Motaher21.net أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ ( বই # ১১৪২) [*‌‌*মানব জীবনে আখিরাতের বিশ্বাসের প্রভাব :- **“মানুষ যে চেষ্টা সাধনা করে তা ছাড়া তার আর কিছুই প্রাপ্য নেই।”:- ** সুপারিশও কোন কাজে আসতে পারে না যতক্ষণ না,:- *সত্যের মুকাবিলায় অনুমানের কোনই মূল্য নেই:-] www.motaher21.net সূরা:৫৩:আন-নাজম। পারা:২৭ ১৯-৪২ নং আয়াত:- আয়াতের ব্যাখ্যা:- ১) তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন:- ২) ফী জিলালিল কুরআন:-

Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১১৪২)
[*‌‌*মানব জীবনে আখিরাতের বিশ্বাসের প্রভাব :-
**“মানুষ যে চেষ্টা সাধনা করে তা ছাড়া তার আর কিছুই প্রাপ্য নেই।”:-
** সুপারিশও কোন কাজে আসতে পারে না যতক্ষণ না,:-
*সত্যের মুকাবিলায় অনুমানের কোনই মূল্য নেই:-]
www.motaher21.net
সূরা:৫৩:আন-নাজম।
পারা:২৭
১৯-৪২ নং আয়াত:-
আয়াতের ব্যাখ্যা:-
১) তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন:-
২) ফী জিলালিল কুরআন:-

সূরা:৫৩:আন-নাজম-১৯
اَفَرَءَیۡتُمُ اللّٰتَ وَ الۡعُزّٰی ﴿ۙ۱۹﴾
তোমরা কি ভেবে দেখেছ ‘লাত’ ও ‘উয্যা’ সম্বন্ধে।
সূরা:৫৩:আন-নাজম-২০
وَ مَنٰوۃَ الثَّالِثَۃَ الۡاُخۡرٰی ﴿۲۰﴾
এবং তৃতীয় আরেকটি ‘মানাত’ সম্বন্ধে?
সূরা:৫৩:আন-নাজম-২১
اَلَکُمُ الذَّکَرُ وَ لَہُ الۡاُنۡثٰی ﴿۲۱﴾
তবে কি তোমাদের জন্য পুত্ৰ সন্তান এবং আল্লাহর জন্য কন্যা সন্তান?
সূরা:৫৩:আন-নাজম-২২
تِلۡکَ اِذًا قِسۡمَۃٌ ضِیۡزٰی ﴿۲۲﴾
তাহলে এটা অত্যন্ত প্রতারণামূলক বন্টন।
সূরা:৫৩:আন-নাজম-২৩
اِنۡ ہِیَ اِلَّاۤ اَسۡمَآءٌ سَمَّیۡتُمُوۡہَاۤ اَنۡتُمۡ وَ اٰبَآؤُکُمۡ مَّاۤ اَنۡزَلَ اللّٰہُ بِہَا مِنۡ سُلۡطٰنٍ ؕ اِنۡ یَّتَّبِعُوۡنَ اِلَّا الظَّنَّ وَ مَا تَہۡوَی الۡاَنۡفُسُ ۚ وَ لَقَدۡ جَآءَہُمۡ مِّنۡ رَّبِّہِمُ الۡہُدٰی ﴿ؕ۲۳﴾
প্রকৃতপক্ষে এসব তোমাদের বাপ-দাদাদের রাখা নাম ছাড়া আর কিছুই না। এজন্য আল্লাহ‌ কোন সনদপত্র নাযিল করেননি।প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে, মানুষ শুধু ধারণা ও প্রবৃত্তির বাসনার দাস হয়ে আছে। অথচ তাদের রবের পক্ষ থেকে তাদের কাছে হিদায়াত এসেছে।
সূরা:৫৩:আন-নাজম-২৪
اَمۡ لِلۡاِنۡسَانِ مَا تَمَنّٰی ﴿۫ۖ۲۴﴾
মানুষ যা চায় তাই কি তার জন্য ঠিক?
সূরা:৫৩:আন-নাজম-২৫
فَلِلّٰہِ الۡاٰخِرَۃُ وَ الۡاُوۡلٰی ﴿٪۲۵﴾
দুনিয়া ও আখেরাতের মালিক তো একমাত্র আল্লাহ‌।
সূরা:৫৩:আন-নাজম-২৬
وَ کَمۡ مِّنۡ مَّلَکٍ فِی السَّمٰوٰتِ لَا تُغۡنِیۡ شَفَاعَتُہُمۡ شَیۡئًا اِلَّا مِنۡۢ بَعۡدِ اَنۡ یَّاۡذَنَ اللّٰہُ لِمَنۡ یَّشَآءُ وَ یَرۡضٰی ﴿۲۶﴾
আসমানে তো কত ফেরেশতা আছে যাদের সুপারিশও কোন কাজে আসতে পারে না যতক্ষণ না আল্লাহ‌ নিজ ইচ্ছায় যাকে খুশী তার জন্য সুপারিশ করার অনুমতি দান করেন।
সূরা:৫৩:আন-নাজম-২৭
اِنَّ الَّذِیۡنَ لَا یُؤۡمِنُوۡنَ بِالۡاٰخِرَۃِ لَیُسَمُّوۡنَ الۡمَلٰٓئِکَۃَ تَسۡمِیَۃَ الۡاُنۡثٰی ﴿۲۷﴾
কিন্তু যারা আখেরাত মানে না তারা ফেরেশতাদেরকে দেবীদের নামে নামকরণ করে।
সূরা:৫৩:আন-নাজম-২৮
وَ مَا لَہُمۡ بِہٖ مِنۡ عِلۡمٍ ؕ اِنۡ یَّتَّبِعُوۡنَ اِلَّا الظَّنَّ ۚ وَ اِنَّ الظَّنَّ لَا یُغۡنِیۡ مِنَ الۡحَقِّ شَیۡئًا ﴿ۚ۲۸﴾
অথচ এ বিষয়ে তাদের কোন জ্ঞান নেই, তারা শুধু অনুমানের অনুসরণ করে। আর সত্যের মুকাবিলায় অনুমানের কোনই মূল্য নেই।
সূরা:৫৩:আন-নাজম-২৯
فَاَعۡرِضۡ عَنۡ مَّنۡ تَوَلّٰی ۬ۙ عَنۡ ذِکۡرِنَا وَ لَمۡ یُرِدۡ اِلَّا الۡحَیٰوۃَ الدُّنۡیَا ﴿ؕ۲۹﴾
অতএব তাকে উপেক্ষা করে চল, যে আমার স্মরণে বিমুখ এবং যে শুধু পার্থিব জীবনই কামনা করে।
সূরা:৫৩:আন-নাজম-৩০
ذٰلِکَ مَبۡلَغُہُمۡ مِّنَ الۡعِلۡمِ ؕ اِنَّ رَبَّکَ ہُوَ اَعۡلَمُ بِمَنۡ ضَلَّ عَنۡ سَبِیۡلِہٖ ۙ وَ ہُوَ اَعۡلَمُ بِمَنِ اہۡتَدٰی ﴿۳۰﴾
তাদের জ্ঞানের দৌড় এই পর্যন্ত। নিশ্চয় তোমার প্রতিপালকই ভাল জানেন, কে তাঁর পথ হতে বিচ্যুত এবং তিনিই ভাল জানেন, কে সৎপথ প্রাপ্ত।
সূরা:৫৩:আন-নাজম-৩১
وَ لِلّٰہِ مَا فِی السَّمٰوٰتِ وَ مَا فِی الۡاَرۡضِ ۙ لِیَجۡزِیَ الَّذِیۡنَ اَسَآءُوۡا بِمَا عَمِلُوۡا وَ یَجۡزِیَ الَّذِیۡنَ اَحۡسَنُوۡا بِالۡحُسۡنٰی ﴿ۚ۳۱﴾
আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে তা আল্লাহরই। যাতে তিনি যারা মন্দ কর্ম করে তাদেরকে দেন মন্দ ফল এবং যারা সৎকর্ম করে তাদেরকে দেন উত্তম পুরস্কার।
সূরা:৫৩:আন-নাজম-৩২
اَلَّذِیۡنَ یَجۡتَنِبُوۡنَ کَبٰٓئِرَ الۡاِثۡمِ وَ الۡفَوَاحِشَ اِلَّا اللَّمَمَ ؕ اِنَّ رَبَّکَ وَاسِعُ الۡمَغۡفِرَۃِ ؕ ہُوَ اَعۡلَمُ بِکُمۡ اِذۡ اَنۡشَاَکُمۡ مِّنَ الۡاَرۡضِ وَ اِذۡ اَنۡتُمۡ اَجِنَّۃٌ فِیۡ بُطُوۡنِ اُمَّہٰتِکُمۡ ۚ فَلَا تُزَکُّوۡۤا اَنۡفُسَکُمۡ ؕ ہُوَ اَعۡلَمُ بِمَنِ اتَّقٰی ٪﴿۳۲﴾
যারা বড় বড় গোনাহ এবং প্রকাশ্য ও সর্বজনবিদিত অশ্লীল কাজ থেকে বিরত থাকে-তবে ছোটখাট ত্রুটি-বিচ্যুতি হওয়া ভিন্ন কথা -নিশ্চয়ই তোমার রবের ক্ষমাশীলতা অনেক ব্যাপক।যখন তিনি মাটি থেকে তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এবং যখন তোমরা মাতৃগর্ভে ভ্রূণ আকারে ছিলে তখন থেকে তিনি তোমাদের জানেন। অতএব তোমরা নিজেদের পবিত্রতার দাবী করো না। সত্যিকার মুত্তাকী কে তা তিনিই ভাল জানেন।
সূরা:৫৩:আন-নাজম-৩৩
اَفَرَءَیۡتَ الَّذِیۡ تَوَلّٰی ﴿ۙ۳۳﴾
তুমি কি দেখেছ সে ব্যক্তিকে যে মুখ ফিরিয়ে নেয়;
সূরা:৫৩:আন-নাজম-৩৪
وَ اَعۡطٰی قَلِیۡلًا وَّ اَکۡدٰی ﴿۳۴﴾
এবং সামান্য মাত্র দিয়ে ক্ষান্ত হয়েছে?
সূরা:৫৩:আন-নাজম-৩৫
اَعِنۡدَہٗ عِلۡمُ الۡغَیۡبِ فَہُوَ یَرٰی ﴿۳۵﴾
তার কাছে কি গায়েবের জ্ঞান আছে যে সে প্রকৃত ব্যাপারটা দেখতে পাচ্ছে?
সূরা:৫৩:আন-নাজম-৩৬
اَمۡ لَمۡ یُنَبَّاۡ بِمَا فِیۡ صُحُفِ مُوۡسٰی ﴿ۙ۳۶﴾
তার কাছে কি মূসার সহীফাসমূহের কোন খবর পৌঁছেনি? সূরা:৫৩:আন-নাজম-৩৭
وَ اِبۡرٰہِیۡمَ الَّذِیۡ وَفّٰۤی ﴿ۙ۳۷﴾
যে ইবরাহীম তার সহীফাসমূহের কথাও কি পৌঁছেনি? যে আনুগত্যের পরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছে ?
সূরা:৫৩:আন-নাজম-৩৮
اَلَّا تَزِرُ وَازِرَۃٌ وِّزۡرَ اُخۡرٰی ﴿ۙ۳۸﴾
একথা যে, “কোন বোঝা বহনকারী অন্যের বোঝা বহন করবে না।”
সূরা:৫৩:আন-নাজম-৩৯
وَ اَنۡ لَّیۡسَ لِلۡاِنۡسَانِ اِلَّا مَا سَعٰی ﴿ۙ۳۹﴾
একথা যে, “মানুষ যে চেষ্টা সাধনা করে তা ছাড়া তার আর কিছুই প্রাপ্য নেই।”
সূরা:৫৩:আন-নাজম-৪০
وَ اَنَّ سَعۡیَہٗ سَوۡفَ یُرٰی ﴿۪۴۰﴾
একথা যে, “তার চেষ্টা-সাধনা অচিরেই মূল্যায়ণ করা হবে।
সূরা:৫৩:আন-নাজম-৪১
ثُمَّ یُجۡزٰىہُ الۡجَزَآءَ الۡاَوۡفٰی ﴿ۙ۴۱﴾
এবং তাকে তার পুরো প্রতিদান দেয়া হবে।”
সূরা:৫৩:আন-নাজম-৪২
وَ اَنَّ اِلٰی رَبِّکَ الۡمُنۡتَہٰی ﴿ۙ۴۲﴾
একথা যে, “শেষ পর্যন্ত তোমার রবের কাছেই পৌঁছতে হবে।”

আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন:-
# মুহাম্মাদ ﷺ তোমাদের যে শিক্ষা দিচ্ছেন তোমরা তা তাকে গোমরাহী ও কুপথগামীতা বলে আখ্যায়িত করছো। অথচ এ জ্ঞান তাঁকে আল্লাহ‌ তা’আলার পক্ষ থেকে দেয়া হচ্ছে। আর আল্লাহ‌ তা’আলা তাঁকে চাক্ষুষভাবে এমন সব সত্য ও বাস্তবতা দেখিয়েছেন যার সাক্ষ্য তিনি তোমাদের সামনে পেশ করেছেন। এখন তোমরা নিজেরাই একটু ভেবে দেখ, যে আকীদা-বিশ্বাস মেনে চলার জন্য তোমরা গোঁ ধরে আছো তা কত অযৌক্তিক। অন্য দিকে যে ব্যক্তি তোমাদের সোজা পথ দেখিয়ে দিচ্ছেন তার বিরোধিতা করে তোমরা কার ক্ষতি করছো? এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে তিনজন দেবীর কথা উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে যাদেরকে মক্কা, তায়েফ, মদীনা এবং হিজাজের আশে পাশের লোক জন বেশী বেশী পূজা করতো। তাদের সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়েছে, কখনো কি তোমরা বুদ্ধি বিবেক খাটিয়ে চিন্তা করে দেখেছো, যমীন ও আসমানের প্রভুত্বের ক্ষেত্রে এদের সামান্যতম দখল বা কর্তৃত্বও থাকতে পারে কি? না বিশ্ব-জাহানের প্রভুর সাথে সত্যিই তাদের কোন সম্পর্ক হতে পারে?

লাতের আস্তানা ছিল তায়েফে। বনী সাকীফ গোত্র তার এত ভক্ত ছিল যে, আবরাহা যে সময় হস্তী বাহিনী নিয়ে কা’বা ঘর ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে মক্কার ওপর আক্রমণ করতে যাচ্ছিল তখন তারা শুধু তাদের এ উপাস্যের আস্তানা রক্ষা করার জন্য সে অত্যাচারীকে মক্কার রাস্তা দেখানোর জন্য পথ প্রদর্শক সরবরাহ করেছিল যাতে সে লাতের কোন ক্ষতি না করে। অথচ কা’বা যে আল্লাহর ঘর গোটা আরববাসীর মত সাকীফ গোত্রও একথা বিশ্বাস করতো। লাত শব্দের অর্থ নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে মতানৈক্য আছে। ইবনে জারীর তাবারীর জ্ঞানগর্ভ বিশ্লেষণ হচ্ছে এ শব্দটি আল্লাহ‌ শব্দের স্ত্রীলিংগ। মূল শব্দটি ছিল اللهة । এটিকেই পরিবর্তন করে اللات করা হয়েছে। যামাখশারীর মতে- لوى يلوى থেকে শব্দটির উৎপত্তি। এর অর্থ ঘুরা বা কারো প্রতি ঝুঁকে পড়া। মুশরিকরা যেহেতু ইবাদতের জন্য তার প্রতি মনযোগী হতো, তার সামনে ঝুঁকতো এবং তার তাওয়াফ করতো তাই তাকে ‘লাত’ আখ্যা দেয়া শুরু হলো। ইবনে আব্বাস نا বর্ণটিতে “তাশদীদ” প্রয়োগ করে لات পড়তেন এবং لت بلت থেকে এর উৎপত্তি হয়েছে বলতেন। এর অর্থ মন্থন করা বা লেপন করা। ইবনে আব্বাস ও মুজাহিদ বর্ণনা করেছেন যে, মূলত সে ছিল একজন মানুষ, যে তায়েফের সন্নিকটে এক কঙ্করময় ভূমিতে বাস করতো এবং হজ্জের উদ্দেশ্যে গমনকারীদের ছাতু ও অন্যান্য খাদ্য খাওয়াতো। সে মারা গেলে লোকেরা ঐ কঙ্করময় ভূমিতে তার নামে একটা আস্তানা গড়ে তোলে এবং তার উপাসনা করতে শুরু করে। কিন্তু লাতের এ ব্যাখ্যা ইবনে আব্বাস ও মুজাহিদের মত সম্মানিত ব্যক্তিদের থেকে বর্ণিত হওয়া সত্ত্বেও দু’টি কারণে গ্রহণযোগ্য নয়। একটি কারণ হলো একে لات লাত বলা হয়েছে لات “লাত্তা” বলা হয়নি। অপর কারণটি হলো, কুরআন মজীদে তিনজনকেই দেবী বলে উল্লেখ করেছে কিন্তু বর্ণিত হাদীস অনুসারে সে পুরুষ ছিল নারী নয়। عزى উয্যা শব্দটির উৎপত্তি عزت শব্দ থেকে। এর অর্থ সম্মানিতা। এটা ছিল কুরাইশদের বিশেষ দেবী। এর আস্তানা ছিল মক্কা ও তায়েফের মধ্যবর্তী “নাখলা” উপত্যকার “হুরাদ” নামক স্থানে (নাখলার অবস্থান জানার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, আল-আহকাফ, টীকা-৩৩) বনী হাশেমের মিত্র বনী শায়বান গোত্রের লোক এর প্রতিবেশী ছিল। কুরাইশ এবং অন্যান্য গোত্রের লোকজন এর যিয়ারতের জন্য আসতো, এর উদ্দেশ্যে মানত করতো এবং বলি দান করতো। কা’বার মত এ স্থানটিতেও কুরবানী বা বলির জন্তু নিয়ে যাওয়া হতো এবং এটিকে সমস্ত মূর্তির চেয়ে অধিক সম্মান দেয়া হতো। ইবনে হিশাম বর্ণনা করেছেন আবু উহায়হার মৃত্যু ঘনিয়ে আসলে আবু লাহাব তাকে রোগ শয্যায় দেখতে গিয়ে দেখলো সে কাঁদছে। আবু লাহাব জিজ্ঞেস করলোঃ আবু উহায়হা, তুমি কাঁদছ কেন? তুমি কি মৃত্যুর ভয়ে ভীত হয়ে পড়েছো? মৃত্যু তো সবারই হবে। সে বললোঃ আল্লাহর শপথ, আমি মৃত্যুর ভয়ে ভীত হয়ে কাঁদছি না। আমার মৃত্যুর পর উয্যার পূজার কি উপায় হবে সে দুশ্চিন্তা আমাকে নিশেষ করে দিচ্ছে। আবু লাহাব বললোঃ তোমার জিবদ্দশায় ও তোমার কারণে উয্যার পূজা করা হতো না আর তোমার মৃত্যুর পরে তাকে পরিত্যাগ করাও হবে না। আবু উহায়হা বললোঃ এখন আমি নিশ্চিন্ত হলাম যে, আমার মৃত্যুর পরে কেউ অবশ্যই আমার স্থান পূরণ করবে।

মানাতের আস্তানা ছিল মক্কা ও মদীনার মাঝে লোহিত সাগরের তীরবর্তী কুদাইদ নামক স্থানে। বিশেষ করে খুযা’আ, আওস এবং খাযরাজ গোত্রের লোকেরা এর খুব ভক্ত ছিল। তার হজ্জ ও তাওয়াফ করা হতো এবং তার উদ্দেশ্যে মানতের বলি দেয়া হতো। হজ্জের মওসূমে হাজীরা বায়তুল্লাহ্‌র তাওয়াফ এবং আরাফাতের ও মিনার অবস্থানের পর সেখান থেকে মানতের যিয়ারত তথা দর্শনলাভের জন্য লাব্বায়কা লাব্বায়কা ধ্বনি দিতে শুরু করতো। যারা এ দ্বিতীয় হজ্জের নিয়ত করতো তারা সাফা ও মারওয়ার মাঝে সাঈ করতো না।

# এসব দেবীদেরকে তোমরা আল্লাহ‌র কন্যা সন্তান বলে ধরে নিয়েছো। এ অর্থহীন আকীদা-বিশ্বাস গড়ে নেয়ার সময় তোমরা আদৌ এ চিন্তা করনি যে, মেয়ে সন্তান জন্মগ্রহণকে তোমরা নিজেদের জন্য অপমানকর ও লজ্জাকর মনে করে থাকো। তোমরাও চাও যেন তোমরা পুত্র সন্তান লাভ করো। কিন্তু যখন আল্লাহ‌র সন্তান আছে বলে ধরে নাও, তখন তাঁর জন্য কন্যা সন্তান বরাদ্দ করো।
# তোমরা যাদের দেবী ও দেবতা বলে থাকো তারা দেবীও নয় দেবতাও নয়। তাদের মধ্যে খোদায়ীর কোন বৈশিষ্ট্যও যেমন দেখা যায় না, তেমনি প্রভুত্বের ক্ষমতা ও এখতিয়ারের সামান্যতম অংশও তাদের মধ্যে নেই। তোমরা নিজেরাই তাদেরকে আল্লাহ‌র সন্তান, উপাস্য এবং প্রভুত্বের অংশীদার বানিয়ে নিয়েছো। নিজেদের মনগড়া এসব বিষয়ের সমর্থনে আল্লাহ‌র পক্ষ থেকে আসা কোন প্রমাণ তোমরা পেশ করতে সক্ষম নও।
# অন্য কথায় তাদের গোমরাহীর মৌলিক কারণ দু’টিঃ এক, তারা কোন জিনিসকে নিজেদের আকীদা-বিশ্বাস ও দ্বীন বানিয়ে নেয়ার জন্য প্রকৃত বস্তুনিষ্ঠ জ্ঞানের কোন প্রয়োজন অনুভব করে না, বরং অনুমান ও ধারণার ওপর ভিত্তি করে একটি জিনিস মেনে নেয় এবং পরে এমনভাবে তা বিশ্বাস করে নেয়, যেন সেটিই সত্য ও বাস্তব। দুই, প্রকৃতপক্ষে তারা নিজেদের নফসের নানা রকম কামনা বাসনা পূরণ করার জন্যই এ নীতি ও আচরণ গ্রহণ করে থাকে। তাদের মন চায় তাদের এমন কোন উপাস্য থাকুক যে দুনিয়ায় তাদের আশা-আকাংখা পুরণ করবে এবং আখেরাত যদি সংঘটিত হয়-ই তাহলে সেখানে তাদেরকে ক্ষমা করিয়ে দেয়ার দায়িত্ব গ্রহণ করবে। কিন্তু সে হালাল-হারামের কোন বাধ্যবাধকতা আরোপ করবে না এবং কোন রূপ নৈতিক বিধিবন্ধনেও আবদ্ধ করবে না। একারণেই তারা নবী-রাসূলের আনীত নিয়ম পদ্ধতি অনুসারে এক আল্লাহ‌র দাসত্ব ও আনুগত্যের জন্য প্রস্তুত হতো না এবং নিজেদের গড়া এসব দেব-দেবীর দাসত্ব করাই তাদের মনঃপুত ছিল।
# প্রত্যেক যুগেই আল্লাহ‌র পক্ষ থেকে নবী-রসূলগণ এসব পথহারা মানুষকে প্রকৃত সত্য সম্পর্কে অবহিত করেছেন। তারপর এখন মুহাম্মাদ ﷺ এসে সত্যিকার অর্থে বিশ্ব-জাহানের প্রভুত্ব কার, তা জানিয়ে দিয়েছেন।
# এ আয়াতের দ্বিতীয় অর্থ এও হতে পারে যে, যাকে ইচ্ছা তাকেই উপাস্য বানিয়ে নেয়ার অধিকার কি মানুষের আছে? এর তৃতীয় অর্থ এও গ্রহণ করা যেতে পারে যে, ঐসব উপাস্যের কাছে মানুষ তার কামনা-বাসনা ও আকাঙ্ক্ষা পূরণের যে আশা করে তা কি কখনো পূরণ হওয়া সম্ভব?
# তোমাদের এসব মনগড়া উপাস্যদের সুপারিশ উপকারে আসা তো দূরের কথা, সমস্ত ফেরেশতা মিলেও যদি কারো জন্য সুপারিশ করে তথাপিও তা তার কাজে আসবে না। প্রভুত্বের এখতিয়ারসমূহ সবই পুরোপুরি আল্লাহ‌র হাতে। যদি আল্লাহ‌ তা’আলা কারো পক্ষে সুপারিশ করতে কাউকে অনুমতি না দেন এবং কারো পক্ষে সুপারিশ শুনতে সম্মত না হন তাহলে ফেরেশতাও তাঁর কাছে কারো জন্য সুপারিশ করার সাহস দেখাতে পারে না।

# তাদের একটি নির্বুদ্ধিতা হচ্ছে, তারা এখতিয়ার ও ক্ষমতাহীন ফেরেশতাদের উপাস্য বানিয়ে নিয়েছে যারা আল্লাহ‌ তা’আলার কাছে সুপারিশ পর্যন্ত করার সামর্থ্য ও সাহস রাখে না। তাছাড়া আরো নির্বুদ্ধিতা হচ্ছে এই যে, তারা তাদেরকে নারী বলে মনে করে এবং আল্লাহ‌র কন্যা বলে আখ্যায়িত করে। এসব অজ্ঞতায় নিমজ্জিত হওয়ার মৌলিক কারণ হলো, তারা আখেরাতকে বিশ্বাস করে না। তারা যদি আখেরাতে বিশ্বাস করতো তাহলে এ ধরনের দায়িত্বহীন কথাবার্তা বলতে পারতো না। আখেরাতের অস্বীকৃতি তাদেরকে পরিণাম সম্বন্ধে নিরুদ্বিগ্ন করে দিয়েছে। তারা মনে করে, আল্লাহ‌কে মানা বা না মানা কিংবা হাজার জন খোদাকে মানায় কোনই পার্থক্য নেই। কারণ, তারা এসব আকীদা-বিশ্বাসের কোনটিরই কোন ভাল বা মন্দ পরিণাম দুনিয়ার বর্তমান জীবনে প্রতিফলিত হতে দেখে না। আল্লাহ‌দ্রোহী মুশরিক কিংবা তাওহীদবাদী যাই হোক না কেন এখানে সবার ফসলই পাকতে এবং ধ্বংস হতে দেখা যায়। সবাই রোগাক্রান্ত হয় আবার সুস্থও হয়ে ওঠে। সব রকম ভাল ও মন্দ পরিস্থিতি সবার জন্যই আসে। তাই কোন ব্যক্তি কাউকে উপাস্য মানুক বা না মানুক কিংবা যত ও যেভাবে ইচ্ছা উপাস্য বানিয়ে নিক এটা তাদের কাছে কোন বড় গুরুত্বপূর্ণ বা সুবিবেচনা পাওয়ার মত বিষয় নয়। তাদের মতে হক এবং বাতিলের ফয়সালা যখন এ দুনিয়াতেই হতে হবে আর এ দুনিয়াতে প্রকাশিত ফলাফল দ্বারাই তা নিরূপিত হবে তখন একথা স্পষ্ট যে, এখানে প্রকাশিত ফলাফল কোন আকীদা-বিশ্বাসের ন্যায় ও সত্য হওয়ার চূড়ান্ত ফায়সালাও দেয় না। কাজেই এরূপ লোকদের পক্ষে একটি আকীদা-বিশ্বাস গ্রহণ করা এবং আরেকটিকে প্রত্যাখ্যান করা মনের খেয়ালীপনা ছাড়া আর কিছুই নয়।

# ফেরেশতারা যে স্ত্রীলোক এবং আল্লাহ‌র কন্যা এ বিশ্বাসটি তারা জ্ঞান অর্জনের কোন একটি মাধ্যম ছাড়া জানতে পেরেছে বলে অবলম্বন করেনি। বরং নিজেদের অনুমান ও ধারণার ওপর ভিত্তি করে এ বিষয়টি স্থির করে নিয়েছে এবং এর ওপর ভিত্তি করেই এসব আস্তানা গড়ে নিয়েছে। তাদের কাছেই মনের কামনা বাসনা পূর্ণ করার জন্য প্রার্থনা করছে এবং নযর-নেওয়াজ পেশ করা হচ্ছে।

# এখানে ‘যিকর’ শব্দটি কয়েকটি অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এর অর্থ কুরআন হতে পারে কিংবা শুধু উপদেশবাণী হতে পারে এবং আয়াতের অর্থ এও হতে পারে যে, আল্লাহ‌র কথা শুনতে একদম পছন্দ করে না।
# তার পিছে লেগে থেকো না এবং তাকে বুঝানোর জন্য নিজের সময় নষ্ট করো না। কেননা এ প্রকৃতির লোক এমন কোন দাওয়াত বা আন্দোলনকে গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত হবে না যার ভিত্তি আল্লাহ‌র দাসত্ব ও আনুগত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত, যা দুনিয়ার বস্তুগত লাভের চেয়ে অনেক উচ্চতর উদ্দেশ্য ও মূল্যমানের দিকে আহবান জানায় এবং আখেরাতের চিরস্থায়ী সাফল্য ও সৌভাগ্যই যার মূল লক্ষ্য। এ ধরনের বস্তু পূজারী এবং আল্লাহ‌ বিমুখ মানুষের পেছনে নিজের শ্রম ব্যয় করার পরিবর্তে যারা আল্লাহ‌র কথা শুনতে প্রস্তুত এবং দুনিয়া পূজার ব্যধিতে আক্রান্ত নয় তাদের দিকে মনোযোগ দাও।
# এটি পূর্বাপর প্রসঙ্গহীন একটি বাক্য যা কথার ধারাবাহিকতা ছিন্ন করে আগের কথার ব্যাখ্যা হিসেবে পেশ করেছে।
# এসব লোক দুনিয়া এবং দুনিয়াবী স্বার্থের ঊর্ধ্বে আর কিছুই জানে না এবং কিছু চিন্তাও করতে পারে না। তাই তাদের পেছনে পরিশ্রম করা বৃথা।
# অন্য কথায় কোন মানুষের পথভ্রষ্ট বা সুপথপ্রাপ্ত হওয়ার ফয়সালা যেমন এ পৃথিবীতে হবে না তেমনি এর ফয়সালা দুনিয়ার মানুষের মতামতের ওপর ছেড়ে দেয়াও হয়নি। এর ফয়সালা একমাত্র আল্লাহ‌র হাতে। তিনিই যমীন ও আসমানের মালিক এবং দুনিয়ার মানুষ ভিন্ন ভিন্ন যেসব পথে চলেছে তার কোন্‌টি হিদায়াতের পথ এবং কোন্‌টি গোমরাহীর পথ তা কেবল তিনিই জানেন। অতএব আরবের এসব মুশরিক এবং মক্কার কাফেররা যে তোমাকে বিপথগামী ও পথভ্রষ্ট বলে আখ্যায়িত করছে আর নিজেদের জাহেলিয়াতকে হিদায়াত বলে মনে করছে সেজন্য তুমি মোটেই পরোয়া করবে না। এরা যদি নিজেদের এ ভ্রান্ত ধারণা মধ্যে ডুবে থাকতে চায় তাহলে তাদের ডুবে থাকতে দাও। তাদের সাথে তর্ক-বিতর্ক করে সময় নষ্ট করা এবং মাথা ঘামানোর কোন প্রয়োজন নেই।
# আগে থেকেই যে বক্তব্য চলছিলো এখান থেকে পুনরায় তার ধারাবাহিকতা শুরু হচ্ছে। সুতরাং মাঝখানে পূর্বাপর প্রসঙ্গহীন কথাটা বাদ দিলে বাক্যের অর্থ দাঁড়ায় এরূপঃ “তাকে তার আপন অবস্থায় চলতে দাও। যাতে আল্লাহ‌ অন্যায়কারীকে তার কাজের প্রতিফল দান করেন।”
# আমি সংকীর্ণমনা নই এবং সংকীর্ণ দৃষ্টির অধিকারীও নই। ছোটখাটো ভুল-ভ্রান্তি ধরে আমি বান্দাকে শাস্তি দেই না। তোমাদের আমলনামায় যদি বড় বড় অপরাধ না থাকে তাহলে ছোটখাটো অপরাধগুলোকে উপেক্ষা করা হবে এবং তোমাদের বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ আনাই হবে না। তবে যদি তোমরা বড় বড় অপরাধ করে থাকো, তাহলে তোমাদের বিরুদ্ধে মামলা চালানো হবে এবং তাতে ছোটখাটো অপরাধগুলোও ধর্তব্যের গণ্য হবে, সেজন্য পাকড়াও করা হবে।

এখানে বড় গোনাহ ও ছোট গোনাহর মধ্যে নীতিগত পার্থক্য বুঝে নেয়া উচিত। কুরআন ও সুন্নাতের মধ্যে আমি যতটুকু চিন্তা-ভাবনা করতে পেরেছি তাতে আমি এটা বুঝতে সক্ষম হয়েছি (তবে যথার্থ সত্য একমাত্র আল্লাহ জানেন) যে, তিনটি কারণে কোন কাজ বড় গোনাহে পরিণত হয়ঃ

একঃ কারো অধিকার হরণ করা। সে অধিকার আল্লাহর, বাপ-মার, অন্য মানুষের বা হরণকারীর নিজেরও হতে পারে। তারপর যার অধিকার যত বেশী হবে তার অধিকার হরণও ঠিক তত বেশী বড় গোনাহ হবে। এ কারণেই গোনাহকে ‘জুলুম’ও বলা হয়। আর এ জন্য কুরআনে শিরককে জুলুম বলা হয়েছে।

দুইঃ আল্লাহকে ভয় না করা এবং আল্লাহর মোকাবিলায় আত্মম্ভরিতা করা, এর ফলে মানুষ আল্লাহর আদেশ ও নিষেধের পরোয়া করে না। তাঁর নাফরমানি করার উদ্দেশ্যে ইচ্ছা করেই এমন কাজ করে যা করতে তিনি নিষেধ করেছেন এবং জেনে বুঝে এমন কাজ থেকে বিরত থাকে যা করার জন্য তিনি হুকুম দিয়েছেন। এই নাফরমানি যে পরিমাণ নির্লজ্জতা, অহমিকা, দুঃসাহস ও আল্লাহভীতির মনোভাবে সমৃদ্ধ হবে গোনাহটিও ঠিক সেই পর্যায়ের কঠিন ও মারাত্মক হবে। এই অর্থের প্রেক্ষিতেই গোনাহের জন্য ‘ফিস্‌ক’ (ফাসেকী) ও ‘মাসিয়াত’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। তিনঃ যে সমস্ত সম্পর্কের সুস্থতা ও বলিষ্ঠতার ওপর মানব জীবনের শান্তি ও নিরাপত্তা নির্ভর করে সেগুলো বিকৃত ও ছিন্ন করা। এ সম্পর্ক বান্দা ও আল্লাহর মধ্যে এবং বান্দা ও বান্দার মধ্যে হতে পারে। আবার যে সম্পর্ক যত বেশী গুরুত্বপূর্ণ, যা ছিন্ন করলে শাস্তি ও নিরাপত্তার যত বেশী ক্ষতি হয় এবং যার ব্যাপারে যত বেশী নিরাপত্তার আশা করা যেতে পারে, তাকে ছিন্ন করা, কেটে ফেলা ও নষ্ট করার গোনাহ তত বেশী বড় হয়। যেমন যিনা ও তার বিভিন্ন পর্যায় সম্পর্কে চিন্তা করুন। এ কাজটি আসলে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ব্যবস্থায় বিপর্যয় ডেকে আনে। তাই এটি মূলত একটি বড় গোনাহ। কিন্তু এর বিভিন্ন অবস্থা গোনাহের ব্যাপারে একটি অন্যটির চাইতে বেশী মারাত্মক। বিবাহিত ব্যক্তির যিনা করা অবিবাহিত ব্যক্তির যিনা করার তুলনায় অনেক কঠিন গোনাহ। বিবাহিত মহিলার সাথে যিনা করা অবিবাহিতা মেয়ের সাথে যিনা করার তুলনায় অনেক বেশী দুষনীয়। প্রতিবেশীর স্ত্রীর সাথে যিনা করা অপ্রতিবেশির স্ত্রীর সাথে যিনা করার তুলনায় বেশী খারাপ। মাহরাম মহিলা যেমন, মা, মেয়ে, বোনের সাথে যিনা করা অন্য অনাত্মীয় মহিলার সাথে যিনা করার তুলনায় অনেক বেশী পাপ। অন্য কোন জায়গায় যিনা করার তুলনায় মসজিদে যিনা করা কঠিন গোনাহ। ওপরে বর্ণিত কারণের ভিত্তিতে এই দৃষ্টান্তগুলোতে একই কাজের বিভিন্ন অবস্থার মধ্যে গোনাহ হবার দিক দিয়ে পর্যায়ের পার্থক্য সূচিত হয়েছে। যেখানে নিরাপত্তার আশা যত বেশী, যেখানে মানবিক সম্পর্ক যত বেশী সম্মানের অধিকারী এবং যেখানে এই সম্পর্ক ছিন্ন করা যত বেশী বিপর্যয়ের কারণ বলে বিবেচিত হয়, সেখানে যিনা করা তত বেশী বড় গোনাহ। এই অর্থের প্রেক্ষিতে গোনাহের জন্য ‘ফুজুর’ এর পরিভাষা করা হয়।
# এখানে আসল শব্দ হচ্ছেفَوَاحِشَ এ শব্দটি এমন সব কাজের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় যেগুলো সুস্পষ্ট খারাপ কাজ হিসেবে পরিচিত। কুরআনে ব্যভিচার, সমকাম (পুরুষ কামিতা), উলংগতা, মিথ্যা দোষারোপ এবং পিতার বিবাহিত স্ত্রীকে বিয়ে করাকে ফাহেশ কাজের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। হাদীসে চুরি ও মদপানের সাথে সাথে ভিক্ষাবৃত্তিকেও ফাহেশ ও অশ্লীল কাজের মধ্যে গণ্য করা হয়েছে। অনুরূপভাবে অন্যান্য সমস্ত নির্লজ্জতার কাজও ফাহেশের অন্তর্ভুক্ত। এক্ষেত্রে আল্লাহর ঘোষণা হচ্ছে এ ধরনের কাজ প্রকাশ্যে বা গোপনে কোনভাবেই করা যাবে না।

# মূল শব্দ হচ্ছে إِلَّا اللَّمَمَ । কোন জিনিসের অতি সামান্য পরিমাণ কিংবা নগন্য প্রভাব অথবা শুধু নৈকট্য বা সামান্য দেরী থাকা বুঝাতে আরবী ভাষায় لَمَم শব্দটি ব্যবহৃত হয়। যেমন বলা হয় اَلَم بِالْمَكَانِ সে অমুক স্থানে সামান্য কিছু সময় মাত্র অবস্থান করেছে কিংবা সামান্য সময়ের জন্য গিয়েছে اَلَمْ بِالطَّعَامِ সে সামান্য খাবার খেয়েছে। به لمم তার মস্তিষ্কে কিছুটা বিকৃতি আছে কিংবা তাতে কিছু উন্মাদনা ভাব আছে। কেউ যখন কোন কাজে লিপ্ত হওয়ার নিকটবর্তী হয় কিন্তু কাজটি তখনো করা হয়নি এমন অবস্থা বুঝাতে এ শব্দটি ব্যবহৃত হয়। ফাররা বলেন, আমি আরবদেরকে এভাবে বলতে শুনেছি ضربه مالمم القتل অমুক ব্যক্তি তাকে মেরেছে যে, কেবল হত্যা করা বাকি আছে এবং اَلَمْ يَفْعَلُ অমুক ব্যক্তি এ কাজ প্রায় করেই ফেলেছিলো। কবি বলেছেনঃ المت فحيت ثم قامت فودعت “সে মুহূর্তের জন্য আসলো, সালাম দিল, উঠলো এবং বিদায় হয়ে গেল।”

এসব ব্যবহারের দিক লক্ষ্য করে তাফসীরকারদের মধ্যে কেউ কেউ এ আয়াতের لمم শব্দের অর্থ গ্রহণ করেছেন ছোট গোনাহ। কেউ কেউ এর অর্থ বলেছেন যে, ব্যক্তির কার্যত বড় গোনাহের নিকবর্তী হওয়া সত্ত্বেও তাতে লিপ্ত না হওয়া। কেউ কেউ একে ক্ষণিকের জন্য গোনাহে লিপ্ত হয়ে পরে তা থেকে বিরত হওয়া অর্থে গ্রহণ করেছেন। কারো কারো মতে এর অর্থ হচ্ছে, ব্যক্তি গোনাহের কল্পনা, ইচ্ছা কিংবা সংকল্প করবে ঠিকই কিন্তু কার্যত কোন পদক্ষেপ নেবে না। এ বিষয়ে সাহাবা ও তাবেয়ীদের মতামত নিম্নরূপঃ

যায়েদ ইবনে আসলাম ও ইবনে যায়েদ বলেনঃ এর অর্থ মানুষ ইসলাম গ্রহণের পূর্বে জাহেলী যুগে যেসব গোনাহ করেছে, কিন্তু ইসলাম গ্রহণের পর তা পরিত্যাগ করেছে। হযরত আবদুল্লাহ্‌ ইবনে আব্বাসের (রাঃ) একটি মতও তাই।

ইবনে আব্বাসের (রাঃ) দ্বিতীয় মতটি হচ্ছে, ব্যক্তির কোন বড় গোনাহ বা অশ্লীল কাজে অল্প সময়ের জন্য কিংবা ভুলক্রমে কখনো লিপ্ত হয়ে পড়া এবং পরে তা পরিত্যাগ করা। হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ), হযরত আবদুল্লাহ্‌ (রাঃ) ইবনে আমর ইবনে আস, মুজাহিদ (রাঃ) হাসান বাসরী (রঃ) এবং আবু সালেহের (রঃ) মতও তাই।

হযরত আবদুল্লাহ্‌ ইবনে মাসউদ (রাঃ), মাসরূক এবং শা’বী বলেনঃ এর অর্থ কোন ব্যক্তির কোন বড় গোনাহের নিকটবর্তী হওয়া এবং তার প্রাথমিক পর্যায়সমূহ অতিক্রম করা কিন্তু চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত হয়ে বিরত থাকা। যেমনঃ কেউ চুরি করার উদ্দেশ্যে বের হলো কিন্তু চুরি করা থেকে বিরত থাকলো। কিংবা পরনারীর সাথে মেলামেশা করলো কিন্তু ব্যভিচার করতে অগ্রসর হলো না। নির্ভরযোগ্য বর্ণনা সূত্রে হযরত আবু হুরাইরা এবং আবদুল্লাহ্‌ আব্বাস থেকেও এ মতটি উদ্ধৃত হয়েছে।

হযরত আবদুল্লাহ্‌ ইবনে যুবায়ের, ইকরিমা, কাতাদা এবং দাহহাক বলেনঃ এর অর্থ এমন ছোট ছোট গোনাহ যার জন্য দুনিয়াতে কোন শাস্তি নির্দিষ্ট করা হয়নি এবং আখেরাতেও আযাব দেয়ার কোন ভয় দেখানো হয়নি।

সাঈদ ইবনুল মুসাইয়েব বলেনঃ এর অর্থ মনে গোনাহের চিন্তার উদ্রেক করা কিন্তু কার্যত তাতে লিপ্ত না হওয়া।

এগুলো হচ্ছে, সম্মানিত সাহাবা ও তাবেয়ীদের বিভিন্ন ব্যাখ্যা যা বিভিন্ন রেওয়ায়াতে উদ্ধৃত হয়েছে। পরবর্তী তাফসীরকার, ইমাম ও ফিকাহবিদদের অধিকাংশই এ মত পোষণ করেন, যে এ আয়াত এবং সূরা নিসার ৩১ আয়াত সুস্পষ্টরূপে গোনাহকে সগীরা ও কবীরা এই দু’টি বড় ভাগে বিভক্ত করেছে। এ দু’টি আয়াত মানুষকে আশান্বিত করে যে, তারা যদি বড় বড় গোনাহ ও অশ্লীল কাজ থেকে বিরত থাকে তাহলে আল্লাহ‌ তা’আলা তাদের ছোট ছোট্ গোনাহ মাফ করে দেবেন। যদিও দুয়েকজন বড় আলেম মত প্রকাশ করেছেন যে, কোন গোনাহই ছোট নয়। আল্লাহ‌র অবাধ্যতা মাত্রই বড় গোনাহ। কিন্তু ইমাম গাযযালী (রঃ) বলেছেনঃ কবীরা ও সগীরা গোনাহের পার্থক্য এমন একটি বিষয় যা অস্বীকার করা যায় না। কারণ, যেসব উৎস থেকে শরীয়াতের হুকুম-আহকাম সম্পর্কিত জ্ঞান লাভ করা যায় তার সবগুলোতেই এর উল্লেখ আছে।

এখন প্রশ্ন হলো, সগীরা ও কবীরা গোনাহর মধ্যে পার্থক্য কি? এবং কি ধরনের গোনাহ সগীরা আর কি ধরনের গোনাহ কবীরা? এ ব্যাপারে কবীরা ও সগীরা গোনাহর যে সংজ্ঞায় আমরা পূর্ণরূপে নিশ্চিত ও পরিতৃপ্ত তা হচ্ছে, “যে গোনাহকে কিতাব ও সুন্নাহর কোন সুস্পষ্ট উক্তিতে হারাম বলা হয়েছে অথবা যে গোনাহর জন্য আল্লাহ‌ ও তাঁর রসূল দুনিয়াতে কোন শাস্তি নির্দিষ্ট করেছেন অথবা যে গোনাহের কারণে আখেরাতের আযাবের ভয় দেখিয়েছেন বা অভিশাপ দিয়েছেন অথবা তাতে লিপ্ত ব্যক্তির ওপর আযাব নাযিলের খবর দিয়েছেন।” এ ধরনের সমস্ত গোনাহই কবীরা গোনাহ। এ প্রকৃতির গোনাহ ছাড়া শরীয়াতের দৃষ্টিতে আর যত রকমের অপছন্দনীয় কাজ আছে তার সবই সগীরা গোনাহের সংজ্ঞায় পড়ে। একই ভাবে কেবলমাত্র গোনাহের আকাঙ্ক্ষা পোষণ করা কিংবা ইচ্ছা করাও কাবীরা গোনাহ নয়, সগীরা গোনাহ। এমন কি কোন বড় গোনাহের প্রাথমিক পর্যায়সমূহ অতিক্রম করাও ততক্ষণ পর্যন্ত কাবীরা গোনাহ নয় যতক্ষণ না ব্যক্তি কার্যত তা করে বসবে। তবে সগীরা গোনাহও যখন ইসলামী বিধানকে হেয় প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে করা হয়, আল্লাহ‌ তা’আলার মোকাবিলায় অহংকারের মনোবৃত্তি নিয়ে করা হয় এবং যে শরীয়াত একে খারাপ কাজ বলে আখ্যায়িত করেছে তাকে আদৌ গুরুত্ব দেয়ার উপযুক্ত মনে করা না হয় তখন তা কবীরা গোনাহে রূপান্তরিত হয়।
# সগীরা গোনাহকারী ব্যক্তিকে মাফ করে দেয়ার কারণ এ নয় যে, সগীরা গোনাহ কোন গোনাহই নয়। বরং এর কারণ হলো, আল্লাহ‌ তা’আলা তাঁর বান্দাহদের সাথে সংকীর্ণচেতার মত আচরণ এবং ছোট ছোট ব্যাপারে পাকড়াও করার নীতি গ্রহণ করেন না। বান্দা যদি নেকীর পথ অনুসরণ করে এবং বড় বড় গোনাহ ও অশ্লীল কাজ থেকে বিরত থাকে তাহলে ছোট ছোট ব্যাপারে তিনি তাকে পাকড়াও করবেন না। অশেষ রহমতের কারণে তাকে ক্ষমা করে দেবেন।
# কুরাইশদের বড় নেতাদের অন্যতম ওয়ালীদ ইবনে মুগীরার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। ইবনে জারীর তাবারী বর্ণনা করেছেন যে, এ ব্যক্তি প্রথমে রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ এর দাওয়াত গ্রহণ করতে মনস্থির করে ফেলেছিল। কিন্তু তার এক মুশরিক বন্ধু জানতে পারলো যে, সে মুসলমান হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেছে। সে তাকে বললো তুমি পিতৃধর্ম ত্যাগ করো না। যদি তুমি আখেরাতের আযাবের ভয় পেয়ে থাকো তাহলে আমাকে এই পরিমাণ অর্থ দিয়ে দাও, তোমাদের পরিবর্তে আমি সেখানকার আযাব ভোগ করার দায়িত্ব গ্রহণ করছি। ওয়ালিদ একথা মেনে নিল এবং আল্লাহ‌র পথে প্রায় এসে আবার ফিরে গেল। কিন্তু সে তার মুশরিক বন্ধুকে যে পরিমাণ অর্থ দেবে বলে ওয়াদা করেছিল তার সামান্য মাত্র দিয়ে অবশিষ্ট অংশ বন্ধ করে দিল। এ ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত করার উদ্দেশ্য ছিল মক্কার কাফেরদের একথা জানিয়ে দেয়া যে, আখেরাত সম্পর্কে নিরুদ্বেগ এবং দ্বীনের তাৎপর্য সম্পর্কে অজ্ঞতা তাদেরকে কি ধরনের মূর্খতা ও নির্বুদ্ধিতার মধ্যে নিমগ্ন করে রেখেছে।

# সে কি জানতে পেরেছে যে, এ আচরণ তার জন্য সত্যিই কল্যাণকর? সে কি জানতে পেরেছে যে, এভাবে কেউ আখেরাতের আযাব থেকে বাঁচতে পারে?
# হযরত মুসা ও হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের সহীফাসমূহে যে শিক্ষা নাযিল করা হয়েছিল তার সংক্ষিপ্তসার এভাবে বর্ণনা করা হচ্ছে। হযরত মূসার সহীফাসমূহ বলতে তো তাওরাতকে বুঝানো হয়েছে। আর হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের পবিত্র গ্রন্থসমূহেও তার কোন উল্লেখ দেখা যায় না। কুরআনই একমাত্র গ্রন্থ যার দু’টি স্থানে ইবরাহীমের সহীফার শিক্ষাসমূহের কোন কোন অংশ উদ্ধৃত হয়েছে। তার একটি স্থান হলো এটি এবং অপর স্থানটি হলো সূরা আল আ’লার শেষ কয়েকটি আয়াত।
# এ আয়াত থেকে তিনটি বড় মূলনীতি পাওয়া যায়। এক, প্রত্যেক ব্যক্তি নিজে তার কাজের জন্য নিজেই দায়ী। দুই, একজনের কাজের দায়দায়িত্ব অন্যের ওপর চাপিয়ে দেয়া যেতে পারে না তবে সেই কাজ সংঘটিত হওয়ার ব্যাপারে তার কোন ভূমিকা থাকলে ভিন্ন কথা। তিন, কেউ চাইলেও অন্য কারো কাজের দায়দায়িত্ব নিজে গ্রহণ করতে পারে না। আর প্রকৃত অপরাধীকে এ কারণে ছেড়ে দেয়া যেতে পারে না যে, তার শাস্তি ভোগ করার জন্য অন্য কেউ এগিয়ে আসছে।
# একথাটি থেকেও তিনটি মূলনীতি পাওয়া যায়। এক, প্রত্যেক ব্যক্তি যা পরিণতি ভোগ করবে তা তার কৃতকর্মেরই ফল। দুই, একজনের কর্মফল অন্যজন ভোগ করতে পারে না। তবে ঐ কাজের পেছনে তার কোন ভূমিকা থাকলে তা ভিন্ন কথা। তিন, চেষ্টা-সাধনা ছাড়া কেউ-ই কিছু লাভ করতে পারে না।

কোন কোন ব্যক্তি এ তিনটি মূলনীতিকে ভুল পন্থায় অর্থনৈতিক ক্রিয়াকাণ্ডের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে এরূপ সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, কোন ব্যক্তি নিজের কাষ্টার্জিত আয় (Earned Income) ছাড়া কোন কিছুর বৈধ মালিক হতে পারে না। কিন্তু একথা কুরআন মজীদেরই দেয়া কিছু সংখ্যক আইন ও নির্দেশের সাথে সাংঘর্ষিক। উদাহরণ হিসেবে উত্তরাধিকার আইনের কথা বলা যেতে পারে। এ আইন অনুসারে কোন ব্যক্তির পরিত্যক্ত সম্পদে বহু সংখ্যক লোক অংশ পায় এবং বৈধ উত্তরাধিকারী হিসেবে স্বীকৃত হয়। কিন্তু উত্তরাধিকার হিসেবে প্রাপ্ত এ সম্পদ তার শ্রম দ্বারা অর্জিত নয়। শত যুক্তি দেখিয়েও একজন দুগ্ধপোষ্য শিশু সম্পর্কে একথা প্রমাণ করা যাবে না যে, পিতার পরিত্যক্ত সম্পদে তার শ্রমের কোন ভূমিকা আছে। অনুরূপভাবে যাকাত ও সাদকার বিধান অনুসারে শুধুমাত্র শরয়ী ও নৈতিক অধিকারের ভিত্তিতে একজনের অর্থ-সম্পদ অন্যেরা লাভ করে থাকে। এভাবে তারা ঐ সম্পদের বৈধ মালিকানা লাভ করে। কিন্তু সেই সম্পদ সৃষ্টির ব্যাপারে তার শ্রমের কেন অংশ থাকে না। অতএব কুরআনের কোন একটি আয়াত নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করে কুরআনের অন্যান্য শিক্ষার সাথে সাংঘর্ষিক কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা কুরআনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সম্পূর্ণ পরিপন্থী।

আবার কিছু সংখ্যক লোক এসব মূলনীতিকে আখেরাতের সাথে সম্পৃক্ত ধরে নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করে যে, এসব মূলনীতি অনুসারে এক ব্যক্তির কাজ কি কোন অবস্থায় অপর ব্যক্তির জন্য কল্যাণকর হতে পারে? এক ব্যক্তি যদি অপর ব্যক্তির জন্য কিংবা তার পরিবর্তে কোন আমল করে তাহলে তার পক্ষ থেকে তা গ্রহণ করা যেতে পারে? এক ব্যক্তির আমল কি অন্য কোন ব্যক্তিকে দিয়ে দেয়া সম্ভব? এসব প্রশ্নের জবাব যদি নেতিবাচক হয় তাহলে “ইসালে সওয়াব” বদলি হজ্জ্ব ইত্যাদি সবই নাজায়েজ হয়ে যায়। এমন কি অন্যের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করাও অর্থহীন হয়ে পড়ে। কেননা যার জন্য দোয়া করা হবে সেই দোয়াও তার নিজের কাজ নয়। তবে শুধুমাত্র মু’তযিলারা ছাড়া ইসলামের অনুসারীদের মধ্য থেকে আর কেউ-ই এ চরম দৃষ্টিভঙ্গী গ্রহণ করেনি। শুধু তারাই এ আয়াতের এ অর্থ গ্রহণ করে থাকে যে, এক ব্যক্তির চেষ্টা-সাধনা কোন অবস্থায়ই অন্যের জন্য কল্যাণকর হতে পারে না। অপরদিকে আহলে সুন্নাত একজনের দোয়া অন্যের জন্য কল্যাণকর হওয়ার বিষয়টা সর্বসম্মতভাবে স্বীকার করে। কেননা, কুরআন থেকেই তা প্রমাণিত। “ইসালে সাওয়াব” এবং অন্য কারো পক্ষ থেকে কৃত কোন নেক কাজের কল্যাণকর হওয়ার ব্যাপারে তাদের মধ্যে মৌলিক দিক দিয়ে কোন পার্থক্য নেই, বরং বিস্তারিত ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে মতানৈক্য বিদ্যমান।

(১) ইসলে সওয়াব হলো, এক ব্যক্তির কোন নেক কাজ করে তার সওয়াব ও প্রতিদান অপর কোন ব্যক্তিকে দেয়া হোক বলে আল্লাহ‌র কাছে দোয়া করা। এ মাসয়ালা সম্পর্কে ইমাম মালেক (রঃ) ও ইমাম শাফেয়ী (রঃ) বলেনঃ নিরেট শারীরিক ইবাদাত যেমনঃ নামায, রোযা ও কুরআন তিলাওয়াত ইত্যাদির সওয়াব অন্যেরা পেতে পারে না। তবে আর্থিক ইবাদাত যেমনঃ সাদকা কিংবা আর্থিক ও শারীরিক উভয়টির সংমিশ্রিত ইবাদাত যেমনঃ হজ্জ্ব-এ সবের সওয়াব অন্যে পেতে পারে। কারণ, মূলনীতি হিসেবে এটা অবিসংবাদিত যে, এক ব্যক্তির আমল অন্যের কল্যাণে আসবে না। তবে, অনেক সহীহ হাদীসের ভাষ্য অনুসারে যেহেতু সাদকার সওয়াব পৌঁছানো যায় এবং বদলি হজ্জ্ব ও করা যায়, তাই আমরা এ প্রকৃতির ইবাদতের “ইসালে সওয়াব” বা সওয়াব পৌঁছানোর বৈধতা স্বীকার করছি। পক্ষান্তরে হানাফী আলেমদের রায় হলো, মানুষ তাঁর সব রকম নেক আমলের সওয়াব অপরকে দান করতে পারে-তা নামায হোক বা রোযা, কুরআন তেলাওয়াত হোক বা যিকর কিংবা সাদকা হোক বা হজ্জ্ব ও উমরা হোক। এর স্বপক্ষে যুক্তি হচ্ছে শ্রমের কাজ করে মানুষ যেমন মালিককে বলতে পারে, এর পারিশ্রমিক আমার পরিবর্তে অমুক ব্যক্তিকে দিয়ে দেয়া হোক। তেমনি কোন নেক কাজ করে সে আল্লাহ‌র কাছে এ বলে দোয়া করতে পারে যে কাজের প্রতিদান আমার পক্ষ থেকে অমুক ব্যক্তিকে দিয়ে দেয়া হোক। এক্ষেত্রে কতিপয় নেকীর কাজকে বাদ দিয়ে অন্য কতিপয় নেকীর কাজের মধ্যে একে সীমিত রাখার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। এ বিষয়টি বহু সংখ্যক হাদীস দ্বারা প্রমাণিতঃ

বুখারী, মুসলিম, মুসনাদে, আহমাদ, ইবনে মাজা, তাবারানী (ফীল-আওসাত) মুসতাদরিক এবং ইবনে আবী শায়বাতে হযরত আয়েশা, হযরত আবু হুরাইরা, হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ্‌, হযরত আবু রাফে, হযরত আবু তালহা আনসারী এবং হুযাইফা ইবনে উসাইদুল গিফারী, কর্তৃক সর্বসম্মতভাবে বর্ণিত হয়েছে যে, রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ দু’টি ভেড়া নিয়ে তার একটি নিজের ও নিজের পরিবারের সবার পক্ষ থেকে এবং অপরটি তাঁর উম্মতের পক্ষ থেকে কুরবানী করেছেন।

মুসলিম, বুখারী, মুসনাদে আহমাদ, আবু দাউদ এবং নাসায়ীতে হযরত আয়েশা কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে যে, এক ব্যক্তি রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ কে বললো, আমার মা অকস্মাৎ মারা গিয়েছেন। আমার বিশ্বাস, যদি তিনি কথা বলার সুযোগ পেতেন তাহলে অবশ্যই সাদকা করার জন্য বলতেন। এখন আমি যদি তাঁর পক্ষ থেকে সাদকা করি তাহলে তিনি কি তার প্রতিদান পাবেন? নবী ﷺ বললেন, হ্যাঁ। মুসনাদে আহমাদ হযরত আবদুল্লাহ্‌ ইবনে আমর ইবনুল আস থেকে বর্ণিত হয়েছে যে তার দাদা আস ইবনে ওয়ায়েল জাহেলী যুগে একশত উট কুরবানী করার মানত করেছিলেন। তার চাচা হিশাম ইবনুল আস তার অংশের পঞ্চাশটি উট কুরবানী করে দিয়েছেন। হযরত আমর ইবনুল আস রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ কে জিজ্ঞেস করলেন, তিনি কি করবেন। নবী ﷺ বললেনঃ তোমার পিতা যদি তাওহদীদের অনুসারী হয়ে মারা যারা গিয়ে থাকেন তাহলে তুমি তার পক্ষ থেকে রোযা রাখো অথবা সাদকা করো। এতে তার কল্যাণ হবে।

মুসনাদে আহমাদ, আবু দাউদ, নাসায়ী ও ইবনে মাজাতে হযরত হাসান বাসরীর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, হযরত সা’দ ইবনে উবাই রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ কে বললেনঃ আমার মা ইনতিকাল করেছেন? আমি কি তাঁর পক্ষ থেকে সাদকা করবো? তিনি বললেনঃ হ্যাঁ। বুখারী, মুসলিম, মুসনাদে আহমাদ, নাসায়ী, তিরমিযী, আবু দাউদ, ইবনে মাজা প্রভৃতি হাদীসগ্রন্থে হযরত আয়েশা (রাঃ), হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) এবং হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত আরো কিছু সংখ্যক হাদীস আছে। ঐ সব হাদীসেও রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে সাদকা করার অনুমতি দিয়েছেন এবং বলেছেন তা মৃত ব্যক্তির জন্য কল্যাণকর।

দারু কুতনীতে বর্ণিত হয়েছেঃ এক ব্যক্তি নবী ﷺ কে জিজ্ঞেস করলো, আমি আমার পিতা-মাতার সেবা তাঁদের জীবদ্দশায়ও করে যাচ্ছি। তাঁদের মৃত্যুর পর কিভাবে সেবা করবো? তিনি বললেনঃ “তাদের মৃত্যুর পর তোমার নামাযের সাথে তাদের জন্যও নামায পড়বে, তোমার রোযার সাথে তাদের জন্য রোযা রাখবে এটাও তাদের সেবার অন্তর্ভুক্ত।” দারু কুতনীতে হযরত আলী (রাঃ) থেকে আরো একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। উক্ত হাদীসে তিনি বলেনঃ নবী ﷺ বলেছেন কোন ব্যক্তি যদি কবরস্থানের পাশ দিয়ে অতিক্রম করে এবং এগার বার কুল হুয়াল্লাহু আহাদ পড়ে ঐ কবরস্থানের মৃতদের জন্য তাহলে ওখানে যত মৃত আছে তাদের সকলকে সওয়াব দান করা হবে। একটি আরেকটির সমর্থক এ ধরনের বিপুল সংখ্যক হাদীসে এ বিষয় স্পষ্ট করে যে “ইসালে সওয়াব” বা সওয়াব পৌঁছানো শুধু সম্ভবই নয়, বরং সব রকম ইবাদাত এবং নেকীর কাজের সওয়াব পৌঁছানো যেতে পারে। এ জন্য বিশেষ ধরনের আমল বা ইবাদাত নির্দিষ্ট নেই। তবে এ প্রসঙ্গে চারটি বিষয় খুব ভালোভাবে বুঝে নিতে হবেঃ

একঃ কেবল এমন আমলের সওয়াবই পৌঁছানো যেতে পারে যা নিছক আল্লাহ‌র উদ্দেশ্যে শরীয়াতের নিয়ম-কানুন মাফিক করা হয়েছে। তা না হলে একথা স্পষ্ট যে, গায়রুল্লাহ্‌র জন্য কিংবা শরীয়াতের বিধি-বিধানের পরিপন্থী কোন কাজ বা ইবাদাত করা হলে তা অন্য কারো জন্য দান করা তো দূরের কথা আমলকারী নিজেই তার কোন সওয়াব পেতে পারে না।

দুইঃ যেসব ব্যক্তি আল্লাহ‌ তা’আলার দরবারে সৎলোক হিসেবে মেহমান হয়ে আছে তারা তো নিশ্চিতভাবেই এ সওয়াবের উপহার লাভ করবেন। কিন্তু যারা সেখানে অপরাধী হিসেবে হাজতে বন্দী আছে তাদের কাছে কোন সওয়াব পৌঁছবে বলে আশা করা যায় না। আল্লাহ‌র মেহমানদের কাছে তো উপহার পৌঁছতে পারে। কিন্তু আল্লাহ‌র বন্দীদের কাছে উপহার পৌঁছানো কোন আশা নেই। কোন ব্যক্তি যদি ভুল বুঝার কারণে তার জন্য ইসালে সওয়াব করে তাহলে তার সওয়াব নষ্ট হবে না, বরং অপরাধীর কাছে পৌঁছার বদলে মূল আমলকারীর কাছে ফিরে আসবে। ঠিক মানি অর্ডার যেমন প্রাপকের হাতে না পৌঁছলে প্রেরকের কাছে ফিরে আসে।

তিনঃ সওয়াব পৌঁছানো সম্ভব কিন্তু আযাব পৌঁছানো সম্ভব নয়। অর্থাৎ কেউ নেককাজ করে অন্য কাউকে তার সওয়াব দান করবে, এটা সম্ভব কিন্তু গোনাহর কাজ করে তার আযাব অন্য কাউকে দান করবে আর তা তার কাছে পৌঁছে যাবে, তা সম্ভব নয়।

চারঃ নেক কাজের দু’টি কল্যাণকর দিক আছে। একটি হচ্ছে, নেক কাজের সে শুভ ফলাফল যা আমলকারীর ব্যক্তিসত্ত্বায় ও চরিত্রের প্রতিফলিত হয় এবং যার কারণে সে আল্লাহ‌র পুরস্কার ও প্রতিদান লাভের যোগ্য বলে বিবেচিত হয়। দ্বিতীয়ত, তার সেই সব প্রতিদান যা তাকে আল্লাহ‌ তা’আলা পুরস্কার হিসেবে দান করেন। এর প্রথমটির সাথে ইসালে সাওয়াবের কোন সম্পর্ক নেই, শুধু দ্বিতীয়টির সাথে এর সম্পর্ক। এর উদাহরণ হলোঃ কোন ব্যক্তি শরীর চর্চার মাধ্যমে কুস্তিতে দক্ষতা লাভ করে। এভাবে তার মধ্যে যে শক্তি ও দক্ষতা সৃষ্টি হয় তা সর্বাবস্থায় তার নিজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে, তা অন্য কাউকে দেয়া যায় না। অনুরূপভাবে সে যদি কোন রাজ দরবারের কর্মচারী হয় এবং কুস্তিগীর হিসেবে তার জন্য একটি বেতন নির্দিষ্ট থাকে তাহলে সে বেতনও শুধু-সেই পাবে। অন্য কাউকে তা দেয়া হবে না। তবে তার কর্মতৎপরতায় খুশী হয়ে তার পৃষ্ঠপোষক তাকে যেসব পুরস্কার ও উপহার দেবে সেগুলো সম্পর্কে সে আবেদন করতে পারে যে তা তার শিক্ষক, মাতা-পিতা কিংবা অন্য কল্যাণকামী ও হিতাকাংখীদের দেয়া হোক। নেক কাজের ব্যাপারটাও তাই। এর আত্মিক কল্যাণসমূহ হস্তান্তর যোগ্য নয়। তার প্রতিদানও কাউকে হস্তান্তর করা যায় না। কিন্তু তার পুরস্কার ও সওয়াব সম্পর্কে সে আল্লাহ‌ তা’আলার কাছে এ বলে দোয়া করতে পারে যে, তা তার কোন ঘনিষ্ঠ বন্ধু কিংবা কোন কল্যাণকামীকে দান করা হোক। এ কারণে একে “ইসালে জাযা” প্রতিদান পৌঁছানো নয়, “ইসালে সওয়াব” সওয়াব পৌঁছানো বলা হয়ে থাকে।

(২) এক ব্যক্তির চেষ্টা ও তৎপরতা অন্য কোন ব্যক্তির জন্য উপকার হওয়ার আরেকটি রূপ হচ্ছে, ব্যক্তি হয় অন্য কারোর ইচ্ছা বা ইঙ্গিতে তার জন্য কোন নেক কাজ করবে। কিংবা তার ইচ্ছা বা ইঙ্গিত ছাড়াই তার পক্ষ থেকে এমন কোন কাজ করবে যা মূলত ঐ ব্যক্তির জন্য ওয়াজিব ছিল কিন্তু সে নিজে তা আদায় করতে পারেনি। এ ব্যাপারে হানাফী ফিকাহবিদদের মত হলোঃ ইবাদাত তিন, প্রকারঃ এক, নিরেট, দৈহিক ইবাদাত, যেমনঃ নামায। দুই, নিরেট আর্থিক ইবাদাত, যেমনঃ যাকাত এবং তিন, দেহ ও অর্থের সমন্বিত ইবাদাত। যেমনঃ হজ্জ্ব । এসব ইবাদাতের মধ্যে প্রথম প্রকারের ইবাদাতে কোন রকম প্রতিনিধিত্ব চলে না। যেমন এক ব্যক্তির প্রতিনিধি হিসেবে আরেক ব্যক্তি নামায পড়তে পারে না। দ্বিতীয় প্রকারের ইবাদাতের প্রতিনিধিত্ব চলতে পারে। যেমনঃ স্বামী, স্ত্রীর অলঙ্কারাদির যাকাত আদায় করতে পারে। তৃতীয় প্রকারের ইবাদতে প্রতিনিধিত্ব নিজের দায়িত্ব তখনি চলতে পারে যখন মূল ব্যক্তি যার পক্ষ থেকে কোন কাজ করা হচ্ছে, নিজের দায়িত্ব নিজে পালনে সাময়িকভাবে নয়, বরং স্থায়ীভাবে অক্ষম হয়ে পড়ে। যেমন, বদলি হজ্জ্ব শুধু এমন ব্যক্তির পক্ষ থেকে হতে পারে যে, নিজে হজ্জ্ব পালন করতে যেতে অক্ষম এবং কখনো হজ্জ্ব পালনে যেতে সক্ষম হওয়ার আশাও করা যায় না। মালেকী ও শাফেয়ী মাযাহাবের অনুসারীগণও এ মতের সমর্থক। তবে বদলী হজ্জ্বের জন্য ইমাম মালেক শর্ত আরোপ করেছেন যে, বাপ যদি ছেলেকে এ মর্মে অসীয়াত করে থাকে যে তার মৃত্যুর পর তার ছেলে তার পক্ষ থেকে হজ্জ্ব করবে তাহলে তা জায়েজ হবে অন্যথায় নয়। তবে এব্যাপারে হাদীসের স্পষ্ট বক্তব্য হচ্ছে বাপের ইঙ্গিত বা অসীয়ত থাক বা না থাক, ছেলে তার পক্ষ থেকে বদলি হজ্জ্ব করতে পারে।

ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, খাস’আম গোত্রের এক মহিলা রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ কে বললোঃ আমার পিতার ওপর হজ্জ্বের আদেশ এমন অবস্থায় প্রযোজ্য হয়েছে যখন তিনি অত্যন্ত বৃদ্ধ হয়ে পড়েছেন। তিনি উটের পিঠে বসে থাকতে পারেন না। নবী ﷺ বললেনঃ فَحُجِّى عَنْهُ “তার পক্ষ থেকে তুমি হজ্জ্ব আদায় করো। (বুখারী, মুসলিম, আহমাদ, তিরমিযী, নাসয়ী)। হযরত আলীও (রাঃ) প্রায় অনুরূপ বিষয়বস্তু সম্বলিত হাদীস বর্ণনা করেছেন।” (আহমাদ, তিরমিযী)।

হযরত আবদুল্লাহ্‌ (রাঃ) যুবায়ের খাস’আম গোত্রেরই একজন পুরুষের কথা উল্লেখ করে বলেন যে, সে ও তার বৃদ্ধ পিতা সম্পর্কে এ একই প্রশ্ন করেছিলো। নবী ﷺ তাকে জিজ্ঞেস করলেনঃ তুমিই কি তার বড় ছেলে। সে বললো হ্যাঁ। তিনি বললেনঃ أَرَأَيْتَ لَوْ كَانَ عَلَى أَبِيكَ دَيْنٌ فَقَضَيْتَهُ عَنْهُ كَانَ يُجْزِئُ ذَلِكَ عَنْهُ- তুমি কি মনে করো, যদি তোমার পিতা ঋণী থাকে আর আর তুমি তা আদায় করে দাও তাহলে তার পক্ষ থেকে তা আদায় হয়ে যাবে? সে বললোঃ জি, হ্যাঁ। তিনি বললেন فاحجج عنه তাহলে অনুরূপভাবে তুমি তার পক্ষ থেকে হজ্জ্ব ও আদায় করো। (আহমাদ নাসায়ী)।

ইবনে আব্বাস বলেনঃ জুহাইনা গোত্রের এক মহিলা এসে বললোঃ আমার মা হজ্জ্ব করার মানত করেছিলেন। কিন্তু হজ্জ্ব আদায় করার আগেই তিনি মারা গেছেন। এখন আমি কি তাঁর পক্ষ থেকে হজ্জ্ব আদায় করতে পারি? রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ জবাব দিলেনঃ তোমার মা যদি ঋণগ্রস্ত হতো তাহলে তুমি কি তা পরিশোধ করতে পারতে না? একইভাবে তোমরা আল্লাহ‌র হকও আদায় করো। আল্লাহ‌র সাথে কৃত ওয়াদা পালন করার মাধ্যমে আল্লাহ‌র অধিকার প্রদান করা সবচেয়ে বেশী জরুরী কাজ। (বুখারী, নাসায়ী) বুখারী ও মুসলিমে আরো একটি রেওয়ায়াত হচ্ছে, এক ব্যক্তি এসে তার বোন সম্পর্কে প্রশ্ন করলো যা ওপরে উল্লেখ করা হয়েছে। নবী ﷺ তাকেও এ একই জবাব দিলেন।

এসব বর্ণনা থেকে অর্থ ও দেহের সমন্বিত ইবাদাতসমূহে প্রতিনিধিত্বের স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। এরপর থাকে নিরেট দৈহিক ইবাদাতসমূহ। এ বিষয়ে এমন কিছু হাদীস আছে যা থেকে এ প্রকৃতির ইবাদাতসমূহের ক্ষেত্রেও প্রতিনিধিত্বের বৈধতার প্রমাণ পাওয়া যায়। যেমন ইবনে আব্বাসের (রাঃ) এই বর্ণনা যে, জুহাইনা গোত্রের এক মহিলা নবী ﷺ কে জিজ্ঞেস করলোঃ আমার মা রোযা মানত করেছিলেন। কিন্তু তা পূরণ করার পূর্বেই তিনি মারা গিয়েছেন। আমি কি তার পক্ষ থেকে রোযা রাখতে পারি? নবী ﷺ বললেনঃ তার পক্ষ থেকে রোযা রাখো। (বুখারী মুসলিম, আহমাদ, নাসায়ী, আবু দাউদ)। হযরত বুরাইদা (রাঃ) বর্ণিত এ হাদীস থেকেও প্রমাণ পাওয়া যায় যে, এক মহিলা তার মা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলো যে, তার ওপর এক মাসের (অথবা আরেকটি বর্ণনা অনুসারে দুমাসের) রোযা ওয়াজিব ছিল। আমি কি তার পক্ষ থেকে এ রোযা পালন করবো? নবী ﷺ তাকেও অনুমতি দিলেন। (মুসলিম, আহমাদ, তিরমিযী আবু দাউদ)। তাছাড়া হযরত আয়েশা (রাঃ) বর্ণিত হাদীসেও নবী ﷺ বলেছেনঃ مَنْ مَاتَ وَعَلَيْهِ صِيَامٌ صَامَ عَنْهُ وَلِيُّهُ কেউ যদি মারা যায় আর তার ওপর কিছু রোযা থাকে তাহলে তার পক্ষ থেকে তার অভিভাবক সেই রোযা রাখবে (বুখারী, মুসলিম, আহমাদ) বাযযার বর্ণিত হাদীসে নবীর ﷺ কথা উল্লেখিত হয়েছে এরূপঃ فَلْيَصُمْ عَنْهُ وَلْيَّهُ اِنْ شَاءَ অর্থাৎ তার অভিভাবক ইচ্ছা করলে তার পক্ষ থেকে রোযা রাখবে। এসব হাদীসের ভিত্তিতে আসহাবুল হাদীস, ইমাম আওযায়ী এব জাহেরিয়ারগণ দৈহিক ইবাদাতসমূহেও প্রতিনিধিত্ব জায়েজ হওয়ার সমর্থক। কিন্তু ইমাম আবু হানিফা, ইমাম মালেক, ইমাম শাফেয়ী এবং ইমাম যায়েদ ইবনে আলীর ফতোয়া হচ্ছে, মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে রোযা রাখা যেতে পারে না। ইমাম আহমাদ, ইমাম লাইস এবং ইসহাক ইবনে রাহবিয়া বলেনঃ এটা কেবল তখনই করা যেতে পারে যখন মৃত ব্যক্তি তা মানত করেছে কিন্তু পূরণ করতে পারিনি। বিরোধিদের যুক্তি হলো, যেসব হাদীসে থেকে এর বৈধতার প্রমাণ পাওয়া যায় তার বর্ণনাকারীগণ নিজেরাই ঐ সব হাদীসের পরিপন্থী ফতোয়া দিয়েছেন। নাসায়ী ইবনে আব্বাসের ফতোয়া নিম্নোক্ত ভাষায় উদ্ধৃত করেছেনঃ

لايصل احد عن احد ولايصم احد عن احد

কোন ব্যক্তি যেন কারো পক্ষ থেকে নামায না পড়ে এবং রোযাও না রাখে। আবদুর রাযযাকের বর্ণনা অনুসারে হযরত আয়েশার ফতোয়া হলো لاتصوموا عن موتكم واطعموا عنهم

“তোমাদের মৃতদের পক্ষ থেকে রোযা রেখো না, খাবার খাইয়ে দাও।” আবদুর রাযযাক, আবদুল্লাহ্‌, ইবনে উমর থেকেও একথাই উদ্ধৃত করেছেন, অর্থাৎ মৃতের পক্ষ থেকে যেন রোযা রাখা না হয়। এ থেকে জানা যায় যে, প্রথম প্রথম শারীরিক ইবাদাতসমূহেও প্রতিনিধিত্বের অনুমতি ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত স্থিরকৃত হয় যে, এটা করা জায়েজ নয়। অন্যথায় কি করে সম্ভব যে যারা রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ এর এসব হাদীস বর্ণনা করেছেন তারা নিজেরাই আবার তার পরিপন্থী ফতোয়া প্রদান করবেন?

এক্ষেত্রে একথা ভালভাবে বুঝতে হবে, যে প্রতিনিধিত্বমূলকভাবে কোন ফরয পালন কেবল তাদের জন্যই উপকারী হতে পারে যারা নিজে ফরয আদায়ে আগ্রহী কিন্তু বাস্তব কোন অসুবিধার কারণে অপারগ হয়ে পড়েছেন। তবে সমর্থ ও সক্ষম হওয়া সত্ত্বেও কোন ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে হজ্জ্ব আদায় করা থেকে বিরত থাকে এবং এ ফরযটি আদায় করা সম্পর্কে তার মনে কোন অনুভূতি পর্যন্ত না থেকে থাকে তার জন্য বদলি হজ্জ্ব যতই করা হোক না কেন তা তার জন্য কল্যাণকর হবে না। এটা ঠিক যেন কোন ব্যক্তি কর্তৃক অপর কোন ব্যক্তির ঋণের টাকা আত্মসাত করা এবং মৃত্যু পর্যন্ত পরিশোধ করার ইচ্ছা না থাকা। পরবর্তী সময়ে তার পক্ষ থেকে যদি প্রতিটি পাইও পরিশোধ করা হয় তবুও আল্লাহ‌ তা’আলার দৃষ্টিতে সে ঋণ আত্মসাতকারী হিসেবেই গণ্য হবে। অপরের আদায় করে দেয়ায় কেবল সেই ব্যক্তিই নিষ্কৃতি পেতে পারে যে তার জীবদ্দশায় ঋণ আদায়ে আগ্রহী ছিল। কিন্তু কোন অসুবিধার কারণে আদায় করতে পারেনি।

১৯-৪২ আয়াতের ব্যাখ্যা:-
ফী জিলালিল কুরআন:

*লাত, মানাত, ওযযার স্বরূপ : এখন এসব ব্যক্তি তাদের বাপ-দাদাদের আমল থেকে যেসব দেব-দেবীর পূজা করতাে তার সপক্ষে তারা কোন্ যুক্তি-প্রমাণ পেশ করছে? কোন যুক্তির ভিত্তিতে তারা লাত, ওযযা ও মানাতের পূজা করে চলেছে? তাদের এসব মাবুদের পূজা করার পক্ষে তাদের কাছে কি দলীল বা যুক্তি-প্রমাণ আছে? এবং কোন ক্ষমতার ওপর ভরসা করে এসব অলীক ধ্যান-ধারণাকে তারা জিইয়ে রেখেছে। এই সব বিষয়ের ওপরই এ সূরার দ্বিতীয় অধ্যায় আলােচনা এসেছে। এরশাদ হচ্ছে ‘ভেবে দেখেছে কি তােমরা লাত ও ওযযা সম্পর্কে এবং তৃতীয় আর একজন, মানাত সম্পর্কে… আর প্রকৃতপক্ষে ওদের কোন (সঠিক) জ্ঞান নেই, নিছক ধারণা-কল্পনার বশবর্তী ওরা কাজ করে। আর প্রকৃতপক্ষে সত্য পথ-প্রাপ্তির ব্যাপারে নিছক ধারণা-কল্পনা তাদেরকে কোনাে সাহায্য করে না।’ লাত’ ছিলাে তাদের মনগড়া খােদার একজন এবং তার মূর্তি তায়েফ নগরীতে অবস্থিত একটি সাদা পাথরে খােদাই করা ছিলাে। এই পাথরের মূর্তির ওপর একটি ঘর নির্মিত ছিলাে যেখানে এর সেবায়েত, অবস্থান করতাে। এর আশেপাশের এলাকায় বাস করতাে এই দেবী মূর্তির ভক্ত সাকীফ-গােত্র ও তার অনুসারীরা। কোরায়েশ ছাড়া আরবের অন্যান্য গােত্রের তুলনায় এরা নিজেদেরকে মর্যাদাবান মনে করতাে, কারণ কোরায়েশদের কাছে ছিলাে ইবরাহীম(আ.)-এর নির্মিত পবিত্র কা’বা শরীফ। সাকীফ গােত্রের লােকেরা মনে করতাে মহান আল্লাহ নামের স্ত্রীলিঙ্গ ‘লাত’ এবং এজন্যেই এই দেবীমূর্তি তাদের কাছে ছিলাে পূজনীয়। মক্কা ও তায়েফ নগরীদ্বয়ের মধ্যবর্তী একস্থানে ওযযা নামক এক বৃক্ষ অবস্থিত ছিলাে। এর ওপরে নির্মিত ছিলাে একটা ঘর এবং এটা খেজুর বাগিচা দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিলাে। কোরায়েশই বিশেষভাবে এ দেবতার পূজা করতাে। যেমন ওহুদ যুদ্ধের দিন আবু সুফিয়ান জোর গলায় বলেছিলাে, আমাদের কাছে রয়েছে মহান উযযা, তােমাদের কাছে তাে এরকম কোনাে ওযযা নেই’। একথার জওয়াবে রাসূলুল্লাহ(স.) বলেছিলেন, (হে মুসলমানগণ) তােমরাও বলাে, ‘আল্লাহ আমাদের মওলা, তােমাদের কোনাে মওলা নেই।’ এই ওযযাকে তারা তাদের দেবী মনে করতাে। আবার মক্কা ও মদীনার মধ্যবর্তী মুসাল্লাল’ নামক স্থানে কাদীদ গােত্রের মধ্যে মানাত দেবীর মূর্তি স্থাপিত ছিলাে যাকে জাহেলিয়াতের যুগে খুযায়া, আওস ও খাযরাজ গোত্র সমূহ পূজা করতাে। এখান থেকেই কাবা ঘরের হজ্জ করার জন্যে তারা রওয়ানা হতাে। আরব উপদ্বীপে তৎকালীন আরব গােত্রসমূহ এই ধরনের আরও বহু দেব-দেবীর উপাসনা করতাে, কিন্তু সেগুলাের মধ্যে ওপরে বর্ণিত লাত, ওযযা ও মানাত-এই তিনটি মূর্তি ছিলাে প্রধান।   *মূর্তি ফেরেশতাদের প্রতীক নয় : ওদের ধারণা ছিলাে এসকল দেবী-মূর্তি হচ্ছে ফেরেশতাদের প্রতীক, যাদেরকে আরবরা নারী মনে করতাে এবং তারা ওদেরকে আল্লাহর কন্যা-সন্তান বলে অভিহিত করতাে। আর এই কারণেই তারা মূল মালিক আল্লাহ রব্বুল আলামীনকে বাদ দিয়ে তাদের পূজা করতাে। অবশেষে অধিকাংশ আরববাসীর কাছে এই প্রতীকগুলােই মূল মাবুদের স্থান দখল করে নিলাে। শুধুমাত্র অতি নগণ্য এক ছােট্ট দল এক আল্লাহর বন্দেগীতে নিজেদেরকে মশগুল রেখেছিলাে। তাই, আশ্চর্যের সাথে জিজ্ঞাসাবােধক বাক্যে আল্লাহ পাক তিন খােদা-এর পূজা করা সম্পর্কে বলছেন, ‘তােমরা কি ভেবে দেখেছাে লাত ও ওযযা সম্পর্কে তৃতীয় আর একজন মানাত সম্পর্কে’ প্রশ্নের সূচনাতেই আরববাসীর এ নিরর্থক কাজের প্রতি বিস্ময় প্রকাশ পেয়েছে যে শব্দে তা হচ্ছে তােমরা কি ভেবে দেখেছাে? কথার মধ্যে তৃতীয় আর এক ব্যক্তি মানাত’ সম্পর্কেও বিস্ময় প্রকাশ করা হয়েছে। ওদের কথাকে ঘৃণাভরে ওদের মুখের ওপর ছুঁড়ে মেরে আল্লাহ পাক বলছেন, কি আশ্চর্য, তাদের নিজেদের জন্যে তারা পুত্র সন্তান পছন্দ করে আর আল্লাহ তায়ালার জন্যে পছন্দ করে কন্যা সন্তান? কত অদ্ভূত বেইনসাফীপূর্ণ বন্টন তাদের। প্রসংগক্রমে এখানে জানানাে হচ্ছে যে, ফেরেশতাদেরকে আল্লাহ তায়ালার কন্যা-সন্তান জ্ঞানে আরবরা তাদের নারীমূর্তি তৈরী করে সেগুলাের পূজা করতাে। তাদের একটু লজ্জাও লাগতাে না যে, আল্লাহ রব্বুল আলামীনকে সর্বশক্তিমান জানা ও মানা সত্ত্বেও তার জন্যে তারা পছন্দ করলাে ফেরেশতা-কন্যা-সন্তান অথচ সেইসব কন্যা-সন্তান তাদের ঘরে পয়দা হলে তাদের মুখ কালাে হয়ে যেত এবং তাদের অধিকাংশকে তারা জীবন্ত প্রােথিত করত! প্রকৃতপক্ষে মূৰ্খ নাদানের দল আল্লাহর জন্যে কন্যা সন্তান হওয়ার এইসব উদ্ভট কথা বলে আসলে তারা যে কী বুঝাতে চায় তা তারা নিজেরাও জানতাে না। এই জন্যেই আলােচ্য আয়াতগুলােতে আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে তাদের এই অলীক ও যুক্তিবুদ্ধিহীন ধারণার ওপর পাকড়াও করছেন। তাই অত্যন্ত তাচ্ছিল্য ভরে তাদের ও তাদের মাবুদ এ মূর্তিগুলাে সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলছেন, ‘কি ব্যাপার, তােমাদের জন্যে তােমরা পছন্দ করলে পুত্র সন্তান, আর তার জন্যে পছন্দ করলে কন্যা সন্তান? না, আল্লাহ ও তােমাদের নিজেদের মধ্যে এই বন্টননীতি বড়ই যুলুমপূর্ণ ও বেইনসাফীতে ভরা!—এই কথাটিই আয়াতে ব্যক্ত হয়েছে। এখানে সকল প্রশ্নের মূল প্রশ্ন হচ্ছে, বাস্তবতার নিরিখে ও যুক্তির দিক দিয়ে তাদের এসব বাজে কথার কোনাে ভিত্তিই নেই, নেই কোনাে যুক্তি বা নেই কোনাে প্রমাণ, তাই এরশাদ হচ্ছে, ‘এগুলাে তাে হচ্ছে নিছক কিছু কথার কথা এবং কিছু বানােয়াট নাম তােমরা নিজেরা রেখে নিয়েছে। এসব কথার পেছনে আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা কোনাে দলীল-প্রমাণ নেই। ওরা নিছক ধারণা-কল্পনার শিকার হয়ে এসব কথা বলছে এবং এগুলাে একেবারেই মনগড়া কথা। অথচ প্রকৃত সত্য হেদায়াত একমাত্র তাদের প্রতিপালকের কাছ থেকেই তাদের কাছে এসেছে। এই যে সব নাম তোমরা শুনছাে, লাত, উযযা, মানাত এবং অন্য আরও অনেক নাম, যাদেরকে মাবুদ বলা হয়েছে, ফেরেশতাদের নামে নামাঙ্কিত করা হয়েছে এবং এ ফেরেশতাদেরকে অভিহিত করা হয়েছে নারী বলে এবং এসব নারীকে আল্লাহর কন্যা বলে দাবী করা হয়েছে, এসব কিছুই নিছক মিথ্যা বানােয়াটি নাম, যার পক্ষে কোনাে প্রমাণ নেই, নেই এসবের পেছনে কোনাে সত্যতা এবং তােমাদের জন্যে আল্লাহ তায়ালা এসবের জন্যে কোনো যুক্তি খাড়া করারও কোনাে সুযােগ দেননি। আর আল্লাহ পাক নিজে যার মূল্যায়ন করেননি তার কোনাে শক্তি বা ক্ষমতা কিছুই নেই, যেহেতু তার বাস্তব কোনাে মূল্য নেই। বাস্তব সত্য জিনিসের ভারত, শক্তি-ক্ষমতা সবই রয়েছে যেহেতু আল্লাহ পাক মানুষের প্রয়ােজনে সেগুলাে ব্যবহারের উপযােগী করেছেন। অসত্য জিনিস এমনই হালকা, যার কোনােই ওজন নেই। এমনই দুর্বল যার নিজের শক্তি বলতে কিছুই নেই এবং এতােই তুচ্ছ সে জিনিস যে কারাে ওপর তার কোনাে ক্ষমতার বহিপ্রকাশও নেই।  *মূর্তি পুজা কী? :  আয়াতের মধ্যভাগে এসব মিথ্যা ধ্বজাধারীদেরকে, তাদের অলীক ধারণাকে এবং তাদের বানোয়াট কাহিনী প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে এবং তাদেরকে সরাসরি সম্বোধন না করে পরিত্যাগ করা হয়েছে, আর তাদেরকে এমনভাবে অবজ্ঞা করা হয়েছে যেন তাদের অস্তিত্ব বলতে কিছুই নেই, যার কারণে তাদেরকে সম্বোধন করে কোনাে কথা না বলে তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে তাদের সম্পর্কে কথা বলা হয়েছে। এরশাদ হচ্ছে, ‘তারা নিছক ধারণা-কল্পনার অনুসরণ করছে এবং পরিচালিত হচ্ছে কুপ্রবৃত্তির চাহিদা অনুসারে।’ সুতরাং তাদের কথায় কোনাে যুক্তি নেই, কোনাে জ্ঞানের সন্ধান পাওয়া যায় না তাদের আচরণে এবং আত্ম-বিশ্বাস বলতেও তাদের কাছে কিছু নেই। তাদের বিশ্বাস গড়ে উঠেছে একমাত্র কল্পনার ওপর এবং কুপ্রবৃত্তির তাড়নে হওয়াকেই তারা তাদের কাজের সপক্ষে দলীল হিসেবে গ্রহণ করেছে। প্রকৃতপক্ষে, সঠিক আকীদা-বিশ্বাসের জন্যে প্রয়ােজন হচ্ছে বুদ্ধি গ্রাহ্য যুক্তি। সেখানে ধারণা, প্রবৃত্তির চাহিদা ও মনের খাহেশের কোনাে স্থান নেই। হক পথ গ্রহণের জন্যে চাই চূড়ান্ত ও নিশ্চিত বিশ্বাস এবং আবেগ মুক্ত হওয়া ও স্বার্থপরতার ঊর্ধে আল্লাহ সন্তুষ্টির জন্যে কাজ করার মানসিকতা। এজন্যে বলা হয়েছে, তারা (হেদায়েতপ্রাপ্তরা) কোনাে ধারণার বশবর্তী হয়ে কোনাে কিছু গ্রহণ করেনি, বা প্রবৃত্তির তাড়নে পরিচালিতও হয়নি। তাদের চালিকাশক্তি সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলা হচ্ছে, ‘অবশ্যই তাদের নিকটে এসেছে তাদের রব-এর পক্ষ থেকে হেদায়াত।’ অতএব, ব্যক্তিগত ওযর-আপত্তি ও মনগড়া কোনাে যুক্তি সন্ধান করার কোনাে সুযোেগ সেখানে নেই এবং কোনাে কারণ তালাশ করাকেও সেখানে নাকচ করে দেয়া হয়েছে। যখন প্রবৃত্তির চাহিদা ও ঝোঁক প্রবণতার কাছে কোনাে কাজকে ছেড়ে দেয়া হয় তখন সে কাজ মযবুত হয় না যেহেতু মানুষের খােশ-খেয়াল, স্বাধীন চিন্তা ও ব্যক্তিগত বুদ্ধি-সত্যপ্রাপ্তির পথে কোনাে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে না। সেখানে সত্য অপ্রকাশিত থাকাই আসল কথা নয়, বা যুক্তি-প্রমাণ দুর্বল হওয়াও মূল কথা নয়। আসল কথা হচ্ছে সেখানে এক সর্বগ্রাসী আবেগের শিকার হওয়ার কারণেই মানুষ কোনাে কিছু করতে চায়, তারপর তার অংগ-প্রত্যংগকে সে কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করে। এটিই হচ্ছে কোনাে মানুষের জন্যে নিকৃষ্ট অবস্থা, যা তার নাফসের দাসত্বের কারণে সম্পন্ন হয় এবং তার মধ্যে সঠিক পথপ্রাপ্তির কোনাে উপায় থাকে না, আর সেখানে কোনাে যুক্তি-প্রমাণও তাকে প্রভাবিত করতে পারে না। এই অবস্থায় সে অন্যায় ও অপ্রিয় কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে। তাই আল্লাহ পাক বলছেন, ‘মানুষ যা চায় তাই কি সে পেতে পারে?’ সুতরাং যতােটা সে আকাংখা করবে সত্য সত্যই সে ততােটা পাবে না। কিছু পরিবর্তন হবে এবং যা তার মন চাইবে ততােটাই বাস্তবে সে লাভ করতে পারবে না। কিছু বদলে যাবে, কিন্তু সত্য আর অসত্যের বেলায় এটা ঠিক নয়। সত্য সত্যই থাকবে এবং বাস্তবে যা সংঘটিত হওয়ার তা ঠিকই ঘটবে। মানুষের অন্তরের আবেগ ও চাহিদার পরিবর্তন হয় না এবং বাস্তবে এগুলাে একেবারে বদলেও যায় না। মানুষ ভাবাবেগে গলিত হয়ে পথভ্রষ্ট হয় এবং অত্যধিক আকাংখার কারণে ধ্বংসও হয়ে যায়। কোনাে বিষয়ের প্রকৃতিকে বদলে দেয়া অথবা তার মধ্যে কোনাে পরিবর্তন আনার ব্যাপারে সে খুবই দুর্বল। সকল কাজের সাফল্য রয়েছে আল্লাহ তায়ালার হাতে। তিনি দুনিয়া ও আখেরাত উভয় স্থানে যেভাবেই চান সেই ভাবেই তার মধ্যে পরিবর্তন আনেন। তাই এরশাদ হচ্ছে, ‘আল্লাহর হাতেই রয়েছে আখেরাত ও পূর্ববর্তী অবস্থা।’ লক্ষ্যণীয় যে, আখেরাতের উল্লেখ করা হয়েছে আগে এবং (আয়াতের মধ্যে) পূর্বের অবস্থা উল্লিখিত হয়েছে শেষে। ছন্দ ও আয়াতগুলাের শেষে মিল রাখার উদ্দেশ্যে এবং বাস্তব অবস্থাকে সঠিকভাবে তুলে ধরার জন্যেও শেষ অবস্থাকে প্রথম অবস্থার পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। এটা কোরআনুল করীমে অবলম্বিত পদ্ধতি, যে একই সাথে অর্থ ও বাস্তব অবস্থাকে তুলে ধরার জন্যে অধিকাংশ স্থান ছন্দময় শব্দ ও মধুর সুরে কথা পেশ করার ভংগি গ্রহণ করা হয়েছে। এ ব্যবস্থা গ্রহণ করায় অর্থ বা বাক্যের সৌন্দর্যের মধ্যে কোনাে ত্রুটি আসতে পারেনি! কোরআনের মর্যাদা রক্ষাও আল্লাহ তায়ালারই হাতে। তিনি যেভাবে চেয়েছেন সেই ভাবেই এর মর্যাদাকে অক্ষুন্ন রেখেছেন। সুতরাং বিশ্বের সকল সৃষ্টির মধ্যে ব্যবহারগত পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও একটির প্রকাশভংগির সাথে আর একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান। যখন চূড়ান্তভাবে জানানাে হলাে যে, পরবর্তী ও পূর্ববর্তী সকল ঘটনা আল্লাহর হাতেই রয়েছে। অর্থাৎ পরে ও পূর্বে যা ঘটবে তা সবই আল্লাহ পাক জানেন এবং তার ইচ্ছাতেই সব কিছু সংঘটিত হবে, তখন ফেরেশতাদেরকে দেবী হিসেবে মেনে নেয়া এবং তাদের শাফায়াত পাওয়া যাবে বলে যে ভুল ধারণা তার কোনাে মূল্যই আর থাকে না। যেমন বলা হয়েছে, আমরা তাদের পূজা-অর্চনা শুধুমাত্র এই জন্যেই করি যে, তারা আমাদেরকে আল্লাহ তায়ালার নিকটবর্তী করে দেবে।’ আসলে এইসব ধারণ-কল্পনার কোনাে ভিত্তি নেই। ফেরেশতারা সারাক্ষণ আকাশে পরিভ্রমণরত। তারা আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে কোনাে বিষয়ে কথা বলার অনুমতি না পাওয়া পর্যন্ত কারাে পক্ষে কিছু বলতে পারবে না। তাই আল্লাহ পাক জানাচ্ছেন, ‘কত ফেরেশতা আকাশমন্ডলীর মধ্যে রয়েছে, যারা কারাে জন্যে কোনাে সুপারিশ করতে পারবে না। তবে যার জন্যে আল্লাহ পাক চাইবেন এবং যার ওপর তিনি রাযী-খুশী থাকবেন তার জন্যে তিনি অনুমতি দিলে পরে তার পক্ষে কোন ফেরেশতা সুপারিশ করতে পারবে।’

ফী জিলালিল কুরআন:

*ফয়সালা একমাত্র আল্লাহর হাতে : পূর্ববর্তী আয়াতগুলােতে তাদের অযৌক্তিক কথাগুলােকে তাদের মুখের ওপর ছুঁড়ে মারার পর এখানকার আলােচনায় তাদের দাবীকে একেবারেই মূলােৎপাটিত করা হয়েছে। অতএব, সন্দেহাতীতভাবে এটা প্রমাণিত হলাে যে, পরবর্তীকাল এবং পূর্ববর্তীকালের সকল ফায়সালা একমাত্র আল্লাহর হাতে এবং অন্তরের মধ্যে অবস্থিত আকিদা- বিশ্বাস সর্বপ্রকার অস্পষ্টতা ও সন্দেহ থেকে মুক্ত হয়ে গেল। এপর্যায়ে এসে মানুষ সত্য থেকে এতটুকু বিচ্যুত হতে পারে না এবং তাদের পক্ষে বুঝা সহজ হয়ে যায় যে, আল্লাহ তায়ালার খুশী ও অনুমতি ছাড়া তাঁর কাছে কেউ সুপারিশ করতেও পারবে না এবং কারাে সুপারিশ গ্রহণও করা হবে না। অর্থাৎ চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই সব কিছুর ফায়সালার মালিক। আর এই কারণেই একমাত্র তাঁরই দিকে পরবর্তী ও পূর্ববর্তী সকল বিষয়ের ব্যাপারে মুখপেক্ষী হতে হবে। এ প্রসংগের সমাপ্তি পর্যায়ে মােশরেকদের অনুমান ও ধারণা-কল্পনা সম্পর্কে আরও একবার আলোচনা করা হচ্ছে; বলা হচ্ছে, যারা আখেরাত সম্পর্কে বিশ্বাস করে না, তারা প্রকৃতপক্ষে ফেরেশতারা যে আল্লাহ তায়ালার নূরের সৃষ্টি এবং তার আজ্ঞাবহ দাস, একথাকে বিশ্বাস করে না। এই কারণেই তাদের কথার মধ্যে তাদের আকীদার দুর্বলতা ফুটে উঠে এবং আসলেই তারা যে ফেরেশতা সম্পর্কে বিশ্বাস করে না তা প্রকাশ পেয়ে যায়।  *আখেরাত অবিশ্বাসীদের যুক্তিহীন ক্রিয়াকান্ড : এরশাদ হচ্ছে, “নিশ্চয়ই যারা আখেরাত সম্পর্কে বিশ্বাস করে না, তারা মেয়েদের নামেই ফেরেশতাদের নাম রাখে। আসলে এ বিষয়ে তাদের কোনােই জ্ঞান নেই, একমাত্র আন্দায- অনুমান করেই তারা চলে ও বলে, অথচ এসব আন্দায-অনুমান সত্যপ্রাপ্তির পথে কোনাে সহায়তা করে না।’ এখানে এই শেষ সমালােচনাটি এসেছে লাত, ওযযা ও মানাতকে কেন্দ্র করে, যেহেতু মােশরেকরা তাদেরকে আল্লাহ তায়ালার কন্যা হিসেবে গণ্য করতাে, আর এটি হচ্ছে এমন একটি বাজে কথা যার মূলে কোনাে দৃঢ় বিশ্বাস নেই, নিছক ধারণা-কল্পনার ভিত্তিতে তারা এসব কথা বলে। ফেরেশতাদের প্রকৃতি সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে জ্ঞান লাভ করার কোনাে উপায় তাদের কাছে নেই। আল্লাহর সাথে ফেরেশতাদের আত্মীয়তার যে সম্পর্কের কথা তারা বলে তার মূলে ভুল আন্দাজ-অনুমান ছাড়া তাদের কাছে কোনাে দলীল-প্রমাণ নেই। আর এসব অনুমানভিত্তিক কোনাে কথা সত্যপ্রাপ্তির পথে কোনাে সাহায্য করে না বা সেই সত্যের কোনাে বিকল্পও এটা নয় যা পরিত্যাগ ও পরিহার করে তারা আন্দায-অনুমানের আশ্রয় গ্রহণ করছে। যারা আখেরাতকে বিশ্বাস করে না, আল্লাহর সাথে অন্যদেরকে শরীক করে এবং ফেরেশতাদেরকে মেয়েদের নামে ডেকে আল্লাহ তায়ালার সাথে তাদের আত্মীয়তার সম্পর্ক আছে বলে উল্লেখ করে তাদের এই হীন আকীদা সম্পর্কে বর্ণনা দেয়ার পর (তাদেরকে সম্বোধন না করে) রসূল(স.)-কে সম্বােধন করা হচ্ছে যাতে করে মােশরেকদের প্রতি অবজ্ঞা ও অবহেলা দেখানাে যায় এবং তাদের সকল কাজের ফায়সালা সেই মহান আল্লাহর ওপর ছেড়ে দেয়া হয় যিনি অন্যায়কারী ও নেককার ব্যক্তিদেরকে জানেন এবং যিনি সত্য-সঠিক পথের ধারক ও বাহকদেরকে নেক প্রতিদান দেবেন ও পথভ্রষ্টদেরকে দেবেন তাদের প্রাপ্য উচিত সাজা, আর যার হাতে রয়েছে আকাশমন্ডলী, পৃথিবী এবং দুনিয়া ও আখেরাতের যাবতীয় বিষয়, আর যিনি ইনসাফের সাথে সবার হিসাব গ্রহণ করবেন এবং কারাে প্রতি কোনাে প্রকার যুলুম করবেন না। সেদিন সেই সকল ব্যক্তির গুনাহখাতা ও ক্রুটি-বিচ্যুতিগুলােকেও তিনি দেখেও দেখবেন না। যারা কোনাে কাজ করার পর শরমিন্দা হয় এবং সে অন্যায়ের ওপর টিকে থাকে না। তিনি অবশ্যই কঠিন শিলাখন্ডের মধ্যে লুকায়িত জিনিস এবং পত্র পল্লব ও বস্ত্রে আচ্ছাদিত সকল গােপন বস্তু সম্পর্কে খবর রাখেন। কারণ তিনিই তাে সকল মানুষের সৃষ্টিকর্তা এবং তাদের জীবনের সমস্ত প্রকাশ্য ও গােপন জিনিস সম্পর্কে ওয়াকেফহাল। তাই তিনি এরশাদ করছেন, ‘অতএব, যে আমার স্মরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলাে এবং দুনিয়ার জীবন ও তার সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ছাড়া আর কিছুই চাইলাে না, তাদের থেকে তুমি মুখ ফিরিয়ে নাও, তাদের (বিবেচনায় তাদের) জ্ঞানের উৎস তাে এই দুনিয়াটাই। অবশ্যই তােমার রব ভাল করেই জানেন কে তার পথ থেকে সরে দাঁড়িয়েছে আর তাকেও জানেন যে হেদায়াতের পথ গ্রহণ করেছে। আর আকাশমন্ডলীর মধ্যে ও পৃথিবীর বুকে যা কিছু আছে, সব কিছুর মালিকও একমাত্র তিনিই। এই মালিক হওয়ার কারণেই তিনি অন্যায় কাজ করনেওয়ালাদেরকে শাস্তি দেবেন এবং নেক কাজ করনেওয়ালাদেরকে তাদের বদলা দেবেন… তিনি ভাল করেই জানেন কে তাকে ভয় করে চলে (ও তাঁরই ভয়ে বাছ-বিচার করে চলে)।'(৩০-৩২) আল্লাহর পক্ষ থেকে এই অবজ্ঞা প্রদর্শন তার জন্যে, যে তাঁর (আল্লাহ তায়ালা) থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে এবং আখেরাতের প্রতি ঈমান রাখে না, আর দুনিয়ার জীবন (ও তার সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য) ছাড়া আর কিছু চায় না। সে মােশরেকদের প্রতি ঘৃণা ও তাচ্ছিল্য প্রদর্শন করতে গিয়েই এ কথাগুলাে রসূল(স.)-কে সম্বােধন করে বলা হয়েছে এবং যাদের ইতিবৃত্ত, আন্দাজ-অনুমান-ভিত্তিক কাজ ও আখেরাতের প্রতি অবিশ্বাস সম্পর্কে ইতিপূর্বে এ সুরার মধ্যে আলােচনা এসেছে। এরপর আল্লাহ সােবহানাহু ওয়া তায়ালা ঐ সকল মুসলমানকে সম্বোধন করেছেন যারা আল্লাহ তায়ালার স্মরণ বিমুখ ও ঈমান-বিরােধী লােকদের সাথে সম্পর্ক রাখে। যারা একমাত্র দুনিয়ার স্বার্থের কারণেই সকল কাজ করে এবং দুনিয়ার লােভ ও লাভ ছাড়া তারা আর কিছু দেখতে পায় না। তারা না আখেরাতকে বিশ্বাস করে আর না একদিন হিসাব দিতে হবে, একথার কোনাে পরওয়া করে। এ বেঈমানরা মনে করে পৃথিবীর বুকে মানুষের জীবনকে ফুলে-ফলে সুশােভিত করাই তার সৃষ্টির একমাত্র উদ্দেশ্য, এরপর আর কোনাে চাওয়া-পাওয়ার নেই। আর এই অনুভূতির ভিত্তিতেই তারা তাদের জীবনের পথ রচনা করে। তারপর মানুষের বিবেক সার্বভৌমক্ষমতার অধিকারী আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হয়, তার সম্পর্কে সে মনে করে যে, তিনি সকল কাজকে নিয়ন্ত্রণ করেন এবং সীমাবদ্ধ এই দুনিয়ার জীবন শেষে তার কাজের হিসাব নেবেন। অবশ্য আজকের পুঁজিবাদী সমাজের লােকদের মধ্যেও এই ধর্মীয় অনুভূতি বিরাজমান রয়েছে।  *মােমেনদের আরেকটি স্বভাব : আল্লাহ তায়ালা ও আখেরাতে বিশ্বাসীরা এ সকল লােকের সাথে কাজ-কারবার করা ও সামাজিক মেলামেশাকে অগ্রাধিকার দিতে পারে না, যারা আল্লাহর স্মরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং তাদের হিসাব-নিকাশ থেকে আখেরাতকে দূরে নিক্ষেপ করে। কারণ এই দুই দলের প্রত্যেকের জীবনের নিজস্ব একটি গতিপথ আছে যা একটি থেকে অপরটি পৃথক হওয়ার কারণে একটির সাথে আর একটি মিশতে পারে না। তাদের প্রত্যেকের স্বতন্ত্র কেন্দ্রবিন্দু রয়েছে। তাদের জীবনের সকল মাপকাঠি, মূল্যবােধ ও লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, ধ্যান-ধারণা সবই বিভিন্ন। সুতরাং তারা কেউই জীবনের যে কোনাে ব্যাপারে পরস্পর সহায়ক হতে পারে না এবং পৃথিবীতে কোনাে তৎপরতা চালাতে গিয়ে একে অপরের শরীকও হতে পারে না। জীবনের মূল্যবােধের চিন্তা-চেতনা ও লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, কর্ম-তৎপরতার পদ্ধতিতে এবং এসব প্রচেষ্টার মধ্যে উদ্দেশ্যের দিক দিয়ে বিরাট পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও এবং পরস্পর সহযােগিতা ও অংশীদার হওয়ার ব্যাপারে নানাপ্রকার ওযর-আপত্তি থাকা সত্ত্বেও কোন জিনিস উভয় দলকে কাছাকাছি আনতে পারে এবং এক দলকে অপরের জন্যে চিন্তা-ভাবনা করতে বাধ্য করতে পারে? আল্লাহর স্মরণবিমুখ এবং একমাত্র দুনিয়ার প্রত্যাশী এইসব লােকের সাথে সামাজিক মেলামেশার সময়ে তাদের সাথে কিভাবে উঠা-বসা করা যায় সে ব্যাপারে প্রকৃত মােমেন ব্যক্তি বড়ই মুশকিলে পড়ে যায়। কারণ ধর্ম-নিরপেক্ষ এসব ব্যক্তি তাকে প্রদত্ত আল্লাহর শক্তিকে ভুল জায়গায় ব্যবহার করে। অবশ্য, তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ার আরও কিছু কারণ আছে, আর তা হচ্ছে, এই দলের লােকেরা আল্লাহকে বিশ্বাস করে না এবং দুনিয়ার জীবনের বাইরে তারা আর কিছুই চায় না, যার কারণে এরা আল্লাহর কাছে ইীন ও তুচ্ছ। এমতাবস্থায় তাদের মর্যাদা যাই হােক না কেন, তারা সত্য থেকে বহু দূরে রয়েছে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান ও আখেরাতের বিশ্বাস তাদের নাগালের বাইরে। ‘তারা দেয়ালের অপর প্রান্তে অবস্থান করছে’, অর্থাৎ দুনিয়ার এই জীবনের চৌহদ্দীর মধ্যে তারা পরিবেষ্টিত আর এটিই হচ্ছে তাদের জ্ঞান লাভের স্থান। এই কারণেই যে যত বড়ই হােক না কেন তার কোনাে মূল্য না থাকার এটিই মূল কারণ। ইসলামী সমাজের কোনাে স্থানেই তাকে খাপ খাওয়ানাে সম্ভব নয়। যতই তাকে সঠিক পথ দেখানাে হােক না কেন, সে ভুলের ওপর দৃঢ় হয়ে থাকে এবং যে ব্যক্তি অন্তরের একাগ্রতা, তীব্র অনুভূতি ও বুদ্ধি থাকা সত্তেও এই ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ার সীমার মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ করে ফেললো এবং দৃষ্টির অন্তরালের কোনাে কিছুকে বিশ্বাস করলাে না, তার পক্ষে মূল্যবান কোনাে কিছু জানা সম্ভবই নয়। অথচ তার দৃষ্টিশক্তির বাইরে রয়েছে আর একটি ভয়ানক জগত যা নিজে নিজেই পয়দা হয়ে যায়নি। এইভাবে তার অস্তিত্ব এমনই একটি বিষয় যা মানুষের অন্তর্দৃষ্টির সম্পূর্ণ বাইরে, অথচ তার সৃষ্টিকর্তা যখন বর্তমান আছেন বলে সে অনুভব করে তখন, তার কোনাে কর্মকান্ড বে-ফায়দা হতে পারে না। তবে মানুষের জন্যে এ দুনিয়ার জীবনই যদি সৃষ্টির একমাত্র লক্ষ্য ও শেষ পরিণতি, তাহলে আখেরাতের যিন্দেগীর কোনাে প্রয়ােজন থাকতাে না এবং তা বে-ফায়দা হতাে। সুতরাং যে কোনাে দিক দিয়েই চিন্তা করা হােক না কেন সৃষ্টির এই বাস্তবতাই সৃষ্টিকর্তার প্রতি ঈমানের যথার্থতা প্রমাণ করে। এমনি করে বিশ্বজগতের সৃষ্টি আখেরাতের ওপর ঈমান আনারও যৌক্তিকতা প্রমাণ করে। সাথে সাথে, সেই মহান স্রষ্টা যিনি এই বিশাল বিশ্বকে পয়দা করেছেন তার এসব সৃষ্টি যে অযথা নয় তারও যথার্থতা প্রমাণ করে। এ কারণেই, যে ব্যক্তি আল্লাহর স্মরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং দুনিয়ার এই সংকীর্ণ সীমার মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ করে ফেলে তাকে উপেক্ষা করাটাই বাঞ্ছনীয় হয়ে পড়ে। যেহেতু সে অপাত্রে দান করে এবং অজায়গায় নিজের ধন-সম্পদ খরচ করে এই জন্যে স্পষ্টভাবে তার প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শনের প্রয়ােজন রয়েছে এবং যেহেতু দুনিয়ার জীবনকেই সে তার জ্ঞান-লাভের একমাত্র উৎস হিসেবে গ্রহণ করেছে। এজন্যে ইসলামের অনুসারীরা অবশ্যই তাকে তুচ্ছ জ্ঞান করবে এবং কোনাে ব্যাপারেই তাকে মূল্য দেবে না। এইভাবে দুনিয়াদার ও সংকীর্ণমনা এসব ব্যক্তির প্রতি তাচ্ছিল্য প্রদর্শনের জন্যেই আমাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আমরা আল্লাহর নির্দেশ যদি খেয়াল করে দেখি এবং তা মান্য করি, তাহলে এর তাৎপর্য বুঝতে কষ্ট হবে না। অবশ্যই আমরা ইহুদীদের মত একথা বলবাে না যে, আমরা শুনলাম, কিন্তু অমান্য করলাম। আল্লাহ পাক এ ধরনের আচরণ থেকে আমাদেরকে রক্ষা করুন! এরশাদ হচ্ছে, ‘অবশ্যই তােমার রব ভাল করেই জানেন কে তার পথ থেকে সরে দাঁড়িয়েছে এবং কে সঠিক পৃথকে আঁকড়ে ধরেছে।’ অবশ্যই আল্লাহ তায়ালা জানেন যে, ওরা পথভ্রষ্ট। এজন্যেই তিনি চাননি যে, তাঁর নবী এবং তাঁর উম্মতের হেদায়াতপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা সে পথভ্রষ্ট ব্যক্তিদেরকে নিয়ে নিজেদের ব্যস্ত রাখুক। এমনকি তাদের সাথে মেলামেশা করুণ বা তাদের সাথে সমাজ-দরবার করুক তাও তিনি চাননি। যারা দুনিয়ার জীবন নিয়ে ব্যস্ত এবং এর উর্ধে আর কোনাে জীবন আছে বলে যারা কল্পনাও করতে পারে না, সেই সব ব্যক্তি দ্বারা ধোকা খেয়ে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হােক তাও তিনি চান না বা চাইতে পারেন না। বরং, তার খালেস বান্দাহদেরকে ওদের অনিষ্ট থেকে রক্ষা করার জন্যে তিনি নিজেই তাদের মধ্যে বাধা হয়ে দাঁড়ান এবং সাধারণ মানবীয় বুদ্ধি ও সত্য সঠিক চেতনার মধ্যে পার্থক্য দেখিয়ে দেন। এই সত্য-চেতনা যার মধ্যে এসে যায়, সে তখন ভুল পথ পরিহার করে এবং তখন তার এই সঠিক চেতনাই তাকে আল্লাহ তায়ালা ও আখেরাতের প্রতি ঈমানের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। তাকে ছক টেনে বুঝিয়ে দেয় যে, এই হচ্ছে হাতে-নাতে পাওয়া দুনিয়ার লােভ ও লাভের সীমানা এবং এই হচ্ছে ক্ষণস্থায়ী ও সীমাবদ্ধ এ পার্থিব জীবন। মানবীয় জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা এ অক্ষম, অবুঝ ও পথভ্রষ্ট ব্যক্তিরা যে জ্ঞান লাভ করেছে তা নিছক সাধারণ মানুষের জ্ঞান এবং তাদের নিজেদের মত মূৰ্থ ব্যক্তিদের নিকটেই তা গ্রহণযােগ্য। দুনিয়ার বাস্তব জীবনে সাধারণ মানুষের হৃদয়াবেগ, গ্রহণযােগ্যতা ও আন্তরিক অনুভূতির যথেষ্ট প্রভাব ও মূল্য অবশ্যই রয়েছে। তাই বলে ভুল পরিণতির ক্ষতি ও অনিষ্টতাও আর দূর হয়ে যেতে পারে না, খতম হতে পারে না অজ্ঞানতা ও ক্রুটি-বিচ্যুতির মন্দ পরিণাম। সুতরাং, দেখা যাচ্ছে সৃষ্টি ও স্রষ্টার মধ্যে যে সম্পর্ক বিদ্যমান এবং মানুষের কাজ ও তার প্রতিদানের মধ্যকার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এমন দুটি সত্য যা যে কোনাে জ্ঞানী ব্যক্তির কাছে ধরা পড়ে এবং এই যথার্থতা অনুভব না করলে সে জ্ঞান মানুষের জীবনে কোনাে কাজে লাগে না, না তার উন্নতির ক্ষেত্রে সে জ্ঞান কোনাে ভূমিকা রাখতে পারে আর না তার মর্যাদা বৃদ্ধিতে তা সহায়ক হয়। মানুষের প্রত্যেকটি জ্ঞানই তার জীবনে কিছু না কিছু অবদান রাখে, কখনও তার মানবতা বিকাশে সহায়ক হয়, আর কখনও তার সাহিত্য ও সৃষ্টির উৎকর্ষ সাধন করে। তার জ্ঞান যদি এ সবের কোনাে একটি অবদানও রাখতে না পারে, তাহলে সে জ্ঞান হয় নিছক যান্ত্রিক উন্নয়ন অথবা মানবতা-বিধ্বংসী কোনাে অস্ত্র । আর মানুষের মানবতার উন্নতি যদি না হলাে, তাহলে শুধুমাত্র যান্ত্রিক উৎকর্ষ সাধনে আসলে কার ফায়দা হবে! মানুষের এই যে চেতনা যে, তার সৃষ্টিকর্তা কেউ আছেন, যিনি তাকে সৃষ্টি করেছেন এবং তার আশেপাশে অবস্থিত সজীব ও নির্জীব সব কিছুর সৃষ্টিকর্তাও একমাত্র তিনি, এ চেতনা সেই একই জীবন ও জগতের অস্তিত্বের চেতনার সাথে পরিপূর্ণভাবে সামঞ্জস্যশীল। মহান সে সৃষ্টিকর্তা তাকে এক বিশেষ উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি করেছেন এবং সে উদ্দেশ্য সর্বশ্রেষ্ঠ, সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ এবং সব থেকে মূল্যবান যেহেতু সকল সৃষ্টির সাথে মানব সৃষ্টির প্রয়ােজন ওতপ্রােতভাবে জড়িত। সে মহাকালের সকল দিনগুলাে থেকে ব্যক্তিগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ, বিশ্বের ব্যক্তিবর্গ সমন্বিত পরিবার থেকেও সে একজন ব্যক্তি হিসেবে বড়, বড় সে ব্যক্তি হিসেবে তার গােটা জাতি থেকে, তার দেশ থেকেও সে অনেক বড় এবং যাদেরকে নিয়ে মানুষ বস্তুগত সমাজ ও আধুনিক সভ্যতা গড়ে তােলে তাদের থেকেও তার ব্যক্তিত্ব অনেক উর্ধে, সে সৃষ্টির সকল বৈচিত্র ও গঠনশৈলী থেকে অনেক বেশী মর্যাদাপূর্ণ।

Leave a Reply