أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#১১০৪)[**মুসলিম সমাজের শাশ্বত মূল্যবোধ:-]
www.motaher21.net
সূরা:৪২:আশ-শূরা
পারা:২৫
২৯-৩৬ নং আয়াত:-
সূরা:৪২:আশ-শূরা-২৯
وَ مِنۡ اٰیٰتِہٖ خَلۡقُ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ وَ مَا بَثَّ فِیۡہِمَا مِنۡ دَآبَّۃٍ ؕ وَ ہُوَ عَلٰی جَمۡعِہِمۡ اِذَا یَشَآءُ قَدِیۡرٌ ﴿٪۲۹﴾
এই আসমান ও যমীনের সৃষ্টি এবং এ দু’জায়গায় তিনি যেসব প্রাণীকুল ছড়িয়ে রেখেছেন এসব তাঁর নিদর্শনসমূহের অন্তর্ভুক্ত। যখন ইচ্ছা তিনি এদেরকে একত্র করতে পারেন।
সূরা:৪২:আশ-শূরা-৩০
وَ مَاۤ اَصَابَکُمۡ مِّنۡ مُّصِیۡبَۃٍ فَبِمَا کَسَبَتۡ اَیۡدِیۡکُمۡ وَ یَعۡفُوۡا عَنۡ کَثِیۡرٍ ﴿ؕ۳۰﴾
তোমাদের যে বিপদ-আপদ ঘটে তা তো তোমাদের কৃতকর্মেরই ফল এবং তোমাদের অনেক অপরাধ তিনি ক্ষমা করে দেন।
সূরা:৪২:আশ-শূরা-৩১
وَ مَاۤ اَنۡتُمۡ بِمُعۡجِزِیۡنَ فِی الۡاَرۡضِ ۚۖ وَ مَا لَکُمۡ مِّنۡ دُوۡنِ اللّٰہِ مِنۡ وَّلِیٍّ وَّ لَا نَصِیۡرٍ ﴿۳۱﴾
তোমরা তোমাদের আল্লাহকে পৃথিবীতে অচল ও অক্ষম করে দিতে সক্ষম নও এবং আল্লাহ ছাড়া তোমাদের আর কোন সহযোগী ও সাহায্যকারী নেই।
সূরা:৪২:আশ-শূরা-৩২
وَ مِنۡ اٰیٰتِہِ الۡجَوَارِ فِی الۡبَحۡرِ کَالۡاَعۡلَامِ ﴿ؕ۳۲﴾
সমুদ্রের বুকে পাহাড়ের মত দৃশ্যমান এসব জাহাজ তাঁর নিদর্শনসমূহের অন্তর্ভুক্ত।
সূরা:৪২:আশ-শূরা-৩৩
اِنۡ یَّشَاۡ یُسۡکِنِ الرِّیۡحَ فَیَظۡلَلۡنَ رَوَاکِدَ عَلٰی ظَہۡرِہٖ ؕ اِنَّ فِیۡ ذٰلِکَ لَاٰیٰتٍ لِّکُلِّ صَبَّارٍ شَکُوۡرٍ ﴿ۙ۳۳﴾
তিনি ইচ্ছা করলে বায়ুকে স্তব্ধ করে দিতে পারেন; ফলে নৌযানসমূহ সমুদ্রের বুকে নিশ্চল হয়ে পড়বে। নিশ্চয়ই এতে ধৈর্যশীল ও কৃতজ্ঞদের জন্য বহু নিদর্শন রয়েছে।
সূরা:৪২:আশ-শূরা-৩৪
اَوۡ یُوۡبِقۡہُنَّ بِمَا کَسَبُوۡا وَ یَعۡفُ عَنۡ کَثِیۡرٍ ﴿۫۳۴﴾
অথবা তার আরোহীদের বহু সংখ্যক গোনাহ ক্ষমা করেও তাদেরকে কতিপয় কৃতকর্মের অপরাধে ডুবিয়ে দেবেন।
সূরা:৪২:আশ-শূরা-৩৫
وَّ یَعۡلَمَ الَّذِیۡنَ یُجَادِلُوۡنَ فِیۡۤ اٰیٰتِنَا ؕ مَا لَہُمۡ مِّنۡ مَّحِیۡصٍ ﴿۳۵﴾
আমার নিদর্শনসমূহ নিয়ে যারা বিতর্ক করে সেই সময় তারা জানতে পারবে, তাদের আশ্রয় লাভের কোন জায়গা নেই।
সূরা:৪২:আশ-শূরা-৩৬
فَمَاۤ اُوۡتِیۡتُمۡ مِّنۡ شَیۡءٍ فَمَتَاعُ الۡحَیٰوۃِ الدُّنۡیَا ۚ وَ مَا عِنۡدَ اللّٰہِ خَیۡرٌ وَّ اَبۡقٰی لِلَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ عَلٰی رَبِّہِمۡ یَتَوَکَّلُوۡنَ ﴿ۚ۳۶﴾
সুতরাং তোমাদেরকে যা কিছু দেয়া হয়েছে তা দুনিয়ার জীবনের ভোগ্য সামগ্ৰী মাত্র। আর আল্লাহর কাছে যা আছে তা উত্তম ও স্থায়ী, তাদের জন্য যারা ঈমান আনে এবং তাদের রবের উপর নির্ভর করে।
ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
*সৃষ্টিজগতের সর্বত্র আল্লাহর অস্তিত্বের নিদর্শন : পরের আয়াতে বলা হয়েছে, ‘আসমান ও যমীনের সৃষ্টি এবং এর উভয়ের মধ্যে তিনি যেসব জীব-জন্তু ছড়িয়ে দিয়েছেন এগুলাে তার এক নিদর্শন…'(আয়াত ২৯-৩১) এই জাগতিক নিদর্শনগুলাে মানুষের দৃষ্টির সামনেই রয়েছে এবং ওহীর মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যে সত্যতার প্রমাণ বহন করছে। মানুষ ওহীর মারফত প্রাপ্ত তথ্যের ব্যাপারে সন্দেহ করেছে এবং বিরােধের সৃষ্টি করেছে। কিন্তু আসমান ও যমীন সংক্রান্ত আয়াতগুলাের ব্যাপারে এই বিতর্ক বা সন্দেহের কোনাে অবকাশ নেই। কারণ, এগুলাে অকাট্য এবং এর আবেদন হচ্ছে হৃদয়ের প্রতি। কোনাে সুস্থ বিবেকের অধিকারী ব্যক্তিই এগুলােকে নিয়ে কোনো বিতর্কে জড়াতে পারে না। এগুলাে সুস্পষ্টরূপে যে সত্যটি প্রমাণ করে তা হলাে, এসবের সৃষ্টি ও পরিচালনার পেছনে মানুষের কোনাে হাত নেই। আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কারও পক্ষে একা সম্ভব নয়। কাজেই স্বীকার করতেই হবে যে, এসবের কোনাে স্রষ্টা আছে, পরিচালক আছে। কারণ এর বিশালতা, এর সুক্ষ্ম মিল, এর আবহমান শৃংখলা এবং এর স্থিতিশীল নিয়মের ঐক্য এ গুলাের ব্যাখ্যা কখনও যুক্তি দ্বারা করা সম্ভব নয়, বরং এ কথা বলা ছাড়া উপায় নেই যে, কোনো স্রষ্টা এগুলাে সৃষ্টি করেছে এবং পরিচালনা করছে। তাছাড়া মানুষের বিবেক সেই সৃষ্টিজগতের মুখের ভাষা সরাসরি বুঝতে ও অনুধাবন করতে পারে এবং তার সম্পর্কে বইয়ের কোনাে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ শােনার আগেই তার সত্যতা সম্পর্কে আশ্বস্ত হয়। আলােচ্য আয়াতে বর্ণিত আল্লাহর অন্যতম নিদর্শন আসমান ও যমীন। এর মধ্যেই আর একটি বিস্ময়কর নিদর্শনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আর তা হচ্ছে, উভয়টির মাঝে বিচরণকারী প্রাণীর অস্তিত্ব। মহাশূন্যে বিচরণকারী বিভিন্ন প্রাণীর কথা বাদ দিলেও খােদ এই পৃথিবীর বুকেই যেসব প্রাণী বিচরণ করছে সেটা তাে কতাে বড় নিদর্শন। পৃথিবীর বুকে প্রাণের অস্তিত্ব এমন একটি রহস্য যার স্বরূপ ও প্রকৃতি এখনও মানুষের কাছে অনুদ্ঘাটিত রয়ে গেছে। প্রাণ সৃষ্টি করার তাে প্রশ্নই ওঠে না। কারণ এই প্রাণ এমন একটি রহস্য যার উৎপত্তি সম্পর্কে কেউ জানে না, প্রাণ কোথা থেকে আসলাে, কিভাবে আসলাে এবং কিভাবে তা প্রাণীর রূপ ধারণ করলো এসব প্রশ্নের আজও কোনাে মীমাংসা হয়নি। প্রাণের উৎস অথবা প্রকৃতি সম্পর্কে জানতে গিয়ে এ পর্যন্ত যা কিছু করা হয়েছে তা বিষয়টিকে আরও রহস্যাবৃত ও জটিল করে তুলেছে। কারণ, এ সম্পর্কিত গােটা গবেষণাকর্ম যে বিষয়টিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে তাহলে প্রাণের উৎপত্তির পর প্রাণীর বিবর্তন এর বিভিন্ন প্রজাতি ও এর বিভিন্ন আচার আচরণ। এই দৃশ্যমান ও সংকীর্ণ ক্ষেত্রটিকে কেন্দ্র করেও বিভিন্ন মতবিরােধ ও মতবাদের সৃষ্টি হয়েছে। আর দৃশ্যের বাইরে যা কিছু আছে তা | রহস্যই থেকে যাচ্ছে, অভাবনীয় ও অজানা দৃষ্টি ও চিন্তা শক্তির আওতার বাইরে। এটা একান্তই আল্লাহর বিষয়। এই বিষয়ে মানুষের কোনাে দখল নেই। এই যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রাণের অস্তিত্ব যার সন্ধান পাই ভূ-পৃষ্ঠে, ভূগর্ভে, সমুদ্রের গভীরে এবং মহাশূন্যের বিভিন্ন স্তরে, মহাকাশে বিচরণকারী অন্যান্য প্রাণীর কথা তাে বাদই দিলাম। এই যে অসংখ্য প্রাণী যার সম্পর্কে মানুষ তার সীমিত উপায় ও মাধ্যম স্বারা খুব সামান্যই জানতে পেরেছে। এই অসংখ্য ও অগণিত প্রাণীকে আল্লাহ তায়ালা যখন ইচ্ছা একত্রিত করবেন। কোনাে একটি প্রাণীও বাদ যাবে না, কোনাে একটি প্রাণীও হারিয়ে যাবে না বা অনুপস্থিত থাকবে না। অথচ মানুষ তার পােষা এক ঝাক পাখিকে খাঁচায় ফিরিয়ে আনতে হিমশিম খায়। একই কথা একটা মৌমাছির বেলায়ও খাটে। অগণিত পাখির ঝাঁক, অগনিত মৌমাছির ও কীট পতংগের ঝাক, অগনিত জীবাণুর ঝাঁক, অসংখ্য মাছ ও সামুদ্রিক প্রাণীর কাক, বিভিন্ন জায়গায় বিচরণকারী অসংখ্য মানুষের দল এবং এর চেয়েও সংখ্যায় অনেক অনেক বেশী বিভিন্ন প্রাণীর সমষ্টি যা মহাশূন্যে অজানা ও অদৃশ্য স্থানে বিচরণ করছে এইসব পশু প্রাণীকে আল্লাহ তায়ালা একটা নির্দিষ্ট দিনে এবং একটা নির্দিষ্ট স্থানে একত্রিত করবেন। কোরআনের বর্ণনা ভংগিতে যে ভাবটি ফুটে উঠেছে তাতে মনে হয়, পৃথিবী ও আকাশে জীবজন্তুর বিস্তার এবং এসবের একত্রিকরণের মাঝে যে সময়টুকু তা কোরআনের একটা ছােট্ট আয়াত তেলাওয়াত করার সমান। এই দুটো দৃশ্য বর্ণনা করার পাশাপাশি আল্লাহ তায়ালা মানুষকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন যে, এই জাগতিক জীবনে তারা যে সকল সমস্যা ও সংকটের সমুখীন হয় সেগুলাে তাদেরই কৃতকর্মের ফল। তবে আল্লাহ তায়ালা তাদের অনেক অপরাধই ক্ষমা করে দেন। এই বিশাল সৃষ্টিজগতের ছােট্ট একটা অংশ হিসেবে মানুষ যে খুবই দুর্বল ও অক্ষম, সে কথাও তাকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলা হচ্ছে, তােমাদের ওপর যেসব বিপদ আপদ পতিত হয়, তা তােমাদের কর্মেরই ফল…।’ (আয়াত ৩০,৩১) প্রথম আয়াতে আল্লাহর ইনসাফ ও ন্যায়বিচারের অভিব্যক্তি প্রকাশ পাচ্ছে, দূর্বল মানবতার প্রতি তাঁর দয়ার বহিপ্রকাশ ঘটেছে। এখানে বলা হয়েছে যে, প্রতিটি আপদ বিপদের পেছনে মানুষের কর্মই ক্রীয়াশীল। তবে আল্লাহ তায়ালা মানুষকে তার প্রতিটি অন্যায়ের জন্যেই পাকড়াও করেন না। কারণ, তিনি মানব স্বভাবের দুর্বল দিকগুলাে সম্পর্কে জানেন। তাই তার অনেক অপরাধই তিনি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখে থাকেন। এটা নিসন্দেহে বান্দার প্রতি তার অশেষ দয়া ও করুণা। দ্বিতীয় আয়াতে মানুষের দুর্বলতার দিকটি চিত্রায়িত হয়েছে। পৃথিবীর বুকে সে পরাক্রমশলী নয়। আল্লাহ তায়ালা ব্যতীত তার কোনা উপায়ও নেই। কাজেই সে এই আল্লাহ তায়ালা ব্যতীত আর কার কাছে গিয়ে আশ্রয় নেবে? কার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করবে?
# পরের আয়াতে বলা হয়েছে, ‘সমুদ্রে ভাসমান পর্বতসম জাহাজসমূহ তাঁর অন্যতম নিদর্শন…'(আয়াত ৩২-৩৫) সমুদ্রে ভাসমান পাহাড়সম জাহাজগুলােও আল্লাহর অন্যতম নিদর্শন। এই নিদর্শন প্রত্যক্ষ ও চাক্ষুষ। এই যে সাগর, এটাকে কে সৃষ্টি করেছে? কোনাে মানুষ কি নিজেকে এর সৃষ্টিকর্তা বলে দাবী করতে পারবে? সাগরের গভীরতা ও প্রশস্ততা কে সৃষ্টি করেছে যার ফলে বিশাল আকৃতির জলযান তার বুকের ওপর ভাসতে পারে? এই যে বিশাল আকৃতির জলযান- এর উপাদানগুলো কে সৃষ্টি করেছে। কে এই উপাদানগুলাের মাঝে এমন গুণ ও বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি করেছে, যার ফলে সেসব জলযান পানির ওপর ভাসতে পারে? এই জলযানগুলাের চালিকা শক্তি হিসেবে এই যে বাতাস, বা বাষ্পচালিত যন্ত্র বা পরমাণুশক্তি চালিত যন্ত্র এগুলাের মূল উপাদান কে সৃষ্টি করেছে? ‘সে সেই সত্ত্বা যিনি এসব প্রাণহীন বস্তুগুলাের মাঝে চালিকা শক্তি দান করেছেন যা পাহাড়সম বিশাল আকৃতির জলযানগুলােকে চালিয়ে নিয়ে যায়?’ পরের আয়াতে বলা হয়েছে, তিনি ইচ্ছা করলে বাতাসকে থামিয়ে দেন। তখন জাহাজগুলাে সমুদ্রপৃষ্ঠে নিশ্চল হয়ে পড়ে যেন পাহাড়…'(আয়াত ৩৩) অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা কখনও কখনও এসব জলযানকে নিশ্চল করে দেন, ফলে মনে হয় যেন এগুলাে প্রাণহীন ও নিথর। তাই বলা হচ্ছে, ‘নিশ্চয় এতে প্রত্যেক সবরকারী, কৃতজ্ঞের জন্যে নিদর্শন রয়েছে।’ অর্থাৎ এই জলযানগুলাের সচলতা ও নিশ্চলতা উভয়টির মাঝে ধৈর্যশীল ও কৃতজ্ঞতাশীল লােকদের জন্যে নিদর্শন রয়েছে। লক্ষণীয় যে, ধৈর্য ও কৃতজ্ঞতা এ দুটো গুণের উল্লখ পবিত্র কোরআনের অনেক স্থানেই এক সংগে দেখা যায়। অর্থাৎ বিপদে ধৈর্যধারণ এবং সুসময়ে আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ এমন দুটো গুণ যা সুখে দুঃখে এবং হাসি আনন্দের সকল মুহূর্তেই মােমেন বান্দার মাঝে পাওয়া যায়। এরপর বলা হচ্ছে, ‘অথবা তাদের কৃতকর্মের জন্যে সেগুলােকে ধ্বংস করে দেন'(আয়াত ৩৪) অর্থাৎ পাপাচার ও ঈমান বিরােধী কাজের প্রায়শ্চিত্ত স্বরূপ আল্লাহ তায়ালা সেসব জলযান ধ্বংস করে দেন অথবা ডুবিয়ে দেন। আবার অনেক পাপ ক্ষমাও করে দেন। মানুষের সব ধরনের পাপের জন্যে তিনি শাস্তি দেননা। এরপর বলা হয়েছে, ‘এবং যারা আমার ক্ষমতা সম্পর্কে বিতর্ক করে, তারা যেন জানে যে, তাদের কোনাে পলায়নের জায়গা নেই।'(আয়াত ৩৫) অর্থাৎ আল্লাহ যদি তাদেরকে ধ্বংস করে দেন, অথবা তাদের জলযানগুলােকে বিধ্বস্ত করে দেন, তাহলে তারা কেউ রক্ষা পাবে না। এর মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা মানুষকে বুঝিয়ে দিতে চান যে, এই পার্থিব জগতে তারা যা কিছুর মালিক তা সবই একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে। আল্লাহর সাথে দৃঢ় সম্পর্ক ব্যতীত আর কোনাে কিছুরই স্থায়িত্ব নেই, স্থিতিশীলতা নেই।
*মুসলিম সমাজের শাশ্বত মূল্যবোধ ও মৌলিক নীতিমালা : এরপর পার্থিব জীবনে দেয়া বিভিন্ন উপায়-উপকরণের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলা হচ্ছে, এগুলাে ক্ষণস্থায়ী ও ধ্বংসশীল। আসলে এগুলাের কোনাে মূল্য নেই। সত্যিকার অর্থে যা মূল্যবান ও চিরস্থায়ী তা হচ্ছে সেই সব নেয়ামত যা আল্লাহ তায়ালা পরকালে কেবল মােমেন ও আস্থাশীল বান্দাদের জন্যে নির্ধারণ করে রেখেছেন। এখন এই মােমেন বান্দাদের গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করে বলা হচ্ছে, ‘অতএব তােমাদেরকে যা দেয়া হয়েছে তা পার্থিব জীবনের ভােগ মাত্র…'(আয়াত ৩৬-৪৩) আলােচ্য সূরার প্রথমে বলা হয়েছে যে, যাদেরকে ঐশীগ্রন্থ দান করা হয়েছে, তারা সজ্ঞানে কোন্দলে জড়িয়ে পড়েছে, মতানৈক্যের সৃষ্টি করেছে। এই কোন্দল ও মতানৈক্য ছিলাে পরস্পর শত্রুতাবশত, অজ্ঞতাবশত নয়। তারা আল্লাহর পক্ষ থেকে দেয়া ঐশী গ্রন্থের ব্যাপারে অজ্ঞ ছিলােনা। তেমনিভাবে তারা সেই ঐশী বিধান সম্পর্কেও অজ্ঞ ছিলাে না যা নুহ(আ.)-এর যুগ থেকে ইবরাহীম(আ.)-এর যুগ পর্যন্ত এবং মূসা(আ.)-এর যুগ থেকে ঈসা(আ.)-এর যুগ পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে চলে আসছিলাে। সেখানে আরও বলা হয়েছে যে, পরবর্তীযুগে যারা উত্তরাধিকার সূত্রে এসব ঐশীগ্রন্থ লাভ করেছিলাে তারাও এর প্রতি বিশ্বাসী ছিলাে না, বরং সংশয় সন্দেহে লিপ্ত ছিলাে। এই যদি অবস্থা হয় সেসব লোকদের যারা ঐশী ধর্মের অনুসারী ছিলাে, নবী রসূলদের অনুসারী ছিলাে এবং ঐশী গ্রন্থের ধারক ছিলাে, তাহলে যারা আদৌ কোনাে নবীর অনুসারী নয় এবং আদৌ কোনাে ঐশী গ্রন্থের প্রতি বিশ্বাসী নয় তাদের অবস্থা কি হবে? নিশ্চয় তাদের অবস্থান ভ্রষ্টতা ও অজ্ঞতার শেষ সীমায়। মক্কাবাসী ও তার আশপাশের লােকদেরকে সতর্ক করিয়ে দেয়ার জন্যে আল্লাহ তায়ালা তার বান্দা ও রসূল মােহাম্মদ(স.)-এর ওপর আরবী ভাষায় কোরআন নাযিল করেছেন এবং এর মাঝে সেই বিধানই রেখেছেন যার প্রচার করে গেছেন নূহ, ইবরাহীম, মূসা এবং ঈসা(আ.) সহ প্রমুখ নবী-রসূলরা। এর ফলে ইতিহাসের উষালগ্ন থেকে চলে আসা দাওয়াত ও তাবলীগের ধারার সাথে এর যােগসূত্র স্থাপিত হয়েছে, এর উদ্দেশ্য আদর্শ ও লক্ষ্য অভিন্ন হয়েছে। এর ফলে এমন একটি মুসলিম সমাজের সৃষ্টি হবে যাদের হাতে থাকবে কর্তৃত্ব ও নেতৃত্ব এবং এই দাওয়াত ও তবলীগকে এই পৃথিবীর বুকে আল্লাহর ইচ্ছা ও পছন্দ অনুযায়ী বাস্তবায়িত করবে। এখানে এই মুসলিম সমাজের বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলী বর্ণনা করা হচ্ছে। আলােচ্য সূরাটি মদীনায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্বে মক্কাতেই অবতীর্ণ হয়েছে, তবুও এই সমাজের অন্যতম একটা বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হয়েছে। আর তা হচ্ছে এই যে, তাদের কার্যাবলী পরস্পর পরামর্শের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়। এর মাধ্যমে এটাই বুঝা যায় যে, শূরা বা পরামর্শের প্রথা মুসলিম জীবনে কেবল একটি রাজনৈতিক পদ্ধতিই নয়, বরং এটা গােটা মুসলিম সমাজেরই বৈশিষ্ট্যমন্ডিত একটা গুণ। এর ওপরই মুসলিম সমাজ প্রতিষ্ঠিত। এরপর এর প্রসার ঘটেছে ইসলামী রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে। কারণ এই রাষ্ট্র, দল ও সমাজের বৃহত্তর রূপ। কাজেই রাষ্ট্র কাঠামােতে দলীয় নিয়ম নীতির প্রতিফলন ঘটবে সেটাই স্বাভাবিক। আলােচ্য আয়াতে মুসলিম সমাজের আর একটি বৈশিষ্ট্য পাই। তা হচ্ছে, যারা আক্রান্ত হলে প্রতিশোধ গ্রহণ করে অথচ আমরা জানি, মক্কায় অবস্থানকালে মুসলমানদেরকে অন্যায় অবিচার ও যুলুম-নির্যাতনের মুখে ধৈর্যধারণের নির্দেশ দেয়া হয়েছিলাে এবং আক্রমণের বিরুদ্ধে পাল্টা আক্রমণ করা তাদের জন্যে নিষেধ ছিলাে। তবে অন্য একটি আয়াতে তাদেরকে সশস্ত্র যুদ্ধের অনুমতি দেয়া হয়। আর এই অনুমতি আসে হিজরতের পর। সেই আয়াতে বলা হয়েছে ‘যুদ্ধের অনুমতি দেয়া হলাে তাদেরকে যাদের সাথে কাফেররা যুদ্ধ করে, কারণ তাদের প্রতি অত্যাচার করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে সাহায্য করতে অবশ্যই সক্ষম।'(সূরা আল হজ্জ ৩৯) এই মক্কী আয়াতে মুসলিম সমাজের মৌলিক ও চিরস্তন বৈশিষ্ট্যের কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ মৌলিকভাবে মুসলিম সমাজ আক্রান্ত হলে প্রতিশােধ নিয়ে থাকে। তবে মক্কায় অবস্থানকালে বিশেষ পরিস্থিতির কারণে তাদেরকে শত্রুর আক্রমণের বিরুদ্ধে পাল্টা আক্রমণ করতে সাময়িকভাবে নিষেধ করা হয়েছিলো। এখানে যেহেতু মুসলিম সমাজের মৌলিক ও চিরন্তন গুণাবলীর আলােচনা করা হচ্ছে তাই যুদ্ধের অনুমতি না থাকা সত্তেও এবং আলােচ্য আয়াত মক্কী হওয়া সত্তেও এই প্রতিশােধ গ্রহণের মৌলিক গুণের উল্লেখ করা হয়েছে। এসব স্বাতন্ত্রযমন্ডিত গুণাবলী এমন একটি মুসলিম সমাজের বলে উল্লেখ করা হয়েছে। যাদেরকে মানবতার হেদায়াতের জন্যে, মুক্তির জন্যে এবং নেতৃত্বের জন্যে মনােনীত করা হয়েছে। এই গুণাবলী মক্কী জীবনের এমন একটি সময়ে উল্লেখ করা হয়েছে যখন সেই মুসলিম সমাজের হাতে আদৌ কোনো নেতৃত্ব ও কর্তত্ব ছিলো না। বিষয়টা ভেবে দেখার মতাে। এর অর্থ হচ্ছে, মানবতার হেদায়াত ও নেতৃত্বের দায়িত্ব পালন করার পূর্বে মুসলিম সমাজকে এসব গুণাবলী অর্জন করতে হবে এবং নিজেকে দায়িত্ব পালনের উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে হবে। এখন এসব গুণাবলীর একটা একটা করে আমাদের চিন্তা করে দেখতে হবে এবং এর স্বরূপ ও প্রকৃতি অনুধাবন করতে হবে। সাথে সাথে দেখতে হবে, মানবজীবনে এসব গুণাবলীর মূল্য ও তাৎপর্য কি? এসব গুণাবলীর অন্যতম হচ্ছে ঈমান, আস্থা, পাপাচার ও অশ্লীলতা পরিহার, ক্রোধের সময় ক্ষমাপ্রদর্শন আল্লাহর আহ্বানে সাড়া দেয়া, নামায কায়েম করা, সকল বিষয়ে পরামর্শ করা, আল্লাহর দেয়া সম্পদ হতে খরচ করা, আক্রান্ত হলে প্রতিশােধ নেয়া, মার্জনা, সংশােধন এবং সহনশীলতা ইত্যাদি। এসব গুণাবলীর তাৎপর্য ও মূল্য কি তা আমাদেরকে বুঝতে হবে। এখানে আর একটি বিষয় লক্ষ্যনীয়। তা হচ্ছে মুসলিম সমাজের গুণাবলী বর্ণনার আগে শাশ্বত আল্লাহর মানদন্ডে সত্যিকার মূল্যবােধের পরিচয় তুলে ধরা হচ্ছে। কোনটি শাশ্বত মূল্যবোেধ, আর কোনটি ক্ষণস্থায়ী মূল্যবােধ সেটা মুসলিম সমাজের সামনে তুলে ধরা হচ্ছে যেন তাদের চিন্তা চেতনায় কোনাে বিভ্রান্তির অবকাশ না থাকে। অন্যথায়, তাদের সকল মানদন্ড ভারসাম্যহীন হয়ে পড়বে। তাই প্রথমেই সেই মূল্যবােধের আলােচনা করা হয়েছে। এ সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘অতএব তােমাদেরকে যা দেয়া হয়েছে তা পার্থিব জীবনের ভােগ মাত্র। আর আল্লাহর কাছে যা আছে, তা উৎকৃষ্ট ও স্থায়ী…’(আয়াত ৩৬) এই পার্থিব জীবনে মনােমুগ্ধকর ও চোখ ধাঁধানাে অনেক কিছুই আছে। এখানে রয়েছে সম্পদের মােহ, সন্তানের মােহ, ভােগের মােহ, বিলাসিতার মােহ, খ্যাতির মােহ, ক্ষমতার মােহ এবং প্রভাব প্রতিপত্তির মােহ। এই পার্থিব জগতে আল্লাহ তায়ালা তার বান্দাদেরকে নিছক দয়া ও করুণার বশবর্তী হয়ে বেশ কিছু নেয়ামত দান করে থাকেন। এখানে পাপ পুণ্যের কোনাে প্রশ্ন নেই। অবশ্য তিনি কখনও কখনও তার বাধ্য বান্দাদের অল্প সম্পদেও বরকত দান করে থাকেন। আবার অবাধ্য বান্দাদের সম্পদে বরকত তুলে নেন। ফলে অঢেল সম্পদের মালিক হয়েও তারা তাতে কোন বরকত লক্ষ্য করে না। কিন্তু এর একটিও শাশ্বত ও চিরন্তন মূল্যবোধ রূপে গন্য হয় না। বরং এগুলাে নিছক ভােগের সামগ্রী, সীমিত সময়ের জন্যে এসব দান করা হয়। এগুলাে প্রকৃত উন্নতি ও অবনতির মানদন্ড নয়। স্বয়ং এগুলাে আল্লাহর কাছে মর্যাদা ও অমর্যাদার আদৌ কোনাে বিষয় হিসেবে গণ্য হয় না। এমনকি এগুলাে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও অসন্তুষ্টির প্রমাণ হিসেবেও গন্য হয় না। এগুলাে কেবলই ভােগ সামগ্রী। অপরদিকে আল্লাহর কাছে যা রয়েছে তাই শ্রেষ্ঠ ও চিরস্থায়ী। অর্থাৎ সেগুলাে সত্তাগত দিক দিয়ে শ্রেষ্ঠ এবং কালগত দিক দিয়ে চিরস্থায়ী। এই হিসেবে দেখলে পার্থিব ভােগসমাগ্রী নিতান্তই তুচ্ছ ও ক্ষণস্থায়ী বলে মনে হবে। কারণ, পার্থিব জীবনের ভােগ সামগ্রী খুবই সীমিত সময়ের জন্য। এর স্থায়িত্ব কোনােভাবেই ব্যক্তির বয়সের অতিরিক্ত নয়। তেমনিভাবে এর স্থায়িত্ব মানবজাতির বয়সেরও অতিরিক্ত নয়। তাই পরকালীন জীবনের তুলনায় এর স্থায়িত্ব এক পলকের কাছাকাছিই বলতে পারি। এই বাস্তব সত্যটি প্রতিষ্ঠিত করার পর এখন মােমেনদের গুণাবলীর কথা বলা হচ্ছে। প্রথমেই বলা হয়েছে, ‘আর যা কিছু আল্লাহর কাছে রয়েছে, তা উত্তম ও চিরস্থায়ী তাদের জন্যে যারা ঈমান এনেছে,’ অর্থাৎ প্রথম গুণাটিই হচ্ছে ঈমানের গুণ। এই ঈমানের তাৎপর্য ও মূল্য কী? ঈমান হচ্ছে সেই আদি সত্যের জ্ঞান যা ব্যতীত মানব মনে এই জগতের কোনাে কিছুরই সঠিক জ্ঞান অর্জিত হতে পারে না। কারণ, আল্লাহর একাত্মবাদের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের মাধ্যমে এই সৃষ্টিজগতের যথার্থরূপ ও বাস্তবতা সম্পর্কে মানব মনে অনুভূতি জাগে। তখন সে বুঝতে পারে এই জগত আল্লাহরই সৃষ্টি। এই অনুভূতি লাভের পরই মানুষ এই জগতের প্রকৃতি সম্পর্কে জানতে পারে এবং পেছনে কার্যকর প্রাকৃতিক নিয়ম কানুন সম্পর্কে জানতে পারে। আর এই জানার ফলেই সে এই বিশাল জগতের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারে এবং গােটা প্রাকৃতিক নিয়মের সাথে সংগতি রক্ষা করে চলতে পারে। এই সংগতির ফলে তার জীবন সুখী হয় এবং গােটা সৃষ্টিজগতের সাথে মিলে মিশে জগতস্রষ্টর প্রতি আনুগত্য ও দাসত্ব প্রদর্শন করে, আত্মনিবেদন করে। এটা প্রতিটি মানুষেরই অপরিহার্য গুণ। কিন্তু যে দল ও গােষ্ঠী মানবতাকে জগতস্রষ্টার সন্ধান দেয় তার মাঝে এই গুণ আরও অপরিহার্য, আরও কাম্য। ঈমানের মূল্য কি? ঈমানের মূল্য হচ্ছে, মানুষ এর মাধ্যমে মানসিক প্রশান্তি লাভ করে, নিজ আদর্শের ব্যাপারে কোনাে দ্বিধা দ্বন্দু থাকে না, কোনাে ভয় ভীতি থাকে না এবং কোনাে হতাশা নিরাশা থাকে না। এই গুণগুলো পৃথিবীর বুকে বসবাসকারী প্রতিটি মানুষের জন্যে অপরিহার্য। কিন্তু যারা সত্যপথের দিশারী, যারা মানবতাকে এই পথে পরিচালিত করে তাদের জন্যে এই গুণাবলী আরও অপরিহার্য, আরও কাম্য। ঈমানের প্রকৃত মূল্য হচ্ছে এই যে, মানুষ এর মাধ্যমে প্রবৃত্তির দাসত্ব থেকে মুক্ত হয়, ব্যক্তি স্বার্থের কয়েদ থেকে মুক্ত হয় এবং তার মন ও মস্তিষ্ক এক মহান উদ্দেশ্যের সাথে সম্পৃক্ত হয়। তখন সে মনে করে, তার নিজের বলতে কিছু নেই, যা কিছু আছে তা আল্লাহর রাহে মানুষকে আহ্বান করা ছাড়া আর কিছুই নয়। এই দাওয়াত ও তাবলীগের জন্যে সে আল্লাহর কাছে দায়বদ্ধ। এই অনুভূতি, এই চেতনা সেই সব লােকদের জন্যে অত্যন্ত জরুরী যাদের ওপর নেতৃত্বের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। কারণ, এই অনুভূতি ও চেতনা তার মাঝে ক্রীয়াশীল থাকলে সে কখনও দাওয়াত তবলীগের ময়দানে কাজ করতে গিয়ে বিপদ-আপদ বা কোনাে নির্যাতনের সম্মুখীন হলে ধৈর্যহারা হবে না, হতাশ ও নিরাশ হবে না। তেমনিভাবে নিজের ডাকে মানুষের ব্যাপক সাড়া পেয়ে বা আনুগত্য পেয়ে আত্মগরিমায় ভুগবে না। বরং নিজেকে কেবলই একজন দায়বদ্ধ কী মনে করবে। *যে ঈমানের ওপর ভিত্তি করে মুসলিম জাতির ইতিহাস লেখা : ইসলামের প্রাথমিক পর্যায়ে যে দলটি সত্যিকার অর্থে ও পরিপূর্ণরূপে ঈমান গ্রহণ করেছিলাে, তাদের স্বভাব চরিত্র, আচার আচরণ ও চিন্তা চেতনায় এই ঈমানের এক অভূতপূর্ব প্রভাব পড়েছে, কিন্তু পরবর্তী যুগে মানুষের হৃদয়ে এই ঈমানের প্রভাব ধীরে ধীরে ম্লান হতে থাকে এবং এমন একপর্যায়ে এসে পৌছে যখন তাদের আচার আচরণে ঈমানের প্রভাব বলতে আর কিছুই ছিলাে না। তাদের হারানাে ঐতিহ্য ফিরে পেতে হলে তাদের মাঝে পুনরায় ঈমানী চেতনা জাগ্রত করতে হবে, পুনরায় তাদের মাঝে ঈমানী প্রভাব সৃষ্টি করতে হবে এবং তাদেরকে পুনরায় মানবতার নেতৃত্বের জন্যে প্রস্তুত হতে হবে। এই ঈমান সম্পর্কে বলতে গিয়ে বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ জনাব আবুল হাসান আলী নদভী তাঁর গ্রন্থ ‘মা যা খাছিরাল আ’লামু বি-ইনহিতাতিল মুসলিমীন’-এ বলেছেন, যখন সবচেয়ে বড় সংকট অর্থাৎ শিরক এবং কুফরের সংকট কেটে গেলাে, তখন মনে হলাে সব সংকটই বুঝি কেটে গেলাে। ওদের বিরুদ্ধে রসূলুল্লাহ(স.) তাঁর প্রথম জেহাদ পরিচালনা করেন। এরপর তাকে নতুন করে প্রতিটি ক্ষেত্রে জেহাদ করতে হয়নি। প্রথম যুদ্ধেই ইসলাম জাহেলিয়াতর বিরুদ্ধে জয়ী হয়। এই বিজয় ইসলাম তার প্রতিটি যুদ্ধেই লাভ করতে থাকে। ফলে তারা মনে প্রাণে পরিপূর্ণ রূপে ইসলামের ছায়াতলে প্রবেশ করে। তখন তারা আর রসূলের বিরুদ্ধাচরণ করেনি, তার ফয়সালার ব্যাপারে কোনাে আপত্তি করেনি এবং তার আদেশ নিষেধের ক্ষেত্রে তাদের কোনাে ইচ্ছা-অনিচ্ছা ছিলাে না। অবশেষে যখন তারা শয়তানের পথ থেকে বেরিয়ে এলাে, তারা তাদের অন্তরের মধ্যে আগত শয়তানের প্রভাব বলয় বা শয়তানের ওয়াসওয়াসা থেকে বেরিয়ে এলাে, অথবা বেরিয়ে এলাে তাদের নিজেদের পরস্পর পরস্পরকে অন্যায় কাজে উদ্বুদ্ধ করার প্রবণতা থেকে, তখন তারা সুবিবেচকের ভূমিকা গ্রহণ করে অন্য কারাে সক্রিয় ভূমিকা ছাড়াই একে অপরের প্রতি সুবিচার করার কাজ শুরু করলাে। এইভাবে দুনিয়াতে বাস করেও তারা আখেরাতমুখী লােকের আমল আখলাক গ্রহণ করলাে। আগামীকাল কেমন হবে ও কী করবে সে সব চিন্তা করেই তারা আজকের দিনের কর্মপন্থা নির্ধারণ করলাে এবং ভূমিকা অবলম্বন করতে গিয়ে বিপদ আপদ ও বিরােধিতা কোনাে কিছুরই পরওয়া করলাে না। কোনাে সম্পদের প্রাচুর্য তাদেরকে দাম্ভিক বানাতে সক্ষম হলাে না। কোনাে দুঃখ দৈন্য তাদেরকে মুষড়ে ফেলতে পারলাে না, কোনাে সচ্ছলতা তাদের সীমালংঘন করাতে পারলাে না। কোনাে ব্যবসা বাণিজ্য বা কাজ কারবার তাদেরকে কর্তব্যচ্যুত করতে পারলাে না বা তাদের শক্তি সামর্থ তাদেরকে অপরের প্রতি বীতশ্রদ্ধ বানাতে সমর্থ হলাে না। তারা দুনিয়ায় নিজেদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা নিয়ােজিত হলাে না, কোনাে উচ্ছংখলতার মধ্যেও গিয়ে তারা পতিত হলাে না, বরং তারা দুনিয়ার জীবনের সকল কথা, কাজ ও ব্যবহারের ব্যাপারে মানুষের মধ্যে সুবিচার প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব পালন করে যেতে লাগলাে। এ দায়িত্ব পালনে তারা আল্লাহর সন্তুষ্টি প্রাপ্তির আশায় এবং তাঁকে সাক্ষী রেখে সুবিচার করতে গিয়ে নিজেদের ও নিজেদের পিতা মাতা ও আত্মীয়স্বজনের বিরুদ্ধে পর্যন্ত রায় দিতে কুণ্ঠাবােধ করলাে না, এসব গুণ অর্জিত হওয়ার পর তারা মানুষের জন্যে নিরাপত্তা বিধানকারী হয়ে গেলাে, জগদ্বাসী যাবতীয় ক্ষতিকর কাজ ও ব্যবহার থেকে নিরাপদ হয়ে গেলাে এবং এইভাবে তারা আল্লাহর দ্বীন এর আহ্বানকারী হওয়ার পূর্ণাংগ দায়িত্ব পালন করলাে। এই শান্তিপ্রিয় ও ন্যায়পরায়ন ব্যক্তিদের সম্পর্কেই আল্লাহ রব্বুল আলামীন জানিয়েছেন যে, তাদের চরিত্র ব্যবহার ও আবেগ উচ্ছাসের মধ্যে ঈমানের সঠিক রূপ ফুটে উঠেছে। এই মহৎ ব্যক্তিদের সম্পর্কেই মন্তব্য করা হয়েছে, এমনই এক যামানায় নবী(স.)-এর আগমন হয়েছে, যখন আরব আজম সবখানেই মানুষ জাহেলী জীবন যাপন করতো যাদের কাজ কথা ও ব্যবহারে কোনাে যুক্তি ছিলাে না। জোর যার মুল্লুক তার ছিলাে তাদের সাধারণ নিয়ম। তারা সৃষ্ট সকল কিছুরই পূজা করতাে। অর্থাৎ তাদের সামনে সিজদা করতাে এবং তারা নিজেদের স্বাধীন ও লাগাম ছাড়া ইচ্ছা ও প্রবৃত্তির কাছে নতি স্বীকার করতাে, ভালাে কাজের জন্যে পুরস্কার দান, মন্দ কাজের জন্যে শাস্তি বিধান করা, ভালাে কাজের নির্দেশ ও মন্দ কাজ থেকে মানুষকে বিরত রাখা-এসব ব্যবস্থা কোথাও চালু ছিলাে না। তাদের জীবনের জন্যে আইন-কানুন যা ছিলো তা এমনই ভাসা-ভাসাভাবে ছিলাে যে, সমাজে কেউ তার তেমন গুরুত্ব দিতাে না। তাদের মন-মগয, চিন্তা ও বাস্তব কাজ কর্মে তাদের চরিত্র বা তাদের সমাজ জীবনেও এসব আইন কানুনের কোনাে গুরুত্ব বা ক্ষমতা ছিলাে না। তারা আল্লাহকে এইভাবে বিশ্বাস করতাে যে, তিনি সৃষ্টি করে তাদেরকে ছেড়ে দিয়েছেন, যেভাবে ইচ্ছা তারা চলুক এতে তার কোনাে দখল বা প্রয়ােজন নেই। তিনি বিশ্ব প্রকৃতির মধ্যে অবস্থিত এসব জিনিসের পরিচালনার ভার কিছুসংখ্যক ক্ষমতাবান ও আইন রচনাকারী দায়িত্বশীলদের হাতে দিয়ে দিয়েছেন, যাদের হাতে তিনি তাদের খুশীমতাে নিয়ম কানুন বানানাে ও সেই অনুযায়ী দেশ ও দশকে চালানাের দায়িত্ব সােপর্দ করেছেন। যার ফলে তারা হুকুমদান ও দন্ডবিধান করার ক্ষমতা পেয়ে গেছে, পেয়ে গেছে দেশ শাসন করার অধিকার, আরাে পেয়ে গেছে সমাজ পরিচালনা ও মানুষের জীবনের জন্যে প্রয়ােজনীয় সকল দ্রব্যাদি সরবরাহ করার দায়িত্ব। এমনকি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা তৈরী ও পরিচালনা, বিধি-নিষেধ আরােপ করা ও শাস্তির বিধান প্রয়োেগ সব কিছুরই ভার তারা পেয়ে গেছে। এ জন্যে আল্লাহর প্রতি তাদের ঈমান ছিলাে, এটা একটা ইতিহাসের ঘটনা হিসাবেই শুধু জানা যায়। আল্লাহর প্রতি তাদের ঈমান যেন এমন যে, দয়া করে তাদের একথা মনে করা যে আল্লাহ তায়ালাই আসমান যমীন সব কিছু সৃষ্টি করেছেন। এটা অনেকটা ইতিহাসের কোনাে একজন ছাত্রের জবাবের মতাে ব্যাপার, তাকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয় ইতিহাসের এ মহান অট্টালিকাটি কে বানিয়েছে? সে বলে, হাঁ, প্রাচীন কোনাে এক বাদশাহ হয়তো এটাকে বানিয়েছে। এ কথা বলার সময় দেখা যায় সে কাল্পনিক নির্মাতা সম্পর্কে না আছে তার কোনাে সমীহ বােধ, না আছে কোনাে ভয়-ভীতি, আর না তার কাছে নতি স্বীকার করার কোনাে প্রয়োজন সে বােধ করে। এমতাবস্থায় সে নির্মাতার প্রতি তার ভক্তি-বিশ্বাস যা আছে তা হচ্ছে, আনুগত্যবােধহীন একটি মানসিক অবস্থা। আসলে আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে তাদের স্বচ্ছ কোনাে বুঝ নেই। যে যেভাবে ভালাে মনে করে সেভাবেই সে তাকে বিশ্বাস করে। আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে তাদের জ্ঞান বা বুঝ হচ্ছে সম্পূর্ণ অস্পষ্ট বা দুর্বোধ্য এক অনুভূতি। তারা তাকে অতি সংক্ষিপ্তভাবে বুঝে এবং এজন্যে তার জন্য না আছে তাদের কোনাে ভয় ভীতি, আর না আছে কোনাে ভালােবাসা। আরব জাতির লােকেরা এবং যারা তাদের এই মুর্দা ও অস্পষ্ট ধারণা ত্যাগ করে মুসলমান হয়ে গিয়েছিলাে তারা আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে স্বচ্ছ ও গভীর এমন একটা অনুভূতি পেয়েছিলো যা তাদের হৃদয়ের গভীরে প্রবেশ করে তাদের গােটা সত্ত্বাকে আন্দোলিত করেছিলাে, তাদের চরিত্রের মধ্যে আমূল পরিবর্তন এসেছে, তাদের সমাজ নতুনভাবে গড়ে ওঠে জীবনে তারা নতুন আলাে পেয়েছে এবং তাদের জীবনে এক অকল্পনীয় গতিধারা প্রবাহিত হয়েছে। তারা আসমান যমীন সম্বলিত গােটা বিশ্বচরাচরের সেই মালিক মনিব প্রভু ও প্রতিপালক তার প্রতি বিশ্বাস করেছে। যিনি পরম করুণাময়, চাইলেও দেন, না চাইলেও যিনি মাহরুম করেন না। তার অপরাধী বান্দাদের প্রতিও তিনি তেমনি মেহেরবান, যেমনি মেহেরবান তার মুমিন বান্দাদের প্রতি। যিনি রােজ হাশরেরও মালিক। যিনি বাদশাহ শাসনকর্তা, যিনি সকল দুর্বলতা থেকে পবিত্র, যিনি শান্তিময় যিনিই একমাত্র সন্দেহাতীতভাবে বিশ্বস্ত, যিনি নেক ও বদ সব প্রকৃতির মানুষের জন্যে অতন্ত্র প্রহরী, যিনি সর্বশক্তিমান, যিনি শক্তি প্রয়ােগে তার বিধান চালু করতে পারেন, একমাত্র যিনি তার শ্রেষ্ঠত্ব প্রদর্শনকারী, যিনি সবার সৃষ্টিকর্তা। যিনি সকল কিছুর সূত্রপাত করেছেন, মহা বিজ্ঞানময়, মাফ করার মালিক, যিনি (মােমেনের জন্যে) বড়ই নরম এবং তাদের জন্যে বড়ই মেহেরবান। সৃষ্টি তার, হুকুম দেয়ার মালিকও একমাত্র তিনি, তাঁরই হাতে নিবদ্ধ সকল ক্ষমতা, তিনি আশ্রয় দেন, তাকে কেউ আশ্রয় দিতে পারে না। এভাবে আল কোরআনের বিভিন্ন স্থানে তার শক্তি ক্ষমতার অসংখ্য গুণের বিবরণ বর্ণিত হয়েছে। তিনি জান্নাতে প্রবেশ করানাের মাধ্যমে নেক লােকদেরকে পুরস্কৃত করবেন এবং ইচ্ছাকৃতভাবে অন্যায় অপকর্মে লিপ্ত যারা তাদেরকে প্রদত্ত শাস্তিস্বরূপ জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন। তিনি পরম করুণাময় প্রতিপালক, তিনি যার জন্যে খুশী তার জন্যে তার রিযিকের ভান্ডারকে প্রশস্ত করে দেন, আর যার জন্যে খুশী তার জন্যে সংকীর্ণ করে দেন। এটা কখনাে যুক্তিহীন বা এলাপাথাড়িভাবে দেয়া হয় না। কখনও এমন হতে পারে না যে, যার জীবন তারই জন্যে নিবেদিত তিনি তাকে কষ্টের মধ্যে রাখবেন এবং তাঁর সন্তুষ্টি লাভে যার জীবন উৎসর্গীকৃত, তাকে যদি তিনি কখনও কিছু কম দেন বা কষ্টের মধ্যে রাখেন অথবা সমস্যা জর্জরিত করেন তা অবশ্যই তারই এমন কোনাে কল্যাণের জন্যে, যা বুঝা আমাদের পক্ষে সম্ভব নাও হতে পারে। এজন্যেই বলা হয়েছে, এটা একান্ত তাঁরই ব্যাপার। [{আল্লাহর পথে টিকে থাকতে গিয়ে যদি দুঃখ কষ্ট ও বিপদ-আপদ আসে, তা আসে দুই কারণে, এক. যদি নিজের কাজ, ব্যবহার বা পরিকল্পনার কোনাে ক্রটি থাকে। দুই. তা আসে পরীক্ষান্বরূপ, যেমন সূরায়ে বাকারা ১৫৫ নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘অবশ্য অবশ্যই পরীক্ষা করবই করব তােমাদেরকে… অতএব, সুসংবাদ দাও সবরকারীদের… তারাই সঠিক পথপ্রাপ্ত।’ একজন সত্যিকার মুমিন সেই ব্যক্তি যে প্রথমে আত্মজিজ্ঞাসার মাধ্যমে নিজের কাজের হিসাব করে। তাতে যদি ভুল ধরা না পড়ে তাহলে সবর ও সালাতের মাধ্যমে বিপদমুক্তির জন্যে আল্লাহর কাছে সাহায্য চায়। সে সাহস হারায় না ও হতাশ হয় না, মনও খারাপ করে না। সে বিশ্বাস করে, এজগতে সে প্রতিদান না পেলেও অবশ্যই সে আখেরাতে পাবে}] ‘আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর গােপন রহস্যরাজি তিনিই জানেন। তিনিই জানেন খেয়ানতকারী চোখগুলােকে এবং সেই সব তথ্য যা বুকের মধ্যে গােপন রয়েছে।’ এইভাবে মহা পবিত্র গ্রন্থ আল কোরআনের মধ্যে বিভিন্ন স্থানে তার শক্তি ক্ষমতাবাহী নিদর্শনাবলী বর্ণিত হয়েছে। বলা হয়েছে তার কুদরত বা ক্ষমতা ও সর্ব বিজয়ী জ্ঞানের কথা। এ দেখে শুনে মােমেনদের অন্তরের মধ্যে একটি অভাবনীয় বিপ্লব সংঘটিত হয়। তার অন্তর প্রাণ প্রশস্ত, গভীর ও সুস্পষ্ট ঈমানের নূরে ভরে যায়, আর তখনই আল্লাহর ওপর ঈমানের ঘােষণা দিতে গিয়ে তারা বলে ওঠে- লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ। এই ঘােষণার সাথে সাথে তাদের জীবনে অভূতপূর্ব এক পরিবর্তন নেমে আসে, তখন তাদের অন্তরে অবস্থিত গােপন গভীর বিশ্বাসকে তারা প্রকাশ করে দেয়। তাদের গােটা শরীর ও মনের মধ্যে, এমনকি তাদের অন্তরের গভীরে পর্যন্ত ঈমান প্রবেশ করে। তাদের গােটা সত্ত্বা ঈমানের রংগে রঞ্জিত হয়। তাদের শিরা-উপশিরায় এবং তার সকল চেতনা ও ধমনীতে ঈমানের সংগীত বাজতে থাকে। এই ঈমানই তাদের আত্মা ও সকল স্নায়ুমন্ডলীর মধ্যে প্রবাহিত হয়। সাথে সাথে তাদের গােটা অস্তিত্ব থেকে জাহেলিয়াতের সকল জীবাণু ধ্বংস হয়ে যায় এবং ভ্রান্ত সকল মতবাদের শিকড় উৎপাটিত হয়ে যায়। এই পবিত্র কালেমার মধুর পরশে বুদ্ধির বিভ্রান্তি ও অন্তরের সকল প্রকার জটিলতা দূর হয়ে যায়, এসময় তারা একজন নতুন মানুষে পরিণত হয়ে যায়। তাদের গােটা অস্তিত্ব থেকে ঈমানের ঝলক নির্গত হতে থাকে, তাদের মধ্যে নিশ্চিত ও দ্বিধাহীন বিশ্বাস, অবিচলতা ও বাহাদুরী জন্ম নেয়। তাদের কাজ ও চরিত্রের মধ্যে এমন সব অলৌকিক পরিবর্তন সংঘটিত হয়, যা সকল দর্শন ও চরিত্রের ইতিহাসকে স্নান করে দেয়। এমনি করে চিরদিন এ কালেমার মহিমা ও অলৌকিক মহিমা অম্লান থাকবে। কিন্তু আমাদের যামানায় দেখা যাচ্ছে আল্লাহর প্রতি সঠিক ও গভীর ঈমানের অভাবে আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞান মানুষের জীবনে সঠিকভাবে কল্যাণ দান করতে পারছে না। ঈমান এমন একটি শিক্ষক এবং এমন একজন প্রশিক্ষক যা মানুষের অন্তরে দৃঢ়তা, কর্মস্পৃহা, উদ্দেশ্যের প্রতি নিষ্ঠা ও আনুগত্য বোধ আনে, এই বলিষ্ঠ শক্তিই মানুষকে ন্যায়বিচারক, সুবিচার বুদ্ধিসম্পন্ন ও ন্যায়নিষ্ঠ বানায়। ঈমানের এই শক্তিই মানুষকে নৈতিক অধঃপতন ও হিংস্রতা থেকে বাচায়, উন্নীত করে তাকে পশুত্বের স্তর থেকে মহান মানবতার স্তরে। নীতি নৈতিকতার ক্ষেতে ঈমানের অবদান অবিসংবাদিত। মানুষ যখন ধ্বংসের অতল তলে তলিয়ে যেতে থাকে, যখন সংগােপনে এমন এমন জঘন্য কাজ করে যা সাধারণ মানুষ জানতে পারে না। যেহেতু সেসব কঠিন অপরাধ মানুষের দৃষ্টির অন্তরালে সংঘটিত হয় এবং কোনাে মানবীয় বুদ্ধি যেখানে তদারক বা ধরপাকড়ে ব্যর্থ হয়ে যায়, সেখানে একমাত্র ঈমানী শক্তিতে এগিয়ে আসে সেই পতানােন্মুখ মানবতাকে নিশ্চিত ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার জন্যে। তখন আল্লাহর প্রতি তার প্রগাঢ় বিশ্বাস এবং মহান আল্লাহ অদৃশ্যে থেকে তার সকল কাজ ও আচরণ পর্যবেক্ষণ করছেন-এই চেতনা তার বিবেক দংশন করতে থাকে, তার মধ্যে জবাবদিহির এমন ভয় জাগায়, যা কোনাে আইন কানুনের পক্ষে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। আল্লাহ রব্বুল আলামীনের উপস্থিতির চেতনা তথা ঈমান এমন এক রক্ষাকবচ হিসাবে কাজ করে যে, তার পক্ষে কোনাে অন্যায় ও নীতিবিরােধী কাজে আর অধিক্ষণ অগ্রসর হওয়া সম্ভব হয় না। এই ঈমানী চেতনাই তার মধ্যে জবাবদিহির চিন্তা জাগিয়ে দেয় এবং এই কারণে সে আল্লাহর আক্রোশ ও আখেরাতের কঠিন আযাব থেকে রেহাই পাওয়ার জন্যে দোষ স্বীকার করে শরীয়তের যে কোনাে শাস্তিকে মাথা পেতে নেয়। এই ঈমানই তাকে মানুষের দেয়া আমানতের হক আদায় করতে উদ্বুদ্ধ করে। তাকে মানুষের ইযযত ও সম্ভ্রম রক্ষা করতে বাধ্য করে, যদিও অন্যায় চরিতার্থ করার অনেক সুযােগ সে পায় যদিও অত্যাচার করে সেরে যাওয়ার নিশ্চয়তাও হয়ত তার থাকে, যদিও সে বুঝে যে তার অন্যায় আচরণ কেউ দেখবে না এবং দুনিয়াতে কারাে কাছে তার জবাবদিহিও করা লাগবে না; তবুও ঈমানের দাবী, প্রকাশ্য ও গােপন সকল প্রকার অন্যায় কাজ ও মানুষের মনে ব্যথা দেয়া এবং তাদের হক নষ্ট করা থেকে তাকে বিরত রাখে। অনেক সময় মানুষ অনুভব করে যে, সে অন্যায় করলে তার শক্তি ক্ষমতার বলয়ে কেউ প্রবেশ করতে পারবে না বা তাকে কেউ ধর-পাকড়ও করতে পারবে না। সে আমানতের খেয়ানত করলেও কেউ তার কাছে কৈফিয়ত তলব করতে পারবে না। সেখানে ঈমানের অনুভূতিই তাকে সেসব অন্যায় থেকে বাঁচায়। ইসলামী যুদ্ধের বিজয়ের ইতিহাসে গণীমতের মাল গ্রহণ করার ব্যাপারে যে সততার দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে। আমানতের মাল তার প্রাপকের কছে পৌছে দেয়ার যে নযির স্থাপিত হয়েছে এবং একমাত্র আল্লাহর জন্যে কাজ করার যে নমুনা তার মধ্যে দেখা গেছে, তার তুলনা সমগ্র মানব জাতির ইতিহাসে আর নেই, আর এটাই ছিলাে খাঁটি ঈমান, আল্লাহর তদারকী ও সর্বদা এবং সর্বত্র তার উপস্থিত থাকার চিন্তা ও বিশ্বাসেরই ফসল। এই ঈমান আনার পূর্বে তৎকালীন আরব অনারব সকলেই তাদের কাজ আখলাক, ব্যবহার, লেনদেন, গ্রহণ বর্জন এবং রাজনীতি ও সামাজিকতার ক্ষেত্রে চরম নৈরাজ্যের মধ্যে জীবন যাপন করছিলাে। সেখানে কোনাে কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থা ছিলাে না, কোনাে শাসকের আনুগত্য কেউ করতাে না, না ছিলাে কোনাে নিয়ম শৃংখলা, না তাদের মধ্যে ছিলাে এক সূত্রে গ্রথিত হওয়ার বা প্রথিত থাকার কোনাে উপায় । প্রবৃত্তির দাসত্ব ও অন্ধ অনুকরণ করা এটাই ছিলাে তাদের নিত্য দিনের বৃত্তি। কারও অন্ধ অনুকরণ এবং এলােমেলাে জীবন যাপন করা ছাড়া কোনাে এমন কেন্দ্রীয় আইন শৃংখলা সেখানে বর্তমান ছিলাে না, যার মাধ্যমে তারা শান্তিপূর্ণ জীবন যাপন করতে পারতাে। এমনই এক বিশৃংখল পরিস্থিতির মধ্যে আল্লাহর রাসূল(স.) এসে তাদেরকে এক নিয়ম শৃংখলাপূর্ণ জীবন যাপন করানাের জন্যে ঈমানের গন্ডীর মধ্যে আবদ্ধ করতে চাইলেন। যারা স্থায়ীভাবে কারাে আনুগত্য করতে অভ্যস্ত ছিলাে না, তাদেরকে এমনভাবে আল্লাহর দাসত্ব করতে আহ্বান জানালেন যে, সে দাসত্ব গ্রহণ করার পর সে দাসত্ব বন্ধন থেকে আর কারও বের হওয়া যাবে না। এমনকি নিজের নফসেরও দাসত্ব করা যাবে না । আহ্বান জানালেন তাদেরকে তাদের সত্যিকার সৃষ্টিকর্তাকে বাস্তবে বাদশাহ ও শাসন কর্তৃপক্ষ বা আইনদাতা হিসাবে মেনে নিতে, একমাত্র তাঁরই হুকুমদাতা ও নিষেধকারী হিসাবে মানতে শেখালেন। তাদের জন্যে তার পরিচালনা, দাসত্ব ও নিরংকুশ বাধ্যতামূলক করে নিতে আনুগত্যকে এবং তাদেরকে পরিচালনার ভার স্বেচ্ছায় তার হাতে ছেড়ে দিতে উদ্বুদ্ধ করলেন। রসূল(স.) তাদেরকে আহ্বান জানালেন যেন তারা একমাত্র সর্বশক্তিমান আল্লাহর কাছে দায়িত্বভার আপন তুলে দেয় এবং তাদের ইচ্ছামত চলার খাহেশ ও ব্যক্তিগত ইচ্ছা-আকাংখা ও আমিত্বকে পুরােপুরিভাবে তাঁর হাতে সোপর্দ করে। নিজেদেরকে তার এমন দাস বানিয়ে দেয়, যাদের নিজস্ব মালিকানা বলতে কিছু থাকবে না, থাকবে না তাদের অর্জিত অর্থ সম্পদের ওপর তাদের কোনাে কর্তৃত্ব। তারা মেনে নেবে যে, অর্থ সম্পদ যেখানে যা কিছু আছে সবই আল্লাহর। সেই সম্পদ থেকে যেভাবে ইচ্ছা সেইভাবে আহরণ করা এবং যেভাবে খুশী সেইভাবে ব্যয় করার অধিকার তাদের নেই, মানুষ বলতে পারবে না, এ জীবন আমার, এ জীবনকে যেভাবে খুশী আমি ব্যবহার করবাে। সব কিছুর ব্যাপারে তাকেই মালিক মেনে নিতে হবে। জীবন থেকে নিয়ে যা কিছু আছে, সন্তান সন্ততি ধন-মান-সহায়-সম্পদ, বিষয়-আশয়-সব কিছু আল্লাহর, এসব কিছুকে তারই ইচ্ছামত ব্যয় করতে হবে, তারই রেজামন্দির পথে সবাইকে ও সব কিছু চালাতে হবে। যুদ্ধ সন্ধি, বন্দী বিনিময়, আদান প্রদান কারাে সাথে রাগ করা বা কারাে প্রতি খুশী হওয়া, কাকে দেয়া যাবে, কাকে দেয়া যাবে না, নামায কখন পড়বে, কখন পড়বে না- সবই তার বিধানমতাে এবং হুকুম অনুযায়ী করতে হবে। আলােচ্য আয়াতে এইভাবেই আল্লাহর কর্তৃত্বে বিশ্বাস করতে বলা হয়েছে এবং তাকে জীবন ও যৌবন এবং ধন মান সব কিছুর নিরংকুশ মালিক বলে মেনে নেয়ার নামকেই বলা হয়েছে ঈমান। এই ঈমানের দাবী হচ্ছে আল্লাহর ওপর পূর্ণ তাওয়াক্কুল করা এবং তারই ওপর পরিপূর্ণ ভরসা রাখা। কিন্তু মহাগ্রন্থ আল কোরআন তাওয়াক্কুলের এ গুণটিকে যিকির বা আল্লাহর স্মরণের সাথে একটু স্বতন্ত্র করে বর্ণনা করেছে এবং এইভাবে এই গুণটির মূল্য দিয়েছে বেশী। যেমন বলছে, ‘আর তারা তাদের রবের ওপর ভরসা করে।’ এইভাবে বাক্য গঠন প্রক্রিয়ার মধ্যে এ শব্দটিকে কখনও আগে আনা, আর কখনও পরে আনার মাধ্যমে জানানাে হচ্ছে যে, তাওয়াক্কুল একমাত্র আল্লাহর ওপরেই করতে হবে, আর কারও ওপর নয়। একমাত্র আল্লাহর ওপর ঈমান আনার দাবী হচ্ছে শুধুমাত্র তার ওপর ভরসা করা, অন্য কারাে ওপর নয়। তাওহীদের যতাে দিক বা যত রূপ আছে, তার মধ্যে এইটিই হচ্ছে প্রথম রূপ। অবশ্যই একজন মােমেন আল্লাহর ওপর ঈমান আনার সাথে সাথে, তার সকল গুণের ওপরও বিশ্বাস স্থাপন করে এবং অন্তরের দৃঢ় প্রত্যয় রাখে যে, এই বিশ্ব চরাচরে, তার ইচ্ছা ছাড়া কেউ কোনাে কিছুই করতে পারে না, আর তার হুকুম ছাড়া কোনাে কিছুই সংঘটিত হয় না। এইভাবে সব কিছুকে একমাত্র তার তাওয়াক্কুলেই সীমাবদ্ধ করে দেয়া হয়। ঈমানের আরও দাবী হচ্ছে একজন মােমেন একমাত্র আল্লাহ তায়ালা ছাড়া অন্য কারাে মুখাপেক্ষী হয় না এবং তার ইচ্ছা ছাড়া কাউকে পরিত্যাগও করে না।
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
২৯-৩১ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
যে-সকল নিদর্শন আল্লাহ তা‘আলার মহত্ত্ব ও বড়ত্ত্বের প্রমাণ বহণ করে তার মধ্যে অন্যতম হলো আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টি। তিনি আকাশ ও জমিনের সৃষ্টিকর্তা এবং তিনিই এতে পাহাড়-পর্বত, নদী-নালা, খাল-বিল, ঝর্ণা, পশু-পাখিসহ সকল কিছু সৃষ্টি করেছেন। সুতরাং যিনি এসব কিছুর সৃষ্টিকর্তা তিনিই সকল ইবাদত পাওয়ার যোগ্য, হাতে তৈরী কোন প্রতিমা, মূর্তি ও কোন নিদর্শন ইবাদত পাওয়ার যোগ্য হতে পারে না।
(وَهُوَ عَلٰي جَمْعِهِمْ إِذَا يَشَا۬ءُ قَدِيْرٌ)
‘তিনি যখন ইচ্ছা তখনই তাদেরকে সমবেত করতে সক্ষম’ অর্থাৎ এসব সৃষ্টির মৃত্যুর পর আল্লাহ তা‘আলা যখন ইচ্ছা সবাইকে একত্রিত করতে পারবেন। এমন নয় যে, তারা মারা যাবে, আর তাদের কোন হিসাব নিকাশ হবে না এবং তাদেরকে পাকড়াও করা হবে না। বরং আকাশ-জমিনে যা আছে সব কিছুকে তিনি যখন ইচ্ছা একত্রিত করতে পারবেন।
এরপর আল্লাহ তা‘আলা বর্ণনা করেন যে, পৃথিবীতে যত বালা-মসিবত ও আপদ-বিপদ আসে তার সকল কিছুই হয় মানুষের নিজ কৃতকর্মের জন্য, আর অধিকাংশ অপরাধ তিনি ক্ষমা করে দেন, সেগুলোর জন্য বিপদ-আপদ দেন না।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(وَلَوْ يُؤَاخِذُ اللّٰهُ النَّاسَ بِمَا كَسَبُوْا مَا تَرَكَ عَلٰي ظَهْرِهَا مِنْ دَا۬بَّةٍ وَّلٰكِنْ يُّؤَخِّرُهُمْ إِلٰٓي أَجَلٍ مُّسَمًّي ج فَإِذَا جَا۬ءَ أَجَلُهُمْ فَإِنَّ اللّٰهَ كَانَ بِعِبَادِه۪ بَصِيْرًا )
“আর যদি আল্লাহ মানুষকে তাদের কাজ-কর্মের দরুণ পাকড়াও করতেন তবে দুনিয়ার বুকে একটি প্রাণীকেও রেহাই দিতেন না। কিন্তু তিনি তাদেরকে এক নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অবকাশ দেন। অতঃপর যখন এসে পড়বে তাদের সেই নির্র্দিষ্ট সময়, (তখন তিনি তাদের কর্মের প্রতিফল দেবেন) আল্লাহ তো তাঁর বান্দাদের (বিষয়ে) সর্বদ্রষ্টা।” (সূরা ফা-ত্বির ৩৫ : ৪৫)
হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : ঐ সত্ত্বার শপথ যাঁর হাতে আমার প্রাণ, মু’মিনের ওপর যে কষ্ট, বিপদ-আপদ, দুশ্চিন্তা আপতিত হয় সে কারণে তার অপরাধ ক্ষমা করে দেয়া হয় এমনকি একটি কাঁটা ফুটলেও। (সহীহ বুখারী হা. ৫৬৪১, সহীহ মুসলিম হা. ২৫৭৩)
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : দুনিয়াতে তোমাদের ওপর যত অসুস্থতা, শাস্তি ও আপদ-বিপদ এসে থাকে তা তোমাদের হাতের অর্জন। আখিরাতে দ্বিতীয়বার সে অপরাধের শাস্তি দিতে আল্লাহ তা‘আলা লজ্জাবোধ করেন। দুনিয়াতে যা ক্ষমা করে দেন তাতে পুনরায় ফিরে আসা থেকে আল্লাহ তা‘আলা অধিক সম্মানিত। (মুসনাদ আহমাদ হা. ৬৪৯, সহীহ)
সুতরাং মানব জাতির পাপ কার্যের কারণেই জমিনে ভূমিকম্প, ভূমিধস ইত্যাদি বিপদ-আপদ ঘটে থাকে। অতএব আমাদের সকল পাপকাজ বর্জন করে আল্লাহ তা‘আলামুখী হওয়া উচিত।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. সকল কিছুর স্রষ্টা একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা আর ‘ইবাদত পাবারও যোগ্য একমাত্র তিনিই।
২. মানুষের বিপদ-আপদ, দুঃখ-কষ্ট, অসুস্থতা ইত্যাদির কারণে তার গুনাহ মোচন করে দেয়া হয়। তবে শর্ত হলো তাকে মু’মিন হতে হবে।
৩২-৩৫ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
পূর্বের আয়াতগুলোতে যেভাবে আল্লাহ তা‘আলার মহত্ত্বের, বড়ত্ত্বের ও ক্ষমতার নিদর্শন বর্ণনা করা হয়েছে এ আয়াতেও তাঁর ক্ষমতার অন্যতম একটি নিদর্শন বর্ণনা করা হয়েছে : তা হলো তাঁর অনুমতিতে পাহাড় সমান বড় বড় নৌযান সমুদ্রে ভাসমান হয়ে চলাচল করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, তিনি যদি বাতাসকে স্তব্ধ করে দিতেন অর্থাৎ বাতাস বন্ধ করে দিতেন তাহলে নৌযানসমূহের চলাচল বন্ধ হয়ে যাবে, মানুষের চলাচল বন্ধ হয়ে যাবে, পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। এগুলো মূলত আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশেই চলাচল করে থাকে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(وَاٰیَةٌ لَّھُمْ اَنَّا حَمَلْنَا ذُرِّیَّتَھُمْ فِی الْفُلْکِ الْمَشْحُوْنِﭸﺫ وَخَلَقْنَا لَھُمْ مِّنْ مِّثْلِھ۪ مَا یَرْکَبُوْنَﭹ وَاِنْ نَّشَاْ نُغْرِقْھُمْ فَلَا صَرِیْخَ لَھُمْ وَلَا ھُمْ یُنْقَذُوْنَﭺ اِلَّا رَحْمَةً مِّنَّا وَمَتَاعًا اِلٰی حِیْنٍﭻ )
“আর তাদের জন্য একটি নিদর্শন এই যে, আমি তাদের সন্তান-সন্ততিকে বোঝাই নৌকায় আরোহণ করিয়েছি। এবং তাদের জন্য আমি এর অনুরূপ যানবাহন সৃষ্টি করেছি যাতে তারা আরোহণ করে। আর আমি ইচ্ছা করলে তাদেরকে ডুবিয়ে দিতে পারি, তখন কেউ তাদের আর্তনাদে সাড়া দেবে না এবং তাদেরকে উদ্ধারও করা হবে না। কিন্তু আমারই পক্ষ থেকে রহমত ও কিছু সময়ের জন্য সুখ ভোগ করতে দেয়ার উদ্দেশ্যে আমি তা করি না।” (সূরা ইয়া-সীন ৩৬ : ৪১-৪৪)
الْجَوَارِ শব্দটি الجارية এর বহুবচন, অর্থ হল নৌযান, মূলত অর্থ চলমান ও ভাসমান। যেহেতু নৌযান ভেসে চলে তাই তাকে الجارية বলা হয়। رَوَاكِدَ শব্দটি راكد এর বহুবচন, অর্থ স্থির থাকা।
الاعلام অর্থ পাহাড়, অর্থাৎ পাহাড় সমান নৌযান।
এ সকল নিদর্শনসমূহ প্রমাণ করে- আল্লাহ তা‘আলা একক, অদ্বিতীয়। তিনিই সকল ইবাদত পাওয়ার হকদার। এ সকল নিদর্শন সম্পর্কে পূর্বে সূরা আন্ নাহ্লসহ অন্যান্য সূরাতেও আলোচনা করা হয়েছে।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. কোন কিছুই এমন নেই যে, আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশ ব্যতীত চলাচল করতে পারে। সকল কিছু তাঁর নির্দেশ মোতাবেক চলাচল করে, এমনকি বাতাসও তাঁর হুকুমে চলাচল করে।
৩৬ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
আলোচ্য আয়াতগুলোতে দুনিয়ার ধন-সম্পদ আখিরাতের নেয়ামতের তুলনায় অতি নগণ্য বস্তু সে কথাই আল্লাহ তা‘আলা বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন : দুনিয়াতে মানুষকে যা কিছু দেয়া হয়েছে তা অস্থায়ী, নশ্বর এবং তা তুচ্ছ বস্তু মাত্র। আর আখিরাতে মু’মিনদের জন্য আল্লাহ তা‘আলার নিকট যা কিছু জমা রয়েছে তা উত্তম এবং চিরস্থায়ী। যা কোন দিনও শেষ হবে না। অতএব মু’মিন কখনো দুনিয়াকে আখিরাতের ওপর প্রাধান্য দিতে পারে না। আখিরাতের অবিনশ্বর নেয়ামত পাওয়ার জন্য সে যেকোন সময় আল্লাহ তা‘আলার রাস্তায় নিজের সম্পদ ও জীবন বিলিয়ে দিতে প্রস্তুত। আল্লাহ তা‘আলার বিধান পালন করতে তার কোন কষ্ট ও ইতস্ততবোধ হবে না।
তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
২৯-৩১ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা’আলা স্বীয় শ্রেষ্ঠত্ব, ক্ষমতা ও আধিপত্যের বর্ণনা দিচ্ছেন যে, আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন তিনিই এবং এতোদুভয়ের মধ্যে যত কিছু ছড়িয়ে রয়েছে সবই তিনি সৃষ্টি করেছেন। ফেরেশতা, মানব, দানব এবং বিভিন্ন প্রকারের প্রাণী, যেগুলো প্রান্তে প্রান্তে ছড়িয়ে রয়েছে, কিয়ামতের দিন তিনি এসবকে একই ময়দানে একত্রিত করবেন, সেদিন তিনি তাদের মধ্যে ন্যায়ের সাথে ফায়সালা করবেন।
মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ “তোমাদের যে বিপদ-আপদ ঘটে তা তো তোমাদের কৃতকর্মেরই ফল। অর্থাৎ হে লোক সকল! তোমাদের উপর যে বিপদ-আপদ আপতিত হয় তা প্রকৃতপক্ষে তোমাদের কৃত পাপকার্যের প্রতিফল। তবে আল্লাহ এমন ক্ষমাশীল ও দয়ালু যে, তিনি তোমাদের বহু অপরাধ ক্ষমা করে দেন। যদি তিনি তোমাদেরকে তোমাদের কৃতকর্মের কারণে পাকড়াও করতেন তবে ভূ-পৃষ্ঠে তোমাদের কেউ চলাফেরা করতে পারতো না।
সহীহ হাদীসে এসেছে যে, নবী (সঃ) বলেছেনঃ “যার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে তাঁর শপথ! মুমিনের উপর যে কষ্ট ও বিপদ-আপদ আপতিত হয় ওর কারণে তার অপরাধ ক্ষমা করে দেয়া হয়, এমনকি একটি কাঁটা ফুটলেও (এর বিনিময়ে গুনাহ মাফ করা হয়)।”
হযরত আবু কালাবাহ (রঃ) বলেন যে, যখন (আরবী) (অর্থাৎ কেউ অণু পরিমাণ সৎ কর্ম করলে তা দেখবে এবং কেউ অণু পরিমাণ অসৎ কর্ম করলে তাও দেখবে) (৯৯:৭-৮) এই আয়াত অবতীর্ণ হয় তখন হযরত আবু বকর (রাঃ) আহার করছিলেন। এ আয়াত শুনে তিনি খাদ্য হতে হাত উঠিয়ে নেন এবং বলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! প্রত্যেক ভাল ও মন্দের প্রতিফল দেয়া হবে?” উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “জেনে রেখো যে, স্বভাব বিরুদ্ধ যা কিছু হয় তাই হলো মন্দ কর্মের প্রতিফল এবং সমস্ত পুণ্য আল্লাহর নিকট জমা থাকে।” (এটা ইমাম ইবনে জারীর (রাঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত আবু ইদরীস (রঃ) বলেন যে, এই আয়াতে এই বিষয়টিই বর্ণিত হয়েছে।
হযরত আলী (রাঃ) বলেন, এসো, আমি তোমাদেরকে শ্রেষ্ঠতম আয়াত এবং হাদীসও শুনাচ্ছি। আয়াতটি হলোঃ (আরবী) অর্থাৎ “তোমাদের যে বিপদ-আপদ ঘটে তা তো তোমাদের কৃতকর্মেরই ফল এবং তোমাদের অনেক অপরাধ তিনি মার্জনা করে দেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ) আমার সামনে এ আয়াতটি তিলাওয়াত করে আমাকে বলেনঃ “হে আলী (রাঃ)! আমি তোমাকে এর তাফসীর বলছি। মানুষের কৃতকর্মের ফলে তাদের উপর যে বিপদ-আপদ আপতিত হয়, আল্লাহ তা’আলার ধৈর্য ও সহনশীলতা এর বহু ঊর্ধে যে, পরকালে আবার তিনি এর কারণে শাস্তি দান করবেন। বহু অপরাধ তিনি ক্ষমা করে দেন। বান্দার উপর যার এতো বড় দয়া তার দ্বারা এটা কখনো সম্ভব নয় যে, যে অপরাধ তিনি ক্ষমা করে দিয়েছেন ওটার জন্যে আবার পরকালে পাকড়াও করবেন।” (ইমাম আহমাদ (রঃ) স্বীয় মুসনাদে (রঃ) এটা বর্ণনা করেছেন)
মুসনাদে ইবনে আবি হাতিমেও এই রিওয়াইয়াতটিই হযরত আলী (রাঃ) হতেই বর্ণিত আছে। তাতে এও রয়েছে যে, আবু জাহফা (রঃ) যখন হযরত আলী (রাঃ)-এর নিকট গমন করেন তখন তিনি তাঁকে বলেনঃ “তোমাকে আমি এমন একটি হাদীস শুনাচ্ছি যা মনে রাখা প্রত্যেক মুমিনের অবশ্য কর্তব্য।” তারপর তিনি এ আয়াতের তাফসীর শুনিয়ে দেন।
হযরত মুআবিয়া ইবনে আবি সুফিয়ান (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে, তিনি বলতে শুনেছেন:“মুমিনের দেহে যে কষ্ট পৌছে, ঐ কারণে আল্লাহ তাআলা তার গুনাহ মাফ করে দেন।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) স্বীয় মুসনাদে বর্ণনা করেছেন)
হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “(মুমিন) বান্দার গুনাহ্ যখন বেশী হয়ে যায় এবং ঐ গুনাহকে মিটিয়ে দেয়ার মত কোন জিনিস তার কাছে থাকে না তখন আল্লাহ তা’আলা তাকে দুঃখ-কষ্টে ফেলে দেন এবং ওটাই তার গুনাহ্ মাফের কারণ হয়ে যায়।” (ইমাম আহমাদই (রঃ) এ হাদীসটিও বর্ণনা করেছেন)
হযরত হাসান বসরী (রঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, … (আরবী)-এই আয়াতটি যখন অবতীর্ণ হয় তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “যার হাতে মুহাম্মাদ (সঃ)-এর প্রাণ রয়েছে তাঁর শপথ! লাঠির সামান্য খোঁচা, হাড়ের সামান্য আঘাত, এমন কি পা পিছলিয়ে যাওয়া ইত্যাদিও কোন পাপের কারণে ঘটে থাকে। আর এমনিতেই আল্লাহ তা’আলা বহু গুনাহ মাফ করে দেন।” (এ হাদীসটি ইমাম ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত হাসান (রঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একবার হযরত ইমরান ইবনে হুসাইন (রাঃ)-এর দেহে রোগ দেখা দেয়। খবর পেয়ে জনগণ তাঁকে দেখতে যান। হযরত হাসান (রঃ) তাঁকে এ অবস্থায় বলেনঃ “আপনার এ অবস্থা দেখে আমরা বড়ই মর্মাহত হয়েছি। তার একথা শুনে হযরত ইমরান ইবনে হুসাইন (রাঃ) তাকে বলেনঃ “এরূপ কথা বলো না। তোমরা যা দেখছো এসব হচ্ছে পাপ মোচনের মাধ্যম। আর এমনিতেই আল্লাহ বহু গুনাহ মাফ করে দিয়েছেন।” অতঃপর তিনি …(আরবী)-এ আয়াতটিই পাঠ করেন। (এটা ইমাম ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
আবুল বিলাদ (রঃ) আ’লা ইবনে বদর (রঃ)-কে বলেনঃ “কুরআন কারীমে তো … (আরবী)-এ আয়াতটি রয়েছে, আর আমি এই অপ্রাপ্ত বয়সেই অন্ধ হয়ে গেছি (এর কারণ কি?)” উত্তরে হযরত আ’লা ইবনে বদর (রঃ) বলেনঃ “এটা তোমার পিতা-মাতার পাপের বিনিময়।”
হযরত যহহাক (রঃ) বলেনঃ “যে ব্যক্তি কুরআন মুখস্থ করে ভুলে যায়, নিশ্চয়ই এটা তার পাপের কারণে হয়। এছাড়া আর কোনই কারণ নেই।” অতঃপর তিনি … (আরবী)-এ আয়াতটি পাঠ করে বলেনঃ “বল তো, এর চেয়ে বড় বিপদ আর কি হতে পারে যে, মানুষ আল্লাহর কালাম মুখস্থ করে ভুলে যাবে?”
৩২-৩৫ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা স্বীয় ক্ষমতার নিদর্শন স্বীয় মাখলুকের কাছে রাখছেন যে, তিনি সমুদ্রকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন। যাতে নৌযানসমূহ তাতে যখন তখন চলাফেরা করতে পারে। সমুদ্রে বড় বড় নৌযানগুলোকে যমীনের বড় বড় পাহাড়ের মত দেখায়। যে বায়ু নৌযানগুলোকে এদিক হতে ওদিকে নিয়ে যায় তা তার অধিকারভুক্ত। তিনি ইচ্ছা করলে ঐ বায়ুকে স্তব্ধ করে দিতে পারেন, ফলে নৌযানসমূহ নিশ্চল হয়ে পড়বে সমুদ্র পৃষ্ঠে। প্রত্যেক ঐ ব্যক্তির জন্যে এতে নিদর্শন রয়েছে যে দুঃখে ধৈর্যধারণ ও সুখে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে অভ্যস্ত। সে এসব নিদর্শন দেখে আল্লাহ তা’আলার ব্যাপক ও অসীম ক্ষমতা ও আধিপত্য জানতে ও বুঝতে পারে। যেমন মহাপ্রতাপান্বিত আল্লাহ বায়ুকে স্তব্ধ করে দিয়ে নৌযানসমূহকে নিশ্চল করে দিতে পারেন, অনুরূপভাবে পর্বত সদৃশ নৌযানগুলোকে ক্ষণেকের মধ্যে সমুদ্রে ডুবিয়ে দিতে পারেন। তিনি ইচ্ছা করলে নৌযানের আরোহীদের পাপের কারণে ঐগুলোকে বিধ্বস্ত করে দিতে পারেন। অনেককে তিনি ক্ষমা করে থাকেন। যদি সমস্ত গুনাহর উপর তিনি পাকড়াও করতেন তবে নৌযানের সমস্ত আরোহীকে সোজাসুজি সমুদ্রে ডুবিয়ে দিতেন। কিন্তু তার সীমাহীন রহমত তাদেরকে সমুদ্রের এপার হতে ওপারে নিয়ে যায়। তাফসীরকারগণ এও বলেছেন যে, তিনি ইচ্ছা করলে বায়ুকে প্রতিকূলভাবে প্রবাহিত করতে পারেন, ফলে নৌযানগুলো আর সোজাভাবে চলতেই পারবে না, বরং এদিক ওদিক চলে যাবে। মাঝি-মাল্লারা তখন আর নৌযানগুলোর ভারসাম্য রক্ষা করতে পারবে না। যেদিকে যাওয়ার দরকার সেদিকে না গিয়ে নৌকা অন্যদিকে চলে যাবে। ফলে যাত্রীরা হতবুদ্ধি হয়ে পড়বে এবং শেষ পর্যন্ত ধ্বংসের মুখে পতিত হবে। মোটকথা, যদি আল্লাহ তা’আলা বায়ুকে স্তব্ধ করে দেন তবে তো নৌকা নিশ্চল হয়ে পড়বে, আবার যদি বায়ুকে এলোপাতাড়িভাবে প্রবাহিত করেন তাহলেও যাত্রীদের সমূহ ক্ষতি হবে। কিন্তু মহান আল্লাহর এটা বড়ই দয়া ও করুণা যে, তিনি শান্ত ও অনুকূল বায়ু প্রবাহিত করেন, ফলে আদম সন্তানরা অতি সহজে ও নিরাপদে নৌকাযোগে সুদীর্ঘ পথ অতিক্রম করে নিজেদের গন্তব্যস্থলে পৌছে যায়। বৃষ্টির অবস্থাও এইরূপ যে, যদি মোটেই বর্ষিত না হয় তবে যমীন শুকিয়ে যাবে এবং কোন ফসল উৎপন্ন হবে না। ফলে মানুষ দুর্ভিক্ষের কবলে পতিত হবে। আর যদি অতিমাত্রায় বর্ষিত হয়, তবে মানুষ বন্যার কবলে পতিত হয়ে ধ্বংস হয়ে যাবে। কিন্তু আল্লাহ তা’আলা কত বড় মেহেরবান যে, যে শহরে ও যে যমীনে বেশী বৃষ্টির প্রয়োজন সেখানে তিনি বেশী বৃষ্টি বর্ষণ করেন। এবং যেখানে বৃষ্টির প্রয়োজন কম সেখানে কমই বর্ষণ করেন।
এরপর মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ বলেনঃ যারা আমার নিদর্শন সম্বন্ধে বিতর্ক করে তাদের জেনে রাখা উচিত যে তারা আমার ক্ষমতার বাইরে নয়। আমি যদি তাদেরকে শাস্তি দেয়ার ইচ্ছা করি তবে তাদের কোন নিষ্কৃতি নেই। সবাই আমার ক্ষমতা ও ইচ্ছার অধীনে রয়েছে।
৩৬ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা’আলা দুনিয়ার অসারতা, তুচ্ছতা এবং নশ্বরতার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন যে, এটা জমা করে কেউ যেন গর্বে ফুলে না উঠে। কেননা, এটাতো ক্ষণস্থায়ী। বরং মানুষের আখিরাতের প্রতি আকৃষ্ট হওয়া উচিত। সকর্ম করে পুণ্য সঞ্চয় করা তাদের একান্ত কর্তব্য। কেননা, এটাই হচ্ছে চিরস্থায়ী। সুতরাং অস্থায়ীকে স্থায়ীর উপর এবং স্বল্পতাকে আধিক্যের উপর প্রাধান্য দেয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়।
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
# যমীন ও আসমান উভয় স্থানেই। জীবনের অস্তিত্ব যে শুধু পৃথিবীতেই নয়, অন্য সব গ্রহেও প্রাণী ও প্রাণধারী সত্তা আছে এটা তার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত।
# তিনি যেমন তাদের ছড়িয়ে দিতে সক্ষম তেমনি একত্র করতেও সক্ষম। তাই কিয়ামত আসতে পারে না এবং আগের ও পরের সবাইকে একই সময়ে উঠিয়ে একত্রিত করা যেতে পারে না এ ধারণা মিথ্যা।
# প্রকাশ থাকে যে, এখানে মানুষের সব রকম বিপদাপদের কারণ বর্ণনা করা হচ্ছে না। এখানে বক্তব্যের লক্ষ্য সেই সব লোক যারা সেই সময় পবিত্র মক্কায় কুফর ও নাফরমানিতে লিপ্ত হচ্ছিলো। তাদের বলা হচ্ছে, আল্লাহ যদি তোমাদের সমস্ত দোষ-ত্রুটির জন্য পাকড়াও করতেন তাহলে তোমাদেরকে জীবিতই রাখতেন না। তবে যে বিপদাপদ তোমাদের ওপর নাযিল হয়েছে (সম্ভবত মক্কার দুর্ভিক্ষের প্রতি ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে) তা কেবল সতর্কীকরণ হিসেবে দেয়া হয়েছে যাতে তোমাদের সম্বিত ফিরে আসে এবং নিজেদের কাজকর্মের পর্যালোচনা করে দেখো যে, তোমরা আপন রবের বিরুদ্ধে কি ধরনের আচরণ করেছো। একথাও বুঝার চেষ্টা করো, যে আল্লাহর বিরুদ্ধে তোমরা বিদ্রোহ করছো তার কাছে তোমরা কত অসহায়। তাছাড়া জেনে রাখো, তোমরা যাদেরকে অভিভাবক ও সাহায্যকারী বানিয়ে বসে আছো কিংবা তোমরা যেসব শক্তির ওপর ভরসা করে আছো আল্লাহর পাকড়াও থেকে বাঁচার জন্য তারা কোন কাজে আসবে না।
আরো সুস্পষ্ট করে তুলে ধরার জন্য এ বিষয়টিও বর্ণনা করা প্রয়োজন যে এ ব্যাপারে খাঁটি মু’মিনের জন্য আল্লাহর বিধান ভিন্ন। মু’মিনের ওপর যে দুঃখ-কষ্ট ও বিপদাপদ আসে তার গোনাহ, ত্রুটি-বিচ্যুতি ও দুর্বলতার কাফফারা হতে থাকে। সহীহ হাদীসে আছেঃ
مَا يُصِيبُ الْمُسْلِمَ مِنْ نَصَبٍ وَلاَ وَصَبٍ وَلاَ هَمٍّ وَلاَ حُزْنٍ وَلاَ أَذًى وَلاَ غَمٍّ حَتَّى الشَّوْكَةِ يُشَاكُهَا ، إِلاَّ كَفَّرَ اللَّهُ بِهَا مِنْ خَطَايَاهُ (بخارى , مسلم)
“মুসলমান যে দুঃখ-কষ্ট, চিন্তা ও দুর্ভাবনা এবং কষ্ট ও অশান্তির সম্মুখীনই হোক না কেন এমন কি একটি কাঁটা বিদ্ধ হলেও আল্লাহ তাকে তার কোন না কোন গোনাহর কাফফারা বানিয়ে দেন।”
এরপর থাকে এমন সব বিপদাপদের প্রশ্ন যা আল্লাহর পথে তাঁর বাণীকে সমুন্নত করার জন্য কোন ঈমানদারকে বরদাশত করতে হয়, তা কেবল ত্রুটি-বিচ্যুতির কাফফারাই হয় না, আল্লাহর কাছে তার মর্যাদা বৃদ্ধিরও কারণ হয়। এসব বিপদাপদ গোনাহর শাস্তি হিসেবে নাযিল হয়ে থাকে এমন ধারণা পোষণ করার আদৌ কোন অবকাশ নেই।
# ধৈর্যশীল অর্থ এমন ব্যক্তি যে নিজের প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণে রাখে এবং ভাল মন্দ সব রকম পরিস্থিতিতে বন্দেগীর আচরণের ওপর দৃঢ়পদ থাকে। তাদের অবস্থা এমন নয় যে, সুদিন আসলে নিজের সত্তাকে ভুলে আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহী এবং বান্দাদের জন্য অত্যাচারী হয়ে ওঠে এবং দুর্দিন আসলে মর্যাদাবোধ খুইয়ে বসে এবং যে কোন জঘন্য থেকে জঘন্যতর আচরণ করতে থাকে। কৃতজ্ঞ বলতে বুঝানো হয়েছে এমন ব্যক্তিকে যাকে তাকদীরে ইলাহী যত উচ্চাসনেই অধিষ্টিত করুক না কেন সে তাকে নিজের কৃতিত্ব নয়, বরং আল্লাহর ইহসান মনে করে এবং যত নিচেই তাকে নিক্ষেপ করা হোক না কেন তার দৃষ্টি নিজের বঞ্চনার পরিবর্তে সেই সব নিয়ামতের ওপর নিবন্ধ থাকে যা অতি করুণ পরিস্থিতির মধ্যেও ব্যক্তি লাভ করে এবং সুখ ও দুঃখ উভয় পরিস্থিতিতে তার মুখ ও অন্তর থেকে তার রবের প্রতি কৃতজ্ঞতাই প্রকাশ পেতে থাকে।
# কুরাইশদেরকে তাদের বাণিজ্যিক কায়কারবারের উদ্দেশ্যে হাবশা এবং আফ্রিকার উপকূলীয় অঞ্চলের দিকে যেতে হতো। এসব সফরে তারা পালের জাহাজ ও নৌকায় লোহিত সাগর পাড়ি দিত যা একটি ভয়ানক সাগর। প্রায়ই তা ঝঞ্ঝা বিক্ষুদ্ধ থাকে এবং তার পানির নীচে বিপুল সংখ্যক পাহাড় বিদ্যমান। বিক্ষুব্ধ সমুদ্রে এসব পাহাড়ের সাথে জাহাজের ধাক্কা খাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। আল্লাহ এখানে সে অবস্থা চিত্রিত করেছেন নিজেদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে কুরাইশরা তা ভালভাবে উপলব্ধি করতে পারতো।
# এটা এমন কোন জিনিস নয় যার জন্য মানুষ গর্বিত হতে পারে। কোন মানুষ পৃথিবীতে সর্বাধিক সম্পদ লাভ করলেও স্বল্পতম সময়ের জন্যই লাভ করেছে। সে কয়েক বছর মাত্র তা ভোগ করে তারপর সব কিছু ছেড়ে খালি হাতে পৃথিবী থেকে বিদায় হয়ে যায়। তাছাড়া সে সম্পদ যত অঢেলই হোক না কেন বাস্তবে তার একটা ক্ষুদ্রতম অংশই ব্যক্তির ব্যবহারে আসে। এ ধরণের সম্পদের কারণে গর্বিত হওয়া এমন কোন মানুষের কাজ নয় যে, নিজের এই অর্থ-সম্পদের এবং এই পৃথিবীর প্রকৃত অবস্থা উপলব্ধি করে।
# সেই সম্পদ গুণগত ও অবস্থাগত দিক দিয়েও উন্নতমানের। তাছাড়া তা সাময়িক বা অস্থায়ীও নয়, বরং চিরস্থায়ী ও অবিনশ্বর।
# এখানে আল্লাহর প্রতি ভরসাকে ঈমানের অনিবার্য দাবী এবং আখেরাতের সফলতার জন্য একটি জরুরী বৈশিষ্ট্য বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তাওয়াক্কুল অর্থ হচ্ছে, প্রথমত, আল্লাহর পথনির্দেশনার ওপর ব্যক্তির পূর্ণ আস্থা থাকবে এবং সে মনে করবে, আল্লাহ প্রকৃত সত্য সম্পর্কে যে জ্ঞান, নৈতিক চরিত্রের যে নীতিমালা, হালাল ও হারামের যে সীমারেখা এবং পৃথিবীতে জীবন যাপনের জন্য যেসব নিয়ম-কানুন ও বিধি-বিধান দিয়েছেন তাই সত্য ও সঠিক এবং সেসব মেনে চলার মধ্যেই মানুষের কল্যাণ নিহিত। দ্বিতীয়ত, মানুষের নির্ভরতা তার নিজের শক্তি, যোগ্যতা, মাধ্যম ও উপায়-উপকরণ, ব্যবস্থাপনা এবং আল্লাহ ছাড়া অন্যদের সাহায্য-সহযোগিতার ওপর হবে না। তাকে একথা পুরোপুরি মনে রাখতে হবে যে, দুনিয়া ও আখেরাতের প্রতিটি ব্যাপারে তার সাফল্য প্রকৃতপক্ষে নির্ভর করে আল্লাহর তাওফীক ও সাহায্যের ওপর। আর সে আল্লাহর তাওফীক ও সাহায্যের উপযুক্ত কেবল তখনই হতে পারে যখন সে তাঁর সন্তুষ্টিকে লক্ষ্য বানিয়ে এবং তাঁর নির্ধারিত সীমারেখাসমূহ মেনে কাজ করবে। তৃতীয়ত, ঈমান ও নেক কাজের পথ অবলম্বনকারী এবং বাতিলের পরিবর্তে ন্যায় ও সত্যের জন্য কর্মতৎপর বান্দাদেরকে আল্লাহ যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ব্যক্তিকে তার ওপর পরিপূর্ণ আস্থা রাখতে হবে। ঐ সব প্রতিশ্রুতির প্রতি আস্থাশীল হয়ে সে সেই সব লাভ, উপকার ও আনন্দকে পদাঘাত করবে যা বাতিলের পথ অনুসরণ করার ক্ষেত্রে লাভ করা যাবে বলে মনে হয় এবং ন্যায় ও সত্যের ওপর দৃঢ়পদ থাকার কারণে যেসব ক্ষতি, দুঃখ-কষ্ট এবং বঞ্চনা তার ভাগ্যে আসে তা সহ্য করবে। ঈমানের সাথে তাওয়াক্কুলের সম্পর্ক কত গভীর তা তাওয়াক্কুল শব্দের অর্থের এই বিশ্লেষণের পর সুস্পষ্ট হয়ে যায় এবং তাওয়াক্কুল ছাড়া যে ঈমান সাদামাটা স্বীকৃতি ও ঘোষণা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ তা থেকে সেই গৌরবময় ফলাফল কি করে অর্জিত হতে পারে ঈমান গ্রহণ করে তাওয়াক্কুলকারীদের যার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে।