Motaher21.net أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ (বই#১১২৫) [ * জিনদের একটি দলকে তোমার কাছে নিয়ে এসেছিলাম, যাতে তারা কুরআন শোনে।:- কুফর ও ঈমানের চূড়ান্ত ফলাফল:-] www.motaher21.net

Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ

(বই#১১২৫)
[ * জিনদের একটি দলকে তোমার কাছে নিয়ে এসেছিলাম, যাতে তারা কুরআন শোনে।:-
কুফর ও ঈমানের চূড়ান্ত ফলাফল:-]
www.motaher21.net

সূরা:৪৬- আল-আহক্বাফ পারা:২৬ ২১-৩৫ নং আয়াত:-
সূরা:৪৬- আল-আহক্বাফ:২১
وَ اذۡکُرۡ اَخَا عَادٍ ؕ اِذۡ اَنۡذَرَ قَوۡمَہٗ بِالۡاَحۡقَافِ وَ قَدۡ خَلَتِ النُّذُرُ مِنۡۢ بَیۡنِ یَدَیۡہِ وَ مِنۡ خَلۡفِہٖۤ اَلَّا تَعۡبُدُوۡۤا اِلَّا اللّٰہَ ؕ اِنِّیۡۤ اَخَافُ عَلَیۡکُمۡ عَذَابَ یَوۡمٍ عَظِیۡمٍ ﴿۲۱﴾
এদেরকে ‘আদের ভাই (হূদ)- এর কাহিনী কিছুটা শুনাও যখন সে আহক্বাফ: তার কওমকে সতর্ক করেছিলো। -এ ধরনের সতর্ককারী পূর্বেও এসেছিলো এবং তার পরেও এসেছে- যে আল্লাহ ছাড়া আর কারো বন্দেগী করো না। তোমাদের ব্যাপারে আমার এক বড় ভয়ংকর দিনের আযাবের আশঙ্কা আছে।
সূরা:৪৬- আল-আহক্বাফ:২২
قَالُوۡۤا اَجِئۡتَنَا لِتَاۡفِکَنَا عَنۡ اٰلِہَتِنَا ۚ فَاۡتِنَا بِمَا تَعِدُنَاۤ اِنۡ کُنۡتَ مِنَ الصّٰدِقِیۡنَ ﴿۲۲﴾
তারা বললোঃ “তুমি কি এ জন্য এসেছো যে, আমাদের প্রতারিত করে আমাদের উপাস্যদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী করে দেবে? ঠিক আছে, তুমি যদি প্রকৃত সত্যবাদী হয়ে থাকো তাহলে আমাদের যে আযাবের ভীতি প্রদর্শন করে থাকো তা নিয়ে এসো।”
সূরা:৪৬- আল-আহক্বাফ:২৩
قَالَ اِنَّمَا الۡعِلۡمُ عِنۡدَ اللّٰہِ ۫ۖ وَ اُبَلِّغُکُمۡ مَّاۤ اُرۡسِلۡتُ بِہٖ وَ لٰکِنِّیۡۤ اَرٰىکُمۡ قَوۡمًا تَجۡہَلُوۡنَ ﴿۲۳﴾
তিনি বললেন, ‘এ জ্ঞান তো শুধু আল্লাহ্‌রই কাছে। আর আমি যা নিয়ে প্রেরিত হয়েছি শুধু তা-ই তোমাদের কাছে প্রচার করি, কিন্তু আমি দেখছি, তোমারা এক মূর্খ সম্প্রদায়।
সূরা:৪৬- আল-আহক্বাফ:২৪
فَلَمَّا رَاَوۡہُ عَارِضًا مُّسۡتَقۡبِلَ اَوۡدِیَتِہِمۡ ۙ قَالُوۡا ہٰذَا عَارِضٌ مُّمۡطِرُنَا ؕ بَلۡ ہُوَ مَا اسۡتَعۡجَلۡتُمۡ بِہٖ ؕ رِیۡحٌ فِیۡہَا عَذَابٌ اَلِیۡمٌ ﴿ۙ۲۴﴾
‘অতঃপর যখন তারা তাদের উপত্যকার দিকে মেঘ আসতে দেখল তখন বলতে লাগল, ‘এ তো মেঘ আমাদেরকে বৃষ্টি দান করবে।’ না, বরং এটাই তো তা, যা তোমারা ত্বারান্বিত করতে চেয়েছ, এক ঝড়, এতে রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।
সূরা:৪৬- আল-আহক্বাফ:২৫
تُدَمِّرُ کُلَّ شَیۡءٍۭ بِاَمۡرِ رَبِّہَا فَاَصۡبَحُوۡا لَا یُرٰۤی اِلَّا مَسٰکِنُہُمۡ ؕ کَذٰلِکَ نَجۡزِی الۡقَوۡمَ الۡمُجۡرِمِیۡنَ ﴿۲۵﴾
‘এটা তার রবের নির্দেশে সব কিছুকে ধবংস করে দেবে।’ অতঃপর তাদের পরিণাম এ হল যে, তাদের বসতিগুলো ছাড়া আর কিছুই দেখা গেল না। এভাবে আমরা অপরাধী সম্পপ্রদায়কে প্রতিফল দিয়ে থাকি।
সূরা:৪৬- আল-আহক্বাফ:২৬
وَ لَقَدۡ مَکَّنّٰہُمۡ فِیۡمَاۤ اِنۡ مَّکَّنّٰکُمۡ فِیۡہِ وَ جَعَلۡنَا لَہُمۡ سَمۡعًا وَّ اَبۡصَارًا وَّ اَفۡـِٕدَۃً ۫ۖ فَمَاۤ اَغۡنٰی عَنۡہُمۡ سَمۡعُہُمۡ وَ لَاۤ اَبۡصَارُہُمۡ وَ لَاۤ اَفۡـِٕدَتُہُمۡ مِّنۡ شَیۡءٍ اِذۡ کَانُوۡا یَجۡحَدُوۡنَ ۙ بِاٰیٰتِ اللّٰہِ وَ حَاقَ بِہِمۡ مَّا کَانُوۡا بِہٖ یَسۡتَہۡزِءُوۡنَ ﴿٪۲۶﴾
আমি তাদেরকে এমন কিছু দিয়েছিলাম যা তোমাদের দেইনি।৩০ আমি তাদেরকে কান, চোখ, হৃদয়-মন সব কিছু দিয়েছিলাম। কিন্তু না সে কান তাদের কোন কাজে লেগেছে, না চোখ, না হৃদয়-মন। কারণ, তারা আল্লাহর আয়াতসমূহ অস্বীকার করতো।তারা সেই জিনিসের পাল্লায় পড়ে গেল যা নিয়ে তারা ঠাট্টা-বিদ্রূপ করতো।
সূরা:৪৬- আল-আহক্বাফ:২৭
وَ لَقَدۡ اَہۡلَکۡنَا مَا حَوۡلَکُمۡ مِّنَ الۡقُرٰی وَ صَرَّفۡنَا الۡاٰیٰتِ لَعَلَّہُمۡ یَرۡجِعُوۡنَ ﴿۲۷﴾
আমি তোমাদের আশে পাশের বহু এলাকার বহু সংখ্যক জনপদ ধ্বংস করেছি। আমি আমার আয়াতসমূহ পাঠিয়ে বার বার নানাভাবে তাদের বুঝিয়েছি, হয়তো তারা বিরত হবে।
সূরা:৪৬- আল-আহক্বাফ:২৮
فَلَوۡ لَا نَصَرَہُمُ الَّذِیۡنَ اتَّخَذُوۡا مِنۡ دُوۡنِ اللّٰہِ قُرۡبَانًا اٰلِـہَۃً ؕ بَلۡ ضَلُّوۡا عَنۡہُمۡ ۚ وَ ذٰلِکَ اِفۡکُہُمۡ وَ مَا کَانُوۡا یَفۡتَرُوۡنَ ﴿۲۸﴾
কিন্তু আল্লাহকে বাদ দিয়ে যেসব সত্তাকে তারা আল্লাহর নৈকট্য লাভের মাধ্যম মনে করে উপাস্য বানিয়ে নিয়েছিলো তারা কেন তাদেরকে সাহায্য করলো না। বরং তারা তাদের থেকে উধাও হয়ে গিয়েছিলো। এটা ছিল তাদের মিথ্যা এবং মনগড়া আকীদা-বিশ্বাসের পরিণাম, যা তারা গড়ে নিয়েছিলো।
সূরা:৪৬- আল-আহক্বাফ:২৯
وَ اِذۡ صَرَفۡنَاۤ اِلَیۡکَ نَفَرًا مِّنَ الۡجِنِّ یَسۡتَمِعُوۡنَ الۡقُرۡاٰنَ ۚ فَلَمَّا حَضَرُوۡہُ قَالُوۡۤا اَنۡصِتُوۡا ۚ فَلَمَّا قُضِیَ وَلَّوۡا اِلٰی قَوۡمِہِمۡ مُّنۡذِرِیۡنَ ﴿۲۹﴾
স্মরণ কর, আমি তোমার প্রতি আকৃষ্ট করেছিলাম একদল জ্বিনকে, যারা কুরআন পাঠ শুনছিল, যখন তারা তার (নবীর) নিকট উপস্থিত হল, তারা একে অপরকে বলতে লাগল, ‘চুপ করে শ্রবণ কর।’ যখন কুরআন পাঠ সমাপ্ত হল, তখন তারা তাদের সম্প্রদায়ের নিকট ফিরে গেল সতর্ককারীরূপে।
সূরা:৪৬- আল-আহক্বাফ:৩০
قَالُوۡا یٰقَوۡمَنَاۤ اِنَّا سَمِعۡنَا کِتٰبًا اُنۡزِلَ مِنۡۢ بَعۡدِ مُوۡسٰی مُصَدِّقًا لِّمَا بَیۡنَ یَدَیۡہِ یَہۡدِیۡۤ اِلَی الۡحَقِّ وَ اِلٰی طَرِیۡقٍ مُّسۡتَقِیۡمٍ ﴿۳۰﴾
তারা বলেছিল, ‘হে আমাদের সম্প্রদায় ! নিশ্চয় আমারা এমন এক কিতাবের পাঠ শুনেছি যা নাযিল হয়েছে মূসার পরে, এটা তার সম্মুখস্থ কিতাবকে সত্যায়ন করে এবং সত্য ও সরল পথের দিকে হেদায়াত করে।
সূরা:৪৬- আল-আহক্বাফ:৩১
یٰقَوۡمَنَاۤ اَجِیۡبُوۡا دَاعِیَ اللّٰہِ وَ اٰمِنُوۡا بِہٖ یَغۡفِرۡ لَکُمۡ مِّنۡ ذُنُوۡبِکُمۡ وَ یُجِرۡکُمۡ مِّنۡ عَذَابٍ اَلِیۡمٍ ﴿۳۱﴾
হে আমাদের কওমের লোকেরা, আল্লাহর প্রতি আহ্বানকারীর আহবানে সাড়া দাও এবং তাঁর প্রতি ঈমান আনো। আল্লাহ‌ তোমাদের গোনাহ মাফ করবেন এবং কষ্টদায়ক আযাব থেকে রক্ষা করবেন।
সূরা:৪৬- আল-আহক্বাফ:৩২
وَ مَنۡ لَّا یُجِبۡ دَاعِیَ اللّٰہِ فَلَیۡسَ بِمُعۡجِزٍ فِی الۡاَرۡضِ وَ لَیۡسَ لَہٗ مِنۡ دُوۡنِہٖۤ اَوۡلِیَآءُ ؕ اُولٰٓئِکَ فِیۡ ضَلٰلٍ مُّبِیۡنٍ ﴿۳۲﴾
আর যে আল্লাহর পক্ষ থেকে আহ্বানকারীর আহবানে সাড়া দেবে না সে না পৃথিবীতে এমন শক্তি রাখে যে আল্লাহকে নিরূপায় ও অক্ষম করে ফেলতে পারে, না তার এমন কোন সাহায্যকারী ও পৃষ্ঠপোষক আছে যে আল্লাহর হাত থেকে তাকে রক্ষা করতে পারে। এসব লোক সুস্পষ্ট গোমরাহীর মধ্যে ডুবে আছে।
সূরা:৪৬- আল-আহক্বাফ:৩৩
اَوَ لَمۡ یَرَوۡا اَنَّ اللّٰہَ الَّذِیۡ خَلَقَ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضَ وَ لَمۡ یَعۡیَ بِخَلۡقِہِنَّ بِقٰدِرٍ عَلٰۤی اَنۡ یُّحۡیِۦَ الۡمَوۡتٰی ؕ بَلٰۤی اِنَّہٗ عَلٰی کُلِّ شَیۡءٍ قَدِیۡرٌ ﴿۳۳﴾
যে আল্লাহ‌ এই পৃথিবী ও আসমান সৃষ্টি করেছেন এবং এগুলো সৃষ্টি করতে যিনি পরিশ্রান্ত হননি তিনি অবশ্যই মৃতদের জীবিত করে তুলতে সক্ষম, এসব লোক কি তা বুঝে না? কেন পারবেন না, অবশ্যই তিনি সব কিছু করতে সক্ষম।
সূরা:৪৬- আল-আহক্বাফ:৩৪
وَ یَوۡمَ یُعۡرَضُ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا عَلَی النَّارِ ؕ اَلَیۡسَ ہٰذَا بِالۡحَقِّ ؕ قَالُوۡا بَلٰی وَ رَبِّنَا ؕ قَالَ فَذُوۡقُوا الۡعَذَابَ بِمَا کُنۡتُمۡ تَکۡفُرُوۡنَ ﴿۳۴﴾
যে দিন এসব কাফেরকে আগুনের সামনে হাজির করা হবে সেদিন তাদের জিজ্ঞেস করা হবে, “এটা কি বাস্তব ও সত্য নয়?” এরা বলবে “হ্যাঁ, আমাদের রবের শপথ, (এটা প্রকৃতই সত্য) ।” আল্লাহ বলবেন : “ঠিক আছে, তাহলে তোমরা যে অস্বীকার করতে তার পরিণতি হিসেবে এখন আযাবের স্বাদ গ্রহণ করো।”
সূরা:৪৬- আল-আহক্বাফ:৩৫
فَاصۡبِرۡ کَمَا صَبَرَ اُولُوا الۡعَزۡمِ مِنَ الرُّسُلِ وَ لَا تَسۡتَعۡجِلۡ لَّہُمۡ ؕ کَاَنَّہُمۡ یَوۡمَ یَرَوۡنَ مَا یُوۡعَدُوۡنَ ۙ لَمۡ یَلۡبَثُوۡۤا اِلَّا سَاعَۃً مِّنۡ نَّہَارٍ ؕ بَلٰغٌ ۚ فَہَلۡ یُہۡلَکُ اِلَّا الۡقَوۡمُ الۡفٰسِقُوۡنَ ﴿٪۳۵﴾
অতএব আপনি ধৈর্য ধারণ করুন যেমন ধৈর্য ধারণ করেছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ রাসূলগণ। আর আপনি তাদের জন্য তাড়াহুড়ো করবেন না। তাদেরকে যে বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে তা যেদিন তারা দেখতে পাবে, সেদিন তাদের মনে হবে, তারা যেন দিনের এক দণ্ডের বেশী দুনিয়াতে অবস্থান করেনি। এ এক ঘোষণা, সুতরাং পাপাচারী সম্প্রদায়কেই কেবল ধ্বংস করা হবে।

ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-

*আদ জাতির ঘটনা : ভিন্ন প্রসঙ্গের এই পর্বটি আলােচ্য সূরায় মূল বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত এবং সাথে সাথে আগের দুটো পর্ব থেকে ভিন্ন মাত্রার একটি বিষয়ের প্রতি তা মানুষের দৃষ্টিকে আকৃষ্ট করছে। বিষয়টি হচ্ছে আ’দ সহ মক্কার আশপাশের বিভিন্ন জাতি ও সম্প্রদায়ের ধ্বংস ও বিলুপ্তির ঘটনা সম্পর্কিত। মক্কার মােশরেকদের সাথে ওদের মিল ছিলাে। কারণ, মােহাম্মদ(স.)-এর সাথে মক্কার মােশরেকরা যে আচরণ করেছে, যে নীতি অবলম্বন করেছে, ঠিক সেই একই আচরণ ও নীতি আ’দ সম্প্রদায় তাদের নবী হুদ(আ.) ও অন্যান্য সম্প্রদায়গুলাে নিজ নিজ নবী রসূলদের ক্ষেত্রে অবলম্বন করেছিলাে। তারা তাদের নবীদের কাছে বিভিন্ন ধরনের আপত্তিকর প্রশ্ন করতাে আর তারাও তাদের নবুওতের দায়িত্ব ও মানবীয় ক্ষমতার আওতায় ভেতর থেকে যতটুকু সম্ভব এর যথাযথ উত্তর দিতে চেষ্টা করতেন। কিন্তু যখন তারা তাদের নবীদের সতর্কবাণীর প্রতি কোনাে ভ্রুক্ষেপ করেনি, তখনই তাদেরকে কঠিন আযাব এসে গ্রাস করে নিয়েছে এবং পৃথিবীর বুক থেকে তাদের চিরতরে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। অথচ তারা ছিলাে শৌর্য বীর্যের অধিকারী। কিন্তু এই শৌর্য বীর্য তাদেরকে এই ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে পারেনি। তারা ছিলাে অঢেল ধন সম্পদের অধিকারী। কিন্তু এই ধন সম্পদও তাদেরকে রক্ষা করতে পারেনি। তারা ছিলাে অপূর্ব মেধা ও মননশীলতার অধিকারী। কিন্তু এই মেধা ও মননশীলতা তাদের কোনােই কাজে আসেনি। এমনকি আল্লাহর নৈকট্য লাভের আশায় ওরা যেসব দেবদেবীর পূজা অর্চনা করতাে, সেগুলােও তাদেরকে ধবংসের হাত থেকে রক্ষা করতে পারেনি। এ সকল ঘটনা মক্কার মােশরেকদেরকে তাদের একই পথ ও আদর্শের অধিকারী পূর্বপুরুষদের ধ্বংসের মুখােমুখি এনে দাঁড় করায়। ফলে এর মাধ্যমে তারা নিজেদের করুণ পরিণতিকেই প্রত্যক্ষ করতে পারবে। এ সকল ঘটনা তাদেরকে রেসালাতের সরল, আবহমান ও নিরবিচ্ছিন্ন ধারায় সামনে এনেও দাঁড় করায়। এই সেই ধারা যা একক ও অভিন্ন উৎস হতে উৎসারিত, যার কোনাে পরিবর্তন নেই, কোনাে বিবর্তন নেই। কারণ, সকল যুগের সকল নবী রসূলের মূল আকিদা ও আদর্শ হচ্ছে অভিন্ন, এর মূল অত্যন্ত গভীরে প্রােথিত এবং এর শাখা প্রশাখা কাল থেকে কালান্তরে বিস্তৃত। ‘আ’দ সম্প্রদায়ের ভাইয়ের কথা স্মরণ করাে, তার আগে ও পরে অনেক সতর্ককারী গত হয়েছিলাে…'(আয়াত ২১) আলােচ্য আয়াতে আ’দ সম্প্রদায়ের ভাই বলতে হুদ(আ.)-কে বুঝানাে হয়েছে। পবিত্র কোরআন তাকে আদ সম্প্রদায়ের ভাই বলে আখ্যায়িত করে সম্প্রদায়ের সাথে তার যে ভ্রাতৃত্ব ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক ছিলো সে কথা বুঝাতে চায় অর্থাৎ এই সম্পর্কের দাবী ছিলাে, হুদ(আ.)-এর আহ্বানে সাড়া দেয়া, তার প্রতি সদাচরণ করা এবং সর্বোপরি তার প্রতি সুধারণা পােষণ করা। ঠিক একই ধরনের সম্পর্ক ছিলাে শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ(সা.) ও তার সম্প্রদায়ের মাঝে। অথচ তারা তার সাথে বৈরী ও শত্রুতামূলক আচরণ করছিলাে। বালুর উঁচু টিলাকে আরবীতে ‘হিকফুন’ বলা হয়। এরই বহুবচন হচ্ছে ‘আহকাফুন। আরব উপদ্বীপের বিভিন্ন উঁচু টিলাতে আ’দ জাতি বসবাস করত। আলােচ্য আয়াতে আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রিয় নবীকে আ’দ সম্প্রদায়ের ভাই অর্থাৎ হুদ(আ.)-এর ঘটনা স্মরণ করতে বলছেন। উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রিয় নবীকে সান্ত্বনা দেয়া এবং এ কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া যে, তারই মতাে একজন নবী ভাই হওয়া সত্তেও সম্প্রদায় ও লােকজনের কাছ থেকে কি ধরনের তাচ্ছিল্য ও অবজ্ঞাপূর্ণ আচরণ পেয়েছেন। অনুরূপ আচরণ তিনিও আত্মীয়তার সম্পর্ক থাকা সত্তেও নিজ সম্প্রদায়ের কাছ থেকে পাচ্ছেন। কাজেই তিনি এই ঘটনার বিষয়ে অবগত হয়ে নিজ সম্প্রদায়ের লােকদেরকে তাদের অশুভ পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করে দেবেন। কারণ অতীতে যারাই এ ধরনের আচরণ করেছে তারাই এই অশুভ পরিণতির শিকার হয়েছে। তারা দূরের কেউ নয়, বরং তারা এদের আশপাশেরই এলাকার লােকজন। হুদ(আ.) তাঁর সম্প্রদায়ের লােকজনকে সতর্ক করেছিলেন। এ কাজ তিনি একাই করেননি, তার আগেও নবী রসূলরা একই কাজ করেছেন। তারাও নিজ নিজ সম্প্রদায়ের লােকজনকে সতর্ক করেছেন, অর্থাৎ দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ এবং নবুওত ও রেসালাতের দায়িত্ব যুগ যুগ ধরে নিরবিচ্ছিন্নভাবে চলে আসছে। এটা নতুন বা আজগুবি কোনাে বিষয় নয়, বরং এটা অতি পরিচিত ও চিরাচরিত একটা বিষয়। আল্লাহ তায়ালা ব্যতীত অন্য কারাে এবাদাত করা যাবে না—এ বিষয়েই হুদ(আ.) সহ অন্যান্য নবী রসূলরা মানুষকে সতর্ক করে দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, বরং তিনি সুস্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিচ্ছেন যে, ‘আমি তােমাদের জন্যে এক মহা দিবসের শাস্তির আশঙ্কা করছি।’ এর অর্থ হচ্ছে একমাত্র আল্লাহর এবাদাতকে মনের বিশ্বাস এবং জীবনের আদর্শ হিসেবে গণ্য করতে হবে। এর বিপরীত করলে পৃথিবীতে অথবা পরকালে অথবা উভয় ক্ষেত্রেই কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে। আলােচ্য আয়াতে, মহান দিবস বলতে কেয়ামতের কঠিন মুহূর্তকে বুঝানাে হয়েছে। হুদ(আ.)- কর্তৃক আল্লাহর পথে এই আহ্বান ও কঠিন শাস্তির ভয় দেখানাের উত্তরে তার সম্প্রদায়ের লােকেরা যে তাচ্ছিল্যপূর্ণ উত্তর দিয়েছিলাে তার ভাষা হচ্ছে এই, ‘তুমি কি আমাদেরকে আমাদের উপাস্য দেবদেবী থেকে দুরে সরাতে এসেছে? যদি তুমি সত্যবাদী হয়ে থাকো তাহলে আমাদেরকে যে বিষয়ের (শাস্তির) ওয়াদা দাও, তা নিয়ে আসাে'(আয়াত ২২) তাদের এই উত্তরে এক ধরনের কুধারণা, নির্বুদ্ধিতা, সতর্ককারীর প্রতি চ্যালেঞ্জ, আসমানী গযবকে ত্বরান্বিত করার আবদার, বিদ্রুপ ও অন্বীকৃতি এবং মিথ্যার ওপর অটল থেকে তা নিয়ে গর্ব করার মনােবৃত্তি প্রকাশ পাচ্ছে। অপরদিকে আল্লাহর নবী হুদ(আ.) এসব বিষয় নবীসুলভ উদারতা ও নিরপেক্ষতার মাধ্যমে মােকাবেলা করছেন। তার মাঝে কোনাে অহমিকাবােধ নেই এবং নেই কোনাে সীমালংঘন। অত্যন্ত নরম ও বিনয়ী ভাষায় তিনি বলছেন, ‘এ জ্ঞান তাে আল্লাহর কাছেই রয়েছে। আমি যে বিষয়সহ প্রেরিত হয়েছি, তা তােমাদের কাছে পৌছাই। কিন্তু আমি দেখছি তােমরা সত্যিই এক মূর্খ সম্প্রদায়'(আয়াত ২৩) অর্থাৎ আমাদের দায়িত্ব হলাে, তােমাদেরকে সতর্ক করে দেয়া এবং আসমানী গযবের ব্যাপারে তোমাদেরকে হুঁশিয়ার করে দেয়া। এই গযব কখন পতিত হবে এবং এর ধরণ ধারণ কি হবে, এসব আমার জানার বিষয় নয়, বরং আমি তাে তার থেকে একজন বার্তাবাহক মাত্র। এর অতিরিক্ত কিছু জানার বা করার শক্তি আল্লাহ তায়ালা আমাকে দেননি। তবে তােমাদের এসব দাবী দাওয়ার পেছনে তােমাদের বােকামীই কাজ করছে বলে আমি মনে করি। কারণ একজন হিতাকাংখী ও পরমাত্মীয় যিনি তােমাদেরকে আসন্ন আসমানী গযবের ব্যাপারে সতর্ক করছে তাকে চ্যালেঞ্জ করা বা অস্বীকার করার মতাে বড় বােকামী ও মূর্খতা আর কী হতে পারে?
*আ’দ জাতির ওপর আল্লাহর গযব : হুদ(আ.) ও তার সম্প্রদায়ের মধ্যকার এই দীর্ঘ বিতর্কের প্রসঙ্গ সংক্ষিপ্ত করে পরবর্তী চূড়ান্ত প্রসঙ্গের প্রতি আয়াতের বক্তবা মােড় নিচ্ছে। সেই চূড়ান্ত প্রসঙ্গটি হচ্ছে হুদ(আ.)-এর সম্প্রদায়ের চ্যালেঞ্জের জবাব এবং তারা দ্রুত যে বিষয়টির কামনা করেছিলাে তার বাস্তবায়ন। বলা হয়েছে, ‘তারা যখন শাস্তিকে মেঘরূপে তাদের উপত্যকা অভিমুখী দেখলাে, তখন বললাে, এ তাে মেঘ, আমাদেরকে বৃষ্টি দেবে…’(আয়াত ২৪-২৫) আলােচ্য আয়াত দু’টোর ব্যাখ্যায় বিভিন্ন বর্ণনায় এসেছে যে, গােটা আদ জাতি প্রচন্ড গরম ও খরা আক্রান্ত হয়ে পড়েছিল। অসহনীয় তাপদাহ গােটা পরিবেশকে ভারাক্রান্ত করে রেখেছিলাে। সেই সংকটময় মুহূর্তে একখন্ড মেঘ তাদের দিকে ভেসে আসে। সেটা দেখে তারা অত্যন্ত আনন্দিত হয়। সেটাকে বরণ করে নেয়ার জন্যে তারা উপত্যকায় নেমে আসে। তারা মনে করেছিলাে এ মেঘ তাদের জন্যে বৃষ্টি বহন করে এনেছে । তাই আনন্দে তারা বলে উঠেছিলাে, ‘এ তাে হচ্ছে মেঘ, আমাদেরকে বৃষ্টি দেবে’… কিন্তু নেপথ্য থেকে সত্যের কণ্ঠ ধ্বনিত হয়ে তাদেরকে জানিয়ে দেয়, বরং এটা সেই বস্তু যা পাওয়ার জন্যে তােমরা অধীর হয়ে পড়েছিলে। এটা এমন বায়ু যাতে রয়েছে মর্মন্তুদ শাস্তি যা তার পালনকর্তার আদেশে সব কিছুকে ধ্বংস করে দেবে। এই আসমানী আযাব টর্নেডাে যেখানেই আঘাত হেনেছে সেখানেই সবকিছুকে তছনছ ও নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। পবিত্র কোরআনের বর্ণনায় বায়ুকে জীবন্ত, সংবেদনশীল ও প্রলয়ঙ্করী রূপে প্রকাশ করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে, ‘যে বায়ু তার প্রভুর নির্দেশে সব কিছুকেই ধ্বংস করে দেয়।’… এর দ্বারা পবিত্র কোরআন মানব জাতির মন মস্তিষ্কে এই সত্যটিকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায় যে, এই জগতের প্রতিটি বস্তু জীবন্ত, এর প্রতিটি শক্তি সংবেদনশীল এবং নিজ স্রষ্টার নির্দেশের ব্যাপারে সচেতন। ফলে নির্দেশ পাওয়ার সাথে সাথে তা কার্যকর করতে সচেষ্ট হয়ে পড়ে। মানব জাতিও এই বিশাল জগতের অন্যতম একটি শক্তি। যখন প্রকৃত ঈমান তার মাঝে সৃষ্টি হয়, যখন জ্ঞান ও দিব্য দৃষ্টির আলোকে তার হৃদয় উদ্ভাসিত হয়, তখন সে তার চারপাশের জাগতিক শক্তিগুলাে অনুভব করতে সক্ষম হয়। তখন সে এগুলাের সাথে একাত্ম হয়ে যায় এবং সেগুলােও জীবন্ত ও সচেতন বস্তুর ন্যায় তার সাথে একাত্ম হয়ে যায়। এখানে জীবন ও সংবেদনশীলতার স্বাভাবিক মানব পরিচিত রূপের কোনােই প্রয়ােজন হয় না। কারণ, প্রতিটি বস্তুর মাঝেই আত্মা রয়েছে ও জীবন রয়েছে। তবে আমরা তা সাধারণত উপলব্ধি করতে পারি না। কারণ, দৃশ্যমান জগত আমাদের সামনে অদৃশ্য জগতের সব কিছুকেই আড়াল করে রেখেছে। আমাদের আশপাশে যে জগত দৃশ্যমান এর অন্তরালে রয়েছে অসংখ্য গােপন রহস্য তা কেবল দিব্যদৃষ্টির মাধ্যমেই অবলােকন করা যায়, বাহ্যিক দৃষ্টিতে নয়। আলােচ্য আয়াতে বর্ণিত বায়ু আল্লাহর নির্দেশ যথাযথভাবে পালন করেছে এবং সব কিছুকেই তছনছ করে দিয়েছে। ফলে সেখানে ধ্বংসপ্রাপ্ত লােকগুলাের শূন্য ভিটের চিহ্ন ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট থাকেনি। তারা নিজেরা, তাদের গবাদি পশু, তাদের আসবাবপত্র এবং তাদের ধনদৌলত পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে পড়ে। তাদের সামান্য চিহ্নটুকু অবশিষ্ট থাকেনি। তাদের ভিটে বাড়ীগুলাে ঠিকই ছিল, কিন্তু তা ছিলাে নির্জন ও ভূতুড়ে। সেখানে কোনাে ঘরও ছিলাে না। এমনকি কোনাে চুলাও ছিলাে না। ‘আর এভাবেই আমি অপরাধী সম্প্রদায়কে শাস্তি দিয়ে থাকি।’ অর্থাৎ অপরাধী জাতিগুলােকে শায়েস্তা করার নিয়মে কোনােই ব্যত্যয় ঘটবে না। ধ্বংসও বিনয়ের এই ভয়ঙ্কর দৃশ্য উপস্থাপন করার পর এবার অনুরূপ মন মানসিকতার অধিকারী উপস্থিত লােকদের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করা হচ্ছে এবং তাদের মনে আতঙ্ক ও কাপুনি জাগিয়ে তােলার জন্যে বলা হচ্ছে, ‘আমি তাদেরকে যে ক্ষমতা দিয়েছিলাম তা তােমাদেরকে দেইনি। আমি তাদেরকে কর্ণ, চক্ষু ও হৃদয় দিয়েছিলাম কিন্তু তা তাদের কোনাে কাজে আসলাে না'(আয়াত ২৬) অর্থাৎ আমার নির্দেশপ্রাপ্ত বায়ুর আঘাতে যারা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলাে তাদেরকে আমি যে শক্তি সামর্থ, ধন দৌলত, জ্ঞান বিজ্ঞান ও সহায় সম্পদ দান করেছিলাম তা তােমাদেরকে দান করিনি। এছাড়া তাদেরকে আমি কর্ণ, চক্ষু ও অন্তরও দান করেছিলাম। এখানে উল্লেখ্য যে, পবিত্র কোরআন মানুষের চিন্তা শক্তিকে কখনও হৃদয় (কলব), কখনও অন্তর (ফুয়াদ), কখনও বুদ্ধি (লুব) আবার কখনও জ্ঞান (আকল) শব্দ দিয়ে ব্যক্ত করে। এ সব কটি শব্দ দ্বারা কোনাে না কোনােভাবে মানুষের অনুভূতি ও অনুধাবন শক্তিই বুঝানাে হয়ে থাকে। কিন্তু এ সকল ইন্দ্রিয় শক্তি তাদের কোনােই কাজে আসেনি। কারণ, এগুলােকে তারা অকেজো করে রেখেছিলাে, আবৃত করে রেখেছিলাে। তার প্রমাণ হলাে, ‘ওরা আল্লাহর নিদর্শনগুলােকে অস্বীকার করেছিলাে। আর যারা আল্লাহর প্রকাশ্য নিদর্শনগুলােকে জেনে শুনে অস্বীকার করে তারা প্রকৃতপক্ষে নিজেদের ইন্দ্রিয় শক্তিগুলােকে মিটিয়ে দেয়, অকার্যকর করে ফেলে। ফলে তাদের মাঝে কোনাে অনুভূতি থাকে না, কোনাে চিন্তাশক্তি থাকে না এবং থাকে না কোনাে দিব্যদৃষ্টি। আর সে কারণেই যে আসমানী গযব নিয়ে তারা ঠাট্টা বিদ্রুপে লিপ্ত হয়েছিলাে, সেই গযবই তাদেরকে পেয়ে বসে। এ ঘটনা থেকে প্রত্যেক বিবেক বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে এই শিক্ষাই গ্রহণ করতে হবে যে, নিজের শক্তি, ধন ও বিদ্যার ব্যাপারে কেউ যেন আত্মপ্রবঞ্চনার শিকার না হয়ে পড়ে। কারণ, প্রকৃতির মাঝে যে শক্তি রয়েছে তা সে ক্ষমতাবান, ধনবান ও জ্ঞানবানদের ওপর চেপে বসলে আর রক্ষা নেই, তাদেরকে একেবারে নিশ্চিহ্ন করে ছেড়ে দেবে। তখন তাদের ভিটে বাড়ী ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়বে না। নাফরমান ও অপরাধীদেরকে আল্লাহ তায়ালা এভাবেই পাকড়াও করেন। এটা তার অমােঘ বিধান।

*প্রকৃতির ওপর আল্লাহর নিয়ন্ত্রণ : আল্লাহর নির্ধারিত জাগতিক নিয়ম অনুসারে বায়ু স্বয়ংক্রিয় শক্তির অধিকারী। কোন কিছুকে ধ্বংস করার ইচ্ছা করলে আল্লাহ তায়ালা এই শক্তি প্রয়ােগ করেন। তখন এই শক্তি জাগতিক নিয়মের অধীনেই পরিচালিত হয় এবং নির্ধারিত প্রাকৃতিক বিধান মােতাবেকই কাজ করে থাকে। কাজেই প্রাকৃতিক নিয়ম লংঘনের আদৌ কোনো প্রশ্ন ওঠে না, যেমনটি সংশয়বাদীরা মনে করে থাকে। প্রাকৃতিক বিধানের যিনি স্ৰষ্টা তিনিই প্রতিটি বস্তুকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণে সৃষ্টি করে রেখেছেন। কোনাে ঘটনা, কোনাে ক্রিয়া, কোনাে লক্ষ্য, কোনাে ব্যক্তি বা কোনাে বস্তুই এই প্রাকৃতিক নিয়ম ও নির্ধারিত পরিমাণের বাইরে নয়। অন্যান্য প্রাকৃতিক শক্তির মতাে বায়ুও আল্লাহর নির্দেশে কাজ করে এবং প্রাকৃতিক নিয়মের অধীনেই পরিচালিত হয়ে থাকে। তেমনিভাবে মানবশক্তিও আল্লাহর নির্দেশ ও ইচ্ছানুযায়ী কাজ করে থাকে। মানবশক্তির সহায়ক শক্তি হিসেবে আল্লাহ তায়ালা নিজ ইচ্ছা ও পছন্দ অনুযায়ী বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তিকে নিয়ােজিত রেখেছেন। তাই মানুষ যখন কোনাে কাজের উদ্যোগ নেয় তখন সে এই জগতে তার নির্ধারিত ভূমিকা পালন করার জন্যেই তা নেয়। এর মাধ্যমে সে আল্লাহর ইচ্ছা ও অভিপ্রায়েরই বাস্তবায়ন ঘটায়। এ ক্ষেত্রে তার বাক্তিগত ইচ্ছা ও পছন্দ অপছন্দ প্রকৃতির সামগ্রিক বিধানেরই একটা অংশ মাত্র। এর মাধ্যমে জগতের সাধারণ নিয়ম শৃংখলার মাঝে একটা ভারসাম্য রক্ষা হয়। জগতের প্রতিটি বস্তুই একটা নির্ধারিত নিয়ম ও সীমা রক্ষা করে চলছে। এতে কোনাে ব্যতিক্রম নেই, অনিয়ম নেই। আদ সম্প্রদায়সহ মক্কার আশেপাশের অন্যান্য সম্প্রদায়ের করুণ পরিণতির বিবরণ থেকে শিক্ষা গ্রহণের জন্য এবং উদ্বুদ্ধ করার জন্যে এই পর্বটির শেষে বলা হচ্ছে, ‘আমি তােমাদের আশপাশের জনপদসমূহ ধ্বংস করে দিয়েছি এবং বার বার আয়াতসমূহ শুনিয়েছি যাতে তারা ফিরে আসে…’(আয়াত ২৭-২৮) আরব উপদ্বীপে বসবাসকারী যেসব সম্প্রদায় তাদের নবী রসূলদেরকে অস্বীকার করেছে, তাদেরকে আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীর বুক থেকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছেন। যেমন দক্ষিণাঞ্চলের আদ সম্প্রদায়, উত্তরাঞ্চলের হিজর নামক নগরে বসবাসকারী সামুদ সম্প্রদায়, ইয়েমেনের সাবা সম্প্রদায় এবং মাদইয়ান সম্প্রদায় যারা মদীনা ও সিরিয়ার মধ্যবর্তী এলাকায় বসবাস করত। তেমনিভাবে লূত সম্প্রদায় যাদের বাস ছিলাে উত্তরাঞ্চলে। এই অঞ্চল দিয়ে মক্কার লােকেরা গ্রীষ্মকালীন বাণিজ্য সফরে যেতাে। এ সকল সম্প্রদায়ের লােকদেরকে আল্লাহ তায়ালা সঠিক পথের সন্ধান দেয়ার জন্যে বিভিন্ন ধরনের নিদর্শন তাদের সামনে তুলে ধরেছেন। কিন্তু তারা তাদের ভ্রান্তপথেই থেকে গেছে। ফলে তিনি তাদের ওপর কঠিন শাস্তি নাযিল করেছেন। এই শাস্তি ছিলাে বিভিন্ন আকৃতি ও প্রকৃতির এবং এগুলাে পরবর্তী লােকজনদের জন্যে শিক্ষার ঘটনা হিসেবে রয়ে গেছে। এসব ঘটনা জেনে তারা যেন সতর্ক হতে পারে । মক্কার মােশরেক সম্প্রদায় এসব ঘটনার নীরব সাক্ষী স্থানগুলাে দিয়ে অহরহ যাতায়াত করতাে। তাই আল্লাহ তায়ালা আলােচ্য আয়াতের মাধ্যমে তাদের দৃষ্টি সেই চিরন্তন সত্যের দিকেই আকৃষ্ট করছেন এবং তাদেরকে জানিয়ে দিচ্ছেন যে, তাদের পূর্ববর্তী কাফের ও মােশরেক সম্প্রদায়গুলােকে তিনি ধ্বংস করে দিয়েছেন। তাদের কল্পিত দেবদেবীরা তাদেরকে এই ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে পারেনি, অথচ তারা মনে করতাে, এদের পূজা অর্চনা করলে আল্লাহর অসন্তুষ্টি ও গযবই তাদের ভাগ্যে জুটেছে। এই বাস্তব সত্যটির প্রতিই ইংগিত করে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহর পরিবর্তে তারা যাদেরকে সান্নিধ্য লাভের জনাে উপাস্যরূপে গ্রহণ করেছিলাে, তারা তাদেরকে সাহায্য করলাে না কেন?'(আয়াত ২৮) ওরা এদেরকে সাহায্য করা তাে দূরে থাক, বরং এদেরকে একা ফেলে রেখে পালিয়ে গিয়েছে। তাই বলা হয়েছে, ‘এটা ছিলাে তাদের মিথ্যা ও মনগড়া বিষয়’ ওদের এসব পরিণতি ধ্বংস ও বিনাস ছাড়া আর কিছুই নয়। কাজেই যারা আল্লাহর সান্নিধ্য ও নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে দেবদেবীর পূজা অর্চনা করে থাকে তারা এই পরিণতির বাইরে আর কী আশা করতে পারে? তাদের পরিণতি তাে এটাই হতে বাধ্য।
*জ্বিনদের ঈমান আনার ঘটনা : আলােচ্য সূরার এই পর্বে জিনদের ঈমান আনার ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে যারা পবিত্র কোরআনের তেলাওয়াত শুনতে পেয়ে অন্যদেরকেও তা নীরবে নিশব্দে শােনার জন্যে ডেকেছিলাে। তাদের মনে প্রশান্তি এসেছিলাে এবং ঈমানের আলােকে তা উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিলাে। তারা নিজেদের সম্প্রদায়ের কাছে ফিরে গিয়ে তাদেরকে আল্লাহর প্রতি ঈমান গ্রহণের জন্যে আহ্বান জানিয়েছিলাে। সাথে সাথে তাদেরকে পরকালের ক্ষমা ও মুক্তির সুসংবাদ জানিয়ে নাফরমানী ও গােমরাহীর অশুভ পরিণতি সম্পর্কে সতর্কও করেছিলাে। এখানে তাদের ঘটনাটি একটি অতীত বিষয়ের রূপে আলােচিত হয়েছে। পবিত্র কোরআনের মধুর বাণীতে তাদের হৃদয় মন কতটুকু উদ্বেলিত ও প্রভাবিত হয়েছিলাে তা সুন্দরভাবে রূপায়িত হয়েছে তাদের এই বাক্যটিতে ‘চুপ থাকো’ অর্থাৎ কোরআনের বাণী তাদের কানে এসে ঝংকৃত হওয়ার সাথে সাথে তারা তা মনোযোগ সহকারে শুনতে থাকে এবং পরস্পরকে চুপ থাকতে বলে। আলােচ্য পর্বে জিনদলের ঘটনা ও তাদের বক্তব্য মানুষের মনকে নাড়া দেয়ার জন্যেই উল্লেখ হয়েছে। এই ঘটনা সত্যই মানব হৃদয়ে গভীর রেখাপাত করে। কারণ পবিত্র কোরআন মূলত তাদের হেদায়াতের জন্যে এসেছে। অথচ এর দ্বারা জ্বিন জাতিও হেদায়াত লাভ করছে। জ্বিন দলের যে বক্তব্য এখানে উদ্ধৃত হয়েছে তা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, পবিত্র কোরআন ও মূসা(আ.)-এর ওপর নাযিলকৃত তাওরাত একই সূত্র হতে উৎসারিত। উভয়টি আসমানী কিতাব। এই সত্যটি জ্বিন জাতি উপলব্ধি করতে পারলাে, অথচ মানব জাতি তা পারলাে না। ওদের এই সত্য উপলব্ধির মাঝে একটা গভীর আবেদন রয়েছে যা আলােচ্য সূরার মূল বিষয়ে সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। জ্বিন দলের বক্তব্যের মাঝে বিশ্বজগতের প্রকাশ্য নিদর্শনগুলাের প্রতি সুস্পষ্ট ইংগিত রয়েছে এবং এর দ্বারা এই সত্যটিই বুঝানাে হয়েছে যে, যিনি আসমান ও যমীন সৃষ্টি করতে পারেন তিনিই মৃতকে পুনরায় জীবিত করার ক্ষমতাও রাখেন। অথচ এই সত্যটিকে অনেকেই স্বীকার করতে চায় না, বরং এ নিয়ে তর্ক বিতর্কে লিপ্ত হয়। পুনরুত্থান সম্পর্কে আলােচনার মাঝে কেয়ামতের একটি ভয়াবহ দৃশ্য বর্ণনা করতে গিয়ে বলা হয়েছে, ‘সেদিন কাফেরদেরকে জাহান্নামের সামনে পেশ করা হবে'(আয়াত ৩৪) সূরার শেষে রসূলুল্লাহ(স)-এর প্রতি উপদেশ রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা তাকে ধৈর্যধারণ করতে বলেছেন এবং কাফেরদের শাস্তির ব্যাপারে তাড়াহুড়া না করে তা নির্ধারিত সময়ের জন্যে ছেড়ে দিতে পরামর্শ দিয়েছেন। আর এই নির্ধারিত চরম সময়টি খুবই নিকটবর্তী, যেন ঘন্টাখানেক পরেই আসবে। কাজেই সেই চরম মুহূর্তটি আসার আগেই তাদেরকে এই সতর্কবাণী পৌছিয়ে দিতে হবে। পবিত্র কোরআন অত্যন্ত বিনয় ও আদবের সাথে শােনার পর জ্বিন দলটি যে বক্তব্য পেশ করেছে তাতে পূর্ণ ঈমান ও বিশ্বাসের মূল বিষয়গুলাে এসেছে। অর্থাৎ ওহীকে সত্য বলে বিশ্বাস করা, তাওরাত ও কোরআনের প্রতি অভিন্ন বিশ্বাস পােষণ করা, পবিত্র কোরআন যে সত্যের সন্ধান দেয়, তা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করা, পরকালের হিসাব নিকাশ, সংকর্মের পুরস্কার এবং অসৎ কর্মের শাস্তিসহ অন্যান্য বিষয়গুলাে বিশ্বাস করা, সৃষ্টি ও লালন পালনের একক ক্ষমতার অধিকারীরূপে আল্লাহকে বিশ্বাস করা এবং সাথে সাথে এও বিশ্বাস করা যে, যিনি জগত সৃষ্টির ক্ষমতা রাখেন তিনি মৃতদেরকে পুনরায় জীবিতও করতে পারেন। এসব বিষয় ছাড়াও অন্যান্য যেসব বিষয় এই সূরাতে আলােচিত হয়েছে তা সবই জ্বিন দলটির বক্তব্য হিসেবে এসেছে যারা মানব জাতি থেকে ভিন্ন একটি জাতি। উল্লেখিত জ্বিন দলটির বক্তব্য আলােচনা করার আগে খােদ জ্বীন জাতি সম্পর্কে এবং তাদের এই ঘটনা সম্পর্কে দু-একটি কথা বলতে চাই ।   *জ্বিন সম্পর্কে কোরআন হাদীসের বক্তব্য : জিন বলতে কোনাে প্রাণী আছে কিনা, তাদেরকে কেন্দ্র করে এমন কোনাে ঘটনা আদৌ ঘটেছে কিনা, তারা আরবী ভাষায় নাযিলকৃত কোরআনের ভাষা বুঝতে পারে কিনা, তারা মােমেন বা কাফের হতে পারে কিনা, তারা হেদায়াতপ্রাপ্ত বা পথভ্রষ্ট হওয়ার মতাে যোগ্যতা রাখে কিনা এসব কয়টি প্রশ্নের নিষ্পত্তি খােদ কোরআন বর্ণিত এই ঘটনাটি দ্বারাই হয়ে যায়-যাতে স্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছে যে, জিন জাতির একটি বিশেষ দল পবিত্র কোরআন শোনার জন্যে রসূলুল্লাহ(স.)-এর কাছে গিয়েছিলাে এবং তারা এই বলেছিলাে ও এই করেছিলাে। এই অকাট্য ও সন্দেহাতীত প্রমাণের অতিরিক্ত আর কিছু বলার প্রয়ােজন আছে বলে আমরা মনে করি না। কারণ স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা দলীল প্রমাণের মাধ্যমে যে বিষয়টির নিষ্পত্তি করছেন, পুনরায় তার নিষ্পত্তির ক্ষমতা ও অধিকার কোনাে মানুষের থাকতে পারে না। তারপরেও মানবীয় দৃষ্টিভংগি থেকে বিষয়টি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছি আমাদের আশপাশে যে জগত দৃশ্যমান তা রহস্যে পূর্ণ, তাতে রয়েছে অজানা অচেনা অনেক সৃষ্টি ও শক্তি। আমরা এসব অজানা শক্তি ও রহস্যের কোলে বাস করছি। এ সবের কিছু কিছু আমাদের জানা, তবে এর অধিকাংশই অজানা। প্রতিদিন আমরা নতুন নতুন রহস্য ও শক্তি উদঘাটন করছি এবং এদের সম্পর্কে জানতে পারছি। অনেক সৃষ্টিকে তার আসল পরিচয়ে আমরা জানতে পারছি। আবার কখনও জানতে পারছি এদের গুণাগুণ ও বৈশিষ্টের মাধ্যমে। আবার কখনও জানতে পারছি আমাদের পারিপার্শ্বিক জগতে বিদ্যমান তাদের বিভিন্ন নিদর্শনের মাধ্যমে। এ বিশাল জগত সম্পর্কে আমাদের যে জ্ঞান, তা এখনও প্রাথমিক স্তরেই রয়ে গেছে। কারণ এই বিশাল জগতের যে স্থানটুকুতে আমরা বাস করছি, আমাদের পূর্বপুরুষরা বাস করেছেন এবং যেখানে আমাদের ভবিষ্যত বংশধররা বাস করবে তা এই বিশাল জগতের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র একটি অংশ মাত্র। নিখিল বিশ্বের বিশাল আকৃতি ও পরিমাপের তুলনায় আমাদের আবাসস্থল পৃথিবী নামক এই গ্রহটি উল্লেখ করার মতাে কিছুই নয়। জ্ঞান বিজ্ঞানের এই প্রাথমিক স্তরে থেকেও আমরা এ পর্যন্ত যা কিছু জানতে পেরেছি তা কেবল পাঁচশতক পূর্বের জানা বিষয়াদির তুলনায় জ্বিন জাতির অস্তিত্বের চেয়েও অনেক অনেক বেশী রহস্যপূর্ণ ও বিস্ময়সমূহের। যে অণু পরমাণুর রহস্য সম্পর্কে আজ আমরা আলাপ আলােচনা করছি, তা যদি পাঁচশত বছর আগের কারাে সাথে করতাম তাহলে তা আমাদেরকে নির্ঘাত পাগল ঠাওরাতাে, অথবা এটাকে তারা জ্বীনের চেয়েও আজগুবী ও বিস্ময়কর একটি বিষয় বলে মনে করতাে। আমরা যা কিছু জানছি, যা কিছু আবিষ্কার করছি তা আমাদের মানবীয় ক্ষমতায় আওতায়ই করছি। এই শক্তি ও ক্ষমতা পৃথিবীর বুকে খেলাফতের দায়িত্ব পালনের জন্যেই আমাদেরকে আল্লাহ তায়ালা দান করেছেন। কাজেই এই খেলাফতের দায়িত্ব পালনের জন্যে যতটুকু প্রয়োজন এবং যতটুকু সহায়ক, কেবল ততটুকুই জানা ও আবিষ্কারের জন্যে আমাদেরকে ক্ষমতা ও শক্তি দেয়া হয়েছে। প্রকৃতি ও পরিধির দিক দিয়ে আমাদের জ্ঞান ও আবিষ্কার এই প্রয়ােজনের সীমাকে কখনও অতিক্রম করতে পারবে না। মানবতার আয়ুষ্কাল যতােই দীর্ঘায়িত হােক না কেন, জগতের বিভিন্ন শক্তি আমাদের যতােই করায়ত্ত হোক না কেন এবং এই জগতের বিভিন্ন রহস্য যতােই উদঘাটিত হােক না কেন, আমাদের জানা ও আবিষ্কার এই সীমারেখাকে কখনও অতিক্রম করবে না। এটাই আল্লাহর ইচ্ছা, এটাই আল্লাহর হেকমত। ভবিষ্যতে আমরা আরাে অনেক কিছু আবিষ্কার করতে পারবাে, আরাে অনেক কিছু জানতে পারবাে, এই সৃষ্টিজগতের অনেক অজানা রহস্য ও তথ্য উদঘাটন করতে পারবাে। যার ফলে হয়ত অণু পরমাণুর রহস্য এ সবের তুলনায় বাচ্চাদের খেলনা বলে মনে হবে। কিন্তু তা সত্তেও আমাদের পক্ষে মানবীয় জ্ঞানের সীমারেখা অতিক্রম করা সম্ভব হবে না এবং সম্ভব হবে না আল্লাহর এই বক্তব্যকে অতিক্রম করা যে, ‘তােমাদেরকে সামান্য জ্ঞানই দান করা হয়েছে….’ হাঁ, এই বিশাল জগতের অন্তর্নিহিত রহস্যাদির তুলনায় আমাদের জ্ঞান খুবই নগণ্য ও সামান্য। এসব রহস্যের প্রকৃত জ্ঞান একমাত্র সেই আল্লাহরই রয়েছে যিনি এসবের সৃষ্টিকর্তা ও লালনকর্তা। তিনি যে অসীম জ্ঞানের অধিকারী আর মানবজাতির জ্ঞানের আওতা ও এর উপায়-উপকরণ যে সীমিত সে সত্যটি পবিত্র কোরআনের এই আয়াতেই প্রতিফলিত হয়েছে, ‘পৃথিবীতে যত বৃক্ষ আছে, সবই যদি কলম হয় এবং সমুদ্রের সাথেও সাত সমুদ্র যুক্ত হয়ে যদি কালি হয়, তবুও তার বাক্যাবলী শেষ করা যাবে না'(লোকমান ২৭) এই যখন আমাদের অবস্থা তখন আমাদের দৃষ্টির বাইরে অজানা রহস্যময় জগতের কোনাে কিছু আছে কি না আছে এবং তা বােধগম্য কি বােধগম্য নয়, এ ব্যাপারে জোর দিয়ে কিছু বলা আমাদের সাজে না। তাছাড়া আমাদের দেহের মাঝেই যে রহস্য লুকায়িত আছে, এর মাঝে যেসব মন্ত্র ও শক্তি কাজ করছে সেটাই তাে আমরা এখনও পুরােপুরিভাবে জানতে পারিনি, আমাদের মস্তিষ্ক ও আত্মার ভেদ সম্পর্কে জানবাে কি করে? এমন অনেক রহস্য থাকতে পারে যার অস্তিত্ব ও প্রকৃতি প্রচলিত নিয়মের আওতায় জানা সম্ভব নয়। বড় জোর এর বিশেষ কোনাে গুণ, বিশেষ কোনাে প্রভাব অথবা এর নিছক অস্তিত্বের প্রমাণ জানা যেতে পারে। কারণ, পৃথিবীর বুকে খেলাফত বা আল্লাহর প্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করার জন্যে এ সবের জ্ঞান লাভ করা জরুরী নয়। এখন যদি আল্লাহ তায়ালা তার ঐশী বাণীর মাধ্যমে এসব রহস্য ও শক্তি সম্পর্কে আমাদের প্রয়ােজন অনুসারে কোনাে তথ্য জানিয়ে দেন যা আমাদের সহজাত যােগ্যতা ও প্রতিভার ওপর ভিত্তি করে করা কোনাে গবেষণা বা পরীক্ষালব্ধ ফলাফল নয়, তাহলে সেটা আমাদেরকে অত্যন্ত বিনয় ও কৃতজ্ঞতার সাথে গ্রহণ করতে হবে, তাতে কোনাে কম বেশী করা চলবে না। কারণ যে একক উৎস থেকে আমরা এই জ্ঞান লাভ করছি তিনি আমাদেরকে এই নির্ধারিত পরিমাণই জানিয়েছেন, তার বেশী নয়। তিনি ব্যতীত এসব রহস্য সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান লাভ করার আর কোনাে উৎস নেই। আলােচ্য আয়াতের বক্তব্য, সূরা জ্বিন এর বক্তব্য, জ্বিন সম্পর্কিত কোরআনের বিভিন্ন বক্তব্য এবং আলােচ্য ঘটনা সম্পর্কিত একাধিক বিশুদ্ধ হাদীসের বক্তব্যের আলােকে আমরা জ্বিন জাতি সম্পর্কে যে তথ্য পাই তা সামান্য, বেশী কিছু নয়। এ তথ্যের আলােকে বলা যায় যে, জ্বিন হচ্ছে একটা বিশেষ জাতি যাদেরকে আগুন দ্বারা সৃষ্টি করা হয়েছে। আদম(আ.)-এর সম্পর্কে বক্তব্য দিতে গিয়ে ইবলিস নিজেই বলেছে, ‘আমি ওর তুলনায় উত্তম, আমাকে তুমি আগুন দিয়ে সৃষ্টি করেছে, আর ওকে সৃষ্টি করেছে মাটি দিয়ে’ এখানে উল্লেখ্য যে, ইবলিস হচ্ছে জ্বিন জাতিরই সদস্য। এ সত্যটি স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা প্রতিষ্ঠিত করে বলেছেন, কেবল ইবলিই (সেজদা) করেনি, আর সে ছিলাে জিন জাতির অন্তর্ভুক্ত। ফলে সে নিজ প্রতিপালকের নির্দেশ অমান্য করে। এর দ্বারা প্রমাণিত হয়, জ্বিন ও ইবলিস একই জাতের অন্তর্ভুক্ত। কোরআন ও হাদীসের আলােকে আরাে জানা যায় যে, জ্বিন জাতির স্বভাব ও বৈশিষ্ট মানব জাতির স্বভাব ও বৈশিষ্ট থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। যেমন জীনের সৃষ্টি আগুন থেকে, জ্বিন মানুষকে দেখতে পায়, কিন্তু মানুষ জ্বিনকে দেখতে পায় না। ইবলিস সম্পর্কে বলতে গিয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘সে এবং তার দলবল তােমাদেরকে দেখে, যেখানে থেকে তােমরা তাদেরকে দেখতে পাও'(আ’রাফ ২৭) মানুষের মতাে জ্বীনেরাও দল ও সমাজবদ্ধভাবে বসবাস করে, মানুষের মতাে তাদেরও গােষ্ঠী ও সমাজ আছে। ওপরে বর্ণিত আয়াতে সে কথা বলা হয়েছে। মানুষের মতাে জ্বীনেরাও এই পৃথিবীতে বাস করছে। তবে কোথায় বাস করছে, তা নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব নয়। বাস যে করছে তা সঠিক। কারণ আল্লাহ তায়ালা যখন আদম(আ.)-কে জান্নাত থেকে পৃথিবীতে অবতরণ করতে বলেছেন, তখন ইবলিসকেও সে নির্দেশ দিয়েছিলেন। যেমন পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, আমি বললাম, তােমরা নেমে যাও। তােমরা একে অপরের শত্রু হবে এবং তােমাদেরকে সেখানে কিছুকাল অবস্থান করতে হবে এবং সেখানে তােমাদের (জীবন যাপনের) যাবতীয় উপকরণ থাকবে।’ (বাকারা-৩৬) যে সকল জ্বিনকে সােলায়মান(আ.)-এর করায়ত্ত করে দেয়া হয়েছিলাে তারা পৃথিবীতে এমন এমন কাজ সমাধা করতো যার জন্যে তাদের জীবন ধারণের শক্তির অধিকারী হওয়া আবশ্যক ছিলাে। পৃথিবীর বুকে জীবিত থাকার শক্তি যেমন এদের আছে, তেমনি পৃথিবীর বাইরেও জীবিত থাকার শক্তি এদের আছে। এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, (জিনরা বললাে) আমরা আকাশ পর্যবেক্ষণ করেছি, অতপর দেখতে পেয়েছি যে, কঠোর প্রহরী ও উল্কাপিন্ড দ্বারা আকাশ পরিবেষ্টিত। আমরা আকাশের বিভিন্ন ঘাটিতে সংবাদ শােনার জন্যে বসতাম। এখন কেউ সংবাদ শুনতে চাইলে সে দেখবে জ্বলন্ত উল্কাপিন্ডকে পেতে রাখা হয়েছে'(সূরা জ্বিন ৮-৯) জ্বিন জাতির আর একটি বৈশিষ্ট হচ্ছে যে, এরা মানুষের ইন্দ্রিয় শক্তির ওপর প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে। তেমনিভাবে আল্লাহর নেক বান্দা ব্যতীত অন্যান্য ভ্রষ্ট লােকদেরকে পরিচালনা হয়েছে, এ সম্পর্কে ধিকৃত ইবলিস শয়তানের উক্তি উদ্ধৃত করে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, সে বললাে, তােমার মর্যাদার কসম, আমি অবশ্যই তাদের সবাইকে বিপথগামী করে ছাড়বো। তবে তাদের মধ্যে যারা তােমার খাটি বান্দা, তাদেরকে নয়'(ঝুমার ৮২-৮৩) এছাড়া আরো একাধিক আয়াতে অনুরূপ উক্তির উদ্ধৃতি এসেছে। তবে শয়তান মানুষকে কিভাবে এবং কোন উপায়ে বিভ্রান্ত ও পথভ্রষ্ট করে তা আমাদের জানা নেই। জ্বিন জাতির আর একটি বৈশিষ্ট হচ্ছে, এরা মানুষের কণ্ঠস্বর শুনতে পায় এবং মানুষের মুখের ভাষাও এরা বুঝতে পারে। এর প্রমাণ খােদ আলােচ্য আয়াতটি, যাতে বলা হয়েছে যে, একদল জ্বিন পবিত্র কোরআন শুনে এবং এর মর্মার্থ উপলব্ধি করে প্রভাবিত হয়েছিলাে। জ্বিন জাতির আরাে একটি বৈশিষ্ট্য হলো, এরা হেদায়াতও লাভ করতে পারে এবং পথভ্রষ্টও হতে পারে। এ সম্পর্কে সূরা জ্বিন এ বলা হয়েছে, আমাদের কিছুসংখ্যক আজ্ঞাবহ এবং কিছুসংখ্যক অন্যায়কারী। যারা আজ্ঞাবহ হয়, তারা সৎপথ বেছে নিয়েছে। আর যারা অন্যায়কারী, তারা তাে জাহান্নামের ইন্ধন।(সূরা জ্বিন ১৪-১৫) এছাড়া আলােচ্য আয়াতে এও বলা হয়েছে যে, জ্বীনের দলটি পবিত্র কোরআনের মধুর বাণী শুনে নিজ সম্প্রদায়ের কাছে ফিরে গিয়ে তাদেরকে ঈমানের দাওয়াত দিয়েছিলাে এবং তাদেরকে পরকালের ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছিলাে। তারা নিজেরা আগে ঈমান গ্রহণ করার পর যখন বুঝতে পারলাে যে, তাদের জাতির মাঝে এই ঈমান নেই, তখন তারা তাদেরকে ঈমানের জন্যে আহ্বান করে। জিন জাতি সম্পর্কে এই সুপ্রতিষ্ঠিত ও প্রামাণ্য নক্তব্য পেশ করার পর বিনা দলীল প্রমাণে এর অতিরিক্ত কিছু বলা সমীচীন নয়। বাকী আলােচ্য আয়াতে এবং সর্বাধিক গ্রহণযােগ্য মতানুসারে গােটা সূরা জ্বিন- এ যে ঘটনাটি উল্লেখ করা হয়েছে তার সমর্থনে একাধিক বিশুদ্ধ হাদীস পাওয়া যায়। নিচে কয়েকটি উল্লেখ করছি। ইমাম বুখারী, ইমাম আহমদ ও ইমাম বায়হাকী নিজ নিজ কিতাবে বিশিষ্ট সাহাবী ইবনে আব্বাস(রা.)-এর বরাত দিয়ে উল্লেখ করেছেন যে, রসূলুল্লাহ(স.) জ্বিনদের সামনে তেলাওয়াত করেননি এবং তাদের দেখেননি। রসূলুল্লাহ(স.) এক দল সাহাবীকে নিয়ে ওকায বাজারের দিকে রওয়ানা হলেন। এ সময় শয়তানদের মাঝে এবং আসমানী সংবাদের মাঝে বাধা সৃষ্টি করা হয়েছিলাে। তাদের ওপর উল্কাপিন্ড নিক্ষিপ্ত হয়েছিলাে। তখন শয়তানরা স্বজাতির কাছে ফিরে গেলাে। তারা বললাে, তােমাদের কি হয়েছে? তারা উত্তরে বলল, আমাদের মাঝে এবং আসমানী সংবাদের মাঝে বাধা সৃষ্টি করা হয়েছে এবং আমাদের ওপর উল্কাপিন্ড নিক্ষেপ করা হয়েছে। তখন তারা পৃথিবীর আনাচে কানাচে ছড়িয়েছিলাে এবং খুঁজতে লাগল, কি ঘটেছে যার ফলে তাদের মাঝে ও আসমানী সংবাদের মাঝে বাধার সৃষ্টি হল। যে দলটি তেহামার দিকে গিয়েছিলাে তারা রসূলুল্লাহ(স.)-এর দিকে অগ্রসর হল। তারা তাকে একটি খেজুর বাগানের পাশে পেল, তিনি তখন উকায বাজারের দিকে যাচ্ছিলেন। তিনি সেখানে তাঁর সাহাবাদেরকে নিয়ে ফজরের নামায আদায় করছিলেন। তারা যখন কোরআনের তেলাওয়াত শুনতে পেল তখন মনযােগ দিয়ে তা শুনতে লাগল এবং বলে উঠলো, আল্লাহর কসম, এই জিনিসটিই আমাদের মাঝে ও আসমানী সংবাদের মাঝে বাধার সৃষ্টি করেছে। সেখান থেকে ফিরে গিয়ে তারা স্বজাতিকে লক্ষ্য করে বললাে, ‘হে আমাদের জাতি! আমরা একটি অদ্ভূত কোরআন শুনতে পেয়েছি যা সত্যপথের সন্ধান দেয়। তাই আমরা সেটার ওপর বিশ্বাস এনেছি। আমরা আর কখনও আমাদের প্রভুর সাথে কাউকে শরীক করবাে না।’ আল্লাহ তায়ালা তার নবীর প্রতি ওহী নাযিল করলেন, বল, আমার প্রতি ওহী এসেছে যে, একদল জিন মনোযোগ সহকারে (কোরআন) শুনেছে …..’ বস্তুত জিনদের বক্তব্য রসূলকে ওহীর মাধ্যমে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। ইমাম মুসলিম, ইমাম আবু দাউদ এবং ইমাম তিরমিযী, বিশিষ্ট তাবেয়ী আলকামাহর বরাতে দিয়ে বর্ণনা করেছে যে, তিনি একদিন ইবনে মাসউদ(রা.)কে জিজ্ঞেস করলেন, যে রাতে জ্বীনদের ঘটনা ঘটেছিলাে সে রাতে আপনাদের মধ্য থেকে কেউ কি রসূলুল্লাহ(স.)-এর সাথে ছিলেন? তিনি বললেন, না, আমাদের কেউ সে রাতে রসূলের সাথে ছিলাে না। কিন্তু অন্য এক রাতে আমরা তার সাথে ছিলাম, সে রাতে আমরা তাকে হারিয়ে ফেলেছিলাম। তাকে আমরা বিভিন্ন উপত্যকা ও মালভূমিতে খুঁজতে লাগলাম। আমরা বলাবলি করতে লাগলাম। তাকে কি উড়িয়ে নেয়া হলাে, নাকি তাকে হত্যা করা হলাে। আমরা অত্যন্ত দুশ্চিন্তার মাঝে রাতটি কাটালাম। ভাের হওয়ার পর আমরা দেখতে পেলাম যে, তিনি হেরা গুহার দিক থেকে আসছেন। তখন আমরা বললাম, হে আল্লাহর রসূল! আমরা আপনাকে হারিয়ে ফেলেছিলাম, তাই আপনাকে আমরা খুঁজেছি, কিন্তু আপনাকে আমরা পাইনি। ফলে আমরা অত্যন্ত দুশ্চিন্তার মাঝে রাত কাটিয়েছি। তিনি উত্তরে বললেন, আমার কাছে জিন জাতির একজন প্রতিনিধি এসেছিলাে, তার সাথে আমি গিয়েছি এবং তাদের সামনে কোরআন তেলাওয়াত করে শুনিয়েছি। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ(রা.) বলেন, রসূল(স.) আমাদেরকে নিয়ে গিয়ে সে জ্বিনদের চিহ্ন এবং তাদের আগুনের চিহ্ন দেখালেন। তারা রসূলকে তাদের খাদ্যবস্তু সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, আল্লাহর নামে যবাই করা পশুর যে কোনাে হাড় তােমাদের হাতের নাগালে পড়বে সেটাই তােমাদের জন্যে বৈধ হবে এবং তা গোশতে পরিপূর্ণ হয়ে যাবে। অপরদিকে যে কোনাে পশুর ল্যাদা ও গােবর তােমাদের পশুর জন্যে খাবার হিসেবে গণ্য হবে। তাই রসূলুল্লাহ(স.) তাঁর সাহাবীদেরকে বললেন, ‘তােমরা ভাইদের খােরাক এ দুটো জিনিস দ্বারা এস্তেঞ্জা করবে না, কারণ সেগুলাে তােমাদের খোরাক।’ (জিন) জ্বিন দলের এই ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে ইবনে হিশাম রসূলুল্লাহ(স.)-এর জীবন চরিত্রে উল্লেখ করেছেন যে, রসূলের চাচা আবু তালিবের মৃত্যুর পর যখন মক্কায় তাঁর বিরুদ্ধে এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে নির্যাতন ও অত্যাচারের মাত্রা বৃদ্ধি পায় তখন তিনি ছাকীফ গােত্রের সাহায্য কামনায় তায়েফে গিয়েছিলেন। কিন্তু ছাকীফ গােত্রের লােকেরা তার সাথে চরম দুর্ব্যবহার করে। তার পেছনে বখাটে ছেলে পেলেদের লেলিয়ে দেয়। তারা তার দুই পায়ে পাথর মেরে মেরে রক্তাক্ত করে দেয়। তখন তিনি নিজ প্রভুর কাছে সেই হৃদয়স্পর্শী ও গভীর আবেদনময় দোয়াটি করেন এবং বলেন, ‘হে মাবুদ! আমার দুর্বলতা, আমার অসহায়ত্ব ও মানুষের বিরুদ্ধে আমার অক্ষমতার কথা তােমাকেই জানাচ্ছি। হে পরম দয়াময়, তুমি দুর্বল ও নির্যাতিত মানুষের মালিক। আমার মালিকও তুমি। তুমি আমাকে কার হাতে ছেড় দিচ্ছাে? কোনাে দূরবর্তী স্থানে নিয়ে যাচ্ছ-যেখানে আমি অবাঞ্ছিত বিবেচিত হবাে? অথবা এমন কোনাে শত্রুর হাতে কি আমাকে ছেড়ে দিচ্ছো যাকে আমার দন্ডমুন্ডের মালিক বানিয়েছে? আমার প্রতি তােমার যদি কোন আক্রোশ না থাকে, তাহলে আমার কোনােই দুঃখ নেই। তবে তােমার নিরাপত্তা আমার জন্যে প্রশস্ততর হােক, সেটাই আমার কাম্য। তােমার আলােময় চেহারার আশ্রয় কামনা করছি, যার আলােকচ্ছটায় অন্ধকার দূরীভূত হয়েছে, যার বদৌলতে দুনিয়া ও আখেরাতের কাজ সঠিক ধারায় প্রবাহিত হয়েছে, তুমি আমার প্রতি তােমার গজব নাযিল করাে না, আমার প্রতি তােমার ক্রোধ নিপতিত করো না। শাস্তির মালিক তুমি, রাযী থাকার মালিকও তুমি, তুমি ব্যতীত কারাে কোনাে সহায় নেই, শক্তি নেই। ইবনে হিশাম বলেন, এরপর রসূলুল্লাহ(স.) ছাকীফ গোত্রের ব্যবহারে হতাশ হলে মক্কার উদ্দেশ্যে তায়েফ ত্যাগ করেন। পথে এক খেজুর বাগানে তিনি আশ্রয় নেন এবং মধ্যরাতে নামায আদায়ে মগ্ন হয়ে যান। তখন তার পাশ দিয়ে একদল জ্বিন যাচ্ছিলাে যাদের কথা পবিত্র কোরআনে উল্লেখ করা হয়েছে। এদের সংখ্যা যতদূর আমি জানি-ছিলাে সাত। তারা সবাই ছিলাে নুসাইবী গোত্রের জ্বিন। তারা তখন রাসূল(স.)-এর তেলাওয়াত শুনতে থাকে। তার নামায শেষ হয়ে গেলে তারা সেখান থেকে নিজেদের লােকদের কাছে ফিরে যায় এবং তাদেরকে সতর্ক করে দেয়। তারা যা শুনেছিলাে তার প্রতি ঈমান এনেছে। জ্বিন দলের ঘটনাটি আল্লাহ তায়ালা তার রসূল(স.)-কে ওহীর মাধ্যমে জানান এবং আলােচ্য সূরার আয়াত নং ২৯ হতে আয়াত নং ৩১ ও সুরা জ্বিন নাযিল করেন। ইবনে হিশামের যরাত দিয়ে ইবনে ইসহাকের এই বর্ণনার ব্যাপারে ইবনে কাসীর তাঁর তাফসীর গ্রন্থে মন্তব্য করে বলেন, ঘটনা ঠিক, কিন্তু সে রাতে জ্বিন দল কোরআন শুনেছে বলে যে মন্তব্য করা হয়েছে সে সম্পর্কে কিছু বলার আছে। কারণ, ইবনে আব্বাসের বর্ণনায় জানা যায় যে, জিন দলের কোরআন শরীফ শােনার ঘটনাটি ঘটেছিলাে ওহীর প্রথম যুগে। আর রসূলুল্লাহ(স.)-এর তায়েফ যাত্রা হয়েছিলাে তার চাচা আবু তালিবের ইন্তেকালের পর অর্থাৎ হিজরতের এক দুই বছর আগে। ইবনে ইসহাক সেটি বলেছেন। এই ঘটনা সম্পর্কে আরাে অনেক বর্ণনা পাওয়া যায়। তবে আমরা এর মধ্য থেকে কেবল ইবনে আব্বাসের বর্ণনাটিই গ্রহণ করছি। কারণ, এই বর্ণনাটি পবিত্র কোরআনের বক্তব্যের সাথে সবচেয়ে সামঞ্জস্যপূর্ণ। যেমন ‘সূরা জিন’ এ বলা হয়েছে, ‘বলাে, আমার প্রতি ওহী নাযিল করা হয়েছে যে, জ্বিনদের একটি দল কোরআন শ্রবণ করেছে’, এই আয়াতই অকাট্য প্রমাণ পেশ করে যে, জ্বিন দলের ঘটনাটি রসূলুল্লাহ(স.) ওহীর মাধ্যমে জেনেছিলেন, তিনি জ্বিনদেরকে দেখতে পাননি এবং তাদের উপস্থিতিও অনুভব করতে পারেননি। তাছাড়া ইবনে আব্বাসের এই বর্ণনাটি সনদের দিক থেকে শক্তিশালী এবং এটি এই বিশেষ ক্ষেত্রটিতে এসে ইবনে ইসহাকের বর্ণনার সাথে মিলে গেছে। তদুপরি পবিত্র কোরআনে জ্বিনদের যে বৈশিষ্ট বর্ণনা করা হয়েছে তার সাথে এই বর্ণনাটি সঙ্গতিপূর্ণ। জ্বিনদের বৈশিষ্ট হলাে, এরা মানুষকে দেখতে পায়, কিন্তু মানুষ তাদেরকে দেখতে পায় না। কাজেই ঘটনার সত্যতা যাচাইয়ের জন্যে এই বিশুদ্ধ বর্ণনাটিই যথেষ্ট। আলোচ্য আয়াতে বলা হয়েছে, ‘যখন আমি একদল জিনকে তােমার প্রতি আকৃষ্ট করেছিলাম, তারা কুরআন পাঠ শুনছিলাে…'(আয়াত ২৯) আয়াতের বক্তব্য দ্বারা সুস্পষ্টভাবে বুঝা যায় যে, আল্লাহ তায়ালা নিজেই জীনের ওই দলটিকে কোরআন শােনার জন্যে সেখানে নিয়ে গিয়েছিলেন। এটা কোনাে দৈব বা আকস্মিক ঘটনা ছিলাে না। আল্লাহর অভিপ্রায় ছিলাে যে, জ্বিন জাতি মূসা(আ.)-এর নবুওতের ব্যাপারে যেমন অবগত ছিলাে তেমনিভাবে সর্বশেষ নবুওতের ব্যাপারেও তারা অবগত হােক, এর প্রতি ঈমান আনুক এবং নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করুক, যে জাহান্নাম কেবল শয়তানদের জন্যেই নয় বরং মানব দানব সকলের জন্যেই সৃষ্টি করা হয়েছে। এই বারাে তের জন জ্বীনের দলটির ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে পবিত্র কোরআন যে দৃশ্য চিত্রায়িত করেছে তা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। পবিত্র কোরআনের মধুর বাণী তাদের হৃদয় মনে কি পরিমাণ আবেগ অনুভূতি এবং বিনয় ও ভক্তির উদ্রেক করেছিলাে তা এই ছােট্ট কথাটির মাঝেই সুন্দরভাবে প্রতিফলিত হয়েছে, যখন তারা সেখানে উপস্থিত হলাে, তখন তারা বললেন, ‘চুপ থাকো’। এই ছােট্ট কথাটির মাঝে যে ব্যঞ্জনা আমরা পাই তার দ্বারাই বুঝা যায় যে, পবিত্র কোরআন শােনার গােটা মুহূর্তটিতে তাদের মনের অবস্থা কি ছিলাে। এরপর বলা হয়েছে, ‘অতপর যখন পাঠ সমাপ্ত হলাে, তখন তারা তাদের সম্প্রদায়ের কাছে সতর্কবাণী রূপে ফিরে গেলাে… এই ছােট্ট, বাক্যটিতেও সেই একই চিত্র ফুটে উঠেছে, যার মাধ্যমে আমরা জ্বিনদের মনে পবিত্র কোরআন শােনার কারণে কি প্রভাব সৃষ্টি হয়েছিলাে তা উপলব্ধি করতে পারি। তারা শেষ পর্যন্ত অত্যন্ত মনযােগ সহকারে এবং চুপচাপ কোরআনের তেলাওয়াত শুনেছিলে। তেলাওয়াত শেষ হওয়ার সাথে সাথে তারা দেরী না করে তাড়াতাড়ি নিজেদের লােকদের কাছে ছুটে চলে যায় কারণ, তাদের হৃদয় মনে ও আবেগ অনুভূতিতে যে পরিবর্তন এসেছিলাে তা নিয়ে চুপ করে বসে থাকা বা অপেক্ষা করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। এটা ছিলাে তাদের জন্যে একটি নতুন অনুভূতি যা তাদের হৃদয় মনকে ভরে দিয়েছিলাে এবং তাদের এমন প্রচন্ড ও অদম্য প্রভাবের সৃষ্টি করেছিলাে যার ফলে তারা ক্ষিপ্রতার সাথে ছুটে চলে যায় এবং প্রবল আগ্রহ ও উদ্দীপনা নিয়ে বিষয়টি অন্যকে জানাতে যায়। তারা বললাে, হে আমাদের সম্প্রদায়, আমরা এমন এক কিতাব শুনেছি যা মূসার পর অবতীর্ণ হয়েছে। এ কেতাব পূর্ববর্তী সব কেতাবের সত্যায়ন করে, সত্যধর্ম ও সরল পথের দিকে পরিচালিত করে।’ (আয়াত ৩০) অর্থাৎ তারা তাড়াতাড়ি তাদের সম্প্রদায়ের লােকদের কাছে ছুটে গিয়ে জানায় যে, তারা একটি নতুন কিতাবের বাণী শুনতে পেয়েছে যা মূসা(আ.)-এর পরে অবতীর্ণ হয়েছে। এই কিতাব মূল বিষয়গুলাের ক্ষেত্রে মূসা(আ.)-এর কিতাবকে সত্য প্রমাণিত করে। এর দ্বারা বুঝা যায় যে, জ্বিনেরা মূসা(আ.)-এর কিতাব সম্পর্কে জানতাে। তাই শােনার সাথে সাথে উভয়টির মধ্যকার সম্পর্ক তারা বুঝতে সক্ষম হয়, যদিও তারা হয়তাে কোরআনের সেই আয়াতগুলােতে মূসা(আ.) ও তার কিতাবের নাম শুনতে পায়নি। কিন্তু সে সবের প্রকৃতি ও ধরন ধারণই তাদের জানিয়ে দিচ্ছিলাে যে, সেগুলাে সে একই উৎস থেকে উৎসারিত যা থেকে উৎসারিত হয়েছে মূসা(আ.)-এর কিতাব। এই জ্বিন জাতি যারা অনেকটা মানবীয় জীবনের প্রভাববলয় থেকে দূরে বসবাস করে তাদের পক্ষ থেকে কেবল কোরআনের বাণী শুনেই এই ধরনের সাক্ষ্য প্রদান করাটা খুবই অর্থবহ ও তাৎপর্যপূর্ণ। এরপর তাদের হৃদয়ের অনুভূতি ও উপলব্ধি এই ভাষায় ব্যক্ত করে, সেই কিতাব সত্যধর্ম ও দৃঢ় পথের দিকে পরিচালিত করে।’ সত্য ও সঠিক পথের সন্ধানের ক্ষেত্রে পবিত্র কোরআনের প্রভাব অপরিমেয় ও অপরিসীম। যে বিবেক স্বচ্ছ ও অবিকৃত তা কখনও এই প্রভাবের সামনে বাধা হয়ে দাড়াতে পারে না। যে হৃদয় অংহকারমুক্ত, গর্বমুক্ত ও রিপুরবন্ধনমুক্ত তা কখনও এই প্রভাবকে প্রতিহত করতে পারে না। বরং পবিত্র কোরআনের অদম্য প্রভাব প্রথম স্পর্শেই এ জাতীয় হৃদয় মনকে নাড়া দিয়ে দেয়। ফলে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই তা কোরআনের সত্যতার ব্যাপারে সাক্ষ্য দিয়ে বলে ওঠে, ‘এই কিতাব সত্যধর্ম দৃঢ় ও সঠিক পথের দিকে পরিচালিত করে।’ এরপর জ্বিনের দল অত্যন্ত আগ্রহ ও উদ্দীপনা নিয়ে এবং বিশ্বাস ও আস্থা নিয়ে নিজেদের সম্প্রদায়ের লােকদের কাছে ছুটে যায় এবং তাদেরকে এই সত্যের ব্যাপারে সজাগ করে তােলে। কারণ, এটাকে তারা নিজেদের একটা কর্তব্য বলে মনে করেছিলাে। তারা নিজ সম্প্রদায়ের লােকদেরকে লক্ষ্য করে বললাে, ‘হে আমাদের সম্প্রদায়, তােমরা আল্লাহর দিকে আহ্বানকারীর কথা মান্য করো এবং তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করো। তিনি তােমাদের গােনাহ মাফ করবেন।…'(আয়াত ৩১-৩২) তাদের এই বক্তব্য দ্বারা বুঝা যায় যে, তারা পৃথিবীর বুকে পবিত্র কোরআনের অবতরণকে মানব দানবসহ সকল বিশ্ববাসীর জন্যে আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি আহ্বান হিসেবে দেখেছিলাে। তেমনিভাবে রসূলুল্লাহ(স.)-কে কেবল এই পবিত্র কোরআনের তেলাওয়াত করতে দেখেই তাকে গােটা বিশ্ববাসীর জন্যে পথপ্রদর্শক হিসেবে বিশ্বাস করেছিলাে, আর সে কারণেই তারা নিজ সম্প্রদায়কে সেই আল্লাহর দিকে আহ্বানকারীর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করার জন্যে উপদেশ দিয়েছিলাে। তাদের বক্তব্য থেকে এটাও বুঝা যায় যে, তারা পরকালের প্রতি বিশ্বাস এনেছিলাে এবং এটা সম্যকভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলাে যে, আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস এবং আল্লাহর ডাকে সাড়া দেয়ার মাধ্যমে পরকালের ক্ষমা ও জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। তাই তারা নিজ সম্প্রদায়কে এই সত্যটিও জানিয়ে দেয়। ইবনে ইসহাকের বর্ণনা অনুযায়ী এই আয়াত পর্যন্তই বিনদের বক্তব্য শেষ হয়ে যায়। কিন্তু পূর্বাপর বিবেচনা করে দেখলে বুঝা যায়, পরের আয়াত দুটোর বক্তব্যও সে জ্বিনদের নিয়েই। এই মতটিকেই আমরা সঠিক বলে মনে করি। বিশেষ করে নিচের আয়াতটি লক্ষনীয়, ‘আর যে ব্যক্তি আল্লাহর দিকে আহ্বানকারীর কথায় সাড়া দেবে না, সে পৃথিবীতে আল্লাহকে অক্ষম করতে পারবে না এবং আল্লাহ তায়ালা ব্যতীত আর কোনাে সাহায্যকারী থাকবে না।’(আয়াত ৩২) এই আয়াতটি জ্বিন দলের আগের বক্তব্যের স্বাভাবিক উপসংহার বলে মনে হয়। কারণ, আগের আয়াতে তারা নিজ সম্প্রদায়কে ঈমানের জন্যে বলেছিলেন এবং আল্লাহর পথে আহ্বানকারীর ডাকে সাড়া দিতে বলেছিলাে। কাজেই এখন একটা জোরালাে ও যুক্তিসঙ্গত সম্ভাবনা থেকে যায় যে, তারা ঈমান গ্রহণ না করলে এবং আল্লাহর রসূল(স.)-এর ডাকে সাড়া না দিলে কী পরিণতি হবে, সে সম্পর্কে নিশ্চয়ই তাদের সম্প্রদায়কে বলেছিলাে এবং তাদেরকে জানিয়ে দিয়েছিলাে যে, যারা ঈমান গ্রহণ করবে না তারা কখনও আল্লাহর কঠিন শাস্তি থেকে রেহাই পাবে না, কাউকে সাহায্যকারী হিসেবেও পাবে না এবং তারা সঠিক ও সত্য পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়বে। তেমনিভাবে পরবর্তী আয়াতটিও জ্বিনদের বক্তব্য বলে মনে হয়। এই আয়াতটিতে তারা সেসব লােকের ব্যাপারে বিস্ময় প্রকাশ করছে যারা আল্লাহর রসূল(স.)-এর ডাকে সাড়া দেয় না এবং মনে করে পরকালে তাদের কোনাে হিসাব নিকাশ হবে না এবং তারা এভাবেই ছাড়া পেয়ে যাবে। তাই জিন দল বিস্ময় প্রকাশ করে বলছে, ‘তারা কি জানে না যে, আল্লাহ তায়ালা যিনি আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এবং এগুলাের সৃষ্টিতে কোনাে ক্লান্তিবােধ করেননি, তিনি মৃতকে জীবিত করতে সক্ষম। কেন নয়, নিশ্চয়ই তিনি সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান।'(আয়াত ৩৩) আলােচ্য আয়াতে জগত নামক এই দৃশ্যমান খােলা কিতাবটির প্রতি মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। সূরার প্রথমেও তা করা হয়েছিলাে। পবিত্র কোরআনের প্রায় সূরার ক্ষেত্রেই এমনটি ঘটেছে। প্রথমে প্রত্যক্ষ বক্তব্যের মাধ্যমে করা হয়, এরপর কোনাে ঘটনা বর্ণনা প্রসঙ্গে পুনরায় তা ব্যক্ত করা হয়। এর ফলে সংশ্লিষ্ট সূরার বক্তব্যের মাঝে একটি সঙ্গতি ও মিল সৃষ্টি হয়। জগত নামক এই বিশাল কিতাবটি আমাদের সামনে মহান স্ৰষ্টার অপার কুদরত ও ক্ষমতার সাক্ষ্য পেশ করে। যে স্রষ্টা আকাশ ও পৃথিবীর মতাে বিশাল জগত সৃষ্টি করতে পাবেন তিনি যে মৃত্যুর পর পুনরায় জীবিতও করতে পারেন-সে সত্যটি একজন সাধারণ বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষও বুঝতে পারে, আর এই সত্যটিকেই প্রমাণ করার জন্যে আলােচ্য আয়াতে প্রশ্ন ও উত্তরের ভঙ্গিতে বক্তব্য পেশ করা হয়েছে। কারণ, এই বর্ণনা ভঙ্গি অত্যন্ত শক্তিশালী ও হৃদয়গ্রাহী হয়। আয়াতের শেষ অংশে পূর্বের বক্তব্যের সমর্থনে একটা সাধারণ মন্তব্য হিসেবে বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয় তিনি সর্ব বিষয়ে সর্বশক্তিমান’… কাজেই, জন্ম মৃত্যুসহ অন্যান্য সকল বিষয়েই আল্লাহর এই অপার ক্ষমতার আওতাধীন। এতে সন্দেহ থাকার কিছুই নেই।
*পরকালের হিসাব নিকাশ : পুনর্জন্মের আলােচনা আসার সাথে সাথে পরকালের হিসাব নিকাশের গােটা দৃশ্যটাই যেন চোখের সামনে ভেসে উঠলাে। তাই পরবর্তী আয়াতে সে দৃশ্যের অবতারণা করে বলা হচ্ছে, ‘যে দিন কাফেরদেরকে জাহান্নামের সামনে পেশ করা হবে, সে দিন বলা হবে, এটা কি সত্য নয়। তারা বলবে, হাঁ, আমাদের পালনকর্তার শপথ। আল্লাহ তায়ালা বলবেন, আযাব আস্বাদন করাে। কারণ, তােমরা কুফরী করতে।’(আয়াত ৩৪) ‘যে দিন কাফেরদেরকে জাহান্নামের সামনে পেশ করা হবে’… এই বক্তব্যটি এসেছে মূল দৃশ্যের বর্ণনা বা এর ভূমিকাস্বরূপ। দর্শক পরবর্তী দৃশ্যের জন্যে যখন অপেক্ষা করছিলাে তখনই গােটা দৃশ্যটি আকস্মিকভাবে চোখের সামনে ভেসে উঠে এবং সাথে সাথে এ সম্পর্কিত সংলাপও চলতে থাকে প্রশ্নের সুরে, ‘এটা কি সত্য নয়?’ কি কঠিন প্রশ্ন, কি নির্মম প্রশ্ন। বিশেষ করে তাদের জন্যে যারা পরকালকে অস্বীকার করতাে, যারা পরকালের বিষয় নিয়ে উপহাস করতাে, বিদ্রুপ করতাে এবং যারা তাচ্ছিল্য ভরে পরকালের শাস্তি বলতে কিছু থাকলে তার দ্রুত আগমন কামনা করতাে। আজ তাদের মাথা নত হয়ে আসবে। এবং যে সত্যটিকে তারা অস্বীকার করতাে সেই সত্যটির সামনেই আজ তাদেরকে আত্মসমর্পণ করতে হচ্ছে। এই কঠিন ও নির্মম প্রশ্নটির উত্তরও আসছে অত্যন্ত লাঞ্ছনা, অপমান ও ভয় ভীতিমাখা কণ্ঠে, এভাবেই তারা সেদিন প্রভুর নামে কসম খাবে। অথচ জীবদ্দশায় এই প্রভুর ডাকে তারা সাড়া দেয়ার প্রয়ােজন অনুভব করেনি, তার প্রেরিত রসূলের ডাকে সাড়া দেয়নি এমনকি আল্লাহর প্রভুত্বও তারা কখনও স্বীকার করেনি। আর তারাই আজ সেই প্রভুর নামে কসম খাচ্ছে, পরম সত্যকে অস্বীকার করে নিচ্ছে যা ছিলাে তাদের কাছে একদিন অবিশ্বাস্য। এই অপমানজনক ও লজ্জাকর উত্তরের পর আর কোনাে বক্তব্য থাকে না। তাই ঘটনার ইতি টেনে বলা হচ্ছে, ‘আযাব আস্বাদন করো। কারণ তােমরা কুফরী করতে মােট কথা, আসামী যেখানে নিজেই তার দোষ স্বীকার করছে সেখানে বিচার যা হওয়ার তাই হয়েছে, আর এভাবেই দৃশ্যটির দ্রুত সমাপ্তি ঘটে। কারণ, চূড়ান্ত রায় এখানে এসে গেছে, চূড়ান্ত বক্তব্যও এখানে এসে গেছে। কাজেই আর কোনো যুক্তি তর্কের অবকাশ নেই। আসামীরা পরকালকে অস্বীকার করতাে, এখন তারা সেটাকে স্বীকার করে নিচ্ছে। তাই পূর্বের অস্বীকৃতির পরিণামও তাদেরকে এখন ভােগ করতে হচ্ছে।
*সবরের নির্দেশ : কুফর ও ঈমানের চূড়ান্ত ফলাফল ও পরিণতির দৃশ্য উপস্থাপন করার পর এবং রসূলুল্লাহ(স.) সম্পর্কে কাফেরদের মন্তব্য উল্লেখ করার মধ্য দিয়ে সূরার শেষে রসূলের প্রতি আল্লাহর পক্ষ থেকে উপদেশস্বরূপ বলা হয়েছে, ‘অতএব তুমি ধৈর্যধারণ করো, যেমন সুদৃঢ় মনােবলের অধিকারী রসূলরা ধৈর্যধারণ করেছে। তুমি ওদের বিষয়ে তড়িঘড়ি করবে না…’(আয়াত ৩৫) আলােচ্য আয়াতের প্রতিটি শব্দ অত্যন্ত অর্থবহ। এর প্রতিটি বাক্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ, ভেদ ও রহস্যে পরিপূর্ণ। এখানে রসূলকে ধৈর্যধারণ করতে উপেশ দেয়া হয়েছে। কারণ, তাঁকে তাঁর সম্প্রদায়ের লােকদের হাতে অনেক নির্যাতন ও লাঞ্ছনা সইতে হয়েছে। তাছাড়া আরাে কথা হচ্ছে, তাঁর প্রথমা স্ত্রী যিনি ছিলেন মমতা, ভালবাসা ও ত্যাগের আঁধার। সব কিছু থেকে মুক্ত হয়ে তিনি একমাত্র আল্লাহর পথে মানুষকে আহ্বান করার জন্যে নিজেকে নিয়ােজিত করে। এমনকি তাকে সাহায্য করার মতাে এবং রক্ষা করার মতােও কেউ আর জীবিত থাকেনি। সেই অসহায় অবস্থায় আপন গােষ্ঠীর লােকদের কাছ থেকে নির্যাতন ও নিপীড়ণমূলক যে আচরণ পেয়েছিলেন তা দূর সম্পর্কের কারও কাছ থেকে পাননি। শুধু তাই নয় তিনি বার বার বিভিন্ন গােত্র ও গােষ্ঠীর লােকদের কাছে গিয়ে দ্বীন গ্রহণ করতে বলেছেন, কিন্তু প্রতিবারই তাঁকে খালি হাতে ফিরতে হয়েছে, অথবা ঠাট্টা বিদ্রুপের শিকার হতে হয়েছে, অথবা পাথরের আঘাত খেয়ে পবিত্র পা দু’টো রক্তাক্ত করে ঘরে ফিরতে হয়েছে। এতােসব পরেও তিনি তাদের জন্যে সে আবেগপূর্ণ ও হৃদয়স্পর্শী দোয়াটি করেন যা ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে, এতাে কিছুর পরেও আবার তাঁকে নিজ মালিকের পক্ষ থেকে ধৈর্যের উপদেশ দেয়ার প্রয়ােজন দেখা দিয়েছে। তাই প্রভুর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তুমি ধৈর্যধারণ করাে যেমন ধৈর্য্য ধারণ করেছে সুদৃঢ় মনোবলের অধিকারী রসূলগণ… এর দ্বারা এ কথাটি জানানো হয়েছে যে,  দাওয়াত ও তাবলীগের রাস্তা অনেক দীর্ঘ ও কঠিন। এ রাস্তা বড়ই কন্টকাকীর্ণ। এই রাস্তায় চলতে গিয়ে স্বয়ং রসূলুল্লাহ(স.)-এর মতাে পুন্যাত্মা, দৃঢ় মনোবল সম্পন্ন, ত্যাগ ও পরম ধৈর্যশীল ব্যক্তিকেও ধৈর্যধারণ করতে এবং বিরুদ্ধবাদীদের ব্যাপারে তড়িঘড়ি ফয়সালা কামনা না করতে উপদেশ দেয়া হয়েছে। সন্দেহ নেই যে এই বন্ধুর পথ অতিক্রম করতে হলে, এই পথের তিক্ততা হজম করতে হলে পরস্পর সহানুভূতির রহমত ও দয়ার প্রয়ােজন আছে। ধৈর্যের এই নির্দেশ কেবলই নির্দেশ নয়; বরং এর মাধ্যমে নবীকে উৎসাহ দেয়া হয়েছে, তার মনােবলকে আরাে দৃঢ় করা হয়েছে, তাঁকে সান্ত্বনা দেয়া হয়েছে, সহমর্মিতা জানানাে হয়েছে এবং সর্বোপরি তাঁকে আশ্বস্ত করা হয়েছে। তাই পরের আয়াতেই বলা হয়েছে, ‘ওদেরকে যে বিষয়ে ওয়াদা দেয়া হতাে, তা যেদিন তারা প্রত্যক্ষ করবে, সেদিন তাদের মনে হবে যেন তারা দিনের এক মুহূর্তের বেশী পৃথিবীতে অবস্থান করেনি।’ অর্থাৎ পরকালের পূর্বে তারা পৃথিবীতে যে জীবনটি কাটাচ্ছে তা অত্যন্ত সংকীর্ণ দিনের এক প্রহরের চেয়ে বেশী নয়। এই ক্ষণস্থায়ী জীবন খুবই তুচ্ছ ও নগণ্য। এই জীবন তার পেছনে যা রেখে যায় তার আবেদন ও প্রভাবের স্থায়িত্ব দিনের এক প্রহরের চেয়ে কোনাে অংশেই বড় নয়। এই ক্ষণস্থায়ী জীবনের পরে আসবে চূড়ান্ত ও অমােঘ পরিণতি যার স্থায়িত্ব হবে অসীম ও অনন্তকালের জন্যে। এই ক্ষণস্থায়ী মুহূর্তটি হচ্ছে কেবলই অবগতি ও সতর্কতার জন্যে যেন ধ্বংস ও কঠিন আযাবের সম্মুখীন হওয়ার আগেই সতর্কতা অবলম্বন করা সম্ভব হয়। তাই বলা হয়েছে, ‘এটা সুস্পষ্ট অবগতি, এখন তারাই ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে যারা গােনাহগার। না, আল্লাহ তায়ালা কখনও তাঁর বান্দাদের প্রতি অবিচার করেন না, এটা হতেই পারে না।’ দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ করতে গিয়ে ধৈর্যের পরিচয় দিতে হবে। কারণ, কষ্টের মুহূর্তগুলাে দিনের এক প্রহরের মতােই ক্ষণস্থায়ী। এরপর যা হবার তা হবেই।

Leave a Reply