Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১১৫৫/মুনাফিক কী, কেন ও কীভাবে?:-৪৫)
[* যারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে,:-
*কয়েক ব্যক্তির মধ্যে এমন কোন গোপন পরামর্শ হয় :-
*তোমরা যখন গোপন পরামর্শ করবে তখন:-]
www.motaher21.net
সূরা:৫৮: আল্-মুজাদিলাহ।
পারা:২৮
৫- ১০ নং আয়াত:-
আয়াতের ব্যাখ্যা:-
১) তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন:-
২) তাফসীরে ফী জিলালিল কুরআন:-
৩) তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:-
৪) তাফসীরে ইবনে কাছীর:-
সূরা:৫৮: আল্-মুজালিদাহ:-৫
اِنَّ الَّذِیۡنَ یُحَآدُّوۡنَ اللّٰہَ وَ رَسُوۡلَہٗ کُبِتُوۡا کَمَا کُبِتَ الَّذِیۡنَ مِنۡ قَبۡلِہِمۡ وَ قَدۡ اَنۡزَلۡنَاۤ اٰیٰتٍۭ بَیِّنٰتٍ ؕ وَ لِلۡکٰفِرِیۡنَ عَذَابٌ مُّہِیۡنٌ ۚ﴿۵﴾
যারা আল্লাহ এবং তাঁর রসূলের বিরোধিতা করে তাদেরকে ঠিক সেইভাবে লাঞ্ছিত ও অপমানিত করা হবে যেভাবে তাদের পূর্ববর্তীদের লাঞ্ছিত ও অপমানিত করা হয়েছে। আমি পরিষ্কার ও স্পষ্টভাবে সব নির্দেশ নাযিল করেছি। কাফেরদের জন্য রয়েছে অপমানকর শাস্তি।
সূরা:৫৮: আল্-মুজালিদাহ:-৬
یَوۡمَ یَبۡعَثُہُمُ اللّٰہُ جَمِیۡعًا فَیُنَبِّئُہُمۡ بِمَا عَمِلُوۡا ؕ اَحۡصٰہُ اللّٰہُ وَ نَسُوۡہُ ؕ وَ اللّٰہُ عَلٰی کُلِّ شَیۡءٍ شَہِیۡدٌ ٪﴿۶﴾
সেই দিন যেদিন আল্লাহ তাদের সবাইকে জীবিত করে উঠাবেন এবং তারা কি কাজ করে এসেছে তা জানিয়ে দেবেন। তারা ভুলে গিয়েছে কিন্তু আল্লাহ তাদের সব কৃতকর্ম সযত্নে সংরক্ষণ করেছেন। আল্লাহ সব বিষয়ে সর্বাধিক অবহিত।
সূরা:৫৮: আল্-মুজালিদাহ:-৭
اَلَمۡ تَرَ اَنَّ اللّٰہَ یَعۡلَمُ مَا فِی السَّمٰوٰتِ وَ مَا فِی الۡاَرۡضِ ؕ مَا یَکُوۡنُ مِنۡ نَّجۡوٰی ثَلٰثَۃٍ اِلَّا ہُوَ رَابِعُہُمۡ وَ لَا خَمۡسَۃٍ اِلَّا ہُوَ سَادِسُہُمۡ وَ لَاۤ اَدۡنٰی مِنۡ ذٰلِکَ وَ لَاۤ اَکۡثَرَ اِلَّا ہُوَ مَعَہُمۡ اَیۡنَ مَا کَانُوۡا ۚ ثُمَّ یُنَبِّئُہُمۡ بِمَا عَمِلُوۡا یَوۡمَ الۡقِیٰمَۃِ ؕ اِنَّ اللّٰہَ بِکُلِّ شَیۡءٍ عَلِیۡمٌ ﴿۷﴾
আল্লাহ যে আকাশ ও পৃথিবীর প্রতিটি জিনিস সম্পর্কে অবগত, সে ব্যাপারে তুমি কি সচেতন নও? যখনই তিন ব্যক্তির মধ্যে কোন গোপন কানাঘুষা হয়, তখন সেখানে আল্লাহ অবশ্যই চতুর্থ জন হিসেবে উপস্থিত থাকেন। যখনই পাঁচজনের মধ্যে গোপন সলাপরামর্শ হয় তখন সেখানে ষষ্ঠ জন হিসেবে আল্লাহ অবশ্যই বিদ্যমান থাকেন। গোপন সলাপরামর্শকারীরা সংখ্যায় এর চেয়ে কম হোক বা বেশী হোক এবং তারা যেখানেই থাকুক, আল্লাহ তাদের সাথে থাকেন।তারপর কিয়ামতের দিন তিনি তাদেরকে জানিয়ে দেবেন তারা কে কি করেছে। আল্লাহ সর্বজ্ঞ।
সূরা:৫৮: আল্-মুজালিদাহ:-৮
اَلَمۡ تَرَ اِلَی الَّذِیۡنَ نُہُوۡا عَنِ النَّجۡوٰی ثُمَّ یَعُوۡدُوۡنَ لِمَا نُہُوۡا عَنۡہُ وَ یَتَنٰجَوۡنَ بِالۡاِثۡمِ وَ الۡعُدۡوَانِ وَ مَعۡصِیَتِ الرَّسُوۡلِ ۫ وَ اِذَا جَآءُوۡکَ حَیَّوۡکَ بِمَا لَمۡ یُحَیِّکَ بِہِ اللّٰہُ ۙ وَ یَقُوۡلُوۡنَ فِیۡۤ اَنۡفُسِہِمۡ لَوۡ لَا یُعَذِّبُنَا اللّٰہُ بِمَا نَقُوۡلُ ؕ حَسۡبُہُمۡ جَہَنَّمُ ۚ یَصۡلَوۡنَہَا ۚ فَبِئۡسَ الۡمَصِیۡرُ ﴿۸﴾
তুমি কি তাদেরকে দেখনি, যাদেরকে কানাঘুষা করতে নিষেধ করা হয়েছিল, তথাপি তারা সে নিষিদ্ধ কাজ করে চলেছে? তারা লুকিয়ে লুকিয়ে পরস্পরে গোনাহ, বাড়াবাড়ি এবং রসূলের অবাধ্যতার কথাবার্তা বলাবলি করে, আর যখন তোমার কাছে আসে, তখন তোমাকে এমনভাবে সালাম করে যেভাবে আল্লাহ তোমাকে ছালাম করেনি। আর মনে মনে বলে যে, আমাদের এসব কথাবার্তার জন্য আল্লাহ আমাদেরকে শাস্তি দেয় না কেন? তাদের জন্য জাহান্নামই যথেষ্ট। তারা তাতেই দগ্ধ হবে। তাদের পরিণাম অত্যন্ত শোচনীয়।
সূরা:৫৮: আল্-মুজালিদাহ:-৯
یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اِذَا تَنَاجَیۡتُمۡ فَلَا تَتَنَاجَوۡا بِالۡاِثۡمِ وَ الۡعُدۡوَانِ وَ مَعۡصِیَتِ الرَّسُوۡلِ وَ تَنَاجَوۡا بِالۡبِرِّ وَ التَّقۡوٰی ؕ وَ اتَّقُوا اللّٰہَ الَّذِیۡۤ اِلَیۡہِ تُحۡشَرُوۡنَ ﴿۹﴾
হে ঈমানদারগণ! তোমরা যখন পরস্পরে গোপন আলাপ-আলোচনায় লিপ্ত হও তখন পাপ, জুলুম ও রসূলের অবাধ্যতার কথা বলাবলি করো না, বরং সততা ও আল্লাহভীতির কথাবার্তা বল এবং যে আল্লাহর কাছে হাশরের দিন তোমাদের উপস্থিত হতে হবে, তাঁকে ভয় কর।
সূরা:৫৮: আল্-মুজালিদাহ:-১০
اِنَّمَا النَّجۡوٰی مِنَ الشَّیۡطٰنِ لِیَحۡزُنَ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ لَیۡسَ بِضَآرِّہِمۡ شَیۡئًا اِلَّا بِاِذۡنِ اللّٰہِ ؕ وَ عَلَی اللّٰہِ فَلۡیَتَوَکَّلِ الۡمُؤۡمِنُوۡنَ ﴿۱۰﴾
গোপন পরামর্শ তো কেবল শয়তানের প্ররোচনায় হয় মুমিনদেরকে দুঃখ দেয়ার জন্য। তবে আল্লাহর অনুমতি ছাড়া শয়তান তাদের সামান্যতম ক্ষতি সাধনেও সক্ষম নয়। অতএব আল্লাহ্র উপরই মুমিনরা যেন নির্ভর করে।
৫-১০ আয়াতের ব্যাখ্যা:-
১) তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন:-
# বিরোধিতা করার অর্থ হলো আল্লাহর নির্ধারিত সীমরেখা বা বিধি-নিষেধ না মেনে তার পরিবর্তে অন্য কতকগুলো মনগড়া সীমারেখা ও বিধি-নিষেধ নির্ধারণ করা।
ইবনে জারীর তাবারী এ আয়াতের তাফসীর করেছেন এভাবেঃ
اى يخالفون فى حدوده وفرائضه فيجعلون حدودا غير حدوده
“তারা আল্লাহর সীমানা ও তাঁর বিধানসমূহের ব্যাপারে তাঁর বিরোধিতা করে এবং আল্লাহর নির্ধারিত সীমার পরিবর্তে অন্যান্য সীমা নির্ধারণ করে।”
আল্লামা বায়যাবী এর তাফসীর প্রসঙ্গে বলেনঃ
اى يعادونهما ويشاقونهما او يضعون او يختارون حدودا غير حدودهما-
“আল্লাহ ও তাঁর রসূলের সাথে দুশমনি ও বিবাদে লিপ্ত হয়, অথবা আল্লাহ ও রসূলের নির্ধারিত সীমারেখার পরিবর্তে অন্যান্য সীমারেখা নির্ধারণ করে। অথবা অন্যদের নির্ধারিত সীমারেখাকে মেনে নেয়।”
আল্লামা আলূসী রুহুল মায়ানীতে বায়যাবীর উক্ত তাফসীরের সাথে মতৈক্য প্রকাশ করে শায়খুল ইসলাম সা’দুল্লা চালপীর এই বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন যে, “এ আয়াতে সেসব রাজা বাদশাহ ও স্বেচ্চাচারী শাসকদের বিরুদ্ধে কঠোর হুশিয়ারী উচ্চারিত হয়েছে, যারা শরীয়াতের নির্ধারিত আইনবিধির পরপন্থী বহু আইনবিধি প্রবর্তন করেছে এবং তাকে আইন নামে আখ্যায়িত করেছে।” এ প্রসঙ্গে আল্লাম আলূসী শরীয়াতী আইনের মোকাবিলায় মানব রচিত আইনের সাংবিধানিক অসারতা (অর্থাৎ ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে সাংবিধানিক অসারতা) সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করতে গিয়ে লিখেছেনঃ
“সে ব্যক্তিতো নিঃসন্দেহে কাফের, যে মানব রচিত আইনকে উত্তম ও শরীয়াতের চেয়ে ভালো বলে আখ্যায়িত করে এবং বলে যে, এ আইন অপেক্ষাকৃত বিজ্ঞজনোচিত ও জাতির জন্য অধিকতর উপযোগী। অধিকন্তু তাকে যখন কোন ব্যাপারে বলা হয় যে, শরীয়াতের আদেশ এ ব্যাপারে এরূপ তখন সে রাগে ফেটে পড়ে। এ ধরনের চরিত্র সম্পন্ন কিছু লোক আমরা দেখেছি, যাদের ওপর আল্লাহর অভিশাপ পড়েছে।”
# মূল আয়াতে ব্যবহৃত শব্দটি হচ্ছে كبت অর্থ হচ্ছে লাঞ্ছিত করা, ধ্বংস করা। অভিসম্পাত দেয়া, দরবার থেকে বিতাড়িত করা, ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়া, অপমানিত করা। আল্লাহর এ উক্তির মর্মার্থ এই যে, আল্লাহ ও তাঁর রসূলের বিরোধিতা এবং তাঁর আইন লংঘনের যে পরিণতি পূর্ববর্তী নবীগণের উম্মতেরা ভোগ করেছে, আজকের মুসলমানদের মধ্য থেকে যারা সে আচরণ করবে তারা সে পরিণতি থেকে কোনমতেই রক্ষা পাবে না। তারাও যখন আল্লাহর শরীয়াতের বিরুদ্ধে নিজেদের মনগড়া আইন অনুসরণ করেছে অথবা অন্যদের কাছ থেকে মানব রচিত আইন গ্রহণ করেছে, তখন তারা আল্লাহর অনুগ্রহ ও অনুকম্পা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। অধিকন্তু এর ফলে তাদের জীবন এমন সব বিভ্রান্তি, অনাচার এবং নৈতিক ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক অপকীর্তি ও পাপাচারে ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েছে যে, দুনিয়ার জীবনেই তারা চরম লাঞ্ছনা গাঞ্জনার শিকার হয়েছে। উম্মাতে মুহাম্মাদী যদি আজ এই একই ভ্রান্তিতে লিপ্ত হয়, তাহলেও তারা আল্লাহর প্রিয়ই থাকবে এবং আল্লাহ তাদেরকে লাঞ্ছনা গাঞ্জনার গহ্বরে নিক্ষিপ্ত হওয়া থেকে রক্ষা করতেই থাকবেন—এর কোনই কারণ নেই। পূর্ববর্তী রসূলগণের উম্মাতদের সাথেও আল্লাহর কোন শত্রুতা ছিল না, আর শেষ নবীর উম্মতের সাথেও আল্লাহর কোন বিশেষ আত্মীয়তা নেই।
# বাক্যের প্রেক্ষিতে নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করলে বুঝা যায় যে, এখানে এ আচরণের দুটো শাস্তির উল্লেখ করা হয়েছে। একটি হচ্ছে অবমাননা ও লাঞ্ছনা—যার শিকার এ দুনিয়াতেই হতে হয়েছে এবং হতে হবে। অপরটি হচ্ছে অপমানজনক আযাব—যা আখেরাতে ভোগ করতে হবে।
# তারা ভুলে গেছে বলেই ব্যাপারটা মিটে যায়নি। আল্লাহর অবাধ্যতা ও তাঁর বিধানের বিরুদ্ধাচরণ তাদের কাছে এমন মামুলী বিষয় বিবেচিত হতে পারে যা করে তারা মনেও রাখে না এমনকি তাদের আদৌ কোন আপত্তিকর জিনিসই মনে করে না যে, তারা তার কিছুমাত্র পরোয়া করবে। কিন্তু আল্লাহর কাছে তা মোটেই মামুলী জিনিস নয়। তাঁর কাছে তাদের প্রতিটি তৎপরতা নিবন্ধিত হয়ে গেছে। কোন্ ব্যক্তি কখন, কোথায় কি কাজ করেছে তা করার পর নিজের প্রতিক্রিয়া কি ছিল, আর অন্যত্র কোথায় কোথায় তার কি কি ফলাফল কি কি আকারে দেখা দিয়েছে, এই সবই সবিস্তরে তার রেজিস্টারে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।
# এখান থেকে ১০ নং আয়াত পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে মুসলিম সমাজে মুনাফিকরা যে কর্মধারা চালিয়ে যাচ্ছিল তার সমালোচনা করা হয়েছে। বাহ্যত তারা মুসলমানদের সমাজে বসবাস করলেও ভেতরে ভেতরে তারা মু’মিনদের থেকে স্বতন্ত্র নিজেদের একটা জোট বানিয়ে রেখেছিল। মুসলমানরা যখনই তাদেরকে দেখতো, এটাই দেখতো যে, তারা পরস্পরে কানে কানে ফিস্ ফিস্ করে কথা বলছে। এসব গোপন সলাপরামর্শের মধ্য দিয়ে তারা মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি এবং রকমারি ফিতনা-বিভ্রান্তি ও ভয়ভীতি ছড়ানোর জন্য নানা ধরনের চক্রান্ত আঁটতো এবং গুজব রটাতো।
# এখানে প্রশ্ন জাগে যে, এ আয়াতে দুই ও তিনের বদলে তিন ও পাঁচের উল্লেখের রহস্য কি? প্রথমে দুই এবং তার পরে চার বাদ দেয়া হলো কেন? তাফসীরকারগণ এর অনেকগুলো জবাব দিয়েছেন। তবে আমার মতে সঠিক জবাব এই যে, আসলে পবিত্র কুরআনের সাহিত্যিক সৌন্দর্য ও ভাষাগত মাধুর্য বাজায় রাখার জন্যই এই বর্ণনাভংগী অবলম্বন করা হয়েছে। এটা না করা হলে বর্ণনা ভংগীটা এ রকম দাঁড়াতোঃ مَا يَكُونُ مِنْ نَجْوَى اِثْنَيْنِ اِلَّا هُوَ ثَالِثُهُمْ وَلَا ثَلَاثَةٍ إِلَّا هُوَ رَابِعُهُمْ এতে نَجْوَى اِثْنَيْنِ কথাটার শব্দ বিন্যাস যেমন সুন্দর হতো না তেমনি ثالث ও ثلثة শব্দ দু’টির পর পর আসাও শ্রুতিমধুর হতো না। اِلَّا هُوَ رَابِعُهُمْ এরপর وَلَا اَرْبَعَةٌ বলাটাও একই রকমের শ্রুতিকটু লাগতো। এজন্য প্রথমে তিন ও পাঁচজন ফিসফিসকারীর উল্লেখ করার পর পরবর্তী বাক্যে এই বলে শূন্যতা পূরণ করা হয়েছে যে, وَلَا أَدْنَى مِنْ ذَلِكَ وَلَا أَكْثَرَ إِلَّا هُوَ مَعَهُمْ “ফিসফিসকারীরা চাই তিনের চেয়ে কম বা পাঁচের চেয়ে বেশী হোক, সর্বাবস্থায় আল্লাহ তাদের সঙ্গে থাকেন।”
# বান্দার সঙ্গে আল্লাহর এই অবস্থান বা সাহচর্য মূলত আল্লাহর সর্বজ্ঞ, সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা এবং সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হওয়াকেই বুঝায়। এরূপ নয় যে, (নাউজুবিল্লাহ) তিনি কোন ভৌতিক বা জৈবিক ব্যক্তি এবং পাঁচ ব্যক্তির বৈঠকে ষষ্ঠ ব্যক্তি হিসেবে কোথাও আত্মগোপণ করে অবস্থান করেন। আসলে একথা দ্বারা মানুষকে এ মর্মে সচেতন করাই আল্লাহ তা’আলার উদ্দেশ্য যে, সে যতই সুরক্ষিত স্থানে বসে গোপন সলাপরামর্শ করুক না কেন, তাদের কথাবার্তা দুনিয়ার আর কোন কর্ণগোচর না হোক আল্লাহর গোচরীভূত না হয়ে পারে না। পৃথিবীর আর কোন শক্তি তাদেরকে পাকড়াও করতে না পারুক আল্লাহর পাকড়াও থেকে তারা কিছুতেই বাঁচতে পারবে না।
# এ বক্তব্য থেকে বুঝা যায় যে, এ আয়াত নাযিল হবার আগে রসূল ﷺ তাদেরকে এ কাজ করতে নিষেধ করেছিলেন। তা সত্ত্বেও যখন তারা এ থেকে নিবৃত্ত হয়নি, তখন সরাসরি আল্লাহর কাছ থেকে এ ভৎর্সনাপূর্ণ বাণী নাযিল হয়।
# ইহুদী ও মুনাফিক—উভয় গোষ্ঠী এ ধরনের আচরণে লিপ্ত ছিল। একাধিক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, কিছু সংখ্যক ইহুদী রসূল ﷺ এর দরবারে উপনীত হয়ে বললোঃ اَلسَّامُ عَلَيْكَ يَا اَبَا الْقَاسِمُ অর্থাৎ “আসসামু আলাইকা ইয়া আবাল কাসেম” কথাটা এমনভাবে উচ্চারণ করলো যে, শ্রোতা মনে করতে পারে যে, তারা তাঁকে সালাম দিয়েছে। অথচ আসলে তারা আসসামু আলাইকা অর্থাৎ তোমার মৃত্যু হোক। রসূল ﷺ জবাবে বললেনঃ وعليكم অর্থাৎ “তোমাদের ওপরও।” হযরত আয়েশা (রা.) আত্মসম্বরণ করতে পারলেন না। তিনি বললেন, “তোমাদের মৃত্যু হোক এবং আল্লাহর গযব ও অভিশাপ পড়ুক।” রসূল ﷺ বললেনঃ হে আয়েশা, আল্লাহ তা’আলা কটু বাক্য পসন্দ করেন না। হযরত আয়েশা (রা.) বললেনঃ হে রসূল, ওরা কি বলেছে তা কি আপনি শোনেননি? রসূল ﷺ বললেনঃ আর আমি কি জবাব দিয়েছি তা তুমি শোনোনি? আমি তাদেরকে বলে দিয়েছে “তোমাদের ওপরও।” (বুখারী, মুসলিম, ইবনে জারীর, ইবনে আবী হাতেম) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস বলেন যে, মুনাফিক ও ইহুদী উভয় গোষ্ঠী এভাবেই সালাম দিতো। (ইবনে জারীর)
# তারা এ জিনিসটাকে রসূল ﷺ এর রসূল হওয়ার প্রমাণ মনে করতো। তারা ভাবতো যে, তিনি যদি রসূল হতেন, তাহলে যে মুহূর্তে আমরা “আসসালামু আলাইকা”র পরিবর্তে “আসসামু আলাইকা” বলেছি, সে মুহূর্তে আমাদের ওপর আযাব এসে যেতো, আমরা দিনরাত এরূপ আচরণ করা সত্ত্বেও যখন কোন আযাব আসেনি, তখন ইনি রসূল নন।
# এ বক্তব্য থেকে বুঝা গেল যে, পরস্পর আলাপ-আলোচনা করা মূলত কোন নিষিদ্ধ কাজ নয়। যারা এ ধরনের আলাপ-আলোচনা করে তারা কেমন চরিত্রের লোক, যে পরিবেশ ও পরিস্থিতেতে এরূপ আলোচনা করা হয় তা কি ধরনের পরিবেশ ও পরিস্থিতি এবং যে কথাবার্তা এভাবে গোপনে অনুষ্ঠিত হয় তা কি ধরনের কথাবার্তা, তার ওপরই এর বৈধতা বা অবৈধতা নির্ভরশীল। সমাজে যাদের সততা, ন্যায়নিষ্ঠতা ও নির্মল চরিত্রের সর্বব্যাপী-খ্যাতি ও পরিচিতি বিরাজমান, তারা কোথাও গোপন পরামর্শে লিপ্ত দেখলে কারো মনে এরূপ সন্দেহ জন্মে না যে, তারা কোন দুরভিসন্ধিতে বা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। পক্ষান্তরে সমাজে যারা অনাচার ও অপকর্মের হোতা এবং দুশ্চরিত্র রূপে খ্যাত, তাদের গোপন সলাপরামর্শ যে কোন মানুষের মনে এরূপ খটকা ও শংকার জন্ম দেয় যে, একটা কিছু গোলযোগ পাকানোর প্রস্তুতি নিশ্চয়ই চলছে। ঘটনাচক্রে কখনো দু’চার ব্যক্তি কোন ব্যাপারে চুপিসারে কিছু আলোচনা সেরে নিলে সেটা কোন আপত্তিকর ব্যাপার হয় না। কিন্তু কিছু লোক যদি নিজেদের একটা আলাদা স্থায়ী দল বানিয়ে নেয় এবং সাধারণ মুসলামানদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে হরহামেশা গোপন সলাপরামর্শ চালাতে থাকে, তাহলে সেটা অবশ্যই একটা দুর্যোগের পূর্বলক্ষণ। আর না হোক, এ দ্বারা অন্তত এতটুকু ক্ষতি অবশ্যম্ভাবী যে এতে মুসলমানদের মধ্য দলাদলির ব্যাধি ছড়িয়ে পড়ে। সর্বোপরি, যে জিনিসের ওপর এসব গোপন সলাপরামর্শের বৈধ বা অবৈধ হওয়া নির্ভর করে। তা হচ্ছে এ গোপন সলাপরামর্শের উদ্দেশ্য ও বিষয়বস্তু। দুই, ব্যক্তি যদি কোন ঝগড়া বিবাদের মীমাংসা করিয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যে কারো কোন ন্যায্য প্রাপ্য আদায় করিয়ে দেয়ার মানসে অথবা কোন ভালো কাজে অংশ গ্রহণের লক্ষ্যে গোপন আলাপ আলোচনা করে, তবে তা কোন অন্যায় কাজ নয়, বরং তা সওয়াবের কাজ। পক্ষান্তরে একাধিক ব্যক্তির সলাপরামর্শের উদ্দেশ্য যদি হয় কোন গোলযোগ ও নাশকতা সংঘটিত করার চক্রান্ত করা, কারো অধিকর নষ্ট করা কিংবা কোন পাপকাজ সংঘটিত করার ফন্দি আঁটা–তাহলে এরূপ অসদুদ্দেশ্য পোষণ করাটাই যে এক দুষ্কৃতি, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আর এই অসদুদ্দেশ্য নিয়ে গোপন সলাপরামর্শ করা দ্বিগুণ পাপ ও দুষ্কৃতি।
এ ব্যাপারে যে মজলিসী রীতিনীতি রসূল ﷺ শিক্ষা দিয়েছেন তা এই যে, اذا كنتم ثلاثة فلا يتناجى اثنان دون صاحبهما فان ذالك يحزنه
“যখন তিন ব্যক্তি এক জায়গায় বসা থাকবে, তখন তাদের মধ্য থেকে দু’জনের তৃতীয় জনকে বাদ দিয়ে গোপন সলাপরামর্শ করা উচিত নয়। কেননা, এটা তৃতীয় ব্যক্তির মনোকষ্টের কারণ হবে। (বুখারী, মুসলিম, মুসনাদে আহমাদ, তিরমিযী, আবু দাউদ)
অপর হাদীসে রসূল ﷺ বলেনঃ فلا يتناجى اثنان دون الثالث الا باذنه فان ذلك يحزنه
“তৃতীয় ব্যক্তির অনুমতি না নিয়ে তাকে বাদ দিয়ে দু’জনে গোপনে আলোচনা করা চাই না। কারণ সেটা তার জন্য মনোপীড়াদায়ক হবে।” (মুসলিম)
দুই ব্যক্তি যদি তৃতীয় ব্যক্তির উপস্থিতিতেই সে বুঝতে পারে না এমন ভাষায় কথা বলে, তাবে সেটাও এ অবৈধ গোপন সংলাপের আওতায় আসে। এর চেয়েও জঘন্য অবৈধ কাজ–হলো গোপন সংলাপের সময় কারো দিকে এমনভাবে তাকানো বা ইশারা করা, যাতে বুঝা যায় যে, তাকে নিয়েই তাদের কথাবার্তা চলছে।
# একথা বলার উদ্দেশ্য এই যে, কতিপয় ব্যক্তির গোপন সলাপরামর্শ দেখে কোন মুসলমানের মনে যদি এরূপ সন্দেহ জন্মেও যায় যে, এসব সলাপরামর্শ তার বিরুদ্ধেই চলেছে, তা হলেও তার এতটা দুঃখ পাওয়া ও ঘাবড়ে যাওয়া উচিত নয় যে, নিছক সন্দেহের বশেই কোন পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণের চিন্তা তাকে পেয়ে বসে, অথবা তার মনে কোন দুশ্চিন্তা, বিদ্বেষ অথবা অস্বাভাবিক উদ্বেগ ও উৎকন্ঠার সঞ্চার হতে থাকে। তার বুঝা উচিত যে, আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কেউ তার কোন ক্ষতি করতে পারে না। এ আস্থা ও প্রত্যয় তার মনে এমন দুর্জয় শক্তির জন্ম দেবে যে, অনেক ভিত্তিহীন শংকা এবং কাল্পনিক ভয়ভীতি ও উৎকণ্ঠা থেকে সে মুক্তি পেয়ে যাবে। দুষ্কৃতিকারীদের চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে সে সম্পূর্ণ নিরুদ্বিগ্ন ও নিশ্চিন্ত মনে আপন কাজে নিয়োজিত থাকবে। আল্লাহর ওপর নির্ভরশীল মু’মিন ব্যক্তি এমন অস্থিরচিত্ত হয় না যে, যে কোন ভীতি ও আশঙ্কা তার মনকে বিচলিত ও অশান্ত করে তুলবে। সে এতটা হীনমনাও হয় না যে, দুষ্কৃতিকারীদের উস্কানীতে উত্তেজিত ও ধৈর্যহারা হয়ে নিজেও ইনসাফ বিরোধী কার্যকলাপ করতে আরম্ভ করবে।
৫-১০ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
ফী জিলালিল কুরআন:
*সীমালংঘনকারীদের প্রতি কঠোর হুমকি : ‘আর কাফেরদের জন্যে রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি ‘ কারণ তারা এই সীমারেখা অতিক্রম করে, প্রতিনিয়ত একে চ্যালেঞ্জ করে, আল্লাহর ওপর ঈমান আনে না এবং তার সীমারেখায় এসে কখনাে থেমে যায় না- যেমন করে মােমেনরা থেমে যায়। ‘কাফেরদের জন্যে রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি’- এই শেষ বাক্যটার সাথে পূর্ববর্তী আয়াতের শেষ মন্তব্যের মিল রয়েছে। আবার এই শেষ বাক্যটা আল্লাহ ও আল্লাহর রসূলের বিরুদ্ধাচরণকারীদের শাস্তির বিবরণ সম্বলিত পরবর্তী আয়াতের সাথেও সংযােগ সেতু রচনা করছে। এভাবে এক বিস্ময়কর ধারাবাহিকতার পথ বেয়ে এক প্রসঙ্গ থেকে আর এক প্রসংগে যাওয়াই কোরআনের বর্ণনাভংগির বৈশিষ্ট্য। ‘নিশ্চয়ই যারা আল্লাহ তায়ালা ও তার রসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে, তারা তাদের পূর্ববর্তীদের মতাে লাঞ্ছিত হবে।… আল্লাহ তায়ালা সব বিষয়ের ওপর সাক্ষী রয়েছেন।’ সূরার প্রথম পর্বটা ছিলাে মুসলমানদের প্রতি সহৃদয়তা ও মমত্ববােধের অভিব্যক্তিতে পরিপূর্ণ। দ্বিতীয় পর্বটায় কাফেরদের বিরুদ্ধে কঠোর মনােভাব ও যুদ্ধংদেহী মানসিকতার অভিব্যক্তি ঘটেছে। কাফেরদের এখানে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের বিরুদ্ধাচরণকারী, অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রসূলের অবাধ্য হয়ে তার নির্দিষ্ট সীমারেখা অতিক্রমকারী বলে আখ্যায়িত করার বিষয়টি এখানে উল্লেখ করা হয়েছে। কেননা এরা আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রসূলের নির্ধারিত সীমারেখা চ্যালেঞ্জ করে তা অতিক্রম করতে চায়, সীমারেখার কাছে এসে থেমে যায় না। এখানে আসলে খােদাদ্রোহীদের প্রকৃত স্বরূপ তুলে ধরা হয়েছে, যাতে তাদের কার্যকলাপের ভয়াবহতা ও তাদের ভূমিকার নিকৃষ্টতা প্রকাশ পায়। যে সৃষ্টি তার স্রষ্টা ও জীবিকাদাতাকে চ্যালেঞ্জ করার ধৃষ্টতা দেখায় এবং তার সীমারেখার বিপরীত সীমারেখায় উপনীত হবার ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করে, তার নীতির মতাে জঘন্য নীতি আর কারাে হতে পারে না। এসব স্পর্ধিত ও উদ্ধত ব্যক্তিরা সবাই আল্লাদ্রোহী। তাদের পূর্ববর্তীরা যেমন লাঞ্ছিত হয়েছিলাে, তেমনি তারাও লাঞ্ছিত হবে। অগ্রগণ্য মত এই যে, এটা আসলে আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের বিরুদ্ধে অভিসম্পাৎ, অর্থাৎ তারা লাঞ্ছিত হােক, আল্লাহর পক্ষ থেকে এ অভিসম্পাত দেয়ার অর্থ দাঁড়ায়, তাদের লাঞ্ছিত করার সিদ্ধান্ত তিনি নিয়ে ফেলেছেন। তিনি যা ইচ্ছা করেন সেটাই বাস্তবায়ন করেন। লাঞ্চনা দ্বারা অপমান ও পরাজয় বুঝানাে হয়েছে। আর পূর্ববর্তীদের দ্বারা বুঝানাে হয়েছে অতীতে আল্লাহ তায়ালা তাদের শাস্তি দিয়েছেন, অথবা বদর যুদ্ধের মতাে বিভিন্ন যুদ্ধে মুসলমানরা যেসব কাফেরদের পরাজিত ও পদানত করেছে তাদেরও বুঝানাে হতে পারে। ‘অথচ আমি সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন আয়াতসমূহ নাযিল করেছি।’ এই বাক্যটি আল্লাহ তায়ালা ও আল্লাহর রসূলের বিরুদ্ধাচরণকারীদের ইহকালের পরিণতি ও পরকালের পরিণতির পার্থক্য ব্যাখ্যা করেছে। বলা হচ্ছে, এই আয়াতগুলােতে এ উভয় ধরনের পরিণতির বিবরণ রয়েছে, আর কাফেররা অজ্ঞতা কিংবা অস্পষ্টতা থাকার কারণে এ পরিণতি ভােগ করে না। কেননা তাদের স্পষ্ট ভাষায় জানানাে হয়েছে এবং তারাও এইসব দ্ব্যর্থহীন আয়াতগুলাে দ্বারা তা জেনেছে। এরপর তাদের পরকালীন পরিণতি তুলে ধরা হয়েছে এবং তার সাথে সাথে হৃদয়ে জাগরণ সৃষ্টিকারী তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্যও করা হয়েছে, ‘আর কাফেরদের জন্যে রয়েছে অপমানজনক শাস্তি। যেদিন আল্লাহ তায়ালা তাদের সবাইকে একত্রিত করবেন…’ এ অপমান হচ্ছে দুনিয়ায় যে ঔদ্ধ্যত্ব ও ধৃষ্টতা দেখানো হয়েছিল তারই অপমানজনক শাস্তি দেয়া হবে। এ শাস্তি তাদের কৃতকর্মের উপযুক্ত শাস্তি। তারা নিজেরা এর কথা ভুলে গেলেও আল্লাহ তায়ালা নিজের জ্ঞান দ্বারা তা গুনে গুনে রেখেছেন। আল্লাহর সে জ্ঞানের কাছ থেকে কোনাে কিছুই গােপন থাকে না। আর আল্লাহ তায়ালা সবকিছুতেই দর্শক ও উপস্থিত। মােমেনদের প্রতি সহৃদয়তা ও মহানুভবতার দৃশ্য এবং কাফেরদের প্রতি কঠোরতা ও শাস্তির এই উভয় দৃশ্য আল্লাহর জ্ঞানে ও তার উপস্থিতিতে একত্রিত করা হয়েছে। তিনি সদয় আচরণ ও সাহায্যের ক্ষেত্রেও উপস্থিত এবং দর্শক থাকেন, আবার নির্দয় কঠোর আচরণের সময়ও একইভাবে দর্শক এবং উপস্থিত থাকেন। সুতরাং সদা সর্বদা তার উপস্থিতির ব্যাপারে মােমেনদের সন্তুষ্ট নিশ্চিন্ত থাকা উচিত আর কাফেরদের থাকা উচিত সতর্ক সাবধান। ‘আল্লাহ তায়ালা সব কিছুতে সদা দর্শক ও উপস্থিত’- এই উক্তির মধ্যে যে তত্ত্ব প্রতিফলিত হয়েছে, পরবর্তী আয়াতে তাকে এমন একটা জীবন্ত ছবিতে পরিণত করেছে, যা শুধু দর্শনেই সীমাবদ্ধ থাকে না; বরং হৃদয়ের তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে তা গভীর পরশ বুলায়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তুমি কি লক্ষ্য করােনি যে, আল্লাহ তায়ালা আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে তা জানেন?
ফী জিলালিল কুরআন:
‘যে কোনাে তিন ব্যক্তি গােপন সলাপরামর্শ করুক, আল্লাহ তায়ালা তাদের মধ্যে চতুর্থ হিসেবে বিরাজ করছেন… নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা সর্ববিষয়ে অবগত।'(আয়াত ৭) আয়াতের শুরুতে আকাশ ও পৃথিবীতে বিরাজমান যাবতীয় জিনিসের ব্যাপারে আল্লাহর সর্বাত্মক জ্ঞান থাকার কথা ব্যক্ত করা হয়েছে। এ কথা ব্যক্ত করে মানুষের মনকে আকাশ ও পৃথিবীর কোণে কোণে, রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনুসন্ধান ও পর্যবেক্ষণ চালানাের জন্যে উৎসাহিত করা হয়েছে। সে ইচ্ছা করলে মহান আল্লাহর সীমাহীন ও সর্বব্যাপী জ্ঞানের আওতায় এই বিশাল সুপরিসর মহাবিশ্বে ছােটো বড়াে, গােপন প্রকাশ্য, জানা অজানা বহু তথ্য সংগ্রহ করতে সচেষ্ট হতে পারে। *আল্লাহ তায়ালা ষড়যন্ত্রকারীদের সব খবর রাখেন : এরপর আয়াতের পরবর্তী অংশ মহাবিশ্বের এই সব দিক-দিগন্ত পেরিয়ে কিছুটা সামনে এগিয়ে যায়, তারপর ধীরে ধীরে হামাগুড়ি দিয়ে তা কোরআনের শ্রোতাদের কাছাকাছি পৌছে যায় এবং আল্লাহর সেই সর্বাত্মক জ্ঞানের ভিত্তিতে তাদের হৃদয়ে এমন পরশ বুলায় যে, তাদের হৃদয়কে প্রবলভাবে আলােড়িত করে, ‘যে কোনাে তিন ব্যক্তি গােপন সলাপরামর্শ করুক, আল্লাহ তায়ালা তাদের মধ্যে চতুর্থ হিসেবে বিরাজ করেন, পাঁচ জন হলে তিনি থাকেন তাদের মধ্যে যষ্ঠ…’ এটা আসলেই কঠিন বাস্তবতা, তবে এ বাস্তবতা এখানে গভীর প্রভাব বিস্তারকারী একটা শাব্দিক রূপ নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে। এ শাব্দিক রূপ হৃদয়কে কখনাে আল্লাহর ভয়ে ভীত ও প্রকম্পিত করে, কখনাে আল্লাহর প্রেম ও ভালোবাসায় তাকে আপন করে। কেননা এ আয়াতের শ্রোতাদের মন সর্বত্র আল্লাহ তায়ালার উপস্থিতি অনুভব করে, যিনি একাধারে ভীতিপ্রদ, আবার প্রেমময়ও। যেখানেই তিন জন নিভৃতে সমবেত হয় এ আয়াতের আলােকে তারা অনুভব করে, আল্লাহ তায়ালা তাদের সাথে চতুর্থ হিসাবে বিরাজ করেন। আর যেখানেই পাঁচ জন নিভৃতে সমবেত হয়, সেখানে তাদের সাথে আল্লাহ তায়ালা যষ্ঠ হিসেবে থাকেন। যেখানেই দুজন নিভৃতে কথা বলে, সেখানেই আল্লাহ তায়ালা থাকেন। যেখানে আরাে বেশী সংখ্যক লােক জমায়েত হয়, সেখানেও আল্লাহ তায়ালা তাদের সাথে থাকেন। এটা এমন এক অবস্থা, যার মােকাবেলা করে টিকে থাকার জন্যে প্রত্যেকেই ভীত প্রকম্পিত হয়ে পড়ে। এ কথা সত্য যে, আল্লাহর উপস্থিতি একটা চিত্তাকর্ষক ব্যাপার। কিন্তু এ কথাও সত্য যে, এটা ভয়াল ও আতংকজনকও বটে। বলা হয়েছে, ‘তারা যেখানেই থাকে, তিনি তাদের সাথে থাকেন।’ আবার বলা হচ্ছে, ‘অতপর তিনি তাদের কেয়ামতের দিন জানিয়ে দেবেন তারা কী করেছে। এ হলাে ভয়ে কাপিয়ে দেয়ার মতাে আরাে একটা হুঁশিয়ারী সংকেত। নিছক আল্লাহর উপস্থিত থাকা ও শ্রবণই যেখানে একটা ভয়ংকর ব্যাপার, সেখানে এই উপস্থিতি ও শ্রবণের পরে যদি জবাবদিহিতা ও শাস্তির কথাও বলা হয়, তাহলে অবস্থাটা কেমন দাঁড়ায়? যে জিনিস লুকিয়ে রাখার জন্যে লােকেরা নিভৃতে মিলিত হয় ও গােপনে সলাপরামর্শ করে, সে জিনিস কেয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা সকল সৃষ্টির সামনে প্রকাশ করে দেবেন, এ কথা শুনলে কারো পশম আতংকে শিউরে না ওঠে পারে? তারপর আয়াতটা তার শুরুর মতােই স্বাভাবিকভাবে শেষ হয়ে যায়। ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা সকল বিষয়ে অবগত।’ এভাবে একই আয়াতে বিভিন্ন ভংগিতে আল্লাহর সর্ববিষয়ে অবগত থাকার বিষয়টি শ্রোতার হৃদয়ে বদ্ধমূল করা হয়। সর্বত্র আল্লাহ তায়ালার উপস্থিত থাকা ও সব কিছু সম্পর্কে অবহিত থাকার বিষয়টি এমন প্রভাবশালী পন্থায় ও এমন ভয়াবহ এক ভংগিতে উপস্থাপন করার আসল উদ্দেশ্য হলাে মােনাফেকদের সাবধান করে দেয়া। কারণ তারা রসূল(স.)-এর বিরুদ্ধে, মদীনার মুসলিম সমাজ ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সর্বক্ষণ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকে। তাদের সাবধান করার সাথে সাথে তাদের এই আচরণে বিস্ময় প্রকাশ করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তুমি কি তাদের প্রতি লক্ষ্য করোনি, যাদের কানাঘুষা করতে নিষেধ করা হয়েছিলাে? তথাপি তারা যা নিষেধ করা হয়েছিলাে তার পুনরাবৃত্তি করে।’(আয়াত-৮) এ আয়াত থেকে প্রতিভাত হয়, শুরুতে মুনাফিকদের ব্যাপারে রাসূল(স.)-এর পরিকল্পনা ছিলাে তাদের একনিষ্ঠ, আন্তরিক ও ঈমানের ব্যাপারে দৃঢ় হওয়া এবং ইহুদীদের প্ররােচনায় মদীনায় চক্রান্তে লিপ্ত থাকা থেকে বিরত হওয়ার উপদেশ দেবেন, কিন্তু উপদেশ দেয়ার পরও তারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে তাদের ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র, গােপন দুরভিসন্ধিতে ও জঘন্য কারসাজিতে লিপ্ত থাকতাে। তাদের সেসব অপকর্ম অপকৌশল চালিয়ে যেতাে, যা ছিলাে রসূল(স.)-এর আদেশ লংঘনের নামান্তর, আর রসূল(স.) ও নিষ্ঠাবান মুসলমানদের বিরুদ্ধে নানা রকমের নােংরা ফন্দিফিকির আঁটতাে। এ আয়াত থেকে এ কথাও জানা যাচ্ছে, মােনাফেকদের কেউ কেউ রসূল(স.)-কে এমন বিকৃত ভাষায় অভিবাদন জানাতাে, যার অর্থ দাঁড়াতাে অত্যন্ত খারাপ। অথচ সেটা স্পষ্টভাবে বুঝাও যেতাে না। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যখন তারা তােমার কাছে আসে, তখন তােমাকে এমন ভাষায় অভিবাদন জানায়, যে ভাষায় আল্লাহ তায়ালা তােমাকে অভিবাদন জানাননি।’ যেমন ইহুদীদের অনুকরণে তারা বলতাে, ‘আসসামু আলাইকুম’। অথচ তারা ধারণা দিতাে, আসসালামু আলাইকুমই বলেছে। আস-সামু আলাইকুম’ এর অর্থ হলাে, ‘তােমাদের মৃত্যু হােক’। অথবা তােমরা তােমাদের ধর্ম নিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়ো। এ ধরনের আরাে অনেক কথা বলতো, যাকে বাহ্যত মনে হতাে নির্দোষ। অথচ আসলে তা ভয়ংকর দূষণীয় ও নিন্দনীয়। এসব বলে তারা আবার মনে মনে এই ভেবে তৃপ্তি লাভ করতাে যে, সে যদি যথার্থই নবী হতাে, তাহলে আল্লাহ আমাদের এসব কথার জন্যে অর্থাৎ বিকৃত অভিবাদন এবং গােপন সলাপরামর্শ ও ষড়যন্ত্রের জন্যে অবশ্যই শাস্তি দিতেন। সূরার শুরু থেকে যে আলােচনা চলে আসছে, তা থেকে স্পষ্ট যে, আল্লাহ তায়ালা তার রসূল(স.)-কে মুনাফিকদের মনের কথা ও গােপন মজলিসের ষড়যন্ত্রের কথা জানিয়ে দিতেন। ইতিপূর্বে ঘােষিত হয়েছে, আল্লাহ তায়ালা বাদানুবাদরত মহিলাটির কথা শুনেছেন এবং তিনি যে কোনাে তিন জনের গােপন পরামর্শে চতুর্থ হিসেবে উপস্থিত থাকেন। অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা মােনাফেকদের বৈঠকে উপস্থিত থেকে তাদের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে রাসূল কে অবহিত করতেন এবং তারা মনে মনে যে কুমতলব পােষণ করতাে, তাও আল্লাহ তায়ালা তাকে জানিয়ে দিতেন। তারপর তাদের জবাব দিয়েছেন, তাদের জন্যে জাহান্নামই যথেষ্ট। সেখানে তারা দগ্ধ হবে। ওটা বড়ােই নিকৃষ্ট ঠিকানা। এইসব গােপন ষড়যন্ত্র ফাঁস করে দেয়া, নিষেধ করা সত্তেও তাদের গােপন সলাপরার্শে লিপ্ত হওয়ার বিষয়ে হাটে হাঁড়ি ভেংগে দেয়া ও তাদের এই বক্তব্য প্রকাশ করে দেয়া যে, ‘আমরা যা বলি, তার জন্যে আল্লাহ আমাদের শাস্তি দেয় না কেনাে’ এসব কিছু থেকে প্রমাণিত হয়, আকাশ ও পৃথিবীর যাবতীয় জিনিস আল্লাহ তায়ালা জানেন এবং সকল সলাপরামর্শে তিনি উপস্থিত থাকেন। এভাবে এ আলােচনা, মােনাফেকদের মনে এ কথা বদ্ধমূল করে দেয় যে, তাদের গােপনীয়তা ফাঁস হয়ে গেছে এবং দুরভিসন্ধি ধরা পড়ে গেছে। এতে মোমেনদের মনে জন্মেছে স্বস্তি ও বিশ্বাস। এরপর মুসলমানদের সম্বােধন করা হয়েছে। তাদের মােনাফেকদের মতাে পাপের কাজ, যুলুম অত্যাচার ও রসূল(স.)-এর নাফরমানী থেকে নিষেধ করা হয়েছে। তাদের আল্লাহর ভয়ের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে। তাদের বােঝানাে হয়েছে যে, এভাবে গোপন সলাপরামর্শ করা শয়তানের প্ররোচণার ফল। এটা মােমেনদের জন্যে শােভনীয় নয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে মােমেনরা! যখন তােমরা গােপন পরামর্শ করো, তখন পাপ কাজ, যুলুম অত্যাচার ও রসূলের অবাধ্যতার পক্ষে পরামর্শ করাে না…’ (আয়াত ৯) মনে হয়, ইসলামী সংগঠনের মেজাজ ও প্রকৃতি অনুসারে তখনাে সবার মন মগয গড়ে ওঠেনি, এমন কিছু সংখ্যক মুসলমান যুদ্ধ-বিগ্রহ ও গুরুতর সংকটের সময় রসূল(স.) ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের কাছ থেকে দূরে সরে গিয়ে বৈঠকে বসে আলাপ আলােচনা ও সলাপরামর্শ করতাে। অথচ ইসলামী সংগঠনের মেজাজ ও প্রকৃতি এ ব্যাপারটা মেনে নিতে পারতাে না। ইসলামী সংগঠনের প্রকৃতি দাবী করতাে, প্রতিটি চিন্তা, মতামত বা প্রস্তাব প্রথমে নেতৃবৃন্দের কাছে পেশ করতে হবে এবং দলের ভেতরে থেকে পৃথক পৃথক বৈঠক করা অনুচিত। সম্ভবত এ জাতীয় কিছু বৈঠকে এমন আলােচনা অনুষ্ঠিত হতাে, যা দলের ঐক্যে ফাটল ধরাতে এবং মুসলমানদের ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারতাে। যদিও এসব গােপন আলােচনার উদ্দেশ্য মুসলমানদের ক্ষতি করা ছিলাে না, তথাপি নিছক চলতি সমস্যাবলীর ব্যাপারে আলােচনা করা, অজ্ঞতা সত্ত্বেও তা নিয়ে মতামত ব্যক্ত করা কখনো কখনাে ক্ষতির কারণ ও অবাধ্যতার প্ররােচক হয়ে দাঁড়াতে পারতাে। এ পর্যায়ে তাদের সেই বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করে সম্বােধন করা হয়েছে, যা দ্বারা তারা আল্লাহর সাথে বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে। সেই বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ঈমান। ঈমানদাররা বলে সম্বােধন করা হয়েছে। বলাবাহুল্য, এই বৈশিষ্ট্যের কারণেই এই সম্বোধন অত্যন্ত প্রভাবশালী ও হৃদয়গ্রাহী হয়েছে। এ সম্বােধনের উদ্দেশ্য হলো, তারা যখন গােপন সলাপরামর্শ করবে, তখন তা যেন গুনাহর কাজ, উৎপীড়ন ও রসূলের অবাধ্যতার লক্ষ্যে না করে। এখানে জানিয়ে দেয়া হয়েছে, কোন কোন বিষয়ে সলাপরামর্শ করা মােমেনদের জন্যে সংগত; বরং কল্যাণমূলক কাজ ও তাকওয়ার বিষয়ে আলাপ আলােচনা করাে। একমাত্র এই দুটো কাজের উপায়-উপকরণ সংগ্রহ ও বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই গােপন আলাপ-আলােচনা চালানাে যেতে পারে। ‘বির’ শব্দটার অর্থ হলাে সর্বপ্রকারের সৎ ও কল্যাণমূলক কাজ। তাকওয়ার অর্থ হলাে সার্বক্ষণিক সতর্কতা ও আল্লাহর সার্বক্ষণিক প্রহরা সম্পর্কে সচেতনতা। এ জিনিসটা মানুষকে কেবল সততা ও ভয়ের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, যার কাছে সকলকে সমবেত হতে হবে এবং তখন তিনি তাদের কাছ থেকে তাদের কৃতকর্মের হিসাব নেবেন। তারা তার কাছ থেকে যতাে কিছুই গােপন করুক, তিনি তা জানেন, দেখে গুনে গুনে রাখেন। ইমাম আহমাদ বর্ণনা করেন, হযরত সাফওয়ান বলেন, আমি একদিন হযরত ইবনে ওমরের হাতধরা অবস্থায় ছিলাম। এই সময় এক ব্যক্তি তার কাছে এসে জিজ্ঞেস করলাে, রসূল(স.)-কে কেয়ামতের গােপন আলাপচারিতা সম্পর্কে তিনি কিভাবে কথা বলতে শুনেছেন? তিনি বললেন, আমি রাসূল(স.)-কে বলতে শুনেছি, আল্লাহ তায়ালা মোমেনকে সকল মানুষের কাছ থেকে আড়ালে ডেকে নেবেন, অতপর তাকে অভয় দেবেন, ডেকে নেবেন। একে একে তার শুনাহগুলাের উল্লেখ করে বলবেন, তুমি কি অমুক গুনাহর কথা জানাে? তুমি কি অমুক গুনাহর কথা জানাে? অমুক গুনাহর কথা জানাে? এভাবে যখন তিনি তার গুনাহগুলাে প্রমাণ করবেন এবং সেই ব্যক্তি মনে করবে, তার সর্বনাশ হয়ে গেছে, তখন আল্লাহ তায়ালা বলবেন, আমি তােমার এসব গুনাহ দুনিয়াতে লুকিয়ে রেখেছিলাম, আজ আমি তা ক্ষমা করে দিলাম । অতপর তার ভালাে কাজের আমলনামা তাকে দেবেন। পক্ষান্তরে কাফের ও মােনাফেকদের সম্পর্কে উপস্থিত জনতা বলে ওঠবে, এরা তাদের প্রতিপালক সম্পর্কে মিথ্যা বলেছে, সাবধান, যালেমদের ওপর অভিম্পাত।(বােখারী ও মুসলিম)
ফী জিলালিল কুরআন:
*সবার মাঝ থেকে মাত্র একজনের সাথে গােপন কথা বলা নিষেধ : পরবর্তী আয়াতে গােপন সলাপরামর্শ এবং একটি দলের সাথে একত্রে থাকা অবস্থায় তাদের থেকে আলাদা হয়ে গােপন আলােচনা করতে নিষেধ করা হয়েছে। যে ব্যক্তি একটি দলের অন্তর্ভুক্ত এবং তার স্বার্থ সে দলের স্বার্থের সাথে একীভূত, তার সম্পর্কে সে দলটি যেন কখনাে অনুভব না করে সে কোন ব্যাপারে তার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এখানে এমন কিছু বিষয়। পরিহার করতে বলা হয়েছে যা মুসলমানদের পরস্পরকে কুপ্ররােচনা দেয়া, কানাঘুষা করা ও দূরে নিয়ে গােপনে এমন সব কথা বলা, যা তাদের সাথীদের মনে দুশ্চিন্তা ও ভয়ভীতি এবং অবিশ্বাস সৃষ্টি করতে পারে, আর শয়তান এরূপ গােপন আলােচনা ও কানাঘুষায় প্ররােচিত করে, যাতে মুসলমানদের আশ্বাস দেয়া হচ্ছে, শয়তান তাদের ব্যাপারে যা করতে চায় তা করতে পারবে না। গােপন আলােচনা শুধু শয়তানের কারসাজি, যাতে সে মুসলমানদের দুর্ভাবনায় ফেলতে পারে। অথচ সে আল্লাহর অনুমতি ছাড়া তাদের কোনােই ক্ষতি করতে পারে না। মােমেনদের কেবল আল্লাহর ওপরই নির্ভর করা উচিত।'(আয়াত ১০) বস্তুত মােমেনরা আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কারাে ওপর ভরসা করে না। কেননা তাদের আর কোথাও কোনাে ভরসা আদৌ নেই, আর আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কারাে ওপরই মােমেনদের তাওয়াক্কুলের কোনাে সুযোগ নেই। যে পরিস্থিতিতে গােপন সলাপরামর্শ করলে আস্থা ও বিশ্বাস নষ্ট হয়ে যায় এবং সন্দেহ ও ভীতির সৃষ্টি করে, সে পরিস্থিতিতে গােপন সলাপরামর্শ করতে একাধিক হাদীসে নিষেধ করা হয়েছে, সহীহ বোখারী ও মুসলিমে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ(রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, রসূল(র.) বলেছেন, তােমরা যখন তিন জন এক জায়গায় থাকো, তখন একজনকে বাদ দিয়ে তােমাদের দু’জনের গােপন আলােচনা করা উচিত, কেননা এটা তৃতীয়জনকে পীড়া দেয়। এ হচ্ছে উন্নত চরিত্র এবং বিজ্ঞজনােচিত সতর্কতা, যাতে কোনাে সন্দেহ সংশয় জন্ম নিতে না পারে। তবে কোথাও যদি গােপনীয়তা রক্ষা করা বা গােপন জিনিস লুকিয়ে রাখা কল্যাণকর হয়, চাই তা ব্যক্তিগত অথবা সামষ্টিক যে কোনাে ব্যাপারেই হােক, তবে সে ক্ষেত্রে গােপনে পরামর্শ করা অবৈধ নয়। দলের দায়িত্বশীল নেতাদের মধ্যে সাধারণত এমনটি হয়ে থাকে। তবে দলের নেতাদের অজ্ঞাতসারে কোনাে উপদলীয় সমাবেশ করা জায়েয নেই। এটাই আল্লাহ তায়ালা ও তার রসূল(স.) নিষেধ করেছেন। এটা দলের ঐক্যে ফাটল ধরায় এবং দলের ভেতরে সন্দেহ ও অনাস্থার সৃষ্টি করে। মােমেনদের দুশ্চিন্তায় ফেলার জন্যে শয়তান এর প্ররােচনা দেয়। আল্লাহর ওয়াদা এই মর্মে অকাট্য যে, শয়তান এ উপায়ে মুসলিম দলের ভেতরে যে অনৈক্যের বীজ বপন করতে চায়, তা সে পারবে না। কেননা মুসলমানদের দলের রক্ষক ও প্রহরী স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা। তিনি সকল গােপন কথাবার্তায় উপস্থিত থাকেন এবং সকল দুরভিসন্ধি সম্পর্কে অবহিত। তাই শয়তান কখনো মােমেনদের ক্ষতি করতে পারে না। ‘আল্লাহর অনুমতি ব্যতীত’- এ উক্তি দ্বারা সর্বক্ষেত্রে আল্লাহর ইচ্ছার অবাধ স্বাধীনতা প্রতিপন্ন হয়েছে। চাই তা প্রতিশ্রুতি ও সংকল্পের যে কোনাে ক্ষেত্রেই হােক না কেন। আর আল্লাহর ওপরই নির্ভরকারীদের নির্ভর করা উচিত। কেননা তিনিই একমাত্র রক্ষক ও প্রহরী, তিনিই সর্বশক্তিমান, তিনিই সর্বজ্ঞ ও সর্ববিষয়ে অবহিত। তিনিই সদা ও সর্বত্র উপস্থিত । কোথাও তিনি অনুপস্থিত থাকেন না। সৃষ্টি জগতে তিনি যা চান তাছাড়া অন্য কিছু হয় না। আল্লাহ তায়ালা মােমেনদের প্রহরা দেয়ার ওয়াদা করেছেন। এরপর আর কোনাে কিছুর আশ্বাস দেয়া অবশিষ্ট থাকে না।
৫-১০ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:-
৫-৭ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
এ আয়াতগুলোতে আল্লাহ তাদের পরিণাম সম্পর্কে অবগত করছেন যারা আল্লাহ তা‘আলা, রাসূল ও শরীয়তের প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে বিরুদ্ধারণ করে এবং তাদেরকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রƒপ করে।
يُحَآدُّوْنَ অর্থ আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলের আদেশ নিষেধের বিরুদ্ধাচরণ করে। আল্লাহ তা‘আলা বলছেন : كُبِتُوْا অর্থাৎ যারা আল্লাহ তা‘আলা, রাসূল ও শরীয়তের বিরুদ্ধাচরণ করে তারা অপদস্থ হয়ে গেছে। এখানে আল্লাহ তা‘আলা ভবিষ্যতে ঘটবে এমন ঘটনাকে অতীতকালের ক্রিয়া দ্বারা বর্ণনা করেছেন এ কথা পরিস্কার করে দেওয়ার জন্য যে, এটা অবশ্যই ঘটবে, এতে কোন সন্দেহ নেই।
(كَمَا كُبِتَ الَّذِيْنَ مِنْ قَبْلِهِمْ)
‘যেমন লাঞ্ছিত করা হয়েছে তাদের পূর্ববর্তীদেরকে’ অর্থাৎ পূর্ববর্তী উম্মাতের মাঝে যারা এরূপ বিরুদ্ধাচরণ করেছিল তারা অপদস্থ হয়েছিল। যেমন ‘আদ, সামূদ, ফির‘আউন জাতি ইত্যাদি।
(يَوْمَ يَبْعَثُهُمُ اللّٰه جَمِيْعًا)
‘সেদিন, যেদিন আল্লাহ পুনরুত্থিত করবেন তাদের সকলকে’ অর্থাৎ কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা‘আলা আদম থেকে শেষ দিবস পর্যন্ত যত মানুষ আগমন করবে সবাইকে এক মাঠে একত্রিত করবেন। তারপর তাদের ভালমন্দ সকল আমল সম্পর্কে জানিয়ে দেবেন।
(أَحْصَاهُ اللّٰهُ وَنَسُوْهُ)
‘আল্লাহ তা সংরক্ষিত রেখেছেন, অথচ তারা তা ভুলে গেছে’ অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা তাদের সকল কৃতকর্ম সংরক্ষণ করে রেখেছেন যদিও তারা তাদের কর্মসমূহ ভুলে গেছে।
(هُوَ مَعَهُمْ أَيْنَ مَا كَانُوْا)
‘যেখানেই থাকুক না কেন, তিনি তাদের সাথে আছেন’ অর্থাৎ প্রত্যেক বান্দার সাথে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর শ্রবণ, দর্শণ ও জ্ঞান দ্বারা সাথে আছেন, সে বান্দা যেখানেই যে অবস্থাতেই থাকুক না কেন। তাই তিনজন লোক যদি গোপনে আলাপ করে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর শ্রবণশক্তি, দর্শন ও জ্ঞান দ্বারা চতুর্থ জন হিসাবে উপস্থিত আছেন। কেননা আল্লাহ তা‘আলা মানুষের প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সব কিছু জানেন।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(أَلَمْ يَعْلَمُوْآ أَنَّ اللّٰهَ يَعْلَمُ سِرَّهُمْ وَنَجْوٰهُمْ وَأَنَّ اللّٰهَ عَلَّامُ الْغُيُوْبِ)
“তারা কি জানে না যে, তাদের অন্তরের গোপন কথা ও তাদের গোপন পরামর্শ আল্লাহ অবশ্যই জানেন এবং যা অদৃশ্য তাও তিনি সবচেয়ে বেশি জানেন?” (সূরা তাওবা ৯ : ৭৮)
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(أَمْ يَحْسَبُوْنَ أَنَّا لَا نَسْمَعُ سِرَّهُمْ وَنَجْوٰـهُمْ ط بَلٰي وَرُسُلُنَا لَدَيْهِمْ يَكْتُبُوْنَ)
“তারা কি মনে করে যে, আমি তাদের গোপন বিষয় ও তাদের পরস্পরে চুপে চুপে যা বলে তার খবর রাখি না? অবশ্যই রাখি। আমার ফেরেশতারা তো তাদের নিকট থেকে সবকিছু লিপিবদ্ধ করে।” (সূরা যুখরুফ ৪৩ : ৮০) ইমাম ইবনু কাসীর (রহঃ) এ ব্যাপারে ইজমাও বর্ণনা করেছেন। (ইবনু কাসীর)
সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা তাঁর শ্রবণ, দর্শন ও জ্ঞান দ্বারা সর্বত্র ও সবার সাথেই রয়েছেন। কিন্তু তিনি স্ব-সত্ত্বায় আরশের ওপরে সমুন্নত রয়েছেন যেমন তিনি তাঁর কিতাবে সংবাদ দিয়েছেন। তাই প্রত্যেক মু’মিনকে বিশ্বাস করতে হবে আল্লাহ তা‘আলা আরশের ওপরে সমুন্নত, তিনি সেখান থেকে সব কিছু দেখছেন, শুনছেন ও জ্ঞান দ্বারা বেষ্টন করে আছেন তাঁর জ্ঞানের বাইরে কিছুই নেই।
আয়াত হতে শি¬ক্ষণীয় বিষয় :
১. আল্লাহ তা‘আলা, রাসূল ও শরীয়তের বিরুদ্ধাচরণ এবং তাদের নিয়ে ঠাট্টা করার পরিণাম কী ভয়াবহ তা জানতে পারলাম।
২. মানুষ তাদের কৃতকর্ম ভুলে গেলেও আল্লাহ তা‘আলা তা সংরক্ষণ করে রেখেছেন।
৩. আল্লাহ তা‘আলা তাঁর শ্রবণ, দর্শন ও জ্ঞান দ্বারা প্রত্যেক মানুষের সাথে রয়েছেন।
৮-১০ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
মু’মিনের সকল কাজ হবে সৎ ও তাক্বওয়ার সাথে, এমনকি কোন বিষয়ে গোপন পরামর্শ করার প্রয়োজন হলেও কেননা গুনাহ ও অবাধ্যতার কাজে গোপন পরামর্শ করা মু’মিনের বৈশিষ্ট্য নয় বরং তা শয়তানের কাজ।
النَّجْوٰي (নাজওয়া) বলা হয় দুই বা ততোধিক ব্যক্তি মিলে গোপন পরামর্শ করা। এটা ভালও হতে পারে আবার খারাপও হতে পারে। আল্লাহ তা‘আলা মু’মিনদেরকে ভালকাজে গোপন পরামর্শ করতে অনুমতি প্রদান করেছেন আর খারাপ কাজে গোপন পরামর্শ করা নিষেধ করেছেন। তবে তিন বা ততোধিকের উপস্থিতিতে দুইজনে আলাদা হয়ে গোপন পরামর্শ করা নিষেধ, তা কোন ভাল কাজে হলেও। কারণ এতে তৃতীয়জন কষ্ট পায় ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : যখন তিনজন থাকবে তখন তৃতীয়জনকে বাদ দিয়ে দু জনে গোপন পরামর্শ করবে না। (সহীহ বুখারী হা. ৬২৮৮)
(نُهُوْا عَنِ النَّجْوٰي)
এখানে মদীনার ইয়াহূদী ও মুনাফিকদেরকে বুঝানো হযেছে। তাদের পাশ দিয়ে কোন মুসলিম অতিক্রম করে গেলে তারা বসে গোপন পরামর্শ করত। ফলে মু’মিনরা ধারণা করতো যে, তারা হয়তো আমাদের হত্যা করার জন্য গোপন পরামর্শ করছে। তাই মু’মিনরা এরূপ অবস্থা দেখলে ভয়ে পথ বর্জন করত। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাদের এরূপ কার্যকলাপ থেকে নিষেধ করলেন কিন্তু তারা উপেক্ষা করে তাতেই লিপ্ত হয়, তখন এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। (ইবনু কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর)
ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন : আয়াতটি ইয়াহূদী ও খ্রিস্টানদের ব্যাপারে নাযিল হয়েছে। তারা নিজেরা পরস্পর গোপন পরামর্শ করত আর মু’মিনদের দিকে তাকাত ও চোখ টিপ মারত। মু’মিনরা মনে করত তাদের কাছে হয়তো আমাদের ভাইদের কোন হত্যা, মসিবত বা দুঃসংবাদ পৌঁছেছে তাই তারা এরূপ করছে। এতে মু’মিনরা খুব কষ্ট অনুভব করত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে অধিক হারে অভিযোগ করতে লাগল, তিনি তাদেরকে বারণ করলেন কিন্তু তারা মানল না, তখন এ আয়াতগুলো নাযিল হয় (কুরতুবী)।
(وَإِذَا جَا۬ءُوْكَ حَيَّوْكَ….)
‘তোমার কাছে আসে তখন তারা তোমাকে এমন শব্দে অভিবাদন করে, যার দ্বারা আল্লাহ তোমাকে অভিবাদন করেননি’ ইবনু উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন : ইয়াহূদীরা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলত : اَلسَّامُ عَلَيْكَ আপনার মৃত্যু হোক। এর মাধ্যমে তারা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে গালি দিত। আর বলত : আমাদের কথার কারণে যদি আল্লাহ তা‘আলা আমাদের শাস্তি না দিত! তখন এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। (আহমাদ২/১৭০, বায়হাকী ৭/১২১ হাসান)
আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : জনৈক ইয়াহূদী রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট আগমন করল এবং বলল
السام عليك يا ابا القاسم
হে আবূল কাসেম! তোমার মৃত্যু হোক। আয়িশাহ (রাঃ) বললেন :
عليك السام واللعنة
তোমার মৃত্যু হোক এবং তোমার ওপর আল্লাহ তা‘আলার লা‘নত। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন : হে আয়িশাহ আল্লাহ তা‘আলা খারাপ ও যারা খারাপ কাজ করে তাদেরকে ভালবাসেন না। আয়িশাহ (রাঃ) বলছেন : আপনি কি তাদের কথা শোনেননি তারা আপনার মৃত্যু কামনা করছে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন : তুমি কি শোননি, আমি তাদের জবাবে কী বলেছি? অর্থাৎ তোমাদেরও এরূপ হোক। তখন আল্লাহ তা‘আলা এ আয়াত নাযিল করলেন। (সহীহ বুখারী হা. ৬২৫৬)
সুতরাং একজন মু’মিন অন্য মু’মিনকে এমন শব্দ দ্বারা অভিবাদন করবে যা আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শিখিয়েছেন। অমুসলিমদের তৈরি করা অভিবাদন বা শরীয়ত গর্হিত শব্দ দ্বারা অভিবাদন জানানো মুসলিমদের আচরণ নয়।
(وَيَقُوْلُوْنَ فِيْٓأَنْفُسِهِمْ لَوْلَا يُعَذِّبُنَا اللّٰهُ بِمَا نَقُوْلُ)
‘আর তারা মনে মনে বলে : কেন আল্লাহ আমাদের শাস্তি দেন না, আমরা যা বলি তার কারণে’ তারা বলে, যদি মুহাম্মাদ সত্য নাবী হত তাহলে আমরা যা বলি সেজন্য আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে শাস্তি দিতেন, আল্লাহ তা‘আলা কেন শাস্তি দিচ্ছেন না? আরো বলত, তিনি সত্য নাবী হলে তার দ্‘ুআ কবুল হয়ে যেত; ফলে আমরা মরে যেতাম। এটা তাদের জন্য আশ্চর্যজনক কথা। কারণ তারা আহলে কিতাব, তারা জানে নাবীরা কারো প্রতি রাগ করলেই তাদের জন্য দ্রুত আযাব কামনা করেন না। বরং তাদের কর্মের জন্য জাহান্নামই যথেষ্ট।
(وَيَتَنَاجَوْنَ بِالْإِثْمِ وَالْعُدْوَانِ وَمَعْصِيَتِ الرَّسُوْلِ)
‘গোপন পরামর্শ করে পাপকার্যে, সীমালঙ্ঘনে ও রাসূলের অবাধ্যাচরণে’ অর্থাৎ নিজেদের মাঝে এমন পাপ কাজের শলাপরামর্শ করত যা নিজেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ।
(إِنَّمَا النَّجْوٰي مِنَ الشَّيْطٰنِ)
অর্থাৎ পাপাচার, সীমালঙ্ঘন ও রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর অবাধ্যতার বিষয়ে গোপন পরামর্শ করা হল শয়তানের কাজ। শয়তান তাদেরকে এ গোপন পরামর্শ করায় মু’মিনদেরকে কষ্ট দেওয়ার জন্য। তারা মু’মিনদের কোন প্রকার কষ্ট বা ক্ষতি করতে পারবে না আল্লাহ তা‘আলা ইচ্ছা না করলে। অতঃপর মু’মিনদের উচিত শয়তানের প্ররোচনায় প্রভাবিত না হয়ে একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার ওপর ভরসা করা। মু’মিনরা কষ্ট পায় এমন বিষয় বা প্রেক্ষাপটে গোপন পরামর্শ করা নিষেধ। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন :
إذَا كَانُوا ثَلاَثَةٌ، فَلاَ يَتَنَاجَي اثْنَانِ دُونَ الثَّالِث فَإِنَّ ذَلِكَ يَحْزُنُهُ
যখন তোমরা তিনজন থাকবে তখন দ্বিতীয়জনকে বাদ দিয়ে গোপন পরামর্শ করিও না কেননা এতে সে চিন্তায় পতিত হবে। (সহীহ বুখারী হা. ৬২৯০)
সুতরাং মু’মিনদের প্রত্যেক কাজ হবে কল্যাণকর ও তাকওয়াপূর্ণ। তারা কখানো মানুষের ক্ষতি করবে না এবং ক্ষতি করার জন্য কাউকে গোপনে পরামর্শও দেবে না। বরং যারা অপরের ক্ষতি করার জন্য পরামর্শ দেয় তারা শয়তানের অনুসারী।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. পাপকাজ, সীমালঙ্ঘন ও রাসূলের অবাধ্য কাজে গোপন পরামর্শ করা নিষেধ।
২. সৎকাজে গোপন পরামর্শ করা বৈধ।
৩. অসৎকাজে গোপন পরামর্শ করা শয়তানের কাজ।
৪. কোন স্থানে তিনজন থাকলে একজনকে রেখে দু জন মিলে গোপন পরামর্শ করা নিষেধ, যতক্ষণ না তৃতীয়জনের অনুমতি নেয়া হয়।
৫. ভরসা করতে হবে একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার ওপর, অন্য কারো ওপর নয়।
৫-১০ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে ইবনে কাছীর:-
৫-৭ নং আয়াতের তাফসীর:
যারা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল (সঃ)-এর বিরুদ্ধাচরণ করে এবং শরীয়তের আহকাম হতে বিমুখ হয়ে যায় তাদের সম্পর্কে আল্লাহ্ তা’আলা খবর দিচ্ছেন যে, তাদেরকে লাঞ্ছিত ও অপদস্থ করা হবে যেমন লাঞ্ছিত ও অপদস্থ করা হয়েছে তাদের পূর্ববর্তীদেরকে।
মহান আল্লাহ বলেনঃ এভাবেই সুস্পষ্ট আয়াত অবতীর্ণ করেছি এবং নিদর্শনসমূহ প্রকাশ করে দিয়েছি, যাদের অন্তরে ঔদ্ধত্যপনা রয়েছে তারা ছাড়া কেউই এগুলো অস্বীকার করতে পারে না। আর যারা এগুলো অস্বীকার করে তারা কাফির এবং এসব কাফিরের জন্যে এখানে রয়েছে লাঞ্ছনাকর শাস্তি এবং এরপর পরকালেও তাদের জন্যে অপমানজনক শাস্তি অপেক্ষা করছে। এখানে তাদেরকে তাদের অহংকার আল্লাহর দিকে ঝুঁকে পড়া হতে বিরত রাখছে, এর প্রতিফল হিসেবে তাদেরকে পরকালে সীমাহীনভাবে অপদস্থ করা হবে। যেদিন তারা হবে চরমভাবে পদদলিত। কিয়ামতের দিন আল্লাহ্ তা’আলা পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সমস্ত মানুষকে একই ময়দানে একত্রিত করবেন এবং তারা দুনিয়ায় ভালমন্দ যা করতো তা তাদেরকে জানিয়ে দেয়া হবে। যদিও তারা বিস্মৃত হয়েছে, কিন্তু আল্লাহ্ ওর হিসাব ৱেখেছেন। তাঁর ফেরেশতামণ্ডলী ওগুলো লিখে রেখেছেন। না আল্লাহ্ হতে কোন কিছু গোপন থাকে এবং না তিনি কোন কিছু ভুলে যান।
মহামহিমান্বিত আল্লাহ্ বলেনঃ তোমরা যেখানেই থাকো এবং যে অবস্থাতেই থকো, আল্লাহ্ তা’আলা তোমাদের সব কথাই শুনেন এবং তোমাদের সব অবস্থাই দেখেন। তাঁর নিকট কিছুই গোপন থাকে না। তার জ্ঞান সারা দুনিয়াকে পরিবেষ্টন করে রয়েছে। প্রত্যেক কাল ও স্থানের খবর তার কাছে সব সময়ই রয়েছে। আসমান ও যমীনের সমস্ত সৃষ্টির খবর তিনি রাখেন। তিনজন লোক মিলিত হয়ে পরস্পর অত্যন্ত গোপনীয়ভাবে পরামর্শ করলেও তিনি চতুর্থজন হিসাবে তা শুনে থাকেন। সুতরাং তাদের এটা মনে করা উচিত নয় যে, তারা তিনজন আছে, বরং আল্লাহ্ তা’আলাকে চতুর্থজন হিসেবে গণ্য করা উচিত। অনুরূপভাবে পাচজন লোক পরস্পর গোপন পরামর্শ করলে ষষ্ঠজন আল্লাহ তাআলা রয়েছেন। তাদের এ ঈমান থাকতে হবে যে, তারা যেখানেই থাকুক না কেন তাদের সাথে আল্লাহ্ রয়েছেন। তিনি তাদের অবস্থা অবগত আছেন এবং তাদের কথা শুনছেন। আবার এর সাথে সাথে তাঁর ফেরেশতামণ্ডলীও লিখতে রয়েছেন যেমন অন্য জায়গায় রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “তারা কি জানে না যে, আল্লাহ তাআলা তাদের গোপনীয় কথা ও গোপন পরামর্শের খবর অবগত আছেন এবং আল্লাহ্ অদৃশ্যের খবর খুব ভাল জানেন?” (৯:৭৮)
আর এক জায়গায় আছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “তারা কি মনে করে যে, আমি তাদের গোপন কথা ও গোপন পরামর্শ শুনি না? অথচ আমার প্রেরিত (ফেরেশতা) গণ তাদের নিকট লিখতে রয়েছে!” (৪৩:৮০)।
অধিকাংশ গুরুজন এর উপর ঐকমত্য পোষণ করেছেন যে, এই আয়াত দ্বারা উদ্দেশ্য হলো (আরবী) অর্থাৎ আল্লাহ তা’আলার সত্তা সব জায়গাতেই বিদ্যমান থাকা নয়, বরং তার ইলম সব জায়গায়ই বিদ্যমান রয়েছে, এটাই উদ্দেশ্য। তিনজনের সমাবেশে চতুর্থটি হবে তাঁর ইলম। নিঃসন্দেহে এ বিষয়ের উপর পূর্ণ ঈমান রাখতে হবে যে, এখানে আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা’আলার সত্তা সঙ্গে থাকা উদ্দেশ্য নয়, বরং তার ইলম সব জায়গায় বিদ্যমান থাকাই উদ্দেশ্য। হ্যাঁ, তবে এটা সুনিশ্চিত যে, তাঁর শোন এবং দেখাও এভাবেই তাঁর ইলমের সাথে রয়েছে। মহান আল্লাহ্ তাঁর সমস্ত মাখলুকের কার্যাবলী সম্যক অবগত। তাদের কোন কাজই তার নিকট গোপনীয় নয়। সুতরাং তারা যা কিছু করছে, তিনি কিয়ামতের দিন তাদেরকে তা জানিয়ে দিবেন। আল্লাহ্ সর্ব বিষয়ে সম্যক অবগত।
হযরত ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (রঃ) বলেন যে, আল্লাহ্ তা’আলা এই আয়াতকে ইলম দ্বারাই শুরু করেছেন এবং ইলম দ্বারাই শেষ করেছেন।
৮-১০ নং আয়াতের তাফসীর:
মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, যাদেরকে গোপন পরামর্শ করতে নিষেধ করা হয়েছিল তারা ছিল ইয়াহূদী। মুকাতিল ইবনে হাইয়ান (রঃ) বলেন যে, নবী (সঃ) ও ইয়াহুদীদের মাঝে যখন চুক্তিপত্র স্বাক্ষরিত হয় তখন ইয়াহুদীরা এই কাজ করতে শুরু করে যে, যেখানেই তারা কোন মুসলমানকে দেখতে এবং যেখানেই কোন মুসলমান তাদের কাছে যেতো তখন তারা এদিকে-ওদিকে একত্রিত হয়ে চুপে-চুপে এবং ইশারা-ইঙ্গিতে এমনভাবে কানাকানি করতো যে, যে মুসলমান একাকী তাদের কাছে থাকতো সে ধারণা করতো যে, তারা তাকে হত্যা করারই চক্রান্ত করছে। তার আরো ধারণা হতো যে, তারা তার বিরুদ্ধে এবং অন্যান্য মুসলমানদের বিরুদ্ধে গোপন সড়যন্ত্রে লিপ্ত হচ্ছে। সুতরাং সে তাদের কাছে যেতেও ভয় কর তো। যখন সাধারণভাবে এসব অভিযোগ রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর কানে পৌছতে লাগলো তখন তিনি তাদেরকে এই ঘৃণ্য কাজে বাধা দিলেন এবং চরমভাবে নিষেধ করলেন। কিন্তু এর পরেও তারা আবার এ কাজে লেগে পড়লো।
হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি তাঁর পিতা হতে এবং তিনি তাঁর দাদা হতে বর্ণনা করেন, তিনি (তাঁর দাদা) বলেনঃ “আমরা রাত্রে পালাক্রমে রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর খিতমতে হাযির হতাম, উদ্দেশ্য এই যে, রাত্রে তাঁর কোন কাজের প্রয়োজন হলে আমরা তা করে দিবো। একদা রাত্রে যাদের পালা ছিল তারা এসে গেল এবং আরো কিছু লোক সওয়াবের নিয়তে এসে পড়লো। লোক খুব বেশী একত্রিত হওয়ার কারণে আমরা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে এদিকে-ওদিকে বসে পড়লাম। প্রত্যেক দল নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করতে লাগলো। ইতিমধ্যে রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) এসে পড়লেন। তিনি বললেনঃ “তোমরা কি গোপন পরামর্শ করছো? আমি কি তোমাদেরকে এর থেকে নিষেধ করিনি?” উত্তরে আমরা বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমরা আল্লাহর নিকট তাওবা করছি। আমরা মাসীহ দাজ্জালের আলোচনা করছিলাম। কেননা, তার ব্যাপারে আমাদের মনে খটকা লাগছে। তিনি একথা শুনে বললেনঃ “আমি তোমাদের উপর তার চেয়েও যে বিষয়ে বেশী ভয় করি তার খবর কি তোমাদেরকে দিবো না?” আমরা বললামঃ হ্যাঁ, হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমাদেরকে আপনি ঐ খবর দিন! তিনি বললেনঃ “তা হলো গোপন শিরক। তা এই ভাবে যে, একটি লোকে দাড়িয়ে গেল এবং লোকদেরকে দেখাবার জন্যে কোন (ইবাদতের) কাজ করলো।” (এ হাদীসটি ইমাম ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন। এর ইসনাদ গারীব এবং এতে কোন কোন বর্ণনাকারী দুর্বল রয়েছেন)
এরপর আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ তারা পাপাচরণ, সীমালংঘন ও রাসূল (সঃ)-এর বিরুদ্ধাচরণের জন্যে কানাকানি করে। অর্থাৎ তারা হয়তো পাপের কাজের উপর কানাকানি করে যাতে তাদের নিজেদেরই ক্ষতি হয়, কিংবা হয়তো যুলুমের কাজে কানাকানি করে যাতে তারা অন্যদের ক্ষতি সাধনের ষড়যন্ত্র করে, অথবা তারা রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর বিরুদ্ধাচরণের উপর কানাকানি করে এবং তার বিরুদ্ধাচরণ করতে একে অপরকে পাকিয়ে তোলে।
আল্লাহ্ তা’আলা ঐ পাপী ও বদ লোকদের আর একটি জঘন্য আচরণের বর্ণনা দিচ্ছেন যে, তারা সালামের শব্দের পরিবর্তন ঘটিয়ে থাকে। তারা রাসূল (সঃ)-কে এমন কথা দ্বারা অভিবাদন করে যদদ্বারা আল্লাহ্ তাঁকে অভিবাদন করেননি।
হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একদা কয়েকজন ইয়াহূদী রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর দরবারে হাযির হয়ে বলেঃ (আরবী) অর্থাৎ “হে আবুল কাসেম (সঃ)! তোমার মৃত্যু হোক (তাদের উপর আল্লাহর লা’নত বর্ষিত হোক!)” তখন হযরত আয়েশা (রাঃ) প্রতি উত্তরে বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “তোমাদের মৃত্যু হোক।” একথা শুনে রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) বলেনঃ “হে আয়েশা (রাঃ)! নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা মন্দ বচন ও কঠোর উক্তিকে অপছন্দ করেন। হযরত আয়েশা (রাঃ)! তখন বলেনঃ “আপনি কি শুনেননি যে, তারা আপনাকে (আরবী) বলেছে?” উত্তরে তিনি বলেনঃ “তুমি কি শুননি যে, আমি তাদেরকে (আরবী) বলেছি?” তখন আল্লাহ্ তা’আলা … (আরবী)আয়াতটি অবতীর্ণ করেন। (এ হাদীসটিও ইমাম ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
সহীহ্ এর মধ্যে অন্য রিওয়াইয়াতে আছে যে, হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেছিলেনঃ (আরবী)
এবং রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) বলেছিলেনঃ “তাদের ব্যাপারে আমাদের দু’আ কবুল হয়েছে এবং আমাদের ব্যাপারে তাদের দু’আ কবূল হয়নি।”
হযরত আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একদা রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) তাঁর সাহাবীবর্গসহ বসেছিলেন এমতাবস্থায় একজন ইয়াহূদী এসে তাদেরকে সালাম করলো। তারা তার সালামের উত্তর দিলেন। তখন রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) বললেনঃ “সে কি বললো তা কি তোমরা জান?” তাঁরা উত্তরে বললেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! সে তো সালাম করলো।” তিনি বললেনঃ “বরং সে (আরবী) বলেছে। অর্থাৎ ‘তোমাদের ধর্ম মিটে যাক’ বা ‘তোমাদের ধর্মের পরাজয় ঘটুক।” অতঃপর তিনি বললেনঃ “তাকে ডেকে আনেনা।” তখন সহাবীগণ (রাঃ) তাকে ডেকে আনলেন। রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) তখন তাকে বললেনঃ “তুমি কি বলেছো?” সে উত্তরে বললোঃ “হ্যাঁ।” অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সঃ) সাহাবাদেরকে বললেনঃ “যদি আলে কিতাবদের কেউ তোমাদেরকে সালাম দেয় তবে তোমরা বলবেঃ অর্থাৎ ‘তোমার উপরও ওটাই যা তুমি বললে’।” (এ হাদীসটি ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বর্ণনা করেছেন। সহীহ্ গ্রন্থেও এ হাদীসটি হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে অনুরূপ বর্ণিত আছে)
ঐ লোকগুলো নিজেদের কৃতকর্মের উপর খুশী হয়ে মনে মনে বলতোঃ যদি ইনি সত্যি আল্লাহর নবী হতেন তবে আমাদের এই চক্রান্তের কারণে আল্লাহ তা’আলা অবশ্যই দুনিয়াতেই আমাদেরকে শাস্তি দিতেন। কেননা, আল্লাহ তা’আলা তো আমাদের ভিতরের অবস্থা সম্পর্কে পূর্ণ ওয়াকিফহাল।
তাই আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা’আলা বলেন যে, তাদের জন্যে পরকালের শাস্তিই যথেষ্ট, যেখানে তারা জাহান্নামে প্রবেশ করবে। কত নিকৃষ্ট সেই আবাস!
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, এই আয়াতের শানে নুযূল হলো ইয়াহূদের এই ভাবে সালাম দেয়ার পদ্ধতি। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, মুনাফিকরা এভাবেই সালাম দিতো।
এরপর আল্লাহ্ তা’আলা মুমিনদেরকে আদব শিক্ষা দিচ্ছেন। বলছেনঃ হে মুমিনগণ! তোমরা এই মুনাফিক ও ইয়াহূদীদের মত কাজ করো না। তোমরা যখন গোপনে পরামর্শ কর তখন সেই পরামর্শ যেন পাপাচরণ, সীমালংঘন ও রাসূল (সঃ)-এর বিরুদ্ধাচরণ সম্পর্কে না হয়। তোমরা কল্যাণকর কাজ ও তাকওয়া অবলম্বনের পরামর্শ করবে। তোমাদের সদা-সর্বদা আল্লাহকে ভয় করে চলা উচিত যার কাছে তোমাদের সকলকেই একত্রিত হতে হবে, যিনি ঐ সময় তোমাদেরকে প্রত্যেক পুণ্য ও পাপের পুরস্কার ও শাস্তি প্রদান করবেন। আর তোমাদের সমস্ত কাজ-কর্ম ও কথাবর্তা সম্পর্কে তোমাদেরকে তিনি অবহিত করবেন। তোমরা যদিও ভুলে গেছো, কিন্তু তাঁর কাছে সবই রক্ষিত ও বিদ্যমান রয়েছে।
হযরত সাফওয়ান (রঃ) বলেনঃ “আমি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ)-এর হাত ধারণ করেছিলাম এমন সময় একটি লোক এসে তাকে জিজ্ঞেস করলোঃ “কিয়ামতের দিন যে আল্লাহ্ তা’আলার সাথে মুমিনদের কানাকানি হবে এ সম্পর্কে আপনি রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) হতে কি শুনেছেন?” হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে উমার (রাঃ) উত্তরে বলেনঃ “আমি রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-কে বলতে শুনেছি যে, আল্লাহ তাআলা মুমিনকে নিজের কাছে ডেকে নিবেন এবং তাকে তার এমনই কাছে করবেন যে, স্বীয় হস্ত তার উপর রেখে দিবেন এবং লোকেদের হতে তাকে পর্দা করবেন। অতঃপর তাঁকে গুনাহসমূহ স্বীকার করিয়ে নিবেন। তাকে তিনি জিজ্ঞেস করবেনঃ “তোমার অমুক অমুক পাপ কর্মের কথা মনে আছে কি?” এভাবে তিনি তাকে প্রশ্ন করতে থাকবেন এবং সে স্বীকার করতে থাকবে। আর সে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার চিন্তায় ভীত-বিহ্বল হয়ে পড়বে। ইতিমধ্যে মহান আল্লাহ্ তাকে বলবেনঃ “দেখো, দুনিয়ায় আমি তোমার এসব গুনাহ্ ঢেকে রেখেছিলাম এবং আজ আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিলাম।” অতঃপর তাকে তার পুণ্যসমূহের আমলনামা প্রদান করা হবে। কিন্তু কাফির ও মুনাফিকদের ব্যাপারে সাক্ষীগণ ঘোষণা করবেঃ “এরা হলো ঐ সব লোক যারা তাদের প্রতিপালকের উপর মিথ্যা আরোপ করতো, জেনে রেখো যে, অত্যাচারীদের উপর আল্লাহর লা’নত’।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন এবং ইমাম বুখারী (রঃ) ও ইমাম মুসলিম (রঃ) তাঁদের সহীহ্ গ্রন্থে কাতাদাহ (রঃ)-এর হাদীস হতে এটা তাখরীজ করেছেন)
এরপর আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা বলেনঃ শয়তানের প্ররোচনায় হয় এই গোপন পরামর্শ, মুমিনদেরকে দুঃখ দেয়ার জন্যে। কিন্তু প্রকৃত ব্যাপার এই যে, আল্লাহর ইচ্ছা ব্যতীত শয়তান বা অন্য কেউ তাদের সমান্যতম ক্ষতি সাধনেও সক্ষম নয়। মুমিনরা যদি এরূপ কোন কার্যকলাপের আভাস পায় তবে তারা যেন (আরবী) পাঠ করে ও আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করে এবং তাঁরই উপর ভরসা করে। এরূপ করলে ইনশাআল্লাহ্ শয়তান তাদের কোনই ক্ষতি করতে পারবে না।
যে কানাকানির কারণে কোন মুসলমানের মনে কষ্ট হয় এবং সে তা অপছন্দ করে এরূপ কানাকানি হতে হাদীসে নিষেধ করা হয়েছে। যেমন হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) বলেছেনঃ “যখন তোমরা তিনজন থাকবে তখন যেন দুইজন একজনকে বাদ দিয়ে কানাকানি না করে, কেননা এতে ঐ তৃতীয় ব্যক্তির মনে কষ্ট হয়।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন এবং ইমাম বুখারী (রঃ) ও ইমাম মুসলিম (রঃ) আমাশ (রঃ)-এর হাদীস হতে এটা তাখরীজ করেছেন)
হযরত ইবনে উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ যখন তোমরা তিনজন থাকবে তখন যেন দুইজন তৃতীয় জনের অনুমতি ছাড়া তাকে বাদ দিয়ে কানাকানি করে। কেননা, এতে সে মনে দুঃখ ও ব্যথা পায়।” (এ হাদীসটি আবদুর রাযযাক (রঃ) বর্ণনা করেছেন এবং ইমাম মুসলিম (রঃ) এটা তাখরীজ করেছেন)।