أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
(বই#১০৯৭)[*মতভেদ নিরসনের সঠিক উপায় :-]
www.motaher21.net
সূরা:৪২:আশ-শূরা
পারা:২৫
১- ১২ নং আয়াত:-
(৪২-শূরা) : নামকরণ:
৩৮ আয়াতের وَاَمْرُهُمْ شُوْرَي بَيْنَهُمْ আয়াতাংশ থেকে এর নাম গৃহীত হয়েছে। এ নামের তাৎপর্য হলো, এটি সেই সূরা যার মধ্যে শূরা শব্দটি আছে।
(৪২-শূরা) : নাযিল হওয়ার সময়-কাল :
নির্ভরযোগ্য কোন বর্ণনা থেকে এ সূরার নাযিল হওয়ার সময় কাল জানা যায়নি। তবে এর বিষয়বস্তু সম্পর্কে চিন্তা করলে স্পষ্ট জানা যায়, সূরাটি حم السجدة সূরা নাযিল হওয়ার পরপরই নাযিল হয়েছে। কারণ, এ সূরাটিকে সূরা হা-মীম আস সাজদার এক রকম সম্পূরক বলে মনে হয়। যে ব্যক্তিই মনযোগ সহকারে প্রথমে সূরা হা-মীম আস সাজদা পড়বে এবং তারপর এ সূরা পাঠ করবে সে-ই এ বিষয়টি অনুধাবন করতে পারবে। সে দেখবে এ সূরাটিতে কুরাইশ নেতাদের অন্ধ ও অযৌক্তিক বিরোধিতার ওপর বড় মোক্ষম আঘাত হানা হয়েছিল। এভাবে পবিত্র মক্কা ও তার আশেপাশের এলাকায় অবস্থানকারী যাদের মধ্যেই নৈতিকতা, শিষ্টাচার ও যুক্তিবাদিতার কোন অনুভূতি আছে তারা জানতে পারবে জাতির উচ্চস্তরের লোকেরা কেমন অন্যায়ভাবে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিরোধিতা করছে আর তাদের মোকাবিলায় তাঁর কথা কত ভারসাম্যপূর্ণ, ভূমিকা কত যুক্তিসঙ্গত এবং আচার-আচরণ কত ভদ্র। ঐ সতর্কীকরণের পরপরই এ সূরা নাযিল করা হয়েছে। ফলে এটি যথাযথভাবে দিক নির্দেশনার দায়িত্ব পালন করেছে এবং একান্ত হৃদয়গ্রাহী ভঙ্গিতে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আন্দোলনের বাস্তবতা বুঝিয়ে দিয়েছে। কাজেই যার মধ্যেই সত্য প্রীতির কিছুমাত্র উপকরণ আছে এবং জাহেলিয়াতের গোমরাহীর প্রেমে যে ব্যক্তি অন্ধ হয়ে যায়নি তার পক্ষে এর প্রভাবমুক্ত থাকা ছিল অসম্ভব ব্যাপার।
(৪২-শূরা) : বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্য :
কথা শুরু করা হয়েছে এভাবে: তোমরা আমার নবীর পেশকৃত বক্তব্য শুনে এ কেমন আজেবাজে কথা বলে বেড়াচ্ছ ? কোন ব্যক্তির কাছে অহী আসা এবং তাকে মানবজাতির পথপ্রদর্শনের হিদায়াত বা পথনির্দেশনা দেয়া কোন নতুন বা অদ্ভূত কথা নয় কিংবা কোন অগ্রহণযোগ্য ঘটনাও নয় যে, ইতিহাসে এই বারই সর্বপ্রথম এ ধরনের ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। এর আগে আল্লাহ নবী-রসূলদের কাছে এ রকম দিক নির্দেশনা দিয়ে একের পর এক অনুরূপ অহী পাঠিয়েছেন। আসমান ও যমীনের অধিকর্তাকে উপাস্য ও শাসক মেনে নেয়া অদ্ভূত ও অভিনব কথা নয়। তাঁর বান্দা হয়ে, তাঁর খোদায়ীর অধীনে বাস করে অন্য কারো খোদায়ী মেনে নেয়াটাই বরং অদ্ভূত ও অভিনব ব্যাপার। তোমরা তাওহীদ পেশকারীর প্রতি ক্রোধান্বিত হচ্ছো। অথচ বিশ্ব-জাহানের মালিকের সাথে তোমরা যে শির্ক করছো তো এমন মহা অপরাধ যে আকাশ যদি তাতে ভেঙ্গে পড়ে তাও অসম্ভব নয়। তোমাদের এই ধৃষ্টতা দেখে ফেরেশতারাও অবাক। তারা এই ভেবে সর্বক্ষণ ভীত সন্ত্রস্ত যে কি জানি কখন তোমাদের ওপর আল্লাহর গযব নেমে আসে।
এরপর মানুষকে বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তিকে নবী হিসেবে নিয়োজিত করা এবং সেই ব্যক্তির নিজেকে নবী বলে পেশ করার অর্থ এ নয় যে, তাঁকে আল্লাহর সৃষ্টির ভাগ্য বিধাতা বানিয়ে দেয়া হয়েছে এবং সেই দাবি নিয়েই সে মাঠে নেমেছে। সবার ভাগ্যের নিয়ন্ত্রণ আল্লাহ নিজের হাতেই রেখেছেন। নবী এসেছেন শুধু গাফিলদের সাবধান এবং পথভ্রষ্টদের পথ দেখাতে। তাঁর কথা অমান্যকারীদের কাছে জবাবদিহি চাওয়া এবং তাদেরকে আযাব দেয়া বা না দেয়া আল্লাহর নিজের কাজ। নবীকে এ কাজের দায়িত্ব দেয়া হয়নি। তাই তোমাদের সমাজের তথাকথিত ধর্মীয় নেতা ও পীর ফকীররা যে ধরনের দাবী করে অর্থাৎ যে তাদের কথা মানবে না, কিংবা তাদের সাথে বে-আদবী করে তারা তাকে জ্বালিয়ে নিশ্চিহ্ন করে দেবে, নবী এ ধরনের কোন দাবী নিয়ে এসেছেন বলে মনে করে থাকলে সে ভ্রান্ত ধারণা মন-মগজ থেকে ঝেড়ে ফেলো। এ প্রসঙ্গে মানুষকে একথাও বলা হয়েছে যে, নবী তোমাদের অমঙ্গল কামনার জন্য আসেননি। তিনি বরং তোমাদের কল্যাণকামী। তোমরা যে পথে চলছো সে পথে তোমাদের নিজেদের ধ্বংস রয়েছে, তিনি শুধু এ বিষয়ে তোমাদের সতর্ক করছেন।
। অতপর আল্লাহ জন্মগতভাবে মানুষকে সুপথগামী করে কেন সৃষ্টি করেননি এবং মতানৈক্যের এই সুযোগ কেন রেখেছেন, যে কারণে মানুষ চিন্তা ও কর্মের যে কোন উল্টা বা সোজা পথে চলতে থাকে, এ বিষয়টির তাৎপর্য বুঝিয়েছেন। বলা হয়েছে, এ জিনিসের বদৌলতেই মানুষ যাতে আল্লাহর বিশেষ রহমত লাভ করতে পারে সে সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। ইখতিয়ারবিহীন অন্যান্য সৃষ্টিকূলের জন্য এ সুযোগ নেই। এ সুযোগ আছে শুধু স্বাধীন ইচ্ছা শক্তির অধিকারী সৃষ্টিকুলের জন্য যারা প্রকৃতিগতভাবে নয়, বরং জ্ঞানগতভাবে বুঝে শুনে নিজের স্বাধীন ইচ্ছাকে কাজে লাগিয়ে আল্লাহকে নিজেদের অভিভাবক (PATRON, GUARDIAN) বানিয়েছে। যে মানুষ এই নীতি ও আচরণ গ্রহণ করে আল্লাহ তাকে সাহায্য করার মাধ্যমে পথ প্রদর্শন করেন এবং সৎকাজের তাওফীক দান করে তাঁর বিশেষ রহমতের মধ্যে শামিল করে নেন। কিন্তু যে ব্যক্তি তার স্বাধীন ক্ষমতা ও ইখতিয়ার ভুল পন্থায় ব্যবহার করে যারা প্রকৃত অভিভাবক নয় এবং হতেও পারে না তাদেরকে অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করে তারা এই রহমত হতে বঞ্চিত হয়ে যায়। এ প্রসঙ্গে আরো বলা হয়েছে যে, প্রকৃতপক্ষে মানুষের ও গোটা সৃষ্টিকুলের অভিভাবক হচ্ছেন আল্লাহ। অন্যরা না প্রকৃত অভিভাবক, না আছে তাদের প্রকৃত অভিভাবকত্বের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করার ক্ষমতা। মানুষ তার স্বাধীন ক্ষমতা ও ইখতিয়ার প্রয়োগ করে নিজের অভিভাবক নির্বাচনে ভুল করবে না এবং যে প্রকৃতই অভিভাবক তাকেই অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করবে। এর ওপরই তার সফলতা নির্ভর করে।
। তারপর মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে দ্বীন পেশ করছেন তা প্রকৃতপক্ষে কি সে বিষয়ে বলা হয়েছে: সেই দ্বীনের সর্বপ্রথম ভিত্তি হলো, আল্লাহ যেহেতু বিশ্ব-জাহান ও মানুষের স্রষ্টা, মালিক এবং প্রকৃত অভিভাবক তাই মানুষের শাসনকর্তাও তিনি। মানুষকে দ্বীন ও শরীয়ত (বিশ্বাস ও কর্মের আদর্শ) দান করা এবং মানুষের মধ্যকার মতানৈক্য ও মতদ্বৈততার ফায়সালা করে কোনটি হক এবং কোনটি না হক তা বলে আল্লাহর অধিকারের অন্তর্ভুক্ত। অন্য কোন সত্তার মানুষের জন্য আইনদাতা ও রচয়িতা (Law giver) হওয়ার আদৌ কোন অধিকার নেই। অন্য কথায় প্রাকৃতিক সার্বভৌমত্বের মত আইন প্রণয়নের সার্বভৌমত্বও আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট। মানুষ বা আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন সত্তা এই সার্বভৌমত্বের ধারক হতে পারে না। কোন ব্যক্তি যদি আল্লাহর এই সার্বভৌমত্ব না মানে তাহলে তার আল্লাহর প্রাকৃতিক সার্বভৌমত্ব মানা অর্থহীন। এ কারণে আল্লাহ তায়ালা মানুষের জন্য প্রথম থেকেই একটি দ্বীন নির্ধারিত করেছেন।
সে দ্বীন ছিল একটিই। প্রত্যেক যুগে সমস্ত নবী-রসূলকে ঐ দ্বীনটিই দেয়া হতো। কোন নবীই স্বতন্ত্র কোন ধর্মের প্রবর্তক ছিলেন না। আল্লাহর পক্ষ থেকে মানবজাতির জন্য প্রথম দিন হতে ঐ দ্বীনটিই নির্ধারিত হয়ে এসেছে এবং সমস্ত নবী-রসূল ছিলেন সেই দ্বীনেরই অনুসারী ও আন্দোলনকারী।
শুধু মেনে নিয়ে চুপচাপ বসে থাকার জন্য সে দ্বীন পাঠানো হয়নি। বরং পৃথিবীতে সেই দ্বীনই প্রতিষ্ঠিত ও প্রচলিত থাকবে এবং যমীনে আল্লাহর দ্বীন ছাড়া অন্যদের রচিত দ্বীন যেন প্রতিষ্ঠিত হতে না পারে সবসময় এ উদ্দেশ্যেই তা পাঠানো হয়েছে। শুধু এ দ্বীনের তাবলীগের জন্য নবী-রসূলগণ আদিষ্ট ছিলেন না, বরং কায়েম করার জন্য আদিষ্ট ছিলেন। এটিই ছিল মানবজাতির মূল দ্বীন। কিন্তু নবী-রসূলদের পরবর্তী যুগে স্বার্থান্বেষী মানুষেরা আত্মপ্রীতি, স্বেচ্ছাচার এবং আত্মম্ভরিতার কারণে স্বার্থের বশবর্তী হয়ে এ দ্বীনের মধ্যে বিভেদ ও বিরোধ সৃষ্টি করে নতুন নতুন ধর্ম সৃষ্টি করেছে। পৃথিবীতে যত ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম দেখা যায় তার সবই ঐ একমাত্র দ্বীনকে বিকৃত করেই সৃষ্টি করা হয়েছে।
এখন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে পাঠানোর উদ্দেশ্য হলো তিনি যেন বহুবিধ পথ, কৃত্রিম ধর্মসমূহ এবং মানুষের রচিত দ্বীনের পরিবর্তে সেই আসল দ্বীন মানুষের সামনে পেশ করেন এবং তা প্রতিষ্ঠার জন্য প্রচেষ্টা চালান। এজন্য আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করার পরিবর্তে তোমরা যদি আরো বিগড়ে যাও এবং সংঘাতের জন্য তৎপর হয়ে ওঠো তাহলে সেটা তোমাদের অজ্ঞতা। তোমাদের এই নির্বুদ্ধিতার কারণে নবী তাঁর কর্মতৎপরতা বন্ধ করে দেবেন না। তাঁকে আদেশ দেয়া হয়েছে, যেন তিনি অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে আপনার ভূমিকায় অটল থাকেন এবং যে কাজের জন্য তিনি আদিষ্ট হয়েছেন তা সম্পাদন করেন। যেসব কুসংস্কার, অন্ধ বিশ্বাস এবং জাহেলী রীতি-নীতি ও আচার-অনুষ্ঠান দ্বারা ইতিপূর্বে আল্লাহর দ্বীনকে বিকৃত করা হয়েছে তিনি তোমাদের সন্তুষ্টি বিধানের জন্য দ্বীনের মধ্যে তা অন্তর্ভুক্ত করার সুযোগ সৃষ্টি করবেন তোমরা তাঁর কাছে এ প্রত্যাশা করো না।
আল্লাহর দ্বীন পরিত্যাগ করে অন্যদের রচিত দ্বীন ও আইন গ্রহণ করা আল্লাহর বিরুদ্ধে কত বড় ধৃষ্টতা সে অনুভূতি তোমাদের নেই। নিজেদের দৃষ্টিতে তোমরা একে দুনিয়ার সাধারণ ব্যাপার মনে করছো। তোমরা এতে কোন দোষ দেখতে পাও না। কিন্তু আল্লাহর দৃষ্টিতে এটা জঘন্যতম শির্ক এবং চরমতম অপরাধ। সেই সব লোককে এই শির্ক ও অপরাধের কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে যারা আল্লাহর যমীনে নিজেদের দ্বীন চালু করেছে এবং তাদের দ্বীনের অনুসরণ ও আনুগত্য করেছে।
এভাবে দ্বীনের একটি পরিষ্কার ও সুস্পট ধারণা পেশ করার পর বলা হয়েছে, তোমাদেরকে বুঝিয়ে সুজিয়ে সঠিক পথে নিয়ে আসার পথে নিয়ে আসার জন্য যেসব উত্তম পন্থা সম্ভব ছিল তা কাজে লাগানো হয়েছে। একদিকে আল্লাহ তাঁর কিতাব নাযিল করেছেন। সে কিতাব অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক পন্থায় তোমাদের নিজের ভাষায় তোমাদের কাছে প্রকৃত সত্য পেশ করছে। অপরদিকে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর সংগী-সাথীদের জীবন তোমাদের সামনে বর্তমান, যা দেখে তোমরা জানতে পার এ কিতাবের দিক নির্দেশনায় কেমন মানুষ তৈরী হয়। এভাবেও যদি তোমরা হিদায়াত লাভ করতে না পার তাহলে দুনিয়ার আর কোন জিনিসই তোমাদেরকে সঠিক পথে আনতে সক্ষম নয়। কাজেই এখন এর ফলাফল যা দাঁড়ায় তা হচ্ছে, তোমরা শতাব্দীর পর শতাব্দী যে গোমরাহীতে ডুবে আছো তার মধ্যেই ডুবে থাকো এবং এ রকম পথভ্রষ্টদের জন্য আল্লাহর কাছে যে পরিণতি নির্ধারিত আছে সেই পরিণতির মুখোমুখি হও।
এসব সত্য বর্ণনা করতে গিয়ে মাঝে মাঝে সংক্ষেপে তাওহীদ ও আখেরাতের স্বপক্ষে যুক্তি-প্রমাণ পেশ হয়েছে, দুনিয়া পূজার পরিণাম সম্পর্কে সাবধান করা হয়েছে, আখেরাতের শাস্তির ভয় দেখানো হয়েছে এবং কাফেরদের সেই সব নৈতিক দুর্বলতার সমালোচনা করা হয়েছে যা তাদের আখেরাত থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকার মূল কারণ ছিল। তারপর বক্তব্যের সমাপ্তি পর্যায়ে দুটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলা হয়েছে:
এক: মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর জীবনের প্রথম চল্লিশ বছর কিতাব কি—এ ধারণার সাথে সম্পূর্ণ অপরিচিত ছিলেন এবং ঈমান ও ঈমান সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে একেবারে অনবহিত ছিলেন। তারপর হঠাৎ এ দু’টি জিনিস নিয়ে তিনি মানুষের সামনে এলেন। এটা তাঁর নবী হওয়ার সুস্পষ্ট প্রমাণ।
দুই: তাঁর পেশকৃত শিক্ষাকে আল্লাহর শিক্ষা বলে আখ্যায়িত করার অর্থ এ নয় যে, তিনি আল্লাহর সাথে সামনা-সামনি কথাবার্তা বলার দাবীদার। আল্লাহর এই শিক্ষা অন্য সব নবী-রসূলদের মত তাঁকেও তিনটি উপায়ে দেয়া হয়েছে। এক—অহী, দুই—পর্দার আড়াল থেকে আওয়াজ দেয়া এবং তিন—ফেরেশতার মাধ্যমে পয়গাম। এ বিষয়টি পরিষ্কার করে বলা হয়েছে যাতে বিরোধীরা এ অপবাদ আরোপ করতে না পারে যে, নবী (সা.) আল্লাহর সাথে সামনা-সামনি কথা বলার দাবি করছেন। সাথে সাথে ন্যায়বাদী মানুষেরা যেন জানতে পারে আল্লাহর পক্ষ থেকে যে মানুষটিকে নবুওয়াতের পদমর্যাদায় অভিষিক্ত করা হয়েছে তাঁকে কোন্ কোন্ উপায় ও পন্থায় দিক নিদের্শনা দেয়া হয়।
# বক্তব্য শুরু করার এই ভঙ্গি থেকেই বুঝা যায়, সেই সময় পবিত্র মক্কার প্রতিটি মাহফিল ও গ্রাম্য বিপণী, প্রতিটি গলি ও বাজার এবং প্রতিটি বাড়ী ও বিপনীতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আন্দোলন ও কুরআনের বিষয়বস্তু নিয়ে যে জোর গুজব, কানাঘুষা ও আলোচনা চলছিলো তা-ই ছিল এর পটভূমি। লোকেরা বলতোঃ এ ব্যক্তি কোথা থেকে এসব অভিনব কথা নিয়ে আসছে তা কে জানে। এ রকম কথা আমরা কখনো শুনিনি বা হতেও দেখিনি। তারা বলতোঃ বাপ-দাদা থেকে যে দ্বীন চলে আসছে, গোটা জাতি যে দ্বীন অনুসরণ করছে, সমগ্র দেশে যে নিয়ম পদ্ধতি শত শত বছর ধরে প্রচলিত আছে এ লোকটি তার সব কিছুকেই ভুল বলে আখ্যায়িত করছে এবং বলছে, আমি যে দ্বীন পেশ করছি সেটিই ঠিক। এ এক বিস্ময়কর ব্যাপার। তারা বলতোঃ এ লোকটি যদি এই বলে তাঁর বক্তব্য পেশ করতো যে, বাপ-দাদার ধর্ম এবং প্রচলিত নিয়ম-পদ্ধতির মধ্যে তাঁর দৃষ্টিতে কিছু দোষ-ত্রুটি আছে এবং সে চিন্তা-ভাবনা করে নিজে কিছু নতুন বিষয় বের করেছে তাহলে তা নিয়েও আলোচনা করা যেতো। কিন্তু সে বলে, আমি তোমাদের যা শুনাচ্ছি তা আল্লাহর বাণী। একথা কি করে মেনে নেয়া যায়। আল্লাহ কি তাঁর কাছে আসেন? না কি সে আল্লাহর কাছে যায়? না তাঁর ও আল্লাহর মধ্যে কথাবার্তা হয়? এসব আলোচনা ও কানাঘুষার জবাবে বাহ্যত রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে উদ্দেশ্য করে কিন্তু মূলত কাফেরদের শুনিয়ে বলা হয়েছেঃ হ্যাঁ, মহাপরাক্রমশালী ও জ্ঞানময় আল্লাহ অহীর মাধ্যমে এসব কথাই বলছেন এবং পূর্বের সমস্ত নবী-রসূলদের কাছে এসব বিষয় নিয়েই অহী নাযিল হতো।
অহীর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে, দ্রুত ইঙ্গিত এবং গোপন ইঙ্গিত অর্থাৎ এমন ইঙ্গিত যা অতি দ্রুত এমনভাবে করা হবে যে তাকে বল ইঙ্গিতদাতা এবং যাকে ইঙ্গিত করা হয়েছে সেই জানতে ও বুঝতে পারবে। তাছাড়া অন্য কেউ তা জানতে পারবে না। এ শব্দটিকে পারিভাষিক অর্থে এমন দিক নির্দেশনা বুঝাতে ব্যবহার করা হয়েছে যা আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর কোন বান্দার মনে বিদ্যুৎ চমকের মত নিক্ষেপ করা হয়। আল্লাহর এ বাণীর উদ্দেশ্য হলো, কোন বান্দার কাছে আল্লাহর আসার কিংবা তাঁর কাছে কোন মানুষের যাওয়ার এবং সামনা-সামনি কথা বলার কোন প্রশ্নই ওঠে না। তিনি মহাপরাক্রমশালী ও জ্ঞানময়। মানুষের হিদায়াত ও দিক নির্দেশনার জন্য যখনই তিনি কোন বান্দার সাথে যোগাযোগ করতে চান তখন কোন অসুবিধাই তাঁর ইচ্ছার পথে প্রতিবন্ধক হতে পারে না। এ কাজের জন্য তিনি তাঁর জ্ঞান দ্বারা অহী পাঠানোর পথ অবলম্বন করেন। সূরার শেষ আয়াতগুলোতে এ বিষয়টিরই পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে এবং সেখানে বিষয়টি আরো পরিষ্কার করে বলা হয়েছে।
তাদের ধারণা ছিল এসব হচ্ছে অদ্ভূত ও অভিনব কথা। তার জবাবে বলা হয়েছে, এসব অদ্ভূত ও অভিনব কথা নয়। বরং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পূর্বে যত নবী-রসূল এসেছেন আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁদের সকলকেই এসব হিদায়াতই দান করা হতো।
# শুধু আল্লাহর প্রশংসার জন্য এই প্রারম্ভিক বাক্যটি বলা হচ্ছে না। যে পটভূমিতে এ আয়াত নাযিল হয়েছে এর প্রতিটি শব্দ তার সাথে গভীরভাবে সম্পর্কিত। যারা নবী ﷺ ও কুরআনের বিরুদ্ধে শোরগোল ও কানাঘুষা করছিলো তাদের আপত্তির প্রথম ভিত্তি হলো, নবী (সা.) তাওহীদের দাওয়াত দিচ্ছিলেন এতে তারা উৎকর্ণ হয়ে বলতোঃ যদি শুধুমাত্র আল্লাহ একাই উপাস্য, প্রয়োজন পূরণকারী এবং আইনদাতা হন তাহলে আমাদের পূর্ববর্তী মনীষীগণ কোন্ মর্যাদার অধিকারী? এর জবাবে বলা হয়েছে, এই গোটা বিশ্ব-জাহান আল্লাহর সাম্রাজ্য। মালিকের মালিকানায় অন্য কারো খোদায়ী কি করে চলতে পারে? বিশেষ করে যাদের খোদায়ী মানা হয় কিংবা যারা নিজেদের খোদায়ী চালাতে চায়, তারা নিজেরাও তাঁর মালিকানাভুক্ত। তারপর বলা হয়েছে তিনি সর্বোন্নত ও মহান। তাই কেউ তাঁর সমকক্ষ হতে পারে না এবং তাঁর সত্তা, গুণাবলী, ক্ষমতা, ইখতিয়ার এবং অধিকারের মধ্যে কোনটিতেই অংশীদার হতে পারে না।
# কোন সৃষ্টির বংশধারা আল্লাহর সাথে সম্পর্কিত করা এবং তাকে আল্লাহর পুত্র বা কন্যা আখ্যায়িত করা কোন সাধারণ ব্যাপার নয়। কাউকে অভাব পূরণকারী ও বিপদ ত্রাণকারী বানিয়ে নেয়া হয়েছে এবং তার কাছে প্রার্থনা করতে আরম্ভ করেছে। কাউকে সারা দুনিয়ার সাহায্যকারী মনে করে নেয়া হয়েছে এবং প্রকাশ্যে বলতে শুরু করা হয়েছে যে, আমাদের হযরত সব সময় সব স্থানে সবার কথা শোনেন। তিনিই প্রত্যেকের সাহায্যের জন্য হাজির হয়ে তার কাজ উদ্ধার করে দেন। কাউকে আদেশ-নিষেধ এবং হালাল ও হারামের মালিক মোখতার মেনে নেয়া হয়েছে। আল্লাহকে বাদ দিয়ে মানুষ এমনভাবে তার নির্দেশের আনুগত্য করতে শুরু করেছে যেন সে-ই তাদের আল্লাহ। এগুলো আল্লাহর বিরুদ্ধে এমন ধৃষ্ঠতা যে এতে আসমান ভেঙে পড়াও অসম্ভব নয়। (সূরা মারয়ামের ৮৮ থেকে ৯১ আয়াতে এই একই বিষয় বর্ণনা করা হয়েছে)
# মানুষের এসব কথা শুনে শুনে ফেরেশতারা এই বলে কানে হাত দেয় যে, আমাদের রব সম্পর্কে এসব কি বাজে বলা হচ্ছে এবং পৃথিবীর এই মাখলুক এ কি ধরনের বিদ্রোহ করেছে? তারা বলেঃ সুবহানাল্লাহ! কে এমন মর্যাদার অধিকারী হতে পারে যে, বিশ্ব-জাহানের রবের সাথে ‘উলুহিয়াত’ ও সার্বভৌম ক্ষমতায় শরীক হতে পারে। তিনি ছাড়া আমাদের ও সব বান্দার জন্য আর কে পৃষ্ঠপোষক আছে যে তার প্রশংসা গীত গাইতে হবে এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে হবে। তাছাড়া তারা উপলব্ধি করে যে, পৃথিবীতে এটা এমন এক মহা অপরাধ করা হচ্ছে যার কারণে যে কোন সময় আল্লাহর গযব নেমে আসতে পারে। তাই তারা পৃথিবীতে বসবাসকারী এই আত্মসংহারী বান্দাদের জন্য বার বার এই বলে দয়া ও করুণার আবেদন জানায় যে, তাদেরকে যেন এখনই শাস্তি দেয়া না হয় এবং সামলে নেয়ার জন্য তাদেরকে আরো কিছুটা সুযোগ দেয়া হয়।
# এটা তাঁর উদারতা, দয়া ও ক্ষমাশীলতা যার কল্যাণে কুফর, শিরক ও নাস্তিকতা এবং পাপাচার ও চরম জুলুম-নির্যাতনে লিপ্ত ব্যক্তিরাও বছরের পর বছর, এমনকি এ ধরনের পুরো এক একটা সমাজ শত শত বছর পর্যন্ত এক নাগাড়ে অবকাশ পেয়ে থাকে। তারা শুধু রিযিকই লাভ করে না, পৃথিবীতে তাদের খ্যতিও ছড়িয়ে পড়ে। তাছাড়া পৃথিবীর এমন সব উপকরণ ও সাজসরঞ্জাম দ্বারা তারা অনুগৃহীত হয় যা দেখে নির্বোধ লোকেরা এই ভ্রান্ত ধারণায় পতিত হয় যে, হয়তো এ পৃথিবীর কোন খোদা-ই নেই।
# মূল আয়াতে اولياء শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে আরবী ভাষায় যার অর্থ অত্যন্ত ব্যাপক। বাতিল উপাস্যদের সম্পর্কে পথভ্রষ্ট মানুষদের বিভিন্ন আকীদা-বিশ্বাস এবং ভিন্ন ভিন্ন অনেক কর্মপদ্ধতি আছে। কুরআন মজীদে এগুলোকেই “আল্লাহ ছাড়া অন্যদের অভিভাবক বানানো” বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। কুরআন মজীদে অনুসন্ধান করলে ولي শব্দটির নিম্নবর্ণিত অর্থসমূহ জানা যায়ঃ
একঃ মানুষ যার কথামত কাজ করে, যার নির্দেশনা মেনে চলে এবং যার রচিত নিয়ম-পন্থা, রীতি-নীতি এবং আইন-কানুন অনুসরণ করে (আন নিসা, আয়াত ১১৮ থেকে ১২০ ; আল-আ’রাফ, আয়াত ৩ ও ২৭ থেকে ৩০ )।
দুইঃ যার দিক নির্দেশনার (Guidance) ওপর মানুষ আস্থা স্থাপন করে এবং মনে করে সে তাকে সঠিক রাস্তা প্রদর্শনকারী এবং ভ্রান্তি থেকে রক্ষাকারী। (আল বাকারা- ২৫৭ ; বানী ইসরাইল -৯৭ ; আল কাহাফ -১৭ ও আল জাসিয়া -১৯ আয়াত)।
তিনঃ যার সম্পর্কে মানুষ মনে করে, আমি পৃথিবীতে যাই করি না কেন সে আমাকে তার কুফল থেকে রক্ষা করবে। এমনকি যদি আল্লাহ থাকেন এবং আখেরাত সংঘটিত হয় তাহলে তার আযাব থেকেও রক্ষা করবেন (আন নিসা- ১২৩ – ১৭৩ ; আল আন’আম -৫১ ; আর রা’দ -৩৭ ; আল আনকাবুত -২২ ; আল আহযাব -৬৫ ; আয-যুমার -৩ আয়াত)।
চারঃ যার সম্পর্কে মানুষ মনে করে, পৃথিবীতে তিনি অতি প্রাকৃতিক উপায়ে তাকে সাহায্য করেন, বিপদাপদে তাকে রক্ষা করেন। রুজি-রোজগার দান করেন, সন্তান দান করেন, ইচ্ছা পূরণ করেন এবং অন্যান্য সব রকম প্রয়োজন পূরণ করেন ( হুদ-২০ , আর রা’দ-১৬ ও আল আনকাবুত-৪১ আয়াত)।
অলী(ولي) শব্দটি কুরআন মজীদের কোন কোন জায়গায় ওপরে বর্ণিত অর্থসমূহের কোন একটি বুঝাতে ব্যবহার করা হয়েছে এবং কোথাও কোথাও সবগুলো অর্থ একত্রেও বুঝানো হয়েছে। আলোচ্য আয়াতটি তারই একটি। এখানে আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্যদেরকে অলী বা অভিভাবক বানানোর অর্থ ওপরে বর্ণিত চারটি অর্থেই তাদেরকে পৃষ্টপোষক, সহযোগী ও সাহায্যকারী মনে করা।
# আল্লাহই তাদের তত্বাবধায়ক অর্থাৎ তিনি তাদের সমস্ত কাজকর্ম দেখছেন এবং তাদের আমলনামা প্রস্তুত করছেন। তাদের কাছে জবাবদিহি চাওয়া ও তাদেরকে পাকড়াও করা তাঁরই কাজ। “তুমি তাদের জিম্মাদার নও।” নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে উদ্দেশ্য করে একথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ তাদের ভাগ্য তোমার হাতে তুলে দেয়া হয়নি যে, যারা তোমার কথা মানবে না তাদেরকে তুমি জ্বালিয়ে ছাই করে দেবে, কিংবা ক্ষমতাচ্যুত করবে অথবা তছনছ করে ফেলবে। একথার অর্থ আবার এও নয় যে, নবী ﷺ নিজেকে সে রকম মনে করতেন। তাই তাঁর ভুল ধারণা বা আত্মবিভ্রম দূর করার জন্য একথা বলা হয়েছে। বরং কাফেরদের শুনানোই এর মূল উদ্দেশ্য। যদিও বাহ্যিকভাবে নবীকেই ﷺ সম্বোধন করা হয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কাফেরদেরকে একথা বলাই উদ্দেশ্য যে, তোমাদের মধ্যে যারা খোদাপ্রাপ্তি এবং আধ্যাত্মিকতার প্রহসন করে সাধারণত যেভাবে ঘটা করে তা দাবী করে, আল্লাহর নবী তেমন কোন দাবী করেন না। জাহেলী সমাজে সাধারণভাবে এ ধারণা প্রচলিত আছে যে, ‘দরবেশ’ শ্রেণীর লোকেরা এমন প্রতিটি মানুষের ভাগ্য নষ্ট করে দেয় যারা তাদের সাথে বে-আদবী করে। এমনকি তাদের মৃত্যুর পরেও কেউ যদি তাদের কবরেরও অবমাননা করে এবং অন্য কিছু না করলেও যদি তাদের মনের মধ্যে কোন খারাপ ধারণার উদয় হয় তাহলেই তাকে ধ্বংস করে দেয়। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে এ ধারণা ঐ সব “দরবেশ মহামান্যরা” নিজেরাই প্রচার করেন এবং যেসব নেককার লোক নিজেরা এ কাজ করেন না কিছু ধূর্ত লোক তাদের হাড্ডিসমূহকে নিজেদের ব্যবসায়ের পুঁজি বানানোর জন্য তাদের সম্পর্কে এ ধারণা প্রচার করতে থাকে যাই হোক মানুষের ভাগ্য গড়া ও ভাংঙ্গার ক্ষমতা-ইখতিয়ার থাকাকেই সাধারণ মানুষ রূহানিয়াত ও খোদাপ্রাপ্তির অতি আবশ্যকীয় দিক বলে মনে করেছে। প্রতারণার যাদুর এই মুখোশ খুলে দেয়ার জন্য আল্লাহ কাফেরদের শুনিয়ে তাঁর রসূলকে বলছেন, নিঃসন্দেহে তুমি আমার নবী এবং আমি তোমাকে আমার অহী দিয়ে সম্মানিত করেছি। শুধু মানুষকে সঠিক পথ দেখানোই তোমার কাজ। তাদের ভাগ্য তোমার হাতে তুলে দেয়া হয়নি। তা আমি নিজের হাতেই রেখেছি। বান্দার কাজকর্ম বিচার করা এবং তাদেরকে শাস্তি দেয়া বা না দেয়া আমার নিজের দায়িত্ব।
# বক্তব্যের প্রারম্ভে যা বলা হয়েছিলো সে কথার পুনরাবৃত্তি করে আরো জোর দিয়ে বলা হয়েছে। ‘আরবী ভাষার কুরআন’ বলে শ্রোতাদের বুঝানো হয়েছে, এটা অন্য কোন ভাষায় নয় তোমাদের নিজেদের ভাষায় নাযিল হয়েছে। তোমরা নিজেরাই তা সরাসরি বুঝতে পারো। এর বিষয়বস্তু সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করে দেখো, আল্লাহর পক্ষ থেকে ছাড়া এই পাক-পবিত্র ও নিস্বার্থ দিক নির্দেশনা কি আর কারো পক্ষ থেকে হতে পারে?
# তাদেরকে গাফলতি থেকে জাগিয়ে দাও এবং এই মর্মে সতর্ক করে দাও যে, ধ্যান-ধারণা ও আকীদা-বিশ্বাসের যে গোমরাহী এবং নৈতিকতা ও চরিত্রের যে অকল্যাণ ও ধ্বংসকারিতার মধ্যে তোমরা ডুবে আছ এবং তোমাদের ব্যক্তি ও জাতীয় জীবন যে বিকৃত নীতিমালার ওপর চলছে তার পরিণাম ধ্বংস ছাড়া কিছু নয়।
# তাদেরকে এও বলে দাও যে, এই ধ্বংস শুধু দুনিয়া পর্যন্তই সীমাবদ্ধ নয়, ভবিষ্যতে এমন দিনও আসবে যখন আল্লাহ সমস্ত মানুষকে একত্রিত করে তাদের হিসাব নিবেন। কোন ব্যক্তি যদি তার গোমরাহী ও দুষ্কর্মের পরিণাম ফল থেকে পৃথিবীতে বেঁচে গিয়েও থাকে তাহলে সেদিন তার বাঁচার কোন উপায় থাকবে না। আর সেই ব্যক্তি তো বড়ই দুর্ভাগা যে এখানেও অকল্যাণ লাভ করলো, সেখানেও দুর্ভাগ্যের শিকার হলো।
# এখানে এই বক্তব্যের মধ্যে একথাটি বলার তিনটি উদ্দেশ্য আছেঃ
প্রথমত-এ কথা বলার উদ্দেশ্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে শিক্ষা এবং সান্তনা দান করা। এতে নবীকে ﷺ বুঝানো হয়েছে, তিনি মক্কার কাফেরদের অজ্ঞতা, গোমরাহী ও বাহ্যিকভাবে তাদের একগুয়েমী ও হঠকারিতা দেখে যেন বেশী মনোকষ্ট ও দুঃখ না পান। মানুষকে ক্ষমতা-ইখতিয়ার ও নির্বাচন করার স্বাধীনতা দেয়াই আল্লাহর ইচ্ছা। তারপর যে হিদায়াত চাইবে সে হিদায়াত লাভ করবে। আর যে পথভ্রষ্ট হতে চাইবে সে পথভ্রষ্ট হবে। সে যেদিকে যেতে চায় সেদিকেই যাবে। আল্লাহর অভিপ্রায় ও বিবেচ্য যদি এটা না হতো তাহলে নবী-রসূল ও কিতাব পাঠানোর প্রয়োজনই বা কি ছিল? সেজন্য মহান আল্লাহর একটি সৃষ্টিসূচক ইঙ্গিতই যথেষ্ট ছিল। এভাবে সমস্ত মানুষ ঠিক তেমনি তাঁর আদেশ মেনে চলতো যেমন আদেশ মেনে চলে নদী, পাহাড়, গাছ, মাটি পাথর ও সমস্ত জীবজন্তু। (এ উদ্দেশ্যে এ বিষয়টি কুরআন মজীদের অন্যান্য জায়গায়ও বর্ণিত হয়েছে। দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, সূরা আনআম, আয়াত ৩৫, ৩৬ ও ১০৭ টীকাসহ )।
দ্বিতীয়-আল্লাহ যদি সত্যিই মানুষকে পথ দেখাতে চাইতেন আর মানুষের মধ্যে আকীদা ও কর্মের যে পার্থক্য বিস্তার লাভ করে আছে তা তাঁর পছন্দ না হতো এবং মানুষ ঈমান ও ইসলামের পথ অনুসরণ করুক তাই যদি তাঁর মনঃপুত, তাহলে এই কিতাব ও নবুওয়াতের কি প্রয়োজন ছিল? এ ধরনের দ্বিধা-দ্বন্দ্বে যেসব মানুষ হাবুডুবু খাচ্ছিলো এখানে তাদেরকেই সম্বোধন করা হয়েছে। তিনি সব মানুষকে মু’মিন ও মুসলিম হিসেবে সৃষ্টি করে এ কাজ সহজেই করতে পারতেন। এই বিভ্রান্তি ও দ্বিধা দ্বন্দ্বের ফলশ্রুতি হিসেবে যুক্তি দেখানো হয় যে, আল্লাহ যখন তা করেননি তখন নিশ্চয়ই তিনি ভিন্ন কোন পথ পছন্দ করেন। আমরা যে পথে চলছি সেটিই সেই পথ আর যা কিছু করছি তাঁরই ইচ্ছায় করছি। তাই এ ব্যাপারে আপত্তি করার অধিকার কারো নেই। এই ভ্রান্ত ধারণা দূর করার জন্যও এ বিষয়টি কুরআন মজীদের বিভিন্ন জায়গায় বর্ণনা করা হয়েছে। দেখুন তাফহীমুল কুরআন, সূরা আনআম, আয়াত ১১২ , ১৩৮ , ১৪৮, ১৪৯ টীকাসহ; সূরা নূর এর (তাফহীম) ভূমিকা; ইউনুস আয়াত ৯৯, টীকাসহ ; হূদ আয়াত ১১৮ টীকাসহ ; আন নাহল, আয়াত ৩৬ ও ৩৭ টীকাসহ ।
তৃতীয়ত-এর উদ্দেশ্য দ্বীনের প্রচার ও আল্লাহর সৃষ্টির সংশোধন ও সংস্কারের পথে যেসব বিপদাপদ আসে ঈমানদারদেরকে তার বাস্তবতা ও তাৎপর্য উপলব্ধি করানো। যারা আল্লাহর দেয়া বাছাই ও ইচ্ছার স্বাধীনতা এবং তার ভিত্তিতে স্বভাব-চরিত্র ও পন্থা-পদ্ধতির ভিন্ন হওয়ার বাস্তবতা উপলব্ধি করে না তারা কখনো সংস্কার কার্যের মন্থর গতি দেখে নিরাশ হতে থাকে। তারা চায় আল্লাহর পক্ষ থেকে এমন কিছু ‘কারামত’ ও ‘মু’জিযা’ দেখানো যা দেখামাত্র মানুষের মন পরিবর্তিত হয়ে যাবে। আবার কখনো তারা প্রয়োজনের অধিক আবেগ-উত্তেজনার বশে সংস্কারের অবৈধ পন্থা-পদ্ধতি গ্রহণ করার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে (এ উদ্দেশ্যেও কুরআন মজীদের কয়েকটি জায়গায় এ বিষয়টি বলা হয়েছে। দেখুন তাফহীমুল কুরআন, সূরা রা’দ আয়াত ৩১ টীকাসহ ; সূরা নাহল, আয়াত ৯০ থেকে ৯৩ টীকাসহ।)
এ উদ্দেশ্যে একটি বড় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এ কয়টি সংক্ষিপ্ত বাক্যে বর্ণনা করা হয়েছে। পৃথিবীতে আল্লাহর সত্যিকার প্রতিনিধিত্ব এবং আখেরাতে তাঁর জান্নাত কোন সাধারণ রহমত নয় যা মাটি ও পাথর এবং গাধা ও ঘোড়ার মত মর্যাদার সৃষ্টিকুলকে সাধারণভাবে বণ্টন করে দেয়া যায়। এটা তো একটা বিশেষ এবং অনেক উচ্চ পর্যায়ের রহমত যার জন্য ফেরেশতাদেরকেও উপযুক্ত মনে করা হয়নি। এ কারণেই মানুষকে একটি স্বাধীন ক্ষমতা ও ইখতিয়ার সম্পন্ন সৃষ্টির মর্যাদা দিয়ে সৃষ্টি করে আল্লাহ তাঁর পৃথিবীর এসব অঢেল উপায়-উপকরণ তার কর্তৃত্বাধীনে দিয়েছেন এবং এসব সাংঘাতিক শক্তিও তাকে দান করেছেন। যাতে সে সেই পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যেতে পারে এবং এতে কামিয়াব হওয়ার পরই কেবল কোন বান্দা তাঁর এই বিশেষ রহমত লাভের উপযুক্ত হতে পারে। এ রহমত আল্লাহর নিজের জিনিস। এর ওপর আর কারো ইজারাদারী নেই। কেউ তার ব্যক্তিগত অধিকারের ভিত্তিতে তা দাবী করেও নিতে পারে না। এমন শক্তিও কারো নেই যে, জোর করেই তা লাভ করতে পারে। সে-ই কেবল তা নিতে পারে যে আল্লাহর কাছে তার দাসত্ব পেশ করবে, তাঁকেই নিজের অভিভাবক বানাবে এবং তাঁরই সাথে লেগে থাকবে। এ অবস্থায় আল্লাহ তাকে সাহায্য ও দিক নির্দেশনা দান করেন এবং তাকে নিরাপদে এ পরীক্ষা পাস করার তাওফীক দান করেন যাতে সে তাঁর রহমতের মধ্যে প্রবেশ করতে পারে। কিন্তু যে জালেম আল্লাহর দিক থেকেই মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং তাঁর পরিবর্তে অন্যদেরকে নিজের অভিভাবক বানিয়ে নেয়, অযথা জোর করে তাঁর অভিভাবক হওয়ার এমন কোন প্রয়োজন আল্লাহর পড়েনি। সে অন্য যাদেরকে অভিভাবক বানায় তাদের আদৌ এমন কোন জ্ঞান, শক্তি বা ক্ষমতা-ইখতিয়ার নেই যার ভিত্তিতে অভিভাবকত্বের হক আদায় করে তাকে সফল করিয়ে দিতে পারে।
# অভিভাবকত্ব কোন মনগড়া বস্তু নয় যে, আপনি যাকে ইচ্ছা আপনার অভিভাবক বানিয়ে নিবেন আর বাস্তবেও সে আপনার অভিভাবক হয়ে যাবে এবং অভিভাবকত্বের হক আদায় করবে। এটা এমন এক বাস্তব জিনিস যা মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষা অনুসারে হয় না বা পরিবর্তিতও হয় না। আপনি মানেন আর না মানেন বাস্তবে যিনি অভিভাবক তিনিই আপনার অভিভাবক। আর বাস্তবে যে অভিভাবক নয় আপনি মৃত্যু পর্যন্ত তাকে মানলেও এবং অভিভাবক মনে করলেও সে অভিভাবক নয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, শুধু আল্লাহই অভিভাবক আর কেউ অভিভাবক নয় তার প্রমাণ কি? এর জবাব হচ্ছে, মানুষের প্রকৃত অভিভাবক হতে পারেন তিনি যিনি মৃত্যুকে জীবনে রূপ দেন, যিনি প্রাণহীন বস্তুর মধ্যে জীবন দান করে জীবন্ত মানুষ সৃষ্টি করেছেন এবং যিনি অভিভাবকত্বের দায়িত্ব পালন করার শক্তি ও ইখতিয়ারের অধিকারী। আল্লাহ ছাড়া আর কেউ যদি তেমন থাকে তাহলে তাকে অভিভাবক বানাও। আর যদি শুধু আল্লাহই তেমন হয়ে থাকেন তাহলে তাঁকে ছাড়া আর কাউকে অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করা অজ্ঞতা, নির্বুদ্ধিতা এবং আত্মহত্যা ছাড়া আর কিছুই নয়।
# এই গোটা অনুচ্ছেদটি যদিও আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহীর মাধ্যমে বলা হয়েছে, কিন্তু বক্তা এখানে আল্লাহ নন, আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। মহান আল্লাহ যেন তাঁর নবীকে নির্দেশ দিচ্ছেন, তুমি একথা ঘোষণা করো। কুরআন মজীদে এ ধরনের বিষয়বস্তু কোথাও قُلْ (হে নবী, তুমি বলো) শব্দ দ্বারা শুরু হয় এবং কোথাও তা ছাড়াই শুরু হয়। সে ক্ষেত্রে কথার ভঙ্গিই বলে দেয়, এখানে বক্তা আল্লাহ নন, আল্লাহর রসূল। কোন কোন স্থানে তো আল্লাহর বাণীর বক্তা থাকেন ঈমানদারগণ। এর উদাহরণ সূরা ফাতেহা, কিংবা ফেরেশতাগণ। যেমন সূরা মারয়ামের ৬৪ থেকে ৬৫ আয়াত।
# এটা আল্লাহর বিশ্ব-জাহানের অধিপতি এবং সত্যিকার অভিভাবক হওয়ার স্বাভাবিক ও যৌক্তিক দাবী। রাজত্ব ও অভিভাবকত্ব যখন তাঁরই তখন শাসকও অনিবার্যরূপে তিনিই এবং মানুষের পারস্পরিক ঝগড়া-বিবাদ ও মতানৈক্যের ফায়সালা করাও তাঁরই কাজ। যারা এ বিষয়টিকে আখেরাতের জন্য নির্দিষ্ট বলে মনে করে তারা ভুল করে। আল্লাহর এই সার্বভৌম মর্যাদা যে এই দুনিয়ার জন্য নয়, শুধু মৃত্যুর পরের জীবনের জন্য তার কোন প্রমাণ নেই। একইভাবে যারা তাঁকে শুধু এই দুনিয়ার আকীদা-বিশ্বাস এবং কতিপয় ধর্মীয় বিষয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ মনে করে তারাও ভুল করে। কুরআন মজীদের ভাষা ব্যাপক অর্থব্যঞ্জক। তাতে সব রকম বিবাদ ও মতানৈক্যের ক্ষেত্রে তা একমাত্র আল্লাহকেই ফায়সালা করার প্রকৃত অধিকারী বলে পরিষ্কার ও সুনিশ্চিতভাবে আখ্যায়িত করছে। সেই অনুসারে আল্লাহ যেমন আখিরাতের مَالِكِ يَوْمِ الدِّينِ (প্রতিদান দিবসের মালিক) তেমনি এই পৃথিবীরও أَحْكَمُ الْحَاكِمِينَ (সব শাসকের চাইতে বড় শাসক)। আকীদাগত মতানৈক্যের ক্ষেত্রে হক কোনটি আর বাতিল কোনটি সে বিষয়ের ফায়সালা যেমন তিনিই করবেন তেমনি আইনগত ক্ষেত্রেও তিনিই ফায়সালা করবেন মানুষের জন্য কোনটি পবিত্র আর কোনটি অপবিত্র, কোনটি বৈধ ও হালাল আর কোনটি হারাম ও মাকরুহ? নৈতিকতার ক্ষেত্রে অন্যায় ও অশোভন কি আর ন্যায় শোভনীয় কি? পারস্পরিক লেনদেনের ক্ষেত্রে কোনটি কার প্রাপ্য আর কোনটি প্রাপ্য নয়? জীবনাচার, সভ্যতা, রাজনীতি এবং অর্থনীতির ক্ষেত্রে কোন্ পন্থা ও পদ্ধতি বৈধ আর কোনটি ভুল ও অবৈধ তাঁর সবই তিনি স্থির করবেন। এর ওপর ভিত্তি করেই তো আইনের মূলনীতি হিসেবে কুরআন মজীদে একথা বিধিবদ্ধ করে দেয়া হয়েছে যে,
فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ (النساء-59)
(যদি কোন ব্যাপারে তোমরা বিবাদে জড়িয়ে পড়ো তাহলে সেটিকে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের কাছে ফিরিয়ে দাও) وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ وَلَا مُؤْمِنَةٍ إِذَا قَضَى اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَمْرًا أَنْ يَكُونَ لَهُمُ الْخِيَرَةُ مِنْ أَمْرِهِمْ- الاحزاب-36
(আল্লাহ ও তাঁর রসূল যখন কোন ব্যাপারে ফায়সালা করে দেন তখন মু’মিন পুরুষ ও মু’মিন নারীর জন্য সে ব্যাপারে কোন ইখতিয়ার থাকে না) এবং اتَّبِعُوا مَا أُنْزِلَ إِلَيْكُمْ مِنْ رَبِّكُمْ وَلَا تَتَّبِعُوا مِنْ دُونِهِ أَوْلِيَاءَ-اعراب-3
(তোমাদের রবের পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে যা নাযিল করা হয়েছে তার অনুসরণ করো এবং তাঁকে ছাড়া অন্য কাউকে অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করো না।)
তাছাড়া যে প্রসঙ্গে এ আয়াত এসেছে তার মধ্যেও এটি আরো একটি অর্থ প্রকাশ করছে। সেটি হচ্ছে আল্লাহ শুধু মতবিরোধসমূহের মীমাংসা করার আইনগত অধিকারীই নন, যা মানা আর না মানার ওপর ব্যক্তির কাফের বা মু’মিন হওয়া নির্ভরশীল। বরং প্রকৃতপক্ষে কার্যত তিনিই হক ও বাতিলের ফায়সালা করছেন, যে কারণে বাতিল ও তার পূজারীরা শেষ পর্যন্ত ধ্বংস হয় এবং হক ও তার অনুসারীরা সফলকাম হয়। পৃথিবীর মানুষ যে ফায়সালা কার্যকর হওয়ার ক্ষেত্রে বিলম্ব হচ্ছে বলে যতই মনে করুক না কেন তাতে কিছু আসে যায় না। পরবর্তী ২৪ আয়াতেও এ বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে এবং এর আগেও কুরআন মজীদের কতিপয় স্থানে আলোচিত হয়েছে। (দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, সূরা আর রা’দ, টীকা ৩৪-৬০ ; সূরা ইবরাহীম, টীকা ২৬-৩৪ ; সূরা বনী ইসরাঈল, টীকা ১০০ ; সূরা আম্বিয়া ১৫ , ১৮-৪৪ , ৪৬ )
# যিনি মতবিরোধসমূহের ফায়সালাকারী আসল শাসক।
# এ দু’টি ক্রিয়াপদ। এর একটি অতীতকাল সূচক শব্দ দ্বারা প্রকাশ করা হয়েছে এবং অপরটি বর্তমান ও ভবিষ্যতকাল সূচক শব্দ দ্বারা প্রকাশ করা হয়েছে, আমি তাঁর ওপরেই ভরসা করেছি। “অর্থাৎ একবার আমি চিরদিনের জন্য চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি যে, মৃত্যু পর্যন্ত আমাকে তাঁরই সাহায্য, তাঁরই দিক নির্দেশনা, তাঁরই আশ্রয় ও সংরক্ষণ এবং তাঁরই সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করতে হবে। অতঃপর বর্তমান ও ভবিষ্যত সূচক ক্রিয়াপদটিতে বলা হয়েছেঃ আমি তাঁর কাছেই ফিরে যাই।” অর্থাৎ আমার জীবনে যা-ই ঘটে সে ব্যাপারে আমি আল্লাহর কাছেই ফিরে যাই। কোন বিপদাপদ, দুঃখ-কষ্ট বা অসুবিধার সম্মুখীন হলে আর কারো মুখাপেক্ষী না হয়ে তাঁর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করি। কোন বিপদ আপতিত হলে তাঁর আশ্রয় তালাশ করি এবং তাঁর নিরাপত্তার ওপর নির্ভর করি। কোন সমস্যা দেখা দিলে তাঁর কাছে দিক নির্দেশনা চাই এবং তাঁরই শিক্ষা ও নির্দেশনামায় সে সমস্যার সমাধান ও সিদ্ধান্ত অনুসন্ধান করি। আর কোন বিবাদের মুখোমুখি হলে তাঁরই দিকে চেয়ে থাকি। কেননা, তিনিই তাঁর চূড়ান্ত ফায়সালা করবেন। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি এ বিষয়ে তিনি যে ফায়সালা করবেন সেটিই হবে সঠিক ও ন্যায়সঙ্গত।
# মূল আয়াতে ব্যবহৃত হয়েছে لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ “কোন জিনিসই তাঁর মত জিনিসের অনুরূপও নয়।” তাফসীরকার ও ভাষাবিদদের কেউ বলেনঃ এ বাক্যাংশে مثل শব্দটির কাফ বর্ণটি (সামঞ্জস্যের অর্থ প্রকাশক হরফ) সংযোজন বাগধারা হিসেবে করা হয়েছে। বক্তব্যকে জোরালো করাই এর উদ্দেশ্য হয়ে থাকে এবং আরবে এ ধরনের বর্ণনাভঙ্গি প্রচলিত। যেমনঃ কবি বলেনঃ وقتلى كمثل جذوع النخل অন্য আরেকজন কবি বলেছেনঃ ما ان كمسلهم فى الناس من احد অপর কিছু সংখ্যক লোকের মত হলোঃ “তাঁর মত কেউ নেই” বলার চেয়ে তাঁর মত জিনিসের অনুরূপও কেউ নেই বলার মধ্যে অতিশয়তার অর্থ আছে। অর্থাৎ আল্লাহর মত তো দূরের কথা। অসম্ভব হলেও যদি আল্লাহর সদৃশ কোন বস্তু আছে বলে ধরে নেয়া যায়, তাহলে সেই সদৃশের অনুরূপ কোন জিনিসও থাকতো না।
# একই সাথে গোটা বিশ্ব-জাহানের সবারই কথা শুনছেন এবং সব কিছুই দেখছেন।
# শুধু একমাত্র আল্লাহই কেন প্রকৃত অভিভাবক, তাঁর ওপর নির্ভর করাই যুক্তিযুক্ত ও সঠিক কেন এবং কেন শুধু তাঁর কাছে ফিরে যেতে হবে, এগুলোই তার যুক্তি। (ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, সূরা আন নামল, টীকা ৭৩-৮৩ ; সূরা আর রূম টীকা ২৫-৩১ )
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
নামকরণ :
الشوري শব্দের অর্থ হলো- পরামর্শ করা, উপদেশ দেয়া ইত্যাদি। এ সূরাতে পরামর্শ করে কাজ করা মু’মিনদের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সূরার ৩৮ নম্বর আয়াতে শূরা শব্দটি উল্লেখ আছে। সেখান থেকেই এ নামে সূরার নামকরণ করা হয়েছে।
১-৬ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
حٰمٓ (হা-মীম) এবং عٓسٓقٓ (আইন-সীন-ক্বফ) এ জাতীয় “হুরুফুল মুক্বাত্বআত” বা বিচ্ছিন্ন অক্ষর সম্পর্কে পূর্বে সূরা বাকারাতে আলোচনা করা হয়েছে। এগুলোর সঠিক উদ্দেশ্য ও অর্থ একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাই ভাল জানেন।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, এ পবিত্র কুরআন যেভাবে তোমার প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে সেভাবেই তোমার পূর্ববর্তী নাবীদের প্রতিও ওয়াহী করা হয়েছে। “ওয়াহী” হলো আল্লাহ তা‘আলার সেই বাণী, যা তিনি ফেরেশতার মাধ্যমে নাবী-রাসূলদের নিকট পাঠিয়েছেন। হাদীসে ওয়াহী অবতীর্ণ হওয়ার ধরণ সম্পর্কে বলা হয়েছে।
‘আয়িশাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত, হারিস ইবনু হিশাম রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে জিজ্ঞাসা করলেন : হে আল্লাহ তা‘আলার রাসূল! আপনার কাছে কিভাবে ওয়াহী আসে? রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার উত্তরে বলেন : কখনো আমার নিকট তা ঘন্টা ধ্বনির ন্যায় আসে, যা আমার কাছে খুব কঠিন ও ভারী মনে হয়। আর এ অবস্থা শেষ হয়ে গেলেই আমি তা মুখস্ত করে নেই। আবার কখনো ফেরেশতা আমার নিকট মানুষের আকৃতিতে আসে এবং আমার সাথে কথা বলেন : তিনি যা বলেন আমি তা মুখস্ত করে নেই। (সহীহ বুখারী হা. ৩২১৫, সহীহ মুসলিম হা. ১৬০, ১৬১)
এতে বুঝা যাচ্ছে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কোন নতুন নাবী নন, তাঁর পদ্ধতি ও পূর্ববর্তী নাবীদের পদ্ধতি একই, তিনি যা নিয়ে এসেছেন তা পূর্ববর্তী নাবীদের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
এরপর আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বড়ত্ব, শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্ত্বের কথা বর্ণনা করছেন।
تَكَادُ ক্রিয়াটি নিকটতম অবস্থা বুঝানো জন্য ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ আকাশসমূহ উপর থেকে ভেঙ্গে পড়ার সময় যেন খুব কাছে এসে গেছে। আকাশসমূহ ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হওয়ার কারণ কী তা নিয়ে আলেম সমাজের দু’টি মত রয়েছে :
(১) আল্লাহ তা‘আলার ভয় ও মহত্ত্বের কারণে তা ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম। এ কথার উপর প্রমাণ করে পূর্বের আয়াতের অংশ
(وَهُوَ الْعَلِيُّ الْعَظِيْمُ)
‘তিনি সর্বোচ্চ, মহান’।
(২) কাফিররা আল্লাহকে যে সব অপবাদ দিয়ে থাকে যেমন তারা বলে আল্লাহর সন্তান রয়েছে, স্ত্রী রয়েছে ইত্যাদি এসব কারণে আকাশসমূহ ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম। যেমন আল্লাহ বলেন :
(وَقَالُوا اتَّخَذَ الرَّحْمٰنُ وَلَدًا لَقَدْ جِئْتُمْ شَيْئًا إِدًّا تَكَادُ السَّمٰوٰتُ يَتَفَطَّرْنَ مِنْهُ وَتَنْشَقُّ الْأَرْضُ وَتَخِرُّ الْجِبَالُ هَدًّا)
“তারা বলে, ‘দয়াময় সন্তান গ্রহণ করেছেন।’ তোমরা এমন এক বীভৎস বিষয়ের অবতারণা করেছ যাতে আকাশসমূহ বিদীর্ণ হবে, পৃথিবী খণ্ড-বিখণ্ড হবে ও পর্বতগুলো চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে পতিত হবে” (সূরা মারইয়াম ১৯ : ৮৮-৯০)
এরপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন : ফেরেশতাগণ তাঁর প্রশংসা করে এবং পৃথিবীবাসীর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। এ সম্পর্কে সূরা আল মু’মিন-এর ৭ নম্বর আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে।
তারপর আল্লাহ তা‘আলা কাফির-মুশরিকদের হুশিয়ার করছেন : যারা أَوْلِيَا۬ءَ বা অন্য কিছুকে আল্লাহ তা‘আলার সাথে অংশী স্থাপন করে, অতঃপর আল্লাহ তা‘আলাকে বাদ দিয়ে তাদের ইবাদত করে ও তাদেরকে অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করে, তিনি তাদের সকল কাজ প্রত্যক্ষ করছেন, তদনুযায়ী তাদের প্রতিদান দেবেন।
সুতরাং হে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! তুমি তাদের কর্মবিধায়ক নও; বরং সকল কিছুর কর্ম-বিধায়ক হলাম আমি আল্লাহ তা‘আলা। তোমার দায়িত্ব শুধু সঠিকভাবে পৌঁছে দেয়া। যারা আমাকে বাদ দিয়ে অন্যদেরকে ওলী তথা তাদের অভিভাবক ও মা‘বূদ বানিয়ে নিয়েছে তাদের জন্য আমিই যথেষ্ট। মূলত একথার মধ্যে ধমক প্রকাশ পেয়েছে। আল্লাহ তা‘আলাকে বাদ দিয়ে যারা অন্যদেরকে মা‘বূদ বানিয়ে নেবে তাদের পরিণতি খুবই খারাপ।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. আল্লাহ তা‘আলার মহত্ত্বের কথা জানতে পারলাম।
২. আকাশ-জমিনে যা কিছু রয়েছে সকল কিছুর মালিক একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা।
৩. রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর দায়িত্ব ছিল শুধু সত্যের বাণী পৌঁছে দেয়া। অনুরূপ বর্তমান ‘আলিমদের দায়িত্ব হলো সঠিক বিধানসমূহ জনগণকে জানিয়ে দেয়া।
৪. ফেরেশতারাও আল্লাহর তাসবীহ পাঠ করেন এবং তারা জমিনবাসীর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন।
৭-৮ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
কুরআনুল কারীম অবতীর্ণ করা হয়েছে বা অবতীর্ণ করার একমাত্র উদ্দেশ্য এই যে, মানুষদেরকে জাহান্নামের শাস্তির ব্যাপারে সতর্ক করা এবং জান্নাতের আরাম-আয়েশের ব্যাপারে সুসংবাদ প্রদান করা। যাতে মানুষ শাস্তির ভয়ে এবং জান্নাত লাভের আকাক্সক্ষায় বেশি বেশি সৎ আমল করে এবং খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকে।
وَكَذٰلِكَ অর্থাৎ যেভাবে পূর্ববর্তী নাবীদের প্রতি ওয়াহী করেছি তেমনি তোমার প্রতি এ কুরআন আরবি ভাষায় ওয়াহীর মাধ্যমে নাযিল করেছি। প্রথম আয়াতে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে।
(أُمَّ الْقُرٰي) উম্মূল কুরা- দ্বারা এখানে পবিত্র মক্কা মুর্কারমাকে বুঝানো হয়েছে। আর মক্কাকে বিশেষ করে উল্লেখ করার কারণ সূরা আন‘আমের ৯২ নম্বর আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে।
আর মক্কাকে “উম্মুল কুরা” বলার কারণ হলো এটা সমস্ত শহর হতে শ্রেষ্ঠ। হাদীসে বলা হয়েছে-
‘আবদুল্লাহ ইবনু আদী হামরা ইবনুল যুহরী (রাঃ) হতে বর্ণিত, একদা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মক্কার এক বাজারে দাঁড়িয়েছিলেন। এমতাবস্থায় তিনি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলতে শুনেন : হে মক্কাভূমি! আল্লাহ তা‘আলার শপথ! তুমি আল্লাহ তা‘আলার কাছে সবচেয়ে উত্তম এবং সবচেয়ে প্রিয় ভূমি। আল্লাহ তা‘আলার শপথ! যদি তোমার থেকে আমাকে বের করে দেয়া না হত তাহলে আমি কখনো তোমাকে ছেড়ে যেতাম না। (মুসনাদ আহমাদ ৪/৩০৫, আত্ তিরমিযী হা. ৩৯২৫, হাসান সহীহ, গরীব)
حَوْلَهَا দ্বারা প্রাচ্যের ও পাশ্চাত্যের সমস্ত শহর ও জনপদকে বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ সমস্ত মানব জাতি। এ আয়াত এটাও প্রমাণ করছে, নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শুধু আরবদের নাবী নন; বরং সারা জাহানের নাবী।
(يَوْمَ الْجَمْعِ)
দ্বারা কিয়ামত দিবস বুঝানো হয়েছে। এ দিনের ব্যাপারে কোনই সন্দেহ সংশয় নেই। আল্লাহ তা‘আলার বাণী :
(يَوْمَ يَجْمَعُكُمْ لِيَوْمِ الْجَمْعِ ذٰلِكَ يَوْمُ التَّغَابُنِ)
“(স্মরণ কর!) যেদিন তিনি তোমাদেরকে সমবেত করবেন মহা সমাবেশ দিবসে সেদিন হবে লাভ লোকসানের দিন।” (সূরা তাগাবুন ৬৪ : ৯)
(فَرِيْقٌ فِي الْجَنَّةِ وَفَرِيْقٌ فِي السَّعِيْر)
‘(সেদিন) একদল জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং একদল জাহান্নামে প্রবেশ করবে’ অর্থাৎ কিয়ামতের দিন বিচার ফায়সালা করার পর একদল হবে জান্নাতী আর একদল হবে জাহান্নামী। যারা দুনিয়াতে ভাল কাজ করবে তারা হবে জান্নাতী আর যারা খারাপ কাজ করবে তারা হবে জাহান্নামী। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
( يَوْمَ يَأْتِ لَا تَكَلَّمُ نَفْسٌ إِلَّا بِإِذْنِه۪ج فَمِنْهُمْ شَقِيٌّ وَّسَعِيْدٌ فَأَمَّا الَّذِيْنَ شَقُوْا فَفِي النَّارِ لَهُمْ فِيْهَا زَفِيْرٌ وَّشَهِيْقٌ)
“যখন সেদিন আসবে তখন আল্লাহর অনুমতি ব্যতীত কেউ কথা বলতে পারবে না; তাদের মধ্যে কেউ হবে হতভাগ্য ও কেউ ভাগ্যবান। অতঃপর যারা হতভাগ্য তারা থাকবে অগ্নিতে এবং সেথায় তাদের জন্য থাকবে চীৎকার ও আর্তনাদ। (সূরা হূদ ১১ : ১০৫-১০৬)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন :
(هُوَ الَّذِيْ خَلَقَكُمْ فَمِنْكُمْ كٰفِرٌ وَّمِنْكُمْ مُّؤْمِنٌ ط وَاللّٰهُ بِمَا تَعْمَلُوْنَ بَصِيْرٌ)
“তিনিই তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর তোমাদের মধ্যে কেউ হয় কাফির এবং কেউ হয় মু’মিন। তোমরা যা কর আল্লাহ তার সম্যক দ্রষ্টা। (সূরা তাগাবুন ৬৪ : ২)
হাদীসে বলা হয়েছে, আবূ নাযরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আবূ আব্দুল্লাহ (রাঃ) নামক একজন সাহাবী রুগ্ন ছিলেন। সাহাবীগণ তাকে দেখতে যান। তারা দেখেন যে, তিনি ফুপিয়ে কাঁদছেন। তারা তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কাঁদছেন কেন? অথচ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আপনাকে শুনিয়েছেন : গোঁফ ছোট করে রাখবে যে পর্যন্ত না তুমি আমার সাথে মিলিত হবে। ঐ সাহাবী উত্তরে বললেন : এটা ঠিকই বটে। কিন্তু আমাকেতো ঐ হাদীসটি কাঁদাচ্ছে যে, আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলতে শুনেছি, আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় ডান মুষ্টির মধ্যে কিছু মাখলূক রাখেন অনুরূপভাবে অপর মুষ্টির মধ্যেও কিছু মাখলূক রাখেন, অতঃপর বলেন : এ লোকগুলো জান্নাতের জন্য এবং এ লোকগুলো জাহান্নামের জন্য, আর এতে আমি কোন পরোয়া করি না। সুতরাং আমার জানা নেই যে, আমি তাঁর কোন মুষ্টির মধ্যে আছি। (আহমাদ ৪/১৭৬) এটি তাকদীর প্রমাণকারী একটি হাদীস। তাকদীর প্রমাণ করার আরো বহু হাদীস আলী, ইবনু মাসঊদ ও আয়িশাহ (রাঃ) প্রমুখ সাহাবী থেকে সহীহ, সুনান এবং মুসনাদ গ্রন্থে বর্ণিত আছে।
এরপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন : যদি আমি ইচ্ছা করতাম তাহলে সকল উম্মাতকে একই উম্মাতে পরিণত করতে পারতাম। অর্থাৎ সকলেই হিদায়াত লাভ করত, ফলে সকলেই জান্নাতে প্রবেশ করত। কিন্তু এটা তিনি করেননি এজন্য যে, যাতে তিনি সকলকে পরীক্ষা করতে পারেন। এ সম্পর্কে পূর্বে আলোচনা করা হয়েছে।
সুতরাং আমল বর্জন করে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকার কোন সুযোগ নেই। বরং তাকদীরের ওপর বিশ্বাস রেখে সৎ আমলের প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. কুরআন পাপাচারীদের জন্য সতর্ককারী ও মু’মিনদের জন্য সুসংবাদবাহী একটি গ্রন্থ।
২. মানুষের মধ্যে একদল জান্নাতী এবং একদল জাহান্নামী হবে।
৩. মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে মূলত পরীক্ষা করার জন্য- কে ভাল কাজ করে আর কে মন্দ কাজ করে।
৯-১২ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
আল্লাহ সকল কিছুর স্রষ্টা, তিনি সকলের অভিভাবক, তিনিই মৃতকে জীবিত করেন। তিনি ব্যতীত আর দ্বিতীয় কেউ এ কাজ করতে সক্ষম নয়। অর্থাৎ রুবুবিয়্যাহর মালিক একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা এসব জানার পরেও যারা আল্লাহ তা‘আলাকে বাদ দিয়ে অন্যকে অভিভাবকরূপে গ্রহণ করবে, অন্যের ইবাদত করবে, অন্যের কাছে সাহায্য চাইবে তারা মূলত মুশরিক, আর তারাই হলো জাহান্নামী। কারণ তাওহীদুর রুবুবিয়্যাহ স্বীকার করলেই কোন ব্যক্তি মুসলিম হতে পারবে না যতক্ষণ না তাওহীদুল উলূহিয়্যাহ বা সকল ইবাতদ একমাত্র আল্লাহর জন্য সম্পাদন করে। মক্কার মুশরিকরাও তাওহীদুর রুবুরিয়্যাহ স্বীকার করত কিন্তু কোন কিছুর প্রয়োজন হলে সরাসরি আল্লাহ তা‘আলার কাছে চাইতো না বরং প্রতিমা ও মূর্তির মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার কাছে চাইতো। এ সম্পর্কে একাধিক স্থানে আলোচনা করা হয়েছে।
এরপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন : যদি তোমরা কোন বিষয় নিয়ে মতভেদ করো, তাহলে তার মীমাংসার জন্য আল্লাহ তা‘আলার নিকট ফিরিয়ে দাও। তোমরা এ বিষয়ে বাড়াবাড়ি বা ঝগড়া-বিবাদ না করে বরং আল্লাহ তা‘আলার কিতাব এবং তাঁর রাসূল-এর হাদীস থেকে সমাধান নাও। তোমরা সেখানেই তোমাদের বিষয়ের মীমাংসা খুঁজে পাবে। আল্লাহ বলেন।
(فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِيْ شَيْءٍ فَرُدُّوْهُ إِلَي اللّٰهِ وَالرَّسُوْلِ إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُوْنَ بِاللّٰهِ وَالْيَوْمِ الْاٰخِرِ ط ذٰلِكَ خَيْرٌ وَّأَحْسَنُ تَأْوِيْلًا)
“তবে কোন বিষয়ে তোমাদের মধ্যে মতভেদ তৈরি হলে তা ফিরিয়ে দাও আল্লাহ ও রাসূলের দিকে। এটাই উত্তম এবং পরিণামে উৎকৃষ্টতর।” (সূরা নিসা ৪ : ৫৯)
সুতরাং হে মুশরিকরা! তোমরা আল্লাহ তা‘আলার সাথে শির্ক করছ, আর নিজেদেরকে সঠিক ধর্মের অনুসারী বলে দাবি করছ, এর ফায়সালা আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূল থেকে নিয়ে নাও। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(لَقَدْ کَفَرَ الَّذِیْنَ قَالُوْٓا اِنَّ اللہَ ھُوَ الْمَسِیْحُ ابْنُ مَرْیَمَﺚ وَقَالَ الْمَسِیْحُ یٰبَنِیْٓ اِسْرَا۬ءِیْلَ اعْبُدُوا اللہَ رَبِّیْ وَرَبَّکُمْﺚ اِنَّھ۫ مَنْ یُّشْرِکْ بِاللہِ فَقَدْ حَرَّمَ اللہُ عَلَیْھِ الْجَنَّةَ وَمَاْوٰٿھُ النَّارُﺚ وَمَا لِلظّٰلِمِیْنَ مِنْ اَنْصَارٍ)
“যারা বলে, ‘আল্লাহই মারিয়ামের ছেলে মসীহ’, তারা কুফরী করেছে। অথচ মসীহ বলেছিল, ‘হে বানী ইসরাঈল! তোমরা আমার প্রতিপালক ও তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহর ‘ইবাদত কর।’ কেউ আল্লাহর সাথে শরীক করলে আল্লাহ তার জন্য জান্নাত অবশ্যই হারাম করবেন এবং তার আবাস হবে জাহান্নাম। জালিমদের জন্য কোন সাহায্যকারী নেই।” (সূরা মায়িদা ৫ : ৭২)
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, আল্লাহ বলেছেন :
أَنَا أَغْنَي الشُّرَكَاءِ عَنِ الشِّرْكِ، مَنْ عَمِلَ عَمَلًا أَشْرَكَ فِيهِ مَعِي غَيْرِي، تَرَكْتُهُ وَشِرْكَهُ
অংশী স্থাপনকারীদের অংশ থেকে আমি অমুখাপেক্ষী। যে ব্যক্তি আমার সাথে অন্যকে অংশী স্থাপন করে কোন আমল করল, আমি তাকে ও তার অংশী উভয়কে ছুঁড়ে মারব। (সহীহ মুসলিম হা. ২৯৮৫)
রাসূলুল্লাহ বলেছেন :
مَنْ لَقِيَ اللّٰهَ لَا يُشْرِكُ بِهِ شَيْئًا دَخَلَ الْجَنَّةَ، وَمَنْ لَقِيَهُ يُشْرِكُ بِهِ دَخَلَ النَّارَ
যে ব্যক্তি শির্ক মুক্ত অবস্থায় আল্লাহ তা‘আলার সাথে সাক্ষাত করবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর যে আল্লাহ তা‘আলার সাথে শির্ক করা অবস্থায় সাক্ষাত করবে সে জাহান্নামে যাবে। (সহীহ মুসলিম হা. ৯৩)
সুতরাং সকল বিষয়ের সমাধান নিতে হবে কুরআন ও সুন্নাহ থেকে। কোন ব্যক্তির নিজস্ব চিন্তা ও মতামত থেকে নয়। আল্লাহ আমাদেরকে কুরআন ও সুন্নাহর দিকে ফিরে আসার তাওফীক দান করুন।
এরপর আল্লাহ বলেন : তিনিই আকাশ ও জমিনের একমাত্র সৃষ্টিকর্তা। তিনি ব্যতীত আর কোনই সৃষ্টিকর্তা নেই যারা কোন কিছু সৃষ্টি করতে পারে। সুতরাং তোমরা আল্লাহ তা‘আলার অনুগ্রহের প্রতি লক্ষ্য করো যে, তিনি তোমাদের মধ্য হতে তোমাদের জোড়া সৃষ্টি করেছেন এবং গরু, ছাগল, ভেড়া, উট ইত্যাদিও তিনি মানুষের মতো নারী-পুরুষ করে জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছেন। এভাবেই মহান আল্লাহ তা‘আলা বংশ বিস্তার করেন। আর এভাবেই মহান আল্লাহর সৃষ্টি কাজ চলমান।
(لَيْسَ كَمِثْلِه۪ شَيْءٌ)
‘কোন কিছুই তাঁর সদৃশ নয়’ আল্লাহ তা‘আলা এমন এক সত্ত্বা ও গুণাবলীর অধিকারী যাঁর সত্ত্বা, নাম, গুণ ও কর্মের সাথে কারো কোন সাদৃশ্য ও উপমা হয়না। সত্ত্বা ও গুণসহ সকল দিক থেকে তাঁর কোন সাদৃশ্য ও উপমা নেই। তিনি সকল জল্পনা-কল্পনার উপরে। তিনি সবকিছু থেকে বেপরোয়া, অভাবমুক্ত। তিনি কারো মুখাপেক্ষী নন বরং সকলেই তাঁর মুখাপেক্ষী। তিনি সকলকে তাদের চাহিদা অনুপাতে দান করে থাকেন। কারো নিকট থেকে তাঁকে কোন কিছুই গ্রহণ করতে হয় না। তিনি অতুলনীয়। যারা আল্লাহ তা‘আলাকে মাখলূকের সাথে সাদৃশ্য দিয়ে বলে : আল্লাহ আমাদের মত শুনেন, আমাদের মত দেখেন ইত্যাদি- আয়াতের এ অংশ তাদের এমন কথার প্রতিবাদ করছে। সুতরাং কুরআন ও সহীহ হাদীসে প্রমাণিত সকল গুণাবলী আল্লাহ তা‘আলার জন্য রয়েছে তা বিশ্বাস করতে হবে, মুতাজিলা ও জাহমিয়াদের মত অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই। কিন্তু তা কোন মাখলূকের সাথে সাদৃশ্য রাখে না, বরং আল্লাহ তা‘আলার সত্ত্বার শানে যেমন শোভা পায় তেমন। আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদের সে সম্পর্কে কোন সংবাদ দেননি ঐ বিষয় পর্যন্তই সেই বিশ্বাস সীমাবদ্ধ রাখব।
(وَهُوَ السَّمِيْعُ الْبَصِيْرُ)
অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা সকল সাদৃশ্য ও উপমার ঊর্ধ্বে থাকা সত্ত্বেও তিনি সবকিছু শুনেন এবং দেখেন।
যারা আল্লাহর গুণাবলী অস্বীকার করে আয়াতের এ অংশ তাদের কথার প্রতিবাদ করছে। সুতরাং আল্লাহর এ দু’টি গুণের মতই অন্যান্য গুণ যেমন আল্লাহর হাত রয়েছে (৪৮ : ১০১), আল্লাহর চেহারা রয়েছে (৫৫ : ২৭), পেন্ডলী রয়েছে (৬৮ : ৪২) ইত্যাদি কুরআন ও হাদীসে যেভাবে উল্লেখ রয়েছে সেভাবেই বিশ্বাস করব। বিশ্বাস করতে গিয়ে বাড়াবাড়িও করব না এবং অস্বীকারও করবনা।
এরপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন, আকাশ ও জমিনের রাজত্ব ও রিযিকের চাবি তাঁরই নিকট। তিনি যাকে খুশি রিযিক বৃদ্ধি করে দেন, আবার যার প্রতি ইচ্ছা তার রিযিককে সঙ্কুচিত করে দেন। তিনি তার ইচ্ছা অনুপাতে দান করে থাকেন। তিনি কারো আশা পূরণ করেন আবার কাউকে নিরাশ করেন। তিনি কাউকে রাজত্ব দান করেন, কারো থেকে রাজত্ব ছিনিয়ে নেন। এ সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(مَا یَفْتَحِ اللہُ لِلنَّاسِ مِنْ رَّحْمَةٍ فَلَا مُمْسِکَ لَھَاﺆ وَمَا یُمْسِکْﺫ فَلَا مُرْسِلَ لَھ۫ مِنْۭ بَعْدِھ۪ﺚ وَھُوَ الْعَزِیْزُ الْحَکِیْمُ)
“আল্লাহ মানুষের জন্য যে রহমত উন্মুক্ত করে দেন তা কেউ প্রতিরোধ করতে পারে না; আর যা তিনি বন্ধ করে দেন তা বন্ধ করার পরে কেউ উন্মুক্ত করতে পারে না। তিনি প্র্রতাপশালী ও মহাপ্রজ্ঞাময়।” (সূরা ফাতির ৩৫ : ২)
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. মু’মিনদের অভিভাবক একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা, তাঁর রাসূল ও মু’মিনগণ। সুতরাং তাদেরকেই অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করা উচিত।
২. কুরআন ও সহীহ হাদীসের আলোকে সকল সমস্যার সমাধান করতে হবে।
৩. আকাশ-জমিনের সকল কল্যাণ-অকল্যাণের চাবি একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার হাতে।
৪. সৃষ্টিকর্তা একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা রিযিকদাতাও তিনিই, সুতরাং ‘ইবাদত পাবার যোগ্যও একমাত্র তিনি, অন্য কেউ নয়।
৫. আল্লাহ তা‘আলার মত কিছুই নেই, তাঁর গুণাবলীর শেষ নেই।
৬. আল্লাহ তা‘আলার গুণাবলী কুরআন ও সহীহ হাদীসে যেভাবে বর্ণিত হয়েছে সেভাবেই বিশ্বাস করব, কোন প্রকার অপব্যাখ্যা করব না এবং অস্বীকারও করব না।
তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
১-৬ নং আয়াতের তাফসীর:
হুরূফে মুকাত্তাআ’ত বা বিচ্ছিন্ন অক্ষরগুলোর আলোচনা পূর্বে গত হয়েছে। ইমাম ইবনে জারীর এখানে একটি বিস্ময়কর, অদ্ভুত ও অস্বীকার্য আসার আনয়ন করেছেন। তাতে রয়েছে যে, একটি লোক হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর নিকট আগমন করে। ঐ সময় তাঁর নিকট হযরত হুযাইফা ইবনে ইয়ামানও (রাঃ) ছিলেন। ঐ আগন্তুক হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)-কে এই অক্ষরগুলোর তাফসীর জিজ্ঞেস করলো। তিনি তখন কিছুক্ষণ মাথা নীচু করে রইলেন। লোকটি দ্বিতীয়বার ঐ প্রশ্নই করলো। তিনি এবারও মুখ ফিরিয়ে নিলেন এবং তার প্রশ্নকে মন্দ মনে করলেন। লোকটি তৃতীয়বার ঐ একই প্রশ্ন করলো। তিনি এবারও কোন উত্তর দিলেন না। তখন হযরত হুযাইফা (রাঃ) লোকটিকে বললেনঃ “আমি তোমাকে এর তাফসীর বলে দিচ্ছি এবং হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) এটাকে কেন অপছন্দ করছেন সেটাও আমার জানা আছে। তাঁর আহলে বায়েতের একটি লোকের ব্যাপারে এটা অবতীর্ণ হয়েছে, যাকে আবদুল ইলাহ এবং আবদুল্লাহ বলা হবে। সে প্রাচ্যের নদীসমূহের একটি নদীর পার্শ্বে অবতরণ করবে এবং তথায় দু’টি শহর বসাবে। নদী কেটে ঐ দু’টি শহরের মধ্যে নিয়ে যাবে। অতঃপর যখন আল্লাহ তা’আলা তাদের দেশের পতন ঘটাবার এবং তাদের ধন-দৌলত ধ্বংস করে দেয়ার ইচ্ছা করবেন তখন ঐ শহর দুটির একটির উপর রাত্রিকালে আগুন আসবে এবং ঐ শহরকে জ্বালিয়ে ভষ্ম করে দিবে। তথাকার লোক সকালে ঐ অবস্থা দেখে অত্যন্ত বিস্ময়বোধ করবে। মনে হবে যেন সেখানে কিছুই ছিল না। অতঃপর সকাল সকালই তথাকার সমস্ত বড় বড় উদ্ধত, অহংকারী এবং সত্য বিরোধী লোক তথায় একত্রিত হবে। তৎক্ষণাৎ আল্লাহ তাআলা তাদের সবকেই ঐ শহর সহ ধ্বংস করে দিবেন। (আরবী)-এর অর্থ এটাই। অর্থাৎ আল্লাহ তা’আলার পক্ষ হতে এটা সিদ্ধান্ত ও ফায়সালা হয়ে গেছে। (আরবী) দ্বারা আদল বা ন্যায়পরায়ণতা বুঝানো হয়েছে। (আরবী) দ্বারা বুঝানো হয়েছে (আরবী) অর্থাৎ সত্বরই হবে এবং (আরবী) দ্বারা অর্থ নেয়া হয়েছে, ঐ দুই শহরে যা সংঘটিত হবে।”
এর চেয়ে বেশী বিস্ময়কর আর একটি রিওয়াইয়াত রয়েছে যা হাফিয আবু ইয়ালা মুসিলী (রঃ) মুসনাদে হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর দ্বিতীয় জিলদ হতে বর্ণনা করেছেন। এটা হযরত আবূ যার (রাঃ) নবী (সঃ) হতে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু এর ইসনাদ খুবই দুর্বল এবং ছেদ কাটা। এতে রয়েছে যে, হযরত উমার ইবনে খাত্তাব (রাঃ) মিম্বরের উপর উঠে বলেনঃ “হে জনমণ্ডলী!
তোমাদের মধ্যে কেউ কি (আরবী)-এর তাফসীর রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) হতে শুনেছে?” তখন হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) লাফিয়ে উঠে বলেন, হ্যা, আমি (শুনেছি)। তিনি (রাসূলুল্লাহ সঃ) বলেছেনঃ (আরবী) হলো আল্লাহ তা’আলার নামসমূহের মধ্যে একটি নাম। (আরবী) দ্বারা অর্থ নেয়া হয়েছেঃ (আরবী) (অর্থাৎ বদরের দিন পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে পলায়নকারীরা শাস্তি আস্বাদন করেছে)। (আরবী) দ্বারা উদ্দেশ্য হলোঃ (আরবী) অর্থাৎ যালিমরা তাদের পরিণাম কি তা সত্বরই জানতে পারবে।”(২৬:২২৭) হযরত উমার (রাঃ) হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)-কে (আরবী)-এর অর্থ জিজ্ঞেস করলে তিনি নীরব থাকেন। তখন হযরত আবু যার (রাঃ) দাড়িয়ে যান এবং হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর মতই তাফসীর করেন এবং বলেন যে, (আরবী)-এর অর্থ হলো (আরবী) অর্থাৎ (লোকদের উপর) আসমানী আযাব আসবে।
এরপর মহান আল্লাহ বলেন, হে নবী (সঃ) ! তোমার উপর যেমন এই কুরআনের অহী অবতীর্ণ হচ্ছে, অনুরূপভাবে তোমার পূর্ববর্তী নবী-রাসূলদের প্রতিও কিতাব ও সহীফাসমূহ অবতীর্ণ হয়েছিল। এগুলো সবই অবতীর্ণ হয়েছিল আল্লাহ তাআলার নিকট হতে যিনি স্বীয় প্রতিশোধ গ্রহণের ব্যাপারে পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।
হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, হযরত হারিস ইবনে হিশাম (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে জিজ্ঞেস করেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আপনার নিকট অহী কিভাবে আসে?” তিনি উত্তরে বলেনঃ “কখনো ঘন্টার অবিরত শব্দের ন্যায়, যা আমার কাছে খুব কঠিন ও ভারী বোধ হয়। যখন ওটা শেষ হয়ে যায়। তখন আমাকে যা কিছু বলা হয় সবই আমার মুখস্থ হয়ে যায়। আর কখনো। ফেরেশতা মানুষের আকৃতিতে আমার নিকট আগমন করেন। আমার সাথে তিনি কথা বলেন এবং যা কিছু তিনি বলেন সবই আমি মনে করে নিই। হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন যে, কঠিন শীতের সময় যখন তাঁর প্রতি অহী অবতীর্ণ হতো তখন তিনি অত্যন্ত ঘেমে যেতেন, এমনকি তাঁর কপাল মুবারক হতে টপ টপ করে ঘাম ঝরে পড়তো। (এ হাদীসটি সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে)
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে অহীর অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি উত্তরে বলেনঃ “জিঞ্জিরের ঝন্ ঝন্ শব্দের মত একটা শব্দ শুনতে পাই। অতঃপর আমি ওর প্রতি কান। লাগিয়ে দিই। এরূপ অহী আমার কাছে খুবই কঠিন বোধ হয়। মনে হয় যেন আমার প্রাণবায়ু নির্গত হয়ে যাবে। (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) স্বীয় মুসনাদে বর্ণনা করেছেন) শরহে বুখারীর শুরুতে আমরা অহীর অবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। সুতরাং সমুদয় প্রশংসা আল্লাহরই প্রাপ্য।
মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ যমীন ও আসমানের সমুদয় সৃষ্টজীব তাঁরই দাস এবং তাঁরই কর্তৃত্বাধীন। তার সামনে সবাই বিনীত ও বাধ্য। তিনি সমুন্নত, মহান। তার শ্রেষ্ঠত্ব, বড়ত্ব ও মাহাত্ম্যের অবস্থা এই যে, আকাশমণ্ডলী ঊর্ধ্বদেশ হতে ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয় এবং ফেরেশতারা তাঁদের প্রতিপালকের সপ্রশংস পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করেন এবং মর্তবাসীদের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। যেমন মহামহিমান্বিত আল্লাহ আর এক জায়গায় বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “আরশ বহনকারী ফেরেশতামণ্ডলী এবং ওর চতুষ্পর্শ্বের ফেরেশতারা তাদের প্রতিপালকের সপ্রশংস পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে এবং যারা তার প্রতি ঈমান রাখে তাদের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকে (এবং বলে), হে আমাদের প্রতিপালক! আপনি আপনার রহমত ও জ্ঞান দ্বারা প্রত্যেক জিনিসকে ঘিরে রেখেছেন। সুতরাং যারা তাওবা করেছে এবং আপনার পথের অনুসারী হয়েছে তাদেরকে ক্ষমা করে দিন এবং তাদেরকে জাহান্নামের শাস্তি হতে রক্ষা করুন।”(৪০:৭)
অতঃপর মহান আল্লাহ বলেনঃ যারা আল্লাহর পরিবর্তে অপরকে অভিভাবকরূপে গ্রহণ করে, আল্লাহ তাদের প্রতি কঠোর দৃষ্টি রাখেন। তিনি স্বয়ং তাদেরকে পুরোপুরি শাস্তি প্রদান করবেন। তোমার (নবীর সঃ) কাজ শুধু তাদেরকে সতর্ক করে দেয়া। তুমি তাদের কর্মবিধায়ক নও, বরং সবকিছুর কর্মবিধায়ক হলেন আল্লাহ।
৭-৮ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ হে নবী (সঃ)! তোমার পূর্ববর্তী নবীদের উপর যেমন আল্লাহর অহী আসতো, অনুরূপভার তোমার উপরও এই কুরআন অহীর মাধ্যমে। অবতীর্ণ করা হয়েছে। এর ভাষা আরবী এবং এর বর্ণনা খুবই স্পষ্ট ও খোলাখুলি। যাতে তুমি মক্কাবাসী এবং ওর চতুর্দিকের জনগণকে সতর্ক করতে। পার। অর্থাৎ তাদেরকে ভয় প্রদর্শন করতে পার আল্লাহর আযাব হতে। দ্বারা প্রাচ্যের ও পাশ্চাত্যের সমস্ত শহরকে ও জনপদকে বুঝানো হয়েছে। মক্কা শরীফকে ‘উম্মুল কুরা’ বলার কারণ এই যে, এটা সমস্ত শহর হতে ভাল ও উত্তম। এর বহু দলীল প্রমাণ রয়েছে যেগুলো নিজ নিজ জায়গায় বর্ণিত হবে। এখানে একটি দলীল বর্ণনা করা হচ্ছে যা সংক্ষিপ্ত এবং স্পষ্টও বটে।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আদী হামরা যুহরী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একদা রাসূলুল্লাহ (সঃ) মক্কার হাশূরাহ নামক বাজারে দাঁড়িয়েছিলেন এমতাবস্থায় তিনি তাঁকে বলতে শুনেনঃ “হে মক্কাভূমি! আল্লাহর কসম! তুমি আল্লাহর সবচেয়ে উত্তম ভূমি এবং আল্লাহর নিকট সবচেয়ে প্রিয় ভূমি। আল্লাহর কসম! যদি তোমার উপর হতে আমাকে বের করে দেয়া না হতো তবে আমি কখনো তোমাকে ছেড়ে যেতাম না।” (এ হাদীসটি ইমাম তিরমিযী (রঃ), ইমাম নাসাঈ (রঃ) এবং ইমাম ইবনে মাজাহ (রঃ) বর্ণনা করেছেন। ইমাম তিরমিযী (রঃ) এটাকে হাসান সহীহ বলেছেন)
মহান আল্লাহ বলেনঃ আর এই কুরআন আমি তোমার প্রতি এজন্যে অবতীর্ণ করেছি যে, যেন তুমি মানুষকে সতর্ক করতে পার কিয়ামত দিবস সম্পর্কে যাতে কোন সন্দেহ নেই। যেদিন কিছু লোক জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং কিছু লোক জাহান্নামে যাবে। এটা এমন দিন হবে যে, জান্নাতীরা লাভবান হবে এবং জাহান্নামীরা হবে ক্ষতিগ্রস্ত। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “স্মরণ কর, যেদিন তিনি তোমাদেরকে সমবেত করবেন সমাবেশ দিবসে সেদিন হবে লাভ লোকসানের দিন।”(৬৪:৯) অন্য এক জায়গায় বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “এতে নিশ্চয়ই ঐ ব্যক্তির জন্যে নিদর্শন রয়েছে যে আখিরাতের আযাবকে ভয় করে। ওটা হলো ঐ দিন যেই দিন সমস্ত মানুষকে একত্রিত করা হবে এবং (সবারই) উপস্থিতির দিন। আমি এটাকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে বিলম্বিত করছি। ঐদিন কেউই আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কথা বলতে পারবে না। তাদের মধ্যে কেউ হবে হতভাগ্য এবং কেউ হবে ভাগ্যবান।”(১১:১০৩-১০৫)।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ একদা রাসূলুল্লাহ (সঃ) আমাদের নিকট আগমন করেন। ঐ সময় তার হাতে দু’টি কিতাব ছিল। তিনি আমাদেরকে জিজ্ঞেস করেনঃ “এ কিতাব দু’টি কি তা তোমরা জান কি?” আমরা উত্তরে বললামঃ আমাদের এটা জানা নেই। হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমাদেরকে এর খবর দিন। তখন তিনি তার ডান হাতের কিতাবটির দিকে ইঙ্গিত করে বলেনঃ “এটা রাব্বল আলামীন আল্লাহ তাআলার কিতাব। এতে জান্নাতীদের এবং তাদের পিতাদের ও গোত্রসমূহের নাম রয়েছে। শেষে হিসেব করে সর্বমোট করে দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে আর কম বেশী হতে পারে না।” অতঃপর তিনি তার বাম হাতের কিতাবটির দিকে ইঙ্গিত করে বলেনঃ “এটা হলো জাহান্নামীদের নামের তালিকা বহি। এতেও তাদের নাম, তাদের পিতাদের নাম এবং তাদের গোত্রসমূহের নাম রয়েছে। শেষে হিসেব করে সর্বমোট করে দেয়া হয়েছে। সুতরাং এর মধ্যে আর কম বেশী হবে না।” তখন তার সাহাবীগণ বললেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! তাহলে আমাদের আমলের আর প্রয়োজন কি?” রাসূলুল্লাহ (সঃ) জবাবে বললেনঃ “ঠিকভাবে থাকো। মঙ্গল ও কল্যাণের কাছে কাছে থাকো। জান্নাতীদের পরিসমাপ্তি ভাল কাজের উপরই হবে, তারা যে কাজই করতে থাকুক না কেন। আর জাহান্নামীদের পরিসমাপ্তি মন্দ আমলের উপরই হবে, তারা যে কাজই করতে থাকুক না কেন।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) স্বীয় হস্তদ্বয় মুষ্টিবদ্ধ করলেন এবং বললেনঃ “মহামহিমান্বিত আল্লাহ স্বীয় বান্দাদের ফায়সালা শেষ করে ফেলেছেন। একদল যাবে জান্নাতে এবং একদল যাবে জাহান্নামে।” এর সাথে সাথেই রাসূলুল্লাহ (সঃ) স্বীয় ডান ও বাম হাত দ্বারা ইশারা করেন যেন তিনি কোন জিনিস নিক্ষেপ করছেন। (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ), ইমাম তিরমিযী (রঃ) এবং ইমাম নাসাঈ (রঃ) বর্ণনা।
করেছেন এবং ইমাম তিরমিযী (রঃ) এটাকে হাসান গারীব বলেছেন)
ইমাম বাগাভীর (রঃ) তাফসীরে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) হতে অনুরূপ বর্ণনা রয়েছে এবং তাতে কিছু বেশী আছে। তাতে আছে যে, একদল যাবে জান্নাতে এবং একদল যাবে জাহান্নামে। আর মহামহিমান্বিত আল্লাহর পক্ষ হতে আদল আর আদল বা ন্যায় আর ন্যায়ই থাকবে।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) বলেন যে, আল্লাহ তা’আলা যখন হযরত আদম (আঃ)-কে সৃষ্টি করেন এবং তার মধ্য হতে তাঁর সন্তানদেরকে বের করেন, আর তারা পিপড়ার মত হয়ে ময়দানে ছড়িয়ে পড়ে। তখন তাদেরকে তিনি স্বীয় দুই মুষ্টির মধ্যে নিয়ে নেন এবং বলেনঃ “এগুলোর একটি অংশ পুণ্যবান এবং অপর অংশ পাপী।” আবার তাদেরকে ছড়িয়ে দেন এবং পুনরায় একত্রিত করেন এবং আবার তিনি তাদেরকে মুষ্টির মধ্যে করে নেন। একটি অংশ জান্নাতী ও আর একটি অংশ জাহান্নামী। (এ রিওয়াইয়াতটি মাওকুফ হওয়াই সঠিক কথা। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সবচেয়ে ভাল জানেন)
হযরত আবু নাযরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, আবু আবদিল্লাহ (রাঃ) নামক রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর একজন সাহাবী রুগ্ন ছিলেন। সাহাবীগণ (রাঃ) তাঁকে দেখতে যান। তারা দেখেন যে, তিনি ক্রন্দন করছেন। তাঁরা তাঁকে বলেন, আপনি কাঁদছেন কেন? অথচ রাসূলুল্লাহ (সঃ) তো আপনাকে শুনিয়েছেনঃ “গোঁফ ছোট করে রাখবে যে পর্যন্ত না তুমি আমার সাথে মিলিত হবে। ঐ সাহাবী (রাঃ) উত্তরে বললেন, এটা ঠিকই বটে। কিন্তু আমাকে তো ঐ হাদীসটি কাঁদাচ্ছে যে, আমি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে বলতে শুনেছি, আল্লাহ তা’আলা স্বীয় ডান মুষ্টির মধ্যে কিছু মাখলুক রাখেন এবং অনুরূপভাবে বাম মুষ্টির মধ্যেও কিছু মাখলুক রাখেন, অতঃপর বলেনঃ “এ লোকগুলো এর জন্যে অর্থাৎ জান্নাতের জন্যে এবং এ লোকগুলো এর জন্যে অর্থাৎ জাহান্নামের জন্যে। আর এতে আমি কোন পরোয়া করি না। সুতরাং আমার জানা নেই যে, আমি তার কোন মুষ্টির মধ্যে ছিলাম। (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন) তকদীর প্রমাণ করার আরো বহু হাদীস রয়েছে।
এরপর আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা বলেনঃ আল্লাহ ইচ্ছা করলে মানুষকে একই উম্মত করতে পারতেন, অর্থাৎ হয় সকলকেই হিদায়াত দান করতেন, না হয় সকলকেই পথভ্রষ্ট করতেন। কিন্তু আল্লাহ এদের মধ্যে পার্থক্য রেখে দিয়েছেন। কাউকেও তিনি হিদায়াতের উপর রেখেছেন এবং কাউকেও সুপথ হতে ফিরিয়ে দিয়েছেন। তার হিকমত বা নিপুণতা তিনিই জানেন। তিনি যাকে ইচ্ছা স্বীয় অনুগ্রহের অধিকারী করেন। আর যালিমদের কোন অভিভাবক নেই, নেই কোন সাহায্যকারী।
ইবনে হাজীরাহ (রঃ)-এর নিকট এ খবর পৌঁছেছে যে, হযরত মূসা (আঃ) আরয করেনঃ “হে আমার প্রতিপালক! আপনি আপনার মাখলুককে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর তাদের কতকগুলোকে নিয়ে যাবেন জান্নাতে এবং কতকগুলোকে নিয়ে যাবেন জাহান্নামে। যদি সবকেই জান্নাতে প্রবিষ্ট করতেন তবে কতই না ভাল হতো!” তখন আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা বলেনঃ “হে মূসা (আঃ)! তোমার জামাটি উঁচু কর।” তিনি তখন তাঁর জামাটি উচু করলেন। মহান আল্লাহ আবার বললেনঃ “আরো উঁচু করে ধর। হযরত মূসা (আঃ) বললেনঃ “হে আল্লাহ! আমি আমার সারা দেহ হতে তো আমার জামাটি উঁচু করেছি, শুধু ঐ জায়গাটুকু বাকী রয়েছে যার উপর হতে সরানোর মধ্যে কোন কল্যাণ নেই।” তখন আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ “হে মূসা (আঃ)! এরূপভাবেই আমি আমার সমস্ত মাখলুককেই জান্নাতে প্রবিষ্ট করবো, শুধু তাদেরকে নয় যারা সম্পূর্ণরূপে কল্যাণ শূন্য হবে।” (এটা ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
৯-১২ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তাআলা মুশরিকদের শিরকপূর্ণ কাজের নিন্দে করছেন যে, তারা শরীক বিহীন আল্লাহর সাথে শরীক স্থাপন করছে এবং অন্যদের উপাসনায় লিপ্ত রয়েছে। তিনি বলছেন যে, সত্য ও সঠিক অভিভাবক এবং প্রকৃত কর্মসম্পাদনকারী তো আল্লাহ। মৃতকে জীবিত করা, এ বিশেষণ তো একমাত্র তাঁরই। প্রত্যেক জিনিসের উপর ক্ষমতাবান একমাত্র তিনিই। সর্বগুণের অধিকারী। হলেন তিনি, সুতরাং তিনি ছাড়া অন্য কেউ ইবাদতের যোগ্য কি করে হতে পারে?
এরপর মহান আল্লাহ বলেনঃ তোমরা যে বিষয়েই মতভেদ কর না কেন, ওর মীমাংসা তো আল্লাহরই নিকট। অর্থাৎ দ্বীন ও দুনিয়ার সমুদয় মতভেদের ফায়সালার জিনিস তো হলো আল্লাহর কিতাব এবং রাসূল (সঃ)-এর সুন্নাত। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “তোমরা কোন বিষয়ে মতবিরোধ করলে তা তোমরা আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (সঃ)-এর দিকে ফিরিয়ে দাও।”(৪:৫৯)
মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ হে নবী (সঃ)! তুমি বলে দাও- ইনিই আল্লাহ, আমার প্রতিপালক, আমি নির্ভর করি তাঁরই উপর এবং আমি তাঁরই অভিমুখী। সব সময় আমি তাঁরই দিকে প্রত্যাবর্তন করি। আসমান, যমীন এবং এতোদুভয়ের মধ্যস্থিত সমস্ত সৃষ্টির সৃষ্টিকর্তা তিনি।
মহান আল্লাহ বলেনঃ তোমরা আল্লাহ তাআলার অনুগ্রহের প্রতি লক্ষ্য কর যে, তিনি তোমাদের মধ্য হতে তোমাদের জোড়া সৃষ্টি করেছেন এবং আনআমের (গরু, ছাগল, ভেড়া, উট ইত্যাদির) মধ্য হতে সৃষ্টি করেছেন আনআমের জোড়া এবং এগুলো আটটি। এই ভাবে তিনি বংশ বিস্তার করেন। যুগ ও শতাব্দী অতীত হয়ে যাচ্ছে এবং মহান আল্লাহর সৃষ্টিকার্য এভাবেই চলতে আছে। এদিকে মানব সৃষ্টি এবং ওদিকে জীবজন্তু সৃষ্টি। বাগাভী (রঃ) বলেন যে, এর ভাবার্থ হলোঃ তিনি গর্ভাশয়ে সৃষ্টি করেন, কেউ বলেন যে, পেটের মধ্যে সৃষ্টি করেন এবং কেউ বলেন যে, এই পন্থায় তিনি বংশ বিস্তার করেন। হযরত মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, এর দ্বারা বংশ বিস্তারই উদ্দেশ্য। কেউ কেউ বলেন যে, এখানে (আরবী) ব্যবহৃত হয়েছে (আরবী)-এর অর্থে। অর্থাৎ পুরুষ ও নারীর জোড়ার মাধ্যমে তিনি মানব বংশ। বিস্তার করছেন এবং সৃষ্টি করতে রয়েছেন। সত্য কথা এই যে, তাঁর মত সৃষ্টিকর্তা আর কেউ নেই। তিনি এক। তিনি বেপরোয়া, অভাবমুক্ত এবং অতুলনীয়। তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা। আকাশ ও পৃথিবীর চাবি তাঁরই নিকট। সূরায়ে যুমারে এর তাফসীর গত হয়েছে। উদ্দেশ্য এই যে, সারা জগতের ব্যবস্থাপক, অধিকর্তা এবং হুকুমদাতা তিনিই। তিনি এক ও অংশীবিহীন। তিনি যার প্রতি ইচ্ছা তার রিযক বর্ধিত করেন অথবা সংকুচিত করেন। তাঁর কোন কাজ হিকমত শূন্য নয়। কোন অবস্থাতেই তিনি কারো উপর যুলুমকারী নন। তার প্রশস্ত জ্ঞান সমস্ত সৃষ্টজীবকে পরিবেষ্টন করে রয়েছে।