أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#১০৯৮)[*জামা‘আতী জিন্দেগীর গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা :-]
www.motaher21.net
সূরা:৪২:আশ-শূরা
পারা:২৫
১৩-১৬ নং আয়াত:-
সূরা:৪২:আশ-শূরা-১৩
شَرَعَ لَکُمۡ مِّنَ الدِّیۡنِ مَا وَصّٰی بِہٖ نُوۡحًا وَّ الَّذِیۡۤ اَوۡحَیۡنَاۤ اِلَیۡکَ وَ مَا وَصَّیۡنَا بِہٖۤ اِبۡرٰہِیۡمَ وَ مُوۡسٰی وَ عِیۡسٰۤی اَنۡ اَقِیۡمُوا الدِّیۡنَ وَ لَا تَتَفَرَّقُوۡا فِیۡہِ ؕ کَبُرَ عَلَی الۡمُشۡرِکِیۡنَ مَا تَدۡعُوۡہُمۡ اِلَیۡہِ ؕ اَللّٰہُ یَجۡتَبِیۡۤ اِلَیۡہِ مَنۡ یَّشَآءُ وَ یَہۡدِیۡۤ اِلَیۡہِ مَنۡ یُّنِیۡبُ ﴿۱۳﴾
তিনি তোমাদের জন্য দ্বীনের সেই সব নিয়ম-কানুন নির্ধারিত করেছেন যার নির্দেশ তিনি নূহকে দিয়েছিলেন এবং (হে মুহাম্মাদ) যা এখন আমি তোমার কাছে অহীর মাধ্যমে পাঠিয়েছি। আর যার আদেশ দিয়েছিলাম আমি ইবরাহীম (আ), মূসা (আ) ও ঈসাকে (আ) । তার সাথে তাগিদ করেছিলাম এই বলে যে, এ দ্বীনকে কায়েম করো এবং এ ব্যাপারে পরস্পর ভিন্ন হয়ো না। (হে মুহাম্মাদ) এই কথাটিই এসব মুশরিকের কাছে অত্যন্ত অপছন্দনীয় যার দিকে তুমি তাদের আহবান জানাচ্ছো। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা আপন করে নেন এবং তিনি তাদেরকেই নিজের কাছে আসার পথ দেখান যারা তাঁর প্রতি রুজু করে।
সূরা:৪২:আশ-শূরা-১৪
وَ مَا تَفَرَّقُوۡۤا اِلَّا مِنۡۢ بَعۡدِ مَا جَآءَہُمُ الۡعِلۡمُ بَغۡیًۢا بَیۡنَہُمۡ ؕ وَ لَوۡ لَا کَلِمَۃٌ سَبَقَتۡ مِنۡ رَّبِّکَ اِلٰۤی اَجَلٍ مُّسَمًّی لَّقُضِیَ بَیۡنَہُمۡ ؕ وَ اِنَّ الَّذِیۡنَ اُوۡرِثُوا الۡکِتٰبَ مِنۡۢ بَعۡدِہِمۡ لَفِیۡ شَکٍّ مِّنۡہُ مُرِیۡبٍ ﴿۱۴﴾
মানুষের কাছে যখন জ্ঞান এসে গিয়েছিল তারপরই তাদের মধ্যে বিভেদ দেখা দিয়েছে। আর তা হওয়ার কারণ তারা একে অপরের বিরুদ্ধে বাড়াবাড়ি করতে চাচ্ছিলো। একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত মূলতবী রাখা হবে একথা যদি তোমার রব পূর্বেই ঘোষণা না করতেন তাহলে তাদের বিবাদের চূড়ান্ত ফায়সালা করে দেয়া হতো। প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে, পূর্ববর্তীদের পরে যাদের কিতাবের উত্তরাধিকারী করা হয়েছে তারা সে ব্যাপারে বড় অস্বস্তিকর সন্দেহের মধ্যে পড়ে আছে।
সূরা:৪২:আশ-শূরা-১৫
فَلِذٰلِکَ فَادۡعُ ۚ وَ اسۡتَقِمۡ کَمَاۤ اُمِرۡتَ ۚ وَ لَا تَتَّبِعۡ اَہۡوَآءَہُمۡ ۚ وَ قُلۡ اٰمَنۡتُ بِمَاۤ اَنۡزَلَ اللّٰہُ مِنۡ کِتٰبٍ ۚ وَ اُمِرۡتُ لِاَعۡدِلَ بَیۡنَکُمۡ ؕ اَللّٰہُ رَبُّنَا وَ رَبُّکُمۡ ؕ لَنَاۤ اَعۡمَالُنَا وَ لَکُمۡ اَعۡمَالُکُمۡ ؕ لَا حُجَّۃَ بَیۡنَنَا وَ بَیۡنَکُمۡ ؕ اَللّٰہُ یَجۡمَعُ بَیۡنَنَا ۚ وَ اِلَیۡہِ الۡمَصِیۡرُ ﴿ؕ۱۵﴾
যেহেতু এরূপ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, তাই হে মুহাম্মাদ এখন তুমি সেই দ্বীনের দিকেই আহবান জানাও এবং যেভাবে তুমি আদিষ্ট হয়েছো সেভাবে দৃঢ়তার সাথে তা আঁকড়ে ধরো এবং এসব লোকের ইচ্ছা আকাংখার অনুসরণ করো না। এদের বলে দাও, “আল্লাহ যে কিতাব নাযিল করেছেন আমি তার ওপর ঈমান এনেছি। আমাকে আদেশ দেয়া হয়েছে যেন তোমাদের মধ্যে ইনসাফ করি। আল্লাহই আমাদেরও রব এবং তোমাদেরও রব তিনিই। আমাদের কাজকর্ম আমাদের জন্য আর তোমাদের কাজকর্ম তোমাদের জন্য। আমাদের ও তোমাদের মাঝে কোন বিবাদ নেই। একদিন আল্লাহ আমাদের সবাইকে একত্রিত করবেন। তাঁর কাছেই সবাইকে যেতে হবে।”
সূরা:৪২:আশ-শূরা-১৬
وَ الَّذِیۡنَ یُحَآجُّوۡنَ فِی اللّٰہِ مِنۡۢ بَعۡدِ مَا اسۡتُجِیۡبَ لَہٗ حُجَّتُہُمۡ دَاحِضَۃٌ عِنۡدَ رَبِّہِمۡ وَ عَلَیۡہِمۡ غَضَبٌ وَّ لَہُمۡ عَذَابٌ شَدِیۡدٌ ﴿۱۶﴾
আল্লাহর আহবানে সাড়া দান করার পরে যারা (সাড়া দানকারীদের সাথে) আল্লাহর দ্বীনের ব্যাপারে বিবাদ করে আল্লাহর কাছে তাদের যুক্তি ও আপত্তি বাতিল। তাদের ওপর আল্লাহর গযব, আর তাদের জন্য রয়েছে কঠিন আযাব।
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
# প্রথম আয়াতে যে কথাটি বলা হয়েছিলো এখানে সেই কথাটিই আরো বেশী পরিষ্কার করে বলা হয়েছে। এখানে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে যে, মুহাম্মাদ ﷺ কোন নতুন ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা নন। নবী-রসূলদের মধ্যে কেউই কোন নতুন ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন না। প্রথম থেকেই সমস্ত নবী-রসূল আল্লাহর পক্ষ থেকে একই দ্বীন পেশ করে আসছেন। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও সেই একই দ্বীন পেশ করছেন। এ প্রসঙ্গে সর্বপ্রথম হযরত নূহের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। মহাপ্লাবনের পর তিনিই ছিলেন বর্তমান মানব গোষ্ঠীর সর্বপ্রথম পয়গস্বর। তারপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, যিনি শেষ নবী। তারপর হযরত ইবরাহীমের (আ) নাম উল্লেখ করা হয়েছে, আরবের লোকেরা যাঁকে তাদের নেতা বলে মানতো। সর্বশেষে হযরত মুসা এবং ঈসার কথা বলা হয়েছে যাঁদের সাথে ইহুদী ও খৃস্টানরা তাদের ধর্মকে সম্পর্কিত করে থাকে। এর উদ্দেশ্য এ নয় যে, শুধু এই পাঁচজন নবীকেই উক্ত দ্বীনের হিদায়াত দান করা হয়েছিলো। বরং একথা বলে দেয়াই এর উদ্দেশ্য যে, পৃথিবীতে যত নবী-রসূলই আগমন করেছেন তাঁরা সবাই একই দ্বীন নিয়ে এসেছেন। নমুনা হিসেবে এমন পাঁচজন মহান নবীর নাম উল্লেখ করা হয়েছে যাঁদের মাধ্যমে দুনিয়ার মানুষ সুবিখ্যাত আসমানী শরীয়তসমূহ লাভ করেছে।
যেহেতু এ আয়াতটি দ্বীন ও দ্বীনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে আলোকপাত করেছে। তাই সে বিষয়ে ভালোভাবে চিন্তা-ভাবনা করে তাকে বুঝে নেয়া আবশ্যকঃ বলা হয়েছে شَرَعَ لَكُمْ “তোমাদের জন্য নির্ধারিত করেছেন।” شَرَعَ শব্দের আভিধানিক অর্থ রাস্তা তৈরী করা এবং এর পারিভাষিক অর্থ পদ্ধতি, বিধি ও নিয়ম-কানুন রচনা করা। এই পারিভাষিক অর্থ অনুসারে আরবী ভাষায় تشريع শব্দটি আইন প্রণয়ন (Legislation) شرع এবং شريعة শব্দটি আইন (Law ) এবং شارع শব্দটি আইন প্রণেতার (Law giver) সমার্থক বলে মনে করা হয়। আল্লাহই বিশ্ব-জাহানের সব কিছুর মালিক, তিনিই মানুষের প্রকৃত অভিভাবক এবং মানুষের মধ্যে যে বিষয়েই মতভেদ হোক না কেন তার ফায়সালা করা তাঁরই কাজ। কুরআন মজীদের বিভিন্ন স্থানে এ ধরনের যেসব মৌলিক সত্য বর্ণিত হয়েছে তারই স্বাভাবিক ও যৌক্তিক পরিণতি হচ্ছে আল্লাহর এই আইন রচনা। এখন মৌলিকভাবে যেহেতু আল্লাহই মালিক, অভিভাবক ও শাসক, তাই মানুষের জন্য আইন ও বিধি রচনার এবং মানুষকে এই আইন ও বিধি দেয়ার অনিবার্য অধিকার তাঁরই। আর এভাবে তিনি তাঁর দায়িত্ব পালন করেছেন। পরে বলা হয়েছে مِنَ الدِّينِ ‘দ্বীন’ থেকে শাহ ওয়ালী উল্লাহ দেহলবী এর অনুবাদ করেছেন আইন থেকে। অর্থাৎ আল্লাহ শরীয়ত নির্ধারণ করেছেন আইনের পর্যায়ভুক্ত। আমরা ইতিপূর্বে সূরা যুমারে ৩নং টীকায় دِّينِ শব্দের যে ব্যাখ্যা করেছি তা যদি সামনে থাকে তাহলে একথা বুঝতে কোন অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, দ্বীন অর্থই কারো নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব মেনে নিয়ে তার আদেশ-নিষেধের আনুগত্য করা। এ শব্দটি যখন পন্থা বা পদ্ধতি অর্থে ব্যবহার করা হয় তখন তার অর্থ হয় এমন পদ্ধতি যাকে ব্যক্তি অবশ্য অনুসরণীয় পদ্ধতি এবং তার যার নির্ধারণকারীকে অবশ্য অনুসরণযোগ্য বলে মেনে চলে। এ কারণে আল্লাহর নির্ধারিত এই পদ্ধতিকে দ্বীনের বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন আইন বলার পরিষ্কার অর্থ হলো এটা শুধু সুপারিশ (Recomendation) ও ওয়াজ-নসীহতের মর্যাদা সম্পন্ন নয়। বরং তা বান্দার জন্য তার মালিকের অবশ্য অনুসরণীয় আইন, যার অনুসরণ না করার অর্থ বিদ্রোহ করা। যে ব্যক্তি তা অনুসরণ করে না সে প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর আধিপত্য, সার্বভৌমত্ব এবং দাসত্ব অস্বীকার করে।
এরপরে বলা হয়েছে, দ্বীনের বৈশিষ্ট্য মণ্ডিত এ আইনই সেই আইন যার নির্দেশ দেয়া হয়েছিলো নূহ, ইবরাহীম ও মূসা আলাইহিমুস সালামকে এবং এখন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সে নির্দেশই দান করা হয়েছে। এ বাণী থেকে কয়েকটি বিষয় প্রতিভাত হয়। এক-আল্লাহ এ বিধানকে সরাসরি সব মানুষের কাছে পাঠাননি, বরং মাঝে মধ্যে যখনই তিনি প্রয়োজন মনে করেছেন এক ব্যক্তিকে তাঁর রসূল মনোনীত করে এ বিধান তার কাছে সোপর্দ করেছেন। দুই-প্রথম থেকেই এ বিধান এক ও অভিন্ন। এমন নয় যে, কোন জাতির জন্য কোন একটি দ্বীন নির্দিষ্ট করা হয়েছে এবং অন্য সময় অপর এক জাতির জন্য তা থেকে ভিন্ন ও বিপরীত কোন দ্বীন পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। আল্লাহর পক্ষ থেকে একাধিক দ্বীন আসেনি। বরং যখনই এসেছে এই একটি মাত্র দ্বীনই এসেছে। তিন-আল্লাহর আধিপত্য ও সার্বভৌমত্ব মানার সাথে সাথে যাদের মাধ্যমে এ বিধান পাঠানো হয়েছে তাদের রিসালাত মানা এবং যে অহীর দ্বারা এ বিধান বর্ণনা করা হয়েছে তা মেনে নেয়া এ দ্বীনেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ। জ্ঞান-বুদ্ধি ও যুক্তির দাবীও তাই। কারণ, যতক্ষণ পর্যন্ত তা আল্লাহর তরফ থেকে বিশ্বাসযোগ্য (Authentic) হওয়া সম্পর্কে ব্যক্তি নিশ্চিত না হবে ততক্ষণ সে এই আনুগত্য করতেই পারে না।
অতঃপর বলা হয়েছে, এসব নবী-রসূলদেরকে দ্বীনর বৈশিষ্ট্য মণ্ডিত এই বিধান দেয়ার সাথে তাগিদসহ এ নির্দেশও দেয়া হয়েছিলো যে, أَقِيمُوا الدِّينَ শাহ ওয়ালী উল্লাহ দেহলবী এ আয়াতাংশের অনুবাদ করেছেন, “দ্বীনকে কায়েম করো” আর শাহ রফিউদ্দিন ও শাহ আবদুল কাদের অনুবাদ করেছেন, “দ্বীনকে কায়েম রাখো” এই দু’টি অনুবাদই সঠিক। اقامت শব্দের অর্থ কায়েম করা ও কায়েম রাখা উভয়ই। নবী-রসূলগণ আলাইহিমুস সালাম এ দু’টি কাজ করতেই আদিষ্ট ছিলেন। তাঁদের প্রথম দায়িত্ব ও কর্তব্য ছিল, যেখানে এই দ্বীন কায়েম নেই সেখানে তা কায়েম করা। আর দ্বিতীয় দায়িত্ব ও কর্তব্য ছিল যেখানে তা কায়েম হবে কিংবা পূর্ব থেকেই কায়েম আছে সেখানে তা কায়েম রাখা। একথা সুস্পষ্ট যে কোন জিনিসকে কায়েম রাখার প্রশ্ন তখনই আসে যখন তা কায়েম থাকে। অন্যথায় প্রথমে তা কায়েম করতে হবে, তারপর তা যাতে কায়েম থাকে সেজন্য ক্রমাগত প্রচেষ্টা চালাতে হবে।
এই পর্যায়ে আমাদের সামনে দু’টি প্রশ্ন দেখা দেয়। একটি হলো, দ্বীন কায়েম করার অর্থ কি? অপরটি হলো, দ্বীন অর্থই বা কি যা কায়েম করার এবং কায়েম রাখার আদেশ দেয়া হয়েছে? এ দু’টি বিষয়ও ভালভাবে বুঝে নেয়া দরকার।
কায়েম করা কথাটি যখন কোন বস্তুগত বা দেহধারী জিনিসের জন্য ব্যবহৃত হয় তখন তার অর্থ হয় উপবিষ্টকে উঠানো। যেমন কোন মানুষ বা জন্তুকে উঠানো। কিংবা পড়ে থাকা জিনিসকে উঠিয়ে দাঁড় করানো। যেমন বাঁশ বা কোন থাম তুলে দাঁড় করানো অথবা কোন জিনিসের বিক্ষিপ্ত অংশগুলোকে একত্র করে সমুন্নত করা। যেমনঃ কোন খালি জায়গায় বিল্ডিং নির্মাণ করা। কিন্তু যা বস্তুগত জিনিস নয়, অবস্তুগত জিনিস তার জন্য যখন কায়েম করা শব্দটা ব্যবহার করা হয় তখন তার অর্থ শুধু সেই জিনিসের প্রচার করাই নয়, বরং তা যথাযথভাবে কার্যে পরিণত করা, তার প্রচলন ঘটানো এবং কার্যত চালু করা। উদাহরণস্বরূপ যখন আমরা বলি, অমুক ব্যক্তি তার রাজত্ব কায়েম করেছে তখন তার অর্থ এ হয় না যে, সে তার রাজত্বের দিকে আহবান জানিয়েছে। বরং তার অর্থ হয়, সে দেশের লোকদেরকে নিজের অনুগত করে নিয়েছে এবং সরকারের সকল বিভাগে এমন সংগঠন ও শৃংখলা প্রতিষ্ঠা করেছে যে, দেশের সমস্ত ব্যবস্থাপনা তার নির্দেশ অনুসারে চলতে শুরু করেছে। অনুরূপ যখন আমরা বলি, দেশে আদালত কায়েম আছে তখন তার অর্থ হয় ইনসাফ করার জন্য বিচারক নিয়োজিত আছেন। তিনি মোকদ্দমাসমূহের শুনানি করছেন এবং ফায়সালা দিচ্ছেন। একথার এ অর্থ কখনো হয় না যে, ন্যায় বিচার ও ইনসাফের গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্যের বর্ণনা খুব ভালভাবে করা হচ্ছে এবং মানুষ তা সমর্থন করছে। অনুরূপভাবে কুরআন মজীদে যখন নির্দেশ দেয়া হয়, নামায কায়েম করো তখন তার অর্থ কুরআন মজীদের দাওয়াত ও তাবলীগ নয়, বরং তার অর্থ হয় নামাযের সমস্ত শর্তাবলী পূরণ করে শুধু নিজে আদায় করা না বরং এমন ব্যবস্থা করা যেন ঈমানদারদের মধ্যে তা নিয়মিত প্রচলিত হয়। মসজিদের ব্যবস্থা থাকে, গুরুত্বের সাথে জুমআ ও জামা’য়াত ব্যবস্থা হয়, সময়মত আযান দেয়া হয়, ইমাম ও খতিব নির্দিষ্ট থাকে এবং মানুষের মধ্যে সময়মত মসজিদে আসা ও নামায আদায় করার অভ্যাস সৃষ্টি হয়। এই ব্যাখ্যার পরে একথা বুঝতে কষ্ট হবার কথা নয় যে, নবী-রসূল আলাইহিমুস সালামদের যখন এই দ্বীন কায়েম করার ও রাখার যে নির্দেশ দেয়া হয়েছিলো, তার অর্থ শুধু এতটুকুই ছিল না যে, তাঁরা নিজেরাই কেবল এ দ্বীনের বিধান মেনে চলবেন এবং অন্যদের কাছে তার তাবলীগ বা প্রচার করবেন, যাতে মানুষ তার সত্যতা মেনে নেয়। বরং তার অর্থ এটাও যে মানুষ যখন তা মেনে নেবে তখন আরো অগ্রসর হয়ে তাদের মাঝে পুরো দ্বীনের প্রচলন ঘটাবেন, যাতে সে অনুসারে কাজ আরম্ভ হতে এবং চলতে থাকে। এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই যে দাওয়াত ও তাবলীগ এ কাজের অতি আবশ্যিক প্রাথমিক স্তর। এই স্তর ছাড়া দ্বিতীয় স্তর আসতেই পারে না। কিন্তু প্রত্যেক বিবেক-বুদ্ধি সম্পন্ন ব্যক্তিই বুঝতে পারবেন এই নির্দেশের মধ্যে দ্বীনের দাওয়াত ও তাবলীগকে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বানানো হয়নি, দ্বীনকে কায়েম করা ও কায়েম রাখাকেই উদ্দেশ্য বানানো হয়েছে। দাওয়াত ও তাবলীগ অবশ্যই এ উদ্দেশ্য সাধনের মাধ্যম, কিন্তু মূল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নয়। নবী-রসূলদের মিশনের একমাত্র উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য দাওয়াত ও তাবলীগ করো একথা বলা একেবারেই অবান্তর।
এখন দ্বিতীয় প্রশ্নটি দেখুন। কেউ কেউ দেখলেন, যে দ্বীন কায়েম করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে তা সমানভাবে সমস্ত নবী-রসূলের দ্বীন। কিন্তু তাদের সবার শরীয়ত ছিল ভিন্ন ভিন্ন। যেমন আল্লাহ কুরআন মজীদে বলেছেন لِكُلٍّ جَعَلْنَا مِنْكُمْ شِرْعَةً وَمِنْهَاجًا “আমি তোমাদের প্রত্যেক উম্মতের জন্য স্বতন্ত্র শরীয়ত এবং একটি পদ্ধতি নির্ধারিত করে দিয়েছি।” তাই তারা ধরে নিয়েছে যে, এ দ্বীন অর্থ নিশ্চয়ই আদেশ-নিষেধ ও বিধি-বিধান নয়, এর অর্থ শুধু তাওহীদ, আখেরাত, কিতাব ও নবুওয়াতকে মানা এবং আল্লাহর ইবাদাত করা। কিংবা বড় জোর তার মধ্যে শরীয়তের সেই সব বড় বড় নৈতিক নীতিমালাও অন্তর্ভুক্ত যা সমস্ত দ্বীনের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য।
কিন্তু এটি একটি অপরিপক্ব মত। শুধু বাহিক্যভাবে দ্বীনের ঐক্য ও শরীয়তসমূহের বিভিন্নতা দেখে এ মত পোষণ করা হয়েছে। এটি এমন একটি বিপজ্জনক মত যে যদি তা সংশোধন করা না হয় তাহলে তা অগ্রসর হয়ে দ্বীন ও শরীয়তের মধ্যে এমন একটি পার্থক্যের সূচনা করবে যার মধ্যে জড়িয়ে সেন্ট পল শরীয়তবিহীন দ্বীনের মতবাদ পেশ করেছিলেন এবং সাইয়েদেনা হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের উম্মতকে ধ্বংস ও বিপর্যস্ত করেছিলেন। কারণ, শরীয়ত যখন দ্বীন থেকে স্বতন্ত্র একটি জিনিস আর নির্দেশ দেয়া হয়েছে শুধু দ্বীন কায়েমের জন্য, শরীয়ত কায়েমের জন্য নয় তখন মুসলমানরাও খৃস্টানদের মত অবশ্যই শরীয়তকে গুরুত্বহীন ও তার প্রতিষ্ঠাকে সরাসরি উদ্দেশ্য মনে না করে উপেক্ষা করবে এবং দ্বীনের শুধু ঈমান সম্পর্কিত বিষয়গুলো ও বড় বড় নৈতিক নীতিসমূহ নিয়েই বসে থাকবে। এভাবে অনুমানের ওপর নির্ভর করে دين এর অর্থ নিরূপণ করার পরিবর্তে কেনই বা আমরা আল্লাহর কিতাব থেকেই একথা জেনে নিচ্ছি না যে, যে দ্বীন কায়েম করার নির্দেশ এখানে দান করা হয়েছে তার অর্থ কি শুধু ঈমান সম্পর্কিত বিষয়সমূহ এবং কতিপয় বড় বড় নৈতিক মূলনীতি না শরীয়তের অন্যান্য আদেশ নিষেধও? কুরআন মজীদ বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখি কুরআন মজীদে যেসব জিনিসকে দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে তার মধ্যে নিম্নোক্ত জিনিসগুলোও আছেঃ
একঃوَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ حُنَفَاءَ وَيُقِيمُوا الصَّلَاةَ وَيُؤْتُوا الزَّكَاةَ وَذَلِكَ دِينُ الْقَيِّمَةِ-البينة : 5
“তাদেরকে এছাড়া আর কোন নির্দেশ দেয়া হয়নি যে, তারা একনিষ্ঠ চিত্তে দ্বীনকে আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট করে কেবল তাঁরই ইবাদাত করবে, নামায কায়েম করবে এবং যাকাত দেবে এটাই সঠিক দ্বীন।” এ আয়াত থেকে জানা যায়, নামায এবং রোযা এই দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত। অথচ নামায ও রোযার আহকাম বিভিন্ন শরীয়তে বিভিন্ন রকম ছিল। পূর্ববর্তী শরীয়তসমূহে বর্তমানের মত নামাযের এই একই নিয়ম-কানুন, একই খুঁটি-নাটি বিষয়, একই সমান রাকআত, একই কিবলা, একই সময় এবং এই একই বিধি-বিধান ছিল একথা কেউ বলতে পারে না। অনুরূপ যাকাত সম্পর্কেও কেউ এ দাবী করতে পারে না যে, সমস্ত শরীয়তে বর্তমানের ন্যায় যাকাতের এই একই হিসাব, একই হার এবং আদায় ও বন্টনের এই একই বিধি-নিষেধ ছিল। কিন্তু শরীয়তের ভিন্নতা সত্ত্বেও আল্লাহ এ দু’টি জিনিসকে দ্বীনের মধ্যে গণ্য করেছেন।
حُرِّمَتْ عَلَيْكُمُ الْمَيْتَةُ وَالدَّمُ وَلَحْمُ الْخِنْزِيرِ وَمَا أُهِلَّ لِغَيْرِ اللَّهِ بِهِ…………… الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ…………..-المائدة: 3 . “তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে মৃত জন্তু, রক্ত, শূকরের গোশত, আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নামে যবেহকৃত জন্তু, দমবন্দ হয়ে, আঘাত প্রাপ্ত হয়ে, ওপর থেকে পড়ে কিংবা ধাক্কা খেয়ে মরা জন্তু অথবা যে জন্তুকে কোন হিংস্র প্রাণী ক্ষত-বিক্ষত করেছে কিন্তু তোমরা তাকে জীবিত পেয়ে যবেহ করেছো কিংবা যে জন্তুকে কোন আস্তানায় জবেহ করা হয়েছে। তাছাড়া লটারীর মাধ্যমে নিজের ভাগ্য সম্পর্কে অবহিত হতে চাওয়াকেও তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে। এসবই গুনাহর কাজ। আজ কাফেররা তোমাদের দ্বীন সম্পর্কে নিরাশ হয়ে গিয়েছে। তাই তোমরা তাদেরকে ভয় করো না, আমাকে ভয় করো। আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণতা দান করলাম।” এ থেকে জানা গেল যে, শরীয়তের এসব হুকুম আহকামও দ্বীনের মধ্যে শামিল।
তিনঃ قَاتِلُوا الَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَلَا بِالْيَوْمِ الْآخِرِ وَلَا يُحَرِّمُونَ مَا حَرَّمَ اللَّهُ وَرَسُولُهُ وَلَا يَدِينُونَ دِينَ الْحَقِّ- التوبة: 29 “তোমরা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো যারা আল্লাহ ও আখেরাত দিবসে বিশ্বাস করে না, আর আল্লাহ ও তাঁর রসূল যা কিছু হারাম করেছেন তা হারাম করে না এবং সত্য দ্বীনকে নিজের দ্বীন হিসেবে গ্রহণ করে না।” এ থেকে জানা যায়, আল্লাহ ও আখেরাতের প্রতি ঈমান পোষণ করা এবং আল্লাহ ও তাঁর রসূল যেসব আদেশ-নিষেধ করেছেন তা মানা ও তার আনুগত্য করাও দ্বীন।
চারঃ الزَّانِيَةُ وَالزَّانِي فَاجْلِدُوا كُلَّ وَاحِدٍ مِنْهُمَا مِائَةَ جَلْدَةٍ وَلَا تَأْخُذْكُمْ بِهِمَا رَأْفَةٌ فِي دِينِ اللَّهِ إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ- النور: 2 “ব্যভিচারী নারী ও পুরুষ উভয়কে একশটি করে বেত্রাঘাত করো। যদি তোমরা আল্লাহ ও আখেরাতের প্রতি ঈমান পোষণ করো তাহলে দ্বীনের ব্যাপারে তাদের প্রতি মায়া-মমতা ও আবেগ যেন তোমাদেরকে পেয়ে না বসে।” مَا كَانَ لِيَأْخُذَ أَخَاهُ فِي دِينِ الْمَلِكِ- يوسف: 76 “বাদশার দ্বীন অনুসারে ইউসুফ তার ভাইকে পাকড়াও করতে পারতো না।” এ থেকে জানা গেলো, ফৌজদারী আইনসমূহও দ্বীনের মধ্যে শামিল। ব্যক্তি যদি আল্লাহর দেয়া ফৌজদারী আইন অনুসারে চলে তাহলে সে আল্লাহর দ্বীনের অনুসারী আর যদি বাদশার দ্বীন অনুসারে চলে তাহলে বাদশাহর দ্বীনের অনুসারী।
এ চারটি উদাহরণই এমন যেখানে শরীয়তের আদেশ-নিষেধ ও বিধি-বিধানকে সুস্পষ্ট ভাষায় দ্বীন বলা হয়েছে। কিন্তু গভীর মনোযোগ সহকারে দেখলে বুঝা যায়, আরো যেসব গোনাহর কারণে আল্লাহ জাহান্নামের ভয় দেখিয়েছেন (যেমন ব্যভিচার, সুদখোরী, মু’মিন বান্দাকে হত্যা, ইয়াতীমের সম্পদ আত্নসাৎ, অন্যায়ভাবে মানুষের অর্থ নেয়া ইত্যাদি) যেসব অপরাধকে আল্লাহর শাস্তির কারণ বলে উল্লেখ করা হয়েছে (যেমনঃ লূতের কওমের মত পাপাচার এবং পারস্পরিক লেনদেনে শু’আইব আলাইহিস সালামের কওমের মত আচরণ) তার পথ রুদ্ধ করার কাজও অবশ্যই দ্বীন হিসেবে গণ্য হওয়া উচিত। কারণ, দ্বীন যদি জাহান্নাম ও আল্লাহর আযাব থেকে রক্ষা করার জন্য না এসে থাকে তাহলে আর কিসের জন্য এসেছে। অনুরূপ শরীয়তের যেসব আদেশ-নিষেধ লংঘনকে চিরস্থায়ী জাহান্নাম বাসের কারণ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে সেই সব আদেশ-নিষেধও দ্বীনের অংশ হওয়া উচিত। যেমন উত্তরাধিকারের বিধি-বিধান বর্ণনা করার পর বলা হয়েছেঃ
وَمَنْ يَعْصِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَيَتَعَدَّ حُدُودَهُ يُدْخِلْهُ نَارًا خَالِدًا فِيهَا وَلَهُ عَذَابٌ مُهِينٌ- النساء: 14
“যে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের অবাধ্য হবে এবং আল্লাহর সীমাসমূহ লংঘন করবে আল্লাহ তাকে দোযখে নিক্ষেপ করবেন। সেখানে সে চিরদিন থাকবে। তার জন্য রয়েছে লাঞ্ছনাকর আযাব।”
অনুরূপ আল্লাহ যেসব জিনিসের হারাম হওয়ার কথা কঠোর ভাষায় অকাট্যভাবে বর্ণনা করেছেন, যেমনঃ মা, বোন ও মেয়ের সাথে বিয়ে, মদ্যপান, চুরি, জুয়া এবং মিথ্যা সাক্ষ্যদান। এসব জিনিসের হারাম হওয়ার নির্দেশকে যদি “ইকামাতে দ্বীন” বা দ্বীন প্রতিষ্ঠার মধ্যে গণ্য করা না হয় তাহলে তার অর্থ দাঁড়ায় এই যে, আল্লাহ কিছু অপ্রয়োজনীয় আদেশ-নিষেধও দিয়েছেন যার বাস্তবায়ন তাঁর উদ্দেশ্য নয়। অনুরূপ আল্লাহ যেসব কাজ ফরয করেছেন, যেমনঃ রোযা হজ্জ-তাও দ্বীন প্রতিষ্ঠার পর্যায় থেকে এই অজুহাতে বাদ দেয়া যায় না যে, রমযানের ৩০ রোযা পূর্ববতী শরীয়তসমূহে ছিল না এবং কা’বায় হজ্জ করা কেবল সেই শরীয়তেই ছিল যা ইবরাহীমের (আ) বংশধারার ইসমাঈলী শাখাকে দেয়া হয়েছিলো।
প্রকৃতপক্ষে সমস্ত ভুল বুঝাবুঝি সৃষ্টির কারণ হলো, ভিন্ন উদ্দেশ্যে ( لِكُلٍّ جَعَلْنَا مِنْكُمْ شِرْعَةً وَمِنْهَاجًا ) (আমি তোমাদের প্রত্যেক উম্মতের জন্য একটি শরীয়ত ও পদ্ধতি নির্ধারণ করে দিয়েছি) আয়াতের এ অর্থ করা যে, যেহেতু প্রত্যেক উম্মতের জন্য শরীয়ত ছিল ভিন্ন কিন্তু কায়েম করতে বলা হয়েছে দ্বীনকে যা সমানভাবে সব নবী-রসূলের দ্বীন ছিল, তাই দ্বীন কায়েমের নির্দেশের মধ্যে শরীয়ত অন্তর্ভুক্ত নয়। অথচ এ আয়াতের অর্থ ও উদ্দেশ্য এর সম্পূর্ণ বিপরীত। সূরা মায়েদার যে স্থানে এ আয়াতটি আছে তার পূর্বাপর অর্থাৎ ৪১ আয়াত থেকে ৫০ আয়াত পর্যন্ত যদি কেউ মনযোগ সহকারে পাঠ করে তাহলে সে জানতে পারবে আয়াতের সঠিক অর্থ হচ্ছে, আল্লাহ যে নবীর উম্মতকে যে শরীয়ত দিয়েছিলেন সেটিই ছিল তাদের জন্য দ্বীন এবং সেই নবীর নবুওয়াত কালে সেটিই কায়েম করা কাম্য ও উদ্দেশ্য ছিল। এখন যেহেতু হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াতের যুগ, তাই উম্মতে মুহাম্মাদীকে যে শরীয়ত দান করা হয়েছে এ যুগের জন্য সেটিই দ্বীন এবং সেটিকে প্রতিষ্ঠিত করাই দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত করা। এরপর থেকে ঐ সব শরীয়তের পরস্পর ভিন্নতা। এ ভিন্নতার তাৎপর্য এ নয় যে, আল্লাহর প্রেরিত শরীয়তসমূহ পরস্পর বিরোধী ছিল। বরং এর সঠিক তাৎপর্য হলো, অবস্থা ও পরিবেশ পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে ঐ সব শরীয়তের খুটিনাটি বিষয়ে কিছু পার্থক্য ছিল। উদাহরণস্বরূপ নামায ও রোযার কথাই ধরুন। সকল শরীয়তেই নামায কায়েম ফরয ছিল কিন্তু সব শরীয়তের কিবলা এক ছিল না। তাছাড়া নামাযের সময়, রাকআতের সংখ্যা এবং বিভিন্ন অংশে কিছুটা পার্থক্য ছিল। অনুরূপ রোযা সব শরীয়তেই ফরয ছিল। কিন্তু রমযানের ৩০ রোযা অন্যান্য শরীয়তে ছিল না। এ থেকে এরূপ সিদ্ধান্ত গ্রহণ ঠিক নয় যে, নামায ও রোযা ‘ইকামাতে দ্বীন’ বা দ্বীন প্রতিষ্ঠার নির্দেশের অন্তর্ভুক্ত ঠিকই, কিন্তু নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে নামায পড়া এবং নির্দিষ্ট কোন সময়ে রোযা রাখা ইকামতে দ্বীনের নির্দেশ বহির্ভূত। বরং এর সঠিক অর্থ হলো, প্রত্যেক নবীর উম্মতের জন্য তৎকালীন শরীয়তে নামায ও রোযা আদায়ের জন্য যে নিয়ম-পদ্ধতি নির্ধারণ করা হয়েছিলো সেই সময়ে সেই পদ্ধতি অনুসারে নামায পড়া ও রোযা রাখাই ছিল দ্বীন কায়েম করা। বর্তমানেও এসব ইবাদতের জন্য শরীয়তে মুহাম্মাদীতে যে নিয়ম-পদ্ধতি দেয়া হয়েছে সে মোতাবেক এসব ইবাদাত বন্দেগী করা ‘ইকামাতে দ্বীন’। এ দু’টি দৃষ্টান্তের ভিত্তিতে শরীয়তের অন্যসব আদেশ-নিষেধও বিচার করুন।
যে ব্যক্তি চোখ খুলে কুরআন মজীদ পড়বে সে স্পষ্ট দেখতে পাবে যে, এ গ্রন্থ তার অনুসারীদেরকে কুফরী ও কাফেরদের আজ্ঞাধীন ধরে নিয়ে বিজিতের অবস্থানে থেকে ধর্মীয় জীবন-যাপন করার কর্মসূচী দিচ্ছে না, বরং প্রকাশ্যে নিজের শাসন ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছে, চিন্তাগত, নৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং আইনগত ও রাজনৈতিক ভাবে বিজয়ী করার লক্ষ্যে জীবনপাত করার জন্য অনুসারীদের কাছে দাবী করছে এবং তাদেরকে মানব জীবনের সংস্কার ও সংশোধনের এমন একটি কর্মসূচী দিচ্ছে যার একটা বৃহদাংশ কেবল তখনই বাস্তব রূপ লাভ করতে পারে যদি সরকারের ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব ঈমানদারদের হাতে থাকে। এ কিতাব তার নাযিল করার উদ্দেশ্য বর্ণনা করে বলেঃ
إِنَّا أَنْزَلْنَا إِلَيْكَ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ لِتَحْكُمَ بَيْنَ النَّاسِ بِمَا أَرَاكَ اللَّهُ- النساء: 105
“হে নবী, আমি ন্যায় ও সত্যসহ তোমার কাছে এই কিতাব নাযিল করেছি যাতে আল্লাহ তোমাকে যে আলো দেখিয়েছেন তার সাহায্যে তুমি মানুষের মধ্যে ফায়সালা করো।”
এই কিতাবে যাকাত আদায় ও বন্টনের যে নির্দেশাবলী দেয়া হয়েছে সেজন্য তা সুস্পষ্টভাবে এমন একটি সরকারের ধারণা পেশ করেছে যে, একটি নির্দিষ্ট নিয়মানুসারে যাকাত আদায় করে হকদারদের কাছে পৌঁছানোর দায়িত্ব নেবে (আত তাওবা ৬০ ও ১০৩ আয়াত )। এই কিতাবে সুদ বন্ধ করার যে আদেশ দেয়া হয়েছে এবং সুদখোরী চালু রাখার কাজে তৎপর লোকদের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে (আল বাকারা ২৭৫-২৭৯ আয়াত) তা কেবল তখনই বাস্তব রূপ লাভ করতে পারে যখন দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা সম্পূর্ণরূপে ঈমানদারদের হাতে থাকবে। এই কিতাবে হত্যাকারীর থেকে কিসাস গ্রহণের নির্দেশ (আল বাকারা ১৭৮ আয়াত), চুরির জন্য হাত কাটার নির্দেশ (আল মায়েদা ৩৮ আয়াত ) এবং ব্যভিচার ও ব্যভিচারের অপবাদ আরোপের জন্য হদ জারী করার নির্দেশ একথা ধরে নিয়ে দেয়া হয়নি যে, এসব আদেশ মান্যকারীদেরকে কাফেরদের পুলিশ ও বিচারালয়ের অধীন থাকতে হবে। এই কিতাবে কাফেরদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের নির্দেশ (আল বাকারা- ১৯০-২১৬ আয়াত) একথা মনে করে দেয়া হয়নি যে, এ দ্বীনের অনুসারীরা কাফের সরকারের বাহিনীতে সৈন্য ভর্তি করে এ নির্দেশ পালন করবে। এ কিতাবে আহলে কিতাবদের নিকট থেকে জিযিয়া আদায়ের নির্দেশ (আত তাওবা ২৯ আয়াত ) একথা ধরে নিয়ে দেয়া হয়নি যে, মুসলমানরা কাফেরদের অধীন থেকে তাদের থেকে জিযিয়া আদায় করে এবং তাদের রক্ষার দায়িত্ব নেবে। এ ব্যাপারটি শুধু মদীনায় অবতীর্ণ সূরাসমূহ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ নয়। দৃষ্টিশক্তির অধিকারীরা মক্কায় অবতীর্ণ সূরাসমূহের মধ্যে স্পষ্টতই দেখতে পারেন, প্রথম থেকেই যে পরিকল্পনা ছিল তা ছিলো দ্বীনের বিজয় ও কর্তৃত্ব স্থাপন, কুফরী সরকারের অধীনে দ্বীন ও দ্বীনের অনুসারীদের জিম্মি হয়ে থাকা নয়। উদাহরণস্বরূপ দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, সূরা বনী-ইসরাইল, আয়াত ৭৬ ও ৮০ ; সূরা কাসাস, আয়াত ৮৫-৮৬ ; সূরা রূম, আয়াত ১ থেকে ৬ ; সূরা আস সাফফাত , আয়াত ১৭১ থেকে ১৭৯ , (টীকা ৯৩-৯৪) এবং সূরা সোয়াদ, ভূমিকা ও ১১ আয়াত ১২ টীকাসহ।
ব্যাখ্যার এই ভ্রান্তি যে জিনিসটির সাথে সবচেয়ে বেশী সাংঘর্ষিক তা হচ্ছে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিজের বিরাট কাজ। যা তিনি ২৩ বছরের রিসালাত যুগে সমাধা করেছেন। তিনি তাবলীগ ও তলোয়ার উভয়টির সাহায্যেই যে গোটা আরবকে বশীভূত করেছিলেন এবং বিস্তারিত শরীয়ত বা বিধি-বিধানসহ এমন একটি পূর্ণাঙ্গ রাষ্ট্রীয় আদর্শ কায়েম করেছিলেন যা আকীদা-বিশ্বাস ও ইবাদাত থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত কর্মকাণ্ডে, সামাজিক চরিত্র, সভ্যতা ও সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও সমাজনীতি, রাজনীতি ও ন্যায় বিচার এবং যুদ্ধ ও সন্ধিসহ জীবনের সমস্ত দিক ও বিভাগে পরিব্যাপ্ত ছিল তা কে না জানে? এ আয়াত অনুসারে নবী ﷺ সহ সমস্ত নবী-রসূলকে ইকামাতে দ্বীনের যে নির্দেশ দেয়া হয়েছিলো নবীর ﷺ এসব কাজকে যদি তার ব্যাখ্যা বলে গ্রহণ করা না হয় তাহলে তার কেবল দু’টি অর্থই হতে পারে। হয় নবীর ﷺ বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আরোপ করতে হবে (মা’আযাল্লাহ) যে, তিনি আদিষ্ট হয়েছিলেন শুধু ঈমান ও নৈতিক চরিত্র সম্পর্কিত বড় বড় মূলনীতিসমূহের তাবলীগ ও দাওয়াতের জন্য কিন্তু তা লংঘন করে তিনি নিজের পক্ষ থেকেই একটি সরকার কায়েম করেছিলেন, যা অন্যসব নবী-রসূলদের শরীয়ত সমূহের সাধারণ নীতিমালা থেকে ভিন্নও ছিল অতিরিক্তও ছিল। নয়তো আল্লাহর বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আরোপ করতে হবে যে, তিনি সূরা শূরায় উপরোক্ত ঘোষণা দেয়ার পর নিজেই তাঁর কথা থেকে সরে পড়েছেন এবং নিজের নবীর নিকট থেকে ঐ সূরায় ঘোষিত “ইকামাতে দ্বীনের” চেয়ে কিছুটা বেশী এবং ভিন্ন ধরনের কাজই শুধু নেননি, বরং উক্ত কাজকে পূর্ণতা লাভের পর নিজের প্রথম ঘোষণার পরিপন্থী দ্বিতীয় এই ঘোষণাটিও দিয়েছেন যে, الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ (আজ আমি তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণতা দান করলাম) নাউযুবিল্লাহি মিন যালিকা। এ দু’টি অবস্থা ছাড়া তৃতীয় এমন কোন অবস্থা যদি থাকে যেক্ষেত্রে ইকামাতে দ্বীনের এই ব্যাখ্যাও বহাল থাকে এবং আল্লাহ কিংবা তাঁর রসূলের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগও না আসে তাহলে আমরা অবশ্যই তা জানতে চাইবো।
দ্বীন প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দেয়ার পর আল্লাহ এ আয়াতে সর্বশেষ যে কথা বলেছেন তা হচ্ছে وَلَا تَتَفَرَّقُوا فِيهِ “দ্বীনে বিভেদ সৃষ্টি করো না” কিংবা “তাতে পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ো না।” দ্বীনে বিভেদের অর্থ ব্যক্তির নিজের পক্ষ থেকে এমন কোন অভিনব বিষয় সৃষ্টি করা এবং তা মানা বা না মানার ওপর কুফর ও ঈমান নির্ভর করে বলে পীড়াপীড়ি করা এবং মান্যকারীদের নিয়ে অমান্যকারীদের থেকে আলাদা হয়ে যাওয়া, অথচ দ্বীনের মধ্যে তার কোন গ্রহণযোগ্যতা নেই। এই অভিনব বিষয়টি কয়েক ধরনের হতে পারে। দ্বীনের মধ্যে যে জিনিস নেই তা এনে শামিল করা হতে পারে। দ্বীনের অকাট্য উক্তিসমূহের বিকৃত প্রায় ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে অদ্ভূত আকীদা-বিশ্বাস এবং অভিনব আচার-অনুষ্ঠান আবিষ্কার করা হতে পারে। আবার দ্বীনের উক্তি ও বক্তব্যসমূহ রদবদল করে তা বিকৃত করা, যেমন যা গুরুত্বপূর্ণ তাকে গুরুত্বহীন বানিয়ে দেয়া এবং যা একেবারেই মোবাহ পর্যায়ভুক্ত তাকে ফরয ও ওয়াজিব এমনকি আরো অগ্রসর হয়ে ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ বানিয়ে দেয়া। এ ধরনের আচরণের কারণেই নবী-রসূল আলাইহিমুস সালামদের উম্মতদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হয়েছে। অতঃপর এসব ছোট ছোট দলের অনুসৃত পথই ক্রমান্বয়ে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ধর্মের রূপ পরিগ্রহ করেছে যার অনুসারীদের মধ্যে বর্তমানে এই ধারণাটুকু পর্যন্তও বর্তমান নেই যে, এক সময় তাদের মূল ছিল একই। দ্বীনের আদেশ-নিষেধ বুঝার এবং অকাট্য উক্তিসমূহ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে মাসয়ালা উদ্ভাবন করার ক্ষেত্রে জ্ঞানী ও পণ্ডিতদের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই যে মতভেদ সৃষ্টি হয় এবং আল্লাহর কিতাবের ভাষার মধ্যে আভিধানিক, বাগধারা ও ব্যাকরণের নিয়ম অনুসারে যার অবকাশ আছে সেই বৈধ ও যুক্তিসঙ্গত মতভেদের সাথে এই বিবাদের কোন সম্পর্ক নেই। এই বিষয় সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, সূরা বাকারা, আয়াত ২১৩, টীকা ২৩০ ; সূরা আল ইমরান, আয়াত ১৯, টীকা ১৬ ও ১৭ , আয়াত ৫১, টীকা ৪৮ ; সূরা আন নিসা, আয়াত ১৭১, টীকা ২১১ থেকে ২১৬ ; আল মায়েদা আয়াত ৭৭, টীকা ১০১ , আল আন’আম, আয়াত ১৫৯, টীকা ১৪১ ; সূরা আন নাহল, আয়াত ১১৮ থেকে ১২৪, টীকা ১১৭ থেকে ১২১ ; সূরা আল আম্বিয়া, আয়াত ৯২-৯৩, টীকা ৯১ , আল হাজ্জ, আয়াত ৬৭-৬৯, টীকা ১১৬, ১১৭ ; আল মু’মিনুন, আয়াত ৫১ থেকে ৫৬, টীকা ৪৫ থেকে ৪৯ ; সূরা আল কাসাস, আয়াত ৫৩ ও ৫৪, টীকা ৭৩ ; সূরা আর রূম, আয়াত ৩২ থেকে ৩৫, টীকা ৫১ থেকে ৫৪ ।
# ইতিপূর্বে ৮ ও ৯ আয়াতে যা বলা হয়েছে এবং ১১ টীকায় আমরা তার যে ব্যাখ্যা করেছি এখানে আবার তার পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। এখানে একথাটা বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে, তোমরা এসব লোকদেরকে দ্বীনের সুস্পষ্ট রাজপথ দেখিয়ে দিচ্ছো আর এ নির্বোধরা এই নিয়ামতকে মূল্য দেয়ার পরিবর্তে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করছে। কিন্তু এদের মধ্যে এদেরই কওমের এমন সব লোক আছে যারা আল্লাহর দিকে ফিরে আসছে এবং আল্লাহও বেছে বেছে তাদেরকে নিজের দিকে নিয়ে আসছেন। কারা এ নিয়ামত লাভ করে এবং কারা এর প্রতি খাপপা হয় তা নিজ নিজ ভাগ্যের ব্যাপার। তবে আল্লাহ অন্ধভাবে কোন কিছু বণ্টন করেন না। যে তাঁর দিকে অগ্রসর হয় তিনি কেবল তাকেই নিজের দিকে টানেন। দূরে পলায়নপর লোকদের পেছনে দৌড়ানো আল্লাহর কাজ নয়।
# বিভেদের কারণ এ ছিল না যে, আল্লাহ নবী-রসূল পাঠাননি এবং কিতাবও নাযিল করেননি, তাই সঠিক পথ না জানার কারণে মানুষ নিজেদের জন্য আলাদা আলাদা ধর্ম, চিন্তা, গোষ্ঠী ও জীবন আদর্শ আবিষ্কার করে নিয়েছে। বরং তাদের মধ্যে এই বিভেদ সৃষ্টি হয়েছে আল্লাহর পক্ষ থেকে জ্ঞান আসার পর। তাই সেজন্য আল্লাহ দায়ী নন, বরং সেই সব লোক নিজেরাই দায়ী যারা দ্বীনের সুস্পষ্ট নীতিমালা এবং শরীয়তের সুস্পষ্ট বিধি-নিষেধ থেকে দূরে সরে গিয়ে নতুন নতুন ধর্ম ও পথ বানিয়ে নিয়েছে।
# কোন প্রকার সদিচ্ছা এই মতভেদ সৃষ্টির চালিকা শক্তি ছিল না। এটা ছিল তোমাদের অভিনব ধারণা প্রকাশের আকাংখা। নিজের নাম ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চিন্তা, পারস্পরিক জিদ ও একগুঁয়েমি, একে অপরকে পরাস্ত করার প্রচেষ্টা এবং সম্পদ ও মর্যাদা অর্জন প্রচেষ্টার ফল। ধূর্ত ও উচ্চাভিলাসী লোকগুলো দেখলো, আল্লাহর বান্দারা যদি সোজাসুজি আল্লাহর দ্বীন অনুসরণ করতে থাকে তাহলে একজনই মাত্র খোদা হবেন মানুষ যার সামনে মাথা নত করবে, একজন রসূল হবেন মানুষ নেতা ও পথপ্রদর্শক হিসেবে যাকে মেনে চলবে, একখানা কিতাব থাকবে যেখান থেকে মানুষ পথনিদের্শনা লাভ করবে এবং একটি পরিচ্ছন্ন ও সুস্পষ্ট আকীদা-বিশ্বাস ও নির্ভেজাল বিধান থাকবে মানুষ যা অনুসরণ করতে থাকবে। এই ব্যবস্থায় তাদের নিজেদের জন্য কোন বিশেষ মর্যাদা থাকতে পারে না যে কারণে তাদের পৌরহিত্য চলবে, লোকজন তাদের পাশে ভিড় জমাবে তাদের সামনে মাথা নত করবে এবং পকেটও শূন্য করবে। এটাই সেই মূল কারণ যা নতুন নতুন আকীদা ও দর্শন, নতুন নতুন ইবাদত-পদ্ধতি ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান এবং নতুন নতুন জীবনাদর্শ উদ্ভাবনের উৎসাহ যুগিয়েছে এবং আল্লাহর বান্দাদের একটি বড় অংশকে দ্বীনের সুস্পষ্ট রাজপথ থেকে সরিয়ে বিভিন্ন পথে বিক্ষিপ্ত করে দিয়েছে। তারপর এ বিক্ষিপ্ততা এসব দল-উপদলের পারস্পরিক বিতর্ক ও বিবাদ এবং ধর্মীয়, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কলহের কারণে চরম তিক্ততায় পর্যবসিত হয়েছে। এমনকি এ থেকে এমন রক্তপাতও ঘটেছে যেজন্য মানবেতিহাস রক্ত রঞ্জিত হয়ে চলেছে।
# যারা গোমরাহী উদ্ভাবন করার এবং জেনে বুঝে তা অনুসরণ করার অপরাধে অপরাধী ছিল তাদেরকে দুনিয়াতেই আযাব দিয়ে ধ্বংস করে দেয়া হতো এবং শুধু সঠিক পথ অনুসরণকারীদের বাঁচিয়ে রাখা হতো যার মাধ্যমে কে ন্যায় ও সত্যের অনুসারী আর কে বাতিলের অনুসারী তা সুস্পষ্ট হয়ে যেতো। কিন্তু আল্লাহ এই চূড়ান্ত ফায়সালা কিয়ামত পর্যন্ত সময়ের জন্য মূলতবী করে রেখেছেন। কারণ, পৃথিবীতে এ ফায়সালা করে দেয়ার পর মানবজাতির পরীক্ষা অর্থহীন হয়ে যেতো।
# প্রত্যেক নবী এবং তাঁর নিকট অনুসারীদের যুগ অতিবাহিত হওয়ার পর আল্লাহর কিতাব পরবর্তী বংশধরদের কাছে পৌঁছলে তারা দৃঢ় বিশ্বাস ও আস্থার সাথে তা গ্রহণ করেনি, বরং তারা সে সম্পর্কে বড় সন্দেহ সংশয় এবং মানসিক দ্বিধাদ্বন্দ্বের শিকার হয়েছে। তাদের এ পরিস্থিতি শিকার হওয়ার অনেকগুলো কারণ ছিল। তাওরাত ও ইনজীলে ঐ সব পরিস্থিতি সম্পর্কে যেসব বিষয় বর্ণিত হয়েছে তা অধ্যয়নের মাধ্যমে আমরা অতি সহজেই সেই সব কারণ অনুধাবন করতে পারি। পূর্ববর্তী প্রজন্মের লোকেরা এ দু’টি গ্রন্থকে তার মূল অবস্থায় মূল রচনাশৈলী ও ভাষায় সংরক্ষিত করে পরবর্তী প্রজন্মের লোকদের কাছে পৌঁছায়নি। তার মধ্যে আল্লাহর বাণীর সাথে ব্যাখ্যা, ইতিহাস এবং জনশ্রুতিমূলক ঐতিহ্য ও ফিকাহবিদদের উদ্ভাবিত খুঁটিনাটি বিষয়সমূহের আকারে মানুষের কথাও মিশিয়ে একাকার করে দিয়েছে। এ দু’টি গ্রন্থের অনুবাদের এত অধিক মাত্রায় প্রচলন করেছে যে, মূল গ্রন্থ হারিয়ে গিয়েছে এবং কেবল তার অনুবাদই টিকে আছে। এর ঐতিহসিক প্রমাণসমূহকেও এমনভাবে ধ্বংস করে ফেলেছে যে, এখন আর কেউই পুরো নিশ্চয়তার সাথে বলতে পারে না তার কাছে যে কিতাব আছে পৃথিবীবাসী সেটিই হযরত মূসা বা হযরত ঈসার মাধ্যমে লাভ করেছিলো। তাছাড়া মাঝে মধ্যে তাদের ধর্মীয় পণ্ডিতরা ধর্ম, অধিবিদ্যা, দর্শন, আইন, পদার্থবিদ্যা, মনস্তত্ব এবং সমাজবিজ্ঞানের এমন সব আলোচনা করেছেন এবং চিন্তাদর্শ গড়ে তুলেছেন যার গোলক ধাঁধাঁয় পড়ে মানুষের জন্য এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ কঠিন হয়ে পড়েছে যে, আঁকাবাঁকা এসব পথের মধ্যে ন্যায় ও সত্যের রাজপথ কোনটি। আল্লাহর কিতাব যেহেতু মূল ও নির্ভরযোগ্য অবস্থায় বর্তমান ছিল না তাই মানুষ নির্ভরযোগ্য এমন কোন প্রমাণের স্মরণাপন্ন হতেও পারতো না যা বাতিল থেকে হককে আলাদা করার ব্যাপারে তাদের সাহায্য করতে পারতো।
# তাদেরকে সন্তুষ্টি করার জন্য এই দ্বীনের মধ্যে কোন রদবদল ও হ্রাস-বৃদ্ধি করবে না। “কিছু নাও এবং কিছু দাও” এই নীতির ভিত্তিতে এই পথভ্রষ্ট লোকদের সাথে কোন আপোষ করো না। শুধু কোন না কোন ভাবে ইসলামের গণ্ডির মধ্যে এসে যাক, এ লোভের বশবর্তী হয়ে এদের কুসংস্কার ও গোঁড়ামি এবং জাহেলী আচার-আচরণের জন্য দ্বীনের মধ্যে কোন অবকাশ সৃষ্টি করো না। আল্লাহ তাঁর দ্বীনকে যেভাবে নাযিল করেছেন কেউ মানতে চাইলে সেই খাঁটি ও মূল দ্বীনকে যেন সরাসরি মেনে নেয়। অন্যথায় যে জাহান্নামে হুমড়ি খেয়ে পড়তে চায় পড়ুক। মানুষের ইচ্ছানুসারে আল্লাহর দ্বীনের পরিবর্তন সাধন করা যায় না। মানুষ যদি নিজের কল্যাণ চায় তাহলে যেন নিজেকেই পরিবর্তন করে দ্বীন অনুসারে গড়ে নেয়।
# অন্য কথায় আমি সেই বিভেদ সৃষ্টিকারী লোকদের মত নই যারা আল্লাহর প্রেরিত কোন কোন কিতাব মানে আবার কোন কোন কিতাব মানে না। আমি আল্লাহর প্রেরিত প্রতিটি কিতাবই মানি।
# এই ব্যাপকার্থক আয়াতাংশের কয়েকটি অর্থ হয়ঃ
একটি অর্থ হচ্ছে, আমি এসব দলাদলি থেকে দূরে থেকে নিরপেক্ষ ন্যায় নিষ্ঠা অবলম্বনের জন্য আদিষ্ট। কোন দলের স্বার্থে এবং দলের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্ব করা আমার কাজ নয়। সব মানুষের সাথে আমার সমান সম্পর্ক। আর সে সম্পর্ক হচ্ছে ন্যায় বিচার ও ইনসাফের সম্পর্ক। যার যে বিষয়টি ন্যায় ও সত্য সে যত দূরেরই হোক না কেন আমি তার সহযোগী। আর যার যে বিষয়টি ন্যায় ও সত্যের পরিপন্থী সে আমার ঘনিষ্ঠ আত্মীয় হলেও আমি তার বিরোধী।
দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে, আমি তোমাদের সামনে যে সত্য পেশ করার জন্য আদিষ্ট তাতে কারো জন্য কোন বৈষম্য নেই, বরং তা সবার জন্য সমান। তাতে নিজের ও পরের, বড়র ও ছোটর, গরীবের ও ধনীর, উচ্চের ও নীচের ভিন্ন ভিন্ন সত্য নেই। যা সত্য তা সবার জন্য সত্য। যা গোনাহ তা সবার জন্য গোনাহ। যা হারাম তা সবার জন্য হারাম এবং যা অপরাধ তা সবার জন্য অপরাধ। এই নির্ভেজাল বিধানে আমার নিজের জন্যও কোন ব্যতিক্রম নেই।
তৃতীয় অর্থ হচ্ছে, আমি পৃথিবীতে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য আদিষ্ট। মানুষের মধ্যে ইনসাফ কায়েম করা এবং তোমাদের জীবনে ও তোমাদের সমাজে যে ভারসাম্যহীনতা ও বে-ইনসাফী রয়েছে তার ধ্বংস সাধনের দায়িত্ব আমাকে দেয়া হয়েছে।
এ তিনটি অর্থ ছাড়া এ বাক্যাংশের আরো একটি অর্থ আছে যা পবিত্র মক্কায় প্রকাশ পায়নি কিন্তু হিজরতের পরে তা প্রকাশ পায়। সেটি হচ্ছে, আমি আল্লাহর পক্ষ থেকে নিয়োগ প্রাপ্ত বিচারক। তোমাদের মধ্যে ইনসাফ করা আমার দায়িত্ব।
# আমাদের প্রত্যেকেই তার নিজ নিজ কাজের জন্য দায়ী এবং জবাবদিহিকারী। তোমরা নেক কাজ করলে তার সুফল আমি ভোগ করবো না, তোমরাই তা ভোগ করবে। অনুরূপ আমি খারাপ কাজ করলে সেজন্য তোমাদের পাকড়াও করা হবে না, আমাকেই তার পরিণাম ভোগ করতে হবে। একথাটিই ইতিপূর্বে সূরা বাকারা ১৩৯ আয়াত , সূরা ইউনূসের ৪১ আয়াত , সূরা হূদের ৩৫ আয়াত এবং সূরা কাসাসের ৫৫ আয়াতে বলা হয়েছে। দেখুন তাফহীমুল কুরআন, সূরা বাকারা, টীকা ১৩৯ , সূরা ইউনুস টীকা ৪৯ , সূরা হূদ, টীকা-৩৯ , সূরা আল কাসাস, আয়াত ৫৫ , টীকা ৭৯ ।
# যুক্তিসঙ্গত দলীল-প্রমাণ দিয়ে কথা বুঝানোর যে দায়িত্ব আমার ছিল তা আমি পালন করেছি। এখন অযথা ঝগড়া-বিবাদ করে লাভ কি? তোমরা ঝগড়া-বিবাদ করলেও আমি তা করতে প্রস্তুত নই।
# সেই সময় প্রতিদিনই মক্কায় যে পরিস্থিতির উদ্ভব হচ্ছিলো এখানে সেই পরিস্থিতির দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। লোকেরা কারো সম্পর্কে যখনই জানতে পারতো যে সে মুসলমান হয়েছে তখনই মরিয়া হয়ে তার পেছনে লেগে যেতো। দীর্ঘদিন পর্যন্ত তাকে কোনঠাসা করে রাখতো। না বাড়ীতে তাকে আরাম থাকতে দেয়া হতো, না মহল্লায় না জাতি-গোষ্ঠীর মধ্যে। সে যেখানেই যেতো সেখানেই অশেষ ও বিরামহীন এক বিতর্ক শুরু হতো। এর উদ্দেশ্য হতো, জাহেলিয়াত বর্জন করে যে ব্যক্তি তার গণ্ডীর বাইরে বের হয়ে গেছে সে যে কোনভাবেই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহচর্য ছেড়ে আবার সেদিকে ফিরে আসুক।
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
১৩-১৪ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
পূর্বের আয়াতগুলোতে আল্লাহ তা‘আলা বাহ্যিক ও দৈহিক নেয়ামত উল্লেখ করার পর এখানে তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ একটি নেয়ামতের কথা উল্লেখ করছেন তা হল : যে আল্লাহ তা‘আলা আকাশ-জমিনের সবকিছুর মালিক সে আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের জন্য এমন এক দীন শরীয়ত হিসেবে নির্ধারণ করে দিয়েছেন যা সব ধর্মের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ও পবিত্র। সে দীন হল ইসলাম, এ শ্রেষ্ঠ দীন দিয়ে আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়ার বুকে শ্রেষ্ঠ মানুষদের প্রেরণ করেছেন। তাদের মধ্যে পাঁচজন হলেন ‘উলূল আযম’ রাসূল। যথা : নূহ, ইবরাহীম, মূসা, ঈসা ও আমাদের নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)। পৃথিবীর সূচনা লগ্ন থেকে শেষ নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পর্যন্ত যত নাবী-রাসূল পৃথিবীতে এসেছেন সকলের ধর্মের মূলনীতি ছিল একটি, তা হলো এক আল্লাহ তা‘আলার ‘ইবাদত করতে হবে, যিনি ব্যতীত আর কোন সত্য মা‘বূদ নেই।
প্রশ্ন হতে পারে, সর্বপ্রথম নাবী আদম (আঃ)-এর কথা উল্লেখ না করে নূহ (আঃ) দ্বারা শুরু করা হল কেন? অথচ তিনি প্রথম নাবী! উত্তর : আদম (আঃ)-এর যুগে কোন কুফর ও শির্ক ছিল না; কারণ তিনি দীন নিয়েই পৃথিবীতে আসেন এবং তা পালন করেন। সর্বপ্রথম ধর্মের নামে সুধারণা নিয়ে শির্কের প্রর্বতন করা হয় নূহ (আঃ)-এর যুগে। তাই তাঁকে দিয়ে দীনের দাওয়াত শুরু করা হয়েছে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(وَإِذْ أَخَذْنَا مِنَ النَّبِيِّيْنَ مِيْثَاقَهُمْ وَمِنْكَ وَمِنْ نُّوْحٍ وَّإِبْرَاهِيْمَ وَمُوْسٰي وَعِيْسَي ابْنِ مَرْيَمَ ص وَأَخَذْنَا مِنْهُمْ مِّيْثَاقًا غَلِيْظًلا)
“আর স্মরণ কর! যখন আমি শপথ গ্রহণ করেছিলাম নাবীদের কাছ থেকে এবং তোমার কাছ থেকে, নূহ, ইবরাহীম ও ঈসা ইবনু মারইয়ামের কাছ থেকে আর তাদের থেকে গ্রহণ করেছিলাম অতি দৃঢ় প্রতিশ্রুতি।” (সূরা আহ্যাব ৩৩ : ৭)
আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(وَمَآ أَرْسَلْنَا مِنْ قَبْلِكَ مِنْ رَّسُوْلٍ إِلَّا نُوْحِيْٓ إِلَيْهِ أَنَّه۫ لَآ إِلٰهَ إِلَّآ أَنَا فَاعْبُدُوْنِ)
“আমি তোমার পূর্বে যখন কোন রাসূল প্রেরণ করেছি তার প্রতি এ ওয়াহী করেছি যে, ‘আমি ব্যতীত অন্য কোন সত্যিকার মা‘বূদ নেই; সুতরাং আমারই ‘ইবাদত কর।’ (সূরা আম্বিয়া- ২১ : ২৫)
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : আমরা রাসূলগণ বৈমাত্রেয় ভাই। (পিতা একই মাতা ভিন্ন) কিন্তু আমাদের সকলের ধর্ম এক ও অভিন্ন।
(أَنْ أَقِيْمُوا الدِّيْنَ)
অর্থাৎ সকল নাবীদের প্রতি এ মর্মে ওয়াহী করেছেন যে, তোমরা দীন তথা আল্লাহ তা‘আলার প্রতি ঈমান, রাসূলদের আনুগত্য ও তাওহীদের সাথে সকল ইবাদত সম্পাদন কর। এটাই সকল নাবীদের দীন, যদিও নিয়ম-পদ্ধতিতে কিছু পার্থক্য ছিল। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(لِكُلٍّ جَعَلْنَا مِنْكُمْ شِرْعَةً وَّمِنْهَاجًا)
“আমি তোমাদের প্রত্যেকের জন্য নির্দিষ্ট করে দিয়েছি একটি নির্দিষ্ট শারীয়ত ও একটি নির্দিষ্ট পথ।” ( সূরা মায়িদা ৫ : ৪৮)
(وَلَا تَتَفَرَّقُوْا فِيْهِ)
অর্থাৎ ধর্মের ভেতর দলাদলি ও মতানৈক্য সৃষ্টি করিও না। এ আয়াতে ধর্ম প্রতিষ্ঠিত রাখা ফরয ও বিভেদ সৃষ্টি করা হারাম বলা হয়েছে। ধর্ম বলে ইসলামকে বুঝানো হয়েছে যা সকল নাবীদের ধর্ম। সুতরাং ধর্মের ওপর ঐক্যবদ্ধ হয়ে থাকতে হবে, বিভিন্ন দল ও মতে বিভক্ত হয়ে ফেরকা তৈরি করা যাবে না।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(إِنَّ الَّذِيْنَ فَرَّقُوْا دِيْنَهُمْ وَكَانُوْا شِيَعًا لَّسْتَ مِنْهُمْ فِيْ شَيْءٍ إِنَّمَآ أَمْرُهُمْ إِلَي اللّٰهِ ثُمَّ يُنَبِّئُهُمْ بِمَا كَانُوْا يَفْعَلُوْنَ)
“নিশ্চয়ই যারা নিজেদের দীনকে (বিভিন্ন মতে) খণ্ড বিখণ্ড করেছে এবং বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়েছে তাদের কোন দায়িত্ব তোমার নয়; তাদের বিষয় আল্লাহর এখতিয়ারভুক্ত। আল্লাহ তাদেরকে তাদের কৃতকর্ম সম্বন্ধে অবহিত করবেন।” (সূরা আনআম ৬ : ১৫৯)
জামা‘আতী জিন্দেগীর গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা :
জামা‘আতবদ্ধ হয়ে জীবন-যাপন করা প্রতিটি মুসলিম ব্যক্তির ওপর আবশ্যক, দলে দলে বিভক্ত হওয়া হারাম। মুসলিমদেরকে জামা‘আতবদ্ধ হয়ে বসবাস করার প্রতি ইসলাম যে গুরুত্ব দিয়েছে তা বর্ণনাতীত। পবিত্র কুরআনে সূরা আলি ইমরানের ১০৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(وَاعْتَصِمُوْا بِحَبْلِ اللّٰهِ جَمِيْعًا وَّلَا تَفَرَّقُوْا)
“আর তোমরা সকলে মিলে আল্লাহর রশিকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধর এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না।” ইবনু কাসীর (রহঃ) বলেন : এ আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা জামা‘আতবদ্ধ জীবন যাপনের নির্দেশ করেছেন এবং দল-উপদলে বিভক্ত হতে নিষেধ করা হয়েছে। (ইবনু কাসীর) ইমাম কুরতুবী (রহঃ) বলেন : নিঃসন্দেহে আল্লাহ তা‘আলা সম্প্রীতির আদেশ করেন এবং দল-উপদলে বিভক্তি হতে নিষেধ করেন। কেননা, দলাদলিতেই ধ্বংস, আর জামা‘আতবদ্ধ জীবন-যাপনেই নাজাত। (কুরতুবী)
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের তিনটি বিষয়ে সন্তুষ্ট, আর তিনটি বিষয়ে অসন্তুষ্ট হন। তিনি তোমাদের জন্য সন্তুষ্ট হন যে, তোমরা তাঁরই ইবাদত করবে, তাঁর সাথে কোন কিছুকে শরীক করবে না। আর তোমরা আল্লাহ তা‘আলার রজ্জুকে সৃদৃঢ় ও সম্মিলিতভাবে ধারণ করবে, দলে দলে বিভক্ত হবে না। আর তোমাদের জন্য অপছন্দ করেন- মানুষের কথা নিয়ে টানা-হেঁচড়া করা, অযথা বেশি বেশি প্রশ্ন করা এবং সম্পদ নষ্ট করা। (সহীহ মুসলিম হা. ১৭১৫)
অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন :
مَنْ فَارَقَ الْجَمَاعَةَ شِبْرًا فَقَدْ خَلَعَ رِبْقَةَ الْإِسْلَامِ مِنْ عُنُقِهِ
যে ব্যক্তি মুসলিমদের জামা‘আত থেকে অর্ধ-হাত পরিমাণও দূরে সরে গেল সে ইসলামের বন্ধন তার কাঁধ থেকে সরিয়ে নিল। (আবূ দাঊদ হা. ৪৭৫৮, সহীহ)
তিনি আরো বলেন :
يَدُ اللّٰهِ مَعَ الجَمَاعَةِ
জামা‘আতীদের সাথেই আল্লাহ তা‘আলার হাত। (তিরমিযী হা. ২১৬৬, সহীহ)
সুতরাং মুসলিমরা যতদিন জামা‘আতবদ্ধ হয়ে জীবন-যাপন করেছে ততদিন তারা পৃথিবী শাসন করেছে, কিন্তু যখনই তারা জামা‘আত ভঙ্গ করে দলাদলি সৃষ্টি করল তখনই তাদের ওপর নেমে আসল লাঞ্ছনা ও অপমান।
কোন ভেড়ার পাল থেকে একটি ভেড়া আলাদা হয়ে গেলে যেমন নেকড়ে সহজেই তাকে আক্রমন করতে পারে ঠিক জামা‘আত থেকে আলাদা হয়ে গেলে অবস্থা তাই-ই হবে। ইসলামের মূল ভিত্তিই হল ঐক্য, একথাটি বুঝতে পেরেছিল ইংরেজরা, তারা বুঝতে পেরেছিল সাত সাগর তের নদী পাড়ি দিয়ে ভারতবর্ষ শাসন করা সম্ভব নয়। তাই তারা নীতি গ্রহণ করল মুসলিমরা এক থাকলে তাদের ওপর শাসন কায়েম করা যাবে না, সুতরাং এদেরকে শাসন করতে হলে প্রয়োজন (ডিভাইডেড এন্ড রোল) অর্থাৎ ‘বিভাজন কর এবং শাসন কর’ নীতি। আজও আমরা সে বিভাজনে পড়ে রইলাম। সুতরাং মুসলিমদের উচিত হবে তাদের সে পুরোনো গৌরবগাঁথা ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে সকলে এক হয়ে ইসলামের জন্য কাজ করা।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. সকল নাবীদের দীনের মূলনীতি ছিল একই- এক আল্লাহ তা‘আলার ‘ইবাদত করতে হবে এবং দলবদ্ধভাবে জীবন-যাপন করতে হবে, পৃথক হওয়া যাবে না।
২. সত্যের দা‘ওয়াত মুশরিকদের নিকট বড়ই রাগের একটি বিষয়।
৩. মানুষের ব্যাপারে পূর্ব থেকেই সিদ্ধান্ত করে রাখা হয়েছে।
৪. সকল মুসলিমকে জামা‘আত বদ্ধ হয়ে আমীরের নেতৃত্বে জীবন-যাপন করা আবশ্যক।
১৫ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
এটি এমন একটি মর্যাদাসম্পন্ন আয়াত, যেখানে আল্লাহ তা‘আলা পৃথক পৃথকভাবে দশটি হুকুম বা বিধান বর্ণনা করেছেন- আয়াতুল কুরসী ব্যতীত পবিত্র কুরআনে এরূপ আয়াত আর নেই। বিধানগুলো হলো।
প্রথম বিধান : (فَلِذٰلِكَ فَادْعُ)
অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে নির্দেশ দিয়েছেন যে, হে নাবী! তোমার প্রতি যা ওয়াহী করা হয়েছে তারই দিকে সমস্ত মানব জাতিকে দা‘ওয়াত দাও। তারা যেন এরই ওপর আমল করে। অর্থাৎ মানব জাতির ওপর দায়িত্ব হলো অন্যকে সঠিক দীনের দা‘ওয়াত দেয়া; কোন দল, তরীকা বা মতাদর্শের দিকে নয়।
দ্বিতীয় বিধান : (وَاسْتَقِمْ كَمَآ أُمِرْتَ)
অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা যে সঠিক দীনের কথা বলেছেন সে দীনের ওপর নিজেকে অটল-অবিচল রাখা, সে পথ থেকে বিচ্যুত না হওয়া।
তৃতীয় বিধান : (وَلَا تَتَّبِعْ أَهْوَا۬ءَهُمْ)
অর্থাৎ কাফির-মুশরিকরা যেভাবে তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করে, আল্লাহ ব্যতীত অন্যের ‘ইবাদত করে সেগুলো থেকে নিজে বেঁচে থাকা এবং অন্যকেও বাঁচিয়ে রাখা।
চতুর্থ বিধান : (اٰمَنْتُ بِمَآ أَنْزَلَ اللّٰهُ مِنْ كِتٰبٍ)
অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা যে কিতাবসমূহ অবতীর্ণ করেছেন সেগুলোর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা। এমনটি যেন না হয় যেমনটি ইয়াহূদীরা করত, তারা কিতাবের এক অংশের প্রতি ঈমান আনত আর অন্য অংশের প্রতি কুফরী করত।
পঞ্চম বিধান : (وَأُمِرْتُ لِأَعْدِلَ بَيْنَكُمُ)
অর্থাৎ “আমি তোমাদের মধ্যে ইনসাফ করার জন্য আদিষ্ট হয়েছি” মানুষের মধ্যে ন্যায় বিচার কায়েম করতে হবে। কোনভাবেই কোন প্রকার অন্যায় বিচার-ফায়সালা করা যাবে না।
ষষ্ঠ বিধান : (اَللّٰهُ رَبُّنَا وَرَبُّكُمْ)
অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা, রিযিকদাতা একমাত্র আল্লাহ। তিনি সকলের রব- এ কথা স্বীকার করা।
সপ্তম বিধান : (لَنَآ أَعْمَالُنَا وَلَكُمْ أَعْمَالُكُمْ)
অর্থাৎ কাফির-মুশরিকদের সাথে কোন প্রকার সম্পর্ক না রাখা, সর্বপ্রকার সম্পর্ক থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা। আর প্রত্যেকের কৃতকর্মের ফল তাকেই ভোগ করতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(وَإِنْ كَذَّبُوْكَ فَقُلْ لِّيْ عَمَلِيْ وَلَكُمْ عَمَلُكُمْ ج أَنْتُمْ بَرِيْ۬ئُوْنَ مِمَّآ أَعْمَلُ وَأَنَا بَرِيْ۬ءٌ مِّمَّا تَعْمَلُوْنَ)
“এবং তারা যদি তোমার প্রতি মিথ্যা আরোপ করে তবে তুমি বল : ‘আমার কর্ম (কর্মফল) আমার এবং তোমাদের কর্ম (কর্মফল) তোমাদের জন্য। আমি যা করি সে বিষয়ে তোমরা দায়মুক্ত এবং তোমরা যা কর সে বিষয়ে আমিও দায়মুক্ত।’’ (সূরা ইউনুস ১০ : ৪১)
সুদ্দী (রহঃ) বলেন : এ বিধান মক্কায় ছিল, আর মদীনায় জিহাদের আয়াতগুলো অবতীর্ণ হওয়ার মাধ্যমে তা রহিত হয়ে যায়। কেননা জিহাদের সারমর্ম হল যারা উপদেশ ও অনুরোধে প্রভাবিত হবে না তাদেরকে যুদ্ধের মাধ্যমে পরাভূত করতে হবে। তাদেরকে তাদের অবস্থার ওপর ছেড়ে দিলে হবে না। তবে সঠিক কথা হল, রহিত হয়নি বরং দলীলের মাধ্যমে সত্য প্রমাণিত হওয়ার পর সত্য বর্জন করলে তাদের সাথে কোন সম্পর্ক থাকবে না।
অষ্টম বিধান : (لَا حُجَّةَ بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمْ)
অর্থাৎ কাফির-মুশরিকদেরকে এ কথা স্পষ্টভাবে বলে দেয়া যে, সত্য স্পষ্ট হয়ে যাবার পর আমাদের মধ্যে এবং তোমাদের মধ্যে কোন প্রকার ঝগড়া-বিবাদ, তর্ক-বিতর্কের প্রয়োজন নেই।
৯ম বিধান : (اَللّٰهُ يَجْمَعُ بَيْنَنَا)
অর্থাৎ কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা‘আলা সকলকে একত্রিত করবেন এ বিশ্বাস পোষণ করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(قُلْ يَجْمَعُ بَيْنَنَا رَبُّنَا ثُمَّ يَفْتَحُ بَيْنَنَا بِالْحَقِّ ط وَهُوَ الْفَتَّاحُ الْعَلِيْمُ)
“বল, আমাদের প্রতিপালক আমাদেরকে একত্রিত করবেন, অতঃপর তিনি আমাদের মধ্যে বিচার করবেন সঠিকভাবে, আর তিনিই শ্রেষ্ঠ ফায়সালাকারী, সর্বজ্ঞ।” (সূরা সাবা ৩৪ : ২৬)
১০ম বিধান : (وَإِلَيْهِ الْمَصِيْرُ)
অর্থাৎ সকলের মৃত্যুর পর প্রত্যাবর্তন তাঁরই নিকট- বিশ্বাস পোষণ করা।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. আল্লাহ তা‘আলার পথে অটল থাকতে হবে এবং মানুষকে তাঁর পথে ডাকতে হবে।
২. প্রবৃত্তির অনুসরণ করা যাবে না।
৩. ন্যায় বিচার করতে হবে, কোন প্রকার জুলুম করা যাবে না।
১৬ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
যে দীন দ্বারা আল্লাহ তা‘আলা নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে প্রেরণ করেছেন সে দীনের প্রতি আহ্বান করার পরেও যারা আল্লাহ তা‘আলা সম্পর্কে বিতর্ক করে, বিভিন্ন যুক্তি-তর্ক পেশ করে, তাদের যুক্তি মূলত ভিত্তিহীন ও বাতিল আর তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি। কেননা তারা এ সকল বাতিল তর্ক-বিতর্কের ফলে আল্লাহ তা‘আলার ক্রোধের পাত্রে পরিণত হয়েছে। এর দ্বারা ঐ সকল মুশরিদেরকে বুঝানো হয়েছে যারা মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ধর্মকে মেনে নিয়েছে এ উদ্দেশ্যে যে, যাতে করে তারা পুনরায় মু’মিনদেরকে সত্য পথ থেকে বিচ্যুত করতে পারে অথবা এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো ইয়াহূদী এবং খ্রিস্টানরা, যারা মুসলিমদের সঙ্গে তর্ক-বিতর্ক করত এবং বলত : আমাদের ধর্ম তোমাদের ধর্মের চেয়ে উত্তম এবং আমাদের নাবী তোমাদের নাবীর পূর্বে এসেছিলেন। অতএব আমরা তোমাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ।
دَاحِضَةٌ অর্থ হলো, দুর্বল, বাতিল, অসার, অনর্থক, ভিত্তিহীন ইত্যাদি। অর্থাৎ তাদের প্রমাণাদী আল্লাহ তা‘আলার কাছে অনর্থক।
الكِتٰبَ দ্বারা এখানে কুরআনসহ সমস্ত আসমানী কিতাবকে বুঝানো হয়েছে।
তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
১৩-১৪ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা’আলা এই উম্মতের উপর যে নিয়ামত দান করেছেন, এখানে মহান আল্লাহ তারই বর্ণনা দিচ্ছেন। মহান আল্লাহ বলেনঃ আল্লাহ তোমাদের জন্যে যে দ্বীন ও শরীয়ত নির্ধারণ করেছেন তা ওটাই যা হযরত আদম (আঃ)-এর পরে দুনিয়ার সর্বপ্রথম রাসূল হযরত নূহ (আঃ) এবং সর্বশেষ রাসূল হযরত মুহাম্মাদ (সঃ)-এর মধ্যবর্তী স্থির প্রতিজ্ঞ নবীদের (আঃ) ছিল। এখানে যে পাঁচজন নবী (আঃ)-এর নাম উল্লেখ করা হয়েছে তাঁদেরই নাম উল্লেখ করা হয়েছে সূরায়ে আহযাবেও। সেখানে রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “স্মরণ কর, যখন আমি নবীদের নিকট হতে অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলাম এবং তোমার নিকট হতেও এবং নূহ (আঃ), ইবরাহীম (আঃ), মূসা (আঃ) মরিয়ম তনয় ঈসা (আঃ)-এর নিকট হতে, তাদের নিকট হতে গ্রহণ করেছিলাম দৃঢ় অঙ্গীকার।”(৩৩:৭) ঐ দ্বীন, যা সমস্ত নবীর মধ্যে মিলিতভাবে ছিল তা হলো এক আল্লাহর ইবাদত। যেমন মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “তোমার পূর্বে আমি যতজন রাসূল পাঠিয়েছিলাম তাদের সবারই কাছে এই অহী করেছিলামঃ আমি ছাড়া কোন মা’বুদ নেই, সুতরাং তোমরা আমারই ইবাদত কর।”(২১:২৫) হাদীসে এসেছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আমরা নবীরা পরস্পর বৈমাত্রেয় ভাই-এর মত। আমাদের সবারই একই দ্বীন।” যেমন বৈমাত্রেয় ভাইদের পিতা একজনই। মোটকথা, শরীয়তের আহকামে যদিও আংশিক পার্থক্য রয়েছে, কিন্তু মৌলিক নীতি হিসেবে দ্বীন একই। আর তা হলো মহামহিমান্বিত আল্লাহর একত্ববাদ। মহান আল্লাহ বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “তোমাদের প্রত্যেকের জন্যে আমি শরীয়ত ও পথ করে দিয়েছি।”(৫:৪৮)।
এখানে এই অহীর ব্যাখ্যা এভাবে দেয়া হয়েছেঃ “তোমরা দ্বীনকে কায়েম রেখো, দলবদ্ধ হয়ে একত্রিতভাবে বাস কর এবং মতানৈক্য সৃষ্টি করে পৃথক পৃথক হয়ে যেয়ো না। তাওহীদের এই ডাক মুশরিকদের নিকট অপছন্দনীয়। সত্য কথা এই যে, হিদায়াত আল্লাহর হাতে। যে হিদায়াত লাভের যোগ্য হয় সে তার প্রতিপালকের দিকে ফিরে যায় এবং মহান আল্লাহ তার হাত ধরে তাকে হিদায়াতের পথে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করিয়ে দেন। পক্ষান্তরে যে নিজেই মন্দ পথ অবলম্বন করে এবং সঠিক ও সরল পথকে ছেড়ে দেয়, আল্লাহও তখন তার মাথায় পথভ্রষ্টতা লিখে দেন। যখন তার কাছে সত্য এসে যায়, হুজ্জত কায়েম হয়ে যায়, তখন পারস্পরিক হঠকারিতার ভিত্তিতে পরস্পরের মধ্যে মতানৈক্য সৃষ্টি হয়।
মহান আল্লাহ বলেনঃ হে নবী (সঃ)! যদি এক নির্ধারিত কাল পর্যন্ত অবকাশ সম্পর্কে তোমার প্রতিপালকের পূর্ব সিদ্ধান্ত না থাকতো তবে তাদের বিষয়ে এখনই ফায়সালা হয়ে যেতো এবং তাদের উপর এই দুনিয়াতেই শাস্তি আপতিত হতো।
এরপর আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ তাদের পর যারা কিতাবের উত্তরাধিকারী। হয়েছে তারা কুরআন সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর সন্দেহে রয়েছে। তারা তাদের পূর্ববর্তীদের অন্ধ অনুসারী। দলীল প্রমাণাদির ভিত্তিতে তাদের ঈমান নেই। বরং তারা অন্ধভাবে তাদের পূর্ববর্তীদের অনুসরণ করছে যারা সত্যের প্রতি অবিশ্বাসী ছিল।
১৫ নং আয়াত এর তাফসীর:-
কুরআন কারীমের এই আয়াতের মধ্যে দশটি স্বতন্ত্র কালেমা রয়েছে যেগুলোর প্রত্যেকটির হুকুম পৃথক পৃথক। আয়াতুল কুরসী ছাড়া এ ধরনের আয়াত কুরআন কারীমের মধ্যে আর পাওয়া যায় না।
প্রথম হুকুম তো এই হচ্ছেঃ হে নবী (সঃ)! তোমার উপর অহী অবতীর্ণ করা হয়েছে এবং অনুরূপ অহী তোমার পূর্ববর্তী নবীদের (আঃ) উপরও হতো। তোমার জন্যে যে শরীয়ত নির্ধারণ করা হয়েছে, তুমি সমস্ত মানুষকে ওরই দাওয়াত দাও। প্রত্যেককে ওরই দিকে আহ্বান কর এবং ওকে মানাবার এবং ছাড়াবার চেষ্টায় লেগে থাকো। দ্বিতীয় হুকুমঃ আল্লাহ তা’আলার ইবাদত ও একত্ববাদের উপর তুমি নিজে প্রতিষ্ঠিত থাকো এবং তোমার অনুসারীদেরকে ওর উপর প্রতিষ্ঠিত রাখো। তৃতীয় হুকুমঃ মুশরিকরা যে মতভেদ সৃষ্টি করে রেখেছে, মিথ্যারোপ ও অবিশ্বাস করা যে তাদের অভ্যাস, গায়রুল্লাহর ইবাদত করাই যে তাদের নীতি, সাবধান! কখনো তোমরা তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না এবং তাদের একটা কথাও স্বীকার করো না। চতুর্থ হুকুমঃ প্রকাশ্যভাবে তোমার এই আকীদার কথা প্রচার করতে থাকো, তা এই যে, তুমি বলে দাও- আল্লাহ যেসব কিতাব অবতীর্ণ করেছেন, সবগুলোর উপরই আমি ঈমান রাখি। আমার এই কাজ নয় যে, কোনটি মানবো এবং কোনটি মানবো না, একটিকে গ্রহণ করবো ও অপরটিকে ছেড়ে দিবো। পঞ্চম হুকুমঃ তুমি বলে দাও আমি আদিষ্ট হয়েছি। তোমাদের মধ্যে ন্যায় বিচার করতে। ষষ্ঠ হুকুমঃ তুমি বল, সত্য মা’বুদ একমাত্র আল্লাহ। তিনি আমাদেরও প্রতিপালক এবং তোমাদেরও প্রতিপালক। তিনি সবারই পালনকর্তা ও আহারদাতা। খুশী মনে কেউ কেউ তার দিকে ঝুঁকে না পড়লেও প্রকৃতপক্ষে সবকিছুই তার সামনে ঝুঁকে রয়েছে এবং সিজদায় পড়ে আছে। সপ্তম হুকুমঃ তুমি বলে দাও আমাদের আমল আমাদের সাথে এবং তোমাদের আমল তোমাদের সাথে। আমাদের ও তোমাদের মধ্যে কোনই সম্পর্ক নেই। যেমন অন্য আয়াতে মহান আল্লাহ বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “হে নবী (সঃ)! যদি তারা তোমাকে অবিশ্বাস করে তবে তুমি তাদেরকে বলে দাও আমার জন্যে আমার কর্ম এবং তোমাদের জন্যে তোমাদের কর্ম। আমি যে কর্ম করি তা হতে তোমরা দায়িত্বমুক্ত এবং তোমরা যে কর্ম কর তা হতে আমিও দায়িত্বমুক্ত।”(১০:৪১) অষ্টম হুকুমঃ তুমি বলে দাওআমাদের ও তোমাদের মধ্যে কোন ঝগড়া-বিবাদ নেই, নেই কোন তর্ক-বিতর্কের প্রয়োজন। হযরত সুদ্দী (রঃ) বলেন যে, এ হুকুম মক্কায় ছিল। মদীনায় আগমনের পর জিহাদের হুকুম নাযিল হয়। খুব সম্ভব এটাই ঠিক। কেননা এটা মক্কী আয়াত: আর জিহাদের আয়াতগুলো অবতীর্ণ হয় মদীনায় হিজরতের পর। নবম হুকুমঃ বলে দাও- কিয়ামতের দিন আল্লাহ সকলকেই একত্রিত করবেন। যেমন অন্য আয়াতে রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “তুমি বলে দাও আমাদের প্রতিপালক আমাদেরকে একত্রিত করবেন, অতঃপর সত্যের সাথে আমাদের মধ্যে ফায়সালা করবেন, তিনিই ফায়সালাকারী এবং সর্বজ্ঞ।”(৩৪:২৬) দশম হুকুমঃ বল- প্রত্যাবর্তন তারই নিকট।
১৬ নং আয়াত এর তাফসীর:-
আল্লাহ তাআলা ঐ লোকদেরকে ভয় প্রদর্শন করছেন যারা মুমিনদের সাথে বাজে যুক্তি-তর্কে লিপ্ত হয় এবং তাদেরকে হিদায়াত হতে বিভ্রান্ত করার ইচ্ছা করে এবং আল্লাহর দ্বীনে বিশৃংখলা সৃষ্টি করে। তাদের যুক্তি-তর্ক মিথ্যা ও অসার। তারা আল্লাহ তা’আলার ক্রোধের পাত্র। কিয়ামতের দিন তাদের জন্যে রয়েছে কঠিন শাস্তি। তাদের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হওয়া অসম্ভব। তা এই যে, মুসলমানরা পুনরায় অজ্ঞতার দিকে ফিরে যাবে। অনুরূপভাবে ইয়াহুদী ও খৃষ্টানরাও বাজে তর্ক করতো এবং মুসলমানদেরকে বলতোঃ “আমাদের দ্বীন তোমাদের দ্বীন অপেক্ষা উত্তম, আমাদের নবী তোমাদের নবীর পূর্বে এসেছিলেন, আমরা তোমাদের চেয়ে উত্তম এবং আমরা আল্লাহ তাআলার নিকট তোমাদের চেয়ে প্রিয়। তারা এগুলো মিথ্যা বলেছিল।
ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
*দলে দলে বিভক্ত হওয়ার পরিণতি : এরপর পুনরায় ১৩ থেকে ১৬ নং আয়াত জুড়ে পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে ওহী ও রেসালাত সংক্রান্ত আলােচনার। ‘সেই দ্বীনকে তিনি তােমাদের জন্যে নির্ধারিত করে দিয়েছেন, যার নির্দেশ তিনি দিয়েছিলেন নূহকে…’(১৩-১৬) সূরার শুরুতে বলা হয়েছে, ‘এভাবেই আল্লাহ তােমার কাছে ও তােমার পূর্ববর্তীদের কাছে ওহী করেন…’ এ বক্তব্যে সংক্ষেপে ইংগিত দেয়া হয়েছে যে, সকল ওহীর উৎস এক এবং সকল ঐশী বিধান মৌলিকভাবে অভিন্ন। এখানে ১৩-১৬ নং আয়াতে উক্ত ইংগিতের বিশদ ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। এখানে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ তায়ালা মুসলমানদেরকে যে নির্দেশ দিয়েছেন, তা সামগ্রিকভাবে অবিকল হযরত নূহ, ইবরাহীম, মূসা ও ঈসাকে দেয়া নির্দেশেরই অনুরূপ। এই নির্দেশ হলাে, তারা যেন আল্লাহ তায়ালার দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত করে এবং এ ব্যাপারে দলে দলে বিভক্ত না হয়। আল্লাহর চিরস্থায়ী বিধানের ওপর যেন তারা অবিচল থাকে, মতবিরােধে লিপ্তদের খেয়াল খুশীর দিকে যেন ভ্রুক্ষেপ না করে। ইসলামের প্রাধান্য যেন বজায় রাখে, আল্লাহর সম্পর্কে বিতর্ককারীদের যুক্তি যেন খন্ডন করে এবং তাদেরকে কঠিন গযব ও আযাব সম্পর্কে যেন সতর্ক করে দেয়। পূর্ববর্তী আয়াতগুলাের সাথে এ তিনটি আয়াতের বক্তব্যে চমৎকার সাদৃশ্য রয়েছে, “তিনি তােমাদের জন্যে নির্ধারিত করে দিয়েছেন সেই দ্বীনকে, যার নির্দেশ তিনি দিয়েছেন নূহকে… তোমরা দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত কর এবং তার কোনাে বিভেদ সৃষ্টি করে না….”(আয়াত ১৩) আয়াতের এ অংশটুকু দ্বারা সুরার প্রথমে দেয়া বক্তব্যের বিশদ ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে যে, ইসলামের মূল উৎস এক ও অভিন্ন এবং আবহমান কাল ধরে সেই একই দ্বীন চালু রয়েছে। এই সাথে মােমেনের অনুভূতিতে একটা চমকপ্রদ শিহরণ বুলানাে হয়েছে। সে যখন দূর থেকে তার পূর্ববর্তীদের দিকে দৃষ্টি দিয়েছে, তখন তাকে দেখানাে হয়েছে যে, হযরত নূহ, হযরত ইবরাহীম, হযরত মূসা ও হযরত ঈসা(আ.) একের পর এক দাড়িয়ে আছেন। তাকে বুঝানাে হয় যে, সে এই সব মহান ব্যক্তিত্বের উত্তরসূরী, এ পথে চলতে তার যতাে কষ্ট হােক এবং যতাে ত্যাগ স্বীকার করুক, অচিরেই সে আনন্দ বােধ করবে এবং পরিণামে শান্তি লাভ করবে। সে ইতিহাসের সূচনা লগ্ন থেকে চলে আসা দ্বীনের এই মহান নেতৃর্গের পদাংক অনুসারী। এ আয়াতাংশে এই ধারণাও দেয়া হয়েছে যে, আল্লাহর এই এক ও অভিন্ন দ্বীনের অনুসারীদের মধ্যে গভীর শান্তি ও সৌহার্দ বিরাজ করে, তাদের মধ্যে বিদ্বেষ ও শক্রতা থাকে না, পরস্পরের মধ্যে অটুট আত্মীয়তার অনুভূতি বিরাজ করে, এই অনুভূতি তাদেরকে পারস্পরিক সহযােগিতা ও সমঝোতার আহ্বান জানায়। অতীতের সাথে বর্তমানের সেতুবন্ধন রচনা করে এবং ঐক্যবদ্ধ ও সংঘবদ্ধ হয়ে দ্বীনের পথে চলার প্রেরণা যােগায়। হযরত মুহাম্মদ(স.)-এর প্রতি ঈমান আনয়নকারীদের জন্যে নির্ধারিত দ্বীন যখন অবিকল হযরত নূহ, ইবরাহীম, মূসা ও ঈসার দ্বীন, তখন মূসা ও ঈসার(আ.) অনুসারীরা কিসের জন্যে লড়াই করে? কিসের জন্যে হযরত ঈসার অনুসারীরা উপদলীয় কোন্দলে রক্ত ঝরায়ঃ কি কারণেই বা মূসা ও ঈসার অনুসারীরা মুহাম্মদ(স.)-এর অনুসারীদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়! কেনই বা হযরত ইবরাহীমের অনুসারী হবার দাবীদার মােশরেকরা মুসলমানদের সাথে লড়াই করে। কেন এরা সবাই সেই একই পতাকার তলে সমবেত হয় না, যা তাদের শেষ রসূল তুলে ধরেন? সকলের জন্যে একমাত্র নির্দেশ হলো, দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত কর এবং এ ব্যাপারে বিভেদে লিপ্ত হয়ো না। সুতরাং সবার উচিত ঐক্যবদ্ধভাবে দ্বীন প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসা, এর দায়িত্ব বহন করা। এ কাজ থেকে পিছু না হটা, বাঁকা পথে না চলা এবং এর পতাকাতলে এককাতারে শামিল হয়ে অবস্থান করা। এই পতাকা একই পতাকা, যাকে একের পর এক হযরত নূহ, ইবরাহীম, মুসা ও ঈসা বহন করেছেন এবং সর্বশেষে বহন করেছেন হযরত মুহাম্মদ(স.)। কিন্তু উম্মুল কোরা অর্থাৎ মক্কা ও তার আশপাশের মােশরেকরা নিজেদেরকে হযরত ইবরাহীমের অনুসারী দাবী করেও এই প্রাচীন দ্বীনের দাওয়াত সম্পর্কে ভিন্নমত তথা বৈরী মত পােষণ করতাে। ‘মােশরেকদের কাছে তােমরা যে আহ্বান জানাও তা তাদের কাছে খুবই দুর্বিষহ বলে মনে হয়। অর্থাৎ তাদের সবাইকে বাদ দিয়ে মােহাম্মদের(স.) ওপর ওহী নাযিল হওয়াটা তাদের কাছে অসহনীয়। কেননা তারা মনে করতাে যে, মক্কা ও তায়েফের যে কোনাে নামকরা ব্যক্তির ওপর ওহী নাযিল হবে। মুহাম্মদ(স.)-কে তারা সত্যবাদী ও বিশ্বাসী বলে মানতাে এবং তিনি কোরায়শ বংশের মধ্যম স্তরের ভ্রান্ত পরিবারের ছেলে ছিলেন। তবুও তাদের দৃষ্টিতে তিনি একটা গোত্রের ক্ষমতাধর সরদার হওয়ারও যােগ্য বিবেচিত হলেন না। তাদের যাবতীয় ক্ষমতা ও প্রতাপের ভিত্তি ছিলাে পৌত্তলিকতা। এই পৌত্তলিকতা ও পৌত্তলিক কৃষ্টির অবসানের মধ্য দিয়ে তাদের ক্ষমতা ও নেতৃত্বের পতন ঘটুক তা সহ্য করতে তারা কোন ভাবেই প্রস্তুত ছিলাে না। তাদের পৌত্তলিকতার ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিলাে তাদের অর্থনৈতিক ও ব্যক্তিগত স্বার্থ। তাই তারা পৌত্তলিকতাকে আঁকড়ে ধরে রেখেছিলাে এবং রসূল(স.) কর্তৃক প্রদত্ত খালেস তাওহীদের ডাক তাদের কাছে অসহনীয় হয়ে উঠেছিলাে। তাদের মৃত পৌত্তলিক পূর্বপুরুষরা বিপথগামিতা ও জাহেলিয়াতের ওপর মারা গেছে-এ কথা বললে তাদের আত্মসম্মানে আঘাত লাগতাে। তাই এটা তারা বরদাশত করতে পারতাে না। এ জন্যে তাদেরকে কেউ বিপথগামী বলে নিন্দা করলে তার জন্যে তারা লড়াই করে মরে জাহান্নামে যেতেও প্রস্তুত থাকতাে। কোরআন তাদের এই মানসিকতা নিয়ে মন্তব্য করেছে যে, আল্লাহ তায়ালা কাকে নবীরূপে বরণ করবেন, সেটা তিনিই স্থির করেন এবং তিনি তাকেই হেদায়াত করেন যে তার অনুগত হয় ও তওবা করে। আল্লাহ তায়ালাই যাকে ইচ্ছা করেন বরণ করে নেন এবং যে তার প্রতি অনুগত হয়, তাকে সুপথে চালিত করেন। আল্লাহ তায়ালা মুহাম্মদ(স.)-কে রাসূল হিসাবে মনােনীত করেছেন। তিনিই তার অনুগত বান্দার জন্যে পথ সুগম করেন। এরপর রসূলদের অনুসারীদের সম্পর্কে পুনরায় আলােচনা করা হয়েছে। রসূলদের একই দ্বীন নিয়ে তাদের কাছে এসেছিলেন। কিন্তু তাদের অনুসারীরা দলে দলে বিভক্ত হয়েছিলাে। ‘তারা তাদের কাছে জ্ঞান আসার পরই বিভক্ত হলাে…'(আয়াত ১৪) অর্থাৎ তারা যে দলে উপদলে বিভক্ত হয়েছে, সেটা অজ্ঞতার কারণে নয়। তারা এ জন্যে বিভক্ত হয়নি যে, তাদের ধর্মের উৎসের অভিজ্ঞতার কথা তারা জানতাে না। সবকিছু জেনেই তারা কোন্দলে লিপ্ত হয়েছিলাে। পরস্পরের প্রতি হিংসা, বিদ্বেষ, যুলুম ও বিদ্রোহের মনােভাব পােষণ করার কারণেই তারা দলে দলে বিভক্ত হয়েছে। নিছক প্রবৃত্তির লালসা ও স্বার্থপরতার কারণেই তারা পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্ত হয়েছে। সঠিক নির্ভুল ও মূল আকীদা ও আদর্শে তাদের বিভেদের পক্ষে কোনাে সমর্থন ছিলাে না। সেই আদর্শের প্রতি যদি তাদের আন্তরিকতা ও নিষ্ঠা থাকতাে তাহলে তারা বিভেদে লিপ্ত হতাে না। এ সব অপকর্ম দ্বারা তারা নিজেদেরকে তাৎক্ষণিকভাবে আল্লাহর আযাবের শিকার হওয়ার যােগ্য বানিয়েছিলাে। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা স্বীয় মহৎ ও প্রজ্ঞাময় উদ্দেশ্যে তাদেরকে একটা নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত অবকাশ দেবেন বলে পূর্বাহ্নে সিদ্ধান্ত নেয়ার তাৎক্ষণিকভাবে আযাব নাযিল করেননি। আল্লাহ যদি পূর্বাহ্নে একটা সিদ্ধান্ত না নিতেন, তাহলে তাদের বিষয়ে ফয়সালা হয়ে যেতাে। অর্থাৎ এই দুনিয়াতেই কোনটা সত্য ও কোনটা মিথ্যে, তার ফয়সালা করে দেয়া হতাে। কিন্তু তাদেরকে কেয়ামত পর্যন্ত সময় দেয়া হয়েছে। কিন্তু নবীদের অনুসারীদের মধ্য থেকে যারা নিজেরাও বিভেদের শিকার হয়েছে এবং অন্যদেরকেও বিভেদের দিকে ঠেলে দিয়েছে। তাদের পরবর্তী যে বংশধর কিতাবের উত্তরাধিকারী হয়েছে, তারা কিতাবকে দৃঢ় বিশ্বাস সহকারে নয় বরং সন্দেহ সংশয়সহ গ্রহণ করেছে। কেননা পূর্ববর্তী মতভেদগুলাে তাদের মধ্যে অবিশ্বাস, সন্দেহ সংশয় ও রকমারি দল উপদল সম্পর্কে অস্থিরতা উস্কে দিয়েছিলাে। ‘যারা তাদের পরে কিতাবের উত্তরাধিকারী হয়েছিলাে, তারা সন্দেহ সংশয়ে লিপ্ত।’ আকীদা বিশ্বাস নিয়ে এ ধরনের ভূমিকা শোভা পায় না। মােমেনের আকীদা বিশ্বাস হতে হয় পাথরের মতাে অটুট। তার চারপাশের সমগ্র পৃথিবী টলতে থাকবে, কিন্তু সে থাকবে অটল, তার পা থাকবে সেই পাথরের ওপর অবিচল। আকীদা হচ্ছে আকাশের সেই স্থির নক্ষত্র, যার দিকে একজন মােমেন সমস্ত বাধাবিপত্তি ও ঝড় বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে এগিয়ে যায় এবং বিপথগামী হয় না। কিন্তু আকীদা বিশ্বাস নিয়ে যদি কেউ সন্দেহ সংশয় ও অস্থিরতায় ভােগে, তবে সে আর কোনাে কিছুতেই স্থিরতা ও নিশ্চয়তা লাভ করতে পারে না। আকীদা বিশ্বাসের আগমন ঘটেছিলােই এ জন্যে যে, বিশ্বাসীদেরকে আল্লাহর পথের সন্ধান দেবে এবং অস্থিরতা ও বিপথগামিতা থেকে রক্ষা করবে। কিন্তু মুসলমানরা যখন নিজেদের আকীদা নিয়ে সন্দেহ সংশয়ে পতিত হলাে, তখন তারা আর বিশ্বে নেতৃত্বের যােগ্য থাকলাে না, বরং নিজেরাই উদ্ভ্রান্ত হয়ে গেলাে। ইসলামের অভ্যুদয়কালে পূর্ববর্তী নবীদের অনুসারীদের অবস্থা এ রকমই ছিলো। ভারতের বিশিষ্ট আলেম আবুল হাসান নদভী তার ‘মাযা খাসিরাল আ’লামু বেইনহিতাতিল’ (মুসলমানদের পতনে বিশ্ব কী হারালাে) নামক পুস্তকে বলেন, ‘প্রধান প্রধান ধর্মগুলাে ভন্ড, মােনাফেক, বিকৃতকারী ও অবজ্ঞাকারীদের ছিনিমিনি খেলার শিকার হয়ে নিজ নিজ আসল রূপ ও প্রাণ শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। এভাবে এই ধর্মগুলাে এতটা বিকৃত হয়ে গেছে যে, এর সাবেক একনিষ্ঠ অনুসারীরা যদি আজ পুনরুজ্জীবিত হয়, তবে এগুলােকে চিনতেই পারবে না। যেসব দেশে সভ্যতা, সংস্কৃতি, সুশাসন ও রাজনীতির সুষ্ঠু চর্চা হতাে, তা আজ নৈরাজ্য, অধােপতন, বিভেদ, কু-শাসন, প্রশাসনিক নিষ্ঠুরতা, যুলুম ও স্বার্থপরতার লীলাভূমিতে পরিণত হয়েছে। তাদের কাছে এখন আর বিশ্ববাসীর জন্যে কোনাে আবেদন নেই। জাতিগুলাের জন্যে কোনো আহ্বান নেই। তারা তাদের সমস্ত প্রাণশক্তি হারিয়ে ফেলেছে, তাদের জীবনী শক্তি নিঃশেষ হয়ে গেছে। তাদের কাছে আল্লাহর দ্বীনের নির্মল জ্ঞানের উৎসও নেই, স্থীতিশীল কোনাে মানব কল্যাণমূলক শাসন ব্যবস্থাও নেই। (পৃঃ ২২) প্রখ্যাত ইউরােপীয় লেখক জি, এইচ, ডেনিসন ‘স্বীয় সভ্যতার ভিত্তি হিসেবে আধ্যাত্মিকতা’ নামক গ্রন্থে বলেন, ‘পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতকে সভ্যজগত নৈরাজ্যের কবলে পড়ে ধ্বংসের মুখােমুখি এসে দাড়িয়েছিলাে। কেননা যেসব আকীদা বিশ্বাস সভ্যতার প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করতাে, তা ধ্বসে পড়েছিলাে। আর তার স্থলাভিষিক্ত হবার মতাে কোনাে বিকল্পেরও আবির্ভাব তখনাে ঘটেনি। তখন মনে হচ্ছিলাে যে, চার হাজার বছর ধরে যে বৃহত্তম সভ্যতার উদ্ভব ঘটেছিলাে, তা ধ্বংস হতে চলেছে এবং মানব জাতি সাবেক বর্বরতা ও পাশবিকতায় ফিরে যাচ্ছে। কেননা গােত্রগুলাে ক্রমাগত যুদ্ধে লিপ্ত হচ্ছিলাে এবং আইন ও শাসন বলতে কোনাে কিছুই অবশিষ্ট ছিলাে না। খৃষ্টবাদের উত্তরাধিকারী সর্দারগুলাে ঐক্য ও শৃংখলার পরিবর্তে ধ্বংস ও বিভেদের রসদ যােগাচ্ছিলাে। সভ্যতা এমন একটা প্রকান্ড গাছের ন্যায় বহু ডালপালা ছড়িয়ে সারাবিশ্বের ওপর তার ছায়া বিস্তার করে দাড়িয়েছিলাে, যার কান্ডটা ভেতর থেকে সম্পূর্ণরূপে পচে গিয়েছিলাে এবং যে কোনাে মুহূর্তে ধুলিসাৎ হবার অপেক্ষায় ছিলে। এহেন সর্বব্যাপী ধ্বংস ও নৈরাজ্যের লক্ষণাদি দেখা দেয়ার মধ্য দিয়েই এই মহাপুরুষ জন্ম নিলেন, যিনি সারাবিশ্বকে একত্রিত করলেন।’ অর্থাৎ মােহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম। রসূলদের অনুসারীদের সজ্ঞানে কোন্দলে জড়িয়ে পড়া, কিতাবের উত্তরাধিকারীদের সংশয়ে লিপ্ত হওয়া। বিশ্ব নেতৃত্বের কেন্দ্রস্থলটি একজন প্রাজ্ঞ, প্রত্যয়ী ও আল্লাহ ভক্ত নেতা থেকে শূন্য থাকার প্রেক্ষাপটে আল্লাহ তায়ালা মােহাম্মদ(স.)-কে রসূল করে পাঠালেন এবং তাকে দাওয়াত দিতে ও দাওয়াতের কাজে অবিচল থাকতে আদেশ দিলেন। তাকে সতর্ক করলেন যে, তার ও তার দাওয়াতের চারপাশে স্বার্থপরদের ধস্তাধস্তিতে বিন্দুমাত্র প্রভাবিত না হয়ে তিনি যেন ইসলামের সেই শাশ্বত দাওয়াত দিয়ে যেতে থাকেন, যা সকল নবীর জন্যে তিনি নির্ধারণ করেছিলেন। ‘সুতরাং তুমি দাওয়াত দিতে থাকো ও অবিচল থাকো।'(আয়াত ১৫) বস্তুত এ হচ্ছে সমগ্র মানব জাতির একচ্ছত্র নেতৃত্ব, কৃতসংকল্প, অটল, অনড় ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ নেতৃত্ব, যা সচেতনভাবে সমগ্র মানবজাতিকে আল্লাহ তায়ালার দিকে আহ্বান জানায় এবং বিন্দুমাত্রও দোদুল্যমানতা ও বিপথগামিতা ছাড়াই আল্লাহর আদেশ পালনে নিয়ােজিত থাকে। এ নেতত্ব সব রকমের প্রবৃত্তির প্ররােচনা থেকে দূরে থাকে। এ নেতৃত্ব একই কিতাব, একই রেসালাত ও একই বিধানের দিকে আহবান জানায় এবং ঈমানকে তার আসল একক ভিত্তির ওপর পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে। এ নেতৃত্ব সমগ্র মানব জাতিকে তার আদি ও আসল সত্য মতাদর্শে ফিরে আসার আহ্বান জানায়। বলাে, আমি আল্লাহর নাযিল করা কিতাবের ওপর ঈমান এনেছি। শুধু তাই নয়, সমগ্র বিশ্বে সত্য ও ন্যায় বিচারের প্রতিষ্ঠার জন্যে প্রতিজ্ঞাসহ আধিপত্য ও প্রতিষ্ঠা লাভেও তিনি তৎপর থাকেন। আমাকে আদেশ দেয়া হয়েছে যেন তােমাদের মধ্যে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করি। সুতরাং এ হচ্ছে সেই ক্ষমতাশালী ও পরাক্রমশালী নেতৃত্ব, যা পৃথিবীতে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করে। উল্লেখ্য যে, এই সময়ে ইসলামী নেতৃত্ব মক্কার পর্বত উপত্যকায় অবরুদ্ধ ছিলো ও তীব্র নিপীড়ণ ভােগ করছিলাে। তা সত্তেও তার ন্যায়বিচারকামী আধিপত্য লাভের অভিলাষ সুস্পষ্ট। এ নেতৃত্ব মহান আল্লাহর একক প্রভুত্বের ঘােষণায় সােচ্চার। ‘আল্লাহ আমাদের প্রভু ও তোমাদের প্রভু।’ সেই সাথে প্রত্যেকের ব্যক্তিগত কর্মফলের নীতি ঘােষণায় অকুতােভয়। আমাদের জন্যে আমাদের কাজ এবং তােমাদের জন্যে তােমাদের কাজ।’ সেই সাথে এও ঘােষণা করছে যে, চুড়ান্ত সত্যের ঘােষণা দিয়ে সমস্ত বিতর্কের অবসান ঘটানাে হলাে। ‘আমাদের মধ্যে ও তােমাদের মধ্যে কোনাে বিতর্ক নেই।’ অতপর সমস্ত বিষয় আল্লাহর হাতে সােপর্দ করা হচ্ছে, ‘আল্লাহ আমাদের ও তােমাদেরকে একত্রিত করবেন এবং তার কাছেই প্রত্যাবর্তন।’ এই একটা মাত্র আয়াত শেষ নবীর নবুওতের প্রকৃত চরিত্র স্পষ্ট করে দিচ্ছে। বলা হচ্ছে যে, এই রিসালাত ও নবুয়ত তার নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে অকুতোভয়ে ও অপ্রতিহত গতিতে এগিয়ে যাবে। মানুষের প্ররােচনায় সে থামবে না। সে পৃথিবীতে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি অর্জন করবে এবং আল্লাহর পথে সবাইকে এককাতারে সমবেত করবে। এভাবে বিষয়টা সুস্পষ্ট হয়ে যাওয়ার পর এবং মুসলিম জাতির আল্লাহর কাছে গৃহীত ও মনােনীত হবার পর আল্লাহর ব্যাপারে তর্ককারীদের প্রত্যাখ্যাত ও উপেক্ষিত হওয়ার লক্ষণ পরিস্কুট হয়ে ওঠে, তাদের সমস্ত যুক্তিতর্ক বাতিল ও বার্থ হয়ে যায় এবং তার আর কোনাে মূল্য থাকে না। তাই সর্বশেষে এ আয়াতটা দ্বারা তাদের ব্যাপারে চূড়ান্ত রায় ঘােষিত হয় এবং তাদেরকে আল্লাহর কঠিনতম হমকি শুনিয়ে দেয়া হয়। ‘আল্লাহর দাওয়াত গৃহীত হবার পর যারা আল্লাহকে নিয়ে তর্ক-বিতর্ক চালিয়ে যায় তাদের যুক্তি তাদের প্রতিপালকের কাছে ব্যর্থ এবং তাদের ওপর আল্লাহর গযব ও কঠিন আযাব অবধারিত।'(আয়াত ১৬) বস্তুত যার যুক্তি প্রমাণ আল্লাহর কাছে কোরআনের বাতিল ও পরাস্ত হয়। তার আর কোনাে যুক্তি শােনা হয় না এবং তার আর কোনাে প্রভাব প্রতিপত্তি থাকে না। আর দুনিয়ার পরাজয় ও ব্যর্থতার পর আখেরাতেও কঠিন আযাব ও গযব তার জন্যে অবধারিত থাকে। বাতিল নিয়ে জিদ, হঠকারিতা ও স্বার্থান্ধ বিতর্কের এটাই সমুচিত শাস্তি।