أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#১০৯২)
[ *সত্যের পথে আহবানকারীদের অবিচল অবস্থান : -]
www.motaher21.net
সূরা:- ৪১:হামীম-আস-সাজদাহ-১
পারা:২৪
১- ৮ নং আয়াত:-
৪১:হামীম-আস-সাজদাহ-১
حٰمٓ ۚ﴿۱﴾
হা-মীম।
৪১:হামীম-আস-সাজদাহ-২
تَنۡزِیۡلٌ مِّنَ الرَّحۡمٰنِ الرَّحِیۡمِ ۚ﴿۲﴾
এটা রহমান, রহীম আল্লাহর কাছ থেকে নাযিলকৃত,
৪১:হামীম-আস-সাজদাহ-৩
کِتٰبٌ فُصِّلَتۡ اٰیٰتُہٗ قُرۡاٰنًا عَرَبِیًّا لِّقَوۡمٍ یَّعۡلَمُوۡنَ ۙ﴿۳﴾
এটি এমন এক গ্রন্থ যার আয়াতসমূহ সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে। আরবী ভাষার কুরআন। সেই সব লোকদের জন্য যারা জ্ঞানের অধিকারী,
৪১:হামীম-আস-সাজদাহ-৪
بَشِیۡرًا وَّ نَذِیۡرًا ۚ فَاَعۡرَضَ اَکۡثَرُہُمۡ فَہُمۡ لَا یَسۡمَعُوۡنَ ﴿۴﴾
সুসংবাদ দানকারী ও সতর্ককারী। কিন্তু তাদের অধিকাংশ লোকই তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, তারা শুনতেই পায় না।
৪১:হামীম-আস-সাজদাহ-৫
وَ قَالُوۡا قُلُوۡبُنَا فِیۡۤ اَکِنَّۃٍ مِّمَّا تَدۡعُوۡنَاۤ اِلَیۡہِ وَ فِیۡۤ اٰذَانِنَا وَقۡرٌ وَّ مِنۡۢ بَیۡنِنَا وَ بَیۡنِکَ حِجَابٌ فَاعۡمَلۡ اِنَّنَا عٰمِلُوۡنَ ؓ﴿۵﴾
তারা বলে, ‘তুমি যার প্রতি আমাদেরকে ডাকছ সে বিষয়ে আমাদের অন্তর আবরণ-আচ্ছাদিত, আমাদের কানে আছে বধিরতা এবং তোমার ও আমাদের মধ্যে আছে পর্দা; কাজেই তুমি তোমার কাজ কর, নিশ্চয় আমরা আমাদের কাজ করব।’
৪১:হামীম-আস-সাজদাহ-৬
قُلۡ اِنَّمَاۤ اَنَا بَشَرٌ مِّثۡلُکُمۡ یُوۡحٰۤی اِلَیَّ اَنَّمَاۤ اِلٰـہُکُمۡ اِلٰہٌ وَّاحِدٌ فَاسۡتَقِیۡمُوۡۤا اِلَیۡہِ وَ اسۡتَغۡفِرُوۡہُ ؕ وَ وَیۡلٌ لِّلۡمُشۡرِکِیۡنَ ۙ﴿۶﴾
হে নবী, এদের বলে দাও, আমি তো তোমাদের মতই একজন মানুষ। আমাকে অহীর মাধ্যমে জানিয়ে দেয়া হয় যে, একজনই মাত্র তোমাদের ইলাহ কাজেই সোজা তাঁর প্রতি নিবিষ্ট হও এবং তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো। মুশরিকদের জন্য ধ্বংস,
৪১:হামীম-আস-সাজদাহ-৭
الَّذِیۡنَ لَا یُؤۡتُوۡنَ الزَّکٰوۃَ وَ ہُمۡ بِالۡاٰخِرَۃِ ہُمۡ کٰفِرُوۡنَ ﴿۷﴾
যারা যাকাত প্ৰদান করে না এবং তারাই আখিরাতের সাথে কুফরিকারী।
৪১:হামীম-আস-সাজদাহ-৮
اِنَّ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ لَہُمۡ اَجۡرٌ غَیۡرُ مَمۡنُوۡنٍ ٪﴿۸﴾
যারা ঈমান এনেছে এবং নেক কাজ করেছে, নিশ্চিতভাবে তাদের জন্য এমন পুরস্কার রয়েছে যার ধারাবাহিকতা কখনো ছিন্ন হবে না।
ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
সংক্ষিপ্ত আলােচনা : আকীদাসংক্রান্ত মেীলিক তত্ত্বসমূহ তথা তাওহীদ, রেসালাত, আখেরাত আল্লাহর দিকে দাওয়াত ও দাওয়াত দাতার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যসমূহ এ সূরার প্রধান আলােচ্য বিষয়। সূরা আর যে যে বিষয় আলােচিত হয়েছে, তা উক্ত তত্ত্বসমূহের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ও সাক্ষ্য প্রমাণের পর্যায়ভুক্ত। তাছাড়া প্রকৃতিতে ও মানব সত্ত্বায় আল্লাহর নিদর্শনাবলী প্রদর্শন, এইসব নিদর্শনকে অগ্রাহ্য ও অস্বীকার করার বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি, অতীত প্রজন্ম সমূহের মধ্য থেকে যারা অস্বীকার করেছিলাে তাদের ধ্বংসের কাহিনী স্মরণ করিয়ে দেয়া এবং কেয়ামতের দিনে কাফেরদের পরিণতির দৃশ্যাবলী এ সূরার অন্যতম উপাদান। সেই সাথে এ কথাও বলা হয়েছে যে, জ্বিন ও মানুষের মধ্য থেকে যারা এ সত্যগুলােকে অস্বীকার করে, তারা ছাড়া আকাশ, পৃথিবী, সূর্য, চন্দ্র, ও ফেরেশতা ইত্যাদি সমুদয় সৃষ্টি এই সব সত্যকে স্বীকার করে, একমাত্র আল্লাহর সামনে সেজদা করে ও আত্মসমর্পণ করে। তাওহীদ সংক্রান্ত আয়াতগুলাে হলাে বলাে, আমি তােমাদের মতাে মানুষ ছাড়া আর কিছুই নই । তােমাদের সাথে সাথে আমার পার্থক্য হচ্ছে, আমার কাছে ওহী প্রেরণ করা হয় যে, তােমাদের মাবুদ একজন মাবুদ মাত্র। অতএব, তার ওপর অবিচল থাকো এবং তার কাছে ক্ষমা চাও। আর মােশরেকদের জন্যে রয়েছে দুর্ভোগ… ‘বলাে, তােমরা কি তাঁকে অস্বীকার করাে, যিনি পৃথিবীকে দু’দিনে সৃষ্টি করেছেন। আর আদ ও সামুদ সম্পর্কে জানান যে, তাদের রসূলরাও তাদেরকে এই একই কথা বলেছেন যে, আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কারাে এবাদাত করাে না। সূরার মাঝখানে বলা হয়েছে। তােমরা সূর্য ও চন্দ্রের সামনে সেজদা করাে না। বরং যিনি এগুলােকে সৃষ্টি করেছেন তাকে সেজদা করাে। সূরার শেষভাগেও এই একই বিষয়ে বলা হয়েছে; ‘যেদিন তিনি তাদেরকে ডেকে জিজ্ঞেস করবেন, আমার শরীর কোথায়…’ আখেরাত সম্পর্কে বলতে গিয়ে যারা আখেরাতে বিশ্বাস করে না তাদেরকে ধমক দিয়ে বলা হয়েছে, ‘মোশরেকদের জন্যে দুর্ভোগ, যারা যাকাত দেয়না আখেরাতে অবিশ্বাস করে।’ শেষ আয়াতে বলা হয়েছে, ‘শুনে রাখাে, তারা তাদের প্রভুর সাথে সাক্ষাতের ব্যাপারে সন্দিহান। জেনে রাখে, তিনি প্রতিটা জিনিসকে ঘেরাও করে রেখেছেন।’ অনুরূপভাবে কেয়ামতের দৃশ্যাবলীর মধ্যেও এ বিষয়টার উল্লেখ পাওয়া যায় । এদ্বারা স্বভাবতই কেয়ামতের দিনে যা যা ঘটবে তার বর্ণনা দেয়া হয়েছে। এই পদ্ধতিটাই এ বিষয়কে গুরুত্ব দেয়ার জন্যে অধিকতর উপযােগী। ওহী ও রেসালাত সম্পর্কে এতাে বেশী আলােচনা এসেছে যে, এ বিষয়টাই এ সূরার প্রধান। আলােচ্য বিষয় বলে মনে হয়। সূরার শুরুতেই এ বিষয়ে বিস্তারিত বক্তব্য দেয়া হয়েছে। যথা, ‘হা-মীম-পরম দাতা ও দয়ালুর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ…’(আয়াত ১-৬) সূরার মাঝখানে রয়েছে মােশরেকরা কোরআনের অভ্যর্থনা কিভাবে করতাে তার বিবরণ ‘কাফেররা বললাে, তােমরা এই কোরআন শুনাে না, বরং এর ভেতরে হৈচৈ করাে, হয়তাে তােমরা বিজয়ী হবে।’ এরপর এই অভ্যর্থনার বিস্তারিত বিবরণ ও এর জবাব রয়েছে। (আয়াত ৪১-৪৪) আর দাওয়াত ও দাওয়াতকারীর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বলা হয়েছে। (আয়াত ৩৩-৩৬) এই বিষয়গুলাে গভীর আবেগােদ্দীপক বিপুলসংখ্যক আয়াতের মধ্য দিয়ে তুলে ধরা হয়েছে। বিরাট বিরাট নিদর্শনাবলীতে পরিপূর্ণ প্রাকৃতিক জগত, বিস্ময়কর গঠন সম্বলিত মানবীয় মনােজগত, অতীতের আল্লাহ দ্রোহীদের ধ্বংসযজ্ঞ এবং সর্বশেষে কেয়ামতের লােমহর্ষক কিছু দৃশ্যের বিবরণের মধ্য দিয়ে এ সূরার আকীদা সংক্রান্ত আলােচ্য বিষয়গুলাের বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এই সূরার প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলীর মধ্য থেকে আকাশ ও পৃথিবীর প্রথম সৃষ্টির অত্যন্ত কৌতূহলােদ্দীপক তথ্য সম্বলিত বিশদ বিবরণটা খুবই উপভােগ্য। এ বিবরণটা ৯নং আয়াত থেকে শুরু হয়ে ১২নং আয়াতের শেষে গিয়ে সমাপ্ত হয়েছে। অনুরূপভাবে রাতদিন ও সূর্য-চন্দ্রে নিদর্শনের সমারােহের বিবরণও এ সূরার প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলীর অন্তর্ভুক্ত। ৩৭নং থেকে শুরু করে ৩৯নং আয়াতে এই বিবরণ বিস্তৃত। আর মানুষের মনমানসসংক্রান্ত তথ্যাবলী খুবই স্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে।(আয়াত ১৯-২০) অতীতের অবিশ্বাসীদের ধ্বংসের বিবরণ থেকে সবিস্তারে উল্লেখ করা হয়েছে আ’দ ও সামুদের ধ্বংসযজ্ঞ।(আয়াত ১৫-১৮) এ সূরায় কেয়ামতেরও অনেক দৃশ্য তুলে ধরা হয়েছে।(আয়াত ১৯-২০) অনুরূপভাবে, দুনিয়াতে যারা প্রতারিত হয়েছিলাে, তারা প্রবঞ্চনাকারীদের ওপর যে ক্রোধ প্রকাশ করবে। সে দৃশ্যও এর আওতাভুক্ত। এ দৃশ্যটা রয়েছে ২৯ নং আয়াতে। এভাবে ইসলামী আকীদা বিষয়ক তত্ত্বগুলাে অত্যন্ত আবেগােদ্দীপক ভাষায় এমনভাবে তুলে ধরা হয়েছে যে, এদ্বারা সমগ্র সূরার পরিবেশ, প্রকৃতি ও প্রভাব কেমন তা সুস্পষ্টভাবে জানা যায় । প্রকৃতপক্ষে সূরার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পাঠকের মন আকাশ ও পৃথিবীর সুবিশাল সম্রাজ্যে, নিজের মনােজগতের গভীর থেকে গভীরতর প্রকোষ্ঠে, অতীতের আল্লাহদ্রোহীদের ধ্বংসের ইতিবৃত্তে ও কেয়ামতের জগতে বিচরণ করতে থাকে এবং মনের ওপর এসবের গভীর প্রভাব সুরাটা তার সমস্ত আলােচ্য বিষয় ও অন্যান্য উদ্দীপনাময় উপদেশসমূহ সহ দুটো পর্বে বিভক্ত, যার উভয়টা পরস্পরের সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ত ও সমন্বিত। প্রথম পর্বের সূচনা হয়েছে কোরআন নাযিল হওয়া, তার প্রকৃতি ও তার প্রতি মােশরেকদের ভূমিকা দিয়ে। এর পরপরই রয়েছে আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টি বৃত্তান্ত, অতপর আ’দ ও সামুদের কাহিনী, তারপর আল্লাহর শত্রুদের পরকালের দৃশ্য এবং তাদের চামড়া, চোখ ও কান কর্তৃক তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দানের দৃশ্য। এখান থেকে প্রসংগ পাল্টে গিয়ে তাদের দুনিয়ার জীবনের বর্ণনা দেয়া হয়েছে। কিভাবে তারা এতাে বিপথগামী হলাে তা উল্লেখ করা হয়েছে। এই পর্যায়ে উল্লেখ করা হয়েছে যে, আল্লাহ তায়ালা জ্বীন ও মানুষের মধ্য থেকে কিছু অসৎ লােককে তাদের সংগী বানিয়ে দিয়েছিলেন। এই সংগীরা তাদের সামনের ও পেছনের সব কাজকে সুন্দর ও শােভন করে দেখাতে। এর ফলে তারা পরস্পরকে বলতাে যে, ‘তােমরা কোরআন শুনােনা, বরং হৈ চৈ করাে। তাহলে হয়তাে জয় লাভ করতে পারবে। এরপর এইসব সংগী তাদের সাথে ধোকাবাজী করার কারণে তারা কেয়ামতের দিন তাদের ওপর যে ক্রোধ ঝাড়বে, তার দৃশ্য তুলে ধরা হয়েছে। অপরদিকে রয়েছে তারা, যারা বলেছে আমাদের প্রভু আল্লাহ এবং তারপর এই ঘােষণায় অবিচল থেকেছে। এদের ওপর কোনাে খারাপ সংগী নয়, বরং ফেরেশতারা নাযিল হবে । এই ফেরেশতারা। তাদেরকে আশ্বাস দেবে, সুসংবাদ দেবে এবং নিজেদেরকে দুনিয়ায় ও আখেরাতে তার সাথী বলে জানাবে। এর অব্যবহিত পরই রয়েছে দায়ী ও দাওয়াতদাতা সংক্রান্ত আলােচনা এবং এখানেই এ পর্বের সমাপ্তি ঘটেছে। এরপরই শুরু হয়েছে দ্বিতীয় পর্ব। এর শুরুতেই রয়েছে রাত ও দিন। সূর্য ও চন্দ্র, এবাদাতরত ও অনুগত ফেরেশতারা বিনয়াবনত পৃথিবী এবং পৃথিবীতে অজন্মার পর জীবন ও উদ্ভিদের সমারােহ সংক্রান্ত আলােচনা। তারপর যারা আল্লাহর নিদর্শনাবলীতে ও তার কিতাবে বক্রতা অনুসন্ধান করে তাদের নিয়ে বক্তব্য এসেছে। এই পর্যায়ে কোৱআন সম্পর্কে আলােচনা করা হয়েছে এবং তারপরই উল্লেখ করা হয়েছে হযরত মূসার কিতাব ও তা নিয়ে তার জাতির মতবিরােধের প্রসংগ। তাদের ব্যাপারটা আল্লাহর কাছে সোপর্দ করা হয়েছে। এই পর্যায়ে কেয়ামত সম্পর্কে কথা এসেছে এবং বলা হয়েছে যে, এ সংক্রান্ত জ্ঞান আল্লাহ ছাড়া আর কারাে কাছে নেই। একমাত্র তিনিই জানেন ফলের ঝুড়িতে কত ফল এবং মায়ের পেটে কি সন্তান রয়েছে। তারপর বলা হয়েছে যে, কাফেরদের কাছে কেয়ামতের দিন জিজ্ঞাসা করা হবে, আল্লাহর সাথে যাদেরকে তােমরা শরীক বানাতে, তারা কোথায় গেলাে। এরপরই এসেছে মানুষের নিজ সত্ত্বা সংক্রান্ত বক্তব্য। বলা হয়েছে যে, মানুষ নিজের এত কল্যাণকামী হয়েও তার ব্যাপারে সতর্ক হয় না, বরং কুফরি করে ও মিথ্যাচারে লিপ্ত হয়, যার ফলে তার জন্য আযাব ও ধ্বংস অনিবার্য হয়ে ওঠে। সূরার সমাপ্তি টানা হয়েছে আল্লাহর এই প্রতিশ্রুতি ঘােষণার মাধ্যমে যে, তিনি মানুষের নিজ সত্ত্বা ও বাইরের প্রকৃতি সংক্রান্ত নিদর্শনাবলী তথা তথ্যাবলী তার কাছে উন্মোচিত করবেন, যাতে তারা আল্লাহর অস্তিত্ব ও একত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত ও সংশয়মুক্ত হয়। (শেষ আয়াত দুটো দেখুন)
‘হা-মীম…’(আয়াত ১-৫) কয়েকটা সূরার শুরুতে এ ধরনের বিচ্ছিন্ন বর্ণমালার উপস্থিতি নিয়ে ইতিপূর্বে আলােচনা করেছি। আর বারংবার এর পুনরাবৃত্তি ও অযৌক্তিক কিংবা বেমানান কিছু নয়। এটা কোরআনের সাধারণ রীতির সাথে সংগতিশীল। কোরআন যে সকল তত্ত্ব ও তথ্য মানুষের মনমগযে বদ্ধমূল করতে চায়, সেগুলােকে সে বারংবার উল্লেখ করে থাকে। কেননা মানুষের মনের প্রকৃতিই এ রকম দাবী জানায় যে, তাকে বারংবার সতর্ক করা হােক। নচেৎ তাকে একবার যা বলা হয়েছে তা একটু দীর্ঘ সময় কেটে গেলেই সে ভুলে যায়। কোনাে আবেগজনিত সত্যকে তার মনে বন্ধমূল করতে হলে প্রাথমিকভাবে সে চায়, ওটাকে বিভিন্ন ভংগীতে পুনরাবৃত্তি করা হােক। কোরআন মানুষের মনকে তার যাবতীয় সহজাত বৈশিষ্ট্য, ক্ষমতা ও যােগ্যতা সহকারেই গ্রহণ করে। মনের সষ্টিকর্তা ও পরিচালক তার সম্পর্কে যা কিছু জানেন, তদনুসারেই তাকে কুরআন বুঝার কাজে লাগান। *কোরআনের আহবান উপেক্ষা করার অজুহাত : ‘হা-মীম, পরম দাতা ও দয়ালুর কাছ থেকে এর অবতরণ।’ কথাটা যেভাবে বলা হয়েছে, তাতে মনে হয়, যেন ‘হা-মীম’ এই সূরার বা কোরআনের নাম। কেনন ‘হা-মীম’ সেইসব বর্ণমালারই অংশ, যা দিয়ে শাব্দিকভাবে এই কোরআন রচিত হয়েছে। আর এই হা-মীম যেন উদ্দেশ্য এবং পরম দাতা ও দয়ালুর কাছ থেকে এর অবতরন বিধেয়। আর কিতাব নাযিলের বিষয়টা উল্লেখ করতে গিয়ে পরম দাতা ও দয়ালু’র কথা উল্লেখ করে বুঝানাে হয়েছে যে, এই কিতাব নাযিল করার পেছনে আল্লাহর যে গুণটার সর্বাধিক অবদান রয়েছে, তা হচ্ছে দয়া বা করুণা। বস্তুত এ কিতাব যে সময় জগদ্বাসীর জন্যে রহমত বা করুণা হিসেবে এসেছে, সে ব্যাপারে কোনাে সন্দেহের অবকাশ নেই। রহমত শুধু কোরআনের প্রতি যারা ঈমান এনেছে তাদের জন্যই নয়, বরং অন্যদের জন্যেও বটে এবং শুধু মানুষের জন্যই নয়, বরং সকল প্রাণীর জন্যেও বটে। কেননা এই কোরআন জীবন-যাপনের এমন বিধান ও কর্মসূচী দেয়, যা সকলের সার্বিক কল্যাণ ও সুখ সমৃদ্ধি নিশ্চিত করে। এ কোরআন মানব জাতির জীবনে, তার চিন্তাধারায়, তার কর্মকান্ডে ও তার উপলব্ধিতে স্বতন্ত্র ছাপ রেখেছে। এ ক্ষেত্রেও তার প্রভাব শুধু মুসলমানদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং তার প্রভাব বিশ্বময় ও চিরন্তন। যার ন্যায়বিচার ও সততার সাথে মানবজাতির ইতিহাস অধ্যয়ন করেন এবং এর ব্যাপক মানবিক অর্থে ও সকল মানবীয় তৎপরতার নিরীখে অধ্যয়ন করেন তারা এ তত্ত্বটি কে যথাযথভাবে হৃদয়াঙ্গম করেন এবং এ ব্যাপারে পূর্ণ তৃপ্ত ও নিশ্চিন্ত হন। এ ধরনের অনেক ব্যক্তি তাদের এ উপলব্ধি ও স্বীকৃতি সুস্পষ্টভাবে লিপিবদ্ধ করেছেন। ‘এটা এমন কিতাব, যার আয়াতগুলােকে বিস্তারিতভাবে ও জ্ঞানী লােকদের জন্যে আরবী কোরআন হিসাবে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।’ বস্তুত উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ভেদে, পাঠকদের স্বভাবপ্রকৃতি ও বিবেক-বুদ্ধির বিভিন্নতার আলােকে, ভিন্ন ভিন্ন স্থান, কাল ও পরিবেশের প্রেক্ষাপটে এবং মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা ও তার রকমারি প্রয়ােজনের দাবিতে এক একটা বিষয় বিস্তারিতভাবে আলােচনা করা। এ কিতাবের একটা সুস্পষ্ট বৈশিষ্ট্য। এইসব দাবী ও চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতেই এ নিদর্শনগুলাে বিস্তারিতভাবে আলােচিত হয়েছে। আলােচিত হয়েছে জ্ঞানী লােকদের জন্য আরবী কোরআন হিসাবে কেননা জ্ঞানী লােকদেরই জানা ও চেনার যােগ্যতা রয়েছে। এই কোরআন সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী হিসাবে তার ভূমিকা পালন করে থাকে। সৎকর্মশীল মােমেনদেরকে সুসংবাদ দেয়, আর প্রত্যাখ্যানকারী ও অসৎকর্মশীলদেরকে সতর্ক করে। এই সতর্কীকরণ ও সুসংবাদের কারণ সে প্রাঞ্জল আরবী ভাষায় বিশ্লেষণও করে। যাদের মাতৃভাষা আরবী, তাদের কাছেই সে বিশ্লেষণ করে। কিন্তু এতদসত্তেও তাদের অধিকাংশই কোরআনকে গ্রহণ করেনি। তাদের অধিকাংশই মুখ ফিরিয়ে চলে গেলাে, তারা শুনলাে না। তারা নিজেরা তাে মুখ ফিরিয়েই থাকতাে এবং কার্যত কোরআনের কিছুই শুনতাে না, যাতে তাদের মনে কোরআনের প্রভাব ছড়িয়ে না পড়ে। এই সাথে তারা জনগণকেও কোরআন শুনতে মানা করতাে। কখনাে কখনাে তারা শুনলেও তা কার্যত না শােনার মতই হতাে। কেননা তাদের মনে এর প্রভাব পড়াকে তারা কঠোরভাবে প্রতিরােধ করতাে। তাই তারা বলতে গেলে বধির ছিলাে, শুনতে পেতাে না। ‘তারা বলতাে, আমাদের হৃদয়ে এমন পর্দা রয়েছে, যা তােমাদের আহবানকে ভেতরে আসতে দেয় না। আর আমাদের কানে রয়েছে বধিরতা এবং আমাদের ও তােমার মাঝে রয়েছে অন্তরায়। কাজেই তুমি যা করছো করতে থাকো, আমরা ও আমাদের যা করা উচিত তা করে যাবাে।’ তারা চরম হঠকারিতা ও গােয়ার্তুমি সহকারে এ কথা বলতাে, যাতে রসূল(স.) তাদেরকে আর দাওয়াত না দেন। কেননা তারা নিজেদের অন্তরে রসূল(স.)-এর কথার প্রচন্ড প্রভাব অনুভব করতাে। অথচ সচেতনভাবে তাদের সিদ্ধান্ত ছিলাে, কোনােক্রমেই তারা ঈমান আনবে না। তাই তারা বলতাে; ‘আমাদের অন্তর পর্দা দিয়ে ঢাকা রয়েছে। তাই সেখানে তােমার কথাবার্তা পৌছে না। আর আমাদের কান বধির হয়ে গেছে। তাই তােমার দাওয়াত আমরা শুনতে পাই না। আমাদের ও তােমার মাঝে আড়াল রয়েছে। ফলে আমাদের ও তােমার মাঝে কোনাে সংযোগ নেই। সুতরাং আমাদেরকে আমাদের ইচ্ছামত কাজ করতে দাও। আর তুমি নিজেও নিজের ইচ্ছামত কাজ করো।’ অথবা তারা বেপরােয়ভাবে বলে থাকবে; আমরা তােমার কথা ও কাজের ধার ধারি না। তােমার হুঁশিয়ারি ও হুমকিরও পরােয়া করি না । তুমি চাও তাে তোমার পথে তুমি চলতে থাকে। আর আমরা আমাদের পথে চলছি। তােমার কোনাে কথা আমরা শুনবাে না। তুমি যা করতে পারাে করাে। তুমি যে আযাবের ভয় দেখাও, তা পারলে নিয়ে আসাে। আমরা ও সবের ভয় পাই না।
*সত্যের পথে আহবানকারীদের অবিচল অবস্থান : রসূল(স.) ইসলামের দাওয়াত দিতে গিয়ে যে বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হতেন, এ হচ্ছে তার কিছু নমুনা। এসব সত্তেও তিনি তার দাওয়াত চালিয়ে যেতেন। দাওয়াতের কাজ থেকে বিরত হতেন না। চরম নৈরাশ্যকর পরিস্থিতিতেও হতাশ হয়ে দমে যেতেন না। আল্লাহর প্রতিশ্রুতি ও হুমকিকে কাফেরদের কাছে প্রকাশ করতে তিনি দ্বিধা করতেন না। তিনি ক্রমাগত ঘােষণা করতেন যে, আল্লাহর আযাবের হুমকি কার্যকরী করার ক্ষমতা তার নেই। তিনি কেবল ওহীপ্রাপ্ত একজন মানুষ মাত্র। তিনি সেই ওহী প্রচারের দায়িত্বপ্রাপ্ত মাত্র। মানুষকে এক আল্লাহর দিকে আহ্বান করাই তার কাজ। এই পথে তিনি অবিচল থাকবেন এবং আল্লাহর আদেশ মােতাবেক তিনি মােশরেকদের সতর্ক করতেই থাকবেন। এরপর সব কিছু আল্লাহর হাতে সমর্পিত। তার হাতে কিছুই নেই, তিনি আল্লাহর আজ্ঞাবাহী একজন মানুষ ছাড়া কিছু নন।(আয়াত ৬) ভেবে অবাক হয়ে যেতে হয় যে, কী বিরাট ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা এবং কত মযবুত ঈমান ও আত্মসমর্পণের শিক্ষা এখানে দেয়া হয়েছে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে ধৈর্যধারণের অর্থ কী দাঁড়ায়, এ ধরনের পরিস্থিতিতে সব রকমের শক্তি ও ক্ষমতা থেকে স্বেচ্ছায় বঞ্চিত হওয়ার পরিণাম কী হয় এবং এমন ধৃষ্টতাপূর্ণ প্রত্যাখ্যান ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ উপেক্ষার পরও এই ধৃষ্টতা প্রকাশকারী কাফেরদেরকে প্রতিহত করার মতাে আযাব ত্বরান্বিত করার আবেদন না জানিয়ে ধৈর্যধারণে যে কতাে মানসিক যাতনা ভােগ করতে হয়, সেটা একমাত্র ভুক্তভােগী ছাড়া আর কেউ উপলব্ধি করতে পারবে না। নবীরা প্রায়ই এ ধরনের পরিস্থিতির সম্মুখীন হতেন বলেই তাদেরকে এতাে বেশী ধৈর্যধারণের নির্দেশ দেয়া হতাে। বস্তুত ইসলামের দাওয়াতের পথটাই দীর্ঘ ধৈর্যের পথ। ইসলামী দাওয়াত ও আন্দোলনের বিজয় ও সাফল্যের আকাংখা যতাে প্রবল হয়, বাস্তবে বিজয় ততােই বিলম্বিত হয়। এ কারণেই ধৈর্য, সস্তোষ ও আত্মসমর্পণ অপরিহার্য হয়ে পড়ে। মোশরেকদের ধৃষ্টতা ও ঔদ্ধত্যের মােকাবেলায় রাসূল(স.)-কে সর্বোচ্চ যে কাজটা করার আদেশ দেয়া হতাে তা ছিলাে তার এ কথা বলা যে ‘মােশরেকরা যাকাত দেয় না ও আখেরাতে বিশ্বাস করে না, তাদের জন্যে রয়েছে দুর্ভোগ।’ এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে যাকাতের উল্লেখের একটা উপলক্ষ অবশ্যই ছিলাে, যা আমরা এখনাে ভেবে দেখিনি। এ আয়াতটা মক্কী যুগের। অথচ যাকাতের আয়াত মদীনায় হিজরতের দ্বিতীয় বছরে নাযিল হয়েছিলাে। অবশ্য যাকাতের মূলনীতিটা মক্কায় থাকা কালেই সবাই জানতাে। মদিনায় কেবল যাকাতের হার এবং একটা সুনির্দিষ্ট ফরয দান হিসেবে তা আদায়ের নির্দেশই জারী হয়েছিলাে। মক্কায় এটা ছিলাে একটা সাধারণ ঐচ্ছিক দান, যার কোনাে পরিমাণ নির্ধারিত ছিলো না। লােকেরা কেবল বিবেকের তাড়নায় স্বেচ্ছায় যতােটা মনে চাইতাে দিতাে। তবে আখেরাত অবিশ্বাস করাটা আসল ও চরম কুফরি এবং এর ফলে আযাব ও দুর্ভোগ অনিবার্য হয়ে ওঠে। কেউ কেউ বলেছেন যে, এখানে যাকাত দ্বারা ঈমান বুঝানাে হয়েছে, যা শিরক থেকে পবিত্রতা অর্জনের নামান্তর। এ ধরনের ক্ষেত্রে এ ব্যাখ্যাটাও গ্রহণযােগ্য। পরবর্তী আয়াতে দ্বীনের পথে আহবানকারীদের শিক্ষা দেয়া হয়েছে, তারা যেন শিরক ও কুফরির ন্যায় অপরাধের নিন্দা ও তার জঘন্যতা বিশ্লেষণ করা অব্যাহত রাখে, তাদেরকে মহাবিশ্বের বিশাল দিগন্ত পরিদর্শন করায়, আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টি রহস্যের দিকে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং সমগ্র সৃষ্টিজগতকে পর্যবেক্ষণ করার আহ্বান জানায়- যার সামনে তারা নিতান্ত ক্ষুদ্র ও তুচ্ছ। এই বিশাল বিশ্বজগতের দিকে দৃষ্টি দিলে তাদের কাছে মহান আল্লাহর সেই অসীম ক্ষমতা স্পষ্ট হয়ে যাবে, যা দ্বারা তিনি এই বিশ্বজগতকে সৃষ্টি করেছেন। অথচ তারা এই বিশ্বজগতেরই অংশ আর এর অংশ হয়েও তার সৃষ্টি ক্ষমতাকে অস্বীকার করে। বিশ্বজগতের সৃষ্টি রহস্য পর্যবেক্ষণ করলে তারা তাদের সেই সংকীর্ণ গন্ডী থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে, যেখান থেকে তারা ইসলামের দাওয়াতকে বিচার-বিবেচনা করে থাকে। এই ক্ষুদ্র গন্ডীতে বসে তারা নিজেদেরকে অনেক বড় দেখতে পায়। নিজেদেরকে এত বড় দেখার কারণেই তারা বুঝতে পারে না তাদেরকে বাদ দিয়ে মােহাম্মদ(স.)-কে রসূল হিসাবে নিয়ােগ করার যৌক্তিকতা কোথায়। তাদের নিজেদের মান-মর্যাদা ও স্বার্থকে তারা অত্যধিক বড় করে দেখার কারণে তারা সেই বিরাট ও মহাসত্যকে উপলব্ধি করতে পারে না, যা রসূল(স.) নিয়ে এসেছেন এবং যার শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্বের মূলে রয়েছে এই কোরআন। এটা সেই মহাসত্য, যা আকাশ ও পৃথিবীর চেয়েও বড়, যা সর্বকালের ও সকল প্রজন্মের মানবজাতির উপযােগী ও কল্যাণকর, যার অবস্থান সকল স্থান, কাল ও ব্যক্তির উর্ধে এবং যা সমগ্র সৃষ্টি জগতের সাথে ওতপ্রােতভাবে জড়িত।
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
(৪১-হামীম-আস-সাজদাহ) : নামকরণ:
(আরবী) حَم السِجْدَة দু’টি শব্দের সমন্বয়ে এ সূরার নামকরণ করা হয়েছে। একটি শব্দ حم ও অপরটি السجدة। অর্থাৎ এটি সেই সূরা যা শুরু হয়েছে হা-মীম শব্দ দিয়ে এবং যার মধ্যে এক স্থানে সিজদার আয়াত আছে।
(৪১-হামীম-আস-সাজদাহ) : নাযিল হওয়ার সময়-কাল :
(আরবী) فَإِنْ أَعْرَضُوا فَقُلْ أَنْذَرْتُكُمْ صَاعِقَةً مِثْلَ صَاعِقَةِ عَادٍ وَثَمُودَ নির্ভরযোগ্য রেওয়ায়েত অনুসারে এর নাযিল হওয়ার সময়কাল হচ্ছে হযরত হামযার (রা:) ঈমান আনার পর এবং হযরত উমরের (রা:) ঈমান আনার পূর্বে। নবী করিম ﷺ এর প্রাচীনতম জীবনীকার মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক বিখ্যাত তাবেয়ী মুহাম্মাদ ইবনে কা’ব আল-কারযীর বরাত দিয়ে এই কাহিনী উদ্ধৃত করেছেন যে, একদিন কিছু সংখ্যক কুরাইশ নেতা মসজিদে হারামের মধ্যে আসর জমিয়ে বসেছিল এবং মসজিদের অন্য এক কোণে রসূলুল্লাহ ﷺ একাকী বসেছিলেন। এটা এমন এক সময়ের ঘটনা যখন হযরত হামযা ঈমান এনেছিলেন এবং কুরাইশরা প্রতিনিয়ত মুসলমানদের সাংগঠনিক উন্নতি দেখে অস্থির হয়ে উঠছিলো। এই সময় ‘উতবা ইবনে রাবী’আ (আবু সুফিয়ানের শ্বশুর) কুরাইশ নেতাদের বললেন, ভাইসব, আপনারা যদি ভালো মনে করেন তাহলে আমি গিয়ে মুহাম্মাদের ﷺ সাথে আলাপ করতে এবং তাঁর কাছে কয়েকটি প্রস্তাব পেশ করতে পারি। সে হয়তো তার কোনটি মেনে নিতে পারে এবং আমাদের কাছেও তা গ্রহণ যোগ্য হতে পারে। আর এভাবে সে আমাদের বিরুদ্ধাচরণ করা থেকে বিরত থাকতে পারে। উপস্থিত সবাই তার সাথে একমত হলো এবং ‘উতবা উঠে নবী ﷺ এর কাছে গিয়ে বসলো। নবী ﷺ তার দিকে ফিরে বসলে সে বললো: ভাতিজা, বংশ ও গোত্রের বিচারে তোমার কওমের মধ্যে তোমার যে মর্যাদা তা তুমি অবগত আছো। কিন্তু তুমি তোমার কওমকে এক মুসিবতের মধ্যে নিক্ষেপ করেছো। তুমি কওমের ঐক্যে ফাটল ধরিয়ে দিয়েছো। গোটা কওমকে নির্বোধ প্রতিপন্ন করেছো। কওমের ধর্ম ও তাদের উপাস্যদের সমালোচনা করেছো এবং এমন কথা বলতে শুরু করেছো যার সারবস্তু হলো, আমাদের সকলের বাপ-দাদা কাফের ছিল। এখন আমার কথা একটু মনোযোগ দিয়ে শোন। আমি তোমার কাছে কিছু প্রস্তাব রাখছি প্রস্তাবগুলো গভীরভাবে চিন্তা করে দেখো। “হয়তো তার কোনটি তুমি গ্রহন করতে পার।” রসূলুল্লাহ ﷺ বললেন: আবুল ওয়ালীদ, আপনি বলুন, আমি শুনবো। সে বললো: ভাতিজা, তুমি যে কাজ শুরু করেছো তা দিয়ে সম্পদ অর্জন যদি তোমার উদ্দেশ্য হয় তাহলে আমরা সবাই মিলে তোমাকে এতো সম্পদ দেব যে, তুমি আমাদের মধ্যে সবার চেয়ে সম্পদশালী হয়ে যাবে। এভাবে তুমি যদি নিজের শ্রেষ্ঠত্ব কামনা করে থাকো তাহলে আমরা তোমাকে আমাদের নেতা বানিয়ে নিচ্ছি, তোমাকে ছাড়া কোন বিষয়ে ফায়সালা করবো না। যদি তুমি বাদশাহী চাও তাহলে আমরা তোমাকে আমাদের বাদশাহ বানিয়ে নিচ্ছি। আর যদি তোমার ওপর কোন জিন প্রভাব বিস্তার করে থাকে যাকে তুমি নিজে তাড়াতে সক্ষম নও তাহলে আমরা ভালো ভালো চিকিৎসক ডেকে নিজের খরচে তোমার চিকিৎসা করিয়ে দেই। ‘উতবা এসব কথা বলছিলো আর নবী ﷺ চুপচাপ তার কথা শুনছিলেন। অতপর তিনি বললেন: আবুল ওয়ালীদ, আপনি কি আপনার সব কথা বলেছেন? সে বললো: হ্যাঁ। তিনি বললেন: তাহলে এখন আমার কথা শুনুন। এরপর তিনি “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম পড়ে এই সূরা তিলাওয়াত করতে শুরু করলেন। উতবা তার দুই হাত পেছনের দিকে মাটিতে হেলান দিয়ে গভীর মনোযোগের সাথে শুনতে থাকলো। সিজদার আয়াত পর্যন্ত তিলাওয়াত করে তিনি সিজদা করলেন এবং মাথা তুলে বললেন: হে আবুল ওয়ালীদ, আমার জবাবও আপনি পেয়ে গেলেন। এখন যা ইচ্ছা করেন।” ‘উতবা উঠে কুরাঈশ নেতাদের আসরের দিকে অগ্রসর হলে লোকজন দূর থেকে তাকে দেখেই বললো: আল্লাহ্র শপথ! ‘উতবার চেহারা পরিবর্তিত হয়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে। যে চেহারা নিয়ে সে গিয়েছিল এটা সেই চেহারা নয়। সে এসে বসলে লোকজন তাকে জিজ্ঞেস করলো: কি শুনে এলে। সে বললো: “আল্লাহ্র কসম! আমি এমন কথা শুনেছি যা এর আগে কখনো শুনিনি। আল্লাহ্র কসম! এটা না কবিতা, না যাদু, না গণনা বিদ্যা। হে কুরাইশ নেতৃবৃন্দ, আমার কথা শোন এবং তাঁকে তাঁর কাজ করতে দাও। আমার বিশ্বাস, এ বাণী সফল হবেই। মনে করো আরবের লোকেরা যদি তার বিরুদ্ধে বিজয় লাভ করে তাহলে নিজের ভাইয়ের গায়ে হাত তোলা থেকে তোমরা রক্ষা পেয়ে যাবে এবং অন্যরাই তাঁকে পরাভূত করবে। পক্ষান্তরে সে যদি আরবদের বিরুদ্ধে বিজয় হয় তাহলে তাঁর রাজত্ব তোমাদেরই রাজত্ব এবং তাঁর সম্মান ও মর্যাদা তোমাদের সম্মান ও মর্যাদা হবে।” তার এই কথা শোনা মাত্র কুরাঈশ নেতারা বলে উঠলো: “ওয়ালীদের বাপ, শেষ পর্যন্ত তোমার ওপর তার যাদুর প্রভাব পড়লো” ‘উতবা বললো: “আমি আমার মতামত তোমাদের সামনে পেশ করলাম। এখন তোমাদের যা ইচ্ছা করতে থাকো।” (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা ৩১৩-৩১৪)
। আরো কতিপয় মুহাদ্দিস বিভিন্ন সনদে হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রা:) থেকে এ ঘটনা বর্ণনা করেছেন। তবে তাতে শব্দগত কিছু মতপার্থক্য আছে। ঐ সব রেওয়ায়েতের কোন কোনটিতে এ কথাও আছে যে, নবী ﷺ তিলাওয়াত করতে করতে যে সময়فان اعرصوا فقل انزرتكم صاعقة مثلفان اعرصوا فقل انزرتكم صاعقة مثل صاعقة عاد وثمود (এখন যদি এসব লোক মুখ ফিরিয়ে নেয় তাহলে এদেরকে বলে দাও আমি তোমাদেরকে আদ ও সামূদ জাতির আযাবের মত অকস্মাত আগমনকারী আযাব সম্পর্কে সতর্ক করে দিচ্ছি।) আয়াতটি পড়লেন তখন উতবা আপনা থেকেই তাঁর মুখের ওপর হাত চেপে ধরে বললো: “আল্লাহ্র ওয়াস্তে নিজের কওমের প্রতি সদয় হও।” পরে সে কুরাইশ নেতাদের কাছে তার এ কাজের কারণ বর্ণনা করেছে, এই বলে যে, আপনারা জানেন, মুহাম্মাদের ﷺ মুখ থেকে যে কথা বের হয় তা সত্যে পরিণত হয়। তাই আমি আমাদের ওপর আযাব নাযিল না হয় এই ভেবে আতংকিত হয়ে পড়েছিলাম। (বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন, তাফসীরে ইবনে কাসীর, ৪র্থ খন্ড, পৃষ্ঠা ৯০-৯১, আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা ৬২ ।
(৪১-হামীম-আস-সাজদাহ) : বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্য :
‘উতবার এই কথার জবাবে আল্লাহ্র পক্ষ থেকে যে বক্তব্য নাযিল হয়েছে তাতে সে নবীকে ﷺ যে অর্থহীন কথা বলেছে সেদিকে আদৌ দৃষ্টিপাত করা হয়নি। কারণ, সে যা বলেছিলো তা ছিল প্রকৃতপক্ষে নবীর ﷺ নিয়ত ও জ্ঞান-বুদ্ধির ওপর হামলা। তার গোটা বক্তব্যের পেছনে এই অনুমান কাজ করছিল যে, তাঁর নবী হওয়া এবং কুরআনের অহী হওয়ার কোন সম্ভাবনাই নেই। তাই অনিবার্য রূপে তাঁর এই আন্দোলনের চালিকা শক্তি হয় ধন-সম্পদ এবং শাসন ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব লাভের প্রেরণা, নয়তো তাঁর জ্ঞান-বুদ্ধিই লোপ পেয়ে বসেছে (নাউযুবিল্লাহ)। প্রথম ক্ষেত্রে সে নবীর ﷺ সাথে বিকিকিনির কারবার করতে চাচ্ছিলো। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে সে এ কথা বলে নবীকে ﷺ হেয় করছিলো যে, আমরা নিজের খরচে আপনার উম্মাদ রোগের চিকিৎসা করে দিচ্ছি। এ কথা সুস্পষ্ট যে, বিরোধীরা যখন এ ধরনের মূর্খতার আচরণ করতে থাকে তখন তাদের এ কাজের জবাব দেয়া শরীফ সম্ভ্রান্ত মানুষের কাজ হয় না। তার কাজ হয় তাদেরকে সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করে নিজের বক্তব্য তুলে ধরা। কুরআনের দাওয়াতকে ব্যর্থ করার জন্য মক্কার কাফেরদের পক্ষ থেকে সে সময় চরম হঠকারিতা ও অসৎচরিত্রের মাধ্যমে যে বিরোধিতা করা হচ্ছিলো ‘উতবার বক্তব্য উপেক্ষা করে এখানে সেই বিরোধিতাকে আলোচ্য বিষয় হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। তারা নবী ﷺ কে বলতো, আপনি যাই করেন না কেন আমরা আপনার কোন কথাই শুনবো না। আমরা আমাদের মনের গায়ে চাদর ঢেকে দিয়েছি এবং কান বন্ধ করে দিয়েছি। আমাদের ও আপনার মাঝে একটি প্রাচীর আড়াল করে দাঁড়িয়েছে, যা আপনাকে ও আমাদের কখনো এক হতে দেবে না।
। তারা তাঁকে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছিলো, আপনি আপনার দাওয়াতের কাজ চালিয়ে যান, আপনার বিরোধিতায় আমাদের পক্ষে সম্ভবপর সবই আমরা করবো।
। তারা নবীকে ﷺ পরাস্ত করার উদ্দেশ্যে যে কর্মসূচী তৈরি করেছিলো তা হচ্ছে, যখনই তিনি কিংবা তাঁর অনুসারীদের কেউ সর্বসাধারণকে কুরআন শুনানোর চেষ্টা করবেন তখনই হৈ চৈ ও হট্টগোল সৃষ্টি করতে হবে এবং এতো শোরগোল করতে হবে যাতে কানে যেন কোন কথা প্রবেশ না করে।
। কুরআন মজীদের আয়াতসমূহের উল্টা-পাল্টা অর্থ করে জনসাধারণের মধ্যে নানা রকম বিভ্রান্তি ছড়ানোর কাজ তারা পূর্ণ তৎপরতার সাথে চালিয়ে যাচ্ছিলো। কোন কথা বলা হলে তারা তাকে ভিন্ন রূপ দিতো। সরল সোজা কথার বাঁকা অর্থ করতো। পূর্বাপর প্রসঙ্গ থেকে বিচ্ছিন্ন করে এক স্থানের একটি শব্দ এবং আরেক স্থানের একটি বাক্যাংশ নিয়ে তার সাথে নিজের পক্ষ থেকে আরো অধিক কথা যুক্ত করে নতুন নতুন বিষয়বস্তু তৈরী করতো যাতে কুরআন ও তার উপস্থাপনকারী রসূল সম্পর্কে মানুষের মতামত খারাপ করা যায়।
। অদ্ভূত ধরনের আপত্তিসমূহ উত্থাপন করতো যার একটি উদাহরণ এ সূরায় পেশ করা হয়েছে। তারা বলতো, আরবী ভাষাভাষী একজন মানুষ যদি আরবী ভাষায় কোন কথা শোনায় তাতে মুজিযার কি থাকতে পারে? আরবী তো তার মাতৃভাষা। যে কেউ ইচ্ছা করলে তার মাতৃভাষায় একটি বাণী রচনা করে ঘোষণা করতে পারে যে, সেই বাণী তার কাছে আল্লাহ্র পক্ষ থেকে নাযিল হয়েছে। মুজিযা বলা যেতো কেবল তখনই যখন হঠাৎ কোন ব্যক্তি তার অজানা কোন ভাষায় একটি বিশুদ্ধ উন্নত সাহিত্য রস সমৃদ্ধ বক্তৃতা শুরু করে দিতো। তখনই বুঝা যেতো, এটা তার নিজের কথা নয়, বরং তা ওপরে কোথাও থেকে তার ওপর নাযিল হচ্ছে।
অযৌক্তিক ও অবিবেচনা প্রসূত এই বিরোধিতার জবাবে যা বলা হয়েছে তার সারকথা হলো:
(১) এ বাণী আল্লাহ্রই পক্ষ থেকে এবং আরবী ভাষায় নাযিলকৃত। এর মধ্যে যেসব সত্য স্পষ্টভাবে খোলামেলা বর্ণনা করা হয়েছে মূর্খেরা তার মধ্যে জ্ঞানের কোন আলো দেখতে পায় না। কিন্তু জ্ঞান-বুদ্ধির অধিকারীরা সে আলো দেখতে পাচ্ছে এবং তা দ্বারা উপকৃতও হচ্ছে। এটা আল্লাহ্র রহমত যে, মানুষের হিদায়াতের জন্য তিনি এ বাণী নাযিল করেছেন। কেউ তাকে অকল্যাণ ভাবলে সেটা তার নিজের দুর্ভাগ্য। যারা এ বাণী কাজে লাগিয়ে উপকৃত হচ্ছে তাদের জন্য সু-খবর। কিন্তু যারা এ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে তাদের সাবধান হওয়া উচিত।
(২) তোমরা যদি নিজেদের মনের ওপর পর্দা টেনে এবং কান বধির করে দিয়ে থাকো, সে অবস্থায় নবীর কাজ এটা নয় যে, যে শুনতে আগ্রহী তাকে শুনাতেন আর যে শুনতে ও বুঝতে আগ্রহী নয় জোর করে তার মনে নিজের কথা প্রবেশ করাবেন। তিনি তোমাদের মতই একজন মানুষ। যারা শুনতে আগ্রহী তিনি কেবল তাদেরকেই শুনাতে পারেন এবং যারা বুঝতে আগ্রহী কেবল তাদেরকেই বুঝাতে পারেন।
(৩) তোমরা নিজেদের চোখ বন্ধ করে নাও আর মনের ওপর পর্দা টেনে দাও প্রকৃত সত্য এই যে, একজনই মাত্র তোমাদের আল্লাহ্, তোমরা অন্য কোন আল্লাহ্র বান্দা নও। তোমাদের হঠকারিতার কারণে এ সত্য কখনো পরিবর্তিত হওয়ার নয়। তোমরা যদি এ কথা মেনে নাও এবং সে অনুসারে নিজেদের কাজকর্ম শুধরে নাও তাহলে নিজেদেরই কল্যাণ সাধন করবে। আর যদি না মানো তাহলে নিজেরাই ধ্বংসের মুখোমুখি হবে।
(৪) তোমরা কার সাথে শির্ক ও কুফরী করছো সে বিষয়ে কি তোমাদের কোন অনুভূতি আছে? তোমরা কি সেই আল্লাহ্র সাথে শির্ক ও কুফরী করছো যিনি বিশাল ও অসীম এই বিশ্ব-জাহান সৃষ্টি করেছেন, যিনি যমীন ও আসমানের স্রষ্টা, যার সৃষ্ট কল্যাণসমূহ দ্বারা তোমরা এই পৃথিবীতে উপকৃত হচ্ছো এবং যার দেয়া রিযিকের দ্বারা প্রতিপালিত হচ্ছো? তাঁরই নগণ্য সৃষ্টিসমূহকে তোমরা তাঁর শরীক বানাচ্ছো আর এ বিষয়টি বুঝানোর চেষ্টা করলে জিদ ও হঠকারিতা করে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছো ?
(৫) ঠিক আছে, যদি মানতে প্রস্তুত না হও সেক্ষেত্রে আদ ও সামূদ জাতির ওপর যে ধরনের আযাব এসেছিল অকস্মাৎ সে ধরনের আযাব আপতিত হওয়া সর্ম্পকে সাবধান হয়ে যাও। এ আযাবও তোমাদের অপরাধের চূড়ান্ত শাস্তি নয়। বরং এরপরে আছে হাশরের জবাবদিহি ও জাহান্নামের আগুন।
(৬) সেই মানুষ বড়ই দুর্ভাগা যার পেছনে এমন সব জ্বিন ও মানুষ শয়তান লেগেছে যারা তাকে চারদিকেই শ্যামল-সবুজ মনোহর দৃশ্য দেখায়, তার নির্বুদ্ধিতাকে তার সামনে সুদৃশ্য বানিয়ে পেশ করে এবং তাকে কখনো সঠিক চিন্তা করতে দেয় না। অন্যের কথা শুনতেও দেয় না। এই শ্রেণীর নির্বোধ লোকেরা আজ এই পৃথিবীতে পরস্পরকে উৎসাহ দিচ্ছে ও লোভ দেখাচ্ছে এবং প্রত্যেকেই পরস্পরের প্রশ্রয় পেয়ে দিনকাল ভালই কাটাচ্ছে। কিন্তু কিয়ামতের দিন যখন দুর্ভাগ্যের পালা আসবে তখন তাদের প্রত্যেকেই বলবে, যারা আমাকে বিভ্রান্ত করেছিলো তাদের হাতে পেলে পায়ের তলায় পিষে ফেলতাম।
(৭) এই কুরআন একটি অপরিবর্তনীয় গ্রন্থ। তোমরা নিজেদের হীন চক্রান্ত এবং মিথ্যার অস্ত্র দিয়ে তাকে পরাস্ত করতে পারবে না। বাতিল পেছন থেকে আসুক, মুখোশ পরে আসুক কিংবা পরোক্ষভাবে আক্রমণ করুক কখনো তাকে পরাজিত করতে সক্ষম হবে না।
(৮) তোমরা যাতে বুঝতে পার সে জন্য কুরআনকে আজ তোমাদের নিজেদের ভাষায় পেশ করা হচ্ছে। অথচ তোমরা বলছো, কোন অনারব ভাষায় তা নাযিল হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তোমাদের হিদায়াতের জন্য যদি আমি কুরআনকে আরবী ছাড়া ভিন্ন কোন ভাষায় নাযিল করতাম তাহলে তোমরাই বলতে, এ কোন ধরনের তামাশা, আরব জাতির হিদায়াতের জন্য অনারব ভাষায় বক্তব্য পেশ করা হচ্ছে যা এখানকার কেউই বুঝে না। এর অর্থ, হিদায়াত লাভ আদৌ তোমাদের কাম্য নয়। কুরআনকে না মানার জন্য নিত্য নতুন বাহানা তৈরী করছো মাত্র।
(৯) তোমরা কি কখনো এ বিষয়টি ভেবে দেখেছো, যদি এটাই সত্য বলে প্রমাণিত হয় যে, এ কুরআন আল্লাহ্র পক্ষ থেকে এসেছে, তাহলে তা অস্বীকার করে এবং তার বিরোধিতায় এতদূর অগ্রসর হয়ে তোমরা কোন্ পরিণতির মুখোমুখি হবে?
(১০) আজ তোমরা এ কুরআনকে মানছো না। কিন্তু অচিরেই নিজের চোখে দেখতে পাবে, এ কুরআনের দাওয়াত দশ দিগন্তে ছড়িয়ে পড়েছে এবং তোমরা নিজেরা তার কাছে পরাজিত হয়ে গিয়েছো। তখন তোমরা বুঝতে পারবে, ইতিপূর্বে তোমাদের যা বলা হয়েছিল তা ছিল সত্য।
বিরোধীদেরকে এসব জবাব দেয়ার সাথে সাথে এই চরম প্রতিকূল পরিবেশে ঈমানদারগণ এবং নবী ﷺ নিজে যে সমস্যাবলীর সম্মুখীন ছিলেন সেদিকেও দৃষ্টি দেয়া হয়েছে। মু’মিনদের পক্ষে সে সময় তাবলীগ ও প্রচার তো দূরের কথা ঈমানের পথে টিকে থাকাও অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ছিলো। যে ব্যক্তি সম্পর্কেই প্রকাশ হয়ে পড়তো যে, সে মুসলমান হয়ে গিয়েছে সে-ই শাস্তির যাঁতাকলে পিষ্ট হতো। শত্রুদের ভয়াবহ জোটবদ্ধতা এবং সর্বত্র বিস্তৃত শক্তির মোকাবিলায় তারা নিজেদেরকে একেবারেই অসহায় ও বন্ধুহীন মনে করছিলো। এই পরিস্থিতিতে প্রথমত, এই বলে তাদেরকে সাহস যোগানো হয়েছে যে, তোমরা সত্যি সত্যিই বান্ধব ও সহায়হীন নও। বরং যে ব্যক্তিই একবার আল্লাহ্কে তার রব মেনে নিয়ে সেই আকীদা ও পথ দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরে থাকে তার কাছে আল্লাহ্র ফেরেশতা নাযিল হয় এবং দুনিয়া থেকে শুরু করে আখেরাত পর্যন্ত তার সাথে থাকে। অতপর তাকে সাহস ও উৎসাহ যোগানো হয়েছে এ কথা বলে যে, সেই মানুষ সর্বোৎকৃষ্ট যে নিজে সৎ কাজ করে, অন্যদের আল্লাহ্র দিকে আহবান জানায় এবং সাহসিকতার সাথে বলে, আমি মুসলমান।
সেই সময় যে প্রশ্নটি নবীর ﷺ সামনে অত্যন্ত বিব্রতকর ছিল তা হচ্ছে, এসব জগদ্দল পাথর যখন এ আন্দোলনের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে তখন এসব পাথরের মধ্যে দিয়ে ইসলামের প্রচার ও প্রসারের রাস্তা কিভাবে বের করা যাবে? এ প্রশ্নের সমাধানের জন্য নবীকে ﷺ বলা হয়েছে, এসব প্রদর্শনীমূলক বাঁধার পাহাড় বাহ্যত অত্যন্ত কঠিন বলে মনে হয়। কিন্তু উত্তম নৈতিক চরিত্রের হাতিয়ার এমন হাতিয়ার যা ঐ সব বাঁধার পাহাড় চূর্ণবিচূর্ণ করে গলিয়ে দেবে। ধৈর্যের সাথে উত্তম নৈতিক চরিত্রকে কাজে লাগাও এবং যখনই শয়তান উত্তেজনা সৃষ্টি করে অন্য কোন হাতিয়ার ব্যবহার করতে উস্কানি দেবে তখনই আল্লাহ্র কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করো।
# এটা এই সূরার সংক্ষিপ্ত ভূমিকা। পরবর্তী বক্তব্য সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করলে এ ভূমিকায় আলোচিত বিষয়বস্তুর পরবর্তী বিষয়বস্তুর সাথে যে সাদৃশ্য আছে তা বুঝা যেতে পারে।
প্রথমে বলা হয়েছে, এ বাণী আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিল হয়েছে। অর্থাৎ যতদিন ইচ্ছা তোমরা এ অপপ্রচার চালাতে থাকো যে, মুহাম্মাদ ﷺ নিজে এ সব কথা রচনা করছেন। প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে, এ বাণী বিশ্ব-জাহানের রবের পক্ষ থেকে এসেছে। তাছাড়া এ কথা বলে শ্রোতাদেরকে এ ব্যাপারে সাবধান করে দেয়া হয়েছে যে, এ বাণী শুনে যদি তোমরা অসন্তুষ্ট হও তাহলে তোমাদের সেই অসন্তুষ্টি মুহাম্মাদ ﷺ এর বিরুদ্ধে নয়, আল্লাহর বিরুদ্ধে। যদি তা প্রত্যাখ্যান করো তাহলে কোন মানুষের কথা করছো না, আল্লাহর নিজের কথা প্রত্যাখ্যান করছো। আর যদি তা থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকো তাহলে কোন মানুষ থেকে মুখ ফিরাচ্ছো না বরং খোদ আল্লাহ তায়ালা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছো।
দ্বিতীয় যে কথাটি বলা হয়েছে তা হচ্ছে এই যে, এ বাণী নাযিলকারী মহান আল্লাহ তাঁর সৃষ্টির প্রতি অত্যন্ত দয়ালু ও মেহেরবান (রাহমান ও রাহীম)। এ বাণী নাযিলকারী আল্লাহর আর সব গুণাবলীর পরিবর্তে ‘রহমত’ গুণটি এ সত্যের প্রতি ইঙ্গিত করে যে, তিনি তাঁর দয়ার দাবী অনুসারে এ বাণী নাযিল করেছেন। এর দ্বারা শ্রোতাদেরকে এ মর্মে সাবধান করা হয়েছে যে, কেউ যদি এ বাণীর প্রতি রুষ্ট হয় বা একে প্রত্যাখ্যান করে কিংবা ভ্রুকুঞ্চিত করে তাহলে প্রকৃতপক্ষে সে নিজের সাথেই শত্রুতা করে। এটা বিরাট এক নিয়ামত যা আল্লাহ মানুষকে পথ প্রদর্শন এবং তার সাফল্য ও সৌভাগ্যের জন্য সরাসরি নাযিল করেছেন। আল্লাহ যদি মানুষের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতেন তাহলে তাদেরকে অন্ধকারে হাতড়িয়ে মরার জন্য পরিত্যাগ করতেন এবং তারা কোন গর্তে গিয়ে পতিত হবে তার কোন পরোয়াই করতেন না। কিন্তু সৃষ্টি করা ও খাদ্য সরবরাহ করার সাথে সাথে তার জীবনকে সুন্দর করে গোছানোর জন্য জ্ঞানের আলো দান করাও তিনি তাঁর কর্তব্য বলে মনে করেন এবং সে কারণেই তাঁর এক বান্দার কাছে এ বাণী নাযিল করছেন, এটা তাঁর দয়া ও অনুগ্রহ। সুতরাং যে ব্যক্তি এই রহমত দ্বারা উপকৃত হওয়ার পরিবর্তে তার বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য অগ্রসর হয় তার চেয়ে বড় অকৃতজ্ঞ এবং নিজেই নিজের দুশমন আর কে হতে পারে? তৃতীয় কথাটি বলা হয়েছে এই যে, এই কিতাবের আয়াত সমূহ অত্যন্ত স্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। অর্থাৎ এর কোন কথাই অস্পষ্ট ও জটিল নয়, যার ফলে এ কিতাবের বিষয়বস্তু কারো বোধগম্য হয় না বলে সে তা গ্রহণ করতে অক্ষমতা প্রকাশ করতে পারে না। হক ও বাতিল কি, সত্য সঠিক আকীদা-বিশ্বাস ও ভ্রান্ত আকীদা-বিশ্বাস কি, ভাল ও মন্দ নৈতিক চরিত্র কি, সৎ কাজ ও নেক কাজ কি, কোন পথের অনুসরণে মানুষের কল্যাণ এবং কোন পথ অবলম্বনে তার নিজের ক্ষতি এ গ্রন্থে তা পরিষ্কার বলে দেয়া হয়েছে। কেউ যদি এরূপ সুস্পষ্ট ও খোলামেলা হিদায়াত প্রত্যাখ্যান করে কিংবা সে দিকে মনযোগ না দেয় তাহলে সে কোন ওজর ও অক্ষমতা পেশ করতে পারে না। তার এই আচরণের সুস্পষ্ট অর্থ হচ্ছে সে ভুলকে আঁকড়ে ধরে থাকতে চায়।
চতুর্থ কথাটি বলা হয়েছে এই যে, এটা আরবী ভাষার কুরআন। অর্থাৎ এ কুরআন যদি অন্য কোন ভাষায় নাযিল হতো তাহলে আরবরা অন্তত এ ওজর পেশ করতে পারতো যে, আল্লাহ যে ভাষায় তাঁর কিতাব নাযিল করেছেন আমরা সে ভাষার সাথেই পরিচিত নই। কিন্তু এ গ্রন্থ তাদের নিজের ভাষায় নাযিল করা হয়েছে। সুতরাং তারা না বুঝার অজুহাত পেশ করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। (এখানে সূরার ৪৪ আয়াতটিও সামনে থাকা দরকার। এ আয়াতে এই বিষয়টিই অন্যভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। এক্ষেত্রে অনারবদের জন্য কুরআনের দাওয়াত গ্রহণ না করার যে যুক্তিসঙ্গত ওজর বিদ্যমান আমরা ইতিপূর্বে তার জবাব দিয়েছি। দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, সূরা ইউসুফ, টীকা ৫ ; রাসায়েল ও মাসায়েল, প্রথম খন্ড, পৃষ্ঠা ১৯ থেকে ২৩)
পঞ্চম কথাটি বলা হয়েছে এই যে, কিতাব তাদের জন্য যারা জ্ঞানের অধিকারী। অর্থাৎ কেবল জ্ঞানী লোকেরাই এর দ্বারা উপকৃত হতে পারে। অজ্ঞ লোকদের কাছে তা ঠিক তেমনি মূল্যহীন যেমন একটি মূল্যবান হীরক খণ্ড এমন ব্যক্তির কাছে মূল্যহীন যে সাধারণ পাথর ও হীরক খণ্ডের পার্থক্য জানে না।
ষষ্ঠ কথাটি বলা হয়েছে এই যে, এ কিতাব সু-সংবাদ দানকারী ও ভীতি প্রদর্শনকারী। অর্থাৎ এটা শুধু এমন নয় যে, শুধু এক কল্পনাচারিতা, একটি দর্শন এবং একটি আদর্শ রচনা শৈলী পেশ করে, যা মানা না মানায় কোন ক্ষতিবৃদ্ধি নেই। এ গ্রন্থ বরং চিৎকার করে ডেকে ডেকে গোটা দুনিয়াকে সাবধান করে দিচ্ছে যে, একে মেনে চলার ফলাফল অত্যন্ত শুভ ও মহিমাময় এবং না মানার পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ ও ধ্বংসকর। এ ধরনের গ্রন্থকে কেবল কোন নির্বোধই অবলীলাক্রমে উপেক্ষা করতে পারে।
# আমাদের মন পর্যন্ত তার পৌঁছার কোন পথই খোলা নেই।
# এই আন্দোলন আমাদের ও তোমাদের মাঝে বিভেদ সৃষ্টি করে দিয়েছে। তা আমাদের ও তোমাদেরকে পরস্পর বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। এটা এমন এক বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে যা আমাদের ও তোমাদেরকে এক হতে দেয় না।
# এর দু’টি অর্থ। একটি অর্থ হচ্ছে, তোমার সাথে আমাদের এবং আমাদের সাথে তোমার কোন সংঘাত নেই। আরেকটি অর্থ হচ্ছে, তুমি যদি তোমার আন্দোলন থেকে বিরত না হও তাহলে নিজের কাজ করে যেতে থাকো। আমরাও তোমার বিরোধিতা পরিত্যাগ করবো না এবং তোমাকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য আমরা সাধ্যমত সব কিছুই করবো।
# তোমরা তোমাদের মনের ওপরের পর্দা উন্মোচন করা, বধির কানকে শ্রবণ শক্তি দান করার এবং যে পর্দা দিয়ে তোমরা নিজেরা আমার ও তোমাদের মধ্যে আড়াল সৃষ্টি করেছো তা সরিয়ে দেয়ার সাধ্য আমার নেই। আমিতো মানুষ। যে বুঝার জন্য প্রস্তুত আমি কেবল তাকেই বুঝাতে পারি, যে শোনার জন্য প্রস্তুত কেবল তাকেই শোনাতে পারি এবং যে মিলিত হওয়ার জন্য প্রস্তুত কেবল তার সাথেই মিলতে পারি।
# তোমরা তোমাদের মনের দুয়ারে পর্দা টাঙ্গিয়ে দাও আর কান বধির করে নাও। প্রকৃত সত্য হলো তোমাদের আল্লাহ অনেক নয়, বরং শুধুমাত্র একজনই। আর তোমরা সেই আল্লাহরই বান্দা। এটা আমার চিন্তা-ভাবনা ও ধ্যান-ধারণা প্রসূত কোন দর্শন নয় যে, তার সঠিক ও ভ্রান্ত হওয়ার সমান সম্ভাবনা রয়েছে। আমার কাছে অহী পাঠিয়ে এ সত্য তুলে ধরা হয়েছে, যার ভুল-ত্রুটির লেশমাত্র থাকার সম্ভাবনা নেই।
# অন্য কাউকে আল্লাহ হিসেবে গ্রহণ করবে না, অন্য কারো দাসত্ব ও পূজা-অর্চনা করবে না, অন্য কাউকে সাহায্যের জন্য ডাকবে না। আর কারো সামনে আনুগত্যের মাথা নত করো না এবং অন্য কারো রীতি ও নিয়ম-কানুনকে অবশ্য অনুসরণীয় বিধান হিসেবে মেনে নিও না।
# আজ পর্যন্ত তোমরা তোমাদের আল্লাহর সাথে যে বিশ্বাস হীনতার কাজ করে এসেছো এবং আল্লাহকে ভুলে যাওয়ার কারণে শিরক, কুফরী, নাফরমানি ও গোনাহ করে এসেছো তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা।
# এখানে ‘যাকাত’ শব্দের অর্থ কি তা নিয়ে তাফসীরকারদের মধ্যে মতভেদ আছে। ইবনে আব্বাস ও তাঁর উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন ছাত্র ইকরিমা ও মুজাহিদ বলেনঃ এখানে ‘যাকাত’ অর্থ আত্মার সেই পবিত্রতা যা তাওহীদের আকীদা এবং আল্লাহর আনুগত্য দ্বারা অর্জিত হয়। এই তাফসীর অনুসারে আয়াতের অনুবাদ হবে, যেসব মুশরিক পবিত্রতা অবলম্বন করে না তাদের জন্য ধ্বংস। তাফসীরকারদের আরেকটি গোষ্ঠী যার মধ্যে কাতাদা, সুদ্দী, হাসান বাসারী, দাহহাক, মুকাতিল ও ইবনুস সাইয়েবের মত তাফসীরকারক আছেন তাঁরা এখানে ‘যাকাত’ শব্দটিকে অর্থ-সম্পদের যাকাত অর্থ গ্রহণ করেন। এ ব্যাখ্যা অনুসারে আয়াতের অর্থ হবে, ‘যারা শিরক করে আল্লাহর হক এবং যাকাত না দিয়ে বান্দার হক মারে তাদের জন্য ধ্বংস।’
# মূল আয়াতে أَجْرٌ غَيْرُ مَمْنُونٍ কথাটি ব্যবহার করা হয়েছে। এ কথাটির আরো দু’টি অর্থ আছে। একটি অর্থ হচ্ছে, তা হবে এমন পুরস্কার যা কখনো হ্রাস পাবে না। আরেকটি অর্থ হচ্ছে, তা হবে এমন পুরস্কার যা স্মরণ করিয়ে দেয়া হবে না বা সেজন্য খোঁটা দেয়া হবে না, যেমন কোন কৃপণ হিম্মত করে কোন কিছু দিলেও সে দানের কথা বার বার স্মরণ করিয়ে দেয়।
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
নামকরণ ও প্রেক্ষাপট :
এ সূরার দ্বিতীয় আরেকটি নাম রয়েছে সেটি হলো “ফুস্সিলাত”। এ সূরার তৃতীয় আয়াতে যে “ফুস্সিলাত” শব্দটি রয়েছে সেই শব্দ থেকেই এ নামে নামকরণ করা হয়েছে।
সূরাটি অবতীর্ণ হওয়ার কারণ সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে যে, একদা কুরাইশ সর্দারগণ আপোষে পরামর্শ করল যে, মুহাম্মাদের অনুসারীদের সংখ্যা দিনের পর দিন বেড়েই চলছে। অতএব এ পথ বন্ধ করার জন্য আমাদের কিছু একটা করা দরকার। তাই তারা তাদের মধ্যে সবচেয়ে বাক্পটু শুদ্ধভাষী উতবা ইবনু রাবী‘-কে নির্বাচন করল যে, সে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে কথা বলবে। সুতরাং সে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে উপস্থিত হয়ে তাঁর ওপর আরবদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা এবং অনৈক্য সৃষ্টির অপবাদ দিয়ে প্রস্তাব পেশ করল যে, এ নতুন ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্য যদি ধন-মাল অর্জন করা হয়, তবে আমরা তোমার জন্য তা সঞ্চয় করে দিচ্ছি। আর যদি এর উদ্দেশ্য হয় নেতা বা সর্দার হওয়া, তবে আমরা তোমাকে আমাদের নেতা বা সর্দার মেনে নিচ্ছি। যদি কোন সুন্দরী নারীকে বিবাহ করতে চাও, তবে একজন নয়, বরং তোমার জন্য দশজন সুন্দরী নারীর ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। আর যদি তোমাকে জিন পেয়ে থাকে, যার কারণে তুমি আমাদের উপাস্যদের নিন্দা করো, তবে আমরা আমাদের খরচে তোমার চিকিৎসার ব্যবস্থা করছি। তিনি সমস্ত কথা শুনে চুপ রইলেন। যখন সে তার কথা শেষ করল, তিনি বললেন : হে আবুল ওয়ালিদ! তুমি কি শেষ করেছ? সে বলল : হ্যাঁ, শেষ করেছি। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন : হে ভাইপো! তুমি শোন, সে বলল : আপনি বলুন, আমি শুনব। তখন নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন : বিসমিল্লাহির রহমানীর রহীম, তারপর এ সূরা পাঠ করলেন। এতে সে বড়ই প্রভাবিত হলো এবং ফিরে গিয়ে কুরাইশ সর্দারদেরকে বলল : যে জিনিস তিনি পেশ করেন তা জাদুবিদ্যা নয়, তিনি জ্যোতিষী নন এবং তাঁর কথা কবিতাও নয়। তার উদ্দেশ্য ছিল রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর দা‘ওয়াতের ব্যাপারে কুরাইশদেরকে চিন্তা-ভাবনা করার প্রতি আহ্বান জানানো। কিন্তু তারা চিন্তা-ভাবনা করা তো দূরের কথা বরং তাকে উল্টো অপবাদ দিলো যে, তুমি তার জাদুর জালে বন্দী হয়ে গেছ। (মুসতাদরাক হাকিম ২/২৫৩, সহীহ)
১-৫ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
حٰم۬ (হা-মীম) এ জাতীয় “হুরূফুল মুক্বাত্বআত” বা বিচ্ছিন্ন অক্ষর সম্পর্কে সূরা আল বাকারার শুরুতে আলোচনা করা হয়েছে। এগুলোর সঠিক অর্থ একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাই ভাল জানেন।
অত্র সূরায় প্রথমত সম্বোধন করা হয়েছে আরবের কুরাইশ গোত্রকে, কারণ তাদের সামনে কুরআন নাযিল হয়েছে এবং তাদের ভাষায় নাযিল হয়েছে। তারা কুরআনের অলৌকিকতা প্রত্যক্ষ করেছে এবং রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর অসংখ্য মু‘জিযাহ দেখেছে। এতদসত্ত্বেও তারা কুরআন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে এবং উপলব্ধি তো দূরের কথা শ্রবণ করাও পছন্দ করেনি। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর শুভেচ্ছামূলক উপদেশের জবাবস্বরূপ অবশেষে তারা বলে দিয়েছে, আপনার কথাবার্তা আমাদের বুঝে আসে না। আমাদের অন্তর এগুলো কবুল করে না এবং আমাদের কানও এগুলো শুনতে প্রস্তুত নয়। আপনার ও আমাদের মাঝখানে অন্তরাল আছে। সুতরাং এখন আপনি আপনার কাজ করুন এবং আমাদেরকে আমাদের অবস্থার ওপর ছেড়ে দিন।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন : এ কুরআন দয়াময় আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে অবতীর্ণ এবং এর আয়াতসমূহ বর্ণনার দিক দিয়ে, অর্থের দিক দিয়ে এবং বিধি-বিধানের দিক দিয়েও বিশদভাবে বিবৃত। এতে কোন প্রকার অস্পষ্টতা নেই। কোন্টি হালাল, কোন্টি হারাম, কোন কাজ করলে শাস্তি পেতে হবে আর কোন্ কাজ করলে শাস্তি থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে এর প্রত্যেকটি বিষয়ই স্পষ্টভাবে বর্ণনা দেয়া আছে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
(وَلَقَدْ جِئْنٰهُمْ بِكِتٰبٍ فَصَّلْنٰهُ عَلٰي عِلْمٍ هُدًي وَّرَحْمَةً لِّقَوْمٍ يُّؤْمِنُوْنَ)
“অবশ্যই আমি তাদেরকে দিয়েছিলাম এমন এক কিতাব যা পূর্ণ জ্ঞান দ্বারা বিশদ ব্যাখ্যা করেছিলাম এবং যা ছিল মু’মিন সম্প্রদায়ের জন্য পথনির্দেশ ও দয়া।” (সূরা আ‘রাফ ৭ : ৫২)
আল্লাহ অন্যত্র বলেন,
(كِتٰبٌ أُحْكِمَتْ اٰيٰتُه۫ ثُمَّ فُصِّلَتْ مِنْ لَّدُنْ حَكِيْمٍ خَبِيْرٍ)
“এটা এমন গ্রন্থ যার আয়াতগুলো সুদৃঢ়, অতঃপর বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়েছে প্রজ্ঞাময়, সর্বজ্ঞের পক্ষ থেকে।” (সূরা হূদ ১১ : ১)
আর এ কুরআন আরবি ভাষায় অবতীর্ণ হয়েছে। যেহেতু কুরআন প্রথমত আরবদের উদ্দেশ্য করেই অবতীর্ণ হয়েছে তাই তাদের ভাষাতেই এটি অবতীর্ণ করা হয়েছে যাতে এটা বুঝতে সহজ হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(قُرْاٰنًا عَرَبِيًّا غَيْرَ ذِيْ عِوَجٍ لَّعَلَّهُمْ يَتَّقُوْنَ)
“এ কুরআন আরবি ভাষায়, এতে বিন্দুমাত্রও বক্রতা নেই, যাতে তারা সাবধানতা অবলম্বন করে।” (সূরা যুমার ৩৯ : ২৮)
أَكِنَّةٍ হলো كنان-এর বহুবচন। অর্থ হলো- আবরণ, পর্দা, অর্থাৎ আমাদের অন্তর আবৃত ও ঢাকা আছে। এ ক্ষেত্রে কাফিরদের তিনটি উক্তি উদ্ধৃত হয়েছে।
(এক) আমাদের অন্তরে পর্দা পড়ে আছে, ফলে আমরা তোমার কথা বুঝতে পারি না। (দুই) আমাদের কান বধির, ফলে তোমার কথা আমাদের কর্ণকুহরে প্রবেশ করে না এবং (তিন) আমাদের ও তোমার মাঝে অন্তরাল রয়েছে। আমরা তোমার ঈমান ও তাওহীদের দা‘ওয়াত বুঝতে পারি না। কাজেই তোমার কাজ তুমি করে যাও আর আমাদের কাজ আমরা করে যাই। কুরআন এসব উক্তি নিন্দার ছলে উদ্ধৃত করেছে, যেন এসব যুক্তি অর্থহীন হিসাবে প্রকাশ পায়। কিন্তু অন্যত্র কুরআন নিজেই তাদের এরূপ অবস্থা বর্ণনা করেছে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(وَجَعَلْنَا عَلٰي قُلُوْبِهِمْ أَكِنَّةً أَنْ يَّفْقَهُوْهُ وَفِيْٓ اٰذَانِهِمْ وَقْرًا)
“আমি তাদের অন্তরের ওপর আবরণ দিয়েছি যেন তারা তা উপলব্ধি করতে না পারে এবং তাদের কানে সৃষ্টি করেছি বধিরতা” (সূরা ইসরা ১৭ : ৪৬)
وَقْر অর্থ হলো, বোঝা। এখানে বধিরতা বুঝানো হয়েছে, যা সত্য শোনার ক্ষেত্রে অন্তরাল সৃষ্টি করে।
কাফিররা এরূপ ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করা সত্ত্বেও রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাদের সাথে কোন খারাপ ব্যবহার করেননি এবং দাওয়াতী ক্ষেত্রে কঠোরতা অবলম্বন করেননি। বরং তাদেরকে নরম কথা ও কোমল আচরণ দ্বারাই দাওয়াত দিয়েছেন। সুতরাং যার কাছে ইসলামের দাওয়াত নিয়ে যাওয়া হবে সে দাওয়াত কবূল না করলে খারাপ আচরণ করতে হবে এমন নয়, হতে পারে ভাল ব্যবহার পেলে আল্লাহ তা‘আলা তার অন্তর উন্মুক্ত করে দেবেন।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. নিঃসন্দেহে কুরআন আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে অবতারিত।
২. কুরআন আরবি ভাষায় অবতীর্ণ, আর এর বিধি-বিধানগুলো স্পষ্টভাবে বিবৃত।
৩. সত্যের দা‘ওয়াত থেকে বিমুখ হলে জাহান্নামে যেতে হবে।
৪. কুরআন সতর্ককারী ও সুসংবাদ দানকারী গ্রন্থ।
৬-৮ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) গঠনগত দিক দিয়ে সকল মানুষের মতই একজন মানুষ, তিনি নূরের তৈরি নন, অথবা আগুনের তৈরি জিনও নন।
তবে সাধারণ মানুষের সাথে তাঁর পার্থক্য শুধু মর্যাদায় আর তা হলো এই যে, তাঁর প্রতি ওয়াহী করা হয় আর সাধারণ লোকদের প্রতি ওয়াহী করা হয় না। এ সম্পর্কে পূর্বে সূরা আল কাহ্ফ-এর শেষের দিকে আলোচনা করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : আমি তোমাদের মতই একজন মানুষ। তবে যখন আমি দীনের ব্যাপারে কোন নির্দেশ দেব তখন তা গ্রহণ কর। (সহীহ মুসলিম হা. ২৩৬২)
(فَاسْتَقِيْمُوْآ إِلَيْهِ)
‘তাঁরই পথ দৃঢ়ভাবে অবলম্বন কর’ অর্থাৎ যে পথ আল্লাহ তা‘আলার কাছে পৌঁছে দেয় সে পথে চল, আল্লাহ তা‘আলা যে সংবাদ দিয়েছেন তা বিশ্বাস করা, যা আদেশ করেছেন তা পালন করা এবং যা নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে। এটাই হল প্রকৃত ইসতিকামাহ বা আল্লাহ তা‘আলার পথে অটল থাকা।
(وَوَيْلٌ لِّلْمُشْرِكِيْنَ الَّذِيْنَ لَا يُؤْتُوْنَ الزَّكٰوةَ)
‘দুর্ভোগ অংশীবাদীদের জন্য- যারা যাকাত প্রদান করে না’ ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন : মুশরিকরা “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” এর সাক্ষ্য দেয় না। এটাই হল নাফসের যাকাত। কাতাদাহ (রহঃ) বলেন : যাকাতকে ওয়াজিব হিসেবে স্বীকার করে না। এ আয়াতের আলোকে অনেকে বলেছেন : কাফিররাও ইসলামী শরীয়তের শাখা-প্রশাখা পালন করতে বাধ্য। কেউ বলেছেন তারা তা পালন করতে বাধ্য নয় কারণ তারা তো ঈমানই আনে নাই। এ নিয়ে অনেক দীর্ঘ আলোচনা রয়েছে, যা এখানে আলোচনা করা সম্ভব নয়।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাধারণ মানুষের মতই গঠনগত দিক দিয়ে মাটির তৈরী একজন মানুষ, তিনি নূরের তৈরী নন, তবে নবুওয়াত লাভের মাধ্যমে তিনি অন্যদের চেয়ে সম্মানীত ও মর্যাদাশীল।
২. সঠিক পথ দৃঢ়ভাবে ধারণ করতে হবে, বিরত হওয়া যাবে না।
৩. যারা সম্পদের অস্বীকারবশত যাকাত আদায় করে না তারা কাফির বলে গণ্য।
৪. সৎ আমল ব্যতীত জান্নাত লাভ করা যাবে না।
তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
১-৫ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা’আলা বলেন যে, আরবী ভাষার এই কুরআন পরম দয়ালু আল্লাহর নিকট হতে অবতীর্ণ। যেমন অন্য আয়াতে রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “হে নবী (সঃ)! তুমি বল- এটা (আল-কুরআন) তোমার প্রতিপালকের নিকট হতে পবিত্র আত্মা (হযরত জিবরাঈল আঃ) সত্যের সাথে অবতীর্ণ করেছেন।”(১৬:১০২) আর এ জায়গায় আছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “নিশ্চয়ই এটা জগতসমূহের প্রতিপালকের নিকট হতে অবতীর্ণ। এটা বিশ্বস্ত আত্মা (হযরত জিবরাঈল আঃ) তোমার অন্তরে অবতীর্ণ করেছে যাতে তুমি সতর্ককারীদের অন্তর্ভুক্ত হও।”(২৬:১৯২-১৯৪)
মহান আল্লাহ বলেনঃ এর আয়াতগুলো বিশদভাবে বিবৃত। এর অর্থ প্রকাশমান এবং আহকাম মযবূত। এর শব্দগুলোও স্পষ্ট এবং পাঠ করতে সহজ। যেমন অন্য আয়াতে রয়েছেঃ (আরবী) (১০:১) অর্থাৎ “এটা এমন কিতাব যার আয়াতসমূহ দৃঢ় ও সুরক্ষিত, অতঃপর ওগুলো বিশদভাবে বিবৃত, এটা হচ্ছে ঐ আল্লাহর কালাম যিনি বিজ্ঞানময় এবং যিনি সবকিছুরই খবর রাখেন। অর্থাৎ এটা শব্দ ও অর্থের দিক দিয়ে অলৌকিক। মহান আল্লাহ বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “ওর কাছে ওর সামনে এবং ওর পিছন হতে বাতিল আসতে পারে না। এটা বিজ্ঞানময় প্রশংসিত আল্লাহর নিকট হতে অবতারিত।” (৪১:৪২)
আল্লাহ তা’আলার উক্তিঃ “জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্যে।” অর্থাৎ এই বর্ণনা ও বিশদ ব্যাখ্যা জ্ঞানী সম্প্রদায়ই অনুধাবন করে থাকে। এই কুরআন একদিকে মুমিনদেরকে সুসংবাদ দেয় এবং অপরদিকে কাফিরদেরকে ভয় প্রদর্শন করে।
মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ তাদের অধিকাংশই বিমুখ হয়েছে। সুতরাং তারা শুনবে না। অর্থাৎ কুরআন কারীমের এমন গুণাবলী থাকা সত্ত্বেও অধিকাংশ কুরায়েশ এর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। তারা বলেঃ তুমি যার প্রতি আমাদেরকে আহ্বান করছে সে বিষয়ে আমাদের অন্তর আবরণ-আচ্ছাদিত এবং আমাদের কর্ণে আছে বধিরতা, আর তোমার ও আমাদের মধ্যে আছে অন্তরাল। সুতরাং তুমি যা বলছে তার কিছুই আমাদের বোধগম্য হয় না। সুতরাং তুমি তোমার কাজ কর এবং আমরা আমাদের কাজ করি। অর্থাৎ তোমার পন্থায় তুমি কাজ করে যাও এবং আমরা আমাদের পন্থায় কাজ করে যাই। আমরা কখনো আমাদের নীতি পরিত্যাগ করে তোমার নীতি গ্রহণ করতে পারি না।
হযরত জাবির ইবনে আবদিল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একদা কুরায়েশরা সমবেত হয়ে পরস্পর পরামর্শ করলোঃ “যে ব্যক্তি যাদু ও কাব্য কবিতায় সবচেয়ে বেশি পারদর্শী, চল আমরা তাকে নিয়ে ঐ লোকটির নিকট অর্থাৎ হযরত মুহাম্মাদ (সঃ)-এর নিকট গমন করি, যে আমাদের দলের মধ্যে ভাঙ্গন ধরিয়ে দিয়েছে এবং আমাদের সমস্ত কাজের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করেছে। ও আমাদের দ্বীনের উপর দোষারোপ করতে শুরু করেছে। একে যেন ঐ ব্যক্তি বিভিন্ন প্রশ্ন করে নিরুত্তর করে দিতে পারে। তারা সবাই বললোঃ “আমাদের মধ্যে উবা ইবনে রাবীআ’ ছাড়া এরূপ লোক আর কেউ নেই। সুতরাং তারা উবার নিকট গেল এবং তার সামনে তাদের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত প্রকাশ করলো। সে তার কওমের কথা মেনে নিলো এবং প্রস্তুতি নিয়ে হযরত মুহাম্মাদ (সঃ)-এর নিকট গমন করলো। অতঃপর সে তাকে বললোঃ “হে মুহাম্মাদ (সঃ)! আচ্ছা, বলতোঃ তুমি ভাল, না আবদুল্লাহ (তার পিতা) ভাল?” তিনি কোন উত্তর দিলেন না। সে আবার প্রশ্ন করলোঃ “তুমি ভাল, না (তোমার দাদা) আবদুল মুত্তালিব ভাল?” রাসূলুল্লাহ (সঃ) এবারও নীরব থাকলেন। তখন সে বললোঃ “দেখো, তুমি যদি তোমার বাপ-দাদাকে ভাল মনে করে থাকো তবে জেনে নাও যে, তারা ঐ সব মা’বুদেরই পূজা করতেন যেগুলোর পূজা আমরা করে থাকি, আর তুমি সেগুলোর উপর দোষারোপ করে থাকো। আর যদি তুমি নিজেকে তাঁদের চেয়ে ভাল মনে করে থাকো তবে তুমি তোমার কথা বলঃ আমরা শুনি। আল্লাহর শপথ! দুনিয়ায় কোন কওমের জন্যে তোমার চেয়ে বেশী ক্ষতিকারক মানুষ সৃষ্ট হয়নি। তুমি আমাদের জামাআতের মধ্যে ভাঙ্গন সৃষ্টি করেছে এবং আমাদের ঐক্যের মধ্যে ফাটল ধরিয়েছো। তুমি আমাদের দ্বীন সম্পর্কে খারাপ মন্তব্য করেছো। সারা আরবের মধ্যে তুমি আমাদের বদনাম করেছে এবং আমাদেরকে অপদস্থ করেছে। এখন তো সব জায়গাতেই এই আলোচনা চলছে যে, কুরায়েশদের মধ্যে একজন যাদুকর রয়েছে, একজন গণক রয়েছে। এখন শুধু এটুকুই বাকী রয়েছে যে, আমরা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি এবং একে অপরের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করি। এই ভাবে আমাদেরকে পরস্পরে লড়িয়ে দিয়ে তুমি আমাদেরকে ধ্বংস করে দিতে চাও। শুন, তোমার ধন-মালের প্রতি যদি লোভ থাকে তবে বল, আমরা সবাই মিলে তোমাকে এমন ধন-দৌলতের মালিক করে দিবো যে, সারা আরবে তোমার চেয়ে বড় ধনী আর কেউ থাকবে না। আর যদি তুমি স্ত্রী লোকদের সাথে কাম-বাসনা চরিতার্থ করতে চাও তবে বল, আমাদের মধ্যে যার মেয়ে তোমার পছন্দ হয়, আমরা একটা কেন, তোমার দশটা বিয়ে দিয়ে দিচ্ছি।” তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাকে বললেনঃ “তোমার কথা বলা শেষ হয়েছে কি?” উত্তরে সে বললোঃ “হ্যা।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) তখন বললেনঃ (আরবী) অবশেষে তিনি নিম্নের আয়াত পর্যন্ত পৌঁছলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “তবুও তারা যদি মুখ ফিরিয়ে নেয় তবে বল- আমি তো তোমাদেরকে সতর্ক করছি এক ধ্বংসকর শাস্তির, আ’দ ও সামূদের শাস্তির অনুরূপ।” এটুকু শুনেই উৎবা বলে উঠলোঃ “আচ্ছা, থামো। তোমার কাছে তাহলে এ ছাড়া আর কিছুই নেই?” রাসূলুল্লাহ (সঃ) উত্তর দিলেনঃ “না।” তখন সে সেখান হতে চলে গেল। কুরায়েশরা তো তার জন্যে অধীরভাবে অপেক্ষা করছিল। তাদের কাছে সে পৌঁছা মাত্রই তারা তাকে জিজ্ঞেস করলোঃ “ব্যাপার কি, তাড়াতাড়ি বল।” সে উত্তর দিলোঃ “দেখো, তোমরা সবাই মিলে তাকে যত কিছু বলতে পারতে আমি একাই তার সবই বলেছি। তারা জিজ্ঞেস করলোঃ “সে তোমার কথার উত্তরে কিছু বলেছে কি?” উবা জবাবে বললোঃ “হ্যা, সে জবাব দিয়েছে বটে, কিন্তু আল্লাহর শপথ! আমি তার কথার একটি অক্ষরও বুঝতে পারিনি। শুধু এটুকু বুঝেছি যে, সে আমাদেরকে আসমানী আযাব হতে সতর্ক করছে যে আযাব আ’দ ও সামূদ জাতির উপর আপতিত হয়েছিল। তারা তখন তাকে বললোঃ তোমার অকল্যাণ হোক! একটি লোক তোমার সাথে তোমার নিজেরই ভাষা আরবীতে কথা বলছে অথচ তুমি বলছো যে, তুমি তার কথার একটি অক্ষরও বুঝতে পারনি?” উৎবা উত্তরে বললোঃ “আমি সত্যিই বলছি যে, শাস্তির বর্ণনা ছাড়া আমি আর কিছুই বুঝিনি।” (এটা ইমাম আব ইবনে হুমায়েদ (রঃ) স্বীয় মুসনাদে বর্ণনা করেছেন)
ইমাম বাগাভীও (রঃ) এ রিওয়াইয়াতটি আনয়ন করেছেন, তাতে এও রয়েছে যে, যখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) আয়াতগুলো পাঠ করতে করতে … (আরবী)-এ আয়াত পর্যন্ত পৌঁছলেন তখন উবা তাঁর পবিত্র মুখের উপর হাত রেখে দিলো এবং তাঁকে আল্লাহর কসম দিতে ও আত্মীয়তার সম্পর্কের কথা স্মরণ করাতে লাগলো। অতঃপর সে সেখান হতে সরাসরি বাড়ীতে ফিরে গেল এবং বাড়ীতেই থাকতে লাগলো ও কুরায়েশদের সমাবেশে উঠাবসা ও যাতায়াত পরিত্যাগ করলো। এ দেখে আবু জেহেল কুরায়েশদেরকে সম্বোধন করে বললোঃ “হে কুরায়েশদের দল! আমার ধারণা যে, উত্বও মুহাম্মাদ (সঃ)-এর দিকে ঝুঁকে পড়েছে এবং তথাকার পানাহারে মজে গেছে। সে তো অভাবীও ছিল। চলো, আমরা তার কাছে যাই।” অতঃপর তারা তার কাছে গমন করলো। আবু জেহেল তাকে বললোঃ “তুমি যে আমাদের কাছে যাতায়াত ছেড়ে দিয়েছো এর কারণ কি? আমার মনে হয় এর কারণ শুধু একটিই। তা এই যে, মুহাম্মাদ (সঃ)-এর দস্তরখানা তোমার পছন্দ হয়ে গেছে এবং তুমিও তার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছে। অভাব খুবই খারাপ জিনিস। আমি মনে করছি যে, আমরা পরস্পরের মধ্যে চাঁদা উঠিয়ে তোমার আর্থিক অবস্থা স্বচ্ছল করে দিবো, যাতে তুমি এই বিপদ ও লাঞ্ছনা হতে মুক্তি পেতে পারো এবং মুহাম্মাদ (সঃ)-এর ও তার নতুন মাযহাবের তোমার কোন প্রয়োজন না হয়। তার একথা শুনে উবা ভীষণ রাগান্বিত হয় এবং বলে ওঠেঃ “মুহাম্মাদ (সঃ)-এর আমার কি প্রয়োজন? আল্লাহর শপথ! আমি তার সাথে আর কখনো কথা বলতে যাবো না। তুমি আমার সম্পর্কে এমন অপমানকর মন্তব্য করলে? অথচ তুমি তো জান যে, কুরায়েশদের মধ্যে আমার চেয়ে বড় ধনী আর কেউ নেই! ব্যাপার এই যে, তোমাদের সবারই কথায় আমি তার কাছে গিয়েছিলাম এবং সব ঘটনা খুলে বলেছিলাম। আমার কথার জবাবে সে যে কালাম পাঠ করেছে, আল্লাহর কসম! তা কবিতা নয়, গণকের কথা নয় এবং যাদু ইত্যাদিও নয়। যখন সে পড়তে পড়তে … (আরবী) পর্যন্ত পৌঁছে তখন আমি তার মুখে হাত রেখে দিই এবং তাকে আত্মীয়তার সম্পর্কের কথা স্মরণ করিয়ে থেমে যেতে বলি। আমার ভয় হয় যে, না জানি হয়তো তখনই আমার উপর ঐ শাস্তি আপতিত হয় যে শাস্তি আ’দ ও সামূদ সম্প্রদায়ের উপর আপতিত হয়েছিল। আর এটা সর্বজন বিদিত যে, মুহাম্মাদ (সঃ) মিথ্যাবাদী নয়।”
সীরাতে আবি ইসহাক গ্রন্থে এ ঘটনাটি অন্য ধারায় রয়েছে। তাতে রয়েছে যে, একদা কুরয়েশরা এক জায়গায় একত্রিত ছিল। রাসূলুল্লাহ (সঃ) খানায়ে কা’বার এক প্রান্তে বসেছিলেন। উত্বা কুরায়েশদেরকে বললোঃ “তোমাদের পরামর্শ হলে আমি মুহাম্মাদ (সঃ)-এর নিকট গমন করবো। তাকে বুঝাবো এবং কিছু লোভ দেখাবো। যদি সে লোভের বশবর্তী হয়ে কিছু চেয়ে বসে তবে আমরা তাকে তা দিয়ে দিবো এবং তার এ কাজ হতে তাকে বিরত রাখবো।” এটা হলো ঐ সময়ের ঘটনা, যখন হযরত হামযা (রাঃ) মুসলমান হয়ে গিয়েছিলেন এবং মুসলমানদের সংখ্যা বেশ বৃদ্ধি পেয়েছিল ও দিন দিন বাড়তেই ছিল। উবার কথায় কুরায়েশরা সম্মত হয়ে যায়। সুতরাং সে রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর নিকট এসে বলতে শুরু করেঃ “হে আমার ভ্রাতুস্পুত্র! তুমি সম্ভ্রান্ত বংশের লোক। তুমি আমাদেরই একজন। তুমি হলে আমাদের চোখের তারা এবং আমাদের কলিজার টুকরা। বড়ই দুঃখের বিষয় যে, তুমি তোমার কওমের কাছে একটি নতুন বিস্ময়কর জিনিস আনয়ন করেছে এবং তাদের দলে ভাঙ্গন সৃষ্টি করে দিয়েছে। তাদের জ্ঞানীদেরকে নির্বোধ বলছে, তাদের মা’বৃদদের প্রতি দোষারোপ করছে এবং তাদের দ্বীনকে খারাপ বলতে শুরু করেছে। আর তাদের বুড়োদেরকে কাফির বলছো। এখন জেনে রেখো যে, আজ আমি তোমার কাছে একটা শেষ ফায়সালার জন্যে এসেছি। তোমার কাছে আমি কয়েকটি প্রস্তাব পেশ করছি। এগুলোর মধ্যে যেটা ইচ্ছা তুমি গ্রহণ কর এবং আল্লাহর ওয়াস্তে এই হাঙ্গামার পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে দাও।” তার একথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাকে বললেন:“তুমি যা বলতে চাও বল, আমি শুনছি।” সে বলতে শুরু করলোঃ “দেখো, তোমার এই চাল দ্বারা যদি মাল জমা করার ইচ্ছা থাকে তবে আমরা সবাই মিলে তোমার জন্যে এতো বেশী মাল জমা করে দিচ্ছি যে, সমস্ত কুরায়েশের মধ্যে তোমার চেয়ে বড় মালদার আর কেউ হবে না। আর যদি নেতৃত্বের ইচ্ছা করে থাকো তবে আমরা সবাই মিলে তোমার নেতৃত্ব মেনে নিচ্ছি। যদি তোমার বাদশাহ্ হওয়ার ইচ্ছা থাকে তবে সারা রাজ্য আমরা তোমাকে সমর্পণ করছি এবং আমরা সবাই তোমার প্রজা হয়ে যাচ্ছি। আর যদি তোমাকে জ্বিনে ধরে থাকে তবে আমরা আমাদের মাল খরচ করে বড় বড় ডাক্তার ও ঝাড়-ফুককারীদের ডেকে তোমার চিকিৎসার ব্যবস্থা করছি। অনেক সময় এমন ঘটে থাকে যে, অনুগত জ্বিন তার আমলকারীর উপর বিজয়ী হয়ে যায়। তখন এই ভাবে তার থেকে মুক্তি লাভ করতে হয়।”
অতঃপর উত্বা নীরব হলো। তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাকে বললেনঃ “তোমার কথা বলা শেষ হয়েছে কি?” সে জবাব দিলোঃ “হ্যা।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) তখন বললেনঃ “তাহলে এখন আমার কথা শুন।” সে তাঁর কথায় কান লাগিয়ে দিলো। তিনি (আরবী) বলে এই সূরাটি তিলাওয়াত শুরু করলেন এবং উত্বা আদবের সাথে শুনতে থাকলো। শেষ পর্যন্ত তিনি সিজদার আয়াত পাঠ করলেন এবং সিজদা করলেন। অতঃপর বললেনঃ “হে আবুল ওয়ালীদ।
আমার যা বলার ছিল তা আমি বললাম। এখন তোমার মনে যা হয় তাই তুমি কর।” উবা সেখান হতে উঠে তার সাথীদের কাছে চলে গেল। তারা তার চেহারা দেখেই বলতে লাগলো যে, উহ্বার অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। তারা তাকে জিজ্ঞেস করলোঃ “ব্যাপার কি?” উত্তরে সে বললোঃ “আল্লাহর শপথ! আমি এমন কথা শুনেছি যা ইতিপূর্বে কখনো শুনিনি। কসম আল্লাহর! ওটা যাদুও নয়, কবিতাও নয় এবং গণকদের কথাও নয়। হে কুরায়েশদের দল! শুনো, তোমরা আমার কথা মেনে নাও। তাকে তার ধারণার উপর ছেড়ে দাও। তার আনুকূল্যও করো না এবং বিরোধিতাও করো না। সে যা কিছু বলছে ও দাবী করছে সে ব্যাপারে সারা আরব তার বিরোধী হয়ে গেছে। তারা তার বিরুদ্ধে তাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করছে। তারা যদি তার উপর বিজয় লাভ করে তবে তো। সহজেই তোমরা তার থেকে পরিত্রাণ পেয়ে যাবে। আর যদি সে-ই তাদের উপর। বিজয়ী হয়ে যায় তবে তার রাজ্যকে তোমাদেরই রাজ্য বলা হবে এবং তার মর্যাদা হবে তোমাদেরই মর্যাদা। আর তোমরাই হবে তার নিকট সবেচেয়ে বেশী গৃহীত।” তার এই কথা শুনে কুরায়েশরা বললোঃ “হে আবুল ওয়ালীদ! আল্লাহর কসম! মুহাম্মাদ (সঃ) তোমার উপর যাদু করে ফেলেছে।” সে জবাব দিলোঃ “দেখো, আমার অভিমত আমি তোমাদের নিকট পেশ করে দিলাম। এখন তোমাদের যা ইচ্ছা হয় তা-ই কর।”
৬-৮ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ হে মুহাম্মাদ (সঃ)! এই মিথ্যা প্রশ্নকারী মুশরিকদেরকে বলে দাও- আমি তোমাদের মতই একজন মানুষ। আমাকে অহীর মাধ্যমে বলে দেয়া হয়েছে যে, তোমাদের সবারই মা’বুদ এক আল্লাহ। তোমরা যে কতকগুলো মা’বূদ বানিয়ে নিয়েছো এটা সরাসরি বিভ্রান্তিকর পন্থা। তোমরা একমাত্র আল্লাহরই ইবাদত কর এবং ঠিক ঐভাবে কর যেভাবে তোমরা তাঁর রাসূল (সঃ)-এর মাধ্যমে জানতে পেরেছে। আর তোমরা তোমাদের পূর্ববর্তী গুনাহ্ হতে তাওবা কর এবং আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর। বিশ্বাস রেখো যে, আল্লাহর সাথে অংশী স্থাপনকারীরা ধ্বংস হয়ে যাবে।
মহান আল্লাহর উক্তিঃ যারা যাকাত প্রদান করে না। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর মতে এর ভাবার্থ হলোঃ “আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নেই’ এই সাক্ষ্য যারা প্রদান করে না। ইকরামাও (রঃ) এ কথাই বলেন। এই উক্তিটি আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা’আলার নিম্নের উক্তির মতইঃ (আরবী) অর্থাৎ “সেই সফলকাম হবে, যে নিজেকে পবিত্র করবে এবং সেই ব্যর্থ হবে, যে নিজেকে কলুষাচ্ছন্ন করবে।”(৯২:৯-১০) নিমের উক্তিটিও অনুরূপঃ (আরবী) অর্থাৎ “নিশ্চয়ই সাফল্য লাভ করবে যে পবিত্রতা অর্জন করে এবং তার প্রতিপালকের নাম স্মরণ করে ও নামায পড়ে।”(৮৭:১৪-১৫) আল্লাহ্ তাআলার নিম্নের এ উক্তিটিও ঐরূপঃ (আরবী) অর্থাৎ “তোমার পবিত্রতা অর্জন করার খেয়াল আছে কি?”(৭৯:১৮) এ আয়াতগুলোতে যাকাত অর্থাৎ পবিত্রতা দ্বারা নফকে বাজে চরিত্র হতে মুক্ত রাখা উদ্দেশ্য। আর এর সবচেয়ে বড় ও প্রথম প্রকার হচ্ছে শিরূক হতে পবিত্র হওয়া। অনুরূপভাবে উপরোক্ত আয়াতে যাকাত না দেয়া দ্বারা তাওহীদকে অমান্য করা বুঝানো হয়েছে। মালের যাকাতকে যাকাত বলার কারণ এই যে, এটা মালকে অবৈধতা হতে পবিত্র করে এবং মালের বৃদ্ধি ও বরকতের কারণ হয়। আর আল্লাহর পথে ঐ মাল হতে কিছু খরচ করার তাওফীক লাভ হয়। কিন্তু ইমাম সুদ্দী (রঃ), মুআবিয়া ইবনে কুরুরা (রঃ), কাতাদা (রঃ) এবং অন্যান্য তাফসীরকারগণ এর অর্থ করেছেন মালের যাকাত না দেয়া এবং বাহ্যতঃ এটাই বুঝা যাচ্ছে। ইমাম ইবনে জারীর (রঃ)-ও এটাকেই পছন্দ করেছেন। কিন্তু এ উক্তিটির ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনার অবকাশ রয়েছে। কেননা, যাকাত ফরয হয়। রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর মদীনায় হিজরতের দ্বিতীয় বছরে। আর এ আয়াত অবতীর্ণ হয় মক্কায়। বড় জোর এই তাফসীরকে মেনে নিয়ে আমরা এ কথা বলতে পারি যে, সাদকা ও যাকাতের আসল হুকুম তো নবুওয়াতের শুরুতেই ছিল। যেমন আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “ফসল কাটার দিন তোমরা তার হক দিয়ে দাও।”(৬:১৪১) হ্যা, তবে ঐ যাকাত, যার নিসাব ও পরিমাণ আল্লাহ তা’আলার পক্ষ হতে নির্ধারিত হয় তা হয় মদীনায়। এটি এমন একটি উক্তি যে, এর দ্বারা দু’টি উক্তির মধ্যে সামঞ্জস্য এসে যায়।
নামাযের ব্যাপারেও এটা দেখা যায় যে, নামায সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের পূর্বে নবুওয়াতের শুরুতেই ফরয হয়েছিল। কিন্তু মিরাজের রাত্রে হিজরতের দেড় বছর পূর্বে পাঁচ ওয়াক্ত নামায নিয়মিতভাবে শর্ত ও আরকানসহ নির্ধারিত হয়। আর ধীরে ধীরে এর সমুদয় সম্পর্কিত বিষয় পুরো করে দেয়া হয়। এসব ব্যাপারে আল্লাহ্ তা’আলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।
এরপর মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ “যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে, তাদের জন্যে রয়েছে নিরবচ্ছিন্ন পুরস্কার।” এটা কখনো শেষ হবার নয়। যেমন অন্য জায়গায় রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “যাতে তারা হবে চিরস্থায়ী।”(১৮:৩) আর এক জায়গায় আছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “তাদেরকে যে ইনআ’ম দেয়া হবে তা কখনো ভাঙ্গবার বা শেষ হবার নয়, বরং অনবরতই থাকবে।”(১১:১০৮) সুদ্দী (রঃ) বলেন যে, তাদেরকে যেন এটা তাদের প্রাপ্য হিসেবে দেয়া হবে, অনুগ্রহ হিসেবে নয়। কিন্তু কতক ইমাম তাঁর এ উক্তি খণ্ডন করেছেন। কেননা, জান্নাতবাসীর উপরও নিশ্চিতরূপে আল্লাহর অনুগ্রহ রয়েছে, এ কথা বলতে হবে। স্বয়ং আল্লাহ্ পাক বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “বরং আল্লাহ্ই ঈমানের দিকে পরিচালিত করে তোমাদেরকে ধন্য করেছেন বা তোমাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন।”(৪৯:১৭) জান্নাতবাসীদের উক্তিঃ (আরবী) অর্থাৎ “আল্লাহ্ আমাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন এবং আমাদেরকে আগুনের শাস্তি হতে রক্ষা করেছেন।”(৫২:২৭) রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) বলেনঃ কিন্তু এই যে, আল্লাহ্ আমাকে স্বীয় রহমত, অনুগ্রহ ও ইহসানের মধ্যে নিয়ে নিবেন।