰہُمۡ ؕ کَبُرَ مَقۡتًا عِنۡدَ اللّٰہِ وَ عِنۡدَ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا ؕ کَذٰلِکَ یَطۡبَعُ اللّٰہُ عَلٰی کُلِّ قَلۡبِ مُتَکَبِّرٍ جَبَّارٍ ﴿۳۵﴾
আল্লাহর আয়াতসমূহের ব্যাপারে ঝগড়া করে। অথচ এ ব্যাপারে তাদের কাছে কোন সনদ বা প্রমাণ আসেনি। আল্লাহ ও ঈমানদারদের কাছে এ আচরণ অত্যন্ত ক্রোধ উদ্রেককারী। এভাবে আল্লাহ প্রত্যেক অহংকারী ও স্বেচ্ছাচারীর মনে মোহর লাগিয়ে দেন।
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:৩৬
وَ قَالَ فِرۡعَوۡنُ یٰہَامٰنُ ابۡنِ لِیۡ صَرۡحًا لَّعَلِّیۡۤ اَبۡلُغُ الۡاَسۡبَابَ ﴿ۙ۳۶﴾
ফিরআউন বলল, ‘হে হামান! আমার জন্য তুমি এক সুউচ্চ প্রাসাদ নির্মাণ কর; যাতে আমি আকাশ ছুঁয়ে যেতে পারি।
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:৩৭
اَسۡبَابَ السَّمٰوٰتِ فَاَطَّلِعَ اِلٰۤی اِلٰہِ مُوۡسٰی وَ اِنِّیۡ لَاَظُنُّہٗ کَاذِبًا ؕ وَ کَذٰلِکَ زُیِّنَ لِفِرۡعَوۡنَ سُوۡٓءُ عَمَلِہٖ وَ صُدَّ عَنِ السَّبِیۡلِ ؕ وَ مَا کَیۡدُ فِرۡعَوۡنَ اِلَّا فِیۡ تَبَابٍ ﴿٪۳۷﴾
‘আসমানে আরোহণের অবলম্বন, যেন দেখতে পাই মূসার ইলাহকে; আর নিশ্চয় আমি তাকে মিথ্যাবাদী মনে করি।’ আর এভাবে ফির’আউনের কাছে শোভনীয় করা হয়েছিল তার মন্দ কাজকে এবং তাকে নিবৃত্ত করা হয়েছিল সরল পথ থেকে এবং ফির’আউনের ষড়যন্ত্র কেবল ব্যর্থই ছিল।
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:৩৮
وَ قَالَ الَّذِیۡۤ اٰمَنَ یٰقَوۡمِ اتَّبِعُوۡنِ اَہۡدِکُمۡ سَبِیۡلَ الرَّشَادِ ﴿ۚ۳۸﴾
যে ব্যক্তি ঈমান এনেছিলো, বললোঃ হে আমার কওমের লোকেরা, আমার কথা মেনে নাও। আমি তোমাদেরকে সঠিক পথের সন্ধান দিচ্ছি।
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:৩৯
یٰقَوۡمِ اِنَّمَا ہٰذِہِ الۡحَیٰوۃُ الدُّنۡیَا مَتَاعٌ ۫ وَّ اِنَّ الۡاٰخِرَۃَ ہِیَ دَارُ الۡقَرَارِ ﴿۳۹﴾
‘হে আমার সম্প্রদায়! এ দুনিয়ার জীবন কেবল অস্থায়ী ভোগের বস্তু, আর নিশ্চয় আখিরাত, তা হচ্ছে স্থায়ী আবাস।
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:৪০
مَنۡ عَمِلَ سَیِّئَۃً فَلَا یُجۡزٰۤی اِلَّا مِثۡلَہَا ۚ وَ مَنۡ عَمِلَ صَالِحًا مِّنۡ ذَکَرٍ اَوۡ اُنۡثٰی وَ ہُوَ مُؤۡمِنٌ فَاُولٰٓئِکَ یَدۡخُلُوۡنَ الۡجَنَّۃَ یُرۡزَقُوۡنَ فِیۡہَا بِغَیۡرِ حِسَابٍ ﴿۴۰﴾
হে কওম, দুনিয়ার এ জীবন তো কয়েক দিনের জন্য। একমাত্র আখেরাতই চিরদিনের অবস্থানস্থল।
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:৪১
وَ یٰقَوۡمِ مَا لِیۡۤ اَدۡعُوۡکُمۡ اِلَی النَّجٰوۃِ وَ تَدۡعُوۡنَنِیۡۤ اِلَی النَّارِ ﴿ؕ۴۱﴾
হে কওম, কি ব্যাপার যে, আমি তোমাদেরকে মুক্তির দিকে আহ্বান জানাচ্ছি আর তোমরা আমাকে আগুনের দিকে আহ্বান জানাচ্ছো।
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:৪২
تَدۡعُوۡنَنِیۡ لِاَکۡفُرَ بِاللّٰہِ وَ اُشۡرِکَ بِہٖ مَا لَیۡسَ لِیۡ بِہٖ عِلۡمٌ ۫ وَّ اَنَا اَدۡعُوۡکُمۡ اِلَی الۡعَزِیۡزِ الۡغَفَّارِ ﴿۴۲﴾
‘তোমরা আমাকে ডাকছ যাতে আমি আল্লাহর সাথে কুফরী করি এবং তাঁর সাথে শরীক করি, যে ব্যাপারে আমার কোন জ্ঞান নেই; আর আমি তোমাদেরকে ডাকছি পরাক্রমশালী, ক্ষমাশীলের দিকে।
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:৪৩
لَا جَرَمَ اَنَّمَا تَدۡعُوۡنَنِیۡۤ اِلَیۡہِ لَیۡسَ لَہٗ دَعۡوَۃٌ فِی الدُّنۡیَا وَ لَا فِی الۡاٰخِرَۃِ وَ اَنَّ مَرَدَّنَاۤ اِلَی اللّٰہِ وَ اَنَّ الۡمُسۡرِفِیۡنَ ہُمۡ اَصۡحٰبُ النَّارِ ﴿۴۳﴾
‘নিঃসন্দেহ যে, তোমরা আমাকে যার দিকে ডাকছ, সে দুনিয়া ও আখিরাতে কোথাও ডাকের যোগ্য নয়। আর আমাদের ফিরে যাওয়া তো আল্লাহর দিকে এবং নিশ্চয় সীমালংঘনকারীরা আগুনের অধিবাসী।
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:৪৪
فَسَتَذۡکُرُوۡنَ مَاۤ اَقُوۡلُ لَکُمۡ ؕ وَ اُفَوِّضُ اَمۡرِیۡۤ اِلَی اللّٰہِ ؕ اِنَّ اللّٰہَ بَصِیۡرٌۢ بِالۡعِبَادِ ﴿۴۴﴾
‘সুতরাং তোমরা অচিরেই স্মরণ করবে যা আমি তোমাদেরকে বলছি এবং আমি আমার ব্যাপার আল্লাহর নিকট সমর্পণ করছি; নিশ্চয় আল্লাহ তার বান্দাদের ব্যাপারে সর্বদ্ৰষ্টা।’
ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
*স্বৈরাচারী শাষকের সামনে মোমেনের বলিষ্ঠ ভাষণ : এই পর্যায়ে আত্মপ্রকাশ করলাে ফেরাউনের অনুসারীদের মধ্য থেকে একব্যক্তি, যার অন্তরে সত্যপ্রেম ঢুকে পড়েছিলাে। কিন্তু সে নিজের ঈমানকে লুকিয়ে রেখেছিলাে। সে মূসার পক্ষে কথা বললাে, তার লােকদেরকে তার ক্ষতি করা থেকে বিরত রাখার কৌশল অবলম্বন করলাে। সে ফেরাউন ও তার সভাসদদেরকে বিভিন্ন পন্থায় উপদেশ দিয়ে এবং ভয় দেখিয়ে ও বুঝ দিয়ে তাদের অন্তরে সংবেদনশীলতা সৃষ্টির চেষ্টা করলাে। ‘ফেরাউনের বংশের একব্যক্তি যে মােমেন ছিলাে এবং নিজের ঈমান গােপন রেখেছিলাে, সে বললাে, তােমরা কি একজন মানুষকে শুধু এ জন্যেই হত্যা করবে যে, সে আমার প্রভু আল্লাহ’ এই কথা বলে?…’(আয়াত ২৮-৩৫) কুচক্রী ফেরাউন ও তার সভাসদদের সাথে আলােচনার যে ঝুঁকি এই ব্যক্তি গ্রহণ করেছিলাে, তা বাস্তবিকই বিপজ্জনক ছিলাে। সতর্কতা, দক্ষতা ও শক্তি সর্বদিক দিয়েই একজন মােমেনের স্বভাবসুলভ পরিপক্কতা ও যুক্তির তীক্ষ্মতা এ ভাষণে ফুটে উঠেছে। প্রথমেই ব্যক্তি এই বলে তাদের পরিকল্পনার ভয়াবহতা ব্যক্ত করলাে! ‘তােমরা কি একজন মানুষকে শুধু এ জন্যেই হত্যা করবে যে ব্যক্তি বলে, ‘আমার প্রভু আল্লাহ।’ অন্তরের সন্তোষ ও বিশ্বাসের সাথে সংশ্লিষ্ট এই নিম্পাপ কথাটা বলায় কি এতােই বড় অপরাধ হয়ে গেছে যে, সে তােমাদের কাছে হত্যার যােগ্য বিবেচিত হচ্ছে। এটাতাে আসলে একটা জঘন্য অন্যায় ও দূষণীয় কাজ। এরপর তাদের সাথে সে আরাে একধাপ অগ্রসর হয়। যে ব্যক্তি আল্লাহ আমার রব এই চমৎকার কথাটা উচ্চারণ করতে পারে, তার কাছে এর যুক্তি প্রমাণও অবশ্যই থাকার কথা। তাই সে বলে! সে তােমাদের প্রতিপালকের কাছ থেকে অকাট্য প্রমাণাদি নিয়ে এসেছে।’ এ দ্বারা সে হযরত মূসার প্রদর্শিত অলৌকিক ঘটনাগুলাের প্রতি ইংগিত দিয়েছে। সে সব ঘটনা তারা সচক্ষে। দেখেছে এবং তা নিয়ে কারাে সন্দেহের অবকাশ ছিলাে না। এরপর সে বিচার বিবেচনার খাতিরে সবচেয়ে খারাপ ধারণাটা মেনে নিয়ে বলছে; সে যদি মিথ্যুক হয়ে থাকে, তবে তার মিথ্যার দায় তার ঘাড়েই পড়বে। অর্থাৎ তার অপকর্মের শাস্তি সে নিজেই ভোগ করবে। কিন্তু এ জন্যে তাকে হত্যা করা কোনাে অবস্থাতেই বৈধ হতে পারে না। অন্য একটা সম্ভাবনাও এখানে রয়েছে যে, সে সত্যবাদীও হয়ে বসতে পারে। এই সম্ভাবনার খাতিরে সতর্কতা অবলম্বন করাই উত্তম। আর যদি সে সত্যবাদী হয়, তাহলে সে যেসব জিনিসের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে, তার অন্তত কিছু কিছু অংশ সত্য হয়ে তােমাদেরকে আক্রান্ত করতে পারে।’ আর তার প্রতিশ্রুতি কিছু কিছু জিনিস দ্বারা তাদের আক্রান্ত হওয়াও নিছক একটা সম্ভাবনা মাত্র। বস্তুত তাদের কাছে সে এর চেয়ে বেশী কিছু দাবী জানাতে পারবে না। তর্কের ক্ষেত্রে এটুকুই সর্বোচ্চ ন্যায়বিচার হিসাবে চিহ্নিত হয়ে থাকে। এরপর সে অত্যন্ত কৌশলে ও গােপনে তাদেরকে একটা হুমকি দিচ্ছে। এ হুমকি হযরত মূসা ও তাদের ক্ষেত্রে সমভাবে প্রযােজ্য; ‘নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা সেই ব্যক্তিকে সুপথ দেখান না, যে সীমা অতিক্রমকারী ও অতিমাত্রায় মিথ্যুক।’ মূসা যদি মিথ্যুক ও সীমা অতিক্রমকারী হয়ে থাকে, তাহলে আল্লাহ তায়ালা তাকে সুপথ দেখাবেন না ও সৎ কাজের শক্তি যােগাবেন না। কাজেই তাকে তার কর্মফল ভােগ করতে দাও। তােমরা সাবধান থাকো যেন তােমরাই মূসা ও তার প্রতিপালকের ওপর মিথ্যা আরাপকারী না হও, সীমা অতিক্রমকারী না হও এবং এর কু-ফল ভােগ না করাে। মিথ্যাবাদী ও সীমা অতিক্রমকারীকে আল্লাহর পক্ষ থেকে শান্তি দেয়া হবে- এ কথা জানানাের পর সে তাদেরকে আল্লাহর আযাবের ভয় দেখাচ্ছে এবং হুঁশিয়ার করে দিচ্ছে যে, রাজত্ব ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কাউকে আযাব থেকে রক্ষা করবে না। সেই সাথে তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে যে, এই নেয়ামত এমন জিনিস, যার শােকর করা কর্তব্য এবং অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ থেকে বিরত থাকা উচিত। ‘হে আমার জাতি, আজ রাজত্ব তােমাদের, তােমরাই পৃথিবীতে বিজয়ী শক্তি। কিন্তু আল্লাহর আযাব যদি এসে পড়ে, তাহলে কে আমাদেরকে তা থেকে রক্ষা করবে?’ এখানে দেখা যাচ্ছে যে, এই মােমেন ব্যক্তি অন্যান্য মােমেনের মতােই অনুভব করে যে, পৃথিবীর রাজা ও শাসকরা আল্লাহর আযাবের সবচেয়ে নিকটবর্তী, তাই তাদেরও তা থেকে সতর্ক থাকা উচিত। কেননা এই আযাব তাদের জন্যে দিনরাত অপেক্ষা করছে। তাই তাদেরকে সে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে যে, তাদেরকে রাজত্ব ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ন্যায় নেয়ামত দেয়া হয়েছে। অতপর বলছে! আল্লাহর আযাব যদি আমাদের ওপর এসে পড়ে তাহলে কে আমাদেরকে রক্ষা করবে? এ কথা বলে সে বুঝাচ্ছে যে, তাদের বিপদ আপদ সম্পর্কে সে উদ্বিগ্ন ও চিন্তিত। কেননা সে তাদেরই একজন এবং তাদের যে পরিণতি হবে, সেও তারই জন্যে অপেক্ষমান। তাই সে তাদের হিতাকাংখী। সে ভেবেছিলাে যে, এতে তারা তার সতর্কবাণীতে কর্ণপাত করবে এবং তাকে নির্দোষ ও আন্তরিক মনে করবে। কেননা সে তাদেরকে এই বলে সতর্ক করার চেষ্টা করছে যে, আল্লাহর আযাব এসে গেলে তা থেকে কেউ রক্ষা করতে ও সাহায্য করতে পারবে না। কেননা তারা তার সামনে খুবই দুর্বল। এখানে ফেরাউন অন্যান্য একনায়কের মতােই তার উপদেশকে শুধু প্রত্যাখ্যানই করলাে না, বরং সে এতে অপমান বােধ করলাে। এই আন্তরিক সদুপদেশ ও কল্যাণকামীতাকে সে তার ক্ষমতায় হস্তক্ষেপ, তার প্রতাপ ও পরাক্রমের ঘাটতি এবং তার ক্ষমতা ও প্রতিপত্তিতে ভাগ বসানাের অভিলাষ হিসাবে বিবেচনা করলাে। তাই তার প্রতিক্রিয়া দাঁড়ালাে এ রকম। ‘ফেরাউন বললাে, আমি যা বুঝি, তাই তােমাদেরকে বলছি। আর আমি তােমাদেরকে কেবল কল্যাণের পথ দেখাচ্ছি।’ অর্থাৎ আমি যা সঠিক ও উপকারী মনে করছি সেটাই তােমাদেরকে বলছি। আমি যা বলছি, নিসন্দেহে সেটাই নির্ভুল। একনায়করা কি কখনাে সঠিক ও কল্যাণকর পথ দেখতে পায়। তারা ভুল করতে পারে বলে কেউ ভাবুক এটা কি তারা বরদাশত করতে পারে। তাদের মতামতের বিপক্ষে কেউ কি কোনাে বিকল্প মত দিতে পারে? তা যদি পারতাে, তাহলে তারা একনায়ক হবে কেন? কিন্তু এই মােমেন লােকটার ঈমান অন্যরকম ছিলাে। সে বুঝতে পেরেছিলাে যে, সতর্ক করা, উপদেশ দেয়া এবং নিজের বিবেচনায় যা ভালাে মনে করে তা ব্যক্ত করা তার দায়িত্ব। একনায়ক ও স্বৈরাচারী মতামত যা হয় হোক। সত্যের পক্ষে অবস্থান নেয়া তার কর্তব্য এরপর সে তাদের বিবেককে জাগ্রত করা ও নম্র করার জন্যে ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে। পরবর্তী আয়াতে এই ভিন্ন পন্থার উল্লেখ রয়েছে। সেটা এই যে, কে তাদেরকে পূর্ববর্তী জাতিগুলাের ধ্বংসের কাহিনীর দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সেই জাতিগুলা দেখেছে আল্লাহর আযাব কিভাবে অস্বীকারকারী ও স্বৈরাচারীদেরকে পাকড়াও করে। ঈমান আনয়নকারী লােকটা বললাে, হে আমার জাতি, আমার আশংকা হয়, পূর্বতন জতিগুলাের ন্যায় বিপজ্জনক দিন তােমাদের ওপর এসে পড়ে কিনা। নূহের জাতি, আদ, সামুদ ও তাদের পরবর্তীদের ন্যায় বিপজ্জনক দিন। আল্লাহ তায়ালা তার বান্দাদের ওপর অত্যাচার করতে চান না। প্রত্যেক জাতির জন্যেই একটা নির্দিষ্ট দিন ছিলাে। কিন্তু এই মােমেন ব্যক্তি সকলের দিনকে একই দিনে সমবেত করেছে। বস্তুত এ দিনটা হলাে আল্লাহর আযাব দেখা দেয়ার দিন। জাতি যতই ভিন্ন ভিন্ন হােক, তাদের এই দিনের প্রকৃতিটা ছিলাে একই রকম। আল্লাহ তায়ালা তার বান্দাদের ওপর অত্যাচার করতে চান না। অর্থাৎ শুধু অপরাধীর শাস্তি দিয়ে তার চারপাশের ও পরবর্তীকালের মানুষকে সংশােধন করতে চান। এরপর এই মােমেন ব্যক্তি তাদের ভেতরে চেতনা সঞ্চারের জন্যে আরাে একটা দিন কেয়ামতের দিনের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে, ‘হে আমার জাতি তােমাদের ওপর আশংকা করি কেয়ামতের দিনের…'(আয়াত ৩২-৩৩) সেদিন ফেরেশতারা লােকজনকে মাঠে সমবেত হবার জন্যে ডাকবে। আ’রাফের অধিবাসীরা দোযখবাসী ও বেহেশতবাসীকে, দোযখবাসীরা বেহেশতবাসীকে এবং বেহেশতবাসীরা দোযখবাসীকে ডাকবে। এভাবে সেদিন নানাভাবে ডাকাডাকি হতে থাকবে। একে এখানে ইয়াওমুত তানাদি (ডাকাডাকির দিন) বলা দ্বারা এর এমন একটা চিত্র ফুটে উঠেছে যে, এখান থেকে ওখান থেকে ডাকাডাকি ও ঝগড়াঝাটি চলতে থাকবে। এটা মােমেন ব্যক্তিটার এই কথার সাথেও সংগতিপূর্ণ; ‘যেদিন তােমরা পালাবে, আল্লাহ ছাড়া তােমাদের কোনাে রক্ষক থাকবে না। এই পালানাের কারণ জাহান্নামের ভীতিও হতে পারে, অথবা এটা নিছক পালানাের চেষ্টাই হবে। কিন্তু সেদিন কোনাে রক্ষকও থাকবে না, পালানােরও কোনাে জায়গা থাকবে না। এখানে পালানাের ভয়ভীতির যে চিত্র আঁকা হয়েছে, পৃথিবীর একনায়ক শাসক ও অহংকারীদের বেলায় এটাই এ ধরনের প্রথম চিত্র। আর আল্লাহ তায়ালা যাকে গােমরাহ করবেন, তার কোনাে পথপ্রদর্শক নেই।’ সম্ভবত এটা ফেরাউনের এই কথাটার দিকে সুক্ষ্ম কটাক্ষ; ‘আমি তােমাদেরকে কেবল সঠিক পথই দেখাই।’ এখানে বলা হচ্ছে যে, আল্লাহর পথ প্রদর্শনই প্রকৃত পথ প্রদর্শন। তিনি যাকে বিপথগামী করেন, তার আর কোনাে পথ প্রদর্শক নেই। কেননা আল্লাহ তায়ালাই মানুষের প্রকৃত অবস্থা জানেন। সেই অনুসারেই তিনি কে হেদায়াতের যােগ্য এবং কে যােগ্য নয় তা স্থির করেন। সবার শেষে এই মােমেন ব্যক্তি তাদেরকে হযরত ইউসুফের কথা তাদের স্মরণ করাচ্ছে। মূসা(আ.) তারই বংশধর। এই ব্যক্তি তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে যে, কিভাবে হযরত ইউসুফকে অবিশ্বাস ও সন্দেহ করা হয়েছে। কাজেই হযরত মূসার সাথেও তাদের একই আচরণ করা উচিত। কেননা তিনি হযরত ইউসুফের আনীত জীবন বিধানের সমর্থক ছিলেন। কিন্তু তবুও তারা তার ওপর সন্দেহ করতাে। তারা একথাও বলতাে যে, হযরত ইউসুফের পর আল্লাহ তায়ালা আর কোনাে রসূল পাঠাবেন না। হযরত মূসা হযরত ইউসুফের কিছুকাল পরে এসেছেন এবং উক্ত কথা মিথ্যা সাব্যস্ত করেন। (আয়াত ৩৪,৩৫) কোরআনে এই একবারই মিসরের জনগণের প্রতি হযরত ইউসুফের রসূলরূপে আগমনের উল্লেখ করা হয়েছে। সূরা ইউসূফ থেকে আমরা এতােটুকু জেনেছি যে, তিনি মিসরের রাষ্ট্র্রক্ষমতার মালিক হয়েছিলেন এবং তিনি মিসরের আযীয’ বা প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। সূরা ইউসুফ থেকে এ ধারণাও পাওয়া যায় যে, তিনি মিসরের সিংহাসনে আরােহন করেছিলেন, তবে এ ব্যাপারটা সুনিশ্চিত নয়। কেননা আয়াতে বলা হয়েছে; ‘তিনি তার পিতামাতাকে সিংহাসনে আরােহন করালেন…’ এমনও হতে পারে যে, তিনি তার পিতামাতাকে যে সিংহাসনে আরােহন করিয়েছিলেন, তা মিসরীয় সম্রাট ফেরাউনের সিংহাসন নয়। সে যাই হােক, এ কথা নিশ্চিত যে, হযরত ইউসুফ শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। এ থেকে আমরা কল্পনা করতে পারি এই মােমেন ব্যক্তি কোন পরিস্থিতির দিকে ইংগিত করেছে। সেটা হলো, হযরত ইউসুফের আনীত শরীয়ত ও বিধান সম্পর্কে তাদের সন্দেহ পােষণ, ইউসুফের ক্ষমতাসীন হওয়ার কারণে তার সাথে তাদের আপস করা ও তাকে প্রকাশ্যে অস্বীকার করতে না পেরে কেবল মনে মনে সন্দেহ পােষণ। অতপর তিনি যখন মারা গেলেন তখন তােমরা বললে, আল্লাহ তায়ালা তাঁর পর আর কোনাে রসূল পাঠাবেন না।’ অর্থাৎ তারা যেন তার মৃত্যুতে হাপ ছেড়ে বেঁচেছে। ফলে তারা এভাবে তাদের আনন্দ প্রকাশ করেছে এবং তার প্রচারিত নির্ভেজাল তাওহীদের প্রতি অনীহা প্রকাশ করেছে। এই তাওহীদ তিনি কারাগারে বসেও প্রচার করেছেন। তিনি তার দুই সাথীকে বলেছিলেন; ‘বহুসংখ্যক প্রভু ভালাে, না এক ও অদ্বিতীয় পরাক্রমশালী আল্লাহ তায়ালা?’ তারা দাবী করতাে যে, তার পর আর কোনাে রসূল তাদের কাছে আসবে না। কেননা তারা আসলে এটাই চাইতাে। মানুষ অনেক সময় যা কামনা করে, সেটাই বাস্তবায়িত হয়েছে বলে বিশ্বাস করে। কেননা তার বাস্তবায়নেই তার কামনা পূর্ণ হয়। তাদের একগুয়েমির কারণে মােমেন লোকটা এই পর্যায়ে এসে খানিকটা কঠোর ভূমিকায় আসে। এখানে সে সন্দেহ ও সীমা অতিক্রমকে প্রত্যাখ্যানের পর্যায়ভুক্ত করে। তাই সে বলে; ‘এভাবেই আল্লাহ তায়ালা সীমা অতিক্রমকারী ও সন্দেহকারীকে গােমরাহ করেন।’ এভাবে সে সতর্ক করছে যে, অকাট্য প্রমাণ থাকা সত্তেও যে ব্যক্তি সন্দেহ পােষণ করে ও সীমা অতিক্রম করে, আল্লাহ তায়ালা তাকে গােমরাহ করেন। এরপর সে তাদেরকে আল্লাহর ঘৃণা ও মােমেনদের ঘৃণার সম্মুখীন হবার হুমকি দেয়। কেননা তারা কোনাে যুক্তি ও প্রমাণ ছাড়া আল্লাহর নিদর্শনাবলী নিয়ে তর্কে লিপ্ত হয়। তারাই এ কাজটা সবচেয়ে জঘন্য আকারে করে। এরপর সে অহংকারের নিন্দা জানায় এবং অহংকারীদের মনকে আল্লাহ তায়ালা নিস্কৃয় করে দেয়ার হুমকি দেন; যারা কোনাে প্রমাণ ছাড়াই আল্লাহর আয়াত নিয়ে বিতর্ক করে। তাদের এ কাজ আল্লাহর কাছে ও মােমেনদের কাছে ঘৃণার্হ। এভাবেই আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক অহংকারী স্বৈরাচারীর মনের ওপর মােহর মেরে দেন। এই মােমেন ব্যক্তির মুখ দিয়ে যে কথাগুলাে উচ্চারিত হয়েছে, তা বলতে গেলে এ সূরার প্রথম দিককার বক্তব্যগুলাের হুবহু প্রতিলিপি। প্রমাণ ছাড়া আল্লাহর আয়াত নিয়ে বিতর্ককারীদের প্রতি ঘৃণা এবং অহংকারীদেরকে বিপথগামীকরণ, যার ফলে তাদের অন্তরে আর হেদায়াত গ্রহণের ও উপলব্ধির আর কোনাে স্থান অবশিষ্ট থাকে না এগুলাে সূরার প্রথমাংশে রয়েছে।
** এই মােমেন ব্যক্তি অনেক ঝুঁকি নিয়ে এ কথাগুলাে বলা সত্তেও ফেরাউন তার গোমরাহী চালিয়ে যেতে থাকলাে এবং সত্যের বিরােধিতা অব্যাহত রাখলাে। তবে সে বাহ্যত দেখালাে যে, সে মুসার দাবীগুলাের সত্যতা যাচাই করতে চায়। এখানে এটাও বুঝা যায় যে, এই মােমেন ব্যক্তির কথাবার্তা ও যুক্তি প্রমাণ অত্যন্ত প্রভাবশালী ও হৃদয়গ্রাহী প্রমাণিত হয়েছিলাে, যার কারণে ফেরাউন ও তার অনুসারীরা এটাকে অস্বীকার করতে পারেনি। এ জন্যে ফেরাউন নতুন ছুতাে খুঁজতে লাগলো; ‘ফেরাউন বললাে হে হামান, তুমি আমার জন্যে একটা সুউচ্চ প্রাসাদ নির্মাণ করাে…'(আয়াত ৩৬ -৩৭) অর্থাৎ হে হামান, আমার জন্যে একটা উচু দালান বানাও, হয়তাে তার ওপর চড়ে আমি আকাশ ও পৃথিবীর উপায় উপকরণ পেয়ে যাবে এবং সেখানে মূসার খােদা সত্যই আছে কিনা, তাও দেখবাে। ‘আসলে আমি তাে ওকে মিথ্যুক মনে করি’ এভাবে স্বৈরাচারী ফেরাউন ক্রমাগত ছলছুতাে অবলম্বন করতে থাকে, যাতে খোলাখুলি সত্যের বিরােধিতাও না হয়, আবার তাওহীদ মেনে নিয়ে সিংহাসনকে নড়বড়ে করে ফেলাও না হয় এবং তার রাজত্বের ভিত্তি যে পৌত্তলিকতার ওপর, তাও বিধ্বস্ত না হয়। এটা সম্ভব নয় যে, এসব উক্তি ফেরাউনের সুস্থ চিন্তা ও উপলব্ধির ফল। এটাও সম্ভব নয় যে, ফেরাউন এমন সহজ-সরল বস্তুবাদী উপায়ে যথার্থই মূসার মাবুদ অনুসন্ধান চালাতে চেয়েছিলো। মিসরের ফেরাউনরা সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে এমন মানে উন্নীত ছিলাে যে, এই ধারণা তার সাথে খাপ খায় না। আসলে এটা ছিলাে তার বিদ্রুপ উপহাস ও ঔদ্ধত্য প্রকাশের নামান্তর। অন্যদিক দিয়ে এটা তার ন্যায়নীতি প্রীতির একটা প্রদর্শনী এবং সত্যানুসন্ধানের একটা প্রহসনও ছিলাে হয়তােবা। এমনও হতে পারে যে, মােমেন ব্যক্তিটার ধারালাে যুক্তি তর্কের সাথে এঁটে উঠতে না পেরে সে এভাবে একটা ছলছুতাে উদ্ভাবন করতে চেয়েছিলাে। এই সব কটা সম্ভাব্য ব্যাখ্যা থেকেই সন্দেহাতীতভাবে বুঝা যায় যে, সে তার গােমরাহীর ওপর অনড় ছিলাে এবং মূসার দাওয়াতকে প্রত্যাখ্যানের ব্যাপারে অবিচল ছিলাে। আল্লাহ তায়ালা বলেন; এভাবেই ফেরাউনের কাছে তারা অপকর্মকে সুদর্শন করে দেখানাে হয়েছিলো এবং তাকে বিপথগামী করা হয়েছিলাে। বস্তুত সে গােমরাহীর যােগ্যও ছিলাে। কেননা এ ধরনের বিতর্ক তােলা দ্বারা সঠিক পথ থেকে বিচ্যুতি অনির্বাণ হয়ে দাঁড়ায়। আয়াতের শেষাংশের মন্তব্যে তার এই ছলছুতােকে তার ব্যর্থতা ও ধ্বংসের কারণ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। ‘ফেরাউনের চক্রান্ত সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছিলাে। এই ধৃষ্টতা ও ঔদ্ধত্যের পাশাপাশি সেই মােমেন ব্যক্তি তার সর্বশেষ বক্তব্য দ্ব্যর্থহীন ভাষায় পেশ করেছে। এর আগে সে জাতিকে তার পদাংক অনুসরণ করার আহ্বান জানিয়েছে এবং তাকে সে হেদায়াতের পথ বলে আখ্যায়িত করেছে। সে এই ক্ষণস্থায়ী পার্থিব জীবনের প্রকৃত ব্যাখ্যা করেছে, তাদেরকে চিরস্থায়ী আখেরাতের সুখ ঐশ্বর্যের প্রতি আগ্রহী হতে চলেছে আখেরাতের আযাব থেকে সতর্ক করেছে এবং শিরককে একটা বাতিল ও অচল মতবাদ বলে ঘােষণা করেছে।(আয়াত ৩৮-৪৪) এখানে যে কথাগুলাে বলা হয়েছে, তা সূরার প্রথমাংশে আলােচিত হয়েছে। মােমেন লােকটা পুনরায় ফেরাউনের মুখোমুখি হয়ে জনগণকে বলেছে; হে আমার জাতি, তােমরা আমার পদাংক অনুসরণ করাে। আমি তােমাদেরকে কল্যাণের পথে পরিচালিত করবাে।’ ওদিকে ফেরাউনও বলতাে যে, “আমি তােমাদেরকে কল্যাণের পথে পরিচালিত করবাে।’ এ থেকে বুঝা যায়, এই মােমেন ফেরাউনকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ দিয়ে সত্য কথা বলতে শুরু করেছে। স্বৈরাচারী ফেরাউন এবং তার সহযােগী হামান কারূণ প্রভৃতি মন্ত্রী ও সভাসদদেরকে সে আর ভয় করছে না। পার্থিব জীবনের স্বরূপ উল্লেখ করে বলা হয়েছে, হে আমার জাতি। এ পার্থিব জীবন তাে কেবল (কয়েকদিনের) উপভােগের বস্তু অর্থাৎ ক্ষণস্থায়ী ভােগের বস্তু, এর কোনাে স্থায়িত্ব নেই। অপরদিকে পরকালের জীবনই হচ্ছে স্থায়ী জীবন। সেই জীবনই হচ্ছে প্রকৃত জীবন। কাজেই সেই জীবনই মুখ্য হওয়া উচিত কাম্য হওয়া উচিত। এই চিরস্থায়ী জীবনে মানুষের কর্মের হিসাব নিকাশ ও ফলাফল কিসের ভিত্তিতে নির্ণয় করা হবে সে সম্পর্কে বলা হচ্ছে, যে মন্দ কর্ম করে, সে কেবল তারই অনুরূপ প্রতিফল পাবে…। (আয়াত ৪০) আল্লাহর বড়ই মেহেরবানী যে, তিনি পুণ্যের প্রতিদান দ্বিগুণ (মাঝে মাঝে আরাে বেশী) করে দেন। কিন্তু পাপের প্রতিদান দ্বিগুণ করেন না। এটা বান্দার প্রতি তার অপার করুণারই জ্বলন্ত নিদর্শন। তিনি তাঁর বান্দাদের দুর্বলতার কথা জানেন, পাপ-পুণ্যের প্রতি তাদের আকর্ষণ ও বিকর্ষণের কথা জানেন বলেই তাদের পুণ্যের পাল্লা ভারি করে দেন আর পাপের পাল্লা হাল্কা করে দেন। শুধু তাই নয়, বরং হিসাব নিকাশের পর যখন তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে তখন তাদেরকে সেখানে অগণিত নেয়ামত দান করবেন। এই মােমেন বান্দা তার জাতিকে মুক্তি ও কল্যাণের পথে ডাকছে, আর তার জাতি তাকে ডাকছে জাহান্নামের দিকে। তাই সে প্রতিবাদের সুরে এবং নিন্দার সুরে তাদেরকে বলছে, ‘হে আমার জাতি। কি আশ্চর্য ব্যাপার, আমি তােমাদেরকে ডাকছি মুক্তির দিকে, আর তােমরা আমাকে ডাকছাে জাহান্নামের দিকে’(আয়াত ৪১) তার জাতি তাকে কিন্তু জাহান্নামের দিকে আহ্বান করেনি, তারা তাকে আহ্বান করেছে শিরকের দিকে। শিরকের দিকে আহ্বান করা, আর জাহান্নামের দিকে আহ্বান করার মাঝে পার্থক্য কোথায়? কোনােই পার্থক্য নেই, বরং দুটোই পরস্পরের খুব নিকটে রয়েছে। তাই মােমেন ব্যক্তি এই পরস্পর বিরােধী দুটো আহ্বানকে ভিন্ন বর্ণনাভঙ্গিতে এভাবে প্রকাশ করছে, তােমরা আমাকে আহ্বান করছ, যাতে আমি আল্লাহকে অস্বীকার করি এবং তার সাথে এমন কাউকে শরীক করি যার কোনাে প্রমাণ আমার কাছে নেই।'(আয়াত ৪২) এই দু’ধরনের আহ্বানের মাঝে বিস্তর ফারাক রয়েছে। মােমেন ব্যক্তি তার জাতিকে যে আহ্বান জানাচ্ছে তা অত্যন্ত সুস্পষ্ট ও সরল। সে তাদেরকে মহাপরাক্রমশালী ও মহাক্ষমাশীল এক সত্ত্বার পানে আহ্বান জানাচ্ছে, এমন একক উপাস্যের পানে আহ্বান জানাচ্ছে যার একত্বের সাক্ষ্য বহন করছে গােটা সৃষ্টিজগত। তার কুশলী ও নিপুণ সৃষ্টি তার সৃষ্টি ক্ষমতা ও নিরুপম শৈলীর পরিচয় দিচ্ছে। তারা যাতে ক্ষমা লাভ করতে পারে, সে জন্য তাদেরকে মহান আল্লাহর দিকে ডাকছে। কারণ ক্ষমা করার শক্তি তার আছে। তিনি পরাক্রমশালী ও মহাক্ষমাশীল। কিন্তু সেই মােমেন বান্দাকে তার জাতি কিসের দিকে ডাকছে? আল্লাহকে অস্বীকার করার জন্যে ডাকছে, তার সাথে এমন কিছুকে শরীক করতে বলছে যে সম্পর্কে তার কোনাে জ্ঞান নেই। কারণ, সেসব হচ্ছে নিছক কুসংস্কার, কল্পনা ও গোলক ধাঁধা। এরপর মােমেন বান্দা সুস্পষ্ট ভাষায় ও সংশয়-সন্দেহবিহীন কষ্ঠে ঘােষণা দিয়ে সেই কল্পিত শরীকদের সম্পর্কে বলছে যে, ওদের করার মতাে কিছুই নেই। দুনিয়াতেও ওদের কোনাে প্রভাব নেই এবং পরকালেও ওদের কোনাে প্রভাব নেই। একমাত্র আল্লাহর কাছেই সকলকে ফিরে যেতে হবে। যারা সীমালংঘন করে তারা জাহান্নামীদের কাতারে শামিল হবে। বলা হচ্ছে, এতে সন্দেহ নেই যে, তােমরা আমাকে যার দিকে আহ্বান করছো ইহকালে ও পরকালে তার দিকে আহ্বান করা কারাে পক্ষেই শােভনীয় নয়…’(আয়াত ৪৩) ঈমান ও আকীদা সম্পর্কিত মৌলিক তত্ত্বের ব্যাপারে এই সুস্পষ্ট ও ব্যাপক অর্থবােধক বক্তব্যের পর আর কি প্রশ্ন থাকতে পারে? ফেরাউনের দরবারে তার সভাসদদের সম্মুখে দাঁড়িয়ে মােমেন ব্যক্তিটি প্রকাশ্যে ঘােষণা দিয়ে এই বক্তব্য পেশ করছে। প্রথমদিকে সে তার ঈমানের বিষয়টি লুকিয়ে রেখেছিলো। এখন আর কোনাে রাখঢাক নেই। সুস্পষ্ট ভাষায় তার মনের কথা সবার সামনে প্রকাশ করে নিজের বিবেককে হাল্কা করতে পেরেছে। তাই এখন নিজেকে আল্লাহর হাতে সপে দেয়া ছাড়া তার আর করার কিছু নেই। তবে সে তার জাতিকে জানিয়ে দিচ্ছে যে, তার এই কথাগুলােয় তারা এমন একদিন বুঝতে পারবে যেদিন এই বুঝ কোনাে উপকারেই আসবে না। কারণ তখন বিচারের ভার থাকবে আল্লাহর হাতে। তাই বলা হচ্ছে, ‘আমি তােমাদেরকে যা বলছি, তােমরা একদিন তা স্মরণ করবে। আমি আমার ব্যাপার আল্লাহর কাছে সমর্পণ করছি…’(আয়াত ৪৪)