(বই#১০৯৩) [ *আপােষের প্রস্তাবে আল্লাহর রাসূলের (সা:) জবাব :-] www.motaher21.net সূরা:৪১:হামীম-আস-সাজদাহ পারা:২৪ ৯-২৫ নং আয়াত:- তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-

أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#১০৯৩)
[ *আপােষের প্রস্তাবে আল্লাহর রাসূলের (সা:) জবাব :-]
www.motaher21.net
সূরা:৪১:হামীম-আস-সাজদাহ
পারা:২৪
৯-২৫ নং আয়াত:-
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
৪১:হামীম-আস-সাজদাহ-৯-১০
# পৃথিবীর বরকতসমূহ অর্থ অঢেল ও সীমা সংখ্যাহীন উপকরণ যা কোটি কোটি বছর ধরে ক্রমাগত পৃথিবীর অভ্যন্তর থেকে বেরিছে আসছে এবং শুধু অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যেই দেখা যায় এমন ক্ষুদ্র কীট থেকে শুরু করে মানুষের উন্নত সভ্যতার দৈনন্দিন চাহিদাসমূহ পূরণ করছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় বরকত হচ্ছে বাতাস ও পানি। কারণ, পানির বদৌলতেই ভূ-পৃষ্ঠে উদ্ভিদ, জীবকূল ও মানুষের জীবন সম্ভব হয়েছে।
# মূল আয়াতের বাক্য হচ্ছে وَقَدَّرَ فِيهَا أَقْوَاتَهَا فِي أَرْبَعَةِ أَيَّامٍ سَوَاءً لِلسَّائِلِينَ এ আয়াতাংশের ব্যাখ্যায় মুফাসসিরগণ কতিপয় স্বতন্ত্র মতামত পেশ করেছেন। কিছু সংখ্যক মুফাসসিরগণ এর অর্থ বর্ণনা করেছেনঃ “পৃথিবীতে প্রার্থীদের সঠিক হিসাব অনুসারে তাদের সমুদয় রিযিক পুরা চার দিনে রাখা হয়েছে।” অর্থাৎ পুরো চার দিনে রাখা হয়েছে এর কম বা বেশী নয়।

ইবনে আব্বাস (রাঃ), কাতাদা ও সুদ্দী এর অর্থ করেনঃ “পৃথিবীতে তার রিযিকসমূহ চার দিনে রাখা হয়েছে। জিজ্ঞেসকারীদের জবাব সম্পূর্ণ হয়েছে।” অর্থাৎ কেউ যদি জিজ্ঞেস করে, এ কাজ কতদিনে সম্পন্ন হয়েছে তার পূর্ণাঙ্গ জবাব হচ্ছে চার দিনে সম্পন্ন হয়েছে। ইবনে যায়েদ এর বর্ণনা করেনঃ “প্রার্থীদের জন্য পৃথিবীতে চার দিনের মধ্যে তাদের রিযিকসমূহ সঠিক পরিমাণে প্রত্যেকের চাহিদা ও প্রয়োজন অনুসারে রেখেছেন।”

ভাষার ব্যাকরণগত নিয়ম অনুসারে আয়াতের বাক্যাংশে এ তিনটি অর্থই গ্রহণ করার অবকাশ আছে। তবে আমাদের মতে প্রথমোক্ত অর্থ দু’টিতে গুণগত কোন বিষয় নেই। স্থান-কাল অনুসারে বিচার করলে এ কথা এমন কি গুরুত্ব বহন করে যে, কাজটি চার দিনের এক ঘণ্টা কমে বা বেশীতে নয় বরং পূর্ণ চার দিনে সম্পন্ন হয়েছে। আল্লাহ‌র কুদরত, রবুবিয়াত ও হিকমতে কি অপূর্ণতা ছিল যা পূরণ করার জন্য এ ব্যাখ্যার প্রয়োজন হবে? আয়াতের পূর্বের ও পরের বিষয়ের মধ্যে কোথাও এমন কোন ইঙ্গিত নেই যা দ্বারা বুঝা যায় তখন কোন জিজ্ঞেসকারী এ প্রশ্ন করেছিলো যে এসব কাজ কতদিনে সম্পন্ন হয়েছিলো যার জবাব দিতে এ আয়াত নাযিল হয়েছিলো। এসব কারণে আমরা অনুবাদের মধ্যে তৃতীয় অর্থটি গ্রহণ করেছি। আমাদের মতে আয়াতের সঠিক অর্থ হচ্ছে, সৃষ্টির সূচনাকাল থেকে কিয়ামত পর্যন্ত যত প্রকারের যত মাখলুক আল্লাহ‌ সৃষ্টি করবেন তাদের প্রত্যেকের সঠিক চাহিদা ও প্রয়োজন অনুসারে খাদ্যের সব সরঞ্জাম হিসাব করে তিনি পৃথিবীর বুকে রেখে দিয়েছেন। স্থলভাগে ও পানিতে অসংখ্য প্রকারের উদ্ভিদ রয়েছে। এদের প্রতিটি শ্রেণীর খাদ্য সংক্রান্ত প্রয়োজন অন্য সব শ্রেণী থেকে ভিন্ন। আল্লাহ‌ বায়ুমণ্ডল, স্থল ও পানিতে অসংখ্য প্রজাতির জীবজন্তু সৃষ্টি করেছেন এবং প্রতিটি প্রজাতিরই স্বতন্ত্র ধরনের খাদ্য প্রয়োজন। তাছাড়া এসব প্রজাতি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের সৃষ্টি মানুষ। মানুষের খাদ্যের প্রয়োজন শুধু দেহের লালন ও পরিপুষ্টি সাধনের জন্যই নয়, তার রুচির পরিতৃপ্তির জন্যও নানা রকম খাদ্যের প্রয়োজন। আল্লাহ‌ ছাড়া আর কার পক্ষে জানা সম্ভব ছিল মাটির তৈরী এই গ্রহটির ওপরে জীবনের উৎপত্তি থেকে শুরু করে তার পরিসমাপ্তি পর্যন্ত কোন্‌ কোন্‌ শ্রেণীর সৃষ্টিকুল কত সংখ্যায় কোথায় কোথায় এবং কোন্‌ কোন্‌ সময় অস্তিত্বলাভ করবে এবং তাদের প্রতিপালনের জন্য কোন্‌ প্রকারের খাদ্য কত পরিমাণে দরকার হবে। নিজের সৃষ্টি পরিকল্পনা অনুসারে যেভাবে তিনি খাদ্যের মুখাপেক্ষী এসব মাখলুককে সৃষ্টি করার পরিকল্পনা করেছিলেন অনুরূপভাবে তাদের চাহিদা পূরণের জন্য খাদ্য সরবরাহেরও পূর্ণ ব্যবস্থা করেছেন।

বর্তমান যুগে যেসব লোক মার্কসীয় সমাজতান্ত্রিক চিন্তার ইসলামী সংস্করণ কুরআনী নেজামে রবুবিয়াতের নামে বের করেছেন তারা سَوَاءً لِلسَّائِلِينَ এর অনুবাদ করেন “সমস্ত প্রার্থীর জন্য সমান” আর এর ওপর যুক্তি প্রমাণের প্রাসাদ নির্মাণ করেন এই বলে যে, আল্লাহ‌ পৃথিবীতে সব মানুষের জন্য সমপরিমাণে খাদ্যের ব্যবস্থা করেছেন। কাজেই আয়াতের উদ্দেশ্য পূরণার্থে এমন একটি রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রয়োজন যা সবাইকে খাদ্যের সমান রেশন সরবরাহ করবে। কারণ, এই কুরআন যে সাম্য দাবী করে ব্যক্তি মালিকানা ব্যবস্থায় তা কায়েম হতে পারে না। কিন্তু কুরআনের দ্বারা নিজেদের মতবাদসমূহের খেদমত করানোর অতি আগ্রহে তারা এ কথা ভুলে যান যে سائِلِينَ বা প্রার্থী বলে এ আয়াতে যাদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে তাদের মধ্যে শুধু মানুষ নয় বিভিন্ন শ্রেণীর অন্যান্য সৃষ্টিও রয়েছে, জীবন ধারণের জন্য যাদের খাদ্যের প্রয়োজন। আল্লাহ‌ কি প্রকৃতই এসব সৃষ্টির মধ্যে কিংবা তাদের এক একটি শ্রেণীর সবার মধ্যে জীবনোপকরণের ক্ষেত্রে সাম্যের ব্যবস্থা রেখেছেন। প্রকৃতির গোটা ব্যবস্থাপনায় কোথাও কি আপনি সমানভাবে খাদ্য বন্টনের ব্যবস্থা দেখতে পান? প্রকৃত ব্যাপার যদি তা না হয়ে থাকে তাহলে তার অর্থ হচ্ছে, উদ্ভিদ এবং জীবজগতের মধ্যে, যেখানে মানুষের পরিচালিত রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা নেই, বরং আল্লাহ‌র রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা সরাসরি রিযিক বন্টনের ব্যবস্থা করেছে সেখানে আল্লাহ‌ নিজেই এই “কুরআনী বিধান” লংঘন করেছেন— এমনকি (নাউযুবিল্লাহ) বে-ইনসাফী করেছেন? তারা এ কথাও ভুলে যায়, মানুষ যে সব জীবজন্তু পালন করে এবং যাদের খাদ্য যোগানোর দায়িত্ব মানুষেরই তারাও سائِلِينَ এর অন্তর্ভূক্ত। যেমনঃ ভেড়া, বকরী, গরু, মোষ, ঘোড়া, গাধা, খচ্চর ও উট প্রভৃতি। সব প্রার্থীকে সমান খাদ্য দিতে হবে এটাই যদি কুরআনী বিধান হয় এবং এ বিধান চালু করার জন্য “নেজামে রবুবিয়াত” পরিচালনাকারী একটি রাষ্ট্রের প্রয়োজন থাকে তাহলে সেই রাষ্ট্র কি মানুষ এবং এসব জীবজন্তুর মধ্যেও আর্থিক সাম্য প্রতিষ্ঠিত করবে?
# এ স্থানের ব্যাখ্যায় সাধারণভাবে মুফাস্‌সিরদেরকে একটি জটিলতার সম্মুখীন হতে হয়েছে। জটিলতাটি হচ্ছে, যদি পৃথিবী সৃষ্টির দুই দিন এবং সেখানে পাহাড় স্থাপন, বরকত দান এবং খাদ্যোপকরণ সৃষ্টির জন্য চার দিন ধরা হয় সেক্ষেত্রে পরে আসমান সৃষ্টির জন্য যে দুই দিনের কথা বলা হয়েছে সেই দুই দিনসহ মোট আট দিন হয়। কিন্তু আল্লাহ‌ কুরআন মজীদের বেশ কিছু জায়গায় সুস্পষ্টভাবে বলেছেন যে, পৃথিবী ও আসমান সর্বমোট ছয় দিনে সৃষ্টি করা হয়েছে (উদাহরণস্বরূপ দেখুন, তাফহীমুল কুরআন— সূরা আল আরাফ ৫৪, সূরা ইউনুস ৩, সূরা হুদ ৭ এবং সূরা আল ফুরকান ৫৯ আয়াতসমূহ।)

এ কারণে প্রায় সমস্ত মুফাস্‌সিরই বলেনঃ এই চার দিন পৃথিবী সৃষ্টির দু’দিন সহ। অর্থাৎ পৃথিবী সৃষ্টির দু’দিন এবং উপরে যেসব জিনিসের উল্লেখ করা হয়েছে পৃথিবীতে সেসব জিনিস সৃষ্টির জন্য আরো দু’দিন। এভাবে মোট চার দিনে পৃথিবী তার সব রকম উপায়-উপকরণসহ পরিপূর্ণতা লাভ করেছে। কিন্তু একদিকে এটা কুরআন মজীদের বাহ্যিক বক্তব্যের পরিপন্থী আর মূলত যে জটিলতা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এই ব্যাখ্যার প্রয়োজন অনুভূত হয়েছে তা একান্তই কাল্পনিক। যে দুদিনে সামগ্রিকভাবে গোটা বিশ্ব-জাহান সৃষ্টি করা হয়েছে মূলত পৃথিবী সৃষ্টির দু’দিন তা থেকে ভিন্ন নয়। পরবর্তী আয়াতসমূহ নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করুন দেখতে পাবেন সেখানে একসাথে পৃথিবী ও আসমান সৃষ্টির কথা বলা হয়েছে। তারপর বলা হয়েছে, আল্লাহ‌ দু’দিনে সাত আসমান নির্মাণ করেছেন। এই সাত আসমান বলে বুঝানো হয়েছে গোটা বিশ্ব-জাহান, আমাদের এই পৃথিবীও যার একটা অংশ। তারপর যখন বিশ্ব-জাহানের অন্যান্য অসংখ্য তারকা ও গ্রহের মত এই পৃথিবীও উক্ত দু’দিনে একটি গ্রহের আকৃতি ধারণ করলো। তখন আল্লাহ‌ সেটিকে জীবকুলের জন্য প্রস্তুত করতে শুরু করলেন এবং চার দিনের মধ্যে সেখানে সেই সব উপকরণ সৃষ্টি করলেন পূর্বোক্ত আয়াতে যার উল্লেখ করা হয়েছে। এ চার দিনে অন্যান্য তারকা ও গ্রহের কি উন্নয়ন সাধন হয়েছে আল্লাহ‌ এখানে তা উল্লেখ করেননি। কারণ যে যুগে কুরআন নাযিল হয়েছিলো সেই যুগের মানুষ তো দূরের কথা এ যুগের মানুষও সে সব তথ্য হজম করার সামর্থ্য রাখে না।
৪১:হামীম-আস-সাজদাহ-১১
# এখানে তিনটি বিষয় স্পষ্ট করে দেয়া প্রয়োজন। এক, এখানে আসমান অর্থ সমগ্র বিশ্ব-জাহান। পরবর্তী আয়াতাংশ থেকে তা সুস্পষ্ট বুঝা যায়। অন্য কথায় আসমানের দিকে মনোনিবেশ করার অর্থ হচ্ছে আল্লাহ‌ বিশ্ব-জাহান সৃষ্টির দিকে মনোনিবেশ করলেন।

দুই, বিশ্ব-জাহানকে আকৃতি দানের পূর্বে তা আকৃতিহীন ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত গোধূলির মতো মহাশূন্যে বস্তুর প্রাথমিক অবস্থায় ছড়ানো ছিল। ধোঁয়া বলতে বস্তুর এই প্রাথমিক অবস্থাকে বুঝানো হয়েছে। বর্তমান যুগের বৈজ্ঞানিকগণ এ জিনিসকেই নীহারিকা (Nebula) বলে ব্যাখ্যা করেন। বিশ্ব-জাহান সৃষ্টির প্রারম্ভিক পর্যায় সম্পর্কে তাদের ধ্যান-ধারণাও হচ্ছে, যে বস্তু থেকে বিশ্ব-জাহান সৃষ্টি হয়েছে সৃষ্টির পূর্বে তা এই ধোঁয়া অথবা নীহারিকার আকারে ছড়ানো ছিল।

তিন, “তারপর তিনি আসমানের দিকে মনোনিবেশ করলেন” বাক্য দ্বারা এ কথা বুঝা ঠিক নয় যে, প্রথমে তিনি পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন তারপর তার ওপরে পাহাড় স্থাপন, বরকত দান এবং খাদ্য উপকরণ সরবরাহের কাজ সম্পন্ন করেছেন। এসব করার পর তিনি বিশ্ব-জাহান সৃষ্টির প্রতি মনোনিবেশ করেছেন। পরবর্তী বাক্যাংশ “তিনি আসমান ও যমীনকে বললেনঃ তোমরা অস্তিত্ব ধারণ করো। উভয়ে বললো, আমরা অনুগতদের মতই অস্তিত্ব গ্রহণ করলাম” এই ভুল ধারণা নিরসন করে দেয়া এ থেকে এ কথা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, এটি এবং পরবর্তী আয়াতসমূহে সেই সময়ের কথা বলা হচ্ছে যখন আসমান ও যমীন কিছুই ছিল না, বরং বিশ্ব-জাহান সৃষ্টির সূচনা করা হচ্ছিলো শুধু ثم (তারপর, অতঃপর বা পরে) শব্দটিকে এ বিষয়ের প্রমাণ হিসেবে পেশ করা যায় না যে আসমান সৃষ্টির পূর্বেই পৃথিবী সৃষ্টি করা হয়েছিলো। ثم শব্দটি যে অনিবার্যরূপে সময়-ক্রম বুঝাতে ব্যবহৃত হয় না বর্ণনা-ক্রম বুঝাতেও ব্যবহৃত হয় কুরআন মজীদে তার বেশ কিছু উদাহরণ বিদ্যমান। (দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, সূরা যুমার, টীকা নম্বর ১২ )

কুরআন মজীদের ভাষ্য অনুসারে প্রথমে যমীন না আসমান সৃষ্টি হয়েছে প্রাচীন যুগের মুফাসসিরদের মধ্যে এ নিয়ে দীর্ঘদিন পর্যন্ত বিতর্ক চলেছে। একদল এ আয়াত এবং সূরা বাকারার ২৯ আয়াতের মাধ্যমে যুক্তি পেশ করেন যে পৃথিবীই প্রথমে সৃষ্টি হয়েছে। অপর দল সূরা নাযিয়াতের ২৭ থেকে ৩৩ পর্যন্ত আয়াত হতে দলীল পেশ করে বলেন, আসমান প্রথমে সৃষ্টি হয়েছে। কেননা, সেখানে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে আসমানের পরে যমীন সৃষ্টি হয়েছে। তবে প্রকৃত ব্যাপার এই যে, পদার্থ বিজ্ঞান বা জ্যোতির্বিদ্যা শেখানোর জন্য কুরআন মজীদের কোথাও বিশ্ব-জাহান সৃষ্টির বিষয় উল্লেখ করা হয়নি, বরং তাওহীদ ও আখেরাতের আকীদার প্রতি ঈমানের দাওয়াত দিতে গিয়ে আরো অসংখ্য নিদর্শনের মতো যমীন ও আসমানের সৃষ্টির বিষয়টিও চিন্তা-ভাবনা করে দেখার জন্য পেশ করা হয়েছে। এ উদ্দেশ্যে আসমান ও যমীন সৃষ্টির সময়-ক্রম বর্ণনা করে যমীন আগে সৃষ্টি হয়েছে না আসমান আগে সৃষ্টি হয়েছে তার উল্লেখ একেবারেই অপ্রয়োজনীয় ছিল। দু’টি বস্তুর মধ্যে এটি বা সেটি যেটিই প্রথমে সৃষ্টি হয়ে থাকুক সর্বাবস্থায় দু’টিই আল্লাহ‌র একমাত্র ইলাহ্‌ হওয়ার প্রমাণ। তা এ কথাও প্রমাণ করে যে, তাদের সৃষ্টিকর্তা এ সমগ্র কারখানা কোন খেলোয়াড়ের খেলনা হিসেবে সৃষ্টি করেননি। এ কারণেই কুরআন কোন জায়গায় পৃথিবী সৃষ্টির কথা প্রথমে উল্লেখ করে আবার কোন জায়গায় প্রথমে উল্লেখ করে আসমান সৃষ্টির কথা যেক্ষেত্রে মানুষের মনে আল্লাহ‌র নিয়ামতসমূহের অনুভূতি সৃষ্টি উদ্দেশ্য হয় সেক্ষেত্রে সাধারণত যমীন সৃষ্টির উল্লেখ প্রথমে করেন। কারণ, তা মানুষের সবচেয়ে কাছে। আর যেক্ষেত্রে আল্লাহ‌র মহত্ব এবং তাঁর কুদরতের পূর্ণতার ধারণা দেয়া উদ্দেশ্য হয় সেক্ষেত্রে সাধারণত আসমানের উল্লেখ প্রথমে করেন। কারণ, সুদূরবর্তী আসমান চিরদিনই মানুষের মনের ওপর বিরাট প্রভাব বিস্তার করে আছে।
# আল্লাহ্‌ এ আয়াতাংশে তাঁর সৃষ্টি পদ্ধতির অবস্থা এমন ভঙ্গিতে বর্ণনা করেছেন যার মাধ্যমে আল্লাহ‌র সৃষ্টি ও মানবীয় সৃষ্টি ক্ষমতার পার্থক্য পুরোপুরি স্পষ্ট হয়ে যায়। মানুষ যখন কোন জিনিস বানাতে চায় তখন প্রথমেই নিজের মন-মগজে তার একটা নকশা ফুটিয়ে তোলে এবং সেজন্য পরে প্রয়োজনীয় উপকরণ সংগ্রহ করে। তারপর ঐ সব উপকরণকে নিজের পরিকল্পিত নকশা ও কাঠামো অনুসারে বাস্তব রূপ দেয়ার জন্য পরিশ্রম করে ও নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা চালায়। যেসব উপকরণকে সে নিজের মগজে অঙ্কিত নকশায় রূপদানের চেষ্টা করে, চেষ্টার সময় তা একের পর এক বিঘ্ন সৃষ্টি করতে থাকে। কখনো উপকরণের বাঁধা সফল হয় এবং কাঙ্খিত বস্তু পরিকল্পিত নকশা অনুসারে ঠিকমত তৈরী হয় না। আবার কখনো ব্যক্তির প্রচেষ্টা প্রবল হয় এবং সে উপকরণসমূহকে কাঙ্খিত রূপদানে সফল হয়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ কোন দর্জি একটি জামা তৈরী করতে চায়। এজন্য সে প্রথমে তার মন-মগজে জামার নকশা ও আকৃতি কল্পনা করে। তারপর কাপড় সংগ্রহ করে নিজের পরিকল্পিত জামার নকশা অনুসারে কাপড় কাটতে ও সেলাই করতে চেষ্টা করে এবং এই চেষ্টার সময় তাকে উপর্যুপরি কাপড়ের প্রতিবন্ধকতার মোকাবিলা করতে হয়। এমনকি এক্ষেত্রে কখনো দর্জির প্রচেষ্টা সফল হয় এবং সে কাপড়কে তার পরিকল্পিত নকশায় রূপদান করে। এবার আল্লাহ‌র সৃষ্টি পদ্ধতির দিকে লক্ষ্য করুন। বিশ্ব-জাহান সৃষ্টির উপকরণ ধূঁয়ার আকারে ছড়িয়ে ছিলো। বিশ্ব-জাহানের বর্তমান যে রূপ আল্লাহ‌ তাকে সেই রূপ দিতে চাইলেন। এ উদ্দেশ্যে তাকে বসে বসে কোন মানুষ কারিগরের মত পৃথিবী, চাঁদ, সূর্য এবং অন্যান্য তারকা ও গ্রহ-উপগ্রহ বানাতে হয়নি। বরং তাঁর পরিকল্পনায় বিশ্ব-জাহানের যে নকশা ছিল সে অনুসারে তাকে অস্তিত্ব গ্রহণ করতে নির্দেশ দিলেন। অর্থাৎ তিনি যে ছায়াপথ, তারকারাজি এবং গ্রহ-উপগ্রহ সৃষ্টি করতে চাচ্ছিলেন ঐ সব উপকরণ যেন সেই আকৃতি ধারণ করে সেই নির্দেশ দান করলেন। আল্লাহ‌র আদেশের পথে প্রতিবন্ধক হওয়ার ক্ষমতা ঐ সব উপকরণের ছিল না। ঐ উপকরণসমূহকে বিশ্ব-জাহানের আকৃতি দান করতে আল্লাহ‌কে কোন পরিশ্রম করতে ও প্রচেষ্টা চালাতে হয়নি। একদিকে আদেশ হয়েছে আরেকদিকে ঐ সব উপকরণ সংকুচিত ও একত্রিত হয়ে অনুগতদের মত প্রভুর পরিকল্পিত নকশা অনুযায়ী তৈরী হতে শুরু করেছে এবং ৪৮ ঘণ্টায় পৃথিবীসহ সমস্ত বিশ্ব-জাহান সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত হয়ে গিয়েছে। আল্লাহ‌র সৃষ্টি পদ্ধতির এই অবস্থাকে কুরআন মজীদের আরো কতিপয় স্থানে এভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহ‌ যখন কোন কাজ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন তখন শুধু এই নির্দেশ দেন, ‘হয়ে যাও’ আর তখনি তা হয়ে যায়। (দেখুন তাফহীমুল কুরআন, আল বাকারা, টীকা ১১৫ ; আল ইমরান, টীকা ৪৪ ও ৫৩ ; আন নাহল, টীকা ৩৫ ও ৩৬ ; মারয়াম, টীকা ২২ ; ইয়াসীন, আয়াত ৮২ এবং আল মু’মিন, আয়াত ৬৮ )।
৪১:হামীম-আস-সাজদাহ-১২
# এসব আয়াত বুঝার জন্য তাফহীমুল কুরআনের নিম্ন বর্ণিত স্থানসমুহ অধ্যয়ন করা সহায়ক হবেঃ আল বাকারা, টীকা ৩৪ ; আর রা’আদ, টীকা ২ ; আল-হিজর, টীকা ৮ থেকে ১২ ; আল আম্বিয়া, টীকা ৩৪ ও ৩৫ ; আল-মু’মিনুন, টীকা ১৫ ;ইয়াসীন, টীকা ৩৭ এবং আস সাফফাত, টীকা ৫ ও ৬ ।
৪১:হামীম-আস-সাজদাহ-১৩
# যিনি এই পৃথিবী ও সারা বিশ্ব-জাহান সৃষ্টি করেছেন তিনি একাই আল্লাহ‌ ও উপাস্য এ কথা মানে না এবং বাস্তবে যারা তাঁর সৃষ্টি ও দাস তাদেরকে উপাস্য বানাবার এবং আল্লাহ‌র সত্ত্বা, গুণাবলী, অধিকার ও ক্ষমতা-ইখতিয়ারে শরীক করার জন্য জিদ করে যেতে থাকে।
৪১:হামীম-আস-সাজদাহ-১৪
# এ আয়াতাংশের কয়েকটি অর্থ হতে পারে। এক, তাদের কাছে একের পর এক রসূল এসেছেন। দুই, রসূলগণ সব উপায় তাদের বুঝানোর চেষ্টা করেছেন এবং তাদেরকে সঠিক পথে পরিচালনার জন্য কোন উপায় ও পন্থা গ্রহণ করতেই কসুর করেননি। তিন, তাদের নিজ দেশেও তাদের কাছে রসূল এসেছেন এবং তাদের আশেপাশের দেশসমূহেও রসূল এসেছেন।
# আল্লাহ‌ যদি আমাদের এ ধর্ম পছন্দ না করতেন এবং এ ধর্ম থেকে বিরত রাখার জন্য আমাদের কাছে কোন রসূল পাঠাতে চাইতেন তাহলে ফেরেশতা পাঠাতেন। তোমরা যেহেতু ফেরেশতা নও, বরং আমাদের মত মানুষ। তাই তোমাদেরকে আল্লাহ‌ পাঠিয়েছেন, আমরা এ কথা মানতে প্রস্তুত নই আর তোমরা যে দ্বীন পেশ করছো আমরা আমাদের ধর্ম পরিত্যাগ করে তা গ্রহণ করি এ উদ্দেশ্যে আল্লাহ‌ তোমাদের পাঠিয়েছেন আমরা একথা মানতেও প্রস্তুত নই। “যে উদ্দেশ্যে তোমাদের পাঠানো হয়েছে” তা আমরা মানি না—কাফেরদের এ উক্তি ছিল তীব্র কটাক্ষ। এর অর্থ এ নয় যে, তারা সেটাকে আল্লাহ‌র প্রেরিত বলে জানতো কিন্তু তা সত্ত্বেও তা মানতে অস্বীকৃতি জানাতো। বরং ফেরাউন হযরত মূসা (আঃ) সম্পর্কে তার সভাসদদেরকে যে ধরনের বিদ্রূপাত্মক উক্তি করেছিলো এটাও সে ধরনের বিদ্রূপাত্মক বর্ণনাভঙ্গি। ফেরাউন তার সভাসদদের বলেছিলোঃ

إِنَّ رَسُولَكُمُ الَّذِي أُرْسِلَ إِلَيْكُمْ لَمَجْنُونٌ (الشعراء : 27)

“যে রসূল সাহেবকে তোমাদের কাছে পাঠানো হয়েছে তাঁকে তো বদ্ধ পাগল বলে মনে হয়।” (আরো ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, সূরা ইয়াসীন, টীকা ১১)
৪১:হামীম-আস-সাজদাহ-১৫-১৬
# অমঙ্গলকর দিনের অর্থ এ নয় যে, দিনগুলোর মধ্যেই অমঙ্গল নিহিত ছিল। আর আদ জাতির ওপর এই অমঙ্গলকর দিন এসেছিলো বলেই যে আযাব এসেছিল তাও ঠিক নয়। এর অর্থ যদি তাই হতো এবং ঐ দিনগুলোই অমঙ্গলকর হতো তাহলে দূরের ও কাছের সব কওমের ওপরই আযাব আসতো। তাই এর সঠিক অর্থ হচ্ছে যেহেতু সেই দিনগুলোতে ঐ কওমের ওপর আল্লাহ‌র আযাব নাযিল হয়েছিলো তাই আদ কওমের জন্য সেই দিনগুলি ছিল অমঙ্গলকর। এ আয়াতের সাহায্যে দিনসমূহের মঙ্গলজনক ও অমঙ্গলজনক হওয়ার প্রমাণ পেশ করা ঠিক নয়।

প্রচন্ড ঝড়ো বাতাস বুঝাতে رِيحًا صَرْصَرًا শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এর অর্থ বর্ণনার ক্ষেত্রে ভাষাবিদদের মতানৈক্য আছে। কেউ কেউ বলেনঃ এর অর্থ মারাত্মক ‘লু’ প্রবাহ; কেউ কেউ বলেনঃ এর অর্থ প্রচণ্ড ঠাণ্ডা বাতাস এবং কারো কারো মতে এর অর্থ এমন বাতাস যা প্রবাহিত হওয়ার সময় প্রচণ্ড শব্দ সৃষ্টি হয়। তবে এ অর্থে সবাই একমত যে, শব্দটি প্রচণ্ড ঝড়ো হাওয়ার জন্য ব্যবহৃত হয়।

কুরআন মজীদের অন্যান্য স্থানে এ আযাব সম্পর্কে যেসব বিস্তারিত বর্ণনা আছে তা হচ্ছে, এ বাতাস উপর্যুপরি সাত দিন এবং আট রাত পর্যন্ত প্রবাহিত হয়েছিলো। এর প্রচণ্ডতায় মানুষ পড়ে গিয়ে এমনভাবে মৃত্যুবরণ করে এবং মরে মরে পড়ে থাকে যেমন খেজুরের ফাঁপা কাণ্ড পড়ে থাকে (আল-হাককাহ, আয়াত ৭)। এ বাতাস যে জিনিসের ওপর দিয়েই প্রবাহিত হয়েছে তাকেই জরাজীর্ণ করে ফেলেছে (আয যারিয়াত, আয়াত ৪২)। যে সময় এ বাতাস এগিয়ে আসছিলো তখন আদ জাতির লোকেরা এই ভেবে আনন্দে মেতে উঠেছিলো যে, মেঘ চারদিক থেকে ঘিরে আসছে। এখন বৃষ্টি হবে এবং তাদের আশা পূর্ণ হবে। কিন্তু তা এমনভাবে আসলো যে গোটা এলাকাই ধ্বংস করে রেখে গেল (আল আহকাফ, আয়াত ২৪ ও ২৫ )।
# যে অহংকার ও গর্বের কারণে তারা পৃথিবীতে বড় সেজে বসেছিলো এবং বুক ঠুকে বলতোঃ আমাদের চাইতে অধিক শক্তিশালী আর কে আছে? অপমান ও লাঞ্ছনাকর এ আযাব ছিল সেই অহংকার ও গর্বের জবাব। আল্লাহ‌ এমন ভাবে তাদেরকে লাঞ্ছিত করলেন যে, তাদের জনপদের একটি বড় অংশকে ধ্বংস করে দিলেন, তাদের সভ্যতাকে নিশ্চিহ্ন করে ফেললেন এবং যে ক্ষুদ্র অংশটি অবশিষ্ট রইলো তারা পৃথিবীর সেই সব জাতির হাতেই লাঞ্ছিত ও অপমানিত হলো যাদের কাছে একদিন তারা শক্তির বড়াই করতো। (আদ জাতির বিস্তারিত কাহিনীর জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন আল আ’রাফ, টীকা ৫১ থেকে ৫৩ ; হুদ, টীকা ৫৪ থেকে ৬৬ ; আল মু’মিনূন, টীকা ৩৪ থেকে ৩৭ ; আশ-শু’আরা, টীকা ৮৮ থেকে ৯৪ ; আল আনকাবূত, টীকা ৬৫ )।
৪১:হামীম-আস-সাজদাহ-১৭-১৮# সামূদ জাতির বিস্তারিত কাহিনী জানার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, আল আ’রাফ, টীকা ৫৭ থেকে ৫৯ ; হূদ, ৬৯ থেকে ৭৪ ; আল কে হিজর, ৪২ থেকে ৪৬ ; বনী ইসরাইল, টীকা ৬৮ ; আশ শুআরা, টীকা ৯৫ থেকে ১০৬ ; আন নামল, টীকা ৫৮ থেকে ৬৬ ।
৪১:হামীম-আস-সাজদাহ-১৯
# মূল উদ্দেশ্য একথা বলা যে আল্লাহ‌র আদালতে হাজির হওয়ার জন্য তাদের পরিবেষ্টন করে আনা হবে। কিন্তু এ বিষয়টিকেই এ ভাষায় বর্ণনা করা হয়েছে যে, দোযখের দিকে যাওয়ার জন্য পরিবেষ্টন করে আনা হবে। কেননা দোযখে যাওয়াই তাদের শেষ পরিণাম।
# এক একটি বংশ ও প্রজন্মের হিসাব-নিকাশ করে একটার পর একটা সিদ্ধান্ত দেয়া হবে তা নয়। বরং আগের ও পরের সমস্ত বংশ ও প্রজন্মকে একই সময়ে একত্র করা হবে এবং এক সাথেই তাদের হিসাব-নিকাশ নেয়া হবে। কারণ, কোন মানুষ তার জীবনে ভাল মন্দ যে কাজই করুক না কেন তার জীবন শেষ হওয়ার সাথে সাথে তার প্রভাব শেষ হয় না, বরং তার মৃত্যুর পরও দীর্ঘদিন পর্যন্ত চলতে থাকে। এক্ষেত্রে সৃষ্ট প্রভাবের জন্য সে-ই দায়ী। অনুরূপ একটি প্রজন্ম তার সময়ে যা কিছুই করে পরবর্তী প্রজন্মসমূহের মধ্যে তার প্রভাব শতাব্দীর পর শতাদ্বী ধরে চলতে থাকে। এই উত্তরাধিকারের জন্য মূলত সে-ই দায়ী হয়। ভুল-ত্রুটি নির্ণয় এবং ইনসাফ প্রতিষ্ঠার এই সমস্ত প্রভাব ও ফলাফল পর্যালোচনা করা এবং তার সাক্ষ্য প্রমাণ তুলে ধরা অপরিহার্য। এ কারণেই কিয়ামতের দিন প্রজন্মসমূহ একের পর এক আসতে থাকবে এবং তাদেরকে অবস্থান করানো হতে থাকবে। যখন আগের ও পরের সবাই এসে একত্রিত হবে তখনি কেবল আদালতের কার্যত্রুম শুরু হবে। (আরো ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, আল আ’রাফ, টীকা ৩০)।
৪১:হামীম-আস-সাজদাহ-২০
# বিভিন্ন হাদীসে এর যে ব্যাখ্যা এসেছে তা হচ্ছে যখন কোন একগুঁয়ে অপরাধী তার অপরাধসমূহ অস্বীকার করতে থাকবে এবং সমস্ত সাক্ষ্য প্রমাণকেও মিথ্যা বলে আখ্যায়িত করতে তৎপর হবে তখন আল্লাহ‌র আদেশে তার দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গসমূহ এক এক করে সাক্ষ্য দিবে, সে ঐগুলোর সাহায্যে কি কি কাজ আঞ্জাম দিয়েছে। হযরত আনাস (রাঃ), হযরত আবু মূসা আশ’আরী (রাঃ), হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) এবং হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) এ বিষয়টি নবী ﷺ থেকে বর্ণনা করেছেন এবং মুসলিম, নাসায়ী, ইবনে জারীর, ইবনে আবী হাতেম প্রমুখ মুহাদ্দিসগণ এসব হাদীস উদ্ধৃত করেছেন। (আরো ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, সূরা ইয়াসীন, টীকা ৫৫ )।
যেসব আয়াত থেকে প্রমাণিত হয়, আখিরাত শুধু একটি আত্মিক জগত হবে না, বরং মানুষকে সেখানে দেহ ও আত্মার সমন্বয়ে পুনরায় ঠিক তেমনি জীবিত করা হবে যেমনটি বর্তমানে তারা এই পৃথিবীতে জীবিত আছে—এ আয়াতটি তারই একটি। শুধু তাই নয়, যে দেহ নিয়ে তারা এই পৃথিবীতে আছে ঠিক সেই দেহই তাদের দেয়া হবে। যেসব উপাদান, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এবং অণু-পরমাণুর (Atoms) সমন্বয়ে এই পৃথিবীতে তাদের দেহ গঠিত কিয়ামতের দিন সেগুলোই একত্রিত করে দেয়া হবে এবং যে দেহে অবস্থান করে সে পৃথিবীতে কাজ করেছিলো পূর্বের সেই দেহ দিয়েই তাকে উঠানো হবে। এ কথা সুস্পষ্ট যে, যেসব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সমন্বয়ে গঠিত দেহ নিয়ে সে পূর্বের জীবনে কোন অপরাধ করেছিলো সেই সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মধ্যেই যদি সে অবস্থান করে কেবল তখনি সে সেখানে সাক্ষ্য দিতে সক্ষম হবে। কুরআন মজীদের নিম্নবর্ণিত আয়াতগুলোও এ বিষয়ের অকাট্য প্রমাণ। বনী ইসরাঈল, আয়াত ৪৯ থেকে ৫১ ও ৯৮ ; আল মু’মিনূন, আয়াত ৩৫ থেকে ৩৮ এবং ৮২ ও ৮৩ ; আস সিজদা, আয়াত ১০ ; ইয়াসিন, আয়াত ৬৫ , ৭৮ ও ৭৯ ; আস সাফফাত, আয়াত ১৬ থেকে ১৮ ; আল ওয়াকিয়া, ৪৭ থেকে ৫০ এবং আন নাযিআত, আয়াত ১০ থেকে ১৪।
৪১:হামীম-আস-সাজদাহ-২১
# এ থেকে জানা গেল কিয়ামতের দিন মানব দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গই শুধু সাক্ষ্য দেবে না, যেসব জিনিসের সামনে মানুষ কোন কাজ করেছিলো তার প্রতিটি জিনিসই কথা বলে উঠবে। সূরা যিলযালে এ কথাই বলা হয়েছেঃ وَأَخْرَجَتِ الْأَرْضُ أَثْقَالَهَا -وَقَالَ الْإِنْسَانُ مَا لَهَا – يَوْمَئِذٍ تُحَدِّثُ أَخْبَارَهَا – بِأَنَّ رَبَّكَ أَوْحَى لَهَا “মাটির গভীরে যেসব ভান্ডার পরিপূর্ণ হয়ে আছে তা সে বের করে দেবে। মানুষ বলবে এ কি ব্যাপার! সে দিন যমীন তার সব কথা শুনাবে (অর্থাৎ মানুষ তার উপরিভাগে যা যা করেছে তার সব কাহিনী বলে দেবে)। কারণ, তোমার রব তাকে বর্ণনা করার আদেশ প্রদান করবেন।”
৪১:হামীম-আস-সাজদাহ-২২-২৩
#এ আয়াতের ব্যাখ্যায় হযরত হাসান বাসারী (র) খুব সুন্দর কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, প্রত্যেকে তার রব সম্পর্কে যে ধারণা পোষণ করে তার আচার-আচরণ সেই ধারণা অনুসারেই নির্ধারিত হয়। সৎ কর্মশীল ঈমানদারের আচরণ সঠিক হওয়ার কারণ সে তার রব সম্পর্কে সঠিক ধারণা পোষণ করে। আর কাফের, মুনাফিক, ফাসেক ও জালেমের আচরণ ভ্রান্ত হওয়ার কারণ হচ্ছে এই যে, রব সম্পর্কে তার ধারণাই ভ্রান্ত হয়ে থাকে। নবী ﷺ একটি সংক্ষিপ্ত কিন্তু অত্যন্ত ব্যাপক অর্থব্যঞ্জক হাদীসে এ বিষয়টিই তুলে ধরেছেন এভাবেঃ তোমাদের রব বলেনأَنَا عِنْدَ ظَنِّ عَبْدِى بِى ‘আমার বান্দা আমার সম্পর্কে যে ধারণা পোষণ করে আমি তার জন্য সেই ধারণার অনুরূপ।’
৪১:হামীম-আস-সাজদাহ-২৪
#এ কথার অর্থ হতে পারে, দুনিয়ায় ফিরে আসতে চাইলে আসতে পারে না। এ অর্থও হতে পারে যে, দোযখ থেকে বের হতে চাইলে বের হতে পারবে না। আবার এও হতে পারে যে, তওবা করতে বা অক্ষমতা প্রকাশ করতে চাইলে তা গ্রহণ করা হবে না।
৪১:হামীম-আস-সাজদাহ-২৫
এটা আল্লাহ‌র স্বতন্ত্র ও স্থায়ী বিধান। খারাপ নিয়ত ও খারাপ আকাঙ্ক্ষা পোষণকারী মানুষকে তিনি কখনো ভাল সঙ্গী যোগান না। তার ঝোঁক ও আগ্রহ অনুসারে তিনি তাকে খারাপ সঙ্গীই জুটিয়ে দেন। সে যতই দুষ্কর্মের নিকৃষ্টতার গহবরে নামতে থাকে ততই জঘন্য থেকে জঘন্যতর মানুষ ও শয়তান তার সহচর, পরামর্শদাতা ও কর্ম সহযোগী হতে থাকে। কারো কারো উক্তি, অমুক ব্যক্তি নিজে খুব ভালো কিন্তু তার সহযোগী ও বন্ধু-বান্ধব জুটেছে খারাপ, এটা বাস্তবের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। প্রকৃতির বিধান হলো, প্রতিটি ব্যক্তি নিজে যেমন তার বন্ধু জোটে ঠিক তেমনি। একজন সৎ ও নেক মানুষের সাহচর্যে খারাপ মানুষ আসলেও বেশী সময় সে তার সাথে থাকতে পারে না। অনুরূপ অসৎ উদ্দেশ্যে কর্মরত একজন দুষ্কর্মশীল মানুষের সাথে হঠাৎ সৎ ও সভ্রান্ত মানুষের বন্ধুত্ব হলেও তা বেশী সময় টিকে থাকতে পারে না। অসৎ মানুষ প্রকৃতিগতভাবে অসৎ মানুষদেরই তার প্রতি আকৃষ্ট করে এবং তার প্রতি অসৎরাই আকৃষ্ট হয়। যেমন নোংরা ময়লা আবর্জনা মাছিকে আকৃষ্ট করে এবং মাছি নোংরা ময়লা আবর্জনার প্রতি আকৃষ্ট হয়।

আর বলা হয়েছে, তারা সামনের ও পেছনের প্রতিটি জিনিস সুদৃশ্য করে দেখাতো। এর অর্থ তারা তাদের মধ্যে এ মর্মে দৃঢ় বিশ্বাস জাগিয়ে তুলতো যে, আপনার অতীত মর্যাদা ও গৌরবে ভরা এবং ভবিষ্যতও অত্যন্ত উজ্জ্বল। তারা তাদের চোখে এমন চশমা পরিয়ে দিতো যে, তারা চারদিকে কেবল সবুজ শ্যামল শোভা-ই দেখতে পেতো। তারা তাদের বলতো, আপনার সমালোচকরা নির্বোধ। আপনি কি কোন ভিন্ন ও বিরল প্রকৃতির কাজ করছেন? আপনি যা করছেন পৃথিবীতে প্রগতিবাদীরা তো তাই করে থাকে আর ভবিষ্যতে প্রথমতঃ আখেরাত বলে কিছুই নেই, যেখানে আপনাকে নিজের সব কাজ-কর্মের জবাবদিহি করতে হবে। তবে কতিপয় নির্বোধ আখেরাত সংঘটিত হওয়ার যে দাবী করে থাকে তা যদি সংঘটিত হয়ও তাহলে যে আল্লাহ‌ এখানে আপনাকে নিয়ামতরাজি দিয়ে পুরস্কৃত করেছেন সেখানেও তিনি আপনার ওপর পুরস্কার ও সম্মানের বৃষ্টি বর্ষণ করবেন। দোযখ আপনার জন্য তৈরী করা হয়নি, তাদের জন্য তৈরী করা হয়েছে যাদেরকে আল্লাহ‌ এখানেও তাঁর নিয়ামতসমূহ থেকে বঞ্চিত রেখেছেন।

أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#১০৯৩)
[ *আপােষের প্রস্তাবে আল্লাহর রাসূলের (সা:) জবাব :-]
www.motaher21.net
সূরা:৪১:হামীম-আস-সাজদাহ
পারা:২৪
৯-২৫ নং আয়াত:-
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
৯-১২ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

আলোচ্য আয়াতগুলোতে মুশরিকদেরকে তাদের শির্ক ও কুফরের কারণে এক সাবলীল ভঙ্গিতে হুশিয়ার করা হয়েছে। এতে আল্লাহ তা‘আলার সৃষ্টিগুণ তথা বিশাল আকাশ ও পৃথিবীকে সৃষ্টি করার বিশদ বিবরণ দিয়ে তাদেরকে এ বলে শাসানো হয়েছে যে, তোমরা এমন নির্বোধ যে, মহান স্রষ্টা ও সর্বশক্তিমানের সাথে অপরকে শরীক সাব্যস্ত কর? সবারই সৃষ্টিকর্তা, অধিকর্তা, শাসনকর্তা ও পালনকর্তা একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা। সবারই ওপর পূর্ণ ক্ষমতাবান একমাত্র তিনিই। জমিনের ন্যায় প্রশস্ত বস্তুকে তিনি স্বীয় ক্ষমতার বলে মাত্র দুদিনে সৃষ্টি করেছেন। সুতরাং যিনি এত ক্ষমতাবান তাঁর সঙ্গে মানুষের কুফরী করা উচিৎ নয় এবং র্শিক করাও উচিৎ নয়।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(كَيْفَ تَكْفُرُوْنَ بِاللهِ وَكُنْتُمْ أَمْوَاتًا فَأَحْيَاكُمْ ج ثُمَّ يُمِيْتُكُمْ ثُمَّ يُحْيِيْكُمْ ثُمَّ إِلَيْهِ تُرْجَعُوْنَ ‏)‏

“কিভাবে তোমরা আল্লাহকে অস্বীকার করছ? অথচ তোমরা নির্জীব ছিলে, পরে তিনিই তোমাদেরকে জীবনদান করেছেন, এরপর তিনি তোমাদের মৃত্যু ঘটাবেন, পরে আবার জীবিত করবেন, অবশেষে তোমাদেরকে তাঁরই দিকে ফিরে যেতে হবে।” (সূরা বাকারাহ ২ : ৮)

এখানে আল্লাহ তা‘আলা জমিনকে দুদিনে সৃষ্টি করার কথা উল্লেখ করেছেন অথচ অন্যান্য জায়গায় বলা হয়েছে আকাশ-জমিন ছয় দিনে সৃষ্টি করা হয়েছে।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

(إِنَّ رَبَّكُمُ اللّٰهُ الَّذِيْ خَلَقَ السَّمٰوٰتِ وَالْأَرْضَ فِيْ سِتَّةِ أَيَّامٍ ثُمَّ اسْتَوٰي عَلَي الْعَرْشِ)

“নিশ্চয়ই তোমাদের প্রতিপালক ‘আল্লাহ যিনি আকাশসমূহ ও পৃথিবী ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর তিনি ‘আরশে সমুন্নত হয়েছেন।” (সূরা আ‘রাফ ৭ : ৫৪)

অন্যান্য আয়াতগুলোতে আকাশ-জমিন সৃষ্টি করার কথা একত্রে ছয় দিনে বলা হয়েছে আর এখানে এগুলোর পৃথক পৃথক বর্ণনা দেয়া হয়েছে। এখান থেকে জানা গেল যে, প্রথমে জমিনকে সৃষ্টি করা হয়েছে। ইমারত নির্মাণ করারও পদ্ধতি এটাই যে, প্রথমে ভিত্তি ও নীচের অংশ নির্মাণ করা হয়। তারপর উপরের অংশ ও ছাদ নির্মাণ করা হয়। আল্লাহ তা‘আলার বাণী :

(هُوَ الَّذِيْ خَلَقَ لَكُمْ مَّا فِي الْأَرْضِ جَمِيْعًا ق ثُمَّ اسْتَوٰٓي إِلَي السَّمَآءِ فَسَوّٰهُنَّ سَبْعَ سَمٰوٰتٍ ط وَهُوَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ)‏

“তিনি সেই স্বত্ত্বা যিনি পৃথিবীতে যা কিছূ আছে সব তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন; অতঃপর তিনি আকাশের প্রতি মনোনিবেশ করেন, এবং সেগুলোকে সপ্ত আকাশে সুবিন্যস্ত করেন। আর তিনি সর্ব বিষয়ে মহাজ্ঞানী।” (সূরা বাকারাহ্ ২ : ২৯)

আর আকাশ ও জমিন সৃষ্টির বিষয়ে, আল্লাহ তা‘আলা বললেন, তিনি দু’ দিনে পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তিনি আকাশসমূহ সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর সেটার ছাদকে উচ্চ ও সুবিন্যস্ত করেছেন দু’ দিনে। এরপর তিনি এতে পানি এবং তৃণভূমি ছড়িয়ে দিয়েছেন। এতে তিনি সৃষ্টি করেছেন পাহাড়-পর্বতসহ বিভিন্ন প্রাণহীন পদার্থ। এগুলো তিনি দু’ দিনে সৃষ্টি করেছেন যা সূরা না-যি‘আ-ত-এর আয়াত এর সঠিক অর্থ। আল্লাহ তা‘আলা পৃথিবী এবং ওর মধ্যস্থিত সকল কিছু সৃষ্টি করেছেন চারদিনে আর আকাশসমূহ সৃষ্টি করেছেন দু’ দিনে। এ মোট ছয়দিন। এভাবেই আল্লাহ তা‘আলা আকাশ-জমিন ও এগুলোর মধ্যবর্তী যা রয়েছে সকল কিছুর সৃষ্টি সমাপ্ত করেন। (সহীহ বুখারী, অত্র সূরার তাফসীর)

এরপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন : তিনি জমিন সৃষ্টির পর আকাশের দিকে মনোনিবেশ করেন যা ছিল ধূম্রপুঞ্জ বিশেষ। আল্লাহ তা‘আলা একে এবং পৃথিবীকে বললেন : তোমরা উভয়ে এসো ইচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায়। অর্থাৎ আমার হুকুম মেনে নিয়ে আমি যা বলি তাই হয়ে যাও, খুশি মনে অথবা বাধ্য হয়ে। উভয়েই খুশি মনে হুকুম মেনে নিতে সম্মত হলো এবং বলল : আমরা খুশি মনে আপনার নির্দেশ মেনে নিলাম। এরপর আল্লাহ তা‘আলা আকাশকে দু’দিনে সপ্তাকাশে পরিণত করেন। প্রত্যেক আকাশে তিনি ইচ্ছামত কার্যক্রম প্রতিষ্ঠিত করেন। দুনিয়ার আকাশকে তিনি তারকারাজি দ্বারা সুশোভিত করেন যেগুলো জমিনে আলো দেয় এবং ঐ শয়তানদের প্রতি ওরা সজাগ দৃষ্টি রাখে যারা ঊর্ধ্ব জগতের কিছু শোনার উদ্দেশ্যে ওপরে ওঠার ইচ্ছা করে এবং তাদেরকে অগ্নিপিণ্ড নিক্ষেপ করে।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. জমিন চার দিনে এবং আকাশ দু’ দিনে মোট ছয় দিনে আকাশ-জমিন সৃষ্টি সম্পন্ন হয়েছে।
২. আকাশ-জমিন আল্লাহ তা‘আলার অনুগত।
৩. দুনিয়ার আকাশ তারকারাজি দ্বারা সুশোভিত যা শয়তানের জন্য অগ্নিপিণ্ডস্বরূপ।
৪. আল্লাহ তা‘আলা ইচ্ছা করলে এক মুহূর্তের মধ্যে সবকিছু সৃষ্টি করতে পারতেন, কিন্তু বান্দাদের কাজে ধীরস্থিরতা শিক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে তিনি ছয় দিনে সবকিছু সৃষ্টি করেছেন।

১৩-১৮ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

এ আয়াতসমূহে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে লক্ষ করে বলেন : তিনি যেন কুরায়শদের জানিয়ে দেন যে, এতসব নিদর্শন দেখার পরেও যদি তারা ঈমান থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় তাহলে তাদেরকে বল, আমি তোমাদেরকে সে-শাস্তির ভিতি প্রদর্শন করছি যা দ্বারা ‘আদ ও সামুদ জাতিকে ধ্বংস করা হয়েছিল। পরের আয়াতগুলোতে ‘আদ এবং সামূদ জাতির অবাধ্যতার কারণে শাস্তি দ্বারা ধ্বংস করার ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন : ‘আদ সম্প্রদায় পৃথিবীতে দম্ভ-অহঙ্কার করত এবং বলত : আমাদের চেয়ে অধিক শক্তিশালী আর কে আছে? তাদের এ সকল গর্ব-অহঙ্কারের কারণে তাদের বিরুদ্ধে এক ঝঞ্ঝাবায়ু প্রেরণ করে তাদেরকে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(وَأَمَّا عَادٌ فَأُهْلِكُوْا بِرِيْحٍ صَرْصَرٍ عٰتِيَةٍ)

“আর আ‘দ সম্প্রদায়, তাদেরকে ধ্বংস করা হয়েছিল এক প্রচন্ড ঘূর্ণিঝড় দ্বারা।” (সূরা হা-ক্কাহ ৬৯ : ৬)

এ ঝঞ্ঝাপূর্ণ আযাব তাদের ওপর অনবরতভাবে সাত রাত ও আট অব্যাহত দিন ছিল। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(سَخَّرَهَا عَلَيْهِمْ سَبْعَ لَيَالٍ وَّثَمٰنِيَةَ أَيَّامٍ لا حُسُوْمًا فَتَرَي الْقَوْمَ فِيْهَا صَرْعٰي لا كَأَنَّهُمْ أَعْجَازُ نَخْلٍ خَاوِيَةٍ)

“যা তিনি তাদের ওপর প্রবাহিত করেছিলেন বিরামহীনভাবে সাত রাত ও আট দিন, তুমি (উপস্থিত থাকলে) সেই সম্প্রদায়কে দেখতে খেজুর কান্ডের ন্যায় সেখানে ছিন্ন ভিন্নভাবে পড়ে আছে।” (সূরা হা-ক্কাহ ৬৯ : ৭)
আর এ বাতাস প্রেরণ করা হয়েছিল এক অশুভ দিনে।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(إِنَّآ أَرْسَلْنَا عَلَيْهِمْ رِيْحًا صَرْصَرًا فِيْ يَوْمِ نَحْسٍ مُّسْتَمِرٍّ)

“আমি তাদের ওপর প্রেরণ করেছিলাম ক্রমাগত প্রবাহমান প্রচণ্ড গতিসম্পন্ন বায়ু, দুর্ভোগের দিনে।” (সূরা কামার ৫৪ : ১৯)

দুনিয়াতে তাদেরকে লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি দেয়া হয়েছে এবং আখিরাতেও তাদের জন্য রয়েছে লাঞ্ছনা দায়ক শাস্তি। এদের সম্পর্কে সূরা আ‘রাফের ৬৫-৭২ নম্বর আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে।

فَهَدَيْنٰهُمْ তথা সামূদ সম্প্রদায়ের কাছে হিদায়াতের বাণী প্রেরণ করেছিলাম। কিন্তু তারা ঈমানের ওপর কুফরীকে প্রাধান্য দিয়েছে। আয়াতে الْعَمٰي বা অন্ধ অর্থ হল পথভ্রষ্টতা ও কুফরী। এদেরকেও তাদের কৃতকর্মের ফলে লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি আঘাত হেনেছিল। তারা তাদের নাবী সালেহ (আঃ)-কে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছিল, এমনকি মু‘জিযাহস্বরূপ যে উটনী প্রদান করা হয়েছিল তাও হত্যা করেছিল ফেলে। সুতরাং এর শাস্তিস্বরূপ তাদেরকে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে।

(الْعَذَابِ الْهُوْنِ) অর্থ অপমানজনক শাস্তি।

(وَنَجَّيْنَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا وَكَانُوْا يَتَّقُوْنَ)

“আমি তাদেরকে রক্ষা করলাম যারা ঈমান এনেছিল এবং যারা তাকওয়া অবলম্বন করে” অর্থাৎ যারা সালেহ (আঃ) এর প্রতি ঈমান এনেছিল তারা শাস্তি থেকে নাজাত পেয়েছিল।

অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করে বলেন : ‏

(فَلَمَّا جَا۬ءَ أَمْرُنَا نَجَّيْنَا صٰلِحًا وَّالَّذِيْنَ اٰمَنُوْا مَعَه۫ بِرَحْمَةٍ مِّنَّا وَمِنْ خِزْيِ يَوْمِئِذٍ ط إِنَّ رَبَّكَ هُوَ الْقَوِيُّ الْعَزِيْز)

“যখন আমার নির্দেশ আসল তখন আমি সালিহ্ ও তাঁর সঙ্গে যারা ঈমান এনেছিল তাদেরকে আমার অনুগ্রহে রক্ষা করলাম এবং রক্ষা করলাম সেদিনের লাঞ্ছনা হতে। নিশ্চয়ই‎ তোমার প্রতিপালক শক্তিমান, পরাক্রমশালী।” (সূরা হুদ ১১ : ৬৬) এরূপ সূরা নামলের ৪৫-৫৩ নম্বর আয়াতে তাদের বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে।

সুতরাং যারা ঈমান থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, কুফরীর ওপর থেকে অহঙ্কার করবে তাদের উচিত পূর্ববর্তী ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতিসমূহ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা। তাদের কাছেও হিদায়াতের বাণী আসার পর তারা ঈমান থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল, ফলে অপমানজনক শাস্তি তাদেরকে গ্রাস করেছে।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. দুনিয়াতে যারা ঈমান থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে গর্ব-অহঙ্কার প্রকাশ করেছে তারাই ধ্বংস হয়েছে।
২. পূর্ববর্তী জাতিসমূহের বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে যাতে আমরা শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি।
৩. যারা ঈমান ও তাকওয়ার পথ অবলম্বন করবে তাদেরকে আল্লাহ তা‘আলা হেফাযত করবেন।

১৯-২৪ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

(وَیَوْمَ یُحْشَرُ اَعْدَا۬ئُ اللہِ…… فَاِنْ یَّصْبِرُوْا فَالنَّارُ مَثْوًی لَّھُمْ)

এ আয়াতসমূহে কিয়ামতের মাঠে মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তাদেরই বিরুদ্ধে সাক্ষ্য প্রদান করবে-আল্লাহ তা‘আলা এ সম্পর্কেই আলোকপাত করেছেন। অতঃপর তাদের ঠিকানা হবে জাহান্নাম। দুনিয়াতে মানুষ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কত সেবাযতœ করে থাকে। কোন অঙ্গ আঘাতপ্রাপ্ত হলে যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা নেওয়াসহ আর কত কি করে। কিন্তু এসব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের যদি সৎ ব্যবহার না করা হয়, যদি অসৎ কাজে ব্যবহার করা হয় তাহলে সে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ মানুষের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে।

অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

(وَّنَسُوْقُ الْمُجْرِمِيْنَ إِلٰي جَهَنَّمَ وِرْدًا ‏)‏

“এবং অপরাধীদেরকে তৃষ্ণাতুর অবস্থায় জাহান্নামের দিকে হাঁকিয়ে নিয়ে যাব।” (সূরা মারইয়াম ১৯ : ৮৬)

আর তথায় তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য প্রদান করবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

(اَلْيَوْمَ نَخْتِمُ عَلٰٓي أَفْوَاهِهِمْ وَتُكَلِّمُنَآ أَيْدِيْهِمْ وَتَشْهَدُ أَرْجُلُهُمْ بِمَا كَانُوْا يَكْسِبُوْنَ ‏)‏

“আজ আমি এদের মুখে মোহর মেরে দেব, এদের হাত আমার সাথে কথা বলবে এবং এদের পা সাক্ষ্য দেবে যা তারা করত সে সম্পর্কে।” (সূরা ইয়া-সীন ৩৬ : ৬৫)

তখন অপরাধিরা তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে ধিক্কার প্রদান করবে এবং বলবে : তোমরা কেন আমার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য প্রদান করছ? তোমরা দূর হও, তোমরা চুপ করো ইত্যাদি। যেমন হাদীসে বলা হয়েছে।

আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : একদা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হেসে উঠলেন এবং সাহাবাদেরকে লক্ষ্য করে বললেন : তোমরা কি জানো কী কারণে আমি হেসেছি? তারা বলল : হে আল্লাহ তা‘আলার রাসূল! আপনি কি কারণে হাসলেন? উত্তরে তিনি বললেন : কিয়ামতের দিন বান্দা কর্তৃক তার রবের সাথে ঝগড়া করার কথা মনে করে আমি বিষ্ময়বোধ করছি। বান্দা বলবে : হে আমার প্রতিপালক! আপনি কি আমার সঙ্গে অঙ্গীকার করেননি যে, আপনি আমার ওপর জুলুম করবেন না? আল্লাহ তা‘আলা জবাবে বলবেন : হ্যাঁ, সে বলবে : আমিতো আমার আমলের ওপর আমার নিজের সাক্ষ্য ছাড়া আর কারো সাক্ষ্য কবূল করব না। তখন আল্লাহ তা‘আলা বলবেন : আমি এবং আমার সম্মানিত ফেরেশতারা কি সাক্ষী হিসেবে যথেষ্ট নয়? কিন্তু সে বারবার এ কথাই বলতে থাকবে। তখন আল্লাহ তা‘আলা তার মুখে মোহর লাগিয়ে দেবেন এবং তার দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে যে, সে কী করেছে। তখন সে তাদেরকে তিরস্কার করে বলবে : তোমরা চুপ করো, আমি তো তোমাদেরকে রক্ষা করার জন্যই তর্ক করছিলাম। (সহীহ মুসলিম হা. ২৯৬৯)

অন্য এক হাদীসে বলা হয়েছে, আবূ মূসা আশ‘আরী (রাঃ) বলেন : কাফির ও মুনাফিক্বদেরকে হিসাবের জন্য ডাকা হবে। তিনি তাদের প্রত্যেকের সম্মুখে তাদের কৃতকর্ম পেশ করবেন। তাদের প্রত্যেকে শপথ করে তার নিজের কৃতকর্ম অস্বীকার করবে এবং বলবে : হে আমার প্রতিপালক! আপনার ইজ্জতের শপথ করে বলছি : আপনার ফেরেশতারা এমন কিছু লিখে রেখেছে যা আমি কখনো করিনি। ফেরেশতারা বলবেন : তুমি কি অমুক দিন অমুক জায়গায় অমুক কাজ করনি? সে উত্তরে বলবে : হে আমার প্রতিপালক! আপনার মর্যাদার শপথ! আমি এ কাজ কখনো করিনি। অতঃপর তার মুখে মোহর লাগিয়ে দেয়া হবে এবং তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে। সর্বপ্রথম তার ডান উরু কথা বলবে। (ইবনু জারীর-ত্ববারী- ২৩/১৭)

সুতরাং মানুষ যে-কোন স্থানে যে-কোন অন্যায় অথবা ভাল কাজ যাই করুক না কেন আল্লাহ তা‘আলা তা সম্যক অবগত রয়েছেন। তিনি সব কিছুই জানেন, শুনেন ও দেখেন।

(تَعْمَلُوْنَ……. وَمَا كُنْتُمْ تَسْتَتِرُوْنَ) শানে নুযূল :

ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : বাইতুল্লাহর পার্শ্বে তিনজন লোক ঝগড়া করছিল। দু’জন কুরাইশ গোত্রের এবং একজন সাক্বীফ গোত্রের অথবা এর বিপরীত। তাদের একজন বলল : তোমরা কি মনে করো যে, আমরা যা বলি আল্লাহ তা‘আলা তা শুনেন? অন্যজন উত্তর দিলো, আমরা যা উচ্চকণ্ঠে বলি তা শুনেন কিন্তু যা চুপিচুপি বলি তা শুনেন না। তৃতীয় জন বলল : যদি তিনি আমাদের উচ্চৈঃস্বরের কথা শুনতে পান তাহলে আমরা যা আস্তে আস্তে বলি তাও তিনি শুনেন। তখন এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। (সহীহ বুখারী হা. ৪৮১৬-১৭, সহীহ মুসলিম হা. ২৭৭৫)

অন্য বর্ণনায় ইবনু মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন : একদা আমি কাবার আস্তিনে আচ্ছন্ন ছিলাম। এমন সময় তিনজন ব্যক্তি আগমন করল। তাদের পেটে চর্বি ছিল অনেক কিন্তু বুদ্ধি ছিল কম। তারা কিছু কথা বলল, আমি তা বুঝতে পারলাম না।

তাদের একজন বলল : তোমরা কি জান না আল্লাহ আমাদের কথা শুনেন। অপরজন বলল, আমরা আওয়াজ উঁচু করলে আল্লাহ তা‘আলা শুনতে পান, আর আওয়াজ উঁচু না করলে শুনতে পাননা। অপরজন বলল, যদি আল্লাহ কিছু শুনেন তাহলে সব কথাই শুনেন। ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন : আমি একথা যখন নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে উল্লেখ করলাম তখন এ আয়াত নাযিল হয়। (তিরমিযী হা. ৩২৪৯, সহীহ)

(وَذٰلِكُمْ ظَنُّكُمُ الَّذِيْ ظَنَنْتُمْ بِرَبِّكُمْ)

“তোমাদের প্রতিপালক সম্বদ্ধে তোমাদের এ ধারণাই তোমাদের ধ্বংস করেছে” অর্থাৎ আল্লাহর ব্যাপারে এরূপ ধারণা করার কারণে তোমরা বেশি বেশি অপরাধ করেছ। ফলে তোমাদের ধ্বংস অনিবার্য হয়ে গেছে। হাদীসে এসেছে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : আল্লাহ তা‘আলার প্রতি ভাল ধারণা না নিয়ে যেন কেউ মারা না যায়। কেননা যে জাতি তাদের প্রতিপালকের ব্যাপারে খারাপ ধারণা করেছে তিনি তাদেরকে ধ্বংস করে দিয়েছেন। (সহীহ মুসলিম হা. ২৮৭৭)

সুতরাং আমরা প্রকাশ্য ও গোপনে যা কিছু করি সব আল্লাহ তা‘আলা দেখেন ও জানেন। তাঁর কাছে কোন কিছু অস্পষ্ট নয়। তাই আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করে প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য সকল পাপ কাজ বর্জন করা উচিত।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. কিয়ামতের মাঠে আল্লাহ তা‘আলার শত্র“দেরকে জাহান্নামের সম্মুখে উপস্থিত করা হবে।
২. কিয়ামতের মাঠে মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে।
৩. অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে কথা বলার ক্ষমতা দেয়া হবে।
৪. সর্বপ্রথম কথা বলবে মানুষের ডান উরু।
৫. শাস্তি আসার পর ধৈর্য ধারণ করাতে কোনই লাভ নেই বরং তার পূর্বেই ঈমান আনতে হবে।
৬. আল্লাহ তা‘আলা মানুষের প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য সকল কিছুই জানেন।
২৫ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

অত্র আয়াতসমূহে যারা মন্দ কর্মপরায়ণ ও সৎ পথ থেকে বিরত থাকে, মন্দকে ভালবাসে আল্লাহ তা‘আলা তাদের জন্য শয়তান সঙ্গী নিযুক্ত করে দিয়েছেন। শয়তান তাদেরকে দুনিয়ার মন্দ কর্মগুলো সুশোভিত করে দেখায়, ফলে তারা শয়তানের ধোঁকায় পড়ে মন্দ কাজে বিভোর থাকে, আখিরাত থেকে গাফেল থাকে আল্লাহ তা‘আলা তাদের বিষয়েই বলেছেন। যেমন অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন : ‏

(وَمَنْ یَّعْشُ عَنْ ذِکْرِ الرَّحْمٰنِ نُقَیِّضْ لَھ۫ شَیْطٰنًا فَھُوَ لَھ۫ قَرِیْنٌﭳ وَاِنَّھُمْ لَیَصُدُّوْنَھُمْ عَنِ السَّبِیْلِ وَیَحْسَبُوْنَ اَنَّھُمْ مُّھْتَدُوْنَﭴ)‏

“যে ব্যক্তি দয়াময় আল্লাহর স্মরণে বিমুখ হয় আমি তার জন্য নিয়োজিত করি এক শয়তান, অতঃপর সে হয় তার সহচর। তারাই (শয়তানরা) মানুষকে সৎপথ হতে বিরত রাখে, অথচ মানুষ মনে করে যে, তারা হেদায়েতের ওপর পরিচালিত হচ্ছে।” (সূরা যুখরুফ ৪৩ : ৩৬-৩৭)

এ সঙ্গী বলতে সেই শয়তান প্রকৃতির মানুষ ও জিন্দেরকে বুঝানো হয়েছে, যারা বাতিলপন্থীদের পশ্চাতে লেগে থাকে। তারা তাদের সামনে কুফরী ও অন্যায়কে সুন্দর করে পেশ করে। ফলে তারা ভ্রষ্টতায় পতিত হয়। পরিশেষে এ অবস্থায় তাদের মৃত্যু আসে এবং তার ফলে তারা চিরদিনের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত সাব্যস্ত হয়।

(وَحَقَّ عَلَيْهِمُ الْقَوْلُ)

অর্থাৎ পূর্ববর্তী উম্মতের মধ্যে যারা কুফরী করেছে তাদের ওপর যেমন শাস্তি অবধারিত হয়েছিল তেমনি তাদের ওপরও শাস্তি অবধারিত হয়ে গেছে।

أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#১০৯৩)
[ *আপােষের প্রস্তাবে আল্লাহর রাসূলের (সা:) জবাব :-]
www.motaher21.net
সূরা:৪১:হামীম-আস-সাজদাহ
পারা:২৪
৯-২৫ নং আয়াত:-
তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
৯-১২ নং আয়াতের তাফসীর:

সবারই সৃষ্টিকর্তা, অধিকর্তা, শাসনকর্তা এবং পালনকর্তা একমাত্র আল্লাহ। সবারই উপর পূর্ণ ক্ষমতাবান একমাত্র তিনিই। যমীনের ন্যায় প্রশস্ত সৃষ্ট জিনিসকে তিনি স্বীয় পূর্ণ ক্ষমতাবলে মাত্র দুই দিনে সৃষ্টি করেছেন। মানুষের তার সাথে কুফরী করাও উচিত নয় এবং শির্ক করাও না। তিনিই যেমন সবারই সৃষ্টিকর্তা তেমনই তিনিই সবারই পালনকর্তা। এটা স্মরণ রাখার বিষয় যে, অন্যান্য আয়াতে যমীন ও আসমানকে ছয় দিনে সৃষ্টি করার কথা বর্ণিত হয়েছে, আর এখানে এগুলোকে সৃষ্টি করার সময় পৃথকভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। সুতরাং জানা গেল যে, প্রথমে যমীনকে সৃষ্টি করা হয়েছে। অট্টালিকা নির্মাণ করারও পদ্ধতি এটাই যে, প্রথমে ভিত্তি ও নীচের অংশ নির্মাণ করা হয়। তারপর উপরের অংশ ও ছাদ নির্মাণ করা হয়ে থাকে। যেমন মহামহিমান্বিত আল্লাহ্ বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “তিনি পৃথিবীর সব কিছু তোমাদের জন্যে সৃষ্টি করেছেন, তৎপর তিনি আকাশের দিকে মনোসংযোগ করেন এবং ওকে সপ্তাকাশে বিন্যস্ত করেন।”(২:২৯) আর আল্লাহ তাআলা যে বলেছেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “তোমাদেরকে সৃষ্টি করা কঠিনতর, না আকাশ সৃষ্টি? তিনিই এটা নির্মাণ করেছেন; তিনি এটাকে সুউচ্চ ও সুবিন্যস্ত করেছেন। তিনি রাত্রিকে করেছেন অন্ধকারাচ্ছন্ন এবং প্রকাশ করেছেন সূর্যালোক; এবং পৃথিবীকে এরপর বিস্তৃত করেছেন। তিনি ওটা হতে বহির্গত করেছেন ওর পানি ও তৃণ, এবং পর্বতকে তিনি দৃঢ়ভাবে প্রোথিত করেছেন। এসব তোমাদের ও তোমাদের (গৃহপালিত) চতুষ্পদ জন্তুর ভোগের জন্যে।”(৭৯ ২৭-৩৩) এর দ্বারা বুঝা যাচ্ছে যে, আসমানকে প্রথমে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং যমীনকে এর পরে বিছানো হয়েছে; কিন্তু এর দ্বারা ভাবার্থ এই যে, পরে যমীন হতে পানি, চারা বের করা হয়েছে এবং পাহাড়কে গেড়ে দেয়া হয়েছে। যেমন এর পরেই রয়েছেঃ “তিনি ওটা হতে বের করেছেন ওর পানি ও তৃণ।” তারপর তিনি আসমান ও যমীনকে ঠিকঠাক করেছেন। সুতরাং দু’টি আয়াতের মধ্যে কোন বিরোধ নেই।

হযরত সাঈদ ইবনে জুবায়ের (রঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একটি লোক হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)-কে বলেনঃ “কুরআন কারীমের কতকগুলো আয়াতের মধ্যে আমি কিছুটা অনৈক্য দেখতে পাচ্ছি। যেমন একটি আয়াতে রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “ঐ দিন তাদের মধ্যে কোন বংশ সম্পর্ক থাকবে না এবং তারা পরস্পর জিজ্ঞাসাবাদ করবে না।”(২৩:১০১) অন্য আয়াতে আছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “তারা একে অপরের সামনা-সামনি হয়ে পরস্পর জিজ্ঞাসাবাদ করবে।”(৫২:২৫) এক আয়াতে আছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “তারা আল্লাহর কাছে কোন কথা গোপন করবে না।”(৪:৪২) অন্য আয়াতে রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “আমাদের প্রতিপালক আল্লাহর কসম! আমরা মুশরিক ছিলাম না।”(৬:২৩) এ আয়াতে রয়েছে যে, তারা গোপন করবে। আল্লাহ্ তা’আলা বলেছেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “তোমাদেরকে সৃষ্টি করা কঠিনতর, না আকাশ সৃষ্টি? তিনিই এটা সৃষ্টি করেছেন।…… এবং পৃথিবীকে এরপর বিস্তৃত করেছেন।”(৭৯:২৭-৩০) এখানে মহান আল্লাহ্ আকাশ সৃষ্টির কথা উল্লেখ করেছেন যমীনের পূর্বে। আর এখানে (সূরায়ে হা-মীম, আস্ সাজদায়) বলেছেনঃ (আরবী) এখানে তিনি যমীন সৃষ্টি করার কথা উল্লেখ করেছেন আকাশ সৃষ্টির পূর্বে। আর মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেছেনঃ (আরবী) তাহলে কি আল্লাহ্ এরূপ ছিলেন, তারপর গত হয়ে গেছেন? দয়া করে এগুলোর সঠিক অর্থ বুঝিয়ে দিন, যাতে অনৈক্য দূর হয়ে যায়। লোকটির এসব প্রশ্নের উত্তরে হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেনঃ “যে দু’টি আয়াতের একটির মধ্যে পরস্পর জিজ্ঞাসাবাদের কথা রয়েছে এবং অন্যটিতে তা অস্বীকার করা হয়েছে। এটা দুই সময়ের কথা। শিংগায় দুটি ফুকার দেয়া হবে। প্রথম ফুৎকারের সময় পরস্পরের মধ্যে কোন জিজ্ঞাসাবাদ হবে না। দ্বিতীয় ফুঙ্কারের সময় পরস্পরের মধ্যে জিজ্ঞাসাবাদ হবে। যে দুটি আয়াতের একটির মধ্যে কোন কথা গোপন না করার এবং অন্য আয়াতে গোপন করার কথা রয়েছে। এরও স্থল দু’টি। যখন মুশরিকরা দেখবে যে, একত্ববাদীদের গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়েছে তখন তারা বলবেঃ “আমরা মুশরিক ছিলাম না। কিন্তু যখন তাদের মুখে মোহর লেগে যাবে এবং দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো সাক্ষ্য দিতে শুরু করবে তখন আর কিছুই গোপন থাকবে না এবং তাদের কৃতকর্মের স্বীকারুক্তি হয়ে যাবে। তখন তারা বলবেঃ “হায়! আমরা যদি মাটি হয়ে যেতাম।”

আসমান এবং যমীনের সৃষ্টির ক্রম পর্যায়ের ব্যাপারেও কোন অনৈক্য নেই। প্রথমে দুই দিনে যমীনকে সৃষ্টি করা হয়। তারপর দুই দিনে আসমানকে সৃষ্টি করা হয়। অতঃপর যমীনের জিনিসগুলো, যেমন পানি, চারা, পাহাড়-পর্বত, প্রস্তরাদি, জড় পদার্থ ইত্যাদি দুই দিনে সৃষ্টি করেন। (আরবী)-এর অর্থ এটাই। সুতরাং যমীনের পূর্ণ সৃষ্টিকার্য চার দিনে হয়েছে। আর আসমান সৃষ্টি করেছেন দুই দিনে।

যে নামগুলো আল্লাহ তা’আলা নিজের জন্যে নির্ধারণ করেছেন ওগুলোর তিনি বর্ণনা দিয়েছেন যে, সদা-সর্বদা তিনি ঐরূপই থাকবেন। আল্লাহ তা’আলার কোন ইচ্ছাই অপূর্ণ থাকে না। সুতরাং কুরআন কারীমের মধ্যে মোটেই অনৈক্য নেই এবং এর আয়াতগুলো পরস্পর বিরোধী নয়। এর এক একটি শব্দ আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলার পক্ষ হতে এসেছে।

যমীনকে আল্লাহ তা’আলা দুই দিনে সৃষ্টি করেছেন অর্থাৎ রবিবার ও সোমবারে। আর যমীনের উপর পাহাড়-পর্বত বানিয়েছেন। যমীনকে তিনি বরকতময় করেছেন। মানুষ এতে বীজ বপন করে এবং তা হতে গাছ, ফলমূল ইত্যাদি উৎপন্ন হয়। পৃথিবীবাসীর যেসব জিনিসের প্রয়োজন তার সবই যমীনেই উৎপন্ন হয়। ক্ষেত এবং বাগানের স্থানও তিনি বানিয়ে দিয়েছেন। যমীনের এই ঠিক-ঠাককরণ মঙ্গল ও বুধবারে হয়। চার দিনে যমীনের সৃষ্টিকার্য সমাপ্ত হয়। যে লোকগুলো এর জ্ঞান লাভ করতে চাচ্ছিল তারা পূর্ণ জবাব পেয়ে যায়। সুতরাং এ বিষয়ে তারা জ্ঞান লাভে সক্ষম হয়।

যমীনের প্রতিটি অংশে মহান আল্লাহ ঐ জিনিস সরবরাহ করেছেন যা তথাকার বাসিন্দার জন্যে উপযোগী। যেমন ইয়ামনে আসব’, সাকূরে ‘সাকূরী’ এবং রাষ্ট্র এ তায়ালিসা’। আয়াতের শেষ বাক্যের ভাবার্থ এটাই। এটাও বলা। হয়েছে যে, যার যা প্রয়োজন ছিল, আল্লাহ তা’আলা তার জন্যে তা সরবরাহ করেছেন। এ অর্থটি আল্লাহ তা’আলার নিম্নের উক্তির সহিত সাদৃশ্যপূর্ণঃ (আরবী) অর্থাৎ “তোমরা যা কিছু চেয়েছে, তিনি (আল্লাহ) তোমাদেরকে তার সবই দিয়েছেন।”(১৪:৩৪) এসব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।

মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ অতঃপর তিনি আকাশের দিকে মনোনিবেশ করেন যা ছিল ধূম্রপুঞ্জ বিশেষ। আল্লাহ একে এবং পৃথিবীকে বললেনঃ তোমরা উভয়ে এসো ইচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায়। অর্থাৎ আমার হুকুম মেনে নিয়ে আমি যা বলি তাই হয়ে যাও, খুশী মনে অথবা বাধ্য হয়ে।

হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, যেমন আকাশকে হুকুম করা হলো সূর্য, চন্দ্র ও তারকারাজি উদিত করার। আর যমীনকে হুকুম করা হলো পানির নহর জারী করার এবং ফল-মূল উৎপন্ন করার ইত্যাদি। উভয়েই খুশী মনে হুকুম মেনে নিতে সম্মত হয়ে গেল এবং বললোঃ “আমরা আসলাম অনুগত হয়ে। কথিত আছে যে, এদুটোকে কথোপকথনকারীদের স্থলাভিষিক্ত করা হয়। একথাও। বলা হয়েছে যে, যমীনের ঐ অংশ কথা বলেছিল যেখানে কাবা ঘর নির্মিত হয়েছে। আর আসমানের ঐ অংশ কথা বলেছিল যা ঠিক এর উপরে রয়েছে। এসব ব্যাপারে সঠিক জ্ঞানের অধিকারী একমাত্র আল্লাহ।

ইমাম হাসান বসরী (রঃ) বলেন যে, যদি আসমান ও যমীন আনুগত্য স্বীকার না করতো তবে ওদেরকে শাস্তি দেয়া হতো, যে শাস্তির যন্ত্রণা তারা অনুভব করতো।

অতঃপর আল্লাহ তা’আলা আকাশমণ্ডলকে দুই দিনে সপ্তাকাশে পরিণত করলেন। অর্থাৎ বৃহস্পতিবার ও শুক্রবারে। প্রত্যেক আকাশে তিনি ইচ্ছামত জিনিস ও ফেরেশতামণ্ডলী প্রতিষ্ঠিত ও নিয়োজিত করে দেন। দুনিয়ার আকাশকে তিনি তারকারাজি দ্বারা সুশোভিত করেন যেগুলো যমীনে আলো বিচ্ছুরিত করে এবং ঐ শয়তানদের প্রতি ওরা সজাগ দৃষ্টি রাখে যারা উর্ধ জগতের কিছু শুনবার উদ্দেশ্য উপরে উঠার ইচ্ছা করে এবং ওগুলো সব দিক হতে ঐ শয়তানদের প্রতি নিক্ষিপ্ত হয়।

মহান আল্লাহ বলেনঃ এটা পরাক্রমশালী, সর্বজ্ঞ আল্লাহর ব্যবস্থাপনা, যিনি সবারই উপর বিজয়ী, যিনি বিশ্বজগতের প্রতিটি অংশের সমস্ত প্রকাশ্য ও গোপনীয় বিষয়ের খবর রাখেন।

হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, ইয়াহূদীরা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে আসমান ও যমীনের সৃষ্টিকার্য সম্পর্কে প্রশ্ন করলে তিনি উত্তরে বলেনঃ “আল্লাহ তা’আলা রবিবার ও সোমবারে যমীন সৃষ্টি করেন। পাহাড় পর্বত এবং সমুদয় উপকারী বস্তুকে সৃষ্টি করেন মঙ্গলবারে। বুধবারে গাছ-পালা, পানি, শহর এবং আবাদী ও অনাবাদি অর্থাৎ জনপদ ও মরু প্রান্তর সৃষ্টি করেন। সুতরাং এটা হলো চার দিন।” এটা বর্ণনা করার পর রাসূলুল্লাহ (সঃ) এ আয়াতটিই পাঠ করেন। অতঃপর বলেনঃ “বৃহস্পতিবারে আল্লাহ তা’আলা আসমান সৃষ্টি করেন এবং শুক্রবারে তিন ঘন্টা বাকী থাকা পর্যন্ত নক্ষত্ররাজি, সূর্য, চন্দ্র এবং ফেরেশতামণ্ডলী সৃষ্টি করেন। দ্বিতীয় ঘন্টায় প্রত্যেকটি জিনিসের উপর বিপদ আপতিত করেন যার থেকে লোক উপকার লাভ করে থাকে। তৃতীয় ঘন্টায় তিনি হযরত আদম (আঃ)-কে সৃষ্টি করেন, তাঁকে বেহেশতে প্রতিষ্ঠিত করেন, ইবলীসকে হুকুম করেন হযরত আদম (আঃ)-কে সিজদা করার এবং পরিশেষে তাকে সেখান হতে বের করে দেন।” ইয়াহূদীরা বললোঃ “হে মুহাম্মাদ (সঃ)! এরপর কি হলো?” তিনি উত্তরে বললেনঃ “অতঃপর তিনি আরশে সমাসীন হন। তারা বললোঃ “আপনি সবই ঠিক বলেছেন, কিন্তু শেষ কথাটি বলেননি। তা হলো এই যে, অতঃপর তিনি আরাম গ্রহণ করেন। তাদের একথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সঃ) রাগান্বিত হলেন। তখন নিম্নলিখিত আয়াত অবতীর্ণ হয়ঃ (আরবী) অর্থাৎ “আমি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী এবং এতদুভয়ের মধ্যস্থিত সবকিছু সৃষ্টি করেছি ছয় দিনে; আমাকে কোন ক্লান্তি স্পর্শ করেনি। অতএব, তারা যা বলে তাতে তুমি ধৈর্য ধারণ কর।”(৫০:৩৮-৩৯) (এটা ইবনে জারীর (রঃ) বর্ণনা করেছেন। কিন্তু এ বর্ণনাটি গারীব)

হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, (একদা) রাসূলুল্লাহ (সঃ) আমার হাত ধরে বললেনঃ “আল্লাহ তা’আলা মাটিকে শনিবারের দিন সৃষ্টি করেন। তাতে পর্বতমালা স্থাপন করেন রবিবারে। বৃক্ষরাজি সৃষ্টি করেন সোমবারে। অপ্রীতিকর জিনিস সৃষ্টি করেন মঙ্গলবারে। আলো সৃষ্টি করেন বুধবারে। জীব-জন্তু যমীনে ছড়িয়ে দেন বৃহস্পতিবারে। আর শুক্রবারের দিন আসরের এবং রাত্রির মাঝামাঝি সময়ে, দিনের শেষ ভাগে হযরত আদম (আঃ)-কে সৃষ্টি করেন এবং এভাবে সৃষ্টিকার্য সমাপ্ত করেন।” (এ হাদীসটি ইবনে জুরায়েজ (রঃ) বর্ণনা করেন। ইমাম মুসলিম (রঃ) এবং ইমাম নাসাঈও (রঃ) এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। কিন্তু এটাও গারীব হাদীস। ইমাম বুখারী (রঃ) এটাকে মুআল্লাল বলেছেন এবং বলেছেন যে, কেউ কেউ এটাকে হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে এবং হযরত হুরাইরা (রাঃ) কা’ব আহবার (রাঃ) হতে বর্ণনা করেছেন এবং এটাই সঠিকতম)
১৩-১৮ নং আয়াতের তাফসীর:

আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ হে মুহাম্মাদ (সঃ)! তোমাকে যারা অবিশ্বাস করছে। এবং আল্লাহর সাথে কুফরী করছে তাদেরকে বলে দাও- তোমরা যদি শিক্ষা ও উপদেশমূলক কথা হতে মুখ ফিরিয়ে নাও তবে তোমাদের পরিণাম ভাল হবে না। জেনে রেখো যে, তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মতরা তাদের নবীদেরকে (আঃ) অমান্য করার কারণে ধ্বংসের মুখে পতিত হয়েছে, তোমাদের কৃতকর্ম যেন তোমাদেরকে তাদের মত না করে দেয়। আ’দ, সামূদ এবং তাদের মত অন্যান্য সম্প্রদায়ের অবস্থা তোমাদের সামনে রয়েছে। তাদের কাছে পর্যায়ক্রমে রাসূলদের আগমন ঘটেছিল। তারা এই গ্রামে, ঐ গ্রামে, এই বস্তীতে, সেই বস্তীতে এসে তাদেরকে আল্লাহর বাণী শুনাতে থাকতেন। কিন্তু তারা গর্বভরে তাদের কথা প্রত্যাখ্যান করে। তারা রাসূলদেরকে (আঃ) বলেঃ আমাদের প্রতিপালকের এইরূপ ইচ্ছা হলে তিনি অবশ্যই ফেরেশতা প্রেরণ করতেন। অতএব, তোমরা যা সহ প্রেরিত হয়েছে আমরা তা প্রত্যাখ্যান করলাম।

আ’দ সম্প্রদায়ের ব্যাপার এই যে, তারা পৃথিবীতে অযথা দম্ভ করতো। ভূ-পৃষ্ঠে তারা বিপর্যয় সৃষ্টি করতো। তাদের গর্ব ও হঠকারিতা চরমে পৌঁছে। গিয়েছিল। তাদের ঔদ্ধত্য ও অগ্রাহ্যতা এমন শেষ সীমায় পৌঁছে গিয়েছিল যে, তারা বলে উঠেছিলঃ “আমাদের অপেক্ষা শক্তিশালী আর কে আছে?” অর্থাৎ আমাদের মত শক্তিশালী, দৃঢ় ও মযবূত আর কেউ নেই। সুতরাং আল্লাহর আযাব আমাদের কি ক্ষতি করতে পারে?

তারা এতো বেশী ফুলে উঠে যে, আল্লাহকে সম্পূর্ণরূপে বিস্মৃত হয়। তারা কি তবে লক্ষ্য করেনি যে, আল্লাহ, যিনি তাদের সৃষ্টিকর্তা, তিনি তাদের চেয়ে বহু গুণে শক্তিশালী? তার শক্তির অনুমানও করা যায় না। যেমন মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “আমি আমার হাতে আকাশ সৃষ্টি করেছি এবং আমি ব্যাপক ক্ষমতার অধিকারী।”(৫১:৪৭)।

প্রবল প্রতাপান্বিত আল্লাহ বলেনঃ অতঃপর আমি তাদেরকে পার্থিব জীবনে লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি আস্বাদন করাবার জন্যে তাদের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেছিলাম ঝঞাবায়ু অশুভ দিনে, যাতে তাদের দর্প চূর্ণ হয়ে যায় এবং তারা সমূলে ধ্বংস হয়।

(আরবী) বলা হয় ভীষণ শব্দ বিশিষ্ট বায়ুকে। পূর্বদিকে একটি নদী রয়েছে, যা ভীষণ শব্দ করে প্রবাহিত হয়। এ জন্যে আরববাসী ওটাকেও (আরবী) বলে থাকে। দ্বারা পর্যায়ক্রমে বা অনবরত চলা বুঝানো হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “(ঐ ঝঞাবায়ু তাদের উপর) সপ্তরাত্রি ও অষ্টদিবস বিরামহীন ভাবে (প্রবাহিত হয়েছিল)।”(৬৯:৭) মহান আল্লাহ আর এক জায়গায় বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “(তাদের উপর আমি প্রেরণ করেছিলাম ঝঞাবায়ু) নিরবচ্ছিন্ন দুর্ভাগ্যের দিনে।”(৫৪:১৯) যে শাস্তি তাদের উপর আপতিত হয়েছিল সাত রাত এবং আট দিন পর্যন্ত স্থায়ীভাবে ছিল। ফলে সবাই তারা ধ্বংসের ঘাটে এসে পতিত হয়েছিল এবং তাদের বীজ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। আর পরকালের শাস্তি তো অধিকতর লাঞ্ছনাদায়ক এবং তাদেরকে সাহায্য করা হবে না। না দুনিয়ায় কেউ তাদের সাহায্য করতে পারলো, না পরকালে কেউ তাদের সাহায্য করতে পারবে। উভয় জগতেই তারা বন্ধনহীন রয়ে গেল।

প্রবল পরাক্রান্ত আল্লাহ বলেনঃ আর সামূদ সম্প্রদায়ের ব্যাপার তো এই যে, আমি তাদেরকে পথ-নির্দেশ করেছিলাম। হিদায়াত তাদের কাছে খুলে দিয়েছিলাম এবং তাদেরকে সৎপথে আহ্বান করেছিলাম। হযরত সালেহ (আঃ) তাদের কাছে সত্যকে প্রকাশ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু এতদসত্ত্বেও তারা বিরোধিতা ও মিথ্যা প্রতিপন্ন করে এবং হযরত সালেহ (আঃ)-এর সত্যবাদিতার। প্রমাণ হিসেবে আল্লাহ্ তা’আলা যে উষ্ট্ৰীটি পাঠিয়েছিলেন তারা তার পা কেটে ফেলে। ফলে তাদের উপরও আল্লাহর শাস্তি এসে পড়ে। তাদেরকে লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি আঘাত হানলো, অর্থাৎ তাদেরকে ধ্বংস করে দেয়া হলো এক প্রলয়ংকর বিপর্যয় দ্বারা। এটা ছিল তাদের কৃতকর্মেরই প্রতিফল।

তাদের মধ্যে যারা আল্লাহ তাআলার উপর ঈমান এনেছিল এবং নবীদের (আঃ) সত্যতা স্বীকার করেছিল এবং অন্তরে আল্লাহর ভয় রাখতো তাদেরকে আল্লাহ তা’আলা বাঁচিয়ে নেন। তাদের মোটেই কষ্ট হয়নি। তারা তাদের নবী (আঃ)-এর সাথে আল্লাহ তা’আলার লাঞ্ছনাজনক শাস্তি হতে পরিত্রাণ লাভ করে।
১৯-২৪ নং আয়াতের তাফসীর:

আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ এই মুশরিকদেরকে বলে দাও- কিয়ামতের দিন তাদেরকে জাহান্নাম অভিমুখে সমবেত করা হবে এবং জাহান্নামের রক্ষক তাদেরকে একত্রিত করবেন। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “আমি অপরাধীদেরকে জাহান্নামের দিকে কঠিন পিপাসার্ত অবস্থায় হাঁকিয়ে নিয়ে যাবো।”(১৯:৮৬) তাদেরকে জাহান্নামের ধারে দাঁড় করিয়ে দেয়া হবে এবং তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, দেহ, কর্ণ, চক্ষু এবং ত্বক তাদের আমলগুলোর সাক্ষ্য প্রদান করবে। তাদের পূর্বের ও পরের সমস্ত দোষ প্রকাশিত হয়ে পড়বে। দেহের প্রতিটি অঙ্গ বলে উঠবেঃ “সে আমার দ্বারা এই গুনাহ করেছে।” তখন সে নিজের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোকে ভৎসনা করে বলবেঃ “কেন তোমরা আমার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য প্রদান করছো?” তারা উত্তরে বলবেঃ “আমরা আল্লাহ তাআলার নির্দেশ পালন করছি মাত্র। তিনি আমাদেরকে কথা বলার শক্তি দান করেছেন। সুতরাং আমরা সত্য সত্য কথা শুনিয়ে দিয়েছি। তিনিই তোমাদেরকে প্রথমে সৃষ্টিকারী। তিনিই সবকিছুকে বাকশক্তি দান করেছেন। সৃষ্টিকর্তার বিরুদ্ধাচরণ এবং তার হুকুমের অবাধ্যাচরণ কে করতে পারে?

হযরত আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একদা রাসূলুল্লাহ (সঃ) হেসে উঠেন। অতঃপর তিনি বললেনঃ “আমি কেন হাসলাম তা তোমরা আমাকে জিজ্ঞেস করলে না যে?” সাহাবীগণ (রাঃ) তখন বললেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আপনি হাসলেন কেন?” উত্তরে তিনি বললেন, কিয়ামতের দিন বান্দার তার প্রতিপালকের সাথে ঝগড়ার কথা মনে করে আমি বিস্ময়বোধ করছি। বান্দা বলবেঃ “হে আমার প্রতিপালক! আপনি কি আমার সঙ্গে অঙ্গীকার করেননি যে, আপনি আমার উপর যুলুম করবেন না?আল্লাহ তা’আলা জবাবে বলবেনঃ “হ্যা (অবশ্যই করেছিলাম)।” সে বলবেঃ “আমি তো আমার আমলের উপর আমার নিজের ছাড়া আর কারো সাক্ষ্য কবুল করবে না। তখন আল্লাহ তাআলা বলবেনঃ “আমি এবং আমার সম্মানিত ফেরেশতারা কি সাক্ষ্য দেয়ার জন্যে যথেষ্ট নই?” কিন্তু সে বারবার তার একথাই বলতে থাকবে। তখন আল্লাহ তা’আলা সমস্ত জ্জতের জন্যে তার মুখে মোহর লাগিয়ে দিবেন এবং তার। দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোকে বলা হবেঃ “সে যা কিছু করেছে তার সাক্ষ্য তোমরা প্রদান কর।” তারা তখন পরিষ্কারভাবে সত্য সাক্ষ্য দিয়ে দিবে। সে তখন। তাদেরকে তিরস্কার করে বলবেঃ “আমি তো তোমাদেরকেই রক্ষা করার জন্যে তর্ক করছিলাম।” (এ হাদীসটি হাফিয আবু বকর আল বাযযায় (রঃ) বর্ণনা করেছেন। ইমাম মুসলিম (রঃ) ও ইমাম নাসাঈ (রঃ) এটা তাখরীজ করেছেন)

হযরত আবূ মূসা আশআরী (রাঃ) বলেনঃ “কাফির এবং মুনাফিকদেরকে হিসাবের জন্যে ডাক দেয়া হবে। তিনি তাদের প্রত্যেকের সামনে তার কৃতকর্ম পেশ করবেন। তাদের প্রত্যেক ব্যক্তি শপথ করে করে নিজের কৃতকর্ম অস্বীকার করবে এবং বলবেঃ “হে আমার প্রতিপালক! আপনার ফেরেশতারা এমন কিছু লিখে রেখেছেন যা আমি কখনো করিনি। ফেরেশতারা বলবেনঃ “তুমি কি অমুক দিন অমুক জায়গায় অমুক আমল করনি?” সে উত্তরে বলবেঃ “হে আমার প্রতিপালক! আপনার মর্যাদার শপথ! আমি এ কাজ কখনো করিনি।” অতঃপর তার মুখে মোহর লাগিয়ে দেয়া হবে এবং দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য প্রদান করবে। সর্বপ্রথম তার ডান উরু কথা বলবে।” (এটা ইমাম ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী (সঃ) বলেছেনঃ “কিয়ামতের দিন কাফিরের সামনে তার কৃত মন্দ আমলগুলো পেশ করা হবে। সে তখন ওগুলো অস্বীকার করবে এবং তর্ক-বিতর্ক শুরু করে দিবে। তখন আল্লাহ তা’আলা বলবেনঃ “এই যে তোমার প্রতিবেশীরা তোমার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিচ্ছে?” সে বলবেঃ “তারা মিথ্যা বলছে।” মহান আল্লাহ বলবেনঃ “এই যে এরা তোমার পরিবারবর্গ, এরা সাক্ষ্য দিচ্ছে? সে উত্তর দিবেঃ “এরাও সবাই মিথ্যাবাদী।” আল্লাহ তা’আলা তখন তাদেরকে শপথ করাবেন। তখন তারা শপথ করবে। তথাপি সে অস্বীকারই করবে। আল্লাহ তাআলা তখন তাদেরকে নীরব করবেন এবং স্বয়ং তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দান করবে এবং তাদেরকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।” (এ হাদীসটি হাফিয আবুল ইয়ালা (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

বর্ণিত আছে যে, হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) ইবনুল আরাক (রঃ)-কে বলেনঃ “কিয়ামতের দিন একটি সময় তো এমন হবে যে, কাউকেও কথা বলার অনুমতি দেয়া হবে না এবং কোন ওযর-আপত্তিও শুনা হবে না। অতঃপর যখন কথা বলার অনুমতি দেয়া হবে তখন বান্দা ঝগড়া ও তর্ক-বিতর্ক করতে শুরু করবে এবং স্বীয় কৃতকর্মকে অস্বীকার করে বসবে। তারা মিথ্যা শপথ করবে। অবশেষে তাদের মুখে মোহর লাগিয়ে দেয়া হবে। সুতরাং তাদের মুখ বন্ধ হয়ে যাবে। তখন তাদের ত্বক, চক্ষু, হাত, পা ইত্যাদি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য প্রদান করবে। অতঃপর তাদের মুখ খুলে দেয়া হবে। তখন তারা তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোকে তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয়ার কারণে তিরস্কার করবে। তারা তখন বলবেঃ “আল্লাহ, যিনি সবকিছুকে বাকশক্তি দিয়েছেন তিনি। আমাদেরকেও বাকশক্তি দিয়েছেন। তিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন প্রথমবার এবং তাঁর নিকট তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে।’ তখন মুখও স্বীকার করে নিবে।” (এটা ইমাম ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

হযরত রাফে আবুল হাসান (রঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, স্বীয় কৃতকর্ম অস্বীকার করার কারণে তার জিহ্বা এতো মোটা করে দেয়া হবে যে, ওটা একটা কথাও বলতে পারবে না। তখন দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোকে সাক্ষ্য দিতে বলা হবে। তারা প্রত্যেকেই তখন নিজ নিজ আমলের কথা বলে দিবে। কর্ণ, চক্ষু, ত্বক, লজ্জাস্থান, হাত, পা ইত্যাদি সবাই সাক্ষ্য দিবে। (এটাও ইমাম ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

এর অনুরূপ আরো বহু হাদীস ও আসার সূরায়ে ইয়াসীনের নিম্নের আয়াতের তাফসীরে বর্ণিত হয়েছে। সুতরাং এখানে পুনরাবৃত্তি নিষ্প্রয়োজন। আয়াতটি হলোঃ (আরবী) অর্থাৎ “আমি আজ তাদের মুখ মোহর করে দিবো, তাদের হস্ত কথা বলবে আমার সাথে এবং তাদের চরণ সাক্ষ্য দিবে তাদের কৃতকর্মের।”(৩৬:৬৫)।

হযরত জাবির ইবনে আবদিল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, যখন আমরা সমুদ্রের হিজরত হতে ফিরে আসি তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) একদা আমাদেরকে বললেনঃ “তোমরা হাবশা দেশে (আবিসিনিয়ায়) বিস্ময়কর ঘটনা কিছু দেখে থাকলে বর্ণনা কর।” তখন একজন যুবক বললোঃ “একদা আমরা সেখানে বসে আছি এমন সময় তাদের আলেমদের একজন বৃদ্ধা মহিলা মাথায় একটি কলসি নিয়ে আমাদের পার্শ্ব দিয়ে গমন করে। তাদের একজন যুবক তাকে ধাক্কা দেয়। ফলে সে পড়ে যায় এবং কলসিটি ভেঙ্গে যায়। তখন ঐ বৃদ্ধা মহিলাটি উঠে ঐ যুবকটির দিকে দৃষ্টিপাত করে বললোঃ “ওরে প্রতারক! তুই এর পরিণাম তখনই জানতে পারবি যখন আল্লাহ তাআলা স্বীয় কুরসীর উপর সমাসীন হবেন এবং তার বান্দাদেরকে একত্রিত করবেন। ঐ সময় তাদের হাত, পা তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য প্রদান করবে এবং প্রত্যেকের প্রত্যেকটি আমল প্রকাশিত হয়ে পড়বে। ঐদিন তোর এবং আমার মধ্যে ফায়সালা হয়ে যাবে।” একথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “বৃদ্ধা মহিলাটি সত্য কথাই বলেছে, আল্লাহ তা’আলা ঐ সম্প্রদায়কে কিভাবে পবিত্র করবেন যাদের দুর্বলদের প্রতিশোধ সবলদের হতে গ্রহণ না করবেন?” (এ হাদীসটি ইমাম ইবনে হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন। এটা এই সনদে গারীব)

ইবনে আবিদ দুনিয়া (রঃ) এই রিওয়াইয়াতটিই অন্য সনদে বর্ণনা করেছেন। যখন বান্দা স্বীয় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোকে তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দানের কারণে ভসনা। করবে তখন তারা উত্তর দিতে গিয়ে এ কথাও বলবেঃ “তোমাদের আমলগুলো আসলে গোপন ছিল না। আল্লাহ তা’আলার দৃষ্টির সামনে তোমরা কুফরী ও অবাধ্যাচরণের কাজে লিপ্ত থাকতে এবং কিছুই পরোয়া করতে না। কেননা, তোমরা মনে করতে যে, তোমাদের বহু কাজ আল্লাহর নিকট গোপন থাকছে। এই মিথ্যা ধারণাই তোমাদেরকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছে। তাই আজ তোমরা ধ্বংস হয়ে গেছে।”

হযরত আবদুল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ “একদা আমি কাবা শরীফের পর্দার আড়ালে লুকিয়ে ছিলাম। এমতাবস্থায় তথায় তিনজন লোক আসলো, যাদের পেট ছিল বড় এবং জ্ঞান ছিল কম। তাদের একজন বললোঃ “আচ্ছা বলতো, আমরা যে কথা বলছি তা কি আল্লাহ শুনতে পাচ্ছেন?” দ্বিতীয়জন বললোঃ “আমরা উচ্চস্বরে কথা বললে তিনি শুনতে পান এবং নিম্ন স্বরে কথা বললে তিনি শুনতে পান না।” তৃতীয় জন বললোঃ “তিনি কিছু শুনতে পেলে সবই শুনতে পান।” আমি এসে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট ঘটনাটি বর্ণনা করলাম। তখন আল্লাহ তা’আলা নিম্নের আয়াতগুলো অবতীর্ণ করেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “তোমরা কিছু গোপন করতে না এই বিশ্বাসে যে, তোমাদের কর্ণ, চক্ষু এবং ত্বক তোমাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিবে না ………. ফলে তোমরা হয়েছে ক্ষগ্রিস্ত।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ), ইমাম মুসলিম (রঃ) ও ইমাম তিরমিযী (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

হযরত বাহ্য ইবনে হাকীম (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি তাঁর পিতা হতে এবং তিনি তাঁর দাদা হতে বর্ণনা করেছেন যে, নবী (সঃ) বলেছেনঃ “কিয়ামতের দিন তোমাদেরকে এমন অবস্থায় আহ্বান করা হবে যে, তোমাদের মুখের উপর মোহর মারা থাকবে। তোমাদের মধ্যে কারো আমল সর্বপ্রথম যে (অঙ্গ) প্রকাশ করবে তা হবে তার উরু ও স্কন্ধ।” (এ হাদীসটি আবদুর রাযযাক (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

মা’মার (রঃ) বলেন যে, হযরত হাসান (রঃ) (আরবী) পাঠ করার পরে বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন, আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ “আমার বান্দা আমার সম্পর্কে যে ধারণা পোষণ করে, আমি তার সাথে ঐ ব্যবহারই করে থাকি। আর যখন সে আমাকে ডাকে আমি তখন তার সাথেই থাকি।” হযরত হাসান (রঃ) এটুকু বলার পর কিছুক্ষণ চিন্তা করে আবার বলতে শুরু করেনঃ আল্লাহ সম্পর্কে যে ব্যক্তি যে ধরিণা করে তার আমলও ঐরূপই হয়ে থাকে। মুমিন আল্লাহর প্রতি ভাল ধারণা রাখে বলে তার আমলও ভাল হয়ে থাকে। পক্ষান্তরে কাফির ও মুনাফিক আল্লাহর প্রতি মন্দ ধারণা পোষণ করে বলে তার আমলও মন্দ হয়। অতঃপর তিনি বলেন যে, আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “তোমরা কিছু গোপন করতে না এই বিশ্বাসে যে, তোমাদের কর্ণ, চক্ষু এবং ত্বক তোমাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিবে না …….. তোমাদের প্রতিপালক সম্বন্ধে তোমাদের এই ধারণাই তোমাদের ধ্বংস এনেছে। ফলে তোমরা ধ্বংস হয়েছে।”

হযরত জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “তোমাদের কেউ যেন এই অবস্থা ছাড়া মৃত্যু বরণ না করে যে, আল্লাহর প্রতি তার ধারণা ভাল রয়েছে। কারণ যে সম্প্রদায় আল্লাহর প্রতি মন্দ ধারণা রেখেছে (আরবী) আল্লাহ তাদেরকে ধ্বংস করে দিয়েছেন।” অতঃপর তিনি … (আরবী)-এ আয়াতটিই তিলাওয়াত করেন। (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

এরপর প্রবল প্রতাপান্বিত আল্লাহ বলেনঃ এখন তারা ধৈর্যধারণ করলেও জাহান্নামই হবে তাদের আবাস এবং তারা অনুগ্রহ চাইলেও তারা অনুগ্রহ প্রাপ্ত হবে না। অর্থাৎ জাহান্নামীদের জাহান্নামের মধ্যে ধৈর্যধারণ করা বা না করা সমান। তাদের কোন ওযর-আপত্তিও গ্রহণ করা হবে না এবং তাদের পাপও ক্ষমা করা হবে না। তাদের জন্যে দুনিয়ায় পুনরায় প্রত্যাবর্তনের পথও বন্ধ। এটা আল্লাহ তা’আলার নিম্নের উক্তির মতঃ (আরবী) অর্থাৎ “তারা বলবে- হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের উপর আমাদের। দুর্ভাগ্য ছেয়ে গেছে, নিশ্চয়ই আমরা ছিলাম বিভ্রান্ত। হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে এর থেকে বের করে নিন, যদি আমরা পুনরায় এ কাজই করি তবে তো আমরা অবশ্যই যালিম হবো। আল্লাহ তা’আলা উত্তরে বলবেনঃ তোমরা এর মধ্যেই পড়ে থাকো এবং আমার সাথে কথা বলে না।”(২৩:১০৬-১০৮)
২৫ নং আয়াতের তাফসীর:

আল্লাহ তাআলা বর্ণনা করছেন যে, তিনি মুশরিকদেরকে পথভ্রষ্ট করেছেন। এটা তাঁর ইচ্ছা এবং ক্ষমতা। তিনি তার সমুদয় কাজে নিপুণ। তাঁর প্রতিটি কাজ হিকমত ও নিপুণতা পূর্ণ। তিনি কতকগুলো দানব ও মানবকে মুশরিকদের সাথী করে দেন। তারা তাদের মন্দ আমলগুলোও তাদের দৃষ্টিতে শোভন করে দেখায়। তারা দূর অতীতের দিক দিয়ে এবং ভবিষ্যৎ কালের দিক দিয়েও তাদের আমলগুলোকে ভাল মনে করে থাকে। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “যে ব্যক্তি দয়াময় আল্লাহর স্মরণে বিমুখ হয় আমি তার জন্যে নিয়োজিত করি শয়তান, অতঃপর সেই হয় তার সহচর। শয়তানরাই মানুষকে সৎপথ হতে বিরত রাখে, অথচ মানুষ মনে করে যে, তারা সৎপথে পরিচালিত হচ্ছে।”(৪৩:৩৬-৩৭)।

তাদের উপর আল্লাহর শাস্তির কথা বাস্তব হয়েছে, যেমন তাদের পূর্ববর্তী দানব ও মানবদের উপর শাস্তি বাস্তবায়িত হয়েছিল। তারা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, এরাও তেমনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তারা এবং এরা সমান হয়ে গেছে।

Leave a Reply