أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ ( বই # ১১২৭/মুনাফিক কি? কেন ও কিভাবে -৪০) [ *মােনাফেকদের কুটীল স্বভাব : –   *জিহাদের ব্যাপারে মােনাফেকদের দৃষ্টিভঙ্গি :- যখন সুস্পষ্ট নির্দেশ সম্বলিত সূরা নাযিল করা হলো :-] www.motaher21.net সূরা:৪৭- মুহাম্মাদ। পারা:২৬ ১০-২৬ নং আয়াত:- ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-

Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১১২৭/মুনাফিক কি? কেন ও কিভাবে -৪০)
[ *মােনাফেকদের কুটীল স্বভাব : –
*জিহাদের ব্যাপারে মােনাফেকদের দৃষ্টিভঙ্গি :-
যখন সুস্পষ্ট নির্দেশ সম্বলিত সূরা নাযিল করা হলো :-]
www.motaher21.net
সূরা:৪৭- মুহাম্মাদ। পারা:২৬
১০-২৬ নং আয়াত:-
ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-

সূরা:৪৭- মুহাম্মাদ। আয়াত-১০
اَفَلَمۡ یَسِیۡرُوۡا فِی الۡاَرۡضِ فَیَنۡظُرُوۡا کَیۡفَ کَانَ عَاقِبَۃُ الَّذِیۡنَ مِنۡ قَبۡلِہِمۡ ؕ دَمَّرَ اللّٰہُ عَلَیۡہِمۡ ۫ وَ لِلۡکٰفِرِیۡنَ اَمۡثَالُہَا ﴿۱۰﴾
তারা কি পৃথিবীতে ভ্রমণ করে সেসব লোকের পরিণাম দেখে না, যারা তাদের পূর্বে অতীত হয়েছে? আল্লাহ‌ তাদের ধ্বংস করে দিয়েছেন। এসব কাফেরের জন্যও অনুরূপ পরিণাম নির্ধারিত হয়ে আছে।
সূরা:৪৭- মুহাম্মাদ। আয়াত-১১
ذٰلِکَ بِاَنَّ اللّٰہَ مَوۡلَی الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ اَنَّ الۡکٰفِرِیۡنَ لَا مَوۡلٰی لَہُمۡ ﴿٪۱۱﴾
এর কারণ, আল্লাহ‌ নিজে ঈমান গ্রহণকারীদের সহযোগী ও সাহায্যকারী। কিন্তু কাফেরদের সহযোগী ও সাহায্যকারী কেউ নেই।
সূরা:৪৭- মুহাম্মাদ। আয়াত-১২
اِنَّ اللّٰہَ یُدۡخِلُ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ جَنّٰتٍ تَجۡرِیۡ مِنۡ تَحۡتِہَا الۡاَنۡہٰرُ ؕ وَ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا یَتَمَتَّعُوۡنَ وَ یَاۡکُلُوۡنَ کَمَا تَاۡکُلُ الۡاَنۡعَامُ وَ النَّارُ مَثۡوًی لَّہُمۡ ﴿۱۲﴾
নিশ্চয় যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকাজ করেছে আল্লাহ তাদেরকে প্ৰবেশ করাবেন জান্নাতে যার নীচে নহরসমূহ প্রবাহিত ; কিন্তু যারা কুফরী করেছে তারা ভোগ বিলাস করে এবং খায় যেমন চতুষ্পদ জন্তুরা খায় ; আর জাহান্নামই তাদের নিবাস।
সূরা:৪৭- মুহাম্মাদ। আয়াত-১৩
وَ کَاَیِّنۡ مِّنۡ قَرۡیَۃٍ ہِیَ اَشَدُّ قُوَّۃً مِّنۡ قَرۡیَتِکَ الَّتِیۡۤ اَخۡرَجَتۡکَ ۚ اَہۡلَکۡنٰہُمۡ فَلَا نَاصِرَ لَہُمۡ ﴿۱۳﴾
তোমার সেই জনপদ; যা তোমাকে বহিষ্কার করেছে, তা অপেক্ষা অতি শক্তিশালী কত জনপদ ছিল, আমি তাদেরকে ধ্বংস করেছি এবং তাদেরকে সাহায্য করার কেউ ছিল না।
সূরা:৪৭- মুহাম্মাদ। আয়াত-১৪
اَفَمَنۡ کَانَ عَلٰی بَیِّنَۃٍ مِّنۡ رَّبِّہٖ کَمَنۡ زُیِّنَ لَہٗ سُوۡٓءُ عَمَلِہٖ وَ اتَّبَعُوۡۤا اَہۡوَآءَہُمۡ ﴿۱۴﴾
যে ব্যক্তি তার প্রতিপালক হতে (আগত) সুস্পষ্ট প্রমাণের উপর প্রতিষ্ঠিত, সে কি তার মত, যার নিকট নিজের মন্দ কর্মগুলো শোভনীয় প্রতীয়মান হয় এবং যারা নিজেদের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করে?
সূরা:৪৭- মুহাম্মাদ। আয়াত-১৫
مَثَلُ الۡجَنَّۃِ الَّتِیۡ وُعِدَ الۡمُتَّقُوۡنَ ؕ فِیۡہَاۤ اَنۡہٰرٌ مِّنۡ مَّآءٍ غَیۡرِ اٰسِنٍ ۚ وَ اَنۡہٰرٌ مِّنۡ لَّبَنٍ لَّمۡ یَتَغَیَّرۡ طَعۡمُہٗ ۚ وَ اَنۡہٰرٌ مِّنۡ خَمۡرٍ لَّذَّۃٍ لِّلشّٰرِبِیۡنَ ۬ۚ وَ اَنۡہٰرٌ مِّنۡ عَسَلٍ مُّصَفًّی ؕ وَ لَہُمۡ فِیۡہَا مِنۡ کُلِّ الثَّمَرٰتِ وَ مَغۡفِرَۃٌ مِّنۡ رَّبِّہِمۡ ؕ کَمَنۡ ہُوَ خَالِدٌ فِی النَّارِ وَ سُقُوۡا مَآءً حَمِیۡمًا فَقَطَّعَ اَمۡعَآءَہُمۡ ﴿۱۵﴾
মুত্তাকীদেরকে যে জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে তার দৃষ্টান্ত : তাতে আছে নির্মল পানির নহরসমূহ, আছে দুধের নহরসমূহ যার স্বাদ অপরিবর্তনীয়, আছে পানকারীদের জন্য সুস্বাদু সুরার নহরসমূহ, আছে পরিশোধিত মধুর নহরসমূহ এবং সেখানে তাদের জন্য থাকবে প্রত্যেক প্রকারের ফলমূল। আর তাদের রবের পক্ষ থেকে ক্ষমা। তারা (মুত্তাকীরা) কি তাদের ন্যায় যারা জাহান্নামে স্থায়ী হবে এবং যাদেরকে পান করানো হবে ফুটন্ত পানি, ফলে তা তাদের নাড়ীভুঁড়ি ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে দিবে?
সূরা:৪৭- মুহাম্মাদ। আয়াত-১৬
وَ مِنۡہُمۡ مَّنۡ یَّسۡتَمِعُ اِلَیۡکَ ۚ حَتّٰۤی اِذَا خَرَجُوۡا مِنۡ عِنۡدِکَ قَالُوۡا لِلَّذِیۡنَ اُوۡتُوا الۡعِلۡمَ مَاذَا قَالَ اٰنِفًا ۟ اُولٰٓئِکَ الَّذِیۡنَ طَبَعَ اللّٰہُ عَلٰی قُلُوۡبِہِمۡ وَ اتَّبَعُوۡۤا اَہۡوَآءَہُمۡ ﴿۱۶﴾
তাদের মধ্যে কতক তোমার কথা মন দিয়ে শোনে, অতঃপর তোমার নিকট হতে বের হয়ে জ্ঞানবানদেরকে বলে, ‘এই মাত্র সে কি বলল?’ ওরাই তারা যাদের অন্তরে আল্লাহ মোহর মেরে দেন এবং তারা নিজেদের খেয়াল-খুশীরই অনুসরণ করে।
সূরা:৪৭- মুহাম্মাদ। আয়াত-১৭
وَ الَّذِیۡنَ اہۡتَدَوۡا زَادَہُمۡ ہُدًی وَّ اٰتٰہُمۡ تَقۡوٰىہُمۡ ﴿۱۷﴾
যারা সৎপথ অবলম্বন করে, তাদেরকে আল্লাহ সৎপথে চলার শক্তি বৃদ্ধি করেন এবং তাদেরকে ধর্মভীরু হবার শক্তি দান করেন।
সূরা:৪৭- মুহাম্মাদ। আয়াত-১৮
فَہَلۡ یَنۡظُرُوۡنَ اِلَّا السَّاعَۃَ اَنۡ تَاۡتِیَہُمۡ بَغۡتَۃً ۚ فَقَدۡ جَآءَ اَشۡرَاطُہَا ۚ فَاَنّٰی لَہُمۡ اِذَا جَآءَتۡہُمۡ ذِکۡرٰىہُمۡ ﴿۱۸﴾
এখন কি এসব লোক শুধু কিয়ামতের জন্যই অপেক্ষা করছে যে, তা তাদের ওপর অকস্মাৎ এসে পড়ুক। তার আলামত তো এসে গিয়েছে। যখন কিয়ামতই এসে যাবে তখন তাদের জন্য উপদেশ গ্রহণের আর কি অবকাশ থাকবে?
সূরা:৪৭- মুহাম্মাদ। আয়াত-১৯
فَاعۡلَمۡ اَنَّہٗ لَاۤ اِلٰہَ اِلَّا اللّٰہُ وَ اسۡتَغۡفِرۡ لِذَنۡۢبِکَ وَ لِلۡمُؤۡمِنِیۡنَ وَ الۡمُؤۡمِنٰتِ ؕ وَ اللّٰہُ یَعۡلَمُ مُتَقَلَّبَکُمۡ وَ مَثۡوٰىکُمۡ ﴿٪۱۹﴾
কাজেই জেনে রাখুন যে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন সত্য ইলাহ নেই । আর ক্ষমা প্রার্থনা করুন আপনার ও মুমিন নর-নারীদের ক্রটির জন্য। আল্লাহ তোমাদের গতিবিধি এবং অবস্থান সম্পর্কে অবগত রয়েছেন।
সূরা:৪৭- মুহাম্মাদ। আয়াত-২০
وَ یَقُوۡلُ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لَوۡ لَا نُزِّلَتۡ سُوۡرَۃٌ ۚ فَاِذَاۤ اُنۡزِلَتۡ سُوۡرَۃٌ مُّحۡکَمَۃٌ وَّ ذُکِرَ فِیۡہَا الۡقِتَالُ ۙ رَاَیۡتَ الَّذِیۡنَ فِیۡ قُلُوۡبِہِمۡ مَّرَضٌ یَّنۡظُرُوۡنَ اِلَیۡکَ نَظَرَ الۡمَغۡشِیِّ عَلَیۡہِ مِنَ الۡمَوۡتِ ؕ فَاَوۡلٰی لَہُمۡ ﴿ۚ۲۰﴾
যারা ঈমান আনায়ন করেছে তারা বলছিলো, এমন কোন সূরা কেন নাযিল করা হয় না (যাতে যুদ্ধের নির্দেশ থাকবে) ? কিন্তু যখন সুস্পষ্ট নির্দেশ সম্বলিত সূরা নাযিল করা হলো এবং তার মধ্যে যুদ্ধের কথা বলা হলো তখন তোমরা দেখলে, যাদের মনে রোগ ছিল তারা তোমার প্রতি সে ব্যক্তির মত তাকাচ্ছে যার ওপর মৃত্যু চেপে বসেছে। তাদের এ অবস্থার জন্য আফসোস।
সূরা:৪৭- মুহাম্মাদ। আয়াত-২১
طَاعَۃٌ وَّ قَوۡلٌ مَّعۡرُوۡفٌ ۟ فَاِذَا عَزَمَ الۡاَمۡرُ ۟ فَلَوۡ صَدَقُوا اللّٰہَ لَکَانَ خَیۡرًا لَّہُمۡ ﴿ۚ۲۱﴾
(তাদের মুখে) আনুগত্যের প্রতিশ্রুতি এবং ভাল ভাল কথা। কিন্তু যখন অলংঘনীয় নির্দেশ দেয়া হলো তখন যদি তারা আল্লাহর সাথে কৃত নিজেদের অঙ্গীকারের ব্যাপারে সত্যবাদী প্রমাণিত হতো তাহলে তা তাদের জন্যই কল্যাণকর হতো।
সূরা:৪৭- মুহাম্মাদ। আয়াত-২২
فَہَلۡ عَسَیۡتُمۡ اِنۡ تَوَلَّیۡتُمۡ اَنۡ تُفۡسِدُوۡا فِی الۡاَرۡضِ وَ تُقَطِّعُوۡۤا اَرۡحَامَکُمۡ ﴿۲۲﴾
এখন তোমাদের থেকে এছাড়া অন্য কিছুর কি আশা করা যায় যে, তোমরা যদি ইসলাম থেকে ফিরে যাও তাহলে পৃথিবীতে ফাসাদ সৃষ্টি করবে এবং একে অপরের গলা কাটবে?
সূরা:৪৭- মুহাম্মাদ। আয়াত-২৩
اُولٰٓئِکَ الَّذِیۡنَ لَعَنَہُمُ اللّٰہُ فَاَصَمَّہُمۡ وَ اَعۡمٰۤی اَبۡصَارَہُمۡ ﴿۲۳﴾
আল্লাহ তা’আলা এসব লোকের ওপর লা’নত করেছেন এবং তাদেরকে অন্ধ ও বধির বানিয়ে দিয়েছেন।
সূরা:৪৭- মুহাম্মাদ। আয়াত-২৪
اَفَلَا یَتَدَبَّرُوۡنَ الۡقُرۡاٰنَ اَمۡ عَلٰی قُلُوۡبٍ اَقۡفَالُہَا ﴿۲۴﴾
তবে কি তারা কুরআন নিয়ে গভীর চিন্তা করে না? নাকি তাদের অন্তরসমূহে তালা রয়েছে?
সূরা:৪৭- মুহাম্মাদ। আয়াত-২৫
اِنَّ الَّذِیۡنَ ارۡتَدُّوۡا عَلٰۤی اَدۡبَارِہِمۡ مِّنۡۢ بَعۡدِ مَا تَبَیَّنَ لَہُمُ الۡہُدَی ۙ الشَّیۡطٰنُ سَوَّلَ لَہُمۡ ؕ وَ اَمۡلٰی لَہُمۡ ﴿۲۵﴾
নিশ্চয় যারা নিজেদের কাছে সৎপথ স্পষ্ট হওয়ার পর তা থেকে পৃষ্ঠপ্ৰদৰ্শন করে, শয়তান তাদের কাজকে শোভন করে দেখায় এবং তাদেরকে মিথ্যা আশা দেয়।
সূরা:৪৭- মুহাম্মাদ। আয়াত-২৬
ذٰلِکَ بِاَنَّہُمۡ قَالُوۡا لِلَّذِیۡنَ کَرِہُوۡا مَا نَزَّلَ اللّٰہُ سَنُطِیۡعُکُمۡ فِیۡ بَعۡضِ الۡاَمۡرِ ۚۖ وَ اللّٰہُ یَعۡلَمُ اِسۡرَارَہُمۡ ﴿۲۶﴾
এটা এজন্যে যে, আল্লাহ যা নাযিল করেছেন, তা যারা অপছন্দ করে তাদেরকে ওরা বলে, ‘অচিরেই আমরা কোন কোন বিষয়ে তোমাদের আনুগত্য করব।’ আর আল্লাহ জানেন তাদের গোপন অভিসন্ধিসমূহ।

ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-

*ইতিহাসের শিক্ষা : এরপর পুনরায় আল্লাহ তায়ালা তাদের মুখকে তাদের পূর্বেকার ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতিগুলাের ইতিহাস দর্শনের জন্যে সজোরে পেছনের দিকে ঘুরিয়ে দিচ্ছেন, তারা কি দেশের বিভিন্ন স্থানে পরিভ্রমণ করেনি এবং দেখেনি তাদের পূর্ববর্তীদের পরিণাম কেমন হয়েছিলাে? আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে বিধ্বস্ত করে দিয়েছিলেন। প্রত্যাখ্যানকারীদের জন্যে এ ধরনের পরিণামই অপেক্ষা করছে। এটা ভয় পাইয়ে দেয়ার মতাে একটা জোরদার ঝাকুনি। এর ভেতরে একটা প্রচন্ড ধাক্কা ও ধমক রয়েছে। পূর্ববর্তী যে সব জাতি শুধু নিজেরাই ধ্বংস হয়নি, বরং তাদের যাবতীয় সহায় সম্পদ ও আশপাশের যাবতীয় স্থাপনা বিধ্বস্ত হয়ে একটা ধ্বংসপুরীর রূপ ধারণ করেছিলাে এবং তারা ধ্বংসাবশেষের নীচে চাপা পড়ে গিয়েছিলাে, এখানে তাদেরই দৃশ্য তুলে ধরা হয়েছে। আয়াতে এমনভাবে শব্দ চয়ন করা হয়েছে যে, তার উচ্চারণেও সেই ধ্বংসযজ্ঞের চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে এবং ধ্বংসপ্রাপ্তদের ভীত বিহ্বল আর্ত চিৎকারে বিকট ধ্বনি নিনাদিত ও অনুরণিত হয়েছে। এই প্রলয়ংকরী ধ্বংসযজ্ঞের ভয়াল দৃশ্য দেখিয়ে উপস্থিত কাফেরদেরকে এবং অনুরূপ বৈশিষ্টের অধিকারী সকলকে জানিয়ে দেয়া হচ্ছে, যে ধরনের ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ তাদেরকে ধ্বংস্তুপের নীচে চাপা দিয়ে রাখবে, তা তাদের জন্যেও অপেক্ষা করছে। বলা হয়েছে, অনুরূপ পরিণতি সকল প্রত্যাখ্যানকারীদের জন্যেই অপেক্ষা করছে।’ এ ধরনের আতংকজনক ঘটনা যা কাফেরদের জন্যে ধ্বংস ও মােমেনদের জন্যে বিজয়বার্তা বহন করে আনে, তার ব্যাখ্যা হিসাবে এই চিরন্তন ও শাশ্বত মূলনীতিটাই তুলে ধরা হচ্ছে। এর কারণ এই যে, আল্লাহ তায়ালা মােমেনদের অভিভাবক এবং কাফেরদের কোনাে অভিভাবক নেই।’ আল্লাহ তায়ালা যার অভিভাবক ও সাহায্যকারী, তার জন্যে তিনিই যথেষ্ট। তার ওপর যদি কোনাে বিপদ মুসিবতও আসে, তবে তা তার জন্যে হয় পরীক্ষাস্বরূপ, যার পেছনে তার জন্যে সার্বিক কল্যাণ নিহিত রয়েছে। এ ধরনের বিপদ মুসিবত আসার অর্থ এ নয় যে, আল্লাহ তায়ালা তার অভিভাবকত্ব ত্যাগ করেছেন এবং তার বান্দাদেরকে সাহায্য করার যে ওয়াদা তিনি দিয়েছেন, তা তিনি ভংগ করেছেন। পক্ষান্তরে আল্লাহ তায়ালা যার অভিভাবক হননি, তার কোনােই অভিভাবক থাকে না। সে যদি দুনিয়ার তাবত জ্বিন ও মানুষকে অভিভাবক হিসাবে গ্রহণ করে, তবুও তাতে কোনাে লাভ হবে না। কেননা অক্ষমদের এই অভিভাবকত্ব শেষ পর্যন্ত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে বাধ্য, চাই মানব সমাজে পরিচিত যাবতীয় শক্তির উপকরণ ও প্রতিরক্ষার সাজ সরঞ্জামই সে সংগ্রহ করুক না কেন।
*শেষ বিচারে মােমেন ও কাফেরদের অবস্থা ঝগড়া লড়াই ও দ্বন্দ্ব সংঘাতে কাফের ও মােমেন এই দুই গােষ্ঠীর ভূমিকা বর্ণনা করার পর, এখন এই দুই গােষ্ঠীর ভােগ বিলাস ও প্রাপ্তিযােগের তুলনা করা হচ্ছে। এই উভয় গােষ্ঠীর ভােগ ও প্রাপ্তিতে যে আকাশ পাতালের ব্যবধান, তাও এই সাথে তুলে ধরা হচ্ছে, নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা ঈমানদার ও সৎ কর্মশীলদের সেই জান্নাতে প্রবেশ করান, যার নীচ দিয়ে ঝর্ণাসমূহ বয়ে যায়। আর যারা কাফের, তারা পশুর মতাে ভােগ বিলাস ও খাওয়া দাওয়ায় মত্ত এবং দোযখই তাদের ঠিকানা। এ কথা সত্য যে, সৎকর্মশীল ঈমানদার ব্যক্তি কখনও কখনও পবিত্রতম সম্পদের প্রাচুর্য উপভােগ করে থাকেন। তবে এখানে যে তুলনাটা করা হচ্ছে তা হলাে, জান্নাতে মােমেনদের জন্যে যে বিশাল ও অকল্পনীয় চিরস্থায়ী ভােগ বিলাস নির্ধারিত রয়েছে এবং পৃথিবীতে কাফেরদের জন্যে যে ক্ষণস্থায়ী একমাত্র সুখ সমৃদ্ধি বরাদ্দ রয়েছে, এই দুই সুখ সমৃদ্ধির মধ্যে তুলনা । মােমেনদের জন্যে জান্নাতে যে সুখ শান্তি বরাদ্দ রয়েছে, তা তারা স্বয়ং আল্লাহর কাছ থেকে লাভ করবে এবং তাদের জান্নাতের নীচ দিয়ে ঝর্ণাধারা প্রবাহিত হতে থাকবে। আল্লাহ তায়ালাই তাদেরকে সেখানে প্রবেশ করাবেন। তাদের ঈমান ও নেক আমলগুলাে যেমন উৎকৃষ্ট ও মহান, আল্লাহর কাছ থেকে প্রাপ্ত তাদের ঈমান ও নেক আমলগুলােও তেমন উৎকৃষ্ট। আর কাফেরদের জন্যে দুনিয়ায় যে সুখ সম্ভোগ বরাদ্দ রয়েছে, তা পশুদের সুখ সম্ভোগের মতােই। এখানে একটা পূর্ণাংগ ও নিখুঁত ছবি তুলে ধরা হয়েছে, যাতে এটা সুস্পষ্ট যে, তাদের সেই ভােগের উপকরণে কোন মানবীয় বৈশিষ্টের ছাপ নেই, বরং নিছক পাশবিক ভোগােপকরণের ছাপ ও সাদৃশ্য রয়েছে। এ হচ্ছে ঘৃণ্য, অরুচিকর, অপবিত্র ও নােংরা ভােগ বিলাস। এতে কোনাে নিয়মনীতি ও নিয়ন্ত্রণের বালাই নেই, বিবেক বিবেচনা, আল্লাহভীতি ও ন্যায় অন্যায়ের বাছ বিচারও নেই।
*মােমেন ও কাফেরদের বৈশিষ্ট্য : একথা সত্য যে, উচ্চাংগের রুচিবোধ ও নানা বৈচিত্র ও প্রীতিসহকারে যে ভােগ বিলাস ও খাওয়া দাওয়া করা হয়, তাতেও পাশবিকতার স্ফুরণ ঘটে, যেমন উচ্চতর বিত্তশালী পরিবারের সন্তানদের বেলায় ঘটে থাকে। তবে এখানে সেটা আলােচনা করা উদ্দেশ্য নয়। এখানে যা বলতে চাওয়া হয়েছে তাহলাে নিজের ইচ্ছা ও বিচার বিবেচনার ওপর নিয়ন্ত্রণশীল মানুষের সংবেদনশীলতা, জীবন জীবিকা সংক্রান্ত বিশেষ মূল্যবােধ ও ন্যায় অন্যায়ের পার্থক্যবােধ। সে স্বেচ্ছায় আল্লাহর দেয়া জীবিকা থেকে কেবল পবিত্র হালাল ও ন্যায়সংগত জীবিকাই বেছে নেয়া। এ ব্যাপারে সে কোনাে লােভ লালসার কাছে নতি স্বীকার করে না। জীবনকে সে কেবল উদ্দেশ্যহীন ও লাগামহীন রসনা তৃপ্তির একটা খাবার টেবিল মনে করে না এবং বৈধ অবৈধ নির্বিশেষে সব রকমের ভােজ্য দ্রব্য দিয়ে উদরপুর্তি করে না। মানুষ ও পশুর মধ্যে প্রধান পার্থক্য হলাে, মানুষ একটা উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য এবং জীবন সম্পর্কে একটা বিশেষ ধারণা পােষণ করে। জীবন সম্পর্কে তার এই বিশেষ ধারণা জীবনের স্রষ্টা আল্লাহর কাছ থেকে প্রাপ্ত নির্ভুল নীতিমালার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত। সে যদি এসব নীতিমালা ও উদ্দেশ্য লক্ষ্য হারিয়ে বসে, তাহলে বুঝতে হবে, মানুষের যে গুণ বৈশিষ্ট্যের দরুণ সে পশু থেকে পৃথক ও শ্রেষ্ঠ, সেই গুণ বৈশিষ্টই সে হারিয়ে ফেলেছে। কাফের ও মােমেনদের তুলনামূলক বৈশিষ্ট আলােচনার ধারাবাহিকতার এই পর্যায়ে রসূল(স.)-কে বহিষ্কারকারী মক্কানগরীর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা ও তার সাথে ধ্বংসপ্রাপ্ত জনপদগুলাের তুলনা করা হয়েছে। অথচ সে সব জনপদ মক্কার চেয়ে অনেক বেশী শক্তিশালী ছিলাে, যে নগর তােমাকে বহিষ্কার করেছে, তার চেয়ে শক্তিশালী কতাে নগর ছিলাে। আমি তাদেরকে ধ্বংস করে দিয়েছি। তাদের কোনাে সাহায্যকারীও ছিলাে না।’ বর্ণিত আছে যে, এ আয়াতটা রসূল(স.)-এর মক্কা থেকে মদীনা অভিমুখে হিজরত করে যাওয়ার সময় পথিমধ্যে নাযিল হয়েছিলাে। এর উদ্দেশ্য ছিলাে রসূল(স.)-কে সান্তনা ও প্রবােধ দেয়া এবং ইসলামী আন্দোলনের প্রতিরোধকারী সেসব দোর্দন্ড প্রতাপশালী মােশরেকদের দর্প খর্ব করা, যারা মুসলমানদের ওপর ক্রমাগত নির্যাতন চালিয়ে তাদের মাতৃভূমি, ঘরবাড়ী ও সহায়সম্পদ ত্যাগ করে কেবল ঈমান বাঁচাতে বিদেশে হিজরত করতে বাধ্য করেছিলাে। এরপর এই দুই গােষ্ঠীর তুলনামূলক পর্যালােচনা অব্যাহত রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা কেন মােমেনদের অভিভাবক হয়েছেন? কেন তাদেরকে ইহকালীন জীবনে বিজয় ও সম্মান দানের পর আখেরাতে জান্নাতে প্রবেশ করান, কেনই বা কাফেরদের কোনাে অভিভাবক থাকে না এবং তারা দুনিয়ার জীবনে অত্যন্ত জঘন্য ধরনের পাশবিক জীবন যাপনের পর ধ্বংসপ্রাপ্ত ও আখেরাতে জাহান্নামের চির অধিবাসী হয়, তার কারণ বিশ্লেষণ করা হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি তার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে আগত সুস্পষ্ট প্রমাণের ওপর প্রতিষ্ঠিত, সে কি সেই ব্যক্তির সমান, যার কাছে তার পাপ কাজগুলােকে সুশােভিত করা হয়েছে এবং যারা স্বীয় প্রবৃত্তির অনুসরণ করে।’ বস্তুত উভয় গােষ্ঠীর অবস্থান, আদর্শ ও চরিত্রে এটাই আসল পার্থক্য। যারা ঈমান এনেছে, তারা তাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট প্রমাণের ওপর প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। তারা সত্যকে দেখেছে ও তাকে চিনে নিয়েছে। তার উৎস সম্পর্কে তারা নিশ্চিত হবার জন্যে তাদের প্রতিপালকের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করেছে, তার কাছ থেকে সুনিশ্চিত তথ্য লাভ করেছে এবং সেই তথ্যের ওপর তাদের সুদৃঢ় প্রত্যয় জন্মেছে। এ ব্যাপারে তারা কোনাে প্রতারণা বা বিভ্রান্তির শিকার হয়নি। পক্ষান্তরে যারা কুফরি অবলম্বন করেছে, তাদের অসৎ কর্মগুলােকে সুশােভিত করে দেয়া হয়েছে। ফলে তা খারাপ হওয়া সত্তেও তাদের কাছে সুন্দর লেগেছে। সত্যকে তারা দেখেওনি, বিশ্বাসও করেনি। তারা কেবল তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করেছে। তাদের কোনাে নীতিও নেই আদর্শও নেই, যার আলােকে তারা হক ও বাতিলের পার্থক্য বুঝতে পারে। এই শেষােক্ত গােষ্ঠী কি প্রথমােক্ত গােষ্ঠীর মতাে? তারা চিন্তা চেতনায়, জীবনাদর্শে, দৃষ্টিভঙ্গীতে ও স্বভাব চরিত্রে পরস্পর থেকে ভিন্ন। সুতরাং তাদের মূল্যবােধ ও মানদন্ড যেমন এক রকম নয়, তেমনি কর্মফল ও পরিণামেও তারা সমান নয়। পরিণতি ও কর্মফলে যে তারা পরস্পর থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন, সে কথাই বলা হয়েছে পরবর্তী আয়াতে, আল্লাহভীরু লােকদের জন্যে যে জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে, তার বিবরণ এ রকম যে, সেখানে কতগুলাে ঝর্ণা আছে বিশুদ্ধ পানির, কতগুলাে ঝর্ণা আছে অপরিবর্তনীয় স্বাদযুক্ত দুধের। কতগুলাে ঝর্ণা আছে পানকারীদের জন্যে খুবই মজাদার পানীয়তে ভর্তি, কতগুলাে ঝর্ণা আছে স্বচ্ছ মধুর, তাদের জন্যে সেখানে থাকবে হরেক রকমের ফলমূল এবং তাদের প্রভুর পক্ষ থেকে ক্ষমা। তারা কি সেই অনন্তকাল দোযখে বসবাসকারীদের মতাে, ‘যাদেরকে ফুটন্ত পানি খেতে দেয়া হবে। সেই পানি তাদের নাড়িভুঁড়ি ছিন্ন ভিন্ন করে দেবে।’ সুখ ও আযাবের এরূপ অনুভবযােগ্য দৃশ্য কোরআনের বহু জায়গায় বর্ণিত হয়েছে। কখনাে কখনাে পরােক্ষ ও প্রত্যক্ষ দৃশ্যও আসে। অনুরূপভাবে আদৌ অনুভবযােগ্য নয় এমন সুখ ও আযাবের দৃশ্যও কোন কোনাে জায়গায় পরিলক্ষিত হয়। | যে আল্লাহ তায়ালা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন তিনি নিজের সৃষ্টি সম্পর্কে সবচেয়ে ভালাে ও সবচেয়ে বেশী অবগত। কিভাবে কথা বললে তাদের হৃদয় গলবে, কোন জিনিস তাদের জন্যে অধিকতর শিক্ষণীয় কোনাে জিনিস তাদের সুখ ও আযাবের জন্যে অধিকতর উপযােগী, সে ব্যাপারে তিনিই বেশী অভিজ্ঞ। মানুষ অনেক রকমের, মানুষের মনেরও অনেক প্রকারভেদ রয়েছে। তাদের স্বভাব প্রকৃতিও অনেক ধরনের। মানুষের সহজাত সত্ত্বায় এর সব কটারই সমাবেশ ঘটে। তারপর প্রত্যেক মানুষের ব্যক্তি স্বাতন্ত্র অনুপাত তার ভেদাভেদ ঘটে। এ জন্যেই আল্লাহ তায়ালা তার বান্দাদের সম্পর্কে তার নিখুঁত ও নির্ভুল জ্ঞান অনুপাতে তাদের জন্যে ভিন্ন ভিন্ন রকমর সুখ ও দুঃখ কিংবা আযাব ও নেয়ামতের ব্যবস্থা করেন। কিছু লােক এমন রয়েছে, যাদের শিক্ষা ও লালনের জন্যে, কর্মে উদ্বুদ্ধ করার জন্যে, প্রতিদান ও প্রতিফল দেয়ার জন্যে এবং তাদের মনকে খুশী করার জন্যে জান্নাতে বিশুদ্ধ পানির নহর থাকা প্রয়ােজন, কারাে জন্যে অপরিবর্তনীয় স্বাদযুক্ত দুধের নহর উপযােগী। কারাে জন্যে স্বচ্ছ মধুর নহর উপযোগী। কারাে জন্যে মজাদার পানীয়ের নহর প্রয়ােজন, কারাে জন্যে রকমারি ফলমূল দরকার। কারাে জন্যে আবার ক্ষমা আবশ্যক যা দোযখ থেকে মুক্তি ও জান্নাতের বিচিত্র উপাদেয় নেয়ামত নিশ্চিত করে। এভাবে যাদের শিক্ষার জন্যে যা দরকার এবং যাদের কর্মফলের জন্যে যা বাঞ্চনীয়, আল্লাহ তায়ালা তাদের জন্যে তারই ব্যবস্থা করেন।  *এবাদাতের ধরন : কিছু লােক সঠিক এমনও রয়েছে যারা শুধু আল্লাহর অগণিত নেয়ামতের শােকর আদায়ের জন্যে অথবা শুধু তার প্রতি ভালােবাসার তাগিদে ও তার নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে তাঁর এবাদাত করে। তারা তাঁর আনুগত্যের মাধ্যমে বন্ধুর সাথে বন্ধুর যে ঘনিষ্ঠতা প্রয়ােজন, সেই ঘনিষ্ঠতা জন্মাতেই সচেষ্ট থাকে বেশী। কেউ কেউ শুধু এই লজ্জার খাতিরেই আল্লাহর এবাদাত করে আল্লাহ তায়ালা যেন তাদেরকে কোনাে অনভিপ্রেত অবস্থায় না দেখে ফেলেন। এ ছাড়া আর কোনাে বেহেশত বা দোযখের চিন্তা তাদের মনে স্থান পায় না। কোনাে আযাব বা নেয়ামতের কথাও তারা আদৌ ভাবে না। তাদের শিক্ষার জন্যে এবং তাদের পুরস্কৃত করার জন্যে আল্লাহর একথাটা বলাই যথেষ্ট, ‘যারা ঈমান এনেছে ও সৎকর্ম করেছে, দয়াময় আল্লাহ তায়ালা তাদের জন্যে অচিরেই ভালােবাসা বরাদ্দ করবেন। তাদের পক্ষে এ কথা জানাও যথেষ্ট হতে পারে যে, ‘তারা মহা ক্ষমতাধর বাদশাহর কাছে সত্যের আসনে অধিষ্ঠিত হবে।’ একটি হাদীসে আছে যে, নামায পড়তে পড়তে যখন রসূল(স.)-এর পা ফুলে গেলাে তখন হযরত আয়শা(রা.) বললেন, ‘হে রসূল, আল্লাহ তায়ালা আপনার আগের ও পেছনের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেয়া সত্তেও আপনি এরূপ করেন?’ রসূল(স.) জবাব দিলেন, হে আয়েশা, তাই বলে কি আমি তার একজন কৃতজ্ঞ বান্দা হব না? রাবেয়া আদডিয়া বলেন, ‘বেহেশত ও দোযখ যদি না থাকতাে, তাহলে কি কেউ আল্লাহর এবাদত করতাে না এবং আল্লাহকে কেউ ভয় করতাে না? সুফিয়ান ছাওরী(রা.) রাবেয়াকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আপনার ঈমানের রহস্য কী? তিনি জবাব দিলেন, আমি আল্লাহর দোযখের ভয়ে বা তার বেহেশতের লােভে তার এবাদাত করিনি। এবাদাত করেছি কেবল তাকে পাওয়ার জন্যে। উপরােক্ত হাদীসে রসূল(স.)-এর দৃষ্টান্তে এবং পরবর্তী রেওয়ায়াতে হযরত রাবেয়ার বক্তব্যে যে দু’ধরনের অনুভূতি প্রকাশ পেলাে, তা ছাড়াও আরাে বহু ধরনের অনুভূতি ও মানসিকতা বিদ্যমান রয়েছে। এর সবগুলােই কোনাে না কোনাে পর্যায়ে দুনিয়ায় চরিত্র গঠনে ও আল্লাহর কাছে কর্মফল প্রাপ্তির ক্ষেত্রে উপযােগী ও উপকারী। সাধারণভাবে যে বিষয়টি লক্ষণীয় তা এই যে, কোরআন নাযিল হওয়ার সুদীর্ঘ মেয়াদকালে প্রশিক্ষণ ও সাংস্কৃতিক মানােন্নয়নে শ্রোতাদের যতই উন্নতি হয়েছে, আযাব ও পুরস্কারের দৃশ্য ততই স্পষ্ট ও স্বচ্ছ হয়েছে। অনুরূপভাবে শ্রোতাদের শ্রেণীভেদে ও অবস্থা ভেদেও শাস্তি ও পুরস্কারের ঘােষণার সচ্ছতা ও স্পষ্টতায় তারতম্য ঘটেছে। সকল যুগে মানব জাতির সকল প্রজন্মেই এসব অবস্থা ও নমুনার পুনরাবৃত্তি ঘটে থাকে। এখানে দু’ধরনের কর্মফল ঘােষিত হলাে, একটা হলো, আল্লাহর পক্ষ থেকে গুনাহ মাফের পাশাপাশি রকমারি ফলমূল ও রকমারি নহর সম্বলিত জান্নাত প্রাপ্তি। আর অপরটা হলো, যে ব্যক্তি চিরদিনের জন্যে দোযখবাসী এবং যাকে এমন গরম পানি খাওয়া হবে, যা খেয়ে নাড়িভুড়ি ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে। শেষােক্ত বর্ণনাটা একটা ভয়ংকর আযাবের এমন দৃশ্য, যা ঐকান্তিকভাবে অনুভূত হয়, যা সূরা আল কিতালের (কেতাল অর্থ যুদ্ধ) প্রেক্ষাপট ও পরিবেশের সাথে সংগতিপূর্ণ এবং সমকালীন মােশরেকদের চারিত্রিক মনের সাথেও সংগতিপূর্ণ। কেননা তারা ভােগ বিলাসে মত্ত থাকতাে ও পশুর মতাে পানাহারে লিপ্ত থাকতাে। সুতরাং এখানে পরিবেশ ও প্রেক্ষাপটটা হলাে আল্লাহর সাথে শিরকী ও কুফুরী আর কর্মফলটা হলাে গরম পানি পান করা ও তার ফলে নাড়িভুড়ি বেরিয়ে যাওয়া। কেননা তারা পশুদের মতাে খেয়ে দেয়ে এই নাড়িভুড়িতেই তা মন্ডিত রাখতাে। আর এই দু’ধরনের মানুষের কর্মফল কখনাে এক রকম হবে না। কেননা তারা চরিত্রে ও আদর্শেও এক রকম নয়। এখানে সূরার প্রথম পর্বের সমাপ্তি। এর সূচনা হয়েছিলাে যুদ্ধ বিগ্রহের কথা দিয়ে এবং তারপর থেকে শেষ পর্যন্ত ক্রমাগত যুদ্ধ বিগ্রহের মধ্য দিয়েই আলােচনা অব্যাহত রয়েছে।
*মােনাফেকদের কুটীল স্বভাব : এই পর্বটিতে মােনাফেকদের সম্পর্কে আলােচনা করা হয়েছে। খােদ রসূলুল্লাহ(স.)-এর ক্ষেত্রে তাদের আচরণ কেমন ছিলাে, পবিত্র কোরআনের ব্যাপারে তাদের মনোভাব কেমন ছিলাে, আল্লাহর দ্বীনকে সমুন্নত করার জন্যে মুসলমানদের ওপর যে জেহাদ ফরয করা হয়েছিলাে সে সম্পর্কে তাদের নীতি কি ছিলাে এবং সর্বোপরি ইসলামের বিরুদ্ধে, মুসলমানদের বিরুদ্ধে পাকানাে। ইহুদীদের ষড়যন্ত্রে তাদের ভূমিকা কী ছিলাে ইত্যাদি বিষয় এই পর্বে আলােচিত হয়েছে। মােনাফেক গােষ্ঠীর আবির্ভাব ঘটে মদীনায়। মক্কায় এদের কোনাে অস্তিত্ব ছিলাে না। সেখানে মােনাফেক সাজার প্রয়ােজনও দেখা দেয়নি। কারণ সেখানে মুসলমানরা ছিলাে নির্যাতিত। কাজেই তাদের সাথে ভন্ডামী ও মুনাফিকের আশ্রয় নেয়ার কারাে প্রয়ােজন হয়নি। কিন্তু মদীনায় আওস ও খাজরায গােত্রদ্বয়ের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা যখন ইসলাম ও মুসলমানদের অবস্থান ও মর্যাদাকে সমুন্নত করেন এবং প্রতিটি পরিবারে ও প্রতিটি ঘরে ইসলামের দাওয়াত পৌছে যায়, তখন কিছুসংখ্যক লােক যারা প্রিয় নবী মােহাম্মদ(স.)-কে মনে মনে ঘৃণা করতাে, ইসলামের উত্থান ও বিজয় কে ঘৃণা করে তারা এই ভন্ডামীর আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলাে। কারণ, ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে তাদের ঘৃণা ও শক্রতা প্রকাশ করার মতাে ক্ষমতা ও সৎসাহস তাদের ছিলাে না। তাই তারা বাধ্য হয়েই মুসলমান হওয়ার ভান করতাে, তবে মনে মনে ঠিকই ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিংসা ও বিদ্বেষ পােষণ করতাে। শুধু তাই নয়, বরং তারা রসূলুল্লাহ(স.) ও তাঁর সাহাবাদের ক্ষতি করার জন্যে সুযােগের সন্ধানে থাকতাে। এই মুনাফিক গােষ্ঠীর শিরােমনি হলাে, আব্দুল্লাহ বিন উবাই বিন সুলুল। মদীনায় প্রথম দিকে যেহেতু ইহুদী সম্প্রদায় সামরিক শক্তি, অর্থনৈতিক শক্তি ও সাংগঠনিক শক্তির অধিকারী ছিলাে এবং তারাও রসূলুল্লাহ(স.)-এর আবির্ভাব, তাঁর ধর্মের বিস্তার এবং তার সাহাবাদেরকে সুনযরে দেখতাে না, তাই এর দ্বারা মােনাফেকদের উৎসাহ ও সাহস বৃদ্ধি পেয়ে যায়। ফলে উভয় সম্প্রদায় হিংসা ও বিদ্বেষের বশবর্তী হয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে একের পর এক ষড়যন্ত্রের জাল বুনতে লাগলাে এবং কূটচাল চালাতে লাগলাে। মুসলমানদের অবস্থা খারাপ দেখলে তখন তারা প্রকাশ্যে তাদের সাথে শত্রুতা ও বিদ্বেষমূলক আচরণ করতাে। আর যখন মুসলমানদেরকে সচ্ছল ও ভালাে অবস্থায় দেখতাে, তখন তাদের বিরুদ্ধে ওরা ষড়যন্ত্র ও কুটচাল চালাতে গােপনে, রাতের অন্ধকারে। মাদানী যুগের মধ্যভাগ পর্যন্ত এই ইহুদী মােনাফেক গােষ্ঠী ইসলাম ও মুসলমানদের জন্যে সত্যিকার অর্থেই একটা আপদ ছিলাে। মাদানী সূরাগুলােতে এই মােনাফেক গােষ্ঠীর পরিচিতি, তাদের ষড়যন্ত্র ও কূটচালের বর্ণনা ধারাবাহিকভাবে এসেছে। ওদের ক্রিমুখী নীতি ও চরিত্রের বর্ণনাও এসেছে। ইহুদীদের সাথে ওদের দহরম মহরম, দেন দরবার এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে একসঙ্গে ষড়যন্ত্র পাকানাের কথাও সেখানে একাধিকবার এসেছে। আলােচ্য আয়াতে প্রসঙ্গক্রমে ওদের আলােচনা এসেছে এবং সেই সাথে ইহুদীদের আলােচনাও এসেছে। এর আগের আয়াতে বলা হয়েছে, তাদের মধ্যে কিছু লােক তােমার দিকে কান পাতে, এরপর যখন তােমার কাছ থেকে বাইরে যায়, তখন যারা শিক্ষিত, তাদেরকে বলে এই মাত্র তিনি কী বললেন?(আয়াত নং-১৬) এই আয়াতে উল্লেখিত তাদের শব্দ দ্বারা সম্ভবত কাফেরদের কথা বলা হয়েছে। কারণ, আগের পর্বে কাফেরদের সম্পর্কে আলােচনা হয়েছে। এখানে মােনাফেকদেরকে কাফেরদের অন্তর্ভুক্ত করার কারণ হচ্ছে, মােনাফেকরা প্রকৃতপক্ষে কাফেরই। পার্থক্য কেবল এতােটুকু যে, ওদের ব্যাপারটা প্রকাশ্য, আর ওদের ব্যাপারটা গােপন। তাই এদের স্বরূপ উদঘাটনের জন্যে আল্লাহ তায়ালা এই আয়াতে এদের সম্পর্কে আলােচনা করছেন। অথবা ‘তাদের শব্দটি দিয়ে মুসলমানদের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। কারণ, মােনাফেকরা তাদের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিলাে। ইসলামের মুখােশ পরে ওরা নিজেদেরকে মুসলিম বলে যাহির করতাে। আর এই বাহ্যিক পরিচিতির ওপর ভিত্তি করে মুসলমানরা ওদের সাথে মুসলমান হিসেবেই আচরণ করতাে। কারণ, বাহ্যিক পরিচিতির ওপর ভিত্তি করেই মানুষের সাথে আচরণ করা ইসলামের বিধান। তবে উভয় অবস্থাই তাদের কতক দ্বারা যাদেরকে বুঝানাে হয়েছে তারা মােনাফেক ব্যতীত আর কেউ নয়। আয়াতে বর্ণিত বিশেষণ ও ক্রিয়াকলাপেই তা প্রমাণ করছে। তাছাড়া আলােচ্য পর্বের প্রসঙ্গ ও মােনাফেকদের আলােচনাও সে কথা প্রমাণ করছে। মনযােগ সহকারে রসূলুল্লাহ(স.)-এর বক্তব্য শুনার পরও তারা জিজ্ঞেস করছে যে, রসূল এই মাত্র কী বললেন। এর দ্বারাই প্রমাণিত হয়, ওরা কেবল শােনার ভান করতাে, প্রকৃত পক্ষে ওদের মন থাকতাে অন্য দিকে। অথবা ওদের মন ছিলাে বিকৃত ও বন্ধ। অথবা ওদের এ ধরনের প্রশ্নের মাঝে একটা চাপা ও ধূর্ততাপূর্ণ বিদ্রপ কাজ করতাে। এর মাধ্যমে ওরা শিক্ষিত ও জ্ঞানী লােকদেরকে এ ধারণা দিতেই চেষ্টা করতাে যে, রসূল যা বলেন তা বােধগম্য নয়, অথবা তার কথা কোনাে অর্থপূর্ণ বক্তব্য সে কারণেই গভীর মনোযোগ সহকারে রসূলের বক্তব্য শােনার পরও তার কোনাে মর্ম বুঝতে পারছে না এবং এ থেকে কোনাে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারছে না! এই প্রশ্নের আর একটি উদ্দেশ্য থাকতে পারে। আর তা হলাে, যে সব শিক্ষিত ও জ্ঞানী লােক রাসূলের বক্তব্য শােনার জন্যে ভিড় করতাে এবং গভীর আগ্রহে তার মর্ম অনুধান করতো ও তা মনে রাখতে চেষ্টা করতাে তাদের সাথে রং তামাশা করা। বিশেষ করে সাহাবায়ে কেরাম, যারা রসূলুল্লাহ(স.)-এর মুখনিসৃত প্রতিটি বাক্য মুখস্ত করে ফেলতেন, তাদের সাথেই হাসিঠাট্টা ও রং তামাশার উদ্দেশ্যে ওরা এ জাতীয় প্রশ্ন করতাে। যা হােক, ওদের এই আচরণের মাধ্যমে ওদের মনের কপটতা, কদর্যতা, বিকৃতি ও গােপন প্রবৃত্তিই প্রকাশ পায়। তাই ওদের সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘এদের অন্তরে আল্লাহ তায়ালা মােহর মেরে দিয়েছেন এবং তারা নিজেদের খেয়াল খুশী মতাে চলে। এই হচ্ছে মােনাফেকদের অবস্থা। অপরদিকে মােমেনদের অবস্থা সম্পূর্ণ এর বিপরীত। যেমন, ‘যারা সৎ পথ প্রাপ্ত হয়েছে, তাদের সৎ পথ প্রাপ্তি আরো বেড়ে যায় এবং আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে তাকওয়া দান করেন।'(আয়াত ১৭) এখানে বক্তব্যের বিন্যাস ও ধারাবাহিকতা লক্ষ্য করার মতাে। যারা সৎ পথের সন্ধান পেয়ে সে পথেই নিজেদেরকে পরিচালিত করেছে, তাদেরকে সৎ পথে টিকে থাকার জন্যে আল্লাহ তায়ালা আরাে শক্তি দান করেছেন। এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের হেদায়াতপ্রাপ্তির জন্যে পুরস্কারস্বরূপ। এর চেয়ে অধিকতর পরিপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ পুরস্কারও তাদেরকে আল্লাহ তায়ালা দান করেন, আর সেটা হলো তাকওয়া। আর তাকওয়া হচ্ছে মনের এমন একটি অবস্থার নাম যার ফলে মানুষ সব সময় এবং সব অবস্থায় আল্লাহকে ভয় করে চলে, আল্লাহর নযরদারী অনুভব করে, তাঁর গজবের ভয় করে, তার সন্তুষ্টির জন্যে সচেষ্ট থাকে এবং আল্লাহর অপছন্দনীয় কোনাে অবস্থায় আল্লাহ তায়ালা তাকে দেখুক সেটা সে মনে প্রাণে কামনা করে না। মনের এই সদা জাগ্রত অবস্থার নামই হচ্ছে তাকওয়া। এটা একটা পুরস্কার যা আল্লাহ তায়ালা কেবল তার সেই বান্দাদেরকে দিয়ে থাকেন যারা নিজেদেরকে সৎ পথে পরিচালিত করে এবং তার সন্তুষ্টি লাভের জন্যে আগ্রহ নিয়ে চেষ্টা করে।  *এরা কি কেয়ামতের অপেক্ষায় আছে! : হেদায়াত, তাকওয়া ও সচেতনতার বিপরীতে আসে কপটতা, মানসিক বিকৃতি ও অচেতনতা- যার উল্লেখ পূর্ববর্তী আয়াতে এসেছে। পরবর্তী আয়াতে এই কপট, মানসিক বিকারগ্রস্ত ও অচেতন লােকদের কথা বলা হয়েছে। এরা মােনাফেকের দল। এরাই রসূলুল্লাহ(স.)-এর মজলিস থেকে উঠে যেতাে এবং তার বক্তব্যের কোনাে মর্মার্থই ওরা অনুধাবন করতে পারতাে না। অথচ এই বক্তব্য ছিলো ওদের জন্যে কল্যাণকর, দিকনির্দেশক এবং অন্তরে আল্লাহভীতি সৃষ্টির মােক্ষম উপায়। তাই ওদের পরিণতি পরকালে কি হতে পারে সে সম্পর্কে ওদেরকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলা হচ্ছে, তারা কি শুধু এই অপেক্ষাই করছে যে, কেয়ামত হঠাৎ করে তাদের কাছে এসে পড়ুক। বস্তুত কেয়ামতের লক্ষণগুলাে তাে এসেই পড়েছে। কাজেই, ‘কেয়ামত এসে পড়লে উপদেশ গ্রহণ করার সুযােগ তাদের আর থাকলাে কৈ?'(আয়াত ১৮) এই আয়াতে গাফিল ও মােনাফেক গােষ্ঠীকে সজোরে ঝাঁকুনি দিয়ে সজাগ করার চেষ্টা করা হয়েছে, যেমনটি করা হয় নেশায় বিভাের কোনাে মদ্যপায়ীকে। এই গাফিলের দল কিসের অপেক্ষায় আছে? রসূলুল্লাহ(স.)-এর মােবারক মজলিসে বসেও এরা কিছু বুঝে না, কিছু স্মরণ করে না, কোনাে উপদেশ গ্রহণ করে না। ওরা চায় কী? ওরা কিসের অপেক্ষা করছে? ওরা কি চায়, হঠাৎ করে ওদের সামনে কেয়ামত এসে হাযির হােক এবং ওদেরকে চমক লাগিয়ে দিক। এই কেয়ামতের জন্যেই কি ওরা অপেক্ষা করছে। অথচ এর লক্ষণগুলাে তাে ইতিমধ্যেই | প্রকাশ পেয়েছে। এই লক্ষণগুলাের মধ্যে সবচেয়ে বড় লক্ষণ হচ্ছে, শেষ নবীর আগমন। কারণ, তাঁর আগমনই সতর্ক করে দিচ্ছে, চরম মুহূর্তটির সময় ঘনিয়ে এসেছে। সে সম্পর্কে খােদ রসূলুল্লাহ(স.) এক হাদীসে বলেছেন, আমার ও কেয়ামতের আগমন পাশাপাশি এরূপ এ কথা বলার সময় তিনি মধ্যমা ও তার পাশের আঙ্গুল দুটো এক সাথে উঁচু করে দেখালেন।(বোখারী ও মুসলিম) রসূলুল্লাহ(স.)-এর আবির্ভাবের পর থেকে নিয়ে এ পর্যন্ত একটা দীর্ঘকাল অতিবাহিত হওয়ার পরও কেয়ামত আসেনি। এর দ্বারা বুঝা যায় আল্লাহর ঘােষিত দিন ও কালের হিসাব আমাদের দিন ও কালের মতাে নয়। কাজেই আল্লাহর হিসাব নিকাশ অনুযায়ী কেয়ামতের লক্ষণ প্রকাশ পেয়ে গেছে। এখন এর আকস্মিক আগমনের অপেক্ষায় বসে থাকা কোনাে বুদ্ধিমানের কাজ নয়। কারণ, কেয়ামত এসে গেলে তখন আর কারাে কিছু করার সুযােগ থাকবে না। তাই বলা হয়েছে, কাজেই কেয়ামত এসে পড়লে উপদেশ গ্রহণ করার সুযােগ তাদের আর থাকলাে কৈ?
*মােমেনদের জন্যে আল্লাহর নির্দেশ : এরপর রসূলুল্লাহ(স.) এবং সঠিক পথের পথিক মােমেন মুসলমানদের সম্বোধন করা হয়েছে এবং তাদেরকে জ্ঞান ও বিদ্যার পথ এবং যিকির ও ইসতেগফারের পথ অবলম্বন করতে বলা হয়েছে। সাথে সাথে তাদেরকে অন্তরে আল্লাহর সার্বক্ষণিক নজরদারি ও তাঁর সর্বব্যাপী জ্ঞানের অনুভূতি জাগ্রত রাখতে বলা হয়েছে এবং অনুভূতি অন্তরে ধারণ করে কেয়ামতের জন্যে সব সময়ই সজাগ ও প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছে। যেমন আয়াতে বলা হয়েছে, ‘জেনে রাখাে, আল্লাহ তায়ালা ব্যতীত কোনাে উপাস্য নেই। ক্ষমা প্রার্থনা করো, নিজের ক্রুটির জন্যে এবং মুমিন পুরুষ ও নারীদের জন্যে। আল্লাহ তায়ালা তোমাদের গতিবিধি ও অবস্থান সম্পর্কে জ্ঞাত।'(আয়াত ১৯) আলােচ্য আয়াতে প্রথমেই যে সত্যটির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে এবং যে সত্যটির ওপর রসূল(স.)-এর গােটা মিশন প্রতিষ্ঠিত- তা হলাে, ‘আল্লাহ তায়ালা ব্যতীত কোনাে উপাস্য নেই’ এই সত্যটিকে মনে প্রাণে বিশ্বাস করে এবং এর অনুভূতি অন্তরে ধারণ করে যে দ্বিতীয় কাজটি করতে বলা হয়েছে, তা হলাে- ‘নিজের ক্রুটির জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করাে।’ বলা বাহুল্য যে, রসূল(স.) ছিলেন নিস্পাপ। ছােটখাট কোনাে ক্রুটিবিচ্যুতি হয়ে থাকলেও তা আল্লাহ তায়ালা ক্ষমা করে দিয়েছেন। কিন্তু ক্ষমা প্রার্থনা হচ্ছে একজন সচেতন, অনুভূতিপরায়ণ মােমেন বান্দার গুণ। সে সব সময়ই নিজের আমলকে ক্রুটিপূর্ণ বলে মনে করে এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে ক্ষমা লাভ করার পরও ক্ষমা প্রার্থনাকে এক ধরনের এবাদত ও আল্লাহর শােকরগোযারী বলে মনে করে। তাছাড়া এর মাঝে অন্যদের জন্যে উপদেশও রয়েছে। রসূলুল্লাহ(স.)-এর পর থেকে নিয়ে। কেয়ামত পর্যন্ত যতাে মােমেন বান্দা এই পৃথিবীতে আগমন করবে এবং যারা আল্লাহর কাছে প্রিয় নবীর মর্যাদা কতাে জানতে পারবে, তাদের সকলের জন্যে এই আয়াত উপদেশ হিসেবে কাজ করবে। এর দ্বারা তারা বুঝতে পারবে যে, রসূলুল্লাহ(স.) আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের জন্যে কতাে বড়াে নেয়ামত। কারণ, তিনি নিষ্পাপ হওয়া সত্তেও আল্লাহ তায়ালা তাকে প্রথমে নিজের জন্যে তারপর সকল মােমেন নর নারীর জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করতে নির্দেশ দিচ্ছেন, আর তিনি যেহেতু আল্লাহর কাছে প্রিয় এবং তার দোয়াও গ্রহণযােগ্য। তাই মােমেন নর নারীদের জন্যে করা তার দোয়া আল্লাহ তায়ালা নিশ্চয়ই কবুল করবেন। আলােচ্য আয়াতের আর একটি বিশেষ লক্ষণীয় ও হৃদয়স্পর্শী দিক হচ্ছে এই যে, আল্লাহ তায়ালা তােমাদের গতিবিধি ও অবস্থান সম্পর্কে জ্ঞাত।’ বলা বাহুল্য, এই সত্য কথাটি জানার পর এক মােমেন বান্দার অন্তরে একই সময়ে প্রশান্তিও জন্ম নেয় এবং ভয়ও জন্ম নেয়। প্রশান্তি জন্ম নেয় এই কারণে যে, মােমেন বান্দা যেখানে যে অবস্থায়ই থাকুক না কেন, সে আল্লাহর হেফাযতে ও তত্ত্বাবধানে থাকে। আর ভয় জন্ম নেয় এই কারণে যে, আল্লাহর দষ্টি তার প্রতি নিবন্ধ রয়েছে, তার প্রতিটি অবস্থা সম্পর্কে তিনি অবগত, এমনকি গােপন কথাবার্তা ও কার্যকলাপ সম্পর্কেও তিনি অবগত। এ জাতীয় বক্তব্যের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা মােমেন বান্দাদের মাঝে সার্বক্ষণিক সচেতনতা ও সাবধানতা, ভয় ভীতি এবং আশা ও আকাঙ্খা সৃষ্টি করতে চান, এই গুণাবলী দিয়ে তাদেরকে গড়ে তুলতে চান।
*জিহাদের ব্যাপারে মােনাফেকদের দৃষ্টিভঙ্গি : পরবর্তী আয়াতে জেহাদের ব্যাপারে মােনাফেকদের দৃষ্টিভঙ্গি কি ছিলাে, সে বিষয়ে আলােচনা করা হয়েছে। জেহাদের নাম শুনলে মােনাফেকরা আতঙ্কিত হয়ে পড়তো, ভীত ও সন্ত্রস্ত হয়ে পড়তাে, তাদের শক্তি লােপ পেয়ে যেতাে এবং মনােবল ভেঙ্গে পড়তাে। অর্থাৎ জেহাদের নির্দেশ আসলে তাদের মনের অবস্থা কোন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়াত, সে কথা এখানে বলা হয়েছে। সাথে সাথে একথাও বলা হয়েছে যে, তারা যদি মুনাফিক এর উপর অটল থাকে, জেহাদের নির্দেশের প্রতি আন্তরিক না হয় এবং সততা ও নিষ্ঠার সাথে আল্লাহর এই নির্দেশ পালন না করে তাহলে তাদের পরিণতি হবে অত্যন্ত করুণ ও ভয়াবহ। আয়াতে বলা হয়েছে, যারা মােমেন, তারা বলে, একটি সূরা নাযিল হয় না কেন? এরপর যখন দ্ব্যর্থহীন কোন সূরা নাযিল হয় এবং তাতে জিহাদের উল্লেখ করা হয়, তখন যাদের অন্তরে রােগ আছে, তাদেরকে তুমি মৃত্যু ভয়ে মুর্ছাপ্রাপ্ত মানুষের মতাে, তােমার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখবে। সুতরাং ধ্বংস তাদের জন্যে।'(আয়াত ২০-২৪) মােমেন বান্দারা নতুন সূরা নাযিলের অপেক্ষা করতাে। এই অপেক্ষা পবিত্র কোরআনের প্রতি এবং পবিত্র কোরআনের নতুন নতুন সূরার প্রতি তাদের ভালোবাসা ও আগ্রহের কারণে হতাে। কেননা প্রতিটি নতুন সূরার মাঝে তারা মনের জন্যে নতুন নতুন খােরাক পেতাে। অথবা এই অপেক্ষা ছিলাে জেহাদ সংক্রান্ত কোনাে সূরার জন্যে। কারণ, জেহাদের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তারা চিন্তা ভাবনা করতাে। আর সে কারণেই তাদের বক্তব্যে অধীর আগ্রহের ভাব ফুটে ওঠেছে। তারা বলছে, কেন একটা সূরা নাযিল হয় না? এরপর তাদের কাংখিত সূরা নাযিল হওয়ার পর অসুস্থ অন্তরের অধিকারী অর্থাৎ মােনাফেকদের অবস্থা কি হত তা বলা হয়েছে। এখানে মােনাফেকদেরকে অসুস্থ অন্তরের অধিকারী বলা হয়েছে। কারণ, জেহাদের নাম শুনলেই তারা হাত পা ছেড়ে দিতাে, তাদের মুখােশ খসে পড়তাে, তাদের মনের দুর্বলতা ও আতঙ্ক প্রকাশ পেয়ে যেতাে। তারা এমন হাব-ভাব দেখাতো যা পুরুষদের জন্যে শোভা পায় না। তাদের অবস্থাটা পবিত্র কোরআনের নিপুণ বর্ণনায় এমন অপূর্ব রূপে চিত্রায়িত হয়েছে যা চাক্ষুষ ও জীবন্ত বলে মনে হয়। বলা হয়েছে, যাদের অন্তরে রোগ আছে, তাদেরকে তুমি মৃত্যুভয়ে মু্র্ছা প্রাপ্ত মানুষের মতাে তােমার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখবে। এই যে নিখুঁত ও নিপুণ বর্ণনা- এর অনুকরণ কারও পক্ষে সম্ভব নয়, এমনকি অন্য ভাষায় এর যথার্থ অনুবাদ সম্ভব নয়। এখানে ভয়কে আতঙ্কের পর্যায়ে, দুর্বলতাকে প্রকম্পনের পর্যায়ে এবং হীনমন্যতাকে মূৰ্ছার পর্যায়ে নিয়ে দেখানাে হয়েছে। এটাই হচ্ছে ঈমানশূন্য, সুস্থ বিবেকশূন্য এবং লাজ লজ্জাশূন্য প্রতিটি অন্তরের চিরস্তন ও পরিচিত রূপ। অন্তরে রােগ থাকলে বা মােনাফেকী থাকলে এই অবস্থারই সৃষ্টি হয়। মােনাফেক যখন ভয়ে, আতঙ্কে ও হীনমন্যতায় ভেঙ্গে পড়ছিলাে তখন তাদের সামনে এমন একটি ওষুধ এনে হাযির করা হলাে, যা সঠিকভাবে ও আন্তরিকতার সাথে পান করলে তাদের মনােবল দৃঢ় হতাে এবং তাদের শক্তি বৃদ্ধি পেতাে। সেই ওষুধটি সম্পর্কে এইভাবে বলা হয়েছে, তাদের আনুগত্য ও মিষ্টবাক্য জানা আছে, ‘অতএব জেহাদের সিন্ধান্ত হলে যদি তারা আল্লাহর প্রতি প্রদত্ত অঙ্গীকার পূর্ণ করে, তবে তাদের জন্যে তা মঙ্গলজনক হবে।'(আয়াত ২১) হাঁ, তাদের এই কেলেঙ্কারী, এই কাপুরুষতা, এই আতঙ্ক এবং এই হঠকারিতা ও কপটতার পরিবর্তে আনুগত্য ও মিষ্টি কথা তাদের জন্যে অবশ্যই উত্তম। এই আনুগত্যের মনােভাব থাকলে মানুষ স্বেচ্ছায় ও সন্তুষ্ট চিত্তে আল্লাহর নির্দেশের সামনে আত্মসমর্পণ করে এবং তা পালন করার জন্যে দৃঢ় মনােবল ও আস্থা নিয়ে কাজ করে। আর মিষ্টি কথা বা ভালাে কথা মানুষের চিন্তা শক্তিকে নির্মল করে, অন্তরকে সুস্থ ও স্থির রাখে এবং বিবেক পরিষ্কার রাখে। জেহাদের সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত আসার পর এবং জেহাদের মুখােমুখি হওয়ার মুহূর্তে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা রাখা তাদের উচিত। সংকল্পের ক্ষেত্রে এই বিশ্বাস থাকতে হবে, অনুভূতির ক্ষেত্রে এই বিশ্বাস থাকতে হবে। এর ফলে তাদের মনােবল দৃঢ় হবে, নিজ অবস্থানে অনড় ও অটল থাকতে পারবে। কঠিন কাজ সহজ বলে মনে হবে এবং যে বিপদকে তারা বিরাট দৈত্য বলে মনে করে এবং যার করাল গ্রাসে তাদেরকে গিলে ফেলবে বলে তারা ভয় করছে, তা তুচ্ছ ও নগণ্য বলে মনে হবে। এ ছাড়াও তাদের জন্যে দুটো উত্তম পরিণতির যে কোনাে একটি হবে, হয় মুক্তি ও বিজয় অথবা শাহাদাত ও জান্নাত, আর এটা নিসন্দেহে তাদের জন্যে উত্তম। এটাই মনের সেই প্রকৃত খােরাক যা ঈমানের মাধ্যমে মানুষ লাভ করে এবং এর দ্বারাই মনােবল বৃদ্ধি পায়, নৈতিক সাহস বৃদ্ধি পায়, ভয় ভীতি দূর হয়ে যায়, তার পরিবর্তে জন্ম নেয় দৃঢ়তা ও মানসিক প্রশান্তি। মােনাফেকদের ব্যাপারে আলােচনা করতে গিয়ে পরবর্তী আয়াতে আল্লাহ তায়ালা সরাসরি তাদেরকে লক্ষ্য করে ধমকের সুরে তাদের করুণ ও ভয়াবহ পরিণতির বিষয়ে সাবধান করে দিচ্ছেন এবং জানিয়ে দিচ্ছেন যে, তাদের এই পরাজিত ও পলায়নপর মানসিকতা যদি তাদেরকে প্রকাশ্য কুফরীর দিকে নিয়ে যায় এবং ইসলামের পাতলা আবরণটুকুও তাদের ওপর থেকে সরিয়ে নিয়ে যায়, তাহলে সেই করুণ ও ভয়াবহ পরিণতি থেকে তাদেরকে আর কেউ রক্ষা করতে পারবে না। আয়াতে বলা হয়েছে, ‘পেছনের দিকে ফিরে গেলে সম্ভবত তােমরা পৃথিবীতে অনর্থ সৃষ্টি করবে এবং আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করবে।’ (আয়াত ২২) আলােচ্য আয়াতে মােনাফেকদের সম্ভাব্য অবস্থার দিকে ইঙ্গিত করে তাদেরকে সতর্ক ও সাবধান করে দেয়া হচ্ছে এবং জানিয়ে দেয়া হচ্ছে যে, তারা যে অবস্থায় বিচরণ করছে তা অচিরেই তাদেরকে সেই পূর্বের জাহেলিয়াতের যুগে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে এবং পূর্বের ন্যায় তারা আবার দাঙ্গা ফাসাদসহ আপন লােকদের সাথে হানাহানিতে লিপ্ত হয়ে আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করবে। এই সাবধানবাণীর পরও যদি তাদের অবস্থার পরিবর্তন না হয় এবং যে অবস্থার আশঙ্কা করা হয়েছিলাে সেটাই যদি সৃষ্টি হয় তাহলে তাদের পরিণতি হবে এই, এদের প্রতিই আল্লাহ তায়ালা অভিসম্পাত করেন, অতপর তাদেরকে বধির ও দৃষ্টিহীন করেন। ‘এরা কি কোরআন সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করে না। নাকি তাদের অন্তর তালাবদ্ধ?'(আয়াত ২৩-২৪) অর্থাৎ যারা আদর্শিক ও মানসিক বিকারগ্রস্ত ও মােনাফেকীর রােগে আক্রান্ত তাদের অবস্থার উন্নতি না হয়ে যদি আরাে অবনতি ঘটে, এমনকি ইসলামের বাহ্যিক আবরণটুকু তারা ছুঁড়ে ফেলে দেয় তাহলে আল্লাহর লানত ও অভিশাপ থেকে তাদের আর রক্ষা নেই। ফলে তারা তাঁর রহমত থেকে বঞ্চিত হবে, হেদায়াত থেকে বঞ্চিত হবে এবং বধির ও দৃষ্টিহীন হয়ে পড়বে। তাদের চোখ ও কান ঠিকই থাকবে, কিন্তু এর শক্তি লােপ পেয়ে যাবে। ফলে সঠিক পথ দেখার এবং হক কথা শােনার মতাে শক্তি তাদের আর থাকবে না। কারণ, তারা এই শক্তিগুলাের যথার্থ ব্যবহার করেনি। এরপর তাদেরকে নিন্দার সুরে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে, এরা কি কোরআন সম্পর্কে গভীর চিন্তা করে না? তারা যদি এ কাজটি করতাে তাহলে তাদের মনের অন্ধকার দূর হয়ে যেতাে, সত্যের দুয়ার খুলে যেতাে, হেদায়াতের নূর তাতে প্রবেশ করতাে, তাদের অনুভূতি ও চিন্তা শক্তি চাঙ্গা হতাে, তাদের অন্তর জেগে উঠতাে, তাদের বিবেক পরিষ্কার হতাে এবং তাদের মাঝে নতুন জীবনের সৃষ্টি হতাে। এর ফলে তাদের অন্তরলােক আলােকিত ও উজ্জ্বল হতাে।  *কাদের অন্তর তালাবদ্ধ? : এরপর জিজ্ঞেস করা হচ্ছে, ‘নাকি তাদের অন্তর তালাবদ্ধ?’ কারণ, বদ্ধ অন্তরে কখনও কোরআনের আলাে ও সত্যের আলাে পৌছতে পারে না। বদ্ধ অন্তর তালাবদ্ধ দুয়ারের মতােই। কারণ সেখানেও সূর্যের আলাে পৌছতে পারে না, মুক্ত বাতাস প্রবেশ করতে পারে না। মােনাফেকদের অবস্থা বর্ণনা এবং তাদের ঔদাসীন্যের কারণ নির্ণয় করতে গিয়ে জানা গেলো যে, তারা ইহুদীদের সাথে চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছে এবং তাদেরকে আনুগত্য ও সহযােগিতার আশ্বাস দিয়েছে।

পরের আয়াতে বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয় যারা সােজা পথ প্রকাশিত হওয়ার পর এর প্রতি পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে, শয়তান তাদের সামনে তাদের কাজকে সুন্দর করে দেখায় এবং তাদেরকে মিথ্যা আশ্বাস দেয়। এটা এ জন্যে যে, তারা আল্লাহর অবতীর্ণ কিতাব যারা অপছন্দ করে তাদেরকে তারা বলে আমরা কোনাে কোনাে ব্যাপারে তােমাদের কথা মান্য করবাে।'(আয়াত ২৫-২৬) সত্য পথের সন্ধান পাওয়ার পর তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ার বিষয়টিকে আলােচ্য আয়াতে জীবন্ত ও দৃষ্টিগােচর করে ফুটিয়ে তােলার উদ্দেশ্যে এটাকে পেছনের দিকে দৌড়ানাের সাথে তুলনা করা হয়েছে। সাথে সাথে এর কারণ হিসেবে শয়তানের প্রলােভন, প্রবঞ্চনা ও মিথ্যা আশ্বাসকে তুলে ধরা হয়েছে। এরপর সেই প্রকৃত কারণটির প্রতি ইংগিত করা হয়েছে যার ফলে শয়তান তাদের ওপর চড়াও হয়েছে এবং তাদেরকে এতােটা প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়েছে যে, তারা সৎ পথের সন্ধান পেয়েও তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে এবং পেছনে ফেলে রেখে আসা সেই ভ্রান্ত ও অন্ধকার পথের দিকেই পুনরায় ফিরে গিয়েছে। নিচের আয়াতে সে কথাই বলা হয়েছে, এটা এ জন্যে যে, ‘যারা আল্লাহর অবতীর্ণ কিতাব অপছন্দ করে তারা তাদেরকে বলে, আমরা কোনাে কোনাে ব্যাপারে তােমাদের কথা মান্য করবাে।'(আয়াত ২৬)  *ইহুদী সম্প্রদায় : আলােচ্য আয়াতে আল্লাহর কিতাবকে ঘৃণা বা অপছন্দকারী সম্প্রদায় হিসেবে যাদের কথা বলা হয়েছে, তারা ইহুদী সম্প্রদায় ব্যতীত আর কেউ নয়। কারণ, মদীনায় একমাত্র ইহুদী সম্প্রদায়ের লােকেরাই সর্বপ্রথম আল্লাহর কিতাবকে ঘৃণা করে। কারণ, তাদের ধারণা ও আশা ছিলাে, শেষ নবী তাদের মধ্য থেকেই আসবে। আর সে কারণেই তারা কাফের মােশরেকদেরকে সে কথা বলে বেড়াতো এবং তাদেরকে আশ্বাস দিয়ে বলতাে যে তাদের শেষ নবী আবির্ভূত হলে তিনি নেতৃত্ব দিয়ে পুনরায় তাদেরকে পৃথিবীতে কর্তৃত্বশালী করে তাদের পূর্বের ক্ষমতা ও রাজত্ব ফিরিয়ে আনবেন। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা যখন ইহুদী সম্প্রদায়ের পরিবর্তে ইবরাহীম(আ.)-এর বংশধরদের মধ্যে থেকে শেষ নবী প্রেরণ করলেন, তখন সেই ইহুদী গােষ্ঠী সেটাকে অপছন্দ করে। এমনকি শেষ নবীর মদীনায় হিজরতকে তারা সুনযরে দেখেনি। কারণ এর ফলে সেখানে তাদের প্রভাব প্রতিপত্তিও হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়েছিলো। আর সে কারণেই তারা প্রথম দিন থেকেই শেষ নবীর বিরুদ্ধে চক্রান্তে মেতে উঠেছিলাে। কিন্তু যুদ্ধ ক্ষেত্রে গিয়ে প্রকাশ্যে তার বিরুদ্ধে শক্রতা দেখানাের মতাে ক্ষমতা তাদের ছিলাে না, তাই প্রত্যেক রসূলবিদ্বেষী ও মােনাফেক ব্যক্তিকে তারা নিজেদের দলে ভিড়িয়ে রসূলের বিরুদ্ধে এক অঘােষিত দীর্ঘ যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত রসূল(স.) এদেরকে গোটা আরব উপদ্বীপ থেকে বিতাড়িত করেন এবং সেখানে একমাত্র ইসলামের ঝান্ডাকেই উড্ডীন রাখেন। এই মােনাফেকের দল- যারা সত্য পথের সন্ধান পেয়েও তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলাে, তারা ইহুদীদেরকে বলতাে, ‘আমরা কোনাে কোনাে ব্যাপারে তােমাদের কথা মান্য করবো…’ এই কিছু কিছু ব্যাপার বলতে তারা ইসলাম ও ইসলামের নবীর বিরুদ্ধে সব ধরনের ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত ও কূটচালের কথাই বুঝিয়েছে বলে মনে হয়। এদের এই বক্তব্যের জবাবে পরক্ষণেই আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালা তাদের গােপন পরামর্শ সম্পর্কে অবগত আছেন।’ বলা বাহুল্য, এটা নিছক একটা মন্তব্যই নয়, বরং এক ধরনের হুমকিও। অর্থাৎ ইসলাম ও রসূলবিদ্বেষী এই গােষ্ঠী যতই ষড়যন্ত্র করুক না কেন, যতই গােপন সলা পরামর্শ করুক না কেন তাদের কোনােই কাজ হবে না। কারণ, আল্লাহ তায়ালা তা সবই জানেন ও দেখেন, তার অপার শক্তি ও ক্ষমতার সামনে এসবের কোনােই প্রভাব নেই, কোনােই কার্যকারিতা নেই।

Leave a Reply