أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#১১১১)
[ ** শয়তানকে যখন মানুষের সহচর বানিয়ে দেয়া হয়:-
**দ্বীনের দায়ীদের দায়িত্বে সীমাবদ্ধতা ও জবাবদিহীতা:-
**যুগ যুগান্তরের সকল মুমিন এক কাফেলার সদস্য : -]
www.motaher21.net
সূরা:৪৩: সূরা:- আয-যুখরুফ পারা:২৫
৩৬-৪৫ নং আয়াত:-
সূরা:৪৩: সূরা:- আয-যুখরুফ:৩৬
وَ مَنۡ یَّعۡشُ عَنۡ ذِکۡرِ الرَّحۡمٰنِ نُقَیِّضۡ لَہٗ شَیۡطٰنًا فَہُوَ لَہٗ قَرِیۡنٌ ﴿۳۶﴾
যে ব্যক্তি পরম দয়াময় আল্লাহর স্মরণে উদাসীন হয় তিনি তার জন্য এক শয়তানকে নিয়োজিত করেন, অতঃপর সে হয় তার সহচর।
সূরা:৪৩: সূরা:- আয-যুখরুফ:৩৭
وَ اِنَّہُمۡ لَیَصُدُّوۡنَہُمۡ عَنِ السَّبِیۡلِ وَ یَحۡسَبُوۡنَ اَنَّہُمۡ مُّہۡتَدُوۡنَ ﴿۳۷﴾
শয়তানেরাই মানুষকে সৎপথ হতে বিরত রাখে। আর মানুষ মনে করে, তারা সৎপথপ্রাপ্ত।
সূরা:৪৩: সূরা:- আয-যুখরুফ:৩৮
حَتّٰۤی اِذَا جَآءَنَا قَالَ یٰلَیۡتَ بَیۡنِیۡ وَ بَیۡنَکَ بُعۡدَ الۡمَشۡرِقَیۡنِ فَبِئۡسَ الۡقَرِیۡنُ ﴿۳۸﴾
অবশেষে যখন সে আমার নিকট উপস্থিত হবে, তখন সে শয়তানকে বলবে, ‘হায়! আমার ও তোমার মাঝে যদি পূর্ব ও পশ্চিমের ব্যবধান থাকত।’ সুতরাং কত নিকৃষ্ট সহচর সে!
সূরা:৪৩: সূরা:- আয-যুখরুফ:৩৯
وَ لَنۡ یَّنۡفَعَکُمُ الۡیَوۡمَ اِذۡ ظَّلَمۡتُمۡ اَنَّکُمۡ فِی الۡعَذَابِ مُشۡتَرِکُوۡنَ ﴿۳۹﴾
ওদেরকে বলা হবে, ‘তোমরা সীমালংঘন করেছিলে; আজ তোমাদের এ অনুতাপ তোমাদের কোন কাজে আসবে না। নিশ্চয় তোমরা সকলেই শাস্তির ভাগী হবে।’
সূরা:৪৩: সূরা:- আয-যুখরুফ:৪০
اَفَاَنۡتَ تُسۡمِعُ الصُّمَّ اَوۡ تَہۡدِی الۡعُمۡیَ وَ مَنۡ کَانَ فِیۡ ضَلٰلٍ مُّبِیۡنٍ ﴿۴۰﴾
তুমি কি বধিরকে শোনাতে পারবে? অথবা যে অন্ধ এবং যে ব্যক্তি স্পষ্ট বিভ্রান্তিতে আছে তাকে কি পারবে সৎপথে পরিচালিত করতে?
সূরা:৪৩: সূরা:- আয-যুখরুফ:৪১
فَاِمَّا نَذۡہَبَنَّ بِکَ فَاِنَّا مِنۡہُمۡ مُّنۡتَقِمُوۡنَ ﴿ۙ۴۱﴾
আমি তোমাকে দুনিয়া থেকে যদি উঠিয়েও নেই, তবুওতো আমার এদেরকে শাস্তি দিতে হবে।
সূরা:৪৩: সূরা:- আয-যুখরুফ:৪২
اَوۡ نُرِیَنَّکَ الَّذِیۡ وَعَدۡنٰہُمۡ فَاِنَّا عَلَیۡہِمۡ مُّقۡتَدِرُوۡنَ ﴿۴۲﴾
কিংবা এদেরকে যে পরিণামের প্রতিশ্রুতি আমি দিয়েছি তা তোমাকে চাক্ষুষ দেখিয়েও দেই ( কোন অবস্থাতেই এরা শাস্তি থেকে রেহাই পাবেনা), এদের বিরুদ্ধে আমি পূর্ণ ক্ষমতা রাখি।
সূরা:৪৩: সূরা:- আয-যুখরুফ:৪৩
فَاسۡتَمۡسِکۡ بِالَّذِیۡۤ اُوۡحِیَ اِلَیۡکَ ۚ اِنَّکَ عَلٰی صِرَاطٍ مُّسۡتَقِیۡمٍ ﴿۴۳﴾
কাজেই আপনার প্রতি যা ওহী করা হয়েছে তা দৃঢ়ভাবে অবলম্বন করুন। নিশ্চয় আপনি সরল পথে রয়েছেন।
সূরা:৪৩: সূরা:- আয-যুখরুফ:৪৪
وَ اِنَّہٗ لَذِکۡرٌ لَّکَ وَ لِقَوۡمِکَ ۚ وَ سَوۡفَ تُسۡـَٔلُوۡنَ ﴿۴۴﴾
নিশ্চয় তা তোমার এবং তোমার সম্প্রদায়ের জন্য উপদেশ; আর অচিরেই তোমাদেরকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হবে।
সূরা:৪৩: সূরা:- আয-যুখরুফ:৪৫
وَ سۡـَٔلۡ مَنۡ اَرۡسَلۡنَا مِنۡ قَبۡلِکَ مِنۡ رُّسُلِنَاۤ اَجَعَلۡنَا مِنۡ دُوۡنِ الرَّحۡمٰنِ اٰلِـہَۃً یُّعۡبَدُوۡنَ ﴿٪۴۵﴾
তোমার পূর্বে আমি যত রসূল পাঠিয়েছিলাম তাঁদের সবাইকে জিজ্ঞেস করে দেখো, আমি উপাসনার জন্য রহমান খোদা ছাড়া আর কোন উপাস্য নির্দিষ্ট করেছিলাম কিনা?
ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
*শয়তানকে যখন মানুষের সহচর বানিয়ে দেয়া হয় : যখন স্পষ্ট করে জানিয়ে দেয়া হলাে যে, দুনিয়ার ধন-সম্পদ ও বিলাস সামগ্রী আল্লাহর কাছে মর্যাদাহীন এবং কোনাে অসৎ ও পাপী লােক এসবের মালিকানা লাভ করলে তা দ্বারা তার মর্যাদা ও কৃতিত্ব প্রমাণিত হয় না, তখন সাথে সাথে সেসব লােকদের পরিণতি কিভাবে ভালাে হতে পারে যারা আল্লাহর অবাধ্যাচরণ করা সত্তেও এবং জিকির থেকে গাফেল থাকা সত্তেও এসব ধন সম্পদের অধিকারী হয়, ভােগ বিলাসিতাপূর্ণ জীবনের অধিকারী হয়। এদের সম্পর্কে বলা হচ্ছে, ‘যে ব্যক্তি দয়াময় আল্লাহর স্মরণ থেকে চোখ ফিরিয়ে নেয়, আমি তার জন্যে এক শয়তান নিয়ােজিত করে দেন…(আয়াত ৩৬-৩৯) আরবী ভাষায় ‘আশা’ চোখের এক ধরনের রােগকে বলা হয়। যার ফলে মানুষ সূর্যের তীক্ষ্ণ আলাে সহ্য করতে পারে না। এর ফলে মানুষ রাতের অন্ধকারেও দেখতে পায় না। এদেরকে রাতকানা বলা হয়। এখানে এই শব্দ দ্বারা মানুষের বাহ্যিক দৃষ্টি ও অন্তরদৃষ্টি উভয়টির বৈকল্যের অবস্থা বুঝানাে হয়েছে। ফলে এ জাতীয় মানুষ আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফেল হয়, আল্লাহর অস্তিত্ব ও তার খবরদারীর বিষয়টি মনেপ্রাণে অনুভব করতে পারে না। তাই বলা হচ্ছে, ‘যে ব্যক্তি দয়াময় আল্লাহর স্মরণ থেকে চোখ ফিরিয়ে নেয়, আমি তার জন্যে এক শয়তান নিয়ােজিত করে দেই…..’ এটাই আল্লাহর বিধান। এই বিধানের দাবী হচ্ছে এই যে, মানুষ যখন আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফেল হয়ে পড়বে তখন শয়তানকে নিজের সহচর হিসেবে পাবে। সারাক্ষণ এই শয়তান তার সাথে থাকবে, তাকে কুমন্ত্রণা দেবে, মন্দকে তার সামনে সুন্দর করে উপস্থাপন করবে। আলােচ্য আয়াতে একটা সাধারণ নিয়ম হিসেবে এই সত্যটিকে প্রকাশ করা হয়েছে। অর্থাৎ যখনই আল্লাহর স্মরণের ক্ষেত্রে গাফলতি বা ঔদাসীন্য প্রকাশ পাবে তখনই অনিবার্য ফল স্বরূপ শয়তানের সাহচর্য্য ভাগ্যে জুটবে। এটা আল্লাহর ফয়সালা। অসৎ সংগী হিসেবে শয়তান যখন কারও সাথে ছায়ার মতাে লেগে থাকবে তখন তাকে আল্লাহর রাস্তা থেকে দূরে সরিয়ে নেবে। অথচ সে মনে করবে সে সঠিক পথেই আছে। বলা হচ্ছে, ‘শয়তানের মানুষকে সৎপথ থেকে ফিরিয়ে রাখে, আর মানুষ মনে করে, তারা সৎপথে রয়েছে'(আয়াত ৩৭) শয়তান তার সংগীর সাথে কি ঘৃণ্য আচরণ করছে। তাকে সঠিক পথ থেকে দূরে সরিয়ে আনছে আবার তাকে অজ্ঞতা ও ভ্রষ্টতার মাঝে ডুবিয়ে রাখছে যেন সে তার ভুল বুঝতে পেরে পুনরায় সঠিক পথে ফিরে না আসতে পারে। তার মনে এই ধারণা দিচ্ছে যে, সে সঠিক পথে এবং কাংখিত লক্ষ্যেই ছুটে চলছে। ফলে ভুলপথে চলতে চলতে এক সময় সে দুঃখজনক পরিণতির সম্মুখীন হবে অথচ সে বুঝতেও পারবে না। আলােচ্য আয়াতে ঘটমান বর্তমান ক্রিয়াপদ ব্যবহার করে বলা হয়েছে, ‘তাদেরকে সৎপথ থেকে দূরে সরিয়ে রাখে… তারা মনে করে…’ইত্যাদি। এর দ্বারা বুঝানাে হচ্ছে যে, শয়তানের এই ক্রিয়াকান্ড এখনও অব্যাহত চলছে যা অন্যরা দেখছে। কিন্তু যারা শয়তানের জালে আটকা পড়ে ভুলপথে চলছে কেবল তারা ব্যাপারটা বুঝতে পারছে না। কিন্তু যখন এই ভুলের পরিণতি হঠাৎ করেই সামনে আসবে তখন তাদের করার আর কিছুই থাকবে না। তাই বলা হচ্ছে, ‘অবশেষে যখন সে আমার কাছে আসবে, তখন সে শয়তানকে বলবে…'(আয়াত ৩৮) আর এভাবেই আমরা এক নিমিষে ইহজগতের দৃশ্য থেকে পরকালের দৃশ্যে চলে আসলাম। হই জগতের দৃশ্যের এখানেই সমাপ্তি ঘটছে। এখানে আমরা নতুন দৃশ্য দেখতে পাচ্ছি। এই দৃশ্যে সেই অন্ধ ও গাফেল ব্যক্তির শেষ পরিণতি দেখতে পাচ্ছি। এখানে এসে হঠাৎ করেই তার অন্ধত্ব ঘুচে যায়। এখন সে তার অসৎ সংগীকে দিব্যি দেখতে পাচ্ছে, যে তাকে ভুল পথে চালিয়ে বলেছিলাে যে, সে ঠিক পথেই চালাচ্ছে, যে তার মন্দ কাজকে সুন্দর ও মােহনীয় রূপে দেখিয়েছিলাে আর এভাবেই সে তাকে ধ্বংসের সামনে এনে দাড় করিয়ে দিয়েছে। অথচ সারাপথ সে তাকে শান্তির বাণী শুনিয়েছে। সে অত্যন্ত রাগের চোখে তাকিয়ে সেই অসৎ সংগীকে লক্ষ্য করে বলবে, ‘হায়! আমার ও তােমার মধ্যে যদি পূর্ব পশ্চিমের দূরত্ব থাকতাে।’ অর্থাৎ আমাদের মাঝে যদি কোনো সাক্ষাতই না ঘটতাে। এরপর সে তার সংগীকে ‘কত হীন সংগী’ বলে মন্তব্য করে। তার এই মন্তব্য পবিত্র কোরআন আমাদেরকে জানিয়ে দিচ্ছে। এই দৃশ্যের যবনিকা পতনের মুহূর্তে নেপথ্য থেকে উভয়ের জন্যে যে হতাশাব্যঞ্জক মন্তব্য শুনতে পাচ্ছি তাহলে, ‘তোমরা যখন জুলুম করছিলে, তখন আজকের তােমাদের সবাইকেই আযাবে শরীক হতে হবে, আজ কিছুই কোনাে কাজে আসবে না।'(আয়াত ৩৯) অর্থাৎ উভয়ের জন্যে আযাব পরিপূর্ণরূপে হবে। কেউ কারও শান্তি ভাগা-ভাগি করে নিয়ে। অপরের শাস্তি লাঘব করতে পারবে না।
*দ্বীনের দায়ীদের দায়িত্বে সীমাবদ্ধতা ও জবাবদিহীতা : এই হতাশাব্যঞ্জক পরিস্থিতির দৃশ্যপট থেকে সরে গিয়ে এখন প্রসংগ চলে যাচ্ছে রাসূলুল্লাহ(স.) -এর দিকে। এখানে আল্লাহ তায়ালা তার প্রিয় রসূলকে সান্তনাবাণী শুনাচ্ছেন। ওহীর মাধ্যমে তাকে যে নির্দেশনা দেয়া হচ্ছ তার ওপর অনড় ও অটল থাকতে আদেশ করছেন। কারণ এই নির্দেশনা সত্য ও চিরন্তন, এই নির্দেশনা প্রত্যেক নবীকেই দেয়া হয়েছে। এ প্রসংগে বলা হচ্ছে, ‘তুমি কি বধিরকে শুনাতে পারবে? অথবা যে অন্ধ ও যে স্পষ্ট পথভ্রষ্টতায় লিপ্ত, তাকে কি পথ প্রদর্শন করতে পারবে?…’(আয়াত ৪০-৪৫) এই ধরনের সান্ত্বনাবাণী পবিত্র কোরআনে বারবার উচ্চারিত হয়েছে। এর মাধ্যমে একদিকে রসূলুল্লাহ(স.)-কে সান্ত্বনা দেয়া হয়েছে, অপরদিকে তাকে জানানাে হয়েছে যে, হেদায়াত ও গােমরাহী সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর ইচ্ছা ও মর্জির সাথে সম্পর্কিত, এ ব্যাপারে নবী-রসূলদের করণীয় কিছুই নেই। তাকে আরও জানানাে হয়েছে যে, নবুওয়তের উচ্চতর মর্যাদা লাভের পরও নবী-রসূলরা সীমিত মানবীয় ক্ষমতার অধিকারী। অপরদিকে আল্লাহ তায়ালা হচ্ছেন অবাধ ও অসীম ক্ষমতার অধিকারী। এই সাম্ত্নাবাণীর পাশাপাশি আলােচ্য আয়াতে তাওহিদের সূক্ষ্ম অর্থটিও তুলে ধরা হয়েছে। যেমন তুমি কি বধিরকে শুনাতে পারবে? অথবা যে অন্ধ ও যে স্পষ্ট পথভ্রষ্টতায় লিপ্ত, তাকে কি পথপ্রদর্শন করতে পারবে? বলা বাহুল্য, আয়াতে বর্ণিত ব্যক্তিরা সত্যিকার অর্থে অন্ধ ও বধির নয়। কিন্তু তারা অন্ধ ও বধিরদের মতই। কারণ তারা সত্য পথ দেখতে পায় না এবং সত্য বাণী শুনতে পায় না। আর রসূলের দায়িত্ব হচ্ছে, যে শুনতে পায়, তাকে শুনানাে এবং যে দেখতে পায়, তাকে পথ দেখানাে। এখন যদি কারও অংগ-প্রত্যংগ বিকল হয়ে পড়ে এবং তার হাঁদয় ও আত্মার সকল দ্বার রুদ্ধ হয়ে যায় তাহলে এদেরকে সঠিক পথের সন্ধান দেয়ার সামর্থ্য রসূলের থাকবে না। কাজেই তারা পথভ্রষ্ট হলে রসূলের করারও কিছু থাকবে না। কারণ তিনি নিজ দায়িত্ব সাধ্যমত পালন করেছেন। রসূল তার ওপর অর্পিত নির্ধারিত দায়িত্ব যথার্থরূপে পালন করেছেন। এখন তার দায় দায়িত্ব আল্লাহর হাতে। তাই বলা হচ্ছে, ‘অতঃপর আমি যদি তোমাকে নিয়ে যাই, তবু আমি তাদের কাছ থেকে প্রতিশােধ নেবাে…’(আয়াত ৪১-৪২) অর্থাৎ দুই অবস্থার যে কোনাে একটি হতে পারে। হয় নবীর মৃত্যুর পর তাঁর অস্বীকারকারীদের কাছ থেকে তিনি নিজেই প্রতিশােধ নেবেন, অথবা তার জীবদ্দশায়ই তিনি তাদের জন্যে যে শাস্তির ফয়সালা করে রেখেছেন তা বাস্তবায়িত করে দেখাবেন। এই উভয়টিই তিনি করতে সক্ষম। তারা তার বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারবে না। গােটা বিষয়টাই আল্লাহর ইচ্ছা ও শক্তির ওপর নির্ভর করে। কারণ দাওয়াত ও তবলীগের নির্দেশদাতা স্বয়ং তিনি। আর রসূলের দায়িত্ব হচ্ছে এই নির্দেশের বাস্তবায়ন। তাই রসূলকে উপদেশ দিয়ে বলা হচ্ছে, ‘অতএব তােমার প্রতি যে ওহী নাযিল করা হয়েছে, তা দৃঢ়ভাবে অবলম্বন করাে। নিসন্দেহে তুমি সরলপথে রয়েছে।’(আয়াত ৪৩) অর্থাৎ তুমি যে পথে আছো, তার ওপর স্থির থাকে। সেই পথেই চলতে থাকো। তােমার সাথে কে চললাে আর না চললাে, সেদিকে খেয়াল করার দরকার নেই। শান্তচিত্তে তােমার পথে তুমি চলতে থাকো। কারণ তুমি সঠিক পথেই চলছো। এই পথ সােজা ও সরল। এই পথে চললে তুমি দিকহারা হবে না, লক্ষ্যবস্তু থেকে বিচ্যুত হবে না। এই বিশ্বাস ও আদর্শের সম্পর্ক হচ্ছে মহাসত্যের সাথে এবং এই আকিদা বিশ্বাস সেই শাশ্বত নিয়মের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ যার ওপর ভিত্তি করে এই জগত টিকে আছে। সেই শাশ্বত নিয়ম যেমন সরল, তেমনি সরল এই আকিদা বিশ্বাসও, তাই উভয়ের মাঝে বিভেদ নেই, বিচ্ছেদ নেই। আর তাই এই আকিদা বিশ্বাসের ধারককে এই সৃষ্টিজগতের স্রষ্টার পথে পরিচালিত করে। আর এই চলার পথে সে স্থিরতা ও অবিচলতা লাভ করে। এই বাস্তব সত্যটি প্রকাশ করে আল্লাহ তায়ালা একদিকে তাঁর রসূলের মনে সাহস জোগাচ্ছেন, অপরদিকে সেই সকল বান্দাদের মনেও সাহস জোগাচ্ছেন যারা রাসূলের পরে দাওয়াত ও তাবলীগ এর দায়িত্ব আঞ্জাম দেবে। ফলে চলার পথে তারা বিপথগামীদের কোনাে চক্রান্তেই বিভ্রান্ত হবে না। এরপর বলা হচ্ছে, ‘এটা তােমার ও তােমার জাতির জন্যে স্বরণিকা এবং শীঘ্রই তােমরা জিজ্ঞাসিত হবে।'(আয়াত ৪৪) এই আয়াতের দুটো ব্যাখ্যা হতে পারে। একটি ব্যাখ্যা হচ্ছে, এই কোরআন তােমার জন্যে ও তােমার জাতির জন্যে উপদেশস্বরূপ। পরকালে তােমাদেরকে সেই ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। তখন কোনাে ওযর আপত্তি চলবে না। দ্বিতীয় ব্যাখ্যা হচ্ছে, এই কোরআন তােমার ও তােমার জাতিকে চিরস্মরণীয় করে রাখবে। দেখা গেছে বাস্তবে তাই ঘটেছে। আর সে কারণেই লক্ষ লক্ষ কণ্ঠে রসূলুল্লাহ(স.)-এর দরূদ সালাম ধ্বনিত হয় । প্রায় দেড় হাজার বছরের ও বেশী ধরে তার অসংখ্য ভক্ত ও অনুরক্তরা তাঁর পবিত্র নাম স্মরণ করে চলেছে। কেয়ামত পর্যন্ত তারা তাদের প্রিয় নবীর নাম স্মরণ করতে থাকবে। আর তাঁর জাতি ইসলামের পুর্বে একটা অজ্ঞাত ও অখ্যাত জাতি ছিলাে। আর যখন থেকে তারা এই কোরআনকে আঁকড়ে ধরেছিলাে তখন থেকে তারা মানব ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ভূমিকা পালন করতে থাকে। এই কোরআনের বদৌলতে গােটা বিশ্বে তাদের নাম ছড়িয়ে পড়ে এবং যতােদিন তারা ততােদিন পর্যন্ত গােটা পৃথিবী তাদের বাধ্য ছিলাে, তাদের করায়ত্ত ছিলাে। আর যখন থেকে তারা এই কোরআনকে পরিত্যাগ করেছে, তখন থেকে পৃথিবীও তাদেরকে ভুলে গিয়েছে ও হীন মনে করছে। তাদেরকে নেতৃত্বের সারি থেকে টেনে এনে পেছনের সারিতে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। এটা একটা বিরাট দায়িত্ব। এই দায়িত্ব সম্পর্কে উম্মতকে কৈফিয়ত দিতে হবে। কারণ, এই দ্বীনের জন্যে আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে মনােনীত করেছিলেন, উভ্রান্ত ও দিশাহারা মানবতার কাফেলাকে পথ দেখানাের দায়িত্ব তাদের ওপর অর্পণ করেছিলেন। অথচ তারা এই দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়িয়েছে। কাজেই তাদেরকে সেই ব্যাপারে কৈফিয়ত দিতে হবে। এই শেষােক্ত ব্যাখ্যাটি অধিকতর ব্যাপক ও অর্থবহ। তাই আমার আলােচনার প্রাধান্য এদিকে বেশী।
*যুগ যুগান্তরের সকল মুমিন এক কাফেলার সদস্য : পরের আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তােমার পূর্বে আমি যে রসূল প্রেরণ করেছি, তাদেরকে জিজ্ঞেস করো…’(আয়াত ৪৫) তাওহীদই হচ্ছে আল্লাহর দ্বীনের একমাত্র ভিত্তি। যুগে যুগে আল্লাহর নবীরা এই তাওহীদের দিকেই মানুষকে আহ্বান করেছেন। তাহলে যারা আল্লাহ তায়ালা ব্যতীত অন্যান্য মনগড়া উপাস্যদের পূজা অর্চনা করে, তারা কিসের ভিত্তিতে এটা করে? এই প্রশ্নটা উত্থাপন করার জন্যে আল্লাহ তায়ালা তার রসূলকে নির্দেশ দিয়ে বলছেন, ‘তোমাদের পূর্বে যাদেরকে রাসূল হিসেবে পাঠিয়েছি, তাদেরকে জিজ্ঞেস করাে, দয়াময় ব্যতীত আমি অন্য কোনাে উপাস্যকে উপাসনা করার জন্যে সৃষ্টি করেছি কিনা? এই প্রশ্নের যে অকাট্য উত্তর প্রত্যেক নবী ও রসূলের কাছ থেকে আসবে তা এখানে উহ্য রাখা হয়েছে। এটাও কোরআনের এক অভিনব বর্ণনা ভংগী। মনের মাঝে এর প্রভাব অত্যন্ত গভীর হয়। লক্ষণীয় যে, রসূলুল্লাহ(স.)-এর মাঝে এবং তার পূর্ববর্তী নবী রসূলদের মাঝে স্থান ও কালের বিরাট ব্যবধান রয়েছে। এর চেয়ে বড় ব্যবধান রয়েছে জীবন ও মৃত্যুর। কিন্তু এসব ব্যবধান এই শাশ্বত ও চিরন্তন সত্যটির সামনে এসে ঘুচে যায়। সে সত্যটি হচ্ছে রেসালতের অভিন্নতা সম্পর্কিত সত্য, যার ভিত্তি হচ্ছে, তাওহীদ বা একত্ববাদ। এই সত্যের যখন বহিপ্রকাশ ঘটে, এই সত্য যখন উদ্ভাসিত হয়, তখন স্থান কাল ও জীবন মৃত্যুর ব্যবধানসহ সকল প্রাকৃতিক ব্যবধান এখানে দূর হয়ে যায়। এই সত্যের মাঝে এসেই মিশে যায় অতীতের সকল জীবিত ও মৃত মানব সন্তান, যেন তাদের মাঝে রয়েছে কতাে দীর্ঘদিনের পরিচয় ও সহযােগিতা। এটাই হচ্ছে পবিত্র কোরআনের সূক্ষ্ম ও বিস্ময়কর বর্ণনা ভঙ্গি। তবে শেষ নবী হযরত মােহাম্মদ(স.) ও তাঁর অন্যান্য নবী-রসূল ভাইদের মাঝে ও তাঁদের পালনকর্তার মাঝে যেন কোনাে অন্তরায়ই থাকে না। কাছেও নয় এবং দূরেরও নয়। তাদের মাঝে সবসময়ই এমন অপার্থিব মুহূর্ত বিরাজ করে যখন সকল বাধা অপসারিত হয়ে যায়, সকল অন্তরায় দূরীভূত হয় এবং পর্দার আড়াল থেকে আদি ও শাস্বত সত্যটি উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। তখন জীবন, জগত ও সুৃষ্টি একাকার হয়ে যায়, এক ও অভিন্ন সত্ত্বারূপে প্রকাশ পায়। সেখানে কালের কোনাে ব্যবধান থাকে না, স্থানের ব্যবধান থাকে না এবং থাকে না আকৃতি ও অবয়বের ব্যবধান। এই অপার্থিব মুহূর্তেই রসুলুল্লাহ(স.) এ প্রশ্ন করেন এবং তাঁকে উত্তর দেয়া হয়। মেরাজের রাতে প্রশ্নকর্তা ও উত্তরদাতার মাঝে কোনাে বাধা থাকে না, কোনাে পর্দা থাকে না। এসব ক্ষেত্রে আমরা সাধারণত, আমাদের দৈনন্দিন জীবনে যা প্রত্যক্ষ করি, যা অনুভব করি, তার বাইরে আমাদের কিছু চিন্তা করা সম্ভব হয় না। সচরাচর ঘটছে বা দৃষ্টিগােচর হচ্ছে, তাই একমাত্র সত্য নয়। আসলে আমরা এই সৃষ্টিজগত সম্পর্কে কেবল ততােটুকুই জানতে পারি ও অনুভব করতে পারি যতােটুকু দৃশ্যমান অথবা যতােটুকু প্রভাব আকারে বিরাজমান। আর এতােটুকুও কেবল তখন জানতে পারি যখন এই সৃষ্টিজগতের মাঝে ক্রিয়াশীল নিয়মের কোনাে অংশের সাথে পরিচিত হতে পারি। এ ছাড়া স্বয়ং আমাদের অস্তিত্বের মাঝে, আমাদের পঞ্চইন্দ্রিয়ের মাঝে এবং এই পঞ্চইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে আমরা যা অনুভব করি তার মাঝেও আড়াল রয়েছে। যে মুহুর্তে আত্মা এ সকল বাধা ও অন্তরায় থেকে মুক্ত হতে পারে কেবল তখনই বিমূর্ত মানব সত্ত্বার সাথে অন্য যে কোনাে বিমূর্ত সত্ত্বার মিলন ঘটতে পারে এবং এটা মূর্ত সত্ত্বার সাথে কোনাে মূর্ত সত্ত্বার মিলনের চেয়েও সহজ।
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
# ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ। রহমানের ‘যিকর’ অর্থ তাঁর পক্ষ থেকে আসা উপদেশ বাণী এবং কুরআনও।
# তোমাদেরকে ভ্রান্ত পথে পরিচালনাকারীরা শাস্তি পাচ্ছে এতে তোমাদের সান্তনা লাভের কিছুই নেই। কারণ, গোমরাহীর পথে চলার অপরাধে তোমরাও একই শাস্তি লাভ করতে যাচ্ছো।
# যারা শোনার জন্য প্রস্তুত এবং যারা প্রকৃত সত্যের দিক থেকে চোখ বন্ধ করে নেয়নি তাদের প্রতি মনযোগ দাও এবং অন্ধদের দেখানো ও বধিরদের শুনানোর প্রয়াসে প্রাণপাত করো না। কিংবা তোমার এসব ভাই বেরাদর কেন সঠিক পথে আসে না এবং কেনই বা তারা নিজেদেরকে আল্লাহর আযাবের উপযুক্ত বানাচ্ছে সেই দুঃখে নিজেই নিজেকে নিঃশেষ করো না।
# যে পরিস্থিতিতে একথা বলা হয়েছে তা সামনে রাখলেই এ কথার তাৎপর্য ভালভাবে উপলব্ধি করা যেতে পারে। মক্কার কাফেররা মনে করছিলো, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ব্যক্তি সত্তাই তাদের জন্য বিপদ হয়ে আছে। মাঝ পথ থেকে এই কাঁটা সরিয়ে দিতে পারলেই তাদের সব কিছু সুন্দর ও ঠিকঠাক হয়ে যাবে। এই ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়ে কোন না কোনভাবে তাঁকে হত্যা করার জন্য তারা রাত দিন বসে বসে পরামর্শ করতো। এতে আল্লাহ তাদের দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে তাঁর নবীকে উদ্দেশ্য করে বলছেনঃ তোমার বর্তমান থাকা না থাকা কিছুই আসে যায় না। তুমি বেঁচে থাকলে তোমার চোখের সামনেই তাদের দুর্ভাগ্য নেমে আসবে। আর যদি তোমাকে উঠিয়ে নেয়া হয় তাহলে তোমার বিদায়ের পরে তাদের দফারফা হবে। অশুভ কর্মফল এখন তাদের ভাগ্যের লিখন হয়ে গিয়েছে। এর হাত থেকে তাদের পক্ষে রক্ষা পাওয়া আর সম্ভব নয়।
# জুলুম ও বে-ঈমানীর সাহায্যে ন্যায় ও সত্যের বিরোধিতাকারীরা তাদের এই কৃতকর্মের শাস্তি কখন এবং কি পায় তুমি সে চিন্তা করবে না। অথবা তোমার জীবদ্দশায় ইসলাম প্রসার লাভ করে কিংবা করে না, সে চিন্তাও তুমি করবে না। তোমার জন্য সান্তনা হিসেবে এতটুকুই যথেষ্ট যে, তুমি ন্যায় ও সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত আছ। অতএব, ফলাফলের চিন্তা না করে নিজের দায়িত্ব পালন করতে থাকো। আর আল্লাহ তোমার সামনেই বাতিলের মাথা অবনত করান না তোমার বিদায়ের পরে করান সেটা আল্লাহর ওপর ছেড়ে দাও।
# সমগ্র মানবজাতির মধ্যে কোন ব্যক্তির জন্য এর চেয়ে সৌভাগ্য আর কিছুই হতে পারে না যে, আল্লাহ তাকেই তাঁর কিতাব নাযিলের জন্য বাছাই করছেন এবং কোন জাতির জন্যও এর চেয়ে বড় কোন সৌভাগ্য কল্পনা করা যেতে পারে না যে, দুনিয়ার অন্য সব জাতিকে বাদ দিয়ে আল্লাহ তাদের মধ্যেই তাঁর নবীকে সৃষ্টি করছেন, তাদের ভাষায় তাঁর কিতাব নাযিল করছেন এবং তাদেরকেই গোটা বিশ্বব্যাপী আল্লাহর বানীবাহক হওয়ার মহা সুযোগ দান করছেন যদি কুরাইশ ও আরববাসীদের এই বিরাট মর্যাদার উপলব্ধি না থেকে থাকে এবং যদি তারা তার অমর্যাদা করতে চায় তাহলে এমন একটি সময় অবশ্যই আসবে যখন এজন্য তাদেরকে জবাবদিহি করতে হবে।
# রসূলদের জিজ্ঞেস করার অর্থ তাদের আনীত কিতাবসমূহ থেকে জেনে নেয়া। যেমনفَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِআয়াতাংশের অর্থ “যদি কোন ব্যাপারে তোমাদের মধ্যে বিবাদ সৃষ্টি হয় তাহলে তা আল্লাহ ও রসূলের কাছে নিয়ে যাও নয়, বরং তার অর্থ হচ্ছে, সে ব্যাপারে আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রসূলের সুন্নাতের স্মরণাপন্ন হও। অনুরূপ রসূলদেরকে জিজ্ঞেস করার অর্থ, যে রসূলগণ দুনিয়া থেকে চলে গিয়েছেন তাদের সবার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করো নয়, বরং এর সঠিক তাৎপর্য হলো আল্লাহর রসূলগণ পৃথিবীতে যেসব শিক্ষা রেখে গিয়েছেন তার মধ্যে অনুসন্ধান করে দেখো, মহান আল্লাহ ছাড়া আরো কেউ উপাসনা লাভের যোগ্য তা কেউ শিখিয়েছিলেন কিনা।
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
৩৬-৪৫ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
এ আয়াতগুলোর প্রথমাংশে আল্লাহ তা‘আলা সে সকল দুর্ভাগা লোকদের বিবরণ তুলে ধরছেন যারা আল্লাহ তা‘আলার যিকির তথা ইবাদত থেকে গাফেল থাকে, আল্লাহ তা‘আলা তার জন্য শয়তান নিযুক্ত করে দেন, ফলে শয়তান তাদেরকে এমনভাবে করায়ত্ত করে নেয় যে, মৃত্যু অবধি ইবাদত বিমুখ করে রাখে। অবশেষে যখন কিয়ামতের মাঠে নিজেকে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে দেখতে পাবে তখন আফসোস করবে কিন্তু সে আফসোস কোন কাজে আসবে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(وَمَنْ يُّشَاقِقِ الرَّسُوْلَ مِنْ م بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُ الْهُدٰي وَيَتَّبِعْ غَيْرَ سَبِيْلِ الْمُؤْمِنِيْنَ نُوَلِّه۪ مَا تَوَلّٰي وَنُصْلِه۪ جَهَنَّمَ ط وَسَا۬ءَتْ مَصِيْرًا )
“কারো নিকট সৎ পথ প্রকাশ হওয়ার পর সে যদি রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে এবং মু’মিনদের পথ ব্যতীত অন্য পথ অনুসরণ করে, তবে যেদিকে সে ফিরে যায় সেদিকেই তাকে ফিরিয়ে দেব এবং জাহান্নামে তাকে দগ্ধ করব, আর তা কতই না মন্দ আবাস!” (সূরা নিসা ৪ : ১১৫)
এরপর আল্লাহ তা‘আলা বলছেন : যাদের কান থাকা সত্ত্বেও সত্য শ্রবণে বধির, চোখ থাকা সত্ত্বেও সত্য দর্শনে অন্ধ তাদেরকে যতই আহ্বান করা হোক না কেন তারা যেন মৃত মানুষের মতই। মৃত মানুষ যেমন সকল কিছু থেকে বিমুখ অনুরূপ তারাও সত্য গ্রহণ করা হতে বিমুখ। তাদেরকে যতই আহ্বান করা হোক না কেন আর যতই সু-পথ দেখানো হোক না কেন তারা সঠিক পথে আসবে না। এ সম্পর্কে সূরা আন্ নাম্ল-এর ৮০ নম্বর আয়াতসহ অন্যত্র আলোচনা করা হয়েছে।
এরপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন যে, হে নাবী! যদি আমি ঐ সকল কাফিরদেরকে তোমার জীবদ্দশায় শাস্তি প্রদান করি তাহলে আমি তাদের ওপর ক্ষমতাবান আর যদি তোমার মৃত্যুর পর তাদেরকে শাস্তি দেই তাহলেও আমি তাদের ওপর এ ব্যাপারে ক্ষমতাবান। অর্থাৎ- তারা শাস্তি ভোগ করবেই, এ শাস্তি থেকে তারা রেহাই পাবে না।
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন :
النُّجُومُ أَمَنَةٌ لِلسَّمَاءِ، فَإِذَا ذَهَبَتِ النُّجُومُ أَتَي السَّمَاءَ مَا تُوعَدُ، وَأَنَا أَمَنَةٌ لِأَصْحَابِي، فَإِذَا ذَهَبْتُ أَتَي أَصْحَابِي مَا يُوعَدُونَ، وَأَصْحَابِي أَمَنَةٌ لِأُمَّتِي، فَإِذَا ذَهَبَ أَصْحَابِي أَتَي أُمَّتِي مَا يُوعَدُونَ
তারকা আকাশের নিরাপত্তা স্বরূপ। যখন তারকা চলে যাবে তখন আকাশ থেকে যে বালা মসিবত আসার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে তা আসবে, আমি আমার সাহাবীদের জন্য নিরাপত্তাস্বরূপ, আমি চলে গেলে আমার সাহাবীদের যে ওয়াদা দেয়া হয়েছে তা আসবে। আমার সাহাবীগণ উম্মাতের নিরাপত্তা স্বরূপ যখন আমার সাহাবীরা চলে যাবে তখন আমার উম্মতকে যে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে তা আসবে। ( সহীহ মুসলিম হা. ৬৬২৯)
(نَذْهَبَنَّ بِكَ) ‘তোমাকে নিয়ে যাব’ কেউ বলেছেন মক্কা থেকে মদীনায় নিয়ে আসবেন, কেউ বলেছেন মৃত্যু বরণ করাবেন। অর্থাৎ হে নাবী! তুমি মক্কা থেকে বের হয়ে গেলেও বা মৃত্যু বরণ করলেও তাদের থেকে প্রতিশোধ নেবই। ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন : আল্লাহ তা‘আলা এ প্রতিশ্রুতি বদরের দিন দেখিয়েছেন। ইবনু মাসঊদ (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন : যখন আল্লাহ তা‘আলা কোন জাতির কল্যাণ চান তখন তাদের প্রতি প্রেরিত নাবীকে তাড়াতাড়ি নিয়ে নেন, আর যখন কোন জাতিকে শাস্তি দিতে চান তখন নাবীর জীবদ্দশায় শাস্তি দেন যাতে তা দেখে নাবীর চোখ শীতল হয় তারা যে তাঁকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে এবং অবাধ্য হয়েছে। (সিলসিলা সহীহাহ হা. ৩০৫৯)
সুতরাং তুমি এ বিষয়ে বিচলিত না হয়ে বরং তোমার প্রতি অবতীর্ণ কুরআন দৃঢ়ভাবে ধারণ করো। নিশ্চয়ই তুমি সিরাতুল মুসতাকীমের ওপরে রয়েছ। কুরআনের অনেক জায়গায় আল্লাহ তা‘আলা নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে তাঁর ওপর অবতীর্ণ ওয়াহীর অনুসরণ করতে বলেছেন।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(وَّاتَّبِعْ مَا يُوْحٰٓي إِلَيْكَ مِنْ رَّبِّكَ ط إِنَّ اللّٰهَ كَانَ بِمَا تَعْمَلُوْنَ خَبِيْرًا)
“আর তুমি অনুসরণ কর যা তোমার প্রতিপালকের পক্ষ হতে তোমার প্রতি ওয়াহী করা হয়েছে। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমরা যা কর সে সম্পর্কে সম্যক অবহিত আছেন।” (সূরা আহযাব ৩৩ : ২)
অর্থাৎ কুরআন তোমার ও তোমার জাতি কুরাইশদের জন্য একটি মর্যাদার বস্তু। কুরআন কুরাইশদের ভাষায় নাযিল হয়েছে এবং তোমাদের মধ্য হতে একজন ব্যক্তির ওপর নাযিল হয়েছে। ইমাম কুরতুবী (রহঃ) বলেন : সঠিক কথা হল কুরআন তাদের জন্য মর্যাদার বস্তু যারা তার ওপর আমল করবে সে কুরাইশ হোক আর অন্য কোন গোত্রের হোক। কুরআন দ্বারা উপকৃত হলেই সে মর্যাদা বহাল থাকবে অন্যথায় তার জন্য জিজ্ঞাসিত হতে হবে।
অতএব এ বিষয়ে আমাদের সচেষ্ট থাকতে হবে যেন কখনো আমরা আল্লাহ তা‘আলার যিকির হতে বিমুখ না হই।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. যারা সৎ পথ বিচ্যুত তাদের সঙ্গী হলো শয়তান।
২. যারা কাফির তারা অবশ্যই শাস্তিপ্রাপ্ত হবে।
৩. আখিরাতে মানুষকে তার আমল সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
৩৬-৪৫ নং আয়াতের তাফসীর:
ইরশাদ হচ্ছেঃ যে দয়াময় আল্লাহর স্মরণে বিমুখ হয় ও অবহেলা প্রদর্শন করে তার উপর শয়তান প্রভাব বিস্তার করে এবং তার সাথী হয়ে যায়।
চোখের দৃষ্টিশক্তি কমে যাওয়াকে আরবী ভাষায় (আরবী) বলা হয়ে থাকে। এই বিষয়টিই কুরআন কারীমের আরো বহু আয়াতে রয়েছে। যেমন মহান আল্লাহ বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “হিদায়াত প্রকাশিত হবার পরেও যে ব্যক্তি রাসূল (সঃ)-এর বিরুদ্ধাচরণ করে এবং মুমিনদের পথ ছাড়া অন্য পথের অনুসরণ করে, আমি তাকে সেখানেই ছেড়ে দিবো এবং জাহান্নামে প্রবিষ্ট করবো যা অত্যন্ত নিকৃষ্ট স্থান।”(৪:১১৫) অন্য আয়াতে রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “অতঃপর তারা যখন বক্রপথ অবলম্বন করলো তখন আল্লাহ তাদের হৃদয়কে বক্র করে দিলেন।”(৬১:৫) অন্য একটি আয়াতে আছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “আমি তাদের জন্যে এমন সাথী নিয়োজিত করি যারা তাদের সামনের ও পিছনের জিনিসগুলোকে তাদের দৃষ্টিতে শোভনীয় করে।”(৪১:২৫)
এখানে মহান আল্লাহ বলেন যে, এরূপ গাফেল লোকের উপর শয়তান ক্ষমতা লাভ করে এবং তাকে সৎপথ হতে বিরত রাখে। আর সে তার অন্তরে এ ধারণা সৃষ্টি করে যে, তার নীতি খুব ভাল এবং সে সম্পূর্ণ সঠিক পথের উপর প্রতিষ্ঠিত রয়েছে।
কিয়ামতের দিন যখন সে আল্লাহর সামনে হাযির হবে এবং প্রকৃত তথ্য খুলে যাবে তখন সে তার ঐ সাথী শয়তানকে বলবেঃ ‘হায়! আজ যদি আমার ও তোমার মধ্যে পূর্ব ও পশ্চিমের ব্যবধান থাকতো।
এখানে (আরবী) দ্বারা পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যবর্তী জায়গাকে বুঝানো হয়েছে। এখানে প্রভাব হিসেবে (আরবী) শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন সূর্য ও চন্দ্রকে (আরবী) বলা হয় এবং পিতা-মাতাকে (আরবী) বলা হয়ে থাকে।
এক কিরআতে (আরবী) রয়েছে। অর্থাৎ যখন শয়তান ও এই গাফেল ব্যক্তি আমার (আল্লাহর) নিকট আসবে।
হযরত সাঈদ জারীরী (রঃ) বলেন যে, কাফির তার কবর হতে উঠা মাত্রই শয়তান এসে তার হাতের সাথে হাত মিলিয়ে নিবে। অতঃপর তার থেকে পৃথক হবে না। যে পর্যন্ত না দু’জনকেই এক সাথে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।
এরপর মহান আল্লাহ বলেনঃ আজ তোমাদের এই অনুতাপ তোমাদের কোন কাজে আসবে না, যেহেতু তোমরা সীমালংঘন করেছিলে, তোমরা তো সবাই শাস্তিতে শরীক।
অতঃপর আল্লাহ তাআলা স্বীয় নবী (সঃ)-কে বলেনঃ তুমি কি বধিরকে শুনাতে পারবে? অথবা যে অন্ধ ও যে ব্যক্তি স্পষ্ট বিভ্রান্তিতে আছে, তাকে তুমি কি পারবে সৎপথে পরিচালিত করতে? অর্থাৎ হে নবী (সঃ)! আমার পক্ষ হতে তোমার উপর এ দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়া হয়নি যে, তাদের সবাইকে মুসলমান করতেই হবে। হিদায়াত তোমার অধিকারভুক্ত জিনিস নয়। যে ব্যক্তি সত্য কথার দিকে কানই দেয় না এবং সরল-সোজা পথের দিকে চোখ তুলে তাকিয়েও দেখে না, যে বিভ্রান্ত হয় এবং তাতেই সন্তুষ্ট থাকে, তুমি তাদের সম্পর্কে এতো চিন্তা করছো কেন? তোমার কর্তব্য হলো শুধু তাবলীগ করা অর্থাৎ আমার বাণী তাদের কাছে পৌঁছিয়ে দেয়া। পথ দেখানো ও পথভ্রষ্ট করা আমার কাজ। আমি ন্যায়বিচারক ও বিজ্ঞানময়। আমি যা চাইবো তাই করবো। তুমি মন সংকীর্ণ করো না।
এরপর মহামহিমান্বিত আল্লাহ স্বীয় নবী (সঃ)-কে বলেনঃ হে নবী (সঃ)! আমি যদি তোমার মৃত্যু ঘটাই, তবুও আমি তাদেরকে শাস্তি দিবই। অথবা আমি তাদেরকে যে শাস্তির ভীতি প্রদর্শন করেছি যদি আমি তোমাকে তা প্রত্যক্ষ করাই, তবে তাদের উপর আমার তো পূর্ণ ক্ষমতা রয়েছে। অর্থাৎ তাদেরকে শাস্তি দিতে অপারগ নই। মোটকথা, এই ভাবে এবং ঐ ভাবে দুই ভাবেই আল্লাহ কাফিরদের উপর শাস্তি অবতীর্ণ করতে সক্ষম, কিন্তু ঐ অবস্থাকে পছন্দ করা হয়েছে যাতে নবী (সঃ)-এর মর্যাদা বেশী প্রকাশ পায়। অর্থাৎ নবী (সঃ)-কে দুনিয়া হতে উঠিয়ে নেয়া হয়নি যে পর্যন্ত না তার শত্রুদের উপর তাকে বিজয় দান করা হয় এবং তাদের জান ও মালের তিনি অধিকারী হন। এইরূপ তাফসীর করেছেন হযরত সুদ্দী (রঃ) প্রমুখ গুরুজন। কিন্তু হযরত কাতাদা (রঃ) বলেন যে, নবী (সঃ)-কে দুনিয়া হতে উঠিয়ে নেয়া হয়, কিন্তু প্রতিশোধ গ্রহণের কাজ বাকী থেকে যায়। আল্লাহ তাআলা তাঁর রাসূল (সঃ)-এর জীবদ্দশায় তাঁর উম্মতের মধ্যে এমন ব্যাপার ঘটাননি যা তিনি অপছন্দ করতেন। তিনি ছাড়া অন্যান্য সমস্ত নবী (আঃ)-এর চোখের সামনে তাদের উম্মতদের উপর আল্লাহর আযাব এসেছিল।
হযরত কাতাদা (রঃ) বলেনঃ “আমাদের কাছে এটাও বর্ণনা করা হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর ইন্তেকালের পর তাঁর উম্মতের উপর কি কি শাস্তি আপতিত হবে তা যখন তাঁকে জানানো হয়, তখন ঐ সময় থেকে নিয়ে মৃত্যু পর্যন্ত তাঁকে কখনো খিল খিল করে হাসতে দেখা যায়নি।” হযরত হাসান (রঃ) হতেও ঐ ধরনের একটি রিওয়াইয়াত বর্ণিত আছে।
একটি হাদীসে আছে যে, নবী (সঃ) বলেছেনঃ নক্ষত্ররাজি হলো আকাশের রক্ষার কারণ, যখনই নক্ষত্রগুলো ছিটকে পড়বে তখনই আকাশের উপর বিপদ নেমে আসবে। আমি আমার সাহাবীদের (রাঃ) জন্যে নিরাপত্তার মাধ্যম। আমি যখন চলে যাবো (ইন্তেকাল করবো) তখন তাদের উপর ঐ সব বিপদ-আপদ আসবে যেগুলোর ওয়াদা দেয়া হচ্ছে।”
এরপর ইরশাদ হচ্ছেঃ হে নবী (সঃ)! তোমার প্রতি যে অহী করা হয়েছে অর্থাৎ কুরআন, যা সত্য ও নির্ভুল, যা সত্যের সোজা ও স্পষ্ট পথ প্রদর্শন করে, তুমি তা দৃঢ়ভাবে অবলম্বন কর। এটাই সুখময় জান্নাতের সরল পথ-প্রদর্শক। যারা এর উপর চলে এবং এর আহকামের উপর আমল করে সে কখনো পথভ্রষ্ট হতে পারে না। এটা তোমার ও তোমার সম্প্রদায়ের জন্যে যিকর অর্থাৎ সম্মানের বস্তু।
হযরত মুআবিয়া (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে বলতে শুনেছেনঃ “নিশ্চয়ই এই আমর (অর্থাৎ খিলাফত ও ইমামত) কুরায়েশদের মধ্যেই থাকবে। যে তাদের সাথে ঝগড়া করবে এবং এটা ছিনিয়ে নিবে আল্লাহ তাকে উল্টো মুখে নিক্ষেপ করবেন, যতদিন তারা দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত রাখবে।” (এ হাদীসটি ইমাম তিরমিযী (রঃ) বর্ণনা করেছেন) এতেও তার জাতীয় আভিজাত্য রয়েছে যে, কুরআন কারীম তাঁরই ভাষায় অবতীর্ণ হয়েছে, কুরায়েশের পরিভাষাতেই নাযিল হয়েছে। সুতরাং এটা প্রকাশমান যে, কুরআন এরাই সবচেয়ে বেশী বুঝবে। সুতরাং এই কুরায়েশদের উচিত সবচেয়ে বেশী দৃঢ়তার সাথে এর উপর আমল করতে থাকা। এতে বিশেষ করে ঐ মহান মুহাজিরদের বড় বুযুর্গী ও আভিজাত্য রয়েছে যারা সর্বাগ্রে ইসলাম গ্রহণ করেছেন এবং হিজরতও করেছেন সবারই পূর্বে। আর যারা এঁদের পদাংক অনুসরণ করেছেন তাদেরও এ মর্যাদা রয়েছে।
(আরবী)-এর অর্থ উপদেশও নেয়া হয়েছে। এটা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর কওমের জন্যে উপদেশ হওয়ার অর্থ এটা নয় যে, অন্যদের জন্যে এটা উপদেশ নয়। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “আমি তোমাদের প্রতি কিতাব অবতীর্ণ করেছি যার মধ্যে তোমাদের জন্যে উপদেশ রয়েছে, তোমরা কি বুঝ না?”(২১:১০) অন্য আয়াতে রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “তুমি তোমার নিকটতম আত্মীয়দের ভয় প্রদর্শন কর।”(২৬:২১৪) মোটকথা, কুরআনের উপদেশ এবং নবী (সঃ)-এর রিসালাত সাধারণ। রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর আত্মীয়-স্বজন, কওম এবং দুনিয়ার সমস্ত মানুষ এর অন্তর্ভুক্ত।
এরপর ঘোষিত হচ্ছেঃ ‘তোমাদেরকে অবশ্যই এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হবে।’ অর্থাৎ তোমাদেরকে প্রশ্ন করা হবে যে, তোমরা আল্লাহর এই কালামের উপর কি পরিমাণ আমল করেছে এবং কতখানি মেনে চলেছো?
মহান আল্লাহ স্বীয় নবী (সঃ)-কে বলেনঃ “হে নবী (সঃ)! তোমার পূর্বে আমি যেসব রাসূল প্রেরণ করেছিলাম তাদেরকে তুমি জিজ্ঞেস কর, আমি কি দয়াময় আল্লাহ ব্যতীত কোন দেবতা স্থির করেছিলাম যার ইবাদত করা যায়?” অর্থাৎ হে নবী (সঃ)! সমস্ত রাসূল নিজ নিজ উম্মতকে ঐ দাওয়াতই দিয়েছে যে দাওয়াত তুমি তোমার উম্মতকে দিচ্ছ। প্রত্যেক নবী (আঃ)-এর দাওয়াতের সারমর্ম এই ছিল যে, তারা তাওহীদ ছড়িয়ে দিয়েছেন এবং শিরকের মূলোৎপাটন করেছেন। যেমন মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “প্রত্যেক উম্মতের মধ্যে আমি রাসূল পাঠিয়েছি (একথা বলার জন্যে) যে, তোমরা আল্লাহরই ইবাদত কর এবং তাগূত (শয়তান) হতে দূরে থাকো।”(১৬:৩৬) হযরত আবদুল্লাহ (রাঃ)-এর কিরআতে নিম্নরূপ রয়েছেঃ (আরবী) এটা মিসাল তাফসীরের জন্যে, তিলাওয়াতের জন্যে নয়। এসব ব্যাপারে আল্লাহই সবচেয়ে ভাল জানেন। তখন অর্থ হবেঃ “তোমার পূর্বে রাসূলদেরকে আমি যাদের নিকট প্রেরণ করেছিলাম তাদেরকে জিজ্ঞেস কর।” আবদুর রহমান (রঃ) বলেন যে, ভাবার্থ হলোঃ তুমি নবীদেরকে জিজ্ঞেস কর, অর্থাৎ মিরাজের রাত্রে, যখন সমস্ত নবী (আঃ) তাঁর সামনে একত্রিত ছিলেন। জিজ্ঞেস করলেই তিনি জানতে পারবেন যে, তাঁরা প্রত্যেকেই তাওহীদ শিক্ষা এবং শিরক মিটানোর শিক্ষা নিয়েই আল্লাহর নিকট হতে প্রেরিত হয়েছিলেন।