Motaher21.net أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ ( বই # ১১৫৮/মুনাফিক কী? কেন ও কীভাবে?:-৪৭) [*‌‌  আপনি কি মুনাফিকদেরকে দেখেননি?:- *মুনাফিক ও কাফিরদের প্রতিশ্রুতি ছলনা মাত্র:- *মুনাফিক দের প্রথম লক্ষন মিথ্যা কথা বলে:- *আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, নিশ্চয় তারা মিথ্যাবাদী:- *মুসলিমদের বিরুদ্ধে অমুসলিমদেরকে সহযোগিতা করা কুফরী:-] www.motaher21.net সূরা:৫৯: আল্-হাশর। পারা:২৮ ১১-১৭ নং আয়াত:-

Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১১৫৮/মুনাফিক কী? কেন ও কীভাবে?:-৪৭)
[*‌‌  আপনি কি মুনাফিকদেরকে দেখেননি?:-
*মুনাফিক ও কাফিরদের প্রতিশ্রুতি ছলনা মাত্র:-
*মুনাফিক দের প্রথম লক্ষন মিথ্যা কথা বলে:-
*আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, নিশ্চয় তারা মিথ্যাবাদী:-
*মুসলিমদের বিরুদ্ধে অমুসলিমদেরকে সহযোগিতা করা কুফরী:-]
www.motaher21.net
সূরা:৫৯: আল্-হাশর।
পারা:২৮
১১-১৭ নং আয়াত:-
আয়াতের ব্যাখ্যা:-
১) তাফসীরে ফী জিলালিল কুরআন:-
২) তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন:-
৩) তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:-
৪) তাফসীরে ইবনে কাছীর:-

সূরা:৫৯: আল্-হাশর:-১১
اَلَمۡ تَرَ اِلَی الَّذِیۡنَ نَافَقُوۡا یَقُوۡلُوۡنَ لِاِخۡوَانِہِمُ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا مِنۡ اَہۡلِ الۡکِتٰبِ لَئِنۡ اُخۡرِجۡتُمۡ لَنَخۡرُجَنَّ مَعَکُمۡ وَ لَا نُطِیۡعُ فِیۡکُمۡ اَحَدًا اَبَدًا ۙ وَّ اِنۡ قُوۡتِلۡتُمۡ لَنَنۡصُرَنَّکُمۡ ؕ وَ اللّٰہُ یَشۡہَدُ اِنَّہُمۡ لَکٰذِبُوۡنَ ﴿۱۱﴾
আপনি কি মুনাফিকদেরকে দেখেননি? তারা কিতাবীদের মধ্যে যারা কুফরী করেছে তাদের সেসব ভাইকে বলে, ‘তোমারা যদি বহিস্কৃত হও, আমারা অবশ্যই তোমাদের সাথে দেশত্যাগী হব এবং আমরা তোমাদের ব্যাপারে কখনো কারো কথা মানবো না এবং যদি তোমরা আক্রান্ত হও আমরা অবশ্যই তোমাদেরকে সাহায্য করব।’ আর আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, নিশ্চয় তারা মিথ্যাবাদী।
সূরা:৫৯: আল্-হাশর:-১২
لَئِنۡ اُخۡرِجُوۡا لَا یَخۡرُجُوۡنَ مَعَہُمۡ ۚ وَ لَئِنۡ قُوۡتِلُوۡا لَا یَنۡصُرُوۡنَہُمۡ ۚ وَ لَئِنۡ نَّصَرُوۡہُمۡ لَیُوَلُّنَّ الۡاَدۡبَارَ ۟ ثُمَّ لَا یُنۡصَرُوۡنَ ﴿۱۲﴾
বস্তুত তারা বহিস্কৃত হলে মুনাফিকরা তাদের সাথে দেশত্যাগ করবে না এবং তারা আক্রান্ত হলে এরা তাদেরকে সাহায্য করবে না এবং এরা সাহায্য করতে আসলেও অবশ্যই পৃষ্ঠপ্রদর্শন করবে ; তারপর তারা কোন সাহায্যই পাবে না।
সূরা:৫৯: আল্-হাশর:-১৩
لَاَنۡتُمۡ اَشَدُّ رَہۡبَۃً فِیۡ صُدُوۡرِہِمۡ مِّنَ اللّٰہِ ؕ ذٰلِکَ بِاَنَّہُمۡ قَوۡمٌ لَّا یَفۡقَہُوۡنَ ﴿۱۳﴾
তাদের মনে আল্লাহর চেয়ে তোমাদের ভয়ই বেশী। কারণ, তারা এমন লোক যাদের কোন বিবেব-বুদ্ধি নেই।
সূরা:৫৯: আল্-হাশর:-১৪
لَا یُقَاتِلُوۡنَکُمۡ جَمِیۡعًا اِلَّا فِیۡ قُرًی مُّحَصَّنَۃٍ اَوۡ مِنۡ وَّرَآءِ جُدُرٍ ؕ بَاۡسُہُمۡ بَیۡنَہُمۡ شَدِیۡدٌ ؕ تَحۡسَبُہُمۡ جَمِیۡعًا وَّ قُلُوۡبُہُمۡ شَتّٰی ؕ ذٰلِکَ بِاَنَّہُمۡ قَوۡمٌ لَّا یَعۡقِلُوۡنَ ﴿ۚ۱۴﴾
এরা একত্রিত হয়ে (খোলা ময়দানে) কখনো তোমাদের মোকাবিলা করবে না। লড়াই করলেও দুর্গাভ্যন্তরে অবস্থিত জনপদে বা প্রাচীরের আড়ালে লুকিয়ে থেকে করবে। তাদের আভ্যন্তরীণ পারস্পরিক কোন্দল অত্যন্ত কঠিন। তুমি তাদের ঐক্যবদ্ধ মনে কর। কিন্তু তাদের মন পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন। তাদের এ অবস্থার কারণ হলো তারা জ্ঞান ও বুদ্ধিহীন।
সূরা:৫৯: আল্-হাশর:-১৫
کَمَثَلِ الَّذِیۡنَ مِنۡ قَبۡلِہِمۡ قَرِیۡبًا ذَاقُوۡا وَبَالَ اَمۡرِہِمۡ ۚ وَ لَہُمۡ عَذَابٌ اَلِیۡمٌ ﴿ۚ۱۵﴾
এরা তাদের কিছুকাল পূর্বের সেই সব লোকের মত যারা তাদের কৃতকর্মের পরিণাম ভোগ করেছে। তাদের জন্য আছে কঠিন শাস্তি।
সূরা:৫৯: আল্-হাশর:-১৬
کَمَثَلِ الشَّیۡطٰنِ اِذۡ قَالَ لِلۡاِنۡسَانِ اکۡفُرۡ ۚ فَلَمَّا کَفَرَ قَالَ اِنِّیۡ بَرِیۡٓءٌ مِّنۡکَ اِنِّیۡۤ اَخَافُ اللّٰہَ رَبَّ الۡعٰلَمِیۡنَ ﴿۱۶﴾
এদের উদাহরণ হলো শয়তান। সে প্রথমে মানুষকে বলে কুফরী কর। যখন মানুষ কুফরী করে বসে তখন সে বলে, আমি তোমার দায়িত্ব থেকে মুক্ত। আমি তো আল্লাহ‌ রব্বুল আলামীনকে ভয় পাই।
সূরা:৫৯: আল্-হাশর:-১৭
فَکَانَ عَاقِبَتَہُمَاۤ اَنَّہُمَا فِی النَّارِ خَالِدَیۡنِ فِیۡہَا ؕ وَ ذٰلِکَ جَزٰٓؤُا الظّٰلِمِیۡنَ ﴿٪۱۷﴾
উভয়েরই পরিণাম হবে এই যে, তারা চিরদিনের জন্য জাহান্নামী হবে জালেমদের প্রতিফল এটাই।

১১-১৭ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
ফী জিলালিল কুরআন:

‘তুমি কি মােনাফেকদের দেখােনি, তারা তাদের কাফের আহলে কিতাব ভাইদের বলে, তােমাদের যদি বের করে দেয়া হয় তাহলে আমরা অবশ্যই তােমাদের সাথে বেরিয়ে যাবাে…'(১১-১৭) এ হচ্ছে বনু নযীর গােত্রীয় ইহুদীদের সম্বােধন করে মােনাফেকরা যা বলেছে তার হুবহু উদ্ধৃতি। মােনাফেকরা সেই প্রতিশ্রুতি পালন করেনি; বরং প্রতিশ্রুতি ভংগ করে তাদের বেকায়দায় ফেলে অপদস্থ করেছিলাে। শেষ পর্যন্ত তাদের কাছে অকল্পনীয়ভাবে আল্লাহর আযাব এসেছিলাে এবং আল্লাহ তাদের অন্তরে আতংক সৃষ্টি করে দিয়েছিলেন। এখানে কোরআনের প্রতিটি বাক্যেই রয়েছে তাৎপর্যময় মর্মস্পর্শী তথ্য, যা হৃদয়রাজ্যে তােলপাড় সৃষ্টি করে এবং দ্বীনী জ্ঞান, প্রশিক্ষণ ও সুগভীর ঈমানের উপকরণ যােগান দেয়।  *মুনাফিকদের সাথে ইহুদী খ্রিষ্টানদের সম্পর্কের রূপ : এখানে আলােচিত হয়েছে মােনাফেকদের ইহুদিদের আত্মীয়তা ও ঘনিষ্ঠতার বন্ধন সম্পর্কে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তুমি কি মােনাফেকদের দেখােনি যে, তারা তাদের ভাই কাফের আহলে কিতাবকে বলে…’ অর্থাৎ বনু নযীর নামক এই আহলে কিতাব গােত্রটি কাফের এবং মােনাফেকরা ইসলামের বেশ ধারণ করলেও তারা এ কাফের আহলে কিতাব গােত্রটিরই ভাই। দ্বিতীয়ত মােনাফেকদের পক্ষ থেকে তাদের ভাইদের প্রদত্ত প্রতিশ্রুতির ভাষায় তাকীদ বা দৃঢ়তার উল্লেখ, ‘যদি তােমাদের বের করে দেয়া হয় তাহলে আমরা অবশ্যই তােমাদের সাথে বেরিয়ে যাবাে, তােমাদের ব্যাপারে আমরা আর কারাে হুকুম মানবাে না এবং তােমাদাদের ওপর যদি যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়া হয়, তাহলে অবশ্যই আমরা তােমাদের সাহায্য করবাে।’ তাদের এই সব প্রতিশ্রুতির স্বরূপ আল্লাহ তায়ালাই ভালাে জানেন এবং তিনি প্রতিশ্রুতির মুখােশ খুলে দেন, ‘আল্লাহ তায়ালা যা সাক্ষ্য দিয়েছেন বাস্তবে সেটাই হয়েছিলাে।’ মােনাফেকরা তাদের ভাইদের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাে, তা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। এরপর মােনাফেকদের ও তাদের ভাই কাফের আহলে কিতাব গােষ্ঠীর একটা মনস্তাত্ত্বিক দুর্বলতার উল্লেখ করা হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই তােমরা তাদের কাছে আল্লাহর চেয়ে বেশী ভয়ের পাত্র।’ এর কারণ এই যে, তারা একটা নির্বোধ গােষ্ঠী। অর্থাৎ তারা আল্লাহ তায়ালার চেয়েও মুসলমানদের বেশী ভয় করে। তারা যদি আল্লাহকে ভয় করতাে, তাহলে আল্লাহর বান্দাদেরকে তাদের ভয় করতে হতাে না। কেননা ভয় একটাই হতে পারে, একাধিক নয়। আল্লাহর ভয় ও বান্দার ভয়- এই দুই ধরনের ভয় কোনাে মােমেনের অন্তরে একই সাথে থাকতে পারে না। বিশ্ব জাহানের যা কিছু শক্তি ও পরাক্রম সবই আল্লাহর। বিশ্ব প্রকৃতির সমস্ত শক্তি একমাত্র আল্লাহর আদেশের অধীন। এমন কোনাে প্রাণী নেই, যার লাগাম আল্লাহর হাতে নেই। তাহলে যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে, সে আর কাকে ভয় করবে? কিন্তু যারা এ সত্য বুঝে না, তারা আল্লাহর চেয়েও তার বান্দাদের বেশী ভয় করে থাকে। কেননা তারা একটা নির্বোধ গােষ্ঠী। এভাবে বনু নযীরের প্রকৃত অবস্থা ও চরিত্র স্পষ্ট করে দেয়া হয়েছে। সেই সাথে এই মৌল তত্ত্বও ব্যক্ত করা হয়েছে, অর্থাৎ মােনাফেকদের ও কাফের আহলে কিতাব গােষ্ঠীর এই মানসিক অবস্থা তুলে ধরা হয়েছে যে, তারা আল্লাহর চেয়েও মােমেনদের বেশী ভয় করে। তারা সম্মিলিতভাবেও তােমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারবে না। তবে পারবে কেবল সুরক্ষিত জনপদের মধ্যে অথবা প্রাচীরের আড়ালে অবস্থান করে। তাদের নিজেদের মধ্যেই রয়েছে তীব্র অন্তর্দ্বন্দ। ‘তুমি তাদের ঐক্যবদ্ধ ভাব, অথচ তাদের মন পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন। কেননা তারা আসলেই একটা নির্বোধ সম্প্রদায়।'(আয়াত ১৪) পরবর্তীকালে যখনই কোথাও এ ধরনের মােনাফেক ও কাফের জনগােষ্ঠী একত্রে অথবা পাশাপাশি বসবাস করেছে, তখনই মুনাফিক ও কাফেরদের এই মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা, যা কোরআনের এই আয়াতে অত্যন্ত নির্ভুলভাবে উদঘাটিত হয়েছে- অলৌকিকভাবে সত্য প্রমাণিত হয়েছে। এটা একটা চাক্ষুষ সত্য হিসাবেও প্রমাণিত হয়েছে। সম্প্রতি মুসলিম গেরিলাদের সাথে ইহুদীদের যে সংঘর্ষ বায়তুল মাকদাসে সংঘটিত হয়েছে, তা থেকে বিস্ময়করভাবে এ সত্যটি প্রমাণিত হয়েছে। ইহুদিরা ফিলিস্তীন ভূখন্ডে নির্মিত সুরক্ষিত কলােনীগুলােতে আশ্রয় নেয়া ছাড়া মুসলমানদের সাথে লড়াই করতে পারেনি। কখনাে প্রকাশ্য ময়দানে মুখােমুখি হলে তারা ইঁদুরের মতাে পালিয়েছে। তা দেখলে মনে হয় যেন এ আয়াত সর্বপ্রথম তাদের ব্যাপারেই বুঝি নাযিল হয়েছে।(এটা সে সময়ের কথা যখন ১৯৪৮ সালে ইসরাঈল রাষ্ট্র গঠিত হবার পর ইখওয়ানুল মুসলিমুনের নেতৃত্বে মুসলমানরা প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলে-সম্পাদক) তাদের বাইরের দৃষ্টিতে মনে হয় অন্যান্য মনস্তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যগুলাে যথারীতি আজো বহাল রয়েছে। অথচ তাদের মন পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন। এটা মােনাফেক ও কাফেরদের বৈশিষ্ট্য। অপরদিকে মুসলমানদের অবস্থা হচ্ছে এর বিপরীত। মুসলমানদের বিভিন্ন প্রজন্মের মাঝে স্থান, কাল, জাতি, বর্ণ, বংশ ও ভৌগােলিক এলাকার যতাে ব্যবধানই থাকুক, সব অতিক্রম করে ঈমানী ঐক্য তাদের অটুট বন্ধনে আবদ্ধ করে। কাফের ও মােনাফেকদের ভেতরে এমন ঐক্য কখনাে হয় না, কারণ তারা নির্বোধ। এদের উভয়ের বা বাহ্যিক হাবভাব কখনাে কখনাে আমাদের ধোকা দেয়। আহলে কিতাব গােষ্ঠীকে কখনাে কখনাে একাত্ম ও ঐক্যবদ্ধ দেখা যায়। অনুরূপভাবে মােনাফেকদেরকেও কখনাে কখনাে একই শিবিরে সমবেত হতে দেখা যায়, কিন্তু প্রকৃত খবর আমাদের কাছে আল্লাহ তায়ালা  আকাশ থেকে আগেই ওহীর মাধ্যমে বলে দিয়েছেন। সে খবর হলাে, তারা আসলে সে রকম নয়। তারা ঐক্যবদ্ধ নয়, বাহ্যত যদিও তা দেখা যায়, সেটা একটা প্রতারণাপূর্ণ দৃশ্য। সময়ে সময়ে এসব প্রতারণার মুখােশ আবার খসেও পড়ে, তখন বাস্তব ঘটনা স্পষ্ট হয়ে যায় এবং একই শিবিরের ভেতরে স্বার্থ, অভিরুচি ও মতামতের বিভিন্নতার কারণে যে বিবাদ-বিসম্বাদ ও অনৈক্য বিদ্যমান তাও ফাস হয়ে যায়। মুসলমানরা যখনই আন্তরিকভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আল্লাহর রজ্জু ধারণ করেছে, তখনই তাদের সামনে তাদের প্রতিপক্ষের অনৈক্য, স্ববিরােধিতা, অন্তর্দ্বন্দ ও কপটতা ধরা পড়ে গেছে। মুসলমানরা যখনই ধৈর্য ধারণ করেছে ও সত্যের ওপর অবিচল অবস্থান গ্রহণ করেছে, তখনই বাতিলপন্থীদের লোক দেখানাে ঐক্য ভেংগে পড়েছে এবং তাদের ভেতরকার তীব্র বিরােধী বিদ্বেষ ও মনের অনৈক্য স্পষ্ট হয়ে ওঠেছে। মােনাফেক ও কাফের ইহুদী খৃষ্টানরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে সক্ষম হয় কেবল তখনই, যখন মুসলমানদের ভেতরে অনৈক্য ও বিরােধের সূচনা হয়। এই অনৈক্য ও বিরােধের কারণে তাদের সেই মৌলিক চরিত্র বহাল থাকে না, যা এই সূরায় পূর্ববর্তী পর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। নচেত মােনাফেকরা সব সময়ই মুসলমানদের চেয়ে দুর্বল ও অক্ষম। মুনাফেকরা ও ইটহুদী-খৃষ্টানরা মানসিক, স্বার্থগত রুচিগত দিক দিয়ে পরস্পর থেকে অনেকটা বিভেদগ্রস্ত। তাদের ক্ষেত্রেই একথা বেশী প্রযােজ্য যে, তাদের ভেতরে তীব্র অন্তর্দ্বন্দ বিদ্যমান, তুমি তাদের ঐক্যবদ্ধ মনে করলেও তাদের হৃদয়গুলাে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন।’ কোরআন এ সত্য মুসলমানদের অন্তরে বদ্ধমূল করতে চায়। কেননা সে তাদের সামনে তাদের শত্রুর ভাবমূর্তি ক্ষীণ করতে এবং তাদের শত্রু-ভীতি থেকে মুক্ত করতে বদ্ধ পরিকর। আসলে সে মুসলমানদের শাশ্বত সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত করা ও তার ভিত্তিতে আধ্যাত্মিক সচেতনতা দান করতে চায়। মুসলমানরা যখনই কোরআনকে নিজেদের চেতনা ও প্রেরণার উৎস হিসেবে গ্রহণ করবে, তখনই তাদের শত্রুরা ও আল্লাহর শত্রুরা তাদের কাছে আর ভয়ের পাত্র থাকবে না। এটা করতে পারলে তারা এক কাতারে সমবেত হতে পারবে। তাদের সামনে দাঁড়ানাের মতাে কোনাে শক্তিই আর পৃথিবীতে থাকবে না। যারা আল্লাহর ওপর যথার্থই ঈমান রাখে, তাদের নিজেদের অবস্থা ও তাদের শত্রুদের অবস্থা উপলব্ধি করা উচিত। এটা উপলব্ধি করতে পারলেই লড়াইয়ে অর্ধেক জয় অর্জিত হয়ে যাবে। একটা ঘটনার বিবরণদান, সেই ঘটনার পর্যালােচনা করা এবং সেই ঘটনার চাক্ষুষ দর্শকরা যাতে তার থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে সে জন্যে তাদের সামনে এই তথ্য প্রমাণগুলাে বিশ্লেষণ প্রসংগে কোরআন এই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মুসলমানদের অবহিত করে। অনুরূপভাবে সে মুসলমানদের পরবর্তী প্রজন্মকেও এ ব্যাপারে অবহিত করাতে এবং এ নিয়ে চিন্তা গবেষণার সুযােগ দিতে চায়। উল্লেখ্য, বনু নযীরের এ ঘটনাই এ জাতীয় প্রথম ঘটনা। এর আগে বনু কায়নুকার ঘটনাটিও ঘটেছিলাে এবং পরবর্তী আয়াতে সম্ভবত সেদিকেই ইংগিত করা হয়েছে, তারা সে লােকদের মতাে, যারা ইতিপূর্বে নিজেদের কৃতকর্মের শাস্তি আস্বাদন করেছে, আর তাদের জন্যে রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। বনু কায়নুকা নামে ইহুদী গােত্রের সাথে মুসলমানদের যে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে, তা ছিলাে বদর যুদ্ধের পর ও ওহদ যুদ্ধের পূর্বের ঘটনা। এই বনু কায়নুকার সাথে রসূল(স.)-এর চুক্তি ছিলাে, কিন্তু বদর যুদ্ধে মােশরেকদের ওপর মুসলমানরা যখন বিজয়ী হলাে, তখন ইহুদীরা তাতে ক্ষুব্ধ হলাে। এতােবড়াে বিজয়লাভে মুসলমানদের ওপর তারা ঈর্ষান্বিত হলাে। তাদের আশংকা ছিলাে, মুসলমানদের এ বিজয় মদীনায় তাদের অবস্থা প্রভাবিত করবে। মুসলমানদের যে পরিমাণ শক্তি বৃদ্ধি ঘটবে, সেই পরিমাণ ইহুদীদের শক্তি ও প্রভাব প্রতিপত্তি কমবে। ইহুদীরা যে কানাঘুষা করে দুরভিসন্ধি ঘটাচ্ছিলাে, সে কথা রসূল(স.) জানতে পেরে তাদের সতর্ক করে দিলেন এবং তাদের সাথে তার যে শান্তি চুক্তি রয়েছে, তার কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন। সেই সাথে এরূপ মনােভাবের পরিণতি সম্পর্কেও তাদের হুঁশিয়ার করে দিলেন, কিন্তু বনু কায়নুকা গােত্রটি রসূল(স.)-কে পাল্টা হুমকি দিয়ে ধৃষ্টতার চরম পরাকাষ্ঠা দেখালাে। তারা বললাে, ‘হে মােহাম্মদ, যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী নয় এমন একটা গােত্রকে যুদ্ধে হারিয়ে দিয়ে তােমার অহংকার করা উচিত নয়। আমাদের সাথে যদি তােমার যুদ্ধ হয়, তাহলে বুঝবে আমরা সত্যিকার যােদ্ধা। এরপর তারা মুসলমানদের ক্রমাগত উস্কানি দিতে থাকলো। একটা বর্ণনা থেকে জানা যায়, জনৈক মুসলিম নারী বনু কায়নুকার বাজারে একদিন একটা পণ্য বিক্রি করে। সে একজন রং মিস্ত্রীর দোকানের সামনে বসে পণ্যটা বিক্রি করেছিলো। ইহুদীরা তার মুখ খােলার জন্যে তাকে উত্যক্ত করতে থাকে, কিন্তু সে কোনােক্রমেই মুখ খুলতে রাজি হয়নি। এদিকে রং মিস্ত্রী সুকৌশলে তার পরিধানের কাপড়ের এক প্রান্ত পিঠের সাথে বেঁধে দেয়। ফলে সে যখন ওঠে দাঁড়ালাে তখন তার লজ্জাস্থান বেরিয়ে পড়লাে। তা দেখে সবাই হেসে ওঠলাে। মহিলাটি তখন চিৎকার দিয়ে ওঠলাে। তার চিৎকারের সাথে সাথে জনৈক মুসলমান রংমিস্ত্রীর ওপর আক্রমণ চালিয়ে তাকে হত্যা করে ফেললাে। আবার ইহুদীরা মুসলমানদের ওপর ঝাপিয়ে পড়ে তাকে মেরে ফেললাে। এরপর মুসলমানের সাথীরা মুসলমানদের সাহায্য চেয়ে চিৎকার করলাে। তখন মুসলমানরা রেগে গেলাে, ফলে মুসলমানদের মধ্যে ও বনু কায়নুকার মধ্যে যুদ্ধ বেধে গেলাে। রসূল(স.) বনু কায়নুকাকে অবরােধ করলেন। তারা রসূল(স.)-এর ফায়সালা মানতে রাজী হলাে। এই সময় মােনাফেক সর্দার আবদুল্লাহ বিন উবাই বিন সলুল রসূল(স.)-এর সাথে তর্ক বিতর্ক শুরু করে দিলাে, সে জানালাে, খাযরাজ গােত্রের সাথে বনু কায়নুকার শান্তি চুক্তি রয়েছে কিন্তু আসলে এটা ছিল মােনাফেকদের ও আহলে কিতাব কাফেরদের মধ্যকার গাটছাড়া। অবশেষে রসূল(স.) বনু কায়নুকাকে তাদের অস্ত্রশস্ত্র ছাড়া অন্য সমস্ত অস্থাবর সম্পত্তি সহকারে মদীনা থেকে নির্বাসন দিয়ে যুদ্ধ না করতে সম্মত হলেন। তারা প্রাণ নিয়ে সিরিয়ায় পালালাে। এখানে কোরআনে এই ঘটনার দিকেই ইংগিত করা হয়েছে এবং তাদের সাথে বনু নযীর ও মােনাফেকদের অবস্থার তুলনা করা হয়েছে।

ফী জিলালিল কুরআন:

পরবর্তী আয়াতে এই মােনাফেকদের সম্পর্কে একটা উদাহরণ দেয়া হয়েছে। মােনাফেকরা ইহুদীদের প্রতিরােধের উস্কানি দিয়ে তাদের শােচনীয় দুর্গতি ঘটিয়েছিলাে, তাই তাদের সাথে শয়তানের উদাহরণ দেয়া হয়েছে। কেননা শয়তান মানুষকে অনুরূপ উস্কানি দিয়ে থাকে এবং মানুষ সেই উস্কানিতে সম্মত হয়ে নিজের শোচনীয় দুর্দশা ডেকে আনে। ‘শয়তানের মতাে যখন সে মানুষকে বলে, তুমি কুফরী করাে। তারপর যখন মানুষ কুফরী করে, তখন সে বলে, আমি তােমার কোনাে ধার ধারি না। আমি তাে বিশ্বপ্রভু আল্লাহকে ভয় করি। তখন উভয়ের পরিণাম হয় এই যে, তারা উভয়ে চিরদিনের জন্যে জাহান্নামে চলে যায়। এটাই অপরাধীদের কর্মফল।’ এখানে শয়তান ও তার উস্কানির ফাঁদে পা দেয়। অথচ তার পরিণাম কারােই অজানা নয়। আসলে এটা একটা চিরন্তন ব্যাপার। আর একটি সাময়িক ঘটনা দিয়ে কোরআন একটি চিরন্তন ব্যাপারের দিকে মানুষের দৃষ্টি ফেরায়। একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা ও একটা শাশ্বত সত্যের মাঝে যােগসূত্র স্থাপন করে এবং তা করে একটি জীবন্ত বাস্তবতা সামনে রেখে। অন্তরে বিচ্ছিন্ন কিছু তত্ত্বই সে উপস্থাপন করে না। কেননা বিচ্ছিন্ন কোনাে তত্ত্ব কখনাে চেতনাকে প্রভাবিত করে না এবং তা গ্রহণে হৃদয়কে উদ্বুদ্ধও করে না। হৃদয়কে সম্বােধন করার ব্যাপারে কোরআনের রীতি এবং দার্শনিক, গবেষক ও তাত্ত্বিকদের রীতিতে এটাই হচ্ছে মৌলিক পার্থক্য। চেতনার জগতে আলােড়ন সৃষ্টিকারী এই উদাহরণটির মধ্য দিয়ে বনু নযীরের কাহিনী শেষ হলাে। এর ফাকে ফাকে বিপুল সংখ্যক তত্ত্ব, দৃশ্য ও নির্দেশনার নীরব সমাবেশ ঘটানাে হয়েছে। সাময়িক ঘটনাবলী শাশ্বত সত্যগুলাের সাথে সংযুক্ত হয়েছে। এখানে বাস্তবতার জগতে ও বিবেকের জগতে এতাে বড়ো একটা সফর সংঘটিত হয়ে গেছে, যা সীমানার বাইরে পর্যন্ত এমনি এমনিই সম্প্রসারিত হয়ে গেছে। আল্লাহর কিতাবে এই সফরের যে বর্ণনা দেয়া হয়েছে তার সাথে মানবীয় বই পুস্তকের বর্ণনার বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। মানুষের সৃষ্টি ও আল্লাহর সৃষ্টির মাঝে যেমন অপরিমেয় পার্থক্য রয়েছে, এ পার্থক্যও ঠিক তদ্রুপ অপরিমেয়।

১১-১৭ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন:-
#পুরো এই রুকূ’র আয়াতসমূহের বাচনভঙ্গি থেকে এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, রসূলুল্লাহ ﷺ যে সময় বনু নাযীরকে মদীনা ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য দশদিন সময় দিয়ে নোটিশ দিয়েছিলেন এবং তাদের বিরুদ্ধে অবরোধ শুরু হতে এখনো কয়েকদিন দেরী ছিল সেই সময় এ রুকূ’র আয়াতগুলো নাযিল হয়েছিলো। আমরা পূর্বেই বর্ণনা করেছি, রসূলুল্লাহ ﷺ বনু নাযীরকে এই নোটিশ দিলে আবদুল্লাহ ইবনে উবাই এবং মদীনার অন্যান্য মুনাফিক নেতারা তাদের বলে পাঠালো যে, আমরা দুই হাজার লোক নিয়ে তোমাদের সাহায্য করার জন্য আসবো। আর বনী কুরায়যা এবং বনী গাতফানও তোমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসবে। অতএব তোমরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াও এবং কোন অবস্থায় তাদের কাছে আত্মসমর্পণ করো না। তারা তোমাদের বিরুদ্ধে লড়াই করলে আমরাও তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করবো। আর তোমরা এখান থেকে বহিষ্কৃত হলে আমরাও চলে যাব। এই প্রেক্ষাপটে আল্লাহ‌ তা’আলা এ আয়াতগুলো নাযিল করেছেন। তাই নাযিল হওয়ার পরম্পরার দিক দিয়ে এ রুকূ’টা প্রথমে নাযিল হয়েছে। আর বনী নাযীরকে মদীনা থেকে বহিষ্কার করার পর প্রথম রুকূ’র আয়াতগুলো নাযিল হয়েছে। তবে কুরআন মজীদে সন্নিবেশ করার ক্ষেত্রে প্রথম রুকূ’র আগে এবং দ্বিতীয় রুকূ’ পরে রাখার কারণ হলো অধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো প্রথম রুকূ’তে বর্ণিত হয়েছে।

# তারা যে তোমাদের মোকাবেলায় প্রকাশ্যে ময়দানে নামছে না তার কারণ এ নয় যে, তারা মুসলমান, তাদের মনে আল্লাহর ভয় আছে এবং এরূপ কোনআশঙ্কাও তাদের মনে আছে যে, ঈমানের দাবী করা সত্ত্বেও তারা যদি ঈমানদারদের বিরুদ্ধে কাফেরদের সাহায্য করে তাহলে আল্লাহ‌ তা’আলার কাছে তাদেরকে জবাবদিহি করতে হবে। বরং তোমাদের প্রকাশ্য মোকাবিলা করা থেকে যে জিনিস তাদের বিরত রাখে তা হলো, ইসলাম ও মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্য তোমাদের ভালবাসা, প্রাণপণ সংকল্প এবং আত্মত্যাগের স্পৃহা আর তোমাদের পারস্পরিক দৃঢ় ঐক্য দেখে তারা সাহস হারিয়ে ফেলে। তারা ভাল করেই জানে যে, তোমরা নগণ্য সংখ্যক হলেও শাহাদাতের যে অদম্য আকাঙ্ক্ষা তোমাদের প্রতিটি ব্যক্তিকে জান কবুল মুজাহিদ বানিয়ে রেখেছে এবং যে সাংগঠনিক ব্যবস্থাপনার কারণে তোমরা একটি ইস্পাত কঠিন দল ও সংগঠনে রূপান্তরিত হয়েছো তার সাথে সংঘর্ষ বাধলে ইহুদীদের সাথে তারা ধ্বংস হয়ে যাবে। এখানে এ বিষয়টি মনে রাখা দরকার যে, কারো অন্তরে আল্লাহর ভয়ের চেয়ে অন্য কারো ভয় অধিক থাকলে তা মূলত আল্লাহর ভয় না থাকারই নামান্তর। একথা সবারই জানা যে, যে ব্যক্তি দু’টি বিপদের একটিকে লঘু এবং অপরটিকে গুরুতর মনে করে সে প্রথমোক্ত বিপদটির পরোয়াই করে না। দ্বিতীয় বিপদটি থেকে রক্ষা পাওয়াই তার সমস্ত চিন্তা-ভাবনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়ায়।
# ছোট এই আয়াতাংশে একটি বড় সত্য তুলে ধরা হয়েছে। বিবেক-বুদ্ধির অধিকারী ব্যক্তি জানে, মানুষের শক্তি নয়, প্রকৃত পক্ষে আল্লাহর শক্তিই ভয় করার মত। এ কারনে যেসব কাজে আল্লাহর সামনে তার জবাবদিহির ভয় থাকবে এ ধরনের সকল কাজ থেকে সে নিজেকে রক্ষা করবে। এক্ষেত্রে জবাব চাওয়ার মত কোন মানবীয় শক্তি থাক বা না থাক তা দেখার প্রয়োজন সে মনে করবে না। আর আল্লাহ‌ তা’আলা যেসব দায়িত্ব ও কর্তব্য তার ওপর ন্যস্ত করেছেন তা সমাধা করার জন্য সে তৎপর হয়ে উঠবে। গোটা দুনিয়ার সমস্ত শক্তি এ পথে বাধা হয়ে দাঁড়ালেও সে তার পরোয়া করবে না। কিন্তু একজন বুদ্ধি-বিবেকহীন মানুষের কাছে যেহেতু আল্লাহর শক্তি অনুভূত হয়না। কিন্তু মানুষের শক্তিসমূহ অনুভূত হয় তাই সমস্ত ব্যাপারে সে তার কর্মনীতি নির্ধারণ করে আল্লাহকে বাদ দিয়ে মানুষের শক্তির প্রতি লক্ষ রেখে। কোন কিছু থেকে দূরে থাকলে এ জন্য থাকে না যে, সেজন্য আল্লাহর কাছে পাকড়াও হতে হবে। বরং এ জন্য দূরে থাকে যে, সামনেই কোন মানবীয় শক্তি তার খবর নেয়ার জন্য প্রস্তুত আছে। আর কোন কাজ যদি সে করে তবে তাও এ জন্য করে না যে, আল্লাহ‌ তা’আলা তা করতে নির্দেশ দিয়েছেন কিংবা সেজন্য সে আল্লাহর পক্ষ থেকে পুরস্কারের প্রত্যাশী। বরং এ জন্য করে যে, কোন মানবীয় শক্তি তা করতে নির্দেশ দিচ্ছে কিংবা পছন্দ করছে এবং সে-ই এ জন্য পুরস্কৃত করবে। বুঝা ও না বুঝার এই পার্থক্যই প্রকৃতপক্ষে একজন ঈমানদার ও ঈমানদারের জীবন ও কর্মকে পরস্পর থেকে পৃথক করে দেয়।
# এখানে মুনাফিকদের দ্বিতীয় দুর্বলতার কথা বলা হয়েছে। তাদের প্রথম দুর্বলতা হলো, তারা ছিল ভীরু-আল্লাহকে ভয় করার পরিবর্তে মানুষকে ভয় করতো। ঈমানদারদের মত তাদের সামনে এমন কোন উন্নত লক্ষ ও আদর্শ ছিল না যা অর্জনের জন্য তাদের মধ্যে প্রাণপণ সংগ্রামে ঝাপায়ে পড়ার অনুপ্রেরণা সৃষ্টি হতো। তাদের দ্বিতীয় দুর্বলতা হলো মুনাফিকীর আচরণ ছাড়া তাদের মধ্যে আর কোন বিষয়ে মিল ছিল না যা তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করে একটি মজবুত ও সুসংবদ্ধ দলে পরিণত করতে পারতো। যে বিষয়টি তাদের ঐক্যবদ্ধ করেছিল তাহলো, নিজেদের শহরে বহিরাগত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নেতৃত্ব ও শাসন চলতে দেখে তাদের কলিজা দগ্ধ হচ্ছিলো আর স্বদেশবাসী আনসার কর্তৃক মুহাজিরদের সসম্মানে গ্রহণ করতে দেখে তাদের মন মুখ ভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছিল। এই হিংসার কারণে তারা সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে এবং আশেপাশের ইসলাম বৈরীদের সাথে ষড়যন্ত্র ও যোগসাজশ করে এই বহিরাগত প্রভাব-প্রতিপত্তিকে খতম করে দিতে চাইতো। তাদেরকে পরস্পর ঐক্যবদ্ধ করার জন্য এই নেতিবাচক উদ্দেশ্য ছাড়া কোন গঠনমূলক জিনিস ছিল না। তাদের প্রত্যেক নেতার আলাদা আলাদা দল ও উপদল ছিল। প্রত্যেকেই নিজের মাতবরী ফলাতে চাইতো। তারা কেউ কারো অকৃত্রিম বন্ধু ছিল না। প্রত্যেকের মনে অন্যদের জন্য এতটা হিংসা-বিদ্বেষ ছিল যে, নিজেদের সাধারণ শত্রুর মোকাবিলায়ও তারা নিজেদের পারস্পরিক শত্রুতা ভুলতে কিংবা একে অপরের মূলোৎপাটন থেকে বিরত থাকতে পারতো না।

আল্লাহ তা’আলা এভাবে বনী নাযীর যুদ্ধের পূর্বেই মুনাফিকদের আভ্যন্তরীণ অবস্থা পর্যালোচনা করে মুসলমানদের জানিয়ে দিলেন যে, তাদের দিক থেকে বাস্তব কোন বিপদেরআশঙ্কা নেই। তাই বারবার এ খবর শুনে তোমাদের ঘাবড়ে যাওয়ার আদৌ কোন কারণ নেই যে, তোমরা বনী নাযীরকে অবরোধ করার জন্য যাত্রা করলেই এই মুনাফিক নেতা দুই হাজার লোকের একটি বাহিনী নিয়ে তোমাদের ওপর আক্রমণ করে বসবে এবং একই সঙ্গে বনী কুরাইযা ও বনী গাতফান গোত্র দু’টিকেও তোমাদের বিরুদ্ধে আক্রমণে উস্কে দেবে। এসবই লম্ফঝম্ফ মাত্র। চরম পরীক্ষা শুরু হতেই এর অন্তসারশূন্যতা প্রমাণিত হয়ে যাবে।
# এখানে কুরাইশ গোত্রের কাফের এবং বনী কায়নুকার ইহুদীদের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে যারা নিজেদের সংখ্যাধিক্য এবং সাজ-সরঞ্জামের প্রাচুর্য সত্ত্বেও এ সব দুর্বলতার কারনে মুসলমানদের সাজ-সরঞ্জামহীন মুষ্টিমেয় লোকের একটি দলের কাছে পরাজিত হয়েছিল।
# এসব মুনাফিক বনী নাযীরের সাথে সেই একই আচরণ করছে, যে আচরণ শয়তান মানুষের সাথে করে থাকে। এখন এসব মুনাফিক তাদের বলছে, তোমরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াও প্রয়োজনে আমরাও তোমাদের সাথে থাকবো। কিন্তু তারা যখন সত্যি সত্যি যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়বে তখন এরা তাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে নিজেদের সমস্ত প্রতিশ্রুতি থেকে দায়িত্বমুক্ত হয়ে যাবে এবং তাদের পরিণতি কি হলো তা দেখার জন্য ফিরেও তাকাবে না। শয়তান প্রত্যেক কাফেরের সাথে এ ধরনের আচরণই করে থাকে। বদর যুদ্ধে কুরাইশ গোত্রের কাফেরদের সাথেও সে এরূপ আচরণ করেছিল। সূরা আনফালের ৪৮ আয়াতে এর উল্লেখ আছে। প্রথমে মুসলমানদের বিরুদ্ধে সে তাদেরকে হিম্মত ও সাহস যুগিয়ে বদর প্রান্তরে এনে হাজির করেছে এবং বলেছেঃ

(لَا غَالِبَ لَكُمُ الْيَوْمَ مِنَ النَّاسِ وَإِنِّي جَارٌ لَكُمْ ) (আজ কেউই তোমাদের বিরুদ্ধে বিজয়ী হতে পারবে না। আর আমি তো তোমাদের পৃষ্ঠপোষক ও সহযোগী হিসেবে আছিই)। কিন্তু যখন দুটো সেনাবাহীনি মুখোমুখি হয়েছে তখন সে একথা বলতে বলতে পালিয়েছেঃ

( إِنِّي بَرِيءٌ مِنْكُمْ إِنِّي أَرَى مَا لَا تَرَوْنَ إِنِّي أَخَافُ اللَّهَ )

(আমি তোমাদের দায়িত্ব থেকে মুক্ত। আমি যা দেখতে পাচ্ছি তোমরা তা দেখতে পাও না। আমি তো আল্লাহকে ভয় পাই।)।

১১-১৭ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:-
১১-১৭ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে, মুনাফিক সর্দার আব্দুল্লাহ বিন উবাই বনু নাযীর গোত্রের লোকদের আশ্বাস দিয়েছিল দু হাজার সৈন্য দ্বারা সহযোগিতা করবে। আল্লাহ তা‘আলা এসব মুনাফিকদের সম্পর্কে বলছেন : এরা মিথ্যা বলছে, তারা কখনো তাদেরকে সহযোগিতা করবে না। তারা যুদ্ধে বের হলে এরা পলায়ন করবে। সত্যি তাই-ই হল। সাহাবীগণ যখন বনু নাযীর গোত্রে আক্রমণ করলেন তখন কেউ সহযোগিতা করার জন্য এগিয়ে আসেনি। এরূপ কিয়ামত অবধি মুনাফিকরা মুসলিমদের সাথে প্রতারণা করে অমুসলিমদেরকে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দেবে। এরা যতই প্রতিশ্রুতি প্রদান করুক যে, তারা কাফিরদেরকে সৈন্য দিয়ে, অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করবে কিন্তু সে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারবে না। কারণ যখন মুসলিমরা সর্বাত্মক জিহাদ শুরু করবে আর কাফিরদেরকে হত্যা করবে তখন তারা পশ্চাদপদ বরণ করবে। যারা মুসিলমদের বিরুদ্ধে কাফিরদেরকে সহযোগিতা করে তারাও কাফির। ইমাম মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব (রহঃ) ঈমান বিনষ্টের আট নম্বর কারণে বলেন : মুসলিমদের বিরুদ্ধে মুশরিকদের সাহায্য করা ঈমান বিনষ্টের অন্যতম কারণ। দলীল : আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

(وَمَنْ یَّتَوَلَّھُمْ مِّنْکُمْ فَاِنَّھ۫ مِنْھُمْﺚ اِنَّ اللہَ لَا یَھْدِی الْقَوْمَ الظّٰلِمِیْنَ)

তোমাদের মধ্য থেকে যে কেউ তাদের বন্ধুরূপে গ্রহণ করবে সে তাদেরই একজন গণ্য হবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ জালিমদেরকে সৎপথে পরিচালিত করেন না। (সূরা মায়িদা ৫ : ৫১)

(لَأَنْتُمْ أَشَدُّ رَهْبَةً)

‘তাদের অন্তরে আল্লাহ অপেক্ষা তোমরাই অধিকতর ভয়ঙ্কর’ অর্থাৎ তোমাদের ঐক্য ও যুদ্ধের ময়দানে দৃঢ়তা দেখে তারা তোমাদেরকে আল্লাহ তা‘আলার চেয়ে বেশি ভয় করে।

(فِيْ قُرَي ًمُّحَصَّنَةٍ)

‘শুধু সুরক্ষিত জনপদের অভ্যন্তরে’ অর্থাৎ প্রকাশ্যে সরাসরি তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার হিম্মত তাদের নেই। কেবল আকাশ থেকে বোমা বর্ষণ করে অথবা দূর থেকে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে যুদ্ধ করবে।

(تَحْسَبُهُمْ جَمِيْعًا وَّقُلُوْبُهُمْ شَتّٰي)

‘তুমি মনে করছ তারা ঐক্যবদ্ধ; কিন্তু তাদের হৃদয় বিচ্ছিন্ন মিল নেই’ বাহ্যিকভাবে অমুসলিমদেরকে দেখা যাবে তারা সবাই মিলে তোমাদের বিরুদ্ধে উঠে পড়ে যুদ্ধ করছে; কিন্তু যদি তোমরা যুদ্ধ শুরু করে দাও তাহলে তাদের প্রকৃত অবস্থা দেখতে পাবে যে, তারা তাদের কেউ কাউকে সাহায্য করবে না। অতএব তাদের বাহ্যিক ঐক্য দেখে ভয় করো না, তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাও।

(كَمَثَلِ الَّذِيْنَ مِنْ قَبْلِهِمْ)

‘এরা তাদের ন্যায়, যারা নিকট অতীতে নিজেদের কৃতকর্মের পরিণাম আস্বাদন করেছে’ এখানে বনু নাযীর গোত্রের সদ্য পূর্ব ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতি বলতে কাদের বুঝানো হয়েছে-এ ব্যাপারে মুজাহিদ বলেন : বদরের যুদ্ধে কুরাইশরা যেমন ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন : বনু কাইনুকার ইয়াহূদীদেরকে বুঝানো হয়েছে, আর এটাই সঠিক। কারণ বনু কাইনুকার ইয়াহূদীদেরকে এদের পূর্বে নির্বাসনে দেওয়া হয়েছে। (ইবনু কাসীর)

(كَمَثَلِ الشَّيْطٰنِ)

অর্থাৎ শয়তান যেমন মানুষকে কাফির বানিয়ে চলে যায় তেমনি এ সকল মুনাফিকরা অন্যদেরকে উস্কানি ও বিভিন্ন আশা-ভরসা দিয়ে সংঘাত ও বিশৃঙ্খলার দিকে ঠেলে দিয়ে নিজেরা গা-ঢাকা দেয়।

(فَكَانَ عَاقِبَتَهُمَآ)

অর্থাৎ যারা কুফরীর নির্দেশ দেয় আর যারা কুফরী করে উভয়ে জাহান্নামী।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. মুনাফিক ও কাফিরদের প্রতিশ্রুতি ছলনা মাত্র।
২. মুসলিমদের ঐক্য, সাহস ও ঈমানী দৃঢ়তাকে অমুসলিমরা ভীষণ ভয় পায়।
৩. অমুসলিমদেরকে বাহ্যিকভাবে একতাবদ্ধ দেখা গেলেও মূলত তারা বিচ্ছিন্ন।
৪. যারা কুফরী করে আর যারা কুফরীর পথ দেখায় সবাই জাহান্নামী।
৫. মুসলিমদের বিরুদ্ধে অমুসলিমদেরকে সহযোগিতা করা কুফরী।

১১-১৭ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে ইবনে কাছীর:-

আবদুল্লাহ ইবনে উবাই এবং তার মত অন্যান্য মুনাফিকদের প্রতারণা ও বিশ্বাসঘাতকতার বর্ণনা দেয়া হচ্ছে যে, তারা ইয়াহূদী বানী নাযীরের সাথে মিথ্যা ওয়াদা করে তাদেরকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে লড়িয়ে দেয়। তারা তাদের সাথে ওয়াদা ও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে বলেঃ “আমরা তোমাদের সঙ্গেই রয়েছি। প্রয়োজনে আমরা তোমাদেরকে সাহায্য করবে। যদি তোমরা পরাজিত হয়ে যাও এবং তোমাদেরকে মদীনা হতে বহিষ্কার করে দেয়া হয় তবে আমরাও তোমাদের সাথে এই শহর ছেড়ে চলে যাবো ।কিন্তু আসলে এই ওয়াদা করার সময় তা পূরণের নিয়তই তাদের ছিল না। তাদের এই মনোবলই ছিল না যে, তারা এরূপ করতে পারে, যুদ্ধে তাদেরকে সাহায্য করতে পারে এবং বিপদের সময় তাদের সাথে থাকে। বদনামের ভয়ে যদি তারা তাদের সাথে যোগও দেয়, কিন্তু তখনো তারা। যুদ্ধক্ষেত্রে স্থির থাকতে পারবে না, বরং কাপুরুষতা প্রদর্শন করে পালিয়ে যাবে। অতঃপর তারা কোন সাহায্যই পাবে না। এটা ভবিষ্যতের জন্যে শুভ সংবাদ।

এরপর আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা’আলা বলেনঃ প্রকৃতপক্ষে এই মুনাফিকদের অন্তরে আল্লাহ্ অপেক্ষা তোমরাই অধিকতর ভয়ংকর। অর্থাৎ হে মুসলমানগণ! এদের অন্তরে আল্লাহর ভয় অপেক্ষা তোমাদেরই ভয় বেশী আছে। যেমন আল্লাহ্ তা’আলা অন্য জায়গায় বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ তাদের একটি দল আল্লাহর ভয়ের মত মানুষকে ভয় করে অথবা আরো বেশী ভয় (অর্থাৎ আল্লাহকে ভয় করার চেয়েও বেশী মানুষকে ভয় করে)।” (৪:৭৭)

এ জন্যেই এখানে আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ এটা এই জন্যে যে, এরা এক নির্বোধ সম্প্রদায়।

তাদের ভীরুতা ও কাপুরুষতার অবস্থা এই যে, তারা মুসলমানদের সাথে। সামনা-সামনি কখনো যুদ্ধ করার সাহস রাখে না। হ্যাঁ, যদি সুরক্ষিত দূর্গের মধ্যে বসে থেকে কিংবা মরিচার (পরিখার) মধ্যে লুকিয়ে থেকে কিছু করার সুযোগে পায় তবে তারা ঐ সুযোগের সদ্ব্যবহার করবে। কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়ে বীরত্ব প্রদর্শন করা তাদের জন্যে সুদূর পরাহত। তারা পরস্পরই একে অপরের শত্রু। তাদের পরস্পরের মধ্যে কঠিন শক্রতা বিদ্যমান। যেমন আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
(আরবী) অর্থাৎ “তোমাদের কাউকেও তিনি কারো যুদ্ধের স্বাদ আস্বাদন করিয়ে থাকেন।” (৬:৬৫)

মহামহিমান্বিত আল্লাহ্ বলেনঃ হে নবী (সঃ)! তুমি মনে কর যে, তারা ঐক্যবদ্ধ, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা ঐক্যবদ্ধ নয়, বরং বিচ্ছিন্ন। তাদের মনের মিল নেই। মুনাফিকরা এক জায়গায় রয়েছে এবং কিতাবীরা অন্য জায়গায় রয়েছে। তারা একে অপরের শক্র। কারণ এই যে, এরা এক নির্বোধ সম্প্রদায়।

মহান আল্লাহ বলেনঃ এদের তুলনা— এদের অব্যবহিত পূর্বে যারা নিজেদের কৃতকর্মের শাস্তি আস্বাদন করেছে তারা। এর দ্বারা উদ্দেশ্য কুরায়েশ কাফিররাও হতে পারে যে, বদরের যুদ্ধের দিন তাদের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয় এবং তারা চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অথবা এর দ্বারা ইয়াহদী বানী কাইনুকাকে বুঝানো হয়েছে। তারাও দুষ্কর্যে ও ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল। আল্লাহ্ তা’আলা স্বীয় নবী (সঃ)-কে তাদের উপর জয়যুক্ত করেন। নবী (সঃ) তাদেরকে মদীনা হতে বিতাড়িত করেন। এ দুটিই নিকট অতীতের ঘটনা। এতে এদের জন্যে উপদেশ ও শিক্ষা রয়েছে। তবে এখানে বানী কাইনুকার ঘটনাটি উদ্দেশ্য হওয়াই অধিকতর যুক্তিসঙ্গত। কেননা, এর পূর্বেই রাসূলুল্লাহ (সঃ) বানী কাইনুকা নামক ইয়াহূদী গোত্রটিকে নির্বাসিত করেছিলেন। এসব ব্যাপারে আল্লাহ্ তা’আলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।

আল্লাহ্ তা’আলার উক্তিঃ এদের (মুনাফিকদের) তুলনা শয়তান- যে মানুষকে বলেঃ কুফরী কর, অতঃপর যখন সে কুফরী করে তখন শয়তান বলেঃ ‘তোমার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। অর্থাৎ মুনাফিকদের অঙ্গীকারের ভিত্তিতে এই ইয়াহূদীদের মুসলমানদের বিরুদ্ধে উত্তেজিত হওয়া ও তাদের সাথে কৃত চুক্তি ভঙ্গ করা, অতঃপর সুযোগেমত এই মুনাফিকদের ঐ ইয়াহূদীদের কাজে না আসা, যুদ্ধের সময় তাদেরকে সাহায্য না করা এবং তাদের নির্বাসনের সময় ঐ মুনাফিকদের তাদের সঙ্গী না হওয়া, একটি দৃষ্টান্তের দ্বারা আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা’আলা বুঝাচ্ছেনঃ দেখো, শয়তান এই ভাবেই মানুষকে কুফরী করতে উত্তেজিত করে। অতঃপর যখন সে কুফরী করে বসে তখন সে নিজেই তাকে তিরস্কার করতে শুরু করে এবং নিজেকে আল্লাহ্ ওয়ালা বলে প্রকাশ করে। ঐ সময় সে বলেঃ নিশ্চয়ই আমি জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহরকে ভয় করি।

এখানে এই দৃষ্টান্তের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বানী ইসরাঈলের একজন আবেদের একটি ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে নাহীক (রাঃ) হযরত আলী (রাঃ)-কে বলতে শুনেছেন যে, বানী ইসরাঈলের মধ্যে একজন আবেদ ছিলেন। তিনি ষাট বছর আল্লাহ্ তা’আলার ইবাদতে কাটিয়ে দিয়েছিলেন। শয়তান তাকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে। কিন্তু তার সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়। অবশেষে সে একজন মহিলার মাধ্যমে উদ্দেশ্য সিদ্ধির চেষ্টা করে। সে তার উপর এমনভাবে প্রভাব বিস্তার করে যে, তাকে যেন জ্বিনে ধরেছে এই লক্ষণ প্রকাশ পায়। এদিকে ঐ মহিলাটির ভাইদেরকে সে এই কুমন্ত্রণা দেয় যে, ঐ আবেদের কাছেই এর চিকিৎসা হতে পারে। তারা মহিলাটিকে ঐ আবেদের কাছে নিয়ে গেল। আবেদ লোকটি তখন তার চিকিৎসা অর্থাৎ ঝাড়-ফুক, দু’আ-তাবী ইত্যাদি শুরু করে দিলেন। মহিলাটি তার ওখানেই থাকতে লাগলো। একদিন আবেদ মহিলাটির পার্শ্বেই ছিলেন এমন সময় শয়তান তার মনে কুচিন্তার উদ্রেক করলো। শেষ পর্যন্ত তিনি মহিলাটির সাথে ব্যভিচার করে বসলেন। মহিলাটি গর্ভবতী হয়ে গেল। এখন এই লজ্জা নিবারণের পন্থা ঐ শয়তান এই বাতলিয়ে দিলো যে, তিনি যেন মহিলাটিকে মেরে ফেলেন, অন্যথায় রহস্য খুলে যাবে। সুতরাং ঐ আবেদ মহিলাটিকে হত্যা করে ফেললেন। ওদিকে শয়তান মহিলাটির ভাইদের মনে আবেদের উপর সন্দেহ জাগিয়ে তুললো। তারা আবেদের আশ্রমের দিকে অগ্রসর হলো। এদিকে শয়তান আবেদের কাছে এসে বললোঃ “মহিলাটির লোকেরা আপনার কাছে আসছে। এখন আপনার মান-সম্মানও যাবে এবং প্রাণও যাবে। সুতরাং এখন যদি আপনি আমাকে সন্তুষ্ট করেন এবং আমি যা বলি তা মেনে নেন তবে আপনার মান-সম্মান ও প্রাণ বেঁচে যেতে পারে।” আবেদ বললেনঃ “ঠিক আছে, তুমি যা বলবে আমি তাই করতে প্রস্তুত আছি।” শয়তান তখন বললোঃ “আমাকে সিজদাহ্ করুন!” তিনি সিজদাহ্ করলেন। শয়তান তখন বললোঃ “হে হতভাগ্য! ধিক্ আপনাকে। আপনার সাথে আমার কোনই সম্পর্ক নেই। আমি বিশ্ব প্রতিপালক আল্লাহকে ভয় করি।” (এ ঘটনাটি ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

অন্য একটি রিওয়াইয়াতে আছে যে, একটি স্ত্রীলোক বকরী চরাতো এবং একজন পাদরীর আশ্রমের নীচে রাত্রি যাপন করতো। তার চারটি ভাই ছিল। একদিন শয়তানের প্ররোচনায় পড়ে পাদরী ঐ স্ত্রীলোকটির সাথে ব্যভিচার করে বসলেন। স্ত্রী লোকটি গর্ভবতী হয়ে গেল। শয়তান পাদরীর কাছে এসে বললোঃ “এটা তো বড়ই লজ্জার কথা। সুতরাং উত্তম পন্থা এটাই যে, মহিলাটিকে হত্যা করে কোন জায়গায় পুঁতে ফেলুন। আপনার সম্পর্কে মানুষের মনে কোন ধারণাই আসবে না। কেননা, আপনার পবিত্রতা সম্বন্ধে তারা পূর্ণ ওয়াকিফহাল। আর যদি আপনাকে এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করাও হয় তবে মিথ্যা কিছু একটা বলে দিবেন। কে এমন আছে যে, আপনার কথা বিশ্বাস করবে না?” এক রাত্রে সুযোগে পেয়ে শয়তানের কথামত তিনি মহিলাটিকে হত্যা করে দিলেন এবং এক জন-মানব হীন জঙ্গলে পুঁতে ফেললেন। তখন শয়তান মহিলাটির চার ভাই এর নিকট গমন করলো এবং স্বপ্নে প্রত্যেককে ঘটনাটি শুনিয়ে দিলো। তাকে পুঁতে ফেলার জায়গাটির কথাও বলে দিলো। সকালে জেগে ওঠে তাদের একজন বললোঃ “আজ রাত্রে আমি এক বিস্ময়কর স্বপ্ন দেখেছি। কিন্তু আমার সাহস হয় না যে, আপনাদের সামনে এটা বর্ণনা করি!” তার ভাইয়েরা বললোঃ “না, অবশ্যই তোমাকে বলতে হবে।” তখন সে বলতে শুরু করলো যে, এই ভাবে অমুক আবেদ তাদের বোনের সাথে কুকাজ করেছিল। ফলে সে গর্ভবতী হয়েছিল, তাই সে তাকে হত্যা করেছে এবং অমুক জায়গায় তার মৃতদেহ পুঁতে রেখেছে। তার এ স্বপ্নের কথা শুনে ঐ তিন ভাইয়ের প্রত্যেকে বললোঃ “আমিও এই স্বপ্নই দেখেছি।” এখন সবারই দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে গেল যে, এ স্বপ্ন সত্য। সুতরাং তারা এ খবর সরকারকে দিয়ে দিলো। বাদশাহর হুকুমে আবেদকে পাকড়াও করা হলো এবং যে জায়গায় সে মহিলাটির মৃতদেহ পুঁতে রেখেছিল সেখানে যাওয়া হলো। তারপর ঐ জায়গা খনন করিয়ে মৃতদেহ উদ্ধার করা হলো। পূর্ণ প্রমাণের পর ঐ পাদরীকে শাহী দরবারে নিয়ে যাওয়া হলো। ঐ সময় শয়তান তার সামনে প্রকাশিত হয়ে বললোঃ “এসব আমিই করিয়েছি। এখনও যদি আপনি আমাকে সন্তুষ্ট করেন তবে আমি আপনার প্রাণ রক্ষা করতে পারি।” আবেদ বললোঃ “বল, কি বলবে?” উত্তরে শয়তান বললোঃ “আমাকে সিজদাহ্ করুন।” আবেদ তাকে সিজদাহ্ও করলো। এভাবে তাকে পূর্ণ বে-ঈমান বানিয়ে নিয়ে শয়তান তাকে বললোঃ “আপনার সাথে আমার কোনই সম্পর্ক নেই। আমি তো বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহকে ভয় করি।” অতঃপর বাদশাহর নির্দেশক্রমে পাদরীকে হত্যা করে দেয়া হলো।

এটা প্রসিদ্ধ হয়ে আছে যে, ঐ পাদরীর নাম ছিল বারসীমা। হযরত আলী (রাঃ), হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ), হযরত তাউস (রাঃ), হযরত মুকাতিল ইবনে হাইয়ান (রঃ) প্রমুখ গুরুজন হতে এ ঘটনাটি বিভিন্ন শব্দে কিছু কম-বেশীর সাথে বর্ণিত আছে। এসব ব্যাপারে আল্লাহ্ তা’আলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।

এরই সম্পূর্ণ বিপরীত হলো হযরত জুরায়েজ (রঃ) নামক আবেদের ঘটনাটি। একজন ব্যভিচারিণী মহিলা তার উপর অপবাদ দেয় যে, তিনি তার সাথে ব্যভিচার করেছেন এবং এরই ফলে তার শিশুটি জন্মগ্রহণ করেছে। তার এই কথার উপর বিশ্বাস করে জনগণ তাঁর ইবাদতখানাটি ঘিরে নেয় এবং গালি দিতে দিতে অত্যন্ত বে-আদবীর সাথে তাঁকে তাঁর ইবাদতখানা হতে বের করে আনে। তারা তাঁর ইবাদতখানাটি ভেঙ্গে ফেলে। এই বেচারা হতবুদ্ধি হয়ে তাদেরকে বার বার বলতে থাকেনঃ “বল, ঘটনাটি কি?” কিন্তু কেউই তাঁর কথায় কর্ণপাত করলো না। অবশেষে তাদের একজন বললোঃ “ওরে ভণ্ড তাপস! তাপসের পোশাক পরে ভণ্ডামী করছো? তোমার দ্বারা এই শয়তানী কাজ সংঘটিত হলো? এই মহিলাটির সাথে তুমি ব্যভিচারে লিপ্ত হলে!” হযরত জুরায়েজ (রঃ) তখন বললেনঃ “আচ্ছা, থামো, ধৈর্য ধর। ঐ শিশুটিকে নিয়ে এসো।” অতঃপর দুধের ঐ শিশুটিকে নিয়ে আসা হলো। হযরত জুরায়েজ (রঃ) নিজের ইজ্জত রক্ষার জন্যে মহান আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করলেন। অতঃপর তিনি ঐ শিশুটিকে জিজ্ঞেস করলেনঃ “হে শিশু! বলতো, তোমার পিতা কে?” নিজের ওলীর ইজ্জত রক্ষার্থে আল্লাহ্ রাব্বল আলামীন ঐ অবলা শিশুকে বাকশক্তি দান করলেন। সুতরাং শিশুটি সুন্দর ভাষায় উচ্চকণ্ঠে বলে উঠলোঃ “আমার পিতা হলো এক রাখাল।” শিশুর মুখে একথা শুনে তো বানী ইসরাঈলের লজ্জার কোন সীমা থাকলো না। ঐ বুযুর্গ ব্যক্তির সামনে তারা করজোড়ে ক্ষমা প্রার্থনা করলো। তখন তিনি বললেনঃ “আচ্ছা, ঠিক আছে। এখন তোমরা আমাকে ছেড়ে দাও।” জনগণ তাঁকে বললোঃ “আমরা সোনা দ্বারা আপনার ইবাদতখানাটি বানিয়ে দিচ্ছি।” তিনি উত্তরে বললেনঃ “না, বরং যেমন ছিল তেমনই বানিয়ে দাও।”

এরপর মহাপ্রতাপান্বিত আল্লাহ্ বলেনঃ ফলে কুফরীকারী ও কুফরীর হুকুমদাতা উভয়ের পরিণাম হবে জাহান্নাম। সেখানে তারা স্থায়ী হবে আর যালিমদের কর্মফল এটাই।

Leave a Reply