بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ ( বই # ১১৪৫) [*‌‌* নিশ্চয় আমি কুরআনকে উপদেশ গ্রহণের জন্য সহজ করে দিয়েছি:- *** অতএব উপদেশ গ্রহণকারী কেউ আছে কি?:- (১৭,২২,৩২,৪০ ও ৫১ – নং আয়াত:-) *  *কোনাে সৃষ্টিই উদ্দেশ্যহীন নয় :- *  *কত পাপিষ্ঠ জাতিকে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে :-] www.motaher21.net সূরা:৫৪: আল্-ক্বামার। পারা:২৭ ১৭-৫৫ নং আয়াত:- আয়াতের ব্যাখ্যা:- ১) তাফসীরে ফী জিলালিল কুরআন:- ২) তাফসীরে ইবনে কাছীর:- ৩) তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:- ৪) তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন:-

أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১১৪৫)
[*‌‌* নিশ্চয় আমি কুরআনকে উপদেশ গ্রহণের জন্য সহজ করে দিয়েছি:-
*** অতএব উপদেশ গ্রহণকারী কেউ আছে কি?:-
(১৭,২২,৩২,৪০ ও ৫১ – নং আয়াত:-)
*  *কোনাে সৃষ্টিই উদ্দেশ্যহীন নয় :-
*  *কত পাপিষ্ঠ জাতিকে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে :-]
www.motaher21.net
সূরা:৫৪: আল্-ক্বামার।
পারা:২৭
১৭-৫৫ নং আয়াত:-
আয়াতের ব্যাখ্যা:-
১) তাফসীরে ফী জিলালিল কুরআন:-
২) তাফসীরে ইবনে কাছীর:-
৩) তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:-
৪) তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন:-
সূরা:৫৪: আল্-ক্বামার-১৭
وَ لَقَدۡ یَسَّرۡنَا الۡقُرۡاٰنَ لِلذِّکۡرِ فَہَلۡ مِنۡ مُّدَّکِرٍ ﴿۱۷﴾
নিশ্চয় আমি কুরআনকে উপদেশ গ্রহণের জন্য সহজ করে দিয়েছি। অতএব উপদেশ গ্রহণকারী কেউ আছে কি?
সূরা:৫৪: আল্-ক্বামার-১৮
کَذَّبَتۡ عَادٌ فَکَیۡفَ کَانَ عَذَابِیۡ وَ نُذُرِ ﴿۱۸﴾
‘আদ সম্প্রদায় মিথ্যারোপ করেছিল, ফলে কিরূপ ছিল আমার শাস্তি ও সতর্কবাণী !
সূরা:৫৪: আল্-ক্বামার-১৯
اِنَّاۤ اَرۡسَلۡنَا عَلَیۡہِمۡ رِیۡحًا صَرۡصَرًا فِیۡ یَوۡمِ نَحۡسٍ مُّسۡتَمِرٍّ ﴿ۙ۱۹﴾
তাদের উপর আমি নিরবচ্ছিন্ন দুর্ভাগ্যের দিনে ঝড়ো হাওয়া প্রেরণ করেছিলাম।
সূরা:৫৪: আল্-ক্বামার-২০
تَنۡزِعُ النَّاسَ ۙ کَاَنَّہُمۡ اَعۡجَازُ نَخۡلٍ مُّنۡقَعِرٍ ﴿۲۰﴾
যা তাদেরকে উপরে উঠিয়ে এমনভাবে ছুঁড়ে ফেলেছিলো যেন তারা সমূলে উৎপাটিত খেজুর বৃক্ষের কাণ্ড।
সূরা:৫৪: আল্-ক্বামার-২১
فَکَیۡفَ کَانَ عَذَابِیۡ وَ نُذُرِ ﴿۲۱﴾
সুতরাং কেমন ছিল আমার শাস্তি ও সতর্কবাণী!
সূরা:৫৪: আল্-ক্বামার-২২
وَ لَقَدۡ یَسَّرۡنَا الۡقُرۡاٰنَ لِلذِّکۡرِ فَہَلۡ مِنۡ مُّدَّکِرٍ ﴿٪۲۲﴾
নিশ্চয় আমি কুরআনকে উপদেশ গ্রহণের জন্য সহজ করে দিয়েছি। অতএব উপদেশ গ্রহণকারী কেউ আছে কি?
সূরা:৫৪: আল্-ক্বামার-২৩
کَذَّبَتۡ ثَمُوۡدُ بِالنُّذُرِ ﴿۲۳﴾
সামূদ সম্প্রদায় সতর্ককারীদেরকে মিথ্যাবাদী বলেছিল;
সূরা:৫৪: আল্-ক্বামার-২৪
فَقَالُوۡۤا اَبَشَرًا مِّنَّا وَاحِدًا نَّتَّبِعُہٗۤ ۙ اِنَّاۤ اِذًا لَّفِیۡ ضَلٰلٍ وَّ سُعُرٍ ﴿۲۴﴾
তারা বলেছিল, ‘আমরা কি আমাদেরই মধ্যকার এক ব্যক্তির অনুসরণ করব? তাহলে তো নিশ্চয় আমরা ভ্রষ্ট ও পাগলরূপে গণ্য হব।
সূরা:৫৪: আল্-ক্বামার-২৫
ءَاُلۡقِیَ الذِّکۡرُ عَلَیۡہِ مِنۡۢ بَیۡنِنَا بَلۡ ہُوَ کَذَّابٌ اَشِرٌ ﴿۲۵﴾
আমাদের মধ্যে কি ওরই প্রতি প্রত্যাদেশ হয়েছে? বরং সে তো একজন মিথ্যাবাদী, দাম্ভিক।’
সূরা:৫৪: আল্-ক্বামার-২৬
سَیَعۡلَمُوۡنَ غَدًا مَّنِ الۡکَذَّابُ الۡاَشِرُ ﴿۲۶﴾
আগামী কাল ওরা অবশ্যই জানবে, কে মিথ্যাবাদী, দাম্ভিক।
সূরা:৫৪: আল্-ক্বামার-২৭
اِنَّا مُرۡسِلُوا النَّاقَۃِ فِتۡنَۃً لَّہُمۡ فَارۡتَقِبۡہُمۡ وَ اصۡطَبِرۡ ﴿۫۲۷﴾
আমি উটনীকে তাদের জন্য ফিতনা বানিয়ে পাঠাচ্ছি। এখন একটু ধৈর্য্য ধরে দেখো, এদের পরিণতি কি হয়।
সূরা:৫৪: আল্-ক্বামার-২৮
وَ نَبِّئۡہُمۡ اَنَّ الۡمَآءَ قِسۡمَۃٌۢ بَیۡنَہُمۡ ۚ کُلُّ شِرۡبٍ مُّحۡتَضَرٌ ﴿۲۸﴾
তাদের জানিয়ে দাও, এখন তাদের ও উটনীর মধ্যে পানি ভাগ হবে এবং প্রত্যেকেই তার পালার দিনে পানির জন্য আসবে।”
সূরা:৫৪: আল্-ক্বামার-২৯
فَنَادَوۡا صَاحِبَہُمۡ فَتَعَاطٰی فَعَقَرَ ﴿۲۹﴾
শেষ পর্যন্ত তারা নিজেদের লোকটিকে ডাকলো, সে এ কাজের দায়িত্ব গ্রহণ করলো এবং উটনীকে হত্যা করলো
সূরা:৫৪: আল্-ক্বামার-৩০
فَکَیۡفَ کَانَ عَذَابِیۡ وَ نُذُرِ ﴿۳۰﴾
সুতরাং কেমন ছিল আমার শাস্তি ও সতর্কবাণী!
সূরা:৫৪: আল্-ক্বামার-৩১
اِنَّاۤ اَرۡسَلۡنَا عَلَیۡہِمۡ صَیۡحَۃً وَّاحِدَۃً فَکَانُوۡا کَہَشِیۡمِ الۡمُحۡتَظِرِ ﴿۳۱﴾
আমি তাদের ওপর একটি মাত্র বিকট শব্দ পাঠালাম এবং তারা খোঁয়াড়ের মালিকের শুষ্ক ও পদদলিত শস্যের মত হয়ে গেল।
সূরা:৫৪: আল্-ক্বামার-৩২
وَ لَقَدۡ یَسَّرۡنَا الۡقُرۡاٰنَ لِلذِّکۡرِ فَہَلۡ مِنۡ مُّدَّکِرٍ ﴿۳۲﴾
নিশ্চয় আমি কুরআনকে উপদেশ গ্রহণের জন্য সহজ করে দিয়েছি। অতএব উপদেশ গ্রহণকারী কেউ আছে কি?
সূরা:৫৪: আল্-ক্বামার-৩৩
کَذَّبَتۡ قَوۡمُ لُوۡطٍۭ بِالنُّذُرِ ﴿۳۳﴾
লূত সম্প্রদায় মিথ্যা মনে করেছিল সতর্ককারীদেরকে।
সূরা:৫৪: আল্-ক্বামার-৩৪
اِنَّاۤ اَرۡسَلۡنَا عَلَیۡہِمۡ حَاصِبًا اِلَّاۤ اٰلَ لُوۡطٍ ؕ نَجَّیۡنٰہُمۡ بِسَحَرٍ ﴿ۙ۳۴﴾
আমি তাদের ওপর পাথর বর্ষণকারী বাতাস পাঠালাম। শুধু লূতের পরিবারের লোকেরা তা থেকে রক্ষা পেল।
সূরা:৫৪: আল্-ক্বামার-৩৫
نِّعۡمَۃً مِّنۡ عِنۡدِنَا ؕ کَذٰلِکَ نَجۡزِیۡ مَنۡ شَکَرَ ﴿۳۵﴾
আমার বিশেষ অনুগ্রহ স্বরূপ;যারা কৃতজ্ঞ আমি এভাবেই তাদেরকে পুরস্কৃত করে থাকি।
সূরা:৫৪: আল্-ক্বামার-৩৬
وَ لَقَدۡ اَنۡذَرَہُمۡ بَطۡشَتَنَا فَتَمَارَوۡا بِالنُّذُرِ ﴿۳۶﴾
সে (লূত) আমার কঠিন শাস্তি সম্পর্কে তাদেরকে সতর্ক করেছিল, কিন্তু তারা সতর্কবাণী সম্বন্ধে বিতন্ডা শুরু করল।
সূরা:৫৪: আল্-ক্বামার-৩৭
وَ لَقَدۡ رَاوَدُوۡہُ عَنۡ ضَیۡفِہٖ فَطَمَسۡنَاۤ اَعۡیُنَہُمۡ فَذُوۡقُوۡا عَذَابِیۡ وَ نُذُرِ ﴿۳۷﴾
অবশ্যই তারা লূতের কাছ থেকে তার মেহমানদেরকে অসদুদ্দেশ্যে দাবি করল ,তখন আমারা তাদের দৃষ্টি শক্তি লোপ করে দিলাম এবং বললাম, ‘আস্বাদন কর আমার শাস্তি এবং ভীতির পরিণাম।
সূরা:৫৪: আল্-ক্বামার-৩৮
وَ لَقَدۡ صَبَّحَہُمۡ بُکۡرَۃً عَذَابٌ مُّسۡتَقِرٌّ ﴿ۚ۳۸﴾
খুব ভোরেই একটি অপ্রতিরোধ্য আযাব তাদের ওপর আপতিত হলো।
সূরা:৫৪: আল্-ক্বামার-৩৯
فَذُوۡقُوۡا عَذَابِیۡ وَ نُذُرِ ﴿۳۹﴾
সুতরাং ‘আস্বাদন কর আমার শাস্তি এবং ভীতিপ্রদর্শনের পরিণাম।’
সূরা:৫৪: আল্-ক্বামার-৪০
وَ لَقَدۡ یَسَّرۡنَا الۡقُرۡاٰنَ لِلذِّکۡرِ فَہَلۡ مِنۡ مُّدَّکِرٍ ﴿٪۴۰﴾
নিশ্চয় আমি কুরআনকে উপদেশ গ্রহণের জন্য সহজ করে দিয়েছি। অতএব উপদেশ গ্রহণকারী কেউ আছে কি?
সূরা:৫৪: আল্-ক্বামার-৪১
وَ لَقَدۡ جَآءَ اٰلَ فِرۡعَوۡنَ النُّذُرُ ﴿ۚ۴۱﴾
ফেরাউনের অনুসারীদের কাছেও সাবধান বাণীসমূহ এসেছিল।
সূরা:৫৪: আল্-ক্বামার-৪২
کَذَّبُوۡا بِاٰیٰتِنَا کُلِّہَا فَاَخَذۡنٰہُمۡ اَخۡذَ عَزِیۡزٍ مُّقۡتَدِرٍ ﴿۴۲﴾
কিন্তু তারা আমার সবগুলো নিদর্শনকে অস্বীকার করলো। অবশেষে আমি তাদেরকে পাকড়াও করলাম। যেভাবে কোন মহা-পরাক্রমশালী পাকড়াও করে।
সূরা:৫৪: আল্-ক্বামার-৪৩
اَکُفَّارُکُمۡ خَیۡرٌ مِّنۡ اُولٰٓئِکُمۡ اَمۡ لَکُمۡ بَرَآءَۃٌ فِی الزُّبُرِ ﴿ۚ۴۳﴾
তোমাদের কাফেররা কি এ সব লোকদের চেয়ে কোন অংশে ভাল? নাকি আসমানী কিতাবসমূহে তোমাদের জন্য কোন ক্ষমা লিখিত আছে?
সূরা:৫৪: আল্-ক্বামার-৪৪
اَمۡ یَقُوۡلُوۡنَ نَحۡنُ جَمِیۡعٌ مُّنۡتَصِرٌ ﴿۴۴﴾
না কি এসব লোক বলে, আমরা একটা সংঘবদ্ধ শক্তি। নিজেরাই নিজেদের রক্ষার ব্যবস্থা করবো।
সূরা:৫৪: আল্-ক্বামার-৪৫
سَیُہۡزَمُ الۡجَمۡعُ وَ یُوَلُّوۡنَ الدُّبُرَ ﴿۴۵﴾
অচিরেই এ সংঘবদ্ধ শক্তি পরাজিত হবে এবং এদের সবাইকে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে পালাতে দেখা যাবে।
সূরা:৫৪: আল্-ক্বামার-৪৬
بَلِ السَّاعَۃُ مَوۡعِدُہُمۡ وَ السَّاعَۃُ اَدۡہٰی وَ اَمَرُّ ﴿۴۶﴾
বরং কিয়ামত তাদের শাস্তির নির্ধারিত সময়। আর কিয়ামত হবে কঠিনতর ও তিক্তকর ;
সূরা:৫৪: আল্-ক্বামার-৪৭
اِنَّ الۡمُجۡرِمِیۡنَ فِیۡ ضَلٰلٍ وَّ سُعُرٍ ﴿ۘ۴۷﴾
নিশ্চয় অপরাধীরা বিভ্রান্তি ও শাস্তির মধ্যে রয়েছে।
সূরা:৫৪: আল্-ক্বামার-৪৮
یَوۡمَ یُسۡحَبُوۡنَ فِی النَّارِ عَلٰی وُجُوۡہِہِمۡ ؕ ذُوۡقُوۡا مَسَّ سَقَرَ ﴿۴۸﴾
যেদিন তাদেরকে উপুড় করে টেনে নিয়ে যাওয়া হবে জাহান্নামের দিকে ; সেদিন বলা হবে, ‘জাহান্নামের যন্ত্রণা আস্বাদন কর।’
সূরা:৫৪: আল্-ক্বামার-৪৯
اِنَّا کُلَّ شَیۡءٍ خَلَقۡنٰہُ بِقَدَرٍ ﴿۴۹﴾
নিশ্চয় আমি প্রত্যেক বস্তুকে সৃষ্টি করেছি নির্ধারিত পরিমাপে।
সূরা:৫৪: আল্-ক্বামার-৫০
وَ مَاۤ اَمۡرُنَاۤ اِلَّا وَاحِدَۃٌ کَلَمۡحٍۭ بِالۡبَصَرِ ﴿۵۰﴾
আমার নির্দেশ একটি মাত্র নির্দেশ হয়ে থাকে এবং তা চোখের পলকে কার্যকর হয়।
সূরা:৫৪: আল্-ক্বামার-৫১
وَ لَقَدۡ اَہۡلَکۡنَاۤ اَشۡیَاعَکُمۡ فَہَلۡ مِنۡ مُّدَّکِرٍ ﴿۵۱﴾
তোমাদের মত অনেককেই আমি ধ্বংস করেছি আছে কি কোন উপদেশ গ্রহণকারী?
সূরা:৫৪: আল্-ক্বামার-৫২
وَ کُلُّ شَیۡءٍ فَعَلُوۡہُ فِی الزُّبُرِ ﴿۵۲﴾
তারা যা কিছু করেছে, তার প্রত্যেকটাই আমল-নামায় (লিপিবদ্ধ) আছে।
সূরা:৫৪: আল্-ক্বামার-৫৩
وَ کُلُّ صَغِیۡرٍ وَّ کَبِیۡرٍ مُّسۡتَطَرٌ ﴿۵۳﴾
আছে ক্ষুদ্র ও বৃহৎ সবকিছুই লিপিবদ্ধ;
সূরা:৫৪: আল্-ক্বামার-৫৪
اِنَّ الۡمُتَّقِیۡنَ فِیۡ جَنّٰتٍ وَّ نَہَرٍ ﴿ۙ۵۴﴾
নিশ্চয় মুত্তাকীরা থাকবে বাগ-বাগিচা ও ঝর্ণাধারার মধ্যে,
সূরা:৫৪: আল্-ক্বামার-৫৫
فِیۡ مَقۡعَدِ صِدۡقٍ عِنۡدَ مَلِیۡکٍ مُّقۡتَدِرٍ ﴿٪۵۵﴾
সত্যিকার মর্যাদার স্থানে মহা শক্তিধর সম্রাটের সান্নিধ্যে।

১৭-৫৫ নং আয়াত:-
আয়াতের ব্যাখ্যা:-
১) তাফসীরে ফী জিলালিল কুরআন:-

*পাপিষ্ঠ আ’দ জাতির অবস্থা : ‘আদ জাতি তার নবীকে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করায় কি ভাবে তাদের ওপর আমার আযাব এসে পড়লো তা চিন্তা করে দেখেছে কি? আমি, তাদের ওপর এক চরম অশুভ দিনে প্রচন্ড বাতাসের আযাব পাঠালাম, যা চিরদিনের জন্যে তাদেরকে ধ্বংস করে দিলাে। এ আযাব তাদেরকে উপড়ে যাওয়া খেজুর গাছের মতাে উৎখাত করে দিলাে। এখন ভেবে দেখাে কি কঠিন ছিলাে এ আযাব এবং পূর্বেই প্রদত্ত সতর্কবাণীর প্রতি তারা কি ব্যবহারটিই করেছিলাে? আর আমি শিক্ষা গ্রহণ করার জন্যে এই কোরআনকে সহজ করে দিয়েছি, এখন আছে কি কেউ এর থেকে শিক্ষা নেয়ার মতাে মানুষ?’ এ হচ্ছে দ্বিতীয় সেই জনপদটি, অথবা দ্বিতীয় সেই আযাবের দৃশ্য যা অত্যন্ত কঠিনভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত না-ফরমানদের বীভৎস চিত্রটি তুলে ধরেছে এবং তুলে ধরেছে নূহ(আ.)-এর আমলে তাঁর জাতি যে মারাত্মক অপতৎপরতায় লিপ্ত ছিলাে তাদেরই পরিণতির অনুরূপ আর একটি দুঃখজনক পরিণতিকে। উল্লেখযােগ্য যে, নূহ(আ.)-এর জাতিই হচ্ছে নবী ও তাঁর শিক্ষাকে প্রত্যাখ্যান করায় সর্বপ্রথম ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতি। অতীতের সংবাদ পরিবেশন করতে গিয়ে এ পর্যায়ে প্রথমই আ’দ জাতির প্রত্যাখ্যান করার কথা তুলে ধরা হয়েছে এবং এ বিষয়টির ওপর আগত আয়াতটি শেষ করার পূর্বেই বিস্ময়ের সুরে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে, ‘অতপর কেমন হলাে আমার আযাব ও সতর্কীকরণের ফল?’ অর্থাৎ আ’দ জাতির সত্যকে প্রত্যাখ্যান করার কি মারাত্মক ফল দাঁড়ালাে তা দেখেছো কি? এরপর আল্লাহ তায়ালা সে ভয়ানক হিংস্র নেকড়ের থাবার মতাে মহা বিপদের প্রকৃতি জানাতে গিয়ে বলছেন, ‘অবশ্যই আমি তাদের ওপর পাঠিয়েছিলাম এক দুর্লক্ষুণে দিনে এমন এক তীব্র ও ভয়ানক বাতাস যা তাদেরকে উৎপাটিত খেজুর গাছের মতাে উৎক্ষিপ্ত করে বিধ্বস্ত করে দিয়েছিলাে।’ ‘রীহুন সরসরুন’ বলতে এক প্রচন্ড ঠান্ডা বাতাসকে বুঝায়। এখানে ব্যবহৃত শব্দের মধ্যে যে ঝংকার ফুটে উঠেছে তাতে সে তীব্র বায়ুর প্রকৃতি এমনিই অনুমান করা যায় এবং তার ধ্বংসাত্মক চেহারা যেন মূর্ত হয়ে উঠে। ‘নাহসুন’ শব্দটি বলতে দুর্লক্ষণ, ভাগ্য বিপর্যয় এবং বিপজ্জনক অবস্থাকে বুঝায়। যে আদ জাতি দুর্গম গিরি সংকটে পাথরের পাহাড় খােদাই করে ঘর-বাড়ী তৈরী করে দাবী করেছিলাে যে, এসব ঘর-বাড়ী কেউ কোনােদিন ভাংতে পারবে না বা তাদেরকে কেউ ধ্বংসও করতে পারবে না। তাদের ওপর এমন শীতল ঘূর্ণিঝড় দিয়ে তাদেরকে আল্লাহ তায়ালা এসব গুহার মধ্য থেকে খেজুর গাছ উপড়ে আনার মতাে বের করে এনে আছড়ে আছড়ে খতম করে দিলেন যে, এমন কঠিন ভাবে দুনিয়ার আর কাউকে তিনি ধ্বংস করেননি। পৃথিবীর মানুষ চিন্তা করে দেখুক ধ্বংসলীলার এমন কঠিন নযীর দ্বিতীয়টি আর আছে কি? এ দৃশ্য যেমন ভয়ানক তেমনি ভীতিপ্রদ, যেহেতু তাদের হাড়-মাংস কঠিন শুকনা তৃণলতার মতো উক্ত পর্বতাঞ্চলের সন্নিহিত মরুভূমিতে ছড়িয়ে ছিটকে পড়েছিলাে এবং আজও তা বিরাজমান। আর আ’দ জাতির ওপর যে বায়ুপ্রবাহ পাঠানাে হয়েছিলাে তাই-ই হচ্ছে আল্লাহর সেই বাহিনী যা দিয়ে তিনি অহংকারী ও সীমালংঘনকারী জাতিকে নাস্তনাবুদ করে দিলেন। বায়ুর এ শক্তি আল্লাহরই এক সৃষ্টি, যাকে তিনি সুসংবাদ বহনকারী হিসাবে কাজে লাগান এবং যার জন্যে ইচ্ছা তার জন্যে ধ্বংসাত্মকও বানান। এই বায়ুকে কত জনপদের জন্যে আরাম ও শাস্তির বন্ধু। হিসাবে পাঠিয়ে তাদেরকে ধন্য করেছেন এবং তাঁরই ইচ্ছা ও নির্দেশে এই বায়ু মানুষের কত কল্যাণকর কাজে লেগেছে। যিনি এই বায়ুকে কাজে লাগিয়েছেন তিনিই তাে সব কিছুর মালিক এবং তিনিই সবাইকে সুসংবাদ দানকারী। ‘তাই কেমন হলাে আমার আযাব এবং কেমন হলাে আমার পথ প্রদর্শনা?’ ওপরের একথাটিকে এ দৃশ্যের বর্ণনা দেয়ার পূর্বে আল্লাহ তায়ালা বারবার ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বলেছেন এবং তারপর সে দৃশ্যের বর্ণনা দিয়ে তার জওয়াব দিয়েছেন! এরপর বিশেষ এক ভংগিতে ধ্বংসপ্রাপ্ত ওই জনপদের প্রতি নেমে আসা শাস্তির উপর্যুপরি উল্লেখের পর একথা বলে এ প্রসংগটির যবনিকাপাত করা হচ্ছে, ‘অবশ্যই আমি শিক্ষা গ্রহণের নিমিত্তে সহজ করে দিয়েছি এই কোরআনকে, সুতরাং আছে কি কেউ সদুপদেশ গ্রহণ করার?’ এরপর, সেই দৃশ্যটির ওপর আলােচনা আসছে যা এই প্রসংগের সাথে পূর্ণ সামঞ্জস্যশীল এবং যা ইতিহাসের পাতায় আজও অম্লান হয়ে রয়েছে।

জিলালিল কুরআন:

*সামুদ জাতির অবস্থা : ‘তারা অস্বীকার করলাে নবীদেরকে এবং মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করলাে সামূদ জাতি তার সতর্ককারীদেরকে। বলো তারা আমাদের মতােই এক ব্যক্তি না এই লােকটি! যার অনুসরণ করতে হবে আমাদের তা করলে তাে আমরাও দারুণ ভ্রান্তিতে পতিত হয়ে দোযখবাসী হয়ে যাব। এর থেকে কেউ আছে কি শিক্ষা গ্রহণ করার?'(আয়াত ২৩-৪০) আরব উপদ্বীপে শক্তি ও ক্ষমতার অধিকারী হিসাবে আদ জাতির পরেই ছিলাে সামূদ জাতির স্থান। এই দুটি জাতি ছিলাে সম-সাময়িক। আ’দ জাতি ছিলাে আরবের দক্ষিণাঞ্চলের অধিবাসী, আর সামূদ জাতি ছিলাে উত্তরাঞ্চলে। আ’দ জাতির মতাে সামূদ জাতিও সতর্ককারী নবীদেরকে অস্বীকার করেছিলাে এবং তাদেরকে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করেছিলাে। নবীদের প্রতি তাদের এই নাফরমানীও বিরুদ্ধাচরণের কথা গােটা আরব দেশে অবিশ্বাস্যরূপে ছড়িয়ে ছিলাে। তারা জাতি হিসাবে যেমন প্রসিদ্ধ ও নামকরা ছিলাে, তেমনি তাদের হিংসাত্মক তৎপরতা ও করুণ পরিণতিও ছিলো সবার জানা। এতদসত্তেও তারা বললাে, ‘লােকটি কি আমাদের মতােই এক সাধারণ ব্যক্তি নয়, তাহলে তার আনুগত্য করব কেন? তা যদি করি তাহলে তাে আমরাও ভ্রান্তিতে পড়ে যাবাে এবং দোযখবাসীতে পরিণত হবো। আমাদের মধ্য থেকে কি একমাত্র তার কাছেই এসব উপদেশবাণী নেমে এলো? (না, এ হতে পারে না), বরং এ লােকটি হচ্ছে নিকৃষ্ট এক মিথ্যাবাদী।’ যুগের পর যুগ ধরে নবীদের প্রতি বারবার এমন সব মিথ্যা আরােপ করা হয়েছে যা তাদের হৃদয়কে ভেংগে চুরমার করে দিয়েছে। কতাে মারাত্মক তাদের এই বাক্যবাণ, ‘আমাদের মধ্য হতে কি এ একমাত্র ব্যক্তির আনুগত্য করতে হবে? তা করলে তাে অবশ্যই আমরা ভ্রান্ত হয়ে যাবো (গােমরাহীর মধ্যে পতিত হবো) এবং (এর ফলে) দোযখবাসীতে পরিণত হয়ে যাব। তাদের পেটভরা এই অহংকারই তাদেরকে নবী(আ.)-এর দাওয়াতের তাৎপর্য বুঝতে দেয়নি, (অর্থাৎ অহংকারের কারণে দাওয়াতের কথাগুলাের দিকে তারা খেয়াল করে তাকাতে পারেনি)। তারা দাওয়াত দানকারীকে দেখেছে তুচ্ছ এক ব্যক্তি হিসাবে। তাদের বিবেচনায় লােকটি আমাদের মতােই এক সাধারণ ব্যক্তি না? তাই যদি হয়ে থাকে, তাহলে তার আনুগত্য করতে হবে কেন? আল্লাহ তায়ালা যদি তার বান্দাদের মধ্য থেকে এক ব্যক্তিকে (দাওয়াত দানকারী হিসাবে) বাছাই করে থাকেন, তাতে হয়েছেটা কি? আল্লাহ তায়ালা ভাল করেই জানেন কোন পাত্রে রেসালাত-এর দায়িত্ব দিতে হবে। কাজেই, তিনি তার পছন্দ মতাে ব্যক্তিকেই রেসালাত-এর এ দায়িত্ব অর্পণ করেন, সদুপদেশ দান করার কাজ অর্থাৎ ওহীর আমানতই হচ্ছে আসল জিনিস যার দিকে খেয়াল করা প্রয়ােজন এবং ওহীর বিষয়বস্তু সম্পর্কে চিন্তা করাই আসল কাজ। ‘বান্দাদের মধ্য থেকে যে বান্দাকে আল্লাহ তায়ালা তাঁর কাজের জন্যে পছন্দ করেন তার যােগ্যতা এবং এ কাজের জন্যে তার প্রস্তুতি কতটা আছে তা তিনিই জানেন, যেহেতু তিনি সকল সৃষ্টির স্রষ্টা এবং তিনিই সকল উপদেশমালা অবতরণকারী, এরপরও বাছাই করার প্রশ্ন কেন?’ এ হচ্ছে একটি বাজে সন্দেহ বা বাজে প্রশ্ন যা না-ফরমান লােকদের মনেই জাগ্রত হয়। যে সব ব্যক্তি দাওয়াতের বিষয়বস্তুর দিকে তাকাতে চায় না, দেখতে চায় না তার মধ্যে সত্য ও সঠিক জিনিস কতটা আছে, তারাই এসব সন্দেহ করতে থাকে। তারা শুধু দাওয়াতদানকারীর দিকেই তাকায় এবং তার তুলনায় নিজেদের বড়ত্ব বিবেচনায় এ দাওয়াত দানকারীর আনুগত্য থেকে দূরে সরে থাকে। তারা মনে করে, এ ব্যক্তির আনুগত্য করতে গেলে তাকে বড় মনে করতে হবে এবং তাকে সম্মান দিতে হবে তার আত্মসম্মাবোধ এটা মেনে নিতে পারে না। আর এই কারণেই তারা মনে মনে বলে, ‘এ ব্যক্তি কি আমাদের মতােই একজন সাধারণ মানুষ নয়? এর আনুগত্য করতে যাব কেন? এর আনুগত্য করলে তাে আমরা গােমরাহ্ এবং দোযখবাসী হয়ে যাবাে।’ অর্থাৎ, হায় এই ব্যক্তির ওপর ঈমান আনার মতাে অপ্রিয় কাজটি যদি আমাদের দ্বারা সংঘটিত হয়ে যায়। সব থেকে আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে, হেদায়াতের পথে চললে তারা গোমরাহ হয়ে যাবে বলে ভয় করছে। আরও তারা মনে করছে যে, তারা দোযখবাসী হয়ে যাবে। শুধু তাই নয়, তারা ভাবছে, একটি দোযখের নয়, তারা বহু দোযখের অধিবাসী হয়ে যাবে। অথচ, বাস্তব সত্য হচ্ছে, নবীর অনুসরণ করলেই তারা ঈমানের ছায়াতলে আশ্রয় পাবে। এই সব বাজে চিন্তা-ভাবনার কারণে যে রসূলকে আল্লাহ তায়ালা তাদের সত্য সঠিক পথে পরিচালনার জন্যে বাছাই করলেন তাকে তারা নানাভাবে দোষারােপ করতে লাগলাে, দোষারােপ করতে লাগলাে মিথ্যাবাদী বলে, লােভী বলে। এতটুকু বলেই তারা ক্ষান্ত হলাে না। তাকে ভীষণ লােভী এবং চরম মিথ্যাবাদী বলে গালিও দিতে থাকলাে। বললাে, সে এমন মিথ্যাবাদী যে তার কথা বা উপদেশ মানার যােগ্যই নয়। ‘আশিরুন’ বলতে বুঝায়, ব্যক্তিগত স্বার্থ পূরণে ভীষণ লােভী। অবশ্য অতীতে আল্লাহর পথে যারাই আহবান জানিয়েছেন তাদের সবাইকেই এই দোষারােপের সম্মুখীন হতে হয়েছে। দোষারােপ করা হয়েছে যে, তারা নিজেদের স্বার্থ-চরিতার্থ করার জন্য দাওয়াতী কাজকে ঢাল হিসেবে গ্রহণ করেছেন। নবীকে মিথ্যাবাদী বলে তারাই এভাবে দাবী করে যাদের বিবেক-বুদ্ধি খতম হয়ে গেছে এবং যারা কুপ্রবৃত্তির গােলামী করে এবং তাদের অন্তরের লাগামছাড়া ইচ্ছামত নিজেরা চলে। তাদের এই আচরণকে ইতিহাসে বর্ণিত নিজেদেরকে নিজেরা ধূলামলিন করার কাহিনীর সাথে তুলনা করা যায়। হঠাৎ করে কোনাে জিনিসের প্রতি একটু মনােযােগী হয়ে তারা আশা করে যে, এ কাজের সুফল তৎক্ষণাৎ পেয়ে যাবে। তারা চলমান বিভিন্ন ঘটনাকে অস্বীকার করে, সত্যকে দেখেও দেখে না, চিন্তাও করে না ভবিষ্যতে কি হবে না হবে। নিজেদের পান্ডিত্য দেখাতে গিয়ে তারা শুধু সেই কথাই বলে যায় যাতে তাদের পান্ডিত্য প্রকাশ পায়। এই কারণেই আল্লাহ তায়ালা তাদের ধমক দিতে গিয়ে বলছেন, শীঘ্রই তারা জানতে পারবে কে চরম মিথ্যাবাদী এবং কে ভীষণ লােভী। কোরআনে বর্ণিত কিসসা-কাহিনীর এ হচ্ছে এক বিশেষ বর্ণনাভংগি। এ এমন এক পদ্ধতি যা সে কাহিনীকে জীবনের জন্যে এক বাস্তব ও প্রাণবন্ত উদাহরণ হিসাবে তুলে ধরেছে এবং সে কাহিনী যেন মানুষের ধমনীতে প্রাণপ্রবাহ ছুটিয়ে দিয়েছে আর মানুষ অনুভব করেছে যেন চোখের সামনেই ঘটনাটি ঘটছে। পরবর্তী ঘটনার জন্যে মন অপেক্ষমান হয়ে যায় এবং মনে করে অদূর ভবিষ্যতেই সংশ্লিষ্ট অবস্থাটি ঘটতে যাচ্ছে। তাই এরশাদ হচ্ছে, ‘আগামী কালই তারা জানতে পারবে, কে চরম মিথ্যাবাদী এবং কে ভীষণ লােভী।’ অর্থাৎ আগামী কালই তাদের সামনে সঠিক অবস্থাটি প্রকাশিত হয়ে পড়বে। এ সত্য যখন প্রকাশিত হয়ে পড়বে তখন তারা কিছুতেই আর রেহাই পাবে না। প্রকৃতপক্ষে যারা মিথ্যাবাদী ও ভীষণ লােভী তাদের ওপর ধ্বংসাত্মক বিপদের দরজা সেই দিন খুলে দেয়া হবে। অতপর এরশাদ হচ্ছে, ‘আমি তাদেরকে পরীক্ষা করার জন্যে নির্দিষ্ট সেই উটনীটি পাঠাবাে, সুতরাং তাদের প্রতি লক্ষ্য রাখাে এবং সবর কর। আর জানিয়ে দাও তাদেরকে যে পানি পান করার দিন তাদের মধ্যে ভাগ করা রয়েছে। প্রত্যেকের জন্যে প্রয়ােজন নিজ নিজ নির্দিষ্ট দিনে যথাস্থানে হাযির হওয়া।’ এ পর্যায়ে এসে পাঠক থমকে দাড়ায় এবং পরবর্তীতে কি ঘটতে যাচ্ছে তার জন্যে অপেক্ষা করতে থাকে। কারণ উটনীটিকে তাে তাদের পরীক্ষার জন্যেই আল্লাহ তায়ালা প্রেরণ করেছিলেন। তাদের সঠিক অবস্থা নিরূপণের জন্যে ছিলাে এ পরীক্ষা এবং রসূলও এ পর্যায়ে এসে থমকে দাঁড়াচ্ছেন। সেই রসূল যাকে আল্লাহ তায়ালা পাঠিয়েছিলেন কি ঘটতে যাচ্ছে তা লক্ষ্য করার জন্যে। তাদের কার্যকলাপ ধৈর্যের সাথে লক্ষ্য করে তিনি দেখছিলেন এবং চিন্তা করছিলেন, কি কঠিন বিপদ তাদের ওপর নেমে আসবে এবং তাদের প্রতি আসা পরীক্ষার অবসান ঘটবে। এ গোত্রের জন্যে আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত উটনীটির পানি পান করার দিন ভাগ করা ছিলাে। এ ছিলাে বিশেষ একটি উটনী যার সুনির্দিষ্ট কিছু বৈশিষ্ট্য ছিলাে। যেগুলাে থেকে স্পষ্টভাবে বুঝা যেত যে, এটি ছিলাে আল্লাহর শক্তি-ক্ষমতার এক নিদর্শন এবং এক বিশেষ চিহ্ন। এজন্য একদিন উটনীটির পানি পানি করার জন্যে নির্দিষ্ট ছিলাে এবং আর একদিন ছিলাে সে গোত্রের পানি গ্রহণ করার জন্যে, যাতে পানির ঘাটে একদিন উটনীটি পানি পান করার জন্যে হাযির হয় এবং অন্যদিন সে গােত্রটি উপস্থিত হয়ে পানি গ্রহণ করে। এরপর পুনরায় কাহিনীটির বিশেষ বর্ণনার দিকে কথার মােড় ফিরিয়ে দিয়ে পরবর্তীতে তাদের ভাগ্যে কি ঘটেছে তা জানানাে হচ্ছে, এরপর তারা তাদের সংগীকে ডাকলাে এবং সে এসে উটনীটিকে ধরে ফেললাে ও নির্মমভাবে হত্যা করলাে। এসব লােকদের যে সংগী (যে লােকটি উটনীটিকে হত্যা করলাে), সে নগরীর মধ্যে চরম বিশৃংখলা সৃষ্টিকারী লােকদেরই একজন ছিলাে। সূরা ‘আন নামল’-এ আল্লাহ তায়ালা এদের সম্পর্কে বলছেন, ‘সে নগরীতে নয় জন লােকের একটি দল ছিলাে, যারা শুধু বিশৃংখলা ও অশান্তি সৃষ্টি করে বেড়াতাে, কখনই কোনাে ভাল কাজ তারা করতাে না।’ আর এদেরই সম্পর্কে সূরা ‘আশ শামস’-এ আল্লাহ তায়ালা জানাচ্ছেন, যখন তাদের মধ্যকার সব থেকে বড় দুই ব্যক্তিটি তৎপর হয়ে উঠলাে। আর এ কথাটিও বলা হয়েছে এ জঘন্য চরিত্রের লােকটি যখন কোনাে শয়তানী কাজ করতে চাইতাে, তখন প্রচুর পরিমাণে মদ পান করে নিত, আর তখন সে যে কোনাে অন্যায় কাজ করতে আর দ্বিধা বােধ করতাে না। সেই ব্যক্তিই আল্লাহর প্রেরিত সেই উটনীটিকে হত্যা করলাে যাকে আল্লাহ তায়ালা তার শক্তির এক নিদর্শন হিসাবে সে গােত্রের মধ্যে পাঠিয়ে ছিলেন। অবশ্যই তাদের রসূল তাদেরকে স্পষ্টভাবে একথা বলে হুঁশিয়ার করে দিয়েছিলেন যে, আল্লাহর এ উটনীটির গায়ে হাত দিলে তাদের ওপর নির্ঘাত ভীষণ বেদনাদায়ক আযাব নাযিল হয়ে যাবে। এতদসত্ত্বেও তারা তাদের সেই নিকৃষ্ট সংগীটিকে ডেকে পাঠালাে, এবং সে এসে উটনীটিকে ধরলাে ও নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করলাে। এর ফলে তাদের ওপর প্রদত্ত পরীক্ষা সমাপ্ত হলাে এবং নাফরমানদের জন্য নির্ধারিত সেই মহাবিপদ সংঘটিত হয়েই গেলাে। ‘সুতরাং, কেমন হলাে আমার সে আযাব আর কেমন ভাবে বাস্তবায়িত হলে আমার সতর্কবাণী, দেখলে তো?’ এ হচ্ছে আশ্চর্যবােধক এবং ভীতিপ্রদ এক প্রশ্ন। এ প্রশ্নটি করা হয়েছে আযাব সম্পর্কে নবীর হুঁশিয়ার করে দেয়ার পর-যখন হতভাগা লােকটি উটনীটিকে মেরে ফেললাে, তার পর দিন ভাের বেলাতেই ওই ভয়ানক আযাব তাদেরকে ঘেরাও করে ফেলে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিলো। আমি পাঠালাম তাদের ওপর ভীষণ এক চিৎকার ধ্বনি, যা তাদেরকে শুকনা ভূষির মতাে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিলাে। এই চিৎকার ধ্বনি সম্পর্কে কোরআন বিশেষ কোনাে ব্যাখ্যা দেয়নি। অবশ্য, সুরা ‘ফুসসিলাত’-এর এক আয়াতে এই চিৎকার ধ্বনি বা ভীষণ এক শব্দের আযাবের কথা বলা হয়েছে, এরশাদ হয়েছে, ‘এর পরও যদি ওরা মুখ ফিরিয়ে চলে যায়, তখন বলল, আমি তােমাদেরকে হুঁশিয়ার করে দিচ্ছি সেই মহা চিৎকার ধ্বনির আযাব সম্পর্কে, যা আ’দ ও সামূদ জাতির ওপর এসে পড়েছিলাে।’ এখানে ‘সইহাতুন’ ও ‘সায়িকাতুন’ শব্দ দুটি একই অর্থে ব্যবহৃত। আবার কখনও এই আযাবের তীব্রতা বুঝানাের জন্যে এ শব্দ দুটিকে ব্যবহার করা হয়েছে। এজন্যে এ শব্দ দুটির অর্থ একই। কখনও এ বিকট শব্দ বলতে বুঝায় এক মহা চিৎকার ধ্বনি যা সহ্য করতে না পেরে মানুষ মরে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায় এবং কোন দিক থেকে ওই শব্দ আসছে তা বুঝার মতাে ক্ষমতা থাকে না। সেই হতভাগ্য জাতির ওপর সেই মহা চিৎকার ধ্বনি একবারই এসেছিলাে এবং তাতেই তাদের যা পরিণাম হবার তাই হয়েছিলাে, অর্থাৎ তারা হয়ে গিয়েছিলাে চুর্ণ-বিচূর্ণ শুকনা ভূষির মতাে। সে জনপদের ওপর আসা মহা বিপদ ছিলাে তাদের নিজেদেরই অর্জিত ফল। তাদের পরিণতি শুকনা খড়কুটার মতাে হয়ে গিয়েছিলাে। কারণ তাদের লাশগুলাে ওই ভয়ানক আযাবের কবলে পড়ে মরুভূমিতে ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়েছিলাে এবং সেখানে রােদে শুকিয়ে শুকনা চূর্ণ ভূষির মতােই সেগুলাে বিক্ষিপ্তভাবে পড়ে ছিলাে, আর এই অবস্থাটি ছিলাে মাত্র একবারেরই এক প্রচন্ড শব্দের পরিণতি। এ ছিলাে একটা ভয়ানক দুঃখজনক দৃশ্য। এ দৃশ্যটি কোরায়শের কাফেরদের কাছে তুলে ধরা হয়েছে যাতে করে তারা তাদের বড়ত্ব ও অহংকার ত্যাগ করতে পারে। তাদেরকে দেখানাে হয়েছে যে, পৃথিবীর বড় বড় শক্তিমান জাতি কিভাবে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেছে, তুচ্ছ পশুর চর্বিত ভূষির মতােই তারা মিশে গেছে মাটির সাথে। এই কঠিন ও ভয়ানক দৃশ্যকে তাদের সামনে তুলে ধরে তাদের অন্তরকে কোরআনের দিকে আহ্বান জানানাে হচ্ছে, যেন তারা এসব থেকে সঠিক শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে এবং চিন্তা করতে পারে। সেসব ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতির দৃশ্য আজও যা বর্তমান আছে তার থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা সহজ। আর অবশ্যই আমি কোরআনকে সহজ করে দিয়েছি উপদেশ গ্রহণের জন্যে। অতএব, কেউ কি আছে শিক্ষা নেয়ার মতো? এরপর আল্লাহ তায়ালা যবনিকা নিক্ষেপ করছেন সে চর্বিত ও অভিশপ্ত ভূষির পর, তবু তাদের সে করুণ দৃশ্য আজও যেন চোখের সামনে ভাসতে থাকে এবং অন্তরের মধ্যে ভীতির সঞ্চার হয়। এজন্যে কোরআনে করীম এ অভিশপ্ত জাতির দৃশ্যের বর্ণনা দিয়ে আহ্বান জানাচ্ছে সেই সব ব্যক্তিকে যারা অতীতের ঘটনাবলী থেকে শিক্ষা নিতে প্রস্তুত হয়ে যায় ও এ নিয়ে চিন্তা ভাবনা করে।
জিলালিল কুরআন:

*কওমে লূতের জঘন্য আচরণ : অতপর আল্লাহ তায়ালা নিম্নে বর্ণিত আর এক নতুন জাতির করুণ ইতিহাসের ওপর থেকে পর্দা সরিয়ে দেখাচ্ছেন যে আরব উপদ্বীপের মধ্যে তাদেরও এক সাংঘাতিক পরিনামের সম্মুখীন হতে হয়েছিলাে। এরশাদ হচ্ছে, ‘প্রত্যাখ্যান করলো লুত(আ.)-এর জাতি উপদেশের বাণীকে… আর আমি সহজ করে দিয়েছি কোরআনে করীমকে, আছে কি কেউ এর থেকে শিক্ষা নেয়ার।’ কোরআনে অন্যান্য জায়গায় ও লূত(আ.)-এর কাহিনী বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়েছে। এখানে বিস্তারিত বিবরণ দেয়া মূল উদ্দেশ্য নয়, শুধু নবীকে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করার পরিণতি কত ভয়াবহ হবে তা বুঝানাের জন্যে ঘটনাটি এখানে উল্লিখিত হয়েছে। সে হতভাগ্য জাতির প্রতি যে কঠিন শাস্তি নাযিল হয়েছিলাে তার বিস্তারিত বিবরণ এখানে দেয়া হয়েছে, আর তারপর এক এক করে নবীদের অমান্যকারীদের ওপর নেমে আসা কঠিন ও বেদনাদায়ক আযাবের বর্ণনা দান করা হয়েছে। এরশাদ হচ্ছে, ‘লূত(আ.)-এর জাতি প্রত্যাখ্যান করলাে এবং মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করলাে ভীতি প্রদর্শনকারী নবীদেরকে’—এই ইংগিতের জের ধরে সে অবাধ্য জাতির প্রতি নেমে আসা চরম শাস্তির কথা বলা হয়েছে। এরশাদ হচ্ছে, ‘অবশ্যই আমি বর্ষণ করেছি তাদের ওপর পাথরের বৃষ্টি, একমাত্র লূত-এর পরিবার বাদে। ভাের বেলায় আমি তাদেরকে এলাকা থেকে সরিয়ে নিলাম। এটা আমার এক বিশেষ অবদান। এইভাবে যারা কৃতজ্ঞতা প্রদর্শন করে তাদেরকে আমি প্রতিদান দেই।’ ‘হাসিব’ বলতে সেই বাতাসকে বুঝায় যা পাথর বহন করে। বহু স্থানে আল্লাহ তায়ালা পাথরের বৃষ্টি বর্ষণ করেছেন। ‘হাসিব’ শব্দের মধ্যে এমন এক সংকেত আছে যার দ্বারা পাথর বর্ষণ করা বুঝানাে হয়েছে। এ শব্দটির মধ্যে রয়েছে প্রচণ্ডতা, ভয়াবহতা এবং সে অবস্থার প্রেক্ষাপটে ভীষণ এক অবস্থার বর্ণনা। এ কঠিন অবস্থায় লূত(আ.)-এর পরিবার ব্যতীত আর কেউ বাঁচতে পারেনি এবং তার পরিবারের মধ্যে তার স্ত্রী ছিলাে একজন ব্যতিক্রম। অর্থাৎ তার স্ত্রীও বাঁচেনি। অন্যান্য সবার বেঁচে যাওয়া এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে এক বিশেষ নেয়ামত হিসেবে ছিলো। এই পরিবারের সদস্যরা ও সংগী-সাথীদের ঈমান ও শােকরগুযারীর কারণে আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে পুরস্কার হিসাবে এই নাজাত দান করেছিলেন। ‘এমনি করে শােকরগােযার যে করে তাকে আমি মহান আল্লাহ নাজাত দান করি।’ অর্থাৎ এই সব ধ্বংসলীলা ও ভয়ভীতিপূর্ণ অবস্থার মধ্যেও আমি তাদেরকে নাজাত দিয়ে থাকি। এখানে এ কাহিনীটির দুটি দিক উল্লেখ করা হয়েছে। মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করা ও কঠিনভাবে পাকড়াও করা। বিস্তারিত আলােচনা এই দুই অবস্থাকে কেন্দ্র করে অগ্রসর হবে। কোরআনের মধ্যে কাহিনী বর্ণনার জন্যে অবলম্বিত বিভিন্ন পদ্ধতির মধ্যে এ হচ্ছে একটি বিশেষ পদ্ধতি। যে কোনাে কাহিনী বর্ণনা করতে গিয়ে তার প্রেক্ষাপট বা কার্যকারণ বর্ণনা করা হয়েছে প্রথম। (দেখুন আততাসওয়ীরুল ফান্নি ফিল কোরআন পুস্তকের মধ্যে আল ক্বিসসাতু ফিল কোরআন অধ্যায়) নীচে এর বিস্তারিত বিবরণ প্রদত্ত হলাে, আর অবশ্যই সে(নবী) তাদেরকে আমার পাকড়াও সম্পর্কে যথাযথভাবে সতর্ক করেছে, কিন্তু তারা সেসব সাবধান বাণীর ওপর সন্দেহ আরােপ করেছে এবং ওরা সেই নবীকে চাপ দিয়েছে যেন সে তার মেহমানদের সাথে লজ্জাকর ব্যবহারের ব্যবস্থা করে দেয়। যার ফলে আমি তাদের চোখগুলােকে অন্ধ করে দিয়ে বলেছিলাম, চোখে দেখ আমার শাস্তি, যা আমি সতর্ক করার পর পাঠালাম। আর তারপর পরবর্তী প্রভাতে তাদের ওপর নেমে এলাে স্থায়ী আযাব। অথচ লূত(আ.) তার জাতিকে এ অন্যায় কাজের কঠিন পরিণতি সম্পর্কে অবিরত সতর্ক করে চলেছিলেন যা কদাচিত কোনাে মানুষ করে থাকে। কিন্তু হতভাগ্য সে জাতি ওই সতর্কবাণীর প্রতি কর্ণপাত না করে হাসি ঠাট্টা করে সে কথাগুলােকে উড়িয়ে দিয়েছে। তাদের নবীর সাথে তারা উপদেশ সম্পর্কে যুক্তিহীনভাবে ঝগড়া করেছে সে কথাগুলাে আল্লাহর বাণী, সে বিষয়ে সন্দেহ পােষণ করেছে এবং আদৌ এ অন্যায় আচরণের জন্যে শাস্তি আসতে পারে বলে তারা সন্দেহ করেছে। এইভাবে এই সন্দেহপূর্ণ মনােভাব তারা পরস্পরের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছে এবং নবীর সাথে নানা প্রকার তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত হয়ে পড়েছে। এতটুকুতেও তারা ক্ষান্ত হয়নি, বরং তারা নবীকে বাধ্য করতে চেয়েছে যেন তিনি তার সেই ফেরেশতা মেহমানদের সাথে সেই দুর্ব্যবহারের ব্যবস্থা করে দেন। তারা ভেবেছিলাে, এই মেহমানরা প্রভাত বেলায় আগত কিছু সংখ্যক বণিক, যার কারণে তারা অস্বাভাবিক ও ঘৃণ্য দুরভিসন্ধিপূর্ণ মনােভাব নিয়ে এগিয়ে যেতে চেয়েছিলাে। চেয়েছিলাে তারা লজ্জা-শরমের সকল সীমা অতিক্রম করে লূত(আ.)-কে প্রলুব্ধ করতে যেন তারা আগত মেহমানদের সাথে তাদের মন্দ উদ্দেশ্যকে চরিতার্থ করতে পারে। তাদের এই চরম অসুস্থ মানসিকতার কারণে নবীর সতর্কবাণীতে তারা এতটুকু কর্ণপাত করলাে না এবং এর কঠিন পরিণতি সম্পর্কে সামান্য একটু চিন্তা করলাে না। এই পর্যায়ে এসে আল্লাহর ক্ষমতার হাত এগিয়ে এল এবং ফেরেশতারা তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে সক্রিয় হয়ে উঠলেন, যার ফলে আমি মহান আল্লাহ তাদের চোখগুলােকে অন্ধ করে দিলাম। এরপর তারা আর কোনাে জিনিস বা কাউকে দেখতে পারলােনা। লূত(আ.)-কে বাধ্য করতে বা মেহমানদের শরীর স্পর্শ করতেও তারা আর সমর্থ হলাে না। চোখ অন্ধ করে দেয়া দ্বারা এখানে যে ইংগিতটি পাওয়া যায় তা হচ্ছে, আলােচ্য এই যে বিশেষ ক্ষেত্র, এখানেই তাদের দৃষ্টিশক্তি কাজ করেনি। অন্যান্য জায়গার জন্যে তাদের দৃষ্টিশক্তি কেমন ছিলাে সে সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘তারা বললাে, হে লূত, আমরা তােমার রব-এর পক্ষ থেকে আগত দূত, ওরা কিছুতেই আমাদের কাছ পর্যন্ত পৌঁছতে পারবে না।’ এখানে বিশেষভাবে অবস্থাটির উল্লেখ করা হয়েছে যার কারণে সে হতভাগারা লূত(আ.)-এর কাছে পৌছুতে পারেনি। আর সেটা হচ্ছে চোখের ওপর পর্দা পড়ে যাওয়া। এ কাহিনীর প্রেক্ষাপট বর্ণনা করতে গিয়ে এমনভাবে বলা হচ্ছে, যেন দৃশ্যটি আমাদের সামনে ভাসছে এবং শান্তিতে ঘেরাও হয়ে যাওয়া ব্যক্তিদেরকে সরাসরি সম্বােধন করে বলা হচ্ছে ‘নাও, এবারে স্বাদ গ্রহণ করাে আমার আযাবের এবং ভােগ করাে আমার সতর্কবাণীর প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শনের পরিণতি।’ অর্থাৎ, এই হচ্ছে সেই শাস্তি যার সম্পর্কে তােমাদেরকে ভয় দেখানাে হয়েছিলাে এবং যে সতর্কবাণী সম্পর্কে তােমরা সন্দেহ করেছিলে। এ হতভাগা জাতির চোখের জ্যোতি তুলে নেয়ার ঘটনাটি ঘটেছে বিকাল বেলায়, যাতে করে তাদের পুরােপুরি ধ্বংস করে দেয়ার জন্যে সকাল বেলা পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখা যায়। এরশাদ হচ্ছে, ‘আর অবশ্যই তাদেরকে পরদিন সকাল বেলায় স্থায়ী আযাব ঘিরে ফেললাে।’ এই ছিলাে সেই আযাব যার বিবরণ সংগে সংগেই দান করা হল-আর এটাই ছিলাে সেই পাথরবৃষ্টি যা সেই ঘৃণ্য কলুষতা ও অশান্তি থেকে পৃথিবীকে মুক্ত করেছিলাে। আযাবের ঘটনাটিকে আবার ভিন্নভাবে তুলে ধরা হচ্ছে এবং এই দৃশ্যকে এমনভাবে তুলে ধরা হচ্ছে যেন শাস্তির পুরাে অবস্থাটি একই সময়ে সংঘটিত হয়েছে। শাস্তিপ্রাপ্তদেরকে এমন সময়ে ডাক দিয়ে আযাবের স্বাদ গ্রহণ করতে বলা হচ্ছে যখন তারা নিজেদের চোখেই আযাব দেখতে পাচ্ছে। এরশাদ হচ্ছে, ‘অতএব, স্বাদ গ্রহণ করাে আমার আযাবের এবং ভােগ করাে আমার সতর্কবাণীকে উপেক্ষা করার পরিণাম।’ এরপর এই কঠিন দৃশ্যের অবতারণার পর পরই আসছে স্নেহপূর্ণ এক সম্বােধন, আর অবশ্যই আমি কোরআনকে উপদেশ হাসিল করার উদ্দেশ্যে সহজ করে দিয়েছি। ‘সুতরাং এর থেকে শিক্ষা নেয়ার মতাে কেউ আছে কি?’
জিলালিল কুরআন:

*ফেরাউন ও তার জাতির অবস্থা : সে জাতির এই করুণ ইতিহাস তুলে ধরার পর এবার আরবের বাইরের এক বিখ্যাত জাতির ইতিহাস বর্ণনা করা হচ্ছে। সে জাতির ঔদ্ধত্য এবং সত্যের বিরুদ্ধে তাদের ষড়যন্ত্র পৃথিবীর মানুষের কাছে সুপরিচিত। এদের সত্যের বিরুদ্ধে তৎপরতার পরিণাম তুলে ধরে ইংগিতে একথা জানানাে হচ্ছে যে, সত্যকে উৎখাত করার জন্যে যারা অপচেষ্টা চালাবে, তাদেরকে এই একই পরিণাম ভােগ করতে হবে। এরশাদ হচ্ছে, ‘ফেরআউনের জাতির কাছে সতর্কবাণী এলো, কিন্তু তারা আমার সকল নিদর্শনকে অস্বীকার করলাে, যার ফলে আমি আমার সার্বভৌম ক্ষমতা বলে তাদের পাকড়াও করলাম।’ এইভাবে ফেরআউন ও তার সভাসদদের আচরণের দুটি দিক তুলে ধরা হয়েছে। সতর্কবাণী নিয়ে তাদের কাছে নবী মূসা(আ.)-এর আগমন এবং তার আনীত মােজেযাগুলােকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার অপচেষ্টা। তারপর এর শাস্তি স্বরূপ সর্বশক্তিমান আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের ওপর নেমে আসা আযাবের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহর শক্তি ও ক্ষমতার দিকে ইংগিত করে তাদের ওপর নেমে আসা আযাবের কঠোরতা ও ভীষণতা জানানাে হয়েছে। এ কাহিনীর মধ্যে একথাও জানানাে হয়েছে যে, ফেরাউন শক্তি-ক্ষমতার দাপটে কত বড় জুলুম ও বিদ্রোহাত্মক কাজে লিপ্ত হয়েছিলাে। কিন্তু দুনিয়া দেখে নিয়েছে কিভাবে তার মিথ্যা-গর্ব চূর্ণ হয়ে গেছে এবং কিভাবে তার শক্তি-ক্ষমতার অলীক দাপট খর্ব হয়ে গেছে। আল্লাহ তায়ালা তাকে ও তার বংশাবলীকে যখন পাকড়াও করলেন, তখন প্রকৃত শক্তি-ক্ষমতার মালিক কে তা প্রমাণিত হয়ে গেলাে। তার দাপট, তার গর্ব ও যুলুম-নির্যাতনের সমুচিত শাস্তি আল্লাহ তায়ালা এমনভাবে দিলেন যা আজও পৃথিবীর মানুষের কাছে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছে। জবরদস্ত শক্তিমান ও যালেম ফেরআউনের জাতির ওপর নেমে আসা এই কঠিন শাস্তি ছিলাে আল্লাহর দেয়া সর্বশেষ সরাসরি কঠিন আযাব। এরপর এ ধরনের কঠিন আযাব সরাসরিভাবে আর নাযিল হয়নি। বর্তমানে আল্লাহ তায়ালা পর্দা নিক্ষেপ করে রেখেছেন এই শেষ আযাবের ওপর যা ফেরআউন ও তার জাতির ওপর নাযিল হয়েছিলাে। তবে সত্যকে যারা প্রত্যাখ্যান করে, তারা আজও যখন এ আযাব দেখে এবং অন্তরের গভীরে তারা অনুভব করে যে, ইচ্ছাকৃতভাবে অন্যায় করলে বা কারও প্রতি জেনে বুঝে যুলুম করলে যে-কোনাে মুহূর্তে এ কঠিন আযাব এসে যেতে পারে।

জিলালিল কুরআন:

পৃথিবীর ইতিহাসে যালেম জাতিসমূহের প্রতি বারবার নেমে আসা শাস্তির ছবি আজকের যালেমদের অবচেতন মনে বিরাজমান রয়েছে এবং এজন্যে তারা শংকিত যে, কখন আবার তাদের ওপর সে দুর্ভাগ্যজনক অবস্থা নেমে আসে। এ জন্যে তাদেরকে সতর্ক করার উদ্দেশ্যে রব্বুল আলামীন ইংগিতে বলছেন যে, অতীতের সে ভীষণ আযাবের কথা জানা সত্তেও যদি তারা এখনও সংশােধিত না হয়, তাহলে পূর্ব থেকে আরও কঠিন আযাব এবং আরও অনেক বড় দুর্ভোগ তাদের ওপর নেমে আসবে। আল্লাহর ভাষ্য লক্ষ্যণীয়, তােমাদের মধ্যে যেসব কাফের বা অস্বীকারকারীরা রয়েছে, তারা পূর্ববর্তী যালেমদের থেকে কোন দিক দিয়ে ভাল? অথবা আসমানী কিতাবসমূহে কি তােমাদের নিরাপত্তা সম্পর্কে কোনাে ঘােষণা এসেছে? অথবা একথাও তারা বলে নাকি যে, আমরাই সবদিক দিয়ে বিজয়ী হবো? (তাদের জানা থাকা দরকার যে) শীঘ্রই তাদের শক্তিজোটকে পরাভূত করা হবে এবং সেদিন তারা পেছন ফিরে পালাতে থাকবে, বরং তাদের জন্যে ওয়াদা করা কেয়ামত আগতপ্রায় যা হবে আরও বেশী দুর্ভাগ্যজনক এবং আরও বেশী কঠিন। কিন্তু অপরাধী চক্রের ভুল কিছুতেই ভাংবে না। তারা বরাবর গোমরাহীর মধ্যেই হাবুডুবু খেতে থাকবে এবং অবশেষে দগ্ধীভূত হবে প্রজ্জলিত আগুনে। তাদের একটু চিন্তা দরকার সেই দিন সম্পর্কে, যে দিন তাদেরকে মুখের ওপরে টেনে-হিঁচড়ে আগুনের মধ্যে নিক্ষেপ করা হবে। বলা হবে, স্বাদ গ্রহণ করাে এই দোযখের। অবশ্যই আমি সব কিছুকে সৃষ্টি করেছি এক নির্দিষ্ট পরিমাপে আর, আমার ফয়সালা এসে যাওয়া সে তাে একটিমাত্র মুহর্তের ব্যাপার। আমি তােমাদের বহু জনপদকে ধ্বংস করে দিয়েছি, সুতরাং এখনও বলাে শিক্ষা গ্রহণ করার মতাে কেউ আছে কি? দেখাে, ওরা যা কিছু অতীতে করেছে তা সবই (আল্লাহর নিয়ন্ত্রণে রক্ষিত) বিভিন্ন গ্রন্থে লিপিবদ্ধ রয়েছে এবং ছােট-বড় সকল বিষয় যথাযথভাবে লিখিত রয়েছে। এসব সতর্কবাণী দুনিয়ার জীবন ও আখেরাত উভয় স্থানের জন্যে। এসব বর্ণনার মাধ্যমে এই সতর্কীকরণের প্রতিটি কথার সত্যতা প্রমাণিত হয়ে গেছে এবং যাবতীয় সন্দেহ-সংশয় দূরীভূত হয়ে আল্লাহর গযব থেকে বাঁচার প্রতিটি আশ্রয় কেন্দ্র বন্ধ হয়ে গেছে, পালানাের বা আযাব থেকে বাঁচার সকল পথ ওদের জন্যে খতম হয়ে গেছে, এমনকি তাদেরকে যে কঠিন পরিণতির সম্মুখীন হতে হবে সে বিষয়ে তাদের মধ্যে ভুল বােঝাবুঝিরও কোনাে অবকাশ নেই। এত ছিলো অতীতে সত্যবিরােধীদের তৎপরতা। কিন্তু এ কঠিন পরিণতি থেকে রেহাই পাওয়ার উদ্দেশ্যে সত্য সঠিক পদ্ধতি গ্রহণ করার পথে তােমাদের জন্যে কোন্ জিনিস অন্তরায় হয়ে রয়েছে? তাই এরশাদ হচ্ছে, ‘তােমাদের মধ্যে অস্বীকারকারী (কাফের যারা রয়েছে), তারা কি ওদের থেকে কোনাে অংশে উত্তম?’ কোন্ কারণে (বর্ণিত) সেসব ব্যক্তি থেকে তােমাদের মধ্যকার কাফেররা ভাল। ‘তােমাদের মুক্তির বার্তা বহন করে আসমানী কিতাবগুলােতে কোনাে কথা নাযিল হয়েছে কি?’ অর্থাৎ ওদের মুক্তির পক্ষে আসমানী কিতাবগুলাে কোনাে সাক্ষ্য বহন করে কি? যার কারণে কুফরী ও নবীকে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করার অপরাধ মাফ হয়ে যেতে পারে? এর কোনােটাই সত্য নয়। কোনােক্রমেই তােমরা পূর্ববর্তী এসব আযাবপ্রাপ্ত লােক থেকে উত্তম নও এবং আসমানী কিতাবসমূহে তােমাদের মুক্তির ঘোষণা নিয়ে কোনাে সংবাদও আসেনি। বরং তােমাদের পূর্বেকার ব্যক্তিরা যে সব পরিণতির সম্মুখীন হয়েছিলো, আল্লাহ তায়ালা তােমাদের জন্যে সেই একই পরিণতি নির্ধারণ করে রেখেছেন। এরপর সম্বােধনের গতি ফিরে যাচ্ছে সাধারণ লােকদের দিকে এবং বিস্ময় প্রকাশ করে বলা হচ্ছে, ‘ওরা কি বলছে আমরাই সাহায্যপ্রাপ্ত এক জনগোষ্ঠী?’ আল্লাহর সাহায্য প্রাপ্তদের কেউ পরাজিত করতে পারে না তখনই তারা এইভাবে কথা বলে যখন তারা নিজেদের সমন্বিত জোটকে দেখে এবং মুগ্ধ বিস্ময়ে তাদের ঐক্যবদ্ধ শক্তির কথা চিন্তা করে। এভাবে, প্রকৃতপক্ষে তারা জোটবদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে ধােকা খায় ও বলে- আমরাই সাহায্যপ্রাপ্ত, আমাদেরকে কেউ পরাজিত করতে পারবে না। বা আমাদের ওপর কেউ বিজয়ীও হতে পারবে না। এ কারণেই আল্লাহর পক্ষ থেকে চূড়ান্ত ঘােষণা আসছে- “অতি শীঘ্র সকল জোটকে ভেংগে দেয়া হবে এবং এ দুশমনের দল পেছন ফিরে পালাতে থাকবে।” তখন বাতিল শক্তির এ জোট তাদেরকে কিছুতেই বাঁচাতে পারবে না এবং ওদের শক্তি-ক্ষমতাও তাদেরকে কোনাে সাহায্য করতে সক্ষম হবে না। এ ঘোষণা যিনি দিচ্ছেন তিনি মহাশক্তিমান এবং জবরদস্ত ক্ষমতার মালিক। তার শক্তি-ক্ষমতা বরাবর ছিলাে এবং চিরদিন একই ভাবে তা অটুট থাকবে। হযরত আব্বাস(রা.)-এর বরাত দিয়ে বোখারী(র.) বলেন, বদর যুদ্ধের দিন রসূল(স.)-এর জন্যে নির্মিত একটি সুরক্ষিত কালচক্র অবস্থানকালে তিনি বলছিলেন, হে আমার পরওয়ারদেগার, আপনার চুক্তি ও ওয়াদার দোহাই দিয়ে তােমার কাছে মিনতি করছি, হে আমার মালিক! তুমি কি চাও, পৃথিবীতে তােমার এবাদাত-বন্দেগী এবং তােমার হুকুম পালন আর কোনাে দিন না করা হােক।’ এতটুকু বলার সাথে সাথে আবু বকর(রা.) তার হাত ধরে কাতরম্বরে বললেন, ব্যস করুন ইয়া রসূলাল্লাহ! আপনার জন্যে যথেষ্ট বলা হয়ে গেছে ইয়া রসূলাল্লাহ! আপনার রবকে অনেক শক্ত কথা আপনি বলে ফেলেছেন, আর না। তারপর তিনি তার এ অবস্থান ক্ষেত্র থেকে ছুটে বেরিয়ে গেলেন এবং বর্মপরিহিত অবস্থায় লাফাতে লাফাতে এগিয়ে গেলেন। তখন তার পবিত্র মুখে উচ্চারিত হচ্ছিলাে, শীঘ্রই তাদের জোট ভেংগে যাবে এবং তারা পেছন ফিরে পালাতে থাকবে।’ ইবনে হাতেম ইকরামার বরাত দিয়ে আর একটি হাদীস এনেছেন: উপরােক্ত আয়াত যখন নাযিল হলাে তখনও ওমর(রা.) বললেন, কোন্ দল পরাভূত হবে, কোন্ জোট পরাজয় বরণ করবে? ওমর(রা.) আরও বলেন, বদর যুদ্ধের দিন দেখলাম রসূলুল্লাহ(স.) বর্মাবৃতাবস্থায় লাফ দিতে দিতে এগিয়ে যাচ্ছেন এবং বলছেন, শীঘ্রই তাদের জোট ভেংগে যাবে এবং তার পেছন ফিরে পালাতে থাকবে। তারপর সেই দিনই আমি এ কথার ব্যাখ্যা বুঝেছিলাম। অথচ এ তো ছিলাে দুনিয়ার পরাজয় এবং এ পরাজয়ই শেষ পরাজয় নয়, এর পরে রয়েছে আখেরাত। আখেরাতের তুলনায় দুনিয়ার এ পরাজয় এতাে শক্ত নয়, এতাে যন্ত্রণাদায়কও নয়, তবু দুনিয়ার একটি ক্ষতির উল্লেখ করে আর একটিকেও স্মরণ করিয়ে দেয়া হচ্ছে, ‘বরং কেয়ামতের সে ভয়ানক আযাবের ওয়াদাই তাদের সাথে করা হয়েছে এবং কেয়ামত আরও বেশী কষ্টকর, আরও বেশী যন্ত্রণাদায়ক।’ অর্থাৎ পৃথিবীতে যত আযাব তারা দেখেছে অথবা দেখবে সে সব কিছু থেকে আখেরাতের আযাব আরও বেশী কঠিন এবং আরও বেশী যন্ত্রণাদায়ক হবে। যে সব দৃশ্য তাদের সামনে এ পর্যন্ত এসেছে সে সব থেকে আরও বেশী যন্ত্রণাদায়ক হবে আখেরাতের আযাব। অর্থাৎ, ঝড়, তুফান ঘুর্ণিঝড়, গগনবিদারী চিৎকার ধ্বনি এবং প্রচন্ড পাথরবৃষ্টি যা মহাশক্তিমান আল্লাহর পক্ষ থেকে এসে ফেরাউন ও তার বংশাবলীকেও পাকড়াও করেছিলাে, সে সব থেকে আখেরাতের আযাব অনেক অনেক বেশী কঠিন।

ফী জিলালিল কুরআন:

*পাপিষ্ঠদের ভয়াবহ শাস্তি : তারপর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলা হচ্ছে ওই আযাব কতটা কষ্টদায়ক ও কতটা যন্ত্রণাদায়ক হবে এবং এই ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে কেয়ামতের ভীষণ দৃশ্যাবলী তুলে ধরা হচ্ছে, অবশ্যই অপরাধীরা ভ্রান্তির মধ্যে আবদ্ধ রয়েছে। যার ফলে প্রবিষ্ট হবে তারা দোযখের আগুনে। স্মরণ করে দেখাে সেদিনের কথা যেদিন তাদেরকে দোযখের দিকে টেনে নিয়ে যাওয়া হবে। বলা হবে ‘সাকার’ নামক দোযখের স্বাদ গ্রহণ করো। অর্থাৎ, এমন গােমরাহীর মধ্যে তারা আজ রয়েছে যার ফলে তাদের সকল জ্ঞানপাপীকে ভয়ংকর শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে। দোযখের মধ্যে তাদের শরীরের চামড়া ও চামড়ার নীচের গােশতগুলাে পুড়তে থাকবে। কেননা, ইতিপূর্বে তারা ও তাদের মতােই আরও অনেকে বলতে থেকেছে, “আমাদের মতােই একজন মানুষ না এ মােহাম্মদ, যার আনুগত্য করা লাগবে? তাহলে তাে আমরা সুস্পষ্ট গােমরাহীর মধ্যে পড়ে যাবাে এবং দোযখবাসী হবো।” তাই আজকে তাদেরকে জানিয়ে দেয়া হবে আসল গোমরাহী কোনটি এবং কিসের ফলে তাদেরকে দোযখবাসী হতে হবে! তাদেরকে মুখের ওপর টানতে টানতে দোযখের মধ্যে নিক্ষেপ করা হবে। এ আযাব যেমন হবে কঠিন তেমনি হবে অপমানজনক, আর এ আযাব দান করা হবে তাদের শক্তির দাপট দেখানাে ও অহংকার প্রদর্শনের প্রতিদানস্বরূপ। এসকল আযাবের সাথে যে মানসিক যন্ত্রণাও তাদেরকে দেয়া হবে তা হচ্ছে অন্যান্য আযাবের সাথে বাড়তি আযাব। অর্থাৎ তাদের অন্যায় আচরণের কারণে যে শাস্তি পেতে হবে তা তাদের অন্তর বলতে থাকে, সে কথাগুলাে যেন শুনতে থাকে এবং চোখে যেন দেখতে থাকে। তাই এরশাদ হয়েছে ‘তােমরা সাকার দোযখের আযাবের স্বাদ গ্রহণ কর।’ এহেন ভয়ংকর আযাবের দৃশ্যের আলােকে যে কথাগুলাে বলা হচ্ছে তার লক্ষ্য হলাে সমগ্র মানব জাতি, বিশেষ করে মক্কার কোরায়শরা। একথাগুলাে উল্লেখ করার উদ্দেশ্য হচ্ছে, যেন তাদের অন্তরে আল্লাহর মর্যাদা, তাঁর অতলস্পর্শী জ্ঞান এবং বিশ্ব পরিচালনার সীমাহীন ক্ষমতার কথা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। এই আযাব দেয়া হবে দুনিয়াতে, তারপর রয়েছে আখেরাতের আযাব। মুসলমান ও কাফের-এ উভয় জাতির পূর্বে বহু রসূল ও বহু সতর্কবাণী এসেছে, এসেছে কোরআন ও আরও বহু আসমানী কিতাব। এ সকল কিতাবের মধ্যে যত কথা এসেছে তা সব কিছু মানব-দানব, পশুপাখী এবং সৃষ্টির অন্যান্য সব কিছুকে কেন্দ্র করেই এসেছে।

*কোনাে সৃষ্টিই উদ্দেশ্যহীন নয় : সৃষ্টির মধ্যে ছােট-বড় যা কিছু আছে, সব কিছুকে এক বিশেষ উদ্দেশ্যে এবং বিশেষ প্রয়ােজনে সৃষ্টি করা হয়েছে। প্রতিটি জিনিস সৃষ্টির পেছনে রয়েছে বােধগম্য প্রচুর যুক্তি। যুক্তিহীনভাবে বা এলােমেলােভাবে কোনাে কিছুকে পয়দা করা হয়নি। কোনাে জিনিসই বেফায়দা নয়, বা একটি আর একটির সাথে সংঘর্ষশীলও নয় বা বিনা পরিকল্পনায় হঠাৎ করে সৃষ্টি করা হয়েছে তাও নয়। এরশাদ হচ্ছে, ‘আমি সৃষ্টি করেছি প্রতিটি জিনিসকে এক নির্দিষ্ট পরিমাপ মতাে।’ অর্থাৎ ছােট-বড়, বাকশক্তিসম্পন্ন ও বাকশক্তিহীন, প্রত্যেক গতিশীল ও গতিহীন, অতীত ও বর্তমানের প্রতিটি জিনিস, জানা-অজানা প্রতিটি জিনিসকেই আমি একটি বিশেষ পরিমাপ অনুযায়ী পয়দা করেছি। অর্থাৎ সৃষ্টির প্রতিটি জিনিসের পারস্পরিক প্রয়ােজনে সুসামঞ্জস্যভাবে পয়দা করেছি এবং এই কারণেই একটির সাথে আর একটি অবিচ্ছেদ্য যােগসূত্র রয়েছে। এমন এক পরিমাপ যেন বাস্তবে এদের প্রত্যেকটির অস্তিত্ব টিকে থাকতে পারে, এই লক্ষ্যেই এদের গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্য সমূহ নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে, নির্ধারণ করা হয়েছে এদের পরিমাণকে, প্রত্যেকের অস্তিত্বকালকে সীমিত করে দেয়া হয়েছে, এদের অবস্থান ক্ষেত্রকেও নির্দিষ্ট করা হয়েছে এবং নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে পারস্পরিক যােগসূত্রকে যাতে করে সৃষ্টির বুকে প্রত্যেকটি বস্তু নিজ নিজ দায়িত্ব সুচারুরূপে পালন করতে পারে। কোরআনের সহজ ও ছােট্ট এই ক্ষুদ্র দলীলে বর্ণিত কথাগুলাে বিরাট এক সত্যকে উদঘাটন করা হয়েছে যা অত্যন্ত ভীতিপ্রদও বটে এবং যে কথাগুলাে গােটা সৃষ্টিজগতের ওপর প্রযােজ্য। এ এমন এক বাস্তব সত্য, যা আচমকা হৃদয়কে গভীরভাবে স্পর্শ করে এবং যার লক্ষ্য সৃষ্টিজগতের সব কিছু, সব কিছুতেই যার সাড়া মেলে এবং সব কিছুর সাথে তা অংগাংগিভাবে জড়িত। আর যে কোনাে হৃদয় অনুভব করে যে সৃষ্টির প্রতিটি জিনিসের মধ্যে অত্যন্ত সূক্ষ্ম বন্ধন বিরাজমান এবং একটি আর একটির অস্তিত্বের জন্যে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে। মানব হৃদয় যখন মুগ্ধ বিস্ময়ে এসব জিনিস প্রত্যক্ষ করে, তখন যেন হঠাৎ করে তার সামনে সৃষ্টি-রহস্যের জট খুলে যায়। প্রতিটি জিনিসই একটি নির্দিষ্ট পরিমাপ মতাে আপনা থেকেই এই সংযােগ বিধানের মাধ্যমে নিজ নিজ কাজ করে চলেছে—এসব জিনিসের দিকে যখন মানুষের মনােযােগ আকৃষ্ট হয়, তখন হৃদয় ভক্তি-বিশ্বাসে আপুত হয়ে যায়। বিশ্বের সকল উপায়-উপকরণের মধ্যে সুনির্দিষ্ট পরিমাপের এই যে ব্যবস্থা পাওয়া যায় তা নিয়ে আলােচনা-পর্যালােচনা ও গবেষণা এগিয়ে চলেছে, মানুষ তার সাধ্যানুযায়ী এগুলাে সম্পর্কে আরও গভীর জ্ঞান লাভ করার জন্যে চেষ্টা চালাচ্ছে এবং এইভাবে কিছু নিত্য নতুন তথ্যও আবিষ্কার করে চলেছে। কিন্তু তাদের এসব জ্ঞান-গবেষণার ওপর আরও একটি অতি সূক্ষ্ম জিনিস রয়েছে যা সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ এবং সব কিছুর ওপরে যার স্থান, যা যে কোনাে বিদগ্ধ মানব-প্রকৃতি অনুধাবন করতে সক্ষম, যার উপর সৃষ্টিজগতের সব কিছু আপনা থেকে কাজ করে চলেছে, আর তা হচ্ছে সব কিছুর মধ্যে একটি সুষ্ঠ অনুপাত বিরাজমান। এই অনুপাতের সামান্যতম হেরফের হলে সব কিছু মুহূর্তের মধ্যে লন্ডভন্ড হয়ে যাবে। আধুনিক জ্ঞান-গবেষণা এই বাস্তবতাকে অনেকাংশে উপলব্ধি করতে পেরেছে। এ সত্য-সন্ধানে অধুনা ব্যবহৃত উপায়-উপকরণ গ্রহ-নক্ষত্র ও তারকারাজির একটি থেকে অপরটির দূরত্ব কত তার অনেকাংশে অনুমান করতে সক্ষম হয়েছে। মহাশূন্যে পরিভ্রমণরত রাশি রাশি তারকা পারস্পরিক আকর্ষণের কারণে অহরহ কাজ করে চলেছে। কিন্তু এসব তারকামন্ডলীর গতিবিধি সম্পর্কে জ্যোতির্বিদরা যত গবেষণাই করুক না কেন, কোনাে পর্যায়ে গিয়েই তারা দাবী করতে পারে না যে, তাদের প্রাপ্ত তথ্যই চূড়ান্ত। কেননা, আন্দায-অনুমানের ভিত্তিতে প্রাপ্ত তথ্যাদি প্রায়ই ভুল হয়ে থাকে এবং বাস্তবে প্রতিনিয়তই এসব ভুল ধরা পড়ছে। এর ফলে আজকে যা সত্য, আগামীতে দেখা যাচ্ছে নতুন নতুন তথ্য পাওয়ার পর পেছনের অনেক কিছুই পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে। তারকারাজির ব্যাপারে একথাগুলাে বিশেষভাবে সত্য প্রমাণিত হয়েছে। অনুরূপভাবে মহাশূন্যে অবস্থিত রহস্যরাজি উদঘাটনের ব্যাপারেও এ সত্য প্রমাণিত হয়। যে পৃথিবীর বুকে আমরা বসবাস করছি তা সংস্থাপনে মহাশূন্যের সবকিছুকে কিভাবে কাজে লাগানাে হয়েছে, তা নিরূপণ করতে গিয়ে মানুষ হয়রান হয়ে যায়। পৃথিবীর সকল বস্তুকে আল্লাহ তায়ালা এমন পরিমাপ মতাে তৈরী করেছেন যেন তা মানুষের জন্যে কল্যাণকর হয়। এসব বস্তুর অনুপাতে সামান্যতম হেরফের হলে উপকার তো দূরের কথা মানব জীবনে চরম বিপর্যয় নেমে আসবে। বরং এ পৃথিবী পুরােপুরি ধবংসস্তুপে পরিণত হবে। অতীতে সূর্যের তাপের তারতম্যের কারণে কখনাে কখনাে ভীষণ বিপর্যয় এসেছে। প্রকৃতপক্ষে সূর্যের চতুর্দিকে একটি নির্দিষ্ট গতিতে পৃথিবীর নিরন্তর আবর্তন হয় এবং সূর্যের আকর্ষণে পৃথিবীর গতি নিয়ন্ত্রিত হয়। এরপর আমরা দেখি চাঁদের গতি পৃথিবীর আকর্ষণে নিয়ন্ত্রিত হয়, কিন্তু চাঁদের আকর্ষণে পৃথিবীর পানির স্ফীত হওয়া এবং নেমে যাওয়া ও জোয়ার-ভাটা হওয়ার কাজ নিরন্তরভাবে একই গতিতে চলছে । হাজার হাজার বছর ধরে এই একই নিয়মে এসব কাজ চলছে। এ সবের মধ্যে সামান্য কিছু পরিবর্তন হলে গােটা বিশ্বে মহা বিপর্যয় সংঘটিত হবে । জীবনের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্যে যে সব বড় বড় উপকরণ রয়েছে, সেগুলাের মধ্যেও পারস্পরিক এক চমৎকার মিল রয়েছে। জীবন এবং যে বিশ্বলােকে জীবনের স্পন্দন বর্তমান রয়েছে, তাদের মধ্যে পারস্পরিক ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক পরিলক্ষিত হয়। জীবজগতের অস্তিত্বের জন্যেও একে অপরের সহায়ক শক্তি হিসাবে তারা কাজ করে চলেছে এই গভীর সত্য যে কোনাে বিদগ্ধজনের চেতনায় সাড়া জাগায় আর কোরআনে করীমের এই আয়াতে এ সব বিষয়ে চিন্তা করার জন্যে উদাত্ত আহবান জানানাে হয়েছে। সুতরাং প্রত্যেকটি জীবন ও তার অস্তিত্বের জন্যে ক্রিয়াশীল কার্যকরণসমূহ একথা স্পষ্ট ভাবে জানায় যে, অবশ্যই একদিন সে মৃত্যুমুখে পতিত হবে। আর বেঁচে থাকার জন্যে এবং জীবনে আরাম-আয়েশ লাভ করার প্রয়ােজনে অবশ্যই তাকে পারিবারিক জীবন যাপন করতে হবে। সৃষ্টির জীবকুলের মধ্যে পারস্পারিক এই যে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বিদ্যমান এ বিষয়ে এখানে কিছু ইংগিত দান করা বােধ হয় অপ্রাসংগিক হবে না। অবশ্য পৃথিবীর সব কিছুর মধ্যে এই অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের কথা আরও অনেকগুলাে সূরাতে বিস্তারিতভাবে আলােচনা করা হয়েছে। একবার ছােট ছােট পাখীর দিকে তাকিয়ে দেখুন, এদের অংগ-প্রত্যংগ খুবই কম। কারণ তারা কয়েকটি মাত্র ডিম দেয় এবং তাদের দু একটি মাত্র বাচ্চা হয়, যদিও তারা একটি নির্দিষ্ট ও সীমাবদ্ধ স্থানে বাস করে। কিন্তু বহু দীর্ঘজীবী এই বিশাল সৃষ্টির মােকাবেলায় তারা টিকে আছে। অনেক বাচ্চাদানকারী জীবজন্তু যারা বিভিন্ন আবহাওয়া ও পরিবেশে বাস করতে পারে, তারা বহু বাচ্চাদানকারী আরও অনেক পাখীকে হত্যা করে এবং সংখ্যায় সেগুলাে অনেক বেশী ও অধিক থাকা ও জন্মানো সত্তেও তাদেরকে ধ্বংস করে দেয়। লক্ষ্যণীয় যে, বৃহৎ আরও অনেক জীব-জানােয়ার আছে যাদের মানুষ খাদ্যের প্রয়ােজনে ব্যবহার করে এবং পৃথিবীর আরও বহু কাজ সম্পাদন করার জন্যে তাদেরকে কাজে লাগায়। এ বিষয়ে নীচের কবিতাংশটি লক্ষ্যযোগ্য, “নিশিদিন দেখেছি আমি অসংখ্য নিরীহ পক্ষীকুল /যারা কখনও কারও ক্ষতি করিতে নারে /আবার হেরেছি সেইসব ক্ষুরধার চঞ্চু ওয়ালা চিল শকুন /যারা হারায়ে আপন বাচ্চাদের বিলাপ করিয়া মরে।” এটিই হচ্ছে আল্লাহর সৃষ্টির সেই নিগূঢ় রহস্য, যার নিয়ন্ত্রণ একান্তভাবে তিনিই করে চলেছেন এবং আমাদের সামনে যার হাজারাে নযীর বর্তমান রয়েছে। এ সকল ব্যবস্থাপনা সেই মহামহিম পরওয়ারদেগারের ইশারায় চলছে, যিনি হিংস্র ও নিরীহ সকল প্রাণীর অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার জন্যে অদৃশ্য হাতে সকল কিছুর আঞ্জাম দিয়ে চলেছেন। মাছিকুল কোটি কোটি ডিম দেয় বটে, কিন্তু দুসপ্তাহের বেশী তা বাচে না। কয়েক বছর এরা বেঁচে থাকলে এবং এ হারে ডিম দিতে থাকলে গােটা পৃথিবী মাছিতে ছেয়ে যেত এবং তাদের জীবন এর বিষাক্ততায় ধ্বংস হয়ে যেত তাদের মধ্যে প্রথম হচ্ছে মানুষ, কোনাে প্রকারেই এ বিশ্বে মানুষের পক্ষে বেঁচে থাকা তখন সম্ভব হতাে না। কিন্তু যিনি এই মহাবিশ্বকে পরিচালনা করছেন তিনি সব কিছুর মধ্যে এমনই ভারসাম্য বজায় রেখেছেন যেন এর মধ্যে মানুষের অস্তিত্ব টিকে থাকে। কেননা, মানুষের জন্যেই তাে সমগ্র সৃষ্টি এবং তাদেরই প্রয়ােজনেই যার যতক্ষণ বাঁচা দরকার ততক্ষণ সে বাঁচতে পারে। তাই কারও আয়ুস্কাল আল্লাহ তায়ালা দিয়েছেন অত্যন্ত কম এবং কারও আয়ুষ্কাল করেছেন দীর্ঘ। অবশ্যই এসব ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবস্থা সহজেই আমাদের দৃষ্টিতে ধরা পড়ে। জীবন্ত প্রাণীর মধ্যে সংখ্যায় সর্বাধিক হচ্ছে রােগজীবাণু, এর বৃদ্ধিও হয় সকল প্রাণী থেকে বেশী এবং এর ধ্বংসাত্মক ক্রিয়াও সবচেয়ে অধিক। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে এগুলাে যেমন সর্বাধিক দুর্বল, তেমনি এগুলাের বয়ােসীমাও সব থেকে কম। এগুলাে মাত্রার বেশী শীতল স্পর্শে ও একটু অধিক তাপে কোটি কোটি সংখ্যায় মারা যায়। সূর্যের কিরণে এবং পাকস্থলীস্থ পাচকরসে এবং রক্তের মধ্যে অবস্থিত জলীয় আর্দ্রতায় এবং আরও বহু প্রক্রিয়ায় এগুলাে প্রচুর পরিমাণে ধ্বংস হয়ে যায়। অথচ জীব-জানােয়ার ও খুব অল্প সংখ্যক মানুষের ওপর এগুলাে বিজয়ী হয়। এগুলাে তেমন শক্তিশালী এবং দীর্ঘজীবী হলে মানুষের জীবন সকল জীবজন্তু ধ্বংস হয়ে যেতাে। দুনিয়ার সকল প্রাণীর অস্তিত্বকে শত্রুর মােকাবেলায় টিকিয়ে রাখার জন্যে এবং ধ্বংস ও বিপর্যয় থেকে আত্মরক্ষার জন্যে তাদেরকে যথেষ্ট পরিমাণে আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা দান করা হয়েছে। প্রতিরক্ষার | কাজে ব্যবহারােপযােগী এসব অস্ত্র বিভিন্ন ধরনের এবং শ্রেণীর সংখ্যাধিক্য হওয়াটা এক প্রকার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং অপরকে পাকড়াও করার মতাে শক্তির অধিকারী হওয়াও আর এক ধরনের অস্ত্র হিসাবে কাজ দেয়। এই উভয় প্রকার ব্যবস্থার মধ্যে আবার বিভিন্ন রং ও প্রকৃতি রয়েছে। প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা হিসাবে ছােট প্রাণী, সাপকে দেয়া হয়েছে তীব্র বিষ এবং দুশমন থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে পালিয়ে যাওয়ার যােগ্যতা। বিশালকায় সাপকে দেয়া হয়েছে শারীরিক প্রচণ্ড পেশীশক্তি, আর এ কারণেই তাদের ওপর অন্যদের বিষক্রিয়া তেমন কার্যকর হয় না। অপরদিকে গান্ধি পােকার শক্তি খুবই কম, কিন্তু এ পােকার মধ্যে পুড়িয়ে দেয়ার শক্তি রয়েছে এবং এটি অত্যন্ত দুর্গন্ধযুক্ত। যে একে স্পর্শ করবে তার ওপরেই এর দাহ্য শক্তি কার্যকর হবে; আর এই শক্তিই শত্রুর আক্রমণ থেকে তাকে বাঁচাতে সাহায্য করে। আবার হরিণকে দেয়া হয়েছে তীব্রগতিতে দৌড়ানাে ও লাফানাের শক্তি, সিংহকে দেয়া হয়েছে। প্রচণ্ড পেশী শক্তি ও শিকার ধরার ক্ষমতা। এইভাবে ছােট বড় প্রত্যেক জীব-জানােয়ারকে কিছু না কিছু বিশেষত্ব দেয়া হয়েছে যার বলে সে জীবিকা অর্জন করে এবং নিজেকে অপরের আক্রমণ থেকে বাঁচায়। এই আল্লাহ প্রদত্ত শক্তির অধিকারী হওয়ার ব্যাপারে মানুষ, জীবজন্তু, পক্ষীকুল এবং অন্য সকল প্রকার প্রাণী সমান। শুক্রবীজের অধিকারী সকল প্রাণী যৌন মিলনের পর জরায়ুতে যে ডিম্বকোষের সৃষ্টি হয়, তা বাচ্চাদানীর গায়ে লেগে থাকে। এ ডিম্বকোষের মধ্যে প্রবলভাবে খাদ্য গ্রহণের চাহিদা এসে যায়, যার কারণে সে বাচ্চাদানীর গায়ে ছড়িয়ে থাকা ও সঞ্চরণশীল রক্ত-কণিকা থেকে নিজ প্রয়োজন মতাে রক্ত চুষে চুষে খেয়ে বড় হয়। এইভাবে গঠিত ভ্রুণটি মাতৃজঠরের সাথে পূর্ণতূপ্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ থাকে এবং অবশেষে নতুন এক শিশুরূপে জন্মলাভ করে। আল্লাহ তায়ালা যে উদ্দেশ্যে মানুষকে সৃষ্টি করতে চেয়েছেন তা পূরণ করতে গিয়ে এই দীর্ঘ ও জটিল প্রক্রিয়া ও কঠিন পথ-পরিক্রমায় তাকে অগ্রসর হতে হয়। এক্ষেত্রে, এজন্যে ক্ষতিকর খাদ্য অথবা বিরূপ পরিবেশ থেকে আল্লাহর মহান ইচ্ছায় তাকে রক্ষা করা হয়। (‘আল্লাহ অল ই’লমু অল হাদীস’ অধ্যাপক আব্দুর রাযযাক নওফল পৃঃ ৪৬-৪৭)  *নবজাত শিশুকে কে লালন পালন করেন? : এরপর মহান আল্লাহ কী চমৎকারভাবে এই নবজাত শিশুর লালন-পালন ও রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন। মায়ের বুকে তার জন্যে দুধের প্রস্রবণ প্রবাহিত করেছেন, আর এ উদ্দেশ্যে গর্ভধারণ করার শেষভাগে মাতৃস্তন দুগ্ধভারে স্ফীত হয়ে যায় এবং বাচ্চা প্রসবের সাথে সাথে স্তনের কোটরগুলােতে হালকা হলুদ-মাখা সাদা দুধ প্রস্তুত হয়ে যায় যা বাচ্চা মুখ লাগানাের সাথে সাথে প্রবাহিত হতে থাকে। আরও মজার ব্যাপার হচ্ছে, প্রবহমান এই দুধ এমন রাসায়নিক পদার্থে তৈরী যা বাচ্চাকে রােগ-ব্যাধি থেকে রক্ষা করে। আর জন্মগ্রহণের পরদিন থেকেই এই দুধ বাচ্চার বৃদ্ধির কাজে লেগে যায়। মহান আল্লাহর ব্যবস্থাপনা ও মমতাভরা ইচ্ছাতে মাতৃবক্ষ থেকে বেরিয়ে আসা স্তনযুগল বাচ্চার ক্রমবর্ধমান প্রয়ােজন মেটাবার তাগিদে দিনে দিনে আরও বড় হয় এবং আরও অধিক দুধ সরবরাহ করতে থাকে। এমনকি বছর খানেক পরে গিয়ে এই দুধের পরিমাণ দিনে দেড় লিটার পর্যন্ত পৌছে যায়, অথচ এর পূর্বে দুধের পরিমাণ ৮/৯ আউন্সের বেশী কখনও হয় না। বাচ্চা বড় হওয়ার সাথে সাথে তার প্রয়ােজন মেটানাের জন্যে দুধ ও বাড়তে থাকে। এ বিস্ময় এখানেই শেষ হয়ে যায় না, বরং দুধের প্রকৃতি ও ঘনত্বও পরিবর্তন হতে থাকে। শিশুর হজম শক্তির সাথে সংগতি রেখে প্রথম দিকে পানির মতাে পাতলা হালকা মিষ্টি দুধের ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে। পরবর্তীতে শিশুদের ক্রমবর্ধমান স্বাস্থ্য ও হজম শক্তি বৃদ্ধির সাথে সাথে মাতৃস্তনের এই দুধকে করে দেয়া হয় আরও ঘন, অধিক মিষ্টি এবং পূর্বাপেক্ষা অনেক বেশী চিনিযুক্ত। (আল্ মাসদারুস সাবেক্ব পৃঃ ৪৭-৪৮) আর পূর্ণাংগ মানুষ গঠনের লক্ষ্যে এইভাবে বিভিন্ন প্রস্তুতি তাকে দান করা হয়, নির্ধারণ করে দেয়া হয় তার পেশা এবং কর্মপদ্ধতি। এ সময়ে ব্যবস্থা করা হয় তার জন্যে জীবনের নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যের নিশ্চয়তা। এ সকল ক্ষেত্রে যে বিষয়টি আমাদের মনে দুরন্ত বিস্ময় সৃষ্টি করে তা হচ্ছে, সৃষ্টিক্রিয়ার স্থায়িত্বের জন্যে গৃহীত উপায় উপকরণের সংগতিপূর্ণ সম্মিলন এবং আল্লাহর নির্ধারিত কাজকে পূর্ণতুদানের প্রয়ােজনেই এ বিপুল সমারােহ। সৃষ্টির সকল কৌশলের মধ্যে আমরা আল্লাহ রব্বুল আলামীনের অদৃশ্য হাতকে সক্রিয় দেখতে পাই, দেখতে পাই প্রত্যেক ব্যক্তির প্রতিটি কাজ তিনিই আঞ্জাম দিচ্ছেন, বরং আরও কঠিন সত্য হচ্ছে প্রত্যেক মানুষের প্রতিটি অংগ-প্রত্যংগের সঞ্চালন প্রতিক্রিয়ায়ও তাঁরই ইচ্ছা কার্যকর রয়েছে। এর সাথে আরাে উজ্জ্বল সত্য হচ্ছে শরীরের প্রত্যেকটি কোষকে তিনি নিয়ন্ত্রণ করেন। আল্লাহর নযর এদের সকলের ওপর সমানভাবে বিদ্যমান। তিনিই এদের প্রতিপালন ও দেখাশুনা করেন। মহাবিশ্বের মধ্যে আল্লাহ প্রদত্ত এসব বিস্ময়ের ব্যাখ্যা দেয়ার ক্ষমতা আমাদের নেই। তবু তার জটিলতা এবং পূর্ণত্ব সম্পর্কে আমরা একটি মাত্র সূক্ষ্ম ইংগিত দিতে চাই। একবার মানুষের মুখস্থ শক্তির কথা ভেবে দেখুন, কিভাবে আল্লাহ তায়ালা মানুষের মধ্যে দীর্ঘকাল ধরে মুখস্থ রাখার শক্তি দান করেছেন। যে সকল ছােট ছােট শিরা-উপশিরা কোনাে জিনিসকে মুখস্থ রাখার জন্যে কাজে নিয়ােজিত রয়েছে, সেগুলাের মধ্যে যে রাসায়নিক ক্রিয়া চলছে তা নিরূপণ করা মানবীয় বুদ্ধির অগম্য। তবু মানুষ এসব রহস্য জানার ও বুঝার জন্যে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তার জ্ঞানে যেগুলাে ধরা পড়েছে তার বিবরণ পেশ করা হলো। বৈজ্ঞানিক গবেষণালব্ধ ফলে বলা হয়েছে, শরীরের মধ্যে ক্রিয়াশীল শিরা-উপশিরার মধ্যে শ্রবণেন্দ্রিয় ও মুখস্থ রাখার কাজ করছে একটিমাত্র শিরা, আর তা হচ্ছে শরীরের মধ্যে অবস্থিত এক হাজার বিলিয়ন শিরা-উপশিরার অন্যতম। তবে এককভাবে এ শিরা কাজ করে চলেছে তা নয়। অন্যান্য সকল শিরা-উপশিরার পারস্পরিক সহযােগিতায় এ সব শিরা কাজ করে চলেছে এবং প্রতিটি শিরা বা উপশিরার কাজগুলােও এদের সবার পারস্পরিক সহযােগিতায় সম্পন্ন হয়। একটি থেকে আর একটি কোনােক্রমেই বিচ্ছিন্ন নয়। এগুলাে এমনভাবে পারস্পরিক সম্পর্কে আবদ্ধ যে, সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ যখন এগুলাে ধরা পড়ে তখন ভীষণভাবে হয়রান হয়ে যেতে হয়। এগুলাের পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্যে সামান্যতম ছেদ বা বিচ্ছিন্নতা গােটা শরীরকে অসুস্থ করে ফেলে।  *প্রাণী ও পরিবেশ : জীবজন্তুর শ্রেণী, পরিবেশ ও জীবনধারণের সামগ্রীর বিভিন্নতায় তাদের প্রচেষ্টা ও বাঁচার প্রস্তুতিমূলক কার্যকলাপে বহু বিভিন্নতা থাকে। সিংহ, চিতাবাঘ, নেকড়ে বাঘ, হায়েনা এবং অন্যান্য যেসব হিংস্র জন্তু জংগলে বাস করে তাদের দন্ত নখরকে তাদের প্রয়ােজন মতােই গড়ে দেয়া হয়েছে। তারা ঝাপ দিয়ে অন্যান্য জীবজন্তু শিকার করে, এছাড়া খাদ্য লাভ করার আর কোনাে উপায় তাদের নেই। এরা ধারাল দাঁত ও তীক্ষ্ণ থাবা দ্বারা শিকারকে চিরে ফেড়ে তাদের রক্ত পান করে ও তাদের গােশত ছিড়ে ছিড়ে খায়। আর এজন্যে তাদের প্রচণ্ড শারীরিক শক্তির প্রয়োজন যা তাদেরকে আল্লাহ তায়ালা নিজেই দিয়ে দিয়েছেন তাদেরকে ধারাল দাঁত দিয়েছেন, দুপাশের চারটি শক্তিশালী চোয়ালের দাঁত ও মাড়ি দিয়েছেন। পায়ের মাংসপেশীগুলােকে করেছেন অত্যন্ত শক্তিশালী এবং ধারাল নখ ও পাঞ্জার অস্ত্র দিয়ে তাদেরকে সজ্জিত করেছেন। শিকারের জন্তুগুলাে ছােট ও বড় সব রকমের হয়। এইসব জন্তুর কঠিন প্রাচ্য গোশত হজম করার উপযােগী পাচকরস ও হজম শক্তি দিয়ে দিয়েছেন এই শিকারী জন্তুদের পাকস্থলীর মধ্যে। অপরদিকে, ছােট-বড় তৃণজীবী ও গৃহপালিত অনেক পশু চারণক্ষেত্রে চরে চরে ঘাস খায়। আকার ও প্রকৃতির বিভিন্নতায় এরাও নানা প্রকারের হয় এবং এদের শক্তি-সামর্থও বিভিন্ন প্রকার হয়ে থাকে। পরিবেশের বিভিন্নতায় এদের বিভিন্ন হজমশক্তি নির্ধারণ করা হয়েছে। এদের প্রয়ােজনের উপযােগী করে এদের মুখ ও চোয়ালগুলােকে তৈরী করে দেয়া হয়েছে। এদের দাঁত ও পাশের লম্বা মাড়িগুলাে তত শক্ত নয়। এগুলােকে দেখলেই বুঝা যায় যে, এগুলাে হিংস্রজন্তু নয় এবং এগুলাে ফেড়ে চিরে খাওয়ার জন্তুও নয়। এসব পশু ঘাস পাতা ও খড়কুটা খেয়ে বাঁচে! তারা ঘাস পাতা দ্রুতগতিতে খেয়ে একেবারে গিলে ফেলে যাতে করে মানুষের যে খেদমতের জন্যে তাদেরকে পয়দা করা হয়েছে তা সঠিকভাবে তারা আঞ্জাম দিতে পারে। আল্লাহ তায়ালা এই শ্রেণীর জন্তুকে আশ্চর্য রকমের হজমশক্তি দিয়েছেন। তাদের ভূক্তদ্রব্য প্রথম পৌছায় পাকস্থলীর উপরিভাগে যাকে রক্ষণাগার বলা যায়। এখানে খাদদ্রব্য জমা করে রেখে তারা কাজ করে এবং কাজ শেষে যখন বিশ্রাম করে, তখন পুনরায় ভুক্ত ঘাস-পাতা মুখের মধ্যে তুলে এনে জাবর কাটতে থাকে এবং মিহি করে চিবানাের পর এগুলােকে পাকস্থলীতে পাঠায়, সেখান থেকে ক্ষুদ্র-অন্ত্রে পাঠিয়ে দেয়। এরপর ক্ষুদ্র অন্ত্র থেকে এই খাদ্য বৃহৎ অন্ত্রে পৌছায়। তারপর আর একটি কোটরে এই ভুক্ত দ্রব্যের নির্যাস পৌছানাে হয়, যাকে বলা যায় আবর্তনের চতুর্থ স্তর। পশুর খাদ্যগ্রহণ ও জীর্ণকরণের এই দীর্ঘসূত্রিতার একমাত্র লক্ষ্যই হচ্ছে মানুষের সার্বিক উপকার সাধন। অধিকাংশ সময়ে জাবর কাটা পশু ব্যস্ততার জন্যেই এইভাবে ঘসপাতা প্রথমে সংগােপনে গিলে ফেলতে বাধ্য হয়। পশু বিষয়ক বিজ্ঞানীরা বলেন যে, জাবর কাটা এ সব পশুর জন্যে একান্তই প্রয়ােজন, বরং আরও সত্য কথা হচ্ছে, তার অস্তিত্বের জন্যেই এই জাবর কাটা অপরিহার্য। তা না হলে এসব গবাদি পশু মাঠে-ময়দানে চরে খেত। ঘাসপাতা ও তরুলতা যা এসব পশু খায়, সেগুলাে হজম করা এদের জন্যে বেশ কষ্টকরই হয়ে যেত। কারণ এদের পাকস্থলীর মধ্যে ‘স্যালােলােজ’ নামক একটি পদার্থ আছে যা ঘাস- পাতার খাদ্য গ্রহণ করলে এগুলাের মধ্যকার ফাঁকগুলাে পূর্ণ করে দেয়। ঘাসপাতা হজমের জন্যে বেশ লম্বা এক সময়ের প্রয়োজন। এইভাবে খাদ্য গলার মধ্য দিয়ে অতিক্রম করা ও পাকস্থলীর মধ্যে সংরক্ষণাগারে সে খাদ্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা যদি নাই থাকত, তাহলে মাঠে গরু চরতে দীর্ঘ সময় লাগিয়ে দিত। হয়ত পুরােদিনটাই তার লেগে যেত খাদ্য জীর্ণ করতে এবং পুনরায় প্রয়ােজনীয় খাদ্য সংগ্রহ করা তার পক্ষে সম্ভব হত না এবং তার মাংসপেশীগুলো খাদ্যগ্রহণ ও চিবানাের ব্যাপারে সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকতো। এর পরিবর্তে, আল্লাহর ব্যবস্থাপনায় গবাদি পশুর এই যে দ্রুতগতিতে খাদ্যগ্রহণ, পাকস্থলীর উপরিভাগে এক নির্দিষ্ট ভান্ডারে তা সংরক্ষণ করে রাখা এবং আধা হজম অবস্থায় ভুক্ত দ্রব্য গেজিয়ে ওঠা যাতে করে আরও মিহি করে চিবানাে ও গলধকরণ সম্ভব হয়- এসব কিছু ব্যবস্থা এই জন্যেই করা হয়েছে যাতে পশুগুলাে মানুষের খেদমতে প্রয়ােজনীয় কাজ করতে পারে। খেতে পারে এবং হজমও করতে পারে। আহ! মহাব্যবস্থাপকের পক্ষ থেকে এ কী চমৎকার ব্যবস্থা। (‘আল্ মাসদারুস সাবেক্ব’ আরবী সংস্করণ পৃঃ ৭২-৭৩) অপর দিকে রয়েছে হিংস্র পাখীগুলাের অবস্থা যারা বাঁকা, তীক্ষ্ণ ও ছুঁচালাে চঞ্চু দ্বারা ছোঁ মেরে শিকার ধরে বা খাদ্য সংগ্রহ করে, যেমন প্যাঁচা, তাদেরকে এ অস্ত্র দেয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে যেন তারা তাদের খাবারগুলাে ছিড়ে টুকরা টুকরা করে গলাধকরণ করতে পারে। পাশাপাশি আবার তাকান পাতিহাঁস ও রাজহাঁসগুলাের দিকে, দেখবেন তাদের চ্যাপ্টা ও চওড়া ঠোটগুলােকে কিভাবে সুবিন্যস্ত করা হয়েছে যেন এগুলাে বড় বড় গর্তওয়ালা চামচ বিশেষ। এগুলাে দ্বারা তারা মাটি ও পানির মধ্য থেকে তাদের খাদ্য খুঁজে বের করে এবং তাদের ঠোটের কিনারা দিয়ে দাঁতের মতাে ছােট ছােট ও খরখরে কিছু অতিরিক্ত গােশত রয়েছে যার দ্বারা বিভিন্ন আগাছা কেটে খেতে পারে। আর এক শ্রেণীর পাখী আছে যারা মােটেই হিংস্র নয়, যেমন মুরগী, কবুতর এবং এ জাতীয় আরও অন্যান্য পাখী, যারা মাটির মধ্য থেকে খাদ্য বীজ খুঁজে সগ্রহ করে। তাদের চঞ্চুগুলাে বেশ খাটো, ছােট ছােট পায়ে তারা চলে এবং হামাগুড়ি দেয়ার মতাে চরে চরে খায়। আরও অনেক পাখী রয়েছে যাদের ঠোটগুলাে বেশ বড় ও লম্বা। এসব পাখীর ঠোঁটের গােড়াগুলােতে রয়েছে ব্লাডার সদৃশ এক প্রকার থলি, দেখতে মনে হয় সেগুলাে যেন কোনাে শিকারীর জাল। এ সব লম্বা ঠোটওয়ালা প্রত্যেক পাখির প্রধান খাদ্য হচ্ছে মাছ। হুদহুদ ও সারস পাখির ঠোটগুলাে লম্বা ও ছুঁচালো এবং এগুলাে তৈরী করাই হয়েছে মাটির অগভীর তলায় অবস্থিত বিভিন্ন আগাছা ও পােকামাকড় তালাশ করে ঠুকরে ঠুকরে খাওয়ার জন্যে। সব পশু-পাখি সম্পর্কে আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞান একথাই দাবী করে যেকোনাে পাখীর খাদ্য খাবার সম্পর্কে মানুষের পক্ষে অবগত হওয়া অবশ্যই সম্ভব। এবারে পাখীর হজমশক্তি সম্পর্কে চিন্তা করতে গেলে দেখা যায় যে, এ এক অদ্ভুত এবং বড়ই আশ্চর্যজনক এক ব্যবস্থা। ওদেরকে খাদ্য চিবানাের জন্যে কোনাে দাঁত দেয়া হয়নি, দেয়া হয়েছে ঠোঁটের (শেষভাগে) তলদেশে এক প্রকার ব্লাডারসম রক্ষণাগার যাকে প্রথম পাকস্থলী বলা যায়। এখানে ভুক্ত দ্রব্য প্রথম হজম হয়। পাখী শক্ত খাদ্যদ্রব্য টুকিয়ে টুকিয়ে খেয়ে ওই প্রথম থলিতে পাঠিয়ে দেয় যাতে হজম করার ব্যাপারে প্রথমেই এই থলি তাকে সাহায্য করে। আমরা যদি একবার এই নিগুঢ় রহস্যময় বিষয়গুলাের প্রতি দৃষ্টিপাত করি এবং এই কিতাব, ‘ফী যিলালিল কোরআন’-এর বিশ্লেষণ-কায়দায় নিরীক্ষণ করি এবং বিভিন্ন শ্রেণী ও বিভিন্ন প্রকারের বিষয়ের দিকে তাকাই, তাহলে আমাদের সামনে আরও বহু রহস্যের দ্বার উদঘাটিত হতে থাকবে। সন্ধান পাবাে আমরা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বহু জীবাণুর যা এমিবা নামে পরিচিত যার মধ্যে একটিমাত্র কোষ আছে, সেখানে গিয়েই আমরা আল্লাহর কুদরতের হাত সক্রিয় দেখতে পাবাে, দেখতে পাবাে সেখানে তার দৃষ্টি নিবন্ধ, বুঝতে পারবাে এই সূক্ষ্ম জীবাণুর যাবতীয় গতিবিধিকে নিয়ন্ত্রণ করতে তিনি সম্পূর্ণ সক্ষম। এই এমিবা অতি ক্ষুদ্র ও সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম এক প্রাণী বা জীবাণু, যা অতি সংগােপনে রক্ত শোষণ করে, যা বক্ষদেশের উপরিভাগে এবং জলাভূমিতে বাস করে অথবা বাস করে নীচু জলাভূমিতে অবস্থিত পাথরের ওপর পতিত গ্যাড়ানীর মধ্যে, যাকে খােলা চোখে দেখা সম্ভব হয় না, একমাত্র অনুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যেই তা দেখা সম্ভব। এগুলো হচ্ছে জেলীর মতাে কিছু বস্তু, পাত্রের কারণে যার আকৃতির পরিবর্তন হতে থাকে। অনেক সময়ে বিভিন্ন প্রয়ােজনে এগুলাের আকৃতি বদলে যায়, ব্যবহারের কারণেও এগুলাের আকৃতি বদলে যায়। যখন এগুলােতে নাড়া লাগে, তখন এদের শরীরের মধ্য থেকে নির্গত এক প্রকার নির্যাস এগুলােকে প্রতিরােধ করে। পায়ের মতােই এক প্রকার বস্তু এর পছন্দনীয় স্থানে এগুলােকে সরিয়ে সরিয়ে নিয়ে যায়। সুতরাং এগুলাের সঞ্চালনশক্তিকে এক নকল পা বলে অভিহিত করা হয়েছে। খাবার পেলে এগুলাে দ্বিগুণ, তিনগুণ বা বহুগুণে বেড়ে যায়, কিন্তু এদের ওপর পাচক-রস এসে পড়ার সাথে সাথে এগুলাে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায় এবং তখন এগুলাে শরীরের গঠনমূলক উপাদান হিসেবে কাজ করে। এজন্যে এ বৃদ্ধিকে এক মিথ্যা পদক্ষেপ বলা যায়। এগুলাে উপযুক্ত খাদ্য পেলে একগুণ বা দ্বিগুণ বা বহুগুণে বৃদ্ধি পায় বটে, কিন্তু হজমকারী পাচক-রস এদের ওপর পতিত হওয়ার ফলে এগুলাে শরীরের জন্যে উপকারী হয়ে যায়। এবং এদের অপ্রয়ােজনীয় অংশগুলাে নির্গত হয়ে যায়। এরা পানি থেকে অক্সিজেন গ্রহণ করে এবং সমস্ত শরীরের সাহায্যে শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণ করে। এ এমন এক অভিনব সৃষ্টি যা খালি চোখে দেখা যায় না, জীবন্ত এসব জীবাণু অবশ্যই নড়াচড়া করে, খাদ্য গ্রহণ করে নিশ্বাস-প্রশ্বাস ছাড়ে। এর বর্জ্য পদার্থ নির্গত হয়ে যায়। তারপর বৃদ্ধি পূর্ণত্ব লাভ করলে এগুলাে দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়, যাতে প্রত্যেক ভাগ নতুন এক প্রাণীতে পরিণত হয়। শাকসবজি ও তরুলতার জীবন আরও বিস্ময়কর। এর বিস্ময় মানুষ, জীবজন্তু ও পাখীর জীবন থেকে কোনাে অংশেই কম নয় এবং এ সকল সৃষ্টির মধ্যে ওদের বহিপ্রকাশ হওয়ার বিষয়টিও একেবারে নণন্য নয়। আর (মহান সে স্রষ্টা) যিনি সৃষ্টি করেছেন সব কিছুকে এবং তিনি নির্ধারণ করে দিয়েছেন তার ভাগ্য সুনিপুণভাবে। (আল্ মাসদারুস সাবেক্ব পৃ ১০১-১০২) আল্লাহর এ বিশাল সৃষ্টির বিষয়টি অবশ্যই আরও বড় এবং আলােচিত বিষয়গুলাে থেকে তা আরও ব্যাপক, বিশেষ করে মানব সৃষ্টি’,(মানব শরীরের ওপর আল্লাহর অপূর্ব সৃষ্টি-কৌশল সম্পর্কে অধিক জানার জন্য- হাফেজ মুনির উদ্দীন আহমদ রচিত প্রজন্মের প্রহসন বইটি পড়ে দেখতে পারেন) যার মধ্যে তকদীর ও তদবীর বিষয়গুলার উভয়টি সমভাবে ক্রিয়াশীল। সৃষ্টিলােকের সবকিছুর মধ্যে যে স্পন্দন রয়েছে নিত্য নতুন ঘটনাবলীর সংযােজন ও আকস্মিক ঘটনাবলী এবং একই ধারায় চলার প্রকৃতি। এসবের মধ্য ছােট বড় সব কিছু কিছু মিলে গড়ে উঠে এক অনবদ্য ইতিহাস। এসবের দিকে তাকালে দেখা যাবে সবকিছু এমন সামঞ্জস্যপূর্ণ তৈরী যেন এসব একজন মাত্র ব্যক্তির জীবনে সংঘটিত ঘটনাবলী এবং একই উৎস থেকে তা উৎসারিত। এই ভাবে প্রত্যেক ব্যক্তির অবস্থান হবে সুনির্দিষ্ট সময়ের জন্যে পূর্ব থেকে নির্ধারিত স্থানে সে বাস করবে এবং একটি নির্দিষ্ট পরিবেশে সে লালিত-পালিত হবে। প্রত্যেকটি জিনিসের অস্তিত্ব এবং সৃষ্টিলােকের প্রতিটি জিনিসের সাথে সে একই নিয়মে বাঁধা থাকবে-এটাও বহু আগে স্থির হয়ে আছে। বড় বড় ঘটনা-দুর্ঘটনার সাথে যেমন সে জড়িত রয়েছে, তেমনি সৃষ্টির প্রতিটি জিনিসের সাথে সামঞ্জস্য রেখে তাকে চলতে হবে-এটাও পূর্বেই নির্ধারিত। এ প্রসংগে শেষ ও চূড়ান্ত কথা হচ্ছে যে সব কিছুই পূর্বে স্থিরীকৃত এক নির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুযায়ী সৃষ্টি হয়েছে এবং সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকেই প্রতিটি জিনিস পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতে কাজ করে চলেছে। আর চুপিসারে পিপড়ার দলের কাজ করে যাওয়া, পাখীর মুক্ত বাতাসে উড্ডয়ন করা, বড় বড় জাহাজের সমদ্রযাত্রা, নদী পথে নৌকা বিহার ও বড় বড় নৌকার মাল-সামান আনা-নেয়ার এই যে ধারা সবই আবাহমানকাল ধরে একই ভাবে চলে আসছে।  *সবকিছুই আল্লাহর নিয়ন্ত্রণে : সময়ের আবর্তন, স্থানের পরিবর্তন কোনাে কিছুর পরিমাণের মধ্যে হ্রাস-বৃদ্ধি,নানা রূপ চেহারা ও আকৃতি -প্রকৃতি এবং সময় ও পরিধেয় বস্ত্র এবং বিভিন্ন অবস্থার মধ্যে যে এক ভারসাম্যপূর্ণ মিল দেখা যায়-এ সবই পূর্বনির্ধারিত ও নির্দিষ্ট এক নিয়মে চলে আসছে । তাক্বদীরের একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত যা আমাদের সামনে রয়েছে। সে দৃষ্টান্তটি হচ্ছে, ইয়াকুব(আ.)-এর দ্বিতীয় স্ত্রীর গর্ভে ইউসুফ(আ.) ও তার ভাই বিনইয়ামীনের জন্ম কোনাে বিচ্ছিন্ন ও আকস্মিক ঘটনা ছিলাে না। এ ঘটনা তো আল্লাহর পূর্ব-পরিকল্পনা অনুসারে সংঘটিত হয়েছিলাে যেন ইউসুফ(আ.)-এর বৈমাত্রেয় ভাইয়েরা তাকে সহ্য না করতে পেরে তার সাথে দুর্ব্যবহার করে এবং পিতার কাছ থেকে মিথ্যা অজুহাত দিয়ে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে জনপদ থেকে বিচ্ছিন্ন এক অন্ধ কুপের মধ্যে নিক্ষেপ করতে পারে এবং সেখান থেকে তাকে তুলে নিয়ে হত্যা না করে মিসরের অধিপতির পণ্যের চাহিদা মিটাতে গিয়ে বাজারে বিক্রি করতে পারে। এখানেই শেষ নয়, আল্লাহ তায়ালা আরও চেয়েছিলেন ইউসুফ(আ.) যেন মিসরের অধিপতির প্রাসাদে তিনি রাজার হালে লালিত-পালিত হন। চেয়েছিলেন যেন তার প্রতি প্রলুব্ধ হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে তাকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। এসব কেন হয়েছিলাে? এসব ঘটনার মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা চেয়েছিলেন যেন কারাগারে দুই কয়েদীর সাথে তার সাক্ষাত হয় এবং তারা তাদের স্বপ্নের বৃত্তান্ত জানার জন্যে তার কাছে আসতে পারে। এরই বা প্রয়ােজন কি ছিলো? তাৎক্ষণিক ভাবে এর কোনাে জবাব পাওয়া যায় না। এ বিষয়ে মানুষ একে অপরের কাছে জিজ্ঞাসা করতে থাকে, কেন এসব ঘটনার অবতারণা? কী দোষে হে আল্লাহ তায়ালা ইউসুফকে এ শাস্তি পেতে হলাে? কেনই বা হযরত ইয়াকুবকে এমনভাবে কষ্ট দেয়া হলাে যে, নিদারুণ দুঃখে এ মহান নবী তার দৃষ্টি শক্তি পর্যন্ত হারিয়ে ফেললেন? কেনই বা আল্লাহর পবিত্র ও নির্দোষ এ বান্দাকে এসব ঘটনাবলীর মাধ্যমে কষ্ট দেয়া হলাে। এসব জটিলতার অর্থ সাথে সাথে কেনই বা বুঝতে দেয়া হলাে না? এসমস্ত ঘটনার প্রথম জবাব দেয়া হলাে ইউসুফ(আ.)-এর জীবনের এক-চর্তুথাংশের ও বেশী সময়কাল কারাগারের কষ্ট সহ্য করার পর। এর কারণ একটিই, আর তা হচ্ছে তার ভাগ্যে এটা লিখিত ছিলাে যে, এসব ঘটনা অতিক্রম করে তিনি সাতটি বছর ধরে মিসরের দুর্ভিক্ষের দুঃসময়ে মিসর, তার অধিবাসী ও আশেপাশের গােত্রসমুহের ওপর কর্তৃত্ব করবেন এবং তাদের যাবতীয় কার্যাবলী পরিচালনা করবেন। তারপর কি হলো? তারপর এটাও নির্ধারিত ছিলাে যে, তিনি তাঁর পিতামাতা ও ভাই-বেরাদরকে মিসরে নিয়ে আসবেন এবং তাদেরই বংশের মধ্য থেকে বনী ইসরাইল জাতির উত্থান হবে যাতে তাদের ওপর ফেরআউন নির্যাতন চালাতে পারে এবং তাদের উদ্ধারকল্পে মূসা(আ.) তাদের মধ্যে লালিত-পালিত হয়ে গড়ে উঠেন। কাজেই তার ইউসুফ(আ.)-এর জীবনের এব ঘটনা ছিলাে পূর্বে নির্ধারিত ভাগ্য লিখন। এর মধ্যে তার পক্ষ থেকে যথাযােগ্য ব্যবস্থা নেয়া ছিলাে তার দায়িত্ব যা তিনি যথাযােগ্যভাবে পালন করেছেন। এ সমস্ত ঘটনা ও বাতাসের গতি ধরে আজকের বিশ্ব সম্মুখে এগিয়ে চলেছে এবং বিশ্বের সকল বিষয়ের ওপর এর প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছে। আজকে কে আছে এমন যে এ উদাহরণ থেকে শিক্ষা নেবে যে ইয়াকুব(আ.)-এর দাদা বিবাহ করার পর জন্মভূমি পরিত্যাগ করে চিরদিনের জন্যে মিসরে চলে গেলেন তা কোনাে বিচ্ছিন্ন ও একক ঘটনা ছিলাে না এবং তার মধ্যে ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত নেয়ার মতােও কোনাে কিছু ছিলাে না। এগুলাে এবং ইতিপূর্বেকার ইবরাহীম(আ.)-এর জীবনের ঘটনাবলী ছিলাে আল্লাহর পূর্ব নির্ধারিত পরিকল্পনা মাফিক ঘটনাপঞ্জীর ক্রমধারা, যার কারণে আমরা দেখতে পাই ইবরাহীম(আ.) ইরাকের নিবাস পরিত্যাগ করে মিসরে বসতি স্থাপন এবং বিবি হাজেরাকে বিয়ে করার পর তার গর্ভে ইসমাঈল(আ.)-এর জন্মগ্রহণ, ইসমাঈল ও তার মায়ের পবিত্র কাবা ঘরের কাছে বসতি স্থাপন ইত্যাদি ঘটনাবলী। এরপর ইবরাহীম(আ.)-এর বংশের এই সিঁড়িতে আরব উপদ্বীপের মধ্যে পৃথিবীতে রেসালাত প্রেরণের জন্যে সব থেকে উপযােগী মক্কা নগরীতে মােহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্মগ্রহণ ও প্রতিপালন হওয়া সবই ছিলাে তাক্বদীরের অপরিহার্য অবদান, যাতে করে বিশ্বমানবতার ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সংঘটিত হয় ঘটনার ধারাবাহিকতা যেন এক অদৃশ্য মালা, যে সূত্রে সে মালা গাঁথা তার সুদূর শেষ প্রান্তে আল্লাহ তায়ালা ইসলামের নূর-এর শেষ জ্যোতি জ্বালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এজন্যেই ছিলাে এই একটির পর আর একটি আসা ঘটনাবলী, এক বিন্দু থেকে আর এক বিন্দু পর্যন্ত টানা সরলরেখা এবং তার মধ্যে বিচিত্র ঘটনাবলী বিচিত্র সমাবেশ। এসব কিছু সংঘটিত হবে-এ ছিলাে আল্লাহর সিদ্ধান্ত, যার জন্যে গভীর, রহস্যাবৃত ও সূক্ষ্ম সেসব ঘটনা পরস্পর সংশ্লিষ্ট অবস্থায় একটির পর একটি তিনি সংঘটিত করেছেন। মানুষের জীবনে অনেক ঘটনা পাওয়া যায় যেসব সূত্র রয়েছে তার সব থেকে কাছের প্রান্তটি সে দেখে এবং দূরের অপর প্রান্তটি না দেখতে পেয়ে হয়রান হয়ে যায়। আবার কোনাে সময় এমনও হয় যে, তার সংকীর্ণ বয়স্ত সীমার মধ্যে শুরু ও শেষের ঘটনাবলী এত দীর্ঘ হয় যে, দুই প্রান্তের সমাবেশকে সে একত্রে দেখত বা আন্দায করতে পারে না, যার জন্যে তার বিস্ময়ের সীমা থাকে না এবং তার কাছে আল্লাহর ব্যবস্থাপনার মধ্যে নিহিত রহস্যাবলী গােপনই থেকে যায়। আর এ কারণেই সে ব্যস্ত হয়ে পড়ে এবং নানা প্রকার জল্পনা-কল্পনায় লিপ্ত হয়ে যায়, ক্রুদ্ধ হয় এবং আল্লাহর নির্দেশের বিরুদ্ধে অনেক পদক্ষেপ নিতে থাকে। আল্লাহ তায়ালা কোরআনের আয়াতের মাধ্যমে তাদেরকে শিক্ষা দিচ্ছেন। বলছেন, প্রতিটি জিনিসের জন্যে নিয়তি নির্ধারিত রয়েছে, যাতে করে কর্মনির্বাহকের কাছে সকল কর্মকে সমর্পণ করা হয় এবং তাদের অন্তর নিশ্চিন্ত হয়ে যায় ও প্রশান্তি লাভ করে। তারা সবাই আল্লাহর নির্ধারিত পরিণতির দিকে এগিয়ে চলছে এবং সেভাবেই সবকিছুর ক্রমবর্ধমান ব্যবস্থা এগিয়ে চলছে। পরিপূর্ণ দৃঢ়তা ও স্থিরতার কারণে যে নিশ্চিন্তে ও নির্লিপ্ততা আসে তার সাথে তাক্বদীরের ওপর বিশ্বাস ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাক্বদীর ও তার (ভাগ্য ও প্রচেষ্টা) এ দুইয়ের মধ্যে রয়েছে নিবিড় এক সম্বন্ধ। এ দুটির সমন্বয়ে গড়ে উঠে মানুষের মধ্যে এমন এক কর্মক্ষমতা যা বড় বড় কাজ এবং জটিল থেকে জটিল বিষয়গুলােকে অত্যন্ত সহজ ইংগিতে সমাধা করতে সাহায্য করে। এ বিষয়ে আল্লাহর উক্তি প্রণিধানযােগ্য। আমার কাজ তাে মাত্র একটিই, যা এক মুহুর্তের মধ্যেই সংঘটিত হয়ে যায়, অথবা এমন একটি কথা যার দ্বারা সকল কিছু পূর্ণত্বপ্রাপ্ত হয়। এ ব্যাপারে ছােট-বড় সব কাজের নিয়ম একই। অবশ্যই তা হচ্ছে বস্তুসমূহ ব্যবহারােপযােগী মানুষের জন্যে নির্ধারিত ব্যবস্থা। ভাগ্য-লিখন আছে তাকে কোনাে কালে কোনাে মানুষ পরিবর্তন করতে পারে না। এক মুহূর্ত বা মানুষের চোখের পলক পড়তে যে সময় লাগে তার থেকেও কম সময়ের মধ্যে তা সংঘটিত হয়। মানুষকে বুঝানাের জন্যেই শুধু এ তুলনাটুকু দেয়া হলাে। মহাকাল বা সময়, যা ধরা-ছোঁয়া যায় না-এ ক্ষুদ্র পৃথিবীর আবর্তনের কারণে মানুষ কল্পনার চোখেই শুধু সময়কে দেখতে পায় বা অনুভব করে। আল্লাহর কাছে সীমাবদ্ধ এ সময়ের কোনাে গুরুত্ব নেই, বরং তার কাছে সময় বলতে কোনাে জিনিসই নেই। আকাশে, বাতাসে, মর্তে, অন্তরীক্ষে, সর্বত্র বিরাজমান একটি মাত্র শক্তি যা এ বিশাল বাস্তবে এনেছে, সেই মহাশক্তিই সবকিছুর মধ্যে পরিবর্তন ও পরিবর্ধন সংঘটিত করেন। সেই শক্তির অধিকারী আল্লাহ তায়ালা যা খুশী তাই করেন। এ শক্তি দ্বারা তিনি সবকিছুকে যিন্দা করেন, এই শক্তি দ্বারা বস্তুকে এখান থেকে ওখানে এবং ওখান থেকে এখানে আনা-নেয়া করেন। এই শক্তি দ্বারা তিনি মৃত্যুর পরিণাম দান করেন। এই শক্তি দ্বারা তিনি অসংখ্য আকৃতি-প্রকৃতির মধ্য থেকে বিশেষ আকৃতিতে কাউকে অতি সুন্দর করে সৃষ্টি করেন। এই শক্তি দ্বারা তিনি শেষ বিচারের দিনে পুনরায় সবাইকে কবর থেকে তুলবেন। একত্রিত হওয়ার সেই চরম দুর্যোগপূর্ণ দিনে এই শক্তি দ্বারাই তিনি সৃষ্টিকে কেয়ামতের দিন তুলবেন। সেই মহাশক্তির চেষ্টার কোনাে প্রয়োজন নাই, তার কাছে সময়ও কোনাে ব্যাপার নয়। সেই মহাশক্তি সকল শক্তির উৎস এবং সকলের ভাগ্য তারই হাতে নিবন্ধ। আর সবকিছুই তার মুখাপেক্ষী এবং সব কিছুই তার জন্যে সহজ।

ফী জিলালিল কুরআন:

*কত পাপিষ্ঠ জাতিকে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে : আল্লাহর অগাধ এই শক্তি দিয়েই তিনি মিথ্যাবাদী ও মিথ্যা সাব্যস্তকারীদেরকে এক নির্দিষ্ট সময়ের পর ধ্বংস করবেন এবং এই শক্তি দ্বারাই তিনি মিথ্যা আরােপকারী সবাইকে তাদের অবশ্যম্ভাবী করুণ পরিণতি সম্পর্কে স্মরণ করাচ্ছেন। এরশাদ হচ্ছে, ‘অবশ্যই তােমাদের বহু গােত্রকে আমি ধ্বংস করে দিয়েছি, সুতরাং শিক্ষা গ্রহণকারী কেউ কি আছে? আর যা কিছু ওরা করেছে তা সবই আমলনামায় লিপিবদ্ধ রয়েছে এবং ছােট-বড় সকল অপরাধের কথাই আসমানী কিতাবের ছত্রে ছত্রে স্পষ্টভাবে লেখা রয়েছে।’ এরাই মিথ্যা আরােপকারী ও অস্বীকারকারী গােষ্ঠী যাদের সম্পর্কে ইতিপূর্বে বিস্তারিত বিবরণ দেয়া হয়েছে, এরশাদ হচ্ছে, ‘সুতরাং শিক্ষা গ্রহণকারী কেউ আছে কি?’ যে শিক্ষা নেবে ও বুদ্ধি-বিবেচনা করে কাজ করবে? ওদের এই বেদনাদায়ক প্রচেষ্টা ইহজগতে শাস্তিপ্রাপ্তির ফলে যে শেষ হয়ে যাবে তা নয়, বরং এরপর শেষ বিচারের দিনে তাদের হিসাব-নিকাশ নেয়া হবে এবং সে হিসাব নেয়ার ব্যাপারে কোনােক্রমেই কম করা হবে না। তাই এরশাদ হচ্ছে, ‘আর যা তারা করেছে তার প্রত্যেকটি জিনিস আসমানী কিতাবে লিপিবদ্ধ রয়েছে। প্রেরিত ছােট ছােট পুস্তিকাতেও প্রয়ােজনীয় হেদায়াত লেখা রয়েছে যাতে করে কেয়ামতের দিনে সেগুলাে হাযির করা যায় আর প্রতিটি ছােটবড় কাজ লিখিত অবস্থায় মওজুদ রয়েছে।’ আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা কিতাবে এসব কথা সুন্দরভাবে লেখা রয়েছে। এর কোনাে একটি অংশও ভুল হয়ে যাবে না যেহেতু কিতাবে লেখা রয়েছে। দোযখবাসীদের দুরাবস্থা ও করুণ শাস্তি সম্পর্কে বিশদ বিবরণ দান করার পর এবার অপর অধ্যায়ের আলােচনা আসছে, অর্থাৎ মিথ্যারােপ যারা না করে এবং সত্যের বাতি যাদেরকে কল্যাণকর কাজের দিকে এগিয়ে দেয়, তাদের প্রসংগে আলােচনার সূচনা করা হচ্ছে। যিনি নিজেকে আল্লাহর কাছে সােপর্দ করেছেন, তার ছায়াতলে এসে যারা মােত্তাকী-পরহেযগার অর্থাৎ আল্লাহভীরু হওয়ার কারণে মন্দ বর্জনকারী হয়ে গেলাে, তাদের প্রসংগে এরশাদ হচ্ছে, ‘অবশ্যই মুত্তাকীরা বাগবাগিচায় ভরা এমন বেহেশতে থাকবে যার মধ্যে প্রবহমান থাকবে কুলকুল নাদিনী নির্ঝরিণীসমূহ। যথাযােগ্য মর্যাদাসম্পন্ন ও অবস্থানে তারা উপবিষ্ট থাকবে, থাকবে তারা সকল শক্তি-ক্ষমতার মালিক মহাসম্রাট আল্লাহ রাব্বুল ইযযতের পরম সান্নিধ্যে।’ এদের পাশাপাশি কল্পনার চোখ দিয়ে একবার দেখা যাক সে হতভাগা দোযখবাসীদের দিকে। চরম ভ্রান্তির মধ্যে পতিত এসব অপরাধীর দল কেমন দিশাহারা হয়ে রয়েছে এবং তারা প্রজ্জলিত অগ্নিকুন্ডের দিকে এগিয়ে চলেছে, দীনহীন অবস্থায় তাদেরকে টেনে-খিচে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে দাউ-দাউ করে জ্বলে উঠা দোযখের ইন্ধন হিসাবে নিক্ষেপ করার জন্যে। অভিসম্পাত ও ধিক্কার চতুর্দিক থেকে বর্ষিত হচ্ছে তাদের প্রতি, আর তার সাথে সাথে তাদের শরীরকে ঝলসে দেয়া হচ্ছে নিদারুণ দোযখের আযাবের কশাঘাতে। আওয়ায আসছে, ‘স্বাদ নাও চূর্ণ-বিচূর্ণ করে অনির্বাণ অগ্নিশিখার।’ নেয়ামতপ্রাপ্ত বান্দাদের চিত্রটিও লক্ষ্যণীয় ফুলে-ফলে ভরা বাগবাগিচা, যার মধ্যে রয়েছে মৃদুমন্দ ধারায় প্রবাহিত নির্ঝরিণী। আরও রয়েছে পরম পুলকময় মহান মর্যাদার আসন অর্থাৎ স্বয়ং বিশ্ব সম্রাটের সিংহাসনের পাশেই তাদের অবস্থান। এসব নেয়ামতের স্বাদ যেমন তারা মধুময় অনুভূতি দ্বারা লাভ করবে, তেমনি তাদের সর্বাংগ দ্বারা আস্বাদন করবে, থাকবে তারা সকল প্রকার নেয়ামতভরা বাগ-বাগিচাসমূহে ও সদা সিদ্ধ প্রস্রবণের আনন্দঘন পরশে। এমনকি নেয়ামত দানকারী মহান প্রভুর প্রিয় সম্ভাষণ হবে সকল প্রকার নেয়ামতের বড়। এ নেয়ামত ও এ সকল সম্বােধন কোনাে আনুষ্ঠানিক ব্যাপার হবে না, বরং আল্লাহর এসব মেহমানদের প্রতি সকল প্রকার আন্তরিকতা ও আতিথেয়তা প্রদর্শিত হবে। অন্তর ও আত্মার পরিতৃপ্তি লাভ করবে এই নেয়ামতপ্রাপ্তরা। তার সাথে আরও লাভ করবে তারা সম্মান ও মর্যাদা মহাসম্রাটের সান্নিধ্যে। যথাযোগ্য মর্যাদার আসনে উপবিষ্ট তারা হবে মহান সম্রাটের সান্নিধ্য লাভে ধন্য। এ মর্যাদার আসনে ক্ষণিকের জন্যে বা সাময়িকভাবে তারা সমাসীন হবে-তাই-ই নয়, বরং এটা হবে তাদের স্থায়ী অবস্থান-ক্ষেত্র, মহাসম্মানের সাথে আল্লাহর কাছেই তারা নির্লিপ্ত ও নিশ্চিন্ত মনে কালাতিপাত করবে। রব্বুল আলামীনের স্নেহ-আদরের পরশ লাভে সদাই থাকবে পুলকিত। এ সকল নেয়ামতের স্থায়িত্ব সম্পর্কে হবে তারা পরিপূর্ণ নিশ্চিন্ত। আর এ সকল নেয়ামত লাভের কারণ হচ্ছে এই যে, তারা পৃথিবীর জীবনে আল্লাহর ভয়ে সদা-সর্বদা বাছবিচার করে চলেছে, ভয়ে-ভয়ে জীবন যাপন করেছে। কি হবে-না হবে- এ আশঙ্কায় থেকেছে সদা কম্পমান আর অপেক্ষমান থেকেছে আল্লাহর সন্তোষের জন্যে নিশিদিন। তাই আল্লাহ তায়ালাও দুটি ভয় এক সাথে কাউকে দেন না। দুনিয়ায় যে তাকে ভয় করে চলবে অবশ্যই আখেরাতে তার জন্যে আযাবের ভয় নেই। অতএব, নগদ পাওনা লাভের ব্যাপারে যে তাকে ভয় করবে, বিলম্বে প্রাপ্য জিনিসের ব্যাপারে সে নিরাপত্তা লাভ করবে। আর নিরাপত্তার সাথে সাথে পাবে সে ভয়-ভাবনাহীন আবাসস্থল, সেখানে সে বাস করবে মহব্বত ভরা পরিবেশে ও মর্যাদার মধ্যে। পাক পবিত্র এ মহান কালামের নিরাপত্তাদানকারী ছায়াতলে বসে পথ-প্রদর্শনকারী উল্লেখিত ঘটনাবলী বর্ণনার সাথে এ সূরাটির ওপর আলােচনা শেষ হচ্ছে। এর মধ্যে একাধারে অপরাধীদের জন্যে নানা প্রকার ভয় ও শাস্তির বিবরণ এবং চূড়ান্তভাবে মােশরেকদেরকে পাকড়াও, ধ্বংস করে দেয়ার হুমকি দানের সাথে সাথে যারা কোরআনের ছায়াতলে এসে সত্য-সঠিক পথ ও নিরাপত্তা লাভ করতে তাদের আত্মাকে নানা প্রকার নেয়ামতের আশ্বাস-দানে আশ্বস্ত করা হয়েছে। এইভাবে যাবতীয় জ্ঞান ভান্ডারের উৎস এবং মহাজ্ঞানী আল্লাহর পক্ষ থেকে যে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে, তা প্রত্যেক সত্যসন্ধ মানুষের অন্ত-প্রাণ ও আত্মার জন্যে এক মহা প্রশান্তি কাজ করেছে। এ প্রসংগে অতি সূক্ষ্ম বিষয় তাক্বদীর সম্পর্কেও আলােচনা করা হয়েছে এবং স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম জিনিস সম্পর্কে ওয়াকেফহাল মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত রয়েছে সবার জন্যে নির্দিষ্ট ও অমােঘ নিয়তি যার বাইরে কেউই যেতে পারে না বা কারাে পক্ষে কিছু করাও সম্ভব নয়।

১৭-৫৫ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
২) তাফসীরে ইবনে কাছীর:-
***মহান আল্লাহ বলেনঃ “আমি কুরআন কারীমের শব্দ ও অর্থ প্রত্যেক এমন ব্যক্তির জন্যে সহজ করে দিয়েছি যে এর দ্বারা উপদেশ গ্রহণ করতে চায়। যেমন তিনি অন্য জায়গায় বলেনঃ

অর্থাৎ “আমি তোমার প্রতি (নবী সঃ-এর প্রতি) বরকতময় কিতাব অবতীর্ণ করেছি যাতে তারা এর আয়াতগুলো সম্পর্কে চিন্তা-গবেষণা করে এবং যেন জ্ঞানীরা উপদেশ গ্রহণ করে।” (৩৮:২৯) আর এক জায়গায় বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “আমি কুরআনকে উপদেশের জন্যে সহজ করেছি। আরো বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “আমি তো তোমার ভাষায় কুরআনকে সহজ করে দিয়েছি যাতে তুমি ওটা দ্বারা মুত্তাকীদের সুসংবাদ দিতে পার এবং বিতণ্ডা প্রবণ সম্প্রদায়কে সতর্ক করতে পার।” (১৯:৯৭)

হযরত মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, এর কিরআত ও তিলাওয়াত আল্লাহ তা’আলা সহজ করে দিয়েছেন।

হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, যদি আল্লাহ তা’আলা একে সহজসাধ্য না করতেন তবে মাখলুকের ক্ষমতা ছিল না যে, তারা আল্লাহর কালাম পড়তে পারে। আমি বলি যে, ঐ সহজগুলোর মধ্যে একটি সহজ ওটাই যা পূর্বে হাদীসে গত হয়েছে। তা এই যে, এই কুরআন সাতটি কিরআতের উপর অবতীর্ণ করা হয়েছে। এই হাদীসের সমস্ত পন্থা ও শব্দ আমরা ইতিপূর্বে জমা করে দিয়েছি। সুতরাং এখানে পুনরাবৃত্তি নিষ্প্রয়োজন। মোটকথা, আল্লাহ তাআলা কুরআনকে খুবই সহজ করে দিয়েছেন। সুতরাং কুরআন হতে উপদেশ গ্রহণকারী কেউ আছে কি? অর্থাৎ কেউ এর থেকে উপদেশ গ্রহণ করতে চাইলে তাকে সাহায্য করা হবে।

১৮-২২ নং আয়াতের তাফসীর:

আল্লাহ তাআলা খবর দিচ্ছেন যে, হূদ (আঃ)-এর কওমও আল্লাহর রাসূলদেরকে মিথ্যাবাদী বলেছিল এবং নূহ (আঃ)-এর কওমের মতই ঔদ্ধত্য প্রকাশ করেছিল। ফলে তাদের প্রতি কঠিন ঠাণ্ডা ও ধ্বংসাত্মক বায়ু প্রেরণ করা হয়। ওটা ছিল তাদের জন্যে সরাসরি অশুভ ও অকল্যাণকর। ঐ বায়ু তাদের উপর অব্যাহতভাবে প্রবাহিত হতে থাকে এবং তাদেরকে সমূলে ধ্বংস করে দেয়। পার্থিব ও পারলৌকিক শাস্তি দ্বারা তাদেরকে পাকড়াও করা হয়। ঐ ঝঞাবায়ুর প্রবাহ তাদের উপর আসতো এবং তাদের কাউকেও উঠিয়ে নিয়ে যেতো, এমন কি সে পৃথিবীবাসীর দৃষ্টির অন্তরালে চলে যেতো। অতঃপর তাকে অধঃমুখে ভূমিতে নিক্ষেপ করতো। তার মস্তক পিষ্ট করতে এবং দেহ হতে মস্তক বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তো। দেখে মনে হতো যেন উলিত খর্জূর গাছের কাণ্ড।

মহাপ্রতাপান্বিত আল্লাহ বলেনঃ দেখো, কত কঠোর ছিল আমার শাস্তি ও সতর্কবাণী! আমি তো কুরআনকে সহজ করে দিয়েছি উপদেশ গ্রহণের জন্যে। সুতরাং যে ইচ্ছা করবে সে উপদেশ ও শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে।

২৩-৩২ নং আয়াতের তাফসীর:

এখানে খবর দেয়া হচ্ছে যে, সামূদ সম্প্রদায় আল্লাহর রাসূল হযরত সালিহ (রাঃ)-কে মিথ্যাবাদী বলে এবং তার নবী হওয়াকে অসম্ভব মনে করে বিস্মিত হয়ে বলেঃ “এটা কি হতে পারে যে, আমরা আমাদেরই একটি লোকের অনুগত হয়ে যাবো? তার এতো বড় মর্যাদা লাভের কারণই বা কি?” এর চেয়ে আরো বেড়ে গিয়ে বলেঃ “আমরা এটা মেনে নিতে পারি না যে, আমাদের সবারই মধ্য হতে শুধুমাত্র এই লোকটিরই উপর আল্লাহর কালাম নাযিল হয়েছে।” তারপর এরও আগে পা বাড়িয়ে গিয়ে আল্লাহর নবী (আঃ)-কে প্রকাশ্যভাবে ও স্পষ্ট ভাষায় চরম মিথ্যাবাদী বলতেও কুণ্ঠাবোধ করেনি। আল্লাহ তা’আলা তাদেরকে ধমকের সুরে বলেন, এখন তোমরা যা চাও তাই বল, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মিথ্যাবাদী এবং মিথ্যায় সীমালংঘনকারী কে তা কালই প্রকাশিত হয়ে যাবে।

মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ আমি তাদের পরীক্ষার জন্যে পাঠিয়েছি এক উষ্ট্ৰী। ঐ লোকদের চাহিদা অনুযায়ী পাথরের এক কঠিন পাহাড় হতে এক বিরাট গর্ভবতী উস্ত্রী বের হয় এবং আল্লাহ তা’আলা স্বীয় নবী (আঃ)-কে বলেনঃ তাদের পরিণাম কি হয় তা তুমি দেখে নিয়ে এবং তাদের কষ্টদায়ক কথার উপর ধৈর্য ধারণ করো। দুনিয়া ও আখিরাতে বিজয় তোমারই হবে। তুমি তাদেরকে বলে দাওঃ পানি এক দিন তোমাদের এবং এক দিন উষ্ট্ৰীর। যেমন আল্লাহ তা’আলা অন্য জায়গায় বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “সালেহ বললোঃ এই যে উষ্ট্ৰী, এর জন্যে আছে পানি পানের পালা এবং তোমাদের জন্যে আছে পানি পানের পালা, নির্ধারিত এক এক দিনে।” (২৬:১৫৫)

(আরবী)-এর তাফসীরে মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, যখন উষ্ট্ৰীটি অনুপস্থিত থার্কতো তখন তারা পানি পেতো, আর যখন উষ্ট্ৰীটি হাযির থাকতো তখন তারা ওর দুধ পেতো।

এরপর আল্লাহ তাআলা বলেনঃ অতঃপর তারা তাদের এক সঙ্গীকে আহ্বান করলো, সে ওকে ধরে হত্যা করলো। তাফসীরকারগণ বলেন যে, হত্যকারী লোকটির নাম ছিল কিদার ইবনে সালিফ। সে ছিল তার কওমের মধ্যে সর্বাধিক হতভাগ্য। যেমন অন্য আয়াতে রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ তাদের মধ্যে যে সর্বাধিক হতভাগ্য, সে যখন তৎপর হয়ে উঠলো।” (৯১:১২)

মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ বলেনঃ “কি কঠোর ছিল আমার শাস্তি ও সতর্কবাণী! আমি তাদেরকে আঘাত হেনেছিলাম এক মহানাদ দ্বারা; ফলে তারা হয়ে গেল খোয়াড় প্রস্তুতকারীর বিখণ্ডিত শুষ্ক শাখা-প্রশাখার ন্যায়।’ অর্থাৎ যেভাবে জমির কর্তিত শুষ্ক পাতা উড়ে গিয়ে হারিয়ে যায় সেই ভাবে আল্লাহ তা’আলা তাদেরকেও নিশ্চিহ্ন করে দেন। শুষ্ক চারা ভুষি যেমনভাবে জঙ্গলে উড়ে উড়ে ফিরে, ঠিক তেমনিভাবে তাদেরকেও ধ্বংস করে দেয়া হয়। অথবা ভাবার্থ হচ্ছেঃ আরবের প্রথা ছিল যে, উটগুলোকে শুষ্ক কাঁটাযুক্ত বেড়ার মধ্যে রেখে দেয়া হতো। যখন ঐ বেড়াকে পদদলিত করা হতো তখন উটগুলোর যে অবস্থা হতো ঐ অবস্থা তাদেরও হয়ে যায়। তাদের একজনও রক্ষা পায়নি। দেয়াল হতে যেমন মাটি ঝরে পড়ে তেমনই তাদেরও মূলোৎপাটন ঘটে। এসব উক্তি হলো তাফসীরকারদের এই বাক্যটির তাফসীর। কিন্তু প্রথম উক্তিটিই প্রবলতম। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।
৩৩-৪০ নং আয়াতের তাফসীর:

হযরত লূত (আঃ)-এর কওমের খবর দেয়া হচ্ছে যে, কিভাবে তারা তাদের রাসূলদেরকে অস্বীকার করেছিল এবং কিভাবে তাদের বিরুদ্ধাচরণ করে এমন জঘন্য কার্যে লিপ্ত হয়ে পড়েছিল। যে কাজ তাদের পূর্বে কেউ কখনো করেনি, অর্থাৎ মেয়েদেরকে ছেড়ে ছেলেদের সাথে কুকার্যে লিপ্ত হওয়ায় তাদের ধ্বংসের অবস্থাটাও ছিল তাদের কাজের মতই অসাধারণ ও অদ্ভুত। আল্লাহ তা’আলার নির্দেশক্রমে হযরত জিবরাঈল (আঃ) তাদের বস্তীটিকে আকাশের কাছে উঠিয়ে নেন এবং সেখান হতে উল্টোভাবে নীচে নিক্ষেপ করেন। আর আকাশ হতে তাদের নামে নামে পাথর বর্ষাতে থাকেন। কিন্তু হযরত লুত (আঃ)-এর অনুসারীদেরকে প্রত্যুষে অর্থাৎ রাত্রির শেষ ভাগে বাচিয়ে নেন। তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল যে, তারা যেন ঐ বস্তী ছেড়ে চলে যান। হযরত লূত (আঃ)-এর কওমের কেউই ঈমান আনেনি। এমন কি স্বয়ং হযরত লুত (আঃ)-এর স্ত্রীও বে-ঈমান ছিল। তাঁর কওমের একটি লোকও ঈমান আনয়নের সৌভাগ্য লাভ করেনি। সুতরাং আল্লাহর আযাব হতেও কেউই রক্ষা পায়নি। তাঁর কওমের সাথে সাথে তাঁর স্ত্রীও ধ্বংস হয়ে যায়। শুধুমাত্র তিনি ও তাঁর কন্যাগণ এই ভয়াবহ শাস্তি হতে রক্ষা পান। মহান আল্লাহ এভাবেই তার কৃতজ্ঞ বান্দাদেরকে বিপদের সময় রক্ষা করে থাকেন এবং তাদেরকে তাদের কৃতজ্ঞতার সুফল প্রদান করেন।

শাস্তি আসার পূর্বেই হযরত লূত (আঃ) স্বীয় কওমকে সতর্ক করেছিলেন। কিন্তু তারা তাঁর কথায় মোটেই কর্ণপাত করেনি। বরং তারা সন্দেহ পোষণ করে তাঁর সাথে ঝগড়ায় লিপ্ত হয়েছিল। আর তার মেহমানদেরকে তাঁর নিকট হতে ছিনতাই করতে চেয়েছিল। হযরত জিবরাঈল (আঃ), হযরত মীকাঈল (আঃ), হযরত ইসরাফীল (আঃ) প্রমুখ মর্যাদাসম্পন্ন ফেরেশতাগণ মানুষের রূপ ধরে হযরত লূত (আঃ)-এর বাড়ীতে মেহমান হয়ে এসেছিলেন। তারা অত্যন্ত সুন্দর চেহারা ও সুঠাম দেহ বিশিষ্ট তরুণ যুবকদের রূপ ধারণ করেছিলেন। এদিকে রাত্রিকালে তারা হযরত লুত (আঃ)-এর বাড়ীতে অবতরণ করেছেন, আর ওদিকে তার বে-ঈমান স্ত্রী কওমকে খবর দিয়ে দেয় যে, হযরত লূত (আঃ)-এর বাড়ীতে সুদৃশ্য যুবকদের দল মেহমান রূপে আগমন করেছেন। এ খবর পেয়েই ঐ দুশ্চরিত্র লোকগুলো দৌড়িয়ে আসে এবং হযরত লূত (আঃ)-এর বাড়ী ঘিরে ফেলে। হযরত লূত (আঃ) তখন দরযা বন্ধ করে দেন। কিভাবে এই মেহমানদেরকে হাতে পাওয়া যায় এই সুযোগের অপেক্ষায় ঐ লোকগুলো ওঁৎ পেতে থাকে। যখন এসব কাণ্ড চলছিল তখন ছিল সন্ধ্যাকাল। হযরত লূত (আঃ) তাদেরকে বুঝাবার চেষ্টা করছিলেন। তিনি তাদেরকে বলছিলেনঃ “আমার এই কন্যাগুলো অর্থাৎ তোমাদের স্ত্রীগুলো বিদ্যমান রয়েছে। তোমরা এই দুষ্কার্য পরিত্যাগ করে তোমাদের হালাল স্ত্রীদের দ্বারা তোমাদের কাম বাসনা চরিতার্থ কর।” কিন্তু ঐ দুবৃত্তের দল জবাবে বলেছিলঃ “আপনি তো জানেন যে, স্ত্রীদের প্রতি আমাদের কোন আকর্ষণ নেই। আমরা যে কি চাই তা তো আপনার অজানা নয়। আপনি আপনার মেহমানদেরকে আমাদের হাতে সমর্পণ করে দিন!” যখন এই তর্ক-বিতর্কে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হয় এবং ঐ লোকগুলো আক্রমণোদ্যত হয় এবং হযরত লুত (আঃ) তাদের এই দুর্ব্যবহারে অত্যন্ত অতিষ্ঠ হয়ে উঠেন তখন হযরত জিবরাঈল (আঃ) বেরিয়ে আসেন এবং তাঁর পাখা তাদের চোখের উপর দিয়ে ফিরিয়ে দেন। ফলে তারা সবাই অন্ধ হয়ে যায়। তাদের দৃষ্টিশক্তি সম্পূর্ণরূপে লোপ পায়। তারা তখন দেয়াল হাতড়াতে হাতড়াতে এবং হযরত লূত (আঃ)-কে গালমন্দ দিতে দিতে সকালের ওয়াদা দিয়ে পশ্চাদপদে ফিরে যায়। কিন্তু সকালেই তাদের উপর আল্লাহর শাস্তি এসে পড়ে, যা হতে না তারা পালাতে পারলো, না শাস্তি দূর করতে সক্ষম হলো। তাই তো মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ বলেনঃ ‘আস্বাদন কর আমার শাস্তি এবং সতর্কবাণীর পরিণাম। হযরত লুত (আঃ)-এর উপদেশবাণীর প্রতি কর্ণপাত না করার শাস্তি তারা আস্বাদন করলো ।

এই কুরআন কারীম খুবই সহজ, যে কেউই ইচ্ছা করলে এটা হতে উপদেশ গ্রহণ করতে পারে। অতএব উপদেশ গ্রহণকারী কেউ আছে কি?
৪১-৪৬ নং আয়াতের তাফসীর:

আল্লাহ তা’আলা ফিরাউন ও তার সম্প্রদায়ের ঘটনা এখানে বর্ণনা করছেন। তাদের কাছে আল্লাহর রাসূল হযরত মূসা (আঃ) ও হযরত হারূন (আঃ) এই খবর শুনাতে আসলেন যে, তারা ঈমান আনলে তাদের জন্যে (জান্নাতের) সুসংবাদ রয়েছে এবং কুফরী করলে (জাহান্নামের) ভয় রয়েছে। তাদেরকে আল্লাহ তা’আলার পক্ষ হতে বড় বড় মু’জিযা ও নিদর্শন প্রদান করা হয়। ওগুলো ছিল তাদের নবুওয়াতের সত্যতার পুরোপুরি দলীল। কিন্তু তারা সবকিছুই অবিশ্বাস করে। ফলে তাদের উপর আল্লাহর শাস্তি নেমে আসে এবং তাদেরকে সমূলে ধ্বংস করে দেয়া হয়।

এরপর বলা হচ্ছেঃ হে কুরায়েশ মুশরিকের দল! তোমরা কি ঐ ফিরাউন ও তার সম্প্রদায় অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ? না, বরং তারাই তোমাদের অপেক্ষা বহুগুণে শক্তিশালী ছিল। তাদের দলবলও ছিল তোমাদের চেয়ে বহুগুণে বেশী। তারাও যখন আল্লাহর আযাব হতে পরিত্রাণ পায়নি, তখন তোমরা আবার কি? তোমাদেরকে ধ্বংস করা তাঁর কাছে অতি সহজ। তোমরা কি ধারণা করছে যে, আল্লাহর কিতাবসমূহে তোমাদের মুক্তিদানের কথা লিখিত রয়েছে? কিতাবে কি এটা লিখা আছে যে, তাদের কুফরীর কারণে তাদেরকে শাস্তি দেয়া হবে এবং তোমরা কুফরী করতে থাকবে, আর তোমাদেরকে কোনই শাস্তি দেয়া হবে না? তোমরা কি মনে করছে যে, তোমরা দলের দল রয়েছে, সুতরাং তোমাদের সংখ্যাধিক্যের কারণে তোমাদের কোনই ক্ষতি হবে না?

মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ বলেনঃ এই দল তো শীঘ্রই পরাজিত হবে প্রদর্শন করবে।

হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, বদরের যুদ্ধের দিন নবী (সঃ) দু’আ করছিলেনঃ “হে আল্লাহ! আমি আপনাকে আপনার প্রতিজ্ঞা ও অঙ্গীকারের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি! হে আল্লাহ! যদি আপনার ইচ্ছা এটাই থাকে যে, আজকের দিনের পর ভূ-পৃষ্ঠে আপনার ইবাদত আর কখনো করা হবে না।” তিনি এটুকুই বলেছিলেন এমতাবস্থায় হযরত আবু বকর (রাঃ) তাঁর হাতখানা ধরে ফেলেন এবং বলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! যথেষ্ট হয়েছে। আপনি আপনার প্রতিপালকের কাছে খুবই অনুনয় বিনয় করেছেন।” অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁবু হতে বেরিয়ে আসলেন এবং তাঁর মুখে (আরবী) -এ দু’টি আয়াত উচ্চারিত হচ্ছিল। হযরত উমার (রাঃ) বলেনঃ “এ আয়াত অবতীর্ণ হবার সময় এর দ্বারা কোন্ জামাআতকে বুঝানো হয়েছে তা আমি চিন্তা করছিলাম। বদরের যুদ্ধের দিন যখন আমি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে বর্ম পরিহিত হয়ে স্বীয় শিবির হতে বের হতে দেখলাম তখন ঐ আয়াতের তাফসীর আমার বোধগম্য হয়।” (এ হাদীসটি ইমাম বুখারী (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ “যে সময় আমি অতি অল্প কসের বালিকা ছিলাম এবং আমার সঙ্গীনিদের সাথে খেলা করতাম ঐ সময় (আরবী)-এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয়।” (ইমাম বুখারী (রঃ) এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। এটা সহীহ বুখারীতে ফাযায়েলুল কুরআনের অধ্যায়ে দীর্ঘভাবে বর্ণিত হয়েছে। ইমাম মুসলিম (রঃ) এটা তাখরীজ করেননি)
৪৭-৫৫ নং আয়াতের তাফসীর:

পাপী ও অপরাধী লোকদের সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা খবর দিচ্ছেন যে, তারা বিভ্রান্ত হয়ে গেছে এবং সত্য পথ হতে সরে গেছে। তারা সন্দেহ ও দুর্ভাবনার মধ্যে পতিত হয়েছে। এই দুষ্ট ও দুরাচার লোকগুলো কাফিরই হোক অথবা অন্য কোন দলের অপরাধী ও পাপী লোকই হোক, তাদের এই দুষ্কর্ম তাদেরকে উল্টোমুখে জাহান্নামের দিকে টানতে টানতে নিয়ে যাবে। এখানে যেমন তারা উদাসীন রয়েছে, তেমনই ওখানেও তারা বে-খবর থাকবে যে, না জানি তাদেরকে কোন দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সেখানে তাদেরকে ধমকের সুরে বলা হবেঃ তোমরা এখন জাহান্নামের অগ্নির স্বাদ গ্রহণ কর।

মহান আল্লাহ বলেনঃ ‘আমি সবকিছু সৃষ্টি করেছি নির্ধারিত পরিমাপে। যেমন অন্য জায়গায় বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “তিনি প্রত্যেক জিনিস সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর ওর পরিমাপ নির্ধারণ করেছেন।” (২৫:২) আর এক জায়গায় বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “তুমি তোমার সুমহান প্রতিপালকের নামের পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা কর। যিনি সৃষ্টি করেন ও সুঠাম করেন। আর যিনি পরিমিত বিকাশ সাধন করেন ও পথ-নির্দেশ করেন।” (৮৭:১-৩)।

আহলে সুন্নাতের ইমামগণ এর দ্বারা দলীল গ্রহণ করেছেন যে, আল্লাহ তা’আলা স্বীয় মাখলুককে সৃষ্টি করার পূর্বেই তার ভাগ্য নির্ধারণ করেছেন এবং প্রত্যেক জিনিস প্রকাশিত হবার পূর্বেই আল্লাহ তা’আলার কাছে লিখিত হয়ে গেছে। কাদরিয়া সম্প্রদায় এটা অস্বীকার করে। এ লোকগুলো সাহাবীদের (রাঃ) আখেরী যুগেই বেরিয়ে পড়েছিল। আহলে সুন্নাত ঐ লোকেদের মাযহাবের বিপক্ষে এই প্রকারের আয়াতগুলোকে পেশ করে থাকেন। আর এই বিষয়ের হাদীসগুলোকেও আমরা সহীহ বুখারীর কিতাবুল ঈমানের ব্যাখ্যায় এই মাসআলার বিস্তারিত আলোচনায় লিপিবদ্ধ করেছি। এখানে শুধু ঐ হাদীসগুলো লিপিবদ্ধ করা হলো যেগুলো আয়াতের বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত।

হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, মুশরিক কুরায়েশরা নবী (সঃ)-এর কাছে এসে তকদীর সম্পর্কে তর্ক-বিতর্ক করতে শুরু করে। তখন (আরবী)-এই আয়াত অবতীর্ণ হয়।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ), ইমাম মুসলিম (রঃ), ইমাম তিরমিযী (রঃ) এবং ইমাম ইবনে মাজাহ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

হযরত আমর ইবনে আয়েব (রঃ) হতে বর্ণিত, তিনি তাঁর পিতা হতে এবং তিনি তাঁর দাদা হতে বর্ণনা করেছেন যে, এ আয়াতগুলো তকদীর অস্বীকারকারীদের প্রতিবাদে অবতীর্ণ হয়।” (এটা বাযযার (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

হযরত যারারাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী (সঃ) এ আয়াতগুলো পাঠ করে বলেনঃ “এই আয়াতগুলো আমার উম্মতের ঐ লোকদের ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়েছে যারা শেষ যামানায় জন্মলাভ করবে এবং তকদীরকে অবিশ্বাস করবে।” (এ হাদীসটি ইমাম ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

হযরত আতা ইবনে আবি রিবাহ (রঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর নিকট গমন করি। ঐ সময় তিনি যমযম কূপ হতে পানি উঠাচ্ছিলেন। তাঁর কাপড়ের অঞ্চল ভিজা ছিল। আমি বললামঃ তকদীরের ব্যাপারে সমালোচনা করা হচ্ছে। কেউ এই মাসআলার পক্ষে রয়েছে এবং কেউ বিপক্ষে রয়েছে। তিনি তখন বললেনঃ “জনগণ এরূপ করছে।” আমি বললামঃ হ্যাঁ, এরূপই হচ্ছে। তখন তিনি বললেনঃ “আল্লাহর শপথ (আরবী)-এ আয়াতগুলো তাদের সম্পর্কেই অবতীর্ণ। হয়েছে। জেনে রেখো যে, এ লোকগুলো হলো এই উম্মতের নিকৃষ্টতম লোক। তারা রোগাক্রান্ত হলে তাদেরকে দেখতে যেয়ো না এবং তারা মারা গেলে তাদের জানাযায় হাযির হয়ো না। তাদের কাউকেও যদি আমি আমার সামনে দেখতে পাই তবে আমার অঙ্গুলি দ্বারা তার চক্ষু উঠিয়ে নিবো।”

হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)-কে বলা হলো, এমন একজন লোক এসেছে যে তকদীরকে বিশ্বাস করে না। তখন তিনি বললেন, আচ্ছা, তোমরা আমাকে তার। কাছে নিয়ে চল। জনগণ বললো, আপনি তো অন্ধ, সুতরাং আপনি তার কাছে গিয়ে কি করবেন? উত্তরে তিনি বলেনঃ “যার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে তাঁর শপথ! যদি আমি তাকে হাতে পাই তবে তার নাক কেটে নিবো এবং যদি তার গর্দান ধরতে পারি তবে তা উড়িয়ে দিবো। আমি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে বলতে শুনেছিঃ “আমি যেন দেখতে পাচ্ছি যে, বানু কাহরের নারীরা খাযরাজের চতুর্দিকে তাওয়াফ করতে আছে। তাদের দেহ নড়াচড়া করছে। তারা মুশরিকা নারী। এই উম্মতের প্রথম শিরক এটাই। যার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে তার শপথ! তাদের নির্বুদ্ধিতা এতো চরমে পৌঁছে যাবে যে, তারা আল্লাহ তাআলাকে কল্যাণ নির্ধারণকারী বলেও স্বীকার করবে না। যেমন তাকে অকল্যাণ নির্ধারণকারী বলে স্বীকার করেনি।” (এ হাদীসটি মুসনাদে আহমাদে বর্ণিত হয়েছে)

হযরত নাফে’ (রঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর সিরিয়াবাসী একজন বন্ধু ছিল, যার সাথে তাঁর পত্র আদান প্রদান চলতো। তিনি শুনতে পেলেন যে, তাঁর ঐ বন্ধুটি তকদীর সম্পর্কে কিছু সমালোচনা করে থাকে। সুতরাং তৎক্ষণাৎ তিনি তাকে পত্র লিখেন- আমি শুনতে পেয়েছি যে, তুমি নাকি তকদীরের ব্যাপারে কিছু বিরূপ মন্তব্য করে থাকে। যদি একথা সত্য হয় তবে আজ হতে তুমি আমার নিকট থেকে কোন পত্র প্রাপ্তির আশা করো না। আজ হতে তোমার সাথে আমার সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেল। আমি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে বলতে শুনেছিঃ “আমার উম্মতের মধ্যে তকন্দীরকে অবিশ্বাসকারী লোকের আবির্ভাব ঘটবে।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) ও ইমাম আবু দাউদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “প্রত্যেক উম্মতের মধ্যে মাজুস (প্রাচীন পারসিক যাজক মণ্ডলী) থাকে। আমার উম্মতের মাজুসী হলো ঐ লোকগুলো যারা তকদীরে বিশ্বাস করে না। তারা রোগাক্রান্ত হলে তোমরা তাদেরকে দেখতে যেয়ো না এবং তারা মারা গেলে তোমরা তাদের জানাযায় হাযির হয়ো না।” (মুসনাদে আহমাদে এ হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে)

হযরত ইবনে উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “শীঘ্রই এই উম্মতের মধ্যে মাসখ’ হবে (অর্থাৎ লোকদের আকৃতি পরিবর্তিত হবে), জেনে রেখো যে, এ অবস্থা ঐ লোকদের হবে যারা তকদীরে বিশ্বাস করে না এবং যারা যিনদীক (অর্থাৎ আল্লাহর একত্বে অবিশ্বাসী)।” (এ হাদীসটিও ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন। জামেউত তিরমিযীতেও এ হাদীসটি রয়েছে)

হযরত ইবনে উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “প্রত্যেক জিনিসই আল্লাহ তা’আলা কর্তৃক নির্ধারিত পরিমাপে রয়েছে, এমনকি অজ্ঞতা ও নির্বুদ্ধিতাও।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) ও ইমাম মুসলিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

সহীহ হাদীসে রয়েছেঃ “আল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনা কর এবং অপারগ ও নির্বোধ হয়ো না। অতঃপর যদি কোন ক্ষতি হয়ে যায় তবে বলো যে, এটা আল্লাহ কর্তৃকই নির্ধারিত ছিল এবং তিনি যা চেয়েছেন তাই করেছেন। আর এরূপ কথা বলো নাঃ যদি এরূপ করতাম তবে এরূপ হতো। কেননা, এই ভাবে যদি বলাতে শয়তানী আমলের দরযা খুলে যায়।”

রাসূলুল্লাহ (সঃ) হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)-কে বলেনঃ “জেনে রেখো যে, যদি সমস্ত উম্মত একত্রিত হয়ে তোমার ঐ উপকার করার ইচ্ছা করে যা আল্লাহ তা’আলা তোমার ভাগ্যে লিখেননি তবে তারা তোমার ঐ উপকার কখনো করতে পারবে না। পক্ষান্তরে, যদি সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে তোমার কোন ক্ষতি করার ইচ্ছা করে যা তোমার তকদীরে লিখা নেই তবে কখনো তারা তোমার ঐ ক্ষতি করতে সক্ষম হবে না। কলম শুকিয়ে গেছে এবং দফতর জড়িয়ে নিয়ে ভাঁজ করে দেয়া হয়েছে।

হযরত ওয়ালীদ ইবনে উবাদাহ (রঃ)-এর পিতা হযরত উবাদাহ ইবনে সামিত (রাঃ) যখন রোগ শয্যায় শায়িত হন এবং তাঁর অবস্থা অত্যন্ত খারাপ হয়ে যায় তখন হযরত ওয়ালীদ (রঃ) তাঁর পিতাকে বলেনঃ “হে পিতঃ! আমাদেরকে কিছু অন্তিম উপদেশ দিন!” তখন তিনি বলেনঃ “আচ্ছা, আমাকে বসিয়ে দাও।” তাকে বসিয়ে দেয়া হলে তিনি বলেনঃ “হে আমার প্রিয় বৎস! ঈমানের স্বাদ তুমি গ্রহণ করতে পার না এবং আল্লাহ তাআলা সম্পর্কে তোমার যে জ্ঞান রয়েছে তার শেষ সীমায় তুমি পৌঁছতে পার না যে পর্যন্ত না তকদীরের ভাল মন্দের উপর তোমার বিশ্বাস হয়।” হযরত ওয়ালীদ (রঃ) তখন জিজ্ঞেস করলেনঃ “আব্বা! কি করে আমি জানতে পারবো যে, তকদীরের ভাল মন্দের উপর আমার ঈমান রয়েছে?” তিনি উত্তরে বললেনঃ “এই ভাবে তুমি জানতে পারবে যে, তুমি যা পেয়েছে তা পাওয়ারই ছিল এবং যা পাওনি তা পাওয়ারই ছিল না এই বিশ্বাস যখন তোমার থাকবে। হে আমার প্রিয় বৎস! জেনে রেখো যে, আমি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট হতে শুনেছিঃ “আল্লাহ তা’আলা সর্বপ্রথম কলম সৃষ্টি করেন এবং ওকে বলেনঃ ‘লিখো।’ তখনই কলম উঠে গেল এবং কিয়ামত পর্যন্ত যতো কিছু হবার আছে সবই লিখে ফেললো।” হে আমার প্রিয় ছেলে! যদি তুমি তোমার মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত এই বিশ্বাসের উপর না থাকো তবে অবশ্যই তুমি জাহান্নামে প্রবেশ করবে।” (এ হাদীসটি জামেউত তিরমিযীতে বর্ণিত হয়েছে এবং ইমাম তিরমিযী (রঃ) এটাকে সহীহ হাসান গারীব বলেছেন)

হযরত আলী ইবনে আবি তালিব (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “তোমাদের কেউ ঈমানদার হতে পারে না যে পর্যন্ত না সে চারটির উপর ঈমান আনে। (এক) সাক্ষ্য দেবে যে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন মা’রূদ নেই, (দুই) আর সাক্ষ্য দেবে যে, আমি (মুহাম্মাদ সঃ) আল্লাহর রাসূল, তিনি আমাকে সত্যসহ প্রেরণ করেছেন, (তিন) মৃত্যুর পর পুনরুত্থানের উপর বিশ্বাস রাখে এবং (চার) তকদীরের ভাল মন্দের উপর ঈমান আনে।” (এ হাদীসটি সুফিয়ান সাওরী (রঃ), ইমাম তিরমিযী (রঃ) এবং দাউদ তায়ালেসী (রঃ) বর্ণনা করেছেন। সুনানে ইবনে মাজাহ্তেও এটা বর্ণিত হয়েছে)

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “নিশ্চয়ই আল্লাহ আসমান ও যমীন সৃষ্টি করার পঞ্চাশ হাজার বছর পূর্বে মাখলুকের তকদীর লিপিবদ্ধ করেছেন। ঐ সময় তাঁর আরশ পানির উপর ছিল।” (ইমাম মুসলিম (রঃ) ও ইমাম তিরমিযী (রঃ) এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন এবং ইমাম।তিরমিযী (রঃ) এটাকে হাসান সহীহ গারীব বলেছেন)

এরপর আল্লাহ তাআলা স্বীয় ইচ্ছা ও আহকাম বিনা বাধায় জারী হওয়ার বর্ণনা দিচ্ছেন। তিনি বলেনঃ আমি নির্ধারণ করেছি তা যেমন হবেই, ঠিক তেমনি যে কাজের আমি ইচ্ছা করি তার জন্যে শুধু একবার ‘হও’ বলাই যথেষ্ট হয়ে যায়, দ্বিতীয়বার গুরুত্বের জন্যে হুকুম দেয়ার কোনই প্রয়োজন হয় না। চোখের পলক ফেলা মাত্রই ঐ কাজ আমার চাহিদা অনুযায়ী হয়ে যায়। আরব কবি কি সুন্দরই না বলেছেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “আল্লাহ যখনই কোন কাজ করার ইচ্ছা করেন তখন শুধু বলেন হয়ে যাও’ আর তখনই তা হয়ে যায়।”

আল্লাহ তাআলা বলেনঃ আমি ধ্বংস করেছি তোমাদের মত দলগুলোকে, অতএব ওটা হতে উপদেশ গ্রহণকারী কেউ আছে কি? আমার তাদেরকে শাস্তিদান ও লাঞ্ছিতকরণের মধ্যে তোমাদের জন্যে শিক্ষা ও উপদেশ নেই কি? যেমন আল্লাহ তাআলা অন্য জায়গায় বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “তাদের এবং তাদের কামনা-বাসনার মধ্যে পর্দা ফেলে দেয়া হয়েছে, যেমন তাদের পূর্ববর্তী দলগুলোর সাথে করা হয়েছিল।” (৩৪:৫৪)

তারা যা কিছু করেছে সবই তাদের আমলনামায় লিপিবদ্ধ রয়েছে, যা আল্লাহ তাআলার বিশ্বস্ত ফেরেশতাগণের হাতে রক্ষিত আছে। ক্ষুদ্র ও বৃহৎ সবকিছুই আছে লিপিবদ্ধ। এমন কিছুই নেই লিখতে ছুটে গেছে।

হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলতেনঃ “হে আয়েশা (রাঃ)! গুনাহকে তুচ্ছ মনে করো না, জেনে রেখো যে, আল্লাহর কাছে এরও জবাবদিহি করতে হবে।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ), ইমাম নাসাঈ (রঃ) এবং ইমাম ইবনে মাজাহ (রঃ) বর্ণনা করেছেন। মুসনাদে ইবনে আবি হাতিমেও এটা বর্ণিত হয়েছে)

হযরত সুলাইমান ইবনে মুগীরা (রঃ) বলেনঃ “একদা আমি একটা গুনাহ করে ফেলি যেটাকে আমি অতি নগণ্য মনে করি। রাত্রে স্বপ্নে দেখি যে, একজন আগন্তুক এসে আমাকে বলছেনঃ হে সুলাইমান (রঃ)! (আরবী) অর্থাৎ “ছোট গুনাহগুলোকেও ছোট ও তুচ্ছ মনে করো না, এই ছোট গুনাহগুলোই বড় গুনাহ হয়ে যাবে। পাপ যদি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্রও হয় এবং ওগুলো করার পর বহু যুগ অতিবাহিত হয়েও যায় তথাপি ওগুলো আল্লাহ তাআলার কাছে স্পষ্টভাবে লিখিত অবস্থায় বিদ্যমান থাকে। পাপ হতে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখো এবং এরূপ হয়ো না যে, অত্যন্ত ভারী হয়ে পুণ্যকার্যের দিকে এগিয়ে যাবে, বরং অঞ্চল উঁচু করে পুণ্য কাজের দিকে অগ্রসর হও। যখন কেউ আন্তরিকতার সাথে আল্লাহকে মহব্বত করে তখন তার প্রতি আল্লাহ তা’আলার পক্ষ হতে চিন্তা-গবেষণার অভ্যাসের ইলহাম করা হয়। স্বীয় প্রতিপালকের নিকট হিদায়াত যাঞা কর এবং নম্রতা ও বিনয় প্রকাশ কর। হিদায়াত ও সাহায্যকারী হিসেবে আল্লাহ তাআলাই তোমার জন্যে যথেষ্ট।”

এরপর আল্লাহ তাআলা বলেনঃ সৎ এবং আল্লাহভীরু লোকেদের অবস্থা হবে। এই পাপী ও অপরাধী লোকেদের অবস্থার বিপরীত। এরা তো থাকবে বিপদ ও কষ্টের মধ্যে এবং অধঃমুখে তারা নিক্ষিপ্ত হবে জাহান্নামে। আর এদের উপর হবে কঠিন ধমক ও শাসন গর্জন। পক্ষান্তরে ঐ সৎ ও আল্লাহভীরু থাকবে স্রোতস্বিনী বিধৌত জান্নাতে। তারা মর্যাদা ও সম্মান, সন্তুষ্টি ও অনুগ্রহ, দান ও ইহসান, সুখ ও শান্তি, নিয়ামত ও রহমত এবং সুন্দর ও মনোরম বাসভবনে অবস্থান করবে। অধিপতি ও সর্বশক্তিমান আল্লাহর নৈকট্য লাভ করে তারা গৌরবান্বিত হবে। যে আল্লাহ সব কিছুরই সৃষ্টিকর্তা এবং সবারই ভাগ্য নির্ধারণকারী। যিনি সবকিছুরই উপর পূর্ণ ক্ষমতাবান। তিনি ঐ আল্লাহভীরু লোকদের সব চাহিদাই পূর্ণ করবেন। তাদের মনোবাসনা মিটাতে মোটেই কার্পণ্য করবেন না তিনি।

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী (সঃ) বলেছেনঃ “আদল ও ইনসাফকারী সৎলোকেরা আল্লাহ তা’আলার নিকট আলোর মিম্বরের উপর রহমানের (করুণাময় আল্লাহর) ডান দিকে থাকবে। আল্লাহ তাআলার দুই হাতই ডানই বটে। এই ন্যায় বিচারক ও ন্যায়পরায়ণ লোক ওরাই যারা তাদের আদেশসমূহে, নিজেদের পরিবার পরিজনের মধ্যে এবং যা কিছু তাদের অধিকারে রয়েছে সবগুলোর মধ্যেই আল্লাহর ফরমানের ব্যতিক্রম করে , বরং আদল ও ইনসাফের সাথেই কাজ করে থাকে।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ), ইমাম মুসলিম (রঃ) এবং ইমাম নাসাঈ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

১৭-৫৫ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
৩) তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:-
*** (وَلَقَدْ تَّرَكْنٰهَآ اٰيَةً فَهَلْ مِنْ مُّدَّكِرٍ)

‘রেখে দিয়েছি আমি এটাকে নিদর্শনরূপে; অতএব উপদেশ গ্রহণকারী কেউ আছে কি?’ অর্থাৎ নূহ (আঃ)-এর এ ঘটনাকে পরবর্তী জাতিদের জন্য নিদর্শনস্বরূপ রেখে দিয়েছেন যাতে তারা উপদেশ গ্রহণ করে সাবধান হয়।

(وَلَقَدْ يَسَّرْنَا الْقُرْاٰنَ لِلذِّكْرِ فَهَلْ مِنْ مُّدَّكِرٍ)

‘কুরআনকে আমি সহজ করে দিয়েছি উপদেশ গ্রহণের জন্য, সুতরাং উপদেশ গ্রহণকারী কেউ আছে কি?’ এর অর্থ ও তাৎপর্য উপলব্ধি করা ও এ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা এবং তা মুখস্ত করা আমি সহজ করে দিয়েছি। অতএব এটা বাস্তব যে, কুরআনুল কারীম অলৌকিকতা ও ভাষা-শৈলীর দিক দিয়ে অতি উচ্চাঙ্গের কিতাব হওয়া সত্ত্বেও আরব অনারব যে কোন মানুষ মনযোগ দিয়ে পড়লে সহজেই মুখস্ত করতে পারে। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কোন গ্রন্থ নেই যা হুবহু কেউ মুখস্থ করেছে। অথচ পৃথিবীতে লক্ষ লক্ষ হাফেযে কুরআন রয়েছে। এটি কুরআনের অন্যতম একটি মু‘জিযাহ।

তারপর আল্লাহ তা‘আলা প্রশ্ন করে বলছেন, কেউ কি উপদেশ গ্রহণ করার আছ? আমাদের সকলের উচিত কুরআন থেকে উপদেশ গ্রহণ করে উভয় জগতের জীবনকে সাফল্যময় করে তোলা।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় : –
# কুরআন থেকে প্রত্যেকের শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত।
১৮-২২ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

নূহ (আঃ)-এর ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতির বিবরণ উল্লেখ করার পর আল্লাহ তা‘আলা হূদ (আঃ)-এর জাতি আদ সম্প্রদায়ের বিবরণ নিয়ে এসেছেন। যারা হূদ (আঃ)-কে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছিল। ফলে আল্লাহ তা‘আলা তাদের শাস্তিস্বরূপ

رِيْحًا صَرْصَرًا

তথা প্রচণ্ড ঠাণ্ডাযুক্ত বাতাস প্রেরণ করেছিলেন।

(فِيْ يَوْمِ نَحْسٍ مُّسْتَمِرٍّ)

তথা দুর্ভাগ্যের দিনে নিরবিচ্ছিন্ন ঝড়ো হওয়া।

পরের আয়াতে বাতাসের তীব্রতা বর্ণনা করতে গিয়ে আল্লাহ তা‘আলা বলেন : তা মানুষকে উৎখাত করেছিল উৎপাটিত খেজুর কাণ্ডের ন্যায়। ঐ ঝঞ্ঝাবায়ুর প্রবাহ তাদের ওপর এসে কাউকে উঠিয়ে নিয়ে যেত, এমনকি সে পৃথিবীবাসীর দৃষ্টির অন্তরাল হয়ে যেত। অতঃপর তাকে অধঃমুখে ভূমিতে নিক্ষেপ করত। তার মস্তক পিষ্ঠ হয়ে যেত এবং দেহ থেকে আলাদা হয়ে যেত। দেখে মনে হয় যেন উৎপাটিত খেজুর গাছের কাণ্ড।
২৩-৩২ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

আলোচ্য আয়াতগুলোতে সালেহ (আঃ)-এর অবাধ্য সামূদ জাতি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে যারা সালেহ (আঃ)-কে পথভ্রষ্ট, পাগল ও মিথ্যাবাদী ইত্যাদি বলত। তারা বলল আমরা এত দল বল, সবাই এক মত ও পথের অনুসারী আর সে অন্য এক পথের দিকে আহ্বান করে, আমরা এ একজন মাত্র মানুষের অনুসরণ করব? আমাদের মধ্য হতে কি কেবল তাকেই ওয়াহী করা হল? অথচ আমাদের মাঝে অনেক ধনবান ও উচ্চ বংশের মানুষ রয়েছে। সুতরাং তার কথা কখনো অনুসরণ করার মত নয়। ফলে আল্লাহ তা‘আলা বিকট আওয়াজ দ্বারা তাদেরকে ধ্বংস করে দেন।

سُعُرٍ শব্দটি سعير-এর বহুবচন। যার অর্থ আগুনের শিখা। এখানে তা পাগলামি বা শাস্তি ও কঠোরতা অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।

أَشِرٌ -এর অর্থ : متكبر বা অহংকারী। অথবা এর অর্থ : মিথ্যার সীমা অতিক্রমকারী। অর্থাৎ তারা বলে : আমাদের মধ্যে কেবল তারই কাছে কি ওয়াহী আসার ছিল? নাকি এর মাধ্যমে আমাদের ওপর স্বীয় বড়ত্ব দেখানো তার উদ্দেশ্য?

(سَيَعْلَمُوْنَ غَدًا)

‘আগামীকাল (কিয়ামতের দিন) তারা জানবে’ আগামীকাল বলতে কিয়ামত দিবস। অর্থাৎ কিয়ামতের দিন জানতে পারবে প্রকৃতপক্ষে কে মিথ্যাবাদী। তারা, নাকি সালেহ (আঃ)।

(إِنَّا مُرْسِلُوا الْنَّاقَةِ فِتْنَةً)

‘নিশ্চয়ই আমি তাদের পরীক্ষার জন্য পাঠিয়েছি এক উষ্ট্রী’ অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে পরীক্ষা করার জন্য তাদের দাবী মতে দশ মাসের গর্ভবর্তী একটি উটনী প্রদান করলেন এবং সালেহ (আঃ)-কে নির্দেশ দিলেন, তারা সে উটনীর সাথে কী আচরণ করে তা খেয়াল রাখার জন্য ও তাদের পক্ষ থেকে প্রাপ্ত কষ্টে ধৈর্য ধারণ করতে। এ সম্পর্কে আরো বিস্তারিত আলোচনা সূরা আ‘রাফের ৭৩ নম্বর আয়াতে করা হয়েছে।

(أَنَّ الْمَا۬ءَ قِسْمَةٌمبَيْنَهُمْ)

‘আর তুমি তাদেরকে জানিয়ে দাও যে, তাদের মধ্যে পানি বন্টন নির্ধারিত’ অর্থাৎ ঘাটে পানি পান করার পালা বণ্টন করা ছিল। একদিন তারা পান করবে, অন্য দিন উটনী পান করবে। যেদিন উটনী পান করবে সেদিন তারা যেতে পারবে না।

যেমন আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন :

(قَالَ هٰذِه۪ نَاقَةٌ لَّهَا شِرْبٌ وَّلَكُمْ شِرْبُ يَوْمٍ مَّعْلُوْمٍ )

“সালিহ্ বলল : ‎ ‘এ একটি উষ্ট্রী, এর জন্য আছে পানি পানের পালা এবং তোমাদের জন্য আছে নির্ধারিত দিনে পানি পানের পালা; (সূরা শু‘আরা- ২৬ : ১৫৫)

(فَتَعَاطٰي فَعَقَرَ) “সে ওটাকে (উষ্ট্রীকে) ধরে হত্যা করল” অর্থাৎ তারা তাদের দলবলকে আহ্বান করে একত্রিত হয়ে তরবারী দ্বারা উটনীর পা কেটে দিয়ে হত্যা করল।

صَاحِبَهُمْ “তাদের সঙ্গী” তার নাম ছিল قدار بن سالف (কুদ্দার ইবনু সালেফ) সে সামুদ জাতির নিকৃষ্ট লোক ছিল। الحظيرة -এর অর্থ الحظورة খোঁয়াড়, যা কাটাযুক্ত শুকনো ডালপালা বা কাষ্ঠ খণ্ড দিয়ে পশুর সংরক্ষণের জন্য তৈরি করা হয়। আর الْمُحْتَظِرِ -এর অর্থ صاحب الحظيرة (খোয়াড়ওয়ালা)

আর هشيم হলো শুকনো ঘাস বা কর্তিত শুকনো ফসলাদি। এভাবেই আল্লাহ তা‘আলা অবাধ্য জাতিসমূহকে ধ্বংস করে থাকেন। আল্লাহ তা‘আলার আমাদের কাছে পূর্ববর্তী অবাধ্য জাতি ও তাদের ওপর আপতিত শাস্তির কথা বর্ণনা করার অন্যতম একটি উদ্দেশ্য- আমরা যেন জেনেশুনে তাদের মত অবাধ্যতাপূর্ণ কাজে লিপ্ত না হই।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. নাবীদের মিথ্যা প্রতিপন্নকারীদেরকে আল্লাহ তা‘আলা ধ্বংস করে দেন, এটাই তাঁর রীতি।
২. বড় বড় নিদর্শন দেখার পরেও অনেকে ঈমান নাও আনতে পারে।
৩. পূর্ববর্তী মিথ্যুক জাতিসমূহের ওপর আপতিত শাস্তি থেকে শিক্ষা নেয়া উচিত।
৩৩-৪০ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

আলোচ্য আয়াতগুলোতে লূত (আঃ)-এর অবাধ্য জাতি সম্পর্কে আলোকপাত করা হচ্ছে। এদের অপরাধ ছিল- যৌন চাহিদা মেটানোর জন্য নারীর কাছে গমন না করে পুরুষের কাছে আসত। যা পৃথিবীতে তাদের পূর্বে কেউ/কোন জাতি করেনি। লূত (আঃ) তাদেরকে বারংবার নিষেধ করা সত্ত্বেও তারা এ হতে বিরত হয়নি। বরং তারা লূত (আঃ)-কে হত্যা করার হুমকি দিয়েছে।

(أَرْسَلْنَا عَلَيْهِمْ حَاصِبًا)

‘আমি তাদের ওপর প্রেরণ করেছিলাম প্রস্তর বর্ষণকারী প্রবল বাতাস’ তাদের শাস্তিস্বরূপ আল্লাহ এমন ঝড়ো হাওয়া প্রেরণ করেছিলেন যা তাদের ওপর কংকর নিক্ষেপ করছিল। অর্থাৎ তাদের জনপদকে এমনভাবে উল্টে দেয়া হয়েছিল যে, তার ওপর অংশ নীচে এবং নীচের অংশ ওপরে চলে গিয়েছিল। অতঃপর তাদের ওপর পাথরের বৃষ্টি বর্ষণ করা হয়েছিল। এদের বসবাস ছিল বর্তমান ইসরাঈলের সীমান্তবর্তী এলাকায় সাগরের বেলাভূমিতে যা ‘ডেড সী’ নামে পরিচিত। প্রতœতাত্তিকগণ এসব এলাকা থেকে মানুষের কংকাল সংগ্রহ করে নিশ্চিত জানতে পেরেছে যে, এখানে এ প্রচন্ড প্রস্তর বর্ষণকারী বাতাস বয়েছিল। এ সম্পর্কে সূরা হূদে আরো আলোচনা করা হয়েছে।

(إِلَّآ اٰلَ لُوْطٍ نَجَّيْنٰهُمْ)

‘কিন্তু লূত পরিবারের ওপর নয়’ লূত (আঃ)-এর পরিবার বলতে যারা তাঁর প্রতি ঈমান এনেছিল তারা। এদের মধ্যে লূত (আঃ)-এর স্ত্রী শামিল নয়। কারণ সে মু‘মিনা ছিল না, লূতের প্রতি ঈমান আনেনি। আল্লাহ তা‘আলা লূত (আঃ)-সহ তাঁর অনুসারীদেরকে রাতের শেষভাগে আপতিত আযাব থেকে রক্ষা করেছেন।

(نِّعْمَةً مِّنْ عِنْدِنَا)

অর্থাৎ তাদেরকে আযাব থেকে মুক্তি দেয়াটা ছিল তাদের ওপর আল্লাহ তা‘আলার দয়া ও অনুগ্রহ। যারা আল্লাহ তা‘আলার প্রতি ঈমান আনে ও আনুগত্য করে তিনি তাদেরকে এভাবেই প্রতিদান দিয়ে থাকেন।

(فَتَمَارَوْا بِالنُّذُرِ)

‘কিন্তু তারা সতর্কবাণী সম্বন্ধে বিতর্ক শুরু করল’ অর্থাৎ লূত (আঃ) যখন তাদেরকে আল্লাহ তা‘আলার আযাব সম্পর্কে সতর্ক করলেন তখন তারা ভীতি প্রদর্শনকে কোন পরোয়া করেনি, বরং সন্দেহ পোষণ করেছিল এবং ভীতি প্রদর্শনকারীর সাথে বিবাদে লিপ্ত হয়েছিল।

(وَلَقَدْ رَاوَدُوْهُ عَنْ ضَيْفِه۫)

‘তারা মেহমানদের জন্য লূতকে ফুসলিয়েছিল’ رَاوَدُ শব্দের অর্থ কাম প্রবৃত্তি চরিতার্থ করার জন্য কাউকে ফুলসানো। অর্থাৎ একদা রাতে লূত (আঃ)-এর নিকট জিবরীল, মিকাঈল, ইসরাফীল (আঃ) সুন্দর সুন্দর নব যুবকের আকৃতিতে মেহমান হিসেবে আগমন করেন। লূতের বাড়িতে মেহমান এসেছে এ কথা জানতে পেরে লূত (আঃ)-এর সম্প্রদায় তাঁর বাড়িতে এসে পীড়াপীড়ি করতে লাগল মেহমানদের সাথে তাদের ঘৃণিত আচরণ চরিতার্থ করার জন্য। তখন জিবরীল (আঃ) তাঁর ডানার একটি অংশ তাদের ওপর মারলেন, ফলে তাদের চোখ বেরিয়ে গেল। কেউ বলেছেন শুধু চোখের দৃষ্টি নষ্ট হয়ে ছিল। সকাল বেলা বিরামহীন শাস্তি দ্বারা আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে ধ্বংস করে দেন (কুরতুবী)। অতএব আল্লাহ তা‘আলা পূর্ববর্তী অবাধ্য জাতিসমূহের ওপর আপতিত শাস্তির বিশদ বিবরণ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করার জন্য তিনি কুরআনকে সহজ করে দিয়েছেন। তাই আমাদের তাদের থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত আমরাও যেন তাদের মত অবাধ্য না হই।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. পৃথিবীতে সর্বপ্রথম সমকামিতায় লিপ্ত হয়েছিল লূত (আঃ)-এর জাতি।
২. আল্লাহ তা‘আলার কৃতজ্ঞ বান্দাদের মর্যাদা জানতে পারলাম যে, তিনি তাদেরকে সকল বালা-মসিবত থেকে হিফাযত করেন।
৩. নাবীদের আনুগত্য বর্জন করার পরিণতি কী তা জানতে পারলাম।
৪১-৪৬ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

পরপর কয়েকজন নাবীর অবাধ্য জাতি ও তাদের শাস্তির কথা আলোকপাতের পর এখানে আল্লাহ তা‘আলা মূসা (আঃ)-ও তাঁর প্রধান শত্র“ ফির‘আউনের কথা তুলে ধরেছেন। যে সর্বদা মূসা (আঃ)-এর বিরোধিতা করেছিল।

আল্লাহ তা‘আলা মূসা (আঃ)-কে অনেক নিদর্শন দিয়ে ফির‘আউন ও তার পরিষদের কাছে প্রেরণ করেছিলেন। কিন্তু সে তা মিথ্যা প্রতিপন্ন করে নিজের দাম্ভিকতার ওপর বহাল ছিল। এর পরিণামস্বরূপ আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে সমুদ্রে ডুবিয়ে মারলেন।

এসব বড় বড় মিথ্যুক ও কাফিরদের পরিণতি উল্লেখ করার পর আল্লাহ মক্কার কুরাইশদেরকে প্রশ্ন করছেন যে, পূর্বের ঐ সকল কাফিরদের চেয়ে তোমরা কি উত্তম? কখনো না, তোমরা তাদের চেয়ে নিকৃষ্ট। অতএব তোমরা কিভাবে আযাব হতে মুক্তি লাভের আশা করো?

زُّبُرِ বলতে পূর্ববর্তী নাবীদের ওপর অবতীর্ণ কিতাবগুলোকে বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ পূর্বের কিতাবগুলোতে কি এ কথা লেখা আছে যে, কুরাইশ বা আরবরা যা ইচ্ছা করুক, তাদের ওপর কোন আযাব আসবে না। ইমাম কুরতুবী বলেন زُّبُرِ অর্থ লাওহে মাহফুজ।

مُّنْتَصِرٌ অর্থ অপরাজেয়, যারা হার মানে না।

(سَيُهْزَمُ الْجَمْعُ وَيُوَلُّوْنَ الدُّبُرَ)

‘এই দল শ্রীঘ্রই পরাজিত হবে এবং পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবে’ আল্লাহ তা‘আলা তাদের ভ্রান্ত ধারণাকে খণ্ডন করলেন। দল বলতে মক্কার কাফিরদেরকে বুঝানো হয়েছে।

ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন : বদর যুদ্ধের দিন নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ছোট্ট একটি তাবুতে অবস্থান করে এ দু‘আ করছিলেন, হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে তোমার ওয়াদা ও অঙ্গীকার পূরণ কামনা করছি। হে আল্লাহ ! যদি তুমি চাও, আজকের পর আর কখনো তোমার ইবাদত না করা হোক….। ঠিক এ সময় আবূ বকর (রাঃ) রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর হাত ধরে বললেন : হে আল্লাহর রাসূল! যথেষ্ট হয়েছে। আপনি আপনার প্রতিপালকের কাছে অনুনয়- বিনয়ের সঙ্গে বহু দু’আ করেছেন। এ সময় তিনি লৌহবর্ম পরে ছিলেন। এরপর তিনি এ আয়াত পড়তে পড়তে তাঁবু থেকে বের হয়ে এলেন,

(سَیُھْزَمُ الْجَمْعُ وَیُوَلُّوْنَ الدُّبُرَ)

অর্থাৎ এই দল তো শ্রীঘ্রই পরাজিত হবে এবং পৃষ্ঠপ্রদর্শন করবে। অধিকন্তু কিয়ামত তাদের শাস্তির নির্ধারিত কাল এবং কিয়ামত হবে কঠিনতর ও তিক্ততর। (সহীহ বুখারী হা. ৪৮৭৭)

‘আয়িশাহ্ (রাঃ) বলেন : আয়াতটি নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ওপর মক্কায় অবতীর্ণ হয়, তখন আমি এমন বালিকা ছিলাম যে, আমি খেলা করতাম। (সহীহ বুখারী হা. ৪৮৭৬)

أَدْهٰي শব্দটি دهاء থেকে গঠিত, অর্থ : কঠিন অপমানকারী। أَمَرّ শব্দটি مرارة থেকে গঠিত, অর্থ অতি তিক্ত। অর্থাৎ দুনিয়াতে এদেরকে যে হত্যা, বন্দী ইত্যাদি করা হয়েছে, এটাই শেষ শাস্তি নয়, বরং এর থেকেও আরো কঠিন শাস্তি তাদেরকে কিয়ামতের দিন দেয়া হবে।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. যুগে যুগে নাবীদের মিথ্যা প্রতিপন্নকারী কাফিরদের কী দুর্দশা হয়েছিল তা দিবালোকের ন্যায় সুস্পষ্ট।
২. হক্বের বিরুদ্ধে লড়াইকারীরা যত শক্তিশালীই হোক সর্বশেষ তাদের পরিণাম দুনিয়াতে পরাজয় আর আখিরাতে অনন্ত যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।
৩. কিয়ামতের দিন কাফিরদের জন্য প্রতিশ্র“ত দিবস।
৪৭-৫৫ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

শানে নুযুল : আবূ হুরাইরাহ্ (রাঃ) বলেন : কুরাইশ মুশরিকরা আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে তাকদীর সম্পর্কে বাদানুবাদ করে। ফলে

( إِنَّ الْمُجْرِمِيْنَ فِيْ ضَلَالٍ وَّسُعُرٍ ……..بِقَدَرٍ)

আয়াতগুলো অবতীর্ণ হয়। (সহীহ মুসলিম হা. ২৬৫৬)

পাপী ও অপরাধী লোকদের সম্পর্কে আল্লাহ সংবাদ দিচ্ছেন যে, তারা সত্যের পথ হতে বিচ্যুত, তারা সন্দেহ ও দুর্ভাবনার মধ্যে পতিত হয়েছে। প্রত্যেক কাফির ও বিদ‘আতী যারা তারা এ দোষে দুষ্ট। এরপর আল্লাহ বলছেন, তাদের এ সন্দেহ ও দোদুল্যমনা জাহান্নামে নিয়ে যাবে। তারপর আল্লাহ তা‘আলা বলছেন : নিশ্চয়ই আমি সবকিছু সৃষ্টি করেছি নির্ধারিত পরিমাপে। এরূপ আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন :

(وَخَلَقَ كُلَّ شَيْءٍ فَقَدَّرَه۫ تَقْدِيْرًا)

“তিনি সমস্ত‎ কিছু সৃষ্টি করেছেন এবং প্রত্যেককে পরিমিত করেছেন যথাযথ অনুপাতে।” (সূরা আল ফুরকান ২৫ : ২) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন :

الَّذِيْ خَلَقَ فَسَوّٰي)‏ (وَالَّذِيْ قَدَّرَ فَهَدٰي‏

“যিনি সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর পরিপূর্ণভাবে সুবিন্যস্ত করেছেন, এবং যিনি পরিমাণ নির্ধারণ করেছেন, তারপর হেদায়েত দিয়েছেন” (সূরা আল আ‘লা- ৮৭ : ২-৩)

ইমাম বুখারী (রহঃ) তাঁর সহীহ বুখারীতে তাকদীরের প্রতি বিশ্বাস রাখা আবশ্যক হওয়ার প্রমাণ এবং যারা তাকদীরকে অস্বীকার করে তাদের প্রতিবাদস্বরূপ অনেক হাদীস কিতাবুল ঈমানে নিয়ে এসেছেন।

এখানে তাকদীরের সাথে সম্পৃক্ত কয়েকটি সহীহ হাদীস তুলে ধরা হলো :

‘আমর ইবনু শু‘আইব তিনি তার পিতা থেকে তিনি তার দাদা থেকে বর্ণনা করে বলেন : এ আয়াতটি কেবলমাত্র “আহলে কদর” তথা তাকদীরে বিশ্বাসীদের ব্যাপারেই নাযিল হয়েছে। (মায্মাউজ জাওয়ায়েদ ৭/১১৭ পৃঃ, হাসান)

হাদীসে জিবরীলে এসেছে, জিবরীল (আঃ) নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে প্রশ্ন করলেন : ঈমান কি? জবাবে নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন :

তুমি ঈমান আনবে আল্লাহর প্রতি, তাঁর ফেরেশতাদের প্রতি, তাঁর কিতাবের প্রতি, তাঁর রাসূলগণের প্রতি ও শেষ দিবসের প্রতি এবং তুমি ঈমান আনবে তাকদীরের ভালমন্দের প্রতি। (সহীহ মুসলিম হা. ৮)

বিশিষ্ট তাবেয়ী নাফি‘ (রহঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন : ইবনু ‘উমারের সিরিয়াবাসী একজন বন্ধু ছিল, যার সাথে পত্র আদান প্রদান চলত। ইবনু ‘উমার (রাঃ) একদা তার কাছে পত্র লিখলেন যে, আমার কাছে সংবাদ এসেছে যে, তুমি নাকি তাকদীর সম্পর্কে সমালোচনা করো। অতএব আমার কাছে পত্র লিখতে তোমাকে সাবধান করছি। কেননা আমি আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলতে শুনেছি- অচিরেই আমার উম্মাতের মধ্যে তাকদীর অস্বীকারকারী সম্প্রদায়ের আবির্ভাব ঘটবে। (আহমাদ ২/৯০)

হাদীসটি সহীহ মুসলিমের শর্তানুপাতে সহীহ, কিন্তু তিনি এটি নিয়ে আসেননি। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : কোন ব্যক্তি চারটি বিষয়ের প্রতি ঈমান না আনা পর্যন্ত ঈমানদার হতে পারবে না।

(১) সাক্ষ্য দেবে আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া সত্যিকার কোন মা‘বূদ নেই এবং আমি আল্লাহ তা‘আলার রাসূল। সত্যসহ আমাকে প্রেরণ করেছেন।
(২) মৃত্যুর প্রতি ঈমান আনবে।
(৩) পুনরুত্থানের প্রতি ঈমান আনবে।
(৪) তাকদীরের ভালমন্দের প্রতি ঈমান আনবে। (তিরমিযী হা. ২১৪৫, ইবনু মাযাহ হা. ৮১, সহীহ)
আব্দুল্লাহ বিন আমর (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন :

كَتَبَ اللّٰهُ مَقَادِيرَ الْخَلَائِقِ قَبْلَ أَنْ يَخْلُقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ بِخَمْسِينَ أَلْفَ سَنَةٍ، قَالَ : وَعَرْشُهُ عَلَي الْمَاءِ

আকাশ-জমিন সৃষ্টি করার ৫০ হাজার বছর পূর্বে আল্লাহ তা‘আলা মাখলুকের তাকদীর লিখে রেখেছেন। (সহীহ মুসলিম হা. ২৬৫৩) এ ছাড়া আরো অনেক সহীহ হাদীস প্রমাণ করে- কখনো একজন ব্যক্তি তাকদীরের প্রতি ঈমান আনা ছাড়া মু‘মিন হতে পারবে না। আহলুস্ সুন্নাহ ওয়ালা জামা‘আহ এসকল আয়াত ও হাদীসের আলোকে বিশ্বাস করেন যে, সবকিছুর তাকদীর পূর্ব নির্ধারিত। আর এ আয়াতগুলো সে সকল বাতিল ফিরকার ভ্রান্ত মতবাদকে প্রতিবাদ করছে যারা তাকদীরে বিশ্বাসী নয়, যাদেরকে কাদরিয়া বলা হয়। এ ফির্কার আবির্ভাব হয়েছিল সাহাবীদের শেষ যুগে। (ইবনু কাসীর)

(وَمَآ أَمْرُنَآ إِلَّا وَاحِدَةٌ)

‘আমার আদেশ তো একটি কথায় নিষ্পন্ন’ এটা আল্লাহর ইচ্ছার ক্ষমতা ও বাস্তবায়নের সংবাদ। আল্লাহ তা‘আলা যখন কিছু করার ইচ্ছা করেন তখন শুধু একবার নির্দেশ দেন, দ্বিতীয়বার নির্দেশের কোন প্রয়োজন নেই। আল্লাহ তা‘আলা শুধু বলেন “হও” সাথে সাথে হয়ে যায়। (সূরা নাহাল ১৬ : ৪০) কোন কবি কত সুন্দরই না বলেছেন :

إِذَا مَا أَرَادَ اللَّهُ أَمْراً فَإِنَّمَا * يَقُولُ لَهُ : كن – قولة – فيكون

যখন আল্লাহ তা‘আলা কোন কিছু করার ইচ্ছা করেন তখন শুধু বলেন হও তখন হয়ে যায় (ইবনু কাসীর)।

أَشْيَاعَكُمْ অর্থাৎ তোমাদের মত পূর্ববর্তী জাতির কাফির সম্প্রদায়কে ধ্বংস করেছি। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(وَحِيْلَ بَيْنَهُمْ وَبَيْنَ مَا يَشْتَهُوْنَ كَمَا فُعِلَ بِأَشْيَاعِهِمْ مِّنْ قَبْلُ ط إِنَّهُمْ كَانُوْا فِيْ شَكٍّ مُّرِيْبٍ)

“তাদের কাক্সিক্ষত জিনিসের মধ্যে প্রতিবন্ধক সৃষ্টি করা হয়েছে, যেমন আগে করা হয়েছিল তাদের স্বধর্মীদের সাথেও। তারা ছিল সন্দেহের মধ্যে উদ্বেগজনক অবস্থায় নিপতিত।” (সূরা সাবা ৩৪ : ৫৪)

(فَعَلُوْهُ فِي الزُّبُرِ)

অর্থাৎ ছোট-বড় যা কিছু করে সবকিছু লাওহে মাহফূজে লিপিবদ্ধ রয়েছে। এ জন্য রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আয়িশাহ (রাঃ)-কে বলতেন, হে আয়িশাহ! ছোট গুনাহ করা তুচ্ছ মনে করা থেকে বিরত থাক। কেননা আল্লাহ তা‘আলা এরও হিসাব নেবেন। (সিলসিলাহ সহীহাহ হা. ৫১৩)

(مَقْعَدِ صِدْقٍ)

অর্থাৎ সম্মানের আসনে।

(مَلِيْكٍ مُّقْتَدِرٍ)

অর্থাৎ মহান বাদশা যিনি সকল কিছুর স্রষ্টা ও পরিমেয়ক।

রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : ইনসাফকারী সৎ লোকেরা আল্লাহ তা‘আলার নিকট আলোর মিম্বরের ওপর রহমানের ডান দিকে থাকবে। আল্লাহ তা‘আলার উভয় হাতই ডান। ইনসাফকারী সৎ লোক তারাই যারা তাদের বিচার ফায়সালায়, পরিবার-পরিজনে এবং যা কিছুর দায়িত্বশীল হয়েছে সবকিছুর ক্ষেত্রে ন্যায় বিচার করেছে। (সহীহ মুসলিম হা. ১৮২৭)

সুতরাং আমরা যেন ছোট গুনাহ করলে কী হবে? এরূপ তুচ্ছ মনে করে তা বার বার না করি। কারণ ছোট ছোট গুনাহ একটি বড় গুনায় পরিণত হবে এবং তা আল্লাহ তা‘আলা তলব করবেন। তাই সকল গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা উচিত।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. তাকদীরের প্রতি বিশ্বাস রাখা ঈমানের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।
২. তাকদীর অস্বীকারকারীদের সাথে একজন প্রকৃত মুসলিমের সম্পর্ক থাকতে পারে না।
৩. আল্লাহ তা‘আলার দুটি হাত রয়েছে এবং তা উভয়টি ডান হাত।

১৭-৫৫ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
৪) তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন:-
# কেউ কেউ يَسَّرْنَا الْقُرْآنَ কথাটির ভুল অর্থ গ্রহণ করেছে। অর্থাৎ কুরআন একখানা সহজ গ্রন্থ। এ গ্রন্থ বুঝার জন্য কোন জ্ঞানের প্রয়োজন নেই। এমনকি আরবী ভাষা সম্পর্কে জ্ঞান লাভ ছাড়াই যে কোন ব্যক্তি ইচ্ছা করলে এর তাফসীর করতে পারে এবং হাদীস ও ফিকাহ্‌র সাহায্য ছাড়াই কুরআনের আয়াত থেকে যে কোন আইন ও বিধান উদ্ভাবন করতে পারে। অথচ পূর্বাপর যে প্রসঙ্গে একথাটি বলা হয়েছে সে দিকে লক্ষ্য রেখে বিবেচনা করলে বুঝা যায়, একথাটির উদ্দেশ্য মানুষকে এ বিষয়টি উপলব্ধি করানো যে, উপদেশ ও শিক্ষা গ্রহণের একটি উৎস হচ্ছে বিদ্রোহী জাতিসমূহের ওপর নাযিল হওয়া দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এবং আরেকটি উৎস হলো এ কুরআন যা যুক্তি প্রমাণ ও ওয়াজ নসীহতের মাধ্যমে তোমাদেরকে সরল সহজ পথ দেখিয়ে দিচ্ছে। প্রথমোক্ত উৎসের তুলনায় নসীহতের এ উৎস অধিক সহজ। এতদত্ত্বেও কেন তোমরা এ থেকে কল্যাণ লাভ করছো না এবং আযাব দেখার জন্যই গোঁ ধরে আছ? এটা সম্পূর্ণরূপে আল্লাহ‌র মেহেরবানী যে, তিনি তাঁর নবীর মাধ্যমে এ কিতাব পাঠিয়ে তোমাদের সাবধান করে দিচ্ছেন যে তোমরা যে পথে চলছো তা চূড়ান্ত ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়। তাছাড়া তোমাদের কল্যাণ কোন পথে তাও বলে দেয়া হয়েছে। নসীহতের এ পন্থা অবলম্বন করা হয়েছে এজন্য যাতে ধ্বংসের গহবরে পতিত হওয়ার আগেই তোমাদেরকে তা থেকে রক্ষা করা যায়। সহজভাবে বুঝানোর পরও যে ব্যক্তি মানে না এবং গর্তের মধ্যে পতিত হওয়ার পরই কেবল স্বীকার করে যে, এটি সত্যিই গর্ত তার চেয়ে নির্বোধ আর কে আছে?
# এমন একটি দিন যার দুর্যোগ একাধারে কয়েকদিন ধরে চলেছিল। সূরা حام السجده এর ১৬ আয়াতে فِي أَيَّامٍ نَحِسَاتٍ কথাটি ব্যবহৃত হয়েছে এবং সূরা الحاقة আল হাক্কার ৭ আয়াতে বলা হয়েছে যে, এ ঝাঞ্চা বাত্যা একাধারে সাত রাত ও আট দিন পর্যন্ত চলেছিল। সাধারণভাবে প্রসিদ্ধ কথা হলো, এ আযাব যেদিন শুরু হয়েছিল সেদিন ছিল বুধবার। এ কারণে মানুষের মধ্যে এ ধারণা ছড়িয়ে পড়েছে যে, বুধবার দিনটি হচ্ছে অশুভ। তাই এ দিনে কোন কাজ শুরু করা উচিত নয়। এ বিষয়ে কিছু যয়ীফ হাদীসও উদ্ধৃত করা হয়েছে যার কারণে এ দিনটির অশুভ হওয়ার বিশ্বাস সাধারণের মন-মগজে বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছে। উদাহরণ হিসেবে ইবনে মারদুইয়া ও খতীব বাগদাদীর বর্ণিত এ হাদীসটিও আছে যে, اخر اربعاء فى الشعر يوم نحس مستمر (মাসের শেষ বুধবার অশুভ, যার অশুভ প্রভাব একাধারে চলতে থাকে।) ইবনে জাওযী একে ‘মাওযু’ অর্থাৎ জাল ও মনগড়া হাদীস বলেছেন। ইবনে রজব বলেছেন, এ হাদীস সহীহ নয়। হাফেজ সাখাবী বলেনঃ এ হাদীস যতগুলো সূত্রে বর্ণিত হয়েছে তা সবই একেবারে ভিত্তিহীন। অনুরূপভাবে তাবারানী বর্ণিত এই হাদীস يوم الاربعاء يوم نحس مستمر (বুধবার দিনটি অশুভ দিন যার অকল্যাণ ক্রমাগত চলতে থাকে)। আরো কিছু সংখ্যক হাদীসে এ কথাও বর্ণিত হয়েছে যে, বুধবার দিন যেন ভ্রমণ না করা হয়, লেনদেন না করা হয়। নখ না কাটানো হয় এবং রোগীর সেবা না করা হয়। কুষ্ঠ ও শ্বেত রোগ এ দিনেই শুরু হয়। কিন্তু এসব হাদীসের সব কটিই যয়ীফ। এর ওপরে কোন আকিদা-বিশ্বাসের ভিত্তি স্থাপন করা যায় না। বিশেষজ্ঞ মুনাভী বলেনঃ

توقى الاربعاء على جهة الطيرة وظن اعتقاد المنجمين حرام شديد التحريم , اذ الايام كلها لله تعالى , لاتنفع ولا تضر بذاتها –

“অশুভ লক্ষণসূচক মনে করে বুধবারের দিনকে পরিত্যাগ করা এবং এক্ষেত্রে জ্যোতিষদের ন্যায় বিশ্বাস পোষণ করা কঠোরভাবে হারাম। কেননা, সব দিনই আল্লাহ‌র। কোন দিনই দিন হিসেবে কল্যাণ বা অকল্যাণ কিছুই সাধন করতে পারে না।”

আল্লামা আলুসী বলেনঃ “সবদিন সমান। বুধবারের বিশেষ কোন বৈশিষ্ট্য নেই। রাত ও দিনের মধ্যে এমন কোন মুহূর্ত নেই যা কারো জন্য কল্যাণকর এবং কারো জন্য অকল্যাণকর নয়। আল্লাহ‌ তা’আলা প্রতিটি মুহূর্তেই কারো জন্য অনুকূল এবং কারো জন্য প্রতিকূল অবস্থা সৃষ্টি করে থাকেন।”
# অন্য কথায় তিনটি কারণে তারা হযরত সালেহ (আঃ) এর অনুসরণ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। প্রথম কারণ, তিনি মানুষ, মানব সত্ত্বার ঊর্ধ্বে নন যে, আমরা তার শ্রেষ্ঠত্ব মেনে নেব। দ্বিতীয় কারণ, তিনি আমাদের কওমেরই একজন মানুষ। আমাদের ওপর তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের কোন কারণ নেই, তৃতীয় কারণ, তিনি একা, এক ব্যক্তি। আমাদের সাধারণ মানুষদেরই একজন। তিনি কোন নেতা নন। তাঁর সাথে কোন বড় দল বা সৈন্য সামন্ত নেই, সেবক সেবিকাও নেই। তাই আমরা তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব মেনে নিতে পারি না। তাদের মনে নবী হবে মানব সত্ত্বার ঊর্ধ্বে। আর তিনি যদি মানুষ হন তাহলে আমাদের নিজের দেশ ও জাতির মধ্যে জন্মগ্রহণ করবেন না, উপর থেকে নেমে আসবেন অথবা বাইরে থেকে পাঠানো হবে। তাও যদি না হয় তাহলে অন্তত তিনি হবেন নেতা। তাঁর অস্বাভাবিক শান-শওকত ও জাঁকজমক থাকবে। এ কারণে মানুষের পথ প্রদর্শনের জন্য আল্লাহ‌ তা’আলা তাঁকে মনোনীত করেছেন বলে মেনে নেয়া হবে। মক্কার কাফেররাও এই মূর্খতার মধ্যেই নিমজ্জিত ছিল। মুহাম্মাদ ﷺ মানুষ। সাধারণ লোকদের মতই তিনি বাজারে চলাফেরা করেন। কাল আমাদের মাঝেই তিনি জন্ম গ্রহণ করেছেন এবং আজ দাবী করেছেন যে, আল্লাহ‌ আমাকে নবী বানিয়েছেন। মক্কার কাফেররা এ যুক্তির ভিত্তিতেই তাঁর রিসালাত মানতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছিলো।

# মূল আয়াতে اَشِرٌ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে যার অর্থ আত্মগর্বী ও দাম্ভিক ব্যক্তি যার মগজে নিজের শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছে এবং এ কারণে সে গর্ব প্রকাশ করে থাকে।
# “আমি উটনীকে তাদের জন্য ফিতনা বানিয়ে পাঠাচ্ছি” এটা এ কথার ব্যাখ্যা। ফিতনাটা ছিল এই যে, হঠাৎ একটি উটনী এনে তাদের সামনে পেশ করে তাদেরকে বলে দেয়া হলো যে, একদিন এটি একা পানি পান করবে। অন্যদিন তোমরা সবাই নিজের ও তোমাদের জীবজন্তুর জন্য পানি নিতে পারবে। যেদিন উটনীর পানি পানের পালা সেদিন তোমাদের মধ্য থেকে কোন ব্যক্তি নিজেও কোন ঝর্ণা বা কূপের ধারে পানি নিতে আসবে না এবং তাদের জীবজন্তুকেও পানি পান করানোর জন্য আনবে না। এ চ্যালেঞ্জ জানানো হয়েছিল সে ব্যক্তির পক্ষ থেকে যার সম্পর্কে তারা নিজেরাই বলতো যে, তার না আছে কোন সৈন্য সামন্ত, না আছে কোন বড় দল।
# এ শব্দগুলো থেকে আপনা আপনি একটি পরিস্থিতির আভাস পাওয়া যায়। তাহলো ঐ উটনীটা অনেক দিন পর্যন্ত তাদের জনপদে দৌরাত্ম্য চালিয়েছে। তার পানি পানের নির্দিষ্ট দিনে পানির ধারে কাছে যাওয়ার সাহস কারো হতো না। অবশেষে তারা তাদের কওমের একজন দুঃসাহসী নেতাকে ডেকে বললোঃ তুমি তো অত্যন্ত সাহসী বীরপুরুষ। কথায় কথায় হাতা গুটিয়ে মারতে ও মরতে প্রস্তুত হয়ে যাও। একটু সাহস করে এ উটনীর ব্যাপারটা চুকিয়ে দাও তো। তাদের উৎসাহ দানের কারণে সে এ কাজ সমাধা করার দায়িত্ব গ্রহণ করলো এবং উটনীকে মেরে ফেললো। এর পরিষ্কার অর্থ হচ্ছে, উটনীর কারণে তারা অত্যন্ত ভীত সন্ত্রস্ত ছিল। তারা উপলব্ধি করতে পেরেছিল যে, এর পেছনে অস্বাভাবিক কোন শক্তি কাজ করছে। তাই তাকে আঘাত করতে তারা ভয় পাচ্ছিল। এ কারণে একটি উটনীকে হত্যা করা, তাদের কাছে একটি অভিযান পরিচালনার চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। অথচ উটনীটা পেশ করেছিলেন একজন নবী যার কোন সেনাবাহিনী ছিল না, যার ভয়ে তারা ভীত ছিল। (আরো বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, আল আ’রাফ, টীকা-৫৮ , আশ শূ’আরা, টীকা ১০৪ , ১০৫ )।

# যারা গবাদী পশু পালে তারা পশুর খোঁয়াড়ের সংরক্ষণ ও হিফাজতের জন্য কাঠ ও গাছের ডাল পালা দিয়ে বেড়া তৈরী করে দেয়। এ বেড়ার কাঠ ও গাছ-গাছালীর ডালপালা আস্তে আস্তে শুকিয়ে ঝড়ে পড়ে এবং পশুদের আসা যাওয়ায় পদদলিত হয়ে করাতের গুড়াঁর মত হয়ে যায়। সামূদ জাতির দলিত-মথিত লাশসমূহকে করাতের ঐ গূঁড়ার সাথে তুলনা করা হয়েছে।
# এ ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা সূরা হূদ ( আয়াত ৭৭ থেকে ৮৩ ) ও সূরা হিজরে ( আয়াত ৬১ থেকে ৭৪ ) পূর্বেই দেয়া হয়েছে। ঘটনার সার সংক্ষেপ হলো, আল্লাহ‌ তা’আলা এ জাতির ওপর আযাব পাঠানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে কয়েকজন ফেরেশতাকে অত্যন্ত সুদর্শন বালকের আকৃতিতে হযরত লূতের বাড়ীতে মেহমান হিসেবে পাঠিয়ে দিলেন। কওমের লোকজন তাঁর কাছে এত সুশ্রী মেহমান আসতে দেখে তাঁর বাড়ীতে গিয়ে চড়াও হলো এবং তাঁর কাছে দাবী করলো যে, তিনি যেন তাঁর মেহমানের সাথে কুকর্ম করার জন্য তাদের হাতে তুলে দেন। হযরত লূত এ জঘন্য আচরণ থেকে বিরত থাকার জন্য তাদের কাছে অত্যন্ত কাকুতি-মিনতি ও অনুরোধ-উপরোধ করলেন। কিন্তু তারা তা মানলো না এবং ঘরে প্রবেশ করে জোর পূর্বক মেহমানদের বের করে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলো। এ পর্যায়ে হঠাৎ তারা অন্ধ হয়ে গেল। এ সময় ফেরেশতারা হযরত লূতকে বললেন, তিনি ও তাঁর পরিবারের লোকজন ভোর হওয়ার পূর্বেই যেন এ জনপদের বাইরে চলে যান। তারা জনপদের বাইরে চলে যাওয়া মাত্র ঐ জাতির ওপর ভয়ানক আযাব নেমে আসে। বাইবেলেও ঘটনাটি এভাবেই বর্ণিত হয়েছে। বাইবেলের ভাষা হচ্ছেঃ তখন তাহারা লোটের উপরে ভারী চড়াও হইয়া কবাট ভাংগিতে গেল। তখন সেই দুই ব্যক্তি হস্ত বাড়াইয়া লোটকে গৃহের মধ্যে আপনাদের নিকটে টানিয়া লইয়া কবাট বন্ধ করিলেন; এবং গৃহদ্বারের নিকটবর্তী ক্ষুদ্র ও মহান সকল লোককে অন্ধতায় আহত করিলেন। তাহাতে তাহারা দ্বার খুঁজিতে খুঁজিতে পরিশ্রান্ত হইল। ( আদি পুস্তক ১৯: ৯-১১ )।

# কুরাইশদের সম্বোধন করা হয়েছে। এর অর্থ, তোমাদের মধ্যে এমন কি গুণ আছে এবং এমন কি মূল্যবান বৈশিষ্ট্য আছে যে, যে ধরনের কুফরী, সত্য প্রত্যাখ্যান ও হঠকারিতার আচরণের জন্য অন্যান্য জাতিসমূহকে শাস্তি দেয়া হয়েছে তোমরা সে একই নীতি ও আচরণ গ্রহণ করলেও তোমাদেরকে শাস্তি দেয়া হবে না?
# এটা একটা সুস্পষ্ট ভবিষ্যতবাণী। হিজরতের পাঁচ বছর পূর্বে এ ভবিষ্যৎবাণী করা হয়েছিল। এতে বলা হয়েছিল, কুরাঈশদের সংঘবদ্ধ শক্তি যে শক্তি নিয়ে তাদের গর্ব ছিল অচিরেই মুসলমানদের কাছে পরাজিত হবে। সে সময় কেউ কল্পনাও করতে পারতো না যে, অদূর ভবিষ্যতে কিভাবে এ বিপ্লব সাধিত হবে। সে সময় মুসলমানরা এমন অসহায় অবস্থার মধ্যে নিপতিত ছিল যে, তাদের একটি দল দেশ ছেড়ে হাবশায় আশ্রয় নিয়েছিল এবং অবশিষ্ট মুসলমান আবু তালেব গিরি গুহায় অবরুদ্ধ ছিল। কুরাইশদের বয়কট ও অবরোধ ক্ষুধায় তাদেরকে মৃতপ্রায় করে দিয়েছিল। এরূপ পরিস্থিতিতে কে কল্পনা করতে পারতো যে, মাত্র সাত বছরের মধ্যে অবস্থা পাল্টে যাবে। হযরত আবদুল্লাহ্‌ ইবনে আব্বাসের ছাত্র ইকরিমা বর্ণনা করেন যে, হযরত উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলতেন, যে সময় সূরা ক্বামারের এ আয়াত নাযিল হয় তখন আমি অস্থির হয়ে পড়েছিলাম যে, এটা কোন সংঘবদ্ধ শক্তি যা পরাজিত হবে। কিন্তু বদর যুদ্ধে যখন কাফেররা পরাজিত হয়ে পালাচ্ছিল সে সময় আমি দেখতে পেলাম রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ বর্ম পরিহিত অবস্থায় সামনের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন এবং তাঁর পবিত্র জবান থেকে উচ্চারিত হচ্ছে سَيُهْزَمُ الْجَمْعُ وَيُوَلُّونَ الدُّبُرَ তখন আমি বুঝতে পারলাম এ পরাজয়ের খবরই দেয়া হয়েছিল। (ইবনে জারীর ইবনে আবী হাতেম)।
# দুনিয়ার কোন জিনিসই উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যহীনভাবে সৃষ্টি করা হয়নি। বরং প্রত্যেক বস্তুরই একটা পরিমিতি ও অনুপাত আছে। সে অনুসারে প্রত্যেক বস্তু একটা নির্দিষ্ট সময় অস্তিত্ব লাভ করে, একটা বিশেষ রূপ ও আকৃতি গ্রহণ করে। একটা বিশেষ সীমা পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি ও ক্রমবিকাশ লাভ করে, একটি নির্দিষ্ট সময়কাল পর্যন্ত টিকে থাকে এবং একটি নির্দিষ্ট সময়ে তার পরিসমাপ্তি ঘটে। এ বিশ্বজনীন নিয়ম-নীতি অনুসারে এ দুনিয়াটারও একটা ‘তাকদীর’ বা পরিমিতি ও অনুপাত আছে। সে অনুযায়ী একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য তা চলেছে এবং একটি নির্দিষ্ট সময়েই তার পরিসমাপ্তি ঘটতে হবে। এর পরিসমাপ্তির জন্য যে সময় নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে তার এক মুহূর্ত পূর্বে এর পরিসমাপ্তি ঘটবে না কিংবা এক মুহূর্ত পারে তা অবশিষ্টও থাকবে না। এ পৃথিবী অনাদি ও চিরস্থায়ী নয় যে, চিরদিনই তা আছে এবং চিরদিন থাকবে। কিংবা কোন শিশুর খেলনাও নয় যে, যখনই তোমরা চাইবে তখনই তিনি এটাকে ধ্বংস করে দেখিয়ে দেবেন।

# কিয়ামত সংঘঠনের জন্য আমাকে কোন বড় প্রস্তুতি নিতে হবে না কিংবা তা সংঘটিত করতে কোন দীর্ঘ সময়ও ব্যয়িত হবে না। আমার পক্ষ থেকে একটি নির্দেশ জারী হওয়ার সময়টুকু মাত্র লাগবে। নির্দেশ জারী হওয়া মাত্রই চোখের পলকে তা সংঘটিত হয়ে যাবে।
# তোমরা যদি মনে করে থাকো যে, এ বিশ্ব কোন মহাজ্ঞানী ও ন্যায়বান আল্লাহ‌র কর্তৃত্বের অধীন নয়, বরং এটা মগের মুল্লুক যেখানে মানুষ যা ইচ্ছা তাই করতে পারে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করার কেউ নেই,-তাহলে তোমাদের চোখ খুলে দেয়ার জন্য মানব ইতিহাসেই বিদ্যমান। এখানে এ নীতি অনুসারী জাতিসমূহকে একের পর এক ধ্বংস করা হয়েছে।

# এ লোকেরা যেন একথা ভেবে বিভ্রান্ত না হয় যে, তাদের সম্পাদিত কাজ-কর্ম বুঝি কোথাও উধাও হয়ে গিয়েছে। না, প্রত্যেক ব্যক্তি, প্রত্যেক গোষ্ঠী এবং প্রত্যেক জাতির গোটা রেকর্ডই সংরক্ষিত আছে। যথা সময়ে তা সামনে এসে হাজির হবে।

Leave a Reply