بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ ( বই # ১১৪৪/এবং কাফের-রা বলে -১৪) [*‌‌*কিয়ামতের সময় নিকটবর্তী হয়েছে এবং চাঁদ বিদীর্ণ হয়েছে:- *কাফিররা বলবে, ‘বড়ই কঠিন এ দিন।’:-] www.motaher21.net সূরা:৫৪: আল্-ক্বামার। পারা:২৭ ১-১৬ নং আয়াত:- আয়াতের ব্যাখ্যা:- ১) তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন। ২) তাফসীরে ইবনে কাছীর। ৩) তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ। ৪) ফী জিলালিল কুরআন।

Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১১৪৪/এবং কাফের-রা বলে -১৪)
[*‌‌*কিয়ামতের সময় নিকটবর্তী হয়েছে এবং চাঁদ বিদীর্ণ হয়েছে:-
*কাফিররা বলবে, ‘বড়ই কঠিন এ দিন।’:-]
www.motaher21.net
সূরা:৫৪: আল্-ক্বামার।
পারা:২৭
১-১৬ নং আয়াত:-
আয়াতের ব্যাখ্যা:-
১) তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন।
২) তাফসীরে ইবনে কাছীর।
৩) তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ।
৪) ফী জিলালিল কুরআন।

সূরা:৫৪: আল্-ক্বামার-১
اِقۡتَرَبَتِ السَّاعَۃُ وَ انۡشَقَّ الۡقَمَرُ ﴿۱﴾
কিয়ামতের সময় নিকটবর্তী হয়েছে এবং চাঁদ বিদীর্ণ হয়েছে।
সূরা:৫৪: আল্-ক্বামার-২
وَ اِنۡ یَّرَوۡا اٰیَۃً یُّعۡرِضُوۡا وَ یَقُوۡلُوۡا سِحۡرٌ مُّسۡتَمِرٌّ ﴿۲﴾
কিন্তু এসব লোকের অবস্থা হচ্ছে তারা যে নিদর্শনই দেখে, তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং বলে এ তো গতানুগতিক যাদু।
সূরা:৫৪: আল্-ক্বামার-৩
وَ کَذَّبُوۡا وَ اتَّبَعُوۡۤا اَہۡوَآءَہُمۡ وَ کُلُّ اَمۡرٍ مُّسۡتَقِرٌّ ﴿۳﴾
এরা (একেও) অস্বীকার করলো এবং নিজেদের প্রবৃত্তিরই অনুসরণ করলো। প্রত্যেক বিষয়কে শেষ পর্যন্ত একটা পরিণতি লাভ করতে হয়।
সূরা:৫৪: আল্-ক্বামার-৪
وَ لَقَدۡ جَآءَہُمۡ مِّنَ الۡاَنۡۢبَآءِ مَا فِیۡہِ مُزۡدَجَرٌ ۙ﴿۴﴾
এসব লোকদের কাছে (পূর্ববর্তী জাতি সমূহের) সেসব পরিণতির খবর অবশ্যই এসেছে যার মধ্যে অবাধ্যতা থেকে নিবৃত্ত রাখার মত যথেষ্ট শিক্ষণীয় বিষয় আছে।
সূরা:৫৪: আল্-ক্বামার-৫
حِکۡمَۃٌۢ بَالِغَۃٌ فَمَا تُغۡنِ النُّذُرُ ۙ﴿۵﴾
এটা পরিপূর্ণ জ্ঞানগর্ভ বাণী, তবে এই সতর্কবাণীসমূহ তাদের কোন উপকারে আসেনি।
সূরা:৫৪: আল্-ক্বামার-৬
فَتَوَلَّ عَنۡہُمۡ ۘ یَوۡمَ یَدۡعُ الدَّاعِ اِلٰی شَیۡءٍ نُّکُرٍ ۙ﴿۶﴾
অতএব, আপনি তাদের উপেক্ষা করুন। (স্মরণ করুন) যেদিন আহ্‌বানকারী আহ্‌বান করবে এক ভয়াবহ পরিণামের দিকে,
সূরা:৫৪: আল্-ক্বামার-৭
خُشَّعًا اَبۡصَارُہُمۡ یَخۡرُجُوۡنَ مِنَ الۡاَجۡدَاثِ کَاَنَّہُمۡ جَرَادٌ مُّنۡتَشِرٌ ۙ﴿۷﴾
লোকেরা ভীত-বিহবল দৃষ্টি নিয়ে নিজ নিজ কবর থেকে এমনভাবে উঠে আসবে যেন তারা বিক্ষিপ্ত পতঙ্গরাজি।
সূরা:৫৪: আল্-ক্বামার-৮
مُّہۡطِعِیۡنَ اِلَی الدَّاعِ ؕ یَقُوۡلُ الۡکٰفِرُوۡنَ ہٰذَا یَوۡمٌ عَسِرٌ ﴿۸﴾
তারা অহ্বানকারীর দিকে ছুটে আসবে ভীত-বিহ্বল হয়ে । কাফিররা বলবে, ‘বড়ই কঠিন এ দিন।’
সূরা:৫৪: আল্-ক্বামার-৯
کَذَّبَتۡ قَبۡلَہُمۡ قَوۡمُ نُوۡحٍ فَکَذَّبُوۡا عَبۡدَنَا وَ قَالُوۡا مَجۡنُوۡنٌ وَّ ازۡدُجِرَ ﴿۹﴾
এদের পূর্বে নূহের (আঃ) জাতিও অস্বীকার করেছে। তারা আমার বান্দাকে মিথ্যাবাদী বলে আখ্যায়িত করেছে এবং বলেছে, এ লোকটি পাগল। উপরন্তু তাকে তীব্রভাবে তিরষ্কারও করা হয়েছে।
সূরা:৫৪: আল্-ক্বামার-১০
فَدَعَا رَبَّہٗۤ اَنِّیۡ مَغۡلُوۡبٌ فَانۡتَصِرۡ ﴿۱۰﴾
তখন তিনি তাঁর রবকে আহবান করে বলেছিলেন, ‘নিশ্চয় আমি অসহায়, অতএব আপনি প্রতিবিধান করুন।’
সূরা:৫৪: আল্-ক্বামার-১১
فَفَتَحۡنَاۤ اَبۡوَابَ السَّمَآءِ بِمَآءٍ مُّنۡہَمِرٍ ﴿۫ۖ۱۱﴾
তখন আমি আসমানের দরজাসমূহ খুলে দিয়ে মুষলধারে বৃষ্টি বর্ষণ করলাম।
সূরা:৫৪: আল্-ক্বামার-১২
وَّ فَجَّرۡنَا الۡاَرۡضَ عُیُوۡنًا فَالۡتَقَی الۡمَآءُ عَلٰۤی اَمۡرٍ قَدۡ قُدِرَ ﴿ۚ۱۲﴾
এবং মাটি হতে ঝরনা প্রবাহিত করলাম, অতঃপর সকল পানি মিলিত হল এক পরিকল্পনা অনুসারে।
সূরা:৫৪: আল্-ক্বামার-১৩
وَ حَمَلۡنٰہُ عَلٰی ذَاتِ اَلۡوَاحٍ وَّ دُسُرٍ ﴿ۙ۱۳﴾
আর নূহকে (আঃ) আমি কাষ্ঠফলক ও পেরেক সম্বলিত বাহনে আরোহন করিয়ে দিলাম।
সূরা:৫৪: আল্-ক্বামার-১৪
تَجۡرِیۡ بِاَعۡیُنِنَا ۚ جَزَآءً لِّمَنۡ کَانَ کُفِرَ ﴿۱۴﴾
যা আমার তত্ত্বাবধানে চলছিলো। এ ছিলো সে ব্যক্তির জন্য প্রতিশোধ যাকে অস্বীকার ও অবমাননা করা হয়েছিলো।
সূরা:৫৪: আল্-ক্বামার-১৫
وَ لَقَدۡ تَّرَکۡنٰہَاۤ اٰیَۃً فَہَلۡ مِنۡ مُّدَّکِرٍ ﴿۱۵﴾
সে নৌকাকে আমি একটি নিদর্শন বানিয়ে দিয়েছি। এমতাবস্থায় উপদেশগ্রহণকারী কেউ আছো কি?
সূরা:৫৪: আল্-ক্বামার-১৬
فَکَیۡفَ کَانَ عَذَابِیۡ وَ نُذُرِ ﴿۱۶﴾
সুতরাং কেমন ছিল আমার শাস্তি ও সতর্কবাণী!

১-১৬ আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন:-
(৫৪-ক্বামার) : নামকরণ:

সূরার সর্ব প্রথম আয়াতের وَانْشَقَّ الْقَمَرُ বাক্যাংশ থেকে এর নাম গৃহীত হয়েছে। এভাবে নামকরণের তাৎপর্য হচ্ছে এটি সেই সূরা যার মধ্যে القمر শব্দ আছে।

(৫৪-ক্বামার) : নাযিল হওয়ার সময়-কাল :

এ সূরার মধ্যে চন্দ্র খণ্ডিত হওয়ার উল্লেখ আছে। এ থেকেই এর নাযিলের সময়-কাল চিহ্নিত হয়ে যায়। মুহাদ্দিস ও মুফাসসিরগণ এ ব্যাপারে একমত যে, চন্দ্র খণ্ডিত হওয়ার এ ঘটনা হিজরতের প্রায় পাঁচ বছর পূর্বে মক্কায় মিনা নামক স্থানে সংঘটিত হয়েছিলো।

(৫৪-ক্বামার) : বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্য:

রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ এর দাওয়াতের বিরুদ্ধে মক্কার কাফেররা যে হঠকারিতার পন্থা অবলম্বন করে আসছিলো এ সূরায় সে বিষয়ে তাদেরকে সাবধান করে দেয়া হয়েছে। কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার যে খবর রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ দিচ্ছিলেন তা যে সত্যিই সংঘটিত হতে পারে এবং তার আগমনের সময়ে যে অত্যন্ত নিকটবর্তী- চন্দ্র খণ্ডিত হওয়ার বিস্ময়কর ঘটনা তার সুস্পষ্ট প্রমাণ। চন্দ্রের মত একটি বিশাল উপগ্রহ তাদের চোখের সামনে বিদীর্ণ হয়েছিলো। তার দুটি অংশ পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে একটি আরেকটি থেকে এত দূরে চলে গিয়েছিলো যে, প্রত্যক্ষদর্শীরা একটি খণ্ডকে পাহাড়ের এক পাশে অপর খণ্ডটিকে অপর পাশে দেখতে পেয়েছিলো। তারপর দুটি অংশ মুহূর্তের মধ্যে আবার পরস্পর সংযুক্ত হয়েছিলো। বিশ্ব ব্যবস্থা যে অনাদি, চিরস্থায়ী, ও অবিনশ্বর নয়, বরং তার ধ্বংস ও ছিন্ন ভিন্ন হতে পারে এটা তার অকাট্য প্রামাণ। বড় বড় তারকা ও গ্রহরাজি ফেটে টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়তে পারে, একটি আরেকটির ওপর আছড়ে পড়তে পারে এবং কিয়ামতের বিস্তারিত বর্ণনা দিতে গিয়ে কুরআনে তার যে চিত্র অংকন করা হয়েছে তার সব কিছুই যে ঘটতে পারে, শুধু তাই নয় বরং এ ঘটনা এ ইঙ্গিতও দিচ্ছিলো যে, বিশ্ব ব্যবস্থা ধ্বংস ও ছিন্নভিন্ন হওয়ার সূচনা হয়ে গিয়েছে এবং কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার সময় অতি নিকটে এসে পড়েছে। নবী ﷺ এ দিকটির প্রতিই মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেন: তোমরা দেখো এবং সাক্ষী থাকো। কিন্তু কাফেররা এ ঘটনাকে যাদুর বিস্ময়কর কর্মকাণ্ড বলে আখ্যায়িত করলো এবং তা না মানতে বদ্ধপরিকর রইল। এ হঠকারিতার জন্য তাদেরকে এ সূরায় তিরস্কার করা হয়েছে।

বক্তব্য শুরু করতে গিয়ে বলা হয়েছে যে, এসব লোক যুক্তি তর্কও মানে না, ইতিহাস থেকেও শিক্ষা গ্রহণ করেনা, স্পষ্ট নিদর্শনাদি চোখে দেখেও বিশ্বাস করে না। এরা কেবল হাশরের দিনের একচ্ছত্র অধিপতির দিকে ছুটে যেতে থাকবে।

এরপর তাদের সামনে নূহের কওম, আদ, সামূদ, লূতের কওম এবং ফেরাউনের অনুসারীদের অবস্থা সংক্ষেপে বর্ণনা করে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ্‌র প্রেরীত রসূলদের সাবধান বাণীসমূহ অমান্য করে এসব জাতি কি ভয়াবহ আযাবে নিপতিত হয়েছিলো। এভাবে এক একটি জাতির কাহিনী বর্ণনা করার পর বারবার বলা হয়েছে যে, কুরআন উপদেশ গ্রহণের সহজ মাধ্যম। এ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে কোন জাতি যদি সঠিক পথ অনুসরণ করে তাহলে এসব কওমের ওপর যে আযাব এসেছে তা তাদের ওপর কখনো আসতে পারে না।

কিন্তু এটা কোন ধরনের নির্বুদ্ধিতা যে, এই সহজলভ্য উৎস থেকে উপদেশ গ্রহণ করার পরিবর্তে কেউ গোঁ ধরে থাকবে যে, আযাবে নিপতিত না হওয়া পর্যন্ত মানবে না।

একইভাবে অতীত জাতিসমূহের ইতিহাস থেকে উদাহরণ পেশ করার পর মক্কার কাফেরদের উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে যে, যে কর্মপন্থা গ্রহণের কারণে অপরাপর জাতিসমূহ সাজা প্রাপ্ত হয়েছে তোমরাও যদি সেই একই কর্মপন্থা গ্রহণ করো তাহলে তোমরাই বা শাস্তি পাবে না কেন? তোমাদের কি আলাদা কোন বৈশিষ্ট্য আছে যে, তোমাদের সাথে অন্যদের চেয়ে ভিন্ন আচরণ করা হবে? নাকি এই মর্মে ক্ষমার কোন বিশেষ সনদ লিখিতভাবে তোমাদের কাছে এসেছে যে, অন্যদেরকে যে অপরাধে পাকড়াও করা হয়েছে সেই একই অপরাধ করলেও তোমাদের পাকড়াও করা হবে না? আর তোমরা যদি নিজেদের দলীয় বা সংঘবদ্ধ শক্তির কারণে গর্বিত হয়ে থাকো তাহলে তোমাদের এ সংঘবদ্ধ শক্তিকে অচিরেই পরাজিত হয়ে পালাতে দেখা যাবে। সর্বোপরি কিয়ামতের দিন তোমাদের সাথে এর চেয়েও কঠোর আচরণ করা হবে।

সবশেষে কাফেরদের বলা হয়েছে, কিয়ামত সংঘটনের জন্য আল্লাহ্‌ তা’আলার বড় কোন প্রস্তুতির প্রয়োজন নেই। তাঁর আদেশ হওয়া মাত্র চোখের পলকে তা সংঘটিত হবে। তবে সব কিছুর মতই বিশ্ব ব্যবস্থা ও মানব জাতির জন্যও একটা “তাকদীর” বা পরিকল্পিত সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ আছে। এই পরিকল্পনা অনুসারে এ কাজের জন্য যে নির্দিষ্ট সময় আছে সে সময়েই তা হবে। এ ক্ষেত্রে কেউ চ্যালেঞ্জ করলো আর অমনি তাকে স্বমতে আনার জন্য কিয়ামত সংঘটিত করে দেয়া হলো এমনটা হতে পারে না। তা সংঘটিত হচ্ছে না দেখে তোমরা যদি বিদ্রোহ করে বসো তাহলে নিজেদের দুস্কর্মের প্রতিফলই ভোগ করবে। আল্লাহ্‌র কাছে তোমাদের সমস্ত কর্মকাণ্ডের ফিরিস্তি প্রস্তুত হচ্ছে। তোমাদের ছোট বড় কোন তৎপরতাই তাতে লিপিবদ্ধ হওয়া থেকে বাদ পড়েছে না।

# যে কিয়ামতের সংঘটিত হওয়ার খবর তোমাদের দিয়ে আসা হচ্ছে তার সময় যে ঘনিয়ে এসেছে এবং বিশ্ব ব্যবস্থা ধ্বংস ও ছিন্ন ভিন্ন হওয়ার সূচনা যে হয়ে গিয়েছে চাঁদ বিদীর্ণ হওয়াই তার প্রমাণ। তাছাড়া চাঁদের মত একটি বিশাল জ্যোতিষ্কের বিদীর্ণ হয়ে যাওয়ার ঘটনা এ বিষয়ের সুস্পষ্ট প্রমাণ যে, যে কিয়ামতের কথা তোমাদের বলা হচ্ছে তা সংঘটিত হওয়া সম্ভব। এ কথা সুস্পষ্ট যে, চাঁদ যখন বিদীর্ণ হতে পারে, তখন পৃথিবীও বিদীর্ণ হতে পরে, তারকা ও গ্রহরাজির কক্ষপথ ও পরিবর্তিত হতে পারে, উর্ধজগতের গোটা ব্যবস্থাই ধ্বংস ও ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যেতে পারে। এর মধ্যেকার কোনটিই অনাদি, চিরস্থায়ী এবং স্থির ও স্বয়ংসস্পূর্ণ নয় যে, কিয়ামত সংঘটিত হতে পারে না।

কেউ কেউ এ আয়াতাংশের ব্যাখ্যা করেছেন যে, “চাঁদ বিদীর্ণ হবে” আরবী ভাষায় বাকরীতি অনুসারে এ অর্থ গ্রহণ সম্ভব হলেও বাক্যের পূর্বাপর প্রসঙ্গের সাথে এ অর্থ একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। প্রথমত এ অর্থ গ্রহণ করলে আয়াতের প্রথম অংশ অর্থহীন হয়ে পড়ে। এ আয়াত নাযিল হওয়ার সময় চাঁদ যদি বিদীর্ণ না হয়ে থাকে বরং ভবিষ্যতে কোন এক সময় বিদীর্ণ হয় তাহলে তার ভিত্তিতে একথা বলা একেবারেই নিরর্থক যে, কিয়ামতের সময় সন্নিকটবর্তী হয়েছে। ভবিষ্যতে সংঘটিত হবে এমন ঘটনা কিয়ামত সন্নিকটবর্তী হওয়ার প্রমাণ হতে পারে কি করে যে তাকে প্রমাণ হিসেবে পেশ করা যুক্তিযুক্ত হবে? দ্বিতীয়ত এ অর্থ গ্রহণ করার পর যখন আমরা পরবর্তী বাক্য পাঠ করি তখন বুঝা যায় যে, এর সাথে তার কোন মিল নেই। পরবর্তী আয়াত সুস্পষ্টভাবে বলছে যে, লোকেরা সে সময় কোন নিদর্শন দেখেছিল যা ছিল কিয়ামতের সম্ভাব্যতার স্পষ্ট প্রমাণ। কিন্তু তারা তাকে যাদুর তেলেসমাতি আখ্যায়িত করে অস্বীকার করেছিলো এবং কিয়ামত সংঘটিত হওয়া সম্ভব নয় বলে নিজেদের বদ্ধমূল ধারণা আঁকড়ে ধরে পড়েছিলো। যদি وَانْشَقَّ الْقَمَرُ কথাটির অর্থ “চাঁদ বিদীর্ণ হয়েছে” গ্রহণ করা হয় তাহলেই কেবল পূর্বাপর প্রসঙ্গের মাঝে তা খাপ খায়। কিন্তু এর অর্থ যদি “বিদীর্ণ হবে” গ্রহণ করা হয় তাহলে সে ক্ষেত্রে পরবর্তী সব কথাই সামঞ্জস্যহীন হয়ে পড়ে। বক্তব্যের ধারাবাহিকতার মাঝে এ অংশটি জুড়ে দিয়ে দেখুন, আপনি নিজেই বুঝতে পারবেন যে, একথাটির কারণে গোটা বক্তব্যই অর্থহীন হয়ে পড়েছে।

“কিয়ামতের সময় নিকটবর্তী হয়েছে এবং চাঁদ বিদীর্ণ হবে। কিন্তু এসব লোকের অবস্থা হচ্ছে, তারা যে নিদর্শনই দেখে তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং বলে, এতো গতানুগতিক যাদু। এরা অস্বীকার করলো এবং নিজেদের প্রবৃত্তিরই অনুসরণ করলো।”

সুতরাং প্রকৃত সত্য এই যে, চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হওয়ার ঘটনা কুরআনের সুস্পষ্ট বক্তব্য থেকেই প্রমাণিত তা কেবল হাদীসের বর্ণনা সমূহের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। তবে হাদীস সমূহের বর্ণনা থেকে এ বিষয়টি সবিস্তারে জানা যায় এবং তা কবে ও কোথায় সংঘটিত হয়েছিলো তাও অবহিত হওয়া যায়। বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, আহমদ, আবু ‘উওয়ানা, আবু দাউদ তায়ালেসী, আবদুর রাযযাক, ইবনে জারীর, বায়হাকী, তাবারানী, ইবনে মারদুইয়া ও আবু নু’য়াইম ইস্পাহানী বিপুল সংখ্যক সনদের মাধ্যমে হযরত আলী, হযরত আবদুল্লাহ্‌ ইবনে মাসউদ, হযরত আবদুল্লাহ্‌ ইবনে আব্বাস, হযরত ইবনে উমর, হযরত হুযাইফা, হযরত আনাস ইবনে মালেক ও হযরত জুবাইর ইবনে মুত’এম থেকে এসব হাদীস বর্ণনা করেছেন।

এসব সম্মানিত সাহাবা কিরামের মধ্যে তিনজন অর্থাৎ আবদুল্লাহ্‌ ইবনে মাসউদ, হযরত হুযাইফা ও হযরত জুবাইর ইবনে মুত’এম স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন যে, তাঁরা এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। তাছাড়া তাঁদের মধ্যে দু’জন এমন ব্যক্তি আছেন যারা প্রত্যক্ষদর্শী নন। কারণ এটি তাদের মধ্যে একজনের (আবদুল্লাহ্‌ ইবনে আব্বাস) জন্মের পূর্বের ঘটনা। আর অপরজন ঘটনার সময় শিশু ছিলেন। কিন্তু তারা উভয়েই যেহেতু সাহাবী। তাই যেসব বয়স্ক সাহাবা এ ঘটনা সম্পর্কে ওয়াকিফহাল ছিলেন তাঁদের নিকট থেকে শুনেই হয়তো তারা এ ঘটনা বর্ণনা করেছেন।

সমস্ত রেওয়ায়াত একত্রিত করলে এ ঘটনার যে বিস্তারিত বিবরণ জানা যায় তা হচ্ছে, এটি হিজরতের প্রায় পাঁচ বছর পূর্বের ঘটনা। সেদিন ছিল চান্দ্র মাসের চতুর্দশ রাত্রি। চাঁদ তখন সবে মাত্র উদিত হয়েছিলো। অকস্মাৎ তা দ্বিখণ্ডিত হলো এবং তার একটি অংশ সম্মুখের পাহাড়ের এক দিকে আর অপর অংশ অপরদিকে পরিদৃষ্ট হলো। এ অবস্থা অল্প কিছু সময় মাত্র স্থিতি পায়। এর পরক্ষণেই উভয় অংশ আবার পরস্পর সংযুক্ত হয়। নবী ﷺ সে সময় মিনাতে অবস্থান করেছিলেন। তিনি লোকদের বললেনঃ দেখো এবং সাক্ষী থাকো। কাফেররা বললোঃ মুহাম্মাদ ﷺ আমাদের ওপর যাদু করেছিলো তাই আমাদের দৃষ্টি ভ্রম ঘটেছিল। অন্যরা বললোঃ মুহাম্মাদ আমাদের ওপর যাদু করতে পারে, তাই বলে সমস্ত মানুষকে তো যাদু করতে সক্ষম নয়। বাইরের লোকদের আসতে দাও। আমরা তাদেরকেও জিজ্ঞেস করবো, তারাও এ ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছে কি না। বাইরে থেকে কিছু লোক আসলে তারা বললো যে, তারাও এ দৃশ্য দেখেছে।

হযরত আনাস থেকে বর্ণিত কোন কোন রেওয়ায়াতের ভিত্তিতে এরূপ ভুল ধারণার সৃষ্টি হয় যে, চন্দ্র দ্বিখণ্ডিত হওয়ার ঘটনা একবার নয়, দুইবার সংঘটিত হয়েছিলো। কিন্তু প্রথমত সাহাবীদের মধ্যে আর কেউ এ কথা বর্ণনা করেননি। দ্বিতীয়ত হযরত আনাসের কোন কোন রেওয়ায়াতে (مَرَّتَيْن) দুইবার কথাটি উল্লেখিত হয়েছে এবং কোনটিতে فِرْقَتَيْن বা شِقَّتَيْنَ দুই খণ্ড শব্দ উল্লেখিত হয়েছে। তৃতীয়ত, কুরআন মজীদে শুধু একবার খণ্ডিত হওয়ার কথা উল্লেখিত হয়েছে। এ দিক দিয়ে সঠিক কথা এটিই যে, এ ঘটনা শুধু একবারই সংঘটিত হয়ছিলো।

এ সম্পর্কে সমাজে কিছু কিচ্ছাকাহিনীও প্রচলিত আছে। ওগুলোতে বলা হয়েছে যে, রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ আঙুল দিয়ে চাঁদের দিকে ইশারা করলেন আর তা দ্বি-খণ্ডিত হয়ে গেল। তাছাড়া চাঁদের একটি অংশ নবীর ﷺ জামার গলদেশ দিয়ে প্রবেশ করে হাতার মধ্য দিয়ে বেরিয়ে গেল। এসব একেবারেই ভিত্তিহীন কল্পকাহিনী।

এখানে প্রশ্ন দেখা দেয় যে, এ ঘটনার সত্যিকার ধরন ও প্রকৃতি কি ছিল? এটা কি কোন মু’জিযা ছিল যা মক্কার কাফেরদের দাবীর প্রেক্ষিতে রিসালাতের প্রমাণ হিসেবে রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ দেখিয়েছিলেন? নাকি এটা কোন দুর্ঘটনা ছিল যা আল্লাহ‌র কুদরত বা অসীম ক্ষমতায় চাঁদের বুকে সংঘটিত হয়েছিল এবং রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ সেদিকে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন শুধু এই জন্য যে, তা কিয়ামতের সম্ভাব্যতাও সন্নিকটবর্তী হওয়ার একটি নিদর্শন। মুসলিম মনীষীদের একটি বিরাট গোষ্ঠী এ ঘটনাকে নবীর ﷺ মু’জিযা হিসেবে গণ্য করেন। তাঁদের ধারণা অনুসারে মক্কার কাফেরদের দাবীর কারণে এ মু’জিযা দেখানো হয়েছিলো। কিন্তু হযরত আনাস বর্ণিত হাদীসসমূহের দু’য়েকটির ওপর ভিত্তি করেই এ অভিমত ব্যক্ত করা হয়েছে। তিনি ছাড়া অন্য আর কোন সাহাবীই এ কথা বর্ণনা করেননি। ইবনে হাজার তাঁর ফাতহুল বারী গ্রন্থে বলেছেনঃ “যতগুলো সূত্রে এ ঘটনার বর্ণনা দেয়া হয়েছে তার মধ্যে হযরত আনাস বর্ণিত হাদীস ছাড়া আর কোথাও এ কথা আমার চোখে পড়েনি যে, মুশরিকদের দাবীর কারণে চন্দ্র দ্বি-খণ্ডিত হওয়ার ঘটনা ঘটেছিল।” باب انْشِقَاقِ الْقَمَرِ । আবু নুয়াইম ইস্পাহানী “দালায়েলুন নবুওয়াত” গ্রন্থে হযরত আবদুল্লাহ্‌ উবনে আব্বাস থেকেও একই বিষয়ে একটি হাদীস উদ্ধৃত করেছেন। কিন্তু তার সনদ দুর্বল। মজবুত সনদে হাদীস গ্রন্থসমূহে যতগুলো হাদীস হযরত ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত হয়েছে তার কোনটিতেই একথার উল্লেখ নেই। তাছাড়া হযরত আনাস ও হযরত আবদুল্লাহ্‌ ইবনে আব্বাস উভয়ই এ ঘটনার সম সাময়িক ছিলেন না। অপর দিকে যেসব সাহাবাকিরাম সে সময় বর্তমান ছিলেন- যেমনঃ হযরত আবদুল্লাহ্‌ ইবনে মাসউদ (রাঃ), হযরত হুযাইফা (রাঃ), হযরত জুবাইর (রাঃ), ইবনে মুত’এম, হযরত আলী (রাঃ) ও হযরত আবদুল্লাহ্‌ ইবনে উমর, তাঁদের কেউ-ই এ কথা বলেননি যে, মক্কার মুশরিকরা নবীর ﷺ নবুওয়াতের সত্যতার প্রমাণ হিসেবে কোন নির্দশনের দাবী করেছিলো এবং সে কারণেই তাদেরকে চন্দ্র দ্বিখণ্ডিত হওয়ার এ মু’জিযা দেখানো হয়েছিলো। সব চেয়ে বড় কথা, কুরআন মজীদ এ ঘটনাকে মুহাম্মাদের ﷺ রিসালাতের নিদর্শন হিসেবে পেশ করছে না, বরং কিয়ামত নিকটবর্তী হওয়ার নিদর্শন হিসেবে পেশ করছে। তবে নবী ﷺ লোকদেরকে কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার যে খবর দিয়েছিলেন এ ঘটনা তার সত্যতা প্রমাণ করেছিলো। সুতরাং এদিক দিয়ে এ ঘটনা অবশ্যই তাঁর নবুওয়াতেরও সত্যতার স্পষ্ট প্রমাণ ছিল।

বিরুদ্ধবাদীরা এক্ষেত্রে দুই ধরনের আপত্তি উত্থাপন করে থাকে। প্রথমত, তাদের মতে এরূপ ঘটা আদৌ সম্ভব নয় যে, চাঁদের মত বিশালায়তন একটি উপগ্রহ বিদীর্ণ হয়ে দুই খণ্ড হয়ে যাবে এবং খণ্ড দু’টি পরস্পর শত সহস্র মাইল দূরত্বে চলে যাওয়ার পর আবার পরস্পর সংযুক্ত হবে। দ্বিতীয়ত, তারা বলে এ ঘটনা যদি ঘটেই থাকে তাহলে তা দুনিয়াময় প্রচার হয়ে যেতো, ইতিহাসে তার উল্লেখ দেখা যেতো এবং জ্যোতিষ-শাস্ত্রের গ্রন্থসমূহে তার বর্ণনা থাকতো। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এ দু’টি আপত্তি গুরুত্বহীন। চন্দ্র বিদীর্ণ হওয়ার সম্ভাব্যতার প্রশ্নে বলা যায়, তা সম্ভব নয়, একথা প্রাচীন কালে হয়তো বা গ্রহণযোগ্য হতে পারতো। কিন্তু গ্রহ-উপগ্রহসমূহের গঠন প্রকৃতি সম্পর্কে বর্তমানে মানুষ যে জ্ঞান ও তথ্য লাভ করেছে তার ভিত্তিতে একটি গ্রহ তার আভ্যন্তরীণ অগ্ন্যৎপাতের কারণে বিদীর্ণ হতে পারে। এ ভয়ানক বিস্ফোরণের ফলে তা দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পরস্পর বহুদূরে চলে যেতে পারে এবং তার কেন্দ্রের চৌম্বুক শক্তির কারণে পুনরায় পরস্পর সংযুক্ত হতে পারে। এটা সম্পূর্ণরূপে সম্ভব। এরপর দ্বিতীয় আপত্তির গুরুত্বহীন হওয়া সম্পর্কে বলা যায়, এ ঘটনা অকস্মাৎ এবং মুহূর্তের জন্য সংঘটিত হয়েছিল। সে বিশেষ মুহূর্তে সারা পৃথিবীর দৃষ্টি চাঁদের দিকে নিবদ্ধ থাকবে এটি জরুরী নয়। সে মূহুর্তে বিস্ফোরণের কোন শব্দ হয়নি যে, সেদিকে মানুষের দৃষ্টি আকৃষ্ট হবে। এ উদ্দেশ্যে পূর্বাহ্ণেই কোন ঘোষণা দেয়া হয়নি যে, লোকজন তার অপেক্ষায় আকাশের দিকে চেয়ে থাকবে। ভূ-পৃষ্ঠের সর্বত্র তা দৃষ্টিগোচর হওয়াও সম্ভব ছিল না। সে সময় শুধু আরব ও তার পূর্বাঞ্চল সন্নিহিত দেশ সমূহেই চন্দ্র উদিত হয়েছিল। সে সময় ইতিহাস চর্চার রুচি ও প্রবণতা ছিল না এবং স্বতন্ত্র বিষয় হিসেবেও সে সময় তা এতটা উন্নত ছিল না যে, পূর্বাঞ্চলীয় দেশসমূহের যেসব লোক তা দেখেছিলো তারা তা লিপিবদ্ধ করে নিতো, কোন ঐতিহাসিকের কাছে এসব প্রমাণাদি সংগৃহীত থাকতো এবং কোন গ্রন্থে সে তার লিপিবদ্ধ করতো। তা সত্ত্বেও মালাবারের ইতিহাসে উল্লেখ আছে যে, সে রাতে সেখানকার একজন রাজা এ দৃশ্য দেখেছিলেন। জ্যোতিষ শাস্ত্রীয় গ্রন্থাদি ও পঞ্জিকাসমূহে এ ঘটনার উল্লেখ কেবল তখনই থাকা জরুরী হতো যদি এর দ্বারা চন্দ্রের গতি, তার পরিক্রমণের পথ এবং উদয়াস্তের সময়ে কোন পরিবর্তন সূচিত হতো। কিন্তু তা যেহেতু, হয়নি, তাই প্রাচীনকালের জ্যোতির্বিদদের দৃষ্টিও এদিকে আকৃষ্ট হয়নি। সে যুগের মান মন্দিরসমূহও এতটা উন্নত ছিল না যে, নভোমণ্ডলে সংঘটিত প্রতিটি ঘটনাই তারা পর্যবেক্ষণ ও রেকর্ডভুক্ত করতে পারতেন।

# মূল ইবারতে سِحْرٌ مُسْتَمِرٌّ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এর কয়েকটি অর্থ হতে পারে। এক, মুহাম্মাদ ﷺ রাতদিন একের পর এক যে যাদু চালিয়ে যাচ্ছেন, নাউযুবিল্লাহ্‌-এটিও তার একটি। দুই, এটা পাকা যাদু। অত্যন্ত নিপুণভাবে এটি দেখানো হয়েছে। তিন, অন্য সব যাদু যেভাবে অতীত হয়ে গিয়েছে এটিও সেভাবে অতীত হয়ে যাবে, এর দীর্ঘস্থায়ী কোন প্রভাব পড়বে না।
# কিয়ামত বিশ্বাস না করার যে সিদ্ধান্ত তারা নিয়ে রেখেছে এ নিদর্শন দেখার পরও তারা সেটিকেই আঁকড়ে ধরে আছে। কিয়ামতকে বিশ্বাস করা যেহেতু তাদের প্রবৃত্তির আকাংখার পরিপন্থী ছিল, তাই সুস্পষ্ট নিদর্শন দেখার পরও এরা তা মেনে নিতে রাজী হয়নি।
# এর অর্থ মুহাম্মাদ ﷺ তোমাদের ন্যায় ও সত্যের দিকে আহবান জানাতে থাকবেন আর তোমরা হঠকারীতা করে নিজেদের বাতিল মত ও পথের ওপর অবিচল থাকবে, এ অবস্থা অনির্দিষ্ট কাল পর্যন্ত চলতে পারে না। তাঁর ন্যায় ও সত্যপন্থী হওয়া এবং তোমাদের বাতিল পন্থী হওয়া কখনো প্রমাণিত হবে না, তা হতে পারে না। সব কিছুই শেষ পর্যন্ত একটা পরিণতি লাভ করে। অনুরূপভাবে তোমাদের ও মুহাম্মাদ ﷺ এর মধ্যে যে দ্বন্দ্ব সংঘাত চলছে তারও একটি অনিবার্য পরিণাম আছে। তাকে অবশ্যই সে পরিণাম লাভ করতে হবে। এমন একটি সময় অবশ্যই আসবে যখন প্রকাশ্যে প্রমাণিত হবে যে, তিনি ন্যায় ও সত্যের পথে ছিলেন আর তোমরা বাতিলের অনুসরণ করেছিলে। অনুরূপভাবে যারা ন্যায় ও সত্যপন্থী, তারা ন্যায় ও সত্যপন্থা অনুসরণের এবং যারা বাতিল পন্থী, তারা বাতিল পন্থা অনুসরণের ফলও একদিন অবশ্যই লাভ করবে।

# অন্য কথায় এদের আপন অবস্থায় ছেড়ে দাও। আখেরাত অস্বীকৃতির পরিণাম ও ফলাফল কি এবং অপরাপর জাতিসমূহ নবী-রসূলদের কথা না মানার যে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ভোগ করেছে তা যখন এদেরকে অধিকতর যুক্তিগ্রাহ্য পন্থায় বুঝানো হয়েছে এবং মানবেতিহাস থেকে উদাহরণ পেশ করে বলে দেয়া হয়েছে, তারপরও এরা যদি হঠকারিতা পরিহার না করে তাহলে তাদেরকে এ বোকার স্বর্গেই বাস করতে দাও। এরপর এরা কেবল তখনই কথা মেনে নেবে যখন মৃত্যুর পর কবর থেকে উঠে নিজের চোখে দেখবে, কিয়ামত শুরু হয়ে গিয়েছে। তখন স্বচক্ষেই দেখতে পাবে যে, যে কিয়ামত সম্পর্কে তাদেরকে আগে ভাগেই সাবধান করে দিয়ে সঠিক পথ অনুসরণের পরামর্শ দেয়া হতো তা যথারীতি শুরু হয়ে গেছে।
# আরেকটি অর্থ অজানা-অচেনা জিনিসও হতে পারে। অর্থাৎ এমন জিনিস যা কখনো তাদের কল্পনায়ও স্থান পায়নি, যার কোন চিত্র বা ধরণ তাদের মগজে ছিল না, কোন সময় এ ধরনের কোন কিছুর মুখোমুখি হতে হবে সে অনুমানও তারা করতে পারেনি।

# মূল শব্দ হচ্ছে خُشَّعًا أَبْصَارُهُمْ অর্থাৎ তাদের দৃষ্টি আনত থাকবে। এর কয়েকটি অর্থ হতে পারে। এক, ভীতি ও আতঙ্ক তাদেরকে আচ্ছন্ন করে ফেলবে। দুই, তাদের মধ্যে লজ্জা ও অপমানবোধ জাগ্রত হবে এবং চেহারায় তার বর্হিপ্রকাশ ঘটবে। কারণ, কবর থেকে বেরিয়ে আসা মাত্র তারা বুঝতে পারবে যে, এটিই সে পরকালীন জীবন যা আমরা অস্বীকার করতাম। যে জীবনের জন্য আমরা কোন প্রস্তুতি গ্রহণ করে আসিনি এবং যে জীবনে এখন আমাদেরকে অপরাধী হিসেবে আল্লাহ‌র সামনে হাজির হতে হবে। তিন, তারা হতবুদ্ধি হয়ে তাদের চোখের সামনে বিদ্যমান সে ভয়াবহ দৃশ্য দেখতে থাকবে। তা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়ার হুঁশও তাদের থাকবে না।
# কবর বলতে শুধুমাত্র সেসব কবরই বুঝানো হয়নি মাটি খুঁড়ে যার মধ্যে কাউকে যথারীতি দাফন করা হয়েছে। বরং এর দ্বারা বুঝানো হয়েছে, যেখানেই কোন ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করেছে কিংবা যেখানেই তার দেহ পড়েছিল হাশরের ময়দানের দিকে আহ্বানকারীর একটি আওয়াজ শুনেই সে সেখান থেকে উঠে দাঁড়াবে।

# আখেরাত সংঘটিত হবে সেখানে মানুষকে তার কাজ কর্মের হিসেব দিতে হবে এবং একথাই তারা অবিশ্বাস করেছে, যে নবী তাঁর জাতিকে এ সত্য সম্পর্কে অবহিত করে আসছিলো সে নবীকেও অস্বীকার করেছে, আখেরাতের জিজ্ঞাসাবাদে সফলকাম হওয়ার জন্য মানুষকে কিরূপ আকীদা-বিশ্বাস পোষণ করতে হবে, কি ধরনের কাজ করতে হবে এবং কোন জিনিস পরিহার করে চলতে হবে, এসব সম্পর্কে নবী যা শিক্ষা দিতেন তাও তারা গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছে।
# এ লোকেরা নবীকে অস্বীকার ও অমান্যই শুধু করেনি, তাঁকে পাগল বলে আখ্যায়িত করেছে, তাঁকে হুমকি ও ভীতি প্রদর্শন করেছে, তাঁর প্রতি অভিশাপ ও তিরস্কার বর্ষণ করেছে, হুমকি-ধমকি ও ভয়-ভীতি দেখিয়ে সত্য প্রচার থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করেছে এবং তাঁর জীবন ধারণ অসম্ভব করে তুলেছে।
# আল্লাহ‌র নির্দেশে ভূ-পৃষ্ঠ ফেটে এমনভাবে ঝর্ণাধারাসমূহ প্রবাহিত হতে থাকলো, যেন তা ভু-পৃষ্ঠ নয়, অসংখ্য ঝর্ণাধারা।

# প্লাবন আসার পূর্বেই আল্লাহ‌র নির্দেশে হযরত নূহ (আঃ) যে জাহাজ নির্মাণ করেছিলেন।

# মূল ইবারত হচ্ছে جَزَاءً لِمَنْ كَانَ كُفِرَ অর্থাৎ এসব করা হয়েছে সে ব্যক্তির কারণে প্রতিশোধ গ্রহণের উদ্দেশ্যে যাকে অবমাননা ও অসম্মান করা হয়েছিল। كفر শব্দটিকে যদি অস্বীকৃতি অর্থে গ্রহণ করা হয় তাহলে অর্থ হবে “যার কথা মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানানো হয়েছিল।” আর যদি নিয়ামতের কৃতজ্ঞতা বা অস্বীকৃতি অর্থে গ্রহণ করা হয় তাহলে তার অর্থ হয় “যার সত্ত্বা ছিল একটি নিয়ামত স্বরূপ তার প্রতি অকৃজ্ঞতা ও অস্বীকৃতির আচরণ করা হয়েছিল।”
# এ অর্থও হতে পারে যে, আমরা এ আযাবকে শিক্ষণীয় নিদর্শন বানিয়ে দিয়েছি। কিন্তু আমাদের মতে সর্বাধিক অগ্রধিকার যোগ্য অর্থ হচ্ছে, সে জাহাজকে শিক্ষণীয় নিদর্শন বানিয়ে দেয়া হয়েছে। একটি সুউচ্চ পর্বতের ওপরে তার অস্তিত্ব টিকে থাকা হাজার হাজার বছর ধরে মানুষকে আল্লাহ‌র গযব সম্পর্কে সাবধান করে আসছে। তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে যে, এ ভূ-খণ্ডে আল্লাহ‌র নাফরমানদের জন্য কি দুর্ভাগ্য নেমে এসেছিল এবং ঈমান গ্রহণকারীদের কিভাবে রক্ষা করা হয়েছিল। ইমাম বুখারী, ইবনে আবী হাতেম, আবদুর রাযযাক ও ইবনে জারীর, কাতাদা থেকে যেসব হাদীস বর্ণনা করেছেন তা থেকে জানা যায় যে, মুসলমানদের ইরাক ও আল-জাযিরা বিজয়ের যুগে এ জাহাজ জুদী পাহাড়ের ওপর (অন্য একটি রেওয়ায়াত অনুসারে “বা-কিরদা” নামক জনপদের সন্নিকটে) বর্তমান ছিল এবং প্রাথমিক যুগের মুসলমানগণ তা দেখেছিলেন। বর্তমান যুগেও বিমান ভ্রমনের সময় কেউ কেউ এ এলাকার একটি পর্বত শীর্ষে জাহাজের মত বস্তু পড়ে থাকতে দেখেছেন। সেটিকে নূহের জাহাজ বলে সন্দেহ করা হয়। আর এ কারণেই তা অনুসন্ধানের উদ্দেশ্যে মাঝে মধ্যে অভিযাত্রী দল অভিযান পরিচালনা করে আসছে। (আরো বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, আল আ’রাফ, টীকা-৪৭ , হূদ, টীকা-৪৬ ; আল আনকাবূত, টীকা-২৫ )।

১-১৬ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে ইবনে কাছীর:-
# হযরত আবূ ওয়াকিদ (রঃ)-এর রিওয়াইয়াত পূর্বে গত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) ঈদুল আযহা ও ঈদুল ফিতরের নামাযে সূরায়ে ও সূরায়ে পাঠ করতেন। অনুরূপভাবে বড় বড় মাহফিলেও তিনি এ দু’টি সূরা তিলাওয়াত করতেন। কেননা, এতে পুরস্কার ও শাস্তির প্রতিজ্ঞা, প্রথম সৃষ্টি ও মৃত্যুর পর পুনরুত্থান এবং এর সাথে সাথে তাওহীদ ও রিসালাত সাব্যস্তকরণ ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর বর্ণনা রয়েছে।

১-৫ নং আয়াতের তাফসীর:

আল্লাহ তা’আলা কিয়ামত নিকটবর্তী হওয়া এবং দুনিয়া শেষ হয়ে যাওয়ার খবর দিচ্ছেন। যেমন তিনি বলেছেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “আল্লাহর আদেশ (কিয়ামত) আসবেই; সুতরাং তা ত্বরান্বিত করতে চেয়ো না।” (১৬:১) আরো বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ মানুষের হিসাব নিকাশের সময় আসন্ন, কিন্তু তারা উদাসীনতায় মুখ ফিরিয়ে রয়েছে।” (২১:১) এই বিষয়ের উপর বহু হাদীসও বর্ণিত হয়েছে।

হযরত আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একদা রাসূলুল্লাহ (সঃ) স্বীয় সাহাবীদের সামনে ভাষণ দান করেন। ঐ সময় সূর্য অস্তমিত হতে অতি অল্প সময় বাকী ছিল। ভাষণে তিনি বলেনঃ “যার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে তার। শপথ! অতীত যুগের তুলনায় দুনিয়ার হায়াতও এই পরিমাণ বাকী আছে যে পরিমাণ সময় এই দিনের বাকী আছে দিনের গত হয়ে যাওয়া সময়ের তুলনায়। সূর্যের তো আমরা সামান্য অংশই দেখতে পাচ্ছি।” (এ হাদীসটি হাফিয আবু বকর আল বাযযার (রঃ) বর্ণনা করেছেন। এ হাদীসের বর্ণনাকারীদের মধ্যে হযরত খালফ ইবনে মূসা (রঃ)-কে ইমাম ইবনে হিব্বান (রঃ) বিশ্বাসযোগ্য বর্ণনাকারীদের মধ্যে গণ্য করেন বটে, কিন্তু বলেন যে, তিনি কখনো কখনো কখনো ভুলও করে থাকেন। দ্বিতীয় রিওয়াইয়াতটি একে সবল করে। এমন কি এর ব্যাখ্যা করে)

হযরত ইবনে উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা আসরের পর যখন সূর্য ডুবু ডুবু প্রায়, তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “অতীত যুগের লোকদের বয়সের তুলনায় তোমাদের বয়স ততটুকু যতটুকু এই বাকী সময়, এই দিনের গত হয়ে যাওয়া সময়ের তুলনায়। (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

হযরত সাহল ইবনে সা’দ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আমি ও কিয়ামত এই ভাবে প্রেরিত হয়েছি।” অতঃপর তিনি তর্জনী ও মধ্যমা অঙ্গুলী দ্বারা ইশারা করেন। অন্য রিওয়াইয়াতে এটুকু বেশী আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “কিয়ামত আমা হতে বেড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল।” (এ হাদীসটিও ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন এবং ইমাম বুখারী (রঃ) ও ইমাম মুসলিম (রঃ) হযরত আবু হাফিয সালমা ইবনে দীনার (রঃ)-এর হাদীস হতে এটা তাখরীজ করেছেন)

হযরত আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) ওয়ালিদ ইবনে আবদিল মালিকের নিকট পোঁছলে তিনি তাঁকে কিয়ামত সম্বলিত হাদীসটি জিজ্ঞেস করেন। তিনি উত্তরে বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে বলতে শুনেছিঃ “তোমরা ও কিয়ামত এ দু’টি অঙ্গুলির মত।” এর সাক্ষ্য এ হাদীস দ্বারাও হতে পারে, যার মধ্যে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর মুবারক নামগুলোর মধ্যে একটি নাম হাশির এসেছে। আর হাশির হলেন তিনি যার পদদ্বয়ের উপর জনগণের হাশর হবে।

হযরত বাহায (রঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, হযরত উৎবা ইবনে গাওয়ান (রাঃ) স্বীয় ভাষণে বলেন এবং কখনো বলতেন, রাসূলুল্লাহ (সঃ) আমাদের সামনে ভাষণ দিতে গিয়ে আল্লাহ তা’আলার হামদ ও সানার পর বলেনঃ “দুনিয়া শেষ হয়ে যাওয়ার ঘোষণা হয়ে গেছে। এটা পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে পালিয়ে যাচ্ছে। যেমন পাত্রের খাদ্য খেয়ে নেয়া হয় এবং ধারে কিছু লেগে থাকে, দ্রুপ দুনিয়ার বয়সের সমস্ত অংশই বেরিয়ে পড়েছে, শুধু নামে মাত্র বাকী আছে। তোমরা এখান হতে এমন জগতের দিকে গমনকারী যা কখনো ধ্বংস হবার নয়। সুতরাং সম্ভব হলে তোমরা এখান হতে কিছু পুণ্য সাথে নিয়ে যাও। জেনে রেখো, আমাদের কাছে বর্ণনা করা হয়েছে যে, জাহান্নামের ধার হতে একটি পাথর নিক্ষেপ করা হবে যা সত্তর বছর ধরে নীচের দিকে অনবরত নামতে থাকবে, তবুও ওর তলা পর্যন্ত পৌঁছতে পারবে না। আল্লাহর শপথ! জাহান্নামের এই গভীর গর্ত মানুষ দ্বারা পূর্ণ করা হবে। তোমরা এতে বিস্ময় প্রকাশ করো না। আমাদের কাছে এও বর্ণনা করা হয়েছে যে, জান্নাতের চৌকাঠের দুটি কাঠের মধ্যবর্তী ব্যবধান চল্লিশ বছরের পথ। আর এটাও একদিন এমনভাবে পূর্ণ হয়ে যাবে যে, খুবই ভীড় দেখা যাবে (শেষ পর্যন্ত)।

আবু আবদির রহমান সালমী (রঃ) বলেনঃ “আমি আমার পিতার সাথে মাদায়েনে গমন করি। জনপদ হতে তিন মাইল দূরে আমরা অবস্থান করি। জুমআর নামাযের জন্যে আমিও আমার পিতার সাথে গমন করি। হযরত হুযাইফা (রাঃ) মসজিদের খতীব ছিলেন। তিনি খুত্বায় বলেনঃ “হে জনমণ্ডলী! জেনে রেখো যে, আল্লাহ তা’আলা বলেছেনঃ “কিয়ামত আসন্ন, চন্দ্র বিদীর্ণ হয়েছে। কিয়ামত নিকটে এসে গেছে এবং অবশ্যই চন্দ্র দ্বিখণ্ডিত হয়েছে। নিশ্চয়ই দুনিয়া বিচ্ছিন্নতার সতর্কধ্বনি করেছে। আজকের দিনটি হলো চেষ্টা ও প্রস্তুতির দিন। আগামী কাল তো হবে দৌড়াদৌড়ি করে আগে বেড়ে যাওয়ার দিন।” আমি আমার পিতাকে জিজ্ঞেস করলামঃ কালকে দৌড় হবে কি যাতে আগে বেড়ে যেতে হবে? তিনি উত্তরে আমাকে বললেনঃ “তুমি তো একেবারে অজ্ঞ ছেলে! এখানে একথার দ্বারা আমলের দিক দিয়ে একে অপরের আগে বেড়ে যাওয়া বুঝানো হয়েছে। দ্বিতীয় জুমআর দিন যখন আমরা আসলাম তখন হত হুযাইফা (রাঃ)-কে প্রায় আগের জুমআর দিনের মতই ভাষণ দিতে শুনলাম। শেষে তিনি একথাও বললেনঃ “পরিণাম হলো আগুন। (আরবী) হলো ঐ ব্যক্তি যে জান্নাতে সর্বপ্রথম পৌঁছে গেল।”

আল্লাহ তাআলার উক্তি – ‘চন্দ্র বিদীর্ণ হয়েছে।’ এটা নবী (সঃ)-এর যুগের ঘটনা। যেমন মুতাওয়াতির হাদীসসমূহে বিশুদ্ধতার সাথে এটা বর্ণিত হয়েছে। সহীহ হাদীসে হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেনঃ “পাঁচটি জিনিস গত হয়েছে। (এক) রূম, (দুই) ধূম্র, (তিন) লিম, (চার) বাশাহ এবং (পাঁচ) চন্দ্র বিদীর্ণ হওন।”

এ সম্পর্কে বর্ণিত হাদীসসমূহ :

হযরত আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, মক্কাবাসী নবী (সঃ)-এর কাছে মু’জিযা দেখানোর আবেদন জানালো। ফলে দুই বার চন্দ্র বিদীর্ণ হয়, যার বর্ণনা এই আয়াত দু’টিতে রয়েছে।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) ও ইমাম মুসলিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

হযরত আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) হতেই বর্ণিত আছে যে, মক্কাবাসী রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর কাছে মু’জিযা দেখাবার আবেদন করলে তিনি চন্দ্রকে দ্বিখণ্ডিত করে তাদেরকে দেখিয়ে দেন। সুতরাং তারা হিরার এদিকে এক খণ্ড এবং ওদিকে এক খণ্ড দেখতে পায়।” (এ হাদীসটি ইমাম বুখারী (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

হযরত জুবায়ের ইবনে মুতইম (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি তাঁর পিতা হতে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেনঃ “রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর যুগে চন্দ্র দ্বিখণ্ডিত হয়। এক খণ্ড এক পাহাড়ে এবং অপর খণ্ড অন্য পাহাড়ে পতিত হয়। তখন তারা বলেঃ “মুহাম্মাদ (সঃ) আমাদের উপর যাদু করেছে।” তখন জ্ঞানীরা বললোঃ “যদি এটা মেনে নেয়া হয় যে, তিনি আমাদের উপর যাদু করেছেন তবে তিনি তো সমস্ত মানুষের উপর যাদু করতে পারেন না।” [এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন ইমাম আহমাদ (রঃ)]

অন্য একটি রিওয়াইয়াতে আছে যে, এটা হিজরতের পূর্বের ঘটনা। আরো বহু রিওয়াইয়াত রয়েছে।

হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে এটাও বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর যুগে চন্দ্র গ্রহণ হলে কাফিররা বলতে শুরু করে যে, চন্দ্রের উপর যাদু করা হয়েছে। তখন (আরবী) হতে (আরবী) পর্যন্ত আয়াতগুলো অবতীর্ণ হয়।

হযরত ইবনে উমার (রাঃ) বলেন যে, যখন চন্দ্র বিদীর্ণ হয় এবং ওর দু’টি টুকরো হয়, একটি পাহাড়ের পিছনে এবং অপরটি পাহাড়ের সামনে, ঐ সময় নবী (সঃ) বলেনঃ “হে আল্লাহ! আপনি সাক্ষী থাকুন।” (সহীহ মুসলিম, জামে তিরমিযী প্রভৃতি হাদীস গ্রন্থে এ হাদীসটি বিদ্যমান রয়েছে)

হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর যুগে চন্দ্র বিদীর্ণ হয় এবং ওটা দুই ভাগে বিভক্ত হয়। জনগণ ভালভাবে তা লক্ষ্য করে। তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “তোমরা সাক্ষী থাকো।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন) অন্য রিওয়াইয়াতে আছে যে, হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেনঃ “ঐ সময় আমরা মক্কায় ছিলাম।”

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ “রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর যুগে চন্দ্র বিদীর্ণ হয়। তখন কুরায়েশরা বলেঃ “ইবনে আবি কাবৃশাহর (অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সঃ-এর) এটা যাদু।” কিন্তু তাদের জ্ঞানী লোকেরা বলেঃ “যদি এটা মেনে নেয়াই হয় যে, তিনি আমাদের উপর যাদু করেছেন, কিন্তু দুনিয়ার সমস্ত লোকের উপর তো তিনি যাদু করতে পারেন না? এখন যারা সফর থেকে আসবে তাদেরকে জিজ্ঞেস করা হোক যে, তারাও ঐ রাত্রে চন্দ্রকে বিদীর্ণ হতে দেখেছে কি না?” অতঃপর যখন তারা ফিরে আসলো তখন তারাও এটা স্বীকার করলো যে, সত্যি তারা ঐ রাত্রে চন্দ্রকে দ্বিখণ্ডিত হতে দেখেছে। কাফিরদের সমাবেশে এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো যে, যদি বাহিরের লোক এসে একথাই বলে তবে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সত্যতায় সন্দেহ করার কিছুই থাকবে না। অতঃপর যখন বাহির হতে লোক আসলো এবং যেখান হতেই আসলো সবাই এই সাক্ষ্য দান করলো যে, তারা স্বচক্ষে চন্দ্রকে দ্বিখণ্ডিত হতে দেখেছে। এরই বর্ণনা এই আয়াতে রয়েছে।

হযরত আবদুল্লাহ (রাঃ) বলেন যে, চন্দ্রের দুই খণ্ডের মধ্যে পাহাড় দেখা যেতো। অন্য রিওয়াইয়াতে আছে যে, চন্দ্র দ্বিখণ্ডিত হলে হযরত আবূ বকর (রাঃ)-কে নবী (সঃ) বলেনঃ “হে আবু বকর (রাঃ)! তুমি সাক্ষী থাকো।” আর মুশরিকরা এই বিরাট মু’জিযাকেও যাদু বলে দিয়ে দূরে সরে গিয়েছিল। এরই বর্ণনা এই আয়াতে রয়েছে যে, তারা বলেঃ এটা তো চিরাচরিত যাদু। এই বলে তারা তা প্রত্যাখ্যান করে। তারা সত্যকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে নবী (সঃ)-এর হুকুমের বিপরীত নিজেদের কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ করে। তারা নিজেদের অজ্ঞতা ও নির্বুদ্ধিতা হতে বিরত থাকে না।

আল্লাহ তাআলা বলেনঃ আর প্রত্যেক ব্যাপারই লক্ষ্যে পৌঁছবে। অর্থাৎ ভাল ভালদের ও মন্দ মন্দদের সাথে। এও বলা হয়েছে যে, এর অর্থ হলোঃ কিয়ামতের দিন প্রত্যেক ব্যাপারই সংঘটিত হবে।

মহান আল্লাহ বলেনঃ তাদের নিকট এসেছে সুসংবাদ, যাতে আছে সাবধান বাণী; এটা পরিপূর্ণ জ্ঞান, তবে এই সতর্কবাণী তাদের কোন উপকারে আসেনি। আল্লাহ তা’আলা যাকে হিদায়াত করেন এবং যাকে পথভ্রষ্ট করেন, এতেও তাঁর পরিপূর্ণ নিপুণতা বিদ্যমান রয়েছে। তারা যে হতভাগ্য এটা তাদের ভাগ্যে লিখে দেয়া হয়েছে। যাদের অন্তরে মোহর মেরে দেয়া হয়েছে তাদেরকে কেউই হিদায়াত দান করতে পারে না। এ আয়াতটি আল্লাহ তাআলার নিম্নের উক্তির মতঃ (আরবী) অর্থাৎ “ (হে নবী সঃ)! তুমি বলে দাও আল্লাহর যুক্তি সবদিক দিয়েই পরিপূর্ণ, তিনি ইচ্ছা করলে তোমাদের সকলকেই হিদায়াত দান করতে পারতেন।” (৬:১৪৯) অনুরূপ নিম্নের উক্তিটিওঃ (আরবী) অর্থাৎ “বেঈমানদেরকে কোন মু’জিযা এবং কোন ভয় প্রদর্শনকারী কোন উপকার পৌঁছায় না।” (১০:১০১)
৬-৮ নং আয়াতের তাফসীর:

আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ হে মুহাম্মাদ (সঃ)! যেসব কাফির মু’জিযা দেখার পরও বলে যে, এটা যাদু, তুমি তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নাও এবং তাদেরকে কিয়ামতের জন্যে অপেক্ষা করতে দাও। ঐদিন তাদেরকে হিসাবের জায়গায় দাঁড়াবার জন্যে একজন আহ্বানকারী আহ্বান করবেন, যা হবে অত্যন্ত ভয়াবহ স্থান। যেখানে তাদেরকে বিপদ আপদে ঘিরে ফেলবে। তাদের চেহারায় লাঞ্ছনা ও অপমানের চিহ্ন পরিস্ফুট হয়ে উঠবে। লজ্জায় তাদের চক্ষু অবনমিত হবে। তারা কবর হতে বের হয়ে পড়বে। অতঃপর বিক্ষিপ্ত পঙ্গপালের মত তারা দ্রুত গতিতে হিসাবের মাঠের দিকে চলে যাবে। তাদের কান থাকবে আহ্বানকারীর আহ্বানের দিকে এবং তারা অত্যন্ত দ্রুত চলবে। না তারা পারবে বিরুদ্ধাচরণ করতে, না বিলম্ব করার ক্ষমতা রাখবে। ঐ ভয়াবহ কঠিন দিনকে দেখে তারা অত্যন্ত ভীত-বিহ্বল হয়ে পড়বে এবং চীৎকার করে বলবেঃ এটা তো বড়ই কঠিন দিন!
৯-১৭ নং আয়াতের তাফসীর:

আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ হে মুহাম্মাদ (সঃ)! তোমার এই উম্মতের পূর্বে হযরত নূহ (আঃ)-এর উম্মতও তাদের নবী আমার বান্দা হযরত নূহ (আঃ)-কে অবিশ্বাস করেছিল, পাগল বলেছিল এবং শাসন গর্জন ও ধমক দিয়ে বলেছিলঃ “হে নূহ (আঃ)! যদি তুমি তোমার এ কাজ হতে বিরত না হও তবে অবশ্যই আমরা তোমাকে পাথর দ্বারা হত্যা করবে। আমার বান্দা ও রাসূল হযরত নূহ (আঃ) তখন আমাকে ডাক দিয়ে বললোঃ “হে আমার প্রতিপালক! আমি তো অসহায়। আমি কোনক্রমেই আর নিজেকে বাঁচাতে পারছি না এবং আপনার দ্বীনেরও হিফাযত করতে পারছি না। সুতরাং আপনি আমাকে সাহায্য করুন এবং আমাকে বিজয় দান করুন। তাঁর এ প্রার্থনা আল্লাহ তা’আলা কবুল করলেন এবং ঐ কাফির কওমের উপর প্রসিদ্ধ তুফান পাঠালেন। আকাশ হতে মুষল ধারের বৃষ্টির দরযা খুলে দিলেন এবং যমীন হতে উথলিয়ে ওঠা পানির প্রস্রবণের মুখ খুলে দিলেন। এমন কি যা পানির জায়গা ছিল না, যেমন উনান ইত্যাদি হতে পানি উঠতে লাগলো। চতুর্দিক পানিতে ভরে গেল। আকাশ হতে বৃষ্টি বর্ষণ বন্ধ হলো না এবং যমীন হতে পানি উঠাও বন্ধ হলো না। নির্ধারিত সময় পর্যন্ত এটা চলতেই থাকলো। আকাশের মেঘ হতেই বৃষ্টি বর্ষিত হয়ে থাকে। কিন্তু ঐ সময় আকাশ হতে পানির দরযা খুলে দেয়া হয়েছিল এবং আল্লাহর শাস্তি বৃষ্টির আকারে বর্ষিত হচ্ছিল। না এর পূর্বে কখনো এতো বেশী পানি বর্ষিত হয়েছিল, না এর পরে কখনো এরূপ পানি বর্ষিত হয়েছে। এদিকে আকাশের এই অবস্থা, আর ওদিকে যমীনের উপর এ আদেশ হয়েছিল যে, ওটা যেন পানি উগলিয়ে দেয়। সুতরাং চতুর্দিকে শুধু পানি আর পানি।

হযরত আলী (রাঃ) বলেন যে, আকাশের মুখ খুলে দেয়া হয় এবং ওগুলো দিয়ে অনবরত পানি বর্ষিত হতে থাকে।

মহান আল্লাহ বলেনঃ আমি তাকে (নূহ আঃ-কে) আরোহণ করালাম কাষ্ঠ ও কীলক নির্মিত এক নৌযানে।

(আরবী) শব্দের অর্থ হলো নৌকার বাম দিকের অংশ এবং প্রাথমিক অংশ যার উপর ঢেউ এসে লাগে। ওর মূল জোড়কেও বলা হয়েছে।

আল্লাহ পাক বলেনঃ “ওটা আমার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে চলতো, এটা পুরস্কার তার জন্যে যে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল। হযরত নূহ (আঃ)-কে সাহায্য করার মাধ্যমে এটা ছিল কাফিরদের হতে প্রতিশোধ গ্রহণ।

ইরশাদ হচ্ছেঃ আমি এটাকে রেখে দিয়েছি এক নিদর্শন রূপে। অর্থাৎ ঐ নৌকাকে শিক্ষণীয় বিষয় রূপে বাকী রেখেছি।

হযরত কাতাদা (রঃ) বলেন যে, এই উম্মতের প্রথম যুগের লোকেরাও ঐ নৌকাটি দেখেছে। কিন্তু এর প্রকাশ্য অর্থ হলোঃ ঐ নৌকার নমুনায় অন্যান্য নৌকাগুলো আমি নিদর্শন হিসেবে দুনিয়ায় কায়েম রেখেছি। যেমন আল্লাহ তা’আলা অন্য জায়গায় বলেনঃ (আরবী)

অর্থাৎ তাদের এক নিদর্শন এই যে, আমি তাদের বংশধরদেরকে বোঝাই নৌযানে আরোহণ করিয়েছিলাম। আর তাদের জন্যে অনুরূপ যানবাহন সৃষ্টি করেছি যাতে তারা আরোহণ করে।” (৩৬:৪১-৪২) অন্য জায়গায় রয়েছেঃ (আরবী)

অর্থাৎ “যখন জলোচ্ছাস হয়েছিল তখন আমি তোমাদেরকে আরোহণ করিয়েছিলাম নৌযানে। আমি এটা করেছিলাম তোমাদের শিক্ষার জন্যে এবং এই জন্যে যে, শ্রুতিধর কর্ণ এটা সংরক্ষণ করে।” (৬৯:১১-১২) এজন্যেই আল্লাহ তা’আলা এখানে বলেনঃ সুতরাং উপদেশ গ্রহণকারী কেউ আছে কি?

হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেনঃ “রাসূলুল্লাহ (সঃ) আমাকে (আরবী) পড়িয়েছেন। (এটা ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন) স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সঃ) হতেও এই শব্দের কিরআত এরূপই বর্ণিত আছে।

হযরত আসওয়াদ (রঃ)-কে জিজ্ঞেস করা হয়ঃ “এই শব্দটি না হবে?” উত্তরে তিনি বলেনঃ “আমি হযরত আবদুল্লাহ (রাঃ)-কে পড়তে শুনেছি … দ্বারা এবং তিনি বলেছেন যে, তিনি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে দ্বারাই পড়তে শুনেছেন।

এরপর আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ “কি কঠোর ছিল আমার শাস্তি ও সতর্কবাণী।’ অর্থাৎ যারা আমার সাথে কুফরী করেছিল, আমার রাসূলদেরকে অবিশ্বাস করেছিল এবং আমার উপদেশ হতে শিক্ষা গ্রহণ করেনি তাদের প্রতি আমার শাস্তি কতই না কঠোর ছিল! কিভাবেই না আমি আমার রাসূলদের শত্রুদের হতে প্রতিশোধ গ্রহণ করেছি। আর কেমন করে আমি সত্য ধর্মের শত্রুদের ধ্বংস ও নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছি।

মহান আল্লাহ বলেনঃ “আমি কুরআন কারীমের শব্দ ও অর্থ প্রত্যেক এমন ব্যক্তির জন্যে সহজ করে দিয়েছি যে এর দ্বারা উপদেশ গ্রহণ করতে চায়। যেমন তিনি অন্য জায়গায় বলেনঃ

অর্থাৎ “আমি তোমার প্রতি (নবী সঃ-এর প্রতি) বরকতময় কিতাব অবতীর্ণ করেছি যাতে তারা এর আয়াতগুলো সম্পর্কে চিন্তা-গবেষণা করে এবং যেন জ্ঞানীরা উপদেশ গ্রহণ করে।” (৩৮:২৯) আর এক জায়গায় বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “আমি কুরআনকে উপদেশের জন্যে সহজ করেছি। আরো বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “আমি তো তোমার ভাষায় কুরআনকে সহজ করে দিয়েছি যাতে তুমি ওটা দ্বারা মুত্তাকীদের সুসংবাদ দিতে পার এবং বিতণ্ডা প্রবণ সম্প্রদায়কে সতর্ক করতে পার।” (১৯:৯৭)

হযরত মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, এর কিরআত ও তিলাওয়াত আল্লাহ তা’আলা সহজ করে দিয়েছেন।

হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, যদি আল্লাহ তা’আলা একে সহজসাধ্য না করতেন তবে মাখলুকের ক্ষমতা ছিল না যে, তারা আল্লাহর কালাম পড়তে পারে। আমি বলি যে, ঐ সহজগুলোর মধ্যে একটি সহজ ওটাই যা পূর্বে হাদীসে গত হয়েছে। তা এই যে, এই কুরআন সাতটি কিরআতের উপর অবতীর্ণ করা হয়েছে। এই হাদীসের সমস্ত পন্থা ও শব্দ আমরা ইতিপূর্বে জমা করে দিয়েছি। সুতরাং এখানে পুনরাবৃত্তি নিষ্প্রয়োজন। মোটকথা, আল্লাহ তাআলা কুরআনকে খুবই সহজ করে দিয়েছেন। সুতরাং কুরআন হতে উপদেশ গ্রহণকারী কেউ আছে কি? অর্থাৎ কেউ এর থেকে উপদেশ গ্রহণ করতে চাইলে তাকে সাহায্য করা হবে।

১-১৬ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:-
নামকরণ ও আলোচ্য বিষয় :

الْقَمَرُ ‘ক্বামার’ শব্দের অর্থ চন্দ্র, চাঁদ। সূরার প্রথম আয়াতে الْقَمَرُ শব্দটি উল্লেখ আছে, এখান থেকেই এ সূরার নামকরণ করা হয়েছে। পূর্বের সূরায় শেষের দিকে

(اَزِفَتِ الْاٰزِفَةُ)

বলা হয়েছে, যাতে কিয়ামত নিকটবর্তী হওয়ার কথা উল্লেখ রয়েছে। আলোচ্য সূরাকে এ বিষয়বস্তু দ্বারাই অর্থাৎ

(اِقْتَرَبَتِ السَّاعَةُ)

‘কিয়ামত নিকটবর্তী হয়েছে’ বলে শুরু করা হয়েছে। এরপর কিয়ামত নিকটবর্তী হওয়ার একটি দলীল আনা হয়েছে। কেননা চন্দ্র বিদীর্ণ হওয়া কিয়ামতের অন্যতম একটি আলামত। কিয়ামতের বিপুল সংখ্যক আলামতের মধ্যে সর্ববৃহৎ আলামত হচ্ছে শেষ নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর আগমন। হাদীসে এসেছে নাবী বলেন : আমার আগমন ও কিয়ামত সংঘটিত হওয়া হাতের দুই আঙ্গুলের ন্যায় অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। (সহীহ বুখারী হা. ৫৩০১)

১-৫ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

শানে নুযুল :

ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে মক্কা থেকে বের করে দেয়ার পূর্বে মক্কায় চাঁদকে দু’খণ্ডে বিভক্ত অবস্থায় দেখেছি। মক্কাবাসী বলছিল : চাঁদকে জাদুগ্রস্থ করা হয়েছে তখন

(اِقْتَرَبَتِ السَّاعَةُ وَانْشَقَّ الْقَمَرُ)

আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। (সহীহ বুখারী হা. ৩৬৩৬)

আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : মক্কাবাসী নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট একটি (নবুওয়াতের প্রমাণস্বরূপ) নিদর্শন চাইল। ফলে মক্কায় দু’বার চাঁদ বিদীর্ণ হয়। তখন এ আয়াত অবতীর্ণ হয়। (সহীহ মুসলিম হা. ২৮০২, সহীহ বুখারী হা. ৪৭৬৭, তিরমিযী হা. ৩৬৩৭)

প্রথম আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা কিয়ামত অতি নিকটবর্তী সে সম্পর্কে সংবাদ দিয়েছেন।

এ সম্পর্কে অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(أَتٰٓي أَمْرُ اللّٰهِ فَلَا تَسْتَعْجِلُوْهُ ط سُبْحٰنَه۫ وَتَعَالٰي عَمَّا يُشْرِكُوْنَ)

“আল্লাহর আদেশ আসবেই; সুতরাং এর জন্য তাড়াহুড়া কর না। তিনি মহিমান্বিত এবং তারা যাকে শরীক করে তিনি তার ঊর্ধ্বে।” (সূরা আন্ নাহ্ল ১৬ : ১) অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(اِقْتَرَبَ لِلنَّاسِ حِسَابُهُمْ وَهُمْ فِيْ غَفْلَةٍ مُّعْرِضُوْنَ)‏

“মানুষের হিসাব-নিকাশের সময় আসন্ন, কিন্তু তারা উদাসীনতায় মুখ ফিরিয়ে রয়েছে।” (সূরা আম্বিয়া- ২১ : ১)

আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন : একদা আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাহাবীদের সামনে ভাষণ দান করেন। ঐ সময় সূর্য অস্তমিত হতে অতি অল্প সময় বাকী ছিল। ভাষণে তিনি বলেন : যার হাতে আমার প্রাণ তাঁর শপথ! অতীত যুগের তুলনায় দুনিয়ার হায়াতও এ পরিমাণ বাকী আছে যে পরিমান সময় এ দিনের বাকী আছে গত হয়ে যাওয়া সময়ের তুলনায়। আর আমি সূর্যের সামান্য অংশই দেখতে পাচ্ছি। (মাজমাউয যাওয়ায়েদ ১০/ ৩১১, বর্ণনাকারীগণ নির্ভরযোগ্য)

ইবনু ‘উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : একদা ‘আসরের পর যখন সূর্য ডুবুডুবু অবস্থা, এমন সময় আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে বসেছিলাম। তখন তিনি বললেন : অতীত যুগের লোকদের বয়সের তুলনায় তোমাদের বয়স ততটুকু যতটুকু সময় বাকী আছে এ দিনের। (আহমাদ ২/১১৫, ১১৬, সহীহ)

(وَانْشَقَّ الْقَمَرُ)

‘চন্দ্র বিদীর্ণ হয়ে গেছে’ চন্দ্র বিদীর্ণ হওয়ার ঘটনা নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর জীবদ্দশায় হয়েছিল। এটি সে মু‘জিযাহ, যা মক্কাবাসীদের দাবী অনুযায়ী দেখানো হয়েছিল। চাঁদ দু’টুকরো হয়ে গিয়েছিল। এমনকি লোকেরা তার (দুখণ্ড চাঁদের) মাঝ দিয়ে হিরা পাহাড়কে দেখতে পায়। অর্থাৎ চাঁদের এক টুকরো পাহাড়ের একদিকে এবং দ্বিতীয় টুকরো পাহাড়ের অপর দিকে চলে যায়। (সহীহ বুখারী হা. ৪৮৬৪, সহীহ মুসলিম হা. ২৮০০)

ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন : রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর যুগে চন্দ্র বিদীর্ণ হয়ে দুই খন্ড হয়ে গেল। সবাই এ ঘটনা অবলোকন করল এবং রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, তোমরা ঈমান আনবে? তারা বলল : হ্যাঁ, তখন চন্দ্রোজ্জল রাত ছিল। আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তখন বললেন : তোমরা সাক্ষী থেক। (সহীহ বুখারী হা. ৪৮৬৫)

(وَإِنْ يَّرَوْا اٰيَةً يُّعْرِضُوْا)

‘তারা কোন নিদর্শন দেখলে মুখ ফিরিয়ে নেয়’ অর্থাৎ মক্কার কুরাইশরা কোন নিদর্শন দেখে ঈমান না এনে উল্টো ঈমান থেকে মুখ ফিরিয়ে নিত। এর প্রমাণ তারা চন্দ্র বিদীর্ণ হওয়া প্রত্যক্ষ করেছে অথচ ঈমানে আনেনি বরং আরো দূরে চলে গেছে। ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন : মুশরিকরা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে একত্রিত হয়ে বলল : তুমি যদি সত্যবাদী হও তাহলে চন্দ্র বিদীর্ণ করে দ্বিখন্ড কর। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাদেরকে বললেন : আমি যদি এরূপ করতে পারি তাহলে কি তোমরা ঈমান আনবে? অতঃপর তারা ঈমান আনার অঙ্গীকার করলে তিনি তাঁর রবের কাছে এ মু’জিযাহ প্রার্থনা করলেন। ফলে চন্দ্র বিদীর্ণ হল, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মুশরিকদেরকে আহ্বান করে বললেন : হে অমুক সাক্ষী থেক, হে অমুক সাক্ষী থেক। (দুররুল মানসূর ৭/৬৭১) এ সম্পর্কে সূরা আল আন‘আম-এর ৭ নম্বর আয়াতে আরো আলোচনা হয়েছে।

(سِحْرٌ مُّسْتَمِرٌّ)

‘বড় জাদু’ শব্দটি চলমান, দীর্ঘস্থায়ী। কিন্তু আরবি ভাষায় কোন সময় চলে যাওয়া, নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার অর্থে ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ মুশরিকরা বলত, চন্দ্র বিদীর্ণ করা এমন একটা জাদু যা অচিরেই চলে যাবে। আরেকটি অর্থ হল : শক্ত ও কঠোর হওয়া। আবূল আলীয়া ও যহহাক এ তাফসীর করেছেন। অর্থাৎ এটা একটি বড় ও শক্ত জাদু। মক্কাবাসী যখন চাক্ষুষ দেখা অস্বীকার করতে পারল না তখন তারা এটা জাদু ও শক্ত জাদু বলে উড়িয়ে দিল।

(وَكُلُّ أَمْرٍ مُّسْتَقِرٌّ) – مُّسْتَقِرٌّ

অর্থ স্থির হওয়া, অর্থাৎ প্রত্যেক আমলকারীর আমল স্থির হয়ে আছে। কাতাদাহ্ (রহঃ) বলেন : এর অর্থ হলো : কল্যাণ ভাল লোকদের সাথে আর অকল্যাণ খারাপ লোকদের সাথে বিদ্যমান থাকবে। আর মুজাহিদ (রহঃ) বলেন : কিয়ামতের দিন প্রত্যেক কাজ স্থিতিশীল হবে।

الأنباء ‘সংবাদ’ বলতে পূর্ববর্তী ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতিদের সংবাদকে বুঝানো হয়েছে।

مُزْدَجَرٌ অর্থাৎ পূর্ববর্তী ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতিদের মাঝে উপদেশ ও শিক্ষা রয়েছে। কেউ যদি তাদের থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে শিরক ও পাপ থেকে বাঁচতে চায়, তাহলে সে বাঁচতে পারবে।

কিয়ামতের দিন যখন আমলনামা প্রকাশ করা হবে তখন ভাল মন্দ প্রত্যেক বিষয় তার হকদার ব্যক্তি পেয়ে যাবে। (তাফসীর মুয়াসসার)

(حِكْمَةٌ ۭبَالِغَةٌ)

অর্থাৎ এমন বাণী যা ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষাকারী।

(فَمَا تُغْنِ النُّذُرُ)

‘তবে সতর্ক বাণীসমূহ তাদের কোন কাজে আসেনি’ অর্থাৎ যার জন্য আল্লাহ তা‘আলা দুর্ভাগ্য লিখে দিয়েছেন এবং যার অন্তরে মোহর মেরে দিয়েছেন নাবীদের ভীতি প্রদর্শন কি তার উপকারে আসতে পারে? আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

( قُلْ فَلِلہِ الْحُجَّةُ الْبَالِغَةُﺆ فَلَوْ شَا۬ئَ لَھَدٰٿکُمْ اَجْمَعِیْنَ)

“বল : ‎ ‘চূড়ান্ত প্রমাণ তো আল্লাহরই; তিনি যদি ইচ্ছা করতেন তবে তোমাদের সকলকে অবশ্যই সৎপথে পরিচালিত করতেন।” (সূরা আন‘আম ৬ : ১৪৯) সুতরাং যারা পূর্ববর্তী জাতির এসব ধ্বংসলীলা দেখেও ঈমান আনবে না, আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করে চলবে না তাদের জন্য সুসংবাদ নয় বরং তারা নিজেরাই নিজেদেরকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিয়েছে।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. কিয়ামত অতি নিকটে, সুতরাং জ্ঞানী সেই ব্যক্তি যে কিয়ামতের কঠিন মুহূর্ত থেকে বাঁচার জন্য সৎ আমল করে।
২. কিয়ামতের কয়েকটি আলামত জানতে পারলাম যা অতীত হয়ে গেছে। যেমন শেষ নাবীর আগমন, চাঁদ বিদীর্ণ হওয়া ইত্যাদি।
৩. প্রবৃত্তির অনুসারীরা নিন্দার পাত্র, এ কারণে তাদেরকে শাস্তি ভোগ করতে হবে।
৪. পূর্ববর্তী জাতিসমূহের ঘটনা বর্ণনা করার মাধ্যমে আমাদের সতর্ক করা হচ্ছে।
৬-১৭ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

(فَتَوَلَّ عَنْھُمْﺭ …. یَقُوْلُ الْکٰفِرُوْنَ ھٰذَا یَوْمٌ عَسِرٌﭗ)

এ আয়াতে নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে সম্বোধন করে আল্লাহ তা‘আলা বলছেন : এতসব নিদর্শন দেখেও যখন তারা জাদু বলে উড়িয়ে দিল, তখন তোমার আর কিছুই করার প্রয়োজন নেই, তুমি তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নাও। আর স্মরণ করো সেদিনের কথা যেদিন একজন আহ্বানকারী একটি অপ্রিয় বিষয়ের দিকে আহ্বান করবে।

এখানে আহ্বানকারী হলো ইসরাফীল (আঃ), আর আহ্বান করবে হাশরের মাঠে উপস্থিত হওয়ার জন্য। কাফিররা দৃষ্টি নত অবস্থায় ক্ববর থেকে উঠবে। তারা লাঞ্ছিত ও বিক্ষিপ্ত পঙ্গপালের ন্যায় হিসাবের মাঠের দিকে অতি দ্রুততার সাথে দৌড়াবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(خٰشِعِيْنَ مِنَ الذُّلِّ يَنْظُرُوْنَ مِنْ طَرْفٍ خَفِيٍّ)

“তারা অপমানে অবনত অবস্থায় গোপনে পার্শ্ব চোখে তাকাবে” (সূরা শুরা- ৪২ : ৪৫)

مُّهْطِعِيْنَ অর্থাৎ مسرعين বা দৌড়াবে, পিছনে পড়ে থাকবে না।

(کَذَّبَتْ قَبْلَھُمْ قَوْمُ نُوْحٍ …..فَھَلْ مِنْ مُّدَّکِرٍﭠ )

আলোচ্য আয়াতগুলোতে আল্লাহ তা‘আলা নূহ (আঃ)-এর সম্প্রদায়ের মধ্যে যারা কুফরী করেছিল, নূহ (আঃ)-কে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছিল তাদেরকে যে ধরনের শাস্তি দ্বারা ধ্বংস করেছিলেন সে কথা তুলে ধরেছেন।

وَّازْدُجِرَ -এর প্রকৃত রূপ হলো وازتجر অর্থাৎ নূহ (আঃ)-এর জাতি নূহ (আঃ)-কে শুধু মিথ্যাবাদীই ভাবেনি বরং তারা তাকে ভয় দেখিয়েছিল, ধমক দিয়েছিল এবং হুমকিও দিয়েছিল।

অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন : (قَالُوْا لَئِنْ لَّمْ تَنْتَهِ يٰنُوْحُ لَتَكُوْنَنَّ مِنَ الْمَرْجُوْمِيْنَ)‏

“তারা বলল : ‎ ‘হে নূহ! তুমি যদি বিরত না হও তবে তুমি অবশ্যই প্রস্তরাঘাতে নিহতদের শামিল হবে।’ (সূরা শু‘আরা- ২৬ : ১১৬)

আবদ ইবনে হুমাইদ (রহঃ) মুজাহিদ (রহঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, নূহ (আঃ)-এর সম্প্রদায়ের কিছু লোক তাঁকে পথে-ঘাটে কোথাও পেলে গলা টিপে ধরত। ফলে তিনি বেহুশ হয়ে যেতেন এরপর হুশ ফিরে এলে তিনি আল্লাহ তা‘আলার কাছে দু‘আ করতেন-

(أَنِّيْ مَغْلُوْبٌ فَانْتَصِرْ)

আমি তো পরাজিত, অতএব, তুমি আমাকে সাহায্য কর। তিনি জাতির জন্য আল্লাহ তা‘আলার কাছে ক্ষমাও চাইতেন। এভাবে সাড়ে নয়শত বছর সম্প্রদায়ের এহেন নির্যাতনের জবাব দেয়ার মাধ্যমে অবশেষে তিনি নিরুপায় হয়ে বদদু‘আ করেন। যার ফলে সমগ্র জাতি মহাপ্লাবনে নিমজ্জিত হয়।

مُّنْهَمِرٍ -এর অর্থ অধিক বা প্রবল।

(فَالْتَقَي الْمَا۬ءُ) ‘অতঃপর সকল পানি মিলিত হল এক পরিকল্পনা অনুসারে।’ অর্থাৎ আকাশ ও পাতালের পানি মিলিত হয়ে সে কাজ পূর্ণ করে দিলো, যা হওয়ার সিদ্ধান্ত পূর্ব নির্ধারিত ছিল। তথা তাদেরকে প্লাবনে ডুবিয়ে মারা হল।

دُسُرٍ হলো دسار-এর বহুবচন। ঐ রশি যা দ্বারা নৌকার তক্তা বাঁধা হয়।

অথবা ঐ পেরেক যা দিয়ে নৌকার তক্তা জোড়া দেয়া হয়। অর্থাৎ কাঠ ও পেরেক দিয়ে নির্মিত নৌকায় নূহ (আঃ) ও তাঁর অনুসারীদেরকে আল্লাহ তা‘আলা মহা প্লাবন থেকে রক্ষা করেছিলেন।

(تَجْرِيْ بِأَعْيُنِنَا)

‘যা আমার চোখের সামনে চলল’ অর্থাৎ এ নৌকা প্লাবনের পানির ওপর আল্লাহ তা‘আলার চোখের সামনে ভেসে ভেসে চলছিল।

(وَلَقَدْ تَّرَكْنٰهَآ اٰيَةً فَهَلْ مِنْ مُّدَّكِرٍ)

‘রেখে দিয়েছি আমি এটাকে নিদর্শনরূপে; অতএব উপদেশ গ্রহণকারী কেউ আছে কি?’ অর্থাৎ নূহ (আঃ)-এর এ ঘটনাকে পরবর্তী জাতিদের জন্য নিদর্শনস্বরূপ রেখে দিয়েছেন যাতে তারা উপদেশ গ্রহণ করে সাবধান হয়।

(وَلَقَدْ يَسَّرْنَا الْقُرْاٰنَ لِلذِّكْرِ فَهَلْ مِنْ مُّدَّكِرٍ)

‘কুরআনকে আমি সহজ করে দিয়েছি উপদেশ গ্রহণের জন্য, সুতরাং উপদেশ গ্রহণকারী কেউ আছে কি?’ এর অর্থ ও তাৎপর্য উপলব্ধি করা ও এ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা এবং তা মুখস্ত করা আমি সহজ করে দিয়েছি। অতএব এটা বাস্তব যে, কুরআনুল কারীম অলৌকিকতা ও ভাষা-শৈলীর দিক দিয়ে অতি উচ্চাঙ্গের কিতাব হওয়া সত্ত্বেও আরব অনারব যে কোন মানুষ মনযোগ দিয়ে পড়লে সহজেই মুখস্ত করতে পারে। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কোন গ্রন্থ নেই যা হুবহু কেউ মুখস্থ করেছে। অথচ পৃথিবীতে লক্ষ লক্ষ হাফেযে কুরআন রয়েছে। এটি কুরআনের অন্যতম একটি মু‘জিযাহ।

তারপর আল্লাহ তা‘আলা প্রশ্ন করে বলছেন, কেউ কি উপদেশ গ্রহণ করার আছ? আমাদের সকলের উচিত কুরআন থেকে উপদেশ গ্রহণ করে উভয় জগতের জীবনকে সাফল্যময় করে তোলা।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. চেষ্টা-প্রচেষ্টা করার পরও যাদের মাঝে সত্য গ্রহণের কোন আগ্রহ পাওয়া যাবে না তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়াই উত্তম।
২. কাফিরদের কিয়ামতের দিন কঠিন অবস্থা হবে।
৩. নূহ (আঃ)-এর অবাধ্য জাতিকে ধ্বংসের কারণ ও যা দ্বারা তাদেরকে ধ্বংস করা হয়েছিল সে সম্পর্কে জানলাম।
৪. কুরআন থেকে প্রত্যেকের শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত।

১-১৬ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
ফী জিলালিল কুরআন:-

Leave a Reply