بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ (বই#১১০০)[*যারা ইসলাম গ্রহণ করার পর তা আবার ত্যাগ করে:-] www.motaher21.net সূরা:৪২:আশ-শূরা পারা:২৫ ১৬-২০ নং আয়াত:-

أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#১১০০)[*যারা ইসলাম গ্রহণ করার পর তা আবার ত্যাগ করে:-]
www.motaher21.net
সূরা:৪২:আশ-শূরা
পারা:২৫
১৬-২০ নং আয়াত:-
সূরা:৪২:আশ-শূরা-১৬
وَ الَّذِیۡنَ یُحَآجُّوۡنَ فِی اللّٰہِ مِنۡۢ بَعۡدِ مَا اسۡتُجِیۡبَ لَہٗ حُجَّتُہُمۡ دَاحِضَۃٌ عِنۡدَ رَبِّہِمۡ وَ عَلَیۡہِمۡ غَضَبٌ وَّ لَہُمۡ عَذَابٌ شَدِیۡدٌ ﴿۱۶﴾
আল্লাহর আহবানে সাড়া দান করার পরে যারা (সাড়া দানকারীদের সাথে) আল্লাহর দ্বীনের ব্যাপারে বিবাদ করে আল্লাহর কাছে তাদের যুক্তি ও আপত্তি বাতিল। তাদের ওপর আল্লাহর গযব, আর তাদের জন্য রয়েছে কঠিন আযাব।
সূরা:৪২:আশ-শূরা-১৭
اَللّٰہُ الَّذِیۡۤ اَنۡزَلَ الۡکِتٰبَ بِالۡحَقِّ وَ الۡمِیۡزَانَ ؕ وَ مَا یُدۡرِیۡکَ لَعَلَّ السَّاعَۃَ قَرِیۡبٌ ﴿۱۷﴾
আল্লাহ্, যিনি নাযিল করেছেন সত্যসহকারে কিতাব এবং মীযান । আর কিসে আপনাকে জানাবে যে, সম্ভবত কিয়ামত আসন্ন?
সূরা:৪২:আশ-শূরা-১৮
یَسۡتَعۡجِلُ بِہَا الَّذِیۡنَ لَا یُؤۡمِنُوۡنَ بِہَا ۚ وَ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا مُشۡفِقُوۡنَ مِنۡہَا ۙ وَ یَعۡلَمُوۡنَ اَنَّہَا الۡحَقُّ ؕ اَلَاۤ اِنَّ الَّذِیۡنَ یُمَارُوۡنَ فِی السَّاعَۃِ لَفِیۡ ضَلٰلٍۭ بَعِیۡدٍ ﴿۱۸﴾
যারা তা আসবে বলে বিশ্বাস করে না তারাই তার জন্য তাড়াহুড়া করে। কিন্তু যারা তা বিশ্বাস করে তারা তাকে ভয় করে। তারা জানে, অবশ্যই তা আসবে। ভাল করে শুনে নাও, যারা সেই সময়ের আগমনের ব্যাপারে সন্দেহ সৃষ্টি করার জন্য বিতর্ক করে তারা গোমরাহীর মধ্যে বহুদূর অগ্রসর হয়েছে।
সূরা:৪২:আশ-শূরা-১৯
اَللّٰہُ لَطِیۡفٌۢ بِعِبَادِہٖ یَرۡزُقُ مَنۡ یَّشَآءُ ۚ وَ ہُوَ الۡقَوِیُّ الۡعَزِیۡزُ ﴿٪۱۹﴾
আল্লাহ্ তাঁর বান্দাদের প্রতি অত্যন্ত কোমল; তিনি যাকে ইচ্ছে রিযিক দান করেন । আর তিনি সর্বশক্তিমান, প্ৰবল পরাক্রমশালী।
সূরা:৪২:আশ-শূরা-২০
مَنۡ کَانَ یُرِیۡدُ حَرۡثَ الۡاٰخِرَۃِ نَزِدۡ لَہٗ فِیۡ حَرۡثِہٖ ۚ وَ مَنۡ کَانَ یُرِیۡدُ حَرۡثَ الدُّنۡیَا نُؤۡتِہٖ مِنۡہَا وَ مَا لَہٗ فِی الۡاٰخِرَۃِ مِنۡ نَّصِیۡبٍ ﴿۲۰﴾
যে ব্যক্তি পরলোকের ফসল কামনা করে, আমি তার জন্য পরলোকের ফসল বর্ধিত করে দিই এবং যে কেউ ইহলোকের ফসল কামনা করে, আমি তাকে তারই কিছু দিই, আর পরলোকে এদের জন্য কোন অংশ থাকবে না।

তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
১৬-১৯ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

যে দীন দ্বারা আল্লাহ তা‘আলা নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে প্রেরণ করেছেন সে দীনের প্রতি আহ্বান করার পরেও যারা আল্লাহ তা‘আলা সম্পর্কে বিতর্ক করে, বিভিন্ন যুক্তি-তর্ক পেশ করে, তাদের যুক্তি মূলত ভিত্তিহীন ও বাতিল আর তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি। কেননা তারা এ সকল বাতিল তর্ক-বিতর্কের ফলে আল্লাহ তা‘আলার ক্রোধের পাত্রে পরিণত হয়েছে। এর দ্বারা ঐ সকল মুশরিদেরকে বুঝানো হয়েছে যারা মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ধর্মকে মেনে নিয়েছে এ উদ্দেশ্যে যে, যাতে করে তারা পুনরায় মু’মিনদেরকে সত্য পথ থেকে বিচ্যুত করতে পারে অথবা এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো ইয়াহূদী এবং খ্রিস্টানরা, যারা মুসলিমদের সঙ্গে তর্ক-বিতর্ক করত এবং বলত : আমাদের ধর্ম তোমাদের ধর্মের চেয়ে উত্তম এবং আমাদের নাবী তোমাদের নাবীর পূর্বে এসেছিলেন। অতএব আমরা তোমাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ।

دَاحِضَةٌ অর্থ হলো, দুর্বল, বাতিল, অসার, অনর্থক, ভিত্তিহীন ইত্যাদি। অর্থাৎ তাদের প্রমাণাদী আল্লাহ তা‘আলার কাছে অনর্থক।

الكِتٰبَ দ্বারা এখানে কুরআনসহ সমস্ত আসমানী কিতাবকে বুঝানো হয়েছে।

এরপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন : তিনি وَالْمِيْزَانَ দাঁড়িপাল্লা নাযিল করেছেন। অর্থাৎ দাঁিড়পাল্লা দিয়ে ওজন করে সঠিকভাবে মেপে দেয়া হয়, কারো প্রতি জুলুম করা হয় না, তাই ইবনু আব্বাস (রাঃ)-এর তাফসীর করেছেন ন্যায়বিচার। মুজাহিদ বলেন : মানুষ ওজন করতে যে দাঁড়িপাল্লা ব্যবহার করে এখানে তা-ই উদ্দেশ্য। ইবনু আব্বাস (রাঃ)-এর তাফসীর অনুযায়ী, মিযান হল ন্যায়বিচারের। কারণ মিযান বা দাঁড়িপাল্লা স্থাপনের প্রধান উদ্দেশ্য হল ন্যায়বিচার করা। অতএব এ দুয়ের মধ্যে কোন বিরোধ নেই।

আল্লাহ তা‘আলা কিতাব ও ন্যায় বিচারসহ নাবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন তার বর্ণনা দিয়ে অন্যত্র বলেন :

(لَقَدْ أَرْسَلْنَا رُسُلَنَا بِالْبَيِّنٰتِ وَأَنْزَلْنَا مَعَهُمُ الْكِتٰبَ وَالْمِيْزَانَ لِيَقُوْمَ النَّاسُ بِالْقِسْطِ)

নিশ্চয়ই আমি আমার রাসূলদেরকে প্রেরণ করেছি স্পষ্ট প্রমাণসহ এবং তাদের সঙ্গে দিয়েছি কিতাব ও মানদণ্ড যাতে মানুষ সুবিচার প্রতিষ্ঠা করে (সূরা হাদীদ ৫৭ : ২৫)

তাছাড়া মিযান দাঁড়িপাল্লা নামক যন্ত্রের নামও এসেছে, তবুও তার মূল উদ্দেশ্য হল ন্যায়বিচার করা। আল্লাহ আরো বলেন,

(وَالسَّمَا۬ءَ رَفَعَهَا وَوَضَعَ الْمِيْزَانَ أَلَّا تَطْغَوْا فِي الْمِيْزَانِ وَأَقِيْمُوا الْوَزْنَ بِالْقِسْطِ وَلَا تُخْسِرُوا الْمِيْزَانَ)

“আকাশকে সমুন্নত করেছেন এবং স্থাপন করেছেন (ন্যায়ের) মানদণ্ড, যাতে তোমরা পরিমাপে সীমালঙ্ঘন না কর। ওজনের ন্যায্য মান প্রতিষ্ঠিত কর এবং ওজনে কম দিও না।” (সূরা আর-রহমান ৫৫ : ৭-৯)

সুতরাং মানুষ লেনদেনের ক্ষেত্রে দাঁড়িপাল্লা ব্যবহার করে যেমন ইনসাফ করে থাকে, তেমনি এর মাঝে এই ইঙ্গিতও রয়েছে যে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা‘আলা ইনসাফের দাঁড়িপাল্লা স্থাপন করবেন, প্রত্যেককে তার আমলের যথার্থ প্রতিদান দেবেন, কারো প্রতি জুলুম করবেন না।

(يَسْتَعْجِلُ بِهَا الَّذِيْنَ لَا يُؤْمِنُوْنَ بِهَا)

‘যারা এর প্রতি বিশ্বাস করে না তারাই এটার (কিয়ামত) জন্য তড়িঘড়ি করে’ এখানে তিনটি বিষয় আলোচনা করা হয়েছে : (১) কাফিররা কিয়ামতকে বিশ্বাস করে না, অস্বীকার করে বিধায় তাড়াতাড়ি সংঘটিত হওয়া কামনা করে। অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা তাদেরক কথা তুলে ধরে বলেন : তারা বলে :

( مَتٰي هٰذَا الْوَعْدُ إِنْ كُنْتُمْ صٰدِقِيْنَ)‏

“তোমরা যদি সত্যবাদী হও (তবে বল : ‎) এ (কিয়ামতের) প্রতিশ্রুতি কখন বাস্তবায়িত হবে?” (সূরা সাবা ৩৪ : ২৯)
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(يَسْأَلُكَ النَّاسُ عَنِ السَّاعَةِ ط قُلْ إِنَّمَا عِلْمُهَا عِنْدَ اللّٰهِ ط وَمَا يُدْرِيْكَ لَعَلَّ السَّاعَةَ تَكُوْنُ قَرِيْبًا ‏)‏

“লোকেরা তোমাকে কিয়ামত সম্পর্কে প্রশ্ন করে। তুমি বলে দাও- এর জ্ঞান শুধু আল্লাহরই কাছে রয়েছে। তুমি কি করে জানবে যে, হয়ত ক্বিয়ামত শীঘ্রই সংঘটিত হবে।” (সূরা আহযাব ৩৩ : ৬৩)

(২) মু’মিনরা কিয়ামতকে খুব ভয় করে থাকে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(الَّذِيْنَ يَخْشَوْنَ رَبَّهُمْ بِالْغَيْبِ وَهُمْ مِّنَ السَّاعَةِ مُشْفِقُوْنَ‏)‏

“যারা না দেখেও তাদের প্রতিপালককে ভয় করে এবং তারা কিয়ামত সম্পর্কে ভীত-সন্ত্রস্ত।” (সূরা আম্বিয়া ২১ : ৪৯)

(৩) মু’মিনরা জানে কিয়ামত সত্য, তা অবশ্যই সংঘটিত হবে। এক সাহাবী রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে জিজ্ঞাসা করলেন : হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! কিয়ামত কখন হবে? রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন : তোমার ধ্বংস হোক, তা অবশ্যই হবে, তুমি কিয়ামতের জন্য কী তৈরি করেছ? তিনি বললেন : আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূলের প্রতি ভালবাসা। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন : তুমি যাকে ভালবাস তার সাথেই তুমি থাকবে।

সুতরাং যারা কিয়ামত সম্পর্কে ঝগড়া করে তারা মূলত পথভ্রষ্টতার মধ্যে নিপতিত।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(بَلْ كَذَّبُوْا بِالسَّاعَةِ وَأَعْتَدْنَا لِمَنْ كَذَّبَ بِالسَّاعَةِ سَعِيْرًا )‏

“বরং তারা কিয়ামতকে অস্বীকার করেছে আর যারা কিয়ামতকে অস্বীকার করে তাদের জন্য আমি প্রস্তুত রেখেছি জ্বলন্ত‎ অগ্নি।” (সূরা ফুরকান ২৫ : ১১)

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. যারা ইসলাম গ্রহণ করার পর তা আবার ত্যাগ করে তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি, আর তারা আল্লাহ তা‘আলার ক্রোধের পাত্র।
২. আল্লাহ তা‘আলা ন্যায়ের মানদণ্ড দ্বারা তাঁর বান্দাদের মধ্যে ন্যায় বিচার করবেন।
৩. কাফির ও মু’মিনের মধ্যে পার্থক্য জানা গেল।
৪. যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে ভালবাসবে সে কিয়ামতের দিন রাসূলের সাথে থাকবে।
২০ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

জন্ম-মৃত্যুর মধ্যবর্তী সময়টুকুই হচ্ছে মানুষের দুনিয়ার জীবন। মৃতুবরণ করে যেকোন সময় দুনিয়া থেকে চলে যাওয়ার ডাক এসে যেতে পারে। আল্লাহ তা‘আলার কাছে দুনিয়াটা মশার ডানার সমমূল্যও নয়। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : যে ব্যক্তি সর্বশেষ জান্নাতে যাবে সে এ পৃথিবী ও এরূপ দশটি পৃথিবী সমতুল্য জান্নাত লাভ করবে। (সহীহ বুখারী হা. ৬৫৭১)

অতএব একজন মু’মিন কি এ তুচ্ছ দুনিয়ার জন্য আমল করবে, নাকি যে জীবনের কোন শেষ নেই, যেখানে সুখ আছে দুঃখ নেই সে জীবনের জন্য আমল করবে? আল্লাহ বলছেন : যে ব্যক্তি আখিরাত কামনা করে আমি তাকে আখিরাতের ফসল বৃদ্ধি করে দেই। অর্থাৎ আল্লাহ তাকে সৎ কাজ করার ব্যাপারে সাহায্য করে থাকেন, ফলে সে আখিরাতে সফলতা অর্জন করে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তির শুধুমাত্র দুনিয়া উদ্দেশ্য, দুনিয়াতে অনেক সম্পদের অধিকারী হবে, সুনাম থাকবে, সবাই তাকে ভয় করে চলবে। সে শুধু দুনিয়াই পায়, আখিরাতে তার জন্য কোন কিছুই বরাদ্দ থাকে না। কেননা সে যা কিছু অর্জন করেছে তা দুনিয়াতেই শেষ হয়ে গেছে। আখিরাতে সে থাকবে রিক্ত হস্তে। আর আখিরাত কামনাকারী ব্যক্তি দুনিয়া এবং আখিরাত দুটোই পাবে।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন : “কেউ পার্থিব সুখ-সম্ভোগ কামনা করলে আমি তাকে যা ইচ্ছা এখানেই সত্বর দিয়ে থাকি; পরে তার জন্য জাহান্নাম নির্ধারিত করি যেথায় সে প্রবেশ করবে নিন্দিত ও বিতাড়িত অবস্থায়। আর যারা মু’মিন অবস্থায় আখিরাত কামনা করে এবং তার জন্য যথাযথ চেষ্টা করে তাদের প্রচেষ্টা পুরস্কারযোগ্য। তোমার প্রতিপালক তাঁর দান দ্বারা এদেরকে ও তাদেরকে সাহায্য করেন এবং তোমার প্রতিপালকের দান অবারিত। লক্ষ্য কর, আমি কীভাবে তাদের কতককে অপরের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি, আখিরাত তো নিশ্চয়ই মর্যাদায় মহত্তর ও গুণে শ্রেষ্ঠতর!” (সূরা ইসরা ১৭ : ১৮-২১)
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. মু’মিনরা দুনিয়ায় আমলের মাধ্যমে আখিরাত অর্জন করে, কাফিররা কেবল দুনিয়াই অর্জন করে।

তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
১৬-১৮ নং আয়াতের তাফসীর:

আল্লাহ তাআলা ঐ লোকদেরকে ভয় প্রদর্শন করছেন যারা মুমিনদের সাথে বাজে যুক্তি-তর্কে লিপ্ত হয় এবং তাদেরকে হিদায়াত হতে বিভ্রান্ত করার ইচ্ছা করে এবং আল্লাহর দ্বীনে বিশৃংখলা সৃষ্টি করে। তাদের যুক্তি-তর্ক মিথ্যা ও অসার। তারা আল্লাহ তা’আলার ক্রোধের পাত্র। কিয়ামতের দিন তাদের জন্যে রয়েছে কঠিন শাস্তি। তাদের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হওয়া অসম্ভব। তা এই যে, মুসলমানরা পুনরায় অজ্ঞতার দিকে ফিরে যাবে। অনুরূপভাবে ইয়াহুদী ও খৃষ্টানরাও বাজে তর্ক করতো এবং মুসলমানদেরকে বলতোঃ “আমাদের দ্বীন তোমাদের দ্বীন অপেক্ষা উত্তম, আমাদের নবী তোমাদের নবীর পূর্বে এসেছিলেন, আমরা তোমাদের চেয়ে উত্তম এবং আমরা আল্লাহ তাআলার নিকট তোমাদের চেয়ে প্রিয়। তারা এগুলো মিথ্যা বলেছিল।

মহান আল্লাহ বলেনঃ আল্লাহই অবতীর্ণ করেছেন সত্যসহ কিতাব। অর্থাৎ তার নিকট হতে তাঁর নবীদের উপর অবতারিত কিতাবসমূহ। আর তিনি অবতীর্ণ করেছেন তুলাদণ্ড। তাহলে আদল ও ইনসাফ। আল্লাহ তাআলার এই উক্তিটি তাঁর নিম্নের উক্তির মতঃ (আরবী) অর্থাৎ “আমি আমার রাসূলদেরকে প্রকাশ্য দলীল প্রমাণাদিসহ প্রেরণ করেছি এবং তাদের সাথে অবতীর্ণ করেছি কিতাব ও তুলাদণ্ড, যাতে মানুষ ইনসাফের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকে।”(৫৭:২৫) আর এক জায়গায় আছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “তিনি আকাশকে করেছেন সমুন্নত এবং স্থাপন করেছেন মানদণ্ড, যাতে তোমরা ভারসাম্য লংঘন না কর। ওজনের ন্যায্য মান প্রতিষ্ঠিত কর এবং ওজনে কম দিয়ো না।”(৫৫:৭-৯)

এরপর আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা বলেনঃ তুমি কি জান যে, কিয়ামত খুবই আসন্ন?’ এতে ভয় ও লোভ উভয়ই রয়েছে। আর এর দ্বারা দুনিয়ার প্রতি অনাসক্ত করাও উদ্দেশ্য।

অতঃপর মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ যারা এটাকে (কিয়ামতকে) বিশ্বাস করে না তারাই এটা ত্বরান্বিত করতে চায় এবং বলে যে, কিয়ামত কেন আসে না? তারা আরো বলেঃ “যদি সত্যবাদী হও তবে কিয়ামত সংঘটিত কর।” কেননা, তাদের মতে কিয়ামত সংঘটিত হওয়া অসম্ভব। অপরপক্ষে মুমিনরা এর কথা শুনে কেঁপে ওঠে। কেননা, তাদের দৃঢ় বিশ্বাস আছে যে, বিচার দিবসের আগমন সুনিশ্চিত। তারা এই কিয়ামতকে ভয় করে এমন কর্ম করতে থাকে যা তাদের ঐদিনে কাজে লাগবে।

মুতাওয়াতিরের পর্যায়ে পড়ে এরূপ একটি বিশুদ্ধ হাদীসে আছে যে, একটি লোক রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে উচ্চস্বরে ডাক দিয়ে বলেঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)! কিয়ামত কখন হবে?” এটা সফরের ঘটনা। লোকটি রাসূলুল্লাহ (সঃ) হতে কিছু দূরে ছিল। তিনি উত্তরে বলেনঃ “হ্যা, হঁ্যা, কিয়ামত অবশ্যই সংঘটিত হবে, তুমি এর জন্যে কি প্রস্তুতি গ্রহণ করেছো তাই বল?” সে জবাব দিলোঃ “আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (সঃ)-এর মহব্বত।” তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “তুমি তাদের সঙ্গেই থাকবে যাদেরকে তুমি মহব্বত কর।” আর একটি হাদীসে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “প্রত্যেক ব্যক্তি তার সঙ্গেই থাকবে যাকে সে মহব্বত করে।” এ হাদীসটি অবশ্যই মুতাওয়াতির। মোটকথা, রাসূলুল্লাহ (সঃ) ঐ লোকটির প্রশ্নের জবাবে কিয়ামতের সময় নির্দিষ্ট করে বলেননি, বরং তাকে কিয়ামতের জন্যে প্রস্তুতি গ্রহণ করতে বলেন। সুতরাং কিয়ামতের সময়ের জ্ঞান আল্লাহ ছাড়া আর কারো নেই।

এরপর মহান আল্লাহ বলেনঃ কিয়ামত সম্পর্কে যারা বাক-বিতণ্ডা করে তারা ঘোর বিভ্রান্তিতে রয়েছে। অর্থাৎ কিয়ামতের ব্যাপারে যে ব্যক্তি তর্ক-বিতর্ক করে, ওকে অস্বীকার করে এবং ওটা সংঘটিত হওয়াকে অসম্ভব বলে বিশ্বাস রাখে সে নিরেট মূর্খ। তার সঠিক বোধশক্তি মোটেই নেই। সরল-সোজা পথ হতে সে বহু দূরে সরে পড়েছে। এটা বড়ই বিস্ময়কর ব্যাপার যে, তারা যমীন ও আসমানের প্রথম সৃষ্টিকর্তাকে স্বীকার করছে, অথচ মানুষের মৃত্যুর পর তাদেরকে পুনরায় যে তিনি জীবন দান করতে সক্ষম এটা স্বীকার করছে না। যিনি একবার বিনা নমুনায় সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন তিনি দ্বিতীয়বার কি সৃষ্টি করতে সক্ষম হবেন না? অথচ তখন তো পূর্বের কিছু কিছু অংশ কোন না কোন আকারে অবশ্যই থাকবে! এটাকে কেন্দ্র করে পুনরায় সৃষ্টি করা কি তাঁর পক্ষে কঠিন? স্থির জ্ঞানও এটা মেনে নেয় যে, তখন সৃষ্টি করা তো আরো সহজ।
১৯-২০ নং আয়াতের তাফসীর:

আল্লাহ তাআলা বলছেন যে, তিনি স্বীয় বান্দাদের প্রতি বড়ই দয়ালু। তিনি একজনকে অপরজনের মাধ্যমে রিযক পৌঁছিয়ে থাকেন। একজনও এমন নেই যাকে তিনি ভুলে যান। সৎ ও অসৎ সবাই তাঁর নিকট হতে আহার্য পেয়ে থাকে। যেমন মহান আল্লাহ বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “ভূ-পৃষ্ঠে বিচরণকারী সকলের জীবিকার দায়িত্ব আল্লাহরই; তিনি তাদের স্থায়ী ও অস্থায়ী অবস্থিতি সম্পর্কে অবহিত; সুস্পষ্ট কিতাবে সব কিছুই আছে।”(১১:৬)

তিনি যার জন্যে ইচ্ছা করেন প্রশস্ত ও অপরিমিত জীবিকা নির্ধারণ করে থাকেন। তিনি প্রবল পরাক্রমশালী। কেউই তাঁর উপর বিজয়ী হতে পারে না।

এরপর মহান আল্লাহ বলেনঃ যে কেউ আখিরাতের আমলের প্রতি মনোযোগী হয়, আমি স্বয়ং তাকে সাহায্য করি এবং তাকে শক্তি সামর্থ্য দান করি। তার পুণ্য আমি বৃদ্ধি করতে থাকি। কারো পুণ্য দশগুণ, কারো সাতশ’ গুণ এবং কারো আরো বেশী বৃদ্ধি করে দিই। মোটকথা, আখিরাতের চাহিদা যার অন্তরে থাকে, আল্লাহ তা’আলার পক্ষ হতে তাকে ভাল কাজ করার তাওফীক দান করা হয়। পক্ষান্তরে, যার সমুদয় চেষ্টা দুনিয়া লাভের জন্যে হয় এবং আখিরাতের প্রতি যে মোটেই মনোযোগ দেয় না, সে উভয় জগতেই ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল। খুব সম্ভব যে, শত চেষ্টা সত্ত্বেও সে দুনিয়া লাভে বঞ্চিত হবে। মন্দ নিয়তের কারণে পরকাল তো পূর্বেই নষ্ট হয়ে গেছে, এখন দুনিয়াও সে লাভ করতে পারলো না। সুতরাং উভয় জগতকেই সে নষ্ট করে দিলো। আর যদি দুনিয়ার সুখ কিছু ভোগও করে তাতেই বা কি হলো? অন্য জায়গায় যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “কেউ আশু সুখ-সম্ভোগ কামনা করলে আমি যাকে যা ইচ্ছা এখানেই সত্বর দিয়ে থাকি; পরে তার জন্যে জাহান্নাম নির্ধারিত করি যেখানে সে প্রবেশ করবে নিন্দিত ও অনুগ্রহ হতে দূরীকৃত অবস্থায়। যারা মুমিন হয়ে পরলোক কামনা করে এবং ওর জন্যে যথাযথ চেষ্টা করে তাদেরই চেষ্টা স্বীকৃত হয়ে থাকে। তোমার প্রতিপালক তাঁর দান দ্বারা এদেরকে আর ওদেরকে সাহায্য করেন এবং তোমার প্রতিপালকের দান অবারিত। লক্ষ্য কর, আমি কিভাবে তাদের একদলকে অপরের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছিলাম, আখিরাত তো নিশ্চয়ই মর্যাদায় মহত্তর ও গুণে শ্রেষ্ঠতর।”(১৭:১৮-২১)।

হযরত উবাই ইবনে কাব (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “এই উম্মতকে শ্রেষ্ঠত্ব, উচ্চতা, সাহায্য এবং রাজত্বের সুসংবাদ দেয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে যে ব্যক্তি পরকালের কাজ করবে দুনিয়া (লাভের) জন্য, পরকালে সে কিছুই লাভ করবে না।” (এ হাদীসটি হ্যরত সাওরী (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
# সেই সময় প্রতিদিনই মক্কায় যে পরিস্থিতির উদ্ভব হচ্ছিলো এখানে সেই পরিস্থিতির দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। লোকেরা কারো সম্পর্কে যখনই জানতে পারতো যে সে মুসলমান হয়েছে তখনই মরিয়া হয়ে তার পেছনে লেগে যেতো। দীর্ঘদিন পর্যন্ত তাকে কোনঠাসা করে রাখতো। না বাড়ীতে তাকে আরাম থাকতে দেয়া হতো, না মহল্লায় না জাতি-গোষ্ঠীর মধ্যে। সে যেখানেই যেতো সেখানেই অশেষ ও বিরামহীন এক বিতর্ক শুরু হতো। এর উদ্দেশ্য হতো, জাহেলিয়াত বর্জন করে যে ব্যক্তি তার গণ্ডীর বাইরে বের হয়ে গেছে সে যে কোনভাবেই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহচর্য ছেড়ে আবার সেদিকে ফিরে আসুক।
# এখানে মীযান অর্থ আল্লাহর শরীয়ত, দাঁড়িপাল্লার মত ওজন করে ভুল ও শুদ্ধ, হক ও বাতিল, জুলুম ও ন্যায়বিচার এবং সত্য ও অসত্যের পার্থক্য স্পষ্ট করে দেয়। ওপরে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুখ দিয়ে বলানো হয়েছে যে, وَأُمِرْتُ لِأَعْدِلَ بَيْنَكُمُ (তোমাদের মধ্যে ইনসাফ করার জন্য আমাকে আদেশ দেয়া হয়েছে। এখানে বলা হয়েছে যে, এই পবিত্র কিতাব সহকারে সেই ‘মিযান’ এসে গেছে যার সাহায্যে এই ইনসাফ কায়েম করা যাবে।
# যার সংশোধন হওয়ার সে যেন অবিলম্বে সংশোধিত হয়ে যায়। চূড়ান্ত ফায়সালার সময় দূরে মনে করে পাশ কাটিয়ে যাওয়া উচিত নয়। একটি নিঃশ্বাস সম্পর্কেও কেউ নিশ্চয়তার সাথে একথা বলতে পারে না যে, তারপরে শ্বাস গ্রহণের সুযোগ তার অবশ্যই হবে। প্রতিবার শ্বাস গ্রহণই শেষবারের মত শ্বাস গ্রহণ হতে পারে।
# মূল আয়াতে لَطِيفٌ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে, যার সঠিক ও পূরা অর্থ “দয়ালু” শব্দ দ্বারা প্রকাশ পায় না। এ শব্দটির মধ্যে দুটি অর্থ আছে। একটি অর্থ হচ্ছে, আল্লাহ‌ তাঁর বান্দার প্রতি অত্যন্ত স্নেহ, মায়া ও বদান্যতা প্রবণ। দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে, তিনি অত্যন্ত সুক্ষদর্শিতার সাথে তার এমন ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রয়োজনের প্রতিও লক্ষ্য রাখেন যেখানে কারো দৃষ্টি যায় না। সে প্রয়োজনগুলো তিনি এমনভাবে পূরণ করেন যে বান্দা নিজেও উপলব্ধি করতে পারে না কে কখন তার কোন্ প্রয়োজন পূরন করেছে। তাছাড়া এখানে বান্দা অর্থ শুধু ঈমানদারেরাই নয়, বরং সমস্ত বান্দা। আল্লাহর এই দয়া ও মেহেরবানী তাঁর সব বান্দার জন্য সমান।
# তাঁর এই নির্বিশেষ মেহেরবানীর দাবী এ নয় যে, সব বান্দাকেই সব কিছু সমানভাবে দেয়া হবে। যদিও সবাইকে তিনি তাঁর নিজের ভাণ্ডার থেকেই দিচ্ছেন। কিন্তু সেই দান একই প্রকৃতির নয়। একজনকে দিয়েছেন একটি জিনিস আরেকজনকে অন্য একটি জিনিস। একজনকে একটি জিনিস প্রচুর পরিমাণে দিয়ে থাকেন অপর একজনকে অন্য কোন জিনিস অঢেল দান করেছেন।
# তাঁর দান ও পুরস্কারের এই ব্যবস্থা নিজের শক্তিতেই চলছে। কারো ক্ষমতা নেই তা পরিবর্তন করতে পারে বা জোরপূর্বক তাঁর নিকট থেকে কিছু নিতে পারে কিংবা কাউকে দান করার ব্যাপারে তাকে বিরত রাখতে পারে।
# পূর্ববর্তী আয়াতে দু’টি সত্য তুলে ধরা হয়েছে, যা আমরা সবসময় সর্বত্র দেখতে পাই। একটি হচ্ছে আল্লাহর দয়া ও মেহেরবানী তাঁর সব বান্দার জন্য সমান। অপরটি হচ্ছে, তাঁর দান ও রিযিক পৌঁছানোর বন্দোবস্ত সবার জন্য সমান নয়, বরং তার মধ্যে পার্থক্য বিদ্যমান। সেখানে এ আয়াতে বলা হচ্ছে, তাঁর দয়া ও মেহেরবানী এবং রিযিক পৌঁছানোর ব্যবস্থায় ছোটখাট পার্থক্য অসংখ্য। কিন্তু একটি অনেক বড় মৌলিক পার্থক্যও আছে। সেটি হচ্ছে, আখেরাতের আকাংখী ব্যক্তির জন্য এক ধরনের রিযিক এবং দুনিয়ার আকাংখী ব্যক্তির জন্য অন্য ধরনের রিযিক। এটি একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ সত্য যা এই সংক্ষিপ্ত বাক্যটিতে বলা হয়েছে। এটিকে বিস্তারিতভাবে উপলব্ধি করা প্রয়োজন। কারণ তা প্রত্যেক মানুষকে তার ভূমিকা নির্ধারণে সাহায্য করে। যারা দুনিয়া ও আখেরাত উভয়ের জন্য চেষ্টা-সাধনা ও কাজ করে এ আয়াতে তাদেরকে এমন কৃষকের সাথে তুলনা করা হয়েছে যারা ভূমি প্রস্তুত করা থেকে ফসল প্রস্তুত হওয়া পর্যন্ত উপর্যুপরি ঘাম ঝরায় এবং প্রাণান্তকর চেষ্টা চালায়। সে মাঠে যে বীজ বপন করছে তার ফসল আহরণ করে যেন উপকৃত হতে পরে সেজন্য সে এত সব পরিশ্রম করে কিন্তু নিয়ত ও উদ্দেশ্যের পার্থক্য এবং বেশীর ভাগই কর্মপদ্ধতির পার্থক্য ও আখেরাতের ফসল বপনকারী কৃষক এবং পার্থিব ফসল বপনকারী কৃষকের মধ্যে বিরাট পার্থক্য সৃষ্টি করে তাই আল্লাহ‌ উভয় পরিশ্রমের ফলাফলও ভিন্ন রেখেছেন। অথচ এই পৃথিবীই উভয়ের কর্মক্ষেত্র। আখেরাতের ফসল বপনকারী দুনিয়া লাভ করবে না আল্লাহ‌ তা বলেননি। কম বা বেশী যাই হোক না কেন দুনিয়া তো সে পাবেই। কারণ এখানে আল্লাহর মেহেরবানী সবার জন্য সমান এবং তার মধ্যে তারও অংশ আছে। তাই ভালমন্দ সবাই এখানে রিযিক পাচ্ছে। কিন্তু আল্লাহ‌ তাকে দুনিয়া লাভের সুসংবাদ দান করেননি, বরং তাকে সুসংবাদ দিয়েছেন এই বলে যে তার আখেরাতের কৃষিক্ষেত্র বৃদ্ধি করা হবে। কেননা সে সেটিই চায় এবং সেখানকার পরিণামের চিন্তায় সে বিভোর। এই কৃষিক্ষেত্র বর্ধিত করার অনেকগুলো উপায় ও পন্থা হতে পারে। যেমনঃ সে যতটা সদুদ্দেশ্য নিয়ে আখেরাতের জন্য নেক আমল করতে থাকবে তাকে তত বেশী নেক আমল করার সুযোগ দেয়া হবে এবং তার হৃদয়-মন নেক কাজের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হবে। যখন সে পবিত্র উদ্দেশ্যের জন্য পবিত্র উপায় অবলম্বন করার সংকল্প করবে তখন তার জন্য পবিত্র উপায়-উপকরণের মধ্যে বরকত দান করা হবে। তার জন্য কল্যাণের সব দরজা বন্ধ হয়ে কেবল অকল্যাণের দরজাসমূহই খোলা থাকবে, আল্লাহ‌ এ অবস্থা কখনো আসতে দেবেন না। তাছাড়া সব চেয়ে বড় কথা হলো তার এই পৃথিবীর সামান্য নেকীও আখেরাতে কমপক্ষে দশগুণ বৃদ্ধি করা হবে। আর বেশীর তো কোন সীমাই থাকবে না। আল্লাহ‌ যার জন্য চাইবেন হাজার বা লক্ষগুণ বৃদ্ধি করে দেবেন। এখন থাকে দুনিয়ার কৃষি বপনকারীর কথা। অর্থাৎ যে আখেরাত চায় না এবং দুনিয়ার জন্যই সব কিছু করে। আল্লাহ‌ তাকে তার এই চেষ্টা-সাধনার দু’টি ফলের কথা সুস্পষ্টভাবে শুনিয়ে দিয়েছেন। এক, সে যত চেষ্টাই করুক না কেন দুনিয়া যতটা অর্জন করতে চায় তা সে পুরাপুরি পাবে না, বরং তার একটা অংশ মাত্র অর্থাৎ আল্লাহ‌ তার জন্য যতটা নির্দিষ্ট করে রেখেছেন ততটাই পাবে। দুই, সে যা কিছু পাবে এই দুনিয়াতেই পাবে। আখেরাতের কল্যাণে তার কোন অংশ থাকবে না।

ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
# (আয়াত ১৬) বস্তুত যার যুক্তি প্রমাণ আল্লাহর কাছে কোরআনের বাতিল ও পরাস্ত হয়। তার আর কোনাে যুক্তি শােনা হয় না এবং তার আর কোনাে প্রভাব প্রতিপত্তি থাকে না। আর দুনিয়ার পরাজয় ও ব্যর্থতার পর আখেরাতেও কঠিন আযাব ও গযব তার জন্যে অবধারিত থাকে। বাতিল নিয়ে জিদ, হঠকারিতা ও স্বার্থান্ধ বিতর্কের এটাই সমুচিত শাস্তি।

*কেয়ামত ও জীবন জীবিকা সম্পর্কিত দর্শন : এরপর ১৭ থেকে ২০ নং আয়াত পর্যন্ত পুনরায় ওহী ও রেসালাত নিয়ে আলােচনা করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা কিতাব নাযিল করেছেন যা সত্য ও ইনসাফের মানদন্ড। এর মাধ্যমে বিভিন্ন মত ও পথের অনুসারী সম্প্রদায়ের মধ্যকার মতবিরােধ পূর্ণ বিষয়াদির মীমাংসা করা হবে। আল্লাহ তায়ালা তার শরীয়তভিত্তিক বিধানকে সূক্ষ্ম ন্যায় বিচারের মানদন্ড রূপে মানবজাতির জন্যে প্রবর্তন করেছেন। এর ওপর ভিত্তি করে মতাদর্শের বিচার করা হবে, অধিকারের বিচার হবে এবং আচার আচরণ ও কাজ কর্মের বিচার হবে। মানদন্ডের প্রকৃতি ও স্বরূপ বর্ণনার পর এখন কেয়ামতের আলােচনা আসছে। সেই দুটো বিষয়ের মাঝে একটা মিল আছে বলেই দুটোর আলােচনা পর পর এসেছে। উভয়ের মধ্যকার মিলটা হলাে, কেয়ামত হচ্ছে ন্যায়বিচার ও চূড়ান্ত রায় ঘােষণার সময়। আর আল্লাহর কালাম হচ্ছে সত্য ও ন্যায়বিচারের মানদন্ড। তবে যেহেতু কেয়ামতের বিষয়টি একটি অজানা ও অদৃশ্য ব্যাপার। তাই এমনও হতে পারে যে, এটা সহসাই ঘটে যেতে পারে। তাই বলা হচ্ছে, ‘তুমি কি জানাে, সম্ভবত কেয়ামত নিকটবর্তী। এই কেয়ামতের বিষয়টি নিয়ে মানুষ গাফিল ও উদাসীন। অথচ এটি খুবই নিকটবর্তী। এটি সংঘটিত হলেই সত্য ও ইনসাফের সাথে মানুষের চূড়ান্ত বিচার অনুষ্ঠিত হবে। এই বিচারের সময় কোনাে কিছুই অবহেলা করা হবে না, কোনাে কিছুই বাদ দেয়া হবে না। এই কেয়ামতের ব্যাপারে মােমেন ও কাফেরদের দৃষ্টিভংগি কি সে সম্পর্কে পরবর্তী আয়াতে আলােচনা করা হচ্ছে। বলা হয়েছে, ‘যারা তাতে বিশ্বাস করে না তারা তাকে তড়িৎ কামনা করে…'(আয়াত ১৮) অথাৎ যারা কেয়ামতে বিশ্বাসী নয়, তারা এর ভয়াবহতা অনুভব করতে পারে না এবং এই কেয়ামতের পর তাদের জন্যে কি ভয়ংকর পরিণতি অপেক্ষা করছে, সেটা তারা অনুমান করতে পারে না। তাই তারা এর কোনাে তোয়াক্কা করছে না, বরং কামনা করছে যাতে তা অতিসত্বর সংঘটিত হয়। কারণ তারা অজ্ঞ এবং অনুভূতিহীন। কিন্তু যারা পরকালে বিশ্বাসী, তারা কেয়ামতেও বিশ্বাসী। তাই তারা একে ভয় করে। কারণ এটা সংঘটিত হলে কি ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে সেটা তাদের জানা আছে। কেয়ামত যে সংঘটিত হবে তা নির্ঘাত সত্য। মােমেনরাও এটাকে সত্য বলেই জানে। কারণ সত্যের মাঝে এবং তাদের মাঝে একটা বন্ধন আছে বলেই তারা সত্যকে সত্য হিসেবেই জানে। অপরদিকে যাদের মাঝে এই গুণ নেই তাদের সম্পর্কে বলা হচ্ছে, ‘জেনে রাখাে, যারা কেয়ামত সম্পর্কে বিতর্কে লিপ্ত হয় তারা দূরবর্তী পথভ্রষ্টতায় লিপ্ত রয়েছে।’ অর্থাৎ সেই জাতীয় লােকেরা বিপথগামিতার গভীরে বিচরণ করছে এবং সত্য থেকে অনেক দূরে পড়ে আছে। তাই সেখান থেকে ফিরে আসা তাদের পক্ষে একটা কঠিন ব্যাপার। পরকালের আলােচনার পর এখন জীবিকার ব্যাপারে আলােচনা করা হচ্ছে। বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ তায়ালা তার বান্দাদের প্রতি দয়ালু…'(আয়াত ১৯) পরকালের সাথে জীবিকার সম্পর্ক বাহ্যিক দৃষ্টিতে সুদূর পরাহত মনে হলেও নিচের আয়াতটির প্রতি দৃষ্টিপাত করলে উভয়ের মাঝে একটা গভীর সম্পর্ক লক্ষ্য করা যাবে। আয়াতে বলা হয়েছে, ‘যে কেউ পরকালের ফসল কামনা করে আমি তার জন্যে সেই ফসল বাড়িয়ে দেই…'(আয়াত ২০) এতে কোনাে সন্দেহ নেই যে, আল্লাহ তায়ালা তার বান্দাদের প্রতি দয়ালু। তিনি যাকে ইচ্ছা জীবিকা দান করেন। তিনি সৎ ও অসৎ এবং মােমেন ও কাফের সকলের আহার যােগান। মানুষ নিজের আহার নিজে যােগান দিতে অপারগ। যেহেতু আল্লাহ তায়ালাই তাদেরকে জীবন দান করেছেন, তাই আহার বা জীবিকার প্রাথমিক ব্যবস্থাও তিনিই করে রেখেছেন। আল্লাহ তায়ালা যদি কাফের ও পাপী-তাপী বান্দাদের আহার বন্ধ করে দিতেন, তাহলে নিজেদের আহার যােগান দেয়া তাদের পক্ষে কখনও সম্ভব হতাে না। ফলে তারা ক্ষুধা ও তৃষ্ণার কারণে এবং জীবন ধারণের প্রাথমিক উপায় উপকরণের অভাবে মারা যেতাে। তখন আল্লাহর একটা বড় উদ্দেশ্য বিফল হয়ে যেতাে। আর সেটা হচ্ছে, পৃথিবীর বুকে মানুষকে জীবিত রেখে তাদেরকে কর্মের সুযােগ দেয়া এবং পরকালে এই কর্মের হিসাব নিয়ে তাদেরকে পুরস্কৃত করা অথবা শাস্তি দেয়া। তাই তিনি জীবিকার ব্যাপারটি পাপ ও পুণ্য এবং ঈমান ও কুফরের গন্ডির বাইরে রেখেছেন। বরং এটাকে সাধারণ জীবনের সাথে সম্পৃক্ত উপায় উপকরণ এবং ব্যক্তির চেষ্টা তদবীরের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। সাথে এটাকে মানুষের জন্যে পরীক্ষার একটা বিষয় হিসেবেও চিহ্নিত করে রেখেছেন যার ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে পরকালে তাদের প্রতিদান দেয়া হবে। তাছাড়া আল্লাহ তায়ালা ইহকাল ও পরকাল উভয়টিকে ফসলের ক্ষেত্র বানিয়েছেন। এখন মানুষ স্বাধীনভাবে এর যে কোনাে একটিকে বেছে নিতে পারে। যারা পরকালের ফসল কামনা করে তারা এর জন্যে কাজ করে যাবে। আল্লাহ তায়ালা তাদের এই ফসলকে বাড়িয়ে দেবেন, তাদের নিয়ত অনুসারে তাদেরকে সাহায্য করবেন এবং তাদের কাজে বরকত দান করবেন। পরকালের এই ফসলের সাথে সাথে ইহকালে তার জন্যে নির্ধারিত করে রাখা জীবিকাও তাকে দেয়া হবে। এই জীবিকা থেকে তাকে একটুও বঞ্চিত করা হবে না। বরং ইহকালে তাকে জীবিকাস্বরূপ যা কিছু দেয়া হবে সেটাই তার জন্যে পরকালের ফসল হিসাবেও গন্য হতে পারে যদি সে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশেই সেই জীবিকার অন্বেষণে কাজ করে, ভোগ করে এবং তা থেকে দান করে। অপরদিকে যারা ইহকালের ফসলই কামনা করে তাদেরকেও আল্লাহতায়ালা ভাগ্য অনুসারে দান করবেন। তাদের প্রাপ্য ভাগ থেকে তাদেরকে মােটেও বঞ্চিত করা হবে না। কিন্তু পরকালের ফসল থেকে তারা কিছুই পাবে না। কারণ, পরকালের ফসলের জন্যে তারা কোনাে কাজই করেনি। তাই ফলাফলেরও কোনো আশা করা তাদের সাজে না। ইহকালের ফসলের প্রত্যাশী আর পরকালের ফসলের প্রত্যাশীদের প্রতি লক্ষ্য করলে ইহকালের ফসলের প্রত্যাশীদের বােকামী ও মূর্খতা ধরা পড়বে। কারণ দুনিয়াতে তাে আল্লাহ তায়ালা সবাইকে জীবিকা দান করবেন। যার ভাগ্যে যতােটুকু নির্ধারিত আছে ততাটুকু সে পাবেই। কিন্তু পরকালের ফসল কেবল তাদের ভাগ্যেই জুটবে যারা এর প্রত্যাশী হবে এবং এর জন্যে যে কাজ করবে। যারা ইহকালের ফসলের প্রত্যাশী, তাদের মাঝে ধনীও আছে, দরিদ্রও আছে। ধনী ও দরিদ্রের ব্যবধান মূলত জাগতিক উপায় উপকরণ ও ব্যক্তির যােগ্যতার সাথে সাথে ভাগ্যের তারতম্যের কারণেও হয়ে থাকে। পরকালের প্রত্যাশীদের মাঝেও এই তারতম্য লক্ষ্য করা যায়। তবে এই পৃথিবীর বুকে জীবিকার ক্ষেত্রে উভয় দলের মাঝে কোনো ব্যবধান নেই। উভয় দলের মাঝে আমলের ব্যবধান দেখা যাবে পরকালে। তাই যে ব্যক্তি পরকালের ফসলকে ত্যাগ করে তার চেয়ে নির্বোধ আর কে হতে পারে। কারণ এই ত্যাগের ফলে তার পার্থিব জীবনে কোনােই পরিবর্তন আসবে না। শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটা সত্য ও ন্যায়ের সাথেই সম্পৃক্ত হয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ যে সত্য ন্যায়ের ওপর ভিত্তি করে কিতাব অবতীর্ণ হয়েছে। তাই সকল প্রাণীর জন্যে জীবিকা নির্ধারণের ক্ষেত্রে এই সত্য ও ন্যায়ের প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই। এই প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই পরকালের ফসলের প্রত্যাশীদের ক্ষেত্রেও ইহকালের ফসলের প্রত্যাশীদের আল্লাহ তায়ালা মাঝে মাঝে অধিক হারে দান করেন, আর ইহকালের প্রত্যাশীদেরকে পরকালের উত্তম প্রতিদান থেকে বঞ্চিত করেন।

Leave a Reply