بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ ( বই # ১১৫৪) [*‌‌আল্লাহ অবশ্যই শুনেছেন সে নারীর কথা:- *তোমাদের মধ্যে যারা নিজেদের স্ত্রীদের সাথে ‘যিহার’ করে:-] www.motaher21.net সূরা:৫৮: আল্-মুজালিদাহ। পারা:২৮ ১-৪ নং আয়াত:- আয়াতের ব্যাখ্যা:- ১) তাফসীরে ফী জিলালিল কুরআন:- ২) তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:- ৩) তাফসীরে ইবনে কাছীর:-

Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১১৫৪)
[*‌‌আল্লাহ অবশ্যই শুনেছেন সে নারীর কথা:-
*তোমাদের মধ্যে যারা নিজেদের স্ত্রীদের সাথে ‘যিহার’ করে:-]
www.motaher21.net
সূরা:৫৮: আল্-মুজালিদাহ।
পারা:২৮
১-৪ নং আয়াত:-
আয়াতের ব্যাখ্যা:-
১) তাফসীরে ফী জিলালিল কুরআন:-
২) তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:-
৩) তাফসীরে ইবনে কাছীর:-

সূরা:৫৮: আল্-মুজালিদাহ:-১
قَدۡ سَمِعَ اللّٰہُ قَوۡلَ الَّتِیۡ تُجَادِلُکَ فِیۡ زَوۡجِہَا وَ تَشۡتَکِیۡۤ اِلَی اللّٰہِ ٭ۖ وَ اللّٰہُ یَسۡمَعُ تَحَاوُرَکُمَا ؕ اِنَّ اللّٰہَ سَمِیۡعٌۢ بَصِیۡرٌ ﴿۱﴾
আল্লাহ অবশ্যই শুনেছেন সে নারীর কথা; যে তার স্বামীর বিষয়ে আপনার সাথে বাদানুবাদ করছে এবং আল্লাহর কাছেও ফরিয়াদ করছে। আল্লাহ তোমাদের কথোপকথন শুনেন ; নিশ্চয় আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বদ্ৰষ্টা ।
সূরা:৫৮: আল্-মুজালিদাহ:-২
اَلَّذِیۡنَ یُظٰہِرُوۡنَ مِنۡکُمۡ مِّنۡ نِّسَآئِہِمۡ مَّا ہُنَّ اُمَّہٰتِہِمۡ ؕ اِنۡ اُمَّہٰتُہُمۡ اِلَّا الّٰٓیِٴۡ وَلَدۡنَہُمۡ ؕ وَ اِنَّہُمۡ لَیَقُوۡلُوۡنَ مُنۡکَرًا مِّنَ الۡقَوۡلِ وَ زُوۡرًا ؕ وَ اِنَّ اللّٰہَ لَعَفُوٌّ غَفُوۡرٌ ﴿۲﴾
তোমাদের মধ্যে যারা নিজেদের স্ত্রীদের সাথে “যিহার” করে তাদের স্ত্রীরা তাদের মা নয়। তাদের মা কেবল তারাই যারা তাদেরকে প্রসব করেছে। এসব লোক একটা অতি অপছন্দনীয় ও মিথ্যা কথাই বলে থাকে। প্রকৃত ব্যাপার হলো, আল্লাহ‌ মাফ করেন, তিনি অতীব ক্ষমাশীল।
সূরা:৫৮: আল্-মুজালিদাহ:-৩
وَ الَّذِیۡنَ یُظٰہِرُوۡنَ مِنۡ نِّسَآئِہِمۡ ثُمَّ یَعُوۡدُوۡنَ لِمَا قَالُوۡا فَتَحۡرِیۡرُ رَقَبَۃٍ مِّنۡ قَبۡلِ اَنۡ یَّتَمَآسَّا ؕ ذٰلِکُمۡ تُوۡعَظُوۡنَ بِہٖ ؕ وَ اللّٰہُ بِمَا تَعۡمَلُوۡنَ خَبِیۡرٌ ﴿۳﴾
যারা৭ নিজের স্ত্রীর সাথে “যিহার” করে বসে এবং তারপর নিজের বলা সে কথা প্রত্যাহার করে এমতাবস্থায় তারা পরস্পরকে স্পর্শ করার পূর্বে একটি ক্রীতদাসকে মুক্ত করতে হবে। এর দ্বারা তোমাদের উপদেশ দেয়া হচ্ছে। তোমরা যা করো আল্লাহ‌ সে সম্পর্কে অবহিত।
সূরা:৫৮: আল্-মুজালিদাহ:-৪
فَمَنۡ لَّمۡ یَجِدۡ فَصِیَامُ شَہۡرَیۡنِ مُتَتَابِعَیۡنِ مِنۡ قَبۡلِ اَنۡ یَّتَمَآسَّا ۚ فَمَنۡ لَّمۡ یَسۡتَطِعۡ فَاِطۡعَامُ سِتِّیۡنَ مِسۡکِیۡنًا ؕ ذٰلِکَ لِتُؤۡمِنُوۡا بِاللّٰہِ وَ رَسُوۡلِہٖ ؕ وَ تِلۡکَ حُدُوۡدُ اللّٰہِ ؕ وَ لِلۡکٰفِرِیۡنَ عَذَابٌ اَلِیۡمٌ ﴿۴﴾
যে মুক্ত করার জন্য কোন ক্রীতদাস পাবে না সে বিরতিহীনভাবে দুই মাস রোযা রাখবে- উভয়ে পরস্পরকে স্পর্শ করার পূর্বেই। যে তাও পারবে না সে ষাট জন মিসকীনকে খাবার দেবে। তোমাদেরকে এ নির্দেশ দেয়া হচ্ছে এজন্য যাতে তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের ওপর ঈমান আনো। এগুলো আল্লাহর নির্ধারিত ‘হদ’। কাফেরদের জন্য রয়েছে কষ্টদায়ক শাস্তি।
১-৪ নং আয়াত:-
আয়াতের ব্যাখ্যা:-
ফী জিলালিল কুরআন:

সংক্ষিপ্ত আলােচনা : আমরা এই গােটা সুরাসহ বলতে গেলে প্রায় এই সমগ্র পারাটার মাঝেই মাদানী সমাজে রসূল(স.)-এর জীবদ্দশায় সংঘটিত ঘটনাবলীর সাক্ষাৎ পাই। দেখতে পাই সদ্যোজাত মুসলিম দলটিকে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে, শুধু এই ছােট পৃথিবীতেই নয়; বরং সমগ্র বিশ্বনিখিলে তার সেই ভূমিকা পালনের জন্যে কিভাবে তাকে গড়ে তােলা হচ্ছে, যে ভূমিকা আল্লাহ তায়ালা তার জন্যে নির্ধারণ করে রেখেছেন। এটা আসলেই এক বিরাট ভূমিকা। এই দলটির হৃদয়ে মানব জীবন সম্পর্কে যে পূর্ণাংগ ও সর্বব্যাপী ধারণা জন্মে এবং সেই ধারণার ভিত্তিতে তাদের যে বাস্তব জীবন ও চরিত্র গড়ে ওঠে, তা থেকেই এই ভূমিকা পালন করা শুরু হয়। জীবন সম্পর্কে এই পূর্ণাংগ ও সর্বব্যাপী ধারণা এই দলটি অতপর সারাবিশ্বে ছড়িয়ে দেয়, যাতে করে সমগ্র মানব জাতির জন্যে এ ধারণার ভিত্তিতে একটা পূর্ণাংগ জীবন ও চরিত্র গড়ে তােলা সম্ভবপর হয়। সুতরাং এই ভূমিকাটা এতাে বড় যে, তার জন্যে একটা পূর্ণাংগ প্রস্তুতির প্রয়োজন। যে মুসলিম দলটিকে মহান আল্লাহ এই বিরাট ভূমিকা পালনের জন্যে তৈরী করছিলেন, সে দলটির লোকগুলো অন্যান্য মানুষের মতােই মানুষ ছিলাে। তাদের মধ্যে একদল ছিলাে সর্বাগ্রে ইসলাম গ্রহণকারী মােহাজের ও আনসার, যাদের ঈমান পরিপক্কতা অর্জন করেছিলো, নতুন আকীদা ও আদর্শের ব্যাপারে তাদের ধারণা পূর্ণতা লাভ করেছিলাে, এর জন্যে তাদের অন্তরও একনিষ্ঠ হয়ে গিয়েছিলাে। তাদের নিজেদের সত্ত্বা ও মহাবিশ্বের বিশাল সত্ত্বার সাথে প্রকৃত পরিচয় তারা জানতে পেরেছিলাে এবং তাদের সত্ত্বা মহাবিশ্বের সাথে মিশ্রিত হয়ে একাকার হয়ে গিয়েছিলাে। এভাবে তারা সৃষ্টিজগতে আল্লাহর পরিকল্পনার একটি অংশে পরিণত হয়ে গিয়েছিলে। তাদের মন মগযে এ ব্যাপারে কোনাে বক্রতা ও সমন্বয়হীনতা ছিলাে না, তাদের গৃহীত কোনাে পদক্ষেপই মহান আল্লাহর পরিকল্পনার বাইরে গৃহীত হতাে না এবং তাদের অন্তরে এমন কোনাে চিন্তা বা ইচ্ছারও জন্ম নিতাে না, যা আল্লাহর কাছে পছন্দনীয় নয়। এই সূরার নিম্নোক্ত আয়াতে তাদের সম্পর্কে যে ধরনের বিবরণ দেয়া হয়েছে তারা আসলে সে রকমই ছিলাে, তুমি আল্লাহ তায়ালা ও তার রসূলের প্রতি বিশ্বাসী কোনাে গােষ্ঠীকে আল্লাহ তায়ালা ও তার রাসূলের বিরােধী কোনাে ব্যক্তিকে ভালােবাসে এমন দেখতে পাবে না, এমনকি সে যদি তাদের মা বাবা, ছেলে মেয়ে, ভাই বােন অথবা ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজন হয় তবুও নয়। তারা হচ্ছে সেসব লােক, যাদের অন্তরে আল্লাহ তায়ালা ঈমান অংকন করে দিয়েছেন…।'(শেষ আয়াত) কিন্তু ঈমান আনয়নে অগ্রণী এসব লােক পরবর্তীকালের ক্রমবর্ধমান মুসলিম জনগােষ্ঠীর তুলনায় ক্ষুদ্রতর জনগােষ্ঠীতে পরিণত হয়, বিশেষত ইসলামের একটা শক্তিতে পরিণত হবার পর থেকে মক্কা বিজয় পর্যন্ত সময়ে এটা বেশী লক্ষ্য করা গেছে। এ সময়ে এমন লােকেরা ইসলামে প্রবেশ করতে থাকে, যারা ইসলামী শিক্ষাও যথেষ্ট পরিমাণে অর্জন করেনি এবং ইসলামী পরিবেশে দীর্ঘকাল জীবন যাপনও করেনি। কিছু কিছু মােনাফেক শ্রেণীর লােকও এই সময়ে ইসলামে প্রবেশ করে, যাদের অন্তরে ইসলাম অতোটা শিকড় গাড়েনি, যেটা শিকড় গেড়েছিলাে স্বার্থপ্রীতি, নিরাপত্তাপ্রীতি, সুযােগসন্ধানী মানসিকতা। মুসলিম শিবির ও তৎলীন শক্তিশালী মােশরেক ও ইহুদী গােষ্ঠীর মধ্যকার সম্পর্কে দোদুল্যমানতা, স্থীতিহীনতা ও নমনীয়তা সৃষ্টির কুমতলব যতােটা মজবুত ছিল তাদের ঈমান ততােটা মযবুত ছিলাে না। সমগ্র সৃষ্টিজগতে এই মুসলিম জাতির জন্যে যে ভূমিকা নির্ধারিত হয়েছিলাে, সে ভূমিকা পালনের উদ্দেশ্যে তাদের প্রস্তুত করা ও উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্যে প্রয়ােজন ছিলাে বহুমুখী চেষ্টা সাধনার, সুদীর্ঘ ধৈর্যের এবং ছােট বড় প্রত্যেক সমস্যার পর্যায়ক্রমিক ও ধীরগতিসম্পন্ন সঠিক সমাধানের। এ উদ্দেশ্যেই গঠিত হয়েছিলাে মানুষ গড়া ও চরিত্র গড়ার সেই বিরাট আন্দোলন, যা ইসলাম ও রাসূল(স.) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলাে। এ আন্দোলন সেসব চরিত্রবান মানুষ গড়ে তুলেছিলাে, যারা ইসলামী সমাজ ও ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পারবে, যারা আল্লাহর আইন ও বিধানের পতাকা উত্তোলন করতে পারবে, সর্বোপরি যারা আল্লাহর বিধান বুঝবে ও বাস্তবায়িত করতে পারবে। যারা তাকে পৃথিবীর সর্বত্র জীবন্ত ও কার্যকরভাবে ছড়িয়ে দেবে, একে শুধু বই পুস্তকের পাতায় সীমাবদ্ধ রাখবে না, কিংবা তা নিয়ে শুধু গলাবাজি করেই ক্ষান্ত হবে না। এই সূরাসহ সমগ্র পারা জুড়ে আমরা সেই বহুমুখী চেষ্টা সাধনা ও সংগ্রামের কিছু নমুনা দেখতে পাই। দেখতে পাই সেই মহান মানুষগুলােকে তৈরী করা ও বিভিন্ন রকমের ঘটনা, আদত অভ্যাস, রীতি নীতি, আবেগ উচ্ছাস ও ঝোকপ্রবণতা নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে কোরআন যে পদ্ধতি অবলম্বন করেছে তার কিছু কিছু দিক। আর ইসলামের নানান রকমের শত্রু মােশরেক, ইহুদী ও মােনাফেকদের সাথে ইসলামের যে দীর্ঘস্থায়ী দ্বন্দ্ব সংঘাত চলে আসছে, তারও কিছু অংশ আমরা এখানে দেখতে পাই। বিশেষত এই সূরায় আমরা সদ্য আবির্ভূত মুসলমান দলটির প্রতি মহান আল্লাহর অসাধারণ কৃপা ও যত্নের একটা প্রতিফলন দেখতে পাই। মনে হয়, আল্লাহ তায়ালা স্বয়ং তাকে চোখে চোখে রেখে গড়ে তুলেছেন, নিজের বিধানের আলােকে তাকে প্রতিপালন করেছেন, তার মনমগযে এরূপ চেতনা ও অনুভূতির সৃষ্টি করেছেন যে, আল্লাহ তায়ালা তার ছােটো বড়াে গােপন প্রকাশ্য সকল ব্যাপারে সর্বদা তার সাথে সাথে রয়েছেন, তাকে তার শত্রুদের গোপন ও প্রকাশ্য সকল চক্রান্ত থেকে রক্ষা করে চলেছেন, তার স্বভাব চরিত্র, আদত অভ্যাস ও ঐতিহ্যকে এমনভাবে গড়ে তুলেছেন যাতে তারা আল্লাহ তায়ালার সুরক্ষাপ্রাপ্ত ও প্রিয় দলের উপযােগী স্বভাব চরিত্রের মানুষে পরিণত হয়, পৃথিবীতে আল্লাহর বাহিনী গড়ে তােলার ও সারা পৃথিবীতে আল্লাহর পতাকা উত্তোলনের যােগ্য হয়। এ কারণেই অত্যন্ত চমকপ্রদ ভংগিতে সূরাটার সূচনা হয়েছে। মূলত এ সময়টা ছিলাে মানবেতিহাসের একটা বিরল যুগ। এ যুগে মহান আল্লাহ কর্তৃক পৃথিবীর অধিবাসীদের সাথে প্রত্যক্ষ ও ইন্দ্রিয়ানুভূতভাবে সংযােগ রক্ষা করা এবং একটি বিশেষ মানবগােষ্ঠীর দৈনন্দিন কর্মকান্ডে অংশগ্রহণের একটা উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালা শুনেছেন সেই মহিলার কথা, যে তার স্বামীর ব্যাপারে তােমার সাথে বিতর্কে লিপ্ত হয়েছিলাে ও আল্লাহর কাছে অভিযােগ পেশ করেছিলাে, আর আল্লাহ তায়ালা তােমাদের উভয়ের কথােপকথনও তখন শুনছিলেন; ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ সবকিছু শােনেন ও দেখেন।'(আয়াত-১) এখানে আমরা দেখতে পাই, মহান আল্লাহ তায়ালা একটা নগণ্য দরিদ্র ও সাধারণ ক্ষুদ্র পরিবারের দৈনন্দিন ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করছেন, যাতে সে পরিবারের উদ্ভূত সমস্যায় আল্লাহর ফয়সালা কার্যকরি হতে পারে। মহিলা রাসূল(স.)-এর সাথে কথা বলার সময় আল্লাহ তায়ালা তা শুনেছেন। অথচ তার কাছে থেকেও হযরত আয়শা(রা.) তা শুনতে পাচ্ছিলেন না! এটা আসলে এমন এক দৃশ্য, যা আল্লাহর উপস্থিতি, নৈকট্য, স্নেহ ও অভিভাবকত্বের অনুভূতি দিয়ে হৃদয়কে পরিপ্লুত করে দেয়। এর পরেই খুব জোরের সাথে বলা হয়েছে যে, যারা আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রসূলের বিরােধিতা করে, তারা আল্লাহর আশ্রয় লাভকারী মুসলমানদের চরম শত্রু। তাদের ওপর ইহকালেও থাকবে আল্লাহর আক্রোশ ও অভিশাপ, আর পরকালেও তারা অপমানজনক শাস্তি পাবে। তারা তাদের নিজেদের কর্মফলই ভােগ করবে। তারা নিজেরা তাদের অপকর্ম ও পপাচার ভুলে গিয়েছিলো, কিন্তু আল্লাহ তায়ালা তা গুনে গুনে লিখে রেখেছেন। কারণ, আল্লাহ তায়ালা তাে সব কিছুই দেখেন। তারপর প্রত্যেক গোপন পরামর্শের সময়েও যে আল্লাহ তায়ালা সেখানে উপস্থিত থাকেন সে কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে। তারা মনে করে যে, সেখানে তারা ছাড়া কেউ নেই। অথচ তারা যেখানেই থাকে, আল্লাহ তায়ালা সেখানেই তাদের সাথে থাকেন। “অতপর তিনি কেয়ামতের দিন তাদের জানিয়ে দেবেন তারা কী করেছে। আল্লাহ তায়ালা সবকিছুই জানেন। বস্তুত এ আয়াতেও এমন দৃশ্য তুলে ধরা হয়েছে, যা আল্লাহর অস্তিত্ব, সার্বক্ষণিক উপস্থিতি, তদারকী ও খবরদারী সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করে তােলে। এই হুঁশিয়ারী আসলে মুসলমানদের বিরুদ্ধে গােপন ষড়যন্ত্রে লিপ্তদের বিরুদ্ধে হুমকিস্বরূপ। এ দ্বারা তাদের মনে উদ্বেগ ও ভীতির সঞ্চার করা হয়েছে। তাদের জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, তাদের গােপন দুরভিসন্ধি ফাঁস হয়ে গেছে। আল্লাহর চোখকে তারা ফাঁকি দিতে পারেনি। পাপকার্য, যুলুম, অত্যাচার, রসূল(স.)-এর অবাধ্যতার লক্ষ্যে তাদের সমস্ত গোপন তৎপরতা ও পরিকল্পনা আল্লাহ লিখে রেখেছেন। আল্লাহ তায়ালা এসবের জন্যে তাদের পাকড়াও করবেন ও শাস্তি দেবেন। তিনি মুসলমানদের নিষেধ করেছেন, তারা যেন ভালাে কাজ, আল্লাহর ভয় এবং এর জন্যে মানুষের মন মগয প্রস্তুত করার উদ্দেশ্য ছাড়া আর কোনাে উদ্দেশ্যে গোপন সলাপরামর্শ না করে। এরপর এই মােমেনদের প্রশিক্ষণ দেয়া অব্যাহত রাখা হয়েছে, রসূল(স.)-এর বৈঠকে, অন্যান্য এলেম ও যিকিরের বৈঠকে তাদের ভদ্রতা, সুশীলতা ও আনুগত্যের শিক্ষা দেয়া হয়েছে। অনুরূপভাবে রসূল(স.)-এর সাথে কথা বলা ও প্রশ্ন করার আদবও শিক্ষা দেয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে গাম্ভীর্য ও সম্মান বজায় রাখার উপদেশ দেয়া হয়েছে। এরপর সূরার অবশিষ্টাংশ হচ্ছে ইহুদিদের সাথে দহরম-মহরম পাতানাে ও তাদের সাথে গােপন ষড়যন্ত্র পাকানাে মােনাফেকদের সাথে সংশ্লিষ্ট। বলা হয়েছে যে, তারা তাদের মােনাফেকী ও অপতৎপরতাকে মিথ্যাচার ও মিথ্যা শপথের মাধ্যমে রাসূল(স.) ও মুসলমানদের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখে। আখেরাতেও তারা মিথ্যা কথা ও মিথ্যা শপথের মাধ্যমে আল্লাহর আযাব থেকে বাঁচতে চেষ্টা করবে, যেমন এই দুই কৌশল কাজে লাগিয়ে তারা দুনিয়াতে রসূল(স.) ও মুসলমানদের আক্রোশ থেকে রক্ষা পেতাে। সেই সাথে এ কথাও জোর দিয়ে বলা হয়েছে যে, যারা আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রাসূলের সাথে শত্রুতা করবে, আল্লাহ তায়ালা তাদের সর্বাপেক্ষা অপমানিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হিসাবে লিখে দেবেন। তিনি এও লিখে রাখবেন যে, তিনিও তাঁর রসূলরাই বিজয়ী হবেন। এ কথা দ্বারা মূলত মােনাফেকদের অপমানিত করা হয়েছে। কেননা কোনাে কোনাে মুসলমান তাদের মর্যাদাশালী মনে করতাে। তাই তারা তাদের সাথে কিছুটা সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চেষ্টা করতাে। অথচ মুসলমানদের শুধুমাত্র আল্লাহর পতাকার নীচে সমবেত করা, একমাত্র আল্লাহর অভিভাবকত্ব দ্বারা সম্মানিত ও শক্তিমান বােধ করা উচিত। আল্লাহর প্রিয় বান্দা এই মুসলমানদের আল্লাহর প্রহরাধীন থাকতে পেরে নিশ্চিন্ত থাকার গুরুত্ব কতাে তা তারা উপলব্ধি করে না। সূরার শেষাংশে আল্লাহর দল হিসেবে মুসলমানদের উজ্জ্বল ভাবমূর্তি তুলে ধরা হয়েছে। এ ভাবমূর্তি হচ্ছে সর্বাগ্ৰে ইসলাম গ্রহণকারী মােহাজের ও আনসারদের। তাদের প্রতিই ইংগিত করা হয়েছে শেষ আয়াতটিতে, ‘তুমি দেখতে পাবে না আল্লাহ তায়ালা ও আখেরাতের প্রতি বিশ্বাসী কোনাে গােষ্ঠী আল্লাহ তায়ালা এবং রাসূলের বিরােধী কোনাে লােকের সাথে প্রীতি ও ভালোবাসার সম্পর্ক রাখে…’

ফী জিলালিল কুরআন:

‘আল্লাহ তায়ালা সেই মহিলার কথা শুনেছেন যে তােমার সাথে তার স্বামীকে নিয়ে তর্ক করেছিলাে এবং আল্লাহর কাছে অভিযােগ করেছিলাে। আর আল্লাহ তায়ালা তােমাদের উভয়ের কথােপকথন শুনেন।'(আয়াত ১-৪)   *কোনো কিছুই আল্লাহর দৃষ্টির অগােচরে নয় : জাহেলী যুগে কখনাে কখনাে এমন ঘটতাে যে, কোনাে স্বামী তার স্ত্রীর কোনাে কাজ বা কথায় রেগে গেলে বলতাে, তুই আমার কাছে আমার মায়ের পিঠের মতাে। এর ফলে সে তার ওপর হারাম হয়ে যেতে, অথচ এতে তালাক হতাে না। সে এভাবেই ঝুলন্ত থেকে যেতাে। সে তার জন্যে হালালও থাকতাে না যে তাদের মধ্যে দাম্পত্য সম্পর্ক বহাল থাকবে, আবার সে তালাকপ্রাপ্তও হতাে না যে, অন্য কোনাে স্বামী গ্রহণ করবে। জাহেলী যুগে এটা ছিলাে নারী নির্যাতনের অসংখ্য উপায়ের মধ্যে অন্যতম একটা উপায়। যখন ইসলামের আবির্ভাব ঘটলাে, ঠিক তখনই এই ঘটনাটা ঘটে, যার দিকে এই আয়াত কটিতে ইংগিত দেয়া হয়েছে। তখনাে পর্যন্ত যেহারের কোনাে বিধান নাযিল হয়নি। ইমাম আহমাদ বর্ণনা করেন যে, হযরত খােওয়ায়লা বিনতে সালাবা(রা.) বলেছেন, আল্লাহর কসম আমার ও আওস বিন সামেত সম্পর্কেই আল্লাহ তায়ালা সূরা মুজাদালাহ প্রথম অংশ নাযিল করেছেন। তিনি বলেন, আমি আওস বিন সামেতের স্ত্রী ছিলাম। সে তখন অতি মাত্রায় বুড়ো এবং মেজাজ খুব খিটখিটে তিরিক্ষি হয়ে গেছে। একদিন সে আমার কাছে এলাে। আমি তাকে একটা বিষয়ে কৈফিয়ত তলব করতেই সে ভীষণ রেগে গেলাে। সে তৎক্ষণাৎ বলে ওঠলাে, তুই আমার কাছে আমার মায়ের পিঠের মতাে। এরপর সে বেরিয়ে গেলাে এবং তার গােত্রের আড্ডাখানায় কিছুক্ষণ বসলাে। তারপর নিভৃতে আমার কাছে এলাে। এসেই সে সহবাস করার ইচ্ছা ব্যক্ত করলাে। আমি বললাম, খবরদার! খােওয়ায়লার প্রভুর কসম, তুমি যে কথা বলেছো, তারপর আর আমার কাছে নিভৃতে সাক্ষাত করাে না, যতােক্ষণ না আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রসূল আমাদের ব্যাপারে ফয়সালা ঘোষণা করেন। এরপর সে আমার সাথে ধস্তাধস্তি করতে লাগলাে, কিন্তু আমি নিজেকে রক্ষা করলাম। একজন দুর্বল বুড়াের ওপর জয়লাভ করতে একজন নারীর যে কৌশল অবলম্বন করতে হয়, তাই অবলম্বন করে আমি জয়লাভ করি। আমি তাকে আমার কাছ থেকে হটিয়ে দিলাম। এরপর আমি এক প্রতিবেশীর কাছ থেকে কিছু পােশাক ধার করে আনলাম। তারপর রসূল(স.)-এর কাছে চলে গেলাম এবং তার সামনে বসে আমার স্বামীর কাছ থেকে যে দুর্ব্যবহার ভােগ করে আসছি, সে ব্যাপারে অভিযােগ পেশ করলাম । রসূল(স.) বললেন, ‘হে খােওয়ায়লা, তােমার চাচাতাে ভাই (অর্থাৎ স্বামী) অত্যধিক বুড়াে। তার ব্যাপারে তুমি আল্লাহকে ভয় করাে।’ এরপর আমার ব্যাপারে কোরআনের আয়াত নাযিল হওয়া পর্যন্ত আমি চুপচাপ থাকি। রসূল(স.) গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে পড়েন। তারপর একদিন তার চিন্তা দূর হলো। তিনি আমাকে বললেন, হে খােওয়ায়লা, আল্লাহ তায়ালা তােমার ও তােমার স্বামীর ব্যাপারে কোরআনের আয়াত নাযিল করেছেন। তারপর তিনি আমাকে এই সূরার প্রথম চারটা আয়াত পড়ে শােনালেন। এরপর রসূল(স.) আমাকে বললেন, তুমি ওকে একটা দাস মুক্ত করে দিতে বলো। আমি বললাম, হে রসূল, তার মুক্ত করার মতাে কোনাে দাস নেই। তিনি বললেন, তাহলে তার একনাগাড়ে দুমাস রােযা রাখা উচিত। আমি বললাম, সে এতােটা বুড়াে হয়ে গেছে যে, তার পক্ষে রােযা রাখা সম্ভব নয়। তিনি বললেন, তাহলে সে ষাট জন দরিদ্রকে এক ওয়াসাক খােরমা খাওয়াক। আমি বললাম, ওর কাছে তাও নেই। রসূল(স.) বললেন, আমরা তাকে এক আরক (৬০ সা) খােরমা দিয়ে সাহায্য করবো। আমি বললাম, হে রসূল, আমিও ওকে আরাে এক আরক খােরমা দিয়ে সাহায্য করবো। রসূল(স.) বললেন, তুমি ঠিক কাজ করেছো ও ভালাে করেছো। যাও, ওর পক্ষ থেকে সদকা দিয়ে দাও। তারপর তােমার চাচাতাে ভাইয়ের জন্যে শুভ কামনা করাে। আমি তাই করলাম।'(আবু দাউদ) এই হচ্ছে সেই সমস্যা, যা নিয়ে রসূল(স.)-এর কাছে এসে বাদানুবাদে লিপ্ত মহিলার ও রসূল(স.)-এর মধ্যকার সংলাপ আল্লাহ তায়ালা শুনেছিলেন। এটাই সেই সমস্যা যার ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা সাত আকাশের ওপর থেকে নিজের ফয়সালা নাযিল করেছিলেন, যাতে এই মহিলাকে তার অধিকার দেয়া যায়। তার ও তার স্বামীর মনকে প্রবােধ দেয়া এবং এ ধরনের দৈনন্দিন পারিবারিক সমস্যায় মুসলমানদের কী করা উচিত তা তাদের জানিয়ে দেয়া যায়। এ হচ্ছে সেই ঘটনা, যা দিয়ে আল্লাহর চিরঞ্জীব কোরআনের একটি সূরা শুরু হয়েছে। যে কোরআনের প্রতিটি শব্দ আল্লাহর সর্বোচ্চ পরিষদের কাছ থেকে নাযিল হয় এবং সৃষ্টিজগতের প্রতিটি অংশ তা দ্বারা আলােড়িত ও স্পন্দিত হয়, তার একটি সূরার শুরুতেই ঘােষণা করা হয়েছে, ‘মহান আল্লাহ তায়ালা সেই মহিলার কথা শুনেছেন, যে তার স্বামীর ব্যাপারে তোমার সাথে বাদানুবাদ করেছিলাে…’ এটা ভেবে দেখার মতাে ব্যাপার যে, সাধারণ মুসলমানদের ও পৃথিবীর পরিচালনা এবং ব্যবস্থাপনার ব্যস্ততা তাকে এ সমস্যাটার প্রতি কর্ণপাত করা ও তার ব্যাপারে ফয়সালা দেয়া থেকে বিরত রাখতে পারেনি। এটা এমন একটা চমকে দেয়া ঘটনা, যা দ্বারা একদল মানুষ উপলব্ধি করতে পারে, আল্লাহ তায়ালা এভাবে তাদের সাথে উপস্থিত রয়েছেন, তাদের ছােটো বড়াে সকল সমস্যার তিনি তদারক করছেন, তাদের দৈনন্দিন সমস্যাবলী নিয়ে তিনি উদ্বিগ্ন হন এবং তাদের যাবতীয় সমস্যা সংকটের সমাধান দিতে তিনি প্রস্তুত থাকেন। অথচ তিনি সেই মহামহিম, মহাপরাক্রমশালী, মহাপ্রতাপশালী আল্লাহ, তার সর্বময় কর্তৃত্ব ও সার্বভৌমত্ব সমগ্র আকাশ এবং পৃথিবী জুড়ে বিস্তৃত। যিনি সকল অভাবমুক্ত ও যাবতীয় প্রশংসনীয় গুণাবলীতে ভূষিত! হযরত আয়শা(রা.) বলেন, সেই আল্লাহর সকল প্রশংসা, যার শ্রবণশক্তি সকল শব্দকে পরিবেষ্টন করে আছে। বাদানুবাদরত খােওয়ায়লা রসূল(স.)-এর কাছে এসে আমাদের ঘরের এক কোণে বসে যে কথাবার্তা বলছিলাে, আমিও তা শুনতে পাচ্ছিলাম না। এই সময়ে আল্লাহ তায়ালা নাযিল করলেন, ‘আল্লাহ তায়ালা সেই মহিলার কথা শুনেছেন……..।'(বােখারী ও নাসায়ী) খাওলা বা খােওয়ায়লা নিজে এ ঘটনার যে বিবরণ দিয়েছেন, অর্থাৎ এ ঘটনায় তার যেটুকু ভূমিকা রয়েছে, রসূল(স.)-এর কাছে তার গমন, সেখানে গিয়ে তার সাথে বাদানুবাদ করা, শেষ পর্যন্ত তার সমস্যার সমাধান নিয়ে কোরআনের আয়াত নাযিল হওয়া- এসব কিছুতে মুসলমানদের সেই অতুলনীয় দলটি সে সময়ে কী ধরনের জীবন যাপন করছিলাে, তার কিছুটা চিত্র দেখতে পাওয়া যায়। জানা যায়, মহান আল্লাহর সাথে তাদের কেমন প্রত্যক্ষ যােগাযােগ থাকতাে, তাদের প্রতিটি সমস্যার সমাধানের জন্যে তারা কিভাবে মহান আল্লাহর নির্দেশের প্রতীক্ষা করতাে এবং এই প্রতীক্ষার পর তিনি কিভাবে তাদের প্রয়ােজনে সাড়া দিতেন। মূলত এসব কিছু সেই দলটিকে যেন আল্লাহর পরিবার হিসেবেই চিহ্নিত করে। তিনি যেন এ পরিবারের এমন সযত্ন তত্ত্বাবধান করছেন, যেমন কোনাে পিতা তার সন্তানর তত্ত্বাবধান করে থাকে। খােদ কোরআনের আয়াতে এ ঘটনার যেটুকু বর্ণনা রয়েছে, তাতেই আমরা অত্যন্ত শিক্ষাপ্রদ ও তাৎপর্যবহ উপাদান দেখতে পাই। আল্লাহর বিধান ও ফায়সালার পাশাপাশি এতে চমকপ্রদ মন্তব্যও করা হয়েছে এবং এটাই কোরআনের অনুপম বর্ণনাভংগি, আল্লাহ তায়ালা শুনেছেন সেই মহিলার কথা, যে তোমার সাথে তার স্বামীর ব্যাপারে বাদানুবাদ করছিলাে এবং আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করছিলাে, আর আল্লাহ তােমাদের উভয়ের সংলাপ শুনছিলেন। এভাবে অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী ও বিস্ময়করভাবে সূরার সূচনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, তােমরা শুধু দু’জনই সেখানে ছিলে না। আল্লাহ তায়ালাও তােমাদের সাথে ছিলেন এবং তিনি তােমাদের কথা শুনছিলেন। তিনি মহিলার কথা শুনেছেন। তাকে তােমার সাথে নিজের স্বামীর ব্যাপারে বাদানুবাদ করতে ও আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করতে শুনেছেন। সমস্ত ঘটনা তিনি জানেন। তিনি তােমাদের উভয়য়ের কথােপকথন ও তার কথােপকথনের বিষয় জানেন। তিনি শ্রবণকারী, দর্শনকারী। ঘটনার এই হচ্ছে একটা চিত্র, যাতে দেখা যাচ্ছে, আল্লাহ তায়ালা তােমাদের দু’জনের সাথে তৃতীয় হিসেবে সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
ফী জিলালিল কুরআন:

*যিহার অর্থাৎ স্ত্রীকে মায়ের সাথে তুলনা করার কাফফারা : কোরআনের বিবরণ হৃদয়কে প্রচন্ডভাবে আলােড়িত করে। এরপর আসল সমস্যার বিবরণ আসছে দ্বিতীয় আয়াতে, ‘তােমাদের মধ্যে যারা তাদের স্ত্রীদের সাথে যিহার করে, তারা তাদের মা নয়। তাদের মা তাে তারাই, যারা তাদের প্রসব করেছে। তারা আসলে একটা নিকৃষ্ট কথা বলে ও মিথ্যা বলে। তবে আল্লাহ ক্ষমাশীল, মার্জনাকারী। এভাবে মূল সমস্যার গােড়ায় হাত দেয়া হয়েছে। বস্তুত যিহার জিনিসটা একটা অমূলক ও ভুয়া ব্যাপার। স্ত্রী কখনাে মা নয় যে, মায়ের মতাে সে হারাম হয়ে যাবে। মা তাে তিনি যিনি তাকে প্রসব করেছেন। মুখের একটা কথায় স্ত্রী মা হয়ে যেতে পারে না। ওটা একটা খারাপ কথা, যা বাস্তবকে অস্বীকার করে। একটা ভুয়া কথা, যা সত্যের সম্পূর্ণ বিপরীত। জীবনের যাবতীয় ব্যাপার সত্য ও বাস্তবতার ওপর প্রতিষ্ঠিত হওয়া উচিত। স্বচ্ছ ও সুস্পষ্ট হওয়া উচিত। একটা অন্যটার সাথে মিশে জগাখিচুড়ি হতে পারে না। তবে যা অতীতে হয়ে গেছে সে ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা ক্ষমাশীল, দয়াশীল। এভাবে সুস্পষ্টভাবে ও স্বচ্ছতায় মূল বিষয়টা তুলে ধরার পর এর ব্যাপারে আইনগত ফায়সালা ঘোষণা করা হচ্ছে, ‘তােমাদের মধ্যে যারা তাদের স্ত্রীর সাথে যিহার করে অতপর তাদের উক্তি প্রত্যাহার করতে চায়, তাদের কর্তব্য একে অপরকে স্পর্শ করার আগে একজন দাস মুক্ত করা। এ নির্দেশ দিয়ে তােমাদের নসীহত করা হয়েছে। আর আল্লাহ তায়ালা তােমাদের কার্যকলাপ সম্পর্কে অবহিত।’ আল্লাহ তায়ালা দাস মুক্তকরণের কাজটাকে বহ রকমের গুনাহর কাফফারা রূপে নির্ধারণ করেছেন। যারা যুদ্ধ বিগ্রহের কারণে প্রথমে যুদ্ধবন্দী হয়ে পরে দাসত্বের ভাগ্য বরণ করতে বাধ্য হতাে, কাফফারা তাদের স্বাধীনতা ও তাদের মুক্তির অন্যতম উপায় হয়ে ওঠেছিলাে। ‘অতঃপর তাদের উক্তি প্রত্যাহার করতে চায়’- এ কথাটার ব্যাখ্যায় অনেকগুলাে মতামত উদ্ধৃত হয়েছে। আমি সেসব মতামতের মধ্যে থেকে এই মতটাই অগ্রগণ্য মনে করেছি যে, এর অর্থ হচ্ছে, তারা তাদের সে উক্তি তথা যিহার দ্বারা নিজেদের ওপর যে স্ত্রী সহবাস হারাম করেছিলাে, সেটা পুনরায় বৈধ করার জন্যে সে উক্তি প্রত্যাহার করতে চায়। এই মতটাই আয়াতের বাহ্যিক বাচনিক রূপের সাথে অধিকতর সামঞ্জস্যপূর্ণ ও নিকটতম। অর্থাৎ স্বামীর নিজের সৃষ্টি করা এই সমস্যার সমাধানের জন্যে একজন দাস মুক্ত করা অপরিহার্য। অতপর মন্তব্য করা হচ্ছে, ‘এ নির্দেশ দিয়ে তােমাদের নসীহত করা হচ্ছে।’ অর্থাৎ যে যেহারের কোনাে ন্যায়সংগত ভিত্তি নেই এবং কোনাে ভালাে কাজ বলে পরিচিতও নয়, তা যাতে তােমরা পুনরায় না করো, সে জন্যে এই কাফফারা একটা উপদেশবাণী ও স্মরণিকা হয়ে থাকবে। ‘আল্লাহ তায়ালা তােমাদের কার্যকলাপ সম্পর্কে অবহিত।’ অর্থাৎ তােমাদের কার্যকলাপের ধরন, তার সংগঠন ও তার পেছনে তােমাদের যে নিয়ত, মনােভাব ও উদ্দেশ্য সক্রিয় রয়েছে তা তার জানা আছে। এই মন্তব্য করা হয়েছে যিহারের বিধান পরিপূর্ণভাবে বর্ণনা করার পূর্বে, যাতে মােমেনদের মন সেই বিধান গ্রহণের জন্য জাগ্রত ও প্রস্তুত হয়, বিধানের আনুগত্য করার প্রশিক্ষণ যেন সে লাভ করে এবং এই মর্মে সতর্ক হয় যে, আল্লাহ তায়ালা যে ব্যাপারেই নির্দেশ দেন, তার সম্পর্কে তার পূর্ণ অভিজ্ঞতা এবং তার গােপন ও প্রকাশ্য সবকিছু অবহিত থাকার ভিত্তিতেই নির্দেশ দেন। এ কথা বলার পর কাফফারার অবশিষ্ট বিধান বর্ণনা করা হচ্ছে, ‘আর যে ব্যক্তি তা (দাসমুক্ত করতে) পারে না, সে যেন উভয়ের পক্ষ থেকে পরস্পরকে স্পর্শ করার পূর্বে একনাগাড়ে দু’মাস রােযা রাখে, আর যে ব্যক্তি তাও না পারে, সে যেন ষাট জন অভাবী ব্যক্তিকে আহার করানো।’ এরপর অধিকতর বিশ্লেষণ ও মনােযােগ আকর্ষণের লক্ষ্যে বলা হচ্ছে, ‘ নির্দেশদানের উদ্দেশ্য হচ্ছে, যেন তােমরা আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রসুলের প্রতি ঈমান আনাে।’ যাদের সম্বােধন করে এ কথা বলা হচ্ছে, তারা মােমেনই। তবুও এই বর্ণনা, এসব কাফফার এবং এর ভেতরে তাদের অবস্থা আল্লাহর নির্দেশ ও ফয়সালার সাথে যেভাবে সংযুক্ত ও সমন্বিত করা হয়েছে, তা ঈমানকে নিছক বিশ্বাস ও মানসিক প্রেরণা-উদ্দীপনার স্তর থেকে বাস্তবতার স্তরে উন্নীত করে। ঈমানের সাথে কর্মময় জীবনের সংযােগ সাধন করে এবং বাস্তব জীবনের জন্য ঈমানকে একটা লক্ষণীয় শক্তির উৎসরূপে প্রতিষ্ঠিত করে। ‘আর এগুলাে আল্লাহর নির্ধারিত সীমারেখা।’ এই সীমারেখা তিনি এজন্যে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, যাতে মানুষ এই সীমারেখার কাছে এসে থেমে না যায় এবং তা অতিক্রম না করে। কেননা যে ব্যক্তি এই সীমারেখা মানে না এবং মাড়াতে দ্বিধাবােধ করে না, তার ওপর আল্লাহ তায়ালা রাগান্বিত হন।

১-৪ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:-
নামকরণ :

الْمُجَادَلَةُ শব্দটি ক্রিয়ামূল। শব্দের অর্থ হল : বাদানুবাদ করা, কথা কাটাকাটি করা। এ সূরার প্রথম আয়াতে উক্ত ক্রিয়ামূলের উল্লিখিত ক্রিয়া تجادلك থেকে সূরার নামকরণ করা হয়েছে।

সূরার শুরুর দিকে যিহারের বিধান ও কাফফারা, যারা আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে তাদের দুনিয়া ও আখেরাতের অবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। তারপর বলা হয়েছে যারা ইসলামের শত্রু তারা ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে পরস্পর গোপন পরামর্শ করে থাকে, তাদের এ ব্যাপারে ভীতি প্রদর্শন করে মু’মিনদেরকে দীনী বিষয়ে পরামর্শ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অতঃপর মজলিস ও রাসূলের সাথে মুআমালাতের আদবের বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে। সবশেষে বলা হয়েছে যারা মুনাফিক তারাই ইসলামের শত্রুদের সাথে সম্পর্ক রাখে, মু’মিনরা কখনো ইসলামের শত্রুদের সাথে সম্পর্ক রাখে না, যদিও তারা নিকটাত্মীয় হয়।

শানে নুযূল :

উম্মুল মু’মিনীন আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন : বরকতময় সে আল্লাহ যার শ্রবণশক্তি সবকিছু বেষ্টন করে নিয়েছে। আমি খাওলা বিনতু সা‘লাবাহর কথা শুনতে ছিলাম। তবে কিছু কিছু আমার কাছে অস্পষ্ট ছিল (একই রুমে ছিলাম তবুও ফিসফিস করে বলার কারণে শুনতে পাইনি) কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা সাত আকাশের ওপর থেকে শুনে নিলেন। সে মহিলা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট তার স্বামীর ব্যাপারে অভিযোগ করে বলছে : হে আল্লাহর রাসূল! আমার স্বামী আমার সম্পদ খেয়ে ফেলেছে, আমার জীবন তার সাথেই কেটেছে। এখন আমি বুড়ি হয়ে গেছি, আমার সন্তান জন্ম দানের ক্ষমতা লোপ পেয়েছে, এমতাবস্থায় আমার স্বামী আমার সাথে যিহার করেছে, হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে অভিযোগ পেশ করছি। আয়িশাহ (রাঃ) বললেন : একটু পরে জিবরীল (আঃ) (قَدْ سَمِعَ اللّٰهُ قَوْلَ الَّتِيْ تُجَادِلُكَ) আয়াত নিয়ে অবতরণ করেন। তার স্বামীর নাম আউস বিন সামেত। (ইবনু মাযাহ হা. ১৮৮, ২০৬৩, নাসায়ী হা. ৩৪৬০, ইমাম বুখারী কিতাবুত তাওহীদে সনদ ছাড়া নিয়ে এসেছেন)।

একদা উমার (রাঃ) এ মহিলার পাশ দিয়ে অতিক্রম করে যাচ্ছিলেন, সাথে সাহাবীরাও ছিলেন। তখন এ মহিলা উমার (রাঃ)-কে দীর্ঘ সময় দাঁড় করিয়ে কথা বলতে লাগলেন এবং অনেক নসীহত করলেন এবং বললেন : হে উমার! তোমাকে মানুষ উমাইর (ছোট উমার অর্থাৎ অল্প বয়সের ছেলে) বলে ডাকত, তারপর মানুষ উমার বলে ডাকতে লাগল, অতঃপর এখন মানুষ তোমাকে আমীরুল মু’মিনীন বলে ডাকে। হে উমার! তুমি আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় কর। কারণ যে ব্যক্তি জানে মৃত্যু অবধারিত তার মাঝে দুনিয়া ছেড়ে যাওয়ার ভয় বিদ্যমান থাকে, যে ব্যক্তি বিশ্বাস করে তাকে হিসাব দিতে হবে সে আযাবকে ভয় করে। উমার (রাঃ) দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এসব কথা শুনছিলেন। মানুষ উমার (রাঃ)-কে বলল : হে আমীরুল মু’মিনীন! এ জায়গায় একজন বৃদ্ধা মহিলার জন্য দাঁড়িয়ে আছেন? তিনি বললেন : এ মহিলা যদি দিনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আমাকে দাঁড় করিয়ে রাখে আমি ফরয সালাতের সময় বাদে তার জন্য দাঁড়িয়ে থাকব। তোমরা কি জান কে এ বৃদ্ধা মহিলা? তিনি হচ্ছেন খাওলা বিনতে ছা‘লাবাহ, যার কথা আল্লাহ তা‘আলা সাত আকাশের ওপর থেকে শুনেছেন। আল্লাহ তা‘আলা তার কথা শুনবেন আর আমি তার কথা শুনব না? (তাফসীর কুরতুবী)

১-৪ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

আলোচ্য আয়াতগুলোতে যিহারের বিধান ও পদ্ধতি এবং কাফফারা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। যিহার হল স্ত্রীকে বা স্ত্রীর কোন অঙ্গকে যাদের সাথে বিবাহ হারাম তাদের সাথে তুলনা করা। (সহীহ ফিকহুস সুন্নাহ ৩/৩৬৯)

মূলত যিহার হল স্বামী তার স্ত্রীকে বলবে : তুমি আমার মায়ের পিঠের মত, কেননা যিহার শব্দটি যহরুন থেকে গৃহীত যার অর্থ পিঠ। তাই অনেক মনীষী বলেছেন : স্ত্রীকে মায়ের পিঠের সাথে তুলনা করলেই যিহার হবে অন্যথায় হবে না। সঠিক কথা হল যেকোন মাহরাম মহিলার যে কোন অঙ্গের সাথে তুলনা করলেই যিহার হবে। যিহারের হুকুম হল যদি কেউ তার স্ত্রীর সাথে যিহার করে তাহলে কাফফারা না দেওয়া পর্যন্ত স্ত্রীর সাথে সহবাস করা তার জন্য হারাম হয়ে যাবে। যিহারের কাফফারা ৩-৪ নম্বর আয়াতে উল্লেখ রয়েছে। শুধু কাফফারা দিলেই হবে না সাথে সাথে মৌখিকবভাবে উক্ত কথা প্রত্যাহার করে নিতে হবে। কারণ আল্লাহ তা‘আলা বলছেন ‘পরে তারা ফিরে আসে যা তারা বলেছে’। এ সম্পর্কে সূরা আহযাবের শুরুতে আলোচনা করা হয়েছে।

(مَّا هُنَّ أُمَّهٰتِهِمْ ط إِنْ أُمَّهٰتُهُمْ إِلَّا الّٰـ۬ئِيْ وَلَدْنَهُمْ)

‘তাদের স্ত্রীগণ তাদের মাতা নয়। তাদের মাতা তো কেবল তারাই যারা তাদেরকে জন্মদান করেছেন।’ অর্থাৎ স্ত্রীকে মায়ের মাথে তুলনা করলেই স্ত্রী মা হয়ে যায় না, বরং কেবল জন্মদাতাই মা।

(مُنْكَرًا مِّنَ الْقَوْلِ وَزُوْرًا)

‘তারা তো একটি অসঙ্গত ও মিথ্যা কথাই বলছে’ অর্থাৎ স্ত্রীকে মায়ের সাথে তুলনা করা একটি খারাপ ও মিথ্যা কথা, যা বলা কখনো সঙ্গত নয়। সুতরাং এরূপ কথা ও আচরণ থেকে মু’মিনরা সতর্ক ও বিরত থাকবে।

(مِّنْ قَبْلِ أَنْ يَّتَمَآسَّا)

‘একে অপরকে স্পর্শ করার পূর্বে’ এখানে স্পর্শ করার অর্থ হল সহবাস করা। অর্থাৎ সহবাসের পূর্বে যিহারের কাফফারা আদায় করতে হবে। কেউ কাফফারা আদায়ের পূর্বে সহবাস করে ফেললে সে ব্যক্তি গুনাহগার হবে ও আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশের অবাধ্য হবে, তাকে অবশ্যই তাওবা করতে হবে, তবে কাফফারা মাফ হবে না।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. আল্লাহ তা‘আলা মানুষের উচুঁ স্বরের ও নীচু স্বরেরসহ সকল কথা শুনতে পান এমনকি তিনি অন্তর্যামী।
২. বান্দার প্রতি আল্লাহ তা‘আলার অনুগ্রহ। তিনি মহিলা সাহাবীর অভিযোগ শুনলেন এবং সুন্দর সুষ্ঠু সমাধান দিলেন আর বিধানটি সকলের জন্য প্রযোজ্য করে দিলেন।
৩. যিহার শুধু স্ত্রীর সাথে হয়, অন্য কোন নারীর সাথে হয় না।
৪. যদি স্ত্রীকে মা অথবা এমন কোন নারীর অঙ্গের সাথে তুলনা করা হয় যার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া হারাম তাহলে যিহার বলে গণ্য হবে।
৫. স্ত্রীকে মাহরাম নারীদের সম্বোধনে ডাকা নিষেধ। যেমন স্ত্রীকে এরূপ বলা যে, হে আমার মা, হে আমার বোন ইত্যাদি।
৬. স্ত্রীর সাথে সহবাস করার পূর্বেই উল্লিখিত তিনটির কোন একটি কাফফারা প্রদান করা ওয়াজিব।
৭. কেউ যিহারের কাফফারাস্বরূপ মিসকীনকে খাওয়াতে চাইলে অবশ্যই ষাট জন মিসকিনকে খাওয়াতে হবে। ষাট জনের খাবার একত্রিত করে একজন বা একাধিক জনকে দিলে শরীয়ত সিদ্ধ হবে না। (তাফসীর সা‘দী)।

১-৪ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে ইবনে কাছীর:-
হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ “সমস্ত প্রশংসা আল্লাহরই জন্যে যাঁর শ্রবণশক্তি সমস্ত শব্দকে পরিবেষ্টন করে রেখেছে। এই বাদানুবাদকারিণী মহিলাটি এসে নবী (সঃ)-এর সাথে এতো চুপে চুপে কথা বলতে শুরু করে যে, আমি ঐ ঘরেই থাকা সত্ত্বেও মোটেই শুনতে পাইনি যে, সে কি বলছে! কিন্তু আল্লাহ্ তা’আলা ঐ গুপ্ত কথাও শুনে নেন এবং এই আয়াত অবতীর্ণ করেন।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ), ইমাম বুখারী (রঃ), ইমাম নাসাঈ (রঃ), ইমাম ইবনে
মাজাহ (রঃ), ইমাম ইবনে আবি হাতিম (রঃ) এবং ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

মুসনাদে ইবনে আবি হাতিমে হাদীসটি নিম্নরূপে বর্ণিত আছেঃ

হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেনঃ “আল্লাহ্ কল্যাণময় যিনি উঁচু-নীচু সব শব্দই শুনেন। এই অভিযোগকারিণী মহিলাটি ছিল হযরত খাওলা বিনতে সা’লাবাহ (রাঃ)। যখন সে রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর নিকট হাযির হয় তখন এতো ফিসফিস করে কথা বলে যে, তার কোন কোন শব্দ আমার কানে আসছিল বটে, কিন্তু অধিকাংশ কথাই আমার কানেও পৌছেনি। অথচ আমি ঐ ঘরেই বিদ্যমান ছিলাম। সে তার স্বামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলেঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমার যৌবন তো তার সাথেই কেটেছে। এখন আমি বুড়ি হয়ে গেছি এবং আমার সন্তান জন্মদানের যোগ্যতা লোপ পেয়েছে, এমতাবস্থায় আমার স্বামী আমার সাথে যিহার [যাহেলী যুগে আরব সমাজে যদি কোন লোক তার স্ত্রীকে (আরবী) (তুমি আমার জন্যে আমার মাতার পৃষ্ঠ সদৃশ) এ কথা বলতো তাহলে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে
যেতো। এভাবে বিবাহ বন্ধন ছিন্ন করাকে যিহার বলে] করেছে। হে আল্লাহ! আমি আপনার সামনে দুঃখের কান্না কাঁদছি।” তখনো মহিলাটি ঘর হতে বের হয়নি ইতিমধ্যেই হযরত জিবরাঈল (আঃ) আয়াত নিয়ে অবতীর্ণ হন। তার স্বামীর নাম ছিল হযরত আউস ইবনে সামিত (রাঃ)।

কখনো কখনো তার মাথা খারাপ হয়ে যেতো, ঐ সময় তিনি তাঁর স্ত্রীর সাথে যিহার করে ফেলতেন। তারপর যখন জ্ঞান ফিরে আসতো তখন এমন হতেন যে, যেন কিছুই হয়নি। তার স্ত্রী রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট ফতওয়া নিতে এবং আল্লাহ্ তা’আলার নিকট আবেদন জানাতে আসলে আল্লাহ্ তা’আলা এই আয়াত অবতীর্ণ করেন।

হযরত যায়েদ (রাঃ) বলেন যে, হযরত উমার (রাঃ) তাঁর খিলাফতের আমলে লোকদের সাথে পথ চলছিলেন, পথে একটি মহিলার সাথে সাক্ষাৎ হয়। মহিলাটি তাকে ডেকে থামতে বলে। হযরত উমার (রাঃ) তৎক্ষণাৎ থেমে যান এবং মহিলাটির কাছে গিয়ে আদব ও মনোযোগের সাথে মাথা ঝুঁকিয়ে দিয়ে তার কথা শুনতে থাকেন। নিজের ফরমায়েশ মুতাবেক কাজ করিয়ে নিয়ে মহিলাটি ফিরে যায় এবং হযরত উমার (রাঃ) তার লোকদের কাছে ফিরে আসেন। তখন একটি লোক বলে ওঠেঃ “হে আমীরুল মুমিনীন! একটি বৃদ্ধা মহিলার কথায় আপনি থেমে গেলেন এবং আপনার কারণে এতোগুলো লোককে এতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করতে হলো।” একথা শুনে হযরত উমার (রাঃ) বললেনঃ “আফসোস! এই মহিলাটি কে তা কি তুমি জান?” উত্তরে লোকটি বলেঃ “জ্বী, না। তখন তিনি বলেনঃ “ইনি ঐ মহিলা যার আবেদন আল্লাহ্ তা’আলা সপ্তম আকাশের উপর হতে শুনেন। ইনি হলেন হযরত খাওলা বিনতে সা’লাবাহ (রাঃ)। যদি তিনি আজ সকাল হতে সন্ধ্যা পর্যন্ত, এমনকি কিছু রাত্রি পর্যন্তও কথা বলতে থাকতেন তবুও আমি তার খিদমত হতে সরতাম না। হ্যাঁ, তবে নামাযের সময় নামায আদায় করতাম এবং তারপর আজ্ঞাবহ রূপে তাঁর খিদমতে হাযির হয়ে যেতাম।” (এ হাদীসটির সনদ ছেদকাটা। তবে অন্য ধারাতেও এটা বর্ণিত আছে)

অন্য একটি রিওয়াইয়াতে আছে যে, মহিলাটি ছিলেন খাওলা বিনতে সামিত (রাঃ) এবং তাঁর মাতার নাম ছিল মুআযাহ্ (রাঃ), যার ব্যাপারে (আরবী) (২৪:৩৩) এই আয়াতটি অবতীর্ণ হয়েছিল। কিন্তু সঠিক কথা এটাই যে, মহিলাটি ছিলেন আউস ইবনে সামিত (রাঃ)-এর স্ত্রী খাওলা (রাঃ)।
২-৪ নং আয়াতের তাফসীর:

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে সালাম (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, হযরত খুওয়াইলাহ্ বিনতে সা’লাবাহ্ (রাঃ) বলেন, আল্লাহর শপথ! আমার এবং (আমার স্বামী) হযরত আউস ইবনে সামিত (রাঃ)-এর ব্যাপারে আল্লাহ্ তাআলা সূরায়ে মুজাদালার প্রাথমিক আয়াতগুলো অবতীর্ণ করেন। আমি তার ঘরে ছিলাম। তিনি খুবই বৃদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন এবং তাঁর চরিত্রও ভাল ছিল না। একদা তিনি আমার কাছে আসেন, আমি তাকে এমন এক কথা বলে ফেলি যে, তিনি রাগান্বিত হন এবং আমাকে বলে ফেলেনঃ (আরবী)

অর্থাৎ “তুমি আমার জন্যে আমার মাতার পৃষ্ঠ সদৃশ।” তারপর তিনি ঘর হতে বেরিয়ে যান। এবং কওমী মজলিসে কিছুক্ষণ বসে থাকেন। অতঃপর তিনি বাড়ীতে ফিরে আসেন। এরপর তিনি আমার সাথে কাম প্রবৃত্তি চরিতার্থ করতে চাইলে আমি বলিঃ কখনো না, যার হাতে খুওয়াইলাহর প্রাণ রয়েছে তাঁর শপথ! আপনার। একথা (যিহারের কথা) বলার পর আপনি আপনার এ মনোবাসনা পূর্ণ করতে পারেন না যে পর্যন্ত না আমাদের ব্যাপারে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল (সঃ)-এর ফায়সালা হয়। কিন্তু তিনি মানলেন না, বরং জোর পূর্বক তাঁর কাম বাসনা চরিতার্থ করতে চাইলেন। কিন্তু তিনি দুর্বল ছিলেন বলে আমি তার উপর বিজয় লাভ করলাম এবং তিনি পরাজিত হলেন। আমি আমার প্রতিবেশিনীর বাড়ী গিয়ে একটা কাপড় চেয়ে নিলাম এবং তা গায়ে দিয়ে সরাসরি রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর নিকট গমন করলাম। আমার স্বামীর সাথে আমার যা কিছু ঘটেছিল তা আমি তাঁর সামনে নিঃসংকোচে বর্ণনা করলাম এবং তার দুশ্চরিত্রতার অভিযোগ করলাম। রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) আমাকে বলতে থাকলেনঃ “হে খুওয়াইলাহ্ (রঃ)! তোমার স্বামীর ব্যাপারে তুমি আল্লাহকে ভয় কর, সে তো অতি বৃদ্ধ হয়ে পড়েছে।” আল্লাহর কসম! আমাদের মধ্যে এসব কথাবার্তা চলতে আছে ইতিমধ্যে রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর উপর অহী অবতীর্ণ হতে শুরু হয়। শেষ হলে তিনি বলেনঃ “হে খুওয়াইলাহ (রাঃ)! তোমার ও তোমার স্বামীর ব্যাপারে আল্লাহ্ তা’আলা কুরআনের আয়াত অবতীর্ণ করেছেন।” অতঃপর তিনি (আরবী) হতে (আরবী) পর্যন্ত আয়াতগুলো পাঠ করেন। তারপর তিনি আমাকে বলেনঃ “তোমার স্বামীকে বলল যে, সে যেন একটি গোলাম আযাদ – করে।” আমি বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! গোলাম আযাদ করার মত সামর্থ্য তার নেই। তিনি বললেনঃ “তাহলে সে যেন একাদিক্রমে দুই মাস রোযা রাখে।” আমি বললাম, আল্লাহর কসম! তিনি তো অতি বৃদ্ধ। দুই মাস রোযা রাখার শক্তি তার নেই। তাহলে সে যেন এক অসাক (প্রায় পাকি চার মণ) খেজুর ষাটজন মিসকীনকে খেতে দেয়।” বললেন তিনি। আমি বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! এ পরিমাণ খেজুরও তার কাছে নেই। তিনি বললেনঃ “আচ্ছা, আমি অর্ধ অসাক খেজুর তাকে দিচ্ছি।” আমি বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! ঠিক আছে, বাকী অর্ধেক আমি দিচ্ছি। তিনি বললেনঃ “বাঃ, বাঃ! খুবই ভাল কাজ করলে তুমি। যাও, এটা আদায় করছে। আর তোমার স্বামীর সাথে প্রেম-প্রীতি, শুভাকাঙ্ক্ষা ও আনুগত্য সহ জীবন কাটিয়ে দাও।” আমি বললামঃ আমি তাই করবো। (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) ও ইমাম আবু দাউদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

কোন কোন রিওয়াইয়াতে মহিলাটির নাম খুওয়াইলাহ্ এর স্থলে খাওলাহ্ রয়েছে এবং বিনতু সা’লাবাহ্ এর স্থলে বিনতে মালিক ইবনে সা’লাবাহ্ আছে। এসব উক্তিতে এমন কোন মতপার্থক্য নেই যে, একে অপরের বিরোধ হবে। এসব ব্যাপারে আল্লাহ্ তা’আলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।

এই সূরার প্রাথমিক এই আয়াতগুলোর সঠিক শানে নুযূল এটাই। হযরত সালমা ইবনে সাখ আনসারীর (রাঃ) ঘটনাটি যা এখনই আসছে, এ আয়াতগুলোতে আছে, এই হুকুমই সেখানেও দেয়া হয়েছে অর্থাৎ গোলাম আযাদ করা বা দুই মাস একাদিক্রমে রোযা রাখা অথবা ষাটজন মিসকীনকে খাদ্য খেতে দেয়া।

ঘটনাটি হযরত সালমা ইবনে সাখর আনসারী (রাঃ) নিজেই নিম্নরূপে বর্ণনা করেছেনঃ

“অন্যদের তুলনায় আমার স্ত্রী-সহবাসের ক্ষমতা অধিক ছিল। রমযান মাসে দিনের বেলায় আমি নিজেকে হয় তত সহবাস হতে বিরত রাখতে পারবো না এই ভয়ে সারা রমযান মাসের জন্যে আমার স্ত্রীর সাথে আমি যিহার করে ফেলি। একদা রাত্রে আমার স্ত্রী আমার সেবায় লিপ্ত ছিল এমতাবস্থায় তার দেহের কোন এক অংশ হতে কাপড় সরে যায়। তখন আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পেরে তার সাথে সহবাসে লিপ্ত হয়ে পড়ি। সকাল হলে আমি আমার কওমের কাছে ফিরে আমার রাত্রির ঘটনাটি বর্ণনা করি এবং তাদেরকে বলিঃ তোমরা আমাকে নিয়ে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট চল এবং তাকে আমার ঘটনাটি অবহিত কর।

তারা সবাই আমার আবেদন প্রত্যাখ্যান করলো এবং বললোঃ “আমরা তোমার সাথে যাবো না। হতে পারে যে, এ ব্যাপারে কুরআন কারীমে কোন আয়াত অবতীর্ণ হয়ে যাবে অথবা রাসূলুল্লাহ (সঃ) এমন কথা বলে দিবেন যার ফলে আমরা চিরদিনের জন্যে কলংকিত হবো। তুমি নিজেই যাও এবং দেখো, তোমার ব্যাপারে কি ঘটে।” আমি তখন বেরিয়ে পড়লাম এবং নবী (সঃ)-এর দরবারে হাযির হয়ে গেলাম। অতঃপর তাকে আমি আমার খবর অবহিত করলাম। তিনি আমাকে বললেনঃ “তুমি এ কাজ করেছো?” আমি উত্তরে বললামঃ জ্বী, হ্যাঁ, আমি এ কাজ করেছি। পুনরায় তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ “তুমি এ কাজ করেছো?” আমি জবাব দিলামঃ হ্যাঁ, জনাব! আমার দ্বারা এ কাজ হয়ে গেছে। আবার তিনি বললেনঃ “এ কাজ করেছো তুমি?” আমি উত্তরে বললামঃ হ্যাঁ, হুযুর! সত্যিই আমি এ কাজ করে ফেলেছি। সুতরাং আমার উপর আপনি মহামহিমান্বিত আল্লাহর হুকুম জারী করুন! আমি ধৈর্যের সাথে তা সহ্য করবে। তখন তিনি বললেনঃ “তুমি একটি গোলাম আযাদ কর।” আমি তখন আমার গদানে হাত রেখে বললামঃ যিনি আপনাকে সত্যসহ প্রেরণ করেছেন তাঁর শপথ! আমি শুধু এরই (অর্থাৎ আমার গদানেরই) মালিক। এ ছাড়া আমি আর কিছুরই মালিক নই (অর্থাৎ আমার গোলাম আযাদ করার ক্ষমতা নেই। তিনি বললেনঃ “তাহলে একাদিক্রমে দুই মাস রোযা রাখো।” আমি বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! রোযার কারণেই তো আমার দ্বারা এ কাজ হয়ে গেছে (সুতরাং এটাও আমার পক্ষে সম্ভব নয়)। তিনি বললেনঃ “যাও, তাহলে সাদকা কর।” আমি বললামঃ আপনাকে যিনি সত্যসহ প্রেরণ করেছেন তাঁর শপথ! আমার কাছে সাদকা করার মত কিছুই নেই। এমন কি আজ রাত্রে আমার পরিবারের সবাই ক্ষুধার্ত রয়েছে। তাদের রাত্রির খাবার পর্যন্ত নেই!

তিনি তখন আমাকে বললেনঃ “তুমি বানু রুয়েক গোত্রের সাদকার মালিকদের কাছে যাও এবং তাদেরকে বল যে, তারা যেন তাদের সাদকার মাল তোমাকেই দেয়। তুমি ওর মধ্য হতে এক অসাক খেজুর ষাটজন মিসকীনকে প্রদান করবে এবং বাকীগুলো তোমার নিজের ও পরিবারের কাজে ব্যয় করবে।”

রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর একথা শুনে আমি খুশী মনে ফিরে আসলাম এবং আমার কওমের কাছে গিয়ে বললামঃ “তোমাদের কাছে আমি পেয়েছিলাম সংকীর্ণতা ও মন্দ অভিমত। আর রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর কাছে পেয়েছি আমি প্রশস্ততা ও বরকত। তিনি তোমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন যে, তোমরা যেন তোমাদের সাদকার মাল আমাকেই প্রদান কর। তারা তখন আমাকে তা দিয়ে দিলো।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ), ইমাম আবু দাউদ (রঃ) এবং ইমাম ইবনে মাজাহ (রঃ) বর্ণনা করেছেন। ইমাম তিরমিযীও (রঃ) সংক্ষিপ্তভাবে এটা বর্ণনা করেছেন এবং তিনি
এটাকে হাসান বলেছেন)

বাহ্যতঃ এটা জানা যাচ্ছে যে, এটা হযরত আউস ইবনে সামিত (রাঃ) এবং তার স্ত্রী হযরত খুওয়াইলাহ্ বিনতে সা’লাবাহ্ (রাঃ)-এর ঘটনার পরবর্তী ঘটনা। যেমন হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, যিহারের প্রথম ঘটনা হচ্ছে হযরত আউস ইবনে সামিত (রাঃ)-এর ঘটনাটি, যিনি হযরত উবাদাহ্ ইবনে সামিতের (রাঃ) ভাই ছিলেন। তাঁর স্ত্রীর নাম ছিল খাওলা বিনতে সা’লাবাহ্ ইবনে মালিক। এই ঘটনার পর হযরত খাওলা (রাঃ)-এর এই ভয় ছিল হয়তো তালাক হয়ে গেছে। তিনি রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর কাছে এসে বলেনঃ আমার স্বামী আমার সাথে যিহার করেছে। যদি আমরা পৃথক পৃথক হয়ে যাই তবে আমরা দুজনই ধ্বংস হয়ে যাবো। আর কোন সন্তানের জন্মদান করার মত ক্ষমতা আমার নেই। দীর্ঘদিন ধরে আমি তার সাথে সংসার করে আসছি।” এভাবে তিনি কথা বলছিলেন এবং ক্রন্দন করছিলেন। এ পর্যন্ত ইসলামে যিহারের কোন হুকুম ছিল। ঐ সময় (আরবী) হতে পর্যন্ত আয়াতগুলো অবতীর্ণ হয়। রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) হযরত আউস ইবনে সামিত (রাঃ)-কে ডেকে বলেনঃ “গোলাম আযাদ করার ক্ষমতা তোমার আছে কি?” তিনি উত্তরে বলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আল্লাহর কসম! এ ক্ষমতা আমার নেই।” রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) তখন তাঁর জন্যে অর্থ সংগ্রহ করেন এবং তা দিয়ে তিনি গোলাম আযাদ করেন। আর এভাবে তিনি তাঁর স্ত্রীকে ফিরিয়ে নেন। (এ হাদীসটি ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) ছাড়াও আরো বহু গুরুজনও একথাই বলেছেন যে, এ আয়াতগুলো তাদের ব্যাপারেই অবতীর্ণ হয়। এসব ব্যাপারে একমাত্র আল্লাহ তাআলাই সর্বাধিক সঠিক জ্ঞানের অধিকারী।

(আরবী) শব্দটি (আরবী) শব্দ হতে এসেছে। অজ্ঞতার যুগের লোকেরা তাদের স্ত্রীদের সাথে যিহার করার সময় বলতোঃ (আরবী) অর্থাৎ “তুমি আমার জন্যে আমার মাতার পৃষ্ঠ সদৃশ।” শরীয়তের হুকুম এই যে, এরূপভাবে যে কোন অঙ্গের নাম নিবে, তাতে যিহার হয়ে যাবে। জাহেলিয়াতের যুগে যিহারকে তালাক মনে করা হতো। আল্লাহ্ তা’আলা এই উম্মতের জন্যে এতে কাফফারা নির্ধারণ করেছেন এবং এটাকে তালাক রূপে গণ্য করেননি, যেমন জাহেলিয়াতের যুগে এই প্রথা ছিল। পূর্বযুগীয় অধিকাংশ গুরুজন একথাই বলেছেন। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) অজ্ঞতার যুগের এই প্রথার উল্লেখ করে বলেনঃ ইসলামে যখন হযরত খুওয়াইলাহ্ সম্পর্কীয় ঘটনাটি সংঘটিত হলো এবং স্বামী-স্ত্রী উভয়েই দুঃখ প্রকাশ করতে লাগলো তখন হযরত আউস (রাঃ) তার স্ত্রীকে রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর দরবারে প্রেরণ করলেন। ঐ সময় রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) চিরুণী করছিলেন। তিনি ঘটনাটি শুনে বললেনঃ “আমাদের কাছে এর কোন নির্দেশ নেই।” ইতিমধ্যে এই আয়াতগুলো অবতীর্ণ হয় এবং তিনি হযরত খুওয়াইলাহ (রাঃ)-কে সুসংবাদ প্রদান করেন। যখন গোলাম আযাদ করার কথা উল্লেখ করা হয় তখন তিনি বলেনঃ “আল্লাহর কসম! আমাদের কাছে কোন গোলাম নেই। আমার স্বামী গোলাম আযাদ করতে সক্ষম নন।” তারপর একাদিক্রমে দুই মাস রোযা রাখার নির্দেশ দেয়া হলে তিনি বলেনঃ “আল্লাহর কসম! আমার স্বামী যদি দিনে তিনবার করে পানি পান না করেন তবে তাঁর দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হয়ে যাবে।” এরপর যখন আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা’আলা বলেনঃ “এতেও যে অসমর্থ, সে ষাটজন অভাবগ্রস্তকে খাওয়াবে।’ তখন হযরত খুওয়াইলাহ (রাঃ) বলেনঃ “কয়েক গ্রাস খাদ্য খেয়েই তো আমাদেরকে সারা দিন কাটিয়ে দিতে হয়, অন্যদেরকে খাওয়ানো তো বহু দূরের কথা!” একথা শুনে রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) অর্ধ অসাক ত্রিশ সা’ (খাদ্য) আনিয়ে নিয়ে তাঁকে দিলেন এবং তাঁর স্বামীকে নির্দেশ দিলেন যে, তিনি যেন তার স্ত্রীকে ফিরিয়ে নেন। (এটা ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বর্ণনা করেছেন। এর ইসনাদ খুবই সবল ও উত্তম। কিন্তু বর্ণনার ধারা গারাবত মুক্ত নয়)

আবুল আলিয়া (রঃ) বলেন যে, খাওলা বিনতে দালীজ (রাঃ) একজন আনসারীর স্ত্রী ছিলেন, যিনি চোখে কম দেখতেন। তিনি ছিলেন খুব দরিদ্র এবং তার চরিত্রও খুব ভাল ছিল না। একদিন কথায় কথায় স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া হয়ে যায় এবং জাহেলিয়াত যুগের প্রথা ও রীতি অনুযায়ী স্বামী স্ত্রীর সাথে যিহার করে নেন। অজ্ঞতা যুগের এটাই ছিল তালাক। স্ত্রী হযরত খাওলা (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর খিদমতে হাযির হন। ঐ সময় তিনি হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর ঘরে ছিলেন এবং হযরত আয়েশা (রাঃ) তাঁর মস্তক ধৌত করছিলেন। হযরত খাওলা (রাঃ) তাঁর সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করেন। ঘটনাটি শুনে রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) বললেনঃ “এখন আর কি হতে পারে? আমার জানা মতে তুমি তার উপর হারাম হয়ে গেছে। তাঁর একথা শুনে হযরত খাওলা (রাঃ) বললেনঃ “আমি আল্লাহর নিকট ফরিয়াদ করছি।” হযরত আয়েশা (রাঃ) রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর মস্তক মুবারকের এক দিক ধুয়ে দিয়ে ঘুরে অন্য দিকে গেলেন এবং ওদিকের অংশ ধুতে লাগলেন। তখন হযরত খাওলাও (রাঃ) ঘুরে গিয়ে ওদিকে বসে পড়েন এবং স্বীয় ঘটনার পুনরাবৃত্তি করেন। রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) পুনরায় ঐ জবাবই দেন।

হযরত আয়েশা (রাঃ) লক্ষ্য করেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর চেহারা মুবারকের রঙ পরিবর্তিত হয়ে গেছে। তখন তিনি হযরত খাওলা (রাঃ)-কে বললেনঃ “তুমি একটু সরে বসো।” তিনি সরে গেলেন। ইতিমধ্যে অহী নাযিল হতে শুরু হয়। অহী নাযিল হওয়া শেষ হলে তিনি প্রশ্ন করেনঃ “মহিলাটি কোথায়?” হযরত আয়েশা (রাঃ) তাঁকে ডাকিয়ে নেন। রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) তখন তাঁকে বলেনঃ “যাও, তোমার স্বামীকে ডেকে নিয়ে এসো।” তিনি কাঁদতে কাঁদতে গেলেন এবং স্বামীকে ডেকে নিয়ে এলেন। স্বামী সম্পর্কে যে মন্তব্য তিনি করেছিলেন যে, তিনি কম দৃষ্টিশক্তি সম্পন্ন, দরিদ্র এবং দুশ্চরিত্র, নবী (সঃ) তাঁকে সেরূপই পেলেন। তখন তিনি পাঠ করলেনঃ (আরবী)

অতঃপর মহিলাটির স্বামীকে বললেনঃ “তুমি স্ত্রীকে স্পর্শ করার পূর্বে গোলাম আযাদ করতে পার কি?” তিনি উত্তরে বললেনঃ “না।” রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) বললেনঃ “তাহলে একাদিক্রমে দুই মাস রোযা রাখতে কি তুমি সক্ষম হবে?” জবাবে তিনি বললেনঃ “যিনি আপনাকে সত্যসহ প্রেরণ করেছেন তার শপথ! আমি দিনে দুইবার বা তিনবার না খেলে আমার চক্ষু নষ্ট হয়ে যাবার উপক্রম হবে।” তখন রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) প্রশ্ন করলেনঃ “তুমি ষাটজন মিসকীনকে খাওয়াতে পারবে কি?” তিনি জবাব দিলেনঃ “না, তবে যদি আপনি আমাকে সাহায্য করেন তাহলে পারবো)।” রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) তাঁকে সাহায্য করলেন এবং তাঁকে বললেনঃ “ষাটজন মিসকীনকে খানা খাওয়ায়ে দাও।” আল্লাহ্ তা’আলা জাহেলিয়াত যুগের প্রথা, তালাককে উঠিয়ে দিয়ে এটাকে যিহাররূপে নির্ধারণ করলেন। (এটা ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) ও ইমাম ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

হযরত সাঈদ ইবনে জুবায়ের (রঃ) বলেন যে, “ঈলা ও যিহার জাহেলিয়াতের যুগের তালাক ছিল। আল্লাহ তা’আলা ঈলায় তো চার মাস সময় নির্ধারণ করেন এবং যিহারে নির্ধারণ করেন কাফফারা।

হযরত ইমাম মালিক (রঃ) (আরবী) শব্দ দ্বারা দলীল গ্রহণ করে বলেন যে, এখানে মুমিনদেরকে সম্বোধন করা হয়েছে, সুতরাং কাফিররা এই হুকুমের অন্তর্ভুক্ত নয়। জমহুরের মাযহাব এর বিপরীত। তাঁরা (আরবী) শব্দের এই জবাব দেন যে, প্রাধান্য হিসাবে এটা বলা হয়েছে। সুতরাং (আরবী) হিসেবে (আরবী) উদ্দেশ্য হতে পারে না। জমহুর (আরবী) দ্বারা দলীল গ্রহণ করেছেন যে, দাসীর সাথে যিহার হয় না এবং দাসী এই বা সম্বোধনের মধ্যে দাখিলও নয়।

আল্লাহ তাআলার উক্তিঃ (আরবী) (তাদের পত্নীগণ তাদের মা নয়, যারা তাদেরকে জন্মদান করে শুধু তারাই তাদের মাতা)। অর্থাৎ কোন ব্যক্তির তার স্ত্রীকে (আরবী) বা (আরবী) অথবা (আরবী) কিংবা এগুলোর সাথে সাদৃশ্য যুক্ত কথা বলার দ্বারা স্ত্রী কখনো তার মা হতে পারে না। বরং যারা তাদেরকে জন্মদান করে শুধু তারাই তাদের মাতা। তারা তো অসংগত ও ভিত্তিহীন কথাই বলে। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ পাপ মোচনকারী ও ক্ষমাশীল। তিনি জাহেলিয়াত যুগের এই সংকীর্ণতাকে তোমাদের হতে দূর করে দিয়েছেন। অনুরূপভাবে প্রত্যেক ঐ কথা যা কোন চিন্তা-ভাবনা ছাড়াই মানুষের মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায় সেটাও তিনি ক্ষমা করে দেন। যেমন সুনানে আবি দাউদে রয়েছেঃ রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) শুনতে পান যে, একটি লোক তার স্ত্রীকে বলছেঃ “হে আমার বোন!” তখন তিনি লোকটিকে বলেনঃ “এটা কি তোমার বোন?” অর্থাৎ তার এ উক্তিকে তিনি অপছন্দ করেন এবং তাকে বাধা দেন। কিন্তু ঐ স্ত্রীকে তিনি তার জন্যে হারাম করে দিলেন না। কেননা, প্রকৃতপক্ষে তার এটা উদ্দেশ্য ছিল না, শুধু মুখ দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল মাত্র। অন্যথায় অবশ্যই ঐ স্ত্রী তার জন্যে হারাম হয়ে যেতো। কেননা, সঠিক উক্তি এটাই যে, নিজের স্ত্রীকে যে ব্যক্তি তাদের নামে স্মরণ করে যারা চিরস্থায়ীভাবে মুহাররামাত (যাদের সাথে বিবাহ চিরতরে অবৈধ) যেমন ভগ্নী, ফুফু, খালা ইত্যাদি, তবে এরাও মাতার হুকুমের পর্যায়ে পড়ে যাবে।

মহান আল্লাহ বলেনঃ “যারা নিজেদের স্ত্রীদের সাথে যিহার করে এবং পরে নিজেদের উক্তি হতে ফিরে আসে।” এর একটি ভাবার্থ এই বর্ণনা করা হয়েছে যে, যিহার করলো, অতঃপর এই শব্দেরই পুনরাবৃত্তি করলো। কিন্তু এটা ঠিক নয়। ইমাম শাফিয়ী (রঃ)-এর উক্তি মতে এর ভাবার্থ হলোঃ যিহার করলো, তারপর ঐ স্ত্রীকে আটক করে রাখলো। শেষ পর্যন্ত এমন এক যামানা অতিবাহিত হলো যে, ইচ্ছা করলে নিয়মিতভাবে তাকে তালাক দিতে পারতো, কিন্তু তালাক দিলো না।

ইমাম আহমাদ (রঃ) বলেন যে, ভাবার্থ হলোঃ আবার ফিরে আসলো সহবাসের দিকে অথবা সহবাসের ইচ্ছা করলো। এটা বৈধ নয় যে পর্যন্ত না উল্লিখিত কাফফারা আদায় করে।

ইমাম মালিক (রঃ) বলেন যে, এর ভাবার্থ হচ্ছেঃ সহবাস করার ইচ্ছা করলো বা তার সাথে জীবন যাপন করার দৃঢ় সংকল্প করলো।

ইমাম আবু হানীফা (রঃ) প্রমুখ গুরুজন বলেন যে, উদ্দেশ্য হলো যিহারের দিকে ফিরে আসা, এর হুরমত ও জাহেলিয়াত যুগের হুকুম উঠে যাওয়ার পর। সুতরাং এখন যে ব্যক্তি যিহার করবে তার উপর তার স্ত্রী হারাম হয়ে যাবে যে পর্যন্ত না সে কাফফারা আদায় করে। হযরত সাঈদ (রঃ) বলেন যে, ভাবার্থ হচ্ছেঃ যে বিষয়কে সে নিজের জীবনের উপর হারাম করে নিয়েছিল সেটা আবার সে বৈধ করতে চায় সে যেন কাফফারা আদায় করে। হযরত হাসান বসরী (রঃ) বলেন যে, কাফফারা আদায় করার পূর্বে সহবাস করা নিষিদ্ধ, কিন্তু যদি গুপ্তাঙ্গ ছাড়া অন্য কিছু স্পর্শ করে তবে কোন দোষ নেই।

হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) প্রমুখ গুরুজন বলেন যে, এখানে (আরবী) দ্বারা সহবাস করাকে বুঝানো হয়েছে।

যুহরী (রঃ) বলেন যে, কাফফারা আদায়ের পূর্বে হাত লাগানো, ভালবাসা দেখানো ইত্যাদিও জায়েয নয়।

আহলুস সুনান হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণনা করেছেন যে, একটি লোক বলেঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমি আমার স্ত্রীর সাথে যিহার করেছি এবং কাফফারা আদায়ের পূর্বে তার সাথে সহবাসও করে ফেলেছি (এখন উপায় কি?)।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাকে বললেনঃ “আল্লাহ্ তোমার প্রতি দয়া করুন, তুমি এটা কেন করেছো?” উত্তরে সে বলেঃ “চাঁদনী রাতে তার পাঁয়জোর (পায়ের অলংকার) আমাকে ব্যাকুল করে তুলেছিল।” তার এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাকে বলেনঃ “এখন হতে আর তার নিকটবর্তী হয়ো না যে পর্যন্ত না আল্লাহ্ তা’আলার নির্দেশ অনুযায়ী কাফফারা আদায় কর।” (ইমাম তিরমিযী (রঃ) হাদীসটিকে হাসান, গারীব, সহীহ বলেছেন। ইমাম আবু দাউদ (রঃ) ও ইমাম নাসাঈও (রঃ) এটাকে মুরসাল রূপে বর্ণনা করেছেন এবং ইমাম নাসাঈ (রঃ) এটা মুরসাল হওয়াকেই সঠিক বলেছেন)

এরপর মহামহিমান্বিত আল্লাহ্ যিহারের কাফফারার বর্ণনা দিচ্ছেন যে, একটি দাস মুক্ত করতে হবে। দাসকে যে মুমিন হতে হবে এ শর্ত এখানে আরোপ করা হয়নি, যেমন হত্যার কাফফারায় দাসের মুমিন হওয়ার শর্ত আরোপ করা হয়েছে।

ইমাম শাফেয়ী (রঃ) তো বলেন যে, এই অনির্দিষ্টকে নির্দিষ্টের উপর স্থাপন করা হবে। অর্থাৎ হত্যার কাফফারার ব্যাপারে যেমন মুমিন গোলাম আযাদ করার হুকুম রয়েছে, তেমনই এই যিহারের কাফফারার ব্যাপারেও ঐ হুকুমই থাকবে। এর দলীল এই হাদীসটিও যে, রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) একটি কালো রঙ এর দাসী সম্পর্কে বলেনঃ “একেই আযাদ বা মুক্ত করে দাও, কেননা, এটা মুমিনা দাসী।”

উপরে বর্ণিত ঘটনায় জানা গেছে যে, যিহার করে কাফফারা আদায় করার পূর্বেই স্ত্রীর সাথে সহবাসকারীকে রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) দ্বিগুণ কাফফারা আদায় করার নির্দেশ দেননি।

এরপর মহান আল্লাহ্ বলেনঃ এই নির্দেশ তোমাদেরকে দেয়া হলো, অর্থাৎ তোমাদের ধমকানো হচ্ছে। আল্লাহ্ তোমাদের কার্যের ব্যাপারে পূর্ণ ওয়াকিফহাল। তোমাদের অবস্থা তিনি সম্যক অবগত। তোমরা যা কর আল্লাহ্ তার খবর রাখেন।

মহামহিমান্বিত আল্লাহ্ বলেনঃ গোলাম আযাদ করার যার সামর্থ্য থাকবে না, একে অপরকে স্পর্শ করার পূর্বে তাকে একাদিক্রমে দুই মাস রোযা রাখতে হবে। যে এতেও অসমর্থ হবে, সে ষাটজন অভাবগ্রস্তকে খাওয়াবে।

পূর্ববর্ণিত হাদীসগুলোর আলোকে জানা যাচ্ছে যে, আদিষ্ট প্রথম সুরতটি (গোলাম আযাদ করা) হলো অগ্রগণ্য, তারপর দ্বিতীয়টি (একাদিক্রমে দুই মাস রোযা রাখা) এবং এরপর তৃতীয়টি (ষাটজন মিসকীনকে খাদ্য খাওয়ানো)। যেমন সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমের এ হাদীসটিতেও রয়েছে যাতে রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) রমযান মাসে স্ত্রীর সাথে সহবাসকারী লোকটিকে নির্দেশ দিয়েছিলেন।

মহান আল্লাহ বলেন, এই আহকাম আমি এ জন্যেই নির্ধারণ করেছি যে, যেন তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলে (সঃ) বিশ্বাস স্থাপন কর। এগুলো আল্লাহর নির্ধারিত বিধান। সাবধান! তোমরা তার বিধানের উল্টো কাজ করো না, তার নিষিদ্ধ বিষয়ের সীমা ছাড়িয়ে যেয়ো না।

মহাপ্রতাপান্বিত আল্লাহ বলেনঃ যারা কাফির হবে অর্থাৎ ঈমান আনয়ন করবে না, আমার আদেশ মান্য করবে না, শরীয়তের আহকামের অমর্যাদা ও অসম্মান করবে এবং ওর প্রতি বেপরোয়া ভাব দেখাবে, তারা আমার শাস্তি হতে বেঁচে যাবে এ ধারণা তোমরা কখনো পোষণ করো না। জেনে রেখো যে, তাদের জন্যে রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।

Leave a Reply