৩২ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
ফী জিলালিল কুরআন:
*মানব জীবনে আখিরাতের বিশ্বাসের প্রভাব : মানুষের জানা দরকার যে, একদিন অবশ্যই তার সৃষ্টিকর্তা তার হিসাব নেবেন এবং তার ভাল বা মন্দ কাজের প্রতিদান দেবেন এবং সেই দিনটিই হবে আখেরাত-এই জ্ঞানই তার চিন্তা-চেতনা ও ধারণাশক্তির মধ্যে পরিবর্তন আনে। তার তৎপরতাকে প্রভাবিত করে এবং তার জীবনের লক্ষ্যকে নিয়ন্ত্রিত করে এবং অন্তরের মধ্যে নৈতিক চরিত্র গড়ে তােলার এক তীব্র অনুভূতি সৃষ্টি করে। এতে তার কর্মস্পৃহা বৃদ্ধি পায় এবং শক্তি উজ্জীবিত হয়। কারণ তার ধ্বংস ও পরিত্রাণ এই অনুভূতির ওপর নির্ভর করে। এর প্রভাব পড়ে তার নিয়ত ও কাজের ওপর, আর এইভাবে মানুষ শক্তি লাভ করে এবং সৃষ্টির সব কিছুকে কাজে লাগাতে সক্ষম হয়। এই সচেতনতা হয় এই জন্যে যে এতে করে তার মধ্যে ঘুমিয়ে থাকা প্রহরী জেগে উঠে, তাকে তার কর্তব্য স্মরণ করিয়ে দেয় এবং তখন সে অবশ্যম্ভাবী পরিণামের জন্যে অপেক্ষা করতে থাকে। অন্যভাবে বলতে গেলে বলতে হয় যে, তার বিবেক জেগে উঠার ফলে কল্যাণ প্রত্যাশায় সে আশান্বিত ও নিশ্চিন্ত হয়ে যায় ও (আত্ম) নিয়ন্ত্রিত জীবন যাপন করার কারণে সে সাহায্য পাওয়ার ব্যাপারে আস্থা অর্জন করে। এমনকি তখনও সে হতাশ ও মন ভাংগা হয় না যখন পৃথিবীর বিভিন্ন ক্ষেত্রে সে বিফল হয় ও কষ্ট পেতে থাকে। মােমেন মানুষ হিসাবে তাকে সদা সর্বদা কল্যাণ ও নেক কাজের ব্যাপারে সাহায্য-সহযােগিতা করতে বলা হয়েছে এবং আল্লাহর পথে টিকে থাকার জন্যে অবিরত সংগ্রাম-সাধনা চালিয়ে যাওয়ার জন্যে সে নির্দেশিত হয়েছে। তাতে দুনিয়ায় সে বিফল হােক বা সফল হােক, তার পরওয়া যেন না করে। কারণ তার পরম ও চরম চাওয়ার ও পাওয়ার স্থান হচ্ছে আখেরাত! জীবনের সব থেকে বড় বিষয় হচ্ছে আল্লাহ ও আখেরাতের ওপর ঈমান এবং এটি জীবনের সব থেকে মৌলিক বিষয় বটে। এমন কি খাদ্য, পানীয় ও পরিধেয় বস্ত্র থেকেও মানুষের জীবনে এই দুটি বিষয়ের প্রতি বিশ্বাসের গুরুত্ব বেশী। এ দুটি বিশ্বাস মযবূতভাবে যার মধ্যে বর্তমান রয়েছে সেই মানুষ, আর যার মধ্যে এ দুটির অস্তিত্ব নেই সে পশু, বরং তার থেকেও অধম! অবশ্য অনেক সময় বিশ্বাসের পরিমাপগুলো কম-বেশী হয়, লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের প্রতি বিশ্বাসের দৃঢ়তা কারো কম, কারাে বেশী এবং জীবন ও জগত সম্পর্কে ধারণা-কল্পনাও মানুষে মানুষে বিভিন্ন হয়। এতে তেমন কিছু আসে-যায় না। কারণ আমরা ইচ্ছা করলেও সকল মানুষের মধ্যে এসব বিষয় সমান করে গড়ে দিতে পারবাে না এবং সকল মানুষের চিন্তা-চেতনাকেও এক করে ফেলতে পারবাে না, যেহেতু সৃষ্টি-বৈচিত্রের মধ্যে সব বিভিন্নতা হচ্ছে এক অমােঘ নিয়ম। আর এই সব কারণেই আল্লাহর স্মরণ থেকে যে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে এবং একমাত্র দুনিয়ার জীবনকেই যে ফুলে-ফলে সুশােভিত করতে চেয়েছে, তার সাথে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী একজন মোমেনের পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপন, অংশীদার হিসেবে কোনাে কাজ এক সাথে করা, এক সাথে বসবাস করা, পারস্পরিক সাহায্য, সহযােগিতার জীবন যাপন করা, পারস্পরিক যত্ন নেয়া এবং একসাথে সমিতি ও বৈঠক করা-কোনােটাই সম্ভব নয়। ঈমান ছাড়া সম্পর্ক স্থাপনের জন্যে যতভাবে যত কথাই বলা হােক না কেন, সবই হবে বৃথা, অসম্ভব এবং নিছক কল্পনা। এ প্রচেষ্টা চালানােতে আসলে আল্লাহর হুকুমের বিরােধিতাই করা হবে, যেহেতু আল্লাহ পাক বলছেন, সুতরাং, মুখ ফিরিয়ে নাও প্রত্যেক সেইসব ব্যক্তি থেকে, যে আমার থেকে ফিরে গিয়েছে এবং সে একমাত্র দুনিয়ার জীবনই কামনা করে।’ ‘আর আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর মধ্যে যা কিছু রয়েছে তার মালিক তাে একমাত্র আল্লাহ তায়ালা।’ (কথাটি বলা হচ্ছে এই জন্যে) যেন তিনি অন্যায় কাজে লিপ্ত ব্যক্তিদের তাদের কাজের উচিত প্রতিদান দেন এবং নেক প্রতিদান দেন তাদেরকে যারা সুন্দরভাবে নেক কাজগুলাে আঞ্জাম দিয়েছে।’ আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর মধ্যে যা কিছু রয়েছে তার মালিকানা যে একমাত্র আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার হাতে, সে বিষয়ের ওপর এই বিবৃতি অত্যন্ত জোরালাে প্রভাবপূর্ণ ও স্পষ্টভাবে এ সত্যটি তুলে ধরছে যে, আখেরাত অবশ্যই সংঘটিত হবে। অতএব, যিনি আখেরাতের জীবন বানিয়েছেন এবং তার আগমনকে স্থির করে রেখেছেন একমাত্র তিনিই আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর মধ্যস্থিত সব কিছুর মালিক। তিনিই উচিত প্রতিদান দিতে সক্ষম। এ ক্ষমতা একমাত্র তাঁরই রয়েছে এবং এর কারণগুলাে নির্ধারণ করনেওয়ালাও একমাত্র তিনি। তার মালিকানার বিশেষত্ব হচ্ছে, পূর্ণ ইনসাফের সাথে, যার যতটুকু পাওনা, তাকে পরিপূর্ণভাবে ততটুকু তিনি দেবেন। তাই এরশাদ হচ্ছে, ‘যারা অন্যায় করেছে যেন তাদেরকে তিনি ততটুকু প্রতিদান দেন যতটুকু তারা করেছে এবং যেন সুন্দরভাবে নেক প্রতিদান দেন তাদেরকে যারা ভাল কাজ করেছে।’ *সগীরা গুনাহ বলতে কী বুঝায় : এরপর আল্লাহ রব্বুল ইযযত তাদের জন্যে একটি বিশেষ সীমা নির্ধারণ করে দিচ্ছেন যারা নেক কাজ করেছে-এই কথা বলে যে, আর তাদেরকে সুন্দরভাবে প্রতিদান দেবেন, যারা বড় বড় গুনাহ ও লজ্জাজনক কাজ পরিহার করে চলবে… তবে (মানবীয় দুর্বলতা ও শয়তানী ওয়াসওয়াসায় পড়ে যারা ছােটখাট ত্রুটি-বিচ্যুতি লিপ্ত হবে, তাদের সে ক্রটিগুলাে তিনি উপেক্ষা করবেন-দেখেও দেখবেন না।’ বড় গুনাহ বলতে বুঝায় বড় বড় নাফরমানির কাজ বা অবাধ্যতা এবং ‘ফাওয়াহেশ’ বলতে বুঝায় বড় বড় অপরাধ ও লজ্জাজনক কাজ। আর ‘লামাম’ এর অর্থে বিভিন্ন মত পাওয়া যায় । ইমাম ইবনে কাছীর বলেন, এটা বিচ্ছিন্ন ও মূল কাজ থেকে ব্যতিক্রমধর্মী কাজ! কারণ লামাম হলাে ছােট ছােট গুনাহ ও তুচ্ছ কার্যাবলী। ইমাম আহমদ বলেন, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস বলেছেন, আবু হােরায়রাহ নবী(স.) থেকে লামাম সম্পর্কে যে কথাগুলাে বর্ণনা করেছেন তার থেকে অধিক সাদৃশ্যপূর্ণ অর্থ আমি আর কোথাও দেখিনি। নবী(স.) বলেছেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা যখন কোনাে আদম সন্তানের ভাগ্যে ব্যভিচারের কোনাে অংশ লিখে দেন, তখন নির্ঘাত সে তাতে লিপ্ত হয়ে পড়ে। অতএব, চোখের যেনা হচ্ছে দৃষ্টিপাত করা (ইচ্ছা করে নিষিদ্ধ কোনাে ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গকে দেখা) এবং মুখের যেনা হচ্ছে (নিষিদ্ধ ও লালসাপূর্ণ) কথা উচ্চারণ করা। আর মনের কাজ তাে এই যে, সে আকাংখা করে এবং কারাে প্রতি প্রলুব্ধ হয়। কিন্তু লজ্জাস্থান এই কামনা-বাসনাকে বাস্তব সত্যে পরিণত করে অথবা কামনাকে মিথ্যা প্রমাণ করে। (বুখারী ও মুসলিম এ হাদীসটিকে আবদুর রাযযাক-এর বরাত দিয়ে রেওয়ায়াত করেছেন) ইবনে জরীর বলেছেন, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ থেকে বর্ণিত হাদীস থেকে জানা যায়, (তার বর্ণনা মতে) চোখের যেনা হচ্ছে ইচ্ছা করে নিষিদ্ধ ব্যক্তিকে দেখা, ঠোট দুটির যেনা চুম্বন করা, হস্তদ্বয়ের যেনা কামনার সাথে বা অবৈধভাবে কাউকে ধরা, পদদ্বয়ের যেনা হচ্ছে যেনার নিয়তে কোনাে দিকে পদচালনা করা। একাজকে লজ্জাস্থান সত্যায়িত করে অথবা মিথ্যা প্রমাণ করে। এমতাবস্থায় কোনাে ব্যক্তি যদি তার লজ্জাস্থানকে এ নিষিদ্ধ কাজে এগিয়ে দেয়, তাহলে সে যেনাকারী হবে, আর যদি এগিয়ে না দেয়, তাহলে তার যেটুকু অপরাধ হবে তারই নাম হবে লামাম। মাসরুক ও শাবী এইভাবেই বলেছেন। ইবনে লুফাফা আত্তায়েফী নামে পরিচিত আব্দুর রহমান ইবনে নাফে বলেন, ‘আমি আবু হােরায়রাকে ‘ইল্লাললামামা’ শব্দের অর্থ জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি বললেন, চুমু দেয়া, ইচ্ছা করে বারবার দেখা, চোখ দিয়ে ইশারা করা এবং জড়িয়ে ধরা। তারপর যখন এক লিংগ অপর লিংগের সাথে এমনভাবে লাগানাে হয় যে গােসল ওয়াজেব হয়ে যায়-সেই অবস্থাটাই হবে (প্রকৃত) যেনা। অতপর ‘লামাম’-এর অর্থে এসব কথা পরম্পর কাছাকাছি অর্থবােধক। এ পর্যায়ে আরও কিছু কথা পাওয়া যায়, আলী ইবনে আবি তালহা হযরত ইবনে আব্বাসের বরাত দিয়ে বলছেন, ‘ইল্লাললামামা’ অর্থ যা পূর্বে সংঘটিত হয়েছে। যায়েদ ইবনে আসিলামও অনুরূপ বলেন। ইবনে জারীর মােজাহেদের কথা উদ্ধৃত করেন, তিনি এ আয়াতের ‘লামাম’ সম্পর্কে বলেন, সেই ব্যক্তির অপরাধ, যেনাহে সামান্য অগ্রসর হয়েছে, কিন্তু পরে সে সেই অভ্যাস ত্যাগ করেছে। ইবনে জারীর আর এক পর্যায়ে বলেন, যা আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস-এর রেওয়ায়াত থেকে জানা যায়, তিনি বলেন, সে ব্যক্তি যে লজ্জাকর কাজের দিকে ঝুঁকে পড়ে কিন্তু পরক্ষণেই সে তওবা করে। তিনি আরও বলেছেন যে, রসূলুল্লাহ(স.) এরশাদ করেছেন, হে আল্লাহ, তুমি যদি ক্ষমা করাে তাহলে গভীরভাবে ক্ষমা করাে। কে আছে এমন ব্যক্তি যে কুপ্রবৃত্তির তাড়নে প্রলুব্ধ না হয়েছে? এমনি করে তিরমিযী পর্যায়ক্রমে আহমদ ইবনে ওসমান, আল বাসরী এবং তিনি আবু আসেম আননাবীল থেকে রেওয়ায়েত করেছেন, তারপর বলেছেন যে, এটা সহীহ হাদীস বটে, তবে শেষ বর্ণনাকারীর উল্লেখ না থাকায় এটা খুব জোরালাে হাদীস নয়। আবার আর একটি হাদীসের বর্ণনায় ইবনে জরীর থেকে জানা যায় যে, আবু হােরায়রাহ(রা.) বলেন, সেই সব ব্যক্তি সম্পর্কে যারা লামাম’ ব্যতীত বড় বড় (কাবীরা) গুনাহ ও লজ্জাজনক কাজ থেকে বেঁচে থাকে আমি দেখতে পাচ্ছি তাদেরকে শাস্তি থেকে তুলে নেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘লামাতুন যেনার একটি অংশ বটে, কিন্তু এতটুকু আচরণ করার পর বাস্তব যেনায় লিপ্ত না হয়ে যতটুকু ক্রটি হয়েছে তার জন্যে যদি তওবা করে এবং পুনরায় সে আচরণে প্রবৃত্ত না হয়, তাহলে তাকে ক্ষমা করা হবে এবং তার সে আচরণকে লামাতুন’ বলে গণ্য করা হবে। চুরির ইচ্ছা করে বাস্তবে চুরি না করাকেও এই শ্রেণীতে ফেলা হবে যদি সে উক্ত ইচ্ছা পরিত্যাগ করে এবং পুনরায় না করে। অনুরূপভাবে মদপান করতে চাইলাে, কিন্তু থেমে গেল এবং সে ইচ্ছা ত্যাগ করলাে, সেটাও লামাতুন’ বলে গণ্য হবে। আবু হােরায়রাহ(রা.) বলেন, এগুলাে সবই তুচ্ছ গুনাহ (লামামুন বা আল লামামু)। এইভাবে আরও কিছু মওকুফ হাদীস আছে যেগুলাের মধ্যে উপরোক্ত কথার সমর্থন পাওয়া যায়। প্রথম কথা থেকে ব্যতিক্রমধর্মী আরও কিছু কথা এ সম্পর্কে পাওয়া গেলেও আমরা মনে করি শেষােক্ত কথাটি কোরআনের কথার সাথে বেশী সামঞ্জস্যশীল। কোরআনে উল্লিখিত হয়েছে, ‘অবশ্যই তােমার রব ক্ষমা প্রদর্শনে বড়ই উদার এবং তার ক্ষমার ভান্ডার বড়ই প্রশস্ত।’ এতে ক্ষমার প্রশস্ততার কথা উল্লেখ করায় বুঝা গেল ‘লামামুন’ হচ্ছে, লজ্জাজনক ও বড় গুনাহগুলাের দিকে অগ্রসর হওয়া, কিন্তু গুনাহের কাজটি সংঘটিত হওয়ার পূর্বেই থেমে যাওয়া এবং প্রত্যাবর্তন করা। এখানে থেয়াল করার বিষয় হচ্ছে, ইল্লাললামামা’ বলে যে ব্যতিক্রম’ অর্থ বুঝানাে হয়েছে সে কথাটি মূল বাক্য থেকে বিচ্ছিন্ন কোনাে কথা নয়। এতে ভাল লােকদের কথা বর্ণনা করতে গিয়ে বলা হয়েছে, তারাই ভাল লােক যারা পরহেয করে বড় বড় মন্দ কাজ ও লজ্জাজনক কাজ থেকে, তবে মানবীয় সাধারণ দুর্বলতার কারণে যে সব ছােটখাট ত্রুটি-বিচ্যুতি হয়ে যায় সেগুলাে আল্লাহর কাছে ধর্তব্য নয়, যেহেতু মন্দ কোনাে কাজে পতিত হতে হতে তারা থেমে যায়, জলদি করে ফিরে আসে এবং পুনরায় এ পথে অগ্রসর হয় না বা বারবার এ কাজে এগিয়ে যায় না। এইভাবে আল্লাহ পাক বলেছেন, আর যারা কোনাে লজ্জাজনক কাজ করলো অথবা নিজেদের ওপর যুলুম করলাে, কিন্তু আল্লাহর কথা স্মরণ হতেই তারা কৃতকর্মের জন্যে তওবা-এস্তেগফার করে ক্ষমাপ্রার্থী হলো (তাদের জন্যে অবারিত দ্বার খােলা রয়েছে ক্ষমার সে মহা ভান্ডার)। আর এমন আল্লাহ তায়ালা ছাড়া কে আছে, যে যাবতীয় গুনাহ ক্ষমা করতে পারে! তবে, (একটি শর্ত হচ্ছে) জেনে বুঝে (ও ইচ্ছা করে) যেন তারা বারবার সে গুনাহগুলাে না করে। এ ধরনের ব্যক্তিদেরকেই আল্লাহ পাক ‘মােত্তাকী’ বলে অভিহিত করেছেন এবং তাদেরকে ক্ষমা ও এমন জান্নাত দেবেন বলে ওয়াদা করেছেন যার প্রশস্ততা আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সম্মিলিত প্রশস্ততার সমান।(আলে ইমরান : ১৩৩-১৩৬) সুতরাং, এই অবস্থাটাই হচ্ছে আল্লাহর রহমত ও সুবিস্তৃত মাগফেরাত হাসিলের জন্যে নিকটতম। *যাবতীয় প্রতিদান শুধু আল্লাহ তায়ালার কাছে : আয়াতটিকে এই কথা বলে শেষ করা হয়েছে যে, অন্যায় কাজ ও নেক কাজের প্রতিদান কাকে কিভাবে এবং কতােটা দেয়া হবে তা সম্পূর্ণ আল্লাহর জ্ঞান ভান্ডারে মজুদ রয়েছে, মানুষের যাবতীয় কাজকে সামনে রেখেই তিনি তাদের বিষয়ে চূড়ান্ত ফায়সালা করবেন। এরশাদ হয়েছে, ‘তিনি তােমাদেরকে যখন পৃথিবীর মাটি থেকে সৃষ্টি করেছিলেন তখন থেকেই তিনি তােমাদের সম্পর্কে ভালা করে জানেন, আর যখন তােমরা তােমাদের মায়ের গর্ভাশয়ে ভ্রুণ আকারে বিরাজ করছিলে তখন থেকেই তিনি তােমাদের খবর রাখেন। মানুষের এই প্রকাশ্য কাজগুলাে সম্পর্কে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের আগাম জ্ঞানের কথাই উপরােক্ত আয়াতে উল্লিখিত হয়েছে। এ জ্ঞান প্রকৃত ও প্রতিষ্ঠিত সত্য সম্পর্কিত মৌলিক জ্ঞান যা অন্য কেউ জানে না, জানেন তিনি যিনি তাদের সৃষ্টি করেছেন। মানুষের মূল অবস্থাকে যখন পৃথিবী থেকে তিনি সৃষ্টি করলেন তখন থেকেই তাঁর এ জ্ঞান রয়েছে সবার সম্পর্কে, আর এই জন্যেই তিনি গায়েব জানেন। মানুষ যখন মাতৃগর্ভাশয়ে ভ্রুণ আকারে বিদ্যমান, যখন তারা দিনের আলাে দেখেনি, তখন থেকেই সবার সম্পর্কে তার এ পরিপূর্ণ জ্ঞান বর্তমান রয়েছে। মানুষ প্রকাশ হওয়ার পূর্বেই তার সম্পর্কে এ সঠিক জ্ঞান এবং তার কাজ সংঘটিত হওয়ার পূর্বেই সে কাজের প্রকৃতি সম্পর্কে তার পূর্ণ জ্ঞান রয়েছে বলে এ আয়াতে উল্লিখিত হয়েছে। আর কারাে মধ্যে এই জ্ঞানের প্রকৃতি সম্পর্কে কিছু অংশ জানা আছে বলে যদি কেউ মনে করেও তা হবে সম্পূর্ণ বাজে কথা এবং চরম বেয়াদবী বলে ধরে নেয়া হবে, যে ব্যক্তি নিজের সম্পর্কে মনে করবে যে, সে মহান আল্লাহ সম্পর্কে কিছু খবর রাখে এবং নিজের কৃতিত্ব দেখাতে গিয়ে বলবে, আমি অমুক, তমুক তার এ অহমিকা তাকে ধিকৃত করবে। ‘অতএব, খবরদার, তােমরা নিজেদেরকে দোষমুক্ত বলে প্রকাশ করাে না, তিনিই ভাল জানেন কে তাকে ভয় করে চলে।’ তোমাদের নিজেদের সম্পর্কে তাকে তোমরা জানাবে এর কোনাে প্রয়ােজন তার নেই, আর তার কাছে তােমাদের পরিমাপ করে তােমরা দেখাবে-এরও কোনাে দরকার নেই, কারণ তার কাছেই তো সব কিছুর পূর্ণ জ্ঞান বর্তমান রয়েছে।
ফী জিলালিল কুরআন:
*হযরত ইবরাহীম(আ.)-এর দৃঢ়তা : এরপর আসছে সূরার শেষ অধ্যায়টি যার মধ্যে মেশানাে রয়েছে ছন্দ মিল। এ অংশ প্রথমাংশের সাথে সর্বাধিক সাদৃশ্যপূর্ণ। এখানে আকীদা-বিশ্বাসের সেই মৌলিক কথাগুলােকে পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে যা প্রথম নিবেদিতপ্রাণ ইবরাহীম(আ.) দৃঢ়তার সাথে ব্যক্ত করেছিলেন, একজন মানুষ হিসেবে তিনি চিনেছিলেন তার সৃষ্টিকর্তাকে, চিনেছিলেন তিনি তার মনিবকে সেই প্রকৃতি প্রদত্ত শিক্ষা দ্বারা যা তার অস্থিমজ্জার মধ্যে আল্লাহ পাক পয়দা করে দিয়েছিলেন এবং যে সত্যানুভূতি এক এক করে তাঁর জীবনের প্রতিটি ব্যাপারে প্রতিফলিত হচ্ছিল। এই সত্যানুভূতির কারণেই তিনি গভীরভাবে অনুধাবন করেছিলেন প্রকৃতির রহস্যকে। এই অনুভূতি যখন পূর্ণত্বপ্রাপ্ত হলাে, তখন প্রকম্পিত হৃদয়ে তিনি তাঁর সৃষ্টিকর্তাকে চিনলেন, তার দিকে এগিয়ে গেলেন এবং তার ডাকে সাড়া দিলেন। মানুষের মধ্যে অবস্থিত সত্য-চেতনাকে ডাক দিয়ে বলা হচ্ছে, ‘দেখেছাে কি তুমি সেই ব্যক্তিকে যে সত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, (কাউকে দেয়ার সময়) অত্যন্ত অল্প দেয় এবং কৃপণতা করে তার কাছে কি গায়েবের জ্ঞান আছে যা সে দেখতে পায়?’ ‘তাকে কি জানানাে হয়নি সেই হেদায়াতের কথা যা মূসা(আ.)-এর কাছে অবতীর্ণ সহীফাসমূহে বর্তমান রয়েছে। রয়েছে ইবরাহীমের কিতাবে, যে তার দায়িত্ব পরিপূর্ণভাবে পালন করেছিলাে? সে সকল সহীফাতে একথা বলা হয়েছে যে, কেউ কারাে বােঝা বহন করবে না এবং মানুষের চেষ্টা ব্যতিরেকে কিছু নেই… সুতরাং, তােমার রবের কোন্ কোন্ নেয়ামতের ব্যাপারে তােমরা বিতর্ক করছো?'(আয়াত ৩৩-৫৫)। ‘(হে মানবমন্ডলী, তােমাদের মধ্যে যে নবী এসেছে সে অতীতে আগত সতর্ককারীদের মতই একজন সতর্ককারী। অতি নিকটে সেই ভয়ানক কেয়ামত এসে গেছে (আগত প্রায় সেই মহা বিপদ) যার ভয়াবহতা দূর করা তিনি ব্যতীত আর কারাে পক্ষে সম্ভব নয়। এখন এই যে কথা নবী মােহাম্মদ তােমাদের কাছে পেশ করছে সে বিষয়ে কি তােমরা বিস্মিত হচ্ছো এবং তােমরা কি হাসি-ঠাট্টা করছে? আর কেয়ামতের ভয়ে একটুও কান্নাকাটি করছো না। বরং তােমরা অহংকারে ফেটে পড়ছো। (না, এমনটি করাে না, সময় থাকতেই সাবধান হও) অহংকার পরিহার করে আল্লাহর সামনে অবনত মাথায় ঝুঁকে পড়ো (সেজদা করাে) এবং তার আনুগত্য করাে পুরােপুরিভাবে। আর এ তাে সেই ব্যক্তি যে মুখ ফিরিয়ে নেয়, খুব কমই সে দেয় এবং চরম কৃপণতা করে। এই ব্যক্তির অদ্ভূত কাজ সম্পর্কেই আল্লাহ তায়ালা বিস্ময় প্রকাশ করছেন। কোনাে কোনাে রেওয়ায়েতে বর্ণিত হয়েছে যে, ওপরের কথাটি নির্দিষ্ট এক ব্যক্তিকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে, যে আল্লাহর পথে খুব কম সম্পদ ব্যয় করতাে, তারপর এক সময়ে দৈন্যের ভয়ে ব্যয় করা একেবারেই বন্ধ করে দিলাে। যামাখশারী তাঁর বিখ্যাত তাফসীর কাশশাফে খুব জোর দিয়ে বলেছেন যে, সে ব্যক্তি হচ্ছে ওসমান ইবনে আফফান রাদিয়াল্লাহু আনহু। এ বিষয়ে তিনি একটি ঘটনার উল্লেখ করেন, অবশ্য এ বিষয়ের ওপর তিনি কোনাে সঠিক দলীল-প্রমাণ পেশ করেননি, আর ওসমান(রা.) সম্পর্কে ও তাঁর প্রকৃতি, আল্লাহর পথে অকাতরে, অবিরতভাবে এবং বে-হিসাব তার। দান-খয়রাত সম্পর্কে যারা খবর রাখে, আল্লাহ তায়ালার প্রতি তাঁর বিশ্বাসের দৃঢ়তা সম্পর্কে যারা জানে এবং যারা তাঁর অনিরুদ্ধ নেক কাজ সম্পর্কে ধারণা রাখে, তারা যামাখশারীর একথা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারে না। {উল্লেখিত ঘটনার বিবরণ নিম্নরূপঃ যামাখশারী বলেন, বর্ণিত হয়েছে যে, হযরত ওসমান(রা.) তাঁর সম্পদ ভাল কাজে ব্যয় করতেন। একদিন আব্দুল্লাহ ইবনে সাদ, ইবনে আবী সারাহ বললেন (যিনি তাঁর দুধ ভাই ছিলেন), যেভাবে তুমি খরচ কর, তাতে শীঘ্রই তােমার নিকট কোন সম্পদ থাকবে না। জওয়াবে হযরত ওসমান(রা.) বলেন, আমার গুনাহখাতা ও ক্রুটি-বিচাতি অনেক আছে, আর যা আমি করছি তার মাধ্যমে আমি আল্লাহ তায়ালার সন্তোষ কামনা করি এবং তাঁর ক্ষমা চাই। তখন দুধ ভাই আব্দুল্লাহ বললেন, বেশ তো, সফরের জনা প্রয়ােজনীয় দ্রব্যসামগ্রী ভর্তি তোমার উটনীটিকে আমাকে দাও, আমি তোমার সকল গুনাহের বােঝা লাঘব করে দেব। তখন তিনি তাকে তার চাহিদা মতাে সব কিছু দিয়ে দিলেন, তাকে সাক্ষী রাখলেন এবং এরপর থেকে দান-খয়রাত করা বন্ধ করে দিলেন। তখন (তার সম্পর্কে) এই আয়াত নাযিল হলাে। এ রেওয়ায়াতের সত্য না হওয়াটা পরিষ্কার, অধিকাংশ বর্ণনাকারীরাই এ ব্যাপারে একমত হননি।} অবশ্য, যে কোনাে ব্যক্তি সম্পর্কে একথা বলা যেতে পারে এবং উদাহরণস্বরূপও কোনাে মানুষের কথা বলা যেতে পারে। সুতরাং যে ব্যক্তি এ মর্যাদাপূর্ণ পথ থেকে সরে দাঁড়াবে এবং তার মাল ও জান এই আকীদা-বিশ্বাসকে কায়েম করার জন্যে খরচ করার পর কৃপণতা করবে, অর্থাৎ এ উন্নত মর্যাদা পর্যন্ত পেীছুতে দুর্বলতা প্রদর্শন করবে এবং খরচ করা বন্ধ করে দেবে-এই বক্তব্যের কথাগুলাে এক আজব ব্যাপার বলে তার কাছে মনে হয়। আশ্চর্যের ব্যাপারই বটে। এ ধরনের ব্যক্তির অবস্থাকে সঠিক আকীদা-বিশ্বাস ও তার জন্যে ত্যাগ স্বীকার করার এক নযির হিসেবে কোরআন করীম তুলে ধরেছে। এরশাদ হচ্ছে, সে কি গায়েব জানে? তার কাছে কি গায়বের জ্ঞান আছে, যা সে দেখে? গায়েব বা অদৃশ্য জিনিস দেখা বা জানার ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর। তিনি ব্যতীত গায়েবের কোনাে কিছু আর কেউই দেখতে পায় না। এজন্যে মানুষ এ জিনিসকে বিশ্বাস করতে চায় না যা গােপন রয়েছে। তার দায়িত্ব হচ্ছে ভাল কাজ করা ও ভাল কাজে ব্যয় করা এবং সারা জীবন ধরে সতর্কতার সাথে জীবন যাপন করা। আর এত বেশী খরচ না করা যা এক সময় বন্ধ হয়ে যাবে। তার জন্যে অজ্ঞাত ভবিষ্যতে সাফল্যের নিশ্চয়তা কেউই দিতে পারে না। সে শুধু সতর্কতা অবলম্বন করতে পারে, নিজ কর্তব্য পালন করতে পারে এবং এক হকদারদের পাওনা পরিশােধ করতে পারে মাত্র। এর সাথে সে আল্লাহর নিকটে ক্ষমাপ্রাপ্ত হতে পারে ও তার নেক কাজগুলাে কবুল হবে বলে আশা করতে পারে। ‘তাকে কি জানানাে হয়নি সেই সকল জিনিস সম্পর্কে যা মূসার নিকটে প্রেরিত সহীফাসমূহে রয়েছে এবং ইবরীমের নিকটে প্রেরিত কিতাবেও সে কর্তব্যগুলাের কথা বলা হয়েছে যা সে পুরােপুরি পূরণ করেছিলাে?’ ইসলামী জীবন ব্যবস্থা এত প্রাচীন জীবন ব্যবস্থা যে, এর সাথে পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সবার সাথে সম্পর্ক রয়েছে। এ ব্যবস্থার বুনিয়াদ এবং এর নিয়ম-কানুন মযবৃতভাবে প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। রাসূলের আগমনের পরম্পরায় এ ব্যবস্থার এক অংশ আর এক অংশকে সত্যায়িত করেছে। শুধুমাত্র স্থান ও কালের ব্যবধান ছাড়া এতে অন্য কোনাে পার্থক্য নেই। এই জীবন ব্যবস্থা সম্পর্কেই তাে মূসা(আ.)-এর সহীফাগুলােতে উল্লেখ রয়েছে। এই জীবন ব্যবস্থাই তাে মূসা(আ.)-এর পূর্বে ইবরাহীম(আ.)-কে দেয়া হয়েছিলো। ইবরাহীম(আ.) সেই মহান ব্যক্তি যিনি তার দায়িত্ব পুরােপুরিভাবে পালন করেছিলেন, সব কিছু দিয়েই তিনি তার দায়িত্ব পালন করেছিলেন। দায়িত্ব পালনের যে নির্দেশ তাকে দেয়া হয়েছিলাে তার হক তিনি আদায় করেছিলেন। কৃপণতা বা সংকীর্ণতা মােকাবেলায় এবং দায়িত্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার পরিবর্তে দায়িত্ব পালনের কথা বলা হয়েছে এবং তাশদীদ-এর সাথে অফফা পদবাচ্য শেষ হয়েছে, যাতে করে শেষের দিকে মিল হওয়ার সাথে সাথে সুরের এক মধুর ঝংকার উঠে। মূসা(আ.)-এর কিতাবে কি আছে এবং ইবরাহীম-এর কিতাবেই বা কি আছে যা সে পূরণ করেছিলাে। সেখানে ছিলাে ‘কেউ কারাে বােঝা বহন করে দেবে না। অতএব বুঝা গেলাে, সেদিন কোনাে ব্যক্তিই অন্য কারাে বােঝা বহন করে দেবে না-না কেউ কারাে বােঝা হালকা করে দিতে পারবে, আর না নিজের বােঝা অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে কেউ নিজে হালকা হতে পারবে। সুতরাং, যেমন করে কোনাে ব্যক্তি নিজের কোনাে দায়িত্ব এবং গুনাহের বােঝা হালকা করার ক্ষমতা পাবে না, তেমনি অপরের কোনাে দায়িত্ব ও গুনাহের বােঝাও হালকা করার ক্ষমতা কারাে থাকবে না। আর মানুষ যে চেষ্টা করবে তাকে তাই দেয়া হবে। অন্য কথায় মানুষের চেষ্টা ব্যতিরেকে কিছু নেই। এইভাবে মানুষের নিজের কামাই-রােযগার, প্রচেষ্টা ও কাজ ব্যতীত অন্য কিছু চিন্তাই করা যায় না। কোনাে ব্যক্তির আমলনামায় অপর কারাে কাজ যােগ হবে না, আর কারাে আমলনামা থেকে কিছু কেটে নিয়ে অপর কারাে আমলনামায় কিছু বাড়ানাে হবে না, আর এই দুনিয়ার জীবন তাকে দেয়া হয়েছে ভাল কাজ করার জন্যে এবং সাধ্যানুযায়ী চেষ্টা করার জন্যে, মৃত্যু আসার সাথে সাথেই কাজের এ সুযােগ শেষ হয়ে যায় এবং সকল কাজ ও তৎপরতার পথ বন্ধ হয়ে যায়। তবে রসূলুল্লাহ(স.)-এর থেকে জানা যায়, এমন কিছু কাজ আছে যা মৃত্যুর পরেও চালু থাকে। যেমন তিনি বলেছেন, ‘মানুষ মারা গেলে তিন ব্যক্তি ব্যতীত বাকি সবার কাজের পথ বন্ধ হয়ে যায়। সে ব্যক্তির কাজ চলতে থাকে যে নেক সন্তান রেখে গেছে এবং সে তার জন্যে দোয়া করতে থাকে, অথবা কোনাে সদকায়ে জারিয়ার ব্যবস্থা রেখে গেছে যার থেকে সে ব্যক্তির মৃত্যুর পরেও ফায়দা পেতে থাকে, অথবা সে কোনাে জ্ঞানার্জনের ব্যবস্থা রেখে গেছে যার থেকে সে ব্যক্তির মৃত্যুর পরেও মানুষ উপকৃত হতে থাকে।'(আবু হুরায়রা (রা.)-এর বরাত দিয়ে মুসলিম শরীফে হাদীসটি বর্ননা হয়েছে) এই তিনটি কাজ প্রকৃতপক্ষে তার নিজেরই কাজ বলে গণ্য হবে। আলােচ্য আয়াত থেকে ইমাম শাফেয়ী দলীল নিয়েছেন যে, যে ব্যক্তি কোনাে মৃত ব্যক্তির অনুসরণ করে, তার পড়াশুনা দ্বারা সে মৃত ব্যক্তির ওপর সে সওয়াব পৌছায় না, কারণ সে পড়াশুনা মৃত ব্যক্তির নিজের কোনাে কাজ বা উপার্জন করা জিনিস নয়। আর এই কারণেই রসূলুল্লাহ(স.) তাঁর উম্মতকে এই সওয়াব-রেসানী করার জন্যে আহবন জানাননি বা উৎসাহিতও করেননি অথবা কোনাে স্পষ্ট কথা বা ইশারা-ইংগিতেও তিনি এজন্যে বলেন সাহাবাদের মধ্য থেকেও কোনাে ব্যক্তি থেকে এ কাজের সমর্থনে কোনাে কথা পাওয়া যায়নি। যদি এটা উত্তম কাজ হত, তাহলে তারা নিজেরা আমাদের পূর্বে এ কাজ করতেন। তবে নিকটাত্মীয় হওয়ার কারণে কেউ কিছু করলে তা হবে নিজস্ব ব্যাপার, তার জন্যে কোরআন-হাদীসের দলীল থাকা বড় কথা নয়। সেখানে বিভিন্ন প্রকার কিয়াস করা অথবা মত প্রয়ােগ করারও কোনাে প্রয়ােজন নেই । অতপর দোয়া বা সদকা করার প্রসংগ ভিন্ন। সে ব্যাপারে তো শরীয়তদাতার পক্ষ থেকে স্পষ্ট দিক-নির্দেশিকা রয়েই গেছে। (ইবনে কাছীর তার তফসীরে এ বিষয়ের ওপর বিস্তারিত আলােচনা করেছেন)
ফী জিলালিল কুরআন:
*চেষ্টা কর্ম অনুযায়ী ফলাফল : ‘আর তার চেষ্টা-সাধনাকে শীঘ্রই সে দেখবে, তারপর তাকে পরিপূর্ণ প্রতিদান দেয়া হবে।’ অতএব, কোনাে চেষ্টা বা কোনাে কাজ এবং উপার্জন কিছুতেই বিনষ্ট হবে না। আল্লাহর জ্ঞান ভান্ডারের মধ্য থেকে এবং তার সূক্ষ্ম দাঁড়িপাল্লা থেকে কোনাে জিনিস বাদ পড়বে না। শীঘ্রই প্রত্যেক ব্যক্তি তার প্রচেষ্টার ফল পুরােপুরিভাবে পেয়ে যাবে, কিছুমাত্র কমও তাকে দেয়া হবে না, বা কোনাে যুলুম বা বে-ইনসাফীও তার প্রতি করা হবে না। এইভাবে ইনসাফপূর্ণ প্রতিদান দেয়ার ব্যাপারে ব্যক্তিগত দায়িত্বের কথা অত্যন্ত জোরালােভাবে পেশ করা হয়েছে। এর ফলে মানুষের কাছে মানবতার সেই মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যা তাকে আত্মপ্রত্যয়ী, দায়িত্ববােধসম্পন্ন, সত্যপন্থী ও সত্যাশ্রয়ী সৃষ্টি হিসেবে কায়েম রাখবে। সে হবে সম্মানী যে তাকে সৎ কাজের সুযােগ দান করা হবে এবং তারপর সে এ কাজ করলাে কিনা সে ব্যাপারে পাকড়াও করা হবে এবং এইভাবে বিনিময় দান করার জন্যে প্রতিষ্ঠিত আদালত সম্পর্কে সে নিশ্চিন্ত হতে পারবে যে তার প্রতি অবিচার হবে না, সেখানে কারাে খােশ খেয়াল মত বিচার হবে না। বিচার কাজে কোনাে ত্রুটি-বিচ্যুতি আসার সুযােগ আসবে না এবং না জানার কারণে বা কোনাে তথ্য গােপন থাকার ফলে কোনাে বে-ইনসাফী সেখানে হবে । এরশাদ হচ্ছে, ‘অবশ্যই তোমার রবের নিকটেই সব কিছুর পরিসমাপ্তি ঘটবে।’ অতএব, সেদিন আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দিকে গমনের পথ ছাড়া অন্য আর কোনাে পথই থাকবে না। তার কাছে ব্যতীত অন্য কোন আশ্রয়স্থল সেদিন থাকবে না, থাকবে না সেদিন আর কোনাে বাসস্থান তার প্রদত্ত বাসস্থান ছাড়া । হয়ত সে থাকবে নেয়ামতে ভরা বাসগৃহে অথবা দোযখের আগুনের মর্মান্তিক দহনে। মানুষের হৃদয়-পটে, চেতনা ও ধ্যান-ধারণার মধ্যে এই অবস্থাটির চিত্র এঁকে দিয়ে এর গুরুত্ব সম্পর্কে তাকে ওয়াকেফহাল করা হচ্ছে যেন সে এর থেকে সঠিক প্রতিক্রিয়া গ্রহণ করতে পারে। এমতাবস্থায়, যখনই সে বুঝবে যে, তার পরিসমাপ্তি আল্লাহর কাছে, যেখানে সব কিছুর পরিসমাপ্তি হবে, সব বিষয়ের এবং সকল ব্যক্তির, তখন সে দেখতে পাবে পথের শুরু থেকে নিয়ে শেষ পর্যন্ত কোনাে জায়গায় লুকিয়ে থাকার অথবা এপথ ছেড়ে কোথাও পালিয়ে যাওয়ার কোনাে সুযােগই নেই, আর তখনই সে তার মন ও কাজকে এই সত্য ও বাস্তবতার নিরিখে পরিচালনা করতে সক্ষম হবে, অথবা সাধ্যানুযায়ী সে এ পথের উপযােগী করে গড়তে ও পরিচালনার চেষ্টা চালাতে থাকবে। তার মন ও চিন্তা-চেতনা পরিসমাপ্তির এ দিনটিকে কেন্দ্র করে জীবন পথের শুরু থেকেই সফলতা অর্জনের জন্যে আশান্বিত হয়ে থাকবে।