Motaher21.net أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ ( বই # ১১৫৩) [*‌‌ভালভাবে জেনে রাখো দুনিয়ার এ জীবন, একটা:- *দৌড়াও এবং একে অপরের চেয়ে অগ্রগামী হওয়ার চেষ্টা করো:- *যমীনে বা ব্যক্তিগতভাবে তোমাদের উপর যে বিপর্যয়ই আসে তা:- *কিতাব ও মিযান নাযিল করেছি যাতে মানুষ ইনসাফের ওপর প্রতিষ্ঠিত হতে পারে:- *বৈরাগ্যবাদ তো তারা নিজেরাই উদ্ভাবন করে নিয়েছে:-] www.motaher21.net সূরা:৫৭:আল-হাদীদ। পারা:২৭ ২০-২৯ নং আয়াত:- আয়াতের ব্যাখ্যা:- ১) তাফসীরে ফী জিলালিল কুরআন:- ২) তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ

Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১১৫৩)
[*‌‌ভালভাবে জেনে রাখো দুনিয়ার এ জীবন, একটা:-
*দৌড়াও এবং একে অপরের চেয়ে অগ্রগামী হওয়ার চেষ্টা করো:-
*যমীনে বা ব্যক্তিগতভাবে তোমাদের উপর যে বিপর্যয়ই আসে তা:-
*কিতাব ও মিযান নাযিল করেছি যাতে মানুষ ইনসাফের ওপর প্রতিষ্ঠিত হতে পারে:-
*বৈরাগ্যবাদ তো তারা নিজেরাই উদ্ভাবন করে নিয়েছে:-]
www.motaher21.net
সূরা:৫৭:আল-হাদীদ।
পারা:২৭
২০-২৯ নং আয়াত:-
আয়াতের ব্যাখ্যা:-
১) তাফসীরে ফী জিলালিল কুরআন:-
২) তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:-
৩) তাফসীরে ইবনে কাছীর:-

সূরা:৫৭:আল-হাদীদ:-২০
اِعۡلَمُوۡۤا اَنَّمَا الۡحَیٰوۃُ الدُّنۡیَا لَعِبٌ وَّ لَہۡوٌ وَّ زِیۡنَۃٌ وَّ تَفَاخُرٌۢ بَیۡنَکُمۡ وَ تَکَاثُرٌ فِی الۡاَمۡوَالِ وَ الۡاَوۡلَادِ ؕ کَمَثَلِ غَیۡثٍ اَعۡجَبَ الۡکُفَّارَ نَبَاتُہٗ ثُمَّ یَہِیۡجُ فَتَرٰىہُ مُصۡفَرًّا ثُمَّ یَکُوۡنُ حُطَامًا ؕ وَ فِی الۡاٰخِرَۃِ عَذَابٌ شَدِیۡدٌ ۙ وَّ مَغۡفِرَۃٌ مِّنَ اللّٰہِ وَ رِضۡوَانٌ ؕ وَ مَا الۡحَیٰوۃُ الدُّنۡیَاۤ اِلَّا مَتَاعُ الۡغُرُوۡرِ ﴿۲۰﴾
ভালভাবে জেনে রাখো দুনিয়ার এ জীবন, একটা খেলা, হাসি তামাসা, বাহ্যিক চাকচিক্য, তোমাদের পারস্পরিক গৌরব ও অহংকার এবং সন্তান-সন্ততি ও অর্থ-সম্পদে পরস্পরকে অতিক্রম করার চেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়। এর উপমা হচ্ছে, বৃষ্টি হয়ে গেল এবং তার ফলে উৎপন্ন উদ্ভিদরাজি দেখে কৃষক আনন্দে উৎফূল্ল হয়ে উঠলো। তারপর সে ফসল পেকে যায় এবং তোমরা দেখতে পাও যে, তা হলদে বর্ণ ধারণ করে এবং পরে তা ভূষিতে পরিণত হয়। পক্ষান্তরে আখেরাত এমন স্থান যেখানে রয়েছে কঠিন আযাব, আল্লাহর ক্ষমা ও সন্তুষ্টি। পার্থিব জীবন প্রতারণার উপকরণ ছাড়া আর কিছুই নয়।
সূরা:৫৭:আল-হাদীদ:-২১
سَابِقُوۡۤا اِلٰی مَغۡفِرَۃٍ مِّنۡ رَّبِّکُمۡ وَ جَنَّۃٍ عَرۡضُہَا کَعَرۡضِ السَّمَآءِ وَ الۡاَرۡضِ ۙ اُعِدَّتۡ لِلَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا بِاللّٰہِ وَ رُسُلِہٖ ؕ ذٰلِکَ فَضۡلُ اللّٰہِ یُؤۡتِیۡہِ مَنۡ یَّشَآءُ ؕ وَ اللّٰہُ ذُو الۡفَضۡلِ الۡعَظِیۡمِ ﴿۲۱﴾
দৌড়াও এবং একে অপরের চেয়ে অগ্রগামী হওয়ার চেষ্টা করো – তোমার রবের মাগফিরাতের দিকে এবং সে জান্নাতের দিকে যার বিস্তৃতি আসমান ও যমীনের মত।তা প্রস্তুত রাখা হয়েছে সে লোকদের জন্য যারা আল্লাহ‌ ও তাঁর রসূলদের প্রতি ঈমান এনেছে। এটা আল্লাহর অনুগ্রহ। যাকে ইচ্ছা তিনি তা দান করেন। আল্লাহ‌ বড়ই অনুগ্রহশীল।
সূরা:৫৭:আল-হাদীদ:-২২
مَاۤ اَصَابَ مِنۡ مُّصِیۡبَۃٍ فِی الۡاَرۡضِ وَ لَا فِیۡۤ اَنۡفُسِکُمۡ اِلَّا فِیۡ کِتٰبٍ مِّنۡ قَبۡلِ اَنۡ نَّبۡرَاَہَا ؕ اِنَّ ذٰلِکَ عَلَی اللّٰہِ یَسِیۡرٌ ﴿ۚۖ۲۲﴾
যমীনে বা ব্যক্তিগতভাবে তোমাদের উপর যে বিপর্যয়ই আসে তা সংঘটিত হওয়ার পূর্বেই আমরা তা কিতাবে লিপিবদ্ধ রেখেছি । নিশ্চয় আল্লাহর পক্ষে এটা খুব সহজ।
সূরা:৫৭:আল-হাদীদ:-২৩
لِّکَیۡلَا تَاۡسَوۡا عَلٰی مَا فَاتَکُمۡ وَ لَا تَفۡرَحُوۡا بِمَاۤ اٰتٰىکُمۡ ؕ وَ اللّٰہُ لَا یُحِبُّ کُلَّ مُخۡتَالٍ فَخُوۡرِۣ ﴿ۙ۲۳﴾
যাতে যে ক্ষতিই তোমাদের হয়ে থাকুক তাতে তোমরা মনক্ষুন্ন না হও। আর আল্লাহ‌ তোমাদের যা দান করেছেন। সেজন্য গর্বিত না হও। যারা নিজেরা নিজেদের বড় মনে করে এবং অহংকার করে,
সূরা:৫৭:আল-হাদীদ:-২৪
الَّذِیۡنَ یَبۡخَلُوۡنَ وَ یَاۡمُرُوۡنَ النَّاسَ بِالۡبُخۡلِ ؕ وَ مَنۡ یَّتَوَلَّ فَاِنَّ اللّٰہَ ہُوَ الۡغَنِیُّ الۡحَمِیۡدُ ﴿۲۴﴾
নিজেরাও কৃপণতা করে এবং মানুষকেও কৃপণতা করতে উৎসাহ দেয় আল্লাহ তাদের পছন্দ করেন না। এরপরও যদি কেউ মুখ ফিরিয়ে নেয় তাহলে আল্লাহ‌ অভাবশূন্য ও অতি প্রশংসিত।
সূরা:৫৭:আল-হাদীদ:-২৫
لَقَدۡ اَرۡسَلۡنَا رُسُلَنَا بِالۡبَیِّنٰتِ وَ اَنۡزَلۡنَا مَعَہُمُ الۡکِتٰبَ وَ الۡمِیۡزَانَ لِیَقُوۡمَ النَّاسُ بِالۡقِسۡطِ ۚ وَ اَنۡزَلۡنَا الۡحَدِیۡدَ فِیۡہِ بَاۡسٌ شَدِیۡدٌ وَّ مَنَافِعُ لِلنَّاسِ وَ لِیَعۡلَمَ اللّٰہُ مَنۡ یَّنۡصُرُہٗ وَ رُسُلَہٗ بِالۡغَیۡبِ ؕ اِنَّ اللّٰہَ قَوِیٌّ عَزِیۡزٌ ﴿٪۲۵﴾
আমি আমার রসূলদের সুস্পষ্ট নিদর্শনসমূহ এবং হিদায়াত দিয়ে পাঠিয়েছি। তাদের সাথে কিতাব ও মিযান নাযিল করেছি যাতে মানুষ ইনসাফের ওপর প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। আর লোহা নাযিল করেছি যার মধ্যে বিরাট শক্তি এবং মানুষের জন্য বহুবিধ কল্যাণ রয়েছে। এটা করা হয়েছে এজন্য যে, আল্লাহ জেনে নিতে চান কে তাঁকে না দেখেই তাঁকে ও তাঁর রসূলদেরকে সাহায্য করে। নিশ্চিতভাবেই আল্লাহ অত্যন্ত শক্তিধর ও মহাপরাক্রমশালী।
সূরা:৫৭:আল-হাদীদ:-২৬
وَ لَقَدۡ اَرۡسَلۡنَا نُوۡحًا وَّ اِبۡرٰہِیۡمَ وَ جَعَلۡنَا فِیۡ ذُرِّیَّتِہِمَا النُّبُوَّۃَ وَ الۡکِتٰبَ فَمِنۡہُمۡ مُّہۡتَدٍ ۚ وَ کَثِیۡرٌ مِّنۡہُمۡ فٰسِقُوۡنَ ﴿۲۶﴾
অবশ্যই আমি নূহ ও ইব্রাহীমকে রসূলরূপে প্রেরণ করেছিলাম এবং আমি তাদের বংশধরদের জন্য স্থির করেছিলাম নবুঅত ও কিতাব, কিন্তু তাদের কিছু সংখ্যক সৎপথ অবলম্বন করেছিল এবং বহু সংখ্যক ছিল সত্যত্যাগী।
সূরা:৫৭:আল-হাদীদ:-২৭
ثُمَّ قَفَّیۡنَا عَلٰۤی اٰثَارِہِمۡ بِرُسُلِنَا وَ قَفَّیۡنَا بِعِیۡسَی ابۡنِ مَرۡیَمَ وَ اٰتَیۡنٰہُ الۡاِنۡجِیۡلَ ۬ۙ وَ جَعَلۡنَا فِیۡ قُلُوۡبِ الَّذِیۡنَ اتَّبَعُوۡہُ رَاۡفَۃً وَّ رَحۡمَۃً ؕ وَ رَہۡبَانِیَّۃَۨ ابۡتَدَعُوۡہَا مَا کَتَبۡنٰہَا عَلَیۡہِمۡ اِلَّا ابۡتِغَآءَ رِضۡوَانِ اللّٰہِ فَمَا رَعَوۡہَا حَقَّ رِعَایَتِہَا ۚ فَاٰتَیۡنَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا مِنۡہُمۡ اَجۡرَہُمۡ ۚ وَ کَثِیۡرٌ مِّنۡہُمۡ فٰسِقُوۡنَ ﴿۲۷﴾
তাদের পর আমি একের পর এক আমার রসূলগণকে পাঠিয়েছি। তাদের সবার শেষে মারয়ামের পুত্র ঈসাকে পাঠিয়েছি, তাঁকে ইনজীল দিয়েছি এবং তাঁর অনুসারীদের মনে দয়া ও করুণার সৃষ্টি করেছি। আর বৈরাগ্যবাদ তো তারা নিজেরাই উদ্ভাবন করে নিয়েছে। আমি ওটা তাদের ওপর চাপিয়ে দেইনি। আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় তারা নিজেরাই এ বিদয়াত বানিয়ে নিয়েছে। তারপর সেটি যেভাবে মেনে চলা দরকার, সেভাবে মেনেও চলেনি।তাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছিল, তাদের প্রতিদান আমি দিয়েছি। তবে তাদের অধিকাংশই পাপী।
সূরা:৫৭:আল-হাদীদ:-২৮
یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللّٰہَ وَ اٰمِنُوۡا بِرَسُوۡلِہٖ یُؤۡتِکُمۡ کِفۡلَیۡنِ مِنۡ رَّحۡمَتِہٖ وَ یَجۡعَلۡ لَّکُمۡ نُوۡرًا تَمۡشُوۡنَ بِہٖ وَ یَغۡفِرۡ لَکُمۡ ؕ وَ اللّٰہُ غَفُوۡرٌ رَّحِیۡمٌ ﴿ۚۙ۲۸﴾
হে মুমিনগন ! আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বল কর এবং তাঁর রাসূলের উপর ঈমান আন। তিনি তাঁর অনুগ্রহে তোমাদেরকে দেবেন দ্বিগুন পুরুষ্কার এবং তিনি তোমাদেরকে দেবেন নূর, যার সাহায্যে তোমারা চলবে এবং তিনি তোমাদেরকে ক্ষমা করবেন। আর আল্লাহ্‌ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।
সূরা:৫৭:আল-হাদীদ:-২৯
لِّئَلَّا یَعۡلَمَ اَہۡلُ الۡکِتٰبِ اَلَّا یَقۡدِرُوۡنَ عَلٰی شَیۡءٍ مِّنۡ فَضۡلِ اللّٰہِ وَ اَنَّ الۡفَضۡلَ بِیَدِ اللّٰہِ یُؤۡتِیۡہِ مَنۡ یَّشَآءُ ؕ وَ اللّٰہُ ذُو الۡفَضۡلِ الۡعَظِیۡمِ ﴿٪۲۹﴾
যাতে কিতাবধারীরা জানতে পারে যে, আল্লাহর অনুগ্রহের ওপর তাদের একচেটিয়া অধিকার নেই, বরং আল্লাহর অনুগ্রহ নিরংকুশভাবে আল্লাহরই হাতে নিবদ্ধ। তিনি যাকে চান তা দেন। তিনি বড়ই অনুগ্রহশীল।

২০-২৯ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
ফী জিলালিল কুরআন:-

ইতিপূর্বে ঈমান এবং আল্লাহর পথে ত্যাগ ও কোরবানীর যে আহবান জানানাে হয়েছে, পরবর্তী আয়াতে তারই পর্যালােচনা করা হয়েছে। এ পর্যালােচনায় সমগ্র দুনিয়ার জীবনকে অত্যন্ত নিকৃষ্ট ও তুচ্ছ করে দেখানাে হয়েছে, মানুষকে তার মােহমুক্ত হতে বলা হয়েছে এবং তাকে আখেরাত ও তার মর্যাদার বিষয়ে সজাগ করা হয়েছে। *পার্থিব জীবন সম্পর্কিত সঠিক বাস্তববাদী দর্শন : ‘তোমরা জেনে রাখাে, দুনিয়ার জীবন খেলাধুলা, তামাশা ও চাকচিক্য, তােমাদের পরস্পরের মধ্যকার বড়াই ও গর্ব এবং ধনসম্পদ ও সন্তান-সন্তুতির সংখ্যা বৃদ্ধির প্রতিযােগিতা ছাড়া আর কিছু নয়…’ বস্তুত দুনিয়ার জীবনকে যখন দুনিয়াবী দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয় ও দুনিয়াবী মানদন্ডে যাচাই করা হয়, তখন তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও বিরাট মনে হয়, কিন্তু তাকে যখন আখেরাতের মানদন্ডে যাচাই করা হয়, তখন অত্যন্ত তুচ্ছ ও নগণ্য বস্তু বলে মনে হয়। এখানে দুনিয়াকে আখেরাতের তুলনায় নিছক শিশুদের খেলাধূলার বস্তুতে চিত্রিত করা হয়েছে। দুনিয়ার খেলাধুলা সাংগ হলে দুনিয়াবাসী তার কর্মফল ভােগ করতে আখেরাতের জগতে পাড়ি জমায়। দুনিয়ার যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যস্ততা ও আয়ােজন অনুষ্ঠান ইত্যাদিকে মাত্র এই শব্দ কটির মধ্য দিয়ে চিত্রিত করা হয়েছে: খেলাধুলা, সৌন্দর্যচর্চা, পারস্পরিক গর্ব, পরস্পরের মধ্যে সম্পদ বৃদ্ধির প্রতিযােগিতা। অতপর কোরআনের অভিনব রীতি অনুসারে এর উদাহরণ দেয়া হয়েছে যে, ঠিক সেই মেঘের মতাে যার কল্যাণে উদ্গত উদ্ভিদ কৃষকদের মুগ্ধ করে। এখানে কুফফার শব্দটি (কাফেরের বহুবচন), অর্থ কৃষককুল। কুফর শব্দের আভিধানিক অর্থ কোনাে কিছু লুকানাে বা গােপন করা। কৃষক এই অর্থে কাফের যে, সে বীজ মাটির নীচে ঢেকে দেয় ও লুকিয়ে রাখে, অর্থাৎ বপন করে। তবে শব্দটি এখানে প্রয়ােগ দ্বারা এই মর্মে ইংগিত করা হয়েছে যে, দুনিয়ার জীবনের প্রতি কাফেরদের প্রলুব্ধ হওয়া কৃষকের একটি উদ্ভিদ দেখে মুগ্ধ ও আনন্দে আত্মহারা হওয়ার মতােই হাস্যকর। কেননা, ‘অচিরেই তা পেকে যায় এবং তুমি তাকে হলুদ দেখতে পাও। অর্থাৎ তা কাটার উপযুক্ত হয়ে যায়। কেননা, উদ্ভিদের আয়ুষ্কাল সীমাবদ্ধ। তা দ্রুত শেষ হয়ে যায়। অতপর তা ধ্বংস হয়ে যায়। মানুষের নিত্যকার সুপরিচিত এই চলমান দৃশ্যের মতােই সমগ্র দুনিয়ার জীবনের ভিডিও টেপ এভাবেই শেষ পরিণতির দৃশ্যে পৌছে যায়, আর এই শেষ পরিণতি হলাে ধ্বংস। আখেরাতের অবস্থা এ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। আখেরাতের সেই ভিন্নতা স্বাতন্ত্র্য বিবেচনায় রেখেই তার জন্যে প্রস্তুতি নেয়া উচিত। আর আখেরাতে রয়েছে কঠিন শাস্তি এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে ক্ষমা ও সন্তোষ। অতএব, সেটা দুনিয়ার মতাে ক্ষণস্থায়ী ও নশ্বর নয় এবং এ উদ্ভিদটির মতাে ধ্বংসশীল নয়। হিসাব নিকাশ ও স্থায়িত্বই হলাে আখেরাতের বৈশিষ্ট্য এবং এ জন্যেই তা অগ্রাধিকার পাওয়ার যােগ্য। ‘দুনিয়ার জীবন কল্পনার ধন ব্যতীত আর কিছু নয়।’ অর্থাৎ দুনিয়ায় যা কিছু সম্পদ রয়েছে, তার নিজস্ব কোনাে অবস্থান ও স্থিতি নেই, শুধুমাত্র প্রবঞ্চনাপূর্ণ কল্পনায় ডুবিয়ে শেষ করে দেয়। মানুষ যদি গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা ও বিচার-বিবেচনা করে, তাহলে বুঝতে পারে, এটি একটি পরম সত্য। তবে এই পরম সত্য দ্বারা কোরআন মানুষকে পার্থিব জীবন থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন করে সংসারত্যাগী বানাতে চায় না, মানুষের ওপর পৃথিবীকে গড়ার ও পৃথিবীতে খেলাফতের যে দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে তাকে অবহেলাও করতে চায় না। (সূরা আয যারিয়াত ওয়ামা খালাকতুল জিন্না ওয়াল ইনসা ইল্লা লিইয়া’বুদন’ আয়াতটির তাফসীর দ্রষ্টব্য) বস্তুত এ দ্বারা সে চায় মানুষের আবেগ অনুভূতির মানদন্ড ও মূল্যবােধকে বিশুদ্ধ করতে এবং তাকে নশ্বর পার্থিব সম্পদের লালসা ও তার আকর্ষণের উর্ধে স্থান দিতে। এই সূরা নাযিল হবার সময়কার মােমেনদের যেমন উক্ত লালসা ও আকর্ষণের উর্ধ্বে ওঠা তাদের ঈমান বাস্তব রূপদানের স্বার্থে অপরিহার্য ছিলাে, তেমনি প্রত্যেক মােমেনেরই নিজ ঈমান ও আকীদাকে বাস্তব রূপ দেয়ার জন্যে এর প্রয়ােজন রয়েছে। এমনকি এই বাস্তব রূপদানের জন্যে যদি গােটা পার্থিব জীবনও বিসর্জন দিতে হয়, তবু তা দিতে কুন্ঠিত হওয়া উচিত না। এ জন্যে প্রকৃত প্রতিযােগিতার ময়দানে এবং যে মহতী লক্ষ্যে প্রকৃতপক্ষে প্রতিযােগিতা হওয়া উচিত, সেই লক্ষ্যে প্রতিযােগিতা করার জন্যে কোরআন আহবান জানাচ্ছে। কেননা, এই লক্ষ্য তার পার্থিব জীবনের শেষ পরিণতির কেন্দ্রবিন্দু এবং পার্থিব জীবনের পরবর্তী চিরস্থায়ী জীবনেও তার অবিচ্ছেদ্য সংগী। এই লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার জন্যে কোরআন যে আহবান জানায় তা হলাে, ‘তােমরা প্রতিযোগিতা করাে তােমাদের প্রতিপালকের ক্ষমা লাভের জন্যে এবং আকাশ ও পৃথিবীর মতাে প্রশস্ত জান্নাতের জন্যে, যা আল্লাহ তায়ালা ও তার রসূলদের প্রতি ঈমান আনয়নকারীদের জন্যে প্রস্তুত করা হয়েছে।…’ অর্থাৎ যারা প্রাপ্তবয়স্ক ও বুদ্ধিমান এবং খেলাধুলার জগতকে শিশুদের জন্যেই রেখে দেয়, খেলাধুলা, পারস্পরিক অহংকার ও সম্পদ বৃদ্ধির প্রতিযােগিতা তাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত নয়; বরং তাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত জান্নাত এবং আল্লাহর ক্ষমা ও সন্তোষ লাভের প্রতিযােগিতা। সম্ভবত মহাবিশ্বের বিশালতা সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য উদঘাটিত হওয়ার আগে অতীতের কেউ কেউ এ ধরনের আয়াত ও হাদীসকে এবং ইতিপূর্বে সাধারণ জান্নাতবাসী উচ্চতর কতিপয় কক্ষের অধিবাসীদের দিকে নক্ষত্রের দিকে তাকানাের মতাে তাকাবে- এই মর্মে যে হাদীসটি বর্ণনা করেছি সেই হাদীসটি রূপক অর্থে গ্রহণ করতেন। তবে আজকাল যখন মানুষের তৈরী ক্ষুদ্র দূরবীক্ষণ যন্ত্র মহাবিশ্বের সীমাহীন দিগন্ত উদঘাটন করে চলেছে, তখন জান্নাতের বিশালত্ব ও দূর থেকে কক্ষসমূহ নিরীক্ষণসংক্রান্ত কথাবার্তা যে একেবারেই স্বাভাবিক, চাক্ষুষ ও বাস্তব সত্য বলে প্রতীয়মান হবে, তা সুনিশ্চিত। একে রূপক অর্থে গ্রহণ করার কোনােই প্রয়ােজন নেই। কেননা, পৃথিবী ও সূর্যের মাঝখানে যা কিছু আছে, তা মহাবিশ্বের বিশাল রাজ্যের একটি ভগ্নাংশ পরিমাণও নয়। জান্নাতের সেই বিশাল রাজ্যে যে কেউ প্রবেশ করতে পারে এবং তার জন্যে যে কেউ প্রতিযােগিতায় লিপ্ত হতে পারে। এর জন্যে একমাত্র প্রয়োজনীয় উপকরণ হলাে আল্লাহ তায়ালা ও তার রসূলদের প্রতি ঈমান। ‘ওটা আল্লাহর অনুগ্রহ, যাকে চান তাকেই তা দেন,.. আর আল্লাহ তায়ালা বিরাট অনুগ্রহের অধিকারী।’ বস্তুত আল্লাহর অনুগ্রহকে কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারে না। লুকিয়ে রাখতে পারে না। আগ্রহী ও সাধনাকারীদের জন্যে তা সহজলভ্য। প্রতিযােগিতাকারীদের উচিত এই অনুগ্রহ অর্জনের জন্যে প্রতিযােগিতা করা- নশ্বর পৃথিবীর তুচ্ছ স্বার্থের জন্যে নয়। এই বিশাল সৃষ্টিজগতের সাথে সমন্বয় রেখে কাজ করা প্রত্যেক মােমেনের কর্তব্য। নিজেকে, নিজের দৃষ্টি, বিচার বিবেচনা ও আবেগ-অনুভূতিকে এই ক্ষুদ্র পৃথিবীর সংকীর্ণ পরিসরের মধ্যে সীমাবদ্ধ করা থেকে বিরত থাকা উচিত। মােমেন হিসাবে তার যথাযােগ্য ভূমিকা পালনের জন্যেই এটা করা উচিত। অবশ্য এই ভূমিকা পালন করা খুবই কঠিন, সাধারণ মানুষের পছন্দ অপছন্দের সাথে সংঘর্ষশীল এবং তাদের গােমরাহী ও বক্রতার সাথে বেমানান। এই ভূমিকা পালন করতে গিয়ে সে বাতিল শক্তির পক্ষ থেকে এবং তার দুনিয়া লােলুপতার দিক থেকে এমন প্রতিরােধের সম্মুখীন হয় যে, তা সহ্য করা খুবই কঠিন হয়ে পড়ে। একমাত্র সেই ব্যক্তিই এই চাপ সহ্য করতে পারে, যে পার্থিব জীবনের চেয়ে বৃহত্তর, প্রশস্ততর ও দীর্ঘস্থায়ী জীবনের সাথে সমন্বয় রেখে চলে। মনে রাখতে হবে, মােমেনের বিবেকে যে সত্য বদ্ধমূল থাকা উচিত, পার্থিব মানদন্ডের সাথে তার পুরােপুরি মিল নেই। পৃথিবীর আয়তনের সাথে মহাবিশ্বের আয়তনের যেটা ব্যবধান, পৃথিবীর বয়সের সাথে মহাকালের যেটা পার্থক্য, পার্থিব মানদন্ডের সাথে মােমেনের বিবেকে বদ্ধমূল সত্যের ঠিক ততােখানি পার্থক্য। বস্তুত এই পার্থক্য এতাে বড় যে, পৃথিবীর সকল দাঁড়িপাল্লা একত্রিত হয়েও তা মাপা তাে দূরের কথা, তার আভাস ইংগিতও দিতে সক্ষম নয়। এ কারণেই মােমেন তার অনুসৃত মহাসত্যের ওপর অবিচল থাকার জন্যে দুনিয়ার জীবনের বাস্তবতার অনেক উর্ধ্বে অবস্থান করে, তা যতাে বড়, দীর্ঘস্থায়ী ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ হােক না কেন। সে পার্থিব জীবনের সংকীর্ণ গন্ডির বাধা বন্ধন মুক্ত মহাসত্যের সাথে সামঞ্জস্য রক্ষা করে চলে, আখেরাতের অনন্ত অসীম জগতের সাথে এবং ক্ষুদ্র ও ছলনাময় তুচ্ছ পার্থিব জীবনের হাজারাে উত্থান পতনের মধ্যেও অটল অবিচল থাকে যে ঈমানী মূল্যবােধ, তার প্রতি আনুগত্য রক্ষা করে চলে। পার্থিব জীবনের মানদন্ড ও মূল্যবোধ সংশােধন করার জন্য এটা মােমেন বান্দাদের আল্লাহর মনােনীত ঈমানী কর্তব্য। পার্থিব মূল্যবােধের সাথে আপস করে ও মিল খাইয়ে চলা মুমিনের কাজ নয়।

ফী জিলালিল কুরআন:

*তাকদীরের সঠিক দর্শন ও মুমিন হৃদয়ের প্রশান্তি : সূরা হাদীদের পরবর্তী আলােচ্য বিষয় হচ্ছে তাকদীর বা অদৃষ্ট সংক্রান্ত। অদৃষ্ট হচ্ছে ইহকালীন জীবনের এক অমােঘ অলংঘনীয় ব্যাপার। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘পৃথিবীতে অথবা তােমাদের সত্তায় যে কোনাে ঘটনা বা দুর্ঘটনা সংঘটিত হােক না কেন, তা তার সৃষ্টির পূর্বেই একটি গ্রন্থে লিপিবদ্ধ থাকে।… আল্লাহই অভাবমুক্ত ও চির প্রশংসিত।’ বস্তুত এই মহাবিশ্বে কোনাে কিছুই আকস্মিক ও অপরিকল্পিতভাবে সংঘটিত হয় না। প্রতিটি সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ঘটনা আগে থেকেই পরিকল্পিত, মহাবিশ্ব ও সকল প্রাণীর সৃষ্টির পূর্বেই আল্লাহ স্বীয় সর্বব্যাপী জ্ঞান দ্বারা তা জানতেন। আল্লাহর জ্ঞানে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত নামের কোনাে কিছুর অস্তিত্ব নেই। সময় ও কাল সংক্রান্ত সেসব বিভক্তি রেখা শুধু আমাদের ন্যায় নশ্বর জীবেরই বৈশিষ্ট্য। এগুলাে দিয়ে আমরা বিভিন্ন জিনিসের সীমানা পরিমাপ করে থাকি। কেননা, আমরা কোনাে বস্তুকে অপর বস্তু থেকে পৃথককারী কালগত ও স্থানগত সীমানা চিহ্ন ছাড়া চিনতে পারি না। কোনাে সীমাহীন বস্তুকে আমরা কেবল তখনই চিনতে সক্ষম হই, যখন এক ধরনের আলােক রশ্মি এসে আমাদের হৃদয়কে তার সাথে যুক্ত করে দেয়। দুনিয়ার অন্যান্য বস্তুকে চিনতে আমরা যে পন্থা নির্ধারণ করে রেখেছি, তা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন পন্থায় এই যুক্তকরণের কাজটি সম্পন্ন হয়, কিন্তু মহান স্রষ্টা আল্লাহর ব্যাপারটা ঠিক এর বিপরীত। তিনি হচ্ছেন সেই অসীম মহাসত্য, যা এই গােটা সৃষ্টিজগতের ব্যাপারে সামগ্রিকভাবে ও প্রত্যক্ষভাবে অবহিত এবং কোনাে সীমা ও বাধাবন্ধন তার অবহিত হওয়া ব্যাহত করে না। সৃষ্টির আদি থেকে অন্ত পর্যন্ত এই মহাবিশ্বের যেখানে যতাে কিছুই ঘটবে, তার সবই আল্লাহর জানা রয়েছে এবং কালগত ও স্থানগত কোনাে বাধা তাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে না। প্রত্যেকটি ঘটনা আল্লাহর পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে এবং তা তার কাছে সুবিদিত। আয়াতে যে মুসিবত শব্দটি রয়েছে, তা দ্বারা আভিধানিক অর্থে ভালাে ও মন্দ উভয় প্রকারের ঘটনাই বুঝানাে হয় এবং এখানে উভয়ই বুঝানাে হয়েছে। অর্থাৎ ভালাে ও মন্দ যাই ঘটুক, তা বিশ্বজগত ও প্রাণীসমূহের আবির্ভাবের আগে থেকেই সেই আদি গ্রন্থে লিপিবদ্ধ রয়েছে। এটা আল্লাহর কাছে খুবই সহজ ব্যাপার। মানুষ যখন প্রকৃত সত্য উপলব্ধি করে, তখন তার অন্তরে এমন এক প্রশান্ত ভাবের সৃষ্টি হয় যে, সে ভালাে ও মন্দ সকল ঘটনাকেই শান্তভাবে গ্রহণ করে। ফলে খারাপ ঘটনায় সে মুষড়ে পড়ে না বা হতাশ ও বিমর্ষ হয় না। আবার ভালাে কিছু সংঘটিত হলেও আনন্দে আত্মহারা হয়ে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে না। পরবর্তী আয়াতে আল্লাহ তায়ালা এ কথাই বলেছেন, ‘যেন তােমরা যা হারিয়েছো তার জন্যে আক্ষেপ না কর এবং আল্লাহ তায়ালা যা কিছু তােমাদের দিয়েছেন তার জন্যে গর্বিত না হও। বস্তুত দৃষ্টিকে যদি প্রশস্ত করা হয়, মহাবিশ্বের সাথে যদি সময় রক্ষা করে চলা হয়, আদি ও অন্তকে দৃষ্টিপথে রেখে আল্লাহর নির্ধারিত বিশ্ব পরিকল্পনার আলােকে যদি ঘটনাবলীকে বিচার বিবেচনা করা হয়, তাহলে ভালােমন্দ সকল ঘটনা হাসিমুখে বরণ করে নেয়ার মতাে মানসিক ঔদার্য, ভারসাম্য, গাম্ভীর্য ও স্থিতি জন্মে। কারণ, সে বুঝতে পারে, এ জাতীয় ঘটনা মানবসত্ত্বা ও প্রাকৃতিক জগতে সমভাবেই ঘটে। মানুষ কেবল তখনই ঘটনাবলীতে অধীর ও অস্থির হয়ে থাকে, যখন সে মহাবিশ্ব থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ভাবে এবং মনে করে যে, এ ধরনের ঘটনা কেবল তার ক্ষুদ্র অস্তিত্বকে বিপর্যস্ত করার জন্যেই ঘটে, কিন্তু সে যখন উপলব্ধি করে যে, সে নিজে এবং তার ওপর ও পৃথিবীর অন্যত্র সংঘটিত ঘটনাবলী মহাবিশ্বের বিশাল দেহে অতি ক্ষুদ্র অণুপরমাণু সদৃশ, এই সকল অণুপরমাণু সামগ্রিক বিশ্ব পরিকল্পনায় যথাস্থলে অবধারিতভাবে বিদ্যমান এবং মহান আল্লাহ তা পুংখানুপুংখরূপে ও অবিকলভাবে জ্ঞাত, তখন সে সব কিছুতেই শান্ত ও সন্তষ্ট থাকে। তখন আর কোনাে কিছু হারিয়ে অস্থির হয় না এবং কোনাে কিছুর প্রাপ্তিতে সে গর্বের আতিশয্যে আত্মভােলা হয়ে যায় না; বরং সে পূর্ণ আনুগত্য ও সন্তোষের সাথে আল্লাহর ফয়সালা ও তাকদীরকে মেনে নেয়। সে বুঝতে পারে যে, যা হয়েছে বা হবে, তা হওয়াই উচিত এবং কল্যাণকর। অবশ্য খুব কম সংখ্যক মােমেনই হয়তাে এই মানে উত্তীর্ণ হয়ে থাকে। তবে সাধারণ মুসলমানদের কাছ থেকে কেবল এতােটুকু প্রত্যাশা করা হয় যে, ক্ষয়ক্ষতির দুঃখ ও বেদনা এবং প্রাপ্তির সুখ ও তৃপ্তি যেন তাদের আল্লাহর দিকে মনােনিবেশ, তার স্মরণ ও ভারসাম্য থেকে বিচ্যুত করে না ফেলে। হযরত ইকরাম(রা.) বলেছেন যে, ‘সুখ-দুঃখ ভােগ করে না এমন কেউ নেই। তবে তােমরা সুখকে শােকরে ও দুঃখকে ধৈর্যে পরিণত করাে। ইসলাম এই ভারসাম্যই শিক্ষা দেয় এবং এ ভারসাম্য সকলেরই সমান আয়াসসাধ্য। আল্লাহ তায়ালা অহংকারী ও গর্বিত লােকদের ভালােবাসেন না, যারা নিজেরাও কার্পণ্য করে এবং অন্যদেরও কার্পণ্য করতে নির্দেশ দেয়। পূর্বের আলােচিত বিষয়ের সাথে অহংকার ও গর্বের যোগসূত্র এবং উল্লিখিত উভয় জিনিসের সাথে কার্পণ্য ও কার্পণের নির্দেশ দানের যােগসূত্র এই যে, যে ব্যক্তি উপলব্ধি করে, যাই ঘটে আল্লাহর নির্দেশেই ঘটে, সে কোনাে প্রাপ্তিতেই গর্ব ও অহংকার করে না এবং কাউকে কিছু দিতে কার্পণ্য করে না ও কার্পণ্য করতে কাউকে নির্দেশ দেয় না, কিন্তু যে ব্যক্তি এটা বােঝে না, সে যে সম্পদ, শক্তি ও পদমর্যাদা লাভ করে, তাকে নিজের উপার্জিত জিনিস মনে করে। ফলে তা নিয়ে সে অহংকারে লিপ্ত হয়, অতপর তা অন্যকে দিতে কার্পণ্য করে এবং নিজের এই আচরণ ও রীতিকে প্রতিষ্ঠিত রাখার জন্যে অন্যদেরও কার্পণ্য করতে উদ্বুদ্ধ করে। ‘আর যে ব্যক্তি অমান্য করে সে জেনে রাখুক যে, আল্লাহ তায়ালা অভাবশূন্য ও চির প্রশংসিত।’ সুতরাং যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে দান করে, সে নিজেরই উপকার সাধন করে। যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে দান করার আদেশ মেনে নেয়, সে নিজেরই কল্যাণ সাধন করে। আল্লাহ তায়ালা | স্বয়ংসম্পূর্ণ ও অভাবশূন্য। তাই তিনি বান্দাদের কোনাে কিছুর মুখাপেক্ষী নন। তিনি চির প্রশংসিত। বান্দাদের প্রশংসায় তার কোনাে অভাব পূরণ হয় না।
ফী জিলালিল কুরআন:

*ইতিহাসের কিছু সংক্ষিপ্ত আলোচনা : সর্বশেষে আসছে সূরার শেষ বিষয়টি। এতে সংক্ষেপে হযরত নূহ ও ইবরাহীম(আ.)-এর আমল থেকে শুরু করে রেসালাত ও ইসলামের ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে। মানব জাতির পার্থিব জীবনে রেসালাতের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য কী এবং বিশেষত আহলে কিতাব ও হযরত ঈসা(আ.)-এর অনুসারীদের অবস্থা কী ছিলাে তা বর্ণনা করা হয়েছে। ‘আমি আমার রসূলদের সুস্পষ্ট প্রমাণাদি সহকারে পাঠিয়েছি… তাদের (ঈসার অনুসারীদের) অনেকেই ফাসেক।’ বস্তুত সকল রেসালাত মূলত একই জিনিস। রসূলরাই ছিলেন রেসালাতের বাহক। সেই সাথে তারা অকাট্য প্রমাণাদি নিয়ে আসতেন। তাদের অধিকাংশই অলৌকিক ঘটনাবলী তথা মােজেযাসমূহ সাথে নিয়ে আসতেন। তাদের কারাে কারাে ওপর কিতাব নাযিল হয়েছিলো। আয়াতের দ্বিতীয়াংশে বলা হয়েছে, এবং তাদের সাথে কিতাব নাযিল করেছি। সকল নবীর কথা এক শব্দে উল্লেখ এবং কিতাবকে বহুবচনের পরিবর্তে একবচনে উল্লেখ করা দ্বারা এই সত্যের প্রতি ইংগিত করা হয়েছে যে, রেসালাত মূলত একই জিনিস। ‘এবং দাঁড়িপাল্লাও (নাযিল করেছি)।’ অর্থাৎ কিতাবের সাথে সাথে। বস্তুত সকল নবী রসূল পৃথিবীতে ও মানব জাতির জীবনে এমন একটা স্থায়ী দাড়িপাল্লা প্রতিষ্ঠিত করতে এসেছিলেন, যার দিকে মানব জাতি তাদের কার্যকলাপ, ঘটনাপ্রবাহ, বস্তুনিচয় ও লােকদের পরিশুদ্ধ করার উদ্দেশ্যে ধাবিত হবে, যার ওপর মানব জাতি নিজের জীবনকে প্রতিষ্ঠিত করে তাকে খেয়ালখুশীর যথেচ্ছাচার, স্বভাবের বহুমুখিতা ও স্বার্থের সংঘাত থেকে নিরাপদ করবে এবং যাকে সকল প্রকার স্বজনপ্রীতি ও বঞ্চনার উচ্ছেদ সাধনের মানদন্ড হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করবে। এ দাঁড়িপাল্লা সত্যের মাপকাঠি দিয়ে সকলের অধিকার মেপে দেয় বিধায় কারাে প্রতি স্বজনপ্রীতি করে না এবং আল্লাহ তায়ালা সকলের প্রভু বিধায় কারাে ওপর যুলুম করে না। রেসালাতের অন্তর্ভুক্ত করে এই দাঁড়িপাল্লা আল্লাহ তায়ালা নাযিল করেছেন, এটি যাবতীয় দুর্যোগ, দুর্বিপাক, বিপদ মুসিবত ও দ্বন্দ্ব সংঘাত থেকে মানব জাতির নিরাপত্তার একমাত্র গ্যারান্টি। মানুষ সকল বঞ্চনা ও স্বজনপ্রীতি থেকে মুক্ত হয়ে ন্যায্য অধিকার, ইনসাফ ও সুবিচার পাওয়ার জন্যে শরণাপন্ন হতে পারে এমন একটা স্থায়ী দাঁড়িপাল্লা বা মানদন্ড তার একান্ত প্রয়ােজন। একথাই বলা হয়েছে আয়াতের পরবর্তী অংশে, ‘যেন মানুষ ইনসাফের ওপর প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।’ আল্লাহর এই অটল দাঁড়িপাল্লা তথা আল্লাহর বিধান ও আল্লাহর আইন ছাড়া মানুষ ন্যায়বিচারের সন্ধান পেতে পারে না, আর যদি ন্যায়বিচারের সন্ধান পায়ও, তবে এই দাঁড়িপাল্লা হাতে না পেলে অজ্ঞতা ও খেয়ালখুশীর স্রোতে ভেসে গিয়ে ন্যায়বিচারের গন্তব্যস্থল থেকে বিপথগামী হয়ে যেতে পারে। ‘আর আমি লােহা নাযিল করেছি। লােহাতে রয়েছে মানব জাতির জন্যে নিদারুণ বিপদাশংকা এবং বিপুল উপকারিতাও। আর এজন্যেও যে, কে কে না দেখে আল্লাহ ও তার রসূলদের সাহায্য করে, তা যেন আল্লাহ তায়ালা জেনে নেন।’ ‘লােহ নাযিল করেছি’ কথাটা ঠিক এ রকম, যেমন অন্যত্র আল্লাহ বলেছেন, ‘তিনি তােমাদের আট জোড়া পশু নাযিল করেছেন।’ উভয় জায়গায় এর মর্মার্থ হলাে, জিনিস ও ঘটনাবলী সৃষ্টিতে আল্লাহর ইচ্ছা ও পরিকল্পনা। কেননা, এ সবই আল্লাহর পরিকল্পনা ও বিচার বিবেচনা অনুসারে নাযিল তথা আবির্ভূত হয়ে থাকে। তা ছাড়া এখানে আয়াতের প্রেক্ষাপটের সাথে সমন্বয় রয়েছে। এই প্রেক্ষাপট হলাে কিতাব ও দাঁড়িপাল্লা নাযিল করার প্রেক্ষাপট। অনুরূপভাবে আল্লাহ যত জিনিস সৃষ্টি করেছেন, তাও তার কিতাব ও দাঁড়িপাল্লার মতােই পরিকল্পিতভাবে সৃষ্টি হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা লােহাকে ‘নিদারুণ বিপদাশংকার উৎস’ অর্থাৎ যুদ্ধ ও শান্তি উভয় অবস্থায় শক্তির উৎস হিসাবে, ‘আর মানুষের জন্যে উপকারিতারও উৎস’ হিসাবে সৃষ্টি করেছেন। এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, আজকের মানব সভ্যতা লােহার ওপর ভর করেই দাঁড়িয়ে আছে। ‘না দেখে কে কে আল্লাহকে সাহায্য করে…’ এ দ্বারা আসলে সশস্ত্র জেহাদের দিকে ইংগিত করা হয়েছে। এ বিষয়টি জান ও মাল উৎসর্গ করা সংক্রান্ত বক্তব্যের আকারে যথাস্থানে আলােচিত হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রসূলদের সাহায্যকারীদের প্রসংগে বক্তব্য রাখার পর পরই সাহায্যের অর্থ ও তাৎপর্য ব্যাখ্যা করা হয়েছে এই বলে যে, আল্লাহ তায়ালা শক্তিশালী ও পরাক্রমশালী। অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা কারাে সাহায্যের মুখাপেক্ষী নন। তাঁর দ্বীনকে সাহায্য করাই আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রসূলদের সাহায্য করার শামিল।

ফী জিলালিল কুরআন:

রেসালাত যে স্বীয় মৌলিক প্রকৃতি, কিতাব ও দাঁড়িপাল্লার দিক দিয়ে এক ও অভিন্ন, সে কথা ঘােষণা করার পর পরবর্তী আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলছেন, এই রেসালাতের বাহকরাও এই হিসাবে এক ও অভিন্ন যে, তারা সবাই নূহ ও ইবরাহীমের বংশধর। ‘আমি নূহ ও ইবরাহীম পাঠিয়েছি এবং তাদের উভয়ের বংশধরকে কিতাব ও নবুওত দিয়েছি।’ বস্তুত এটি একটি অখন্ড বৃক্ষ, যার বহু শাখা প্রশাখা। এসব শাখা প্রশাখা কিতাব ও নবুওতের ধারক বাহক। মানব জাতির উৎপত্তিকাল থেকে এবং নূহ(আ.)-এর সময়কাল থেকে তা চলে আসছে। ইবরাহীম(আঃ) পর্যন্ত এলে তা ক্রমান্বয়ে বহু শাখা প্রশাখায় বিস্তৃত হয় এবং চুড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে উপনীত হয়। তবে যে বংশধরের কাছে কিতাব ও নবুওত এসেছিলাে, তারা নিজেদের ঐক্যবদ্ধ রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। ‘তাদের কতেক ছিলাে হেদায়াতপ্রান্ত এবং অনেকেই ছিলাে ফাসেক।’ এখানে এক দীর্ঘ ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতাকে অতি সংক্ষেপে তুলে ধরা হয়েছে। এই ধারাবাহিকতার প্রায় শেষ পর্যায়ে আসেন মারইয়ামের ছেলে ঈসা(আ.)। বলা হচ্ছে, ‘অতপর আমি তাদের পর আমার অন্য রসূলদের ও মারইয়ামের ছেলে ঈসাকে পাঠিয়েছিলাম।’ অর্থাৎ নূহ ও ইবরাহীমের প্রাথমিক বংশধরের পদাংক অনুসরণ করে পরবর্তীদের পাঠিয়েছি। এই রেসালাত একই ধারা-প্রবাহ এবং এরই শেষ প্রান্তের কাছাকাছি ঈসা(আ.)-এর আবির্ভাব ঘটে।  *বৈরাগ্যবাদ কখনাে ইসলামসম্মত নয় : এখানে আল্লাহ তায়ালা হযরত ঈসার অনুসারীদের একটি উল্লেখযােগ্য বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করছেন, আমি তাঁর অনুসারীদের হৃদয়ে দয়া ও মমতার সৃষ্টি করেছি।’ এই সকল গুণ হযরত ঈসার দাওয়াত, তাঁর মহত্ত্ব ও ঔদার্য, আত্মিক পবিত্রতা ও উজ্জ্বল স্বচ্ছতার স্বাভাবিক ফল। দয়া মমতা হযরত ঈসার রেসালাতের একনিষ্ঠ ভক্ত ও যথার্থ ঈমানদার লােকদের এক সুস্পষ্ট বৈশিষ্ট্য। কোরআনের অন্যান্য আয়াতেও এদিকে ইংগিত করা হয়েছে। নাজ্জাশী, নাজরান থেকে আগত প্রতিনিধি দল এবং ইসলামের বিজয়ের পর অন্যান্য যারা ইসলাম গ্রহণে আগ্রহী হয়ে মুসলিম দেশে এসেছে, তাদের সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের প্রদত্ত বিবরণেও তাদের এই গুণবৈশিষ্ট্যের চিত্র ফুটে ওঠেছে। কেননা, তারা হযরত ঈসার যথার্থ অনুসারী হওয়ায় তাদের হৃদয়ে সত্যের প্রকৃত রূপ বন্ধমূল ছিলাে। এখানে হযরত ঈসার অনুসারীদের আরাে একটা বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হয়েছে, ‘আর বৈরাগ্যবাদ তারাই উদ্ভাবন করে নিয়েছিলাে, আমি তাদের ওপর এটিকে শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের নিমিত্তেই বিহিত করেছিলাম।’ এ আয়াতের যে তাফসীর সর্বাধিক অগ্রগণ্য তা এই যে, খৃষ্টান জাতির ইতিহাসে বৈরাগ্যবাদের যে স্থান, তা হযরত ঈসার কিছু সংখ্যক অনুসারীর স্বনির্বাচিত ব্যবস্থা ছিলাে। আল্লাহর সন্তুষ্টিলাভ এবং দুনিয়ার জীবনের নােংরামি থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্যে তারা এটি উদ্ভাবন করেছিলাে। এ জিনিসটি প্রথম থেকে আল্লাহর দেয়া বিধান হিসাবে চালু ছিলাে না। তবে তারা যখন এটা নিজেরাই গ্রহণ করে নিলাে এবং নিজেদের ওপর এটিকে বাধ্যতামূলক করে নিলাে, তখন একে যথাযথভাবে মেনে চলা ও এর দাবী অনুযায়ী উচ্চতর, পরিচ্ছন্ন, অল্পে তুষ্ট ও লালসামুক্ত জীবন যাপন এবং যিকর ও এবাদাতে নিয়ােজিত থাকা তাদের দায়িত্ব হয়ে দাড়ালাে। অন্য কথায়, যেহেতু আল্লাহর সর্বাত্মক নিষ্ঠা ও আনুগত্য অর্জনই ছিলাে তাদের এই স্ব-উদ্ভাবিত ও মনগড়া বৈরাগ্যবাদের উদ্দেশ্য, তাই এই উদ্দেশ্যের বাস্তবায়ন তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যে পরিগণিত হয়েছিলাে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এটি প্রাণহীন প্রথা ও অনুষ্ঠানে পরিণত হয়ে গেলাে। এর জন্যে যে কষ্ট স্বীকার করার প্রয়ােজন ছিলাে, তাদের খুব কম লােকই তার জন্যে প্রস্তুত ছিলো। আল্লাহ তায়ালা একথাই বলেছেন, ‘তবে তারা তাকে যথাযথভাবে মেনে চললাে না। ফলে আমি তাদের মধ্য থেকে যথার্থ ঈমানদারদের তাদের প্রতিদান দিলাম। তবে তাদের অনেকেই ছিলাে ফাসেক।’ আল্লাহ তায়ালা বাহ্যিক কোনাে রূপ গ্রহণ করেন না। তিনি গ্রহণ করেন মানুষের আমল ও নিয়ত। গ্রহণ করেন বাস্তব কাজ ও তার অন্তর্নিহিত সদুদ্দেশ্য। আর সেই অনুসারেই তাদের হিসাব গ্রহণ করেন। তিনি তাে মনের গােপন অবস্থা জানেন। এই সংক্ষিপ্ত ইতিহাস উপস্থাপন ও পর্যালােচনার পর মােমেনদের প্রতি সর্বশেষ আহবান জানানাে হয়েছে। এই মােমেনদের দ্বারা নবীদের অনুসারীদের সর্বশেষ কাফেলা অর্থাৎ উম্মতে মােহাম্মাদীকে বুঝানাে হয়েছে, যারা কেয়ামত পর্যন্ত এই দ্বীনের উত্তরাধিকারী হবে। ‘হে মােমেনরা, আল্লাহকে ভয় করাে….. আর আল্লাহ তায়ালা বিরাট অনুগ্রহের অধিকারী। এখানে ‘হে মােমেনরা বলে সম্বােধনে তাদের হৃদয়ে এক বিশেষ উজ্জীবনী পরশ বুলানাে হয়েছে, ঈমানের প্রকৃত মর্ম পুনরুজ্জীবিত করার প্রয়াস চালানাে হয়েছে, ঈমানের দাবী অনুসারে কাজ করার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে, তাদের প্রতিপালকের সাথে তাদের সম্পর্ক পুনরুজ্জীবিত করা হয়েছে এবং এই সম্পর্কের ওসিলায় তাদের আল্লাহভীতি ও আল্লাহর রসূলের প্রতি যথার্থ ঈমান আনয়নের আহ্বান জানানাে হয়েছে। সুতরাং যে ঈমানের আহ্বান জানানাে হয়েছে, তা বিশেষ তাৎপর্যবহ। অর্থাৎ আসল ও প্রকৃত ঈমান এবং তার দাবীর বাস্তবায়ন। আল্লাহকে ভয় করাে এবং তার রসূলের প্রতি ঈমান আনাে। তাহলে আল্লাহ তায়ালা তােমাদের দ্বিগুণ রহমত দান করেন। আল্লাহর রহমত যদিও অখন্ড বস্তু, তবু এ দ্বারা নিরবচ্ছিন্ন ও ক্রমবর্ধমান রহমত বুঝানাে হয়েছে। ‘আর তােমাদের জন্যে এমন জ্যোতি প্রস্তুত করবেন, যা দ্বারা তােমরা চলতে পারবে।’ এ হচ্ছে আল্লাহর পক্ষ থেকে দাতব্য বিশেষ দান, যা আল্লাহ তায়ালা সত্যিকার মােমেন ও আল্লাহভীরু হৃদয়কে দিয়ে থাকেন। এ দান মােমেনদের হৃদয়কে এতাে আলােকিত করে যে, তারা পর্দার আড়ালের সত্যও দেখতে পায়। ফলে তারা কখনাে গােমরাহ হয় না, বিপথগামী হয় না। ‘এবং তােমাদের গুনাহ মাফ করবেন, বস্তুত আল্লাহ তায়ালা ক্ষমাশীল, দয়াবান।’ মনে রাখতে হবে, মানুষ যতােই জ্যোতি বা নুর লাভ করুক, যতই জ্ঞানী ও পারদর্শী হােক, তথাপি সে মানুষ এবং তার ভুলত্রুটি ও গুনাহ হতে পারে। তাই সে ক্ষমা ও দয়ার মুখাপেক্ষী। আর আল্লাহ তায়ালা ক্ষমাশীল ও দয়াবান। আল্লাহ তায়ালা বলছেন, “হে মােমেনরা! আল্লাহকে ভয় করাে ও তাঁর রসূলের প্রতি ঈমান আনাে।’ যাতে আল্লাহর দ্বিগুণ রহমত লাভ করতে পারাে এবং সেই নূর বা জ্যোতি অর্জন করতে পারাে, যা দিয়ে পথ চলতে পারবে এবং যার সাহায্যে তােমাদের গুনাহ মাফ হয়ে যেতে পারে। যাতে আহলে কিতাব না জানে যে, তারা আল্লাহর অনুগ্রহের ওপর কোনাে নিয়ন্ত্রণের অধিকারী নয় । অনুগ্রহ আল্লাহরই হাতে রয়েছে এবং তা তিনি যাকে ইচ্ছা দিয়ে থাকেন। আহলে কিতাব তথা ইহুদী-খৃষ্টানরা মনে করতাে, তারাই আল্লাহর মনােনীত জাতি এবং তার সন্তান ও প্রিয়জন। তারা বলতাে, তােমরা ইহুদী অথবা খৃষ্টান হয়ে যাও। সুপথগামী হতে পারবে। তারা বলতাে যে, ইহুদী অথবা খৃষ্টান, তারা কি বেহেশতে যাবে না। তাই আল্লাহ তায়ালা মােহাম্মদ(স.)-এর ওপর ঈমান আনয়নকারীদের ডেকে নিজের রহমত, জান্নাত, ক্ষমা ও অনুগ্রহ দেয়ার আশ্বাস দিচ্ছেন, যাতে আহলে কিতাবের সে ভ্রান্ত ধারণা দূর হয় এবং বুঝতে পারে যে, আল্লাহর অনুগ্রহ তাদের মুঠোর মধ্যে নেই এবং তাদের তা ঠেকানাের ক্ষমতাও নেই, বরং সকল অনুগ্রহ ও রহমত আল্লাহর হাতে নিবদ্ধ, তিনি যাকে যতাে খুশী দিয়ে থাকেন। এটা কোনাে জাতি বা সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এই আহবানে জান্নাত ও রহমত লাভের জন্যে প্রতিযোগিতায় উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। এই আহবানের মধ্য দিয়েই সূরা হাদীদ শেষ হয়ে যাচ্ছে। সর্বশেষে এই আহবানের পুনরাবৃত্তির উদ্দেশ্য হলাে, মােমেনরা যেন ঈমানের দাবীর বাস্তবায়ন করে। আল্লাহর যথার্থ অনুগত হয় এবং একনিষ্ঠতা ও আন্তরিকতা সহকারে তার জন্যে যাবতীয় জানমালের ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত হয়। বস্তুত সূরা হাদীদ মানুষের হৃদয়কে সম্বােধন করার দিক দিয়ে কোরআনের এক অনন্য দৃষ্টান্তমূলক সূরা। এর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে মানুষের মনের ওপর গভীর প্রভাব ও ভাবাবেগ সৃষ্টি করার উপকরণ নিহিত । ইসলামী দাওয়াত ও আন্দোলনের পতাকাবাহীদের জন্যে এতে রয়েছে চমকপ্রদ শিক্ষা। কিভাবে মানুষকে সম্বােধন করতে হয়, কিভাবে হৃদয়কে উজ্জীবিত ও জাগ্রত করতে হয়, এ সূরায় তার প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। এ শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ হৃদয়সমূহের স্রষ্টার, কোরআন নাযিলকারীর ও পরিকল্পিতভাবে প্রতিটি জিনিস সৃষ্টিকারীর। এই প্রশিক্ষণাগার থেকেই তৈরী হয়ে বেরুতে পারবে সেই সব দাওয়াতদাতা, যাদের দাওয়াত গ্রহণযােগ্য হবে এবং যারা দাওয়াতের প্রেরণায় উজ্জীবিত থাকবে।

২০-২৯ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:-
২০-২১ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

আলোচ্য আয়াতদ্বয়ে আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়ার সম্পূর্ণ জীবনের একটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করছেন। মানুষ জন্মের পর তার শিশু ও শৈশবকাল অতিবাহিত করে খেল-তামাশায়, তারপর যৌবনকাল পোশাক-পরিচ্ছেদ, খাবার-দাবার ইত্যাদিতে চাকচিক্য পছন্দ করে, তারপর বৈবাহিক জীবনে সন্তান ও সম্পদের প্রাচুর্য নিয়ে প্রতিযোগিতা করে, এভাবেই তো মানুষ তাদের মূল্যবান জীবন অতিবাহিত করে। যারা এভাবে দুনিয়ার মোহে মোহিত হয়ে দীন-ধর্মের তোয়াক্কা না করে দুনিয়ার জীবন অতিবাহিত করে তাদের উদাহরণ হল সে বৃষ্টির মত যা নাযিল হয়ে কৃষকের ফসল খুব সবুজ শ্যামল ও তরতাজা করে তুলে যা দেখে কৃষকের মন জুড়িয়ে যায়। তারপর তা হঠাৎ শুকিয়ে গিয়ে পীতবর্ণ ধারণ করে, অতঃপর তা টুকরো টুকরো হয়ে খড় কুটোয় পরিণত হয়। কৃষকের আশা যেমন নিরাশায় পরিণত হয়ে যায় তেমনি দুনিয়াকে নিয়ে যারা সন্তুষ্ট তাদের অবস্থাও ঠিক তা-ই।

(وَفِی الْاٰخِرَةِ عَذَابٌ شَدِیْدٌ)

অর্থাৎ যারা দীন-ধর্ম উপেক্ষা করে দুনিয়ার ক্রীড়া ও কৌতুকেই মগ্ন থাকে তাদের জন্য আখিরাতেও রয়েছে মহা শাস্তি। পক্ষান্তরে মু’মিনদের জন্য রয়েছে ক্ষমা ও আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি।

(سَابِقُوْآ إِلٰي مَغْفِرَةٍ)

এরূপ তাফসীর সূরা আলি ইমরানের ১৩৩ নম্বর আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে।

(ذٰلِكَ فَضْلُ اللّٰهِ يُؤْتِيْهِ)

‘এটা আল্লাহর অনুগ্রহ, যাকে ইচ্ছা তিনি এটা দান করেন’ একদা দরিদ্র মুহাজির বলল : হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! সম্পদশালী লোকেরা তো জান্নাতের উচ্চশ্রেণি ও চিরস্থায়ী নেয়ামতরাজির অধিকারী হয়ে গেল। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন : কিভাবে? তারা বললেন : সালাত, সিয়াম ও অন্যান্য ইবাদত তারাও করে এবং আমরাও করে থাকি। কিন্তু তারা সদকা করতে পারে আমরা তা করতে পারি না। তারা গোলাম আযাদ করে, আমরা করতে পারি না। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন : আমি কি তোমাদেরকে এমন একটি আমলের সন্ধান দেব, যা করলে তোমাদের নেকী সম্পদশালীদের আগে চলে যাবে? ঐরূপ যারা করবে তারা ছাড়া তোমাদের সমান কেউ হবে না। তা হল : প্রত্যেক সালাতের পর ৩৩ বার তাসবীহ (সুবহানাল্লাহ) ৩৩ বার তাকবীর (আল্লাহু আকবার) ও ৩৩ বার আল হামদুলিল্লাহ পাঠ করবে। পরবর্তীতে তারা বললেন : আমাদের সম্পদশালী ভাইগণ এটা শুনে আমাদের মত আমল করতে লেগে গেছে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন : এটা (সম্পদ) আল্লাহ তা‘আলার অনুগ্রহ তিনি যাকে ইচ্ছা প্রদান করেন। (সহীহ মুসলিম হা. ৮৪৩)

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. দুনিয়া অতি তুচ্ছ ও নগণ্য বস্তু, তাই দুনিয়ার ধোঁকা থেকে সতর্ক থাকা উচিত।
২. সৎকাজে প্রতিযোগিতা করা ভাল।
৩. জান্নাতের প্রশস্ততার বিবরণ জানলাম।
২২-২৪ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

এখানে আল্লাহ তা‘আলা মানুষ সৃষ্টির পূর্ব নির্ধারিত তাকদীরের বর্ণনা দিচ্ছেন। পৃথিবীতে যত বিপর্যয় ও বালা-মসিবত এবং মানুষের ব্যক্তিগত যে রোগ-ব্যাধি, কষ্ট- ক্লেশ ও অভাব-অনটনসহ ভাল-মন্দ যা কিছু আসে সব কিছুই সমস্ত সৃষ্টিকে সৃষ্টি করার পূর্বেই লিপিবদ্ধ আছে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : আকাশ-জমিন সৃষ্টি করার এক হাজার বছর পূর্বেই আল্লাহ তা‘আলা তাকদীর নির্ধারণ করে রেখেছেন। (সহীহ মুসলিম হা. ২৬৫৩, তিরমিযী হা. ২১৫৬)

(فِيْ كِتٰبٍ مِّنْ قَبْلِ)

‘পূর্বেই আমি তা কিতাবে লিপিবদ্ধ করে রেখেছি’ কিতাব বলতে লাওহে মাহফূয উদ্দেশ্য।

সাহাবী আলী (রাঃ) বলেন : আমরা বাকি গারকাদ নামক স্থানে এক জানাযায় ছিলাম, সেখানে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আগমন করলেন। (জানাযা শেষে) তিনি বসলেন, তাঁর সাথে একটি লাঠি ছিল, লাঠি দ্বারা মাটিতে খোঁচাচ্ছিলেন, তারপর মাথা তুলে বললেন : তোমাদের এমন কেউ নেই যার ঠিকানা জান্নাতে অথবা জাহান্নামে লিখে রাখা হয়নি। এমনকি কে সৌভাগ্যশীল ও কে দুর্ভাগা তাও লিখে রাখা হয়েছে। মানুষের মধ্যে একজন লোক বলল : হে আল্লাহর নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আমরা কি আমাদের লিখিত তাকদীরের ওপর ভরসা করে থাকব না এবং আমল ছেড়ে দেবো না? কারণ, যে সৌভাগ্যশীল সে সৌভাগ্যবান হবেই আর যে দুর্ভাগা সে দুর্ভাগা হবেই। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন : তোমরা আমল করে যাও, প্রত্যেককে যে জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে তা তার জন্য সহজ করে দেওয়া হবে। (আবূ দাঊদ হা. ৪৬৯৬, তিরমিযী হা. ৩৩৪৪, হাদীসটি বুখারীতে রয়েছে)

(لِّكَيْلَا تَأْسَوْا) ‘এটা এজন্য যে, তোমরা যা হারিয়েছ তাতে যেন তোমরা হতাশাগ্রস্ত না হও’ এখানে যে দুঃখ ও আনন্দ থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে তা হল এমন দুঃখ ও আনন্দ যা মানুষকে অবৈধ কাজ পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। তাছাড়া কোন কষ্টে দুঃখিত এবং কোন সুখে আনন্দিত হওয়া তো মানুষের একটি প্রকৃতিগত ব্যাপার। তবে মু’মিন বিপদে এ মনে করে ধৈর্য ধারণ করে যে, এটা আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছা ও ভাগ্যের লিখন। আর্তনাদ ও হা-হুতাশ করে কোন পরিবর্তন ঘটবে না বরং এর মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি ও উত্তম কিছু আশা করে। অনুরূপ মু’মিন সুখের দিন পেলে তাতে গর্ব ও অহংকার প্রদর্শন করে না। বরং এর জন্য আল্লাহ তা‘আলার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। আর এ কথা মনে করে না যে, এ সুখ তার প্রাপ্য, এ শুধু তার পরিশ্রমেরই ফল। বরং বিশ্বাস করে, এ হল আল্লাহ তা‘আলার অনুগ্রহ ও দয়া।

ইবনু মাসঊদ (রাঃ) হতে বর্ণিত নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : তোমাদের কেউ ঈমানের স্বাদ গ্রহণ করতে পারবে না যতক্ষণ না এ কথা জানবে যে, তার ওপর যত বিপদ-আপদ আসে তা ভুল করে আসে না এবং যে সব বিপদ-আপদ থেকে বেঁচে যায় তা ভুল করে বেঁচে যায় না। (যিলালুল জান্নাত হা. ২৪৭, হাসান)

(الَّذِيْنَ يَبْخَلُوْنَ)

অর্থাৎ দুটি নিন্দনীয় বিষয় একত্রিত হয়েছে- (১) নিজে কৃপণতা করে (২) অপরকে কৃপণতা করার প্রতি উৎসাহিত করে। অথচ নিন্দার জন্য একটিই যথেষ্ট। কৃপণতা হল : ওয়াজিব হক যেমন যাকাত-ফিতরা ইত্যাদি আদায় না করা।

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন :

إِيَّاكُمْ وَالشُّحَّ، فَإِنَّمَا هَلَكَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ بِالشُّحِّ

তোমরা কৃপণতা থেকে বেঁচে থাক। কেননা কৃপণতা তোমাদের পূর্ববর্তীদেরকে ধ্বংস করেছে। (আবূ দাঊদ হা. ১৬৯৮, সহীহ)

অতএব প্রত্যেক মু’মিন ব্যক্তিকে তাকদীরের ওপর বিশ্বাস রাখতে হবে এবং বিপদাপদে আল্লাহ তা‘আলার ফায়সালাকে মেনে নিতে হবে।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. সৃষ্টি জীবের তাকদীর সৃষ্টির পূর্বেই নির্ধারিত।
২. এমন দুঃখ বা খুশি হওয়া উচিত না যা কুফরীর দিকে পৌঁছে দেয়।
৩. কৃপণতা করা নিন্দনীয়।
২৫ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

بِالْبَيِّنٰتِ (প্রমাণসমূহ) অর্থাৎ মুজিযাহ, দলীল-প্রমাণাদি ও ঐসব আলামত যা রাসূলের সত্যতার প্রমাণ বহন করে তা দিয়ে রাসূল প্রেরণ করছি।

وَالْمِيْزَانَ (তুলাদণ্ড) বলতে ন্যায়নীতি বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা লোকদের মাঝে সুবিচার করার নির্দেশ দিয়েছেন। কেউ কেউ বলেছেন, এর অর্থ হল দাড়িপাল্লা। দাঁড়িপাল্লা অবতীর্ণ করার অর্থ হল মানুষের মাঝে সঠিক ওজন প্রতিষ্ঠা করা।

(وَأَنْزَلْنَا الْحَدِيْدَ)

হাসান বাসরী (রহঃ) বলেন : এখানে انزال অর্থ সৃষ্টি করা, তৈরি করা। যেমন সূরা আন‘আমের ১৪৩ নম্বর আয়াতে انزال দ্বারা সৃষ্টি করার অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। ভাষাবিদগণ বলেন : খনিজ থেকে লোহা বের করেছেন, অতঃপর ওয়াহীর মাধ্যমে তা তৈরির জ্ঞান দান করেছেন। (ইবনু কাসীর)

হাদীদ শব্দটি কুরআনে ৬ জায়গায় ব্যবহার হয়েছে। সূরা ইসরার ৫০ নম্বর, সূরা কাহফের ৯৬ নম্বর, সূরা হাজ্জের ২১ নম্বর, সূরা সাবার ১০ নম্বর, সূরা ক্বাফের ২২ নম্বর এবং সূরা হাদীদের অত্র আয়াত। প্রত্যেকটিতেই লোহার উপরকরণ অর্থে ব্যবহার হয়েছে। তবে সূরা ক্বাফের আয়াতে প্রত্যক্ষ করা অর্থে ব্যবহার হয়েছে।

অত্র আয়াতের তাফসীরে ইবনু কাসীর (রহঃ) বলেন : যাদের কাছে প্রমাণ পৌঁছার পরেও সত্য গ্রহণে অবাধ্য হবে এবং সত্যের বিরোধিতা করবে তাদের প্রতিরোধক হিসাবে লোহা দিয়েছেন। এজন্য নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নবুওয়াত পাওয়ার পর তের বছর মক্কায় অবস্থান করে তাওহীদের দাওয়াত দিয়ে সত্যের প্রমাণ প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তারপর হিজরত করার অনুমতি দিয়েছেন এবং কেউ ইসলামের বিরোধিতা করলে তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণের বিধান দিয়েছেন।

(وَّمَنَافِعُ لِلنَّاسِ)

অর্থাৎ মানুষের জীবন-যাপনে এর অনেক উপকারিতা রয়েছে, যেমন লোহা দ্বারা কৃষি কাজের উপকরণ তৈরি করা, দৈনন্দিন কাজে ব্যবহৃত দা, চাকু ইত্যাদি তৈরি করা। যুদ্ধ-জিহাদের অস্ত্র তৈরি হয় এ লোহা দ্বারাই। (ইবনু কাসীর)

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. আল্লাহ লোহা অবতীর্ণ করেছেন মানুষের নানাবিধ উপকারের জন্য।
২৬-২৭ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

আলোচ্য আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন : নূহ (আঃ) ও ইবরাহীম (আঃ)-এর পর যত কিতাব নাযিল ও নাবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন সকলেই তাদের উভয়ের বংশধর থেকে এসেছেন। নূহ (আঃ)-এর প্লাবনের পর দুনিয়াতে মু’মিন ছাড়া কেউ ছিল না। তাই সকল মু’মিনকে নূহ (আঃ)-এর বংশধরের মধ্যে শামিল করা হয়। আর ইবরাহীম (আঃ)-এর দু’ ছেলে ইসহাক ও ইসমাঈল (আঃ) উভয়ে নাবী ছিলেন। তার মধ্যে ইসহাক (আঃ) থেকে ইয়া‘কূব, ইয়া‘কূব থেকে ইউসুফ এভাবে বানী ইসরাঈলের সকল নাবীগণ আগমন করেছেন আর ইসমাঈল (আঃ) থেকে কেবল নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আগমন করেছেন।

(فَمِنْهُمْ مُّهْتَدٍ)

অর্থাৎ যাদের নিকট নাবী-রাসূল প্রেরণ করেছি তাদের কেউ নাবী-রাসূলের দাওয়াত গ্রহণ করে হিদায়াত প্রাপ্ত হয়েছে তবে অধিকাংশ লোকেরাই রাসূলদের আনুগত্য করেনি।

قَفَّيْنَا অর্থ অনুসরণ করিয়েছি, اٰثَارِهِمْ তাদের পদচিহ্ন অর্থাৎ নূহ ও ইবরাহীম (আঃ)-এর পরে অনেক রাসূল প্রেরণ করেছি যেমন মূসা, ইলিয়াস, দাঊদ, সুলাইমান, ইউনুস ও অন্যান্য নাবী-রাসূলগণ, তাদেরকে তাওরাত, ইঞ্জিল ও যাবুর ইত্যাদি কিতাব প্রদান করেছেন।

(وَقَفَّيْنَا بِعِيْسَي ابْنِ مَرْيَمَ )

‘মারইয়াম পুত্র ঈসাকে পাঠিয়েছি’ এখানে ঈসা (আঃ)-কে বিশেষভাবে উল্লেখ করার উদ্দেশ্য হল আয়াতের পরবর্তী অংশ ঈসা (আঃ)-এর অনুসারীদের সাথে সম্পৃক্ত।

رَأْفَةً অর্থ : নম্রতা, করুণা। অর্থাৎ ঈসা (আঃ)-এর হাওয়ারী বা অনুসারীদের মাঝে আল্লাহ তা‘আলা দীনের ব্যাপারে অনুকম্পা দিয়েছিলেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(لَتَجِدَنَّ اَشَدَّ النَّاسِ عَدَاوَةً لِّلَّذِیْنَ اٰمَنُوا الْیَھُوْدَ وَالَّذِیْنَ اَشْرَکُوْاﺆ وَلَتَجِدَنَّ اَقْرَبَھُمْ مَّوَدَّةً لِّلَّذِیْنَ اٰمَنُوا الَّذِیْنَ قَالُوْٓا اِنَّا نَصٰرٰی)

“অবশ্যই মু’মিনদের প্রতি শত্রুতায় মানুষের মধ্যে ইয়াহূদী ও মুশরিকদেরকেই তুমি সর্বাধিক উগ্র দেখবে এবং যারা বলে ‘আমরা খ্রিস্টান’ মানুষের মধ্যে তাদেরকেই তুমি মু’মিনদের নিকটতর বন্ধুত্বে দেখবে; (সূরা মায়িদা ৫ : ৮২) পরস্পরের মাঝ ভালবাসা, সম্প্রীতি ও সৌহার্দ ছিল। বলা হয় এর মাঝে এ নির্দেশ রয়েছে যে, তাদেরকে ইঞ্জিলে শান্তি ও সম্প্রীতির নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল এবং মানুষকে কষ্ট দেওয়া হতে বারণ করা হয়েছিল। এজন্য আল্লাহ তা‘আলা তাদের অন্তরকে নরম করে দিয়েছিলেন যা ইয়াহূদীদের বিপরীত, কারণ তাদের অন্তর কঠিন করে দেওয়া হয়েছিল।

(وَرَهْبَانِيَّةَنِ ابْتَدَعُوْهَا) رَهْبَانِيَّةَ

অর্থ হল : বৈরাগ্যবাদ, দুনিয়ার সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করে কোন জঙ্গলে বা মরুভূমিতে গিয়ে নির্জনে আল্লাহ তা‘আলার উপাসনা করা। এর পটভুমি হল, ঈসা (আঃ)-এর পর এমন রাজাদের আগমন ঘটল যারা তাওরাত ও ইঞ্জিলের মধ্যে বহু পরিবর্তন সাধন করে। যে কাজকে একটি দল মেনে নিতে পারেনি। উক্ত দল রাজাদের ভয়ে পাহাড়ের চূড়া ও গুহায় আশ্রয় গ্রহণ করে। এখান থেকেই বৈরাগ্যবাদের সূচনা হয়। যার ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল পরিস্থিতির চাপে পড়ে। কিন্তু তাদের পরে আগত অনেক লোক তাদের বড়দের অন্ধ অনুসরণ করে দেশ ত্যাগ করা ও সংসার না করাকে ইবাদতের তরীকা বানিয়ে নেয় এবং নিজেকে গির্জা ও উপাসনালয়ে আবদ্ধ করে নেয়। এটাকে আল্লাহ তা‘আলা (মনগড়া) বলে উল্লেখ করেছেন। (ইবনু কাসীর)

(مَا كَتَبْنٰهَا عَلَيْهِمْ إِلَّا ابْتِغَا۬ءَ رِضْوَانِ اللّٰهِ)

অর্থাৎ এ বৈরাগ্যবাদ আল্লাহ তা‘আলা তাদের ওপর ফরয করে দেননি, এটা তারা নিজেরা উদ্ভাবন করেছে, বরং আল্লাহ তা‘আলা কেবল তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন করা ফরয করে দিয়েছিলেন। ইসলামেও বৈরাগ্যবাদ বলতে কিছু নেই। বৈরাগ্যবাদকে ইসলামে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। (সহীহ বুখারী হা. ৫০৬৩)

এর দ্বিতীয় অর্থ হল : তারা এ কাজ আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি লাভের জন্য করেছিল। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা পরিস্কার করে দিলেন- দীনে নিজের তৈরি বিদআত দ্বারা তাঁর সন্তুষ্টি পাওয়া যায় না।

সাহাবী উমামা আল বাহিলী (রাঃ) বলেন : একদা আমরা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে কোন একটি যুদ্ধে বের হলাম, তারপর উক্ত সাহাবী বললেন : জনৈক ব্যক্তি একটি গুহার পাশ দিয়ে অতিক্রম করছিল, সে গুহায় পানি ছিল। সে ব্যক্তি মনে মনে চিন্তা করল সেখানে সে অবস্থান করবে, দুনিয়ার সাথে কোন সম্পর্ক রাখবে না। গুহায় যে পানি আছে ও আশ পাশে ফল-মূল আছে তা তার খাবার হিসাবে যথেষ্ট। তিনি বললেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে আগমনের পর এ কথা উল্লেখ করলে তিনি অনুমতি দিলে তাই করব। অনুমতি না দিলে করব না। নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে এসে বিস্তারিত খুলে বলল। নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : আমি ইয়াহূদীবাদ ও খ্রিস্টবাদ নিয়ে প্রেরিত হইনি বরং একনিষ্ঠ দয়াদ্র দীন নিয়ে এসেছি। সে সত্তার শপথ যার হাতে আমার প্রাণ! আল্লাহ তা‘আলার রাস্তায় এক সকাল বা বিকাল ব্যয় করা দুনিয়া ও তার মাঝে যা কিছু আছে তার চেয়ে উত্তম। আর সালাতে প্রথম কাতারে দাঁড়ানো (বৈরাগ্যবাদের) ষাট বছর সালাতের চেয়ে উত্তম। (আহমাদ হা. ২১৭৮৮, সিলসিলা সহীহাহ হা. ২৯২৪)

(فَمَا رَعَوْهَا حَقَّ رِعَايَتِهَا)

অর্থাৎ তারা নিজেদের তৈরি করা বৈরাগ্যবাদকে যথাযথভাবে পালন করতে পারেনি। এখানে আল্লাহ তা‘আলা দুভাবে বৈরাগ্যবাদীদেরকে তিরস্কার করলেন-

১. তারা দীনের মধ্যে এমন কিছু তৈরি করে নিয়েছে যা আল্লাহ তা‘আলা নির্দেশ করেননি।
২. নিজেদের তৈরি করা বিদআত যথাযথভাবে পালন করতে পারেনি।

তাদের বিশ্বাস ছিল এর মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্য হাসিল করা যাবে। সুতরাং নিজের কাছে যা ভাল লাগবে তাই ইবাদত হিসাবে গ্রহণ করার কোন সুযোগ নেই। বরং কোন কাজ ও কথা ইবাদত হওয়ার মাপকাঠি হল কুরআন ও সহীহ সুন্নাহ। এর মাপকাঠির বাইরে যা আছে সব মানুষের মনগড়া, যার মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলাকে পাওয়া অসম্ভব বরং আরো পাপের ভাগী হতে হবে।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. নূহ (আঃ) ও ইবরাহীম (আঃ)-এর ফযীলত জানলাম।
২. ঈসা (আঃ) আল্লাহ তা‘আলার একজন রাসূল ও বান্দা।
৩. দীনের ভেতরে নিজের মনগড়া কিছু তৈরি করা বিদ‘আত। যদিও তা নিজের কাছে ভাল লাগে।
৪. বিদআতের মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি হাসিল করা যায় না।
৫. দীনের ভেতর কোন বাড়াবাড়ি নেই। যারাই দীনের মধ্যে বাড়াবাড়ি করবে দীন তাদের ওপর জয় লাভ করবে।
৬. ইসলামে বৈরাগ্যবাদের কোন স্থান নেই।
২৮-২৯ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

অত্র আয়াতদ্বয়ে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর প্রতি ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনা এবং তাঁকে ভয় করে চলার ফযীলত বর্ণনা করছেন। ইবনু আব্বাস (রাঃ) ও যহহাক (রহঃ) বলেন : আয়াতে উল্লিখিত ফযীলত ঐ সকল আহলে কিতাবদের জন্য যারা তাদের নাবী মূসা ও ঈসা (আঃ)-এর প্রতি ঈমান এনেছিল, তাওরাত ও ইঞ্জিল অনুপাতে আমল করত, অতঃপর নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর আগমনের পর তাঁর প্রতি ঈমান আনল ও তাঁর অনুসরণ করল। ইবনু জারীর (রহঃ) এ মত সমর্থন করেছেন।

হাদীসে এসেছে তিন শ্রেণির মানুষকে দ্বিগুণ প্রতিদান প্রদান করা হবে, তার মধ্যে একশ্রেণি হল ঐ আহলে কিতাব যে তার নাবীর প্রতি ঈমান এনেছে এবং নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি ঈমান এনেছে। (সহীহ বুখারী হা. ৮২, সহীহ মুসলিম হা. ২৪১)

তবে অধিকাংশ মুফাসসিরগণ এ মত পোষণ করেছেন যে, অত্র আয়াতে উল্লিখিত ফযীলত এ উম্মতের মু’মিন মুত্তাকীদের জন্য। আহলে কিতাবদের মু’মিনদেরকে দ্বিগুণ প্রতিদান দেওয়া হবে সে সম্পর্কে সূরা কাসাসের ৫২-৫৫ নম্বর আয়াতে উল্লেখ করা আছে। সাঈদ বিন যুবাইর (রহঃ) বলেন : যখন আহলে কিতাবগণ এ গর্ব করতে লাগল যে, তাদেরকে দ্বিগুণ প্রতিদান দেওয়া হবে তখন এ উম্মতের জন্য অত্র আয়াত নাযিল করলেন। (ইবনু কাসীর)

আল্লামা শানকিতী (রহঃ) বলেন : যারা অত্র আয়াতকে আহলে কিতাবদের ফযীলত হিসাবে উল্লেখ করে তারা ভুল করে। (আযওয়াউল বায়ান)

সুতরাং উম্মাতে মুহাম্মাদির কোন মু’মিন ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করলে এবং সঠিক ঈমান ও আমল করলে আহলে কিতাবের চেয়ে বেশি নেকী দেবেন। হাদীসে আহলে কিতাবের চেয়ে উম্মতে মুহাম্মাদির অনেক বেশি ফযীলত বর্ণিত হয়েছে। অন্যতম একটি হাদীস হল সহীহ বুখারীর এই হাদীস-

>مَثَلُكُمْ وَمَثَلُ أَهْلِ الْكِتَابَيْنِ كَمَثَلِ رَجُلٍ اسْتَأْجَرَ أُجَرَاءَ فَقَالَ مَنْ يَعْمَلُ لِي مِنْ غُدْوَةَ إِلَي نِصْفِ النَّهَارِ عَلَي قِيرَاطٍ فَعَمِلَتْ الْيَهُودُ ثُمَّ قَالَ مَنْ يَعْمَلُ لِي مِنْ نِصْفِ النَّهَارِ إِلَي صَلَاةِ الْعَصْرِ عَلَي قِيرَاطٍ فَعَمِلَتْ النَّصَارَي ثُمَّ قَالَ مَنْ يَعْمَلُ لِي مِنْ الْعَصْرِ إِلَي أَنْ تَغِيبَ الشَّمْسُ عَلَي قِيرَاطَيْنِ فَأَنْتُمْ هُمْ فَغَضِبَتْ الْيَهُودُ وَالنَّصَارَي فَقَالُوا مَا لَنَا أَكْثَرَ عَمَلًا وَأَقَلَّ عَطَاءً قَالَ هَلْ نَقَصْتُكُمْ مِنْ حَقِّكُمْ قَالُوا لَا قَالَ فَذَلِكَ فَضْلِي أُوتِيهِ مَنْ أَشَاءُ-

তোমরা ও উভয় আহলে কিতাব (ইয়াহুদী ও খ্রিষ্টান)-এর উদাহরণ হল এমন এক ব্যক্তির মতো, যে কয়েকজন মজদুরকে কাজে নিয়োগ করে বলল, সকাল হতে দুপুর পর্যন্ত এক কিরাত পারিশ্রমিকের বিনিময়ে আমার কাজ কে করবে? তখন ইয়াহুদী কাজ করে দিল। তারপর সে ব্যক্তি বলল, কে আছ যে দুপুর হতে আসর পর্যন্ত এক কিরাতের বিনিময়ে কাজ করে দেবে? তখন খ্রিষ্টান কাজ করে দিল। তারপর সে ব্যক্তি বলল, কে আছ যে আসর হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত দুই কিরাত পারিশ্রমিকের বিনিময়ে কাজ করবে? আর তোমরাই হলে (মুসলমান) তারা (যারা অল্প পরিশ্রমে অধিক পারিশ্রমিক লাভ করলে) তাতে ইয়াহুদী ও খ্রিষ্টানরা রাগান্বিত হল। তারা বলল, এটা কেমন কথা, আমরা কাজ করলাম বেশি, অথচ পারিশ্রমিক পেলাম কম? তখন সে ব্যক্তি (নিয়োগকর্তা) বলল, আমি তোমাদের প্রাপ্য কম দিয়েছি? তারা বলল, না। তখন সে বলল, সেটা তো আমার অনুগ্রহ, যাকে ইচ্ছা দান করি। (বুখারী ২২৬৮ নম্বর হাদীস)

(وَيَجْعَلْ لَّكُمْ نُوْرًا تَمْشُوْنَ بِه۪)

‘তিনি তোমাদেরকে আলো দেবেন’ অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা তোমাদেরকে জ্ঞান, হিদায়াত ও সুষ্পষ্ট বর্ণনা দেবেন যার দ্বারা অজ্ঞতার অন্ধকারে চলতে পারবে, ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন : নূর হল কুরআন। আবার বলা হয় এমন আলো যার দ্বারা আখিরাতে পুলসিরাতে হাঁটবে। আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন।

(لِّئَلَّا يَعْلَم) এখানের لا (লা) অক্ষরটি অতিরিক্ত, মূল ইবারতটি হল

ليعلم اهل الكتاب انهم لا يقدرون علي ان ينالوا شيءا من فضل الله

কিতাবীগণ যেন জানতে পারে, আল্লাহ তা‘আলার সামান্যতম অনুগ্রহের ওপরও তাদের কোন অধিকার নেই। সকল অনুগ্রহ আল্লাহ তা‘আলার হাতে, তিনি যাকে ইচ্ছা দান করেন। সুতরাং তোমাদের ওপর উম্মাতে মুহাম্মাদীকে বেশি মর্যাদা দেওয়া হয়েছে এতে হিংসা-বিদ্বেষের কোন কারণ নেই। হাদীসে এসেছে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : তোমাদের পূর্বে যারা বসবাস করেছে তাদের তুলনায় দুনিয়াতে তোমাদের অবস্থান হল তেমন আছরের পর থেকে সূর্য অস্ত যাওয়া পর্যন্ত যতটুকু সময়। তাওরাত ধারীদেরকে তাওরাত প্রদান করা হয়েছে তারা তাওরাত অনুযায়ী অর্ধদিন আমল করেছে, তারপর আমল করতে অপারগ হয়ে গেছে। ফলে তাদের আমলের বিনিময়ে এক কিরাত পারিশ্রমিক প্রদান করা হয়েছে। তারপর ইঞ্জিল ধারীদেরকে ইঞ্জিল প্রদান করা হয়েছে, তারা ইঞ্জিল অনুপাতে আছর পর্যন্ত আমল করেছে, তারপর অপারগ হয়ে গেছে। ফলে তাদের পারিশ্রমিক এক কিরাত প্রদান করা হয়েছে। তারপর তোমাদেরকে কুরআন প্রদান করা হয়েছে, তোমরা কুরআন অনুপাতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আমল করেছ। ফলে তোমাদেরকে দু কিরাত পারিশ্রমিক প্রদান করা হয়েছে। তাওরাতধারীরা বলল : হে আমাদের প্রভু! তারা কম সময় আমল করেছে, কিন্তু প্রতিদান পেয়েছে বেশি। আল্লাহ তা‘আলা বললেন : তোমাদের ওপর কি জুলুম করা হয়েছে। তারা বলল : না, আল্লাহ তা‘আলা বললেন : এটা হল আমার অনুগ্রহ, যাকে ইচ্ছা আমি তা দিয়ে থাকি। (সহীহ বুখারী হা. ৭৪৬৭)

উম্মাতে মুহাম্মাদীর মু’মিন ব্যক্তিরা কম সময় আমল করবে কিন্তু তাদের প্রতিদান পূর্ববর্তী আহলে কিতাবদের চেয়ে অনেক বেশি। সুতরাং আমাদের এ নেয়ামতের প্রশংসাসহ বেশি বেশি সৎআমল করা উচিত।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. আল্লাহ তা‘আলা ও নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ওপর সঠিক ঈমান এনে আল্লাহ তা‘আলার আদেশ পালন ও নিষেধ বর্জন করত তাঁকে যথাযথ ভয় করে চললে দ্বিগুণ প্রতিদান, সঠিক পথে চলতে পারলে আলোকবির্তকা ও অপরাধ ক্ষমা করে দেবেন।
২. সকল নেয়ামত ও অনুগ্রহের মালিক একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা।
৩. উম্মাতে মুহাম্মাদীর অন্যতম একটি ফযীলত হল তারা সকল উম্মতের চেয়ে বেশি মর্যাদাবান, তারা কম সময় আমল করেও বেশি সময় আমলকারীদের চেয়ে অনেক বেশি প্রতিদান পাবে।

Leave a Reply