Motaher21.net أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ ( বই # ১১৩৫/এবং কাফের-রা বলে:-১০) [*এবং কাফিররা বলে, ‘এ তো এক আশ্চর্য জিনিস ! :- *  *পুনরুজ্জীবনের জীবন্ত উদাহরণ :-   *মানুষের আমলের রেকর্ড :-] www.motaher21.net সূরা:৫০-ক্বাফ। পারা:২৬ ০১-২৯ নং আয়াত:-

Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১১৩৫/এবং কাফের-রা বলে:-১০)
[*এবং কাফিররা বলে, ‘এ তো এক আশ্চর্য জিনিস ! :-
*  *পুনরুজ্জীবনের জীবন্ত উদাহরণ :-
*মানুষের আমলের রেকর্ড :-]
www.motaher21.net
সূরা:৫০-ক্বাফ। পারা:২৬
০১-২৯ নং আয়াত:-
আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে ফি জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন কুরআন বলেছেন:-
আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-

সূরা:৫০-ক্বাফ:-১
قٓ ۟ۚ وَ الۡقُرۡاٰنِ الۡمَجِیۡدِ ۚ﴿۱﴾
ক্বাফ, মহিমান্বিত কল্যাণময় কুরআনের শপথ।
সূরা:৫০-ক্বাফ:-২
بَلۡ عَجِبُوۡۤا اَنۡ جَآءَہُمۡ مُّنۡذِرٌ مِّنۡہُمۡ فَقَالَ الۡکٰفِرُوۡنَ ہٰذَا شَیۡءٌ عَجِیۡبٌ ۚ﴿۲﴾
বরং তারা বিস্ময় বোধ করে যে, তাদের মধ্য থেকে একজন সতর্ককারী তাদের কাছে এসেছেন। আর কাফিররা বলে, ‘এ তো এক আশ্চর্য জিনিস !
সূরা:৫০-ক্বাফ:-৩
ءَاِذَا مِتۡنَا وَ کُنَّا تُرَابًا ۚ ذٰلِکَ رَجۡعٌۢ بَعِیۡدٌ ﴿۳﴾
‘আমাদের মৃত্যু হলে এবং আমরা মাটিতে পরিণত হলে আমরা কি পুনরুখিত হব? এ ফিরে যাওয়া সুদূরপরাহত।’
সূরা:৫০-ক্বাফ:-৪
قَدۡ عَلِمۡنَا مَا تَنۡقُصُ الۡاَرۡضُ مِنۡہُمۡ ۚ وَ عِنۡدَنَا کِتٰبٌ حَفِیۡظٌ ﴿۴﴾
অথচ মাটি তার দেহের যা কিছু খেয়ে ফেলে তা সবই আমার জানা। আমার কাছে একখানা কিতাব আছে। তাতে সবকিছু সংরক্ষিত আছে।
সূরা:৫০-ক্বাফ:-৫
بَلۡ کَذَّبُوۡا بِالۡحَقِّ لَمَّا جَآءَہُمۡ فَہُمۡ فِیۡۤ اَمۡرٍ مَّرِیۡجٍ ﴿۵﴾
এসব লোকেরা তো এমন যে, যখনই তাদের কাছে সত্য এসেছে, তখনই তারা তাকে মিথ্যা মনে করেছে। এ কারণেই তারা এখন দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যে পড়ে আছে।
সূরা:৫০-ক্বাফ:-৬
اَفَلَمۡ یَنۡظُرُوۡۤا اِلَی السَّمَآءِ فَوۡقَہُمۡ کَیۡفَ بَنَیۡنٰہَا وَ زَیَّنّٰہَا وَ مَا لَہَا مِنۡ فُرُوۡجٍ ﴿۶﴾
আচ্ছা, এরা কি কখনো এদের মাথার ওপরের আসমানের দিকে তাকায়নি? আমি কিভাবে তা তৈরী করেছি এবং সজ্জিত করেছি।তাতে কোথাও কোন ফাটল নেই।
সূরা:৫০-ক্বাফ:-৭
وَ الۡاَرۡضَ مَدَدۡنٰہَا وَ اَلۡقَیۡنَا فِیۡہَا رَوَاسِیَ وَ اَنۡۢبَتۡنَا فِیۡہَا مِنۡ کُلِّ زَوۡجٍۭ بَہِیۡجٍ ۙ﴿۷﴾
ভূপৃ‌ষ্ঠকে আমি বিছিয়ে দিয়েছি, তাতে পাহাড় স্থাপন করেছি এবং তার মধ্যে সব রকম সুদৃশ্য উদ্ভিদরাজি উৎপন্ন করেছি।
সূরা:৫০-ক্বাফ:-৮
تَبۡصِرَۃً وَّ ذِکۡرٰی لِکُلِّ عَبۡدٍ مُّنِیۡبٍ ﴿۸﴾
এসব জিনিসের সবগুলোই দৃষ্টি উন্মুক্তকারী এবং শিক্ষাদানকারী ঐ সব বান্দার জন্য যারা সত্যের দিকে প্রত্যাবর্তন করে।
সূরা:৫০-ক্বাফ:-৯
وَ نَزَّلۡنَا مِنَ السَّمَآءِ مَآءً مُّبٰرَکًا فَاَنۡۢبَتۡنَا بِہٖ جَنّٰتٍ وَّ حَبَّ الۡحَصِیۡدِ ۙ﴿۹﴾
আমি আসমান থেকে বরকতপূর্ণ পানি নাযিল করেছি। অতঃপর তা দ্বারা বাগান ও খাদ্য শস্য উৎপন্ন করেছি।
সূরা:৫০-ক্বাফ:-১০
وَ النَّخۡلَ بٰسِقٰتٍ لَّہَا طَلۡعٌ نَّضِیۡدٌ ﴿ۙ۱۰﴾
তাছাড়া থরে থরে সজ্জিত ফলভর্তি কাঁদি বিশিষ্ট দীর্ঘ সুউচ্চ খেজুর গাছ।
সূরা:৫০-ক্বাফ:-১১
رِّزۡقًا لِّلۡعِبَادِ ۙ وَ اَحۡیَیۡنَا بِہٖ بَلۡدَۃً مَّیۡتًا ؕ کَذٰلِکَ الۡخُرُوۡجُ ﴿۱۱﴾
এটা হচ্ছে বান্দাহদেরকে রিযিক দেয়ার ব্যবস্থা। এ পানি দ্বারা আমি মৃত ভূমিকে জীবন দান করি। (মৃত মানুষের মাটি থেকে) বেরিয়ে আসাও এভাবেই হবে।
সূরা:৫০-ক্বাফ:-১২
کَذَّبَتۡ قَبۡلَہُمۡ قَوۡمُ نُوۡحٍ وَّ اَصۡحٰبُ الرَّسِّ وَ ثَمُوۡدُ ﴿ۙ۱۲﴾
তাদের আগেও মিথ্যারোপ করেছিল নূহের সম্প্রদায়, রাস্ এর অধিবাসী ও সামূদ সম্প্রদায়,
সূরা:৫০-ক্বাফ:-১৩
وَ عَادٌ وَّ فِرۡعَوۡنُ وَ اِخۡوَانُ لُوۡطٍ ﴿ۙ۱۳﴾
আ’দ, ফিরআউন ও লূত সম্প্রদায়,
সূরা:৫০-ক্বাফ:-১৪
وَّ اَصۡحٰبُ الۡاَیۡکَۃِ وَ قَوۡمُ تُبَّعٍ ؕ کُلٌّ کَذَّبَ الرُّسُلَ فَحَقَّ وَعِیۡدِ ﴿۱۴﴾
এবং আয়কার অধিবাসী ও তুব্বা’ সম্প্রদায়, তারা সবাই রসূলদেরকে মিথ্যাবাদী বলেছিল, ফলে তাদের উপর আমার শাস্তির প্রতিশ্রুতি সত্য হয়েছে।
সূরা:৫০-ক্বাফ:-১৫
اَفَعَیِیۡنَا بِالۡخَلۡقِ الۡاَوَّلِ ؕ بَلۡ ہُمۡ فِیۡ لَبۡسٍ مِّنۡ خَلۡقٍ جَدِیۡدٍ ﴿٪۱۵﴾
আমি কি প্রথমবার সৃষ্টি করতে অক্ষম ছিলাম? আসলে নতুন করে সৃষ্টির ব্যাপারে এসব লোক সন্দেহে নিপতিত হয়ে আছে।
সূরা:৫০-ক্বাফ:-১৬
وَ لَقَدۡ خَلَقۡنَا الۡاِنۡسَانَ وَ نَعۡلَمُ مَا تُوَسۡوِسُ بِہٖ نَفۡسُہٗ ۚۖ وَ نَحۡنُ اَقۡرَبُ اِلَیۡہِ مِنۡ حَبۡلِ الۡوَرِیۡدِ ﴿۱۶﴾
অবশ্যই আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি এবং তার মন তাকে যে কুমন্ত্রণা দেয়, তা আমি জানি।আমি তার ঘাড়ে অবস্থিত ধমনী অপেক্ষাও নিকটতর।
সূরা:৫০-ক্বাফ:-১৭
اِذۡ یَتَلَقَّی الۡمُتَلَقِّیٰنِ عَنِ الۡیَمِیۡنِ وَ عَنِ الشِّمَالِ قَعِیۡدٌ ﴿۱۷﴾
দু’জন লেখক তার ডান ও বাঁ দিকে বসে সবকিছু লিপিবদ্ধ করছে।
সূরা:৫০-ক্বাফ:-১৮
مَا یَلۡفِظُ مِنۡ قَوۡلٍ اِلَّا لَدَیۡہِ رَقِیۡبٌ عَتِیۡدٌ ﴿۱۸﴾
এমন কোন শব্দ তার মুখ থেকে বের হয় না যা সংরক্ষিত করার জন্য একজন সদা প্রস্তুত রক্ষক উপস্থিত থাকে না।
সূরা:৫০-ক্বাফ:-১৯
وَ جَآءَتۡ سَکۡرَۃُ الۡمَوۡتِ بِالۡحَقِّ ؕ ذٰلِکَ مَا کُنۡتَ مِنۡہُ تَحِیۡدُ ﴿۱۹﴾
মৃত্যুযন্ত্রণা সত্যই আসবে; এ তো তাই, যা হতে তুমি অব্যাহতি চেয়ে আসছ।
সূরা:৫০-ক্বাফ:-২০
وَ نُفِخَ فِی الصُّوۡرِ ؕ ذٰلِکَ یَوۡمُ الۡوَعِیۡدِ ﴿۲۰﴾
আর শিংগায় ফুৎকার দেওয়া হবে, ওটাই শাস্তির প্রতিশ্রুতির দিন।
সূরা:৫০-ক্বাফ:-২১
وَ جَآءَتۡ کُلُّ نَفۡسٍ مَّعَہَا سَآئِقٌ وَّ شَہِیۡدٌ ﴿۲۱﴾
প্রত্যেক ব্যক্তি এমন অবস্থায় এসে হাজির হলো যে, তাদের সাথে হাঁকিয়ে নিয়ে আসার মত একজন এবং সাক্ষ্য দেয়ার মত একজন ছিল।
সূরা:৫০-ক্বাফ:-২২
لَقَدۡ کُنۡتَ فِیۡ غَفۡلَۃٍ مِّنۡ ہٰذَا فَکَشَفۡنَا عَنۡکَ غِطَآءَکَ فَبَصَرُکَ الۡیَوۡمَ حَدِیۡدٌ ﴿۲۲﴾
তুমি এই দিবস সম্বন্ধে উদাসীন ছিলে, এখন তোমার সম্মুখ হতে পর্দা উন্মোচন করেছি; সুতরাং আজ তোমার দৃষ্টি প্রখর।
সূরা:৫০-ক্বাফ:-২৩
وَ قَالَ قَرِیۡنُہٗ ہٰذَا مَا لَدَیَّ عَتِیۡدٌ ﴿ؕ۲۳﴾
সূরা:তার সঙ্গী (ফিরিশতা) বলবে, ‘এই তো আমার নিকট (আমলনামা) প্রস্তুত।’
সূরা:৫০-ক্বাফ:-২৪
اَلۡقِیَا فِیۡ جَہَنَّمَ کُلَّ کَفَّارٍ عَنِیۡدٍ ﴿ۙ۲۴﴾
আদেশ করা হবে, তোমারা উভয়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ কর প্রত্যেক উদ্বত কাফিরকে-
সূরা:৫০-ক্বাফ:-২৫
مَّنَّاعٍ لِّلۡخَیۡرِ مُعۡتَدٍ مُّرِیۡبِۣ ﴿ۙ۲۵﴾
কল্যাণকর কাজে প্রবল বাধাদানকারী, সীমালংঘনকারী ও সন্দেহ পোষণকারী।
সূরা:৫০-ক্বাফ:-২৬
الَّذِیۡ جَعَلَ مَعَ اللّٰہِ اِلٰـہًا اٰخَرَ فَاَلۡقِیٰہُ فِی الۡعَذَابِ الشَّدِیۡدِ ﴿۲۶﴾
এবং আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে ইলাহ বানিয়ে বসেছিল। নিক্ষেপ কর তাকে কঠিন আযাবে।
সূরা:৫০-ক্বাফ:-২৭
قَالَ قَرِیۡنُہٗ رَبَّنَا مَاۤ اَطۡغَیۡتُہٗ وَ لٰکِنۡ کَانَ فِیۡ ضَلٰلٍۭ بَعِیۡدٍ ﴿۲۷﴾
তার সহচর শয়তান বলবে, ‘হে আমাদের রব! আমি তাকে বিদ্রোহী করে তুলিনি। বস্তুত সেই ছিল ঘোর বিভ্রান্ত ।
সূরা:৫০-ক্বাফ:-২৮
قَالَ لَا تَخۡتَصِمُوۡا لَدَیَّ وَ قَدۡ قَدَّمۡتُ اِلَیۡکُمۡ بِالۡوَعِیۡدِ ﴿۲۸﴾
জবাবে বলা হলোঃ আমার সামনে ঝগড়া করো না। আমি আগে তোমাদেরকে মন্দ পরিণতি সম্পর্কে সাবধান করে দিয়েছিলাম।
সূরা:৫০-ক্বাফ:-২৯
مَا یُبَدَّلُ الۡقَوۡلُ لَدَیَّ وَ مَاۤ اَنَا بِظَلَّامٍ لِّلۡعَبِیۡدِ ﴿٪۲۹﴾
‘আমার কাছে কথা রদবদল হয় না এবং আমি বান্দাদের প্রতি যুলুমকারীও নই।’

০১-২৯ নং আয়াত:-
আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে ফি জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
সংক্ষিপ্ত আলােচনা : রসূলুল্লাহ(স.) সাধারণত এই সূরা দিয়ে ঈদ ও জুমার জামায়াতে ভাষণ দিতেন এবং তাতে শ্রোতাদের মধ্যে বিপুল চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হতাে। আসলে এটি একটি অত্যন্ত প্রভাবশালী ও ভীতিপ্রদ বিবরণ সম্বলিত সূরা। আল্লাহ তায়ালা যে তার সকল সৃষ্টিকে প্রতি মুহূর্তে অত্যন্ত গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে চলেছেন এবং সেই পর্যবেক্ষণ যে তার ওপর তার জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত, মৃত্যু থেকে পুনরুজ্জীবন পর্যন্ত, তার পর থেকে কেয়ামতের ময়দানে জমায়েত হওয়া পর্যন্ত এবং তারপর থেকে হিসাব গ্রহণ পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে, সে কথা এই সূরায় সুন্দর করে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। এটি একটি নিদারুণ ভীতিপ্রদ ও সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ, যা মানুষ নামক এই দুর্বল সৃষ্টির ওপর পরিপূর্ণভাবে কার্যকর রয়েছে ও থাকবে। মানুষ এমন এক সত্তার মুঠোর মধ্যে রয়েছে, যিনি তার সম্পর্কে কখনাে এক মুহূর্তের জন্যেও উদাসীন হন না এবং একটুও দূরে সরেন না। তার প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাসকে তিনি গুনে রাখেন। তার মনের প্রতিটি চিন্তা তার জানা। তার প্রতিটি উচ্চারণ তাঁর কাছে লিখিত এবং তার প্রতিটি কার্যকলাপ ও নড়াচড়ার হিসাব তাঁর কাছে সংরক্ষিত। এই সর্বাত্মক ও ভয়ংকর পর্যবেক্ষণের আওতাধীন রয়েছে তার অন্তরের প্রতিটি ভাবনা এবং তার অংগ-প্রত্যংগের প্রতিটি তৎপরতা। এই পর্যবেক্ষণের মাঝে কোনাে পর্দা নেই, কোনাে আড়াল নেই। প্রতিটি মুহূর্তে তার প্রতিটি গােপন ও প্রকাশ্য কাজের ওপর এই সর্বাত্মক প্রহরা কার্যকর রয়েছে। আল্লাহর এই সর্বাত্মক প্রহরা ও পর্যবেক্ষণের বিষয়টি সর্বজন বিদিত। কিন্তু এই সূরায় তা এমনডাবে তুলে ধরা হয়েছে যেন তা নতুন কিছু, যেন তা শরীরের রােমাঞ্চ তােলে, স্নায়ুতে শিহরণ জাগায় এবং উদাসীন মানুষকে সচকিত করে তােলে। আর এ সব কিছুই করা হয় জীবন, মৃত্যু, পরকাল ও কেয়ামতের কথা স্মৃতিতে জাগরক করার মাধ্যমে এবং আকাশ, পৃথিবী, পানি, উদ্ভিদ, ফল ও ফসলের দৃশ্য তুলে ধরার মাধ্যমে। এ ধরনের সূরার আলােচ্য বিষয়ের সংক্ষিপ্তসার তুলে ধরা খুবই কঠিন। তাই আমি মূল সূরাটি নিয়েই সরাসরি আলােচনায় প্রবৃত্ত হতে চাই।

ফী জিলালিল কুরআন:

সূরার প্রথম রুকুটি লক্ষ্য করুন। এটি সূরার প্রথমাংশ। এতে আখেরাতের কথা এবং মােশরেক কর্তৃক আখেরাতকে অস্বীকার করা ও আখেরাত সংক্রান্ত কথাবার্তায় তাদের বিস্ময় প্রকাশ করার বিবরণ দেয়া হয়েছে। তবে কোরআন শুধু তাদের অস্বীকার করার বিষয়টিরই উল্লেখ করেনি যে, শুধু এর প্রতিবাদ করেই ক্ষান্ত হবে। বরং তাদের বিভ্রান্ত মন ও মানসিকতার পর্যালােচনা করে যাতে তাকে সত্যের পথে ফিরিয়ে আনতে পারে, তার বক্রতা দূর করে এবং সব কিছুর আগে মনকে এমনভাবে জাগিয়ে তােলা ও আন্দোলিত করার চেষ্টা করে, যাতে তা মহাবিশ্বের অন্তরালে বিরাজমান মহাসত্য সম্পর্কে অবগত হতে পারে। এ জন্যে কোরআন পরকালকে প্রমাণ করার জন্যে তাদের সাথে কোনাে মনস্তাত্ত্বিক বিতর্কে লিপ্ত হয় না। কেবল তাদের মনকে জাগিয়ে তােলে, যাতে তা চিন্তাভাবনা করে এবং তাদের প্রজ্ঞা ও বিবেককে আলােড়িত করে, যাতে তা চারপাশের প্রত্যক্ষ সত্যগুলাে দ্বারা প্রভাবিত হয় ও তা গ্রহণ করে। যারা মনের বিশুদ্ধি ও সুচিকিৎসা কামনা করে, তাদের জন্যে এতে উপকৃত হওয়ার মতাে শিক্ষা রয়েছে। সূরাটি শুরু হয়েছে আরবী বর্ণমালার একটি অক্ষর ‘কাফ’ দ্বারা এবং কাফ দিয়ে লেখা ও শুরু করা কোরআনের নামে শপথ করার মাধ্যমে। শপথ করে কোরআন কোন কথাটা বলতে চায়, তার উল্লেখ করেনি। তবে শুরুতেই শপথ করা দ্বারা বুঝা যায়, সূরার গােটা আলােচ্য বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চেতনায় এই গুরুত্ববােধ সৃষ্টি করার পর এমন একটি বিষয়ের সূত্রপাত করা হয়েছে, যাতে তাদের কাছে রসূলের আগমন ও আখেরাতের আলােচনা সম্বলিত কোরআন নাযিল হওয়া সম্পর্কে কাফেরদের বিষয় প্রকাশ নিয়ে মন্তব্য করা হয়েছে।  *কেয়ামত ও জবাবদিহিতা অবধারিত : বলা হয়েছে- ‘বরং তারা এ জন্যে অবাক হয়ে গেছে যে, তাদের কাছে তাদেরই মধ্য থেকে একজন সতর্ককারী এসে গেছে। তা দেখে কাফেররা বলেছে যে, এতাে খুবই বিস্ময়ের ব্যাপার। আমরা মরে মাটি হয়ে যাওয়ার পর আবার বেঁচে উঠবাে নাকি? সে তাে খুবই সুদর পরাহত এক প্রত্যাবর্তন। অর্থাৎ তাদের মধ্য থেকে একজন সতর্ককারী এসেছে এতে তারা অবাক হয়ে গেছে। অথচ এতে অবাক হবার কিছু নেই। এটা বরঞ্চ স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, যাকে বক্রতামুক্ত সুস্থ বিবেক মাত্রেই সানন্দে গ্রহণ না করে পারে না। স্বাভাবিক ব্যাপার তো এটাই যে, কোনাে মানব গােষ্ঠীকে কোনাে জিনিস শেখাতে হলে আল্লাহ তায়ালা সে জন্যে সে গােষ্ঠীর মধ্য থেকেই কাউকে বাছাই করবেন। এই ব্যক্তি তাদেরই লােক হওয়ায় তার চেতনা অনুভূতি তাদের চেতনা অনুভূতির মতােই হবে। তাদের ভাষায় সে কথা বলবে। তাদের তৎপরতায় ও জীবনধারায় সেও অংশগ্রহণ করবে, তাদেরকে কিসে আকৃষ্ট করে এবং কিসে বিরক্ত করে তা সে বুঝবে। তাদের কর্মক্ষমতা ও ধারণ ক্ষমতা কতখানি তা সে জানবে। এরূপ ব্যক্তিকে পাঠালে সে তাদেরকে তাদের অনিবার্য পরিণতি সম্পর্কে সাবধান করবে, তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য বুঝাবে এবং নিজে হবে সর্বপ্রথম এই দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনকারী। খালেদ রিসালাত নিয়েও তারা বিস্মিত। রসূল তাদেরকে যে পরকালের কথা বলেন, তা তাদের কাছে বড়ই আশ্চার্যজনক। পরকালে-বিশ্বাস ইসলামের একটা মূলনীতি। এ মূলনীতি গােটা ইসলামের অন্যতম ভিত্তি। ইসলামী আকীদা বিশ্বাসের দাবী ও চাহিদা সংক্রান্ত সামগ্রিক ধ্যানধারণা এই মূলনীতির ওপরই প্রতিষ্ঠিত। মুসলমানের কাছে ইসলামের দাবি এই যে, অসত্যকে প্রতিহত করার জন্যে সে যেন সত্যের পতাকাবাহী হয়। অন্যায় ও অকল্যাণকে নিশ্চিহ্ন করার জন্যে সে যেন ন্যায়ের পতাকাবাহী হয়। পার্থিব জীবনে তার সকল কাজ যেন আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে নিবেদিত হওয়ার মাধ্যমে এবাদাতে পরিণত হয়। বস্তুত দুনিয়ার প্রতিটি কাজেরই বদলা প্রয়ােজন। কিন্তু সেই বদলা পার্থিব জীবনে নাও মিলতে পারে। সে ক্ষেত্রে বদলা পার্থিব জীবনের পরবর্তী জীবন পর্যন্ত পিছিয়ে যাবে। এ জন্যে আরেকটা জগত প্রয়ােজন। আর সেই জগতে হিসাব গ্রহণের জন্যে মানুষকে পুনরুজ্জীবিত করা অপরিহার্য। মানুষের মন মগযে যখন আখেরাতের ভিত্তি ধ্বংস হয়ে যায়, তখন সেই সাথে ইসলামী আদর্শের সকল তত্ত্ব ও সে সংক্রান্ত দায়দায়িত্ব বিলুপ্ত হয় এবং এরূপ দায়িত্ববােধহীন মন ইসলামী জীবনধারার সাথে কখনাে খাপ খাইয়ে চলতে পারে না। কিন্তু মােশরেকরা এ বিষয়টাকে এ দৃষ্টিকোণ থেকে কখনাে দেখেনি। তারা এটিকে দেখেছে অন্য একটি অতীব জটিল দৃষ্টিকোণ থেকে। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে জীবন ও মৃত্যুর প্রকৃত স্বরূপ উপলব্ধি করা যায় না। উপলব্ধি করা যায় না আল্লাহর শক্তির প্রকৃত স্বরূপও। এ জন্যেই মােশরেকরা বলেছিলাে, ‘আমরা মরে মাটি হয়ে যাওয়ার পর পুনরুজ্জীবিত হবে নাকি? সেটা তাে একটা সুদূর পরাহত প্রত্যাবর্তন।’ এ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, তাদের চোখে আসল সমস্যাটা হলাে মৃত্যু ও ধ্বংসের পর পুনরুজ্জীবনের সম্ভাবনাকে সুদূর পরাহত মনে করা। এটা যে একটা স্থূল ও অসূক্ষ্ম দৃষ্টিকোণ, সে কথা আমি আগেই বলেছি। কেননা, একবার যে জীবন অলৌকিকভাবে অস্তিত্বে এসেছে তা আরাে একবার অস্তিত্বে আসতে পারে। এই অলৌকিক ঘটনা তাদের সামনে অহরহই ঘটে চলেছে। গােটা সৃষ্টিজগত জুড়ে এ ঘটনা দৃশ্যমান। এই দিকটিই কোরআন আলােচ্য সূরায় তুলে ধরেছে। তবে কোরআনের জীবন ও প্রকৃতি সংক্রান্ত আয়াতগুলাে পর্যালোচনা করার আগে সেই আয়াতগুলাে নিয়ে আলােচনা করতে চাই যাতে মৃত্যু ও ধ্বংসের কথা বলা হয়েছে এবং এ সম্পর্কে মােশরেকদের বক্তব্য উদ্ধৃত করা ও তার ওপর মন্তব্য করা হয়েছে। তারা বলেছিলাে, আমরা মরে মাটি হয়ে যাওয়ার পরও পুনরুজ্জীবিত হবো নাকি?’ এ কথা সত্য যে, মানুষ একদিন মরবেই এবং মরার পর মাটিও হবে। মােশরেকদের এই উক্তির উদ্ধৃতি যে-ই পড়বে সে সরাসরি নিজের দিকে নযর বুলাবে এবং পার্শ্ববর্তী অন্যান্য প্রাণীর দিকেও তাকাবে, যাতে মৃত্যু ও ধ্বংস দৃশ্য কল্পনা করা যায়। এমনকি আজ মাটির ওপরে জীবিত অবস্থায় অবস্থান করা সত্তেও অতি ধীরগতিতে কিভাবে তার দেহে মৃত্যু ও ধ্বংস নেমে আসবে, তা অনুভব করতে পারে। মৃত্যু ও ধ্বংস যেমন জীবিত প্রাণীর মনকে প্রকম্পিত করে, তেমন আর কিছু করে না। পরবর্তী আয়াতে আল্লাহ তায়ালা মুশরিকদের উক্ত বক্তব্যের যে পর্যালোচনা করেছেন, তাতে মৃত্যুর এই প্রভাব ও প্রতিক্রিয়াকে আরাে শাণিত ও গভীর করা হয়েছে এবং মাটি কিভাবে মানুষের মৃতদেহকে একটু একটু করে খেয়ে ফেলে, তার ধারণা দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন তাদের দেহকে মাটি কিভাবে ক্ষয় করে তা আমি জানি এবং আমার কাছে সুরক্ষিত লিপি রয়েছে।’ মাটির ভেতরে সমাহিত দেহ মাটির আলােড়নে কিভাবে পর্যায়ক্রমে ক্ষয় হয়ে যায় এবং ধীরে ধীরে কিভাবে মাটি দেহকে খেয়ে ফেলে, সেই দৃশ্যকে এ আয়াতে মূর্ত করে তােলা হয়েছে। আর জীবিত অবস্থায়ও মানুষের দেহ কিভাবে ক্রমাগত ক্ষয়প্রাপ্ত ও প্রাচীন হতে থাকে, তাও এতে তুলে ধরা হয়েছে। আয়াতটির মর্মার্থ হলাে, পৃথিবী (জীবিত কিংবা মৃত উভয় অবস্থায়) কিভাবে তাদের দেহকে ক্ষয় করতে থাকে, তা আল্লাহ তায়ালা জানেন এবং এটা একটা সুরক্ষিত গ্রন্থে সংরক্ষিত। তারা মরে মাটি হয়ে গেলে একেবারে বিলীন হয়ে যায় না। জীবনকে এই মাটির অভ্যন্তরে নিয়ে যাওয়ার কাজটা তো আগেও সংঘটিত হয়েছে। আর মৃতকে জীবিত করার ঘটনাও চারপাশে অহরহ ঘটে চলেছে এবং তা অবিরাম গতিতে চলেছে। এভাবেই মানুষের মনকে নরম করা, গলানাে, সচেতন করা, উদ্দীপিত করা ও ত্বরিত দাওয়াত গ্রহণ করার যােগ্য বানানাের চেষ্টা চলেছে এ আয়াতে এবং মূল বিষয় নিয়ে আলােচনা করার আগেই এই প্রচেষ্টা চালানাে হয়েছে। অতপর মােশরেকদের মানসিক অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে, যা এই সকল অলীক ও উদ্ভট আপত্তির মূলে সক্রিয় রয়েছে। কেননা, তারা চিরস্তন ও চিরস্থায়ী সত্যকে অস্বীকার করার কারণে তাদের পায়ের তলার মাটি সরে গেছে এবং এরপর কোনাে ব্যাপারেই তারা স্থায়ী অবস্থান নিতে পারেনি। ‘বরঞ্চ তারা তাদের কাছে আগত সত্যকে অস্বীকার করেছে। ফলে তারা সংশয়ে দোদুল্যমান।’ যারা চিরন্তন সত্যকে অস্বীকার করে, তাদের অবস্থার এক অতুলনীয় ও সচিত্র দৃশ্য তুলে ধরা হয়েছে এ আয়াতে। স্থিতিশীল সত্যকে ত্যাগ করার পর তারা আর স্থিতি খুঁজে পায় না।
ফী জিলালিল কুরআন:

*সত্য ও সত্যের পথিক সবসময়ই অটল : সত্য একটা অনড়, অটল ও অক্ষয় জিনিস। যে ব্যক্তি সত্যের ওপর ঈমান আনে, তার কদম কখনাে টলটলায়মান হয় না। কেননা তার পায়ের নিচের মাটি অনড় ও অবিচল। সত্য ছাড়া আর সবই দোদুল্যমান ও টলটলায়মান। সত্য ছাড়া আর কোনাে কিছুর স্থিতি নেই এবং স্থায়িত্ব নেই। তাই সে স্থিতিহীন ও ক্ষয়িষ্ণু সত্যকে যে ত্যাগ করে, তাকে তার প্রবৃত্তি, বিভিন্ন প্ররােচনা, ধোকা, সন্দেহ ও সংশয় ক্রমাগত ফুটবলের মতাে এদিক থেকে ওদিকে, ডান থেকে বামে ছুঁড়ে মারতে থাকে। ফলে সে কোথাও স্থির হয়ে দাড়াতে পারে না। তার কোনাে স্থায়ী ঠিকানা থাকে না। অনড়, অটল, অক্ষয় ও চিরস্থায়ী সত্য সম্পর্কে এবং পরকালীন জীবন সম্পর্কে তাদের উদ্ভট ও অযৌক্তিক আপত্তির বিবরণ দেয়ার পাশাপাশি বিশ্ব প্রকৃতিতে বিরাজমান সত্যের কিছু প্রতীক তুলে ধরা হয়েছে পরবর্তী আয়াতে। এতে আকাশ, পৃথিবী, পাহাড়, পর্বত, বৃষ্টি, খেজুরের বাগান, উদ্ভিদ ও ফলের বাগানের দিকে এমনভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে, যা অনড়, অটল সত্যের গুণাবলীর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। বলা হয়েছে, ‘তারা কি দেখেনি, কিভাবে আমি আকাশকে তাদের মাথার ওপর নির্মাণ করেছি, সুসজ্জিত করেছি এবং তাতে ফাঁক বা ফাটল নেই।’ বিশ্ব নিখিলকে যদি একটি গ্রন্থ রূপে কল্পনা করা যায়, তবে আকাশ হচ্ছে তার একটি পৃষ্ঠা রূপ। এই পৃষ্ঠায় সেই মহাসত্য বর্ণিত হয়েছে, যাকে কাফের ও মােশরেকরা পরিত্যাগ করেছে। মহাকাশে যে স্থিতি, সৌন্দর্য ও শৃংখলা বিরাজ করছে, তা কি তারা দেখতে পায় না? বন্তুত স্থীতি, পূর্ণতা ও সৌন্দর্য হচ্ছে আকাশের বৈশিষ্ট্য। আর এই তিনটে জিনিস কোরআনেরও বৈশিষ্ট্য। তাই আল্লাহর সৃষ্টি আকাশ, মহাসত্য ইসলাম ও আল্লাহর রচিত কোরআন পরস্পরের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এ কারণেই নির্মাণ, সৌন্দর্য ও ফাটলহীন হওয়ার গুণাবলী বর্ণিত হয়েছে। অনুরূপভাবে পৃথিবী মহাবিশ্বরূপী গ্রন্থের একটি পৃষ্ঠা। এই গ্রন্থখানি চির সুন্দর, চির উজ্জ্বল ও চিরস্থায়ী সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত। আল্লাহ তায়ালা বলেন ‘আর পৃথিবীকে আমি বিস্তৃত করেছি, তাতে স্থাপন করেছি পর্বতমালা এবং তাতে উদগত করেছি নয়নাভিরাম যাবতীয় উদ্ভিদ। এখানে পৃথিবীর বিস্তৃতি, স্থাপিত পর্বতমালা ও উদ্ভিদের নয়নাভিরাম সৌন্দর্য-সব কিছুতে যে স্থিতি, ও সৌন্দর্যের সাধারণ বৈশিষ্ট্য বিরাজমান, তাতে স্রষ্টার সৃজনী-দক্ষতা ও বিচক্ষণতার একটি দিক এবং মহাবিশ্বরূপী গ্রন্থের বিভিন্ন পৃষ্ঠা তুলে ধরা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন ‘আল্লাহর অনুরাগী প্রত্যেক ব্যক্তির জন্যে অন্তর্দৃষ্টি ও উপদেশ স্বরূপ।’ অর্থাৎ এই কোরআনে রয়েছে এমন জ্ঞান ও উপদেশ, যা পর্দা সরিয়ে দেয়, অন্তর্দৃষ্টি উদ্ভাসিত ও প্রখর করে, হৃদয়কে উন্মীলিত করে আর অন্তরাত্মাকে এই বিচিত্র সৃষ্টিজগতের সাথে এবং এর অন্তরালে যে অভিনবত্ব, বিচক্ষণতা ও ধারাবাহিকতা লুকিয়ে রয়েছে, তার সাথে সংযুক্ত করে। এরূপ অন্তর্দৃষ্টি দ্বারা প্রত্যেক অনুগত বান্দা উপকৃত হয়ে থাকে এবং নিজের প্রতিপালকের নিকটবর্তী হয়।  *বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ও ঈমানের দৃষ্টিভঙ্গি : মানুষের হৃদয় ও এই মনােরম চিত্তাকর্ষক সৃষ্টিজগতের দৃশ্যপটের মাঝে এই হচ্ছে যােগসূত্র। এই যােগসূত্রের কারণে সৃষ্টিজগতের প্রতি মানুষের দৃষ্টিপাত ও সৃষ্টিজগত সম্পর্কে পরিচয় লাভ মানব মনের ওপর রেখাপাত করে ও মানব জীবনে তাৎপর্য বয়ে আনে। কোরআন জ্ঞান ও বিজ্ঞানের সাথে মানুষের এই যােগসূত্রই স্থাপন করে। অথচ এ যুগের তথাকথিত বৈজ্ঞানিক গবেষণায় এই যােগসূত্রটাই উপেক্ষিত হয়ে থাকে। আল্লাহ তায়ালা মানুষের আবাসস্থল এই প্রকৃতির সাথে তার যে সম্পর্ক স্থাপন করেছেন, উক্ত গবেষণা তাকে ছিন্ন করে। আসলে মানুষ তাে বিশ্ব প্রকৃতিরই একটা অংশ। এই বিশ্বপ্রকৃতির সাথে খাপ খাওয়াতে না পারলে মানুষের জীবন বিশুদ্ধ ও নির্ভুল হতে পারে না। এই মহাবিশ্বের দৃশ্যপটের সাথে মানুষের হৃদয়ের যােগসূত্র মযবুত ও অটুট না হলে মানুষের জীবন স্বাচ্ছন্দ্যময় হতে পারে না। আকাশের একটি নক্ষত্র, মহাশূন্যের কোনাে একটি স্তর, উদ্ভিদ ও প্রাণীর কোনাে একটি গুণবৈশিষ্ট, অথবা সামগ্রিকভাবে গােটা বিশ্ব-প্রকৃতির গুনবৈশিষ্ট এবং বিশ্ব-প্রকৃতিতে আন্দোলিত কোনাে সজীব ও জড় পদার্থের গুণবৈশিষ্ট্য সম্পর্কে যে কোনাে বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ও তথ্য মানব হৃদয়ে তাৎক্ষণিকভাবে এক মনােরম দৃশ্যপটের সৃষ্টি করে, বিশ্ব-প্রকৃতির সাথে তার সখ্য গড়ে তােলে, মানুষের সাথে প্রাণী ও বস্তুর বন্ধুত্বপূর্ণ পরিচয় প্রদান করে এবং এই বিশ্বজগত ও তার ভেতরে যত বন্ধু ও প্রাণী আছে, তার স্রষ্টার একতা সম্পর্কে চেতনা দান করে। মানব জীবনের এই সুমহান, প্রাণবন্ত, কার্যকর দিকনির্দেশক লক্ষ্য অর্জনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় এমন যে কোনাে জ্ঞান, বিজ্ঞান বা গবেষণা অসম্পূর্ণ, ত্রুটিপূর্ণ ও বিকৃত। এ ধরনের জ্ঞান, বিজ্ঞান ও গবেষণা মানব জীবনের কোনাে উপকার সাধন করতে পারে না। আমাদের এই মহাবিশ্ব সত্যের এক উন্মুক্ত গ্রন্থ। এ গ্রন্থ সকল ভাষায় পড়া যায় এবং সকল উপায়ে উপলব্ধি করা যায়। অজ্ঞ বস্তিবাসী থেকে শুরু করে সুসভ্য প্রাসাদবাসী সকলেই এ গ্রন্থ নিজের যােগ্যতা ও বােধশক্তি অনুপাতে অধ্যয়ন করতে পারে এবং সত্যান্বেষী মাত্রেই এই অধ্যয়ন দ্বারা সত্যের পাথেয় সংগ্রহ করতে পারে। এ গ্রন্থ সব সময়ই উন্মুক্ত। আল্লাহর অনুগত প্রত্যেক ব্যক্তির জন্যে অন্তর্দৃষ্টি ও উপদেশ স্বরূপ’-এ উক্তির এটাই মর্মার্থ । কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান এই অন্তর্দৃষ্টিকে বিকৃত করে দেয় অথবা মানব হৃদয়ের সাথে বিদ্যমান বিশ্বজগতের এই যােগসূত্রকে ছিন্ন করে দেয়। কেননা, এই বিজ্ঞানের সূতিকাগার হচ্ছে কতকগুলাে বিকৃত মস্তিষ্ক, যাকে তথাকথিত বৈজ্ঞানিক কারিকুলাম’ সম্পূর্ণরূপে স্থবির করে দেয়। এই বৈজ্ঞানিক কারিকুলাম মানুষের সাথে তার আবাসস্থল এই প্রকৃতির সম্পর্ক ছিন্ন করে দেয়। অথচ ইসলাম উক্ত বৈজ্ঞানিক কারিকুলাম-এর সুফলকে কিছুমাত্র ক্ষতিগ্রস্ত করে না এবং অকাট্য সত্যকে উপলব্ধি করতে বাধা দেয় না। তবে ইসলাম সেই সাথে বিচ্ছিন্ন সত্যগুলােকে পরস্পরের সাথে যুক্ত করে, সেগুলােকে বৃহত্তম সত্যের সাথে সম্পৃক্ত করে এবং তার সাথে মানব মনকে সংযুক্ত করে। অর্থাৎ মানব মনকে প্রাকৃতিক বিধান ও বিশ্বজগতের যাবতীয় তত্ত্ব ও তথ্যের সাথে যুক্ত করে এবং এই সকল প্রাকৃতিক বিধান ও তথ্যাবলীকে মানুষের অনুভূতিতে ও জীবনে কার্যকর প্রভাব বিস্তারকারী শক্তিতে পরিণত করে। ইসলাম নিছক নিষ্প্রাণ নিরস ও পক্ষপাতদুষ্ট তথ্যাবলী পরিবেশন করে না, যা প্রকৃতির সুন্দর ও চিত্তাকর্ষক রহস্যগুলােকে অনুদঘাটিত অবস্থায় রেখে দেয়, যাবতীয় শিক্ষায় ও গবেষণায় ইসলামী বিধানকে অবশ্যই অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, যাতে তার এই অটুট যােগসূত্রের সাথে বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ও তথ্যাবলীকে যুক্ত করা যায়।
ফী জিলালিল কুরআন:

*পুনরুজ্জীবনের জীবন্ত উদাহরণ : এই আলােচনার পর কোরআন প্রকৃতি নামক গ্রন্থের আরাে এমন কয়েকটি পাতা উন্মীলিত করে, যাতে মহাসত্যের সন্ধান দেয়া হয়েছে। অতপর সর্বশেষে এখানে কিয়ামত ও পরকালের কথা বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আমি আকাশ থেকে বরকতপূর্ণ পানি বর্ষণ করেছি… পুনরুত্থানের ব্যাপারটাও এভাবেই ঘটবে।’ আকাশ থেকে বর্ষিত পানি মৃত মাটিকে তাে জীবনীশক্তি দেয়ই, কিন্তু তার আগে মানুষের মৃত হৃদয়কে পুনরুজ্জীবিত করে থাকে। বৃষ্টির দৃশ্য যে মানুষের অন্তরে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে থাকে, তাতে কোনাে সন্দেহ নেই। শুধু শিশুরাই বৃষ্টিতে আনন্দিত হয় না, বরং বড়দের মনও এ দৃশ্য দেখে উল্লসিত হয়ে থাকে এবং প্রকৃতি-ঘনিষ্ঠ নিম্পাপ শিশুদের মত তাদের মনও স্পন্দিত হয়ে থাকে। এখানে বরকতময় বলে পানির একটি গুণ বর্ণনা করা হয়েছে এবং মহান আল্লাহর উদ্যোগে তা ফলের বাগান ও পরিপক্ক শস্য পয়দা করে থাকে। পানি দ্বারা খেজুর গাছও জন্মে। খেজুর গাছকে উচ্চ ও সুন্দর বলে বিশেষিত করা হয়েছে পরবর্তী আয়াতে। বলা হয়েছে, ‘আরাে উৎপন্ন করে থাকি খেজুর গাছ, যা উচ্চ ও যাতে গুচ্ছ গুচ্ছ খেজুর থাকে।’ আসলে এ আয়াতে উঁচু উঁচু খেজুর গাছে থোকায় থোকায় খেজুরের কাদি কত সুন্দর ও মনােহর দেখায়, সেটাই তুলে ধরা হয়েছে। মহাসত্যের সাথে সামঞ্জস্য রেখেই এ বিশেষণটি ব্যবহৃত হয়েছে। কেননা, মহাসত্য তথা ইসলামী আদর্শ ও বিধান অতি উচ্চ ও উন্নত এবং তা অতীৰ সুন্দর তথা নিখুঁত ও চমকপ্রদ। এই পানি, বাগান, খেজুর গাছ, শস্য ও খেজুর ইত্যাদি দিয়ে যে আল্লাহ তায়ালা মানুষের ওপর কত বড় করুণা ও অনুগ্রহ বর্ষণ করেছেন, তা বর্ণনা করেছেন পরবর্তী আয়াতে মর্মস্পর্শী ভংগিতে বলেছেন, ‘বান্দাদের জীবিকা হিসাবে।’ অর্থাৎ আল্লাহ নিজেই এই জীবিকার উপকরণ তথা বৃষ্টি ইত্যাদি সরবরাহ করেন, তার অংকুরােদগমের ব্যবস্থা করেন এবং বান্দাদের জন্যে তাতে ফল উৎপন্ন করেন। কারণ তিনি তাে মনিব, অথচ এ জন্যে তারা তার শোকর করে না। এই পর্যায়ে প্রাকৃতিক বস্তুসমূহের বিবরণ দেয়া শেষ হয়েছে এবং এর চূড়ান্ত লক্ষ্য তুলে ধরা হয়েছে, ‘অতপর আমি তা দ্বারা মৃত শহরকে পুনরুজ্জীবিত করেছি, আর এভাবেই ঘটবে পুনরুত্থান।’ বস্তুত এ প্রক্রিয়াটি তাদের চারপাশে অহরহই ঘটছে এবং এটা তাদের কাছে সুপরিচিত। কিন্তু তারা এ দ্বারা সচেতন হয় না এবং আপত্তি ও বিস্ময় প্রকাশের আগে এর দিকে ভ্রুক্ষেপও করে না। ‘আর এভাবেই ঘটবে পুনরুথান।’ অর্থাৎ এই প্রক্রিয়ায় এবং এত সহজেই কেয়ামত সংঘটিত হবে। এ কথাটা বলার আগে প্রকৃতির যে দৃশ্যাবলী মানুষের মনের ওপর রেখাপাত করে এবং যা প্রত্যেক অনুগত বান্দার মনকে অনুপ্রাণিত করে, তার বর্ণনা দেয়া হয়েছে। বস্তৃত মন-মগযের স্রষ্টা এভাবেই মন-মগকে নিয়ন্ত্রণ করেন।

ফী জিলালিল কুরআন:

*মানব ইতিহাসের কয়েকটি বিচ্ছিন্ন পাতা : এরপর মানবেতিহাসের এমন কয়েকটি পাতা তুলে ধরা হয়েছে, যাতে মক্কার মােশরেকদের ন্যায় একদল মানুষ আল্লাহর কিতাব, রসূল ও আখেরাতকে নিয়ে তর্কে লিপ্ত হয়েছিলাে, মিথ্যা সাব্যস্ত করেছিলাে এবং শেষ পর্যন্ত আল্লাহর অনিবার্য আযাবে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিলাে। ‘তোমাদের পূর্বে নূহ-এর জাতি… সবাই নবীদেরকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন… বরং তারা নবতর সৃষ্টি সম্পর্কে সন্দেহে লিপ্ত রয়েছে।’ রাস্ শব্দটির অর্থ হচ্ছে বদ্ধ পুকুর, আর আইকা অর্থ ঘন পাতাপূর্ণ বন। আসহাবুল আইকা বলে সম্ভবত হযরত শােয়ায়বের জাতিকে বুঝানাে হয়েছে। কিন্তু ‘আসহাবুর রাস’ বলে কাদেরকে বুঝানাে হয়েছে তা স্পষ্ট নয়। আর ‘তুববা ছিলাে ইয়ামানের হিময়ারী রাজাদের উপাধি। অন্য যেসব জাতির এখানে উল্লেখ করা হয়েছে, কোরআনের পাঠক মাত্রেরই কাছে তারা পরিচিত। আয়াতে অতীতের এই জাতিগুলাের বিস্তারিত বৃত্তান্ত তুলে ধরা উদ্দেশ্য নয়। কেবল আল্লাহর রসূলদেরকে প্রত্যাখ্যান করার পরিণামে কিভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে, সেটাই বর্ণনা করা হয়েছে এবং এ দ্বারা পরবর্তীকালের মানুষের মনকে সতর্ক করা হয়েছে। যে বিষয়টি এখানে লক্ষ্যণীয় তা এই যে, এই জাতিগুলাের সবাই রসূলদেরকে অস্বীকার করেছিলাে। সবাই রসূলদের অস্বীকার করেছিলাে, ফলে আমার হুমকি কার্যকরী হলাে। এ দ্বারা মূলত ইসলামী আকীদা-বিশ্বাস ও রসূলদের দাওয়াতের বিষয় যে সর্বকালে একই ছিলাে, সেটাই বলা উদ্দেশ্য। যে ব্যক্তি একজন রসূলকে অস্বীকার করে, সে সকল রসূলকে অস্বীকার করে। কেননা, সে সকল নবী ও রসূলের আনীত বার্তাকে প্রত্যাখ্যান করে। নবী ও রসূলরা পরস্পর ভাই। একই উম্মাত এবং স্থান-কাল নির্বিশেষে একই বৃক্ষের বিভিন্ন ডালপালা। এর একটি ডালকে ধরার অর্থ গােটা বৃক্ষকে এবং তার সবকটি ডালকে ধরা। ‘ফলে আমার হুমকি কার্যকরী হলাে।’ তাদের কী পরিণতি হয়েছিলাে, তা পাঠকদের কাছে সুবিদিত। এই ধ্বংসাত্মক পরিণতির প্রেক্ষাপটে পুনরায় সেই বিষয়টির উল্লেখ করা হচ্ছে যাকে কাফেররা অস্বীকার করেছিলাে। সেটি হচ্ছে পরকাল সংক্রান্ত বিষয়। বলা হচ্ছে, ‘প্রথমবার সৃষ্টি করেই কি আমি অক্ষম হয়ে গিয়েছি।’ উপস্থিত সৃষ্টিজগতই এর সাক্ষী। তাই এর জবাবের প্রয়ােজন নেই। ‘বরং তারা নতুন সৃষ্টি সম্পর্কে সন্দেহে লিপ্ত রয়েছে’ অর্থাৎ প্রথম সৃষ্টির সাক্ষ্য উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও তারা গ্রহণ করছে না। সাক্ষী থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি অস্বীকার করে, তার কেমন পরিণতি হওয়া উচিত, সেটাই এখন বিবেচ্য।

ফী জিলালিল কুরআন:

*আল্লাহ তায়ালা মানুষের শাহ রগের চেয়েও কাছে : ‘আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি এবং আমি জানি তার প্রকৃতি তাকে কি কি প্ররােচনা দেয়?… সেখানে তারা যা যা চাইবে, তা তাদের জন্যে সংরক্ষিত থাকবে। উপরন্তু আরাে অনেক কিছু আমার কাছে রয়েছে।’ এ হচ্ছে সূরার দ্বিতীয় অংশ। এটা প্রথমাংশের আখেরাত সংক্রান্ত আলােচনার ধারাবাহিকতা এবং রেসালাতকে অস্বীকারকারীদের জবাব। সূরার ভূমিকায় আমরা আল্লাহর যে প্রত্যক্ষ প্রহরা ও পর্যবেক্ষণ এবং তার দৃশ্যাবলী তুলে ধরেছি, এখানে সেটি আলােচিত হয়েছে। তা ছাড়া মৃত্যু ও মৃত্যু প্রাক্কালীন দৃশ্য, অতপর হিসাব গ্রহণ ও আমলনামা প্রদর্শনের দৃশ্য, অতপর জাহান্নামের মুখ ব্যাদান করে ‘আরাে আছে নাকি’ বলে মানুষরূপী কাষ্ঠ প্রার্থনার ভয়াবহ দৃশ্য এবং তার পাশেই জান্নাত ও তার নেয়ামত ও মর্যাদার বিবরণ রয়েছে এ অংশে। জন্ম থেকে মানব জীবনের যে যাত্রা শুরু হয়, মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তার কেবল এক পর্ব থেকে অপর পর্বে উত্তরণ ঘটে এবং কেয়ামত ও হিসাব-নিকাশের মাধ্যমে তার পরিসমাপ্তি ঘটে। এটি একটি বিরতিহীন একক সফর। এ সফর মানুষের মনে তার একমাত্র যাত্রাপথ অংকিত করে, যাতে কোনাে ফাটল বা ছেদ নেই। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এ যাত্রা আল্লাহর প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ ও পর্যবেক্ষণের আওতাধীন। এতে বিন্দুমাত্র উদাসীনতা ও বিপথগামিতার অবকাশ নেই। এটি একটি ভয়ংকর যাত্রা, যা গােটা স্নায়ুকে আতংক ও ত্রাসে আচ্ছন্ন করে রাখে। মহাপরাক্রান্ত ও অন্তর্যামী আল্লাহর মুঠোর মধ্যে থেকে মানুষ কিভাবে তাঁকে ফাকি দেবে? আল্লাহর তাে ঘুম তন্দ্রা নেই, ভুল-ভ্রান্তি নেই! মানুষ যখন জানতে পারে যে, দুনিয়ার কোনা শাসক তার পেছনে গােয়েন্দা লাগিয়ে দিয়েছে এবং নিজেও তার গতিবিধির ওপর নযর রাখছে, তখন তার দেহ-মনে কম্পন এসে যায় এবং সে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। অথচ দুনিয়ার শাসক যত ধুরন্ধরই হােক না কেন, সে বাহ্যিক তৎপরতারই শুধু খবর নিতে পারে। মানুষ যদি নিজ ঘরে বসে থাকে, দরজা বন্ধ করে রাখে কিংবা নীরবতা অবলম্বন করে, তবে সে সহজেই শাসকের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে যেতে পারে। কিন্তু মহাবিশ্বের মহাপরাক্রান্ত শাসক আল্লাহর পাকড়াও থেকে তার নিস্তার নেই, চাই সে যেখানেই বাস করুক এবং যেখানেই চলে যাক। এমনকি আল্লাহর পর্যবেক্ষণে তার মনমগ ও চিন্তা পর্যন্ত ধরা না পড়ে পারে না। এমন কঠিন নিয়ন্ত্রণ ও পর্যবেক্ষণ থেকে মানুষ কোনােভাবেই রেহাই পেতে পারে না। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি এবং আমি জানি তার প্রবৃত্তি তাকে কি প্ররােচনা দেয়। আমি তার ঘাড়ের শাহরগের চেয়েও নিকটবর্তী। ডান ও বাম দিকে উপবিষ্ট দুই প্রহরী যখন মিলিত হয়, তখন মানুষ যে শব্দই উচ্চারণ করে, তা তার কাছে বিদ্যমান সদা প্রস্তুত প্রহরী লিখে রাখে।’ আয়াতের প্রথম কথাটি ‘আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি।’ এর আনুষংগিক বক্তব্যের দিকে ইংগিত করছে। সেটি এই যে, একটি যন্ত্রের প্রস্তুতকারী তার নির্মাণ কৌশল ও যাবতীয় গােপন রহস্য সম্পর্কে অন্য সবার চেয়ে ভালাে জানে অথচ কোনাে যন্ত্রের নির্মাতা তার সৃষ্টিকর্তা নয়। কেননা, সে তার মূল উপাদানগুলাে তৈরী করেনি। সে শুধু তার উপাদানগুলাের সংযােগ ও সমন্বয় ঘটিয়েছে মাত্র! কিন্তু যিনি প্রতিটি বস্তুর সৃষ্টিকর্তা, তার অবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন। মানুষ মূলত আল্লাহর প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণের বাইরে থেকে কিছুটা স্বাধীনতা ভােগ করলেও তার মনের একান্ত গোপন ধ্যান-ধারণা ও চিন্তাধারা তার সর্বজ্ঞ স্রষ্টার কাছে সম্পূর্ণ জানা। তার কাছ থেকে সে কোনাে কিছুই লুকাতে সক্ষম নয়। ‘আর তার প্রবৃত্তি তাকে কী কী প্ররােচনা দেয় তা আমি জানি।’ এভাবে মানুষ দেখতে ও উপলব্ধি করতে পারে যে, সে সম্পূর্ণরূপে প্রকাশিত, কোনাে কিছুর আড়ালে সে লুকিয়ে থাকতে সক্ষম নয়। তার মনে যতরকম কুপ্ররােচনা থাকে তা আল্লাহর কাছে জ্ঞাত। এভাবে যে হিসাবের দিনকে সে অস্বীকার করে থাকে, তার জন্যে তাকে প্রস্তুত করা হয়েছে। ‘আর আমি তার কাছে ঘাড়ের রোগের চেয়েও নিকটতর। ওয়ারিদ হচ্ছে রগ, যার ভেতর দিয়ে রক্ত প্রবাহিত হয়। রগের চেয়েও নিকটবর্তী হওয়া। এমন একটি প্রতীকী উক্তি, যা দ্বারা তার ওপর মহান আল্লাহর একচ্ছত্র ও নিরংকুশ আধিপত্য ও প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণের দৃশ্য ফুটিয়ে তােলা হয়েছে। মানুষ যখন এই ব্যাপারটা কল্পনা করে, তখন সে শিউরে না উঠে ও আত্মসমালােচনা না করে পারে না। এই উক্তিটি দ্বারা যা বুঝানাে হয়েছে তা যদি কোনাে মানুষের হৃদয়ে জাগরূক থাকে, তবে সে এমন একটি শব্দও মুখে উচ্চারণ করতে সাহস পাবে না, যা আল্লাহর পছন্দনীয় নয়। এমনকি আল্লাহর কাছে অনুমােদনযােগ্য নয় এমন চিন্তা তার মনে স্থান পাবে না।

ফী জিলালিল কুরআন:

*মানুষের আমলের রেকর্ড : এই একটি উক্তিই মানুষের সার্বক্ষণিক সতর্কতা, সার্বক্ষণিক ভীতি ও জাগৃতি এবং আত্মসমালােচনার ভেতর দিয়ে জীবন যাপন করার জন্যে যথেষ্ট। তথাপি কোরআন স্বতন্ত্রভাবে আল্লাহর প্রহরা ও পর্যবেক্ষণের ধারণা জাগ্রত ও মযবুত করে। ফলে মানুষ তার জীবন যাপন, কাজকর্ম, ঘুম, পানাহার, কথা বলা ও নীরব থাকা- সবই ডানে ও বামে পাহারারত দু’জন ফেরেশতার মাঝে সম্পন্ন করে-যারা তার প্রতিটি কথা ও কাজ পর্যবেক্ষণ করে এবং সংঘটিত হওয়া মাত্রই লিপিবদ্ধ করে। এরা কিভাবে মানুষের আমল লিপিবদ্ধ করে তা আমরা জানি না। আর এ নিয়ে ভিত্তিহীন আন্দাজ-অনুমানের কোনাে প্রয়ােজন নেই। এ সকল অদৃশ্য বিষয়ে আমাদের নীতি এই যে, এগুলাে যেমন আছে, তেমনভাবেই এগুলােতে বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে এবং এর উপায় ও পন্থা নিয়ে কোনাে চিন্তা-ভাবনা করার দরকার নেই। কেননা, সে চিন্তা-ভাবনায় কোনাে লাভও নেই। তা ছাড়া এসব তথ্য আমাদের অভিজ্ঞতার সীমানারও বাইরে এবং আমাদের মানবীয় জ্ঞানের সীমানারও বাইরে। আমাদের বাহ্যিক মানবীয় বিজ্ঞানের আওতাধীন কিছু রেকর্ডিং এর উপকরণ আবিষ্কৃত হয়েছে, যা আমাদের পূর্বতন পুরুষদের কল্পনারও অতীত ছিলাে। এগুলাের মধ্যে অডিও ক্যাসেট মানুষের কথা ও শব্দ রেকর্ড করে। আর ভিডিও ক্যাসেট, সিনেমার ফিল্ম ও টেলিভিশন ফিল্ম মানুষের কার্যকলাপকে রেকর্ড করে। এগুলাে আমাদের মানবীয় ক্ষমতার আওতাধীন। সুতরাং আমাদের এ কথা বলার প্রয়ােজন নেই যে, ফেরেশতারা আমাদের ব্যবহৃত সীমিত মানবীয় কোনো পদ্ধতিতে রেকর্ড করে থাকতে পারে। কেননা, আমাদের চিন্তা-ভাবনা আমাদের অজানা সেই জগত থেকে অনেক দূরে অবস্থিত এবং সেই জগত সম্পর্কে আমরা আল্লাহর জানানাে তথ্যের বাইরে বিন্দু-বিসর্গ জানতে পারি না। আমাদের জন্যে এই আয়াতে সত্যের যে দৃশ্য তুলে ধরা হয়েছে, কেবল সেইটুকু অনুসরণ করাই যথেষ্ট। আমরা মনে মনে শুধু এতটুকু বিশ্বাস করলেই চলবে যে, আমরা যা-ই বলি বা করি না কেন, তা তাৎক্ষণিকভাবে রেকর্ড করার জন্যে আমাদের ডানে-বামে প্রহরী রয়েছে। তারা এগুলােকে আমাদের আমলনামায় সংরক্ষণ করেন এবং এই আমলনামা সম্পূর্ণ অক্ষত অবস্থায় আল্লাহর সামনে সংরক্ষিত থাকে [{( মানুষের কর্মকান্ড রেকর্ড করার ক্ষেত্রে যেসব নতুন প্রযুক্তি আবিষ্কৃত হয়েছে তার ভিত্তিতে আল্লাহ তায়ালার এ অসীম কুদরতকে আমরা সহজেই বুঝতে পারি। জীব বিজ্ঞানীদের মতে মানুষের হাতের তালুতে যে নানা ধরনের অসংখ্য রেখা রয়েছে, তা তার হাত আ্বারা সম্পাদিত যাবতীয় কর্মকান্ডকে নিখুতভাবে ধরে রাখতে পারে। এমনিভাবে তার পায়ের তালুর রেখাগুলাে তার পায়ের কাজগুলােকে সঙ্গে রক্ষা করে। তাদের মতে ক্ষুত্র ক্ষু্দ্র এ রেখাগুলো রেকর্ডিং-এর ফিতার মতােই মানুষের কর্মকান্ডের সংরক্ষণ করে। সম্ভবত এ কারণেই পৃথিবীর জন্ম থেকে আজ পর্যন্ত এমন দুজন মানুষ পাওয়া যাবে না-যাদের হাতের রেখার মাঝে কোনাে রকম সাদৃশ্য আছে। পার্সেনাল আইডেন্টিফিকেশানের ক্ষেত্রে এই কারণেই দস্তখতের চাইতে টিপসইর মূল্য এতাে বেশী-সম্পাদক)}] এই ভয়াবহ সত্যকে স্বীকার করে এর আওতায় জীবন যাপন করা আমাদের জন্যে যথেষ্ট। এটা একটা অকাট্য সত্য, যদিও আমরা এর বিস্তারিত জানতে পারি না। যেভাবেই হােক, আমলনামা তথা কর্মের রেকর্ড থাকবেই এবং কোনক্রমেই তা থেকে নিস্তার পাওয়া যাবে না। আমরা যাতে এর ভয়ে সাবধান হয়ে চলি, সে জন্যে আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে এর কথা জানিয়েছেন। এর স্বরূপ কী, তা নিয়ে বৃথা চিন্তা-ভাবনা করার কোনাে দায়িত্ব আমাদের ওপর অর্পণ করা হয়নি। যারা কোরআন ও রাসূল(স)-এর নির্দেশের আলােকে জীবন গড়েছে, তাদের নীতি ছিলো এই যে, ইসলামের জ্ঞানার্জন করতে হবে এবং অর্জিত জ্ঞান অনুসারে কাজ করতে হবে। রসূলুল্লাহ(স.) বলেছেন, মানুষ কখনাে কখনাে তার কথাবার্তা দ্বারা আল্লাহকে এতাে সন্তুষ্ট করে যে, তা সে ভাবতেও পারে না। ফলে আল্লাহ তায়ালা তার সে কথার জন্যে কেয়ামত পর্যন্ত তার প্রতি নিজের সন্তোষ লিখে দেন। আবার মানুষ কখনাে কখনাে তার কথাবার্তা দ্বারা আল্লাহকে এতাে অসন্তুষ্ট করে যে, তা সে ভাবতেও পারে না। ফলে আল্লাহ সে কথার জন্যে তার প্রতি কেয়ামত পর্যন্ত অসন্তোষ লিপিবদ্ধ করে দেন। হযরত আলকামা বলেন, এই হাদীসটি আমাকে বহু কথা বলা থেকে বিরত রেখেছে।(তিরমিযী, নাসাঈ, ইবনে মাজা)। কথিত আছে যে, ইমাম আহমদ যখন মৃত্যু শয্যায় শায়িত ছিলেন, তখন তার মুখ দিয়ে যন্ত্রণাজনিত উহ আহ শব্দ বেরুচ্ছিলাে। এই সময় তাকে যেই বলা হলাে যে, উহ আহ শব্দও আমলনামায় লিখিত হয়, তখন তিনি নীরব হয়ে গেলেন এবং সেই অবস্থায়ই তিনি ইন্তিকাল করলেন, সেকালের মনীষীরা এ রকমই ছিলেন। তারা এ সত্যকে মানতেন এবং তদনুসারে কাজ করতেন।  এ আয়াতগুলাে ছিলাে জীবিতকালের প্রসংগ।

ফী জিলালিল কুরআন:

*মৃত্যুর যন্ত্রনা থেকে যারা রক্ষা নেই : এবার আসছে মৃত্যুকালীন প্রসংগ, মৃত্যু যন্ত্রণা সত্য সত্যই আসবে। তুমি তা থেকেই অব্যাহতি চেয়ে আসছে। মানুষ যে সব জিনিস থেকে অব্যাহতি পেতে চায়, এমনকি যার কথা কল্পনাও করতে চায় না, তার মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ জিনিস হচ্ছে মৃত্যু। কিন্তু এ থেকে সে কিভাবে অব্যাহতি পাবে? মৃত্যু তো অবধারিত এবং তা ঠিক নির্দিষ্ট মুহূর্তেই আসবে। মৃত্যু যন্ত্রণার উল্লেখ হাড়গােড়ে কাঁপুনি তােলার জন্যে যথেষ্ট। এই দৃশ্যটা থাকবে উন্মুক্ত এবং মানুষ তা শুনতে পাবে, ‘তুমি তা থেকেই অব্যাহতি চেয়ে আসছ।’ জীবিতাবস্থায় মৃত্যু-যন্ত্রণা থেকে অনেক দূরে অবস্থান করেও যদি মানুষ এই যন্ত্রণার ভয়ে কম্পমান হতে পারে, তাহলে এই যন্ত্রণা ভােগ করার সময়ে যখন তাকে এ কথা বলা হবে, তখন কী অবস্থা হবে, তা সহজেই অনুমেয়। হাদীসে আছে যে, রসূল(স.) যখন মৃত্যু-শয্যায় শায়িত ছিলেন, তখন মুখ থেকে ঘাম মুছতে মুছতে বললেন, ‘সােবহানাল্লাহ। সত্যিই মৃত্যুর যন্ত্রণা রয়েছে।’ মহান আল্লাহকে সর্বোচ্চ বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করা ও তার সাক্ষাতের জন্যে উদগ্রীব হয়েও তিনি যদি এ কথা বলতে পারেন, তাহলে অন্যদের অবস্থা। সহজেই অনুমেয়। এখানে ‘হক’ তথা সত্য শব্দটির উল্লেখ লক্ষণীয়। বলা হয়েছে, মৃত্যু-যন্ত্রণা সত্য সত্যই আসবে।’ এ থেকে বুঝা যায় যে, মানুষের মন মৃত্যু-যন্ত্রণা ভােগ করার সময় সত্যকে পরিপূর্ণভাবে দেখবে। সত্যকে অবারিত অবস্থায় দেখবে এবং সত্যের যেটুকু জানতাে না ও বুঝতাে না তা জানবে ও বুঝবে। তবে তখন আর বুঝে কোনাে লাভ হবে না। কেননা, তখন তাওবার কোনাে গ্রহণযােগ্যতা থাকবে না এবং ঈমানের কোনাে গুরুত্ব থাকবে না। এই সত্যকেই কাফেররা অস্বীকার করতাে এবং এ নিয়ে সংশয়ে আচ্ছন্ন থাকতাে। যখন তা বুঝবে ও স্বীকার করবে, তখন আর তাতে কোনাে লাভ হবে না।
ফী জিলালিল কুরআন:

*কবর থেকে কেয়ামত : মৃত্যু-যন্ত্রণার পর কেয়ামত ও হিসাব-নিকাশ পর্যন্ত আর যা যা ঘটবে তা হচ্ছে, শিংগায় ফুঁক দেয়া হবে। ‘প্রত্যেক ব্যক্তি সেদিন একজন রক্ষক ও একজন সাক্ষী সহকারে আসবে। আমি বান্দাদের জন্যে যালেম নই।’ এ আয়াতগুলােতে যে দৃশ্যাবলী তুলে ধরা হয়েছে, তা মনে জাগরূক রাখা যে কানাে মানুষকে তার সমগ্র জীবন সংযম ও সতর্কতার মধ্যে কাটিয়ে দিতে উদবদ্ধ করে। রসূলুল্লাহ(স.) বলেছেন, আমি কিভাবে স্বস্তি লাভ করি? অথচ শিংগাধারী মুখে শিংগাধারণ করে প্রস্তুত হয়ে বসে আছে, নিজের কপালকে লাল রং-এ রঞ্জিত করেছে এবং তাকে যে কোনাে মুহূর্তে শিংগায় ফুৎকারের নির্দেশ দেয়া হতে পারে। সাহাবীরা বললেন, হে রসূলুল্লাহ(স.) আমরা এখন কী বলবাে? রসূলুল্লাহ(স.) বললেন, বলাে, আমাদের জন্যে আল্লাহ তায়ালাই যথেষ্ট এবং তিনি কতাে সুন্দর অভিভাবক। তখন সকলে বললাে, ‘আমাদের জন্যে আল্লাহই যথেষ্ট এবং তিনি কতাে সুন্দর অভিভাবক।’ প্রত্যেক নাফস সেদিন একজন রক্ষক ও একজন সাক্ষী সহকারে আসবে। এখানে নাফস বলতে সেই মানুষকে বুঝানাে হয়েছে, যার হিসাব নেয়া হবে এবং যাকে কর্মফল দেয়া হবে। তার সাথে তাকে পরিচালনাকারী একজন ও তাকে সাক্ষ্যদানকারী একজন থাকবে। এরা দুইজন পার্থিব জীবনে মানুষের প্রহরী ও পাপপুণ্য লিপিবদ্ধকারী দু’জন ফেরেশতাও হতে পারে। অথবা অন্য কেউও হতে পারে। তবে প্রথমােক্ত দু’জন হওয়াই অধিকতর নির্ভরযােগ্য। এটা বিচারের জন্যে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্যের সাথে অধিকতর সাদৃশ্যপূর্ণ। তবে এই নিয়ে যাওয়াটা কোনাে সাধারণ আদালতে নয়, বরং মহা পরাক্রমশালী আল্লাহর সামনে। এহেন কঠিন ও দুঃসহ অবস্থায় তাকে বলা হবে, তুমি এই দিন সম্পর্কে উদাসীন ছিলে। তাই আমি তােমার চোখ থেকে পর্দা সরিয়ে দিয়েছি এবং এখন তােমার দৃষ্টিশক্তি প্রখর। এখানে প্রখর অর্থ হচ্ছে এরূপ শক্তিশালী যে, পর্দা দিয়ে তা ঢাকা যায় না। আয়াতের মর্ম এই যে, এই দিনটি সম্পর্কে তুমি উদাসীন ছিলে এবং এদিনটির যথাযথ গুরুত্ব দাওনি। এখন একটু তাকাও তাে। আজ তাে তােমার দৃষ্টিশক্তি খুবই প্রখর। এই সময় তার সংগী এগিয়ে আসবে। সম্ভবত সেই হবে শহীদ অর্থাৎ তার সাথী তার সংগী বলবে, এই যে আমার কাছে সব কিছু প্রস্তুত। আয়াতে আমলনামা দেখা ও আদেশ কার্যকরী করার কোনাে উল্লেখ নেই। কেবল রক্ষক ফেরেশতাদ্বয়কে আল্লাহ তায়ালা যা বলবেন তার উল্লেখ রয়েছে। যথা, ‘তোমরা উভয়ে প্রত্যেক হঠকারী কাফেরকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করাে, যে সৎ কাজে ভীষণ বাধাদানকারী, সীমা অতিক্রমকারী, সন্দেহ সৃষ্টিকারী, সর্বোপরি যে আল্লাহর সাথে আরেকজন ইলাহ বানিয়েছে। সুতরাং তাকে কঠিন আযাবে নিক্ষেপ কর।’ এখানে কাফেরের এতগুলাে বিশেষণের উল্লেখ দ্বারা মূলত মহান আল্লাহর ক্রোধ ও আক্রোশকে বুঝানাে হয়েছে। অতপর যেই তাকে কঠিন আযাবে নিক্ষেপ করার আদেশ দেয়া হয়, অমনি তার সংগী ঘাবড়ে যায়, ভয়ে কেঁপে ওঠে এবং তার সংগী হিসাবে নিজের ওপর থেকে সম্ভাব্য অপবাদ প্রক্ষালণের চেষ্টা চালায়, তার সংগী বলে, হে আমাদের প্রতিপালক, আমি ওকে বিপথগামী করিনি, সে নিজেই বিরাট বিভ্রান্তিতে লিপ্ত ছিলাে। সম্ভবত এই সাথী পূর্ববর্তী আমলনামা বহনকারী সাথী নয়। সম্ভবত এই সাথী তাকে গােমরাহকারী শয়তান। সে নিজে তাকে গোমরাহ করেনি বরং সে নিজেই গােমরাহ ছিলাে বলে সাফাই গাইছে। কোরআনে এ ধরনের আরা বহু দৃষ্টান্ত আছে যে, শয়তান তার সংগী মানুষের গােমরাহীর দায়-দায়িত্ব বহনে অস্বীকৃতি জানায়। আবার এই ব্যক্তি আমলনামা বহনকারী ফেরেশতা হতে পারে। কিন্তু পরিস্থিতির ভয়াবহতা হয়তাে সেও ঘাবড়ে গিয়ে নিজেকে নিরপরাধ প্রমাণ করতে সচেষ্ট হতে পারে। নিরপরাধ হয়েও তাকে যদি এভাবে নিজের সাফাই গাইতে হয়, তাহলে সহজেই বুঝা যায় যে, সেই পরিস্থিতিটা কত ভয়াবহ হতে পারে। এই পর্যায়ে এসে চূড়ান্ত নির্দেশ জারী করা হচ্ছে, আল্লাহ তায়ালা বলেন, তােমরা আমার কাছে কোন্দল করো না। আমি তো আগেই তােমাদেরকে হুঁশিয়ারী দিয়েছিলাম। আমার কাছে কথা পরিবর্তিত হয় না এবং আমি বান্দাদের জন্যে যালেম নই। কেননা, ওটা কোনাে ঝগড়াঝাটির জায়গা নয়। প্রত্যেক কাজের পরিণাম ও ফলাফল নির্দিষ্ট করে আগেই হুঁশিয়ারী দেয়া হয়েছে। সব কিছুই রেকর্ড করা এবং তাতে কোনাে রদবদলের অবকাশ নেই। কাউকে রেকর্ড করা আমলনামা ব্যতীত অন্য কিছুর কর্মফল দেয়া হয় না। কাউকে যুলুম করা হয় না। কেননা, কর্মফলদাতা ও বিচারক হচ্ছেন ন্যায়বিচারক। এখানে হিসাব-নিকাশের ভয়াবহ দৃশ্য শেষ হলাে। কিন্তু সব দৃশ্য শেষ হয়নি। বরং এর একটা ভয়ংকর দিক পরবর্তী আয়াতে তুলে ধরা হয়েছে।

Leave a Reply