(বই#১০৮৮) [ *স্বৈরাচারী শাষকের সামনে মোমেনের বলিষ্ঠ ভাষণ :-] www.motaher21.net সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন পারা:২৪ ২৮-৪৪ নং আয়াত:-

أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#১০৮৮)
[ *স্বৈরাচারী শাষকের সামনে মোমেনের বলিষ্ঠ ভাষণ :-]
www.motaher21.net
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন
পারা:২৪
২৮-৪৪ নং আয়াত:-
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:২৮
وَ قَالَ رَجُلٌ مُّؤۡمِنٌ ٭ۖ مِّنۡ اٰلِ فِرۡعَوۡنَ یَکۡتُمُ اِیۡمَانَہٗۤ اَتَقۡتُلُوۡنَ رَجُلًا اَنۡ یَّقُوۡلَ رَبِّیَ اللّٰہُ وَ قَدۡ جَآءَکُمۡ بِالۡبَیِّنٰتِ مِنۡ رَّبِّکُمۡ ؕ وَ اِنۡ یَّکُ کَاذِبًا فَعَلَیۡہِ کَذِبُہٗ ۚ وَ اِنۡ یَّکُ صَادِقًا یُّصِبۡکُمۡ بَعۡضُ الَّذِیۡ یَعِدُکُمۡ ؕ اِنَّ اللّٰہَ لَا یَہۡدِیۡ مَنۡ ہُوَ مُسۡرِفٌ کَذَّابٌ ﴿۲۸﴾
ফেরাউনের দরবারের এক ব্যক্তি যে তার ঈমান গোপন রেখেছিলো- বললোঃ তোমরা কি এক ব্যক্তিকে শুধু এ কারণে হত্যা করবে যে, সে বলে, আল্লাহ‌ আমার রব? অথচ সে তোমাদের রবের পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে সুস্পষ্ট নিদর্শনসমূহ নিয়ে এসেছে। সে মিথাবাদী হয়ে থাকলে তার মিথ্যার দায়-দায়িত্ব তারই। কিন্তু সে যদি সত্যবাদী হয়ে থাকে তাহলে যেসব ভয়ানক পরিণামের কথা সে বলছে তার কিছুটা তো অবশ্যই তোমাদের ওপর আসবে। আল্লাহ‌ কোন সীমালংঘনকারী মিথ্যাবাদী লোককে হিদায়াত দান করেন না।
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:২৯
یٰقَوۡمِ لَکُمُ الۡمُلۡکُ الۡیَوۡمَ ظٰہِرِیۡنَ فِی الۡاَرۡضِ ۫ فَمَنۡ یَّنۡصُرُنَا مِنۡۢ بَاۡسِ اللّٰہِ اِنۡ جَآءَنَا ؕ قَالَ فِرۡعَوۡنُ مَاۤ اُرِیۡکُمۡ اِلَّا مَاۤ اَرٰی وَ مَاۤ اَہۡدِیۡکُمۡ اِلَّا سَبِیۡلَ الرَّشَادِ ﴿۲۹﴾
‘হে আমার সম্প্রদায়! আজ তোমাদেরই রাজত্ব, যমীনে তোমরাই প্রভাবশালী; কিন্তু আমাদের উপর আল্লাহর শাস্তি এসে পড়লে কে আমাদেরকে সাহায্য করবে?’ ফিরআউন বলল, ‘আমি যা সঠিক মনে করি, তা তোমাদেরকে দেখাই। আর আমি তোমাদেরকে শুধু সঠিক পথই দেখিয়ে থাকি।’
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:৩০
وَ قَالَ الَّذِیۡۤ اٰمَنَ یٰقَوۡمِ اِنِّیۡۤ اَخَافُ عَلَیۡکُمۡ مِّثۡلَ یَوۡمِ الۡاَحۡزَابِ ﴿ۙ۳۰﴾
যে ঈমান এনেছিল সে আরও বলল, ‘হে আমার সম্প্রদায়! নিশ্চয় আমি তোমাদের জন্য পূর্ববর্তী দলসমূহের দিনের অনুরূপ আশংকা করি—
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:৩১
مِثۡلَ دَاۡبِ قَوۡمِ نُوۡحٍ وَّ عَادٍ وَّ ثَمُوۡدَ وَ الَّذِیۡنَ مِنۡۢ بَعۡدِہِمۡ ؕ وَ مَا اللّٰہُ یُرِیۡدُ ظُلۡمًا لِّلۡعِبَادِ ﴿۳۱﴾
‘যেমন ঘটেছিল নূহ, ‘আদ, সামূদ এবং তাদের পরবর্তীদের ব্যাপারে। আর আল্লাহ্ বান্দাদের প্রতি কোন যুলুম করতে চান না।
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:৩২
وَ یٰقَوۡمِ اِنِّیۡۤ اَخَافُ عَلَیۡکُمۡ یَوۡمَ التَّنَادِ ﴿ۙ۳۲﴾
হে কওম, আমার ভয় হয়, তোমাদের ওপর ফরিয়াদ ও অনুশোচনা করার দিন না এসে পড়ে,
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:৩৩
یَوۡمَ تُوَلُّوۡنَ مُدۡبِرِیۡنَ ۚ مَا لَکُمۡ مِّنَ اللّٰہِ مِنۡ عَاصِمٍ ۚ وَ مَنۡ یُّضۡلِلِ اللّٰہُ فَمَا لَہٗ مِنۡ ہَادٍ ﴿۳۳﴾
‘যেদিন তোমরা পিছনে ফিরে পালাতে চাইবে, আল্লাহর শাস্তি হতে রক্ষা করার কেউ থাকবে না। আর আল্লাহ্ যাকে বিভ্রান্ত করেন, তার জন্য কোন হেদায়াতকারী নেই।’
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:৩৪
وَ لَقَدۡ جَآءَکُمۡ یُوۡسُفُ مِنۡ قَبۡلُ بِالۡبَیِّنٰتِ فَمَا زِلۡتُمۡ فِیۡ شَکٍّ مِّمَّا جَآءَکُمۡ بِہٖ ؕ حَتّٰۤی اِذَا ہَلَکَ قُلۡتُمۡ لَنۡ یَّبۡعَثَ اللّٰہُ مِنۡۢ بَعۡدِہٖ رَسُوۡلًا ؕ کَذٰلِکَ یُضِلُّ اللّٰہُ مَنۡ ہُوَ مُسۡرِفٌ مُّرۡتَابُۨ ﴿ۚۖ۳۴﴾
আর অবশ্যই পূর্বে তোমাদের কাছে ইউসুফ এসেছিলেন স্পষ্ট প্রমাণাদিসহ; অতঃপর তিনি তোমাদের কাছে যা নিয়ে এসেছিলেন তোমরা তাতে সর্বদা সন্দেহ করেছিলে। পরিশেষে যখন তার মৃত্যু হল তখন তোমরা বলেছিলে, ‘তার পরে আল্লাহ্‌ আর কোন রাসূল প্রেরণ করবেন না।’ এভাবেই আল্লাহ্ যে সীমালংঘনকারী, সংশয়বাদী তাকে বিভ্ৰান্ত করেন —
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:৩৫
الَّذِیۡنَ یُجَادِلُوۡنَ فِیۡۤ اٰیٰتِ اللّٰہِ بِغَیۡرِ سُلۡطٰنٍ اَتٰہُمۡ ؕ کَبُرَ مَقۡتًا عِنۡدَ اللّٰہِ وَ عِنۡدَ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا ؕ کَذٰلِکَ یَطۡبَعُ اللّٰہُ عَلٰی کُلِّ قَلۡبِ مُتَکَبِّرٍ جَبَّارٍ ﴿۳۵﴾
আল্লাহ‌র আয়াতসমূহের ব্যাপারে ঝগড়া করে। অথচ এ ব্যাপারে তাদের কাছে কোন সনদ বা প্রমাণ আসেনি। আল্লাহ ও ঈমানদারদের কাছে এ আচরণ অত্যন্ত ক্রোধ উদ্রেককারী। এভাবে আল্লাহ‌ প্রত্যেক অহংকারী ও স্বেচ্ছাচারীর মনে মোহর লাগিয়ে দেন।
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:৩৬
وَ قَالَ فِرۡعَوۡنُ یٰہَامٰنُ ابۡنِ لِیۡ صَرۡحًا لَّعَلِّیۡۤ اَبۡلُغُ الۡاَسۡبَابَ ﴿ۙ۳۶﴾
ফিরআউন বলল, ‘হে হামান! আমার জন্য তুমি এক সুউচ্চ প্রাসাদ নির্মাণ কর; যাতে আমি আকাশ ছুঁয়ে যেতে পারি।
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:৩৭
اَسۡبَابَ السَّمٰوٰتِ فَاَطَّلِعَ اِلٰۤی اِلٰہِ مُوۡسٰی وَ اِنِّیۡ لَاَظُنُّہٗ کَاذِبًا ؕ وَ کَذٰلِکَ زُیِّنَ لِفِرۡعَوۡنَ سُوۡٓءُ عَمَلِہٖ وَ صُدَّ عَنِ السَّبِیۡلِ ؕ وَ مَا کَیۡدُ فِرۡعَوۡنَ اِلَّا فِیۡ تَبَابٍ ﴿٪۳۷﴾
‘আসমানে আরোহণের অবলম্বন, যেন দেখতে পাই মূসার ইলাহকে; আর নিশ্চয় আমি তাকে মিথ্যাবাদী মনে করি।’ আর এভাবে ফির’আউনের কাছে শোভনীয় করা হয়েছিল তার মন্দ কাজকে এবং তাকে নিবৃত্ত করা হয়েছিল সরল পথ থেকে এবং ফির’আউনের ষড়যন্ত্র কেবল ব্যর্থই ছিল।
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:৩৮
وَ قَالَ الَّذِیۡۤ اٰمَنَ یٰقَوۡمِ اتَّبِعُوۡنِ اَہۡدِکُمۡ سَبِیۡلَ الرَّشَادِ ﴿ۚ۳۸﴾
যে ব্যক্তি ঈমান এনেছিলো, বললোঃ হে আমার কওমের লোকেরা, আমার কথা মেনে নাও। আমি তোমাদেরকে সঠিক পথের সন্ধান দিচ্ছি।
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:৩৯
یٰقَوۡمِ اِنَّمَا ہٰذِہِ الۡحَیٰوۃُ الدُّنۡیَا مَتَاعٌ ۫ وَّ اِنَّ الۡاٰخِرَۃَ ہِیَ دَارُ الۡقَرَارِ ﴿۳۹﴾
‘হে আমার সম্প্রদায়! এ দুনিয়ার জীবন কেবল অস্থায়ী ভোগের বস্তু, আর নিশ্চয় আখিরাত, তা হচ্ছে স্থায়ী আবাস।
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:৪০
مَنۡ عَمِلَ سَیِّئَۃً فَلَا یُجۡزٰۤی اِلَّا مِثۡلَہَا ۚ وَ مَنۡ عَمِلَ صَالِحًا مِّنۡ ذَکَرٍ اَوۡ اُنۡثٰی وَ ہُوَ مُؤۡمِنٌ فَاُولٰٓئِکَ یَدۡخُلُوۡنَ الۡجَنَّۃَ یُرۡزَقُوۡنَ فِیۡہَا بِغَیۡرِ حِسَابٍ ﴿۴۰﴾
হে কওম, দুনিয়ার এ জীবন তো কয়েক দিনের জন্য। একমাত্র আখেরাতই চিরদিনের অবস্থানস্থল।
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:৪১
وَ یٰقَوۡمِ مَا لِیۡۤ اَدۡعُوۡکُمۡ اِلَی النَّجٰوۃِ وَ تَدۡعُوۡنَنِیۡۤ اِلَی النَّارِ ﴿ؕ۴۱﴾
হে কওম, কি ব্যাপার যে, আমি তোমাদেরকে মুক্তির দিকে আহ্বান জানাচ্ছি আর তোমরা আমাকে আগুনের দিকে আহ্বান জানাচ্ছো।
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:৪২
تَدۡعُوۡنَنِیۡ لِاَکۡفُرَ بِاللّٰہِ وَ اُشۡرِکَ بِہٖ مَا لَیۡسَ لِیۡ بِہٖ عِلۡمٌ ۫ وَّ اَنَا اَدۡعُوۡکُمۡ اِلَی الۡعَزِیۡزِ الۡغَفَّارِ ﴿۴۲﴾
‘তোমরা আমাকে ডাকছ যাতে আমি আল্লাহর সাথে কুফরী করি এবং তাঁর সাথে শরীক করি, যে ব্যাপারে আমার কোন জ্ঞান নেই; আর আমি তোমাদেরকে ডাকছি পরাক্রমশালী, ক্ষমাশীলের দিকে।
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:৪৩
لَا جَرَمَ اَنَّمَا تَدۡعُوۡنَنِیۡۤ اِلَیۡہِ لَیۡسَ لَہٗ دَعۡوَۃٌ فِی الدُّنۡیَا وَ لَا فِی الۡاٰخِرَۃِ وَ اَنَّ مَرَدَّنَاۤ اِلَی اللّٰہِ وَ اَنَّ الۡمُسۡرِفِیۡنَ ہُمۡ اَصۡحٰبُ النَّارِ ﴿۴۳﴾
‘নিঃসন্দেহ যে, তোমরা আমাকে যার দিকে ডাকছ, সে দুনিয়া ও আখিরাতে কোথাও ডাকের যোগ্য নয়। আর আমাদের ফিরে যাওয়া তো আল্লাহর দিকে এবং নিশ্চয় সীমালংঘনকারীরা আগুনের অধিবাসী।
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:৪৪
فَسَتَذۡکُرُوۡنَ مَاۤ اَقُوۡلُ لَکُمۡ ؕ وَ اُفَوِّضُ اَمۡرِیۡۤ اِلَی اللّٰہِ ؕ اِنَّ اللّٰہَ بَصِیۡرٌۢ بِالۡعِبَادِ ﴿۴۴﴾
‘সুতরাং তোমরা অচিরেই স্মরণ করবে যা আমি তোমাদেরকে বলছি এবং আমি আমার ব্যাপার আল্লাহর নিকট সমর্পণ করছি; নিশ্চয় আল্লাহ তার বান্দাদের ব্যাপারে সর্বদ্ৰষ্টা।’

ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-

*স্বৈরাচারী শাষকের সামনে মোমেনের বলিষ্ঠ ভাষণ : এই পর্যায়ে আত্মপ্রকাশ করলাে ফেরাউনের অনুসারীদের মধ্য থেকে একব্যক্তি, যার অন্তরে সত্যপ্রেম ঢুকে পড়েছিলাে। কিন্তু সে নিজের ঈমানকে লুকিয়ে রেখেছিলাে। সে মূসার পক্ষে কথা বললাে, তার লােকদেরকে তার ক্ষতি করা থেকে বিরত রাখার কৌশল অবলম্বন করলাে। সে ফেরাউন ও তার সভাসদদেরকে বিভিন্ন পন্থায় উপদেশ দিয়ে এবং ভয় দেখিয়ে ও বুঝ দিয়ে তাদের অন্তরে সংবেদনশীলতা সৃষ্টির চেষ্টা করলাে। ‘ফেরাউনের বংশের একব্যক্তি যে মােমেন ছিলাে এবং নিজের ঈমান গােপন রেখেছিলাে, সে বললাে, তােমরা কি একজন মানুষকে শুধু এ জন্যেই হত্যা করবে যে, সে আমার প্রভু আল্লাহ’ এই কথা বলে?…’(আয়াত ২৮-৩৫) কুচক্রী ফেরাউন ও তার সভাসদদের সাথে আলােচনার যে ঝুঁকি এই ব্যক্তি গ্রহণ করেছিলাে, তা বাস্তবিকই বিপজ্জনক ছিলাে। সতর্কতা, দক্ষতা ও শক্তি সর্বদিক দিয়েই একজন মােমেনের স্বভাবসুলভ পরিপক্কতা ও যুক্তির তীক্ষ্মতা এ ভাষণে ফুটে উঠেছে। প্রথমেই ব্যক্তি এই বলে তাদের পরিকল্পনার ভয়াবহতা ব্যক্ত করলাে! ‘তােমরা কি একজন মানুষকে শুধু এ জন্যেই হত্যা করবে যে ব্যক্তি বলে, ‘আমার প্রভু আল্লাহ।’ অন্তরের সন্তোষ ও বিশ্বাসের সাথে সংশ্লিষ্ট এই নিম্পাপ কথাটা বলায় কি এতােই বড় অপরাধ হয়ে গেছে যে, সে তােমাদের কাছে হত্যার যােগ্য বিবেচিত হচ্ছে। এটাতাে আসলে একটা জঘন্য অন্যায় ও দূষণীয় কাজ। এরপর তাদের সাথে সে আরাে একধাপ অগ্রসর হয়। যে ব্যক্তি আল্লাহ আমার রব এই চমৎকার কথাটা উচ্চারণ করতে পারে, তার কাছে এর যুক্তি প্রমাণও অবশ্যই থাকার কথা। তাই সে বলে! সে তােমাদের প্রতিপালকের কাছ থেকে অকাট্য প্রমাণাদি নিয়ে এসেছে।’ এ দ্বারা সে হযরত মূসার প্রদর্শিত অলৌকিক ঘটনাগুলাের প্রতি ইংগিত দিয়েছে। সে সব ঘটনা তারা সচক্ষে। দেখেছে এবং তা নিয়ে কারাে সন্দেহের অবকাশ ছিলাে না। এরপর সে বিচার বিবেচনার খাতিরে সবচেয়ে খারাপ ধারণাটা মেনে নিয়ে বলছে; সে যদি মিথ্যুক হয়ে থাকে, তবে তার মিথ্যার দায় তার ঘাড়েই পড়বে। অর্থাৎ তার অপকর্মের শাস্তি সে নিজেই ভোগ করবে। কিন্তু এ জন্যে তাকে হত্যা করা কোনাে অবস্থাতেই বৈধ হতে পারে না। অন্য একটা সম্ভাবনাও এখানে রয়েছে যে, সে সত্যবাদীও হয়ে বসতে পারে। এই সম্ভাবনার খাতিরে সতর্কতা অবলম্বন করাই উত্তম। আর যদি সে সত্যবাদী হয়, তাহলে সে যেসব জিনিসের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে, তার অন্তত কিছু কিছু অংশ সত্য হয়ে তােমাদেরকে আক্রান্ত করতে পারে।’ আর তার প্রতিশ্রুতি কিছু কিছু জিনিস দ্বারা তাদের আক্রান্ত হওয়াও নিছক একটা সম্ভাবনা মাত্র। বস্তুত তাদের কাছে সে এর চেয়ে বেশী কিছু দাবী জানাতে পারবে না। তর্কের ক্ষেত্রে এটুকুই সর্বোচ্চ ন্যায়বিচার হিসাবে চিহ্নিত হয়ে থাকে। এরপর সে অত্যন্ত কৌশলে ও গােপনে তাদেরকে একটা হুমকি দিচ্ছে। এ হুমকি হযরত মূসা ও তাদের ক্ষেত্রে সমভাবে প্রযােজ্য; ‘নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা সেই ব্যক্তিকে সুপথ দেখান না, যে সীমা অতিক্রমকারী ও অতিমাত্রায় মিথ্যুক।’ মূসা যদি মিথ্যুক ও সীমা অতিক্রমকারী হয়ে থাকে, তাহলে আল্লাহ তায়ালা তাকে সুপথ দেখাবেন না ও সৎ কাজের শক্তি যােগাবেন না। কাজেই তাকে তার কর্মফল ভােগ করতে দাও। তােমরা সাবধান থাকো যেন তােমরাই মূসা ও তার প্রতিপালকের ওপর মিথ্যা আরাপকারী না হও, সীমা অতিক্রমকারী না হও এবং এর কু-ফল ভােগ না করাে। মিথ্যাবাদী ও সীমা অতিক্রমকারীকে আল্লাহর পক্ষ থেকে শান্তি দেয়া হবে- এ কথা জানানাের পর সে তাদেরকে আল্লাহর আযাবের ভয় দেখাচ্ছে এবং হুঁশিয়ার করে দিচ্ছে যে, রাজত্ব ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কাউকে আযাব থেকে রক্ষা করবে না। সেই সাথে তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে যে, এই নেয়ামত এমন জিনিস, যার শােকর করা কর্তব্য এবং অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ থেকে বিরত থাকা উচিত। ‘হে আমার জাতি, আজ রাজত্ব তােমাদের, তােমরাই পৃথিবীতে বিজয়ী শক্তি। কিন্তু আল্লাহর আযাব যদি এসে পড়ে, তাহলে কে আমাদেরকে তা থেকে রক্ষা করবে?’ এখানে দেখা যাচ্ছে যে, এই মােমেন ব্যক্তি অন্যান্য মােমেনের মতােই অনুভব করে যে, পৃথিবীর রাজা ও শাসকরা আল্লাহর আযাবের সবচেয়ে নিকটবর্তী, তাই তাদেরও তা থেকে সতর্ক থাকা উচিত। কেননা এই আযাব তাদের জন্যে দিনরাত অপেক্ষা করছে। তাই তাদেরকে সে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে যে, তাদেরকে রাজত্ব ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ন্যায় নেয়ামত দেয়া হয়েছে। অতপর বলছে! আল্লাহর আযাব যদি আমাদের ওপর এসে পড়ে তাহলে কে আমাদেরকে রক্ষা করবে? এ কথা বলে সে বুঝাচ্ছে যে, তাদের বিপদ আপদ সম্পর্কে সে উদ্বিগ্ন ও চিন্তিত। কেননা সে তাদেরই একজন এবং তাদের যে পরিণতি হবে, সেও তারই জন্যে অপেক্ষমান। তাই সে তাদের হিতাকাংখী। সে ভেবেছিলাে যে, এতে তারা তার সতর্কবাণীতে কর্ণপাত করবে এবং তাকে নির্দোষ ও আন্তরিক মনে করবে। কেননা সে তাদেরকে এই বলে সতর্ক করার চেষ্টা করছে যে, আল্লাহর আযাব এসে গেলে তা থেকে কেউ রক্ষা করতে ও সাহায্য করতে পারবে না। কেননা তারা তার সামনে খুবই দুর্বল। এখানে ফেরাউন অন্যান্য একনায়কের মতােই তার উপদেশকে শুধু প্রত্যাখ্যানই করলাে না, বরং সে এতে অপমান বােধ করলাে। এই আন্তরিক সদুপদেশ ও কল্যাণকামীতাকে সে তার ক্ষমতায় হস্তক্ষেপ, তার প্রতাপ ও পরাক্রমের ঘাটতি এবং তার ক্ষমতা ও প্রতিপত্তিতে ভাগ বসানাের অভিলাষ হিসাবে বিবেচনা করলাে। তাই তার প্রতিক্রিয়া দাঁড়ালাে এ রকম। ‘ফেরাউন বললাে, আমি যা বুঝি, তাই তােমাদেরকে বলছি। আর আমি তােমাদেরকে কেবল কল্যাণের পথ দেখাচ্ছি।’ অর্থাৎ আমি যা সঠিক ও উপকারী মনে করছি সেটাই তােমাদেরকে বলছি। আমি যা বলছি, নিসন্দেহে সেটাই নির্ভুল। একনায়করা কি কখনাে সঠিক ও কল্যাণকর পথ দেখতে পায়। তারা ভুল করতে পারে বলে কেউ ভাবুক এটা কি তারা বরদাশত করতে পারে। তাদের মতামতের বিপক্ষে কেউ কি কোনাে বিকল্প মত দিতে পারে? তা যদি পারতাে, তাহলে তারা একনায়ক হবে কেন? কিন্তু এই মােমেন লােকটার ঈমান অন্যরকম ছিলাে। সে বুঝতে পেরেছিলাে যে, সতর্ক করা, উপদেশ দেয়া এবং নিজের বিবেচনায় যা ভালাে মনে করে তা ব্যক্ত করা তার দায়িত্ব। একনায়ক ও স্বৈরাচারী মতামত যা হয় হোক। সত্যের পক্ষে অবস্থান নেয়া তার কর্তব্য এরপর সে তাদের বিবেককে জাগ্রত করা ও নম্র করার জন্যে ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে। পরবর্তী আয়াতে এই ভিন্ন পন্থার উল্লেখ রয়েছে। সেটা এই যে, কে তাদেরকে পূর্ববর্তী জাতিগুলাের ধ্বংসের কাহিনীর দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সেই জাতিগুলা দেখেছে আল্লাহর আযাব কিভাবে অস্বীকারকারী ও স্বৈরাচারীদেরকে পাকড়াও করে। ঈমান আনয়নকারী লােকটা বললাে, হে আমার জাতি, আমার আশংকা হয়, পূর্বতন জতিগুলাের ন্যায় বিপজ্জনক দিন তােমাদের ওপর এসে পড়ে কিনা। নূহের জাতি, আদ, সামুদ ও তাদের পরবর্তীদের ন্যায় বিপজ্জনক দিন। আল্লাহ তায়ালা তার বান্দাদের ওপর অত্যাচার করতে চান না। প্রত্যেক জাতির জন্যেই একটা নির্দিষ্ট দিন ছিলাে। কিন্তু এই মােমেন ব্যক্তি সকলের দিনকে একই দিনে সমবেত করেছে। বস্তুত এ দিনটা হলাে আল্লাহর আযাব দেখা দেয়ার দিন। জাতি যতই ভিন্ন ভিন্ন হােক, তাদের এই দিনের প্রকৃতিটা ছিলাে একই রকম। আল্লাহ তায়ালা তার বান্দাদের ওপর অত্যাচার করতে চান না। অর্থাৎ শুধু অপরাধীর শাস্তি দিয়ে তার চারপাশের ও পরবর্তীকালের মানুষকে সংশােধন করতে চান। এরপর এই মােমেন ব্যক্তি তাদের ভেতরে চেতনা সঞ্চারের জন্যে আরাে একটা দিন কেয়ামতের দিনের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে, ‘হে আমার জাতি তােমাদের ওপর আশংকা করি কেয়ামতের দিনের…'(আয়াত ৩২-৩৩) সেদিন ফেরেশতারা লােকজনকে মাঠে সমবেত হবার জন্যে ডাকবে। আ’রাফের অধিবাসীরা দোযখবাসী ও বেহেশতবাসীকে, দোযখবাসীরা বেহেশতবাসীকে এবং বেহেশতবাসীরা দোযখবাসীকে ডাকবে। এভাবে সেদিন নানাভাবে ডাকাডাকি হতে থাকবে। একে এখানে ইয়াওমুত তানাদি (ডাকাডাকির দিন) বলা দ্বারা এর এমন একটা চিত্র ফুটে উঠেছে যে, এখান থেকে ওখান থেকে ডাকাডাকি ও ঝগড়াঝাটি চলতে থাকবে। এটা মােমেন ব্যক্তিটার এই কথার সাথেও সংগতিপূর্ণ; ‘যেদিন তােমরা পালাবে, আল্লাহ ছাড়া তােমাদের কোনাে রক্ষক থাকবে না। এই পালানাের কারণ জাহান্নামের ভীতিও হতে পারে, অথবা এটা নিছক পালানাের চেষ্টাই হবে। কিন্তু সেদিন কোনাে রক্ষকও থাকবে না, পালানােরও কোনাে জায়গা থাকবে না। এখানে পালানাের ভয়ভীতির যে চিত্র আঁকা হয়েছে, পৃথিবীর একনায়ক শাসক ও অহংকারীদের বেলায় এটাই এ ধরনের প্রথম চিত্র। আর আল্লাহ তায়ালা যাকে গােমরাহ করবেন, তার কোনাে পথপ্রদর্শক নেই।’ সম্ভবত এটা ফেরাউনের এই কথাটার দিকে সুক্ষ্ম কটাক্ষ; ‘আমি তােমাদেরকে কেবল সঠিক পথই দেখাই।’ এখানে বলা হচ্ছে যে, আল্লাহর পথ প্রদর্শনই প্রকৃত পথ প্রদর্শন। তিনি যাকে বিপথগামী করেন, তার আর কোনাে পথ প্রদর্শক নেই। কেননা আল্লাহ তায়ালাই মানুষের প্রকৃত অবস্থা জানেন। সেই অনুসারেই তিনি কে হেদায়াতের যােগ্য এবং কে যােগ্য নয় তা স্থির করেন। সবার শেষে এই মােমেন ব্যক্তি তাদেরকে হযরত ইউসুফের কথা তাদের স্মরণ করাচ্ছে। মূসা(আ.) তারই বংশধর। এই ব্যক্তি তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে যে, কিভাবে হযরত ইউসুফকে অবিশ্বাস ও সন্দেহ করা হয়েছে। কাজেই হযরত মূসার সাথেও তাদের একই আচরণ করা উচিত। কেননা তিনি হযরত ইউসুফের আনীত জীবন বিধানের সমর্থক ছিলেন। কিন্তু তবুও তারা তার ওপর সন্দেহ করতাে। তারা একথাও বলতাে যে, হযরত ইউসুফের পর আল্লাহ তায়ালা আর কোনাে রসূল পাঠাবেন না। হযরত মূসা হযরত ইউসুফের কিছুকাল পরে এসেছেন এবং উক্ত কথা মিথ্যা সাব্যস্ত করেন। (আয়াত ৩৪,৩৫) কোরআনে এই একবারই মিসরের জনগণের প্রতি হযরত ইউসুফের রসূলরূপে আগমনের উল্লেখ করা হয়েছে। সূরা ইউসূফ থেকে আমরা এতােটুকু জেনেছি যে, তিনি মিসরের রাষ্ট্র্রক্ষমতার মালিক হয়েছিলেন এবং তিনি মিসরের আযীয’ বা প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। সূরা ইউসুফ থেকে এ ধারণাও পাওয়া যায় যে, তিনি মিসরের সিংহাসনে আরােহন করেছিলেন, তবে এ ব্যাপারটা সুনিশ্চিত নয়। কেননা আয়াতে বলা হয়েছে; ‘তিনি তার পিতামাতাকে সিংহাসনে আরােহন করালেন…’ এমনও হতে পারে যে, তিনি তার পিতামাতাকে যে সিংহাসনে আরােহন করিয়েছিলেন, তা মিসরীয় সম্রাট ফেরাউনের সিংহাসন নয়। সে যাই হােক, এ কথা নিশ্চিত যে, হযরত ইউসুফ শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। এ থেকে আমরা কল্পনা করতে পারি এই মােমেন ব্যক্তি কোন পরিস্থিতির দিকে ইংগিত করেছে। সেটা হলো, হযরত ইউসুফের আনীত শরীয়ত ও বিধান সম্পর্কে তাদের সন্দেহ পােষণ, ইউসুফের ক্ষমতাসীন হওয়ার কারণে তার সাথে তাদের আপস করা ও তাকে প্রকাশ্যে অস্বীকার করতে না পেরে কেবল মনে মনে সন্দেহ পােষণ। অতপর তিনি যখন মারা গেলেন তখন তােমরা বললে, আল্লাহ তায়ালা তাঁর পর আর কোনাে রসূল পাঠাবেন না।’ অর্থাৎ তারা যেন তার মৃত্যুতে হাপ ছেড়ে বেঁচেছে। ফলে তারা এভাবে তাদের আনন্দ প্রকাশ করেছে এবং তার প্রচারিত নির্ভেজাল তাওহীদের প্রতি অনীহা প্রকাশ করেছে। এই তাওহীদ তিনি কারাগারে বসেও প্রচার করেছেন। তিনি তার দুই সাথীকে বলেছিলেন; ‘বহুসংখ্যক প্রভু ভালাে, না এক ও অদ্বিতীয় পরাক্রমশালী আল্লাহ তায়ালা?’ তারা দাবী করতাে যে, তার পর আর কোনাে রসূল তাদের কাছে আসবে না। কেননা তারা আসলে এটাই চাইতাে। মানুষ অনেক সময় যা কামনা করে, সেটাই বাস্তবায়িত হয়েছে বলে বিশ্বাস করে। কেননা তার বাস্তবায়নেই তার কামনা পূর্ণ হয়। তাদের একগুয়েমির কারণে মােমেন লোকটা এই পর্যায়ে এসে খানিকটা কঠোর ভূমিকায় আসে। এখানে সে সন্দেহ ও সীমা অতিক্রমকে প্রত্যাখ্যানের পর্যায়ভুক্ত করে। তাই সে বলে; ‘এভাবেই আল্লাহ তায়ালা সীমা অতিক্রমকারী ও সন্দেহকারীকে গােমরাহ করেন।’ এভাবে সে সতর্ক করছে যে, অকাট্য প্রমাণ থাকা সত্তেও যে ব্যক্তি সন্দেহ পােষণ করে ও সীমা অতিক্রম করে, আল্লাহ তায়ালা তাকে গােমরাহ করেন। এরপর সে তাদেরকে আল্লাহর ঘৃণা ও মােমেনদের ঘৃণার সম্মুখীন হবার হুমকি দেয়। কেননা তারা কোনাে যুক্তি ও প্রমাণ ছাড়া আল্লাহর নিদর্শনাবলী নিয়ে তর্কে লিপ্ত হয়। তারাই এ কাজটা সবচেয়ে জঘন্য আকারে করে। এরপর সে অহংকারের নিন্দা জানায় এবং অহংকারীদের মনকে আল্লাহ তায়ালা নিস্কৃয় করে দেয়ার হুমকি দেন; যারা কোনাে প্রমাণ ছাড়াই আল্লাহর আয়াত নিয়ে বিতর্ক করে। তাদের এ কাজ আল্লাহর কাছে ও মােমেনদের কাছে ঘৃণার্হ। এভাবেই আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক অহংকারী স্বৈরাচারীর মনের ওপর মােহর মেরে দেন। এই মােমেন ব্যক্তির মুখ দিয়ে যে কথাগুলাে উচ্চারিত হয়েছে, তা বলতে গেলে এ সূরার প্রথম দিককার বক্তব্যগুলাের হুবহু প্রতিলিপি। প্রমাণ ছাড়া আল্লাহর আয়াত নিয়ে বিতর্ককারীদের প্রতি ঘৃণা এবং অহংকারীদেরকে বিপথগামীকরণ, যার ফলে তাদের অন্তরে আর হেদায়াত গ্রহণের ও উপলব্ধির আর কোনাে স্থান অবশিষ্ট থাকে না এগুলাে সূরার প্রথমাংশে রয়েছে।

** এই মােমেন ব্যক্তি অনেক ঝুঁকি নিয়ে এ কথাগুলাে বলা সত্তেও ফেরাউন তার গোমরাহী চালিয়ে যেতে থাকলাে এবং সত্যের বিরােধিতা অব্যাহত রাখলাে। তবে সে বাহ্যত দেখালাে যে, সে মুসার দাবীগুলাের সত্যতা যাচাই করতে চায়। এখানে এটাও বুঝা যায় যে, এই মােমেন ব্যক্তির কথাবার্তা ও যুক্তি প্রমাণ অত্যন্ত প্রভাবশালী ও হৃদয়গ্রাহী প্রমাণিত হয়েছিলাে, যার কারণে ফেরাউন ও তার অনুসারীরা এটাকে অস্বীকার করতে পারেনি। এ জন্যে ফেরাউন নতুন ছুতাে খুঁজতে লাগলো; ‘ফেরাউন বললাে হে হামান, তুমি আমার জন্যে একটা সুউচ্চ প্রাসাদ নির্মাণ করাে…'(আয়াত ৩৬ -৩৭) অর্থাৎ হে হামান, আমার জন্যে একটা উচু দালান বানাও, হয়তাে তার ওপর চড়ে আমি আকাশ ও পৃথিবীর উপায় উপকরণ পেয়ে যাবে এবং সেখানে মূসার খােদা সত্যই আছে কিনা, তাও দেখবাে। ‘আসলে আমি তাে ওকে মিথ্যুক মনে করি’ এভাবে স্বৈরাচারী ফেরাউন ক্রমাগত ছলছুতাে অবলম্বন করতে থাকে, যাতে খোলাখুলি সত্যের বিরােধিতাও না হয়, আবার তাওহীদ মেনে নিয়ে সিংহাসনকে নড়বড়ে করে ফেলাও না হয় এবং তার রাজত্বের ভিত্তি যে পৌত্তলিকতার ওপর, তাও বিধ্বস্ত না হয়। এটা সম্ভব নয় যে, এসব উক্তি ফেরাউনের সুস্থ চিন্তা ও উপলব্ধির ফল। এটাও সম্ভব নয় যে, ফেরাউন এমন সহজ-সরল বস্তুবাদী উপায়ে যথার্থই মূসার মাবুদ অনুসন্ধান চালাতে চেয়েছিলো। মিসরের ফেরাউনরা সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে এমন মানে উন্নীত ছিলাে যে, এই ধারণা তার সাথে খাপ খায় না। আসলে এটা ছিলাে তার বিদ্রুপ উপহাস ও ঔদ্ধত্য প্রকাশের নামান্তর। অন্যদিক দিয়ে এটা তার ন্যায়নীতি প্রীতির একটা প্রদর্শনী এবং সত্যানুসন্ধানের একটা প্রহসনও ছিলাে হয়তােবা। এমনও হতে পারে যে, মােমেন ব্যক্তিটার ধারালাে যুক্তি তর্কের সাথে এঁটে উঠতে না পেরে সে এভাবে একটা ছলছুতাে উদ্ভাবন করতে চেয়েছিলাে। এই সব কটা সম্ভাব্য ব্যাখ্যা থেকেই সন্দেহাতীতভাবে বুঝা যায় যে, সে তার গােমরাহীর ওপর অনড় ছিলাে এবং মূসার দাওয়াতকে প্রত্যাখ্যানের ব্যাপারে অবিচল ছিলাে। আল্লাহ তায়ালা বলেন; এভাবেই ফেরাউনের কাছে তারা অপকর্মকে সুদর্শন করে দেখানাে হয়েছিলো এবং তাকে বিপথগামী করা হয়েছিলাে। বস্তুত সে গােমরাহীর যােগ্যও ছিলাে। কেননা এ ধরনের বিতর্ক তােলা দ্বারা সঠিক পথ থেকে বিচ্যুতি অনির্বাণ হয়ে দাঁড়ায়। আয়াতের শেষাংশের মন্তব্যে তার এই ছলছুতােকে তার ব্যর্থতা ও ধ্বংসের কারণ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। ‘ফেরাউনের চক্রান্ত সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছিলাে। এই ধৃষ্টতা ও ঔদ্ধত্যের পাশাপাশি সেই মােমেন ব্যক্তি তার সর্বশেষ বক্তব্য দ্ব্যর্থহীন ভাষায় পেশ করেছে। এর আগে সে জাতিকে তার পদাংক অনুসরণ করার আহ্বান জানিয়েছে এবং তাকে সে হেদায়াতের পথ বলে আখ্যায়িত করেছে। সে এই ক্ষণস্থায়ী পার্থিব জীবনের প্রকৃত ব্যাখ্যা করেছে, তাদেরকে চিরস্থায়ী আখেরাতের সুখ ঐশ্বর্যের প্রতি আগ্রহী হতে চলেছে আখেরাতের আযাব থেকে সতর্ক করেছে এবং শিরককে একটা বাতিল ও অচল মতবাদ বলে ঘােষণা করেছে।(আয়াত ৩৮-৪৪) এখানে যে কথাগুলাে বলা হয়েছে, তা সূরার প্রথমাংশে আলােচিত হয়েছে। মােমেন লােকটা পুনরায় ফেরাউনের মুখোমুখি হয়ে জনগণকে বলেছে; হে আমার জাতি, তােমরা আমার পদাংক অনুসরণ করাে। আমি তােমাদেরকে কল্যাণের পথে পরিচালিত করবাে।’ ওদিকে ফেরাউনও বলতাে যে, “আমি তােমাদেরকে কল্যাণের পথে পরিচালিত করবাে।’ এ থেকে বুঝা যায়, এই মােমেন ফেরাউনকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ দিয়ে সত্য কথা বলতে শুরু করেছে। স্বৈরাচারী ফেরাউন এবং তার সহযােগী হামান কারূণ প্রভৃতি মন্ত্রী ও সভাসদদেরকে সে আর ভয় করছে না। পার্থিব জীবনের স্বরূপ উল্লেখ করে বলা হয়েছে, হে আমার জাতি। এ পার্থিব জীবন তাে কেবল (কয়েকদিনের) উপভােগের বস্তু অর্থাৎ ক্ষণস্থায়ী ভােগের বস্তু, এর কোনাে স্থায়িত্ব নেই। অপরদিকে পরকালের জীবনই হচ্ছে স্থায়ী জীবন। সেই জীবনই হচ্ছে প্রকৃত জীবন। কাজেই সেই জীবনই মুখ্য হওয়া উচিত কাম্য হওয়া উচিত। এই চিরস্থায়ী জীবনে মানুষের কর্মের হিসাব নিকাশ ও ফলাফল কিসের ভিত্তিতে নির্ণয় করা হবে সে সম্পর্কে বলা হচ্ছে, যে মন্দ কর্ম করে, সে কেবল তারই অনুরূপ প্রতিফল পাবে…। (আয়াত ৪০) আল্লাহর বড়ই মেহেরবানী যে, তিনি পুণ্যের প্রতিদান দ্বিগুণ (মাঝে মাঝে আরাে বেশী) করে দেন। কিন্তু পাপের প্রতিদান দ্বিগুণ করেন না। এটা বান্দার প্রতি তার অপার করুণারই জ্বলন্ত নিদর্শন। তিনি তাঁর বান্দাদের দুর্বলতার কথা জানেন, পাপ-পুণ্যের প্রতি তাদের আকর্ষণ ও বিকর্ষণের কথা জানেন বলেই তাদের পুণ্যের পাল্লা ভারি করে দেন আর পাপের পাল্লা হাল্কা করে দেন। শুধু তাই নয়, বরং হিসাব নিকাশের পর যখন তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে তখন তাদেরকে সেখানে অগণিত নেয়ামত দান করবেন। এই মােমেন বান্দা তার জাতিকে মুক্তি ও কল্যাণের পথে ডাকছে, আর তার জাতি তাকে ডাকছে জাহান্নামের দিকে। তাই সে প্রতিবাদের সুরে এবং নিন্দার সুরে তাদেরকে বলছে, ‘হে আমার জাতি। কি আশ্চর্য ব্যাপার, আমি তােমাদেরকে ডাকছি মুক্তির দিকে, আর তােমরা আমাকে ডাকছাে জাহান্নামের দিকে’(আয়াত ৪১) তার জাতি তাকে কিন্তু জাহান্নামের দিকে আহ্বান করেনি, তারা তাকে আহ্বান করেছে শিরকের দিকে। শিরকের দিকে আহ্বান করা, আর জাহান্নামের দিকে আহ্বান করার মাঝে পার্থক্য কোথায়? কোনােই পার্থক্য নেই, বরং দুটোই পরস্পরের খুব নিকটে রয়েছে। তাই মােমেন ব্যক্তি এই পরস্পর বিরােধী দুটো আহ্বানকে ভিন্ন বর্ণনাভঙ্গিতে এভাবে প্রকাশ করছে, তােমরা আমাকে আহ্বান করছ, যাতে আমি আল্লাহকে অস্বীকার করি এবং তার সাথে এমন কাউকে শরীক করি যার কোনাে প্রমাণ আমার কাছে নেই।'(আয়াত ৪২) এই দু’ধরনের আহ্বানের মাঝে বিস্তর ফারাক রয়েছে। মােমেন ব্যক্তি তার জাতিকে যে আহ্বান জানাচ্ছে তা অত্যন্ত সুস্পষ্ট ও সরল। সে তাদেরকে মহাপরাক্রমশালী ও মহাক্ষমাশীল এক সত্ত্বার পানে আহ্বান জানাচ্ছে, এমন একক উপাস্যের পানে আহ্বান জানাচ্ছে যার একত্বের সাক্ষ্য বহন করছে গােটা সৃষ্টিজগত। তার কুশলী ও নিপুণ সৃষ্টি তার সৃষ্টি ক্ষমতা ও নিরুপম শৈলীর পরিচয় দিচ্ছে। তারা যাতে ক্ষমা লাভ করতে পারে, সে জন্য তাদেরকে মহান আল্লাহর দিকে ডাকছে। কারণ ক্ষমা করার শক্তি তার আছে। তিনি পরাক্রমশালী ও মহাক্ষমাশীল। কিন্তু সেই মােমেন বান্দাকে তার জাতি কিসের দিকে ডাকছে? আল্লাহকে অস্বীকার করার জন্যে ডাকছে, তার সাথে এমন কিছুকে শরীক করতে বলছে যে সম্পর্কে তার কোনাে জ্ঞান নেই। কারণ, সেসব হচ্ছে নিছক কুসংস্কার, কল্পনা ও গোলক ধাঁধা। এরপর মােমেন বান্দা সুস্পষ্ট ভাষায় ও সংশয়-সন্দেহবিহীন কষ্ঠে ঘােষণা দিয়ে সেই কল্পিত শরীকদের সম্পর্কে বলছে যে, ওদের করার মতাে কিছুই নেই। দুনিয়াতেও ওদের কোনাে প্রভাব নেই এবং পরকালেও ওদের কোনাে প্রভাব নেই। একমাত্র আল্লাহর কাছেই সকলকে ফিরে যেতে হবে। যারা সীমালংঘন করে তারা জাহান্নামীদের কাতারে শামিল হবে। বলা হচ্ছে, এতে সন্দেহ নেই যে, তােমরা আমাকে যার দিকে আহ্বান করছো ইহকালে ও পরকালে তার দিকে আহ্বান করা কারাে পক্ষেই শােভনীয় নয়…’(আয়াত ৪৩) ঈমান ও আকীদা সম্পর্কিত মৌলিক তত্ত্বের ব্যাপারে এই সুস্পষ্ট ও ব্যাপক অর্থবােধক বক্তব্যের পর আর কি প্রশ্ন থাকতে পারে? ফেরাউনের দরবারে তার সভাসদদের সম্মুখে দাঁড়িয়ে মােমেন ব্যক্তিটি প্রকাশ্যে ঘােষণা দিয়ে এই বক্তব্য পেশ করছে। প্রথমদিকে সে তার ঈমানের বিষয়টি লুকিয়ে রেখেছিলো। এখন আর কোনাে রাখঢাক নেই। সুস্পষ্ট ভাষায় তার মনের কথা সবার সামনে প্রকাশ করে নিজের বিবেককে হাল্কা করতে পেরেছে। তাই এখন নিজেকে আল্লাহর হাতে সপে দেয়া ছাড়া তার আর করার কিছু নেই। তবে সে তার জাতিকে জানিয়ে দিচ্ছে যে, তার এই কথাগুলােয় তারা এমন একদিন বুঝতে পারবে যেদিন এই বুঝ কোনাে উপকারেই আসবে না। কারণ তখন বিচারের ভার থাকবে আল্লাহর হাতে। তাই বলা হচ্ছে, ‘আমি তােমাদেরকে যা বলছি, তােমরা একদিন তা স্মরণ করবে। আমি আমার ব্যাপার আল্লাহর কাছে সমর্পণ করছি…’(আয়াত ৪৪)

তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
# সে তোমাদেরকে এমন সব সুস্পষ্ট নির্দশন দেখিয়েছে যে, সে যে তোমাদের রবের রসূল তা দিবালোকের মতো পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে। ফেরাউনের সভাসদদের মধ্যকার ঈমানদার ব্যক্তির ইঙ্গিত ছিল সে নিদর্শনসমূহের প্রতি যার বিস্তারিত বিবরণ পূর্বেই বর্ণিত হয়েছে। (তাফহীমুল কুরআন, আল আ’রাফ, টীকা ৮৭ , ৮৯ , ৯০ , ৯১ এবং ৯৪ থেকে ৯৬ ; বনী ইসরাঈল, টীকা ১১৩ থেকে ১১৬ ; ত্বা-হা, টীকা ২৯ থেকে ৫০ ; আশ শু’রা টীকা ২৬ থেকে ৩৯ ; আন নামল, টীকা ১৬ )।
# এরূপ সুস্পষ্ট নিদর্শন সত্ত্বেও তোমরা যদি তাঁকে মিথ্যাবাদী মনে করো, সে ক্ষেত্রেও তোমাদের জন্য উচিত তাঁকে তাঁর মতো চলতে দেয়া। কারণ, অপর সম্ভাবনা এবং অত্যন্ত জোরদার সম্ভাবনা হচ্ছে, সে সত্যবাদী। আর সেক্ষেত্রে তাঁকে হত্যা করে আল্লাহর আযাবে নিক্ষিপ্ত হবে। তাই তোমরা যদি তাঁকে মিথ্যাবাদীও মনে করো তবুও তাঁকে বাঁধা দিও না। সে যদি আল্লাহর নামে মিথ্যা কথা বলে থাকে তাহলে আল্লাহ‌ নিজেই তাঁর সাথে বুঝা পড়া করবেন। এর আগে হযরত মূসা আলাইহিস সালামও প্রায় অনুরূপ কথাই ফেরাউনকে বলেছিলেনঃ

وَإِنْ لَمْ تُؤْمِنُوا لِي فَاعْتَزِلُونِ (الدخان : 21)

“তোমরা যদি কথা না মানো তাহলে আমাকে আমার মত চলতে দাও।”

এখানে এ বিষয় লক্ষ্য রাখতে হবে যে, ফেরাউনের সভাসদদের মধ্যকার মু’মিন ব্যক্তি তার বক্তব্যের শুরুতে স্পষ্ট করে একথা বলেনি যে, সে হযরত মূসার (আ) প্রতি ঈমান এনেছে। ‌ প্রথম দিকে সে এমনভাবে তার বক্তব্য পেশ করেছে যাতে মনে হয় সে ফেরাউনের গোষ্ঠীরই একজন লোক এবং তার জাতির কল্যাণের জন্যই সে এ কথা বলছে। কিন্তু যখন সে দেখছে ফেরাউন ও সভাসদরা কোনক্রমেই সঠিক পথ অনুসরণ করতে চাচ্ছে না তখন শেষ মুহূর্তে সে তার ঈমানের গোপনীয়তা প্রকাশ করছে। পঞ্চম রুকূ’তে তার বক্তব্য থেকে তা প্রকাশ পাচ্ছে।
# এ আয়াতাংশের দু’টি অর্থ সম্ভব। ফেরাউনের সভাসদদের মধ্যকার ঈমান গ্রহণকারী ব্যক্তি হয়তো ইচ্ছা করেই এ দ্ব্যর্থবোধক শব্দটি এজন্য বলেছিলো যে, তখনো সে তার ধ্যান-ধারণা খোলাখুলি প্রকাশ করতে চাচ্ছিলো না। এর একটি তাৎপর্য হচ্ছে, একই ব্যক্তির মধ্যে সত্যবাদিতার মত গুণ এবং মিথ্যা ও অপবাদের মত দোষের সমাবেশ ঘটতে পারে না। তোমরা স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছো, মূসা ﷺ একজন অতীব পবিত্র চরিত্র এবং অত্যন্ত উন্নত স্বভাবের মানুষ। তোমাদের মন-মগজে একথা কি করে স্থান পায় যে, এক দিকে সে এত বড় মিথ্যাবাদী যে আল্লাহর নাম নিয়ে নবুওয়াতের ভিত্তিহীন দাবী করছে, অন্যদিকে তা সত্ত্বেও আল্লাহ‌ তাঁকে এরূপ উন্নত স্বভাব চরিত্র দান করেছেন। এর আরেকটি তাৎপর্য হচ্ছে, তোমরা যদি সীমালংঘনের মাধ্যমে মূসার (‌আ) প্রাণনাশের জন্য উঠে পড়ে লাগো এবং তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ এনে তোমাদের দূরভিসন্ধিমূলক পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করতে তৎপর হও তাহলে মনে রেখো, আল্লাহ‌ কখনো তোমাদেরকে সফল হতে দেবেন না।
# আল্লাহর দেয়া এ ক্ষমতা ও প্রতিপত্তিরূপ নিয়ামতের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ না করে নিজেদের জন্য তাঁর গযব ডেকে আনছো কেন?
# ফেরাউনের এ জবাব থেকে বুঝা যায় তার দরবারের এ সভাসদ যে মনে মনে ঈমান এনেছে, তা সে তখনো পর্যন্ত জানতে পারেনি। এ কারণে সে তার কথায় অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেনি বটে তবে একথা সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে যে, তার মতামত ও চিন্তা-ভাবনা শোনার পরও সে নিজের মত পাল্টাতে প্রস্তুত নয়।
# বান্দার সাথে আল্লাহর কোন শত্রুতা নেই যে, তিনি অযথা তাদের ধ্বংস করবেন। তিনি তাদের ওপর আযাব কেবল তখনই পাঠান যখন তারা সীমালঙ্ঘন করে। আর সে সময় তাদের ওপর আযাব তাঁর ন্যায় ও ইনসাফের দাবী হয়ে দাঁড়ায়।
# তোমাদের গোমরাহী এবং সে গোমরাহীর ব্যাপারে তোমাদের হঠকারিতার অবস্থা এই যে, মূসা আলাইহিস সাল্লামের পূর্বে তোমাদের দেশে ইউসুফ আলাইহিস সালাম নবী হয়ে এসেছিলেন। তাঁর সম্পর্কে তোমরা নিজেরাও স্বীকার করো যে, তিনি অত্যন্ত উন্নত স্বভাব-চরিত্রের অধিকারী ছিলেন, একথাও তোমরা স্বীকার করো যে, সে সময়ে তোমাদের ওপর যে দুর্ভিক্ষ এসেছিলো তৎকালীন বাদশাহর স্বপ্নের সঠিক ব্যাখ্যা বলে দিয়ে সাত বছর ব্যাপী সে ভয়ানক দুর্ভিক্ষের ধ্বংসকারিতা থেকে তিনি তোমাদের রক্ষা করেছিলেন। তোমাদের গোটা জাতি একথাও স্বীকার করে যে, তাঁর শাসনামলের চেয়ে অধিক ন্যায় ও ইনসাফ এবং কল্যাণ ও বরকতের যুগ মিসরে আর কখনো আসেনি। কিন্তু তাঁর এসব গুণাবলী জানা ও মানা সত্ত্বেও তোমরা তাঁর জীবদ্দশায় তাঁর ওপর কখনো ঈমান আনো নাই। তাঁর মৃত্যু হলে তোমরা বলতে শুরু করলে, তাঁর মত লোক কি আর কখনো জন্ম নিতে পারে? তোমরা তাঁর গুণাবলী স্বীকার করলেও পরবর্তী কালেও সেটিকেই যেন তোমরা পরবর্তী সমস্ত নবীকে অস্বীকার করার একটা স্থায়ী বাহানা বানিয়ে নিয়েছো। এর অর্থ, কোন অবস্থায়ই তোমরা হিদায়াত গ্রহণ করবে না।
# বাহ্যত মনে হয়, ফেরাউনের সভাসদদের মধ্যকার ঈমান গ্রহণকারী ব্যক্তির বক্তব্যের ব্যাখ্যা ও সংযোজনা হিসেবে আল্লাহ‌ তা’আলা পরবর্তী বাক্যগুলো বলেছেন।
# আল্লাহর পক্ষ থেকে সেসব লোককেই গোমরাহীতে নিক্ষেপ করা হয় যাদের মধ্যে এ তিনটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এক, তারা কুকর্মে সীমা লংঘন করে এবংস গোনাহ ও পাপাচারে এমনভাবে আসক্ত হয়ে পড়ে যে, নৈতিক চরিত্র সংশোধনের কোন আহবানই গ্রহণ করতে প্রস্তুত হয় না। দুই, নবী-রসূলদের (আলাইহিমুস সালাম) ব্যাপারে সন্দেহ-সংশয়ে লিপ্ত থাকা হয় তাদের স্থায়ী আচরণ। আল্লাহর নবী তাদের সামনে যত সুস্পষ্ট নিদর্শনই পেশ করুন না কেন, তারা তাঁর নবুওয়াতের ব্যাপারেও সন্দেহ পোষণ করে। তাছাড়া তাওহীদ ও আখেরাত সম্পর্কে তারা যেসব সত্য ও বাস্তবতা পেশ করেছেন তারা সেগুলোকেও সবসময় সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখে থাকে। তিন, তারা আল্লাহর‌ কিতাবের বাণীসমূহ সম্পর্কে যুক্তি গ্রাহ্য পন্থায় চিন্তা-ভাবনা করার পরিবর্তে কূট তর্কের দ্বারা তার মোকাবিলার চেষ্টা করে। তাদের এ কূট তর্কের ভিত্তি কোন জ্ঞানগত যুক্তি বা আসমানী কিতাবের সনদ নয় বরং প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত তাদের জিদ ও হঠকারিতাই তার একমাত্র ভিত্তি। যখন কোন গোষ্ঠীর মধ্যে এ তিনটি দোষ দেখা দেয় আল্লাহ‌ তখন তাদেরকে গোমরাহীর গহবরে নিক্ষেপ করেন। দুনিয়ার কোন শক্তিই তাদেরকে সেখান থেকে উদ্ধার করতে পারে না।
# বিনা কারণে কারো মনে মোহর লাগিয়ে দেয়া হয় না। যার মধ্যে অহংকার ও স্বেচ্ছাচারিতা সৃষ্টি হয় লা’নতের এ মোহর কেবল তার মনের ওপরেই লাগানো হয়। ‘তাকাববুর’ অর্থ ব্যক্তির মিথ্যা অহংকার যার কারণে ন্যায় ও সত্যের সামনে মাথা নত করাকে সে তার মর্যাদার চেয়ে নীচু কাজ বলে মনে করে। স্বেচ্ছাচারিতা অর্থ আল্লাহর সৃষ্টির ওপর জুলুম করা। এ জুলুমের অবাধ লাইসেন্স লাভের জন্য ব্যক্তি আল্লাহর শরীয়াতের বাধ্য-বাধকতা মেনে নেয়া থেকে দূরে থাকে।
# ফেরাউনের সভাসদদের মধ্যকার মু’মিন ব্যক্তির বক্তব্য পেশের সময় ফেরাউন হামানকে সম্বোধন করে একথা কিছুটা এমন ভঙিতে বলছে যেন ঐ মু’মিনের কথাকে আদৌ বিবেচনার যোগ্য বলে মনে করে না। তাই অহংকারী ভঙ্গিতে তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে হামানকে বলছে? আমার জন্য একটা উঁচু ইমরাত নির্মাণ করো। আমি দেখতে চাই, মূসা যে আল্লাহর কথা বলে সে আল্লাহ‌ কোথায় থাকে। (ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুর্‌আন, আল কাসাস, টীকা ৫২ , ৫৩ , ৫৪ )
# তোমরা যে এ পৃথিবীর অস্থায়ী ধন-সম্পদ ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে গর্বিত হয়ে আল্লাহকে ভুলে যাচ্ছো তা তোমাদের অজ্ঞতা।
# তারা আল্লাহর শরীক এ ব্যাপারে আমার কাছে কোন জ্ঞানগত প্রমাণ নেই। তাই আমি চোখ বন্ধ করে এত বড় কথা কি করে মেনে নিতে পারি যে, প্রভুত্বে তাদেরও অংশীদারিত্ব আছে এবং আল্লাহর বন্দেগী করার সাথে সাথে আমাকে তাদের বন্দেগীও করতে হবে।
# এ আয়াতাংশের কয়েকটি অর্থ হতে পারে। একটি অর্থ হচ্ছে, তাদের প্রভুত্ব মেনে নেয়ার জন্য আল্লাহ‌র সৃষ্টিকে দাওয়াত দেয়ার অধিকার তাদের দুনিয়াতেও নেই আখেরাতেও নেই। দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে, মানুষ জোর করে তাদেরকে ইলাহ বানিয়েছে। অন্যথায় তারা নিজেরা না দুনিয়াতে প্রভুত্বের দাবী করে, না আখিরাতে এ দাবী করবে যে, আমরাও ইলাহ ছিলাম। তোমরা আমাদেরকে কেন মেনে নাওনি? তৃতীয় অর্থ তাদেরকে ডাকার কোন উপকার না এই দুনিয়ায় আছে, না আখেরাতে আছে। কেননা, তারা একেবারেই ক্ষমতা ও কর্তৃত্বহীন এবং তাদেরকে ডাকা একেবারেই অর্থহীন।
# ‘সীমালঙ্ঘন করা” অর্থ ন্যায় ও সত্যকে লংঘন করা। যারা আল্লাহ‌ ছাড়া অন্য কারো প্রভুত্ব মেনে নেয় অথবা নিজেই প্রভু হয়ে বসে কিংবা আল্লাহর‌ বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে পৃথিবীতে নিজে স্বাধীন হওয়ার নীতি ও আচরণ করে এবং নিজের ওপর, আল্লাহর সমস্ত সৃষ্টির ওপর এবং পৃথিবীর যে জিনিসের সাথেই তারা সংশ্লিষ্ট হয় তার ওপরই অত্যাচার ও বাড়াবাড়ি করে, এসব ব্যক্তি প্রকৃতপক্ষে জ্ঞান-বুদ্ধি ও ইনসাফের সকল সীমালংঘনকারী মানুষ।
# এ আয়াতাংশ থেকে স্পষ্ট বুঝা যায়, একথা বলার সময় উক্ত মু’মিন ব্যক্তির দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, এ সত্য বলার অপরাধে সে ফেরাউনের গোটা রাজ শক্তির রোষানলে পড়বে এবং তাকে শুধু তার সম্মান, মর্যাদা ও স্বার্থ হারাতে হবে তাই নয়, জীবনের আশাও ছেড়ে দিতে হবে। কিন্তু এত কিছু বুঝতে পারা সত্ত্বেও তিনি শুধু আল্লাহর ওপর ভরসা করে এ নাজুক সময়ে তার বিবেক যেটিকে তার কর্তব্য বলে মনে করেছে সে দায়িত্ব পালন করেছেন।

তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
২৩-৪৬ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

এ আয়াতগুলোতে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর প্রিয় নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে পূর্ববর্তী নাবী মূসা (আঃ)-এর জীবন বৃত্তান্ত উল্লেখ করে সান্ত্বনা প্রদান করছেন যে, পূর্ববর্তী যুগে যেমন নাবী-রাসূলগণই বিজয়ী হয়েছিলেন তদ্রুপ তুমিও তোমার সময়ের কাফির-মুশরিকদের ওপর বিজয়ী হবে। সুতরাং তাদের কথা বার্তায়, কার্য-কলাপে চিন্তিত ও ভীত হওয়ার কোনই কারণ নেই।

মূসা (আঃ) ফির‘আউনকে যেভাবে দীনের দা‘ওয়াত দিয়েছিলেন তা হলো, ফির‘আউন ছিল মিশরে বসবাসকারী ক্বিবতীদের বাদশাহ। সে ছিল অত্যাচারী ও জালিম এবং সর্বোচ্চ রব হওয়ার দাবীদার। সে মূসা (আঃ)-এর সম্প্রদায় বানী ইসরাঈলকে দাস বানিয়ে রেখেছিল এবং তাদের ওপর নানাভাবে কঠোর নির্যাতন চালাত। হামান ছিল তার মন্ত্রী ও তার প্রধান উপদেষ্টা। আর কারূন ছিল তার যুগের বিরাট বিত্তশালী ব্যক্তি। আল্লাহ তা‘আলা মূসা (আঃ)-কে রিসালাত দিয়ে তাদের নিকট পাঠালেন এবং বললেন : তুমি ফির‘আউন, হামান এদের নিকট দীনের দা‘ওয়াত পৌঁছে দাও। যখন মূসা (আঃ) আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশে তাদের নিকট আগমন করলেন তখন তারা তাঁকে জাদুকর ও পাগল বলে আখ্যায়িত করল। যেমন আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন,

(كَذٰلِكَ مَآ أَتَي الَّذِيْنَ مِنْ قَبْلِهِمْ مِّنْ رَّسُوْلٍ إِلَّا قَالُوْا سَاحِرٌ أَوْ مَجْنُوْنٌ قف-‏ أَتَوَاصَوْا بِه۪ ج بَلْ هُمْ قَوْمٌ طَاغُوْنَ)‏

“এভাবে, তাদের পূর্ববর্তীদের নিকট যখনই কোন রাসূল এসেছে, তারা বলেছে : তুমি তো এক জাদুকর অথবা উন্মাদ। তারা কি একে অপরকে এই উপদেশই দিয়ে এসেছে? বস্তুত তারা এক সীমালঙ্ঘনকারী সম্প্রদায়।” (সূরা আয্ যা-রিয়া-ত ৫১ : ৫২-৫৩)

এমনকি ফির‘আউন এ নির্দেশও দিলো যে, মূসা (আঃ)-সহ তাঁর সাথে যারা ঈমান এনেছে তাদের পুত্র সন্তানদেরকে হত্যা করো এবং এদের কন্যা সন্তানদেরকে জীবিত রাখো। এটি ছিল ঐ শাস্তি যে শাস্তি ফির‘আউন বানী ইসরাঈলকে দিয়েছিল মূসা (আঃ)-এর জন্মকে কেন্দ্র করে। এটা করার কারণ ছিল এই যে, যাতে করে বানী ইসরাঈলরা মূসা (আঃ)-এর আগমন নিজেদের জন্য মুসীবত ও অমঙ্গলের কারণ মনে করে। যেমন তারা তাই বলেছিল।

(قَالُوْآ أُوْذِيْنَا مِنْ قَبْلِ أَنْ تَأْتِيَنَا وَمِنْۭ بَعْدِ مَا جِئْتَنَا)

“তারা বলল : ‘আমাদের নিকট তোমার আসার পূর্বে আমরা নির্যাতিত হয়েছি এবং তোমার আসার পরেও।’’ (সূরা আ‘রাফ ৭ : ১২৯)

তখন ফির‘আউন মূসা (আঃ)-কে হত্যা করার জন্য উদ্ধত হয়ে বলল : আমাকে ছেড়ে দাও আমি মূসা-কে হত্যা করি যাতে সে তার রবের শরণাপন্ন হয়। আর বানী ইসরাঈলকে এ বলে সতর্ক করল যে, তাঁর থেকে সাবধান হও, সে তোমাদেরকে তোমাদের দীন হতে বিচ্যুত করবে অথবা সে জমিনে ফিৎনা-ফাসাদ সৃষ্টি করবে।

যখন মূসা (আঃ) এ কথা জানতে পারলেন যে, ফিরআউন তাঁকে হত্যা করার ইচ্ছা করছে, তখন তিনি আল্লাহ তা‘আলার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করলেন। আমাদের নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন শত্র“র ভয় করতেন তখন তিনি এ দু‘আ পড়তেন :

اللهم انا نجعلك في نحورهم ونعوذبك من شرورهم

অর্থ : হে আল্লাহ তা‘আলা আপনাকে আমরা তাদের মুখোমুখি করছি, তাদের অনিষ্ট থেকে আপনার কাছে আশ্রয় চাচ্ছি। (আবূ দাঊদ হা. ১৫৩৭)

এমতাবস্থায় ফির‘আউনের বংশের একজন মু’মিন ব্যক্তি যে তার ঈমানকে গোপন রেখেছিল সে বলল : তোমরা কি এক ব্যক্তিকে এজন্য হত্যা করবে যে, সে বলে : আমার রব হলেন একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা, আর সে এ বিষয়ে তোমাদের নিকট প্রমাণও উপস্থাপন করেছে? যদি তাঁর দাবী মিথ্যা হয় তাহলে এ জন্য সে দায়ী, আর যদি তার কথা সত্য হয় তাহলে তোমাদের তা পালন করতে বাধা কোথায়? সে ঈমানদার ব্যক্তি তাঁর সম্প্রদায়কে লক্ষ্য করে আরো বলল : আজ পৃথিবীতে তোমাদের কর্তৃত্ব, দেশে তোমরাই প্রবল। কিন্তু যখন আল্লাহ তা‘আলার শাস্তি এসে যাবে তখন কে এ শাস্তি থেকে রক্ষা করবে? তাঁর কথার উত্তরে ফির‘আউন বলল : আমি তোমাদেরকে সঠিক পথেরই দিক নির্দেশনা দিয়ে থাকি। তখন তারা ফির‘আউনেরই অনুসরণ করতে থাকল। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

( فَاتَّبَعُوْآ أَمْرَ فِرْعَوْنَ ج وَمَآ أَمْرُ فِرْعَوْنَ بِرَشِيْدٍ)

“কিন্তু তারা ফির‘আউনের কার্যকলাপের অনুসরণ করত আর ফির‘আউনের কার্যকলাপ ভাল ছিল না।” (সূরা হূদ ১১ : ৯৭)

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

(وَأَضَلَّ فِرْعَوْنُ قَوْمَه۫ وَمَا هَدٰي)

“আর ফির‘আউন তার সম্প্রদায়কে পথভ্রষ্ট করেছিল এবং সৎ পথ দেখায়নি।” (সূরা ত্বা-হা- ২০ : ৭৯)
তখন মু’মিন ব্যক্তিটি পুনঃরায় তাঁর সম্প্রদায়কে লক্ষ্য করে বলল : আমি তোমাদের পূর্ববর্তী জাতি, ‘আদ, সামূদ, তুব্বা সম্প্রদায়ের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি, তারা আল্লাহ তা‘আলার রাসূলের অবাধ্য হয়েছিল ফলে তাদের ওপর আল্লাহ তা‘আলার শাস্তি এসেছিল এবং আমি তোমাদের ব্যাপারে ভয় করি যে, তোমাদের অবস্থাও তেমনই হবে। আর আমি ভয় করি সেদিনের যেদিন তোমরা পশ্চাৎ ফিরে পলায়ন করতে চাইবে কিন্তু তোমরা সেদিন এ শাস্তি থেকে পলায়ন করতে পারবে না। এরপর সে (মু’মিন ব্যক্তি) তাঁর সম্প্রদায়ের পূর্ববর্তী কার্য-কলাপের কথা তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিলো এবং বলল : যারা এরূপ কার্য-কলাপ করে তারা মূলত অতিশয় ঘৃণিত মানুষ।

التناد এটি কিয়ামতের একটি নাম।

এ সকল উপদেশ শোনার পরও ফির‘আউন মূসা (আঃ)-এর রব অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলাকে উপহাস করণার্থে তার মন্ত্রী ও উপদেষ্টা হামানকে নির্দেশ দিলো যে, সে যেন ফির‘আউনের জন্য একটি সুউচ্চ প্রাসাদ নির্মাণ করে যাতে আরোহন করে আকাশ পর্যন্ত পৌঁছতে পারে এবং মহান আল্লাহকে উঁকি মেরে দেখতে পারে। যেমন অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(وَقَالَ فِرْعَوْنُ يٰٓأَيُّهَا الْمَلَأُ مَا عَلِمْتُ لَكُمْ مِّنْ إلٰهٍ غَيْرِيْ فَأَوْقِدْ لِيْ يٰهَامٰنُ عَلَي الطِّيْنِ فَاجْعَلْ لِّيْ صَرْحًا لَّعَلِّيْٓ أَطَّلِعُ إِلٰٓي إلٰهِ مُوْسٰي لا وَإِنِّيْ لَأَظُنُّه۫ مِنَ الْكٰذِبِيْنَ)‏

“ফির‘আউন বলল : ‎ ‘হে পরিষদবর্গ। আমি ব্যতীত তোমাদের অন্য কোন মা‘বূদ আছে বলে আমি জানি না। হে হামান! তুমি আমার জন্য ইট পোড়াও এবং একটি সুউচ্চ প্রাসাদ তৈরি কর; হয়ত আমি তাতে উঠে মূসার মা‘বূদকে দেখতে পাব। তবে আমি অবশ্যই মনে করি সে মিথ্যাবদী।’’ (সূরা আল ক্বাসাস ২৮ : ৩৮)

এবং সে এও বলল যে, আল্লাহ তা‘আলা বলতে কিছু নেই। মূসা যে দাবী উত্থাপন করেছে তা আমি মিথ্যা মনে করি। এভাবেই ফির‘আউন সৎ পথে আসতে নিজে বিরত থাকল এবং তার সম্প্রদায়কেও বাধা দিল। আর সে যে ষড়যন্ত্র করেছিল তাও ব্যর্থ হলো।

ঈমানদার লোকটি পুনরায় তাঁর সম্প্রদায়কে লক্ষ্য করে বলল : তোমরা আমার অনুসরণ করো, আমি তোমাদেরকে সৎ পথে পরিচালিত করব। তখন সে তাদেরকে পার্থিব জীবন যে নশ্বর এবং পরকালের জীবন চিরস্থাযী সে সম্পর্কে নসীহত করল। সে এও বললেন যে, যদি তোমরা দুনিয়াতে মন্দ কর্মে লিপ্ত হও তাহলে পরকালে তার প্রতিদান মন্দই পাবে, আর যদি ভাল আমল করো তাহলে তার প্রতিদান হিসেবে তোমরা পরকালে চিরস্থায়ী জান্নাতে প্রবেশ করবে আর সেখানে তোমরা পাবে অপরিমেয় রিযিক এবং তোমাদের মন যা চাইবে তা-ই।

ঈমানদার ব্যক্তিটি তাঁর সম্প্রদায়কে এ কথাও বলল যে, এটা কতই না আশ্চার্যজনক যে, আমি তোমাদেরকে আহ্বান করছি মুক্তির পথে, যে পথে চললে তোমরা নাজাত পাবে। আর তোমরা কিনা তার বদৌলতে আমাকে আহ্বান করছ জাহান্নামের দিকে। তোমরা আমাকে নির্দেশ দিচ্ছ যেন আমি এক আল্লাহ তা‘আলাকে অস্বীকার করি, আর তাঁর সাথে অংশীদার স্থাপন করি। আমি তোমাদেরকে আহ্বান করছি পরাক্রমশালী, ক্ষমাশীল এক আল্লাহর দিকে, আর তোমরা আমাকে আহ্বান করছ এমন এক ব্যক্তির অনুসরণ করার যে কিনা দুনিয়া ও পরকাল কোথাও অনুসরণের যোগ্য নয়। বস্তুত আমাদেরকে এক আল্লাহরই অনুসরণ করতে হবে যার দিকে আমরা সকলেই প্রত্যাবর্তিত হব।

সুতরাং যারা তাঁর অনুসরণ করবে না মূলত তারাই জাহান্নামী। সে এ সকল নসীহত করে সর্বশেষে বলল : আমি আমার রবের নিকট আমার ব্যাপার অর্পন করছি, তিনিই তা দেখবেন। আর তোমরা অচিরেই এ সকল কথা-বার্তা স্মরণ করবে অর্থাৎ তোমরা আমার এ সকল কথার সত্যতা ও প্রমাণ পেয়ে যাবে। এ সকল কথা বলে ঈমানদার লোকটি তাদের থেকে চলে গেল।

অবশেষে অবস্থা এমন হলো যে, আল্লাহ তা‘আলা ঐ মু’মিন ব্যক্তিকে ষড়যন্ত্রের অনিষ্টতা হতে রক্ষা করলেন এবং কঠিন শাস্তি পরিবেষ্টন করল ফির‘আউন ও তার সম্প্রদায়কে। অর্থাৎ তারা পানিতে ডুবে মৃত্যুমুখে পতিত হলো।

বারযাখ তথা কবরে ফির‘আউন ও তার দলবলের সামনে প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যায় শাস্তির আগুনের শিখা পেশ করা হয়। এ আয়াত থেকে কবরের আযাবের কথা প্রমাণ হয়। আয়িশাহ (রাঃ)-এর প্রশ্নের জবাবে একদা নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন :

نعم عذاب القبر حق

হ্যাঁ, কবরের আযাব সত্য। (সহীহ বুখারী হা. ১৩৭২) অনুরূপ একটি হাদীসে বলা হয়েছে : “যখন তোমাদের মধ্যে কেউ মৃত্যু বরণ করে, তখন (কবরে) সকাল সন্ধ্যায় তাকে তার স্থান দেখানো হয়। অর্থাৎ সে জান্নাতী হলে জান্নাত এবং জাহান্নামী হলে তার সামনে জাহান্নাম পেশ করা হয় এবং বলা হয়- এটা হলো তোমার আসল ঠিকানা যেখানে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা‘আলা তোমাকে পাঠাবেন। (সহীহ বুখারী হা. ১৩৭৯)

এ থেকে আরো পরিস্কার হয় যে, সকাল-সন্ধ্যায় তাদের সাথে শাস্তির আগুন পেশ করার ব্যাপারটা কিয়ামতের আগেই। আর কিয়ামতের পূর্বে বারযাখও কবরেরই জীবন। ال (ফির‘আউনের বংশধর) বলতে তার জাতি এবং তার সকল অনুসারী। আর যেদিন কিয়ামত সংঘটিত হবে সেদিন ফেরেশতাদের নির্দেশ দেয়া হবে যে, ফির‘আউনসহ তার সম্প্রদায়কে কঠিন শাস্তিতে নিক্ষেপ করো। তথায় তাদেরকে চিরস্থাযী শাস্তিতে নিক্ষেপ করা হবে। যে শাস্তি থেকে তারা কোনদিন পরিত্রাণ পাবে না।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. এক আল্লাহ তা‘আলারই ইবাদত করতে হবে।
২. অন্ধের ন্যায় দলীল-প্রমাণ ব্যতীত কোন কিছু মানা যাবে না।
৩. সত্য জিনিস জানতে পারলে যত বাধাই আসুক মিথ্যা পরিহার করে সত্যকে গ্রহণ করতে হবে।
৪. গর্ব-অহংকার করা আল্লাহ তা‘আলা পছন্দ করেন না।
৫. পূর্ববর্তী জাতিসমূহের ঘটনা থেকে আমাদের শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে।
৬. সৎ ব্যক্তিদেরকে সাহায্য করা আল্লাহ তা‘আলার দায়িত্ব।
৭. কবরের আযাব সত্য।
৮. আল্লাহ তা‘আলা সস্বত্তায় আরশের ওপর আছেন, এ কথা ফির‘আউনও জানত।

তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
২৮-২৯ নং আয়াতের তাফসীর:

প্রসিদ্ধ কথা তো এটাই যে, এই মুমিন লোকটি কিবতী ছিল। সে ছিল ফিরাউনের বংশধর। এমনকি সুদ্দী (রঃ) বলেন যে, সে ছিল ফিরাউনের চাচাতো ভাই। একথাও বলা হয়েছে যে, সে হযরত মূসা (আঃ)-এর সাথে মুক্তি পেয়েছিল। ইবনে জারীরও (রঃ) এটাই পছন্দ করেছেন। এমনকি যাঁদের উক্তি রয়েছে যে, ঐ মমিন লোকটিও ইসরাঈলী ছিলেন তিনি তা খণ্ডন করেছেন এবং বলেছেন যে, যদি মুমিন লোকটি ইসরাঈলী হতেন তবে ফিরাউন কখনো এভাবে ধৈর্যের সাথে তাঁর নসীহত শুনতো না এবং হযরত মূসা (আঃ)-এর হত্যার অভিপ্রায় হতে বিরত থাকতো না। বরং তাকে কষ্ট দিতো।

হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, ফিরাউনের বংশের মধ্যে একজন ঈমানদার ছিলেন এই লোকটি। আর একজন যিনি ঈমান এনেছিলেন তিনি ছিলেন ফিরাউনের স্ত্রী এবং তৃতীয় ঈমানদার ছিলেন ঐ ব্যক্তি যিনি হযরত মূসা (আঃ)-কে সংবাদ দিয়েছিলেন যে, নেতৃস্থানীয় লোকেরা তাঁকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।

এই মুমিন লোকটি নিজের ঈমান আনয়নের কথা গোপন রেখেছিলেন। ফিরাউন যখন বলেছিলঃ “তোমরা আমাকে ছেড়ে দাও, আমি মূসা (আঃ)-কে হত্যা করি’ সেদিনই শুধু তিনি নিজের ঈমানের কথা প্রকাশ করেছিলেন। আর প্রকৃতপক্ষে এটাই সর্বোত্তম জিহাদ যে, অত্যাচারী বাদশাহর সামনে মানুষ সত্য কথা বলে দেয়, যেমন হাদীসে এসেছে। আর ফিরাউনের সামনে এর চেয়ে বড় ও সত্য কথা আর কিছুই ছিল না। সুতরাং এ লোকটি বড় উচ্চ পর্যায়ের মুজাহিদ ছিলেন, যার সাথে কারো তুলনা করা যায় না। তবে অবশ্যই সহীহ বুখারী ইত্যাদি হাদীস গ্রন্থে একটি ঘটনা কয়েকটি রিওয়াইয়াতে বর্ণিত আছে, যার সারমর্ম এই যে, হযরত উরওয়া ইবনে যুবায়ের (রাঃ) একদা হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করেনঃ “আচ্ছা, বলুন তো, মুরিকরা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে সবচেয়ে বড় কষ্ট কি দিয়েছিল?” উত্তরে তিনি বলেনঃ “তাহলে শুন, একদা রাসূলুল্লাহ (সঃ) কাবা শরীফে নামায পড়ছিলেন। এমন সময় উকবা ইবনে আবি মুঈত এসে তাকে ধরে ফেললো এবং তার Bদরখানা তার গলায় বেঁধে দিয়ে টানতে শুরু করলো, যার ফলে তার গলা চিপে গেল এবং তার শ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। তৎক্ষণাৎ হযরত আবু বকর (রাঃ) দৌড়িয়ে এসে তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলেন এবং বললেনঃ “তোমরা কি এমন এক ব্যক্তিকে হত্যা করতে চাচ্ছ যিনি বলেন, “আমার প্রতিপালক আল্লাহ এবং যিনি তোমাদের প্রতিপালকের নিকট হতে দলীল প্রমাণাদি নিয়ে এসেছেন?”

আর একটি রিওয়াইয়াতে আছে যে, এক জায়গায় কুরায়েশদের সমাবেশ ছিল। রাসূলুল্লাহ (সঃ) সেখান দিয়ে গমন করলে তারা বললোঃ “তুমিই কি আমাদেরকে আমাদের পিতৃপুরুষদের মা’বুদগুলোর ইবাদত করতে নিষেধ করে থাকো?” তিনি উত্তরে বললেনঃ “হ্যা, আমিই ঐ ব্যক্তি বটে।” তখন তারা উঠে গিয়ে তার কাপড় ধরে টানতে থাকে। তখন হযরত আবু বকর (রাঃ) তার পিছন হতে দৌড়িয়ে গিয়ে তাঁকে তাদের হাত হতে রক্ষা করেন এবং তার দুই চক্ষু দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল। এমতাবস্থায় তিনি উচ্চ স্বরে চীৎকার করে বলেনঃ “তোমরা কি এমন একটি লোককে হত্যা করতে যাচ্ছ- যিনি বলেন, আমার প্রতিপালক আল্লাহ এবং যিনি তোমাদের কাছে তোমাদের প্রতিপালকের নিকট হতে দলীল প্রমাণাদি নিয়ে এসেছেন?” (এ হাদীসটি ইমাম ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

ঐ মুমিন লোকটিও একথাই বলেছিলেনঃ “তোমরা এক ব্যক্তিকে এই জন্যে হত্যা করবে যে, সে বলে- “আমার প্রতিপালক আল্লাহ’ অথচ সে তোমাদের প্রতিপালকের নিকট হতে সুস্পষ্ট প্রমাণসহ তোমাদের নিকট এসেছে? যদি সে মিথ্যাবাদীই হয় তবে তার মিথ্যাবাদিতার জন্যে সে-ই দায়ী হবে, আর যদি সত্যবাদী হয়, তবে সে তোমাদেরকে যে শাস্তির কথা বলে, তার কিছু তো তোমাদের উপর আপতিত হবেই। সুতরাং বিবেক সম্মত কথা এটাই যে, তোমরা তাকে ছেড়ে দাও। যারা তাদের অনুসারী হবার তারা হয়ে যাক। তোমরা তাদের ব্যাপারে কোন হস্তক্ষেপ করো না।” হযরত মূসা (আঃ)-ও ফিরাউন এবং তার লোকদের নিকট হতে এটাই কামনা করেছিলেন। যেমন মহান আল্লাহ বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “আমি তাদের পূর্বে ফিরাউনের কওমকে পরীক্ষা করেছি। তাদের কাছে সম্মানিত রাসূল এসেছিল এবং তাদেরকে বলেছিলঃ আল্লাহর বান্দাদেরকে (বানী ইসরাঈলকে) আমার নিকট সমর্পণ করে দাও। আমি তোমাদের কাছে বিশ্বস্ত রাসূলরূপে প্রেরিত হয়েছি। তোমরা আল্লাহর উপর বিদ্রোহ ঘোষণা করো না। আমিও তোমাদের নিকট সুস্পষ্ট দলীল নিয়ে এসেছি। তোমরা আমাকে পাথর নিক্ষেপে হত্যা করবে তা হতে আমি আমার প্রতিপালকের এবং তোমাদের প্রতিপালকের নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি। যদি তোমরা ঈমান আনয়ন না কর তবে তোমরা আমা হতে দূরে থাকো (আমাকে কষ্ট দিয়ো না)।” (৪৪:১৭-২১)

রাসূলুল্লাহও (সঃ) স্বীয় কওমকে একথাই বলেছিলেনঃ “আল্লাহর বান্দাদেরকে তাঁর দিকে আমাকে ডাকতে দাও। তোমরা আমাকে কষ্ট দেয়া হতে বিরত থাকো। আমার আত্মীয়তার প্রতি লক্ষ্য রেখে আমাকে কষ্ট দিয়ো না।” হুদায়বিয়ার সন্ধিও প্রকৃতপক্ষে এটাই ছিল, যাকে প্রকাশ্য বিজয় বলা হয়েছে।

ঐ মুমিন লোকটি তার কওমকে আরো বললেনঃ “আল্লাহ সীমালংঘনকারী ও মিথ্যাবাদীকে সৎপথে পরিচালিত করেন না। তাদের উপর আল্লাহর সাহায্য থাকে না। তাদের কথা ও কাজ সত্বরই তাদের খিয়ানতকে প্রকাশ করে দিবে। পক্ষান্তরে এই নবী (আঃ) বিশৃংখলা সৃষ্টি করা হতে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র। তিনি সরল, সঠিক ও সত্য পথের উপর রয়েছেন। তিনি কথায় সত্যবাদী এবং আমলে পাকা। যদি তিনি সীমালংঘনকারী ও মিথ্যাবাদী হতেন তবে তার মধ্যে কখনো এই সততা ও সত্যবাদিতা থাকতো না।” অতঃপর স্বীয় সম্প্রদায়কে উপদেশ দিচ্ছেন এবং তাদেরকে আল্লাহর আযাব হতে ভয় প্রদর্শন করছেন। তিনি তাদেরকে বলেনঃ “হে আমার সম্প্রদায়! আজ কর্তৃত্ব তোমাদের, দেশে তোমরাই প্রবল। কিন্তু আমাদের উপর শাস্তি এসে পড়লে কে আমাদেরকে সাহায্য করবে?” অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা এদেশের শাসন ক্ষমতা তোমাদেরকেই দান করেছেন এবং তোমাদেরকে বড়ই মর্যাদা দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলার এই নিয়ামতের জন্যে তোমাদের তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উচিত এবং তাঁর রাসূল (সঃ)-কে সত্যবাদী হিসেবে মেনে নেয়া একান্ত কর্তব্য। যদি তোমরা অকৃতজ্ঞ হও এবং তাঁর রাসূল (আঃ)-এর প্রতি মন্দ দৃষ্টি নিক্ষেপ কর তবে নিশ্চয়ই আল্লাহর আযাব তোমাদের উপর আপতিত হবে। বলতে, ঐ সময় কে তোমাদেরকে আল্লাহর আযাব হতে রক্ষা করবে? তোমাদের এ সেনাবাহিনী, জান ও মাল তোমাদের কোনই কাজে আসবে না।

ফিরাউন ঐ ব্যক্তির একথার কোন জ্ঞান সম্মত উত্তর দিতে পারলো না। সুতরাং বাহ্যিকভাবে সহানুভূতি দেখিয়ে বললোঃ “আমি তো তোমাদের শুভাকাক্ষী। আমি তোমাদেরকে ধোকা দিচ্ছি না। আমি যা বুঝছি তাই তোমাদেরকে বলছি। আমি তোমাদেরকে শুধু সৎপথই দেখিয়ে থাকি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটাও ছিল তার বিশ্বাসঘাতকতা। সে ভালভাবেই জানতো যে, হযরত মূসা (আঃ) আল্লাহর রাসূল। যেমন মহান আল্লাহ হযরত মূসা (আঃ)-এর উক্তি উদ্ধৃত করেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “(হে ফিরাউন!) তুমি তো জান যে, এগুলো (এ বিস্ময়কর জিনিসগুলো) আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর প্রতিপালকই অবতীর্ণ করেছেন, যেগুলো জ্ঞানবর্তিকা স্বরূপ।” (১৭:১০২) অন্য আয়াতে রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “অন্তরে বিশ্বাস থাকা সত্ত্বেও শুধু যুলুম ও সীমালংঘন হিসেবেই তারা অস্বীকার করে বসেছে।” (২৭:১৪) অনুরূপভাবে তার আমি যা বুঝি, তাই তোমাদেরকে বলছি’ এ কথাও ছিল সম্পূর্ণ ভুল। প্রকৃতপক্ষে সে জনগণকে প্রতারিত করছিল এবং প্রজাবর্গের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করছিল। তার কওম তার প্রতারণার ফাঁদে আবদ্ধ হয়ে পড়েছিল এবং তার কথা মেনে নিয়েছিল। ফিরাউন তাদেরকে কোন ভাল পথে আনয়ন করেনি। তার কাজ সঠিকই ছিল না। মহান আল্লাহ বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “ফিরাউন তার কওমকে পথভ্রষ্ট করেছিল, তাদেরকে সুপথ প্রদর্শন করেনি।” (২০:৭৯) হাদীসে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যে নেতা তার প্রজাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে সে জান্নাতের সুগন্ধও পাবে না, অথচ জান্নাতের সুগন্ধ পাঁচশ বছরের পথের ব্যবধান হতেও এসে থাকে। এসব ব্যাপারে সঠিক জ্ঞানের অধিকারী একমাত্র আল্লাহ।
৩০-৩৫ নং আয়াতের তাফসীর:

ঐ মুমিন লোকটির নসীহতের শেষাংশের বর্ণনা দেয়া হচ্ছে যে, তিনি স্বীয় কওমকে সম্বোধন করে আরো বলেনঃ “হে আমার কওম! যদি তোমরা আল্লাহর এই রাসূল (সঃ)-কে নামানো এবং নিজেদের হঠকারিতার উপর স্থির থাকো তবে আমি আশংকা করছি যে, তোমাদের পূর্ববর্তী কওমের মত তোমাদের উপরও আল্লাহর আযাব এসে পড়বে। হযরত নূহ (আঃ)-এর সম্প্রদায়, আ’দ সম্প্রদায় এবং সামূদ সম্প্রদায়ের প্রতি লক্ষ্য কর যে, রাসূলদেরকে (আঃ) না মানার কারণে তাদের উপর কি ভীষণ আযাবই না আপতিত হয়েছিল! এমন কেউ ছিল না যে, তাদেরকে ঐ আযাব হতে রক্ষা করতে পারে। এতে তাদের প্রতি মহান আল্লাহর কোন যুলুম ছিল না। তার মহান সত্তা বান্দাদের উপর যুলুম করা হতে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র। ওটা ছিল তাদের নিজেদেরই কৃতকর্মের ফল। আমি তোমাদের ব্যাপারে কিয়ামত দিবসের শাস্তিকে ভয় করি, যেই দিন অত্যন্ত ভয়াবহ হবে।”

শিংগায় ফুৎকার দেয়ার হাদীসে রয়েছে যে, যখন যমীনের উপর ভূমিকম্প আসবে এবং যমীন ফেটে যাবে তখন জনগণ ভয় ও সন্ত্রাসে হতবুদ্ধি হয়ে এদিক ওদিক ছুটাছুটি করবে এবং একে অপরকে ডাকাডাকি করতে থাকবে। যহহাক (রঃ) প্রমুখ গুরুজন বলেন যে, এটা ঐ সময়ের বর্ণনা, যখন জাহান্নামকে আনয়ন করা হবে এবং জনগণ ওটা দেখে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পালাতে থাকবে এবং ফেরেশতামণ্ডলী তাদেরকে হাশরের ময়দানের দিকে ফিরিয়ে আনবেন। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “ফেরেশতারা আকাশের প্রান্তদেশে থাকবে।” আর এক জায়গায় বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “হে জ্বিন ও মনুষ্য সম্প্রদায়! আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সীমা তোমরা যদি অতিক্রম করতে পার, অতিক্রম কর, কিন্তু তোমরা তা পারবে না শক্তি ব্যতিরেকে।” (৫৫:৩৩)

হযরত হাসান (রঃ) ও হযরত কাতাদা (রঃ)-এর কিরআতে অর্থাৎ (আরবী) অক্ষরে তাশদীদ রয়েছে। এটা (আরবী) বাক্য হতে গৃহীত হয়েছে। যখন উট বেয়াড়া ও উদ্ধত হয়ে উঠে তখন এই বাক্য বলা হয়ে থাকে।

বলা হয়েছে যে, যে দাঁড়িপাল্লায় আমল ওযন করা হবে সেখানে একজন ফেরেশতা থাকবেন। যার পুণ্য বেশী হবে তার ব্যাপারে ঐ ফেরেস্তা উচ্চ স্বরে ডাক দিয়ে বলবেনঃ “হে জনমণ্ডলী! অমুকের পুত্র অমুক সৌভাগ্যবান হয়ে গেছে এবং আজকের পরে তার ভাগ্য কখনো আর খারাপ হবে না। আর যার পুণ্য কমে যাবে তার সম্পর্কে ঐ ফেরেশতা উচ্চ স্বরে ডাক দিয়ে বলবেনঃ “অমুকের পুত্র অমুক হতভাগ্য হয়ে গেছে এবং সে ধ্বংসের মুখে পতিত হয়েছে।”

হযরত কাতাদা (রঃ) বলেনঃ কিয়ামতকে (আরবী) বলার কারণ এই যে, প্রত্যেক কওমকে তাদের আমলসহ ডাক দেয়া হবে। জান্নাতবাসী ডাকবে জান্নাতবাসীকে এবং জাহান্নামবাসী ডাকবে জাহান্নামবাসীকে। এ কথাও বলা হয়েছে যে, জান্নাতবাসীরা জাহান্নামবাসীদেরকে ডাক দিবে এবং জাহান্নামবাসীরা জান্নাতবাসীদেরকে আহ্বান করবে বলেই কিয়ামত দিবসকে (আরবী) বলা হয়েছে। যেমন জান্নাতীরা জাহান্নামীদের ডাক দিয়ে বলবেঃ (আরবী) অর্থাৎ “আমাদের প্রতিপালক আমাদেরকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন আমরা তো তা সত্য পেয়েছি। তোমাদের প্রতিপালক তোমাদেরকে যা বলেছিলেন তোমরাও তা সত্য পেয়েছো কি? তারা বলবে, হাঁ।” (৭:৪৪) আর জাহান্নামীরা জান্নাতীদেরকে সম্বোধন করে বলবেঃ (আরবী) অর্থাৎ “আমাদের উপর কিছু পানি ঢেলে দাও, অথবা আল্লাহ্ জীবিকারূপে তোমাদেরকে যা দিয়েছেন তা হতে কিছু দাও। তারা বলবেঃ আল্লাহ্ এ দু’টি নিষিদ্ধ করেছেন কাফিরদের উপর।”(৭:৫০) আর এ কারণেও যে, আরাফবাসীরা জান্নাতবাসীদেরকে ও জাহান্নাম বাসীদেরকে ডাক দিবে। যেমন এগুলো সূরায়ে আ’রাফে বর্ণিত হয়েছে।

ইমাম বাগাভী (রঃ) প্রমুখ গুরুজন এটাই গ্রহণ করেছেন যে, এসব কারণেই কিয়ামত দিবসকে (আরবী) বলা হয়েছে। এই উক্তিটি খুবই পছন্দনীয় বটে। তবে এসব ব্যাপারে সঠিক জ্ঞানের অধিকারী একমাত্র আল্লাহ।

মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ সেই দিন মানুষ পশ্চাৎ ফিরে পলায়ন করতে চাইবে, কিন্তু পালাবার কোন জায়গা পাবে না এবং তাদেরকে বলা হবেঃ আজ অবস্থান স্থল এটাই। সেই দিন আল্লাহর শাস্তি হতে রক্ষা করার কেউ থাকবে না। আল্লাহ ছাড়া ব্যাপক ক্ষমতার অধিকারী আর কেউই নেই। তিনি যাকে পথভ্রষ্ট করেন তার জন্যে কোন পথ প্রদর্শক নেই।

এরপর ইরশাদ হচ্ছে ? ইতিপূর্বে মিসরবাসীদের নিকট হযরত ইউসুফ (আঃ) আল্লাহর নবী হিসেবে আগমন করেছিলেন। তিনিই প্রেরিত হয়েছিলেন হযরত মূসা (আঃ)-এর পূর্বে। মিসরের আযীযও তিনি ছিলেন। তিনি স্বীয় উম্মতকে আল্লাহর পথে আহ্বান করেছিলেন। কিন্তু তাঁর কওম তার কথা মানেনি। তবে পার্থিব শাসন ক্ষমতা তার ছিল বলে পার্থিব দিক দিয়ে তাদেরকে তাঁর অধীনতা স্বীকার করতেই হয়েছিল। তাই মহান আল্লাহ্ বলেনঃ পরিশেষে যখন ইউসুফ (আঃ)-এর মৃত্যু হলো তখন তোমরা বলেছিলেঃ তার পরে আল্লাহ্ আর কাউকেও রাসূল করে প্রেরণ করবেন না। এই ছিল তাদের কুফরী ও অবিশ্বাসকরণ। এই ভাবে আল্লাহ্ বিভ্রান্ত করেন সীমালংঘনকারী ও সংশয়বাদীদেরকে। অর্থাৎ তোমাদের যে অবস্থা হয়েছে এই অবস্থাই এমন সবারই হয়ে থাকে যারা সীমালংঘন করে সংশয় সন্দেহের মধ্যে পতিত হয়। যারা সত্যকে মিথ্যা দ্বারা সরিয়ে দেয় এবং বিনা দলীলে প্রকৃত দলীলসমূহ পরিহার করে ও বিতর্কে লিপ্ত হয়। এ কারণে আল্লাহ তাদের প্রতি খুবই অসন্তুষ্ট। তাদের এ কার্যকলাপ যখন আল্লাহ্ তা’আলার অসন্তুষ্টির কারণ তখন মুমিনরাও তাদের প্রতি অসন্তুষ্ট। যেসব লোকের মধ্যে এই ঘৃণ্য বিশেষণ থাকে তাদের অন্তরে আল্লাহ্ তা’আলা মোহর মেরে দেন, যার কারণে এর পরে তারা না ভাল-কে ভাল বলে বুঝতে পারে, না . মন্দকে মন্দ জ্ঞান করতে পারে। তাই তো মহান আল্লাহ বলেনঃ এই ভাবে আল্লাহ্ প্রত্যেক উদ্ধত ও স্বৈরাচারী ব্যক্তির হৃদয়কে মোহর করে দেন।

হযরত শা’বী (রঃ) বলেন যে, জাব্বার হলো ঐ ব্যক্তি যে দু’জন লোককে হত্যা করে। আবূ ইমরান জাওনী (রঃ) এবং কাতাদা (রঃ) বলেন যে, যে অন্যায়ভাবে কাউকেও হত্যা করে সেই হলো জাব্বার। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।
৩৬-৩৭ নং আয়াতের তাফসীর:

আল্লাহ তা’আলা ফিরাউনের হঠকারিতা ও অহংকারের খবর দিচ্ছেন যে, সে তার উযীর হামানকে বললোঃ হে হামান! তুমি আমার জন্যে একটি সুউচ্চ প্রাসাদ নির্মাণ কর। ইষ্টক ও চূর্ণ দ্বারা পাকা ও খুবই উচ্চ অট্টালিকা নির্মাণ কর। যেমন অন্য জায়গায় রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “হে হামান! ইট পাকা করে আমার জন্যে সুউচ্চ প্রাসাদ নির্মাণ কর।”(২৮:৩৮)।

ইবরাহীম নাখঈ (রঃ)-এর উক্তি এই যে, কবরকে পাকা করা ও তাতে চুনকাম করাকে পূর্বযুগীয় গুরুজন অপছন্দ করতেন। (এটা ইমাম ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

ফিরাউন বললোঃ আমি এ প্রাসাদ এ জন্যেই নির্মাণ করাতে চাচ্ছি যে, যাতে আমি আসমানের দর ও আসপথ পর্যন্ত পৌঁছে যেতে পারি। অতঃপর যেন আমি মূসা (আঃ)-এর মাবুদকে দেখতে পাই। তবে আমি জানি যে, মূসা (আঃ) মিথ্যাবাদী। সে যে বলছে, আল্লাহ্ তাকে পাঠিয়েছেন এটা সম্পূর্ণ বাজে ও মিথ্যা কথা।

আসলে ফিরাউনের এটা একটা প্রতারণা ছিল এবং সে তার প্রজাবর্গের উপর এটা প্রকাশ করতে চেয়েছিল যে, সে এমন কাজ করতে যাচ্ছে যার দ্বারা মূসা (আঃ)-এর মিথ্যা খুলে যাবে এবং তার মত তার প্রজাদেরও বিশ্বাস হয়ে যাবে যে, মূসা (আঃ) প্রতারক ও মিথ্যাবাদী। ফিরাউনকে সরল পথ হতে নিবৃত্ত করা হয়েছিল এবং তার ষড়যন্ত্র সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছিল। ওটা হয়েছিল তার জন্যে ক্ষতিকর এবং ওটা তাকে ধ্বংসের মুখেই ঠেলে দিয়েছিল।
৩৮-৪০ নং আয়াতের তাফসীর:

পূর্ববর্ণিত মুমিন লোকটি স্বীয় সম্প্রদায়ের উদ্ধত, আত্মম্ভরী ও অহংকারী লোকদেরকে উপদেশ দিতে গিয়ে আরো বললেনঃ হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা আমার কথা মেনে নাও এবং আমার পথে চলো। আমি তোমাদেরকে সরল-সঠিক পথে পৌছিয়ে দিবো। এ মুমিন লোকটি তাঁর এ উক্তিতে ফিরাউনের ন্যায় মিথ্যাবাদী ছিলেন না। ফিরাউন তো স্বীয় কওমকে প্রতারিত করছিল, আর এ মুমিন লোকটি তাদের মঙ্গল কামনা করছিলেন।

অতঃপর ঐ মুমিন তাঁর কওমকে দুনিয়ার প্রতি অনাসক্ত ও আখিরাতের প্রতি আসক্ত হওয়ার উপদেশ দেন। তিনি বলেনঃ “হে আমার সম্প্রদায়! এই পার্থিব জীবন তো অস্থায়ী উপভোগের বস্তু এবং আখিরাতই হচ্ছে চিরস্থায়ী আবাস। আখিরাতের শান্তি ও দুর্ভোগ হবে চিরস্থায়ী। কেউ মন্দ কর্ম করলে সে শুধু তার কর্মের অনুরূপ শাস্তি পাবে এবং পুরুষ কিংবা নারীর মধ্যে যারা মুমিন হওয়া অবস্থায় সঙ্কর্ম করে তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে। সেথায় তাদেরকে অপরিমিত জীবনোপকরণ দেয়া হবে। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।
৪১-৪৬ নং আয়াতের তাফসীর:

ফিরাউনের কওমের মুমিন লোকটি স্বীয় উপদেশপূর্ণ বক্তৃতা চালু রেখে বলেনঃ এটা কতই না বিস্ময়কর ব্যাপার যে, আমি তোমাদেরকে তাওহীদ অর্থাৎ এক ও শরীক বিহীন আল্লাহর ইবাদতের দিকে আহ্বান করছি এবং রাসূল (আঃ)-এর সত্যতা স্বীকার করার দিকে ডাকছি, আর তোমরা আমাকে ডাকছো কুফরী ও শিরুকের দিকে! তোমরা চাচ্ছ যে, আমি যেন অজ্ঞ হয়ে যাই এবং বিনা দলীলে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (আঃ)-এর বিরোধিতা করি! তোমরা একটু চিন্তা করে দেখো তো যে, তোমাদের ও আমার দাওয়াতের মধ্যে কতো পার্থক্য রয়েছে! আমি তোমাদেরকে ঐ আল্লাহর দিকে নিয়ে যেতে চাচ্ছি যিনি বড়ই ইয্যত ও মর্যাদার অধিকারী এবং ব্যাপক ক্ষমতাবান। এতদসত্ত্বেও তিনি এমন প্রত্যেক ব্যক্তির তাওবা কবুল করে থাকেন যে তাঁর দিকে ঝুঁকে পড়ে ও ক্ষমা প্রার্থনা করে।

(আরবী)-এর অর্থ হলো হক ও সত্যতা। অর্থাৎ এটা নিশ্চিত সত্য যে, যেদিকে তোমরা আমাকে আহ্বান করছে অর্থাৎ মূর্তি এবং আল্লাহ্ ছাড়া অন্যান্যদের ইবাদতের দিকে, ওগুলো এমনই যে, ওদের দ্বীন ও দুনিয়ার কোন আধিপত্য নেই। ওগুলো না পারে কারো কোন উপকার করতে এবং না পারে কোন ক্ষতি করতে। ওরা ওদের আহ্বানকারীদের আহ্বান শুনতে পায় না এবং ককূল করতেও পারে না, এই দুনিয়াতেও না এবং পরকালেও না। এটা আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলার নিম্নের উক্তির মতইঃ (আরবী) অর্থাৎ “এই ব্যক্তি অপেক্ষা বড় পথভ্রষ্ট আর কে হতে পারে যে আল্লাহকে ছাড়া এমন কিছুকে ডেকে থাকে যারা কিয়ামত পর্যন্তও তার ডাকে সাড়া দিতে পারে না? আর তারা তাদের ডাক হতে উদাসীন ও অমনোযোগী। যখন লোকদেরকে একত্রিত করা হবে তখন তারা তাদের আহ্বানকারীদের শত্রু হয়ে যাবে এবং তাদের ইবাদতকে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করে বসবে।” (৪৬:৫-৬) আর এক জায়গায় মহান আল্লাহ্ বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “যদি তোমরা তাদেরকে ডাকো তবে তারা তোমাদের ডাক শুনবে না, আর (মনে করা যাক যে,) যদি শুনেও বা তবুও তোমাদের ডাকে তারা সাড়া দিতে পারবে না।” (৩৫:১৪) মুমিন লোকটি বললেনঃ আমাদের প্রত্যাবর্তন তো আল্লাহরই নিকট। অর্থাৎ পরকালে আমাদেরকে আল্লাহ্ তা’আলার নিকট ফিরে যেতে হবে। অতঃপর তিনি প্রত্যেককে তার আমলের প্রতিফল দিবেন। এ জন্যেই বলেনঃ ‘সীমালংঘনকারীরাই জাহান্নামের অধিবাসী।’

মুমিন লোকটি তাদেরকে আরো বললেনঃ আমি তোমাদেরকে যা বলছি তোমরা অচিরেই তা স্মরণ করবে। তখন তোমরা হা-হুতাশ ও আফসোস করবে। কিন্তু তখন সবই বৃথা হবে। আমি তো আমার ব্যাপার আল্লাহর কাছে সমর্পণ করছি। আমার ভরসা তাঁরই উপর। আমি আমার প্রতিটি কাজে তারই কাছে সাহায্য প্রার্থনা করছি। এখন তোমাদের সাথে আমার কোনই সম্পর্ক নেই। আমি তোমাদের কাজে ঘৃণা প্রকাশ করছি। তোমাদের হতে আমি এখন সম্পূর্ণ পৃথক। আল্লাহ্ তাঁর বান্দাদের প্রতি সবিশেষ দৃষ্টি রাখেন।’ যারা সুপথ প্রাপ্তির যোগ্য তাদেরকে সুপথ প্রদর্শন করেন। আর যারা পথভ্রষ্ট হওয়ার যোগ্য তাদেরকে তিনি হিদায়াত লাভে বঞ্চিত করেন। তাঁর প্রতিটি কাজ হিকমতে পূর্ণ এবং তার সমস্ত কৌশল কল্যাণময়।

আল্লাহ্ তা’আলা মুমিন লোকটিকে ফিরাউনের ও তার কওমের ষড়যন্ত্রের অনিষ্ট হতে রক্ষা করলেন। দুনিয়াতেও তিনি রক্ষা পেলেন অর্থাৎ হযরত মূসা (আঃ)-এর সাথে মুক্তি পেলেন এবং আখিরাতের কঠিন শাস্তি হতেও রক্ষা পাবেন। বাকী সবাই তারা নিকৃষ্ট শাস্তির শিকার হলো। অর্থাৎ ফিরাউন তার কওমসহ সমুদ্রে নিমজ্জিত হলো। এতো হলো দুনিয়ার শাস্তি। আর আখিরাতে তো তাদের জন্যে কঠিন শাস্তি রয়েছেই।

সকাল-সন্ধ্যায় তাদেরকে উপস্থিত করা হয় আগুনের সামনে। কিয়ামত পর্যন্ত তাদের এ শাস্তি হতেই থাকবে। আর কিয়ামতের দিন তাদের আত্মাগুলোকে দেহসহ জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। সেই দিন তাদেরকে বলা হবেঃ “হে ফিরাউনীরা! তোমরা ভীষণ কষ্ট ও যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির মধ্যে চলে যাও।” আল্লাহ্ তা’আলা ফেরেশতাদেরকে বলবেনঃ “ফিরাউন সম্প্রদায়কে নিক্ষেপ কর কঠিন শাস্তিতে।

এ আয়াতটি আহলে সুন্নাতের ঐ মাযহাবের এই কথার উপর বড় দলীল যে, কবরে শাস্তি হয়ে থাকে। তবে এখানে এ কথাটি স্মরণ রাখা দরকার যে, কোন কোন হাদীসে এমন কতকগুলো বিষয় এসেছে যেগুলো দ্বারা জানা যায় যে, বারযাখের শাস্তি সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) অবহিত হয়েছিলেন মদীনায় হিজরতের পর। আর এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয় মক্কায়। তাহলে এর জবাব এই যে, এই আয়াত দ্বারা শুধু এটুকু জানা যাচ্ছে যে, মুশরিকদের আত্মাগুলোকে সকাল-সন্ধ্যায় জাহান্নামের সামনে পেশ করা হয়। বাকী থাকলো এই কথাটি যে, এই শাস্তি কি সব সময় হয়, না সব সময় নয়? আর এটাও যে, এই আযাব কি শুধু রূহের উপর হয়, না দেহের উপরও হয়ে থাকে? এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) অবহিত হন মদীনায়। রাসূলুল্লাহ (সঃ) এটা বর্ণনা করে দিয়েছেন। সুতরাং হাদীস ও কুরআনকে মিলিয়ে এই মাসআলা বের হলো যে, কবরের শাস্তি ও শান্তি আত্মা ও দেহ উভয়ের উপর হয়ে থাকে। আর এটাই সত্য বটে।’

হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একজন ইয়াহুদিনী তাঁর খিদমতে নিয়োজিতা ছিল। হযরত আয়েশা তার প্রতি কোন অনুগ্রহ করলেই সে বলতোঃ “আল্লাহ্ আপনাকে কবরের আযাব হতে রক্ষা করুন!” একদা হযরত আয়েশা (রাঃ) রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-কে জিজ্ঞেস করেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! কিয়ামতের পূর্বেও কি কবরে আযাব হয়?তিনি উত্তরে বললেনঃ “না। কে এ কথা বলেছে?” হযরত আয়েশা (রাঃ) ঐ ইয়াহূদী মহিলাটির ঘটনা বর্ণনা করলেন। তখন রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) বললেনঃ “ইয়াহূদী মিথ্যাবাদী। তারা তো এর চেয়েও বড় মিথ্যা আরোপ করে থাকে। কিয়ামতের পূর্বে কোন শাস্তি নেই।” ইতিমধ্যে কিছুদিন অতিবাহিত হয়ে গেছে। একদা রাসূলুল্লাহ (সঃ) যুহরের সময় কাপড় গুটানো অবস্থায় আগমন করেন এবং তাঁর চক্ষুদ্বয় রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছিল। তিনি উচ্চ স্বরে বলছিলেনঃ “হে জনমণ্ডলী! আমি যা জানি তা যদি তোমরা জানতে তবে তোমরা অবশ্যই হাসতে কম এবং কাঁদতে বেশী। হে লোক সকল! কবরের আযাব হতে আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা কর। নিশ্চিতরূপে জেনে রেখো যে, কবরের আযাব সত্য।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন। এর ইসনাদ ইমাম বুখারী (রঃ) ও ইমাম মুসলিম (রঃ)-এর শর্তের উপর সহীহ। তারা এটা তাখরীজ করেননি)

অন্য একটি রিওয়াইয়াতে আছে যে, একজন ইয়াহূদী মহিলা হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর কাছে এসে কিছু ভিক্ষা চায়। তিনি তাকে কিছু দান করেন। তখন সে বলেঃ “আল্লাহ আপনাকে কবরের আযাব হতে রক্ষা করুন!” এর শেষে রয়েছে যে, এর কিছুদিন পরে রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) বলেনঃ “আল্লাহ তাআলা আমার নিকট ওহী করেছেন যে, তোমাদেরকে তোমাদের কবরে ফিতায় ফেলে দেয়া হয়।”

সুতরাং এই আয়াত ও হাদীসগুলোর মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান প্রথমতঃ এই ভাবে হতে পারে যা উপরে বর্ণিত হলো। দ্বিতীয়তঃ আয়াতের (আরবী) দ্বারা শুধু এটুকু সাব্যস্ত হয় যে, কাফিরদেরকে আলমে বরযখে শাস্তি দেয়া হয়। কিন্তু এর দ্বারা এটা অপরিহার্য নয় যে, মুমিনকেও তার কিছু পাপের কারণে তার কবরে শাস্তি দেয়া হয়। এটা শুধু হাদীস দ্বারা সাব্যস্ত হচ্ছে।

হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একদা রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) তাঁর নিকট প্রবেশ করেন। ঐ সময় একজন ইয়াহূদী মহিলা তাঁর নিকট বসেছিল। সে তাঁকে বলেঃ “আপনাদেরকে আপনাদের কবরে আজমায়েশ করা হবে এটা কি আপনি জানেন?” এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) কেঁপে ওঠেন এবং বলেনঃ “ইয়াহুদীকে আজমায়েশ করা হবে। এর কিছুদিন পর রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) বলেনঃ “সাবধান! তোমরা তোমাদের কবরে আজমায়েশের মধ্যে পড়বে।” হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন যে, এরপর থেকে রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) কবরের ফিত্না হতে আশ্রয় প্রার্থনা করতে থাকতেন। (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন। সহীহ মুসলিমেও এটা বর্ণিত আছে)

এটাও হতে পারে যে, এ আয়াত দ্বারা শুধু রূহের উপর শাস্তির কথা প্রমাণিত হয়, দেহের উপরও শাস্তি হওয়া প্রমাণিত হয় না। পরে ওহীর মাধ্যমে রাসূলুল্লাহকে জানিয়ে দেয়া হয় যে, কবরের আযাব দেহ ও আত্মা উভয়ের উপর হয়ে থাকে। সুতরাং পরে তিনি এর থেকে মুক্তির প্রার্থনা শুরু করেন। এসব ব্যাপারে মহান আল্লাহই সবচেয়ে ভাল জানেন।

হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একটি ইয়াহুদী মহিলা তার কাছে এসে বলেঃ “কবরের আযাব হতে আমরা আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাচ্ছি।” তখন হযরত আয়েশা (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে কবরের আযাব সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি উত্তরে বলেনঃ “হ্যা, কবরের আযাব সত্য।” হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেনঃ “এরপর থেকে আমি দেখতাম যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) প্রত্যেক নামাযের পরে কবরের আযাব হতে আশ্রয় প্রার্থনা করতেন।” এ হাদীস দ্বারা তো প্রমাণিত হচ্ছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) ইয়াহূদী মহিলাটির কথা শুনা মাত্রই তার সত্যতা স্বীকার করেন। আর উপরে বর্ণিত হাদীসসমূহ দ্বারা জানা যাচ্ছে যে, তার কথাকে তিনি মিথ্যা বলেন। এ দ্বন্দ্বের সমাধান এই যে, এখানে ঘটনা হলো দু’টি। প্রথম ঘটনার সময় তাকে ওহীর দ্বারা জানানো হয়নি বলেই তিনি মহিলাটির কথার সত্যতা অস্বীকার করেন। তারপর যখন জানতে পারেন তখন তার কথার সত্যতা স্বীকার করেন। এসব ব্যাপারে একমাত্র মহান আল্লাহই সর্বাপেক্ষা সঠিক জ্ঞানের অধিকারী।

হযরত কাতাদা (রঃ) বলেন যে, দুনিয়া থাকা পর্যন্ত প্রত্যহ সকাল-সন্ধ্যায় ফিরাউন সম্প্রদায়ের রূহগুলোকে জাহান্নামের সামনে নিয়ে যাওয়া হয় এবং ওগুলোকে বলা হয়ঃ “হে ফিরাউন সম্প্রদায়! এটা তোমাদের চিরস্থায়ী আবাসস্থল।” যাতে তাদের দুঃখ-চিন্তা বেড়ে যায় এবং তারা লাঞ্ছিত ও অপমানিত হয়। সুতরাং আজও তারা শাস্তির মধ্যেই রয়েছে। আর স্থায়ীভাবে ওর মধ্যেই থাকবে।

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেন যে, শহীদদের আত্মাগুলো সবুজ রঙ এর পাখীসমূহের দেহের মধ্যে থাকে। তারা ইচ্ছামত জান্নাতের যেখানে সেখানে ঘুরে বেড়ায়। আর মুমিনদের শিশুগুলোর আত্মাও পাখীর দেহের মধ্যে থাকে। তারাও জান্নাতের যেখানে সেখানে ইচ্ছামত চলাফেরা করে। আর তারা আরশের সাথে লটকানো লণ্ঠনের মধ্যে আশ্রয় গ্রহণ করে। পক্ষান্তরে, ফিরাউন সম্প্রদায়ের রূহগুলো কালো পাখীর দেহে অবস্থান করে। পাখীগুলো সকালে ও সন্ধ্যায় জাহান্নামের নিকট যায়। এটাই হলো তাদেরকে সকাল-সন্ধ্যায় জাহান্নামের সামনে উপস্থিত করা।

মিরাজের সুদীর্ঘ হাদীসের মধ্যে এও রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “অতঃপর হযরত জিবরাঈল (আঃ) আমাকে এক বিরাট মাখলুকের নিকট নিয়ে গেলেন যাদের প্রত্যেকের পেট ছিল খুব বড় ঘরের মত, যারা ফিরাউন সম্প্রদায়ের পার্শ্বে বন্দী ছিল। ফিরাউন সম্পদায়কে সকাল-সন্ধ্যায় আগুনের সম্মুখে উপস্থিত করা হয়।”

মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ যেদিন কিয়ামত সংঘটিত হবে সেদিন আল্লাহ তাআলা (ফেরেশতাদেরকে) বলবেনঃ ‘ফিরাউন সম্প্রদায়কে কঠিন শাস্তিতে নিক্ষেপ কর।’ এই ফিরাউনী লোকগুলো লাগাম দেয়া উটের মত মুখ নীচু করে পাথর ও গাছ চাটছে এবং তারা সম্পূর্ণ অজ্ঞান ও নির্বোধ।

হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী (সঃ) বলেছেনঃ “যে ইহ্সান করে আল্লাহ তাকে তার প্রতিদান অবশ্যই দেন, সে মুসলমানই হোক বা কাফিরই হোক।” সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! কাফিরদের প্রতিদান কেমন?” উত্তরে তিনি বললেনঃ “যদি সে আত্মীয়তার সম্পর্ক যুক্ত রাখে, সাদকা করে অথবা অন্য কোন ভাল কাজ করে তবে আল্লাহ তা’আলা ওর প্রতিদান তার ধন-মালে, তার স্বাস্থ্যে এবং এরূপই অন্যান্য জিনিসে দিয়ে থাকেন।” সাহাবীগণ আবার প্রশ্ন করলেনঃ “পরকালে তারা কি বিনিময় লাভ করবে?” রাসূলুল্লাহ (সঃ) জবাবে বললেনঃ “বড় আযাব হতে ছোট আযাব।” অতঃপর তিনি (আরবী) (ফিরাউন সম্প্রদায়কে নিক্ষেপ কর কঠিন শাস্তিতে) এ আয়াত পাঠ করলেন। (এটা ইমাম ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

হযরত আওযায়ী (রঃ)-কে একটি লোক জিজ্ঞেস করলোঃ “আচ্ছা বলুন তো, বহু ঝাকের ঝক সাদা পাখীকে আমরা সমুদ্র হতে বের হতে দেখি। ওরা সমুদ্রের পশ্চিম তীরে সকাল বেলায় উড়ে যায়। ওগুলোর সংখ্যা এতো বেশী যে, কেউ গণনা করতে সক্ষম হবে না। সন্ধ্যার সময় ঐ ভাবেই ঝাঁকে ঝাঁকে ফিরে আসে। কিন্তু ঐ সময় ওগুলোর রঙ সম্পূর্ণ কালো হয়ে যায়। এর কারণ কি?” উত্তরে হযরত আওযায়ী (রঃ) তাকে বলেন, “তুমি কি সত্যিই এরূপ লক্ষ্য করেছো?” লোকটি জবাব দেয়ঃ হ্যা। তখন তিনি বলেনঃ “ঐ পাখীগুলোর দেহের মধ্যে ফিরাউন সম্প্রদায়ের রূহ রয়েছে যেগুলোকে সকাল-সন্ধ্যায় আগুনের সামনে উপস্থিত করা হয়। অতঃপর ওগুলো ওদের বাসায় ফিরে আসে। ওদের পালকগুলো পুড়ে গিয়ে কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করে। রাত্রে আবার পালক বের হয় এবং কালো রঙ দূর হয়ে যায়। দুনিয়ায় তাদের এই অবস্থা হতে থাকে। আর কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা’আলা তাদেরকে বলবেনঃ “তোমরা কঠিন শাস্তির মধ্যে প্রবেশ কর।” (ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) এটা বর্ণনা করেছেন)

কথিত আছে যে, তাদের সংখ্যা ছিল ছয় লক্ষ, যারা ফিরাউনের সৈন্য ছিল।

হ্যরত ইবনে উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন, যখন তোমাদের মধ্যে কেউ মারা যায় তখন সকাল-সন্ধ্যায় তার (স্থায়ী) বাসস্থান তাকে দেখানো হয়। সে জান্নাতী হলে জান্নাত এবং জাহান্নামী হলে জাহান্নাম দেখানো হয়ে থাকে। অতঃপর তাকে বলা হয়ঃ “এটা তোমার আসল বাসস্থান, যেখানে মহামহিমান্বিত আল্লাহ কিয়ামতের দিন তোমাকে পাঠিয়ে দিবেন।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন এবং ইমাম বুখারী (রঃ) ও ইমাম মুসলিম (রঃ) এটা তাখরীজ করেছেন)

Leave a Reply