(বই#১০৯৩) [ *আপােষের প্রস্তাবে আল্লাহর রাসূলের জবাব :-] www.motaher21.net সূরা:৪১:হামীম-আস-সাজদাহ পারা:২৪ ৯-২৫ নং আয়াত:-

أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#১০৯৩)
[ *আপােষের প্রস্তাবে আল্লাহর রাসূলের জবাব :-]
www.motaher21.net
সূরা:৪১:হামীম-আস-সাজদাহ
পারা:২৪
৯-২৫ নং আয়াত:-
৪১:হামীম-আস-সাজদাহ-৯
قُلۡ اَئِنَّکُمۡ لَتَکۡفُرُوۡنَ بِالَّذِیۡ خَلَقَ الۡاَرۡضَ فِیۡ یَوۡمَیۡنِ وَ تَجۡعَلُوۡنَ لَہٗۤ اَنۡدَادًا ؕ ذٰلِکَ رَبُّ الۡعٰلَمِیۡنَ ۚ﴿۹﴾
বল, তোমরা কি তাঁকে অস্বীকার করবেই যিনি দু’দিনে পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এবং তাঁর সমকক্ষ দাঁড় করাবে? তিনি তো বিশ্বজগতের প্রতিপালক।
৪১:হামীম-আস-সাজদাহ-১০
وَ جَعَلَ فِیۡہَا رَوَاسِیَ مِنۡ فَوۡقِہَا وَ بٰرَکَ فِیۡہَا وَ قَدَّرَ فِیۡہَاۤ اَقۡوَاتَہَا فِیۡۤ اَرۡبَعَۃِ اَیَّامٍ ؕ سَوَآءً لِّلسَّآئِلِیۡنَ ﴿۱۰﴾
আর তিনি স্থাপন করেছেন অটল পর্বতমালা ভূপৃষ্ঠে এবং তাতে দিয়েছেন বরকত এবং চার দিনের মধ্যে এতে খাদ্যের ব্যবস্থা করেছেন সমভাবে যাচঞাকারীদের জন্য।
৪১:হামীম-আস-সাজদাহ-১১
ثُمَّ اسۡتَوٰۤی اِلَی السَّمَآءِ وَ ہِیَ دُخَانٌ فَقَالَ لَہَا وَ لِلۡاَرۡضِ ائۡتِیَا طَوۡعًا اَوۡ کَرۡہًا ؕ قَالَتَاۤ اَتَیۡنَا طَآئِعِیۡنَ ﴿۱۱﴾
তিনি আকাশের দিকে মনোনিবেশ করেন, যা ছিল ধূম্রপুঞ্জবিশেষ। অতঃপর তিনি ওকে ও পৃথিবীকে বললেন, ‘তোমরা উভয়ে ইচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায় এস।’ওরা বলল, ‘আমরা তো অনুগত হয়ে আসলাম।’
৪১:হামীম-আস-সাজদাহ-১২
فَقَضٰہُنَّ سَبۡعَ سَمٰوَاتٍ فِیۡ یَوۡمَیۡنِ وَ اَوۡحٰی فِیۡ کُلِّ سَمَآءٍ اَمۡرَہَا ؕ وَ زَیَّنَّا السَّمَآءَ الدُّنۡیَا بِمَصَابِیۡحَ ٭ۖ وَ حِفۡظًا ؕ ذٰلِکَ تَقۡدِیۡرُ الۡعَزِیۡزِ الۡعَلِیۡمِ ﴿۱۲﴾
তিনি সেগুলোকে সাত আসমানে পরিণত করলেন দু’দিনে এবং প্রত্যেক আসমানে তার নির্দেশ ওহী করে পাঠালেন এবং আমরা নিকটবর্তী আসমানকে সুশোভিত করলাম প্ৰদীপমালা দ্বারা এবং করলাম সুরক্ষিত। এটা পরাক্রমশালী, সর্বজ্ঞের ব্যবস্থাপনা।
৪১:হামীম-আস-সাজদাহ-১৩
فَاِنۡ اَعۡرَضُوۡا فَقُلۡ اَنۡذَرۡتُکُمۡ صٰعِقَۃً مِّثۡلَ صٰعِقَۃِ عَادٍ وَّ ثَمُوۡدَ ﴿ؕ۱۳﴾
এর পরেও যদি ওরা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে (ওদেরকে) বল, আমি তো তোমাদেরকে এক ধ্বংসকর শাস্তি সম্পর্কে সতর্ক করেছি; যেরূপ শাস্তির সম্মুখীন হয়েছিল আ’দ ও সামূদ;
৪১:হামীম-আস-সাজদাহ-১৪
اِذۡ جَآءَتۡہُمُ الرُّسُلُ مِنۡۢ بَیۡنِ اَیۡدِیۡہِمۡ وَ مِنۡ خَلۡفِہِمۡ اَلَّا تَعۡبُدُوۡۤا اِلَّا اللّٰہَ ؕ قَالُوۡا لَوۡ شَآءَ رَبُّنَا لَاَنۡزَلَ مَلٰٓئِکَۃً فَاِنَّا بِمَاۤ اُرۡسِلۡتُمۡ بِہٖ کٰفِرُوۡنَ ﴿۱۴﴾
যখন তাদের কাছে তাদের সামনে ও পিছন থেকে রাসূলগণ এসে বলেছিলেন যে, ‘তোমরা আল্লাহ ছাড়া কারো ইবাদাত করো না।’ তারা বলেছিল, ‘যদি আমাদের রব ইচ্ছে করতেন তবে তিনি অবশ্যই ফেরেশতা নাযিল করতেন। অতএব তোমরা যা সহ প্রেরিত হয়েছ, নিশ্চয় আমরা তার সাথে কুফরী করলাম।’
৪১:হামীম-আস-সাজদাহ-১৫
فَاَمَّا عَادٌ فَاسۡتَکۡبَرُوۡا فِی الۡاَرۡضِ بِغَیۡرِ الۡحَقِّ وَ قَالُوۡا مَنۡ اَشَدُّ مِنَّا قُوَّۃً ؕ اَوَ لَمۡ یَرَوۡا اَنَّ اللّٰہَ الَّذِیۡ خَلَقَہُمۡ ہُوَ اَشَدُّ مِنۡہُمۡ قُوَّۃً ؕ وَ کَانُوۡا بِاٰیٰتِنَا یَجۡحَدُوۡنَ ﴿۱۵﴾
তাদের অবস্থা ছিল এই যে, পৃথিবীতে তারা অন্যায়ভাবে নিজেদেরকে বড় মনে করে বসেছিলো এবং বলতে শুরু করেছিলঃ আমাদের চেয়ে অধিক শক্তিশালী আর কে আছে? তারা একথা বুঝলো না যে, যে আল্লাহ‌ তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, তিনি তাদের অপেক্ষা অধিক শক্তিশালী। তারা আমার আয়াতসমূহকে অস্বীকারই করে চললো।
৪১:হামীম-আস-সাজদাহ-১৬
فَاَرۡسَلۡنَا عَلَیۡہِمۡ رِیۡحًا صَرۡصَرًا فِیۡۤ اَیَّامٍ نَّحِسَاتٍ لِّنُذِیۡقَہُمۡ عَذَابَ الۡخِزۡیِ فِی الۡحَیٰوۃِ الدُّنۡیَا ؕ وَ لَعَذَابُ الۡاٰخِرَۃِ اَخۡزٰی وَ ہُمۡ لَا یُنۡصَرُوۡنَ ﴿۱۶﴾
অবশেষে আমি কতিপয় অমঙ্গলকর দিনে তাদের ওপর প্রবল ঝড়ো বাতাস পাঠালাম যেন পার্থিব জীবনেই তাদেরকে অপমান ও লাঞ্ছনাকর আযাবের মজা চাখাতে পারি। আখেরাতের আযাব তো এর চেয়েও অধিক অপমানকর। সেখানে কেউ তাদের সাহায্যকারী থাকবে না।
৪১:হামীম-আস-সাজদাহ-১৭
وَ اَمَّا ثَمُوۡدُ فَہَدَیۡنٰہُمۡ فَاسۡتَحَبُّوا الۡعَمٰی عَلَی الۡہُدٰی فَاَخَذَتۡہُمۡ صٰعِقَۃُ الۡعَذَابِ الۡہُوۡنِ بِمَا کَانُوۡا یَکۡسِبُوۡنَ ﴿ۚ۱۷﴾
আমি সামূদের সামনে সত্য পথ পেশ করেছিলাম কিন্তু তারা পথ দেখার চেয়ে অন্ধ হয়ে থাকা পছন্দ করলো। অবশেষে তাদের কৃতকর্মের কারণে তাদের ওপর লাঞ্ছনাকর আযাব ঝাঁপিয়ে পড়লো।
৪১:হামীম-আস-সাজদাহ-১৮
وَ نَجَّیۡنَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ کَانُوۡا یَتَّقُوۡنَ ﴿٪۱۸﴾
যারা ঈমান এনেছিল এবং গোমরাহী ও দুষ্কৃতি থেকে দূরে অবস্থান করতো আমি তাদেরকে রক্ষা করলাম।
৪১:হামীম-আস-সাজদাহ-১৯
وَ یَوۡمَ یُحۡشَرُ اَعۡدَآءُ اللّٰہِ اِلَی النَّارِ فَہُمۡ یُوۡزَعُوۡنَ ﴿۱۹﴾
স্মরণ কর,) যেদিন আল্লাহর শত্রুদেরকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করার জন্য সমবেত করা হবে এবং ওদেরকে বিভিন্ন দলে বিন্যস্ত করা হবে,
৪১:হামীম-আস-সাজদাহ-২০
حَتّٰۤی اِذَا مَا جَآءُوۡہَا شَہِدَ عَلَیۡہِمۡ سَمۡعُہُمۡ وَ اَبۡصَارُہُمۡ وَ جُلُوۡدُہُمۡ بِمَا کَانُوۡا یَعۡمَلُوۡنَ ﴿۲۰﴾
পরে যখন সবাই সেখানে পৌঁছে যাবে তখন তাদের কান, তাদের চোখ এবং তাদের দেহের চামড়া তারা পৃথিবীতে কি করতো সে সম্পর্কে তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে।
৪১:হামীম-আস-সাজদাহ-২১
وَ قَالُوۡا لِجُلُوۡدِہِمۡ لِمَ شَہِدۡتُّمۡ عَلَیۡنَا ؕ قَالُوۡۤا اَنۡطَقَنَا اللّٰہُ الَّذِیۡۤ اَنۡطَقَ کُلَّ شَیۡءٍ وَّ ہُوَ خَلَقَکُمۡ اَوَّلَ مَرَّۃٍ وَّ اِلَیۡہِ تُرۡجَعُوۡنَ ﴿۲۱﴾
জাহান্নামীরা ওদের চামড়াকে জিজ্ঞাসা করবে, ‘তোমরা আমাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিলে কেন?’ উত্তরে চামড়া বলবে, ‘আল্লাহ যিনি সমস্ত কিছুকে বাকশক্তি দিয়েছেন, তিনি আমাদেরও বাকশক্তি দিয়েছেন।’ তিনি তোমাদেরকে প্রথমবার সৃষ্টি করেছেন এবং তাঁরই নিকট তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে।
৪১:হামীম-আস-সাজদাহ-২২
وَ مَا کُنۡتُمۡ تَسۡتَتِرُوۡنَ اَنۡ یَّشۡہَدَ عَلَیۡکُمۡ سَمۡعُکُمۡ وَ لَاۤ اَبۡصَارُکُمۡ وَ لَا جُلُوۡدُکُمۡ وَ لٰکِنۡ ظَنَنۡتُمۡ اَنَّ اللّٰہَ لَا یَعۡلَمُ کَثِیۡرًا مِّمَّا تَعۡمَلُوۡنَ ﴿۲۲﴾
তোমরা কিছুই গোপন করতে না এ বিশ্বাসে যে, তোমাদের কান, চোখ ও ত্বক তোমাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিবে না— বরং তোমরা মনে করেছিলে যে, তোমরা যা করতে তার অনেক কিছুই আল্লাহ্ জানেন না।
৪১:হামীম-আস-সাজদাহ-২৩
وَ ذٰلِکُمۡ ظَنُّکُمُ الَّذِیۡ ظَنَنۡتُمۡ بِرَبِّکُمۡ اَرۡدٰىکُمۡ فَاَصۡبَحۡتُمۡ مِّنَ الۡخٰسِرِیۡنَ ﴿۲۳﴾
তোমাদের এই ধারণা— যা তোমরা তোমাদের রব সম্পর্কে করেছিলে— তোমাদের সর্বনাশ করেছে এবং এর বদৌলতেই তোমরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছো।
৪১:হামীম-আস-সাজদাহ-২৪
فَاِنۡ یَّصۡبِرُوۡا فَالنَّارُ مَثۡوًی لَّہُمۡ ۚ وَ اِنۡ یَّسۡتَعۡتِبُوۡا فَمَا ہُمۡ مِّنَ الۡمُعۡتَبِیۡنَ ﴿۲۴﴾
এ অবস্থায় তারা ধৈর্য ধারণ করুক (বা না করুক) আগুনই হবে তাদের ঠিকানা। তারা যদি প্রত্যাবর্তনের সুযোগ চায় তাহলে কোন সুযোগ দেয়া হবে না।
৪১:হামীম-আস-সাজদাহ-২৫
وَ قَیَّضۡنَا لَہُمۡ قُرَنَآءَ فَزَیَّنُوۡا لَہُمۡ مَّا بَیۡنَ اَیۡدِیۡہِمۡ وَ مَا خَلۡفَہُمۡ وَ حَقَّ عَلَیۡہِمُ الۡقَوۡلُ فِیۡۤ اُمَمٍ قَدۡ خَلَتۡ مِنۡ قَبۡلِہِمۡ مِّنَ الۡجِنِّ وَ الۡاِنۡسِ ۚ اِنَّہُمۡ کَانُوۡا خٰسِرِیۡنَ ﴿٪۲۵﴾
আমি তাদের ওপর এমন সব সঙ্গী চাপিয়ে দিয়েছিলাম যারা তাদেরকে সামনের ও পেছনের প্রতিটি জিনিস সুদৃশ্য করে দেখাতো। অবশেষে তাদের ওপরও আযাবের সেই সিদ্ধান্ত প্রযোজ্য হলো যা তাদের পূর্ববতী জিন ও মানব দলসমূহের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়েছিলো। নিশ্চিতভাবেই তারা ক্ষতিগ্রস্ত ছিলো।

ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-

*পৃথিবীর সৃষ্টি ও কোরআনের তথ্য ও বিজ্ঞান : ‘বলো, তােমরা কি সেই মহান সত্ত্বাকেই অস্বীকার করছে, যিনি দু’দিনে পৃথিবীকে সৃষ্টি করেছেন…’(আয়াত ৯-১২) অর্থাৎ হে রসূল, তুমি ওদেরকে বলো; তােমরা যখন কুফরি করছো, যখন এই ভয়ংকর কথাটা চরম ধৃষ্টতার সাথে ছুঁড়ে দিচ্ছো, তখন তােমরা একটা সাংঘাতিক অপকর্ম করছাে, একটা চরম অবাঞ্ছিত কাজ করছে, তােমরা সেই মহাশক্তিধর সত্ত্বাকে অস্বীকার করছ, যিনি পৃথিবীকে সৃষ্টি করেছেন, তার স্থানে স্থানে পাহাড় পর্বতসমূহ স্থাপন করেছেন, পৃথিবীকে কল্যাণময় করেছেন, তাতে তার খাদ্য যােগানাের ব্যবস্থা করেছেন যিনি আকাশকেও সৃষ্টি করেছেন ও সুশৃংখল করেছেন, সর্বনিম্ন আকাশকে প্রদ্বীপমালা দিয়ে সজিত করেছেন, বিশেষ নিরাপত্তার খাতিরে এবং যার কাছে আকাশ ও পৃথিবী স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ ও আনুগত্য প্রকাশ করেছে। অথচ তােমরা এই পৃথিবীর কিছু অধিবাসী অস্বীকার করছে ও দম্ভ প্রকাশ করছাে? তবে কোরআন এই তত্ত্বগুলােকে এমন একটা পদ্ধতিতে তুলে ধরে যে, তা অন্তরের অন্তস্থলে পৌছে যায় এবং মনকে প্রবল জোরে ঝাকি দেয়। আমরা এই পদ্ধতিটা সবিস্তারে ও পর্যায়ক্রমে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করছি। বলাে তােমরা কি তাকে অস্বীকার করাে, যিনি দু’দিনে পৃথিবীকে সৃষ্টি করেছেন এবং তােমরা কি তার জন্যে শরীক সাব্যস্ত করাে? তিনিই সারা জাহানের প্রতিপালক। তিনি পৃথিবীর উপরিভাগে অটল পর্বতরাজি স্থাপন করেছেন এবং তাতে প্রবৃদ্ধি নিহিত রেখেছেন। আর চার দিনের মধ্যে তাতে খাদ্যের ব্যবস্থা করেছেন, যা গণনায় পরিপূর্ণ রয়েছে প্রশ্নকারীদের জন্যে।(আয়াত ৯-১০) এ দুটো আয়াতে দুদিনে পৃথিবী সৃষ্টির তথ্য দেয়া হয়েছে। তারপর পৃথিবীর অবশিষ্ট কাহিনী বর্ণনা করার আগে এই তথ্যের ওপর মন্তব্য করা হয়েছে। পৃথিবীর কাহিনীর প্রথমাংশ সম্পর্কে মন্তব্য করা হয়েছে যে, ‘তিনিই সারাজাহানের প্রতিপালক।’ অথচ তােমরা কিনা তারই সাথে কুফরি করছো এবং তার সাথে শরীক বানাচ্ছো। আর যে পৃথিবীতে তােমরা বসবাস করছে, তাকে তিনিই সৃষ্টি করছেন। তাহলে ভেবে দেখো, এটা কতােবড় ঔদ্ধত্য, কতােবড় ধৃষ্টতা এবং কতাে জঘন্য কাজ! তাহলে দিনের সংখ্যা কতাে? দু’দিনে পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। দু’দিনে পৃথিবীতে পাহাড় পর্বত স্থাপন করেছেন, খাদ্যের ব্যবস্থা করেছেন এবং তাতে বরকত বা প্রবৃদ্ধি নিহিত রেখেছেন। এভাবে চারদিন পূর্ণ হয়। নিসন্দেহে এ দিনগুলাে আল্লাহর সেসব দিন, যার পরিমাণ একমাত্র আল্লাহই জানেন। আমরা পৃথিবীতে যে দিনের সাথে পরিচিত, তা পৃথিবীর জন্মের পরে সৃষ্ট কালমাত্র। পৃথিবীর যেমন দিন রয়েছে, যা সূর্যের কক্ষপথ প্রদক্ষিণকালে নিজের চারপাশে একবার আবর্তনের ফলে জন্ম, তেমনি অন্যান্য গ্রহ নক্ষত্রেরও দিন রয়েছে, যা পৃথিবীর দিনের সমান নয় কোনােটা এর চেয়ে বড়, কোনােটা ছােট। প্রথম যে দিনগুলােতে পৃথিবীর সৃষ্টি হয়েছে, তারপর যে দিনগুলােতে পাহাড় পর্বতের সৃষ্টি হয়েছে এবং খাদ্যের ব্যবস্থা করা হয়েছে, সে দিনগুলাে অন্য পরিমাপক দিয়ে মাপ দিন। আমরা এর সঠিক পরিমাণ জানি না। তবে এটা জানি যে, পৃথিবীর বর্তমান প্রচলিত দিনের চেয়ে অনেক বড়াে। মানবীয় বিজ্ঞান বর্তমানে যে পর্যায়ে পৌঁছেছে তার আলােকে আমরা যতােদুর অনুমান করতে পারি, তাতে মনে হয়, পৃথিবী তার জন্মের পর প্রাথমিক স্তরগুলাে অতিক্রম করে আসতে যে যুগগুলাে কাটিয়ে এসেছে, তার এক একটা যুগকেই এখানে দিন বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এই স্তরগুলাে অতিক্রম করে আসার পর পৃথিবী স্থীতিশীল হয়েছে, ভূ-পৃষ্ঠ শক্ত হয়েছে এবং আমাদের পরিচিত এই জীবনের উক্তি ও বিকাশের যােগ্যতা অর্জন করেছে। এই প্রক্রিয়ায় যে সময় লেগেছে, তা এ যাবত প্রান্ত বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব আলােকে আমাদের পৃথিবীর বর্তমান বছরের দু’হাজার মিলিয়ন বছর। আর এই পরিসংখ্যানটা নিছক বৈজ্ঞানিক অনুমান। প্রাপ্ত পাথরগুলার ওপর গবেষণা চালানাের মাধ্যমে পৃথিবীর বয়স অনুমানের ফলে এটা পাওয়া গেছে। আমরা কোরআনের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে এই সব অনুমানকে চূড়ান্ত সত্য হিসেবে ধরে নিতে পারি না। কেননা এগুলাে বাস্তবেই তেমন নয়। এগুলাে নিছক গবেষণালব্ধ তত্ত্ব ও তথ্য, যা সব সময়ই রদবদলযােগ্য ও সংশােধনযােগ্য। তাই আমরা কোরআনকে এসব তথ্যের ওপর নির্ভরশীল করতে পারি না। আমরা যখন দেখবাে, এসব তথ্যের মাঝে ও কোরআনের বক্তব্যের মাঝে অনেকখানি মিল রয়েছে, এবং এসব তথ্যকে নির্দ্বিধায় কোরআনের তাফসীরের উপযােগী মনে করতে পারবে, কেবল তখনই এগুলাে বিশুদ্ধ হতে পারে বলে ধারণা করতে পারবাে। কেবল এরূপ অবস্থায়ই আমরা বলতে পারবাে যে, অমুক বা তমুক তত্ত্ব কোরআনের বক্তব্যের কাছাকাছি হওয়ার কারণে বিশুদ্ধতার অধিকতর নিকটবর্তী। প্রাপ্ত সর্বশেষ বৈজ্ঞানিক তথ্য থেকে জানা যায়, বর্তমানে সূর্য যেমন একটা জ্বলন্ত গ্যাসপিন্ড, এক সময় পৃথিবী ও তদ্রুপ ছিলাে। অধিকতর নির্ভরযােগ্য তথ্য হলাে, পৃথিবী মূলত সূর্যেরই একটা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া অংশ। এই বিচ্ছিন্নতার সর্বসম্মতভাবে অনুমিত কোনাে কারণ এখনাে জানা যায়নি। আরাে জানা যায় যে, এই জ্বলন্ত গ্যাসপিন্ড বা সূর্যের কাল অতিবাহিত হয়েছে। পৃষ্ঠদেশ ঠান্ডা ও শক্ত হবার পরও ভূগর্ভ এখনও গলিত তরল অবস্থায় রয়েছে। কেননা সেখানে এতাে প্রবল উত্তাপ বিরাজমান যে, কঠিনতম শীলাগুলিও তাতে গলে যায় । ভূ-পৃষ্ঠ ঠান্ডা হবার পর জমাট ও শক্ত হয়ে যায়। প্রথম দিকে তা ছিলাে কঠিন শীলাময় ও কংকরময়। ভূগর্ভ ছিলাে একটার পর একটা শীলাময় স্তর দিয়ে গঠিত। এক অতীব প্রাচীন যুগে হাইড্রোজেন ২ মাত্রা ও অক্সিজেন ১ মাত্রায় একত্রিত হয়ে পানির সৃষ্টি হয়ে সাগর মহাসাগর গঠিত হলাে। ডক্টর আহম্মদ বাকী ‘মায়াল্লাহি ফিস্ সামা’ (মহাশুন্যে আল্লাহর সাথে) নামক গ্রন্থে বলেন; পানি ও বায়ু আমাদের এই পৃথিবীতে শীলাগুলাকে চূর্ণবিচূর্ণ করা, স্থান থেকে স্থানান্তরে বহন করে নেয়া ও নিম্নতর স্তরে নিয়ে স্থাপন করার কাজে পরস্পরকে সহযােগিতা করেছিলো। এর ফলে সৃষ্টি কাজের উপযোগী মাটির উৎপত্তি ঘটতে পেরেছিলাে। অনুরূপভাবে বায়ু ও পানি সহযােগিতা করেছিলাে পাহাড় ও উচ্চভূমিকে ধ্বসিয়ে নীচু করা এবং নিম্নভূমিকে ভরাট করার কাজেও। ফলে পৃথিবীতে আগে থেকে বিদ্যমান অথবা পরে উদ্ভূত এমন কোনাে বস্তুই পাওয়া যাবে না, যা ধ্বংস ও নির্মাণকে প্রভাবিত করে না। ভূপৃষ্ঠ সার্বক্ষণিকভাবে চলমান ও পরিবর্তনশীল। তরঙ্গের কারণে সমুদ্র আলােড়িত হয় এবং ভূ-পৃষ্ঠকে প্রভাবিত করে এবং সমুদ্রের পানি বাষ্পে পরিণত হয়। সূর্যের কিরণ সমুদ্রের পানিকে বাষ্পে পরিণত করে। এ বাষ্প আকাশে উঠে যায় এবং মেঘে পরিণত হয়ে মিষ্টি পানি বর্ষণ করে। এই পানি পৃথিবীতে প্রচুর পরিমাণে নামে। ফলে স্রোত ও বন্যা হয়, এবং নদ নদীর আকারে ভূ-পৃষ্ঠের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে পৃথিবীকে প্রভাবিত করে। ভূ-পূষ্ঠের শীলা ও পাথরকে প্রভাবিত করে এবং এক ধরনের পাথরকে অন্য ধরনের পাথরে পরিণত করে। এরপর নদনদীর স্রোতে তা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় চলে যায় এবং শত শত ও লক্ষ কোটি বছরে ভূপৃষ্ঠ পরিবর্তিত হয়ে যায়। ভূ-পৃষ্ঠের জমাট বরফ সেই ভূমিকা পালন করে, যা করে প্রবহমান পানি। অনুরূপভাবে পানি ভূপৃষ্ঠে যে কাজ সমাধা করে, বায়ুও তাই করে। আর সূর্যের কিরণ ভূপৃষ্ঠে সেই কাজ করে, যা পানি ও বাতাস করে। এদ্বারা ভূপৃষ্ঠে আগুন ও আলাের বিস্তার ঘটে। আর ভূ-পৃষ্ঠের প্রাণীকূলেও পরিবর্তন আসে এবং ভূগর্ভ থেকে উৎসারিত আগ্নেয়গিরিতেও পরিবর্তন আসে। ভূ-পৃষ্ঠের শিলা ও পাথর সম্পর্কে যদি কোনাে ভূ-তত্ত্ববিদকে প্রশ্ন করেন, তাহলে সে বহুরকমের শীলার নাম বলবে। তন্মধ্যে প্রধান শীলা তিন রকমের। প্রথমত আগ্নেয় শীলা, যা ভূগর্ভ থেকে গলিত লাভার আকারে বেরিয়ে ভূপৃষ্ঠে পড়ে এবং পরে ঠান্ডা হয়ে যায়। এই শীলা তিন রকমের যথা, গ্রানাইট, বাস্যালট এবং সাদা, লাল ও কালাে এই তিন বর্ণের ক্রিষ্টাল পাথর। ভূ-তত্ত্ববিদরা বলেন, এই তিন রকমের ক্রিষ্টাল পাথরের প্রত্যেকটাতেই এক একটা রাসায়নিক যৌগিক পদার্থ এবং প্রত্যেকটারই একটা স্বতন্ত্র সত্ত্বা রয়েছে। এই শীলাগুলাে মিশ্র পদার্থ এবং এইসব আগ্নেয় শীলা ও অনুরূপ অন্যান্য পদার্থ সহযােগেই সেই আদিমকালে গড়ে উঠেছে আমাদের এই পৃথিবী। এরপর পৃথিবীতে আকাশ থেকে বর্ষিত, ভূ-পূষ্ঠে প্রবহমান অথবা বরফ গলা পানি নিজের ভূমিকা পালন করেছে। ভূমিকা পালন করেছে বায়ু ও রােদ। সব কিছু মিলে এইসব শীলার মূল প্রকৃতি ও রাসায়নিক উপাদান পাল্টে দিয়েছে। এভাবে এই শীলাগুলাে থেকে সম্পূর্ণ নতুন শীলা জন্ম নিয়েছে। এই নতুন শীলা ও পুরানাে শীলা দেখতেও অন্যরকম, পরীক্ষাগারে পরীক্ষা করলেও দুটোর মধ্যে কোনাে মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। ভূ-তাত্ত্বিকেরা আরাে একশ্রেণীর বৃহত্তর শীলার সন্ধান দিয়েছেন, যার নামকরণ তারা করেছেন কঠিন শীলা বা ঘনশীলা। পানি, বায়ু ও রোদের প্রভাবে অথবা ভূ-গর্ভের অধিকতর প্রাচীন ও মৌল শীলার প্রভাবে এ শীলাগুলাের রূপান্তর ঘটেছে। এগুলাের নামকরণ কঠিন শীল করা হয়েছে এজন্যে যে এগুলােকে তার পূর্বতন স্থানে পাওয়া যায় না। পূর্বতন শীলাগুলাে থেকে রূপান্তরের পর অথবা রূপান্তরের প্রক্রিয়াধীন থাকাকালে তা স্থানান্তরিত হয়। পানি অথবা বাতাস তাকে স্থানান্তরে নিয়ে যায়, তারপর তা মাটির নীচে ঢুকে যায়, কঠিন হয়ে যায় এবং মাটির সেই হরে স্থায়ীভাবে জেঁকে বসে। ভূতত্ত্ববিদরা মিসরের মুকাত্তাম পর্বতের প্রধান উপাদান চুনাপাথরের উদাহরণ দিয়ে বলেন, এটা এক ধরনের রাসায়নিক যৌগিক, যা কার্বনেট ক্যালসিয়াম বলে পরিচিত। এটা ভূগর্ভের রাসায়নিক অথবা জৈবিক রূপান্তরের প্রক্রিয়ায় রূপান্তরিত। এই মুকাত্তাম পর্বতের পাথর দিয়ে কায়রাের ভবনগুলাে তৈরী হয়ে থাকে। তারা বালুর উদাহরণও দিয়ে থাকেন এবং বলেন, বালুর বেশীর ভাগ উপাদানই হলাে সেলসিয়াম অক্সাইড। এটাও রূপান্তরিত। আরাে একটা উদাহরণ দিয়ে থাকেন কুমােরের কাদা মাটি ও শুকনাে ঠনঠনে দো-আশ মাটির। এগুলাের উৎপত্তি ঘটেছে তার পূর্বতন উৎস থেকে। কঠিন শীলার উৎপত্তিস্থল হচ্ছে আগ্নেয়শীলা। আদিম যুগে যখন পৃথিবীর উপরিভাগ তরলাবস্থা থেকে জমাট রূপ ধারণ করে, তখনই তা মাটিতে রূপান্তরিত হতে শুরু করে। তখন জমাট বাঁধা এই ভূ-পৃষ্ঠে আগ্নেয়শীলা ছাড়া আর কোনাে পদার্থ ছিলাে না। এর পরে এলাে পানি। সৃষ্টি হলে সমুদ্র। তারপর আগ্নেয় শিলার সাথে পানির প্রক্রিয়াকরণ শুরু হলাে। তার সাথে যােগ দিলাে বায়ু, যােগ দিলাে প্রক্রিয়াধীন রকমারি প্রাকৃতিক গ্যাস, যােগ দিলাে ঝঞ্জা বায়ু এবং সূর্যের আলাে ও উত্তাপ। এই সমস্ত উপাদান, নিজ নিজ প্রকৃতি অনুসারে প্রক্রিয়াকরণ শুরু করলাে। অবশেষে কঠিন  আগ্নেয়শীলা এমন উপকারী শীলায় পরিণত হলাে, যা ঘরবাড়ী নির্মাণে ও খনিজ পদার্থ উত্তোলনে কাজে লাগে। এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ এবং এর চেয়েও চমকপ্রদ ব্যাপার হলাে, এই রূপান্তর প্রক্রিয়ায় সেই কঠিন আগ্নেয়শীলা, যা জীবনের অস্তিত্ব ও স্থীতির উপযােগী নয়, তা থেকে মাটির উৎপত্তি ঘটলাে। আর এই মাটি পৃথিবীর উপরিভাগে স্থীতিশীল হয়ে জীবনের অস্তিত্ব ও রকমারি সৃষ্টির উদ্ভবের পথ সুগম করলাে। গ্রানাইট চাষাবাদ, উদ্ভিদ জন্মানাে কিংবা পানি প্রবাহের উপযােগী নয়। তবে তা থেকে যে নরম ও উর্বর মাটি জন্মে, তা খুবই উপকারী ও কার্যোপযােগী। এই মাটির উৎপত্তি হয়েছে বলেই উদ্ভিদ জন্মেছে এবং উদ্ভিদের কল্যাণেই প্রাণীর উদ্ভব হয়েছে। আর এভাবে পৃথিবী সৃষ্টির সেরা মানুষের বাসােপযােগী হয়েছে। সৃষ্টির এই সুদীর্ঘ প্রক্রিয়ার যে বিবরণ আধুনিক বিজ্ঞান আমাদেরকে দিয়েছে, এ দ্বারা আমরা চারদিনে পৃথিবীর সৃষ্টি, তার ওপর পাহাড় পর্বত স্থাপন, তার কল্যাণময়তা ও প্রবৃদ্ধিশীলতা এবং তার খাদ্যের ব্যবস্থাপনার তাৎপর্য বুঝতে পারি । আল্লাহর সে দিনগুলাে কেমন, কতাে বড় তা আমরা না জানলেও এটা বুঝতে পারছি যে, সেসব দিন আজকের পৃথিবীর দিন থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। পরবর্তী আয়াতে যে আকাশের বিবরণ আসছে, সে ব্যাপারে আলোচনা করার আগে এ আয়াতের প্রতিটা বাক্যের ব্যাখ্যা প্রয়োজন। ‘তিনি তার উপরিভাগে কিলকসমূহ স্থাপন করেছেন।’ পাহাড়পর্বতকে প্রায়শ রাওয়াসী অর্থাৎ কিলক বা নােঙর নামকরণ করা হয়, কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে এই কিলকগুলাে স্থাপনের কারণ দর্শানাে হয়েছে এই বলে যাতে পৃথিবী তােমাদেরকে নিয়ে নুয়ে না পড়ে। অর্থাৎ এগুলাে পৃথিবীর ভারসাম্য রক্ষা করে। ফলে পৃথিবী নড়বড় করে না বা কোনাে দিকে ঝুঁকে পড়ে না। অতীতে মানুষ মনে করতাে যে, পৃথিবী খুবই মযবুত স্তম্ভসমূহের ওপর স্থাপিত এবং সুরক্ষিত। তারপর এখন অন্য যুগ এসেছে, যখন বলা হচ্ছে যে, এই পৃথিবী একটা গােলাকার জিনিস। যা মহাশুন্যে সাঁতরে বেড়াচ্ছে এবং কোনাে কিছুর ওপর এটা দাড়িয়ে নেই। এ কথা যারা প্রথম শুনেছে, তারা হয়তাে আঁতকে উঠেছিলাে এবং হয়তাে বা ডানে বামে ভয়ে ভয়ে তাকাতাে যে, পৃথিবী এই বুঝি কাত হয়ে পড়লাে বা মহাশূন্যে কোথাও কখন যেন উন্টে পড়ে যায়। কিন্তু কোরআনের এই আশ্বাসে তাদের আশ্বস্ত হওয়া উচিত যে, আল্লাহ তায়ালা তার হাত দিয়ে আকাশ ও পৃথিবীকে কোনাে দিকে কাত হওয়া বা পড়ে যাওয়া থেকে ঠেকিয়ে রেখেছেন। কেননা আকাশ ও পৃথিবী পড়ে গেলে আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কেউ তাকে সামাল দিতে পারবে না। এজন্যেও আশ্বস্ত হওয়া উচিত যে, যে প্রাকৃতিক নিয়মবিধি এই সৃষ্টিজগতকে নিয়ন্ত্রণ করছে, তা অত্যন্ত শক্ত ও অটুট। কেননা এগুলাে স্বয়ং মহাশক্তিধর আল্লাহরই সৃষ্ট। পাহাড় পর্বতের কথা বলছিলাম। পাহাড় পর্বতকে কোরআনে রাওয়াসী’ বলা হয়েছে, যার অর্থ কিলক, পেরেক বা নােঙর কেননা এগুলাে পৃথিবীকে কাত হওয়া বা নড়াচড়া করা থেকে রক্ষা করছে। আমরা এই তাফসীরের অন্যত্র বলেছি যে, এসব পাহাড় পর্বত সমুদ্রের তলদেশ ও পৃথিবীর উচ্চ ভূমিগুলাের মধ্যে সমন্বয় রক্ষা করছে, ফলে কোনােটাই ঝুঁকে পড়ে না বা উল্টে যায় না। ডক্টর আহমাদ যাকী ‘মহাশূন্যে আল্লাহর সাথে’ গ্রন্থে আরাে বলেন, পৃথিবীতে যে ঘটনাই ঘটুক ভূ-পৃষ্ঠে বা ভূগর্ভে, যেখানেই ঘটুক না কেন, তার প্রভাবে কিছু বস্তু একস্থান থেকে অন্যস্থানে স্থানান্তরিত না হয়ে পারে না এবং এই স্থানান্তরের ফলে পৃথিবীর গতিবেগ দ্রুততর হওয়া অবশ্যম্ভাবী। পৃথিবীর গতিবেগকে শুধু জোয়ার ভাটাই প্রভাবিত করে না। (অর্থাৎ হ্রাসবৃদ্ধি করে না)। এমনকি নদ-নদী পৃথিবীর এক পাশ থেকে আর এক পাশে যে পানি সরিয়ে নেয়, তাও পৃথিবীর গতিবেগ কে প্রভাবিত করে। সমুদ্রের তলদেশে কোনাে কিছুর পতন অথবা ভূ-পৃষ্ঠে কোনাে কিছুর উদ্ভবও পৃথিবীর গতিবেগ কে প্রভাবিত করে। এমনকি বিভিন্ন কারণে পৃথিবী যখন ঈষৎ সংকুচিত বা প্রসারিত হয়, তখন তাও পৃথিবীর গতিবেগকে প্রভাবিত করে, যদিও এই সংকোচন বা সম্প্রসারণের পরিমাণ কয়েক ফুটের চেয়ে বেশী হয় না। যে পৃথিবীর স্পর্শকাতরতা এতাে তীব্র, তার ভারসাম্য রক্ষায় পাহাড়পর্বত যে কার্যকর অবদান রাখবে, তা মােটেই বিচিত্র নয়। কোরআন প্রায় দেড় হাজার বছর আগে এ কথাই তাে বলেছে যে, যাতে পৃথিবী তােমাদেরকে নিয়ে কাত হয়ে না পড়ে। আর এতে তিনি কল্যাণ ও প্রবৃদ্ধি নিহিত রেখেছেন এবং তার অধিবাসীদের জন্য খাদ্যের ব্যবস্থা করেছেন। এই বাক্যে আমাদের পূর্বপুরুষদের মনে স্বতস্ফূর্তভাবে বর্ধনশীল ফসলাদির চিত্র এবং আল্লাহ তায়ালা ভূগর্ভে সােনা, রূপা, লােহা ইত্যাকার যেসব উপকারী দ্রব্য সামগ্রী সংরক্ষণ করেছেন, তার চিত্র তুলে ধরেছিলাে, আর আজকাল আল্লাহ তায়ালা মানুষকে ভূগর্ভে ও ভূপৃষ্ঠে যে বিপুল সম্পদ সম্ভার ও খাদ্য শস্যের সন্ধান দিয়েছেন, তাতে করে এ বাক্যটা আমাদের মনমস্তিস্কে আমাদের পূর্ব পুরুষের তুলনায় অনেক বেশী প্রাচুর্যের ছবি ফুটিয়ে তােলে। আমরা স্বচক্ষেই দেখেছি, কিভাবে বায়ুর উপাদানগুলাে পারস্পরিক সহযােগিতার মাধ্যমে পানি উৎপাদন করে এবং পানির বাতাস ও রোদের সহযােগিতায় কিভাবে কৃষিযােগ্য উর্বর মাটি তৈরী হয়। আমরা দেখেছি কিভাবে বাতাস, পানি ও রােদের সহযােগিতায় বৃষ্টি বর্ষিত হয়, আর এই বৃষ্টিই হয়ে থাকে ভূ-পৃষ্ঠের ও ভূগর্ভের মিষ্টি পানির উৎস। সেই মিষ্টি পানি থেকেই পুকুর, ঝর্ণা ও নদীনালার সৃষ্টি হয়। এসবই খাদ্য ও বরকতের উৎস। এ ছাড়াও রয়েছে বাতাস, যা আমাদের স্বাস-প্রশ্বাসের উৎস ও শরীরের রক্ষণাবেক্ষণের নিয়ামক। ড. আহমাদ বাকী আরাে বলেন, পৃথিবী নামক গােলাকার গ্রহটা একটা শীলাস্তর দিয়ে ঢাকা। এই শীলান্তরের বেশীর ভাগ রয়েছে পানির স্তর পরিবেষ্টিত। আর এই শীলা ও পানির স্তরের সবটা মিলে বায়ুর একটা স্তর গঠিত। এই স্তরটা সমুদ্রের ন্যায় একটা বিশাল ঘন গ্যাসের আস্তরণে আচ্ছাদিত । এই সমুদ্রের তলদেশে রয়েছে অসংখ্য স্তর। আমরা মানবসন্তান, জীবজগত, উদ্ভিদজগত এই সমুদ্রের তলদেশে সানন্দে বসবাস করছি।’ বাতাসের অক্সিজেন থেকে আমরা শ্বাস নেই। আর এই বাতাসের কার্বনডাই অক্সাইড থেকে গঠিত ও পুষ্ট হয় উদ্ভিদের দেহ। একেই রসায়ণবিদরা দ্বিতীয় কার্বনডাই অক্সাইড বলে থাকেন। এই অক্সাইড থেকে উদ্ভিদ নিজেদের দেহ গঠন করে। আমরা সেসব উদ্ভিদ খাই। যে সব জীবজন্তু এইসব উদ্ভিদ খেয়ে বেঁচে থাকে, সেসব জীবজন্তুও আমরা খাই। এই উভয় খাদ্য দিয়ে আমরা আমাদের দেহ গঠন করি। বাতাসের উপাদানের মধ্য থেকে অবশিষ্ট রইলাে নাইট্রোজেন। এর উদ্দেশ্য অক্সিজেনকে বিশুদ্ধ করা, যাতে আমরা নিজেদের স্বাস প্রশ্বাসে পুড়ে না যাই। তারপর অবশিষ্ট রইল পানির বাম্প, যা বাতাসকে আর্দ্র রাখে। এ ছাড়া আরাে কিছুসংখ্যক গ্যাস অবশিষ্ট থাকে, যার পরিমাণ খুবই কম থাকে। এগুলাের মধ্যে হিলিয়াম ও হাইড্রোজেন অন্যতম। এগুলাের বেশীর ভাগ পৃথিবীর প্রথম সৃষ্টির পর থেকে মহাশূন্যে ভেসে বেড়াচ্ছে। আর যেসব জিনিস আমরা খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করি, যেগুলাে দ্বারা আমরা আমাদের জীবনে নানাভাবে উপকৃত হই, তার সবই ভূ-গর্ভে অথবা ভূপৃষ্ঠে বিরাজমান মৌলিক উপদানগুলাে দ্বারা গঠিত। উদাহরণ স্বরূপ, আমরা যে চিনি খাই তা কঠিন, হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনের সমষ্টি। অনুরূপভাবে আমরা যতাে খাদ্য, পানীয়, পােশাক বা সাজসরঞ্জাম ব্যবহার করি, তার সবই পৃথিবীতে সংরক্ষিত বিভিন্ন মৌলিক উপাদানেরই সমাহার। প্রসংগত উল্লেখ্য যে, আয়াতে যে খাদ্যের কথা বলা হয়েছে, তা দ্বারা কেবল আমরা যা কিছু পেটে দেই, শুধু তাই বুঝায়না; বরং খাদ্যের অবস্থান আরো ব্যাপক। এসব তথ্য থেকে বরকত ও চার দিনের খাদ্য ব্যবস্থাপনা কি রকম, তার কিছুটা আভাস পাওয়া যায়। এই ব্যবস্থাপনা সম্পন্ন হয়েছে যুগ যুগ কাল ধরে। তাই এ দিনগুলাে অর্থাৎ এই যুগগুলাে কতাে বড়, তা আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কেউ জানে না।

‘তারপর তিনি আকাশের দিকে মনােনিবেশ করলেন…’(আয়াত ১১-১২) ইস্তাওয়া শব্দের অর্থ এখানে ইচ্ছা করা বা মনােনিবেশ করা। আর আল্লাহর ইচ্ছা করা বা মনােনিবেশ করার অর্থ হলাে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও তার বাস্তবায়ন। এখানে ছুম্মা বা অতপর শব্দটা দ্বারা সময়ের ধারাবাহিকতা বুঝানাে হয়নি, বরং চেতনাগত ধারাবাহিকতা বুঝানাে হয়েছে। কেননা চেতনা ও অনুভূতিতে আকাশ পৃথিবী অপেক্ষা উচ্চতর। সাধারণ প্রচলিত ধারণা এই যে, গ্রহ-নক্ষত্র সৃষ্টির আগে শূন্যে এক ধরনের ঘন কুয়াশা বা ধুয়া বিরাজ করতাে। ডক্টর আহমাদ বাকী আরাে বলেন, গ্রহ-নক্ষত্র সৃষ্টির পরে যে গ্যাস, ও ধুলােবালি মহাকাশে বিরাজ করছিলাে, কুয়াশা বলতে তাকেই বুঝানাে হয়েছে। সৃষ্টিতত্বে বলা হয়েছে, ছায়াপথ কেবল গ্যাস ও ধুলােবালি দ্বারা গঠিত ছিলাে। এইসব গ্যাস ও ধুলােবালির কিছু অংশ ঘনীভূত হয়ে গ্রহ-নক্ষত্র গঠিত হয়। আর কিছু অংশ অবশিষ্ট থাকে। সেই অবশিষ্ট অংশ থেকে কুয়াশার সৃষ্টি হয়। সেই অবশিষ্ট অংশ থেকে খানিকটা গ্যাস ও ধুলােবালি এই বিশাল ছায়াপথে ছড়িয়ে পড়ে। যে অংশ থেকে গ্রহ-নক্ষত্রের সৃষ্টি হয়েছে, সেটা এই অংশের সমান। গ্রহ নক্ষত্র মন্ডলী এই কুয়াশা থেকে আকর্ষণ ক্ষমতা অর্জন করে এবং ছায়াপথের প্রতি আকৃষ্ট থাকে। এইসব গ্রহ নক্ষত্র আকাশকে ঝাড় দিয়ে পরিস্কার রাখে। তবে মহাশূন্য এতাে বিশালায়তন এবং এতাে ভয়াবহ যে, এই-ঝাড়ুদাররা সংখ্যায় বিপুল হওয়া সত্তেও এ কাজের জন্যে যথেষ্ট নয়। ড. বাকীর এ তথ্য সঠিকও হতে পারে। কেননা এটা কোরআনের সেই বক্তব্যের নিকটতম, যাতে বলা হয়েছে, অতপর তিনি আকাশের দিকে মনােনিবেশ করলেন, যা এখনাে ধোয়াটে। তা ছাড়া আকাশ যে দীর্ঘ সময় ধরে সৃষ্টি হয়েছে, অর্থাৎ আল্লাহর দুদিন লেগেছে, এই সত্যটাও উক্ত বৈজ্ঞানিক তথ্যকে সঠিক প্রমাণিত করে।  *আল্লাহর অবাধ্যতাই হচ্ছে প্রকৃতির সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়া : এরপর এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা নিয়ে আমাদের একটু চিন্তা ভাবনা করা দরকার; অতঃপর তিনি আকাশ ও পৃথিবীকে বললেন, ইচ্ছায় হােক, অনিচ্ছায় হােক, তােমরা উভয়ে এসাে। তারা উভয়ে বললাে; আমরা অনুগত হয়েই এলাম। এই মহাবিশ্ব যে আল্লাহর প্রাকৃতিক বিধানের অনুগত এবং সমগ্র সৃষ্টিজগত যে তার সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছা ও হুকুমের আজ্ঞাবহ, সে ব্যাপারে এ আয়াতে চমকপ্রদ ইংগিত রয়েছে। এথেকে বুঝা গেলাে, মহাবিশ্বে একমাত্র মানুষই এমন প্রাণী, যে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে বাধ্য হয়েই আল্লাহর  প্রাকৃতিক নিয়মের আনুগত্য করে। সে অনিবার্যভাবেই প্রাকৃতিক নিয়মের অনুসারী। কারণ সেটা অনুসরণ করা ছাড়া তার গত্যন্তর থাকে না। এ বিশাল সৃষ্টিজগতে সে একটা ক্ষুদ্র প্রাণী। প্রাকৃতিক নিয়মগুলাে তার ওপর কার্যকরী হয়ই, তা সে পছন্দ করুক বা অপছন্দ করুক। কিন্তু একমাত্র সেই আকাশ ও পৃথিবীর মতাে স্বেচ্ছাপ্রণােদিত হয়ে আনুগত্য করে না। সে সহজ ও সরল পথ থেকে বিপথগামী হবার চেষ্টা করে। আর এটা করতে গিয়ে সে প্রাকৃতিক বিধানগুলাের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। জানা কথা যে, প্রাকৃতিক বিধান তার ওপর কর্তৃত্বশীল থাকবেই। এই বিধান তাকে ধ্বংসও করে দিতে পারে। তাই সে বাধ্য হয়েই অনুগত হয়। এর একমাত্র ব্যতিক্রম আল্লাহর সেই সব বান্দা, যাদের হৃদয় দেহ, চাল চলন, চিন্তা ভাবনা, ইচ্ছা আকাংখা, কামনা বাসনা, ও ঝোক সব কিছুই আল্লাহর প্রাকৃতিক আইনের সাথে সংগতিশীল। ফলে তারা আল্লাহর বিধান স্বেচ্ছায় মেনে চলে এবং প্রকৃতির চাকার সাথে সমন্বয় রক্ষা করে চলে। এরূপ পরিস্থিতিতেই বিস্ময়কর ও আলৌকিক ঘটনাবলী ঘটে। কেননা প্রকৃতির সাথে সে সংগতিশীল। সে প্রকৃতির শক্তি থেকেই শক্তি অর্জন করে। সে প্রকৃতিরই অংশ এবং আল্লাহর পথে সে প্রাকৃতিক নিয়মের আওতাধীন থেকেই চলতে বাধ্য। আমরা আল্লাহর বিধান বাধ্য হয়ে মেনে চলি। যদি স্বেচ্ছায় মেনে চলতাম, তাহলে খুবই ভালো হতাে। যদি আকাশ ও পৃথিবীর মতাে স্বেচ্ছায় আল্লাহর হুকুম মানতে পারতাম, খুবই ভালাে হতাে। তাহলে প্রকৃতির আত্মার সাথে আমাদের আত্মার মিল হতাে। প্রকৃতির মতােই আমরাও বিশ্বপ্রভু আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পিত হয়ে যেতাম।  আমরা কখনাে কখনাে খুবই হাস্যকর কান্ড করে বসি। প্রকৃতির গাড়ী যখন নিজ পথে, নিজের গতিতে ও নিজের গন্তব্যের দিকে ছুটে চলেছে এবং প্রাকৃতিক বিধান অনুসারে সমগ্র প্রকৃতি তাকে পরিচালিত করছে, তখন আমরা তার বিপরীত দিকে তার চেয়ে দ্রুতগতিতে অথবা শ্লথগতিতে চলতে চাই। এতে আমরা গােটা সৃষ্টির বিশাল মিছিল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি। এই মিছিল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আমরা নানা চিন্তা-ভাবনা, কামনা বাসনা, আগ্রহ ও অনীহা পােষণ করি এবং এদিক ওদিক ছিটকে পড়ি। এই বিচ্ছিন্নতা ও বিপরীতমুখী গতির কারণে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হই ও কষ্ট পাই, কখনাে আহত হই, কখনাে ধ্বংস হয়ে যাই। অথচ সৃষ্টির মিছিল স্ৰষ্টার বিধান অনুসারে অপ্রতিহত গতিতে আপন গন্তব্যের দিক এগিয়ে যেতে থাকে। আর আমাদের সকল চেষ্টাসাধনা ও শক্তি বিফল ও বৃথা হয়ে যায়। পক্ষান্তরে আমাদের অন্তরাত্মা ও মনমগজ যখন যথার্থই ঈমানদার হয়, আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করে এবং গােটা সৃষ্টি জগতের আত্মার সাথে একাত্ম হয়ে যায়, তখন আমরা আমাদের আসল ভূমিকা কী হওয়া উচিত, তা বুঝতে পারি, আমাদের কর্মকান্ডকে গােটা সৃষ্টিজগতের কর্মকান্ডের সাথে সুমমন্বিত করতে পারি। প্রয়ােজনীয় মুহূর্তে প্রয়ােজনীয় দ্রুততার সাথে তৎপর হতে পারি এবং যে পর্যায়ে ও যে মানে তৎপর হওয়া দরকার, হতে পারি। এরূপ অবস্থায় আমরা মহান স্রষ্টারও সাহায্য পেতে পারি এবং অনেক বড় বড় কৃতিত্ব দেখাতে পারি। অথচ কোনাে দম্ভ বা অহংকার আমাদেরকে স্পর্শ করতে পারবে না। কেননা কোন উৎস থেকে শক্তির যােগান পেয়ে আমরা এসব বড় বড় কৃতিত্ব দেখিয়েছি, তা আমরা জানি। আমরা বুঝতে পারি যে, এ কৃতিত্ব আমাদের নিজস্ব নয়। শুধু সর্বোচ্চ শক্তির সাথে সম্পৃক্ত হবার কারণেই আমরা এ কৃতিত্ব দেখাতে পেরেছি। আর তখনই আমরা চরম ও পরম সুখ, সৌভাগ্য সন্তোষ, তৃপ্তি ও শান্তি লাভ করতে পারি। কেবল তখনই এই ক্ষণস্থায়ী জীবনে আল্লাহর অনুগত এই গ্রহে আমাদের হৃদয় আনন্দ পরিপূর্ণ হয়ে যায়। কেননা আমরা তখন দেখতে পাই যে, এ পৃথিবী সর্বতােভাবে ও পরিপূর্ণ সমন্বয়ের সাথে আমাদেরকে সাথে নিয়ে মহান আল্লাহর ঈপ্সিত গন্তব্যের দিকে ধাবমান রয়েছে, এমন একটা বন্ধুপ্রতিম বিশ্বে বসবাস করায় যে কতাে শান্তি ও তৃপ্তি, তা বলে শেষ করা যায় না, যে বিশ্ব তার প্রভু ও প্রতিপালকের কাছে সর্বতােভাবে আত্মসমর্পিত, আমরাও তার সাথে আত্মসমর্পিত, আমাদের এক পাও বিপরীত দিকে চলে না, আমরাও তার বিরুদ্ধে চলিনা, সেও আমাদের বিরুদ্ধে চলে না। কেননা আমরা তার সমমনা ও সহযাত্রী। ‘অতপর আল্লাহ তায়ালা তাদের বিষয় নিস্পত্তি করে ফেললেন দু’দিনে এবং প্রত্যেক আকাশে তার হুকুম পাঠালেন…’ এই দু’দিন সেই দু’দিনও হতে পারে- যখন কুয়াশা থেকে নক্ষত্ররাজি জন্মেছে, অথবা যখন আল্লাহর জ্ঞান মোতাবেক সৃষ্টিকার্য সম্পন্ন হয়েছে। প্রত্যেক আকাশে হুকুম পাঠানাের মর্মার্থ হলাে, সেখানে আল্লাহর নির্দেশ মােতাবেক প্রাকৃতিক বিধান চালু করা। আকাশ শব্দটা কী বুঝায়, সে ব্যাপারে নির্দিষ্টভাবে কিছু বলা যায় না। এমনও হতে পারে যে, দূরত্বের পরিমাণকেই আকাশ নাম দেয়া হয়েছে। আবার এক একটা ছায়াপথকেও আকাশ বলা হয়ে থাকতে পারে। বিভিন্ন দূরত্বে অবস্থিত ছায়াপথগুলােকে পৃথক পৃথকভাবে আকাশ বলাও বিচিত্র নয়। এ ছাড়া এর আরাে বহু সম্ভাব্য অর্থ হয়তাে রয়েছে। আর আমি সর্বনিম্ন আকাশকে জ্যোতিষ্কসমূহ দ্বারা সজ্জিত করেছি (শয়তান থেকে) নিরাপত্তার খাতিরে সর্বনিম্ন আকাশেরও কোনাে নির্দিষ্ট একটামাত্র অর্থ নয়। হতে পারে এটা আমাদের নিকটতম ছায়াপথ, যার দূরত্বের পরিমাণ এক লক্ষ মিলিয়ন আলােক বর্ষ। এ দ্বারা অন্য কিছুকেও বুঝানাে হয়ে থাকতে পারে। যার ভেতরে হয়তাে গ্রহ-উপগ্রহ রয়েছে এবং প্রদ্বীপের আকারে আমাদেরকে আলাে বিতরণ করছে। ‘নিরাপত্তার খাতিরেও’ এর অর্থ হলাে, শয়তান থেকে নিরাপদ রাখার উদ্দেশ্যে। কোরআনের অন্যান্য স্থানের সুস্পষ্ট আয়াতসমূহের বক্তব্য থেকেও উক্ত ব্যাখ্যার সমর্থন পাওয়া যায়। শয়তান কে, সে সম্পর্কে আমরা বিস্তারিত কিছু বলতে পারি না। কোরআনে যে সংক্ষিপ্ত কথাগুলাে এসেছে, সেগুলাে ছাড়া আর কিছুই নিশ্চিতভাবে বলার উপায় নেই। ‘এ হচ্ছে মহাজ্ঞানী ও মহাশক্তিধর (আল্লাহর) ব্যবস্থাপনা।’ বস্তুত এতাে সব জিনিসের নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনা সেই মহাশক্তিধর ও মহাপ্রতাপশালী আল্লাহ ছাড়া আর কি কারাে পক্ষে সম্ভব, যিনি একাই যাবতীয় সম্পদ সভার সম্পর্কে সঠিকভাবে অবহিত?

*আপােষের প্রস্তাবে আল্লাহর রাসূলের জবাব : এই বিশাল বিশ্বজগতে এতবড় তত্ত্বানুসন্ধানী অভিযান পরিচালনা করার পর আল্লাহকে অস্বীকারকারী ও আল্লাহর সাথে শরীক সাব্যস্তকারীদের ভূমিকা কেমন? যেখানে আকাশ ও পৃথিবী তাদের প্রতিপালকের কাছে নতি স্বীকার করে বলে; ‘আমরা স্বেচ্ছায় অনুগত হয়ে এসেছি’ সেখানে এই ক্ষুদ্র ও অক্ষম মানুষ কিনা আল্লাহর সাথে কুফরি করার ধৃষ্টতা দেখায়? এই ধৃষ্টতা ও স্পর্ধার শান্তি কী হওয়া উচিত? মহান আল্লাহ আদ ও সামূদের ইতিহাস বর্ণনা করে এ প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন। ‘এরপরও যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাহলে তুমি বলে দাও আমি তােমাদেরকে আ’দ ও সমূদের ন্যায় দুর্যোগ থেকে সাবধান করে দিয়েছি'(আয়াত ১৩-১৮) ‘তাহলে বলে দাও, আমি তােমাদেরকে আ’দ ও সামূদের ন্যায় দুর্যোগ থেকে সাবধান করে দিয়েছি’- এই ভয়ংকর সতর্ককারী কাফেরদের ধৃষ্টতা ও অপরাধের ভয়াবহতার সাথে সংগতিপূর্ণ। সূরার শুরুতেই তাদের এই অপরাধ ও ধৃষ্টতার উল্লেখ রয়েছে। সেই সাথে মানবজাতির মধ্য থেকে যারা কুফরী করেছে, তারা যে গােটা সৃষ্টিজগত থেকে বিচ্ছিন্ন, সে কথাও জানানাে হয়েছে এই সতর্কবাণী উচ্চারণের আগে। এই সতর্কবাণী কি পরিবেশে উচ্চারিত হয়েছিলো, সে সম্পর্কে ইবনে ইসহাক একটা ঘটনা বর্ণনা করেছেন। ঘটনাটা হলাে, ‘বিশিষ্ট কোরায়শ নেতা ওতবা ইবনে ববীয়া একদিন কোরায়শদের একটা বৈঠকে বসেছিলাে। সে সময় রাসূল(স.) মসজিদুল হারামে একাকী বসেছিলেন। ওতবা বললাে, “শােনাে কোরায়শ বংশধররা! যদি আমি মােহাম্মদের(স.) কাছে গিয়ে একটু কথা বলি এবং তার কাছে আপসের কিছু প্রস্তাব দেই সেটাকে তােমরা সঠিক সিদ্ধান্ত মনে করাে না? সে হয়তাে এসব প্রস্তাবের কোনাে কোনােটা গ্রহণ করবে, এবং আমরা তার মধ্যে যা যা তাকে দেয়া পছন্দ করি দেবাে। এর বিনিময়ে সে হয়তাে আমাদের কাছে ইসলামের দাওয়াত দেয়া থেকে বিরত থাকবে।’ উল্লেখ্য যে, এ সময়ে হযরত হামযা(রা.) ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন এবং রসূল(স.)-এর সাথীদের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছিলাে। লােকেরা ওতবাকে বললাে, ঠিক আছে, আপনি গিয়ে আলােচনা করুন। ওতবা রসূল(স.)-এর কাছে গিয়ে বললাে, শােনাে ভাতিজা, তুমি আমাদের গোত্রের মধ্যে কতটা মর্যাদা রাখো, তা তুমি ভালাে করেই জানাে। কিন্তু তুমি তােমার এমন একটা গুরুতর বাণী নিয়ে এসেছে, যা দ্বারা তুমি তাদের ঐক্যে ভাংগন ধরিয়েছে, তাদের সমাজ ব্যবস্থাকে চূর্ণ করে দিয়েছে, তাদের উপাস্যদের ও তাদের ধর্মের খুঁত বের করেছাে, এবং তাদের মৃত পূর্ব-পুরুষদেরকে বিধর্মী আখ্যায়িত করেছো। এমতাবস্থায় আমি তােমার কাছে কয়েকটা প্রস্তাব নিয়ে এসেছি, তুমি তা মন দিয়ে শেন ও বিবেচনা করাে। হয়তাে তুমি এগুলাের ভেতরে অন্তত কিছু না কিছু গ্রহণ করতে পারবে। রসূল(স.) তাকে বললেন, আচ্ছা বলুন, আমি শুনবাে। সে বললাে! ভাতিজা, তুমি যে বাণী নিয়ে এসেছো, তা দ্বারা তুমি যদি অর্থ উপার্জন করতে চাও, তাহলে আমরা তােমাকে অনেক অর্থ সংগ্রহ করে দেবাে, যাতে তুমি আমাদের ভেতরে সবচেয়ে ধনী হয়ে যাবে। আর যদি তুমি নেতৃত্ব চাও, তাহলে আমরা তােমাকে নেতা বানিয়ে নেবাে। কোনো কাজই তােমাকে বাদ দিয়ে করবাে না। আর যদি তােমার রাজা হবার সখ হয়ে থাকে, তাহলে আমরা তােমাকে রাজা বানাবাে। আর যদি ব্যাপারটা এমন কিছু হয়ে থাকে যে, তােমার কাছে যে অশরীরী আত্মা আসে, তাকে তুমি দেখতে পাও, কিন্তু তুমি ঠেকাতে পারাে না, তাহলে আমরা তােমার জন্যে ডাক্তার কবিরাজ ডাকবাে, এবং যতাে টাকা লাগুক, খরচ করবাে। তবু তােমাকে সুস্থ না করে ছাড়বাে না। জানি, এমন ঘটনাও কখনাে কখনাে ঘটে যে, যে ব্যক্তি কাউকে নিজের অনুগত বানাতে চায়, সে নিজেই তার কাছে পরাভূত হয়ে যায় এবং চিকিৎসা না করালে সে আর তা থেকে মুক্তি পায় না। এ পর্যন্ত বলে ওতবা যখন কথা শেষ করলাে, তখন রসূল(স.) বললেন, আপনার কথা কি শেষ হয়েছে? সে বললাে, হাঁ। আমার কথা শেষ,’ রসূল(স.) বললেন, এখন তাহলে আমি যা বলি শুনুন। সে বললাে, বলাে। রসূল(স.) বিসমিল্লহির রহমানির রহীম’ বলে এই সূরার শুরু থেকে পড়তে শুরু করলেন। ওতবা চুপচাপ করে পিঠের পেছনে হাত দুখানা রেখে তার ওপর ভর দিয়ে শুনতে লাগলো। রসূল(স.) যখন সেজদার আয়াতে পৌছলেন, অমনি সেজদা করলেন। তারপর বললেন, যা শুনলেন, তাতাে শুনলেনই। এখন আপনি ভেবে দেখুন কী করবেন। ওতবা উঠে লােকজনের কাছে চলে গেলাে। ওতবাকে আসতে দেখে কোরায়শরা বলাবলি করতে লাগলাে, আল্লাহর কসম, ওলীদের বাবা যে চেহারা নিয়ে গিয়েছিলাে, এখন আর সে চেহারা নেই। ওতবা তাদের কাছে এসে বসলাে সবাই তাকে বললাে, আপনার কী হয়েছে। সে বললো, কী আর হবে? আমি আজ যে বাণী শুনেছি, তেমন বাণী আর কখনাে শুনিনি। আল্লাহর কসম, এটা যাদুও নয়। কবিতাও নয়, জ্যোতিষীর বাণীও নয়। হে কোরায়শ, তােমরা আমার কথা শােনাে এবং এ ব্যাপারটা আমার ওপর ছেড়ে দাও, এই লােকটা যা করছে করুক। ওর পথ থেকে তোমরা সরে দাঁড়াও। তার যে কথাবার্তা আমি শুনেছি, তার কিছু না কিছু ফল ফলবেই। আরবরা যদি তার ওপর চড়াও হয়, তাহলে তােমাদের কিছু করতে হলাে না। তােমরা নিজেরা কিছু না করেই তার কবল থেকে রেহাই পেয়ে গেলে। আর যদি সে আরবদের ওপর বিজয়ী হয়, তাহলে তার রাজত্ব তােমাদেরই রাজত্ব হবে। তার সম্মান তােমাদেরই সম্মান হবে। তােমরা হবে দুনিয়ার সবচেয়ে সৌভাগ্যশালী জাতি। তারা বললাে, আল্লাহর কসম, হে আবুল ওলীদ, সে তার কথা দিয়ে তােমার ওপর যাদু করেছে। ওতবা বললাে, এ হলাে আমার মত। এখন তােমরা যা ভালাে বুঝ করাে। ইমাম বাগাওয়ী বর্ণনা করেন, হযরত জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ বলেছেন যে, রসূল(স.) আ’দ ও সামুদের বিবরণ সম্বলিত আয়াত পড়তে শুরু করা মাত্রই ওতবা তার মুখ চেপে ধরলো, তার করুণা ভিক্ষা করলাে এবং কোরায়শদের বৈঠকে ফিরে না গিয়ে সােজা নিজের বাড়ীতে চলে গেলাে এবং কোরায়শদের থেকে একটু দূরে দূরে থাকতে লাগলাে। পরে যখন ওরা এ বিষয়ে আলাপ আলােচনা করছিলাে তখন ও বলতে শুরু করলাে, আমি সংগে সংগে তার মুখের ওপর হাত রেখে দিলাম এবং তার জাতির ওপর রহম করার জন্যে তাকে অনুরােধ করলাম। তাকে মিনতি করে বললাম, যেন সে থেমে যায়। অতপর সে বললাে, তােমরা তাে জানই যে মােহাম্মদ যখন যা কিছু বলেছে কখনই মিথ্যা কথা বলেনি। এ জন্যে আমার ভয় হলাে যে অবশ্যই তােমাদের ওপর আযাব নাযিল হয়ে যাবে।’ এটা ছিলাে একটা বাস্তব ঘটনা, তারা জানতে এবং বিশ্বাস করতাে যে রসূল(স.)-এর মুখ দিয়ে কোনাে কথা বের হলে তা কখনাে মিথ্যা হয় না। যে ব্যক্তি ঈমান আনেনি তার অন্তরেও এ কথাটা জাগ্রত ছিলাে। এ বর্ণনাটিকে আমরা আরও একটু গভীরভাবে বুঝতে চাই। বাহ্যিক দিক দিয়ে যে কথাগুলাে বুঝা যাচ্ছে তার ওপরেই আমরা কথাটাকে ছেড়ে দিতে চাই না। আসুন আমরাও আমাদের প্রিয় নবী(স.)-এর চেহারার সামনে একবার দাঁড়াই। ও যখন এই কথাগুলাে বলছিল এবং সেই ছােট্ট ঘটনাটি উল্লেখ করছিলাে, তখন তার চেহারাতে যে পরিবর্তন দেখা যাচ্ছিলাে তার থেকে তার অন্তরের অবস্থা ছিলাে আরও বেশী প্রভাবিত, যার কারণে তার মুখ দিয়ে সেই কথাগুলােই বের হচ্ছিলাে। তার হৃদয় মুহমূহ প্রকম্পিত হচ্ছিলাে যার চিহ্ন তার চেহারাতে ফুটে উঠছিলাে। কিন্তু রাসূল(স.) ধীর স্থিরভাবে ও নির্লিপ্ত মনে এই অবস্থাটি পর্যবেক্ষণ করছিলেন, প্রশান্ত বদনে তার কথাগুলাে শুনছিলেন। সত্যের মধুর পরশে তিনি ছিলেন পরিতৃপ্ত। তিনি ছিলেন ধীর স্থির ও দরদী। তিনি ওতবার সাথে কথা বলার সময় কোনাে ব্যস্ততা প্রদর্শন করছিলেন না। তার কথাগুলো মনােযােগ দিয়ে এবং পুরােপুরিই শুনছিলেন ও শান্তডাবে তার জবাব দিচ্ছিলেন। এতবার কথা শেষ হলে তখন অত্যন্ত শান্তভাবে ও দৃঢ়কণ্ঠে খুবই শালীনতার সাথে বললেন, ‘আবু ওয়ালীদ আপনার কথা শেষ হয়েছে কি? সে বললাে,হাঁ, তখন রসূল(স.) বললেন, তা হলে এবার আমার কথা শুনুন। এরপর নবী(স.) নিজের থেকে আর কোনাে কথা না বলে পরিপূর্ণ বিশ্বাস ও গভীর আবেগের সাথে আলােচ্য সূরাটি তেলাওয়াত করতে শুরু করলেন। প্রশান্ত বদনে ও মধুর কণ্ঠে উচ্চারিত মহান আল্লাহর বাণী দিগন্ত বলয়ে আকাশ বাতাস মুখরিত করে ছড়িয়ে পড়ছিলাে। “বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম, হামীম… ওতবার ভীত প্রকম্পিত বিহ্বল চিত্তে উচ্চারিত সেই আয়াতগুলাে মধুর পরশ, বুলিয়ে দিলাে। সে শুনছিলাে আর তার মন ডেকে বলছিলাে আহা, একি মধুর বাণী, অপূর্ব এর সূর লহরী, কী মায়াভরা কথা, কী সম্মােহনী মমতা বহন করছে এ বাণীর প্রতি ছত্র। সে আপনহারা হয়ে শুনছিলাে আর ভাবের আবেগে দুলছিলাে। হাঁ, এ বাণী চিরদিন সকল শ্রোতার হৃদয়ে মধু ঝরায়। যারা এ বাণী উপেক্ষা করে, ঠাট্টা মস্কারি করে, কিন্তু এ বাণী শােনার পর তাদের হঠকারী হৃদয়েগুলােও বিগলিত হয়ে যায়। আল্লাহ রব্বুল আলামীন রহমত বর্ষণ করুন আপন নবীর ওপর, মহান আল্লাহ যথার্থই বলেছেন, ‘আল্লাহ তায়ালাই সবচেয়ে ভালাে জানেন রিসালাত কার কাছে নাযিল করতে হয়।’   *অহংকারের কারণে ধ্বংসপ্রাপ্ত আদ ও সামুদ জাতি : এই ছােট্ট ঘটনাটি থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে আমরা পুনরায় পাক পরওয়ারদেগারের মহান বাণী আল কোরআনের আলােচ্য আয়াতগুলাের দিকে প্রত্যাবর্তন করি, ‘(হে রাসূল) এরপরও যদি ওরা ফিরে যায় তাহলে তুমি বলাে, আমি তােমাদেরকে সেই ভীষণ আযাবের ভয় দেখাচ্ছি যা আদ ও সামূদ জাতির ওপর নেমে এসেছিলাে…’ ওপরের আয়াতে যে আযাবের ভয় দেখানাে হয়েছে তার দ্বারা অতীতের গযবপ্রাপ্ত জাতিসমূহের দিকে ইংগিত করা হয়েছে। তারপর আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সম্মিলিত রাজ্যের ক্ষমতা কার হাতে রয়েছে সে বিষয়ে চিন্তা করতে আহ্বান জানানাে হচ্ছে। বিশাল এ সাম্রাজ্য সম্পর্কে যখন সে ক্ষমতাগর্বী ও অপরিণামদর্শী ব্যক্তিরা চিন্তা করে তখন তাদের হৃদয় কম্পিত হয় এবং তাদের দর্প চূর্ণ হয়ে যায়। তাই এরশাদ হচ্ছে, ‘স্মরণ করাে সেই সময়ের কথা যখন আল্লাহর রসূলরা তাদের কাছে তাদের সামনে থেকে ও পেছন থেকে এসেছেন এবং বলেছেন, আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কারও এবাদত করাে না।’ এই একটি কথা এবং একই দাওয়াত নিয়ে সকল রসূলরা এসেছেন, এই একই কথার ওপর। তাদের দাওয়াতের বুনিয়াদ স্থাপিত হয়েছে। ‘ওরা বললাে, যদি আল্লাহ তায়ালা (আমাদের ঈমান গ্রহণ করাটা) চাইতেন তাহলে অবশ্যই তিনি কোনাে ফেরেশতা নাযিল করতেন, সুতরাং তােমরা যা কিছু নিয়ে প্রেরিত হয়েছ তা আমরা মানি না।’ সকল রসূলকেই তাদের জাতির কাছ থেকে এসব সন্দেহের কথা শুনতে হয়েছে। কেননা পৃথিবীর শুরু থেকে শেষ রাসূল পর্যন্ত যেতে রাসূল এসেছেন সবাই মানুষ হিসেবেই এসেছেন। জনগণ তাদেরকে চিনতাে এবং তারাও দেশবাসীকেও চিনতেন। মানুষ দেখেছে সবার দাওয়াত যেমন এক, তেমনি সবার উদ্দেশ্য ও আদর্শও এক। প্রত্যেক নবী তাঁর জাতিকে একই পথের দিকে আহবান করেছেন। আ’দ ও সামূদ জাতি তাদের নিজ নিজ নবীকে এই কথা বলে অস্বীকার করার ঘােষণা দিয়ে দিয়েছিলাে যে, তারা মানুষ ছিলেন-ফেরেশতা নয়, কারণ তারা মনে করতাে ফেরেশতা ছাড়া আর কেউ রসূল হতে পারে না। এই কারণেই দেখা যায় কি ভয়ংকর হয়েছিলাে তাদের পরিণতি। উভয় জাতির একই পরিণতি হয়েছিলো। একটি নির্দিষ্ট সময় পর তাদেরকে বজ্রাঘাত পাকড়াও করেছিলাে। এরপর তাদের প্রত্যেকের কাহিনী মােটামুটি বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। ‘আ’দ জাতির অবস্থা হচ্ছে এই যে তারা পৃথিবীর বুকে অন্যায়ভাবে অহংকার করেছিলো এবং বলেছিলাে কে আছে আমাদের থেকে বেশী শক্তিশালী?’ কিন্তু প্রকৃত সত্য হচ্ছে, বান্দারা আল্লাহর কাছে নত হয়ে থাকবে এবং কখনও পৃথিবীতে অহংকার করবে না। যদি সত্যি সত্যিই কেউ কোনাে দিক দিয়ে সামান্য একটু বড় হয়েও থাকে, কিন্তু আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের বড়ত্বের কাছে তার কী প্রাধান্য থাকতে পারে! আসলে জগতে যে যতাে দিক দিয়েই নিজেকে বড় মনে করতে চাক না কেন, সবাই তা অকারণেই করে। এ জন্যে দেখা গেছে, যখনই কেউ অহংকার করেছে সে তখন চরম ধোকা খেয়েছে। কি ঔদ্ধত্যই না আ’দ ও সামূদ জাতির লােকেরা দেখিয়েছে। তারা বলেছে, আমাদের থেকে বেশী শক্তিশালী আর কে আছে?’ বরাবরই পৃথিবীর অহংকারী ব্যক্তিরা এই অলীক দম্ভে লিপ্ত থাকে। এ হচ্ছে এমন এক চেতনা যা কারাে মনে থাকলে সে কাউকে কেয়ার করে না এবং তার থেকে বড় বা বেশী শক্তিশালী কেউ আছে এটা সে চিন্তাই করতে পারে না, এধরনের ব্যক্তিরা তাদের সীমাবদ্ধতা ভুলে যায় । তাই এরশাদ হচ্ছে, ‘ওরা কি দেখছে না যে আল্লাহ তায়ালা সেই মহান সত্ত্বা যিনি তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, যিনি সৃষ্টিকারী তিনি কি ওদের থেকে বেশী শক্তিশালী নন?’ এই কথাটাই একমাত্র যুক্তিপূর্ণ কথা যিনি প্রথম তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, অস্তিত্বহীনতা থেকে অস্তিত্বে এনেছেন, অবশ্যই তিনি তাদের থেকে বেশী শক্তিশালী, যেহেতু তিনিই তাদেরকে সেই সীমাবদ্ধ শক্তি সামর্থ ও মর্যাদা দিয়েছেন। কিন্তু অহংকারী মানুষেরা চিন্তা করে না। তাদের সম্পর্কে বলা হয়েছে আমার আয়াত (আমার ক্ষমতার নিদর্শন) গুলােকে তারা অস্বীকার করতাে। আমি সর্বশক্তিমান আল্লাহ। তাদেরকে আমি আমার সৃষ্টির সেরা বানিয়েছি, তাদেরকে জ্ঞান বুদ্ধি বিবেক, শক্তি ও সামর্থ দিয়েছি। তাদেরকে আমার নিজ মেহেরবানী বলে স্বাস্থ্য ও সৌন্দর্য দিয়েছি, এসব কিছুই আমি দিয়েছি এক নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে। কিন্তু এ সব হিসাব নিকাশ না করে তারা আমার সামনে অহংকার দেখায়। আমার সামনে তাদের পেশী শক্তি প্রদর্শনী করে? কোন শক্তির প্রদর্শনী তারা করে? তাহলে সেই অর্বাচীন, অপরিণামদর্শী, অকৃতজ্ঞ ও সংকীর্ণমনা নাফরমান মানুষগুলাে পারলে আমার শাস্তিকে প্রতিরােধ করুক, সেসব আযাবকে ঠেকিয়ে রাখুক যার বর্ণনা পরে আসছে। অতপর তাদের ওপর আমি কতিপয় দুর্লক্ষুণে দিনে প্রচন্ড এক তীব্র বাতাস পাঠালাম। যাতে করে তাদেরকে আমি দুনিয়ার বুকে অপমানজনক শাস্তির স্বাদ গ্রহণ করাতে পারি। অর্থাৎ এক ভয়ংকর দিনে তাদের ওপর দিয়ে যে প্রচন্ড ঘূর্ণিঝড় প্রবাহিত করা হয়েছিলাে। তাতে তারা সবাই হালাক হয়ে গিয়েছিলাে, এ ঘটনা পৃথিবীর মানুষের কাছে অজানা নয়। কোনাে জাতির জন্যে এটা এক তুলনাহীন ও নযীরবিহীন অপমান। শক্তিদর্পী, অহংকারী ও নিজেদের প্রাধান্য বিস্তারকারী মানুষের জন্যে এটাই সমুচিত শাস্তি। তারপরও-এ তাে গেলাে দুনিয়ার জীবনের শাস্তি, আর আখেরাতের শাস্তির ব্যাপারে এরশাদ হচ্ছে, ‘আখেরাতের শান্তি আরও বেশী অপমানজনক এবং সেদিন তাদেরকে কোনাে সাহায্য করা হবে না।’ সামূদ জাতির কথাও (একবার চিন্তা করা দরকার।) আমি তাদেরকে সঠিক পথ দেখিয়েছিলাম, কিন্তু তারা হেদায়াতের ওপর তাদের জাহেলিয়াতকে প্রাধান্য দিলাে, সঠিক পথে চলার তুলনায় ভুল পথকেই ভালোবাসলে। তাদের কাছে উটনীর নিদর্শন পাঠানাে হয়েছিলাে। এখানে ইংগিত করা হচ্ছে সেই ঘটনার দিকে এবং যা এসে যাওয়ার পরও তাদের সঠিক পথ প্রাপ্তির প্রশ্নে আর কোনাে বাধাই ছিলাে না। কিন্তু আল্লাহর ক্ষমতার সুস্পষ্ট এই নিদর্শন এসে যাওয়ার পরও এ দাওয়াতকে তারা প্রত্যাখ্যান করলাে এবং এরপরও তারা কুফরী করলাে। আর এটা সত্য কথা যে, হেদায়াতের ওপর অন্ধত্বকে অগ্রাধিকার দেয়া এবং হেদায়াত লাভ করার পর গােমরাহী পছন্দ করা হচ্ছে সবচেয়ে বড় অন্ধত্ব। এর ফলে তাদেরকে তাদের শাস্তিস্বরূপ অপমানের আযাব পাকড়াও করলাে।’ সেই হতভাগাদের জন্যে এই অপমানই হলাে অধিকতর উপযােগী অবস্থা। এটা শুধু আযাব বা ধ্বংসই নয়, বরং ঈমানের নেয়ামত লাভ করার পর অন্ধত্বকে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে তাদের এমন এক অপরাধ যার কারণে তাদেরকে কঠিন শাস্তির সাথে ভীষণ অপমানও দেয়া হয়েছে। এরশাদ হচ্ছে, ‘আমি তাদেরকে বাঁচিয়ে নিলাম যারা ঈমান এনেছিলাে এবং তাকওয়া হাসিল করেছিলাে।’ এ আ’দ ও সামূদ জাতির ইতিহাস বর্ণনার সাথে এ পর্যায়ের আলােচনা সমাপ্ত হচ্ছে।

*আল্লাহর দরবারে মানুষের অংগ প্রত্যংগের সাক্ষ্য : অতপর তাদেরকে ভয়ানক আযাবের সংবাদ শুনিয়ে সতর্ক করা হচ্ছে। তাদের সামনে আল্লাহর ক্ষমতার কথা পেশ করা হচ্ছে, যার শক্তি ক্ষমতাকে কেউই প্রতিহত করতে পারে না। কোনাে দূর্গ এমন নেই যার মধ্যে আশ্রয় নিয়ে তাঁর আযাব থেকে কেউ রেহাই পেতে পারে। তার আযাব এসে যাওয়ার পর কোনাে অহংকারী ও স্বেচ্ছাচারী ব্যক্তি সে আযাবকে খন্ডনও করতে পারে না। এতােটুকু আলােচনার পর আমরা বুঝতে পারছি যে, সেই হঠকারী ব্যক্তিদের কাছে সারা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা আল্লাহরর ক্ষমতা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিলাে। মানব জাতির যে ইতিহাস আমাদের সামনে আজ রয়েছে, তার থেকে পরিষ্কারভাবে আমরা আল্লাহর ক্ষমতার কথা বুঝতে পারি। এ ইতিহাস থেকে আমরা এও জানতে পারি যে, মানব জাতির মধ্যে কেউ এমন নেই, যে বলতে পারে যে, তার নিজের শরীরের ওপর তার সামান্য কর্তৃত্ব রয়েছে; বরং তার প্রতিটি অংগ প্রত্যংগ সদা সর্বদা আল্লাহর হুকুম মেনে চলছে। আল্লাহর ইচ্ছা এখতিয়ার উপেক্ষা করে কেউ নিজেদের শরীর বাঁচাতে পারে না। এমনকি তাদের কান, তাদের চোখ, তাদের শরীরের ত্বক সবই সদা-সর্বদা একমাত্র আল্লাহরই হুকুম মেনে চলে এবং তার নিয়মের বাইরে এদের চালাতে চাইলে তার সাথে সাথেই বাধা হয়ে দাঁড়ায়। দুনিয়ায় এদেরকে আল্লাহর ইচ্ছার বিরুদ্ধে চালাতে চাইলে কেয়ামতের দিন এরা সবাই তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে। তাই এরশাদ হচ্ছে, ‘যখন আল্লাহর দুশমনদেরকে দোযখের দিকে নিয়ে যাওয়া হবে… তারা নিজেদের দোষ খন্ডন করতে চাইবে। তখন তারা কাউকে দোষারােপ করে নিজেদের দোষ মুক্তির কোনাে সুযােগ পাবে না।’(১৯-২৪) সেই কঠিন দিনে হঠাৎ করেই মানুষ আল্লাহর দরবারে হাযির হয়ে যাবে। তখন তাদের সেই শরীর যার প্রত্যেকটি অংগ প্রত্যংগের ওপর আল্লাহর কর্তৃত্ব বহাল রয়েছে। তারা তাঁরই আনুগত্য করবে এবং তার হুকুমই তারা পালন করতে থাকবে। আর এই অংগ-প্রতংগগুলাে মানুষদেরকে দোষারােপ করতে গিয়ে বলবে যে, অবশ্যই তারা আল্লাহর দুশমন। আল্লাহর এসব দুশমনদের যায়গা আর কোথায় হবে? অবশ্যই ওদেরকে আল্লাহর দরবারে হাযির করা হবে, তাদেরকে সেনা বাহিনীর মতাে একত্রিত করা হবে, আনা হবে প্রথম দলকে পরবর্তী দলের ওপর এবং পরবর্তী দলকে প্রথম দলের ওপর। কোন দিকে নেয়া হবে তাদেরকে দোযখের (আগুনের) দিকে। সেখানে জীবিত অবস্থাতেই তাদেরকে হাযির করা হবে এবং তাদের বিচার শুরু হয়ে যাবে। যারা তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে তাদেরকে কিন্তু কোনাে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে না এবং তাদের থেকে কোনাে হিসাবও নেয়া হবে না। সেদিন তাদের জিহ্বাকে বেঁধে দেয়া হবে, সেগুলাে সেদিন কথা বলতে পারবে না, কারণ এই জিহ্বাগুলােই একদিন তাদের অস্থায়ী মালিকের গােলামী করতে গিয়ে মিথ্যা কথা উচ্চারণ করেছে, অপরকে মিথ্যা অপবাদ দিয়েছে এবং সত্যপন্থীদেরকে ঠাট্টা-মস্কারি করেছে। আজ তাদের কান, চোখ ও চামড়া তাদের রবের প্রতি আনুগত্যবােধ নিয়ে ও তার ডাকে সাড়া দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে নালিশ দায়ের করবে। সেই সময়ে সে গােপনে যেসব চিন্তা ভাবনা করেছে সেগুলোও আজ আপনা থেকেই প্রকাশিত হয়ে যাবে। দুনিয়ার জীবনে তারা তাদের মনের মধ্যে অনেক কথা লুকিয়ে রাখতো এবং আল্লাহর থেকে সেই বিষয়গুলােকে আড়াল করে রাখতাে, আর ভাবতাে যে তিনি ওগুলাে দেখতে পাচ্ছেন না। কোনাে সময়েই তাে তারা তাদের ইচ্ছা ও অপরাধগুলােকে আল্লাহর কাছে গােপন রাখতে পারতাে না দুনিয়াতে তাদের চোখ, কান ও ত্বক থেকেও তাে সেগুলাে গােপন রাখতে পারতাে না! এ অংগ-প্রত্যংগের কী সম্পর্ক ছিলাে তাদের সাথে? বরং আরও বলা যায়, শরীরের কেমন অংশ ছিলাে? আজকে ওরা বুঝবে যে, গােটা সৃষ্টি থেকে নিজেদেরকে যতােই তারা আড়াল করে রাখুক না কেন এবং রব্বুল আলামীন থেকে ওরা যতােই আত্মগোপন করার চেষ্টা করুক না কেন, সেই কঠিন দিনে তা ওদেরকে লজ্জিত করেই ছাড়বে। আল্লাহ রব্বুল আলামীনের এই গােপন ক্ষমতার পরিধি কতাে বিশাল। তার সর্ববিজয়ী ক্ষমতা তাদের সকল অংগ প্রত্যংগের ওপর পরিব্যাপ্ত হয়ে রয়েছে। সুতরাং তাদের জন্যে বুদ্ধিমানের কাজ হবে যে, আজ সময় থাকতেই তারা মহান আল্লাহর ডাকে সাড়া দেবে এবং সাথে সাথে তার হুকুম পালনে এগিয়ে আসবে। এরশাদ হচ্ছে, ‘তারা তাদের জিহবাসমূহকে বলবে, আমাদের বিরুদ্ধে কেন তােমরা সাক্ষ্য দিলে?’ দুনিয়ার জীবনে তাদের কাছে যেসব তথ্য ছিলাে গােপন সেগুলাে আজ সঠিকভাবে ও সরাসরি তাদের মুখের ওপর এসে হাযির হবে। এখানে কোনাে ধোকাবাজি বা কারাে কোনাে তােষামােদি ভূমিকা থাকবে না। এ জন্যে জওয়াব দিতে গিয়ে বলা হয়েছে, ‘ওরা বলবে, আমাদের কথা বলার ক্ষমতা দিয়েছেন স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা যিনি সকল কিছুকে কথা বলার যােগ্যতা দিয়েছেন। তিনি এ ছাড়া আরও অনেক কিছু করতে সক্ষম (যা আমরা জানি না) অবশ্যই তিনি সবাইকে কথা বলার তাওফীক দিয়েছেন, তিনি বলেছেন, ‘তিনিই প্রথমবারে তােমাদের সৃষ্টি করেছেন আর তার কাছেই তােমাদের ফিরে যেতে হবে।’ অর্থাৎ, যিনি অস্তিত্ব দান করেছেন, তার কাছেই ফিরে যেতে হবে, তার পাকড়াও থেকে প্রথমে বা পরে কেউ পালাতে পারবে না আজকে তারা যুক্তি-বুদ্ধি খাটিয়ে যেগুলাকে অস্বীকার করছে, কেয়ামতের দিন তাদের গায়ের চামড়াও সেগুলােরই সত্যতা জানাবে। তাদের সম্পর্কে আল কোরআনে যেসব কথা বলা হয়েছে তা চিরদিন মানুষের জন্যে শিক্ষণীয় বিষয় হয়ে থাকবে, আলােচ্য আয়াতে তাদের সেই অদ্ভুত আচরণের ওপর কী চমৎকারভাবে মন্তব্য করা হয়েছে, ওদেরকে লক্ষ্য করে বলা হবে, ’আর তােমরা তাে (পৃথিবীতে থাকাকালে) কিছুতেই তােমাদের কান, চোখ ও চামড়া থেকে তােমাদের অপকর্মগুলােকে গােপন রাখতে পারতে না এবং এ নিশ্চয়তা লাভ করতে পারতে না যে তারা কোনােদিন তােমাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে না।’ অর্থাৎ পৃথিবীর জীবনে তােমাদের মনে একথা কখনও জাগেনি যে, তােমাদের নিজেদের শরীরের অংগ প্রত্যংগ কোনাে সময়ে তােমাদের বিরুদ্ধে কথা বলবে, আর সত্যিকারে বলতে কি, চাইলেও তােমাদের নিজেদের শরীরের কাছে কোনাে কিছু গোপন রাখা অবশ্যই তােমাদের সাধ্যের বাইরে ছিলাে। তাই এরশাদ হচ্ছে, ‘বরং তোমরা ধারণা করছিলে যে, তােমরা যা কিছু করছো তার অধিকাংশই আল্লাহ তায়ালা জানেন না।’ দুনিয়ার জীবনে তােমাদের অজ্ঞতাপূর্ণ ও অপরাধজনক এই ধারণাটাই তােমাদেরকে ধোকার মধ্যে ফেলে রেখেছিলাে এবং তাই তােমাদেরকে আজ জাহান্নামের দিকে এগিয়ে দিয়েছে। এরশাদ হচ্ছে, ‘ওটাই ছিলাে তােমাদের রব সম্পর্কে তােমাদের ধারণা, যা তােমাদেরকে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে দিয়েছিলাে, অতপর তােমরা পরবর্তীতে এক ক্ষতিগ্রস্ত জনপদে পরিণত হয়ে গিয়েছিলে।’ এরপর আসছে শেষ মন্তব্য, এমতাবস্থায় তারা যদি সবর করে তাহলেও দোযখই হবে তাদের ঠিকানা। হায়, অদৃষ্টের কী পরিহাস! এখানে সবর বলতে বুঝানাে হয়েছে দোযখের মধ্যে ধৈর্য ধরে অবস্থান করা। যদিও এ সবর সে সবর নয়, যার পর প্রশস্ততা ও সচ্ছলতা সুন্দর প্রতিদান আসতে পারে। কিন্তু যে সবরের পরিণাম দোযখের স্থায়ী আগুন ছাড়া আর কিছু নয়। এ সবর মানুষকে এক চরম নিকৃষ্ট স্থানে আশ্রয় নিতেই বাধ্য করবে। ওরা যদি এটা ওটা ওর দিয়ে দোষ স্খলন করতে চায় তাহলেও তাদেরকে ছাড়া হবে না, তাদের কোনাে ওযরও তখন কবুল করা হবে না। অর্থাৎ, সে স্থানটি এমন কঠিন হবে যে, সেখানে (সংশােধনের জন্যে) বারবার তিরস্কার করা হবে না, অথবা বারবার তাওবা করার সুযােগও দেয়া হবে না। সাধারণভাবে এটা মনে করা হয় যে, যেখানে তিরস্কার রয়েছে সেখানে ক্ষমা সন্তোষও রয়েছে। অর্থাৎ তিরস্কার ও শাস্তির পরই অন্যায়কারীর অন্যায় ও তার শান্তি লাঘব হয়ে যায়। কিন্তু কেয়ামতের সে ভয়ংকর দিনে এমন কোনাে দোষারােপ করা হবে না যে, এর তার পরবর্তীতে ক্ষমা প্রাপ্তির কোনাে সুযােগও থাকবে।

*পাপীদের সামনে অপরাধকে শােভনীয় করে তােলা : এ আলােচনার পরপরই সেই ব্যক্তিদের অন্তরের মধ্যে আল্লাহ রব্বুল আলামীনের ক্ষমতার কথা জাগিয়ে দেয়া হয়েছে। অথচ দুনিয়ার জীবনে তারা ঈমান আনেনি আর এই জন্যেই আল্লাহ তায়ালা শাস্তিস্বরূপ এমন এক অবস্থা সৃষ্টি করে দিয়েছেন যা তাদের মনের বিশৃংখল অবস্থা প্রকাশ করে দিয়েছে। তাদের পেছনে তিনি জ্বিন ও মানব শয়তানদেরকে লাগিয়ে দিয়েছিলেন যারা তাদের মন্দ কাজগুলােকে তাদের সামনে সুন্দর করে তুলে ধরতাে, অবশেষে তারা এমন কাজ করতাে, যার পরিণতিতে তারা চরম ক্ষতির ভাগী হয়ে যেতাে এবং তাদের জন্যে আযাব আসার কথাটা নির্ধারিত হয়ে যেতাে। এরশাদ হচ্ছে, আমি তাদের পেছনে কিছু সাথী, লাগিয়ে দিয়েছিলাম, যারা তাদের সামনে থেকে ও পেছন দিক থেকে এসে তাদের (অসৎ) কাজগুলােকে তাদের কাছে সুন্দর করে দেখাতাে। এর ফলে তাদের ওপর শান্তির কথা তেমনি করেই বাস্তবায়িত হয়েছিলাে যেমন করে তাদের পূর্বে অনেক জ্বিন ও মানুষের ব্যাপারে তা বাস্তবায়িত হয়েছে। সুতরাং আজ যারা অহংকারের কারণে তাঁর এবাদত থেকে দূরে থাকতে চাইছে তাদের চিন্তা। করা দরকার যে তারা যখন আল্লাহর কবজার মধ্যে গিয়ে পড়বে তখন কি নিদারুণ অবস্থার সম্মুখীনই না তারা হবে! কি ভয়ানক অবস্থা তাদের হবে যখন তাদেরকে আল্লাহর আযাব ও চরম ক্ষতির দিকে টেনে নিয়ে যাওয়া হবে। আজ তাদের পেছনে আল্লাহ তায়ালা এমন কিছু সাথী লাগিয়ে দিয়েছেন যারা তাদেরকে সদা সর্বদা ওয়াসওয়াসা দিয়ে চলেছে এবং তাদের সামনে তাদের সকল কাজকে ওরা এমনভাবে সুন্দর করে তুলছে যে, তারা কতােটা অন্যায়ের মধ্যে ডুবে রয়েছে তা টেরই পাচ্ছে না। মানুষের জন্যে সব চাইতে বড় ক্ষতিকর জিনিস হচ্ছে, সে অন্যায় কাজ করে চলেছে অথচ সে যে অন্যায় করছে তা বুঝতেই পারছে না অর্থাৎ অন্যায়ের অনুভূতি পর্যন্ত তার বিলুপ্ত হয়ে গেছে, বরঞ্চ এসব অন্যায় করার পরও তার নযরে মনে হয়, যা সে করেছে বা করছে তা সবই সুন্দর। অতএব তার জন্যে এটাই হচ্ছে সব চাইতে বড় ধ্বংসাত্মক অবস্থা এবং এই অনুভূতিই তাকে ধ্বংসের চরম গহ্বরে ফেলে দেয়। শুধু তাই নয়, পৃথিবীর মানুষের কাছেও সে নিন্দা ও ধিক্কারের পাত্রে পরিণত হয়ে যায়। তারা সেসব ধ্বংসপ্রাপ্ত মানুষ ও জ্বিন শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায় যাদের ওপর পূর্বেই কঠিন আযাব নাযিল হয়েছে ও তাদেরকে নাস্তানাবুদ করে দেখা হয়েছে। তাই বলা হয়েছে, ‘অবশ্যই ওরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেছে।’

Leave a Reply