بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ ( বই # ১১৪০/এবং কাফের-রা বলে -১৩) [*‌‌ আপনি উপদেশ দিতে থাকুন,:- **এ বাণীর মত একটি বাণী তৈরি করে আনুক!!!:- ***কাফেররাই উল্টো নিজেদের ষড়যন্ত্রের জালে আটকা পড়বে:- *  *কতিপয় বাজে মন্তব্যের জবাব :- *  *দ্বীনের দাওয়াত হবে নিঃস্বার্থ :-] www.motaher21.net সূরা:৫২-আত-তূর। পারা:২৭ ২৯- ৪৯ নং আয়াত:- আয়াতের ব্যাখ্যা:-(১) তাফসীরে ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:- ২৯-৪৯ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-(২) তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন

Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১১৪০/এবং কাফের-রা বলে -১৩)
[*‌‌ আপনি উপদেশ দিতে থাকুন,:-
**এ বাণীর মত একটি বাণী তৈরি করে আনুক!!!:-
***কাফেররাই উল্টো নিজেদের ষড়যন্ত্রের জালে আটকা পড়বে:-
*  *কতিপয় বাজে মন্তব্যের জবাব :-
*  *দ্বীনের দাওয়াত হবে নিঃস্বার্থ :-]
www.motaher21.net
সূরা:৫২-আত-তূর।
পারা:২৭
২৯- ৪৯ নং আয়াত:-
আয়াতের ব্যাখ্যা:-(১)
তাফসীরে ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
২৯-৪৯ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-(২)
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
সূরা:৫২-আত-তূর:-২৯
فَذَکِّرۡ فَمَاۤ اَنۡتَ بِنِعۡمَتِ رَبِّکَ بِکَاہِنٍ وَّ لَا مَجۡنُوۡنٍ ﴿ؕ۲۹﴾
অতএব আপনি উপদেশ দিতে থাকুন, কারণ, আপনার রবের অনুগ্রহে আপনি গণক নন, উন্মাদও নন।
সূরা:৫২-আত-তূর:-৩০
اَمۡ یَقُوۡلُوۡنَ شَاعِرٌ نَّتَرَبَّصُ بِہٖ رَیۡبَ الۡمَنُوۡنِ ﴿۳۰﴾
তারা কি বলতে চায় যে, ‘সে একজন কবি? আমরা তার জন্য কালের বিপর্যয়ের (মৃত্যুর) প্রতীক্ষা করছি।’
সূরা:৫২-আত-তূর:-৩১
قُلۡ تَرَبَّصُوۡا فَاِنِّیۡ مَعَکُمۡ مِّنَ الۡمُتَرَبِّصِیۡنَ ﴿ؕ۳۱﴾
তাদেরকে বলো, ঠিক আছে অপেক্ষা করতে থাক, আমিও তোমাদের সাথে অপেক্ষা করছি।
সূরা:৫২-আত-তূর:-৩২
اَمۡ تَاۡمُرُہُمۡ اَحۡلَامُہُمۡ بِہٰذَاۤ اَمۡ ہُمۡ قَوۡمٌ طَاغُوۡنَ ﴿ۚ۳۲﴾
তাদের বিবেক-বুদ্ধি কি তাদেরকে এসব কথা বলতে প্ররোচিত করে, না কি প্রকৃতপক্ষে তারা শত্রুতায় সীমালংঘনকারী লোক?
সূরা:৫২-আত-তূর:-৩৩
اَمۡ یَقُوۡلُوۡنَ تَقَوَّلَہٗ ۚ بَلۡ لَّا یُؤۡمِنُوۡنَ ﴿ۚ۳۳﴾
তারা কি বলে যে, এ ব্যক্তি নিজেই কুরআন রচনা করে নিয়েছে? প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে তারা ঈমান গ্রহণ করতে চায় না।
সূরা:৫২-আত-তূর:-৩৪
فَلۡیَاۡتُوۡا بِحَدِیۡثٍ مِّثۡلِہٖۤ اِنۡ کَانُوۡا صٰدِقِیۡنَ ﴿ؕ۳۴﴾
তাদের একথার ব্যাপারে তারা যদি সত্যবাদী হয় তাহলে এ বাণীর মত একটি বাণী তৈরি করে আনুক।
সূরা:৫২-আত-তূর:-৩৫
اَمۡ خُلِقُوۡا مِنۡ غَیۡرِ شَیۡءٍ اَمۡ ہُمُ الۡخٰلِقُوۡنَ ﴿ؕ۳۵﴾
কোন সৃষ্টিকর্তা ছাড়া এরা কি নিজেরাই সৃষ্টি হয়েছে? না কি এরা নিজেরাই নিজেদের সৃষ্টিকর্তা?
সূরা:৫২-আত-তূর:-৩৬
اَمۡ خَلَقُوا السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضَ ۚ بَلۡ لَّا یُوۡقِنُوۡنَ ﴿ؕ۳۶﴾
না কি পৃথিবী ও আসমানকে এরাই সৃষ্টি করেছে? প্রকৃত ব্যাপার হলো, তারা বিশ্বাস পোষণ করে না।
সূরা:৫২-আত-তূর:-৩৭
اَمۡ عِنۡدَہُمۡ خَزَآئِنُ رَبِّکَ اَمۡ ہُمُ الۡمُصَۜیۡطِرُوۡنَ ﴿ؕ۳۷﴾
তোমার রবের ভাণ্ডারসমূহ কি এদের অধিকারে? নাকি ঐ সবের ওপর তাদের কর্তৃত্ব চলে?
সূরা:৫২-আত-তূর:-৩৮
اَمۡ لَہُمۡ سُلَّمٌ یَّسۡتَمِعُوۡنَ فِیۡہِ ۚ فَلۡیَاۡتِ مُسۡتَمِعُہُمۡ بِسُلۡطٰنٍ مُّبِیۡنٍ ﴿ؕ۳۸﴾
তাদের কাছে কি কোন সিঁড়ি আছে, যাতে আরোহণ করে তারা ঊর্ধ্বজগতের কথা শুনে নেয়? এদের মধ্যে যে শুনেছে সে পেশ করুক কোন সুস্পষ্ট প্রমাণ।
সূরা:৫২-আত-তূর:-৩৯
اَمۡ لَہُ الۡبَنٰتُ وَ لَکُمُ الۡبَنُوۡنَ ﴿ؕ۳۹﴾
আল্লাহর জন্য কি কেবল কন্যা সন্তান আর তোমাদের জন্য যত পুত্র সন্তান?
সূরা:৫২-আত-তূর:-৪০
اَمۡ تَسۡـَٔلُہُمۡ اَجۡرًا فَہُمۡ مِّنۡ مَّغۡرَمٍ مُّثۡقَلُوۡنَ ﴿ؕ۴۰﴾
তুমি কি তাদের কাছে কোন পারিশ্রমিক দাবী করছো যে, তাদের ওপর জোরপূর্বক চাপানো জরিমানার বোঝার নীচে তারা নিস্পেষিত হচ্ছে?
সূরা:৫২-আত-তূর:-৪১
اَمۡ عِنۡدَہُمُ الۡغَیۡبُ فَہُمۡ یَکۡتُبُوۡنَ ﴿ؕ۴۱﴾
তাদের কাছে কি অদৃশ্য সত্যসমূহের জ্ঞান আছে যার ভিত্তিতে তারা লিখছে?
সূরা:৫২-আত-তূর:-৪২
اَمۡ یُرِیۡدُوۡنَ کَیۡدًا ؕ فَالَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا ہُمُ الۡمَکِیۡدُوۡنَ ﴿ؕ۴۲﴾
তারা কি কোন চক্রান্ত আঁটতে চাচ্ছে?(যদি তাই হয়) তাহলে কাফেররাই উল্টো নিজেদের ষড়যন্ত্রের জালে আটকা পড়বে।
সূরা:৫২-আত-তূর:-৪৩
اَمۡ لَہُمۡ اِلٰہٌ غَیۡرُ اللّٰہِ ؕ سُبۡحٰنَ اللّٰہِ عَمَّا یُشۡرِکُوۡنَ ﴿۴۳﴾
নাকি আল্লাহ ছাড়া ওদের অন্য কোন ইলাহ আছে? তারা যে শির্ক স্থির করে আল্লাহ্‌ তা থেকে পবিত্ৰ !
সূরা:৫২-আত-তূর:-৪৪
وَ اِنۡ یَّرَوۡا کِسۡفًا مِّنَ السَّمَآءِ سَاقِطًا یَّقُوۡلُوۡا سَحَابٌ مَّرۡکُوۡمٌ ﴿۴۴﴾
এরা যদি আসমানের একটি অংশ পতিত হতে দেখে তাহলেও বলবে, এ তো ধাবমান মেঘরাশি।
সূরা:৫২-আত-তূর:-৪৫
فَذَرۡہُمۡ حَتّٰی یُلٰقُوۡا یَوۡمَہُمُ الَّذِیۡ فِیۡہِ یُصۡعَقُوۡنَ ﴿ۙ۴۵﴾
অতএব, তাদেরকে আপন অবস্থায় থাকতে দাও। যাতে তারা সে দিনটির সাক্ষাত পায় যেদিন তাদেরকে মেরে ভূপাতিত করা হবে।
সূরা:৫২-আত-তূর:-৪৬
یَوۡمَ لَا یُغۡنِیۡ عَنۡہُمۡ کَیۡدُہُمۡ شَیۡئًا وَّ لَا ہُمۡ یُنۡصَرُوۡنَ ﴿ؕ۴۶﴾
সেদিন না তাদের কোন চালাকি কাজে আসবে, না কেউ তাদেরকে সাহায্য করতে এগুবে।
সূরা:৫২-আত-তূর:-৪৭
وَ اِنَّ لِلَّذِیۡنَ ظَلَمُوۡا عَذَابًا دُوۡنَ ذٰلِکَ وَ لٰکِنَّ اَکۡثَرَہُمۡ لَا یَعۡلَمُوۡنَ ﴿۴۷﴾
আর সেদিনটি আসার আগেও জালেমদের জন্য একটা আযাব আছে। কিন্তু তাদের অধিকাংশই জানে না।
সূরা:৫২-আত-তূর:-৪৮
وَ اصۡبِرۡ لِحُکۡمِ رَبِّکَ فَاِنَّکَ بِاَعۡیُنِنَا وَ سَبِّحۡ بِحَمۡدِ رَبِّکَ حِیۡنَ تَقُوۡمُ ﴿ۙ۴۸﴾
আর আপনি ধৈর্যধারণ করুন আপনার রবের সিদ্ধান্তের উপর ; নিশ্চয় আপনি আমাদের চক্ষুর সামনেই রয়েছেন । আপনি আপনার রবের সপ্ৰশংসা পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করুন যখন আপনি দণ্ডায়মান হন ,
সূরা:৫২-আত-তূর:-৪৯
وَ مِنَ الَّیۡلِ فَسَبِّحۡہُ وَ اِدۡبَارَ النُّجُوۡمِ ﴿٪۴۹﴾
তাছাড়া রাত্রিকালেও তাঁর তাসবীহ পাঠ করো। আর তারকারাজি যখন অস্তমিত হয় সে সময়ও।

২৯-৪৯ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
আলােচ্য এ সূরাতে প্রথমে কেন আযাবের কষাঘাত সম্পর্কে বলা হয়েছে আর কেনই বা দ্বিতীয় অধ্যায়ে গিয়ে প্রচুর নেয়ামতের ঘােষণা দান করা হয়েছে এবং কেনইবা সর্বপ্রকার উপায়ে তাদের অনুভূতিতে প্রকৃত সত্য বিষয়ের চেতনা দান করা হয়েছে তা পরিস্কার হয়ে গেলাে। বর্তমান প্রসংগে এসে তাই অত্যন্ত দ্রুতগতিতে ও তাৎক্ষণিকভাবে বান্দার সামনে সকল অবস্থার বাস্তব চিত্র এঁকে দেয়া হয়েছে। এর ফলে বান্দাহর সামনে বহু তথ্য উদঘাটিত হয়েছে, তার পরপরই আবার তার অন্তরের গােপন কোনে নানাপ্রকার সন্দেহ-সংশয় উঁকি-ঝুকি মারা শুরু করেছে এবং এমন সীমাবদ্ধতার বেড়াজালে সে জড়িয়ে গেছে যেখান থেকে বেরিয়ে আসা বড়ই কঠিন। তাই আল্লাহ তায়ালা তাকে সেই কঠিন অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার পথ বাতলাতে গিয়ে এরশাদ করছেন, ‘অতপর উপদেশ দাও এবং স্মরণ করাও তাদেরকে তুমি তাে আর কোনাে জ্যোতির্বিদ বা গনক নও আর কোনাে পাগলও তুমি নও যে, যা মনে আসবে তাই বলবে…’ (আযাব থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে) আমরা আগেও আল্লাহ… কোনাে নিদর্শন মনে না করে) বলবে, এ তাে হচ্ছে, পুঞ্জিভূত একখন্ড মেঘ মাত্র! (আয়াত ২৮-৪৪) রসূলের ওপর মানুষকে শুধু স্মরণ করিয়ে দেয়ার দায়িত্ব। ‘ফা-যাক্কির’-এ শব্দটি রসূলুল্লাহ(স.)-কে সম্বােধন করে বলা হয়েছে যাতে করে তার উপদেশদানের কারণে তারা প্রিয় নবী(স.)-এর সাথে বেয়াদবী করতে না পারে এবং তাকে মিথ্যা দোষারােপ না করে। আবার তারা একথাও কোনাে সময় বলেছে, সে একজন গনক বা জ্যোতির্বিদ, কখনও বলেছে পাগল। অবশ্য এ দুটি কথা তাদের কাছে একইরকম বলে মনে হয়, যেহেতু জ্যোতর্বিদরা শয়তানের কাছ থেকে কিছু কথা আহরণ করে। আর শয়তানও এই সুযোগে মানুষের বুদ্ধিকে বিভ্রান্ত করে দেয়, যার কারণে তার মধ্যে কিছু পাগলামি দেখা দেয়। সুতরাং প্রকৃতপক্ষে শয়তানই এই উভয় প্রকার দোষের জন্য দায়ী। সে হয়তাে বা জ্যোতির্বিদ একথা বলে তারা মহাগুণান্বিত নবী (স.)-এর ওপর এই ধরনের কথা প্রয়ােগ করতাে, অর্থাৎ কখনও বলতাে তিনি জ্যোতির্বিদ, কখনও বলতাে পাগল। এর কারণ অবশ্য এটিই যে কোরআনে করীমের অলৌকিক বাণীর সামনে তাদের বুদ্ধি খেই হারিয়ে ফেলতাে। তারা বুঝতেই পারতাে না যে কি বলবে। যে কথা তারা বলত, তাদের নিজেদের কাছেই তা খাপ খাওয়ার মতাে কথা মনে হতো না। তারা নিজেরাও ছিলাে কথার রাজা। আল্লাহর কাছ থেকে এ বাণী এসেছে তাদের মানসিক ব্যাধির কারণে তারা এ কথা যখন মানতে পারছিলো না তখন তারা এমন একটি কথা বলতে শুরু করলাে যা মানুষের বুদ্ধিতে ধরে না। এজন্যই তারা বলছিলাে, এটা জিনদের পক্ষ থেকে আসা কথা, অথবা তাদের সাহায্যে আসা অন্য কোনাে কথা। কাজেই যার কাছে এসেছে সে হয় এমন একজন জ্যোতির্বিদ যাকে শয়তান কিছু শিখিয়ে দিয়েছে, অথবা এমন একজন যাদুকর, যে নিয়মিত জিনদের সাহায্য পেয়ে থাকে, কিংবা একজন কবি, যে জিনদের পক্ষ থেকে আসা কোনাে কবিত্ব প্রতিভা হাসিল করেছে, নতুবা এমন একজন পাগল, যার ওপর শয়তান আছর করায় সে পাগল হয়ে গেছে এবং এইসব অদ্ভুত কথা বলতে শুরু করে দিয়েছে। মােশরেকদের এই কথাগুলাে ছিলাে অবশ্য অত্যন্ত বিশ্রী ও মারাত্মক। এ ব্যাপারে আল্লাহ রব্বুল আলামীন রসূলুল্লাহ(স.)-কে সান্ত্বনা দিচ্ছেন এবং সেসব কথাকে তুচ্ছ জ্ঞান করার জন্য তাকে বিশেষভাবে নসীহত করছেন। কেননা তিনি তা নিজেই সাক্ষী যে, মােহাম্মদ(স.) তার প্রতিপালকের করুণা-ধন্য। যার কারণে তার ওপর আন্দায-অনুমানভিত্তিক জ্যোতির্বিদ্যা চর্চা করা বা পাগলামিতে পেয়ে বসার মতাে অবস্থা কিছুতেই আসতে পারে না।  *প্রিয় নবীর ওপর কবিয়াল হবার অপবাদ : এরপর আল্লাহ তায়ালা তাদের যে কথা, ‘তিনি একজন কবি’-একে ঘৃণাভরে খন্ডন করছেন। তিনি বলছেন, ‘ওরা কি বলছে, সে একজন কবি, যার জন্য মৃত্যুকঠিন কোন দুর্ঘটনা আমরা কামনা করি।’ এ কথা তাে ওরা নিজেরা প্রিয় নবী(স.)-কে বলেছে, আবার ওরা একে অপরকে বলেছে, একটু ধৈর্য ধর এবং যা বলেছে তার ওপর টিকে থাকো, যতক্ষণ পর্যন্ত তার মৃত্যু না আসে, ব্যস মৃত্যু এসে গেলেই আমরা বেঁচে গেলাম। আমাদের জানে স্বস্তি এসে গেলাে। এজন্যই তো ওরা নবী(স.)-এর মৃত্যুকে তাদের সান্তুনার বিষয় বলে মনে করতাে, আর এরই কারণে আল্লাহ রব্বুল ইযযত এ হতভাগাদেরকে সন্ত্রস্ত করার উদ্দেশ্যে রসূলুল্লাহ(স.)-কে বিশেষভাবে নির্দেশ দিচ্ছেন। এবং বলছেন, ‘বলাে, (হে রসূল), অপেক্ষা করো, আমিও তােমাদের সাথে আপেক্ষমান হয়ে আছি।’ আর শীঘ্রই তোমরা জানতে পারবে শেষ পরিণতিতে কার কি অবস্থা হবে, আর এই অপেক্ষা করায় কে সাহায্য-প্রাপ্ত হবে আর কে বিজয় লাভ করবে। কোরায়শ নেতারা খুবই ধৈর্যশীল ও বড়ই বুদ্ধিমান বলে পরিচিত ছিলাে এবং তাদের লােকজনকে খুবই বুদ্ধিমান বলে আখ্যায়িত করতো অথবা বলতাে তারা বিস্তর বুদ্ধির অধিকারী। একথা দ্বারা তারা ইংগিতে বুঝাতে চাইতাে যে, তারা গুরুত্বপূর্ণ যে কোনাে কাজ করার ব্যাপারে অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তা ও কৌশলের সাথে কাজ করে। তাই আল্লাহ তায়ালা অত্যন্ত কঠোরভাবে তাদের ধিক্কার দিচ্ছেন, কেননা ইসলাম সম্পর্কে তারা যে দৃষ্টিভংগি পােষণ করতাে তার মধ্যে কোনাে কৌশল, প্রজ্ঞা বা বুদ্ধির লক্ষণ ছিলাে না। এজন্য এ মােশরেকদেরকে লক্ষ্য করে আল্লাহ তায়ালা অত্যন্ত ঘৃণা ভরে বলছেন, মােহাম্মদ(স.)-কে কি এই সমস্ত নিকৃষ্ট গুণের অধিকারী বলে আখ্যায়িত করা যায়, আর তার রেসালাত সম্পর্কে ওরা যে দৃষ্টিভংগি রাখে তা-ই কি তাদের প্রজ্ঞা ও বুদ্ধির পরিচয় বহনকারী? না তারা বিদ্রোহী, যালেম, তারা যুক্তি-বুদ্ধির কোনাে মূল্যই প্রকৃতপক্ষে দেয় না। এরশাদ হচ্ছে, ‘তাদের যুক্তি-বুদ্ধি কি তাদেরকে এইসব বাজে কথা বলতে বলে, না এই আচরণ করতে শেখায়? না, আসলে তারা এক বিদ্রোহী জাতি।’ ওপরের দুটি প্রশ্নের প্রথমটি হচ্ছে, এক তীব্র দংশনকারী প্রশ্ন এবং দ্বিতীয় প্রশ্নটির মধ্যে মারাত্মক মিথ্যা দোষারােপ করার কথা রয়েছে। এইভাবে রসূলুল্লাহ(স.)-এর বিরুদ্ধে তাদের লম্বা কথা বলার অভ্যাস অত্যাধিক বেড়ে গিয়েছিলাে। তারা বহু মনগড়া কথা তৈরী করে বলতে থাকলাে। তাই এখানে আল্লাহ তায়ালা ঘৃণার সাথে তাদেরকে জিজ্ঞাসা করছেন, ‘ওরা কি বলে, সে (মােহাম্মদ) নিজে (কোরআন) রচনা করে বলছে?’ তার মানে ওরা এটা বলতে চায়, যে কথা সে বলছে তা সাধারণভাবে মানুষের পক্ষে বলা সম্ভব নয়। এই কারণেই তাে আল্লাহ তায়ালা ঘৃণার সাথে ওদের কথাটি উদ্ধৃত করতে গিয়ে বলছেন, ‘ওরা কি বলে নাকি সে নিজে রচনা করে করে বলছে?’ সাথে সাথে এই আজব কথাটি বলার কারণও আল্লাহতায়ালা উল্লেখ করছেন, ‘বরং আসল ব্যাপার হচ্ছে, তারা কিছুতেই ঈমান আনবে না।’ এরই কারণে আল্লাহ তায়ালাও তাদের অন্তরকে ঈমানের চেতনা থেকে বঞ্চিত করে দিয়েছেন। ঈমানের তাৎপর্য যাতে তারা না জানতে পারে তার জন্য তিনিই তাে তাদের মুখ দিয়ে এই ধরনের কথা বলাচ্ছেন। তারা যদি তাদের বুঝ শক্তিকে কাজে লাগাতাে, তাহলে নিশ্চয়ই তারা জানতে পারতাে যে, অবশ্যই এটা মানুষের তৈরী করা কোনাে কথা নয় এবং একথাও চিন্তা করতাে, যে কথাটি তিনি বহন করে নিয়ে এসেছেন তিনি সেই মহান ব্যক্তি যিনি পরম সত্যবাদী এবং বিশ্বস্ত বলে খ্যাত।
# এরপর অবতীর্ণ এই মহাগ্রন্থ যে আল্লাহর বাণী তা বুঝা সে হঠকারীদের পক্ষে আর সম্ভবই রইল না, আর এই কারণে আল্লাহ তায়ালা এমন এক যুক্তিপূর্ণ কথা বললেন যার ওপর আর কোনাে তর্কই করা চলে না, ঠিক আছে, ওদের দাবীতে ওরা যদি সত্যবাদীই হয়ে থাকে, তাহলে তৈরী করে নিয়ে আসুক না এমনই কিছু কথা!’ কোরআন করীমে বারবার এই চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। কিন্তু এ নাফরমানরা কোরআনকে শুধু পরাজিতই করতে চেয়েছে এবং বরাবরই কোরআনকে ছােট করে রাখতে চেয়েছে। এহেন আচরণকারী ব্যক্তিরা কেয়ামত পর্যন্ত এমন ধিকৃত আচরণই করতে থাকবে।  *কোরআনের কিছু গােপন রহস্য : অবশ্যই কোরআনুল করীমের মধ্যে বিশেষ কিছু গােপন রহস্য রয়েছে। তারাই সে রহস্য বুঝতে পারে, যারা-এর মধ্যে অবস্থিত আশ্চর্যজনক স্থানগুলাের ব্যাপারে তর্ক করার পূর্বে শুরু থেকেই এই মহান কালাম সম্পর্কে ভিন্ন ধরনের খেয়াল করে এসেছে। কোরআনের প্রতিটি লাইন সম্পর্কে বিশেষভাবে তারা তাদের চিন্তাশক্তি প্রয়ােগ করে। এটা তারা বুঝে যে, কোরআনের যে বাহ্যিক অর্থ মানুষের জ্ঞানে আসে তার উর্ধে-আরও কিছু তাৎপর্য অন্তর্নিহিত আছে। কোরআনের মধ্যে এমন একটি দিক আছে যা সে ব্যক্তির কানে ফোঁটায় ফোটায় মধু ঝরায় যে ব্যক্তি মনােনিবেশ সহকারে কুরআন শোনে। অমিয় সে বাণীর সুধা কারও কারও কানে স্পষ্টভাবে পৌছে যায়, আর কারও কারও কাছে তা অস্পষ্টই থেকে যায়, কিন্তু বাস্তবে তাে এ সুধা ও তার মিষ্টতা সর্বক্ষণ আছেই। এই অমিয় বাণী অনুভূতির মধ্যে প্রবেশ করে কোনাে সুনির্দিষ্ট উৎসের খবর জানায়, এখন প্রশ্ন হচ্ছে সে অমিয় সুধা কি? বাহ্যিক এই বাক্যাবলী, না এর মধ্যে অবস্থিত অন্য কোনাে গােপন রহস্য? না সেই সব চিত্র এবং ছায়া যা দিগন্তব্যাপী ছড়িয়ে রয়েছে! অথবা এ জিনিসগুলাে কি কোরআনের মধ্যে উপস্থাপিত বিশেষ কোনাে বিষয় যা মানুষের রংগীন ভাষা যথাযথভাবে প্রকাশ করতে পারে না? না এগুলাে সবই সামষ্টিক কিছু উপাদান? না মানুষের মধ্যে নিহিত সীমা-সংখ্যার আওতার বাইরের কোনাে অজানা রহস্য? মূলত এসব হচ্ছে এমন সব রহস্য যা কোরআনের সকল আয়াতের মধ্যেই নিবদ্ধ রয়েছে। এসব রহস্য তারাই বুঝতে পারে যারা জীবনের শুরু থেকে কোরআন বুঝতে চায়। এরপর কোরআনে বর্ণিত তথ্যাবলীর ভিত্তিতে সব কিছু গভীরভাবে চিন্তা করে, পর্যবেক্ষণ করে এবং এর ফলে বহু অজানা রহস্যের দ্বার তাদের সামনে উদ্ঘাটিত হতে থাকে। পূর্ণাঙ্গ ও সঠিক চিন্তা তাে সেইটিই যা মানুষের হৃদয়-মন ও তাকে যুক্তি-বুদ্ধি থেকে বেরিয়ে আসে। মানুষের সৃষ্টি কেন, এ সকল সৃষ্টির উদ্দেশ্যই বা কি এবং কি সে মহাসত্য যা প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে দুনিয়া জাহানের সকল কিছুকে সৃষ্ট করা হয়েছে-একথা জানার জন্যই মানুষের মধ্যে চিন্তা শক্তি জাগানাে হয়েছে। এ চিন্তাশক্তির মধ্যে প্রথম সেই সত্যটি সম্পর্কে চেতনা দেয়া হয়েছে যা অন্য সকল সত্যের উৎস, আর তা হচ্ছে আল্লাহর বাস্তবতা সম্পর্কে চিন্তা-ধারণা। এ চিন্তাশক্তিকে পূর্ণাঙ্গ ও সঠিক খাতে প্রবাহিত করা ও মানুষের বােধগম্য করার জন্য যে পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়েছে তা হচ্ছে মানুষের স্বভাব-প্রকৃতির কাছে আবেদন পেশ করা। এ এমন বৈশিষ্টমন্ডিত আবেদন যা গােটা মানবমন্ডলীর কোনাে ভাষার মাধ্যমে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। এ আবেদন মানুষের অন্তরকে সবদিক থেকে ফিরিয়ে নিয়ে আসে এবং এ আবেদনের কারণে তার মধ্যে অন্য কোনাে কথা প্রবেশ করতে পারে না। এ আবেদন সকল দিক থেকে মানুষের মনকে ফিরিয়ে এনে আল্লাহমুখী বানিয়ে দেয় এবং সকল রহস্য বুঝার জন্য উদ্বুদ্ধ করে। মানুষকে সব কিছুর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে, সবার সাথে ভারসাম্য রক্ষা করে চলতে এবং জীবনের সকল দিক ও বিভাগের সাথে পরিপূর্ণ যােগাযােগ রক্ষা করে চলতে। অবশ্য এসব সম্পর্ক-সম্বন্ধ মহান সেই উৎসমূল আল্লাহ রাব্বুল আলামীন-এর সম্পর্কের ভিত্তিতেই গড়ে উঠে। এ ব্যাপারে একজন মােমেন কোনাে মানুষের কাজের সাথে স্বাধীনভাবে সম্পর্ক স্থাপন করবে না। যেহেতু মানুষের চিন্তা-ভাবনাপ্রসূত কর্মকান্ড কোনাে বিশেষ এক জায়গায় স্থির থাকে না বা জীবনের সকল দিককে পরিচালনা করারও যােগ্যতা রাখে না। মানুষ এমন কোনাে ভারসাম্যপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে পারে না যার মধ্যে কোনো বাড়াবাড়ি বা ত্রুটি-বিচ্যুতি নাই এবং এমন কোনাে পন্থাও সে উদ্ভাবন করতে পারে না যা সব দিক দিয়ে ভাল। এ কথাও সে বলতে পারে না যে চূড়ান্ত কোনাে প্রান্তিক সীমারেখার হাতছানি থেকে সে নিজেকে মুক্ত রাখতে পারবে। এ কথাও সে বলতে পারে না যে পূর্ণ নিয়ম-শৃংখলা মত সে নিজে চলতে ও সব কিছুকে চালাতে পারবে। এমন কোনাে মৌলিক বিষয় বা তার শাখা-প্রশাখা নিখুঁতভাবে সে গড়ে তুলতে পারে না, যার মধ্যে কোনাে ত্রুটি দেখা দেবে না সে বিষয়ের উপাদানসমূহের মধ্যে পারস্পরিক বিরােধ লাগবে না বা কোনাে সংঘর্ষও লাগবে না-এ ধরনের কোনাে নিশ্চয়তাও সে দিতে পারে না। এগুলাে তাে হচ্ছে প্রকাশ্য ও বাহ্যিক জিনিস এবং এইগুলাের মতাে অন্যান্য আরও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জিনিস রয়েছে। এসবের সাথে আরও অনেক গােপন তথ্য রয়েছে যার কোনােটাকেই অস্বীকার যায় না। এই সব ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ও রহস্যময় বিষয়ের অনেকগুলাে এই পাক কালামের মধ্যে বর্ণিত হয়েছে যাতে সর্ব যুগের চাহিদা পূরণ করা যায় এবং সকল শ্রেণীর মানুষের মন মুগ্ধ হয়। এ হচ্ছে এমন একটি বিষয় যাকে মানুষের অন্তর ও অনুধাবনশক্তি শ্রদ্ধা করে, আর এই কারণেই এ নিয়ে সে বেশী মাথা ঘামায় না। সে সম্মান করে সেই শক্তিকে যা সে তার সমন্ত বুঝশক্তি দিয়ে গভীরভাবে বুঝতে পারে। এই মযবুত বুঝশক্তি বা হৃদয়কে আল-কোরআন ‘কালবুন সালীম’ অর্থাৎ আনুগত্য ভরা প্রশান্ত মন বলে অভিহিত করেছে ‘অতএব-(বিরোধী সে মােশরেকরা) এই রকমই কিছু কথা নিয়ে আসুক না কেন-যদি কোরআন মােহাম্মদ-এর মনগড়া তাদের এই দাবীকে তারা সত্য বলে মনে করে।
# জিলালিল কুরআন:

*মানুষ নিজেই তার এক রহস্য : নীচের প্রশ্নগুলাে হচ্ছে তাদের অস্তিত্বের রহস্য ও তার তাৎপর্য সম্পর্কে। তারা নিজেরা, অর্থাৎ তাদের নিজেদের অস্তিত্বই তাে রহস্যময়। এ এমন এক সত্য যা কেউই অস্বীকার করতে পারে না। আর মানুষের জীবন ও অস্তিত্ব যে কি আশ্চর্যভাবে নির্মিত তার ব্যাখ্যা আল কোরআন ছাড়া আর কেউই দিতে পারে না। তাদের অবশ্যই একজন সৃষ্টিকর্তা আছেন, যিনি তাদের থেকে যােগ্য ও অধিক মান-মর্যাদাসম্পন্ন। তিনিই মহান আল্লাহ, তিনি বরাবরই যিন্দা আছেন এবং তিনিই স্বয়ংসম্পূর্ণ, আর বাকি সবাই সৃষ্টজীব। এ বিষয়ে এরশাদ হচ্ছে, ‘তারা কি এমনি এমনিই সৃষ্টি হয়ে গেছে, অথবা তারা নিজেরাই কি নিজেদের সৃষ্টিকর্তা?’ কোনাে জিনিসের সাহায্য ছাড়া নিজে নিজেই সৃষ্টি হয়ে যাওয়া-এ এমন একটি কথা, যা প্রথমত প্রত্যেক মানুষের মধ্যে অবস্থিত যুক্তিবুদ্ধি কিছুতেই স্বীকার করে না এবং এ বিষয়ে বেশী বা কম তর্ক-বিতর্কের প্রয়োজন নেই। অন্য প্রশ্ন, সে নিজেই নিজের সৃষ্টিকর্তা। এটা এমনই এক | বিষয়, যা সে নিজে বা অন্য কোনাে সৃষ্টজীব কোনাে দিন দাবী করেনি। নিজে নিজে সৃষ্টি হওয়া এবং নিজেই নিজের সৃষ্টিকর্তা হওয়া-এই দুইটির কোনােটাই যুক্তি-তর্কে যদি না টেকে, তাহলে আল কোরআন যে সত্য পেশ করেছে তা গ্রহণ করা ছাড়া আর কোনােই উপায় থাকে না, আর আল কোরআনে পেশ করা সে সত্য হচ্ছে সব কিছু একমাত্র আল্লাহরই সৃষ্টি। সে মহান স্রষ্টার সাথে (সাহায্য করার বা এ কাজের) অংশীদার বলতে আর কেউ নেই। মূল ঘটনা যখন এই তখন তার এই সৃষ্টির প্রতিপালন ও তাদের আনুগত্য লাভের যােগ্যতা ও অধিকারও আর কারও নেই। এ যুক্তিটা যেমন স্পষ্ট, তেমনই সুদূরপ্রসারী।
# জিলালিল কুরআন:

*পৃথিবী সৃষ্টির মৌলিক দর্শন : এরপর তাদের সামনে রয়েছে গােটা আকাশমন্ডলী ও বিশাল এ পৃথিবীর অস্তিত্ব। ওরাই কি এসব কিছুকে সৃষ্টি করেছে? একথার জওয়াব একমাত্র এটিই যে, না, মানুষ নিজেকে যেমন সৃষ্টি করতে অক্ষম, তেমনি অন্য কাউকে বা অন্য কিছুকে সৃষ্টি করার ক্ষমতা তার নেই। এরশাদ হচ্ছে, ‘তারা কি আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীকে সৃষ্টি করেছে?’ না, বরং তারা নিজেরাই একথা স্থিরভাবে বিশ্বাস করে না। তারা নিজেরা বা কোনাে যুক্তি-বুদ্ধি একথা বলার অধিকার রাখে না। তারা একথাও কেউ বলে না যে, আকাশ -মন্ডলী ও পৃথিবী নিজেদেরকে নিজেরাই সৃষ্টি করেছে, অথবা কোনাে স্রষ্টা ছাড়া এমনি এমনিই সৃষ্টি হয়ে গেছে, আর তারা কেউ একথাও দাবী করে না যে তারাই এ আসমান-যমীনকে সৃষ্টি করেছে। বিশাল এ সৃষ্টি দাঁড়িয়ে আছে সবার সামনে তার সকল রহস্যরাজি নিয়ে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, কে এ সবের স্রষ্টা আর ইতিপূর্বেও যখনই তাদেরকে আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে, তখন তারা বলেছে, আল্লাহ। কিন্তু এ মহাসত্যের ওপর তাদের ঈমান এতটা স্পষ্ট নয় যে, তাদের অন্তরের ওপর দৃঢ়ভাবে এর ছাপ পড়তে পারে এবং তাদের এ বিশ্বাসকে গভীর বিশ্বাসের রূপ দিতে পারে, ‘বরং সত্যিকারে তারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে না।’ এরপর তাদের মর্যাদাকে আর এক স্তর নামিয়ে দিয়ে তাদেরকে জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে, অর্থাৎ তাদের নিজেদের অথবা আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সৃজনী ক্ষমতার নীচে অন্য কোনাে ক্ষমতা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে, ওরা কি আল্লাহ পাকের সম্পদ ও অর্থভান্ডারের মধ্যে কোনাে কিছুর ওপর মালিকানার দাবী রাখে নাকি? ইচ্ছা করলেই কি তারা এগুলাে সব করতে পারে, বা ইচ্ছামত কি এগুলােকে ছেড়ে দিতে পারে, অথবা এগুলাের কোনাে ক্ষতি বা উপকার তারা করতে পারে কি? এরশাদ হচ্ছে, ‘তাদের কাছে কি তােমার রব-এর কোনাে ভান্ডার রয়েছে, না তারাই এগুলাের তত্ত্বাবধায়ক?” আর যদি তা না হয় এবং এ দাবীও যদি তা না করে, তাহলে এগুলাের মালিক কে, আর কেই বা এসব কিছুকে পরিচালনা করছে। এ বিষয়ে আল কোরআন জওয়াব দিচ্ছে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা এগুলাে প্রয়ােজন মতাে কাজ করেন, আবার ছাড়তে চাইলে ছেড়ে দেন। এগুলােকে তিনি চালান এবং এগুলাের মধ্যে পরিবর্তন-পরিবর্ধনের কাজও একমাত্র তিনিই করেন।’ সৃষ্টির মধ্যে কোনাে কিছুকে পাকড়াও করা, ঢিল দেয়া, নিয়ন্ত্রণ করা বা পরিচালনা করার ক্ষমতা ও অধিকার অন্য কারও আছে- একথা প্রত্যাখ্যান করার পর একথা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, এসব কিছুর মালিক হওয়ার অধিকার একমাত্র আল্লাহর- এইটিই গােটা সৃষ্টি-পরিচালনার একমাত্র ব্যাখ্যা। এরপর ভ্রান্ত ও সীমা অতিক্রমকারী মানুষের মর্যাদাকে আর এক দফা নামাতে গিয়ে জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে, ‘আল্লাহর বাণীর উৎসমূলে পৌঁছানোর মতাে কোনাে উপায় তাদের কাছে আছে কি? তাদের কাছে কোনাে সিড়ি আছে নাকি, যা বেয়ে ওপরে উঠে গিয়ে তারা আল্লাহ রব্বুল আলামীনের কথা শুনে আসতে পারে? বেশ, তা যদি থেকেই তাকে, তাহলে সে ব্যক্তি তাদের এই দাবীর পক্ষে কোনাে যুক্তি বা স্পষ্ট দলীল-প্রমাণ হাযির করুক না কেন?’ মােহাম্মদ(স.) সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে বলছেন, সে তাে একজন রসূল (বার্তাবাহক) মাত্র তার কাছে ওহী পাঠানাে হয় এবং এই কোরআন তার কাছে উর্ধাকাশ থেকে নেমে আসে। অথচ যে বিষয়ে আল্লাহ তায়ালা নিজেই কথা বলছেন, সেই বিষয়টিকেই তারা মিথ্যা বলে দাবী করছে? তাহলে তাদের কাছে কোনাে সিঁড়ি আছে নাকি, যা বেয়ে ওপরে উঠে গিয়ে তারা নিজেরা মূল সত্যটি জেনে আসতে পারে এবং তারা যদি আরও জেনে আসতে পারে যে, মােহাম্মদ(স.)-এর কাছে কোনাে ওহী আসে না, বরং তিনি যা বলছেন তা সঠিক নয়, সত্য অন্য কিছু। এরশাদ হচ্ছে, ‘বেশ তাে সে ব্যক্তিরা (তাদের দাবীর পক্ষে) স্পষ্ট কোনাে দলীল-প্রমাণ হাযির করুক না কেন।’ অর্থাৎ কোনাে এমন মযবুত দলীল তারা পেশ করুক, যার দ্বারা তাদের কথা সত্য প্রমাণিত হয়। এ কথার মধ্যে কোরআনের ক্ষমতার প্রতি ইংগিত করা হয়েছে। আল কোরআনের আয়াতসমূহে যে সব যুক্তি-প্রমাণ পেশ করা হয়েছে তা খন্ডন করার সাধ্য কারও নেই। অথচ তারা সে যুক্তি-প্রমাণের দিকে খেয়াল না করে অহংকারে মত্ত এবং নিজেদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠায় সদাসর্বদা ব্যস্ত।
# জিলালিল কুরআন:

*কতিপয় বাজে মন্তব্যের জবাব : এরপর আলােচনা আসছে পাক-পবিত্র আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে তারা যেসব এলােমেলো ও লাগামহীন কথার্বাতা বলতাে সে বিষয়ে ফেরেশতাদের সম্পর্কে তারা বলতাে যে, তারা সব আল্লাহর কন্যা সন্তান-এ বিষয়ে তাদের প্রতি সরাসরি ইংগিত করে বলা হচ্ছে, ‘হাঁ, যত কন্যা সন্তান সব তার, আর যত পুত্র সন্তান সবই তােমাদের?’ অথচ আরবের সাধারণ অবস্থা ছিলাে এই যে, তারা ছেলেদের তুলনায় মেয়ে হওয়াকে তাদের জন্য তুচ্ছ ও অপমানজনক মনে করতাে। মেয়েদেরকে তারা এত বেশী ছােট জানতো যে, কারও ঘরে কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করেছে জানতে পাবার সাথে সাথে রাগে-দুঃখে তার মুখ কালাে হয়ে যেতাে। এতদসত্ত্বেও ফেরেশতাদেরকে আল্লাহর কন্যা সন্তান বলতে তারা এতটুকু লজ্জাবােধ করতাে না। এজন্যই আল্লাহ তায়ালা অত্যন্ত কঠোরভাবে তাদের প্রচলিত রীতির বিরুদ্ধে আল্লাহর কন্যা সন্তান দাবীর সমালােচনা করেছেন। মূলত এ ছিল এমন এক দাবী যার পেছনে কোনাে যুক্তি ছিলাে না।
# ফী জিলালিল কুরআন:

*দ্বীনের দাওয়াত হবে নিঃস্বার্থ : অপরদিকে সত্য সঠিক পথের দিকে নবীর আহবানকে বড়ই কষ্টকর এক বােঝা বলে তারা মনে করতাে। অথচ নিছক নবুয়তের দায়িত্ব পালন করার উদ্দেশ্য ছাড়া এই আহবানে তার নিজের যে কিছুমাত্র স্বার্থ ছিলাে না একথা তারা ভালভাবেই বুঝতাে। কারণ একাজের জন্য তিনি কখনও তাদের কাছে কোনাে মজুরী বা প্রতিদান চাননি। এ দায়িত্ব পালনের কাজ করতে গিয়ে তিনি যে সকল মানুষের কল্যাণ কামনা করতেন তা বুঝা খুবই সহজ ছিলাে। যে কথাগুলাে ওদের কাছে নবী(স.) পেশ করছিলেন তার দ্বারা তিনি যে তাদের কল্যাণই কামনা করতেন তা এইভাবে বুঝা যায় যে, তিনি তাদের বাপ-দাদাদের অমিলের প্রচলিত ধর্মের বিরুদ্ধে তখন কথা বলেছেন যখন তাদেরকে সে জীবন বিধানের দিকে আহ্বান করার মতাে কেউই ছিলাে না। তাই আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করছেন, ‘তুমি কি তাদের কাছে ইসলামের দাওয়াত পেশ করার বিনিময়ে কিছু প্রতিদান চাইছে, যার কারণে তারা এটাকে জরিমানার বিরাট এক বােঝা মনে করে নিয়েছে।’ অর্থাৎ, তুমি যে কথাগুলাে তাদেরকে বলছো তার প্রতিদান হিসাবে তাদের কাছে কিছু চাইলে সেটাকে তারা জরিমানার বােঝা মনে করতাে। কিন্তু বাস্তবে তাে কোনাে বিনিময় চাওয়ার প্রশ্নই আসে না, তাহলে জরিমানা আদায় করার প্রশ্ন আসবে কেমন করে। নবীর সাথে এইভাবে ব্যবহার করা এবং তাকে এই ধারণা দেয়া যে, তার প্রদত্ত দাওয়াত যেন জরিমানার বিরাট এক বােঝা এক মহা যুলুম নয় কি?
# ফী জিলালিল কুরআন:

*তারা কি গায়েব জানে? : এরপর, আবারও আল্লাহ তায়ালা লােকদেরকে তাদের অস্তিত্বের গুরুত্ব এবং গােটা সৃষ্টির মধ্যে তাদের মর্যাদার কথা স্মরণ করাচ্ছেন। আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টির সকল বস্তুকে তাদের অনুগত করে দিয়েছেন-এটা তারই নিজস্ব আইন অনুযায়ী করেছেন বলেই সব কিছু এক নির্দিষ্ট মাত্রায় মানুষের পদানত হয়ে যায়। সৃষ্টির কিছু রহস্য তাদের কাছে উদ্ঘাটন করেছেন এবং নির্দিষ্ট সে সীমার বাইরে অনেক কিছু তাদের নজরের ও বােধগম্যের বাইরে রেখেছেন, যা একমাত্র সৃষ্টির মালিক আল্লাহ তায়ালাই জানেন। কিছু রহস্য এমনও আছে, যা মানুষ ছাড়া আল্লাহর অন্য কোনাে বান্দা জানে না, এ বিষয়ে মানুষ ইচ্ছা করলেও তার সে জ্ঞান হাসিল করতে পারবে না। সে তাে তারই বান্দা! তার ইচ্ছা ছাড়া কোনাে বান্দা কোনাে কিছু জানতে পারে না। এরশাদ হচ্ছে, ‘ওদের কি গায়বের কোনাে খবর আছে, যা তারা লিখে রাখছে?’ অথচ তারা জানে যে গায়বের কোনাে খবর তারা জানে না এবং গায়বের জ্ঞান লাভ করার মতাে কোনাে ক্ষমতাও তাদের নেই। গায়বের রেজিষ্টারে তারা কিছু লিখে রাখতেও সক্ষম নয়, সে পুস্তকে একমাত্র আল্লাহ তায়ালা তার বান্দার ভাগ্যে যা দান করতে চান, তা লিখে রাখেন। কে আছে এমন যে গায়বের খবর রাখতে পারে, জানতে পারে সে কথা যা আল্লাহ তায়ালা নির্ধারণ করে রেখেছেন এবং সেই ব্যবস্থা যা তিনি পরিচালনা করছেন। একমাত্র তিনিই সকল ব্যবস্থা ঠিক করে রাখার মালিক এবং তিনিই সর্বকালের সকল চক্রান্তকারীর যাবতীয় চক্রান্তকে নস্যাৎ করে দিতে পারেন। সুতরাং যারা গায়বের খবর রাখে না, তার রেজিষ্টারে কিছু লিখতে পারে না, তাদের কি করার ক্ষমতা আছে? হে রসূল, তােমার বিরুদ্ধে ওরা যেসব ষড়যন্ত্র করছে এবং তােমাকে বিপদে ফেলার জন্য তারা নানারকম ব্যবস্থা নিচ্ছে, আর মনে করছে ভবিষ্যতের অনেক কাজ তাদের ইচ্ছামতাে তারা করতে পারবে। এ জন্যই তাে ওরা বলছে, এ ব্যক্তি নিছক একজন কবি বৈ ভিন্ন কিছু নয়, আমরা ওর জন্য মৃত্যু-কঠিন কোনাে দুর্ঘটনার অপেক্ষা করছি। আল্লাহ তায়ালা ওদের একথার জবাবে বলছেন, ওরা কি কিছু চক্রান্ত করতে চাইছে? অতপর ওদের জানা দরকার, কুফরী যারা করেছে তারাই ষড়যন্ত্রের শিকার হবে। এ অবিশ্বাসী ও সত্যের দুশমনদেরকেই গায়বের মালিক সর্বশক্তিমান আল্লাহ তায়ালা সেই শাস্তি দ্বারা পাকড়াও করবেন, যা তাদের জন্য তিনি ঠিক করে রেখে দিয়েছেন। তাদের ওপরেই নেমে আসবে আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত শাস্তি এবং তার ফায়সালা এবং আল্লাহ তায়ালাই। সর্বোত্তম ব্যবস্থা গ্রহণকারী। ‘আল্লাহ তায়ালা ছাড়া ওদের পক্ষে (কাজ করার মতাে) অন্য কোনো সার্বভৌম মালিক আছে নাকি? যারা ওদেরকে রক্ষা করবে, মুরব্বী বা বন্ধুর মতো সাহায্য করতে দরদভরা দিল নিয়ে এগিয়ে আসবে এবং আল্লাহর ক্রোধ থেকে ওদেরকে বাঁচাবে? ‘আল্লাহ তায়ালা সকল প্রকার শরীক গ্রহণ করা থেকে মহা পবিত্র, তিনি পবিত্র তাদের থেকে যাদেরকে ওরা তাঁর সাহায্যকারী মনে করে।’ আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এ ব্যাধিগ্রস্ত মােশরেকদের ভুল ও রােগগ্রস্ত চিন্তা-ভাবনার উর্ধে সর্বশক্তিমান মহাসত্তা। আল্লাহ সােবহানাহু ওয়া তায়ালার ক্ষমতা যাবতীয় দুর্বলতার উর্ধে থাকার কথা ঘোষণার সাথে সাথে এবং রসূল(স.) ও দ্বীন ইসলামের ওপর আঘাতের জওয়াব দান করার পর এ প্রসংগ শেষ করা হচ্ছে। এখানে নাফরমানদের ওপর যে কঠিন আযাব নেমে আসবে তারও বিশদ বিবরণ দেয়া হয়েছে। এ আলােচনায় সকল সন্দেহ-সংশয়ের জট খুলে গেছে। তাদের প্রত্যেক কুটতর্ককে খন্ডন করা হয়েছে। অবশেষে সমগ্র জাতি স্পষ্ট সত্যের মুখােমুখি হওয়ার সুযােগ লাভ করেছে। তাদের কাছে ইসলামের বাইরে থাকার মতো অজুহাত অথবা পেশ করার মতাে কোনাে দলীল আর অবশিষ্ট থাকেনি। কিন্তু অন্তরের অন্ধ যারা তারা তখনও সুস্পষ্ট সত্যের বিরুদ্ধে নানাপ্রকার ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছিল এবং সুদূরপ্রসারী আরও বিভিন্ন সন্দেহ সৃষ্টি করার প্রয়াসে মেতেছিলাে। এরশাদ হচ্ছে, ‘আকাশ থেকে কোনাে কিছুর টুকরা পড়লে তারা বলে উঠতাে, এ তাে হচ্ছে এক খণ্ড জমাট মেঘখন্ড’ অর্থাৎ আকাশ থেকে আযাব হিসাবে ধ্বংসাত্মক কোনাে পাথর বৃষ্টি হতে দেখলেও তারা বলতাে, এত জমাট মেঘ খন্ড, এর মধ্যে পানি ও সঞ্জাবনী শক্তি রয়েছে, এতে ভয়ের কি আছে! সত্যের বিরুদ্ধাচরণের উদ্দেশ্যেই তারা এসব বলতাে যাতে সত্যের দিকে কেউ এগিয়ে না আসে। যদিও এসময়ে তাদের মাথার ওপর তরবারি ঝুলছিলাে। যেমন তাদের নিজেদের কথাতেই প্রকাশ পেয়েছে। এই সময় ওদের নিজেদের কথা বলতে গিয়ে সম্ভবত আদ জাতির পরিণতির দিকে ইংগিত করা হয়েছে, যেহেতু এ ঘটনা সাধারণভাবে তাদের মধ্যে জানাজানি ছিলাে। তারা নিজেরা এ আদ জাতির কথা বলাবলি করতাে। এ জাতির ওপর যখন গযব ও ধ্বংসের বার্তা বহনকারী মেঘ নেমে আসছিলাে, তখনও ওরা বলছিলো, ‘এত মনােরম মেঘমালা (আমাদের ওপর) বারিবর্ষণ করার জন্যই নেমে আসছে।’ কোথায় গেল তাদের এ আযাব প্রতিরােধ শক্তি? ‘বরং, এ তাে হচ্ছে সেই আযাব যার জন্য তােমরা বড়ই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলে। এ ছিলাে এক প্রচন্ড বায়ুপ্রবাহ, যার মধ্যে কঠিন আযাব ছিলাে যা তার রব-এর নির্দেশে সব কিছুকে মিসমার করে এক ধ্বংস্তুপে পরিণত করেছিলাে।
# জিলালিল কুরআন:

*মােশরেকদের ধ্বংস অনিবার্য : মােশরেকদের মাথার ওপর ধ্বংস ও বিপর্যয়ের সংকেত দাঁড়িয়ে থাকা সত্ত্বেও তারা সত্যের বিরুদ্ধে যে দৌরাত্ম্য প্রদর্শন করে চলেছিলাে, যে হিংসা-বিদ্বেষ ও অহংকার দেখাচ্ছিল, এখানে ছবির মতাে তার বিবরণ দান করার পর রসূলুল্লাহ(স.)-কে সম্বােধন করে আল্লাহ তায়ালা তাদের ব্যাপারে সর্বপ্রকার হস্তক্ষেপ বন্ধ করার জন্য নির্দেশ দিচ্ছেন। সেই দিনের জন্য তাদেরকে ছেড়ে দিতে বলছেন যার বর্ণনা ইতিমধ্যে পেশ করা হয়েছে এবং এ সূরার শুরুতেও যার উল্লেখ করা হয়েছে এবং সেই আযাবের কথা উল্লিখিত হয়েছে যা তাদের জন্য অপেক্ষা করছে। আর নবী(স.)-কে আল্লাহ যে মান-মর্যাদা দিয়েছেন, নিজ হাতে পরিচালনা করেছেন এবং সর্বাবস্থায় তার তত্ত্বাবধান করেছেন তা স্মরণ রেখে তার ফায়সালা আসা পর্যন্ত একটু ধৈর্য ধরার জন্য উপদেশ দিচ্ছেন। তাকে নির্দেশ দিচ্ছেন যেন তিনি আল্লাহ পাকের কৃতিত্বের কথা উল্লেখ করে ঘুম থেকে উঠার সময়, রাতের এক অংশে এবং তারকারাজি ডুবে যাওয়ার পর অর্থাৎ শেষ রাতে বেশী বেশী তার পবিত্রতার কথা ঘােষণা করেন। একথা বেশী বেশী স্মরণ করেন যে তিনি সকল সীমাবদ্ধতার উর্ধে। তাই এরশাদ হচ্ছে, ‘অতএব, ওদেরকে ছেড়ে দাও সেই দিনের জন্য যেদিন তাদের ওপর এসে পড়বে এক বজ্রকঠিন শব্দের’ আযাব । যেদিন তাদের কোনাে চক্রান্ত তাদের এতটুকু উপকারে আসবে না। আর তাদেরকে কোনাে দিক থেকে কোনাে সাহায্যই করা হবে না। আর মানুষের ওপর যারা অতীতে অত্যাচার করেছে, তাদেরকে তাে এই আযাব ছাড়াও অন্য আরও অনেক আযাব দেয়া হবে, যা তাদের অধিকাংশই জানে না। আর তুমি তােমার রব-এর ফায়সালার অপেক্ষা করাে। জেনে রাখ, তুমি আমার সরাসরি সাহায্যের মধ্যে আছ আর যখনই তুমি ঘুম থেকে ওঠো আমার নামের তাসবীহ জপতে থাকবে এবং আমি যে যাবতীয় দুর্বলতামুক্ত তা স্মরণ করতে থাকবে। রাতের একটি অংশে এবং তারাগুলাে ডুবে যাওয়ার পরও আমার কথা স্মরণ করে আমার প্রশংসা করো। মােশরেকদেরকে আক্রমণ করতে গিয়ে যে নতুন আর একটি অধ্যায় শুরু করা হচ্ছে তার সূচনা করা হচ্ছে এই ভয়াবহ দিনের ভীষণ ভীতিজনক অবস্থার ভয় দেখিয়ে, যেদিন শিংগায় ফুঁক দেয়া হবে, যার ফলে তারা বেহুশ হয়ে পড়ে যাবে-সে ভীষণ অবস্থার পরই কবর থেকে সবাই উঠে হাশরের মাঠ জমা হয়ে যাবে। সেদিন কারও কোনাে তদ্বীর কাজে লাগবে না এবং কোনাে সাহায্যকারী মেদিন কাউকে সাহায্য করতে পারবে না। আজকে তারা নানাপ্রকার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকতে পারে এবং বিভিন্ন প্রকার তদবীর করলেও করতে পারে, কিন্তু সেদিন কোনাে ষড়যন্ত্র এবং কোনাে তদবীর তাদের কোনাে কাজে লাগবে না। অবশ্য একথাও সত্য যে, এ চূড়ান্ত আযাব আসার আগেও কিছু শাস্তি তাদের জন্য রয়েছে, যা তাদেরকে সবার স্মরণের বাইরে নিক্ষেপ করবে। কিন্তু তাদের অধিকাংশই এ বিষয়ে জানে না। নবীকে মিথ্যাবাদী বলে দোষারােপকারী ও সেইসব যালেম যারা দীর্ঘদিন ধরে মুসলমানদের পেছনে লেগে থেকেছে, তাদের সম্পর্কে সর্বশেষ এই কঠিন ও প্রচন্ড তিরস্কারের কথা উচ্চারণের পর এ প্রসংগ শেষ করা হচ্ছে। সংগে সংগে শাস্তি না দিয়ে এই কঠিন দিনের অপেক্ষা করার প্রয়ােজন ছিলাে এই যে, তারা যেন অত্যাচারের মাত্রা পূর্ণ করে সে ভয়ানক দিনের দিকে এগিয়ে যেতে পারে, যে দিনের কঠিন আযাব কাছে ও দূরে, সকল দিক থেকে চূড়ান্তভাবে তাদেরকে পাকড়াও করবে।
# জিলালিল কুরআন:

*সবরের নির্দেশ : আযাবের বর্ণনা শেষ করে আল্লাহ তায়ালা তার সেই প্রিয় নবীর দিকে মনােযােগ দিচ্ছেন যাকে দীর্ঘ দিন ধরে যালেমরা কষ্ট দিয়ে আসছিলাে। তারা তাকে এই বলে দোষারােপ করে আসছিলো যে, আল কোরআন তার নিজের রচনা করা কথা। এ কারণেই আল্লাহ তায়ালা তাকে এই সব দুঃখ-কষ্টের মধ্যে সবর করার জন্য বিশেষভাবে উপদেশ দিচ্ছেন, তাকে মিথ্যাবাদী আখ্যা দেয়ার জন্য এবং শারীরিক ও মানসিক নানাপ্রকার নির্যাতন করার জন্য সান্ত্বনা দিতে গিয়ে আল্লাহ তায়ালা বলছেন যে তাকে এসব প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে আরও দঢ়তার সাথে তার দাওয়াতী কাজ চালিয়ে যেতে হবে। তারা দাওয়াত গ্রহণ করুক আর না-ই করুক, তারা নিজ নিজ অপরাধের শাস্তি পাক আর না-ই পাক, এসব ব্যাপার আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিতে হবে। তিনি যা চাইবেন তা-ই করবেন। এরশাদ হচ্ছে, ‘অতপর তুমি সবর কর এবং তােমার রব-এর পক্ষ থেকে আসা ফায়সালার জন্য অপেক্ষা করতে থাকো’ তবে সবর করার জন্য উৎসাহিত করতে গিয়ে যে শব্দগুলাে ব্যবহার করা হয়েছে তা পাক পরওয়ারদেগারের পক্ষ থেকে যেমন সম্মানজনক, তেমনই স্নেহসিঞ্চিত এবং এমন মহব্বত ভরা যা তার দুর্গম পথের যাবতীয় কষ্টকে মুছে দিয়েছে। এর ফলে সবর করা বড়ই প্রিয় বস্তু বলে তাঁর কাছে মনে হয়েছে। আসলে সবর বা আল্লাহর ওপর ভরসা করে দৃঢ়তা অবলম্বন করে নিজ দায়িত্ব পালন করার মানসিকতাই মহান সম্মানের অধিকারী হওয়ার উপায় হয়। তাই পুনরায় আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করছেন, পরিপূর্ণ দৃঢ়তার সাথে তােমার পরওয়ারদেগারের পক্ষ থেকে আসা ফায়সালার জন্য অপেক্ষা করতে থাকো। অবশ্যই তুমি আমার সাহায্যের মধ্যে রয়েছ। কী চমৎকার এ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ। আল্লাহ পাকের কথাগুলাে কেমন ছবির মতাে হৃদয়গ্রাহী হয়ে এখানে ফুটে উঠেছে আর তাকদীর সম্পর্কিত কথাগুলােকে কী সুন্দরভাবে গ্রহণযােগ্য করে তােলা হয়েছে। রসূলুল্লাহ(স.)-কে সম্বােধন করতে গিয়ে আল্লাহ তায়ালা তাকে যে মর্যাদা দিয়েছেন, তা দুনিয়ায় আর কেউ কখনও পায়নি। তার প্রতি মর্যাদাসূচক এই যে বিশেষ এক তুলনাহীন ভাষা তিনি ব্যবহার করেছেন, তা এখানেই শুধু সীমাবদ্ধ নয়, বরং কোরআনের সর্বত্র এই ধরনের সম্মানজনক ভাষা ও বর্ণনাভংগি তার জন্য প্রয়োগ করা হয়েছে। এমনকি আরও বিভিন্ন জায়গায় সাদৃশ্য দেখাতে গিয়েও একই সম্মানজনক পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়েছে। মুসা(আ.)-কে বলা হয়েছে, আমি তােমাকে পছন্দ করেছি। সুতরাং যে ওহী পাঠানাে হচ্ছে তা খেয়াল করে শোনে। আরও বলা হয়েছে, আমি তােমার ওপর আমার মহব্বত বর্ষণ করলাম। আর এমন এক বিশেষ ব্যবস্থা নিলাম যাতে করে তুমি আমার চোখের সামনে প্রতিপালিত হও। আরও বলা হয়েছে, আর তােমাকে আমি গড়ে তুললাম আমার নিজের প্রয়ােজনে। উপরােক্ত এ সকল কথা অবশ্যই অত্যন্ত উচু মর্যাদার অর্থ ব্যক্ত করছে। কিন্তু মােহাম্মদ(স.)-এর জন্য যে ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে তা লক্ষ্য করুন, আমি বলছি, তুমি আমার চোখে চোখে আছ। এ কথায় এক বিশেষ সম্মানসূচক অর্থ বুঝা যাচ্ছে এবং এ কথায় এক বিশেষ মহব্বত প্রকাশ পাচ্ছে। এ শব্দগুলাে অদ্বিতীয় এক ভঙ্গিমায় ব্যবহৃত হয়েছে, অন্যান্য যে কোনাে বর্ণনা-পদ্ধতি থেকে অনেক বেশী মােলায়েম, আরও বেশী স্নেহপূর্ণ। এ এমন বিশেষ পদ্ধতি আল্লাহ তায়ালা তার প্রিয়তম নবীর জন্য ব্যবহার করেছেন, যার অর্থ করার মতাে ভাষা মানুষ কোনাে দিন তৈরী করতে পারেনি। সুতরাং ‘আমরা আল্লাহ পাকের রহমতের ছায়াতলে রয়েছি’ একথার যে অর্থ সাধারণভাবে গৃহীত হয়ে রয়েছে, সেই দিকে ইংগিত করেই ক্ষান্ত হওয়া শ্রেয় মনে করছি এবং এই যে কিতাব ‘ফী যিলালিল কোরআন’ এর মধ্যে প্রদত্ত এই ব্যাখ্যাই গ্রহণ করছি। এই মহব্বত প্রকাশের সাথে সাথে এ সূরাটির মধ্যে আল্লাহর সাথে মানুষের স্থায়ী সম্পর্ক গড়ে তােলার জন্য যে পদ্ধতি জানানাে হয়েছে তাও লক্ষ্যণীয়। এরশাদ হচ্ছে, ‘আর তাসবীহ করাে তােমার রব-এর প্রশংসার সাথে যখনই তুমি ঘুম থেকে জেগে ওঠো এবং তারাগুলাে ডুবে যাওয়ার পরও তার নামের তাসবীহ পড়ো।’ আজকের প্রেক্ষাপটে এ আয়াতের শেষ অংশটুকুর অর্থ দাঁড়ায়, তার তাসবীহ করাে রাতে যখন তােমার ঘুম ভেংগে যায়, রাতের প্রথম অংশে এবং ফজরের নামাযের সময়, যখন তারাগুলাে ডুবে যায়। এইভাবে যদি আল্লাহর হুকুম পালন করা হয়, তাহলে তার কথায় যথাযথভাবে কান দেয়া হবে বলে আল্লাহ তায়ালা মেনে নেবেন। আর তাসবীহ পাঠ করা, অর্থাৎ সােবহানাল্লাহ পড়ে সৃষ্ট বস্তুর যাবতীয় সীমাবদ্ধতা থেকে তিনি মুক্ত-একথার ঘােষণা দান করা। এইভাবে উল্লিখিত সময়গুলােতে বিশেষ করে এবং সাধারণভাবে অন্যান্য সময় আল্লাহর তাসবিহ পাঠ করার মাধ্যমে তাঁর মহব্বত আকর্ষণ করা হয়, তাঁর সাথে গোপন সম্পর্ক বিনিময় করা সম্ভব হয় এবং তার সাথে বিশেষ আন্তরিকতা গড়ে ওঠে।

২৯-৪৯ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
# মক্কার কাফেররা জুলুম ও হঠকারিতার মাধ্যমে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দাওয়াতের মোকাবিলা করছিল। ওপরে আখেরাতের চিত্র পেশ করার পর এখন বক্তব্যের মোড় এখানে তাদের জুলুম ও হঠকারিতার দিকে ঘুরে যাচ্ছে। এখানে বাহ্যতঃ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সম্বোধন করা হলেও প্রকৃতপক্ষে তার মাধ্যমে মক্কার কাফেরদেরকেই এসব কথা শুনানো হচ্ছে। তিনি যখন তাদের সামনে কিয়ামত, হাশর-নশর, হিসেব-নিকেশ, শাস্তি ও পুরস্কার এবং জান্নাত ও জাহান্নামের কথা বলতেন আর এসব বিষয় সম্বলিত কুরআন মজীদের আয়াত শুনিয়ে দাবী করতেন, এসব খবর আল্লাহর পক্ষ থেকে আমার কাছে এসেছে, এ হচ্ছে আল্লাহর বাণী আল্লাহ তা’আলা অহীর মাধ্যমে এ বাণী নাযিল করেছেন তখন তাদের নেতৃবৃন্দ, ধর্মীয় পুরোহিত গোষ্ঠী এবং তাদের বখাটে লোকেরা তাঁর এ বক্তব্য যেমন কখনো সুস্থ মস্তিষ্কে ভেবে-চিন্তে দেখতো না, তেমনি এও চাইতো না যে, জনসাধারণ তাঁর বক্তব্যের প্রতি মনোযোগ দিক। তাই তারা কখনো বলতো তিনি গণক, কখনো বলতো তিনি পাগল, কখনো বলতো তিনি কবি, আবার কখনো বলতো তিনি নিজেই এসব অদ্ভূত কথা রচনা করেন এবং নিজের প্রভাব বৃদ্ধির জন্য আল্লাহর নাযিলকৃত অহী বলে পেশ করেন। তাদের ধারণা ছিল, এভাবে অপবাদ আরোপ করে মানুষের মনে তাঁর ব্যাপারে খারাপ ধারণা সৃষ্টি করে দিতে পারবে এবং তাঁর সব কথা ব্যর্থ হয়ে যাবে। সূতরাং এখানে বলা হচ্ছে, হে নবী, বাস্তব অবস্থা তো তাই যা সূরার শুরু থেকে এ পর্যন্ত বর্ণনা করা হয়েছে। কিন্তু এসব কারণে এসব লোক যদি তোমাকে গণক এবং পাগল বলে তাহলে তার পরোয়া করো না। আল্লাহর বান্দাদেরকে তাদের গাফলতি সম্পর্ক সতর্ক এবং প্রকৃত সত্য সম্পর্কে সাবধান করার কাজ করতে থাকো। কারণ, আল্লাহর মেহেরবানীতে তুমি গণকও নও, পাগলও নও।

আরবী ভাষায় كاهن শব্দটি জোতিষী, ভবিষ্যৎ বক্তা ও জ্ঞানবান অর্থে ব্যবহৃত হয়। জাহেলী যুগে এটি একটি স্বতন্ত্র পেশা ছিল। গণকরা দাবী করতো এবং দুর্বল আকীদার লোকেরা মনে করতো যে, তারা নক্ষত্র বিশারদ বা আত্মা, শয়তান ও জিনদের সাথে তাদের বিশেষ সম্পর্ক আছে, যার মাধ্যমে তারা গায়েবী খবর জানতে পারে। কোন জিনিস হারিয়ে গেলে তা কোথায় পড়ে আছে তা তারা বলে দিতে পারে। কারো বাড়ীতে চুরি হলে কে চোর তা তারা বলে দিতে পারে। কেউ তার ভাগ্য সম্পর্কে জানতে চাইলে তারা বলে দিতে পারে তার ভাগ্যে কি লেখা আছে। মানুষ এসব উদ্দেশ্য নিয়েই তাদের কাছে যেতো। তারা কিছু নযর-নিয়াজ নিয়ে তাদেরকে গায়েবী কথা বলে দিতো। মানুষ যাতে তাদের কাছে আসে এ উদ্দেশ্যে তারা নিজেরাও অনেক সময় বস্তিতে গিয়ে হাঁক ছেড়ে বেড়াতো। তাদের একটা বিশেষ ঢং হতো, যা দিয়ে তাদের চেনা যেতো। তাদের কথাবার্তাও সাধারণ বোলচাল থেকে ভিন্ন হতো। তারা বিশেষ ভংগীতে কিছুটা গানের সূরে ছন্দবদ্ধ কথা বলতো এবং সাধারণত এমন হেঁয়ালিপূর্ণ কথা বলতো যা থেকে প্রত্যেক ব্যক্তি তার মনের কথার সন্ধান করে নিতে পারে। জনসাধারণকে ধোঁকা দেয়ার জন্য কুরাইশ নেতারা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি তারা গণক হওয়ার অপবাদ আরোপ করেছিল। আর তা করেছিল শুধু এ কারণে যে, তিনি এমন সব বিষয়ে কথা বলতেন যা মানুষের দৃষ্টির আড়ালে ছিল, তাছাড়া তিনি দাবী করতেন যে আল্লাহর পক্ষ থেকে একজন ফেরেশতা এসে তার কাছে অহী নাযিল করে এবং আল্লাহর যে বাণী তিনি পেশ করেন তাও ছিল ছন্দায়িত। কিন্তু তাদের এ অপবাদের কারণে আরবের কোন মানুষই প্রতারিত হয়নি। কারণ গণকদের পেশা, তাদের চালচলন, তাদের কথাবার্তা এবং তাদের কারবার কারোই অজানা ছিল না। সবাই জানতো, তারা কি কাজ করে, কি উদ্দেশ্যে লোকজন তাদের কাছে যায়, কি কি কথা তারা তাদেরকে বলে, তাদের ছন্দবদ্ধ কথাগুলো কেমন হয় এবং তার বিষয়বস্তু কি থাকে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, এটা আদৌ কোন গণকের কাজ হতে পারে না যে, জাতির মধ্যে তৎকালে প্রচলিত আকীদা-বিশ্বাসের পরিপন্থী আকীদা-বিশ্বাস সে তুলে ধরবে, দিনরাত তার প্রচার প্রসারে জীবনপাত করবে এবং সেজন্য গোটা জাতির শত্রুতার ঝুঁকি নেবে। তাই রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে গণক হওয়ার এ অপবাদের নাম মাত্র সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। সুতরাং আরবের কোন নিরেট বোকা লোকও এতে প্রতারিত হয়নি।

অনুরূপভাবে মক্কার কাফেররা নিছক তাদের মনের সান্ত্বনার জন্য নবীকে ﷺ পাগল হওয়ার অপবাদ দিতো। যেমন বর্তমান যুগের কোন কোন বেশরম পাশ্চত্য লেখক ইসলামের বিরুদ্ধে তাদের হিংসা চরিতার্থ করার জন্য দাবী করে যে, নবীর ﷺ ওপর মৃগি রোগের (Epilepsy) আক্রমণ হতো এবং আক্রান্ত অবস্থায় তাঁর মুখ থেকে যেসব কথা বের হতো লোকে তাকেই অহী মনে করতো। সে যুগের কোন জ্ঞানী লোকও এসব বেহুদা অপবাদকে বিশ্বাসযোগ্য মনে করেনি, এ যুগের কোন মানুষও কুরআন মজীদ অধ্যয়ন করে এবং রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নেতৃত্বে ও তত্ত্বাবধানে সাধিত বিস্ময়কর কীর্তিসমূহ দেখে একথা বিশ্বাস করতে পারে না যে, এসব কিছু মৃগী রোগে আক্রান্ত হওয়ার ফল।

# এ ব্যক্তির ওপর কোন আকস্মিক বিপদ আপতিত হোক এবং আমরা তাঁর জ্বালাতন থেকে রক্ষা পাই, এজন্য আমরা অপেক্ষা করছি। সম্ভবত তাদের ধারণা ছিল, মুহাম্মাদ ﷺ যেহেতু আমাদের উপাস্যদের বিরোধিতা এবং তাদের অলৌকিক কর্মকাণ্ড অবিশ্বাস করেন, তাই হয় তাঁর ওপরে আমাদের কোন উপাস্য দেব-দেবীর কোপনল পড়বে অথবা কোন দুঃসাহসী বীর তাঁর এসব কথা শুনে ধৈর্য হারিয়ে ফেলবে এবং তাঁকে হত্যা করবে।

# এর দু’টি অর্থ হতে পারে। একটি অর্থ হচ্ছে, আমিও দেখছি তোমাদের এ আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয় কিনা। অপর অর্থটি হচ্ছে, দুর্ভাগ্য আমার আসে না তোমাদের আসে, তা দেখার জন্য আমিও অপেক্ষা করছি।

# এ দু’টি বাক্যে বিরোধীদের সমস্ত অপপ্রচার খণ্ডন করে দিয়ে তাদের মুখোশ সম্পূর্ণরূপে খুলে দেয়া হয়েছে। যুক্তির সারকথা হলো, কুরাইশদের এসব নেতা এ প্রবীণ ব্যক্তি বড় বড় জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান সেজে বসে আছে। কিন্তু তাদের জ্ঞানবুদ্ধি কি বলে, যে ব্যক্তি কবি নয় তাঁকে কবি বলো, গোটা জাতির লোক যাকে একজন জ্ঞানী বলে জানে তাঁকে পাগল বলো এবং গণনা বিদ্যার সাথে যার দূরতম সম্পর্কও নেই তাঁকে অযথা গণক বলে আখ্যায়িত করো। এরপরও যদি তারা জ্ঞান ও যুক্তির ভিত্তিতেই এ সিদ্ধান্ত নিতো তাহলে যে কোন একটি কথাই বলতো। অনেকগুলো পরস্পর বিরোধী উপাধি তো কাউকে একসাথে দেয়া যায় না। এক ব্যক্তি কবি, পাগল ও গণক একই সাথে কিভাবে হতে পারে? সে যদি পাগল হয়ে থাকে তাহলে গণক বা কবি হতে পারে না। গণক হলে কবি হতে পারে না এবং কবি হলে গণক হতে পারে না। কেননা, কবিতার ভাষা ও আলোচ্য বিষয় যা গণক বা জোতিষীদের ভাষা ও বিষয়বস্তু তা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। একই কথাকে যুগপৎ কাব্য ও গণকদের গণনা বলে আখ্যায়িত করা এমন কোন ব্যক্তির কাজ হতে পারে না, যে কাব্য ও গণনা বিদ্যার পার্থক্য সম্পর্কে অবহিত। অতএব, এটা অত্যন্ত পরিষ্কার কথা যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিরুদ্ধে পরস্পর বিরোধী কথা ও মন্তব্য জ্ঞান-বুদ্ধির ভিত্তিতে নয়, বরং সরাসরি জিদ ও হঠকারীতার ভিত্তিতে করা হচ্ছে। জাতির এসব বড় বড় নেতা শুধু শত্রুতার আতিশয্যে অন্ধ হয়ে এমন সব ভিত্তিহীন অপবাদ আরোপ করছে যা কোন সুস্থ ও স্থির মস্তিষ্কের মানুষ গ্রহণযোগ্য মনে করতে পারে না। (আরো ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, সূরা আল আ’রাফ, টীকা ১০৪ ; ইউনুস, টীকা ৩ ; বনী ইসরাইল, টীকা ৫৩ , ৫৪ ; আশ শু’আরা, টীকা ১৩০ , ১৩১ , ১৪০ , ১৪২ , ১৪৩ , ১৪৪ , )।
# অন্য কথায় এ উক্তির তাৎপর্য হচ্ছে, কুরাইশদের মধ্যে যেসব লোক বলতো, কুরআন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিজের রচিত বাণী তারাও জানতো যে, এটা তাঁর বাণী হতে পারে না। তাছাড়া অন্য যেসব লোকের ভাষা আরবী, তারা এ বাণী শোনা মাত্র পরিষ্কার বুঝে ফেলতো যে, এটা মানুষের কথার চেয়ে অনেক ঊর্ধ্বের জিনিসই শুধু নয়, বরং তাদের মধ্যে যে ব্যক্তিই মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জানতো সে কখনো ধারণাই করতে পারতো না যে, এটা সত্যিই তাঁর নিজের কথা। অতএব, পরিষ্কার ও সোজা কথা হলো, কুরআনকে তাঁর নিজের রচনা বলে আখ্যা দানকারী আসলে ঈমান আনতে চায় না। তাই তারা নানা রকমের মিথ্যা বাহানা খাড়া করছে। আর এটা সেসব বাহানারই একটি। (আরো ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, ইউসূফ, টীকা ২১ ; আল ফুরকান, টীকা ১২ ; আল কাসাস, টীকা ৬৪ ; আল আনকাবূত, টীকা, ৮৮ – ৮৯ ; আস সাজদা, টীকা ১ থেকে ৪ ; হা-মীম আস সাজদা; টীকা ৫৪ ; আল আহকাফ, টীকা ৮ থেকে ১০ )।
#.কথা শুধু এটুকু নয় যে, এটা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী নয়, বরং এটা আদৌ মানুষের কথা নয়। এ রকম বাণী রচনা করাও মানুষের সাধ্যাতীত। তোমরা যদি একে মানুষের কথা বলতে চাও তাহলে মানুষের রচিত এ মানের কোন কথা এনে প্রমাণ করো। শুধু কুরাইশদের নয়, বরং দুনিয়ার মানুষকে এ আয়াতের মাধ্যমে সর্বপ্রথম এ চ্যালেঞ্জ জানানো হয়েছিল। এরপর পুনরায় মক্কায় তিনবার এবং মদীনায় শেষ বারের মত এ চ্যালেঞ্জ জানানো হয়েছে। (দেখুন ইউনুস, আয়াত ৩৮ ; হূদ, ১৩ ; বনী ইসরাঈল, ৮৮ ; আল বাকারা, ২৩ )। কিন্তু সে সময়ও কেউ এর জবাব দেয়ার সাহস দেখাতে পারেনি। তারপরেও আজ পর্যন্ত কেউ কুরআনের মোকাবিলায় মানুষের রচিত কোন কিছু পেশ করার দুঃসাহস দেখাতে পারেনি। কেউ কেউ এ চ্যালেঞ্জের প্রকৃত ধরন না বুঝার কারণে বলে থাকে, শুধু কুরআন কেন, কোন একক ব্যক্তির নিজস্ব রীতিতেও অন্য কেউ গদ্য বা কবিতা লিখতে সমর্থ হয় না। হোমার, রুমী, সেক্সপিয়ার, গেটে, গালিব, ঠাকুর, ইকবাল, সবাই এদিক দিয়ে অনুপম যে তাদের অনুকরণ করে তাদের মত কথা রচনা করার সাধ্য কারোই নেই। কুরআনের চ্যালেঞ্জের এ জবাবদাতারা প্রকৃতপক্ষে এ বিভ্রান্তিত আছে যে, فَلْيَأْتُوا بِحَدِيثٍ مِثْلِهِ আয়াতাংশের অর্থ হুবহু কুরআনের মতই কোন গ্রন্থ রচনা করে দেয়া। অথচ এর অর্থ বাকরীতির দিক দিয়ে সমমান নয়। এর অর্থ সামগ্রিকভাবে এর গুরুত্ব ও মর্যাদার সমপর্যায়ের কোন গ্রন্থ নিয়ে এসো। যেসব বৈশিষ্ট্যের কারণে কুরআন একটি মু’জিযা ঐ গ্রন্থও সে একই রকম বৈশিষ্ট্য মণ্ডিত সমপর্যায়ের হতে হবে। যেসব বড় বড় বৈশিষ্ট্যের কারণে কুরআন পূর্বেও মু’জিযা ছিল এবং এখনো মু’জিযা তার কয়েকটি সংক্ষেপে নিম্নরূপঃ

একঃ যে ভাষায় কুরআন মজীদ নাযিল হয়েছে তা সে ভাষার সাহিত্যের উচ্চতম ও পূর্ণাঙ্গ নমুনা। গোটা গ্রন্থের একটি শব্দ বা একটি বাক্যও মানের নিচে নয়। যে বিষয়টিই ব্যক্ত করা হয়েছে সেটিই উপযুক্ত শব্দ ও উপযুক্ত বাচনভংগীতে বর্ণনা করা হয়েছে। একই বিষয় বার বার বর্ণিত হয়েছে এবং প্রতিবারই বর্ণনার নতুন ভংগী গ্রহণ করা হয়েছে কিন্তু সেজন্য পৌনপুনিকতার দৃষ্টিকটূতা ও শ্রুতিকটূতা কোথাও সৃষ্টি হয়নি। গোটা গ্রন্থে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত শব্দের গাঁথুনি এমন যেন আংটির মুল্যবান পাথরগুলো ছেঁটে ছেঁটে বসিয়ে দেয়া হয়েছে। কথা এতটা মর্মস্পর্শী যে, তা শুনে ভাষাভিজ্ঞ কোন ব্যক্তিই মাথা নিচু না করে থাকতে পারে না। এমন কি অমান্যকারী এবং বিরোধী ব্যক্তির মনপ্রাণ ও ভাবাবেগ পর্যন্ত উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। ১৪ শত বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও আজ অবধি এ গ্রন্থ তার ভাষায় সাহিত্যের সবচেয়ে উন্নত নমুনা। এর সমপর্যায়ের তো দূরের কথা সাহিত্যিক মর্যাদা ও মূল্যমানে আরবী ভাষায় কোন গ্রন্থ আজ পর্যন্ত এর ধারে কাছেও পৌঁছনি। শুধু তাই নয়, এ গ্রন্থ আরবী ভাষাকে এমনভাবে আঁকড়ে ধরে বসেছে যে, ১৪ শত বছর অতিবাহিত হওয়ার পরও এ ভাষার বিশুদ্ধতার মান তাই আছে যা এ গ্রন্থ প্রতিষ্ঠিত করে দিয়েছিল। অথচ এ সময়ের মধ্যে ভাষাসমূহ পরিবর্তিত হয়ে ভিন্ন রূপ ধারণ করে। পৃথিবীতে আর কোন ভাষা এমন নেই যা এত দীর্ঘ সময় পর্যন্ত লিখন পদ্ধতি, রচনা রীতি, বাচনভংগী, ভাষার নিয়মকানুন এবং শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রে একই রূপ নিয়ে টিকে আছে। এর সাহিত্যমান আজ পর্যন্ত আরবী ভাষার উচ্চ মানের সাহিত্য। ১৪ শত বছর আগে কুরআনে যে বিশুদ্ধ ভাষা ব্যবহার করা হয়েছিল বক্তৃতা ও লেখায় আজও সেটাই বিশুদ্ধ ভাষা বলে মানা হচ্ছে। দুনিয়ার কোন ভাষায় মানুষের রচিত কোন গ্রন্থ কি এ মর্যাদা লাভ করেছে!

দুইঃ এটা পৃথিবীর একমাত্র গ্রন্থ যা মানবজাতির ধ্যান-ধারণা, স্বভাব-চরিত্র, সভ্যতা-সংস্কৃতি এবং জীবন প্রণালির ওপর এমন ব্যাপক, এমন গভীর এবং এমন সর্বাত্মক প্রভাব বিস্তার করেছে যে, পৃথিবীতে তার কোন নজির পাওয়া যায় না। এর প্রভাব প্রথমে একটা জাতির মধ্যে পরিবর্তন আনলো। অতঃপর সেই জাতি তৎপর হয়ে পৃথিবীর একটি বিশাল অংশে পরিবর্তন আনলো। দ্বিতীয় আর কোন গ্রন্থ নেই যা এতটা বিপ্লবাত্মক প্রমাণিত হয়েছে। এ গ্রন্থ কেবলমাত্র কাগজের পৃষ্ঠাসমূহেই লিপিবদ্ধ থাকেনি বরং তার এক একটি শব্দ ধ্যান-ধারণাকে বাস্তবে রূপদান করেছে এবং একটি স্বতন্ত্র সভ্যতা নির্মাণ করেছে। ১৪ শত বছর ধরে তার এ প্রভাব চলে আসছে এবং দিনে দিনে তা আরো বিস্তৃত হচ্ছে।

তিনঃ এ গ্রন্থ যে বিষয়ে আলোচনা করে তা একটি ব্যাপকতর বিষয়। এর পরিধি আদি থেকে অন্ত পর্যন্ত গোটা বিশ্ব-জাহানকে পরিব্যাপ্ত করে আছে। এ গ্রন্থ বিশ্ব-জাহানের তাৎপর্য তার শুরু ও শেষ এবং তার নিয়ম-শৃংখলা সম্পর্কে বক্তব্য ও মত পেশ করে। এ গ্রন্থ বলে দেয় এ বিশ্ব-জাহানের স্রষ্টা, শৃংখলাবিধানকারী এবং পরিচালক কে? কি তাঁর গুণাবলী, কি তাঁর ইখতিয়ার ও ক্ষমতা এবং কি সেই মূল ও আসল বিষয় আর যার ভিত্তিতে তিনি এ গোটা বিশ্ব ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা করেছেন। সে এ পৃথিবীতে মানুষের প্রকৃত মর্যাদা ও অবস্থান সঠিকভাবে নির্দিষ্ট করে বলে দেয় যে, এটা তার স্বাভাবিক অবস্থান এবং এটা তার জন্মগত মর্যাদা। সে এ অবস্থান ও মর্যাদা পাল্টে দিতে সক্ষম নয়। এ অবস্থান ও মর্যাদার দিক দিয়ে মানুষের জন্য সত্য ও বাস্তবতার সাথে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যশীল সঠিক পথ কি এবং সত্য ও বাস্তবের সাথে সংঘাতপূর্ণ ভ্রান্ত পথ কি তা সে বলে দেয়। সঠিক পথের সঠিক হওয়া এবং ভ্রান্ত পথের ভ্রান্ত হওয়া প্রমাণের জন্য সে যমীন ও আসমানের এক একটি বস্তু থেকে মহাবিশ্ব ব্যবস্থার এক একটি প্রান্ত থেকে মানুষের নিজের আত্মা ও সত্তা থেকে এবং মানুষেরই নিজের ইতিহাস থেকে অসংখ্য যুক্তি-প্রমাণ পেশ করে। এর সাথে সে বলে দেয় মানুষ কিভাবে ও কি কি কারণে ভ্রান্ত পথে চলেছে এবং প্রতি যুগে তাকে কিভাবে সঠিক পথ বাতলে দেয়া হয়েছে যা সবসময় একই ছিল এবং একই থাকবে। সে কেবল সঠিক পথ দেখিয়েই ক্ষান্ত হয় না। বরং সে পথে চলার জন্য একটা পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থার চিত্র পেশ করে যার মধ্যে আকায়েদ, আখলাক, আত্মার পরিশুদ্ধি, ইবাদত বন্দেগী, সামাজিকতা, তাহযীব, তামাদ্দুন, অর্থনীতি, রাজনীতি, ন্যায়বিচার, আইন-কানুন, এক কথায় মানব জীবনের প্রতিটি দিক সম্পর্কে অত্যন্ত সুসংবদ্ধ বিধি-বিধান বর্ণনা করা হয়েছে। তাছাড়া এ সঠিক পথ অনুসরণ করার এবং ভ্রান্ত পথসমূহে চলার কি কি ফলাফল এ দুনিয়ায় দেখা দেবে এবং দুনিয়ার বর্তমান ব্যবস্থা ধ্বংস হওয়ার পর অন্য আরেকটি জগতে দেখা দেবে তাও সে বিস্তারিত বলে দেয়। সে এ দুনিয়ার পরিসমাপ্তি এবং আরেকটি দুনিয়া প্রতিষ্ঠার অবস্থা অত্যন্ত বিস্তারিতভাবে আলোচনা করে, এ পরিবর্তনের সমস্ত স্তর এক এক করে বলে দেয়, দৃষ্টির সামনে পরজগতের পূর্ণ চিত্র অংকন করে এবং সেখানে মানুষ কিভাবে আরেকটি জীবন লাভ করবে তা স্পষ্ট করে বর্ণনা করে, কিভাবে তার পার্থিব জীবনের কার্যাবলীর হিসেব-নিকেশ হবে, কোন্ কোন্ বিষয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে, কেন অনস্বীকার্য রূপে তার সামনে তার আমলনামা পেশ করা হবে। সেসব কাজের প্রমাণ স্বরূপ কি ধরনের অকাট্য সাক্ষ্যসমূহ পেশ করা হবে, পুরস্কার ও শাস্তিলাভকারী কেন পুরস্কার ও শাস্তিলাভ করবে। পুরস্কার লাভকারীরা কি ধরনের পুরস্কারলাভ করবে এবং শাস্তি প্রাপ্তরা কি কি ভাবে তাদের কার্যাবলীর মন্দফল ভোগ করবে, এ ব্যাপক বিষয়ে যে বক্তব্য এ গ্রন্থে পেশ করা হয়েছে তার মর্যাদা এমন নয় যে, তার রচয়িতা তর্ক শাস্ত্রের কিছু যুক্তিতর্ক একত্রিত করে কতকগুলো অনুমানের প্রসাদ নির্মাণ করেছেন, বরং এর রচয়িতা প্রকৃত সত্য সম্পর্কে সরাসরি জ্ঞান রাখেন তাঁর দৃষ্টি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সবকিছু দেখছে। সমস্ত সত্য তাঁর কাছে উন্মুক্ত। মহাবিশ্বের গোটাটাই তাঁর কাছে একখানা উন্মুক্ত গ্রন্থের মত। মানবজাতির শুরু থেকে শেষ পর্যন্তই শুধু নয়। লয় প্রাপ্তির পর তার অপর জীবনও তিনি যুগপৎ এক দৃষ্টিতে দেখছেন এবং শুধু অনুমান ও ধারণার ভিত্তিতে নয়, জ্ঞানের ভিত্তিতে মানুষকে পথপ্রদর্শন করছেন। এ গ্রন্থ যেসব সত্যকে তাত্বিকভাবে পেশ করে থাকে আজ পর্যন্ত তার কোন একটিকে ভুল বা মিথ্যা বলে প্রমাণ করা যায়নি। বিশ্ব-জাহান ও মানুষ সম্পর্কে সে যে ধারণা পেশ করে তা সমস্ত দৃশ্যমান বস্তু ও ঘটনাবলীর পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা পেশ করে এবং জ্ঞানের প্রতিটি শাখায় গবেষণার ভিত্তি রচনা করে। দর্শন বিজ্ঞান এবং সমাজ বিজ্ঞানের সমস্ত সাম্প্রতিকতম প্রশ্নের জবাব তার বাণীতে বর্তমান এবং এসবের মধ্যে এমন একটা যৌক্তিক সম্পর্ক বিদ্যমান যে, ঐগুলোকে ভিত্তি করে একটা পূর্ণাংগ সুসংবদ্ধ ও ব্যাপক চিন্তাপদ্ধতি গড়ে ওঠে। তাছাড়া জীবনের প্রতিটি দিক সম্পর্কে সে মানুষকে যে বাস্তব পথনির্দেশনা দিয়েছে তা শুধু যে, সর্বোচ্চ মানের যুক্তিগ্রাহ্য ও অত্যন্ত পবিত্র তাই নয়। বরং ১৪ শত বছর ধরে ভূপৃষ্ঠের বিভিন্ন আনাচে কানাচে অসংখ্য মানুষ কার্যত তার অনুসরণ করেছে। আর অভিজ্ঞতা তাকে সর্বোত্তম ব্যবস্থা বলে প্রমাণিত করেছে। এরূপ মর্যাদার মানব রচিত কোন গ্রন্থ কি দুনিয়ায় আছে কিংবা কোন সময় ছিল, যা এ গ্রন্থের মোকাবিলায় এনে দাঁড় করানো যেতে পারে?

চারঃ এ গ্রন্থ পুরোটা একবারে লিখে দুনিয়ার সামনে পেশ করা হয়নি। বরং কতকগুলো প্রাথমিক নির্দেশনা নিয়ে একটি সংস্কার আন্দোলন শুরু করা হয়েছিল। এরপর ২৩ বছর পর্যন্ত উক্ত আন্দোলন যেসব স্তর অতিক্রম করেছে তার অবস্থা ও প্রয়োজন অনুসারে ঐ আন্দোলনের নেতার মুখ দিয়ে এর বিভিন্ন অংশ কখনো দীর্ঘ ভাষণ এবং কখনো সংক্ষিপ্ত বাক্যের আকারে উচ্চারিত হয়েছে। অতঃপর এ কার্যক্রম পূর্ণতা লাভের পর বিভিন্ন সময়ে মুখ থেকে উচ্চারিত এসব অংশ পূর্ণাংগ গ্রন্থের আকারে সাজিয়ে দুনিয়ার সামনে পেশ করা হয়েছে যাকে ‘কুরআন’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। আন্দোলনের নেতার বক্তব্য হলো, এসব ভাষণ ও বাক্য তাঁর রচিত নয়, বরং তা বিশ্ব-জাহানের রবের পক্ষ থেকে তাঁর কাছে নাযিল হয়েছে। কেউ যদি একে ঐ নেতার নিজের রচিত বলে অভিহিত করে, তাহলে সে দুনিয়ার গোটা ইতিহাস থেকে এমন একটি নজির পেশ করুক যে, কোন মানুষ বছরের পর বছর নিজে একাধারে একটি বড় সংঘবদ্ধ আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে কখনো একজন বক্তা এবং কখনো একজন নৈতিক শিক্ষক হিসেবে, কখনো একটি মজলূম দলের নেতা হিসেবে, কখনো একটি রাষ্ট্রের শাসক হিসেবে, কখনো আইন ও বিধান দাতা হিসেবে মোটকথা অসংখ্য ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশ-পরিস্থিতি ও সময়ে ভিন্ন ভিন্ন মর্যাদায় অধিষ্ঠিত থেকে ভিন্ন ভিন্ন যেসব বক্তব্য পেশ করেছেন, কিংবা কথা বলেছেন, তা একত্রিত হয়ে একটি পূর্ণাংগ, সুসংবদ্ধ ও সর্বাত্মক চিন্তা ও কর্মপ্রণালীতে পরিণত হয়েছে এবং তার মধ্যে কোথাও কোন বৈপরীত্য পাওয়া যায় না, তার মধ্যে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত একটিই মাত্র কেন্দ্রীয় ধারণা ও চিন্তার ধারাবাহিকতা সক্রিয় দেখা যায়। প্রথম দিন থেকে তিনি তাঁর আন্দোলনের যে ভিত্তি বর্ণনা করেছিলেন শেষ দিন পর্যন্ত সে ভিত্তি অনুসারে আকীদা-বিশ্বাস ও কার্যাবলীর এমন একটি ব্যাপক ও সার্বজনীন আদর্শ নির্মাণ করেছেন যার প্রতিটি অংশ অন্যান্য অংশের সাথে পূর্ণরূপে সামঞ্জস্য রাখে এবং এ সংকলন অধ্যয়নকারী কোন দূরদৃষ্টি সম্পন্ন ব্যক্তিই একথা উপলব্ধি না করে পারবে না যে আন্দোলনের সূচনাকালে আন্দোলনকারীর সামনে আন্দোলনের শেষ পর্যায় পর্যন্ত গোটা আন্দোলনের পূর্ণাংগ চিত্র বর্তমান ছিল। এমন কখনো হয়নি মধ্য পথে কোন স্থানে তাঁর মাথায় এমন কোন ধারণার উদ্ভব হয়েছে যা পূর্বে তাঁর কাছে পরিষ্কার ছিল না অথবা যা পরে পরিবর্তন করতে হয়েছে। মস্তিস্কের সৃষ্টিশীলতার এমন চরম পরাকাষ্ঠা দেখাতে সক্ষম হয়েছে এমন কোন মানুষ যদি কোন সময় জন্মগ্রহণ করে থাকে তাহলে তা দেখিয়ে দেয়া হোক।

পাঁচঃ যে নেতার মুখ থেকে এসব ভাষণ ও বাণীসমূহ উচ্চারিত হয়েছে, তিনি হঠাৎ কোন গোপন আস্তানা থেকে শুধু এগুলো শোনানোর জন্য বেরিয়ে আসতেন না এবং শোনাবার পর আবার কোথাও চলে যেতেন না। এ আন্দোলন শুরু করার পূর্বেও তিনি মানব সমাজে জীবন যাপন করেছিলেন এবং পরেও জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সবসময় ঐ সমাজেই থাকতেন। মানুষ তাঁর আলোচনা ও বক্তব্যের ভাষা এবং বাচনভংগীর সাথে ভালভাবে পরিচিত ছিল। হাদীসসমূহে তার একটি বড় অংশ এখনও সংরক্ষিত আছে। পরবর্তী সময়ের আরবী ভাষাবিজ্ঞ মানুষ যা পড়ে সহজেই দেখতে পারে না যে, সেই নেতার বাচনভংগী কেমন ছিল। তাঁর স্বভাষী মানুষ সে সময়ও পরিষ্কার উপলব্ধি করতো এবং আরবী ভাষা জানা মানুষ আজও উপলব্ধি করে যে, এ গ্রন্থের (কুরআন) ভাষা ও বাকরীতি সেই নেতার ভাষা ও বাকরীতি থেকে অনেক ভিন্ন। এমন কি তার ভাষণের মধ্যে যেখানে এ গ্রন্থের কোন বাক্যের উদ্ধৃতি আসে তখন উভয়ের ভাষার পার্থক্য সুস্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, পৃথিবীতে কোন মানুষ কি কখনো দু’টি সম্পূর্ণ ভিন্ন স্টাইলে বছরের পর বছর কথা বলার ভান করতে সক্ষম হয়েছে বা হতে পারে অথচ দু’টিই যে, একই ব্যক্তির স্টাইল, সে রহস্য কখনো প্রকাশ পায় না? এ ধরনের ভান বা অভিনয় করে আকস্মিক বা সাময়িকভাবে সফল হওয়া সম্ভব। কিন্তু একাধারে ২৩ বছর পর্যন্ত এমনটি হওয়া কোনক্রমেই সম্ভব নয় যে, এক ব্যক্তি যখন আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা অহী হিসেবে কথা বলে তখন তার ভাষা ও স্টাইল এক রকম হবে আবার যখন নিজের পক্ষ থেকে কথা বলে বা বক্তৃতা করে তখন তার ভাষা ও স্টাইল সম্পূর্ণ আরেক রকম হবে।

ছয়ঃ এ আন্দোলনের নেতৃত্ব দান কালে সেই নেতা বিভিন্ন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছেন। কখনো তিনি বছরের পর বছর স্বদেশবাসী ও স্বগোত্রীয় লোকদের উপহাস, অবজ্ঞা ও চরম জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, কখনো তাঁর সঙ্গী-সাথীদের ওপর এমন জুলুম করা হয়েছে যে, তারা দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। কখনো শত্রুরা তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছে, কখনো তাঁর নিজেকেই স্বদেশভূমি ছেড়ে হিজরত করতে হয়েছে। কখনো তাঁকে চরম দারিদ্রকষ্ট সইতে এবং ভুখা জীবন কাটাতে হয়েছে। কখনো তাঁকে একের পর এক লড়াইয়ের সম্মুখীন হতে হয়েছে এবং তাতে বিজয় ও পরাজয় উভয়টিই এসেছে। কখনো তিনি দুশমনদের বিরুদ্ধে বিজয় লাভ করেছেন এবং যেসব দুশমন তাঁর ওপর নির্যাতন চালিয়েছিল তাদেরকেই তাঁর সামনে অধোবদন হতে হয়েছে। কখনো তিনি এমন ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব লাভ করেছেন যা খুব কম লোকের ভাগ্যেই জুটে থাকে। একথা স্পষ্ট যে, এ ধরনের নানা পরিস্থিতিতে কোন মানুষের আবেগ অনুভূতি এক রকম থাকতে পারে না। এসব রকমারি ক্ষেত্র ও পরিস্থিতিতে সেই নেতা যখনই তাঁর ব্যক্তিগত অবস্থান থেকে কথা বলেছেন তখনই তাঁর মধ্যে স্বভাবসুলভ মানবোচিত আবেগ অনুভূতির প্রভাব পরিলক্ষিত হয়েছে যা এরূপ ক্ষেত্র ও পরিস্থিতিতে একজন মানুষের মনে সচারাচর সৃষ্টি হয়ে থাকে। কিন্তু এসব পরিস্থিতিতে তাঁর মুখ হতে আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা অহী হিসেবে যেসব কথা শোনা গিয়েছে তা ছিল মানবিক আবেগ-অনুভূতি থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। কোন একটি ক্ষেত্রেও কোন কট্টর সমালোচকও অঙ্গুলি নির্দেশ করে বলতে পারবে না যে, এখানে মানবিক আবেগ-অনুভূতির প্রভাব পড়েছে বলে পরিলক্ষিত হচ্ছে।

সাতঃ এ গ্রন্থে যে ব্যাপক ও পূর্ণাংগ জ্ঞান পাওয়া যায় তা সে যুগের আরববাসী, রোমান, গ্রীক ও ইরানবাসীদের কাছে তো দূরের কথা এ বিংশ শতাব্দীর বড় বড় পণ্ডিতদেরও কারো ঝুলিতে নেই। বর্তমানে অবস্থা এই যে, দর্শন, বিজ্ঞান এবং সমাজ বিদ্যার কোন একটি শাখার অধ্যয়নে গোটা জীবন কাটিয়ে দেয়ার পরই কেবল কোন ব্যক্তি জ্ঞানের সেই শাখার সর্বশেষ সমস্যাবলী জানতে পারে। তারপর যখন গভীর দৃষ্টি নিয়ে সে কুরআন অধ্যয়ন করে তখন জানতে পারে যে, এ গ্রন্থে সেসব সমস্যার একটি সুস্পষ্ট জবাব বিদ্যমান। এ অবস্থা জ্ঞানের কোন একটি শাখার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং যেসব জ্ঞান বিশ্ব-জাহান ও মানুষের সাথে কোনভাবে সম্পর্কিত তার সবগুলোর ক্ষেত্রেই সঠিক। কি করে বিশ্বাস করা যেতে পারে যে, ১৪ শত বছর পূর্বে আরব-মরুর এক নিরক্ষর ব্যক্তি জ্ঞানের প্রতিটি শাখায় এমন ব্যাপক দক্ষ ছিল এবং তিনি প্রতিটি মৌলিক সমস্যা সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করে সেগুলোর একটি পরিষ্কার ও চূড়ান্ত জওয়াব খুঁজে পেয়েছিলেন?

কুরআনের মু’জিযা হওয়ার যদিও আরো অনেক কারণ আছে। তবে কেউ যদি শুধু এ কয়টি কারণ নিয়ে চিন্তা করে তাহলে সে জানতে পারবে কুরআন নাযিল হওয়ার যুগে কুরআনের মু’জিযা হওয়া যতটা স্পষ্ট ছিল আজ তার চেয়ে অনেক গুণে বেশী স্পষ্ট এবং ইনশায়াল্লাহ কিয়ামত পর্যন্ত স্পষ্টতম হতে থাকবে।
# ইতিপূর্বে যেসব প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়েছিলো তার উদ্দেশ্য ছিল মক্কার কাফেরদের বুঝানো যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রিসালাতের দাবীকে মিথ্যা সাব্যস্ত করার জন্য তারা যেসব কথা বলছে তা কতটা অযৌক্তিক। এ আয়াতে তাদের সামনে প্রশ্ন রাখা হয়েছে যে, মুহাম্মাদ ﷺ যে দাওয়াত পেশ করছেন তার মধ্যে এমন কি আছে যেজন্য তোমরা ক্রোধান্বিত হচ্ছো? তিনি তো একথাই বলছেন যে, আল্লাহ তোমাদের স্রষ্টা এবং তোমাদের উচিত তারই বন্দেগী করা। এতে তোমাদের ক্রোধান্বিত হওয়ার যুক্তিসঙ্গত কি কারণ থাকতে পারে? তোমরা কি নিজে নিজেই সৃষ্টি হয়েছো, কোন স্রষ্টা তোমাদের সৃষ্টি করেননি? নাকি তোমরা নিজেরাই নিজেদের স্রষ্টা? কিংবা এ বিশাল মহাবিশ্ব তোমাদের তৈরী? এসব কথার কোনটিই যদি সত্য না হয়, আর তোমরা নিজেরাই স্বীকার করো যে তোমাদের স্রষ্টা আল্লাহ আর এই বিশ্ব-জাহানের স্রষ্টাও তিনিই, তাহলে যে ব্যক্তি তোমাদের বলে, সেই আল্লাহই তোমাদের বন্দেগী ও উপাসনা পাওয়ার অধিকারী সেই ব্যক্তির প্রতি তোমরা এত ক্রোধান্বিত কেন? আসলে ক্রোধোদ্দীপক ব্যাপার তো যে স্রষ্টা নয় তার বন্দেগী করা এবং যিনি স্রষ্টা তার বন্দেগী না করা। তোমরা মুখে একথা অবশ্যই স্বীকার করো যে, বিশ্ব-জাহান ও তোমাদের স্রষ্টা আল্লাহ। কিন্তু সত্যিই যদি একথায় বিশ্বাস থাকতো তাহলে তার বন্দেগীর প্রতি আহ্বানকারীর পেছনে এভাবে আদাপানি খেয়ে লাগতে না।

এটা ছিল এমন একটি তীক্ষ্ণ ছুঁচালো প্রশ্ন যা মুশরিকদের আকীদা-বিশ্বাসের ভিত্তিমূলকেই কাঁপিয়ে দিয়েছে। বুখারী ও মুসলিম বর্ণিত হাদীসে আছে, বদর যুদ্ধের পর বন্দী কুরাইশদের মুক্ত করার বিষয়ে আলোচনা করার জন্য মক্কার কাফেরদের পক্ষ থেকে জুবাইর ইবনে মুতয়িম মাদীনায় আসে। তখন রসূলুল্লাহ ﷺ মাগরিবের নামাযে ইমামতি করছিলেন। নামাযে তিনি সূরা তূর পড়ছিলেন। তার নিজের বর্ণনা হচ্ছে, নবী (সা.) যখন সূরার এ আয়াত পড়ছিলেন তখন মনে হলো, আমার কলিজাটা বুঝি বক্ষ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। সেদিন এ আয়াত শুনে তার মনে ইসলাম বদ্ধমূল হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে এটি তার ইসলাম গ্রহণ করার একটি বড় কারণ হয়েছিল।
# মক্কার কাফেরদের প্রশ্ন ছিল, শেষ পর্যন্ত আবদুল্লাহর পুত্র মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকেই কেন রসূল বানানো হলো? এটি তাদের সে প্রশ্নের জবাব। এ জবাবের তাৎপর্য হচ্ছে, এসব লোককে গায়রুল্লাহর ইবাদতের গোমরাহী থেকে মুক্ত করার জন্য কাউকে না কাউকে তো রসূল বানিয়ে পাঠাতেই হতো। এখন প্রশ্ন হলো, সে সিদ্ধান্ত কে গ্রহণ করবেন? আল্লাহ কাকে তাঁর রসূল মনোনীত করবেন আর কাকে করবেন না সে সিদ্ধান্ত কে গ্রহণ করবে? এরা যদি আল্লাহর মনোনীত রসূলকে মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে থাকে তাহলে তার অর্থ দাঁড়ায় এই যে, হয় তারা নিজেদেরকে আল্লাহর রাজ্যের মালিক মনে করে নিয়েছে। নয়তো তারা ধারণা করে বসে আছে, যে বিশ্ব-জাহানের মালিক মনিব তো আল্লাহ তা’য়ালাই থাকবেন, তবে সেখানে বাস্তব কর্তৃত্ব চলবে তাদের।
# এ সংক্ষিপ্ত বাক্যসমূহে একটা বিরাট যুক্তি-তর্ক ধরা হয়েছে। এর বিস্তারিত রূপ হলো, তোমরা যদি রসূলের কথা মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানাও তাহলে সত্যকে জানার জন্য তোমাদের কাছে কি উপায় ও মাধ্যম আছে? তোমাদের কেউ কি ঊর্ধ্বজগতে আরোহণ করে আল্লাহ তা’আলা কিংবা তাঁর ফেরেশতাদের নিকট থেকে সরাসরি একথা জেনে নিয়েছে যে, যেসব আকীদা-বিশ্বাসের ওপর তোমাদের বাতিল ধর্মের ভিত্তি স্থাপিত তা পুরোপুরি বাস্তব সম্মত ও সত্য? কেউ যদি এ দাবী করতে চায় তাহলে সে সামনে আসুক এবং বলুক, সে কবে কিভাবে ঊর্ধ্বজগতে আরোহণের অধিকার লাভ করেছে এবং সেখান থেকে কি জ্ঞান সে নিয়ে এসেছে? কিন্তু এটা যদি তোমাদের দাবী না হয়, তাহলে নিজেরাই ভেবে দেখো, বিশ্ব-জাহানের পালনকর্তা আল্লাহর সন্তান আছে বলে তোমরা যে দাবী করছো তাও আবার কন্যা সন্তান—যাকে নিজের জন্য তোমরা লজ্জা ও অপমানের কারণ বলে মনে করো—এর চেয়ে অধিক হাস্যকর ধারণা আর কিছু হতে পারে কি? প্রকৃত জ্ঞান ছাড়াই তোমরা এ ধরনের স্পষ্ট মূর্খতার অন্ধাকারে হাতড়ে বেড়াচ্ছো, আর যে ব্যক্তি আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমাদের সামনে জ্ঞানের আলো পেশ করছে, তোমরা তাঁর প্রাণের দুশমন হয়ে দাঁড়াচ্ছো।
# প্রশ্নের মূল লক্ষ্য কাফেররা। অর্থাৎ তোমাদের কাছে রসূলের যদি কোন স্বার্থ থাকতো এবং নিজের কোন ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য তিনি তৎপরতা দেখাতেন তাহলে তাঁর নিকট থেকে সরে যাওয়ার একটা যুক্তিসঙ্গত কারণ অন্তত তোমাদের থাকতো। কিন্তু তোমরা জান এ আন্দোলনের ব্যাপারে তিনি সম্পূর্ণ নিস্বার্থ, শুধু তোমাদের কল্যাণের জন্যই তিনি জীবনপাত করেছেন। এরপরও ধির স্থির মন-মেজাজ নিয়ে তাঁর কথা শোনার মত উদারতা তোমাদের না থাকার কি কারণ থাকতে পারে? এ প্রশ্নের মধ্যে একটি সূক্ষ্ম সমালোচনাও বিদ্যমান। সারা দুনিয়ার ভণ্ড ধর্মগুরুরা এবং ধর্মীয় আস্তানার সেবকদের মত আরবেও মুশরিকদের ধর্মীয় নেতা এবং পণ্ডিত পুরোহিতরা খোলাখুলি ধর্মীয় কারবার চালিয়ে যাচ্ছিল। তাই তাদের সামনে প্রশ্ন রাখা হয়েছে যে, একদিকে আছে এসব ধর্ম ব্যবসায়ীরা যারা তোমাদের নিকট থেকে প্রকাশ্যে নজর-নিয়াজ এবং প্রতিটি ধর্মীয় কাজ আঞ্জাম দেয়ার জন্য পারিশ্রমিক আদায় করছে। অপরদিকে এক ব্যক্তি সম্পূর্ণ নিস্বার্থভাবে বরং নিজের ব্যবসায়-বাণিজ্য ধ্বংস করে অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত প্রমাণ দিয়ে তোমাদেরকে দ্বীনের সোজা পথ দেখানোর চেষ্টা করছে অথচ তোমরা তার নিকট থেকে সরে যাচ্ছো এবং তাদের দিকে দৌড়ে অগ্রসর হচ্ছো এটা চরম নির্বুদ্ধিতা ছাড়া আর কি?
# রসূল তোমাদের সামনে যেসব সত্য পেশ করছেন তা মিথ্যা প্রমাণ করার জন্য তোমাদের কাছে এমন কি প্রমাণ আছে যা পেশ করে দাবী করতে পারো দৃশ্যমান বস্তু ছাড়া চোখের আড়ালে যেসব সত্য লুকিয়ে আছে তোমরা যাদেরকে সরাসরি তা জানো? তোমরা কি সত্যিই জানো যে, আল্লাহ এক নন এবং তোমরা যাদেরকে উপাস্য বানিয়ে রেখেছো তারাও আল্লাহর গুণাবলী ও ক্ষমতা-ইখতিয়ারের অধিকারী? তোমরা কি সত্যিই ফেরেশতাদের দেখেছো; তারা যে মেয়ে তা জানতে পেরেছো এবং নাউযুবিল্লাহ আল্লাহর ঔরসেই তারা জন্ম নিয়েছে, তোমরা কি সত্যিই জানো যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে কোন অহী আসেনি এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে কোন বান্দার কাছে তা আসতেও পারে না? তোমরা কি সত্যিই একথা জানতে পেরেছো যে, কিয়ামত সংঘটিত হবে না, মৃত্যুর পরে আর কোন জীবন হবে না, আখেরাত কায়েম হবে না যেখানে মানুষের হিসেব-নিকেশ করে তাকে শাস্তি ও পুরস্কার দেয়া হবে? তোমরা এ ধরনের কোন জ্ঞানের দাবী করলে একথা লিখে দিতে কি প্রস্তুত আছ যে, তোমরা এ সম্পর্কে রসূলের পেশকৃত বর্ণনা ও তথ্য যে অস্বীকার করছো তার কারণ হলো পর্দার পেছনে উঁকি দিয়ে তোমরা দেখে নিয়েছো, রসূল যা বলছেন তা বাস্তব ও সত্য নয়। এখানে কেউ একথা বলে সন্দেহ প্রকাশ করতে পারেন যে, এ জবাব ঐ সব মানুষ যদি হঠকারিতার আশ্রয় নিয়ে তা লিখে দেয় তাহলে কি এসব যুক্তি অর্থহীন হয়ে পড়ে না? কিন্তু এরূপ সন্দেহ করা ভুল। কারণ, হঠকারিতা করে যদি তা লিখেও দেয় তাহলেও যে সমাজে জনসম্মুখে এ চ্যালেঞ্জ পেশ করা হয়েছিল সেখানে সাধারণ মানুষ অন্ধ ছিল না। প্রত্যেকেই জানতে পারতো, একথা নিছক হঠকারিতা করেই লিখে দেয়া হয়েছে এবং রসূলের বর্ণনাসমূহে এজন্য অস্বীকার করা হচ্ছে না যে, তার অসত্য ও বাস্তবতা বিরোধী হওয়া সম্পর্কে কেউ প্রত্যক্ষ ও নির্ভুল জ্ঞান লাভ করেছে।
# মক্কার কাফেররা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কষ্ট দেয়া ও তাঁকে হত্যা করার জন্য একত্রে বসে যে সলাপরামর্শ করতো ও ষড়যন্ত্র পাকাতো এখানে সেদিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে।

# মক্কার কাফেররা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কষ্ট দেয়া ও তাঁকে হত্যা করার জন্য একত্রে বসে যে সলাপরামর্শ করতো ও ষড়যন্ত্র পাকাতো এখানে সেদিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে।
# এটি কুরআনের সুস্পষ্ট ভবিষ্যতবাণীসমূহের একটি। মক্কী যুগের প্রথম দিকে যখন মুষ্টিমেয় সহায় সম্বলহীন মুসলমান ছাড়া রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাহ্যত আর কোন শক্তি ছিল না। গোটা জাতিই তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধরত ছিল এবং প্রত্যেকেই ইসলাম ও কুফরী শক্তির নিতান্তই অসম মোকাবিলা প্রত্যক্ষ করছিল। কেউ-ই সে সময় ভাবতে পারেনি যে, কয়েক বছর পরই এখানে কুফরী শক্তির মূলোৎপাটিত হতে যাচ্ছে। স্থুল দৃষ্টির অধিকারীরা দেখতে পাচ্ছিলো, কুরাইশ ও গোটা আরবের বিরোধিতা শেষ পর্যন্ত এ আন্দোলনকে উৎখাত করে ছাড়বে। এ পরিস্থিতিতেও কাফেরদেরকে চূড়ান্ত ও পরিষ্কার ভাষায় চ্যালেঞ্জ করে বলে দেয়া হয়েছে যে, এ আন্দোলনকে হেয় করার জন্য যত অপকৌশল ও ষড়যন্ত্র তোমরা করতে চাও তা করে দেখো। ঐ ষড়যন্ত্র ও অপকৌশল উল্টো তোমাদের বিরুদ্ধেই যাবে। তোমরা কখনো এ আন্দোলনকে পরাস্ত করতে সক্ষম হবে না।

# প্রকৃত ব্যাপার হলো, যাদেরকে তারা ইলাহ বানিয়ে রেখেছে প্রকৃতপক্ষে তারা ইলাহ নয় এবং শিরক আগাগোড়া একটি ভিত্তিহীন জিনিস। তাই যে ব্যক্তি তাওহীদের আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁর সাথে আছে সত্যের শক্তি। আর যারা শিরকের সহযোগিতা করছে, তারা একটি অবাস্তব ও অসত্য জিনিসের জন্য লড়াই করছে। লড়াইয়ে শিরক কি করে বিজয় লাভ করবে?

# একথার উদ্দেশ্য এক দিকে কুরাইশ নেতাদের হঠকারিতার মুখোস খুলে দেয়া, অন্যদিকে রসূলুল্লাহ ﷺ এবং তাঁর সঙ্গী-সাথীদের সান্ত্বনা দেয়া। নবী (সা.) ও সাহাবায়ে কেরামের মনে বারবার এ আকাঙ্ক্ষা জাগতো যে, এসব লোককে আল্লাহর পক্ষ থেকে এমন কোন মু’জিযা দেখানো হোক যার দ্বারা মুহাম্মাদের ﷺ নবুওয়াতের সত্য বুঝতে পারবে। তাই বলা হয়েছে, এরা যদি নিজ চোখে কোন মু’জিযাও দেখে তবুও তার কোন না কোন অপব্যাখ্যা করে কুফরীর ওপর অবিচল থাকার অজুহাত খুঁজে নেবে। কারণ, তাদের মন ঈমান আনার জন্য প্রস্তুত নয়। কুরআন মজীদের আরো কয়েকটি স্থানেও তাদের এ হঠকারিতার উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন সূরা আনআমে বলা হয়েছে, আমি যদি তাদের কাছে ফেরেশতাও পাঠাতাম, মৃত ব্যক্তিরা এদের সাথে কথা বলতো এবং এদের চোখের সামনে সারা দুনিয়ার সবকিছু এনে জড়ো করে দিতাম তবুও এরা ঈমান আনতো না। ( আয়াত ১১১ , ৭ ) সূরা হিজরে বলা হয়েছে, আমি যদি তাদের জন্য আসমানের কোন দরজা খুলেও দিতাম আর এরা প্রকাশ্য দিবালোকে সে দিকে উঠতে থাকতো তারপরও একথাই বলতো, আমাদের চোখ প্রতারিত হচ্ছে, আমাদেরকে যাদু করা হয়েছে। (আয়াত ১৪-১৫ )
# এটি সূরা আস সাজদার ২১ আয়াতের বিষয়বস্তুর পুনরাবৃত্তি। সেখানে বলা হয়েছে “সেই বড় আযাবের পূর্বে আমি দুনিয়াতেই তাদেরকে কোন না কোন ছোট আযাবের স্বাদ ভোগ করাতে থাকবো। হয়তো এরা তাদের বিদ্রোহাত্মক আচরণ থেকে বিরত হবে।” অর্থাৎ দুনিয়াতে মাঝে মাঝে ব্যক্তিগত ও জাতিগত পর্যায়ে আযাব নাযিল করে আমি তাদের একথা স্মরণ করিয়ে দিতে থাকবো যে, ওপরে কোন এক উচ্চতর শক্তি তাদের ভাগ্যের ফায়সালা করছে। তাঁর ফায়সালা পরিবর্তন করার শক্তি কেউ রাখে না। তবে যারা জাহেলিয়াতের মধ্যে ডুবে আছে তারা এ ঘটনাবলী থেকে পূর্বেও কোন শিক্ষা গ্রহণ করেনি এবং ভবিষ্যতেও কখনো করবে না। দুনিয়াতে যেসব বিপর্যয় আসে তারা তার অর্থ বুঝে না। তাই তারা এসব বিপর্যয়ের এমন এমন সব ব্যাখ্যা করে যা তাদেরকে সত্য উপলব্ধি করা থেকে আরো দূরে নিয়ে যায়। নিজেদের নাস্তিকতা বা শিরকের ত্রুটি ধরা পড়ে তাদের মেধা ও মস্তিষ্ক এমন ব্যাখ্যার দিকে কখনো আকৃষ্ট হয় না। একটি হাদীসে রসূলুল্লাহ ﷺ এ বিষয়টি ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেছেনঃ

إِنَّ الْمُنَافِقَ إِذَا مَرِضَ ثُمَّ أُعْفِىَ كَانَ كَالْبَعِيرِ عَقَلَهُ أَهْلُهُ ثُمَّ أَرْسَلُوهُ فَلَمْ يَدْرِ لِمَ عَقَلُوهُ وَلَمْ يَدْرِ لِمَ أَرْسَلُوهُ (ابو داؤد , كتاب الجنائز)

“মুনাফিক যখন অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং পরে যখন সুস্থ হয়ে যায় তখন তার অবস্থা হয় সেই উটের মত যাকে তার মালিক বেঁধে রাখলো কিন্তু সে বুঝলো না তাকে কেন বেঁধে রাখা হয়েছিল এবং তারপর আবার যখন খুলে দিল তখনও সে কিছু বুঝলো না তাকে কেন ছেড়ে দেয়া হলো।” (আরো ব্যাখ্যার দেখুন তাফহীমুল কুরআন, আল আম্বিয়া, টীকা ৪৫ ; আন নামল, টীকা ৬৬ ; আল আনকাবূত, টীকা ৭২ ও ৭৩ )।

# আরেকটি অর্থ হতে পারে ধৈর্য ও দৃঢ়তার সাথে আপন প্রভুর নির্দেশ পালন করতে বদ্ধপরিকর থাকো।

# আমি তোমাদের রক্ষণাবেক্ষণ করছি। তোমাদেরকে তোমাদের অবস্থার ওপর ছেড়ে দেইনি।
# একথাটির কয়েকটি অর্থ হতে পারে এবং এখানে সবগুলো অর্থ গ্রহণীয় হওয়া অসম্ভব নয়।

একটি অর্থ হচ্ছে, তুমি যখনই কোন মজলিস থেকে উঠবে আল্লাহর প্রশংসা ও তাসবীহ করে উঠবে। নবী ﷺ নিজেও এ নির্দেশ পালন করতেন এবং মুসলমানদেরকে নির্দেশ দিয়েছিলেন যে তারা যেন কোন মজলিস থেকে উঠার সময় আল্লাহর প্রশংসা ও তাসবীহ করে। এভাবে সেই মজলিসে যেসব কথাবার্তা হয়েছে তার কাফফারা হয়ে যায়। আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসায়ী এবং হাকেম হযরত আবু হুরাইরার (রা.) মাধ্যমে নবীর ﷺ এ বাণী উদ্ধৃত করেছেন, যে ব্যক্তি কোন মজলিসে বসলো এবং সেখানে অনেক বাকবিতণ্ডা করলো সে যদি উঠে যাওয়ার সময় বলেঃ

سُبْحَانَكَ اللهُمَّ وَبِحَمْدِكَ, أَشْهَدُ أَنْ لَا إلَهَ إلَّا أَنْتَ, أَسْتَغْفِرُكَ وَأَتُوبُ إِلَيْكَ

“হে আল্লাহ! আমি তোমার প্রশংসাসহ তাসবীহ করছি। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, তুমি ছাড়া কোন মাবুদ নেই। আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি এবং তোমার কাছে তাওবা করছি।”

তাহলে সেখানে যেসব ভুল-ত্রুটি হবে আল্লাহ তা মাফ করে দেবেন।

এর দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে, যখন তোমরা ঘুম থেকে জেগে বিছানা ছাড়বে তখন তাসবীহসহ তোমার রবের প্রশংসা করো। নবী ﷺ এটিও নিজে আমল করতেন এবং ঘুম থেকে জেগে উঠার পর একথাগুলো বলার জন্য সাহাবীদের শিক্ষা দিয়েছিলেনঃ

لاِ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيكَ لَهُ لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَىْءٍ قَدِيرٌ سُبْحَانَ اللَّهِ وَالْحَمْدُ لِلَّهِ وَلاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَاللَّهُ أَكْبَرُ وَلاَ حَوْلَ وَلاَ قُوَّةَ إِلاَّ بِاللَّهِ– (المسند احمد , بخارى بروايت عياده بن الصامت)

এর তৃতীয় অর্থ হচ্ছে, তোমরা যখন নামাযের জন্য দাঁড়াবে তখন আল্লাহর হামদ ও তাসবীহ দ্বারা তার সূচনা করো। এ হুকুম পালনের জন্য নবী ﷺ নির্দেশ দিয়েছেন যে, তাকবীর তাহরীমার পর নামায শুরু করবে একথা বলেঃ

سُبْحَانَكَ اللهُمَّ وَبِحَمْدِكَ , وَتَبَارَكَ اسْمُكَ , وَتَعَالَى جَدُّكَ , وَلَا إِلَهَ غَيْرُكَ

এর চতুর্থ অর্থ হচ্ছে, যখন তোমরা আল্লাহর পথে আহবান জানানোর জন্য প্রস্তুত হবে তখন আল্লাহর প্রশংসা ও তাসবীহ দ্বারা তার সূচনা করো। নবী ﷺ এ নির্দেশটিও স্থায়ীভাবে পালন করতেন। তিনি সবসময় আল্লাহর প্রশংসা দ্বারা তাঁর খুতবা শুরু করতেন।

তাফসীর বিশারদ ইবনে জারীর এর আরো একটি অর্থ বর্ণনা করেছেন। সে অর্থটি হচ্ছে, তোমরা যখন দুপুরের আরামের পর উঠবে তখন নামায পড়বে। অর্থাৎ যোহরের নামায।

# এর অর্থ মাগরিব, ইশা এবং তাহাজ্জুদের নামায। সাথে সাথে এর দ্বারা কুরআন তিলাওয়াত এবং আল্লাহর যিকরও বুঝানো হয়েছে।

# তারকারাজির অস্তমিত হওয়ার অর্থ রাতের শেষভাগে এগুলোর অস্তমিত হওয়া এবং ভোরের আলো দেখা দেয়ায় তার আলো নিষ্প্রভ হয়ে যাওয়া। এটা ফজরের নামাযের সময়।

Leave a Reply