بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ (বই#১১১০/এবং কাফেররা বলে-৬) [ তাওহীদ প্রতিষ্ঠার অন্যতম প্রাণপুরুষ ইবরাহীম(আ.) : ‘যখন ইবরাহীম তার জাতিকে ও পিতাকে সম্বােধন করে বললাে, আমি তােমাদের উপাস্যদের থেকে মুক্ত:- **  যদি এই আশঙ্কা না থাকতো তাহলে যারা দয়াময় আল্লাহর সাথে কুফরি করে আমি তাদের ঘরের ছাদ স্বর্ণনির্মিত ‌‌ও রৌপ্য দিয়ে বানিয়ে দিতাম,:-] www.motaher21.net সূরা:৪৩: সূরা:- ‌আয-যুখরুফ পারা:২৫ ২৬-৩৫ নং আয়াত:-

أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#১১১০/এবং কাফেররা বলে-৬)
[ তাওহীদ প্রতিষ্ঠার অন্যতম প্রাণপুরুষ ইবরাহীম(আ.) : ‘যখন ইবরাহীম তার জাতিকে ও পিতাকে সম্বােধন করে বললাে, আমি তােমাদের উপাস্যদের থেকে মুক্ত:-
**  যদি এই আশঙ্কা না থাকতো তাহলে যারা দয়াময় আল্লাহর সাথে কুফরি করে আমি তাদের ঘরের ছাদ স্বর্ণনির্মিত ‌‌ও রৌপ্য দিয়ে বানিয়ে দিতাম,:-]
www.motaher21.net
সূরা:৪৩: সূরা:- ‌আয-যুখরুফ পারা:২৫
২৬-৩৫ নং আয়াত:-
সূরা:৪৩: সূরা:- ‌আয-যুখরুফ:২৬
وَ اِذۡ قَالَ اِبۡرٰہِیۡمُ لِاَبِیۡہِ وَ قَوۡمِہٖۤ اِنَّنِیۡ بَرَآءٌ مِّمَّا تَعۡبُدُوۡنَ ﴿ۙ۲۶﴾
আর স্মরণ করুন, যখন ইবরাহীম তার পিতা এবং তার সম্প্রদায়কে বলেছিলেন, ‘তোমরা যেগুলোর ইবাদাত করা নিশ্চয় আমি তাদের থেকে সম্পৰ্কমুক্ত।
সূরা:৪৩: সূরা:- ‌আয-যুখরুফ:২৭
اِلَّا الَّذِیۡ فَطَرَنِیۡ فَاِنَّہٗ سَیَہۡدِیۡنِ ﴿۲۷﴾
আমার সম্পর্ক শুধু তাঁরই সাথে যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন। তিনিই আমাকে পথপ্রদর্শন করবেন।”
সূরা:৪৩: সূরা:- ‌আয-যুখরুফ:২৮
وَ جَعَلَہَا کَلِمَۃًۢ بَاقِیَۃً فِیۡ عَقِبِہٖ لَعَلَّہُمۡ یَرۡجِعُوۡنَ ﴿۲۸﴾
আর এ ঘোষণাকে তিনি চিরন্তন বাণীরূপে রেখে গিয়েছেন তার উত্তরসূরীদের মধ্যে, যাতে তারা ফিরে আসে।
সূরা:৪৩: সূরা:- ‌আয-যুখরুফ:২৯
بَلۡ مَتَّعۡتُ ہٰۤؤُلَآءِ وَ اٰبَآءَہُمۡ حَتّٰی جَآءَہُمُ الۡحَقُّ وَ رَسُوۡلٌ مُّبِیۡنٌ ﴿۲۹﴾
বস্তুতঃ আমিই ওদেরকে এবং ওদের পূর্বপুরুষদেরকে উপভোগের সুযোগ দিয়েছিলাম যতক্ষণ না ওদের কাছে সত্য ও স্পষ্ট প্রচারক রসূল এল।
সূরা:৪৩: সূরা:- ‌আয-যুখরুফ:৩০
وَ لَمَّا جَآءَہُمُ الۡحَقُّ قَالُوۡا ہٰذَا سِحۡرٌ وَّ اِنَّا بِہٖ کٰفِرُوۡنَ ﴿۳۰﴾
যখন ওদের কাছে সত্য এল, তখন ওরা বলল, ‘এ তো যাদু এবং আমরা এ প্রত্যাখ্যান করি।’
সূরা:৪৩: সূরা:- ‌আয-যুখরুফ:৩১
وَ قَالُوۡا لَوۡ لَا نُزِّلَ ہٰذَا الۡقُرۡاٰنُ عَلٰی رَجُلٍ مِّنَ الۡقَرۡیَتَیۡنِ عَظِیۡمٍ ﴿۳۱﴾
তারা বলে, দু’টি শহরের বড় ব্যক্তিদের কারো ওপর এ কুরআন নাযিল করা হলো না কেন?
সূরা:৪৩: সূরা:- ‌আয-যুখরুফ:৩২
اَہُمۡ یَقۡسِمُوۡنَ رَحۡمَتَ رَبِّکَ ؕ نَحۡنُ قَسَمۡنَا بَیۡنَہُمۡ مَّعِیۡشَتَہُمۡ فِی الۡحَیٰوۃِ الدُّنۡیَا وَ رَفَعۡنَا بَعۡضَہُمۡ فَوۡقَ بَعۡضٍ دَرَجٰتٍ لِّیَتَّخِذَ بَعۡضُہُمۡ بَعۡضًا سُخۡرِیًّا ؕ وَ رَحۡمَتُ رَبِّکَ خَیۡرٌ مِّمَّا یَجۡمَعُوۡنَ ﴿۳۲﴾
তোমার রবের রহমত কি এরা বণ্টন করে? দুনিয়ার জীবনে এদের মধ্যে জীবন-যাপনের উপায়-উপকরণ আমি বণ্টন করেছি এবং এদের মধ্য থেকে কিছু লোককে অপর কিছু সংখ্যক লোকের ওপর অনেক বেশী মর্যাদা দিয়েছি, যাতে এরা একে অপরের সেবা গ্রহণ করতে পার। (এদের নেতারা) যে সম্পদ অর্জন করছে তোমার রবের রহমত তার চেয়ে অনেক বেশি মূল্যবান।
সূরা:৪৩: সূরা:- ‌আয-যুখরুফ:৩৩
وَ لَوۡ لَاۤ اَنۡ یَّکُوۡنَ النَّاسُ اُمَّۃً وَّاحِدَۃً لَّجَعَلۡنَا لِمَنۡ یَّکۡفُرُ بِالرَّحۡمٰنِ لِبُیُوۡتِہِمۡ سُقُفًا مِّنۡ فِضَّۃٍ وَّ مَعَارِجَ عَلَیۡہَا یَظۡہَرُوۡنَ ﴿ۙ۳۳﴾
সব মানুষ এক মতাবলম্বী হয়ে পড়বে, এ আশংকা না থাকলে দয়াময়ের সাথে যারা কুফরী করে, তাদেরকে আমারা দিতাম তাদের ঘরের জন্য রৌপ্য-নির্মিত ছাদ ও সিঁড়ি যাতে তারা আরোহণ করে,
সূরা:৪৩: সূরা:- ‌আয-যুখরুফ:৩৪
وَ لِبُیُوۡتِہِمۡ اَبۡوَابًا وَّ سُرُرًا عَلَیۡہَا یَتَّکِـُٔوۡنَ ﴿ۙ۳۴﴾
এবং তাদের ঘরের দরজাসমূহ এবং যে সিংহাসনের ওপর তারা বালিশে হেলান দিয়ে বসে তা সবই ( রৌপ্য এবং স্বর্ণের ) বানিয়ে দিতাম।
সূরা:৪৩: সূরা:- ‌আয-যুখরুফ:৩৫
وَ زُخۡرُفًا ؕ وَ اِنۡ کُلُّ ذٰلِکَ لَمَّا مَتَاعُ الۡحَیٰوۃِ الدُّنۡیَا ؕ وَ الۡاٰخِرَۃُ عِنۡدَ رَبِّکَ لِلۡمُتَّقِیۡنَ ﴿٪۳۵﴾
আর (তাদের জন্য) স্বর্ণনির্মিত এগুলো তো শুধু পার্থিব জীবনের উপকরণ, তোমার রবের দরবারে আখেরাত শুধু মুত্তাকীদের জন্য নির্দিষ্ট।

ফী জিলালিল কুরআন:

সংক্ষিপ্ত আলোচনা (২৬-৫৬) : কোরায়শরা বলতাে, তারা হযরত ইব্রাহীম এর বংশধর। তাদের একথা নিসন্দেহে সত্য। কিন্তু তারা হযরত ইবরাহীমের আদর্শের উত্তরসূরী হিসেবে তারা যে দাবী করতাে মােটেই সত্য নয়। কেননা হযরত ইবরাহীম দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তাওহীদের বাণী প্রচার করে গেছেন। আর এ জন্যেই তিনি নিজের পিতা ও জাতিকে পরিত্যাগ করে দেশান্তরিত হন। উক্ত তাওহীদের ওপরই তার আনীত শরীয়তের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এটা অক্ষরে অক্ষরে পালন করার জন্যে তিনি তার বংশধরকে নির্দেশ দেন। সুতরাং হযরত ইবরাহীমের আদর্শে শিরকের কোন স্থান ও অবকাশ ছিলাে না। সূরার এ অংশটাতে এই ঐতিহাসিক সত্য তুলে ধরা হয়েছে। যাতে তার আলাকে কোরায়শের দাবীর যথার্থতা যাচাই করা যায়। এরপর রসূল(স.)-এর ওপর তাদের আপত্তি ও অভিযোগ তুলে ধরা হয়। তারপর পর্যালােচনা করা হয় তাদের এই উক্তিটার। এই কোরআন দুই শহরে একজন মান্য গন্য ব্যক্তির ওপর নাযিল করা হলাে না কেন? তাদের এই উক্তিটার এবং এর ভেতরে যে ভ্রান্ত মূল্যায়নের দৃষ্টান্ত রয়েছে, তার পর্যালােচনা করা হয়েছে। এই ব্যাপারে সত্যটা তুলে ধরার পর তাদেরকে সত্য প্রত্যাখ্যানকারীদের পরিণাম জানিয়ে দেয়া হয়েছে। তার আগে জানিয়ে দেয়া হয়েছে, তাদের এই হঠকারিতার কারণ হলাে শয়তানের কুপ্ররােচণা। সবার শেষে রসূল(স.)-কে তাদের হঠকারিতা ও উপেক্ষা সম্পর্কে সান্তুনা দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে যে, অন্ধকে পথ দেখানাে ও বধিরকে কথা শােনানাে তার ক্ষমতার অতীত। অচিরেই তারা এর প্রতিফল পাবে, চাই তা আল্লাহর প্রতিশােধই হােক, অথবা সে প্রতিশােধকে বিলম্বিত করা হােক এখানে আল্লাহর পক্ষ থেকে আগত ওহীকে আঁকড়ে ধরার নির্দেশ দেয়া হয়েছে, যা সকল নবীর ওপর নাযিল হতাে। সকল নবী ও রসূল তাওহীদের শিক্ষা নিয়ে এসেছেন। (আয়াত ৪৫) এরপর হযরত মূসার কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে। এ কাহিনীর মধ্য দিয়ে আরবরা তাদের রসূলের সাথে যে আচরণ করেছে, তার দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হয়েছে। এ যেন একই ঘটনা একই আপত্তির পুনরাবৃত্তি। আর ফেরাউনের কার্যকলাপের সাথে আরবের মুশরিকদের কার্যকলাপের কত গভীর মিল লক্ষ্য করুন।

*তাওহীদ প্রতিষ্ঠার অন্যতম প্রাণপুরুষ ইবরাহীম(আ.) : ‘যখন ইবরাহীম তার জাতিকে ও পিতাকে সম্বােধন করে বললাে, আমি তােমাদের উপাস্যদের থেকে মুক্ত।’(আয়াত ২৬-২৮) যে তাওহীদের দাওয়াতকে আরবের মােশরেকরা না জানার ভান করতাে, তা হচ্ছে তাদের পিতা হযরত ইবরাহীমের দাওয়াত। এই দাওয়াত দিয়েই তিনি তার পিতা ও স্বজাতির সাথে সংঘাতের সূচনা করেন। তাদের বাতিল আকীদার বিরােধিতা করেন। তাদের পুরুষানুক্রমিক এবাদাত উপাসনার অনুকরণ থেকে বিরত থাকেন। সুস্পষ্ট ভাষায় তাদের সেই পৌত্তলিক ধ্যান ধারণা থেকে নিজের সম্পর্কচ্যুতি ঘোষণা করেন, যা অত্যন্ত বিব্রতকর ও অসৌজন্যমূলক মনে হয়েছিলো। হযরত ইবরাহীমের উক্তি (২৬ নং আয়াত) এবং একমাত্র সৃষ্টিকর্তা ব্যতীত অন্য সমস্ত উপাস্যের উপাসনা থেকে তার সম্পর্কচ্যুতির ঘােষণা থেকে বুঝা যায় যে, তারা আল্লাহর অস্তিত্বকে অস্বীকার করতাে না। তার সাথে অন্যদেরকেও শরীক করতাে এবং অন্যান্যদেরও উপাসনা করতাে। তিনি তাদের যাবতীয় এবাদাতকে প্রত্যাখ্যান করলেন কেবল আল্লাহর এবাদাত ছাড়া । তিনি আল্লাহর সেই গুণটার উল্লেখ করলেন, যার কারণে আল্লাহ তায়ালা মূলত এবাদাতের উপযুক্ত সাব্যস্ত হন। সেই গুণটা হলাে, তিনিই সৃষ্টিকর্তা। তিনি এবাদাত পাওয়ার যােগ্য যে, তিনি স্ৰষ্টা। তিনি আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে এই প্রত্যয় ব্যক্ত করলেন যে, তিনি তাকে হেদায়াত করবেন। কেননা তিনি তার সৃষ্টিকর্তা। তিনি তাকে সৃষ্টি করেছেনই এ জন্য যে, তাকে হেদায়াত দান করবেন। আর কিভাবে হেদায়াত দান করবেন, সেটা তিনিই ভালাে জানেন। হযরত ইবরাহীমের এই উক্তি মানব জাতির জীবনকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলাে। তাওহীদের এই কালেমার পক্ষে গােটা সৃষ্টিজগত সাক্ষ্য দিয়েছিলাে।(আয়াত ২৮) তাওহীদের এই কলেমাকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত করা এবং তার পরবর্তী প্রজন্মগুলাের কাছে তা তার বংশধরদের মাধ্যমেই পৌছানাের ব্যাপারে হযরত ইবরাহীম(আ.) সবচেয়ে বেশী কৃতিত্বের অধিকারী। তার বংশধরের মধ্য থেকে বহুসংখ্যক নবী ও রসূল এ কাজ করেন। তন্মধ্যে তিনজন সবচেয়ে বেশী মর্যাদাবান ও দৃঢ়চেতা, হযরত মূসা, হযরত ঈসা ও শেষ নবী হযরত মােহাম্মদ(স.)। আর বর্তমানে বহু শতাব্দী পর, বড় বড় ধর্মের অনুসারীদের মধ্য থেকে একশাে কোটিরও বেশী লােক হযরত ইবরাহীমের তাওহীদী কাফেলার অনুসারী। তারাই এই কালেমাকে পরবর্তীকালের মানুষের জন্যে টিকিয়ে রেখেছে। তাদের মধ্য থেকে যতাে মানুষই বিপথগামী হােক, হতে পারে। কিন্তু এই কালেমা কখনাে নষ্ট হবে না, কালেমা যেমন ছিলাে তেমনই থাকবে এবং বাতিলের সাথে তার কোনাে সংশ্রব থাকবে না। যাতে তারা ফিরে আসে।’ অর্থাৎ তাদের সৃষ্টিকর্তার দিকে ফিরে আসে, অতপর তাকে চিনে নেয় ও তার এবাদাত করে, ফিরে আসে একক সত্যের দিকে এবং তাকে আঁকড়ে ধরে। মানব জাতি হযরত ইবরাহীমের পূর্ব থেকেই তাওহীদের বাণীর সাথে পরিচিত হয়েছিলাে। কিন্তু হযরত ইবরাহীমের পরে ছাড়া তা স্থীতিশীলতা লাভ করেনি। হযরত নূহ, হুদ, সালেহ এবং সম্ভবত হযরত ইদ্রিসের মুখ দিয়েও তাওহীদের বাণী প্রচারিত হয়। এ ছাড়া আরাে বহু নবী ও রাসূল ছিলেন। কিন্তু তাদের পর নিরবচ্ছিন্ন ধারাবাহিকতার সাথে এই কালেমা প্রচার করা হয়নি। একমাত্র হযরত ইবরাহীমের মুখ দিয়ে প্রচারিত হবার পরই তা পরবর্তী যুগে অব্যাহতভাবে প্রচারিত হতে থাকে। তারপর একের পর এক নবী ও রসূলরা আসতে থাকেন। মাঝে কোনাে বিরতি বা ছেদ ঘটেনি। তার সর্বশেষ ও তার সাথে সবচেয়ে বেশী সাদৃশ্যপূর্ণ পুত্র ছিলেন হযরত ইসমাইলের বংশােদ্ভূত মুহাম্মদ (সা.)। তিনি ছিলেন শেষ রাসূল এবং তাওহীদের কলেমাকে তিনি সর্বশেষ সবচেয়ে ব্যাপক ও পূর্ণাংগরূপে তুলে ধরেছিলেন। এই কলেমার পেছনে সমগ্র মানব জীবন আবর্তিত হতে থাকে এবং মানুষের প্রতিটা কাজে ও চিন্তায় তার প্রভাব পড়তে থাকে। এই হলাে হযরত ইবরাহীমের সময় থেকে প্রতিষ্ঠিত তাওহীদের কাহিনী। তিনি সেই হযরত ইবরাহীম, যার বংশধর হবার দাবী করে আরবরা গর্ববােধ করতাে। আর এই হচ্ছে তাওহীদের সেই কালেমা, যাকে হযরত ইবরাহীম তার পরবর্তী প্রজন্মের কাছে স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত করে যান। এই কালেমা হযরত ইব্রাহীম এর বংশােদ্ভূত একজনের মুখ দিয়ে প্রচারিত হয়ে বর্তমান প্রজন্ম পর্যন্ত চলে এসেছে। এমতাবস্থায় যারা নিজেদেরকে হযরত ইবরাহীমের বংশধর ও তাঁর আদর্শের উত্তরসূরী বলে দাবী করে, এই কালেমার আহবানে তাদের কিভাবে সাড়া দেয়া উচিৎ ছিলাে, তা কারাে কাছেই অজানা নয়।(হযরত জাবের(রা.) বলেছেন, নবীদেরকে আমার সামনে উপস্থাপন করা হয়েছিলাে।… হযরত ইবরাহীমকে দেখলাম, তিনি তােমাদের সহচরের সাথে অর্থাৎ মােহাম্মদ(স.)-এর সাথে সবচেয়ে বেশী সাদৃশ্যপূর্ণ) দীর্ঘদিন অতিবাহিত হওয়ার কারণে আরবরা হযরত ইবরাহীমের আদর্শকে ভুলে গিয়েছিলাে এবং তাদের ভেতরে তাওহীদের কালেমা অজানা অচেনা হয়ে গিয়েছিলাে। এই কালেমার প্রচারককে তারা অত্যন্ত খারাপ অভ্যর্থনা জানায় এবং আল্লাহর কাছ থেকে আগত রেসালাতকে তারা পার্থিব মানদন্ডে মূল্যায়ন করে। ফলে তাদের হাতে সমস্ত মানদন্ডই ক্রটিপূর্ণ হয়ে যায়। (আয়াত ২৯-৩২)
“” রিসালাত অস্বীকারে পাপিষ্ঠদের টালবাহানা : হযরত ইবরাহীমের কাহিনী থেকে সম্পর্কচ্ছেদ করে আরবদের সম্পর্কে বলা হয়েছে। বরং আমি তাদেরকে ও তাদের পূর্বপুরুষদেরকে জীবন ভােগের উপকরণ দিয়েছিলাম। অবশেষে তাদের কাছে সত্য ও স্পষ্ট বর্ণনাকারী রাসূল এসে গেলাে।(আয়াত ২৯) অর্থাৎ ইবরাহীমের কাহিনী রাখাে। কেননা তার সাথে এদের কোনাে সম্পর্কই নেই। এখন আমাদের দৃষ্টি দিতে হবে আরবদের অবস্থার দিকে, যার সাথে ইবরাহীমের অবস্থার কোনােই মিল নেই। এরা ও এদের পূর্ব পুরুষের পার্থিব জীবনে অনেক ভােগের উপকরণ পেয়েছে। অবশেষে যখন এই কোরআনে তাদের জন্যে সত্যের বাণী এলাে এবং তাদের কাছে একজন সুস্পষ্ট বর্ণনাকারী রসূল এলেন, যিনি তাদের কাছে এই সত্যকে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরলেন, তখন তারা তাকে অস্বীকার করলাে।(আয়াত ৩০) সত্য কখনাে যাদুর সাথে মিশ্রিত হয় না। সত্য স্বচ্ছ ও সুস্পষ্ট কোরআনকে যাদু বলে আখ্যায়িত করাটা যে তাদের একেবারে ভ্রান্ত কথা, তা তারা বুঝতে পেরেছিলাে। কোরআন যে অকাট্য সত্য, সে কথা কোরায়শ নেতাদের মােটেই অজানা ছিলাে না। তারা শুধু জনগণকে ধোকা দিতাে। তারা প্রকাশ্যে বলতাে যে, এটা যাদু। আর এর প্রতি তাদের কুফরির কথা সােচ্চার কণ্ঠে ঘােষণা করতাে। তারা বলতাে, ‘আমরা একে অস্বীকার করি।’ এ কথা বলে জনগণকে বুঝাতো যে, তাদের কথায় কোনাে দোদুল্যমানতা বা সন্দেহ নেই এবং তারা যা বলছে, সে ব্যাপারে তার আপােষহীন। এতে সাধারণ আরবরা তাদের অনুসারী ও অনুগত হবে বলে তাদের ধারণা ছিলাে। জনগণকে বিভ্রান্ত করার এই স্বভাবটা সর্বযুগের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের থাকে। কেননা তারা ভয় পায় যে, তা না হলে জনগণের ওপর তাদের কোনাে প্রভাব থাকবে না এবং তারা তাওহীদের ওপর ঈমান আনবে। আর এই তাওহীদের কলেমায় যে বিশ্বাসী হয় তার চোখে আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কারাে কোনাে মূল্য থাকে না এবং সে আর কারাে গােলামীও করে না এবং কাউকে ভয়ও পায় না। এরপর কুরআন তাদের অতি নিম্নমানের মানদন্ড ও মূল্যবােধের উল্লেখ করে এবং মােহাম্মদ(স.)-কে রাসূল নিয়ােগে তারা যে আপত্তি জানিয়েছিলাে তা তুলে ধরে। তারা বলে এই কোরআন দুই শহরের একজন মান্যগণ্য ব্যক্তির ওপর নাযিল হলাে না কেন? দুই শহর দ্বারা তারা মক্কা ও তায়েফকে বুঝাতাে। রাসুল(স.) কোরায়শ বংশের মধ্যমনি ছিলেন। তিনি বনু হাশেমেরও মধ্যমনি ছিলেন। আর এই কোরায়শ বংশটা ছিলাে আরবের মধ্যে অভিজাত ও সম্ভ্রান্ত বংশ। ব্যক্তিগতভাবেও রসূল(স.) তার সমাজে নবুওতের পূর্ব থেকেই উচ্চ নৈতিক চরিত্রে ভূষিত ছিলেন। তবে তিনি কোনাে গােত্রের সর্দার ছিলেন না। অথচ এ ধরনের পদ তখন খুবই সম্মানজনক পদ ছিলাে। দুই শহরের কোনাে মান্য গন্য ব্যক্তি কথাটা দ্বারা তারা এটাই বুঝিয়েছিলাে। আসলে কাকে রাসূল নিয়ােগ করতে হবে, সে সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালাই ভালাে জানেন। রেসালাতের উপযুক্ত যে ব্যক্তি, তাকেই তিনি মনােনীত করেছেন। সম্ভবত আল্লাহ তায়ালা এটা চাননি যে, রেসালাতের জন্যে অন্য কোনাে পার্থিব মানদন্ড থাকুক। তাই তিনি এমন ব্যক্তিকে রসূল নিয়ােগ করলেন, যার সর্বোত্তম বৈশিষ্ট্য ছিলাে চরিত্র। এটাই ইসলামী দাওয়াতের প্রধান স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য। দাওয়াতের বাস্তবতা এরই দাবী জানায়। তাকে তিনি কোনাে গােত্রের প্রধান, কোন উচ্চপদে অধিষ্ঠিত অথবা কোনাে ধনবান ব্যক্তিরূপে মনােনীত করলেন না যাতে করে ইসলামী দাওয়াতের পদমর্যাদার সাথে অন্য কোনাে দুনিয়াবী পদমর্যাদা মিলেমিশে একাকার হয়ে না যায়।
***অর্থনৈতিক তারতম্যের ব্যাপারে কোরআনের বক্তব্য : আরবের মােশরেকরা মােহাম্মদ(স.)-এর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থানের বাহানা তুলে তারা রেসালাত অস্বীকার করার ফন্দি আঁটছিলাে। আসলে পার্থিব ভােগ বিলাসিতায় যারা গা ভাসিয়ে দিয়েছে এবং যারা উর্ধজগতের আহ্বানের মর্ম উপলব্ধি করতে পারেনি, তারাই এ ধরনের অভিযােগ করে, কোরআন কেন দুই জনপদের কোনাে প্রধান ব্যক্তির ওপর অবতীর্ণ হলাে না?(আয়াত ৩১) যারা আল্লাহর রহমতের ব্যাপারে অভিযােগ উত্থাপন করে, যারা আল্লাহর স্বাধীন ইচ্ছার ব্যাপারে অভিযােগ করে, যারা ইহজগতের মূল্যবােধ আর উর্ধজগতের মূল্যবােধকে এক করে দেখে, পবিত্র কোরআন তাদের এই অভিযােগকে খন্ডন করে, এর নিন্দা জানায়। আল্লাহর মানদন্ডে আল্লাহর দৃষ্টিতে এই মূল্যবােধের স্বরূপ কি, এর সঠিক মর্যাদা কী তা বর্ণনা করছে। তারা কি তােমার পালনকর্তার রহমত বন্টন করে আমি পার্থিব জীবনে তাদের মধ্যে তাদের জীবিকা বন্টন করেছি।'(আয়াত ৩২) ওরা তােমার পালনকর্তার রহমত বন্টন করতে চায়? কি অদ্ভুত ব্যাপার, তােমার পালনকর্তার রহমতের সাথে ওদের কী সম্পর্ক? ওরা নিজেরাই তাে নিজেদের কোনাে কিছুরই মালিক নয়। ওরা তাে নিজেদের জীবিকার যােগানই দিতে পারে না। এমনকি পৃথিবীর বুকে তারা যে সামান্য জীবিকার মালিক বনে আছে সেটাও আমি দিয়েছি। এই জীবিকা আমিই দিয়েছি বিশেষ নিয়মের অধীনে এবং পরিমাণমত বন্টন করেছি শুধু পৃথিবীটা আবাদ করার জন্যে, এই জীবনের বিকাশের জন্যেই আমার এই ব্যবস্থা। পার্থিব জীবনে জীবিকার ব্যাপারটি নির্ভর করে ব্যক্তির প্রতিভার ওপর, পরিবেশ, পরিস্থিতি এবং সমাজের মধ্যকার সম্পর্কের ওপর। ব্যক্তি ও সমষ্টির মাঝে জীবিকা বন্টনের অনুপাতে যে পার্থক্যের সৃষ্টি হয় তা ওই সব কয়টি উপাদানের পার্থক্যের কারণেই হয়ে থাকে। এই পার্থক্য বিভিন্ন পরিবেশে বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে, আর সেটাও হয়ে থাকে সেই সমাজের প্রচলিত নিয়ম নীতি ও এর সামগ্রিক পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করে। কিন্তু সমাজে এ বৈশিষ্ট্যটি এখনও অবশিষ্ট আছে, এমনকি সেই সব সমাজেও যা উৎপাদন ও বন্টন নির্ভর মতবাদ দ্বারা পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত, সেখানেও ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে জীবিকায় বৈষম্য রয়েছে। এই বৈষম্যের কারণ সমাজ ও নীতির বিভিন্নতার কারণে বিভিন্ন হলেও এই বৈষম্য কিন্তু আজও অবিকল সেভাবেই আছে। সমাজের সকল সদস্যের জীবনমান একই পর্যায়ের হয়েছে এমনটি কখনও হয়নি। এমনকি সেই উৎপাদন ও বন্টন নির্ভর কৃত্রিম সমাজেও হয়নি। তাই এই সত্যটির প্রতি ইংগিত করে বলা হয়েছে,’এবং একের মর্যাদাকে অপরের ওপর উন্নীত করেছি।’ প্রত্যেক যুগে, প্রত্যেক পরিবেশে এবং প্রত্যেক সমাজে এই বৈষম্যের পেছনে যে গভীর তাৎপর্যটি কাজ করছে তা হলাে, যাতে একে অপরকে সেবক রূপে গ্রহণ করে।’ অর্থাৎ যাতে তােমরা একে অপরকে কাজে লাগাতে পারাে। জীবন চাকা যখন ঘুরে তখন মানুষ নিশ্চয়ই একজন আরেকজনকে কাজে লাগায়। এই কাজে লাগানাের কারণে কেউ কারও ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দাবী করতে পারে না। এর কারণে শ্রেণী শ্রেণীর ওপর এবং ব্যক্তি ব্যক্তির ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দাবী করবে, এমনটি কখনও হতে পারে না। এটা যারা মনে করে তারা নির্বোধ। আল্লাহর অমর বাণীর এমন অর্থ গ্রহণ করা মােটেও সমীচীন নয়। এই অমর বাণীর মর্ম মানব সমাজের যাবতীয় পরিবর্তন ও বিবর্তনের উর্ধে থাকবে এবং পরিস্থিতির বিবর্তন আবর্তনেরও উর্ধে থাকবে। এতে সন্দেহ নেই, প্রত্যেক মানুষ একে অপরকে সেবা করে যাচ্ছে। এরই ফলে জীবনের চাকা ঘুরছে। সকল অবস্থায় এবং সকল পরিস্থিতিতে মানুষ একে অপরকে সেবা করে যাচ্ছে। অসচ্ছল ব্যক্তির কাছ থেকে সচ্ছল ব্যক্তি সেবা পাচ্ছে। এর বিপরীতও মাঝে মাঝে দেখা যায়, অর্থাৎ অসচ্ছল ব্যক্তিও সচ্ছল ব্যক্তির কাছ থেকে সেবা পাচ্ছে। কারণ, সে নিজের প্রয়োজন মেটানাের মতাে অর্থ তার কাছ থেকে পাচ্ছে। এই হিসেবে উভয়ই উভয়ের কাছ থেকে সেবা পাচ্ছে এবং একে অপরকে কাজে লাগাচ্ছে। সম্পদের পার্থক্যের কারণেই এটা সম্ভব হচ্ছে। আর এরই ফলে জীবন গতিশীল। একজন শ্রমিক যখন কাজ করে তখন তার এই কাজ হয় সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী এবং মালিকের জন্যে। ওদিকে প্রকৌশলী যখন কাজ করে, তখন তার এই কাজ হয় শ্রমিকের জন্যে এবং মালিকের জন্যে। আবার মালিক নিজে যখন কাজ করে, তখন তার এই কাজ হয় শ্রমিকের জন্যে এবং প্রকৌশলীর জন্যে। মােটকথা, শ্রমিক, মালিক এবং প্রকৌশলী প্রত্যেকে প্রত্যেকের জন্যে কাজ করছে। এদের প্রত্যেকেই প্রত্যেকের কাজ থেকে সেবা গ্রহণ করছে। আর এভাবেই তারা সকলেই পৃথিবীর চাকা সচল রাখছে। আর এটা সম্ভব হয়েছে প্রতিভা ও যােগ্যতার তারতম্যের কারণে, অনেকটা জীবিকা ও কাজের তারতম্যের কারণে। আমার ধারণা, আধুনিক মতবাদের প্রচারকদের অনেকেই এই আয়াতটিকে ইসলামের অর্থ সামাজিক ব্যবস্থার ওপর আক্রমণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। কোনাে কোনাে মুসলমানও এই আয়াতটির সামনে এসে ব্রিতকর অবস্থায় পড়ে যায়। ভাবখানা এই, যেন তারা ইসলামের বিরুদ্ধে আনীত অর্থনৈতিক বৈষম্যের অভিযােগ তারা খন্ডন করছে। আমি মনে করি, মুসলমানদের উচিত নিজেদের জীবন বিধানকে নিয়ে হীনমন্যতায় না ভােগা, আত্মরক্ষার মনােভাব নিয়ে না চলা; বরং তাদের উচিত মাথা উঁচু করে দাঁড়ানাে। কারণ, ইসলাম সেসব শাশ্বত ও চিরন্তন সত্যগুলাে মানুষের সামনে তুলে ধরে যা প্রকৃতির সাথে মিশে আছে, যা ভারসাম্যপূর্ণ প্রাকৃতিক বিধানেরই অধীন। ব্যক্তির প্রতিভার তারতম্য এবং ব্যক্তির কর্মক্ষমতার তারতম্যের ওপর ভিত্তি করেই এই মানব জীবন টিকে আছে। এই পৃথিবীকে আবাদ করতে হলে এবং এই পৃথিবীকে সচল রাখতে হলে কর্ম, যােগ্যতা ও প্রতিভার এই তারতম্যের অবশ্যই প্রয়ােজন আছে। প্রত্যেক মানুষ যদি একে অপরের সমপর্যায়ের হতাে, তাহলে পৃথিবী এখন যেভাবে চলছে, সেভাবে কিছুতেই চলতে পারতােনা। এমন অনেক কাজ অসম্পূর্ণ থেকে যেতাে যা সম্পূর্ণ করার মতাে যােগ্য লােক পাওয়া যেতাে না। যিনি এই পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এবং জীবন সৃষ্টি করেছেন, তিনি এর অস্তিত্ব রক্ষা করতে চান, এর বিকাশ চান। তিনি বিভিন্ন কাজের জন্যে বিভিন্ন যােগ্যতা ও প্রতিভা সৃষ্টি করেছেন। যােগ্যতা ও প্রতিভার বিভিন্নতার কারণে সম্পদের মাঝেও পার্থক্য হয়। এটাই নিয়ম। তবে সম্পদের মাঝে যে পার্থক্য ও বৈষম্য দেখা যায় তাও আবার একপর্যায়ের নয়। একেক সমাজ একেক নিয়মের অধীনে চলছে, কিন্তু সর্বত্রই তা জীবনের বিকাশের জন্যে আবশ্যক প্রাকৃতিক নিয়মের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। আর এ কারণেই আজ পর্যন্ত কোনাে কৃত্রিম ও বানােয়াট জীবন ব্যবস্থা বা মতবাদের ধারকরা একজন শ্রমিক ও প্রকৌশলীর বেতনের মাঝে যে বিস্তর ব্যবধান থাকে, তা দূর করতে পারেনি। এমনিভাবে একজন সাধারণ সৈনিক ও একজন সেনানায়কের বেতন ও ভাতাদির মধ্যকার বৈষম্যও তারা দূর করতে পারেনি। অথচ তারা বৈষম্যহীন তথাকথিত সমাজ কায়েমের লক্ষ্যে নিজেদের সেই মনগড়া মতবাদ বাস্তবায়িত করার জন্যে কম চেষ্টা করেনি। কিন্তু প্রকৃতির নিয়মের সামনে তারা সবাই হেরে গেছে। এই নিয়মের বাস্তবতাকেই পবিত্র কোরআনের এই আলােচ্য আয়াতটি প্রতিষ্ঠিত করছে, এই আয়াত জীবনের জন্যে অপরিহার্য একটা চিরন্তন নিয়মের পরিচয়ই এখানে তুলে ধরেছে। পার্থিব জগতে জীবন ও জীবিকার এটাই নিয়ম। কিন্তু এর বাইরে আরও একটি জিনিস আছে, আর তা হচ্ছে আল্লাহর রহমত ও দয়া। তাই বলা হচ্ছে, ‘তারা যা সঞ্চয় করে, তােমার পালনকর্তার রহমত তা অপেক্ষা উত্তম এই রহমত তিনি কেবল তাদেরকেই দান করেন, যাদেরকে তিনি এর উপযুক্ত বলে মনে করেন। দুনিয়ার ধন-সম্পদের সাথে এর কোনাে সম্পর্ক নেই, তেমনিভাবে এই জাগতিক জীবনের কোনাে মূল্যবােধের সাথেও এর কোনাে সম্পর্ক নেই। কারণ, এসব মূল্যবােধ আল্লাহ তায়ালার কাছে তুচ্ছ ও নগণ্য। এ কারণেই জাগতিক জীবনের ধন-সম্পদে ভাল ও মন্দ সবাই সমান। এই ধন-সম্পদের মালিক একজন সৎলােকও হতে পারে এবং একজন অসৎ লােকও হতে পারে। অপরদিকে আল্লাহর রহমত কেবল তারই বিশেষ বিশেষ বান্দা ছাড়া আর কেউ পাবে না। এই পার্থিব জগতের ধন সম্পদ আল্লাহর কাছে এতােই তুচ্ছ ও নগন্য যে, তিনি একজন কাফেরকেও তা অঢেল পরিমাণে দিয়ে থাকেন। উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষকে পরীক্ষা করা। সেই সম্পর্কে বলা হচ্ছে, ‘যদি মানুষের এক মতাবলম্বী হয়ে যাওয়ার আশংকা না থাকতা…’(আয়াত ৩৩-৩৫) দুনিয়ার ধন দৌলত ও ভােগ বিলাসিতার প্রতি মানুষের একটা আকর্ষণ আছে। এটা মানবিক দুর্বলতা, এই দুর্বলতার কথা আল্লাহ তায়ালা জানেন। তিনি ভালাে করেই জানেন, এই ধন দৌলত ও ভােগ বিলাসিতা অনেক ক্ষেত্রে মানুষকে পরীক্ষায় ফেলে দেয় এবং ঈমানের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। যদি এমন আশংকা থাকতাে, তাহলে আল্লাহ তায়ালা কাফেরদেরকে এমন অট্টালিকা। দান করতেন যার ছাদ হতে রূপার, সিড়িগুলাে হতে স্বর্ণের, যার অসংখ্য দরজা থাকতাে এবং হেলান দিয়ে বসার জন্যে স্বর্ণখচিত বাহারী পালংক থাকতাে। অর্থাৎ স্বর্ণ, রৌপ্য এবং জাগতিক বিলাস সামগ্রী আল্লাহর কাছে এতােই তুচ্ছ ও নগণ্য যে, তিনি একজন কাফেরকেও এসব দিতে পারেন। কারণ, ‘এগুলো সবই তাে পার্থিব জীবনের ভােগ সামগ্রী মাত্র।’ অর্থাৎ এসব হচ্ছে নিতান্তই ক্ষণস্থায়ী। এর স্থায়িত্ব পার্থিব জীবন পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। তাই এসব পার্থিব জীবনের জন্যেই মানায়। অপরদিকে পরকালীন জীবনের সুখ শান্তি হচ্ছে কেবল তাদের জন্যেই, যারা আল্লাহকে ভয় করে চলে। এই আল্লাহভীতির জন্যেই পরকালে তারা সম্মান পাবে, মর্যাদা পাবে। আল্লাহ তায়ালা তাদের জন্যে এই সম্মান ও মর্যাদা পরকালের জন্যে সঞ্চয় করে রাখছেন, যা হবে চিরস্থায়ী ও অধিকতর মূল্যবান। তাদের এই মর্যাদা কাফেরদের মান মর্যাদার তুলনায় উর্ধের ও অনেকটা স্বাতন্ত্রমডিত। কারণ কাফেরদেরকে আল্লাহ তায়ালা দুনিয়াতে সেসব তুচ্ছ ও মূল্যহীন সামগ্রী দান করেন যা তিনি অন্যান্য প্রাণীকেও দান করে থাকেন। দুনিয়ায় ধন দৌলত, ভােগ বিলাসিতা ও জৌলুস অনেকের কাছেই আকর্ষণীয় বলে মনে হয়। এর ফলে তারা পরীক্ষার সম্মুখীন হয়। বিশেষ করে যখন তারা দেখে, পাপীরা এসব ভােগ করছে, আর সৎলােকেরা এসব থেকে বঞ্চিত রয়েছে, অথবা যখন দেখে, সৎ লােকেরা অভাব অনটন ও দুঃখ কষ্টে জীবন যাপন করছে, আর অসৎ ও পাপী-তাপী লােকেরা ধন দৌলত, ক্ষমতা ও প্রভাব প্রতিপত্তির মালিক বনে আছে। আল্লাহ তায়ালা জানেন, এসব বিষয় মানুষের মনে নানা অশুভ প্রভাবের সৃষ্টি করে। তাই তিনি মানুষকে জানিয়ে দিচ্ছেন যে, এসব মূলাহীন ও মর্যাদহীন; এসব তুচ্ছ ও নগন্য। অপরদিকে পরকালে সৎলােকদের জন্যে যা কিছু রাখা আছে তা অত্যন্ত মূল্যবান ও মর্যাদাপূর্ণ। এই প্রকৃত ও বাস্তব অবস্থা জানার পর মােমেনদের অন্তর আল্লাহ তায়ালার ফয়সালায় সন্তুষ্ট থাকে এবং সৎ ও অসৎ লােকদের জন্যে তিনি যা পছন্দ করে রেখেছেন, সে ব্যাপারেও তাদের অন্তর আশ্বস্ত হয়। এই পার্থিব জগতের ধন সম্পদ থেকে বঞ্চিত একজন মানুষকে আল্লাহ তায়ালা নবী হিসেবে মনােনীত করেছেন বলে যারা অভিযােগ করতাে, যারা ধন সম্পদ ও পদের ভিত্তিতে মানুষের মর্যাদা নির্ণয় করতাে, তারা এসব আয়াতের মাধ্যমে জানতে পারছে যে, পার্থিব জীবনের ধন সম্পদ ও বিলাস সামগ্রী কতাে তুচ্ছ ও নগন্য, তাই সেগুলাে এমন লোকদেরকেও দেয়া হয়েছে। যারা আল্লাহর কাছে সবচেয়ে নিকৃষ্ট ও ঘৃণ্য। এর দ্বারা প্রমাণিত হয়, পার্থিব ধন দৌলত আল্লাহর সন্তুষ্টি ও পছন্দের পরিচয় বহন করে না। এভাবেই পবিত্র কোরআন প্রতিটি বিষয়ের প্রকৃত অবস্থা বর্ণনা করে এবং এর যথার্থ স্থান নির্ণয় করে দেয়। সাথে সাথে ইহকাল ও পরকালে মানুষের প্রাপ্য জীবিকা বন্টনের আল্লাহর বিধানের স্বরূপ কি, তার ব্যাখ্যা প্রদান করে এবং আল্লাহর কাছে চিরক্তন মূল্যবােধ কোনটি, তার পরিচয় তুলে ধরে। যারা মােহাম্মদ(স.)-এর রেসালতের ব্যাপারে আপত্তি করে এবং যারা ক্ষমতাধর ও প্রভাবশালীদেরকে ভক্তি করে তাদের উপযুক্ত জবাব দিতে গিয়ে পবিত্র কোরআন এসব বক্তব্য তুলে ধরেছে। আলােচ্য আয়াত আমাদের সামনে এমন কিছু মৌলিক নীতি এবং চিরন্তন বাস্তব সত্য তুলে ধরে যা স্থিতিশীল ও অপরিবর্তনশীল, যা জীবনের বিবর্তন, ব্যবস্থার তারতম্য, মতবাদের বিভিন্নতা এবং পরিবেশের বৈচিত্র্যের কারণে প্রভাবিত হয় না। তাই বলা যায়, জীবনের এমন কিছু নিয়মনীতি আছে যা স্থিতিশীল, যাকে কেন্দ্র করে জীবন আবর্তিত হয়। গতিশীল হয়, তবে জীবনকে তার নিজস্ব সীমারেখা থেকে বিচ্যুত করে না। যারা পরিবর্তনশীল জগত ও পরিবেশের কারণে চিরন্তন বাস্তবতা সম্পর্কে গভীর চিন্তা ভাবনা করতে অক্ষম, তারা কখনও এই আল্লাহর বিধানের স্বরূপ উপলব্ধি করতে পারে না, যা জীবনের মূল কাঠামােতে এবং জীবনের বিভিন্ন স্তরে স্থিতিশীলতা ও পরিবর্তনশীলতার মাঝে সমন্বয় সাধন করে। তারা মনে করে, সব কিছুই পরিবর্তনশীল ও গতিশীল । স্থিতিশীল বলতে এখানে কিছু নেই, অব্যাহত বিবর্তন ধারাই হচ্ছে তাদের কাছে চিরন্তন সত্য। কিন্তু যারা ইসলামী মূল্যবােধে বিশ্বাস করে, তারা মনে করে জীবন ও জগতের প্রতিটি স্তরে এবং প্রতিটি দিকে স্থিতিশীলতা ও গতিশীলতা সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা যে সত্যটি উচ্চারণ করেছেন, তাই সত্য এবং তাই বাস্তব। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হচ্ছে যে, মানুষের জীবন ও জীবিকার মাঝে যে বৈষম্য দেখতে পাই তা স্থিতিশীল। অপরদিকে এই বৈষম্যের যে অনুপাত ও কারণ বিভিন্ন সমাজ ও সমাজ ব্যবস্থায় দেখতে পাই তা পরিবর্তনশীল। স্থিতিশীলতা ও গতিশীলতার প্রমাণ এই উদাহরণ ছাড়া আরও অনেক আছে।
**অর্থনৈতিক তারতম্যের ব্যাপারে কোরআনের বক্তব্য : আরবের মােশরেকরা মােহাম্মদ(স.)-এর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থানের বাহানা তুলে তারা রেসালাত অস্বীকার করার ফন্দি আঁটছিলাে। আসলে পার্থিব ভােগ বিলাসিতায় যারা গা ভাসিয়ে দিয়েছে এবং যারা উর্ধজগতের আহ্বানের মর্ম উপলব্ধি করতে পারেনি, তারাই এ ধরনের অভিযােগ করে, কোরআন কেন দুই জনপদের কোনাে প্রধান ব্যক্তির ওপর অবতীর্ণ হলাে না?(আয়াত ৩১) যারা আল্লাহর রহমতের ব্যাপারে অভিযােগ উত্থাপন করে, যারা আল্লাহর স্বাধীন ইচ্ছার ব্যাপারে অভিযােগ করে, যারা ইহজগতের মূল্যবােধ আর উর্ধজগতের মূল্যবােধকে এক করে দেখে, পবিত্র কোরআন তাদের এই অভিযােগকে খন্ডন করে, এর নিন্দা জানায়। আল্লাহর মানদন্ডে আল্লাহর দৃষ্টিতে এই মূল্যবােধের স্বরূপ কি, এর সঠিক মর্যাদা কী তা বর্ণনা করছে। তারা কি তােমার পালনকর্তার রহমত বন্টন করে আমি পার্থিব জীবনে তাদের মধ্যে তাদের জীবিকা বন্টন করেছি।'(আয়াত ৩২) ওরা তােমার পালনকর্তার রহমত বন্টন করতে চায়? কি অদ্ভুত ব্যাপার, তােমার পালনকর্তার রহমতের সাথে ওদের কী সম্পর্ক? ওরা নিজেরাই তাে নিজেদের কোনাে কিছুরই মালিক নয়। ওরা তাে নিজেদের জীবিকার যােগানই দিতে পারে না। এমনকি পৃথিবীর বুকে তারা যে সামান্য জীবিকার মালিক বনে আছে সেটাও আমি দিয়েছি। এই জীবিকা আমিই দিয়েছি বিশেষ নিয়মের অধীনে এবং পরিমাণমত বন্টন করেছি শুধু পৃথিবীটা আবাদ করার জন্যে, এই জীবনের বিকাশের জন্যেই আমার এই ব্যবস্থা। পার্থিব জীবনে জীবিকার ব্যাপারটি নির্ভর করে ব্যক্তির প্রতিভার ওপর, পরিবেশ, পরিস্থিতি এবং সমাজের মধ্যকার সম্পর্কের ওপর। ব্যক্তি ও সমষ্টির মাঝে জীবিকা বন্টনের অনুপাতে যে পার্থক্যের সৃষ্টি হয় তা ওই সব কয়টি উপাদানের পার্থক্যের কারণেই হয়ে থাকে। এই পার্থক্য বিভিন্ন পরিবেশে বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে, আর সেটাও হয়ে থাকে সেই সমাজের প্রচলিত নিয়ম নীতি ও এর সামগ্রিক পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করে। কিন্তু সমাজে এ বৈশিষ্ট্যটি এখনও অবশিষ্ট আছে, এমনকি সেই সব সমাজেও যা উৎপাদন ও বন্টন নির্ভর মতবাদ দ্বারা পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত, সেখানেও ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে জীবিকায় বৈষম্য রয়েছে। এই বৈষম্যের কারণ সমাজ ও নীতির বিভিন্নতার কারণে বিভিন্ন হলেও এই বৈষম্য কিন্তু আজও অবিকল সেভাবেই আছে। সমাজের সকল সদস্যের জীবনমান একই পর্যায়ের হয়েছে এমনটি কখনও হয়নি। এমনকি সেই উৎপাদন ও বন্টন নির্ভর কৃত্রিম সমাজেও হয়নি। তাই এই সত্যটির প্রতি ইংগিত করে বলা হয়েছে,’এবং একের মর্যাদাকে অপরের ওপর উন্নীত করেছি।’ প্রত্যেক যুগে, প্রত্যেক পরিবেশে এবং প্রত্যেক সমাজে এই বৈষম্যের পেছনে যে গভীর তাৎপর্যটি কাজ করছে তা হলাে, যাতে একে অপরকে সেবক রূপে গ্রহণ করে।’ অর্থাৎ যাতে তােমরা একে অপরকে কাজে লাগাতে পারাে। জীবন চাকা যখন ঘুরে তখন মানুষ নিশ্চয়ই একজন আরেকজনকে কাজে লাগায়। এই কাজে লাগানাের কারণে কেউ কারও ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দাবী করতে পারে না। এর কারণে শ্রেণী শ্রেণীর ওপর এবং ব্যক্তি ব্যক্তির ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দাবী করবে, এমনটি কখনও হতে পারে না। এটা যারা মনে করে তারা নির্বোধ। আল্লাহর অমর বাণীর এমন অর্থ গ্রহণ করা মােটেও সমীচীন নয়। এই অমর বাণীর মর্ম মানব সমাজের যাবতীয় পরিবর্তন ও বিবর্তনের উর্ধে থাকবে এবং পরিস্থিতির বিবর্তন আবর্তনেরও উর্ধে থাকবে। এতে সন্দেহ নেই, প্রত্যেক মানুষ একে অপরকে সেবা করে যাচ্ছে। এরই ফলে জীবনের চাকা ঘুরছে। সকল অবস্থায় এবং সকল পরিস্থিতিতে মানুষ একে অপরকে সেবা করে যাচ্ছে। অসচ্ছল ব্যক্তির কাছ থেকে সচ্ছল ব্যক্তি সেবা পাচ্ছে। এর বিপরীতও মাঝে মাঝে দেখা যায়, অর্থাৎ অসচ্ছল ব্যক্তিও সচ্ছল ব্যক্তির কাছ থেকে সেবা পাচ্ছে। কারণ, সে নিজের প্রয়োজন মেটানাের মতাে অর্থ তার কাছ থেকে পাচ্ছে। এই হিসেবে উভয়ই উভয়ের কাছ থেকে সেবা পাচ্ছে এবং একে অপরকে কাজে লাগাচ্ছে। সম্পদের পার্থক্যের কারণেই এটা সম্ভব হচ্ছে। আর এরই ফলে জীবন গতিশীল। একজন শ্রমিক যখন কাজ করে তখন তার এই কাজ হয় সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী এবং মালিকের জন্যে। ওদিকে প্রকৌশলী যখন কাজ করে, তখন তার এই কাজ হয় শ্রমিকের জন্যে এবং মালিকের জন্যে। আবার মালিক নিজে যখন কাজ করে, তখন তার এই কাজ হয় শ্রমিকের জন্যে এবং প্রকৌশলীর জন্যে। মােটকথা, শ্রমিক, মালিক এবং প্রকৌশলী প্রত্যেকে প্রত্যেকের জন্যে কাজ করছে। এদের প্রত্যেকেই প্রত্যেকের কাজ থেকে সেবা গ্রহণ করছে। আর এভাবেই তারা সকলেই পৃথিবীর চাকা সচল রাখছে। আর এটা সম্ভব হয়েছে প্রতিভা ও যােগ্যতার তারতম্যের কারণে, অনেকটা জীবিকা ও কাজের তারতম্যের কারণে। আমার ধারণা, আধুনিক মতবাদের প্রচারকদের অনেকেই এই আয়াতটিকে ইসলামের অর্থ সামাজিক ব্যবস্থার ওপর আক্রমণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। কোনাে কোনাে মুসলমানও এই আয়াতটির সামনে এসে ব্রিতকর অবস্থায় পড়ে যায়। ভাবখানা এই, যেন তারা ইসলামের বিরুদ্ধে আনীত অর্থনৈতিক বৈষম্যের অভিযােগ তারা খন্ডন করছে। আমি মনে করি, মুসলমানদের উচিত নিজেদের জীবন বিধানকে নিয়ে হীনমন্যতায় না ভােগা, আত্মরক্ষার মনােভাব নিয়ে না চলা; বরং তাদের উচিত মাথা উঁচু করে দাঁড়ানাে। কারণ, ইসলাম সেসব শাশ্বত ও চিরন্তন সত্যগুলাে মানুষের সামনে তুলে ধরে যা প্রকৃতির সাথে মিশে আছে, যা ভারসাম্যপূর্ণ প্রাকৃতিক বিধানেরই অধীন। ব্যক্তির প্রতিভার তারতম্য এবং ব্যক্তির কর্মক্ষমতার তারতম্যের ওপর ভিত্তি করেই এই মানব জীবন টিকে আছে। এই পৃথিবীকে আবাদ করতে হলে এবং এই পৃথিবীকে সচল রাখতে হলে কর্ম, যােগ্যতা ও প্রতিভার এই তারতম্যের অবশ্যই প্রয়ােজন আছে। প্রত্যেক মানুষ যদি একে অপরের সমপর্যায়ের হতাে, তাহলে পৃথিবী এখন যেভাবে চলছে, সেভাবে কিছুতেই চলতে পারতােনা। এমন অনেক কাজ অসম্পূর্ণ থেকে যেতাে যা সম্পূর্ণ করার মতাে যােগ্য লােক পাওয়া যেতাে না। যিনি এই পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এবং জীবন সৃষ্টি করেছেন, তিনি এর অস্তিত্ব রক্ষা করতে চান, এর বিকাশ চান। তিনি বিভিন্ন কাজের জন্যে বিভিন্ন যােগ্যতা ও প্রতিভা সৃষ্টি করেছেন। যােগ্যতা ও প্রতিভার বিভিন্নতার কারণে সম্পদের মাঝেও পার্থক্য হয়। এটাই নিয়ম। তবে সম্পদের মাঝে যে পার্থক্য ও বৈষম্য দেখা যায় তাও আবার একপর্যায়ের নয়। একেক সমাজ একেক নিয়মের অধীনে চলছে, কিন্তু সর্বত্রই তা জীবনের বিকাশের জন্যে আবশ্যক প্রাকৃতিক নিয়মের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। আর এ কারণেই আজ পর্যন্ত কোনাে কৃত্রিম ও বানােয়াট জীবন ব্যবস্থা বা মতবাদের ধারকরা একজন শ্রমিক ও প্রকৌশলীর বেতনের মাঝে যে বিস্তর ব্যবধান থাকে, তা দূর করতে পারেনি। এমনিভাবে একজন সাধারণ সৈনিক ও একজন সেনানায়কের বেতন ও ভাতাদির মধ্যকার বৈষম্যও তারা দূর করতে পারেনি। অথচ তারা বৈষম্যহীন তথাকথিত সমাজ কায়েমের লক্ষ্যে নিজেদের সেই মনগড়া মতবাদ বাস্তবায়িত করার জন্যে কম চেষ্টা করেনি। কিন্তু প্রকৃতির নিয়মের সামনে তারা সবাই হেরে গেছে। এই নিয়মের বাস্তবতাকেই পবিত্র কোরআনের এই আলােচ্য আয়াতটি প্রতিষ্ঠিত করছে, এই আয়াত জীবনের জন্যে অপরিহার্য একটা চিরন্তন নিয়মের পরিচয়ই এখানে তুলে ধরেছে। পার্থিব জগতে জীবন ও জীবিকার এটাই নিয়ম। কিন্তু এর বাইরে আরও একটি জিনিস আছে, আর তা হচ্ছে আল্লাহর রহমত ও দয়া। তাই বলা হচ্ছে, ‘তারা যা সঞ্চয় করে, তােমার পালনকর্তার রহমত তা অপেক্ষা উত্তম এই রহমত তিনি কেবল তাদেরকেই দান করেন, যাদেরকে তিনি এর উপযুক্ত বলে মনে করেন। দুনিয়ার ধন-সম্পদের সাথে এর কোনাে সম্পর্ক নেই, তেমনিভাবে এই জাগতিক জীবনের কোনাে মূল্যবােধের সাথেও এর কোনাে সম্পর্ক নেই। কারণ, এসব মূল্যবােধ আল্লাহ তায়ালার কাছে তুচ্ছ ও নগণ্য। এ কারণেই জাগতিক জীবনের ধন-সম্পদে ভাল ও মন্দ সবাই সমান। এই ধন-সম্পদের মালিক একজন সৎলােকও হতে পারে এবং একজন অসৎ লােকও হতে পারে। অপরদিকে আল্লাহর রহমত কেবল তারই বিশেষ বিশেষ বান্দা ছাড়া আর কেউ পাবে না। এই পার্থিব জগতের ধন সম্পদ আল্লাহর কাছে এতােই তুচ্ছ ও নগন্য যে, তিনি একজন কাফেরকেও তা অঢেল পরিমাণে দিয়ে থাকেন। উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষকে পরীক্ষা করা। সেই সম্পর্কে বলা হচ্ছে, ‘যদি মানুষের এক মতাবলম্বী হয়ে যাওয়ার আশংকা না থাকতা…’(আয়াত ৩৩-৩৫) দুনিয়ার ধন দৌলত ও ভােগ বিলাসিতার প্রতি মানুষের একটা আকর্ষণ আছে। এটা মানবিক দুর্বলতা, এই দুর্বলতার কথা আল্লাহ তায়ালা জানেন। তিনি ভালাে করেই জানেন, এই ধন দৌলত ও ভােগ বিলাসিতা অনেক ক্ষেত্রে মানুষকে পরীক্ষায় ফেলে দেয় এবং ঈমানের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। যদি এমন আশংকা থাকতাে, তাহলে আল্লাহ তায়ালা কাফেরদেরকে এমন অট্টালিকা। দান করতেন যার ছাদ হতে রূপার, সিড়িগুলাে হতে স্বর্ণের, যার অসংখ্য দরজা থাকতাে এবং হেলান দিয়ে বসার জন্যে স্বর্ণখচিত বাহারী পালংক থাকতাে। অর্থাৎ স্বর্ণ, রৌপ্য এবং জাগতিক বিলাস সামগ্রী আল্লাহর কাছে এতােই তুচ্ছ ও নগণ্য যে, তিনি একজন কাফেরকেও এসব দিতে পারেন। কারণ, ‘এগুলো সবই তাে পার্থিব জীবনের ভােগ সামগ্রী মাত্র।’ অর্থাৎ এসব হচ্ছে নিতান্তই ক্ষণস্থায়ী। এর স্থায়িত্ব পার্থিব জীবন পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। তাই এসব পার্থিব জীবনের জন্যেই মানায়। অপরদিকে পরকালীন জীবনের সুখ শান্তি হচ্ছে কেবল তাদের জন্যেই, যারা আল্লাহকে ভয় করে চলে। এই আল্লাহভীতির জন্যেই পরকালে তারা সম্মান পাবে, মর্যাদা পাবে। আল্লাহ তায়ালা তাদের জন্যে এই সম্মান ও মর্যাদা পরকালের জন্যে সঞ্চয় করে রাখছেন, যা হবে চিরস্থায়ী ও অধিকতর মূল্যবান। তাদের এই মর্যাদা কাফেরদের মান মর্যাদার তুলনায় উর্ধের ও অনেকটা স্বাতন্ত্রমডিত। কারণ কাফেরদেরকে আল্লাহ তায়ালা দুনিয়াতে সেসব তুচ্ছ ও মূল্যহীন সামগ্রী দান করেন যা তিনি অন্যান্য প্রাণীকেও দান করে থাকেন। দুনিয়ায় ধন দৌলত, ভােগ বিলাসিতা ও জৌলুস অনেকের কাছেই আকর্ষণীয় বলে মনে হয়। এর ফলে তারা পরীক্ষার সম্মুখীন হয়। বিশেষ করে যখন তারা দেখে, পাপীরা এসব ভােগ করছে, আর সৎলােকেরা এসব থেকে বঞ্চিত রয়েছে, অথবা যখন দেখে, সৎ লােকেরা অভাব অনটন ও দুঃখ কষ্টে জীবন যাপন করছে, আর অসৎ ও পাপী-তাপী লােকেরা ধন দৌলত, ক্ষমতা ও প্রভাব প্রতিপত্তির মালিক বনে আছে। আল্লাহ তায়ালা জানেন, এসব বিষয় মানুষের মনে নানা অশুভ প্রভাবের সৃষ্টি করে। তাই তিনি মানুষকে জানিয়ে দিচ্ছেন যে, এসব মূলাহীন ও মর্যাদহীন; এসব তুচ্ছ ও নগন্য। অপরদিকে পরকালে সৎলােকদের জন্যে যা কিছু রাখা আছে তা অত্যন্ত মূল্যবান ও মর্যাদাপূর্ণ। এই প্রকৃত ও বাস্তব অবস্থা জানার পর মােমেনদের অন্তর আল্লাহ তায়ালার ফয়সালায় সন্তুষ্ট থাকে এবং সৎ ও অসৎ লােকদের জন্যে তিনি যা পছন্দ করে রেখেছেন, সে ব্যাপারেও তাদের অন্তর আশ্বস্ত হয়। এই পার্থিব জগতের ধন সম্পদ থেকে বঞ্চিত একজন মানুষকে আল্লাহ তায়ালা নবী হিসেবে মনােনীত করেছেন বলে যারা অভিযােগ করতাে, যারা ধন সম্পদ ও পদের ভিত্তিতে মানুষের মর্যাদা নির্ণয় করতাে, তারা এসব আয়াতের মাধ্যমে জানতে পারছে যে, পার্থিব জীবনের ধন সম্পদ ও বিলাস সামগ্রী কতাে তুচ্ছ ও নগন্য, তাই সেগুলাে এমন লোকদেরকেও দেয়া হয়েছে। যারা আল্লাহর কাছে সবচেয়ে নিকৃষ্ট ও ঘৃণ্য। এর দ্বারা প্রমাণিত হয়, পার্থিব ধন দৌলত আল্লাহর সন্তুষ্টি ও পছন্দের পরিচয় বহন করে না। এভাবেই পবিত্র কোরআন প্রতিটি বিষয়ের প্রকৃত অবস্থা বর্ণনা করে এবং এর যথার্থ স্থান নির্ণয় করে দেয়। সাথে সাথে ইহকাল ও পরকালে মানুষের প্রাপ্য জীবিকা বন্টনের আল্লাহর বিধানের স্বরূপ কি, তার ব্যাখ্যা প্রদান করে এবং আল্লাহর কাছে চিরক্তন মূল্যবােধ কোনটি, তার পরিচয় তুলে ধরে। যারা মােহাম্মদ(স.)-এর রেসালতের ব্যাপারে আপত্তি করে এবং যারা ক্ষমতাধর ও প্রভাবশালীদেরকে ভক্তি করে তাদের উপযুক্ত জবাব দিতে গিয়ে পবিত্র কোরআন এসব বক্তব্য তুলে ধরেছে। আলােচ্য আয়াত আমাদের সামনে এমন কিছু মৌলিক নীতি এবং চিরন্তন বাস্তব সত্য তুলে ধরে যা স্থিতিশীল ও অপরিবর্তনশীল, যা জীবনের বিবর্তন, ব্যবস্থার তারতম্য, মতবাদের বিভিন্নতা এবং পরিবেশের বৈচিত্র্যের কারণে প্রভাবিত হয় না। তাই বলা যায়, জীবনের এমন কিছু নিয়মনীতি আছে যা স্থিতিশীল, যাকে কেন্দ্র করে জীবন আবর্তিত হয়। গতিশীল হয়, তবে জীবনকে তার নিজস্ব সীমারেখা থেকে বিচ্যুত করে না। যারা পরিবর্তনশীল জগত ও পরিবেশের কারণে চিরন্তন বাস্তবতা সম্পর্কে গভীর চিন্তা ভাবনা করতে অক্ষম, তারা কখনও এই আল্লাহর বিধানের স্বরূপ উপলব্ধি করতে পারে না, যা জীবনের মূল কাঠামােতে এবং জীবনের বিভিন্ন স্তরে স্থিতিশীলতা ও পরিবর্তনশীলতার মাঝে সমন্বয় সাধন করে। তারা মনে করে, সব কিছুই পরিবর্তনশীল ও গতিশীল । স্থিতিশীল বলতে এখানে কিছু নেই, অব্যাহত বিবর্তন ধারাই হচ্ছে তাদের কাছে চিরন্তন সত্য। কিন্তু যারা ইসলামী মূল্যবােধে বিশ্বাস করে, তারা মনে করে জীবন ও জগতের প্রতিটি স্তরে এবং প্রতিটি দিকে স্থিতিশীলতা ও গতিশীলতা সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা যে সত্যটি উচ্চারণ করেছেন, তাই সত্য এবং তাই বাস্তব। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হচ্ছে যে, মানুষের জীবন ও জীবিকার মাঝে যে বৈষম্য দেখতে পাই তা স্থিতিশীল। অপরদিকে এই বৈষম্যের যে অনুপাত ও কারণ বিভিন্ন সমাজ ও সমাজ ব্যবস্থায় দেখতে পাই তা পরিবর্তনশীল। স্থিতিশীলতা ও গতিশীলতার প্রমাণ এই উদাহরণ ছাড়া আরও অনেক আছে।

তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
# বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, আল বাকারা, টীকা ১২৪ থেকে ১৩৩ ; আল আন’আম, টীকা ৫০ থেকে ৫৫ ; ইবরাহীম, টীকা ৪৬ থেকে ৫২ ; মার্‌য়াম, টীকা ২৬ ও ২৭ ; আল আম্বিয়া, টীকা ৫৪ থেকে ৬৬ ; আশ্‌-শু’আরা, টীকা ৫০ থেকে ৬২ ; আল আনকাবূত, টীকা ২৬ ও ৪৬; আস সাফফাত , আয়াত ৮৩ থেকে ১০০ টীকা ৪৪ থেকে ৫৫ ।

# একথা দ্বারা হযরত ইবরাহীম (আ) শুধু তাঁর আকীদা বিশ্বাসই বর্ণনা করেননি, তার সপক্ষে যুক্তি-প্রমাণও পেশ করেছেন। অন্য সব উপাস্যদের সাথে সম্পর্ক না রাখার কারণ হচ্ছে, না তারা সৃষ্টি করেছে, না কোন ব্যাপারে সঠিক পথনির্দেশনা দেয় বা দিতে পারে। শুধু লা-শরীক আল্লাহর সাথে সম্পর্ক রক্ষা করার কারণ হচ্ছে, তিনিই সৃষ্টি করেছেন। তিনিই মানুষকে সঠিক পথনির্দেশনা দেন এবং দিতে পারেন।
# আল্লাহ‌ ছাড়া কেউ উপাস্য হওয়ার অধিকারী নয়, একথাটা।

# সঠিক পথ থেকে যখনই সামান্য একটু পদস্খলনও ঘটেছে এ বাণী তখনই তার পথনির্দেশনার জন্য সামনে রয়েছে। আর তারাও সেদিকেই ফিরে এসেছে। এখানে এ ঘটনাটি যে উদ্দেশ্যে বর্ণনা করা হয়েছে তা হচ্ছে, কুরাইশ গোত্রের কাফেরদের অযৌক্তিকতাকে পুরোপুরি উলংগ করে দেয়া এবং একথা বলে তাদের লজ্জা দেয়া যে, তোমরা পূর্ব-পুরুষদের অন্ধ অনুকরণ করে থাকলেও এ উদ্দেশ্যে সর্বোত্তম পূর্ব-পুরুষদের বাদ দিয়ে নিজেদের জঘন্যতম পূর্ব-পুরুষদের বেছে নিয়েছো। আরবে যে কারণে কুরাইশদের পৌরোহিত্য চলছিলো তা হচ্ছে, তারা হযরত ইবরাহীম ও ইসমাঈলের বংশধর এবং তাদের নির্মিত কা’বার তত্বাবধায়ক। তাই কুরাইশদের উচিত ছিল তাদের অনুসরণ করা। যারা হযরত ইবরাহীম ও ইসমাঈলের পথ ছেড়ে আশেপাশের মূর্তি পূজরী জাতিসমূহের নিকট থেকে শিরকের শিক্ষা লাভ করেছিলো তাদের অনুসরণ কুরাইশদের জন্য সঠিক ছিল না। এই ঘটনা বর্ণনা করে আরো একটি দিক থেকেও এসব পথভ্রষ্ট লোকদের ভ্রান্তি সুস্পষ্ট করে দেয়া হয়েছে। সেটি হচ্ছে, হক ও বাতিল যাচাই বাছাই না করেই যদি চোখ বন্ধ করে বাপ-দাদার অন্ধ অনুসরণ ঠিক হতো তাহলে সর্বপ্রথম হযরত ইবরাহীমই এ কাজ করতেন। কিন্তু তিনি তাঁর বাপ-দাদা ও কওমকে পরিষ্কার ভাষায় একথা বলে দিয়েছিলেন, আমি তোমাদের অজ্ঞতা প্রসূত ধর্মের অনুসরণ করতে পারি না যার বিধান অনুসারে তোমরা স্রষ্টাকে বাদ দিয়ে যারা স্রষ্টা নয় সেই সব সত্তাকে উপাস্য বনিয়ে নিয়েছো। এ থেকে জানা যায়, হযরত ইবরাহীম বাপ-দাদার অন্ধ অনুসরণের সমর্থক নন। বরং তাঁর নীতি ছিল বাপ-দাদার অনুসরণের পূর্বে ব্যক্তিকে চোখ খুলে দেখতে হবে তারা সঠিক পথে আছে কিনা। যদি যুক্তি দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, তারা সঠিক পথে চলছে না তখন তাদের অনুসরণ বাদ দিয়ে যুক্তি অনুসারে যেটা ন্যায় ও সত্যের পথ সেটিই অনুসরণ করতে হবে।
# মূল আয়াতে رسول مبين শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে যার আরেকটি অর্থ এও হতে পারে যে, এমন রসূল এসেছেন যার রসূল হওয়া সুস্পষ্ট ছিল, যার নবুওয়াত-পূর্ব জীবন ও নবুওয়াত পরবর্তী জীবন স্পষ্ট সাক্ষ্য দিচ্ছিলো যে, তিনি অবশ্যই আল্লাহর রসূল।
# দুটি শহর অর্থ মক্কা ও তায়েফ। কাফেররা বলতো সত্যিই যদি আল্লাহর কোন রসূল পাঠানোর প্রয়োজন হতো এবং তিনি সেই রসূলের কাছে তাঁর কিতাব নাযিল করতে চাইতেন তাহলে আমাদের কেন্দ্রীয় মর্যাদার এই শহরগুলোর মধ্য থেকে কোন নামকরা লোককে বাছাই করতেন। আল্লাহ‌ রসুল বানানোর জন্য পেলেন এমন ব্যক্তিকে যে ইয়াতীম হয়ে জন্মলাভ করেছে, যে কোন উত্তরাধিকার লাভ করেনি, যে বকরি চরিয়ে যৌবনকাল অতিবাহিত করেছে, যে এখন স্ত্রীর সম্পদ দিয়ে জীবন যাপনও করে, ব্যবসা-বানিজ্য করে এবং যে কোন গোত্রের অধিপতি বা গোষ্ঠীর নেতা নয়। মক্কায় কি ওয়ালিদ ইবনে মুগীরা ও ‘উতবা ইবনে রাবীআর মত সম্মানিত ও নামজাদা লোক ছিল না? তায়েফে কি উরওয়া ইবনে মাসউদ, হাবীব ইবনে ‘আমর, কিনানা ইবনে আবদে আমর এবং ইবনে আবদে ইয়ালীলের মত নেতারা ছিল না? এটা ছিল তাদের, যুক্তি প্রমাণ। কোন মানুষ নবী হতে পারে প্রথমে তারা একথা মানতেই প্রস্তুত ছিল না। কিন্তু কুরআন মজীদে যখন একের পর এক যুক্তি-প্রমাণ দিয়ে তাদের এ ধারণা পুরোপুরি বাতিল করে দেয়া হলো এবং বলা হলো, ইতিপূর্বেও মানুষই সবসময় নবী হয়ে এসেছেন এবং মানুষের হিদায়াতের জন্য মানুষই রসূল হতে পারেন অন্য কেউ নয়। দুনিয়াতে রসূল হিসেবে যিনিই এসেছেন তিনি হঠাৎ আসমান থেকে নেমে আসেননি। মানুষের এসব জনপদেই তিনি জন্মলাভ করেছিলেন, বাজারসমূহে চলাফেরা করতেন, সন্তানের পিতা ছিলেন এবং পানাহারের প্রয়োজন মুক্ত ছিলেন না। (দেখুন, আন-নাহল, আয়াত ৪৩ , বনী ইসরাঈল ৯৪ ও ৯৫ ; ইউসুফ, ১০৯ ; আল ফুরকান, ৭ ও ২০ ; আল আম্বিয়া, ৭ ও ৮ এবং আর রা’দ ৩৮ আয়াত ) তখন তারা কৌশল পরিবর্তন করে বললো, বেশতো, মানুষই রসূল হয়েছেন তা ঠিক। কিন্তু তাকে তো কোন নামজাদা লোক হতে হবে। তিনি হবেন সম্পদশালী, প্রভাবশালী, বড় দলবলের অধিকারী এবং মানুষের মধ্যে তার ব্যক্তিত্বের প্রভাব থাকবে। সেজন্য মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কি করে উপযুক্ত হতে পারেন?
# এটা তাদের আপত্তির জবাব। এ জবাবের মধ্যে সংক্ষিপ্ত কয়েকটি কথায় অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলা হয়েছে। প্রথম বিষয়টি হলো, তোমার রবের রহমত বন্টন করার দায়িত্ব তাদেরকে কবে দেয়া হলো? আল্লাহ‌ তাঁর রহমত কাকে দান করবেন আর কাকে দান করবেন না সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ কি তাদের কাজ? (এখানে রবের রহমত অর্থ তাঁর ব্যাপক রহমত। যে রহমত থেকে প্রত্যেকেই কিছু না কিছু লাভ করে থাকে)।

দ্বিতীয় বিষয়টি হলো, নবুওয়াত তো অনেক বড় জিনিস। পৃথিবীতে জীবন-যাপন করার যে সাধারণ উপায়-উপকরণ আছে বন্টন ব্যবস্থাও আমি নিজের হাতেই রেখেছি, অন্য কারো হাতে তুলে দেইনি। আমি কাউকে সুশ্রী এবং কাউকে কুশ্রী, কাউকে সুকন্ঠের অধিকারী এবং কাউকে অপ্রিয় কন্ঠের অধিকারী, কাউকে শক্তিশালী-সুঠামদেহী এবং কাউকে দুর্বল, কাউকে মেধাবী এবং কাউকে মেধাহীন, কাউকে মজবুত স্মৃতি শক্তির অধিকারী এবং কাউকে স্মৃতি শক্তিহীন, কাউকে সুস্থ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের অধিকারী, কাউকে বিকলাঙ্গ, অন্ধ অথবা বোবা, কাউকে আমীর পুত্র এবং কাউকে গরীবের পুত্র, কাউকে উন্নত জাতির সদস্য এবং কাউকে পরাধীন অথবা পশ্চাদপদ জাতির সদস্য হিসেবে সৃষ্টি করে থাকি। জন্মগত এই ভাগ্যের ব্যাপারে কেউ সামান্যতম কর্তৃত্বও খাটাতে পারে না। আমি যাকে যা বানিয়েছি সে তাই হতে বাধ্য এবং কারো তাকদীরের ওপর এই ভিন্ন ভিন্ন জন্মগত অবস্থার যে প্রভাবই পড়ে তা পাল্টে দেয়ার সাধ্য কারো নেই। তাছাড়া আমিই মানুষের মধ্যে রিযিক, ক্ষমতা, মর্যাদা, খ্যাতি, সম্পদ ও শাসন কর্তৃত্ব ইত্যাদি বণ্টন করছি। যে আমার পক্ষ থেকে সৌভাগ্য লাভ করে কেউ তার মর্যাদাহানি করতে পারে না। আর আমার পক্ষ থেকে যার জন্য দুর্ভাগ্যে ও অধঃপতন এসে যায় কেউ তাকে পতন থেকে রক্ষা করতে পারে না। আমার সিদ্ধান্তের মোকাবিলায় মানুষের সমস্ত চেষ্টা ও কৌশল কোন কাজেই আসে না। এই বিশ্বজনীন খোদায়ী ব্যবস্থাপনায় বিশ্ব-জাহানের অধিপতি কাকে তাঁর নবী বানাবেন আর কাকে বানাবেন না সে ব্যাপারে এসব লোক কি ফায়সালা করতে চায়?

তৃতীয় বিষয়টি হলো, এই খোদায়ী ব্যবস্থাপনায় একজনকেই সব কিছু অথবা সবাইকে সব কিছু না দেয়ার চিরস্থায়ী একটি নিয়মের প্রতি লক্ষ্য রাখা হয়। চোখ মেলে দেখো, আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে সর্বত্র সর্ব ক্ষেত্রে পার্থক্যই নজরে পড়বে। আমি কাউকে কোন জিনিস দিয়ে থাকলে আরেকটি জিনিস থেকে তাকে বঞ্চিত করেছি। এবং সেটি অন্য কাউকে দিয়েছি। এমনটি করার ভিত্তি হলো কোন মানুষই যেন অন্য মানুষদের মুখাপেক্ষিতা মুক্ত না হয়। বরং কোন না কোন ব্যাপারে প্রত্যেকেই পরস্পরের মুখাপেক্ষী থাকে। যাকে আমি নেতৃত্ব ও প্রভাব-প্রতিপত্তি দান করেছি নবুওয়াতও তাকেই দিতে হবে এরূপ নির্বুদ্ধিতামূলক ধ্যান-ধারণা তোমাদের মগজে ঢুকলো কি করে? অনুরূপ তোমরা কি একথাও বলবে যে, একজনের মধ্যেই বুদ্ধি, জ্ঞান, সম্পদ, সৌন্দর্য, ক্ষমতা, কর্তৃত্ব এবং অন্য সব পূর্ণতার সমাবেশ ঘটাতে হবে এবং যে একটি জিনিসও পায়নি তাকে অন্য কোন জিনিসই দিতে হবে না?
# এখানে রবের রহমত অর্থ তাঁর বিশেষ রহমত, অর্থাৎ নবুওয়াত। এর সারমর্ম হলো, তোমরা নিজেদের যেসব নেতাকে তাদের সম্পদ, প্রভাব, প্রতিপত্তি ও মুরুব্বিয়ানার কারণে বড় একটা কিছু মনে করছো তা মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যে সম্পদ দেয়া হয়েছে তার সমপর্যায়ের নয়। এ সম্পদ ঐ সম্পদ থেকে অনেক গুণ বেশী উৎকৃষ্টতার মানদণ্ড অন্য কিছু। তোমরা যদি মনে করে থাকো, তোমাদের প্রত্যেক চৌধুরী আর শেঠই নবী হওয়ার উপযুক্ত তাহলে সেটা তোমাদের নিজেদের ধ্যান-ধারণার পশ্চাদপদতা। আল্লাহর কাছে এ ধরনের অজ্ঞতার আশা করো কেন?
# এই সোনা রূপা যা কারো লাভ করা তোমাদের দৃষ্টিতে চরম নিয়ামত প্রাপ্তি এবং সম্মান ও মর্যাদার চরম শিখরে আরোহণ, তা আল্লাহর দৃষ্টিতে এতই নগণ্য যে, যদি সমস্ত মানুষের কুফরীর প্রতি ঝুঁকে পড়ার আশঙ্কা না থাকতো তাহলে তিনি প্রত্যেক কাফেরের বাড়িঘর সোনা ও রূপা দিয়ে তৈরী করে দিতেন। এই নিকৃষ্ট বস্তুটি কখন থেকে মানুষের মর্যাদা ও আত্মার পবিত্রতার প্রমাণ হয়ে দাঁড়িয়েছে? এই সম্পদ তো এমন সব মানুষের কাছেও আছে যাদের ঘৃণ্য কাজ-কর্মের পংকিলতায় গোটা সমাজ পূতিগন্ধময় হয়ে যায়। আর একেই তোমরা মানুষের শ্রেষ্টত্বের মানদণ্ড বানিয়ে রেখেছো।

তাফসীরে‌ ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
২৬-৩৫ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

এ আয়াতগুলোতে কয়েকটি বিষয়ের আলোচনা প্রস্ফুটিত হয়েছে। প্রথমত : একজন মু’মিন সকল প্রকার তাগুত ও শির্ক থেকে সম্পর্ক মুক্ত থাকবে এবং নিজের সকল বিষয় আল্লাহ তা‘আলার ওপর সোপর্দ করে দেবে। একনিষ্ঠ তাওহীদবাদী আল্লাহ তা‘আলার বন্ধু ইবরাহীম (আঃ)-এর ঘটনা এ কথাই বলে দিচ্ছে। ধর্মের জন্য তিনি তাঁর মুশরিক পিতা ও জাতির সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতে দ্বিধাবোধ করেননি। আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন :

(قَالَ أَفَرَأَيْتُمْ مَّا كُنْتُمْ تَعْبُدُوْنَ لا‏ أَنْتُمْ وَاٰبَا۬ؤُكُمُ الْأَقْدَمُوْنَ ز فَإِنَّهُمْ عَدُوٌّ لِّيْٓ إِلَّا رَبَّ الْعٰلَمِيْنَ لا الَّذِيْ خَلَقَنِيْ فَهُوَ يَهْدِيْنِ)‏‏

“সে বলল : ‎ ‘তোমরা কি ভেবে দেখেছ, কিসের পূজা করছো ‘তোমরা এবং তোমাদের অতীত পিতৃপুরুষেরা? ‘তারা সকলেই আমার শত্র“, জগতসমূহের প্রতিপালক ব্যতীত; ‘যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন, তিনিই আমাকে পথ প্রদর্শন করেন।” (সূরা শুআরা ২৬ : ৭৫-৭৮)

এ ছাড়াও সূরা আন‘আমের ৭৮-৭৯ নম্বর আয়াতে এবং সূরা মুমতাহিনার ৪ নম্বর আয়াতে উল্লেখ রয়েছে।

(وَجَعَلَهَا كَلِمَةًۭ بَاقِيَةً فِيْ عَقِبِه۪)

অর্থাৎ একনিষ্ঠভাবে শুধুমাত্র আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করা এবং আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত সকল বানানো মা‘বূদের ইবাদত থেকে নিজেকে মুক্ত ঘোষণা করার বাণীটি পরবর্তী বংশধরদের শিক্ষার জন্য অবশিষ্ট রেখেছেন। যাতে তারা সকল প্রকার তাগুতের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করে। এটাই হল লা ইলাহা ইল্লালাহ (لا اله الا الله) এর দাবী। لا اله আল্লাহ ব্যতীত সকল মা‘বূদ থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করবে, الا الله সকল প্রকার ইবাদত একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার জন্য সম্পাদন করবে। সুতরাং একজন মু’মিন সর্বদা সর্বক্ষেত্রে আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করবে, কখনো আল্লাহ তা‘আলার বিধানের বাইরে যাবে না। একবার মাসজিদে যাবে, আরেক বার মন্দিরে যাবে, একবার মাসজিদ উদ্বোধন করবে আরেক বার মন্দির বা গির্জা উদ্বোধন করবে তা হতে পারে না।

দ্বিতীয়ত :

মানুষের জীবিকা, জীবন-মৃত্যু, কল্যাণ-অকল্যাণ ও মান-সম্মান সবকিছু আল্লাহ তা‘আলা বন্টন করে দিয়েছেন। এমনকি আল্লাহ তা‘আলা কাকে নবুওয়াত দেবেন তাও বন্টন করে দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলার বণ্টনানুপাতে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন রাসূল হিসেবে প্রেরিত হলেন তখন মক্কার মুশরিকরা অস্বীকার করল। এবং বলতে লাগল কেন এ দুই গ্রামের (মক্কা ও তায়েফ) মধ্য হতে একজন সম্মানিত ব্যক্তিকে নাবী বানানো হয়নি। আল্লাহ তা‘আলা বলছেন : আমি আমার রহমত তথা নবুওয়াত উপযুক্ত ব্যক্তিকেই প্রদান করি। অতএব এখানে তাদের কোন হাত নেই।

(لِّيَتَّخِذَ بَعْضُهُمْ بَعْضًا سُخْرِيًّا)

অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা কাউকে ধনী বানিয়েছেন, কাউকে গরীব বানিয়েছেন, কাউকে মালিক বানিয়েছেন, কাউকে শ্রমিক বানিয়েছেন যাতে একজন অন্যজন দ্বারা উপকার নিতে পারে। সবাই যদি মালিক হতো তাহলে শ্রমিক হতো কে? আর সবাই যদি ধনী হতো তাহলে মুচি হতো কে? তাই আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য উপযুক্ত রিযিক বন্টন করে দিয়েছেন, আর এ সম্পর্কে কিয়ামতের দিন জিজ্ঞাসা করা হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(وَاللّٰهُ فَضَّلَ بَعْضَكُمْ عَلٰي بَعْضٍ فِي الرِّزْقِ ج فَمَا الَّذِيْنَ فُضِّلُوْا بِرَا۬دِّيْ رِزْقِهِمْ عَلٰي مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُهُمْ فَهُمْ فِيْهِ سَوَا۬ءٌ ط أَفَبِنِعْمَةِ اللّٰهِ يَجْحَدُوْنَ)‏

“আল্লাহ জীবনোপকরণে তোমাদের কাউকে কারো ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন। যাদেরকে শ্রেষ্ঠত্ব দেয়া হয়েছে তারা তাদের অধীনস্থ দাস-দাসীদেরকে নিজেদের জীবনোপকরণ হতে এমন কিছু দেয় না যাতে তারা এ বিষয়ে তাদের সমান হয়ে যায়। তবে কি তারা আল্লাহর অনুগ্রহ অস্বীকার করে?” (সূরা নাহ্ল ১৬ : ৭১)

অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা বর্ণনা করেছেন যে, সত্য প্রত্যাখ্যানে যদি মানুষ এক মতাবলম্বী হয়ে পড়ার আশংকা না থাকত তাহলে আমি দুনিয়ায় যারা আমার বিরুদ্ধাচরণ করে, আমাকে অস্বীকার করে তাদেরকে আমি দিতাম তাদের গৃহের জন্য রৌপ্য নির্মিত ছাদ ও সিঁড়ি যাতে তারা আরোহণ করতে পারে এবং তাদেরকে দিতাম তাদের গৃহের জন্য রৌপ্য নির্মিত দরজা, বিশ্রামের জন্য পালঙ্ক যাতে তারা হেলান দিয়ে বসে থাকবে। আর তার সাথে স্বর্ণ নির্মিতও। তবে এগুলো পার্থিব জীবনেই সীমাবদ্ধ। আর আখিরাতে তারা ভোগ করবে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি এবং মু’মিনগণ থাকবে পরম আনন্দে ও আরাম-আয়েশে। হাদীসে বলা হয়েছে।

একদা ‘উমার (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর বাড়িতে গমন করেন, ঐ সময় রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্বীয় স্ত্রীদের থেকে ঈলা করছিলেন। (কিছু দিনের জন্য স্ত্রীদের সংগ ত্যাগ করার শপথ করাকে ঈলা বলে)। সে জন্য রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একাকী ছিলেন। ‘উমার (রাঃ) ঘরে প্রবেশ করে দেখেন যে, তিনি একটি চাটাইয়ের উপর শুয়ে আছেন এবং তাঁর দেহে চাটাইয়ের দাগ পড়ে গেছে। এ অবস্থা দেখে ‘উমার (রাঃ) কেঁদে ফেললেন এবং বললেন : হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! রূম সম্রাট কাইসার এবং পারস্য সম্রাট কিসরা তারা কত আরামে দিন অতিবাহিত করছে। আর আপনি আল্লাহ তা‘আলার প্রিয় ও মনোনীত বান্দা হওয়া সত্ত্বেও আপনার এ অবস্থা। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হেলান দেয়া অবস্থা থেকে সোজা হয়ে বসে বললেন : হে ইবনুল খাত্ত্বাব! তুমি কি সন্দেহের মধ্যে রয়েছো? অতঃপর তিনি বলেন : এরা হলো ঐ সকল লোক যারা তাদের পার্থিব জীবনেই তাদের ভোগ্য বস্তু পেয়ে গেছে। (সহীহ মুসলিম ২ : ১১৩)

অন্য এক হাদীসে বলা হয়েছে, সাহল ইবনু সা‘দ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : আল্লাহ তা‘আলার নিকট দুনিয়ার মূল্য যদি একটি মশার ডানার পরিমাণও হত তাহলে তিনি কোন কাফিরকে এক ঢোক পানিও পান করতে দিতেন না। (সহীহ, তিরমিযী হা. ২৩২০)

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. একজন মু’মিন শির্ক ও মুশরিকদের সাথে সম্পর্ক যুক্ত থাকতে পারে না।
২. দুনিয়াতে সুখে থাকার মানেই এমনটি নয় যে, আখিরাতেও সে সুখে থাকবে।
৩. দুনিয়ার মূল্য আল্লাহ তা‘আলার নিকট একটি মশার ডানার সমানও নয়।
৪. আল্লাহ কারো ইচ্ছামত কোন কিছু করেন না, বরং তিনি তাঁর ইচ্ছামত কাজ করে থাকেন।
৫. আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক ব্যক্তির রিযিক বরাদ্দ করে দিয়েছেন। কারো রিযিক শেষ না হওয়া পর্যন্ত সে দুনিয়া থেকে বিদায় নেবে না।

তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-

২৬-৩৫ নং আয়াতের তাফসীর:

কুরায়েশ কাফিররা বংশ ও দ্বীনের দিক দিয়ে হযরত ইবরাহীম খলীলুল্লাহ (আঃ)-এর সাথে সম্পর্কযুক্ত ছিল বলে আল্লাহ তাআলা হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর সুন্নাতকে তাদের সামনে রেখে বলেনঃ “দেখো, যে ইবরাহীম (আঃ) ছিলেন তাঁর পরবর্তী সমস্ত নবী (আঃ)-এর পিতা, আল্লাহর রাসূল এবং একত্ববাদীদের ইমাম, তিনিই স্পষ্ট ভাষায় শুধু নিজের কওমকে নয়, বরং স্বয়ং নিজের পিতাকেও বলেনঃ তোমরা যাদের পূজা কর তাদের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই, আমার সম্পর্ক আছে শুধু ঐ আল্লাহর সাথে যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন এবং তিনিই আমাকে সৎপথে পরিচালিত করবেন। আমি তোমাদের এসব মাবুদ হতে সম্পূর্ণরূপে বিমুখ। এদের সাথে আমার কোনই সম্পর্ক নেই।

আল্লাহ তাআলাও তাঁকে তাঁর হক কথা বলার সাহসিকতা ও একত্ববাদের প্রতি আবেগ ও উত্তেজনার প্রতিদান প্রদান করেন যে, তিনি তাঁর সন্তানদের মধ্যে কালেমায়ে তাওহীদ চিরদিনের জন্যে বাকী রেখে দেন। তাঁর সন্তানরা এই পবিত্র কালেমার উক্তিকারী হবেন না এটা অসম্ভব। তাঁর সন্তানরাই এই তাওহীদী কালেমার প্রচার করবেন এবং দিকে দিকে ছড়িয়ে দিবেন। ভাগ্যবান ও সৎ লোকেরা এই বংশের লোকদের নিকট হতেই তাওহীদের শিক্ষা গ্রহণ করবে। মোটকথা, ইসলাম ও তাওহীদের শিক্ষক রূপে মনোনয়ন পেয়েছেন এই বংশের লোকেরাই।

প্রবল প্রতাপান্বিত আল্লাহ বলেনঃ আমিই এই কাফিরদেরকে এবং এদের পূর্বপুরুষদেরকে সুযোগ দিয়েছিলাম ভোগের, অবশেষে তাদের নিকট আসলো সত্য ও স্পষ্ট প্রচারক রাসূল। যখন তাদের নিকট সত্য আসলো তখন তারা বললোঃ এটা তো যাদু এবং আমরা এটা প্রত্যাখ্যান করি। জিদ ও হঠকারিতার বশবর্তী হয়ে তারা সত্যকে অস্বীকার করে বসলো এবং কুরআনের মুকাবিলায় দাঁড়িয়ে গেল এবং বলে উঠলো- সত্যিই যদি এটা আল্লাহর কালাম হয়ে থাকে তবে কেন এটা মক্কা ও তায়েফের কোন প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তির উপর অবতীর্ণ হলো না?

প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তি দ্বারা তারা ওয়ালীদ ইবনে মুগীরা, উরওয়া ইবনে মাসঊদ সাকাফী, উমায়ের ইবনে আমর, উবা ইবনে রাবীআহ, হাবীব ইবনে আমর ইবনে উমায়ের সাকাফী, ইবনে আবদে ইয়ালীল, কিনানাহ ইবনে আমর প্রমুখ ব্যক্তিদেরকে বুঝিয়েছিল। তাদের মতে এই দুই জনপদের কোন উচ্চমর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তির উপর কুরআন অবতীর্ণ হওয়া উচিত ছিল।

তাদের এই প্রতিবাদের জবাবে মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ এরা কি তোমার প্রতিপালকের করুণার মালিক যে, এরাই তা বন্টন করতে বসেছে? আমার জিনিস আমারই অধিকারভুক্ত। আমি যাকে ইচ্ছা তাকেই তা প্রদান করে থাকি। কোথায় আমার জ্ঞান এবং কোথায় তাদের জ্ঞান! রিসালাতের সঠিক হকদার কে তা আমিই জানি। এই নিয়ামত তাকেই দেয়া হয় যে সমস্ত মাখলুকের মধ্যে সর্বাপেক্ষা পবিত্র হৃদয়ের অধিকারী, যার আত্মা পবিত্র, যার বংশ সবচেয়ে বেশী সম্ভ্রান্ত এবং যে মূলগতভাবেও সর্বাপেক্ষা পবিত্র।

এরপর মহান আল্লাহ বলেনঃ আল্লাহর করুণা যারা বন্টন করতে চাচ্ছে তাদের জীবনোপকরণও তো তাদের অধিকারভুক্ত নয়। আমিই তাদের মধ্যে জীবিকা বন্টন করি তাদের পার্থিব জীবনে এবং একজনকে অপরের উপর মর্যাদায় উন্নত করি যাতে একে অপরের দ্বারা কাজ করিয়ে নিতে পারে। আমি যাকে যা ইচ্ছা এবং যখন ইচ্ছা দিয়ে থাকি এবং যখন যা ইচ্ছা ছিনিয়ে নিই। জ্ঞান, বিবেক, ক্ষমতা ইত্যাদিও আমারই দেয়া এবং এতেও আমি পার্থক্য রেখেছি। এগুলো সবাইকে আমি সমান দিইনি। এর হিকমত এই যে, এর ফলে একে অপরের দ্বারা কাজ করিয়ে নিতে পারে। এর ওর প্রয়োজন হয় এবং ওর এর প্রয়োজন হয়। সুতরাং একে অপরের অধীনস্থ থাকে।

অতঃপর মহান আল্লাহ বলেনঃ “(হে নবী সঃ)! তারা যা জমা করে তা হতে তোমার প্রতিপালকের অনুগ্রহ উৎকৃষ্টতর।

মহামহিমান্বিত আল্লাহ এরপর বলেনঃ আমি যদি এই আশংকা না করতাম যে, মানুষ মাল-ধনকে আমার অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টির প্রমাণ মনে করে নিয়ে সত্য প্রত্যাখ্যানে এক মতাবলম্বী হয়ে পড়বে, তবে আমি কাফিরদেরকে এতো বেশী মাল-ধন দিতাম যে, তাদের গৃহের ছাদ রৌপ্য নির্মিত হতো, এমনকি ঐ সিঁড়িও হতো রৌপ্য নির্মিত যাতে তারা আরোহণ করে। আর তাদের গৃহের জন্যে দিতাম রৌপ্য নির্মিত দরযা এবং বিশ্রামের জন্যে দিতাম রৌপ্য ও স্বর্ণ নির্মিত পালংক। তবে এ সবই শুধু পার্থিব জীবনের ভোগ-সম্ভার। এগুলো ক্ষণস্থায়ী ও ধ্বংসশীল এবং আখিরাতের নিয়ামতরাশির তুলনায় এগুলো অতি তুচ্ছ ও নগণ্য। আর আখিরাতের এই নিয়ামত ও কল্যাণ রয়েছে মুত্তাকীদের জন্যে। দুনিয়া লোভীরা এখানে ভোগ-সম্ভার ও সুখ-সামগ্রী কিছুটা লাভ করবে বটে কিন্তু আখিরাতে তারা হবে একেবারে শূন্য হস্ত। সেখানে তাদের কাছে একটাও পুণ্য থাকবে না। যার বিনিময়ে তারা মহান আল্লাহর নিকট হতে কিছু লাভ করতে পারে, যেমন সহীহ হাদীস দ্বারা এটা প্রমাণিত।

অন্য হাদীসে রয়েছেঃ “আল্লাহর কাছে যদি এই দুনিয়ার মূল্য একটি মশার ডানার পরিমাণও হতো তবে তিনি এখানে কোন কাফিরকে এক চুমুক পানিও পান করাতেন না।”

মহান আল্লাহ বলেন যে, পরকালের কল্যাণ শুধু ঐ লোকদের জন্যেই রয়েছে। যারা দুনিয়ায় সদা আল্লাহর ভয়ে ভীত থাকে। পরকালে এরাই মহান প্রতিপালকের বিশিষ্ট নিয়ামত ও রহমত লাভ করবে, যাতে অন্য কেউ তাদের শরীক হবে না।

একদা হযরত উমার (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর বাড়ীতে আগমন করেন, ঐ সময় রাসূলুল্লাহ (সঃ) স্বীয় স্ত্রীদের হতে ঈলা কিছু দিনের জন্যে স্ত্রীদের সংসর্গ ত্যাগ করার শপথ করাকে শরীয়তের পরিভাষায় ঈলা বলা হয়) করেছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ) একাকী ছিলেন। হযরত উমার (রাঃ) ঘরে প্রবেশ করে দেখেন যে, তিনি একখণ্ড চাটাই এর উপর শুয়ে রয়েছেন এবং তাঁর দেহে চাটাই এর দাগ পড়ে গেছে। এ অবস্থা দেখে হযরত উমার (রাঃ) কেঁদে ফেলেন এবং বলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! রোমক সম্রাট কায়সার এবং পারস্য সম্রাট কিসরা কত শান-শওকতের সাথে আরাম-আয়েশে দিন যাপন করছে! আর আপনি আল্লাহর প্রিয় ও মনোনীত বান্দা হওয়া সত্ত্বেও আপনার এই (শশাচনীয়) অবস্থা!” রাসূলুল্লাহ (সঃ) হেলান লাগিয়ে ছিলেন, হযরত উমার (রাঃ)-এর একথা শুনে তিনি সোজা হয়ে বসলেন এবং বললেনঃ “হে উমার (রাঃ)! তুমি কি সন্দেহের মধ্যে রয়েছো?” অতঃপর তিনি বলেনঃ “এরা হলো ঐ সব লোক যারা তাদের পার্থিব জীবনেই তাড়াতাড়ি তাদের ভোগ্য বস্তু পেয়ে গেছে। অন্য রিওয়াইয়াতে আছে যে, তিনি বলেনঃ “তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও যে, তাদের জন্যে দুনিয়া এবং আমাদের জন্যে আখিরাত?”

সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম প্রভৃতি হাদীস গ্রন্থসমূহে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “তোমরা স্বর্ণ ও রৌপ্যের পাত্রে পান করো না এবং এগুলোর থালায় আহার করো না, কেননা, এগুলো দুনিয়ায় তাদের (কাফিরদের) জন্যে এবং আখিরাতে আমাদের জন্যে।” আল্লাহ তা’আলার দৃষ্টিতে দুনিয়া খুবই ঘৃণ্য ও তুচ্ছ।

হযরত সাহল ইবনে সা’দ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আল্লাহ তা’আলার নিকট দুনিয়ার মূল্য যদি একটি মশার ডানার সমানও হতো তবে তিনি কোন কাফিরকে এক চুমুক পানিও পান করাতেন না। (এ হাদীসটি ইমাম তিরমিযী (রঃ) ও ইমাম ইবনে মাজাহ (রঃ) বর্ণনা করেছেন এবং ইমাম তিরমিযী (রঃ) এটাকে হাসান সহীহ বলেছেন)

Leave a Reply