أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ ( বই # ১১২৯ /মুনাফিক কি? কেন ও কিভাবে -৪২) [ *  اِنَّا فَتَحۡنَا لَکَ فَتۡحًا مُّبِیۡنًا ۙ﴿۱﴾ নিশ্চয়ই (হে রসূল!সা:) আমি আপনাকে দিয়েছি সুস্পষ্ট বিজয়:-   *মানসিক প্রশান্তি একটি আল্লাহর নেয়ামত :- মুনাফিক নারী ও পুরুষ এবং মুশরিক নারী ও পুরুষ আল্লাহ‌ সম্পর্কে খারাপ ধারণা পোষণ করে:-] www.motaher21.net সূরা:৪৮-ফাত্হ।পারা:২৬ ১-৭ নং আয়াত:-

أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১১২৯ /মুনাফিক কি? কেন ও কিভাবে -৪২)
[ *  اِنَّا فَتَحۡنَا لَکَ فَتۡحًا مُّبِیۡنًا ۙ﴿۱﴾
নিশ্চয়ই (হে রসূল!সা:) আমি আপনাকে দিয়েছি সুস্পষ্ট বিজয়:-
*মানসিক প্রশান্তি একটি আল্লাহর নেয়ামত :-
মুনাফিক নারী ও পুরুষ এবং মুশরিক নারী ও পুরুষ আল্লাহ‌ সম্পর্কে খারাপ ধারণা পোষণ করে:-]
www.motaher21.net
সূরা:৪৮-ফাত্হ।পারা:২৬
১-৭ নং আয়াত:-
তাফসীরে ফি জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
সূরা:৪৮-ফাত্হ।-১
اِنَّا فَتَحۡنَا لَکَ فَتۡحًا مُّبِیۡنًا ۙ﴿۱﴾
নিশ্চয়ই (হে রসূল!সা:) আমি আপনাকে দিয়েছি সুস্পষ্ট বিজয়।
সূরা:৪৮-ফাত্হ।-২
لِّیَغۡفِرَ لَکَ اللّٰہُ مَا تَقَدَّمَ مِنۡ ذَنۡۢبِکَ وَ مَا تَاَخَّرَ وَ یُتِمَّ نِعۡمَتَہٗ عَلَیۡکَ وَ یَہۡدِیَکَ صِرَاطًا مُّسۡتَقِیۡمًا ۙ﴿۲﴾
যেন আল্লাহ আপনার অতীত ও ভবিষ্যত ত্রুটিসমূহ মার্জনা করেন এবং আপনার প্রতি তাঁর অনুগ্রহ পূর্ণ করেন। আর আপনাকে সরল পথের হেদায়াত দেন,
সূরা:৪৮-ফাত্হ।-৩
وَّ یَنۡصُرَکَ اللّٰہُ نَصۡرًا عَزِیۡزًا ﴿۳﴾
আল্লাহ তাআলা আপনাকে বড়ো রকমের একটা সহযোগিতা করবেন।
সূরা:৪৮-ফাত্হ।-৪
ہُوَ الَّذِیۡۤ اَنۡزَلَ السَّکِیۡنَۃَ فِیۡ قُلُوۡبِ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ لِیَزۡدَادُوۡۤا اِیۡمَانًا مَّعَ اِیۡمَانِہِمۡ ؕ وَ لِلّٰہِ جُنُوۡدُ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ ؕ وَ کَانَ اللّٰہُ عَلِیۡمًا حَکِیۡمًا ۙ﴿۴﴾
তিনিই তো সে সত্তা যিনি মু’মিনদের মনে প্রশান্তি নাযিল করেছেন৬ যাতে তারা নিজেদের ঈমান আরো বাড়িয়ে নেয়। আসমান ও যমীনের সমস্ত বাহিনী আল্লাহর কর্তৃত্বাধীন। তিনি মহাজ্ঞানী ও কৌশলী।
সূরা:৪৮-ফাত্হ।-৫
لِّیُدۡخِلَ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ وَ الۡمُؤۡمِنٰتِ جَنّٰتٍ تَجۡرِیۡ مِنۡ تَحۡتِہَا الۡاَنۡہٰرُ خٰلِدِیۡنَ فِیۡہَا وَ یُکَفِّرَ عَنۡہُمۡ سَیِّاٰتِہِمۡ ؕ وَ کَانَ ذٰلِکَ عِنۡدَ اللّٰہِ فَوۡزًا عَظِیۡمًا ۙ﴿۵﴾
যাতে তিনি মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীদেরকে প্রবেশ করান জান্নাতে, যার নিচ দিয়ে নহরসমূহ প্রবাহিত, যেখানে তারা স্থায়ী হবে এবং তিনি তাদের পাপসমূহ মোচন করবেন ; আর এটাই হলো আল্লাহর নিকট মহাসাফল্য।
সূরা:৪৮-ফাত্হ।-৬
وَّ یُعَذِّبَ الۡمُنٰفِقِیۡنَ وَ الۡمُنٰفِقٰتِ وَ الۡمُشۡرِکِیۡنَ وَ الۡمُشۡرِکٰتِ الظَّآنِّیۡنَ بِاللّٰہِ ظَنَّ السَّوۡءِ ؕ عَلَیۡہِمۡ دَآئِرَۃُ السَّوۡءِ ۚ وَ غَضِبَ اللّٰہُ عَلَیۡہِمۡ وَ لَعَنَہُمۡ وَ اَعَدَّ لَہُمۡ جَہَنَّمَ ؕ وَ سَآءَتۡ مَصِیۡرًا ﴿۶﴾
আর যেসব মুনাফিক নারী ও পুরুষ এবং মুশরিক নারী ও পুরুষ আল্লাহ‌ সম্পর্কে খারাপ ধারণা পোষণ করে তাদের শাস্তি দেবেন। তারা নিজেরাই অকল্যাণর চক্রে পড়ে গিয়েছে। আল্লাহর গযব পড়েছে তাদের ওপর তিনি লা’নত করেছেন তাদেরকে এবং তাদের জন্য জাহান্নাম প্রস্তুত করে রেখেছেন-যা অত্যন্ত জঘন্য জায়গা।
সূরা:৪৮-ফাত্হ।-৭
وَ لِلّٰہِ جُنُوۡدُ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ ؕ وَ کَانَ عَزِیۡزًا حَکِیۡمًا ﴿۷﴾
আসমানসমূহ ও যমীনের বাহিনীসমূহ আল্লাহরই এবং আল্লাহ্ হচ্ছেন পরাক্রমশালী, হিকমতওয়ালা।

ফী জিলালিল কুরআন:

সংক্ষিপ্ত আলােচনা : এই সুরাটা মাদানী। হিজরতের ষষ্ঠ বছরের হুদায়বিয়ার সন্ধির পর এটি নাযিল হয়। এতে হুদায়বিয়ার সন্ধির গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ও তার সাথে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয় আলােচিত হয়েছে। এই সময়ে মুসলমানদের ও তাদের আশপাশের অবস্থা কেমন ছিলাে, তাও এতে তুলে ধরা হয়েছে। সূরা মােহাম্মাদ কোরআনের ধারাক্রম অনুসারে এই সূরার পূর্বে থাকলেও এই দুই সূরার নাযিল হওয়ার মাঝে প্রায় তিন বছরের ব্যবধান ছিলাে। এই তিন বছরে সার্বিক দিক থেকে মদীনার মুসলমানদের অবস্থায় বহু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সংঘটিত হয়েছিলাে। এই পরিবর্তন যেমন সুচিত হয়েছিলাে মুসলমানদের সামষ্টিক জীবনে, তেমনি সূচিত হয়েছিলাে তাদের শত্রুদের জীবনে। অনুরূপভাবে মুসলমানদের মানসিক অবস্থা, ঈমানী দৃঢ়তা ও সুগভীর পরিপক্ক ঈমানের ওপর টিকে থাকার ক্ষেত্রেও তাদের পরিবর্তন ও উন্নয়ন সাধিত হয়েছিলাে।  *সুরাটির পটভূমি : সূরা ও তার পটভূমি সম্পর্কে বিস্তারিত আলােচনা শুরু করার আগে যে ঘটনাকে কেন্দ্র করে এ সূরাটি নাযিল হয়েছে, তার বিবরণ দেয়া উচিত বলে আমি মনে করি। এতে করে পুনরায় সেই পরিস্থিতি ও পরিবেশ আমাদের সামনে ভেসে উঠবে, যা কোরআন নাযিল হবার সময়ে তৎকালীন মুসলমানরা প্রত্যক্ষ করেছিলাে। একদিন রসূল(স.) স্বপ্ন দেখলেন যে, তিনি স্বয়ং ও তার সাথে অন্যান্য মুসলমানরা কেউবা চুল কামিয়ে কেউবা চুল ছেটে পবিত্র কাবায় প্রবেশ করছেন। অথচ হিজরতের পর থেকেই মােশরেকরা তাদেরকে মক্কায় প্রবেশ করতে দিচ্ছিলাে না। এমনকি যে নিষিদ্ধ মাসগুলােকে জাহেলী যুগের আরবদের সম্মান করতাে, যে নিষিদ্ধ মাসগুলােতে তারা অস্ত্র সংবরণ করতাে এবং যুদ্ধ বিগ্রহ ও মাসজিদুল হারামে প্রবেশে কাউকে বাধা দেয়া ঘােরতর অন্যায় বলে মনে করতাে, সেই নিষিদ্ধ মাসগুলােতেও তারা মুসলমানদেরকে মক্কায় প্রবেশ করতে দিত না। তারা এই মাসগুলােকে এতােই সম্মান করতাে যে, নিজ বংশের কোনাে নিহত ব্যক্তির প্রতিশােধ গ্রহণ থেকেও তারা বিরত থাকতাে। এই মাসগুলােতে কেউ তার পিতা বা ভাইয়ের হত্যাকারীকে দেখলেও তার ওপর তরবারী তুলতােনা এবং তাকে মাসজিদুল হারামে ঢুকতে বাধা দিতাে না। অথচ মুসলমানদের ব্যাপারে তারা তাদের এই অটুট ঐতিহ্যের লংঘন করলাে এবং হিজরতের পরবর্তী পুরাে দুটা বছর রসূল(স.) ও মুসলমানদেরকে পবিত্র কাবায় প্রবেশ করতে দিলাে না। হিজরতের ৬ষ্ঠ বছরে পদার্পণ করার পর রাসূল(স.) এই স্বপ্নটা দেখলেন। যখন তিনি মুসলমানদেরকে এই স্বপ্নের কথা জানালেন তখন তারা একে একটা ভালো লক্ষণ মনে করে খুশী হলাে। হুদায়বিয়ার ঘটনা সম্পর্কে ইবনে হিশামের বর্ণনা সবচেয়ে পূর্ণাংগ ও বিস্তারিত চিত্র তুলে ধরে। সার্বিক বিচারে ইমাম বুখারী, ইমাম আহমদ এবং ইমাম ইবনে হাযমের জাওয়ামিউস্ সীরাত’ গ্রন্থে উদ্ধৃতি বর্ণনার সাথে এ বর্ণনার হুবহু মিল রয়েছে। ইবনে ইসহাক বলেন, ‘অতপর রসূল(স.) রমযান ও শাওয়াল মাস মদীনায় অবস্থান করলেন। (বনু মুসতালিকের যুদ্ধ ও তারপর হযরত আয়েশার বিরুদ্ধে অপবাদ রটনাসংক্রান্ত ঘটনার পর) যিলকদ মাসে তিনি ওমরা করার উদ্দেশ্যে মক্কা অভিমুখে রওয়ানা হলেন। যুদ্ধের কোনাে ইচ্ছাই তার ছিলাে না। তিনি মদীনার আশপাশের আরব ও মরুচারী বেদুইনদেরকেও তার সাথে যেতে উদ্বুদ্ধ করলেন। কারণ তিনি আশংকা করছিলেন যে, কোরায়শ তার সাথে পূর্বেকার মতােই আচরণ করবে, তার সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হতে চাইবে অথবা তাকে কাবা শরীফে প্রবেশে বাধা দেবে। বেদুইনদের অনেকেই তার সাথে যাত্রা করতে প্রস্তুত হলাে না। অগত্যা রসূল(স.) তার সাথী মােহাজের আনসার ও তাঁর সাথে যোগদানকারী আরবদেরকে সাথে নিয়ে রওয়ানা হলেন। সাথে কোরবানীর জন্তুও হাঁকিয়ে নিয়ে চললেন ও ওমরার এহরাম বাঁধলেন, যাতে মক্কাবাসী তার যুদ্ধের ইচ্ছা নেই ভেবে আশ্বস্ত ও নিরাপদ বােধ করে এবং নিশ্চিত হয় যে, তিনি শুধু কা’বা শরীফের যিয়ারত ও তার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্যই এসেছেন। হযরত জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ বলেন, আমরা সংখ্যায় ছিলাম চৌদ্দশ। যুহরী বলেন, রসূল(স.) যাত্রা করে যখন মক্কা ও মদীনার মধ্যবর্তী স্থানে উপনীত হলেন, তখন তার সাথে বিশর বিন সুফিয়ান আল কাবী সাক্ষাত করলাে। সে বললাে, হে রসূল! কোরায়শ আপনার যাত্রার খবর পেয়ে গেছে। খবর পেয়ে তারা সদলবলে বেরিয়েছে। এমনকি তাদের সাথে গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারীনী মহিলারাও বেরিয়ে এসেছে। সবাই বাঘের চামড়া পরেছে এবং যী তুবাতে যাত্রা বিরতি করেছে। তারা আল্লাহকে সাক্ষী রেখে প্রতিজ্ঞা করেছে যে, আপনাদেরকে কখনাে মক্কায় ঢুকতে দেবে না। খালেদ বিন ওলীদ তাদের অধিনায়ক হয়ে আসছে। তারা কুরাউল গামীমে পৌছে গেছে। (উসফান থেকে আট মাইল সামনে অবস্থিত জায়গার নাম) রসূল(স.) এ কথা শুনে বললেন, ধিক কোরায়শকে। যুদ্ধ তাদেরকে গিলে খেয়ে ফেলেছে। আমাকে সমগ্র আরব জাতির সাথে একটা বুঝাপড়া করতে দিলে তাদের অসুবিধা কোথায়? আরবরা যদি আমাকে খতম করে দেয়, তাহলে তাে তারা যা চায় সেটাই হয়ে যাবে। আর যদি আল্লাহ তায়ালা তাদের ওপর আমাকে বিজয়ী করেন, তাহলে তারা দলে দলে ইসলামে যােগদান করবে। আর তা না হলে তারা আমার সাথে সর্বশক্তি দিয়ে লড়াই করবে। তাহলে কোরায়শের ভাবনাটা কি? আল্লাহর কসম, আল্লাহ তায়ালা আমাকে যে বাণী দিয়ে পাঠিয়েছেন তার প্রতিষ্ঠার জন্য আমি সর্বাত্মক সংগ্রাম চালিয়েই যাবাে-যতক্ষণ না আল্লাহ তায়ালা আমাকে বিজয়ী করেন অথবা আমার এই গর্দান থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তারপর তিনি বললেন, এখানে এমন কে আছে, যে আমাদেরকে এমন পথে মক্কায় নিয়ে যেতে পারে মক্কাবাসীরা যেপথ দিয়ে আসছে তার থেকে ভিন্ন। ইবনে ইসহাক বলেন, বনু আসলাম গােত্রের একজন বললাে, হে আল্লাহর রসূল, আমি পারবাে আপনাদেরকে সেই রকম একটা পথ দিয়ে নিয়ে যেতে। অতপর সে মুসলমানদেরকে একটা দুর্গম প্রস্তরময় পাবর্ত্য পথ ধরে নিয়ে চলে। এ পথ ধরে চলা মুসলমানদের জন্য খুবই কষ্টসাধ্য ছিলাে। একসময়ে তারা এই দুর্গম পথ অতিক্রম করে সমভূমিতে উপনীত হলাে। রসূল(স.) মুসলমানদেরকে বললেন, তােমরা বলাে, আমরা আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাই ও তওবা করি। তারা। তৎক্ষণাত তা বললাে। তখন রসূল(স.) বললেন, বনী ইসলাঈলকেও এই কথার সমার্থক হিত্তাতুন বলতে বলা হয়েছিলাে, কিন্তু তারা তা বলেনি। ইবনে শিহাব আয যুহরী বলেন, এরপর রসূল(স.) জনগণকে আদেশ দিলেন যে, তােমরা হিময এর এর ভেতর দিয়ে মিরারের সংকীর্ণ গিরিপথ দিয়ে মক্কার নিম্নাঞ্চলের হুদায়বিয়ার সমভূমি অভিমুখে এগিয়ে যাও। (মক্কার অদূরে একটা গ্রামের নাম হুদায়বিয়া) এরপর মুসলমানরা সেই পথ ধরে এগিয়ে চললাে। কোরায়শ বাহিনী যখন মুসলমানদের পথের উড়ন্ত ধুলাে দেখতে পেয়ে বুঝলাে যে, তারা যে পথ দিয়ে যাচ্ছে, মুসলমানরা তা থেকে ভিন্ন পথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন তারা ত্বরিতগতিতে কোরায়শের কাছে ফিরে গেলাে। এদিকে রসূল(স.) তার দলবল নিয়ে এগিয়ে যেতে লাগলেন। তারা মিরারের পাহাড়ের কাছে যেতেই রাসূল(স.)-এর উটনীটা শুয়ে পড়লো, তা দেখে মুসলমানদের অনেকেই বলে উঠলাে, উটনীটা গােয়ার্তুমি শুরু করেছে। রসূল(স.) বললেন, গােয়ার্তুমি করছে না এবং এটা তার স্বভাবও নয়। আসলে আবরাহার হস্তি বাহিনী মক্কায় প্রবেশে যে বাধার সম্মুখীন হয়েছিলাে, এ উটনীটা সেই একই বাধার সম্মুখীন। আজ কোরায়শ আমাকে রক্তসম্পর্ক বজায় রাখার দাবী জানিয়ে যে প্রস্তাবই দেবে, আমি তা মেনে নেবাে। {বােখারীর বর্ণনা অনুসারে রসূল(স.) বললেন, যে আল্লাহ তায়ালার হাতে আমার জীবন তার শপথ, আল্লাহ তায়ালার নিষিদ্ধ জিনিসগুলাের প্রতি সম্মান প্রদর্শন সাপেক্ষে কোরায়শ আমার কাছে যে দাবীই জানাবে আমি তা মেনে নেব।} তারপর রাসূল(স.) মুসলমানদেরকে বললেন, তােমরা এখানে যাত্রাবিরতি করাে। তাকে বলা হলাে, হে রসূলুল্লাহ! এই প্রান্তরে পানি নেই। রসূল(স.) নিজের একটি তীর বের করে জনৈক সাহাবীকে দিলেন। সে সাহাবী তৎক্ষণাত সামান্য বৃষ্টির পানি ধারণকারী একটা নীচু জায়গায় তীরটা গেড়ে দিতেই তা পানিতে ভরে উঠলাে। এভাবে রসূল(স.) নিশ্চিন্ত হলে, তখন তার কাছে বুদাইল বিন ওয়ারকা খাযায়ীর নেতৃত্বে বনু খাযায়া গােত্রের একটা প্রতিনিধি দল এসে রসূল(স.)-কে জিজ্ঞেস করলাে, তিনি কী উদ্দেশ্যে এসেছেন? রসূল(স.) তাদেরকে জানালেন যে, তিনি যুদ্ধ করতে আসেননি, কেবল কাবা শরীফ যিয়ারত করতে এবং তার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে এসেছেন। তারপর তিনি বিশর বিন সুফিয়ান আল কা’বীকে যা বলেছিলেন, একইরকম কথা তাদেরকেও বললেন। তারপর এই প্রতিনিধি দল কোরায়শের কাছে ফিরে গিয়ে বললাে, হে কোরায়শ, তােমরা মােহাম্মদের ব্যাপারে বড় তাড়াহুড়াে করে সিদ্ধান্ত নিচ্ছ। আসলে মােহাম্মদ যুদ্ধ করতে আসেনি। সে এসেছে কা’বা যিয়ারত করতে। কিন্তু কোরায়শ তাদের কথায় কর্ণপাত করলাে না। তারা বরং খাযায়ীদেরকেই পক্ষপাতিত্বের দায়ে দোষী সাব্যস্ত করে বললাে, আল্লাহ তায়ালার কসম, যদি যুদ্ধ করার ইচ্ছা নিয়ে নাও এসে থাকে, তবুও সে আমাদের শহরে জোর করে ঢুকতে পারবে না এবং আরবরা আমাদের সম্পর্কে এমন কথা বলতে পারুক তা আমরা কিছুতেই হতে দেবাে না। খাযায়া গোত্রের কাফের ও মুসলমান নির্বিশেষে সবাই রাসূল(স.)-এর প্রতি সহানুভূতিশীল ও শুভাকাংখী ছিলাে। মক্কায় যা কিছুই ঘটতাে, তা তারা রাসূল(স.)-এর কাছে গোপন করতাে না। খাযায়ী প্রতিনিধি দলের পর কোরায়শ বনু আমের বিন লুয়াই গােত্রের মুকারী বিন হাফসাকে রসূল(স.)-এর কাছে পাঠালাে। তাকে আসতে দেখে রসূল(স.) দূর থেকেই বললেন, এক বিশ্বাসঘাতক আসছে। তখন তিনি বুদাইল ও তার সাথীদেরকে যা বলেছিলেন তাকেও তাই বললেন। সে কোরায়শের কাছে ফিরে গিয়ে রাসূল(স.) যা জানিয়েছেন তা জানালাে। এরপর কোরায়শ হুলায়স বিন আলকামাকে রসূল(স.)-এর কাছে পাঠালাে। সে আহাবিশ নামক মরু অঞ্চলীয় গোত্রের সর্দার ছিলাে। এই গোত্র বনু হারেস গোত্রের একটা শাখা। তাকে আসতে দেখে রসূল(স.) বললেন, এই লােকটি একজন ধর্মানুরাগী ব্যক্তি। ওকে তােমরা আমাদের কোরবানীর জন্য নিয়ে আসা পশুগুলােকে দেখিয়ে দাও। সে যখন কোরবানীর পশুগুলােকে মাঠে চরে বেড়াতে দেখলাে এবং এও দেখলাে যে, দীর্ঘদিন আটক থাকার কারণে পশুগুলাের দেহের বিভিন্ন স্থান থেকে পশম ঝরে গেছে, তখন সে রসূল(স.)-এর কাছে না এসেই কোরায়শের কাছে ফিরে গেলাে। কেননা যে দৃশ্য সে দেখেছে, তাতে সে বুঝেছে যে, যথার্থই তিনি কা’বার যিয়ারত  করতে এসেছেন। সে যখন কোরায়শকে এ কথা বললাে, তখন কোরায়শ বললাে, ‘তুমি একজন বেদুঈন। এ বিষয়ে তােমার কোনাে জ্ঞান নেই।’ ইবনে ইসহাক বলেন, কোরায়শ নেতাদের মুখ থেকে এ কথা শুনে হুলায় রেগে গিয়ে বললাে, হে কোরায়শ জনতা, তােমাদের সাথে আমাদের যে মৈত্রী চুক্তি হয়েছিলাে, তার ভেতরে এ বিষয়টা অন্তর্ভুক্ত ছিলাে না যে, ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালার ঘরের প্রতি সম্মান জানাতে আসে, তাকে কি তা থেকে প্রতিহত করা হবে? হুলায়সের জন্ম মৃত্যু যার হাতে, সেই আল্লাহ তায়ালার কসম, তােমরা যদি মােহাম্মদ যে উদ্দেশ্যে এসেছে, তা তাকে করতে না দাও, তাহলে আমি সমস্ত আহাবিশীদেরকে নিয়ে চলে যাবাে। একথা শুনে কোরায়শ নেতারা বললাে, হে হুলায়স, আমরা যা পছন্দ করি, তা করতে আমাদেরকে বাধা দিও না।’  *ওরওয়া বিন মাসুদের আগমন : যুহরী বলেন, এরপর কোরায়শ রাসূল(স.)-এর কাছে পাঠালাে বনু সাকীফ গােত্রের নেতা ওরওয়া বিন মাসউদ সাকাফীকে। সে বললো, শােনাে কোরায়শ, আমি দেখতে পাচ্ছি, তােমরা যাকেই মােহাম্মাদের কাছে পাঠাচ্ছ, সে ফিরে এলে তাকে তােমরা অনেক ভৎর্সনা করছাে ও কটু কথা বলছাে। তােমরা তাে জানাে, আমি তােমাদের সন্তান এবং তােমরা আমার বাবা। (তার মা কোরায়শের শাখা বনু আব্দুশ শামসের মেয়ে ছিলাে) তােমাদের ওপর কী বিপদ এসেছে, তা আমি শুনেছি। সে জন্যে আমার গােত্রের যারা আমার অনুগত তাদেরকে সমবেত করেছি এবং তােমাদেরকে সান্ত্বনা দিতে এসেছি।’ কোরায়শ বললাে, তুমি ঠিকই বলেছো, আমরা তােমার ওপর কোনাে দোষারােপ করিনি। তারপর সে রসূল(স.)-এর কাছে গিয়ে তার সামনেই বসলাে। তারপর বলল, হে মুহাম্মদ, তুমি তো বিরাট একদল মানুষ জমায়েত করে তােমারই গােত্রের লোকদের ধ্বংস করার জন্য নিয়ে এসেছাে, তাই না? তবে শুনে রাখাে, কোরায়শ তােমাকে যুদ্ধে হারাতে তাদের সন্তানসম্ভবা নারী ও দুধ খাওয়ানাে মায়েদেরকে পর্যন্ত সাথে নিয়ে বাঘের চামড়া পরে বেরিয়ে এসেছে। তারা আল্লাহ তায়ালার কাছে প্রতিজ্ঞা করেছে যে, তােমাকে কোনাে ক্রমেই বলপ্রয়ােগে মক্কায় ঢুকতে দেবে না। আল্লাহ তায়ালার কসম, হয়তাে আগামীকাল আমিও তাদের সাথে থাকবাে এবং তােমার কাছে তাদের উপস্থিতি সুস্পষ্ট হয়ে ওঠবে। একথা বলার সময় হযরত আবু বকর(রা.), রসূল(স.)-এর পেছনে বসেছিলেন। তিনি তাকে ধমক দিয়ে বললেন, আমরা কি রাসূল(স.)-কে পর্যুদস্ত হতে দেবাে? ওরওয়া বললাে, হে মােহাম্মাদ এ লাকটি কে? তিনি বললেন, এ হচ্ছে ইবনে আবি কোহাফা। সে বললাে, আল্লাহ তায়ালার কসম, আমার যদি তােমার সাহায্যের প্রয়ােজন না হতো, তাহলে আমি এর প্রতিশােধ নিতাম। সেই প্রয়ােজনের কারণে এটা সহ্য করলাম। এরপর সে রসূল(স.)-এর দাড়ি বিলি দিতে দিতে তার সাথে কথা বলতে লাগলাে। ওদিকে হযরত মুগীরা ইবনে শো’বা(রা.)তখন লেীহ শিরস্ত্রান পরে রসূল(স.)-এর মাথার কাছে দাঁড়িয়ে ছিলেন, সে যখনই তাঁর দাড়ি বিলি দিচ্ছিলাে, তখনই তিনি তার হাতে আঘাত করছিলেন আর বলছিলেন, রাসূল(স.)-এর মুখ থেকে তােমার হাত সরাও। নচেত এই যন্ত্র দিয়ে ওটা সরানাে হবে। ওরওয়া বললাে, ধিক তােমাকে। তুমি কতাে কর্কশভাষী! রসূল(স.) মুচকি হাসলেন, তখন ওরওয়া বললাে, হে মােহাম্মদ, এ ব্যক্তি কে? রসূল (স.) বললেন, এ তােমার ভাতিজা মুগীরা ইবনে শােবা। সে বললাে, ওহে বিশ্বাসঘাতক। মাত্র সেদিনও তাে আমি তােমার মলমূত্র পরিষ্কার করেছি। ইবনে হিশাম বলেন, ওরওয়া তার এই কথা দ্বারা যা বুঝাচ্ছিলাে তা হলাে, কোনাে এক বিরােধ নিয়ে মুগীরা ইসলাম গ্রহণের আগে বনু মালেক বিন সাকীফের ১৩ জনকে হত্যা করেছিলেন। এতাে বনু মালেক ও মুগীরার পক্ষ যুদ্ধ করতে প্রস্তুত হয়ে যায়। ওরওয়া দশটা দিয়ত (রক্তপণ) দিয়ে এই উত্তেজনা প্রশমিত করেছিলাে ও বিবাদ মিটিয়ে দিয়েছিলাে। ইবনে ইসহাক আরাে বর্ণনা করেন যে, যুহরী বলেছেন, রসূল(স.) পূর্ববর্তীদেরকে যা যা বলেছিলেন, ওরওয়াকেও অবিকল তাই বললেন। তাকে জানালেন যে, তিনি যুদ্ধ করতে আসেননি। এরপর সে কোরায়শের কাছে ফিরে গেলাে। সে দেখে গিয়েছিলাে যে রসূল(স.) ওযু করলে তার ওযুর পানি এবং তিনি থুথু ফেললে তার থুথু নেয়ার জন্য তার শিষ্যরা কিভাবে পাল্লা দেয়। তার চুল পড়লেও তা নেয়ার জন্যে ছুটোছুটি শুরু হয়ে যায়। সে কোরায়শকে গিয়ে বললাে, ওহে কোরায়শ! আমি এমন এক ব্যক্তির কাছ থেকে এসেছি যার রাজ্যে পারস্য, আবিসিনিয়া ও রােমের সম্রাটের মতাে দোর্দন্ড ক্ষমতাশালী ও প্রতাপশালী। আল্লাহ তায়ালার কসম, মােহাম্মদের সাথীরা তার যেমন আনুগত্য করে, তেমন কোনাে রাজাকেও তার প্রজাদের আনুগত্য পেতে দেখিনি। আমি নিশ্চত যে, মােহাম্মাদের সাথীরা কোনাে অবস্থাতেই তাকে কারাে হাতে সমর্পণ করবে না। এখন তােমরা ভেবে দেখাে কী করবে।  *রাসুল(স)-এর পক্ষ থেকে মক্কায় দূত প্রেরণ : ইবনে ইসহাক বলেন, রাসূল(স.) তাঁর উদ্দেশ্য জানানাের জন্যে খাররাশ বিন উমাহইয়া খাযায়ীকে নিজের উটে চড়িয়ে মক্কায় কোরায়শের কাছে পাঠালেন, কিন্তু রাসূলের সেই উটটাকে তারা হত্যা করলাে। তারা খাররাশকেও হত্যা করতে চেয়েছিলাে। কিন্তু আহাবিশীয়রা তা করতে দেয়নি, বরং তাকে রাসূল(স.) কাছে ফিরে আসতে দিয়েছিলাে। ইবনে ইসহাক আরাে বলেন, কোরায়শ চল্লিশ বা পঞ্চাশ জনের একটা দলকে রসূল(স.)-এর বাহিনীর পাশ দিয়ে চক্কর দিতে ও সাহাবীদের কোনাে একজনকে ধরে নিতে পাঠিয়েছিলো। কিন্তু তারা সবাই গ্রেফতার হয়ে রসূল(স.)-এর কাছে নীত হয়। তিনি তাদেরকে ক্ষমা করেন ও ছেড়ে দেন। অথচ তারা রসূল(স.)-এর বাহিনীকে লক্ষ করে পাথর ও তীর ছুঁড়েছিলাে। এরপর তিনি হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব ডাকলেন এবং তাকে মক্কায় পাঠিয়ে কোরায়শ নেতৃবৃন্দকে তার আগমনের উদ্দেশ্য অবহিত করার ইচ্ছা ব্যক্ত করলেন। ওমর(রা.) বললেন, হে রাসূল(স.), আমি কুরাইশদের পক্ষ থেকে আমার জীবনাশংকা বোধ করছি। আমার গােত্র বনু আদির এমন কোনাে লােক মক্কায় নেই যারা আমার পক্ষ নেবে। তাছাড়া কোরায়শের বিরুদ্ধে আমি যে কট্টর শত্রুতার মনােভাব পােষণ করি, তা তারা জানে। তবে আমার চেয়েও কোরায়শদের ওপর বেশী প্রভাবশালী একজনের সন্ধান আপনাকে দিতে পারি। তিনি হচ্ছেন হযরত ওসমান ইবনে আফফান। অগত্যা রসূল(স.) হযরত ওসমান ইবনে আফফানকে আবু সুফিয়ান ও অন্যান্য কোরায়শ নেতার কাছে এই বার্তা দিয়ে পাঠালেন যে, তিনি কোনাে যুদ্ধ বিগ্রহের উদ্দেশ্যে নয়, বরং পবিত্র কাবার যেয়ারত ও তার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের নিমিত্তে এসেছেন। ইবনে ইসহাক বলেন, অতপর হযরত ওসমান(রা.) মক্কা চলে গেলেন। সেখানে আব্বান বিন সাঈদ ইবনুল আস তার সাথে সাক্ষাত করলাে এবং তাকে আশ্রয় দিলাে। হযরত ওসমান(রা.) তার কাছে রাসূল(স.)-এর বার্তা পৌছালেন। বার্তা পৌছানাের পর তারা হযরত ওসমানকে বললাে, তুমি যদি কা’বা শরীফ তাওয়াফ করতে চাও, তাওয়াফ করাে। হযরত ওসমান বললেন, রাসূল(স.) তাওয়াফ না করা পর্যন্ত আমি করবাে না। অতপর কোরায়শ হযরত ওসমানকে আটক করলাে। ওদিকে রাসূল(সা) ও সাহাবীদের কাছে খবর পৌছলাে যে, হযরত ওসমানকে হত্যা করা হয়েছে।  *ঐতিহাসিক বাইয়াতুর রিদওয়ান : ইবনে ইসহাক বলেন, হযরত ওসমান নিহত হয়েছেন এই মর্মে খবর পেয়ে রসূল(স.) বললেন, ‘মােশরেকদের সাথে লড়াই না করে আমরা এ স্থান ত্যাগ করবে না। অতপর রসূল(স.) সকল মুসলমানদেরকে বাইয়াত (অংগীকার) করার আহবান জানালেন। এটাই ছিলাে গাছের নীচে বসে সম্পাদিত ‘বাইয়াতুর রিদওয়ান’ বা আল্লাহর সন্তুষ্টির বাইয়াত। এ আয়াত সম্পর্কে সাধারণ মুসলমানদের মন্তব্য ছিলাে এই যে, রসূল(স.) মৃত্যুর জন্যে প্রস্তুত থাকার বাইয়াত করিয়েছেন। হযরত জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ(রা.) বলতেন, রাসূল(স.) মৃত্যুর জন্যে প্রস্তুত থাকার বাইয়াত নয়, বরং আমরা যেন পালিয়ে না যাই সে জন্যে বাইয়াত করিয়েছেন। এই বাইয়াতে অংশগ্রহণকারীদের মধ্য থেকে একমাত্র বনু সালমা গােত্রের সদস্য জাদ্দ বিন কায়েস ছাড়া আর কেউ রসূল(স.)-কে ছেড়ে পিছিয়ে যায়নি। জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ(রা.) বলতেন, আল্লাহ তায়ালার কসম, আমি যেন স্বচক্ষে দেখতে পাচ্ছি যে, জাদ্দ বিন কায়েস নিজেকে তার উটের বগলের সাথে লেপ্টে রেখে জনসাধারণের দৃষ্টির আড়াল হয়ে কোথাও চলে গেলাে। তারপর রসূল(স.)-এর কাছে এসে জানালাে যে, হযরত ওসমানের ব্যাপারে যা প্রচারিত হয়েছে, তা মিথ্যে। ইবনে হিশাম বলেন, রসূল(স.) হযরত ওসমানের জন্য হাতের ওপর হাত রেখে বাইয়াত নিয়েছিলেন। ইবনে ইসহাক যুহরীর বরাত দিয়ে বলেন, এরপর কোরায়শ বনু আমের গোত্রের সােহায়েল বিন আমরকে পাঠালাে। তাকে তারা বললাে, তুমি মােহাম্মাদের কাছে গিয়ে সন্ধি চুক্তি করাে। এই সন্ধিতে একথা থাকা চাই যে, মােহাম্মদ এ বছর অবশ্যই হুদায়বিয়া থেকে মদীনায় ফিরে যাবে। কেননা আল্লাহ তায়ালার কসম, আমরা থাকতে মােহাম্মাদ জোরপূর্বক মক্কায় ঢুকেছে একথা আরবরা বলাবলি করবে সেটা আমরা কখনাে হতে দেব না। অতপর সােহায়েল রসূল(স.)-এর কাছে এলাে। রাসূল(স.) তাকে দেখেই বললেন, কুরাইশ যখন এই ব্যক্তিকে পাঠিয়েছে, তখন সন্ধির উদ্দেশ্যেই পাঠিয়েছে। সােহায়েল রসূল(স.)-এর কাছে এসে দীর্ঘ আলােচনা চালালাে। অতপর উভয়ের মধ্যে চুক্তির সিদ্ধান্ত হলো। যখন সন্ধির প্রস্তুতি সম্পন্ন হলাে এবং চুক্তির বিবরণ লিপিবদ্ধ করা ছাড়া আর কিছুই বাকী থাকলাে না, তখন হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব ভীষণ লম্ফ-ঝম্ফ শুরু করলেন। তিনি প্রথমে হযরত আবু বকরের কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন, ওমর : হে আবু বকর, তিনি কি আল্লাহর রসূল নন? আবু বকর : অবশ্যই। ওমর : আমরা কি মুসলমান নই? আবু বকর : অবশ্যই। ওমর : ওরা কি মােশরেক নয়? আব বকর : অবশ্যই। ওমর : তাহলে কিসের জন্য আজ আমরা দুনিয়ার বিনিময়ে দ্বীনকে বিসর্জন দিচ্ছি? আবু বকর : হে ওমর, রসূলের আদেশ মনে চলাে। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি তিনি আল্লাহর রসূল। ওমর : আমিও সাক্ষ্য দিচ্ছি তিনি আল্লাহর রাসূল। তারপর তিনি রসূল(স.)-এর কাছে এসে বললেন, হে রসূলুল্লাহ, আপনি কি আল্লাহর রসূল নন? রসূলুল্লাহ(স.) : হাঁ। ওমর : আমরা কি মুসলমান নই? রসূলুল্লাহ (স.) : হা। ওমর ওরা কি মােশরেক নয়? রসূলুল্লাহ (স.) : হাঁ। ওমর : তাহলে আমরা কিসের জন্যে আজ দুনিয়ার বিনিময়ে দ্বীনকে বিসর্জন দিচ্ছি? রসূলুল্লাহ(স) : আমি আল্লাহ তায়ালার বান্দা ও রাসূল। আমি কোনােক্রমেই আল্লাহ তায়ালার আদেশ লংঘন করতে পারবাে না। তিনি আমাকে কখনাে ধ্বংস করবেন না। ইবনে ইসহাক বলেন, পরবর্তী জীবনে হযরত ওমর(রা.) বলতেন, আমি সদকা দেয়া, নামায পড়া, রােযা রাখা ও দাস মুক্ত করা অব্যাহত রেখেছি, যাতে আমার সে দিনের আচরণের পাপ মােচন হয় এবং ভালাে হবে মনে করে যে কথা বলেছি তার গুনাহ যেন মাফ হয়।  *সন্ধি লেখার ঘটনা : এরপর রাসূল(স.) হযরত আলী ইবনে তালিব(রা.)-কে বললেন, লেখাে, ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম। কিন্তু সােহায়েল বললাে, এটা আমি মানি না। লেখাে, বিসমিকা আল্লাহুম্মা। (অর্থাৎ তােমার নামে হে আল্লাহ) রসূল(স.) বললেন, ঠিক আছে, বিসমিকা আল্লাহুম্মা লেখাে। হযরত আলী(রা.) তাই লিখলেন। পুনরায় তিনি বললেন, লেখাে, এ হচ্ছে সােহায়েল ইবনে আমরের সাথে আল্লাহ তায়ালার রসূল মোহাম্মদের সম্পাদিত চুক্তি। সােহায়েল বললাে, আমি যদি তােমাকে আল্লাহর রসূল বলে স্বীকারই করতাম, তাহলে তাে তােমার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতাম না। শুধু তােমার নাম ও তােমার বাবার নাম লেখাে। অগত্যা রাসুল(স.) হযরত আলী(রা.)-কে বললেন, লেখাে, ‘এ হচ্ছে সােহায়েল ইবনে আমরের সাথে মােহাম্মদ বিন আব্দুল্লাহর সম্পাদিত সন্ধি চুক্তি। তারা উভয়ে জনগণকে দশ বছরের জন্যে যুদ্ধ থেকে নিরাপত্তা দানের পক্ষে চুক্তি সম্পাদন করেছেন। এই সময়ে জনগণ নিরাপদে থাকবে। একে অপরের ওপর আক্রমণ থেকে বিরত থাকবে। কুরাইশ থেকে যে কেউ মোহাম্মদের কাছে আসবে, তাকে কোরায়শের কাছে ফিরিয়ে দেয়া হবে। আর মােহাম্মদের কাছ থেকে যে কেউ কোরায়শের কাছে আসবে, তাকে কোরায়শ মােহাম্মদের কাছে ফেরত দেবে না। আমাদের ভেতরে একটা অনাক্রমণ চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে। একপক্ষ অপরপক্ষের ওপর আক্রমণও করবে না, কেউ কারাে সম্পদ অপহরণও করবে না এবং কেউ কারাে সাথে বিশ্বাসঘাতকতাও করবেনা। যে ব্যক্তি মোহাম্মদের চুক্তি ও প্রতিশ্রুতির অংশীদার হতে চাইবে, হতে পারবে। আর যে ব্যক্তি কোরায়শের চুক্তি ও প্রতিশ্রুতির অংশীদার হতে চাইবে, হতে পারবে। এক পর্যায়ে বনু খাযায়া গোত্রের মুহাম্মদ(স.)-এর চুক্তি ও প্রতিশ্রুতির অংশীদার হবার সিদ্ধান্ত ঘােষণা করলাে। এবার তুমি মােহাম্মদ(স.) আমাদের কাছ থেকে ফিরে যাবে, মক্কায় প্রবেশ করবে না আগামী বছর আমরা মক্কা থেকে বেরিয়ে যাবে এবং তুমি তােমার সাথীদেরকে নিয়ে প্রবেশ করবে, মক্কায় তিন দিন থাকবে, তােমাদের সাথে কোষবদ্ধ তরবারী থাকবে। তরবারী ছাড়া প্রবেশ করবে না। রসূল(স.) ও সােহায়েলের সামনে এই চুক্তি লেখা চলছে এমতাবস্থায় সােহায়েলের ছেলে আবু জান্দাল শিকলবদ্ধ অবস্থায় উপস্থিত হলাে। সে রাসূল(স.)-এর কাছে পালিয়ে এসেছিলাে। এ সময়ে রসূলের সাহাবীদের মানসিক অবস্থা ছিলাে খুবই নাযুক। রসূলের স্বপ্নের কারণে তারা মক্কা বিজয় নিশ্চিত জেনেই মদীনা থেকে বেরিয়েছিলাে। পরে যখন তারা সন্ধি হওয়া ও ওমরা না করেই ফিরে যাওয়ার বিষয়টিও বুঝতে পারলাে। আরো কয়েকটা অসহনীয় ব্যাপার রসূল(স.)-কে সহ্য করতে দেখলাে, তখন মুসলমানদের মন এতাে খারাপ হয়ে গেলাে যে, সে অবস্থাটা তাদের কাছে মৃত্যুতুল্য মনে হচ্ছিলো সােহায়েল আবু জান্দালকে দেখা মাত্রই তার দিকে ছুটে গিয়ে তার কলার টেনে ধরে চপেটাঘাত করলাে তারপর সে বললাে, হে মােহাম্মদ, সে আসার আগেই তােমার ও আমার মাঝে বিষয়টার নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। রসূল(স.) বললেন, তােমার কথা সত্য। তারপর সােহায়েল আবু জান্দালকে কলার ধরে সজোরে টেনে মক্কায় নিয়ে যেতে লাগলাে। আবু জান্দাল উচ্চস্বরে চিল্কার করে বলতে লাগলাে, ওহে মুসলমান ভাইয়েরা আমাকে কি মােশরেকদের কাছে ফেরত পাঠানাে হচ্ছে? ওরা তাে আমাকে নির্যাতন করে ধর্মান্তরিত করার চেষ্টা করবে। এ অবস্থা দেখে মুসলমানদের মনের দুঃখ ও যন্ত্রণা আরাে বেড়ে গেলাে। রসূল(স.) বললেন, হে আবু জান্দাল, ধৈর্যধারণ করাে ও ঈমানের দৃঢ়তা বজায় রাখাে। মনে রেখাে, আল্লাহ তায়ালা তােমার জন্য ও তােমার দুর্বল সাথীদের জন্যে অচিরেই মুক্তির ব্যবস্থা করবেন। আমরা মোশরেকদের সাথে একটা আপােস রফা করেছি এবং সে ব্যাপারে আমরা পরস্পরের সাথে আল্লাহর নামে চুক্তিবদ্ধ হয়েছি। আমরা তাদের সাথে ওয়াদাখেলাপী করতে পারি না।’ ওমর ইবনুল খাত্তাব(রা.) এগিয়ে গিয়ে আবু জান্দালের সাথে সাথে চলতে লাগলেন। চলতে চলতে ওমর নিজের তরবারীর মুঠো আবু জান্দালের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, হে আবু জান্দাল, ধৈর্যধারণ করে। ওরা মােশরেক। ওদের রক্ত কুকুরের রক্তের সমান। ওমর(রা.) বলেন, ‘আমি আশা করেছিলাম যে, সে তরবারী তুলে নিয়ে তার বাবাকে আঘাত করবে।’ কিন্তু লােকটা তার বাবার প্রতি দুর্বলতা দেখালাে এবং চুক্তিটা কার্যকরী হয়ে গেলাে।[বর্ণিত আছে যে, আবু জান্দাল তার বাবার প্রতি দুর্বলতার কারণে নয়, বরং রসূল(স.)-এর চুক্তিরক্ষার প্রতি আগ্রহী হয়ে তার বাবাকে হত্যা করা থেকে বিরত থেকেছিলো।-সম্পাদক] চুক্তিটা লেখা সম্পন্ন হলে মুসলমানদের মধ্য থেকে কিছু সংখ্যক ও অমুসলিমদের মধ্য থেকে কিছু সংখ্যক লােককে সাক্ষী করা হলাে। এই সাক্ষীরা হলেন, আবু বকর সিদ্দীক, ওমর ইবনুল খাত্তাব, আব্দুর রহমান বিন আওফ, আব্দুল্লাহ বিন সােহায়েল বিন আমির, সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস, মাহমুদ বিন মাসলামা, মুকাররায বিন হাফস (তিনি তখন মােশরেক ছিলেন) ইবনে আবি তালেব। হযরত আলী(রা.) ছিলেন চুক্তিপত্রের লেখক। যুহরী বলেন, চুক্তিপত্র লেখা শেষ হলে রসূল(স.) তার সাহাবীদেরকে বললেন, তােমরা এখন ওঠো, কোরবানী করে মাথার চুল কামাও।’ যুহরী বলেন, রসূল(স.)-এর আদেশে সাড়া দিয়ে কেউ উঠল না। ফলে রসূল(স.) তাঁর আদেশ তিনবার পুনরাবৃত্তি করলেন। তারপরও কেউ উদ্যোগী হলাে না দেখে রাসূল(স.) হযরত উম্মে সালমা(রা.)-এর কাছে গেলেন। সাহাবীদের পক্ষ থেকে তিনি যে আচরণ প্রত্যক্ষ করেছেন তা তাকে জানালেন। উম্মে সালমা(রা.) বললেন, হে আল্লাহর নবী! আপনি কি চান সবাই কোরবানী করুক? যদি চান তাহলে তাদের কারাে সাথে আর একটা কথাও না বলে নিজের উট কোরবানী করে ফেলুন এবং আপনার চুল কামানেওয়ালাকে ডেকে আনুন, সে আপনার চুল কামিয়ে দিক। রসূল(স.) তৎক্ষণাত বেরিয়ে গেলেন, কাউকে | কিছু না বলে কোরবানীর কাজটা নিজ হাতেই সমাধা করলেন এবং চুল কামানেওয়ালাকে ডাকলেন। সে তার চুল কামিয়ে দিলাে। সাহাবীরা যখন এটা দেখলেন, তখন তারা গা ঝাড়া দিয়ে উঠলেন, কোরবানী করলেন এবং তারা একে অপরের মাথা কামিয়ে দিলেন। তাদের মানসিক অবস্থা তখনাে এমন ছিলাে যে, তারা মনের দুঃখে ও ক্ষোভে (একে অপরের চুল কামাতে গিয়ে) একে অপরকে হত্যা করে বসতে পারেন, এমন আশাংকা দেখা দিয়েছিলাে। ইবনে ইসহাক বলেন, হুদাইবিয়ার সন্ধির দিনে কিছু মুসলমান চুল কামায় এবং কিছু মুসলমান চুল ছােট করে ছাঁটেন। এরপর রসূল(স.) বললেন, ‘যারা চুল কামিয়েছে, তাদের ওপর আল্লাহ তায়ালা রহমত করুন।’ সাহাবীরা বললেন, হে রসূলুল্লাহ(স.) যারা চুল ছেটেছে? তিনি বললেন, যারা চুল কামিয়েছে, তাদের ওপর আল্লাহ তায়ালা রহমত করুন। সাহাবীরা আবারাে বললেন, হে রসুলুল্লাহ(স.), যারা চুল ছেটেছে? তিনি বললেন, যারা চুল কামিয়েছে, আল্লাহ তায়ালা তাদের ওপর রহমত করুন। তৃতীয়বার যখন সাহাবীরা বললেন, হে রসূল(স.), যারা চুল কামিয়েছে? তিনি বললেন, যারা চুল ছেটেছে তাদের ওপরও আল্লাহ তায়ালা রহমত করুন। তারা বললেন, হে রসূলুল্লাহ(স.), আপনি যারা চুল কামিয়েছে, তাদের জন্যে যারা চুল ছেটেছে তাদের চেয়ে বেশী রহমত কামনা করলেন কেন? রসূল(স.) বললেন, তারা সন্দেহ করেনি। (অর্থাৎ হুদায়বিয়ার সন্ধির যথার্থতা সম্পর্কে তারা সন্দেহ করেনি)   *সুরা ফাতাহর নাযিল শুরু : যুহরী বললেন, অতপর রসূলুল্লাহ(স.) যাত্রা শুরু করলেন। মক্কা ও মদীনার মধ্যবর্তী স্থানে পৌছুলে সূরা আল ফাতাহ নাযিল হলাে। ইমাম আহমদ মুহাম্মদ বিন হারিসা আনসারী থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি (মুজাম্মা) বলেছেন, আমরা হুদায়বিয়ায় উপস্থিত ছিলাম। যখন সেখান থেকে যাত্রা করলাম, লােকেরা তাদের উটগুলােকে জোরে জোরে হাকাতে শুরু করলাে। তা দেখে অন্যরা পরস্পরকে জিজ্ঞেস করতে লাগলাে, ব্যাপার কি? ওরা এ রকম করছে কেন? বলা হলাে, রসূল(স.)-এর কাছে ওহী এসেছে। একথা শুনে আমরা আবেগে উদ্বেলিত হয়ে ছুটলাম। দেখলাম, কারাউল গামীমে রসূল(স.) তাঁর বাহন জন্তুটির ওপর বসে আছেন। মুসলমানরা তার চারপাশে সমবেত হলাে। তিনি তাদের সামনে পাঠ করলেন, ইন্না ফাতাহনা লাকা ফাতহাম মুবীনা… (আমি তােমাকে একটা সুস্পষ্ট বিজয়ে ভূষিত করেছি।) এ সময় জনৈক সাহাবী বললেন, হে রসূলুল্লাহ, ওটা কি বিজয়? তিনি বললেন, ‘হাঁ, আল্লাহর কসম, ওটা বিজয়। ইমাম আহমদ আরাে বর্ণনা করেন যে, হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব(রা.) বলেছেন, আমরা একটা সফরে রসূল(স.)-এর সাথে ছিলাম। তখন তাকে একটা কথা তিনবার জিজ্ঞেস করলাম । কিন্তু তিনি আমাকে কোনাে জবাব দিলেন না। আমি নিজেকে ধিক্কার দিয়ে বললাম, ওহে খাত্তাবের ছেলে, তাের মরণ হােক, তুই রসূলুল্লাহ(স.)-কে তিনবার জিজ্ঞেস করলি তিনি একবারও জবাব দিলেন না! তারপর আমি আমার উটের পিঠে চড়ে বসলাম, উটকে তাড়িয়ে সামনে এগিয়ে গেলাম। আমি ভয় পাচ্ছিলাম যে, আমার সম্পর্কে কোন আয়াত নাযিল হয় কিনা। হঠাৎ দেখলাম, একজন আমাকে ডাকছে। আমি ভাবলাম, হয়তাে আমার সম্পর্কে কিছু নাযিল হয়েছে। আমি ফিরে এলাম। তখন রসূল(স.) বললেন, গতকাল আমার ওপর এমন একটা সূরা নাযিল হয়েছে, যা আমার কাছে সমগ্র পৃথিবী ও তার যাবতীয় ধন সম্পদের চেয়ে প্রিয়। তা হচ্ছে সুরা আল ফাতাহ। রসূল(স.) সূরার প্রথম দুটি আয়াত পড়লেন।(বােখারী, তিরমিযী, নাসায়ী) এই হলাে সেই পটভূমি, যার মধ্যে এ সূরা অবতীর্ণ হয়েছে। এ পটভূমিতে রসূল(স.) আল্লাহর পক্ষ থেকে আগত সিদ্ধান্তকে নিশ্চিন্ত মনে ও নির্দ্বিধায় মেনে নিয়েছিলেন। ফলে তিনি শুধু এই ওহীভিত্তিক ইচ্ছা ছাড়া আর কোনাে ইচ্ছায় ও প্রেরণায় অনুপ্রাণিত হননি। অন্য সকল ইচ্ছা ও আকাংখাকে তিনি ঝেড়ে ফেলে দিয়েছেন। পরবর্তী প্রতিটি পদক্ষেপে ও প্রতিটি উদ্যোগে তিনি এই ঐশী সিদ্ধান্ত দ্বারাই উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। তা থেকে কারো প্ররােচনা তাকে ফেরাতে পারেনি, তাই সে প্ররোচনা মােশরেকদের পক্ষ থেকে আসুক অথবা তার সেসব সাহাবীর পক্ষ থেকে আসুক, যাদের মন মােশরেকদের ধৃষ্টতাপূর্ণ দাবী দাওয়া ও জাহেলী মানসিকতা থেকে উদ্ভূত হঠকারিতাকে মেনে নেয়ায়, সন্তুষ্টি হতে পারেনি। পরে আল্লাহ তায়ালা তাদের মনে প্রশান্তি ও স্থিরতা এনে দিয়েছেন। আর এর ফলে তারা সন্তোষ, প্রত্যয় ও আন্তরিকতাপূর্ণ আনুগত্যের পথে ফিরে এসে তাদের সেই ভাইদের সমান্তরালে এসে দাঁড়িয়েছেন, যারা প্রথম থেকেই একনিষ্ঠ আনুগত্যের ওপর অবিচল ছিলেন। যেমন হযরত আবু বকর সিদ্দীক(রা.) যার আত্মা এক মুহূর্তের জন্যও রসূল(স.)-এর আত্মার সাথে প্রত্যক্ষ ও আভ্যন্তরীণ সম্পর্ক ও যােগাযােগ হারায়নি। এ জন্যই তার মন মগয সব সময়ই স্থির ও শান্ত ছিলাে এবং কখনাে তা শান্তি ও স্থিরতা থেকে বঞ্চিত হয়নি। এ কারণে সূরার শুরুতে রসূল(স.)-এর জন্যে এমন সুসংবাদ এসেছে, যা পেয়ে তার হৃদয় সুগভীর তৃপ্তি ও আনন্দে বিভোর হয়েছে, বলা হয়েছে আমি তোমাকে সুস্পষ্ট বিজয়ে ভূষিত করেছি। যাতে আল্লাহ তায়ালা তােমার আগের সমস্ত গুনাহ মার্জনা করেন।(আয়াত-১-৩) অনুরূপভাবে, সূরার প্রথম ভাগেই মােমেনদেরকে শান্তি ও স্থিরতা প্রদান করে অনুগ্রহপ্রাপ্ত করার কথা ঘােষণা করা হয়েছে। ঈমান আনয়নে তাদের অগ্রণী ভূমিকার স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছে। তাদেরকে ক্ষমা ও সওয়াবের সুসংবাদ দেয়া হয়েছে এবং আল্লাহর সেনাবাহিনী দ্বারা সাহায্য করার আশ্বাস দেয়া হয়েছে।(আয়াত ৪, ৫) সেই সাথে মােশরেক ও মােনাফেকদের জন্যে নির্ধারিত আযাব ও গযবের কথাও ঘােষণা করা হয়েছে।(আয়াত ৬) এরপর রাসূল(স.)-এর বাইয়াত গ্রহণের উল্লেখ এবং সেই বায়াতকে স্বয়ং আল্লাহর বাইয়াত বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এভাবে মােমেনদের মনকে সরাসরি সেই আল্লাহর সাথে সংযুক্ত করা হয়েছে। যিনি চিরঞ্জীব, চিরস্থায়ী ও অক্ষয়।(আয়াত ৭-১০) আবার হুদায়বিয়ায় মােমেনদের অবস্থা প্রসংগে আলােচনা সম্পূর্ণ করার আগেই বাইয়াত ও তা লংঘন প্রসংগে বেদুইনদের বিষয়টি আলােচনায় এসেছে। তারা যেসব ওযর বাহানা করে বাড়ী থেকে বের হয়নি। সেগুলােকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে এবং তাদের অন্তরে আল্লাহর প্রতি যে খারাপ ধারণা ছিলাে, তা প্রকাশ করে দেয়া হয়েছে। তারা রসূল(স.) ও তার সাথী মোমেনদের জন্যে যে খারাপ পরিণতির প্রত্যাশা করতাে, তাও জানিয়ে দেয়া হয়েছে এবং রসূল(স.)-কে তাদের ব্যাপারে ভবিষ্যতে কি ধরনের নীতি অবলম্বন করা উচিত, সে ব্যাপারেও নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আর এসব নির্দেশ এমনভাবে দেয়া হয়েছে, যা দ্বারা মােমেনদের দৃঢ়তা ও যারা অভিযানে বের হয়নি, তাদের দুর্বলতা প্রকাশ পায়। এও প্রকাশ পায় যে, যারা ঈমানের দুর্বলতার কারণে পিছিয়ে থাকে ও অভিযানে রাসূল(স.)-এর সাথে আসেনি, তারা গনিমত ও বিজয়ের লােভে লালায়িত।(আয়াত ১১-১৭) এই প্রসংগে যারা অভিযানে বের হয়নি এবং জেহাদে অংশগ্রহণ করেনি, তাদেরকে অব্যাহতি দানের স্বপক্ষে একটিমাত্র গ্রহণযােগ্য ও যুক্তিসংগত ওযরের উল্লেখ করা হয়েছে। সেটি হলাে, অন্ধের ওপর কোনাে বাধ্যবাধকতা নেই, খঞ্জের ওপর কোনাে বাধ্যকতা নেই এবং রােগীর ওপরও কোনাে বাধ্যবাধকতা নেই।(আয়াত-১৭) এই দৃষ্টি আকর্ষণী বক্তব্যের পর পুনরায় মেয়েদের ও তাদের মানসিক দ্বিধাদ্বন্দ্বের আলােচনায় প্রত্যাবর্তন করা হয়েছে। এ আলােচনার সবটাই আল্লাহর সন্তুষ্টি, স্বচ্ছতা ও সম্মান প্রদর্শন মূলক। এতে একনিষ্ঠ ও দৃঢ় ঈমানধারী ও আত্মােৎসর্গিত মােমেনদেরকে যাবতীয় আশ্বাস বানী শােনানাে হয়েছে। এ আলােচনায় আল্লাহ তায়ালা তার এই প্রিয় বান্দাদের প্রতি সন্তোষ প্রকাশ করেছেন, তাদেরকে নানা রকমের সুসংবাদ দিয়েছেন, তাদেরকে বিভিন্ন নেয়ামতে ভূষিত করার আশ্বাস দিয়েছেন এবং তাদের ঈমানকে দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর করার জন্যে প্রয়ােজনীয় উপদেশ দিয়েছেন। তাদেরকে জানিয়েছেন যে, তারা যখন গাছের নীচে বসে বাইয়াত গ্রহণ করছিলাে। তখন তিনি তাদের ওপর খুশী ছিলেন এবং তাদের কাছেই উপস্থিত ছিলেন। তিনি তাদের মনের কথা জানেন, তাদের ওপর সন্তুষ্ট হয়েছেন। ভবিষ্যতে তাদের জন্যে সাহায্য বিজয় ও গনিমত বরাদ্দ করেছেন এবং এর সব কিছুকেই তিনি সৃষ্টি জগতের শাশ্বত নিয়ম ও বিধির সাথে সমন্বিত করেছেন। সমগ্র সৃষ্টিজগতের অবস্থান এই বিধানেরই পক্ষে। সমগ্র সৃষ্টি এর পক্ষে সাক্ষ দিচ্ছে এবং এর পরতে পরতে লিপিবদ্ধ করে রেখেছে সেই বিরাট ও বিরল ঘটনা। (আয়াত ১৮) সূরার শেষাংশে আল্লাহর প্রিয় সেই মহান মানব গােষ্ঠীর গুণাবলী বর্ণনা করা হয়েছে, যা তাওরাত ও ইঞ্জিলেও লিপিবন্ধ রয়েছে। তারপর সবার শেষে তাদের জন্যে আল্লাহর পক্ষ থেকে ক্ষমা ও বিরাট পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি ঘােষিত হয়েছে।(আয়াত ২৯ দ্রষ্টব্য) এভাবে সূরার সমগ্র ভাষা খুবই স্পষ্ট প্রাঞ্জল ও বােধগম্য হয়ে উঠেছে। সমগ্র সূরার বিষয়বস্তু তার অবতরণের প্রেক্ষাপটেই সীমাবদ্ধ। কোরআনের সুনির্দিষ্ট শৈল্পিক ভংগীতে এই পটভূমিকে সবচেয়ে জোরদারভাবে ফুটিয়ে তােলা হয়েছে। কোরআন কোনাে ঘটনাকে ধারাবাহিকভাবে বর্ণনা করার বাধ্যবাধকতা অনুসরণ করে না। তবে তা থেকে যথার্থ শিক্ষণীয় বিষয় গ্রহণ এবং একটা একক ঘটনাকে বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে মূলনীতির আওতায় প্রয়ােজনীয় অংশটুকু তুলে ধরে। বিশেষ ঘটনাকে সংযুক্ত করে সাধারণ প্রাকৃতিক বিধানের সাথে, আর এক অসাধারণ পন্থা ও পদ্ধতিতে মানুষের মনকে সম্বােধন করে।  *আগের সূরার সাথে এই সুর মিল : সূরার মূল পাঠ তার প্রেক্ষাপট ও পরিবেশ এবং কোরআনের সংকলনী ধারাবাহিকতায় এ সূরাটিকে পূর্বেকার সূরা মােহাম্মদের সাথে তুলনা করলে বুঝা যায়, এ দুই সূরার নাযিল হওয়ার মধ্যবর্তী তিন বছরে মুসলমানদের স্বভাব চরিত্রে, আচরণে, অবস্থানে এবং আদর্শিক ও নৈতিক মানে কতাে গভীর পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এই পরিবর্তনই দুই সূরার নাযিল হওয়ার সময়ের পার্থক্য ও ব্যবধান স্পষ্ট করে তুলে ধরে। এ দুটি সূরার তুলনা করলে এও জানা যায় যে, পবিত্র কোরআনের শিক্ষা ও রসূল(স.)-এর নির্ভুল ও নিখুঁত প্রশিক্ষণ মহানবী ও কোরআনের তত্ত্বাবধানে বেড়ে ওঠো এই সৌভাগ্যশালী মানব গোষ্ঠীটির নৈতিক মানের কতাে উৎকর্ষ সাধন করেছে এবং এর ফলে সুদীর্ঘ কালের মানবেতিহাসে কতাে অভাবনীয় উন্নতি সাধিত হয়েছে। আসলে সূরা আল ফাতাহ-এর নাযিল হওয়ার পটভূমি ও শিক্ষা থেকে আমাদের চোখের সামনে এমন একটা দলের ভাবমূর্তি ভেসে ওঠে, যাদের মন মগযে ইসলামী আকীদা বিশ্বাসের উপলব্ধি যথাযথ পরিপক্কতা লাভ করেছে। যাদের ঈমানী মান প্রায় উচু পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে, যাদের মন ও বিবেক ইসলামের অর্পিত দায়িত্ব গ্রহণে পরিপূর্ণ সন্তোষ ও ব্যকুলতা সহকারে সম্মত হয়েছে। জান ও মালের ঝুকি নিয়ে হলেও এই দায়িত্ব গ্রহণ করতে তাদেরকে আর কোনাে প্রেরণা ও উৎসাহ যােগানাের প্রয়ােজন হয় না। বরঞ্চ যাদের আবেগ উদ্দীপনা ও জযবাকে নিয়ন্ত্রণ করা, তেজস্বীতা ও দুঃসাহসিকতাকে সীমার ভেতরে সামাল দিয়ে রাখা, দাওয়াত ও আন্দোলনের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতার আলােকে কখনাে কখনো শান্তি ও আপােসের স্বার্থে লাগাম টেনে ধরার প্রয়ােজন পড়ে। এ সূরা যখন নাযিল হয়, তখন মুসলমানরা এতােটা অনগ্রসর ছিলাে না যে, তাদেরকে (সূরা মােহাম্মদের) এ কথা বলার দরকার হবে, ‘তােমরা যখন শান্তির দিকে আহ্বান জানাচ্ছ, তােমরাই যখন শ্রেষ্ঠ এবং আল্লাহ তায়ালা যখন তােমাদেরই সাথে রয়েছেন, তখন দুর্বলতা ও কাপুরুষতা প্রদর্শন করাে না, আল্লাহ তায়ালা কখনাে তােমাদের নেক কাজগুলােকে বাতিল করবেন না। তাদেরকে (সূরা মােহাম্মদের) এ কথাও বলার আবশ্যকতা ছিলাে না যে, “তােমরাই তাে সে সব লােক, যাদেরকে আল্লাহর পথে ব্যয় করার আহ্বান জানানাে হয়, অতপর তােমাদের কেউ কেউ কার্পণ্য করে… আর যদি তােমরা মুখ ফিরিয়ে চলে যাও, তাহলে আল্লাহ তায়ালা তােমাদের পরিবর্তে অন্য এমন এক দলকে নিয়ে আসবেন, যারা তােমাদের মতাে হবে না। এ সময়ে মুসলমানদের শহীদের দৃষ্টান্ত ও আল্লাহ তায়ালা তাদের জন্যে যে উচ্চ মর্যাদা বরাদ্দ করে রেখেছেন, তার উল্লেখ করে জিহাদের প্রেরণায় উজ্জীবিত করারও প্রয়ােজন ছিলাে না। প্রয়োজন ছিলাে না সশস্ত্র সংগ্রামের অগ্নিপরীক্ষায় নিক্ষেপ করার যৌক্তিকতা ও কল্যাণকর দিকগুলাে বর্ণনা করার, যেমনি সূরা মােহাম্মদে আল্লাহ তায়ালা বলেন, লড়াইয়ের এ নির্দেশ রইলাে। আল্লাহ তায়ালা যদি চাইতেন, তবে তােমাদের পক্ষ হতে নিজেই প্রতিশােধ নিতেন। কিন্তু তােমাদের কতককে দিয়ে কতককে পরীক্ষা করার জন্যেই এ নির্দেশ দিয়েছেন। যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়েছে, আল্লাহ তায়ালা কখনােই তাদের সৎকাজ ব্যর্থ করবেন না। এ সূরায় বরঞ্চ আল্লাহ তায়ালা মােমেনদের মনে যে স্বস্তি ও স্থিরতা নাযিল করেছেন, তা নিয়ে আলােচনা করলে দেখা যায়। এর উদ্দেশ্য হলাে, তাদের আবেগ উত্তেজনাকে প্রশমিত করা এবং তাদের মনকে আল্লাহর হুকুম মানানাে, আপােস মীমাংসা ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় আল্লাহর রসূলের প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতাকে হৃদয়ঙ্গম করার জন্য প্রস্তুত করা। এর পাশাপাশি সূরার শেষভাগে গাছের নীচে বসে বাইয়াত গ্রহণকারীদের ওপর আল্লাহর সন্তুষ্টিরও বর্ণনা দেয়া হয়েছে। সূরার শেষ ভাগে রসূল(স.) ও তার সাথীদের এক উজ্জ্বল ভাবমূর্তি তুলে ধরা হয়েছে ! অবশ্য এ সূরার একটা আয়াতে বাইয়াতের শর্তাবলী পূরণ ও তার লংঘনের বিষয়ও আলােচিত হয়েছে। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যারা তােমার কাছে বাইয়াত করে, তারা আল্লাহর কাছেই বায়াত করে। তাদের হাতের ওপর রয়েছে আল্লাহর হাত। আর যে ব্যক্তি তা লংঘন করে, সে নিজের ক্ষতির জন্যই লংঘন করে…’ তবে লক্ষণীয় যে, এখানে বাইয়াত গ্রহণকারীদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন ও বায়াতের উচ্চ মর্যাদার প্রতি ইংগিতই অপেক্ষাকৃত প্রবল। বাইয়াতের লংঘন বিষয়ক কথাবার্তা বেদুইনদের পশ্চাদপসারণের প্রসংগেই এসেছে। অনুরূপভাবে মােনাফেক নারী পুরুষদের ব্যাপারেও সংক্ষিপ্ত আভাস দেয়া হয়েছে, যা এই গােষ্ঠীর ঈমানী দুর্বলতার বিপরীতে মদীনার মুসলমানদের ঈমানী পরিপক্কতার প্রমাণ বহন করে। মােটকথা, এটা এতাে সংক্ষিপ্তভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, তা সূরা মােহাম্মদের মুনাফিক সংক্রান্ত আলােচনার ন্যায় গুরুত্ব লাভ করেনি। সেখানে মােনাফেকদের ও তাদের মিত্র গােষ্ঠী ইহুদীদের বিষয়ে বিশদ আলােচনা হয়েছে। এদিক দিয়ে দেখা যাচ্ছে, এটা মুসলমানদের আভ্যন্তরীণ পর্যায়ে যে মানসিক উন্নতি ও অগ্রগতি সাধিত হয়েছে, তার সাথে সামঞ্জস্যশীল একটা বহির্মুখী অগ্রগতি। এ সূরার আয়াত ও পটুমিতে এটাও প্রতীয়মান হয় যে, এ সময়ে মুসলমানদের শক্তি ও প্রতিপত্তি মোশরেকদের শক্তি ও প্রতিপত্তির সমপর্যায়ে উপনীত হয়েছে। এতে ভবিষ্যতে গনীমত প্রাপ্তির সম্ভাবনা, সকল ধর্ম ও মতাদর্শের ওপর ইসলামের বিজয়ের ভবিষ্যদ্বাণীও করা হয়েছে। এসব কিছু থেকে এ কথাই প্রতীয়মান হয় যে, এ দুই সূরার নাযিল হবার মধ্যবর্তী মেয়াদে মুসলমানরা যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে উঠেছিলাে। মধ্যবর্তী এই সময়টাতে মুসলমানদের মনােবলে, সামষ্টিক অবস্থায় এবং পারিপার্শিক পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে সুস্পষ্ট অগ্রগতি সাধিত হয়েছিলাে। পবিত্র কোরআনে নবীজীবনের যে ইতিবৃত্ত আলােচিত হয়েছে, তা অধ্যয়ন করলে এ অগ্রগতি সুস্পষ্টভাবে উপলব্ধি করা যায়। এ অগ্রগতি অত্যন্ত মূল্যবান। এর দ্বারা মুসলিম জাতি কোরআনের শিক্ষা ও নবীর প্রশিক্ষণ দ্বারা কতাে লাভবান হয়েছিলাে এবং তা তাদের জীবনে কতােবড় বৈপ্লবিক প্রভাব বিস্তার ও পরিবর্তন সাধন করেছিলাে তা বুঝা যায়। এই অগ্রগতি থেকে বুঝা যায়, যারা মানবীয় সংগঠনে সুদৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করে, তারা কিভাবে অটুট মনােবল বজায় রাখতে সক্ষম হয়। সংগঠনে কিছু লােকেরা দুর্বলতা, অপরিপক্কতা, অতীতের জড়তা ও পশ্চাদপদতা, পরিবেশের কু-প্রভাব, পার্থিব স্বার্থের মােহ এবং রক্ত মাংসের সৃষ্ট দুর্বলতা দেখে তারা ঘাবড়ে যায় না এবং তাদের মনােবল ভেংগে যায় না। সংগঠনের প্রাথমিক পর্যায়ে এসব উপসর্গ খুবই শক্তিশালী ও প্রবল থাকে। কিন্তু অব্যাহত চেষ্টা সাধনা, প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা, বিচক্ষণতা এবং ধৈর্যের সাথে প্রতিকার ও নিরাময়ের চেষ্টা চালালে অবশ্যই পরিস্থিতির উন্নতি ও অগ্রগতি সাধিত হয়। ক্রমাগত অভিজ্ঞতা অর্জন ও দুর্ভোগ পােহানাে এই উন্নতি ও অগ্রগতিকে আরাে নিশ্চিত ও ত্বরান্বিত করে। এতে করে প্রশিক্ষণ ও দিক নির্দেশনা লাভের সুযােগ সৃষ্টি হয়। তারপর ক্রমান্বয়ে রক্ত মাংস ঘটিত দুর্বলতা, পরিবেশের কু-প্রভাব এবং অতীতের উত্তরাধিকার হিসাবে আগত জড়তা সবই দূর হয়ে যায়। মন উচ্চতর মার্গে উন্নীত হতে থাকে এবং আলােকিত পরিবেশে আল্লাহর নূরের সাক্ষাৎ পায়। কেননা আমাদের জন্যে আল্লাহর নবীর জীবনে রয়েছে সুন্দর আদর্শ এবং কোরআনের বিধানে রয়েছে নির্ভুল ও সোজা সরল পথ।

১-৩ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আমি তােমার জন্যে একটা প্রকাশ্য বিজয় সূচিত করেছি, যাতে আল্লাহ তায়ালা তােমার পূর্বাপর সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেবেন, তার নেয়ামতকে তােমার ওপর সম্পূর্ণ করে দেবেন এবং তােমাকে সহজ সরল সঠিক পথে চালিত করবেন।'(আয়াত ১-৩) আল্লাহর রসূলের ওপর তাঁর যে ক’টা বিরাট অনুগ্রহের বার্তা ঘােষণার মধ্য দিয়ে সুরাটির উদ্বোধন করা হয়েছে, তা হলাে প্রকাশ্য বিজয়, সর্বব্যাপী ও সর্বাত্মক ক্ষমা, পূর্ণাংগ নেয়ামত, চিরস্থায়ী পথনির্দেশ ও সুদৃঢ় সাহায্য। আল্লাহর পক্ষ থেকে আগত দিক নির্দেশনা পূর্ণ সন্তুষ্টচিত্তে গ্রহণ করা, তার শিক্ষা, সূক্ষ্ম আভাস ইংগিতের কাছে পূর্ণ সন্তোষ সহকারে আত্মসমর্পণ করা, সর্বপ্রকার পার্থিব কামনা বাসনাকে সর্বতােভাবে ত্যাগ করা ও আল্লাহর সদয় তত্ত্বাবধানের প্রতি অগাধ বিশ্বাসের প্রতিদান বা পুরস্কার হিসাবেই রসূল(স.)-কে এগুলাে প্রদান করা হয়েছে। তিনি একটা স্বপ্ন দেখেই স্বপ্নের ইংগিত অনুযায়ী সক্রিয় হয়ে উঠলেন। যখন উটনী শুয়ে পড়লাে এবং লােকেরা তা নিয়ে চিৎকার শুরু করলাে যে, উটনীটা গােয়ার্তুমি শুরু করেছে, তখন তিনি বললেন, না সে গােয়ার্তুমি শুরু করেনি, সেটা তার স্বভাবও নয়। বরঞ্চ আবরাহার হাতিগুলো যে বাঁধা পেয়ে থেমে যেতে বাধ্য হয়েছিলাে, ওকেও সেই বাধা থামিয়ে দিয়েছে। আজকে কোরায়শ রক্ত সম্পর্কের দোহাই দিয়ে আমার কাছে যাই চাইবে, আমি তা-ই দেবাে। হযরত ওমর(রা.) যখন আবেগােদ্দীপ্ত হয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমরা কেন তুচ্ছ দুনিয়াবী স্বার্থের বিনিময়ে দ্বীনকে বিসর্জন দিচ্ছি? তখন তিনি জবাব দিলেন, আমি আল্লাহর বান্দা ও রসূল, আমি কোনােক্রমেই তাঁর আদেশ লংঘন করবাে না। তিনি আমাকে কিছুতেই ব্যর্থ করবেন না। আর যখন গুজব ছড়িয়ে পড়লাে যে, হযরত ওসমানকে হত্যা করা হয়েছে তখন রসূল(স.) বললেন, ‘কোরায়শের সাথে লড়াই না করে স্থান ত্যাগ করবাে না। অতপর তিনি জনগণকে (মুসলমানদেরকে) বাইয়াতের আহ্বান জানালেন। এর ফলে সেই ঐতিহাসিক ‘বাইয়াতুর রিদওয়ান’ সম্পাদিত হলাে, যার ফলে বাইয়াতকারীরা সর্বাত্মক কল্যাণ লাভ করলেন ও সৌভাগ্যশালী হলেন।  *হুদায়বিয়ার সন্ধি ও মুসলমানদের বিজয় : মূলত এটাই ছিলাে বিজয়। হুদায়বিয়ার সন্ধির আকারে যে বিজয় অর্জিত হয়েছিলাে, এটা তার অতিরিক্ত! হুদায়বিয়ার সন্ধির পর বিভিন্ন আকারে আরাে বহু বিজয় এসেছিলাে। প্রথমত ইসলামের দাওয়াত ও প্রচারে অভাবনীয় বিজয় সূচিত হয়েছিলাে। ইমাম যুহরী বলেন, এর আগে ইসলাম কখনাে এর চেয়ে বড় কোনাে বিজয় অর্জন করেনি। ইতিপূর্বে মুসলমান ও মােশরেকদের যখনই কোথাও সাক্ষাৎ হতাে, যুদ্ধ বেধে যেতাে। যখন সন্ধি হলাে, যুদ্ধাবস্থা থেমে গেলাে, লােকেরা পরস্পর থেকে নিরাপদ হয়ে গেলাে, তখন আর সাক্ষাৎ মাত্রই যুদ্ধ বাধেনি। তখন ইসলাম, নিয়ে এখানে সেখানে আলাপ আলােচনা ও বিতর্ক চলতে থাকে। এ সময় ইসলাম নিয়ে আলাপ আলােচনার মাধ্যমে কেউ ইসলামের কোনাে বিষয় বুঝতে পারলেই ইসলাম গ্রহণ করতাে। ফলে হুদায়বিয়ার সন্ধি ও মক্কা বিজয়ের মধ্যবর্তী দু’বছরে যে বিপুলসংখ্যক লােক ইসলাম গ্রহণ করে, তাদের সংখ্যা তার পূর্বে ইসলাম গ্রহণকারীদের সংখ্যার সমান বা বেশী ছিলাে। ইবনে হিশাম বলেন, যুহরীর উক্তির যথার্থতার প্রমাণ হলাে, রসূল(স.) যখন হুদায়বিয়ায় গিয়েছিলেন, তখন তাঁর সাহাবীদের সংখ্যা ছিলাে এক হাজার চার শাে। এর দু’বছর পর যখন তিনি মক্কা বিজয়ের জন্য বের হন, তখন দশ হাজার সাহাবী নিয়ে বের হন। এই সময়ে ইসলাম গ্রহণকারীদের মধ্যে খালিদ ইবনে ওলীদ ও আমর ইবনুল আ’সও ছিলেন। এ বিজয় ভৌগলিকভাবেও সত্য প্রমাণিত হয়েছিলাে। কেননা মুসলমানরা কোরায়শের দিক থেকে নিরাপদ হয়ে যাওয়ার কারণে রাসূল(স.) ইহুদী গােত্র বনু কাইনুকা, বনু নাযীর ও বনু কোরায়যা থেকে অব্যাহতি লাভ করার পর খয়বর থেকেও তাদেরকে বিতাড়িত করেন। এখানে তাদের মযবুত ঘাটি ও বহু দূৰ্গ ছিলাে এবং এর কারণে মুসলমানদের সিরিয়া যাতায়াতের রাস্তা বিপন্ন ও ঝুকিপূর্ণ হয়ে উঠেছিলাে। আল্লাহ তায়ালা খয়বরকে মুসলমানদের দখলে এনে দিলেন এবং তারা বিপুল ধন সম্পদ গনিমত হিসাবে লাভ করলেন। রসূল(স.) এই ধন সম্পদ শুধু হুদায়বিয়াতে যারা উপস্থিত ছিলাে, তাদেরকে দিয়েছিলেন। মদীনার মুসলমানরা মক্কার কুরাইশ ও মক্কার আশপাশে অন্যান্য মােশরেকদের সাথে সম্পর্ক ও অবস্থানের ব্যাপারেও এ বিজয় স্বার্থক প্রমাণিত হয়। অধ্যাপক ইযযত দোরােযা তাঁর ‘সীরাতুর রাসূল সুয়ারুম মুকতাবাসাম মিনাল কোরআনিল কারীম’-এ বলেন ইসলামের ইতিহাসে এটি ইসলামের শক্তিবৃদ্ধির দিক দিয়ে অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঘটনা। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে কোরায়েশ সর্বপ্রথম রসূল(স.) ও ইসলামের শক্তি ও অস্তিত্ব স্বীকার করে। রাসূল(স.) ও মুসলমানদের তারা নিজেরদের সমান প্রতিপক্ষ ভাবতে শুরু করে। সত্য বলতে কি, যে কোরায়শ দু’বছরের ভেতরে দু’বার মদীনা আক্রমণ করেছিলাে, তারা হুদায়বিয়াতে মুসলমানদেরকে ঠেকালেও সর্বোত্তম পন্থায় তথা শান্তিপূর্ণ উপায়ে ঠেকিয়েছে। তারা এক বছর আগে মদীনায় সর্বশেষ যে আক্রমণ চালায়, সেটা ছিলাে এক বিশাল বাহিনীর সর্বনাশা আক্রমণ। এ বাহিনীতে স্বয়ং কোরায়শ এবং তাদের সকল মিত্র গােত্রগুলো অন্তর্ভুক্ত ছিলাে। এ আক্রমণের লক্ষ্য ছিলাে মুসলমানদেরকে সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন করা। এ আক্রমণ মুসলমানদের সবচেয়ে বেশী পেরেশান ও আতংকিত করে তুলেছিলাে। কারণ আক্রমণকারীদের তুলনায় তাদের সংখ্যা ছিলাে খুবই নগণ্য এবং তারা অস্ত্রবলেও ছিলাে দুর্বল। এ জন্যে সাধারণ আরবদের মধ্যেও এর বিরাট প্রভাব পড়েছিলো। এ ঘটনায় তারা কোরায়শকে আরবের প্রধান কর্তৃত্বশীল গােষ্ঠী মেনে নিয়েছিলাে এবং তাদের ইসলামবিরােধী নীতি দ্বারা প্রচন্ডভাবে প্রভাবিত ছিলাে। আর যখন আমরা লক্ষ্য করি যে, বেদুইনরা ধরে নিয়েছিলাে, রসুল(স.) ও মুসলমানরা এই অভিযান থেকে (হুদায়বিয়া অভিযান) নিরাপদে ফিরে আসতে পারবে না, আর মােনাফেকরাও খুবই জঘন্য ধারণা পােষণ করছিলাে, তখন আমাদের সামনে এই বিজয়ের গুরুত্ব ও সুদূর প্রসারী প্রভাব স্পষ্ট হয়ে ফুটে ওঠে। ঘটনাবলী প্রমাণ করে যে, রসূল(স.) যা করেছেন, সে ব্যাপারে তার অন্তরে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে আগত সুপ্ত প্রত্যাদেশ তথা ইলহাম সত্য ও সঠিক ছিলাে (অর্থাৎ হুদায়বিয়ার সন্ধি চুক্তি সম্পাদন সম্পর্কে তার ইলহামভিত্তিক সিদ্ধান্ত সঠিক ও নির্ভুল ছিলাে) সেই সিদ্ধান্তকে কোরআনও সমর্থন করেছে। উপরন্তু এর দ্বারা যে বিরাট বস্তুগত, নৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক উপকার মুসলমানরা অর্জন করেছে, তাও পরবর্তী ঘটনাবলী দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে। সকল গােত্রের চোখে তারা কোরায়শের শক্তিশালী প্রতিপক্ষ সাব্যস্ত হয়েছে। যেসব বেদুইন তাদের হুদায়বিয়া পর্যন্ত অভিযানে অংশ নেয়নি, মুসলমানরা ফিরে আসার পর তারা রসূল(স.)-এর কাছে এসে নানারকমের ওযর পেশ করতে থাকে। আর মদীনায় মােনাফেকদের আওয়াযও স্তিমিত হয়ে আসে। এই সময় দূর দূরান্ত থেকে আরবদের প্রতিনিধি দল রসূল(স.)-এর কাছে আসতে শুরু করে। রসূল(স.) খয়বর, সিরিয়া ও অন্যান্য স্থানের রাস্তার আশপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পল্লীগুলােতে ইহুদীরা যে দাপট ও ঔন্ধত্য প্রদর্শন করছিলাে, তা চিরতরে স্তন্ধ করে দিতে সক্ষম হন। উপরন্তু তিনি নাজদ, ইয়েমেন ও বালকা প্রভৃতি দূরবর্তী অঞ্চলগুলােতে ছােট ছােট সেনাদল প্রেরণ করতে সক্ষম হন। এমনকি মাত্র দু’বছর পর তিনি মক্কায় সফল অভিযান চালাতে সক্ষম হন। এটা ছিলাে চূড়ান্ত বিজয়। এরপরই নাযিল হয় সূরা আন নাসর, এই সূরায় বলা হয়, ‘যখন আল্লাহ তায়ালার সাহায্য ও বিজয় আসবে এবং জনগণকে তুমি দলে দলে আল্লাহ তায়ালার দ্বীনে প্রবেশ করতে দেখবে।’ আমি পুনরায় জোর দিয়ে বলছি যে, এসব বিজয় ও সাফল্যের পাশাপাশি আরাে একটা বিজয় অর্জিত হয়েছিলাে, যাকে মনস্তাত্বিক বিজয় বলা যেতে পারে। ‘বাইয়াতুর রিদওয়ান’-এর মধ্য দিয়ে এ বিজয় প্রতিফলিত হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা এই বায়াতকারীদের ওপর সন্তুষ্ট হয়েছিলেন। কোরআনে এর বিবরণ দেয়া হয়েছে এবং সূরার শেষ আয়াতে এই সন্তুষ্টির আলােকে মুসলমানদেরকে বিভিন্ন গুণে ভূষিত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘মােহাম্মাদ আল্লাহর রসূল। আর যারা তার সাথী তারা কাফেরদের ওপর কঠোর এবং নিজেরা পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল…’ সুতরাং এটা (হােদায়বিয়ার সন্ধি) এমন এক বিজয়, যা আন্দোলন ও বিপ্লবের ইতিহাসে নযীরবিহীন। এর অবদান অপরসীম এবং পরবর্তীকালের গােটা ইতিহাস এ দ্বারা প্রভাবিত ছিলাে। রসূল(স.) এ সূরা নাযিল হওয়ায় খুবই আনন্দিত হয়েছিলেন। তার ওপর ও তার সহচর মােমেনদের ওপর আল্লাহ তায়ালার এ অসামান্য অনুগ্রহে তিনি অভিভূত হয়েছিলেন। প্রকাশ্য বিজয়, সর্বাত্মক ক্ষমা, পূর্ণাংগ নেয়ামত ও সীরাতুল মুস্তাকিমের পথ নির্দেশনা পেয়ে তিনি আনন্দে বিভোর হয়ে গিয়েছিলেন মহাপরাক্রান্ত ও মহা দয়াময় আল্লাহ তায়ালার সাহায্য ও মােমেনদের প্রতি তার সন্তোষের নিশ্চয়তা পেয়ে তিনি এতাে আনন্দিত হয়েছিলেন যা ভাষায় বর্ণনা করার মতাে নয়, তিনি চমৎকারভাবে তা বর্ণনাও করেছেন। এক বর্ণনায় আছে, রসূল(স.) বলেছিলেন, গতকাল আমার ওপর এমন সূরা নাযিল হয়েছে, যা সমগ্র পৃথিবী ও পৃথিবীর যাবতীয় সম্পদের চেয়ে উত্তম। অপর বর্ণনায় আছে, তিনি বলেছেন, ‘আজ রাতে আমার ওপর এমন এক সুরা নাযিল হয়েছে, যা আমার কাছে সুর্যের কিরণ দ্বারা আলােকিত যাবতীয় জিনিসের চেয়ে উত্তম।’ আল্লাহ তায়ালার নেয়ামতের কৃতজ্ঞতায় তার মন পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। এই কৃতজ্ঞায় অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি লম্বা লম্বা নামায পড়তেন। হযরত আয়েশা(রা.) এ সম্পর্কে বলেন, রসূল(স.) এতাে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে নামায পড়তেন যে, তার পা ফুলে উঠতাে। হযরত আয়েশা(রা.) তাকে ডেকে বলতেন, হে রসূলুল্লাহ, আপনি এরূপ করছেন? অথচ আল্লাহ তায়ালা আপনার পুর্বাপর সমস্ত শুনাহ মাফ করে দিয়েছেন। রসূল(স.) জবাব দিলেন, হে আয়েশা, তাই বলে কি আমি একজন কৃতজ্ঞ বান্দা হবো না?
*মানসিক প্রশান্তি একটি আল্লাহর নেয়ামত : উদ্বোধনী তিনটি আয়াত ছিলাে বিশেষভাবে রসূল (স.)-এর জন্য বরাদ্দকৃত। এরপর এই বিজয় দ্বারা আল্লাহ তায়ালা মুসলমানদের কি কল্যাণ সাধন করেছেন ও তাদের ওপর কিরূপ অনুগ্রহ বর্ষণ করেছেন, তাদের অন্তরে কি ধরনের প্রশান্তি এনে দিয়েছেন এবং তাদের জন্যে আখেরাতে কিরূপ ক্ষমা সাফল্য ও সমৃদ্ধি করে রেখেছেন, তার বিবরণ দিয়ে পরবর্তী কয়েকটি আয়াত আসছে, ‘তিনিই সেই আল্লাহ তায়ালা, যিনি মােমেনদের অন্তরে, প্রশান্তি নাযিল করেছেন, যাতে তাদের ঈমান আরাে বেড়ে যায়'(আয়াত ৪-৫) ‘সাকীনাহ’ (প্রশান্তি) শব্দটা ব্যাপক অর্থবােধক। এটি যখন আল্লাহ তায়ালা কারাে অন্তরে নাযিল করেন, তখন তার অর্থ হয় নিশ্চিন্ততা, প্রশান্তি, প্রত্যয়, দৃঢ় বিশ্বাস, স্থিতি ও স্থিরতা, সন্তোষ ও আত্মসমর্পণ। হুদায়বিয়ার ঘটনায় মােমেনদের অন্তরে নানা ধরনের ভাবাবেগ ও নানারকমের প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছিলাে। রাসূল(স.)-এর স্বপ্নের কথা শুনে তারা এই স্বপ্ন কখন স্বার্থক হবে, কখন মাসজিদুল হারামে প্রবেশের সুযােগ আসবে, তার অপেক্ষায় ব্যাকুলভাবে প্রহর গুণছিলাে। তারপর যখন কোরায়ণের সিদ্ধান্ত জানা গেলাে, সেই সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে রসূল(স.) যখন এ বছরের জন্যে কা’বা শরীফে গিয়ে ফিরে যেতে রাযি হলেন এবং এহরাম বাঁধা ও কোরবানীর জন্তু সাথে করে নেয়ার পরও এটা ঘটলাে, তখন তা মেনে নিতে মুসলমানদের কষ্ট হচ্ছিলো, এ ব্যাপারে কোনােই সন্দেহ নেই। বর্ণিত আছে যে, হযরত ওমর হযরত আবু বকরের কাছে খুবই উত্তেজিত অবস্থায় এসেছিলেন। তখন তাদের মধ্যে যে কথােপকথন হয়, আমরা এ ঘটনা সংক্রান্ত প্রধান বর্ণনায় ইতিপুর্বে তা উল্লেখ করেছি, আরো কিছু কথা এখানে তুলে ধরা হলাে হযরত ওমর(রা.) বলেন, রসূল(স.) কি আমাদেরকে বলেছিলেন না যে, আমরা শীঘ্রই কাবা শরীফে উপস্থিত হবো এবং তার তওয়াফ করবাে? রসূল(স.)-এর হৃদয়ের সাথে যার হৃদয় একীভূত হয়ে গিয়েছিলাে এবং রসূলের হৃদয়ের স্পন্দনের সাথে যার হৃদয় স্পন্দিত হতো, সেই হযরত আবু বকর(রা.) বললেন, হাঁ, তবে তিনি কি তােমাকে বলেছেন যে, তুমি এ বছরই কাবায় হাযির হতে পারবে? হযরত ওমর বললেন, না। হযরত আবু বকর(রা.) বললেন, তাহলে জেনে রেখাে, তুমি সেখানে যেতে পারবে এবং তওয়াফও করতে পারবে। এরপর ওমর(রা.) হযরত আবু বকরের কাছ থেকে রসূল(স.)-এর কাছে গেলেন। তারপর নিম্নরূপ কথােপকথন হলাে, হযরত ওমর, হে রসূল, আপনি কি বলেছিলেন না যে, আমরা কা’বা শরীফে যেতে পারবাে ও তাওয়াফ করতে পারবাে? রাসূল(স.) : হাঁ, বলেছিলাম। তবে আমরা এ বছরই সেখানে যাবাে, এ কথা কি বলেছিলাম। হযরত ওমর : না। রাসূল (স.) : নিশ্চিন্ত থাকো, তুমি সেখানে যেতে পারবে, তাওয়াফ করতে পারবে। এই কথােপকথন থেকে বুঝা যায়, কি ধরনের ভাবাবেগের জোয়ার বয়ে যাচ্ছিলাে মুসলমানদের মনে। কোরায়শদের পক্ষ থেকে এ বছর ওমরা করতে না দেয়ার ব্যাপারটা মেনে নেয়া যেখানে এতাে কষ্টকর ছিল, সেখানে আরাে কয়েকটা শর্ত তাদের মর্ম যাতনাকে আরাে বাড়িয়ে দিয়েছিলাে। যে ব্যক্তি মক্কা থেকে মদীনায় রসুল(স.)-এর কাছে আসবে ও ইসলাম গ্রহণ করবে তাকে ফেরত দিতে হবে, রাহমানির রহীম শব্দ দুটো প্রত্যাখ্যান করার জাহেলিয়াতসুলভ গােয়ার্তুমি এবং আল্লাহর রসূল শব্দটা চুক্তিতে উল্লেখ করতে অসম্মতি। বর্ণিত আছে যে, রসূলুল্লাহ শব্দটা লেখার পর তা সােহায়ল বিন আমরের দাবী মােতাবেক মুছে ফেলতে হযরত আলী(রা.) রাযি হননি। তাই রাসূল(স.) নিজে তা মুছে ফেলেন এবং বলেন, হে আল্লাহ তায়ালা, তুমি তাে জানাে যে, আমি তােমার রাসূল। সামষ্টিক বায়াত থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, মুশরিকদের সাথে লড়াই করার জন্য মুসলমানদের মনে ইসলামী জযবা ও বীরত্বের প্রচন্ড জোয়ার বহমান ছিলাে। অথচ সন্ধিচুক্তি সেই জযবাকে ঠান্ডা করে দিলাে এবং আপােস ও প্রত্যাবর্তন মেনে নিতে বাধ্য করলাে। এটা মেনে নেয়া তাদের পক্ষে সহজসাধ্য ছিলাে না যে, ব্যাপারটা এতােদূর গড়াবে। তাদের চুল কামানাে ও কুরবানী দিতে গড়িমসি করার মধ্য দিয়ে মনের এই দুঃসহ অবস্থাটা ফুটে উঠেছে। এমনকি রসূল(স.)-কে এ আদেশ তিনবার দিতে হয়েছে। অথচ রাসূলের আদেশের আনুগত্যে তাদের কোনাে জুড়ি ছিলাে না। যেমন কোরায়শের প্রতিনিধি ওরওয়া ইবনে মাসউদ সাকাফী তাদের সেই আনুগত্য ও ভক্তির দৃষ্টান্ত দেখে গিয়ে তা তাদের কাছে বর্ণনাও করেছিলাে। স্বয়ং রসূল(স.) কোরবানি না করা ও চুল না কামানাে পর্যন্ত তারা চুল কামাতে ও কোরবানী করতে উদ্যোগী হয়নি। রাসূল(স.) কথায় তাদের সক্রিয় করতে পারেনি, শুধু তাঁর কাজই তাদেরকে সক্রিয় করতে পেরেছিলাে। এরপর তারা আগের মতােই আনুগত্যে ফিরে গিয়েছিলাে। মুসলমানরা মক্কা থেকে বেরিয়েছিলাে ওমরার নিয়তে, যুদ্ধের নিয়তে নয়। এর জন্য তারা মানসিকভাবেও প্রস্তুত ছিলাে না, বাস্তবভাবেও নয়। তারপর সহসা তারা কোরায়শের উগ্র নীতির মুখােমুখি হয়। হযরত ওসমানের শাহাদাতের গুজব ছড়িয়ে পরে এবং একদল মােশরেক মুসলমানদের দলের ওপর পাথর ও তীর নিক্ষেপ করে। এ সবের পরিপ্রেক্ষিতে যখন রসূল (স.) লড়াই এর সংকল্প করেন এবং সে জন্য বাইয়াত গ্রহণ করেন, তখন একযােগে বাইয়াত অংশ নেয়। তবে এ দ্বারা এ কথা বুঝা যায় না যে, তাদের মন যার জন্য প্রস্তুত হয়েছে, তা ছাড়া অন্য কিছুর আকস্মিক প্রয়ােজন হলে মত পাল্টানাে যাবে না। এটাও তাদের অনেকের বিরূপ মানসিক প্রতিক্রিয়ার একটা কারণ ছিলাে। এসময় কোরায়শ তাদের বাড়ীতে ছিলাে। আর ১৪শ মুসলমান পথে বেরিয়ে এসেছিলাে। বেদুইন ও অন্যান্য মােশরেকরা কারাে পক্ষই অবলম্বন করেনি। তাই সম্ভবত মুসলমানরা একটা সুবর্ণ সুযােগ হাতছাড়া হয়ে গেলাে মনে করেছিলাে। এই দৃশ্যগুলাের প্রতি দৃষ্টি দিলে আল্লাহ তায়ালার এই উক্তির মর্ম বুঝা যায়, তিনিই আল্লাহ তায়ালা, যিনি মােমেনদের হৃদয়ে প্রশান্তি নাযিল করেছেন…’ এ দ্বারা সেদিনের পরিস্থিতি ও পটভূমিও হৃদয়ঙ্গম করা যায় এবং তাদের অন্তরে শান্তি কিভাবে ফিরে এলাে, তাও অনুভব করা যায়।   *আল্লাহ তায়ালা চাইলেই বিজয় আসে : যেহেতু আল্লাহ তায়ালা সেদিনকার মােমেনদের মনের প্রকৃত অবস্থা জানতেন এবং বুঝতেন যে, তাদের মনে যে ভাবাবেগের উভ্ভব হয়েছে, তা ঈমান থেকেই হয়েছে। ঈমানী আত্মমর্যাদাবোধ তার উৎস। অন্য কানে ব্যক্তিগত স্বার্থও নয় এবং কোনাে জাহেলী মানসিকতাও নয়, তখন তাদেরকে এই প্রশান্তি দান করেন, যাতে তাদের ঈমান আরাে বাড়ে। বস্তুত প্রশান্তি হচ্ছে আত্মমর্যাদাবােধ ও বীরত্বের পরবর্তী একটা ধাপ। এতে দৃঢ় প্রত্যয় থাকে, যা কখনাে উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তায় ভারাক্রান্ত হয় না। এতে এমন সন্তোষ থাকে, যা বিশ্বাসের প্রভাবে শান্ত ও স্থির থাকে। এ জন্যে আল্লাহ তায়ালা জানাচ্ছেন যে, বিজয় ও সাহায্য সেদিন কঠিন ও সুদূর পরাহত ছিলাে না, বরং আল্লাহ তায়ালার প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতার দাবী যদি এই হতাে যে, মােমেনরা যা চাইছিলাে, সেটাই সেদিন সংঘটিত হােক, তাহলে তা আল্লাহ তায়ালার পক্ষে খুবই সহজসাধ্য ছিলাে। কেননা আল্লাহ তায়ালার অগনিত সৈন্য সামন্ত রয়েছে, যাদেরকে কখনাে পরাজিত করা যায় না। যখনই আল্লাহ তায়ালা চান, তিনি বিজয় এনে দিতে পারেন, ‘আল্লাহ তায়ালার জন্যে রয়েছে আকাশ ও পৃথিবীর সৈন্য সামন্ত, তিনি মহাজ্ঞানী ও প্রজ্ঞাময়।’ বস্তুত আল্লাহ তায়ালা তার জ্ঞান ও প্রজ্ঞা দ্বারাই সব কিছু নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী সংঘটিত করে থাকেন। তিনি তার জ্ঞান ও প্রজ্ঞার আলােকেই মােমেনদের মনে প্রশান্তি নাযিল করেন, যাতে তাদের ঈমান বেড়ে যায়।’ ‘যাতে তাদের জন্যে বরাদ্দ করা নেয়ামত ও সাফল্য বাস্তবায়িত হয়, যাতে তিনি মােমেনদেরকে সেসব জান্নাতে প্রবেশ করান, যার নীচ দিয়ে ঝর্ণাসমূহ প্রবাহিত…’(আয়াত ৫) এটা যখন আল্লাহ তায়ালার বিবেচনায় বিরাট সাফল্য, তখন মাপকাঠি অনুযায়ী আল্লাহ তায়ালার কাছ থেকে এ সাফল্য পাওয়াও মােমেনদের জন্যে বিরাট সাফল্য। আল্লাহ তায়ালা সেদিন মােমেনদের জন্যে যা বরাদ্দ করেছেন, তা পেয়ে তারা অবশ্যই আনন্দিত হয়েছে। তারা সূরার উদ্বোধনী আয়াতগুলাে শুনে উদগ্রীব ছিলাে ও জানতে পেরেছিলাে আল্লাহ তায়ালা তার রসূলের ওপর কী করুণা ধারা বর্ষণ করেছেন। তারা তাদের নিজেদের প্রাপ্য সম্পর্কেও জানতে চেয়েছিলাে। যখন তা শুনলাে ও জানলো, তখন তাদের অন্তর সন্তুষ্টি, আনন্দ ও প্রত্যয়ে ভরপুর হয়ে গিয়েছিলাে।

*মােনাফেকদের স্বভাব : এরপর এই ঘটনায় আল্লাহ তায়ালার বরাদ্দকৃত বিষয়ে তার প্রজ্ঞা ও হেকমতের আরাে একটা সম্পর্কে অবহিত করছেন। তা হচ্ছে, তার পক্ষ থেকে মােনাফেক ও মােশরেকদের অপকর্মের প্রতিফল দান, আর তিনি মােনাফেক নারী ও পুরুষদের এবং মােশরেক নারী ও পুরুষকে শাস্তি দেবেন…'(আয়াত ৬,৭) এ আয়াত ক’টিতে মােনাফেক ও মােশরেকদের কয়েকটা সম্মিলিত বৈশিষ্টির উল্লেখ করেছেন। এই বৈশিষ্টগুলাে হচ্ছে, আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে খারাপ ধারণা পােষণ, মােমেনদের প্রতি তার সাহায্যে অবিশ্বাস, তাদের উভয় গােষ্ঠীর ওপর অবধারিত অমংগলের আবর্তন, যা তাদের ওপর ক্রমাগত আবর্তন করতে থাকে ও পড়তে থাকে। তাদের ওপর আল্লাহ তায়ালার চিরস্থায়ী গযব ও অভিশাপ এবং তাদের জন্য আল্লাহ তায়ালার নির্ধাৱিত ভয়ংকর খারাপ পরিণতি। কেননা মােনাফেকী এমন একটা জঘন্য দোষ, যা নিকৃষ্টতায় শিরকের চেয়ে কোনাে অংশে কম নয়, বরঞ্চ তা তার চেয়েও খারাপ। তাছাড়া মােমেনদেরকে মােনাফেকরা যতাে কষ্ট দেয় ও নির্যাতন চালায়, তা মােশরেকদের নির্যাতনের চেয়ে কম নয়, যদিও তার পদ্ধতি ও প্রকারে বিভিন্নতা থাকতে পারে। আল্লাহ তায়ালা যখন তাঁর প্রতি খারাপ ধারণা পােষণকে মােনাফেক ও মােশরেকদের সম্মিলিত দোষ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন, তখন মােমেনের মন নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালার প্রতি সুধারণা পােষণকারী হবে এবং সে তার কাছ থেকে সবসময় কল্যাণই কামনা করবে। সুখেই হােক, দুঃখেই হােক, আল্লাহর কাছ থেকে সে ভালাের আশাই করে। সে ঈমান রাখে যে, আল্লাহ তায়ালা উভয় অবস্থায় তার কল্যাণই চান। এর নিগুঢ় রহস্য এই যে, মােমেনের অন্তর সব সময় আল্লাহ তায়ালার সাথে সংযুক্ত থাকে। আর আল্লাহ তায়ালার কাছ থেকে কল্যাণের স্রোতধারা কখনাে বন্ধ হয় না। যখনই তার সাথে তাঁর অন্তর সংযুক্ত হয়, তখন সে এই মূল তত্তটা হৃদয়ঙ্গম করতে পারে এবং এটিকে প্রত্যক্ষভাবে আস্বাদন করে। পক্ষান্তরে মুনাফিক ও মােশরেকদের বন্ধন আল্লাহ তায়ালার সাথে ছিন্ন থাকে। তাই তারা এই তত্ত্ব কখনাে উপলব্ধি করে না। ফলে আল্লাহ তায়ালার সম্পর্কে তাদের ধারণা খারাপ হয়ে যায়, তাদের হৃদয় শুধু বাহ্যিক জিনিসগুলাের সাথে সম্পৃক্ত থাকে এবং তার ভিত্তিতেই তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। যখনই বাহ্যিক লক্ষণাদি থেকে খারাপ সম্ভাবনা দেখা দেয় তখনই তারা নিজেদের ও মােমেনদের জন্য কেবল খারাপ পরিণতিই কামনা করে। কেননা আল্লাহ তায়ালার শক্তি ও আল্লাহ তায়ালার অদৃষ্ট তত্ত্বে তাদের কোনাে বিশ্বাস থাকে না, থাকে না আল্লাহ তায়ালার গােপন ও সূক্ষ্ম ব্যবস্থা সম্পর্কে কোনাে জ্ঞান। এ আয়াতে আল্লাহ তায়ালা ইসলাম ও মুসলমানদের শত্রুদের, কয়েকরকম অবস্থা ও কয়েকরকম পরিণতির উল্লেখ করেছেন। তারপর তার অসীম ক্ষমতা ও প্রজ্ঞার বিবরণ দিয়ে উপসংহার টেনেছেন। আর আল্লাহ তায়ালার জন্যে রয়েছে আকাশ ও পৃথিবীর সকল সৈন্য সামন্ত। ‘আল্লাহ তায়ালা মহা পরাক্রমশালী, মহা প্রজ্ঞাময়।’ তাই তার কাছে কোনাে কিছুই দুর্বোধ্য জটিল ও দুঃসাধ্য নয়, তার কাছে তাদের কোনাে কিছুই অজ্ঞাত নয় এবং তার জন্যে রয়েছে আকাশ ও পৃথিবীর সৈন্য সামন্ত, তিনি হচ্ছেন মহা পরাক্রমশালী ও মহা বিজ্ঞানী।

Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১১২৯ /মুনাফিক কি? কেন ও কিভাবে -৪২)
[ *  اِنَّا فَتَحۡنَا لَکَ فَتۡحًا مُّبِیۡنًا ۙ﴿۱﴾
নিশ্চয়ই (হে রসূল!সা:) আমি আপনাকে দিয়েছি সুস্পষ্ট বিজয়:-
*মানসিক প্রশান্তি একটি আল্লাহর নেয়ামত :-
মুনাফিক নারী ও পুরুষ এবং মুশরিক নারী ও পুরুষ আল্লাহ‌ সম্পর্কে খারাপ ধারণা পোষণ করে:-]
www.motaher21.net
সূরা:৪৮-ফাত্হ।পারা:২৬
১-৭ নং আয়াত:-
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
সূরা:৪৮-ফাত্হ।-১
اِنَّا فَتَحۡنَا لَکَ فَتۡحًا مُّبِیۡنًا ۙ﴿۱﴾
নিশ্চয়ই (হে রসূল!সা:) আমি আপনাকে দিয়েছি সুস্পষ্ট বিজয়।
সূরা:৪৮-ফাত্হ।-২
لِّیَغۡفِرَ لَکَ اللّٰہُ مَا تَقَدَّمَ مِنۡ ذَنۡۢبِکَ وَ مَا تَاَخَّرَ وَ یُتِمَّ نِعۡمَتَہٗ عَلَیۡکَ وَ یَہۡدِیَکَ صِرَاطًا مُّسۡتَقِیۡمًا ۙ﴿۲﴾
যেন আল্লাহ আপনার অতীত ও ভবিষ্যত ত্রুটিসমূহ মার্জনা করেন এবং আপনার প্রতি তাঁর অনুগ্রহ পূর্ণ করেন। আর আপনাকে সরল পথের হেদায়াত দেন,
সূরা:৪৮-ফাত্হ।-৩
وَّ یَنۡصُرَکَ اللّٰہُ نَصۡرًا عَزِیۡزًا ﴿۳﴾
আল্লাহ তাআলা আপনাকে বড়ো রকমের একটা সহযোগিতা করবেন।
সূরা:৪৮-ফাত্হ।-৪
ہُوَ الَّذِیۡۤ اَنۡزَلَ السَّکِیۡنَۃَ فِیۡ قُلُوۡبِ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ لِیَزۡدَادُوۡۤا اِیۡمَانًا مَّعَ اِیۡمَانِہِمۡ ؕ وَ لِلّٰہِ جُنُوۡدُ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ ؕ وَ کَانَ اللّٰہُ عَلِیۡمًا حَکِیۡمًا ۙ﴿۴﴾
তিনিই তো সে সত্তা যিনি মু’মিনদের মনে প্রশান্তি নাযিল করেছেন৬ যাতে তারা নিজেদের ঈমান আরো বাড়িয়ে নেয়। আসমান ও যমীনের সমস্ত বাহিনী আল্লাহর কর্তৃত্বাধীন। তিনি মহাজ্ঞানী ও কৌশলী।
সূরা:৪৮-ফাত্হ।-৫
لِّیُدۡخِلَ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ وَ الۡمُؤۡمِنٰتِ جَنّٰتٍ تَجۡرِیۡ مِنۡ تَحۡتِہَا الۡاَنۡہٰرُ خٰلِدِیۡنَ فِیۡہَا وَ یُکَفِّرَ عَنۡہُمۡ سَیِّاٰتِہِمۡ ؕ وَ کَانَ ذٰلِکَ عِنۡدَ اللّٰہِ فَوۡزًا عَظِیۡمًا ۙ﴿۵﴾
যাতে তিনি মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীদেরকে প্রবেশ করান জান্নাতে, যার নিচ দিয়ে নহরসমূহ প্রবাহিত, যেখানে তারা স্থায়ী হবে এবং তিনি তাদের পাপসমূহ মোচন করবেন ; আর এটাই হলো আল্লাহর নিকট মহাসাফল্য।
সূরা:৪৮-ফাত্হ।-৬
وَّ یُعَذِّبَ الۡمُنٰفِقِیۡنَ وَ الۡمُنٰفِقٰتِ وَ الۡمُشۡرِکِیۡنَ وَ الۡمُشۡرِکٰتِ الظَّآنِّیۡنَ بِاللّٰہِ ظَنَّ السَّوۡءِ ؕ عَلَیۡہِمۡ دَآئِرَۃُ السَّوۡءِ ۚ وَ غَضِبَ اللّٰہُ عَلَیۡہِمۡ وَ لَعَنَہُمۡ وَ اَعَدَّ لَہُمۡ جَہَنَّمَ ؕ وَ سَآءَتۡ مَصِیۡرًا ﴿۶﴾
আর যেসব মুনাফিক নারী ও পুরুষ এবং মুশরিক নারী ও পুরুষ আল্লাহ‌ সম্পর্কে খারাপ ধারণা পোষণ করে তাদের শাস্তি দেবেন। তারা নিজেরাই অকল্যাণর চক্রে পড়ে গিয়েছে। আল্লাহর গযব পড়েছে তাদের ওপর তিনি লা’নত করেছেন তাদেরকে এবং তাদের জন্য জাহান্নাম প্রস্তুত করে রেখেছেন-যা অত্যন্ত জঘন্য জায়গা।
সূরা:৪৮-ফাত্হ।-৭
وَ لِلّٰہِ جُنُوۡدُ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ ؕ وَ کَانَ عَزِیۡزًا حَکِیۡمًا ﴿۷﴾
আসমানসমূহ ও যমীনের বাহিনীসমূহ আল্লাহরই এবং আল্লাহ্ হচ্ছেন পরাক্রমশালী, হিকমতওয়ালা।

১-৭ নং আয়াত এর তাপসীর:-
(৪৮-ফাতাহ্) : নামকরণ:

সূরার একেবারে প্রথম আয়াতের إِنَّا فَتَحْنَا لَكَ فَتْحًا مُبِينًا বাক্যাংশ থেকে এর নাম গৃহীত হয়েছে। এটি এ সূরার শুধু নামই নয় বরং বিষয়বস্তু অনুসারে এর শিরোনামও। কেননা, আল্লাহ তা’আলা হুদাইবিয়ার সন্ধির আকারে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও মুসলমানদেরকে যে মহান বিজয় দান করেছিলেন এসে সে বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
(৪৮-ফাতাহ্) : নাযিল হওয়ার সময়-কাল :

৬ষ্ঠ হিজরীর যুল-কা’দা মাসে মক্কার কাফেরদের সাথে সন্ধিচুক্তি সম্পাদনের পর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন মদীনার দিকে ফিরে যাচ্ছিলেন সে সময় এ সূরাটি নাযিল হয়। এ ব্যাপারে সমস্ত রেওয়ায়াত একমত।
(৪৮-ফাতাহ্) : ঐতিহাসিক পটভূমি :

যেসব ঘটনার প্রেক্ষিতে সূরাটি নাযিল হয়েছিল তার সূচনা হয়েছিল এভাবে যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একদিন স্বপ্নে দেখলেন, তিনি তাঁর সাহাবীদের সাথে পবিত্র মক্কা নগরীতে গিয়ে উমরা আদায় করেছেন। নবী স্বপ্ন নিছক স্বপ্ন এবং কল্পনা হতে পারে না। বরং তা এক প্রকার অহী। পরবর্তী ২৭ আয়াতে আল্লাহ তা’আলা নিজেও একথা অনুমোদন করেছেন যে, তিনিই তাঁর রসূলকে এ স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। তাই প্রকৃতপক্ষে এটি নিছক স্বপ্ন ছিল না, বরং মহান আল্লাহর ইঙ্গিত ছিল যার অনুসরণ নবীর (সা.) জন্য জরুরী ছিল।

বাহ্যিক কার্যকরণ অনুসারে এ নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করা কোনভাবেই সম্ভব বলে মনে হচ্ছিলো না। কাফের কুরাইশরা ৬ বছর যাবত মুসলমানদের জন্য বায়তুল্লাহর পথ বন্ধ করে রেখেছিল এবং এ পুরো সময়টাতে তারা হজ্ব ও উমরাহ আদায়ের জন্য পর্যন্ত কোন মুসলমানকে হারাম এলাকার ধারে কাছে ঘেঁষতে দেয়নি। তাই এখন করে আশা করা যায় যে, তারা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সাহাবীদের একটি দলসহ মক্কায় প্রবেশ করতে দেবে? উমরার জন্য ইহরাম বেঁধে যুদ্ধের সাজ সরঞ্জাম সাথে নিয়ে বের হওয়ার অর্থ যুদ্ধ ডেকে আনা এবং নিরন্ত্র হয়ে যাওয়ার অর্থ নিজের ও সংগীদের জীবনকে বিপন্ন করা। এ পরিস্থিতিতে আল্লাহ তা’আলার ইঙ্গিত অনুসারে কিভাবে কাজ করা যেতে পারে তা কেউই বুঝে উঠতে পারছিলো না।

কিন্তু নবীর পদমর্যাদাই এই যে, তাঁর রব তাঁকে যে নির্দেশই দান করেন তা তিনি বিনা দ্বিধায় বাস্তবায়িত করেন। তাই রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর স্বপ্নের কথা দ্বিধিহীন চিত্তে সাহাবীদের বললেন এবং সফরের প্রস্তুতি শুরু করে দিলেন। আশপাশের গোত্রসমূহের মধ্যেও ব্যাপকভাবে ঘোষণা করলেন, আমরা উমরা আদায়ের জন্য যাচ্ছি। যারা আমাদের সাথে যেতে ইচ্ছুক তারা যেন এসে দলে যোগ দেয়। বাহ্যিক কার্যকরণসমূহের ওপর যাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল তারা মনে করলো এরা মৃত্যুর মুখে ঝাঁপ দিতে যাচ্ছে। তাদের কেউই তার সাথে যেতে প্রস্তুত হলো না। কিন্তু যারা সত্যি সত্যিই আল্লাহ ও তার রসূলের প্রতি ঈমান পোষণ করতো পরিণাম সম্পর্কে তারা কোন পরোয়াই করেছিলো না। তাদের জন্য এটাই যথেষ্ট ছিল যে, এটা আল্লাহ তা’আলার ইঙ্গিত এবং তাঁর রসূল এ নির্দেশ পালনের জন্য প্রস্তুত হয়েছেন। সুতরাং এখন কোন জিনিসই আর তাদেরকে আল্লাহর রসূলকে সহযোগিতা করা থেকে বিরত রাখতে সক্ষম ছিল না। নবীর (সা.) সাথে এ বিপজ্জনক সফরে যেতে ১৪শ সাহাবী প্রস্তুত হলেন।

৬ষ্ঠ হিজরীর যুল-কা’দা মাসের প্রারম্ভে এ পবিত্র কাফেলা মদীনা থেকে যাত্রা করলো। যুল-হুলাইফাতে ১ পৌঁছে সবাই উমরার জন্য ইহরান বাঁধলেন। কুরবানীর জন্য ৭০ টি উট সাথে নিলেন। এ ছাড়া যুদ্ধের আর কোন উপকরণ সংগে নিলেন না। এভাবে তাঁদের এ কাফেলা লাব্বায়কা, লাব্বায়কা, ধ্বনি তুলে বায়তুল্লাহ অভিমুখে যাত্রা করলো।

১। এ স্থানটি মদীনা থেকে মক্কার পথে ৬ মাইল দূরত্বে অবস্থিত। এর বর্তমান নাম বি’রে আলী। মদীনার হাজীগণ এখান থেকেই হজ্ব ও উমরার ইহরাম বেঁধে থাকেন।

সে সময় মক্কা ও মদীনার মধ্যে যে ধরনের সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল আরবের প্রতিটি শিশুও সে সম্পর্কে অবহিত ছিল। এই তো গত বছরই ৫ম হিজরীর শাওয়াল মাসের কুরাইশরা বিভিন্ন আরব গোত্রের সম্মিলিত শক্তি নিয়ে মদীনার ওপর চড়াও হয়েছিল যার কারণে বিখ্যাত আহযাব যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। তাই রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন এত বড় একটা কাফেলা নিয়ে তাঁর রক্তের পিয়াসী শত্রুর নিজ এলাকার দিকে যাত্রা করলেন তখন স্বাভাবিকভাবেই গোটা আরবের দৃষ্টি এ বিস্ময়কর সফরের প্রতি নিবদ্ধ হলো। সংগে সংগে তারা এও দেখলো যে, এ কাফেলা লড়াই করার জন্য যাত্রা করেনি। বরং পবিত্র মাসে ইহরাম বেঁধে কুরবানীর উট সাথে নিয়ে একবারে নিরস্ত্র অবস্থায় বায়তুল্লাহর তাওয়াফের জন্য যাচ্ছে।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ পদক্ষেপ কুরাইশদেরকে মারাত্মক অসুবিধায় ফেলে দিল। যে পবিত্র মাসগুলোকে শত শত বছর ধরে আরবে হজ্ব ও বায়তুল্লাহর যিয়ারতের জন্য পবিত্র মনে করা হতো যুল-কা’দা মাসটি ছিল তার অন্যতম। যে কাফেলা এ পবিত্র মাসে ইহরাম বেঁধে হজ্ব অথবা উমরার জন্য যাত্রা করেছে তাকে বাধা দেয়ার অধিকার কারো ছিল না। এমনকি কোন গোত্রের সাথে যদি তার শত্রুতা থেকে থাকে তবুও আরবের সর্বজন স্বীকৃত আইন অনুসারে সে তাকে তার এলাকা দিয়ে অতিক্রম করতেও বাধা দিতে পারে না। কুরাইশরা দ্বিধান্বিত হয়ে পড়লো যে, যদি তারা মদীনায় এ কাফেলার ওপর হালমা করে মক্কা প্রবেশ করতে বাধা দেয় তাহলে গোটা দেশে হৈ চৈ শুরু হয়ে যাবে। আরবের প্রতিটি মানুষ বলতে শুরু করবে এটা বাড়াবাড়ী ছাড়া আর কিছুই নয়। আরবের সমস্ত গোত্র মনে করবে, আমরা খানায়ে কা’বার মালিক মুখতার হয়ে বসেছি। প্রতিটি গোত্রই এ ভেবে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়বে যে ভবিষ্যতে কাউকে হজ্ব ও উমরা করতে দেয়া না দেয়া আমাদের মর্জির ওপর নির্ভরশীল। আজ যেমন মদীনার যিয়ারতকারীদের বাধা দিচ্ছি তেমনি যাদের প্রতিই আমরা অসন্তুষ্ট হবো ভবিষ্যতে তাদেরকেই বায়তুল্লার যিয়ারত করতে বাধা দেব। এটা হবে এমন একটা ভুল যার কারণে সমগ্র আরব আমাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে উঠবে। অপরদিকে আমরা যদি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এত বড় কাফেলা নিয়ে নির্বিঘ্নে আমাদের শহরে প্রবেশ করতে দেই তাহলে গোটা দেশের সামনেই আমাদের প্রভাব প্রতিপত্তি বিনষ্ট হবে। লোকজন বলবে, আমরা মুহাম্মাদের (সা.) ভয়ে ভীত হয়ে পড়েছি। শেষ পর্যন্ত অনেক চিন্তা-ভাবনা ও বিচার-বিবেচনার পর তাদের জাহেলী আবেগ ও মানসিকতাই তাদের ওপর প্রভাব বিস্তার করলো এবং তারা নিজেদের মুখ রক্ষার জন্য যে কোন মূল্যে এ কাফেলাকে শহরে প্রবেশ করতে না দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলো।

রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আগেভাগেই বনী কা’ব গোত্রের এক ব্যক্তিকে গুপ্তচর হিসেবে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন যাতে সে যথাসময়ে তাঁকে কুরাইশদের সংকল্প ও গতিবিধি সম্পর্কে অবহিত করতে থাকে। তিনি উসফান ১ নামক স্থানে পৌছলে সে এসে জানালো যে, পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে কুরাইশরা যি-তুয়ায় ২ পৌঁছেছে এবং তাঁর পথরোধ করার জন্য তারা খালিদ ইবনে ওয়ালিদকে দুই শত অশ্বরোহী সহ কুরাউল গমীম ৩ অভিমুখে অগ্রগামী বাহিনী হিসেবে পাঠিয়ে দিয়েছে। দুই কুরাইশদের চক্রান্ত ছিল এই যে, কোন না কেন উপায়ে নবীর (সা.) সংগী-সাথীদের উত্যক্ত করে উত্তেজিত করা এবং তার পরে যুদ্ধ সংঘটিত হলে গোটা দেশে একথা প্রচার করে দেয়া যে, উমরা আদায়ের বাহানা করে এরা প্রকৃতপক্ষে যুদ্ধ করার জন্যই এসেছিলো এবং শুধু ধোঁকা দেয়ার জন্যই ইহরাম বেঁধেছিল।

এ খবর পাওয়া মাত্র রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রাস্তা পরিবর্তন করলেন এবং ভীষণ কষ্ট স্বীকার করে অত্যন্ত দুর্গম একটি পথ ধরে হারাম শরীফের একেবারে প্রান্ত সীমায় অবস্থিত হুদাইবিয়ায় ৪ গিয়ে পৌছলেন। এখানে খুয’আ গোত্রের নেতা বুদায়েল ইবনে ওয়ারকা তার গোত্রের কতিপয় লোককে সাথে নিয়ে নবীর (সা.) কাছে আসলো এবং তাঁকে জিজ্ঞেস করলো। আপনি কি উদ্দেশ্যে এখানে এসেছেন? নবী (সা.) বললেন: “আমরা কারো বিরুদ্ধে লড়াই করতে আসিনি। আমাদের উদ্দেশ্য শুধু বায়তুল্লাহর যিয়ারত ও তাওয়াফ”। তারা গিয়ে কুরাইশ নেতাদের একথাটিই জানিয়ে দিল। তারা তাদেরকে এ পরামর্শও দিল যে, তারা যেন হারামের এসব যিয়ারতকারীদের পথরোধ না করে। কিন্তু তারা তাদের জিদ বজায় রাখলো এবং নবীকে (সা.) ফিরে যেতে রাজি করানোর জন্য আহাবিশদের নেতা হুলাইস ইবনে আলকামাকে তাঁর কাছে পাঠালো। কুরাইশ নেতাদের উদ্দেশ্য ছিল, মুহাম্মামদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার কথা না মানলে সে অসন্তুষ্ট হয়ে ফিরে আসবে এবং এভাবে আহাবিশদের শক্তি তাদের পক্ষে থাকবে। কিন্তু সে এসে যখণ স্বচক্ষে দেখলো, গোটা কাফেলা ইহরাম বেঁধে আছে, গলায় কিলাদা লটকানো কুরবানীর উটগুলে সামনেই দাঁড়িয়ে আছে এবং এ মানুষগুলো লড়াই করার জন্য নয়, বরং বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করার জন্য এসেছে তখন সে নবীর (সা.) সাথে কোন কথাবার্তা না বলেই মক্কায় ফিরে গিয়ে কুরাইশ নেতাদের স্পষ্ট বলে দিল যে, তারা বায়তুল্লাহর মর্যাদার স্বীকৃতি দিয়ে তা যিয়ারত করতে এসেছে। তোমরা যদি তাদের বাধা দাও তাহলে আহাবিশরা কখনো তোমাদের সহযোগিতা করবে না। তোমরা নিষিদ্ধ বিষয়কে পদদলিত করবে আর আমরা সাহয্য-সহযোগিতা করবো এ জন্য আমরা তোমাদের সাথে মিত্রতাবন্ধনে আবদ্ধ হইনি।

১। এ স্থানটি মদীনা থেকে মক্কাগামী পথে মক্কা থেকে প্রায় দু’দিনের দূরত্বে অবস্থিত। অর্থাৎ উটের পিঠে এখান থেকে মক্কা পৌছতে দু’দিন লেগে যায়।

২। মক্কার বাইরে উসফানগামী পথের ওপর অবস্থিত একটি স্থান।

৩। উসফান থেকে মক্কা অভিমুখে আট মাইল দূরে অবস্থিত।

৪। জেদ্দা থেকে মক্কাগামী সড়কের যে স্থানে হারাম শরীফের সীমা শুরু হয়েছে এ স্থানটি ঠিক সেখানে অবস্থিত। বর্তমানে এ স্থানটির নাম শুমাইসি। মক্কা থেকে এর দূরত্ব প্রায় ১৩ মাইল।

অতপর কুরাইশদের পক্ষ থেকে মাসউদ সাকাফী আসলো এবং সেও নিজের পক্ষ থেকে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ভাল-মন্দ সব দিক বুঝিয়ে তাঁকে মক্কায় প্রবেশ করার সংকল্প থেকে বিরত রাখতে চাইলো। নবী (সা.) বনী খুযআ গোত্রের নেতাকে যে জওয়াব দিয়েছিলেন তাকেও সে একই জওয়াব দিলেন। অর্থাৎ আমরা লড়াই করার উদ্দেশ্যে আসিনি, বায়তুল্লাহের মর্যাদা প্রদর্শনকারী হিসেবে একটি ধর্মীয় কর্তব্য পালন করার জন্য এসেছি। ফিরে গিয়ে উরওয়া কুরাইশদের বললো: আমি কায়সার, কিসরা এবং নাজ্জাসীর দরবারে গিয়েছি। কিন্তু আল্লাহর শপথ!আমি মুহাম্মাদের (সা.) সংগী-সাথীদেরকে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি যেমন নিবেদিত প্রাণ দেখেছি তেমন দৃশ্য বড় বড় বাদশাহর দরবারেও দেখেনি। এদের অবস্থা এই যে, মুহাম্মাদ (সা.) অযু করলে তারা এক বিন্দু পানিও মাটিতে পড়তে দেয় না, সবাই তো নিজেদের শরীর ও কাপড় মেখে নেয়। এখন চিন্তা করে দেখ, তোমরা কার মোকাবিলা করতে যাচ্ছো?

দূতদের আসা যাওয়া ও আলাপ-আলোচনা চলাকালীন সময়ে গোপনে নবীর (সা.) সেনা শিবিরে আকস্মিক হামলা চালিয়ে সাহাবীদের উত্তেজিত করা এবং যুদ্ধের অযুহাত হিসেবে কাজে লাগানো যায় তাদের দ্বারা এমন কোন কাজ করানোর জন্য কুরাইশরা বারবার চেষ্টা চালাতে থাকে। কিন্তু সাহাবায়ে কিরামের ধৈর্য ও সংযম এবং নবীর (সা.) বিচক্ষণতা ও দূরদৃষ্টি তাদের সমস্ত অপেচেষ্টা ব্যর্থ করে দেয়। তাদের চল্লিশ পঞ্চাশজন লোকের একটি দল একদিন রাত্রিকালে এসে মুসলমানদের তাঁবুর ওপরে পাথর নিক্ষেপ ও তীর বর্ষণ করতে থাকে। সাহাবা কিরাম, তাদের সবাইকে বন্দী করে নবীর (সা.) সামনে হাজির করেন। কিন্তু তিনি তাদের সবাইকে ছেড়ে দেন। অপর এক ঘটনায় ঠিক ফজর নামাযের সময় তানঈমের ১দিক থেকে ৮০ ব্যক্তির একটি দল এসে আকস্মিকভাবে হামলা করে বসে। তাদেরকেও বন্দী করা হয়। নবী (সা.) তাদেরকেও মুক্ত করে দেন। এভাবে কুরাইশরা তাদের প্রতিটি ধূর্তামি ও অপকৌশলে ব্যর্থতার সম্মুখীন হতে থাকে।

১। মক্কার হারাম সীমার বাইরে অবস্থিত একটি স্থানের নাম, মক্কার লোকেরা সাধারণত এখানে এসে ওমরার জন্য ইহরাম বাঁধে এবং ফিরে গিয়ে ওমরাহ আদায় করে।

অবশেষে নবী (সা.) নিজের পক্ষ থেকে হযরত উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহুকে দূত হিসেবে মক্কায় পাঠান এবং তাঁর মাধ্যমে কুরাইশ নেতাদের জানিয়ে দেন যে, আমরা যুদ্ধের উদ্দেশ্যে নয়, বরং বায়তুল্লাহ যিয়ারতের উদ্দেশ্যে কুরবানীর পশু সংগে নিয়ে এসেছি। বায়তুল্লাহর তাওয়াফ ও কুরবানী করে ফিরে যাব। কিন্তু তারা এতে স্বীকৃতি হলো না এবং হযরত উসমানকে (সা.) মক্কাতে আটক করলো। এ সময় এ খবর ছড়িয়ে পড়লো যে, হযরত উসমানকে (সা.) হত্যা করা হয়েছে তাঁর ফিরে না আসায় মুসলমানরাও নিশ্চিত হয়ে গেলেন যে, খবরটা সত্য। এখন অধিক সংযম প্রদর্শনের আর কোন অবকাশ ছিল না। মক্কা প্রবেশের ব্যাপারটি ছিল ভিন্ন জিনিস। সে জন্য শক্তি প্রয়োগের কোন চিন্তা আদৌ ছিল না। কিন্তু যখন দূতকে হত্যা করার ঘটনা পর্যন্ত ঘটলো তখন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হওয়া ছাড়া মুসলমানদের আর কোন উপায় থাকলো না। সুতরাং রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সমস্ত সাহাবীকে একত্রিত করলে এবং তাদের নিকট থেকে এ মর্মে বাইয়াত গ্রহণ করলেন যে, আমরা এখন এখান থেকে আমৃত্যু পিছু হটবো না। অবস্থার নাজুকতা বিচার করলে যে কেউ উপলব্ধি করবেন যে, এটা কোন মামুলি বাইয়াত ছিল না। মুসলমানদের সংখ্যা ছিল মাত্র ১৪শত। কোন যুদ্ধ সরঞ্জামও তাদের সাথে ছিল না। নিজেদের কেন্দ্র থেকে আড়াই শত মাইল দূরে একেবারে মক্কার সীমান্তে অবস্থান করেছিলেন তারা সেখানে শত্রু তার পুরো শক্তি নিয়ে আক্রমণ করতে পারতো এবং আশপাশের সহযোগী গোত্রগুলোকে ডেকে এনে তাদের ঘিরে ফেলতে পারতো। এসব সত্ত্বেও শুধু একজন ছাড়া গোটা কাফেলার সবাই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাতে হাত রেখে জীবনের ঝূঁকি নিতে দ্বিধাহীন চিত্তে প্রস্তুত হয়ে গেল। তাদের নিষ্ঠাপূর্ণ ঈমান এবং আল্লাহর পথে নিবেদিত প্রাণ হওয়ার এর চেয়ে বড় প্রমাণ আর কি হতে পারে? এটিই ইসলামের ইতিহাসে “বাইয়াতে রিদওয়ান” নামে খ্যাত।

পরে জানা গেল যে, হযরত উসমানকে হত্যা করার খবর মিথ্যা ছিল। হযরত উসমানকে নিজেও ফিরে আসলেন এবং কুরাইশদের পক্ষ থেকে সন্ধির আলোচনা করার জন্য সুহাইল ইবনে আমরের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দলও নব্যীর (সা.) শিবিরে এসে পৌঁছল। নবী (সা.) এবং তাঁর সংগী-সাথীদের আদৌ মক্কায় প্রবেশ করতে দিবে না- কুরাইশরা তাদের এ জিদ ও একগুয়েমী পরিত্যাগ করেছিলও। তবে নিজেদের মুখ রক্ষার জন্য তারা পীড়াপীড়ি করছিলো যে, নবী (সা.) এ বছর ফিরে যাবেন এবং আগামী বছর আসতে পারবেন। দীর্ঘ আলাপ আলোচনার পর যেসব শর্তের ভিত্তিতে সন্ধি পত্র লেখা হলো তা হচ্ছে:

(১) উভয় পক্ষের মধ্যে দশ বছর যুদ্ধ বন্ধ থাকবে এবং এক পক্ষ অপর পক্ষের বিরুদ্ধে গোপনে বা প্রকাশ্যে কোন প্রকার তাৎপরতা চালাবে না।

(২) এ সময়ে কুরাইশদের কেউ তার অভিভাবের অনুমতি ছাড়া যদি পালিয়ে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে চলে যায় তাহলে তিনি তাকে ফেরত দেবেন। কিন্তু তাঁর সংগী-সাথীদের কেউ কুরাইশদের কাছে চলে গেলে তারা তাকে ফেরত পাঠাবে না।

(৩) যে কোন আরব গোত্র যে কোন পক্ষের মিত্র হয়ে এই চুক্তির অন্তর্ভুক্ত হতে চাইলে তার সে অধিকার থাকবে।

(৪) মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ বছর ফিরে যাবেন এবং আগামী বছর উমরার জন্য এসে এ শর্ত তিনদিন মক্কায় অবস্থান করতে পারবেন যে, সাজ-সরঞ্জামের মধ্যে শুধু একখানা করে তরবারি ছাড়া আর কোন যুদ্ধ সরঞ্জাম সাথে আনতে পারবেন না। মক্কাবাসীরা উক্ত তিন দিন তাদের জন্য শহর খালি করে দেবে যাতে কোন প্রকার সংঘর্ষের পরিস্থিতি সৃষ্টি না হয। কিন্তু ফিরে যাওয়ার সময় এখানকার কোন অধিবাসীকে সংগে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি তাঁর থাকবে না।

যে সময় এ সন্ধির শর্তসমূহ নির্ধারিত হচ্ছিলো তখন মুসলমানদের পুরা বাহিনী অত্যন্ত বিচলিত বোধ করেছিলেন। যে মহত উদ্দেশ্য সামনে রেখে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এসব শর্ত মেনে নিচ্ছিলেন তা কেউই বুঝে উঠতে পারছিলো না। এ সন্ধির ফলে যে বিরাট কল্যাণ অর্জিত হতে যাচ্ছিলো তা দেখতে পাওয়ার মত দূরদৃষ্টি করোই ছিল না। কুরাইশদের কাফেররা একে তাদের সফলতা মনে করেছিলো আর মুসলমানরা বিচলিত হচ্ছিলো এই ভেবে যে, তারা নীচ হয়ে এ অবমাননাকর শর্তাবলী গ্রহণ করবে কেন? এমন কি হযরত উমরের (রা.) মত গভীরদৃষ্টি সম্পন্ন জ্ঞানীজনের অবস্থা ছিল এই যে, তিনি বলেন: ইসলাম গ্রহণের পরে কখনো আমার মনে কোন সন্দেহ-সংশয় সৃষ্টি হয়নি। কিন্তু এ যাত্রায় আমিও তা থেকে রক্ষা পাইনি। তিনি বিচলিত হয়ে হযরত আবু বকরের (রা.) কাছে গিয়ে বললেন: “তিনি কি আল্লাহর রসূল নন? আমরা কি মুসলমান নই? এসব লোক কি মুশরিক নয়? এসব সত্ত্বেও আমরা আমাদের দ্বীনের ব্যাপারে এ অবমাননা মেনে নেব কেন?” তিনি জবাব দিলেন: “হে উমর তিনি আল্লাহর রসূল আল্লাহ কখনো তাঁকে ধ্বংস করবেন না”। এরপরও তিনি ধৈর্যধারণ করতে পারলেন না। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে গিয়ে তাঁকেও এ প্রশ্নগুলো করলেন। হযরত আবু বকর (রা.) তাকে যে জবাব দিয়েছিলেন নবীও (সা.) তাঁকে সেরূপ জবাব দিলেন। এ সময় হযরত উমর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে যে কথাবার্তা বলেছিলেন তার জন্য তিনি পরবর্তী সময়ে দীর্ঘদিন পর্যন্ত লজ্জিত ও অনুতপ্ত ছিলেন। তাই তিনি অধিক পরিমাণে দান-খয়রাত এবং নফল নামায আদায় করতেন। যাতে আল্লাহ তা’আলা তাঁকে মাফ করে দেন।

এ চুক্তির দু’টি শর্ত লোকজনের কাছে সবচেয়ে বেশী অসহনীয় ও দুর্বিসহ মনে হচ্ছিলো। এক, ২ নম্বর শর্ত। এটি সম্পর্কে লোকজনের বক্তব্য হলো এটি অসম শর্ত। মক্কা থেকে পালিয়ে আসা লোকদের যদি আমরা ফিরিয়ে দেই তাহলে মদীনা থেকে পালিয়ে আসা লোকদের তারা ফিরিয়ে দেবে না কেন? এর জবাবে নবী (সা.) বললেন: যে আমাদের এখান থেকে পালিয়ে তাদের কাছে চলে যাবে সে আমাদের কোন কাজে লাগবে? আল্লাহ যেন তাকে আমাদের থেকে দূরেই রাখেন। তবে যে তাদের ওখান থেকে পালিয়ে আমাদের কাছে চলে আসবে তাকে যদি আমরা ফিরিয়েও দেই তাহলে তার মুক্তিলাভের অন্য কোন উপায় হয়তো আল্লাহ সৃষ্টি করে দেবেন। দ্বিতীয় যে জিনিসটি লোকজনের মনে দ্বিধা-সংশয় সৃষ্টি হচ্ছিলো সেটি ছিল সন্ধির চতুর্থ শর্ত। মুসলমানগণ মনে করেছিলেন, এটি মেনে নেয়ার অর্থ হচ্ছে গোটা আরবের দৃষ্টিতে আমরা যেন ব্যর্থ হয়ে ফিরে যাচ্ছি। তাছাড়া এ প্রশ্নও মনে সন্দেহ সৃষ্টি করেছিল যে, নবী (সা.) তো স্বপ্নে দেখেছিলেন, আমরা মক্কায় বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করেছি। অথচ এখানে আমরা তাওয়াফ না করেই ফিরে যাওয়ার শর্ত মেনে নিচ্ছি। নবী (সা.) ব্যাখ্যা দিয়ে বললেন: চুক্তির শর্ত অনুসারে এ বছর যদি না-ও হয় তাহলে আগামী বছর ইনশায়াল্লাহ, তাওয়াফ হবে।

যে ঘটনাটি জ্বলন্ত আগুনে ঘি ঢালার কাজ করলো তা হচ্ছে, যে সময় সন্ধি চুক্তিটি লিপিবদ্ধ করা হচ্ছিলো ঠিক তখন সুহাইল ইবনে আমরের পুত্র আবু জানদাল কোন প্রকারে পালিয়ে নবীর (সা.) শিবিরে গিয়ে হাজির হলেন। তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন এবং মক্কার কাফেররা তাকে বন্দী করে রেখেছিলো। এ সময় তাঁর পায়ে শিকল পরানো ছিল এবং দেহে নির্যাতনের চিহ্ন ছিল। তিনি নবীর (সা.) কাছে আবেদন জানালেন, আমাকে এ অন্যায় বন্দীদশা থেকে মুক্ত করুন। এ করুণ অবস্থা দেখে সাহাবায়ে কিরামের পক্ষে ধৈর্যধারণ করা কঠিন হয়ে পড়লো। সুহাইল ইবনে আমর বললো: চুক্তিপত্র লেখা শেষ না হলেও চুক্তির শর্তাবলী সম্পর্কে আপনার ও আমাদের মধ্যে সিদ্ধান্ত হয়ে গিয়েছে। অতএব এ ছেলেকে আমার হাতে অর্পণ করুন। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার যুক্তি মেনে নিলেন এবং আবু জানদালকে জালেমদের হাতে তুলে দিলেন।

সন্ধি চুক্তি শেষ করে নবী (সা.) সাহাবীদের বললেন: এখানেই কুরবানী করে মাথা মুড়ে ফেলো এবং ইহরাম শেষ করো। কিন্তু কেউ-ই তাঁর জায়গা থেকে একটুও নড়লেন না। নবী (সা.) তিনবার আদেশ দিলেন কিন্তু দু:খ, দুশ্চিন্তা ও মর্মবেদনা সাহাবীদের ওপর এমন প্রবল প্রভাব বিস্তার করেছিলো যে, তারা যার যার জায়গা হতে একটু নড়াচড়া পর্যন্ত করলেন না। নবী (সা.) সাহাবীদের আদেশ দিচ্ছেন কিন্তু তারা তা পালনের জন্য তৎপর হচ্ছেন না এমন ঘটনা একটি ক্ষেত্র ছাড়া নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের গোটা নবুয়াত জীবনে আর কখনো ঘটেনি। এতে নবী (সা.) অত্যন্ত দু:খ পেলেন। তিনি তাঁর তাঁবুতে গিয়ে উম্মুল মু’মিনীন হযরত উম্মে সালামার কাছে নিজের মনের কষ্টের কথা প্রকাশ করলেন। হযরত উম্মে সালামা বললেন, আপনি চুপচাপ গিয়ে নিজের উট কুরবানী করুন এবং ক্ষৌরকার ডেকে মাথা মুড়ে ফেলুন। তাহলে সবাই স্বতস্ফূর্তভাবে আপনাকে অনুসরণ করবে এবং বুঝবে, যে সিদ্ধান্ত হয়েছে তা পরিবর্তিত হওয়ার নয়। হলোও তাই। নবীকে (সা.) এরূপ করতে দেখে সবাই কুরবানী করলো, মাথা মুড়ে কিংবা চুল ছেঁটে নিল এবং ইহরাম থেকে বেরিয়ে আসলো। কিন্তু দু:খ ও মর্ম যাতনায় তাদের হৃদয় চৌচির হয়ে যাচ্ছিলো।

এরপর এ কাফেলা যখন হুদাইবিয়ার সন্ধিকে নিজেদের পরাজয় ও অপমান মনে করে মদীনার দিকে ফিরে যাচ্ছিলো তখন দাজনান ১ নামক স্থানে (অথবা কারো কারো মতে কুরাউল গামীম) এ সূরাটি নাযিল হয় যা মুসলমানদের জানিয়ে দেয় যে, এ সন্ধিচুক্তি যাকে তারা পরাজয় মনে করেছে তা প্রকৃতপক্ষে বিরাট বিজয়। এ সূরা নাযিল হওয়ার পর নবী (সা.) মুসলমানদের একত্রিত করে বললেন: আজ আমার ওপর এমন জিনিস নাযিল হয়েছে যা আমার জন্য দুনিয়া ও দুনিয়ার সবকিছুর চেয়েও বেশী মূল্যবান। তারপর তিনি এ সূরা তেলাওয়াত করলে এবং বিশেষভাবে হযরত উমরকে ডেকে তা শুনালেন। কেননা, তিনিই সবচেয়ে মনোকষ্ট পেয়েছিলেন।

১। মক্কা থেকে প্রায় ২৫ মাইল দূরবর্তী একটি স্থান।

ঈমানদারগণ যদিও আল্লাহ তা’আলার এ বাণী শুনেই সন্তুষ্ট ও পরিতৃপ্ত হয়েছিলেন। তবুও খুব বেশী সময় যেতে না যেতেই এ চুক্তির সুফলসমূহ এক এক করে প্রকাশ পেতে থাকলো এবং এ চুক্তি যে সত্যিই একটা বিরাট বিজয় সে ব্যাপারে আর কারো মনে কোন সন্দেহ থাকলো না।

এক: এ চুক্তির মাধ্যমে আরবে প্রথমবারের মতে ইসলামী রাষ্ট্রের অস্তিত্ব মেনে নেয়া হলো। এর পূর্ব পর্যন্ত আরবদের দৃষ্টিতে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তাঁর সংগী-সাথীদের মর্যাদা ছিল শুধু কুরাইশ ও আরব গোত্রসমূহের বিরুদ্ধে বিদ্রোহকারী একটি গোষ্ঠী হিসেবে তারা তাদের সমাজচ্যুত (Out law) বলেই মনে করতো। এখন তাঁর সাথে চুক্তি সম্পদানের মাধ্যমে কুরাইশরা নিজেরাই ইসলামী রাষ্ট্রের অধিকারভুক্ত এলাকার ওপর তার ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব মেনে নিল এবং দুটি রাজনৈতিক শক্তির যারা সাথে ইচ্ছা মৈত্রী চুক্তিতে আবদ্ধ হওয়ার পথ খুলে দিল।

দুই: কুরাইশরা এ যাবত ইসলামকে ধর্মহীনতা বলে আখ্যায়িত করে আসছিলো। কিন্তু মুসলমানদের জন্য বায়তুল্লাহর যিয়ারতের অধিকার মেনে নিয়ে তারা আপনা থেকেই যেন একথাও মেনে নিল যে, ইসলাম কোন ধর্মহীনতা নয়, বরং আরবে স্বীকৃতি ধর্মসমূহের একটি এবং অন্যান্য আরবদের মত এ ধর্মের অনুসারীরাও হজ্ব ও উমরার অনুষ্ঠানসমূহ পালনের অধিকার রাখে। কুরাইশদের অপপ্রচারের ফলে আরবের মানুষের মনে ইসলামের বিরুদ্ধে যে ঘৃণার সৃষ্টি হয়েছিলো এতে সে ঘৃণাও অনেকটা হ্রাস পেল।

তিন: দশ বছরের জন্য যুদ্ধ বিরতি চুক্তি হওয়ার ফলে মুসলমানগণ নিরাপত্তা ও শান্তিলাভ করলেন এবং গোটা আরবের আনাচে কানাচে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে এত দ্রুত ইসলামের প্রচার চালালেন যে, হুদাইবিয়ার সন্ধি পরবর্তী দু’বছর লোক মুসলমান হলো সন্ধি পূর্ববর্তী পুরো ১৯ বছরেও তা হয়নি। সন্ধির সময় যেখানে নবীর (সা.) সাথে মাত্র ১৪ শত লোক ছিলেন। সেখানে মাত্র দুই বছর পরেই কুরাইশদের চুক্তিভংগের ফলে নবী (সা.) যখন মক্কায় অভিযান চালান তখন দশ হাজার সৈনিকের এক বিশাল বাহিনী তাঁর সাথে ছিল। এটা ছিল হুদাইবিয়ার সন্ধির সুফল।

চার: কুরাইশদের পক্ষে থেকে যুদ্ধ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর অধিকারভুক্ত এলাকায় ইসলামী সরকারকে সুদৃঢ় করার এবং ইসলামী আইন-কানুন চালু করে মুসলিম সমাজকে একটি পূর্ণাঙ্গ সভ্যতা ও সংস্কৃতি হিসেবে দাঁড় করানোর সুযোগ লাভ করেন। এটিই সেই মহান নিয়ামত যে সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা সূর মায়েদার ৩ আয়াতে বলছেন: “আজ আমি তোমাদের দ্বীনকে তোমাদের জন্য পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম, তোমাদের জন্য আমার নিয়ামতকে পরিপূর্ণ করলাম এবং তোমাদের দ্বীন হিসেবে ইসলামকে গ্রহণ করলাম। “(ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, সূরা মায়েদার ভূমিকা এবং টীকা ১৫, ।

পাঁচ: কুরাইশদের সাথে সন্ধি হয়ে যাওয়ার পর দক্ষিণ দিক থেকে শান্তি লাভের এ সুফলও পাওয়া গেল যে, মুসলমানগণ উত্তর ও মধ্য আরবের সমস্ত বিরোধী শক্তিকে অতি সহজেই বশীভূত করে নেয়। হুদাইবিয়ার সন্ধির মাত্র তিন মাস পরেই ইহুদীদের সবচেয়ে বড় দুর্গ খায়বার বিজিত হয় এবং তারপর ফাদাক, ওয়াদিউল কুরা, তায়ামা ও তাবুকের মত ইহুদী জনপদেও একের পর এক মুসলমানদের কর্তৃত্বধীনে চলে আসে। তারপর মধ্য আরবের যেসন গোত্র ইহুদী ও কুরাইশদের সাথে গাঁটছড়া বেঁধেছিলো তার সবগুলোই এক এক করে মুসলমানদের শাসনাধীন হয়ে পড়ে। হুদাইবিয়ার সন্ধি এভাবে মাত্র দু’বছরের মধ্যে আরবে শক্তির ভারসাম্য এতটা পাল্টে দেয় যে, কুরাইশ এবং মুশরিকদের শক্তি অবদমিত হয়ে পড়ে এবং ইসলামের বিজয় নিশ্চিত হয়ে যায়।

যে সন্ধিচুক্তিকে মুসলমানগণ তাদের ব্যর্থতা আর কুরাইশরা তাদের সফলতা মনে করেছিলো সে সন্ধিচুক্তি থেকেই তারা এসব সুফল ও কল্যাণ লাভ করে। এ সন্ধিচুক্তির যে বিষয়টি মুসলমানদের কাছে সবচেয়ে বেশী অপছন্দনীয় ছিল এবং কুরাইশরা তাদের বড় বিজয় বলে মনে করেছিলো তা হচ্ছে, মক্কা থেকে পালিয়ে মদীনায় আশ্রয় গ্রহণকারীদের ফিরিয়ে দেয়া হবে কিন্তু মদ্বীন থেকে পালিয়ে মক্কায় গমনকারীদের ফিরিয়ে দেয়া হবে না। কিন্তু অল্প কিছুদিন যেতে না যেতেই এ ব্যাপারটিও কুরাইশদের স্বার্থের পরিপন্থী হয়ে দাঁড়ালো এবং অভিজ্ঞতার আলোকে জানা গেল যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুদূরপ্রসারী দৃষ্টি কি কি সুফল দেখে এ শর্তটি মেনে নিয়েছিল। সন্ধির কিছুদিন পরেই মক্কার একজন মুসলমান আবু বাসীর কুরাইশদের বন্দীত্ব থেকে পালিয়ে মদীনায় চলে আসেন। কুরাইশরা তাকে ফেরত দেয়ার দাবি জানালো এবং নবীও (সা.) চুক্তি অনুযায়ী মক্কা থেকে যারা তাকে বন্দী করে নিয়ে যেতে এসেছিলো তাদের কাছে হস্তান্তর করলেন। কিন্তু মক্কা যাওয়ার পথে সে আবার তাদের বন্দীত্ব থেকে নিজেকে মুক্ত করে এবং লোহিত সাগরের যে পথ ধরে কুরাইশদের বাণিজ্য বহর যাতায়াত করতো সে পথের একটি স্থানে গিয়ে আশ্রয় নেয়। এরপর থেকে যে মুসলমানই কুরাইশদের বন্দিত্ব থেকে নিজেকে মুক্ত করার সুযোগ করতে পারতো সে-ই মদীনায় যাওয়ার পরিবর্তে আবু বাসীরের আশ্রয়ে চলে যেত। এভাবে সেখানে ৭০ জনের সমাবেশ ঘটে এবং তারা কুরাইশদের কাফেলার ওপর বারবার অতর্কিতে আক্রমণ চালিয়ে তাদের অবস্থা শোচনীয় করে তোলে। অবশেষে তাদেরকে মদীনায় নিয়ে যাওয়ার জন্য কুরাইশরা নিজেরাই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে আহবান জানায়। এভাবে হুদায়বিয়ার চুক্তির ঐ শর্তটি আপনা থেকেই রহিত হয়ে যায়।

এ ঐতিহাসিক পটভূমি সামনে রেখে সূরাটি অধ্যায়ন করলে তা ভালভাবে বোধগম্য হতে পারে।
# হুদাইবিয়ার সন্ধির পরে বিজয়ের এ সুসংবাদ শুনানো হলে লোকজন বিস্মিত হলো এই ভেবে যে, এ সন্ধিকে বিজয় বলা যায় কি করে? ঈমানের ভিত্তিতে আল্লাহর নির্দেশ মেনে নেয়া ভিন্ন কথা। কিন্তু তাকে বিজয় বলাটা করোরই বোধগম্য হচ্ছিলো না। এ আয়াতটি শুনে হযরত উমর (রা.) জিজ্ঞেস করলেনঃ হে আল্লাহর রসূল, এটা কি বিজয়? নবী (সা.) বললেনঃ হাঁ (ইবনে জারীর)। অন্য একজন সাহাবীও নবীর ﷺ কাছে এসে একই প্রশ্ন করলে তিনি বললেনঃ إِى وَالَّذِى نَفْسُ مُحَمَّدٍ بِيَدِهِ إِنَّهُ لَفَتْحٌ সেই মহান সত্তার শপথ যার হাতে মুহাম্মাদের ﷺ প্রাণ, এটা অবশ্যই বিজয়। (মুসনাদে আহমাদ, আবু দাউদ) মদীনায় ফেরার পর আরো এক ব্যক্তি তার সঙ্গীকে বললো, “এটা কেমন বিজয়? বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করতে আমাদের বাধা দেয়া হয়েছে, আমাদের কুরবানীর উটগুলোও আর সামনে অগ্রসর হতে পারেনি, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হুদাইবিয়াতেই থামতে হয়েছে এবং এ সন্ধির ফলেই আমাদের দু’মজলুম ভাই আবু জানদাল ও আবু বাসীরকে জালেমদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে। “একথাটি নবী (সা.) এর কাছে পৌঁছলে তিনি বললেনঃ এটা অত্যন্ত ভুল কথা। প্রকৃতপক্ষে এটা বিরাট বিজয়। তোমরা একেবারে মুশরিকদের বাড়ীর দরজায় গিয়ে হাজির হয়েছিলে এবং তারা আগামী বছর উমরা করতে দেয়ার প্রস্তাব দিয়ে তোমাদের ফিরে যেতে সম্মত করেছিল। যুদ্ধ বন্ধ করা এবং সন্ধি করার জন্য তারা নিজেরাই ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। অথচ তাদের মনে তোমাদের প্রতি যে শত্রুতা রয়েছে তা অজানা নয়। আল্লাহ‌ তা’আলা তোমাদেরকে তাদের ওপর বিজয় দান করেছেন। সেদিনের কথা কি ভুলে গেলে উহুদে যেদিন তোমরা ছুটে পালাচ্ছিলে আর আমি পশ্চাত দিক থেকে চিৎকার করে তোমাদের ডাকছিলাম? সেদিনের কথা কি ভুলে গেলে যেদিন আহযাবের যুদ্ধে শত্রুরা সব দিক থেকে চড়াও হয়েছিল এবং তোমাদের শ্বাসরুদ্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল? (বায়হাকীতে উরওয়া ইবনে যুবায়ের বর্ণনা) কিন্তু এ সন্ধি যে প্রকৃতই বিজয় তা কিছুদিন যেতে না যেতেই প্রকাশ পেতে থাকলো এবং সব শ্রেণীর মানুষের কাছে একথা পুরোপুরি স্পষ্ট হয়ে গেল যে, প্রকৃতপক্ষে হুদাইবিয়ার সন্ধি থেকেই ইসলামের বিজয়ের সূচনা হয়েছিলো। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ, হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ এবং হযরত বারা ইবনে আযেব এ তিন সাহাবী থেকে প্রায় একই অর্থে একটি কথা বর্ণিত হয়েছে যে, লোকেরা মক্কা বিজয়েকেই প্রকৃত বিজয় বলে থাকে। কিন্তু আমরা হুদাইবিয়ার সন্ধিকেই প্রকৃত বিজয় মনে করি। (বুখারী, মুসলিম, মুসনাদে আহমাদ, ইবনে জারীর)।
# যে পরিবেশ পরিস্থিতিতে একথাটি বলা হয়েছে তা মনে রাখলে স্পষ্ট বুঝা যায়, ইসলামের সাফল্য ও বিজয়ের জন্য রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নেতৃত্বে মুসলমানগণ বিগত ১৯ বছর ধরে যে চেষ্টা-সাধনা করে আসছিলেন তার মধ্যে যেসব ত্রুটি-বিচ্যুতি ও দুর্বলতা রয়ে গিয়েছিলো এখানে সেসব ত্রুটি-বিচ্যুতি ও দুর্বলতা ক্ষমা করার কথা বলা হয়েছে। এসব ত্রুটি-বিচ্যুতি কি তা কোন মানুষের জানা নেই। বরং মানবীয় বিবেক-বুদ্ধি এ চেষ্টা-সাধনার মধ্যে কোন ত্রুটি ও অপক্কতা খুঁজে পেতে একেবারেই অক্ষম। কিন্তু আল্লাহ‌ তা’আলার দৃষ্টিতে পূর্ণতার যে অতি উচ্চ মানদণ্ড রয়েছে তার বিচারে ঐ চেষ্টা সাধনার মধ্যে এমন কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি ছিল যার কারণে মুসলমানগণ আরবের মুশরিকদের বিরুদ্ধে এত দ্রুত চূড়ান্ত বিজয় লাভ করতে পারতেন না। আল্লাহ‌ তা’আলার বাণীর তাৎপর্য হচ্ছে, তোমরা যদি ঐ সব ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়ে চেষ্টা সাধনা করতে তাহলে আরব বিজিত হতে আরো দীর্ঘ সময় দরকার হতো। কিন্তু এসব দুর্বলতা ও ত্রুটি-বিচ্যুতি ক্ষমা করে কেবল নিজের মেহেরবানী দ্বারা আমি তোমাদের অপূর্ণতা দূর করেছি এবং হুদাইবিয়া নামক স্থানে তোমাদের জন্য সে বিজয় ও সফলতার দ্বার উন্মক্ত করে দিয়েছি যা স্বাভাবিকভাবে তোমাদের প্রচেষ্টা দ্বারা অর্জিত হতো না।

এখানে একথাটিও ভালভাবে উপলব্ধি করা দরকার যে, কোন লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য যে দল চেষ্টা-সাধনা চালাচ্ছে তার ত্রুটি-বিচ্যুতির জন্য সে দলের নেতাকে সম্বোধন করা হয়। তার অর্থ এ নয় যে, ঐ সব ত্রুটি ও দুর্বলতা উক্ত নেতার ব্যক্তিগত ত্রুটি ও দুর্বলতা। গোটা দল সম্মিলিত ভাবে যে চেষ্টা-সাধনা চালায় ঐ সব ত্রুটি ও দুর্বলতা সে দলের সম্মিলিত চেষ্টা-সাধনার। কিন্তু নেতাকে সম্বোধন করে বলা হয়, আপনার কাজে এসব ত্রুটি-বিচ্যুতি বর্তমান।

তা সত্ত্বেও যেহেতু রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সম্বোধন করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে যে, আল্লাহ‌ তা’আলা তাঁর পূর্বপর সব ত্রুটি-বিচ্যুতি ক্ষমা করে দিয়েছেন, তাই সাধারণভাবে এ শব্দগুলো থেকে এ বিষয়টিও বুঝা যায় যে, আল্লাহর কাছে তাঁর রসূলের সমস্ত ত্রুটি-বিচ্যুতি (যা কেবল তাঁর উচ্চ মর্যাদার বিচারে ত্রুটি-বিচ্যুতি ছিল) ক্ষমা করে দেয়া হয়েছিল। এ কারণে সাহাবায়ে কিরামের যখন নবীকে ﷺ ইবাদাতের ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক রকমের কষ্ট করতে দেখতেন তখন বলতেন, আপনার পূর্বাপর সমস্ত ত্রুটি-বিচ্যুতি তো ক্ষমা করা হয়েছে। তারপরও আপনি এত কষ্ট করেন কেন? জবাবে নবী (সা.) বলতেনঃ) أَفَلاَ أَكُونُ عَبْدًا شَكُورًا “আমি কি কৃতজ্ঞ বান্দাও হবো না? ” (আহমাদ, বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ)।
# নিয়ামতকে পূর্ণতা দানের অর্থ হচ্ছে মুসলমানরা স্বস্থানে সব রকম ভয়-ভীতি, বাধা-বিপত্তি এবং বাইরের সব রকম হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত থেকে পুরোপুরি ইসলামী সভ্যতা, সংস্কৃতি ও ইসলামী আইন-কানুন অনুসারে জীবন যাপনের স্বাধীনতা ভোগ করবে এবং পৃথিবীতে আল্লাহর বিধানকে উঁচু করে তুলে ধরার শক্তি লাভ করবে। কূফর ও পাপাচারের আধিপত্য যা আল্লাহর দাসত্বের পথে বাধা এবং আল্লাহর বিধানকে সমুন্নত করার প্রচেষ্টায় প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায় তা ঈমানদারদের জন্য সবচেয়ে বড় বিপদ। কুরআন এ বিপদকেই ফিতনা বলে আখ্যায়িত করে। এ ফিতনা থেকে মুক্তি পেয়ে যখন তারা এমন একটি শান্তি ও আবাস লাভ করে যেখানে আল্লাহর দ্বীন পূর্ণরূপে হুবহু বাস্তবায়িত হতে পারে এবং সাথে সাথে এমন উপায়-উপকরণও লাভ করে যার দ্বারা আল্লাহর যমীনে কুফর ও পাপাচারের স্থানে ঈমান ও তাকওয়ার শাসন চালু করতে পারে তখন তা হয় তাদের জন্য আল্লাহর নিয়ামতের পরিপূর্ণতা দান। মুসলমানরা যেহেতু রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মাধ্যমেই আল্লাহর এ নিয়ামত লাভ করেছিলো, তাই আল্লাহ‌ তা’আলা নবীকে ﷺ সম্বোধন করেই বলছেনঃ আমি তোমার জন্য আমার নিয়ামতকে পরিপূর্ণতা দান করতে চাচ্ছিলাম, আর সে জন্যই তোমাকে এই বিজয় দান করেছি।
# রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সোজা পথ দেখানোর অর্থ এখানে তাঁকে বিজয় ও সাফল্যের পথ দেখানো। অন্য কথায় এর অর্থ হচ্ছে, আল্লাহ‌ তা’আলা হুদাইবিয়া নামক স্থানে সন্ধিচুক্তি করিয়ে নবীকে ﷺ ইসলামের বিরুদ্ধে বাধাদানকারী শক্তিসমূহকে পরাভূত করার পথ সহজ করে দিয়েছেন এবং সেজন্য কৌশল শিখিয়ে দিয়েছেন।
# আরেকটি অনুবাদ এও হতে পারে যে, “তোমাকে অভূতপূর্ব বা বিরল সাহায্য দান করেছেন।” মূল আয়াতে نَصْرًا عَزِيزًا ব্যবহৃত হয়েছে। عَزِيزًا শব্দের অর্থ যেমন পরাক্রমশালী তেমনি নজীরবিহীন অতুলনীয় এবং বিরলও। প্রথম অর্থের বিচারে এ আয়াতাংশের তাৎপর্য হচ্ছে, এ সন্ধির মাধ্যমে আল্লাহ‌ তা’আলা নবীকে ﷺ যে সাহায্য করেছেন তার কারণে তাঁর শত্রুরা অক্ষম হয়ে পড়বে। দ্বিতীয় অর্থটির বিচারে এর তাৎপর্য হচ্ছে, মানুষ বাহ্যত যে জিনিসটিকে শুধু একটি সন্ধিচুক্তি হিসেবে দেখছিলো-তাও আবার অবদমিত হয়ে মেনে নেয়া সন্ধি-তা-ই একটি চূড়ান্ত বিজয়ে রূপান্তরিত হবে, কাউকে সাহায্য করার এমন অদ্ভুত পন্থা খুব কমই গ্রহণ করা হয়েছে।

سكِينَةَ আরবী ভাষায় স্থিরত#
প্রশান্তি ও দৃঢ় চিত্ততাকে বুঝায়। এখানে আল্লাহ‌ তা’আলা মু’মিনদের অন্তরে তা নাযিল করাকে হুদাইবিয়ায় ইসলাম ও মুসলমানগণ যে বিজয় লাভ করেছিলো তার গুরুত্ব পূর্ণ কারণ বলে আখ্যায়িত করেছেন। সে সময়ের পরিস্থিতি সম্পর্কে সামান্য চিন্তা-ভাবনা করলেই বুঝা যায় তা কি ধরনের প্রশান্তি ছিল যা ঐ পুরো সময়টা ধরেই মুসলমানদের হৃদয় মনে অবতীর্ণ করা হয়েছিল আর কিভাবে তা এ বিজয়ের কারণ হয়েছিল। যে সময় রসূলুল্লাহ ﷺ উমরা আদায়ের জন্য মক্কা শরীফ যাওয়ার সংকল্প প্রকাশ করেছিলেন মুসলমানগণ যদি সে সময় ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়তেন এবং মুনাফিকদের মত মনে করতেন যে এতো স্পষ্টত মৃত্যুর মুখের মধ্যে চলে যাওয়া কিংবা পথে যখন খবর পাওয়া গেল কাফের কুরাইশরা যুদ্ধ করতে সংকল্প করেছে তখন যদি মুসলমানরা হতবুদ্ধি ও অস্থির হয়ে পড়তেন যে, যুদ্ধের সাজসরঞ্জাম ছাড়াই কিভাবে আমরা শত্রুর মোকাবিলা করবো আর এ কারণে তাদের মধ্যে বিশৃংখলার সৃষ্টি হতো তাহলে হুদাবিয়াতে যে ফলাফল অর্জিত হয়েছিল তা কখনো অর্জিত হতো না। তাছাড়া কাফেররা হুদায়িবিয়ায় যখন মুসলমানদের আক্রমণ হতে বাধা দিয়েছিল, যখন আকস্মিক হামলা চালিয়ে এবং রাতের অন্ধাকারে আক্রমণ করে করে উত্তেজিত করার চেষ্টা করেছিল, যখন হযরত উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহুর শাহাদাত লাভের খবর পাওয়া গিয়েছিল, যখন আবু জানদাল অত্যাচারিতের মূর্ত ছবি হয়ে মুসলমানদের জনসমাবেশের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলেন তখন যদি মুসলমানগণ উত্তেজিত হয়ে রসূল্লাল্লাহ ﷺ যে শৃংখলা ও সংযম প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন তা নষ্ট করতেন তাহলে সবকিছুই ভুন্ডল হয়ে যেতো। সবচেয়ে বড় কথা হলো, মুসলমানদের গোটা সংগঠনের কাছে সন্ধিচুক্তির যেসব শর্ত অত্যন্ত অপছন্দনীয় ছিল রসূলুল্লাহ ﷺ যখন তা মেনে নিয়েই চুক্তি সম্পাদন করতে যাচ্ছিলেন তখন যদি সাহাবীগণ নবীর ﷺ নির্দেশ অমান্য করে বসতেন তাহলে হুদাইবিয়ার এ বিরাট বিজয় বিরাট পরাজয়ে রূপান্তরিত হতো। এসব নাজুক মুহূর্তে রসূলের নেতৃত্ব ও পথপ্রদর্শন সম্পর্কে, ইসলামের সত্যতা সম্পর্কে এবং নিজেদের আদর্শিক কর্ম-তৎপরতার ন্যায় ও সত্য হওয়া সম্পর্কে মুসলমানদের মনে যে পূর্ণ আস্থা ও প্রশান্তি ছিল তা সরাসরি আল্লাহর মেহেরবানী। এ কারণে তারা ধীরে স্থীর মনে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল যে, আল্লাহর পথে চলতে গিয়ে যাই ঘটুক না কেন তা সবই শিরধার্য। এ করণে তারা ভয়-ভীতি, অস্থিরতা, উস্কানী এবং নৈরাশ্য সবকিছু থেকে মুক্ত ছিলেন। এর কল্যাণেই তাঁদের শিবিরে পূর্ণ শৃংখলা ও সংযম বজায় ছিল এবং সন্ধির শর্তসমূহ সম্পর্কে অত্যন্ত অবনত মস্তকে মেনে নিয়েছিলেন। এটাই সেই প্রশান্তি যা আল্লাহ‌ তা’আলা মু’মিনদের মনে নাযিল করেছিলেন। এর কারণেই উমরা আদায়ের সেই বিপদসংকুল উদ্যোগটি সর্বোত্তম সাফল্যের কারণ হয়ে দেখা দিয়েছিল।
# তাদের যে ঈমান এ অভিযানের পূর্বে ছিল, তার সাথে আরো ঈমান তারা অর্জন করলো এ কারণে যে, এ অভিযান চলাকালে একের পর এক যত পরীক্ষা এসেছে তার প্রত্যেকটিতে তারা নিষ্ঠা, তাকওয়া ও আনুগত্যের নীতির ওপর দৃঢ়পদ থেকেছে। যেসব আয়াত থেকে বুঝা যায় ঈমান কোন স্থির, জড় ও অপরিবর্তনীয় অবস্থার নাম নয়। বরং ঈমান হ্রাস বৃদ্ধি ও ওঠানামা আছে, এ আয়াতটি তার একটি। ইসলাম গ্রহণের পর থেকে মু’মিনদের জীবনের পদে পদে এমন সব পরীক্ষা আসে যখন তাকে এ সিদ্ধান্তকর প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় যে, আল্লাহর দ্বীনের জন্য সে তার জান-মাল আবেগ-অনুভূতি, আশা-আকাংখা, সময়, আরাম আয়েশ এবং স্বার্থ কুরবানী করতে প্রস্তুত আছে কিনা। এরূপ প্রতিটি পরিক্ষার সময় যদি সে কুরবানী ও ত্যাগের পথ অনুসরণ করে তাহলে তার ঈমান উন্নতিও সমৃদ্ধিলাভ করে। আর যদি মুখ ফিরিয়ে নেয় তাহলে তার ঈমান থমকে দাঁড়ায়। শেষ পর্যন্ত এমন এক সময়ও আসে যখন তার ঈমানের প্রাথমিক ও পুঁজিও সংকটাপন্ন হয়ে পড়ে, যা নিয়ে সে ইসলামের গণ্ডিতে প্রবেশ করেছিল। (আরো ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, সূরা আনফাল, টীকা ২ ; আল আহযাব, টীকা ৩৮ )।
# আল্লাহর কাছে এমন বাহিনী আছে, যার সাহায্যে তিনি যখন ইচ্ছা কাফেরদের ধ্বংস করে দিতে পারেন। কিন্তু বিশেষ উদ্দেশ্যের পরিপ্রেক্ষিতে ইচ্ছা করেই তিনি ঈমানদারদের ওপর এ দায়িত্ব অর্পণ করেছেন যাতে তারা কাফেরদের বিরুদ্ধে চেষ্টা-সাধনা ও দ্বন্দ্ব-সংঘাতে লিপ্ত হয়ে আল্লাহর দ্বীনকে সমুন্নত করেন। এ কাজের দ্বারাই তাদের মর্যাদা উন্নত এবং আখোতের সাফল্যের দ্বার উন্মুক্ত হয়। পরের আয়াত এ কথারই প্রতিধ্বনি করছে।
# কুরআন মজীদে সাধারণত ঈমানদারদের পুরস্কারের উল্লেখ সামষ্টিকভাবে করা হয়ে থাকে। নারীও পুরুষের কথা স্বতন্ত্রভাবে উল্লেখ করা হয় না। কিন্তু এখানে একত্রে উল্লেখ করলে যেহেতু এরূপ ধারণা সৃষ্টি হতে পারতো যে, এ পুরস্কার হয়তো শুধু পুরুষদের জন্যই। তাই আল্লাহ‌ তা’আলা মু’মিন নারীদের সম্পর্কে স্বতন্ত্রভাবে স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, তারাও মু’মিন পুরুষদের সাথে এ পুরস্কারে সমভাবে অংশীদার। এর কারণ স্পষ্ট। যেসব দ্বীনদার ও আল্লাহভীরু মহিলা তাদের স্বামী, পুত্র, ভাই ও পিতাকে এ বিপজ্জনক সফরে যেতে বাধা দেয়া এবং মাতম ও বিলাপ করে নিরুৎসাহিত করার পরিবর্তে সাহস যুগিয়েছেন, যারা তাদের অনুপস্থিতিতে তাদের বাড়ীঘর ও সন্তান-সন্তুতি, তাদের সহায়-সম্পদ, তাদের সম্ভ্রম এবং তাদের সন্তানদের সংরক্ষক হয়ে এ ব্যাপারে তাদেরকে দুশ্চিন্তা মুক্ত রেখেছেন। একযোগ চৌদ্দশ সাহাবীর চলে যাওয়ার পর আশেপাশের কাফের ও মুনাফিকরা শহরের ওপর আক্রমণ করে না বসে এ আশঙ্কায় যারা কান্নাকাটি ও চিৎকার শুরু করে দেয়নি তারা বাড়ীতে অবস্থান করা সত্ত্বেও সওয়াব ও পুরস্কারের ক্ষেত্রে তারা যে তাদের পুরুষদের সাথে সমান অংশীদার হবেন-এটাই স্বাভাবিক।
# মানবিক দূর্বলতার কারণে যে ত্রুটি-বিচ্যুতিই তাদের দ্বারা হয়েছে তা মাফ করে দেবেন, জান্নাতে প্রবেশের পূর্বেই ঐ সব ত্রুটি-বিচ্যুতির সব রকম প্রভাব থেকে তাদের পবিত্র করবেন এবং এমনভাবে তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে যে, তাদের দেহে কোন কালিমা থাকবে না যার কারণে সেখানে তাদেরকে লজ্জিত হতে হবে।
# এ যাত্রায় মদীনার আশেপাশের মুনাফিকদের ধারণা ছিল যে, রসূলুল্লাহ ﷺ এবং তাঁর সাহাবীগণ এ সফর থেকে জীবিত ফিরে আসতে পারবেন না। পরবর্তী ১২ আয়াতে একথাটিই বর্ণিত হয়েছে। তাছাড়া মক্কার মুশরিক এবং তাদের সহযোগী কাফেররা মনে করেছিল যে, রসূলুল্লাহ ﷺ এবং তাঁর সঙ্গীগণকে উমরা আদায় করা থেকে বিরত রেখে তারা তাঁকে পরাজিত ও অপমানিত করতে সক্ষম হয়েছে। ঐ দু’টি গোষ্ঠীর এসব চিন্তার মূলে প্রকৃতপক্ষে যে জিনিসটি কার্যকর ছিল তাহলো আল্লাহ‌ সম্পর্কে তাদের এই কুধারণা যে, তিনি তাঁর নবীকে সাহায্য করবেন না এবং হক ও বাতিলের এ সংঘাতে হকের আওয়াজকে অবদমিত করার অবাধ সুযোগ দেবেন।
# যে মন্দ পরিণাম থেকে তারা রক্ষা পেতে চাচ্ছিল এবং যা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তারা এসব কৌশল অবলম্বন করেছিল তারা নিজেরাই সে ফাঁদে আটকা পড়েছে। তাদের সেসব কৌশলই তাদের মন্দ পরিণাম ত্বরান্বিত করার কারণ হয়েছে।
# এ কথাটিকে এখানে আরেকটি উদ্দেশ্যে পুনরায় উল্লেখ করা হয়েছে। ৪ নম্বর আয়াতে কথাটি যে উদ্দেশ্যে বলা হয়েছিল তা হচ্ছে, কাফেরদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য আল্লাহ‌ তা’আলা তাঁর অতি প্রাকৃতিক বাহিনীকে কাজে লাগানোর পরিবর্তে মু’মিনদের দ্বারাই তা করিয়েছেন। কারণ, তিনি মু’মিনদের পুরস্কৃত করতে চাচ্ছিলেন। আর এখানে এ বিষয়টিকে পুনরায় বর্ণনা করেছেন এ জন্য যে, আল্লাহ‌ যাকে শাস্তি দিতে চান তার মূলোৎপাটনের জন্য তিনি নিজের সৈন্যবাহীনির মধ্য থেকে যাকে ইচ্ছা ব্যবহার করতে পারেন। কারো এ ক্ষমতা নেই যে, নিজের কৌশল ও বুদ্ধিমত্তার জোরে তাঁর শাস্তি এড়িয়ে যেতে পারে।

তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
নামকরণ ও ফযীলত :

(الفتح) আল-ফাতহ অর্থ বিজয়, অত্র সূরার প্রথম আয়াতে “ফাতহ” শব্দটি উল্লেখ রয়েছে এখান থেকেই এ নামে সূরার নামকরণ করা হয়েছে। তাছাড়া এ সূরাতে মক্কা বিজয়ের পূর্বাভাসও দেয়া হয়েছে।

এ সূরাটি মদীনায় অবতীর্ণ। ইমাম কুরতুবী বলেন : মক্কা ও মদীনার মধ্যবর্তী জায়গায় হুদায়বিয়ার সন্ধিকে কেন্দ্র করেই রাতে অবতীর্ণ হয়েছে। উভয় মতের মাঝে কোন বৈপরিত্য নেই। কারণ হিজরত পরবর্তী সূরাগুলোকে মাদানী সূরা বলা হয়। (ফাতহুল কাদীর, অত্র সূরার তাফসীর)

আনাস (রাঃ) বলেন : যখন এ সূরা অবতীর্ণ হয় তখন সাহাবীরা চিন্তিত ও ভারাক্রান্ত অবস্থায় হুদায়বিয়া হতে প্রত্যাবর্তন করছিলেন। তারা হুদায়বিয়াতে কুরবানীর পশসমূহ জবাই করেছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন : আমার কাছে এমন একটি আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে যা সমস্ত দুনিয়া হতে উত্তম। (সহীহ মুসলিম হা. ১৭৮৬)

আবদুল্লাহ বিন মুগাফফাল (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মক্কা বিজয়ের দিন চলার পথে বাহনের ওপর এ সূরা পড়েছিলেন এবং বারবার পুনরাবৃত্তি করতে ছিলেন। (সহীহ বুখারী হা. ৫০৩৪)

জায়েদ বিন আসলাম (রাঃ) তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেন : রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একদা কোন এক সফরে গমন করছিলেন, সাথে উমার (রাঃ)-ও ছিলেন। উমার (রাঃ)-কোন বিষয়ে প্রশ্ন করলেন, কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জবাব দিলেন না। এভাবে তিনবার জিজ্ঞাসা করলেন কিন্তু কোন উত্তর দিলেন না। উমার (রাঃ) বললেন : উমারের মা ধ্বংস হয়ে গেছে, তিনবার রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে প্রশ্ন করলাম, তিনি কোন উত্তর দিলেন না। উমার (রাঃ) বললেন : আমার উটকে নড়াচড়া করে মানুষের সামনে চলে গেলাম। ভয় করলাম আমার ব্যাপারে কুরআন অবতীর্ণ হয়ে না যায়। একজন লোককে উঁচু আওয়াজে আমার ব্যাপারে বলতে শুনলাম। আমি আশঙ্কা করছি হয়তো আমার ব্যাপারে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে আসলাম এবং সালাম দিলাম। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন : আমার উপর এমন একটি সূরা অবতীর্ণ হয়েছে যা আমার কাছে অধিক প্রিয় তা হতে যাতে সূর্য উদিত হয় (পৃথিবী)। তারপর এ সূরা তিলাওয়াত করেন। (সহীহ বুখারী হা. ৪১৭৭)

ইমাম ইবনু কাসীর (রহঃ) বলেন : ষষ্ঠ হিজরীর যুলকাদাহ মাসে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন হুদায়বিয়া থেকে ফিরে আসেন তখন এ সূরাটি অবতীর্ণ হয়। তখন তিনি উমরা করার জন্য মাসজিদে হারামের উদ্দেশ্যে রওনা করেছিলেন। কিন্তু মুশরিকরা বাধা দেয়। (ইবনু কাসীর অত্র সূরার ১ নং আয়াতের তাফসীর)

অবতীর্ণের প্রেক্ষাপট : হাবীব ইবনু আবূ সাবিত (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন : আমি আবূ ওয়ায়িল (রাঃ)-এর কাছে কিছু জিজ্ঞাসা করার জন্য এলে তিনি বললেন : আমরা সিফফীনের ময়দানে ছিলাম। এমন সময় এক ব্যক্তি বললেন : তোমরা কি সে লোকদেরকে দেখতে পাচ্ছ না যাদেরকে আল্লাহ তা‘আলার কিতাবের দিকে আহ্বান করা হচ্ছে।

আলী (রাঃ) বললেন : হ্যাঁ, তখন সাহল ইবনু হুনাইফ (রাঃ) বললেন, প্রথমে তোমরা নিজেদের খবর নাও। হুদায়বিয়ার দিন অর্থাৎ নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এবং মক্কার মুশরিকদের মধ্যে যে সন্ধি হয়েছিল আমরা সেটা দেখেছি। যদি আমরা একে যুদ্ধ মনে করতাম তাহলে অবশ্যই আমরা যুদ্ধ করতাম। সেদিন উমার (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে এসে বলেছিলেন : আমরা কি হকের ওপর নেই, আর তারা কি বাতিলের ওপর নয়? আমাদের নিহত ব্যক্তিরা জান্নাতে, আর তাদের নিহত ব্যক্তিরা কি জাহান্নামে যাবে না? তিনি বললেন : হ্যাঁ। তখন উমার (রাঃ) বললেন : তাহলে কেন আমাদের দীনের ব্যাপারে অপমানজনক শর্তারোপ করা হবে এবং আমরা ফিরে যাব? অথচ আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে এ সন্ধির ব্যাপারে হুকুম করেননি। তখন নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন : হে খাত্তাবের পুত্র! আমি আল্লাহ তা‘আলার রাসূল। আল্লাহ তা‘আলা কখনো আমাকে ধ্বংস করবেন না। উমার রাগে মনে দুঃখ নিয়ে ফিরে গেলেন। তিনি ধৈর্য ধরতে পারলেন না। তারপর আবূ বকর (রাঃ)-এর কাছে গেলেন এবং বললেন : হে আবূ বকর! আমরা কি হকের ওপর নই এবং তারা কি বাতিলের ওপর নয়? তিনি বললেন : হে খাত্তাবের পুত্র! নিশ্চয়ই তিনি আল্লাহ তা‘আলার রাসূল! আল্লাহ তা‘আলা কখনো তাঁকে ধ্বংস করবেন না। এ সময় সূরা ফাতহ অবতীর্ণ হয়। (সহীহ বুখারী হা. ৪৮৪৪, সহীহ মুসলিম হা. ১৭৮৫)

১-৩ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

আয়াতে উল্লেখিত ‘‘ফাতহুম মুবীন” সুস্পষ্ট বিজয় দ্বারা উদ্দেশ্য হল হুদায়বিয়ার সন্ধি। কারণ এ সন্ধির ফলে মুসলিমরা সর্বত্র ইসলামের দাওয়াত ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়। ফলে আরবের অনেক গোত্র ইসলামের ছায়াতলে আসে। এটা আরও সুস্পষ্ট করে যে, হুদায়বিয়ার সন্ধিতে ১৪০০ জন্য সাহাবী অংশগ্রহণ করেন। দু বছর পর যখন মক্কা বিজয়ের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন তখন সাথে সাহাবী ছিল দশ হাজার।

এটাই প্রমাণ করেছেন : সন্ধিই ছিল সুস্পষ্ট বিজয় যার কারণে মুসলিমদের সংখ্যা ও শক্তিসামর্থ্য বৃদ্ধি পায়। তাই সুস্পষ্ট বিজয় দ্বারা মক্কা বিজয় উদ্দেশ্য নয়। যদিও কিছু কিছু আলেমগণ মক্কা বিজয়ের কথা বলেছেন। (আযওয়াউল বায়ান, অত্র আয়াতের তাফসীর) এটাই অধিকাংশ আলেমদের কথা। তাছাড়া হুদায়বিয়ার সন্ধিই পরবর্তীতে মক্কা বিজয়ের কারণে পরিণত হয়েছিল।

ইবনু মাসঊদ (রাঃ) ও অন্যান্যদের থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : তোমরা বিজয় বলতে মক্কা বিজয়কে বুঝে থাক, আর আমরা বিজয় বলতে হুদায়বিয়ার সন্ধিকে বুঝে থাকি।

জাবের (রাঃ) বলেন : আমরা বিজয় বলতে কেবল হুদায়বিয়ার দিনকে গণ্য করতাম। (ইবনু জারীর. ২৬/৯৪)

বারা বিন আজেব (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : তোমরা বিজয় বলতে মক্কা বিজয়কে বুঝে থাক। মক্কা বিজয় অবশ্য একটি বিজয়, কিন্তু আমরা হুদায়বিয়ার দিনের ‘বাইয়াতে রিদওয়ান’-কে বিজয় হিসেবে গণ্য করি। (সহীহ বুখারী হা. ৪১৫০)

আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হুদায়বিয়া হতে প্রত্যাবর্তনকালে

(لِيَغْفِرَ لَكَ اللّٰهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْۭبِكَ وَمَا تَأَخَّرَ)

আয়াত নাযিল হয়।

নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : আমার কাছে এমন একটি আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে যা আমার কাছে জমিনে যা কিছু আছে তার চেয়ে অধিক প্রিয়। অতঃপর নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাহাবীদের কাছে এ আয়াতটি তিলাওয়াত করেন। সাহাবীরা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে মুবারকবাদ জানালেন এবং বললেন : হে আল্লাহ তা‘আলার নাবী! এতো আপনার জন্য আমাদের জন্য কি? তখন

(لِيُدْخِلَ الْمُؤْمِنِيْنَ وَالْمُؤْمِنَاتِ جَنَّاتٍ تَجْرِيْ مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِيْنَ فِيْهَا وَيُكَفِّرَ عَنْهُمْ)

আয়াত নাযিল হয়। (সহীহ বুখারী হা. ৪১৭২)

(لِّيَغْفِرَ لَكَ اللّٰهُ)

‘যাতে আল্লাহ তোমার‎ আগের ও পরের ভুল-ক্রটি মাফ করেন’ অর্থাৎ আমি আপনাকে সুস্পষ্ট বিজয় দান করেছি যাতে বিজয় ও আপনার গুনাহ ক্ষমা দুটি একসাথে হয়। ফলে দুনিয়া ও পরকালের উভয় কল্যাণ আপনার হাসিল হবে যা আপনার চক্ষুকে শীতল করবে।

মুগীরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন : নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সালাত আদায় করতেন (রাতের তাহাজ্জুদ) এমনকি তার উভয় পা ফুলে যেত। বলা হল : আল্লাহ তা‘আলা আপনার পূর্বাপর সকল গুনাহ ক্ষমা করে দিয়েছেন। (তারপরেও এতো ইবাদত করেন কেন?) জবাবে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন : আমি কি আল্লাহ তা‘আলার কৃতজ্ঞ বান্দা হব না। (সহীহ বুখারী হা. ৪৮৩৬, সহীহ মুসলিম হা. ২৮১৯)

(وَيُتِمَّ نِعْمَتَهُ عَلَيْكَ)

অর্থাৎ দুনিয়া ও আখিরাতে তার নেয়ামতকে পূর্ণ করে দিতে চান।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. সূরা আল-ফাতহ অবতীর্ণের প্রেক্ষাপট জানলাম।
২. ফাতহুম মুবীন দ্বারা উদ্দেশ্য হুদায়বিয়ার সন্ধি, মক্কা বিজয় নয়।
৩. রাসূলের (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পূর্বাপর সকল অপরাধ ‎আল্লাহ তা‘আলা‎ ক্ষমা করে দিয়েছেন।
৪. আল্লাহ তা‘আলার প্রতি কৃতজ্ঞতাস্বরূপ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বেশি বেশি ইবাদত করতেন।
৪-৭ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

السَّكِينَةَ – শব্দের অর্থ : প্রশান্তি। ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন : এর অর্থ রহমত। কাতাদাহ (রহঃ) বলেন : তা ছিল হুদায়বিয়ার দিন সাহাবীদের অন্তরে প্রশান্তি অবতরণ যারা আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলের ডাকে সাড়া দিয়েছিল। ফলে ‎আল্লাহ তা‘আলা‎ তাদের ঈমানের সাথে আরও ঈমান বৃদ্ধি করে দেন।

বারা বিন আজেব (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর জনৈক সাহাবী কুরআন পড়ছিল। তার বাড়িতে ঘোড়া বাধা ছিল। হঠাৎ তা লাফাতে লাগল। সে সাহাবী বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে কোন কিছু দেখতে পেলেন না। তেলাওয়াতের সময় ঘোড়াটি লাফিয়েই যাচ্ছিল। পরদিন সকালে ঘটনাটি নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে জানালেন। নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন : এটা হল প্রশান্তি যা কুরআন তিলাওয়াত করার সময় অবতীর্ণ হয়ে থাকে। (সহীহ বুখারী হা. ৪৮৩৯, সহীহ মুসলিম হা. ৭৯৫)

(لِيَزْدَادُوا إِيمَانًا مَعَ إِيمَانِهِمْ)

‘যাতে তারা তাদের ঈমানের সাথে আরও ঈমান বাড়িয়ে নেয়’ অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা মু’মিনদের অন্তরে এ প্রশান্তি নাযিল করলেন যাতে এর দ্বারা তাদের ঈমানের সাথে আরও ঈমান বৃদ্ধি পায়। এ আয়াত প্রমাণ করে যে, ঈমান বাড়ে ও কমে।

অন্যত্র ‎আল্লাহ তা‘আলা‎ বলেন :

(إِنَّمَا الْمُؤْمِنُوْنَ الَّذِيْنَ إِذَا ذُكِرَ اللّٰهُ وَجِلَتْ قُلُوْبُهُمْ وَإِذَا تُلِيَتْ عَلَيْهِمْ اٰيٰتُه۫ زَادَتْهُمْ إِيْمَانًا وَّعَلٰي رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُوْنَ)

“মু’মিন তো তারাই যাদের হৃদয় কম্পিত হয় যখন আল্লাহকে স্মরণ করা হয় এবং যখন তাঁর আয়াত তাদের নিকট পাঠ করা হয়, তখন সেটা তাদের ঈমান বৃদ্ধি করে এবং তারা তাদের প্রতিপালকের ওপরই নির্ভর করে।” (সূরা আনফাল ৮ : ২)

এ সম্পর্কে সূরা আনফালের শুরুতেও আলোচনা করা হয়েছে।

(لِّيُدْخِلَ الْمُؤْمِنِيْنَ وَالْمُؤْمِنٰتِ جَنّٰتٍ)

অর্থাৎ এজন্যও মু’মিনদের অন্তরে এ প্রশান্তি নাযিল করেছেন যাতে এর মাধ্যমে তারা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারে এবং তাদের অপরাধসমূহও ক্ষমা করে দেয়া যায়।

(وَيُعَذِّبَ الْمُنَافِقِينَ وَالْمُنَافِقَاتِ)

‘আর আল্লাহ মুনাফিক নারী-পুরুষ ও মুশরিক নারী-পুরুষকে আযাব দেবেন’ অর্থাৎ মু’মিনদের অন্তরে প্রশান্তি নাযিল হলে যেমন তাদের ঈমান বৃদ্ধি পায়, ঠিক তার বিপরীত মুনাফিক ও কাফিরদের অন্তরে কুফরী বৃদ্ধি পায় ফলে তারা অর্š—জ্বালা ভোগ করে। এরূপ ‎আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন :

“আমি এ আমানত পেশ করেছিলাম আকাশসমূহ, পৃথিবী ও পাহাড়গুলোর নিকট, তারা তা বহন করতে অস্বীকার করল এবং তা গ্রহণ করতে ভয় পেল, কিন্তু মানুষ তা বহন করল; নিশ্চয়ই সে অতিশয় জালিম, বড়ই অজ্ঞ। যাতে আল্লাহ মুনাফিক্ব পুরুষ ও মুনাফিক্ব নারীকে এবং মুশরিক পুরুষ ও মুশরিক নারীকে শাস্তি দিতে পারেন, আর মু’মিন পুরুষ ও মু’মিন নারীকে ক্ষমা করতে পারেন। আল্লাহ অতিশয় ক্ষমাশীল, অত্যন্ত দয়ালু।” (সূরা আহযাব ৩৩ : ৭২-৭৩)

অর্থাৎ তাদের ধারণা ছিল আল্লাহ নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও সাহাবীদের কাউকে হুদায়বিয়া থেকে মদীনাতে ফেরত আনবে না। মুশরিকরা তাদেরকে মুলোৎপাটন করে ফেলবে। যেমন আল্লাহ তাদের ব্যাপারে সংবাদ দিয়ে বলেন :

(بَلْ ظَنَنْتُمْ أَنْ لَّنْ يَّنْقَلِبَ الرَّسُوْلُ وَالْمُؤْمِنُوْنَ إِلٰٓي أَهْلِيْهِمْ أَبَدًا)

“বরং তোমরা ধারণা করেছিলে যে, রাসূল ও মু’মিনগণ তাদের পরিবার-পরিজনের কাছে আর কখনো ফিরে আসতে পারবে না।”

(عَلَيْهِمْ دَا۬ئِرَةُ السَّوْءِ)

‘তাদের ওপর অকল্যাণের চক্র’ অর্থাৎ দুনিয়াতে হত্যা, বন্দি ও অপদস্তের মাধ্যমে আর পরকালে জাহান্নামের মাধ্যমে। সর্বোপরি আল্লাহ তা‘আলা তাদের জন্য প্রস্তুত করে রেখেছেন একের পর এক শাস্তি।

(وَلِلّٰهِ جُنُوْدُ السَّمٰوٰتِ وَالْأَرْضِ)

আকাশসমূহ ও জমিনের সকল বাহিনীসমূহ ‎আল্লাহ তা‘আলা‎র। অন্যত্র ‎আল্লাহ তা‘আলা‎ বলেন : তাঁর বাহিনীর সংখ্যা ও বৈশিষ্ট্য তিনি ছাড়া কেউ জানে না :

(وَمَا يَعْلَمُ جُنُوْدَ رَبِّكَ إِلَّا هُوَ ط وَمَا هِيَ إِلَّا ذِكْرٰي لِلْبَشَرِ)‏

“তোমার প্রতিপালকের বাহিনী সম্পর্কে একমাত্র তিনিই জানেন। (জাহান্নামের) এই বর্ণনা তো সমস্ত মানুষের জন্য নিছক উপদেশ।” (সূরা মুদ্দাসির ৭৪ : ৩১)

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. কুরআন তেলাওয়াতের ফযীলত অপরিসীম এবং তা সর্বোত্তম নফল ইবাদত।
২. সৎ আমল করলে ঈমান বাড়ে ও পাপ কাজ করলে ঈমান কমে।
৩. মু’মিনদের মর্যাদা, মুশরিক ও মুনাফিকদের দুর্ভোগ সম্পর্কে জানলাম।
৪. ‎আল্লাহ তা‘আলা‎র বাহিনী সম্পর্কে ‎আল্লাহ তা‘আলা‎ই ভাল জানেন।

তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে মুগাফফাল (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, মক্কা বিজয়ের বছর রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) সফরে পথ চলা অবস্থায় স্বীয় উষ্ট্রীর উপরই সূরায়ে ফাহ্ তিলাওয়াত করেন এবং বার বার ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পড়তে থাকেন। বর্ণনাকারী হযরত মুআবিয়া ইবনে কুররা (রাঃ) বলেনঃ “লোকদের একত্রিত হয়ে যাওয়ার আশংকা করলে আমি রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর তিলাওয়াতের মত তিলাওয়াত করেই তোমাদেরকে শুনিয়ে দিতাম।” (এ হাদীসটি ইমাম বুখারী (রঃ), ইমাম মুসলিম (রঃ) এবং ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

১-৩ নং আয়াতের তাফসীর:

ষষ্ঠ হিজরীর যুলকা’দাহ্ মাসে রাসূলুল্লাহ (সঃ) উমরা আদায় করার উদ্দেশ্যে মদীনা হতে মক্কার পথে যাত্রা শুরু করেন। কিন্তু মক্কার মুশরিকরা তাঁর পথে বাধা সৃষ্টি করে এবং মসজিদুল হারামের যিয়ারতের ব্যাপারে প্রতিবন্ধক হয়ে যায়। অতঃপর তারা সন্ধির প্রস্তাব করে এবং রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-কে অনুরোধ করে যে, তিনি যেন ঐ বছর ফিরে যান এবং আগামী বছর উমরা করার জন্যে মক্কায় প্রবেশ করেন। রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-ও তাদের এ প্রস্তাবে সম্মত হয়ে যান এবং তাদের সাথে সন্ধি করে নেন। সাহাবীদের (রাঃ) একটি বড় দল এ সন্ধিকে পছন্দ করেননি, যাঁদের মধ্যে হযরত উমার (রাঃ)-ও একজন ছিলেন। রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) সেখানেই স্বীয় জন্তুগুলো কুরবানী করেন। অতঃপর মদীনায় ফিরে আসেন। এর ঘটনা এখনই এই সূরারই তাফসীরে আসবে ইন্শাআল্লাহ।

মদীনায় ফিরবার পথেই এই পবিত্র সূরাটি রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর প্রতি অবতীর্ণ হয়। এই সূরাতেই এই ঘটনার বর্ণনা রয়েছে। এই সন্ধিকে ভাল পরিণামের দিক দিয়ে বিজয় নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। যেমন হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) প্রমুখ সাহাবীগণ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তারা বলতেনঃ “তোমরা তো মক্কা বিজয়কেই বিজয় বলে থাকো, কিন্তু আমরা হুদায়বিয়ার সন্ধিকেই বিজয়রূপে গণ্য করে থাকি।” হযরত জাবির (রাঃ) হতেও এটাই বর্ণিত আছে।

সহীহ্ বুখারীতে হযরত বারা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেনঃ “তোমরা মক্কা-বিজয়কে বিজয়রূপে গণ্য করে থাকো, কিন্তু আমরা হুদায়বিয়াতে সংঘটিত বায়আতে রিওয়ানকেই বিজয় হিসেবে গণ্য করি। আমরা চৌদ্দশ’ জন সাহাবী আল্লাহর রাসূল (সঃ)-এর সাথে এই ঘটনাস্থলে ছিলাম। হুদায়বিয়া। নামক একটি কূপ ছিল। আমরা ঐ কূপ হতে আমাদের প্রয়োজন মত পানি নিতে শুরু করি। অল্পক্ষণ পরেই ঐ কূপের সমস্ত পানি শুকিয়ে যায়, এক ফোঁটা পানিও অবশিষ্ট থাকে না। কূপের পানি শুকিয়ে যাওয়ার ঘটনাটি শেষ পর্যন্ত আল্লাহর রাসূল (সঃ)-এর কানেও পৌঁছে যায়। তিনি কূপের নিকটে এসে ওর ধারে বসে পড়েন। অতঃপর এক বরতন পানি চেয়ে নিয়ে অযু করেন এবং তাতে কুল্লীও করেন। তারপর দু’আ করেন এবং ঐ পানি ঐ কূপে ঢেলে দেন। অল্পক্ষণ পরেই আমরা দেখলাম যে, কূপটি সম্পূর্ণরূপে পানিতে ভরে গেছে। ঐ পানি আমরা নিজেরা পান করলাম, আমাদের সওয়ারী উটগুলোকে পান করালাম, নিজেদের প্রয়োজন পুরো করলাম এবং পাত্রগুলো পানিতে ভরে নিলাম।”

হযরত উমার ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ “আমি এক সফরে রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর সাথে ছিলাম। তিনবার আমি তাকে কিছু জিজ্ঞেস করলাম, কিন্তু তিনি কোন উত্তর দিলেন না। এতে আমি খুবই লজ্জিত হলাম যে, হায় আফসোস! আমি রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-কে কষ্ট দিলাম! তিনি উত্তর দিতে চান না, আর আমি অযথা তাঁকে প্রশ্ন করছি! অতঃপর আমি ভয় পেয়ে গেলাম যে, না জানি হয়তো আমার এ বেআদবীর কারণে আমার ব্যাপারে কোন আয়াত নাযিল হয়ে যাবে! সুতরাং আমি আমার সওয়ারীকে দ্রুত চালাতে লাগলাম এবং আগে বেরিয়ে গেলাম। কিছুক্ষণ পর আমি শুনলাম যে, কে যেন আমার নাম ধরে ডাকছে। আমি উত্তর দিলে সে বললোঃ “চলুন, আল্লাহর রাসূল (সঃ) আপনাকে ডাক দিয়েছেন।” এ কথা শুনে তো আমার আক্কেল গুড়ুম! ভাবলাম যে, অবশ্যই আমার ব্যাপারে কোন আয়াত নাযিল হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর খিদমতে হাযির হলাম। আমাকে দেখে তিনি বললেনঃ “গত রাত্রে আমার উপর এমন একটি সূরা অবতীর্ণ হয়েছে যা আমার কাছে দুনিয়া এবং দুনিয়ার সমস্ত জিনিস হতে বেশি প্রিয়। অতঃপর তিনি আমাকে (আরবী)-এই সূরাটি পাঠ করে শুনালেন।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ), ইমাম বুখারী (রঃ), ইমাম তিরমিযী (রঃ) এবং ইমাম নাসাঈ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

হযরত আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, হুদায়বিয়া হতে ফিরবার পথে (আরবী) এ আয়াতটি অবতীর্ণ হলে রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) বলেনঃ “রাত্রে আমার উপর এমন একটি আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে যা আমার নিকট দুনিয়া এবং ওর মধ্যে যা কিছু রয়েছে, সমস্ত হতে বেশি প্রিয়।” অতঃপর তিনি … (আরবী)-এ আয়াতটি পাঠ করে শুনালেন। তখন সাহাবীগণ (রাঃ) তাঁকে মুবারকবাদ জানালেন এবং বললেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! এ তো আপনার জন্যে, আমাদের জন্যে কি আছে? তখন (আরবী) পর্যন্ত আয়াতগুলো অবতীর্ণ হয়। (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন এবং ইমাম বুখারী (রঃ) ও ইমাম মুসলিম (রঃ) এটা তাখরীজ করেছেন)

করআন কারীমের একজন কারী হযরত মাজমা ইবনে হারেসা আনসারী। (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ “আমরা হুদায়বিয়া হতে ফিরে আসছিলাম, দেখি যে, জনগণ তাদের (সওয়ারীর) উটগুলোকে তাড়িয়ে নিয়ে চলছে। জিজ্ঞেস করলামঃ ব্যাপার কি? জানলাম যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর উপর কোন ওহী অবতীর্ণ হয়েছে। তখন আমরাও আমাদের উটগুলোকে তাড়িয়ে নিয়ে চললাম। এভাবে সবারই সাথে রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর নিকট পৌছে গেলাম। ঐ সময় তিনি কিরাউল গামীম নামক স্থানে স্বীয় সাওয়ারীর উপর অবস্থান করছিলেন। তার নিকট সমস্ত লোক একত্রিত হলে তিনি সকলকে এই সূরাটি পাঠ করে শুনিয়ে দেন। তখন একজন সাহাবী (রাঃ) জিজ্ঞেস করেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! এটা কি বিজয়?” উত্তরে তিনি বলেনঃ “যার হাতে মুহাম্মাদ (সঃ)-এর প্রাণ রয়েছে তাঁর শপথ! নিশ্চয়ই এটা বিজয়।” খায়বার যুদ্ধের গনীমত শুধু তাদের মধ্যেই বন্টিত হয় যারা হুদায়বিয়ায় উপস্থিত ছিলেন। মোট আঠারোটি অংশ করা হয়। সৈন্যদের মোট সংখ্যা ছিল পনেরশ’। অশ্বারোহী সৈন্য ছিলেন তিনশ’ জন। সুতরাং অশ্বারোহীদেরকে দ্বিগুণ অংশ দেয়া হয় এবং পজীদেরকে দেয়া হয় একগুণ।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) ও ইমাম আবু দাউদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত; তিনি বলেনঃ “হুদায়বিয়া হতে ফিরবার পথে এক জায়গায় রাত্রি যাপনের জন্যে আমরা অবতরণ করি। আমরা সবাই শুয়ে পড়ি এবং গভীর ঘুম আমাদেরকে পেয়ে বসে। যখন জাগ্রত হই তখন দেখি যে, সূর্য উদিত হয়ে গেছে। তখনো রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) ঘুমিয়েই রয়েছেন। আমরা পরস্পর বলাবলি করলাম যে, তাঁকে জাগানো উচিত, এমন। সময় তিনি নিজেই জেগে ওঠেন এবং বলেনঃ “তোমরা যা করছিলে তাই কর এবং যে ঘুমিয়ে পড়ে অথবা ভুলে যায় সে যেন এরূপই করে।” এই সফরে রাসুলুল্লাহ (সঃ)-এর উষ্ট্ৰীটি হারিয়ে যায়। আমরা তখন ওটার খোঁজে বেরিয়ে পড়ি, দেখি যে, একটি গাছে ওর লাগাম আটকে গেছে। ফলে সে বন্দী অবস্থায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। আমরা ওকে ছুটিয়ে নিয়ে আসলাম। রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) এর উপর সওয়ার হলেন। আমরা সেখান হতে প্রস্থান করলাম। হঠাৎ করে পথেই রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর উপর অহী নাযিল হতে শুরু হয়। অহী অবতীর্ণ হওয়ার সময় তাঁর অবস্থা খুব কঠিন হতো। যখন অহী আসা শেষ হয়ে গেল তখন তিনি আমাদেরকে বললেন যে, তার উপর (আরবী)-এ সূরাটি অবতীর্ণ হয়েছে।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ), ইমাম আবু দাউদ (রঃ) এবং ইমাম নাসাঈ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

হযরত মুগীরা ইবনে শু’বা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) এতো (নফল, তাহাজ্জুদ ইত্যাদি) নামায পড়তেন যে, তাঁর পা দু’টি ফুলে যেতো। তাকে জিজ্ঞেস করা হয়ঃ ‘আল্লাহ্ তা’আলা কি আপনার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সমস্ত গুনাহ্ মাফ করে দেননি?” উত্তরে তিনি বলেনঃ আমি কি কতজ্ঞতা প্রকাশকারী বান্দা হবো না?” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ), ইমাম বুখারী (রঃ) এবং ইমাম মুসলিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) নামাযে এমনভাবে দাঁড়িয়ে থাকতেন যে, তাঁর পা দু’টি ফুলে যেতো। হযরত আয়েশা (রাঃ) তাঁকে বলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আপনি এটা করছেন, অথচ আল্লাহ্ তা’আলা তো আপনার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সমস্ত পাপ মার্জনা করেছেন?” উত্তরে তিনি বলেনঃ “হে আয়েশা (রাঃ)! আমি কি কৃতজ্ঞ বান্দা হব না?” (হাদীসটি এভাবে ইমাম মুসলিম (রঃ) তাঁর সহীহ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন)

সুতরাং এটা সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হচ্ছে যে, (আরবী) (স্পষ্ট বিজয়) দ্বারা হুদায়বিয়ার সন্ধিকেই বুঝানো হয়েছে। এর কারণে রাসূলুল্লাহ (সঃ) এবং মু’মিনগণ বড়ই কল্যাণ ও বরকত লাভ করেছিলেন। জনগণের মধ্যে শান্তি ও নিরাপত্তা বিরাজ করছিল। মুসলমান ও কাফিরদের মধ্যে পরস্পর কথাবার্তা ও আলাপ আলোচনা শুরু হয়। জ্ঞান ও ঈমান চতুর্দিকে ছড়িয়ে দেয়ার সুযোগ লাভ হয়।

মহান আল্লাহ বলেনঃ ‘যেন আল্লাহ তোমার অতীত ও ভবিষ্যৎ ক্রটিসমূহ মার্জনা করেন। এটা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর জন্যে খাস বা এটা তাঁর একটি বিশেষ মর্যাদা। এতে তার সাথে আর কেউ শরীক নেই। হ্যা, তবে কোন কোন আমলের পুণ্যের ব্যাপারে অন্যদের জন্যেও এ শব্দগুলো এসেছে। এর দ্বারা রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর বিশেষ সম্মান ও মর্যাদা প্রকাশ পেয়েছে। তিনি তাঁর সমস্ত কাজকর্মে সততা, দৃঢ়তা এবং আল্লাহ্ তা’আলার আনুগত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। পূর্ববর্তী ও পরবর্তী কেউই এরূপ ছিল না। সমস্ত মানুষের মধ্যে তিনি ছিলেন সর্বাপেক্ষা অধিক পূর্ণতা প্রাপ্ত মানব এবং দুনিয়া ও আখিরাতে তিনি সমস্ত আদম-সন্তানের নেতা ও পথপ্রদর্শক। যেহেতু তিনি ছিলেন আল্লাহ্ তা’আলার সবচেয়ে বেশি অনুগত এবং তার আহকামের প্রতি সর্বাপেক্ষা অধিক মনোযোগী, সেই হেতু তাঁর উষ্ট্রীটি যখন তাঁকে নিয়ে বসে পড়ে তখন তিনি বলেনঃ “হাতীকে আটককারী (আল্লাহ) একে আটক করে ফেলেছেন। যার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে তাঁর শপথ! আজ এ কাফিররা আমার কাছে যা চাইবে আমি তাদেরকে তাই দিবো যদি না সেটা আল্লাহর মর্যাদা-হানিকর হয়।” যখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) আল্লাহ্ তা’আলার কথা মেনে নিয়ে তাদের সঙ্গে সন্ধি করেন তখন আল্লাহ্ পাক বিজয়ের সূরা অবতীর্ণ করেন এবং দুনিয়া ও আখিরাতে স্বীয় নিয়ামত তার উপর পূর্ণ করে দেন। আর তিনি তাঁকে পরিচালিত করেন সরল-সঠিক পথে। তাঁর বিনয় ও নম্রতার কারণে আল্লাহ্ তা’আলা তার মর্যাদা সমুন্নত করেন। তাঁর শত্রুদের উপর তাঁকে বিজয় দান করেন। যেমন সহীহ্ হাদীসে এসেছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) বলেছেনঃ “বান্দা (মানুষের অপরাধ) ক্ষমা করার দ্বারা সম্মান লাভ করে এবং বিনয় প্রকাশের দ্বারা উচ্চ মর্যাদায় সমাসীন হয়ে থাকে।” হযরত উমার ইবনে খাত্তাব (রাঃ) বলেনঃ “যে তোমার ব্যাপারে আল্লাহর অবাধ্যাচরণ করে তাকে তুমি এর চেয়ে বড় শাস্তি দাও না যে, তার ব্যাপারে তুমি আল্লাহর আনুগত্য কর (অর্থাৎ এটাই তার জন্যে সবচেয়ে বড় শাস্তি)।”
৪-৭ নং আয়াতের তাফসীর:

মহান আল্লাহ্ বলেন যে, তিনি মুমিনদের অন্তরে সাকীনা অর্থাৎ প্রশান্তি, করুণা ও মর্যাদা দান করেন। ইরশাদ হচ্ছে যে, হুদায়বিয়ার সন্ধির দিনে যেসব ঈমানদার সাহাবী (রাঃ) আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসূল (সঃ)-এর কথা মেনে নেন, আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা’আলা তাদের অন্তরে প্রশান্তি নাযিল করেন। এর ফলে তাঁদের ঈমান আরো বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। এর দ্বারা ইমাম বুখারী (রঃ) প্রমুখ গুরুজন দলীল গ্রহণ করেছেন যে, অন্তরে ঈমান বাড়ে ও কমে।

ঘোষিত হচ্ছেঃ আকাশ মণ্ডলী ও পৃথিবীর বাহিনীসমূহ আল্লাহরই। তাঁর সেনাবাহিনীর কোন অভাব নেই। ইচ্ছা করলে তিনি নিজেই কাফিরদেরকে ধ্বংস করে দিতেন। একজন ফেরেশতা প্রেরণ করলে তিনি সবকেই নিশ্চিহ্ন করে ফেলতেন। কিন্তু তা না করে তিনি মুমিনদেরকে জিহাদের নির্দেশ দিয়েছেন। এতে তাঁর পূর্ণ নিপুণতা রয়েছে। তা এই যে, এর মাধ্যমে তার হুজ্জতও পূর্ণ হয়ে যাবে এবং দলীল-প্রমাণও সামনে এসে যাবে। এ জন্যেই তিনি বলেনঃ ‘আল্লাহ সর্বজ্ঞ ও প্রজ্ঞাময়। তাঁর কোন কাজই জ্ঞান ও নিপুণতা শূন্য নয়। এতে এক যৌক্তিকতা এও আছে যে, ঈমানদারদেরকে তিনি স্বীয় উত্তম নিয়ামত দান করবেন। পূর্বে এ রিওয়াইয়াতটি গত হয়েছে যে, সাহাবীগণ (রাঃ) যখন রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে মুবারকবাদ দিলেন এবং তাদের জন্যে কি রয়েছে তা জিজ্ঞেস করলেন তখন মহামহিমান্বিত আল্লাহ্ … (আরবী) এ আয়াতটি অবতীর্ণ করেন। অর্থাৎ “এটা এ জন্যে যে, তিনি মুমিন পুরুষ ও মুমিনা নারীদেরকে দাখিল করবেন জান্নাতে যার নিম্নদেশে নদী প্রবাহিত, যেথায় তারা স্থায়ী হবে এবং তিনি তাদের পাপ মোচন করবেন, এটাই আল্লাহর দৃষ্টিতে মহা সাফল্য।” যেমন অন্য আয়াতে আল্লাহ পাক বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “যাকে জাহান্নাম হতে দূর করা হয়েছে ও জান্নাতে প্রবেশ করানো হয়েছে সে সফলকাম হয়েছে।” (৩:১৮৫)

এরপর আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা আর একটি কারণ বর্ণনা করছেন যে, তিনি মুনাফিক পুরুষ ও মুনাফিকা নারী, মুশরিক পুরুষ ও মুশরিকা নারী, যারা আল্লাহ্ সম্বন্ধে মন্দ ধারণা পোষণ করে তাদেরকে শাস্তি দিবেন। অর্থাৎ শির্ক ও নিফাকে জড়িত যেসব নরনারী আল্লাহ তাআলার আহকাম সম্বন্ধে মন্দ ধারণা পোষণ করে এবং রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) ও তাঁর সাহাবীদের সম্পর্কে কু-ধারণা রাখে, তাদের নাম ও নিশানা মিটিয়ে দেয়া হবে, আজ হোক বা কাল হোক। এই যুদ্ধে যদি তারা রক্ষা পেয়ে যায় তবে অন্য যুদ্ধে তারা ধ্বংস হয়ে যাবে। আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা বলেন যে, অমঙ্গল চক্র তাদের জন্যে, আল্লাহ তাদের প্রতি রুষ্ট হয়েছেন এবং তাদেরকে অভিশপ্ত করেছেন, আর তাদের জন্যে প্রস্তুত রেখেছেন জাহান্নাম এবং এ জাহান্নাম কতই না নিকৃষ্ট আবাস!

পুনরায় মহা পরাক্রমশালী আল্লাহ্ স্বীয় ব্যাপক ক্ষমতা এবং শত্রুদের উপর প্রতিশোধ গ্রহণের শক্তি প্রকাশ করতে গিয়ে বলেন যে, আকাশ-মণ্ডলী ও পৃথিবীর বাহিনীসমূহ আল্লাহ্ই এবং তিনি পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়।

Leave a Reply