(বই#১০৯৬)[ *এবং কাফিররা বলে-৫, দ্বীনের দাওয়াত অস্বিকারকারীদের টালবাহানা : -] www.motaher21.net সূরা:৪১:হামীম-আস-সাজদাহ পারা:২৪ ৩৭-৫৪ নং আয়াত:-

أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#১০৯৬)[ *এবং কাফিররা বলে-৫, দ্বীনের দাওয়াত অস্বিকারকারীদের টালবাহানা : -]
www.motaher21.net
সূরা:৪১:হামীম-আস-সাজদাহ
পারা:২৪
৩৭-৫৪ নং আয়াত:-

তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
# এখানে জনসাধারণকে উদ্দেশ্য করে বক্তব্য পেশ করা হচ্ছে এবং তাদেরকে প্রকৃত সত্য উপলব্ধি করানোর জন্য কয়েকটি কথা বলা হচ্ছে।
# এসব আল্লাহ‌র প্রতিভূ নয় যে, এগুলোর আকৃতিতে আল্লাহ‌ নিজেকে প্রকাশ করছেন বলে মনে করে তাদের ইবাদাত করতে শুরু করবে। বরং এগুলো আল্লাহ‌র নিদর্শন। এসব নিদর্শন নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করলে তোমরা বিশ্ব-জাহান ও তার ব্যবস্থাপনার সত্যতা ও বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পারবে এবং এ কথাও জানতে পারবে যে নবী-রসূল আলাইহিমুস সালাম আল্লাহ‌ সম্পর্কে যে তাওহীদের শিক্ষা দিচ্ছেন তাই প্রকৃত সত্য। সূর্য ও চাঁদের উল্লেখের পূর্বে দিন ও রাতের উল্লেখ করা হয়েছে এ বিষয়ে সাবধান করে দেয়ার জন্য যে রাতের বেলা সূর্যের অদৃশ্য হওয়া ও চাঁদের আবির্ভূত হওয়া এবং দিনের বেলা চাঁদের অদৃশ্য হওয়া ও সূর্যের আবির্ভূত হওয়া সুস্পষ্টভাবে একথা প্রমাণ করে যে, এ দু’টির কোনটিই আল্লাহ‌ বা আল্লাহ‌ প্রতিভূ নয়। উভয়েই তাঁর একান্ত দাস। তারা আল্লাহ‌র আইনের নিগড়ে বাঁধা পড়ে আবর্তন করছে।
# শিরককে যুক্তিসঙ্গত প্রমাণ করার জন্য কিছুটা অধিক মেধাবী শ্রেণীর মুশরিকরা সাধারণত যে দর্শনের বুলি কপচিয়ে থাকে এটা তারই জবাব। তারা বলে, আমরা এসব জিনিসকে সিজদা করি না। বরং এদের মাধ্যমে আল্লাহ‌কেই সিজদা করি। এর জবাব দেয়া হয়েছে, তোমরা যদি সত্যিই আল্লাহ‌র ইবাদতকারী হয়ে থাকো তাহলে এসব মাধ্যমের প্রয়োজন কি? সরাসরি তাঁকেই সিজদা করো না কেন?
# “অহংকার করে” অর্থ যে অজ্ঞতার মধ্যে এরা ডুবে আছে যদি তোমাদের কথা মেনে নেয়াকে নিজেদের অপমান মনে করে সেই অজ্ঞতাকেই আঁকড়ে ধরে থাকে।
# এসব ফেরেশতার মাধ্যমে গোটা বিশ্ব-জাহানের যে ব্যবস্থাপনা চলছে তা আল্লাহ‌র একত্ব ও দাসত্বের অধীনেই চলছে এবং এই ব্যবস্থার ব্যবস্থাপক ফেরেশতারা প্রতি মুহূর্তে সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, তাদের রবের সার্বভৌম কর্তৃত্ব ও দাসত্বে অন্য কারো শরিক হওয়া থেকে তিনি মুক্ত ও পবিত্র। তবে বুঝানো সত্ত্বেও যদি কতিপয় আহাম্মক না মানে এবং গোটা বিশ্ব-জাহান যে পথে চলছে সে পথ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে শিরকের পথে চলতেই গোঁ ধরে থাকে তাহলে তাদেরকে তাদের নির্বুদ্ধিতার পথেই হাবুডুবু খেতে দাও।

এ স্থানটিতে সিজদা করতে হবে এ বিষয়ে সবাই একমত। তবে উপরোক্ত দু’টি আয়াতের কোন্‌টিতে সিজদা করতে হবে সে বিষয়ে ফিকাহবিদদের মধ্যে মতানৈক্য হয়েছে। হযরত আলী ও হযরত আবদুল্লাহ্‌ ইবনে মাসউদ (রাঃ)إِنْ كُنْتُمْ إِيَّاهُ تَعْبُدُونَ পর্যন্ত পাঠ করে সিজদা করতেন। ইমাম মালেক এ মতটিই গ্রহণ করেছেন। এর সমর্থনে ইমাম শাফেয়ীর একটি মতও উদ্ধৃত হয়েছে। কিন্তু হযরত ইবনে আব্বাস, ইবনে উমর, সাঈদ ইবনুল মুসাইয়েব, মাসরূক, কাতাদা, হাসান বাসারী, আবু আবদুর রহমান আস-সুলামী, ইবনে সিরীন, ইবরাহীম নাখায়ী এবং আরো কতিপয় শিক্ষক وَهُمْ لَا يَسْأَمُونَ এর কাছে সিজদা করার পক্ষপাতী। এটি ইমাম আবু হানিফারও মত। তাছাড়া শাফেয়ীদের দৃষ্টিতেও এটিই অগ্রাধিকার প্রাপ্ত মত।
# যে তাওহীদ ও আখেরাত বিশ্বাসের দিকে মুহাম্মাদ ﷺ আহবান জানাচ্ছেন সেটি যুক্তিসঙ্গত এবং বিশ্ব-জাহানের নিদর্শনাবলী তারই সত্যতা প্রতিপাদন করছে, কয়েকটি বাক্যে জনসাধারণকে একথা বুঝানোর পর পুনরায় বক্তব্যের মোড় সেই সব বিরোধীদের দিকে ফিরছে যারা হঠকারিতার মাধ্যমে বিরোধিতা করার জন্য এক পায়ে দাঁড়িয়েছিলো।
# মূল আয়াতে ব্যবহৃত বাক্যাংশ হচ্ছে يُلْحِدُونَ فِي آيَاتِنَا (আমার আয়াতসমূহে ইলহাদ করে) ‘ইলহাদ’ অর্থ ফিরে যাওয়া, সোজা পথ ছেড়ে বাঁকা পথের দিকে যাওয়া, বক্রতা অবলম্বন করা। আল্লাহ‌র আয়াতসমূহে ইলহাদের অর্থ হচ্ছে কোন ব্যক্তি কর্তৃক সোজা কথার বাঁকা অর্থ করার চেষ্টা করা। আল্লাহ‌র আয়াতসমূহের শুদ্ধ ও সঠিক অর্থ গ্রহণ না করে সব রকম মিথ্যা ও ভুল অর্থ করে নিজেও পথভ্রষ্ট হওয়া এবং অন্যদেরকেও পথভ্রষ্ট করতে থাকা। মক্কার কাফেররা কুরআন মজীদের দাওয়াত ব্যর্থ করে দেয়ার জন্য যে চক্রান্ত করছিলো তার মধ্যে ছিল, তারা কুরআনের আয়াত শুনে তারপর কোন আয়াতকে পূর্বাপর প্রসঙ্গ থেকে বিচ্ছিন্ন করে, কোন আয়াতের শাব্দিক বিকৃতি ঘটিয়ে কোন বাক্যাংশ বা শব্দের ভুল বা মিথ্যা অর্থ করে নানা রকমের প্রশ্ন উত্থাপন করতো এবং এই বলে মানুষকে বিভ্রান্ত করতো যে, আজ নবী সাহেব কি বলেছেন তা শোন।
# এ কথাটির মধ্যে একটি হুমকি প্রচ্ছন্ন আছে। ক্ষমতাবান শাসক যদি বলেন, “অমুক ব্যক্তি যে আচরণ করছে তা আমার কাছে গোপন নয়” তাহলে আপনা থেকেই সে কথার অর্থ দাঁড়ায়, তার বাঁচার কোন উপায় নেই।
# অনড় ও অবিচল। বাতিলের পূজারীরা এর বিরুদ্ধে যেসব চক্রান্ত করছে তার দ্বারা একে পরাভূত করা সম্ভব নয়। এর মধ্যে আছে সততার শক্তি, সত্য জ্ঞানের শক্তি, যুক্তি-প্রমাণের শক্তি, প্রেরণকারী আল্লাহ‌র সার্বভৌম কর্তৃত্বের শক্তি এবং উপস্থাপনকারী রসূলের ব্যক্তিত্বের শক্তি। কেউ যদি মিথ্যা ও অন্তঃসারশূন্য প্রচারের হাতিয়ার দিয়ে একে ব্যর্থ করে দিতে চায় তাহলে কি তা সম্ভব?
# সামনের দিক থেকে না আসতে পারার অর্থ হচ্ছে কেউ যদি কুরআনের ওপর সরাসরি আক্রমণ করে তার কোন কথা ভুল এবং কোন শিক্ষা বাতিল ও বিকৃত প্রমাণ করতে চায় তাহলে এক্ষেত্রে সে সফলকাম হতে পারে না। পেছন দিক থেকে না আসতে পারার অর্থ হচ্ছে কখনো এমন কোন বাস্তব ও সত্য দেখা দিতে পারে না যা কুরআনের পেশকৃত সত্যতা ও বাস্তবতার পরিপন্থী, এমন কোন জ্ঞান-বিজ্ঞান উদ্ভাবিত হতে পারে না যা প্রকৃতই জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং কুরআনের বর্ণিত জ্ঞান-বিজ্ঞানকে অস্বীকার করে। এমন কোন অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণ থাকতে পারে না যা আকীদা-বিশ্বাস, নৈতিকতা, আইন-কানুন, সভ্যতা ও সংস্কৃতি, জীবন-প্রণালী ও সামাজিকতা এবং রাজনীতির ক্ষেত্রে কুরআন মানুষকে যে দিক নির্দেশনা দিয়েছে তা ভ্রান্ত প্রমাণ করবে। যে জিনিসকে এ গ্রন্থ ন্যায় ও সত্য বলে ঘোষণা করেছে তা কখনো বাতিল প্রমাণিত হতে পারে না। এর এ অর্থও হতে পারে যে বাতিল সম্মুখ দিক থেকে এসে হামলা করুক আর প্রতারণামূলক পথে এসে অকস্মাৎ হামলা করুক কুরআন যে দাওয়াত পেশ করছে তাকে সে কোন ভাবেই পরাজিত করতে পারবে না। সমস্ত বিরোধিতা এবং বিরোধীদের সব রকম গোপন ও প্রকাশ্য চক্রান্ত সত্ত্বেও এ আন্দোলন প্রসার লাভ করবে এবং কেউ একে ব্যর্থ করতে পারবে না।
# তাঁর রসূলদের প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে, গালি দেয়া হয়েছে, কষ্ট দেয়া হয়েছে তা সত্ত্বেও তিনি বছরের পর বছর তাদেরকে অবকাশ দিয়েছেন। এটা তাঁর ধৈর্য্য ও সহিষ্ণুতা এবং ক্ষমা ছাড়া আর কিছুই নয়।
# যেসব হঠকারিতার মাধ্যমে নবী ﷺ এর মোকাবিলা করা হচ্ছিলো এটা তার আরেকটি নমুনা। কাফেররা বলতো, মুহাম্মাদ ﷺ আরব। আরবী তাঁর মাতৃভাষা। তিনি যখন আরবীতে কুরআন পেশ করছেন তখন কি করে বিশ্বাস করা যায়, একথা তিনি নিজে রচনা করেননি, বরং আল্লাহ‌ তাঁর ওপর নাযিল করেছেন। তাঁর একথাকে আল্লাহ‌র নাযিলকৃত বাণী হিসেবে কেবল তখনই মেনে নেয়া যেতো যদি তিনি এমন কোন ভাষায় অনর্গল বক্তৃতা করতে শুরু করতেন যা জানেন না। যেমন ফারসী, রোমান বা গ্রীক ভাষা। এর জবাবে আল্লাহ‌ বলছেনঃ এদের নিজের ভাষায় কুরআন পাঠানো হয়েছে যা এরা বুঝতে সক্ষম। কিন্তু এদের আপত্তি হচ্ছে, একজন আরবের মাধ্যমে আরবদের জন্য আরবী ভাষায় এ বাণী নাযিল করা হলো কেন? কিন্তু অন্য কোন ভাষায় যদি নাযিল করা হতো তাহলে তখনও এই সব লোকই আপত্তি তুলে বলতো—আজব ব্যাপার তো! আরব জাতির কাছে একজন আরবকে রসূল বানিয়ে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু তাঁর কাছে এমন এক ভাষায় বাণী নাযিল করা হয়েছে যা রসূল বা গোটা জাতি কেউই বুঝে না।
# দূর থেকে যখন কাউকে ডাকা হয় তখন তার কানে একটা আওয়াজ প্রবেশ করে ঠিকই তবে আওয়াজ দাতা কি বলছে তা সে বুঝতে পারে না। এটা এমন একটা নজিরবিহীন উপমা যার মাধ্যমে হঠকারী বিরোধীদের পুরো মনঃস্তাত্ত্বিক চিত্র চোখের সামনে ফুটে ওঠে। বিদ্বেষ বা পক্ষপাত দোষ মুক্ত লোকের সামনে যদি আপনি কথা বলেন, তাহলে সে তা শোনে, বুঝার চেষ্টা করে এবং যুক্তিসঙ্গত কথা হলে খোলা মনে তা গ্রহণ করে। এটাই স্বাভাবিক। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি আপনার বিরুদ্ধে শুধু বিদ্বেষই পোষণ করে না, বরং শত্রুতাও পোষণ করে তাকে আপনি আপনার কথা যতই বুঝাতে চেষ্টা করবেন সে আদৌ সে কথার প্রতি মনোযোগী হবে না। আপনার সব কথা শোনার পরও এত সময় ধরে আপনি তাকে কি বললেন তা সে বুঝবে না। আপনিও মনে করবেন যেন আপনার কথা তার কানের পর্দায় ধাক্কা খেয়ে বাইরে দিয়েই চলে গেছে, মন ও মগজে প্রবেশ করার মত কোন রাস্তাই খুঁজে পায়নি।
# কিছু সংখ্যক লোক তা মেনেছিলো আর কিছু সংখ্যক লোক তার বিরোধিতা করতে বদ্ধপরিকর হয়েছিলো।
# একথার দু’টি অর্থ। একটি অর্থ হচ্ছে, চিন্তা-ভাবনা করা ও বুঝার জন্য মানুষকে যথেষ্ট সুযোগ দেয়া হবে আল্লাহ‌ যদি পূর্বেই এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করে থাকতেন তাহলে এ ধরনের বিরোধিতাকারীদের ধ্বংস করে দেয়া হতো। আরেকটি অর্থ হচ্ছে, সব রকম মতানৈক্যের চূড়ান্ত ফায়সালা আখেরাতে করা হবে আল্লাহ‌ যদি পূর্বেই এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করতেন তাহলে প্রকৃত সত্যকে এই পৃথিবীতেই উন্মুক্ত করে দেয়া হতো এবং কে ন্যায় ও সত্যের অনুসারী আর কে বাতিলের অনুসারী তাও পরিষ্কার করে দেয়া হতো।
# এই সংক্ষিপ্ত আয়াতাংশে মক্কার কাফেরদের রোগ পুরাপুরি চিহ্নিত করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, তারা কুরআন এবং মুহাম্মাদ ﷺ এর ব্যাপারে সন্দেহে নিপতিত আছে। এই সন্দেহ তাদেরকে চরম অস্থির ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করে রেখেছে। অর্থাৎ বাহ্যত তারা অত্যন্ত তোড়জোড়ের সাথেই কুরআনের আল্লাহ‌র বাণী হওয়া এবং মুহাম্মাদ ﷺ এর রসূল হওয়া অস্বীকার করে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাদের এই অস্বীকৃতি কোন নিশ্চিত বিশ্বাসের ভিত্তিতে নয় বরং এ ব্যাপারে তাদের মনে রয়েছে চরম দোদুল্যমানতা। এক দিকে তাদের ব্যক্তিস্বার্থ, প্রবৃত্তির কামনা-বাসনা এবং অজ্ঞতামূলক বিদ্বেষ কুরআন ও মুহাম্মাদ ﷺ কে অস্বীকার এবং পূর্ণ শক্তিতে বিরোধিতা করার দাবী করে। অপরদিকে ভেতর থেকে তাদের মন বলে, এ কুরআন সত্যি সত্যিই এক নজিরবিহীন বাণী। কোন সাহিত্যিক বা কবির নিকট থেকে এ ধরনের বাণী কখনো শোনা যায়নি। না কোন পাগল উম্মাদনার সময় এ ধরনের কথা বলতে পারে। না মানুষকে আল্লাহভীরুতা সৎকর্ম ও পবিত্রতার শিক্ষা দানের উদ্দেশ্যে কখনো শয়তানদের আগমন ঘটতে পারে। একই ভাবে যখন তারা মুহাম্মাদ ﷺ কে মিথ্যাবাদী বলে তখন ভেতর থেকে তাদের মন বলে, আল্লাহ‌র বান্দারা, কিছু লজ্জাও তো তোমাদের থাকা উচিত, এ ব্যক্তি কি মিথ্যাবাদী হতে পারে? যখন তারা তাঁকে পাগল বলে তখন তাদের বিবেক তাদেরকে ডেকে বলে ওঠে, ‘জালেমের দল, তোমরা কি সত্যিই এ ব্যক্তিকে পাগল বলে মনে করো?’ যখন তারা তাঁর বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আনে যে, মুহাম্মাদ ﷺ এত সব কিছু ন্যায় ও সত্যের জন্য করছেন না বরং নিজের বড়ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ করার জন্য করছেন তখন তাদের বিবেক ভেতর থেকে তিরস্কার করে বলে, তোমাদের প্রতি লা’নত, যাঁকে তোমরা কখনো ধন-সম্পদ, ক্ষমতা ও খ্যাতির জন্য প্রচেষ্টা চালাতে দেখনি, যাঁর গোটা জীবন স্বার্থপরতার ক্ষুদ্রতম কালিমা থেকেও মুক্ত, যিনি সর্বদা নেকী ও কল্যাণের জন্য কাজ করেছেন, কিন্তু কখনো নিজের প্রবৃত্তি ও ব্যক্তি স্বার্থের জন্য অন্যায় কাজ করেননি, এমন সৎ ও পবিত্র মানুষকে তোমরা স্বার্থপর বলছো?
# সৎ মানুষের সৎকর্মকে ধ্বংস করে দিবেন এবং দুষ্কর্মকারীকে তার দুষ্কর্মের শাস্তি দিবেন না, তোমার রব এ ধরনের জুলুম কখনো করতে পারেন না।
# সেই সময় অর্থ কিয়ামত। অর্থাৎ সেই বিশেষ সময় যখন দুষ্কর্মকারীদেরকে তাদের দুষ্কর্মের প্রতিফল দেয়া হবে এবং সৎকর্মশীল সেই সব মানুষের প্রতি ন্যায় বিচার করা হবে, যাদের বিরুদ্ধে দুষ্কর্ম করা হয়েছিলো।
# সে সময়টি কখন আসবে তা আল্লাহ‌ ছাড়া কেউ জানে না। কাফেররা বলতো, আমাদের ওপর দুষ্কর্মের যে প্রতিক্রিয়া হওয়ার হুমকি দেয়া হচ্ছে তা কখন পূরণ হবে? এখানে এ প্রশ্নের জবাব দেয়া হয়েছে। আল্লাহ‌ তাদের প্রশ্নের উল্লেখ না করেই তার জবাব দিয়েছেন।
# একথা বলে শ্রোতাদেরকে দু’টি বিষয় বুঝানো হয়েছে। একটি হচ্ছে, শুধু কিয়ামত নয়, বরং সমস্ত গায়েবী বিষয়ের জ্ঞান আল্লাহ‌র জন্য নির্দিষ্ট। গায়েবী বিষয়ে জ্ঞানের অধিকারী আর কেউ নেই। অপরটি হচ্ছে, যে আল্লাহ‌ খুঁটিনাটি বিষয়সমূহের এত বিস্তারিত জ্ঞান রাখেন, কোন ব্যক্তির কাজ কর্ম তাঁর দৃষ্টি এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। অতএব তাঁর সার্বভৌম ক্ষমতার আওতায় নির্ভয়ে যা ইচ্ছা তাই করা ঠিক নয়। দ্বিতীয় অর্থ অনুসারে এই বাক্যাংশের সম্পর্ক পরবর্তী বাক্যাংশের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। একথাটির পরেই যা বলা হয়েছে সে সম্পর্কে যদি চিন্তা করেন তাহলে বক্তব্যের ধারাক্রম থেকে আপনা-আপনি একথার ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, কিয়ামতের তারিখ জানার ধান্ধায় কোথায় পড়ে আছ? বরং চিন্তা করো কিয়ামত যখন আসবে তখন নিজের এসব গোমরাহীর জন্য কি দুর্ভোগ পোহাতে হবে। কিয়ামতের তারিখ সম্পর্কে প্রশ্নকারী এক ব্যক্তিকে নবী ﷺ একথার মাধ্যমেই জবাব দিয়েছিলেন। সহীহ সুনান ও মুসনাদ গ্রন্থসমূহে মুতাওয়াতির পর্যায়ভুক্ত একটি হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, একবার সফরে নবী ﷺ কোথাও যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে এক ব্যক্তি দূর থেকে ডাকলো, হে মুহাম্মাদ! নবী ﷺ বললেন, হ্যাঁ কি বলতে চাও, বলো। সে বললোঃ কিয়ামত কবে হবে? তিনি জবাবে বললেনঃ

ويحل انها كائنة لامحالة فما اعددت لها

“হে আল্লাহ‌র বান্দা, কিয়ামত তো আসবেই। তুমি সেজন্য কি প্রস্তুতি গ্রহণ করেছো?”
# এখন আমাদের কাছে প্রকৃত সত্য উদঘাটিত হয়েছে। আমরা যা বুঝেছিলাম তা যে একেবারেই ভ্রান্ত ছিল তা আমরা জানতে পেরেছি। এখন আমাদের মধ্যকার একজনও একথা বিশ্বাস করে না যে, আপনার খোদায়ীতে আদৌ অন্য কোন অংশীদার আছে। “আমরা আগেই বলেছি” কথা থেকে বুঝা যায়, কিয়ামতের দিন প্রতিটি পর্যায়ে কাফেরদের বার বার জিজ্ঞেস করা হবে, পৃথিবীতে তোমরা আল্লাহ‌র রসূলদের কথা মানতে অস্বীকার করেছিলে। এখন বলো দেখি, তাঁরাই সত্যের অনুসারী ছিলেন না তোমরা? প্রতিটি ক্ষেত্রেই কাফেররা স্বীকার করতে থাকবে যে রসূলগণ যা বলেছিলেন তাই ছিল সত্য। আর সেই জ্ঞানের বিষয় পরিত্যাগ করে অজ্ঞতাকে আঁকড়ে ধরে থেকে আমরা ভুল করেছিলাম।
# তারা নিরাশ হয়ে এই আশায় চতুর্দিকে দৃষ্টিপাত করতে থাকবে যে, সারা জীবন তারা যাদের সেবা করলো হয়তো তাদের মধ্য থেকে কেউ আসবে এবং আল্লাহ‌র আযাব থেকে উদ্ধার করবে কিংবা অন্ততঃ শাস্তির মাত্রা কমিয়ে দেবে। কিন্তু কোথাও তারা কোন সাহায্যকারীকে দেখতে পাবে না।
# কল্যাণ অর্থ সুখ স্বাচ্ছন্দ্য, অঢেল রিযিক, সুস্থতা, সন্তান-সন্ততির কল্যাণ ইত্যাদি। এখানে মানুষ অর্থ প্রতিটি মানুষ নয়। কেননা নবী-রসূল ও নেককার মানুষেরাও মানুষের মধ্যে শামিল, কিন্তু তাঁরা এমনটা নন। এ সম্পর্কে পরে আলোচনা করা হবে। এখানে মানুষ বলতে নীচমনা ও অদূরদর্শী মানুষকে বুঝানো হয়েছে, যারা কঠিন সময়ে কাকুতি-মিনতি করতে থাকে কিন্তু পার্থিব আরাম-আয়েশ ও ভোগের উপকরণ লাভ করা মাত্র আনন্দ উল্লাসে মেতে ওঠে। অধিকাংশ মানুষের মধ্যেই যেহেতু এ দুর্বলতা আছে তাই একে মানবজাতির দুর্বলতা বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
# এসব কিছুই আমি আমার যোগ্যতা বলে লাভ করেছি এবং এসব পাওয়া আমার অধিকার।
# আমার আনুগত্য ও দাসত্ব পরিত্যাগ করে এবং আমার সামনে মাথা নত করাকে নিজের অপমান মনে করতে থাকে।
# এর অর্থ এ নয় যে, কুরআন সত্যিই আল্লাহ‌র পক্ষ থেকে নাযিল হয়ে থাকলে এর বিরোধিতার ফলে আমাদের ওপর দুর্ভাগ্য নেমে আসতে পারে শুধু এই ভয়ে এর ওপর ঈমান আনো। বরং এর অর্থ হলো, যেভাবে তোমরা না বুঝে-শুনে, কোন প্রকার ভাবনা-চিন্তা না করে কুরআনকে অস্বীকার করছো, বুঝার চেষ্টা করার পরিবর্তে কানে আঙ্গুল দিচ্ছো এবং অযথা জিদ করে বিরোধিতায় বদ্ধপরিকর হয়েছো তা বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক নয়। এ কুরআন আল্লাহ‌র পক্ষ থেকে আসেনি এবং আল্লাহ‌ তা পাঠাননি বলে জানতে পেরেছো এ দাবীও তোমরা করতে পারো না। একথা সুস্পষ্ট যে, কুরআনকে আল্লাহ‌র বাণী বলে মেনে নিতে তোমাদের অস্বীকৃতি নিশ্চিত জ্ঞানের ভিত্তিতে নয়, ধারণার ভিত্তিতে। বাহ্যত এ ধারণা যেমন অভ্রান্ত হওয়া সম্ভব তেমনি ভ্রান্ত হওয়াও সম্ভব। এই উভয় সম্ভাবনাকে একটু পর্যালোচনা করে দেখো। মনে করো তোমাদের ধারণাই সঠিক প্রমাণিত হলো। এক্ষেত্রে তোমাদের ধারণা অনুসারে বড় জোর এতটুকু হবে যে, মান্যকারী ও অমান্যকারী উভয়ের পরিণাম একই হবে। কারণ, মৃত্যুর পর উভয়েই মাটিতে মিশে যাবে। এরপরে আর কোন জীবন থাকবে না। যেখানে কুফর ও ঈমানের কোন ভাল মন্দ ফলাফল দেখা দিতে পারে। কিন্তু সত্যি সত্যিই যদি এ কুরআন আল্লাহ‌র পক্ষ থেকে হয়ে থাকে এবং কুরআন যা বলছে তা যদি বাস্তব রূপ নিয়ে সামনে আসে তাহলে বলো তা অস্বীকার করে ও বিরোধিতার ক্ষেত্রে এতদূর অগ্রসর হয়ে তোমরা কোন্ পরিণামের মুখোমুখি হবে? কাজেই তোমাদের আপন স্বার্থই দাবী করে, জিদ ও হঠকারিতা পরিত্যাগ করে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে কুরআন সম্পর্কে ভেবে দেখো। চিন্তা-ভাবনার পরও যদি তোমরা ঈমান না আনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে চাও তবে তাই করো। কিন্তু বিরোধিতায় বদ্ধপরিকর হয়ে এ আন্দোলনের পথ রুদ্ধ করার জন্য এতটা অগ্রসর হয়ো না যে মিথ্যা, চক্রান্ত, প্রতারণা এবং জুলুম-নির্যাতনের অস্ত্র ব্যবহার করতে শুরু করে দেবে এবং শুধু নিজেদের ঈমান আনা থেকে বিরত থাকা যথেষ্ট মনে না করে অন্যদেরকেও ঈমান আনা থেকে বিরত রাখার প্রচেষ্টা চালাতে থাকবে।
# এ আয়াতের দু’টি অর্থ। আর দু’টি অর্থই বর্ণনা করেছেন বড় বড় মুফাসসিরগণ। একটি অর্থ হচ্ছে, অচিরেই এরা নিজ চোখে দেখতে পাবে এ কুরআনের আন্দোলন আশেপাশের সব দেশে বিস্তার লাভ করেছে এবং এরা নিজেরা তার সামনে নতশির। সে সময় তারা জানতে পারবে আজ তাদের যা বলা হচ্ছে তাই ছিল পুরোপুরি ন্যায় ও সত্য। অথচ এখন তারা তা মেনে নিচ্ছে না। কেউ কেউ এ অর্থ সম্পর্কে এই বলে আপত্তি উত্থাপন করেছেন যে, কোন আন্দোলনের শুধু বিজয়ী হওয়া এবং বিরাট বিরাট এলাকা জয় করা তার ন্যায় ও সত্য হওয়ার প্রমাণ নয়। বাতিল আন্দোলনসমূহও বিস্তার লাভ করে এবং তার অনুসারীরাও দেশের পর দেশ জয় করে থাকে। কিন্তু এটা একটা হাল্কা ও গুরুত্বহীন আপত্তি। গোটা বিষয় সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা না করেই এ আপত্তি উত্থাপন করা হয়েছে। নবী ﷺ ও খোলাফায়ে রাশেদীনের যুগে ইসলাম যেসব বিস্ময়কর বিজয় লাভ করেছে তা কেবল এ অর্থে আল্লাহ‌র নিদর্শন ছিল না যে, একদল ঈমানদার লোক দেশের পর দেশ জয় করেছে। বরং তা এ অর্থে আল্লাহ‌র নিদর্শন যে তা পৃথিবীর আর দু’দশটি বিজয়ের মত ছিল না। কারণ ঐ সব পার্থিব বিজয়ে এক ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা জাতিকে অন্যদের প্রাণ ও সম্পদের মালিক মোখতার বানিয়ে দেয় এবং আল্লাহ‌র পৃথিবী জুলুম নির্যাতনে ভরে ওঠে। অপরদিকে এই বিজয় তার সাথে এক বিরাট ধর্মীয়, নৈতিক, চিন্তাগত ও মানসিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং তামাদ্দুনিক ও অর্থনৈতিক বিপ্লব নিয়ে এসেছিলো। যেখানেই এর প্রভাব পড়েছে সেখানেই মানুষের মধ্যে সর্বোত্তম যোগ্যতা ও গুণাবলী সৃষ্টি হয়েছে এবং কুপ্রবৃত্তি ও অসৎ স্বভাবসমূহ অবদমিত হয়েছে। পৃথিবীর মানুষ কেবল মাত্র দুনিয়া ত্যাগী দরবেশ এবং নিভৃত বসে ‘আল্লাহ্‌ আল্লাহ‌’ জপকারীদের মধ্যে যেসব গুণাবলী দেখার আশা করতো এবং দুনিয়ার কায়কারবার পরিচালনাকারীদের মধ্যে যা পাওয়ার চিন্তাও কখনো করতে পারতো না, এই বিপ্লব সেই সব গুণাবলী ও নৈতিকতা শাসকদের রাজনীতিতে, ন্যায় বিচারের আসনে সমাসীন বিচারকদের আদালতে, সেনাবাহিনীর নেতৃত্বদানকারী সেনাধ্যক্ষদের পরিচালিত যুদ্ধে বিজয় অভিযানসমূহ পরিচালনার ক্ষেত্রে, রাজস্ব আদায়কারীদের আচরণে এবং বড় বড় কারবার পরিচালনাকারীদের ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রতিফলন ঘটিয়ে দেখিয়েছে। এই বিপ্লব তার সৃষ্ট সমাজে সাধারণ মানুষকে নৈতিক চরিত্র ও আচরণ এবং পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতার দিক দিয়ে এত উর্ধ্বে তুলে ধরেছে যে, অপরাপর সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিরাও তার চেয়ে অনেক নীচু পর্যায়ের বলে প্রতিভাত হয়েছে। এ বিপ্লব মানুষকে কুসংস্কার ও অমূলক ধ্যান-ধারণার আবর্ত থেকে বের করে জ্ঞান-গবেষণা যুক্তিসঙ্গত চিন্তা ও কর্মনীতির সুস্পষ্ট রাজপথে এনে দাঁড় করিয়েছে। এ বিপ্লব সামাজিক জীবনের সেই সব রোগ-ব্যাধির চিকিৎসা করেছে অপরাপর ব্যবস্থায় যার চিকিৎসার ধারণা পর্যন্ত ছিল না। কিংবা থাকলেও সেসব রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে সফলকাম হয়নি। যেমনঃ বর্ণ, গোত্র এবং দেশ ও ভাষার ভিত্তিতে মানুষে মানুষে পার্থক্য, একই সমাজে বিভিন্ন শ্রেণী বিভাগ এবং তাদের মধ্যে উচ্চ নীচের বৈষম্য, অস্পৃশ্যতা, আইনগত অধিকার ও বাস্তব আচরণে সাম্যের অভাব, নারীদের পশ্চাদপদতা ও মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চনা, অপরাধের আধিক্য, মদ ও মাদকদ্রব্যের ব্যাপক প্রচলন, জবাবদিহি ও সমালোচনার ঊর্ধ্বে সরকারের অবস্থান, মৌলিক অধিকার থেকেও জনগনের বঞ্চনা, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে চুক্তিসমূহের অমর্যাদা, যুদ্ধের সময় বর্বর ও পশুসুলভ আচরণ এবং এরূপ আরো অনেক ব্যাধি। সবচেয়ে বড় কথা, এ বিপ্লব দেখতে দেখতে আরব ভূমিতে রাজনৈতিক অরাজকতার জায়গায় শৃংখলা, খুন-খারাবি ও নিরাপত্তাহীনতার জায়গায় নিরাপত্তা, পাপাচারের জায়গায় তাকওয়া ও পবিত্রতা, জুলুম ও বে-ইনসাফির জায়গায় ন্যায় বিচার, নোংরামি ও অশিষ্টতার জায়গায় পবিত্রতা ও রুচিশীলতা, অজ্ঞতার জায়গায় জ্ঞান এবং পুরুষাণুক্রমিক শত্রুতার জায়গায় ভ্রাতৃত্ব ও ভালবাসা সৃষ্টি করে এবং যে জাতির লোকেরা নিজ গোত্রের সরদারী ছাড়া বড় আর কোন স্বপ্নও দেখতে পারতো না তাদেরকে সমগ্র পৃথিবীর নেতা বানিয়ে দিল। এগুলোই ছিল সেই নিদর্শনাবলী। নবী ﷺ সর্বপ্রথম যাদেরকে উদ্দেশ্য করে এ আয়াত শুনিয়েছিলেন সেই প্রজন্মের লোকেরাই নিজেদের চোখে এসব নিদর্শন দেখেছিলো। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত আল্লাহ‌ নিরবচ্ছিন্নভাবে এসব নিদর্শন দেখিয়ে যাচ্ছেন। মুসলমানরা নিজেদের পতন যুগেও নৈতিক চরিত্রের যে পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছে যারা সভ্যতা ও শিষ্ঠাচারের ঝাণ্ডাবাহী সেজে আছে তারা কখনো তার ধারে কাছেও ঘেঁষতে পারেনি। ইউরোপের বিভিন্ন জাতি আফ্রিকা, আমেরিকা, এশিয়া এবং এমনকি ইউরোপেরও পরাজিত জাতিসমূহের সাথে যে নির্যাতনমূলক আচরণ করেছে মুসলমানদের ইতিহাসের কোন যুগেই তার কোন নজির পেশ করা সম্ভব নয়। কুরআনের কল্যাণকারিতাই মুসলমানদের মধ্যে এতটা মানবিক গুণাবলী সৃষ্টি করেছে যে, বিজয় লাভ করেও তারা কখনো ততটা অত্যাচারী হতে পারেনি ইতিহাসের প্রতিটি যুগে অমুসলিমরা যতটা অত্যাচারী হতে পেরেছে এবং আজও পারছে। চোখ থাকলে যে কেউ নিজেই দেখে নিতে পারে, মুসলমানরা যখন শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে স্পেনের শাসক ছিল তখন তারা খৃস্টানদের সাথে কিরূপ আচরণ করেছিলো। কিন্তু খৃস্টানরা সেখানে বিজয়ী হয়ে তাদের সাথে কি আচরণ করেছিলো? হিন্দুস্থানে দীর্ঘ আটশ’ বছরের শাসনকালে মুসলমানরা হিন্দুদের সাথে কিরূপ আচরণ করেছিলো। কিন্তু এখন হিন্দুরা বিজয়ী হয়ে তাদের সাথে কেমন ব্যবহার করেছে। বিগত তেরশ’ বছর যাবত মুসলমানরা ইহুদীদের সাথে কি আচরণ করেছে আর বর্তমানে ফিলিস্তিনে মুসলমানদের সাথে তাদের আচরণ কেমন!

এ আয়াতের দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে, আল্লাহ‌ আসমান ও যমীনের সর্বত্র এবং মানুষের আপন সত্তার মধ্যেও মানুষকে এমন সব নিদর্শন দেখাবেন যা দ্বারা কুরআন যে শিক্ষা দান করছে তা যে সত্য সে কথা সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ পাবে। কেউ কেউ এ অর্থ গ্রহণ সম্পর্কে এই আপত্তি উত্থাপন করেছে যে, আসমান ও যমীনের দিগন্তরাজি এবং নিজের সত্তাকে মানুষ তখনো দেখছিলো। তাই ভবিষ্যতে এসব জিনিসের মধ্যে নিদর্শনাবলী দেখানোর অর্থ কি? কিন্তু ওপরে বর্ণিত অর্থ গ্রহণ সম্পর্কে আপত্তি যেমন হাল্কা ও গুরুত্বহীন এ আপত্তিও তেমনি হাল্কা ও গুরুত্বহীন। আসমান ও যমীনের দিগন্তরাজি নিঃসন্দেহে ছিল এবং মানুষ তা সব সময় দেখে এসেছে। তাছাড়া সব যুগে মানুষ তার আপন সত্তাকে যেমনটা দেখেছে এখনো ঠিক তেমনটাই দেখছে। কিন্তু এসব জিনিসের মধ্যে আল্লাহ‌র এত অসংখ্য নিদর্শন আছে যে, মানুষ কখনো তা পূর্ণরূপে জ্ঞানের আওতায় আনতে সক্ষম হয়নি এবং হবেও না। প্রত্যেক যুগে মানুষের সামনে নতুন নতুন নিদর্শন এসেছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত আসতে থাকবে।
# মানুষকে মন্দ পরিণাম সম্পর্কে সাবধান করার জন্য এতটুকু কথা কি যথেষ্ঠ নয় যে, ন্যায় ও সত্যের এই আন্দোলনকে মিথ্যা প্রতিপন্ন ও ব্যর্থ করার জন্য তারা যা কিছু করছে আল্লাহ‌ তাদের প্রতিটি আচরণ ও তৎপরতা দেখছেন।
# তাদের কখনো আপন রবের সামনে হাজির হতে হবে এবং নিজের কাজ-কর্মের জন্য জবাবদিহি করতে হবে তারা এ বিশ্বাস পোষণ করে না। তাদের এরূপ আচরণের এটাই মৌলিক কারণ।
# তাঁর পাকড়াও থেকে আত্মরক্ষা করে কোথাও যেতে সক্ষম নয়। তাছাড়া তাঁর রেকর্ড থেকে তাদের আচরণ বাদ পড়াও সম্ভব নয়।

তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
৩৭-৩৯ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

আল্লাহর অসংখ্য বড় বড় নির্দশনাবলীর মধ্যে অন্যতম হলো রাত-দিন, চন্দ্র-সূর্য। এ সকল নিদর্শন আল্লাহ তা‘আলার এককত্ব ও রুবুবিয়্যাহর প্রমাণ বহন করে। তাই এ সকল নিদর্শনের সৃষ্টা আল্লাহ তা‘আলার তা‘আলা সকল প্রকার ইবাদত পাওয়ার হকদার। সে জন্য তিনি সকল নিদর্শনের ইবাদত করতে নিষেধ করেছেন। অতত্রব, আল্লাহ তা‘আলার এ সকল বড় বড় নিদর্শনের যদি ইবাদত না করা যায় তাহলে কিভাবে মানুষের হাতের তৈরি জিনিসের ইবাদত করা যাবে!

এরপর আল্লাহ তা‘আলা এ কথা বলে মানুষকে সতর্ক করে দিচ্ছেন যে, তোমরা আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করো। মনে রাখবে, যদি তোমরা আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করতে অহঙ্কার পোষণ করো, গর্ব করো, তাঁর ইবাদত থেকে বিরত থাকো তাতে তাঁর কিছুই হবে না। তিনি তোমাদের ইবাদতের মুখাপেক্ষী নন, তোমরা এমনটি মনে করো না যে, তোমরা আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত না করলে অন্য কেউ তাঁর ইবাদত করবে না বরং তাঁর ফেরেশতাগণ দিবা-রাত্রি তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে থাকে।

আল্লাহ তা‘আলার বাণী :

(أُولٰ۬ئِكَ الَّذِيْنَ اٰتَيْنٰهُمُ الْكِتٰبَ وَالْحُكْمَ وَالنُّبُوَّةَ ج فَإِنْ يَّكْفُرْ بِهَا هٰٓؤُلَا۬ءِ فَقَدْ وَكَّلْنَا بِهَا قَوْمًا لَّيْسُوْا بِهَا بِكٰفِرِيْنَ‏)‏

“আমি তাদেরকেই কিতাব, কর্তৃত্ব ও নবুওয়াত দান করেছি, অতঃপর যদি এরা এগুলোকে প্রত্যাখ্যানও করে তবে আমি তো এমন এক সম্প্রদায়ের প্রতি এগুলোর ভার অর্পণ করেছি যারা এগুলো প্রত্যাখ্যান করবে না।” (সূরা আন‘আম ৬ : ৮৯)

এরপর আল্লাহ তা‘আলা তাঁর আরো একটি নিদর্শনের কথা বর্ণনা করেছেন যে, তিনি মৃত ও শুষ্ক ভূমিকে আকাশ হতে পানি বর্ষণের দ্বারা জীবিত করেন। যার ফলে তা উর্বর ও উৎপাদনশীল হয়ে ওঠে। বৃষ্টি বর্ষণ করে যেভাবে মৃত জমিনকে জীবিত করেন অনুরূপভা্েব মৃত মানুষকে আল্লাহ তা‘আলা পুনরুজ্জীবিত করবেন। এ সম্পর্কে সূরা আন্ নাহ্ল-এ আলোচনা করা হয়েছে।

يلحدون-এর অর্থ হলো, শুষ্ক-অনাবৃষ্টি, অর্থাৎ মৃত বা উদ্ভিদ শূন্য।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. সকল কিছুর সৃষ্টিকর্তা একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা।
২. আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্য কারো উদ্দেশ্যে সিজদা দেয়া যাবে না, করলে র্শিক হবে এবং এর ফলে জাহান্নামে যেতে হবে।
৩. আল্লাহ মানুষের ইবাদত থেকে অমুখাপেক্ষী। বরং তাদের ইবাদত তাদেরই কাজে লাগবে।
৪. কোন প্রকার গর্ব-অহঙ্কার করা যাবে না।
৪০-৪৩ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

يُلْحِدُوْنَ শব্দের অর্থ বিকৃত করা, পরিবর্তন করা, এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় সরিয়ে দেয়া। এখানে মূলতঃ তাদের কথা বলা হয়েছে যারা আল কুরআনের মধ্যে পরিবর্তন পরিবর্ধন সাধনের চেষ্টা করে।

যারা আল্লাহ তা‘আলার কিতাবকে বিকৃত করে তাদেরকে উদ্দেশ্য করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন : যারা কুফরী করে এবং আল্লাহ তা‘আলার কিতাবকে বিকৃত করে তারা হলো জাহান্নামের আধিবাসী। তাই আল্লাহ তাদেরকে এখতিয়ার দিয়ে বলেন : তোমরা তোমাদের ইচ্ছামত কাজ করতে থাকো, এটা মূলতঃ তাদের জন্য ধমকস্বরূপ যে, তোমরা যাই কিছু করো না কেন, এ কুরআন যতই বিকৃত করতে চাওনা কেন এতে কোন প্রকার মিথ্যা অনুপ্রবেশ করবে না। এটা সংরক্ষণ করার দায়িত্ব আমার।

আল্লাহ তা‘আলার বাণী :

(إِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِّكْرَ وَإِنَّا لَه۫ لَحٰفِظُوْنَ)‏

“নিশ্চয়ই‎ আমিই এ কুরআন অবতীর্ণ করেছি এবং অবশ্যই আমিই তার সংরক্ষক।” (সূরা হিজর ১৫ : ৯)

এরপর আল্লাহ তা‘আলা তাঁর প্রিয়পাত্র মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে সান্ত্বনা দিয়ে বলছেন যে, হে নাবী! এ কাফির-মুশরিকরা যা কিছু বলে তা শুধু তোমাকেই নয়, বরং তোমার পূর্ববর্তী নাবী-রাসূলদেরকেও এরূপ কথা-বার্তা বলা হয়েছিল। তাঁরা ধৈর্য ধারণ করেছিল, সুতরাং তুমিও ধৈর্য ধারণ করো।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. জাহান্নামীরা কখনো জান্নাতীদের সমান হতে পারে না। জান্নাতী লোকেরাই উত্তম।
২. কুরআন সংরক্ষণ করার দায়িত্ব স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলা গ্রহণ করেছেন।
৩. বিপদে ধৈর্য ধারণ করতে হবে।
৪. সত্য-সঠিক জিনিস জানার পর তার উপর অবশ্যই আমল করতে হবে। তা থেকে বিরত থাকা যাবে না।
৪৪-৪৫ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

আল্লাহর রহমত ও করুনা যে তিনি নাবীর ভাষায় কুরআন নাযিল করেছেন। কুরআনুল কারীমকে আরবি ভাষায় অবতীর্ণ করার হিকমাত হল : এ কুরআন যদি আরবি ভাষা ব্যতীত অন্য ভাষায় অবতীর্ণ করা হত তাহলে এ সকল কাফির-মুশরিকরা বলত : এ কুরআন যথাযথভাবে বিবৃত হয়নি। এটা বড়ই অবাক হবার বিষয় যে, রাসূল আরবী ভাষী আর কুরআন অবতীর্ণ করা হয়েছে অনারবীয় ভাষায়। এটা কুরআন বুঝা ও বুঝানোর ক্ষেত্রে অন্তরায়।

যেমন আল্লাহ বলেন :

(وَلَوْ نَزَّلْنٰھُ عَلٰی بَعْضِ الْاَعْجَمِیْنَﰕفَقَرَاَھ۫ عَلَیْھِمْ مَّا کَانُوْا بِھ۪ مُؤْمِنِیْنَ)‏

“আমি যদি এটা কোন অনারবীয়’র প্রতি অবতীর্ণ করতাম। এবং তা সে তাদের নিকট পাঠ করত, তবে তারা তাতে ঈমান আনত না; (সূরা শু‘আরা- ২৬ : ১৯৮-১৯৯)

সুতরাং এ দিকে বিবেচনা করেই কুরআনকে আরবী ভাষায় অবতীর্ণ করা হয়েছে। যাতে কোন প্রকার ভুল-ত্র“টি বা ঘাটতি তারা ধরতে না পারে।

আরব ব্যতীত দুনিয়ার অপর জাতিসমূহকে আজম বলা হয়। যদি শব্দটির প্রথমে আলিফ যোগ করে أعجم বলা হয় তাহলে এর অর্থ হয় অপ্রাঞ্জল বাক্য। তাই যে ব্যক্তি আরবী নয় তাকে আজমী বলা হবে যদিও সে প্রাঞ্জল ভাষা বলে। বস্তুত أعجم বলা হবে তাকেই যে ব্যক্তি প্রাঞ্জল ভাষা বলতে পারে না। (কুরতুবী)

এরপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন : এ কুরআন মু’মিনদের জন্য হিদায়াত গ্রন্থ ও ব্যাধির প্রতিকার। আল্লাহ তা‘আলার বাণী :

(وَنُنَزِّلُ مِنَ الْقُرْاٰنِ مَا هُوَ شِفَا۬ءٌ وَّرَحْمَةٌ لِّلْمُؤْمِنِيْنَ لا وَلَا يَزِيْدُ الظَّالِمِيْنَ إِلَّا خَسَارًا ‏)‏

“আমি কুরআনের এমন আয়াত অবতীর্ণ করি, যা মু’মিনদের জন্য আরোগ্য ও রহ্মত, কিন্তু সেটা জালিমদের ক্ষতিই বৃদ্ধি করে।” (সূরা ইসরা ১৭ : ৮২)

পক্ষান্তরে যারা কাফির, যারা শয়তানের অনুসারী এ কুরআন তাদেরকে হিদায়াত দান করবে না বরং এটি তাদের জন্য এক পীড়াদায়ক যন্ত্রণা যা তাদের অন্ধত্ব ও বধিরতাকে বৃদ্ধি করে। আল্লাহ তা‘আলার বাণী :

(وَمَثَلُ الَّذِیْنَ کَفَرُوْا کَمَثَلِ الَّذِیْ یَنْعِقُ بِمَا لَا یَسْمَعُ اِلَّا دُعَا۬ئً وَّنِدَا۬ئًﺚ صُمّۭ بُکْمٌ عُمْیٌ فَھُمْ لَا یَعْقِلُوْنَ‏)‏

“আর যারা কুফরী করেছে তাদের দৃষ্টান্ত ওদের ন্যায় যাদেরকে কেউ আহ্বান করলে শুধু চিৎকার ও শব্দ ব্যতীত আর কিছুই শোনে না। তারা বধির, মূক, অন্ধ। কাজেই তারা বুঝতে পারে না।” (সূরা বাকারাহ্ ২ : ১৭১)

(أُولٰ۬ئِكَ يُنَادَوْنَ مِنْ مَّكَانٍۭ بَعِيْدٍ)

‘তারা এমন যে, যেন তাদেরকে আহ্বান করা হয় বহু দূর হতে’ এটা একটি প্রবাদ বা দৃষ্টান্ত। যে ব্যক্তি কথা বোঝে অনারবরা তাকে বলে

أنت تسمع من قريب

অর্থাৎ তুমি নিকটবর্তী স্থান থেকে শুনছ। আর যে কথা বোঝে না তাকে বলে

أنت تنادي من بعيد

অর্থাৎ তোমাকে দূর থেকে ডাকা হচ্ছে (কুরতুবী)। উদ্দেশ্য হল তারা যেহেতু কুরআনের নির্দেশাবলী শোনার ও বোঝার ইচ্ছা করে না তাই তাদের কান যেন বধির এবং চক্ষু অন্ধ।

তাদেরকে হিদায়াত করা এমন যেমন কাউকে অনেক দূর থেকে ডাক দেয়া, ফলে তার কানে আওয়াজ পৌঁছে না এবং সে সাড়া দিতে পারে না।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. কুরআন আরবি ভাষায় অবতীর্ণ করার হিকমাত জানতে পারলাম।
২. কুরআন মু’মিনদের জন্য হিদায়াত দানকারী আর কাফিরদেরকে গোমরাহকারী।
৩. প্রত্যেক মানুষের ব্যাপারে পূর্ব থেকে সিদ্ধান্ত করে রাখা হয়েছে সে কোথায় কী করবে এবং কখন কিভাবে মৃত্যু বরণ করবে।
৪৬ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

আল্লাহ তা‘আলা বলেন, যারা ভাল কাজ করে তার প্রতিদান তারা পাবে আর যারা মন্দ আমল করে তার পরিণাম তাকেই ভোগ করতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(إِنْ أَحْسَنْتُمْ أَحْسَنْتُمْ لِأَنْفُسِكُمْ قف وَإِنْ أَسَأْتُمْ فَلَهَا)

তোমরা সৎকর্ম করলে সৎকর্ম নিজেদের (কল্যাণের) জন্য করবে এবং মন্দ কর্ম করলে তাও করবে নিজেদের (ক্ষতির) জন্য। (সূরা ইসরা ১৭ : ৭)

আল্লাহ তা‘আলা কারো প্রতি বিন্দু পরিমাণ জুলুম করবেন না। এ সম্পর্কে সূরা জাসিয়াহ্র ১৫ নম্বর আয়াত, আলি ইমরানের ১৮২ ও ১৮৩ নম্বর আয়াত, সূরা হাজ্জের ১০ও ১১ নম্বর আয়াতসহ অনেক স্থানে আলোচনা করা হয়েছে।

হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

يَا عِبَادِي إِنِّي حَرَّمْتُ الظُّلْمَ عَلَي نَفْسِي، وَجَعَلْتُهُ بَيْنَكُمْ مُحَرَّمًا، فَلَا تَظَالَمُوا

হে আমার বান্দা! আমি নিজের প্রতি জুলুম করা হারাম করে নিয়েছি এবং তোমাদের মাঝেও হারাম করে দিয়েছি, সুতরাং তোমরা পরস্পর জুলুম করো না। (সহীহ মুসলিম হা. ২৫৭৭)

কিয়ামতের মাঠে মানুষ ভাল-মন্দ যে ফলাফল পাবে তা তার কৃতকর্মের কারণে, আল্লাহ তা‘আলা তার ওপর বিন্দু পরিমাণ জুলুম করবেন না।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. প্রত্যেককে তার নিজ নিজ কৃতকর্মের ফলাফল দেয়া হবে।
২. আল্লাহ তা‘আলা নিজের জন্য জুলুম করা হারাম করে নিয়েছেন এবং বান্দাদের মাঝেও তা হারাম করে দিয়েছেন।
৪৭-৪৮ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

এখানে আল্লাহ তা‘আলা বলেন : কিয়ামত কখন সংঘঠিত হবে তার জ্ঞান একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার কাছে। অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(وَعِنْدَه۫ مَفَاتِحُ الْغَيْبِ لَا يَعْلَمُهَآ إِلَّا هُوَ)

“সকল গায়েবের চাবিকাঠি তাঁরই নিকট রয়েছে, তিনি ব্যতীত অন্য কেউ তা জানে না।” (সূরা আন‘আম ৬ : ৫৯)

অতঃপর তিনি বলেন : দুনিয়াতে যা কিছু হয় সবকিছু আল্লাহ তা‘আলা জানেন, এমনকি কোন মহিলা গর্ভ ধারণ করে কি করে না এবং কখন করে, কখন প্রসব করবে সে সম্পর্কেও তিনি অবগত আছেন।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(اَللّٰهُ يَعْلَمُ مَا تَحْمِلُ كُلُّ أُنْثٰي وَمَا تَغِيْضُ الْأَرْحَامُ وَمَا تَزْدَادُ ط وَكُلُّ شَيْءٍ عِنْدَه۫ بِمِقْدَارٍ‏)‏

“প্রত্যেক নারী যা গর্ভে ধারণ করে এবং জরায়ুতে যা কিছু কমে ও বাড়ে আল্লাহ তা জানেন এবং তাঁর কাছে প্রত্যেক বস্তুরই এক নির্দিষ্ট পরিমাণ আছে।” (সূরা রা‘দ ১৩ : ৮)

এরপর আল্লাহ তা‘আলা বর্ণনা করছেন যে, যারা দুনিয়াতে আল্লাহ তা‘আলার সাথে অন্যকে শরীক করত, আল্লাহ তা‘আলার পরিবর্তে অন্যের ইবাদত করত তারা কিয়ামতের মাঠে মুক্তি পাবার কোনই পথ খুঁজে পাবে না এবং তারা যাদের ইবাদত করত তারা সেদিন তাদের থেকে অদৃশ্য হয়ে যাবে।

আল্লাহ বলেন,

(وَرَأَي الْمُجْرِمُوْنَ النَّارَ فَظَنُّوْآ أَنَّهُمْ مُّوَاقِعُوْهَا وَلَمْ يَجِدُوْا عَنْهَا مَصْرِفًا ‏)‏

“অপরাধীরা আগুন দেখে বুঝবে যে, তারা তথায় পতিত হবে এবং তারা সেখান হতে কোন পরিত্রাণস্থল পাবে না।” (সূরা কাহ্ফ ১৮ : ৫৩)

ظن অর্থ يقين বা দৃঢ় বিশ্বাস, এখানে ধারণার অর্থ দিবে। কারণ কাফিররা যখন আযাব প্রত্যক্ষ করবে এবং প্রকৃত ব্যাপার অনুধাবন করতে পারবে তখন তারা দৃঢ়তার সাথে জানতে পারবে তাদের মুক্তির কোন পথ নেই।

যারা আল্লাহ তা‘আলাকে বাদ দিয়ে অন্যের ইবাদত করছে, যাদের পূজা করছে তারা কিয়ামতের দিন নাজাতের কোন পথ পাবে না। সেদিন তারা সত্য অনুধাবণ করতে পারবে যে তারা যা কিছু করেছে তা সবই ছিল ভুল। তাই সেদিন তাদের পক্ষে কোন সাক্ষী থাকবে না।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. কিয়ামতের জ্ঞান আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্য কারো নেই।
২. প্রত্যেক জিনিস আল্লাহর দৃষ্টির মধ্যেই রয়েছে, এমন কোন কিছু নেই যা তিনি জানেন না।
৩. মুশরিকদের কিয়ামতের মাঠে নাজাতের কোনই পথ খোলা থাকবে না।
৪৯-৫১ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

এখানে আল্লাহ তা‘আলা মানুষের একটি মন্দ অভ্যাসের কথা আলোচনা করেছেন। মানুষ প্রাচুর্যের লালসায় মোহিত। তার যত সম্পদ, সন্তান, ক্ষমতা ও সম্মান থাকে সে আরো বেশি কামনা করে। একটি বাড়ি থাকলে চায় আরেকটি বাড়ি যদি থাকত! এরূপ কামনা করতেই থাকে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : আদম সন্তানের একটি স্বর্ণের পাহাড় থাকলে সে পছন্দ করে তার যদি দু’টি স্বর্ণের পাহাড় থাকত। (সহীহ বুখারী হা. ৬৪৩৯) সে কথাই আল্লাহ তা‘আলা এখানে বলছেন- মানুষ তার জন্য সম্পদ, ক্ষমতা, রাজত্ব ও সম্মান চাইতে বিরক্ত বোধ করে না। কিন্তু যখন কোন আপদ-বিপদ যেমন অসুস্থতা, দরিদ্রতা ইত্যাদি দ্বারা আক্রান্ত হয় তখন আল্লাহ তা‘আলার রহমত থেকে নিরাশ হয়ে যায়, মনে করে এ বিপদে সে ধ্বংস হয়ে যাবে। তবে যারা মু’মিন তারা নয়, কারণ তাদেরকে কোন বিপদ আক্রান্ত করলে ধৈর্য ধারণ করে এটা তাদের স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য।

তারপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(وَلَئِنْ أَذَقْنٰهُ رَحْمَةً)

অর্থাৎ যে ব্যক্তি ধন-সম্পদ চাইতে বিরক্ত হয় না তাকে যদি বিপদাপদ আক্রান্ত করে, আর আল্লাহ তা‘আলা সে বিপদ থেকে মুক্তি দান করেন তাহলে সে শুকরিয়া আদায় করে না, বরং সে বাড়াবাড়ি করে ও বড়ত্ব্ প্রকাশ করে বলে- আমি এটার হকদার বলেই আমাকে তা দেয়া হয়েছে।

মুজাহিদ বলেন :

(لَيَقُوْلَنَّ هٰذَا لِيْ)

‘সে বলেই থাকে : এটা আমার প্রাপ্য’ মানুষ বিপদাপদে আক্রান্ত হওয়ার পর আল্লাহ তা‘আলা তা থেকে মুক্তি দিলে সে বলে এটা আমার কর্মের ফল ও আমি এর হকদার। মূলত এটা আল্লাহ তা‘আলার নেয়ামতকে অস্বীকার করা। ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ) বলেন : শুকরিয়ার মূল হল- নেয়ামত দানকারীকে বিনয়-নম্রতা ও মহব্বতের সাথে স্মরণ করা ও নেয়ামতকে স্বীকার করা। যে ব্যক্তি নেয়ামতকে চিনতে পারল না সে শুকরিয়া আদায় করতে পারবে না। আর যে নেয়ামতকে চিনল কিন্তু যিনি নেয়ামত দান করেছেন তাঁকে চিনল না সে ব্যক্তিও নেয়ামতের যথার্থ শুকরিয়া আদায় করতে সক্ষম হয় না। নেয়ামত ও নেয়ামত দানকারীকে চেনার পর অস্বীকার করলে নেয়ামতের সাথে কুফরী করা হয়। যে ব্যক্তি নেয়ামতকে চিনল এবং যিনি নেয়ামত দান করেছেন তাকেও চিনল অস্বীকারও করল না কিন্তু তার প্রতি বিনয়ী ও সন্তুষ্টি প্রকাশ করল না এবং তা ভালবাসল না সেও নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করল না। সুতরাং যে ব্যক্তি নেয়ামত চিনল, নেয়ামত দানকারীকে চিনল এবং তা স্বীকার করল এবং তার প্রতি বিনয়ী হল সে ব্যক্তিই নেয়ামতের যথার্থ শুকরিয়া আদায় করতে পারবে। (মাদারিজুস সালিকীন ২ : ১৩৫-১৪৪) যেমন বানী ইসরাঈলের তিন ব্যক্তি, একজনের কুষ্ট রোগ ছিল, আরেকজনের মাথায় টাক ছিল, অন্য জন অন্ধ ছিল।

আল্লাহ তা‘আলার রহমতে তিনজন আরোগ্য লাভ করে। প্রথম দুজন নেয়ামত অস্বীকার করে, ফলে তাদের নেয়ামত ছিনিয়ে নেয়া হয়, তৃতীয়জন স্বীকার করে ফলে আল্লাহ তা‘আলা তাকে প্রদত্ত নেয়ামত বহাল রাখেন। (সহীহ বুখারী হা. ৩৪৬৪)

(وَمَآ أَظُنُّ السَّاعَةَ قَا۬ئِمَةً)

‘আমি মনে করি না যে, কিয়ামত সংঘটিত হবে’ অর্থাৎ সে পুনরুত্থানকে অস্বীকার করে।

(وَّلَئِنْ رُّجِعْتُ إِلٰي رَبِّيْٓ…)

অর্থাৎ ‘যদি কিয়ামত হয়ই তাহলে আমি আল্লাহ তা‘আলার কাছে ফিরে যাব এমন অবস্থায় যে, তার কাছে আমার উত্তম প্রতিদান রয়েছে।’ যেমন আমার দুনিয়াতে অনেক সম্পদ ছিল, আখিরাতেও আমার জন্য এরূপ থাকবে। এটা আল্লাহ তা‘আলার প্রতি বানিয়ে কথা বলা এবং তাঁর সাথে স্পর্ধা দেখানো। আল্লাহ তা‘আলা তাকে ধমক দিয়ে পরের কথাগুলো বলেছেন।

(فَذُوْ دُعَا۬ءٍ عَرِيْضٍ)

‘দীর্ঘ প্রার্থনায় রত হয়ে যায়’ অর্থাৎ বেশি বেশি দু’আ করতে থাকে। কারণ সে বিপদে ধৈর্য ধারণ করতে পারে না এবং সাচ্ছন্দ্যের সময় শুকরিয়া আদায় করতে পারে না। তবে আল্লাহ তা‘আলা যাকে রহমত ও অনুগ্রহ করেছেন সে ব্যতীত। এ সম্পর্কে পূর্বে সূরা ইউনুস-এর ১২ নম্বর আয়াত, সূরা আল কাহ্ফ-এর ৩৬ নম্বর আয়াতসহ অন্যান্য স্থানেও আলোচনা করা হয়েছে।

সুতরাং আল্লাহ তা‘আলার প্রত্যেক নেয়ামতের যথাযথ শুকরিয়া আদায় করা প্রতিটি মু’মিন-মুসলিমের একান্ত কর্তব্য। আল্লাহ তা‘আলার নেয়ামত পাওয়ার শুকরিয়া আদায় না করা নেয়ামতকে অস্বীকার করার শামিল। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে তাঁর নেয়ামত চিনে যথাযথ শুকরিয়া আদায় করার তাওফীক দান করুন। (আমীন)

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. বিপদে-আপদে, সুখে-দুঃখে সর্বদা আল্লাহ তা‘আলাকে ডাকতে হবে এবং তাঁরই কাছে সাহায্য প্রার্থনা করতে হবে। বিপদে পড়ে আল্লাহ তা‘আলাকে ডাকব আর সুখের সময় তাঁর সাথে কুফরী করব এমনটি করা যাবে না।
২. বিপদে পড়ে নিরাশ হওয়া যাবে না এবং সুখে অতি আনন্দিতও হওয়া যাবে না।
৩. প্রত্যেক নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করা আবশ্যক।
৫২-৫৪ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

কুরআনুল কারীম প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তা‘আলার বাণী। জিবরীল (আঃ) তা যথোচিত সংরক্ষণের সাথে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ওপর অবতীর্ণ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে মুশরিকদের বলে দিতে নির্দেশ দিয়ে বলেন : হে মুশরিকরা! তোমরা কি একটু চিন্তা করে দেখেছ, এ কুরআন যদি সত্যিকার আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে এসে থাকে (আর তা অবশ্যই সত্য) এরপরেও তোমরা অস্বীকার করলে পথভ্রষ্ট বলে গণ্য হবেন? অর্থাৎ তোমাদের চেয়ে অধিক পথভ্রষ্ট আর কেউ নেই। কারণ তোমরা শত্র“তা ও বিরোধিতায় শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছ।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন : এ কুরআন প্রকৃতপক্ষেই আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে অবতীর্ণ। সুতরাং যারা একে অস্বীকার ও এর বিরোধিতা করবে তারা হলো সবচেয়ে বড় পথভ্রষ্ট। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, যারা এরূপ অস্বীকার করে আমি তাদের বিরুদ্ধে নিদর্শনাবলী ব্যক্ত করব ফলে তাদের নিকট এ কথা স্পষ্ট হয়ে যাবে যে এ কুরআন প্রকৃতই সত্য। এতে মিথ্যা কিছুই নেই। তাদের এরূপ মনে করার কারণ এই যে, তারা মূলত তাদের রবের ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করে থাকে। যার ফলে তারা বলে- এ কুরআন সত্য নয়, এটা মিথ্যা।

এর দ্বারা কুরআনের সত্যতা এবং এ কুরআন যে আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে এসেছে তা সুস্পষ্ট হয়ে যায়। الْاٰفَاقِ শব্দটি افق এর বহুবচন, অর্থ হলো কিনারা (দিকচক্রবাল), দিগন্ত। উদ্দেশ্য হলো, আমি নিজ নিদর্শনাবলী বিশ্বজাহানের দিকচক্রবালেও দেখাবো, আর মানুষের নিজ দেহের ভেতরেও। কেননা, আকাশ ও পৃথিবীর প্রান্তে-প্রান্তেও তার বড় বড় নিদর্শন বিদ্যমান রয়েছে। যেমন সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্ররাজি, দিবারাত্রি, বৃষ্টি, পাহাড়-পর্বত, নদী-নালা ইত্যাদি। ‘নিজেদের মধ্যে ’বলতে যে সকল মিশ্রিত উপাদান ও পদার্থ দ্বারা মানুষের অস্তিত্ব ও কাঠামো গঠিত তাই উদ্দেশ্য। কেউ কেউ বলেছেন : الْاٰفَاقِ (দিকচক্রবাল) থেকে পূর্ব ও পশ্চিমের সেই দূর-দূরান্ত এলাকা উদ্দেশ্য, যা জয় করা মুসলিমদের জন্য আল্লাহ তা‘আলা সহজ করে দিয়েছেন। আর وَفِيْٓ أَنْفُسِهِمْ (নিজেদের মধ্যে) থেকে নিজেদের অথবা ভুমির ওপর মুসলিমদের উন্নতি ও সাফল্য উদ্দেশ্য। যেমন বদর যুদ্ধ, মক্কা বিজয় প্রভৃতিতে মুসলিমদেরকে প্রভূত সম্মান ও মর্যাদা দান করা হয়েছে।

মূলত কুরআন ও মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সম্পর্কে কাফিরদের সন্দেহের কারণ হল তারা পুনরুত্থানের প্রতি সন্দিহান, তাদেরকে মৃত্যুর পর জীবিত করা হবে এটা তারা বিশ্বাস করতে পারে না।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. কুরআন আল্লাহর কালাম, এটা তাঁর পক্ষ থেকে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ওপর অবতীর্ণ হয়েছে।
২. পৃথিবীর সবকিছু প্রমাণ করে আল্লাহ তা‘আলা এক ও অদ্বিতীয়।
৩. আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস না থাকলে ঈমান থাকবে না।

তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
৩৭-৩৯ নং আয়াতের তাফসীর:

আল্লাহ্ তা’আলা স্বীয় ব্যাপক শক্তি এবং অতুলনীয় ক্ষমতার বর্ণনা দিচ্ছেন যে, তিনি যা করার ইচ্ছা করেন তাই করে থাকেন। সূর্য, চন্দ্র এবং দিবস ও রজনী তাঁর পূর্ণ ক্ষমতার নিদর্শন। রাতকে তিনি অন্ধকারময় এবং দিনকে আলোকময় বানিয়েছেন। এগুলো একটির পিছনে আর একটি এসে থাকে। সূর্য এবং ওর রশ্মি ও ঔজ্জ্বল্য এবং চন্দ্র ও ওর জ্যোতি দেখে বিস্মিত হতে হয়। আকাশে এগুলোর কক্ষপথও আল্লাহ্ তা’আলা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। এগুলোর উদয় ও অস্তের কারণে দিবস ও রজনীর মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি হয়ে থাকে। মাস ও বছরের গণনা করা যায়, যার ফলে ইবাদত-বন্দেগী, পারস্পরিক লেন-দেন ও প্রাপ্য নিয়মিতভাবে আদায় করা সম্ভব হয়।

আসমান ও যমীনের মধ্যে সর্বাপেক্ষা সুন্দর ও উজ্জ্বল ছিল সূর্য ও চন্দ্র, এজন্যেই এই দুটোকে মাখলুক বলা হয়েছে এবং আল্লাহ তা’আলা বলেছেনঃ তোমরা যদি আল্লাহর বান্দা হয়ে থাকো তবে সূর্য ও চন্দ্রের সামনে তোমরা মাথা নত করো না, কেননা এ দুটো তো মাখলুক বা সৃষ্ট। সৃষ্ট কখনো সিজদার যোগ্য হতে পারে না। সিজদার যোগ্য একমাত্র তিনি যিনি সবকিছুরই সৃষ্টিকর্তা। সুতরাং তোমরা আল্লাহ তা’আলারই ইবাদত করতে থাকো। কিন্তু যদি তোমরা আল্লাহ ছাড়া তার কোন মাখলুকেরও ইবাদত কর তবে তোমরা তাঁর রহমতের দৃষ্টি হতে সরে যাবে এবং তিনি তোমাদেরকে কখনো ক্ষমা করবেন না। যারা শুধু আল্লাহরই ইবাদত করে না, বরং তার সাথে অন্যেরও ইবাদত করে তারা যেন এটা ধারণা না করে যে, তারাই শুধু আল্লাহর ইবাদতকারী। সুতরাং তারা যদি তার ইবাদত ছেড়ে দেয় তবে তাঁর কেউ ইবাদতকারী থাকবে না। কখনো নয়। আল্লাহ তাআলা তাদের ইবাদতের মুখাপেক্ষী নন। তাঁর ফেরেশতামণ্ডলী দিবস ও রজনীতে তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করতে রয়েছে এবং তারা ক্লান্তিবোধ করে না। যেমন মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “যদি এরা কুফরী করে তবে আমি এমন সম্প্রদায়ও ঠিক করে রেখেছি যারা কুফরী করবে না।” (৬:৮৯)

হযরত জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “তোমরা রাত্রি ও দিবসকে, সূর্য ও চন্দ্রকে এবং বাতাসকে মন্দ বলো না। কেননা, এগুলো কতক লোকের জন্যে রহমত স্বরূপ এবং কতক লোকের জন্যে শাস্তি স্বরূপ হয়ে থাকে।” (এ হাদীসটি হাফিয আবূ ইয়ালা (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

অতঃপর মহান আল্লাহ বলেনঃ তার ক্ষমতার একটি নিদর্শন অর্থাৎ তিনি যে মৃতকে পুনর্জীবিত করতে সক্ষম তার একটি নিদর্শন এই যে, তুমি ভূমিকে দেখতে পাও শুষ্ক, উষর, অতঃপর আমি তাতে বারি বর্ষণ করলে তা আন্দোলিত ও স্ফীত হয়। যিনি এই মৃত যমীনকে জীবিত করেন তিনিই মৃতের জীবনদানকারী। তিনি তো সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান।

৪০-৪৩ নং আয়াতের তাফসীর:

হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর বর্ণনামতে শব্দের অর্থ হলো কালামকে ওর জায়গা হতে সরিয়ে অন্য জায়গায় রেখে দেয়া। আর কাতাদা (রঃ) প্রমুখ গুরুজন এর অর্থ করেছেন কুফরী ও হঠকারিতা। মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ যারা আমার আয়াতসমূহকে বিকৃত করে তারা আমার অগোচর নয়। যারা আমার নাম ও গুণাবলীকে এদিক হতে ওদিকে করে দেয় তারা আমার দৃষ্টির মধ্যেই রয়েছে। তাদেরকে আমি কঠিন শাস্তি প্রদান করবো। যারা জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে এবং যারা ভয়-ভীতি ও বিপদাপদ হতে নিরাপদে থাকবে তারা কি কখনো সমান হতে পারে? কখনো নয়। পাপী, দূরাচার এবং কাফিররা যা ইচ্ছা আমল করে যাক। তাদের কোন আমলই আল্লাহ তা’আলার নিকট গোপন নেই। ক্ষুদ্র হতে ক্ষুদ্রতম জিনিসও তার চক্ষু এড়ায় না। তারা যা কিছু করে তিনি তার দ্রষ্টা।

যহহাক (রঃ), সুদ্দী (রঃ) এবং কাতাদা (রঃ)-এর উক্তি এই যে, এখানে যিকর দ্বারা কুরআন কারীমকে বুঝানো হয়েছে। এটা ইযযত ও মর্যাদাসম্পন্ন কিতাব। কোন মিথ্যা এতে অনুপ্রবেশ করবে না, অগ্র হতেও নয়, পশ্চাত হতেও নয়। কারো কালাম এর সমতুল্য হতে পারে না। এটা জগতসমূহের প্রতিপালকের নিকট হতে অবতারিত। যিনি তাঁর কথায় ও কাজে বিজ্ঞানময় ও নিপুণ। তাঁর সমুদয় হুকুম উত্তম ফলদায়ক।

মহান আল্লাহ স্বীয় নবী (সঃ)-কে বলেনঃ তোমার যুগের কাফিররা তোমাকে ঐ কথাই বলে যা তোমার পূর্ববর্তী যুগের কাফিররা তাদের রাসূলদেরকে বলেছিল। ঐ নবীরা যেমন ধৈর্যধারণ করেছিল তেমনই তুমিও ধৈর্যধারণ কর।

যে ব্যক্তি আল্লাহর দিকে ফিরে, আল্লাহ তার প্রতি অবশ্যই ক্ষমাশীল। পক্ষান্তরে যে আল্লাহ হতে বিমুখ হয়, কুফরী ও হঠকারিতার উপর অটল থাকে, সত্যের বিরোধিতা এবং রাসূল (সঃ)-কে অবিশ্বাস করা হতে বিরত থাকে না তাকে তিনি কঠিন শাস্তিদাতা।

রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “যদি আল্লাহ তা’আলার মার্জনা ও ক্ষমা না থাকতো তবে একটি প্রাণীও বাঁচতো না। পক্ষান্তরে, যদি আল্লাহ তা’আলার পাকড়াও ও শাস্তি না হতো তবে প্রত্যেকেই প্রশান্তভাবে হেলান লাগিয়ে নির্ভয় হয়ে যেতো।” (এ হাদীসটি ইমাম ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
৪৪-৪৫ নং আয়াতের তাফসীর:

আল্লাহ তা’আলা কুরআন কারীমের বাকপটুত্ব, শব্দালংকার এবং এর শাব্দিক ও মৌলিক উপকারের বর্ণনা দেয়ার পর এর উপর যারা ঈমান আনেনি তাদের ঔদ্ধত্য ও হঠকারিতার বর্ণনা দিচ্ছেন। যেমন আল্লাহ তা’আলা অন্য আয়াতে বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “যদি আমি এটা কোন আজমীর উপর অবতীর্ণ করতাম, অতঃপর সে তাদের কাছে এটা পাঠ করতো, তবে এর উপর তারা ঈমান আনতো না।” (২৬:১৯৮-১৯৯) ভাবার্থ এই যে, অমান্যকারীদের টালবাহানার কোন শেষ নেই। তাদের না আছে এতে শান্তি এবং না আছে ওতে শান্তি। তাই এখানে আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ আমি যদি আজমী ভাষায় কুরআন অবতীর্ণ করতাম তবে তারা অবশ্যই বলতোঃ “এর আয়াতগুলো বিশদভাবে বিবৃত হয়নি কেন? কি আশ্চর্য যে, এর ভাষা আজমী, অথচ রাসূল আরবীয়।” আবার যদি আরবী ভাষায় এবং কিছু অন্য ভাষায় হতো তবুও এই প্রতিবাদই করতো যে, এর কারণ কি?”

হযরত হাসান বসরী (রঃ)-এর কিরআতে (আরবী) রয়েছে। হযরত সাঈদ ইবনে মুসাইয়াবও (রঃ) এ ভাবার্থই বর্ণনা করেছেন। এর দ্বারা তাদের ঔদ্ধত্য ও হঠকারিতা জানা যাচ্ছে।

এরপর মহান আল্লাহ বলেনঃ মুমিনদের জন্যে এই কুরআন পথ-নির্দেশ ও ব্যাধির প্রতিকার। অর্থাৎ এটা তাদের অন্তরের ব্যাধি দূরকারী। এর মাধ্যমে তাদের সমস্ত সন্দেহ দূর হয়ে যায়। পক্ষান্তরে যারা অবিশ্বাসী তাদের অন্তরে বধিরতা রয়েছে। কুরআন হবে এদের জন্যে অন্ধত্ব। এরা এমন যে, যেন এদেরকে আহ্বান করা হয় বহু দূর হতে। যেমন মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “আমি অবতীর্ণ করেছি কুরআন, যা মুমিনদের জন্যে আরোগ্য ও রহমত, কিন্তু এটা যালিমদের ক্ষতিই বৃদ্ধি করে।”(১৭-৮২) তাদের দৃষ্টান্ত এমনই যে, যেন তাদেরকে আহ্বান করা হচ্ছে বহুদূর হতে। তাদের কানে যেন কুরআনের শব্দ পৌঁছেই না। সে সঠিকভাবে কুরআনের অর্থ অনুধাবনই করতে পারে না। যেমন অন্য আয়াতে রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “কাফিরদের উপমা ঐ ব্যক্তির মত যে ডাক দেয়, কিন্তু শব্দ এবং ডাক ছাড়া কিছুই তার কানে পৌছে না, সে বধির, মূক এবং অন্ধ, সুতরাং সে বুঝে ।”(২:১৭১)

যহাক (রঃ) এই ভাবার্থ বর্ণনা করেছেন যে, কিয়ামতের দিন তাদেরকে তাদের ঘৃণ্য নাম দ্বারা ডাক দেয়া হবে।

সুদ্দী (রঃ) বলেন যে, একদা হযরত উমার ইবনে খাত্তাব (রাঃ) একজন মুসলমানের পার্শ্বে বসেছিলেন। হঠাৎ সে লাব্বায়েক বলে ডাক দিলো। তখন হযরত উমার (রাঃ) তাকে জিজ্ঞেস করলেনঃ “তুমি কি কাউকেও দেখেছো, না কেউ তোমাকে ডাকছে?” লোকটি উত্তরে বললোঃ “হ্যা, সমুদ্রের ঐ প্রান্ত হতে কে একজন ডাকছে।” তখন হযরত উমার (রাঃ) (আরবী)-এই বাক্যটি পাঠ করলেন।

এরপর মহান আল্লাহ বলেনঃ আমি তো মূসা (আঃ)-কে কিতাব দিয়েছিলাম, অতঃপর এতে মতভেদ ঘটেছিল। অর্থাৎ তাকেও অবিশ্বাস করা হয়েছিল এবং কষ্ট দেয়া হয়েছিল। সুতরাং সে যেমন ধৈর্যধারণ করেছিল, তদ্রুপ তোমাকেও ধৈর্যধারণ করতে হবে। তোমার প্রতিপালক পূর্ব হতেই এটার সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছেন যে, একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অর্থাৎ কিয়ামত পর্যন্ত এদের উপর হতে শাস্তি সরিয়ে রাখবেন। এ জন্যেই তিনি এদেরকে অবকাশ দিচ্ছেন। এই সিদ্ধান্ত হয়ে না থাকলে এদের মীমাংসা হয়েই যেতো। অর্থাৎ এখনই এদের উপর শাস্তি আপতিত হতো। এরা অবশ্যই এর সম্বন্ধে বিভ্রান্তিকর সন্দেহে রয়েছে। অর্থাৎ এরা যে অবিশ্বাস করছে এটা কোন বিশ্বাসের ভিত্তিতে নয়, বরং এরা বিভ্রান্তিকর সন্দেহের মধ্যে পড়ে রয়েছে। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।

# এই আয়াতের ভাবার্থ খুবই পরিষ্কার। যে ব্যক্তি ভাল কাজ করে তার সুফল সেই লাভ করে। পক্ষান্তরে, যে মন্দ কাজ করে, ওর কুফলও তাকেই ভোগ করতে হয়। মহান প্রতিপালক আল্লাহ কারো প্রতি বিন্দুমাত্র যুলুম করেন না। যুলুম করা হতে তাঁর সত্তা সম্পূর্ণরূপে পবিত্র। একজনের পাপের কারণে তিনি অন্যজনকে কখনো পাকড়াও করেন না। যে পাপ করে না তাকে তিনি কখনো শাস্তি প্রদান করেন না। প্রথমে তিনি রাসূল প্রেরণ করেন এবং কিতাব অবতীর্ণ করেন। এভাবে তিনি স্বীয় যুক্তি-প্রমাণ শেষ করে দেন। সবারই কাছে তিনি নিজের বাণী পৌঁছিয়ে থাকেন। এর পরেও যারা মানে না তারাই শাস্তির যোগ্য হয়ে যায়।
৪৭-৪৮ নং আয়াতের তাফসীর:

আল্লাহ তা’আলা বলেন যে, কিয়ামত কখন সংঘটিত হবে এর জ্ঞান আল্লাহ ছাড়া আর কারো নেই। যেমন হযরত মুহাম্মাদ (সঃ)-কে যখন ফেরেশতাদের নেতা হযরত জিবরাঈল (আঃ) কিয়ামত কখন সংঘটিত হবে তা জিজ্ঞেস করেছিলেন তখন তিনি সমস্ত মানুষের নেতা হওয়া সত্ত্বেও উত্তরে বলেছিলেনঃ “জিজ্ঞাসিত ব্যক্তি জিজ্ঞাসাকারীর চেয়ে অধিক জ্ঞান রাখেন না।” মহামহিমান্বিত আল্লাহ আর এক জায়গায় বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “এর চরম জ্ঞান আছে। তোমার প্রতিপালকেরই নিকট।”(৭৯:৪৪) অন্য এক আয়াতে রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “এর সময় তিনি ছাড়া আর কারো কাছে প্রকাশমান নয়।”(৭:১৮৭) ভাবার্থ এটাই যে, কিয়ামত সংঘটনের সময় আল্লাহ ছাড়া আর কেউই জানে না।

এরপর আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা বলেনঃ প্রত্যেক জিনিসকে তার জ্ঞান পরিবেষ্টন করে রয়েছে। এমনকি যে ফল ওর আবরণ হতে বের হয়, যে নারী গর্ভধারণ করে এবং সন্তান প্রসব করে, এ সবই তাঁর গোচরে থাকে। যমীন ও আসমানের একটি অণুপরিমাণ জিনিসও তার ব্যাপক জ্ঞানের বাইরে নয়। যেমন মহান আল্লাহ বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “যে পাতা ঝরে পড়ে সেটাও তিনি জানেন।”(৬:৫৯) মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “প্রত্যেক নারী যা গর্ভে ধারণ করে এবং জরায়ুতে যা কিছু কমে ও বাড়ে আল্লাহ তা জানেন এবং তাঁর বিধানে প্রত্যেক বস্তুরই এক নির্দিষ্ট পরিমাণ। আছে।” (১৩:৮) মহান আল্লাহ আর এক জায়গায় বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “বয়স যে বাড়ে ও কমে এটাও কিতাবে লিপিবদ্ধ রয়েছে, এটা আল্লাহর নিকট সহজ।”(৩৫:১১)

কিয়ামতের দিন সমস্ত মাখলুকের সামনে আল্লাহ তা’আলা মুশরিকদের বলবেনঃ যাদেরকে তোমরা আমার সাথে ইবাদতে শরীক করতে তারা আজ কোথায়? তারা উত্তরে বলবেঃ আমরা তো আপনার নিকট নিবেদন করেছি যে, এই ব্যাপারে আমরা কিছুই জানি না। সেই দিন তাদের বাতিল মা’বৃদরা সবাই হারিয়ে যাবে। এমন কাউকেও তারা দেখতে পাবে না যে তার কোন উপকার করতে পারে। তারা নিজেরাও জানতে পারবে যে, তাদের নিষ্কৃতির কোন উপায় নেই।

এখানে (আরবী) শব্দটি (আরবী) বা দৃঢ় বিশ্বাস’ এর অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন আল্লাহ তা’আলা অন্য আয়াতে বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “এবং অপরাধীরা জাহান্নাম দেখে নিবে এবং দৃঢ় বিশ্বাস করবে যে, তাদেরকে জাহান্নামে পতিত হতেই হবে এবং তারা তা হতে বাঁচবার কোন পথ পাবে না।”(১৮:৫৩)।
৪৯-৫১ নং আয়াতের তাফসীর:

আল্লাহ্ তা’আলা বলেন যে, মালধন, স্বাস্থ্য ইত্যাদি কল্যাণের প্রার্থনা হতে মানুষ ক্লান্ত হয় না। কিন্তু যদি তার উপর বিপদ-আপদ এসে পড়ে তখন সে এতো বেশী হতাশ ও নিরাশ হয়ে পড়ে যে, যেন আর কখনো সে কোন কল্যাণের মুখ দেখতেই পাবে না। আবার যদি কোন বিপদ ও কাঠিন্যের পর সে কোন কল্যাণ ও সুখ লাভ করে তখন সে বলে বসেঃ “আল্লাহ তা’আলার উপর তো আমার এটা হক বা প্রাপ্যই ছিল। আমি এর যোগ্যই ছিলাম। এখন সে এই নিয়ামত লাভ করে ফুলে উঠে এবং ধরাকে সরা জ্ঞান করে বসে। মহান আল্লাহকে বিস্মরণ হয়ে যায় এবং পরিষ্কারভাবে তাকে অস্বীকার করে ফেলে। কিয়ামতের সংঘটনকে স্পষ্টভাবে অবিশ্বাস করে বসে। ধন-দৌলত এবং আরাম ও আয়েশ তার কুফরীর কারণ হয়ে দাড়ায়। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “বস্তুতঃ মানুষ তো সীমালংঘন করেই থাকে, কারণ সে নিজেকে অভাব মুক্ত মনে করে।”(৯৬:৬-৭) তাই সে মস্তক উঁচু করে হঠকারিতা করতে শুরু করে দেয়।

মহান আল্লাহ বলেন যে, শুধু এটুকুই নয়, বরং এই দুষ্কর্যের উপর সে ভাল আশাও রাখে এবং বলেঃ যদি কিয়ামত সংঘটিত হয়েও যায় এবং আমি আল্লাহ তা’আলার নিকট প্রত্যাবর্তিতও হই, তবে যেমন আমি এখানে সুখ-স্বচ্ছন্দে রয়েছি, অনুরূপভাবে সেখানেও অর্থাৎ পরকালেও সুখেই থাকবো। মোটকথা, সে কিয়ামতকে অস্বীকারও করে, মৃত্যুর পর পুনজীবনকে মানেও না, আবার বড় বড় আশাও পোষণ করে যে, দুনিয়ায় যেমন সুখে রয়েছে, আখিরাতেও তেমনি সুখেই থাকবে।

যাদের আমল ও বিশ্বাস এইরূপ তাদেরকে আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা ভয় প্রদর্শন করে বলেনঃ “আমি এই কাফিরদেরকে তাদের কৃতকর্ম সম্বন্ধে অবশ্যই অবহিত করবো এবং তাদেরকে আস্বাদন করাবো কঠোর শাস্তি।

মহামহিমান্বিত আল্লাহ মানুষের স্বভাব ও আচরণের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেনঃ ‘যখন আমি মানুষের প্রতি অনুগ্রহ করি তখন (গর্বভরে) মুখ ফিরিয়ে নেয় ও দূরে সরে যায়। আর যখন তাকে অনিষ্ট স্পর্শ করে তখন সে দীর্ঘ প্রার্থনায় রত হয়। (আরবী) ওকেই বলা হয় যার শব্দ বেশী এবং অর্থ কম হয়। আর যে কালাম বা কথা এর বিপরীত হয় অর্থাৎ শব্দ কম ও অর্থ বেশী, ওকে (আরবী) বলা হয়ে থাকে। এই বিষয়টিই অন্য জায়গায় নিম্নরূপে বর্ণিত হয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “মানুষকে যখন কষ্ট ও বিপদ স্পর্শ করে তখন সে শুয়ে, বসে এবং দাড়িয়ে আমাকে আহ্বান করে থাকে, অতঃপর যখন আমি ঐ কষ্ট ও বিপদ দূরীভূত করি তখন সে এমন বেপরোয়া ভাব দেখিয়ে ফিরে যায় যে, যেন সে বিপদের সময় আমাকে আহ্বান করেইনি।” (১০:১২)
৫২-৫৪ নং আয়াতের তাফসীর:

আল্লাহ তা’আলা স্বীয় নবী (সঃ)-কে বলছেনঃ তুমি কুরআন অমান্যকারী মুশরিকদেরকে বলে দাওঃ এই কুরআন সত্য সত্যই আল্লাহর পক্ষ হতে এসেছে, অথচ তোমরা একে অবিশ্বাস করছো! তাহলে আল্লাহ তাআলার নিকট তোমাদের কি অবস্থা হবে! যে ব্যক্তি স্বীয় কুফরী ও বিরোধিতার কারণে সত্য পথ হতে বহু দূরে সরে পড়েছে তার চেয়ে অধিক বিভ্রান্ত আর কে আছে?

এরপর মহান আল্লাহ বলেনঃ আমি তাদের জন্যে আমার নিদর্শনাবলী ব্যক্ত করবো বিশ্ব জগতে এবং তাদের নিজেদের মধ্যে। ইসলামপন্থীদেরকে আমি বিজয় দান করবো। তারা সাম্রাজ্যসমূহের সম্রাট হয়ে যাবে। সমস্ত দ্বীনের উপর দ্বীনে ইসলামের প্রাধান্য থাকবে।

বদর ও মক্কা বিজয়ের নিদর্শন স্বয়ং মুশরিকদের নিজেদের মধ্যেই রয়েছে যে, তারা সংখ্যায় অধিক হওয়া সত্ত্বেও অল্প সংখ্যক মুসলমানের নিকট লাঞ্ছনাজনক পরাজয় বরণ করে। ভাবার্থ এও হতে পারে যে, আল্লাহ তা’আলার হাজার হাজার নিদর্শন স্বয়ং মানব জাতির নিজেদের মধ্যেই বিদ্যমান রয়েছে। তাদের সষ্টি ও গঠন কৌশল, তাদের স্বভাব-প্রকৃতি, তাদের পৃথক পৃথক চরিত্র, পৃথক পৃথক রূপ ও রং ইত্যাদি তাদের সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি নৈপুণ্য এবং শিল্প চাতুর্যেরই পরিচায়ক, যেগুলো সদা তাদের চোখের সামনে রয়েছে, এমন কি স্বয়ং তাদের নিজেদের সত্তার মধ্যেই বিদ্যমান রয়েছে। তাদের জীবনের বিভিন্ন পর্যায় ও অবস্থা, যেমন বাল্যকাল, যৌবন, বার্ধক্য, তাদের রুগ্নতা ও সুস্থতা, দারিদ্র্য ও স্বচ্ছলতা, সুখ ও দুঃখ ইত্যাদি পরিষ্কারভাবে তাদের উপর প্রকাশমান। মোটকথা, আল্লাহ তাআলার বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ নিদর্শনাবলী এতো অধিক রয়েছে যে, মানুষ এগুলো দেখে তাঁর কথার সত্যতা স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয়। আল্লাহ তা’আলার সাক্ষ্যই যথেষ্ট এবং তিনি স্বীয় বান্দাদের কথা ও কাজ সম্বন্ধে পূর্ণ ওয়াকিফহাল। তিনি যখন বলছেন যে, হযরত মুহাম্মাদ (সঃ) একজন সত্য নবী, তখন মানুষের এটা স্বীকার করে নিতে বাধা কিসের? যেমন মহান আল্লাহ বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “কিন্তু আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, যা তিনি তোমার উপর অবতীর্ণ করেছেন তা তিনি তাঁর জ্ঞানের সাথেই অবতীর্ণ করেছেন।” (৪:১৬৬)

অতঃপর মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ জেনে রেখো যে, এরা এদের। প্রতিপালকের সাথে সাক্ষাঙ্কারে সন্দিহান অর্থাৎ কিয়ামত যে সংঘটিত হবে এটা তারা বিশ্বাসই করে না, আর এ কারণেই তারা নিশ্চিন্ত রয়েছে, পুণ্য অর্জনে রয়েছে উদাসীন এবং পাপ কার্য হতে বিরত থাকছে না। অথচ কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার ব্যাপারে সন্দেহের লেশমাত্র নেই।

হযরত সাঈদ আনসারী (রঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, হযরত উমার ইবনে আবদিল আযীয (রঃ) একদা মিম্বরের উপর উঠে আল্লাহ তা’আলার হামদ ও সানার পর বলেনঃ “হে জনমণ্ডলী! আমি তোমাদেরকে কোন নতুন কথা বলার জন্যে একত্রিত করিনি, বরং এজন্যেই তোমাদেরকে আমি একত্রিত করেছি যে, বিচার দিবসের ব্যাপারে আমি খুব চিন্তা-ভাবনা করেছি, এতে আমি যা বুঝেছি তা তোমাদেরকে শুনাতে চাই। তা এই যে, যারা এটাকে সত্য বলে বিশ্বাস করে তারা নির্বোধ এবং যারা এটাকে মিথ্যা মনে করে তারা ধ্বংস প্রাপ্ত।” অতঃপর তিনি মিম্বর হতে নেমে পড়লেন। তাঁর যারা এটাকে সত্য বলে বিশ্বাস করে তারা নির্বোধ’ একথার ভাবার্থ এই যে, তারা এটাকে সত্য মনে করছে অথচ এর জন্যে কোন প্রস্তুতি গ্রহণ করছে না। এর অন্তর প্রকম্পিতকারী ও ভয়াবহ অবস্থা হতে সম্পূর্ণরূপে উদাসীন থাকছে, একে ভয় করে এমন আমল করে না যা তাকে ঐদিনের ভীতি হতে নিরাপত্তা দান করতে পারে। ঐ ব্যক্তি নিজেকে ওর সংঘটনের সত্যতা স্বীকারকারীও বলছে, আবার খেল-তামাশা, অবহেলা, কুপ্রবৃত্তি, পাপ এবং নির্বুদ্ধিতার মধ্যে নিমজ্জিত থাকছে, আর এদিকে কিয়ামত নিকটে চলে আসছে। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সবচেয়ে ভাল জানেন ।

এরপর আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা স্বীয় পূর্ণ ক্ষমতার বর্ণনা দিচ্ছেন যে, সবকিছুকে তিনি পরিবেষ্টন করে রয়েছেন। কিয়ামত ঘটানো তাঁর কাছে খুবই সহজ কাজ। সমস্ত সৃষ্টজীব ও সৃষ্ট বস্তু তাঁর অধিকারে রয়েছে। তিনি যা ইচ্ছা করেন তাই করতে পারেন। কেউই তাঁর হাত ধরে রাখতে পারে না। তিনি যা চেয়েছেন তা হয়েছে এবং যা চাইবেন তা অবশ্যই হবে। তিনি ছাড়া প্রকৃত হুকুমদাতা আর কেউ নেই। তিনি ছাড়া অন্য কারো সত্তা কোন প্রকারের ইবাদতের যোগ্য নয়।

Leave a Reply