أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#১০৯৬)[ *এবং কাফিররা বলে-৫, দ্বীনের দাওয়াত অস্বিকারকারীদের টালবাহানা : -]
www.motaher21.net
সূরা:৪১:হামীম-আস-সাজদাহ
পারা:২৪
৩৭-৫৪ নং আয়াত:-
৪১:হামীম-আস-সাজদাহ-৩৭
وَ مِنۡ اٰیٰتِہِ الَّیۡلُ وَ النَّہَارُ وَ الشَّمۡسُ وَ الۡقَمَرُ ؕ لَا تَسۡجُدُوۡا لِلشَّمۡسِ وَ لَا لِلۡقَمَرِ وَ اسۡجُدُوۡا لِلّٰہِ الَّذِیۡ خَلَقَہُنَّ اِنۡ کُنۡتُمۡ اِیَّاہُ تَعۡبُدُوۡنَ ﴿۳۷﴾
এই রাত ও দিন এবং চন্দ্র ও সূর্য আল্লাহর নিদর্শনের অন্তর্ভুক্ত। সূর্য ও চাঁদকে সিজদা করো না, সেই আল্লাহকে সিজদা করো যিনি তাদের সৃষ্টি করেছেন, যদি সত্যিই তোমরা তাঁর ইবাদাতকারী হও।
৪১:হামীম-আস-সাজদাহ-৩৮
فَاِنِ اسۡتَکۡبَرُوۡا فَالَّذِیۡنَ عِنۡدَ رَبِّکَ یُسَبِّحُوۡنَ لَہٗ بِالَّیۡلِ وَ النَّہَارِ وَ ہُمۡ لَا یَسۡـَٔمُوۡنَ ﴿ٛ۳۸﴾
কিন্তু যদি অহংকার করে এসব লোকেরা নিজেদের কথায় গোঁ ধরে থাকে। তবে পরোয়া নেই। যেসব ফেরেশতা তোমার রবের সান্নিধ্য লাভ করেছে তারা রাত দিন তাঁর তাসবীহ বর্ণনা করছে এবং কখনো ক্লান্ত হয় না।
৪১:হামীম-আস-সাজদাহ-৩৯
وَ مِنۡ اٰیٰتِہٖۤ اَنَّکَ تَرَی الۡاَرۡضَ خَاشِعَۃً فَاِذَاۤ اَنۡزَلۡنَا عَلَیۡہَا الۡمَآءَ اہۡتَزَّتۡ وَ رَبَتۡ ؕ اِنَّ الَّذِیۡۤ اَحۡیَاہَا لَمُحۡیِ الۡمَوۡتٰی ؕ اِنَّہٗ عَلٰی کُلِّ شَیۡءٍ قَدِیۡرٌ ﴿۳۹﴾
এটিও আল্লাহর নিদর্শনসমূহের একটি যে তোমরা দেখতে পাও ভূমি শুষ্ক শস্যহীন পড়ে আছে। অতঃপর আমি যেই মাত্র সেখানে পানি বর্ষণ করি অকস্মাৎ তা অঙ্কুরোদগমে সুসজ্জিত হয়ে ওঠে। যে আল্লাহ এই মৃত ভূমিকে জীবন্ত করে তোলেন, নিশ্চিতভাবেই তিনি মৃতদেরকেও জীবন দান করবেন। নিশ্চয়ই তিনি সব কিছু করতে সক্ষম।
৪১:হামীম-আস-সাজদাহ-৪০
اِنَّ الَّذِیۡنَ یُلۡحِدُوۡنَ فِیۡۤ اٰیٰتِنَا لَا یَخۡفَوۡنَ عَلَیۡنَا ؕ اَفَمَنۡ یُّلۡقٰی فِی النَّارِ خَیۡرٌ اَمۡ مَّنۡ یَّاۡتِیۡۤ اٰمِنًا یَّوۡمَ الۡقِیٰمَۃِ ؕ اِعۡمَلُوۡا مَا شِئۡتُمۡ ۙ اِنَّہٗ بِمَا تَعۡمَلُوۡنَ بَصِیۡرٌ ﴿۴۰﴾
যারা আমার আয়াতসমূহের উল্টা অর্থ করে তারা আমার অগোচরে নয়। নিজেই চিন্তা করে দেখো যে ব্যক্তিকে আগুনে নিক্ষেপ করা হবে সেই ব্যক্তিই ভাল, না যে ব্যক্তি কিয়ামতের দিন নিরাপদ অবস্থায় হাজির হবে সে-ই ভালো? তোমরা যা চাও করতে থাকো, আল্লাহ তোমাদের সব কাজ দেখছেন।
৪১:হামীম-আস-সাজদাহ-৪১
اِنَّ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا بِالذِّکۡرِ لَمَّا جَآءَہُمۡ ۚ وَ اِنَّہٗ لَکِتٰبٌ عَزِیۡزٌ ﴿ۙ۴۱﴾
নিশ্চয় যারা তাদের কাছে কুরআন আসার পর তার সাথে কুফরী করে ; আর এ তো অবশ্যই এক সম্মানিত গ্রন্থ—
৪১:হামীম-আস-সাজদাহ-৪২
لَّا یَاۡتِیۡہِ الۡبَاطِلُ مِنۡۢ بَیۡنِ یَدَیۡہِ وَ لَا مِنۡ خَلۡفِہٖ ؕ تَنۡزِیۡلٌ مِّنۡ حَکِیۡمٍ حَمِیۡدٍ ﴿۴۲﴾
সম্মুখ অথবা পশ্চাৎ হতে মিথ্যা এতে প্রক্ষিপ্ত হতে পারে না। এ প্রজ্ঞাময়, প্রশংসার্হ আল্লাহর নিকট হতে অবতীর্ণ।
৪১:হামীম-আস-সাজদাহ-৪৩
مَا یُقَالُ لَکَ اِلَّا مَا قَدۡ قِیۡلَ لِلرُّسُلِ مِنۡ قَبۡلِکَ ؕ اِنَّ رَبَّکَ لَذُوۡ مَغۡفِرَۃٍ وَّ ذُوۡ عِقَابٍ اَلِیۡمٍ ﴿۴۳﴾
আপনাকে শুধু তা-ই বলা হয়, যা বলা হতো আপনার পূর্ববর্তী রাসূলগণকে। নিশ্চয় আপনার রব একান্তই ক্ষমাশীল এবং যন্ত্রণাদায়ক শাস্তিদাতা।
৪১:হামীম-আস-সাজদাহ-৪৪
وَ لَوۡ جَعَلۡنٰہُ قُرۡاٰنًا اَعۡجَمِیًّا لَّقَالُوۡا لَوۡ لَا فُصِّلَتۡ اٰیٰتُہٗ ؕ ءَؔاَعۡجَمِیٌّ وَّ عَرَبِیٌّ ؕ قُلۡ ہُوَ لِلَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا ہُدًی وَّ شِفَآءٌ ؕ وَ الَّذِیۡنَ لَا یُؤۡمِنُوۡنَ فِیۡۤ اٰذَانِہِمۡ وَقۡرٌ وَّ ہُوَ عَلَیۡہِمۡ عَمًی ؕ اُولٰٓئِکَ یُنَادَوۡنَ مِنۡ مَّکَانٍۭ بَعِیۡدٍ ﴿٪۴۴﴾
আমি যদি একে আজমী কুরআন বানিয়ে পাঠাতাম তাহলে এসব লোক বলতো, এর আয়াতসমূহ সুস্পষ্ট করে বর্ণনা করা হয়নি কেন? কি আশ্চর্য কথা, আজমী বাণীর শ্রোতা আরবী ভাষাভাষী এদের বলো, এ কুরআন মু’মিনদের জন্য হিদায়াত ও রোগমুক্তি বটে। কিন্তু যারা ঈমান আনে না এটা তাদের জন্য পর্দা ও চোখের আবরণ। তাদের অবস্থা হচ্ছে এমন যেন দূর থেকে তাদেরকে ডাকা হচ্ছে।
৪১:হামীম-আস-সাজদাহ-৪৫
وَ لَقَدۡ اٰتَیۡنَا مُوۡسَی الۡکِتٰبَ فَاخۡتُلِفَ فِیۡہِ ؕ وَ لَوۡ لَا کَلِمَۃٌ سَبَقَتۡ مِنۡ رَّبِّکَ لَقُضِیَ بَیۡنَہُمۡ ؕ وَ اِنَّہُمۡ لَفِیۡ شَکٍّ مِّنۡہُ مُرِیۡبٍ ﴿۴۵﴾
এর আগে আমি মূসাকে কিতাব দিয়েছিলাম। সে কিতাব নিয়েও এই মতানৈক্য হয়েছিলো তোমার রব যদি পূর্বেই একটি বিষয় ফায়সালা না করে থাকতেন তাহলে এই মতানৈক্যকারীদের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত কার্যকরী করা হতো। প্রকৃত ব্যাপার হলো, এসব লোক সে ব্যাপারে চরম অস্বস্তিকর সন্দেহে নিপতিত।
৪১:হামীম-আস-সাজদাহ-৪৬
مَنۡ عَمِلَ صَالِحًا فَلِنَفۡسِہٖ وَ مَنۡ اَسَآءَ فَعَلَیۡہَا ؕ وَ مَا رَبُّکَ بِظَلَّامٍ لِّلۡعَبِیۡدِ ﴿۴۶﴾
যে সৎকাজ করে সে তার নিজের কল্যাণের জন্যই তা করে এবং কেউ মন্দ কাজ করলে তার প্রতিফল সে-ই ভোগ করবে। আর আপনার রব তাঁর বান্দাদের প্রতি মোটেই যুলুমকারী নন।
৪১:হামীম-আস-সাজদাহ-৪৭
اِلَیۡہِ یُرَدُّ عِلۡمُ السَّاعَۃِ ؕ وَ مَا تَخۡرُجُ مِنۡ ثَمَرٰتٍ مِّنۡ اَکۡمَامِہَا وَ مَا تَحۡمِلُ مِنۡ اُنۡثٰی وَ لَا تَضَعُ اِلَّا بِعِلۡمِہٖ ؕ وَ یَوۡمَ یُنَادِیۡہِمۡ اَیۡنَ شُرَکَآءِیۡ ۙ قَالُوۡۤا اٰذَنّٰکَ ۙ مَا مِنَّا مِنۡ شَہِیۡدٍ ﴿ۚ۴۷﴾
কিয়ামতের জ্ঞান শুধু আল্লাহর কাছেই প্রত্যাবর্তিত হয়। তাঁর অজ্ঞাতসারে কোন ফল আবরণ হতে বের হয় না, কোন নারী গর্ভ ধারণ করে না এবং সন্তানও প্রসব করে না । আর যেদিন আল্লাহ্ তাদেরকে ডেকে বলবেন, ‘আমার শরীকেরা কোথায়?’ তখন তারা বলবে, ‘আমরা আপনার কাছে নিবেদন করি যে, এব্যাপারে আমাদের থেকে কোন সাক্ষী নেই।’
৪১:হামীম-আস-সাজদাহ-৪৮
وَ ضَلَّ عَنۡہُمۡ مَّا کَانُوۡا یَدۡعُوۡنَ مِنۡ قَبۡلُ وَ ظَنُّوۡا مَا لَہُمۡ مِّنۡ مَّحِیۡصٍ ﴿۴۸﴾
আগে তারা যাদেরকে ডাকত তারা তাদের কাছ থেকে উধাও হয়ে যাবে এবং তারা বিশ্বাস করবে যে, তাদের পলায়নের কোন উপায় নেই।
৪১:হামীম-আস-সাজদাহ-৪৯
لَا یَسۡـَٔمُ الۡاِنۡسَانُ مِنۡ دُعَآءِ الۡخَیۡرِ ۫ وَ اِنۡ مَّسَّہُ الشَّرُّ فَیَـُٔوۡسٌ قَنُوۡطٌ ﴿۴۹﴾
মানুষ কল্যাণ প্রার্থনায় কোন ক্লান্তি বোধ করে না, কিন্তু যখন তাকে অকল্যাণ স্পর্শ করে তখন সে প্রচণ্ডভাবে হতাশ ও নিরাশ হয়ে পড়ে;
৪১:হামীম-আস-সাজদাহ-৫০
وَ لَئِنۡ اَذَقۡنٰہُ رَحۡمَۃً مِّنَّا مِنۡۢ بَعۡدِ ضَرَّآءَ مَسَّتۡہُ لَیَقُوۡلَنَّ ہٰذَا لِیۡ ۙ وَ مَاۤ اَظُنُّ السَّاعَۃَ قَآئِمَۃً ۙ وَّ لَئِنۡ رُّجِعۡتُ اِلٰی رَبِّیۡۤ اِنَّ لِیۡ عِنۡدَہٗ لَلۡحُسۡنٰی ۚ فَلَنُنَبِّئَنَّ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا بِمَا عَمِلُوۡا ۫ وَ لَنُذِیۡقَنَّہُمۡ مِّنۡ عَذَابٍ غَلِیۡظٍ ﴿۵۰﴾
যদি দুঃখ-দৈন্য স্পর্শ করার পর আমরা তাকে আমার পক্ষ থেকে অনুগ্রহের আস্বাদন দেই, তখন সে অবশ্যই বলে থাকে, ‘এ আমার প্রাপ্য এবং আমি মনে করি না যে, কিয়ামত সংঘটিত হবে। আর যদি আমাকে আমার রবের কাছে ফিরিয়ে নেয়াও হয়, তবুও তাঁর কাছে আমার জন্য কল্যাণই থাকবে।’ অতএব, আমরা অবশ্যই কাফিরদেরকে তাদের আমল সম্বন্ধে অবহিত করব এবং তাদেরকে অবশ্যই আস্বাদন করাব কঠোর শাস্তি।
৪১:হামীম-আস-সাজদাহ-৫১
وَ اِذَاۤ اَنۡعَمۡنَا عَلَی الۡاِنۡسَانِ اَعۡرَضَ وَ نَاٰ بِجَانِبِہٖ ۚ وَ اِذَا مَسَّہُ الشَّرُّ فَذُوۡ دُعَآءٍ عَرِیۡضٍ ﴿۵۱﴾
আমি যখন মানুষকে নিয়ামত দান করি তখন সে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং গর্বিত হয়ে ওঠে। কিন্তু যখনই কোন অকল্যাণ তাকে স্পর্শ করে তখন লম্বা চওড়া দোয়া করতে শুরু করে।
৪১:হামীম-আস-সাজদাহ-৫২
قُلۡ اَرَءَیۡتُمۡ اِنۡ کَانَ مِنۡ عِنۡدِ اللّٰہِ ثُمَّ کَفَرۡتُمۡ بِہٖ مَنۡ اَضَلُّ مِمَّنۡ ہُوَ فِیۡ شِقَاقٍۭ بَعِیۡدٍ ﴿۵۲﴾
বলুন, ‘তোমরা ভেবে দেখেছ কি, যদি এ কুরআন আল্লাহর কাছ থেকে নাযিল হয়ে থাকে আর তোমরা এটা প্রত্যাখ্যান কর, তবে যে ব্যক্তি ঘোর বিরুদ্ধাচরণে লিপ্ত আছে, তার চেয়ে বেশী বিভ্রান্ত আর কে?’
৪১:হামীম-আস-সাজদাহ-৫৩
سَنُرِیۡہِمۡ اٰیٰتِنَا فِی الۡاٰفَاقِ وَ فِیۡۤ اَنۡفُسِہِمۡ حَتّٰی یَتَبَیَّنَ لَہُمۡ اَنَّہُ الۡحَقُّ ؕ اَوَ لَمۡ یَکۡفِ بِرَبِّکَ اَنَّہٗ عَلٰی کُلِّ شَیۡءٍ شَہِیۡدٌ ﴿۵۳﴾
অচিরেই আমি এদেরকে সর্বত্র আমার নিদর্শনসমূহ দেখাবো এবং তাদের নিজেদের মধ্যেও। যাতে এদের কাছে একথা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, এ কুরআন যথার্থ সত্য এটাই কি যথেষ্ঠ নয় যে, তোমার রব প্রতিটি জিনিস দেখছেন?
৪১:হামীম-আস-সাজদাহ-৫৪
اَلَاۤ اِنَّہُمۡ فِیۡ مِرۡیَۃٍ مِّنۡ لِّقَآءِ رَبِّہِمۡ ؕ اَلَاۤ اِنَّہٗ بِکُلِّ شَیۡءٍ مُّحِیۡطٌ ﴿٪۵۴﴾
জেনে রাখো, এসব লোক তাদের রবের সাথে সাক্ষাত সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করে। শুনে রাখো, তিনি সব জিনিসকে পরিবেষ্টন করে আছেন।
ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
এরপর আর একটি অধ্যায় আসছে, যেখানে বলা হচ্ছে, ‘তাঁর নিদর্শনগুলাের মধ্যে রয়েছে, রাত দিন, সূর্য ও চাঁদ… শােনাে, নিশ্চয়ই তিনি সবকিছুকে আয়ত্তে রাখার মালিক।’(৩৭-৫৪) এখানে দাওয়াত দানের ক্ষেত্রে মানবীয় অন্তরের সাথে বিজড়িত আর একটি অধ্যায় আসছে। এ অধ্যায়ের বিশ্ব প্রকৃতির মধ্যে বিরাজমান নানাপ্রকার নিদর্শন নিয়ে আলােচনা শুরু হচ্ছে, যেমন রাত দিন, সূর্য ও চাঁদ। সাথে সাথে সেসব মােশরেকদেরকে নিয়েও কথা আসছে, যারা আল্লাহর সাথে সূর্য ও চাঁদকে সিজদা করে। এ উভয়টি তাে আল্লাহরই সৃষ্টি। এই নিদর্শনগুলাে পেশ করার পর পরই বলা হচ্ছে, সেসব মােশরেকরা অহংকারের কারণে আল্লাহর এবাদত থেকে দূরে রয়েছে। তারা নিরংকুশভাবে আল্লাহরই একনিষ্ঠ দাসত্ব করায় বিশ্বাসী নয়। তারা মনে করতাে তাদের থেকে বেশী নেককার ও যােগ্যতাসম্পন্ন কিছু লােক আছে, যারা আল্লাহর সৃষ্ট মানুষ হলেও আল্লাহর বেশী প্রিয় এবং তাদের মর্যাদা আল্লাহর কাছে অনেক বেশী। এরপর রয়েছে এই বিশাল পৃথিবী, এর সবটুকু এবং সব কিছু আল্লাহর দাসত্বের শৃংখলে আবদ্ধ। তাদের মত এরা সবাই আল্লাহর কাছ থেকে জীবন পেয়েছে, কিন্তু এরা তাে আল্লাহর কাছে মাথানত করে না। এইভাবে অর্থহীন কথা বলে এরা বিশ্ব প্রকৃতির মধ্যে বিরাজমান বস্তুনিচয় সম্পর্কে সঠিক চিন্তা থেকে দূরে সরে যায়। উপরন্তু তারা কোরআনের আয়াতগুলােকে ভুল প্রমাণিত করার জন্যে যুক্তিহীনভাবে তর্ক-বিতর্ক করে, অথচ তারা নিজেরাই দেখছিলাে আল কোরআন আরবী ভাষায় নাযিল হয়েছে, কোনাে অনারবীয় ভাষার মিশ্রণ এ গ্রন্থে নেই। এরপর আল কোরআন তাদের সামনে কেয়ামতের কিছু দৃশ্য তুলে ধরছে। তাদের সামনে তাদের নিজেদের অস্তিত্ব ও তাদের মধ্য বিরাজমান দুর্বলতাসমূহ তুলে ধরছে। এসব গ্রন্থ তাদেরকে তাদের পরিবর্তনশীলতা ও প্রকৃতিগত ভুল ভ্রান্তির অবস্থা জানাচ্ছে, তারপর তাদের দৃষ্টিকে সকল প্রকার কল্যাণের দিকে আকর্ষণ করছে। দুঃখ কষ্টের মধ্যে তাদের ঘাবড়ে যাওয়ার প্রকৃতি সম্পর্কেও জানিয়ে দিচ্ছে। এতদসত্তেও তারা তাদের শেষ পরিণতি সম্পর্কে চিন্তা করছে না এবং অবশেষে আল্লাহর কাছে গিয়ে এসব ইচ্ছাকৃত অপরাধের জন্যে যে আযাব ভোগ করতে হবে, তার থেকে বাঁচার জন্যেও তাদের কোনাে মাথাব্যথা নেই। আল্লাহর এ ঘােষণার সাথে এই সূরাটির সমাপ্তি টানা হচ্ছে যে, তিনি তাদের সামনে দিগন্তব্যাপী তার শক্তি ক্ষমতার বিভিন্ন নিদর্শনাবলী খুলে দেবেন এবং সেসব রহস্যকে উন্মোচিত করবেন, যা তাদের নিজেদের অস্তিত্বের মধ্যেই বিরাজ করছে, যা দেখে তারা পরিষ্কারভাবে বুঝবে যে, তিনি সত্য এবং তখন তাদের অন্তরের মধ্যে বিরাজমান যাবতীয় সন্দেহ সংশয় আস্তে আস্তে দূর হয়ে যাবে। *সৃষ্টিজগতের দিকে মানবজাতির দৃষ্টি আকর্ষণ : আমরা যদি একটু চোখ তুলে তাকাই, তাহলে দেখতে পাবো আল্লাহর অসংখ্য নিদর্শন সবার চোখের সামনেই রয়েছে। এগুলাে শিক্ষিত অশিক্ষিত সবাই দেখতে পায়। এসবের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা না জানলেও মানব হৃদয়ে এর একটা প্রভাব পড়ে। কারণ, এসবের মাঝে ও মানবজাতির মাঝে যে সম্পর্ক বিদ্যমান তা সেই বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের চেয়েও অধিক গভীর। উভয়ের মধ্যকার সেই সম্পর্ক গড়ে উঠেছে-এর উৎপত্তিকে প্রকৃতিকেও এর গঠন প্রণালীকে কেন্দ্র করে। এ হিসেবে মানবজাতি গােটা সৃষ্টিজগতেরই একটা অংশ অপরদিকে সৃষ্টিজগতও মানবজাতি থেকে ভিন্ন কিছু নয়। উভয়ের গঠনপ্রণালী অভিন্ন, উভয়ের উপাদান অভিন্ন, উভয়ের প্রকৃতি অভিন্ন, উভয়ের নিয়ম নীতি অভিন্ন এবং উভয়ের সৃষ্টিকর্তা ও মাবুদও অভিন্ন। তাই মানুষ যখন গভীর দৃষ্টি ও অনুভূতি নিয়ে এই সৃষ্টিজগতের দিকে তাকায় তখন এর শাশ্বত আবেদন তার মাঝে সাড়া জাগায় এবং প্রত্যক্ষ উপলব্ধি সৃষ্টি করে। সে কারণেই পবিত্র কোরআন মানব হৃদয়কে বার বার এই সৃষ্টি জগতের দিকে আহ্বান করে এবং অসচেতনতার নিদ্রা থেকে তাকে জাগিয়ে তােলে। মানুষের মাঝে এই অসচেতনতা সৃষ্টিজগতের সাথে দীর্ঘ দিনের পরিচিতি ও মাখামাখির কারণে জন্ম নেয়, আবার কখনাে দীর্ঘ দিনের জমে ওঠা বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা ও বাধার কারণে জন্ম নেয়। পবিত্র কোরআন এই প্রতিবন্ধকতা দূর করে, মনের এই অচেতনতাকে দূর করে। ফলে তার মাঝে এক নতুন ও সচেতন মন জন্ম নেয়, যে মন এই বন্ধুসুলভ প্রকৃতিকে আপন করে নেয় এবং পুরনাে ও গভীর সম্পর্কের তাড়নায় তার আহ্বানে সাড়া দেয়। বিপথগামিতা ও ভ্রষ্টতার একটা চিত্র আলােচ্য আয়াতে তুলে ধরা হয়েছে। আর তা হচ্ছে, চন্দ্র-সূর্যকে কেন্দ্র করে সম্প্রদায় বিশেষের অতিভক্তি ও বিকৃত অনুভূতি। আল্লাহর নৈকট্য লাভের নামে তারা এর উপাসনায় লিপ্ত হয়। পবিত্র কোরআন এই বিপথগামিতা থেকে বিশ্বাসে জমে ওঠা আবিলতা ও পংকিলতা দূর করতে চায়। তাদেরকে লক্ষ্য করে বলে, যদি তােমরা সত্যিকার অর্থেই আল্লাহর এবাদাত করতে চাও তাহলে চন্দ্র-সূর্যকে সিজদা করো না। বরং যে আল্লাহ তায়ালা এসবকে সৃষ্টি করেছেন, তাঁকে সিজদা করার’ কারণ, একমাত্র স্রষ্টার প্রতিই গােটা সৃষ্টিজগত মনােনিবেশ করে, তার প্রতিই ধাবিত হয়। এই চন্দ্র সুর্যও তােমাদের মতােই নিজ স্রষ্টার প্রতি ধাবিত হয়। কাজেই তাদের সাথে তােমরাও একমাত্র সেই একক ও অদ্বিতীয় স্রষ্টার এবাদাতে আত্মনিয়ােগ করো যিনি এবাদত বন্দেগীর একমাত্র উপযুক্ত পাত্র। আলােচ্য আয়াতে চন্দ্র সূর্যের জন্যে বহুবচন সর্বনাম ব্যবহার করা হয়েছে। এর দ্বারা চন্দ্র-সূর্যের সাথে সাথে অন্যান্য গ্রহ নক্ষত্রকেও বুঝানাে হয়েছে। আর একটা দিক লক্ষণীয়, তা হচ্ছে এসব গ্রহ নক্ষত্রের জন্যে প্রাণী বাচক বহুবচন ব্যবহার করা হয়েছে। এর মাধ্যমে সেইগুলােকে জীবন্ত ও বুদ্ধিসম্পন্ন বলে উপস্থাপন করা হয়েছে যেন সেই সবের নিজস্ব ব্যক্তিসত্ত্বা রয়েছে। এই সুস্পষ্ট নিদর্শন ও বর্ণনার পরও যদি তারা অহংকারী মানসিকতার পরিচয় দেয় তাহলে তাতে কিছুই আসে যাবে না এবং তাতে কারাে লাভ বা ক্ষতি হবে না। কারণ, আল্লাহর এবাদাত বন্দেগী করার জন্যে আরো অনেক সৃষ্টজীব আছে। তারা বিনা অহংকারে আল্লাহর এবাদাত বন্দেগী করে আসছে। তাই বলা হচ্ছে, ‘অতপর তারা যদি অহংকার করে, তবে যারা তােমার পালনকর্তার কাছে আছে তারা দিবারাত্রি তার পবিত্রতা ঘােষণা করে এবং তারা ক্লান্ত হয় না।'(আয়াত ৩৮) ‘যারা তােমার পালনকর্তার কাছে আছে’ এই বাক্য দ্বারা প্রথমেই ফেরেশতাদের কথা মনে আসে। তবে ফেরেশতা ছাড়া হয়তাে আল্লাহর আরও কোনাে প্রিয় বান্দা থাকতে পারে যাদের সম্পর্কে আমরা হয়তাে জানি না। মােটকথা, যারা আল্লাহর কাছে রয়েছে তারা খুবই সম্মানিত, খুবই মর্যাদাবান খুবই আদর্শবান। তাদের মাঝে সেই অহংকার ও আত্মম্ভরিতা নেই যা পৃথিবীতে বসবাসকারী বিপথগামী ও ভ্রষ্ট লোকের মাঝে আছে। তারা আল্লাহর খুব কাছে থেকেও তাদের মাঝে কোনাে আত্মশ্লাঘা নেই। তারা দিন রাত চব্বিশ ঘন্টা আল্লাহর এবাদাত বন্দেগীতে লিপ্ত থেকেও ক্লান্তি বােধ করে না, অস্বস্তি বােধ করে না। তাহলে তাদের সাথে পৃথিবীতে বসবাসকারী আল্লাহর এবাদাতবিমুখ লােকদের তুলনা কোথায়? এই যে ধরণী যা মানুষকে মায়ের মতে আহার যােগাচ্ছে। যে ধরণী থেকে তারা জন্ম নিয়েছে এবং তার মাঝেই আবার মিশে যাবে। এই ধরনীর বুকে তারা পিপিলিকার ন্যায় বিচরণ করছে এবং এর মধ্য থেকেই খাদ্য আহরণ করছে, পানীয় আহরণ করছে। এই ধরণী আল্লাহর সামনে নতশীরে দাঁড়িয়ে আছে এবং তার কাছ থেকেই জীবনীশক্তি লাভ করছে। বলা হয়েছে, ‘তার এক নিদর্শন এই যে, তুমি ভূমিকে দেখবে অনুর্বর পড়ে আছে । অতপর আমি যখন তার ওপর বৃষ্টি বর্ষণ করি তখন সে শস্যশ্যামল ও স্ফীত হয়…'(আয়াত ৩৯) প্রতিটি স্থানে পবিত্র কোরআনের যে সূক্ষ্ম বর্ণনাভংগি তা লক্ষ্য করার মতাে। এখানে ভূমির বিনয় ও নম্রতা বলতে বৃষ্টিপাতের পূর্বে এর যে অবস্থা হয়, তা বুঝানাে হয়েছে। অর্থাৎ বৃষ্টিপাতের পূর্বে ভূমি থাকে নীথর ও নিশ্চল। কিন্তু যখনই তার ওপর বৃষ্টিপাত হয় তখনই তাতে সৃষ্টি হয় জীবনের স্পন্দন ও চাঞ্চল্য। এই স্পন্দন ও চাঞ্চল্য যেন কৃতজ্ঞতা ও আরাধনার প্রতীক। কারণ যে পটভূমিতে আলােচ্য আয়াতটি উল্লেখ করা হয়েছে তা মিনতি, প্রার্থনা ও পবিত্রতা বর্ণনার পটভূমি। এই পটভূমির দৃশ্যের অন্যান্য চরিত্রের মাঝে ধরণীকেও অন্যতম চরিত্র হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে এবং তার মাঝেও চরিত্রের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ আবেগ ও ক্রিয়া কলাপ আরােপ করা হয়েছে। *কোরআনের শৈল্পিক বর্ণনাভংগী : পবিত্র কোরআনের এই সূক্ষ্ম বর্ণনাভংগির মাঝে যে শৈল্পিক সংগতি ফুটে উঠেছে তার পরিচয় তুলে ধরার জন্যে আমরা ‘কোরআনের শিল্পগত চিত্র’ নামক গ্রন্থ থেকে কিছু উদ্ধৃতি পেশ করছি। এই গ্রন্থের ৯৮ নং পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, ‘বৃষ্টিপাতের পূর্বে এবং শস্যশ্যামল হওয়ার আগে ভূমির যে অবস্থা হয় তাকে এক জায়গায় বলা হয়েছে পতিত’ এবং আর এক জায়গায় বলা হয়েছে অনুর্বর’। অনেকেই মনে করে যে, এখানে শুধু শব্দের পার্থক্য, অর্থের কোনাে পার্থক্য নেই। কিন্তু যে দুটো ভিন্ন প্রেক্ষাপটে শব্দদুটো উল্লেখ করা হয়েছে তা লক্ষ্য করলেই আমরা উভয়ের মধ্যকার পার্থক্যটি অনুধাবন করতে পারবাে। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলতে পারি, পতিত শব্দটি যে প্রেক্ষাপটে বর্ণিত হয়েছে তা হলাে এই, হে লােকসকল। যদি তােমরা পুনরুত্থানের ব্যাপারে সন্দিগ্ধ হও, তবে (ভেবে দেখ) আমি তােমাদেরকে মৃত্তিকা থেকে সৃষ্টি করেছি। এরপর বীর্য থেকে, এরপর জমাট রক্ত থেকে, এরপর পূর্ণাকৃতিবিশিষ্ট ও অপূর্ণাকৃতিবিশিষ্ট মাংসপিন্ড থেকে, তােমাদের কাছে ব্যক্ত করার জন্যে। আর আমি এক নির্দিষ্ট কালের জন্যে মাতৃগর্ভে যা ইচ্ছা রেখে দেই, এরপর আমি তােমাদেরকে শিশু অবস্থায় বের করি, তারপর যাতে তােমরা যৌবনে পদার্পণ করে। তােমাদের মধ্যে কেউ কেউ মৃত্যুমুখে পতিত হয় এবং তােমাদের মধ্যে কাউকে নিষ্কর্মা বয়স পর্যন্ত পৌঁছানাে হয়, যাতে সে জানার পর জ্ঞাত বিষয় সম্পর্কে সজ্ঞান থাকে না। ‘তুমি ভূমিকে পতিত দেখতে পাও, অতপর আমি যখন তাতে বৃষ্টি বর্ষণ করি, তখন তা সতেজ ও স্ফীত হয়ে যায় এবং সর্বপ্রকার সুদৃশ্য উদ্ভিদ উৎপন্ন করে।'(সূরা আল হজ্জ ৫) অপরদিকে ‘অনুর্বর’ শব্দটি যে প্রেক্ষাপটে এসেছে তা হলাে, তার নিদর্শন সমূহের মধ্যে রয়েছে দিবস, রজনী সূর্য ও চন্দ্র….'(আয়াত ৩৭-৩৯) এই প্রেক্ষাপট দুটো সম্পর্কে একটু চিন্তা করলেই ‘পতিত’ ও ‘অনুর্বর’ শব্দ দুটোর মধ্যকার সংগতি সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে। প্রথম প্রেক্ষাপটে উত্থান, পুনর্জীবন এবং উৎপাদনের একটা পরিবেশ বিরাজ করছিলাে। তাই সেই পরিবেশের সাথে সংগতি রক্ষা করতে গিয়ে ভূমিকে পতিত বলে চিত্রায়িত করা হয়েছে। এর পর এর সজীবতা, উর্বরতা ও উৎপাদনশীলতার কথা বলা হয়েছে। অপরদিকে দ্বিতীয় প্রেক্ষাপটের পরিবেশ ছিলাে উপাসনা, আরাধনা ও প্রার্থনার। তাই এই পরিবেশের সাথে সংগতি রক্ষা করার লক্ষ্যে ভূমিকে চিত্রায়িত করা হয়েছে বিনয়ী অনুর্বর বলে। আর একটা বিষয় লক্ষণীয় যে, দ্বিতীয় প্রেক্ষাপটে ভূমির আন্দোলন ও শস্যশ্যামলতায় অতিরিক্ত আর কিছু বলা হয়নি। এখানে সজীবতা ও উৎপাদনশীলতার কথা বলা হয়নি। কারণ, উপাসনা আরাধনার পরিবেশের সাথে তা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তাছাড়া এখানে আন্দোলিত ও শস্যশ্যামলতা সেই উদ্দেশ্যে আসেনি যে উদ্দেশ্যে প্রথম প্রেক্ষাপটে এসেছে। এখানে ভূমির বিনয়ের পরে গতিময়তাকে দেখানাে হয়েছে। এই গতিময়তাই এখানে কাম্য। কারণ এখানে দৃশ্যের আড়ালে যে চরিত্রগুলাে দেখতে পাই তার প্রতিটির মাঝে এই গতিময়তার গুণ রয়েছে। আর এই গতিময়তা হচ্ছে উপাসনা আরাধনাকে কেন্দ্র করে। তাই, ভূমি এককভাবে নিশ্চল ও নিথর থাকুক এটা সুন্দর দেখায় না বা চরিত্রের সাথে মানানসই নয়। সেই কারণেই সে আন্দোলিত হয়ে উঠছে যেন দৃশ্যের অন্যান্য চরিত্রের সাথে তাল মিলিয়ে তাদের উপাসনা আরাধনায় শরীক হতে পারে। ফলে দৃশ্যের প্রতিটি চরিত্রকেই গতিময় বলে দেখাচ্ছে। আর এটাই হচ্ছে কল্পিত গতিময়তার সংগতির সূক্ষ্ম বর্ণনা যা মানবীয় চিন্তা ও ধারণার অনেক উর্ধে।’ এখন আমরা আলােচ্য আয়াতের মূল বক্তব্যে ফিরে আসি। আয়াতের শেষাংশে মৃতকে জীবিত করার কথা বলা হয়েছে। আর এটাকে প্রমাণ করার জন্যে মৃত ভূমিকে উজ্জীবিত করার দৃষ্টান্ত পেশ করে বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয় যিনি একে জীবিত করেন, তিনি মৃতদেরকেও জীবিত করবেন'(আয়াত ৩৯) এ জাতীয় দৃষ্টান্ত পবিত্র কোরআনে বার বার এসেছে এবং এগুলােকে পরকালে মানুষকে পুনরায় জীবিত করার প্রমাণ হিসেবে পেশ করা হয়েছে। সাথে সাথে এগুলােকে আল্লাহর অপার কুদরতের প্রমাণ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। পৃথিবীতে জীবনের যে অস্তিত্ব তা প্রতিটি মানুষ অনুধাবন করতে পারে, বুঝতে পারে। কারণ এই জীবন বিবেক বুদ্ধিকে নাড়া দেয়ার আগে হৃদয় মনকে নাড়া দেয়। আর জীবনের উন্মেষ যখন মৃত্যুর মধ্যে থেকে ঘটে তখন তা সৃজনশীল শক্তির পরিচয় এমনভাবে তুলে ধরে যা অনুভূতির গভীরে গিয়ে নাড়া দেয়, আর এভাবেই পবিত্র কোরআন স্বভাবধর্মকে তার নিজস্ব ভাষায় এবং অত্যন্ত সরল পন্থায় আহ্বান করে।
*আল্লাহর আয়াত অস্বীকার করার পরিণতি : জাগতিক নিদর্শনাবলীর গভীর অনুভূতিপূর্ণ এই দৃশ্যের পাশাপাশি সেই সকল লােকদের জন্যে নিন্দা ও হুঁশিয়ারি বাণী উচ্চারিত হচ্ছে যারা সেইসব প্রকাশ্য ও সুস্পষ্ট নিদর্শনের ব্যাপারে সন্দিহান হয়ে সেগুলােকে অস্বীকার করে অথবা সেগুলাের মাঝে ক্রুটি বিচ্যুতি খুঁজে বেড়ায়। বলা হচ্ছে, ‘নিশ্চয়ই যারা আমার আয়াতসমূহের ব্যাপারে বক্রতা অবলম্বন করে, তারা আমার কাছে গােপন নয়…'(আয়াত ৪০) এখানে হুঁশিয়ার বাণীটি প্রত্যক্ষভাবে না আসলেও অত্যন্ত ভীতিকররূপে এসেছে। বলা হয়েছে, তারা আমার কাছে গােপন নয় অর্থাৎ আল্লাহর জ্ঞানের সামনে তারা উন্মুক্ত। তাই তারা যতােই বাঁকা রাস্তায় চলুক, যতই ক্রুটি-বিচ্যুতি খুঁজে বেড়াক, যতােই ছিদ্রান্বেষণ করুক আল্লাহর শাস্তি থেকে তারা রেহাই পাবার নয়, আল্লাহ তায়ালা ওদেরকে পাকাড়ও করেই ছাড়বেন। ওরা হয়তাে মনে করেছে, ছল-চাতুরী করে মানুষের হাত থেকে ওরা যেভাবে রেহাই পেয়ে যায় সেভাবেই আল্লাহর হাত থেকেও রেহাই পেয়ে যাবে। কিন্তু, তা হবার নয়। এরপর সুস্পষ্ট ভাষায় হুঁশিয়ারবাণী উচ্চারণ করে বলা হচ্ছে, যে ব্যক্তি জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে সে শ্রেষ্ঠ, না- সে ব্যাক্তি ভালাে যে কেয়ামতের দিন নিরাপদে আসবে?’ আলােচ্য আয়াতে ওদের ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে ওদেরকে সতর্ক করে দেয়া হচ্ছে এবং বলা হচ্ছে যে, ওদেরকে জাহান্নামের আগুনে ফেলা হবে, পক্ষান্তরে মােমেন বান্দারা এই জাহান্নাম থেকে সহি-সালামতে থাকবে। আয়াতের শেষাংশে আর একটি হুঁশিয়ারবাণী উচ্চারণ করে বলা হচ্ছে, তােমাদের যা মনে চায় করাে, নিশ্চয়ই তিনি তােমাদের কাজকাম প্রত্যক্ষ করছেন’ কি মারাত্মক ব্যাপার যে, একজন লােককে স্বাধীনভাবে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে, যাতে করে সে আল্লাহর আয়াতের ব্যাপারে বক্রতা অবলম্বন করতে পারে, আর আল্লাহ তায়ালা তার এসব ক্রিয়াকলাপ দেখবেন ও লক্ষ্য করবেন। পরবর্তী আয়াতে সেই সকল লােকদের কথা বলা হয়েছে যারা কোরআনের আয়াতগুলােকে অস্বীকার করে। অথচ কুরআন হচ্ছে এমন একটি মযবুত ও সুরক্ষিত গ্রন্থ যার মাঝে অসত্যের অনুপ্রবেশ ঘটার কোনাে সম্ভাবনাই নেই। তাই বলা হচ্ছে, ‘নিশ্চয় যারা কোরআন আসার পর তা অস্বীকার করে, (তাদের মধ্যে চিন্তা-ভাবনার অভাব রয়েছে)…'(আয়াত ৪১-৪৪) আলােচ্য আয়াতে কেবল এতােটুকু বলা হয়েছে যে, যারা কোরআন আসার পর তা অস্বীকার করে, কিন্তু তারা কি এবং তাদের পরিণতি কি, সে ব্যাপারে কিছু বলা হয়নি। অর্থাৎ কোরআন আসার পর যারা তা অস্বীকার করে তারা এমনই একটি দল যাদের অপকর্মের জন্যে উপযুক্ত কোনাে বিশেষণ নেই। কারণ, এই অপকর্ম অত্যন্ত নিকৃষ্ট ও জঘন্য প্রকৃতির অপকর্ম। সেই জন্যে এখানে উদ্দেশ্য বলার পর ‘বিধেয়’ এর কোনাে উল্লেখ নেই। বরং পবিত্র কোরআনের বৈশিষ্ট্য বর্ণিত হয়েছে। যেমন, ‘এটা অবশ্যই এক সম্মানিত গ্রন্থ। এতে মিথ্যার প্রভাব নেই, সামনের দিক থেকেও নেই এবং পেছন দিক থেকেও নেই। এটা প্রজ্ঞাময়, প্রশংসিত আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ।’(আয়াত ৪১-৪৪) এই মহাগ্রন্থে মিথ্যার অনুপ্রবেশ কিভাবে ঘটতে পারে। কারণ, এটা তাে মহাসত্য আল্লাহর কাছ থেকে এসেছে, সত্যের ঘােষণা দিচ্ছে এবং সেই আদি সত্যের সাথে জুড়ে আছে যার ওপর ভিত্তি করে টিকে আছে আসমান ও যমীন। এতে মিথ্যার অনুপ্রবেশ কেন ঘটবে? কারণ এটা তাে সম্মানিত একটি গ্রন্থ, আল্লাহর নির্দেশে সুরক্ষিত একটি গ্রন্থ এবং স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা এর হেফাযতের নিশ্চয়তা দান করেছেন। এ মর্মে তিনি ঘােষণা দিয়ে বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই কোরআন আমিই অবতীর্ণ করেছি এবং আমিই হচ্ছি এর রক্ষক।’ যারা গভীর দৃষ্টি নিয়ে এই কোরআন অধ্যয়ন করে তারা এতে সত্যের সন্ধান পাবে। সত্যের সন্ধান পাবে এর প্রতিটি বক্তব্যে এবং এর সহজ সরল বর্ণনা ভংগিতে। এই সত্য স্বাভাবিক সত্য, সন্তোষজনক সত্য। এই সত্য বিবেকের গভীরে রেখাপাত করে এবং এক অব্যক্ত প্রভাবের সৃষ্টি করে। এই কোরআন প্রজ্ঞাময়, প্রশংসিত সত্ত্বার কাছ থেকে অবতীর্ণ কাজেই এই প্রজ্ঞার পরিচয় পাই কোরআনের গঠনে, এর নির্দেশনার মাঝে, এর অবতরনের পদ্ধতিতে এবং মানব হৃদয়কে রোগমুক্ত করার এর সংক্ষিপ্ত পন্থার মাঝে। কাজেই যে আল্লাহ তায়ালা এই কোরআনকে অবতীর্ণ করেছেন, তিনি অবশ্যই প্রশংসার দাবীদার ও উপযুক্ত। কেননা এই কোরআনের মাঝেই এমন কিছু রয়েছে যা হৃদয়কে আল্লাহর অধিক প্রশংসার জন্যে উদ্বুদ্ধ করে।
*শাশ্বত ঐতিহ্যবাহী ঈমানী কাফেলা : পরবর্তী আয়াতে কোরআনকে পূর্ববর্তী অন্যান্য ঐশী গ্রন্থের সাথে এবং রসূল(স.)-কে পূর্ববর্তী অন্যান্য সকল নবী রসূলদের সাথে একীভূত করা হয়েছে, যেন তারা একই পরিবারভুক্ত, একই প্রভূর কাছ থেকে বাণীপ্রাপ্ত, তার সাথেই তাদের হৃদয় মন সংযুক্ত এবং তাদের পথ ও দাওয়াত তার সাথেই সম্পৃক্ত। ফলে একজন মুসলমান অনুভব করতে পারে যে, সে এমন একটি বৃক্ষের শাখা যার শিকড় গভীরে প্রােথিত এবং সে এমন একটি পরিবারের সদস্য যার রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস ও শাশ্বত ঐতিহ্য। বলা হয়েছে, ‘তােমাকে তাই তাই বলা হয়, যা বলা হতাে পূর্ববর্তী রসূলদেরকে। নিশ্চয় তােমার পালনকর্তার কাছে যেমন ক্ষমা রয়েছে এবং যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি রয়েছে।’(আয়াত ৪৩) অর্থাৎ ওহীর উৎস অভিন্ন, বাণী অভিন্ন, আকিদা অভিন্ন। তাই মানবজাতির পক্ষ থেকে এর গ্রহণের পদ্ধতিও অভিন্ন এবং অভিযােগের পদ্ধতিও অভিন্ন। এই হিসেবে নবী রসূলরা যেন একটিমাত্র বৃক্ষ, একটি মাত্র পরিবার। তাদের দুঃখ-বেদনা এক, তাদের অভিজ্ঞতা এক, চুড়ান্ত লক্ষ্য এক এবং পথ ও আদর্শ এক। এই বাস্তব সত্যটি সত্য আদর্শের ধারক, বাহক ও প্রচারকদের মনে এক অদ্ভূত সহানুভূতি, শক্তি, ধৈর্য ও সংকল্পের জন্ম দেবে। তখন তারা অনুভব করতে পারবে যে,তারা সেই একই পথের পথিক, যে পথ পূর্বে পাড়ি দিয়ে চলে গেছেন নুহ, ইবরাহীম, মূসা, ঈসা এবং মুহাম্মদ(স.) সহ সব নবী রাসূল। এর ফলে সত্য আদর্শের প্রচারকদের মনে এক অপূর্ব মর্যাদাবােধ, গর্ববােধ এবং সহনশীলতা জন্ম নেবে। চলার পথে সকল বাধা বিপত্তি, দুঃখ কষ্ট ও বিপদাপদ হাসিমুখে সহ্য করে নেবে এবং মনে করবে যে, তাদের সম্মানিত মহাপুরুষরাও এই পথে চলতে গিয়ে অনুরূপ পরিস্থিতি মোকাবেলা করে গেছেন। তারা ছিলেন মূলত সর্বশ্রেষ্ঠ মানব। ‘তােমাকে তাই বলা হয়েছে, যা তােমার পূর্ববর্তী রসূলদেরকে বলা হয়েছে’ এটা একটা বাস্তব সত্য। কিন্তু এই বাস্তব সত্যটি মােমেনদের অন্তরে গেঁথে যাওয়ার পর যে প্রভাবের সৃষ্টি হবে, তা হবে অত্যন্ত গভীর ও সুদূরপ্রসারী। আর এটাই হচ্ছে পবিত্র কোরআনের একটা অমরকীর্তি। অর্থাৎ সেই জাতীয় মহাসত্য প্রতিষ্ঠিত করার পর তা হৃদয়পটে গেঁথে দেয়। তাই বলা হয়েছে, ‘পূর্ববর্তী রসূলদেরকে যা কিছু বলা হয়েছে, শেষ নবী মােহাম্মদ(স.)-কেও ঠিক তাই বলা হয়েছে।’ এরপর বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয় তােমার পালনকর্তার কাছে রয়েছে ক্ষমা এবং রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি’, সান্ত্বনাবাণী শােনার পর মােমেনদের অন্তর শান্ত হবে, সুস্থির হবে এবং তারা আল্লাহর রহমত ও মাগফেরাতের আশা পােষণ করবে, মোমেনদের অন্তরে কখনও হতাশা-নিরাশা জন্ম নেবে না। সাথে সাথে আল্লাহর শাস্তির ব্যাপারেও সতর্ক থাকবে এবং ভীত থাকবে, সে কখনও আল্লাহর ব্যাপারে গাফেল ও উদাসীন থাকবে না। এটাই হচ্ছে ভারসাম্যপূর্ণ নীতি যা ইসলামেরই চিরন্তন বৈশিষ্ট্য।
*দ্বীনের দাওয়াত অন্ধীকারকারীদের টালবাহানা : পরবর্তী আয়াতে তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলা হচ্ছে যে, আল্লাহ তায়ালা অত্যন্ত দয়াপরবশ হয়েই আরবী ভাষায় এই পবিত্র কোরআন তাদের জন্যে অবতীর্ণ করেছেন। সাথে সাথে তাদের গোয়ার্তুমি, বক্রতা, তর্ক-বিতর্ক ও জালিয়াতি প্রবণতার প্রতিও ইংগিত করা হয়েছে। বলা হচ্ছে, ‘আমি যদি একে অনারবীয় ভাষায় নাযিল করতাম, তবে অবশ্যই তারা বলতাে, এর আয়াতসমূহ পরিষ্কার ভাষায় বিবৃত হয়নি কেন? এ কি আশ্চর্য, কিতাব অনারবীয় ভাষায় আর রসূল আরবী ভাষায়!’(আয়াত ৪৪) আরবী ভাষায় কোরআন অবতীর্ণ হওয়া সত্তেও ওরা এর বক্তব্য শুনতে চায় না। বরং ওরা আশংকা বােধ করে যে, আরবী ভাষায় অবতীর্ণ হওয়ার ফলে এর বক্তব্য আরবদের মনে গেঁথে যাবে। তাই তারা বলে, ‘তােমরা এ কোরআন শ্রবণ করাে না এবং এর আবৃত্তিতে হট্টগােল সৃষ্টি করাে, যাতে তােমরা জয়ী হতে পারে'(আয়াত ২৬) কিন্তু আল্লাহ তায়ালা যদি এটাকে অন্য কোনাে ভাষায় অবতীর্ণ করতেন, তাহলে তারা আপত্তি জানাতাে এবং বলতাে বিশুদ্ধ আরবী ভাষায় কেন অবতীর্ণ করা হলাে না। আর যদি এর কিছু অংশ আরবী ভাষায়, আর কিছু অংশ অনারবীয় ভাষায় অবতীর্ণ করা হতাে তাহলেও তারা আপত্তি জানাতো এবং বলতাে, কি অদ্ভুত ব্যাপার। আরবী আর অনারবী এক সংগে? মােটকথা, ওরা ঝগড়াটে ও বক্র স্বভাবের মানুষ। ওরা তর্কের জন্যেই তর্ক করে। এই বিতর্ক থেকে যে সত্যটি বের হয়ে আসছে তা হলাে, এই মহাগ্রন্থ মােমেনদের জন্যে হেদায়েত ও আরােগ্যস্বরূপ। তাই মােমেনদের হৃদয়ই কেবল এই মহাগ্রন্থের প্রকৃতি ও স্বরূপ উপলব্ধি করতে পারে এবং এর মাধ্যমে দিকনির্দেশনা পেতে পারে ও আরােগ্য লাভ করতে পারে। আর যারা ঈমানদার নয়, তাদের অন্তর বিকৃত। তাই তাতে এই মহাগ্রন্থের কোনাে প্রভাব পড়ে না। তাদের কর্ণকুহরে এর বাণী পৌঁছে না, তাদের অন্তর্র্দৃষ্টিও এর মর্ম উপলব্ধি করতে পারে না। তাই তারা বধির ও অন্ধ। এই কোরআন থেকে তারা কোনােই উপকৃত হতে পারে না। কারণ তারা এই মহাগ্রন্থের প্রকৃতি ও মর্মবাণী থেকে যােজন দূরে। তাই বলা হচ্ছে, ‘বলে দাও, এটা বিশ্বাসীদের জন্যে হেদায়াত ও রোগের প্রতিকার। যারা মােমেন নয়, তাদের কানে আছে ছিপি, আর কোরআন তাদের জন্যে অন্ধত্ব। তাদেরকে যেন দূরবর্তী স্থান থেকে আহ্বান করা হয়’(আয়াত ৪৪) মানুষ প্রতিটি যুগে এবং প্রতিটি পরিবেশে এই বক্তব্যের সত্যতা প্রত্যক্ষ করে আসছে। এই কোরআনের বাণী কিছু লােকের অন্তরে যখন প্রভাব সৃষ্টি করে তখন তাতে নতুন জীবনের উন্মেষ ঘটায়, এবং তার মাঝে ও তার চতুর্পাশের লােকদের এর প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়। অপরদিকে এমন অনেক লােক আছে যাদের কর্ণকুহরে ও অন্তরে এই কোরআন একটা বােঝাস্বরূপ। ফলে এই কুরআন তাদের বধিরতা ও অন্ধত্বকে আরও বাড়িয়ে দেয়। আসলে কোরআনের পরিবর্তন হয়নি, পরিবর্তন হয়েছে মানুষের হৃদয়ের। তাই আল্লাহ তায়ালা যা বলেছেন তা যথার্থই বলেছেন।
*মানুষের সুখ সাচ্ছন্দ ও পরকাল বিশ্বাস : পরবর্তী আয়াতে মূসা(আ.)-এর ঘটনার প্রতি ইংগিত করা হয়েছে, তার প্রতি নাযিল করা কিতাবের কথা এবং এই কিতাবকে কেন্দ্র করে মূসা(আ.)-এর জাতির মতবিরােধের কথা বলা হয়েছে। এই ঘটনার প্রতি ইংগিত করা হয়েছে মূলত পূর্ববর্তী রসূলদের জন্যে দৃষ্টান্তরূপে। মূসা(আ.)-এর কিতাবের ব্যাপারে তার সম্প্রদায়ের লােকদের যে মতবিরোধ, এর বিচার ও মীমাংসা আল্লাহ তায়ালা পরকালের জন্যে মুলতবী করে রেখেছেন। এ সম্পর্কে বলা হচ্ছে, ‘আমি মূসাকে কিতাব দিয়েছিলাম, অতপর তাতে মতভেদ সৃষ্টি হয়। তোমার পালনকর্তার পক্ষ থেকে পূর্ব সিদ্ধান্ত না থাকলে তাদের মধ্যে একটা ফয়সালা হয়েই যেতাে…’(আয়াত ৪৫) ঠিক একইভাবে শেষ নবীর ক্ষেত্রেও চূড়ান্ত ফয়সালা ওই প্রতিশ্রুত দিনটিতেই হবে। তাই মানুষকে স্বাধীনভাবে কাজ করার জন্যে সুযােগ দেয়া হচ্ছে, এরপর তাদের এই কর্মফলের প্রতিদান দেয়া হবে। এ সম্পর্কে তাই বলা হচ্ছে, ‘যে সৎকর্ম করে সে নিজের উপকারের জন্যেই করে, আর যে অসৎ কর্ম করে তা তার ওপরই বর্তাবে…'(আয়াত ৪৬) এই বার্তা মানুষের বিবেক বুদ্ধিকে আহ্বান করছে, এর ওপরই পছন্দ অপছন্দের দায়িত্বভার চাপিয়ে দিচ্ছে এবং ব্যক্তি স্বাধীনতার মূলনীতি ঘােষণা করছে। কাজেই প্রত্যেক ব্যক্তি তার কর্মকান্ডের ব্যাপারে স্বাধীন, পছন্দ অপছন্দের ব্যাপার স্বাধীন। কারণ, ‘তােমার পালনকর্তা বান্দাদের প্রতি মােটেই যুলুম করেন না।’ চুড়ান্ত বিচারের নির্ধারিত সময়ের প্রতি ইংগিত এবং সেই বিচারে আল্লাহর ইনসাফের বিষয়টি প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে আরও একটি প্রসংগ এখানে উল্লেখ করা হচ্ছে। তা হলাে, কেয়ামত কখন সংঘটিত হবে এ ব্যাপারটি সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর ওপর নির্ভর করে। এর সঠিক জ্ঞান একমাত্র তাঁরই রয়েছে। আল্লাহর এই জ্ঞানকে কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে এমন ব্যঞ্জনাময় রূপে উপস্থাপন করা হয় যা হৃদয়ের গভীরে গিয়ে স্পর্শ করে। বিশেষ করে কেয়ামতের দৃশ্য যখন চিত্রায়িত করা হয় এবং সে সম্পর্কে যখন মােশরেকদের প্রশ্নের উত্তর দেয়া হয়। যেমন, ‘কেয়ামতের জ্ঞান একমাত্র তাঁরই জানা। তার জ্ঞানের বাইরে কোনাে ফল আবরণমুক্ত হয় না…'(আয়াত ৪৭-৪৮) কেয়ামত হচ্ছে অদৃশ্য ও অজানা জগতে লুকায়িত। আর আবরণের ভেতর ফলের অস্তিত্ব হচ্ছে অজানা অদৃশ্যমান রহস্য। তেমনিভাবে মায়ের পেটের ভেতরে ভ্রুণও হচ্ছে এক অদৃশ্য ও গােপন অস্তিত্ব। এসব কিছুর যথার্থ জ্ঞান একমাত্র আল্লাহরই রয়েছে। একমাত্র তার জ্ঞানই এসবকে পরিবেষ্টিত করে রেখেছে। মানুষ যদি পৃথিবীর বুকে বিদ্যমান সকল ফলকে আবরণের ভেতর খুঁজতে যায়, মায়ের পেটের ভেতরে অবস্থিত সকল ভ্রুণের খোঁজ নিতে যায় এবং তা কল্পনা করতে যায় তাহলে তার পক্ষে সেটা কখনও সম্ভব হবে না। অসীম সত্যেকে কল্পনা করার ক্ষমতা মানুষের মাঝে যতাে বেশী সৃষ্টি হবে ততােবেশী সে আল্লাহর অসীম জ্ঞানের স্বরূপ উপলব্ধি করতে পারবে। উদ্ভ্রান্ত মানুষের একটি দল মহান আল্লাহর এই অসীম জ্ঞানের সম্মুখে দাঁড়িয়ে চিন্তা করতে থাকবে। আর সেই মুহূর্তে তাদেরকে লক্ষ্য করে বলা হবে, ‘আমার শরীকরা আজ কোথায়?’ উত্তরে তারা আজ কী বলবে? আজ তা কোনাে তর্ক-বিতর্কের সুযোগ নেই, কথার মারপ্যাচের কোনাে সুযােগ নেই। আজ ওরা যা বলবে তা হচ্ছে, আমরা তােমাকে বলে দিয়েছি যে, আমাদের কেউই এটা স্বীকার করি না অর্থাৎ আমরা তােমাকে জানিয়ে দিয়েছি যে, আমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই যে তােমার কোনাে শরীক আছে বলে স্বীকার করবে। এরপর বলা হচ্ছে, ‘পূর্বে তারা যাদের পূজা করত তারা উধাও হয়ে যাবে এবং তারা বুঝে নেবে, যে তাদের কোনাে নিষ্কৃতি নেই'(আয়াত ৪৮) তাই আজ আর তারা তাদের পূর্বের দাবীর কোনাে কিছুই মনে করবে না। তাদের মনে বিশ্বাস জন্মাবে যে, আজ তাদের আর কোনাে উপায় নেই, কোনাে মুক্তি নেই। এটা নিসন্দেহে চরম মানসিক যন্ত্রণা ও অস্থিরতার মুহূর্ত। এই মুহর্তে মানুষ তার অতীতের সব কিছু ভুলে যাবে। কেবল মনে পড়বে বর্তমানের যন্ত্রণাদায়ক মুহূর্তটি। এই মুহূর্তটি যে একদিন আসবে সে ব্যাপারে তারা কখনও সতর্ক ছিলােনা এবং এই মুহূর্তটিকে তারা কখনও ভয়ও করতাে না। অথচ মানুষ লাভের ব্যাপারে সাধারণত খুবই লোভী হয় আর ক্ষতির ব্যাপারে থাকে ভীত। আজ এই মুহর্তে তাদের মনে কোনাে আশা ভরসা নেই। তাই বলা হচ্ছে, ‘মানুষ উন্নতি কামনায় ক্লান্ত হয় না, যদি তাকে অমংগল পর্শ করে, তবে সে সম্পূর্ণরূপে নিরাশ হয়ে পড়ে…’(আয়াত ৪৯-৫১) মানব হৃদয়ের এটাই হচ্ছে সত্য ও সূক্ষ্ম চিত্র । এই মানবহৃদয় আল্লাহর দেখানা পথ অনুসরণ করে না, তাই সঠিক গন্তব্যে পৌঁছতে পারে না। মানব চিত্তের অস্থিরতা, দুর্বলতা, লােভ-লালসা, অকৃতজ্ঞতা, সুখের মুহূর্তের আস্ফালন এবং বিপদের মুহূর্তের হা-হুতাশের চিত্রটি অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে ও সুচারুরূপে তুলে ধরা হয়েছে। নিজের ভালোর জন্যে, মংগলের জন্যে দোয়া করতে গেলে মানুষ ক্লান্তিবােধ করে না। নিজের জন্যে এই মংগলের দোয়া সে বার বার করে। এতে একটুও বিরক্ত হয় না। আর যদি একটু বিপদের ছোঁয়া লাগে তাতেই হতাশ ও নিরাশ হয়ে পড়ে। মনে করে আর বুঝি মুক্তির উপায় নেই, সকল পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে। তার মন ছােটো হয়ে যায়, দুশ্চিন্তা বেড়ে যায়, আল্লাহর রহমতের ব্যাপারে নিরাশ হয়ে যায়, তার সাহায্যের ব্যাপারে হতাশ হয়ে যায়। কারণ, নিজের প্রভুর প্রতি তার আস্থা খুবই কম এবং তার সাথে তার বন্ধন খুবই দুর্বল। এই মানুষকে আল্লাহ তায়ালা বিপদের পর যখন সুখের মুখ দেখান, তখন এই নেয়ামতকে সে হালকা মনে করে। ফলে আল্লাহর শােকর আদায় করতেও ভুলে যায়। সুখ-স্বাচ্ছন্দে ডুবে গিয়ে সে এই সুখ-স্বাচ্ছন্দের আসল উৎসকে ভুলে যায় এবং বলে উঠে, এটা আমার। এটা আমারই প্রাপ্য ছিলাে। এটা চিরকালই থাকবে। সে তখন পরকালকেও ভুলে যায়। এমনকি পরকাল বলতে কিছু আছে বলেও বিশ্বাস করতে চায় না। তাই বলে, ‘কেয়ামত সংঘটিত হবে বলে আমি মনে করি না।’ নিজেকে সে বড় মনে করে। এমনকি আল্লাহর সাথেও বড়াই করতে যায়। আল্লাহর কাছে নিজের বিশেষ মর্যাদা আছে বলে মনে করে অথচ সে পরকালকে অস্বীকার করে খোদ আল্লাহকেই অস্বীকার করেছে। তারপরও সে মনে করে, আল্লাহর কাছে ফিরে গেলে তার কাছে সে বেশ আদর-যত্ন ও মান-মর্যাদা পাবে। তার বক্তব্য হলাে, ‘আমি যদি আমার পালনকর্তার কাছে ফিরে যাই, তবে অবশ্যই তার কাছে আমার জন্যে কল্যাণ রয়েছে।’ এটা এক ধরনের আত্মপ্রবঞ্চনা। তাই এর উত্তরে ধমকের সুরে বলা হচ্ছে, ‘অতএব, আমি কাফেরদেরকে তাদের কর্ম সম্পর্কে অবশ্যই অবহিত করবাে এবং তাদেরকে অবশ্যই কঠিন শাস্তি আস্বাদন করাবো।’ এই মানুষের প্রতি আল্লাহ তায়ালা যখন করুণা করেন এবং তাকে নেয়ামত দান করেন তখন সে অহংকারী হয়ে ওঠে, স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠে এবং উদাসীনতা প্রদর্শন করে। আর যখন বিপদে পড়ে, তখন নিজেকে দীন ও হীন মনে করে, ছােট ও অধম মনে করে এবং কাকুতি-মিনতি করতে থাকে, আহাজারি করতে থাকে। দীর্ঘ মােনাজাতে মগ্ন থাকে। তাতে বিন্দুমাত্র ক্লান্ত হয় না, বিরক্ত হয় না। মানুষের মনের ছােট বড় সব কিছুই সূক্ষ্মভাবে আল্লাহ তায়ালা বর্ণনা করছেন। কেন করবেন না? তিনিই তাে মানুষের সৃষ্টিকর্তা তাই তিনি মানুষের অন্তরের সকল অলি গলি সম্পর্কে খবর রাখেন। তিনি ভালাে করেই জানেন যে, তার দেখানাে সঠিক পথে না চললে এই আঁকা-বাঁকা রাস্তায়ই চিরকাল চলতে হবে।
*প্রকৃতি ও মানুষের মাঝে বিরাজিত আল্লাহর নিদর্শন : এরপর তাদেরকে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে, ‘বলাে তােমরা ভেবে দেখেছাে কি, যদি এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে হয়, অতপর তােমরা একে অমান্য করাে…’(আয়াত ৫২) এটা এমনই একটা সম্ভাবনা যে ব্যাপারে খুবই সতর্ক থাকতে হবে। কিন্তু তারা কি সতর্কতামূলক কোনাে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে? ওদের প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে এখন দৃষ্টি নিবদ্ধ করা হচ্ছে এই বিশাল জগতের প্রতি। সেখান থেকে এবং খােদ মানুষের অস্তিত্ব থেকে কিছু নিদর্শন তুলে ধরার কথা বলা হচ্ছে। যেমন, ‘এখন আমি তাদেরকে আমার নিদর্শনাবলী প্রদর্শন করবাে পৃথিবীর দিগন্তে এবং তাদের নিজেদের মধ্যে…’(আয়াত ৫৩-৫৪) এটা সর্বশেষ এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য। এখানে আল্লাহ তায়ালা তার বান্দাদেরকে এই জগতের কিছু গােপন রহস্য সম্পর্কে অবহিত করবেন বলে ওয়াদা করছেন। এমনকি তাদের নিজেদের অস্তিত্বের গােপন রহস্য সম্পর্কে অবহিত করবেন বলে ওয়াদা করছেন। এর মাধ্যমে তিনি সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে চান। অর্থাৎ তার এই সত্য ধর্ম, এই সত্য কিতাব এবং সত্য আদর্শকে তিনি প্রতিষ্ঠিত করতে চান। যখন তিনি ওয়াদা করেছেন তখন তার এই ওয়াদার চেয়ে আর কার ওয়াদা দৃঢ় হতে পারে, সত্য হতে পারে? আল্লাহ তায়ালা বান্দাদের সাথে করা ওয়াদা পূরণ করে দেখিয়েছেন। এই ওয়াদার পর থেকে বিগত চৌদ্দশত বছরের চাইতে বেশী সময় যাবত তিনি বান্দাদের সামনে অনেক রহস্যই উন্মোচন করেছেন। প্রতিদিন জীবন ও জগত সম্পর্কিত নতুন নতুন রহস্য, নতুন নতুন তত্ত্ব তাদের সামনে উদঘাটিত হচ্ছে। গােটা দিগন্ত তাদের সামনে উন্মেচিত হয়েছে। জীবনের অনেক না জানা ভেদ তাদের সামনে এসেছে। এই দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে মানুষ অনেক কিছুই জানতে পেরেছে। কিভাবে জানতে পারলাে, সে সম্পর্কে যদি তারা চিন্তা করতাে এবং সেজন্যে আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতাে, তাহলে তাদের জন্যে মংগলজনক হতো। এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে তারা জানতে পেরেছে যে, এই পৃথিবী যেটাকে তারা গােটা বিশ্বজগতের কেন্দ্রবিন্দু মনে করতাে এটা সূর্যের অধীনস্থ ছােট্ট একটা গ্রহ যা গােটা বিশ্বের তুলনায় এক বিন্দুর চেয়ে বড় কিছু নয়। তারা আরও জানতে পেরেছে যে, মহাশূন্যে ভাসমান কোটি কোটি গ্রহ নক্ষত্রের মাঝে সূর্যও একটি ছােট্ট নক্ষত্র মাত্র। তারা তাদের পৃথিবীর প্রকৃতি সম্পর্কে জানতে পেরেছে, তাদের সূর্যের প্রকৃতি সম্পর্কে জানতে পেরেছে, এমনকি গােটা জগতের প্রকৃতি সম্পর্কেও অনেক কিছু জানতে পেরেছে তবে তাদের এই জানা যদি নির্ভুল হয়ে থাকে তাহলে অবশ্যই তা তাদের জন্যে কল্যাণকর। তারা এই জগতের মূল উপাদান বা বস্তু সম্পর্কে জানতে পেরেছে, যদি সত্যিকার অর্থেই বস্তু বলতে কিছু থেকে থাকে। যাহােক, তারা জানতে পেরেছে যে, এই জগতের গঠনের পেছনে মূল উপাদান হচ্ছে অণু। তারা আরও জানতে পেরেছে যে, এই অণু-বিকিরণে রূপান্তরিত হয়। এর দ্বারা তারা বুঝতে পেরেছে যে, গােটা জগতটাই বিকিরণের ফলস্বরূপ। এই বিকিরণ বিভিন্নরূপে ঘটে থাকে এবং এর ফলেই জগতে বিভিন্ন আকার ও আকৃতির সৃষ্টি হয়েছে। তাদের পৃথিবী নামক গ্রহ সম্পর্কেও অনেক কিছু জানতে পেরেছে। তারা জানতে পেরেছে যে, এটা অনেকটা বলের মতাে গােলাকার। এই গ্রহ নিজেকে কেন্দ্র করে এবং সূর্যকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে। তারা তাদের মহাদেশ, মহাসাগর এবং নদী সম্পর্কে জানতে পেরেছে। মহাসাগরের তলদেশের অনেক না জানা তথ্যই এখন তাদের নাগালের মধ্যে। মাটির নীচে লুকায়িত বিভিন্ন সম্পদের সন্ধান লাভে তারা সক্ষম হয়েছে। এমনকি খােদ এই সম্পদের ভেতর লুকায়িত অন্যান্য খনিজ সম্পদেরও তারা সন্ধান পেয়েছে। তারা প্রকৃতির একক ও অভিন্ন নিয়ম সম্পর্কে জানতে পেরেছে এবং বুঝতে পেরেছে যে, এই নিয়মের অধীনেই পরিচালিত হয়ে আসছে তাদের পৃথিবীসহ গােটা সৃষ্টিজগত। আবার অনেকেই এই প্রাকৃতিক নিয়মের মধ্য দিয়ে এর স্রষ্টার সন্ধান লাভে সক্ষম হয়েছে। আবার অনেকেই বিভ্রান্ত হয়েছে এবং বৈজ্ঞানিক আবিস্কার ও তত্ত্বের বাইরে আর কিছু চিন্তা করার অবকাশ পায়নি। কিন্তু বিজ্ঞানের কারণে বিভ্রান্তি ও ভ্রষ্টতার শিকার মানবতা এই বিজ্ঞানের মাধ্যমেই সঠিক পথের সন্ধান লাভ করতে সক্ষম হচ্ছে এবং বুঝতে পারছে যে, বিজ্ঞান মানুষকে মহাসত্যেরই সন্ধান দেয়। মানুষের দেহ কেন্দ্র করে যে সকল বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ও তথ্যাদি এ যাবত আবিস্কৃত হয়েছে তা এই জগতের দেহের তুলনায় কম নয়। এ যাবত মানুষ তার দেহের গঠনপ্রণালী, এর বৈশিষ্ট্য এবং এর কার্য প্রণালী সম্পর্কে না জানা অনেক তথ্যই জানতে পেরেছে। দেহের সৃষ্টি, গঠন প্রণালী, কার্যপ্রণালী, রােগ-ব্যাধী, খাদ্য এবং গতি সম্পর্কে জানতে পেরেছে। মােটকথা দেহের কার্য ও গতি সম্পর্কে যেসব গােপন রহস্য মানুষ এ যাবত জানতে সক্ষম হয়েছে তাকে অলৌকিক ঘটনাই বলা যায় এবং এই অলৌকিক ঘটনার স্রষ্টা আল্লাহ তায়ালা ব্যতীত আর কেউ নয় । মানবাত্মা সম্পর্কেও তারা কিছু কিছু তথ্য জানতে পেরেছে। তবে এই জানা তথ্য দেহ সম্পর্কিত জানা তথ্যের সমপরিমাণ নয়। কারণ দেহের উপাদন ও এর মেকানিজমের প্রতি যতােটুকু দৃষ্টি দেয়া হয়েছে ততােটুকু দৃষ্টি মানুষের বিবেক ও আত্মার প্রতি দেয়া হয়নি। তা সত্তেও যতােটুকু জ্ঞান এ সম্পর্কে লাভ হয়েছে তাতে বােঝা যায় যে, কাংখিত বিজয় বেশী দূরে নয়। তবুও মানুষের জানার আরও অনেক কিছু বাকী আছে। তাই আল্লাহর ওয়াদাও বহাল থাকবে। যে সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করার কথা আলােচ্য আয়াতের শেষাংশে উল্লেখ করা হয়েছে যে সত্যের বহিপ্রকাশ এই শতাব্দীর সূচনালগ্ন থেকেই পরিলক্ষিত হয়ে আসছে। মােমেনদের কাফেলায় বিভিন্ন শ্রেণী থেকে বিভিন্ন দেশ ও জাতি থেকে লােকজন যােগ দিচ্ছে। বিজ্ঞানের পথ ধরেও অনেক মানুষ এই কাফেলায় যােগ দিচ্ছে। দিনের পর দিন এই কাফেলা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। অথচ নাস্তিকতার বাঁধভাংগা স্রোত অতীতে এই পৃথিবীকে গ্রাস করতে চেয়েছিলাে, সেই স্রোতে এখন ভাটা পড়েছে যদিও প্রতিকূল পরিবেশ এখনও রয়েছে। তবে আশা করা যায়, সত্যিকার অর্থে এই বিংশ শতাব্দীর সমাপ্তি ঘটবে যতােক্ষণ পর্যন্ত এই স্রোতে পুরােপুরি ভাটা না পড়বে ইনশাআল্লাহ আর এর মাধ্যমেই আল্লাহর ওয়াদা বাস্তবায়িত হবে। তারা নিজেদের পালনকর্তার সম্মুখে হাযির হওয়ার ব্যাপারে সন্দিহান, আর সে কারণেই তাদের এই বিভ্রান্তি ও ভ্রষ্টতা ও পাপাচার। তাদের জানা উচিত, আল্লাহর পাকড়াও থেকে তারা কখনই রক্ষা পাবে না। কারণ তিনি সব কিছুকে পরিবেষ্টিত করে রেখেছেন।