Motaher21.net أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ ( বই # ১১৪৩) [*‌‌*জীবন মৃত্যুর চূড়ান্ত ফয়সালা আল্লাহর হাতে :-   *হাসি কান্নার আসল রহস্য : -] www.motaher21.net সূরা:৫৩:আন-নাজম। পারা:২৭ ৪৩- ৬২ নং আয়াত:- আয়াতের ব্যাখ্যা:- ১)‌ তাফসীরে ফী জিলালিল কুরআন। ২) তাফসীরে ইবনে কাছীর। ৩) তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন। ৪) তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ।

Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১১৪৩)
[*‌‌*জীবন মৃত্যুর চূড়ান্ত ফয়সালা আল্লাহর হাতে :-
*হাসি কান্নার আসল রহস্য : -]
www.motaher21.net
সূরা:৫৩:আন-নাজম।
পারা:২৭
৪৩- ৬২ নং আয়াত:-
আয়াতের ব্যাখ্যা:-
১)‌ তাফসীরে ফী জিলালিল কুরআন।
২) তাফসীরে ইবনে কাছীর।
৩) তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন।
৪) তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ।

সূরা:৫৩:আন-নাজম-৪৩
وَ اَنَّہٗ ہُوَ اَضۡحَکَ وَ اَبۡکٰی ﴿ۙ۴۳﴾
আর এই যে, তিনিই হাসান, তিনিই কাঁদান।
সূরা:৫৩:আন-নাজম-৪৪
وَ اَنَّہٗ ہُوَ اَمَاتَ وَ اَحۡیَا ﴿ۙ۴۴﴾
একথা যে, “তিনিই মৃত্যু দিয়েছেন এবং তিনিই জীবন দান করেছেন।”
সূরা:৫৩:আন-নাজম-৪৫
وَ اَنَّہٗ خَلَقَ الزَّوۡجَیۡنِ الذَّکَرَ وَ الۡاُنۡثٰی ﴿ۙ۴۵﴾
একথা যে, “তিনিই পুরুষ ও নারী রূপে জোড়া সৃষ্টি করেছেন-
সূরা:৫৩:আন-নাজম-৪৬
مِنۡ نُّطۡفَۃٍ اِذَا تُمۡنٰی ﴿۪۴۶﴾
-এক ফোঁটা শুক্রের সাহায্যে যখন তা নিক্ষেপ করা হয়।”
সূরা:৫৩:আন-নাজম-৪৭
وَ اَنَّ عَلَیۡہِ النَّشۡاَۃَ الۡاُخۡرٰی ﴿ۙ۴۷﴾
আর এই যে, পুনরুত্থান ঘটাবার দায়িত্ব তাঁরই।
সূরা:৫৩:আন-নাজম-৪৮
وَ اَنَّہٗ ہُوَ اَغۡنٰی وَ اَقۡنٰی ﴿ۙ۴۸﴾
একথা যে, “তিনিই সম্পদশালী করেছেন এবং স্থায়ী সম্পদ দান করেছেন।”
সূরা:৫৩:আন-নাজম-৪৯
وَ اَنَّہٗ ہُوَ رَبُّ الشِّعۡرٰی ﴿ۙ۴۹﴾
আর এই যে, তিনি শি’রা নক্ষত্রের রব।
সূরা:৫৩:আন-নাজম-৫০
وَ اَنَّہٗۤ اَہۡلَکَ عَادَۨ ا الۡاُوۡلٰی ﴿ۙ۵۰﴾
আর এই যে, তিনিই প্রথম আ’দ সম্প্রদায়কে ধ্বংস করেছিলেন।
সূরা:৫৩:আন-নাজম-৫১
وَ ثَمُوۡدَا۠ فَمَاۤ اَبۡقٰی ﴿ۙ۵۱﴾
এবং সামূদকে এমনভাবে নিশ্চিহ্ন করেছেন যে, কাউকে অবশিষ্ট রাখেননি।
সূরা:৫৩:আন-নাজম-৫২
وَ قَوۡمَ نُوۡحٍ مِّنۡ قَبۡلُ ؕ اِنَّہُمۡ کَانُوۡا ہُمۡ اَظۡلَمَ وَ اَطۡغٰی ﴿ؕ۵۲﴾
তাদের পূর্বে তিনি নূহের কওমকে ধ্বংস করেছেন। কারণ, তারা আসলেই বড় অত্যাচারী ও অবাধ্য লোক ছিল।
সূরা:৫৩:আন-নাজম-৫৩
وَ الۡمُؤۡتَفِکَۃَ اَہۡوٰی ﴿ۙ۵۳﴾
তিনি উৎপাটিত আবাস ভূমিকে উল্টিয়ে দিয়েছিলেন।
সূরা:৫৩:আন-নাজম-৫৪
فَغَشّٰہَا مَا غَشّٰی ﴿ۚ۵۴﴾
তারপর ওকে আচ্ছন্ন করল যা আচ্ছন্ন করার।
সূরা:৫৩:আন-নাজম-৫৫
فَبِاَیِّ اٰلَآءِ رَبِّکَ تَتَمَارٰی ﴿۵۵﴾
সুতরাং তুমি তোমার প্রতিপালকের কোন অনুগ্রহ সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করবে?
সূরা:৫৩:আন-নাজম-৫৬
ہٰذَا نَذِیۡرٌ مِّنَ النُّذُرِ الۡاُوۡلٰی ﴿۵۶﴾
অতীতের সতর্ককারীদের ন্যায় এও একজন সতর্ককারী।
সূরা:৫৩:আন-নাজম-৫৭
اَزِفَتِ الۡاٰزِفَۃُ ﴿ۚ۵۷﴾
কিয়ামত আসন্ন।
সূরা:৫৩:আন-নাজম-৫৮
لَیۡسَ لَہَا مِنۡ دُوۡنِ اللّٰہِ کَاشِفَۃٌ ﴿ؕ۵۸﴾
আল্লাহ ছাড়া কেউই এটা প্রকাশ করতে সক্ষম নয়।
সূরা:৫৩:আন-নাজম-৫৯
اَفَمِنۡ ہٰذَا الۡحَدِیۡثِ تَعۡجَبُوۡنَ ﴿ۙ۵۹﴾
তাহলে কি এসব কথা শুনেই তোমরা বিস্ময় প্রকাশ করছো?
সূরা:৫৩:আন-নাজম-৬০
وَ تَضۡحَکُوۡنَ وَ لَا تَبۡکُوۡنَ ﴿ۙ۶۰﴾
আর হাসি-ঠাট্টা করছ ! এবং কাঁদছো না ?
সূরা:৫৩:আন-নাজম-৬১
وَ اَنۡتُمۡ سٰمِدُوۡنَ ﴿۶۱﴾
তোমরা তো উদাসীন।
সূরা:৫৩:আন-নাজম-৬২
فَاسۡجُدُوۡا لِلّٰہِ وَ اعۡبُدُوۡا ﴿٪ٛ۶۲﴾
অতএব তোমরা আল্লাহকে সিজদা কর এবং তাঁর ইবাদত কর।
(সিজদার আয়াত:-)

৪৩-৬২ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
ফী জিলালিল কুরআন:

*মানব জীবনে আল্লাহর ইচ্ছার প্রতিফলন : এরপর পার্থিব জীবন যাপন কালে আখেরাতের এ চিন্তা তার অন্তর ও মন-মগযের মধ্যে এমন এক আবর্তন সৃষ্টি করবে যে, সে প্রতিনিয়ত ও সর্বাবস্থায় জীবনের সর্ব পর্যায়ে আল্লাহর সন্তুষ্টিপ্রাপ্তির চিহ্ন নিজের মধ্যে দেখতে আকাংখী হয়ে যাবে। এই প্রেক্ষাপটেই এরশাদ হচ্ছে, ‘আর তিনিই হাসান এবং তিনি কাদান’, অর্থাৎ হাসানাের কাজ যেমন তিনি করেন, তেমনি কাদানাের ক্ষমতাও তার হাতে। এ আয়াতের আওতায় বহু রহস্য লুকিয়ে আছে এবং এর মধ্যে বিভিন্ন প্রেরণা উদ্রেককারী কথা মেলে যা হৃদয়-মনের ওপর গভীরভাবে রেখাপাত করে। তাই, সে কথাগুলাে যেমন মানুষকে হাসতে সাহায্য করে, তেমনি আখেরাত-ভীতি মানুষের মধ্যে ক্রন্দনও সৃষ্টি করে। এই দুটি কাজই মানুষের মধ্যে তীব্র অনুভূতির বহিপ্রকাশ। এ দুটি অবস্থাই মানব-সৃষ্টির মধ্যে প্রচ্ছন্ন রহস্যময় এমন কিছু বৈশিষ্ট্য যার সম্পর্কে কেউ জানে না কেমনভাবে এবং কখন এ অবস্থা সংঘটিত হবে, অর্থাৎ কখন কিভাবে হাসি-কান্নার সৃষ্টি হবে তা নির্দিষ্ট করে বলা কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। কখনও এই হাসি-কান্নার জন্যে বড় কোনাে কারণের প্রয়ােজন হয় না, মানসিক উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার দরুন তার অংগ-প্রত্যংগের মধ্যে এমন কিছু চাপ সৃষ্টি হয় যার কারণে সে হাসে বা কাঁদে, আবার কোনাে কোনাে সময় অনেক বড় বড় কারণেও হাসি বা কান্নার উদ্রেক করে না। এই জন্যেই বলা হয়েছে, তিনিই হাসান এবং তিনিই কাদান। আল্লাহ তায়ালাই মানুষের মধ্যে হাসি ও কান্নার প্রেরণাসমূহ পয়দা করে দিয়েছেন এবং হাসি-কান্নার উদ্রেক তিনিই করান মানুষের আভ্যন্তরীণ গুপ্ত ও রহস্যময় আবেগ-উৎকণ্ঠার ভিত্তিতে। তাই কোনাে কারণে কখনও সে হাসে আবার অন্য কারণে কখনও সে কাঁদে। আবার দেখা যায় যে কারণে আজকে সে কাঁদছে, সেই একই কারণে পরের দিন সে হাসছে। আবার আজকে যে কারণে সে হাসছে, সেই একই কারণে পরের দিন সে কাঁদছে। এটা কোনাে পাগলামি বা ভুলের কারণে নয়। এর পেছনে মানুষের পরিবর্তনশীল মানসিকতাই ক্রিয়াশীল। আর বিভিন্ন মূল্যায়নবােধ, আবেগ-উৎকণ্ঠা আনয়নকারী নানাপ্রকার অনুভূতি, প্রতিরােধও বিবেচনাশক্তি মানুষের মধ্যে স্থায়ীভাবে এক রকম থাকে না। তিনিই হাসান, আর তিনিই কাদান’… আবার এমনও হয় যে, একই সময় পর্যায়ক্রমে তিনি মানুষকে হাসান ও কাঁদান। এসবই সম্ভব হয় বাস্তব অনুভূতির তারতম্যের কারণে। আবার এমনও দেখা যায়, কোনাে ব্যাপারে একদল লােক হাসছে, কিন্তু এ একই ব্যাপারে আর এক লােক কাঁদছে। কারণ ব্যাপারটি হয়তাে কারাে জন্যে একটি চমকপ্রদ ঘটনা, আবার হয়ত অপরের জন্যে দুর্ঘটনা। কেউ হয়তাে এ ঘটনাকে আলিঙ্গন করতে পারছে, আবার অপর কেউ ঐ ঘটনা থেকে অনেক দূরে সরে যেতে চাচ্ছে। ‘তিনিই হাসান এবং তিনিই কাদান।’ আজকে দেখা যাচ্ছে, একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে কোনাে ব্যক্তি হাসছে, কিন্তু যখন এ ঘটনার কুফল সে পরবর্তী কালে দেখছে তখন সে কাদছে। সে কামনা করছে, যদি কাজটি না হতাে এবং এ কাজে সে খুশী প্রকাশ করতে গিয়ে না হাসতাে। আর এইভাবেই দুনিয়ায় আজ কতজন হাসছে, যারা আখেরাতে কাঁদতে থাকবে, কিন্তু সে কান্না সেদিন কোনাে কাজে লাগবে না। এই সব বিভিন্ন চেহারা, প্রতিবিম্ব, অনুভূতি ও বিভিন্ন অবস্থা এবং আরও বহু জিনিস এই ছােট আয়াতটি থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে যা অনুভূতি ও চেতনার কাছে স্পষ্টভাবে ফুটে উঠছে, যা আত্মার মুক্তির পথে উল্লেখযােগ্য ভূমিকা রাখে এবং যতই বিভিন্ন অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে আখেরাতের এ চিন্তা মানুষের মধ্যে বৃদ্ধি পেতে থাকে, ততই আখেরাতের ভয়ংকর সংকট থেকে নাজাতের পথে সে এগিয়ে যায় এবং তার মধ্যে হাসা ও কাঁদার আবেগগুলাে নিত্য নতুনভাবে ক্রিয়াশীল হতে থাকে, আর কোরআনে বর্ণিত বহু অবস্থার মধ্যে আখেরাতের এ চিত্রটি এক বিশেষ মাে’যেজা হিসাবে কাজ করে।
ফী জিলালিল কুরআন:

*জীবন মৃত্যুর চূড়ান্ত ফয়সালা আল্লাহর হাতে : ‘আর তিনিই মৃত্যু দান করেন এবং তিনিই জীবিত করেন।’ এমনি করে কালামে পাকের এই আয়াতগুলাে হৃদয়ানুভূতিকে সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্যে অত্যন্ত বলিষ্ঠভাবে কাজ করে। ‘তিনিই মারেন এবং তিনিই যিন্দা করেন’-কথাটি দ্বারা বুঝানাে হচ্ছে যে তিনিই মৃত্যু দান করার ও জীবন দেয়ার কাজের সূচনা করেছেন। যেমন অন্য আয়াতে বলা হচ্ছে, ‘(মহান আল্লাহ সেই সত্তা) যিনি সৃষ্টি করেছেন মৃত্যুকে এবং জীবন দান করেছেন। এ দুটি অবস্থার অভিজ্ঞতা বারবার হওয়ার ফলে সাধারণভাবে এ দুটি অবস্থাকে মানুষ ভালভাবেই বুঝেছে। এতদসত্তেও এটা বাস্তব সত্য কথা যে, মানুষ যখন এ দুটি অবস্থার প্রকৃতি এবং গোপন রহস্য বুঝার চেষ্টা করে, তখন অবস্থা দুটি এক অজানা রহস্য হিসেবেই থেকে যায় (অনুভব করলেও সুনির্দিষ্টভাবে বুঝা সম্ভব হয় না)। মৃত্যু কি? জীবনই বা কি? এ দুটি অবস্থার তাৎপর্যই বা কি? এ দুটি অবস্থার চেহারা কি এবং প্রকৃতিই বা কি! এই আংগিকে যখন মানুষ গবেষণা চালায়, তখন তার চিন্তার খেই হারিয়ে যায়। কি ভাবে মৃদু-মন্দ গতিতে সৃষ্টিজগতে জীবন পদার্পণ করলাে। সে জীবন কি? কোত্থেকে এলাে এবং কেমনভাবেই বা সৃষ্টির আবরণের মধ্যে ধরা দেয়ায় সে যিন্দা হয়ে গেল? আর কেমনভাবেই বা এই সৃষ্টির মাঝে সে বিচরণ করে বেড়াচ্ছে অথবা জীবন্ত সৃষ্টির সবার মাঝে পরিভ্রমণরত রয়েছে? মৃত্যুই বা কি? জীবনের আগমনের পূর্বে মৃত্যু কিভাবে ছিলাে এবং জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর কিভাবে বিরাজ করবে-এ সব কিছুর রহস্য পর্দার অন্তরালে একমাত্র আল্লাহ তায়ালার হাতেই নিহিত। মৃত্যু দান করলেন এবং তিনি যিন্দা করলেন। একথার লক্ষ কোটি অর্থ হতে পারে, অর্থাৎ একই মুহূর্তে কোটি কোটি ধরন ও উপায়ে জীব জগতে মৃত্যু আসতে পারে ও জীবনের উন্মেষ ঘটতে পারে। একই মুহূর্তে কোটি কোটি মৃত্যু সংঘটিত হয়, আবার ঐ একই মুহূর্তেই কোটি কোটি জীবন বাস্তবে আসে। এর মধ্যে যে রহস্য রয়েছে তা আল্লাহ পাক ব্যতীত আর কেউ জানে না। আবার এমনও দেখা যায়, বহু মৃত্যুর কারণে আরও বহু জীবন বাস্তবে আসে। যুগে যুগে এর বিস্তর দৃষ্টান্ত মানুষের সামনে এসেছে যা দূর অতীতে ঘটেছে এবং মানুষের স্মৃতির মণিকোঠায় সংরক্ষিত রয়েছে। স্মরণাতীত কাল থেকে এইভাবে মৃত্যু এসেছে, আবার নতুন নতুন জীবনও এসেছে। পৃথিবী নামক এ গ্রহে মানব সৃষ্টির বহু পূর্ব থেকে এমন জীবন এসেছে ও মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছে। এ গ্রহ ব্যতীত আরও যেসব গ্রহ-উপগ্রহ সৃষ্টির বুকে রয়েছে, সেসবের মধ্যে কত জীবন আছে এবং কত মৃত্যু এসেছে সে সবের কথা হিসাব নাই-ই বা করলাম, কারণ তাদের সম্পর্কে মানুষের পক্ষে জানা সম্ভব নয়। (এখন অবশ্য পৃথিবী ছাড়া একাধিক গ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব রয়েছে বলে অনেকেই মনে করছেন, তবে একথা কতােটুকু সত্য তা আগামী কালের আবিষ্কার উদ্ভাবনের মাধ্যমেই জানা যাবে।-সম্পাদক) এসব জীবন-মৃত্যুর অসংখ্য ঘটনা জগতে ঘটেছে যার বিবরণ দেয়ার মতাে ভাষা বা কথা আমাদের কাছে নেই। সেসব চিন্তা করতে গেলে মানুষের হৃদয় গভীর আবেগে প্রকম্পিত হতে থাকে, কিন্তু সেসব ঘটনার পরিমাপ করা বা কল্পনার নেত্রেও সেসব দৃশ্য দেখা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়।
ফী জিলালিল কুরআন:

*আল্লাহ তায়ালার জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি : ‘আর তিনি একটি মাত্র শুক্রবিন্দু থেকে নর-নারীর জোড়া পয়দা করেন যখন তা (শুক্রবিন্দু লাফিয়ে লাফিয়ে) নির্গত হয়।’ জীবন সৃষ্টির এ বিরাট কাজ প্রতি মুহূর্তেই উপর্যুপরি সংঘটিত হয়ে চলেছে। বারবার নযরের সামনে ঘটতে দেখে এর গুরুত্ব, অভিনবত্ব এবং বৈচিত্র মানুষ ভুলে যায়। অথচ একটু খেয়াল করলেই মানুষ বুঝতে পারবে, যত জিনিস সম্পর্কেই মানুষ চিন্তা করুক না কেন তার মধ্যে এটিই হচ্ছে সব থেকে বড় আশ্চর্যজনক রহস্য। নুৎফাতুন তুমনা-অর্থ শুক্রকোষ থেকে শুক্র বীজকে স্থানচ্যুত করা হয় বা স্খলিত করা হয় । এ স্খলন হচ্ছে ঠিক তেমনি যেমন শরীরের মধ্য থেকে ঘাম, অশ্রু, শিকনি ইত্যাদি বেরিয়ে আসে। এ বস্তুটি আল্লাহর ক্ষমতার রশিতে নিয়ন্ত্রিত এক নির্দিষ্ট বিরতির ব্যবধানে স্খলিত হয়। তারপর কি হয়। তারপর এই অতি তুচ্ছ ও সূক্ষ বস্তুটি রূপ নেয় একটি পূর্ণাঙ্গ মানুষের। আর এই মানুষের মধ্যে কেউ হয় পুরুষ এবং কেউ হয় নারী! কেমন করে এটা হয়? এই মণি নির্গত হওয়ার কাজ সংঘটিত না হলে কেমন করে সেই আশ্চর্যজনক মানুষ বাস্তবে আসতাে? কেমন করে এই শক্ত ও সুগঠিত মানুষের অস্তিত্ব চিন্তা করা যেত, কি করেই বা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গুলাের এমন সুদৃঢ় বন্ধন সম্ভব হতাে! কোথায় লুকিয়ে ছিলাে এই মানুষটি শুক্রবীজের কোন্ সূক্ষাতিসূক্ষ বিন্দুতে? হাঁ এক ফোটা শুক্র বীজের মধ্যে কোটি কোটি শুক্র-কীটের কোনাে একটির মধ্যে নিহিত ছিলাে আজকের এই পূর্ণাঙ্গ মানুষটি! কোথায় লুক্কায়িত ছিলাে সে হাড়, মাংস ও চামড়ার মধ্যে, আচ্ছাদিত ছিলাে শিরা-উপশিরা চুল ও নখের ভিতর। পথে-ঘাটে, নানা বর্ণের পােশাকের আবরণে ও যুদ্ধ ক্ষেত্রে, আচার-ব্যবহার, স্বভাব-প্রকৃতি ও যােগ্যতার বিকাশের ক্ষেত্রে? লুকিয়েছিলাে কোন সে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম কোষের মধ্যে যা একমাত্র অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যেই পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব এবং যা এক ফোটা শুক্রের মধ্যে কোটি কোটি সংখ্যায় বিচরণশীল? সেই সব কোষের মধ্যে পুরুষ ও নারী বৈশিষ্ট্য নিয়ে সে বিরাজ করছিলাে কোথায়, কোন সে গােপন আবাসস্থলে। হাঁ, আবর্তন চক্রের সমাপ্তি পর্যায়ে সেই জীবন্ত কীট এসে গর্ভাশয়ে স্থির হলাে এবং ভ্রুণ আকারে আত্মপ্রকাশ করলো। যে কোনাে মানব-হৃদয় এই মহা বিস্ময়কর সত্যের মুখােমুখি দাঁড়াবে, আত্মনিয়ন্ত্রণ করবে এবং আল্লাহর দিকে মন রুজু করবে, সে কিছুতেই আখেরাতকে অস্বীকার করতে পারবে না এবং অহংকারও করতে পারবে না। অবশ্যই সে বলে উঠবে হাঁ, এইভাবেই সৃষ্টিকুল বাস্তবে এসেছে এবং এইভাবেই একই নিয়মে সবখানে শান্তি বিরাজমান রয়েছে। অতপর প্রাকৃতিক এসব দৃশ্য থেকে শিক্ষা নিতে গিয়ে সে বলবে, যে মহান স্রষ্টা এইভাবে সৃষ্টিলােককে বাস্তবে এনেছেন, তিনি অবশ্যই মানব জাতিকে পুনরায় জীবিত করতে সক্ষম-অন্যান্য প্রাণী যাদেরকে এই একই প্রকারের জীবন দেয়া হয়েছে, তার জন্মগতভাবে এসব যােগ্যতাপ্রাপ্ত, এজন্যে পুনরায় এর ব্যাখ্যা প্রয়ােজন। এইভাবে সৃষ্টি রহস্যের কোনাে একটি রহস্য যখন কারাে সামনে উদঘাটিত হয়ে যায়, তখন পরবর্তী বহু রহস্য ভান্ডারের দ্বারও তার সামনে উন্মােচিত হতে থাকে। কে সেই মহান সত্তা, যিনি এই সত্য উদ্ঘাটনের ক্ষমতা দান করেছেন, এ মানব শ্রেণীকে পুনরায় জীবিত করে সংরক্ষণের জন্যে কে গােপন প্রেরণা সৃষ্টি করলাে? দুর্বল ও অক্ষম হয়ে যাওয়ার পর কে তাকে পুনরায় শক্তি যােগায়? কে তাকে চলার জন্য সত্য সঠিক পথ বাতলে দিয়েছে এবং সেই পথে চলার জন্যে তার মধ্যে সুপ্ত এক আগ্রহ কে রেখে দিয়েছে। কে সেই মহান সত্তা যিনি মানব শ্রেণীর জন্যে নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যসমূহ দিয়ে তাকে সম্মানিত করেছেন। সেসব বৈশিষ্ট্য সহ তাকে পুনরায় জীবিত করার এই আগ্রহ এবং এর গুরুত্বই বা কি? একাজ করার জন্যে তার ইচ্ছা, আগ্রহ ও নির্দেশ যদি না হতাে, তিনি যদি এটা না-ই দিতেন এবং এর জন্যে তিনি প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা যদি সৃষ্টি না-ই করতেন, তাহলে কি অবস্থা হতো? (এই সব নানাপ্রকার প্রশ্ন আমাদের মনে জাগে, যার কোনাে জওয়াব আমরা খুঁজে পাই না)

ফী জিলালিল কুরআন:

*পুনরুত্থান আল্লাহ তায়ালার একক ক্ষমতা : প্রথম জন্মগ্রহণ-যেহেতু অহরহ আমাদের সামনে এ ঘটনা ঘটছে, এজন্যে একে কেউ অস্বীকার করতে পারে না। কিন্তু পুনরায় জন্ম বা পুনরুত্থান হওয়ার ব্যাপারটি দৃষ্টির অন্তরালে থাকার কারণে সেই ব্যাপারে মানুষের মনােযােগ সরাসরি আকর্ষণ করা হচ্ছে। এরশাদ হচ্ছে, ‘এবং পুনরুত্থান ঘটানাের দায়িত্ব তারই।’ এই পুনরুত্থান রয়েছে অদৃশ্য ও আমাদের কাছে অজানা। কিন্তু সেই দিবসটির প্রমাণ হিসেবে আমাদের কাছে প্রথম জন্মগ্রহণ দিবসটি বর্তমান। পুনরুত্থান ঘটা কি সম্ভব তা প্রথম জন্ম লাভের ব্যাপারটি খেয়াল করলে বুঝতে পারি। যিনি পুরুষ ও নারীর জোড়াকে সেই শুক্রবিন্দু দিয়ে সৃষ্টি করেছেন যা স্খলিত (স্থানচ্যুত) হয়, তিনি হাড্ডি ও গলিত অবস্থার মধ্য থেকে পুনরায় অস্তিত্বে আনতে নিসন্দেহে সক্ষম। অবশ্যই হাড্ডি এবং চূর্ণ-বিচূর্ণ বা গলিত শবদেহ তাে তরল শুক্র-বিন্দু থেকে তুচ্ছ কোনাে পদার্থ নয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এ ব্যাপারটি প্রকৃত পক্ষে যে সংঘটিত হবে, তার প্রমাণ কি! এবং এর যৌক্তিকতা কিভাবে বুঝা যায়? জন্ম প্রক্রিয়ার এই যে ব্যবস্থা, পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে জানা গেছে যে, এটি একটি গােপন ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সংঘটিত হয়, এ ব্যবস্থাপনায় সূক্ষাতিসূক্ষ এক শুক্র-জীব কোষ এক দীর্ঘ ও জটিল পথ-পরিক্রমার পর পরিণত হয় পুরুষ, না হয় নারীর ভ্রুণে। এই ব্যবস্থার পথ-পরিক্রমা অবশ্যই সেই চলমান ও বিধ্বস্ত পৃথিবী থেকে অধিক কঠিন যার মধ্যে কোনাে কিছুই পূর্ণত্বপ্রাপ্ত হয় না এবং কোনাে এহসানকারী তার প্রতিদান পূর্ণ মাত্রায় পায় না। আর না কোনাে অন্যায়কারী তার পূর্ণ বদলা (শাস্তি) পেতে পারে। এই সকল বিষয়ে হিসাব-নিকাশ করলে পুনরুথান-দিবসের আগমন সম্পূর্ণভাবে যুক্তিসংগত। সুতরাং প্রথম জন্ম বা আগমন পুনরায় জন্ম হওয়ার যুক্তির সাথে ওতপ্রােতভাবে জড়িত। আর এই কারণেই পুনরুত্থান এর প্রথম আগমনের পূর্বে বর্ণনা করা হয়েছে। প্রথম জন্ম ও পরবর্তী উত্থান—এই দুই সময়েই আল্লাহ তায়ালা যাকে ইচ্ছা তাকে অভাবমুক্ত করেন এবং যাকে ইচ্ছা তাকে অভাবী রাখেন।
ফী জিলালিল কুরআন:

*ধনী নির্ধন সবই আল্লাহ তায়ালার হাতে : এরশাদ হচ্ছে, ‘তিনিই (মানুষকে) অভাবমুক্ত বানিয়েছেন, আবার তিনিই তাদেরকে অভাবী করেছেন।’ আল্লাহ পাক পৃথিবীতে তাঁর বান্দাহদের মধ্য থেকে যাকে ইচ্ছা বহু প্রকারের সচ্ছলতা দিয়েছেন। আর্থিক সচ্ছলতা দিয়েছেন, দিয়েছেন সুস্থতা ও স্বাস্থ্যের সৌন্দর্য এবং উত্তম সন্তানাদি। আরও দিয়েছেন ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও চিন্তার আযাদী। এর সাথে আরও দিয়েছেন আল্লাহ তায়ালার সাথে সম্পর্ক স্থাপনের প্রশস্ততা ও সেই পাথেয় যার কোনাে তুলনা নেই। তার বান্দাহদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা তাকে তিনি সচ্ছলতা দিয়েছেন, দিয়েছেন সবই যা দুনিয়ায় দেয়ার আছে। এমনি করে আখেরাতেও দেবেন তাকে যা কিছু তার প্রয়ােজন। সৃষ্ট জীব মাত্রই অভাবগ্রস্ত ও অন্তসারশূন্য। তারা নিজেদেরকে অভাবমুক্ত বােধ করতে পারে না এবং আল্লাহর ভান্ডার থেকে না পেয়ে অন্য কোনাে জায়গা থেকে কিছু পাওয়ারও আশা করতে পারে না। একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই তার যাবতীয় অভাব দূর করতে পারেন। এ সব হচ্ছে বাস্তব জীবনের এমন প্রয়ােজন যা তারা নিজেরা জানে এবং যা তাদের চোখগুলাে দেখে এবং তাদের অন্তর অনুভব করে, যাতে তারা একই মাত্র উৎস থেকে তাদের প্রয়ােজন মেটানাের পথ দেখতে পায় এবং সেই একই ভান্ডার থেকে তাদের যাবতীয় চাওয়া-পাওয়ার জন্যে রুজু করতে পারে কারণ অন্য সবাই সর্বতােভাবে অভাবী এবং নিঃস্ব। আর তিনিই হচ্ছেন শি’রা নামক নক্ষত্রের রব। আর শি’রা হচ্ছে এমন একটি নক্ষত্র যা সূর্য থেকে বিশগুণ ভারী এবং তার আলাে সূর্যের আলাে থেকে পঞ্চাশ গুণ বেশী। আর আমাদের এই পৃথিবী থেকে সূর্যের যে দূরত্ব সূর্য থেকে তার দূরত্ব আরও কোটি কোটি গুণ বেশী। আরবে অনেকে এই নক্ষত্রের পূজা করতাে এবং অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ জ্ঞানে এই নক্ষত্রটিকে দেখার জন্যে বহু লােক চেষ্টা-সাধনা করতাে। সুতরাং এ বিষয়ে আল্লাহর বক্তব্য হচ্ছে যে, সে শি’রার রবও আল্লাহ রব্বুল ইযযত এবং এই অস্তমিত নক্ষত্রের কসমই দেয়া হয়েছে আলােচ্য সূরার শুরুতে। এ সূরা আরও জানাচ্ছে যে ঊর্ধাকাশে অবস্থিত এক বিশেষ জগতে অবশেষে সবাইকে যেতে হবে, যেমন তাওহীদ-বিশ্বাসের লক্ষ্য এই একই আখেরাতের জীবন-লাভ এবং শিরক-এর নিরর্থক ও মনগড়া দাবী প্রত্যাখ্যান। এরই সাথে শেষ হচ্ছে মানুষের নিজের মধ্যে ও গগনবিদারী দৃশ্যাবলীর মধ্যে অবস্থিত অসংখ্য রহস্যরাজির ওপর এ সংক্ষিপ্ত আলােচনা। এরপর আমরা পশ্চাৎপন্থীদের আচরণ সম্পর্কে কিছু আলােচনা করতে চাই। এসব লােকেরা যুগে যুগে সতর্ককারী নবীদের আগমনের পর তাদের প্রত্যাখ্যান করেছে, যেমন তাদেরকে মােশরেকরা প্রত্যাখ্যান করতে দেখেছে এবং তাদেরকে মিথ্যাবাদী বলেও আখ্যায়িত করেছে। নবীদের প্রেরণ ও তাদের মাধ্যমে আল্লাহর বাণী পৃথিবীবাসীর কাছে পৌছানাে-এ এমন একটি ক্ষেত্র যেখানে আল্লাহর কুদরত ও ইচ্ছাসমূহ এক এক করে ইতিপূর্বে যুগের পর যুগ ধরে মানুষকে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে।

ফী জিলালিল কুরআন:

*ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতিসমূহের পরিণতি : তিনিই প্রথম আ’দ জাতিকে ধ্বংস করে দিয়েছেন, ধ্বংস করেছেন সামূদ জাতিকেও এবং তাদের মধ্য থেকে কেউই রেহাই পায়নি। ধ্বংস করেছেন ইতিপূর্বে নূহ(আ.)-এর জাতিকেও। তারা ছিলাে আরও বড় যালেম এবং আরও কঠিন বিদ্রোহী এবং মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা বস্তি ওপরে তুলে নিক্ষেপ করেছেন, তারপর তাকে ঢেকে দিয়েছেন পুরােপুরিভাবে। এখন বলল, তােমরা তােমাদের রবের কোন সে নেয়ামত সম্পর্কে বিতর্ক করছো? মহাকালের মধ্যে (দুনিয়ার এ জীবন) দ্রুতগতিতে অতিক্রমশীল এ এক নিদারুণ সফর। বিশাল এ সফরের ক্ষেত্রে প্রত্যেক জাতি কিছু দিনের জন্যে সাময়িকভাবে অবস্থান করার জন্যে এক সুযােগ পায় যখন সে অপরকে কঠিনভাবে আঘাত করে। এ আঘাত চেতনাকে ভীষণভাবে ঘায়েলও করে। আবারও আ’দ, সামূদ ও নূহ(আ.)-এর জাতির কথা উল্লেখ করছি। এদের সম্পর্কে কোরআনের পাঠকরা ভালভাবেই কোরআনের বিভিন্ন জায়গায় জানতে পেরেছে। মুতাফিকাত বলতে লুত জাতিকে বুঝানাে হয়েছে। এদেরকে যেসব কারণে ধ্বংস করা হয়েছিলাে তা ছিলাে-মিথ্যা, মিথ্যা দোষারােপ এবং ইচ্ছাকৃতভাবে ভুল পথে চলা। এসব অপরাধ তাদেরকে অতলান্ত হাবিয়া দোযখের দিকে নিক্ষেপ করেছে এবং তাদেরকে যমীনের বুকে ধসিয়ে দিয়েছে। ‘সুতরাং ঢেকে ফেলেছে তাদেরকে পৃথিবী পুরাপুরি এমনভাবে যে, আজ তাদের কোনাে নাম-নিশানা ও অবশিষ্ট নেই।’ এককালে পৃথিবীতে তারা এতাে শক্তিমান জাতি থাকা সত্তেও এমনভাবে মানুষ তাদেরকে আজ ভুলে গেছে যে, কেউ তাদেরকে স্মরণ করে না, তাদের কথা উল্লেখও করে না। তবু, (মানুষের শিক্ষার জন্য) তাদেরকে যেসব এলাকায় ধ্বংস করা হয়েছিলাে এবং ধসিয়ে দেয়া হয়েছিলাে, সেখানকার ধ্বংসাবশেষ এখনও মানুষের জন্যে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। তাদের শাস্তির এ চিহ্নগুলাে দুনিয়াবাসীকে এখনও জানায় শক্তির বড়াই করলে এমনি করে পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত করে দেয়া হবে এবং কখনও মাথা তােলার সুযােগ থাকবে না। সুতরাং আল্লাহ তায়ালার কোনাে নেয়ামতকে নিয়ে তােমরা তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত হচ্ছো?’ যেসব বিষয়ে আল্লাহ পাক তাদেরকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়েছেন তার মূল কথা হচ্ছে, শক্তি-সামর্থ এবং যাবতীয় নেয়ামত ও শ্রেষ্ঠত্ব যে আল্লাহর তা তারা অস্বীকার করে নিজেদেরকেই শক্তিমান বলে ঘােষণা দিয়েছিলাে এবং নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে সর্বপ্রকার যুলুম চালিয়েছিলাে। তাই আল্লাহ পাক জানান, তিনি কি এসব অন্যায়কারীকে ধ্বংস করেননি। তিনি কি মিথ্যার ওপর সত্যকে বিজয়ী করেননি। এইভাবে অপ্রমাণিত করেননি তাদের দাবীকে। ফলে তারা ধ্বংস্তুপে পরিণত হয়েছে! যারা চিন্তা করে এবং শিক্ষা নিতে চায়, তাদের জন্য আল্লাহর শক্তি-ক্ষমতা জানার বহু নিদর্শন এইসব ধ্বংসাবশেষের মধ্যে রয়েছে। মানুষকে শিক্ষাদান করার ব্যাপারে এসব কি আল্লাহর বিভিন্ন নেয়ামত নয়? সুতরাং, আল্লাহ তায়ালার কোন্ কোন্ নেয়ামতের ব্যাপারে তােমরা বিতর্ক চালাচ্ছাে? একথার সম্বােধন করা হয়েছে সবার জন্যে। প্রত্যেক অন্তর ও প্রত্যেক চিন্তাশীল লােকের জন্যে, যারা আল্লাহর সৃষ্টির শিল্প-নৈপূণ্য সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করে এবং সবখানেই আল্লাহর অসংখ্য নেয়ামত দেখতে পারে। এমনকি নানা প্রকার বিপদের মধ্যেও তার নেয়ামতের সন্ধান তারা পায়। আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছা ও মানুষের ওপর এবং দিগন্তবলয়ে বিস্তৃত আল্লাহর ইচ্ছার বহিপ্রকাশগুলােকে সামনে নিয়ে মানুষের চিন্তা করা দরকার চরম মিথ্যাবাদী ও নবীদেরকে প্রত্যাখ্যানকারী প্রাচীন এসব জাতি ও তাদের তৎপরতা সম্পর্কে। তাহলে অবশ্যই আমাদের মধ্যে গভীর চিন্তা জাগবে সত্য সঠিক পথ গ্রহণ করার জন্যে এক মনােবল সৃষ্টি হবে। প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী ও চলমান ঘটনাসমূহ মহাপ্রলয় সংঘটিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এক মহা-বিপদ-সংকেত হিসেবে আমাদের মন-মগজকে আন্দোলিত করতে থাকবে। তাই, আল্লাহর পক্ষ থেকে ঘােষণা আসছে, ‘এ মহান নবী হচ্ছে অতীতে আগত অন্যান্য সতর্ককারী (নবীদের) ন্যায় একজন সতর্ককারী। মহাপ্রলয় (কেয়ামত) আগতপ্রায়। (যখন তা এসেই পড়বে, তখন) আল্লাহ ব্যতীত ঐ ভয়ানক বিপদকে কেউ দূর করতে পারবে না।’ এই যে রসূল (তােমাদেরকে সতর্ক করে চলেছেন), তার রসূল হওয়ার প্রশ্নকে কেন্দ্র করে তােমরা নানাপ্রকার বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছো এবং তিনি প্রকৃতপক্ষে সতর্ককারী রসূল কিনা এ বিষয়ে তােমরা কি নানা ধরনের তর্ক করছে?-এ বিষয়ে জেনে নাও, অবশ্যই সে পূর্বে আগত অন্যান্য নবী রসূলদের মতই একজন সতর্ককারী রসূল। অন্যান্য-নবী রসূল যে শিক্ষা নিয়ে এসেছিলেন এবং আখেরাত সম্পর্কে যে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিলেন, এ রসূলও সেই একই দায়িত্ব নিয়ে আগমন করেছেন। আর অবশ্যই কেয়ামত হওয়ার দিন নিকবর্তী হয়ে গেছে। সেই দিন শীঘ্র সমাগত হওয়ার সময় এসে গেছে যখন সব কিছুকে ভীষণ ঝড়ের বেগে চালিত করা হবে। সেই দিনটিতেই হবে মহা প্রলয় এবং সেই মহা ধ্বংস সম্পর্কেই এই সতর্ককারী তােমাদেরকে সে বিষয়ে হুঁশিয়ার করছেন, অথবা সে এমন এক আযাবের সন্ত্রাস যার প্রকৃতি আল্লাহ তায়ালা ব্যতীত আর কেউ জানে না এবং যাকে নিয়ন্ত্রণ করা অথবা থামিয়ে দেয়ার মালিক একমাত্র আল্লাহ পাক। এজন্যেই বলা হয়েছে, ‘তা দূর করার ক্ষমতা আল্লাহ তায়ালা ছাড়া কারও নেই।’
ফী জিলালিল কুরআন:

*হাসি কান্নার আসল রহস্য : হঠাৎ করে এ মহা বিপদ আসার সময় অতি আসন্ন এবং পরম দয়ালু উপদেশদাতা নবীও মুক্তির দিকে আহ্বান জানাছেন। তখন তােমাদের অবস্থা হবে এই যে, তােমরা পেরেশান হয়ে মাতালের মতাে টলতে থাকবে এবং কোনাে স্থানে স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারবে না। এ অবস্থা কিছুতেই দূর হবে না। এ প্রসংগে এরশাদ হচ্ছে, ‘কি ব্যাপার, একথায় কি তােমরা খুবই আশ্চর্য হচ্ছাে? হাসছাে? একটুও কাদছাে না? বরং উপহাস-বিদ্রুপ করছো?’ একথাগুলাে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যা অধিকাংশ মানুষের ওপর প্রযােজ্য। একথাগুলাে সম্পর্কে চিন্তা করা সবারই কর্তব্য এবং বর্তমান একথাগুলাের মাধ্যমে তাদেরকে একটি পূর্ণাঙ্গ কথার দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। অতএব, কোন জিনিসের কারণে তারা আশ্চর্য হচ্ছে এবং কোন কথার ওপর তারা হাসছে। অপরদিকে রয়েছে আল্লাহর বেশ কিছু অনুগত বান্দাহ, তারা মহা সৌভাগ্যবান। পৃথিবীর বুকে বসবাস করার সময়েই তারা আশা করে যে, একদিন তাদের সমুদয় কাজের হিসাব দিতে হবে। তারা দুনিয়ার এ যিন্দেগীতে কান্নাকাটি করে সেই ভয়ানক দিনে মুক্তির প্রয়াসে। তাই, সেদিন ভয়ানক আযাবের দৃশ্যের পাশাপাশি এরা মুক্তি লাভ করে সৌভাগ্যবান হবে। এখানের একথাগুলাে যেন চাপা স্বরে তাদেরকে পরকালের কথা স্মরণ করিয়ে যাচ্ছে, তাদের কান ও অন্তরের মধ্যে তার নিজস্ব স্বরে ঘােষণা করছে এবং ভীষণভাবে নাড়া দিয়ে তাদের নিজ অস্তিত্বের কথা স্মরণ করার জন্যে প্রেরণা যােগাচ্ছে। তবু তারা ধ্বংসের দিকেই এগিয়ে চলেছে। তাই, তাদেরকে আহবান জানানাে হচ্ছে, ‘সেজদা করাে আল্লাহর এবং একমাত্র তাঁরই সার্বিক আনুগত্য কর’। এই প্রসংগে এ আহবান এমন একটি আওয়ায বান্দার মনে প্রচণ্ড কম্পন সৃষ্টি করে এবং অন্য সব কিছু থেকে তাকে উদাসীন করে দেয়। আর এই ‘তাফসীর ফী যিলালিল কোরআন’-এর মধ্যে এক দীর্ঘ ভূমিকার পর এমন কিছু কথা পেশ করা হয়েছে যা হৃদয়কে সত্যিই গভীরভাবে আন্দোলিত করে। এরই ফলে এ আয়াতটি যখন পঠিত হলাে তখন সেইসব মােশরেক, যারা কোরআন ও ওহীর সত্যতা সম্পর্কে তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত ছিলাে, যারা আল্লাহ ও রসূল-এর ব্যাপারে ঝগড়া করছিলাে, তারা সবাই একযােগে সেজদায় পড়ে গেল। এই সূরার মধ্যে মােহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ(স.)-এর মুখ দিয়ে কেয়ামতের ঐসব ভয়াবহ বিবরণ বেরুনোর সাথে সাথে তারা সেজদায় পতিত হলাে। উপস্থিত এসব লােকের মধ্যে মুসলমান ও মােশরেক উভয় শ্রেণীর মানুষই বর্তমান ছিলো। কোরআনের এই তেজোদীপ্ত বাণীর সামনে তারা স্থির থাকতে অক্ষম হয়ে গেলাে। কোরআনের এই ক্ষমতার কাছে তারা নিজেদের অজান্তেই পরাজয় বরণ করে সেজদায় পড়ে গেছে। বেশ কিছু সময় ধরে সেজদায় পড়ে থাকলাে। দীর্ঘ সময় ধরে এই সেজদায় অতিবাহিত করার পর তারা মখন মাথা তুললাে, তখন সেজদায় থাকাকালে যেমন আত্মহারা অবস্থায় ছিলাে তেমনি আত্মহারা অবস্থায় দীর্ঘক্ষণ ধরে তারা বসে থাকলো। এই বিবরণ মােতওয়াতের হাদীসের মাধ্যমে জানা যায় । তারপর এই ঘটনার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে নানা কথা এসেছে। আসলে এটা কোনো আশ্চর্যজনক ঘটনা ছিলাে না। এ ছিলাে আল-কোরআনের এক বিশেষ মােজেযা, যা হৃদয়ের ওপর এমন প্রবল প্রভাব বিস্তার করেছিলাে! এ ঘটনাটি এত রেওয়ায়েতের মাধ্যমে জানা গেছে যা ভুল বলে মন মানতে চায় না। মুসলমানদের সাথে মােশরেকরা সেজদায় পড়ে। এর পেছনে কি কারণ জানার জন্যে আমার খুবই আগ্রহ হলাে। কোনাে বিশেষ হৃদয়গ্রাহী অভিজ্ঞতা এ বিষয়ে আসার পূবেই আমি নিজেই কিছু নির্ণয় করেছি এবং আমার কাছে তা খুবই স্পষ্ট ও যুক্তিসংগত মনে হয়েছে।  *একটি হাদীস ও তার ব্যাখ্যা : ‘হাদীসে গারানীক’ নামে পরিচিত মিথ্যা ও বানােয়াট এ রেওয়ায়েতটি আমি নিজে পড়েছি, যা ইবনে সা’দ তার ‘তাবাকাত’ নামক পুস্তকে বর্ণনা করেছেন এবং ইবনে জরীর আত্তাবারী-রচিত ইতিহাসেও উল্লেখ করেছেন। কোনাে কোনাে মােফাসসেরও আল্লাহর বাণী-‘আমি তােমার পূর্বে যে কোনাে নবী-রসূল প্রেরণ করেছি, সে নবী বা রসূল যখনই কোনাে আকাংখা পেশ করেছে, শয়তান তার আকাংখার মধ্যে নিজের কিছু কথা ঢুকিয়ে দিয়েছে। অতপর, শয়তানের আনীত সে কথাগুলােকে আল্লাহ পাক নাকচ করে দিয়েছেন এবং আল্লাহ তায়ালা তার নিজের কথাগুলাে মযবুত ও নিসন্দেহ বানিয়ে দিয়েছেন।’ এ রেওয়ায়াতগুলাে সম্পর্কেই ইবনে কাছীর কিছু সুন্দর তথ্য পেশ করে বলেছেন (আল্লাহ পাক তাকে নেক প্রতিদান দিন), এ রেওয়ায়েতগুলাের সবগুলােই হচ্ছে মুরসাল যার সহীহ হওয়ার কোনাে নিশ্চয়তা নেই। এ রেওয়ায়েতগুলাে অধিকাংশ খুব বিস্তারিত কিছু সংখ্যক মিথ্যা ও বানােয়াট কথায় ভরা যা রসূল(স.)-এর কথা বলে চালানাে হয়েছে। ইবনে আবি হাতেমের রেওয়ায়াতে বলা হয়েছে, সূরায়ে নাজম যখন নাযিল হয়, তখন মােশরেকরা বলছিলাে, এ লােকটি যদি আমাদের মাবুদ দেবতাদের সম্পর্কে কিছু ভাল কথা বলতাে, তাহলে তাকে ও তার সংগী-সাথীদেরকে আমরা অবশ্যই মেনে নিতাম। কিন্তু ইহুদী-নাসারাদের মধ্যে যেসব লােক তার আনীত এই নতুন ব্যবস্থাকে মানছে না, তবু তাদেরকে তাে এলােকটি এভাবে নিন্দা করে না বা গালিও দেয় না যেমন আমাদের দেব-দেবতাদের নিন্দা করে। অথচ, বাস্তব অবস্থা হচ্ছে এই যে, রসূলুল্লাহ(স) এবং তার সাহাবারা ওদের থেকে যে দুর্ব্যবহার ও প্রত্যাখ্যান পেয়েছেন তাতে তিনি অত্যন্ত কষ্ট পেয়েছেন এবং তাদের ভুল পথে চলতে থাকায় তিনি অত্যন্ত বেদনাহতে ছিলেন। তিনি মনে-প্রাণে চাইতেন যেন তারা হেদায়াতের পথ গ্রহণ করে। এরপরই যখন আল্লাহ তায়ালা সূরা ‘নাজম’ নাযিল করে বললেন, তােমরা লাত, ওযযা এবং তৃতীয় আর একটি দেবী মানাত সম্পর্কে চিন্তা করে দেখেছাে কি?’ সে সময় শয়তান একথা যােগ দিয়েছিলাে সেখানে আল্লাহ তায়ালা আল্লদ্রোহীদের কথা বলতে গিয়ে বললেন, ওরা হচ্ছে উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন সুন্দরী মেয়েলােক এবং তাদের সুপারিশ এত মূল্যবান যা আশা করা হয়। আসলে এসব শয়তানের ছন্দময় কথা এবং তার দুরভিসন্ধি। এ দুটি কথা মক্কার মােশরেকদের মনে স্থান করে নিলাে এবং তাদের মুখেও সে কথা জারি হয়ে গেলাে। আর মক্কাবাসীরা একথাগুলাে থেকে সুসংবাদ গ্রহণ করলাে ও বললো, যাক, মােহাম্মদ তার জাতির ও তাদের প্রথম ধর্মের দিকে ফিরে এসেছে। কথাটি রসূল(স.)-এর কানে গেলে তিনি দীর্ঘক্ষণ ধরে সূরায়ে নাজম পড়লেন, তারপর তিনি এবং উপস্থিত মুসলিম ও মােশরেক জনগণ সবাই সিজদায় পড়ে গেলেন। শুধুমাত্র মােশরেক বর্ষীয়ান নেতা ওলীদ ইবনে মুগীরা সিজদা করা থেকে বিরত রইলাে। সে এক মুষ্টি মাটি তুলে নিয়ে তার ওপর সিজদা করলাে। তখন উপস্থিত দু’পক্ষের লােকজন সবাই রসূলুল্লাহ(স.)-এর সেজদা দেখে চমৎকৃত হলাে এবং বিশেষ করে মুসলমানগণ আশ্চর্য হলেন যে, ঈমান-ইয়াকীন ছাড়া মােশরেকরা কিভাবে সিজদা করলো! তারপর যখন রসূল(স.)-এর আকাংখার মধ্যে শয়তান উপরােক্ত কথাটি প্রবেশ করিয়ে দিলো, তখন মােশরেকরা আশ্বস্ত হলাে যে, তারা তাদের দেব-দেবীদের সম্মানার্থেই সিজদা করেছে। শয়তানও তাদের মনে একথা জাগিয়ে দিলাে যে, রসূলুল্লাহ(স.) সূরায়ে নাজম-এর মধ্যে একথা পড়েছেন যার কারণে সবাই এসব দেব-দেবীর সম্মানে সেজদা করেছে। এরপর একথাগুলাে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লাে এবং শয়তানও সবখানে একথা প্রকাশ করতে লাগলাে। শেষ পর্যন্ত আবিসিনিয়াতে সবার কাছে, এমনকি মুসলমানদের কাছেও খবরটি পৌছে গেলাে। সেখানে ওসমান ইবনে মাযযুন ও তার সংগীরাও উপস্থিত ছিলাে। তারা বলাবলি শুরু করে দিলাে যে, মক্কাবাসী সবাই ইসলাম গ্রহণ করেছে এবং তারা রসূলুল্লাহ(স.)-এর সাথে নামায পড়েছে। তাদের কাছে এ খবরও পৌছলাে যে, ওলীদ ইবনে মুগীরা হাতে মাটি নিয়ে তার ওপর সিজদা করেছে। আরও খবর পৌছলাে যে, মক্কায় মুসলমানগণ নিরাপদ হয়ে গেছে, যার কারণে তারা আবিসিনিয়া থেকে মক্কার দিকে রওয়ানা হয়ে গেলাে। শয়তান যা কিছু কথা সূরায়ে নাজম-এর সাথে জুড়ে দিয়েছিলাে আল্লাহ পাক তা মনসূখ (নাচ) করে দিয়ে তার আয়াতগুলাে সন্দেহমুক্ত করে দিলেন এবং মনগড়া কথা থেকে মুক্ত করে জানালেন, ‘তােমার পূর্বে যে কোনাে রসূল বা নবী পাঠিয়েছি… আল্লাহ তায়ালা তার ফায়সালা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিলেন এবং ফেরেশতাদের সম্পর্কে শয়তানের ছন্দপূর্ণ তৈরী করা কথা থেকে যে তিনি সম্পূর্ণভাবে মুক্ত তা পরিষ্কারভাবে বলে দিলেন। এরপর মােশরেকরা তাদের পূর্ব গােমরাহী ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে শক্রতার মনােভাবের দিকে পুনরায় ফিরে গেলাে, বরং তাদের দুশমনী আরও বেড়ে গেলাে। আরও কিছু রেওয়ায়েত পাওয়া গেছে যা এই বানোয়াট কথাকে আরও জোরদার করেছে এবং ‘সুন্দরী ফেরেশতাদের কাহিনীকে রসূলুল্লাহ(স.)-এর কথা বলে প্রচার করেছে এবং জানিয়েছে যে, রসূলুল্লাহ(স.) কুরাইশদের খুশী করার জন্যে এবং দ্বীন-ইসলামের দিকে আগ্রহান্বিত করার উদ্দেশ্যে সান্তনা দিতে গিয়ে উৎসাহপূর্ণভাবে এরকম কিছু কথা বলেছিলেন। এসমস্ত মিথ্যা ও বানােয়াট বর্ণনাকে প্রথম অবস্থাতেই নাকচ করে দেয়া হয়েছে—যখন এগুলাে প্রচার হওয়ার ভয় দেখা গিয়েছিলো। নবুওতের নিরাপত্তা ও কোরআনকে মিথ্যা ও মানুষের মনগড়া কথা থেকে মুক্ত রাখার জন্যেও প্রথম সুযােগেই এ ছাঁটাই-বাছাই করা হয়েছে। এটা এজন্যেও প্রয়ােজন ছিলাে যাতে কোরআন করীমের সকল বাক্য বা শব্দ সকল প্রকার পরিবর্তনের হাত থেকে রক্ষা পায়। সুতরাং আলােচ্য সূরার বর্ণনাভংগি চুড়ান্তভাবে বানােয়াট-এ কাহিনীকে প্রত্যাখ্যান করে এ সূরার মধ্যে অলীক দেব-দেবীর প্রতি মােশরেকদের বিশ্বাস এবং এ সম্পর্কিত যাবতীয় কল্প কাহিনীর প্রতি কঠিন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়েছে। অতএব, ওপরে (শয়তানের তৈরী করা) কথা দুটি এ সূরার অংশ হওয়ার কোনাে প্রশ্নই আসে না। এমনকি আর একটি প্রচলিত কথাও যুক্তিহীন, যার মধ্যে বলা হয়েছে, শয়তান মোশরেকদের কানে এই বাক্য দুটি এনে দিয়েছিলাে যা মুসলমানগণ শুনতে পায়নি। এখানে চিন্তা করার বিষয় হচ্ছে, এ সব মোশরে তাে আরবই ছিলাে যারা তাদের ভাষা ভাল করেই বুঝতাে এবং বর্ণনার মধ্যে যে কাব্যিক সৌন্দর্য ছিলাে তাও যথাযথভাবে অনুভব করতাে। কাজেই হঠাৎ করে একটি অপ্রাসংগিক কথা এলে তার সত্য সম্পর্কে তাদের মনে কোনাে প্রশ্ন জাগবে না! দেখুন, আয়াতে কি বলা হচ্ছে, ‘তােমাদের জন্যে হচ্ছে পুরুষ (সন্তান) আর তাঁর (আল্লাহ) জন্যে কন্যা (সন্তান)? এটা বড়ই বে-ইনসাফ-পূর্ণ বন্টন।’ প্রকৃতপক্ষে এগুলাে হচ্ছে তােমাদের কিছু বানানাে নাম যা তােমরা ও তােমাদের বাপ-দাদারা নিজেরা এসব নামকরণ করেছে। এ বিষয়ে আল্লাহ পাক কিছু দলীল নাযিল করেননি। (শেষ পর্যন্ত)। এর পরবর্তী কথাগুলাে তারা (মােশরেকরা) শুনতে পাচ্ছে, যারা আখেরাতের প্রতি বিশ্বাসী নয়, তারাই ফেরেশতাদেরকে মেয়েদের নামে নামকরণ করেছে, অথচ এ বিষয়ে তাদের কোনাে জ্ঞান নেই (আসলে এবিষয়ে তারা কিছুই বুঝে না)। তারা শুধুমাত্র ধারণা-কল্পনার ওপরই কথা বলে এবং ধারণার বশবর্তী হয়েই চলে। আর এটা নিশ্চিত যে, ‘নিছক ধারণা সত্য প্রাপ্তিতে কোনাে সাহায্য করে না।’ এর পূর্বে আরও ওরা (মােশরেকরা) শুনছে, আকাশে কত শত ফেরেশতা রয়েছে যারা তাদের পক্ষে কোনাে সুপারিশ করার অধিকার রাখে না, তবে আল্লাহ পাক যদি কারও সম্পর্কে সুপারিশের অনুমতি দেন এবং তিনি খুশী হন তাে তার কথা ভিন্ন। একথাগুলাে শােনার সময় সে মোশরেকরা রসূল(স.)-এর সাথে সিজদা করেনি, কারণ সিজদার প্রসংগ এখানে আসেনি। এখানে তাদের দেব-দেবীর কোনাে প্রশংসাও করা হয়নি বা তারা শাফায়াত করতে পারবে বলেও জানানাে হয়নি। ওরা এই মিথ্যা রেওয়ায়েতকারীর মত কোনাে নির্বোধ ব্যক্তিও ছিলো না। আসলে এ সব মিথ্যা বর্ণনাকারীদের কাছ থেকে পাশ্চাত্য ছিদ্রান্বেষণকারীরা এ কথাগুলো লুফে নিয়ে নিজেদের গরজ মত হঠকারিতার সাথে কথাগুলাে চালিয়ে দিয়েছে (যেন মানুষ সন্দেহের মধ্যে পড়ে যায়)। তাহলে অবশ্যই এ কারণ ছাড়া অন্য আরও কোনাে ব্যাপার ছিলাে যার কারণে মােশরেকরা সিজদা করেছিলাে এবং আবিসিনিয়ার মােহাজেররা একটি নির্দিষ্ট সময় পর অন্য কোনাে কারণে মক্কায় প্রত্যাবর্তন করেছিলেন। মােহাজেররা আবিসিনিয়া থেকে কেন ফিরে এলেন এবং কিছু দিন থাকার পর পুনরায় কেন আবার হিজরত করলেন তা নির্ণয় করার জন্যে তেমন কোনাে নির্ভরযােগ্য কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে সিজদা করার কারণটি এই প্রসংগে আমরা বুঝতে না পারায় বিরােধী ভাব দেখাচ্ছি। ওপরে বর্ণিত কারণ ব্যতীত সিজদা করার আরও কিছু কারণ আছে বলে আমি মনে করি। আমার মনে হয় সিজদা করার ব্যাপারটি আদতেই সংঘটিত হয়নি। দু’মাস বা তিন মাস পরে আবিসিনিয়া থেকে মােহাজেরদের ফিরে আসার কারণ নির্ণয় করতে গিয়ে সম্ভবত এ ঘটনাটির উল্লেখ করা হয়েছে। কারণ মােহাজেরদের ফিরে আসার পেছনে কিছু না কিছু এ ধরনের ঘটনা অবশ্যই ঘটে থাকবে। এধরনের বিশেষ কিছু অভিজ্ঞতা আমারও যা আমি ইতিপূর্বেও উল্লেখ করেছি। আমরা কয়েক জন লােক একবার এক জায়গায় বসে কথা বলছিলাম, এমন সময় কাছাকাছি কোনাে এক জায়গা থেকে কোরআন তেলাওয়াতের শব্দ শুনতে পেলাম এবং যখন খেয়াল করে বুঝতে পারলাম যে, সূরায়ে আন্ নাজম পাঠ করা হচ্ছে, তখন আমাদের মধ্যে কথা বন্ধ হয়ে গেলাে এবং আমরা মনােনিবেশ সহকারে চুপ করে তেলাওয়াত শুনতে লাগলাম। যে কারী সাহেব পড়ছিলেন তার কণ্ঠস্বরটি বড়ই হৃদয়গ্রাহী ছিলাে। তিনি বড় সুন্দর করে থেমে থেমে পড়ছিলেন। যখন তিনি সুমধুর সুরে কোরআন পড়ছিলেন, তখন আমি ধীরে ধীরে তার সেই সুর লহরী আকন্ঠ পান করছিলাম, পান করছিলাম-মােহাম্মদ(স.)-এর সেই মুহুর্তের হৃদয় দিয়ে যখন আকাশের উচ্চতম মার্গে তিনি আরােহণ করেছিলেন, যখন তিনি জিবরাঈল(আ.)-কে আল্লাহর সৃষ্ট ফেরেশতার আসল চেহারায় দেখছিলেন। আমি যেন তারই সেই অবস্থানে নিজেকে অনুভব করছিলাম। এ এমন এক আশ্চর্য ঘটনা যা চিন্তা করতে গেলে মানুষ বুদ্ধিহারা হয়ে যায়। আমি যেন রসূলুল্লাহ(স.)-এর সাথেই সেই পরম মুহূর্তে অবস্থান করছিলাম যখন তিনি উর্ধাকাশের দিকে দ্রুতগতিতে আরােহণ করে সিদরাতুল মুনতাহা ও জান্নাতুল মাওয়ার দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন। আমার সমস্ত শক্তি দিয়ে আমি এই কল্পনা করছিলাম। বড় তৃপ্তির সাথে এবং আমার শক্তি ও অনুভূতি দিয়ে সেই সুরসুধা পান করছিলাম। ফেরেশতা, তাদের এবাদত, তাদের বান্দা হওয়া এবং নিরন্তর তাদের আল্লাহর অনুগত সৃষ্টি হিসেবে কাজ করা সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করেছি, আর পাশাপাশি অনুভব করেছি কী চরম নির্বুদ্ধিতার সাথে তাদের সম্পর্কে মােশরেকরা চিন্তা করে এবং তাদের সম্পর্কে কত মারাত্মক ভ্রান্ত ধারণার মধ্যে তারা পতিত হয়। এরপর মাটি থেকে তৈরী মানুষ ও ভ্রুণ আকারে মাতৃগর্ভে তার আগমনের বিষয়েও ভেবেছি। তারপর বুঝেছি একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই এসব কিছুর রহস্য জানেন। সূরাটির শেষ ভাগে উল্লিখিত এ সকল বিস্ময়কর রহস্যরাজির সংস্পর্শে এসে আমার অস্তিত্ব প্রকম্পিত হতে থেকেছে। এখানে পর্দার অন্তরালে লুকিয়ে থাকা সেইসব জিনিস সম্পর্কে বলা হয়েছে যা আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কেউ দেখে না এবং এমন সব সুনির্দিষ্ট কাজের উল্লেখ করা হয়েছে যার কোনাে তুলনা নাই আর যার হিসাব-নিকাশ করে অবশ্যই প্রতিদান দেয়া হবে। অবশেষে, বান্দার সকল কাজ আল্লাহর কাছে ফিরে যাবে, যা সে জীবনের বিভিন্ন চলার পথে করতে থেকেছে। তখন অনেকে হাস্য-মুখরিত অবস্থায় থাকবে আর অনেকে থাকবে ক্রন্দনরত ও আত্ম-অনুশােচনীয় বিলাপরত। কেউ মৃত্যুকে ডাকতে থাকবে আর কেউ নতুন এ জীবনের অমরত্ব কামনা করবে। মানব সৃষ্টির সূচনাতে শুক্রবিন্দু অন্ধকারাচ্ছন্ন এক সুড়ং পথে এগুতে থাকে এবং এর গােপন প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করতে করতে একপর্যায়ে এসে তা নর বা নারীর ভ্রুণে পরিণত হয়। এর পরেই পরবর্তীতে এক নতুন জীবে পরিণত হয়। এইভাবেই মানব প্রকৃতির পূর্ণত্ব লাভের পথে এক নিরন্তর সংগ্রাম চলতে থাকে এবং যেন এক প্রচন্ড ঝড়ো হাওয়া তাকে দ্রুতবেগে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায় এবং তাকে পুরােপুরি অন্ধকারাচ্ছন্ন করে ফেলে। এরপর ‘আমি ভীতি প্রদর্শনকারীর (নবীর) সর্বশেষ শব্দটি হঠাৎ করে আসা ধ্বংসের পূর্বেই যেন শুনতে পেলাম।’ এই হচ্ছে সেই ভীতি প্রদর্শনকারী যা পূর্বে আসা অন্যান্য ভীতি প্রদর্শনকারীদের অন্যতম মহা-বিপর্যয় আগতপ্রায়। ‘আল্লাহ ব্যতীত অন্য কেউ এই বিপদকে হঠাতে পারে না।’ তারপর এল পরবর্তী প্রচন্ড এক শব্দ এবং আমার গােটা অস্তিত্ব ভয়ানক ক্রন্দনের সাথে থরথর করে কেঁপে উঠলাে, ‘এই কথাতে তুমি কি আশ্চর্য হচ্ছো? হাসছাে? কাঁদছােনা! আর তােমরা কি ঠাট্টা-মঙ্কারি করছো!’ তারপর যখন শুনলাম, ‘আল্লাহর সামনে সিজদায় পড়ে যাও এবং তারই পূর্ণাঙ্গ আনুগত্য কর।’ তখন এই কম্পন ছড়িয়ে পড়লাে আমার অন্তর থেকে নিয়ে সমগ্র অংগ-প্রত্যংগে। আর অংগ-প্রত্যংগের এই কম্পন-এর প্রবাহ এমনভাবে আমার গােটা অস্তিত্বকে আচ্ছন্ন করে ফেললাে যে, আমি নিজেকে আর সামলাতে পারছিলাম না। গােটা দেহ প্রচন্ড বেগে কাঁপছিলো, কিছুতেই সে কম্পনকে থামাতে পারছিলাম না। এর সাথে দর-বিগলিত ধারায় অশ্রু প্রবাহিত হয়ে চলেছিলাে, যা শত চেষ্টা করেও আমি থামাতে পারছিলাম না। ঠিক এই মুহূর্তেই আমি অনুভব করলাম, সিজদার ঘটনাটি ছিলাে অবশ্যই সত্য এবং এই সিজদার কারণও যথার্থ। আমি অনুধাবন করলাম যে, কোরআনের এই অত্যাশ্চর্য ক্ষমতার কারণেই সে সিজদার ঘটনাটি সংঘটিত হয়েছিলাে। সম্ভব হয়েছিলাে সূরার মধ্যে উল্লিখিত বিভিন্ন ঘটনার সংস্পর্শে এসে। সূরায়ে নাজম আমি এই প্রথম পড়লাম বা শুনলাম তা তাে নয়, কিন্তু এইবারেই উক্ত ঘটনাটি সংঘটিত হলাে এবং আমার মধ্যে এই ভাবান্তর লক্ষ্য করলাম। এর ভীষণ শক্তি আমার হৃদয় পুরােপুরিভাবে অনুভব করলাে এবং এর প্রভাবে আমার যে অবস্থা হওয়া। দরকার তা হলাে। মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ(স.) যখন সূরাটি তেলাওয়াত করছিলেন তখন উপস্থিত সকল ব্যক্তির মধ্যে একই অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিলাে। তিনিও তার হৃদয়ের সমস্ত আবেগ ঢেলে দিয়েই সূরাটি পড়ছিলেন এবং এর পূর্বে সূরাটি পড়ে যেভাবে অভিভূত হয়েছেন এবারও সেই একইভাবে তিনি মুগ্ধ-আবেগে প্রকম্পিত হয়েছেন। আমাদের কাছে পাঠরত সে কারী সাহেবের কণ্ঠস্বরের মধ্যে শ্রোতাদের ধমনীতে যেন সেই গােপন শক্তি অনুভূত হচ্ছিলাে যা মােহাম্মদ(স.)-এর কণ্ঠস্বরে ছিলো, যার কারণে তারা কাঁপছিলাে আর সমস্ত হৃদয় দিয়ে শুনছিলাে, ‘অতএব, আল্লাহকে সিজদা করো ও তাঁরই এবাদত করাে।’ একারণে মুহাম্মদ(সা.) ও মুসলমানগণ সিজদা করলেন। উপস্থিত অন্যান্য মানুষ যারা শুনেছিলাে তারাও সিজদায় পড়ে গেল। হা কেউ বলতে পারে আপনার ওপর দিয়ে একটি বিশেষ অবস্থা যাওয়ার কারণে এবং আপনার এক বিশেষ অভিজ্ঞতা হওয়ার দরুণ আপনি এসব অনুমান করছেন, কারণ আপনি মুসলমান, কোরআনে করীমকে আপনি ভক্তি-শ্রদ্ধা করেন এবং আপনার অন্তরে কোরআনে করীমের বিশেষ একটি প্রভাব রয়েছে। কিন্তু অন্যরা তাে ছিলাে মােশরেক, যারা ঈমান আনতে অস্বীকার করেছিলাে এবং কোরআনকেও প্রত্যাখ্যান করেছিলাে।’ সিজদা করার বিষয়টিকে কেন্দ্র করে যে প্রশ্ন উঠেছে তার মােকাবেলা করতে গিয়ে দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিবেচনা করা প্রয়ােজন, এক. এ সময় যিনি সূরাটি পড়ছিলেন তিনি খােদ আল্লাহর প্রিয় নবী মােহাম্মদ(স.), যার ওপর কোরআনের মূল উৎস থেকে উৎসারিত হয়ে এই কোরআনে করীম সরাসরি জিবরাঈল(আ.)-এর মাধ্যমে নাযিল হয়েছে। কোরআন নিয়েই তিনি কাজ করেছেন এবং এই পবিত্র গ্রন্থই তাকে পরিচালনা করেছে। তিনি কোরআনকে হৃদয়-প্রাণ দিয়ে এতটা ভালবেসেছেন যে, কেউ ঘরের অভ্যন্তরে ধীরে ধীরে কোরআন তেলাওয়াত করছে শুনতে পেয়ে তার পদযুগল ভারী হয়ে গেছে, গতি মন্থর হয়ে গেছে আর তিনি দরজার পাশে পাঠ শেষ না হওয়া পর্যন্ত শােনার জন্যে দাঁড়িয়ে থেকেছেন। আর আলােচ্য এই সূরাটিতে যে ইংগিত পাওয়া যায় তাতে বুঝা যায় উর্ধাকাশে সশরীরে সফরকালে জিবরাঈল আমীনের কাছ থেকে এ সূরাটি তিনি পেয়েছেন। যে সময় তিনি তার প্রথম সেই চেহারায় দেখেছেন যা ওহী নাযিলের একেবারে শুরুতে তার নযরে এসেছিলাে। আর আমি! আমি তাে এ সূরাটি শুনছিলাম একজন সাধারণ কারীর কষ্ঠ থেকে। এই দুই শােনার মধ্যে নিসন্দেহে বিরাট পার্থক্য রয়েছে। দ্বিতীয় বিবেচ্য বিষয়টি হচ্ছে, মোহাম্মদ(স.)-এর মুখ থেকে মুশরিকরা যখন এ সূরাটির তেলাওয়াত শুনছিলাে, তখন তাদের হৃদয় ভয় ও কম্পন মুক্ত থাকতে পারেনি। একমাত্র হিংসা-বিদ্বেষ এর পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলাে। নিম্নবর্ণিত দুটি ঘটনা তাদের ভীত-বিহবল চিত্তের সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়েছে, আবু লাহাবের পুত্র ওৎবার ঘটনাটি তুলে ধরতে গিয়ে ইবনে আসাকির জানাচ্ছেন, আবু লাহাব ও তার পুত্র ও সিরিয়া সফরে যাওয়ার জন্যে প্রস্তুতি নিল। তাদের সাথে একই কাফেলায় যাওয়ার জন্যে আমিও প্রস্তুত হলাম। তখন আবু লাহাব পুত্র ও বললাে, আল্লাহর কসম, আমি মােহাম্মদ-এর কাছে গিয়ে তার রব সম্পর্কে কটাক্ষপাত করে কিছু কষ্ট দিয়ে আসি। একথা বলার পর মুহাম্মদ(সা.)-এর কাছ সে গেল এবং বললাে হে মােহাম্মদ, আমি অস্বীকার করছি সেই ব্যক্তিটিকে যে ব্যক্তি নিকটবর্তী হয়েছিলাে এবং আরও কাছে এসে তার দিকে ঝুঁকে পড়েছিলাে। তারপর মুখােমুখি রাখা দুটো ধনুকের থেকেও কাছে এসে গিয়েছিলাে, বরং আরও নিকটতর হয়েছিলাে। তখন নবী(স.) শুধু বললেন, হে আল্লাহ, এর ওপর তােমার কুকুরগুলাের মধ্য থেকে যে কোনাে একটি কুকুরকে সওয়ার করে দিয়াে। এরপর সে তার বাপের কাছে ফিরে গেলে তার বাবা তাকে বললাে, হে পুত্র আমার, কারও জন্য মােহাম্মদ বদদোয়া করলে তাকে কেউ নিরাপত্তা দিতে পারে না। একথা শােনার পর আমরা রওয়ানা হয়ে গেলাম এবং সিরিয়ার দ্বার-প্রান্তে ‘আবরা’ নামক স্থানে পৌছে গেলাম। এর পর এক পাদ্রীর এবাদতখানাতে গেলে সে পাদ্রী সাহেব বললেন, হে আরববাসীরা, এ শহরে আপনারা কোন উদ্দেশ্যে এসেছেন? এখানে প্রতিনিয়ত তেমনি করেই সিংহরা গর্জন করে যেমন করে অহরহ মেষপাল ডাকতে থাকে। তখন আবু লাহাব বললাে, তোমরা তারে আমার বার্ধক্যের অবস্থা জানাও আর একারণে তােমাদের কাছে আমার কতটুকু অধিকার আছে তাও বুঝে অপরদিকে এই যে ব্যক্তি (মােহাম্মদ) আমার ছেলেকে কি বদদোয়া দিয়েছে তাও তােমাদের জানা আছে। আল্লাহর কসম, আমি তাে মনে করি তার কোনাে নিরাপত্তা নেই। অতএব, তােমাদের মাল-মাত্তা এই এবাদতখানার কাছে একত্রিত করে তার ওপর আমার পুত্রকে শয়ন করাও এবং এর চতুর্দিকে তােমরা বিছানা রচনা করাে।’ একথার পর আমরা সেই মত কাজ করলাম। তারপর এক সময় সিংহ এলাে এবং আমাদের সবার মুখ শুঁকতে লাগলাে। কিন্তু, যাকে সে চাইছিলাে তাকে না পেয়ে পিছিয়ে গিয়ে এক লাফে মাল-মাত্তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লাে এবং ওকে (উৎবাকে) কে দেখে তাকে আক্রমণ করলাে এবং তার মাথা টুকরা টুকরা করে ফেললাে। তখন আবু লাহাব বললাে, ‘আমি অবশ্যই বুঝেছিলাম যে, মোহাম্মদ কারও জন্যে বদ-দোয়া করলে তার বাঁচার আর কোনােই উপায় থাকে না।’ এটিই হচ্ছে সেই প্রথম ঘটনা যা আবু লাহাব নিজে প্রত্যক্ষ করেছে। মােহাম্মদ (স.)-এর নিজের চাচা ও নিকটতম প্রতিবেশী হওয়া সত্ত্বেও সে ছিলাে তার চরম দুশমন এবং সে-ই হচ্ছে একমাত্র ব্যক্তি যার ওপর কোরআনে অভিসম্পাত করা হয়েছে। তার ও তার পরিবারের ওপর অভিশাপ দিতে গিয়ে নাযিল হয়েছে-ধ্বংস হয়ে যাক আবু লাহাবের হাত দুটি, পুরােপুরিভাবে। কোনাে কাজে লাগবে না তার (মৌরুসী সূত্রে প্রাপ্ত) ধনসম্পদ এবং সেই সম্পদ যা সে উপার্জন করেছে। শীঘ্রই কুন্ডলী পাকিয়ে উঠা আগুনে সে প্রবেশ করবে, প্রবেশ করবে সেথায় শুকনা কাঠ (কাটা) বহনকারিণী-তার স্ত্রীও। তার গলায় খেজুর-শাখার আঁশে তৈরী রশির ফাস লেগে যাওয়ায় সে মরবে। ওপরে বর্ণিত আবু লাহাবের ছেলে ওৎবার পরিণতিতে যে কথা সে ব্যক্ত করেছিলাে তাতে মােহাম্মদ(স.) ও তাঁর মুখ নিসৃত বাণী সম্পর্কে তার তীব্র অনুভূতি সঠিকভাবে প্রকাশ পেয়েছে। তার ছেলের জন্যে মুহাম্মদ(সা.)-এর বদ-দোয়া শােনার সাথে সাথে তার হৃদকম্পন শুরু হয়েছিলাে এবং কেঁপে উঠেছিলাে তার সকল অংগ-প্রত্যংগ। দ্বিতীয় ঘটনা ওৎবা ইবনে আবী রাবীয়া একবার মােহাম্মদ(স.)-এর কাছে কিছু সময় কাটালাে। বর্ষীয়ান এ ব্যক্তিটিকে কোরায়শরা তাঁর কাছে পাঠিয়েছিলাে। কারণ তাদের মতে এই ব্যক্তির হাতে তাদের হাতের দেব-দেবীরা লাঞ্ছিত হচ্ছিল এবং সে কোরায়েশদের একতায় ফাটল ধরিয়ে দিয়েছিলাে, সে এখানে এসে মােহাম্মদ(স.)-কে ধন-দৌলত, সাম্রাজ্য অথবা সুন্দরী নারীর লােভ দিয়ে বশীভূত করতে চেষ্টা করলাে। লােভনীয় এ প্রস্তাবগুলাে পেশ করা শেষ হলে তাকে মােহাম্মদ(স.) বললেন, ‘আপনার বক্তব্য শেষ হয়েছে কি আবুল ওলীদ।’ সে বললাে, হাঁ। তখন তাকে রসূলুল্লাহ(স.) বললেন, ‘এবারে আমার কথা একটু খেয়াল করে শুনুন।’ সে বললাে, আচ্ছা শুনছি।’ তখন রসূলুল্লাহ(স.) পড়তে শুরু করলেন ‘বিসমিল্লাহির রাহিমানির রহীম, হা-মীম, তানযীলুম মিনার রাহমানির রহীম… পরম করুণাময় মহান দাতা আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে অবতীর্ণ এ বাণী। এ হচ্ছে সেই কিতাব যার আয়াতগুলােকে বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। যারা বুদ্ধিকে কাজে লাগায় সেইসব জ্ঞানী ব্যক্তিদের জন্যে আরবী ভাষায় নাযিল হয়েছে এ কোরআন। এ কিতাব সুসংবাদ দানকারী ও সতর্ককারী। কিন্তু হায় ওদের বেশীরভাগ লোকই এ কিতাবকে প্রত্যাখ্যান করলাে, যার কারণে তারা এ কিতাবের বাণী শুনতেও প্রস্তুত নয়।’ এইভাবে পাক কোরআনের বর্ণনাধারা এগিয়ে চললাে এবং যখন তিনি এই আয়াতে পৌছলেন ‘এর পরও যদি ওরা মুখ ফিরিয়ে চলে যায়, তখন তুমি ওদেরকে বলাে, আমি তােমাদেরকে সেই কঠিন আযাবের ভয় দেখাচ্ছি যা আ’দ ও সামুদ জাতিকে পাকড়াও করেছিলাে।’ তখন সে বৃদ্ধ ব্যক্তিটি অস্থির হয়ে তার মুখের ওপর হাত রেখে বললাে, বাবা, তােমার জাতির প্রতি রহম করাে। তারপর সে নিজ কওমের কাছে ফিরে গিয়ে সবিস্তারে এ ঘটনা বললাে। আরও বললাে, তােমরা জান, মােহাম্মদ যখন কোনাে কথা বলে ফেলে তখন কিছুতেই তা মিথ্যা প্রমাণিত হয় না। অতএব, আমার ভয় হচ্ছে যে, তােমাদের ওপর সেই কঠিন আযাব অত্যাসন্ন।(বিভিন্ন রেওয়ায়াতের সংক্ষিপ্ত সার) এটাই হচ্ছে সেই বয়স্ক লােকটির অনুভূতি যে আদৌ ইসলাম গ্রহণ করেনি। তার ওপর কোরআনের প্রভাবে প্রকম্পন জারী হয়ে যাওয়াটা স্পষ্ট। বিদ্বেষ ও অহংকার থাকা সত্ত্বেও তাদের অন্তরে লুকিয়ে থাকা ভয়ের ছাপ তাদের মুখের ওপর পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠতাে। মােহাম্মদ(স.)-এর কাছ থেকে যখন তারা সূরা আন্ নাজম-এর তেলাওয়াত শুনেছিলাে তখনও এ একই ধরনের প্রতিক্রিয়া তাদের ওপর হয়েছিলাে। সুতরাং, কোরআনের বাণী শুনে তাদের অন্তর অপ্রতিরােধ্যভাবে বিগলিত হতাে এবং তাদের সর্বাংগে ভয়ভীতির প্রভাব ছড়িয়ে পড়তাে। তখন তারা আর নিজেদেরকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারতাে না। আর এই কারণে সূরায়ে ‘আন নাজমে’ সিজদার আয়াত শােনার সাথে সাথে কোরায়েশের মােশরেক ব্যক্তিদের পক্ষে মুসলমানদের সাথে সিজদায় পড়ে যাওয়াটা ছিলাে খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। এটা কোনাে মিথ্যা সৃষ্টিকারীর রেওয়ায়াতে পাওয়া সুন্দরী-নারীর বানােয়াট কিসসা-কাহিনীর ফল ছিলাে না!

৪৩-৬২ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে ইবনে কাছীর:-
৪২-৫৫ নং আয়াতের তাফসীর:

ঘোষিত হচ্ছে যে, শেষে প্রত্যাবর্তন স্থল আল্লাহর নিকট। কিয়ামতের দিন সবকেই তারই সামনে হাযির হতে হবে। হযরত মুআয (রাঃ) বানু আওদ গোত্রের মধ্যে ভাষণ দিতে গিয়ে বলেনঃ “হে বানু আওদ! আমি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর দূতরূপে তোমাদের নিকট আগমন করেছি। তোমরা সবাই এ বিশ্বাস রেখো যে, তোমাদের সবকেই আল্লাহ তাআলার নিকট ফিরে যেতে হবে। অতঃপর তোমাদেরকে জান্নাতে প্রবিষ্ট করা হবে অথবা জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।” (এটা ইমাম ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

হযরত উবাই ইবনে কা’ব (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী (সঃ) (আরবী)-এ আয়াতের তাফসীরে বলেনঃ “আল্লাহর সত্তা সম্পর্কে চিন্তা করা জায়েয নয়।” এটা ঐ হাদীসের মতই যা হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “সৃষ্টি সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করো, কিন্তু সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করতে যেয়ো না। তাকে জ্ঞান ও চিন্তা পেতে পারে না ।” (ইমাম বাগাভী (রঃ) এটা বর্ণনা করেছেন)

এ হাদীসটি এ শব্দগুলো দ্বারা সুরক্ষিত না হলেও সহীহ হাদীসেও এ বিষয়টি বিদ্যমান রয়েছে। তাতে রয়েছেঃ “তোমাদের কাছে এসে বলে- এটা কে সৃষ্টি করেছেন? ওটা কে সৃষ্টি করেছেন?” শেষ পর্যন্ত সে বলেঃ “আল্লাহকে কে সৃষ্টি করেছেন?” তোমাদের মধ্যে কারো অন্তরে এই কুমন্ত্রণা আসলে সে যেন আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করে এবং অন্তর হতে ঐ ধারণা দূর করে দেয়।”

সুনানের অন্য একটি হাদীসে রয়েছেঃ “তোমরা সৃষ্টজীব ও বস্তু সম্পর্কে চিন্তা-গবেষণা করো, কিন্তু সৃষ্টিকর্তার সত্তা সম্পর্কে চিন্তা-গবেষণা করো না। জেনে রেখো যে, আল্লাহ তা’আলা এমন একজন ফেরেশতা সৃষ্টি করেছেন যার কানের নিম্নভাগ হতে কাঁধ পর্যন্ত স্থান তিনশ বছরের পথ।” অথবা যেরূপ বলেছেন।

মহান আল্লাহ বলেনঃ “তিনিই হাসান, তিনিই কাঁদান।’ অর্থাৎ হাসি-কান্নার মূল ও কারণ তিনিই সৃষ্টি করেছেন, যা সম্পূর্ণরূপে পৃথক পৃথক। তিনিই মারেন, তিনিই বাঁচান।’ যেমন তিনিঃ (আরবী) অর্থাৎ “যিনি সৃষ্টি করেন মৃত্যু ও জীবন।”

ঘোষিত হচ্ছেঃ “তিনিই সৃষ্টি করেন যুগল পুরুষ ও নারী শুক্রবিন্দু হতে যখন তা স্খলিত হয়। যেমন আল্লাহ তা’আলার উক্তিঃ (আরবী) অর্থাৎ “মানুষ কি মনে করে যে, তাকে নিরর্থক ছেড়ে দেয়া হবে? সে কি স্খলিত শুক্র বিন্দু ছিল না? অতঃপর সে রক্তপিণ্ডে পরিণত হয়। তারপর আল্লাহ তাকে আকৃতি দান করেন ও সুঠাম করেন। অতঃপর তিনি তা হতে সৃষ্টি করেন যুগল নর ও নারী। তবুও কি সেই স্রষ্টা মৃতকে পুনর্জীবিত করতে সক্ষম নন?” (৭৫:৩৬-৪০)।

মহান আল্লাহ বলেনঃ ‘পুনরুত্থান ঘটাবার দায়িত্ব তারই।’ অর্থাৎ যেমন তিনি প্রথমবার সৃষ্টি করেছেন তেমনই মৃত্যুর পর পুনর্জীবিত করার দায়িত্ব তারই। “তিনিই অভাবমুক্ত করেন ও সম্পদ দান করেন। ধন-সম্পদ তাঁরই অধিকারে রয়েছে যা তাঁর কাছে পুঁজি হিসেবে থাকে। অধিকাংশ তাফসীরকারের উক্তি এ স্থলে এটাই, যদিও কিছু লোক হতে বর্ণিত আছে যে, এর ভাবার্থ হচ্ছেঃ তিনি মাল দিয়েছেন ও গোলাম দিয়েছেন। তিনি দিয়েছেন ও খুশী হয়েছেন। তিনি নিজেকে অমুখাপেক্ষী করেছেন এবং স্বীয় মাখলুককে তাঁর মুখাপেক্ষী করেছেন। তিনি যাকে ইচ্ছা সম্পদশালী করেছেন এবং যাকে ইচ্ছা দরিদ্র করেছেন। কিন্তু এই পরবর্তী দু’টি উক্তি শব্দের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

‘শি’রা ঐ উজ্জ্বল তারকার নাম যাকে ‘মারমুল জাওয়াও বলা হয়। আরবের একটি দল ওর ইবাদত করতো।

আ’দে ঊলা অর্থাৎ হযরত হূদ (আঃ)-এর কওম, যাকে আ’দ ইবনে ইরাম ইবনে সাম ইবনে নূহ (আঃ) বলা হতো। এই কওমকে আল্লাহ তা’আলা ঔদ্ধত্যের কারণে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। যেমন তিনি বলেনঃ (আরবী)

অর্থাৎ “তুমি কি দেখোনি তোমার প্রতিপালক কি করেছিলেন আ’দ বংশেরইরাম গোত্রের প্রতি- যারা অধিকারী ছিল সুউচ্চ প্রাসাদের? যার সমতুল্য কোন দেশে নির্মিত হয়নি।” (৮৯:৬-৮) এই সম্প্রদায়টি অত্যন্ত শক্তিশালী ছিল এবং সাথে সাথে তারা ছিল আল্লাহ তা’আলার চরম অবাধ্য ও রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর চরম বিরোধী। তাদের উপর ঝড়ের শাস্তি আপতিত হয়, যা সাত রাত ও আট দিন পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। অনুরূপভাবে সামূদ সম্প্রদায়কেও ধ্বংস করে দেন এবং তাদের কাউকেও তিনি বাকী রাখেননি। তাদের পূর্বে নূহ (আঃ)-এর সম্প্রদায়কেও ধ্বংস করেছেন, তারা ছিল অতিশয় যালিম ও অবাধ্য। আর। উৎপাটিত আবাস ভূমিকে উল্টিয়ে নিক্ষেপ করেছিলেন। আকাশ হতে প্রস্তর বর্ষণ করে সমস্ত পাপীকে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। তাদেরকে একটি জিনিস ঢেকে ফেলে, অর্থাৎ পাথর সমূহ, যেগুলোর বৃষ্টি তাদের উপর বর্ষিত হয় এবং অত্যন্ত মন্দ অবস্থায় তারা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। ঐ গ্রামে চার লক্ষ লোক বসবাস করতো। আবাসভূমির সবটাই অগ্নি, গন্ধক ও তেল হয়ে তাদের উপর প্রজ্বলিত হয়েছিল।

হযরত কাতাদা (রঃ)-এর উক্তি এটাই যার সনদ অত্যন্ত দুর্বল। এটা’মুসনাদে ইবনে আবি হাতিমে বর্ণিত হয়েছে।

এরপর মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ তাহলে হে মানুষ! তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের কোন অনুগ্রহ সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করবে? কেউ কেউ বলেন যে, এটা নবী (সঃ)-কে সম্বোধন করা হয়েছে। কিন্তু সম্বোধনকে সাধারণ রাখাই বেশী যুক্তিযুক্ত। ইমাম ইবনে জারীরও (রঃ) সাধারণ রাখাকেই পছন্দ করেছেন।
৫৬-৬২ নং আয়াতের তাফসীর:

ইনি অর্থাৎ হযরত মুহাম্মাদ (সঃ) ভয় প্রদর্শক। তাঁর রিসালাত পূর্ববর্তী রাসূলদের রিসালাতের মতই। যেমন আল্লাহ তা’আলা অন্য জায়গায় বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “ (হে নবী সঃ)! তুমি বলঃ আমি নতুন রাসূল তো নই।” (৪৬:৯) অর্থাৎ রিসালাত তো আমা হতে শুরু হয়নি। বরং আমার পূর্বে দুনিয়ায় বহু রাসূল আগমন করেছিলেন।

মহান আল্লাহ বলেনঃ কিয়ামত আসন্ন। না এটাকে কেউ প্রতিরোধ করতে পারবে, না এর নির্ধারিত সময়ের অবগতি আল্লাহ ছাড়া আর কারো আছে। অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া এটা সংঘটনের নির্দিষ্ট সময় কারো জানা নেই।

আরবী ভাষায় (আরবী) ওকে বলা হয়, যেমন একটি দল রয়েছে, যাদের মধ্যে একটি লোক কোন ভয়ের জিনিস দেখে দলের লোককে সতর্ক করে। অর্থাৎ ভয়ের খবর শুনিয়ে দেয়। যেমন অন্য আয়াতে রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “তিনি তো আসন্ন কঠোর শাস্তি সম্পর্কে তোমাদেরকে সতর্ককারী মাত্র।” (৩৪:৪৬)।

হাদীসে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) স্বীয় গোত্রকে সম্বোধন করে বলেছিলেনঃ “আমি তোমাদেরকে প্রকাশ্যভাবে সতর্ককারী বা ভয় প্রদর্শনকারী।” অর্থাৎ যেমন কেউ কোন খারাপ জিনিস দেখে নেয় যে, ওটা তার কওমের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে, তখন সে যে অবস্থায় রয়েছে ঐ অবস্থাতেই ভয়ে দৌড়িয়ে এসে হঠাৎ করে স্বীয় সম্প্রদায়কে সতর্ক করে দেয় এবং বলেঃ “দেখো, এই বিপদ আসছে, সুতরাং আত্মরক্ষার ব্যবস্থা কর।” অনুরূপভাবে কিয়ামতের ভয়াবহ শাস্তিও জনগণের উদাসীনতার অবস্থায় তাদের একেবারে নিকটবর্তী হয়ে গেছে এবং রাসূলুল্লাহ (সঃ) তা হতে তাদেরকে সতর্ক করছেন। যেমন এর পরবর্তী সূরায় রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “কিয়ামত নিকটবর্তী হয়েছে।” (৫৪:১)।

হযরত সাহল ইবনে সা’দ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “তোমরা ছোট ছোট গুনাহগুলোকে ছোট ও তুচ্ছ জ্ঞান করা হতে বেঁচে থাকো। ছোট ছোট গুনাহগুলোর দৃষ্টান্ত এমন, যেমন একটি যাত্রীদল কোন জায়গায় অবতরণ করলো। সবাই এদিক ওদিক চলে গেল এবং কিছু কিছু করে জ্বালানী কাঠ নিয়ে আসলো। এখন যদিও প্রত্যেকের কাছে অল্প অল্প কাষ্ঠ রয়েছে, কিন্তু যখন ওগুলো একত্রিত করা হলো, তখন একটা বড় স্তুপ হয়ে গেল যার দ্বারা হাঁড়ি হাঁড়ি খাদ্য রান্না করা যাবে। অনুরূপভাবে ছোট ছোট পাপ জমা হয়ে ঢেরি হয়ে যায় এবং আকস্মিকভাবে ঐ পাপীকে পাকড়াও করা হয়। সুতরাং সে ধ্বংস হয়ে যায়।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

হযরত সাহল ইবনে সা’দ (রাঃ) হতেই বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আমার এবং কিয়ামতের দৃষ্টান্ত এ দুটির মত।” অতঃপর তিনি স্বীয় তর্জনী ও মধ্যমা অঙ্গুলিদ্বয়ের মাঝে কিছুটা ফাঁকা রেখে দেন। তারপর তিনি বলেনঃ “আমার এবং কিয়ামতের দৃষ্টান্ত দু’টি ঘোড়ার মত।” এরপর তিনি বলেনঃ “আমার এবং আখিরাতের দিনের দৃষ্টান্ত ঠিক ঐ ব্যক্তির মত যাকে তার সম্প্রদায় নৈশ পাহারায় পাঠালো। অতঃপর সে যখন শত্রু সেনাবাহিনীকে একেবারে নিকটে চলে আসতে দেখলো তখন সে একটি টিলার উপর চড়ে তার কাপড় নেড়ে নেড়ে ইঙ্গিতে তার কওমকে সতর্ক করলো। তারপর রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “আমিও ঐরূপ।” (এই হাদীসের সাক্ষী হিসেবে আরো বহু হাসান ও সহীহ হাদীস বিদ্যমান রয়েছে)

এরপর আল্লাহ তাআলা মুশরিকদের এ কাজের উপর ঘৃণা প্রকাশ করছেন যে, তারা কুরআন শ্রবণ করে বটে, কিন্তু তা হতে বিমুখ হয়ে যায় ও বেপরোয়া হয় এবং বিস্মিতভাবে ওর রহমতকে অস্বীকার করে বসে। আর হাসি-ঠাট্টা ও বিদ্রুপ-উপহাস করে থাকে। তাদের উচিত ছিল যে, মুমিনদের মত ওটা শুনে কাঁদতো এবং উপদেশ গ্রহণ করতো। যেমন মুমিনদের অবস্থা বর্ণনা করেছেন যে, তারা আল্লাহর কালাম শুনে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে, সিজদায় পড়ে যায় এবং তাদের বিনয় বৃদ্ধি পায়।

হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, (আরবী) গানকে বলা হয়। এটা ইয়ামানী ভাষা। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতেই (আরবী)-এর অর্থ বিমুখ হওয়া এবং অহংকার করাও বর্ণিত আছে। হযরত আলী (রাঃ) এবং হযরত হাসান (রাঃ) বলেন যে, এর অর্থ হলো উদাসীন।

এরপর আল্লাহ তা’আলা নির্দেশ দিচ্ছেনঃ তোমরা একত্ববাদী ও অকপট হয়ে যাও। বিনয়ের সাথে তোমরা ভূমিতে লুটিয়ে পড়।

হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, সূরায়ে নাজমের সিজদার স্থলে নবী (সঃ) সিজদা করেন এবং তার সাথে মুসলমানরা, মুশরিক এবং দানব ও মানব সবাই সিজদা করে। (এ হাদীসটি ইমাম বুখারী (রঃ) বর্ণনা করেন)

হযরত মুত্তালিব ইবনে আবি অদাআহ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) মক্কায় সূরায়ে নাজম পাঠ করেন। অতঃপর তিনি সিজদা করেন এবং ঐ সময় তার কাছে যারা ছিল তারা সবাই সিজদা করে। বর্ণনাকারী মুত্তালিব (রাঃ) বলেনঃ “আমি তখন আমার মাথা উঠালাম এবং সিজদা করলাম না।” তখন পর্যন্ত মুত্তালিব (রাঃ) ইসলাম গ্রহণ করে নি। এরপরে যে কেউই এই সূরা তিলাওয়াত করতেন এবং যিনি শুনতেন তখন তিনিও তাঁর সাথে সিজদা করতেন। (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) এবং ইমাম নাসাঈ বর্ণনা করেছেন)

৪৩-৬২ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:-
৪৩-৫৫ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

এ আয়াতগুলোতে আল্লাহ তা‘আলার রুবুবিয়্যাহ ও তাঁর ক্ষমতা এবং সবকিছুর সর্বশেষ প্রত্যাবর্তন একমাত্র তাঁর কাছে সে কথাই তুলে ধরেছেন।

আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে হাসান, তিনিই মানুষকে কাঁদান, তিনিই কান্না-হাসির উপকরণ ভাল-মন্দ, আনন্দ-বেদনা ইত্যাদি সৃষ্টি করেন। তিনিই জীবন-মৃত্যু দান করেন। তিনিই মানুষকে নর-নারীরূপে জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছেন, তিনি মানুষকে অভাবমুক্ত রাখেন, সম্পদ দান করেন। এসব কিছুতে তিনিই একচ্ছত্র মালিক। সুতরাং যে প্রভু আমাদের জীবন-মৃত্যু থেকে শুরু করে সব কিছুর মালিক তিনিই সকল ইবাদত পাওয়ার যোগ্য।

(خَلَقَ الزَّوْجَيْنِ)

অর্থাৎ প্রত্যেক প্রাণী তা বাকশক্তি সম্পন্ন হোক আর চতুষ্পদ হোক কিম্বা কীট-পতঙ্গ হোক এমনকি গাছ-পালা ও জড় পদার্থকেও আল্লাহ বিপরীত লিঙ্গ তথা নারী-পুরুষ করে সৃষ্টি করেছেন।

(مِنْ نُّطْفَةٍ إِذَا تُمْنٰي)

‘শুক্র বিন্দু হতে যখন তা নিক্ষিপ্ত হয়’ আল্লাহর পূর্ণ ক্ষমতার এটা অন্যতম একটি বড় প্রমাণ। তুচ্ছ ও দুর্বল এক ফোঁটা বীর্য থেকে আল্লাহ বিশাল বিশাল প্রাণী সৃষ্টি করছেন। ঐ একটু ও একই প্রকার বীর্য দ্বারা একই মায়ের গর্ভে কখনো ছেলে সন্তান দিচ্ছেন, আবার কখনো মেয়ে সন্তান দিচ্ছেন।

(وَأَنَّ عَلَيْهِ النَّشْأَةَ الْأُخْرٰي)

‘আর পুনরায় জীবিত করার দায়িত্বও তাঁরই’ অর্থাৎ যে মানুষকে আল্লাহ একটু বীর্য থেকে সৃষ্টি করে সুস্থ ও সুন্দরভাবে দুনিয়াতে বসবাস করার সুযোগ করে দিয়েছেন সে আল্লাহই আবার মৃত্যুর পর প্রত্যেককে হিসাব-নিকাশের জন্য পুনরুত্থিত করে উপস্থিত করবেন।

(وَأَنَّه۫ هُوَ أَغْنٰي وَأَقْنٰي)

অর্থাৎ যাকে ইচ্ছা তিনি সম্পদশালী করেন যাকে ইচ্ছা তিনি অভাবগ্রস্থ করেন, তিনিই রাজাধিরাজ।

আল্লাহ বলেন :

(قُلِ اللّٰهُمَّ مَالِكَ الْمُلْكِ تُؤْتِي الْمُلْكَ مَنْ تَشَا۬ءُ وَتَنْزِعُ الْمُلْكَ مِمَّنْ تَشَا۬ءُ وَتُعِزُّ مَنْ تَشَا۬ءُ وَتُذِلُّ مَنْ تَشَا۬ءُ ط بِيَدِكَ الْخَيْرُ ط إِنَّكَ عَلٰي كُلِّ شَيْءٍ قَدِيْرٌ) ‏

“বলুন, হে আল্লাহ! আপনিই রাজত্বের মালিক, যাকে চান রাজত্ব দান করেন, আবার যার থেকে চান রাজত্ব কেড়ে নেন। আর যাকে চান সম্মানিত করেন আবার যাকে চান অপদস্থ করেন। আপনার হাতেই সকল কল্যাণ। নিশ্চয়ই আপনি সর্ব বিষয়ে সর্ব শক্তিমান।” (সূরা আলি ইমরান ৩ : ২৬)

الشِّعْرٰي হল একটি তারকা যা الشعري العبور নামে পরিচিত। তা المرزم নামেও নামকরণ করা হয়। আল্লাহ সব তারকার মালিক, কিন্তু এখানে বিশেষভাবে এ তারকার নাম উল্লেখ করা হল কেন? কারণ জাহিলি যুগে এ তারকার ইবাদত করা হত। আল্লাহ এখানে জানিয়ে দিলেন মুশরিকরা যার ইবাদত করে তাও আল্লাহর পরিচালনাধীন মাখলুক, সুতরাং কিভাবে তা মা‘বূদ হতে পারে? তারপর আল্লাহ পূর্ববর্তী কয়েকটি ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতির কথা নিয়ে এসেছেন আমাদেরকে সতর্ক করার জন্য। যেমন ‘আদ সম্প্রদায়, সামূদ সম্প্রদায় ও নূহ (আঃ)-এর জাতি, এদের ধ্বংস প্রাপ্তরা সবাই ছিল জালিম ও সীমালঙ্ঘনকারী।

আ‘দ সম্প্রদায় হল হূদ (আঃ)-এর জাতি, যখন তারা হূদ (আঃ)-কে মিথ্যা প্রতিপন্ন করল তখন আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে প্রচন্ড ঝড় দ্বারা ধ্বংস করে দিলেন।

(وَالْمُؤْتَفِكَةَ أَهْوٰي)

বলতে লূত (আঃ)-এর জাতিকে বুঝানো হয়েছে। তাদেরকে জমিন উল্টিয়ে দিয়ে শাস্তি প্রদান করা হয়েছিল।

(فَغَشّٰهَا مَا غَشّٰي)

অর্থাৎ পাথরের বৃষ্টি দ্বারা তারা আচ্ছাদিত হয়ে গিয়েছিল। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(فَجَعَلْنَا عَالِيَهَا سَافِلَهَا وَأَمْطَرْنَا عَلَيْهِمْ حِجَارَةً مِّنْ سِجِّيْلٍ)

“আর আমি জনপদকে উল্টিয়ে ওপর-নীচ করে দিলাম এবং তাদের ওপর প্রস্তর-কংকর বর্ষণ করলাম।” (সূরা হিজর ১৫ : ৭৪)

(فَبِأَيِّ اٰلَا۬ءِ رَبِّكَ تَتَمَارٰي)

‘অতএব তুমি তোমার প্রতিপালকের কোন অনুগ্রহ সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করবে?’ অর্থাৎ হে মানব সকল! আল্লাহ তা‘আলার কোন নেয়ামত ও অনুগ্রহকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখবে? কোন নেয়ামতকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখার সুযোগ নেই। বরং স্বীকার করতে হবে, প্রত্যেক নেয়ামত একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার, অন্য কারো নয়।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. আল্লাহ তা‘আলার অসীম ক্ষমতা সম্পর্কে জানলাম।
২. আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে অভাবমুক্ত করেন। অতএব তার কাছেই চাওয়া উচিত।
৩. পূর্ববর্তী সীমালঙ্ঘনকারী জালিম জাতির কী খারাপ পরিণতি হয়েছিল তা জানলাম
৪. প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য সকল নেয়ামত একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার।
৫৬-৬২ নম্বর ¬আয়াতের তাফসীর :

পূর্বের আয়াতগুলোতে আল্লাহ তা‘আলার রুবুবিয়্যাহ ও অসীম ক্ষমতা সম্পর্কে আলোচনার পর পূর্ববর্তী কয়েকটি ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতির বর্ণনা করে আমাদের সতর্ক করে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন : তাদের নিকট সতর্ককারী রাসূলগণ এসেছিলেন কিন্তু তারা অবাধ্য ও জালিম হয়েছিল বিধায় তাদেরকে ধ্বংস করে দিয়েছি। অতএব তোমাদের কাছে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে সতর্ককারীরূপে প্রেরণ করলাম যাতে তোমরা সতর্কতা অবলম্বন করে চলো। মুহাম্মাদ বিন কাব বলেন : هٰذَا نَذِيْرٌ দ্বারা উদ্দেশ্য হল মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)। পূর্ববর্তী ভীতি প্রদর্শনকারীগণ যে ভয় প্রদর্শন করে গিয়েছেন এ নাবীও তেমন একজন সত্যিকার ভীতি প্রদর্শনকারী। যদি তোমরা তাঁর অনুসরণ কর তাহলে তোমরা সফলকাম হবে। অন্যথায় পূর্ববর্তী জাতিদের মধ্যে যারা নাবীদেরকে মিথ্যাপ্রতিপন্ন করেছে তাদের ওপর যেমন শাস্তি এসেছিল তেমনি তোমাদের ওপরও আসবে (কুরতুবী)।

অতএব আমাদের আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলের আনুগত্য করে চলা উচিত। অন্যথায় পূর্ববতীদের মত শাস্তি গ্রাস করে নেবে।

(اَزِفَتِ الْاٰزِفَةُ)

অর্থাৎ কিয়ামত অতি নিকটবর্তী। কিয়ামতকে الْاٰزِفَةُ নামে নামকরণের কারণ হল অচিরেই তা বাস্তবায়িত হবে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(إِنَّهُمْ يَرَوْنَه۫ بَعِيْدًا‏ وَّنَرَاهُ قَرِيْبًا)

“নিশ্চয়ই তারা ঐ দিনকে অনেক দূরে মনে করে, কিন্তু আমি তা দেখছি নিকটে।” (সূরা মাআরিজ ৭০ : ৬-৭)

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন :

مَثَلِي وَمَثَلُ السَّاعَةِ كَهَاتَيْنِ “. وَفَرَّقَ بَيْنَ إِصْبُعَيْهِ الْوُسْطَي وَالَّتِي تَلِي الْإِبْهَامَ

আমার ও কিয়ামতের উদাহরণ হল এরূপ। এ কথা বলে নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মধ্যমা ও তার সাথের আঙ্গুলের মাঝে ফাঁক করে দেখালেন। (মুসনাদে আহমাদ হা. ২২৮০৯)

(لَيْسَ لَهَا مِنْ دُوْنِ اللّٰهِ كَاشِفَةٌ)

‘আল্লাহ ছাড়া কেউই এটা ব্যক্ত করতে সক্ষম নয়’ অর্থাৎ কিয়ামত কখন সংঘটিত হবে আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া তা কেউ আগিয়ে নিয়ে আসতে পারবে না এবং পিছাতেও পারবে না। আবার বলা হয় কিয়ামত আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া কেউ ঘটাতে পারবে না।

(أَفَمِنْ هٰذَا الْحَدِيْثِ تَعْجَبُوْنَ)

‘তোমরা কি এই কথায় (কুরআনে) বিস্ময়বোধ করছ’ অর্থাৎ কুরআন আল্লাহ তা‘আলার কালাম, জিবরীল (আঃ) নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ওপর নাযিল করেছেন এবং তা একটি নির্ভুল আসমানী কিতাব- এ কারণে তোমরা আশ্চর্যবোধ করছ? এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছুই নেই বরং তোমরা কুরআনের সাথে ঠাট্টা-বিদ্রƒপ করে হাসাহাসি করছ, আল্লাহ তা‘আলার শাস্তিকে ভয় করে কাঁদছ না। এখানে حديث বলতে কুরআনকে বুঝানো হয়েছে। এ ছাড়াও অনেক আয়াত রয়েছে যেখানে কুরআনকে হাদীস বলা হয়েছে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(فَلَعَلَّكَ بَاخِعٌ نَّفْسَكَ عَلٰٓي اٰثَارِهِمْ إِنْ لَّمْ يُؤْمِنُوْا بِهٰذَا الْحَدِيْثِ أَسَفًا)‏

“তারা এ হাদীসকে (কুরআনকে) বিশ্বাস না করলে সম্ভবত তাদের পেছনে ঘুরে তুমি দুঃখে নিজেকে ধ্বংস করে দেবে।” (সূরা কাহ্ফ ১৮ : ৬)

سامدون এর سامد অর্থ গাফেল, অসচেতন। অর্থাৎ কুরআন থেকে তোমরা বিমুখ ও গাফেল। এটা তোমাদের জ্ঞানের সল্পতা ও ধর্মের প্রতি তাচ্ছিল্যতা।

(فَاسْجُدُوْا لِلّٰهِ وَاعْبُدُوْا)

‘অতএব তোমরা আল্লাহকে সিজদা কর এবং তাঁর ইবাদত কর’ এটা সিজদার আয়াত। সিজদার বিধান সম্পর্কে সূরা আল আ‘রাফ-এর শেষ আয়াতে বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছে।

আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন : সিজদার আয়াত সম্বলিত অবতীর্ণ হওয়া সর্বপ্রথম সূরা হলো আন নাজম। এ সূরার মধ্যে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সিজদা করলেন এবং সিজদা করল তাঁর পেছনের সকল লোক। তবে এক ব্যক্তিকে আমি দেখলাম, এক মুষ্টি মাটি হাতে তুলে তাতে সিজদা করছে। এরপর আমি তাকে কাফির অবস্থায় নিহত হতে দেখেছি। সে হল উমাইয়াহ বিন খালফ। (সহীহ বুখারী হা. ৪৮৬৩, সহীহ মুসলিম হা. ৫৭৬)

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. কিয়ামত অতি নিকটবর্তী।
২. বেশি বেশি কান্না করার প্রতি উৎসাহ প্রদান করা হচ্ছে।
৩. বেশি বেশি হাসাকে নিন্দা করা হয়েছে।
৪. এ সিজদার আয়াতের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো মুশরিকরাও নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে কা‘বার পাশে সিজদাবনত হয়েছিল।

৪৩-৬২ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন:-
# আনন্দ ও দুঃখের কার্যকারণ তাঁর পক্ষ থেকেই সৃষ্টি হয়ে থাকে। ভাল ও মন্দ ভাগ্যের মূলসূত্র তাঁরই হাতে। কারো ভাগ্যে যদি আরাম ও আনন্দ জুটে থাকে তাহলে তা তাঁর দানেই হয়েছে। আবার কেউ যদি বিপদ-আপদ ও দুঃখ-কষ্টের মুখোমুখি হয়ে থাকে তাও তাঁর ইচ্ছায়ই হয়েছে। এ বিশ্ব-জাহানে এমন আর কোন সত্ত্বা নেই ভাগ্যের ভাঙা গড়ায় যার কোন হাত আছে।
# ওপরের দু’টি আয়াতের সাথে এ আয়াতটি মিলিয়ে পড়লে বুঝা যায়, বাক্যের বিন্যাস থেকে আপনা আপনি মৃত্যুর পরের জীবনের প্রমাণও পাওয়া যাচ্ছে। যে আল্লাহ‌ মৃত্যু এবং জীবন দান করার ক্ষমতা রাখেন, যিনি এক ফোঁটা নগণ্য শুক্র দিয়ে মানুষের মত একটি সৃষ্টিকে তৈরী করেন, বরং সৃষ্টির একই উপাদান ও একই সৃষ্টির পদ্ধতি থেকে নারী ও পুরুষের দু’টি স্বতন্ত্র শ্রেণী সৃষ্টি করে দেখান, তাঁর জন্য মানুষকে পুনরায় সৃষ্টি করা কোন কঠিন কাজ নয়।
# মূল আয়াতে اقني শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। ভাষাবিদ ও মুফাসসিরগণ এর বিভিন্ন অর্থ বর্ণনা করেছেন। কাতাদা বলেনঃ ইবনে আব্বাস এর অর্থ বলেছেন ارضي সম্মত করে দিয়েছেন। ইবনে আব্বাস থেকে ইকরিমা এর অর্থ বর্ণনা করেছেন قنع সন্তুষ্ট করে দিয়েছেন। ইমাম রাযী বলেনঃ মানুষকে তার প্রয়োজনের অতিরিক্ত যা-ই দেয়া হয়ে থাকে তাকেই اقناء বলে। আবু উবায়দা এবং আরো কিছু সংখ্যক ভাষাভিজ্ঞের মতে اقني শব্দটির উদ্ভব قنية শব্দ থেকে। এর অর্থ অবশিষ্ট ও সংরক্ষিত থাকার মত সম্পদ। যেমনঃ ঘর-বাড়ী, জমিজমা, বাগান, গবাদিপশু ইত্যাদি। ইবনে যায়েদ এসব অর্থ থেকে ভিন্ন অর্থ গ্রহণ করেছেন। তিনি বলেন اقني শব্দটি এখানে افقر দরিদ্র করে দিয়েছে অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এভাবে আয়াতের অর্থ দাঁড়ায় তিনি যাকে ইচ্ছা সম্পদশালী করেছেন এবং যাকে ইচ্ছা দরিদ্র বানিয়েছেন।
# শে’রা আকাশের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র। আরবীতে একে مرزم الجوزاء الكلب الاكبر , الكلب الجبار , الشعرى العبور প্রভৃতি নামে উল্লেখ করা হয়ে থাকে। ইংরেজী ভাষায় Sirius, dog star এবং Canis Majoris বলা হয়। এটি সূর্যের চেয়েও ২৩ গুণ বেশী উজ্জ্বল। কিন্তু পৃথিবী থেকে এর দূরত্ব আট আলোকবর্ষেরও বেশী। তাই একে সূর্যের চেয়ে ছোট ও কম উজ্জ্বল দেখা যায়। মিসরবাসীরা এর উপাসনা করতো। কারণ এর উদয়কালে নীল নদে জোয়ার ও প্লাবন হতো। সুতরাং তারা মনে করতো, এর উদয়ের প্রভাবেই এরূপ হয়েছে। জাহেলী যুগে আরবদেরও বিশ্বাস ছিল যে, এ নক্ষত্র মানুষের ভাগ্যের ওপর প্রভাব বিস্তার করে। সেই কারণে এটি আরবদের উপাস্য দেবতাদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং বিশেষ করে কুরাইশদের প্রতিবেশী খুজা’আ গোত্র এর উপাসনার জন্য বিখ্যাত ছিল। আল্লাহ‌ তা’আলার বক্তব্যের অর্থ হচ্ছে, শে’রা নক্ষত্র তোমাদের ভাগ্য গড়ে না বরং তার রব গড়ে থাকেন।
# প্রথম আদ অর্থ প্রাচীন আদ জাতি যাদের কাছে হযরত হূদ আলাইহিস সালামকে পাঠানো হয়েছিল। হযরত হূদকে (আঃ) অস্বীকার করার অপরাধে এ জাতি আল্লাহ‌র আযাবের শিকার হলে যারা তার ওপর ঈমান এনেছিল কেবল তারাই রক্ষা পায়। এদের বংশধরদেরকে ইতিহাসে পরবর্তীকালে আদ বা দ্বিতীয় আদ বলা হয়ে থাকে।

# উল্টিয়ে দেয়া জনপদসমূহ অর্থ লূতের কওমের জনপদসমূহ। আর “আচ্ছন্ন করে দিয়েছিল তাদের ওপর যা কিছু আচ্ছন্ন করে দিয়েছিলো” অর্থ সম্ভবত মরু সাগরের পানি। তাদের জনপদসমূহ মাটিতে ডুবে যাওয়ার পর এ সমুদ্রের পানি তার ওপর ছড়িয়ে পড়েছিলো। আজ পর্যন্ত তা এ অঞ্চল প্লাবিত করে আছে।
# কোন কোন মুফাসসিরের মতে একথাটিও ইবরাহীম ও মূসার সহীফাসমূহের একটি বাক্যাংশ। কিন্তু কোন কোন মুফাসসিরের মতে فَغَشَّاهَا مَا غَشَّى পর্যন্তই সহীফাসমূহের বাক্য শেষ হয়েছে এবং এখান থেকে অন্য বিষয় শুরু হচ্ছে। পরবর্তী কথার প্রতি লক্ষ্য করলে প্রথমোক্ত বক্তব্যই সঠিক বলে মনে হয়। কারণ, পরবর্তী এই বাক্যঃ “এটি একটি সাবধান বাণী-ইতিপূর্বে আগত সাবধানবাণীসমূহের মধ্য থেকে” এ বিষয়ের প্রতিই ইঙ্গিত করে যে, পূর্ববর্তী সবগুলো বাক্যই হযরত ইবরাহীম (আঃ) ও মূসার (আঃ) সহীফাসমূহে উদ্ধৃত হয়েছে। আর এগুলো সবই পূর্বেকার সাবধান বাণীসমূহের অন্তর্ভুক্ত।

# মূল আয়াতে تَتَمَارَى শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে যার অর্থ সন্দেহপোষণ এবং ঝগড়া করা উভয়টিই। এখানে প্রত্যেক শ্রোতাকে সম্বোধন করা হয়েছে। যে ব্যক্তিই এ বাণী শুনছে তাকেই সম্বোধন করে বলা হচ্ছে, আল্লাহ‌ তা’আলার নিয়ামতসমূহ অস্বীকার করা এবং তা নিয়ে নবী-রসূলদের সাথে ঝগড়ায় লিপ্ত হওয়ার যে পরিণতি মানব ইতিহাস দেখেছে তা সত্ত্বেও কি তুমি সেই নির্বুদ্ধিতার কাজ করবে? অতীত জাতিসমূহও তো এ একই সন্দেহপোষণ করেছিলো যে, তারা এ পৃথিবীতে যেসব নিয়ামত ভোগ করছে তা একমাত্র আল্লাহ‌র নিয়ামত না, তা সরবরাহের কাজে অন্য কেউ শরীক আছে? অথবা এসব কারো সরবরাহকৃত নিয়ামত নয়, বরং আপনা থেকেই পাওয়া গিয়েছে। এ সন্দেহের কারণেই তারা নবী-রসূলদের বিরোধিতায় লিপ্ত হয়েছিল। নবী-রসূলগণ তাদের বলতেন, আল্লাহ‌ এবং এক আল্লাহ‌ই তোমাদেরকে এসব নিয়ামতের সবগুলো দান করেছেন। তাই তোমাদের উচিত তাঁরই প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়া এবং তাঁরই দাসত্ব করা। কিন্তু তারা একথা মানতো না এবং এ বিষয়টি নিয়েই নবী-রসূলদের সাথে বিবাদে লিপ্ত হতো। এখন কথা হলো, এসব জাতি তাদের এ সন্দেহ ও বিবাদের কি পরিণাম দেখেছে তা কি তুমি ইতিহাসে দেখতে পাও না? যে সন্দেহ-সংশয় ও বিবাদ অন্যদের জন্য ধ্বংসাত্মক প্রমাণিত হয়েছে তুমিও কি সেই সন্দেহ-সংশয় ও ঝগড়ায় লিপ্ত হবে?

এক্ষেত্রে আরো লক্ষ্য রাখতে হবে যে, আদ, সামূদ এবং নূহের কওমের লোকেরা হযরত ইবরাহীমের (আঃ) পূর্বে অতিবাহিত হয়েছিলো এবং লূতের কওম হযরত ইবরাহীমের (আঃ) সময়েই আযাবে নিপতিত হয়েছিল। তাই এ বাক্যটি যে ইবরাহীমের সহীফার অংশ সে ব্যাপারে কোন অস্পষ্টতা বা জটিলতা নেই।
# মূল কথাটি হল هَذَا نَذِيرٌ مِنَ النُّذُرِ الْأُولَى । এ আয়াতটির ব্যাখ্যায় মুফাসসিরগণের তিনটি মত হলো। এক نَذِيْر অর্থ মুহাম্মাদ ﷺ । দুই, এর অর্থ কুরআন। তিন, এর অর্থ অতীতের ধ্বংস প্রাপ্ত জাতিসমূহের পরিণতি যা পূর্ববর্তী আয়াতসমূহে বর্ণনা করা হয়েছে। পরবর্তী বিষয়বস্তু বিচারে আমাদের মতে এ তৃতীয় ব্যাখ্যাই অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য।

# একথা মনে করো না যে, চিন্তা-ভাবনা করার জন্য এখনো অনেক সময় আছে। তাই এসব কথা নিয়ে এখনই গুরুত্ব সহকারে চিন্তা-ভাবনা করার এবং অবিলম্বে এসব মেনে নেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার জন্য তাড়াহুড়ার প্রয়োজনটা কি? কিন্তু না; তোমাদের কেউ-ই জানে না তার জন্য জীবনের আর কতটা সময় এখনো আছে। যে কোন সময় তোমাদের যে কোন লোকের মৃত্যু এসে হাজির হতে পারে এবং অকস্মাৎ কিয়ামতও এসে পড়তে পারে। তাই চূড়ান্ত ফায়সালার মুহূর্তকে দূরে মনে করো না। যে ব্যক্তিই নিজের পরিণাম সম্পর্কে ভেবে দেখতে চায় সে যেন এক মুহূর্তও বিলম্ব না করে নিজেকে সংযত করে। কারণ, প্রতিবার শ্বাস গ্রহণের সাথে সাথে এ সম্ভাবনাও বিদ্যমান যে, দ্বিতীয়বার শ্বাস গ্রহণের আর কোন সুযোগ হয়তো পাওয়া যাবে না।

# ফায়সালার সময় যখন এসে পড়বে তখন তোমরা না পারবে তা প্রতিরোধ করতে আর আল্লাহ‌ ছাড়া তোমাদের যেসব উপাস্য আছে তাদের কারো এমন ক্ষমতাও নেই যে তা ঠেকাতে পারে। তা ঠেকালে কেবল মাত্র আল্লাহ‌ তা’আলাই ঠেকাতে পারেন। কিন্তু আল্লাহ‌ তা’আলা তা ঠেকাবেন না।
# মূল আয়াতেهَذَا الْحَدِيثِ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ এর মাধ্যমে কুরআন মজীদের আকারে যেসব শিক্ষা পেশ করা হচ্ছিলো এর দ্বারা সেই সব শিক্ষাকে বুঝানো হয়েছে। আর বিস্ময় বলতে বুঝানো হয়েছে সেই বিস্ময়কে যা অভিনব ও অবিশ্বাস্য কথা শুনে মানুষ প্রকাশ করে থাকে। আয়াতটির প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে, মুহাম্মাদ ﷺ যে বিষয়ের প্রতি আহবান জানাচ্ছেন, তা তো এসব কথাই যা তোমরা শুনছো। তাহলে এগুলোই কি সেই সব কথা যা শুনে তোমরা কান খাড়া করে থাকো এবং বিস্ময়ের সাথে এমনভাবে মুখের দিকে তাকাতে থাকো যেন তোমাদেরকে কোন অদ্ভুত ও অভিনব কথা শুনানো হচ্ছে?
# নিজেদের মূর্খতা ও গোমরাহীর কারণে যেখানে তোমাদের কান্না আসা দরকার সেখানে যে সত্য তোমাদের সামনে পেশ করা হচ্ছে তা নিয়ে তোমরা ঠাট্টা ও বিদ্রূপ করছো।

# মূল আয়াতে سَامِدُونَ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। ভাষাবিদগণ এ শব্দটির দু’টি অর্থ বর্ণনা করেছেন। ইবনে আব্বাস, ইকরিমা এবং আবু উবায়দা নাহবীর মতে سمود অর্থ গান বাদ্য করা। মক্কার কাফেররা কুরআনের আওয়াজকে স্তব্ধ করতে ও মানুষের দৃষ্টি অন্যদিকে ফিরিয়ে দেয়ার জন্য জোরে জোরে গান বাদ্য শুরু করতো। এখানে সেদিকেই ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। ইবনে আব্বাস ও ইকরিমা এর আরেকটি অর্থ বর্ণনা করেছেন। তা হচ্ছেঃ

السمود البرطمة وهى رفع الراس تكبرا , كانوا يمرون على النبى صلى الله عليه وسلم عضابا مبرطمين

“অহংকার ভরে ঘাড় উঁচু বা বাঁকা করা। মক্কার কাফেররা রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ এর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ক্রোধে ঘাড় উঁচু করে চলে যেতো।”

রাগেব ইস্পাহানী তার ‘মুফরাদাত’ গ্রন্থে এ অর্থটিই গ্রহণ করেছেন। এ অর্থ বিবেচনা করে কাতাদা ছামিদুন سَامِدُونَ শব্দের অর্থ করেছেন গাফিলুন غَافِلُوْن এবং সায়ীদ ইবনে জুবাইর অর্থ করেছেন মু’য়রিদুন مُعْرِضُوْن ।

# ইমাম আবু হানিফা, ইমাম শাফেয়ী ও অধিকাংশ আলেমের মতে এ আয়াত পাঠ করে সিজদা করা অবশ্য কর্তব্য। ইমাম মালেক, এ আয়াত তিলাওয়াত করে যদিও সব সময় সিজদা করতেন (যেমন কাজী আবু বকর ইবনুল আরাবী আহকামূল কুরআন গ্রন্থে উদ্ধৃত করেছে।) কিন্তু এখানে সিজদা করা জরুরী নয় বলে তিনি মত পোষন করতেন। তাঁর এ মতের ভিত্তি যায়েদ ইবনে সাবেতের এই বর্ণনা যে, “আমি রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ এর সামনে সূরা নাজম পাঠ করলে তিনি সিজদা করেননি।” (বুখারী, মুসলিম, আহমাদ, তিরমিযী, আবু দাউদ, নাসায়ী)। কিন্তু উক্ত হাদীসটি এ আয়াত পাঠ করে সিজদা করার বাধ্যবাধকতা রহিত করে না। কারণ এক্ষেত্রে এরূপ সম্ভাবনা বিদ্যমান যে, কোন কারণে নবী ﷺ সে সময় সিজদা করেননি কিন্তু পরে করেছেন। এ বিষয়ে অন্য সব রেওয়ায়াত থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ পায় যে, এ আয়াত পাঠ করে সব সময় অবশ্যই সিজদা করা হয়েছে। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ), ইবনে আব্বাস (রাঃ) ও মুত্তালিব (রাঃ) ইবনে আবী ওয়াদা’আর সর্বসম্মত বর্ণনাসমূহ হচ্ছে, নবী ﷺ সর্বপ্রথম যখন হারাম শরীফে তিলাওয়াত করেন তখন তিনি সিজদা করেছিলেন। সে সময় মুসলমান ও কাফের সবাই তাঁর সাথে সিজদায় পড়ে গিয়েছিলো।” (বুখারী, আহমাদ, নাসায়ী)। ইবনে উমর (রাঃ) বর্ণনা করেছেন যে, “নবী ﷺ নামাযে সূরা নাজম তিলাওয়াত করে সিজদা করেছেন এবং অনেকক্ষণ পর্যন্ত সিজদায় থেকেছেন।” (বায়হাকী, ইবনে মারদুইয়া)। সাবুরাতুল জুহানী বলেনঃ হযরত উমর (রাঃ) ফজরের নামাযে সূরা নাজম পড়ে সিজদা করেছেন এবং তারপর উঠে সূরা যিলযাল পড়ে রুকূ’ করেছেন।” (সা’য়ীদ ইবনে মানসুর)। ইমাম মালেক নিজেও মুয়াত্তা গ্রন্থের مَا جَاءَ فِى سُجُ

Leave a Reply