أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ (বই#১১১২) [ ** ফেরাউনের ঘটনা ও জনগণকে বােকা বানানাের কারসাজি : -] www.motaher21.net সূরা:৪৩: সূরা:- ‌আয-যুখরুফ পারা:২৫ ৪৬- ৫৬ নং আয়াত:-

أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#১১১২)
[ ** ফেরাউনের ঘটনা ও জনগণকে বােকা বানানাের কারসাজি : -]
www.motaher21.net
সূরা:৪৩: সূরা:- ‌আয-যুখরুফ পারা:২৫
৪৬- ৫৬ নং আয়াত:-
সূরা:৪৩: সূরা:- ‌আয-যুখরুফ:৪৬
وَ لَقَدۡ اَرۡسَلۡنَا مُوۡسٰی بِاٰیٰتِنَاۤ اِلٰی فِرۡعَوۡنَ وَ مَلَا۠ئِہٖ فَقَالَ اِنِّیۡ رَسُوۡلُ رَبِّ الۡعٰلَمِیۡنَ ﴿۴۶﴾
অবশ্যই মূসাকে আমি আমার নিদর্শনাবলীসহ ফিরআউন ও তার পারিষদবর্গের নিকট পাঠিয়েছিলাম; সে বলেছিল, ‘আমি বিশ্বজগতের প্রতিপালক কর্তৃক প্রেরিত।’
সূরা:৪৩: সূরা:- ‌আয-যুখরুফ:৪৭
فَلَمَّا جَآءَہُمۡ بِاٰیٰتِنَاۤ اِذَا ہُمۡ مِّنۡہَا یَضۡحَکُوۡنَ ﴿۴۷﴾
সে ওদের নিকট আমার নিদর্শনাবলীসহ আসা মাত্র ওরা তা নিয়ে হাসিঠাট্টা করতে লাগল।
সূরা:৪৩: সূরা:- ‌আয-যুখরুফ:৪৮
وَ مَا نُرِیۡہِمۡ مِّنۡ اٰیَۃٍ اِلَّا ہِیَ اَکۡبَرُ مِنۡ اُخۡتِہَا ۫ وَ اَخَذۡنٰہُمۡ بِالۡعَذَابِ لَعَلَّہُمۡ یَرۡجِعُوۡنَ ﴿۴۸﴾
আমি তাদেরকে একের পর এক এমন সব নিদর্শন দেখাতে থাকলাম যা আগেরটার চেয়ে বড় হতো। আমি তাদেরকে আযাবের মধ্যে লিপ্ত করলাম যাতে তারা তাদের আচরণ থেকে বিরত থাকে।
সূরা:৪৩: সূরা:- ‌আয-যুখরুফ:৪৯
وَ قَالُوۡا یٰۤاَیُّہَ السّٰحِرُ ادۡعُ لَنَا رَبَّکَ بِمَا عَہِدَ عِنۡدَکَ ۚ اِنَّنَا لَمُہۡتَدُوۡنَ ﴿۴۹﴾
প্রত্যেক আযাবের সময় তারা বলতো, হে যাদুকর! তোমার রবের পক্ষ থেকে তুমি যে পদমর্যাদা লাভ করেছো তার ভিত্তিতে আমাদের জন্য তাঁর কাছে দোয়া করো। আমরা অবশ্যই সঠিক পথে এসে যাবো।
সূরা:৪৩: সূরা:- ‌আয-যুখরুফ:৫০
فَلَمَّا کَشَفۡنَا عَنۡہُمُ الۡعَذَابَ اِذَا ہُمۡ یَنۡکُثُوۡنَ ﴿۵۰﴾
কিন্তু আমি যেই মাত্র তাদের ওপর থেকে আযাব সরিয়ে দিতাম তারা তাদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করতো।
সূরা:৪৩: সূরা:- ‌আয-যুখরুফ:৫১
وَ نَادٰی فِرۡعَوۡنُ فِیۡ قَوۡمِہٖ قَالَ یٰقَوۡمِ اَلَیۡسَ لِیۡ مُلۡکُ مِصۡرَ وَ ہٰذِہِ الۡاَنۡہٰرُ تَجۡرِیۡ مِنۡ تَحۡتِیۡ ۚ اَفَلَا تُبۡصِرُوۡنَ ﴿ؕ۵۱﴾
ফিরআউন তার সম্প্রদায়কে সম্বোধন করে বলেছিল,[হে আমার সম্প্রদায়! আমি কি মিশরের অধিপতি নই? এই নদীগুলি আমার নিম্নদেশে প্রবাহিত, তোমরা কি দেখ না?
সূরা:৪৩: সূরা:- ‌আয-যুখরুফ:৫২
اَمۡ اَنَا خَیۡرٌ مِّنۡ ہٰذَا الَّذِیۡ ہُوَ مَہِیۡنٌ ۬ۙ وَّ لَا یَکَادُ یُبِیۡنُ ﴿۵۲﴾
আমিই উত্তম না এই ব্যক্তি যে হীন ও নগণ্য৪৭ এবং নিজের বক্তব্যও স্পষ্ট করে বর্ণনা করতে পারে না।
সূরা:৪৩: সূরা:- ‌আয-যুখরুফ:৫৩
فَلَوۡ لَاۤ اُلۡقِیَ عَلَیۡہِ اَسۡوِرَۃٌ مِّنۡ ذَہَبٍ اَوۡ جَآءَ مَعَہُ الۡمَلٰٓئِکَۃُ مُقۡتَرِنِیۡنَ ﴿۵۳﴾
সে নবী হলে তাকে স্বর্ণের বালা দেওয়া হল না কেন অথবা তার সঙ্গে দলবদ্ধভাবে ফিরিশতাগণ এল না কেন?’
সূরা:৪৩: সূরা:- ‌আয-যুখরুফ:৫৪
فَاسۡتَخَفَّ قَوۡمَہٗ فَاَطَاعُوۡہُ ؕ اِنَّہُمۡ کَانُوۡا قَوۡمًا فٰسِقِیۡنَ ﴿۵۴﴾
এভাবে সে তার সম্প্রদায়কে বোকা বানাল, ফলে তারা তার কথা মেনে নিল ৷ নিশ্চয় তারা ছিল এক ফাসিক সম্পপ্ৰদায়।
সূরা:৪৩: সূরা:- ‌আয-যুখরুফ:৫৫
فَلَمَّاۤ اٰسَفُوۡنَا انۡتَقَمۡنَا مِنۡہُمۡ فَاَغۡرَقۡنٰہُمۡ اَجۡمَعِیۡنَ ﴿ۙ۵۵﴾
অবশেষে তারা যখন আমাকে ক্রোধান্বিত করলো তখন আমি তাদের থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করলাম, তাদের সবাইকে এক সাথে ডুবিয়ে মারলাম
সূরা:৪৩: সূরা:- ‌আয-যুখরুফ:৫৬
فَجَعَلۡنٰہُمۡ سَلَفًا وَّ مَثَلًا لِّلۡاٰخِرِیۡنَ ﴿٪۵۶﴾
ফলে পরবর্তীদের জন্য আমারা তাদেরকে করে রাখলাম অতীত ইতিহাস ও দৃষ্টান্ত।

ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-

*ফেরাউনের ঘটনা ও জনগণকে বােকা বানানাের কারসাজি : রাসূলুল্লাহ(স.)-এর সম্প্রদায়ের নেতৃস্থানীয় লােকেরা তাকে নবী হিসেবে মনােনীত করায় আপত্তি উত্থাপন করেছিলাে এবং এই পার্থিব জীবনের নশ্বর ও ভ্রান্ত মূল্যবােধগুলাে নিয়ে তারা গর্ববােধ করতাে। তাই ওপরের আয়াতগুলােতে রসূলকে সান্ত্বনা বাণী শুনানাে হয়েছে। এই প্রসঙ্গে এখন মূসা(আ.)-এর সাথে এবং ফেরাউন ও তার পারিষদের কি ঘটনা ঘটেছিলাে, সে সম্পর্কে আলােচনা করা হচ্ছে। এই আলােচনায় বলা হয়েছে যে, মক্কার নেতৃস্থানীয় লােকেরা যেমন অহংকারে বশবর্তী হয়ে বলেছিলো, কোরআন কেন দুই জনপদের কোনাে প্রধান ব্যক্তির ওপর অবতীর্ণ হলাে না’ অনুরূপভাবে ফেরাউন ও তার ধন-শক্তি, জনশক্তি ও রাজ্যশক্তির অহংকারে বশবর্তী হয়ে বলেছিলাে, ‘আমি কি মিসরের সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক নই? এই নদীগুলাে কি আমার নিম্নদেশে প্রবাহিত হয় না?’ প্রতিপত্তি এবং পার্থিব ধন সম্পদের জোরে আল্লাহর বান্দা ও রসূল মূসা(আ.)-এর সামনে আত্মগরিমায় ফুলে যেতাে। সে বলতাে, আমি যে শ্রেষ্ঠ সেই ব্যক্তি থেকে, যে নীচ এবং কথা বলতেও সক্ষম নয় মকার নেতৃস্থানীয় লােকেরা যেমনটি বলে ছিলাে, তেমনটি ফেরাউনও বলেছিলো। সে বলেছিলো, তাকে কেন স্বর্ণবলয় পরিধান করানাে হলাে না? অথবা কেন ফেরেশতারা দল বেঁধে তার সংগে আসলাে না? মনে হয় যেন একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে অথবা একই রেকর্ড পুনরায় বাজানাে হচ্ছে। এরপর বলা হয়েছে, প্রতারিত ও বােকা জনগণ ফেরাউনের ডাকে কিভাবে সাড়া দিয়েছিলাে এবং বিভিন্ন পরীক্ষার সম্মুখীন হয়ে মূসা(আ.)-কে তার পালনকর্তার কাছে বিপদ দূর করার জন্যে দোয়া করতে অনুরােধ জানিয়েছিলাে। অথচ মূসা(আ.) তাদের সামনে মোজেজা প্রদর্শন করেছিলেন। এরপর বর্ণনা করা হয়েছে, দাওয়াত ও তাবলীগের সর্বশেষ সুযােগটিও যখন তারা গ্রহণ করেনি তখন তাদেরকে কি ভয়াবহ পরিণতির সম্মুখীন হতে হয়েছিলাে। যেমন ‘অতপর যখন আমাকে রাগান্বিত করল, তখন আমি তাদের কাছ থেকে প্রতিশােধ নিলাম এবং তাদের সবাইকে নিমজ্জিত করলাম। কিন্তু পরবর্তী লােকেরা এসব ঘটনা থেকে কোনই উপদেশ গ্রহণ করেনি। এই আলােচনার মধ্য দিয়ে একদিকে রিসালাত আদর্শ ও পন্থার অভিন্ন প্রতিভাত হয়ে ওঠে, অপরদিকে সত্যের ডাকের উত্তরে অহংকারী ও স্বৈরাচারীদের চরিত্র, পর্থিব জীবনের তুচ্ছ ও ক্ষণস্থায়ী বিলাস সামগ্রীর প্রতি তাদের গর্ববােধ এবং তাদের স্বভাবচরিত্র ফুটে উঠেছে, যাদেরকে শাসকগােষ্ঠী ও ক্ষমতাসীনরা যুগে যুগে বােকা বানিয়ে এসেছে। আয়াতে বলা হয়েছে, ‘‘আমি মূসাকে আমার নিদর্শনাবলী দিয়ে ফেরাউন ও তার পারিষদবর্গের কাছে প্রেরণ করেছিলাম, অতপর সে বলেছিলাে, আমি বিশ্ব পালনকর্তার রসূল….’(আয়াত ৪৬-৪৭) এখানে মূসা(আ.) ও ফেরাউনের মাঝে প্রথম সাক্ষাতের ঘটনাটি সংক্ষিপ্ত আকারে বর্ণনা করা হচ্ছে। কেবল মূল অংশগুলাে এখানে তুলে ধরা হয়েছে। বিশেষ করে যেসব অংশের সাথে মক্কার মােশরেকদের ঘটনার সাথে মিল রয়েছে। এখানে মূসা(স.)-এর রেসালতের স্বরূপ এভাবে বর্ণনা করা হয়েছে, ‘আমি বিশ্ব পালনকর্তার রসূল’ এটাই হচ্ছে রেসালতের স্বরূপ যার বাহক ছিলেন প্রত্যেক নবী ও রসূল। তাঁদেরও সেই একই বক্তব্য ছিলাে। অর্থাৎ তারা রসূল এবং যিনি তাদেরকে রসূলরূপে প্রেরণ করেছেন তিনি হচ্ছেন, ‘রব্বুল আলামীন বা বিশ্ব প্রতিপালক। এখানে খুব সংক্ষিপ্ত আকারে সেই সব অলৌকিক ঘটনাবলীর প্রতিও ইংগিত করা হয়েছে যা মূসা(আ.) তার জাতির সামনে পেশ করেছিলেন। এসকল ঘটনাবলী প্রত্যক্ষ করে তারা হেসে ওঠে। বােকা এবং অহংকারী লােকেরা এমনটাই করে থাকে। এরপর ফেরাউন ও তার লােকজনদেরকে প্রায়শ্চিত্ত স্বরূপ আল্লাহ তায়ালা কি কি ভাবে পাকড়াও করলেন যার বিস্তারিত বর্ণনা অন্যান্য সুরায় এসেছে যেদিকে ইংগিত করে বলা হয়েছে, ‘আমি তাদেরকে যে নিদর্শনই দেখাতাম, তা হতাে পূর্ববর্তী নিদর্শন অপেক্ষা বড়। আমি তাদেরকে শাস্তি দ্বারা পাকড়াও করলাম…’(আয়াত ৪৮-৪৯) মূসা(আ.)-এর হাতে যে সকল অলৌকিক ঘটনাবলী প্রকাশ পেয়েছিলাে, তা তার সম্প্রদায়ের লােকদের ঈমান গ্রহণে সহায়ক হয়নি। একের পর এক অলৌকিক ঘটনা তাদের সামনে আসতে থাকে, আর তাদের অবাধ্যতাও ততােই প্রকাশ পেতে থাকে। এর দ্বারা আল্লাহর এই বক্তব্যের সত্যতাই প্রতিষ্ঠিত হয় যে, যারা হেদায়াতের যোগ্য নয়, তারা কখনও অলৌকিক ঘটনা দেখে হেদায়াত লাভ করতে পারে না। তাই রসূলকে বলা হয়েছে, ‘বধিরকে শুনানাে সম্ভব নয় এবং অন্ধকে রাস্তা দেখানােও সম্ভব নয়।’ এখানে ফেরাউন ও তার লােকজনদের এক অদ্ভুত ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। আর তা হলাে, ‘হে যাদুকর, তুমি আমাদের জন্যে তােমার পালনকর্তার কাছে সে বিষয়ে প্রার্থনা করাে, যার ওয়াদা তিনি তােমাকে দিয়েছেন…’(আয়াত ৪৯) তারা বিপদের সম্মুখীন এই বিপদ থেকে রক্ষা করার জন্যে তারা মূসা(আ.)-এর কাছে সাহায্য কামনা করছে। তারপরও তারা তাকে ‘যাদুকর বলে সম্বােধন করছে এবং বলছে, ‘তােমার প্রভু তােমাকে যে ওয়াদা দিয়েছেন সে বিষয়ে আমাদের জনাে দোয়া করাে। অথচ তিনি তাদেরকে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, তিনি বিশ্ব প্রতিপালকের রসূল।’ অর্থাৎ শুধু তাঁর নিজ প্রতিপালকের রাসূল নন। কিন্তু ওদের মনে অলৌকিক ঘটনাবলীরও কোনো রেখাপাত করেনি এবং রসূলের কথাও কোনাে রেখাপাত করেনি। এমনকি ঈমানের কোনাে স্পর্শও ওদের মনে লাগেনি। ‘অথচ ওরা দাবী করছে, আমরা হেদায়াতপ্রাপ্ত।’ পরের আয়াতে বলা হয়েছে, ‘অতপর যখন আমি তাদের থেকে আমার আযাব প্রত্যাহার করে নিলাম, তখনই তারা অংগীকার ভংগ করতে লাগলো।'(আয়াত ৫০) জনসাধারণের মনে অনেক সময় অলৌকিক ঘটনা রেখাপাত করতে পারে এবং তাদের প্রতারিত মনে অনেক সময় সত্যের আলাে ঝিলিক দিয়েও উঠতে পারে। তাই ফেরাউন তার পূর্ণ শান শওকত ও চাকচিক্যময় পােশাক পরিচ্ছদসহ জনসমক্ষে উপস্থিত হচ্ছে এবং সহজ সরল গণমানুষের মনকে আকৃষ্ট করার জন্যে সেই পন্থায়ই অবলম্বন করছে, যা যুগে যুগে অহংকারী ও স্বৈরাচারী শাসকগােষ্ঠী তাদের দাম প্রজাদের বেলায় করে আসছে। তারা শস্তা জৌলুসপূর্ণ ও চাকচিক্যময় জীবন ধারার মাধ্যমে জনগণকে বােকা বানিয়ে ডেকে বললো…’(আয়াত ৫১-৫৩) বলাবাহুল্য, মিসরের সাম্রাজ্য এবং ফেরাউনের প্রাসাদের নিচে প্রবাহিত নদীগুলাে জনগণের চোখের সামনেই ছিলাে। তা দেখে তারা বিমােহিত হতাে। এগুলাের মাধ্যমে তাদেরকে বােকা বানানাে খুব সহজ ছিলাে। কিন্তু আসমান ও যমীন এবং এর মাঝে যা কিছু আছে তার মালিকানা ছিলাে ভিন্ন জিনিস। এর সাথে মিসর সাম্রাজ্যের মালিকানার কোনাে তুলনাই হতে পারে না। অবশ্য এই সত্যটুকু উপলব্ধি করার জন্যে ঈমানের আলােকে আলােকিত একটি হৃদয়ের প্রয়ােজন। কেবল এমন হৃদয়ই আসমান ও যমীনের মালিকানা আর মিসরের মতাে তুচ্ছ সাম্রাজ্যের মালিকানার পার্থক্য নির্ণয় করতে সক্ষম। গণমানুষের পক্ষে এই বিশাল জগতের মালিকানার বিষয়টি উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। তাদের বুদ্ধি এত ঊর্ধের নয়। তারা তাে বাহ্যিক চাকচিক্যেই মত্ত থাকে না। চোখের সামনে যা পায় তা নিয়েই ব্যস্ত থাকে। সে কারণেই ফেরাউন বুঝতে পারে, এদের মন নিয়ে কিভাবে খেলা যায় এবং বাহ্যিক চাকচিক্যে এদেরকে কিভাবে ভুলানাে যায়। সে তাদেরকে লক্ষ্য করে বলে উঠলাে, ‘আমি কি তারচেয়ে শ্রেষ্ঠ নই, যে নীচ এবং কথাও বলতে পারে না….’(আয়াত ৫২) সে মূসা(আ.)-কে নীচ বলছে এই কারণে যে, তিনি কোনাে রাজা বাদশা নন, কোনাে রাজকুমার নন, প্রভাব-প্রতিপত্তি এবং ধন-দৌলতের মালিক নন। অথবা এই কারণে বলেছে যে, তিনি পরাধীন জাতি অর্থাৎ বনী ইসরাইলের লােক ছিলেন। অপরদিকে ‘সে কথাও বলতে পারে না…’ এর দ্বারা সে মূসা(আ.)-এর তােতলামীর দোষটি নিয়ে ব্যঙ্গ করেছে। এটা ছিলাে মিসর ত্যাগ করার আগে। পরবর্তীকালে তিনি আল্লাহর কাছে দোয়া করেন, ‘হে আমার পালনকর্তা। আমার বক্ষ প্রশস্ত করে দিন এবং আমার কাজ সহজ করে দাও। আমার জিহবা থেকে জড়তা দূর করে দাও, যাতে তারা আমার কথা বুঝতে পারে।’ আল্লাহ তায়ালা তার এই দোয়া কবুল করেছিলেন এবং তার মুখের জড়তা বা তােতলামী দূর হয়ে যায়। ফলে তিনি স্পষ্টভাবে কথা বলতে পারতেন। সরল-সােজা গণমানুষের কাছে মূসা(আ.)-এর তুলনায় ফেরাউনই ছিলাে শ্রেষ্ঠ। কারণ সে মিসরের অধিপতি, প্রভাব প্রতিপত্তির মালিক এবং তার প্রাসাদের নিচ দিয়ে নদী প্রবাহিত হয়। অপরদিকে মূসা(আ.) সত্যের বাহক, নবুওতের মর্যাদার অধিকারী এবং কঠিন আযাব থেকে মুক্তির জন্যে প্রার্থনাকারী হওয়া সত্তেও গণমানুষের সামনে তার কোনাে আবেদন নেই । পরের আয়াতে বলা হয়েছে, তাকে কেন স্বর্ণ বলয় পরিধান করানাে হলাে না?’ কি তুচ্ছ ও বাজে জিনিসের আব্দার! স্বর্ণের মাধ্যমে ওরা একজন নবীর নবুওতকে প্রমাণ করতে চায়! ওরা স্বর্ণের কয়টি বালাকে সেসব অলৌকিক ঘটনার চেয়েও বড় বলে মনে করে যা আল্লাহ তায়ালা মূসা(আ.)-এর মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। অথবা তারা কি স্বর্ণবলয় পরিধান করানাের দ্বারা সিংহাসনে আরােহন বুঝাতে চায়। অর্থাৎ মূসা(আ.) একজন রাজা বাদশা কেন হলেন না। হয়তাে সেই যুগে এই প্রথার মাধ্যমেই রাজা বাদশাদের অভিষেক হতাে। এরপর বলা হয়েছে, অথবা তার সাথে ফেরেশতারা কেন দল বেঁধে নিচে এলাে না? এটা আর এক ধরনের অভিযোগ। এর দ্বারা গণমানুষকে আর বেশী বােকা বানানাে যায় । তাই একই অভিযােগ একাধিক রাসূলের ক্ষেত্রেও করা হয়েছে। এরপর বলা হয়েছে, ‘অতপর সে তার জাতিকে বােকা বানিয়ে দিলাে, ফলে তারা তার কথা মেনে নিয়ে…’(আয়াত ৫৪) স্বৈরাচারী শাসকরা জনসাধারণকে সব সময় বােকা বানায়। এতে অবাক হওয়ার কিছুই নেই। এরা প্রথমে জনগণকে জ্ঞানের সকল পথ থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। এরপর সত্য ঘটনা তাদের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখে, যেন সেগুলাে তারা ভুলে যায় এবং সেগুলাে নিয়ে আর কখনও ঘাটাঘাটি না করতে পারে। এরপর ইচ্ছামতাে তাদের মন মানসিকতাকে প্রভাবান্বিত করতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত তাদের মন মানসিকতা সেই কৃত্রিম ছাঁচেই গড়ে ওঠে। ফলে বােকা বানানাে সহজ হয়, তাদেরকে ইচ্ছামত চালানাে যায় এবং যেদিক ইচ্ছা সেদিকে হাঁকিয়ে নেয়া যায়। এতে তারা কোনাে আপত্তি করে না। স্বৈরাচারী শাসকগােষ্ঠী জনসাধারণের সাথে এই আচরণ কেবল তখনই করতে পারে যখন তাদের মাঝে নৈতিক অবক্ষয় ঘটে, যখন তারা সৎপথ থেকে ছিটকে পড়ে, আল্লাহর দ্বীন থেকে দূরে সরে পড়ে এবং ঈমানের মানদন্ড তাদের হাতছাড়া হয়ে যায়। অপরদিকে যারা বিশ্বাসী, যারা ঈমানদার, তাদেরকে ধোকা দেয়া, তাদেরকে বােকা বানানাে বা তাদেরকে নিয়ে তামাশা করা এতাে সহজ নয়। সেই জন্যেই আল্লাহ তায়ালা ফেরাউনের সম্প্রদায়কে বােকা ও অসৎ বলে আখ্যায়িত করেছেন। এখন পরীক্ষার পর্ব শেষ, উপদেশের পর্ব শেষ এবং সতর্কীকরণের পর্বও শেষ। এখন আল্লাহ তায়ালা নিশ্চিতভাবে জানতে পেরেছেন যে, এই অসৎ জাতি আর ঈমান গ্রহণ করবে না। কারণ, তারা ক্ষমতার দম্ভে আত্মহারা ফেরাউনের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছে এবং সুস্পষ্ট ও উজ্জ্বল নিদর্শনগুলাে থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়েছে। তাই আল্লাহর ওয়াদা বাস্তবায়িত হয়েছে এবং সতর্কবাণী সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। বলা হচ্ছে, ‘অতপর ওরা যখন আমাকে রাগান্বিত করলাে, তখন আমি তাদের কাছ থেকে প্রতিশােধ নিলাম এবং তাদেরকে ডুবিয়ে মারলাম’(আয়াত ৫৫) আল্লাহকে তারা রাগান্বিত করেছিলাে বলেই তিনি তাদের কাছ থেকে প্রতিশােধ নিয়েছেন। অর্থাৎ ফেরাউন ও তার লােক-লস্কর সহ সকলকে পানিতে ডুবিয়ে মেরেছেন। ওরা মূসা(আ.)-কে ধাওয়া করে নিয়ে যাচ্ছিলাে। কিন্তু মাঝ দরিয়ায়ই আল্লাহ তায়ালার ওদের ডুবিয়ে দেন। আর এভাবেই ওরা পরবর্তী যুগের প্রত্যেক অত্যাচারী ও স্বৈরাচারী শাসকদের জন্যে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকেবে। যুগ যুগ ধরে মানুষ ওদের নির্মম ঘটনা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করবে। মূসা(আ.)-এর ঘটনা আর মক্কার আরবদের ঘটনার মাঝে এভাবেই একটা মিল খুঁজে পাই, অর্থাৎ ওরাও তাদের নবীর বিরুদ্ধাচরণ করেছিলাে, তাকে অস্বীকার করেছিলাে। কিন্তু রসূল এবং তার অনুসারী মােমেনরাই জয়ী হয়েছিলাে, তারাই ময়দানে টিকে ছিলাে। তাই মূসা(আ.)-এর ঘটনার মাধ্যমে অভিযােগকারী মােশরেকদেরকে সতর্ক করে দেয়া হচ্ছে এবং তাদেরকে পূর্ববর্তী জাতিগুলাের অনুরূপ পরিণতি সম্পর্কে ভয় দেখানো হচ্ছে। আলােচ্য পর্বের অবস্থা এবং এর উপস্থাপনের ঈপ্সিত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সাথে উল্লেখিত ঘটনার তাৎপর্য সুসামঞ্জস্যরূপে মিলে যাচ্ছে। আর এর মাধ্যমে উল্লেখিত ঘটনাটি ঐশী আদর্শের জন্য শিক্ষার একটা উপকরণরূপে আত্মপ্রকাশ করেছে।

তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
# এখানে এ ঘটনাটা তিনটি উদ্দেশ্য বর্ণনা করা হয়েছে। এক-আল্লাহ তাঁর নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে পাঠিয়ে আরববাসীদের বর্তমানে একটি সুযোগ দান করেছেন। যখনই আল্লাহ‌ কোন দেশ ও জাতির কাছে তাঁর নবী পাঠিয়ে তাদের এ ধরনের সুযোগ দান করেন কিন্তু সে জাতি তার মর্যাদা ও মূল্য দেয়া এবং তা থেকে উপকৃত হওয়ার পরিবর্তে ফিরাউন ও তার কওম যেমন নির্বুদ্ধিতার কাজ করেছিলো তেমন কাজ করে বসে। তখন তারা এমন পরিণামের সম্মুখীন হয় যা ইতিহাসে শিক্ষণীয় উদাহরণ হয়ে আছে। দুই-যেভাবে বর্তমানে মক্কার কুরাইশ গোত্রের কাফেররা তাদের নেতাদের তুলনায় মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নগণ্য ও হেয় মনে করছে ফিরাউনও তার বাদশাহী, জাঁকজমক, প্রতিপত্তি এবং ধন-সম্পদের গর্বে গর্বিত হয়ে মূসা আলাইহিস সালামকে ঠিক তেমনি নগণ্য ও হেয় মনে করেছিলো। কিন্তু মহান আল্লাহর ফায়সালা ছিল ভিন্ন রকম। এবং বাস্তবে হেয় ও নগণ্য কে ছিলো সেই ফায়সালাই শেষ পর্যন্ত তা বুঝিয়ে দিয়েছে। তিন-আল্লাহর নিদর্শনসমুহের সাথে বিদ্রূপ করা এবং তাঁর সতর্ক বাণীসমূহের বিরুদ্ধে শক্তিমত্তা প্রদর্শন করা কোন ছোটখাট ব্যাপার নয়, বরং অত্যন্ত চড়া মূল্য দাবী করার মত ব্যাপার। যারা এর পরিণাম ভোগ করেছে তাদের উদাহরণ থেকে যদি শিক্ষা গ্রহণ না করো তাহলে নিজেও একদিন সেই পরিণাম ভোগ করবে।
# এর অর্থ প্রাথমিক যেসব নিদর্শন নিয়ে হযরত মূসা আলাইহিস সালাম ফেরাউনের দরবারে গিয়েছিলেন। অর্থাৎ লাঠি ও ‘ইয়াদে বায়দা’ বা আলোকোজ্জ্বল হাত (ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, সূরা আল আ’রাফ, টীকা ৮৭ থেকে ৮৯ ; ত্বাহা, টীকা ১২, ১৩ , ২৯, ৩০ ; আশ শু’আরা, টীকা ২৬-২৯ ; আন নামল, টীকা ১৬ ; আল কাসাস, টীকা ৪৪ ও ৪৫ )।
# এসব নিদর্শন বলতে বুঝানো হয়েছে সেই নিদর্শনসমূহকে যা আল্লাহ‌ পরবর্তীকালে হযরত মূসা আলাইহিস সালামের মাধ্যমে তাদের দেখিয়ে ছিলেন। নিদর্শনগুলো ছিলঃ

একঃ জনসমক্ষে যাদুকরদের সাথে আল্লাহর নবীর মোকাবিলা হয় এবং তারা পরাজিত হয়ে ঈমান আনে। বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, সূরা আল আ’রাফ, টীকা ৮৮ থেকে ৯২ ; ত্বাহা, টীকা ৩০ থেকে ৫০ ; আশ শু’আরা, টীকা ২৯ থেকে ৪০ ।

দুইঃ হযরত মূসার ভবিষ্যত বাণী আনুসারে মিসর দেশে প্রচণ্ড দুর্ভিক্ষ হয় এবং হযরত মূসার দোয়ার কারণেই তা দূরীভূত হয়।

তিনঃ তাঁর ভবিষ্যত বাণীর পর গোটা দেশে ভয়াবহ বৃষ্টি, শিলা বৃষ্টি, বজ্রপাত এবং বিদ্যুৎ বর্ষণসহ প্রবল ঝড়, তুফান আসে, যা জনপদ ও কৃষি ক্ষেত্র ধ্বংস করে ফেলে। বিপদও তাঁর দোয়াতেই কেটে যায়।

চারঃ তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে গোটা দেশে পঙ্গপালের ভয়ানক আক্রমণ হয় এবং এ বিপদও ততক্ষণ পর্যন্ত দূরীভূত হয়নি যতক্ষন না তিনি তা দূরীভূত হওয়ার জন্য দোয়া করেছেন।

পাঁচঃ তাঁর ঘোষণা অনুযায়ী গোটা দেশে উকুন ও কীটানু ছড়িয়ে পড়ে যার কারণে একদিকে মানুষ ও জীবজন্তু মারাত্মক কষ্টে পড়ে, অপর দিকে খাদ্য শস্যের গুদাম ধ্বংস হয়ে যায়। এ আযাব কেবল তখনই দূরীভূত হয় যখন কাকুতি-মিনতি করে হযরত মূসার দ্বারা দোয়া করানো হয়।

ছয়ঃ হযরত মূসা (আ) এর পূর্ব-সতর্ক বাণী অনুসারে গোটা দেশের আনাচে-কানাচে ব্যাঙের সয়লাব আসে যার ফলে গোটা জনপদের প্রায় দমবদ্ধ হওয়ার মত অবস্থা হয়। আল্লাহর এ সৈনিকরাও হযরত মূসার দোয়া ছাড়া ফিরে যায়নি।

সাতঃ ঠিক তাঁর ঘোষণা মোতাবেক রক্তের আযাব দেখা দেয়। যার ফলে সমস্ত নদী নালা, কূপ, ঝর্ণাসমূহ, দীঘি এবং হাউজের পানি রক্তে পরিণত হয়, মাছ মরে যায়, সর্বত্র পানির আধারে দূর্গন্ধ সৃষ্টি হয় এবং পুরো এক সপ্তাহ পর্যন্ত মিশরের মানুষ পরিষ্কার পানির জন্য তড়পাতে থাকে। এ বিপদও কেবল তখনই কেটে যায় যখন তা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য হযরত মূসাকে দিয়ে দোয়া করানো হয়। বিস্তারিত ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, সুরা আল আ’রাফ, টীকা ৯৪-৯৬ ; আন নামল টীকা ১৬ ও ১৭ ; আল মু’মিন, টীকা ৩৭ ।

বাইবেলের যাত্রা পুস্তকের ৭, ৮ , ৯ , ১০ ও ১২ অধ্যায়েও এসব আযাবের বিস্তারিত বর্ণনা লিপিবদ্ধ আছে। তবে তা কল্পকাহিনী ও সত্যের সংমিশ্রণ মাত্র। সেখানে বলা হয়েছে, যখন রক্তের আযাব এলো তখন যাদুকররাও অনুরূপ রক্ত তৈরী করে দেখালো। কিন্তু উকুনের আযাব আসলে জবাবে যাদুকররা উকুন সৃষ্টি করতে পারলো না। তারা বললো, এটা আল্লাহর কাজ। এর চেয়েও অধিক মজার ব্যাপার হলো, অসংখ্য ব্যাঙের সয়লাব সৃষ্টি হলে জবাবে যাদুকররাও ব্যাঙের সয়লাব আনলো এবং এরপরও ফেরাউন মূসার কাছেই আবেদন জানালো যে আল্লাহর কাছে দোয়া করে এ আযাব দূর করিয়ে দিন। প্রশ্ন হচ্ছে যাদুকররাও যেখানে ব্যাঙের সয়লাব আনতে সমর্থ ছিল সেখানে ফেরাউন যাদুকরদের দিয়েই এই আযাব দূর করিয়ে নিলো না কেন? তাছাড়া কোনগুলো যাদুকরদের ব্যাঙ আর কোনগুলো আল্লাহর ব্যাঙ তাই বা কি করে বুঝা গেল? রক্ত সম্পর্কেও এই প্রশ্ন দেখা দেয় যে, হযরত মূসার সাবধান বাণী অনুসারে যখন সব জায়গায় পানির ভাণ্ডার রক্তে পরিণত হয়েছিলো তখন যাদুকররা কোন পানিকে রক্ত বানিয়েছিলো এবং কিভাবে বুঝা গেল অমুক জায়গার পানি যাদুকরদের যাদু বিদ্যা দ্বারা রক্তে পরিণত হয়েছে? এ ধরনের বক্তব্যের কারণে স্পষ্ট বুঝা যায়, বাইবেল আল্লাহর নির্ভেজাল বাণী সমাহার নয়। বরং যারা তা রচনা করেছে তারা নিজেদের পক্ষ থেকে তার মধ্যে অনেক কিছু সংযোজিত করেছে। তবে সবচেয়ে পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, ঐ সব রচয়িতারা ছিল নগণ্য জ্ঞান-বুদ্ধি সম্পন্ন লোক। কোন কথা সুন্দর করে রচনা করার যোগ্যতা পর্যন্ত তাদের ছিল না।
# ফেরাউন ও তার কওমের নেতাদের হঠকারিতার মাত্রা পরিমাপ করা যায় এভাবে যে, যখন তারা আল্লাহর আযাবে অতিষ্ঠ হয়ে তা থেকে মুক্তি লাভের জন্য মূসাকে দিয়ে দোয়া করতে চাইতো তখনও তারা তাঁকে নবী বলে সম্বোধন না করে যাদুকর বলেই সম্বোধন করতো। অথচ যাদুর তাৎপর্য তারা জানতো না, তা নয়। তাছাড়া একথাও তাদের কাছে গোপন ছিল না যে, এসব অদ্ভূত কর্মকাণ্ড কোন প্রকার যাদুর সাহায্যে সংগঠিত হতে পারে না। একজন যাদুকর বড় জোর যা করতে পারে তা হচ্ছে, একটি সীমিত পরিসরে যেসব মানুষ তার সামনে বর্তমান থাকে সে তাদের মন-মস্তিষ্কের ওপর এমন প্রভাব বিস্তার করে যার ফলে তারা মনে করতে থাকে, পানি রক্তে পরিণত হয়েছে অথবা ব্যাঙ উপছে পড়ছে কিংবা পঙ্গপালের ঝাঁক ক্রমে এগিয়ে আসছে। এই সীমিত পরিসরের মধ্যেও পানি বাস্তবিকই রক্তে পরিণত হবে না। বরং ঐ পরিসর থেকে মুক্ত হওয়া মাত্রই পানি পানিতে পরিণত হবে। বাস্তবে কোন ব্যাঙ সৃষ্টি হবে না। আপনি যদি সেটিকে ধরে ঐ গণ্ডির বাইরে নিয়ে যান তাহলে আপনার হাতে ব্যাঙের বদলে থাকবে শুধু বাতাস। পঙ্গপালের ঝাকও হবে শুধু মনের কল্পনা। তা কোন ক্ষেতের ফসল ধ্বংস করতে পারবে না। এখন কথা হলো, একটা গোটা দেশ দুর্ভিক্ষ কবলিত হওয়া, কিংবা সমগ্র দেশের নদী-নালা, ঝর্ণা এবং কূপসমূহ রক্তে পরিপূর্ণ হওয়া অথবা হাজার হাজার মাইল এলাকা জুড়ে পঙ্গপালের আক্রমণ হওয়া এবং লাখ লাখ একর জমির ফসল ধ্বংস করা। আজ পর্যন্ত কখনো কোন যাদুকর এ কাজ করতে সক্ষম হয়নি এবং যাদুর জোরে কখনো তা সম্ভবও নয়। কোন রাজা-বাদশাহর কাছে এমন কোন যাদুকর থাকলে তার সেনাবাহিনী রাখার এবং যুদ্ধের বিপদাপদ সহ্য করার প্রয়োজনই হতো না। যাদুর জোরেই সে গোটা দুনিয়াকে পদানত করতে পারতো। যাদুকরদের এমন শক্তি থাকলে তারা কি রাজা-বাদশাহদের অধীনে চাকরি করতো? তারা নিজেরাই কি বাদশাহ হয়ে বসতো না?

মুফাসসিরগণ এখানে সাধারণভাবে একটি জটিলতার সম্মুখীন হয়েছেন। অর্থাৎ আযাব থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ফেরাউন ও তার সভাসদরা হযরত মূসার কাছে যখন দোয়ার জন্য আবেদন করতো তখনো তারা তাকে ‘হে যাদুকর’ বলে সম্বোধন করতো কি করে? বিপদের সময় সাহায্য প্রার্থনাকারী তো তোষামোদ করে থাকে, নিন্দাবাদ নয়। এ কারণে তারা এই বলে ব্যাখ্যা করেছেন যে, সে যুগে মিসরবাসীদের দৃষ্টিতে যাদু অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ বিদ্যা ছিল। ‘হে যাদুকর’ বলে তারা প্রকৃতপক্ষে হযরত মূসার নিন্দাবাদ করতো না, বরং তাদের মতে যেন সম্মানের সাথে তাঁকে ‘হে জ্ঞানী’ বলে সম্বোধন করতো। কিন্তু এ ব্যাখ্যা পুরোপুরিই ভুল। কারণ কুরআনের অন্যান্য স্থানে যেখানেই ফেরাউন কর্তৃক মূসাকে যাদুকর এবং তাঁর পেশকৃত মু’জিযাসমূহকে যাদু বলে আখ্যায়িত করার কথা উদ্ধৃত হয়েছে সেখানেই নিন্দাবাদ ও হেয় প্রতিপন্ন করার অভিপ্রায়ই সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছে এবং স্পষ্ট বুঝা গেছে, তাদের কাছে যাদু ছিল একটি মিথ্যা জিনিস। আর এ কারণেই তারা হযরত মূসার বিরুদ্দে যাদুর অভিযোগ আরোপ করে তাঁকে নবুওয়াতের মিথ্যা দাবীদার বলে আখ্যায়িত করতো। তাই এক্ষেত্রে ‘যাদুকর’ কথাটি হঠাৎ করে তাদের দৃষ্টিতে সম্মানিত আলেম বা বিদ্বানের উপাধি হয়ে যাবে তা গ্রহণযোগ্য নয়। এখন প্রশ্ন হলো, দোয়ার জন্য আবেদন জানানোর সময়ও যখন তারা প্রকাশ্যে হযরত মূসার অমর্যাদা করতো তখন তিনি তাদের আবেদন গ্রহণই বা করতেন কেন? এর জবাব হচ্ছে, হযরত মূসার লক্ষ্য ছিল আল্লাহর নির্দেশে ঐ সব লোকদের কাছে ‘ইতমামে হুজ্জত’ বা যুক্তি-প্রমাণের চূড়ান্ত করা। আযাব দূরীভূত করার জন্য তাঁর কাছে তাদের দোয়ার আবেদন করাই প্রমাণ করছিল যে, আযাব কেন আসছে কোথা থেকে আসছে এবং কে তা দূর করতে পারে মনে মনে তারা তা উপলব্ধি করে ফেলেছিলো। কিন্তু তা সত্ত্বেও যখন তারা হঠকারিতা করে তাঁকে যাদুকর বলতো এবং আযাব কেটে যাওয়ার পর সঠিক পথ গ্রহণের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করতো তখন মূলত তারা আল্লাহর নবীর কোন ক্ষতি করতো না। বরং নিজেদের বিরুদ্ধে মোকদ্দমাকে আরো বেশি জোরালো করে তুলতো। আর আল্লাহ‌ তাঁর ফায়সালা করে দিয়েছিলেন তাদের পুরোপুরি মূলোৎপাটন করার মাধ্যমে। তাঁকে তাদের যাদুকর বলার অর্থ এ নয় যে, তারা সত্যিই মন থেকেও বিশ্বাস করতো, তাদের ওপর যেসব আযাব আসছে তা যাদুর জোরেই আসছে। তারা মনে মনে ঠিকই উপলব্ধি করতো যে এগুলো সবই বিশ্ব-জাহানের রব আল্লাহর নিদর্শন। কিন্তু জেনে শুনেও তা অস্বীকার করতো। সূরা নামলে এ কথাটিই বলা হয়েছেঃ আরবীوَجَحَدُوا بِهَا وَاسْتَيْقَنَتْهَا أَنْفُسُهُمْ ظُلْمًا وَعُلُوًّا (ايت : 14) “তারা মনে মনে বিশ্বাস করে ফেলেছিলো। কিন্তু জুলুম ও অহংকারের বশবর্তী হয়ে এসব নিদর্শন অস্বীকার করতো।”
# গোটা জাতির মধ্যে ঘোষণার বাস্তব রূপ সম্ভবত এই ছিল যে, ফেরাউন তার দরবারে সাম্রাজ্যের উচ্চ পদস্থ কর্মচারি ও জাতির বড় বড় নেতাদের উদ্দেশ্য করে যে কথা বলে ছিলো ঘোষকদের মাধ্যমে তা গোটা দেশের সমস্ত শহর ও জনপদে প্রচার করা হয়েছিলো। সেই যুগে তার কাছে তো তোষামুদে প্রেস, নিজের পোষা সংবাদ সরবরাহ প্রতিষ্ঠান এবং সরকারী বেতার ছিল না যে তার মাধ্যমে ঘোষণা করতো।
# ঘোষণার এই বিষয়বস্তু থেকেই প্রকাশ পায় যে “হিজ ম্যাজেষ্টির” পায়ের নীচে থেকে মাটি সরে যাচ্ছিলো। হযরত মূসা আলাইহিস সালামের একের পর মু’জিযা দেখানো দেবতাদের প্রতি জনসাধারণের আস্থা ও বিশ্বাস নড়বড়ে করে দিয়েছিলো এবং যে তেলেসমাতির মাধ্যমে ফেরাউনদের খান্দান আল্লাহর অবতার সেজে মিসরে তাদের খোদায়ী চালিয়ে যাচ্ছিলো তা ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গিয়েছিলো। এই পরিস্থিতি দেখে ফেরাউন বলে উঠেছিলোঃ হতভাগারা, এ দেশে কার রাজত্ব চলছে এবং নীল নদ থেকে উৎপন্ন যে সব নদী-নালার ওপর তোমাদের গোটা আর্থিক কায়-কারবার নির্ভরশীল তা কার নির্দেশে প্রবাহিত হচ্ছে তা তোমরা চোখে দেখতে পাও না? এসব উন্নয়নমূলক কাজ তো করেছি আমি এবং আমার খান্দান আর তোমরা ভক্ত অনুরক্ত হচ্ছো এই ফকীরের।
# যার কাছে না আছে অর্থ-সম্পদ না আছে ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব।
# কোন কোন মুফাসসিরের ধারণা, বাল্যকাল থেকেই হযরত মূসার (আ) কথায় যে তোতলামি ছিল সে বিষয়েই ফেরাউনের এই আপত্তি। কিন্তু এ ধারণা ঠিক নয়। সূরা তোহাতে একথা বলা হয়েছে যে, হয়রত মূসাকে (আ) যে সময় নবুওয়াতের পদ-মর্যাদার ভূষিত করা হচ্ছিলো তখন তিনি আল্লাহর কাছে এই বলে প্রার্থনা করেছিলেন যে আমার কথার জড়তা দূর করে দিন যাতে মানুষ ভালভাবে আমার কথা বুঝতে পারে। সেই সময়ই তাঁর অন্যান্য প্রার্থনার সাথে এই প্রার্থনাও মঞ্জুর করা হয়েছিলো (আয়াতে ২৭ থেকে ৩৬ )। তাছাড়া কুরআন মজীদের বিভিন্ন স্থানে হযরত মূসার (আ) যেসব বক্তৃতা উদ্ধৃত করা হয়েছে তা তাঁর পূর্ণ মাত্রার সাবলীল ভাষার প্রতি ইঙ্গিত করে। অতএব, ফেরাউনের আপত্তির কারণ তাঁর কথার তোতলামি ছিল না। বরং তার আপত্তির বিষয় ছিল এই যে, এ ব্যক্তি অজানা কি সব এলোমেলো কথাবার্তা বলে যার উদ্দেশ্য ও অভিপ্রায় কখনো আমাদের বোধগম্য হয়নি।
# যার কাছে না আছে অর্থ-সম্পদ না আছে ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব।
# কোন কোন মুফাসসিরের ধারণা, বাল্যকাল থেকেই হযরত মূসার (আ) কথায় যে তোতলামি ছিল সে বিষয়েই ফেরাউনের এই আপত্তি। কিন্তু এ ধারণা ঠিক নয়। সূরা তোহাতে একথা বলা হয়েছে যে, হয়রত মূসাকে (আ) যে সময় নবুওয়াতের পদ-মর্যাদার ভূষিত করা হচ্ছিলো তখন তিনি আল্লাহর কাছে এই বলে প্রার্থনা করেছিলেন যে আমার কথার জড়তা দূর করে দিন যাতে মানুষ ভালভাবে আমার কথা বুঝতে পারে। সেই সময়ই তাঁর অন্যান্য প্রার্থনার সাথে এই প্রার্থনাও মঞ্জুর করা হয়েছিলো (আয়াতে ২৭ থেকে ৩৬ )। তাছাড়া কুরআন মজীদের বিভিন্ন স্থানে হযরত মূসার (আ) যেসব বক্তৃতা উদ্ধৃত করা হয়েছে তা তাঁর পূর্ণ মাত্রার সাবলীল ভাষার প্রতি ইঙ্গিত করে। অতএব, ফেরাউনের আপত্তির কারণ তাঁর কথার তোতলামি ছিল না। বরং তার আপত্তির বিষয় ছিল এই যে, এ ব্যক্তি অজানা কি সব এলোমেলো কথাবার্তা বলে যার উদ্দেশ্য ও অভিপ্রায় কখনো আমাদের বোধগম্য হয়নি।
# প্রাচীনকালে কোন ব্যক্তিকে যখন কোন এলাকার শাসন কর্তৃত্ব অথবা অন্য দেশে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব নিয়োগ করা হতো তখন বাদশাহর পক্ষ থেকে তাঁকে খেলাত দেয়া হতো যার মধ্যে স্বর্ণ-বলাকা অথবা চুড়িও থাকতো। তার সাথে সিপাই, দণ্ডধারী ও সেবকদের একটি দল থাকতো যাতে তার প্রভাব ও শান শওকত প্রতিষ্ঠিত হয় এবং যে বাদশাহর পক্ষ থেকে সে আদিষ্ট হয়ে আসছে তার জৌলুস ও জাঁকজমক প্রকাশ পায়। ফেরাউনের উদ্দেশ্য ছিল, সত্যিই যদি আসমানের বাদশাহ মূসাকে (আলাইহিস সালাম) আমার কাছে তাঁর দূত বানিয়ে পাঠাতেন তাহলে সে বাদশাহী খেলাত লাভ করতো এবং তাঁর সাথে ফেরেশতাদের অনেক দল আসতো। এ কেমন কথা যে, একজন নিঃস্ব ও সহায়-সম্বলহীন মানুষ হাতে একখানা লাঠি নিয়ে এসে বলছে, ‘আমি বিশ্ব-জাহানের রবের রসূল’।
# এই ছোট্ট আয়াতটিতে একটি অনেক বড় সত্য বর্ণনা করা হয়েছে। যখন কোন ব্যক্তি কোন দেশে তার স্বেচ্ছাচারিতা চালানোর চেষ্টা করে এবং সেজন্য প্রকাশ্যে সব রকমের চক্রান্ত করে। সব রকমের প্রতারণা, শঠতা ও বিশ্বাসঘাতকতার আশ্রয় নেয়। প্রকাশ্যে বিবেক বিক্রির কারবার চালায় এবং যারা বিক্রি হয় না তাদেরকে দ্বিধাহীন চিত্তে পদদালিত করে তখন সে মুখে না বললেও কার্যক্ষেত্র একথা স্পষ্ট করে দেয় যে, প্রকৃতপক্ষে সে ঐ দেশের অধিবাসীদেরকে বুদ্ধি-বিবেক, নৈতিকতা ও সাহসিকতার দিক থেকে গুরুত্বহীন মনে করে এবং তাদের সম্পর্কে এই মত পোষন করে যে, এসব নির্বোধ, বিবেক-বুদ্ধিহীন ও ভীরু লোকগুলোকে আমি যেদিকে ইচ্ছা তাড়িয়ে নিয়ে যেতে পারি। তার এ প্রচেষ্টা যখন সফল হয় এবং দেশের অধিবাসীরা এর অনুগত দাসে পরিণত হয় তখন নিজেদের কাজ দ্বারাই তারা প্রমাণ করে দেয় যে, সেই ঘৃণ্য লোকটি তাদেরকে যা মনে করেছিলো তারা বাস্তবেও তাই। তাদের এই লাঞ্ছনাকর অবস্থায় পতিত হওয়ার আসল কারণ হচ্ছে, তারা মৌলিকভাবে ‘ফাসেক’। হক ও বাতিল এবং ইনসাফ ও জুলুম কি তা নিয়ে তাদের কোন মাথা ব্যাথা থাকে না। সততা, দ্বীনদারী এবং মহত্ব মূল্য ও মর্যাদা লাভের উপযুক্ত না মিথ্যা, বে-ঈমানী এবং নীচতা মূল্য ও মর্যাদা লাভের উপযুক্ত তা নিয়ে তাদের কোন মাথা ব্যাথা থাকে না। এসব বিষয়ের পরিবর্তে ব্যক্তি স্বার্থই তাদের কাছে আসল গুরুত্বের বিষয়। সেজন্য তারা যে কোন জালেমকে সহযোগিতা করতে, যে কোন স্বৈরাচারের সামনে মাথা নত করতে, যে কোন বাতিলকে গ্রহণ করতে এবং সত্যের যে কোন আওয়াজকে দাবিয়ে দিতে প্রস্তুত হয়ে যায়।
# যারা তাদের পরিণাম দেখে শিক্ষা গ্রহণ না করবে এবং তাদের মতই আচরণ করবে তাদের জন্য তারা অগ্রবর্তী আর যারা শিক্ষা গ্রহণ করবে তাদের জন্য শিক্ষণীয় উদাহরণ।

তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
৪৬-৫৬ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

আল্লাহ তা‘আলা মূসা (আঃ)-কে সুস্পষ্ট দলীল ও নির্দশনসহ ফির‘আউন ও তার পরিষদবর্গের কাছে প্রেরণ করেন, যাতে তিনি তাদেরকে এক আল্লাহ তা‘আলার ‘ইবাদত করার জন্য আহ্বান করেন এবং তিনি ছাড়া অন্য কারো ‘ইবাদত করা থেকে বিরত থাকারও আহ্বান জানান। কিন্তু মূসা (আঃ) যখন এ দা‘ওয়াত নিয়ে তাদের নিকট আসলেন তখনই তারা তার প্রতি ঠাট্টা-বিদ্রূপ করল। তাদের এ ঠাট্টা-বিদ্রূপ করার ফলে তারা যখন শাস্তিপ্রাপ্ত হলো তখন বলল : হে জাদুকর! তুমি তোমার প্রভুর কাছে দু‘আ কর যদি তিনি আমাদেরকে এ সকল শাস্তি থেকে মুক্তি দেন তাহলে আমরা তোমার প্রতি ঈমান আনব। অতঃপর তাদের ওপর থেকে শাস্তি দুর করে দেয়া হলেও তারা ঈমান আনল না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন : “এবং যখন তাদের ওপর শাস্তি আসত তখন তারা বলত, ‘হে মূসা! তুমি তোমার প্রতিপালকের নিকট আমাদের জন্য প্রার্থনা কর- তোমার সাথে তিনি যে অঙ্গীকার করেছেন তদনুযায়ী, যদি তুমি আমাদের হতে শাস্তি অপসারিত কর তবে আমরা ঈমান আনবই এবং বানী ইস্রাঈলকেও তোমার সাথে অবশ্যই পাঠিয়ে দেব।’ আমি যখনই তাদের ওপর হতে শাস্তি অপসারিত করতাম এক নির্দিষ্ট কালের জন্য যা তাদের জন্য নির্ধারিত ছিল, তারা তখনই তাদের অঙ্গীকার ভঙ্গ করত।” (সূরা আ‘রাফ ৭ : ১৩৪-১৩৫)

অবশেষে তারা ঈমান আনা থেকে বিরতই থাকল এবং তারা তাদের পূর্ব ধর্মেরই অনুসরণ করতে থাকল আর মূসা (আঃ)-কে অস্বীকার করল।

ফির‘আউন তার বড়ত্ত্ব ও মহত্ত্ব প্রকাশ করে পরিষদবর্গকে বলেছিল, হে আমার সম্প্রদায়! এ মিসরের রাজত্ব কি আমার নয়? এ নদী কি আমার পাদদেশে প্রবাহিত নয়? আর আমি কি ঐ ব্যক্তির থেকে উত্তম নই যে স্পষ্ট ভাষায় কথাও বলতে পারে না? তখন সে বিভিন্ন যুক্তি-তর্কের মাধ্যমে তার সম্প্রদায়কে হতবুদ্ধি করে দিলো।

ফলে তারা মূসা (আঃ)-কে অস্বীকার করল এবং ফির‘আউনের অনুগামী হয়ে থাকল। এভাবেই তারা সত্য পথ হতে বিচ্যুত থাকল। অবশেষে তারা সমুদ্রে নিমজ্জিত হয়ে মৃত্যু বরণ করল।

সুতরাং দাওয়াতী কাজ দেশের শাসক শ্রেণিদের কাছেও পৌঁছাতে হবে, বরং তাদেরকেই আগে দেয়া উচিত, কারণ তাদের মাঝে পরিবর্তন আসলে সারা দেশে পরিবর্তন চলে আসবে। যেমন সুলাইমান (আঃ) দেশের রাণী বিলকিসকে দাওয়াত দিয়েছিলেন। নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রোম ও পারস্যের বাদশাদের কাছে দাওয়াতী পত্র প্রেরণ করেছিলেন।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. একজন দাঈ মানুষকে আল্লাহর দিকে আহ্বান করবে, কোন দল বা মতের দিকে নয়।
২. দাওয়াতী কাজে অনেক বাধা বিপত্তি আসতে পারে তাই বলে হাল ছেড়ে দিলে চলবে না।
৩. যেখানে বেশি উপকার হবে সেখানে প্রথমে দাওয়াত দেয়া উচিত।
৪. পূর্ববর্তী জাতিদের ইতিহাস বর্ণনা করা হয়েছে আমাদের শিক্ষা গ্রহণের জন্য।

তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
৪৬-৫০ নং আয়াতের তাফসীর:

আল্লাহ তাআলা হযরত মূসা (আঃ)-কে স্বীয় রাসূল করে ফিরাউন, তার সভাষদবর্গ, তার প্রজা কিবতী এবং বানী ইসরাঈলের নিকট প্রেরণ করেন, যাতে তিনি তাদেরকে তাওহীদ শিক্ষা দেন এবং শিরক হতে রক্ষা করেন। আল্লাহ তা’আলা তাঁকে বড় বড় মু’জিযাও দান করেন। যেমন হাত উজ্জ্বল হওয়া, লাঠি সর্প হয়ে যাওয়া ইত্যাদি। কিন্তু ফিরাউন ও তার লোকেরা তাঁর কোন মর্যাদা দিলো না। বরং তাঁকে অবিশ্বাস করলো এবং ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে উড়িয়ে দিলো। তখন তাদের উপর আল্লাহর আযাব আসলো যাতে তাদের শিক্ষা লাভ হয় এবং হযরত মূসা (আঃ)-এর উপর দলীলও হয়। তুফান আসলো, ফড়িং আসলো, উকুন আসলো, ব্যাঙ আসলো, শস্য, মাল, ফল ইত্যাদি কমতে শুরু করলো। যখনই কোন আযাব আসতো তখনই তারা অস্থির হয়ে উঠতো এবং হযরত মূসা (আঃ)-কে অনুনয় বিনয় করে বলতো যে, তিনি যেন ঐ আযাব সরিয়ে নেয়ার জন্যে আল্লাহ তা’আলার নিকট দু’আ করেন। এবার আযাব সরে গেলেই তারা ম্মান আনবে। এই ভাবে তারা ওয়াদা-অঙ্গীকার করতো। কিন্তু হযরত মূসা (আঃ)-এর দু’আর ফলে যখন আযাব সরে যেতো তখন আবার তারা হঠকারিতায় লেগে পড়তো। আবার আযাব আসতো এবং তারা ঐরূপ করতো।

(আরবী) অর্থাৎ যাদুকর দ্বারা তারা খুব বড় আলেমকে বুঝাতো। তাদের যুগের আলেমদের উপাধি এটাই ছিল। তাদের যুগের লোকদের মধ্যে এটা একটা ইলম বলৈ গণ্য হতো এবং তাদের যুগে এটা নিন্দনীয় ছিল না। বরং এটা খুব মর্যাদার দৃষ্টিতে দেখা হতো। সুতরাং তাদের হযরত মূসা (আঃ)-কে ‘হে যাদুকর’ বলে সম্বোধন করা সম্মানের জন্যে ছিল, প্রতিবাদ হিসেবে ছিল না। কেননা, তাদের কাজ তো চলেই যেতো। প্রত্যেকবার তারা মুসলমান হয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করতো এবং একথাও বলতো যে, তারা বানী ইসরাঈলকে তাঁর সাথে পাঠিয়ে দিবে। কিন্তু যখনই আযাব সরে যেতো তখন তারা বিশ্বাসঘাতকতা করতো এবং অঙ্গীকার ভঙ্গ করে দিতো। যেমন মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “অতঃপর আমি তাদেরকে পাবন, পঙ্গপাল, উকুন, ভেক ও রক্ত দ্বারা ক্লিষ্ট করি। এগুলো স্পষ্ট নিদর্শন, কিন্তু তারা দাম্ভিকই রয়ে গেল, আর তারা ছিল এক অপরাধী সম্প্রদায়। যখন তাদের উপর শাস্তি আসতো তখন তারা বলতোঃ হে মূসা (আঃ)! তুমি তোমার প্রতিপালকের নিকট আমাদের জন্যে প্রার্থনা কর তোমার সাথে তার যে অঙ্গীকার রয়েছে তদনুযায়ী, যদি তুমি আমাদের উপর হতে শাস্তি অপসারিত কর তবে আমরা তো তোমাকে বিশ্বাস করবোই এবং বানী ইসরাঈলকেও তোমার সাথে যেতে দিবো। অতঃপর যখনই আমি তাদের উপর হতে শাস্তি অপসারিত করতাম এক নির্দিষ্ট কালের জন্যে যা তাদের জন্য নির্ধারিত ছিল, তারা তখনই তাদের অঙ্গীকার ভঙ্গ করতো।”(৭:১৩৩-১৩৫)।
৫১-৫৬ নং আয়াতের তাফসীর:

আল্লাহ তা’আলা ফিরাউনের ঔদ্ধত্য ও আমিত্বের বর্ণনা দিচ্ছেন যে, সে তার কওমকে একত্রিত করে ঘোষণা করলোঃ আমি কি একাই মিসরের বাদশাহ নই? আমার বাগ-বাগীচায় ও প্রাসাদে কি নদীগুলো প্রবাহিত নয়। তোমরা কি আমার শ্রেষ্ঠত্ব ও সাম্রাজ্য দেখতে পাচ্ছ না? আর মূসা (আঃ) এবং তার সঙ্গীদেরকে দেখো তো যে, তারা কেমন দুর্বল ও দরিদ্র! যেমন আল্লাহ তা’আলা অন্য জায়গায় বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “সে সবকে একত্রিত করে বললোঃ আমিই তোমাদের বড় প্রভু। ফলে, আল্লাহ তাকে আখিরাত ও দুনিয়ার শাস্তিতে গ্রেফতার করলেন।”(৭৯:২৩-২৫)

এখানে (আরবী) শব্দটি (আরবী) শব্দের অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। কোন কোন কারীর কিরআতে (আরবী) এরূপও রয়েছে। ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বলেন যে, যদি এই কিরআত শুদ্ধ ও সঠিক হয় তবে অর্থ সম্পূর্ণরূপে স্পষ্ট ও পরিষ্কার হয়ে যাবে। কিন্তু এই কিরআত সমস্ত শহরের কিরআতের বিপরীত। সব জায়গারই কিরআতে (আরবী) শব্দটি (আরবী) বা প্রশ্নবোধক রূপে রয়েছে। মোটকথা, অভিশপ্ত ফিরাউন নিজেকে হযরত মূসা (আঃ) অপেক্ষা উত্তম ও ভাল মনে করলো। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তার এটা মিথ্যা দাবী।

(আরবী) শব্দের অর্থ হলো ঘৃণ্য, দুর্বল, নির্ধন ও মান-সম্মানহীন। ফিরাউন বললো যে, মূসা (আঃ) ভালরূপে কথা বলতে জানেন না, তাঁর ভাষা অলংকার পূর্ণ নয় এবং তিনি বাকপট নন। তিনি তাঁর মনের কথা প্রকাশ করতে পারেন না।

কেউ কেউ বলেন যে, বাল্যকালে হযরত মূসা (আঃ) স্বীয় মুখে আগুনের অঙ্গার পুরে দিয়েছিলেন। ফলে তিনি তোতলা হয়ে গিয়েছিলেন।

আসলে এটাও ফিরাউনের প্রতারণামূলক ও মিথ্যা কথা। হযরত মূসা (আঃ) ছিলেন বাকপটু। তাঁর ভাষা ছিল অলংকারপূর্ণ। তিনি উচ্চ মান-মর্যাদার অধিকারী ও প্রভাবশালী ছিলেন। কিন্তু অভিশপ্ত ফিরাউন আল্লাহর নবী হযরত মূসা (আঃ)-কে কুফরীর চোখে দেখতো বলে তাকে ঐরূপ দেখতো। প্রকৃতপক্ষে সে। নিজেই ছিল ঘৃণ্য ও লাঞ্ছিত। বাল্যকালে হযরত মূসা (আঃ) তার মুখে আগুনের অঙ্গার পুরে দেয়ার কারণে তাঁর কথা যদিও তোতলা হতো, কিন্তু তার তোতলামি যেন দূর হয়ে যায় এজন্যে তিনি মহান আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করেছিলেন। ফলে মহান আল্লাহর দয়ায় তাঁর ঐ তোতলামি ছুটে গিয়েছিল। কাজেই পরে তিনি সুন্দরভাবে তাঁর বক্তব্য জনগণের সামনে পেশ করতে পারতেন এবং তারা তাঁর কথা ভালভাবে বুঝতে পারতো। আর যদি এটা মেনে নেয়াও হয় যে, এরপরেও তাঁর যবানের কিছুটা ত্রুটি রয়ে গিয়েছিল, কেননা তিনি প্রার্থনায় শুধু এটুকুই বলেছিলেনঃ হে আমার প্রতিপালক! আমার জিহ্বার জড়তা আপনি দূর করে দিন, যাতে তারা আমার কথা বুঝতে পারে, তবুও এটা কোন দোষের কথা নয়। আল্লাহ তা’আলা যাকে যেভাবে সৃষ্টি করেন সে সেভাবেই হয়ে থাকে, এতে দোষের এমন কি আছে? আসলে ফিরাউন একটা কথা বানিয়ে নিয়ে তার মূখ প্রজাদেরকে উত্তেজিত ও বিভ্রান্ত করতে চেয়েছিল। যেমন সে বলেছিলঃ মূসা (আঃ)-কে কেন দেয়া হলো না স্বর্ণ-বলয় অথবা তার সাথে কেন আসলো না ফেরেশতারা দলবদ্ধভাবে?’ মোটকথা, সে বহু রকম চেষ্টা চালিয়ে তার প্রজাবর্গকে নির্বোধ বানিয়ে নেয় এবং তাদেরকে তারই মতাবলম্বী করে নেয়। সে নিজেই ছিল পাপী, অপরাধী ও লম্পট।

যখন সে মন খুলে আল্লাহর অবাধ্যাচরণ করেই চললো এবং আল্লাহ তার প্রতি চরমভাবে অসন্তুষ্ট হয়ে গেলেন তখন তার পিঠের উপর আল্লাহর চাবুক পড়লো। প্রবল পরাক্রান্ত আল্লাহ তাকে তার সমুদয় কৃতকর্মের ফল প্রদান করলেন। তাকে সদলবলে সমুদ্রে নিমজ্জিত করা হলো। আর পরকালে সে জাহান্নামে জ্বলতে থাকবে।

হযরত উকবা ইবনে আমির (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যখন তুমি দেখো যে, আল্লাহ কোন মানুষকে ইচ্ছামত দিতে রয়েছেন, আর সে তার অবাধ্যাচরণ করতে রয়েছে তখন তুমি বুঝবে যে, আল্লাহ তাকে অবকাশ দিয়েছেন।” অতঃপর তিনি (আরবী) এই আয়াতটিই তিলাওয়াত করেন।” (এ হাদীসটি ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

হযরত আবদুল্লাহ (রাঃ)-এর সামনে হঠাৎ মৃত্যুর আলোচনা করা হলে তিনি বলেনঃ “মুমিনের উপর এটা খুব সহজ, কিন্তু কাফিরের উপর এটা দুঃখজনক।” তারপর এ আয়াতটি পাঠ করে শুনিয়ে দেন।

হযরত উমার ইবনে আবদিল আযীয (রঃ) বলেন যে, গাফলতি বা অমনোযোগিতার সাথে শাস্তি রয়েছে।

এরপর আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ তৎপর পরবর্তীদের জন্যে আমি তাদেরকে করে রাখলাম অতীত ইতিহাস ও দৃষ্টান্ত। অর্থাৎ পরবর্তী লোকেরা যেন তাদের পরিণাম দেখে শিক্ষা গ্রহণ করে এবং নিজেদের পরিত্রাণ লাভের উপায় অনুসন্ধান করে।

Leave a Reply