Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১১৪৬)
[** আর-রাহমান, আল্লাহ কুরআন শিক্ষা দিয়েছেন:-
*‘তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছে,:-
*কথা বলার ক্ষমতা দিয়েছেন :-
*শক্তিশালী ও অপরিবর্তনীয় শৃংখলার বাঁধনে আবদ্ধ:-
*আকাশের তারকা ও পৃথিবীর বৃক্ষরাজি সবই আল্লাহর নির্দেশের অনুগত:-
*দাড়িপাল্লা কায়েম করেছেন:-
*তোমাদেরকেও সুবিচার ও ইনসাফের ওপর প্রতিষ্ঠিত হতে হবে:-
*জ্বীন ও মানব জাতি, তোমরা তোমাদের রবের কোন কোন নিয়ামতকে অস্বীকার করবে?:-]
www.motaher21.net
সূরা:৫৫:আর-রহমান।
পারা:২৭
১-১৩ নং আয়াত:-
আয়াতের ব্যাখ্যা:-
১) তফসীরে তাফহীমুল কুরআন:-
২) তাফসীরে ইবনে কাছীর:-
৩) তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:-
৪) তাফসীরে ফী জিলালিল কুরআন:-
সূরা:৫৫:আর-রহমান-১
اَلرَّحۡمٰنُ ۙ﴿۱﴾
আর-রাহমান।
সূরা:৫৫:আর-রহমান-২
عَلَّمَ الۡقُرۡاٰنَ ؕ﴿۲﴾
তিনিই শিক্ষা দিয়েছেন কুরআন।
সূরা:৫৫:আর-রহমান-৩
خَلَقَ الۡاِنۡسَانَ ۙ﴿۳﴾
তিনিই সৃষ্টি করেছেন মানুষ।
সূরা:৫৫:আর-রহমান-৪
عَلَّمَہُ الۡبَیَانَ ﴿۴﴾
তিনিই তাকে শিখিয়েছেন ভাব প্রকাশ করতে।
সূরা:৫৫:আর-রহমান-৫
اَلشَّمۡسُ وَ الۡقَمَرُ بِحُسۡبَانٍ ﴿۪۵﴾
সূর্য ও চন্দ্র একটি হিসেবের অনুসরণ করছে।
সূরা:৫৫:আর-রহমান-৬
وَّ النَّجۡمُ وَ الشَّجَرُ یَسۡجُدٰنِ ﴿۶﴾
এবং তারকারাজি৫ ও গাছপালা সব সিজদাবনত।
সূরা:৫৫:আর-রহমান-৭
وَ السَّمَآءَ رَفَعَہَا وَ وَضَعَ الۡمِیۡزَانَ ۙ﴿۷﴾
আর আসমান, তিনি তাকে করেছেন সমুন্নত এবং স্থাপন করেছেন দাঁড়িপাল্লা,
সূরা:৫৫:আর-রহমান-৮
اَلَّا تَطۡغَوۡا فِی الۡمِیۡزَانِ ﴿۸﴾
যাতে তোমরা সীমালজান না কর দাঁড়িপাল্লায়।
সূরা:৫৫:আর-রহমান-৯
وَ اَقِیۡمُوا الۡوَزۡنَ بِالۡقِسۡطِ وَ لَا تُخۡسِرُوا الۡمِیۡزَانَ ﴿۹﴾
ইনসাফের সাথে সঠিকভাবে ওজন করো এবং ওজনে কম দিও না।
সূরা:৫৫:আর-রহমান-১০
وَ الۡاَرۡضَ وَضَعَہَا لِلۡاَنَامِ ﴿ۙ۱۰﴾
তিনি পৃথিবীকে স্থাপন করেছেন সৃষ্টজীবের জন্য।
সূরা:৫৫:আর-রহমান-১১
فِیۡہَا فَاکِہَۃٌ ۪ۙ وَّ النَّخۡلُ ذَاتُ الۡاَکۡمَامِ ﴿ۖ۱۱﴾
এখানে সব ধরনের সুস্বাদু ফল প্রচুর পরিমাণে আছে। খেজুর গাছ আছে যার ফল পাতলা আবরণে ঢাকা।
সূরা:৫৫:আর-রহমান-১২
وَ الۡحَبُّ ذُو الۡعَصۡفِ وَ الرَّیۡحَانُ ﴿ۚ۱۲﴾
এবং খোসাবিশিষ্ট শস্যদানা ও সুগন্ধ ফুল।
সূরা:৫৫:আর-রহমান-১৩
فَبِاَیِّ اٰلَآءِ رَبِّکُمَا تُکَذِّبٰنِ ﴿۱۳﴾
অতএব, হে জ্বীন ও মানব জাতি, তোমরা তোমাদের রবের কোন কোন নিয়ামতকে অস্বীকার করবে?
১-১৩ নং আয়াত:-
আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন:-
(৫৫-আররহমান) : নামকরণ:
প্রথম শব্দটিকেই এ সূরার নাম হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। এভাবে বুঝানো হয়েছে যে, এটি সেই সূরা যা “আর-রাহমান” শব্দ দিয়ে শুরু হয়েছে। তাছাড়া সূরার বিষয়বস্তুর সাথেও এ নামের গভীর মিল রয়েছে। কারণ এ সূরার মধ্যে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত আল্লাহ তা’আলার রহমতের পরিচায়ক গুণাবলী ও তার বাস্তব ফলাফলের উল্লেখ করা হয়েছে।
(৫৫-আররহমান) : নাযিল হওয়ার সময়-কাল :
তাফসীর বিশারদগণ সাধারণত: এ সূরাটিকে মক্কী সূরা বলে আখ্যায়িত করেন। যদিও হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস, ইকরিমা ও কাতাদা থেকে কোন কোন হাদীসে একথা উদ্ধৃত হয়েছে যে, এ সূরা মদীনায় অবতীর্ণ তা সত্ত্বেও প্রথমত ঐ সব সম্মানিত সাহাবা থেকে আরো কিছু সংখ্যক হাদীসে বিপরীত বক্তব্যও উদ্ধৃত হয়েছে। দ্বিতীয়ত, এ সূরার বিষয়বস্তু মদীনায় অবতীর্ণ সূরাসমূহের তুলনায় মক্কায় অবতীর্ণ সূরাসমূহের সাথে বেশী সামঞ্জস্যপূর্ণ। এমন কি বিষয়বস্তুর বিচারে এটি মক্কী যুগেরও একেবারে প্রথম দিকের বলে মনে হয়। তাছাড়া বেশ কিছু নির্ভরযোগ্য হাদীস থেকে একথা প্রমাণিত হয় যে, এটি হিজরতের কয়েক বছর পূর্বে মক্কাতে নাযিল হয়েছিল। মুসনাদে আহমদে হযরত আসমা বিনতে আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বর্ণনা করেছেন: কা’বা ঘরের যে কোণে হাজরে আসওয়াদ স্থাপিত আমি হারাম শরীফের মধ্যে সে কোণের দিকে মুখ করে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নামায পড়তে দেখেছি। তখনও পর্যন্ত আল্লাহর নির্দেশ فَاصْدَعْ بِمَا تُؤْمَرُ (তোমাকে যে নির্দেশ দেয়া হচ্ছে তা প্রকাশ্যে বলে দাও) নাযিল হয়নি। সে নামাযে মুশরিকরা তাঁর মুখ থেকে فَبِأَيِّ آلَاءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبَانِ কথাটি শুনেছিল। এ থেকে জানা যায় যে, এ সূরাটি সূরা আল হিজরের পূর্বেই নাযিল হয়েছিল।
আল বাযযার, ইবনে জারীর, ইবনুল মুনযির, দারুকুতনী (ফীল আফরাদ, , ইবনে মারদুইয়া এবং আল খাতীব (ফিত তারীখ) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর থেকে এ হাদীসটি উদ্ধৃত করেছেন যে, একবার রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে সূরা আর রহমান তিলাওয়াত করলেন অথবা এ সূরাটি তাঁর সামনে পাঠ করা হলো। পরে তিনি লোকদের বললেন: জিনরা তাদের রবকে যে জওয়াব দিয়েছিল তোমাদের নিকট থেকে সে রকম সুন্দর জওয়াব শুনছি না কেন? লোকেরা বললো, সে জওয়াব কি ছিল! নবী (সা.) বললেন: যখনই আমি আল্লাহর বাণী فَبِأَيِّ آلَاءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبَانِ পড়ছিলাম, জিনরা তার জবাবে বলেছিল لَابِشَئٍ مِّنْ نِعْمَةِ رَبِّنَا نُكَذِّبُ “আমরা আমাদের রবের কোন নিয়ামতকেই অস্বীকার করি না।”
তিরমিযী, হাকেম ও হাফেজ আবু বকর বায্যার হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ থেকে প্রায় অনুরূপ বিষয়বস্তু সম্বলিত হাদীস বর্ণনা করেছেন। তাঁদের বর্ণনার ভাষা হচ্ছে: সূরা রাহমানের তিলাওয়াত শুনে লোকজন যখন চুপ করে থাকলো তখন নবী (সা.) বললেন:
لَقَدْ قَرَأْتُهَا عَلَى الْجِنِّ لَيْلَةَ الْجِنِّ فَكَانُوا أَحْسَنَ مَرْدُودًا مِنْكُمْ كُنْتُ كُلَّمَا أَتَيْتُ عَلَى قَوْلِهِ فَبِأَىِّ آلاَءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبَانِ قَالُوا لاَ بِشَىْءٍ مِنْ نِعَمِكَ رَبَّنَا نُكَذِّبُ فَلَكَ الْحَمْدُ-
।। । “যে রাতে কুরআন শোনার জন্য জিনরা একত্রিত হয়েছিল, সে রাতে আমি জিনদের এ সূরা শুনিয়েছিলাম। তারা তোমাদের চেয়ে এর উত্তম জওয়াব দিচ্ছিল। যখনই আমি আল্লাহ তা’আলার এ বাণী শুনাচ্ছিলাম হে জিন ও মানুষ তোমরা তোমাদের রবের কোন কোন নিয়ামতকে অস্বীকার করবে” তখনই তারা জওয়াবে বলেছিল: হে আমাদের বর, আমরা তোমার কোন নিয়ামতকেই অস্বীকার করি না। সব প্রশংসা কেবল তোমারই।” এ হাদীস থেকে জানা যায়, সূরা আহকাফে (২৯ থেকে ৩২ আয়াত) রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুখ থেকে জিনদের কুরআন শোনার যে ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে সেই সময় নবী (সা.) নামাযে সূরা আর রাহমান পাঠ করেছিলেন। এটা নবুয়াতের ১০ম বছরের ঘটনা। সে সময় নবী (সা.) তায়েফ সফর থেকে ফেরার পথে “নাখলা” নামক স্থানে কিছু সময় অবস্থান করেছিলেন। যদিও অপর কিছু সংখ্যক হাদীসে বর্ণনা করা হয়েছে যে, সে সময় রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জানা ছিল না যে, জিনেরা তাঁর নিকট থেকে কুরআন শরীফ শুনছে। বরং পরে আল্লাহ তা’আলা তাঁকে এ কথা অবহিত করেছিলেন যে, জিনেরা তাঁর কুরআন তিলাওয়াত শুনেছিলো কিন্তু আল্লাহ তা’আলা নবীকে (সা.) যেভাবে জিনদের কুরআন তিলাওয়াত শোনা সম্পর্কে অবহিত করেছিলেন অনুরূপভাবে তাঁকে একথাও জানিয়েছিলেন যে, কুরআন তিলাওয়াত শোনার সময় তারা কি জওয়াব দিচ্ছিল। এরূপ হওয়াটা অযৌক্তিক ব্যাপার নয়।
এসব বর্ণনা থেকে শুধু এতটুকুই জানা যায় যে, সূরা আর রহমান, সূরা আল হিজর ও সূরা আহকাফের পূর্বে নাযিল হয়েছিল। এসব ছাড়া আমরা আরো একটি হাদীস দেখতে পাই যা থেকে জানা যায়, সূরা আর রহমান মক্কী যুগের প্রথম দিকে অবতীর্ণ সূরা সমূহের একটি। ইবনে ইসহাক হযরত ‘উরওয়া ইবনে যুবায়ের থেকে এই মর্মে একটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন যে, সাহাবা কিরাম একদিন পরস্পর আলোচনা করলেন কুরাইশরা তো প্রকাশ্যে কখনো কাউকে উচ্চস্বরে কুরআন তিলাওয়াত করতে শুনেনি। আমাদের মধ্যে এমন কে আছে যে একবার অন্তত তাদেরকে এ পবিত্র বাণী শোনাতে পারে? হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ বললেন: আমি এ কাজ করবো। সাহাবা কিরাম বললেন: তারা তোমার ওপর জুলুম করবে বলে আমাদের আশংকা হয়। আমাদের মতে, একাজ এমন কোন ব্যক্তির করা উচিত যার জ্ঞাতী-গোষ্ঠী শক্তিশালী। কুরাইশদের যদি তার অনিষ্ট করার উদ্দেশ্যে হাত বাড়ায় তাহলে তার গোষ্ঠীর লোকেরা যেন তার সাহায্যে এগিয়ে আসে। হযরত আবদুল্লাহ বললেন, আমাকেই একাজ করতে দাও আল্লাহ আমার হিফাজতকারী। পরে বেশ কিছু বেলা হলে তিনি হারাম শরীফে গিয়ে উপস্থিত হলেন। কুরাইশ নেতারা সেই সময় নিজ নিজ মজলিসে বসেছিল। হযরত আবদুল্লাহ মাকামে ইবরাহীমে পৌঁছে উচ্চস্বরে সূরা আর রহমান তিলাওয়াত করতে শুরু করলেন। আবদুল্লাহ কি বলেছে কুরাইশরা প্রথমে তা বুঝার চেষ্টা করলো। পরে যখন তারা বুঝতে পারলো মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর বাণী হিসেবে যেসব কথা পেশ করেন এটা সে কথা তখন তারা তার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়লো এবং তার মুখের ওপর চপেটাঘাত করতে লাগলো। কিন্তু হযরত আবদুল্লাহ কোন পরোয়াই করলেন না। যতক্ষণ তাঁর সাধ্যে কুলালো ততক্ষণ তিনি তাদের কুরআন শুনিয়ে যেতে থাকলেন। পরিশেষে তিনি তাঁর ফুলে উঠা মুখ নিয়ে ফিরে আসলো সংগী-সাথীরা বললো: আমরা এ আংশকাই করেছিলাম। জবাবে তিনি বললেন: আল্লাহর দুশমনরা আমার কাছে আজকের চেয়ে অধিক গুরুত্বহীন আর কখনো ছিল না। তোমরা চাইলে আমি আগামীকাল আবার তাদেরকে কুরআন শোনাবো। সবাই বললো এ-ই যথেষ্ট হয়েছে। যা তারা আদৌ শুনতে চাইতো না তা তো তুমি শুনিয়ে দিয়েছো (সীরাতে ইবনে হিশাম, প্রথম খন্ড, পৃষ্ঠা-৩৩৬, ।
(৫৫-আররহমান) : বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্য:
এটাই কুরআন মজীদের একমাত্র সূরা যার মধ্যে মানুষের সাথে পৃথিবীর অপর একটি স্বাধীন সৃষ্টি জিনদেরকেও সরাসরি সম্বোধন করা হয়েছে এবং উভয়কেই আল্লাহর কুদরতের পরিপূর্ণতা, তাঁর সীমা-সংখ্যাহীন দয়া ও অনুগ্রহ, তাঁর সামনে তাদের অক্ষমতা ও অসহায়ত্ব এবং তাঁর কাছে তাদের জবাবদিহির উপলব্ধী জাগ্রত করে তাঁর অবাধ্যতার অশুভ পরিণতি সম্পর্কে সাবধান করে দেয়া হয়েছে আর আনুগত্যের উত্তম ফলাফল সম্পর্কে অবহিত করা হয়েছে। যদিও পবিত্র কুরআনের কয়েকটি স্থানে এ বিষয়ে পরিষ্কার বক্তব্য রয়েছে যা থেকে স্পষ্ট জানা যায় যে, জিনরা ও মানুষের মত স্বাধীন ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব সম্পন্ন দায়িত্বশীল সৃষ্টি, যাদেরকে কুফরী ও ঈমান গ্রহণের এবং আনুগত্য করার ও অবাধ্য হওয়ার স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। তাদের মধ্যেও মানুষের মতই কাফের ও ঈমানদার এবং অনুগত ও অবাধ্য আছে। তাদের মধ্যেও এমন গোষ্ঠী আছে যারা নবী-রসূল আলাইহিমুস সালাম ও আসমানী কিতাবসমূহের ওপর ঈমান এনেছে। তবে এ সূরা অকাট্যভাবে প্রমাণ করে যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও কুরআন মজীদের দাওয়াত জিন ও মানুষ উভয়ের জন্য এবং নবীর (সা.) রিসালাত শুধু মানবজাতি পর্যন্ত সীমাবদ্ধ নয়।
এ সূরার শুরুতে মানুষকে লক্ষ্য করেই সম্বোধন করা হয়েছে। কারণ তারাই পৃথিবীর খিলাফত লাভ করেছে, তাদের মধ্যেই আল্লাহর রসূল এসেছেন। এবং তাদের ভাষাতেই আল্লাহর কিতাব নাযিল করা হয়েছে। কিন্তু পরে ১৩ আয়াত থেকে মানুষ ও জিন উভয়কেই সমানভাবে সম্বোধন করা হয়েছে এবং উভয়ের সামনে একই দাওয়াত পেশ করা হয়েছে।
সূরার বিষয়বস্তু ছোট ছোট বাক্যে একটি বিশেষ ক্রমানুসারে বর্ণিত হয়েছে:
১ থেকে ৪ পর্যন্ত আয়াতে বলা হয়েছে, এ কুরআন শিক্ষা আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে এসেছে। এ শিক্ষার সাহায্যে তিনি মানব জাতির হিদায়াতের ব্যবস্থা করবেন এই তাঁর রহমতের স্বাভাবিক দাবী। কারণ বুদ্ধি বিবেচনা ও বোধশক্তি সম্পন্ন জীব হিসেবে তিনিই মানুষকে সৃষ্টি করেছেন।
৫ থেকে ৬ আয়াতে বলা হয়েছে, গোটা-বিশ্ব জাহানের ব্যবস্থাপনা আল্লাহ তা’আলার একক নির্দেশ ও কর্তৃত্বাধীনে চলেছে। আসমান ও যমীনের সব কিছুই তার কর্তৃত্বাধীন। এখানে দ্বিতীয় আর কারো কর্তৃত্ব চলছে না।
৭ থেকে ৯ আয়াতে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সত্য বর্ণনা করা হয়েছে তা হচ্ছে, আল্লাহ তা’আলা বিশ্ব-জাহানের গোটা ব্যবস্থাকে পূর্ণ ভারসাম্য ও সামঞ্জস্যসহ ইনসাফের ওপর প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এ ব্যবস্থাপনার প্রকৃতি দাবি করে যে, এখানে অবস্থানকারীরাও তাদের ক্ষমতা ও স্বাধীনতার সীমার মধ্যে সত্যিকার ভারসাম্য ও ইনসাফের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকুক এবং ভারসাম্য বিনষ্ট না করুক।
১০ থেকে ২৫ আয়াত পর্যন্ত আল্লাহ তা’আলার অসীম ক্ষমতার বিস্ময়কর দিক ও তার পূর্ণতা বর্ণনা করার সাথে সাথে জিন ও মানুষ তাঁর যেসব নিয়ামত ভোগ করছে সে দিকেও ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে।
২৬ থেকে ৩০ পর্যন্ত আয়াতে জিন ও মানব জাতিকে এ মহাসত্য স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে যে, এই বিশ্ব-জাহানে একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কেউ-ই অবিনশ্বর ও চিরস্থায়ী নয় এবং ছোট বড় কেউ-ই এমন নেই যে তার অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়োজনে আল্লাহর মুখাপেক্ষী নয়। যমীন থেকে আসমান পর্যন্ত রাতদিন যা কিছু ঘটছে তা তাঁরই কর্তৃত্ব সংঘটিত হচ্ছে।
৩১ থেকে ৩৬ পর্যন্ত আয়াতে এ উভয় গোষ্ঠীকেই এই বলে সাবধান করে দেয়া হয়েছে যে, সে সময় অচিরেই আসবে যখন তোমাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। এ জিজ্ঞাসাবাদের হাত থেকে রক্ষা পেয়ে তোমরা কোথাও যেতে পারবে না। সবখানে আল্লাহর কর্তৃত্ব তোমাদের পরিবেষ্টন করে আছে। তার মধ্য থেকে বেরিয়ে সটকে পড়ার সাধ্য তোমাদের নেই। তাঁর কর্তৃত্বের গণ্ডি থেকে পালিয়ে যেতে পারবে বলে যদি তোমাদের মধ্যে অহমিকা সৃষ্টি হয়ে থাকে তাহলে একবার পালিয়ে দেখ।
৩৭ ও ৩৮ আয়াতে বলা হয়েছে যে, এ জিজ্ঞাসাবাদ হবে কিয়ামতের দিন।
যেসব মানুষ ও জিন দুনিয়ায় আল্লাহ তা’আলার নাফরমানী করতো ৩৯ থেকে ৪৫ পর্যন্ত আয়াতে তাদের পরিণাম সম্পর্কে বলা হয়েছে।
যেসব সৎকর্মশীল মানুষ ও জিন পৃথীবিতে আল্লাহকে ভয় করে জীবন যাপন করেছে এবং একদিন আল্লাহর সামনে হাজির হয়ে নিজের সব কাজের হিসেব দিতে হবে এ উপলব্ধি নিয়ে কাজ করেছে আখেরাতে আল্লাহ তা’আলা তাদেরকে যেসব পুরস্কার দিবেন, ৪৬ আয়াত থেকে সূরা শেষ পর্যন্ত সে সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা দেয়া হয়েছে।
এ বক্তব্যের পুরোটাই বক্তৃতার ভাষায় পেশ করা হয়েছে। এটা একটা আবেগময় ও উচ্চমানের ভাষণ। এ ভাষণের মধ্যে আল্লাহ তা’আলার অসীম শক্তির এক একটি বিস্মরয়কর দিক, তাঁর দেয়া নিয়ামতসমূহের এক একটি নিয়ামত, তাঁর সার্বভৌম ক্ষমতা ও পরাক্রমের এক একটি দিক এবং তার পুরস্কার ও শাস্তির ব্যাপক বিস্তৃত ক্ষেত্রসমূহের এক একটি জিনিস বর্ণনা করে জিন ও মানুষকে বার বার প্রশ্ন করা হয়েছে فَبِأَيِّ آلَاءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبَانِ । الاء যে একটি ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ তা আমরা পরে আলোচনা করবো। এ ভাষানের মধ্যে এ শব্দটিকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত করা হয়েছে। জিন ও মানুষের উদ্দেশ্যে এ প্রশ্ন প্রত্যক ক্ষেত্রে স্থান কাল ও পাত্র ভেদে একটি বিশেষ অর্থ বহন করেছে।
# এ কুরআনের শিক্ষা কোন মানুষের রচিত বা তৈরী নয়, বরং পরম দয়ালু আল্লাহ নিজে এর শিক্ষা দাতা। আল্লাহ তা’আলা কুরআনের এ শিক্ষা কাকে দিয়েছে এখানে সে কথা বলার প্রয়োজন ছিল না। কেননা, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুখ থেকেই মানুষ তা শুনছিলো। তাই অবস্থার দাবী অনুসারে আপনা থেকেই একথার প্রতিপাদ্য এই প্রকাশ পাচ্ছিল যে, এ শিক্ষা দেয়া হয়েছিল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে।
এ বাক্য দিয়ে সূচনা করার প্রথম উদ্দেশ্যই হচ্ছে একথা বলে দেয়া যে, নবী (সা.) নিজে এর রচয়িতা নন, এ শিক্ষা দানকারী স্বয়ং আল্লাহ তা’আলা। তাছাড়া আরো একটি উদ্দেশ্য আছে। ‘রহমান’ শব্দটি সে দিকেই ইঙ্গিত করেছে। এটা নবীর ﷺ রচিত কোন শিক্ষা নয়, বরং আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে শুধু এতটুকু কথা বলার প্রয়োজন হলে আল্লাহ তা’আলার ‘যাত’বা মূল নাম ব্যবহার না করে গুণবাচক নাম ব্যবহারের কোন প্রয়োজন ছিল না। তাছাড়া একান্তই গুণবাচক নাম ব্যবহার করার প্রয়োজন হলে শুধু এ বিষয়টি প্রকাশের জন্য আল্লাহর পবিত্র নামসমূহের মধ্য থেকে যে কোন একটি নাম গ্রহণ করা যেতে পারতো। কিন্তু যখন আল্লাহ, স্রষ্টা, বা রিযিকদাতা এ শিক্ষা দিয়েছেন বলার পরিবর্তে ‘রাহমান’ এ শিক্ষা দিয়েছেন বলা হয়েছে তখন আপনা থেকেই এ বিষয় প্রকাশ পায় যে, বান্দাদের হিদায়াতের জন্য কুরআন মজীদে নাযিল করা সরাসরি আল্লাহর রহমত। যেহেতু তিনি তাঁর সৃষ্টির প্রতি অতীব দয়াবান; তাই তিনি তোমাদেরকে অন্ধকারে হাতড়িয়ে মরার জন্য ছেড়ে দেয়া পছন্দ করেননি। তিনি তাঁর রহমতের দাবী অনুসারে এ কুরআন পাঠিয়ে তোমাদেরকে এমন জ্ঞান দান করেছেন যার ওপরে পার্থিব জীবনে তোমাদের সত্যানুসরণ এবং আখেরাতের জীবনের সফলতা নির্ভরশীল।
# অন্য কথায় আল্লাহ তা’আলা যেহেতু মানুষের স্রষ্টা, তাই স্রষ্টার দায়িত্ব হচ্ছে নিজের সৃষ্টিকে পথ প্রদর্শন করা এবং এ পথের মাধ্যমে সে তার সৃষ্টির উদ্দেশ্য পূরণ করতে সক্ষম হবে সে পথ দেখেনো। সুতরাং আল্লাহর পক্ষ থেকে কুরআনের এ শিক্ষা নাযিল হওয়া শুধু তাঁর অনুগ্রহ পরায়ণতার দাবীই নয়, তাঁর স্রষ্টা হওয়ারও অনিবার্য এবং স্বাভাবিক দাবী। স্রষ্টা যদি সৃষ্টিকে পথ প্রদর্শন না করেন তাহলে আর কে তা করবে? তাছাড়া স্রষ্টা নিজেই যদি পথ প্রদর্শন না করেন তাহলে আর কে তা করতে পারে? স্রষ্টা যে বস্তু সৃষ্টি করলেন তিনি যদি তাকে সৃষ্টির উদ্দেশ্য পূরণ করার পন্থা পদ্ধতি না শেখান তাহলে তাঁর জন্য এর চেয়ে বড় ত্রুটি আর কি হতে পারে? সুতরাং প্রকৃত পক্ষে আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে মানুষকে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা হওয়া কোন আশ্চর্যজনক ব্যাপার নয়। বরং তাঁর পক্ষ থেকে যদি এ ব্যবস্থা না থাকতো তাহলে সেটাই হতো বিস্ময়কর ব্যাপার। গোটা সৃষ্টিলোকে যে জিনিসই তিনি সৃষ্টি করেছেন তা কেবল সৃষ্টি করেই ছেড়ে দেননি। তাকে এমন উপযুক্ত আকার-আকৃতি দিয়েছেন যার সাহায্যে সে প্রাকৃতিক ব্যবস্থার অধীনে তার নিজের অংশের কাজ করার যোগ্য হতে পারে। সাথে সাথে সে কাজ সম্পাদন করার পন্থা পদ্ধতিও তাকে শিখিয়েছেন। মানুষের নিজের দেহের এক একটি লোম এবং এক একটি কোষকে (Cell) মানবদেহে যে কাজ আঞ্জাম দিতে হবে সে কাজ শিখেই তা জন্ম লাভ করেছে। তাই মানুষ নিজে কেমন করে তার স্রষ্টার শিক্ষা ও পথ নির্দেশ লাভ করা থেকে মুক্ত ও বঞ্চিত হতে পারে? এ বিষয়টি কুরআন মজীদের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ভঙ্গিতে বুঝানো হয়েছে। সূরা লায়লে ( ১২ আয়াত )বলা হয়েছেঃإِنَّ عَلَيْنَا لَلْهُدَى “পথ প্রদর্শন করা আমার দায়িত্ব।” সূরা নাহলে ( ৯ আয়াত ) বলা হয়েছেঃ وَعَلَى اللَّهِ قَصْدُ السَّبِيلِ وَمِنْهَا جَائِرٌ “সরল সোজা পথ দেখিয়ে দেয়া আল্লাহর দায়িত্ব। বাঁকা পথের সংখ্যা তো অনেক।” সূরা ত্বা-হায় ( ৪৭-৫০আয়াত ) উল্লেখ করা হয়েছে যে, ফেরাউন মূসার মুখে রিসালাতের পয়গাম শুনে বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলোঃ তোমার সেই ‘রব’ কে যে আমার কাছে দূত পাঠায়? জবাবে হয়রত মূসা বললেনঃ
رَبُّنَا الَّذِي أَعْطَى كُلَّ شَيْءٍ خَلْقَهُ ثُمَّ هَدَى
“তিনিই আমার রব যিনি প্রতিটি জিনিসকে একটি নির্দিষ্ট আকার-আকৃতি দান করে পথ প্রদর্শন করেছেন।”
অর্থাৎ তিনি তাকে সেই নিয়ম-পদ্ধতি শিখিয়েছেন যার সাহায্যে সে বস্তু জগতে তার করণীয় কাজ সম্পাদন করতে পারবে। মানুষকে শিক্ষা দেয়ার জন্য আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে নবী-রসূল ও আসমানী কিতাবসমূহ আসা যে সরাসরি প্রকৃতিরই দাবী, একজন নিরপেক্ষ মন-মগজের অধিকারী মানুষ এসব যুক্তি প্রমাণ দেখে সে বিষয়ে নিশ্চিত ও সন্তুষ্ট হতে পারে।
# মূল আয়াতে بيان শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এর একটি অর্থ হচ্ছে মনের ভাব প্রকাশ করা। অর্থাৎ কোন কিছু বলা এবং নিজের উদ্দেশ্য ও অভিপ্রায় ব্যক্ত করা। দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে পার্থক্য ও বৈশিষ্ট্য স্পষ্ট করে তোলা। এখানে এর অর্থ হচ্ছে ভাল মন্দ ও কল্যাণ-অকল্যাণের মধ্যকার পার্থক্য। এ দু’টি অর্থ অনুসারে ক্ষুদ্র এ আয়াতাংশটি ওপরে বর্ণিত যুক্তি প্রমাণকে পূর্ণতা দান করে। বাকশক্তি এমন একটি বিশিষ্ট গুণ যা মানুষকে জীবজন্তু ও পৃথিবীর অন্যান্য সৃষ্টিকূল থেকে পৃথক করে দেয়। এটা শুধু বাকশক্তিই নয়। এর পেছনে জ্ঞান ও বুদ্ধি, ধারণা ও অনুভূতি, বিবেক ও সংকল্প এবং অন্যান্য মানসিক শক্তি কার্যকর থাকে যেগুলো ছাড়া মানুষের বাকশক্তি কাজ করতে পারে না। এজন্য বাকশক্তি প্রকৃতপক্ষে মানুষের জ্ঞানী ও স্বাধীন সৃষ্টজীব হওয়ার স্পষ্ট প্রমাণ। আর আল্লাহ তা’আলা এ বিশেষ গুণটি যখন মানুষকে দান করেছেন তখন এটাও স্পষ্ট যে, জ্ঞান ও অনুভূতি এবং ইখতিয়ারবিহীন সৃষ্টিকূলের পথ প্রদর্শনের জন্য শিক্ষার যে প্রকৃতি ও পদ্ধতি উপযুক্ত হতে পারে মানুষের শিক্ষার প্রকৃতি ও পদ্ধতি তা হতে পারে না। একইভাবে মানুষের আরেকটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিশেষ গুণ হলো আল্লাহ তায়ালা তার মধ্যে একটি নৈতিক অনুভূতি (Moral sense) সৃষ্টি করে দিয়েছেন যার কারণে সে প্রকৃতিগতভাবেই ভাল ও মন্দ, ন্যায় ও অন্যায়, জুলুম ও ইনসাফ এবং উচিত ও অনুচিতের মধ্যে পার্থক্য করে এবং চরম গোমরাহী ও অজ্ঞতার মধ্যেও তার ভিতরের এ আত্মজ্ঞান ও অনুভূতি লোপ পায় না। এ দু’টি বিশেষ বৈশিষ্ট্যের অনিবার্য দাবী হচ্ছে মানুষের জ্ঞানলোক সমৃদ্ধ ও স্বাধীন জীবনের জন্য শিক্ষাদানের পন্থা ও পদ্ধতি জন্মগতভাবে লব্ধ শিক্ষা পদ্ধতি-যার সাহায্য মাছকে সাঁতার কাটা, পাখীকে উড়ে বেড়ানো এবং মানুষের নিজ দেহের মধ্যে চোখের পাতাকে পলক ফেলা, চোখকে দেখা, কানকে শোনা এবং পাকস্থলীকে হজম করা শেখানো হয়েছে-থেকে ভিন্ন হতে হবে। জীবনের এক্ষেত্রে মানুষ নিজেও শিক্ষক, বই পুস্তক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, প্রচার-প্রোপাগাণ্ডা ও ধর্মীয় শিক্ষা, লেখা, বক্তৃতা, বিতর্ক ও যুক্তি প্রমাণের মত উপায় উপকরণকেই শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে স্বীকার করে এবং শুধু জন্মগতভাবে লব্ধ জ্ঞানকে যথেষ্ট মনে করে না। তাহলে মানুষের স্রষ্টার ওপরে তাদের পথ প্রদর্শনের যে দায়িত্ব বর্তায় তা সম্পাদন করার জন্য যখন তিনি রসূল ও কিতাবকে শিক্ষাদানের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করেন তখন তা বিস্ময়ের ব্যাপার হবে কেন? সৃষ্টি যেমন হবে তার শিক্ষাও তেমন হবে এটা একটা সহজ যুক্তিগ্রাহ্য কথা। بيان যে সৃষ্টিকে শেখানো হয়েছে তার জন্য ‘কুরআন’ই হতে পারে শিক্ষার উপযুক্ত মাধ্যম। যেসব সৃষ্টিকে ‘বায়ান’ শেখানো হয়নি তাদের উপযোগী শিক্ষা মাধ্যম ‘বায়ান’ শেখানো হয়েছে এমন সৃষ্টির জন্য উপযোগী হতে পারে না।
# এসব বিরাট গ্রহ উপগ্রহ একটা অত্যন্ত শক্তিশালী নিয়মবিধি ও অপরিবর্তনীয় শৃংখলার বাঁধনে আবদ্ধ। মানুষ সময়, দিন, তারিখ এবং ফসলাদি ও মওসূমের হিসেব করতে সক্ষম হচ্ছে এ কারণে যে, সূর্যের উদয়াস্ত ও বিভিন্ন রাশি অতিক্রমের যে নিয়ম কানুন নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে তাতে কোন সময়ই কোন পরিবর্তন হয় না। পৃথিবীতে অসংখ্য জীব-জন্তু বেঁচেই আছে এ কারণে যে, চন্দ্র ও সূর্যকে ঠিকমত হিসেব করে পৃথিবী থেকে একটি বিশেষ দূরত্বে স্থাপন করা হয়েছে এবং একটি সঠিক মাপ জোকের মাধ্যমে বিশেষ শৃংখলার সাথে এ দূরত্বের হ্রাস বৃদ্ধি ঘটে। কোন হিসেব নিকেশ ও মাপজোক ছাড়াই যদি পৃথিবী থেকে এদের দূত্বের হ্রাস বৃদ্ধি ঘটতো তাহলে কারো পক্ষেই এখানে বেঁচে থাকা সম্ভব হতো না। অনুরূপভাবে পৃথিবীর চারদিকে চন্দ্র ও সূর্যের গতি বিধিতে এমন পূর্ণ ভারসাম্য কায়েম করা হয়েছে যে, চন্দ্র একটি বিশ্বজনীন পঞ্জিকায় রূপান্তরিত হয়েছে যা অত্যন্ত নিয়মতান্ত্রিকভাবে প্রতিরাতে সমগ্র বিশ্বকে চান্দ্র মাসের তারিখ নির্দেশ করে দেয়।
# মূল আয়াতে النجم শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এর সর্বজন বিদিত ও সহজ বোধগম্য অর্থ তারকা। কিন্তু আরবী ভাষায় এ শব্দটি দ্বারা এমন সব লতাগুল্ম ও লতিয়ে উঠা গাছকে বুঝানো হয় যার কোন কাণ্ড হয় না। যেমনঃ শাক-সবজি, খরমুজ, তরমুজ ইত্যাদি। এখানে এ শব্দটি কোন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে সে বিষয়ে মুফাসসিরদের মধ্যে মতভেদ আছে। ইবনে আব্বাস, সাঈদ ইবনে জুবায়ের, সুদ্দী ও সুফিয়া সাওরীর মতে এর অর্থ কাণ্ডহীন উদ্ভিদরাজি। কেননা এর পরেই الشَّجَرُ (বৃক্ষ) শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে যার সাথে এ অর্থ বেশী সামঞ্জস্যপূর্ণ। অপর দিকে মুজাহিদ, কাতাদা ও হাসান বাসরীর মতে এখানেও ‘নাজম’ অর্থ পৃথিবীর লতাগুল্ম নয়, বরং আকাশের তারকা। কারণ এটাই এর সহজ বোধগম্য ও সর্বজন বিদিত অর্থ। এ শব্দটি শোনার সাথে সাথে মানুষের মন-মগজে এ অর্থটিই জেগে উঠে এবং সূর্য ও চন্দ্রের উল্লেখের পর তারকাসমূহের উল্লেখ করাই সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। মুফাসসির ও অনুবাদকের অধিকাংশই যদিও প্রথম অর্থকেই অগ্রাধিকার দিয়েছেন। একে ভ্রান্ত বলা যায় না। কিন্তু তা সত্ত্বেও হাফেজ ইবনে কাসীরের এ মতটি সঠিক যে, ভাষা ও বিষয়বস্তু উভয় বিচারেই দ্বিতীয় অর্থটিই অধিক অগ্রগণ্যতা পাওয়ার যোগ্য বলে মনে হয়। কুরআন মজীদের অন্য একটি স্থানেও তারকা ও বৃক্ষরাজির সিজদাবনত হওয়ার উল্লেখ আছে এবং সেখানে نجوم শব্দটি তারকা ছাড়া অন্য কোন অর্থ গ্রহণ করা যেতে পারে না। আয়াতটি হচ্ছেঃ
أَلَمْ تَرَ أَنَّ اللَّهَ يَسْجُدُ لَهُ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَمَنْ فِي الْأَرْضِ وَالشَّمْسُ وَالْقَمَرُ وَالنُّجُومُ وَالْجِبَالُ وَالشَّجَرُ وَالدَّوَابُّ وَكَثِيرٌ مِنَ النَّاسِ………………..(الحج : 18) (সূরা হজ্জ আয়াত ১৮ )
এখানে সূর্য ও চন্দ্রের সাথে نجوم শব্দটি উল্লেখ করা হয়েছে এবং شجر শব্দটি উল্লেখ করা হয়েছে পাহাড় ও জীবজন্তুর সাথে। আর বলা হয়েছে, এসব আল্লাহর সামনে সিজদাবনত।
টিকা:৬) অর্থাৎ আকাশের তারকা ও পৃথিবীর বৃক্ষরাজি সবই আল্লাহর নির্দেশের অনুগত এবং তাঁর আইন-বিধানের অনুসারী। তাদের জন্য যে নিয়ম-বিধি তৈরী করে দেয়া হয়েছে তারা তা মোটেই লংঘন করে না। এ দু’টি আয়াতে যা কিছু বর্ণনা করা হয়েছে তার উদ্দেশ্য এ কথা বলা যে, সমগ্র বিশ্ব-জাহানের গোটা ব্যবস্থাপনা আল্লাহ তা’আলার তৈরী এবং সব কিছু তাঁরই আনুগত্য করে চলেছে। পৃথিবী থেকে আসমান পর্যন্ত কোথাও কোন সার্বভৌম সত্তা নেই। অন্য কারো কর্তৃত্ব এ বিশ্বজাহানে চলছে না। আল্লাহর কর্তৃত্বে কারো কোন রকম দখলও নেই, কারো এমন মর্যাদাও নেই যে, তাকে উপাস্য বানানো যায়। সবাই এক আল্লাহর বান্দা ও দাসানুদাস। একমাত্র সর্বশক্তিমান আল্লাহই সকলের মনিব। তাই তাওহীদই সত্য। আর কুরআনই তার শিক্ষা দিচ্ছে। এ শিক্ষা পরিত্যাগ করে যে ব্যক্তিই শিরক অথবা কুফরীতে লিপ্ত হচ্ছে সে প্রকৃতপক্ষে গোটা বিশ্ব-জাহানের ব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে লড়াইতে লিপ্ত আছে।
# প্রায় সব তাফসীরকারই এখানে “মীযান” (দাড়িপাল্লা) অর্থ করেছেন সুবিচার ও ইনাসাফ এবং মীযান কায়েম করার অর্থ বর্ণনা করেছেন এই যে, আল্লাহ তা’আলা বিশ্ব-জাহানের এই গোটা ব্যবস্থায় ইনসাফ ও সুবিচার কায়েম করেছেন। মহাকাশে আবর্তনরত এসব সীমা সংখ্যাহীন তারকা ও গ্রহ উপগ্রহ, বিশ্ব-জাহানে সক্রিয় এই বিশাল শক্তিসমূহ এবং এ বিশ্বলোকে বিদ্যমান অসংখ্য সৃষ্টি ও বস্তুরাজির মধ্যে যদি পূর্ণমাত্রায় সুবিচার ও ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করা না হতো তাহলে এ জগত এক মুহূর্তের জন্যও চলতে পারতো না। কোটি কোটি বছর ধরে এই পৃথিবীর বুকে বাতাস ও পানি এবং স্থলভাগে সৃষ্টিকূল আছে, তাদের প্রতি লক্ষ করুন। তাদের জীবন তো এ জন্যই টিকে আছে যে, তাদের জীবন ধারণের উপকরণের মধ্যে পুরোপুরি সুবিচার ও ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত আছে। এসব উপকরণের মধ্যে যদি সামান্য পরিমাণ ভারসাম্যহীনতারও সৃষ্টি হয় তাহলে এখানে জীবনের নাম গন্ধ পর্যন্ত অবশিষ্ট থাকবে না।
# তোমরা যেহেতু এমন একটি ভারসাম্যপূর্ণ বিশ্বলোকে বাস করছো যার গোটা ব্যবস্থাপনাই সুবিচার ও ইনসাফের ওপর প্রতিষ্ঠিত। তাই তোমাদেরকেও সুবিচার ও ইনসাফের ওপর প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। যে গণ্ডির মধ্যে তোমাদেরকে স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে সেখানে যদি তোমরা বে-ইনসাফী করো এবং যে হকদারদের হক তোমাদের হাতে দেয়া হয়েছে যদি তোমরা হরণ কর, তাহলে তা হবে বিশ্ব প্রকৃতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহের শামিল। এ মহা বিশ্বের প্রকৃতি জুলুম, বে-ইনসাফী ও অধিকার হরণকে স্বীকার করে না। এখানে বড় রকমের কোন জুলুম তো দূরের কথা, দাঁড়ি পাল্লার ভারসাম্য বিঘ্নিত করে কেউ যদি খরিদ্দারকে এক তোলা পরিমাণ জিনিসও কম দেয় তাহলে সে বিশ্বলোকের ভারসাম্যে বিপর্যয় সৃষ্টি করে।-এটা কুরআনের শিক্ষার দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এ তিনটি আয়াতে এ শিক্ষাটাই তুলে ধরা হয়েছে। কুরআনের প্রথম শিক্ষা হচ্ছে তাওহীদ এবং দ্বিতীয় শিক্ষা হচ্ছে, সুবিচার ও ইনসাফ। এভাবে সংক্ষিপ্ত কয়েকটি বাক্যে মানুষকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, ‘রাহমান’ বা পরম দয়াবান আল্লাহ পথ প্রদর্শনের জন্য যে কুরআন পাঠিয়েছেন তা কি ধরনের শিক্ষা নিয়ে এসেছে!
# এখান থেকে ২৫ আয়াত পর্যন্ত আল্লাহ তা’আলার সেসব নিয়ামত, অনুগ্রহ এবং তার অসীম শক্তির সেসব বিস্ময়কর দিকের উল্লেখ করা হচ্ছে যা মানুষ ও জিন উভয়েই উপভোগ করছে এবং যার স্বাভাবিক ও নৈতিক দাবী হলো, কুফরী বা ঈমান গ্রহণের স্বাধীনতা থাকা সত্ত্বেও তারা যেন নিজেদের ঐকান্তিক আগ্রহ ও ইচ্ছায় তাদের রবের বন্দেগী ও আনুগত্যের পথ অনুসরণ করে।
# মূল কথাটি হলো পৃথিবীকে তিনি انام এর জন্য وضع (সংস্থাপিত) করেছেন। এখানে وضع বা সংস্থাপন করাবলতে বুঝানো হয়ে সংযোজন করা, নির্মাণ করা, তৈরী করা, রাখা এবং স্থাপিত করা বা সেঁটে দেয়া। আর আরবী ভাষায় انام শব্দ দ্বারা সব সৃষ্টিকেই বুঝায়। এর মধ্যে মানুষ ওও অন্যান্য সব প্রণীকূল অন্তর্ভূক্ত। ইবনে আব্বাস বলেনঃ كُلُّ شَيْئٍ مَا فِيْهِ الرُّوْحُ প্রাণ ধারি সব সত্তাই انام হিসেবে গণ্য। মুহাজিদের মতে, এর অর্থ সমস্ত সৃষ্টিকূল। কাতাদা, ইবনে যায়েদ ও শা’বীর মতেসমস্ত প্রাণীই انام । হাসান বাসরী বলেনঃ মানুষ ও জিন উভয়েই এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। সমস্ত ভাষাভিজ্ঞ পণ্ডিত এ অর্থই বর্ণনা করেছেন। এ থেকে জানা যায় যে, যারা এ আয়াতের সাহায্যে ভূমিকে রাষ্ট্রের মালিকানাধী করার নির্দেশ দিতে চান তারা অর্থহীন কথা বলেন। এটা বাইরের মতবাদ এনে জোরপূর্বক কুরআনের ওপর চাপিয়ে দেয়ার একটি কদর্য্য প্রচেষ্টা। আয়াতে ব্যবহৃত শব্দাবলী থেকে যেমন তা প্রমাণিত হয় না, তেমনি পূর্বাপর প্রসঙ্গ দ্বারাও তা সমর্থিত হয় না। শুধু মানব সমাজকেই আনাম বলা হয় না, বরং পৃথিবীর অন্যান্য সৃষ্টিও এর মধ্যে শামিল। পৃথিবীকে আনামের জন্য সংস্থাপিত করার অর্থ এ নয় যে, তা সবার সাধারণ মালিকানা। বাক্যের ভাবধারা থেকেও প্রকাশ পায় যে, এখানে কোন অর্থনৈতিক নিয়ম-বিধি বর্ণনা করা এর উদ্দেশ্য। প্রকৃতপক্ষে এখানে এ কথা বলাই উদ্দেশ্য যে, আল্লাহ তা’আলা এ পৃথিবীকে এমনভাবে সৃষ্টি ও প্রস্তুত করে দিয়েছেন যে, তা নানা প্রকারের প্রাণীকূলের বসবাস ও জীবন যাপনের উপযোগী হয়ে গিয়েছে। এ পৃথিবী আপনা থেকেই এরূপ হয়ে যায়নি, বরং স্রষ্টার বানানোর কারণেই এরূপ হয়েছে। তিনি নিজের জ্ঞান ও সৃষ্টি কৌশলের আলোকে এ পৃথিবীকে এ অবস্থানে সংস্থাপন করেছেন এবং তার পৃষ্ঠদেশে এমন পরিবেশ ও অবস্থা সৃষ্টি করেছেন যার ফলশ্রুতিতে প্রাণধারী প্রজাতিসমূহের পক্ষে এখানে টিকে থাকা সম্ভব হয়েছে। (ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, আন নামল, টীকা ৭৩-৭৪ ; ইয়াসীন, টীকা ২৯-৩২ ; আল মু’মিন, টীকা ৯০-৯১ ; হা মীম আস সাজদা, টীকা ১১ থেকে ১৩ পর্যন্ত ; আয যুখরুফ, টীকা ৭ থেকে ১০ পর্যন্ত; আল জাসিয়া, টীকা ৭ )।
# মানুষের জন্য খাদ্য শস্য এবং পশুর ভূঁষিখাদ্য।
# মূল আয়াতে الاء শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে এবং পরবর্তী আয়াতসমূহে এ শব্দটি বার বার উল্লেখ করা হয়েছে। আমরাও বিভিন্নস্থানে এর অর্থ বিভিন্ন শব্দে ব্যক্ত করেছি। তাই এ শব্দটি কতটা ব্যাপক অর্থবোধক এবং কত গভীর তাৎপর্যপূর্ণ, তা শুরুতেই বুঝে নেয়া দরকার। ভাষাভিজ্ঞ পণ্ডিত ও তাফসীর বিশারদগণ الاء আলা শব্দের অর্থ করেছেন সাধারণত “নিয়ামতসমূহ।” সমস্ত অনুবাদক এ শব্দের অনুবাদও করেছেন তাই। ইবনে আব্বাস, কাতাদা, হাসান বাসরী থেকে এর এই অর্থই বর্ণিত হয়েছে। এটি যে এ শব্দের সঠিক অর্থ তার বড় প্রমাণ হলো নবী ﷺ নিজে জিনদের এ উক্তি উদ্ধৃত করেছেন যে, এ আয়াত শুনে তারা বারবার বলেছিল لاَ بِشَىْءٍ مِنْ نِعَمِكَ رَبَّنَا نُكَذِّبُ । বর্তমান যুগের কোন কোন গবেষকের এ সিদ্ধান্তের সাথে আমরা একমত নই যে, الاء শব্দটি নিয়ামত অর্থে আদৌ ব্যবহৃত হয়না।
এ শব্দের আরেকটি অর্থ হচ্ছে, অসীম ক্ষমতা, অসীম ক্ষমতার বিস্ময়কর দিকসমূহ অসীম ক্ষমতার পরিপূর্ণতাসমূহ। ইবনে জারীর তাবারী ইবনে যায়েদের এ উক্তি উদ্ধৃত করেছেন যে, فَبِأَيِّ آلَاءِ رَبِّكُمَا অর্থ فَبِاَىِّ قُدْرَةِ اللهِ । ইবনে জারীর নিজেও ৩৭ ও ৩৮ আয়াতের ব্যাখ্যায় الاء শব্দটিকে অসীম ক্ষমতা অর্থে গ্রহণ করেছেন। ইমাম রাযীও ১৪, ১৫ও ১৬ আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেছেন, “এ আয়াতগুলোতে নিয়ামতের বর্ণনা করা হয়নি, বরং অসীম ক্ষমতার বর্ণনা করা হয়েছে। তিনি ২২ ও ২৩ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেনঃ এ দু’টি আয়াতে আল্লাহ তা’আলার নিয়ামতের বর্ণনা করা হয়নি। বরং তার অসীম ক্ষমতার বিস্ময়কর দিকসমূহ বর্ণনা করা হয়েছে।”
এর তৃতীয় অর্থ হচ্ছে গুণাবলী, মহত গুণাবলী এবং পরিপূর্ণ ও মর্যাদা। ভাষাভিজ্ঞ পণ্ডিত ও তাফসীরকারগণ এ অর্থ বর্ণনা করেননি। কিন্তু আরবদের কাব্যে এ শব্দটি এ অর্থে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। কবি নাবেগাহ বলেছেনঃ
هم الملوك وابناء الملوك لهم : فضل على الناس فى الالاء والنعم
“তারা বাদশাহ এবং বাদশাহজাদা। প্রশংসনীয় গুণবলী ও নিয়ামতের দিক দিয়ে মানুষের কাছে তাদের মর্যাদা আছে।”
মুহালহিল তার ভাই কুলাইবের জন্য রচিত শোকগাথায় বলেছেনঃ
الحزم والعزم كانا من طبائعه : ما كل الائه ياقوم احصيها
“পরিণাম দর্শিতা ও দৃঢ়সংকল্প ছিল তার মহতগুণাবলীর অন্তর্ভুক্ত। হে লোকেরা, আমি তার সব মহত গুণ এখানে তুলে ধরছি না।”
ফাদালা ইবনে যায়েদ আল-আদওয়ানী দারিদ্রের মন্দ দিকসমূহের বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেছেন যে, দরিদ্র মানুষ ভাল কাজ করলেও মন্দ বিবেচিত হয়। কিন্তু وتحمد الاء البخيل المدرهم
সম্পদশালী কৃপণের অনেক গুণ-বৈশিষ্ট ও পরিপূর্ণতার প্রশংসা করা হয়। আজদা’হামদানী তার “কুমাইত” নামের ঘোড়ার প্রশংসা প্রসঙ্গে বলেনঃ ورضيت الاء الكميت فمن يبع : فرسا فليس جوادنا بمباع
“আমি ‘কুমাইতে’র উত্তম গুণাবলী পছন্দ করি। কেউ কোন ঘোড়া বিক্রি করতে চাইলে করুক। আমাদের ঘোড়া বিক্রি করা হবে না।” হাম্মাসার এক কবি আবু তামাম যার নাম উল্লেখ করেনি তার শ্রদ্ধেয় ও প্রশংসনীয় ব্যক্তি ওয়ালিদ ইবনে আদহামের ক্ষমতা ও কতৃত্বের শোকগাথায় বলেছেনঃ
اذا ما امرؤ اثنى بالاءميت : فلا يبعد الله الوليدين ادهما “যখনই কেউ কোন মৃত ব্যক্তির গুণাবলীর প্রশংসা করবে আল্লাহ না করুন, সে যেন ওয়ালীদ ইবনে আদহামকে ভুলে না যায়।” عما كان مفراحا اذا الخير مسه : ولاكان منانا اذا هو انعما
“সুদিন আসলে সে আনন্দে আত্মহারা হয়ো না এবং কারো প্রতি অনুগ্রহ করে থাকলে কখনো খোঁটা দিয়ো না।”
কবি তারাফা এক ব্যক্তির প্রশংসা উপলক্ষে বলেনঃ
كامل يجمع الاء الفتى : نبه سيد سادات خضم
“সে পূর্ণাঙ্গ ও নিষ্কলুষ, সাহসিকতার সমস্ত গুণাবলীর সমাহার, অভিজাত, নেতাদের নেতা এবং উদারমনা।”
এসব প্রমাণাদি ও দৃষ্টান্তাবলী সামনে রেখে الاء শব্দটিকে আমরা তার ব্যাপক অর্থে গ্রহণ করেছি এবং প্রতিটি ক্ষেত্রে স্থান-কাল-পাত্র ভেদে যে অর্থটি যথোপযুক্ত মনে হয়েছে অনুবাদে সেটিই লিপিবদ্ধ করেছি। তা সত্ত্বেও কোন কোন জায়গায় একই স্থানে الاء শব্দটির কয়েকটি অর্থ হতে পারে। অনুবাদের বাধ্যবাধকতার কারণে আমাকে তার একটি অর্থই গ্রহণ করতে হয়েছে। কেননা, যুগপত সবগুলো অর্থই ধারণ করতে পারে আরবী ছাড়া অন্য ভাষায় এরূপ ব্যাপক অর্থবোধক কোন শব্দ নেই। দৃষ্টান্ত স্বরূপ, আলোচ্য আয়াতটিতে পৃথিবী সৃষ্টি এবং সেখানকার সমস্ত সৃষ্টির রিযিক সরবরাহের সর্বোত্তম ব্যবস্থাপনার উল্লেখ করার পর বলা হয়েছে, তোমরা তোমাদের রবের কোন কোন الاء কে অস্বীকার করবে? এক্ষেত্রে الاء শব্দটি শুধুমাত্র নিয়ামত অর্থেই ব্যবহৃত হয়নি, বরং মহান আল্লাহর অসীম ক্ষমতার পরিপূর্ণতা এবং তাঁর মহৎ গুণাবলীর অর্থেও ব্যবহৃত হয়েছে। এটা তাঁর অসীম ক্ষমতার পূর্ণাঙ্গ প্রকাশ যে, তিনি এই মাটির পৃথিবীকে এমন বিস্ময়কর পন্থায় তৈরী করেছেন যেখানে অসংখ্য প্রজাতির প্রাণীকূল বাস করে এবং নানা রকমের ফল ও শস্য উৎপন্ন হয়। এটাও তাঁর প্রশংসানীয় গুণ যে, তিনি এসব প্রাণীকূলকে সৃষ্টি করার সাথে সাথে এখানে তাদের লালন-পালন এবং রিযিক সরবরাহেরও ব্যবস্থা করেছেন। ব্যবস্থাপনাও এমন ব্যাপক ও নিখুঁত যে, তাদের খাদ্যে কেবল খাদ্য গুণ ও পুষ্টিই নয়, বরং তার মধ্যে প্রবৃত্তি ও রসনার তৃপ্তি আছে এবং আছে অগণিত দৃষ্টিলোভা দিক। এক্ষেত্রে আল্লাহ তা’আলার কারিগরী ও নৈপুন্যের চরম পূর্ণতার একটি মাত্র দিকের প্রতি নমুনা হিসেবে ইঙ্গিত দিয়ে দেখানো হয়েছে কিভাবে খেজুর গাছে পাতলা আবরণে আচ্ছাদিত করে ফল সৃষ্টি করা হয়। এই একটি মাত্র উদাহরণকে সামনে রেখে একটু লক্ষ্য করুন, কলা, দাড়িম্ব, কমলালেবু, নারিকেল এবং অন্যান্য ফলের প্যাকিংয়ে কি রকম নৈপুন্য ও শৈল্পিক কারুকার্যের পরাকাষ্ঠা ও উৎকর্ষতা দেখানো হয়েছে। তাছাড়া নানা রকমের খাদ্য শস্য, ডাল এবং বীজ যা আমরা পরিতুষ্টির সাথে অবলীলাক্রমে রান্না করে খাই তার প্রত্যেকটিকে উৎকৃষ্ট ও পরিচ্ছন্ন আঁশ ও ছালের আকারে প্যাক করে এবং অতি সূক্ষ্ম আরবণে জড়িয়ে সৃষ্টি করা হয়।
# অস্বীকার করার অর্থ আল্লাহ তা’আলার নিয়ামতসমূহ, তাঁর অসীম ক্ষমতার বিস্ময়কর কার্যাবলী এবং মহৎ গুণাবলীর ক্ষেত্রে মানুষের কতিপয় আচরণ। যেমনঃ
এসব জিনিসের সৃষ্টিকর্তা যে মহান আল্লাহ, অনেকে তা আদৌ স্বীকার করে না। তাদের ধারণা, এসবই বস্তুর আকস্মিক বিশৃংখলার কিংবা একটা দুর্ঘটনার ফল যার মধ্যে জ্ঞান ও সৃষ্টিশীলতার কোন হাত নেই। এ ধরনের উক্তি একেবারে খোলাখুলি অস্বীকৃতির নামান্তর।
কিছু সংখ্যক লোক এ কথা স্বীকার করে যে, এসব জিনিসের সৃষ্টিকর্তা, আল্লাহ। তবে তারা এর সাথে সাথে অন্যদেরকেও খোদায়ীতে শরীক মনে করে, তাঁর নিয়ামতের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে অন্যদের কাছে এবং তাঁর দেয়া রিযিক খেয়ে অন্যের গুণ গায়। এটা অস্বীকৃতির আরেকটি রূপ। কোন লোক যখন স্বীকার করে যে, আপানি তার প্রতি অমুক অনুগ্রহ করেছেন এবং তখনি আপনার সামনেই সেজন্য অন্য কোন লোকের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে শুরু করে-অথচ প্রকৃত পক্ষে সে তার প্রতি আদৌ অনুগ্রহ করেনি-তাহলে আপনি নিজেই বলবেন যে, সে জঘন্য অকৃতজ্ঞতা দেখিয়েছে। কারণ তার এ আচরণ সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, সে আপনাকে নয় বরং সে ব্যক্তিকেই অনুগ্রহকারী স্বীকার করে যার প্রতি সে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে।
আরো কিছু লোক আছে যারা আল্লাহকেই সমস্ত জিনিসের সৃষ্টিকর্তা স্বীকার করে, কিন্তু তাদেরকে নিজেদেরসৃষ্টি ও পালনকর্তার আদেশ নিষেধের আনুগত্য এবং তাঁর হিদায়াতসমূহের অনুসরণ করতে হবে তা মানে না। এটা অকৃতজ্ঞতা ও নিয়ামত অস্বীকার করার আরো একটি রূপ। কারণ, যে ব্যক্তি এরূপ আচরণ করে সে নিয়ামসমূহ স্বীকার করা সত্ত্বেও নিয়ামত দাতার অধিকারকে অস্বীকার করে।
আরো এক শ্রেণীর মানুষ মুখে নিয়ামতকে অস্বীকার করে না কিংবা নিয়ামত দানকারীর অধিকারকেও অস্বীকার করে না। কিন্তু কার্যত তাদের এবং একজন অস্বীকৃতি জ্ঞাপনকারী ও মিথ্যানুসারীর জীবনে উল্লেখযোগ্য কোন পার্থক্য থাকে না। এটা মৌখিক অস্বীকৃতি নয়, কার্যত অস্বীকৃতি।
১-১৩ আয়াতে:-
আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে ইবনে কাছীর:-
# হযরত যার (রঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একটি লোক বলেঃ “ (আরবী)-এর মধ্যে (আরবী) শব্দটি (আরবী) হবে, না (আরবী) হবে?” তখন তাকে জবাবে বলেনঃ “তুমি কি কুরআন পূর্ণটাই পড়েছো?” সে উত্তর দেয়ঃ “আমি মুফাসসালের সমস্ত সূরা এক রাকআতে পড়ে থাকি।” তিনি তখন বলেনঃ “কবিতা যেমন তাড়াতাড়ি পড়া হয়, তুমি হয়তো এই ভাবেই কুরআনও পড়ে থাকো? এটা খুব দুঃখজনক ব্যাপারই বটে। আল্লাহর নবী (সঃ) মুফাসসালের প্রাথমিক সূরাগুলোর কোন দুটি সূরা মিলিয়ে পড়তেন তা আমার খুব ভাল স্মরণ আছে। হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ)-এর কিরআতে মুফাসসালের সর্বপ্রথম সূরা হলো এই সূরায়ে রহমান। (এটা ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একদা রাসূলুল্লাহ (সঃ) সাহাবীদের (রাঃ) সমাবেশে আগমন করেন এবং সূরায়ে রহমান প্রথম হতে শেষ পর্যন্ত পাঠ করেন। সাহাবায়ে কিরাম (রাঃ) নীরবে শুনতে থাকেন। তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাদেরকে বলেনঃ “আমি জ্বিনের রাত্রে এ সূরাটি পাঠ করেছিলাম, তারা তোমাদের চেয়ে উত্তমরূপে জবাব দিয়েছিল। যখনই আমি (আরবী)-এই আয়াতে এসেছি তখনই তারা জবাবে বলেছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা আপনার অনুগ্রহ সমূহের কোন অনুগ্রহকেই অস্বীকার করি না। সুতরাং সমস্ত প্রশংসা আপনারই জন্যে।”
এই রিওয়াইয়াতটিই তাফসীরে ইবনে জারীরেও বর্ণিত হয়েছে। তাতে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) নিজেই এই সূরাটি পাঠ করেছিলেন অথবা তার সামনে এটা পাঠ করা হয়েছিল। ঐ সময় সাহাবীদেরকে নীরব থাকতে দেখে তিনি একথা বলেছিলেন। আর জ্বিনদের উত্তরের শব্দগুলো নিম্নরূপ ছিলঃ (আরবী) অর্থাৎ “আমাদের প্রতিপালকের এমন কোন নিয়ামত নেই যা আমরা অস্বীকার করতে পারি।”
১-১৩ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা’আলা স্বীয় পূর্ণ করুণার বর্ণনা দিচ্ছেন যে, তিনি তাঁর বান্দাদের উপর কুরআন কারীম অবতীর্ণ করেছেন এবং স্বীয় ফল ও করমে ওর মুখস্থকরণ খুবই সহজ করে দিয়েছেন। তিনিই মানুষকে সৃষ্টি করেছেন এবং তাকে কথা বলা শিখিয়েছেন। এটা হযরত হাসান (রঃ)-এর উক্তি। আর যহ্হাক (রঃ), কাতাদা (রঃ) প্রমুখ গুরুজন বলেন যে, দ্বারা ভাল ও মন্দ বুঝানো হয়েছে। কিন্তু কথা বলা শিখানো অর্থ নেয়াই বেশী যুক্তিযুক্ত। কারণ এর সাথে সাথেই কুরআন শিক্ষা দেয়ার বর্ণনা রয়েছে। এর দ্বারা তিলাওয়াতে কুরআন বুঝানো হয়েছে। আর তিলাওয়াতে কুরআন কথা বলা সহজ হওয়ার উপর নির্ভরশীল। প্রত্যেক অক্ষরকে ওর মাখরাজ হতে জিহ্বা বিনা কষ্টে আদায় করে থাকে। তা কণ্ঠ হতে বের হোক অথবা ওষ্ঠাধরকে মিলানোর মাধ্যমেই হোক। বিভিন্ন মাখরাজ এবং বিভিন্ন প্রকারের অক্ষরের উচ্চারণের পদ্ধতি আল্লাহ তা’আলা মানুষকে শিখিয়েছেন। সূর্য ও চন্দ্র নিজ নিজ নির্ধারিত কক্ষপথে আবর্তন করে। এতদুভয়ের আবর্তনের মধ্যে আছে টক্কর এবং না আছে কোন অস্থিরতা। যেমন আল্লাহ তা’আলা অন্য জায়গায় বলেনঃ (আরবী)
অর্থাৎ “সূর্যের পক্ষে সম্ভব নয় যে, সে চন্দ্রের নাগাল পায় এবং রজনীর পক্ষে সম্ভব নয় দিবসকে অতিক্রম করা এবং প্রত্যেকে নিজ নিজ কক্ষপথে সন্তরণ করে।” (৩৬:৪০) মহান আল্লাহ আরো বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “তিনি (আল্লাহ) সকালকে বেরকারী, রাত্রিকে তিনি আরাম ও বিশ্রামের সময় বানিয়েছেন এবং সূর্য ও চন্দ্রকে হিসাবের উপর রেখেছেন, এটা হলো পরাক্রমশালী, সর্বজ্ঞের নিয়ন্ত্রণ।” (৬:৯৬)
হযরত ইকরামা (রঃ) বলেন যে, যদি সমস্ত মানুষের, জ্বিনের, চতুষ্পদ জন্তুসমূহের এবং পক্ষীকূলের চক্ষুগুলোর দৃষ্টিশক্তি একটি মাত্র মানুষের চোখে দিয়ে দেয়া হয়, অতঃপর সূর্যের সামনে যে সত্তরটি পর্দা রয়েছে ওগুলোর মধ্যে একটিকে সরিয়ে ফেলা হয় তবুও সম্ভব নয় যে, এই লোকটিও সূর্যের দিকে তাকাতে পারে। অথচ সূর্যের আলো কুরসীর আলোর সত্তর ভাগের একভাগ মাত্র। সুতরাং এটা চিন্তা করার বিষয় যে, আল্লাহ স্বীয় জান্নাতী বান্দাদের চোখে কি পরিমাণ নূর দিবেন যে, তারা তাদের মহান প্রতিপালকের চেহারাকেও খোলাখুলিভাবে তাদের চক্ষু দ্বারা বিনা বাধায় দেখতে পাবে। (এটা ইমাম ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
আল্লাহ পাকের উক্তিঃ তৃণলতা ও বৃক্ষাদি মেনে চলে তাঁরই বিধান। মুফাসসিরগণ এ বিষয়ে একমত যে, (আরবী) বলা হয় ঐ গাছকে যে গাছের গুঁড়ি আছে। কিন্তু (আরবী) এর কয়েকটি অর্থ রয়েছে। কেউ কেউ বলেন যে, গুঁড়ি বিহীন লতা গাছকে (আরবী) বলা হয়, যে গাছ মাটির উপর ছড়িয়ে থাকে। আবার কেউ কেউ বলেন যে, (আরবী) হলো ঐ তারকা যা আকাশে রয়েছে। এ উক্তিটিই বেশী প্রকাশমান, যদিও প্রথম উক্তিটিকেই ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) পছন্দ করেছেন। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলাই সবচেয়ে ভাল জানেন। কুরআন কারীমের নিম্নের আয়াতটিও দ্বিতীয় উক্তিটির পৃষ্ঠপোষকতা করেঃ (আরবী) অর্থাৎ “তুমি কি দেখো না যে, আল্লাহকে সিজদা করে যা কিছু আছে আকাশমণ্ডলীতে ও পৃথিবীতে, সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্রমণ্ডলী, পর্বতরাজি, বৃক্ষলতা, জীবজন্তু এবং সিজদা করে মানুষের মধ্যে অনেকে।” (২২:১৮)
এরপর আল্লাহ তাআলা বলেনঃ তিনি আকাশকে করেছেন সমুন্নত এবং স্থাপন করেছেন মানদণ্ড অর্থাৎ আদল ও ইনসাফ। যেমন তিনি বলেছেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “নিশ্চয়ই আমি আমার রাসূলদেরকে দলীল প্রমাণাদিসহ প্রেরণ করেছি এবং তাদের সাথে নাযিল করেছি কিতাব ও মানদণ্ড, যাতে মানুষ ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকে।” (৫৭:২৫) অনুরূপভাবে এখানে আল্লাহ তাআলা বলেনঃ যাতে তোমরা ভারসাম্য লংঘন না কর। অর্থাৎ আল্লাহ তা’আলা আসমান ও যমীনকে সত্য ও ন্যায়ের সাথে সৃষ্টি করেছেন যাতে সমস্ত জিনিস সত্য ও ন্যায়ের সাথে থাকে। তাই তিনি বলেনঃ ওযনের ন্যায্য মান প্রতিষ্ঠিত কর এবং ওযনে কম দিয়ো না। অর্থাৎ যখন ওযন করবে তখন সঠিকভাবে ওযন করবে। কম-বেশী করবে না। অর্থাৎ নেয়ার সময় বেশী নিবে এবং দেয়ার সময় কম দিবে এরূপ করো না। যেমন আল্লাহ তা’আলা অন্য জায়গায় বলেনঃ
(আরবী) অর্থাৎ “তোমরা ন্যায়ের দণ্ড সোজা রেখে ওযন করো।” (১৭:৩৫)
আল্লাহ তা’আলা আকাশকে সমুন্নত করেছেন, আর পৃথিবীকে নীচু করে বিছিয়ে দিয়েছেন এবং তাতে মযবুত পাহাড় পর্বতকে পেরেকের মত করে গেড়ে দিয়েছেন যাতে এটা হেলা-দোলা ও নড়াচড়া না করে। আর তাতে যেসব সৃষ্টজীব বসবাস করছে তারা যেন শান্তিতে অবস্থান করতে পারে। হে মানুষ! তোমরা যমীনের সৃষ্টজীবের প্রতি লক্ষ্য করো, ওগুলোর বিভিন্ন প্রকার, বিভিন্ন রূপ, বিভিন্ন বর্ণ, বিভিন্ন ভাষা এবং বিভিন্ন স্বভাব ও অভ্যাসের প্রতি দৃষ্টিপাত করে আল্লাহ তা’আলার ব্যাপক ও সীমাহীন ক্ষমতার পরিমাপ করে নাও। সাথে সাথে যমীনের উৎপাদিত জিনিসের দিকে চেয়ে দেখো। এতে রঙ বেরঙ এর টক-মিষ্ট ফল, নানা প্রকারের সুগন্ধি বিশিষ্ট ফল। বিশেষ করে খেজুর বৃক্ষ যা একটি উপকারী বৃক্ষ এবং যা রোপিত হওয়ার পর হতে নিয়ে শুকনো হয়ে যাওয়া পর্যন্ত এবং এর পরেও খাওয়ার কাজ দেয়। খেজুর একটি সাধারণ ফল। ওর উপর খোসা থাকে যাকে ভেদ করে এটা বের হয়ে আসে। অতঃপর ওটা হয় কাদার মত, এরপর হয় রসাল এবং এরপর পেকে গিয়ে ঠিক হয়ে যায়। এটা খুবই উপকারী। আর এর গাছও হয় খুব সোজা ও সুন্দর।
হযরত শা’বী (রঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, রোমক সম্রাট হযরত উমার ইবনে খাত্তাব (রাঃ)-এর নিকট পত্র লিখেনঃ “আমার দূত আপনার নিকট হতে ফিরে এসে বলেছে যে, আপনার ওখানে নাকি একটি বক্ষ রয়েছে যার মত স্বভাব বা প্রকৃতি অন্য কোন গাছের মধ্যে নেই। ওটা গর্দভের কানের মত যমীন হতে বের হয়। তারপর রক্তিম বর্ণ ধারণ করে মুক্তার মত হয়, এরপর সবুজ বর্ণ ধারণ করে পান্নার (মূল্যবান সবুজ পাথর বিশেষ) মত হয়ে যায়, তারপর লাল বর্ণ। ধারণ করে লাল ইয়াকৃত বা পদ্মরাগের মত হয়। এরপর পেকে গিয়ে অতি উত্তম ও সুস্বাদু ফলে পরিণত হয়। তারপর শুকিয়ে গিয়ে স্থায়ী বাসিন্দাদের রক্ষণ এবং মুসাফিরদের পাথেয় হয়। সুতরাং যদি আমার দূতের বর্ণনা সত্য হয় তবে আমার ধারণায় এটা জান্নাতী গাছ।” তাঁর এই পত্রের জবাবে হযরত উমার ইবনে খাত্তাব (রাঃ) তাকে লিখেনঃ “এই পত্র আল্লাহর দাস এবং মুসলমানদের নেতা উমার (রাঃ)-এর পক্ষ হতে রোমক সম্রাট কায়সারের নিকট। আপনার দূত আপনাকে যে খবর দিয়েছে তা সম্পূর্ণ সত্য। এ ধরনের গাছ আরবে প্রচুর রয়েছে। এটা ঐ গাছ যা আল্লাহ তা’আলা হযরত মারইয়াম (আঃ)-এর পার্শ্বে জন্মিয়েছিলেন, যখন তাঁর পুত্র ঈসা (আঃ) তার গর্ভ হতে ভূমিষ্ট হন। অতএব, হে বাদশাহ! আল্লাহকে ভয় করুন এবং হযরত ঈসা (আঃ)-কে মা’রূদ মনে করবেন না। আল্লাহ এক, তার কোন শরীক নেই। দেখুন, আল্লাহ তাআলা বলেনঃ (আরবী)
অর্থাৎ “আল্লাহর নিকট ঈসা (আঃ)-এর দৃষ্টান্ত আদম (আঃ)-এর দৃষ্টান্ত সদৃশ। তাকে তিনি মৃত্তিকা হতে সৃষ্টি করেছিলেন, অতঃপর তাকে বলেছিলেনঃ ‘হও’ ফলে সে হয়ে গেল। এই সত্য তোমার প্রতিপালকের নিকট হতে, সুতরাং তুমি সংশয়কারীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না।” (৩:৫৯-৬০)
(আরবী)-এর অর্থ (আরবী) ও করা হয়েছে যা খেজুর বৃক্ষের গর্দানের উপর বাকল বা আবরণের মত থাকে।
এই যমীনে রয়েছে খোসা বিশিষ্ট দানা ও সুগন্ধ গুল্ম। -এর অর্থ হলো ক্ষেত্রের ঐ সবুজ পাতা যাকে উপর হতে কেটে দেয়া হয় এবং শুকিয়ে নেয়া
হয়।
(আরবী)-এর অর্থ হলো সুগন্ধ গুল্ম অথবা ক্ষেতের সবুজ পাতা। ভাবার্থ এই যে, গম, যব ইত্যাদির ঐ দানা যা ওর মাথার উপর ভূষিসহ থাকে এবং যে পাতা ওগুলোর গাছের উপর জড়িয়ে থাকে। আর এটাও বলা হয়েছে যে, ক্ষেতের প্রথমেই উৎপাদিত পাতাকে তো বলা হয়, আর যখন তাতে দানা ধরে তখন ওকে বলা হয়। যেমন কবি যায়েদ ইবনে আমর স্বীয় প্রসিদ্ধ। কাসীদায় বলেছেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “তোমরা দু’জন (হযরত মূসা আঃ ও হযরত হারূন আঃ) তাকে (ফিরাউনকে) বলোঃ কে মৃত্তিকায় শস্য উৎপাদন করেন? অতঃপর ওটা হতে চারা গাছ হয় যা আন্দোলিত হয় এবং তা হতে ওর মাথায় দানা বের করেন (কে তিনি? অর্থাৎ আল্লাহই এসব করে থাকেন)। সুতরাং এগুলোর মধ্যে সংরক্ষণকারীর জন্যে নিদর্শন রয়েছে।”
তাই মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ অতএব তোমরা উভয়ে (অর্থাৎ দানব ও মানব) তোমাদের প্রতিপালকের কোন অনুগ্রহ অস্বীকার করবে? অর্থাৎ হে দানব ও মানব! তোমরা তোমাদের আপাদমস্তক আল্লাহর নিয়ামত রাজির মধ্যে ডুবে রয়েছে। সুতরাং প্রকৃতপক্ষে তোমরা আল্লাহ তাআলার কোন নিয়ামতকেই অস্বীকার করতে পার না। দু’ একটি নিয়ামত হলে আলাদা কথা ছিল, কিন্তু এখানে তো তোমাদের পা হতে মাথা পর্যন্ত আল্লাহর নিয়ামতে পরিপূর্ণ রয়েছে। এ জন্যেই তো মুমিন জ্বিনগুলো একথা শোন মাত্রই উত্তরে বলেছিলঃ (আরবী) অর্থাৎ “হে আল্লাহ! হে আমাদের প্রতিপালক! আপনার এমন কোন নিয়ামত নেই যা আমরা অস্বীকার করতে পারি। সুতরাং আপনারই জন্যে সমস্ত প্রশংসা।” হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) এর জবাবে বলতেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “হে আমার প্রতিপালক! আমরা আপনার নিয়ামতরাজির কোন একটিও অস্বীকার করতে পারি না।”
হযরত আসমা বিনতে আবি বকর (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ “রিসালাতের প্রাথমিক অবস্থায় যখন ইসলাম পুরোপুরিভাবে ঘোষিত হয়নি তখন আমি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে বায়তুল্লাহর রুকনের দিকে নামায পড়তে দেখেছি। ঐ সময় তিনি (আরবী) পাঠ করেছেন এবং মুশরিকরাও তা শ্রবণ করেছে।
১-১৩ আয়াতে:-
আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:-
নামকরণ ও ফযীলত :
(الرحمن) “রহমান” আল্লাহ তা‘আলার গুণবাচক নামসমূহের মধ্যে অন্যতম। অর্থ : দয়াময় (আল্লাহ তা‘আলা) যিনি তাঁর রহমত দ্বারা সমস্ত মাখলুককে বেষ্টন করে আছেন।
সূরা আল ফাতিহায় এর তাফসীর করা হয়েছে। প্রথম আয়াতে উল্লিখিত আর-রহমান (الرحمن) শব্দ থেকে সূরাটির নামকরণ করা হয়েছে। সূরাটি মক্কায় অবতীর্ণ সূরাসমূহের অন্তর্ভুক্ত।
আবূ যার (রাঃ) হতে বর্ণিত, জনৈক লোক ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ)-কে বলেন : من ماء غير اسن বাক্যটির اسن শব্দটি কি اسن হবে না ياسن হবে তা কিভাবে চিনবেন? ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) জবাবে বলেন : তুমি কি সম্পূর্ণ কুরআন পড়েছ? সে জবাবে বলল : মুফাস্সালের সমস্ত সূরা এক রাক‘আতে পড়ে থাকি। তিনি বললেন : কবিতা যেমন তাড়াতাড়ি পড়া হয়, তুমিও কি কুরআন সেভাবেই পড়ে থাকো? এটা দুঃখজনক ব্যাপার। নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মুফাস্সালের প্রাথমিক সূরাগুলোর কোন্ দু’টি সূরা মিলিয়ে পড়তেন তা আমার ভাল স্মরণ আছে। ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) সূরা র্আ রহমানকে মুফাস্সালের প্রথম সূরা হিসেবে গণ্য করতেন। (আহমাদ হা. ৩৯১০, সনদ সহীহ)
জাবের (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন : একদা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাহাবীদের কাছে বের হলেন। তিনি তাদের কাছে সূরা র্আ রহমানের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সম্পূর্ণ সূরা তিলাওয়াত করে শুনান। সবাই চুপ রয়ে গেলেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন : কি হলো আমি তোমাদেরকে চুপচাপ দেখছি? জিনের রাতে জিনদের কাছে এ সূরা তিলাওয়াত করেছি তারা তোমাদের চেয়ে উত্তম জবাব দিয়েছে। যখনই আমি
(فَبِأَيِّ اٰلَا۬ءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبٰنِ)
আয়াতটি তিলাওয়াত করেছি তখন তারা বলেছে :
لَا بِشَيْءٍ مِّنْ نِّعْمَةِ رَبِّنَا نُكَذِّبُ فَلَكَ الْحَمْدُ
হে আমাদের রব! আমরা আপনার কোন নেয়ামতকে অস্বীকার করি না, সকল প্রশংসা একমাত্র আপনার জন্যই। (তিরমিযী হা. ৩২৯১, হাকিম ২/৪৭৩, সহীহ)
সূরাটি মাক্কী না মাদানী এ নিয়ে একাধিক মত রয়েছে, ইমাম কুরতুবী দুটি মত নিয়ে এসে মাক্কী হওয়াকে প্রাধান্য দিয়েছেন। কারণ উরওয়া ইবনু যুবাইর (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন : রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পর মক্কায় যিনি সর্বপ্রথম উচ্চ আওয়াজে কুরআন তেলাওয়াত করেন তিনি হলেন ইবনু মাসঊদ (রাঃ)। সাহাবীগণ বলেন : আওয়াজের সাথে কুরআন তেলাওয়াত করা কুরাইশরা শোনেনি, কে আছে যে তাদেরকে আওয়াজের সাথে কুরআন তেলাওয়াত শোনাবে? ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বললেন : আমি, তারা বললেন : আমরা তোমার ব্যাপারে আশংকা করছি। আমরা চাচ্ছি এমন একজন ব্যক্তি যার কুরাইশদের সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক রয়েছে; ফলে তারা তাকে হেফাযত করবে। কিন্তু তিনি তা মানলেন না, সে স্থানে দাঁড়িয়ে অত্র সূরা তেলাওয়াত শুরু করলেন (কুরতুবী)। সুতরাং আয়াতগুলো প্রমাণ করছে সূরাটি মক্কায় অবতীর্ণ।
সূরার যোগসূত্র এবং
(فَبِأَيِّ اٰلَا۬ءِ….)
বাক্যটি বার বার উল্লেখ করার তাৎপর্য : পূর্ববর্তী সূরা কামারের অধিকাংশ বিষয়বস্তু অবাধ্য জাতিসমূহের শাস্তির সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে। তাই প্রত্যেক শাস্তির পর মানুষকে হুশিয়ার করার জন্য
(فَكَيْفَ كَانَ عَذَابِيْ وَنُذُرِ)
বাক্যটি ব্যবহার করা হয়েছে। এর সাথে ঈমান ও আনুগত্যে উৎসাহিত করার জন্য দ্বিতীয় বাক্য
(وَلَقَدْ يَسَّرْنَا الْقُرْاٰنَ)
কে বার বার উল্লেখ করা হয়েছে। এর বিপরীতে সূরা রহমানের বেশির ভাগ বিষয়বস্তু আল্লাহ তা‘আলার দুনিয়াবী ও আখিরাতের অনুগ্রহসমূহের বর্ণনা সম্পর্কিত। তাই যখন কোন বিশেষ অবদান উল্লেখ করা হয়েছে তখনই মানুষকে সতর্ককরণ ও কৃতজ্ঞতা স্বীকারে উৎসাহিত করার জন্য
(فَبِأَيِّ اٰلَا۬ءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبٰنِ)
বাক্যটি বার বার উল্লেখ করা হয়েছে। প্রত্যেক বার বাক্যটি নতুন নতুন বিষয়বস্তুর সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার কারণে এটা অলংকার শাস্ত্রের পরিপন্থী নয়।
১-১৩ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
সূরাটিকে আর রহমান দ্বারা শুরু করার কারণ হল মক্কার মুশরিকরা রহমানকে অস্বীকার করত।
(وَاِذَا قِیْلَ لَھُمُ اسْجُدُوْا لِلرَّحْمٰنِ قَالُوْا وَمَا الرَّحْمٰنُﺠ اَنَسْجُدُ لِمَا تَاْمُرُنَا وَزَادَھُمْ نُفُوْرًا)
“যখন তাদেরকে বলা হয়, ‘রহমান’-কে সিজদা কর,’ তখন তারা বলে : ‘রহমান আবার কে? তুমি কাউকে সিজ্দা করতে বললেই কি আমরা তাকে সিজ্দা করব?’ এতে তাদের বিমুখতাই বৃদ্ধি পায়।” (সূরা ফুরকান ২৫ : ৬০) বলা হয়, এ সূরাটি নাযিল হয়েছে মক্কাবাসীর এ কথার জবাবে যে, যখন তারা বলে : এ কুরআন মুহাম্মাদকে কোন খারাপ ব্যক্তি শিক্ষা দিয়েছে। সে হল ইয়ামামার রহমান। এর দ্বারা তারা বুঝাতো মুসায়লামাতুল কাযযাবকে। তখন এ আয়াত নাযিল হল (কুরতুবী)।
(عَلَّمَ الْقُرْاٰنَ)
অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে কুরআন শিক্ষা দিয়েছেন, আর তাঁর থেকে তাঁর উম্মাত গ্রহণ করেছে।
এ আয়াত তাদের কথার প্রতিবাদ করছে যারা বলে : এ কুরআন মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কোন ব্যক্তির কাছ থেকে শিখেছে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(وَلَقَدْ نَعْلَمُ أَنَّهُمْ يَقُوْلُوْنَ إِنَّمَا يُعَلِّمُه۫ بَشَرٌ ط لِسَانُ الَّذِيْ يُلْحِدُوْنَ إِلَيْهِ أَعْجَمِيٌّ وَّهٰذَا لِسَانٌ عَرَبِيٌّ مُّبِيْنٌ)
“অবশ্যই আমি জানি, তারা বলে : ‘তাকে শিক্ষা দেয় এক মানুষ। তারা যার প্রতি এটা আরোপ করে তার ভাষা তো আরবী নয়; কিন্তু কুরআনের ভাষা স্পষ্ট আরবী।” (সূরা আন্ নাহ্ল ১৬ : ১০৩)
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(وَقَالَ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا إِنْ هٰذَا إِلَّا إِفْكٌ افْتَرَاهُ وَأَعَانَهُ عَلَيْهِ قَوْمٌ آخَرُوْنَ فَقَدْ جَاءُوْا ظُلْمًا وَزُورًا – وَقَالُوْٓا اَسَاطِیْرُ الْاَوَّلِیْنَ اکْتَتَبَھَا فَھِیَ تُمْلٰی عَلَیْھِ بُکْرَةً وَّاَصِیْلًا)
“কাফিররা বলে : ‘এটা মিথ্যা ব্যতীত কিছুই নয়, সে এটা উদ্ভাবন করেছে এবং ভিন্ন সম্প্রদায়ের লোক তাকে এ ব্যাপারে সাহায্য করেছে।’ এরূপে তারা অবশ্যই জুলুম ও মিথ্যায় উপনীত হয়েছে। তারা বলে : ‘এগুলো তো সে-কালের উপকথা, যা সে লিখিয়ে নিয়েছে; এগুলো সকাল-সন্ধ্যা তার নিকট পাঠ করা হয়।” (সূরা আল ফুরক্বা-ন ২৫ : ৪-৫)
মানুষ সৃষ্টি করার পূর্বে কুরআন শিক্ষা দেয়ার কথা উল্লেখের মাঝে এ ইঙ্গিত রয়েছে যে, মানুষ সৃষ্টিই করা হয়েছে কুরআন শিখার জন্য এবং কুরআনের নির্দেশিত পথে চলার জন্য।
(خَلَقَ الْإِنْسَانَ)
অর্থাৎ প্রথমেই আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর আল্লাহ তাদেরকে ভাব প্রকাশ করার যে ক্ষমতা দিয়েছেন তা একটি বড় নিদর্শন। এদিকে ইশারা করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(خَلَقَ الْإِنْسَانَ مِنْ نُّطْفَةٍ فَإِذَا هُوَ خَصِيْمٌ مُّبِيْنٌ)
“তিনি শুক্র হতে মানুষ সৃষ্টি করেছেন; অথচ সে প্রকাশ্য বিতণ্ডাকারী!” (সূরা আন্ নাহ্ল ১৬ : ৪) মানুষ সৃষ্টির পর তাকে অসংখ্য নিয়ামত প্রদান করা হয়েছে। তান্মধ্যে এখানে বিশেষভাবে ভাব বর্ণনা শিক্ষা তথা মনের ভাব প্রকাশের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কারণ মানুষের অন্যান্য প্রয়োজনের পূর্বে মনের ভাব প্রকাশের প্রয়োজন। মানুষ সুস্থ থাকুক, অসুস্থ হোক, কোন কিছুর প্রয়োজন হলে প্রথম দরকার তা প্রকাশ করার ক্ষমতা, তাছাড়া কুরআন শিক্ষার জন্যও প্রকাশ ক্ষমতা দরকার। এজন্য মানব সৃষ্টির পরেই মনের ভাব প্রকাশ করার ক্ষমতার নেয়ামতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
(اَلشَّمْسُ وَالْقَمَرُ بِحُسْبَانٍ)
অর্থাৎ সূর্য ও চন্দ্র উভয়টাই একটি অপরটির পর নিজ কক্ষপথে আবর্তন করে। এতদু’ভয়ের আবর্তনের মধ্যে না আছে টক্কর এবং না আছে কোন অস্থিরতা। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(فَالِقُ الْإِصْبَاحِ ج وَجَعَلَ اللَّيْلَ سَكَنًا وَّالشَّمْسَ وَالْقَمَرَ حُسْبَانًا ط ذٰلِكَ تَقْدِيْرُ الْعَزِيْزِ الْعَلِيْمِ)
“তিনিই সকালকে প্রকাশ করেন, তিনিই বিশ্রামের জন্য রাতকে সৃষ্টি করেছেন এবং গণনার জন্য সূর্য ও চাঁদ সৃষ্টি করেছেন; এসবই পরাক্রমশালী সর্বজ্ঞের নিরূপণ।” (সূরা আন‘আম ৬ : ৯৬)
(وَالنَّجْمُ وَالشَّجَرُ يَسْجُدٰنِ)
ইবনু জারীর আত্ তাবারী (রহঃ) বলেন : النَّجْمُ-এর অর্থ নিয়ে মুফাস্সিরগণ একাধিক মত প্রকাশ করেছেন। তবে এ বিষয়ে সকলে একমত যে, الشَّجَرُ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো ঐ গাছ যা তার দেহের ওপর দণ্ডায়মান।
ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন :
(وَالنَّجْمُ وَالشَّجَرُ يَسْجُدٰنِ)
আয়াতে “নাজম” হলো সেসব উদ্ভিদ যা জমিনের ওপর বিস্তার লাভ করে।
এরূপ কথাই বলেছেন সা‘ঈদ ইবনু যুবাইর সুদ্দী ও সুফিয়ান সাওরী (রহঃ) ইবনু জারীর এ মতকে সমর্থন করেছেন।
মুজাহিদ বলেন : নাজম হল আকাশের তারকা। হাসান বাসরী ও কাতাদাহ্ও এ কথা বলেছেন : ইমাম ইবনু কাসীর (রহঃ) বলেন : এটাই সঠিক। (আল্লাহ তা‘আলাই অধিক জানেন) কারণ আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(اَلَمْ تَرَ اَنَّ اللہَ یَسْجُدُ لَھ۫ مَنْ فِی السَّمٰوٰتِ وَمَنْ فِی الْاَرْضِ وَالشَّمْسُ وَالْقَمَرُ وَالنُّجُوْمُ وَالْجِبَالُ وَالشَّجَرُ وَالدَّوَا۬بُّ وَکَثِیْرٌ مِّنَ النَّاسِ)
“তুমি কি দেখ না যে, আল্লাহকে সিজদা করে যা কিছু আছে আকাশসমূহে ও পৃথিবীতে, সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্ররাজি, পর্বতমালা, বৃক্ষলতা, জীবজন্তু এবং সিজ্দা করে মানুষের মধ্যে অনেকে?” (সূরা আল হাজ্জ ২২ : ১৮)
(وَوَضَعَ الْمِيْزَانَ)
অর্থাৎ পৃথিবীতে সুবিচার প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং মানুষকেও তার নির্দেশ দিয়েছেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(لَقَدْ أَرْسَلْنَا رُسُلَنَا بِالْبَيِّنٰتِ وَأَنْزَلْنَا مَعَهُمُ الْكِتٰبَ وَالْمِيْزَانَ لِيَقُوْمَ النَّاسُ بِالْقِسْطِ)
“নিশ্চয়ই আমি আমার রাসূলদেরকে প্রেরণ করেছি স্পষ্ট প্রমাণসহ এবং তাদের সঙ্গে দিয়েছি কিতাব ও মানদণ্ড যাতে মানুষ সুবিচার প্রতিষ্ঠা করে।” (সূরা আল হাদীদ ৫৭ : ২৫)
(أَلَّا تَطْغَوْا فِي الْمِيْزَانِ)
অর্থাৎ ওজনে ন্যায়পরায়ণতার গণ্ডি অতিক্রম করো না।
– اكمام শব্দটি كم-এর বহুবচন। অর্থ কচি খেজুরের ওপরের আবরণ।
حب বলতে এমন সব শস্য যা খাদ্যরূপে গণ্য করা হয়। শস্য শুকিয়ে ভূসি হয়ে যায়, যা পশু ভক্ষণ করে।
الرَّيْحَانُ হাসান বাসরী বলেন, ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন : الرَّيْحَانُ অর্থ সবুজ বৃক্ষ। (ইবনু কাসীর) আরবে তুলসী গাছকে “রাইহান” বলা হয়।
(فَبِأَيِّ اٰلَا۬ءِ رَبِّكُمَا)
এ সম্বোধন মানুষ ও জিন উভয়কেই করা হয়েছে। মহান আল্লাহ তাঁর নেয়ামতসমূহ স্মরণ করিয়ে দিয়ে তাদেরকে জিজ্ঞাসা করছেন। আর বারবার এর পুনরাবৃত্তির ব্যাপারটা এমন ব্যক্তির মতো যে, কারো প্রতি অব্যাহতভাবে অনুগ্রহ করে, কিন্তু সে তা অস্বীকার করে। যেমন বলে : আমি তোমার অমুক কাজটি করে দিয়েছি, তুমি কি তা অস্বীকার করবে? অমুক জিনিসটা তোমাকে দিয়েছি, তোমার কি স্মরণ নেই? অমুক অনুগ্রহটি তোমার প্রতি আমি করেছি, তোমার কি আমার ব্যাপারে একটুও খেয়াল নেই। (ফাতহুল কাদীর)
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. রহমান আল্লাহর অন্যতম একটি নাম। এ নামে অন্য কাউকে নামকরণ করা বৈধ নয়।
২. সূরা র্আ রহমানের ফযীলত অবগত হলাম।
৩. আল্লাহ তা‘আলা প্রদত্ত নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করা আবশ্যক।
৪. সর্বত্র ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা অবশ্য কর্তব্য।
৫. ওজনে কম দেয়া হারাম।
১-১৩ নং আয়াতে:-
আয়াতের ব্যাখ্যা:-
ফী জিলালিল কুরআন:-
সংক্ষিপ্ত আলােচনা : এই মক্কী সূরার একটা বিশেষ বাচনভংগি লক্ষ্য করা যায়।{কেউ কেউ একে মদীনায় অবতীর্ণ এবং কেউ কেউ মক্কায় অবতীর্ণ সুরা মনে করেন। আমি মক্কায় অবতীর্ণ হওয়ার মতটিকে অগ্রগণ্য মনে করি। কারণ সূরার বাচনভঙ্গি ও ভাষাগত বিন্যাসে মক্কী সূরার লক্ষণ সুস্পষ্ট। সামান্য পার্থক্য বাদ দিলে এর শাব্দিক বিন্যাস সুরা রা’দের মতাে। সূরাটি নিয়ে আলােচনা করার সময় আমি যথাস্থানে একে মক্কী সূরা হিসেবে আখ্যায়িত করেছি এবং তার সুনির্দিষ্ট কারণগুলােও তুলে ধরেছি} মহাবিশ্বের মুক্ত অংগনে এটি একটি সার্বজনীন ঘােষণা এবং আল্লাহর অতুলনীয় নেয়ামতরাজির একটি পরিচিতি বিশেষ। আল্লাহর এই নেয়ামতরাজি যে জিনিসগুলাের মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হয়েছে, তা হচ্ছে তার চমকপ্রদ ও অনিন্দ্য সুন্দর সৃষ্টি নৈপুণ্য, তার নতুন নতুন ও অভিনব সৃষ্টি বৈচিত্র্য, তার অব্যাহত ও অফুরন্ত অবদানসমূহ, আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক স্বীয় সৃষ্টিজগতকে পরিচালনা এবং সমগ্র সৃষ্টিজগতের তাঁর প্রতি সবিনয় আনুগত্য ও অভিনিবেশ। এই সূরায় গােটা বিশ্বজগতকে জিন ও মানুষ এই দুই জাতির ওপর সাক্ষী রাখা হয়েছে, এই দুই জাতিকে সমভাবে এই সূরায় সম্বােধন করা হয়েছে এবং সমগ্র বিশ্বজগতের সম্মুখে প্রকাশ্যে বার বার প্রতিটি নেয়ামত বা অবদানের বিবরণ দেয়ার পর জ্বিন ও মানুষ উভয়কে চ্যালেঞ্জ দেয়া হয়েছে যে, আল্লাহর নেয়ামতগুলাে অস্বীকার করার স্পর্ধা তাদের আছে কিনা। আল্লাহর এই নেয়ামতসমূহ চ্যালেঞ্জের আওতায় শুধু যে গােটা সৃষ্টিজগত অন্তর্ভুক্ত হয়েছে তা নয়; বরং আখেরাতও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। সূরার গােটা কাঠামােতে, এর তাৎপর্যময় বিরতিতে এবং উচ্চতর ও সুদূরপ্রসারী ধনাত্মক বিস্তৃতিতে উক্ত ঘােষণার সুর ঝংকৃত। ঘােষণা ও পরিচিতি দানের সুর মূর্তমান হয়ে ওঠেছে সূরাটির আলােড়ন সৃষ্টিকারী সূচনাতেও। একটি মাত্র শব্দ ‘আর রাহমান’ দিয়ে এমন ভংগিতে সূরাটির সূচনা করা হয়েছে যে, শ্রোতা এর পরবর্তী বক্তব্য শোনার জন্যে ব্যাকুলভাবে অপেক্ষা করতে থাকে। আর রাহমান একটি মাত্র শব্দ, যার অর্থের মধ্যে রয়েছে দয়া, কৃপা ও করুণা, আর যার ধ্বনিতে রয়েছে ঘােষণার সুর। এই সূচনার পরেই সমগ্র সূরা জুড়ে বিস্তৃত রয়েছে আল্লাহর দয়া ও কৃপার বিবরণ এবং দয়াময়ের নেয়ামত ও অবদানসমূহের উপস্থাপনা। আল্লাহর এই নেয়ামতসমূহের বিবরণ শুরু হয়েছে কোরআন শিক্ষাদানের উল্লেখের মধ্য দিয়ে। এভাবে কোরআন শিক্ষাদানকে মানব জাতির ওপর আল্লাহর সবচেয়ে বড় দান হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এমনকি এটিকে স্বয়ং মানুষের সৃষ্টি এবং তাকে বাকশক্তি ও বিশ্লেষণ শক্তি প্রদানেরও আগে উল্লেখ করা হয়েছে। কোরআনের শিক্ষাদানজনিত অবদানের পরই উল্লেখ করা হয়েছে মানব সৃষ্টি ও মানুষকে সবচেয়ে বড় মানবীয় গুণ বাকশক্তি ও বিশ্লেষণ শক্তি প্রদানের বিষয়টি। এরপর একে একে এসেছে সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্র, তরুলতা, সুউচ্চ আকাশ, সুপ্রতিষ্ঠিত দাঁড়িপাল্লা, পৃথিবী ও তার পৃষ্ঠে উৎপন্ন ফল, ফুল, খেজুর ও ফসলাদি, জ্বিন, মানুষ, দুই উদয়াচল, দুই অস্তাচল, দুই সমুদ্র, যার মাঝখানে অলংঘনীয় ব্যবধান রয়েছে, সমুদ্রের মধ্য থেকে নির্গত মূল্যবান রত্নরাজি এবং তার উপর দিয়ে চলাচলকারী নৌযান সমূহের বিবরণ। এ সৰ প্ৰধান প্রধান নিদর্শনের উল্লেখের পর উপস্থাপিত হয়েছে এই গোটা সৃষ্টির সার্বিক ধ্বংস ও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার দৃশ্য। আর গােটা সৃষ্টির ধ্বংসের পর চিরঞ্জীব ও চিরস্থায়ী মহান স্রষ্টা আল্লাহর অম্লান অক্ষয় সত্ত্বাকে দেখানাে হয়েছে। তাঁরই স্বাধীন সার্বভৌম ইচ্ছার কাছে গােটা সৃষ্টি বিনয়াবনত ও আত্মসমর্পিত। সমগ্র সৃষ্টিজগতের চূড়ান্ত ধ্বংস ও স্রষ্টার চিরঞ্জীব চির অক্ষয় থাকার বিবরণ দেয়ার পর জ্বিন ও মানব জাতিকে লক্ষ্য করে উচ্চারিত হয়েছে ভীতিপ্রদ হুমকি ও মহাজাগতিক চ্যালেঞ্জ। ‘ওহে দুই জাতি (জ্বিন ও মানব), অচিরেই আমি তােমাদের জন্যে একাগ্রচিত্ত হয়ে যাবাে, হে জ্বীন ও মানব জাতি, তােমরা যদি আকাশ ও পৃথিবীর সীমারেখা অতিক্রম করতে সক্ষম হয়ে থাকো, তবে অতিক্রম করো। বিশেষ ক্ষমতা ব্যতীত কখনাে অতিক্রম করতে পারবে না।’ এরপর থেকে দেখানাে হয়েছে সৃষ্টিজগতের ধ্বংস তথা কেয়ামতের দৃশ্য। একটি প্রাকৃতিক দৃশ্যের আকারে তা দেখানাে হয়েছে। আকাশের দৃশ্যকে একটি লাল তরল পদার্থের আকারে তুলে ধরা হয়েছে। দেখানাে হয়েছে অপরাধীদের আযাবের দৃশ্য এবং অপেক্ষাকৃত বিস্তারিত বিবরণ দেয়া হয়েছে আল্লাহভীরুদের উত্তম প্রতিদানের। অবশেষে এই বলে নেয়ামতের বিবরণের উপসংহার টানা হয়েছে, ‘তোমার মহামহিম ও মহাপরাক্রমশালী প্রভুর নাম কল্যাণময় হোক।’ গােটা সূরাই যে বিশাল সৃষ্টির উন্মুক্ত প্রান্তরে আল্লাহর নেয়ামতসমূহের বিবরণ ও ঘােষণা স্বরূপ, তা আগেই বলেছি। মহান আল্লাহর সুউচ্চ দরবার থেকেই এ ঘােষণা এসেছে। এ ঘােষণায় সৃষ্টিজগত প্রতিধ্বনিত হয় এবং সৃষ্টিজগতের সকল প্রাণী ও বন্ধু তা প্রত্যক্ষ করে থাকে। এবারে সূরাটির ব্যাখ্যায় মনােনিবেশ করছি।
ফী জিলালিল কুরআন:
‘আর রাহমান’ অর্থাৎ পরম দয়ালু। এই শব্দটির সুদূরপ্রসারী সুরে গােটা সৃষ্টিজগত ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত। গােটা আকাশ ও পৃথিবী আলােড়িত। প্রত্যেক প্রাণীর হৃদয় ও কান এতে ঝংকৃত ও উদ্দীপিত। *মানবজাতির শিক্ষার উৎস : এরপর গােটা বিশ্বজগত যেন পরবর্তী বক্তব্য শােনার অধীর প্রতীক্ষায় হয়ে পড়ে নিঝুম নিস্তব্ধ। আর তখনি আসে প্রতীক্ষিত সেই বক্তব্য, যার জন্যে গােটা সৃষ্টির বিবেক ব্যাকুল, ‘তিনি শিক্ষা দিয়েছেন কোরআন। সৃষ্টি করেছেন মানুষকে। তাকে শিখিয়েছেন বর্ণনা ও বিশ্লেষণ।… অতপর তােমরা তােমাদের প্রতিপালকের কোন নেয়ামতকে অস্বীকার করবে?’ এ হচ্ছে দয়াময় আল্লাহর নেয়ামতরাজির বিবরণ সম্বলিত সূরার প্রথম অংশ । পূর্বোক্ত ঘোষণার পর এ হচ্ছে তার প্রথম বক্তব্য। ‘তিনি কোরআন শিক্ষা দিয়েছেন।’ মানব জাতির ওপর আল্লাহর সবচেয়ে বড় অবদান হচ্ছে কোরআন। বিশ্বজগতের কাছে প্রেরিত আল্লাহর বাণীসমূহের পূর্ণাংগ ও সঠিক বাহন হচ্ছে কোরআন। কোরআন হচ্ছে পৃথিবীবাসীর জন্যে প্রদত্ত আল্লাহর সেই বিধান, পৃথিবীবাসীকে তার সৃষ্টির উদ্দেশ্যের সাথে সংযুক্ত করে এবং বিশ্বজগত যে অটল ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত তার ওপর মানব জাতির আকীদা বিশ্বাস, চিন্তাধারা, মূল্যবােধ, জীবন পদ্ধতি ও জীবনাচারকে প্রতিষ্ঠিত করে, আর এর মাধ্যমে তাকে দেয় শান্তি, পরিতৃপ্তি এবং বিশ্ব প্রকৃতির সাথে গড়ে তােলে তার সমঝােতা ও সখ্যতা। যে কোরআন তাদের আবেগ অনুভূতিকে এই মনােরম বিশ্ব প্রকৃতির ওপর উক্ত ও অবারিত করে দেয়, সেই কোরআন যেন এবারই সর্বপ্রথম তাদের প্রত্যক্ষ করছে এবং তার নিজের সত্ত্বার প্রতি ও তার পারিপার্শ্বিক সৃষ্টির প্রতি মানব জাতির অনুভূতি ও চেতনাকে সজাগ সতেজ করে তুলছে। শুধু তাই নয়, তার পারিপার্শ্বিক প্রতিটি বস্তুকে এমন সক্রিয় ও সজীব করে তুলছে যে, তা মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে ওঠে ও সাড়া দেয়। ফলে মানুষ এই পৃথিবীতে অবস্থান করা ও চলাফেরার সময় নিজেকে অচেতন পদার্থসমূহের মধ্যে নয়; বরং জীবন্ত সাথী ও বন্ধুদের মধ্যে অবস্থানরত বলে অনুভব করে। এই কোরআনই তাে মানুষের অন্তরে এই অনুভূতির সৃষ্টি করে যে, সে পৃথিবীতে আল্লাহর খলীফা বা প্রতিনিধি, আল্লাহর কাছে সম্মানিত এবং যে আমানত বহন করতে আকাশ, পৃথিবী ও পাহাড় পর্বত ভয় পেয়েছিলাে, তারা সেই আমানতেরই বাহক। অতপর তাদের শিক্ষা দেয় কিভাবে তাদের মনুষ্যত্বের মান সর্বোচ্চ পর্যায়ে উন্নীত করা যায় । কোরআন তাদের একমাত্র উপকরণ ঈমানকে কাজে লাগিয়ে তা উচ্চতম মানে উন্নীত করতে শেখায়। এই ঈমান তাদের আত্মায় আল্লাহর উজ্জীবনী শক্তি সঞ্চারিত করে এবং তার সর্ববৃহৎ নেয়ামতকে মানুষের জীবনে বাস্তবায়িত করে। এ জন্যেই মানব সৃষ্টির আগে কোরআন শিক্ষাদানের উল্লেখ করা হয়েছে। কেননা কোরআন শিক্ষালাভের পরই মানুষের জীবনে ও সত্ত্বায় প্রকৃত মনুষ্যত্ব বাস্তবায়িত হয়।
ফী জিলালিল কুরআন:
*মানুষকে কথা বলার ক্ষমতা দান : আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছে, তাকে বর্ণনা ও বিশ্লেষণ করা শিখিয়েছেন।’ এখানে প্রথমে যে মানব সৃষ্টির উল্লেখ করা হয়েছে, সে বিষয়ে আলােচনা আপাতত স্থগিত রাখছি। কেননা, কিছু পরেই যথাস্থানে এর আলােচনা আসছে। এখানে মানব সৃষ্টির উল্লেখ করার উদ্দেশ্যই হলাে এর অব্যবহিত পরে উল্লিখিত বাকশক্তি ও বর্ণনা শক্তি প্রদান। মানুষের কথা বলা, কোনাে কিছুর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করা, বর্ণনা দেয়া, সমঝোতা করা, আলাপ বিনিময় করা আমাদের কাছে সুপরিচিত। আমরা অনবরতই মানুষকে কথাবার্তা বলতে দেখে থাকি। দীর্ঘকাল ধরে এটা দেখতে থাকার কারণে আমরা ভুলে গেছি যে, এটা কত বড় একটা দান এবং কত বড় একটা অলৌকিক শক্তি। তাই কোরআন আমাদের এই জিনিসটা নিয়ে নতুন করে চিন্তাভাবনা করতে বিভিন্ন জায়গায় উদ্বুদ্ধ করে থাকে। এখন প্রশ্ন এই যে, মানুষ কী? তার উৎস কোথায়? কিভাবে তার সৃষ্টির সূচনা হয়েছে এবং কিভাবে তাকে বর্ণনা ও বিশ্লেষণ করা শেখানাে হয়। মানুষের মূল হলাে একটি মাত্র জীবকোষ, যার জীবনের সূচনা ও উৎপত্তি ঘটে জরায়ুতে এবং যা এতাে ক্ষুদ্র, এতাে সূক্ষ্ম এবং এতে নগণ্য যে, শুধুমাত্র অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়েই তা দেখা যায়। শুরুতে তার অবস্থা এমন থাকে যে, তার কথা বলা তো দূরের কথা, সে সহজে দৃষ্টিগােচরই হয় না। অথচ এই কোষ অচিরেই একটি সজীব দেহের রূপ ধারণ করে। গর্ভস্থ এই মানবদেহ কোটি কোটি কোষের সমষ্টি। এসব কোষ নানা রকমের। কোনােটি কঠিন অস্থি সংক্রান্ত, কোনােটি কোমল অস্থি সংক্রান্ত, কোনােটি মাংস সংক্রান্ত, কোনােটি স্নায়ু সংক্রান্ত এবং কোনােটি চর্ম সংক্রান্ত ইত্যাদি। এ সব কোষ থেকেই উৎপত্তি ঘটে অংগ প্রত্যংগের, ইন্দ্রিয়সমূহের এবং তাদের বিস্ময়কর কাজ যথা শ্রবণ, দর্শন, আস্বাদন, ঘ্রাণ লওয়া, স্পর্শ করা এবং সবচেয়ে অলৌকিক ও বিস্ময়ােদ্দীপক কাজ উপলব্ধি করা, বর্ণনা করা বা কথা বলা, অনুভব করা ও প্রজ্ঞা। এসব কিছুই জন্ম লাভ করে এই একটি মাত্র অতি ক্ষুদ্র, অতি নগণ্য, অদৃষ্টিগোচর ও অবলা কোষ থেকে। কিভাবে ও কোথা থেকে এটা সম্ভব? একমাত্র পরম দয়ালু (আর রাহমান) আল্লাহর পক্ষ থেকে ও তারই নিপুণ কর্ম দ্বারা এটা সম্ভব হয়ে থাকে। এবার দেখা যাক, কিভাবে মানুষের কথা বলার বা বর্ণনা করার শক্তির উৎপত্তি ঘটে। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘আল্লাহ তায়ালা তােমাদেরকে তােমাদের জননীদের উদর থেকে বের করেছেন। সে সময়ে তােমরা কিছুই জানতে না। তিনি তােমাদের জন্যে কান, চোখ ও অন্তর বানিয়ে দিয়েছেন।’ শুধু কথা বলার শক্তি ও অংগ প্রত্যংগ সৃষ্টি করাই এমন এক অপার বিস্ময় যা ভেবে কুল কিনারা পাওয়া যায় না। যে অংগগুলাে একত্রিত হয়ে মানুষের কথা বলা ও উচ্চারণ করার কাজটি সম্পন্ন করে তা হচ্ছে, জিহ্বা, দুই ঠোট, চোয়াল, দাঁত, গলা, আলা জিহ্বা, শ্বাসনালী ও ফুসফুস। এ অংগগুলাে দ্বারা শব্দ উচ্চারণের জটিল যান্ত্রিক কাজটি সম্পন্ন হয়ে থাকে মাত্র, যা পরবর্তী পর্যায়ে কান, মগয ও স্নায়ুমন্ডলীর সাথেও সম্পৃক্ত হয়ে থাকে, অতপর বিবেক বা বুদ্ধির সাথে সম্পৃক্ত হয়ে থাকে। এই বিবেক জিনিসটা যে কী, তা আমাদের অজানা। আমরা শুধু এর নামই জানি। এর মূল রহস্য কী জানি না। এমনকি এর কাজ কী এবং কাজের পদ্ধতি কী তাও প্রায় আমাদের অজানা। এভাবে একজন মানুষ একটি শব্দ উচ্চারণ করে? এটি একটি জটিল কাজ। অনেকগুলাে স্তর পার হয়ে, অনেকগুলাে সরঞ্জাম ব্যবহার করে ও অনেকগুলাে তৎপরতা চালিয়ে এ কাজটি সম্পন্ন করা হয়। সে স্তর ও সরঞ্জামের অনেকগুলােই এখনাে অজানা ও গােপন। কাজটি শুরু হয় এভাবে যে, প্রথমে একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে একটি নির্দিষ্ট শব্দ উচ্চারণের প্রয়ােজনীয়তা অনুভব করা হয়। অতপর এই অনুভূতি বিবেক বা বােধশক্তি বা আত্মা থেকে কার্যকর অনুভব যন্ত্র হিসেবে মন্তিষ্কে স্থানান্তরিত হয়। কিভাবে হয় তা কেউ জানে না। মতান্তরে মস্তিষ্ক স্নায়ুমন্ডলীর মাধ্যমে কাংখিত বাক্যটি বলার আদেশ প্রেরণ করে। এই শব্দটি স্বয়ং আল্লাহ তায়ালাই শিখিয়েছেন এবং তিনিই এর অর্থও জানিয়ে দিয়েছেন। এই পর্যায়ে ফুসফুস তার অভ্যন্তরে সঞ্চিত বাতাসের খানিকটা বের করে দেয়। এই বাতাসটুকু শ্বাসনালী দিয়ে কণ্ঠনালীতে ও তার বিস্ময়কর যন্ত্রগুলােতে পৌছে। এই যন্ত্রগুলাের সাথে মানুষের তৈরী কোনাে যন্ত্রপাতির তুলনা হয় না। এমনকি শব্দ উচ্চারণে ব্যবহৃত সকল অংগ প্রত্যংগ থেকে এটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ও অতুলনীয়। এখানে যে বাতাস পৌছে তা কন্ঠে এক শব্দের সৃষ্টি করে। অতপর বিবেক নিজের ইচ্ছামত সে শব্দের রূপান্তর ঘটায়। বিবেকই তাকে বিকট, কিংবা ছােট, দ্রুত কিংবা ধীরগতি সম্পন্ন এবং কর্কশ কিংবা সুরেলা শব্দে পরিণত করে। অতপর কণ্ঠনালীর সাথে জিহবা, ঠোট, চোয়াল ও দাঁত মিলিত হয়ে উক্ত শব্দকে সুনির্দিষ্ট অক্ষরের আকারে উচ্চারিত করে। বিশেষত জিহ্বার বিভিন্ন স্থানে এসে তা সুনির্দিষ্ট রূপ লাভ করে। এ হচ্ছে একটি মাত্র শব্দ তৈরীর প্রক্রিয়া। এরপর রয়েছে বাক্য তৈরী, বিষয় নির্বাচন, ধ্যান ধারণা ও পূর্ববর্তী বা পরবর্তী আবেগ অনুভূতি নির্ণয়ের কাজ। এর প্রতিটিই এক একটা বিচিত্র জগত, যা এই বিস্ময়কর প্রাণী মানুষের ভেতরে জন্ম লাভ করে। এটা একমাত্র আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহের ফলেই জন্ম লাভ করে থাকে।